০৩. স্বর্গের বেশ্যা যাঁহারা = স্বৰ্গবেশ্যা

০৩. স্বর্গের বেশ্যা যাঁহারা = স্বৰ্গবেশ্যা

ভারতের প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে–বিশেষ করে পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতে প্রচুর গণিকার উল্লেখ আছে। এইসব গণিকাদের মধ্যে বেশ কিছু গণিকা ‘স্বৰ্গবেশ্যা’ হিসাবেই পরিচিতা। সংস্কৃত শব্দ অপ্ (বাংলা অর্থ জল) থেকে এঁদের উৎপত্তি, তাই ‘অপ্সরা’ বলা হয়। ঋগবেদে অপ্সরা হলেন গন্ধর্বের স্ত্রী। অপ্সরা আবার দুই ধরনের–লৌকিক ও বৈদিক। অপ্সরাদের সৌন্দর্য ও যৌন আবেদনের কথা সবসময়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, অপ্সরারা মায়ারূপিনী, তাঁরা শরীর বা দেহ পরিবর্তন করতে পারত, অর্থাৎ চূড়ান্ত ছলনাময়ী ছিলেন। অথর্ব বেদে উল্লেখ আছে, এঁরা পাশা খেলতে খুব ভালোবাসত। পারদর্শিতার সঙ্গে খেলত। দেবাসুরের সমুদ্রমন্থনকালে এঁরা সমুদ্র থেকে উত্থিত হয়েছিলেন। কথিত আছে, দেবতা ও অসুরের সমুদ্রস্নানের সময় গণিকারা সমুদ্রের ভিতর থেকে অসংখ্য নারীর সঙ্গে উঠে আসেন। কিন্তু এইসব গণিকাদের কী দেবকুল কী অসুরকুল, কেউই গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। তাহলে সমুদ্র থেকে উত্থিত এই নারীদের ভবিষ্যৎ কী? অতএব গ্রহণ করা না-গেলেও পণ্য করে নিতে কোনো বাধা নেই। প্রভাবশালী মানুষদের যৌন-বিনোদনের জন্য বিতরণ করা যেতেই পারে। একই সঙ্গে শরীরী ফাঁদ পেতে ধনী ও প্রভাবশালী পুরুষদের বিভ্রান্ত করাই হবে এঁদের কাজ।

অধিকাংশ স্বৰ্গবেশ্যার স্বামী ছিলেন গন্ধর্বরা। তবে অপ বা জল থেকে উৎপন্ন হননি, এমন কিছু অতুলনীয় নারীকেও স্বৰ্গবেশ্যা হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এঁদের মধ্যে স্বর্গের কিছু স্বাধীনা স্বৰ্গবেশ্যাও আছেন। এঁদেরকে সপ্তম মনু সৃষ্টি করেছিলেন বলে জানা যায়। এদের সংখ্যা প্রায় ৬০,০০০। এই ৬০,০০০ স্বৰ্গবেশ্যাদের অধিপতি ছিলেন কামদেবতা। এঁরা নৃত্যকলায় পারদর্শী ছিলেন। অধিকাংশ সময় গন্ধর্বদের সঙ্গে এঁরা ইন্দ্রের সভায় নর্তকী হিসাবে নৃত্য প্রদর্শন করতেন।

ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্রের প্রথম অধ্যায় ৪৫-৫০ শ্লোকে পাওয়া যায়, ব্রহ্মা ভরতকে কৌশিকীনৃত্তির জন্য শিবের নৃত্য থেকে শৃঙ্গাররসের উপযোগী কোমল অঙ্গহার, আত্মা রস, ভাব ও ক্রিয়া নামক উপাদান দেন। এ সকল উপাদান নারী ছাড়া পুরুষ এককভাবে প্রয়োগ করতে পারে না। তাই ব্রহ্মা কিছু নিপুণ অপ্সরা তৈরি করলেন। এই অপ্সরা ছিলেন মঞ্জুকেশী, সুকেশী, মিশ্রকেশী, সুলোচনা, সৌদামিনী, দেবদত্তা, দেবসেনা, মনোরমা, সুদতী, সুন্দরী, বিদগ্ধা, সুমালা, সন্ততি, সুনন্দা, সুমুখী, মাগধী, অর্জুনী, সরলা, কেরলা, ধৃতি, নন্দা, সুপুষ্কলা ও কলভা। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিগুলোতে যে সমস্ত স্বৰ্গবেশ্যা বা অপ্সরার নাম পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন—অদ্রিকা, অরুণা, অর্জুনী, অলম্বুষা, অসিতা, উর্বশী, কলভা কেরলা, ঘৃতাচী, জানপদী, তিলোতমা, দেবদত্তা, দেবসেনা, ধৃতি, নন্দা, নাগদত্তা, পুঞ্জিকাস্থলা, বিদগ্ধা, বিদ্যুৎপর্ণা, বিশ্বাচী, পঞ্চচূড়া, পূর্বচিত্তি, মঞ্জুকেশী, মনোরমা, মাগধী, মিশ্রকেশী, মেনকা, রম্ভা, রুচিরা, সরলা, সুকেশী, সুদতী, সুনন্দা, সন্ততি, সুন্দরী, সুপুষ্কলা, সুবাহু, সুমধ্যা, সুমালা, সুমুখী, সুলোচনা, সোমা, সৌদামিনী, হেমা প্রমুখ। এঁদের মধ্যে মেনকা, উর্বশী, রম্ভা ও তিলোত্তমা হলেন অন্যতম। পুরাণে নানা রকম নারী আছে। স্বৰ্গবেশ্যা নারী, সতী নারী, ছলনাময়ী নারী, রহস্যময়ী নারী। পুরাণ থেকে নারী সরিয়ে দিলেই তা আর পুরাণ থাকে না।

খুব সুন্দরী মেয়েদের ‘অপ্সরা সুন্দরী’ বলার সময় কি কাদের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে সুন্দরীদের ভাবা হয়? সে যাই হোক, এইসব অপ্সরারা যে অতীব সুন্দরী ছিলেন, এটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। তাঁরা শুধু অতীব সুন্দরী ছিলেন, তা নয়। তাঁরা নৃত্য ও সংগীতেও পারদর্শিনী ছিলেন। ইন্দ্রের সভায় এঁদের গায়িকা ও নর্তকী হিসাবে পাই। এঁদের উপস্থিতিতে ইন্দ্রের সভা সর্বদাই ঝলমলে থাকত। স্বর্গের গণিকাদের অধিপতি ছিলেন স্বয়ং কামদেব। তাই কামদেব এইসব গণিকাদের যৌনপ্রতিমা করে গড়ে তুলেছিলেন। মোদ্দা কথা, গণিকা মানেই সাক্ষাৎ যৌনপ্রতিমা। যৌনক্রিয়ায় ইচ্ছাপূরণ দেবী যেন। তথাকথিত দেবতারা আসন্ন বিপদের ঘ্রাণ পেলেই সেই বিপদ থেকে মুক্তি পেতে পরমা সুন্দরী গণিকাদের লেলিয়ে দিত। এই লেলিয়ে দেওয়ার কাজটি করতেন স্বয়ং ইন্দ্র। দেবরাজ ইন্দ্র প্রায়ই এঁদের পাঠিয়ে দিত মুনি-ঋষিদের প্ররোচিত ও প্রলোভিত করে ধ্যানভঙ্গ করার জন্য। কারণ তাঁদের ধ্যান সমাপ্ত হলে তাঁরা যদি প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে ওঁর ইন্দ্ৰত্ব (ইন্দ্রত্ব’ বিষয়টি আর কিছু নয়। ইন্দ্রত্ব একটি পদমাত্র। ইন্দ্রের পদ এবং ঐশ্বর্য ) দাবি করে বসে! গণিকারা ছলা আর কলায় তাঁদের বিভোর করে কাজ হাসিল করে নিত। এইসব গণিকারা মুনি-ঋষিদের ধ্যান ভাঙাতেন। কেন ধ্যান ভাঙাতেন? উদ্দেশ্য কী? কারণ বৈদিক যুগে কঠোর তপস্যার বলে কখনো-কখনো দেবতাদের চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর উঠতেন মুনি-ঋষিরা। যাতে তাঁরা দেবতাদের চেয়ে ক্ষমতাধর হয়ে না-পড়েন, সেই কারণেই গণিকাদের নিয়োগ করা হত। এমনকি অসুরদের কবজা করতেও এঁদের নিয়োগ করা হত।

পাঠকগণ, আলোচনায় দেবতা প্রসঙ্গে বিভ্রান্ত হবেন না। হিন্দুসমাজের দেবতা কোনো অশরীরী, অলৌকিক কোনো বিষয় নয়। কিছু নিছক কাল্পনিক হলেও বেশিরভাগই শরীরী, রক্তমাংসের অস্তিত্ব। দেবতাদের জন্ম আছে, পূর্বাপর-সম্বন্ধ আছে। এক দেবতা থেকে আর-এক দেবতার জন্ম আছে। প্রায় সব বিষয়েই মানুষের সঙ্গে দেবতাদের মিল দেখা যায়। তাই হিন্দুধর্মের দেবতাদের মধ্যে মানুষেরই প্রতিরূপ পাওয়া যায়। সেই কারণে পুরাণের বর্ণিত দেবতারা মানুষের মতো দোষেগুণে (ষড়রিপু = কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য) গড়ে উঠেছে। আবার অনেক দেবতা সাধারণ মানুষ থেকেও জন্মেছেন। তাই আহার-বিহার, যানবাহন, বসন-ভূষণ প্রভৃতি ব্যাপারে অনেক দেবতা মানুষের কাছাকাছি। ইতিহাস থেকে আমরা দুই ধরনের দেবতাদের পাই–(১) আর্য দেবতা এবং (২) অনার্য দেবতা। বস্তুত পুরাণ থেকে আমরা প্রচুর দেবতার কাহিনি পাই। বিভিন্ন অলৌকিক কাণ্ডকারখানার মধ্য দিয়ে এই দেবদেবীদের প্রকাশ। এত দেবদেবতার প্রাবল্য একমাত্র সনাতন ধর্মেই দেখা মেলে। তবে গ্রিস ও রোমেও দেবদেবতাদের আধিক্য দেখা যায় যাঁদের দেখতে অবিকল মানুষের মতোই। সনাতনী দেবতারাও মানুষের রূপধারী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষই দেবতায় উন্নীত হয়েছে সনাতন ধর্মে। আজও মানুষ দেবতায় উন্নীত হয়–ভগবান রজনীশ, ভগবান চন্দ্রস্বামী, ভগবান সাঁইবাবা, ভগবান আশারাম, ভগবান সারথীবাবা ইত্যাদি!!! ভগবান মনু রাজাদেরও দেবতা বা দেবতারূপী বলেছেন। বস্তুত প্রাচীন যুগে রাজা বা শাসকরাই ছিলেন স্বঘোষিত ভগবান। এঁরা পুজো পান। ভক্তদের কাছে অমিতাভ বচ্চনও দেবতা। কলকাতাতেই অমিতাভ বচ্চনের মূর্তি গড়ে মন্দির বানিয়ে পুজো দেওয়া হয়। আবার গুজরাটে গান্ধি হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকেও মূর্তি গড়ে মন্দির বানিয়ে পুজো দেওয়া হয়। আসুন, কতিপয় স্বৰ্গবেশ্যাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।

মেনকা : মহাঋষি বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভাঙার জন্য গণিকা মেনকাকে নিয়োগ করা হয়েছিল। মেনকা নগ্ন হয়ে কামনামদির নৃত্য প্রদর্শন করে কামশৃঙ্গারে বিশ্বামিত্রকে বিচলিত করেছিল। তারই ফলস্বরূপ বিশ্বামিত্র গণিকা মেনকার সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য হন এবং শকুন্তলার জন্ম দেন। যেহেতু এই ধরনের সম্পর্ক এবং সম্পর্কের ফলে জন্মানো সন্তান সমাজ স্বীকৃত নয়, সেহেতু সেই সদ্যজাত শিশুকে মালিনী নদীর তীরে নিক্ষেপ করে মেনকা পালিয়ে যায়। পালাবেই না-কেন, মেনকা তো মা হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় জন্ম দেননি। তিনি আজ্ঞাবাহক মাত্র। ঋষির ধ্যান ভাঙতে সফল হয়েছেন, সেইসঙ্গে তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্যও শেষ হয়েছে।

হিন্দুধর্ম মতে, ব্রাহ্মণগণ কঠোর তপস্যার ফলে দেবতা পদে উন্নীত হতে পারতেন। বিশ্বামিত্র তেমনই একজন ব্রাহ্মণ, দোর্দণ্ডপ্রতাপ। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে যেমন সমীহ করতেন, তেমনি ঈর্ষাও করতেন। ভয়ও করতেন। ইন্দ্র সর্বদাই এক আতঙ্কে ভুগতেন, এই বোধহয় কেউ এসে তাঁর সিংহাসন ও পদ দখল করে নিল। ইন্দ্র আশঙ্কায় থাকতেন, ইন্দ্রের রাজ্যে বিশ্বামিত্র হানা দিতে পারেন। বিশ্বামিত্র তপস্যায় মগ্ন হলে ইন্দ্র বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভাঙার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। হাতিয়ার করলেন গণিকা মেনকাকে। বিশ্বামিত্রের ধ্যানভঙ্গের জন্য মেনকাকে নির্দেশ দিলেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই। সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানভাবে চলছে। আজও বিভিন্ন কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে নেতা-মন্ত্রী-ধনী-পুঁজিপতিরা গণিকাদের রূপ-যৌবনকে কাজে লাগায়। এমনকি সেনানায়কদেরও কুপোকাৎ করে গোপন নথি সরিয়ে ফেলা হয়। গণিকা নিয়োগের মাধ্যমে কত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে যাচ্ছে, তার হিসাব কে রেখেছে! খেলোয়াড়দের মনোযোগ নষ্ট করার জন্য নারীকে নগ্ন করিয়ে মাঠের মাঝখান দিয়ে দৌড় করানোর রেকর্ড তো আছেই। খেলোয়াড়দের নারীমাংসের আবেশে ভুলিয়ে রাখার জন্য কত গণিকা যে হোটেল পর্যন্ত হানা দেয়!

কালিকাপুরাণে আমরা মেনকাকে দক্ষকন্যা সতীর সখী হিসাবে পাই। মহাভারতেও মেনকাকে পাই গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসুর স্ত্রী হিসাবে। বিশ্বাবসু ও মেনকার মিলনে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। সেই কন্যাকে মহর্ষি স্থূলকেশের আশ্রমের পাশে বয়ে চলা এক নদীতীরে চলে যান। মহর্ষি সেই পতিত কন্যা দেখতে পেয়ে তাঁকে আশ্রমে এনে লালনপালন করতে থাকেন। নাম দেন প্রমদ্বরা। প্রমদ্বরা মহাভারতে উল্লিখিত বিখ্যাত রাজা রুরুর স্ত্রী।

উর্বশী : উর্বশী নাকি নারায়ণের উরু থেকে জন্ম নিয়েছেন। সে যেখান থেকেই জন্ম নিক, ইনি একজন স্বনামখ্যাত স্বর্গের পরমা সুন্দরী গণিকা। শতপথব্রাহ্মণে উর্বশী ও পুরূরবার প্রেমকাহিনি আছে। এই কাহিনি ঋগবেদেও কিছুটা পাওয়া যায়। সেই কাহিনি এখানে উল্লেখ করার প্রাসঙ্গিকতা নেই। পদ্মপুরাণে আছে, বিষ্ণু ধর্মপুত্র হয়ে পর্বতে তপস্যা করছিলেন। তাঁর এই তপস্যায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। অতএব বিষ্ণুর তপস্যায় বিঘ্ন ঘটাতে হবে। ভাবনার বাস্তবায়ন করতে ইন্দ্র কয়েকজন গণিকার সঙ্গে বসন্ত ও কামদেবকে চক্রান্তে নিয়োগ করলেন। তাঁদের পাঠিয়ে দিলেন বিষ্ণুর ধ্যানভঙ্গ করতে। বলা হয়েছে, সেই দল তপস্যা ভঙ্গে ব্যর্থ হলে স্বয়ং কামদেব অন্যান্য গণিকাদের উরু থেকে উর্বশীকে সৃষ্টি করলেন এবং বিষ্ণুর ধ্যানভঙ্গ করতে পাঠিয়ে দিলেন। এর কার্যসিদ্ধি হল। কার্যসিদ্ধি করলেন গণিকা উর্বশী ধ্যান ভাঙলে বিষ্ণু উর্বশীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। উর্বশী রাজি হয়ে যান। উর্বশীর পতন হল পরে। না, বিষ্ণুর কারণে নয়। উর্বশীর পতন হল মিত্র ও বরুণের অভিশাপে (পড়ুন নির্দেশে)। বিষ্ণুর কিছু পরে মিত্র ও বরুণ উর্বশীকে কাছে পেতে চাইলেন। উর্বশী তা প্রত্যাখ্যান করেন। সেই অপরাধে উর্বশীকে মনুষ্যভোগ্যা করে মর্ত্যলোকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কারোকে প্রত্যাখ্যানের অধিকার গণিকার নেই। তাই এই চরমতম শাস্তি।

রম্ভা : রম্ভা হলেন স্বর্গগণিকাদের মধ্যে অন্যতম। রম্ভা নামের মানে কলাগাছের মতো পুষ্ট যে নারীর উরু। রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে উল্লেখ আছে, লঙ্কেশ্বর রাবণ পথে রম্ভাকে একা পেয়ে জোরপূর্বক যৌনসঙ্গম করেন। রম্ভা কুবেরের পুত্র নলকুবেরের কাছে অভিসারে যাওয়ার সময় রম্ভাকে দেখে কামদগ্ধ হয়ে পড়ে রাবণ। লঙ্কেশ্বর রাবণ সংযম হারিয়ে খোলা আকাশের নীচেই রম্ভাকে ধর্ষণ করেন। এরপর রম্ভা নলকুবেরের কাছে পৌঁছে সমস্ত ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেন। সেই অপরাধে নলকুবের রাবণকে অভিসম্পাত করেন–রাবণ যদি কখনো নারীকে বলপ্রয়োগ করে ধর্ষণ করবে, তখনই তাঁর মাথা সাত খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যাবে।

স্কন্ধপুরাণে উল্লেখ আছে, বিশ্বামিত্রের তপস্যায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র গণিকা রম্ভাকে নিয়োগ করেন। কিন্তু ইন্দ্র এই অপারেশন চরমভাবে ব্যর্থ হন, সেইসঙ্গে বিশ্বামিত্রের ক্রোধে বিশ্বামিত্রের আশ্রমে রম্ভা ১০০০ বছরের জন্য শিলায় পরিণত হন। বিশ্বামিত্রের আশ্রমে যেসময় রম্ভার শিলারূপে অবস্থান করছিলেন, সেসময় অঙ্গকার নামে রাক্ষুসী নানারকম উপদ্রব করছিলেন। সেসময় ওই আশ্রমে তপস্যারত শ্বেমুনি বায়ব্য অস্ত্রে ওই শিলারূপী রম্ভাকে দু-টুকরো করে রাক্ষুসীকে লক্ষ করে নিক্ষেপ করেন। রাক্ষুসীর মৃত্যু হয়। রম্ভা আবার নিজরূপ ফিরে পান। স্কন্ধপুরাণের অন্য এক কাহিনি বলছে, ইন্দ্রের সভায় নৃত্য পরিবেশনের সময় রম্ভার তালভঙ্গ হয়। ইন্দ্র ক্ষুব্ধ হন এবং রম্ভাকে স্পন্দনহীন বিকলাঙ্গ করে সভা থেকে বহিষ্কার করে ভূতলে নিক্ষেপ করেন। গণিকার ভুল হতে নেই যে। পরে অবশ্য ব্ৰহ্মর্ষি নারদের পরামর্শে শিবকে সন্তষ্ট করে ইন্দ্রলোকে ফিরে আসতে সক্ষম হন।

অন্য এক পুরাণে উল্লেখ আছে, জাবালি মুনির তপস্যা ভঙ্গ করতে ইন্দ্র গণিকা রম্ভাকে নিয়োগ করেন। রম্ভা ইন্দ্রের ষড়যন্ত্র সফল করেন। রম্ভার রূপ-যৌবনে কামমোহিত হয়ে জাবালি মুনির সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হন। এর ফলে মুনির ঔরসে রম্ভা এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। জাবালি এই কন্যার প্রতিপালন করেন। কন্যার নাম দেন ফলবতী। জাবালি মুনি বিশ্বামিত্রের মতোই অসংযমী হলেও বিশ্বামিত্রের মতো নিজ সন্তানকে প্রত্যাখ্যান করেননি। তবে বিশ্বামিত্রের সময়ে মেনকা যে কাজটি করেছেন, রম্ভাও সেই কাজ করেছেন। নিজ সন্তানকে ত্যাগ করে চলে যান। সেটাই স্বাভাবিক। তাঁরা গণিকাধর্ম পালন করেছেন, সন্তানের মা হতে নয়।

তিলোত্তমা : কালিকাপুরাণে আমরা গণিকা তিলোমাকে পাই। অপরূপা গণিকাদের মধ্যে অন্যতম। দৈত্যরাজ নিকুম্ভের দুই পুত্র সুন্দ ও উপসুন্দকে রূপের জালে ফাঁসানোর জন্য তিলোত্তমাকে নিয়োগ করা হয়েছিল। সুন্দ ও উপসুন্দ দুই ভাই ত্রিলোক বিজয়ের জন্য কঠোর তপস্যার মাধ্যমে ব্রহ্মার কাছে অমরত্ব প্রার্থনা করেন। কিন্তু ব্রহ্মা এঁদেরকে অমরত্ব দানে মোটেই রাজি নন। শেষপর্যন্ত অমরত্ব দিতেই হল, তবে তা কৌশল করেই। বলা হল, স্থাবর-জঙ্গমের কোনো প্রাণীই তাঁদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এ পর্যন্ত এটা একপ্রকার অমরত্ব বলেই ভ্রম হতে পারে। মৃত্যুহীন জীবনযাপন করতে পারবে তা কি হয়? অর্থাৎ এরপর সংযোজন করা হল–তাঁদের মৃত্যু তখনই হবে, যখন দুই ভাই পরস্পর পরস্পরের হাতে হত্যা করবে। সুন্দ ও উপসুন্দ দুই ভাইয়ের মধ্যে এত ভাব-ভালোবাসা ছিল যে, এঁরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি এক ভাইয়ের দ্বারা অন্য ভাইয়ের ন্যূনতম ক্ষতি হতে পারে। তাই অমরত্বের দাপটে স্বর্গলোকে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। ওঁরা স্বপ্নে কখনো ভাবতে না পারলেও বরদাতা ব্রহ্মা সেই ব্যবস্থা করে নিলেন, যাতে দুই ভাইয়ের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হল যৌন-আবেদনময়ী লাস্যময়ী নারীকে। এতটাই যৌন-আবেদনময়ী নারীকে ব্যবহার করা হল, তেমন নারী গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেও দেখা গেল না। তাই স্বয়ং ব্রহ্মা স্পেশাল নারী সৃষ্টি করলেন, যিনি স্বর্গীয় সুন্দরী তিলোত্তমা। যাঁকে দেখে পাথর পর্যন্ত গলে যাবে, আর সুন্দ ও উপসুন্দ তো রক্তমাংসের! ত্রিভুবনের সমস্ত উত্তম বস্তু তিল তিল করে সংগ্রহ করে ব্রহ্মা এই তিলোত্তমাকে সৃষ্টি করলেন। সুন্দ ও উপসুন্দকে নিকেশ করতে নিয়োগ করা হল তিলোত্তমাকে। পরমা সুন্দরী তিলোত্তমা দুই ভাইয়ের সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন উপস্থিত হয়ে নৃত্য শুরু করে দিলেন। তিলোতমার ভুবনমোহিনী রূপ আর কামোদ্দীপক দেহবল্লরীর ঝাঁকুনিতে দুই ভাই বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। দুজনেই তিলোত্তমাকে কাছে পেতে চাইলেন। কিন্তু একজন নারীকে দুইজন কীভাবে পেতে পারে! তার উপর এইসব গণিকারা যত জনের সঙ্গেই যৌনমিলন করুক না-কেন, এঁরা পুনরায় কুমারীত্ব ফিরে পায়। এরা সসময়ই কুমারী। এ স্বাদের তো ভাগও করা সম্ভব নয়। অতএব যুদ্ধ, এক নারীকে পাওয়ার জন্য দুই ভাইয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। যুদ্ধে দুই ভাইয়েরই মৃত্যু হল একে অপরের শাণিত অস্ত্রে। বোধহয়, স্বয়ং ঈশ্বর গণিকা সৃষ্টি করলেন কামুক পুরুষদের ধ্বংসের জন্য।

ঘৃতাচী : স্বর্গের আরও একজন গণিকার কথা না বললেই নয়। তিনি ঘৃতাচী। ইন্দ্রের হুকুমে ইনিও নিজের নগ্ন রূপ দেখিয়ে প্রচুর মুনি-ঋষিদের তপস্যাকর্মে জল ঢেলে দিয়েছেন। ঘৃতাচী এতটাই যৌন-আবেদনময়ী ছিলেন যে, তাঁকে দেখামাত্রই পুরুষদের বীর্যপাত হয়ে যেত। যেমন-তেমন পুরুষ নয় এমন মুনি-ঋষিদেরও একই হাল হত। ঘৃতাচীকে দেখে ভরদ্বাজ ঋষিরও বীর্যপাত হয়ে যায়। এই পতিত বীর্যেই দ্রোণের জন্ম হয়। ইনিই মহাভারতের দ্রোণাচার। অপরদিকে চ্যবন ও সুকন্যার পুত্র প্রমতির সঙ্গে ঘৃতাচী যৌনমিলন হয় এবং রুরুর জন্ম হয়।

একবার ব্যাসদেব সুমেরু পর্বত থেকে নিজ আশ্রমে ফিরে হোমের আয়োজন করছিলেন। সেসময় সেই হোম অনুষ্ঠানে গণিকা ঘৃতাচী এসে উপস্থিত হন। ঘৃতাচীকে দেখামাত্রই ব্যাসদেব কামাতুর হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় অনিবার্য ধর্ষণের আশঙ্কায় ঘৃতাচী পড়িমরি করে অকুস্থল থেকে পালিয়ে যান শুকপাখির রূপ ধরে। কিন্তু চরম কামোত্তেজনায় ব্যাসদেবের বীর্যপাত হয়ে যায়। সেই বীর্য অরণির (অরণি হল একপ্রকার কাঠ, যে কাঠের ঘর্ষণে আগুন জ্বলে) উপর ছিটকে গিয়ে পতিত হয়। ব্যাসদেব সেই অরণি মন্থন করতে শুরু করে দিলেন। মন্থনের ফলে এক শিশুপুত্রের জন্ম হয়। ঘৃতাচীকে স্মরণ করে সেই শিশুপুত্রের নাম রাখেন শুক। স্বর্গের সব গণিকাদের নিয়ে আলোচনা করাই যেত। কিন্তু তাতে কলেবর বৃদ্ধি হয়, লাভ কিছু হয় না। কয়েকজন গণিকার বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করলাম স্বর্গের গণিকাদের বিষয়ে কিঞ্চিত আভাস দেওয়ার জন্য। আর-একটু সংযোজন করি। এইসব অনন্তযৌবনা গণিকারা দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশে গুপ্তচরবৃত্তি ও গুপ্তহত্যার কাজে নিযুক্ত হতেন। রামায়ণেও প্রচুর গণিকার উল্লেখ আছে, যাঁরা গুপ্তচর বৃত্তির কাজে নিয়োজিত ছিল। রামচন্দ্রের অভিষেকের সময় প্রচুর গণিকা অংশগ্রহণ করেছিলেন। রামায়ণের যুগে বিশিষ্ট অভ্যাগতদের অভ্যর্থনায় রাজপরিবারের মানুষদের মৃগয়ায় গণিকাদের নিয়োগপ্রথার প্রচলন ছিল। গণিকা কর্তৃক ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির প্রলোভনের আখ্যান রামায়ণে সুখ্যাত হয়ে আছে।

মহাভারতের যুগে এমন জনা পাঁচেক মুনি-ঋষির নাম পড়ে পড়ছে, যাঁরা গণিকাদের শরীরী ছলনায় বশীভূত হয়ে কামার্ত হয়ে যৌন-সংসর্গ করেছিলেন। এঁরা হলেন–বিশ্বামিত্র, শরদ্বান, ভরদ্বাজ, ব্যাস, বশিষ্ঠ, পরাশর, দীর্ঘতমা প্রমুখ। মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মানজনক বৃত্তিগুলির মধ্যে গণিকাবৃত্তি ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে গণিকাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। এঁরা মনোহর রত্ন, সোনা ও মণিমুক্তাখচিত অলংকারাদি ও মহামূল্য পোশাকে আচ্ছাদিত হয়ে রাজপথে অবাধে বিচরণ করতেন। যে-কোনো অনুষ্ঠানে ও শোভাযাত্রায় আয়োজন হলে পুরোভাগে বস্ত্রালংকার শোভিত সুন্দরী গণিকারা থাকতেন।

শুধু সুরলোকেই নয়, অন্যত্র গণিকাদের প্রয়োজনীয়তা ছিল যথেষ্ট, উপস্থিতিও ছিল লক্ষ্যণীয়। মহাভারতে তৃষ্টা নামক এক ঋষির কথা জানা যায়। ত্বষ্টার পুত্র ছিলেন ত্রিশিরা। ত্রিশিরা ছিলেন মদ্যপ ও নিষ্ঠাবান ধার্মিক। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল স্বর্গলোক জয়। যেহেতু স্বর্গলোকের চৌকিদার স্বয়ং ইন্দ্র, সেইহেতু ইন্দ্রের ভয়ের কারণ হল ত্রিশিরা। উপায় খুঁজতে রূপবতী গণিকাদের শরণাপন্ন হলেন পুরন্দর ইন্দ্র। ত্রিশিরার তপস্যা ভঙ্গ করতে সুন্দরী গণিকাদের কাজে লাগালেন দেবরাজ। এখনকার মতো মহাভারতের যুগেও সমরসম্ভারের সঙ্গে সৈন্যশিবিরে সুন্দরী গণিকাদের স্থান দেওয়া হত। সেনাদের একঘেয়েমি নিবারণ ও যৌনক্ষুধা মেটানোর জন্য এঁদের মজুত রাখা হত। যুযুধান দুইপক্ষ পাণ্ডব ও কৌরব সেনাশিবিরে অসংখ্য সৈন্যদের বিনোদন ও মনোরঞ্জনের জন্য শত সহস্র গণিকা নিয়োগ করা হয়েছিল। পাণ্ডব সেনাশিবিরে যেসব ‘বেশস্ত্রী’ অর্থাৎ বেশ্যা বা গণিকা নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁদের সুযোগসুবিধা যা কিছু দেখভালের দায়িত্ব সবই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের উপর ন্যস্ত ছিল। রামায়ণে রামচন্দ্রের জন্য যে স্বতন্ত্র সৈন্যবাহিনী গঠন করা হয়েছিল, সেই বাহিনীতে বিবিধ সমরসম্ভারেও অজস্র যৌবনবতী গণিকা নিয়োগ করা হয়েছিল।

শুধু হিন্দুধর্মেই নয়, আমরা ইসলাম ধর্মেও স্বৰ্গবেশ্যাদের কথা জানতে পারি, যাদের হুরপরি বলা হয়। বেহেশতকামীদের লোভ দেখাতেই এই স্বৰ্গবেশ্যাদের উপস্থাপনা। যাদের সঙ্গে বেহেশতবাসী পুরুষরা অনন্তকাল সেক্স করতে পারবে। মাসের পর মাস তাঁরা সেক্স করবে, কিন্তু সেই সেক্স কোনোদিন শেষ হবে না। তাঁরা ক্লান্ত হবে না, সেই বেশ্যারাও ক্লান্ত হবে না। কেমন হবে সেই গণিকারা? কেমন বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সব বেশ্যাদের? স্বৰ্গবেশ্যাদের শারীরিক বর্ণনা যা পাওয়া যায়, তা হচ্ছে অনেকটা এরকম–

প্রত্যেক বেহেশতবাসীকে দেওয়া হবে ৭২টি অনিন্দ্য সুন্দরী হুরপরি তাঁদের ভোগের জন্য। বেহেশতবাসীরা যে কোনো বয়সেই মারা যাক না-কেন, তাঁরা যখন বেহেশতে প্রবেশ করবে তখন তাঁদের বয়স হবে ৩০ বছরের যুবকের মতো এবং তাঁদের বয়সের আর কোনো পরিবর্তন হবে না; আর প্রত্যেক বেহেশতবাসীকে ১০০টি শক্তিশালী পুরুষের সমান যৌনশক্তি দান করা হবে (তিরমিজি, অধ্যায় ২, পৃষ্ঠা ১৩৮)। হজরত আলি বর্ণনা করেছেন, নবি বলেছেন যে বেহেশতে একটি মস্ত বড় খোলা বাজার থাকবে, যেখানে কোনো কেনাবেচা হবে না। সেখানে শুধুই থাকবে অতিসুন্দরী উন্নবক্ষা হুরপরিরা, যাঁরা ফলের দোকানের মতো সেজেগুজে বসে থাকবে বেহেশতবাসীদেরকে আকর্ষণ করার জন্য। বেহেশতবাসীদের পছন্দ হলেই তৎক্ষণাৎ তাঁরা সেই হুরির সঙ্গে যৌনকর্ম শুরু করে দেবে ঠিক সেখানেই (সহি হাদিস, অধ্যায় ৪, পৃষ্ঠা ১৭২, নং ৩৪)। হুরপরিরা এত বেশি সুন্দরী ও রূপসী হবে যে, তাঁরা যদি আকাশের জানালা দিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকায়, তাহলে সমস্ত দুনিয়া আলোকিত হবে এবং সুঘ্রাণে ভরে যাবে আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানের সব জায়গা। একজন হুরির মুখমণ্ডল হবে আয়নার চেয়েও মসৃণ বা পরিষ্কার, যাতে নিজ চেহারা দেখতে পাবে এবং হুরির পায়ের মজ্জা দেখা যাবে খালি চোখে (মিসকাত অধ্যায় ৩, পৃষ্ঠা ৮৩-৯৭)। একজন হুরি অনিন্দ্যসুন্দরী যুবতী, যাঁর শরীর হবে আয়নার মত স্বচ্ছ বা মসৃণ। তাঁর পায়ের হাড়ের ভেতরের মজ্জা দেখতে পাওয়া যাবে যেন মণি-মুক্তোর ভিতরে রেখার মতো। তাঁকে মনে হবে একটি সাদা গ্লাসে রাখা লাল মদের মতো। সে হবে সাদা রঙের দুধে আলতা মিশানো এবং তাঁর কখনো হায়েজ (মাসিক), মলমুত্র ত্যাগ, গর্ভবতী হওয়া ইত্যাদি কিছুই হবে না। হুরি হবে অল্পবয়স্কা, যাঁর স্তনযুগল হবে বড়ো বড়ো ও গোলাকার, যা কখনোই ঝুলে পড়বে না; সবসময় তীরের মতো তীক্ষ্ণ থাকবে। এসব হুরিরা থাকবেন এক অতি উজ্জ্বল এবং জৌলুসপূর্ণ জায়গায় (তিরমিজি, অধ্যায় ২, পৃষ্ঠা ৩৫ ৪০)।

আবু ওমামা বলেছেন যে, আল্লাহর রসুল বলেছেন—“আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহেশতে স্থান দেবেন এবং প্রতিটি বেহেশতবাসীকে বিবাহ দেবেন ৭২ জন অনিন্দ্যসুন্দরী রমণীয় সঙ্গে; যাঁদের মধ্যে দুইজন হবে চিরকুমারী আয়তলোচনা এবং বড়ো বড়ো চোখওয়ালা হুরি এবং বাকি ৭০ জন হবে উত্তরাধিকার, যা সে লাভ করবে জাহান্নমবাসীদের গনিমতের মাল থেকে। প্রত্যেকটি সুন্দরী রমণীর থাকবে খুব সুখদায়ক যৌনাঙ্গ এবং বেহেশতি পুরুষের যৌনাঙ্গ সর্বদাই শক্ত ও খাড়া হয়ে থাকবে, কখনো বাঁকা হবে না যৌনতার সময়। অর্থাৎ মূলত পুরুষাঙ্গটি সবসময়ই হুরপরিদের যোনির ভিতরে প্রবিষ্ট থাকবে পালাক্রমে একের পর এক প্রায় ৭০ বছর ধরে (হাদিস নং ৪৩৩৭ ইবনে মাজাহ, ভলিউম ৫, পৃষ্ঠা ৫৪৭)। আবু উমামা কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসুল বলেছেন–“আল্লাহ যাঁদের জান্নাতে প্রেরণ করবেন, তাঁদের প্রত্যেককে ৭২ জন হুরির সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হবে; যাঁর দুটি হুরি এবং বাকি সত্তরখানা হবে জাহান্নামবাসীদের সম্পত্তির। তাঁদের সকলের থাকবে কামুক যৌনাঙ্গ এবং তাঁর লিঙ্গ থাকবে অনন্তকাল উত্থিত [সুনান ইবনে মাজা, যুহদ (Book of Abstinence) ৩৯]। দারাজ ইবনে আবি হাতিম কর্তৃক উল্লেখিত, আবু সাইদ আল-খুদরির কাছ থেকে প্রাপ্ত, আবু আল-হায়থাম আবদুল্লাহ ইবনে ওহাব কর্তৃক বর্ণিত, যিনি শুনেছেন, নবি বলেছেন–“জান্নাতের সবচেয়ে ছোটো পুরস্কার হবে একটি প্রাকৃতিক ঘর, যেখানে আট হাজার ভৃত্য এবং ৭২ জন হুরি থাকবে, যার গম্বুজ থাকবে মুক্তো, পান্না ও চুনি দ্বারা সজ্জিত, এবং যা প্রশ্বস্ত হবে আল-জাবিয়াহ থেকে সানার মধ্যকার দুরত্বের সমান (আল-তিরমিজি, ভল্যুম ৪, চ্যাপ্টার ২১, নাম্বার ২৬৮৭)। একজন হুরির সঙ্গে প্রতিবার শয্যাগ্রহণকালে আমরা তাঁকে কুমারী হিসেবে পাব। তাছাড়া জান্নাতিদের লিঙ্গ কখনো নমনীয় হবে না। এই লিঙ্গোত্থান হবে অনন্তকালের জন্য; প্রতিবার তোমরা যে আনন্দ উপভোগ করবে, তা হবে পরম তৃপ্তিদায়ক যা এই দুনিয়ার কেউ পায়নি, এবং তোমরা যদি সেই পুলক দুনিয়াতে থেকে লাভ করতে তাহলে অজ্ঞান হয়ে যেতে। নির্বাচিত প্রতিটি মুসলিম বান্দা তাঁদের পৃথিবীর স্ত্রীদের ছাড়া আরও ৭০ খানা হুরির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হইবে, এবং তাঁদের সকলের থাকবে অত্যন্ত কামুক যোনি। (আল-ইতকান ফি উলুম আল-কুরান, পৃষ্ঠা ৩৫১)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *