০০১. যোগেন মণ্ডল বরিশালের মেগাস্থিনিস

এই নভেলটি ১৯৩৭ থেকে ৪৭-এ বাংলায়। একমাত্র বাংলাতেই, যা সব ঘটনা ঘটেছে ও সে-সব ঘটনার ফলে বাংলা সারা ভারতের শাসননীতি ও রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে, তার নানা গল্প।

———–

যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল প্রায় সম্পূর্ণ বিস্মৃত এখন। ১৯৩৭ থেকে ৪৭ এই দশটি বছরে তিনি ছিলেন বাংলার নমশূদ্রদের অবিসংবাদী নেতা। বাংলার ও ভারতের রাজনীতিতে পরে তিনি প্রধানতম বিসংবাদী নেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৪৩-এ খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় তিনি ছিলেন। ৪৬-এ পূনর্নির্বাচিত হয়ে সারওয়ারদির মন্ত্রিসভাতেও। ১৯৪৬-এ তিনি। মহম্মদ আলি জিন্না কর্তৃক অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভায় মুসলিম লিগের প্রতিনিধি মনোনীত হওয়ায় হিন্দু ও মুসলিম দুই জাতেরই শত্রু হয়ে পড়েন। তিনি পাকিস্তানের প্রথম মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫০-এ কলকাতায় চলে আসেন। আম্বেদকর ও যোগেন মণ্ডল তাদের ক্ষুদ্রতার কারণে কোনো জাতীয়তাবাদেই গৃহীত হন নি। কিন্তু বহু নিন্দা ও বিরোধিতার পর কংগ্রেস দলিত-ভোটের জন্য আম্বেদকরকে জাতীয়-আখ্যানের দেবমণ্ডলিতে জায়গা করে দেয়। বাংলা বিভক্ত হওয়ায় যোগেন মণ্ডল সম্পর্কে তেমন কোনো দায় বা ভয় জাতীয়তাবাদীদের ছিল না। তাকে তাই ইতিহাস থেকে স-ম্‌-পূ-র্ণ মুছে দেয়া হয়েছে। তাঁর নাম এখন কোনো স্থানীয় ইতিহাসের ফুটনোটেও থাকে না।

———–

বাংলা ছিল মুসলিম প্রধান ও তপশিলিজন অধ্যুষিত। কংগ্রেসের হিন্দুওয়ালা নেতারা সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস থেকে তাড়ালেন। মুসলিম লিগের অবাঙালি নেতারা ফজলুল হককে লিগ থেকে তাড়ালেন। ব্রিটিশ যুদ্ধনীতি পূর্ব পরিকল্পনামত সিঙ্গাপুর, মালয়, ব্রহ্মদেশ ও থাইল্যান্ড থেকে পশ্চাদপসরণ করে বাংলাকে যুদ্ধের পূর্ব রণাঙ্গন করে তোলে। ফলে, নিম্নবঙ্গকে ধ্বংস করে দেয়া হল ও যুদ্ধের রেশন চালাতে বাংলায় ঘটল ৪৩-এর দুর্ভিক্ষ। ৪৫-এ ম্যালেরিয়া মহামারী। ১৯৪০ পর্যন্ত ও ১৯৪৫-এর পর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ছিল বাংলার নিজস্ব রাজনীতি।

ভারতের অন্য কোনো প্রদেশ থেকে বাংলা কোনো প্রকার সাহায্য পায়নি। এমনকী সর্বাধিক সংখ্যক রাজবন্দীদের জন্যও তারা জেলখানায় জায়গা দেয়নি।

এই নতুন সময়ে বাংলার তপশিলি নেতা বরিশালের যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ছিলেন অবিসংবাদী শূদ্রনেতা। তিনিই প্রথম বলেন, উচ্চবর্ণ হিন্দুদের রক্ষা করা শূদ্রদের কাজ নয় ও মুসলমানদের সঙ্গে শূদ্রদের শ্ৰেণীগত মিল অনেক বেশি। এই শূদ্র যোগেন মণ্ডলই একমাত্র ভারতীয় যিনি পাকিস্তানকে তাঁর স্বদেশ বলেছিলেন ও সেই কালবেলায় ভারতবর্ষ-ধ্যানটিকে রক্ষা করেছিলেন।

—————

বরিশালের যোগেন মণ্ডল – উপন্যাস – দেবেশ রায়
প্রথম প্রকাশ : বৈশাখ ১৪১৭, এপ্রিল ২০১০

.

উৎসর্গ
বেণুমাসিকে

বেণুমাসি ছিলেন আমাদের মাতৃসমা। তিনি সারাজীবন আমাদের লালনপালন করেছেন।

দেশ থেকে জলপাইগুড়িতে যখন চলে আসি আমরা, ৪৩-এ, বেণুমাসি তো তখন আসবেনই। ১৯৫৩ পর্যন্ত সমরেশ ছিল আমাদের সবচেয়ে ছোটভাই। সমরেশের জন্মের পর মা এমন অসুখে পড়েন যে তাকে স্থানান্তরে নিয়ে যেতে হয়। আমরা ভাইবোনরা কখনো-সখনো ভাবতাম মা আর বেঁচে নেই। কিন্তু বেণুমাসি আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন।

সমরেশকে লালন করেছেন। সমরেশ তার ছোট মা-র কাছেই খেত-শুত। আমার মা-কে বেণুমাসি ডাকতেন ‘বৌমা’ বলে। এমন ভাবতে চাই এখন, এমন ভাবতে ভাল লাগে, আমরা ভাইবোনরা শুদ্ৰাণী-পালিত বংশ।

এই উপন্যাসটির গল্পটুকুতে আমার সেই বাল্য-কৈশোর-প্রথম যৌবনের পারিবারিক শুদ্রপ্রচ্ছায়া চিনতে পেরেছি, রচনার সময় জুড়ে বেণুমাসির গলার স্বর শুনতে পেয়েছি ও ভারী কাজের ওতপোত বিষণ্ণ ক্লান্তিতে বেণুমাসির অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় সেরেও উঠেছি।

এ-লেখাটি বেণুমাসি ছাড়া কাউকে দেয়া যায় না।

নববর্ষ ১৪১৭

.

কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন

যে-কোনো আক্কেলে মানুষই বুঝবেন–পুরনো একটি সময়, অনেকেরই জানা ঘটনা ও মানুষজন নিয়ে এত জনবহুল ও পৃষ্ঠাবহুল একটি লেখা কত মানুষের কত রকম সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। শিল্পকর্মের তেমন কোনো কৃতজ্ঞতার দায় স্বীকার করা অনর্থক। কিন্তু যদি কারো শারীরিক শ্রম নিয়ে থাকি, তা স্বীকার না-করা ঋণখেলাপি।

সমরেশ রায়, আমার ভাই, যা খেটেছে সেটাই এই বইটি লেখা হয়ে-ওঠার প্রধান একটি কারণ। বাংলাদেশের শামীম রেজা ও অন্যান্য বন্ধুরা হাত-উজাড় সাহায্য করেছেন। অধ্যাপক বন্ধু স্বপন পাণ্ডা, শাশ্বতী মজুমদার, মণিময় মুখোপাধ্যায় এঁরা নিজেদের শরীরের অসুবিধে, ও শেষ দু-জন কলকাতা আসা-যাওয়ার নিত্য বাধা, যে-অনায়াসে উৎরে এই এত বড় লেখার প্রফ একাধিক বার দেখে দিয়েছেন সেটা যেন রহস্যময় ঠেকে। শাশ্বতীই একমাত্র নানা আকারে পুরো পাণ্ডুলিপি অনেকবার পড়েছেন ও তার স্বাধীন মত-অমত জানিয়ে আমাকে সংস্কারে সাহায্য করেছেন। অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বদলি, টানা ও পাকা প্রুফের ও অনবরত বদলের ঝামেলা মিটিয়েছেন। সিতশ্রী ভড় ম্যাপগুলো এঁকে দিয়েছেন আমার আবছা ইচ্ছে অনুমান করে। বর্তমানে দিল্লিবাসিনী নিবেদিতা সেন-এর আঁকা অনেক ছবি দেখছিলাম–তাঁর কল্পনা ও সামর্থ্যে মুগ্ধ হয়ে। এই ছবিটি তিনি প্রচ্ছদে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন।

সবচেয়ে বেশি রাত জাগতে হয়েছে মুদ্ৰক দিলীপ দে-কে। দিলীপ কিছুতেই কেন যে হাল ছাড়েননি!

আমার প্রধান প্রকাশক সুধাংশুশেখর দে আমাকে শুধু আরো নির্ভরশীল করে তুললেন দু-বছরের বেশি সময় ধরে বইটি ছাপানোর প্রক্রিয়া সয়ে।

আমার বন্ধু অরুণ সেন লেখালিখি সংক্রান্ত সব ব্যাপারেই আমার ভরসা ও চিরসখা। ফোন, ইন্টারনেট, বইপত্র, ম্যাপ জোগাড়, লোকজনের হদিশ এত সব জটিলতা অরুণই সামলেছেন।

দেবেশ রায়
নববর্ষ, ১৪১৭
বল্মীক আবাসন
কলকাতা ৭০০ ০৫৯

.

অধ্যায়সূচি

.

০০১. যোগেন মণ্ডল বরিশালের মেগাস্থিনিস

‘আরে, মুই–না চব্বিশ ঘণ্টার উপুর আরো চব্বিশ চাপ্যাইয়া–না নাগাড়ে কই, বাবু, মুই হিন্দু, মোর বাপ–চোড্ড পুরুষ হিন্দু, মোর নাতি-নাতনিরা চোদ্দও হিন্দুই হইব, আমাগ তো হিন্দু না হইয়্যা কুনো উপায় রাখেন নাই। বাবুরা চইঠ্যাই থাহে, ব্যাডা তুই হিন্দুই তবে এক পোয়া কম। মুই কই তাইলে মোর ঐ খালাশ এক পোয়াডায় মুই জল মিশাই–স্যায় খালেরল জল নদীর জল যাই হোক, তার লগে তো আপনাগ কোনো নিষেধ নাই আমাগও কোনো প্রাচিত্তির নাই। কিন্তু বাবুরা তো বাবু তাইলেও বরশালিয়া বাবু। একবার যদি রগ চইড্যা। চইড্যা যায়, আর নামা নামি নাই। কয়–বেটা নম, তোগো আবার পুরাপুরি চারপোয়া ক্যা রে। যা, ঐ এক পোয়া কমই থাকবি।’

নিজের কথায় যোগেন মণ্ডল নিজেই হেসে ওঠে তার সুস্থ, স্বাস্থ্যল, পেশল শরীরে ছড়ানো তেত্রিশ বছর বয়সের যৌবন নিয়ে। তার সেই খোলা আওয়াজের হাসিতে গোপন প্রতাপের প্রকাশ একটু অমীমাংসিত থাকে। না-হয় বরিশাল সদর আদালতে ঢুকতে-না-ঢুকতেই নামগাম করেছে, না-হয় বারে যোগ দেওয়ার আগেই ভোটে জিতে লোকাল বোর্ডের মেম্বার হয়েছে, না-হয় ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডে মনোনীত মেম্বার, আর দিন-পনের পরে এমএলএ ভোটের প্রার্থী, কিন্তু এর কোনো একটি কারণে বা সবগুলি কারণ এক করে দিয়ে একটা কারণ তৈরি করে নিলেও, একজন নমশূদ্রের পক্ষে এমন একটা বৈঠকে এতটা জোরে এতক্ষণ ধরে হাসাটা, একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে না? যোগেনের হাসিটা শেষ হওয়ার মুখে তার ঠোঁটের বিস্তার কমে এলে তার সম্মুখপাটির দাঁতগুলি যেমন দেখা যায়, তাতে কারো মনে হতেও পারত, যোগেনের একেবারে ভিতরে একটা আক্রমণ যেন লেজ ঝাঁপটাচ্ছে। লেজই ঝাঁপটাচ্ছে বটে তবে দৃষ্টি, যোগেনের দৃষ্টি, সম্পূর্ণ লক্ষনিবদ্ধ নয়–যেন লক্ষ নিয়ে দ্বিধা ঘটে যাচ্ছে।

বাংলা তেতাল্লিশ সালের পৌষের মাঝামাঝি বরিশাল শহরের বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘বরিশাল হিতৈষী’র ছাপাখানায় বসে কথা হচ্ছিল মালিক, প্রকাশক, মুদ্রক, সম্পাদক ও একাই একশ দুর্গামোহন সেনের টেবিল ঘিরে। টেবিলটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না–এত নানা সাইজের কাগজের স্তূপ। সেই স্তূপের ভিতর থেকে অনেক কাগজের লালচে কোনা বেরিয়ে আছে–সেগুলো যে কতই পুরনো তার নিশানা দিয়ে। একটি কোণে পাঁজা করা পুরনো পাঁজি। ওপর থেকে একটা আলো ঝোলানো, টেবিলের মাঝামাঝি, কেরোসিনের লম্বা চোঙের আলো, চোঙের মাথায় একটা কাগজের ঘের বসানো, আলো যাতে ছড়িয়ে না পড়ে। টেবিলে দুর্গামোহন সেনের সামনে বরিশালের যোগেন মণ্ডল একটু জায়গা, পৌনে একহাত মত, আর তার মুখোমুখি চেয়ারটার সামনে খানিকটা, বিঘতখানেক, ফাঁকা–কাজের দরকারে। ঘরের ভিতর দুটো বড় র‍্যাকে ‘বরিশাল হিতৈষী’ স্তূপ করা, আর-একটাতে শাদা কাগজ, দু-তিন সাইজের। দুর্গামোহন সেনের টেবিল ঘিরেই ইতস্তত ছড়ানো ছ-সাতটি কাঠের ও টিনের চেয়ার। এর বাইরেও বারান্দার দিকে দুটো-একটা টুল ছিল। এগুলো কম্পোজিটারদের টুল–এখন ভিড় সামলাতে এখানে দেয়া হয়েছে।

যা হচ্ছিল, দুদিন আগে টাউন হলের সাধারণ সভার ঘটনা নিয়ে–মাস দেড়েকের মধ্যে ৩৫ সালের ‘ভারতশাসন আইন অনুযায়ী প্রাদেশিক আইনসভা তৈরির প্রথম ভোট। সভাপতির ভাষণের জায়গায় যখন সভা পৌঁছেছে যোগেন মণ্ডল দাঁড়িয়ে জানায়, সে কিছু বলতে চায়। সভাপতি ঠিক বুঝতে পারে না, কী করবে। সে বলে উঠল, ‘কিন্তু তুমি তো ক্যানডিডেট!’ যোগেন হেসে উঠে বলে, ‘তার লগেই তো কবার চাই। নাকী বরিশাল নিয়্যা আমার ভাবন-কহন প্রহিবিটেড হইয়া গেল নাকী? আমি তো ভাইবছিলাম উলটা। নাইলে আমার ভোটে দাঁড়ানোর কামডা কী ছিল? সবে তো সেরেস্তা খুইলছি, ভোটে জিতলে তো ওকালতির হাঁড়ি শিকায় উঠব। আর, ভোটে হাইরলে তো নাম হইব নে–হারুয়া উকিল, মামলা জিইতব্যার পারব না। ভোটের কথা ছাড়ান দ্যান। আমার কথা আছে–বরিশালের লাইগ্যা, খালবিলের লাইগ্যা, ইশকুল-কলেজের লাইগ্যা। কইব্যার দিবেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, স্যার?’

ততক্ষণে সভা থেকেই কথা ওঠে।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।‘

‘আরে যোগেনেরই তো আগে ডাকা দরকার ছিল।‘

‘ওর মত কেউ চেনে নাকী বরিশাল?’

‘কও, কও।

যোগেন মণ্ডল তখন বরিশালের একজন এমন নেতা হয়ে উঠছে, যার কথার দিকে কান আর কাজের দিকে নজর রাখতে শুরু করেছে টাউনের মানুষজন। বারে যোগ দিতে-না-দিতেই কয়েকটা কেস এমন জিতল যোগেন, যে কারো কোনো সন্দেহ থাকল না-যোগেন বরিশালের প্রধান উকিলদের একজন হবেই। তার ওপর তার ইংরেজি বাগ্মিতা সহজেই মুগ্ধ করত। সেই মুগ্ধতার মধ্যে এমন একটা অতিরিক্ত তারিফও গোপন থাকত–ব্যাটা নমো-র ছেলে, ইংরেজি কয় য্যান্ কার্ভালো। বরিশালে তখন ‘কেদার রায়’ যাত্রার খুব চল ছিল। যোগেনের সিনিয়ার ছিলেন, বরিশালের একডাকে চেনা উকিল কুলদারঞ্জন দাশগুপ্ত। যোগেন তোটটোটে দাঁড়ানোয় তিনি বিরক্ত হয়েই বলেছিলেন, ইংরেজিতে, ইভেন ইফ ইন্ডিয়া গেটু ফ্রিডম, হোয়াট উড শি ডু উইথ দিস ইরিট্রিভিবল লস অব সাচ এ ব্রিলিয়ান্ট অ্যান্ড রেয়ার লিগ্যাল ব্রেন টু পলিটিকস। কুলদারঞ্জনের রাগ কমাতে যোগেন তাকে আশ্বস্ত করতে বলেছিল, ‘কীই যে কন স্যার, ওকালতি না কইরলে বাড়িতে হাঁড়ি চইড়ব ক্যামনে?’

যোগেনের এই প্রকাশ্যতা ও স্পষ্টতা সকলের চেনা হয়ে যাচ্ছিল আর তা থেকে তার ওপর একটা ভরসা তৈরি হচ্ছিল।

বোধহয়, আর একটা বড় কারণ ছিল, গোপনে।

বরিশাল অশ্বিনী দত্তের দেশ। এত দুরে, এত দুর্গম একটি জেলাকে সারা বাংলায় যে প্রাধান্যে তিনি নিয়ে গেলেন, সে বরিশালবাসীর গৌরবকথা। জনসেবা, শিক্ষা, জাতিবৈরিতার অবসান, এক নাগরিক সমাজ তৈরি করে তোলার দরকার ও এক সামাজিক নৈতিকতা, তার কাছ থেকে বরিশালবাসী শিখেছিল ও বরিশালের কাছ থেকে সারা বাংলা শিখতে চাইছিল। দূরত্ব ও দুর্গমতা হয়ত বরিশালকে এমন সমষ্টিবদ্ধ জীবন তৈরি করার পক্ষে দরকারি বিচ্ছিন্নতা দিয়েছিল। বরিশালের বিচ্ছিন্নতা ছিল বরিশালবাসীর একক বৈশিষ্ট্যের চিহ্ন। ও কতকটা উদ্ভট এক স্থানপ্রেমের অনড় অবলম্বন।

কিন্তু অশ্বিনী দত্তের সময় থেকে বিশ-তিরিশ বছর পর তার কর্মসূচির প্রাসঙ্গিকতা কমে আসছিল। যেন মনে হতে শুরু করেছিল যে এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে স্বাদেশিকতার সাধনা হয়ে উঠছে গূঢ় কিছু ধর্মাচরণের মত। তার সঙ্গে বরিশালের খুব একটা বাঁধন কিছু নেই। বরিশাল খালবিলের দেশ, পঞ্চাশ পা যেতে হলেও সেখানে একটা খাল পেরতে হয় আর সেইসব খালে ভরা জোয়ারের জল সমুদ্র থেকে কলকলিয়ে বয়ে আসে প্রায় সব বাড়ির পৈঠায় দিনে বার কয়েক। বরিশাল জুড়ে নমশূদ্র আর মুসলমান জনগোষ্ঠী ছড়ানো বামুন-কায়েত-বৈদ্যরা খুব নামডাক নিয়ে আছেন তারা তাদের গ্রামগুলিকে শহুরে করে নেন। এখানকার বেশির ভাগ মুসলমানই ফরাইজি। বিরিশালে একদিকে ‘ভক্তিযোগ’, অন্যদিকে বামুন বৈদ্য-মুসলমান সকলেই আর, নমশূদ্ররা ছড়িয়ে আছে অসংখ্য জমিদারির চাষী হয়ে। বরিশালের জমিদারির ব্যবস্থাও আলাদা–একজন মধ্যস্বত্বভোগীর জমি থেকে ধাপে-ধাপে নেমে গেছে উপস্বত্বভোগীরা। নামডাকের জমিদারিও কিছু কম ছিল না–কীর্তিপাশা, বাটাজোড়, কোদালধোয়া, গৌরনদী, হিজলা। একবার এক হিশেবে বেরিয়েছিল এক জমিদারির জমিদার থেকে রায়ত পর্যন্ত উনিশজন উপস্বত্বভোগীর ধাপ।

১৯১১-এর সুমারিতে সারা বাংলায় নমশুদ্রের সংখ্যা গোনা হয়েছিল প্রায় ২১ লক্ষ। এর পরের সুমারিগুলোতে জাত জানাতে আপত্তি শুরু হয়ে যায়। ১১ সালের সুমারিকেই প্রামাণিক ধরা যায়। এই প্রায় ২১ লক্ষ নমশূদ্রের ছ-আনি, আট লাখই, থাকত–বাখরগঞ্জ, দক্ষিণ ফরিদপুর, নড়াইল, মাগুরা, খুলনা, বাগেরহাট মিলিয়ে যে-ডাঙা, সেখানে। এগুলো সবই ১১ সালের হিশেব। ১৯২০ থেকেই সরকার ভাঙনের নদীর চরে দখল মেনে নিতে শুরু করে। সেই চরের দখল নিতে জমিদাররা এই নমশুদ্র আর মুসলমান জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাত। তখন থেকেই এই স্থলদেশ একটা মারামারি-কাটাকাটির জায়গা হয়ে যায় কিন্তু তাতে হিন্দু-মুসলমান ভাগাভাগি ছিল না।

বরিশালের এই জলময় পশ্চাদভূমির সঙ্গে বরিশাল শহরের সম্পর্ক ছিল একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে। এমন বোধহয় আর কোনো জেলায় ছিল না। সদরে বাংলাখ্যাত ব্রজমোহন কলেজ, হাইস্কুল, ব্রাহ্মসমাজ, সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকা, কংগ্রেস ও অন্যান্য দল, কলকাতার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, কলকাতার নেতাদের মিটিং। নমশূদ্রদের যারা নেতা ছিল তারা যদি-বা ২০-২৫ সালে জনগোষ্ঠীভিত্তিক নানারকম আন্দোলন করেছে, সেসব আন্দোলন বেশিরভাগটাই ছিল হিন্দু বর্ণসমাজে নমশূদ্রদের জায়গা ওপরের দিকে তোলার চেষ্টা। ৩০ সাল নাগাদ সেই নেতারা কৃষক-নমশূদ্রদের নিয়ে মাথা ঘামায়নি–তখন কাউন্সিল, লোকাল বোর্ড আর ইউনিয়ন বোর্ডে ঢোকার হাওয়া। নমশূদ্রদের নেতাদের অনেকেই কংগ্রেসের ও নেতা হয়ে গেছে কেশবচন্দ্র দাস, মোহিনীমোহন দাস। ফজলুল হক কৃষকপ্রজা পার্টি তৈরি করেছিলেন। সে পার্টি মুসলিম রাজনীতির এই ফঁকটা ভরে দিল বটে কিন্তু তপশিলি জাতি নিয়ে তাদের মাথাব্যথা ছিল না। নমশূদ্র নেতারা কেউ বর্ণাশ্রম ও শূদ্র দাসত্বের কথা ভাবেনি। নমশূদ্রেরা না-ঘরটা না-ঘাটকী হয়ে থাকল। তাই তপশিলি জাতির জন্য আসন সংরক্ষিত রেখে প্রায় সর্বজনীন ভোটাধিকার দিয়ে ৩৭ সালের যে ভোট হল–সেটাকে উপলক্ষ করেই বরিশালে নমশূদ্রদের নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়ে গেল নিজে থেকেই। তৈরি হওয়ার পর বোঝা গেল, সেই নেতৃত্বের প্রথম ও প্রধান ব্যক্তি–যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, বিএ, বিএল, যে মাত্র ৩২ বছর বয়সে বরিশাল বারে ঢুকল আর বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই আইনসভার ভোটে দাঁড়াল সাধারণ আসন থেকে, সংরক্ষিত আসন থেকে নয়। কেন, কী-সেটা আলাদা ঘটনা। আর-একটু পরে, আরো বোঝা গেল–যোগেনের মত নেতা পাওয়ার ফলেই ফাঁকটা চেনা গিয়েছিল। বরিশালের একটা নেতা চাই। এই ভোটেরই দিনপনের আগে বরিশাল টাউন হলের সেই সভা, যোগেন যেখানে উপযাচক হয়ে বক্তৃতা করেছিল। সেই বক্তৃতা শুনে ‘বরিশাল হিতৈষী’-র সম্পাদক দুর্গামোহন সেন এতটাই মুগ্ধ হন যে তার কাগজে যোগেনকে নতুন বরিশালের নতুন নেতা, ‘বরিশালের মেগাস্থিনিস,’ বলে বর্ণনা করেন।

দুর্গামোহন সেন কংগ্রেসি, যেমন যে আর-কিছু না, সে কংগ্রেসি। তার খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা ছিল নির্ভীক সত্যভাষণের জন্য। তাকে নিয়ে একটা প্রবাদই চালু ছিল, বরিশাল-গান’। মেঘনায় যখন সমুদ্র থেকে বাঁড়াষাড়ির বান ডাকত, তখন, কখনো-কখনো কামানের গোলা ফাটার মত আওয়াজ হত। তার কারণ খুব একটা স্পষ্ট করে জানা যায়নি। তাকে বলত, বরিশাল-গান, ইংরেজি gun। দুর্গামোহন কখনো কাউকে প্রশংসা বা সমর্থন করতেন না। তার মতামতে একটা হুল থাকতই। সে-কারণেই তার মতামতের দামও ছিল খুব উঁচু।

সেই বরিশাল-গান যখন তার কাগজে যোগেনের প্রশংসা করে তাকে বরিশালের মেগাস্থিনিস’ আখ্যা দিলেন, তখন ভোটাভুটিতে যেন যোগেনের পক্ষে জোয়ারের স্রোত ঢুকল। যোগেন, পৌষের মাঝামাঝি এই সকালে দুর্গামোহনের সঙ্গে, দেখা করে কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছে। এসব কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা তখন তৈরি হয়নি, ঐ যোগেনের আসাতেই যা বোঝা যায় তা-ই। এসে, যোগেন আড্ডায় জমে গেল। সেখানে ছিলেনও শহরের দু-একজন মান্যগণ্য ব্যক্তি। দিন চক্রবর্তী, বরদা ব্যানার্জি। দু-জনই বরিশাল বারের খুব বড় উকিল।

সাইকেল থেকে নেমে, ঘরে ঢুকে এঁদের দেখে, যোগেন বলে, ‘আইজ কি কোর্ট ছুটি, স্যার? দুই-দুইজনই এইখানে। জজশাহেবরাই-বা কইরবে কী, মক্কেলগুলাই-বা কইরবে কী। এইডা কী কথা, স্যার? আর, সাক্ষীগুলারে যে এত মিথ্যা কথা শিখাইল্যাম, সব তত ভুইল্যা যাবে নে।

বরদা-উকিলই বললেন–’তুমি তোমার ভোটের জায়গাগুলা ঘুরান দিছ?

‘এইডা কি একড়া সম্ভব কথা, স্যার? আমার কনস্টিটুয়েন্সি পুরাখান ঘুরান দিবার তো লর্ড লিনলিথগোও পারব না।‘

‘ক্যা? হইলডা কী?’

‘হইব আবার কী স্যার? ভাইসরয়ের না-হয় একশখানেক লঞ্চ-ইস্টিমার থাইকতে পারে কিন্তু স্যার কোন খালে কোন লঞ্চ যাবার পারে এইডা কে ঠিক করব? এইডা কি একড়া কনস্টিটুয়েন্সি স্যার? এইডা তো একখান মহাদেশ। তিন-তিনখান সাব-ডিভিশন, সদর, নর্থ, সাউথ, আর ভোলা। ষোলডা থানা। যে যে-জায়গার লোক, সে ছাড়া কেউ সেই জায়গা চিনে না। যাব ক্যামনে?

‘তার লগেই তো সেনমশাই তোমারে মেগাস্থিনিস কইছেন। তুমি বরিশালের আবিষ্কারক। তো কোর্টকাছারি পুরাপুরি বাদ দিয়ো না যোগেন। তোমার স্মৃতিশক্তির যা অবস্থা দেখি—’

‘কেন স্যার। আমার মেমরি তো ভাল। দ্যাহেন স্যার, মাঝখান থিক্যা কয়্যা দেই–
হেরো লয়ে মেঘ রাশ রাশ
লইয়্যা আলোক অন্ধকার
কী গাঢ় গভীর সুখে
পড়িয়া ধরার বুকে
নাহি ঘৃণা নাহি অন্ধকার।’

‘বাঃ বাঃ, তোমারে তো ‘দাঁড়া কবি’ টাইটেল দেয়া উচিত।
খাড়ায়া খাড়ায়া বানাইয়া দিল্যা?’

‘স্যার, এই কাব্যটি আমার জিভে আসে। অক্ষয় বড়াল মশায়ের।‘

‘না। জিগাইল্যা না–আজ কোর্টে যাই নাই ক্যান?’

‘সেডা তো এহনো জিগাই স্যার।‘

‘তুমি গেছিলা? না যাইবা?’

‘যাইব স্যার, এখান থিক্যা বাড়ি, দুইড়া মুখে দিয়া কাষ্ঠাহরণে যাইব।‘

‘যাইও না।’

‘ক্যান স্যার? এতগুলা প্রাণীর আহার! কাষ্ঠ আইনব্যার লাগব না?’

‘আজ-না সম্রাট বদলের ছুটি? তোমার মেমরি তাহলে তো ভালই। আর দিন কয়েক পরেই তো তুমি হইবা এমএলএ আর ষষ্ঠ জর্জ হইবেন কিং এমপোর।‘

‘হ তাই তো! ৩১ ডিসেম্বর তো অষ্টম এডোয়ার্ড-এর সিংহাসন ত্যাগের দিন। হ স্যার। মুহুরি হালদার মশাই তো সেরেস্তা ছাইড়্যা মাথায় গামছা বাইন্ধ্যা ভোট কইরবার গিছেন কোথায়-না-কোথায়। ডায়রিখানাও দিয়্যা যান নাই।

‘মুহুরি একখান পাইছ যোগেন–শিবু হালদার।‘

‘কী কইব স্যার, শিবুবাবুরে আমি কইলাম, তুমি আমার মুহুরি নাকী আমি তোমার মুহুরি। কইরল কী কাণ্ড? নমিনেশন ফর্ম জমা দেওয়ার আড়াইশ টাকা পাব কুথায়। আর তহন আমি ভোটে খাড়াইতেও চাই না। শিবু কোথা থিক্যা টাকা আইনল, আরো কার কাছ থিক্যা কী নিল আর আমারে দিয়া সই করাইয়া নমিনেশন জমা দিল।‘

‘অন্তত এই একডা কারণে শিবুর কাছে আমাগ কৃতজ্ঞ থাকা দরকার। সেই তো সঙ্গলের আগে বুইঝছে–বরিশালের একখান নূতন নেতা দরকার। অশ্বিনী দত্তের নাম ভাঙানোর দিন শ্যাষ। এহন তো নতুন নেতা দরকার,’ দুর্গামোহন সেনের কথা বলায় জিভে একটু আচমকা বাধা আসে। সেই কারণেই একটু কম কথা বলেন।

‘কী যে কন স্যার,’ স্বাভাবিকভাবে দুর্গামোহন সেনকে তো তার জ্যাঠাই বলা উচিত, কিন্তু যোগেন জানে, তার মত এক নমশুদ্রের জ্যাঠা হতে তাদের আপত্তিও থাকতে পারে। তাই, সে ‘স্যার’ এই শব্দটিই বেছে নিয়েছে।’

‘স্যার’ শুনলে টাউনের বাঙালি বামুন-কায়েত-বৈদ্য খুশিই হয়।

‘কী যে কন স্যার–আমার নি শিবুর কথায় ভোটে খাড়ানো সম্ভব ছিল? সোজা হিশাব দেইখ্যা একটুখান লোভ হইছিল। কংগ্রেস আর দুই স্বতন্ত্র যদি ভোটগুল্যা ভাগ কইর‍্যা দ্যায়, মাঝখান দিয়া আমি গইল্যা যাইতে পারি। সে লোভখান চাগাইতে-চাগাইতেই তো কীর্তিপাশার শীতাংশু রায়চৌধুরি স্যার উইড্র কইরলেন। আমার ভোটের শখও মিলাইয়া গেল। অ্যাহন তো রণক্ষেত্রে সরলকুমার দত্ত স্যার আর এই অভাগা। তাই তো কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট আর অশ্বিনী দত্তের ভাইয়ের বেটা আর জমিদার। এক্কেরে মাহেন্দ্র যোগ। আমারে তো নস্যির নাগাল টাইন্যা নিবেন। তো কইল্যাম, শিবুবাবু, উইড্র করেন নমিনেশন। কিন্তু শিবু কইরল উলটা কামন–আপনাগো জানাইল, স্যানসারডে জানাইল, পাঁজিপুঁথি পাড়ার পণ্ডিতস্যারকে জোট কইরল। মনোরঞ্জন স্যার আইস্যা খুউব একচোট গালি দিলেন–হ্যারামজাদা, ভোট কি তোর একার যে তোর খাড়া হইবার হাউশ হইলে খাড়াবি আর সইরা যাবার হাউশ হলি সইর‍্যা যাবু। ভোটর ফল তো ভোটে। কিন্তু ভোটের আগেই একখান্ জিত্ তো আমার হইয়া গিছে, স্যার।‘

‘সেইড্যা কী। খুইল্যা কও।

‘সে স্যার আপনাগ কারণে। আমি তো শিডিউল সিটে খাড়াই নাই। আপনারাই স্যার এই নমশুদ্রকে হিন্দু বইল্যা সম্মান দিলেন।‘

‘হিন্দু সিট কও ক্যান? জেনারেল সিট কও।‘

‘কেড়া কয় স্যার? এইডাই তো বরিশালের রেকর্ড হইয়া গেল–জিতি হারি যাই হোক। শিডিউল হইয়া জেনারেল সিট। এইডা স্যার বরিশালের বর্ণহিন্দুদের সাপোর্ট ছাড়া হইত না।‘

‘সে তো ভোটের পরের হিশাব মিলাইয়্যা দেইখতে হবি যোগেন। কিন্তু সেইডা তো কাস্ট হিন্দুগো ব্যাপার। কিন্তু হিন্দু বুইঝতে তুমি কী বুঝো?’

‘না, না, স্যার, আমি তো এইডা কই নাই যে বেবাক বামুন-কায়েত আমারে ভোট দিবে। আমি কইছি যে আমার যে সাধারণ-আসন থিক্যা খাড়া হওয়া গেল, তার পিছনে তো স্যার কিছু বর্ণহিন্দুর, আপনাগ নাগান, সাপোর্ট পাইছি বইল্যা।‘

‘তুমি তো তোমারে হিন্দু বইল্যাই ভাববা? বাড়ির কাজকর্মে তো তোমাগ বামুন লাগে?’

‘সে তো স্যার নমো-বামুন, পতিত। বামুন-কায়েতরা তো সেই পুরুত্ব দিয়্যা তুলসীপাতাও ছোঁয়ায় না।

‘আরে, সে তো হিন্দুগ সাইডের কথা, সে তো তোমাগ সাইডের কথা না?’

‘আমাগ সাইডের কি এইডা কম কথা স্যার? একডা নমকে হিন্দু-আসনে ছাইড়া দেয়া?’

‘তুমি কি বামুন-কায়েত হবার চাও?’

‘না স্যার, আমি নমশূদ্রই থাইকব্যার চাই। সে আকাক্ষি ছিল আমাগ বাপ-ঠাকুরদার। পৈতা পইর‍্যা বামুন হবার ধরছিল না?’

‘হয়। অ্যাহন তো হিন্দুগ সংখ্যা বাড়াইতে লাগব। বামুন-কায়েত আর কয়? তাগো দিয়া তো আর ফজলুল হকরে সামাল দিয়া যাবে না। মুসলিম লিগরেও ঠেকান যাবে না।’

‘সেইডা ঠিক কথা স্যার। যহন আমরা কইছিলাম, আমরাও বামুন, তহন বামুনরা কইল আরে চাড়াল তো চাড়ালই থাকব। আর, অহন মুসলমানরা যহন কবার ধইরছে আমরা আলাদা নেশন, তহন বামুনরা আইসা আমাগ ভজাইবার ধইরছে, আরে, চাড়ালও হিন্দু, তোগো কী সৌভাগ্য, হিন্দু বইল্যাই তো চাড়াল হইবার পারলি, মুসলমান তো আর চাড়াল হইবার পারে না। মোগল-বাদশাহেব পুরস্ত্রী মাত্রই অন্য রাজ্যের পাটরানী অপেক্ষাও বড়।‘

‘আরগুমেন্ট হিশাবে কিন্তু কথাডার একটা জোর আছে। কও, এর পালটা কী কবা? মুসলমান তো আর চড়াল হইবার পারে না। সুতরাং বাই ইমপ্লিকেশন, চাড়াল ইজ অন এ সুপরিয়র লেভেল টু এ মুসলমান। তার মানে এইডাও দাঁড়াইতে পারে যে, এ চাড়াল হ্যাঁজ এ স্ট্যাটাস। বলল, এই আরগুমেন্টটা তুমি অ্যাজ পার জুরিসপ্রুডেন্স সায়েন্স, তুমি কাটান দিব্যা কেমনে? মানে, উই আর ডিসকাসিং অ্যান অ্যাকাডেমিক পয়েন্ট। তোমার শার্প সেন্স অব কাউন্টার-আরগুমেন্ট আমরা তত লইখ্য করি। ইন ক্রিমিন্যাল সাইড দ্যাট ইজ অ্যান আসেট।‘

‘এইডা কি একডা কথা হইল স্যার? ওকালতি কি বামুন-কায়েতদের বিয়ার দুই পক্ষের পুরুতের ঝগড়া? আমি তো স্যার, আপনাগো দেইখ্যা-শুইন্যা শিখত্যাছি–ওকালতি মানে শুধুই ল পয়েন্ট, গলা কাঁপাইয়া চিল্লালেই কি আর চাঁদরায় হয়?’

‘সে বিষয়ে তোমার এড়ডু অসুবিধাই আছে, যোগেন।’

‘কী অসুবিধা স্যার?’

‘আরে, আমরা তো কেউ তোমার নাগাল পাবলিক স্পিকার না। কই, দেখছনি, কুনোদিন কুনো মিটিঙে মুখ খুলি?’

‘সে তো স্যার আরো বড় স্পিকিং পাওয়ার। একড়াও কথা কইল্যাম না কিন্তু যা বলার সব বলা হইয়া গেল।‘

‘আরে, কইতে পাইরলে তো কইব? কাল কোট, একখান চেয়ারের মাথা আর চোখের সামনে হাকিম না থাইকলে মুখে কথা ফোটে না। তুমি পারবা না যোগেন–তুমি য্যামন অরেটার, তোমার গলায় খুব ইনট্রিকেট ল-পয়েন্টেও, ঐ কইল্যা না, চাঁদরায়ের ঢক আইস্যা যাবে। তাতে ক্ষতি কী? এ তো একড়া অ্যাডিশন্যাল কোয়ালিফিকেশন। এই যে তোমার টাউন হলের মেগাস্থিনিস স্পিচে তুমি যে সেদিন কইল্যা যোগেন–ভেগাই হালদারের ইশকুলের কথা, ভর্তার বিলের কথা, মাহিলাড়ার মানে বাঘের গ্রামের খালের কথা-তহন সত্যি-সত্যি মনে আইল –হ তো, এইডাই তো আমাগ স্বদেশী হওয়া উচিত–এই ভেগাই হালদারের ইশকুল, বিলের বাঁধ, জলের খাল। এইডা তো তোমার স্পিকিং পাওয়ারের জন্যই সম্ভব হইল। আবিষ্কারের মত একখান। স্যান মশায় তোমার টাইটেলখান ঠিকই দিছেন–মেগাস্থিনিস!’

‘স্যার, সইত্যের তো কুনো শক্ত হয় না। ঐ কথা তো আমার অন্তরের কথা স্যার, ওর সঙ্গে ভোটাভুটির কুনো সম্বন্ধই নাই স্যার। আমি স্যার, আপনাগো মন জাগাইবার জন্য কই নাই। আমার নিজের মন জাগানোর জইন্যে কইছি।‘

‘আরে, তা না হইলে কি তোমার কথাগুলা মন দুইবার পাইরত, যোগেন? তোমার বিসমিল্লায় কুনো গলদ নাই।‘

‘আমি এইডা অনুভব করি স্যার, পৈতা পইর‍্যা আর পদবী পালটাইয়া নমশূদ্ররা কুনোদিন কাস্ট-হিন্দু হইবার পারব না। আরে, বামুন-কায়েত-বৈদ্যরা তো শুধু হায়ার কাস্ট না, হায়ার কালচার। সেই কালচার তুমি পাইব্যা ক্যামনে–এডুকেশন ছাড়া? এক এডুকেশনই তো তোমারে নমশূদ্র-পরিচয়ে প্রাইড দিবার পারে। স্যার, কয়ডা মানুষ জানে, খুলনার কুমুদ মল্লিক নমশূদ্রদের মইধ্যে প্রথম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ভীষ্মদেব দাস প্রথম উকিল, আর মল্লিকদের তিন ভাইয়ের কথা আর কী কইব। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির পালি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর। আমাগ জাইতের তাতে কুনো চৈতন্য নাই। তাই উনাদেরও মনে থাকে না যে উনারা নমশূদ্র। এ নেশন উইদাউট এনি আইডেনটিটি। আমার স্যার, নমশূদ্র ছাড়া মানুষ নাই, বরিশাল ছাড়া দ্যাশ নাই।‘

‘যোগেন, যা কইছ–কইছ। আর কয়ো না। ধরো আমরা শুনি নাই। এ কথায় মানুষজন তোমারে ভুল বুইঝবে।‘

1 Comment
Collapse Comments

দেবেশ রায়ের “উপন্যাস নিয়ে” বইটা এড করেন প্লিজ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *