০৩. ‘নরচন্দ্রমা’ শ্রীরামচন্দ্র : ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসক? ভগবান? ঐতিহাসিক মানুষ?

‘নরচন্দ্রমা’ শ্রীরামচন্দ্র : ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসক? ভগবান? ঐতিহাসিক মানুষ?

বাল্মীকির রাম কেবল ক্ষত্রিয় রাজা, কোনো অবতার বা ভগবান নন। বিভিন্ন পৌরাণিক সূত্র থেকে জানা যায়, রাম রাজত্ব করেছিলেন ত্রেতা যুগেত্রেতা যুগের সময়কাল ১২ লাখ ৯৬ হাজার বছর। অনেকে বলেন, রাম বেঁচেছিলেন ১০,০০০ বছর, “দশবর্ষ সহস্রাণি দশবর্ষ শতানিচ/রামোরাজ্য মুপাসিত্বা ব্রহ্মলোকং প্রস্যতি”। উচ্চতায় ছিলেন তাঁর নিজের হাতের মাপে ১৪ হাত। রামায়ণে মানুষের এরকম বিশাল বিশাল আয়ুর কথা নানা জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক কেদারনাথ মজুমদার বলেছেন–“এইরূপ বৃহৎ সংখ্যাবাচক নির্দেশগুলি যে পৌরাণিক যুগের কল্পনাসম্ভুত, তাহা বলাই বাহুল্য।” শ্রীরামচন্দ্রের জন্ম আর জন্মভূমি নিয়ে এ দেশে তুমুল বিতর্ক। শ্রীরামের জন্মকাল সুনির্দিষ্ট সাল-তারিখ দিয়ে নির্ধারণের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা বিশেষ নেই। রাম দশরথ-কৌশল্যার জ্যেষ্ঠ পুত্র-সন্তান। তবে সন্তান হিসাবে জ্যেষ্ঠ নন। তার কারণ দশরথের প্রথমটি কন্যা-সন্তান, শান্তা৷ রামায়ণের মুখ্য পুরুষ চরিত্র রাম ও তার অনুজ ভরত, লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্নের জন্ম বেশ বিতর্ক আছে। অনেক গবেষক-পণ্ডিত বলেন শ্রীরামচন্দ্র দশরথের ঔরসজাত সন্তান নন। তিনি এবং তার অন্যান্য ভ্রাতৃসকল ঋষ্যশৃঙ্গেরই ‘ক্ষেত্রজ’ সন্তান। অতএব রামের জন্মদাতা পিতা ঋষ্যশৃঙ্গ, দশরথ পালকপিতা। বাল্মীকির রামায়ণে বলাই হয়েছে–“বিপ্রবর ঋষ্যশৃঙ্গ হইতে তাঁহার এই পুত্রেষ্টি পূর্ণ হইবে এবং তাঁহার ঔরসে ত্রিলোক বিখ্যাত অতুল বলসম্পন্ন বংশধর চারিপুত্র উৎপন্ন হইবে।” (রামায়ণ/হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যভারবি/প্রথম সংস্করণ/পৃষ্ঠা ৩৯) সারথী সুমন্ত্রও একই আশ্বাস দিয়েছিলেন–“ঋষ্যশৃঙ্গই আপনার (দশরথের) সন্তানকামনা পূর্ণ করিবেন।” (রামায়ণ/হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যভারবি/প্রথম সংস্করণ/পৃষ্ঠা ৩৫) অশ্বমেধ যজ্ঞের আস্থা না-থাকায় দশরথও যজ্ঞশেষে ঋষ্যশৃঙ্গকে বিনীতভাবে অনুরোধ করেছিলেন–“সুব্রত! যাহাতে আমার বংশরক্ষা হয়, আপনি এইরূপ কার্য অনুষ্ঠান করুন।”(পৃষ্ঠা ৪৬) এত বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের পিতা হওয়ার ব্যাপারটায় পাছে প্রজাদের সন্দেহ হয়, সেই সন্দেহ নিরসনের জন্য একটি লোক-দেখানো অশ্বমেধ (এই অশ্ব পক্ষবিশিষ্ট বলে বাল্মীকির রামায়ণে উল্লেখ হয়েছে। ঋগবেদে বলা হয়েছে এই অশ্ব সমুদ্র থেকে জায়মান। বেদ বলছে, শ্যেনপক্ষীর মতো এদের পাখা ছিল। যেসব প্রাণীতত্ত্ববিদ এই অশ্ব সম্বন্ধে গবেষণা করেন তাঁরাই বলতে পারবেন এমন পক্ষযুক্ত অশ্বের উদ্ভব সম্ভব ছিল কি না। তবে ঋগবেদের সময় থেকে রূপকথার পক্ষীরাজ ঘোড়া পর্যন্ত এই পক্ষবিশিষ্ট অশ্ব সম্বন্ধে কিংবদন্তি চলে আসছে। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে আছে–“অপসু যোনির্বা অশ্বঃ”, অর্থাৎ জল থেকে অভ্যুদয় হয়েছে বলেই একে অশ্ব বলা হয়।)

যজ্ঞেরও আয়োজন করলেন দশরথ। নিয়ম অনুযায়ী যজ্ঞের উদ্দেশে সেই অশ্ব বিভিন্ন দেশ বা রাজ্য সসৈন্যে ঘুরে বেড়াবে এবং যে যে দেশ বা রাজ্য বিনা বাধায় অতিক্রম করে যাবে সেই সেই দেশই যজ্ঞকারী রাজার অধীন হবে। কিন্তু দশরথ তা করেননি। কারণ দশরথ ছিলেন অত্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষমতার রাজা বা নরপতি। তাঁর পক্ষে ব্যয়বহুল তথা যথার্থ অশ্বমেধ যজ্ঞ করা প্রায় অসম্ভব। তাই নিজের রাজ্যের চারদিকে অশ্বকে ঘুরিয়ে এনে যজ্ঞ সমাপন করেছিলেন। যুদ্ধবিগ্রহও রাজা দশরথের একেবারেই না-পছন্দ। তাই রাজা দশরথের রাজ্যও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়নি। ওই ক্ষুদ্র রাজ্য নিয়েই রাজা দশরথ সন্তুষ্টই ছিলেন। যাই হোক, সংশ্লিষ্ট অশ্ব ফিরে এলে প্রধানা মহিষীকে তাঁর সঙ্গে রাত্রিযাপন করতে হত, কৌশল্যাও রাত্রিযাপন করলেন। পরদিন সেই যজ্ঞপূত অশ্বকে প্রধানা মহিষী কর্তৃক কর্তন করে ভক্ষণ করা হত। অশ্বদের পুরুষের পুত্রস্বরূপ বলা হয়েছে। তাই পুত্রার্থে অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করতেন অপুত্রক রাজারা।

মনে রাখতে হবে কৌশল্যার জ্যেষ্ঠ সন্তান শান্তা। শান্তার স্বামী ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি। আবার ঋষ্যশৃঙ্গের পিতা রোমপাদ। রোমপাদের স্ত্রী বর্ষিণী হলেন কৌশল্যার বোন। রোমপাদের দ্বারা ক্ষেত্রজ সন্তান শান্তাকে লাভ করেন কৌশল্যা। সেই হিসাবে ঋষ্যশৃঙ্গ যেমন রোমপাদের নিজের ঔরসজাত সন্তান, অপরদিকে শান্তা ক্ষেত্রজ হলেও নিজের ঔরসজাত সন্তান। তাহলে সম্পর্কটা দাঁড়াল ঋষ্যশৃঙ্গ কৌশল্যার ভগ্নীপুত্র। ভগ্নীপুত্র মানে ঋষ্যশৃঙ্গ কৌশল্যার সন্তানতুল্য। আবার কন্যার স্বামী হিসাবে জামাইও বটে। এমন এক সম্পর্কের পুরুষ, সে আবার শান্তা ও দশরথের অনুরোধে কৌশল্যাকে ‘পুত্রকামাষ্টি যজ্ঞ’ বা ‘পুত্রেষ্টি যজ্ঞ’-এর মাধ্যমে চার ক্ষেত্রজ সন্তান উপহার দেয়। সেই চার সন্তান হলেন–রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন। অর্থাৎ চরম অজাচার। ( ‘immortal Love of Rama’–G. B. Kanuga) এসব ঘটনা বাল্মীকি রামায়ণের বালকাণ্ডে পাবেন।

যেসব পণ্ডিতেরা বলেন বালকাণ্ড প্রক্ষিপ্ত, সেসব পণ্ডিতেরা কেন দশরথের পুত্রলাভে ঋষ্যশৃঙ্গকে টেনে আনলেন? ঋষ্যশৃঙ্গকে তো কেবলমাত্র বাল্মীকির রামায়ণে বালকাণ্ডতেই পাওয়া যায়। অন্য কোথাও নেই। দু-দিক নয়–হয় প্রক্ষিপ্ত, নয় প্রক্ষিপ্ত। যদি প্রক্ষিপ্ত হয় ঋষ্যশৃঙ্গ দ্বারা পুত্র-কন্যার জন্মবৃত্তান্তকে অগ্রাহ্য করতেই হয়। আর যদি বালকাণ্ডকে আদি বাল্মীকির স্বরচিত বলে মেনে নিই, তাহলে তো অজাচার সম্পর্ককে মেনে নিতেই হবে। ক্ষেত্রজই বলি আর পুত্রকামাষ্টি যজ্ঞই বলি, মৈথুন ছাড়া, শুক্রাণু-ডিম্বাণুর নিষেক ছাড়া সন্তানের জন্ম কোনোদিন কোনোভাবেই হয়নি। সম্ভবও নয়। অতীতে হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।

শ্রীরামচন্দ্র পিতৃসত্য পালনকারী হিসাবে বেশ প্রসিদ্ধ। পিতৃসত্য পালনের জন্য শ্রীরামচন্দ্র ভারতীয়দের মনে আদর্শ হয়ে আছেন। কেমন ছিল সেই পিতৃসত্য পালন? আসলে শ্রীরামচন্দ্রের কাছে বনবাসে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। শ্রীরামচন্দ্র বনবাসে যেতে বাধ্য। শ্রীরামচন্দ্র যদি বিনা প্রশ্নে বনবাসে না যেতেন, তাহলে দশরথের প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হত। যদি না যেতেন কী হত? বাল্মীকির রামায়ণে বিশ্লেষণ করলে যেটা পাওয়া যায়, সেটা হল, রাজ্য ও রাজত্বের জন্য শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে ভরতের যুদ্ধ অনিবার্য হত। রাম ছাড়লেও ভরত শত্রুঘ্ন-বশিষ্ঠ-কেকয়রাজ কেউ ছেড়ে দিত না। মহাভারতের মতো ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ হত। তদুপরি দশরথের সঙ্গে কেকয়রাজ অশ্বপতির যুদ্ধ হত এবং দশরথ পরাজিত হত। দশরথ যে যুদ্ধবাজ ছিলেন না, তা বোঝা যায় মাত্র ৪৯৫ বর্গমাইল ভূখণ্ড নিয়ে তাঁর খুশি থাকায়। দশরথ এবং শ্রীরামচন্দ্র দুজনেই ছিলেন শান্তিকামী মানুষ। অনাবশ্যক যুদ্ধ-সংঘর্ষ এড়াতে একবাক্যে বনবাস গমনই একমাত্র পথ। (অথচ এই শান্তিকামী রামচন্দ্রকেই পরবর্তী সময়ে দেখব আর্যদেবতাদের প্ররোচনায় পা দিয়ে কীভাবে নৃশংস যুদ্ধবাজে পরিণত হলেন)। বনবাস গমনই একমাত্র পথ ভাবার কারণ এর প্রস্তুতি পূর্বেই ছিল। হঠাৎ করে মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়েনি। কৈকেয়ীর পুত্রই ভবিষ্যতে অযোধ্যার সিংহাসনে আরোহণ করবে, এই প্রতিশ্রুতি বিয়ের আগেই দশরথ দিয়েছিলেন কৈকেয়ীর পিতাকে। কৈকেয়ীর বিয়ের সময় থেকেই দশরথ এই প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে সত্যবদ্ধ। ছিলেন। দশরথ-পরবর্তী ভরত অযোধ্যার রাজা হলে শ্রীরামচন্দ্রের আর কাজ কী বনবাসে যাওয়া ছাড়া! দশরথের সঙ্গে শ্বশুর অশ্বপতির প্রতিজ্ঞাকে দুইজন মাত্র অস্বীকার করতেই পারতেন। একজন কৈকেয়ী, তিনি যদি দশরথের কাছ থেকে ভরতের জন্য অযোধ্যার সিংহাসন না-চাইতেন। দ্বিতীয়ত ভরত, তিনি যদি দাদার অগ্রাধিকারকে মূল্য দিয়ে অযোধ্যার সিংহাসন গ্রহণ করতে অস্বীকার করতেন। বস্তুত ভরতও সেই সত্য জেনে জেনেই বড়ো হয়েছেন যে, তিনিই অযোধ্যার রাজা হচ্ছেন। জেনেছেন মা কৈকেয়ী ও দাদু অশ্বপতির কাছ থেকেই। দশরথকেও সর্বক্ষণ এই প্রতিজ্ঞা তাড়া করে নিয়ে বেড়াত। রামচন্দ্রসহ নিকটবর্তী সকলেই এ প্রতিজ্ঞার কথা জানতেন। দশরথ ভরতকে একেবারেই পছন্দ করতেন না। দশরথ মনে করতেন রামের জন্য ভরতের ভূমিকা মারাত্মক হতে পারে। তাই দশরথ ভরত ও তাঁর দোসর শত্রুঘ্নকে মাতুলালয়ে পাঠিয়ে দেন ১২ বছরের জন্য। এই বারো বছরে একবারের জন্যেও ভরতের খোঁজ নেননি বিচক্ষণ রাজা দশরথ।

শুধু তাই নয়–মাতা কৈকেয়ী, পিতা দশরথ এবং স্বদেশ অযোধ্যা ত্যাগ করে যাওয়ার পর ১২ বছরের মধ্যে একবারের জন্যেও অযোধ্যায় ফেরেননি ভরত। এর ফলে রাজঅন্তঃপুরে ভরতের জনপ্রিয়তা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যায়। অপরদিকে রামচন্দ্রের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে আসে। এই দীর্ঘ ১২ বছর ব্যাপী দশরথ রাজ্যাভিষেকের নিমিত্তেই রামকে প্রস্তুত করছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারেননি। রামের ২৮ বছর সমাপ্তি এবং রামের রাজ্যাভিষেকের সময় আসন্ন। আয়োজনের আগের দিন অন্দরমহলের ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন দশরথ। দশরথ বন্দি হলেন কৈকেয়ীর গৃহনজরে। অন্তরীণ করে রাখা হল তাঁকে। কৈকেয়ী দশরথকে জানিয়ে দিলেন রামকে চোদ্দো বছরের জন্য বনবাসে যেতে হবে এবং ভরতই হবে অযোধ্যার রাজা। নিরূপায় দশরথ ভেঙে পড়লেন, মুহ্যমান হলেন। দশরথ কৈকেয়ীর ভয়ে ভীত, সন্ত্রস্ত। কৈকেয়ীকে অগ্রাহ্য করা মানে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানো। দশরথ বুঝে গিয়েছিলেন কুলগুরু বশিষ্ঠের নেতৃত্বে অযোধ্যার সিংহাসন দখলের অতঃসলিলা ষড়যন্ত্র চলছে। বশিষ্ঠ ছিলেন ভরতের প্রবল সমর্থক এবং রামের বিরোধী। ভরত কুলগুরু বশিষ্ঠের দ্বারা দীক্ষিত হন এবং রাম দীক্ষিত হন বিশ্বামিত্রের দ্বারা। বিশ্বামিত্র আর বশিষ্ঠ একে অপরের জাতশত্রু। সেই বিশ্বামিত্রকে ভ্যানিশ (অন্তর্হিত?) করে দিয়েছেন বশিষ্ঠ অনেক আগেই, যেদিন ষোলো বছর বয়সে রামচন্দ্রকে বিয়ে করিয়ে ফিরছিলেন বিশ্বামিত্র। গোটা রামায়ণে বিশ্বামিত্রকে আর দেখা যায়নি সেদিন থেকে। কেকয়রাজ বশিষ্ঠের সমর্থক। কেকয়রাজ অশ্বপতির কন্যা কৈকেয়ী এবং ভরত দৌহিত্র। অতএব চক্রান্তের গভীরতা বুঝতে দশরথের এতটুকু অসুবিধা হয়নি। ভরতের রাজা হওয়ার পথে রাম ছিলেন সাক্ষাৎ কাঁটা। কৈকেয়ী চেয়েছিলেন রামকে চিরতরে সরিয়ে ফেলতে। আর তাই তিনি রামকে কেবল বনবাসে পাঠিয়েই ক্ষান্ত হননি, বনটিও তিনিই নির্বাচন করলেন–দণ্ডকারণ্য, দণ্ডকারণ্য যে এক ভয়াল-ভয়ংকর শ্বাপদসংকুল এবং হিংস্র মানুষখেকো রাক্ষস অধ্যুষিত জঙ্গল কৈকেয়ী তা বিলক্ষণ জানতেন। এখানে বসবাস তো দূরের কথা, প্রবেশের পর কারোর পক্ষেই জীবন্ত ফিরে আসা সম্ভব নয়। অতএব ভরতের সিংহাসন আজীবনকাল নিরঙ্কুশ।

কৈকেয়ী যখন দশরথকে ডেকে জানিয়ে দিলেন চতুর্দশ বর্ষ দণ্ডকারণ্যে রামের বসবাস এবং ভরতের অভিষেক, একথা শ্রবণ করে ক্রোধে দশরথ কৈকেয়ীকে তুই-তোকারি করে ব্যাকালাপ করতে দ্বিধা করেননি৷ বলেছেন–“এক্ষণে তোকে ও আমার ঔরসজাত পুত্র তোর ভরতকে পরিত্যাগ করিলাম। রজনী প্রভাত হইয়াছে। আমি কিছুতেই তোর কথা শুনিব না। তোকে অবমাননা করিব ও রামকে রাজ্য দিব।” অতএব দশরথ রামকে বনবাসে পাঠাতে একদম পাঠাতে রাজি নন। ভরতকেও রাজা করতে চান না। কিন্তু কৈকেয়ীও সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নন, কড়া ভাষায় হুকুম দিলেন–“তুমি এখন রামকে এ স্থানে আনাও এবং তাহাকে বনবাসে দিয়া ভরতকে রাজা করো। তুমি আমার শত্রু দূর না করিয়া এ স্থান হইতে এক পদও যাইতে পারিবে না।” (রামায়ণ/ভারবী/প্রথম সংস্করণ/পৃঃ ১৬৫) দশরথ কার্যত কৈকেয়ীর ক্রোধাগারে বন্দি হলেন। ইতিমধ্যে সুহৃদ অমাত্য ও সারথি সুমন্ত্র দশরথকে জানিয়ে দিয়ে গেছেন পরিস্থিতি খুবই প্রতিকূল। রাজদরবার এখন ব্রাহ্মণ বশিষ্ঠ তাঁর সঙ্গীদের দখলে, ক্ষত্রিয়রা নেই। আগের রাতে দশরথ রামকে জীবনসংশয় আছে বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। রামও পিতার আসন্ন বিপদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ অনবহিত ছিলেন।

দশরথের আদেশে সুমন্ত্র রামকে নিয়ে যেতে আসেন। রামের আজ অভিষেক হওয়ার কথা। যাওয়ার সময় জানকীকে তিনি বলে গেলেন–“প্রিয়ে, আমার নিমিত্ত পিতা দেবী কৈকেয়ীর সহিত সমাগত হইয়া আমারই অভিষেকের পরামর্শ করিতেছেন সন্দেহ নাই।.. পিতা নিশ্চয়ই আজ আমাকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিবেন।” রাম খুশি খুশি মনে দশরথের কাছে পৌঁছোলেন। কিন্তু পিতার অবস্থা দর্শন করে রাম চুপসে গেলেন। হাওয়া ভালো নয় বুঝে গেলেন বিচক্ষণ রাম। রামের দর্শনমাত্রই দশরথ কেবল ধরা-ধরা গলায় ‘রাম’ শব্দটিই উচ্চারণ পারলেন। দশরথের চোখে জল, বাঁধ মানে না। এতই জল যে রামকে দেখতেই পারছেন না, নির্মম কথাগুলিও রামকে বলতে পারলেন না। যে কথা বলতে দশরথ কষ্ট পাচ্ছেন, সে কথা কৈকেয়ী অবশ্যই অবলীলায় বলে ফেললেন।

রাম বিচক্ষণ পুরুষ। তিনি বুঝলেন প্রাসাদের পরিবেশ খুবই ভয়ংকর। প্রাসাদ-বিপ্লবের শিকার তাঁরা। প্রাসাদ এখন দেবী কৈকেয়ীর দখলে। পিতা বন্দি। উচ্চবাচ্য করলেই পিতার জীবনহানি তো হতে পারে, উপরন্তু মাতা কৌশল্যা ও তাঁদেরও ক্ষতির আশঙ্কা আছে। ভরত বশিষ্ঠের কাছে দীক্ষিত হয়েছেন, রাম নয়। রাম দীক্ষিত বিশ্বামিত্রের কাছে। বিশ্বামিত্রের পথই রামের পথ। অতএব কুলগুরু বশিষ্ঠ ভরতের পক্ষ নিয়ে ষড়যন্ত্রের খুঁটি সাজাচ্ছেন, এ ভাবনায় সন্দেহের অবকাশ কোথায়! তার উপর যখন বশিষ্ঠের সঙ্গে কৈকেয়ীর মতো দুরাচার রাজমাতা, পরম বন্ধু কেকয়রাজ ও তাঁর পুত্র যুধাজিৎ আছেন, তখন দশরথকে শুইয়ে দিতে কঠিন কোথায়? পূর্বে ভরতকে নিষ্কণ্টক করতে প্রতিপক্ষ রামকে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে বনে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বশিষ্ঠই। বশিষ্ঠ ভেবেছিলেন প্রতিপক্ষ রাম আর শত্রুপক্ষ বিশ্বামিত্রের বিনাশ হবে ভয়ংকর নিশাচরদের বিনাশ করতে গিয়ে। ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করলে একথা স্পষ্ট হয় যে, বশিষ্ঠ ভরতের সমর্থক এবং রামচন্দ্রের বিরোধী। কেকয়রাজ বশিষ্ঠের সমর্থক, কৈকেয়ীর পিতা এবং ভরত তাঁর দৌহিত্র। দশরথ এদের একদম পছন্দ করতেন না। কোনো শুভাশুভ কাজে এদের আমন্ত্রণ জানাতেন না, সোজা ইগনোর করতেন। রামের বিয়ে বা রামের রাজ্যাভিষেক–এমন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি দশরথের পক্ষ থেকে। দশরথ জানতেন রাম নয়, ভরতেরই দল ভারী। রামের ছিল কেবল রাজশক্তির প্রতি প্রজাগণের নিরঙ্কুশ আনুগত্য। রামচন্দ্রের প্রতি প্রজাদের এই নিরঙ্কুশ আনুগত্য বশিষ্ঠদের ভীত করেছিল৷ বিবাহসূত্রে রাম যদি জনকরাজা সীরধ্বজের আনুকূল্যে অধিক শক্তিশালী হয়ে ওঠেন, সেই পথও বন্ধ করতে প্রয়াস চালালেন এবং সফলও হলেন। মিথিলায় বশিষ্ঠ, যুধাজিৎ, ভরত, শত্রুঘ্ন নিমন্ত্রিত ছিলেন না, তা সত্ত্বেও তাঁরা অনাহূত হয়ে পৌঁছে গেলেন মিথিলায় বিয়ের আসরে। বশিষ্ঠ ভাবলেন রাম ও লক্ষ্মণ মিথিলাপতির সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়ে গেলে রামচন্দ্রের শক্তি বৃদ্ধি হবে। ভরতের কী হবে! কিন্তু মিথিলাপতি সীরধ্বজের মাত্র দুটি কন্যা–সীতা ও ঊর্মিলা। সীতা রামের স্ত্রী হবেন, ঊর্মিলা লক্ষ্মণের। ভরতের তো কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে! ভরতকে মিথিলার যুক্ত করতেই হবে। অতএব সীরধ্বজের কন্যা নেই তো তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা কুশধ্বজের দুটি কন্যা আছে তো–মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তি। তাঁর উপর আবার কুশধ্বজ বশিষ্ঠপন্থী। এক্কেবারে সোনায় সোহাগা! শেষপর্যন্ত পনেরো কলা পূর্ণ হল বশিষ্ঠের–রাজর্ষি সীরধ্বজের কন্যা সীতা ও ঊর্মিলার সঙ্গে যথাক্রমে রাম ও লক্ষ্মণের এবং কুশধ্বজের কন্যা মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তির সঙ্গে ভরত ও শত্রুঘ্নের বিয়ে সম্পন্ন হল।

এ পর্যন্ত ক্ষমতার লড়াইয়ে জয় বশিষ্ঠরই হল, বিশ্বামিত্রের পরাজয়৷ পনেরো আনা পূর্ণ হয়েছে, ভরতরকে নিরঙ্কুশ করতে আর-একটি কাঁটা উপড়ে ফেলতে পারলেই ষোলো আনা পূর্ণ। সেই কাঁটার নাম বিশ্বামিত্র। যে বশিষ্ঠের পরম শত্রু, সে রামের পক্ষে। বিবাহের পরদিন সকালে কী এমন হল, বিশ্বামিত্র অযোধ্যায় ফিরলেন না। মহর্ষি বিশ্বামিত্র রাজা দশরথ ও জনককে সম্ভাষণ জানিয়ে হিমাচলে প্রস্থান করলেন। হিমাচলে কেন? তাহলে বিশ্বামিত্রও কি ষড়যন্ত্রের শিকার? বশিষ্ঠদের তরফ থেকে কোনো জীবনহানির ‘গ্রেড’ ছিল কী বিশ্বামিত্রের উপর? বিশ্বামিত্রের এটা প্রস্থান, না অন্তর্ধান? জনকপুরীতে অবস্থানকালেই বিশ্বামিত্রকে অন্তর্হিত হতে হল। বিদায়কালে দশরথ ও জনকরাজাকে যথাযথ সম্ভাষণ জানালেও, বশিষ্ঠকে কোনো সম্ভাষণ বিশ্বামিত্র জানাননি। এরপর থেকে বিশ্বামিত্রকে আমরা আর পাইনি গোটা রামায়ণে। তাহলে কি বশিষ্ঠ নিজের শতপুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে নিলেন সুযোগ বুঝে। সেই সুযোগ, যে সুযোগে এক ঢিলে তিন পাখি মারা যায়। পুত্রহত্যার প্রতিশোধ, রামকে শক্তিহীন করে দেওয়া এবং ভরতের নিরঙ্কুশ রাজ্য প্রদান করা। কারণ ভরতকে অযোধ্যার রাজা করতে পারলেই রাজদরবারে বশিষ্ঠের আধিপত্য থাকবে, রামের ক্ষেত্রে সেটা উলটো হবে। রাম অযোধ্যার রাজা হলে বিশ্বামিত্রের আধিপত্য রক্ষা হত। বশিষ্ঠ কোণঠাসা হয়ে পড়ত। এ অপমান বশিষ্ঠের সহ্য হবে কেন? ব্রাহ্মণ বলে কথা!

অযোধ্যার পরিস্থিতি বড়ই জটিল। রাজা দশরথ ভয়ে জুজু, অসহায়। লোকবল, সৈন্যবল সবই কৈকেয়ীর নিয়ন্ত্রণে। এমতাবস্থায় রামের যত দ্রুত সম্ভব অযোধ্যা ত্যাগ করাই বিধেয়। তাতে পিতা দশরথ, মাতা কৌশল্যা এং নিজের প্রাণ রক্ষা করতে পারবেন। বাল্মীকির রামায়ণে রাম সরাসরিই বলেছেন–“লক্ষ্মণ আমার বোধ হইতেছে যে, ভরতকে রাজ্যে নিয়োজিত, আমাকে নির্বাসিত ও পিতার প্রাণান্ত করিবার নিমিত্তেই কৈকেয়ী আসিয়াছেন।” অযোধ্যা ত্যাগ তথা বনবাসে যাওয়ার সিদ্ধান্তের ঘটনায় রামচন্দ্র যতটা-না পিতাকে মান্য করেছেন, তার চেয়ে বেশি মান্য (?) করেছেন বিমাতা কৈকেয়ীকে। বাল্মীকির রামায়ণে রামের মনোভাবকে স্পষ্ট করেছে, ক্ষোভে রাম বলছেন লক্ষ্মণকে–“ভার্যার সহিত ভরতই সুখী, তিনি একাকী অধিরাজের ন্যায় সমগ্র কোশল রাজ্য উপভোগ করিবেন। পিতা জীর্ণ হইয়াছেন, আমিও অরণ্য আশ্রয় করিলাম, সুতরাং তিনি একাকীই রাজা হইবেন।” পিতা দশরথের উদ্দেশে বলেন–“যিনি ধর্ম ও অর্থ পরিত্যাগ করিয়া কামের অনুসরণ করেন, তিনি শীঘ্রই রাজা দশরথের ন্যায় এইরূপ বিপন্ন হন, সন্দেহ নাই।” নির্বাসন-ক্ষুব্ধ রাম পিতা দশরথকে কামের অনুসরণকারী বলে উল্লেখ করেছেন। পিতা দশরথকে কামুক’ বলেছেন লক্ষ্মণও। বাল্মীকির রামায়ণে কৈকেয়ীর মুখের কথাতেই রামচন্দ্র বনবাসগমনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দশরথ তো তাঁর নিজের মুখে শ্রীরামচন্দ্রকে বনবাসেই যেতে বলেননি। দশরথ সেকথা কোনোদিন বলতেও পারতেন না এমন কঠিন কথা। পিতা দশরথ একবারের জন্যেও রামকে বনবাসে যেতে আজ্ঞা করেননি–জনসমক্ষেও নয়, একান্তিকেও নয়। কারণ রামচন্দ্রকে দশরথ নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি স্নেহ করতেন। সেই কঠিন কথা অন্য কেউ বলে ফেলেছেন তা শুনেই দশরথ অসুস্থ হয়ে পড়েন। দশরথ যতই রামচন্দ্রকে অন্ধের মতো স্নেহ করুক না-কেন, রামচন্দ্র যে পিতার প্রতি অন্ধভক্ত ছিলেন তার কিন্তু কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না৷ এক, বনবাসের যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পিতার অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকেননি। সিদ্ধান্তটা তিনি একাই চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। দুই, বনবাসের আগে মাত্র ষোলো বছর বয়সে যখন যজ্ঞবিনাশকারীদের বিনাশ করতে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে অরণ্যে রওনা দিয়েছিলেন, তখনও দশরথের ওজর-আপত্তিকে রামচন্দ্র গ্রাহ্য করেননি। বস্তুত রামচন্দ্র বড়ো ও উপযুক্ত হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দশরথ খুব চাপের মধ্যে কাটাচ্ছিলেন। দশরথ যে কেকয়রাজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন, তা তিনি নিজেই মনে রাখার প্রয়োজন মনে করেননি। সেই প্রতিজ্ঞাকে স্বয়ং দশরথই পাত্তা দেননি। পাত্তা দেননি তার প্রমাণ মিথিলা থেকে রামের বিয়ে করে আসার পর দশরথ ভরত ও তাঁর অঙ্গরক্ষক শত্রুঘ্নকে ১২ বছরের জন্য মাতুলালয় কেকয়রাজের কাছে কৌশল করে পাঠিয়ে দেন। দশরথ জানতেন ভরত রামের জন্য বিপজ্জনক। পরবর্তী ১২ বছর ব্যাপী পিতা দশরথ পুত্র রামচন্দ্রকে অযোধ্যার পরবর্তী রাজা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এই ১২ বছর দশরথ ভুলেও ভরতকে অযোধ্যায় আসতে বলা তো দূরের কথা, স্মরণ পর্যন্ত করেননি। বাস্তবিক ক্ষেত্রে শেষরক্ষা করতে পারেননি দশরথ। তীরে এসে তরী ডুবে যায়। শ্রীরামচন্দ্রের রাজা হতে না-পারাটা দশরথ মানসিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। রাজা দশরথ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কৈকেয়ীর নির্দেশে সত্যাসত্য পিতার কাছ থেকে যাচাই করার সাহস দেখালেন না পুত্র রামচন্দ্র।

কয়েকদিনের মধ্যেই দশরথ প্রাণত্যাগ করলেন। রামচন্দ্র পিতা দশরথের মানসিক বিপর্যস্ততা উপলব্ধি করতে পারলেন না। রামের বনবাস এবং ভরতের রাজত্বলাভ দশরথ কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। পিতার সত্যরক্ষা করতে গিয়ে পিতারই মৃত্যুর কারণ হলেন রামচন্দ্র। যাঁর জন্য রামচন্দ্র মহত্বের পরিচয় দিলেন, সেই ব্যক্তির মৃত্যু হল বনগমনের পর। যাঁর জন্য সত্যরক্ষা, তিনিই থাকলেন না। তাহলে কি এটাই বোঝায় প্রাণ দিতে হলেও সত্যরক্ষা করতেই হবে? দশরথ তো সত্যরক্ষা করতে পারেননি। দশরথের যৎসামান্য সত্যরক্ষা হয়েছে রামের বনবাসের মাধ্যমেই। রাম বনবাস মেনে না নিলে দশরথের মৃত্যু হত না। আর দশরথের মৃত্যু না-হলে ভরত কোনোদিনই রাজা হতে পারতেন না। দশরথ কখনোই ভরতের হাতে রাজত্ব তুলে দিতেন না।

শুধু এটুকুই নয়, ভরতের রাজা হওয়া আর শ্রীরামচন্দ্রের বনবাসে যাওয়ার পিছনে এক শক্তিশালী ‘বি’ কাজ করেছে। ভরতের পক্ষে বশিষ্ঠের লবি এবং শ্রীরামচন্দ্রের পক্ষে বিশ্বামিত্রের লবি। বিশ্বামিত্র আর বশিষ্ঠের মধ্যে বিরোধের কাহিনি সর্বজনবিদিত (দুই ঋষি বিরোধের কাহিনি বিশ্বামিত্রের আলোচনার সময়ে বিস্তারিত বলব।)। এই দুই ঋষির ব্যক্তিগত বিরোধই রাম-ভরতের মধ্যে আপাতনিরীহ সংঘর্ষ। রামও যথাসময়ে সেই বিপদের গন্ধ পেয়েছিলেন। রাম বুঝেছিলেন এঁদের সঙ্গে যুঝে ওঠা কোনোমতেই সম্ভব নয়। সিংহাসনের জন্য গা-জোয়ারি করলে দশরথ ও রাম গুপ্তখুনও হয়ে যেতে পারেন। রামকে বনবাসে পাঠানোর উদ্দেশ্যও কৈকেয়ীর সেই কারণেই। তিনি বনবাসে পাঠিয়েও ক্ষান্ত হননি, ভয়ংকর জঙ্গল দণ্ডকারণ্য নির্বাচন করে দিলেন। দণ্ডকারণ্য এমন এক গভীর জঙ্গল, যা শ্বাপদসংকুল ও নরমাংসখেকো রাক্ষস-খোক্ষস অধ্যুষিত–যেখানে প্রবেশ করলে আর প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা সম্ভব নয় কারোর পক্ষে। কৈকেয়ীরা ভেবেছিলেন রামচন্দ্র আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না, ভরতও সারাজীবন নিরঙ্কুশ থাকবে। রামচন্দ্রও সমস্ত ক্ষোভ উগরে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন (নির্গত হইলে আজ কৈকেয়ী কৃতকার্য হইয়া নিষ্কণ্টক আপনার পুত্র ভরতকে রাজ্যে অভিষেক করিবেন। আমি জটাবল ধারণপূর্বক অরণ্যে প্রস্থান করিলে তিনি মনের সুখে কালযাপন করিতে পারিবেন।” ((রামায়ণ/হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য/ভারবি/প্রথম সংস্করণ/পৃষ্ঠা ১৮১)

তবে দেবী কৈকেয়ীর সাধ পূরণ করবেন, এমন সাধও শ্রীরামচন্দ্রের ছিল না। তাই কৈকেয়ীর আদেশমতো রামচন্দ্র দণ্ডকারণ্যে যাওয়ার কথা মনেই রাখেননি। কারণ রাম বিলক্ষণ জানতেন, দণ্ডকারণ্য কোনোভাবেই মনুষ্যের উপযুক্ত নয়। তাই অযোধ্যা থেকে বেরিয়ে সারথী সুমন্ত্রকে নিয়ে দণ্ডকারণ্যে নয়, গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থল প্রয়াগে ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে পৌঁছে সুমন্ত্রকে অযোধ্যায় ফিরে যেতে আদেশ করেন। সুমন্ত্রও এদিক ওদিক ঘুরে সময় অতিবাহিত করে অযোধ্যায় পৌঁছে যান। রাম-লক্ষ্মণ-সীতা মুনির কাছে রাত কাটিয়ে পরদিন দশ ক্রোশ দূরে চিত্রকুট পর্বতের কাছে পৌঁছোলেন। এখানে অসংখ্য মুনিঋষিদের বাস, খাদ্য-খাবার-পানীয়ও সহজলভ্য। অতএব রাম সিদ্ধান্ত নিলেন–“ইহা বসবাস করিবার যোগ্য স্থান৷” তিনি লক্ষ্মণকে নির্দেশ দিলেন–“দৃঢ় উৎকৃষ্ট কাষ্ঠ আনিয়া গৃহ প্রস্তুত করো। চিত্রকুটে বাস করিতে আমার অত্যন্তই অভিলাষ হইয়াছে।” বিশ্বস্ত মুনি ভরদ্বাজের গৃহে বা আশেপাশে গৃহনির্মাণ করে বসবাস করতেই পারতেন। পারতেন ঠিকই, কিন্তু সে স্থান রামেদের জন্য নিরাপদ ছিল না বলেই রামের আশঙ্কা ছিল। লোকমুখে কোনোভাবে তার এই অবস্থানের খবর অযোধ্যায় পৌঁছোলে তিনি বিপদগ্রস্ত হতে পারেন–এই ছিল আশঙ্কা। দণ্ডকারণ্যে মৃত্যুর ফাঁদে নিজেদের সঁপে না-দিয়ে, চিত্রকুটেই আত্মগোপন করে নিরাপদে থাকতে চেয়েছিলেন। বনবাসকালীন রাম সারাক্ষণই আতঙ্কে ছিলেন। এই বুঝি ভরত অরণ্যে ঢুকে পড়ে এবং তাঁকে হত্যা করে। এই আশঙ্কার কথা নিজ বন্ধু নিষাদরাজ গুহককে জানিয়ে রাখতে ভোলেননি। গুহকও রামকে রক্ষা করতে তাঁর সৈন্যদের পরোক্ষভাবে প্রস্তুত থাকতেও বলেছিলেন।

চিত্রকুট পর্বতশৃঙ্গে অবস্থানও রাম যখন দগ্ধ মৃগমাংস সহযোগে সীতার মনোরঞ্জন করছিলেন, তখন দিগন্তব্যাপী ধুলো উড়িয়ে তুমূল কোলাহল কানে এলো। লক্ষ্মণ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে একটা দীর্ঘ শালগাছে উঠে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে রামকে বললেন–“আর্য, এক্ষণে অগ্নি নির্বাণ করিয়া ফেলুন, জানকী গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হউন, আর আপনি বর্ম ধারণ কামুকে জ্যা আরোপণ ও শর গ্রহণ করিয়া প্রস্তুত হইয়া থাকুন।… আর্য, কৈকেয়ীর পুত্র ভরত অভিষিক্ত হইয়া রাজ্য নিষ্কণ্টক করিবার বাসনায় আমাদের নিধন কামনায় উপস্থিত হইয়াছে।.. যাহার নিমিত্ত আপনি রাজ্যচ্যুত হইলেন, এক্ষণে সেই শত্ৰু উপস্থিত হইয়াছে। সে আমাদের বধ্য, তাহাকে বধ করিতে আমি কিছুমাত্র দোষ দেখি না।… এক্ষণে আপনি ঐ দুষ্টকে বধ করিয়া সমগ্র পৃথিবী শাসন করুন।” চতুরঙ্গ সৈন্যবাহিনী নিয়ে রামকে ফিরিয়ে আনতে (লোক-দেখানো) অযোধ্যার রাজা ভরত চিত্রকুটে পৌঁছেলে এবং পিতার মৃত্যুসংবাদ দিয়ে রামকে অযোধ্যায় ফিরে যেতে অনুরোধ করলে, রাম স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে–বনবাসের কাল অতিক্রান্ত হলেও দশরথবিহীন অযোধ্যায় আর ফিরবেন না। কোনোভাবেই তিনি ভরতের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চান না। এরপর সুদীর্ঘ চোদ্দো বছরে একবারের জন্যেও ভরতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি রাম।

ভরত চিত্রকুট থেকে বিদায় নিলে ভরতের চোখে ধুলো দিতে রাম অকুস্থল ত্যাগ করে অবশেষে দণ্ডকারণ্যের পথেই পাড়ি দিলেন। এর ফলে পিতৃসত্যও রক্ষা হল, ভরতের চোখের আড়াল করা গেল নিজেদেরকে। বাল্মীকি বলেছেন–“অনন্তর নানা কারণে রামের তথায় বাস করিতে আর প্রবৃত্তি রহিল না৷” অবশ্য ভরতও রামকে মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি যে, চিত্রকুট পর্বতের মতো মনোরম স্থানে বসবাসের জন্য বনবাস নয়, নির্বাসন দণ্ডাদেশ হয়েছিল রাক্ষস অধ্যুষিত দণ্ডকারণ্যে। কাজেই সেই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হওয়া প্রয়োজন। অতএব অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাম প্রায় বাধ্য হয়েই দণ্ডকারণ্যের গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলেন এবং নানা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে থাকলেন–যা অনভিপ্রেত। গভীর অরণ্যে ভিনদেশি মানুষকে অরণ্যবাসীরা খুব স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে পারেনি। তার উপর তাঁরা আবার সশস্ত্র! ফলে প্রতিমুহূর্তে রাম-লক্ষ্মণদের সংঘর্ষের মুখোমুখি হতে হয়েছে। দণ্ডকারণ্যে প্রবেশ থেকে শুরু করে সীতার খোঁজে পম্পা নদীর তীরে সুগ্রীবের কাছে পৌঁছোতে পৌঁছোতে টিকে থাকার তাগিদে প্রায় ১০,০০০ রাক্ষস-খোক্ষস-নিশাচরদের নির্বিচারে হত্যা করতে হয়েছিল আত্মরক্ষার তাগিদে।

ইতিমধ্যে এক স্বর্ণময় হরিণীকে কেন্দ্র করে ঘটে যায় অঘটন। সেই স্বর্ণময় হরিণ দেখতে পেয়ে সীতা প্রলুব্ধ হয়ে পড়লেন। রামকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন জীবিত অবস্থায় হরিণটিকে ধরে এনে দেন, তিনি পুষবেন। স্ত্রীর মনোরঞ্জনের খাতিরে, আগুপিছু কিছু না-ভেবে রামও ছুটলেন হরিণ ধরতে। হরিণের ছদ্মবেশে মারীচ পরিকল্পনামাফিক রামের কণ্ঠ নকল করে সীতা’ ‘লক্ষ্মণ’ বলে আর্ত চীৎকার করতে শুরু করে দিল। রামের কণ্ঠে আর্ত চীৎকার শুনে সীতা বিচলিত হয়ে পড়ে। লক্ষ্মণকে প্ররোচনা দিয়ে স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দেন। লক্ষ্মণও বাধ্য হয়ে সীতাকে অরক্ষিত (কৃত্তিবাস লক্ষ্মণকে দিয়ে লক্ষ্মণরেখা’ও টানিয়েছিলেন।) রেখে দাদার খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। ইত্যবসরে রাবণ ব্রাহ্মণের বেশ ধরে অকুস্থলে এসে সীতাকে অপহরণ করে স্বদেশে পালিয়ে যান। যাত্রাপথে সীতা রাবণ কর্তৃক নিদারুণভাবে লাঞ্ছিত হলেন। এ ঘটনাটি ঘটল এমনি এমনি নয়, এ ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল শূর্পণখাকে কেন্দ্র করে। গোদাবরী নদীর কাছে এক রমণীয় সরোবর তীরে অবস্থিত পঞ্চবটিতে সুরম্য পর্ণকুঠীর তৈরি করে বেশ দিব্যি কাটছিল রামচন্দ্রদের। শূর্পণখা এই অরণ্যেই বিচরণ করতেন। সৌম্যদর্শন দুই সুঠাম সুপুরুষকে দেখে শূর্পণখা আর ঠিক থাকতে পারেননি। কামজ্বরে জর্জরিত হয়ে প্রথমে রামকে বিয়ের প্রস্তাব দেন শূর্পণখা। তিনি বিবাহিত জানিয়ে রাম তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং লক্ষ্মণ অবিবাহিত এই সংবাদ দিয়ে লক্ষ্মণকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পরামর্শ দিলেন। শূর্পণখা অতি উৎসাহিত হয়ে লক্ষ্মণের কাছে যান এবং তাঁকে বিবাহের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। লক্ষ্মণও প্রত্যাখ্যান করলে শূর্পণখা ক্ষিপ্ত হয়ে সীতা উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় লক্ষ্মণ নিজেকে সামলাতে পারলেন না। অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে খড়গ দিয়ে শূর্পণখার নাক ও কান উভয়ই ছিন্ন করে দিলেন। রক্তাক্ত অবস্থায় শূর্পণখা কোনোরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করলেন। ক্রোধের থেকে বড়ো এ পৃথিবীতে আর কিছু নেই।

লক্ষ্মণের এই ক্রোধ ভয়ংকর এক পরিণতিকে আমন্ত্রণ করে ফেললেন। শূর্পণখা তো এলিতেলি কেউ নন, তিনি স্বয়ং লঙ্কেশ্বর কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ, রাবণের আদরের ভগিনী। অপমানিত শূর্পণখা লঙ্কায় ফিরে গিয়ে দাদা রাবণকে সব ঘটনা বিস্তারিত জানালেন, সঙ্গে এও জানালেন যে জঙ্গলে রামের সঙ্গে আছেন তাঁর বউ। সে অতীব পরমা সুন্দরী। যেমন তাঁর রূপ, তেমন তাঁর দেহবল্লরী। ভগিনীর অপমানের প্রতিশোধ নিতে, রামকে উচিত শিক্ষা দিতে এবং সীতাকে ভোগ করার বাসনায় রাবণ বিন্দুমাত্র কালবিলম্ব না-করে দণ্ডকারণ্যে পৌঁছে। গেলেন। কোনো দোর্দণ্ড পুরুষকে উচিত শিক্ষা দিতে তাঁর বউ কিংবা বোন কিংবা মাকে বন্দি করে ফেলা বহু প্রাচীন কৌশল। এখনও সিনেমাগুলিতে দেখবেন হিরোকে কবজা করতে মা, বোন অথবা স্ত্রী বা প্রেমিকাকে নিজের ডেরায় এনে ফেলেন ভিলেন। রাবণও অনুরূপ করলেন। রাবণ জানতেন সীতাকে লঙ্কায় এনে ফেলতে পারলে রাম-লক্ষ্মণও সুড়সুড় করে ধরা দেবেন। তবে গল্প কতটা বাস্তব সেটা ভেবে দেখা দরকার। এক কোপে নাক-কান একসঙ্গে কেটে ফেলা সম্ভব? যদি সম্ভব হয়, তবে তো মাথার অর্ধেকটাই কাটা পড়ে যাবে। যদি অর্ধেক মাথা কাটা পড়ে যায়, তবে সেই অবস্থায় রক্তাক্ত শূর্পণখা কীভাবে পঞ্চবটি থেকে লঙ্কার সুদীর্ঘ পথ প্রাণ নিয়ে পৌঁছোলেন কীভাবে? আসলে পঞ্চবটিতে কী হয়েছিল? কী হয়েছিল তা শূর্পণখা অধ্যায়ে আলোচনা করেছি।

এদিকে তো রাম তো বউয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। এক্ষেত্রে বলতেই হয়–রাম পুত্র হিসাবে যত মহান, ভাই হিসাবে যত মহান, বন্ধু হিসাবে যত মহান–স্বামী হিসাবে তিনি গোল্লা পেয়েছেন। তিনি স্ত্রীকে কখনোই গুরুত্ব দেননি, তাই স্ত্রীকে কোনোদিনই রক্ষা করতে পারেননি। অরণ্যে প্রবেশের মুখেই বিরাধ রাক্ষসের খপ্পরে চলে যায় যায় সীতা। সে যাত্রা কোনোক্রমে রক্ষা পেয়ে গেলেও এবার সত্যিই রাখালপালে বাঘ পড়েছে। শূর্পনখাও তো সীতার উপর হামলে পড়েছিল। রাম তো বটেই, লক্ষ্মণ দাদা রামকে সবসময় রক্ষা করতে সমর্থ হলেও বউদি সীতাকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

তো সীতার খোঁজে পথে দেখা হয়ে যায় জঘন্যভাবে আহত জটায়ুর সঙ্গে। সীতা অপহরণকালে রাবণকে বাধা দিতে গিয়ে জটায়ুর এই করুণ পরিণতি। জটায়ু রাবণের বন্ধু, পরিচিত। রামের সঙ্গে দেখা হলে জানিয়ে দেন রাবণ সীতাকে অপহরণ করে এই পথ দিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে গেছেন। রাম রাবণকে চেনেন না, কোনোদিন নামও শোনেননি। জটায়ুর বয়ান অনুযায়ী রাম-লক্ষ্মণ ভারতের দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হলেন। অগ্রসর তো হলেন, কিন্তু যাবেন কোথায়? কিছুই তো চেনেন না! রাবণের নামটা শুনলেন বটে, কিন্তু রাম পূর্বে রাবণকে চিনতেন না–কী তাঁর রূপ, কত তাঁর বয়স, কোথায় তাঁর দেশ, কেমন তাঁর শক্তি–কিছুই তিনি জানেন না। এক আঁধার যেন! এক নিরুদ্দিষ্ট দিগশূন্য পথচলা। কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বিমর্ষ পথ চলতে চলতে সৌভাগ্যবশত দেখা হয়ে গেল কবন্ধের সঙ্গে। কবন্ধ রাম-লক্ষ্মণের উপর হামলা করলে রাম-লক্ষ্মণ তাঁকে বধ করেন। মৃত্যুপথযাত্রী কবন্ধ রাম-লক্ষ্মণকে দিশা দিয়ে বলেন–“এই সময় কোনো বিপন্ন মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করো। এছাড়া আমি ভেবেও তোমার কার্যসিদ্ধির উপায় খুঁজে দেখছি না।”

রামও বুঝলেন এত ক্ষুদ্র ক্ষমতা নিয়ে ভার্যা-উদ্ধার কোনোমতেই সম্ভব নয়। প্রয়োজন রাজার বিরুদ্ধে রাজশক্তি। প্রয়োজন প্রচুর লোকবল, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র। লঙ্কার খুব কাছেই পম্পা নদীর তীরে তাঁরা পৌঁছোলেন। সেইসময় ঋষ্যমূক পর্বতে বিষণ্ণ হৃদয়ে স্বরাজ্য থেকে বিতারিত পত্নীহারা সুগ্রীব অবস্থান করছিলেন। সুগ্রীব কিন্তু সেনাবাহিনীসহ সশস্ত্র রাম-লক্ষ্মণকে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। ভেবেছিলেন বালীর চর। বালী সুগ্রীবের আপন ভাই। অবশেষে হনুমানের মধ্যস্থতায় সুগ্রীব সংশয়মুক্ত হলেন। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হনুমান ছিলেন সুগ্রীবের মহামন্ত্রী। কী হয়েছিল সুগ্রীবের সঙ্গে সে কাহিনি রাম-লক্ষ্মণকে জানানো হল–পিতার মৃত্যুর পর বড়োভাই বালী স্বাভাবিক নিয়মে কিষ্কিন্ধ্যার (বর্তমানের মহিশূরের উত্তরে পম্পা নদর কাছেই বালীর সমৃদ্ধিশালী রাজ্য কিষ্কিন্ধ্যা। স্বর্ণখচিত, যন্ত্রপূর্ণ বানরসংকুল ও ধ্বজশোভিত।) রাজা হলেন আর সুগ্রীব হলেন বালীর পদানত দাস। একসময় নারীঘটিত এক কেলেংকারীতে জড়িয়ে পড়েন বালী। এ নিয়ে মায়াবী নামে এক বিক্রমশালী অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় এবং বালী পরাজিত হন। সে যুগে যুদ্ধে পরাজিত হলে হয় মৃত্যু নয় বন্দি হতে হত। বিপদ বুঝে এক বিস্তীর্ণ জঙ্গলে দুর্গম গর্তে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েন বালী। মায়াবীও বালীর পিছু নিয়েছিলেন। সে সময় উপায়ান্তর না-দেখে গুহার মুখে সুগ্রীবকে প্রহরায় রেখে বালী গুহার ভিতর গা-ঢাকা দিয়ে বাঁচে। গুহার ভিতর ঢোকার আগে সুগ্রীবকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেয়–তিনি না-ফেরা পর্যন্ত সুগ্রীব যেন দ্বাররক্ষা করেন। দিন যায় মাস যায় বালী আর ফেরে না। এমতাবস্থায় সুগ্রীব গুহামুখে এক বিশাল পাথর চাপা দিয়ে কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরে আসেন। কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরে এসে সুগ্রীব সারাদেশ রটিয়ে দিলেন যুদ্ধে বালীর মৃত্যু হয়েছে। অবশেষে সুগ্রীবকেই কিষ্কিন্ধ্যার রাজা করলেন মন্ত্রী-অমাত্যরা। চালাকির দ্বারা মহৎ কাজ হয় না। সুগ্রীবেরও সুখের দিন ফুরোলো। বালী দ্বারমুক্ত করে কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরে এসে দেখেন সুগ্রীব কিষ্কিন্ধ্যার রাজা হয়ে বসে আছেন। খুব ক্ষেপে গেলেন বালী। সুগ্রীবকে একবস্ত্রে দেশ থেকে বহিষ্কার করলেন। সুগ্রীব তাঁর বিশ্বস্ত বান্ধবদের ঋষ্যমুক পর্বতে ঠাঁই নিলেন। এই বিশ্বস্ত বান্ধবেরা হলেন–হনুমান, নল, নীল প্রমুখ ব্যক্তি। শুধু বহিষ্কারই করলেন না, সেইসঙ্গে সুগ্রীবের স্ত্রী রুমাকে অপহরণ করে ভোগ করতে থাকলেন বালী।

তো এই হল সুগ্রীবের রাজ্য ও স্ত্রী হারানোর গল্প। রামও শুনিয়ে দিলেন তাঁর রাজ্য ও স্ত্রী হারানোর গল্প। দুই সমব্যথী বন্ধুত্ব স্থাপন করলেন এবং চুক্তিবদ্ধ হলেন। চুক্তি হল রাম সুগ্রীবের রাজ্য ও স্ত্রীকে ফিরিয়ে দেবেন, বিনিময়ে সুগ্রীব রামের স্ত্রীকে ফিরিয়ে বন্দোবস্ত করবেন। তবে তাঁর আগে যাচাই করে নেওয়া দরকার, রাম কি সত্যিই পারবে তাঁর রাজ্য ও স্ত্রীকে ফিরিয়ে দিতে–বিচক্ষণ সুগ্রীব এমনই ভাবলেন। যেই ভাবা সেই কাজ। রামচন্দ্রকে শক্তিপরীক্ষা দিতে বললে রাম একটিমাত্র তীক্ষ্ণ শরে সাত-সাতটি তালগাছ ছেদ করে শক্তিপরীক্ষায় সফল হলেন। সুগ্রীব অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন। কিন্তু রামের এই অধীত শক্তি খুব খারাপভাবে প্রয়োগ হল। যে ঘটনা রামকে কলঙ্কময় কলুষিত করে দিল। গিভ অ্যান্ড টেক’ পলিসিতে রামকে দিয়ে আগেই অঙ্গীকার অনুযায়ী কাজ করতে অগ্রসর হতে হল। কীভাবে? রামের পরামর্শে সুগ্রীব কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরে গিয়ে বালীকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন। বালী নিশ্চয়ই এ আহ্বান শুনে উপলব্ধি করলেন–শত্রুর শেষ রাখতে নেই! শত্রুর শেষ রাখতে গিয়ে কত রাজা যে নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। ইতিহাস সাক্ষী। প্রসঙ্গত পৃথ্বীরাজ চৌহানের কাহিনিটা স্মরণ করতে পারেন। পৃথ্বীরাজ চৌহান পরাজিত মোহম্মদ ঘুরিকে মুক্তি না-দিলে শক্তিসঞ্চয় করে মোহম্মদ ঘুরি ফিরে এসে পৃথ্বীরাজকে হত্যা করতে পারতেন না। পৃথ্বীরাজ এমন ভুল না-করলে ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত। সেই একই ভুল বালীও করেছিল এবং মাসুল গুণতে হল।

কিন্তু রাম কীভাবে সুগ্রীবকে তাঁর রাজ্য ও স্ত্রী ফিরিয়ে দেবেন–তাঁর না-আছে লোকবল, না-আছে অস্ত্রবল! অতএব “বুদ্ধিস্য বলংতস্য নৈবতুল্যং কদাচন। এক্ষেত্রে অবশ্য কুবুদ্ধি। কথা হল বালী যখন সুগ্রীবের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করবেন তখন রাম গাছের আড়ালে লুকিয়ে এবং সেখান থেকে গোপনে বালীকে লক্ষ করে প্রাণান্তকর তীর ছুঁড়ে বালীকে হত্যা করবেন। নাঃ, সব প্ল্যান ভেস্তে গেল। বালীকে রাম হত্যা করতে পারলেন না। উল্টে সুগ্রীবকে মেরে পিঠ ফাটিয়ে দিল বালী। প্রাণেই মেরে ফেলত, যদি-না সেখান থেকে পালিয়ে পুনরায় ঋষ্যমূক পর্বতে ঠাঁই মিলত। কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাম সুগ্রীবের কাছে গিয়ে তাঁর অপারগতার কারণ বললেন এবং বালীর কাছে গিয়ে পুনরায় দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করতে বললেন সুগ্রীবকে। সেইসঙ্গে বলে দিলেন সুগ্রীব যেন নাগপুষ্পী লতার মালা পরে নেন। তাহলে চিনে নিতে সুবিধা হবে। কারণ দুজনেই একইরকম দেখতে৷ পৃথক দেখাতেই এই মালা। ঘোর দ্বন্দ্বযুদ্ধ শুরু হল। এবার আর ভুল করলেন না রাম। দ্বন্দ্বযুদ্ধে সুগ্রীবের পরাজয় আসন্ন হলে রামচন্দ্র আড়াল থেকে তীর ছুঁড়ে বালীকে হত্যা করলেন। জীবনের সবচেয়ে জঘন্যতম কাজটি করে ফেললেন স্বয়ং রাম। বালী রামের শত্রু ছিলেন না। রামের কোনো অনিষ্ট তিনি করেননি। একটা হীন চরিত্রের লোকের হয়ে কিষ্কিধ্যার রাজাকে হত্যা করে ফেললেন রাম। গুপ্তঘাতকের মতো বিনা অপরাধে বালীকে হত্যা করে রাম নিজের চরিত্রকেই কলঙ্কিত করলেন। মুমূর্ষ মৃতপ্রায় বালী ভগবান রামের উদ্দেশে কী বললেন, পড়ুন–“রাম!.. তুমি অতি দুরাত্মা, ধর্মধ্বজী ও অধার্মিক। তুমি ধর্মের আবরণ ধারণপূর্বক তৃণাচ্ছন্ন কূপ ও ভস্মাবৃত অগ্নির ন্যায় রহিয়াছ। তুমি দুরাচার ও পাপিষ্ঠ, কিন্তু সাধুর আকার পরিগ্রহ করিতেছ।” বালীর এহেন তিরস্কারে রাম বিন্দুমাত্র অনুতপ্তে দগ্ধ হয়ে যাননি, লজ্জায় নতমস্তক হয়ে যাননি। বরং ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে মিথ্যাচার করলেন–“এই শৈলকাননপূর্ণ ভুভাগ ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজগণের অধিকৃত, এই স্থানের মৃগপক্ষী ও মনুষ্যগণের দণ্ডপুরস্কার তাঁহারাই করিয়া থাকেন। … রাজা ভরত এই ভূমির রক্ষার স্বয়ং গ্রহণ করিয়াছেন।… সেই মহাবীরই পৃথিবীর রাজা।”

কোথায় ভরতের অযোধ্যা, আর কোথায় বালীর কিষ্কিন্ধ্যা! কিষ্কিন্ধ্যা কবে ইক্ষ্বাকুবংশীয়দের অধিকৃত রাজ্য হয়ে গেল? অন্যায়ভাবে বালীকে হত্যার অপরাধ ঢাকতে মিথ্যাচারের অপরাধ! ভরত পৃথিবীর অধীশ্বর? ভরতের পৃথিবীর আয়তন কতটুকু? ইক্ষ্বাকুবংশীয়রা তো কোশলরাজ বলেই জানা যায়! কোশল কোথায়? রামায়ণ উল্লিখিত কোশল বর্তমানে উত্তরপ্রদেশের কাশীর উত্তরে সরযূ নদী সন্নিহিত সমগ্ৰ অঞ্চল। সমগ্র অঞ্চল বলতে–এই কোশল রাজ্যটি দুইভাগে বিভক্ত–উত্তর কোশল ও দক্ষিণ কোশল। উত্তর কোশল কৌশল্যার পিত্রালয় এবং দক্ষিণ কোশল দশরথের। দুই কোশলের মাঝে সরযূ নদী। দক্ষিণ কোশলের রাজধানী অযোধ্যা। আয়তন দৈর্ঘ্যে ৪৮ ক্রোশ, প্রস্থে ৮ ক্রোশ। পাপ ঢাকতে মিথ্যা আধিপত্য!

দ্রোণাচার্য বধে যেমন সারা পৃথিবী যেমন চিরকাল যুধিষ্ঠিরের অপশের কীর্তন করে, তেমনই বালী বধে রামেরও অপযশ হয়েছে। রাম অধার্মিক উপারে কাপুরুষের মতো বালীকে হত্যা করেছিলেন। বালী এত বড়ো বীর ছিলেন যে, সম্মুখ সমরে তিনি পরাজিত হতে পারেন এমন আশঙ্কা রামের ছিলই। তাই ক্ষাত্রধর্ম, বীরধর্ম জলাঞ্জলি দিয়ে যেনতেনপ্রকারেণ স্বার্থসিদ্ধি করেছেন। অতঃপর ড্যামেজ কন্ট্রোলের তাগিদে রামচন্দ্র বালীকে নিজের প্রজা বলে শাসন করেছেন বলেছেন, যা নিতান্তই অযৌক্তিক। তখনও পর্যন্ত রাম রাজা ছিলেন না, তিনি বনবাসী। কিষ্কিন্ধ্যার রাজাও তিনি নন, এমনকি কিষ্কিন্ধ্যা অযোধ্যার অন্তর্ভুক্তও নয়। কিষ্কিন্ধ্যা দাক্ষিণাত্যের দেশ, অযোধ্যা আর্যাবর্তের দেশ। তার উপর বালী হত্যাকে ‘মৃগয়া’ বলা হয়েছে, বানর মাংস অভক্ষ্য তবুও বালী হত্যাকে ‘মৃগয়া’ বলার মতো প্রভূত কুযুক্তির অবতারণা করেছেন। রামায়ণের বালীই মহাভারতের জরা নামক ব্যাধই নাকি দ্বাপর যুগে কৃষ্ণের হত্যার কারণ হয়েছিলেন–এমন গল্পও বলা হয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা রামকে বিষ্ণুর অবতার বলেছেন, কৃষ্ণকেও বিষ্ণুর অবতার বলেছেন–তাই বুঝি রাম আড়াল থেকে বালীকে হত্যা করলেও বালী জরারূপে কৃষ্ণকেও আড়াল থেকে হত্যা করে গায়ের ঝাল মিটিয়ে নিলেন? তবে ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের কবি জুড়ে দিয়েছেন–সীতাহরণের সংবাদ পাইবার পর ভরত অযোধ্যা এবং আর্যাবর্তের সমস্ত সৈন্য একত্র করিয়া লঙ্কা অভিযানে প্রেরণ করেন–“অক্ষৌহিণণ্যাহি তত্রাস রাঘবার্থে সমুদ্যতাঃ”। বোঝাই যাচ্ছে রাম কর্তৃক বালীবধকে বৈধতা দেওয়ার জন্যেই এই সংযোজন হয়েছে। অর্থাৎ রামচন্দ্র সুগ্রীবের সৈন্য-সাহায্য ছাড়াই রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হতেন। তাহলে রামও কলুষ থেকে মুক্ত হয়। স্বার্থসিদ্ধির পর অকৃতজ্ঞতার শেষ নেই যেন!

অবশ্য এছাড়া রাম আর কিই-বা করতে পারতেন! রাজশক্তি যে তাঁর বড়াই প্রয়োজন, নাহলে আর্য-উপনিবেশ কীভাবে সম্ভব! কিষ্কিন্ধ্যাকে এড়িয়ে লঙ্কায় পৌঁছোনো একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু সেখানেও কাঁটা। মৃত্যুপথযাত্রী বালী রামকে বলেছিলেন, অন্যায়ের পথে কেন, “যদি পূর্বে জানকীর আনয়নার্থ আমার কহিতে, তবে আমি এক দিবসেই তাহাকে (রাবণকে) আনিয়া দিতে পারিতাম।” হয়তো পারত কিংবা নয়। বালী এখন মৃত, একথার আর কোনো দাম নেই। তা ছাড়া স্বার্থ ছাড়া কেউ কোনো কাজ করেন না, বালীও করতেন না। নাহলে এক অপরিচিত ব্যক্তির জন্য বালী কেন সৈন্যক্ষয়, অর্থক্ষয় করতে যাবেন?

বালীর মৃত্যুতে সুগ্রীব এবার সত্যি সত্যিই কিষ্কিন্ধ্যার নিরঙ্কুশ রাজা হলেন। নিজের স্ত্রী রুমাকে তো ফিরে পেলেনই, উপরি হিসাবে পেলেন বালীর স্ত্রী তারাকেও।

দিন যায় মাস যায়, সুগ্রীবের কোনো খবর নেই। বিলাসব্যসনে মত্ত সুগ্রীব সীতা উদ্ধারের অঙ্গীকারের কথা বেমালুম ভুলে গেলেন। মহামন্ত্রী হনুমান সুগ্রীবকে মনে করিয়ে দিলেন অঙ্গীকারের কথা। চার মাস অতিক্রান্ত। রাম হতাশ, লক্ষ্মণ ক্রুব্ধ। ক্রুব্ধ লক্ষ্মণ রামকে জানালেন, প্রয়োজনে সুগ্রীবকে হত্যা করে তাঁর পুত্র অঙ্গদের সাহায্যে জানকীর সন্ধান করা হোক। বাঁধনহারা লক্ষ্মণ সুগ্রীবের অন্তঃপুরে ঢুকে ধনুকে টঙ্কার দিলেন। সুগ্রীব বেজায় ভয়ে ভীত হয়ে পড়লেন। পরিস্থিতি সামলাতে সুগ্রীব তারা সহ সুন্দরী মেয়েদের লেলিয়ে দিলেন। লক্ষ্মণকে কামার্ত করতে। কিন্তু লক্ষ্মণের রক্তচক্ষুর সামনে কোনো সুন্দরী নারীই ঘেঁষতে পারলেন না। অবশেষে সুগ্রীব লক্ষ্মণকে জানিয়ে দিলেন, তিনি সৈন্য সংগ্রহে মনোনিবেশ করেছেন। মাত্র দশদিনের মধ্যেই সেই কাজ শেষ হয়ে যাবে। রামও খুশি। (বালী আর সুগ্রীবের পরিচয় একটু নেওয়া যেতে পারে–বর্ণিত আছে যে, বালী ছিলেন ইন্দ্রের পুত্র, আর সুগ্রীব ছিলেন সূর্যের পুত্র। ঋক্ষরজার চুলে ইন্দ্রের বীর্যপাতে এঁর জন্ম হয়েছিল। ঋক্ষরজার মৃত্যুর পর বালী রাজা হন। ইনি অত্যন্ত শক্তিশালী ছিলেন। এঁর স্ত্রীর নাম তারা এবং পুত্র অঙ্গদ। একবার রাবণ দিগ্বিজয়ে বের হয়ে বালীর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য কিষ্কিন্ধ্যায় উপস্থিত হন। সেখানে পৌঁছে ইনি জানতে পারলেন যে বালী চার সমুদ্রে সন্ধ্যাবন্দনা করতে গিয়েছেন। রাবণ বালীর সন্ধানে দক্ষিণ সমুদ্রে উপস্থিত হলে বালী অতর্কিতে তাঁকে মুঠোয় পুরে আকাশে উঠে গেলেন। এরপর পরপর চার সমুদ্রে সন্ধ্যাবন্দনা শেষ করলেন। রাবণ বালীর এরূপ শক্তি দেখে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন এবং ফিরে আসেন। দুন্ধুভি নামক এক মহিষরূপী অসুর তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে এলে ইনি উক্ত অসুরের শিং ধরে ভূমিতে আছড়ে খুন করেন। পরে এই অসুরের শরীর দূরে আছাড় দিলে অসুরের মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে মাতঙ্গ মুনির আশ্রমকে সিক্ত করে দেয়। ফলে মাতঙ্গ মুনি অভিশাপ দেন–আশ্রমদুষিতকারী তাঁর আশ্রমের এক যোজনের মধ্যে উপস্থিত হলে তাঁর মৃত্যু হবে।)

তার পরের ঘটনা তো ইতিহাস। একটু বলে নিই–আগেই বলেছি রামায়ণ যদি হয় বশিষ্ঠ আর বিশ্বামিত্রের বিরোধ, তবে মহাভারতও ব্রাহ্মণ দ্রোণাচার্যের সঙ্গে ক্ষত্রিয় দ্রুপদরাজের বিরোধ। সেই বিরোধ থেকেই সংঘর্ষ, মহাভারতের কুরু-পাণ্ডব বংশের পরিণতি। এখানেও লড়াইটা ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণের, কৌরব-পাণ্ডবরা এ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। এই দ্বন্দ্বকে তরান্বিত করতে সাহায্য করেছিলেন তাঁদের কুচক্রী মামা শকুনি। তবে রামায়ণের এই আপাতনিরীহ সংঘর্ষে কেবল বিশ্বামিত্র-বশিষ্ঠকে দায়ী করা যায় না। ফাঁক ছিল রাজপরিবারেই। দুই ঋষি কেবল এই ফাঁকটাকেই কাজে লাগাতে সমর্থ হয়েছিলেন। বশিষ্ঠ ছিলেন কুলগুরু। বশিষ্ঠ জানতেন রাজসভায় শ্রীরামচন্দ্রের আধিপত্য থাকলেও, রাজঅন্তঃপুরে ভরত তথা কেকয়বংশীয়দের আধিপত্য ছিল অপ্রতিরোধ্য। রামের পক্ষে যেমন লক্ষ্মণ ছিলেন, তেমনই ভরতের পক্ষে শত্রুঘ্ন ছিলেন। বস্তুত লক্ষ্মণ ছিলেন শ্রীরামের অঙ্গরক্ষক, যে কর্তব্য থেকে তিনি একবার জন্যেও বিচ্যুত হননি৷ অরণ্যে যত নারীহত্যা সব লক্ষ্মণই সম্পন্ন করেছেন। অপরদিকে শত্রুঘ্ন ছিলেন ভরতের অঙ্গরক্ষক, সেই কারণে লক্ষ্মণ শ্রীরামের সঙ্গে বনবাসে গেলেও, শত্রুঘ্ন কিন্তু কর্তব্যের খাতিরে ভরতের সঙ্গেই থেকে গেলেন। লক্ষ্মণ যতটা-না শ্রীরামচন্দ্রের ভাই ছিলেন তার চেয়ে বেশি ছিলেন দাদার দেহরক্ষী। বাল্মীকির গোটা রামায়ণে লক্ষ্মণকে দেহরক্ষী রূপকেই পাওয়া গেছে। এটা বুঝতে পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু বনবাসেই নয়, লক্ষ্মণ শ্রীরামের বিপদসঙ্কুল পথের ছায়াসঙ্গী হয়েছিলেন আরও আগে। রামচন্দ্র মাত্র ষোলো বছর বয়সে যখন যজ্ঞবিনাশকারী নিশাচরদের বিনাশ করতে গিয়েছিলেন, তখনও লক্ষ্মণ দেহরক্ষীর কর্তব্য পালন করেছিলেন। অরণ্যে যত হত্যাকাণ্ড সব লক্ষ্মণের দ্বারাই সাধন হয়েছিল, যা একজন দেহরক্ষীরা কাজ। রামের সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মণই বুক চিতিয়ে যুদ্ধ করেছেন, এভাবে রামকেও সুরক্ষা দিয়েছেন যতদিন পেয়েছেন।

পিতৃসত্য পালনের দৃষ্টান্ত স্থাপন কেবল রামায়ণের শ্রীরামচন্দ্রই নয়, মহাভারতের ভীষ্মও (দেবব্রত) পিতৃসত্য পালন করার চরম দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। ভীষ্মের পিতৃসত্য পালন শ্রীরামচন্দ্রের পিতৃসত্য পালন ছাপিয়ে যায়। নিম্নবর্গীয় ধীবরকন্যা সত্যবতাঁকে বিয়ে করার সময় শান্তনুকেও দশরথের মতো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হয়েছিল। প্রতিজ্ঞা ছিল সত্যবতীর সন্তানই হস্তিনাপুরের পরবর্তী রাজা হবেন। সত্যবতীর পিতা জানতেন শান্তনু পূর্বে বিবাহিত এবং তাঁর একটি পুত্রসন্তান আছে। বিচক্ষণ পিতা তাই শান্তনুকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন। এ কথা শুনে ভীষ্মও প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনি চিরকুমার থাকবেন। অতএব তিনি তো দূরের কথা, তাঁর উত্তরসুরীরাও হস্তিনাপুরের সিংহাসনের দাবি করবেন না। এই প্রতিজ্ঞার জন্য ভীষ্মকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। অম্বাকে প্রত্যাখ্যান করায় অপমানিত অম্বাই (শিখণ্ডী রূপে) তার মৃত্যুর কারণ হয়। সে তো না-হয় হল, কিন্তু সিংহাসনে বসবেন কে? সত্যবতী-শান্তনুর ঔরসজাত সন্তান চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। বিচিত্রবীর্য ও চিত্রাঙ্গদ তো মারাই গিয়েছিলেন। তাহলে বংশরক্ষাই-বা হবে কীভাবে? পরবর্তীতে রাজাই-বা কে হবেন? সত্যবতীও তাঁর পুত্রবধূ অম্বিকা ও অম্বালিকাকে পর্যায়ক্রমে মিলিত হওয়ার অফারও দিয়েছিলেন ভীষ্মকে। এইভাবে অম্বিকা আর অম্বালিকা গর্ভবতী হয়ে পড়লে মহান কুরুবংশের ধারাও অক্ষুণ্ণ থাকবে। ভীষ্ম সেই অফার প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ সত্যবতী-শান্তনুর বিবাহকালে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তিনি তাঁর জীবৎকালে কোনো নারীসংসর্গ করবেন না। এক্ষেত্রে সত্যবতী বা সত্যবতীর পিতা ভীষ্মের রাজা হওয়ার অধিকার কেড়ে নিলেও বনবাস চাননি, তাই ভীষ্ম রাজধর্ম পালন করতে সক্ষম ছিলেন।

বীর হিসাবে রামের ক্ষমতা কতটা ছিল? : বিশ্বামিত্র রামের প্রতি তুষ্ট হয়ে যে অস্ত্রগুলি দিয়েছিলে তার। তালিকা অনেক লম্বা। অস্ত্রগুলি হল : বলা, অতিবলা, ধর্মচক্র, কালচক্র, বিষ্ণুচক্র, ইন্দ্রচক্র, ব্রহ্মশির, ঐষিক, ব্রহ্মাস্ত্র, ধর্মপাশ, কালপাশ, বরুণ পাশ, শুষ্ক অশনি, আর্দ্র অশনি, পৈনাক, নারায়ণ, শিখর, বায়ব্য হয়শির, ক্রৌঞ্জ, কঙ্কাল, মুষল, কপাল, শক্তি, খড়গ, গদা, শূল, বস্ত্র, কিঙ্কিণী, নন্দন, মোহন, প্রস্বাপন, প্রশমণ, বর্ষণ, শোষণ, সন্তাপন, বিলাপন, মাদন, মানব, তামস, সৌমন, সংবর্ত। আরও অনেক নাম-না-জানা অস্ত্র! তা এমন বিপুল অস্ত্র কারও কাছে থাকলে এ গ্রহে তাঁকে রুখবে এমন সাধ্যি কার! এমন অস্ত্রে সজ্জিত একজনকে ‘মহামানব’ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, সাধারণ হলেই চলে। কেবল এক ব্রহ্মাস্ত্রই নাকি যথেষ্ট। এটা একবার ছুঁড়লে ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।)।

বস্তুত আমরা মানবজাতির বড়ো অংশই বিজয়ীর পক্ষেই থাকি, বিজেতার পক্ষে নয়। বিজয়ীর সব ন্যায়, বিজেতার সবই অন্যায় হিসাবেই দেখি। তাই বেশির ভাগ মানুষ রামের পক্ষে, রাবণের নয়। তাই অক্ষশক্তির বিজেতা হিটলার বিশ্বাস হয়, মিত্রশক্তি আমেরিকানরা নয়। হিরোসিকা নাগাসাকিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করলেও নয়। অনুরূপ বিজেতা সাদ্দাম হোসেনেরও বিপক্ষে থাকি, বিজয়ী আমেরিকার বিপক্ষে নয়। বিজয়ীর পক্ষে সবাই থাকেন না, কেউ কেউ বিজেতার পক্ষেও থাকেন তাঁদের বিচারে। তাই দক্ষিণ ভারতে অনেকেই বিজেতা রাবণকে বীর হিসাবে পুজো করেন। তাই অনেকেই মিত্রপক্ষ এবং আগ্রাসী আমেরিকার বিপক্ষেও ধিক্কার জানায়। মিথিলা থেকে বিয়ে করে অযোধ্যায় ফেরার পথে দেখা হয়ে যায় অন্য এক রামের সঙ্গে, যিনি ভৃগুনন্দন ‘পরশুরাম’ বলে পরিচিত। ‘পরশু’ কথার অর্থ কুঠার। ক্ষত্রিয় রাজা কার্তবীর্যাজুনের সঙ্গে তাঁর মা রেণুকা প্রেমাসক্ত হয়েছিলেন। সেই অপরাধে বাবার নির্দেশে কুঠার দিয়ে মায়ের মুণ্ডুচ্ছেদ করেছিলেন তিনি। তাঁর এই গুণকীর্তির জন্য হয়ে যান পরশুরাম। এই বিদ্রোহী ব্রাহ্মণ সন্তান পৃথিবীকে একুশবার নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন বলে কাহিনিতে জানা যায়। এখন দাশরথি রামকে হত্যা করে বাইশতম ক্ষত্রিয় হত্যা করার ইচ্ছা পোষণ করেন পরশুরাম। অতএব রামের পথ অবরোধ করেন এবং যুদ্ধের আহ্বান করেন। রামের উদ্দেশ্যে পরশুরাম বলেন–“তুমি আমার পূর্বপুরুষগণের শরাসনে শর যোজনায় যদি সক্ষম হও তবে আমি তোমার সঙ্গে প্রবল রূপে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ করব। শর সংযোজন করো।” ‘নরচন্দ্রমা’ শ্রীরাম শর ও শরাসন গ্রহণ করে ধনুতে গুণ সংযোগ ও শর সংযোগ করে পরশুরামকে বলেন–“তুমি ব্রাহ্মণ, বিশেষত বিশ্বামিত্র আমার পূজনীয়। কেবল সেই কারণেই আমি এই প্রাণহরণকারী শর পরিত্যাগ করতে পারছি না। আমি এই শর কোথায় নিক্ষেপ করব?” শ্রীরাম প্রথম আলাপে পরশুরামকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করলেও কিছুক্ষণ পরেই অবজ্ঞাভরে ‘তুমি’ সম্বোধন করতে থাকলেন। যাই হোক শ্রীরামের পরাক্রম দর্শন করে পরশুরাম স্তম্ভিত এবং ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি শ্রীরামের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলেন। বললেন–“হে রাম, তুমি আমাকে পলায়ণ করতে দাও। এক্ষণে তুমি এই অসম শর শরাসন থেকে মোচন করো।” রাম পরশুরামকে পলায়ণের সুযোগ দিলেন। পরশুরামে দ্রুতবেগে স্থান ত্যাগ করলেন। যঃ পলায়তি সঃ জীবতি।

রামচন্দ্রের বীরত্বই শুরু হয়েছে দুর্বল নিশাচরদের বধের মধ্যে দিয়ে, যখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৬ বিশ্বামিত্রের মতো ব্যক্তির আদেশে বেশ কিছু নিশাচর হত্যা করেই শুরু হয়ে যায় রামচন্দ্রের বীরত্বপ্রকাশ। পরে অবশ্য দণ্ডকারণ্যে আসার পর রাম হাজার হাজার রাক্ষস জাতি হত্যা করেছেন বলে কাহিনি শোনা যায়, তা সবটা সত্য নয়। এই হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগ কৃতিত্ব আর্যদেবতাদের, যাঁরা রামকে শিখণ্ডী করে দাক্ষিণাত্যে আর্য-উপনিবেশ ঘটাতে চাইছিলেন। দণ্ডকারণ্যে খরদূষণের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় রাম-লক্ষ্মণ-সীতা সকলেই ভয়ে ভীত হয়ে গুহায় লুকিয়ে পড়েছিলেন। খরদূষণের আবির্ভাবে রাম নিজেই লক্ষ্মণকে বলেছিলেন জানকীকে নিয়ে গুহায় লুকিয়ে পড়তে। খরদূষণকে কে বা কারা পরাস্ত করেছিলেন, সে বিষয়ে বাল্মীকি স্পষ্ট করে উল্লেখ না করলেও, যেভাবে আর্যদেবতাদের সমারোহ ঘটিয়েছিলেন এবং তাঁদেরকে দিয়ে খরদূষণের বিরুদ্ধে অস্ত্রপ্রয়োগ করেছিলেন, এ থেকে বুঝে নেওয়া খুব কষ্ট নয় যে এ সংঘর্যে রামের কোনো প্রয়োজন পড়েনি। শূর্পণখাকেও কেউ আহত কিংবা হত্যা করেননি। করবেই-বা কেন? শূর্পণখা তাঁর স্বামীহত্যার বদলা নিতে দাদা রাবণের বিরুদ্ধে ফুঁসছেন। যে-কোনো উপারে দাদা রাবণের বিনাশ চান তিনি। আর সেই কারণেই শূর্পণখা আর্যদেবতাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন এবং রাবণকে প্ররোচনা দিয়ে সীতার অপহরণের জন্যে উজ্জীবিত করেছে। বাকিটা তো ইতিহাস।

রামের অস্ত্রে প্রথম খুন হওয়া রাক্ষস জাতি তাড়কা। লক্ষ্মণ অবশ্য তার আগে তাড়কার নাসিকা-কৰ্ণ ছেদন করে দিয়েছিলেন। তাড়কা নারী, তাই রাম কিঞ্চিত ইতস্তত করলেও বিশ্বামিত্র সেই মুহূর্তে বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন–“এই নারী হত্যার কোনো অন্যায় হবে না। যুক্তি–বনে রাক্ষসরা যখন-তখন ব্রাহ্মণদের আক্রমণ করে, ব্রাহ্মণ তথা মুনি-ঋষিদের যজ্ঞ এবং তপস্যায় বিঘ্ন ঘটায়। এসব ঘটনা ব্রাহ্মণরাই মোকাবিলা করতে পারত, কিন্তু তা না-করে ক্ষত্রিয়দের এই অপকর্মে লেলিয়ে দিত। এর ফলে সাপ তো মরতই, লাঠিও ভাঙত না। খুনের সব দায় ক্ষত্রিয়দের ঘাড়ে, ব্রাহ্মণগণ নিষ্কলুষ। অবশ্য এতে ক্ষত্রিয়গণও গর্বিত বোধ করত। এতে শৌর্য-বীর্যও প্রকাশ পেত। ব্রাহ্মণদের সন্তান যেমন বয়সে ছোটো হলেও পূজ্য, তেমনই ক্ষত্রিয়ের সন্তান বয়সে ছোটো হলেও ক্ষত্রিয়-তেজ দেখাতে পারত। রামও তার ব্যতিক্রম নয়। মনে রাখতে হবে রাম যখন রাক্ষসদের হত্যা করা শুরু করেছে তখন কিন্তু রাম রাজা নন, রাজদণ্ডও তাঁর নেই–তাই কারোকে দণ্ড দেওয়ার অধিকারও তাঁর থাকার কথা নয়। রাম অবশ্যই রাজপুত্র। রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র।

বীর তো সেই, যে বীরদের হত্যা করতে সক্ষম হয়। দু-চারটে ক্ষুদ্র রাক্ষসহত্যায় কি বীর বলা সমীচীন? লঙ্কাযুদ্ধে রাম কয়টা বীর হত্যা করেছেন বা হত্যা করতে পেরেছেন? প্রতিপক্ষ যুদ্ধক্ষেত্রে এক একবার সহস্র সহস্র রাম দেখছেন, কখনো-বা একজন রামই দেখছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ‘সহস্র সহস্র’ রামের ড্যামি কেন? আসলে রাম যাতে কঠিন লড়াই থেকে নিজেকে গোপন রাখতে পারেন, সেই কারণে দেবসেনারা রামবেশী হয়ে আসল রামকে আড়াল করে রেখেছেন। রাম আদৌ যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন না, উপস্থিত ছিলেন রামের ছদ্মবেশে দেবসেনারা, প্রতিপক্ষের চোখ থেকে রামকে রক্ষা করতে। পুরো যুদ্ধটাই করে দিয়েছেন বানরসেনা ও আর্যদেবতারা। যুদ্ধকালীন বেশিরভাগ সময়ই রামকে রণক্ষেত্রে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। প্রতিপক্ষের একটি বীরও রাম হত্যা করতে পারেননি, বরং যখনই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন তখন প্রতিপক্ষের আঘাতে মৃতপ্রায় হয়েছেন। অথচ প্রতিপক্ষে পুরো যুদ্ধটাই সর্বদা একজন করে বীরই লড়াই করতে আসতেন, কখনোই সমস্ত বীর একযোগে লড়াই করেননি। অপরপক্ষে রামশিবিরের সমস্ত বীরেরা একযোগে লড়াই করেছেন। হনুমান, জাম্ববান, সুগ্রীব, অঙ্গদ, নীল, নল, দ্বিবিদ, লক্ষ্মণ এবং আর্যদেবতারা একযোগে যুদ্ধ করছেন প্রতিপক্ষের একজন বীরের বিরুদ্ধে। এতগুলি বীর একসঙ্গে নিয়ে রাম একটি বীরের মোকবিলা করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন বারবার। তারপরেও রাম ও তাঁর বীর যোদ্ধরা বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। প্রতিপক্ষের একটি বীরও রামচন্দ্র নিকেশ করতে পারেননি।প্রতিপক্ষের বীর অকম্পন ও বীর ত্রিশিরাকে হত্যা করেছেন বীর হনুমান; বীর প্রহস্তকে হত্যা করেছেন বীর নীল; বীর মহাপার্শ্ব, বীর নরান্তক ও বীর বজ্রদংষ্টকে হত্যা করেছেন বীর অঙ্গদ; বীর ইন্দ্রজিৎ ও বায়ুর সহায়তায় বীর অতিকায়কে হত্যা করেন বীর লক্ষ্মণ; বীর বিরূপাক্ষ ও বীর মহোদয়কে হত্যা করেছেন বীর সুগ্রীব। বীর রাম কাকে হত্যা করলেন? মহাবীর রাবণকে? রাবণের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী মন্দোদরী কী বলছেন, পড়ন–“বোধ হয় স্বয়ং কৃতান্ত ছদ্মবেশে রামরূপে আসিয়া থাকিবেন, তিনি তোমাকে বধ করিবার জন্য এইরূপ অতর্কিত মায়াজাল বিস্তার করিয়াছেন। অথবা বোধহয় ইই তোমাকে বধ করিলেন।” এই সংলাপ-অংশ বাল্মীকির রামায়ণে পাবেন। কোনো কৃত্তিবাসী, তুলসীদাসে পাবেন না।

কেমন ছিল রাম-রাবণের সরাসরি যুদ্ধ? প্রাবন্ধিক বীরেন্দ্র মিত্রের বয়ান আমরা দেখে নিতে পারি–“রামচন্দ্র যখন ভয়ে কাতর, ঠিক তখনই ইন্দ্র-বিমান এসে উপস্থিত। চালক মাতলি রামচন্দ্রকে বিমানে তুলে নিলেন। মাতলি রামকে বিভিন্ন ঐন্দ্রাস্ত্রও দিলেন। রামকে ঘিরে বিমানচারী দেব, দানব, গন্ধর্ব, উরগ, ঋষিরাও রণস্থলের উপর অবস্থান করতে লাগলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন দাক্ষিণাত্যে আর্য-উপনিবেশ স্থাপনের মহাস্থপতি অগস্ত্য।… রামচন্দ্র ধনুকের (যে-কোনো অস্ত্রই ‘ধনু’ নামে অভিহিত হয়েছে রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণে) ছিলায় টান দেওয়ার আগেই দেবতারা রাবণের বিমান ঘিরে আক্রমণ চালিয়েছেন। ওই ভিড়ের মধ্যে রামচন্দ্র হারিয়ে গেছেন। যদি-বা কোথাও তিনি থেকে থাকেন, তবে বহু যুদ্ধে অভিজ্ঞ ইন্দ্র-বিমান রথের চালক মাতলিই তাঁকে পরিচালিত করেছেন। অথবা স্বয়ং ইন্দ্র ওই বিমানে বসে ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করেছেন। বাল্মীকি রামায়ণটি পাঠ করলে ভগবান রামচন্দ্রকে নেহাতই নাবালক মনে হয়।

মনুর মতে রাজা ভগবান বা ভগবানের অংশ–“যস্মাদেং সুরেন্দ্রাণাং মাত্রাভ্যো নির্মিত নৃপঃ।/তস্মাদভিভবত্যেষ সর্বভূতানি তেজসা।/সো অগ্নিৰ্ভবতি বায়ুশ্চ সো অর্কঃ সোমঃ স ধর্মরাটা/স কুবেরঃ স বরুণঃ স মহেন্দ্রঃ প্রভাবতঃ৷” অতএব রাজাও যা, ভগবানও তাই। সে হিসাবে রামচন্দ্র হলেন ভগবানের সন্তান ভগবান। সেই কারণেই হয়তো রাম বনবাসী হয়েও রাজার মতো আচরণ করেছেন, যা ঔদ্ধত্যেরই। প্রকাশ। অনুসন্ধিৎসু পাঠকগণ রাজা ও রাজদণ্ডের বিষয়ে যদি আরও জানতে চান, তাহলে মনুসংহিতার সপ্তম অধ্যায় পাঠ করে দেখতে পারেন। সীতা উদ্ধার করে অযোধ্যায় ফিরে রাজা হওয়ার পরও রাম কোনো হত্যা (উত্তরকাণ্ডে শম্বুক ছাড়া, এ হত্যাও ব্রাহ্মণদের প্ররোচনায় পড়ে। প্রক্ষিপ্ত) করেছেন বলে শুনিনি। শুধু তাই-ই নয়, রাম তাঁর জীবনে যত হত্যা করেছেন, তার সবটাই ভিন রাজ্যে ভিন দেশে–অযোধ্যায় কিন্তু নয়। নিজরাজ্য অযোধ্যায় তিনি একটাও খুনখারাপি করেননি। এটাও নীতিগতভাবে অন্যায় কাজ। অন্য রাজ্যে, অন্য দেশে ঢুকে সেই দেশের সার্বভৌম নষ্ট করে সেখানকার প্রজাদের হত্যা করা অবশ্যই অন্যায় কাজ। আমেরিকা যেমন এ-দেশে ও-দেশে তাঁদের সেনা পাঠিয়ে যুদ্ধ করে বেড়ায়, নিজের ক্ষমতা বুঝিয়ে দেয়! বনবাস মানে অকাল বানপ্রস্থ। বানপ্রস্থ মানে ফলমূল আহার করা এবং খোলা আকাশের নীচে ঘাসে শয্যা করা। অনেকে মনে করেন, অনার্য রাক্ষসদের উপর্যুপরি কচুকাটা করার পরিণতিই রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ। রাবণ সহ রাক্ষসগণ তো অযোধ্যায় গিয়ে গায়ে পড়ে হামলা করেনি! তাহলে কেন এই সংঘর্ষ? এই সংঘর্ষের হোত রামচন্দ্রও নয়, রাবণও নয়–এই সংঘর্ষের হোতা আর্যদেবতারা। রামকে সামনে রেখে আর্যদেবতারা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছেন। সংঘর্ষের কারণ একটাই–উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতে নিরঙ্কুশ আর্য-উপনিবেশ বিস্তার করা। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন নয়। বাল্মীকি অন্তত এরকম বক্তব্য রাখেননি তাঁর রামায়ণে। প্রকৃত উদ্দেশ্য আড়াল করে রামকে শ্রেষ্ঠত্ব দিতেই ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নানা মিথ্যা ব্যাখ্যা করেছেন। বাল্মীকিকে অগ্রাহ্য করে মিথ্যা গল্প ফেঁদেছেন অন্য কবিরা। তাঁদের বর্ণনা অনুসারে রাবণকে বধের যে কারণগুলি দেখানো হয়েছে, তা কেবল রাবণই নয়, প্রাচীনযুগ থেকে মধ্যযুগের শেষভাগ পর্যন্ত প্রায় সব রাজাই এমন চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তাহলে তো সব রাজাকেই কোতল করতে হয়। তাহলে রাম কেবল রাবণকে হত্যা করেই থেমে যাবেন কেন? নারী ধর্ষণ, নারী হরণ, নারী রক্ষণ (হারেমে রক্ষিতা), অন্য রাজ্যের রাজকে হত্যা করা বা বন্দি করে সেই রাজ্য দখল করা–এসব সব রাজাই কমবেশি করতেন। রাবণ কি কোনো ব্যতিক্রম রাজা, যে তাঁকে ঘিরে তাঁকে হত্যা এত আয়োজন?

রাম যখন স্বামী, সেই স্বামী হিসাবে স্ত্রী সীতার প্রতি রামের কেমন আচরণ ছিল, কেমন মর্যাদা দিয়েছেন। প্রাণাধিকা স্ত্রীকে? স্বামী হিসাবে রাম পাবেন গোল্লা। যাঁরা রামের মতো স্বামী চান তাঁদের ভালো লাগবে। মেঘনাদের শক্তিশেল খেয়ে লক্ষ্মণ যখন অজ্ঞান হয়ে ভূলুণ্ঠিত হলেন, তখন রাম বিলাপ করতে থাকলেন–“প্রাণ পেয়ে সীতা পেয়ে কী লাভ আমার? মর্তলোকে খুঁজলে সীতার মতো নারী আরও পাওয়া যাবে। কিন্তু লক্ষ্মণের মতো সচিব ও যোদ্ধা ভাতা কোথাও পাওয়া যাবে না।” এখানেই শেষ নয়, রাম আরও বলেন–“দেশে দেশে স্ত্রী পাওয়া যায়, বন্ধুও পাওয়া যায়, কিন্তু তেমন দেশ মেলে না যেখানে সহোদর ভাই পাওয়া যায়।… তুমি যখন মৃত্যুমুখে পতিত তখন আমার জীবন নিরর্থক, সীতা বা বিজয়লাভ করাও নিরর্থক।” ভ্রাতৃস্নেহে পত্নীপ্রেম ভ্যানিস! স্ত্রী সুলভে মেলে, ভাত ছড়ালে কাকের অভাব! তাই ইচ্ছামতো ত্যাগ করা যায়।

সহোদর ভাই ভরত যৌবরাজ্যে অভিষেক হবেন শুনে রামের একটিই মাত্র অভিযোগ–“আমি পিতার কথায় অগ্নিতে প্রবেশ করতে পারি। কেন পিতা আগের মতো আমায় অভিনন্দন করছেন না? একটি অলীক ব্যাপার আমার চিত্তকে দগ্ধ করছে; রাজা নিজে কেন আমাকে ভরতের অভিষেকের সংবাদ দিলেন না? বললে আমি খুশি হয়েই ভাই ভরতের জন্য সীতা, রাজ্য, প্রাণও দিতে পারতাম।” স্ত্রীকে ত্যাগ করাই নয়, স্বামী হিসাবে রাম স্ত্রী সীতাকে ভাই ভরতের ভোগ্য পর্যন্ত করতে পারেন। সীতা তো কোনো ব্যক্তি নন, নিরেট বস্তুমাত্র।

অথচ ভাবুন তো, যে স্বামী (রাম) স্ত্রীকে (সীতা) ভাইয়ের (ভরত) হাতে তুলে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। যে স্ত্রী বলেন–“তোমাকে বাদ দিয়ে আমার স্বর্গে বাস করতেও অভিরুচি নেই। তোমার বিরহে আমি এখানে প্রাণত্যাগ করব।” এহেন পতিব্রতা স্বামী-সোহাগিনী নারীকে মন্দোদরী, তারা, কুন্তীদের (“অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা/পঞ্চকন্যা স্মরে নিত্যং মহাপাতক নাশনম্৷৷”) মতো এক কাতারে প্রাতঃস্মরণীয় করেননি সমাজপতিরা। সীতা সেই স্ত্রী, যাঁকে লঙ্কাধিপতি রাবণ বিবাহের প্রস্তাব দিলে তিনি স্বামীর প্রতি অগাধ আস্থা জ্ঞাপন করে রাবণকে চরম দৃঢ়তায় বলেন–“তুমি শৃগাল হয়ে সিংহীকে পেতে চাইছ? কাল সাপের মুখে হাত দিয়ে তার বিষদাঁত উপড়াতে চাইছে। কালকূট বিষপান করে স্বস্তিতে থাকতে চাইছ? সূচী দিয়ে চক্ষুভেদ করতে বা জিহ্বা দিয়ে ক্ষুরলেহন করতে চাইছ? রাঘবের প্রিয়াকে তুমি পেতে চাইছ? কণ্ঠে শিলাখণ্ড বেঁধে সমুদ্র উত্তরণ করতে চাইছ? দুই হাত দিয়ে চন্দ্র সূর্য ধরতে চাইছ? তুমি রামের প্রিয়া বধূকে ধর্ষণ করতে চাইছ? জ্বলন্ত অগ্নিকে কাপড় দিয়ে আহরণ করতে চাইছ, তাই রামের কল্যাণী বধূকে হরণ করতে চাইছ? লৌহমুখ শূলের সামনে বিচরণ করতে চাও, তাই রামের অনুরূপ বধূকে পেতে চাইছ? বনে সিংহ ও শিয়ালের যে পার্থক্য, ছোটো খাল ও সমুদ্রের যে পার্থক্য, শ্রেষ্ঠ বীর ও কাপুরুষের যে পার্থক্য, হাতি ও বিড়ালের যে পার্থক্য, গোরুড় ও সাপের যে পার্থক্য, পানকৌড়ি ও ময়ূরের যে পার্থক্য, হাঁস ও শকুনের যে পার্থক্য–দাশরথি রামের সঙ্গে তোমারও সেই পার্থক্য।

যদন্তরং সিংহশৃগালোর্বনে..যদন্তরং কাঞ্চনসীসলোহয়োঃ…যদন্তরং বায়সবৈনতেয়য়োঃ…।”

তবুও সীতা অপমানিত হয়েছেন নিজের প্রাণাধিক স্বামীর কাছে। যুদ্ধশেষে স্বামী-স্ত্রীর প্রথম সাক্ষাতে দীর্ঘ অদর্শনে সীতার প্রতি রামের প্রেম বিলীন হয়ে গিয়েছিল। সীতাকে লঙ্কাপুরীর বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন বটে, কিন্তু রাম সেইসঙ্গে একথাটাও সীতাকে জানাতে ভোলেনি যে, “যুদ্ধ তাঁর জন্য হয়নি। যুদ্ধে শত্রুকে জয় করেছি। তোমাকেও মুক্ত করেছি। আমার পৌরুষ দিয়ে যা করার আমি তা সব করেছি। বৈরীভাবের এক্কেবারে শেষপ্রান্তে পৌঁছেছি, ধর্ষণ প্রমার্জনা করেছি। শত্রু এবং অপমান একসঙ্গে খতম করেছি। আজ আমার পৌরুষ প্রকাশিত হয়েছে, আজ আমার শ্রম সফল হয়েছে। প্রতিজ্ঞা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছি এবং নিজের প্রভূত্ব ফিরে পেয়েছি।”

‘আদর্শ স্বামী’ রাম আরও বলেন–“তোমার কুশল হোক। জেনে রাখো, এই যে যুদ্ধের পরিশ্রম, বন্ধুদের বীরত্বের সাহায্যে যা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছি, তা তোমার জন্যে নয়। আমার চরিত্র মর্যাদা রক্ষা করার জন্যে এবং প্রখ্যাত আত্মবংশের কলঙ্ক মোচন করার জন্যেই তা করেছি। তোমার চরিত্র সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে। আমার সামনে তুমি আছ, চক্ষুপীড়াগ্রস্তের সামনে প্রদীপ যেমন পীড়াদায়ক হয় তেমনই। তাই জনকাত্মজা, এই দশদিক পড়ে আছে, যেখানে ইচ্ছা তুমি চলে যাও, আমি অনুমতি দিলাম–তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই। কোন্ সদ্বংশজাত তেজস্বী পুরুষ বন্ধুত্বের লোভে পরগৃহবাস করেছে যে, স্ত্রী, তাকে ফিরিয়ে নেবে? রাবণের কোলে বসে পরিক্লিষ্ট, তার দুষ্ট দৃষ্টিতে দৃষ্টা তুমি, তোমাকে গ্রহণ করে আমি আমার উজ্জ্বল বংশের গৌরব নষ্ট করব?–“অঙ্ক, আরোপ্য তু পুরা রাবণেন বলা ধৃতাম”। যেজন্য যুদ্ধ করেছি তা পেয়েছি, তোমার প্রতি আমার কোনো অভিলাষ নেই, যেখানে খুশি চলে যাও তুমি। আমি তোমাকে বলছি লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সুগ্রীব বা বিভীষণ এদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করে নাও।” অথচ এ তো সেই সীতা, যিনি বনবাসের প্রাক্কালে শাশুড়িমাতা কৌশল্যাকে বলেছিলেন–“নাতন্ত্রী বাদ্যতে বীণা নাচক্রো বিদ্যতে রথঃ।/নাপতিঃ সুখমেধতে যা স্যাদপি শতাত্মজা।” অর্থাৎ, তন্ত্রীহীন বীণা বাজে না, চক্ৰহীন রথ হয় না। পতিহীনা নারী শতপুত্রের জননী হলেও সুখ পায় না।

রামের মতো সূক্ষ্ম ধর্মবুদ্ধিযুক্ত ব্যক্তি পরহস্তগতা নারীকে মুহূর্তের জন্যে হলেও কী করে গ্রহণ করবেন! সীতা দুশ্চরিত্র হোন বা না-হোন, সচ্চরিত্র হোন বা না-হোন–তাঁকে ‘ভোগ’ করা রামের পক্ষে অসম্ভব। কুকুরে চাটা ঘি’ যেমন কোনো পুজোয় লাগে না, দুধে কেরোসিন পড়লে যেমন সেই দুধ পানের অযোগ্য হয়ে যায়, মাছের মাথায় পচন ধরলে যেমন সেই মাছ অখাদ্য হয় পরহস্তগত স্ত্রী তথা নারীও তেমন স্বামীর অঙ্কশায়িনী হতে পারে না। রাবণ সীতাকে স্পর্শ করেছিল কি না তা জেনে নেওয়ার প্রয়োজন নেই, রাবণ সীতাকে বলাৎকার করেছিল কি না সেটাও জানার প্রয়োজন নেই। সতীত্ব নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠেছে, তখন ত্যাগই একমাত্র সমাধানের পথ। কারণ সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় ফেরার পর প্রজারা রামচন্দ্রকে বলেছে–“কীদৃশং হৃদয়ে তব সীতাসম্ভোগজং সুখম্।/অঙ্কমারোপ্য তু পুরা রাবণেন বলাক্বতাম্।” অর্থাৎ “রাবণ যাকে অঙ্কে আরোপণ করে সবলে হরণ করেছিল, সেই সীতার সম্ভোগে তোমার হৃদয়ে কেমন সুখ হয়?” স্বামীর একনিষ্ঠতায় অভাব থাকলে কেউ আঙ্গুল তোলে না ঠিকই, কিন্তু স্ত্রীকে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে ত্যাগ করা চলে! সীতা চরমভাবে অপমানিত হন এবং লক্ষ্মণকে আদেশ করেন চিতা সাজাতে–“অপ্রীতেন গুণৈর্ভর্তা ত্যজায়াঃ জনসংসদি।/যা ক্ষমা মে গতির্গন্তং প্রবেক্ষ্য হব্যবাহন৷৷” অর্থাৎ “স্ত্রীর গুণে যে প্রীত নয় এমন স্বামী যখন জনসভায় স্ত্রীকে ত্যাগ করে তখন সেই স্ত্রীর যে পথে যাওয়া সম্ভব তাই করব, আগুনে প্রবেশ করব।” অর্থাৎ আত্মহননের পথ বেছে নেবেন। বেদনাহত সীতা আগুনে প্রবেশ করেছিল এবং ভেবেছিলেন রাম একাজে বাধা দেবেন। না, রামচন্দ্র বাধা দেননি। লক্ষ্মণও ছিলেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়। একথা না বললেই নয় যে, সীতাকে দাহ করার সিদ্ধান্তে লক্ষ্মণ অসন্তুষ্ট ছিলেন। সে কথা লক্ষ্মণ ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন রামকে। এই অংশে এসে দেখা যায়, রাম বা সীতা কেউই একে অপরকে স্বামী-স্ত্রী বলে সম্বোধন করেননি। সীতা রামকে ‘মহাবাহু বলে সম্বোধন করেছেন এবং রাম সীতাকে ‘বৈদেহী’, ‘মৈথিলী’, ‘ভদ্রা’ বলে সম্বোধন করেছেন। স্পষ্টত বোঝা যায় সম্পর্কটার মৃত্যু হয়ে গেছে। কবি বলেছেন–“ন হি রামং তদা কশ্চিৎ কালান্তকসমোপমম।/অনুনেতুমথো বতুং দ্রষ্টুং বাপ্যশকৎ সুহৃদ৷৷”–রামকে তখন কালান্তক এবং যমের মতো দেখাচ্ছিল, তাঁকে অনুনয় করা তাঁকে কিছু বলা বা তাঁর দিকে চেয়ে দেখার সাধ্যও কোনো বন্ধুর ছিল না।

রাবণের স্পর্শ করার অনেক আগেই অনার্য বিরাধ সীতাকে স্পর্শ করেছিল। আর তখন কিন্তু রামের কিছু মনে হয়নি, যে ঘটনা তিনি স্বয়ং চাক্ষুষ করেছেন। তখন কিন্তু রামের মনে হয়নি তাঁর স্ত্রী পরপুরুষ কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছেন। তখন কিন্তু তাঁর স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেননি। বনবাসকালে দণ্ডকারণ্যে বিচরণ করতে করতে রাম লক্ষ্মণ-সীতা বীভৎস রাক্ষস বিরাধের মুখোমুখি। সুন্দরী সীতাকে কোলে তুলে নিলেন ক্রুব্ধ বিরাধ। এবং বলতে থাকলেন–“তোরা জটাধারী ও চীরপরিধারী, অথচ হাতে ধনুক, বাণ, তলোয়ার ব্যবহার করেছিস কেন? সে যা হোক, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যখন তোরা দণ্ডকারণ্যে ঢুকেছিস, তখন তোদর আর বাঁচার আশা নেই। তোরা কে? আমি রাক্ষস, আমার নাম বিরাধ। এই সুন্দরী আমার স্ত্রী হবে।” লক্ষণীয়, বিরাধ রাক্ষস কর্তৃক সীতা চরম নিপীড়া হলেও রামচন্দ্র একবারের জন্যেও ‘ধর্ষণ’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। একবারের জন্যেও বলেননি ‘কুকুরে চাটা ঘি’, অভোগ্য, অভক্ষ্য। প্রকৃতিও বিচলিত হননি৷ কেন বলেননি? সাইকোলজিটা কিন্তু পরিষ্কার–বিরাধ যখন সীতাকে কাঁধে তুলে চম্পট দিচ্ছিল, তখন সীতা ‘সতীত্ব’ নিয়ে রামের কোনোরূপ প্রশ্নের উদয় হয়নি। অথচ রাবণ যখন জটায়ুর কাছ থেকে জানতে পারলেন রাবণ তাঁর স্ত্রীকে কোলে বসিয়ে নিয়ে গেছে, তখন সীতার ‘সতীত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। বিরাধ যখন সীতাকে কোলপাঁজা করে কাঁধে তুলে নিল তখন রাম সাধারণ মানুষ, বিপদগ্রস্ত, অসহায়, তাঁর অনিশ্চিত ভবিষ্যত–এ অবস্থায় এমন দুষ্টভাবনা মাথায় আসার কথা নয়। বরং বিপদের এই দিনগুলিতে একে অপরকে আঁকড়ে ধরে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করতে হচ্ছিল। অপরদিকে যখন রাম সীতাকে ‘অসতী’ হিসাবে অভিযুক্ত করছেন এবং তাঁকে পরিত্যাগ করছেন, তখন তিনি নিরঙ্কুশ বিজয়ী, তখন তাঁর সামনে-পিছনে-ডানে-বায়ে অসংখ্য সুহৃদ মানুষ, তখন তিনি রাজাধিরাজ–এ সময় সীতার মতো ‘অসতী’ নারীর আর কোনো প্রয়োজন নেই রামের। যে সাহস তিনি বিরাধরাক্ষসের সময় দেখাতে পারেননি, তার চেয়ে অধিক সাহস লঙ্কা বিজয়ের পর রামচন্দ্র দেখাতেই পারেন! বস্তত রাম সীতার সতীত্ব নিয়ে যতটা বাড়াবাড়ি করেছেন, দ্রৌপদীর সতীত্ব নিয়ে তাঁর কোনো স্বামীই বিন্দুমাত্র প্রশ্ন তোলেননি। তাই বোধহয় পরে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা পঞ্চসতীর তালিকায় দ্রৌপদীকে রেখেছেন, সীতাকে নয়।

তবে এ ঘটনায় রামকে পুরোপুরি দোষারোপ করা যায় না। নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতিগ্রস্ত বলে যেসব নাগরিকরা নিজেদেরকে চরিত্রবান বলে ভাবতে পছন্দ করেন তাঁদের বলব আয়নার সামনে দাঁড়ান এবং নিজের চোখে চোখ রেখে বলুন আপনি কতটা দুর্নীতিমুক্ত! এক্ষেত্রে স্ত্রীকে ঘৃণা আর পরিত্যাগের জন্য রামের সমালোচনা করলে সেইসব প্রজা তথা নাগরিকদেরও সমালোচনা করতে হবে। কারণ প্রজারাই রামকে খুব বিশ্রীভাবে প্ররোচিত করেছেন, যে প্ররোচনায় রাম পা দিয়ে ফেলেছেন। সব বিষয়েই যে প্রজাদের মতামত নেওয়ার নেই, সেটা ভুলে যাওয়ার জন্যই রামকে মাশুল গুনতে হয়েছে।

সীতাকে প্রাপ্তির পর প্রজাবৎসল রাম যখন প্রজাদের জিজ্ঞাসা করলেন–আমার বিষয়ে প্রজারা তেমন কোনো সমালোচনা করছে কি না (“কাঃ কথা নগরে ভদ্র বৰ্তন্তে বিষয়েষু চা/মামাশ্রিতানি কান্যাহঃ পৌরা জানপদা জনাঃ”)। রাম এমন একটা সমাজে অবস্থান করছেন, সে সমাজ যে রামের সমালোচনা করবেন সেটা তিনি বিলক্ষণ জানতেন। তা ছাড়া রাম নিজেও সীতার ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন, নাহলে এতটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। রামের এই দুর্বলতা প্রজারাও বুঝতে পেরেছিলেন নিশ্চয়ই। আর তাই অনধিকার চর্চার’ সুযোগ হাতছাড়া করেননি প্রজারা। ভদ্র নামক জনৈক ধুরন্ধর প্রজা ফরফর করে বলতে শুরু দিলেন–

“হত্বা চ রাবণং সখ্যে সীমান্ধত্য রাঘবঃ।

অমর্যং পৃষ্ঠতঃ কৃত্বা স্ববেশ পুনরানয়ৎ।

কীদৃশং হৃদয়ে তস্য সীতাসম্ভোগজং সুখ।

অঙ্কমারোপ্য তু পুরা রাবণেন বলদ্ধৃতাম৷৷

লঙ্কামপি পুরীং নীতামশোকবনিকাং গতাম্।

রক্ষসাং বশমাপন্নাং কথং রামো ন কুৎস্যতি৷৷

অস্মাকমপি দারেষু সহণীয়ং ভবিষ্যতি৷

যথা হি কুরুতে রাজা প্রজাস্তমনুবৰ্ত্ততে৷৷

এবং বহুবিধা বাচো বদন্তি পুরবাসিনঃ।

নগরেষু চ সর্বেষু রাজন্ জনপদেষু চা।”

অর্থাৎ–রঘুনন্দন রাম, রাবণকে যুদ্ধে হত্যা করেছেন এবং যে সীতাকে রাবণ স্পর্শ করেছেন, সেজন্য কিছুমাত্র ক্ষুব্ধ না-হয়ে পুনরায় সীতাকে নিজঘরে এনেছেন। রাবণ আগেই সীতাকে বলপ্রয়োগে অপহরণ করে লঙ্কাপুরীতে নিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও রামের হৃদয়ে সীতাসম্ভোগসুখ কীভাবে হচ্ছে? সীতা রাক্ষসদের বশীভূতা হয়ে অশোকবনে দিনরাত অতিবাহিত করেছেন, তা সত্ত্বে রাম কেন সীতাকে ঘৃণা করেন না? যা রাজা করেন, প্রজারা তাই-ই অনুসরণ করে। এরজন্য আমাদেরও আমাদের স্ত্রীদের এহেন দোষ মেনে নিতে হবে। জনপদের সমস্ত নাগরিক এমনই নানা কথা বলছেন।

তা ছাড়া রাম কি কোনোভাবে জেনে গেছেন যে, যে সীতাকে লংকা থেকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে সে সীতা নয়, বেদবতী। তাই কি রামের এমন রুক্ষ্ম আচরণ, এমন দুর্বিনীত, এমন অমানবিক মুখ তাঁর। পঞ্চবটিতে সীতাহরণে নাটকটা আর্যদেবতারাই রচনা করেছিলেন। রাম-লক্ষ্মণের অনুপস্থিতিতে আর্যদেবতারা পঞ্চবটিতে জানকীকে নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে রেখে বেদবতীকে বসিয়ে রেখেছিলেন। যে নারীকে রাবণ অপহরণ করেছিলেন, সেই নারী স্বৰ্গবেশ্যা বেদবতী–সীতা নয়। তাই পঞ্চবটিতে রাবণের সঙ্গে বেদবতীর সাক্ষাৎ হলে রাবণ যে ভাষায় আদিরসাত্মক শরীর বিষয়ক বর্ণনা করছিলেন এবং যে নারী আপ্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে মজিয়ে শুনছিলেন, সে কখনোই সীতা হতে পারে না। এখানেই শেষ নয়, রাবণের সঙ্গে লঙ্কায় যাওয়ার পথে এবং অশোকবনে অবস্থানকালে যে ভাষায় তিনি বাক্যালাপ করেছেন, তা কোনো সাধারণ নারী করতে পারেন না। এ তো এক কথা। কিন্তু লঙ্কা থেকে ফেরার পর আর্যদেবতারা সকলের অলক্ষ্যে বেদবতীকে সরিয়ে আসল সীতাকে হাজির করেছিলেন। তারপরেও কেন স্ত্রীর প্রতি রামের কু-আচরণ? যিনি রাবণের কাছেই ছিলেন না, তাঁকে কেন রাবণ দ্বারা ধর্ষিতা হওয়ার অপবাদ দেওয়া হবে? তাহলে কি রামচন্দ্র আর্যদেবতাদেরও বিশ্বাস করতেন না? নাকি পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রভাব?

ভুললে চলবে না, রামও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থারও শিকার। দেবর্ষি নারদ কথিত বাল্মীকির রামচন্দ্র ‘দেবতা নন, মানুষ। সে কথা বাল্মীকি রামকাহিনি রচনার শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন। বাল্মীকি নরশ্রেষ্ঠ রামচন্দ্রের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। এ ব্যাপারে মতান্তরের কোনো জায়গা নেই। সীতার প্রতি রামের যে আচরণ ও ব্যবহার তাতে বোঝা যায় ত্রেতাযুগেও নারীর সম্মান ছিল না, দ্বাপর যুগেও ছিল না, কলিযুগেও নেই। মানুষ’ রামও সেই ব্যবস্থা থেকে মুক্ত নন, মুক্ত নন রামের প্রজারাও। রামায়ণের যুগে নারীর অবস্থান নারীর সম্মান মোটেই সুখকর ছিল না। মুনিবর বাল্মীকি সে ঘটনা বড়ো দরদ দিয়ে বর্ণনা করেছেন। সে যুগে পুরুষ তথা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের যে চোখে দেখতেন কবি সেই ছবিই চিত্রিত করেছেন। রামচন্দ্র ‘পুরুষ’ বই তো নয়। এ প্রসঙ্গে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীও স্পষ্টত বলেছেন–“রাম পুরুষমানুষ, পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েদের দাম ছিল না। প্রেম বলে কোনো জিনিস তারা বুঝত না–অতএব রাম সীতাকে পরিত্যাগ করেছেন।” এ যুগেও কি সেই চিত্র বিন্দুমাত্র বদলেছে? এখনও কি ঘরের বউ মাসকে মাস তো দূরের কথা একদিন বাড়ির বাইরে অচেনা কারোর সঙ্গে রাতযাপন করলে বিনাপ্রশ্নে ঘরে তুলবেন কোনো পুরুষ? বলা হয়–বউ আর বই একবার অন্যের হাতে গেলে তা পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে না। অতএব বোকার মতো কেবলমাত্র রামের দিকে আঙুল তোলা অর্থহীন। যদি সত্যিই রামের দিকে আঙুল তোলার সাধ জাগে তবে আমি বলব আগে নিজেকে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ান। নিজের দিকেও আঙুল ঘোরান। আসলে শতশত বছর আগেও রামচন্দ্র যেখানে ছিলেন; শতশত বছর পরেও আমরা রামের ভক্তরা সেখানেই পড়ে আছি। এতটুকু বদলাইনি।

তা ছাড়া সীতা অভিযুক্ত, প্রাচীন যুগের বিচারে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি নির্দোষ। রাম রাজা রাজার কাছে রাজার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, পুত্র, ভার‍্যা সম্পর্ক সব তুচ্ছ। কেমন ছিল প্রাচীন যুগে বিচার? হিউয়েন সাঙের ভারত বিবরণ থেকে জেনে নিলে দোষের হবে না নিশ্চয়–কেউ আইন ভাঙলে বা ক্ষমতার অপব্যবহার করলে বিষয়টিকে খুঁটিয়ে বিচার করে তবে অপরাধীকে কারাদণ্ড দেওয়া হত। কোনরূপ দৈহিক শাস্তি দেওয়া হয় না। অপরাধীকে সোজাসুজি বাঁচতে বা মরতে ছেড়ে দেওয়া হয় ও মানুষের মধ্যে ধরা হয় না। যদি নীতি নিয়ম ভাঙা হয়, যদি কোনো লোক স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাস ভঙ্গ করে বা জনক-জননীর প্রতি কর্তব্য উপেক্ষা করে তবে তার নাক বা কান বা হাত-পা কেটে দেওয়া হয়, অথবা দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয় বা তাকে জনহীন অরণ্যে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। কোনো দোষী লোককে প্রশ্ন করার বেলায় যদি সে ভোলা মনে সব কথার উত্তর দেয় তবে তদনুযায়ী দণ্ড লঘু করা হয়। যদি অপরাধী একগুঁয়ের মতো অপরাধ অস্বীকার করে চলে বা দোষ-স্খলনের চেষ্টা করে, তবে সত্য খুঁজে বের বিচার নিষ্পত্তির জন্য চার রকমের পরীক্ষার আশ্রয় নেওয়া হয়–(১) জলের দ্বারা, (২) শক্তি প্রয়োগের দ্বারা, (৩) পরিমাপের দ্বারা এবং (৪) বিষের দ্বারা।

জলের দ্বারা : যখন জলের দ্বারা পরখ করা হয় তখন অভিযুক্তকে একটি বস্তার মধ্যে ভরা হয়। বস্তাটি একটি পাথরের পাত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তারপর ওই অবস্থায় তাকে জলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। যদি সে ডুবে যায় ও পাথরটি ভাসে তবে সাব্যস্ত হয়–সে দোষী। যদি লোকটি ভাসে ও পাথরটি ডুবে যায় তবে সাব্যস্ত হয়–সে নির্দোষ।

শক্তি প্রয়োগ : যখন শক্তি প্রয়োগের দ্বারা পরখ করা হয় তখন সাহায্য নেওয়া হয় আগুনের। তারা একটি লোহার পাত গরম করে ও অভিযুক্তকে তার উপর বসতে বাধ্য করে। তারপর তার পা-দুটি তার উপর রাখা হয়। পরে তার হাতের পাতায় এটি রাখা হয়। আবার জিভ দিয়েও তাকে এটি চাটতে বাধ্য করা হয়। এর ফলে যদি কোথাও কোনো পোড়া দাগের সৃষ্টি না হয় তবে প্রমাণ হয়–সে নির্দোষ। যদি পোড়া দাগের সৃষ্টি হয় তাহলে প্রমাণ হয়–সে দোষী। যারা দুর্বল ও ভীতু লোক, যাদের সহন ক্ষমতা এ ধরনের পরখের অন্তরায় তাদের বেলায় একটি ফুলের কুঁড়ি নিয়ে তাকে আগুনে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। যদি আগুনের তাপে এটি ফুলের মতো ফোটে, তবে প্রমাণ হয় যে অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্দোষ। যদি কুঁড়িটি পুড়ে যায়, তবে সাব্যস্ত হয় সে দোষী।

পরিমাপের দ্বারা : একজন মানুষ ও একটি পাথরকে সমানভাবে পাল্লায় রাখা হয়। তারপর তুলনামূলকভাবে কে ভারি আর কে হালকা তাই দেখে দোষী নির্দোষী স্থির হয়। যদি অভিযুক্ত লোকটি নির্দোষ হয় তাহলে তার ওজন পাথরের চেয়ে বেশি হবে। যদি দোষী হয় তবে তবে পাথরটি তুলনায় তার ওজন কম হবে।

বিষের দ্বারা : একটি ভেড়া নিয়ে এসে তার ডান উরুতে একটি ক্ষত করা হয়। তারপর অভিযুক্তের খাবার থেকে খানিকটা নিয়ে তাতে সব রকমের বিষ মিশিয়ে তা সেই ক্ষতের মধ্যে ভরে দেওয়া হয়। যদি সেই বিষের ক্রিয়ায় প্রাণীটি মারা যায় তাহলে প্রমাণ হয় যে মানুষটি দোষী। যদি প্রাণীটি বেঁচে থাকে তবে মানুষটি নির্দোষ সাব্যস্ত হয়।

লক্ষ করুন পাঠক, এগুলি কোনোটাই বিচার বা যাচাই নয়, এগুলি নেহাতই প্রহসন। অভিযুক্তের নিশ্চিত মৃত্যু ঘটানোই এসব হাস্যকর পরীক্ষার উদ্দেশ্য। এতক্ষণ যে অভিযুক্তের শাস্তি বিষয়ে আলোচনা করলাম তার একটাই কারণ, অভিযুক্ত সীতাকে আগুনে ঠেলে দেওয়ার বিষয়টাও দেখতে হবে। কারোকে আগুনে ঠেলে দিলে তাঁর বেঁচে থাকার কথা নয়। আগুনে পুড়ে অভিযুক্ত যে এর ফলে মারা যাবে, এটা জেনেই এহেন যাচাইয়ের বিধান। সতী কি না এটা যাচাইয়ের জন্য সীতাকেও লেলিহান আগুনে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। প্রথমবার যাচাইয়ের পরীক্ষায় বিভীষণ আর লক্ষ্মণের কৌশলে সীতা সে যাত্রায় বেঁচে যান। শ্বাপদসংকুল গভীর অরণ্যে সীতাকে নির্বাসন দেওয়া হলে এবং বাল্মীকি আশ্রয় না-দিলে, সেদিনও সীতার কোনো হিংস্র প্রাণীর পেটে চলে যেত। সীতার তৃতীয় ও শেষবারের মতো সতীত্ব যাচাইয়ে পরীক্ষার সময় লক্ষ্মণ আর বিভীষণ উপস্থিত নেই, ফলে আগুন থেকে বাঁচানোর কৌশল কে প্রয়োগ করবে! তাই আর আগুনে প্রবেশ নয়, মাটির নীচে চলে গেলেন তিনি। এটাই বাস্তব–কোনো অলৌকিক বা ভেলকি নয়।

তা মাটির নীচে কীভাবে গেলেন? ‘হে ধরণী দ্বিধা হও’ বা ‘পৃথিবী বিদীর্ণা হও’–আর অমনি ধরণী দু-ভাগ হয়ে গেল। ধরণী দু-ভাগ হয়ে গেল আর সীতা মাটির নীচে চলে গেল! মাটির নীচে কী আছে? মাটির নীচে কেউ গেলে তাঁর তো পঞ্চত্ব সুনিশ্চিত হয়! তাহলে সীতার পাতালপ্রবেশের যুক্তিটা কী, উদ্দেশ্যটাই-বা কী? যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক বীরেন্দ্র মিত্র লিখেছেন–“সভাস্থ সাধারণ যখন স্তম্ভিত তখন হড়হড় করে পৃথিবী বিদীর্ণ। হলেন, সীতাও রথে চেপে নেমে গেলেন। সর্বসমক্ষে সাধ্বী সীতার পাতালপ্রবেশ ঘটল। আমাদেরও উদ্বেগেরও অবসান হল। কেবল একটি প্রশ্ন, দেবতারা কি আধুনিক কায়দায় একটি নাট্যমঞ্চ আগেই প্রস্তুত রেখেছিলেন, যার সুইচ টিপলে দুই পাটাতন সরে গিয়ে দৈব-আসন সেই গহ্বর থেকে ওঠে নামে? এসব ব্যাপার সেকালে দৈব প্রহেলিকা ছিল, একালে হিন্দি ছায়াছবির সেটে হরদম দেখা যায়।” মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

আমরা লব ও কুশকে পাচ্ছি উত্তরকাণ্ডে। যে কাণ্ডটি মহর্ষি বাল্মীকির রচনা করেননি বলে অনেক পণ্ডিত মনে করেন। এই লব ও কুশ যে রামচন্দ্রেরই ঔরসজাত সন্তান তেমন কোনো জোরালো ঘটনায় কথা কবি বলেননি। ফলে লব-কুশের পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন রয়েই গেছে, সেটা বোধহয় রামচন্দ্রও বিলক্ষণ জানতেন। তাই বোধহয় সীতার সতীত্ব যাচাই। প্রজাদের চাপ নয়, নিজেও সন্দিহান ছিলেন। তাই বোধহয় অবলীলায় বলে ফেলতে পারেন–“নোসাহে পরিভোগায় শ্বাবলীঢ়ং হব্যির্থ।” কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়। লব ও কুশ যখন রামের রাজসভায় রামগান করছিলেন, তখন সভার সকলে বলছিলেন, বালক দুটি অবিকল রাজা রামের মতো দেখতে। তাহলে এত সন্দেহ কেন স্ত্রীকে? সভার উপস্থিত ব্যক্তিদের কথা কি রামের কানে ঢোকেনি, নাকি ঢোকাননি? রাম ঠিক, না সীতা ঠিক? সীতা কি সত্যিই ধর্ষিতা হয়েছিলেন? সীতা প্রসঙ্গে আলোচনার সময় বিস্তারিত বলব।

তাহলে কি রাম “রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম কামগন্ধ নাহি তায়”? অনেকে বলেন রাম সীতার প্রতি তেমন সুবিচার না-করতে পারলেও, রাম দ্বিতীয় কোনো নারীতে উপগত হননি। রাম চরিত্রবান পুরুষ। আমি বলি–রাম পনেরো কিংবা ষোলো বছর বয়সে বিয়ে করেন। বারো বছর দাম্পত্যজীবন ভোগ করেন অযোধ্যাতেই। তখন তিনি রাজপুত্র, রাজা নন। রাজপুত্রের একাধিক নারীসঙ্গের সুযোগ নেই। এরপর যখন রামের বয়স সাতাশ কিংবা আঠাশ, তখন দণ্ডকারণ্যে নির্বাসন। চোদ্দো বছর শ্বাপদসংকুল অরণ্যেই কেটে যায়। রাক্ষস মারতে মারতেই সময় অতিবাহিত হয়। এ অরণ্যে সংগ্রামীজীবনে অন্য নারীতে আসক্ত হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। লঙ্কাযুদ্ধের শেষে যখন রাম অযোধ্যায় ফিরলেন, তখন রামের বয়স বিয়াল্লিশ কিংবা তেতাল্লিশ। এ সময় সীতাকে বিসর্জন দিয়ে অন্য নারীকে গ্রহণ করা সময়ানুগ ছিল না। অতএব বাল্মীকির রাম সীতা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নারী আসক্ত নন। স্ত্রীকে বর্জনের পর অশ্বমেধ যজ্ঞে স্ত্রীকে প্রয়োজন হলেও দ্বিতীয় বিয়ের কথা তিনি ভাবেননি। কাজ মিটিয়েছেন স্বর্ণসীতা নির্মাণ করে।

তা ছাড়া রাম কখনো ভোলেননি পিতা দশরথের কামুকতার কথা। বাতাসে কান পাতা দায় হত পিতার কামুকচরিত্রের জন্য। রাস্তাঘাটের লোকেরা পর্যন্ত যার সম্বন্ধে বলেছে ‘কামাত্মা’, ‘কামবেগবশানুগ’ লক্ষ্মণ যেমন পিতাকে কামুক’ বলে তিরস্কার করেছিলেন, রামও অনুরূপ ভাষায় তিরস্কার করেছিলেন। দশরথ নিজেও বেশ স্পষ্ট করেই জানতেন যে তিনি কামুক। তিনি কৈকেয়ীকে কী বলছেন শুনুন–

“বালিশে বত কামাত্মা রাজা দশরথথা ভৃশ। স্ত্রীকৃতে যঃ প্রিয়ং পুত্রং বনং প্রস্থাপয়িষ্যতি।”

অর্থাৎ পুত্র রাম বনে গেলে লোকে কী বলবে? বলবে কামুক রাজা স্ত্রীর কথায় পুত্রকে বনে পাঠাল। লোকে যে বলে লোকে যে বলবে সে বিষয়ে দশরথ বিলক্ষণ অবগত।

কৈকেয়ী-কামুকত্বেই দশরথ শেষ হয়েছে। রামের বনবাসও সেই কামুকতারই ফল। কামজৰ্জর রাজা তথা পিতা কৈকেয়ীর বিরুদ্ধে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারেননি। সেই কারণেই হয়তো রামও কঠোরভাবে নিজের চরিত্রকে রক্ষা করেছেন। আর যাই-ই বলুক, পিতার মতো কেউ যেন কামুক’ না-বলে, সে ব্যাপারে রাম সদা সতর্ক ও কঠোরব্রত পালন করেছিলেন। পিতার কার্বন-কপি হননি। শুধু রাম নয়–লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন কারোর বিরুদ্ধেই নারীঘটিত চরিত্র নিয়ে কেউ আঙুল তোলার সুযোগ পাবে না। সে যুগে একপত্নীতে সন্তুষ্ট চার ভাই-ই, এ দৃষ্টান্ত বড়োই বিরল। তবে বাল্মীকির রাম ‘একপত্নী’ হলেও, চন্দ্রাবতী রামায়ণ, জৈন রামায়ণে অন্যভাবে রামের আরও তিনখানি স্ত্রীর কথা উল্লেখ আছে।

তাই বলে রাম কামগন্ধহীন ছিলেন, একথা কোনো নিন্দুকও বলবেন না–বাল্মীকিও বলেননি। বাল্মীকির রাম অরণ্যজীবনে বারবার কামাতুর হয়েছেন। সীতাহারা হয়ে রাম যখন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তখন প্রকৃতির কোলে পশুপাখির কামক্রীড়া দর্শন করে বারবার কামদগ্ধ হয়েছেন। অবশ্য পশুদের কামকেলি দর্শন করতে করতে সীতার কথাই মনে পড়ছিল বিরহী রামের। লক্ষ্মণকে ডেকে বলেছেন–“ম্মদনেনাভিবৰ্ত্তেত যদি নপেহৃতা ভবেৎ।” তিনি খোলামনে স্বীকার করেছেন যে, প্রাণীদের রমণ দর্শন করে তাঁরও কাম জেগে উঠছে–

“রমতে কাস্তয়া সার্ধং কামম্ উদ্দীপয়ন্নিব।”

এ হল রাম কামবেপথু বিলাপ। কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে জানা যাচ্ছে, দীর্ঘ অরণ্যজীবনে স্ত্রীসংসর্গবঞ্চিত লক্ষ্মণকে নিজের কামজ্বরের কথা বলছেন ‘ভগবান রাম–“হে লক্ষ্মণ! আমি কামার্ত। … সীতা ব্যতীত বাস করা আমার পক্ষে অত্যন্ত সুকঠিন।… এক্ষণে যদি আমি পম্পাতটে তাঁহার সহবাসে কালক্ষেপ করি তাহা হইলে ইন্দ্রত্ব কি অযোধ্যা কিছুই চাই না।” লক্ষ্মণ যারপরনাই বিরক্ত হন এবং জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে তিরস্কার করেন–“আপনি শোককে দূরে ফেলুন এবং কামুকতাও পরিত্যাগ করুন।” যে কথা না-বললেই নয়, তা হল–তিনি কখনোই কামের দাস হয়ে পড়েননি। দুরন্ত কামরিপু তাঁর চরিত্রকে কখনোই কালিমালিপ্ত করতে পারেনি। এএখানেই শেষ হয়নি। রামের আদেশে সমুদ্রসৈকতে সৈনাশিবির গড়ে উঠল। তিন ভাগে ভাগ হল সৈন্যদল। নেতৃত্বে সেনাপতি নীল। সবাই যখন যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, রাম সেই অবকাশযাপনে স্ত্রী সীতার কথা ভাবছেন এবং স্ত্রীসুখবঞ্চিত ছোটো ভাই লক্ষ্মণের কাছে প্রকাশও করলেন–“কবে আমি তাঁহার রজোষ্ঠ চারুদর্শন মুখমণ্ডল কিঞ্চিত উন্নত করিয়া উৎফুল্ল মনে চুম্বন করিব। কবেই-বা তিনি তালফলবৎ বর্তুল স্তনযুগল ঈষৎ কম্পিত করিয়া আমাকে গাঢ়তর আলিঙ্গন করিবেন।” এইখানেই শেষ নয়, আরও আছে। শিকার শেষে রাম যখন ঘরে ফেরেন, তখন দেখেন সীতা নেই। সীতার খোঁজে বেরলে জটায়ুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, তখন জানতে পারেন সীতা রাবণ কর্তৃক অপহৃত হয়েছেন। এ সময় সীতাহারা হয়ে রাম বিলাপ করছেন। সাক্ষাৎ বিপদাবস্থায় রামবিলাপ শুনুন–

“যাঁহার স্তনযুগল শ্রীফলের তুল্য, সর্বাঙ্গ নবপল্লববৎ কোমল … হে মরুবক! জানকীর উরুদ্বয় তোমারই ত্বকের ন্যায় সুদৃশ্য, এক্ষণে তিনি কোথায় … তাল! প্রেয়সীর স্তনযুগল সুপক্ক তাল ফলের তুল্য, যদি তুমি তাহাকে দেখিয়া থাকো তো কৃপা করিয়া বলো … হা! জানকীর নাসিকা কী সুদৃশ্য, দন্ত কী সুন্দর এবং ওষ্ঠই বা কী মনোহর। …তাঁহার বর্তুলস্তনযুগল সতত রমণীয় হরিচন্দন রাগে রঞ্জিত থাকিত, এক্ষণে পঙ্কে লিপ্ত হইয়া গিয়াছে।”  

যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক বীরেন্দ্র মিত্রের বক্তব্য অনুধাবনযোগ্য–“রামচন্দ্র কামনিপুণা রসবতী দেবলক্ষ্মীদের দ্বারা মোহিত হয়ে সে সব পরামর্শে কান দেননি। বলেছিলেন, অমন দেবনারী ভোগ করতে পেলে তিনি অযোধ্যা কেন, হিমালয় স্বর্গের প্রভুত্বও কামনা করেন না। এহেন ক্ষত্রিয় পুত্রের দুর্বলতা কোথায়, দেবতারা তা বিলক্ষণ জানতেন। এ সব মানুষকে তাঁরা ঐ দেবনারী দিয়েই বশ করতেন। যতকাল রামকে ব্যবহার করা হয়েছে। দেবতাদের স্বার্থের প্রয়োজন ছিল, ততকাল ঐ দেবনারীদের তাঁরা যোগান দিয়েছেন। বনপথে জানকী ও বেদবতী নানা রঙে ঢঙে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন রামকে। শেষ পর্যায়ে যখন মাথার ওপর, তখন দুই স্বনারীকেই তাঁরা রণক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিয়ে নিরাপদ স্থানে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। কারণ এইসব কামনিপুণা নারীরাই দেবতাদের মূলধন। এই মানুবী-ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করে রামচন্দ্রের মতো বহু আত্মসুখপরায়ণ ভারতীয় রাজাকে মাতাল করে তাঁরা আপন কাজ গুছিয়ে নিয়েছেন। ফলে রামের ওপর শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছেন প্রজাসাধারণ। ভরত ও লক্ষ্মণের মধ্যেও অশ্রদ্ধার ভাব সুস্পষ্ট হয়েছে ক্রমশ। অতঃপর রামকে দেবনারী দিয়ে তুষ্ট রাখার প্রয়োজনও ফুরিয়েছে। সেই রমণী-অস্ত্র দেবতাদেরই ভোগ্যা। সুতরাং তাঁরা কেড়ে নিয়েছেন জানকী।”

সে যাই বলুক রাম, অনেক পণ্ডিতদের মতে রাম সীতার প্রতি যথার্থ আচরণই করেছেন। গোটা রামায়ণে রাম ক্রীড়নকমাত্র। বনবাস গমন থেকে অযোধ্যায় রাজা হয়ে বসা পর্যন্ত যে যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে রামের ভূমিকাই-বা কতটুকু! এর পিছনে ছিল আর্যদেবতাদের সক্রিয় কার্যক্রম। এমন অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে, যা রামচন্দ্র অনেকক্ষেত্রে নিজেও বুঝে উঠতে পারেননি। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, ইন্দ্র, নারদ–এরকম মহাশক্তিধর পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই ছিলেন রামচন্দ্রের ঘটনাবহুল বনবাসজীবনের নেপথ্য-কারিগর। আর প্রচুর মারণাস্ত্র সরবরাহের জন্য বিশ্বামিত্র, অগস্ত্যের মতো ধুরন্ধর ব্রাহ্মণরা তো ছিলেনই। না-হলে কেন তাঁরা এত এত মারণাস্ত্র রামচন্দ্রকে দিতে যাবেন! সেই কারিগররাই শূর্পণখাকে কাজে লাগিয়ে রাবণকে দণ্ডকারণ্যে টেনে এনেছিলেন ‘ডবকা’ সীতার লোভ দেখিয়ে। রামের প্রতিশোধ নিতে রামের বউকে রাবণ অপহরণ করবেন, সেটাই ছিল স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। সকলের সামনে দাঁড় করিয়ে রাম যে মহিলাটিকে অপমান করছিলেন তিনিও সীতা নন, তিনি বেদবতী। রাবণ ভুল করে সীতাকে না-এনে বেদবতীকে নিয়ে এসেছিলেন। রাম-লক্ষ্মণ অন্তরালে যেতেই সীতাকে সরিয়ে দিয়ে বেদবতীকে বসিয়ে রেখেছিলেন আর্যদেবতারা, ‘টোপ’ হিসাবে। আর এসবই ছিল পূর্বপরিকল্পিত।

পুরাণকারদের অবশ্য বাল্মীকির সীতার অগ্নিপরীক্ষার বর্ণনা পছন্দ হয়নি। তাই তাঁরাও আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে অন্য গল্প শুনিয়েছেন। উদ্দেশ্য স্পষ্ট : রামচন্দ্রকে নিষ্কলুষ করা। পদ্মপুরাণে জানকী সীতাও নেই, স্বৰ্গবেশ্যা বেদবতীও নেই। বস্তুত বল্মীকির রামায়ণের যেসব ঘটনাগুলি ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরাণকারদের পছন্দ করেননি সেইসব ঘটনাগুলি পুনঃনির্মাণ করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই এমন সব ঘটনা এবং তার ব্যাখ্যা করেছেন, যা বাল্মীকি স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না। তিনি সে সময় বেঁচে থাকলে ঠাটিয়ে চড় কষিয়ে দিতেন। আর পুরাণের সেইসব ঘটনাবলি শিরোধার্য করে বাল্মীকি-পরবর্তী কবিরা কাব্য করেছেন। পদ্মপুরাণে লেখা হয়েছে–অগ্নিপরীক্ষায় যে সীতাকে লেলিহান আগুনে প্রবেশ করতে হয়েছিল, তিনি প্রকৃতই সীতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন ‘মায়াসীতা’ সেই সীতা রামের আদেশ পালনার্থে আগুনে প্রবেশ করেন এবং অদৃশ্য হয়ে যান। বনবাসের আগেই অগ্নিদেবের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, তাঁকে রক্ষা করার জন্য। অগ্নি এক মায়াসীতা নির্মাণ করেন। আসল সীতাকে তিনি রক্ষা করেন। মায়াসীতাকেই রাবণ অপহরণ করেছিলেন। লঙ্কা থেকে ফিরে রামচন্দ্র যে সীতাকে অগ্নিপরীক্ষার নির্দেশ দেন, তিনি মায়াসীতা। তিনি অগ্নি দ্বারা সৃষ্ট। ফলে আগুনে তাঁর কোনো ক্ষতি হতে পারে না। অতএব মায়াসীতা আগুনেই অদৃশ্য হয়ে যায়। পদ্মপুরাণ দাবি করেছে, রামচন্দ্র এসব পূর্বেই জানতেন। তিনি প্রজাদের আবদারে সীতাকে ঠেলে দেননি। অবশ্য রাম যে গর্ভবতী সীতাকে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন, তিনি কিন্তু জানকী সীতা।

সীতা, ভরত, লক্ষ্মণ, সুগ্রীব, বিভীষণদের ত্যাগ করে রামচন্দ্র এ সময় প্রায় একা। ক্ষমতা পাওয়ার আগের রাম আর ক্ষমতা পাওয়ার পরের রামের মধ্যে বিস্তর ফাঁক। রাবণ হত্যার পরেই রাম বদলে গেলেন, এ যেন এক অন্য মানুষ। আধুনিক রাজনীতিতেও আমরা লক্ষ করে থাকব–নেতা বা নেত্রীরা বিরোধীতে থাকার সময় এক রূপ, ক্ষমতায় আসার পর সেই নেতা বা নেত্রীদের আর-এক রূপ। কাউকেই আর তোয়াক্কা করেন না তিনি। সংকটকালের সঙ্গীরাও ব্রাত্য হয়ে যায়। যেমন রামের কাছে ব্রাত্য হয়ে যায় লক্ষ্মণ, সুগ্রীব, বিভীষণ, হনুমান, জাম্বুবান প্রমুখেরা। এমনকি সহধর্মিনী সীতাও পর হয়ে যায়। আপন হয়ে যায় একদা শত্রুরা। শত্রুরাও পেয়ে যায় মন্ত্রীসভার গুরু দায়িত্বগুলি। প্রাদেশিক কবিদের হাতযশে এ রামকে আমরা অনেকেই চিনি না।

ভরত যেমন চতুরঙ্গ সৈন্যবাহিনী নিয়ে রামের সাক্ষাতে গিয়েছিলেন, রামও তেমনি অযোধ্যায় ফিরলেন সুগ্রীব, বিভীষণের মতো মিত্র ও বিশাল বানরসেনাদের নিয়ে। অযোধ্যায় একা ফেরা সাহস রামের হচ্ছিল না। তাই সসৈন্যে অযোধ্যায় প্রবেশ করতে হবে। ভরতকে বিশ্বাস নেই। যদিও রাম চিত্রকুট অবস্থানকালে ভরতকে নিশ্চিত করেছিলেন যে, তিনি আর দশরথবিহীন রাজ্য অবোধ্যায় ফিরবেন না। রাম বলেছিলেন–

“এক্ষণে বনবাসকাল অতিক্রান্ত হইলেও আমি আর সেই নিরাশ্রয় বহুনায়ক অযোধ্যায় ফিরব না।”

তখন তো রাম নির্বাসিত, কিন্তু এখন নির্বাসনের সময় উত্তীর্ণ। নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে এই নির্বাসিত চোদ্দো বছরে উপলব্ধি করেছেন, সিংহাসন-রাজত্ব বড়োই প্রয়োজন। এই চোদ্দো বছরে ভরতকে হাড়েহাড়ে চিনেছেন রাম। নির্বাসনের চোদ্দো বছর তো নয়ই, এমনকি নির্বাসন উত্তীর্ণের আট মাস পরও ভরত একবারের জন্য রামের খোঁজ করেননি। রামের অযোধ্যায় ফেরার পর ভরতের আত্মসমর্পণ করার কথা। কিন্তু ভরত ভুলেই গিয়েছিলেন রাম নামে কেউ এ পৃথিবীতে কেউ আছেন। এ ভরতকে কীভাবে বিশ্বাস করা যায়, কীভাবে আস্থা আর ভরসা করা যায়?

যে বিভীষণ ছাড়া সীতা উদ্ধার কার্যত অসম্ভব ছিল, সেই বিভীষণকেও রাম এখন বিশ্বাস করতে পারছেন না। যুদ্ধশেষে বিভীষণ বলেছিলেন–

“যদি আমার প্রতি তোমার স্নেহ ও সৌহার্দ্য থাকে তবে ভ্রাতা লক্ষ্মণ ও জানকীর সহিত বিবিধ ভোগসুখে। একদিন মাত্র এই লঙ্কায় বাস করে। পশ্চাৎ অযোধ্যা যাইও।”

রাম ভ্রূক্ষেপ করেননি। আসলে রাম ভিতরে ভিতরে রাজায় রূপান্তরিত হচ্ছিলেন বোধহয়। তাই তাঁর কাছে। কেউই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। বিভীষণ, সুগ্রীব কেউই বিশ্বস্ত বন্ধু নন। বিভীষণ আর সুগ্রীবের উপকার কাজ মিটে যেতেই ভুলে গেলেন। অতএব সীতা এমন কোনো অমূল্য সম্পদ নয় যে, তার জন্যে বিভীষণ আর সুগ্রীবের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। বিনিময়ে বিভীষণ লঙ্কারাজ্য পেয়েছেন, মন্দোদরীকেও পেয়েছেন। সুগ্রীব কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্য পেয়েছেন, নিজের স্ত্রীর সঙ্গে বালীর স্ত্রীকেও পেয়েছেন। হিসাব বরাবর। উঁহু, হিসাব বরাবর এখনও হয়নি। আসল কাজটাই তো বাকি। অযোধ্যায় এখনও ভরতরাজ চলছে, এমতাবস্থায় রামের পক্ষে একা যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ভরত ঝাঁপিয়ে পড়তে পরে। তাই এদের প্রয়োজন যতক্ষণ-না মিটছে ততক্ষণ পর্যন্ত মিষ্টি কথায় চিড়ে ভেজাতে হবে। রাম চললেন অযোধ্যায়, এক মুহূর্তও বিলম্ব নয়। বিভীষণকে রথ আনার আদেশ দিলেন। সুসজ্জিত রথে চেপে রাম চললেন অযোধ্যার পথে। সঙ্গী অবশ্যই সসৈন্যে বিভীষণ, সুগ্রীব, হনুমান, রণক্লান্ত রাক্ষসখোক্ষ, বানরসেনাও। লঙ্কা থেকে সুদূর অযোধ্যা। দক্ষিণের শেষপ্রান্ত থেকে উত্তরে। সেকি এমনি এমনি! ভরতকে চমকাতে। একদা ভরতও যে চমকেছিলেন চিত্রকুটে চতুরঙ্গ সৈন্যবাহিনী নিয়ে গিয়ে! প্রথমেই ভরত নয়, পৌঁছোলেন নিকটবর্তী ভরদ্বাজ আশ্রমে। এখানে অবস্থান করে হনুমানকে আদেশ দিলেন, বললেন ভরতের কাছে গিয়ে বলল–

“তুমি অযোধ্যায় গিয়া ভরতকে জানকী, লক্ষ্মণ ও আমার কুশল জানাইয়া কহিও, আমি পূর্ণকাম হইয়াছি। পরে রাবণের সীতাহরণ, সুগ্রীবের সহিত পরিচয়, বালীবধ, সমুদ্র উল্লঙ্ঘন, সীতার অন্বেষণ, সসৈন্য সমুদ্রতীরে গমন, সমুদ্রদর্শন, সেতুনির্মাণ, রাবণবধ; ইন্দ্র ও ব্রহ্মার বরপ্রদান; শঙ্করপ্রসাদে পিতৃসমাগম ও অযোধ্যার নিকট আগমন এই সমস্ত কথা ভরতকে আনুপূর্বিক কহিও।”

রাম আরও বললেন–

“বলিও, রাম শত্রুগণকে পরাজয় ও উৎকৃষ্ট যশোলাভ করিয়া, বিভীষণ, সুগ্রীব ও অন্যান্য মহাবল মিত্রের সহিত আসিতেছেন।”

রাম এও বললেন–

“এই সংবাদ পাইলে ভরতের যেরূপ মুখাকার হয় তাহা এবং আমার প্রতি তাহার কিরূপ মনের ভাব তাহাও জানিও। তিনি কি করিতেছেন এবং তাহার আকার-ইঙ্গিতই-বা কিরূপ ইহা মুখ, বর্ণ, দৃষ্টি ও বাক্যালাপে যথার্থতঃ জানিয়া আইস।”

ভরত সম্বন্ধে রামের এই ভাবনা অমূলক নয়। ভরতের প্রতি রামের ভ্রাতৃপ্রেম এক্কেবারে তলানিতে।

হনুমানের মুখে রামের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে বিস্তারিত শুনে ভরত অজ্ঞান হয়ে গেলেন। ভরত বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না রাক্ষস-খোক্ষসদের হাত থেকে বেঁচে রাম অযোধ্যায় ফিরতে পারেন। কিছু বিশ্বাস করার আগেই ভরত দেখতে পেলেন দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়ে গেছেন রাম, বানর, সুগ্রীব, বিভীষণ সকলে। রাম ভরতের কোনো প্রতিক্রিয়াকেই পাত্তা দিতে চাইলেন না। ভরতও বিচক্ষণ ব্যক্তি। দণ্ডকারণ্য থেকে কেউ ফিরতে পারে না, রাম ফিরেছেন। অতএব বিষয়টা হালকা করে দেখা যায় না। এঁরা মহাপরাক্রান্ত। কালবিলম্ব না-করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অযোধ্যা রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন রামকে। রামের অভিষেকের দিন অবশ্য ভরতের আত্মীয়রা উপস্থিতই ছিলেন না। হয়তো নিমন্ত্রিত হননি। তবে সীতার পিতা সীরধ্বজ উপস্থিত ছিলেন।

সে যুগে শাসন-ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখতে ভাই-ব্রাদার কিচ্ছু না। প্রয়োজনে পিতাকেও হত্যা করা যেত, নৈতিক বৈধতাও ছিল। সেই মর্মে লক্ষ্মণ দশরথকে হত্যার প্রস্তাব দিয়েছিলেন–

“অদ্য মহারাজের প্রভূত্ব নাশ এবং আপনার প্রভূত্ব সংস্থাপন–এই উভয় কারণে আমার অস্ত্রপ্রভাব প্রদর্শিত হইবে। আমি আপনার চিরকিঙ্কর।” “দেবী পশ্যতু মে বীর্যং রাঘবশ্চৈব পশ্যতু৷৷হনিষ্যে পিতরং বৃদ্ধং কৈকেয়াসক্ত মানসম্।/কৃপনং চ স্থিতং বাল্যে বৃদ্ধাভাবে গহির্তম।”

কৌশল্যারও দশরথকে হত্যা করার প্রস্তাবে সমর্থন ছিল। রামকে কৌশল্যা বললেন–

“বৎস! লক্ষ্মণ যাহা কহিল, তুমি তো তাহা শ্রবণ করিলে। এক্ষণে যদি তোমার অভিপ্রেত হয়, তবে ইহার মতাবর্তী হও।”

অসাধারণ বলশালী ও অস্ত্রনিপুণ লক্ষ্মণ এটুকুতেই ছাড়লেন না। তিনি রামকে আরও বললেন–

“আর্য, আপনার এই নির্বাসন-সংবাদ প্রচার না হইতেই আপনি আমার সাহায্যে সমস্ত রাজ্য হস্তগত করুন।”

রাম বিচক্ষণ ব্যক্তি, স্থান-কাল-পাত্রভেদ বিবেচনায় রেখে প্ররোচনায় পা দিলেন না। রাম জানতেন সে শক্তি তাঁর বর্তমানে নেই, যা দিয়ে এই কার্য সমাধা করা সম্ভব। উল্টে প্রাণসংশয় পর্যন্ত হতে পারে। এই মুহূর্তে আওরঙ্গজেবের কথা মনে পড়ছে, যিনি ভাইদের হত্যা করে পিতাকে গারদে চেলে দিয়ে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করেছিলেন। রাজতন্ত্রের রাজাদের সিংহাসন দখলের রাজনীতি মোটামুটি এইরকমই (আওরঙ্গজেবের তুলনা টানলাম বলে আবার রেগে যাবেন না যেন! তুলনা টানলাম এই কারণে যে, ভারতে রাজতন্ত্রের প্রথম প্রতিনিধি যদি রামচন্দ্র হন তো আওরঙ্গজেব শেষতম রাজতন্ত্রের প্রতিনিধি বলাই যায়)। খারাপ লাগার কিছু নেই। ইতিহাস দিয়েই ইতিহাসর বিচার করা ছাড়া উপায় কী! এটাই রাজতন্ত্রের দস্তুর। রামচন্দ্রও সেই রাজতন্ত্রের লাইনকে বিন্দুমাত্র অন্যথা করেননি।

রামচন্দ্রের অযোধ্যায় ফিরে আসার সংবাদ শুনে ভরত অজ্ঞান হয়ে গেলেন কেন?

(এক) ভরত ভেবেই নিয়েছিলেন রামচন্দ্র কোনোদিনই রাক্ষসখোক্ষসদের হাত থেকে বেঁচে অযোধ্যায় ফিরতে পারবেন না। তা ছাড়া ভরত চিত্রকূটে এলে রামচন্দ্র নিজের মুখেই বলেছিলেন, তিনি আর কোনোদিনই অযোধ্যায় ফিরবেন না। অতএব ভরত নিশ্চিন্তেই ছিলেন। দীর্ঘ চোদ্দো বছরের মধ্যে একবারের জন্য ভরত রামচন্দ্রের খোঁজখবর নেননি, এমনকি চোদ্দো বছর পরও আর প্রায় অতিবাহিত হয়ে গেলেও দাদার খোঁজে ভাই বেরোননি। এতদিন পর রামচন্দ্রের ফিরে আসার যেন ভরতের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া।

(দুই) মৃত্যুভয়। ভরত প্রয়োজনে রামকে হত্যা করতে হবে এই ভেবে অযোধ্যা থেকে চিত্রকূটে চতুরঙ্গ সৈন্যদল নিয়ে পৌঁছেছিলেন, সে ব্যাপারে ভরত নিশ্চয় সচেতন। অতএব রামও একই পদ্ধতিতে সিংহাসন দখল করতে পারে সেই কথা ভেবেই ভীত-সন্ত্রস্ত। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বলে কথা।

যাই হোক, সদলবলে সৈন্যসামন্ত নিয়ে রাম অযোধ্যায় প্রবেশ করেছিলেন। রামের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই ভরত সিংহাসন ছেড়ে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। যদিও এমন শর্ত ছিল না যে, রাম বনবাস থেকে ফিরে এলেই রাজ্যলাভ করবেন। ভরত দিলে তবেই রাজ্য পাবেন। তবে প্রতিশোধ তো নিতেই হবে। অতএব বলপ্রয়োগ নয়, বল প্রদর্শনেই রামের কার্যসিদ্ধি হল। কিন্তু রাম এতটুকুতেই খুশি হবেন কেন? রাজার সিংহাসনে কাঁটা থাকলে চলে! ভরতকে নয়, লক্ষ্মণকে রাম যৌবরাজ্যের দায়িত্ব দিতে চাইলেন। বারবার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু লক্ষ্মণ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন রামের অনুরোধ। রামচন্দ্র যদি ভরতের প্রতি আস্থা রাখতে পারতেন, তবে কখনোই লক্ষ্মণকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে চাইতেন না। প্রথা অনুযায়ী যুবরাজ পদটির জন্য ভরতই একমাত্র দাবিদার। তা ছাড়া লক্ষ্মণও আর রামের অনুগত নন। সীতাকে দাহ করার পর থেকে রাম-লক্ষ্মণের সম্পর্কে ভাঙন ধরেছিল। সীতাকে আগুনে জ্বালানো লক্ষ্মণ মেনে নিতে পারেননি। তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেছে যমুনা দিয়ে। লক্ষ্মণ এখন এক স্বতন্ত্র সত্তা। অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভরতকেই যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। তবে তা সাময়িক, লোক-দেখানো। ভরত কখনোই বিশ্বস্ত নন। যুবরাজ করেছেন বটে, সেইসঙ্গে তাঁকে নজরবন্দিও করে রেখেছেন। অযোধ্যা নগরীর বাইরে পর্যন্ত বেরতে দেননি ভরতকে।

রামচন্দ্র অযোধ্যার উপযুক্ত রাজা। উপযুক্ত রাজার সিংহাসন কখনো কাঁটাযুক্ত হতে পারে না। রাজারা কখনো কাঁটা পছন্দ করেন না। কাঁটা নির্মূল করাটাই রাজার প্রথম কাজ। না-হলে সুষ্ঠুভাবে রাজ্য পরিচালনা সম্ভব নয়। অতএব কাঁটা মুক্ত করার অভিযানে সক্রিয় হতে হবে। নিরঙ্কুশ ক্ষমতাই রাজার মনোবা। প্রথম টার্গেট ভরত, বড়ো কাঁটা। যৌবরাজ্যে অধিষ্ঠিত করার কয়েকদিনের মধ্যেই অযোধ্যা থেকে বহু দূর অন্য একটি ভূখণ্ডের দায়িত্ব অর্পণ করে পাঠিয়ে দিলেন। কূটনীতিতে বালখিল্যতার কোনো জায়গা নেই। রামচন্দ্র সেটা বিলক্ষণ জানতেন। কেকয় রাজ্যের রাজা যুধাজিৎ (ভরতের মামা) কেকয় রাজ্যের পার্শ্ববর্তী গন্ধর্বদের পরাজিত করে গন্ধর্বদেশ অধিকার করতে বললেন। কারণ ওই যুদ্ধ প্রাণঘাতী ছিল, রামের সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি। অতএব এমন মরণযুদ্ধে ভরতই শ্রেয়। পাঠিয়ে দিলেন ভরত ও ভরতের দুই পুত্রকে। অযোধ্যা চিরকালের জন্য ভরতমুক্ত হল। এমনিতেই লঙ্কাযুদ্ধের পর রামচন্দ্র আর কোনো যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেননি। যুদ্ধের প্রয়োজন হলে ভরত ও তাঁর শাকরেদ শত্রুঘ্নকে ঠেলে দিয়েছেন। রাজত্বকালের প্রথম বছরেই শত্রুঘ্নকে পাঠিয়ে দিলেন মথুরায় লবণাসুরকে হত্যা করতে৷ অযোধ্যা শত্রম্নমুক্ত হল। ভরতের কাছ থেকে শত্রুঘ্নকে বিচ্ছিন্ন করেও দেওয়া গেল। ভরতের শক্তিক্ষয় হল। ভরত গন্ধর্বদেশ জয় করে ওখানেই থেকে গেলেন এবং শত্রুঘ্নকে মথুরার রাজপদে রাম অভিষিক্ত করে দিলেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। সঙ্গে লবণকে হত্যা করার জন্য চার হাজার ঘোড়া, দুই হাজার রথ আর একশো হাতি পাঠিয়ে দিলেন। সেনাদের একমাস আগে পাঠিয়ে দিয়ে শত্রুঘ্নকে একা শরাসন হাতে দিয়ে পাঠালেন। অযোধ্যায় ফিরে আসার কোনো অনুমতি ছিল না শত্ৰুগ্নর। পাছে অযোধ্যা আক্রমণ করে বসে সেই সতর্কতায় কি সৈন্যবাহিনীসহ শত্ৰুগ্নকে অযোধ্যায় অবস্থান করতে দেননি?

এর মধ্যে অবশ্য গর্ভলক্ষণ দেখে সীতাকেও পরিত্যাগ করা হয়ে গেছে গভীর ও শ্বাপদসংকুল জঙ্গলে। পত্নীপ্রেমে পাগল রামচন্দ্রের কাছে সীতা হলেন চক্ষুশূল। বাল্মীকি রামকে বললেন ‘নেত্ররাগী’। লক্ষ্মণকে দিয়েই সীতাকে পরিত্যাগ করার মতো পাপ কাজটি করানো হয়েছিল। লক্ষ্মণ জানতেন না যে, সীতা গর্ভবতী ছিলেন। যখন জানতে পারলেন তখন সীতা গভীর জঙ্গলে পরিত্যক্ত। লক্ষ্মণ বাকরুদ্ধ হলেন।

রামের নজরে রইল বাকি এই লক্ষ্মণ। না না, বাকি থাকবে কেন? ভ্রাতৃবৎসল রামের ভ্রাতৃপ্রেমও উধাও হল। লক্ষ্মণও হলেন চক্ষুশূল। অতএব লক্ষ্মণকেও অযোধ্যায় রাখা যায় না। তিনি নিরাপদ নয় মোটেই। কারণ–লঙ্কাযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে লক্ষ্মণ রামের কাজকর্মকে অপছন্দ করেছেন। সীতাকে আগুনে ঠেলে দেওয়ায় বিরক্ত হয়েছেন, সীতাকে পরিত্যাগ করার বিরক্ত প্রকাশ করেছেন, সীতাকে পোড়ানোর জন্য লক্ষ্মণকে চিতা প্রস্তুতের আদেশ দেওয়ার জন্য ক্রোধী হয়েছেন। রামের এইসব গর্হিত কাজ লক্ষ্মণ মন থেকে অনুমোদন করতে পারেননি। এহেন আনুগত্যহীনতায় রামও ক্ষিপ্ত। অতএব এহেন লক্ষ্মণকে পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। রাজার কাজে দ্বিমত পোষণ! কিন্তু কীভাবে লক্ষ্মণকে বর্জন করা সম্ভব? লক্ষ্মণের মতো সর্বক্ষণের সঙ্গী ও সহযোদ্ধাকে ত্যাগ করা তো সহজ কথা নয়! লোকে কী বলবে? রাজ্য-সিংহাসন-রাজা হওয়ার লোভও লক্ষ্মণের কখনোই ছিল না। অতএব লক্ষ্মণকে রাজ্য ধরিয়ে অযোধ্যা থেকে সরানো যাবে না। অতএব–মহর্ষি অতিবলের দূত কাল তাপসের বেশে রাজদ্বারে এসে তাঁর নিজের পরিচয় দিলেন এবং দ্বাররক্ষী লক্ষ্মণকে জানালেন তিনি রাজা রামের সঙ্গে একান্তে সাক্ষাতে আগ্রহী। কাল যাতে রামের সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ করতে পারেন তার সব ব্যবস্থাই করে দিলেন। কে এই অতিবল? কেই-বা অতিবলের দূত কাল? গোটা রামায়ণ, গোটা মহাভারত, সমগ্র পুরাণ তন্নতন্ন করেও এঁদের দেখা মেলে না। শুধু রামায়ণের এই অংশটুকুতেই তাঁদের পরিচয়। উদ্দেশ্য কী? দ্বাররক্ষীর মতো নিকৃষ্ট কাজে কেন লক্ষ্মণকে নিয়োগ করলেন রাজা রাম? অন্য দ্বাররক্ষী তো আগেই ছিল। তাকে কেন অপসারণ করে লক্ষ্মণকে নিয়োগ করা হল? এটা তো মর্যাদাহানি! অকারণে রাজা রাম লক্ষ্মণকে দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব দেননি। এই দায়িত্বের মধ্য দিয়েই লক্ষ্মণের যবনিকা পতন সম্ভব। কারণ দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব দিয়ে রাম লক্ষ্মণকে এটাও জানিয়ে দিলেন–

“স্বয়ং দ্বারে দণ্ডায়মান থাকো। এই ঋষি ও আমার সঙ্গে নির্জনে যাহা কথাবার্তা হইবে যদি কেহ তাহা দেখে বা শুনে সে আমার বধ্য হইবে।”

কী বুঝলেন পাঠক? লক্ষ্মণ বলিপ্রদত্ত! লক্ষ্মণের পরিণতির ক্ষেত্র প্রস্তুত করাই ছিল। লক্ষ্মণ যখন দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব পালন করছিলেন, ঠিক তখনই হাজির সেই ভয়াল ভয়ংকর ক্ৰোধী ব্রাহ্মণ-পুরুষ, তিনি দুর্বাসা। গোটা রামায়ণে তিনি কোথাও নেই, শুধু এইটুকু অংশ ছাড়া। রাজদ্বারে এসে লক্ষ্মণকে দুর্বাসা বললেন–

“তুমি শীঘ্রই রামের সহিত আমার দেখা করাইয়া দাও।”

লক্ষ্মণ জানালেন রাম এখন বিশেষ রাজকার্যে ব্যস্ত আছেন। দেখা করা সম্ভব নয়। একথা শুনে দুর্বাসা স্বভাবদোষে ক্ষিপ্ত হলেন এবং বললেন–

“আমি সবংশে তোমাদের চারভ্রাতার উপর এবং গ্রাম নগর সকলেরই অভিসম্পাত করিব।”

উভয় সংকট–রামরক্ষা না দুর্বাসারক্ষা, দুর্বাসারক্ষা না আত্মরক্ষা! দ্বাররক্ষী হিসাবে তাঁর আত্মরক্ষার কোনো জায়গা নেই। ওটা অনৈতিক, অশাস্ত্রীয়! অতএব স্বেচ্ছায় হাড়িকাঠে গলা বাড়িয়ে দেওয়াই একমাত্র উপায়। রামের অনুমোদন আদায়ের জন্য লক্ষ্মণের প্রবেশ করা মানে মৃত্যুদণ্ডকে বরণ করে নেওয়া। যদি অনুমোদন আদায়ের জন্য লক্ষ্মণ রামের কাছে নাও যান এবং দুর্বাশা যদি রামের সঙ্গে দেখা করতে এসে বিমুখ হয়ে ফিরে যান, তাহলে কি রাম লক্ষ্মণকে ক্ষমাচোখে দেখতেন? উঁহু, ক্ষমাচোখে দেখতেন না। তাহলে দ্বাররক্ষীর শর্ত অত কঠোর ও নিশ্চিদ্র করতেন না, দ্বাররক্ষীর যখন তাঁর প্রাণপ্রিয় ভাই! পৃথিবী খুঁজলে এরকম হাজার সীতা পাওয়া যায়, লক্ষ্মণ তোমার মতো একটিও ভাই পাওয়া যায় না। সেই ভাইয়ের আজ কী পরিণতি! মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এ যেন বাঘের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়া! লক্ষ্মণ রামের আলোচনাকক্ষে ঢুকে দুর্বাসার আগমনবার্তা দিলেন রামকে। অতিবলের দূতকে বিদায় দিয়ে দুর্বাসাকে অভিবাদন জানালেন রাজা রাম৷

সত্যাশ্রয়ী রাম। এখন তিনি রাজা। তিনি তো প্রতিজ্ঞাভঙ্গের দোষে দুষ্ট হতে পারেন না। একদা শত্রু বশিষ্ঠও রামচন্দ্রকে মনে করিয়ে দিলেন শাস্ত্রকথা–

“প্রতিজ্ঞাভঙ্গে ধর্মক্ষতি। ধর্ম নষ্ট হলে স্থাবর জঙ্গমাত্মক বিশ্ব নিশ্চয়ই ধ্বংস হইবে।”

প্রজারাই-বা কী বলবেন! অতএব তিনি নিরুপায়। নিজের সত্যপালনের জন্য লক্ষ্মণের হত্যা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। লক্ষ্মণ রামচন্দ্রের বধ্য। আদতে রাজা রাম সত্যনিষ্ঠ থাকতে পারেননি। লক্ষ্মণকে হত্যা করেননি, বর্জন করলেন। কারণ নিজের ভাইকে হত্যা করলে দুর্নাম হতে পারে। হিতে বিপরীত হতে পারে। তা ছাড়া বশিষ্ঠ যখন ভিন্ন উপায় বাতলেছেন, তখন খামোকা ঝামেলা বাড়ানোর কী দরকার! ব্রাহ্মণ-পুরুষ বশিষ্ঠ নিদান দিয়েছেন–

“আপনার জনের পক্ষে ত্যাগ বা বধ উভয়ই সাধুগণের চক্ষে সমান।”

অতএব আর দেরি কেন! এক্ষণে লক্ষ্মণকে পরিত্যাগ করো। আজীবন অনুচর লক্ষ্মণকে রাজা রাম বর্জন করলেন। এতে লক্ষ্মণ আত্মহত্যা করেন তো অতি উত্তম। সাপও মরল, লাঠিও অক্ষত রইল। রামও জানতেন লক্ষ্মণকে হত্যা না করলেও লক্ষ্মণশূন্য হবে অযোধ্যা। লক্ষ্মণ আত্মহত্যাই করবেন। রামায়ণের কবি বলছেন–

“লক্ষ্মণ সগৃহে আর প্রবেশ না করিয়া জলধারাকুললোচনে প্রস্থান করিলেন এবং সরযূতীরে উপস্থিত আচমনপূর্বক সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার রুদ্ধ করিলেন। তাহার শ্বাসপ্রশ্বাস আর পড়িল না।”

তবে কি লক্ষ্মণ বিষপান করে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন? সেকালে তো রাজপুরুষদের আংটির মধ্যে মারণবিষ রাখার প্রচলন ছিলই।

সব শেষ। রাজা রামচন্দ্র প্রকৃতই নিরঙ্কুশ, একাকী। রামের রাজত্বে ‘প্রাণপ্রিয় ভাই’ লক্ষ্মণ নেই, ‘অনুরাগী ভাই’ ভরত নেই, ‘সতীসাধ্বী স্ত্রী সীতা নেই–ব্রাহ্মণ পরিবৃত হয়ে রাম সিংহাসন অলংকৃত করে বসে আছেন। উঁহু, তিনি একাকী নন। রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনরা না-থাকলেও, তাঁর চারধার ঘিরে আছেন ব্রাহ্মণকুল। কে নেই রামচন্দ্রের রাজসভায়! যে অগস্ত্যকে রামচন্দ্র কোনোদিন পাত্তা দিতেন না, সেই অগস্ত্যও রামচন্দ্রের। রাজসভা আলোকিত করে বসে আছেন। আলোকিত বসে আছেন বশিষ্ঠ, বামদেব, আঙ্গিরস, কাশ্যপ, ভৃগু, মার্কণ্ডেয়, কাত্যায়ন, কুৎসের মতো অসংখ্য ব্রাহ্মণকুল। গোটা রামায়ণে অগস্ত্য মুনির তেমন উপস্থিতি লক্ষ করা যায় না। রামের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন হওয়াতেই তিনি আবির্ভাব হয়ে গেছেন। রাজদরবারে পাকাপাকি জায়গা করে নেওয়ার জন্যই। যাতে রাজার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তটা পাকা হয়ে যায়। চোদ্দো বছরের মধ্যে একবারের জন্যও অগস্ত্য মুনি অযোধ্যায় আসেননি ভরতের রাজসভায় স্থান পাওয়ার জন্য। কারণ তিনি জানতেন ভরতের রাজসভায় এসে তেমন সুবিধা করতে পারতেন না। ভরত অত সহজ সরল নন। তিনি জানতেন ভরতকে বশ করার মতো কোনো উপায় তাঁর জানা নেই। কিন্তু রামকে বশ করার মতো হাজার উপায় আছে। সেই কাজটাই শুরু দিলেন মুনি অগস্ত্য। কাজটা অবশ্যই আপ্ত-সহায়ক বা স্তাবকের। অর্থাৎ রাজা রাম ঠিক কতটা বীর তারই ফোলানো-ফাঁপানো গল্প। বলতে থাকলেন তাঁরা কত বড়ো বীর ছিলেন, সেই শত্রুপক্ষকে করেন যিনি হত্যা করেছেন সে তো ততধিক বীর। এমন বীরদের তিনি হত্যা করেছেন, পরাস্ত করেছেন, পর্যদস্ত যে তাঁকে দেবতারাও কাবু করতে পারেননি। যে কাজ দেবতারাও পারেন না, সেই কাজ রাম পেরেছেন। অতএব রাম বীরশ্রেষ্ঠ। লঙ্কাকাণ্ডে রাবণ প্রায় এলিতেলিই ছিল। সুগ্রীবের রাজশক্তির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় রাবণবধ রামের গরিমা তেমন উজ্জ্বল হয় না। এমন মানুষকে মেরে রাজার বীরত্ব প্রকাশ পায় না। তাই উত্তরকাণ্ডে এসে অগস্ত্য বলতে থাকলেন রাবণের পূর্বজন্ম, রাবণ কীভাবে ক্রমশ ভয়াল-ভয়ংকর হয়ে উঠতে থাকল। এই পূর্বজন্ম বর্ণনার মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হল রাবণ কতটা ভয়ংকর এবং অবধ্য ছিল। শুধু রাবণ বা রাবণের বংশপরিচয় নয়, একই সঙ্গে বানরদেরও পূর্বজন্মের কাহিনি শোনানো হল রামকে। এখানেই শেষ হয় না–মুনিঋষিরা রামচন্দ্রকে নারায়ণ, বিষ্ণু পর্যন্ত বলতে থাকলেন। নিজের প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে। পারিষদবর্গ, অগস্ত্য ও অন্যান্য মুনিরা ঢাক পিটাচ্ছেন, আর রাজা রাম নিষ্ঠাভরে শুনছেন। রাজার গুণগান করে রাজাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে কিছু প্রাপ্তির আশা করার মতো মানুষ প্রাচীন যুগেও ছিল, আজও আছে।

যে বশিষ্ঠের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সক্রিয়তায় রামকে বনবাসে গিয়ে অশেষ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল, জীবন বাজি রাখতে হয়েছিল, যে রামচন্দ্র বিশ্বামিত্রের সান্নিধ্যে ব্রাহ্মণদের একাধিপত্যের বিরোধী ছিলেন–সেই বশিষ্ঠই এখন রামের সবচেয়ে কাছের মানুষ, প্রধান উপদেষ্টা। এ সেই বশিষ্ঠ, যিনি তাঁর ব্রাহ্মণ সেনাপতিদের রাজপুরিতে প্রবেশ ঘটিয়ে দশরথকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন, যেদিন রামের রাজপদে অভিষেক হওয়ার কথা। বশিষ্ঠ রামের জমানাতেও মন্ত্রী, পুরোহিত এবং কুলগুরু। রামচন্দ্র বিলক্ষণ জানেন, বশিষ্ঠ অতীব শক্তিধর। তাঁকে অবজ্ঞা করলে ফল ভালো হবে না। নিজের সিংহাসন বাঁচানোও সম্ভব হবে না। অবস্থাভিজ্ঞ রাম বুঝেছিলেন কালোপযযাগিতা ও উদ্দেশ্যসিদ্ধিই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। বশিষ্ঠের বিরোধিতা মানে নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মারা। অতএব ব্রাহ্মণদের দাসত্ব স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। সেই ব্রাহ্মণদের সংস্পর্শে ও সহাবস্থানে রাজা রাম ব্রাহ্মণ্যবাদের পূজারী হয়ে গেলেন, হলেন চতুর্বর্ণের ধারক ও বাহক।

রামচন্দ্রের এই পরিবর্তনের প্রভাব উত্তরকাণ্ডের কবির লেখনীতে। যেখানে ব্রাহ্মণদের মঙ্গলার্থে শম্বুকের গলা কেটে হত্যা করলেন রাম। রামচন্দ্রের খুনি হাত দিয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্মের নব-অভ্যুত্থান হল। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া গেল ব্রাহ্মণদের টক্কর দিলে শম্বুকদের এই দশাই হবে। এটাই উত্তরকাণ্ডের শিক্ষা। শম্বুকরা আজও অবনত হয়েই রইলেন। সে যুগের মানুষরা অস্পৃশ্য শূদ্রদের চুমো খেতেন এটা কেউ আগুন ছুঁয়ে বললেও বিশ্বাসযোগ্য হয় না। রামও ব্যতিক্রম নন। চতুবর্ণ সৃষ্টিকারী ব্রাহ্মণগণ এই বিভাজনে সদা ব্যস্ত ছিলেন। সে যুগেও, এ যুগেও।

শম্বুককে রাম হত্যা করেছিলেন এক ব্রাহ্মণের অকাল মৃত পুত্রকে বাঁচাতে। অতএব ব্রাহ্মণ-পুত্র অপেক্ষা শূদ্র পুত্রের জীবনের দাম কানাকড়ি–এ কাহিনি পাওয়া যায় রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে রামের সঙ্গে চণ্ডালের বন্ধুত্ব কেবল কথায়, প্রয়োগে নয়। যে ফল-জল ব্রাহ্মণ-ঋষিদের কাছ থেকে গ্রহণ করা যায়, তা একজন অস্পৃশ্য চণ্ডালের কাছ থেকে গ্রহণ করা যায় না। তাই শূদ্রের সন্তান শম্বুক তপস্বী কৃচ্ছসাধনের অপরাধে তাঁর মুণ্ডুখানি এক কোপে নামিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। সে আবার এমন কী! শূদ্রের জীবনের মূল্য আর ব্রাহ্মণের জীবনের মূল্য তো এক হতে পারে না! ব্রাহ্মণ্যবাদের সমর্থক ব্রাহ্মণদের প্ররোচনায় শূদ্র হত্যা করে নিজেকে কলঙ্কিত করেছেন রাম রাম যে সময় শম্বুককে হত্যা করছেন, সে সময় রামের রাজসভা তাবড়তাবড় ব্রাহ্মণদের রমরমা অবস্থা। রামও সে সময় ব্রাহ্মণদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিলেন।

রামায়ণের যুগে শূদ্র-নির্যাতন তেমনভাবে না-হলেও মহাভারত-পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় শূদ্রদের ক্রমশ ঘৃণার যোগ্য করে তুলেছিলেন। সেই বিষ আজও সেবন করে চলেছেন মানুষ। তবে কেউ কেউ বলতেই পারেন ভালো কাজ করলে শূদ্রও ব্রাহ্মণ হতে পারে। কীভাবে হবে? নিয়ম আর প্রয়োগে যে যোজন-দূর পার্থক্য। ব্রাহ্মণ হতে চাইলেই শূদ্রের ব্রাহ্মণ হওয়া সম্ভব! সম্ভব নয়, তাই চুনি কোটালদের মরতে হয়। সম্ভব নয়, তাই রোহিত ভেমুলাদের আত্মহত্যা করতে হয়। পৌরাণিক যুগ হলে বলা হত চুনি কোটাল, রোহিত ভেমুলারা পূর্বজন্মে দেবতা বা গন্ধর্ব বা কিন্নর-কিন্নরী ছিলেন–এই জন্মে ব্রাহ্মণ্যবাদের স্পর্শ পেয়ে মুক্তি লাভ করে স্বর্গে গেছেন।পৌরাণিক যুগে সব গল্পেই অনার্যদের হত্যা করার পিছনে এরকম মুক্তির গল্প আছে। বিরাধ, শূর্পণখা, মারীচ, বালী, মেঘনাথ, রাবণ সকলেই পূর্বজন্মে হয় দেবতা, নয় গন্ধর্ব ছিলেন। যেমন বিরাধ ছিলেন গন্ধর্ব। গন্ধর্বজীবনে তাঁর নাম ছিল তুম্বুক। কুবেরের অভিশাপেই নাকি তাঁর এই অনার্যজীবন, নাম হয় বিরাধ। রাম বধ করলেই নাকি তিনি গন্ধর্বজীবন ফিরে পাবেন।

গন্ধর্বরা কোথায় থাকতেন? স্বর্গে? কোথায় সেই স্বর্গ? কাবুলের উপত্যকাই গন্ধর্বদেশ–হিন্দুকুশ পর্বতের দক্ষিণে জালালাবাদ, কান্দাহার, পাঞ্জাব ও কাশ্মীরের কিছুটা অংশ। আর্যদের প্রবেশ ঘটেছিল এই অঞ্চল দিয়েই। তাঁরাই অনার্য বিতারিত করেছিল দাক্ষিণাত্যের শ্বাপদসংকুল গভীর জঙ্গলে। বিরাধের সঙ্গে রামের মুখোমুখি হয় দণ্ডকারণ্যে। দণ্ডকারণ্য দাক্ষিণাত্যের পূর্বভাগ। এই মুড়িমুড়কির মতো অন্যায়ভাবে অনার্য হত্যা কাবোর কারোর মনে পুলক আনলেও, ধর্মভাবের উদয় হলেও–আমার হয় না। বাল্মীকি নিজে অনার্যদের প্রতিনিধি হয়েও আর্যদের পৃষ্ঠপোষকতায় আর্যদেরই ঢাক পিটিয়ে গেছেন। পৃষ্ঠপোষকতায় এমনই বাধ্যবাধকতা। সেটাই স্বাভাবিক। যাঁর নুন খাবে তাঁর গুণ তো গাইতেই হবে। আর সেইজন্যই বাল্মীকির রামায়ণ নয়, অন্য রামায়ণের এত কদর, আর সেইজন্যেই রামায়ণকে ঘিরে এত ইমোশন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের। সেসব রামায়ণে রাম কেবলই ভগবান, শমিত্র সকলেই রামের ভক্ত। সকলেই রামের হাতে মরে উদ্ধার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছেন। অন্য রামায়ণগুলিতে রাম যে বিষ্ণুর অংশ! এত বছর পরেও তাই রামকে ঘিরে দাঙ্গা। রাম-গ্রহণ রাম বর্জনের লড়াই জারি আছে। রামায়ণ’ যদি অনার্যদের জয়ের ইতিহাস হত, তাহলে এই গ্রন্থ আঁতুরঘরেই বিনাশ করা হত।

ঈশ্বরের চোখে যদি সবাই সমান হত তাহলে তিনি ব্রাহ্মণদের মাথা থেকে আর শুদ্রদের পা থেকে তৈরি করতেন না, কী বলেন? আর মনুসংহিতায় তো বর্ণভেদ আছে ছত্রে ছত্রেই। যেমন, মনু বলেছেন–

“দাসত্বের কাজ নির্বাহ করার জন্যই বিধাতা শূদ্রদের সৃষ্টি করেছিলেন” (৮ : ৪১৩)।

এমন কী হিন্দুধর্মের দৃষ্টিতে শূদ্রদের উপার্জিত ধনসম্পত্তি তাদের ভোগেরও অধিকার নেই। সব উপার্জিত ধন দাস-মালিকেরাই গ্রহণ করবে–এই ছিল মনুর বিধান–

“ন হি তস্যাস্তি কিঞ্চিত স্বং ভর্তৃহার্যধনো হি সঃ” (৮ : ৪১৬)।

এ ধরনের শত শত বর্ণবিদ্বেষী শ্লোক হিন্দু ধর্মগ্রন্থে ছড়িয়ে আছে। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণেও। মহাভারতের কৃষ্ণ যেমন জাত-বিভাজন সমর্থন করতেন, রামায়ণের রামও একই পথে হেঁটেছেন। অবশ্য রামায়ণ মহাভারতেরও অনেক আগের রচনা। মর্যাদা পুরুষোত্তম’, পুরুষের উৎকর্ষের সীমায় উন্নীত রাম এ কেমন পুরুষ! উত্তরকাণ্ডে শম্বুক হত্যায় যে স্বর্গের দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করেছিলেন! কেবল পুষ্পবৃষ্টিতেই থেমে থাকেননি দেবতারা, রামকে সাধুবাদ দিয়ে বলেছেন–

“রাম তুমি দেবতাদের কার্য সম্পন্ন করলে। তোমারই জন্য এই শূদ্রটি স্বর্গভাক হতে পারল না।”

এই আহ্লাদে রাম যে সারা পৃথিবী শূদ্রহীন করতে অভিযানে নামেননি, এই রক্ষে! শূদ্র হত্যায় দেবতারা সকলেই তো রামেরই দলে। এমনিতেই শূদ্রের স্থান স্বর্গ তো দূরের কথা, মর্তেও নেই। নিষাধ জাতি গুহক নাকি রামের বন্ধু, বন্ধুর আতিথ্য কি প্রত্যাখ্যান করা যায়? রাম পেরেছেন। বনবাসের প্রথম পর্বেই রাম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বন্ধু গুহকের আতিথ্য। যুক্তি হিসাবে রাম বলেছিলেন–তাঁরা বনবাসী, খাদ্য গ্রহণ করবেন না। বরং রথের ঘোড়াদের খাদ্য দিলেই উপকার হয়। বনবাসের ১৪ বছর রাম-লক্ষ্মণরা এক্কেবারে নির্জলা উপবাসে কাটিয়েছিলেন, এমন গল্পো কিন্তু নেই। বরং পরবর্তী সময়ে অত্রি, অনসূয়া, ভরদ্বাজ এবং অন্যান্য মুনিঋষিদের আতিথ্য গ্রহণ করতে তাঁদের আপত্তি ছিল না। মুনিঋষিদের আতিথ্য অবশ্যই গ্রহণ করা যায়, তাই বলে চণ্ডালের ঘরে ‘পুরুষোত্তম’! তবে আমি মনে করি এই শম্বুক হত্যার কাহিনি মুনিবর বাল্মীকি রচনা করেননি। এটি কোনো দুষ্ট ব্রাহ্মণ কর্তৃক প্রক্ষিপ্ত প্রবেশের সম্ভাবনা প্রবল। অনেকে মনে করেন বাল্মীকি নিজেও একজন অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ। তিনি নিজগুণে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করে মহাকবি হয়েছেন। যোগ্যতম না-হলে দেবমন্ত্রী ব্ৰহ্মার আদেশে দেবর্ষি নারদ কখনোই বাল্মীকিকে দিয়ে রামকাহিনি রচনা করাতেন না।

গোটা রামায়ণের circumstances বিচার করলে রাম বা বাল্মীকি কারোরই এ ধরনের আচরণ মানানসই হয় না। তা ছাড়া রামচন্দ্রের পিতা দশরথের যে ৩৫০ পুরস্ত্রীর কথা মুনিবর বাল্মীকি জানিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু পুরস্ত্রী শূদ্রই ছিলেন। অন্তঃপুরের শূদ্র মাতাদের সঙ্গে সহাবস্থানে থাকা রামের নিশ্চয় শূদ্রদের প্রতি ঘৃণা জন্মানোর কথা নয়। মানুষ যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে সেই পরিবেশ থেকেই সে শিক্ষিত হয়, দীক্ষিত হয়। এমনকি বিশ্বামিত্র রামচন্দ্রের শিক্ষাগুরু, ব্রাহ্মণবিরোধী এমন গুরুর কাছ থেকে শ্রীরামের এমন শিক্ষা হতেই পারে না। নিজেরা ব্রহ্মার মুখ থেকে জন্ম নিয়েছেন বলে প্রচার করে হাঁটু থেকে জন্ম নেওয়া শূদ্রদের ঘৃণা করতেন ব্রাহ্মণরাই, ক্ষত্রিয়রা নন।

শম্বুকহত্যার কাহিনির মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীকে মহিমান্বিত করার জন্যই কোনো ব্যক্তি পরবর্তীকালে সংযোজন করেছেন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। শূদ্র যে বধযোগ্য সেটা প্রতিষ্ঠা করতেই এই কাহিনির অবতারণা, একথা স্পষ্ট হয়। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে রাম মনুর (বৈবস্বাত) বংশধর। তাই মনুর পথই রামের পথ–এর মধ্যে অস্বাভাবিকতার কী আছে! রাম সূর্যবংশের (ইক্ষ্বাকুবংশ বলেও পরিচিত) উত্তরপুরষ। সূর্যবংশীয় প্রথম রাজা বৈবস্বত মনু। মনুর পুত্র ইক্ষ্বাকু। ইক্ষ্বাকুর জন্ম হয়েছে মনুর নাকের ভিতর থেকে! সে নাক থেকে নিক বা অন্য কথাও থেকে, মনুই জন্ম দিক বা মনুর বউ–ইক্ষ্বাকুর জন্ম হয়েছিল। সেই ইক্ষ্বাকু বংশ-তালিকা হল, যথাক্রমে–(১) ইক্ষ্বাকু (২) কুক্ষি (৩) বিকুক্ষি (৪) বাণ (৫) অনরণ্য (৬) পৃথু (৭) ত্ৰিশংকু (৮) ধুন্ধুমার (৯) যুবনাশ্ব (১০) মান্ধাতা (১১) সুসন্ধি (১২) ধ্রুবসন্ধি (এঁর এক ভাই ছিলেন, তার নাম প্রসেনজিৎ) (১৩) ভরত (১৪) অসিত (১৫) সগর (১৬) অসমঞ্জ (১৭) অংশুমান (১৮) দিলীপ (১৯) ভগীরথ (২০) ককুৎস্থ (২১) রঘু (২২) কল্মষপাদ (১৩) শঙ্খণ (২৪) সুদর্শন (২৫) অগ্নিবর্ণ (২৬) শীঘ্রগ (২৭) মরু (২৮) প্রশুশ্রুক (২৯) অম্বরীষ (৩০) নহুষ (৩১) যযাতি (৩২) নাভাগ (৩৩) অজ (৩৪) দশরথ (৩৫) রাম এবং লক্ষ্মণ। লক্ষণীয় যে এক্ষেত্রে ভরত ও শত্রুঘ্নর কোনো উল্লেখ নেই। ইক্ষ্বাকুর জন্মদাতা মনু, মনুর পিতা সূর্য। অতএব রাম যে মনুবাদের ধারক ও বাহক হবেন, এ আবার নতুন কথা কী! এ তো পরম্পরা!!

রাম সীতাকে বিসর্জন দিয়ে নিজেও বিসর্জিত হয়েছিলেন সরযূ নদীর জলে। রামের বয়স তখন কত হয়েছিল সে বিষয়ে রামায়ণে স্পষ্ট কোনো উল্লেখ নেই। থাকার কথাও নয়, কারণ রাম সিংহাসনে থাকাকালীনই কবিবর বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করেছিলেন। রাম না-জন্মাতেই রামায়ণ লেখেননি বাল্মীকি! বাল্মীকি প্রত্যক্ষদর্শী। রাম ও বাল্মীকি উভয়ই সমসাময়িক। রামায়ণ যে রামের জন্মের আগেই লিখিত হয়েছিল তার কোনো আভাস কোথাও পাওয়া যায় না। এটি একটি ভিত্তিহীন উড়ো কথা। বরং বলা যায়, রামায়ণ বাল্মীকির সমসাময়িক ঘটনার চিত্র নিয়েই হয়েছিল। বাল্মীকি যে রামের সমসাময়িক ঋষিকবি, তা রামায়ণের অন্য স্থানে স্বীকৃত আছে। রামের সঙ্গে বাল্মীকির সাক্ষাৎও হয়েছে। বাল্মীকি লঙ্কাকাণ্ডে রামায়ণ সমাপ্ত করেছিলেন, রামের অনুরোধে বাল্মীকি উত্তরকাণ্ড লিখতে শুরু করেন বলে অনেক পণ্ডিত মনে করেন। তবে বর্তমানে যে কলেবরে আমরা উত্তরকাণ্ডকে পাই, সেই উত্তরকাণ্ড বাল্মীকির নয়। অতএব রাম জন্মানোর অনেক অনেক পরেই রামায়ণ রচিত হয়েছে।

আগেই বলেছি, রামকথা বহু আগে থেকেই মানুষের মুখে মুখে ফিরত, বর্ধিত হতে হতে বাল্মীকির কাছে লিপিবদ্ধ হয়েছে। বস্তুত পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এত বড়ো রচনা এই যুগে প্রায় অসম্ভব, সেই যুগে তো কল্পনাই করা যায়। কিন্তু রামায়ণ রচনায় পৃষ্ঠপোষক কারা ছিল, সেইটা বের করা কিন্তু খুবই জটিল কাজ। প্রাচীন যুগে বেশির ভাগ সাহিত্য বা কাব্যচর্চা রাজা-সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই সৃষ্টি হত। এইসব মহান কবি রাজসভা অলংকৃত করে রাখত। বাল্মীকিও হয়তো রামের রাজসভায় কবি ছিলেন। এটা আমার নিরীক্ষণ, বাল্মীকির রামায়ণে বা অন্য কোথাও এমন তথ্য পাইনি। তবে রামজীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিতে বাল্মীকি কার্পণ্য করেননি। অনার্য রাবণকে রাক্ষস, মানুষখেকো ইত্যাদি বানাতে ‘রাজকবি’ কার্পণ্য করেননি। বাল্মীকি নয়, অন্যান্য কবিয়া রামকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী করেছেন। তাই তাঁরা একজন এলিতেলি লোককে পরাজিত করলে তো রাম হয় না, তাই প্রতিপক্ষকেও বিরাট করে নির্মাণ করতে হয়। তাই রাবণের দশমাথা কুড়ি হাত ইত্যাদিও বলতে হয়। বাল্মীকির রাবণের মাথা একটাই, হাত দুটোই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব থেকে রাম-রাবণকে দেখা হয়েছে। তাই কেউ কেউ মনে করেন হতে পারে কোনো বৈষ্ণব রাজা, যে কৃষ্ণ ঘরানার বৈষ্ণব থেকে আলাদা একটা বৈষ্ণব ঘরানা খুঁজছিল (যদিও এখন রাম আর কৃষ্ণ দুইজনেই একই বৈষ্ণব ঘরানার অবতার)। শাস্ত্ৰ-পুরাণগুলি লক্ষ করলেই বোঝা যায়, এগুলি ব্যাপক চালাচালি হয়েছে সমসাময়িক উদ্ভূত পরিস্থিতিতে। রাম আর কৃষ্ণের ঘরানা নিয়ে যখন দ্বন্দ্ব, তখন বিষ্ণুর দশাবতারে রাম ও কৃষ্ণ দুজনেই উপস্থিত। অর্থাৎ যাহা রাম তাহাই কৃষ্ণ–একজনই, তিনি বিষ্ণু যখন বৈদিক ধর্ম আর বৌদ্ধধর্মে সংঘাত চরমে, তখনও বিষ্ণুর দশাবতারে বুদ্ধদেবের প্রবেশ ঘটল। অর্থাৎ যাহাই বৈদিক ধর্ম, তাহাই বৌদ্ধধর্ম!

রাম কি ‘ভগবান’ কিংবা লর্ড কিংবা ‘দেবতা কিংবা ‘ঈশ্বর’ ছিলেন? বাল্মীকির রাম কিন্তু মানুষই, ভগবান নন। রাম ভগবান হলে যুদ্ধক্ষেত্রে এভাবে অসহায় হয়ে পড়তেন না। রামের হয়ে অন্য কেউ যুদ্ধ করে দিতেন না। ভয়ে ভীত হয়ে রণক্ষেত্রে আত্মগোপন করে থাকতে হত না। বাল্মীকির রাম যদি ভগবান হতেন, তাহলে সীতার উদ্দেশে রামের মুখ দিয়ে একাধিকবার অশ্রাব্য বাক্য বের করাতেন না। পিতা দশরথের প্রতি কটুক্তি করাতেন না। পিতার উদ্দেশে লক্ষ্মণ যেমন কটুক্তি করেছেন, তেমনি রামও করেছেন। ভগবানের মুখে অশ্রাব্য ভাষা সামঞ্জস্য নয়। এখানেই শেষ নয়, সীতার মুখ দিয়ে সীতার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা এবং রাবণের

মুখ দিয়ে সীতার শরীরের বর্ণনাও ভগবানোচিত নয়। বাল্মীকির রামায়ণের বালকাণ্ডে ও উত্তরকাণ্ডে (অনেক গবেষক মনে করেন বালকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড বাল্মীকির রচনা নয়, প্রক্ষিপ্ত) রামকে বিষ্ণুর অবতার’ বলে উল্লেখ করলেও, কবিবর বাল্মীকি স্বয়ং গোটা রামায়ণে (অযোধ্যাকাণ্ড থেকে লঙ্কাকাণ্ড) কোথাও রামকে ‘ভগবান’ বা ‘ভগবানের অংশ’ বা ‘অবতার’ বলেননি। অথচ উত্তরকাণ্ডের কবি রামচন্দ্রকে নারায়ণ, বিষ্ণু বলে সম্বোধন করেছেন।

“রামায়ণ কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়”–একথা পণ্ডিত নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন। অতএব ধর্মগ্রন্থ। যখন নয়, তখন দেবদেবতাও প্রাসঙ্গিক নয়। যদি বালকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ডে রামায়ণের সকল চরিত্রে দেবত্ব আরোপ না হত, তাহলে রামায়ণকে কে মনে রাখত? অবশ্য রামায়ণের চরিত্রগুলিতে চরমভাবে দেবত্ব আরোপ হয়েছে কৃত্তিবাস, তুলসীদাস, রঙ্গনাথন, দিবাকর ভট্ট প্রমুখের হাত ধরেই।

মূল কাণ্ডপঞ্চকে বাল্মীকি রামচন্দ্রকে ‘নরশ্রেষ্ঠ’ বা ‘নরচন্দ্রমা’-র অতিরিক্ত মর্যাদা দেননি৷ মহর্ষি নারদ বাল্মীকিকে মহাকাব্য রচনা করতে বললে বাল্মীকি সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “দেবর্ষে, এক্ষণে এই পৃথিবীতে কোন্ ব্যক্তি গুণবান, বিদ্বান, মহাবল পরাক্রান্ত, মহাত্মা, ধর্মপরায়ণ, সত্যবাদী, কৃতজ্ঞ, দৃঢ়ত ও সচ্চরিত্র আছেন? কোন্ ব্যক্তি সকল প্রাণীর হিতসাধন করিয়া থাকেন? কোন্ ব্যক্তি লোকব্যবহারকুশল, অদ্বিতীয়, সচতুর ও প্রিয়দর্শন? কোন ব্যক্তিই-বা রোষ ও অসূয়ার বশবর্তী নহেন? রণস্থলে জাতক্রোধ হইলে কাহাকে দেখিয়া দেবতারাও ভীত হন? হে তপোধন! এইরূপ গুণসম্পন্ন মনুষ্য কে আছেন, তাহা আপনিই বিলক্ষণ জানেনে। এক্ষণে বলুন, ইহা শ্রবণ করিতে আমার একান্ত কৌতূহল উপস্থিত হইয়াছে।” ত্রিকালদর্শী নারদ বাল্মীকির কৌতূহলে যারপরনাই পুলকিত হলেন এবং বললেন–

“তাপস! তুমি যে সমস্ত গুণের কথা উল্লেখ করিলে তৎসমুদয় সামান্য মনুষ্যে নিতান্ত সুলভ নহে। যাহাই হউক, এইরূপ গুণবান মনুষ্য এই পৃথিবীতে কে আছেন, এক্ষণে আমি তাহা স্মরণ করিয়া কহিতেছি, শ্রবণ করো।”

এই বলে মহর্ষি নারদ ইক্ষ্বাকুবংশীয় এক নরপতি রামের বিবরণ শোনাতে থাকলেন। অতএব বাল্মীকির রামায়ণ এক অনন্যসাধারণ মানুষের রাজকাহিনি, এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়। তাই বিতর্কেরও কোনো অবকাশ নেই। ‘রসজলনিধি’ গ্রন্থের রচয়িতা ভূদেব মুখোপাধ্যায় বলেছেন–শোনা যায়, ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র বনবাসকালে কালনাথ নামে মহর্ষির কাছে রসবিদ্যা শিক্ষা করে রামরাজীয়’ ও ‘রমেন্দ্রচিন্তামণি’ দু খানি গ্রন্থও লিখেছেন। গ্রন্থাদি তো মানুষই রচনা করে, তথাকথিত অলৌকিক অশরীরি দেবতারা নিশ্চয়ই নয়।

ভারতীয় পুরাণে তিনজন রামকে আমরা পাই। যেমন–পরশুরাম, রাম ও বলরাম। পরশুরাম কুঠারধারী, রাম ধনুর্ধারী এবং বলরাম লাঙ্গলধারী। ত্রেতাযুগের রামায়ণে পরশুরাম চরিত্রটি পাওয়া গেলেও বলরামকে পাওয়া যায় না। কারণ বলরাম চরিত্রটি দ্বাপরযুগের মহাভারতে পাওয়া যায়, যিনি কৃষ্ণের বৈমাত্রেয় বড়ো ভাই। পরশুরামকে রামের পূর্ববর্তী বলে ভাবা যেতে পারে। পরবর্তীকালে পুরাণ রচয়িতারা এবং জয়দেব এই তিনজন রামকেই বিষ্ণুর দশাবতারের তিন অবতার বলে বর্ণনা করেছেন। গবেষকগণ বলছেন পরশুরাম, রাম, বলরামকে বিবর্তনের ধারা হিসাবে দেখলে পরশুরাম ছিলেন কুঠারধারী, তিনি মানব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। এ সময় মানুষ কৃষিকাজ জানতেন না। কাঠ কাটার যুগ, অর্থাৎ কুঠারের সাহায্যে কাঠ কাটত এবং কাঠে আগুন সংযোগ করত। বন্যপ্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হলে এই কুঠারের সাহায্যে আঘাত হেনে আত্মরক্ষা করত। মানবসভ্যতার এটাই কি প্রাথমিক স্তর? অপরদিকে রামচন্দ্র ধনুর্ধারী ছিলেন। এ যুগে মানুষ প্রস্তরখণ্ড, বৃক্ষ, কাঠ, কুঠার ত্যাগ করে তীর-ধনুক হাতে তুলে নিয়েছেন। তীর-ধনুকের মধ্য দিয়ে মানুষের হাতে এল আয়ুধ, আয়ুধ মানে যুদ্ধাস্ত্র। তীর-ধনুক কেবল আত্মরক্ষার হাতিয়ার নয়, আক্রমণেরও হাতিয়ার। বলরাম হল বা লাঙ্গলধারী, ইনি কৃষিকাজের প্রতীক। অর্থাৎ এ সময় মানুষ কৃষিকাজ আয়ত্ত করেছে ধরে নেওয়া যায়। প্রতীকি অর্থে এই বিশ্লেষণে যথেষ্ট অর্থে বহন করে বইকি!

যাই হোক, ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’–সেকালে রাজাই ছিলেন সব অগতির গতি, ত্রাতা। সেই কারণেই হয়তো রাজা ‘পতিতপাবন হে ভগবান’। প্রাচীনকালে রাজাদের ভগবান বা ভগবান তুল্য ভাবা হত বা মান্য করা হত। ‘মনুসংহিতা’ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে মনু খুব উঁচুতে রেখেছেন ক্ষত্রিয় বা শাসক বা রাজাকে এবং ব্রাহ্মণদের। ঋষিবর মনু রাজাদের দেবতা বা ভগবান কেমনভাবে ভাবিয়েছেন সেটা দেখে নিতে পারি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যাঁরা ছাত্র তাঁরা জানেন রাষ্ট্রর উৎপত্তির বিষয়ে ঐশ্বরিক মতবাদ। যাঁরা জানেন না তাঁদের জন্য বিষয়টি পুনরায় উল্লেখ করলে অত্যুক্তি হবে না বোধকরি। প্রাচীনকালে রাষ্ট্রের ঐশ্বরিক মতবাদ বহুল প্রচলিত ছিল। মধ্যযুগে সেন্ট অগাস্টাইন, সেন্ট পল, সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাসের লেখনীতে এই মতবাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে ১৬৮৮ সালের ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লবের পর থেকে এই মতবাদের গুরুত্ব হ্রাস পেতে শুরু করে। ঐশ্বরিক মতবাদের মূল বক্তব্য ছিল–

(১) রাষ্ট্র ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন। এই সৃষ্টির পিছনে মানুষের কোনো ভূমিকা নেই।

(২) রাজা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তাই ঈশ্বরের ইচ্ছা রাজার মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়। সেইজন্য রাজার আদেশ বা নির্দেশ, যা আইনরূপে গণ্য হয়ে থাকে, তা মান্য করা সকল মানুষের একান্ত কর্তব্য। রাজার আইন মান্য না-করার অর্থ হল ঈশ্বরকে অবমাননা করা।

(৩) ঈশ্বরের বিধান অনুসারে রাজপদ উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করা যায়। রাজার মৃত্যু হলে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজা হবেন।

(৪) রাজা যেহেতু ঈশ্বরের প্রতিনিধি সেইহেতু তিনি কখনোই অন্যায় করতে পারেন না। ঈশ্বর ছাড়া তিনি আর কারও কাছে তাঁর কাজের জন্য জবাব দিতে বাধ্য নন।

(৫) ঈশ্বরের প্রতিনিধি এই রাজার বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহ করা যায় না। এই ধারণা বা তত্ত্ব শুধু ভারতবর্ষের হিন্দুধর্মেই নয়–এই তত্ত্ব মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি ইত্যাদি সব ধর্মেই প্রচার করা হয়েছে।

মনুর বলছেন রাজা কে? রাজশূন্য এই জগতকে রক্ষার জন্য ইন্দ্র, বায়ু, যম, সূর্য, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র এবং কুবের–এই দেবতার সারভূত অংশ নিয়ে পরমেশ্বর রাজাকে সৃষ্টি করেছেন। যেহেতু এই শ্রেষ্ঠ দেবগণের অংশ থেকে রাজার সৃষ্টি হয়েছিল সেইজন্য তিনি সকল জীবকে তেজে অভিভূত করেন।

“অরাজকে হি লোকেহস্মিন্ সর্বতো বিদ্রুতে ভয়াৎ।

রক্ষার্থমস্য সর্বস্য রাজানমসৃজৎ প্রভুঃ।

ইন্দ্রানিলমার্কাণামগ্নেশ্চ বরুণস্য চ।

চন্দ্রবিত্তেশয়োশ্চৈব মাত্রা নিত্য শাশ্বতীঃ।।

যস্মাদেং সুরেন্দ্রাণাং মাত্রাভ্যো নির্মিতো নৃপঃ।

তস্মাদভিভবত্যেষ সর্বভূতানি তেজসা”। (মনুসংহিতা, সপ্তম অধ্যায়, শ্লোক ৩-৪-৫)

রাজা কী? মনু বলছেন–

(১) তিনি সূর্যের মতো চোখ ও মন সন্তপ্ত করেন। পৃথিবীতে কেউ তাঁকে মুখোমুখি অবলোকন করতে পারে না।

(২) বালক হলেও রাজাকে মানুষ মনে করে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। ইনি মানুষের রূপে মহান দেবতা।

(৩) অতি নিকটে গেলে আগুন একমাত্র সেটাই দগ্ধ করে, কিন্তু রাজারূপ আগুন বংশ-পশু-সম্পত্তি সহ দগ্ধ করে।

(৪) রাজার অনুগ্রহে বিশাল সম্পত্তি লাভ হয়, যাঁর বীরত্বে জয়লাভ হয়, যাঁর ক্রোধে মৃত্যু বাস করে, তিনি প্রকৃতই সর্বতেজোময়। ইত্যাদি ইত্যাদি।

অর্থাৎ যিনিই রাজা, তিনিই ভগবান। ভগবানের প্রতি যেমন আনুগত্য থাকা প্রয়োজন, তেমনই রাজার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনও বিধেয়। অন্যথায় সে বিদ্রোহী, দেশদ্রোহী। হিন্দি বলয়ে রামই একমাত্র আরাধ্য দেবতা, যিনি একাধারে রাজা এবং ভগবান। একাধারে রাজা ও ভগবান, এমন ‘ভগবান’ তেত্রিশ কোটি দেবতাদের মধ্যে দ্বিতীয়টি নেই। মনুর নির্দেশ বা বিধান অনুসারে রাজা এবং ব্রাহ্মণ উভয়ই ভগবান। এদের ফতোয়ার ভয়ে সাধারণ প্রজা-মানুষরা সর্বদা তটস্থ থাকতেন।  

পণ্ডিত অক্ষয়কুমার দত্ত ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থে কী বলেছেন, সেটা দেখি–যুদ্ধকাণ্ডের ১১৯ সর্গে রাম যে স্বয়ং পূর্ণব্রহ্ম ভগবান, এ কথাটি ব্রহ্মা তাঁকে জানিয়ে দেন–এই অংশটি প্রক্ষিপ্ত বলেই তিনি মনে করেন। তিনি বলেন–কোনো ভক্তব্যক্তি রামায়ণের মধ্যে তাঁর ভাবনা প্রবেশ করিয়েছেন, রামকে বিষ্ণু ও সীতাকে লক্ষ্মী বলে প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে। এমনকি এই অংশে কৃষ্ণের নাম উল্লেখ থাকাতে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়, অভিপ্রায়টিও প্রকট হয়। রামের অনেককাল পরে কৃষ্ণকে আমরা পাই। রাম ত্রেতা যুগের, কৃষ্ণ দ্বাপর যুগের–মাঝে কয়েক হাজার বছরের ব্যবধান। পণ্ডিত যোগেশচন্দ্র রায় তাঁর ‘পৌরাণিক উপাখ্যান’ গ্রন্থে লিখেছেন–“রামায়ণে যে কত কবি পরে পরে শ্লোক জুড়িয়া দিয়াছেন, তাহার নির্ণয় দুঃসাধ্য। এক কবি একটা গোটা কাণ্ড, উত্তরকাণ্ড জুড়িয়া দিয়াছেন। বোধহয় তিনিই শ্রীরামকে বিষ্ণুর অবতার করিয়াছিলেন এবং মৃত্তিকা হইতে সীতার জন্ম কল্পনা করিয়াছেন। কিন্তু রামায়ণে শ্রীরাম কুত্রাপি বৈষ্ণবী শক্তি প্রদর্শন করেন নাই।” তা ছাড়া রামায়ণের যুগে আমাদের প্রচলিত দেবদেবতার, অর্থাৎ দুর্গা-কালী-গণেশ-লক্ষ্মী ইত্যাদি দেবদেবীরা আবিষ্কৃত হয়নি। বাল্মীকির যুগ বৈদিক ভাবাপন্ন। তাই হনুমানের কার্যারম্ভের আগে বেদে উল্লিখিত তেত্রিশটি দেবতাদের মধ্য থেকেই স্মরণ করেছেন, অন্য কোনো দেবতা নয়। তাই ত্রিমূর্তি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের উল্লেখ নেই রামায়ণে৷ উল্লেখ আছেন কেবল বৈদিক দেবতা–বসুগণ, রুদ্রগণ, আদিত্যগণ, মরুদগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়। এঁরা রামায়ণের যুগে পূজ্য হলেও, হিন্দুরা পুজো করেন না। হনুমান প্রণাম জানিয়েছেন রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, রুদ্র, ইন্দ্র, যম, অনিল, চন্দ্র, অগ্নি, মরুদ এবং সুগ্রীবকে–

“নমোহস্তু রামায় সলক্ষ্মণায় দেব্যৈ চ তস্যৈ জনকাত্মজায়ৈ।

নমোহস্তুরুদ্ৰেন্দ্ৰমানিলেভ্যো নমোহস্তু চন্দ্রাগ্নিমরুদগণেভ্যা৷

স তেভ্যস্ত নমস্কৃত্য সুগ্রীবায় চ মারুতি।

দিশঃ সৰ্ব্বাঃ সমালোক্য সোহশোকবনিকাং গতঃ৷৷”

যেটুকু আছে, তা প্রক্ষিপ্ত প্রবেশ হয়েছে বলে অনেক পণ্ডিতগণ মনে করেন। তবে রাবণ হত্যায় আগে রাম সূর্যের আরাধনা করেছিলেন। সূর্যপুজো বহু প্রাচীন, আজও সূর্য অনেকের উপাস্য। পৃথিবীর বহু দেশে সূর্যোপসনার প্রচলন আছে। চন্দ্র, সূর্য, অগ্নি, বায়ু, বরুণদের যে একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন এবং তিনিই পাপপুণ্যের বিচার করবেন, এমন আধ্যাত্মিকতা রামায়ণে অনুপস্থিত। মহাভারতে রামকে প্রথমেই বিষ্ণুর অবতার বলে স্বীকার করে নিয়েছে–“বিষ্ণু মানুষরূপেণ”। কোথাও কোথাও রামকে বিষ্ণুই বলা হয়েছে। রামায়ণের আদিকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ডেও রামকে বিষ্ণু বলেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

বিষ্ণুর দশমাবতারে রামের কথা উল্লেখ আছে। অবতারবাদ নতুন কিছু নয়। ভারতের সনাতন ধর্মে অবতারবাদ বহু প্রাচীন যুগ থেকেই শুরু। বেদ, উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র, পঞ্চরাত্র–সবখানেই অবতারবাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। অবতারবাদ হচ্ছে এক ধরনের মতবাদ যেখানে সৃষ্টিকর্তা মানবকুলকে সঠিক পথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে মানুষ বা অপর কোনো জাগতিক রূপ নিয়ে বা অবতার হয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। অন্যভাবে বলতে গেলে মানুষ বা জাগতিক কোনো প্রাণীকে সকল দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে এবং সর্বজ্ঞ ও মহাক্ষমতার অধিকারী হিসাবে বিবেচনা করার নাম ‘অবতারবাদ। যুগে যুগে রাজনৈতিকভাবে এই অবতারবাদকে ব্যবহার করা হয়েছে কোনো নেতা বা রাজাকে তাঁদের অনুসারীরা সকল দোষ-ত্রুটির ঊর্ধে এবং সর্বজ্ঞ ও মহাক্ষমতার অধিকারী হিসাবে বিবেচনা করে অন্ধ অনুসরণ করত এবং অনেক সময় সৃষ্টিকর্তার আসনে বসিয়ে পুজোও করত, এ ধরনের অন্ধ অনুসারীদেরকে অবতারবাদের অনুসারী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এ ধরনের নেতা বা রাজাকেও অবতার হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ভারতবর্ষে বুদ্ধকে বৈদিক দেবতা বিষ্ণুর সঙ্গে সমীকরণ করা হয়। মৎসপুরাণে এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। ভগবত পুরাণেও বুদ্ধকে বিষ্ণুর সঙ্গে সমীকরণ করা হয়। বুদ্ধকে ভারতীয় ধর্মীয় ঐতিহ্যে বিষ্ণুর নবম অবতার মনে করা হয়। এরকমভাবে পরশুরাম, কৃষ্ণ, চৈতন্য, রামকৃষ্ণও অবতার হিসাবে পূজিত।

অবতারদের দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়–(১) সাক্ষাৎ এবং (২) অবেস। যখন বিষ্ণু স্বয়ং অবতীর্ণ হন, তখন তাকে সাক্ষাৎ বা শাক্ত্যবেসাবতার বলা হয়। কিন্তু যখন তিনি নিজে অবতীর্ণ না-হয়ে কারোর মাধ্যমে প্রকাশিত হন, তখন তাকে বলা হয় অবেস অবতার। মনে করা হয়, অবেস অবতারের সংখ্যা অনেক। অবেস অবতারগণ পরমেশ্বর রূপে পূজিত হন না। কেবলমাত্র প্রত্যক্ষ ও প্রধান অবতারগণই ওইরূপে পূজিত হন। প্রকৃতপক্ষে যে সকল প্রত্যক্ষ অবতার আজ পূজিত হন তাঁরা হলেন পূর্ণ অবতার–নৃসিংহ, রাম ও কৃষ্ণ।

হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর সঙ্গেই অবতারবাদের বিশেষ সম্পর্ক। যদিও এই মতবাদ কিছু ক্ষেত্রে অন্য কয়েকজন দেবদেবীদের ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হয়। হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিতে বিষ্ণুর অবতারগুলির ভিন্ন ভিন্ন তালিকা পাওয়া যায়। গরুড় পুরাণ গ্রন্থে বিষ্ণুর দশাবতার ও ভাগবত পুরাণ গ্রন্থে বিষ্ণুর বাইশটি অবতারের বর্ণনা পাওয়া যায়। যদিও শেষোক্ত পুরাণটিতে এও বলা হয়েছে বিষ্ণুর অবতারের সংখ্যা অগণিত। বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বে অবতারবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মতবাদ। হিন্দুধর্মের দেবীকেন্দ্রিক শাক্তধর্মে মহাশক্তির বিভিন্ন অবতারের রূপ বর্ণিত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কালী, দুর্গা ও ত্রিপুরাসুন্দরী সর্বাধিক পরিচিত। মধ্যযুগে রচিত কয়েকটি হিন্দু ধর্মগ্রন্থে গণেশ ও শিব প্রমুখ অন্য কয়েকজন দেবতার অবতারের কথা উল্লিখিত হলেও সেই গ্রন্থগুলি অপ্রধান ও স্বল্পপরিচিত। উল্লেখ্য, হিন্দুধর্মের বৈষ্ণব ও শৈব সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যতম প্রধান পার্থক্যই হল এই অবতারবাদ। ভাগবত পুরাণের প্রথম স্কন্দে সংখ্যাক্রম অনুসারে বিষ্ণুর যে বাইশ অবতারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা হল–(১) চতুর্সন [ভাগবত ১।৩।৬] (ব্রহ্মার চার পুত্র) (২) বরাহ [ভাগবত ১।৩।৭] (বন্য শূকর) (৩) নারদ [ভাগবত ১।৩৮] (ভ্রাম্যমাণ ঋষি) (৪) নর-নারায়ণ [ভাগবত ১।৩।৯] (যমজ) (৫) কপিল [ভাগবত ১।৩।১০] (দার্শনিক) (৬) দত্তাত্রেয় [ভাগবত ১।৩।১১] (ত্রিমূর্তির যুগ্ম অবতার) (৭) যজ্ঞ [ভাগবত ১।৩।১২] (সাময়িকভাবে ইন্দ্রের ভূমিকা গ্রহণ করা বিষ্ণু) (৮) ঋষভ [ভাগবত ১।৩।১৩] (রাজা ভরত ও বাহুবলীর পিতা) (৯) পৃথু [ভাগবত ১।৩।১৪] (যে রাজা পৃথিবীকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন) (১০) মৎস্য [ভাগবত ১।৩।১৫] (মাছ) (১১) কূর্ম [ভাগবত ১।৩।১৬] (কচ্ছপ) (১২) ধন্বন্তরী [ভাগবত ১।৩।১৭] (আয়ুর্বেদের জনক) (১৩) মোহিনী [ভাগবত ১।৩।১৭] (সুন্দরী নারী) (১৪) নৃসিংহ [ভাগবত ১।৩।১৮] (নর-সিংহ) (১৫) বামন [ভাগবত ১।৩।১৯] (খর্বকায়) (১৬) পরশুরাম [ভাগবত ১।৩।২০] (পরশু অর্থাৎ কুঠার সহ রাম) (১৭) ব্যাসদেব [ভাগবত ১।৩।২১] (বেদ সংকলক) (১৮) রাম [ভাগবত ১।৩।২২] (অযোধ্যার রাজা) (১৯) বলরাম [ভাগবত ১।৩।২৩] (কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা) (২০) কৃষ্ণ [ভাগবত ১।৩।২৩] (রাখাল বা স্বয়ং ভগবান) (২১) বুদ্ধ [ভাগবত ১।৩।২৪] (জ্ঞানী) (২২) কল্কি [ভাগবত ১।৩।২৫] (ধ্বংসকারী)। এই বাইশ অবতার ছাড়াও উক্ত গ্রন্থের পরবর্তী অংশে আরও তিন অবতারের কথা আছে–(১) প্রশ্নিগর্ভ [ভাগবত ১।৩।৪১] (প্রশ্নির সন্তান) (২) হয়গ্রীব [ভাগবত ২৭।১১] (অশ্ব) (৩) হংস [ভাগবত ১১।১৩।১৯] (রাজহংস)। কল্কি অবতারের বর্ণনা দেওয়ার পর ভাগবত পুরাণে ঘোষিত হয়েছে, বিষ্ণুর অবতার অসংখ্য। যদিও উপরি উল্লিখিত পঁচিশ অবতারের গুরুত্বই সর্বাধিক। বোঝাই যাচ্ছে বিষ্ণু নামক ব্যক্তিটি অত্যন্ত প্রভাবশালী ও দোর্দণ্ডপ্রতাপ ‘দেবতা’ ছিলেন। তাঁর নাম জড়িয়ে অসংখ্য মানুষ অবতার হয়েছেন। তবে রাম নয়, বেশিরভাগ পুরাণগুলিতে কৃষ্ণেরই আধিপত্য বেশি। বালকাণ্ডের অনেক উপাখ্যান ও ঘটনা যথা গঙ্গোৎপত্তি ও কার্তিকেয় জন্ম, বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র দ্বন্দ্ব, অহল্যা উদ্ধার, ইন্দ্র কর্তৃক দিতির গর্ভ-ছেদন ইত্যাদি–এগুলি বাদ দিলেও রামায়ণে রামকথার মূল কাহিনিটি বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হত না। বস্তুত এই সমস্ত উপাখ্যানের পরিপ্রেক্ষিতে রামচরিত্রটি দৈবত্ব লাভ করেছে।

অতএব রাম ‘অবতার’ হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শ্রীরামচন্দ্রের ভগবত্তা নিয়ে আমার শেষ কথা–বুদ্ধ, অশোক, সাঁইবাবা, ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, রজনীশ, রবিশঙ্কর, বালক ব্রহ্মচারী, বাবা লোকনাথ, চন্দ্রস্বামী, রামকৃষ্ণ প্রমুখরা যদি ভগবান বা ভগবানতুল্য বা অবতার হতে পারেন–তাহলে শ্রীরামচন্দ্রের মতো মহান ব্যক্তির ভগবান বা অবতার হতে বাধা কোথায়! এক আশারামেরই ভক্তসংখ্যা ১০ কোটি। চাট্টিখানি কথা! বাকি অবতারের ভক্তসংখ্যা তো ঈর্ষণীয়। মনে রাখতে হবে প্রাচীন যুগে বাল্মীকি ও ব্যাসদেব পরবর্তী কবিয়া তাঁদের সংস্কৃত ভাষার কাব্য-সাহিত্যে কোনো-না-কোনোভাবে দেবতাদের টেনে আনতেন। তাঁদের সব কাহিনির সব চরিত্ররাই হয় দেবতা, নয় মুনি-ঋষি। দেবতা, মুনি-ঋষিরা নেই, এমন কোনো সংস্কৃত সাহিত্যই নেই। আর আছে অলৌকিক, অবাস্তব, অপার্থিব কাণ্ডকারখানা। কোনো ধর্মগ্রন্থ নয় এমন একটি সংস্কৃত সাহিত্যের সংখ্যা কম নেই। পাঠকবন্ধুরা, পড়ে দেখতে পারেন ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের কবি দণ্ডী বিরচিত ‘দশকুমারচরিতম্। বাস্তুশাস্ত্রমের মতো কিছু কেজো গ্রন্থ সহ যৌনমূলক গ্রন্থ (বাৎসায়নের কামশাস্ত্র’, কোক্কাচার্যের ‘রতিরহস্য’, জ্যোতির্মল্লের ‘পঞ্চসায়ক’, বীরভদ্র দেবের ‘কন্দর্পচূড়ামণি’) ছাড়া বাকি সব সংস্কৃত সাহিত্যেই অপার্থিব ঘটনার ঘনঘটা। শুধু কাহিনিই নয়, কাহিনিকারও অলৌকিক হয়। যেমন মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি জন্ম, ইনি স্বর্গ থেকে সাপের রূপে মহাবৈয়াকরণ পাণিনির অঞ্জলিতে পতিত হয়। অঞ্জলিতে পতিত হলেন বলে তিনি পতঞ্জলি। পতৎ (পতনশীল) + অঞ্জলি = পতঞ্জলি।

মোট কথা, রামচন্দ্রের অবতার হিসাবে প্রতিষ্ঠা অনেক পরবর্তীকালের। পণ্ডিত হরিপদ চক্রবর্তী তাঁর ‘The Murder of Vali’ প্রবন্ধে লিখেছেন, একাদশ শতকের (AD 11) আগে অবতার রামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা হয়নি।

পণ্ডিত হরিপদ চক্রবর্তী লিখেছেন–

“Although almost from the beginning of the Christion era Rama began to be identified with the same divinity as Visnu is, he was not fully established as so before the eleventh century AD. On the other hand, Krishna-baSED VAISNAVA-sect had always been in eminence.”

পণ্ডিত উপেন্দ্র নায়ক বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা জরুরি। তিনি তাঁর রচিত ‘Impact of Ramayana on the Socio-Cultural Life of Orissa’ প্রবন্ধে লিখেছেন–

“…erudite scholars are unable to ascertain accurately the exact date of the incarnation of Sri Rama. Moreover, whereas innumerable temples have been built for the worship of ‘Siva’, ‘Visnu’, ‘Durga’ since time immemorial, temples for worship of Rama are comparatively new, recently built … Ramkrishna Vandarkar opines that there was no Rama temple nor even the image of Rama before the 11th century AD. … Madhabacarya, the spokesman of Bramha sect of Vaisnavism, had introduced the Rama worship in South India by bringing for the first time the idol of warrior Rama from Badrikasram.”

বাল্মীকির রামায়ণে রাম নিজেই বলেছেন–

“আমি রাজা দশরথের পুত্র রাম। আমি আপনাকে মনুষ্য বোধ করিয়া থাকি। এক্ষণে আমি কে এবং আমার স্বরূপই-বা কী, আপনারা তাহাই বলুন।”

সুপরিকল্পিতভাবে রামচন্দ্র এমন স্মরণ করালেন ব্রহ্মাকে। ব্রহ্মাও চিত্রনাট্য মোতাবেক প্রত্যাশিত এবং অনিবার্য উত্তরটি দিয়ে দিতে দেরি করলেন না। ব্রহ্মা বললেন–

“তুমি ত্রিলোকের আদিকতা, কেহ তোমার নিয়ন্তা নাই,… তুমি আদ্যন্তমধ্যে বর্তমান।”

ব্রহ্মা আরও বোঝালেন–

রামচন্দ্র জন্মমৃত্যুরহিত নিত্য, অক্ষয় সত্যস্বরূপ ব্রহ্ম। তিনি খড়াধারী বিষ্ণু ও কৃষ্ণ, ত্রিলোকের আদিস্রষ্টা।

ব্যস, সব কালি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার। আর্যদেবতাদের আগ্রাসনের চক্রান্ত, রামচন্দ্রের নীতিহীন কার্যকলাপ ‘সব দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ মাহাত্ম পেয়ে গেল।

জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রামচন্দ্র প্রতিদ্বন্দ্বীহীন অযোধ্যার রাজা ছিলেন। সে রাজ্য যতই ক্ষুদ্র বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হোক না-কেন রাম কিন্তু সেই ‘রামরাজ্য’-এর উত্তরাধিকার পুত্রদ্বয় লব ও কুশ একজনকেও দেননি৷ লব ও কুশ কেউ কোনোদিনই অযোধ্যার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতে পারননি। জ্যেষ্ঠ কুশ, কনিষ্ঠ লব। তবে অযশ এড়াতে রামচন্দ্র অযোধ্যার রাজসিংহাসনের পরিবর্তে লব ও কুশকে অন্যত্র ‘সেটেল্ড’ করে দিয়েছিলেন। কুশকে প্রতিষ্ঠা করা হল বিন্ধ্যপর্বতের প্রান্তে কুশাবতীর সিংহাসনে এবং লবকে প্রতিষ্ঠিত করা হল শ্রাবস্তীপুরীর সিংহাসনে। পিতা হয়ে পুত্রদের অযোধ্যা না-দিলেও অন্য রাজ্য দিলেন বটে, কিন্তু প্রথামাফিক অভিষেক করলেন না কেন? কেন সম্পূর্ণভাবে অনাড়ম্বর হল এ রাজ্যদান? নাকি ‘উড়ো খই গোবিন্দায় নমঃ। প্রশ্ন হল, রামচন্দ্র কীভাবে কুশাবতী ও শ্রাবস্তীপুরী ভূখণ্ডে যথাক্রমে কুশ ও লবকে প্রদানে সমর্থ হলেন? কুশাবতী ও শ্রাবস্তীপুরী কি রামরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল? যদি থাকে সেটা কীভাবে থাকল? রাম তো লঙ্কাযুদ্ধের পর আর কোনো যুদ্ধ করে রাজ্য করেছেন বলে তো কোনো উল্লেখ নেই। বিনাযুদ্ধে রাজ্য বাড়ে কীভাবে? যদি না-থাকে তাহলেই-বা বিনাযুদ্ধে কুশাবতী ও শ্রাবস্তীপুরী কুশ ও লব প্রাপ্ত করলেন কীভাবে? ভরত ও শত্রুঘ্নকে তো নতুন রাজ্য পেতে রীতিমতো মারণযুদ্ধ করতে হয়েছিল। প্রশ্ন থাকলেও উত্তর নেই!

যদি প্রশ্ন করেন রাম কোন্ দেশের রাজা ছিলেন? উত্তর ভারত’ বললে ডাহা ভুল। রাম ভারত উপমহাদেশের অন্তর্গত অতি ক্ষুদ্র এক দেশ অযোধ্যার রাজা ছিলেন, ভারত কখনোই নয়। তখনকার সময়ে ভারত কোনো একটি দেশের নাম ছিল না। অসংখ্য দেশগুচ্ছ নিয়েই ভারত উপমহাদেশ। তখন ভারত উপমহাদেশের সঙ্গে পারস্যও সংযুক্ত ছিল। সেই দেশগুচ্ছের মধ্যে অযোধ্যা একটি অতি ক্ষুদ্র দেশ। রাম এই অতি ক্ষুদ্র দেশেরই রাজা ছিলেন। তৎকালীন ভারত উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের নাম এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, তাতে খানিকটা ধারণা তৈরি হবে–লম্পক, নগরহার, গান্ধার, উদ্যান, বোলর-গান্ধার, তক্ষশীলা, সিংহপুর, উরস, কাশ্মীর, পুনচ, রাজপুরী, টক্ক, চীনাপতি, জালন্ধর, কুলুত, শতদ্রু, পারিযাত্র, মথুরা, স্থানেশ্বর, শ্রু, মতিপুর, ব্ৰহ্মপুর, হিরণ্যগোত্র, গোবিসান, অহিক্ষেত্র বা অহিচ্ছত্র, বীরসান, কপিঙ্খ, কনৌজ, অযোধ্যা, হয়মুখ, প্রয়াগ, কৌশাম্বী, বিশাখা বা বিশোক, শ্রাবস্তী, কপিলাবস্তু, বারানসী, গর্জপুর বা ঘাজিপুর, বৈশালী, বৃজি, নেপাল, মগধ, হিরণ্য পর্বত, চম্পা, কজুঘীরা, পুণ্ড্রবর্ধন, কামরূপ, তাম্রলিপ্ত, কর্ণসুবর্ণ, উড্র, কঙ্গোদ, কলিঙ্গ, কোশল, ধনকণ্টক, চোল, দ্রাবিড়, ভরুকচ্ছ, মালব, কাম্পিল্য, গুর্জর, উজ্জয়িনী ইত্যাদি।এই দেশগুলি প্রত্যেকটিই ছিল স্বাধীন, ছিল স্বাধীন রাজা। একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ কারোর শাসনাধীনে ছিলেন না, কোনো কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না। এক সাম্রাজ্যের শাসক অন্য সাম্রাজ্যের শাসককে রাজস্ব দিতেন না। প্রাচীন ভারতীয় বলা যায় কোনো কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা ছিল না।

রাজা হওয়ার আগে রাম মাত্র দুটি দেশ জয় করেন বলা যায়–একটি কিষ্কিন্ধ্যা, অপরটি লঙ্কা। যদিও এই যুদ্ধগুলি শর্তসাপেক্ষে হয়েছিল, যথাক্রমে প্রথমটি সুগ্রীবের হাতে এবং দ্বিতীয়টি বিভীষণের হতে তুলে দিতে হয়। সুগ্রীব প্রতিজ্ঞা খেলাপ করলে তাঁকে হত্যা করে বালী-পুত্র অঙ্গদকে কিষ্কিন্ধ্যর রাজা হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল।

এই হল সংক্ষিপ্ত রামকাহিনি৷ রাম-রাবণের যুদ্ধ নয়, রামের সঙ্গে রাবণের যুদ্ধটা জাস্ট ইনসিডেন্ট মাত্র। মোটেই পূর্বপরিল্পিত নয়। রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য রামচন্দ্র অযোধ্যা থেকে চিত্রকুট, চিত্রকুট থেকে দণ্ডকারণ্য, দণ্ডকারণ্য থেকে লঙ্কায় পৌঁছোননি। এই অকারণ যুদ্ধ রামের প্রয়োজনও ছিল না। চাইলে সেই যুদ্ধ অযোধ্যা থেকেই পরিচালনা করা সম্ভব ছিল। লোকের দোরে দোরে করুণাপ্রার্থী হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হত না। দুষ্টের দমন শিষ্ঠের পালনও নয়। রামায়ণ হল রাজতন্ত্রের ইতিহাস। ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। ষড়যন্ত্রের শিকার দশরথপুত্র রামচন্দ্র। যাই হোক, রামচন্দ্রকে সাধ্যমতো তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। এবার রামায়ণের অন্যান্য চরিত্রগুলিও বিশ্লেষণ করা যাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *