০১. বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সৰ্গাৎ

০১. বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সৰ্গাৎ

‘পবিত্র’ গণিকাবৃত্তি প্রাচীন প্রাচ্য দেশে বেশি মাত্রায় হত। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ানরা ধর্মীয় যৌনতার প্রতিটি সুযোগই কাজে লাগাত। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডটাস বলেন—ব্যাবলীয়ানদের সবচেয়ে খারাপ রীতি ছিল জীবনে একবার হলেও প্রত্যেক মহিলাকে বাধ্য করা হত আফ্রিদিতি মন্দিরে যেতে, যেখানে তাঁকে একজন অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে হত। যেসব মহিলারা ধনী ও বংশমর্যাদায় গর্বিত ছিলেন, তাঁরা মিলিত হতে চাইতেন না। তাঁদের তখন দড়ি দিয়ে বেঁধে আনা হত মন্দিরে। প্রচুর অনুগামী লোক ভিড় করত তখন। এভাবে বিপুল সংখ্যক মহিলাদের আনা হত। যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়ার আগে মহিলারা কখনোই বাড়িতে ফিরে যেতে পারতেন না। অপরিচিত কোনো লোককে অবশ্যই টাকা দিতে হত বন্দিনী মহিলার আঁচলে এবং তাঁকে আহবান করতে হত মাইলিত্তা দেবীর নামে। তাঁদের মন্দিরের বাইরে মিলিত হতে হত। টাকার পরিমাণ যাই হোক না-কেন, তা নিতে অস্বীকার করা পাপ মনে করা হত। এইভাবে সুন্দরী মহিলারা মর্যাদা খুঁইয়ে মুক্তি পেত অল্প দিনে। অসুন্দরীদের থাকতে হত দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত কোনো লোকের সঙ্গে যৌনমিলন হওয়া পর্যন্ত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৪ বছর আগে গ্রিসে জেনোফন নামের একজন অলিম্পিক বিজয়ী দেবীর মন্দিরে ১০০ জনের মতো তরুণীকে উপহার হিসেবে দান করে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ। করিন্থ নামক ওই শহরে দেবী আফ্রিদিতির মন্দির ছিল। রোমান যুগে ওই মন্দিরে প্রায় হাজারের উপর দেবদাসী ছিল।

“বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সৰ্গাৎ”–বেশ্যাগণের পুরুষগ্রহণ প্রবৃত্তি বা পুরুষকে প্রলুব্ধ করা এবং অর্থাৰ্জন সেই সৃষ্টিকাল থেকে চলে আসছে। এহেন ব্যাখ্যাই বাৎস্যায়ন তাঁর ‘কামসূত্র’ গ্রন্থের চতুর্থ অধিকরণে অবহিত করেছেন। বাৎস্যায়ন তাঁর গ্রন্থের চতুর্থ অধিকরণটি বৈশিক বা বেশ্যাদের জন্যই বেশ গুরুত্ব সহকারে বরাদ্দ রেখেছেন। প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে ‘বেশ্যা’ বিশেষণের বেশ কিছু সমতুল প্রতিশব্দ পাওয়া যায় পেশার ধরন হিসাবে। যেমন–পতিতা, বারাঙ্গনা, দেহপসারিণী, দেহপোজীবিনী, রূপোপজীবিনী, রক্ষিতা, খানকি, ছিনাল, বারবনিতা, উপপত্নী, জারিণী, সাধারণী, মহানগ্নী, পুংলী, পুংশ্চল, অতীত্বরী, বিজর্জরা, অসোঙ, অতিষ্কদ্বয়ী, গণিকা, গণেরুকা, নটী, হট্টবিলাসিনী এবং হাল আমলের ‘যৌনকর্মী। আমি যেহেতু আমার গ্রন্থের নাম ‘গণিকা দর্শন’ রেখেছি, তাই গোটা গ্রন্থে যথাসম্ভব ‘গণিকা’ প্রতিশব্দটিই ব্যবহার করব। তবে ইংরেজিতে যেমন Domimonde, Public Women, Hatairai, Aspasia, Phrynes ইত্যাদি শব্দের মতো আদিম ও প্রাগৈতিহাসিক বিশেষণ আছে, ঠিক তেমনি আধুনিক বিশেষণগুলি হল–Prostitute, Call Girl, Escort Girl, Pornstar ইত্যাদি।

মোদ্দা কথা, অর্থ বা পার্থিব সম্পদের বিনিময়ে যে নারীরা একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন বা যৌনসুখ শরীর উলঙ্গ করে প্রদর্শনকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছে, তাঁকেই গণিকা (Prostitute) বলে। বলা হয়, এটি পৃথিবীর আদিম পেশা। বিশেষ এই পেশা মেয়েদের যে বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে, সেগুলির সবই পেশার রকমফেরের উপর ভিত্তি করে। সবকটি বিশেষণের ব্যাখ্যা দিয়ে কলেবর বৃদ্ধি করব না। তবে আমাদের কাছে ‘বেশ্যা’ বিশেষণ বা পরিচয়টি বেশি পরিচিত। ভিন্টারনিৎসের মতে, ঋগবেদের প্রথম মণ্ডলের ১২৬ তম সূক্তের অন্তর্গত পঞ্চম ঋকে যে ‘বিশ্যা’ শব্দটি আছে, তা থেকেই ‘বেশ্যা’ শব্দটির উৎপত্তি। ঋকটি এরকম–“সুবন্ধবো যে বিশ্যা ইব ব্রা অনস্বন্তঃ শ্রব ঐযন্ত পূজা”। ভিন্টারনিৎস ঠিক না বেঠিক, সে ব্যাপারে এই ভারতের কোনো বেদবেত্তা আপত্তি করেছেন বলে শুনিনি।

‘বেশ্যা’ বা ‘গণিকা’ শব্দটির সঙ্গে ‘বৃত্তি’ শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এটাকে ব্যবসাও বলে, যেমন–দেহ-ব্যাবসা। যিনি অর্থ বা অন্য কোনো সম্পদের বিনিময়ে যৌনক্রিয়া করে, সে বিক্রেতা। আর সেই নারীর কাছে গিয়ে যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে যৌনসুখ পেতে যে বা যাঁরা অর্থ বা সম্পদ প্রদান করে, সে ক্রেতা। যিনি অর্থ বা সম্পদের বিনিময়ে ক্রেতার সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হন, সে যৌনসুখ পেল কি পেল না তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু যিনি অর্থ বা সম্পদ প্রদানের মাধ্যমে কোনো নারীর সঙ্গে যৌনক্রিয়া করতে আসেন, তাঁর যৌনসুখ অবশ্যই চাই। যৌনসুখ ছাড়া সে অর্থ প্রদান করবে না। ক্রেতাকে চরম যৌনসুখ দেওয়াটাই বিক্রেতার একমাত্র কর্তব্য। বিক্রেতারা চাইবে ক্রেতাদের নেশাগ্রস্ত কামগ্রস্ত করে তুলতে, যাতে ক্রেতারা বারবার বিক্রেতাদের কাছে আসে। কারণ শরীরই যে তাঁর পণ্য। ভালো মোড়কে সুস্বাদু করে পরিবেশন করতে হবে তাঁকে। শরীর বাজারে বিক্রেতার অধিকার অর্থ (Money), আর ক্রেতার অধিকার নারী-শরীর, যৌনসুখ।

গণিকাবৃত্তির শুরুটা ঠিক কবে থেকে? গণিকাবৃত্তির প্রসঙ্গ উঠলেই সবাই বলে ‘আদিম পেশা। “আদিম’ মানে কী? “আদিম জাতি’ বলতে আমরা সেই সময়ের মানুষের কথা বুঝি, যে সময় মানুষ পোশাকের ব্যবহার জানত না, উলঙ্গ থাকত। তাহলে গণিকাবৃত্তির শুরু কি সেইসময় থেকেই? গণিকাবৃত্তি ঠিক তখন থেকেই সৃষ্টি হয়েছে বলে আমি মনে করি না। সম্ভবত গণিকাবৃত্তি শুরু হয়েছে মানুষের পোশাকের ব্যাবহার শেখার অনেক পরে। নাগরিক সভ্যতায় বিনিময় প্রথার প্রচলন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরীর বিক্রির প্রথা চালু হতে পারে। ক্রয়-বিক্রয় ব্যবস্থা চালু হলে শরীর বিক্রিও চালু হয়। নাগরিক জীবন শুরু হল বহির্দেশীয় মানুষদের আগমনের মধ্য দিয়ে। এই বহির্দেশীয়রাই ভূমিকন্যাদের যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করত। ক্রীতদাসী হিসাবে কিনে নিত বা দখল করত এবং যথেষ্ট ভোগ করত। সমাজের ধনশালী, বলশালী এবং তথাকথিত উচ্চস্তরের মানুষগুলো ভূমিকন্যা বা অনার্যদের সঙ্গে শারীরিকভাবে লিপ্ত হলেও স্বীকৃতি দেয়নি। অনার্য-কন্যাদের শারীরিকভাবে ভোগ করা যায়, কিন্তু গ্রহণ করা যায় না। প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে আমরা আর্য-অনার্যদের সংঘর্ষের কাহিনি পাই। মনুসংহিতায় এইভাবেই পেয়ে যাই হাজারো জারজ সন্তানের সংবাদ। ধর্ষণ করলে অনার্যদের শাস্তির বিধান ছিল, কিন্তু আর্যদের নয়। আর্যদের তুলনায় অনার্যরা সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে দুর্বল ছিল। তাঁরা আর্যদের মতো তির-ধনুক, বর্শা, ছোঁড়া, কুঠার ব্যবহার করলেও শিরস্ত্রাণের ব্যবহার জানত না। তাই অনার্যদের বারবার পরাজয় ঘটত। সেই পরাজয়ের ফলে পুরুষ অনার্যদের হয় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, নচেৎ দাসত্ব বা বশ্যতা মেনে নিতে হয়েছে। আর অনার্য নারীরা দখলীকৃত ভোগের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগ জুড়ে অঞ্চলে অঞ্চলে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকত ভূমিদখলের জন্য। যুদ্ধে যুদ্ধে বিধ্বস্ত পুরুষরা ক্রীতদাসে পরিণত হত, আর নারীরা যৌনদাসীতে পরিণত হত। এঁদেরই একটা বড়ো অংশ যৌনজীবিকার পথ বেছে নিয়েছিল। সেইসব নারীরা বুঝে নিয়েছিল, নারী-শরীরের প্রতি পুরুষদের তীব্র লালসা। তাঁদের এই লালসা মোচন কেন মাগনায় হবে? সমাজেরই ধণিক শ্রেণি সেইসব নারীদের মূল্য নির্ধারণ করে দিল। তৈরি করা হল সেইসব নারীদের নির্দিষ্ট আস্তানা। সেই সময় গণিকাগমনের অধিকার ছিল শুধুমাত্র ধনীদেরই। সমাজে যখন রাজতান্ত্রিকতার উন্মেষ ঘটেছিল, তখন এইসব নারীদের শরীরী-ছলনায় শত্রু নিধন এবং গুপ্তচর বৃত্তির কাজে লাগানো হত। আজও এই ব্যবস্থা চালু আছে। স্বার্থসিদ্ধির জন্য নারীকে ‘ভেট’ দেওয়ার রীতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। আজকাল তো শুনছি নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে টিকিট পেতেও ‘মেয়েমানুষ’ ভেট দিতে হয়! একথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই বিশিষ্ট অতিথি, অমাত্য এবং অপরাপর উচ্চধনীবর্গদের আবদার মেটাতে নারী-শরীর উপঢৌকন দেওয়ার রীতি আজও অব্যাহত আছে। ব্রিটিশ যুগেও এই বৃত্তি রাষ্ট্রের আনুকূল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট হত। কলামিস্ট তসলিমা নাসরিন এই পেশা সম্বন্ধে এক লেখায় বলেছেন–“এটাকে পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশা বলে লোককে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা হয় বটে, আসলে কিন্তু প্রাচীনতম পেশা নয়, এটা বরং মেয়েদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর প্রাচীনতম নির্যাতন।”

প্রচলিত অর্থে বেশ্যা বা পতিতা বা গণিকা বলতে আমরা যেমনটাই বুঝি না-কেন, প্রাচীন ভারতে এইসব রমণীরা কিন্তু তেমনটা ছিলেন না। দেশের (দেশ বলতে সমগ্র ভারত বুঝবেন না। সে সময় দেশ বলতে সংশ্লিষ্ট রাজার শাসিত এক টুকরো ভূখণ্ড বা অঞ্চলকে বোঝাত।) রাজা স্বয়ং গণিকাদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বার্ষিক ১০০০ পণ বেতন দিয়ে রাজা তাঁর প্রাসাদে গণিকাদের নিয়োগ করতেন। গণিকাদের আয়ের একটা অংশ কর হিসাবে রাজাদের কোষাগারে সংগৃহীত হত। প্রাচীন ভারতে গণিকারা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হত। তদুপরি গণিকাদের ঘরে যেমন জ্ঞানী-গুণীদের আলোচনা সভা বসত, আবার এমন জ্ঞানী-গুণীদের এবং শিক্ষাব্রতীদের গণিকালয় ছিল প্রধান আখড়া। প্রাচীনকালে গণিকালয়ে যাতায়াত খুব একটা গোপনীয় বা লজ্জাকর বিষয় ছিল না। সে যুগের নাগরিকরা বসন-ভূষণে সজ্জিত হয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে দিনে-দুপুরেই গণিকালয়ে যাতায়াত করতে পারতেন।

আগেই বলেছি, প্রাচীনকালে বহুভোগ্যা নারীদের নানাবিধ নামে উল্লেখ করা হত গণিকাবৃত্তির চরিত্রানুসারে। কেন সেটা কিছুটা আন্দাজ করা যেতেই পারে। যদিও মোটিভেশন একই, সকলেরই পেশা শরীর বিক্রি করা। এখনকার মত প্রাচীনকালেও গণিকা বলতে বোঝাত বহুভোগ্যা নারীকেই।গণ বা দলবদ্ধ হয়ে যে নারী যাপন করে, তিনিই গণিকা। অনুরূপ বেশ্যা বলতে বোঝায় যে নারী বেশ বা সাজসজ্জা দ্বারা পুরুষদের প্রলুব্ধ করে, তিনিই বেশ্যা। যে নারীদের পণের বাজি রেখে সম্ভোগ করা হত, সেই নারীরা পণ্যাঙ্গনা। যে নারীরা যুগপৎ মন্দিরের সেবাদাসী বা রাজা বা অমাত্য মর্যাদার রাজকর্মচারীদের ভোগ্যা হতেন, সেসব নারী বারস্ত্রী। পরিচারিকা বা ক্রীতদাসী বা রক্ষিতারা ভূজিয়া বলে পরিচিত। যে নারীর চরিত্রের পতন হয়েছে, তিনি পতিতা। অনুমান করা হয়, প্রধানত ব্রাহ্মসমাজের প্রচারের দৌলতেই ‘পতিতা’ শব্দটি বেশ্যার সুভাষণরূপে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। ১৮৯৪ সালে লেখা ‘বিচারক’ গল্পে রবীন্দ্রনাথও দেখছি ‘পতিতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সাহিত্যিক সমর সেন অবশ্য গণিকা শব্দটিই ব্যবহার করতেন। প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তাঁর পত্রিকায় বারবার ‘বেশ্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সাম্প্রতিককালে গণিকা বা বেশ্যা শব্দের বিকল্পে ‘যৌনকর্মী শব্দটিও শোনা যাচ্ছে। যৌনকর্মী শব্দটি যেন একটু বেশি নগ্ন হয়ে ধরা পড়েছে। যৌনকর্মী শব্দটি যেন তাঁদের জীবিকার ধরনকে আরও প্রকট করে তুলেছে। যোনিক্ষেত্রকেই প্রকট করে এই ‘যৌনকর্মী’ সম্ভাষণ। এই সম্ভাষণ তাঁরা স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন। কারণ তাঁদের শ্লোগান–“গতর খাঁটিয়ে খাই, শ্রমিকের অধিকার চাই”, “যৌনকর্মীর অধিকার, নারী-আন্দোলনের হাতিয়ার”, “মে দিবসের অঙ্গিকার, যৌনপেশার পূর্ণ অধিকার”।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *