দ্বন্দ্বযুদ্ধের পরিণাম
প্রথম পরিচ্ছেদ : হন্তারক
কথায় কথায় ঝগড়া। তারপরই মুষ্টিবদ্ধ হস্তের মুষ্টিযোগ।
পশ্চিম আমেরিকায় অবস্থিত ঊনবিংশ শতাব্দীর শহর ফোর্ট গিবসন-এর একটি নৃত্যশালায় দুটি ক্রুদ্ধ যুবকের মধ্যে যে-লড়াইটা শুরু হয়েছিল, সেই মুষ্টিযুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল কয়েক মিনিট পরেই কিন্তু পরবর্তীকালে ওই দ্বন্দ্বযুদ্ধের পরিণাম সমগ্র দেশের বুকে ছড়িয়ে দিয়েছিল সন্ত্রাস ও বিভীষিকার করাল ছায়া।
ফোর্ট গিবসন শহর। ওই শহরের একটি নৃত্যশালায় রাতের আসর জমজমাট। পুরুষদের সঙ্গে মেয়েরাও যোগ দিয়েছে মহা আনন্দে; চলছে নাচগান, হইহুল্লোড়। হঠাৎ সামান্য কারণে ঝগড়া বাধল দুটি যুবকের মধ্যে। যুবকদের নাম ক্রফোর্ড গোল্ডসবি এবং জেক লিউইস।
ক্রফোর্ডের বয়স লিউইসের চাইতে অনেক কম, তার শরীরটাও বেশ দশাসই জোয়ানের মতো। বিপুলবপু দীর্ঘদেহী ক্রফোর্ডের সামনে জেককে নিতান্তই নগণ্য মনে হয়। কিন্তু লিউইস মারামারিতে পোক্ত–বহুদিনের অভিজ্ঞতার ফলে সে মার খেতে যেমন অভ্যস্ত, মার ফিরিয়ে দিতেও তেমনই ওস্তাদ। অতএব ক্রফোর্ড যখন তার ঘুসি হজম করে পালটা ঘুসিতে তাকে মেঝের উপর শুইয়ে দিল, তখনই পরাজয় স্বীকার করতে রাজি হল না সে।
হঠাৎ বাধা দিলেন একজন বয়স্ক ভদ্রলোক, ওহে ছোকরারা, তোমরা বাইরে গিয়ে ফয়সালা করো। এটা মারামারির জায়গা নয়। এখানে মহিলারা আছেন।
বেশ, জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ক্রফোর্ডের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল লিউইস, আমি বাইরে যাচ্ছি।
খুব ভালো কথা। আমিও যাচ্ছি, সদম্ভে উত্তর দিল ক্রফোর্ড।
নাচঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল দুই যুযুধান।
মে মাসের রাত্রি, আলো-আঁধার-মাখা রাজপথের উপর শুরু হল মারামারি। সজোরে ঘুসি চালাল ক্রফোর্ড। ছিটকে পড়ল জেক। পরক্ষণেই বিড়ালের মতো লঘু চরণে ভূমিশয্যা ত্যাগ করে লিউইস ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রমাণ হয়ে গেল শক্তির চাইতে অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক বেশি। হাত ঝেড়ে লিউইস ঢুকল নাচঘরের ভিতর, বাইরে মাটিতে পড়ে রইল প্রহার-জর্জরিত ক্রফোর্ডের প্রায়-অচেতন অবসন্ন দেহ।
কয়েকটি দর্শক ধরাধরি করে আহত ক্রফোর্ডকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল।
ছেড়ে দাও! ক্রোধরুদ্ধ হিংস্র কণ্ঠে গর্জে উঠল ক্রফোর্ড, আমাকে একা থাকতে দাও।
টলতে টলতে কয়েক পা এগিয়ে এসে একবার দাঁড়াল সে। তার দুই চোখ ঘুসির আঘাতে প্রায় বুজে এসেছে সেই আধবোজা চোখের ক্রুদ্ধ দৃষ্টি দরজার উপর নিবদ্ধ; ওই দরজা দিয়েই নাচঘরের ভিতর ঢুকেছে জেক লিউইস।
আসরের মুক্ত দ্বারপথে ভেসে আসছে নৃত্যগীত ও বাদ্যযন্ত্রের মধুর ধ্বনি, কিন্তু সেই শব্দের তরঙ্গ ক্রফোর্ডের কানে প্রবেশের পথ পায়নি। তার অন্তরের অন্তস্থল ভেদ করে জেগে উঠেছে এক হত্যাপাগল হন্তারক, প্রতিশোধের হিংস্র আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ না-করে তার তৃপ্তি নেই।
দুই হাতে মুঠো পাকিয়ে একবার মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটিকে সে নিরীক্ষণ করল। মুঠির হাড়গুলো ঘুসোঘুসির ফলে ক্ষতবিক্ষত। হাত দুটো নামিয়ে নিল ক্রফোর্ড, তারপর অস্পষ্ট ভগ্ন স্বরে বলে উঠল, এই শেষ। হাতাহাতি মারামারির মধ্যে আমি আর নেই।
কাছাকাছি যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তারা পিছিয়ে গেল সভয়ে। কণ্ঠস্বরে খুনির উদগ্র আগ্রহ বুঝে নিতে তাদের একটু দেরি হয়নি।
ক্রফোর্ড যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই জায়গাটার উপর আলো এসে পড়েছিল নাচঘরের ভিতর থেকে। ক্রফোর্ড গোল্ডসবি আলোকিত স্থান ত্যাগ করে ছায়াচ্ছন্ন অন্ধকারের ভিতর পদচালনা করল। তার দীর্ঘ দেহ রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই নাচঘরের দরজা ঠেলে বাইরে ছুটে এল ক্রফোর্ডের বান্ধবী ম্যাগি গ্লাস। সে চিৎকার করে ডাকল, ক্রফোর্ড! ক্রফোর্ড!
উত্তর এল না। আবার চিৎকার করে ডাক দিল তরুণী। রাতের অন্ধকার ভেদ করে এইবার ভেসে এল ক্রফোর্ডের কণ্ঠস্বর, এখানে এসো না। এখন আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই না। পরে সাক্ষাৎ হবে। সম্ভবত নোয়াটা শহরে তোমার সঙ্গে আমি দেখা করতে পারব।
যেখানে তার ঘোড়াটা বাঁধা ছিল, সেইখানে এগিয়ে গেল ক্রফোর্ড–তারপর একলাফে ঘোড়ার পিঠে উঠে বাহনকে চালনা করল তিরবেগে। সারারাত ধরে ছুটল ঘোড়া। ভোরের দিকে সে এসে পৌঁছোল বাড়িতে। ক্রফোর্ড তার ঘুমন্ত মা আর ভাইকে জাগাল না, নিঃশব্দে বাড়ির ভিতর ঢুকে সে অস্ত্র গ্রহণ করল এবং পথশ্রান্ত বাহনটিকে রেখে আর-একটি তাজা ঘোড়া বেছে নিল আস্তাবল থেকে।
পরের দিন। বেশ বেলা হয়েছে। ধক ধক জ্বলছে সূর্যের আলো। ওল্ড টাউন শহরের জি. এল. বাউডেন নামক ভদ্রলোকটির গোলাবাড়ির দিকে হেঁটে চলেছে লিউইস। ওইখানেই সে কাজ করে।
উঠোন পার হয়ে গোলাবাড়ির এলাকার মধ্যে লিউইস পদার্পণ করল। মাথা নীচু করে সে পদচারণা করছিল অন্যমনস্কভাবে, হঠাৎ তার কানে এল তীব্র কণ্ঠস্বর, এই যে লিউইস! ঠিক সময়েই তুমি এসে পড়েছ!
সচমকে মুখ তুলে লিউইস দেখল, সামনে দাঁড়িয়ে আছে গোেল্ডসবি ক্রফোর্ড!
ক্রফোর্ডের মুখের ওপর বিগত রাত্রের প্রহার-চিহ্ন দিবালোকে সুস্পষ্ট, ক্ষতবিক্ষত সেই মুখে করাল ক্রোধের হিংস্র অভিব্যক্তি লিউইস সভয়ে নিরীক্ষণ করল, ক্রফোর্ডের ডান হাতে রয়েছে একটা ভারী রিভলভার।
মুহূর্তের মধ্যে লিউইস বুঝে নিল তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মূর্তিমান মৃত্যুদূত; মহা আতঙ্কে পিছন ফিরে সে ছুটল। সঙ্গেসঙ্গে ছুটল রিভলভারের গুলি। লিউইস ছিটকে পড়ল মাটির উপর। তার মরণাহত দেহ একবার ছটফট করে উঠল। তৎক্ষণাৎ আবার গর্জে উঠল ক্রফোর্ডের রিভলভার। দ্বিতীয় বারের নিক্ষিপ্ত বুলেট লিউইসের শরীর থেকে জীবনের শেষ চিহ্ন মুছে দিল। মৃতদেহ পড়ে রইল নিশ্চল পাথরের মতো, রক্তে ভিজে গেল গোলাবাড়ির প্রাঙ্গণ।
শান্তভাবে চারদিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ক্রফোর্ড। কিন্তু তার চোখ দুটো জ্বলছিল জ্বলন্ত কয়লার মতো।
ক্রফোর্ড দেখতে পেল গোলাবাড়ির দরজা খুলে তার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছেন বাউডেন। অত্যন্ত নির্বিকারভাবে হাত তুলে তাকে অভিনন্দন জানাল খুনি, গুড মর্নিং, মি. বাউডেন।
প্রতি-অভিবাদনের জন্য না-দাঁড়িয়ে গোলাবাড়ি প্রদক্ষিণ করে সে এগিয়ে গেল তার ঘোড়ার দিকে। জন্তুটাকে একটা খুঁটির সঙ্গে সে বেঁধে রেখেছিল গোলাবাড়ির কাছেই। এইবার বাঁধন খুলে সে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হল। একটুও তাড়াহুড়ো না-করে সে দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : তিন স্যাঙাতের ত্র্যহস্পর্শ যোগ
বাড়ির পথে যায়নি ক্রফোর্ড। সে জানত তার মাথার ওপর ঝুলছে ফাঁসির দড়ি; স্বচক্ষে তাকে খুন করতে দেখেছে বাউডেন। তার মুখ থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরবাসী জেনে যাবে জেক লিউইসকে খুন করেছে ক্রফোর্ড গোল্ডসবি। অশ্বারোহণে সে এগিয়ে চলল দক্ষিণ দিকে অবস্থিত ক্রিক নেশান নামক প্রদেশ অভিমুখে।
১৮৯৪ সালের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে উইটাম্পকা শহরে এসে পৌঁছোল ক্রফোর্ড। পথশ্রমে সে তখন অবসন্ন, ক্ষুধার্ত। সঙ্গে টাকাকড়ি কিছু নেই, সম্বলের মধ্যে একটি শ্রান্ত ক্লান্ত অশ্ব, একটি উইনচেস্টার ৩০ রাইফেল এবং কোল্ট, ৪৪ রিভলভার। এক নজরে দেখলেই বোঝা যায় মানুষটা অত্যন্ত বেপরোয়া এক পলাতক আসামি।
একটি দোকানের সামনে বসে ছিল দুই ব্যক্তি। রূঢ় দৃষ্টি মেলে চারদিক পর্যবেক্ষণ করছিল তারা। দুজনের মধ্যে যে লোকটি বয়সে বড়ো, সে হঠাৎ হাত তুলে বন্ধুর মতো হাঁক দিল, ওহে ছোকরা! পিছন দিকের আস্তাবলে তোমার ঘোড়াটাকে নিয়ে যাও। আর জনকে বলো ঘোড়াটাকে দলাইমলাই করে কিছু দানাপানির ব্যবস্থা যেন করে দেয়। আমরা হচ্ছি জিম কুক আর বিল কুক। তুমি হয়তো আসার পথে আমাদের নাম শুনে থাকবে।
হয়তো শুনেছি, গোল্ডসবি সতর্কভাবে উত্তর দিল, অবশ্য আমি যাদের কথা ভাবছি, তোমরা যদি সেই লোক হও।
আমরাই সেই লোক, জানাল জিম কুক।
অল্পবয়সি খুনিটি অনেকদিন পরে পেট ভরে খেতে পেল। নতুন বন্ধুদের ব্যবহারে সে কৃতজ্ঞ বোধ করল। সে আরও লক্ষ করল উইটাম্পকা শহরের মানুষ তার বন্ধুদের সঙ্গে তাকেও যথেষ্ট সমীহ করছে। শহরবাসীর সমীহ করার কারণ ভয়ে ভক্তি–জিম আর বিল তদানীন্তন কালের দুর্ধর্ষ দস্যু। ক্রফোর্ড গোল্ডসবিকে পূর্বোক্ত দুই দস্যুর গৃহে অতিথি হতে দেখে শহরবাসী ভেবে নিয়েছিল নবাগত মানুষটিও নিশ্চয়ই ভয়ানক চরিত্রের এক দুবৃত্ত না হলে সে দস্যুদের গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করবে কেন?
কয়েকটা দিন কাটল। ক্রফোর্ড তখন বেশ সুস্থ। তার ঘোড়াটিও পরিচর্যার ফলে বেশ তাজা হয়ে উঠেছে। কুক ভাইরা বুঝল এইবার ক্রফোর্ডকে কাজে লাগানো যায়। তাদের দলে এখন নতুন মানুষ দরকার। রতনে রতন চেনে ক্রফোর্ডকে দেখেই কুক ভাইরা বুঝে নিয়েছিল এই ছোকরা বেশ কাজের হবে।
জিম কুক টোপ ফেলল, স্কেলস বুড়োর দোকানে বেশ ভালো টাকাকড়ি পাওয়া যেতে পারে।
মাছ টোপ খেল; ক্রফোর্ড বলল, লুঠেরা মানুষ কাজের জায়গার কাছাকাছি বন্ধুবান্ধব রাখে। এই শহরের লোক আমাদের যথেষ্ট ইজ্জত দেয়। সুতরাং বন্ধু পাওয়া খুব কঠিন হবে না।
জিম বলল, লুঠেরা মানুষ বন্ধুর পরোয়া করে না। লুঠেরার বন্ধু নেই, থাকতে পারে না। লুঠেরা যদি মনে করে তার বন্ধু আছে, আর সেই বন্ধুর ভরসা যদি সে করে তার দফা শেষ খুব বেশিদিন তাকে দুনিয়ার আলো দেখতে হবে না।
ক্রফোর্ড কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল, ঠিক আছে। তোমরা যা ভালো বুঝবে, তাই হবে।
এইসব কথা যেদিন হল, ঠিক তার পরের দিনই স্কেলস মার্কেন্টাইল স্টোর্স নামে দোকানটার ওপর রিভলভার হাতে হানা দিল তিন দুবৃত্ত–জিম কুক, বিল কুক ও গোল্ডসবি ক্রফোর্ড।
তারা মুখোশ অথবা রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে আত্মপরিচয় গোপন করার চেষ্টা করল না। বুক ফুলিয়ে ডাকাতি করে টাকা নিয়ে সরে পড়ল তিন স্যাঙাত। শহর থেকে অনেক দূরে একটা বনের মধ্যে টাকাকড়ির ভাগবাটোয়ারা হল।
গোল্ডসবি ক্রফোর্ড মনে মনে গর্ববোধ করতে লাগল–সে এখন সাধারণ খুনি নয়, স্বনামধন্য কুক দস্যুদের যোগ্য সহকর্মী এক লুঠেরা সে!
কুক ভাইরা কিন্তু হতাশ হয়েছিল। জিম কুক তার লুঠের বখরা পকেটস্থ করে বলল, ধৎ! কিচ্ছু হল না। আরও অনেক বেশি টাকা পাওয়া উচিত ছিল।
আরও অনেক জায়গা আছে যেখানে মালকড়ি পাওয়া যায়, ক্রফোর্ড বলল, শুধু সঠিক জায়গা চিনে হানা দেওয়া দরকার।
জিম বলল, এই ক্রিক নেশান এলাকায় মালকড়ি বিশেষ নেই।
ক্রফোর্ড বলল, চেরোকি এলাকাতে ভালো রেস্ত পাওয়া যায়।
জিম মন্তব্য করল, তা যায়। তবে ওই জায়গার হাওয়া বড়োই ফাঁকা, আর ওই ফাঁকা হাওয়ার উপর ঠ্যাং ছুঁড়তে ছুঁড়তে শূন্যে ঝুলতে মোটেই ভালো লাগে না, বুঝেছ দোস্ত?
বিল এতক্ষণ চুপচাপ ছিল, এইবার সে মুখ খুলল, আরে! ফাঁসিতে ঝোলাতে হলে লুঠেরাকে আগে ধরতে হবে তো! আমরা সেই সুযোগ দেব কেন? আমার মনে হয় বব আর এফির সাহায্যে আমরা গা-ঢাকা দিতে পারব।
জিম সায় দিল, তা বটে।
কুক ভাইরা যার কথা বলল সেই বব হার্ডিন হচ্ছে কুক ভাইদের শ্যালক। শালাবাবু কাজ করত এফি ক্রিটেনডেন নামে এক মহিলার সরাইখানাতে। সরাইখানাটির নাম হাফওয়ে হাউস। ওই হাফওয়ে হাউস ছিল ফোর্ট গিবসন ও টেলাকুয়া প্রদেশের মধ্যস্থলে অবস্থিত একমাত্র বিশ্রামাগার। পূর্বোক্ত দুটি প্রদেশের মধ্যে যাতায়াতকারী পথিকদের বিশ্রাম ও খাদ্যগ্রহণের জন্য হাফওয়ে হাউস ছাড়া অন্য কোনো সরাইখানা সেই অঞ্চলে ছিল না।
বিল কুক বলল, সে যাই হোক, ওই সরাইখানায় ববের কাছেই আমাদের যেতে হবে। স্কেলস বুড়োর দোকান লুঠ করার পর এখন আর এই এলাকার মানুষ আমাদের সুনজরে দেখবে না। অতএব চলো ববের কাছে।
পর্বতসংকুল পথের উপর দিয়ে ঘোড়ায় চেপে তিন স্যাঙাত চলল বব হার্ডিনের সঙ্গে মোলাকাত করতে। অধিকাংশ সময়েই রাতের দিকে তারা ভ্রমণ করত অশ্বপৃষ্ঠে। ওইভাবে ঘোড়া চালিয়ে কয়েকটা পাহাড় পার হয়ে তারা এসে পৌঁছোল তাদের লক্ষ্যস্থল হাফওয়ে হাউস নামক পূর্বে উল্লিখিত সারাইখানাতে।
বব এবং কত্রীঠাকুরানি এফি মহানন্দে তাদের অভ্যর্থনা জানাল। তবে কয়েকটা দিন সেখানে কাটিয়েই তারা অধৈর্য হয়ে পড়ল। তা ছাড়া ব্যাপারটা ব্যয়সাপেক্ষ। এফি ঠাকুরানি ব্যাবসা করছে, বিনা পয়সায় দস্যুদের আশ্রয় ও আহার সে দেবে কেন?
নাঃ, এভাবে পকেটের টাকা খরচ করার কোনো মানে হয় না। অতএব পরামর্শ-সভা বসল তিন বন্ধুর মধ্যে। টেলাকুয়া শহরে অর্থ উপার্জনের উপায় আছে। উপায়টা অবশ্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
গোয়িং স্নেক ও টেলাকুয়া পরগনার রাজধানী হচ্ছে টেলাকুয়া। রাজধানীতে আইনরক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা–ফোর্ট স্মিথ থেকে যুক্তরাজ্যের এক দঙ্গল মার্শাল জমায়েত হয়েছে ওই শহরে। রাজধানী টেলাকুয়া তাই মার্শালদের সবচেয়ে বড়ো ডেরা, অর্থাৎ হেড কোয়ার্টার। ওখানে ডাকাতির চেষ্টা করা মানেই ভিমরুলের চাকে ঘা দেওয়া। কিন্তু তিন স্যাঙাত বদ্ধপরিকর। ওই শহরে মানুষজনের টাকা আছে, বিপদের ঝুঁকি না-নিলে লাভের আশা কোথায়?
মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার–এই হচ্ছে তিন বন্ধুর প্রাণের কথা।
অতএব জিম কুক পাঠিয়ে দিল শ্রীমতী এফিকে খবরাখবর সংগ্রহ করতে। বলাই বাহুল্য, লুঠের একটা অংশ এফির হস্তগত হবে এই ধরনের আশ্বাস তাকে দেওয়া হয়েছিল।
দিন দুই পরে ফিরে এসে এফি জানাল অবস্থা অনুকূল, মার্শালরা এখন টেলাকুয়া শহরে অনুপস্থিত।
জিম বলল, তাহলে তুমি বলছ এখন নিরাপদে কাজ হাসিল করা যাবে?
এফি সহাস্যে বলল, আলবত! ভয়ের কোনো কারণ নেই।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে জিম কুক একবার এফির দিকে তাকাল। তার মনে হল এফি যেন জোর করে সহজ হতে চাইছে। সে যেন একটু বেশিরকম হাসিখুশি, বড়ো বেশি সপ্রতিভ।
জিম তার সঙ্গীদের একান্তে ডেকে চুপি চুপি বলল, হাওয়া সুবিধের নয়। মনে হচ্ছে এফি শয়তানি করে কর্তাদের কাছে আমাদের খবর পাঠিয়েছে।
বিল বলল, কিন্তু ও তো শহরে গিয়েছিল। খবর দিতে হলে শহরের ভিতর না-গেলেও চলত। এখান থেকেও খবর পাঠানো যায়।
জিম ঘাড় নাড়ল, তা বটে। কিন্তু এফির হাবভাব আমার মোটেই ভালো লাগছে না।
তিন বন্ধু সতর্ক হয়ে গেল। দিনের আলোতে যে তাদের কেউ ধরতে আসবে না, এ-বিষয়ে তারা নিঃসন্দেহ। হঠাৎ যদি পলায়নের প্রয়োজন হয়, তাই ঘোড়াগুলিকে জিন লাগাম চড়িয়ে তারা তৈরি রাখল। তারপর চটপট শেষ করে নিল নৈশভোজন।
ধীরে ধীরে রাত বাড়ে। ঘনিয়ে আসে অন্ধকার। তিন স্যাঙাতের চোখে ঘুম নেই। অনাগত বিপদের আশঙ্কায় তারা জেগে আছে অতন্দ্র প্রহরায়।
অন্ধকারের ভিতর হঠাৎ লাগাম টানার শব্দ। ঘোড়ার জিনে চামড়ার মচ মচ আওয়াজ। কারা যেন আসছে!
ছায়াচ্ছন্ন রাতের আঁধারে আত্মগোপন করে অগ্রসর হল তিন পলাতক আসামি, হাতে তাদের উদ্যত রাইফেল।
কয়েক মিনিট পরেই চেরোকি নেশান অঞ্চলের শেরিফ এলিস র্যাটলিং গোর্ড ঘোড়ায় চেপে সরাইখানার সম্মুখবর্তী ফাঁকা জায়গাটার উপর এসে দাঁড়াল; সঙ্গে তার একদল সশস্ত্র রক্ষী।
রক্ষীদের নাম সিকুয়া হোস্টন, বিল নিকেল, আইজ্যাক গ্রিস, ব্র্যাকেট, হিকস, ডিক ক্রিটেনডেন ও জেক ক্রিটেনডেন। পূর্বোক্ত ডিক ক্রিটেনডেন হচ্ছে শ্রীমতী এফির পূর্বতন স্বামী (বর্তমানে বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে বিচ্ছিন্ন) আর জেক হচ্ছে তার ভাই, অর্থাৎ এফির দেবর।
দস্যুদের সন্দেহ সত্য। এফি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
এবার ওদের একটু ওষুধ দেওয়া দরকার, শান্তস্বরে বলল ক্রফোর্ড; তারপরই গুলি ছুড়ল। লক্ষ্য ব্যর্থ হল না, ঘোড়ার উপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ল সিকুয়া হোস্টনের মৃতদেহ।
পরক্ষণেই অগ্নি-উগার করে গর্জে উঠল কুক ভাইদের জোড়া রাইফেল। লড়াই শুরু হল।
রক্ষীবাহিনী পাগলের মতো ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তারপর এদিক-ওদিক ছুটে আড়াল খুঁজে গুলি থেকে প্রাণ বাঁচাতে সচেষ্ট হল। আরোহীবিহীন ঘোড়াগুলো তীব্র হ্রেষাধ্বনি তুলে ছোটাছুটি শুরু করল। অন্ধকারের ভিতর থেকে শোনা গেল একাধিক যাতনাকাতর কণ্ঠে ক্রুদ্ধ শপথবাক্য ও অভিশাপ।
তারপরই কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ওই যে এক বেটা!
তৎক্ষণাৎ জাগল অনেকগুলো আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন-ধ্বনি, ছুটে এল তপ্ত বুলেটের ঝটিকা–জিম কুকের দেহ বিদ্ধ করল সাত-সাতটা গুলি।
গুলির আওয়াজ থামাল কিছুক্ষণ পরে। আশেপাশের ঝোপঝাড়ে শব্দ উঠল; আগেকার আশ্রয়স্থল ছেড়ে আরও ভালো জায়গায় আড়াল খুঁজে সরে যেতে চাইছে বন্দুকধারী মানুষ। আবার জাগল নূতন শব্দের তরঙ্গ। অশ্বখুর-ধ্বনি। প্রায় আধ ঘণ্টা পরে শেরিফ বুঝল শিকার পলাতক খুনিরা পালিয়েছে আধ ঘণ্টা আগেই।
আহত জিম কুককে মাঝখানে নিয়ে অদ্ভুত কৌশলে ঘোড়া ছুটিয়ে বিল আর ক্রফোর্ড এসে পৌঁছোল কুক ভাইদের এক বোনের বাড়ি। বিল এবং ক্রফোর্ডের হাতে হাত মিলিয়ে আহত জিমকে ঘরের ভিতর দিয়ে আসতে সাহায্য করল ভগ্নী লু, তারপর ক্ষতগুলো ধুয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।
তোমরা এবার ওকে চটপট সরিয়ে নিয়ে যাও,লু বলল, শেরিফ র্যাটলিং গোর্ড এখনই এখানে এসে পড়বে।
বিল বলল, শেরিফ যদি বেঁচে থাকে তাহলে সে এখানে আসতে পারে বটে, কিন্তু জিমকে বাইরে নিয়ে গেলে সে নির্ঘাত মারা পড়বে।
লু উত্তর দিল, তোমরা যদি ওকে এখনই বাইরে না-নিয়ে যাও, তাহলে কি ও বাঁচবে? এখানে থাকলে ও মরবে ফাঁসিতে ঝুলে।
তা বটে। লু-র যুক্তি অস্বীকার করতে পারল না দুই দস্যু। আহত সঙ্গীকে নিয়ে তারা বাইরে বেরিয়ে গেল। সঙ্গেসঙ্গে আঁধার রাতের গর্ভ ভেদ করে তাদের কানে ভেসে এল ধাবমান অশ্বের পদশব্দ। তারপরই সব চুপচাপ। একবার মার খেয়ে শেরিফ বুঝেছে পলাতক তিন আসামি অতি ভয়ংকর চরিত্রের মানুষ–ওরা অন্ধকারেও নির্ভুল লক্ষ্যে গুলি চালাতে পারে এবং নরহত্যা করতে তাদের দ্বিধা নেই বিন্দুমাত্র। দ্বিতীয়বার ভুল করল না শেরিফ র্যাটলিং গোর্ড, সদলবলে : বাড়িটাকে ঘিরে ফেলল নিঃশব্দে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর শেরিফ বুঝল শিকার পলাতক, সে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করল।
একটি গামলার ভিতর রক্তাক্ত জল দেখতে পেল শেরিফ। অভিজ্ঞ আইনরক্ষক বুঝল দস্যুরা একটু আগেও এখানে ছিল। লুর উদ্দেশে প্রশ্ন নিক্ষেপ করল শেরিফ, তোমার ভাইদের সঙ্গে যে-লোকটি এখানে এসেছিল, সে কে? আমার মনে হয় ওই লোকটি হচ্ছে ক্রফোর্ড গোল্ডসবি।
লু মাথা নাড়ল, না ক্রফোর্ড নয়। লোকটির বেশ বয়স হয়েছে। ভাইরা বলছিল ওর নাম চেরোকি বিল।
শেরিফের কবল থেকে ক্রফোর্ডকে বাঁচানোর জন্য যে মিথ্যা নামটি আবিষ্কার করেছিল কুক ভগ্নী লু, সেই নামটিই স্থায়ী হয়ে গেল ক্রফোর্ডের জীবনে–ক্রফোর্ড গোল্ডসবির পরিবর্তে জন্মগ্রহণ করল দস্যু চেরোকি বিল। পশ্চিম আমেরিকার কুখ্যাত নরহন্তা দস্যুদের ইতিহাসে চেরোকি বিল নামটি অতিশয় পরিচিত।
১৮৯৪ সালে ৮ জুলাই রাত্রে শেরিফ র্যাটলিং গোর্ডকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিল বিল। তারপর থেকে বিল অধিকাংশ সময়েই নিঃসঙ্গ অবস্থায় ঘুরে বেড়িয়েছে; লুঠতরাজ করেছে বিভিন্ন স্থানে, নরহত্যা করেছে একটার পর একটা। সেই বছরেরই শেষের দিকে যেসব অপরাধ সে করেছিল, সেই দুষ্কর্মগুলির তালিকা আছে ফোর্ট স্মিথ আর্ক নামক স্থানে। ওই তালিকার দিকে দৃষ্টিপাত করলে জানা যায় নোয়াটা অঞ্চলে ট্রেন-ডাকাতিতে অভ্যস্ত আর এক দস্যুকে সে হত্যা করেছে, তারপর তার হাতে খুন হয়েছে পূর্বোক্ত দস্যুর শ্যালক জন ব্রাউন–অতঃপর বিল কর্তৃক লুণ্ঠিত হয়েছে রেড ফর্ক অঞ্চলের ট্রেন, ওকমালজিতে পার্কিনের দোকান, শ্যাটো এক্সপ্রেস অফিস, করেটার একটা ট্রেন এবং লেনাপা পোস্ট অফিস। মাত্র সাড়ে চার মাসের মধ্যে বারোটি নরহত্যা করেছিল বিল। নিহত বারো জনের মধ্যে শেষ ব্যক্তির নাম আর্নেস্ট মেলটন।
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : শেষ সংঘাত
১৮৯৪ সালে নভেম্বর মাসের ৮ তারিখে লেনাপার রাজপথের উপর দিয়ে সবেগে ও সশব্দে ঘোড়া ছুটিয়ে চেরোকি বিল এসে থামল শাফেল্ট-এর দোকানের সামনে।
সঙ্গে তার এক সহযোগী দস্যু, নাম ভার্ডিগ্রিস কিড।
কিডের রাইফেল সগর্জনে কয়েকবার অগ্নিবর্ষণ করল, সঙ্গেসঙ্গে রাজপথ কঁকা। চেরোকি বিল দোকানে ঢুকল, হাতে তার উইনচেস্টার রাইফেল।
তরুণ দোকানি শাফেল্টকে উদ্দেশ করে বিল বলল, যা আছে সব নিয়ে যাব।
ঠিক আছে বিল, সব কিছুই তোমার, বলল শাফেল্ট, তারপর সিন্দুক খুলে দিল।
শাফেল্টের দোকানের পাশেই একটা রেস্তোরাঁ বা ভোজনালয়। ওই রেস্তোরাঁ এবং শাফেন্টের দোকানের মাঝখানে অবস্থান করছিল খানিকটা ফাঁকা জায়গা। রেস্তোরাঁর একটি জানালা দিয়ে আর্নস্ট মেলটন সাগ্রহে ডাকাতির ব্যাপারটা দেখছিল। হঠাৎ বিলের দৃষ্টি পড়ল মেলটনের দিকে। বীরত্বের সাক্ষী হিসাবে দর্শক পেলে খুশি হত বিল, কিন্তু কী কারণে জানি না সেদিন মেলটনকে দেখেই তার মেজাজ ছিল বিগড়ে–ধাঁ করে রাইফেল তুলে সে গুলি চালিয়ে দিল। জানালার কাঁচ ভেঙে মেলটনের মস্তিষ্কে গুলিবিদ্ধ হল। তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করল আর্নেস্ট মেলটন।
এমন অকারণ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ না-করে থাকতে পারল না তরুণ শাফেল্ট :লোকটাকে শুধু শুধু মারলে? কাজটা মোটেই ভালো হল না।
তুমিও বুঝি ওইভাবে মরতে চাও?
না। বিল, তুমি আমার সোনাগুলি নিয়েছ। ওতেই খুশি থেকো, আমার প্রাণ নিয়ে তোমার কিছু লাভ নেই।
ঠিক আছে।
হত্যাকারী দোকানের বাইরে এসে ঘোড়ায় চাপল। ভার্ডিগ্রিস কিড এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল সঙ্গীর জন্য। দোকানের সামনে কয়েকবার গুলি ছুঁড়ে শহরবাসীকে বিদায় সংবর্ধনা জানাল দুই দস্যু, তারপর সবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে শহর ত্যাগ করল।
প্রায় দুই মাইল পথ অশ্বারোহণে অতিক্রম করার পর বিল তার সঙ্গীকে বলল, এবার মালের বখরা নিয়ে তুমি সরে পড়ো। পরের সপ্তাহে টালসি শহরে আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব। এখন আমি যাচ্ছি ম্যাগি গ্লাসের সঙ্গে দেখা করতে। ম্যাগি আছে নোয়াটাতে তার আত্মীয়স্বজনের কাছে।
কিড বলল, ওহে বিল, তোমার বান্ধবী ম্যাগির কাছে তুমি যেয়ো না। সবাই জানে তুমি ওখানে যাও। মার্শাল তোমাকে ওইখান থেকেই গ্রেপ্তার করবে। ভালো চাও তো ওইখানে যাওয়া ছেড়ে দাও।
রূঢ়স্বরে বিল বলল, আমার ব্যাপার আমি ভালোই বুঝি। তুমি কি আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাতে চাও?
ভার্ডিগ্রিস কিড ব্যস্ত হয়ে জানিয়ে দিল সেরকম উদ্দেশ্য তার নেই।
অতঃপর লুঠের মাল ভাগ হল। দুই দস্যু চলে গেল দুই দিকে। সেই রাতেই নোয়াটা শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে আইজ্যাক রজার্সের বাড়ির দরজায় এসে ধাক্কা দিল বিল। দরজা খুলে বিলকে দেখে ভারি খুশি রজার্স : আরে দোস্ত যে! তাড়াতাড়ি ঘোড়া রেখে ভিতরে এসো।
আইজ্যাক, তুমি কেমন আছ? বিল বলল, তুমি একবার নোয়াটাতে গিয়ে ম্যাগিকে নিয়ে এসো।
নিশ্চয়, নিশ্চয়।
পথে কারো সঙ্গে আজেবাজে কথা কইবে না। বুঝেছ আইক?
আমাকে তুমি জান না, বিল? আমি কাউকে তোমার কথা বলব না।
আমার কথা অন্য লোককে বললে তোমাকে বেশিক্ষণ বাঁচতে হবে না, আইক।
ওভাবে কথা বলছ কেন? আমি কি তোমাকে বিপদে ফেলতে পারি? বিল, তুমি মিছিমিছি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ।
কিছুক্ষণ পরে ভাইঝি ম্যাগিকে নিয়ে ফিরে এল রজার্স। বিলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যে জায়গা থেকে ভাইঝিকে আনতে রওনা হয়েছিল রজার্স, ঠিক সেই জায়গাতেই অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বিল হাতে তার নিত্যসঙ্গী রাইফেল, চোখের দৃষ্টি কঠোর এবং বিশ্লেষণে তীক্ষ্ণ।
আইজ্যাক সরে যেতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল ম্যাগি : তোমার এখানে আসা উচিত হয়নি ক্রফোর্ড। আইজ্যাক তোমাকে ধরিয়ে দিতে চায়। আগেও তোমাকে সাবধান করে দিয়েছি আমি। কেন তুমি এখানে এলে?
অনেকেই ও-কথা বলছে বটে, কিন্তু আমি জানি আইজ্যাক আমাকে ধরিয়ে দেবে না।
বিল স্মিথ এখানে অন্তত বার-ছয়েক এসে আইজ্যাকের সঙ্গে পরামর্শ করেছে।
স্মিথ ছাড়া আরও অনেক মার্শাল আমার পিছু নিয়েছে। সদম্ভে ঘোষণা করল বিল, আমি ওদের পরোয়া করি না।
পুরো দুটো দিন রজার্সের সঙ্গে কাটালেও রাইফেলটাকে বিল একবারও হাতছাড়া করেনি।
সে সবসময়েই হাসিখুশি, কিন্তু তার সতর্ক দৃষ্টি সর্বদাই রজার্সের উপর। তৃতীয় দিন সকালে রজার্সের বাড়ি থেকে সে বেরিয়ে গেল। তারপর অশ্বপৃষ্ঠে টালসিতে গিয়ে ভার্ডিগ্রিস কিড এবং কুক ভাইদের সঙ্গে মিলিত হল বিল। কিন্তু কয়েকদিন পরেই রক্ষীবাহিনীর তাড়া খেয়ে আবার তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল।
১৮৯৫ সালের জানুয়ারি ২৯ তারিখে আবার আইজ্যাক রজার্সের গৃহে উপস্থিত হল অশ্বারোহী বিল :ওহে রজার্স, তুমি চটপট নোয়াটাতে গিয়ে ম্যাগিকে নিয়ে এসো। আমি বেশ কিছুদিন এখানে বিশ্রাম নেব। চারদিকে হাওয়া বড়ো গরম, গতিক সুবিধের নয়।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি বিশ্রাম করো বিল, রজার্স বলল, রাইফেল রেখে দিয়ে একটু আরাম করো।
ওই কথাটি বলবে না আইজ্যাক। আমি রাইফেলের উপর নজর রাখি, তাই রাইফেলও আমার উপর নজর রাখে।
ক্রফোর্ড গোল্ডসবি বহু নরহত্যা করেছিল। তার ভগ্নীপতিকে সামান্য কারণে সে গুলি করে মেরে ফেলেছিল। অনেক মানুষকে সে খুন করেছে সম্পূর্ণ অকারণে। কিন্তু রজার্স যে তাকে ধরিয়ে দিতে চায় সে-কথা জেনেও কেন যে ওই লোকটিকে বিল খুন করেনি তা বলা মুশকিল। খুব সম্ভব রজার্সের সঙ্গে একটা বিপজ্জনক খেলায় নেমে সে মনে মনে আনন্দ আর উত্তেজনার চমক উপভোগ করেছিল। রজার্স যে এক সময়ে যুক্তরাজ্যের অন্যতম মার্শাল ছিল এবং বর্তমান ডেপুটি মার্শাল উইলিয়াম স্মিথের সঙ্গে চক্রান্ত করে সে যে বিলকে ধরতে চাইছে, সেইসব তথ্যও বিলের অজ্ঞাত ছিল না। রজার্সের আর এক প্রতিবেশী ক্লিং স্কেলসও বিলকে ধরিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিল। শুধু পুরস্কারের লোভেই যে সে এই কাজ করছিল তা নয়। উইটাম্পকিন শহরে যে স্কেলসদের দোকানে বন্ধুদের নিয়ে বিল ডাকাতি করেছিল, সেই স্কেলসদের এক আত্মীয় ছিল ক্লিং স্কেলস।
ম্যাগি গ্ল্যাস আবার সতর্ক করে দিল তার বন্ধুকে, কিন্তু চেরোকি বিল তার কথায় কান দিল না।
রজার্স অবশ্য খুবই যত্ন করছিল তার অতিথিকে। আদর করে এক গ্যালন হুইস্কি নিয়ে এল সে বিলের জন্য। দুঃখের বিষয়, বিল সেই হুইস্কির স্বাদ গ্রহণ করতে রাজি হল না। রজার্স তার প্রতিবেশী ক্লিংকে নিয়ে এসেছিল তাস খেলার অন্যতম সঙ্গী হিসেবে। অতিথিকে সন্তুষ্ট করতে বিভিন্ন সুস্বাদু পদ রান্না করেছিল রজার্সের বউ। অবশ্য ওইসব রান্নার উপকরণ সংগৃহীত হয়েছিল চেরোকি বিলের টাকা থেকেই।
টেবিলের উপর সাজানো আহার্য নিয়ে নৈশভোজনে বসেছিল বিল। চেয়ারে উপবিষ্ট বিলের পিঠ ছিল দেয়ালে, মুখ ছিল দরজার দিকে ফেরানো এবং কোলের উপর ছিল উইনচেস্টার রাইফেল।
সারা দুনিয়া জানে তোমার বন্ধুরা তোমাকে ভালোবাসে, ক্ষুণ্ণকণ্ঠে অভিযোগ জানাল রজার্স, কিন্তু তুমি বন্ধুদের বিশ্বাস করো না। সত্যি, এটা খুবই অপমানের বিষয়।
বিলের ওষ্ঠাধরে ফুটল হিংস্র হাস্য; নির্বিকার স্বরে সে বলল, আইক, ওই মাংসের পাত্রটা এগিয়ে দাও তো।
খাওয়া শেষ হলে তারা তাস খেলতে বসল। খেলা চলল ভোর চারটে পর্যন্ত; এর মধ্যে একবারও কোলের উপর থেকে রাইফেল নামায়নি বিল। তিন খেলোয়াড়ই অনুভব করছিল হাওয়া খারাপ, পরিবেশ সুবিধের নয়। অবশেষে চারটের সময় তিনজনেই শুয়ে পড়ল।
একই খাটে একই বিছানায় শয্যা নিয়েছিল তিনজন। কিছুক্ষণ পরে অতি সন্তর্পণে খাট থেকে নিঃশব্দে নামল রজার্স, তৎক্ষণাৎ বিলের পা পড়ল মেঝের উপর এবং মুহূর্তপূর্বে শায়িত বিল হল রাইফেল হাতে দণ্ডায়মান!
মধুর হেসে বিল জানতে চাইল, কোনো শব্দ-টব্দ শুনে উঠে পড়েছ বুঝি, আইক?
আইক আবার শয্যা গ্রহণ করল। বিলও শুয়ে পড়ল তার নিজস্ব জায়গায়।
একটু পরে আবার যেই আইক উঠেছে, সঙ্গেসঙ্গে বিলও উঠে দাঁড়িয়েছে রাইফেল নিয়ে এবং নিরীহ কণ্ঠে আইকের নিদ্রাভঙ্গের কারণ জানতে চেয়েছে। বার বার একই ঘটনার যখন পুনরাবৃত্তি ঘটল, তখন হতাশ হয়ে নিদ্রার ক্রোড়ে আত্মসমর্পণ করল আইক।
ঘুম ভাঙতে আইক দেখল সে একাই শুয়ে আছে; চারদিকে ঝলমল করছে সূর্যালোক। সে বুঝল বেশ বেলা হয়েছে। শয্যাত্যাগ করে জামাকাপড় চড়িয়ে আইক রান্নাঘরে এসে দেখল ওই ঘরে খাওয়ার টেবিলের সামনে চেয়ার পেতে বসে আছে বিল–কোলে নিত্যসঙ্গী রাইফেল, মুখে বিদ্রপের মৃদু হাসি।
স্কেলসও ছিল সেখানে, মিসেস রজার্স ব্রেকফাস্ট বা প্রাতরাশ পরিবেশন করছিল। খাওয়া শেষ হলে তিনজনই চেয়ার পেতে উপবিষ্ট হল অগ্নিকুণ্ডের সামনে। শীতের দেশ, সকালের কনকনে ঠান্ডায় অগ্নিকুণ্ডের উত্তপ্ত সান্নিধ্য বেশ আরামদায়ক।
হঠাৎ ঘরের ভিতর ঢুকল বিলের বান্ধবী ম্যাগি গ্লাস। চঞ্চল-চরণে সে ঘরের এক দরজা দিয়ে ঢুকে অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। যাতায়াত করার সময়ে তার উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি ঘুরছিল উপবিষ্ট তিন ব্যক্তির মুখের উপর। কয়েকবার ওইভাবে ঘোরাঘুরি করার পর হঠাৎ বিলের পাশে এসে দাঁড়াল ম্যাগি এবং পুরোনো নাম ধরে সম্বোধন করে বলল, ক্রফোর্ড! তুমি এখানে রয়েছ কেন? তাড়াতাড়ি চলে যাও এখান থেকে। তুমি কি জানো না, ওরা দুজনে তোমাকে ধরিয়ে দিতে চায়?
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, অকারণে নরহত্যা করতে যার কিছুমাত্র দ্বিধা ছিল না, সেই চেরোকি বিল দুই চক্রান্তকারীর অসৎ উদ্দেশ্য জানতে পেরেও তাদের খুন করার চেষ্টা করেনি। বোধ হয় ষড়যন্ত্রকারীদের আশা-নিরাশার উদবেগপূর্ণ মুহূর্তগুলি সে উপভোগ করছিল; নিজের উপর তার আস্থা ছিল অপরিসীম।
বান্ধবীর সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করে রজার্সের বাড়িতেই থেকে গেল বিল। সকালের পর দুপুর; আবহাওয়া থমথমে। প্রত্যেকেই নীরব। একটা আসন্ন দুর্ঘটনার ইঙ্গিত অনুভব করছিল সকলেই।
আইক রজার্স সশব্দে গলা পরিষ্কার করল, তারপর ভাইঝিকে ডেকে বলল, ম্যাগি, দোকানে গিয়ে ভালো দেখে কয়েকটা মুরগি নিয়ে এসো। বিল যখন এখানে আছে, ওকে ভালো করে খাওয়ানো দরকার। অতিথিকে আদর যত্ন করা আমাদের কর্তব্য।
একটু ইতস্তত করে পিতৃব্য রজার্সের হাত থেকে টাকা নিল ম্যাগি। একবার বিলের মুখে দিকে তাকাল সে, কিন্তু বিল নির্বিকার বান্ধবীর মুখের দিকে সে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল না। অগত্যা একটা শাল টেনে মুরগি আনতে চলে গেল ম্যাগি।
স্কেলস খানিকটা তামাক ও সিগারেট পাকানোর কাগজ পকেট থেকে বার করল এবং নিপুণ হস্তে পাকিয়ে ফেলল একটি চমৎকার সিগারেট। তারপর সিগারেট তৈরির ওই মালমশলা সে তুলে দিল বিলের হাতে। বিল জানাল ওইভাবে সিগারেট বানাতে সে অভ্যস্ত নয়, তবে চেষ্টা করতে তার আপত্তি নেই। অনভ্যস্ত হাতে একটা বিশ্রী হোঁতকা সিগারেট বানাল বিল, তারপর সঙ্গীদের কাছে দেশলাই চাইল। দুই সঙ্গী জানিয়ে দিল তাদের কাছে দেশলাই নেই।
ওই তো আগুন, ওইখান থেকেই সিগারেট ধরাও, আঙুল তুলে অগ্নিকুণ্ড দেখিয়ে দিল রজার্স।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বিল। নিত্যসঙ্গী রাইফেল তখনও তার হাতে। একহাতে রাইফেল ধরে অপর হাতে কাঠের স্তূপ থেকে একটা কাষ্ঠখণ্ড তুলে নিল সে। অগ্নিকুণ্ড থেকে কাঠের টুকরোটা জ্বালিয়ে সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করতে সচেষ্ট হয়েছিল বিল এবং সেইজন্যেই সঙ্গীদের দিকে পিছন ফিরে সে ঝুঁকে পড়েছিল অগ্নিকুণ্ডের ওপর।
মুহূর্তের জন্য সে সঙ্গীদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল, মুহূর্তের জন্য তার দৃষ্টি সরে গিয়েছিল স্কেলস ও রজার্সের উপর থেকে।
ওই একটি মুহূর্তই যথেষ্ট রজার্সের কাছে বিড়ালের মত ক্ষিপ্রবেগে, বিড়ালের মতোই নিঃশব্দে কাঠের স্তূপ থেকে একটি কাঠ তুলে নিল রজার্স–পরক্ষণেই প্রচণ্ড বেগে সেই কাষ্ঠখণ্ড পড়ল বিলের মস্তকে।
অমন মোটা কাঠ দিয়ে অত জোরে বাড়ি মারলে যেকোনো জোয়ান মানুষের মাথা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যেত, কিন্তু বিল ছিল অসাধারণ শক্তিশালী–আঘাতের বেগে সে হাঁটু দুমড়ে পড়ে গেল, তবে কাবু হল না।
বিলের রাইফেল হাত থেকে ছিটকে পড়েছিল কাষ্ঠপের উপর, সেটাকে পুনরায় হস্তগত করার সুযোগ সে পেল না–তার আগেই বিলের উপর একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল রজার্স ও স্কেলস।
এক ঝটকায় দুজনকে ছিটকে ফেলে দিয়ে বিল উঠে দাঁড়াল, তারপর সজোরে ঘুসি চালাতে লাগল আততায়ীদের লক্ষ করে।
মারামারির শব্দ শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসেছিল মিসেস রজার্স। রাইফেলটাকে কাষ্ঠপের উপর পড়ে থাকতে দেখে মেয়েটি সেটাকে তুলে নিল, তারপর খেলা দরজা দিয়ে অস্ত্রটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল পাশের ঘরে।
ওর রাইফেল এখন আমার কাছে! চেঁচিয়ে উঠল মিসেস রজার্স।
খেপা ষাঁড়ের মতো গর্জন করছিল বিল। বাইরের দরজা দিয়ে বিল একবার ছুটে পালাতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু স্কেলস আর রজার্স একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। পরক্ষণেই তিনজন গড়িয়ে পড়ল মেঝের উপর। অন্তত বিশ মিনিট ধরে ঘরের মেঝেতে গড়াগড়ি আর ধস্তাধস্তি চলল তিনজনের মধ্যে। যুযুধানদের হস্তপদ ও দেহের আঘাতে চেয়ারগুলি হল টুকরো টুকরো। বিলের ক্রুদ্ধ গর্জন শুনে ছুটে এল তার বান্ধবী ম্যাগি গ্ল্যাস, কিন্তু ওই অবস্থায় বিপন্ন বন্ধুকে সাহায্য করার কোনো উপায়ই খুঁজে পেল না মেয়েটি।
অসহায়ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে ম্যাগি দেখল, বিলের রক্তাক্ত দেহটাকে মেঝের উপর চেপে ধরেছে দুই স্যাঙাত। কড়াৎ করে একটা শব্দ হল, ম্যাগির ভয়ার্ত দৃষ্টির সামনেই বিলের কবজিতে সশব্দে হাতকড়ি লাগিয়ে দিল রজার্স।
প্রহারক্লিষ্ট ক্ষতবিক্ষত দেহে মেঝের উপর পড়ে বিল কিছুক্ষণ ধরে সজোরে শ্বাস গ্রহণ করল, তারপর উঠে বসল। রজার্সের দিকে তাকিয়ে বিল বলল, আমি ভাবতেই পারিনি তুমি আমাকে ধরতে পারবে। আইক, তুমি অসাধ্য সাধন করেছ!
আইক বলল, জ্যান্ত অবস্থায় তোমাকে ধরতে পারব কি না সে-বিষয়ে আমারও সন্দেহ ছিল। একবার ভেবেছিলাম তোমাকে খুন করব।
বিল অনুনয় করে বলল, সেই ভালো। আইক, তুমি বরং আমাকে খুন করো। পুরস্কারের টাকা তো তুমি পাবেই সরকারের হাতে তুলে আমাকে ফাঁসিতে লটকে তোমার কী লাভ?
রজার্স জানাল বিচারক পার্কারের সামনে সে চেরোকি বিলকে হাজির করতে চায়।
কিন্তু বিচারে তো আমার ফাঁসির হুকুম হবে। তার চেয়ে তুমি আমাকে এখানেই মেরে ফেলছ না কেন?
উঁহু, রজার্স বলল, ওরা তোমার মৃতদেহ চায় না। তোমাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে উপস্থিত করতে পারলে আমরা মোটা টাকা পুরস্কার পাব। সেইরকম চুক্তি হয়েছে আমাদের সঙ্গে।
বিল বলল, তুমিও নিস্তার পাবে না আইক! মনে রেখো, আমার ভাই আছে! ক্লারেন্স তোমার উপর বদলা নেবে!
রজার্স তাচ্ছিল্য জানিয়ে বলল, ছাই করবে! তোমার ভাই ক্লারেন্স আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
নোয়াটা শহরে এসে রজার্স বিলকে তুলে দিল বিল স্মিথ নামক ডেপুটির হাতে। সশস্ত্র রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে ক্রফোর্ড গোল্ডসবি ওরফে চেরোকি বিলকে নিয়ে যাত্রা করল ডেপুটি বিল স্মিথ এবং তিনদিন ভ্রমণ করে পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে আরকানসাস নদী পেরিয়ে উপস্থিত হল ফোর্ট স্মিথ বিচারশালায়। পূর্বোক্ত বিচারশালাটি ছিল ওই অঞ্চলের একমাত্র আদালত।
বিচারক আইজ্যাক পার্কার কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত উনষাট জন অপরাধী যে-কারাগারে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিল, সেইখানেই বিচারের আগে বন্দি হয়ে রইল ক্রফোর্ড গোল্ডসবি ওরফে চেরোকি বিল।
১৮৯৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বিলকে উপস্থিত করা হল আদালতে বিচারের জন্য। বিচারক পার্কারের এজলাসে বিলের ফাঁসির হুকুম হয়েছিল, কিন্তু জে. ওয়ারেন রিড নামে জনৈক অ্যাটর্নির চেষ্টায় সাময়িকভাবে মুত্যুদণ্ড স্থগিত রইল।
বিলকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল কারাগারে। সেইদিনই কারাগারের লৌহকপাটের ভিতর থেকে তরুণ হন্তারক আঘাত হানল।
লরেন্স কিটিং ও ইয়ফ নামে দুজন কারারক্ষী খুনিদের তত্ত্বাবধান করছিল। সারিবদ্ধ লৌহপিঞ্জরের ভিতর ঘুরতে ঘুরতে তালা লাগাচ্ছিল ইয়ফ। কোমরে রিভলভার ঝুলিয়ে বাইরে পায়চারি করছিল লরেন্স কিটিং।
চেরোকি বিল যে লৌহপিঞ্জরে আবদ্ধ ছিল, ঠিক তার পার্শ্ববর্তী খাঁচাটা ছিল ডেনিস ডেভিন্স নামে জনৈক অপরাধীর বাসস্থান।
উক্ত ডেনিসের খাঁচার তালা লাগাতে গিয়ে ইয়ফ দেখল চাবি লাগছে না, কারণ, তালার গায়ে চাবি লাগানোর ফুটোটাকে কাগজ ঢুকিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ব্যাপারটা সন্দেহজনক! খাঁচার রেলিং-এর ভিতর দিয়ে বাইরে রিভলভারধারী সঙ্গীর দিকে তাকাল ইয়ফ, ওহে ল্যারি, এখানে একটা গণ্ডগোল হয়েছে। ব্যাপার সুবিধের মনে হচ্ছে না।
আচম্বিতে বিলের খাঁচার দরজাটা খুলে গেল। লৌহকপাট ইয়ফের পৃষ্ঠদেশে আঘাত করল, সজোরে। সঙ্গেসঙ্গে পার্শ্ববর্তী কারাকক্ষ থেকে ইয়ফের লৌহপিঞ্জরে প্রবেশ করল চেরোকি বিল, হাতে তার প্রকাণ্ড রিভলভার।
(ভগবান জানেন রিভলভারটা সে কোথা থেকে জোগাড় করেছিল!)
–খাঁচার দরজার ভিতর দিয়ে রিভলভারটা কিটিং-এর দিকে উঁচিয়ে ধরল বিল, উন্মুক্ত দন্তের ফকে বেরিয়ে এল রোষরুদ্ধ অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর :কিটিং! তোমার হাতের রিভলভার আমাকে দাও। তারপর হাত দুটো উপরে তোলো! চটপট করো!
কিটিং হাত উপরে তুলল না, চটপট নামিয়ে আনল নীচে কোমরবন্ধে আবদ্ধ রিভলভারের বাঁটের উপর। কিন্তু অস্ত্রটাকে টেনে বার করার আগেই গর্জে উঠল বিলের রিভলভার। গুলি লাগল, কিটিং তবুও ধরাশায়ী হল না। আবার গুলি ছুড়ল বিল। এবার পড়ে গেল কিটিং। অপর রক্ষী ইয়ফ তখন খাঁচার ভিতরের দিকে লম্বা গলিপথ ধরে ছুট দিয়েছে। পর পর দু-বার তাকে লক্ষ করে বিল গুলি ছুড়ল।
চারজন প্রহরী গুলির আওয়াজ শুনে অকুস্থলে ছুটে এল। টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল কিটিং, এগিয়ে গেল সহকর্মীদের দিকে। চেরোকি বিল পালাতে চেষ্টা করছে, কিটিং বলল, ও আমাকে খুন করেছে!
কথাগুলো বলেই মাটিতে পড়ে গেল কিটিং। তার মৃত্যু হল তৎক্ষণাৎ।
লরেন্স কিটিং-এর রিভলভারটা মাটিতে পড়ে ছিল। অস্ত্রটাকে কুড়িয়ে নিয়ে বিলের দিকে গুলি চালাল প্রহরী ম্যাককনেল। সঙ্গেসঙ্গে তাকে লক্ষ করে গর্জে উঠল বিলের রিভলভার। দুজনের নিশানাই ব্যর্থ হল, খাঁচার গরাদে প্রতিহত হয়ে সশব্দে ছিটকে গেল বুলেট।
প্রহরীরা এক জায়গায় জড়ো হল। তারা বুঝেছিল চেরোকি বিল আর পালাতে পারবে না। কিন্তু তার কাছে গিয়ে তাকে বন্দি করবে কে? বিলের হাতে রিভলভার আছে, সুতরাং তার খাঁচার কাছাকাছি গেলেই যে গুলি খেয়ে মরতে হবে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিলকে নিরস্ত্র করার কোনো উপায় প্রহরীদের মাথায় এল না।
সমস্যার সমাধান করল বন্দি দস্যু হেনরি স্টার। সে তার কারাকক্ষ থেকে হাঁক দিয়ে বলল, আমাকে যদি তোমরা বিলের কাছে যেতে দাও, তাহলে রিভলভারটা আমি নিয়ে আসতে পারি।
হেনরিকে অনুমতি দেওয়া হল। ডেপুটি মার্শাল ব্রুনার সাবধানবাণী শুনিয়ে বলল, ঠিক আছে হেনরি, তুমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারো। কিন্তু খবরদার, শয়তানির চেষ্টা করতে যেয়ে না!
কোন মন্ত্রে ক্ষিপ্ত বিলকে ঠান্ডা করেছিল হেনরি সে-কথা কারো জানা নেই, তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল তাও কেউ বলতে পারে না–তবে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বিলের কারাকক্ষ থেকে রিভলভারটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল হেনরি স্টার। লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে অস্ত্রটাকে সে সমর্পণ করল ব্রুনারের হাতে।
কারাগারের ভিতর থেকে খুনের খবর বাইরে ছড়িয়ে পড়ল, লরেন্সের মৃত্যুসংবাদ শুনে খেপে গেল শহরের মানুষ। এক ক্ষিপ্ত জনতা কারাগার ঘেরাও করে দাবি জানাল হত্যাকারী বিলকে তাদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতেই তারা খুনির দণ্ড বিধান করতে চায়।
বলা বাহুল্য, মার্শাল জনতার দাবি মানল না। দৃঢ়ভাবে সে জানিয়ে দিল, বিচারক পার্কার যথাসময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা করবেন–নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার
অধিকার জনসাধারণের নেই।
১৮৯৫ সালের ২৪ অগাস্ট চেরোকি বিলকে আবার আদালতে হাজির করা হল।
.
পরিশিষ্ট
বিচারক পার্কারের রায় অনুসারে ১৮৯৬ সালের ১৭ মার্চ ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করল ক্রফোর্ড গোল্ডসবি ওরফে চেরোকি বিল।
মরার আগে বিশ্বাসঘাতক রজার্সের মৃত্যুসংবাদ শুনে গিয়েছিল বিল। সম্মুখযুদ্ধে গুলি করে রজার্সকে হত্যা করেছিল এক ব্যক্তি।
ওই ব্যক্তির নাম ক্লারেন্স গোল্ডসবি–চেরোকি বিলের ভাই সে।
Leave a Reply