০৩. শিক্ষা-জীবন

০৩. শিক্ষা-জীবন

রুদ্রের নিজবাড়ি সাহেবের মেঠ থেকে নানাবাড়ি মিঠেখালি খুব বেশি দূরের নয়। মিঠেখালি ইউনিয়নেই এই দুটি গ্রামের অবস্থান। ছোটবেলার অধিকাংশ সময় রুদ্র তার নানাবাড়িতে কাটাতেন। নানাবাড়ির পাঠশালাতেই তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। এমনকি, লেখালেখির আগ্রহও সৃষ্টি হয় ঐ নানাবাড়ি থেকে। নানাবাড়িতে ঐ সময় ঢাকার ‘বেগম’ আর কলক ‘শিশুভারতী’ আসত নিয়মিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলামের বইপত্র তো ছিলই। পাঠশালার পাঠ ডিঙানোর পর ১৯৬৪ সালে রুদ্র দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন নানার নামে। প্রতিষ্ঠিত ‘ইসমাঈল মেমোরিয়াল স্কুল’-এ। এখনো পর্যন্ত এই স্কুলটি বাগেরহাট অঞ্চলের বিখ্যাত স্কুল হিসেবে পরিচিত। রুদ্রের বয়স তখন আট বছর। এ-সময় স্কুলের পড়ালেখার পাশাপাশি রুদ্র বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং রবীন্দ্র-নজরুলের বই পড়ার সুযোগ পান। এঁদের অনেক কবিতা শিশু রুদ্রের মুখস্ত ছিল। নানাবাড়িতে থেকে রুদ্র তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর ১৯৬৬ সালে মংলা থানাসদরে সেন্ট পলস স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। এই স্কুলে পাঁচ বছর পড়াশোনা করে তিনি ১৯৭০ সালে অষ্টম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৭১-র মার্চমাসে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। রুদ্রের আর নবম শ্রেণীতে পড়া হয় নি। যুদ্ধে বিজয়ের পর ১৯৭২ সালে নবম শ্রেণী টপকিয়ে রুদ্র ঢাকার ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলে দশম শ্রেণীতে ভর্তি হন। থাকতেন ৫০ লালবাগে মামার বাসায়। এই স্কুলে থেকেই তিনি ১৯৭৩ সালে ৪টি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। পিতামাতার প্রবল ইচ্ছে সত্ত্বেও রুদ্র বিজ্ঞান শাখায় পড়ে ডাক্তার হওয়ার পথে যান নি। তিনি নিজের পছন্দে মানবিক শাখায় চলে যান। ঢাকা কলেজে এসে রুদ্র পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। এসময়ে তিনি সহপাঠী হিসেবে পান কামাল চৌধুরী, আলী রীয়াজ, জাফর ওয়াজেদ, ইসহাক খানসহ একঝাক তরুণ সাহিত্যকর্মীকে। কামাল চৌধুরী কবি ও প্রশাসক, আলী রীয়াজ প্রাবন্ধিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ইসহাক খান কথাসাহিত্যিক এবং জাফর ওয়াজেদ কবিতাচর্চা থেকে আপাত-বিদায় নিলেও সাংবাদিকতায় নিবেদিত, দৈনিক মুক্তকণ্ঠের চিফ রিপোর্টার। ঢাকা কলেজ থেকেই রুদ্র ১৯৭৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন দ্বিতীয় বিভাগে। দু’বছরে রুদ্র ক্লাস করেছিলেন মাত্র ১৮টি। নির্বাচনী পরীক্ষা দিতেও সমস্যা হয়েছিল। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বিএ (অনার্স) শ্রেণীতে। বন্ধু জাফর ওয়াজেদও একই বিভাগে একসঙ্গে ভর্তি হন এসময় আরো যারা তার লেখক-বন্ধু ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম রেজা সেলিম, ইসহাক খান, মঈনুল আহসান সাবের, সুব্রত শংকর ধর, সলিমুল্লাহ খান, তুষার দাশ, বিশ্বজিৎ ঘোষ, রফিকুল্লাহ খান, ভীষ্মদেব চৌধুরী, আলমগীর রেজা চৌধুরী, সাজেদুল আউয়াল, মোহন রায়হান, শাহজাদী আঞ্জুমান আরা মুক্তি প্রমুখ। এসময় রুদ্র থাকতেন ২১ সিদ্ধেশ্বরীতে, বন্ধু বদরুল হুদা সেলিমের বাসায়। ১৯৭৮ সালে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মনোনয়নে সাহিত্য-সম্পাদক পদে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কামাল চৌধুরী (ছাত্রলীগ) এবং আলী রীয়াজ (জাসদ-ছাত্রলীগ)। বন্ধু জাফর ওয়াজেদও ডাকসু-তে সদস্য পদে প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন। আর সেবার সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন আলী রীয়াজ। রুদ্র সরাসরি ছাত্ররাজনীতির নেতৃত্বে না-এলেও নির্বাচনে অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসকে প্রকাশ করেন। তার এই বিশ্বাস জীবনের শেষদিন পর্যন্ত টিকে ছিল।

রুদ্র আবাসিক ছাত্র ছিলেন সলিমুল্লাহ হলের। কিন্তু যতদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকতেন তার অধিকাংশই কাটাতেন ফজলুল হক হলের কামাল চৌধুরীর ৩০৯ নম্বর কক্ষে অথবা রেজা সেলিমের ১১০ নম্বর কক্ষে। ১৯৭১ সালে রুদ্রের অনার্স পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ক্লাসে উপস্থিতির হার কম থাকায় অনেক অনুরোধেও বাংলা বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডক্টর আহমদ শরীফ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে এবং জাফর ওয়াজেদকে পরীক্ষা দিতে অনুমতি দেন নি।(৫) পরের বছর ১৯৮০ সালে এঁরা বিএ (অনার্স) ডিগ্রি লাভ করেন দ্বিতীয় শ্রেণী পেয়ে। এ-সময় রেজা সেলিমও তাদের সঙ্গে পরীক্ষা দেন।(৬) এরপর নানা রাজনৈতিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় রুদ্রের প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা আবারো পিছিয়ে পড়ে। অবশেষে ১৯৮৩ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবনেই রুদ্রের ২টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। প্রথম গ্রন্থের প্রকাশক ছিলেন বুক সোসাইটির পক্ষে বিশিষ্ট সাহিত্যিক আহমদ ছফা। বইটির প্রকাশের সময়-সম্পর্কে রুদ্রের বন্ধু রেজা সেলিম জানিয়েছেন–

রুদ্রের প্রথম কবিতার বই ‘উপদ্রুত উপকূল’ বেরোয় ফেব্রুয়ারি উনআশি সালে। আমার খুব মনে আছে, সে সময়টায় ওর অস্থিরতাগুলোর কথা। ইতিমধ্যে আমাদের সব ব্যবধান ঘুচে আমরা হয়ে উঠেছিলাম সময়ের খুব কাছাকাছি। একই সাথে বেরিয়েছিল মোহনের ‘জ্বলে উঠি সাহসী মানুষ’ এবং রীয়াজের আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রবন্ধের বই ‘বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ’। এই বই তিনটি এবং সেই সময়টি আমাদের সবচে’ উজ্জ্বল ‘ এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।(৭)

ছাত্রাবস্থায় রুদ্রের দ্বিতীয় যে-বইটি প্রকাশিত হয়। তার নাম ‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮১ সালে। এই দুটি গ্রন্থের জন্যে ছাত্রাবস্থায়ই তিনি সংস্কৃতি সংসদ প্রবর্তিত মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন যথাক্রমে ১৯৮০ ও ১৯৮১ সালে।(৮) এরকম কৃতিত্বের মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হয়েছে রুদ্রের শিক্ষাজীবন। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ছাত্র হিসেবে সংযুক্ত ছিলেন সলিমুল্লাহ হলে। কিন্তু এই হলে কোনোদিন থাকেন নি। তার কলেজ-জীবন কাটে ৫০ লালবাগের মামাবাড়িতে। আর বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে কোনো হলেরই আবাসিক ছাত্র ছিলেন না। কিছুদিন থেকেছেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সঙ্গে ১১/১ উত্তর বাসাবো ভাড়াবাড়িতে। ওখান থেকে এসে ওঠেন বন্ধু বদরুল হুদা সেলিমের ২১ সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িতে। এ-সময় বন্ধু আলী রীয়াজের বাড়ি ২৩ সিদ্ধেশ্বরীতেও কিছুদিন থেকেছেন। একপর্যায়ে হলে ছিলেন কিছুদিন। তা-ও নিজের সলিমুল্লাহ হল ছেড়ে ফজলুল হক হলে থাকতেন, কখনো কামাল চৌধুরীর ৩০৯ নম্বর কক্ষে, কখনো রেজা সেলিমের ১১০ নম্বর কক্ষে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *