০৭. লক্ষ্মণ : কর্তব্যনিষ্ঠ, ক্রোধী, বলশালী, অকুতোভয় এবং স্পষ্টবক্তা

লক্ষ্মণ : কর্তব্যনিষ্ঠ, ক্রোধী, বলশালী, অকুতোভয় এবং স্পষ্টবক্তা

লক্ষ্মণ রামের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। অযোধ্যার রাজা দশরথের কনিষ্ঠা মহিষী সুমিত্রার দুই যমজ পুত্র হলেন লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন। মূল রামায়ণে লক্ষ্মণের মাতা সুমিত্রার কোনো পিতৃপরিচয় উল্লেখ করেননি কবি। কিন্তু মহাকবি কালিদাস বলেছেন সুমিত্রা মগধের মেয়ে। আবার কৃত্তিবাস বলেছেন সিংহলে সুমিত্রার বাপের বাড়ি।

লক্ষ্মণ রামের অত্যন্ত অনুগত ছিলেন। বিশ্বামিত্র রাক্ষসবধের জন্য রামকে আমন্ত্রণ জানালে লক্ষ্মণ তাঁর সঙ্গী হন। পরবর্তীকালে তিনি রামকে পিতার আদেশের বিরুদ্ধে বনগমনে না-যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু রাম বনবাসে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকলে, লক্ষ্মণও তাঁর সঙ্গে বনে যান। বনবাসকালে তিনি একাধারে রামের ভাই, বন্ধু ও সহায়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন। লঙ্কার যুদ্ধে তিনি রাবণের পুত্র মেঘনাদ সহ আর অনেক বীরপুরুষদের হত্যা করেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র ষষ্ঠ সর্গে বলেছেন, লক্ষ্মণের হাতে অন্যায় যুদ্ধে মৃত্যু ঘটে অসমসাহসী বীর মেঘনাদের। মায়াদেবীর আনুকূল্যে এবং রাবণের অনুজ বিভীষণের সহায়তায়, লক্ষ্মণ শত শত প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রবেশে সমর্থ হয়। কপট লক্ষ্মণ নিরস্ত্র মেঘনাদের কাছে যুদ্ধ প্রার্থনা করলে মেঘনাদ বিস্ময় প্রকাশ করে। শত শত প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষ্মণের অনুপ্রবেশ যে মায়াবলে সম্পন্ন হয়েছে, বুঝতে বিলম্ব ঘটে না তার। ইতোমধ্যে লক্ষ্মণ তলোয়ার কোশমুক্ত করলে মেঘনাদ যুদ্ধসাজ গ্রহণের জন্য সময় প্রার্থনা করে লক্ষ্মণের কাছে। কিন্তু লক্ষ্মণ তাকে সময় এবং সুযোগ না দিয়ে আক্রমণ করে। লক্ষ্মণের মেঘনাদবধ প্রসঙ্গে অন্য কবিরা ‘তস্কর’ কাপুরুষ’ শিরোপা দিলেও, বাল্মীকির রামায়ণে এর কোনো সমর্থন পাওয়া যায় না। বাল্মীকির রামায়ণে লক্ষ্মণ রীতিমতো বীরত্ব প্রদর্শন করে মেঘনাদ সহ অসংখ্য বীরপুরুষদের হত্যা করেছেন বাহুবলেই এবং রণক্ষেত্রেই। অর্থাৎ নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষ্মণ নিরস্ত্র অসহায় মেঘনাদকে চোরের মতো হত্যা করেছেন, একথা সত্য নয়–এটা কাহিনি কষ্টকল্পনা। লক্ষ্মণ মেঘনাদকে হত্যা করেছেন বানরসৈন্য ও রাক্ষসসৈন্যের সঙ্গে সংগ্রামে এক দ্বৈত শরযুদ্ধে।

মেঘনাদের এমন বর ছিল যে, যে ব্যক্তি ১৪ বছর না খেয়ে, না ঘুমিয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করবেন তিনি শুধু মেঘনাদকে বধ করতে পারবেন। বনবাসের সময় ১৪ বছর শ্রীরামের ভ্রাতা লক্ষণ এই মহা কঠিন কার্য ও শক্তি অর্জন করেন। লক্ষ্মণ ১৪ বছর না খেয়ে না ঘুমিয়ে ছিলেন কোন্ দুঃখে! অরণ্যে প্রবেশের পর লক্ষ্মণ জানতেন বউদি সীতাকে রাবণ অপহরণ করবেন? যদি জানতেন তবে কেন সীতাকে একা অরক্ষিত রেখে রামের আর্ত চীৎকার শুনে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলেন? ‘লক্ষ্মণের গণ্ডি’ একটি পরিকল্পিত প্রক্ষিপ্ত, মনগড়া। বাল্মীকির রামায়ণে এমন ঘটনার উল্লেখ নেই। নারীর স্বাধীনতা এবং সীমাবদ্ধতাকে নির্দিষ্ট করে দিতেই পুরুষতান্ত্রিক সংযোজন।

সীতাকে অপহরণের ফলে তাঁকে লঙ্কায় যেতে হবে এবং মেঘনাদকে হত্যা করতে হবে জানতেন? রামের ১৪ বনবাস হলে তাঁর সঙ্গে লক্ষ্মণের বেরিয়ে আসাটা কি সেই কারণে? কোথায়, এমন আভাস তো বাল্মীকি সহ অন্য কবিরা রামায়ণে দেননি! মেঘনাদকে হত্যা করতেই যদি ১৪ বছর না-খেয়ে না-ঘুমিয়ে থাকতে হয়, তাহলে এত ছলনা আর চালাকির কী ছিল? মেঘনাদের মৃত্যু যখন ১৪ বছর না-খেয়ে না-ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তির। হাতেই নিশ্চিত, তবে কেন কাপুরুষের মতো নিরস্ত্র মেঘনাদকে না-মেরে সশস্ত্র মেঘনাদকে বীরের মতো লক্ষ্মণ হত্যা করেননি। এর আগে তিন তিনবার মেঘনাদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করে লক্ষ্মণ পরাজিতও হয়েছিল, লক্ষ্মণ জয়ী হল তখনই যখন মেঘনাদ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়, সমরসজ্জায় সজ্জিত নয়। তাছাড়া ১৪ বছর না-খেয়ে না-ঘুমিয়ে লক্ষ্মণ কী করতেন? দাদা-বউদিকে পাহারা দিতেন? ভাই না-খেয়ে না-ঘুমিয়ে থাকতেন, আর দাদা বউদি স্বার্থপরের মতো নিশ্চিন্তে ঘুমোতেন কীভাবে? অভুক্ত ভাইয়ের সামনে মুখে কীভাবে খাবার তুলতেন তাঁরা? উত্তর নেই।

লক্ষ্মণের স্ত্রী ঊর্মিলা ছিলেন মিথিলারাজ জনক এবং রানি সুনয়নার মেয়ে, অর্থাৎ সীতার বোন। লক্ষ্মণ জানান, রামের ১৪ বছর বনবাসের কথা। এবং এও জানান তিনিও রাম সীতার সঙ্গে বনবাসে যাবেন। ঊর্মিলা যখন লক্ষ্মণের কাছ থেকে রামের ১৪ বছর বনবাসের কথা জানতে পারেন এবং এও জানতে পরেন যে তিনিও রাম ও সীতার সঙ্গে বনবাসে যাবেন। তখন এই কথা শুনে নিজের মনকে যতটা সম্ভব শান্ত রাখেন ঊর্মিলা। অবিচলিত থাকেন স্বামীর সামনে। জানিয়ে দেন, তাঁরও উচিত স্বামী লক্ষ্মণের পথ অনুসরণ করা। কিন্তু তিনি তা করবেন না। কারণ তিনি গেলে লক্ষ্মণ সেভাবে মন দিয়ে রাম-সীতার সেবা করতে পারবেন না। লক্ষ্মণ যাতে দাদা-বৌদির সেবা করতে পারেন, সেজন্য স্ত্রী ঊর্মিলা অযোধ্যাতেই থেকে যান।

শুধু তাই নয়। নিদ্রাদেবীর কাছে তিনি প্রার্থনা করেন, যাতে এই ১৪ বছর, লক্ষ্মণের সব ঘুম তাঁকে দিয়ে দেন দেবী। এবং বনবাসে গিয়ে অতন্দ্র প্রহরীর হয়ে থাকতে পারেন রামানুজ লক্ষ্মণ। সেই প্রার্থনা মঞ্জুর হয়। রাম লক্ষ্মণ-সীতার বনবাসের ১৪ বছর বা ৫১১০ দিন ঘুমিয়ে ছিলেন ঊর্মিলা। এবং লক্ষ্মণ ছিলেন রাম-সীতার সেবায় নিবেদিত। ৫১১০ দিন লক্ষ্মণের না-ঘুমোনোর ব্যাপারটা না-হয় মেনে নেওয়া গেল গল্পের খাতিরে, কিন্তু না-খেয়ে থাকার ব্যাপারটা! কৃত্তিবাস আর রঙ্গনাথের রামায়ণেই এসব আষাঢ়ে গপ্পো পাওয়া যায়। বাল্মীকির রামায়ণে এসব অবাস্তব গাঁজাখুরি গপ্পো নেই। আসলে বাল্মীকি-পরবর্তী কবিরা আষাঢ়ে গপ্পো ফাঁদতে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেলেছেন, মেলাতে পারেননি। অসংলগ্নতার কথা মাথায় রাখেননি। এইসব অর্বাচীন বিদগ্ধ কবিদের কারণেই রামায়ণ আজ বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লক্ষ্মণ প্রসঙ্গে সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘রামায়ণের সমালোচনা’ নিবন্ধে লিখেছেন–

“হিন্দুস্বভাবের জঘন্যতার লক্ষ্মণ আর একটি উদাহরণ। তাহার চরিত্র এরূপে চিত্রিত হইয়াছে যে তদ্বারা লক্ষ্মণকে কর্মক্ষম বোধ হয়। অন্যজাতীয় হইলে সে একজন বড় লোক হইতে পারি, কিন্তু তাহার এক দিনের জন্যও সে দিকে মন যায় নাই। সে কেবল রামের পিছু পিছু বেড়াইল, আপনার উন্নতির কোন চেষ্টা করিল না। ইহা কেবল ভারতবর্ষীয়দিগের স্বভাবসিদ্ধ নিশ্চেষ্টতার ফল।”

লক্ষ্মণ স্পষ্টবক্তা। কাউকে তিনি উচিত কথা বলতে ছাড়েননি। অপ্রিয় হলেও সত্য কথা উচ্চকণ্ঠে বলতে পারতেন। সে রামই হোক কিংবা দশরথ–কেউই বাদ যাননি। হ্যাঁ, রামও বাদ যাননি। যুক্তিবাদী লক্ষ্মণ তাই প্রণম্য। বিমাতা কৈকেয়ীর বর চাওয়ার প্রসঙ্গটি অস্বীকার করে যুক্তিবাদী লক্ষ্মণ বলেছেন–

“যদি বর প্রসঙ্গ সত্য হইত, অভিষেক আরম্ভের পূর্বেই কেন তাহার সূচনা না হইল?”

লক্ষ্মণ বুঝেছিলেন রাম ষড়যন্ত্রের শিকার। এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্য কারিগর আর্যদেবতারাই। তাই তিনি রামকে বলেন–

“আপনি অনায়াসেই দৈবকে প্রত্যাখ্যান করিতে পারেন, তবে কি নিমিত্ত … দৈবের প্রশংসা করিতেছেন। … এই জঘন্য ব্যাপার আমার কিছুতেই সহ্য হইতেছে না। . আপনি যে ধর্মের মর্ম অনুধাবন করিয়া মুগ্ধ হইতেছেন, যাহার প্রভাবে আপনার মতদ্বৈধ উপস্থিত হইয়াছে, আমি সেই ধর্মকেই দ্বেষ করি।”

পিতা দশরথকে বলেছেন, মেনিমুখো’। বলেছেন–বুড়ো বয়সে খোকা হয়েছেন–“পুনর্বাল্যমুপেয়ুষঃ”। বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে–“বিপরীতশ্চ বৃদ্ধশ্চ স্ত্রিয়ো বাক্যবশং গতঃ”। রামের বনবাসযাত্রাকাল চূড়ান্ত হলে দশরথের উদ্দেশেও লক্ষ্মণ বলেছেন–“মহারাজ বৃদ্ধ হইয়াছেন, তিনি বিষয়াসক্ত কামার্ত ও স্ত্রৈণ, সুতরাং স্ত্রীলোকমন্ত্রণায় তিনি কি না বলিবেন।” এখানেই শেষ নয়, ক্রোধী লক্ষ্মণ এ সময় রামের উদ্দেশে বলেছেন–“আর্য, আপনার এই নির্বাসন-সংবাদ না হইতেই আপনি আমার সাহায্যে সমস্ত রাজ্য হস্তগত করুন। … যে ব্যক্তি ভরতের পক্ষে, যে তাহার হিতাভিলাষ করিয়া থাকে, আমি আজ তাহাদের সকলকেই বিনষ্ট করিব। অধিক আর কী কহিব, পিতা কৈকেয়ীর প্রতি সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহারই উৎসাহে যদি আমাদিগের বিপক্ষতা করেন, তবে তাহাকেও সংহার করিতে হইবে। আপনার ও আমার সহিত শত্রুতা করিয়া অদ্য কেহই ভরতকে রাজ্যদান করিতে পারিবে না।” লক্ষ্মণ পিতার উদ্দেশে বলেছেন–“হনিষ্যে পিতরং বৃদ্ধং কৈকয্যাসক্তমানসম্। কৃপণঞ্চ স্থিতং বাল্যে বৃদ্ধভাবেন গর্হিতম।” অতএব পিতাকে হত্যার করার ব্যাপারে লক্ষ্মণের কোনোরূপ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না।

শুধু পিতা দশরথ ও দাদা রামকে নয়, বউদি সীতাকেও তুলোধুনো করতে ছাড়েননি লক্ষ্মণ। পঞ্চবটি বনে রামের চিন্তায় উদ্বিগ্ন সীতা যখন লক্ষ্মণকে বারবার অনুরোধ করছিলেন এবং তাঁর প্রতি লোভ এই অপবাদ দেন, তখন লক্ষ্মণ বলেছিলেন–“ধিক্ ত্বা অদ্য বিনশ্যন্তীং যন্মামেবং বিশঙ্কসে। স্ত্রীত্বাদ দুষ্টস্বভাবেন।” অর্থাৎ এইসব সন্দেহ করছ! তবে মরো তুমি। স্ত্রীলোক তো, আর কী হবে! ভরতও বাদ যাননি। চতুরঙ্গ সৈন্যবাহিনি নিয়ে ভরত চিত্রকুটে পৌঁছেলে লক্ষ্মণ গর্জে উঠে রামকে উদ্দেশ্য করে বললেন–“যাহার নিমিত্ত আপনি রাজ্যচ্যুত হইলেন, এক্ষণে সেই শত্ৰু উপস্থিত হইয়াছে। সে আমাদের বধ্য, তাহাকে বধ করিতে আমি কিছুমাত্র দোষ দেখি না। … এক্ষণে আপনি ওই দুষ্টকে বধ করিয়া সমগ্র পৃথিবী শাসন করুন। আর বসুমতী মহাপাপ হইতে বিমুক্ত হউন। … আমি নিশ্চয় কহিতেছি, ভরতকে সসৈন্যে নিহত করিয়া অদ্য শর-কামুকের ঋণ পরিশোধ করিব।”–“ভরতস্য বধে দোষং নাহং পশ্যামি রাঘব”।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে লক্ষ্মণ সবসময়ই মারমুখী। এরপর ঝাড়লেন সুগ্রীবকে। সুগ্রীবের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন রাম। শর্ত একে অপরের বউ ফিরিয়ে দেওয়া হবে, উপরন্তু সুগ্রীব পাবে হৃতরাজ্য। সেই সূত্রেই বন্ধুত্ব। সেই শর্তেই রাম অন্যায়ভাবে বালীতে আড়াল থেকে হত্যা করেছিলেন। না-হলে আর্য হয়ে কোনোমতে অনার্যদের সঙ্গে পিতলা করতে যেতেন না। সেই সুগ্রীব কিনা ভাইকে হত্যা করিয়ে ভাইয়ের স্ত্রীকে ভোগদখল করে, নিজ স্ত্রীকে ফিরে পেয়ে, তদুপরি হৃতরাজ্য ফিরে পেয়ে মাসের মাস নিশ্চিন্তে আছেন! রাম ছেড়ে দিলেও লক্ষ্মণ ছাড়বেন কেন! তাঁর তো মাটি দিয়ে গড়া হৃদয় নয়! তিনি যে লৌহহৃদয়ের অধিকারী। বালীবধের পর চার মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, সীতার অনুসন্ধানে তদন্ত একচুলও নড়েনি। রাজ্য ও রমণীভোগে মাতোয়ারা হয়ে আছেন সুগ্রীব। সুগ্রীবের মহামন্ত্রী হনুমানের অনুরোধে সৈন্যসংগ্রহের আদেশ দিয়েই সুগ্রীব তাঁর কাজ শেষ করে অন্তঃপুরে ঢুকে পড়েন। আর কোনো উদ্যোগই তিনি নেননি। উল্কণ্ঠিত রামকে লক্ষ্মণ জানিয়ে দেন, প্রয়োজনে–“সুগ্রীবকে হত্যা করে বালীপুত্র অঙ্গদকে রাজা করে তাঁর সাহায্য নিয়ে জানকীর খোঁজ করব।” বলেছেন–“মিথ্যাবাদীকে বিনাশ করিব। এক্ষণে বালীর পুত্র অঙ্গদ বানরগণকে লইয়া জানকীর অন্বেষণ করুন।” অঙ্গদকে দিয়ে মধ্যস্থতা করার পর যখন সুগ্রীবের হুঁশ আসে না, তখন লক্ষ্মণ নিজেই পৌঁছে যান। সুগ্রীবের অন্তঃপুরে। রক্তচক্ষু লক্ষ্মণ ধনুকের টঙ্কার শুনিয়ে দিলেন সুগ্রীবকে, সেই টঙ্কার শুনে সুগ্রীবের গলা মুখ শুকিয়ে উঠল। লক্ষ্মণকে কামবশে বিবশ করার জন্য নৃত্যরত গণিকা ও পরমাসুন্দরী তারাকে লেলিয়ে দিলেন। কিন্ত লক্ষ্মণকে কামবাণে বিদ্ধ করা অত সহজ কাজ নয়। উলটে লক্ষ্মণ আরও ক্রুব্ধ হলেন। ঘাবড়ে গিয়ে সুগ্রীব জানালেন, আগামী দশদিনের মধ্যেই সৈন্য সংগ্রহের কাজ শেষ যাবে। সৈন্য সংগ্রহই নয়, সৈন্যবাহিনীদের হুশিয়ারিও দিলেন–“একমাস পূর্ণ হইলে আসিও, নচেৎ বধদণ্ড বহিতে হবে।” লক্ষ্মণ তেড়ে না-গেলে অকৃজ্ঞ সুগ্রীব কিছুতেই কর্তব্য পালন করতেন না। শেষপর্যন্ত কর্তব্যে নয়, লক্ষ্মণের নিশিত শরে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুভয়ে রামচন্দ্রকে সাহায্য করেছেন।

লক্ষ্মণের কাছে রাম ছিলেন একাধারে যেমন পিতার মতো, তেমনই প্রভু-ভাই-বন্ধুও। রামের অনুপস্থিতিতে লক্ষ্মণ সুগ্রীবকে রাম সম্পর্কে বলেছিলেন–“আমি এই কৃতজ্ঞ বহুদর্শী গুণগ্রামে বশীভূত হইয়া, দাসত্ব স্বীকার করিয়া আছি।” আর বলবেন নাই-বা কেন–বনবাসজীবনের একেবারে গোড়ার দিকে এই লক্ষ্মণই যে রামকে নিজের মনের কথা বলে দিয়েছেন–“জল হইতে মৎস্য উদ্ধৃত হইলে যেমন জীবিত থাকিতে পারে না, সেইরূপ আপনার বিয়োগে আমরা ক্ষণকালও প্রাণধারণ করিতে পারিব না। আপনাকে পরিত্যাগ করিয়া পিতা, মাতা, ভ্রাতা ও স্বর্গই-বা কী, কিছুই অভিলাষ করি না।” সেই লক্ষ্মণ অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সময় বদলে যেতে একদণ্ডও সময় নেন না। রামের তীব্র ভাষা শুনে যখন সীতা যখন অপমানিত হচ্ছেন এবং সীতা যখন অগ্নিতে আত্মাহুতি দেবেন বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেন, লক্ষ্মণ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। লক্ষ্মণ রামের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রোষপূর্ণ চোখে রামের দিকে দৃষ্টিক্ষেপণ করেছেন। লক্ষ্মণ রীতিমতো রামের সিদ্ধান্ত ও আচরণে রামের উপর রুষ্ট হয়েছিলেন। এই কারণে লক্ষ্মণকে চরম শাস্তিও পেতে হয়েছিল। চির অনুগত লক্ষ্মণের সঙ্গে রামের সম্পর্কে গভীর ফাটল দেখাল। এখানেই শেষ হয় না। ছল করে রাজা রাম অযোধ্যা থেকে লক্ষ্মণকে বহিষ্কার করে দেন। এই লক্ষ্মণ বর্জন এবং পরিণতির ঘটনা পূর্বে বিস্তারিত উল্লেখ করেছি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও লক্ষ্মণকে দুটি অপ্রীতিকর কাজ করতে হয়েছিল–(১) সীতার অগ্নিপরীক্ষার জন্য চিতা সাজানো এবং (২) সীতাকে একাকী জঙ্গলে রেখে আসা। লক্ষ্মণ জানতেন না কী কারণে সীতাকে জঙ্গলে রেখে আসতে হল, লক্ষ্মণ জানতেন না সীতা আসন্নপ্রসবা। যখন জেনেছেন তখন তিনি হাউহাউ করে কেঁদেছেন। গহীন অরণ্যে সীতাকে রেখে ফিরে আসার সময় বারবার পিছন ফিরে দেখছিলেন–“মুহুর্মুহু পরাবৃত্য দৃষ্টা সীতামনাথবৎ”। শুধু দেখলেনই না, দেখলেন বাল্মীকির আশ্রম পর্যন্ত সীতা নিরাপদে পৌঁছোলেন কি না–“দৃষ্টা, তু মৈথিলীং সীতামাশ্রমে সম্প্রবেশিতা”।

যাই হোক, বনবাসের শেষে রাম অযোধ্যার রাজা হলে লক্ষ্মণ তাঁর মন্ত্রী নিযুক্ত হন। অরণ্যে যত হত্যাকাণ্ড সব লক্ষ্মণের দ্বারাই সাধন হয়েছিল, যা একজন দেহরক্ষীরা কাজ। রামের সামনে লক্ষ্মণই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছেন, এভাবে রামকে সুরক্ষা দিয়েছেন যতদিন পেরেছেন। প্রতিজ্ঞাভঙ্গের অপরাধে রাম তাঁকে পরিত্যাগ করলে, তিনি সরযূ (বালিয়ার কাছে ছেটি-সরযূ নদী গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই সরযূকেই তমসা বলা হত।) নদীর জলে মৃত্যুবরণ করেন। কথিত আছে, লখনউ শহরটি (বর্তমান উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের রাজধানী)। লক্ষ্মণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

লক্ষণের দুই ছেলে অঙ্গদ ও চন্দ্রকেতু। প্রথম জন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কারুপদ রাজ্য এবং চন্দ্রকেতু প্রতিষ্ঠা করেন মালব প্রদেশের চন্দ্ৰকান্তি নগর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *