০৫. সীতা : তেজস্বিনী, পতিব্রতা এবং নার্সিসিস

সীতা : তেজস্বিনী, পতিব্রতা এবং নার্সিসিস

সীতা কে? একটাই উত্তর, রামের স্ত্রী। বড়োজোর জনকরাজার দুহিতা। উত্তরকাণ্ডকে বাদ রাখলে সীতার আর কোনো পরিচয় বাল্মীকি দেননি। সীতার বিবাহের সময় বরকর্তা বিশ্বামিত্রকে সীতার যেটুকু জন্মবৃত্তান্ত জনকরাজা সীরধ্বজ প্রয়োজন মনে করেন, সেটুকু হল হলকর্ষণ করে এ কন্যাকে পেয়েছেন। আসলে সীতা যে জনকরাজা সীরধ্বজের ঔরসজাত কন্যা নয়, সেটাই কায়দা করে পাত্রপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া আর কী। সীতা হল রামের স্ত্রী। বাল্মীকির রামায়ণে বালকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ডে রামকে নারায়ণ, বিষ্ণু বা বিষ্ণুর অবতার হিসাবে মেলে ধরা হয়েছে। রাম পূজ্য, তাই তাঁর হিসাবে সীতাদেবীও পূজ্যা! রাম বিষ্ণুর অবতার হলে, সীতা স্বাভাবিক নিয়মেই লক্ষ্মীর অবতার। বিষ্ণু কে? বিষ্ণুপুরাণে পরাশর বলছেন–

“এই বিশ্বের উৎপত্তি বিষ্ণু থেকে। এর স্থিতিও তাঁরই মধ্যে, এটি এক ছন্দোময় সুসম্বন্ধ ব্যবস্থা। বিষ্ণুই এর একমাত্র রক্ষাকর্তা, একমাত্র নিয়ন্তা, আর আসলে এই বিশ্বই তিনি৷”

বাল্মীকি রামায়ণে সীতা ক্ষত্রিয়াণী, বীরাঙ্গনা, বঙ্গে এসে কৃত্তিবাস প্রমুখ বাঙালি কাছে সীতা হয়ে গেলেন গৃহস্থ ঘরের কোমলমতি অসহায় বধূ। অপরদিকে রাজস্থানে তিনি মধ্যযুগের রাজপুতানি, কেরলে তিনি কেরল সীমন্তিনী, তুলসীদাস প্রমুখ কবিদের কাছে তিনি উত্তর ভারতের লজ্জাশীলা অথচ তেজোদৃপ্তা কুলবধূ। সীতা মহিয়সী বীরাঙ্গনা–অথচ আমরা বাঙালি ঘরের ‘জনম-দুখিনী’ লাজুক বধূ সীতাকেই জানি।

রামায়ণের কেন্দ্রীয় বা প্রধান নারী চরিত্র যিনি সেই সীতা নেপালে অবস্থিত জনকপুরে জন্মগ্রহণ করেন। কোথাও-বা বলা হয়েছে জনক মিথিলার রাজা। প্রাচীন ভারতে মিথিলা কি জনকপুরের অন্তর্ভুক্ত ছিল? মিথিলাই-বা কোথায় ছিল? একটু খোঁজার চেষ্টা করব। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, রামায়ণে যেমন মিথিলার কথা জানতে পাই, তেমনই মিথিলার কথা জানতে পারি বিদ্যাপতির কল্যাণে। পঞ্চদশ শতকের মিথিলার কবি ছিলেন বিদ্যাপতি। প্রাচীন ভারতের পূর্বদিকে ছিল বিদেহ রাজ্য, মিথিলা ছিল বিদেহ রাজ্যের রাজধানী। বর্তমানে উত্তর বিহারের তিরহুত জেলা ও দক্ষিণ নেপালের জনকপুর মিলিয়ে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন বিদেহ রাজ্য। এই বিদেহ রাজ্যের রাজা ছিলেন সীরধ্বজ, যিনি জনকরাজা নামেই পরিচিত। অতএব সীতা মিথিলাবাসী, ভাষা মৈথিলী। বিদেহ রাজ্যের কন্যা বলে সীতার অন্য নাম ‘বৈদেহী’। আবার অনেকে বলেন সীতার পালক পিতা জনক বিশেষ শক্তিবলে নিজের দেহকে অদৃশ্য করে রাখতে পারতেন, তাই তাঁর নাম বিদেহ। বিদেহর কন্যা বলে সীতা হলেন ‘বৈদেহী’।

হিন্দুসমাজে তাকে আদর্শ স্ত্রী তথা আদর্শ নারীর উদাহরণ হিসাবে মনে করা হয় সীতাকে। সীতা মূলত তাঁর উৎসর্গীকরণ, আত্মবিসর্জন, সাহসিকতা এবং বিশুদ্ধতার জন্যে পরিচিত হয়। বাল্মীকির রামায়ণে হলকর্ষণ করতে গিয়ে জনকরাজা সীরধ্বজ জমি থেকে সীতাকে পেয়েছেন। এর বেশি কাহিনি বাল্মীকি শোনাননি। বিবাহের আসরে জনকরাজা বলেছেন–

“অনন্তর একদা আমি হল দ্বারা যজ্ঞক্ষেত্র শোধন করিতেছিলাম। ওই সময় লাঙ্গল পদ্ধতি হইতে এক কন্যা উখিতা হয়। ক্ষেত্র শোধনকালে হলমুখ হইতে উত্থিত হইল বলিয়া আমি উহার নাম সীতা রাখিলাম। এই অযোনিসম্ভবা তনয়া আমার আলয়েই পরিবর্ধিত হইতে লাগিল।”

অর্থাৎ সীতার জন্ম স্বাভাবিকভাবে মাতৃগর্ভে হননি বলে সাব্যস্ত করার চেষ্টা। সীতা সীরধ্বজের দত্তককন্যা?

বাল্মীকি সরাসরি কিছু না-বললেও সীতা কখনোই অযোনিসম্ভবা নন, তাঁর জন্ম কোনো-না-কোনো মাতৃগর্ভেই হয়েছে। দিবাকর ভট্টের ‘কাশ্মীরি রামায়ণ এবং কৃত্তিবাসের ‘শ্রীরাম পাঁচালি’ এবং ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ থেকে জানা যায়, সীতা হলেন রাবণ ও মন্দোদরীর মেয়ে। প্রত্যেকের কাহিনি অল্পবিস্তর হলেও কাহিনির অভিমুখ প্রায় একই। প্রাদেশিক এইসব কবিরা বলেছেন, তাঁর জন্মের আগে গণকরা জানিয়েছিলেন, সীতা রাবণের মৃত্যু এবং বংশের ধ্বংসের কারণ হবেন। দেবীভাগবত পুরাণ’-এ বলা হয়েছে–রাবণ যখন মন্দোদরীকে বিবাহ করতে চান, তখন ময়াসুর রাবণকে সাবধান করে বলেন যে, মন্দোদরীর কোষ্ঠীতে আছে, তাঁর প্রথম সন্তান তাঁর বংশের ধ্বংসের কারণ হবে। তাই এই সন্তানটিকে জন্মমাত্রই হত্যা করতে হবে। ময়াসুরের উপদেশ অগ্রাহ্য করে রাবণ মন্দোদরীর প্রথম সন্তানকে একটি ঝুড়িতে করে জনকের নগরীতে রেখে আসেন। জনক তাঁকে দেখতে পান এবং সীতারূপে পালন করেন। বাসুদেবহিন্দি, উত্তরপুরাণ ইত্যাদি জৈন রামায়ণেও সীতাকে রাবণ ও মন্দোদরীর কন্যাই বলা হয়েছে। এই সব গ্রন্থেও উল্লেখ আছে যে, সীতা রাবণ ও তাঁর বংশের ধ্বংসের কারণ হবেন বলে ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছিল, তাই রাবণ তাঁকে পরিত্যাগ করেন।

মালয় ‘সেরি রামা’ ও জাভানিজ ‘রামা কেলিং’ গ্রন্থে রয়েছে, রাবণ রামের মা মন্দোদরীকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পরিবর্তে তাঁরই মতো দেখতে এক ছদ্ম-মন্দোদরীকে রাবণ বিবাহ করেন। রামের পিতা সেই ছদ্ম-মন্দোদরীকে সম্ভোগ করেছিলেন। তাঁর ঔরসে ছদ্ম-মন্দোদরীর গর্ভে সীতার জন্ম হয়। এইভাবে সীতা নামেমাত্র রাবণের কন্যারূপে পরিচিত হন। “আনন্দ রামায়ণ অনুসারে, রাজা পদ্মাক্ষের পদ্মা নামে এক কন্যা ছিল। তিনি ছিলেন লক্ষ্মীর অবতার। যখন পদ্মার বিবাহ স্থির হয়, তখন রাক্ষসরা রাজাকে হত্যা করে। শোকাহত পদ্মা আগুনে ঝাঁপ দেন। রাবণ যখন পদ্মার দেহটি পান তখন তা পাঁচটি রত্নে পরিণত হয়েছিল। রাবণ একটি পেটিকায় ভরে সেটিকে লঙ্কায় নিয়ে আসেন। মন্দোদরী পেটিকা খুলে ভিতরে পদ্মাকে দেখতে পান। তিনি রাবণকে উপদেশ দেন পিতার মৃত্যুর কারণ দুর্ভাগিনী পদ্মা সহ পেটিকাটি জলে ভাসিয়ে দিতে। রাবণ যখন পেটিকার ঢাকনা বন্ধ করছিলেন, তখন পদ্মা রাবণকে অভিশাপ দিয়ে বলেন যে, তিনি লঙ্কায় ফিরে আসবেন এবং রাবণের মৃত্যুর কারণ হবেন। রাবণ পেটিকাটি জনকের নগরীতে প্রোথিত করেন। জনক পদ্মাকে পেয়ে সীতারূপে পালন করেন।

বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে অগস্ত্যমুনি রামকে যে রাবণের কাহিনি শোনাচ্ছিলেন তাতে বেদবতী নামে এক সুন্দরী কন্যাকে পাওয়া যায়। সীতা পূর্বজন্মে ছিলেন বেদবতী নামে এক পুণ্যবতী নারী। রাবণ তাঁর শ্লীলতাহানি করতে চাইলে তিনি রাবণকে অভিশাপ দেন যে, তিনি পরবর্তী জন্মে রাবণকে হত্যা করবেন। বেদবতী হলেন বৃহস্পতির পুত্র কুশধ্বজের কন্যা। ইনিই জন্মান্তরে মিথিলার রাজা জনকের গৃহে সীতা রূপে জন্ম লাভ করেন। ব্রহ্মর্ষি কুশধ্বজ লক্ষ্মীকে নিজের কন্যা হিসাবে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করেন। তাঁর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে লক্ষ্মী তাঁর কন্যা রূপে জন্ম নিতে রাজি হন। একদিন যখন কুশধ্বজ বেদ পাঠ করছিলেন, সেই সময় লক্ষ্মী বাত্ময়ী মূর্তিতে জন্মগ্রহণ করেন। ইনি অযযানিসম্ভবা ছিলেন! কুশধ্বজ ও তাঁর স্ত্রী মালাবতী তাঁকে নিজের কন্যা রূপে স্বীকার করেন। বেদ পাঠকালে জন্ম লাভ করায় এঁর নাম হয় বেদবতী। একদিন রাবণ পায়চারী করতে করতে লক্ষ করলেন দেবীর মতো সুন্দরী কন্যা তপস্যা করছেন। রাবণ তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাঁর সবিস্তারে জানিয়ে দেন। তিনি রাবণকে অতিথি হিসাবে সম্মান প্রদর্শনও করেন। কিন্তু ‘লেডিকিলার’ রাবণ তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্তু বেদবতী রাবণের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। রাবণ ক্ষুব্ধ হলেন, অপহরণ করার জন্য যেই-না বেদবতীর কেশস্পর্শ করলেন, তৎক্ষণাৎ বেদবতীর হাতখানি তরবারি হয়ে যায়। রাবণের যে হাত তাঁর কেশস্পর্শ করেছিল সেই হাত কর্তন করে দিলেন। এরপর নিজেই চিতা জ্বালিয়ে আত্মাহুতি দিলেন এবং হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন–

“বর্বর রাক্ষস, তোর হাতে ধর্ষিত হয়ে আমি আর জীবিত থাকতে চাই না। তোর সবংশে নিধনের জন্য আমি কোনো ধার্মিকের গৃহে অযযানিজা কন্যা রূপে পুনরায় জন্ম নেব।”

সেই কন্যাই সীতা রূপে রামের ঘরে রামের স্ত্রী হলেন।

সীতার পূর্বজন্মের বেদবতীর সম্বন্ধে আর দু-চারটে কথা না বললেই নয়। বেদবতীও লক্ষ্মীর অবতার ছিলেন। বেদবতী বিষ্ণুর অপেক্ষায় ছিলেন আমৃত্যুকাল। বিষ্ণুকেই তিনি পতিরূপে কল্পনায় গ্রহণ করেছেন। বিষ্ণু ছাড়া তিনি আর কারোকেই পতি বলে স্বীকার করতে পারবেন না। বেদবতী অতীব সুন্দরী ছিলেন। কেমন সুন্দরী ছিলেন? শেখর সেনগুপ্ত বলেছেন–

“কৃষ্ণবর্ণ হরিণচর্মে উর্ধাঙ্গ ও নিম্নঙ্গ আচ্ছাদিত। প্রশস্ত জঘা, ক্ষীণ কটিদেশ, সুপক্ক আম্রের ন্যায় স্তনযুগল, বিশাল তৃষ্ণার্ত মেঘসমান কেশসম্ভার, দুই আয়ত লোচনে নারীর চিরন্তন প্রণয়তৃষ্ণা।”

জঙ্গলে যেসব রাজা-যক্ষ-দক্ষ-দৈত্য-দানো মৃগয়ায় আসতেন তারাই তপোবনের কন্যা দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়তেন, কামসিক্ত হতেন। কেবল রাবণই নয়, এর আগে বহু পুরুষ বেদবতীকে কামনা করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। কারণ বেদবতীর স্বামী একমাত্র বিষ্ণুই, দ্বিতীয় অন্য অন্য কেউ হতে পারে না। সীতার সঙ্গে বেদবতীর চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যটির খুব সাদৃশ্য। রাবণের আগে দৈত্যরাজ শম্ভ বেদবতীকে কামনা করে। দৈত্যরাজ শম্ভ সমুদ্র মন্থনকালে অসুরদের সঙ্গে দেবতারা বেইমানি করেছিলেন বলে দেবতাদের স্বর্গ শুধু নয়, মর্ত্য ও পাতালের অধিকার পেতে বদ্ধপরিকর। তো এহেন দৈত্য অরণ্যে পরিভ্রমণকালে বেদবতীকে দেখে কামাতুর হয়ে পড়লেন। বেদবতীকে কামনা করলেন পিতা কুশধ্বজের কাছে। প্রত্যাখ্যাত হলে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হলেন শম্ভু। অনিয়ন্ত্রিত হুঙ্কার ছাড়লেন শম্ভ। সেই হুঙ্কারে বেদবতীর পিতা ও মাতা উভয়রই মৃত্যু হয়। এরপর অনেক খুঁজেও বেদবতীকে পাননি। সেদিন পালিয়ে দৈত্যরাজ শম্বুর হাত থেকে রক্ষা পেলেও ভুবনবিজয়ী লঙ্কার রাজা রাবণের হাত থেকে নিজেকে আর রক্ষা করতে পারলেন না বেদবতী। রাবণ সরাসরি বেদবতীকে প্রস্তাব দিলে প্রত্যাখ্যাত হন। কামক্ষিপ্ত অপমানিত রাবণ বেদবতীর কেশরাশি ধরে টেনে আনলে বেদবতী কেশত্যাগ করেন। এরপর চারধারে আগুন জ্বালিয়ে বেদবতী স্বেচ্ছামৃত্যুবরণ করলেন। আত্মবিসর্জনের সময় রাবণকে বলে গেলেন–“তুই আমাকে যেভাবে অপমান করলি, তার শাস্তি তোকে পেতেই হবে।”

এখন প্রশ্ন–বেদবতীও লক্ষ্মী বা লক্ষ্মীর অবতার, বিষ্ণুর বাগদত্তা। সেই বেদবতীকে দৈত্যরাজ শম্ভ ও রাক্ষসরাজরাজ রাবণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারলেন না বিষ্ণু, এমনকি এদের বধ পর্যন্ত করতে পারলেন না। সেই রাবণকে বধ করতে বেদবতীকে সীতা হয়ে জন্মানোর প্রয়োজন কোথায়? কী এমন হল যেটা সীতার ক্ষেত্রে সম্ভব হল, অথচ বেদবতীর ক্ষেত্রে হল না! সীতাকে লাঞ্ছনা করার জন্য যদি রাবণকে বধ করা ন্যায্যত করা হয়, তাহলে এত যুদ্ধ-ফুদ্ধের কী প্রয়োজন! যুদ্ধ মানে তো উভয়পক্ষের অসংখ্য প্রাণের বিনাশ। যদি রাবণকে হত্যা করাই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে এত প্রাণের বিনাশ কেন! কেনই-বা বালীকে হত্যার মতো এমন জঘন্য কাজ করতে হবে? কেন বিভীষণকে ভ্রাতৃঘাতীতে পরিণত করতে হবে? কেন মেঘনাদ, কুম্ভকর্ণদের মতো বীরদের হত্যা করতে হবে? এঁরা তো সীতা বা অন্য কোনো নারীকে টেনে এনে অপমান করেননি! বিষ্ণুকে প্রতিষ্ঠা করতেই রাম-লক্ষ্মণ-ভরত-শত্রুঘ্নর কাঁধে বিষ্ণুকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস?

সীতাও লক্ষ্মী, সীতামাঈ। একথা কিন্তু মানতেই হবে, অগস্ত্যমুনির গল্প অনুসারে সীতা নয়, বেদবতীই রাবণের মৃত্যুর কারণ। তাই-বা বলি কী করে, তাহলে তো স্বৰ্গবেশ্যা পুঞ্জিকস্থলী ও রম্ভার অভিশাপবাণীর গল্পটির কোনো মানেই হয় না। প্রথমজনে হয়ে অভিশাপ দিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা, দ্বিতীয়জনের ক্ষেত্রে অভিশাপ দিলেন নলকুবর। অভিশাপটি ছিল এইরকম–রাবণ যদি জোর করে কোনো রমণীকে উপভোগ করে তাহলে সেই মুহূর্তে তাঁর মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। পুঞ্জিকস্থলী সীতাহরণের আগের কাহিনি, রম্ভা সীতাহরণের পরের কাহিনি। এর আগে-পরে-মাঝে রাবণ অসংখ্য নারীকে জোর করে ভোগ করেছেন বা ভোগ করার চেষ্টা করেছেন, তা সত্ত্বেও কিন্তু রাবণের মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যায়নি। অনিয়ন্ত্রিত কল্পনায় পাখা মেলা বোধহয় একেই বলে! তাহলে কী বুঝব বিষ্ণুর মাহাত্ম্য প্রচার করতেই এইসব ‘অপার্থিব’ গল্পের অবতারণা?

‘রামায়ণ’-এর কিছু অন্য এক রচনা থেকে জানা যায়, রাবণ সীতাকে হরণই করেননি। যাকে রাবণ হরণ করেছিলেন, সে নাকি মায়াসী। দেবী পার্বতী আসল সীতাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন এবং রাম-রাবণের যুদ্ধের পরে আসল সীতা প্রকট হন। মায়াসীতা নাকি পরে দ্রৌপদী হিসাবেও জন্মগ্রহণ করেন। তাহলে লক্ষ্মী থেকে বেদবতী, বেদবতী থেকে সীতা, সীতা থেকে দ্রৌপদী, দ্রৌপদী থেকে….। না, এরপর আর কোনো এমন মহাকাব্য লেখা হয়ে ওঠেনি, যাতে আর কোনো ধ্বংসের কারণ’ নারীর জন্ম নিতে পারে। এমনও হতে পারে, যেহেতু পৃথিবীতে আর কোনো রাবণ বা রাবণের মতো দুশ্চরিত্র’ পুরুষ জন্মায়নি, তাই এমন ‘অগ্নিকন্যা’রও জন্ম নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি।

রামায়ণ অনুসারে, সীতা পৃথিবীর কন্যা এবং জনকের পালিতা কন্যা। জনক কারোর নাম নয়, জনকপুর থেকে জনক–দেশের নাম। আধুনিক নেপালের দক্ষিণ সীমান্ত এবং পাটনার প্রায় চল্লিশ ক্রোশ উত্তর-পূর্বে জনকপুর অবস্থিত। মিথিলার রাজাদেরকে ‘জনক’ উপাধিতে সম্মানিত করা হত। সীতার পালিত পিতা জনকপুরার রাজার নাম সীরধ্বজ (ধর্মধ্বজ?)। কেউ বলেন জানকীকুণ্ড নামে একটি পুকুরের কাছে মিথিলেশ্বর সীতাকে পেয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন সীতামাড়ীর তিন মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে পনৌড়া গ্রামে ‘জনক’ সীরধ্বজ সীতাকে পেয়েছিলেন। রামায়ণে বর্ণিত আছে, ক্ষেত্ৰকৰ্ষণকালে জনকরাজা সীরধ্বজ লাঙ্গলের ফালে এক কন্যাশিশু পান। এই ক্ষেত্ৰকৰ্ষণকে বলে ‘লাঙ্গল-পদ্ধতি। লাঙ্গল-পদ্ধতির অন্য নাম ‘সীতা। সীতার জন্মসূত্রকে রহস্যাবৃত রেখে বলা হয়েছে যে সীতা ‘অযোনিজা’। মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ বলেছেন–

“ত্বষ্টা প্রজাপতিঃ স্বয়মেব সঙ্কল্পেন চকার, ন তু মৈথুনদ্বারা, অযোনিজাম্ ইত্যর্থ।

সীতা যে অযোনিজা, তার কোনো সমর্থন অন্য রামায়ণে মেলে না। এই মুহূর্তে মন্দোদরীর দুটো কাহিনি উল্লেখ করতে পারি। এক, মন্দোদরীর প্রথম সন্তান ছিল বিয়ের আগে। যাকে সে জঙ্গলে ফেলে এসে রাবণকে বিয়ে করে। দুই, রাবণকে বিয়ের পরেই সে প্রথম সন্তান। রাবণ আর মন্দোদরী দুইজনে পরামর্শ করে সেই সন্তানকে জঙ্গলে ফেলে আসে। সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘অদ্ভূত রামায়ণ’ গ্রন্থে এ বিষয়ে এক ব্যাপক গপ্পো আছে, সেটা একটু শোনাতে ইচ্ছে করছে–রাবণ ত্রিভুবন (স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল) জয় করে দণ্ডকারণ্যে (দাক্ষিণাত্যের পূর্বভাগ) অবস্থান করলেন। জয়ের দম্ভে এবার তাঁর মনে হল ঋষিদের পিছনে লাগলে কেমন হয়! এঁরা কেমন অগ্নিতেজী একটু চেখে দেখা যাক। যেই ভাবা সেই কাজ। না, তাঁদের হত্যা করার কথা ভাবলেন না, ঋষিদের শরীরে বাণের খোঁচা মেরে রক্তাক্ত করতে থাকলেন। শুধু রক্তাক্তই করলেন না, সেই রক্ত সংগ্রহ করে একটি কলসীতে ধারণ করলেন। কলসীটি কিন্তু পূর্বে ফাঁকা ছিল না, তাতে ছিল মন্ত্রপূত’ দুধ। এই মন্ত্রপূত দুধ সংগ্রহ করে রেখেছিলেন ঋষি গৃৎসমদ, ইনি শতপুত্রের পিতা। ইনি স্বয়ং লক্ষ্মীকে কন্যা হিসাবে পাওয়ার জন্যই সেই কলসীটিতেই প্রতিদিন মন্ত্রপূত দুধ সংগ্রহ করছিলেন, যেই কলসীটিতে রাবণ ঋষিদের রক্ত সংগ্রহ করছিলেন। যাই হোক, রাবণ তো এর দুধ মিশ্রিত রক্ত নিয়ে চলে এলেন লঙ্কায়। লঙ্কায় এসে রাবণ স্ত্রী মন্দোদরীকে পইপই করে বলে দিলেন–সাবধান গিন্নি, এই কলসীর ভিতর মুনিঋষিদের রক্ত আছে, যা বিষের থেকেও ভয়ংকর! এই বলে তিনি পর্বতে পর্বতে বেরিয়ে পড়লেন সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে কামকেলি করার জন্যে। এ ঘটনায় মন্দোদরীর খুব মনঃকষ্ট হল। দীর্ঘকাল যুদ্ধ করে ফেরার পর কোথায় তাঁর সঙ্গে আদর-সোহাগ করবে, সেখানে তাঁকে অবজ্ঞা করে অন্য মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি! কষ্ট সহ্য করতে না-পেরে তিনি নিজের জীবন শেষ করে দেবেন ভাবলেন। অতএব হাতে আছে এই বিষের চেয়ে ভয়ংকর রক্ত, যা পান করলেই এক লহমায় মৃত্যু। উঁহু, মৃত্যু তো হলই না, উল্টে রক্ত পান করে মন্দোদরী গর্ভবতী হয়ে গেলেন–পান করার মুহূর্তেই পূর্ণমাস। লজ্জায়-ঘৃণায় তিনি তীর্থদর্শনের বাহানা দিয়ে পথে বেরিয়ে পড়লেন। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন কুরুক্ষেত্রে, এখানেই তিনি গর্ভমুক্ত হলেন। কী করবেন তিনি এ সন্তান নিয়ে, অতএব ‘ফেক দে কাঁচড়া মে’। না, তিনি সদ্যোজাত সন্তানকে কাঁচড়াতে ফেলেননি, তিনি সেখানেই মাটি তে চাপা দিয়ে দিলেন সদ্যোজাতকে এবং কাছেই সরস্বতীর জলে স্নান সেরে শুদ্ধটি হয়ে বাড়ি ফিরলেন। মহারাজ জনক হলকর্ষণ করতে এসে তাঁর লাঙ্গলের উঠে এল একটি কন্যা সন্তান, নাম দিলেন সীতা।

পণ্ডিত নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী তাঁর ‘সীতা’ প্রবন্ধে লিখেছেন–

“ক্ষত্রিয় রাজা নিজে লাঙল হাতে কৃষিকার্য করছেন, এটা তৎকালীন সমাজে প্রায় অসম্ভব এক কল্পনা। বিশেষত খোদ রামায়ণের মধ্যেই যেখানে স্বধর্ম ত্যাগ করে শূদ্র শম্বুক ব্রাহ্মণোচিত তপস্যা করার জন্য শাস্তি লাভ করেন, সেখানে রাজর্ষি জনক ধর্মধ্বজ লাঙল দিয়ে জমির ফসলযোগ্যতা তৈরি করছেন, এটা খুব স্বাভাবিক কথা নয়, সমাজসংগত তো নয়ই সেকালের দিনের নিরিখে। জনক ধর্মধ্বজ এই ব্যবহারের মধ্যে যে একটা সামাজিক বৈপরীত্য আছে এবং সেটা যে আমরা ঠিক ধরেছি, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে পরম্পরাবাহী রামায়ণ-টীকাকারদের চেষ্টাকৃত সমাধান-কল্পনার মধ্যে। ওঁরা বলেছেন–না, না, জনক ধর্মধ্বজ সাধারণ কৃষকের মতো লাঙল দিয়ে জমি চাষ করছিলেন না, তিনি অগ্নিচয়নের জন্য যজ্ঞভূমি কর্ষণ করছিলেন। টীকাকারেরা শাস্ত্র উদ্ধার করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের কাছে যজ্ঞভূমির একটা অন্য মর্যাদা ছিল। যজ্ঞের জন্য যজ্ঞভূমি চাষ করাটা কোনো হেয় কাজ নয়, বিশেষত অগ্নিচয়নের জন্য এটা-ওটা শস্যেরও প্রয়োজন হত, অতএব তার জন্য একেবারে ছ-ছটা গোরু জুড়ে লাঙল হাতে চাষ করতে লজ্জা পেতেন না। ব্রাহ্মণেরা এবং রাজ-রাজড়ারাও। এখনকার পণ্ডিত গবেষকরা জানিয়েছেন যে, এই যজ্ঞভূমিতে লাঙল ছোঁয়ানোর ব্যাপারটা অনেকটাই প্রতীকী। কেননা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মতো উচ্চবর্ণের জাতকেরা জমি চাষ করার ব্যাপারটা খুব মর্যাদাসম্পন্ন মনে করতেন না। কিন্তু যজ্ঞভূমি বলে কথা, সেখানে যজ্ঞকর্মের মর্যাদায় একটু আধটু লাঙল ছুঁয়ে হলকর্ষণের আরম্ভটুকু করে দিলেই অধস্তন কৰ্ষক-চাষিরা লাঙল ধরে নিত। এত কথা বলছি। এই জন্য যে, সীতাকে জনক ধর্মধ্বজ নিজেই লাঙলের রেখাদীর্ণ ভূমিতে আবিষ্কার করেছিলেন, নাকি অন্য কেউ, নাকি তেমন কোনো কঠিন-হৃদয় মানুষ জনকের যজ্ঞভূমিতে রেখে গিয়েছিল এক শিশুকন্যাকে, সেই সন্দেহটা বড়ো প্রবল হয়ে ওঠে। অলৌকিকতায় বিশ্বাস করলে ঠিক আছে–তাহলে তো জনক ধর্মধ্বজের যজ্ঞভূমির মাটির তলায় এক শিশুকন্যা নিশ্বাসান্ধ অবস্থায় পড়ে ছিলেন, আর লাঙলের ফলায় নিচের মাটি উপরে উঠতেই পুরাতন প্রত্নমূর্তির মতো ভূমিকন্যা সীতা উঠে এলেন উপরে। ধর্মধ্বজ তাঁকে কোলে করে নিয়ে রানির কোলে দিলেন। ব্যস! নটে গাছ মুড়িয়ে গেল। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ নয় বলেই এবং তেমন বিশ্বাসযোগ্য নয় বলেই হয়তো সীতার জন্ম নিয়ে এত গল্প, এত রহস্য তৈরি হয়েছে। রহস্য তৈরি হওয়ার মূল কারণ অবশ্যই এই যে, সীতা ধর্মধ্বজ জনকের নিজের মেয়ে নন।”

কাহিনিগুলি থেকে জানা যায়, সেই জঙ্গলে বা জলে বা জমিতে পরিত্যাগ করা সন্তানটি ছিল কন্যা। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে। আজও কন্যাসন্তান জঙ্গলে-আস্তাকুড়ে-ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে যায় স্বয়ং মা, কিংবা বাবা কিংবা মা-বাবা উভয়ই। পরিত্যক্ত কন্যাসন্তান যত্রতত্র কুড়িয়ে পাওয়া যায়–বর্তমানেও এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, অতীতেও ছিল না। কার্তিক, শকুন্তলা, কৃপ, কৃপীর মতো অজস্র ‘নাজায়েজ’ সন্তান কুড়িয়ে পাওয়ার ঘটনা আমরা জানি।

নারী-পুরুষের যৌনমিলন (শুক্রাণু ও ডিম্বাণু) ছাড়া কখনোই সন্তান উৎপাদন সম্ভব নয়। অতীতেও হয়নি, বর্তমানেও হয় না, ভবিষ্যতেও হবে না। যিনি জন্মেছেন তিনি অবশ্যই নারী-পুরুষের যৌনমিলনের ফলেই জন্মেছেন। তা বৈধ পথেই হোক বা অবৈধ পথে? ‘অযোনিস্যুতা’ একটি মিথ্যাচারের নাম, সত্য লুকোনোর পথ। এখনও অনেককে বলতে শুনি অমুক ঠাকুরবাড়ির কলা-পড়া খেয়ে নাকি অমুক গর্ভবতী হয়েছে। আরে ভাই, কলা-পড়া খেয়েই যদি গর্ভবতী হওয়া যায়, তাহলে যৌনমিলনের আর প্রয়োজন কী! পটাপট কলা খেয়ে নিলেই তো হয়। কত নিঃসন্তান দম্পতি একটি সন্তানের জন্য কত কীই-না করে বেড়ান, ধরে ধরে কলা খাইয়ে দিলেই তো হয়!

‘লাঙ্গল’ কথাটি এখানে গভীর দ্যোতনাবাহী। কেননা সংস্কৃতে ‘লাঙ্গল’ শব্দটি একদিকে যেমন ভূমিকৰ্ষণের যান্ত্রিক রূপ, তেমনই তা পুরুষের লিঙ্গকেও বোঝায়। লাঙ্গল’ শব্দটি প্রতীকী অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। ফুলের মতো কমনীয় ও গৌরবর্ণা হওয়ার কারণেই জনকদুহিতার নাম সিতা’। অভিধানকার বামন শিবরাম আপ্তের অভিধানে ‘সি’ শব্দের অর্থ মনোরমা স্ত্রী (a graceful woman) বলা হয়েছে। সত্যকে আড়াল করে সীতার জন্মকে গূঢ় রহস্যাবৃত করা হয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই। কারণ রামচন্দ্র যখন ভগবান, ভগবান নারায়ণের অংশ তখন তাঁর স্ত্রী কুড়িয়ে পাওয়া, অজ্ঞাত পরিচয়, অতি সাধারণ, এটা হজম করা যায় কীভাবে! সুতরাং ‘অযোনিজ’ কল্পনা জারিয়ে নিজের বক্তব্যকে ‘সত্যগন্ধী করে তুলতেই ‘সি’ রূপান্তরে সীতা’য় বদলে যায়। জনকরাজা সীরধ্বজ নিজের মুখেই সে কথা বলছেন। বলছেন বরকর্তা বিশ্বামিত্রকে–“বীর্যশুক্লেতি মে কন্যা স্থাপিতেয়মযোনিজা।/ভূতিলাদুখিতাং তান্তু বর্ধমানাং মমাত্মজাম্।”

সীতার জন্মেতিহাস বাল্মীকি রামায়ণে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সেটির খোঁজ করতে হবে পরবর্তী পুরাণগুলিতে। কারণ দেবতার ভাবমূর্তিকে রক্ষার জন্য সীতার লক্ষ্মীস্বরূপী একটি মূর্তি গড়া হয়েছে সেখানেই। যেমন স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে–

“পুরা ত্রেতাযুগে পুণ্যে রাবণং হতবানহম্।

তদা বেদবতী কন্যা সাহায্যমকররাচ্ছিয়ঃ।

সীতারূপাভবল্লক্ষ্মীর্জনকস্য মহীতলাৎ।”

একসময় রাক্ষসদের হত্যা করার জন্য বিশ্বামিত্র ঋষির রামকে মনে পড়ল। অভিযোগ, রাক্ষসদের উপদ্রবে তাঁরা যজ্ঞ সম্পাদন করতে পারছিলেন না। হত্যাকার্য সম্পাদনের জন্য ঋষি বিশ্বামিত্র দশরথের কাছ থেকে রামকে ১০ দিনের জন্য চাইলেন। রামের বয়স তখন মাত্র ১৫। দশরথ শঙ্কিত হলেন, বললেন–

“উনষোড়শবর্ষো মে রামমা রাজীবলোচনঃ।

ন যুদ্ধযোগ্যতামস্য পশ্যামি সহ রাক্ষসৈঃ।”

দশরথের একথা শুনে বিশ্বামিত্র ক্রোধে জ্বলে উঠল। এতটাই সেই ক্রোধ যে, পৃথিবী কম্পিত হল, দেবতারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। অবশেষে দশরথ বিশ্বামিত্রের হাতে রামকে সঁপে দিলেন। কৃত্তিবাস অবশ্য রাম-লক্ষ্মণকে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে ভয়ংকর সব রাক্ষসবধ করতে পাঠাননি, পাঠিয়েছেন ভরত-শত্রুঘ্নকে। অর্থাৎ গিনিপিগ হওয়ার জন্য ভরত-শত্রুঘ্নই আদর্শ। অর্থাৎ ভরত-শত্রুঘ্নদের চেয়ে রাম-লক্ষ্মণের জীবনের দাম অনেক গুণ বেশি। এই ভাবনা বাল্মীকির সঙ্গে কৃত্তিবাসের খুব মিলে যায়।

যাই হোক, নয়দিন ব্যাপী কয়েকশো রাক্ষস-খোক্ষস হত্যা করে দশম দিনে মিথিলায় উপস্থিত হলেন এবং এগারোতম দিনে সীতাকে স্ত্রী হিসাবে লাভ করেন। রামায়ণের আদি কাণ্ডের ৬৬ তম সর্গে জানা যায়, বিবাহের পূর্বেই সীতা যৌবনাসম্পন্নাই ছিলেন। এমনকি বিবাহের বয়সের থেকে আরও দুই বছর অতিক্রান্ত হয়েছিল। মহাভারতের আদিপর্বের ৬৪ অধ্যায়ে উল্লেখ আছে, সে সময় যৌবনাবস্থায় পদার্পণ না করলে কেউ বিয়ে করত না। বিয়ের সময়ে সীতার বয়স যখন ১৮ ছিল, তখন রামের বয়স ১৫। অর্থাৎ রামের চাইতে সীতা ৩ বছরের বড়ো। সীতার বিয়ের পর ইক্ষ্বাকু বংশে ১২ বছর সংসার করার পর রামের সঙ্গে ১৪ বছর বনবাস যাপন। অরণ্যকাণ্ডে ৪৭ তম সর্গে সীতা রাবণকে বলছেন–

“উষিত্বা দ্বাদশ সমা ইক্ষ্বাকুণাং নিবেশনে।

ভুঞ্জানা মানুষ ভোগা সর্বকামসমৃদ্ধিনী।”

রামায়ণে রাম ও সীতার বয়স নিয়ে বিস্তর গোলমেলে ব্যাপার আছে। অনেক বলেন রাম যখন সীতার পাণিগ্রহণ করেন তখন তাঁর বয়স ছিল ১৩ বছর, আর সীতার বয়স ৬। কোনটি গ্রহণীয়, কোনটি বর্জনীয় তা পণ্ডিতগণ ভাবুন–আমি সেই জটিলতায় যেতে চাই না। তবে এটুকু বলতে চাই–৬ বছর বয়সি একটি মেয়েকে স্ত্রী হিসাবে পাওয়ার জন্য পরাক্রমশালী রাজরাজড়ারা দেশ-দেশান্তর থেকে মিথিলায় জমায়েত হয়েছেন, একথা বিশ্বাসযোগ্য হয় কি? এ যুগে নিশ্চয় বিশ্বাসযোগ্য নয়, অতি প্রাচীন এমন ঘটনা তো আকছারই ঘটত। সমাজে যখন গৌরীদানে অক্ষয় স্বর্গপ্রাপ্তি এবং কন্যার একাদশ বয়সে না-হলে মাতা-পিতা এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নরকে যাওয়ার বন্দোবস্ত হয়ে যায়, এমন প্রথার প্রচলন আছে। অপরাপর পুরাণ গ্রন্থগুলিতে সীতার বয়স কখনো ৬, কখনো ৮ বছর লিপিবদ্ধ হয়েছে।

বিবাহের সময় সীতার স্তন কেমন পুষ্ট হয়েছিল সেটাও উল্লেখ করেছেন মুনিবর বাল্মীকি–“স্তনৌ চাবিরলৌ পীনৌ মগ্নচুচুকৌ”। এহেন স্তন কখনোই ছয় বছর বয়সে হতে পারে না। লঙ্কাকাণ্ডে ৪৮ তম সর্গে সীতার নিজের মুখে তাঁর শরীর ও উদ্ভিন্ন যৌবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন, বলেছেন–

“আমার কেশসকল সূক্ষ্ম, সমান নীলাবর্ণ। জ্বজোড়া পরস্পর অসংশ্লিষ্ট। জঙ্ঘাদ্বয় সুগোল এবং লোমহীন। দন্ত সকল বিরল। কটাক্ষ, চোখ, হাতজোড়া, পাজোড়া, গোড়ালি, উরুদ্বয় পরস্পর সংযুক্ত। আমার সবকটি আঙ্গুলের মধ্যভাগ হল অক্ষ ও আনুভূমিক, বর্তুলনখশোভিত। আমার স্তনজোড়া পরস্পর অসংসক্ত পীন ও উন্নত এবং স্তনের বোঁটা দুটি মধ্যনিমগ্ন। অধিকন্তু আমার স্তন নিকটবর্তী পার্শ্বদেশ ও বক্ষঃস্থল বিশাল, নাভিপার্শ্ব উন্নত ও সুগভীর।”

অপ্রাসঙ্গিক হলেও জেনে রাখা যায়–আদিকাণ্ডে রামের জীবনের ১৫/১৬ বছরের কথা, অযোধ্যা কাণ্ডে রামের জীবনের অনুমান ১ সপ্তাহের কথা, কিকিন্ধ্যাকাণ্ডে অনুমান ১০ মাস, সুন্দরকাণ্ডে মাসাধিক কাল এবং লঙ্কাকাণ্ডে মাসাধিক সময়ের কথা বর্ণিত হয়েছে।

রামচন্দ্র চোদ্দো বছরের জন্য বনবাসে গেলে সীতা তাঁর সঙ্গী হন। মনে রাখতে হবে, কেবলমাত্র রামকেই চোদ্দো বছরের জন্য বনবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সীতা ও লক্ষ্মণ স্বেচ্ছায় রামের সঙ্গে বনবাসে গিয়েছিলেন। লক্ষ্মণ তো রামের সঙ্গী হবেনই, এটা লক্ষ্মণের কর্তব্য। নতুন কিছু ব্যাপার নয়। কিন্তু সীতা কেন রামের সঙ্গী হলেন? সীতা রামের পিছু নিলে, রাম সীতাকে জঙ্গলের বিপদের কথা বর্ণনা করেছিলেন। বলেছিলেন–বন নয়, অযোধ্যায় অবস্থান করে শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করে জীবন কাটিয়ে দাও। রাজা ভরতের অনুবর্তিনী হয়ে থাকো। একথার উত্তরে সীতা রামকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন–

“ন পিতা নাত্মজো নাত্মা ন মাতা ন সখীজনঃ … কিমিদং ভাষষে রাম বাক্যাং লঘুতয়া ধ্রুবম্। .. স্ক্রিয়ং পুরুষবিগ্রহ। … শৈলুষ ইব মাং রাম পরেভ্যো দাতুমিচ্ছসি। … ত্বং তস্য ভব বশ্যশ্চ বিধেয়শ্চ সদানঘ।”

এ থেকে প্রমাণ হয় সীতা মিনমিনে মুখচোরা ছিলেন না, রীতিমতো মুখরাই ছিলেন। স্পষ্ট কথা স্পষ্ট করে বলে দিতেন সীতা। একথা যেমন রামের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি রাবণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রাম কিংবা রাবণ–কারোকেই তিনি ছেড়ে কথা বলেননি।

নিয়ম অনুসারে বনে বাসের জন্য রাজপপাশাক ত্যাগ করে মুনি-পরিধেয় চীর ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ গাছের ছাল পরে থাকতে হবে। সীতার ঘোরতর আপত্তি থাকলেও লক্ষ্মণ রামের অনুসরণে বিধিসম্মতভাবেই চীরবসন ধারণ করেন। এবং এই চীরবসন দশরথের সামনেই গ্রহণ করেন। কিন্তু কৌশেয়-সীতা চীরবসন দেখে আঁতকে উঠলেন। ভীত হয়ে পড়লেন। এই এক চিলতে গাছের ছালে একজন উদ্ভিন্নযৌবনা নারীর লজ্জা নিবারণ হবে কীভাবে! বাষ্পপূর্ণ চোখে স্বামী রামের কাছে তাঁর কৌতূহল প্রকাশ করলেন–বনবাসীরা কীভাবে এই বসন পরিধান করেন? রাম স্বয়ং সীতার অঙ্গে কৌশেয় বসনের উপরেই চীরবসন বন্ধনের চেষ্টা করতে থাকেন। এ দৃশ্য দেখে কুলগুরু বশিষ্ঠ বললেন “যেহেতু সীতা এই বনবাসে নিযুক্ত হননি, তাই তাঁর চীরবসনও অনাবশ্যক।” ব্রাহ্মণ যা বলেন, তাই-ই বিধান (আইন)। অতএব চীরসনকে সরিয়ে দিয়ে উত্তম আভরণ ও বসন পরিধানের ব্যবস্থা করে দিলেন। বনবাস যাত্রায় সীতা অলংকারে সেজে উঠুক, সেটা স্বয়ং দশরথই অনুমোদন করেছিলেন। স্বয়ং দশরথই কোষাধ্যক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন–

“বাসাংসি চ বরাহণি ভূষণানি মহান্তি চ।

বর্ষাণ্যেতানি সংখ্যায় বৈদেহ্যাঃ ক্ষিপ্রমানয়।

নরেন্দ্রেণৈবমুক্তস্তু গত্বা কোশগৃহং ততঃ।

প্রাযচ্ছৎ সর্বহৃত্য সীতায়ৈ ক্ষিপ্রমেব তৎ।

সা সুজাতা সুজাতানি বৈদেহী প্রস্থিতা বনম্।

ভূষয়ামাস গাত্রাণি তৈর্বিচিত্রৈবিভূষণৈঃ।

ব্যরাজয়ত বৈদেহী বেশ্ম তৎ সুবিভূষিতা।

উদ্যতোহংশুমতঃ কালে খংপ্রভেব বিবস্বতঃ।”

কোশাধ্যক্ষ নরেন্দ্র দশরথ কর্তৃক মহামূল্য বসন ও উৎকৃষ্ট ভূষণ আনার ব্যবস্থা করা হল এবং মহামূল্যবান অলংকারে সেজে উঠলেন সীতা। অযোধ্যাকাণ্ডের ৩৯ তম সর্গ পাঠ করে দেখতে পারেন। রামের সহধর্মিনী সীতাদেবী রাজবধূর বেশবিন্যাস ত্যাগ করে রাম-লক্ষ্মণের মতো গাছেল ছাল পরিধান করেছিলেন, এমন কথা মহাকবি বাল্মীকি কোথাও বলেননি। পতিব্রতার সংজ্ঞা বদলে নাকি!

রাবণ সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার সময় এই অলংকারগুলো ছড়ানোর কাজে লাগিয়েছিল, যা দেখে রাম-লক্ষ্মণ বিপদের আন্দাজ করতে পেরেছিল। সোনার অলংকারের চেয়ে নিজের প্রাণ ও মান উভয়ই দামি। বলাই বাহুল্য, এই সীতাকে অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করেই রাম ও রাবণের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত হয়। তাঁকে উদ্ধার করতেই রাম, লক্ষ্মণ, সুগ্রীব, হনুমানের যারপরনাই উদ্যোগ সহ বিশাল বাহিনী লংকা আক্রমণ ও লঙ্কা ধ্বংস করে। সীতাকে উদ্ধারের পরেও স্বয়ং রাম লঙ্কাতেই সীতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সীতার চরিত্রের পবিত্রতা প্রমাণের জন্য রাম অগ্নিপরীক্ষার আয়োজন করেন। অগ্নিপরীক্ষার অংশ হিসাবে সীতাকে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করতে হয়। সীতা ‘সতীসাধ্বী’ হলে আগুন তাঁর কোনো ক্ষতি করবে না, এটাই প্রমাণ করানোর চেষ্টা। অপমানের পর অপমানিত হয়েছেন সীতা। লক্ষ্মণ এবং বাইরের লোক বিভীষণ, সুগ্রীব, হনুমান, জাম্ববান ও বানরদের সামনেই সীতা অপমানিত হলেন স্বামী রামের দ্বারা, যাচ্ছেতাইভাবে মাথা নিচু হয়ে গেল সীতার। উপস্থিত অসংখ্য অনার্যদের সামনে আর্যভার্যার এই অপমান কারোর জন্যই সহনীয় হতে পারে না। সীতা আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করতে চাইলেন। ভাবলেশহীন রাম সীতার সেই ইচ্ছাকে অনুমোদন দিলেন, সীতা লক্ষ্মণকে চিতা সাজানোর আদেশ দিলেন। জ্বলন্ত চিতায় সীতা প্রবেশ করলেন, কিন্তু তিনি দগ্ধ হলেন না। অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে সীতার চরিত্রের পবিত্রতা প্রমাণ হলে রামচন্দ্র সীতাকে অযোধ্যায় নিয়ে যান। অগ্নিপরীক্ষা প্রসঙ্গে পণ্ডিত হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য–

“প্রকৃত প্রস্তাবে যা ঘটেছিল তা অনেকটা এইরকম বলে অনুমান করা যায় : রামচন্দ্র চিতা প্রস্তুতের আজ্ঞা দিলে লক্ষ্মণ ও অন্যান্যরা রুষ্ট হয়েছিলেন। তারা সরাসরি রামের ইচ্ছায় বাধা দিতে পারেননি বটে, কিন্তু সুকৌশলে মৃত্যুর হাত থেকে সীতাকে রক্ষা করেছিলেন। রাক্ষসেরা জাদুবিদ্যায় পারদর্শী ছিল। মায়া সীতা, মায়া রামের কাহিনি রামায়ণের যুদ্ধকাণ্ডে এইভাবে উল্লিখিত আছে : রাবণের আহ্বানে বিদ্যুৎজ্জিত্ব রামের মায়ামুণ্ড, শরাসন সীতার সামনে নিক্ষেপ করেছিল। সীতা রামের ছিন্নমুণ্ড ও ধনুক স্বচক্ষে দেখলেন।…সীতা এই মায়ামূর্তিকে রামচন্দ্র বলে বিশ্বাস করেছিলেন। রাক্ষসরা এই মায়ামূর্তি নির্মাণে এমনই পারদর্শী ছিল যে, ওই মায়ামুণ্ড রামের নয়–সীতার পক্ষেও বোঝা সম্ভব হয়নি। শুধু তাই নয়, রথের উপর ইন্দ্রজিৎ সমস্ত বানরসৈনদের সামনে মায়াসীতা বধ করেছিলেন। হনুমান খুব ভালোভাবেই সীতাকে চিনতেন। তা সত্ত্বেও প্রবল সাদৃশ্যের জন্য তিনি এই মায়াসীতা’কে প্রকৃত সীতা বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু রাক্ষস বিভীষণ বিভ্রান্ত হননি। প্রকৃত ব্যাপার তার অজানা ছিল না। … রাক্ষসরা মায়ামূর্তি নির্মাণে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এই পটভূমিকায় ধরে নেওয়া বোধহয় অসংগত হবে না, সীতার অগ্নিপ্রবেশের ব্যাপারটি সাজানো এবং সে ব্যাপারে রাক্ষসরাজ বিভীষণ অগ্রণীর ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁরই নির্দেশে সীতার পরিবর্তে রাক্ষস-নির্মিত আর-একটি ‘মায়াসীতাকে চিতায় প্রবেশ করানো হয়েছিল।”

পূর্বেই বিভীষণ অনুমান করে নিতে পেরেছিলেন পরপুরুষের কাছে থাকা স্ত্রী সীতাকে স্বামী হিসাবে রাম কী চোখে দেখবেন। রাম যে সীতার ঘৃণার চোখে দেখবেন সেটা অনুমান করেই বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভেবে রেখেছিলেন বিভীষণ।

কিন্তু পরবর্তীতে আবারও সীতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্ন ওঠে অযোধ্যায় পৌঁছোনোর পর। রামচন্দ্রের কাহিনিকারের মতে চোদ্দো বছর বনবাসান্তে রামচন্দ্র দেশে প্রত্যাবর্তন করে নির্বিঘ্নে সংসারধর্ম তথা রাজ্যশাসন করেছিলেন দীর্ঘ ২৭ (?) বছর। অতঃপর প্রজাবিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। কেননা লঙ্কার অশোককাননে বন্দিনী থাকাকালীন রাবণ সীতাদেবীর অঙ্গ স্পর্শ করে সতীত্ব নষ্ট করেছিলেন এবং অসতী সীতাকে গৃহে স্থান দেওয়ায় প্রজাগণ ছিল অসন্তুষ্ট। উপরোক্ত বিবরণটি শুনে স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্নের উদয় হয় যে, মরার দু-যুগের পরে শোকের কান্না কেন? বনবাসান্তে রামচন্দ্র স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে তাঁর বনবাসের বিবরণ তথা লঙ্কাকাণ্ড দেশময় ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর দেশে ফেরার সংগে সঙ্গেই এবং সীতাকলঙ্কের কানাকানিও চলছিল দেশময় তখন থেকেই। আর গুজবের ভিত্তিতে সীতাকে নির্বাসিত করতে হলে তা করা তখনই ছিল সংগত। তাহলে দীর্ঘ ২৭ বছর পর কেন? তারাকান্ত কাব্যতীর্থকৃত মূল বাল্মীকি রামায়ণের বঙ্গানুবাদে বলা আছে রাম বহুবছর সীতার সঙ্গে বিহার করে ও রাজ্যপালন করে কাটালেন। ২৭ বছর করেছিলেন তা কিন্তু বলা নেই। যাই হোক, রাম সীতাকে আবারও বনবাসে পাঠান এবং কোনোরূপ বিবেচনা না-করেই (“তস্মাত্ত্বং গচ্ছ সৌমিত্রে নাত্ৰ কাৰ্য্যা বিচারণা।/অপ্রীতিৰ্হি পরা মহং ত্বয়ৈতৎ প্রতিবারিতে।”)। রামের আদেশানুসারে লক্ষ্মণ পরদিনই ভোরে নৌকোযোগে তমসা নদীর তীরে বাল্মীকির আশ্রমে পরিত্যাগ করে আসেন। ফেরার সময় লক্ষ্মণের উদ্দেশ্যে সীতা তাঁর অপমানের কথা গোপন রাখেননি, বুক-ফাটা যন্ত্রণা নিয়ে তিনি বলেছেন–“লক্ষ্মণ! আমার গর্ভে সন্তান বড়ো হচ্ছে, এক্ষণে প্রাণত্যাগ করলে আমার স্বামীর বংশলোপ হবে। তা না-হলে আজই জাহ্নবীর জলে প্রাণ বিসর্জন করতাম (“ন খন্বদ্যৈব সৌমিত্রে জীবিতং জাহ্নবীজলে।ত্যজেয়ং রাজবংশস্তু ভর্তুর্মে পরিহাস্যতে।”)। নারীর এই মর্মভেদী যন্ত্রণা এই অপমান রামভক্তদের হৃদয়ে পৌঁছোয় না। প্রাণত্যাগ, অর্থাৎ আত্মহত্যার ইচ্ছা আরও-একবার প্রকাশ করেছেন সীতা, উত্তরকাণ্ডে–“চিতাং মে কুরু সৌমিত্রে ব্যসনস্যাম্য ভেষজম্।/মিথ্যাপবাদোপহতা নাহং জীবিতুমুৎসহে।/অপ্রীতেন গুণৈর্ভর্তা ত্যক্তায়া জনসংসদি।/যা ক্ষমা মে গতির্গন্তুং প্রবেক্ষ্যে হব্যবাহন।” (সৌমিত্রে! এমন মিথ্যাপবাদগ্ৰস্তা হয়ে আমি আর প্রাণধারণ করতে ইচ্ছা করি না। এখনই চিতাই আমার এই ঘোরতর বিপদকালের একমাত্র ওষুধ। অতএব তুমি চিতা প্রস্তুত করো। স্বামী আমার গুণে অসন্তুষ্ট হয়ে জনগণের মধ্যেই আমাকে পরিত্যাগ করলেন। সুতরাং আমি এখনই আগুনে প্রবেশ করে আমার কর্মানুরূপ গতি লাভ করতে প্রস্তুত।) লক্ষ করুন পাঠক, সীতাদেবী দু-বার প্রাণত্যাগ ইচ্ছা পোষণ করেছেন, দু-বারই দেবর লক্ষ্মণের কাছে–স্বামী রামের কাছে নয়।

স্বামী রামের চোখে সীতা কেমন ছিল? কার হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন সীতা? দেখুন কয়েকটা নমুনা–মেঘনাদের শক্তিশেল খেয়ে লক্ষ্মণ যখন অজ্ঞান হয়ে ভূলুণ্ঠিত হলেন, তখন রাম বিলাপ করতে থাকলেন–

“প্রাণ পেয়ে সীতা পেরে কী লাভ আমার? মর্তলোকে খুঁজলে সীতার মতো নারী আরও পাওয়া যাবে। কিন্তু লক্ষ্মণের মত সচিব ও যোদ্ধা ভাতা কোথাও পাওয়া যাবে না।”

এখানেই শেষ নয়, রাম আরও বলেন–

“দেশে দেশে স্ত্রী পাওয়া যায়, বন্ধুও পাওয়া যায়, কিন্তু তেমন দেশ মেলে না যেখানে সহোদর ভাই পাওয়া যায়।… তুমি যখন মৃত্যুমুখে পতিত তখন আমার জীবন নিরর্থক, সীতা বা বিজয়লাভ করাও নিরর্থক।”

এইখানেই শেষ নয়, “বললে আমি খুশি হয়েই ভাই ভরতের জন্য সীতা, রাজ্য, প্রাণও দিতে পারতাম।” স্ত্রীকে ত্যাগ করাই নয়, স্বামী হিসাবে রাম স্ত্রী সীতাকে ভাই ভরতের ভোগ্য পর্যন্ত করতে পারেন। সীতা তো কোনো ব্যক্তি নন, নিরেট মাংসপিণ্ডমাত্র। অথচ ভাবুন তো, যে স্বামী (রাম) স্ত্রীকে (সীতা) ভাইয়ের (ভরত) হাতে তুলে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। যে স্ত্রী বলেন–

“তোমাকে বাদ দিয়ে আমার স্বর্গে বাস করতেও অভিরুচি নেই। তোমার বিরহে আমি এখানে প্রাণত্যাগ করব।”

এহেন পতিব্রতা স্বামী-সোহাগিনী নারীকে মন্দোদরী, তারা, কুন্তীদের (“অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা/পঞ্চকন্যা স্মরে নিত্যং মহাপাতক নাশনম্৷”) মতো এক কাতারে প্রাতঃস্মরণীয় করেননি সমাজপতিরা। সীতা সেই স্ত্রী, যাঁকে লঙ্কাধিপতি রাবণ বিবাহের প্রস্তাব দিলে তিনি স্বামীর প্রতি অগাধ আস্থা জ্ঞাপন করে রাবণকে চরম দৃঢ়তায় বলেন–

“তুমি শৃগাল হয়ে সিংহীকে পেতে চাইছ? কাল সাপের মুখে হাত দিয়ে তার বিষদাঁত উপড়াতে চাইছে। কালকূট বিষপান করে স্বস্তিতে থাকতে চাইছ? সূচী দিয়ে চক্ষুভেদ করতে বা জিহ্বা দিয়ে ক্ষুরলেহন করতে চাইছ? রাঘবের প্রিয়াকে তুমি পেতে চাইছ? কণ্ঠে শিলাখণ্ড বেঁধে সমুদ্র উত্তরণ করতে চাইছ? দুই হাত দিয়ে চন্দ্র সূর্য ধরতে চাইছ? তুমি রামের প্রিয়া বধূকে ধর্ষণ করতে চাইছ? জ্বলন্ত অগ্নিকে কাপড় দিয়ে আহরণ করতে চাইছ, তাই রামের কল্যাণী বধূকে হরণ করতে চাইছ? লৌহমুখ শূলের সামনে বিচরণ করতে চাও, তাই রামের অনুরূপ বধূকে পেতে চাইছ? বনে সিংহ ও শিয়ালের যে পার্থক্য, ছোটো খাল ও সমুদ্রের যে পার্থক্য, শ্রেষ্ঠ বীর ও কাপুরুষের যে পার্থক্য, হাতি ও বিড়ালের যে পার্থক্য, গোরুড় ও সাপের যে পার্থক্য, পানকৌড়ি ও ময়ূরের যে পার্থক্য, হাঁস ও শকুনের যে পার্থক্য–দাশরথি রামের সঙ্গে তোমারও সেই পার্থক্য।”

যদন্তরং সিংহশৃগালয়োর্বনে..যদন্তরং কাঞ্চনসীসলোহয়োঃ…যদন্তরং বায়সবৈনতেয়য়োঃ..

তবুও সীতা অপমানিত হয়েছেন নিজের প্রাণাধিক স্বামীর কাছে।

যুদ্ধশেষে স্বামী-স্ত্রীর প্রথম সাক্ষাতে দীর্ঘ অদর্শনে সীতার প্রতি রামের প্রেম বিলীন হয়ে গিয়েছিল। সীতাকে লঙ্কাপুরীর বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন বটে, কিন্তু রাম সেইসঙ্গে একথাটাও সীতাকে জানাতে ভোলেনি যে–

“যুদ্ধ তাঁর জন্য হয়নি। যুদ্ধে শত্রুকে জয় করেছি। তোমাকেও মুক্ত করেছি। আমার পৌরুষ দিয়ে যা করার আমি তা সব করেছি। বৈরীভাবের এক্কেবারে শেষপ্রান্তে পৌঁছেছি, ধর্ষণ প্রমার্জনা করেছি। শত্রু এবং অপমান একসঙ্গে খতম করেছি। আজ আমার পৌরুষ প্রকাশিত হয়েছে, আজ আমার শ্রম সফল হয়েছে। প্রতিজ্ঞা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছি এবং নিজের প্রভূত্ব ফিরে পেয়েছি।”

‘আদর্শ স্বামী রাম আরও বলেন–

“তোমার কুশল হোক। জেনে রাখো, এই যে যুদ্ধের পরিশ্রম, বন্ধুদের বীরত্বের সাহায্যে যা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছি, তা তোমার জন্যে নয়। আমার চরিত্র মর্যাদা রক্ষা করার জন্যে এবং প্রখ্যাত আত্মবংশের কলঙ্ক মোচন করার জন্যেই তা করেছি। তোমার চরিত্র সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে। আমার সামনে তুমি আছ, চক্ষুপীড়াগ্রস্তের সামনে প্রদীপ যেমন পীড়াদায়ক হয় তেমনই। তাই জনকাত্মজা, এই দশদিক পড়ে আছে, যেখানে ইচ্ছা তুমি চলে যাও, আমি অনুমতি দিলাম–তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই। কোন্ সদ্বংশজাত তেজস্বী পুরুষ বন্ধুত্বের লোভে পরগৃহবাস করেছে যে, স্ত্রী, তাকে ফিরিয়ে নেবে? রাবণের কোলে বসে পরিক্লিষ্ট, তার দুষ্ট দৃষ্টিতে দৃষ্টা তুমি, তোমাকে গ্রহণ করে আমি আমার উজ্জ্বল বংশের গৌরব নষ্ট করব? যেজন্য যুদ্ধ করেছি তা পেয়েছি, তোমার প্রতি আমার কোনো অভিলাষ নেই, যেখানে খুশি চলে যাও তুমি। আমি তোমাকে বলছি লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সুগ্রীব বা বিভীষণ এদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করে নাও।”

অথচ এ তো সেই সীতা, যিনি বনবাসের প্রাক্কালে শাশুড়িমাতা কৌশল্যাকে বলেছিলেন–

“নাতন্ত্রী বাদ্যতে বীণা নাচক্রো বিদ্যতে রথঃ।নাপতিঃ সুখমেধতে যা স্যাপি শতাত্মজা৷৷”

অর্থাৎ, তন্ত্রীহীন বীণা বাজে না, চক্ৰহীন রথ হয় না। পতিহীনা নারী শতপুত্রের জননী হলেও সুখ পায় না।

রামের মতো সূক্ষ্ম ধর্মবুদ্ধিযুক্ত ব্যক্তি পরহস্তগতা নারীকে মুহূর্তের জন্যে হলেও কী করে গ্রহণ করবেন! সীতা দুশ্চরিত্র হোন বা না-হোন, সচ্চরিত্র হোন বা না-হোন–তাঁকে ‘ভোগ’ করা রামের পক্ষে অসম্ভব। কুকুরে চাটা ঘি’ যেমন কোনো পুজোয় লাগে না–পরহস্তগত স্ত্রী তথা নারীও তেমন স্বামীর অঙ্কশায়িনী হতে পারে না। রাবণ সীতাকে স্পর্শ করেছিল কি না তা জেনে নেওয়ার প্রয়োজন নেই, রাবণ সীতাকে বলাৎকার করেছিল কি না সেটাও জানার প্রয়োজন নেই। সতীত্ব নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠেছে, তখন ত্যাগই একমাত্র সমাধানের পথ। কারণ সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় ফেরার পর প্রজারা রামচন্দ্রকে বলেছে–

“কীদৃশং হৃদয়ে তব সীতাসম্ভোগজং সুখ।

অঙ্কমারোপ্য তু পুরা রাবণেন বলাক্বতাম্।”

অর্থাৎ “রাবণ যাকে অঙ্কে আরোপণ করে সবলে হরণ করেছিল, সেই সীতার সম্ভোগে তোমার হৃদয়ে কেমন সুখ হয়?”

এই হল রাম, ভারতের রাজা রাম। সীতার প্রতি রামচন্দ্রের এহেন আচরণে যদি ভেবে বসেন যে, সীতার প্রতি রামের বিন্দুমাত্র প্রেম ছিল না, তাহলে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বরং বলা যায়, রাম-সীতার প্রেম এতটাই ছিল যে, যা অত্যন্ত বিরল। বিবাহের পর থেকে পঞ্চবটিতে সীতার অপহরণের আগে পর্যন্ত রামের প্রেম অবিসংবাদিত। অরণ্যযাপনকালে খাবার, পানীয় ভাগ করে খাওয়াসহ সোনার হরিণ অসম্ভব অবাস্তব বুঝেও সীতাকে খুশি দেখতে ছুটে গিয়েছিলেন বিপদের ঝুঁকি নিয়ে।

উত্তরকাণ্ড থেকে জানা যায়, বাল্মীকির আশ্রমে সীতার নির্বাসন হওয়ার কিছুদিন পরেই সীতার দুই পুত্র সন্তান–লব ও কুশের জন্ম হয়। সে পুত্রযুগল জন্মেছিল তখন নাকি রামচন্দ্রের বিবাহের তেপ্পান্ন বছর পর (বাস্তব ১২ + ১৪ = ২৬ বছর পর)। বছরের এ হিসেবটা প্রিয় পাঠকদের কাছে একটু বেমানান বোধ হতে পারে। তাই বছরগুলির একটা হিসাব দিচ্ছি। বিবাহন্তে রামচন্দ্র গৃহবাসী ছিলেন ১২ বছর, বনবাসী ১৪ বছর এবং গৃহে প্রত্যাবর্তন করে রাজাসনে কাটান নাকি ২৭ বছর (ওই ২৭ বছর উদ্দেশ্যমূলক, কাল্পনিক)। এরপর ‘কলঙ্কিনী বলে অন্তঃসত্ত্বা সীতাকে নির্বাসিত করা হয় বাল্মীকির তপোবনে। সেখানই লব ও কুশের জন্ম হয় বলে উত্তরকাণ্ডে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ সীতাদেবী বন্ধ্যা ছিলেন না এবং উক্ত তেপ্পান্ন বছরের মধ্যে বনবাসকালের। দশ মাস (অশোককাননে রাবণের হাতে সীতা বন্দিনী ছিলেন ১০ মাস) ছাড়া বাহান্ন বছর দু-মাস সীতা ছিলেন রামচন্দ্রের অঙ্কশায়িনী। অন্য হিসাবে সীতার যখন গর্ভসঞ্চার হয় তখন তাঁর বয়স ছিল (১৮+১২+১৪+২৭) ৭১ বছর, মতান্তরে (৬+১২+১৪+২৭) ৫৯ বছর। বাস্তবিক কোনো নারী এই বয়সে গর্ভধারণ করতে পারেন না। নারীর গর্ভধারণের সময় কিছু কমবেশি ১২ বছর থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। মেনোপোজ বা পিরিয়ড বন্ধ হয়ে গেলে কোনো নারীর পক্ষেই সন্তানধারণ সম্ভব নয়। এ ভুল মহাকবি বাল্মীকি করতে পারেন না। তাহলে প্রাচীনযুগে নারীর মেনোপোজ আরও দেরিতে আসত! না, তা নিশ্চয়ই নয়। চরক সেকথা বলছেন না। তা ছাড়া অনেক গবেষক মনে করেন, লব-কুশ চরিত্র দুটি বাল্মীকি সৃষ্টি করেননি, প্রয়োজনও মনে করেননি। আষাঢ়ে গল্প বানাতে গিয়ে উত্তরকাণ্ডের কবি এই বিপত্তি ঘটিয়েছেন। কারণ তিনি জানতেন না চিকিৎসার জনক চরক কী বলেছেন–

“দ্বাদশাদ্বৎসরাদূর্ধমা পঞ্চাশৎসমাঃ স্ত্রীয়ঃ।/মাসি মাসি ভগদ্বারা প্রকৃত্যৈবার্তবংসেবেৎ”

অর্থাৎ “স্ত্রীলোকের ১২ বছর বয়স থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত স্বভাবতই প্রতিমাসে তিনদিন করে আর্তব (রজঃ) যযানিমুখ দিয়ে প্রশ্রুত হয়। এ সময়কালেই গর্ভধানের উপযুক্ত সময়, এই সময়কালের আগে বা পরে নয়। এরপর কলঙ্কিনী’ বলে অন্তঃসত্ত্বা সীতাকে নির্বাসিত করা হয় বাল্মীকির তপোবনে। সেখানই লব ও কুশের জন্ম হয় বলে উত্তরকাণ্ডে বর্ণিত হয়েছে।

রামচন্দ্রের সন্তানের ব্যাপারে কেউ কেউ বলেন–“সন্তান কামনা করে না, এমন কোনো লোক বা জীবজগতে নেই। কারও সন্তান না-থাকলে তার দুঃখের অবধি থাকে না; বিশেষত ধনিক পরিবারে। আর রাজ্যেশ্বর রামচন্দ্রের বৈবাহিক জীবনের দীর্ঘ ২৬ বছর পরে আসন্ন সন্তান পরিত্যাগ করলেন শুধু কি প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য? নিশ্চয়ই তা নয়। তিনি জানতেন যে, সীতার গর্ভস্থ সন্তান তাঁর ঔরসজাত নয়, ঔরসজাত রাবণের। আর সংগত কারণেই সীতার গর্ভজাত সন্তানের প্রতি তাঁর কোনো মায়ামমতা ছিল না, বরং ছিল ঘৃণা ও অবজ্ঞা। তাই তিনি সীতা-সুতের কোনো খোঁজখবর নেননি বহু বছর যাবৎ। বিশেষত ঋষি বাল্মীকির আশ্রম অযোধ্যা থেকে বেশি দূরেও ছিল না, সেই আশ্রম তিনি চিনতেন। অতঃপর সীতাসহ কুশ-লব বিনা নিমন্ত্রণে (বাল্মীকির নিমন্ত্রণও ছিল) ঋষি বাল্মীকির সঙ্গে শ্রীরামের অশ্বমেধ যজ্ঞে উপস্থিত হয়ে যেদিন রামায়ণ কীর্তন করে, সেদিন কুশ-লবের মনোরম কান্তি ও স্বরে-সুরে মুগ্ধ হয়ে রামচন্দ্র তাদের দত্তকরূপে গ্রহণ করেন। হয়তো তখন তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে, ঘটনাক্রমে ফেলনা হলেও ছেলে দুটো (কুশ-লব) রাজপুত্র তো বটে। কুশ-লবকে গ্রহণ করলেও সীতাকে গ্রহণ করেননি রামচন্দ্র সেদিনও। সীতাদেবী হয়তো আশা করেছিলেন যে, বহু বছরান্তে পুত্ররত্ন-সহ রাজপুরীতে এসে এবার তিনি সমাদর পাবেন। কিন্তু তা তিনি পাননি, বিকল্পে পেয়েছিলেন যত অনাদর-অবজ্ঞা। তাই তিনি ক্ষোভে-দুঃখে হয়তো আত্মহত্যা করেছিলেন। নারীহত্যার অপবাদ লুকোনোর উদ্দেশ্যে এবং ঘটনাটি বাইরে প্রকাশ পাওয়ার ভয়ে শোনে দাহ করা হয়নি সীতার শবদেহটি, হয়তো লুকিয়ে গ্রোথিত করা হয়েছিল মাটির গর্তে। আর তা-ই প্রচারিত হয়েছে–“স্বেচ্ছায় সীতাদেবীর ভূগর্ভে প্রবেশ বলে। সে যা হোক, অযোধ্যেশ্বর রাম ও লঙ্কেশ্বর রাবণের সন্তান-সন্ততি সম্বন্ধে পযালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, রাবণ ছিলেন শত শত সন্তানের জনক, আর রামের ছিল না একটিও পুত্র। তিনি ছিলেন ‘আঁটকুড়ো’। লঙ্কেশ্বর রাবণের যাবতীয় গুণগরিমা ও সৌরভ-গৌরব গুপ্ত রাখার হীন প্রচেষ্টার মুখ্য কারণ–তিনি আধ্যাত্মবাদী ছিলেন না, ছিলেন জড়বাদী বিজ্ঞানী। বিশেষত তিনি আর্যদলের লোক ছিলেন না, ছিলেন অনার্যদলের লোক।” এরূপ অনুমান করা হয়তো সংগত নয়। সীতা রাবণকে কতটা ঘৃণা করতেন তা অশোকবনে সীতা রাবণের কথোপকথন থেকে জানা যায়। আসলে রামের সঙ্গে সীতার মিলন হয়েছিল বনবাস ছেড়ে অযোধ্যায় ফিরে আসার পরে। এইসব ঘটনা উত্তরকাণ্ডে আছে। রাম নিজে বহু বছর সীতার সঙ্গে মিলন করার পর নিজে সীতাকে গর্ভবতী দেখে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। যদি লব-কুশ রাবণের ছেলে হত, তাহলে লঙ্কায় সীতার উদ্ধারের সময়ই রাম সীতার গর্ভলক্ষণ দেখতে পেতেন। তা তিনি পাননি। সুতরাং ওরা যে রাবণের ছেলে নয় তা অনুমান করাই যায়।

পাশাপাশি ঐতিহাসিকভাবে যুগটার কথাও মনে রাখতে হবে। সেটা হল, সীতাকে জানছেন রামায়ণের যুগে। রামায়ণের যুগ ও মহাভারতের যুগ–দুইয়ের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। এই দুই যুগের দুই মহাকাব্যের নিরিখে যদি তুলনা করি তাহলে দেখব–রামায়ণের যুগে (ত্রেতা) নারীর একাধিক পতিত্ব এবং পরপুরুষের সঙ্গে যৌনসংসর্গ ছিল নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয়। রামায়ণের নারীরা পরপুরুষ থেকে শতহস্ত দূরে অবস্থান করেন। জান দেবেন কিন্তু মান দেবেন না। সীতাও সম্মত হননি রাবণের বিলাস-বৈভবে ভেসে যেতে। রাবণের কোলে সীতা ধর্ষিতা হয়েছেন এমন সন্দেহ যদি রামের মতো পুরুষের হয়, যদি সীতা ধর্ষিতাও হন–যা যথাসাধ্য গোপন রাখাই সেই সমাজের রীতি। রামায়ণের কবিরা সেই চেষ্টা সর্বত্র করেছেন। রক্ষণশীল সমাজে নারীরা বিয়ের  আগে তো দূরের কথা বিয়ের পরেও অন্য কোনো পুরুষের অঙ্গশায়িনী হয়ে গর্ভবতী হতে পারতেন না। পুরুষও সন্তানদানে অক্ষম হলে তাও গোপন রাখার প্রয়াস ছিল। তাই দশরথের পুত্রলাভের ব্যাপারটায় অলৌকিকতার প্রলেপ দিতে হয়েছে। রামায়ণের কাহিনি নিয়ে রচিত কালিদাসের ‘রঘুবংশম্’-এও দিলীপ সুদক্ষিণার পুত্রলাভের ঘটনাতেও অলৌকিকতা প্রদান করা হয়েছে। সত্য চেপে দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে মহাভারতের যুগে (দ্বাপর) এসে অনেকটাই খুল্লামখুল্লা। এ যুগে এত রাখঢাক নেই। নিয়োগপ্রথার প্রয়োগ মহাভারতের যুগে এসে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। পরপুরষে যৌনসংসর্গ ব্যাপারটা বেশ খোলাখুলিই। এমনকি বিয়ের আগে যৌনসংসর্গও গ্রহণযোগ্য। ধরুন সত্যবতীর কথা। সত্যবতী অবিবাহিত সময়ে পরাশরের সঙ্গে নির্জনে যৌনসংসর্গ করে গর্ভবতী হয়েছিলেন। গর্ভের সেই সন্তানই কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, দ্বৈপায়ন ব্যাস। সমাজ স্বীকৃত সন্তান, যিনি মহাভারতকার। তারপরেও সত্যবতীর প্রেমে পড়ে এবং তাঁকে বিয়ে করতে শান্তনুর কোনো সংস্কারে বাধেনি। সত্যবতাঁকে কখনোই তিনি বলেননি ‘কুকুরে চাটা ঘি’ ভোগ করা যাবে না সত্যবতাঁকে। রামায়ণের যুগে রাম কিন্তু সীতাকে লঙ্কা ফিরিয়ে আনার পর সীতাকে বলেছিলেন–“তুমি সচ্চরিত্রই হও আর অসচ্চরিত্রই হও, মৈথিলি, তোমাকে আমি ভোগ করতে পারি না, (তুমি) যেন কুকুরে চাটা ঘি।” না, এ ব্যাপারে শান্তনুর কোনো সমস্যা হয়নি। মৎস্যগন্ধা’ সুন্দরী সত্যবতীর মোহে স্বপুত্র ভীষ্মকে রাজ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করলেন। ভীষ্মকেই শুধু বঞ্চিত করলেন না, ভীষ্মের কোনো বংশধরই রাজ্যের অধিকার দাবি করতে না-পারেন সে ব্যবস্থাও করে ফেললেন। ভীষ্ম চিরব্রহ্মচারী পালন করলেন। সত্যবতীর দই পুত্র বিচিত্রবীর্য ও চিত্রাঙ্গদের যখন অকালমৃত্যু হল তখন সত্যবতীর স্বপ্নকে পূরণ করতে ভীষ্মকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন তার দুই পুত্রবধু অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে যৌনসংসর্গ করে সন্তান দেন। সত্যবতী কাকে অনুরোধ করছেন, যিনি শান্তনু-গঙ্গার সন্তান ভীষ্ম। শান্তনু-গঙ্গার সন্তান ভীষ্মকে সত্যবতী অনুরোধ করছেন। শান্তনু-সত্যবতীর পুত্রবধুদের যৌনসংসর্গ করতে। সত্যবতী বিমাতা হলেও ভীষ্মের মা তো! কারণ রাজসিংহাসনের দাবিদার তো একমাত্র সত্যবতীর পুত্রেরই। তো পুত্রদের অকালমৃত্যু হয়েছে বলে হাল ছাড়লে চলবে! যে কোনো উপায়েই হোক নাতিই এখন শেষ ভরসা। কিন্তু ভীষ্ম প্রত্যাখ্যান করলে ভীষ্মেরই পরামর্শে সত্যবতী অগত্যা তাঁর কুমারীকালের জন্ম-দেওয়া বুড়োপুত্র দ্বৈপায়নকে দিয়ে অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে সন্তান রোপন করালেন। দ্বৈপায়নও অম্বিকা ও অম্বালিকাকে নারাজ সত্ত্বেও গর্ভবতী তো করালেনই, উপরি হিসাবে এক অজ্ঞাতনামা দাসীকেও একই সঙ্গে গর্ভবতী করে দিলেন। সেই পুত্ররাই হলেন যথাক্রমে ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুর। মহাভারতে এরকম ঘটনা অজস্র আছে, উল্লেখে শেষ করা যাবে না। মহাভারতকার কোনোরূপ লুকোছাপা করে এসব ঘটনায় বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। কারোর কোনো ছুৎমার্গ নেই। কিন্তু রামায়ণে বাল্মীকি এমন ঘটনা ঘটলেও জাহির করে বলার সাহস পাননি। কিন্তু ঘটনাগুলি যে ঘটেনি সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না, সেগুলি আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে তা স্পষ্টতই অনুমিত হয়। এসব কর্ম করতে মহাভারতে নীতির আগমার্কা ছাপ পেলেও, রামায়ণে কিন্তু তা এক অতি ভয়ংকর অপরাধ। ফলে সীতার প্রতি রামের তিরস্কার, অপমান, অবমাননার বিষয়গুলি এযুগের নিরিখে ভাবলে হবে না–রামায়ণের যুগটাকে স্বীকার করতে হবে।

সীতাকে বিসর্জনের পর রাম মহাসমারোহে এক বিরাট যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সীতাবর্জনের পর রামের কোনোরূপ অপরাধবোধ সৃষ্টি হয়নি, বিমর্ষ হয়ে পড়েননি, বিন্দুমাত্র যন্ত্রণাকাতর হননি। সীতাকে ফিরিয়ে আনা যায় কীভাবে সে ব্যাপারেও তিনি ভাবিত ছিলেন না। ত্যাগ মানে ত্যাগই! সীতার সতীত্ব প্রসঙ্গে সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর রামায়ণের সমালোচনা নিবন্ধে লিখেছেন–

“ভারতবর্ষীয় স্ত্রীলোক যে, স্বভাবতই অসতী, এই সীতার ব্যবহারই তাহার উত্তম প্রমাণ। সীতা যেমন গৃহের বাহির হইল, অমনই অন্য পুরুষ ভজনা করিল। রামকে ত্যাগ করিয়া রাবণের সঙ্গে লঙ্কায় রাজ্যভোগ করিতে গেল। নির্বোধ রাম পথে পথে কাঁদিয়া বেড়াইতে লাগিল। হিন্দুরা এই জন্যই স্ত্রীলোকদিগকে গৃহের বাহির করে না।”

রামচন্দ্রের এই মহাযজ্ঞে বিভিন্ন দেশের রাজনগণ, মুনিঋষিগণও নানাবিধ উপহার নিয়ে এলেন। মহাকবি বাল্মীকিও এসেছিলেন লব-কুশ সহ তাঁর অন্যান্য শিষ্যদের নিয়ে। উদ্দেশ্য, সমগ্র রামগান শোনানো। তদুপরি ঋষিবর বাল্মীকি লব-কুশকে পইপই করে বলে দিলেন–

“যদি পৃচ্ছেৎ স্ কাকুৎস্থে যুবাং কস্যেতি দারকৌ।

বাল্মীকেরথ শিষ্যৌ ঘৌ ব্রতমেবন্নরাধিপম্।”

অর্থাৎ, “রামচন্দ্র যদি তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করে তোমরা কার পুত্র, তাহলে বলবে–আমরা বাল্মীকির শিষ্য।” একসময় রাম জানতে পারেন লব-কুশ সীতারই সন্তান। অতঃপর তিনি আশ্রমের শুদ্ধাচারী দূতদের বললেন–

“তোমরা ভগবান বাল্মীকির কাছে গিয়ে বলল, জানকীর চরিত্র যদি বিশুদ্ধ এবং নিষ্পাপ হয় তাহলে তিনি মহর্ষির অনুমতি নিয়ে তাঁর বিশুদ্ধতার পরিচয় দিন। সীতা যদি বিশুদ্ধতার প্রমাণ দিতে সম্মত হন তাহলে আগামীকাল প্রভাতেই তিনি সভামধ্যে শপথ করুন।”

হাড় হিম হয়ে আসা পরিবেশ, পরিস্থিতি! পরে ঋষিবর বাল্মীকি সীতাকে মহাযজ্ঞানুষ্ঠানের আসরে এনে উপস্থিত জনসমূহের মধ্যে বললেন–

“দাশরথি রাম! সীতা পতিব্রতা ধৰ্মচারিণী হলেও তুমি লোকনিন্দার ভয়ে তাঁকে আমার আশ্রমে ত্যাগ করেছিলে। লোকাপবাদের ভয়ে ভীত তুমি। অতএব যাতে লোকপবাদ দূর হয়, সীতা তোমাকে এমন প্রত্যয় দেবেন। রাম, তুমি অনুমতি দাও। আমি সত্য বলছি–“জানকীর গর্ভজাত এই দুর্ধর্ষ যমজসন্তান তোমারই পুত্র। আমি শপথ করে বলছি–যদি সীতা দুশ্চরিত্রা হন, তবে আমার বহু সহস্র বছরের তপস্যার ফল সব নষ্ট হবে। জানকী যদি নিষ্পাপ হন, তাহলে আমি কায়মনোবাক্যে যে পাপকর্ম করিনি তার ফলভোগ করব।”

এসব কথা শুনে রাম বললেন–

“এই যমজ সন্তান লব ও কুশ আমারই, আমি জানি।”

তা সত্ত্বেও রাম তাঁর সতীত্ব তথা বিশুদ্ধতার পরীক্ষার আয়োজন করলেন। সীতা কিন্তু সে সুযোগ রামকে আর দেননি। বল এবার সীতার কোর্টে। অনেক হয়েছে, আর নয়! এসময় বিভীষণ নেই, বিভীষণের মায়াবলও নেই। সীতাকে রক্ষা করার মতো কেউ নেই অযোধ্যায়। অশ্রুসজল চোখে সীতা বসুন্ধরাকে আহ্বান করলেন–

“যথাহং রাঘবাদন্যং মনসাপি ন চিন্তয়ে।

তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমহতি।

মনসা কমণা বাঁচা যথা রামং সমৰ্চয়ে।

তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমহতি।”

সীতার চরিত্র নিয়ে প্রজাদের সামনে নিন্দা শুরু হলে লজ্জায় ও ক্ষোভে সীতা পাতালে প্রবেশ করেন। নারীকে এভাবে অপমান করার মতো বাড়াবাড়িটা উত্তরকাণ্ডের কবি না-করলেই পারতেন!

অগ্নিপরীক্ষার ব্যাপারে একটি মত পাওয়া যায়। সেই মতানুসারে আমরা দেখব অগ্নিপরীক্ষা ব্যাপারটা কেমন? দাউদাউ জ্বলতে থাকা লেলিহান শিখার ভিতর প্রবেশ করা? তারপর পূণ্যবান ব্যক্তির সেই আগুনের ভিতর থেকে অবিকৃতরূপে বেরিয়ে আসা? একদম না। বিষ্ণুসংহিতায় একাদশ অধ্যায়ে অগ্নিপরীক্ষা ব্যাপারটা স্পষ্ট করেছে। পণ্ডিতপ্রবর শ্রীমনোনীত সেনের ভাষায় বলি–

“অগ্নিপরীক্ষার কথা কথিত হইতেছে। ষোড়শ-অঙ্গুলি-পরিমিত ষোড়শ-অঙ্গুলি অন্তর অন্তর সাতটি মণ্ডল করিবে। অনন্তর পূর্বমুখপ্রসারিত-বাহু অভিযুক্ত ব্যক্তির করদ্বয়ে সাতটি অশত্থাপত্র দিবে। দুই হস্তের সহিত সেই সকল পত্র সূত্র দ্বারা বেষ্টন করিবে। তৎপরে, অর্থাৎ পত্ৰাচ্ছাদিত হস্তদ্বয়ে পঞ্চাশৎপল-পরিমিত সমতল অগ্নিবর্ণ জ্বলন্ত লৌহপিণ্ড স্থাপন করিবে। (অভিযুক্ত ব্যক্তি) তাহা লইয়া সেই সকল মণ্ডলে নাতিশীঘ্র-নাতিবিলম্বিতভাবে পদক্ষেপ করত গমন করিবে। তৎপশ্চাৎ সপ্তম মণ্ডল পার হইয়া হস্তস্থিত লৌহপিণ্ড ভূমিতে ফেলিয়া দিবে। যে ব্যক্তির দুই হাতের মধ্যে কোন স্থল দগ্ধ হয়, তাহাকে অশুদ্ধ বলিয়া নির্দেশ করিবে। আর যে ব্যক্তি সর্বথা অদগ্ধ, সেই ব্যক্তি বিশুদ্ধ হইবে। যে ব্যক্তি ভয়ক্রমে লৌহপিণ্ড ফেলিয়া দেয়, অথবা যে ব্যক্তি দগ্ধ হইল কি না ঠিক করা যায় না, শপথক্রিয়ার অশুদ্ধিবশতঃ অর্থাৎ তাহা ঠিক না হওয়ায় তাহাকে পুনর্বার লৌহপিণ্ড গ্রহণ করিতে হইবে, অভিযুক্ত ব্যক্তি উভয় কর দ্বারা ব্রীহি মর্দন করিলে তাহার উভয় করতল অগ্রেই (অর্থাৎ অশ্বথপত্র দিবার পূর্বেই) লক্ষ্য করিবে (কোনো চিহ্ন আছে কি না দেখিবে)। অনন্তর মন্ত্রপাঠ করিয়া ইহার (অর্থাৎ অভিযুক্ত পুরুষের হস্তদ্বয়ে লৌহপিণ্ড (স্থাপন কর্তব্য। হে অগ্নি! তুমি সাক্ষীর ন্যায় সর্বভূতের অন্তরে বিচরণ করিতেছ; অতএব হে অগ্নি! যাহা মনুষ্যের অজ্ঞাত, তাহা তুমিই অবগত আছ। ব্যবহারস্থলে আরোপিত কলঙ্ক হইতে এই মনুষ্য শুদ্ধি আকাঙ্ক্ষা করিতেছে, অতএব ইহাকে এই সংশয় হইতে ধর্মতঃ পরিত্রাণ করা তোমার উচিত।”

সীতা কি সত্যিই ধর্ষিতা হয়েছিল? নাকি কেবলই অপবাদ! অমন পিলে চমকানো সুন্দরী রমণীকে দীর্ঘ দশ মাস নিজের কবজায় পেয়েও ‘দুঃশ্চরিত্র’, কামুক’ ও ‘ধর্ষকামী’ রাবণ ছেড়ে দিল! একথা ঠিক যে, বাল্মীকি বলেছেন সীতার চেয়েও পরমা সুন্দরী নারী রাবণের অন্দরমহল ভরপুর ছিল। প্রধানা মহিষী মন্দোদরীও ডাকসাইটে সুন্দরী। সুন্দরী নারী সংগ্রহে রাবণের জুড়ি মেলা ভার। সেইসব সুন্দরীদের দেখে হনুমানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া–

“ন তত্র কাশ্চিৎ প্রমদা প্ৰসহ্য, বীর্যোপপন্নেন গুণেন লন্ধা।”

তাঁর সংগ্রহে সবর্ণেরই নারী নয়, জাতিবর্ণনির্বিশেষে নারীরা আছেন–“রাজর্ষি-বিপ্র-দৈত্যানাং গন্ধর্বনাঞ্চ ঘোষিতঃ।” তা সত্ত্বেও রাবণের বিশ্বস্ত অনুচর মহাপার্শ্ব লঙ্কাকাণ্ডের ১৩ তম সর্গে রাবণকে স্পষ্টত বলেছিলেন–

“হে মহাবল, যদি রমণকালে সীতা আপনার অনুকূল না-হয়, তাহলে আপনি কুকুটবৃত্তিতে অর্থাৎ বলপ্রয়োগ করে আক্রমণ করবেন, তাকে উপভোগ ও রমণ করুন।” (বলাৎ কুকুটবৃত্তেন প্রবর্তস্ব মহাবল।/আত্রুম্যাক্রম্য সীতাং বৈ তাং ভুং চ রমস্য চ) রাবণ নিজেও বলেছেন–

“দ্বৌ মাসৌ রক্ষিতবৌমে যো অবধিন্তে ময়াকৃতঃ।

ততঃ শয়নমারোহ মম ত্বং বরবৰ্ণিনি।”

অন্যথা হলে খণ্ড খণ্ড করে কেটে খাওয়ার কথাও বলা হয়েছে–

“দ্বাভ্যামূর্ধন্তু মাসাভ্যাং ভর্তারং মামনিচ্ছতীম্।

মম ত্বাং প্রাতরাশার্থে সূদাচ্ছেৎস্যন্তি খণ্ডশঃ।”

অপহৃত হয়ে সীতাও রাবণকে বলেছিলেন–তুই আমাকে ধর্ষণ করেছিস। সেই হেতু তোর নিজের, রাক্ষসদের এবং অন্তঃপুরের বিনাশকাল আসছেই। “মাং প্রধৃষ্য স তে প্রাপ্তো অয়ং রাসসাধম্।/আত্মনো রাক্ষসানাঞ্চ বধায়ান্তঃপুরস্য চ।” রাবণের স্ত্রী মন্দোদরীও লঙ্কাকাণ্ডের ১১৩ তম সর্গে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন–

“তদৈব যন্ন দগ্ধস্তং ধর্ষংস্তনুধম্যমাম্।

দেবা বিভ্যতি তে সর্বে সেন্দ্রাঃ সাগ্নিপুনরাগমাঃ।”

অর্থাৎ তুমি যে সেই জানকী ধর্ষণ করতে করতেই দগ্ধ হওনি, তার কারণ ইন্দ্রাদি দেবগণও তোমাকে ভয় করে চলেন। মন্দোদরী বিলক্ষণ জানতেন রাবণের চরম ‘আলুর দোষ আছে। সীতা ছাড়া অন্য কোনো নারীদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করার দোষে মন্দোদরী রাবণকে তিরস্কার করেছেন এমন কোনো কাহিনি জানা নেই। যদিও সে যুগে ব্রাহ্মণ আর রাজরাজড়াদের একাধিক নারীসঙ্গ নিন্দিত ছিল না–তার উপর রাবণ কেবল রাজাই ছিলেন না, তিনি চতুর্বেদী ব্রাহ্মণও ছিলেন। তবে রাবণ পূর্বে যাঁকেই ধর্ষণ করুন-না কেন, সীতাকে ধর্ষণ করার উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না। উদ্দেশ্য কী ছিল, সেটা বরং রাবণের মুখ থেকেই শোনা যাক। সীতা অপহরণের অব্যবহিত পরেই নিজেকে ছদ্মবেশ মুক্ত করে রাবণ বলছেন–আমি বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক নারী এনেছি, তুমি আমার মহিষী হয়ে তাঁদের সকলের প্রধান হও। তুমি যদি আমার স্ত্রী হও, তবে সবরকমের অলংকার ভূষিতা ৫০০০ দাসী তোমার সেবা-পরিচর্যা করবে। মিলিয়ে নিন পাঠকবন্ধু–

“বীনামূত্তমন্ত্ৰিণামাহৃতানামিতস্ততঃ।

সর্বাত্ৰামেষ ভদ্রং তে মমার্গমহিষী ভব।

… পঞ্চ দাস্যঃ সহস্রাণি সর্বাভরণভূষিতাঃ।

সীতে পরিচারষ্যন্তি ভার‍্যা ভবসি মে যদি।”

রাবণকে মানুষ যতটা ‘ছোটোলোক’ ভাবেন, রাবণ ঠিক ততটা ছোটোলোক নন। সেই উদারতা নিয়ে উত্তরকাণ্ডের ৪৬ সর্গে মহাতেজা অগস্ত্য কী বলছেন সেটাও জেনে নিতে পারি–

“লঙ্কামানায় যত্নেন মাতেব পরিরক্ষিতা।

এবমেতৎ সমাখ্যাতং তব রাম মহাযশ।”

অর্থাৎ, রাবণ সীতাকে লঙ্কায় এনে সযত্নে মায়ের মতো সবরকমভাবে রক্ষা করেছিলেন। মহাযশা রাম, এই সমস্ত বিবরণ তোমার কাছে বর্ণনা করলাম। কম্বনের রামায়ণে রাবণ সীতাকে অপহরণ করেননি, বলপ্রয়োগ করেননি, স্পর্শ করেননি–যেমনভাবে বাল্মীকি রাবণ কর্তৃক সীতাকে অপহরণ করিয়েছেন। কম্বন রামায়ণে রাবণ সীতাকে স্পর্শ না-করে যেখানে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন সেখানকার মাটি সমেত তাঁকে তুলে নিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, কোনো আকাশযানে নয়। রাবণ যাকে অপহরণ করেছিলেন তিনি আসল সীতা নন, মানে রক্তমাংসের নারী নন। মায়া-সীতা।

রাবণ যেদিন অপহরণ করেছিলেন সেদিন থেকেই অশোকবনে রাখেন। কিন্তু হরিশঙ্কর জলদাস এক লেখায় বলেছেন–সীতাকে অপহরণের পর রাবণ তাঁর নিজ প্রাসাদের সবাইকে বাইরে বের করে দিয়ে এক রাত্রি সীতার সঙ্গে থাকে। তার পরের দিন মন্দোদরীর তীব্র বাধায় সীতাকে অশোকবনে সরিয়ে দেয়। মন্দোদরী যে জবরদোস্ত বাধা দিয়েছিল তা প্রায় সব রামায়ণেই পাওয়া যায়। বাধা দিয়েছিল কেন? শুধুই কি একজন নারী অপমানিত হচ্ছিল বলে বাধা? নাকি তাঁর মুখের আদলের সঙ্গে সীতার মুখের আদলে মিল পাওয়া গিয়েছিল বলে! রাবণ কেন তড়িঘড়ি অশোকবনে সীতাকে রেখে এসেছিল? রাবণের সঙ্গে সীতার সম্পর্ক কি সেটা মন্দোদরী রাবণকে বলে দিয়েছিলেন? অশোকবনে রাখার পর রাবণ কিন্তু ভুলেও একবারের জন্যেও সীতাকে স্পর্শ করেননি। হনুমানও কিন্তু লঙ্কায় পৌঁছে দূর থেকে মন্দোদরীকে সীতা বলে ভুল করেছিল। যদিও বেশিরভাগ রামায়ণ থেকে জানা যায় সীতা অপহরণের পর সুগ্রীবের সঙ্গে দেখা হওয়ার প্রাক্কালে হনুমানের সঙ্গে পরিচয় হয়। অর্থাৎ তার আগে সীতাকে দেখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু খটকা লাগে যে কারণে, সেটা হল, যদি পূর্ব-পরিচয় না-ই থাকে তবে রাম-লক্ষ্মণের সঙ্গে হনুমানের যে সম্পর্ক এবং আনুগত্য পরিলক্ষিত হয়, তাতে তো অন্য রহস্য আছে মনে হয়। না-হলে সুগ্রীবের আদেশ পেয়ে রাম-লক্ষ্মণকে দেখে ভক্ত হয়ে যায় কোন্ আদরে! যে হনুমানের বয়সের গাছপাথর নেই, যাকে মহাভারতেও দেখা মেলে–তাঁর কাছে যে সীতার সঙ্গে পূর্ব-পরিচয় থাকবে না, তা মেনে নেওয়া কঠিন। সেই কারণেই সীতার আদলের সঙ্গে মন্দোদরীর আদল গুলিয়ে ফেলছিল হনুমান। মেয়ের সঙ্গে মায়ের চেহারা মিল থাকাটা তো অস্বাভাবিক নয়।

চন্দ্রাবতী রামায়ণে আছে দেবতাদের চমকিয়ে রাবণ যখন লঙ্কায় ফিরল, সে সময় প্রভূত পরিমাণে দেবকন্যা অপহরণ করে নিয়ে এসেছিল। তাঁদেরকে নিয়ে অশোকবনে ফুর্তি করতে লাগল। এই কথা শুনে মন্দোদরী মনঃকষ্টে বিষপান করল। বিষপান করলেও মৃত্যু হয়নি, হল গর্ভবতী। দশমাস পর তিনি ডিম প্রসব করলেন। এই ঘটনায় গণকেরা নিদান দিল এই ডিম রাক্ষসদের ধ্বংস করবে। অতএব ধ্বংস করো। একথা শুনে মন্দোদরী কান্নায় ভেঙে পড়লেন এবং রাবণকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যাতে ডিমটি ধ্বংস না-করে যেন সোনা-রুপোর খাঁচায় বন্দি করে সমুদ্রে ফেলে দেয়। যেই কথা সেই কাজ। ডিমটি সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হল। একদিন গরীব জেলে মাধবের জালে সেদিন কোনো মাছ ধরা পরে না। হঠাৎ তাঁর জালে এই সোনা-রুপোর খাঁচায় ভরা ডিম পায়। সোনা-রুপো বিক্রি করে বড়লোক হয় সে। মাধবের বউয়ের নাম সতা। সতা স্বপ্ন দেখে ডিমের ভিতরে এক নারী আছে, যে তাকে বলছে জনকের কাছে নিয়ে যেতে, জনক তার পিতা। এইভাবে সীতার জন্ম। সতার নামে মিলিয়ে তার নাম সীতা রাখা হয়। তবে সীতা যাঁর গর্ভে যেখানে যেভাবেই জন্মাক না-কেন, প্রাপ্তি কিন্তু হলকর্ষণেই। এ ব্যাপারে সব কবিই একমত।

কবিবর বাল্মীকি রাবণ কর্তৃক সীতার অপহরণের সময় যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, তাও বিবেচনা করার বিষয়–“সীতা রাবণ কর্তৃক ধর্ষিতা হলে স্থাবর ও জঙ্গম প্রাণীগণ সহ সমগ্র পৃথিবী মর্যাদাবিহীন ও ভীষণ অন্ধকারে আড়াল হল। সেখানে বায়ুপ্রবাহ স্তব্ধ হল এবং সূর্য নিষ্প্রভ হল। ব্রহ্মা দিব্যচক্ষে সীতাকে রাবণ কর্তৃক ধর্ষিতা হতে দেখে ‘কার্যসিদ্ধি হল’ বলেন।” তবে একথা মনে রাখা দরকার, প্রজাবৎসল রাজা রামচন্দ্র প্রজাদের সন্দেহ দূর করতে সীতাকে আগুনের ভিতর ঠেলে দিলেও, সে সময় রাম বলেছিলেন–

“ন চ শক্ত স দুষ্টাত্মা মনসাপি চ মৈথিলীম্।

প্ৰধর্ষয়িতুমপ্রাপ্যাং দীপ্তমগ্নিশিখামিব৷৷”

এই সংলাপে সীতাকে যে দুষ্টাত্মা ধর্ষণ করতে পারেনি সেই আত্মবিশ্বাস পরিলক্ষিত হলেও, এই রামই যখন অবলীলায় সীতার উদ্দেশে বলে ফেলেন ‘কুকুরে চাটা ঘি’, তখন বিস্ময়াভিভূত হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। লঙ্কাকাণ্ডের ১১৭ তম সর্গে ১৩ থেকে ২৪ নম্বর শ্লোক পর্যন্ত সীতাকে রাম যে ঘৃণ্য ভাষায় অপমান করেছেন, আক্রমণ করেছেন, তা কোনো আদর্শ মানবের কাছ থেকে আশা করা যায় না। একজন প্রাণপ্রিয় স্বামীর কাছ থেকে এহেন আচরণ একজন পতিব্রতা স্ত্রীর কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এ ঘটনায় সীতা এতটাই আহত হয়েছিলেন যে তা প্রকাশে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি।

হে পাঠক, সীতার কথা শুনুন–

“বীর, ভদ্রেতর ব্যক্তি যে ভাষায় আর্যেতর নারীকে বলে থাকে, সেই ভাষাতে কেন আমাকে এমন নিদারুণ রূঢ় বাক্য শোনাচ্ছেন? আপনি আমাকে যেমনটা ভাবছেন, আমি তেমনটা নই। আমি আমার চরিত্রের দিব্যি দিয়ে বলছি, আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন। আর্যেতরা সাধারণী নারীর চরিত্র দেখে আপনি স্ত্রীজাতির উপর আশঙ্কা করছেন, কিন্তু আপনি অনেকবার পরীক্ষা করেছেন। সুতরাং এ আশঙ্কা পরিহার করুন। আমি আত্মবশে না থাকায় রাবণের সঙ্গে আমার যে শরীরের স্পর্শ ঘটেছিল, তা আমার ইচ্ছাকৃত নয়। অপরাধী সে তো দৈবই। যা আমার অধীন, সেই হৃদয় তো কেউ স্পর্শ করতে পারেনি। সেই হৃদয় আপনার জন্যই সমানভাবেই অনুরাগী আছে। কিন্তু শরীর আমার বশীভূত নয়, অতএব রক্ষক না-থাকায় রাবণ তা স্পর্শ করেছে। এতে আমার দোষ কোথায়? হায়, বহুদিন একসঙ্গে থেকে আমাদের উভয়ের অনুরাগ একসময় তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আপনি যে তাতেও আমার চরিত্রকে বুঝতে পারেননি, তাতেই আমি প্রচণ্ড দুঃখ প্রাপ্ত হয়েছি। আপনি যখন লঙ্কায় হনুমানকে পাঠিয়েছিলেন আমাকে দেখতে, তখনই কেন সেদিন আমাকে প্রত্যাখ্যান করেননি? হনুমান আমাকে আপনার সেই প্রত্যাখ্যানের খবর শোনালে আমি সেই মুহূর্তেই প্ৰাণত্যাগ করতাম। তাহলে আপনাকে আর প্রাণসংশয় হয় এমন যুদ্ধশ্রম করতে হত না।”

এরপর সীতা লক্ষ্মণকে আদেশ করলেন–

“সৌমিত্রে, এমন মিথ্যা অপবাদগ্রস্ত হয়ে আমি আর প্রাণধারণ করতে চাই না। এখনই চিতা প্রস্তুত করো, চিতাই আমার এই বিপদের একমাত্র ওষুধ। স্বামী আমার গুণে অসন্তুষ্ট হয়ে লোকজনদের মধ্যে আমাকে ত্যাগ করলেন। সুতরাং এক্ষুনি আগুনে প্রবেশ করে আমার কর্ম অনুসারে মুক্তিপ্রাপ্ত হই।”

এত কথার পরেও বরফ গলেনি। স্ত্রীর শরীরে অগ্নিসংযোগ করা হলই। স্বামী রাম গো-হারা হারলেন, কলঙ্কিত হলেন, তিরস্কৃত হলেন, নিন্দনীয় হলেন–রাজা রাম সার্থক হলেন, প্রজানুরঞ্জক হলেন, রামরাজত্ব দৃষ্টান্ত হল। বস্তুত এই অগ্নিপরীক্ষা নাট্যাংশে কী ঘটেছিল? অনেক গবেষক বলেন–সীতাবদল। হ্যাঁ, সীতাবদলই হয়েছিল। সবার সামনেই তা ঘটেছিল। যজ্ঞকুণ্ডও প্রজ্জ্বলিত হল। রাম যাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে বললেন তিনি সীতা নন, বেদবতী। যে বেদবতীকে রাবণ অপহরণ করে লঙ্কায় এনেছিলেন। রাম উদ্ধার করেছেন বেদবতীকে, সীতাকে নয়। যাই হোক, যাঁরা বদলাবদলি করে বেদবতীকে পঞ্চবটিতে রেখে সীতাকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিরাপদ স্থানে, তাঁরাই এখন প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের পিছনে বেদবতীকে সরিয়ে সীতাকে আবির্ভূত করালেন অগ্নি পদাধিকারী ব্যক্তিটি। এ সব ঘটনাই লক্ষ্মণ, বিভীষণ, হনুমান চাক্ষুষ করলেও প্রকাশ্যে কিছু বলার সাহস পাননি। বাল্মীকি তাঁর বর্ণনায় স্পষ্ট করেছেন দুই নারীর উপস্থিতি। বেদবতীর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন ‘নীলকুঞ্চিতকেশা’, আর সীতার বর্ণনা বলেছেন ‘কেশকলাপ কৃষ্ণ ও কুঞ্চিত’। রামও বেদবতীকে ‘ভদ্রে’ (madam) সম্বোধন করেছেন।

রামায়ণের সবচেয়ে মজার বিষয়ই হল সীতার সতীত্ব প্রমাণ। রামের চরিত্র বিনির্মাণের জায়গায় সীতার চরিত্র প্রধান হয়ে যায়। কোনোভাবেই একজন অনার্যর সঙ্গে সীতাকে বিছানায় নামানো যায় না। দশমাস পার হলেও। রামের বউ একজন আদিবাসীর সঙ্গে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় সময় অতিবাহিত করেছে, এটা কোনোভাবেই ইতিহাসে রাখা যাবে না। এই কারণেই রামায়ণে রামের চেয়ে সীতা অনেকাংশে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রামের বউকে যে কোনো মূল্যে গরিব-গুরবো অনার্য রাক্ষসদের সংস্পর্শমুক্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা রামায়ণের কবি। রামায়ণ শেষপর্যন্ত যতটা-না রামের হয়েছে, বাধ্য হয়েই সেটা শেষপর্যন্ত সীতার চরিত্র নির্মাণের ঝাণ্ডা হয়েছে। তাই বলা হয়, রাবণ যে সীতাকে অপহরণ করেছিলেন সে আসল সীতা নয়, সে মায়া-সীতা। তা সেই মায়া-সীতার জন্য শ্রীরামের এত লঙ্কাকাণ্ড’! মায়া-সীতার ধারণা সম্ভবত মধ্যযুগের রচনাকারদের আবিষ্কার। যেমনটা আমরা হেলেনের ক্ষেত্রে দেখতে পাই। ইউরিপিদেস, স্তেসিকোরাস এবং হেরোডোটাস আসল হেলেনকে মিশরে পাঠিয়ে দিয়ে তার প্রতিরূপকে ট্রয়ে পাঠিয়েছিলেন। গ্রিকদের এই পিউরিটান ধারণা (নারী অপহৃতা হলে বা পরপুরুষের অনুগামিনী হলে ওই পুরুষের সঙ্গে তার যৌনসংসর্গ হতে পারে, তাতে তাঁকে আর গ্রহণ করা যাবে না) গ্রিকদের ভারতে আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আমদানি হয়ে থাকতে পারে। পিউরিটান ধারণার উৎস যাই-ই হোক ভারতীয় প্রক্ষিপ্ত রচনাকাররাই সীতার সতীত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই মায়া-সীতার আমদানি করেছেন। বস্তুত উত্তরকাণ্ডের কবি সীতার আত্মসম্মান শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। নারীর সতীত্ব সম্পদ নেই, স্বামী ছাড়া স্বাতন্ত্র্যতা নেই।

ব্যতিক্রম কবিবর বাল্মীকি, রাম-রাবণ-বান্দর-ব্রাহ্মণ যখন সকলেই সীতাকে ‘অপবিত্র’ সাব্যস্ত করেই চললেন, তখন বাল্মীকিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বললেন–

“সীতা যদি অপবিত্র হয়, তবে আমার সমস্ত ঋষিত্বের পূণ্য যেন শূন্য হয়ে যায়।”

বাল্মীকির এই হুংকারে কর্ণপাত করেননি উত্তরকাণ্ডের কবি। অগ্নিপরীক্ষার সিদ্ধান্তে অটুট থেকে সীতাকে মাটির নিচে সেঁধিয়ে দিলেন, বাল্মীকিকে অগ্রাহ্য করে। বস্তুত বাংলা রামায়ণটা তাই মূলত সীতায়ণ, আর বেশিরভাগ রামায়ণ মূলত হনুমানায়ণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *