১৪. যাঁরা রামায়ণেও আছেন, মহাভারতেও আছেন

যাঁরা রামায়ণেও আছেন, মহাভারতেও আছেন

বেশকিছু চরিত্রকে আমরা রামায়ণ ও মহাভারত উভয় মহাকাব্যেই পাই। যেমন–(১) রামায়ণে জাম্ববান ভাল্লুক সেনা। রামের সেনার এক অন্যতম সদস্য। সীতার খোঁজ নিতে যখন হনুমানকে পাঠানোর কথা হয় তখন কোনও এক অভিশাপের জেরে নিজের শক্তি সম্পর্কে ভুলে গিয়েছিলেন হনুমান। তখন জাম্ববানই হনুমানকে তাঁর পরিচয় ও শক্তি সম্পর্কে অবহিত করেন। মহাভারতে কৃষ্ণর আসল পরিচয় না-জেনেই তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করেন জাম্ববান। যখন কৃষ্ণ নিজের পরিচয় প্রকাশ করে বলেন রাম ও তিনি একই, তখন লজ্জায় মাথা নিচু করে ক্ষমা চান জাম্ববান এবং নিজের মেয়ে জামবতীর সঙ্গে কৃষ্ণর বিবাহ দেন। (২) রামায়ণে হনুমানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভগবান রামের একনিষ্ঠ ভক্ত হনুমান। রাবণের স্বর্ণলঙ্কা জ্বালিয়ে দেওয়া থেকে সীতা উদ্ধারে হনুমান ছিলেন খুবই প্রাসঙ্গিক। মহাভারতে সুগন্ধিকা পুষ্প আনার সময় পথে এক বৃদ্ধ হনুমানকে দেখেন ভীম। ভীম দেখে ওই বৃদ্ধ হনুমানের লেজে রাস্তা আটকে রয়েছে। ভীম ওই বৃদ্ধ হনুমানকে লেজ সরানোর অনুরোধ করেন। হনুমান বলেন, তিনি বৃদ্ধ, নিজের লেজ নাড়ানোর ক্ষমতাও তাঁর নেই। তাই ভীমকেই সেই লেজ সরিয়ে দিতে হবে। ভীমের নিজের শক্তির উপর অগাধ বিশ্বাস ও অহংকার ছিল। সেই অহংকার চূর্ণ হয় যখন সে বৃদ্ধ হনুমানের লেজ নড়াতে অপারগ হয়। ভীম বৃদ্ধ হনুমানের আসল পরিচয় জানতে চান। তখন নিজের পরিচয় দেন ভগবান হনুমান। (৩) রামায়ণে সীতার স্বয়ম্বর সভায় রাম মহাদেব শিবের ধনুক ভেঙেছেন এই খবর জানতে পেরে উদ্বিগ্ন পরশুরাম রামকে প্রতিযোগিতার জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু পরে যখন তিনি জানতে পারেন রাম আসলে শিবেরই অবতার, তখন তিনি ক্ষমাপ্রার্থনা করেন, পাশাপাশি রামকে আশীর্বাদও দেন। মহাভারতেও পিতামহ ভীষ্ম ও কর্ণের গুরু হিসাবে পরশুরামের উল্লেখ আছে। (৪) রামায়ণের রাবণের ছোটো ভাই বিভীষণ, যিনি রামের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর লঙ্কার পরবর্তী রাজাও হন বিভীষণ। মহাভারতে পাণ্ডবরা যখন রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন, তখন বিভীষণ তাঁদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। এবং তাঁদের বহুমূল্য সমস্ত সামগ্রী ও উপহার প্রদান করেন। সভাপর্বে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময় সহদেব কর গ্রহণের জন্য বিভিন্ন রাজ্যে যান। এই দিগবিজয়কালে তিনি কচ্ছদেশে অবস্থান করে বিভীষণের কাছ থেকে কর আদায়ের জন্য ঘটোৎকচকে দূতরূপে পাঠান। বিভীষণ সহদেবের শাসন মেনে নেন। এবং বহু মূল্যবান সামগ্রী পাঠান। দাক্ষিণাত্য পাঠে আরও বেশ কয়েকটি জায়গায় বিভীষণকে পাওয়া যায়। (৫) রামায়ণে মায়াসুর রাবণের শ্বশুর। রাবণের স্ত্রী মন্দোদরী আসলে মায়াসুরের কন্যা। মহাভারতে পাণ্ডবরা যখন দণ্ডকারণ্য জ্বালিয়ে দিয়েছিল তখন একমাত্র মায়াসুরই বেঁচে গিয়েছিল। কৃষ্ণ তাঁকে মারতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে অর্জুনের কাছে প্রাণভিক্ষা চায়। পরে এই মায়াসুরই ইন্দ্রপ্রস্থ তৈরি করেন। (৬) রামায়ণে মহর্ষি দুর্বাসাই সেই ব্যক্তি যিনি রাম ও সীতার বিচ্ছেদের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। মহাভারতে মহর্ষি দুর্বাসার মন্ত্রেই কুন্তী পাঁচ সন্তানের (পাণ্ডব) মা হয়েছিলেন।

তবু আছে অনেক কিছু–মহাভারতে রামায়ণ আছে ঠিকই, রামায়ণে মহাভারত নেই। রামায়ণ মহাভারতের চেয়ে জনপ্রিয় বোধহয় এই কারণেই। সেই কারণেই বোধহয় রামায়ণের শত শত ভার্সান, মহাভারতে নেই। শ্রীরামচন্দ্র আর শ্রীকৃষ্ণের জনপ্রিয়তা এবং দেবত্ব প্রায় সমান সমান হলেও রামকে নিয়ে হিন্দুবাদীদের যতটা উন্মাদনা, শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে ততটা নয়। রাম ও হিন্দুত্ব যতটা সমার্থক হয়ে গেছে, কৃষ্ণ ও হিন্দুত্ব ততটা সমার্থক নয়। কৃষ্ণ যেন কেবলমাত্র বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদেরই সম্পদ। রাম জন্মভূমি আর বাবরি মসজিদ যেন এক কলঙ্কিত ইতিহাসের স্রষ্টা, কৃষ্ণকে ঘিরে তেমন কোনো কলঙ্কময় ইতিহাস রচিত হয়নি। অথচ রাম অপেক্ষা কৃষ্ণের জনপ্রিয়তা অনেক গুণ বেশি, সারা বিশ্বেই। কৃষ্ণ সারা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়, রাম নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *