০৬. রাবণ : প্রাজ্ঞ, নির্ভীক বীর, কামুক এবং অপরিমাণদর্শী

রাবণ : প্রাজ্ঞ, নির্ভীক বীর, কামুক এবং অপরিমাণদর্শী

বাল্মীকির রামকথায় রাবণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যাকে বাদ দিলে রামের অস্তিত্ব নেই, রামায়ণও অর্থহীন। রাবণ ছাড়া রামের যশ নেই, খ্যাতিও নেই। রাম ঐতিহাসিক ব্যক্তি হলে রাবণও অবশ্যই ঐতিহাসিক ব্যক্তি। কোনো অলৌকিক অস্বাভাবিক কিম্ভুতকিমাকার কোনো বস্তু নয়। দশগ্ৰীব বিংশতিভুজ কোনো আজব প্রাণী নন তিনি। রাবণের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করতে গিয়ে কোনো অর্বাচীন কবি গঞ্জিকাসেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রভাবে রাবণের দশ মুণ্ডু বিশ হাতবিশিষ্ট অবয়ব বলে লিপিবদ্ধ করেছেন। বাল্মীকির রামায়ণে রাবণ সুশ্রী, সুপুরুষ, দ্বিভুজ। বিশ্বাস না হয়, মন্দোদরীর মুখেই শুনুন–

“উজ্জ্বলতায় সূর্য, কমনীয়তায় চন্দ্র এবং শোভায় পদ্মের তুল্য, ইহার জ্বযুগল, উন্নত নাসা ও ত্বক সুন্দর, ইহা রত্নকিরীট ও দীপ্ত কুণ্ডলে শোভিত।”

রাবণের মৃত্যুর পর একক মাথা কোলে নিয়ে শোকার্তা মন্দোদরীর এটাই ছিল বিলাপ-সংলাপ। হনুমান সর্বসুলক্ষণযুক্ত সুপুরুষ রাবণকে দর্শন করে মুগ্ধ হয়েছেন। এমনকি রামও যুদ্ধক্ষেত্রে রাবণকে দর্শন করে মুগ্ধ হয়ে বলেছেন–

“উঁহার যেমন দেহভাগ্য, দেব ও দানবেরও এইরূপ নহে।”

অতএব যাঁরা রাবণকে দশ মাথা কুড়ি হাতের অতিকায় রাক্ষস ভেবে রেখেছেন, তাঁরা কল্পনার দেশ থেকে বাস্তব মাটিতে নেমে আসুন।

সবদিক দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে বলা যায় রাবণ অনার্যই ছিলেন। শিবভক্ত শৈব্য। শিব আদিতে অনার্য দেবতাই ছিলেন, পরে আর্যরা তাঁকে আত্মসাৎ করে নেয়। মিথ্যা অপপ্রচারে রাবণ দশমুণ্ডধারী, পাপিষ্ঠ। বাল্মীকির রামায়ণে তিনি সুপুরুষ, ন্যায়নিষ্ঠ, ক্ষমাশীল, দুই হাতবিশিষ্ট, একটি মাথা সর্বস্ব এক দিগ্বিজয়ী শৈব রাজা। বস্তুত শৈব হওয়ার অপরাধে ব্ৰহ্মাবাদী বর্ণাশ্রমধর্মী জাতিভেদপ্রধান সমাজ-সংস্থাপক আর্যসমাজে রাবণ ব্রাত্য হন। রাম-রাবণের সংঘাত আদতেই আর ভার্সেস আর্যের সংঘাত। শিব আর ব্রহ্মার বিবাদ। আদিতে শিব অনার্য দেবতা, পশুপতি। শিব রাবণের সহায়ক ছিলেন। যতদিন শিব রাবণের সহায়ক ছিলেন, ততদিনই রাবণ অপরাজেয় ছিলেন। যেদিন থেকে অনার্য দেবতা শিবকে আর্ব দেবতারা নিজেদের দলে টেনে নিলেন (আর্য দেবতারা শুধু টেনেই নিলেন না, তাঁকে ‘মহাদেব’ ‘মহেশ্বর’ শিরোপা দিয়ে ব্রহ্মা আর বিষ্ণুর সঙ্গে এক পংক্তিতে বসালেন), সেইদিন থেকে রাবণের পতন ধীরে ধীরে অনিবার্য হয়ে উঠল।

রাবণ মহাকাব্য ও পুরাণে বর্ণিত লঙ্কা দ্বীপের রাজা। এই লঙ্কা কি বর্তমানের শ্রীলঙ্কা? শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে রাবণ তথা স্বর্ণলঙ্কার কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। রামায়ণে উল্লিখিত রাবণের দেশ লঙ্কা আজকের শ্রীলঙ্কা কি না তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যেও বিতর্ক আছে। দক্ষিণ সমুদ্রের তীরে ত্রিকুট নামে একটি পর্বতের কথা জানা যায়। তার কাছে আরেকটি পর্বত, নাম সুবল। ওই পাহাড়ের উপর লঙ্কা নির্মাণ করেছিলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। অতএব লঙ্কা যে সমুদ্রের ভিতর কোনো দ্বীপ বা বর্তমানের শ্রীলঙ্কা নয় একথা স্পষ্ট। তবে জম্মু-কাশ্মীরেও একটি ত্রিকুট পর্বতের সন্ধান পাওয়া যায়। এটির গুহায় বৈষ্ণোদেবীর মন্দির।

লঙ্কায় ভূগোল-ইতিহাসটা একটু দেখা যাক। রাবণের জন্মের বহু আগে মালী, সুমালী ও মাল্যবান এই তিন রাক্ষস ভাই স্বর্গের দখলদারির স্বার্থে দেবতাদের উপর খুব অত্যাচার শুরু করেছিল। সৰ্বলোক জয় করে তাঁরা এবার তাঁদের জন্য একটি প্রাসাদ বানালেন বিশ্বকর্মাকে দিয়ে। কেউ কেউ বলেন লঙ্কা রাক্ষস-স্থপতি ময়দানবের সৃষ্টি। ময়দানব অনার্যদের স্থপতি। ময়দানবের রচিত গ্রন্থের নাম ময়মত। কথিত আছে, ময়দানব ছিলেন বিশ্বকর্মারই পুত্র, অন্যদিকে আর্যদের স্থপতি বিশ্বকর্মা। অবশ্য বিশ্বকর্মা গোড়াতে অনার্যদেরই সভাপতি ছিলেন, পরে আরও বেশি সুযোগের সন্ধানে আর্যদেবতাদের মহাস্রষ্টা আসন অলংকৃত করেন, আর্যরাও তাঁর পরিচয় আর্যরূপেই প্রচার করতে থাকেন। বিশ্বকর্মার রচিত গ্রন্থের নাম ‘বিশ্বকর্মাস্তুশাস্ত্রম্ বিশ্বকর্মা “স্থাপত্য বেদ’ নামক একটি উপবেদের রচয়িতা। বিশ্বকর্মার নামে অন্ততপক্ষে দশখানি বাস্তুবিদ্যার গ্রন্থ পাওয়া যায়। বিশ্বকর্মার আর-এক পুত্র ছিলেন, তিনি বানর যুথপতি নল। পৌরাণিক মতে বিশ্বকর্মাও বানর জাতীয় বলা হয়েছে।

লঙ্কায় সৌন্দর্য বর্ণনায় বাল্মীকি অকৃপণ। ত্রিভুবন খুঁজলেও লঙ্কার মতো সৌন্দর্য-বৈভব পাওয়া যাবে না। লঙ্কার উত্তর দ্বার ছিল সুরক্ষিত। গৃহগুলো বহুতল ও গগনস্পর্শী। হনুমান লঙ্কায় পৌঁছে তো থ। লঙ্কাগৃহের স্থাপত্য দর্শন করে হনুমান তো বুঝতেই পারছেন না, এটা স্বর্গপুরী নাকি ইন্দ্রপুরী!–

“স্বর্গোহয়ং দেবলোকোহয় ইন্দ্রস্যাপি পুরী ভবেৎ।”

হনুমান দেখলেন মেঘাকার লম্ব পর্বতে প্রতিষ্ঠিত লঙ্কায় সমস্ত পথই অতি প্রশস্ত। সর্বত্র প্রাসাদ, স্বর্ণস্তম্ভ ও স্বর্ণজাল। কোনো কোনো সাপ্তভৌমিক ভবন, কোথাও-বা অষ্টতল গৃহও দেখা গেছে। স্থানে স্থানে স্বর্ণময়। তোরণ। এ যেন যথার্থই স্বর্ণলঙ্কা।

চন্দ্রাবতী রামায়ণে এইভাবে বর্ণিত হয়েছে–

“স্বর্গপুরে আছে যথা ইন্দ্রের নন্দন।

সেইমতে লঙ্কাপুরে গো অশোকের বন।”

কিংবা “সোণার পালঙ্কে তারা গো শুইয়া নিদ্রা যায়।

দেবের অমৃত তারা গো সুখে বৈসা খায়।

বিচিত্র সুবর্ণ লঙ্কা গো নিৰ্মাইল বিশাই।

এমন বিচিত্র পুরী গো তিরভুবনে নাই।”

রামচন্দ্রের স্ত্রী সীতাকে অপহরণ করে রাবণ এই লঙ্কাতেই নিয়ে আসেন। সীতার উদ্ধারকল্পে কিষ্কিন্ধ্যার বানরসেনার সাহায্যে রামচন্দ্র লঙ্কা আক্রমণ করলে রাবণের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয়। রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে অগ্যস্ত মুনির মুখ দিয়ে তাঁর পূর্বজীবনের কথা বলা হয়েছে।

রাবণ কোনোদিনই অপরাজেয় ছিলেন না। মৃত্যু না-হলেও বহু যুদ্ধে বহুবার তিনি পরাজিত হয়েছেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে–নর্মদা নদীর তীরে মাহিষ্যতি নগরী, সেখানকার রাজা হলেন সহস্রহাতসর্বস্ব (সহস্রহাতসর্বস্ব হাত শুনে ভেবে নেওয়ার কারণ নেই যে, কোনো ব্যক্তির ১০০০ টি হাত। বাস্তবে সেটা কখনোই হয় না। এই সহস্রহাত মানে কার্তবীর্যাজুনের ৫০০ দেহরক্ষীর কথা বোঝানো হয়েছে। ৫০০ দেহরক্ষীর ১০০০ হাত। সেটাই বাস্তব) কার্তবীর্যাজুন। যুদ্ধ করতে গিয়ে রাবণ কার্তবীর্যাজুনের সেই হাজার হাতের মাঝে বন্দি হন, কার্তবীর্যাজুন রাবণকে জাপটে ধরে বন্দি করে রাখেন। রাবণের বাবা বিশ্রবা এসে কার্তবীর্যাৰ্জুনকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। বিশ্রবার অনুরোধে রাবণ মুক্তি পান। রাবণ বালীর কাছেও পরাজিত হয়েছিলেন। বালি আহ্নিক করছিলেন, এমন সময় রাবণ তাই পা টিপে টিপে নিঃশব্দে তার পিছনে এসে দাঁড়ান এবং আচমকাই চেপে ধরবেন। নির্বিকার বালী রাবণকে বগলে চেপে ধরে চার সমুদ্র ঘুরে সন্ধ্যা আহ্নিক সমাপ্ত করলেন। রাবণের আর-একটি পরাজয়ের গল্প মনে পড়ছে। রাবণ নারদকে জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় গেলে একটি মনের মতো যুদ্ধ করতে পারবেন। বহুদিন তিনি তেমন যুদ্ধ করে তৃপ্তি পাননি। নারদ বললেন, সমুদ্রের মধ্যে শ্বেতদ্বীপ। সেখানকার অধিবাসীরা সবাই সাদা রঙের। তুমি সেখানে গিয়ে যুদ্ধ করতে পারো। সময় নষ্ট না-করে রাবণ দ্রুত শ্বেতদ্বীপে চলে গেলেন। কিন্তু সেই দ্বীপে একজনও পুরুষ নেই যে! কেবলই নারী। তবুও রাবণ যুদ্ধ করতে চাইলেন। রাবণের সেই ইচ্ছার কথা শুনে সেইসব নারীরা তো হেসেই কুটিপুটি। তাঁরা রাবণকে কোলে তুলে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। দশ মাথা কুড়িটা হাত দেখে তাঁরা খুব মজা পাচ্ছিলেন। মান্ধাতার সঙ্গেও রাবণের যুদ্ধ হয়। তবে এ যুদ্ধ অমীমাংসিত ছিল–কারোর হার বা জিৎ হয়নি। ব্রহ্মা মহর্ষি পুলস্ত্যরা এসে মান্ধাতাকে ক্ষান্ত করেন ও রাবণকে তিরস্কার করে দুজনের সখ্যতার আয়োজন করেন।

‘রাবণ’ নামটি শিবের কাছ থেকে পাওয়া। কোথাও কোথাও মূর্তিশিল্পে বা চিত্রশিল্পে তার দশটি মাথা, কুড়িটি হাত ও দশটি পা দেখানও হয়। অন্য রামায়ণে ‘কামুক’ ও ‘ধর্ষকামী’ বলে নিন্দিত হলেও বাল্মীকির রামায়ণে রাবণকে মহাজ্ঞানী ও তাপসও বলা হয়েছে। রাবণকে যে দশানন বা দশমাথা বলা হয় সেটা হল তার দশ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, জ্ঞানের জন্য। তার মাঝে আছে ছয়টি শাস্ত্র আর চারটি বেদ–মোট দশটা জ্ঞান। মহাকাব্য ‘রামায়ণ’-এ লঙ্কাধিপতি রাবণকে কখনোই সম্পূর্ণ ভিলেন হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়নি। বরং বলা যায়, রাবণ রামায়ণ-কাহিনির অ্যান্টাগনিস্ট। এই বিশেষ চরিত্রটিকে ঘিরে এত বেশি কথা, উপকথা এবং অতিকথা এই ভারতভূমে আবর্তিত হয়েছে যে, রামায়ণের বর্ণনাই অনেক সময়ে চলে গিয়েছে অন্তরালে। সামনে এসে গেছে রাম, সীতা ও হনুমান–ইতিহাস ছাপিয়ে দেবত্বে। বীরপূজাই যে আমাদের রোগ! আর সেই বীর যদি দেবতা হয়, তাহলে তো পোয়া বারো। তাই রাবণ হয়ে উঠেছেন এক পরিপূর্ণ খলনায়ক। কারোকে খলনায়কের তকমা দেগে দিলে তার গুণগুলি আর দেখা যায় না, দেখা গেলেও সেটা আড়ালে রাখতেই বেশি তৃপ্ত বোধ করি। অথচ রামায়ণকে অনুসরণ করেই বলা যায়, রাবণ অজস্র গুণে গুণান্বিত এক ব্যক্তিত্ব। কিছু দুর্বলতা হেতু তাঁর পতন ঘটে এই মাত্র।

রাবণ চরিত্রের তেমন কয়েকটি দিকের কথা তুলে ধরা হল, যা সাধারণত আলোচনার আওতায় আসে না। যেমন–

(১) শাসক হিসাবে রাবণকে কোথাও অপশাসক বা নিষ্ঠুর বলা হয়নি। তিনি স্বর্ণলঙ্কার অধিপতি। স্বর্ণ বা সোনার রূপকে সমৃদ্ধ লঙ্কা এমনি এমনি হয় না। ফলে বোঝাই যায়, তিনি সমৃদ্ধ এক সাম্রাজ্য শাসন করতেন। আর এ কথা কে না জানে, সুশাসন ছাড়া সমৃদ্ধি সম্ভব নয়! বাল্মীকির রামায়ণে হনুমান যখন সীতার খোঁজে লঙ্কায় পৌঁছোন, সে সময় লঙ্কাদর্শন করে হনুমান বিহ্বল হয়ে যান, মুগ্ধ হওয়ার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।

(২) যুদ্ধক্ষেত্রে আহত অবস্থায় পড়ে থাকাকালীন রাবণকে দেখতে যান লক্ষ্মণ। রাবণ তাঁকে বিবিধ বিষয়ে জ্ঞান দান করেন। রাবণের সেই আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল ‘রাজধর্ম’ কী এবং কীভাবে তা পালন করতে হয়। ভাবুন তো, একেই তো বলে সুশাসক। শুধু তাই নয়–

(৩) রাবণ ছিলেন এক অসামান্য বীণাবাদক। তিনি নিজেই তাঁর বীণার নকশা করেছিলেন। তিনি ‘শিব তাণ্ডব’ স্তোত্রেরও রচয়িতা।

(৪) রাবণ একনিষ্ঠ শিবভক্ত ছিলেন। রাবণকে শিব এক আশ্চর্য বর দান করেন। সেই বরে তিনি প্রায় অমরত্ব। প্রাপ্ত হন।

(৫) রাবণ ছিলেন দক্ষ চিকিৎসক। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। নাড়ি পরীক্ষা’, ‘অর্ক শাস্ত্র’, ‘অর্ক পরীক্ষা’ প্রভৃতি বিখ্যাত আয়ুর্বেদ শাস্ত্রগ্রন্থ রাবণ কর্তৃক লিখিত বলে প্রচলিত। ক্ষত চিকিৎসায় তাঁর অবদানের কথা আজও আয়ুর্বেদ স্বীকার করে।

(৬) রাবণের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি ছিল ভুবনবিদিত। চার বেদ এবং ছয় উপনিষদ তাঁর নখদর্পণে ছিল।

(৭) জ্যোতির্বিদ্যায় রাবণের বিশেষ দখল ছিল। একথা রামায়ণে বার বার উল্লিখিত হয়েছে যে, তিনি নাকি গ্রহতারকাদের নির্দেশ দিতেও পারতেন। আসলে তিনি গ্রহতারকার ভবিষ্যৎ অবস্থান অনর্গল বলে যেতে পারতেন। তাঁর রচিত ‘রাবণসংহিতা’ নামে একটি গ্রন্থ আছে।

(৮) রাবণ এবং তাঁর ভাই কুম্ভকর্ণ ছিলেন বিষ্ণুর দ্বাররক্ষক। তাঁরা ব্ৰহ্মকুমারদের দ্বারা অভিশাপগ্রস্ত হন। তাতেই তাঁদের রাক্ষসজন্ম ঘটে বলে উল্লেখ আছে।

(৯) রাবণকে ত্রিলোকের অধীশ্বর হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে বহু রামায়ণে। সুতরাং তাঁর ক্ষমতা যে-কোনো রাজার থেকে অনেক বেশি ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

(১০) রাবণ কেবল লঙ্কারই অধীশ্বর ছিলেন না, তিনি সমগ্র দক্ষিণ ভারতে রাজ করতেন।

(১১) অন্ধ্রপ্রদেশের কাকিনাড়ায় রাবণ ও শিবলিঙ্গ একত্রে পূজিত হন। এ থেকে বোঝা যায়, মানুষের রাবণ চিরকালই খলনায়ক ছিলেন না।

লঙ্কায় রাজা রাবণের জন্ম হয় বিশ্রবা মুনির ঔরসে কৈকসীর (অন্য নাম নিকষা) গর্ভে। কৈকেসী মোট চারটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিল। এই চারটি সন্তানের মধ্যে পুত্র হল–রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ ও কন্যা শূর্পণখা। বিভিন্ন রামায়ণে বলা হয়েছে–রাবণের দশটি মাথা, কুড়িটি হাত। গায়ের রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, উজ্জ্বল চুল ও দাঁত এবং টকটকে লাল ঠোঁট ছিল। ইনি স্থপতি ময়দানবের কন্যা মন্দোদরীকে বিবাহ করেন। কথিত আছে, তাঁর প্রায় এক লক্ষ পুত্র ও সোয়া লক্ষ নাতি ছিল। প্রাচীন যুগে প্রজাদের সন্তানের চোখে দেখা হত। রাজা নিজেকে প্রজাদের পিতৃতুল্য বা অভিভাবক ভাবত। এটাই ছিল রীতি। রাবণের উল্লেখযোগ্য পুত্র ছিলেন মেঘনাদ বা ইন্দ্রজিৎ। বিশ্রবার প্রথমা স্ত্রী দেবর্ণিনীর সন্তান কুবের ছিলেন যক্ষদের রাজা। কুবের অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী ছিলেন বলে কৈকসী ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁর পুত্রদেরকে অনুরূপ ঐশ্বর্য এবং সেই সঙ্গে অমিত তেজ অর্জনের জন্য তপস্যা করতে আদেশ দিলেন। এঁরা ব্রহ্মার গভীর উপাসনা শুরু করলে ব্রহ্মা তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে বর প্রার্থনা করতে বললেন। রাবণ অমরত্বের বর প্রার্থনা করলেন এবং ব্রহ্মা তা দিতে অসম্মত হলেন। পরে ইনি দেব, দানব, দৈত্য, যক্ষ, রক্ষ ইত্যাদির কাছে অজেয় ও অবধ্য হওয়ার বর প্রার্থনা করলেন। মানুষকে তিনি এই তালিকায় রাখলেন না। ব্রহ্মা এই বর মঞ্জুর করলেন।

এসময় কুবের লঙ্কার রাজা ছিলেন। কুবের রাবণের দাদা। প্রথমে রাবণ কুবেরকে লঙ্কা থেকে বিতারিত করে সেখানে রাক্ষসরাজ্য স্থাপন করেন। এই সময় ইনি কুবেরের পুষ্পক রথ অধিকার করেন। এরপর তিনি দিগ্বিজয়ে বের হয়ে নর্মদা নদীতীরে শিবপুজো আরম্ভ করলেন। সেখানে হাজার হাতবিশিষ্ট কার্তবীর্য নামক এক রাজা জলক্রীড়া করছিলেন। এর ফলে নদীর জল ঘোলা হতে থাকলে ক্রুদ্ধ রাবণ তাঁকে আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে রাবণ পরাজিত ও বন্দি হন। পরে রাবণের স্বর্গীয় পিতামহ পুলস্ত্যের অনুরোধে কার্তবীর্য তাঁকে মুক্তি দেন।

মহর্ষি নারদের প্ররোচনায় ইনি যমরাজের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেন। পরে অবশ্য ব্রহ্মার অনুরোধে এই যুদ্ধ বন্ধ হয়। কৈলাসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাবণের রথের গতি রুদ্ধ হয়। এই সময় মহাদেবের অনুচর নন্দী রাবণকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, এখানে হর-পার্বতী আছেন। নন্দীর বানর মুখ দেখে রাবণ অবজ্ঞায় হাস্য করলে নন্দী অভিশাপ দেন যে, তাঁর মতো বানরদের হাতেই রাবণবংশ ধ্বংস হবে। রাবণ এরপর ক্ষিপ্ত হয়ে কৈলাস মাটি থেকে উপরে তুলতে থাকলে পার্বতী চঞ্চল হয়ে উঠেন। তখন মহাদেব পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে রাবণকে চেপে ধরেন। রাবণ সে চাপ সহ্য করতে না-পেরে প্রচণ্ড চিৎকার করতে থাকেন। পরে মহাদেবের স্তব গুণগান করে মুক্তি পান। এই সময় মহাদেব তাঁকে ‘চন্দ্রহাস’ নামে একটি দীপ্ত খড়া উপহার দেন। স্বর্গে গিয়েও রাবণ দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে ইন্দ্র সহ সকলকে পরাজিত করেন। রাবণের পুত্র মেঘনাদ কপট যুদ্ধে ইন্দ্রকে পরাজিত ও বন্দি করে লঙ্কায় নিয়ে আসেন। এই কারণে মেঘনাদ ইন্দ্রজিৎ’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেন। পরে ব্রহ্মার অনুরোধে ইনি ইন্দ্রকে মুক্তি দেন। এরপর রাবণ ধীরে ধীরে অত্যন্ত অত্যাচারী রাজায় পরিণত হলেন। ইনি দেব, দানব ও ঋষি কন্যাদের হরণ করতে থাকেন। একবার ইনি বৃহস্পতির পুত্র মহর্ষি কুশধ্বজের কন্যা বেদবতীকে হরণ করতে উদ্যত হলে, ইনি অগ্নিতে আত্মাহুতি দেন। আত্মাহুতিকালে ইনি রাবণকে জানান যে, পরে ইনি কোনো ধার্মিক পুরুষের ‘অযোনিজ’ কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করবেন এবং রাবণ বধের কারণ হবেন। এই কন্যাই পরে সীতারূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

স্বৰ্গবেশ্যা রম্ভা নলকুবেরের কাছে অভিসারে যাওয়ার সময় রাবণ তাঁকে ধর্ষণ করেন। ফলে নলকুবের তাঁকে অভিশাপ দেন যে, কোনো নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করলে রাবণের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হবে। এমনকি রাবণ সমুদ্রে প্রবেশ করে প্রথমে নাগদের পরাজিত করেন, পরে নিবাতকবচ নামক দৈত্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। রাম এবং নিবাতকবচ উভয়ই ব্রহ্মার বরে অজেয় ছিলেন। সে কারণে ব্রহ্মার মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধ নিবারিত হয়। পরে রাবণ এঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। পরে ইনি নিবাতকবচের কাছ থেকে বহুবিধ মায়াবিদ্যা অর্জন করেন। এরপর তিনি জলদেবতা বরুণের পুত্রদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং তাঁদের পরাজিত করেন। এরপর ইনি অশ্মনগরে চারশত কালকেয় দানবের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাঁদেরকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধে রাবণের বোন শূর্পণখার স্বামী বিদ্যুৎজিহ্বা নিহত হন। রাবণ তাঁর এই বিধবা বোনকে সান্ত্বনা দিয়ে দণ্ডকারণ্যে বাসবাস করার জন্য প্রেরণ করেন। এই সময় রাম পিতৃসত্য রক্ষার্থে সীতা ও লক্ষ্মণসহ পঞ্চবটী বনে কুটির নির্মাণ করে বসবাস করছিলেন। শূর্পণখা রাম ও লক্ষণের কাছে তাঁর প্রণয়ের কথা ব্যক্ত করলে, লক্ষ্মণ শূর্পণখার নাক ও কান কেটে দেন। এরপর শূর্পণখার অধীনস্থ খর ও দূষণ নামক সেনাপতিদ্বয়কে রামের বিরুদ্ধে প্রেরণ করলে তাঁরা সসৈন্যে নিহত হন। ক্ষুব্ধ শূর্পণখা লঙ্কায় গিয়ে সমস্ত বিষয়ে রাবণকে জানান এবং সীতার অপহরণের জন্য রাবণকে উত্তেজিত করে তুললেন।

রাবণ পঞ্চবটীতে পৌঁছে তাড়কার পুত্র মারীচের সাহায্যে সীতা অপহরণের পরিকল্পনা নেন। মারীচ সোনার হরিণের ছদ্মবেশে সীতার সামনে ঘোরাঘুরি করতে থাকলে সীতা রামের কাছে উক্ত হরিণ ধরে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। রাম ওই সোনার হরিণ ধরতে যান। এরপর মারীচ রামের কণ্ঠ নকল করে কাঁদতে থাকল। রামের বিপদ হয়েছে মনে করে সীতা লক্ষণকে পাঠান। এরপর লঙ্কেশ্বর রাবণ পরিব্রাজকের ছদ্মবেশে এসে সীতার কাছে আসেন এবং সীতার শরীরের প্রশংসা করতে থাকেন–

“বিশালং জঘনং পীনমূরূ করিকরপমৌ।

এতাবুপচিতৌ বৃত্তৌ সংহতৌ সংগলভিতৌ।

পীনোন্নতমুখে কান্তৌ স্নিগ্ধতালফলপমৌ।

মণিপ্রবেকাভরণৌ রুচিরৌ তৌ পয়ধরৌ।”

পরে ইনি সবলে সীতাকে অপহরণ করে লঙ্কার পথে অগ্রসর হন। পথে জটায়ু পাখি তাঁকে বাধা দিলে রাবণ তাঁর পাখা কেটে পথে ফেলে রেখে অগ্রসর হন। সীতাকে নিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর অলংকার ঋষমূকপর্বতে বানরদের উদ্দেশ্য নিক্ষেপ করেন। লঙ্কায় গিয়ে রাবণ সীতাকে বশ করার বহু চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে, ইনি সীতাকে অশোকবনে বন্দিনী করে রাখেন। রাবণ জানিয়ে দেন, দশ মাসের মধ্যে সীতা বশীভূত না-হলে তাঁকে খণ্ড খণ্ড কেটে খেয়ে ফেলা হবে।

রাম-লক্ষণ কুটিরে ফিরে এসে সীতাকে দেখতে না-পেয়ে, অন্বেষণে বেরিয়ে পড়েন। পথে আহত জটায়ু পাখির মুখে রাবণ কর্তৃক সীতাহরণের সব কাহিনি শুনে ঋষমূকপর্বতে বানরদের কাছ থেকে সীতার অলংকার দেখতে পান। সেখানে একে অপরের স্বার্থে কিষ্কিন্ধ্যার অধিপতি সুগ্রীবের সঙ্গে রামের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এখান থেকে রাম হনুমানকে লঙ্কায় পাঠান সীতার সংবাদ আনার জন্য। হনুমান লঙ্কায় পৌঁছে সীতার সংবাদ রামকে পৌঁছে দেন। তারপর রাম বানরসৈন্যদের সহায়তায় সমুদ্রের উপর সেতু নির্মাণ করে লঙ্কায় পৌঁছে যান। এই সময় রাবণের কনিষ্ঠ ভাই বিভীষণ সীতাকে ছেড়ে দিতে পরামর্শ দিলে, রাবণ তাঁর সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং বিভীষণকে অপমান করেন। রাবণ বললেন,–

“ন তু মিত্রপ্রবাদেন সংবসেৎ শত্রুসেবিনা”।

অর্থাৎ “শত্রু ও সাপের সঙ্গেও আমি ঘর করব, কিন্তু নামেমাত্র বন্ধু এই শত্রুসেবী বিভীষণের সঙ্গে থাকব না।”

‘রাজদ্রোহী’, ‘গৃহভেদী’ বিভীষণকে কেবল অপমান করেই রাবণ ছেড়ে দিলেন, হত্যা করলেন না–যেটা প্রয়োজন ছিল। বিভীষণ তাঁর চারজন বন্ধুর সঙ্গে রাবণের রাজসভা ছেড়ে শত্রুপক্ষ রামের সঙ্গে যোগ দেন। সেদিন যদি ‘রাজদ্রোহী’ বিভীষণ হত্যা করতেন, তাহলে রামের পক্ষে যোগদান করে রাবণের সর্বনাশকে তরান্বিত করতে পারতেন না। বিভীষণকে বুকে লাথি মেরে ফেলে দেওয়া এবং খড়গ তুলে হত্যা করতে যাওয়ার ঘটনা বাল্মীকি বলেননি, বলেছেন কৃত্তিবাস ওঝা। রাম-রাবণের চূড়ান্ত যুদ্ধ আরম্ভের পূর্বে বিভীষণ রামের পক্ষে যোগ দেন। যুদ্ধে রাবণের পুত্র মেঘনাদ অসাধারণ বিক্রম প্রদর্শন করেন।

সাম্রাজ্যবাদী রাবণ বিভিন্ন দেশে গিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করতেন। বলতেন–হয় পরাজয় স্বীকার করো, নয় মৃত্যবরণ করো। দুষ্কন্ত, সুরথ, গাধি, পুরুরবা পরাজয় স্বীকার করেন। কিন্তু পরাজয় স্বীকার করলেন না অযোধ্যার অধিপতি অনুরণ্য। অস্ত্রাঘাতের পর রাবণ অনুরণ্যকে সজোরে এক থাপ্পর মারেন। সেই থাপ্পরেই অনুরণ্যের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় অনুরণ্য রাবণকে অভিশাপ দেন এই বলে যে, আমার বংশেই তোর ঘাতক জন্মাবে। রাম-রাবণের যুদ্ধ প্রায় ষোলোসতেরো দিন ব্যাপী হয়েছিল। প্রতিপদে যুদ্ধ শুরু হয়। এই রাতেই মেঘনাদ কর্তৃক নাগপাশে আবদ্ধ হন রাম-লক্ষণ, দুজনেই। পরে অবশ্য গরুড়ের সাহায্যে এই বন্ধন থেকে উভয়ই মুক্তি লাভ করেন। দ্বিতীয়ায় ধুম্রাক্ষ হত্যা, তৃতীয়ায় বজ্রদংষ্ট্রা হত্যা, চতুর্থীতে অকম্পন হত্যা, পঞ্চমীতে প্রহস্ত হত্যা, ষষ্ঠীতে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ এবং রাম-লক্ষ্মণের পরাজয়, সপ্তমীতে কুম্ভকর্ণ হত্যা, অষ্টমীতে নরান্তক ও অতিকায় প্রমুখদের হত্যা, নবমীতে মেঘনাদ বা ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যুদ্ধ, দশমীতে নিকুম্ভ হত্যা, একাদশীতে পুনরায় ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যুদ্ধ, দ্বাদশীতেও পুনরায় ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যুদ্ধ, ত্রয়োদশীতে ইন্দ্রজিৎ হত্যা, চতুর্দশীতে রাবণ শোকবিহ্বল ও পুনরায় যুদ্ধের প্রস্তুতি। অবিরাম তিনদিন ব্যাপী যুদ্ধের পর রাবণের মৃত্যু হয়।

রামায়ণের বানরেরা যেমন monky নয়, তেমনই রাক্ষসরাও man-eater নন। রাবণ রীতিমতো ব্রাহ্মণদের মতো যাগযজ্ঞ করতেন। বেদান্ত শাস্ত্রে তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন। “এষ আহিতাগ্নিশ্চ মহাতপাশ্চ বেদান্তগঃ কর্মসু চাগ্রশূরঃ”–বৈদিক কর্মকাণ্ডেও তিনি অগ্রণী পুরুষ। রাক্ষস বলতে যেমন কল্পনা করা হয় কুলোর মতো কান, মুলোর মতো দাঁত, বড়ো বড়ো চুল, লম্বা লম্বা নখ, বিশালাকার দেহ, চরমভাবে হিংস্র, কিম্ভুতকিমাকার–তা কিন্তু নয়। আমি দেখেছি চলচ্চিত্র, ধারাবাহিকে এইরকম রূপে বোঝানো হয়, ওরা কী কুৎসিত! ওরা এক্কেবারে মানুষের মতো, অন্য কোনোরকম নয়। মানুষ যেমন কুৎসিত সুন্দর হয়, ওরাও তেমনই। লঙ্কায় প্রবেশের পর হনুমান যেমন কুৎসিত রাক্ষস দেখেছেন, তেমনই সুন্দর-সুন্দর রাক্ষসদের দেখেছেন। বাল্মীকি বলেছেন–“ননন্দ দৃষ্টা চ স তান্ সুরূপান, নানাগুণান্ আত্মগুণানুরূপান্।”। আর লঙ্কার নারীরা তো অতীব সুন্দরী। রাবণের অন্দরমহলের নারীরা যেন বিশ্বের সেরা সুন্দরীদের সমাবেশ। হনুমানের দেখা সেরা সুন্দরী বালীর স্ত্রী তারার সৌন্দর্যও ম্লান হয়ে যায়–

“তেষাং স্ত্রিয়স্তত্র মহানুভাবা, দদর্শ তারা ইব সুস্বভাবাঃ”।

চন্দ্রাবতীর রামায়ণেও উল্লেখ আছে–

“রূপেতে রূপসী যত গো রাক্ষস-কামিনী।

পারিজাত ফুলে তারা গো বিনাইয়া বান্ধে বেণী।

মণি-মাণিক্যেতে কেউ গো চাঁচর কেশ বান্ধে।

বায়ু সুরভিত হয় গো শ্রীঅঙ্গের গন্ধে।”

রাবণের স্ত্রীদের দেখে হনুমান বলেছেন–

“ন তত্র কাশ্চিৎ প্রমদা প্রসহ্য, বীর্যোপপন্নেন গুণেন লক্কা”।

অর্থাৎ, সব সুন্দরী মহিলারাই রাবণের গুণে কিংবা বীরত্বে আপন-ইচ্ছায় ধরা দিয়েছে।

জাতবর্ণনির্বিশেষে সেইসব সুন্দরীদের মধ্যে কী ছিল না–রাজার কন্যা, ব্রাহ্মণের কন্যা, দৈত্যের কন্যা, ঋষির কন্যা, গন্ধর্বের কন্যা প্রমুখ। যে মানুষটিকে ব্রাহ্মণ তো বটেই–রাজা, ঋষির কন্যারাও পতি বলে স্বেচ্ছায় বরণ। করে নিয়েছেন–সেই রাবণকে রাক্ষস’ বলা ধৃষ্টতা নয় কি! সীতা এমন কোনো আহামরি সুন্দরী ছিলেন না, রাবণের অন্দরমহলে যে বিশ্বসেরা সুন্দরী ছিল সেই নিরিখে তো নয়ই। আসলে সীতার ‘না’ বলাটা তথা প্রত্যাখ্যান করাটা রাবণের হজম হয়নি। যে রাবণের বাহুডোরে বিশ্বের তাবড় তাবড় সুন্দরী নারীরা স্বেচ্ছায় সমর্পণ করেন, সেখানে সামান্য এই বনবাসিনী নারী কিনা প্রত্যাখ্যান করবে, ঔদ্ধত্য দেখাবে! সীতাকে ভোগের ব্যাপারে রাবণের যতটা-না আগ্রহ ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল জেদ। সীতার প্রত্যাখ্যানের স্পর্ধাই রাবণকে ক্রোধী করে তুলেছিল। অহংকারী রাবণ সেই ক্রোধে বশবর্তী হয়ে নিজের মৃত্যুকেই দাওয়াত এবং দস্তক দিয়েছিলেন। রাবণের একটাই মহাদোষ, রাবণ বিশ্বধর্ষণবাজ। একদিকে যেমন গাদা গাদা সুন্দরীদের বিয়ে করে অন্দরমহলে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন, অপরদিকে যেসব সুন্দরীরা বেগড়বাই করেছেন রাবণ তাঁদের ধর্ষণ করেছেন। রাবণ শুধু ধর্ষণবিলাসীই ছিলেন, তিনি ব্রহ্মার প্রশ্রয়ে ও পৃষ্ঠপোষকতায় যাঁর-তাঁর ধড় থেকে মাথা নামিয়ে ফেলতে চাইতেন। রাবণকে সারাজীবন এইসব বদামোর জন্য প্রচুর মাশুল গুণতে হয়েছে।

লঙ্কেশ্বর রাবণ বেশকিছু কাজ করতে চেয়েছিলেন। যে কাজগুলি করতে চেয়েছিলেন, তা নানা কারণে করা হয়ে ওঠেনি–সে কাজগুলি একনজরে দেখে নিতে পারি। মহাকাব্য রামায়ণ’-এ রাবণকে এমন এক তুলিতে এঁকেছিলেন কবি বাল্মীকি, যাতে তাঁকে একেবারে খলনায়ক’ বলে কিছুতেই মনে হয় না। সত্যি বলতে, রাবণের উপরে আরোপিত হয়েছে এমন কিছু বিরল গুণাবলি, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা যায় না। তবে এটাও ঠিক, রাক্ষসরাজ রাবণ তো মানুষ ছিলেন না। তাঁর জন্ম এবং সাধনা তাঁকে এক প্রবল পরাক্রমশালী ‘অর্ধ-দেবতা হিসাবেই তাকে স্থিত করে। রামায়ণ’-এ রাবণকে এভাবেই দেখানো হয়েছে যে, তিনি পারেন না এমন কোনো কাজ নেই। চূড়ান্ত আত্মম্ভরিতার কারণে এমন কিছু সংকল্প রাবণ করে বসেন, যা প্রবল পরাক্রমশালী হওয়া সত্ত্বেও তিনি পূরণ করতে ব্যর্থ হন। কী সেসব কাজ, যা রাবণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু করতে পারেননি? ইচ্ছে হলেই সব কাজ করা সম্ভব হয় না। রাবণও সম্ভব করতে পারেনি।

কল্পনায় সব সম্ভব, বাস্তবে নয়। গল্পের গোরু গাছে চড়লেও, বাস্তবে সে মাটিতেই বিচরণ করে। একটু পর্যবেক্ষণ করা যাক, রামায়ণের পথে–

(১) দোর্দণ্ডপ্রতাপ এবং পরাক্রান্ত রাবণ চেয়েছিলেন একটা সম্পূর্ণ নতুন ওয়ার্ল্ড অর্ডার নির্মাণ করতে। যার বেশিরভাগই ছিল প্রকৃতিবিরুদ্ধ। রাবণ চেয়েছিলেন মানুষ ঈশ্বরের উপাসনা বন্ধ করুক। তবে কি রাবণ নাস্তিক ছিলেন? নিশ্চয়ই ‘ঈশ্বর’ বলতে রাবণ ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিবদের বলেননি। কারণ ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু-শিব প্রমুখ ঈশ্বর নন, দেবতা। দেবতা আর ঈশ্বর এক নয়। দেবতা আকার, ঈশ্বর নিরাকার। রাবণ ঈশ্বরকে অগ্রাহ্য করে দেবতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ দেবতাদের দ্বারা তিনি নানাভাবে উপকৃত হয়েছেন নানা সময়ে। আত্মরক্ষার ভয়ানক ভয়ানক অস্ত্র পেয়েছেন। দেবতাদের সহায়তাতেই ভুবনজুড়ে দৌরাত্ম্য দেখাতে পেরেছেন। তাই রক্তমাংসের দেবতাদের প্রতিই তাঁর বিশেষ দুর্বলতা তৈরি হতে পারে। ভেবেছিলেন তিনিই দেবতা হবেন। কিন্তু তার এই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কারণ মহাকবির সর্বৈ চেষ্টায় তিনি খলনায়কই, দেবতা নন।

(২) রাবণ সারাজীবন প্রচুর যুদ্ধ করেছিলেন, শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছেন। লঙ্কার দিকে চোখ তুলে তাকাতে দেননি কোনো শত্রুকে। রক্তপাতও তাঁর কোমল অন্তরকে বারবার নাড়া দিয়েছিল, ভাবিত করে তুলেছিল। রক্তের লাল রংয়ে তাঁর ট্রমার সৃষ্টি হয়েছিল বলেই হয়তো তিনি রক্তের রং বর্ণহীন হয়ে যাক চেয়েছিলেন–যাতে তার রক্তলোলুপতাকে কেউ আঙুল তুলে দেখাতে পারবে না। সেই ইচ্ছাও পূরণ হয়নি। কারণ এটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ।

(৩) রাজারাজড়াদের নানারকমের ‘অবসেশন’ থাকে। রাবণেরও ছিল, সোনার প্রতি। তিনি চেয়েছিলেন সোনা গন্ধযুক্ত হয়ে যাক, যাতে খুব সহজেই সোনা খুঁজে পাওয়া যায়। পৃথিবীর সব সোনার মালিক তিনি হতে চেয়েছিলেন। এটাও প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। তাই এই ইচ্ছাও পূরণ হয়নি।

(৪) রাবণ সরাসরি স্বর্গে পৌঁছনোর জন্য একটা সিঁড়ি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। সিঁড়িটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। স্বর্গ কোথায়? বাস্তবিক স্বর্গের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই সিঁড়িও অধুরা।

(৫) রাবণ মদ্যপানে শৌখিন ছিলেন। সেই কারণে তিনি চেয়েছিলেন, মদ যেন দুর্গন্ধমুক্ত হোক। এই কামনাও পূরণ হয়নি। রাবণের যুগে দুর্গন্ধমুক্ত মদ তৈরি করা না-গেলেও, এখন কিন্তু গন্ধহীন মদ পাওয়া যায়।

(৬) রাবণের গায়ের রং ছিল কালো। তিনি চেয়েছিলেন পৃথিবীর সমস্ত পুরুষের গায়ের রং ফরসা হয়ে যাক। যাতে কোনো নারী আর পুরুষের গায়ের রং নিয়ে মজা করতে না পারে। এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যেটা, তা হল তিনি কেবল নিজের গায়ের রং ফর্সা চাইতে পারতেন। স্বার্থপরের মতো তিনি তা চাইতেই পারতেন। কিন্তু তিনি সমগ্র পৃথিবীর পুরুষের ফর্সা রং চেয়েছেন। এখানে তাঁর উদারতা প্রকাশ পেলেও ইচ্ছাপূরণ হয়নি।

(৭) সমুদ্রের জল লবণাক্ত, বিস্বাদ, অপেয়। রাবণের চেয়েছিলেন সমুদ্রের জল যদি মিষ্টি হয়ে যায়, তাহলে পানীয় জলের সমস্যা মিটে যাবে। এটাও প্রকৃতিবিরুদ্ধ। তাঁর এই ইচ্ছাও পূরণ হয়নি।

(৮) রাবণ চেয়েছিলেন সীতা তাঁর প্রতি অনুরক্তা হয়ে উঠুন। চেয়েছিলেন সীতা তাঁর অঙ্কশায়িনী হোক। সীতা পূর্বেই রামচন্দ্রের স্ত্রী। অতএব এ ইচ্ছাও পূরণ হয়নি।

অনেকে বলেন, রাবণ আর রাম মূলত দুই সময়ের মানুষ। রাবণের কাহিনিগুলি আলাদাভাবে খুঁজলে রামের সময়কার কনটেক্সটের সঙ্গে মেলে না। হতে পারে বাল্মিকী একটা সমকাল থেকে রাবণকে নিয়ে রামের চরিত্র বড়ো করে তুলেছেন। রাবণের কাহিনি কিন্তু সমান্তরালভাবে শিবের কাহিনির সঙ্গেই যায়। তাকে বলা হয় শিবের সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্ত। তার সত্তাই কুবের হল শিবের বান্ধব। ভারতীয় পুরাণে নারায়ণ/বিষ্ণুর কাহিনি থেকে কিন্তু শিবের কাহিনিগুলিই বেশি প্রাচীন। মহাভারত পুরোটাই শৈব, কৃষ্ণকে সেইখানে বিষ্ণু অবতার বলা হলেও সমস্ত পুজো কিন্তু হয়েছে শিবের। রামায়ণের রামকেও দেখতে পাই শিব পূজারী হিসাবে। কিন্তু এটা বেশ আরোপিত মনে হয়। রাম শিবের ধনুক ব্যবহার করতেন, যেটা আবার অন্য কাহিনিতে দেখা যায় শিব নিজে ব্যবহার করেছেন ত্রিপুরাসুরকে হত্যা করতে। এরপরে সেই ধনুক দান করেছেন পরশুরামকে। সমাজকে আর্য অনার্য হিসাবে ভাগ করা বোধ হয় বৈষ্ণবযুগের (বৈষ্ণব রাজাদের) কাজ। দ্বাদশ শতক পর্যন্ত শৈব আর বৈষ্ণব পুরো আলাদা ধর্মই ছিল। আর শৈব ঘরানায় কিন্তু আর্য-অনার্য ভেদ নেই। শিবের ভক্ত যেমন দেবগুরু বৃহস্পতি, তেমনই নন্দী ত্রিপুরাসুর কিংবা রাবণ। অথচ নারায়ণের ভক্তরা আবার বেশ সম্ভ্রান্ত মানুষ।

রাবণের আধিপত্য ছিল লঙ্কা ছাড়িয়ে সমগ্র দক্ষিণ ভারতে। শুধু দক্ষিণ ভারতই নয়, তিনি কায়েম করেছিলেন। দক্ষিণবঙ্গও। রাবণ সদলবলে সাগরদ্বীপে বেড়াতে এসেছিলেন। ভেবেছিলেন সাগরদ্বীপ সহ সমগ্র এই ভূখণ্ডটি করায়ত্ত করবেন। বিশ্বজয়ী রাবণ ভাবতে পারেননি এখানে সুবিধা করতে পারবেন না। এই ভূখণ্ডে থাকেন এক শক্তিমান ও দীর্ঘদেহী পুরুষ। তিনি কপিল, কপিল মুনি। মুনি দেখলেই রাবণের উৎকট উল্লাস হয়। মুনিঋষিদের পর্যস্ত করতে পারলেই রাবণের পৈশাচিক উল্লাস হয়। এই কপিলের সঙ্গে রাবণের তুমূল সংঘর্ষ হয়। বজ্রের সমান দুই হাতে কপিল মুনি জাপটে ধরলেন রাবণকে। রাবণের প্রায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার উপক্রম হল। এরপর কপিল মুনি রাবণকে দু-হাতে মাথার উপর তুলে সবেগে মাটিতে আছাড় মারলেন। এক আছাড়েই রাবণের মাথা ঘুরে গেছে। দর্প চূর্ণ হয়েছে। বিভিন্ন বীরদের কাছে বারবার পর্যদস্ত হয়েছেন। অবশেষে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর রাম ও বানরবাহিনির কাছে রাবণের মৃত্যু হয় এবং বৈদিক রীতিনীতি মেনে অগ্নি প্রজ্বলন করে তাঁর সত্ত্বার সম্পন্ন হয়। রাক্ষস বিরাধকে কবর দেওয়া হলেও রাক্ষসরাজ রাবণের মরদেহ আনুষ্ঠানিকভাবে দাহ করা হয়েছিল (৬.১১৩.১২০)৷ স্বয়ং রাম এবং মিত্রপক্ষ অকুস্থলে দাঁড়িয়ে থেকে রাবণের দাহকর্ম সম্পন্ন করেন। শত্রুর সত্ত্বার করে রাম মহান’ হলেন, আর্তের সেবক হলেন। রামায়ণে কবর ও দাহ উভয় প্রথার নির্দেশ পাওয়া যায়। শবদাহ প্রথা–আর্যদেরই “ভস্মান্তং শরীরম্” (ঈশোপনিষৎ-যজুর্বেদ)। অনার্যদের কবর দেওয়াই প্রথা–রামায়ণে (অরণ্যকাণ্ড, চতুর্থ সর্গ ২২ শ্লোক) প্রমাণ পাওয়া যায়–

“রাক্ষসাং গতসত্ত্বানুমেষ ধৰ্ম্ম সনাতনঃ।

অবটে যে নিধীয়ন্তে তেষাং লোকাঃ সনাতনাঃ।”

ভূগর্ভে যাঁদের দেহ প্রোথিত হয়, তাঁদের নিত্যলোক প্রাপ্তি হয়, গতপ্রাণ রাক্ষসদের (অনার্যদের) এটাই চিরন্তন ধর্ম।

স্বদেশ ও প্রজাদের রক্ষার স্বার্থে তাঁর শক্তি নিয়োজিত। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে রাবণ রামকে বলেছিলেন–একজন শাসকের কীভাবে চললে সফল ও প্রাণবন্ত অবস্থায় থাকা সম্ভব। রাবণকে মূল্যায়ণ করতে হলে মনে রাখতে হবে পৃথিবীর সব রাজা-মহারাজা-মুখ্যমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী নিজের দাপট দেখাতে পছন্দ করেন। বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খাওয়াতে না-পারলে কীসের রাজা! শুধু রাবণই নয়–রাম, ভরত, কৌরবগণ, পাণ্ডবগণ, সগররাজা প্রত্যেকেই তাঁদের সর্বোচ্চ দাপট দেখাতে কার্পণ্য করেননি।

রাবণকে নিয়ে লেখা শেষ করার আগে তাঁর সম্বন্ধে আরও দু-চারটা কথা না-লিখলেই নয়। প্রক্ষিপ্ত কবিরা সহ অন্যান্য রামায়ণের কবিরাও তাঁকে একজন ভয়ংকরতম অত্যাচারী শাসক সাব্যস্ত করে দিলেন। সীতা তথা নারীহরণ নতুন কিছু তো নয়! তখনকার সময়ে রাবণ কেন, প্রায় সমস্ত রাজরাজারা ও দেবপ্রধানরা নারীহরণ ও পরনারী ভোগ করাটা বীরত্ব বলেই গণ্য করা হত। সেইসব রাজাদের স্ত্রীরাও এইসব ব্যাপার ধর্তব্যের মধ্যেই রাখতেন না। দেবরাজ ইন্দ্রের তো প্রচুর সুনাম নারীহরণ আর নারীভোগের ব্যাপারে। ইন্দ্র পদাধিকারী ব্যক্তিরা বারবার সুযোগ পেলেই পরনারী ভোগ করছেন। ব্রাহ্মণ-নেতারাও পরস্ত্রী ভোগে পিছপা হননি। রাজারা নারীর অধিকারের জন্য যুদ্ধ বাধিয়ে নিরপরাধ লক্ষ লক্ষ প্রজার মৃত্যু এবং সর্বনাশের কারণ সৃষ্টি করেছেন। এরকম দাপট নবাবী আমল পর্যন্ত চলেছিল। অতএব সীতাকে লঙ্কায় টেনে নিয়ে গিয়ে রাবণ বিরাট পাপকর্ম করেছেন এমন কথা বলা কতটা যুক্তিসংগত, তা ভেবে দেখার দরকার। তা ছাড়া রামায়ণের যুগে সারা পৃথিবীতে তো শুধু রাবণ বাস করতেন না। একমাত্র রাবণই কি ভয়ানক পাপী ছিলেন? সে সময়ে অন্য রাজারা কি সাধুপুরুষ ছিলেন? তাঁদেরও হত্যা না-করে শুধু রাবণে হত্যা করেই রাম ক্ষান্ত হলেন কেন? উদ্দেশ্য কি দুষ্টের দমন, নাকি যেনতেনপ্রকারেণ অনার্য ও প্রতিপক্ষদের নির্বংশ করে আর্যসম্প্রসারণের জন্য। উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত দখল নেওয়া?

তাই সব অপরাধ বিজেতারাই করেন, সব অন্যায় বিজেতাই করে থাকেন। তাই প্রাজ্ঞ রাবণ বিশ্বধর্ষক, বিশ্বখুনি, বিশ্ব-অত্যাচারী। অপরদিকে জয়ী নিষ্পাপ, আর্তের ত্রাতা। জয়ীর পক্ষে সব সমর্থন। না-হলে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন দেখানো যাবে কী করে! এ নতুন কিছু নয়। যুগে যুগে এটাই হয়ে আসছে। কোথাও অন্যথা হয়নি। আসুন, ঠিক এরকমই দুটি সাম্প্রতিককালের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখি। প্রথমটি ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেইন। “খুব খারাপ মানুষ সাদ্দাম’–এরকমই প্রচার হয়ে গেল বিশ্বজুড়ে। বিশ্বের জনসমর্থন আদায়ের জন্য বুঝিয়ে দেওয়া হল–ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম ১৯৯১ সালের চুক্তি অমান্য করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণ করছে এবং তাঁদের কাছে এ ধরনের অস্ত্রের মজুতও আছে। তখন সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছিল, ইরাক যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এবং মিত্র রাষ্ট্রগুলির জন্য বড় ধরনের হুমকি। আগ্রাসনের পরে পরিদর্শকরা ইরাকে গিয়ে কোনো ধরনের গণবিধ্বংসী অস্ত্র খুঁজে পায়নি। তাঁরা জানায়, ইরাক ১৯৯১ সালেই গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণ ত্যাগ করেছে, ইরাকের উপর থেকে আন্তর্জাতিক অনুমোদন সরিয়ে নেওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁদের নতুন করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণের কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। কোনো কোনো মার্কিন কর্মকর্তা দাবি করেন যে, সাদ্দাম হোসেন আল-কায়েদাকে সহযোগিতা করছেন, কিন্তু এর পক্ষেও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷ কুয়েত এবং ইরাকের তেল অবৈধভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে আমেরিকা সাদ্দাম হোসেইনের বিরুদ্ধে নোংরা ষড়যন্ত্র করে। মিথ্যা আরোপ করা হয় হোসেইন বায়ো-কেমিক্যাল অস্ত্র মজুত রেখেছে। কিন্তু ইরাক দেশ পুরো ছারখার হয়ে যাওয়ার পরও সেই রকম কোনো অস্ত্র পাওয়া যায়নি।

সাদ্দাম গ্রেফতার হলেন, গ্রেফতার করল আমেরিকা। আন্তর্জাতিক আদালতে সাদ্দামের ফাঁসির হুকুম শোনানো হয়। প্রকৃত সত্য হল সাদ্দাম মোটেই নিষ্ঠুর ছিলেন না। ফাঁসির রায় ঘোষণার পর জীবনের শেষ দিনগুলিতে তাঁকে পাহারা দিয়েছিলেন ১২ জন মার্কিন সেনা। এই ১২ জন সাদ্দামের শেষ সময়ের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁরাই ছিলেন সাদ্দামের সঙ্গী। তাঁদেরই একজন উইল বার্ডেনওয়ার্পার। উইল বার্ডেনওয়ার্পার তাঁর “The Prisoner in is Palace, his American guards and what history left unsaid” গ্রন্থে লিখলেন–

“আমরা কখনও সাদ্দামকে মানসিক বিকারগ্রস্ত হত্যাকারী হিসাবে দেখিনি। নিজের জীবনের শেষ দিনগুলিতে সাদ্দাম তাঁদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করতেন। ওই ব্যবহার দেখে বোঝাই যেত না যে সাদ্দাম হোসেন কোনো একসময়ে একজন অত্যন্ত নিষ্ঠুর শাসক ছিলেন।”

বার্ডেনওয়ার্পার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে লিখেছেন–“একবার সাদ্দাম তাঁর ছেলে উদয় কতটা নিষ্ঠুর ছিল, সেটা বোঝাতে গিয়ে বীভৎস একটা ঘটনার কথা বলেছিলেন। ওই ব্যাপারটায় সাদ্দাম প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন। উদয় কোনো একটা পার্টিতে গিয়ে গুলি চালিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে বেশ কয়েকজন মারা গিয়েছিলেন। গুলিতে আহত হয়েছিলেন আরও কয়েকজন। সাদ্দাম ব্যাপারটা জানতে পেরে উদয়ের সবকটি গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই ঘটনাটা বলতে গিয়ে সেনা-প্রহরীদের সাদ্দাম ভীষণ রেগে গিয়ে শুনিয়েছিলেন উদয়ের দামি রোলস রয়েস, ফেরারি, পোর্শে গাড়িগুলিতে তিনি আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সাদ্দাম হোসেনের নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত আমেরিকান সেনারাই তাঁকে একদিন জানিয়েছিলেন যে তাঁর ভাই মারা গিয়েছেন। যে সেনা-সদস্য খবরটা দিয়েছিলেন, সাদ্দাম তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আজ থেকে তুমিই আমার ভাই।’ আরেকজন প্রহরীকে বলেছিলেন, ‘যদি আমার সম্পত্তি ব্যবহার করার অনুমতি পাই, তাহলে তোমার। ছেলের কলেজে পড়তে যা খরচ লাগবে, সব আমি দিতে রাজি।’ বার্ডেনওয়ার্পারের গ্রন্থটিতে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক যা উল্লেখ রয়েছে, তা হল সাদ্দামের মৃত্যুর পরে তাঁর প্রহরীরা রীতিমতো শোক পালন করেছিলেন, যদিও তিনি আমেরিকার কট্টর শত্রু ছিলেন। প্রহরীদেরই একজন অ্যাডাম রজারসন উইল বার্ডেনওয়ার্পারকে বলেছিলেন, “সাদ্দামের ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পরে আমার মনে হচ্ছে আমরা ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। নিজেদেরই এখন তাঁর হত্যাকারী বলে মনে হচ্ছে। এমন একজনকে মেরে ফেললাম আমরা, তিনি যেন আমাদের খুব আপনজন ছিলেন।” ওই ১২ জনের অন্যতম স্টিভ হাচিনসন সাদ্দামের ফাঁসির পরেই আমেরিকার সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দেন। হাচিনসন এখন জর্জিয়ায় বন্দুক চালনা আর ট্যাকটিক্যাল ট্রেনিং দেওয়ার কাজ করেন। তাঁর মনে এখনও ক্ষোভ বর্তমান, কারণ সেদিন যেসব ইরাকি সাদ্দামের মৃতদেহকে অপমান করছিল, তাঁদের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে না-পড়ার আদেশ দেওয়া হয়েছিল তাঁদের।

দ্বিতীয় ঘটনা আফগানিস্তান। ওসামা বিন লাদেনকে খোঁজার বাহানায় আফগানিস্তান আক্রমণ করল আমেরিকা। আক্রমণ করার আগে আমেরিকা ঘোষণা করে বসল–“সন্ত্রাসবাদ দমনে কারা আমেরিকার সঙ্গে আছেন বলুন। যারা আমেরিকার সঙ্গে থাকবেন তাঁরা সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের পক্ষে, যাঁরা আমেরিকার সঙ্গে থাকবেন না, তাঁরা সন্ত্রাসবাদীর সমর্থক। সার্বিক সমর্থন নিয়ে আমেরিকা ঝাঁপিয়ে পড়ল আফগানিস্তানের উপর। তছনছ করে দিল আফগানিস্তান ভূখণ্ড। লাদেন কোথায়! আমেরিকার উদ্দেশ্য সফল হল, আফগানিস্তানের তালিবান সরকারকে ফেলে দিয়ে আমেরিকার তাবেদার সরকার বসিয়ে দিল। দীর্ঘ ১৩ বছর যাবৎ আফগানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেল ন্যাটো বাহিনী। আফগান যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করা হলেও দেশটিতে ১৩,৫০০ ন্যাটো সেনা অবস্থান করবে বলে আমেরিকার তরফ থেকে জানানো হল, যার মধ্যে থাকবে ১১,০০০ মার্কিন সেনা। তাঁরা কেবল প্রশিক্ষণের কাজ করবে বলে জানানো হয়েছে। মার্কিন সেনারা ২০০১ সালে আফগানিস্তান থেকে তালিবান ও আল-কায়দা গোষ্ঠীসহ সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের দোহাই দিয়ে দেশটি দখল করে নেয়। আসলে ওয়াশিংটন সন্ত্রাস দমনের জন্য আফগানিস্তানে সেনা পাঠায়নি, বরং সন্ত্রাস দমনের অজুহাতে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এই দেশটিকে নিজের সামরিক ও গোয়েন্দা ঘাঁটিতে পরিণত করতে চেয়েছে। ২০১১ সালের মে ২ তারিখে দিবাগত রাতে পাকিস্তানের আবোটাবাদ শহরে মার্কিন কমান্ডোদের হামলায় (অপারেশন জেরোনিমো) ওসামা বিন লাদেন নিহত হন। তার জন্য পাকিস্তান ভূখণ্ডকে তছনছ করতে হয়নি। আমেরিকা নিজেদেরকে ‘বিশ্বের ত্রাতা’ ভাবতে এবং ভাবাতে শুরু করে দিলেন।

রাবণের পূনর্মূল্যায়নের সুযোগ হয়নি। তাই রাবণের ভাবমূর্তিকে যেভাবে ভাবানো হল, সেভাবেই রয়ে গেল। রামও নিছক সীতাকে পাওয়ার জন্য রাবণের সঙ্গে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ করেননি। সীতার খোঁজ যে বাহানামাত্র, তা রাম নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন। সীতাকে ফিরিয়ে দিলেও যুদ্ধটা হতই। আর অহংকার? দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রায় অপরাজেয় রাজা, যাঁর সঙ্গে স্বয়ং ব্রহ্মা আর শিবের মদত রয়েছে, তাঁর অহংকার থাকবে না তো কার থাকবে! এখন প্রশ্ন হল রাম কেন রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন? উদ্দেশ্য স্পষ্ট : উত্তরভারত থেকে সুদূর। দক্ষিণ ভারতের শেষ সীমা পর্যন্ত আর্যসভ্যতার আধিপত্য বিস্তার।

এখন প্রশ্ন করা যেতেই পারে–লঙ্কাযুদ্ধে রাবণের পতনের কারণ কী? রাবণে বিরুদ্ধে আর্যদেবতা ও ব্রাহ্মণদের অভিযোগ–তিনি ধর্ষক, তিনি নারী লোভী, তিনি অন্যের রাজ্য আক্রমণ করেন এবং রাজাদের হত্যা অথবা বন্দি করেন, তিনি স্বর্গের দখল নিতে চান, তিনি নারীকে রক্ষিতা (হারেম) করেন ইত্যাদি। এগুলি অভিযোগ, না অজুহাত? এগুলি যদি রাবণের অপরাধ হয়, তাহলে বলব প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগের শেষদিক পর্যন্ত প্রায় সব রাজা তো এরকমই ছিল। শত্রুরাজ্যের নারী হরণ করা, নারী ধর্ষণ করা, শত্রুরাজাকে হত্যা বা বন্দি করা এ তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। প্রাচীন যুগে এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর সংঘর্ষে যে গোষ্ঠী। পরাজিত হত, তাঁদের সম্পত্তি দখল করা হত এবং তাঁদের দাস হিসাবে ব্যবহার করা হত, এমনকি নারীও বিজয়ীর অধিকারে চলে যেত। রাবণ ব্যতিক্রম কী করল? আসলে তোকে আমি মারবই, তুই জল ঘোলা করিসনি তো তোর বাপে করেছে, নাহলে তাঁর তাঁর বাপে জল ঘোলা করেছে। উদ্দেশ্য যখন দাক্ষিণাত্যে আর্য উপনিবেশন, তখন প্রতিপক্ষের দোষ মাপা না-মাপায় কী যায় আসে। রাবণের কিছু ত্রুটি ছিল তো অবশ্যই, তাই তাঁর পরাজয় হল। প্রাচীনকালে রাজায় রাজায় সম্মুখ সমর হত। একপক্ষের হয় মৃত্যু হত, অথবা বন্দি হয়ে দাসত্ব মেনে নিতে হত। তা ছাড়া রাবণের অপরাধ তো বিরল থেকে বিরলতম অপরাধ’ নয় যে, তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে! রাজার পরাজয় তখনই হয়, যখন রাজা একের এক ভুল করে যায়। আর সেই ভুলের মাশুল গুনতে হয় রাজাকেই। রাবণের পরাজয় রাম ও রামশিবিরের দৈবশক্তি নয়, রাবণের পরাজয়ের জন্য দায়ী রাবণের অবিমৃষ্যকারিতা। পতনের কারণগুলি এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক–

(১) চারিত্রিক ত্রুটি : রাবণ অহংকারী, চরম আত্মবিশ্বাসী এবং ঔদ্ধত্য। অহংকার থেকে জন্ম নেয় চরম আত্মবিশ্বাস এবং চরম আত্মবিশ্বাস থেকে জন্ম নেয় ঔদ্ধত্য। ঔদ্ধত্যই চেতনা লুপ্ত করে, বুদ্ধিনাশ করে। গঠনমূলক পরিকল্পনা করতে ব্যর্থ হন।

(২) মিত্রহীন : লঙ্কেশ্বর রাবণ একা। যুদ্ধের জন্য তিনি অক্ষশক্তি তৈরি করেননি বা করতে পারেননি। মিত্রশক্তি রামচন্দ্র যখন আর্যদেবতা ও তাঁর দেবসেনাবাহিনী, অগস্ত্যের মতো যুদ্ধবিশারদ, কিষ্কিন্ধ্যার রাজা সুগ্রীব ও তাঁর পরাক্রমী সেনাবাহিনী, বিভীষণের মতো বিশ্বাসাতক, শূর্পণখার মতো ঘরশত্রু গুপ্তচর–তখন রাবণ একক শক্তি। আর কোনো রাজা বা শক্তিকে একত্রিত করতে পারেননি তিনি। নিজেকে সর্বশক্তিমান ভেবে ফেলার এটাই ফল। রাম কিন্তু নিজেকে কখনোই সর্বশক্তিমান ভাবেননি, আর ভাবেননি বলেই যেখানে যত শক্তি আছে যথাসম্ভব সংগ্রহ করে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাই এ যুদ্ধ অসম হয়েছে। হারও অনিবার্য।

(৩) ভ্রান্ত রণনীতি : রামশিবিরে যখন দুর্ধর্ষ দেবসেনাপতি ইন্দ্র সহ সমগ্র দেবসেনা, দক্ষ বীর লক্ষ্মণ, ধুরন্ধর বীর সুগ্রীব, মহাশক্তিশালী হনুমান, দুর্ধর্ষ অঙ্গদ, বীর চিকিৎসক জাম্ববান, যুদ্ধ বিশারদ অগস্ত্য, পরম সহযোগী ‘ঘরশত্রু বিভীষণ, বীর নীল ও অসংখ্য বীর এবং আত্মনিয়জিত বানরসেনা চারদিক ঘিরে একযোগে যুদ্ধ করছেন–সেখানে রাবণ যুদ্ধক্ষেত্রে একজন করে বীর সেনাপতিদের পাঠাচ্ছেন মিত্রপক্ষের মোকাবিলা করতে! কখনো ইন্দ্রজিতের মতো মহাবীর একা যুদ্ধ করতে আসছেন, কখনো কুম্ভকর্ণের মতো মহাবীর একা যুদ্ধ করতে আসছেন, কখনো অকম্পনের মতো মহাবীর একা যুদ্ধক্ষেত্রে আসছেন–এটা ক্রিকেট খেলা নাকি? একজন করে ব্যাটসম্যান আসছেন, রান করছেন আর বোল্ড আউট হচ্ছেন। অথচ মিত্রপক্ষ রামশিবির ফুটবল টিম নিয়ে মাঠে নেমেছেন আর চারদিক ঘিরে খেলছেন। যদি ইন্দ্রজিৎ, অকম্পন, প্রহস্ত, বজ্রদংষ্ট, কুম্ভকর্ণ, নান্তক, ত্রিশিরা, মহাপার্শ্ব, অতিকায়, বিরূপাক্ষ, মহোদরের দুর্ধর্ষ মহাবীরেরা একযোগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতেন, তাহলে রামশিবিরের বীরসেনারা পালানোর পথ খুঁজে পেতেন না। এমনিতেই অক্ষশক্তির এক বীরের দাপটেই রামশিবিরের অবস্থা বহুবার ল্যাজেগোবরে হয়েছেন–ইন্দ্রজিতের বাণ ও নাগপাশে রাম-লক্ষ্মণের দুই দুইবার মৃতপ্রায় অবস্থা হয়েছিল। রামশিবিরের যুদ্ধক্ষেত্র প্রায় শ্মশান করে দিয়েছিলেন ইন্দ্রজিৎ। কুম্ভকর্ণের অস্ত্রাঘাতে বিশ্রীভাবে আহত হয়েছিলে হনুমান, এমনকি রাবণের অস্ত্রাঘাতেও হনুমান জ্ঞান হারিয়েছিলেন। কুম্ভকর্ণের আঘাতে অঙ্গদ জ্ঞান হারান ও সুগ্রীব বন্দি হন। যুদ্ধনীতিতে ভুল থাকলে পরিকল্পনাহীন সেই যুদ্ধে জয় অসম্ভব।

(৪) বিদ্রোহ দমনে অক্ষমতা : রাবণের সাধের রাজপরিবারের অন্দরমহলে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্রোহ, সেই বিদ্রোহের নাটের গুরু জ্ঞাতিদ্রোহী বিভীষণ। এত কাণ্ড, তবুও রাবণ টের পাননি। সেই বিদ্রোহ দমন করতে সচেষ্ট হননি তিনি। নিজের বোন শূর্পণখা তাঁকে ও তাঁর রাজ্য ধ্বংস করতে রামশিবিরের আর্যদেবতাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন, সে ব্যাপারেও লঙ্কেশ্বর উদাসীন। রাজার এই উদাসীনতা পরাজয়ের জন্য যথেষ্ট।

(৫) বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি না-দেওয়া; জ্ঞাতিদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক বিভীষণের মতো কালসাপকে দুধকলা দিয়ে পুষেছিলেন তিনি। যাঁর বুকে বসেছিলেন তিনি তাঁরই বুকে বসে তাঁরই শিলনোড়া দিয়ে তাঁরই দাঁতের গোড়া ভেঙেছেন। লঙ্কায় বসে লঙ্কার রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রচনা করছেন। রাজার অপশাসনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নয়, সিংহাসন আর মন্দোদরীকে ভোগ করার লোভেই রামের পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন বিভীষণ। একথা রামশিবিরে যোগ দিয়ে রামকে খোলাখুলিই বলেছেন বিভীষণ। কোনো ঢাককাক গুড়গুড় ছিল না। সেই শর্তেই তিনি রামকে বলেছিলেন–

“আমি রাক্ষস বধ ও লঙ্কাপরাভব বিষয়ে যথাশক্তি তোমায় সাহায্য করিব এবং রাবণের প্রতিদ্বন্দ্বী হইব।”

বিভীষণও রামভক্ত নন, ক্ষমতাভক্ত। ইন্দ্রজিতের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধে রাম-লক্ষণ মৃতপ্রায় হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ইন্দ্রজিতের মতো বিভীষণ ভেবেছিলেন রাম-লক্ষ্মণ মারা গেছেন। এই ভেবে বিভীষণ মরাকান্না জুড়ে দিলেন–

“হায়, আমি যাঁহাদের বাহুবলে রাজ্যপদ কামনা করিয়াছিলাম, এক্ষণে তাঁহারাই মৃত্যুর জন্য শয়ান। বলিতে কি আজ আমার জীবনমৃত্যু, রাজ্যকামনা দূর হইল এবং পরমশত্রু রাবণেরও জানকীর অপরিহার সংকল্প পূর্ণ হইল।”

শুধু বিভীষণই নয়, রাবণের জন্মশত্রু ছিল নিজের ভাই কুবের। এই কুবেরই ছিলেন একদা লঙ্কার শাসনকর্তা। রাবণের সঙ্গে হেরে গিয়ে আর্যদেবতাদের দলে যোগ দিয়ে ‘লোকপাল’ পদে নিযুক্ত হন। আর্যদেবতারা এই কুবেরের মাধ্যমেই লঙ্কার অলিগলি জেনেছেন। কুবেরের থেকে রাবণের যথেষ্ট সাবধান থাকা উচিত ছিল। কথায় বলে আহত সাপ বাঁচিয়ে রাখা উচিত নয়।

রাবণের সভায় বসে বিভীষণ শত্রুপক্ষের হয়ে ঢাক পেটাতে থাকলে রাবণ ভর্ৎসনা করেন–“রে কুলকলঙ্ক! তোরে ধিক্! যদি অন্য কেহ এইরূপ কহিত, তবে তদ্দণ্ডেই তাহার মস্তক দ্বিখণ্ড করিতাম।” ‘অন্য কেহ’ নয়, নিজের ভাই। ক্ষমাশীল দাদা রাবণ, হত্যা না-করে সামান্য তিরস্কার করে ছেড়ে দিলেন। ঘাড় ধাক্কা খেয়ে কালসাপ বিভীষণ সোজা শত্রুশিবিরে যোগ দিলেন। ভাইয়ের প্রতি স্নেহবশত বিশ্বাসঘাতককে মৃত্যুদণ্ড দিলেন না। তাঁকে দেশত্যাগ করার সুযোগ দিয়ে দিলেন। রাবণ একবারের জন্যেও খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না যে, বিভীষণ দীর্ঘদিন ধরে লঙ্কার কোথায় কোথায় ছিদ্র করে রেখে গেছেন। লঙ্কেশ্বর রাবণ যদি এহেন রাজদ্রোহীর মৃত্যুদণ্ড দিতেন, তাহলে মাশুল অনেক কম গুনতে হত রাবণকে। বালীর মতো ভুল রাবণও করলেন। তাঁকে হত্যা করার জন্য গোকুলে যিনি বাড়ছেন, তাঁকে চিহ্নিত করে নিকেশ করতে পারলেন না রাবণ। চরম মূল্য দিতে হল।

(৬) গুপ্তচরের অপদার্থতা : বিশ্বস্ত গুপ্তচর কি রাবণের ছিল না? থাকলে কী করছিলেন তাঁরা? বিভীষণ কি সব গুপ্তচরকেই নিজের পক্ষে টেনে নিয়েছিলেন? নাকি শূর্পণখার মতো রাবণের গুপ্তচরগুলিও রামবাহিনী কবজা করে নিয়েছেন?

(১) রামচন্দ্র দলবল নিয়ে লঙ্কায় রাবণকে হত্যা করতে আসছেন, সে খবর রাবণের গুপ্তচরেরা জানাতে পারেননি।

(২) টানা পাঁচদিন ধরে সমুদ্রের উপর শত্রুপক্ষ বিনাবাধায় একটা আস্ত সেতু গড়ে ফেলল, সে খবর রাবণের গুপ্তচরেরা জানতে পারলেন না?

(৩) তীব্র শাব্দিক বিমান নিয়ে সমুদ্র পেরিয়ে মহাবীর হনুমান লঙ্কায় ঢুকে পড়ল, অশোকবনে ঘুরল, সীতার সঙ্গে দেখা করল–এত কাণ্ড হয়ে গেল, অথচ রাবণের গুপ্তচর কিছুই জানাতে পারল না। (৪) রামের নির্দেশে বানরসেনারা দলে দলে লঙ্কায় ঢুকে ঘরে ঘরে আগুনে দিয়ে আবালবৃদ্ধ পুড়িয়ে দিল, সেই খবরও রাবণের গুপ্তচরের কাছে ছিল না? গুপ্তচরেরা কি সব বিভীষণের পক্ষে চলে গিয়েছিল? তাই যদি হয়, তাহলে রাবণের পরাজয় কে ঠেকাবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *