০৬০. সৌভপতি শাল্ব

৬০.

সৌভপতি শাল্ব অম্বাকে ত্যাগ করলে অম্বা খুব কাঁদলেন। শাম্বপুর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় বারবার নিজেকে বড় অসহায় মনে হল তার। এক উদ্ভিযৌবনা রমণীর পক্ষে এইভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়াটা তার যৌবনেরই অপমান বলে মনে হল যেন। তার মনে হল–দ্বিতীয়া কোনও যুবতী নেই এই পৃথিবীতে যে নাকি এমন দুরবস্থায় পড়েছে–পৃথিব্যাং নাস্তি যুবতি-বিষমস্থতরা ময়া। ভীষ্ম তাকে উঠিয়ে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার বাপের বাড়ির আত্মীয়-স্বজন তাকে ত্যাগ করেছেন অনেক আগেই। শাল্বরাজ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন অতি নির্মমভাবে। অন্যদিকে হস্তিনাপুরে ভীষ্মের কাছে শাধের প্রতি নিজের ভালবাসার কথা এমন সরবে সোচ্চার বলে এসেছেন অম্বা যে, সেখানে আর তার ফিরে যাবার উপায় নেই–ন চ শক্যং ময়া গন্তুং ময়া বারণসাহয়।

শুধু কোথাও গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করা নয়, অম্বার মন এখন দীর্ণ হয়ে উঠল নানা অকারণ স্বগ্রথিত ভাবনার শৃঙ্খলে। যদি এটা না হত, তবে ওই ঘটনাটা ঘটত না, যদি এটা না করে ওটা করতাম, তবে এটা ঘটত না–এইরকম স্বকল্পিত গ্রন্থনার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে অম্বা মনে মনে ভাবলেন–মুখ ফুটে শান্দুরাজার প্রতি আমার প্রেমের কথা জানিয়েছিলাম বলেই তো ভীষ্ম আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিয়েছিলেন; এখন আমি কাকে দোষ দেব? নিজেকে? না ওই। ভীষ্মকে?–কিন্তু গাম্যথাত্মানম্ অথ ভীষ্মং দুরাসদম্?

নিজের পিতার ওপরেও অম্বার রাগ হল। ভাবলেন–আমার পিতা-ঠাকুরটিই একটি মস্ত বোকা তোক। তিনিই তো স্বয়ম্বরের আয়োজন করে আমাকে সকলের চক্ষুর সামনে ঠেলে দিলেন–অথবা পিতৰং মূঢ়ং যো মেকাষীৎ স্বয়ম্বর। স্বয়ম্বরের আয়োজনই যদি না হত, তাহলে গোপনে গোপনে শারাজার সঙ্গে বিয়ে হয়ে যেতে পারত আমার। কিন্তু ওই বোকা বদমাশ বাবাটি আমার! স্বার্থপরের মতো তিনি নিজে রাজকীর্তি লোকের সামনে তুলে ধরার জন্য আমাকে বেশ্যার মতো সব রাজার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। রাজাদের সুবিধে হল–যার গায়ের জোর আছে, তিনিই জিতে নিতে পারেন আমাকে, স্বয়ম্বরের। নিয়মমতো–যেনাহং বীর্যশুকেন পণ্যস্ত্রীব প্ৰচোদিতা! ভীষ্মও তাই করেছেন।

পিতার সঙ্গে সঙ্গে নিজের দোষ স্বীকার করে নিলেন অম্বা। আমরা আগে বলেছি–অম্বা একবারও ভীষ্মের কাছে নিজের অনুরাগের প্রসঙ্গ তোলেননি। না স্বয়ম্বরসভায়, না রথে উঠবার সময়, না রথে যেতে যেতে। এখন তার মনে হচ্ছে-ই। আমি নিজে কী বোকামিই না করেছি? যখন ভীষ্মের সঙ্গে শাম্বের যুদ্ধ হচ্ছিল, তখন যদি আমি ভীষ্মের রথ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছুট্টে শাল্বরাজের কাছে চলে যেতাম! কিন্তু তা তো আমি করিনি এবং এখন তার ফল পাচ্ছি। এখন কারও কাছেই আমার ঠাই নেই–তস্যেয়ং ফলনিবৃত্তি-যদাপন্নাস্মি মূঢ়বৎ।

নিজের দোষ, পিতার দোষ, এবং সমস্ত সঙ্কটময় পরিস্থিতির দোষ–যত দোষই দিন অম্বা, কিন্তু একবারের তরেও তিনি উচ্চারণ করলেন না–মনের গভীরে আকস্মিকভাবে উদগত সেই বুদবুদোপম সুখের কথা। ভীষ্মের যুদ্ধকৌশলে, বীরত্বে, ব্যক্তিতে তার যে মোহ তৈরি হয়েছিল অবচেতনায়–যা দূর থেকে শাশ্ব পর্যন্ত লক্ষ্য করেছেন, সেই সামান্য মোহটুকুর জন্যই যে এই সর্বব্যাপ্ত ক্ষতি হয়ে গেল, সে কথা তিনি একবারও স্বগতভাবে বললেন না। কিন্তু মুখে না বললেও মহাভারতের কবি সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন মনস্তাত্ত্বিকের মন্ত্রণা মিশিয়ে।

অম্বা পিতার ওপর রাগ করলেন, নিজের ওপর রাগ করলেন, বিধাতাকেও ধিক্কার দিলেন। কিন্তু ভাগ্যের দোষ দিয়ে সবার শেষে যেখানে এসে তার সমস্ত ক্রোধ কেন্দ্রীভূত হল, তিনি মহামতি ভীষ্ম। ভীষ্ম তার কোনও ক্ষতি করেননি, যখনই শারাজার কথা তিনি উচ্চারণ করেছেন সঙ্গে সঙ্গে তার সুরক্ষার সমস্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন করে ধাই-বামুন সঙ্গে দিয়ে তাকে শারাজার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। এসব মহানুভবতা অম্বাও অস্বীকার করেন না। কিন্তু এখন। শা, পিতা, বিধাতা সবাইকে রেহাই দিয়ে তিনি ধরলেন ভীষ্মকে। বললেন-কপালের লিখন যার যেমন থাকে, তা তো হবেই, কিন্তু আমার এই দুরবস্থার জন্য আসল দায়ী হলেন ভীষ্ম-অনয়সাস্য তু মুখং ভীষ্মঃ শান্তনবো মম। যদি কারও ওপর প্রতিশোধ নিতে হয়–সে তপস্যা করে নিজের শক্তিবর্ধন করেই হোক, অথবা যুদ্ধ করেই হোক–যদি কারও ওপর প্রতিশোধ নিতে হয় তবে ভীষ্মের ওপরেই তা নেব; সেই আমার সমস্ত দুঃখের মূলসা ভীষ্মে প্রতি কর্তব্যং…দুঃখহেতুঃ স মে মতঃ।

এই যে প্রতিক্রিয়া, এক নির্দোষ ব্যক্তির প্রতি এক সুন্দরী রমণীর এই যে প্রতিশোধস্পৃহা– এই প্রতিক্রিয়া মনস্তাত্ত্বিকের নীতিতে বড় সাধারণ নয়। মনস্তাত্ত্বিক দার্শনিকের কথা যদি ধরেন, তাহলে তারা বলবেন-মানুষের কামনা যেখানে প্রতিহত হয়, সেখানেই ক্রোধের উৎপত্তি হয়। এখানে ভীষ্মের প্রতি অম্বার ক্রোধ থেকেই তার প্রতি অম্বার অবচেতন কামনার অনুমান করা যেতে পারে। অথবা এই যে সব ছেড়ে সবাইকে ছেড়ে অম্বার সমস্ত ক্রোধ ভীষ্মের প্রতি কেন্দ্রীভূত হল, তার পিছনে আছে এক ধরনের বিকার, যে বিকার উদাসীনতা থেকে কখনই জন্মায় না। একটা লোককে খারাপ লাগা বা ভাল লাগা থেকেই এই বিকারের উৎপত্তি হয়। ভীষ্ম অম্বাদের তিন বোনকে কাশীরাজের রাজসভা থেকে তুলে এনেছিলেন। তাতে তাদের। রাগও হতে পারে, আনন্দও হতে পারে। কিন্তু রাগ বা আনন্দ কোনওটারই প্রকাশ হয়নি তখন। কারণ তাদের নিয়ে কী করা হবে, কার সঙ্গে তাঁদের বিয়ে হবে–সে সম্বন্ধে তাঁদের কোনও ধারণা ছিল না।

প্রকৃত বিবাহ উৎসবের আয়োজন শুরু হতেই অম্বা শারে প্রতি তার অনুরক্তির কথা প্রকাশ করলেন, তাতেও তার কোনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু শাস্বরাজ তাকে প্রত্যাখ্যান করার পর তার সমস্ত রাগ যে ভীষ্মের ওপর গিয়ে পড়ল, এইখানেই হৃদয়-বিকারের লক্ষণ প্রকট হয়ে ওঠে। মহাভারতের শব্দমাত্র আভিধানিকভাবে বিচার করলে এই বিকারের সন্ধান পাওয়া যাবে না। কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন–আমার সমস্ত কষ্টের মূল কারণ হলেন ওই ভীষ্ম–দুঃখহেতুঃ স মে মতঃ-সেই মুহূর্তেই ভীষ্মের প্রতি এই ক্রুদ্ধা রমণীর অবচেতন দুর্বলতা প্রমাণ হয়ে যায়।

অম্বা মনে মনে ঠিক করলেন-ভীষ্মকে শাস্তি দিতে হবে। হয় ভীন্সের থেকে অধিক কৌশলশালী কোনও অস্ত্রবিদের দ্বারা ভীষ্মকে মার খাওয়াতে হবে। নয়ত তপস্যার মাধ্যমে কোনও দেবতাকে তুষ্ট করে অম্বা নিজেই ভীষ্মের ওপর প্রতিশোধ নেবেন। কাউকে দিয়ে ভীষ্মকে মার খাওয়াতে গেলে কাকে ধরতে হবে–এসব অবশ্য তার জানা নেই। কিন্তু তার প্রতিশোধস্পৃহা এখন এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, একজনকে তিনি খুঁজে বার করবেনই যিনি যুদ্ধে ভীষ্মের অসমোৰ্ব্ব প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন। এই সব নানা চিন্তা এবং প্রতিজ্ঞা নিয়ে তিনি শাপুরের নগরসীমা অতিক্রম করলেন। সমস্ত লোকালয় পেরিয়ে আসতে আসতেই অরণ্য ঘন ঘনতর হতে লাগল। সুদুর বনের উপান্তে এক আরণ্যক ঋষির আশ্রম চোখে পড়ল অম্বার।

 সেদিন আর বেশি কথা হল না। তপস্যা, যজ্ঞ, হোম আর আরণ্যক ঋষি-মুনির উদাসীন শুষ্ক-রুক্ষ মন-সেখানে এক রমণী এসে প্রথমেই সবকিছু প্রকট করে দিতে পারে না। প্রথমে যা হয়, সেই রকম প্রণাম, কুশল-প্রশ্ন আর সদাচার-সৎকারেই রাত নেমে এল আশ্রমের অরণ্য-আবাসে। অম্বা আশ্রয় পেলেন, ঋষি-মুনিরা তাকে সমস্ত সুরক্ষা দিয়ে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করে দিলেন–ততস্তা অবস রাত্রি তাপসৈঃ পারিবারিতা। পরের দিন অম্বাকে নিয়ে মুনি-ঋষিদের আসর বসল। অম্বা আনুপুর্বিক সমস্ত ঘটনা মুনি-ঋষিদের জানালেন। ভীষ্ম তাঁকে কীভাবে হরণ করেছেন, কীভাবে অম্বার কথা শুনে ভীষ্ম তাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন শারে কাছে এবং অবশেষে কীভাবে শাল্ব তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, সব বললেন অম্বা। বলতে বলতে অম্বার চোখ জুড়ে কান্না এল, নিঃশ্বাস উষ্ণ এবং বাম্পায়িত হল–নিঃশ্বসন্তীং সতীং বালাং দুঃখশোকপরায়ণাম্।

মুনি-ঋষিদের মধ্যে তপোবৃদ্ধ যিনি ছিলেন, তার নাম শৈখাবত্য। আরণ্যক শাস্ত্র-উপনিষদের অধ্যাপক তিনি। তিনি একটু উদাসীন সুরেই বললেন–আমরা তো আশ্রমে থাকি, মা। ধ্যান আর তপস্যা নিয়েই আমাদের দিন কাটে। তোমার এই সমস্যায় এই সব তপস্বীরা কীই বা করতে পারেন–এবং গতে তু কিং ভদ্রে শক্যং কর্তৃং তপস্বিভিঃ।

অম্বা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। একটু চতুরাও বটে। তিনি একবারও বললেন না যে, ভীষ্মের ওপর তিনি প্রতিশোধ নিতে চান। খুব ভালমানুষের মেয়ের মতো তিনি শাল্বরাজের ওপরেই আপাতত সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিয়ে তার অসহায় অবস্থার কথা বুঝিয়ে বললেন–দেখুন, শাল্বরাজ আমাকে প্রত্যাখ্যান করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। আমার মনে আনন্দ বলে আর কিছু নেই–প্রত্যাখ্যাত নিরানন্দা শানে চ নিরাকৃতাঃ।

সংস্কৃত ভাষায় কথাটা দ্ব্যর্থব্যঞ্জক। ভীষ্মের নাম না করেও এই শ্লোকের অর্থ এইরকম হতে পারে–ভীষ্ম আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন আর শাম্ব আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এই অবস্থায় আর আমার বাড়িতে নিজের জনের কাছেও ফিরে যাবার উপায় নেইনোসহে চ পুনর্গত্তং স্বজনং প্রতি তাপসা। তাই ভাবছিলাম–যা হবার তা তো হয়েই গেছে। পূর্বজন্মে অনেক পাপ করেছি তার ফলও পাচ্ছি। এখন এই অবস্থায় আপনারা আমায় একটু অনুগ্রহ করুন। আমিও সন্ন্যাসিনী হয়ে জীবন কাটিয়ে দেব। যেমন তপস্যা করা যায় না, সেই দুশ্চর তপস্যায় মন দেব আমি–ব্রাজ্যমহমিচ্ছামি তপস্তন্স্যামি দুশ্চরম্।

 অম্বার কথা শুনে শৈখাবত্য মুনি নানান শাস্ত্র-যুক্তি দিয়ে সান্ত্বনা দিলেন তাকে। তবে এক যুবতী মেয়ের মুখে যোগিনী হবার কথা শুনে সমস্ত মুনি-ঋষিদের মনই একটু করুণা-সিক্ত হয়ে রইল। সত্যিই অস্থার জন্য কিছু করা যায় কি না, তার জন্য তাদের মনও খানিকটা প্রস্তুত হল। তপস্বীদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য তাকে ঘরে ফিরে যেতে বললেন। কেউ ভীষ্মকে। গালাগালি দিলেন, কেউ বা শাশ্বকেও। কিন্তু নানা আলোচনা করে, সবার দোষ-গুণ বিচার করে, আশ্রয়স্থল হিসেবে কোন জায়গাটা সবচেয়ে যোগ্য হবে, তার বিধান দিলেন মুনিরা। বললেন-মা! এই বয়সে তোমার ঘর ছেড়ে সন্ন্যাসিনী হওয়া সাজে না। আমাদের কথা শোন–অলং প্রব্রজিতেনেহ ভদ্রে শৃণু হিতং বচঃ।

ঋষিরা বললেন–তুমি তোমার বাপের বাড়িতেই ফিরে যাও, মা! তিনি তোমার জন্য সব থেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা করবেন। স্বামী সুস্থ থাকলে, ভাল থাকলে তার বাড়িটাই মেয়েদের পক্ষে সবচেয়ে ভাল বটে; কিন্তু স্বামীর বিপদ ঘটলে, মারা গেলে অথবা যা হোক স্বামীর বাড়িতে কোনও ঝামেলা হলে, বাপের বাড়িটাই মেয়েদের পক্ষে সবচেয়ে ভাল। গতিঃ পতিঃ সমস্থায় বিষমে চ পিতা গতিঃ। তার ওপরে দেখো, তোমার এই কাঁচা বয়স। তুমি রাজার মেয়ে বলে কথা, তোমার স্বভাবও নরম, শরীরটাও নরম, এই বয়সে তোমার কি যোগিনী হওয়া সাজে–প্রব্রজ্যা হি সুদুঃখেয়ং সুকুমাৰ্য্যা বিশেষতঃ।

মুনিরা এবার আশ্রমে থাকার অসুবিধেগুলোও বললেন। বললেন–তুমি ভাবছ মা! আশ্রমে সন্ন্যাসিনী হয়ে রইলাম, আর সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল? তপস্যার মধ্যেও অনেক সমস্যা আছে, মা। তোমার মতো সুন্দরীদের তপস্যার ভূমিতেও শান্তি নেই। রাজা-রাজড়ারা অনেক সময়েই আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমে আসেন। তারা তোমাকে দেখলেই তোমার সল কামনা করবেন, তোমাকে স্ত্রী হিসেবেও পেতে চাইবেন। অনেকে। সেও কি কম সমস্যা? তাই বলছিলাম, এই বয়সে তপস্বিনী হওয়ার মন কোরো না অন্তত–প্রার্থয়িষ্যন্তি রাজানঃ তস্মান্মৈবং মনঃ কৃথাঃ।

মুনি-ঋষিদের সব কথা শুনেও অম্বা কিন্তু খুব বিচলিত হলেন না। কারণ তারও বাস্তববুদ্ধি, সামাজিক বোধ কিছু কম নয়। তিনি বললেন–কাশীনগরীতে পিতার ঘরে আর আমার পক্ষে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়, বাবা! আমার আত্মীয়স্বজন, নিজের লোকেরা কেউই আমার অবস্থা ভাল করে বুঝবেন না, ফলে তাদের অবজ্ঞার পাত্র হব আমি। ছোটবেলা থেকে বাপের বাড়িতে যে আদর আর মর্যাদা নিয়ে আমি বড় হয়েছি–উষিতাস্মি যথা বাল্যে পিতৃর্বেশ্মনি তাপসাঃ–সেই আদর আর আমি পাব না। কারণ এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। কাজেই আপনারা আমাকে যে সুপরামর্শ দিয়েছেন, তার জন্য বড় জোর আমি সাধুবাদ জানাতে পারি, কিন্তু আমার পক্ষে বাপের বাড়ি ফেরা আর সম্ভব নয়-নাহং গমিষে ভদ্রং বস্তত্ৰ যত্র পিতা মম। আমি তপস্যাই করব এবং আমার সুরক্ষার ভার আপনাদের।

 ব্রাহ্মণ মুনি-ঋষিরা অম্বার দৃঢ়তায় একটু বিচলিতই বোধ করতে লাগলেন যেন। কী করা যায় এই সুন্দরী যুবতাঁকে নিয়ে–এই চিন্তায় যখন তাঁদের মনোজগতে ঝড় চলছে, ঠিক সেই সময় সেখানে এসে উপস্থিত হলেন রাজর্ষি হোত্ৰবাহন। হোত্ৰবাহন রাজকর্ম করেন বটে, কিন্তু তিনিও মুনি-ঋষিদের মতোই তপঃসিদ্ধ, যার জন্য তাকে রাজর্ষি বলা হয়। মুনি-ঋষিরাও তাঁকে খুব সম্মান করেন। লক্ষণীয় বিষয় হল–রাজর্ষি হোত্ৰবাহনের সঙ্গে অশ্বর একটা আত্মীয়-সম্বন্ধও আছে। হোত্ৰবাহন অম্বার মাতামহ অর্থাৎ মায়ের বাবা, দাদু। স্বাভাবিক কারণেই অম্বার দুরবস্থার কথা শুনে তিনি অত্যন্ত বিচলিত হলেন।

 রাজর্ষি হোত্ৰবাহনের আরও বড় পরিচয় আমরা পরে পাব এবং সেটা অন্য কারণে খুব গুরুত্বপূর্ণও বটে। কিন্তু পরের কথা পরেই হবে। আপাতত অম্বার ব্যাপারে তার হস্তক্ষেপটুকুই বিচার্য বিষয়। অম্বার দাদু বলে কথা। হোত্ৰবাহন তার দুঃখের কথা শোনামাত্রই পরম স্নেহে আদরের নাতনিকে কোলে তুলে নিলেন–তাং কন্যা অঞ্চমারোপ্য পৰ্য্যশ্বাসয়ত প্রভোসাত্বনা দিলেন নানান মতে। অম্বাও ভীষ্ম, শা, তাদের অঙ্গীকার, প্রত্যাখ্যান–সব সবিস্তারে জানালেন দাদু হোত্ৰবাহনকে। সব শুনে হোত্ৰবাহন বললেন-বাপের বাড়ি ফিরে যাবার কোনও প্রয়োজন নেই তোমার। আমি তোমার দাদু, তোমার দুঃখ দূর করার ভার আমার-দুঃখং ছিন্দাম্যহং তে বৈ…মাতুস্তে জনকো হ্যহম্।

রাজর্ষি হোত্ৰবাহন অর দুঃখের সঙ্গে একাত্ম হলেন। অম্বার ক্লিষ্ট শীর্ণ শরীর আর মানসিক কষ্ট দেখে তিনি তাকে আত্মীয়তার আশ্রয় দিয়ে বললেন–তুমি আমার কাছেই থাকবে–এ তো সাধারণ কথা। সঙ্গে সঙ্গে এও জানাই–তুমি যা চাইছ, তারও উপায় আছে। বলি শোনো–তুমি একবার ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ পরশুরামের কাছে যাও। মহাকালের আগুনের মতো তার তেজ। ভীষ্ম যদি তার কথা না শোনেন, তবে তিনিই একমাত্র পারেন ভীষ্মকে যুদ্ধে হারাতে, এমনকি মেরেও ফেলতে-হনিষ্যতি রণে ভীষ্মং ন করিষ্যতি চেচঃ। সাধারণ মেয়েরা সংসারে স্বামী-পুণ্ডুর নিয়ে যে অবস্থায় থাকে, তোমাকে সেই অবস্থা ফিরিয়ে দিতে পারেন একমাত্র পরশুরাম।

কথাটা শুনে অম্বার কান্না পেয়ে গেল। কীভাবে, কোথায় পরশুরামের সঙ্গে তার দেখা হবে, তখন-তখনই তার যাওয়া উচিত কি না–এসব প্রশ্ন নিয়েও আলোচনা চলল মাতামহ হোত্ৰবাহনের সঙ্গে। হোত্ৰবাহন বললেন–পরশুরাম থাকেন মহেন্দ্র পর্বতে। দেখবে এক মহাবনের মধ্যে তিনি তপস্যায় নিযুক্ত আছেন। আমার নাম করে, আমার পরিচয় দিয়ে তুমি যা চাইছ, সে সব কথা তুমি তাকে বলো। দেখবে, তোমার কথা তিনি শুনবেন, কারণ পরশুরাম আমার বন্ধু মানুষ-মম রামঃ সখা বৎসে প্রীতিযুক্তঃ সুহৃচ্চ মে।

হোত্রবাহনের সমস্ত নির্দেশ শুনে অম্বা মহেন্দ্র পর্বতে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন এমন সময় পরশুরামের অনুচর অকৃতব্রণ ওই আশ্রমেই এসে উপস্থিত হলেন। আশ্রমে উপস্থিত রাজর্ষি হোত্ৰবাহনকে দেখে অকৃতব্রণ খুবই খুশি হলেন এবং সানন্দে বললেন– মহাত্মা পরশুরাম সবসময় আপনার গল্প করেন। বারবার আমাদের বলেন–সৃঞ্জয়বংশীয় হোত্ৰবাহন আমার পরম প্রিয় সখা-সৃঞ্জয়ো মে প্রিয়সখো রাজর্ষিারতি পার্থিব।

 রাজর্ষি হোত্ৰবাহনের আরও একটা পরিচয় বেরল। তিনি সৃঞ্জয়বংশীয়–স চ রাজা বয়োবৃদ্ধঃ সৃঞ্জয়া হোত্ৰবাহন। এই পরিচয়টা আমাদের কাছে অত্যন্ত জরুরী। সৃঞ্জয়বংশীয়দের কথা আমরা আগে বলেছি। সঞ্জয় পাঞ্চালদেশের রাজা ছিলেন এবং দ্ৰৌপদী, ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং শিখণ্ডীর পিতা বলে পরিচিত দ্রুপদের পূর্বপূরুষ সৃঞ্জয়। বস্তুত পাঞ্চালদেশের রাজারা সকলেই সৃঞ্জয়ের নামেই বিখ্যাত। পরবর্তী কালে শিখণ্ডীর মধ্যে অম্বার রূপান্তর এবং এখন সৃঞ্জয় হোত্ৰবাহনের ভীষ্মবধের পরিকল্পনার মধ্যে বহু পরবর্তী কালের রাজনৈতিক স্থিতিগুলি অনেকটাই সুপ্ত ছিল বলে আমরা মনে করি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্ম পাণ্ডবদের পক্ষে না এসে কৌরবদের পক্ষেই কেন থেকে গেলেন–এই রাজনৈতিক কূটের সমাধান করার জন্য যাঁরা শুধু ভীষ্মের মৌখিক কথাটুকু বিশ্বাস করেন, তারা আর যাই বুঝুন মহাভারতের রাজনৈতিক তাৎপর্য বোঝেন না। ভীষ্ম নাকি বলেছিলেন–মানুষ অর্থ এবং অন্নের দাস। আমি কুরুবাড়ির অন্ন খেয়েছি, অতএব সেই ঋণশোধের জন্যই আমাকে কৌরবপক্ষে থাকতে হবে।

ভীষ্মের এই কথাটা বোকা-বোঝনোর মৌখিকতা মাত্র। ভারতযুদ্ধের রাজনৈতিক তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করলে দেখা যাবে-কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কাশীর রাজা পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন এবং পাঞ্চাল-সৃঞ্জয়রাও যোগ দিয়েছিলেন পাণ্ডবপক্ষে। কাশীর রাজার মেয়েদের হরণ করে আনতে গিয়ে সেই স্বয়ম্বরসভায় ভীষ্ম যেভাবে অপমানিত হয়েছিলেন এবং পরবর্তী কালে পাঞ্চাল দেশের রাজা সৃঞ্জয় হোত্ৰবাহন পরশুরামকে দিয়ে যেভাবে ভীষ্মকে মার খাওয়ানোর পরিকল্পনা করছেন, তাতে ভীষ্মের পক্ষে পাণ্ডবদের হয়ে যুদ্ধ করার রাজনৈতিক সমস্যা ছিল। রাজর্ষি হোত্ৰবাহন যেভাবে অম্বার পাশে এসে দাঁড়ালেন এবং সেকালের ক্ষত্রিয়দের চরম শত্রু পরশুরামের সঙ্গে জোট বাঁধলেন রাজনৈতিক দিক দিয়ে সেটা রীতিমতো এক ধূর্ত পরিকল্পনা।

এ বাবদে মহাভারতের কবির বক্তব্য বড়ই সরল। তিনি যেহেতু মহাকাব্যের কবি, তাই অনর্থকভাবে রাজনৈতিক আবর্ত তৈরি করেন না। নইলে ঈষৎ পূর্বের পরিস্থিতিটাই একটু মনোযোগ দিয়ে দেখুন–যে আশ্রমের ঋষিরা একটু আগেই অম্বাকে বাপের বাড়ি ফিরে যেতে বলেছেন, যাঁকে তারা বলেছেন–আমরা ঋষিরা কীই বা করতে পারি তোমার সমস্যায়, সেই আশ্রমেই মুহূর্তের মধ্যে পাঞ্চাল রাজর্ষি হোত্ৰবাহন এসে পৌঁছলেন, সেই আশ্রমে পরশুরামের নাম উচ্চারণ মাত্রেই তার অনুচর অকৃতব্রণ এসে পৌঁছলেন, আবার তিনি এসে বলছেন কিনা–পরশুরাম এখনই আসছেন–এই সমস্ত ঘটনার শৃঙ্খল মহাকাব্যোচিত আকস্মিকতার সূত্রে গাঁথা হলেও ঘটনাগুলি আমাদের কাছে এত সরল নয়। আর সরল নয় বলেই এই সম্পূর্ণ কাহিনীটা আমরা ভীষ্মের মুখেই শুনতে পাচ্ছি। তিনি এই ঘটনার বলি। এবং এই সমস্ত ঘটনা তিনি নিজমুখে বর্ণনা করেছেন সেই উদ্যোগপর্বে গিয়ে। কীভাবে, কত সুপরিকল্পিত তার পিছনে লাগা হয়েছিল, সে সব ঘটনা তিনি সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন কুরুবাড়ির নেতাদের কাছে।

আরও লক্ষ্য করে দেখবেন–গীতায় অর্জুন যেখানে বিশাল দুই যুযুধান সৈন্যবাহিনীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে পড়েছেন, সেখানে যারা শাঁখ বাজিয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করেছেন তাদের মধ্যে পাশাপাশি নাম দুটি হল-কাশীর রাজা এবং পাঞ্চাল শিখণ্ডীর–কাশশ্চ পরমেম্বাসঃ শিখণ্ডী চ মহারথঃ। কাশী এবং পাঞ্চালের এই জোট আরম্ভ হয়েছিল বহু আগে, সেই বিচিত্রবীর্যের বিবাহ-সময়ে এবং সেটা প্রধানত হস্তিনাপুরের সর্বময় কর্তা ভীষ্মের বিরুদ্ধে। আমাদের মতে এই রাজনৈতিক শত্রুতা চলেছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ পর্যন্ত।

.

৬১.

ওদিকে শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী অম্বিকা এবং অম্বালিকার সঙ্গে কুমার বিচিত্রবীর্যের বিয়ে হয়ে গেল। রাজবাড়ির বিয়ে বলে কথা। ধুমধাম যথেষ্ট হল। কিন্তু বিয়ে মিটে যাবার পর দুই স্ত্রীর সঙ্গে বিচিত্রবীর্যের সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ হবার আগেই বোধহয় মহামতি ভীষ্মকে বাড়ি ছেড়ে যুদ্ধ করবার জন্য যেতে হল। কারণ সেই অম্বা। শান্বরাজের কাছে প্রত্যাখ্যাত হবার পর এক মুনির আশ্রমে বসেই তিনি যেভাবে সেকালের রাজনীতি ঘেঁটে তুললেন তা রীতিমতো আশ্চর্যের।

আগেই বলেছি–অম্বার মাতামহ ছিলেন মহাবীর পরশুরামের প্রিয় সখা। মুনি-ঋষিদেরও তিনি নমস্য–রাজর্ষি হোত্ৰবাহন। পরশুরামের অনুচর অকৃতব্রণ, যিনি এই একটু আগেই শৈখাবত্যের আশ্রমে এসে উপস্থিত হয়েছেন। প্রথমে তার কাছেই অম্বার করুণ কাহিনীর সমস্ত বিবরণ দিলেন স্বয়ং সৃঞ্জয় হোত্ৰবাহন। সেই তিনকন্যার স্বয়ম্বর থেকে আরম্ভ করে অম্বার হস্তিনাপুর থেকে চলে যাওয়া এবং শাল্বরাজের প্রত্যাখ্যান পর্যন্ত–সব কাহিনী পাঞ্চাল হোত্ৰবাহনের মুখে শুনলেন অকৃতব্রণ। শেষে খুব ভালমানুষের মতো তিনি জানালেন–এখন তো আর কোনও উপায় নেই। এখন এই আমার দুঃখিনী নাতনিটি তপস্যা করবে বলে এই আশ্রমে এসেছে–সেয়ং তপোবনং প্রাপ্তা তাপস্যেভিরতা ভৃশম্।

হোত্ৰবাহন নাকি অম্বাকে আগে ভাল করে চিনতে পারেননি। কিন্তু পরিচয়ের সময় পিতৃকুল-মাতৃকুলের বংশধারার কথা শুনে হোত্ৰবাহন বুঝেছেন–এটি তারই নাতনিময়া চ প্রত্যভিজ্ঞতা বংশস্য পরিকীর্তনাৎ। মহাকাব্যের সহজ-সরল মনোভূমি থেকে এই বর্ণনাই স্বাভাবিক বটে, তবে আমরা কলিকালের কুটিলতায় ঘটনাগুলিকে এত সরলভাবে বিশ্বাস করিনি। ঘটনা যে তত সরল নয়, তা সবচেয়ে বেশি বোঝা যাবে পরশুরামের অনুচর অকৃতব্রণের উত্তরে অথবা প্রশ্নে। হোত্ৰবাহন এতক্ষণ অম্বার করুণ অবস্থা বর্ণনা করেছেন অকৃতব্রণের কাছে, অম্বাও তাঁর মাতামহকে সমর্থন করে নিজের বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু হোত্ৰবাহন কিংবা অম্বা কেউই কিন্তু ভীষ্মকে শাস্তি দেবার কথা তেমন করে বলেননি। হোত্ৰবাহন সবার শেষে শুধু একবার বলেছিলেন-আমার এই নাতনিটি এখন ভীষ্মকেই তার কষ্টের জন্য দায়ী মনে করছে–অস্য দুঃখস্য চোৎপত্তিং ভীষ্মমেবেহ মন্যতে।

অকৃতব্রণ পরশুরামের সার্থক শিষ্য। পরশুরাম ভয়ঙ্কর ব্যস্ত মানুষ। তিনি পরের দিন সকালে শৈখাবত্যের আশ্রমে এসে পৌঁছবেন–এই সংবাদ আগাম দেবার জন্যই অকৃতব্রণ আগের দিনই এসে পৌঁছেছেন আশ্রমে। সৃঞ্জয় হোত্ৰবাহনের মর্যাদা থেকে অকৃতব্রণ বুঝেছেন-হোত্ৰবাহন খুব কম লোক নন। তিনি তার গুরুর সাহায্য চান। অতএব কীভাবে অথবা কতটুকু সাহায্য এঁরা চান, সেটা অকৃতব্রণের জেনে রাখা দরকার। কারণ কাল সকালেই এ ব্যাপারে তার গুরুকে ‘ব্রিফ’ করবেন তিনি।

অকৃতব্রণ উত্তর দেবার সময় প্রথম প্রশ্ন যেটা করলেন অম্বাকে, সেটা হল–বংসে! তুমি। কী চাও? শাল্ব এবং ভীষ্ম–এই দুজনের মধ্যে কাকে বেশি ঝামেলায় ফেলতে চাও তুমি–দুঃখং দ্বয়োরিদং ভদ্রে কতরস্য চিকীর্ষসি? তুমি যদি মনে ক–যাতে শাল্বরাজ তোমাকে বিয়ে করেন, সে ব্যাপারে তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, বা তাকে জোর করতে হবে, তবে মহাত্মা পরশুরাম তাই করবেন। তোমার যাতে ভাল হয়, তাই তিনি করবেন-নিযোক্ষ্যতি মহাত্মা স রামশুদ্ধিতকাম্যয়া। অকৃণ এবার বললেন–আর যদি তুমি মনে কর যুদ্ধে জয় করে ভীষ্মকে। একটা উচিত শিক্ষা দিতে হবে, তুমি যদি এতেই খুশি হও, তবে পরশুরাম তাই করবেন–রণে বিনির্জিতং দ্রং কুৰ্য্যাত্তদপি ভার্গবঃ।

এই মুহূর্তে কী কঠিন সংকটে পড়লেন এই রমণী। যার কাছে তিনি প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, তার চরিত্রাশঙ্কী সেই শারাজাকে বিয়ের জন্য জোর করলে, তিনি যদি চাপে পড়ে রাজিও হন, তো সে বিয়ে যে সুখের হবে না তো তিনি জানতেন। অপরদিকে ভীষ্ম! এক মুহূর্তের জন্য হলেও তো এই প্রৌঢ়-বৃদ্ধ মানুষটিকে দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। না হয় রাগের মাথায় দাদু হোত্ৰবাহনকে একবার বলেই ফেলেছিলেন যে, ভীষ্মকে তিনি শাস্তি দিতে চান। তাই বলে এত তাড়াতাড়ি সে ব্যবস্থা করতে হবে। অম্বার মনের গভীরে কী হচ্ছিল, কে জানে?

অকৃতব্রণ প্রশ্ন করলে তিনি অসত্য কথা বলতে পারলেন না। আবারও বলি–কেন, কে জানে? অম্বা বললেন–ভীষ্ম কিছুটি না জেনেই আমাকে অপহরণ করেছিলেন। আমি যে পূর্বাহ্নেই শাল্বরাজের প্রতি অনুরক্ত ছিলাম, তাকে যে আমি আগে থেকেই মন দিয়েছি–সে কথাও তো তিনি কিছু জানতেন না–ন হি জানাতি ভীষ্মে মে ব্ৰহ্মন্ শাগতং মনঃ। অম্বা নিজের কোনও সিদ্ধান্ত জানাতে পারলেন না, যেমনটি পাঞ্চাল হোত্ৰবাহন জানিয়েছিলেন অকৃতব্রণকে। অম্বা বললেন–আপনারাই বিচার করে স্থির করুন–কার শাস্তি পাওয়া উচিত? কৌরবশ্রেষ্ঠ ভীষ্মই অন্যায় করেছেন, নাকি শাল্বরাজ, নাকি দুজনেই–তা আপনারাই বলুন। আমি আমার দুঃখ-কষ্ট যেমনটি ঘটেছে, তেমনটি নিবেদন করেছি। এখন শা এবং ভীষ্ম–এই দুজনের মধ্যে সত্যিই কার শাস্তি পাওয়া উচিত–তা আপনারাই সবচেয়ে সযৌক্তিকভাবে ঠিক করতে পারেন–ভীষ্মে বা কুরুশার্দুলে শারাজে’থবা পুনঃ।

অম্বা আগে যতই রাগ করুন ভীষ্মের ওপরে, ঠিক ঠিক যখন তাকে মার খাওয়ানোর প্রশ্ন এল, তখন কিন্তু ভীয়ের দোষের কথা তিনি কিচ্ছুটি বললেন না। বরঞ্চ, তার ঘটনায় ভীষ্মের যে কোনও দোষই নেই, সেই কথাই তো তিনি শেষ মুহূর্তে ‘প্লিড’ করলেন, আর তার নাম বলার সময় একটা শ্রেষ্ঠত্বসূচক বিশেষণও লাগালেন–কুরুশ্রেষ্ঠ ভীষ্মভীষ্মে বা কুরুশাধূলে, যে বিশেষণ তার পূর্বপ্রিয়তম শাল্বরাজের ভাগ্যে জুটল না। অম্বার মনে সত্যি কী ছিল, তা মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে না বললেও আমরা যেন বুঝতে পারি। কিন্তু সমস্ত ঘটনা মিলিয়ে পরিস্থিতিটা এখন এমনই জটিল হয়ে গেছে যে, এখন আর তার হাতের মধ্যে কিছু নেই। তার মধ্যে ঘটনার কর্তৃত্ব এখন চলে গেছে সৃঞ্জয় হোত্ৰবাহনের হাতে। হোত্ৰবাহন তাকে বলেছেন–তুমি আমার কাছেই থাকবে এবং আমিই তোমার দুঃখ দূর করব-দুঃখং ছিলাম্যহং তে বৈ ময়ি বর্ত পুত্রিকে।

পরশুরামের শিষ্য অকৃতব্রণ অম্বার মুখে ভীষ্মের নির্দোষ আচরণের কথা এই মুহূর্তে শুনলেও তিনি পূর্বাহ্নেই হোত্ৰবাহনের কথায় প্রভাবিত হয়েই রয়েছেন। হোত্ৰবাহন তাকে বলেছিলেন–আমার এই নাতনিটি এখন নিজের দুঃখের জন্য ভীষ্মকেই দায়ী করছে। কিন্তু অম্বা যে অকৃতব্রণকে তা বলেননি। ভীষ্ম না শা, অথবা দুজনেই শাস্তি পাবার যোগ–এই বিচারের ভার যখন অকৃতব্রণের ওপর পড়ল, তখন তিনি কিন্তু মত দিলেন হোত্ৰবাহনের কথা অনুসারেই। তিনি যুক্তি দিয়ে বললেন-বৎসে! ন্যায় এবং ধর্মের প্রতি দৃষ্টি রেখে তুমি যা বলেছ, বেশ বলেছ–উপপন্নমিদং ভদ্রে। কিন্তু আমার কথা যদি শোন তবে আমি বলব–ভীষ্মই এখানে মূল দোষী। তিনি যদি তোমাকে হস্তিনায় নিয়ে না যেতেন,–যদি ত্বামাপগেয়ো বৈ ন নয়ে গজসাহয়–তাহলে পূর্ব রামের আদেশে শাল্বরাজ এখনই তোমাকে মাথায় করে নিয়ে যেতেন–শাশ্বত্ত্বাং শিবৗ ভীরু গৃহীয়াদ্রামচোদিত।

আমরা বলি–এই ‘যদি’র যুক্তিটা নিতান্তই ভুল। ভীষ্ম যদি অম্বাকে হস্তিনায় না নিয়ে যেতেন, তাহলে শাল্বরাজ এমনিই তাঁকে মাথায় নিয়ে নাচতেন, তার জন্য পরশুরামের আদেশের কোনও প্রয়োজন হত না। ভীষ্ম অম্বাকে রথে চড়িয়ে নিয়ে গেছেন সমস্ত রাজাদের পরাজিত করে, অতএব শাল্বরাজের সন্দেহ হয়েছে অম্বার ওপরেই-সংশয়ঃ শাহুরাজস্য তেন ইয়ি সুমধ্যমে।

কারণ যদি শুধু এইটুকুই হত তাহলেও বুঝতাম অকৃতব্রণর ন্যায়ের যুক্তিতে সরলতা আছে। কিন্তু এর পরে তিনি যা বললেন, সেটা শুধু অন্যায়ই নয়, তার পিছনে রীতিমতো উদ্দেশ্য খুঁজে বার করা যায়। অকৃতব্রণ বললেন–সবচেয়ে বড় কথা, ভীষ্ম নিজের পৌরুষ এবং বীরত্ব সম্বন্ধে বড় বেশি আত্মসচেতন এবং সে যে সমস্ত রাজাদের যুদ্ধে জয় করেছে–এই নিয়েও তার গর্ব আছে যথেষ্ট–ভীষ্ম পুরুষমানী চ জিতকাশী তথৈব চ।

এক সুন্দরী রমণীর বীরপূজার বিস্ময়কে ক্রোধে রূপান্তরিত করার জন্য এই যথেষ্ট। ভীষ্মের যুদ্ধ-নৈপুণ্য দেখে যে রমণী শাল্বরাজের ভাষায় প্রীতিমতী’ হয়েছিলেন, অকৃতব্রণর কথা শুনে সেই রমণীই এখন বোধহয় পুরনো কথা ভাবতে বসলেন। সত্যিই তো, ভীষ্ম ভীষণ অহংকারী মানুষ। স্বয়ম্বর-সভায় উপস্থিত সমস্ত রাজাকে তিনি যুদ্ধাহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন–আমি এই মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছি, ক্ষমতা থাকে তো আটকান। সত্যিই তো, এ যে ভীষণ অহংকারের কথা। তারপর শাল্বরাজকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে তিনি হস্তিনায় ফিরলেন। একবার ফিরেও তাকালেন না পরাজিত শত্রু সৌভপতি শান্তের দিকে, তার প্রিয়তম বীরের দিকে। আর শাল্বরাজও পষ্টাপষ্টি স্বীকার করেছেন যে, তিনি শুধু ভীষ্মের ভয়েই অম্বাকে ফিরিয়ে নিতে পারছেন না। সত্যিই তো এত ক্ষমতা, এত অহংকার এই লোকটার যে, শুধু একবার তাকে রথে তুলে নিয়েছিলেন বলে তাঁর প্রিয়তম ব্যক্তিটি পর্যন্ত তাকে অস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। অতএব এ দোষ তো তার নয়, দোষ ভীষ্মেরই। রাজর্ষি হোত্ৰবাহনের প্ররোচনায় এবং অকৃতব্রণের সমর্থনে অম্বা ভীষ্মকে তাঁর দুরবস্থার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী করার যুক্তি খুঁজে পেলেন।

অম্বা অকৃতব্রণকে বললেন–মনে মনে আমারও এইরকমই অভিলাষ-হৃদি কামোভিবর্ততে–ইচ্ছে হয়, ওই ভীষ্মটাকে যদি যুদ্ধে বধ করা যেত কোনওভাবে–ঘাতয়েয়ং যদি রণে ভীষ্মমত্যেব নিত্যদা! এইরকম সম্পূর্ণ নিশ্চিত সিদ্ধান্তের পরেও কিন্তু অম্বার মনে সংশয় থেকে গেছে। বারবার মনে হয়েছে লোটার সত্যিই তো দোষ নেই কোনও। তিনি তো কিচ্ছুটি জানতেন না। শাল্বরাজের কথা শোনামাত্র তাকে ছেড়ে দিয়েছেন। আর যুদ্ধজয়! তার শক্তি যে সকলের চাইতে বেশি, এও কি কোনও দোষ হতে পারে? অতএব অকৃতব্রণর প্ররোচনায় সম্পূর্ণ আপ্লুত হয়েও অম্বা কিন্তু শেষবারের মতো বললেন–আমি যে যে লোকের। জন্য এই সঙ্কটে পড়েছি, সে তিনি ভীষ্মই হোন অথবা শা–ভীষ্মং বা শারাজং বা–যাঁকে আপনি দোষী মনে করেন, এমনকি দুজনকেই যদি দোষী মনে করেন, তবে তাদের শাসন করার ব্যবস্থা করুন। অর্থাৎ নির্দোষ ভীষ্ম পড়ে পড়ে মার খাবেন, আর শাল্বরাজ তাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা সত্ত্বেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখবেন–সেটা অম্বার খুব একটা পছন্দ হল না। মার খাওয়াতে হলে তিনি দুজনকেই মার খাওয়াতে চান–ভীষ্মং বা শাল্বরাজং বা।

কিন্তু তিনি যা চান, তা হল না। কারণ সেই রাতটুকু কাটল, তারপর দিনটুকু কাটতেই স্বয়ং পরশুরাম এসে গেলেন শৈখাবত্যের আশ্রমে। আগুনের মতো পরশুরামের তেজ-প্রজুলম্নিব তেজসা। মাথায় মুনিসুলভ জটাভার, কাঁধে ধনুক। এক হাতে বঙ্গ, আরেক হাতে পরশু। দেখলে বেশ ভয় করে। পরশুরাম এসেই সঞ্জয় হোত্ৰবাহনের কাছে গেলেন। আশ্রমের সমস্ত মুনি, হোত্রবাহন স্বয়ং এবং অম্বা–সকলে মিলে সাদর অভিনন্দন জানালেন পরশুরামকে। হোত্ৰবাহনের সঙ্গে পরশুরামের অনেক কথা হল–অনেক পুরনো কথা, সুখ-দুঃখের কথা, পরিচিত পুরাতন দ্বৈত অভিজ্ঞতার কথা। সব কথার শেষে পরশুরাম এবং হোত্রবাহনের বন্ধুত্ব যখন নতুন সরসতায় ভরে উঠল তখনই হোত্ৰবাহন নিজের কথাটা আস্তে আস্তে পাড়লেন।

হোত্ৰবাহন অম্বাকে দেখিয়ে পরশুরামকে বললেন–এইটি আমার বড় আদরের নাতনি। কাশীরাজের মেয়ে গো। তা আমার এই নাতনিটির একটা আর্জি আছে তোমার কাছে। তুমি তার কথা শুনে যা হয় একটা ব্যবস্থা করো–অস্যাঃ শৃণু যথাতত্ত্বং কাৰ্যং কার্যবিশারদ। পরশুরাম শুনেই অম্বার দিকে তাকিয়ে বললেন–বলল, কী তোমার বক্তব্য? অম্বা প্রথমেই কিছু বললেন না। ভীষ্ম কিংবা শা-এই দুজনের ওপর তার যে গভীর ক্রোধ হয়েছে, তা বেরিয়ে এল ক্রন্দনের রূপ ধরে। তিনি তার পদ্মদলসস্নিভ হস্ত দুটি দিয়ে পরশুরামের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন–রুরোদ সা শোকবতী বাস্পব্যাকুললোচনা।

একে তো বন্ধু হোত্ৰবাহনের নাতনি, তাতে আবার তিনি কাঁদছেন। পরশুরাম বিনা দ্বিধায় কথা দিলেন–তুমি যেমন এই সৃঞ্জয় হোত্রবাহনের নাতনি তেমনই আমারও নাতনি। তুমি বলো–কী করতে হবে তোমার জন্য। যা বলবে তাই করব-ব্রহ যত্তে মনোদুঃখং করিয্যে বচনং তব। অম্বা বললেন–আমি আপনার শরণ নিয়েছি, আপনি যা ভাল মনে হয় করুন। স্নেহের নাতনিটির মতো হলেও অম্বার শরীরের দিকে এবার পরশুরামের নজর পড়ল। দেখলেন–অম্বা অতিশয় সুন্দরী এবং নবযৌবনবতী। এমন রূপ দেখে–তস্যা দৃষ্টা রূপঞ্চ বপুশ্চাভিনবং পুনঃপরশুরাম করুণায় বিগলিত হলেন। ভাবলেন–এই ভরা যৌবনে মেয়েটা কী দুঃখটাই বা না জানি পেয়েছে–রামঃ কৃপয়াভিপরিপ্লুতঃ। পরশুরাম অম্বার জীবনকাহিনী শুনতে চাইলেন তারই মুখে।

এক এক করে সেই স্বয়ম্বরসভা থেকে শাল্বরাজের প্রত্যাখ্যান পর্যন্ত একই কথা আবারও শোনালেন অম্বা। পরশুরাম সমস্ত ব্যাপারটা সহজ করে দিয়ে বললেন–আমি এক্ষুনি কুরুশ্রেষ্ঠ ভীষ্মের কাছে সংবাদ পাঠাচ্ছি। তিনি নিশ্চয় আমার কথা শুনবেন। আর যদি না শোনেন তো আমি নিশ্চয়ই যুদ্ধ করব ভীষ্মের সঙ্গে। আমার অস্ত্রের তেজে তাকে দন্ধ করে ছাড়ব। ভীষ্মের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে পরশুরাম শাল্বরাজের প্রসঙ্গটাও টেনে আনলেন। বললেন-তোমার। যদি ভীষ্মের ব্যাপারে এই প্রতিশোধস্পৃহা না থাকে, তবে শাশ্বরাজার কথাটাও জানাও। আমি তাকেও তোমার ইচ্ছামতে বাধ্য করতে পারি–যাবচ্ছাপতিং বীরং যোজয়াম্যত্র কর্মণি। অম্বা সত্যি কথাই বললেন আবার। বললেন–শারাজার প্রতি আমার অনুরক্তি জেনেই ভীষ্ম ছেড়ে দিয়েছেন আমাকে। কিন্তু শাল্বকে আমি এমনভাবেই অনুরোধ করেছিলাম, যে অনুরোধ আমার ঘরানার কোনও মেয়ের করার কথা নয়। কিন্তু তিনি আমার চরিত্রের ব্যাপারে আশঙ্কা করেছেন এবং সে আশঙ্কার কারণ ভীষ্ম। তিনি আমাকে জোর করে রথে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং আমি যেন কেমন বশীভূত হয়ে পড়েছিলাম–যেনাহং বশমানীতা সমুৎক্ষিপ বলাত্তদা–তিনি জোর করেই আমাকে নিজের করায়ত্ত করেছিলেন।

‘বশীভূত’ হবার কোনও কারণ বলেননি অম্বা। কেমন করে অথবা কী রকম এই বশীকরণ, তাও তিনি ভাল করে বলেননি। আমরাও তা ভাল করে বুঝি না বলেই অনুমানের জায়গাটা আরও প্রশস্ত হয়ে যায়। ভীষ্ম জোর করে নিজের অধিকারে স্থাপন করেন অম্বাকে–যেনাহং বশমানীত–বশীকরণ শব্দের অর্থ যদি এই দাঁড়ায়, তবে সে অম্বারই ইচ্ছাকৃত-রথে ওঠবার সময়েও তাই, এখনও তাই। পাঞ্চাল হোত্রবাহন, অকৃতব্রণ–সবার যুক্তি মেনে এই মুহূর্তে পরশুরামের সামনে নিজের দুর্ভাগের জন্য ভীষ্মকেই যে শেষ পর্যন্ত এককভাবে দায়ী করলেন অম্বা, তার পিছনে আছে প্রখর বাস্তব। পরশুরামের কাছে অম্বা বললেন–আপনি ভীষ্মকেই মারুন, তিনি আমার সমস্ত দুঃখের মূলভীষ্মং জহি মহাবাহো যকৃতে দুঃখমীদৃশ।

এতক্ষণ কিন্তু ভীষ্মের দোষ দেখতে পাননি অশ্ব। সেই নির্দোষ মানুষটিই এখন তার চোখে সম্পূর্ণ দোষী সাব্যস্ত হলেন। ঘটনাটা নিতান্তই অদ্ভুত। মনে রাখতে হবে–সমস্ত ঘটনার রাশ এখন পরশুরামের হাতে চলে গেছে। তার মতো অস্ত্রযোদ্ধা ভূমণ্ডলে দ্বিতীয় কেউ নেই। অম্বা বুঝলেন–এখন তিনি যার কথা বলবেন তার মৃত্যু অবধারিত। এতক্ষণ তিনি যেভাবে কথা বলেছেন, তাতে ভীষ্মকে কখনই তিনি দোষী সাব্যস্ত করেননি। শাল্বরাজের ওপরেই তার রাগ ছিল বেশি। কিন্তু হোত্ৰবাহন, অকৃতব্রণ–এঁদের প্ররোচনায় অস্থার মত খানিকটা বদলেছে, আর সেই সঙ্গে আছে প্রখর বাস্তব। পরশুরামের হাতে পড়লে যত বড় যুদ্ধবাজই হোন, তিনি মারা যাবেন। অম্বা শাল্বরাজকে ভালবেসেছিলেন। তার শেষের ব্যবহার অম্বার কাছে ভীষণ অপ্রিয় হলেও তিনি পুরাতন প্রেমিককে মেরে ফেলার ইচ্ছে প্রকাশ করতে পারেন না। সেটা ভাল লাগে না, ভাল দেখায়ও না। সৃঞ্জয় হোত্ৰবাহন কিংবা অকৃতব্রণ-এই দুজনেই অম্বার পুরাতন প্রেমের কথা ভেবেই ভীষ্মকে দায়ী করেছেন। অম্বাও শেষ পর্যন্ত তাই করলেন। পরশুরামকে তিনি শেষ সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন–আপনি আমার দুঃখ দূর করুন, ভগব। মারুন ওই ভীষ্মকে–ত ভীষ্মপ্রসূতং মে তং জহীশ্বর মা চিরম্।

কাশীরাজকন্যার প্রস্তাবটা তার নিজের মুখে এতক্ষণ শোনেননি পরশুরাম। কিন্তু শোনার পর তার একটু দোনামোনাই হল যেন। দেবব্রত ভীষ্ম পরশুরামের পরম প্রিয় অস্ত্রশিষ্য। তার সঙ্গে যুদ্ধ করা বা তাকে বধ করা–কোনওটাই পরশুরামের পরম ঈঙ্গিত ছিল না। পরশুরাম সেইভাবেই একটা ইঙ্গিতও দিলেন। বললেন–রাজকন্যে! আরও একবার ভেবে বলো। ভীষ্ম তোমার পূজনীয় হলেও আমি যদি একবার তাকে বলি, তবে তিনি তোমার পা দুটো মাথায় বয়ে নিয়ে যাবেন-শিরসা বন্দনাৰ্হোপি গ্রহীষ্যতি গিরা মম।

অম্বা মানলেন না। রমণীর প্রতিহত প্রেম এখন ধ্বংসের রূপ ধারণ করেছে। তিনি বললেন–আপনি যদি আমার তুষ্টির কথা চিন্তা করেন, তবে ভীষ্মকে মেরে ফেলতেই হবে–জহি ভীষ্মং রণে রাম মম চেদিচ্ছসি প্রিয়তাছাড়া আপনি না আমাকে কথা দিয়েছিলেন। অতএব এই হচ্ছে সেই সময়। আপনি আপনার প্রতিজ্ঞা পালন করুন। অম্বার কথা শুনে পরশুরামের সহচর অকৃতব্রণ বললেন–মেয়েটা আপনার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে আছে, মুনিবর! ওকে আপনার ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়-কন্যাং ন ত্যমহসি। আপনি ভীষ্মকে মারুন তো। আর তা না হলে, হয় সে আপনার কথা মেনে নিক, নয় তো সে এসে বলুক যে, সে আগেই পরাজয় স্বীকার করে নিচ্ছে আপনার কাছে নির্জিতা’শ্মীতি বা ব্রুয়াৎ কুৰ্য্যাদ বা বচনং তব।

অকৃতব্রণ পরশুরামকে নানা কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভীষ্মের সঙ্গে পরশুরামের যুদ্ধের সম্ভাবনাটাই চেতিয়ে তুললেন। কিন্তু ব্যাপারটা এঁরা যত সহজ ভাবছেন, তত সহজ যে নয়, সেটা পরশুরাম ভাল করেই জানেন। নিজে প্রখ্যাত অস্ত্রবিদ বলেই ভীষ্মের সঙ্গে লড়াইটা কী রকম হবে, সেটা পরশুরাম ভাল করেই জানেন। সেই কারণেই অকৃতন্ত্রণের চেতিয়ে ভোলা ভাষায় উদৃপ্ত হয়ে পরশুরাম একটা প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করে বললেন-কথা না শুনলে আমি ভীষ্মকে মৃত্যুদণ্ড দেব ঠিকই কিন্তু তবু আমায় দেখতে হবে যাতে ভাল কথায় কাজ হয়–তথৈব চ করিষ্যামি যথা সামৈব ল্যতে। অর্থাৎ ভাল কথায় কাজ করাটাই পরশুরামের প্রথম ইচ্ছে।

শৈখাবত্যের আশ্রমে থাকা ব্রহ্মর্ষি মুনিদের নিয়ে এবং স্বয়ং অম্বাকে নিয়ে পরশুরাম কুরুক্ষেত্রে এসে উপস্থিত হলেন–কুরুক্ষেত্ৰং মহারাজ কন্যয়া সহ ভারত। পরশুরাম প্রথমে ভীষ্মের কাছে একটি দূত পাঠালেন। খবর দিলেন-আমি এসেছি–প্রাপ্তোস্মি। খবর শুনে। ভীষ্ম হস্তিনাপুরের ব্রাহ্মণ-পুরোহিত এবং একটি দুধেল গাই নিয়ে পরশুরামের সামনে উপস্থিত হলেন। ভীষ্ম প্রণাম করে দাঁড়াতেই পরশুরাম বললেন–ভীষ্ম! এ তোমার কেমন ব্যবহার? তুমি নিজে যখন বিয়ে করবে না, তখন কেনই বা এই মেয়েটিকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলে, আর কেনই বা তাকে ত্যাগ করলে? তুমি জান–তুমি কী করেছ? মেয়েটার কোনও দুর্নাম ছিল না, অথচ তুমি তার সর্বনাশ, ধর্মনাশ–সবই করেছ–বিভ্রংশিতা ত্বয়া হীয়ং ধর্মাদাস্তে যশস্বিনী। তুমি একে স্পর্শ করেছিলে বলে এখন শারাজা একে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

পরশুরাম একেবারে ঠিক ‘পয়েন্টে’ আঘাত করেছেন। ভীষ্মের দিক থেকে ওই একটাই ছেলেমানুষি হয়েছে। তিনি নিজে বিয়ে করবেন না, অথচ কন্যা হরণ করেছেন। পরশুরাম তাই সেই যুক্তিতেই তাকে বললেন-তুমি এক্ষুনি আমার আদেশে এই কন্যাকে গ্রহণ করো, যাতে এই রাজপুত্রী নারী-জীবনের সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে–তস্মাদিমাং মন্নিয়োগাৎ প্রতিগৃহ্নীষ ভারত। ভীষ্ম সরলভাবে বললেন–আমি এই রমণীকে আর আমার ভাইয়ের হাতে তুলে দিতে পারব না। ভীষ্ম নিজের যুক্তি দেখিয়ে বললেন–শারাজার কথা বলতেই আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি। এখন সব জেনেশুনে কীভাবে এক পরানুরক্তা রমণীকে আমাদের ঘরে নিয়ে তুলতে পারি?

পরশুরাম যুদ্ধের ভয় দেখালেন, হত্যার ভয় দেখালেন, কিন্তু ভীষ্ম নিজের যুক্তি থেকে একটুও সরলেন না। পরশুরামও নরমে-গরমে ভীষ্মকে বোঝনোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনও ফল হল না। আস্তে আস্তে গুরু-শিষ্যের যুদ্ধের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠল। পরশুরাম যুদ্ধের ভয় দেখালে ভীষ্ম একটু রেগেই গেলেন। বললেন–আপনাকে এতকাল আমি শুরু বলে মেনেছি, কিন্তু এখন আর আপনি আমার সঙ্গে গুরুর মতো ব্যবহার করছেন না, অতএব আপনার সঙ্গেই যুদ্ধ করব–গুরুবৃত্তিং ন জানীযে তস্মাদ যোৎস্যামি বৈ ত্বয়া।

পরশুরাম জন্মগতভাবে ব্রাহ্মণ অথচ তিনি ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি, যুদ্ধকার্য করেন। যুদ্ধ যে তাকে ব্রাহ্মণত্ব থেকে চ্যুত করেছে–এই কথাও বলতে দ্বিধা বোধ করলেন না ভীষ্ম। পরিশেষে বেশ একটু মেজাজ নিয়েই ভীষ্ম বললেন–আপনি বহু বছর ধরে যত্রতত্র বলে বেড়াচ্ছেন যে, আপনি সমস্ত ক্ষত্রিয়কে জয় করেছেন। আপনি মনে রাখবেন আপনার ওই ক্ষত্রিয়-নিধন কালে ভীষ্মের মতো ক্ষত্রিয় পুরুষ জন্মায়নি-ন তদা জাতবান ভীষ্মঃ ক্ষত্রিয়ো বাপি মদ্বিধঃ-ফলে ঘাসের ওপর যেমন আগুন জ্বলে, তেমনই তৃণোপম ক্ষত্রিয়দের ওপরে আপনি আপনার তেজ দেখিয়েছেন। কিন্তু আজকে আপনি বুঝবেন ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে যুদ্ধ কাকে বলে। আপনার সারা জীবনের যুদ্ধের অভিলাষ আমি আজকেই ঘুচিয়ে দেব-ব্যপনেষ্যামি তে দর্পং যুদ্ধে রাম ন সংশয়ঃ। আপনি কুরুক্ষেত্রের সমন্তপঞ্চকে গিয়ে দাঁড়ান। আমি সেখানেই আসছি–তত্ৰৈষ্যামি মহাবাহো যুদ্ধায় ত্বং তপোধন।

যুদ্ধের আগে আত্মশ্লাঘা করাটা যুদ্ধেরই অঙ্গ। এতে পরপক্ষের মানসিক চাপ বাড়ে। ভীষ্মও তাই করলেন। পরশুরামের সঙ্গে ভীষ্মের এই যুদ্ধ চলেছিল বহুদিন ধরে। মহাভারতে অন্তত আট অধ্যায় জুড়ে এই যুদ্ধের বিশদ বর্ণনা আছে। ভীষ্ম নিজমুখে এই যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছেন এবং বর্ণনা অত্যন্ত নিরপেক্ষ। সেখানে কখনও ভীষ্মের দেহ পরশুরামের অস্ত্রাঘাতে ক্ষতবিক্ষত, কখনও বা পরশুরাম ভীষ্মের মারণাস্ত্রে প্রায় ধরাশায়ী। শুভার্থী মানুষেরা শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধ বন্ধ করেছিলেন এবং দুজনকেই যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধটা শেষ হয়েছিল এমন একটা করুণ সুরে, যার অর্থ ছিল একটাই–পরশুরাম যুদ্ধে হেরে যাচ্ছেন।

সেকালের অত বড় বীর, পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন একুশবার, সেই পরশুরামও নিজের এলেম বোঝেন যথেষ্ট। যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হয়ে ভীষ্ম সবিনয়ে গুরু পরশুরামের চরণ বন্দনা করলেন। পরশুরাম আপন শিষ্যের মাহাত্মে পরম গর্বিত হয়ে বললেন–পৃথিবীতে তোমার মতো ক্ষত্রিয় বীর আর দ্বিতীয়টি নেই–বৎসমো নাস্তি লোকেস্মিন ক্ষত্রিয়ঃ পৃথিবীচরঃ। তুমি এখন ফিরে যেতে পার। আমি পরম সন্তুষ্ট হয়েছি। ভীষ্মকে একথা বলেই পরশুরাম অম্বাকে জানালেন–আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে যুদ্ধ করেও আমি কী করতে পেরেছি, তা সকলেই এখানে দেখেছেন–প্রত্যক্ষমত-লোকানাং–আমি ভীষ্মকে জয় করতে পারিনি। শক্তি বল, ক্ষমতা বল, আমার সামর্থ্য এইটুকুই। আমার আর কিছুই করার নেই, ভদ্রে। পরশুরাম সম্পূর্ণ স্বীকারোক্তি করে নিজের অক্ষমতা জ্ঞাপন করলেন এবং শেষ পরামর্শ হিসেবে অম্বাকে বললেন–আমার কথা যদি শোন, তবে তুমি ভীষ্মেরই শরণাপন্ন হও, তিনিই তোমার পরমা গতি–ভীষ্মমেব প্রপদ্যস্ব ন তে’ন্যা বিদ্যতে গতিঃ।

পরশুরাম যখন অম্বাকে এই কথাগুলি বলছিলেন, তখন ভীষ্ম তার সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন। পরশুরামের মতো বীর যখন যুদ্ধভূমিতে ভীষ্মকে কিছুই করতে পারলেন না এবং অম্বা তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন, তখন তার পক্ষে ভীষ্মের প্রশংসা করা ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর থাকে না। অতএব অম্বাও ভীষ্মকে দেব-দানবের অজেয় বলে আখ্যা দিলেন বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও বললেন যে, আমি কোনওভাবেই তাই বলে ভীষ্মের কাছে ফিরে যেতে পারি না–ন চাহমেনং যাস্যামি পুনভীষ্মং কথঞ্চন। আমি বরং সেই চেষ্টা করব যাতে আমি নিজেই তাকে বধ করতে পারি। কী আর বলব, রমণীর প্রতিহত প্রেমের সংজ্ঞাই বোধহয় অম্বা। শাল্বরাজের থেকেও ভীষ্মের ব্যাপারে তার মুগ্ধতা বেশি। এমন বিরাট এক চরিত্র তিনি পূর্বে কল্পনাও করতে পারেননি।

পরশুরাম যুদ্ধ শেষ করে নিজের জায়গা মহেন্দ্র-পর্বতে চলে গেলেন। অম্বা নিজের প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য গভীর বনে চলে গেলেন তপস্যায় আত্মনিয়োগ করবেন বলে। ভীষ্ম ব্রাহ্মণদের সুতিগীত আর জয়কার শুনতে শুনতে হস্তিনায় ফিরে এলেন। সমস্ত ঘটনা জানালেন জননী সত্যবতীকে। সত্যবতী ভীষ্মের যুদ্ধজয়ে পরম আনন্দ লাভ করলেন। সবই হল। সবই ভালয় ভালয় শেষ হল। কিন্তু সেই যে রমণীটি ভীষ্ম-বধের প্রতিজ্ঞা নিয়ে বনে চলে গেল, তার জন্য ভীষ্মের চিন্তা রয়ে গেল। হস্তিনাপুরের কতগুলি বিশ্ব গুপ্তচরকে তিনি সদা-সর্বদা নিযুক্ত করে রাখলেন সেই রমণীর গতিবিধি এবং মনোভাব প্রতিনিয়ত ভীষ্মের কাছে জানানোর জন্য পুরুষাংস্টাদিশং প্রাজ্ঞ কন্যাবৃত্তান্তকর্মণি। দিবসে দিবসে হ্যস্যা গতি-জলিত-চেষ্টিত। প্রত্যাহরংশ্চ মে যুক্তাঃ স্থিতা প্রিয়হিতে সদা।

.

৬২.

হস্তিনাপুরের রাজা কুমার বিচিত্রবীর্য ভালই রাজ্যশাসন করছিলেন। অবশ্য সে শাসনের মধ্যে তার নিজের অবদান সামান্যই ছিল। শাসন সংক্রান্ত সমস্ত সিদ্ধান্ত যেহেতু ভীষ্মই নিতেন, তাই বিচিত্রবীর্য খানিকটা অপরিপকই থেকে গিয়েছিলেন। এই অল্পবয়স্ক ভ্রাতাটির ওপরে ভীষ্মের স্নেহ-ভালবাসাও এতটাই গভীর ছিল যে, এত বড় একটি রাজ্যের বিভিন্ন বিপদ-আপদ–বিপর্যয়ে তিনি নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন, ভাইটির গায়ে কোনও ঝামেলার ছোঁয়াটিও লাগতে দিতেন না। নইলে দেখুন, বিবাহের মতো একটি বিষয়, যা সেকালের রাজাদের নিতান্তই ব্যক্তিগত পছন্দ এবং কন্যা নির্ধারণের ব্যাপার ছিল, সেখানেও কোনও যুদ্ধ বা কোনও অস্বস্তি হবে ভেবে ভীষ্ম তার ছোট ভাইটিকে এগোতে দেননি। তিনি নিজে যুদ্ধ-বিগ্রহ শেষ করে কাশীরাজের দুই মেয়ে অম্বিকা এবং অম্বালিকাকে তুলে দিলেন ভাইয়ের হাতে।

এর মধ্যে অম্বাকে নিয়ে যে সমস্ত সমস্যার সূচনা হল, তার মধ্যে একবারের তরেও কুমার বিচিত্রবীর্যের অনুপ্রবেশ ঘটেনি। ভীষ্মের অপার স্নেহ, মমতা আর আদর পেয়ে পেয়ে বিচিত্রবীর্যের এমনই পাওয়ার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে, সংসার এবং রাজনীতির বৃহত্তর ক্ষেত্রে তার যে কোনও কৃত্য আছে, কোনও কিছুতে তাকে যে আগ বাড়িয়ে এগিয়ে যেতে হবে–এসব তিনি বুঝতেই পারতেন না। আর এ ব্যাপারে পিতাপ্রতিম ভীষ্ম এবং জননী সত্যবতীর প্রশ্রয়ও কিছু কম নয়। পিতা শান্তনুর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত প্রথম পুত্র চিত্রাঙ্গদ মারা যাবার পর থেকে ভীষ্মও বুঝি যথেষ্ট আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

এই আতঙ্ক ছিল অনেকটাই এক পুত্রনিষ্ঠ আধুনিক পিতামাতার মতোই। এখনকার দিনে বহুত্র যেমন দেখতে পাই–পিতামাতা সন্তানের গায়ে সামান্য আঁচড়টি পর্যন্ত লাগতে দেন না, সংসারের যাবতীয় সাধারণ–অসাধারণ কর্মে নবযুবক পুত্রটিকেও যেমন করে পিতামাতা বাঁচিয়ে চলেন, ভীষ্মও সেইভাবেই একান্তভাবেই বিচিত্রবীর্যকে লালন করেছেন। নইলে, যে স্বয়ম্বর সভায় একান্তভাবেই বিচিত্রবীর্যের গমন প্রার্থনীয় ছিল, যেখানে হস্তিনাপুরের নবযৌবনোদ্ধত রাজা আপন শক্তির প্রথম পরিমাপটুকু করতে পারতেন। সেখানে ভীষ্ম নিজে গিয়ে নিজের বিপদ যেমন ঘটালেন, তেমনই কুমার বিচিত্রবীর্যকেও কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ না দিয়ে অন্য এক ধরনের বিপত্তি ঘটালেন বলে আমরা মনে করি।

এখনকার দিনের সংসারে একেকটি স্নেহাস্পদ পুত্রকে দেখলে যেমন মনে হয়–এ কিছুই করতে পারবে না, এ বড় নরম, বড় লাজুক’, সংসারের সবচেয়ে ভাল জিনিসটি শুধু এরই প্রাপ্য, হস্তিনাপুরের রাজা বিচিত্রবীর্যকে দেখলেও আমাদের সেইরকম মনে হয়। মহাভারতের কবি একবার মাত্র হস্তিনাপুরের রাজবংশের মাহাত্ম্য খ্যাপন করে বলেছিলেন-বিচিত্রবীর্যের পিতা শান্তনু যেভাবে রাজ্য শাসন করতেন, কুমার বিচিত্রবীর্যের শাসন সেরকম তো ছিলই, বরং বলা উচিত, বিচিত্রবীর্য আপন গুণে পিতাকেও অতিক্রম করেছিলেন–অচিরেণৈব। কালেন সো’ত্যক্রামরাধিপঃ।

মহাকাব্যের কবির কাছে বিচিত্রবীর্যের এই খ্যাতি ‘রুটিন’ মাত্র। আমরা জানি–মহাকাব্যের কবির এই অতিবাদ মহাকাব্যের পরিমণ্ডলে নিতান্তই বর্ণনা। কারণ একটি শ্লোকেই বিচিত্রবীর্যের স্বতিরচনা সেরে কবি কিন্তু ভীষ্মের প্রসঙ্গে চলে গেছেন। বাস্তব ক্ষেত্রে পিতা শান্তনুকে গুণে যদি কেউ অতিক্রম করে থাকেন, তিনি গাঙ্গেয় ভীষ্ম শান্তনুর ক্ষেত্রেও রাজ্য শাসনের বা রাজধর্মের যত না গুণ ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল সাংসারিক ভোগ-লালসা। একে কামুকতা বলার সমস্যা আছে, কারণ মাতৃসম্বন্ধে শান্তনু মহাভারতের কবির পিতা। কিন্তু পিতার কামুকতা পুত্রের মধ্যে কীভাবে সঞ্চারিত হয়েছিল মহাভারতের কবি পিতার কামুকতার কথা স্পষ্টত না বললেও-ওই একটিমাত্র শ্লোকে বিচিত্রবীর্যের স্তুতি রচনা সাঙ্গ করার পর কবি বেশ খানিকক্ষণ শুধু ভীষ্মের অনন্ত কর্মরাশি বর্ণনা করে গেলেন; আর তার পরেই বিচিত্রবীর্য অম্বিকা আর অম্বালিকার পাণিগ্রহণ করা মাত্রই–তয়োঃ পাণী গৃহীত্ব তু–ভয়ঙ্করভাবে কামাসক্ত হয়ে পড়লেন-কামাত্মা সমপদ্যত।

মহাভারতের বর্ণনানিপুণ কবি বিচিত্রবীর্যের অনন্ত কামনার প্রতিপদ-বৰ্ণনার মধ্যে যাননি। পরিবর্তে তিনি অম্বিকা এবং অম্বালিকার রূপ-বর্ণনা করে দিয়েছেন একটি মাত্র শ্লোকে। বুঝিয়ে দিয়েছেন–কামনার এতাদৃশ আধার পাবার ফলেই বিচিত্রবীর্য সব কিছু বাদ দিয়ে শুধু তাঁর দুটি স্ত্রী নিয়েই দিন-রাত যাপন করতে লাগলেন। অম্বিকা এবং অম্বালিকার অপূর্ব রূপের মধ্যে কুঞ্চিত কেশ, রক্ত-তুজ-নখ অখবা পীনশ্রোণীপয়োধরের সৌন্দর্য আমাদের কাছে খুব বড় কথা নয়। আমাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কথা হল–এরা দুই বোনই–অম্বিকা এবং অম্বালিকা–দুজনেই কালো ছিলেন–তে চাপি বৃহতীশ্যামে নীলকুঞ্চিতমূর্ধজে।

লক্ষ্য করে দেখবেন–শান্তনু-পত্নী সত্যবতীর গায়ের রঙও কালো ছিল; এতটাই কালো ছিল যে তার ডাক নামও ছিল কালী। তার উত্তর-বংশে যে দুটি মেয়ে কাশী রাজ্য থেকে এলেন, তাদের গায়ের রঙও কালো। কিন্তু এই কালো রঙের সঙ্গে অম্বিকা এবং অম্বালিকার স্তন-জঘনের সৌন্দর্য কুমার বিচিত্রবীর্যকে পাগল করে তুলল। সুরূপা এবং যৌবনবতী কৃষ্ণা রমণীদের ক্ষমতা এবং স্বভাবই বুঝি এইরকম। শেকস্পীয়রের ব্ল্যাক লেডি’র কথাই বা এখানে অনুল্লিখিত থাকে কেন? যাই হোক বিচিত্রবীর্য নিজেও দেখতে ভাল ছিলেন এবং আপন সৌন্দর্য সম্বন্ধে তার সচেতনতাও ছিল–রূপযৌবনগর্বিতঃ। অন্যদিকে অম্বিকা এবং অম্বালিকাও এমন সুন্দর স্বামী লাভ করে স্বামীর সমস্ত কামনা পূরণ করতে লাগলেন তার চাহিদা মতো।

এই চাহিদা সামান্য ছিল না। আগেই বলেছি–রাজপরিবারের সমস্ত সারভাগ পেতে পেতে বিচিত্রবীর্যের এমনই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, যে দুটি রমণীরত্ন লাভ করামাত্রই তিনি উপলব্ধি করলেন–যেন যথাসাধ্য কাম উপভোগ করার জন্যই তাঁর জন্ম এবং জীবন। রাজকার্য নেই, প্রজাপালন নেই, ধর্মাধর্ম নেই, সময়-অসময় নেই, বিচিত্রবীর্য স্ত্রীসম্ভোগ করে যাচ্ছেন। সাত সাতটি বছর এই ক্রমান্বয়ী ভোগেই কাটিয়ে দিলেন বিচিত্রবীর্য-তাভ্যাং সহ সমাঃ সপ্ত বিহর পৃথিবীপতিঃ।

এই সম্ভোগের ফল খুব একটা ভাল হল না। বাড়িতে যদি আশি-নব্বই বছরের বৃদ্ধ সক্ষম অবস্থায় থাকেন, তবে তাদের জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে-এই অতিরিক্ত স্ত্রীসম্ভোগের ফল কী? আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও বিবাহিত দম্পতির একতর পুরুষ মানুষটির যদি টিবি হত, তাহলে বয়স্ক জনেরা মনে মনে সন্দেহ করতেন যে, ওই রোগ অতিরিক্ত স্ত্রী-সম্ভোগের ফল।

আজকের দিনের ডাক্তাররা পুরুষের অতিরিক্ত ধাতুক্ষয়কে কোনও বৃহৎ উপসর্গ মনে করেন না, কিন্তু সেকালের কবিরাজ এবং বৈদ্যজনেরা অতিরিক্ত ধাতুক্ষয়কে যক্ষ্মারোগের অন্যতম কারণ বলে মনে করতেন। আমাদের ধারণ<সেকালের দিনের বয়স্কজন এবং কবিরাজ গোষ্ঠীর এই সিদ্ধান্ত প্রধানত বিচিত্রবীর্যের উদাহরণ থেকেই প্রণোদিত হয়েছিল কি না কে জানে।

অবশ্য কেউ মনে করুন আর নাই করুন, মহাভারতের কবির ধারণা–সাত বছর ধরে অতিরিক্ত স্ত্রীসম্ভোগ করার ফলে বিচিত্রবীর্যের তরুণ বয়সেই যক্ষ্মা ধরে গেল বিচিত্রবীর্যস্তরুণো যক্ষ্মণা সমপদ্যত। আমদের পূর্বকালের বৃদ্ধরাও যে অতিরিক্ত স্ত্রীসম্ভোগকেই যক্ষ্মারোগের অন্যতম কারণ মনে করতেন, তার ছায়া পাওয়া যাবে হরিদাসের টীকায়। তিনি বলেছেন–বিচিত্রবীর্যের যক্ষ্মা হল। কেন? কারণ অতিরিক্ত শুক্রক্ষয়–শুক্রক্ষয়নিবন্ধনেন যক্ষ্মারোগেণ। আমরা পূর্বে আরও একবার এই যক্ষ্মারোগের কথা বলেছি–চন্দ্রবংশের মূল পুরুষ চন্দ্রের যক্ষ্মারোগ হওয়ার প্রসঙ্গে।

 যাই হোক বিচিত্রবীর্য যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হলেন আর হস্তিনাপুরের যত বৈদ্য-চিকিৎসক, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সকলে তার রোগ উপশমের জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন। কিছুতেই কিছু হল না অবশ্য। সূর্য যখন অস্তে যায়, যখন যেমন শত চেষ্টা করলেও তাকে ধরে রাখা যায় না, বিচিত্রবীর্যও তেমনই বৈদ্য-চিকিৎসকদের সমস্ত চেষ্টা বিফল করে দিয়ে মারা গেলেন–জগামাস্তম্ ইবাদিত্যঃ কৌরবব্যা যমস্যাদন।

বিচিত্রবীর্য মারা গেলেন। কিন্তু মারা যাবার আগের সেই সাতটি বছর, যখন তিনি স্ত্রীসম্ভোগে মত্ত ছিলেন, তখন মহামতি ভীষ্মের কী দশা গেছে? প্রথমে তো সেই অম্বার তাড়নায় পরশুরামের সঙ্গে যুদ্ধ হল। সেই যুদ্ধের আগে পরে এবং যুদ্ধের সময়টুকু ধরে ভীষ্ম যে ঘরে বাইরে কোথাও স্বস্তি পাননি, সে কথা বলাই বাহুল্য। মহাভারতের মধ্যে যাঁরা ভার্গব। প্রক্ষেপের কথা বলেন, তাঁদের মতে পরশুরামের সঙ্গে ভীষ্মের যুদ্ধটা অন্য দিক দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। মহাভারতের এই অংশ তাদের মতে অবশ্যই প্রক্ষিপ্ত এবং এখানে যেহেতু ভৃগুবংশীয় ভার্গব পরশুরামের সঙ্গে ভীষ্মের যুদ্ধ শেষ হয়েছে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মিলনের তাৎপর্য নিয়ে, তাই মহাভারতের এই অংশে ভাগবদের গুরুত্ব একভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েইছে। মহামতি ভীষ্ম যুদ্ধ করার পরে ভার্গব পরশুরামের চরণ বন্দনা করে এই গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে। দিয়েছেন।

তর্কের খাতিরে এখানে প্রক্ষেপের আলোচনা বাদ দিয়ে যদি মহাভারতে যা আছে তাই সত্য বলে ধরে নিই, তাহলে পরশুরামের সঙ্গে যুদ্ধকালীন সময়টুকু ভীষ্মের দিক থেকে খুব আরাম এবং রক্তচাপহীন অবস্থায় যে কাটেনি, তা অনুমান করা যেতে পারে। মনে রাখা দরকার, পরশুরাম ক্ষত্রিয়-শাস্তা এক বীর হিসেবে প্রতীকীভাবেই সর্বত্র ব্যবহৃত হয়েছেন। নইলে রামচন্দ্রের আমলে যে পরশুরাম বেঁচে ছিলেন, সেই পরশুরাম এখনও বেঁচে আছেন, এমন অলৌকিক ভাবনার কোনও লৌকিক ভিত্তি নেই। বরং লৌকিকতার তাৎপর্যে পরশুরামকে একটা ইনস্টিটিউশন হিসেবেই ধরা উচিত। বংশ-পরম্পরাতেই হোক অথবা শিষ্য পরস্পরাতেই হোক, ভার্গব পরশুরামেরা ক্ষত্রিয় বীরদের বিরুদ্ধ-ভূমিতে থাকতেন শাস্তা হিসেবে। অম্বা এমনই কোনও এক পরশুরামের শরণাপন্ন হয়েছিলেন ভীষ্মকে শাস্তি দেবার জন্য। ভীষ্মের শাস্তি হয়নি বটে, কিন্তু তাঁকে যুদ্ধের কষ্ট অবশ্যই ভোগ করতে হয়েছে। শেষে পরশুরাম ভীষ্মের ওপর প্রসন্ন হয়ে চলে গেছেন।

এই অবস্থায় অম্বা নিজের ভার নিজে নিয়েছেন। তিনি বনে গেছেন তপস্যা করতে। ভীষ্ম এতে মোটেই স্বস্তি পাননি। তাঁর ‘টেনশন’ বেড়েছে। একটি সুন্দরী রমণী তাকে প্রার্থনা করে এবং প্রত্যাখ্যাত হয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা করার জন্য তপস্যার সিদ্ধি চাইছে–এই বিপরীত পরিস্থিতি ভীষ্মকে মনে-প্রাণে আকুল করেছে। উদ্যোগ-পর্বে ভীষ্ম নিজ মুখে স্বীকার করেছেন যে–অম্বা যখন তপস্যা করার জন্য বনে গেলেন, সেদিন থেকেই আমি উদ্বিগ্ন, বিষণ্ণ এবং চৈতন্যহীনের মতো হয়ে গিয়েছিলাম– তদৈব ব্যথিতো দীনো গত চেতা ইবভব। এই উদ্বেগের মধ্যে ‘না বলা বাণী’ বা অলুব্ধ প্রেমের কোনও মোক্ষধাম রচিত হয়েছিল কি না, তা রসিক জনের অনুমেয়।

ভীষ্মের উদ্বেগ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তিনি শুধু তপস্বিনী অম্বার প্রাত্যহিক গতিবিধি জানার জন্য–দিবসে দিবসে হ্যস্যা গতি-জল্পিত-চেষ্টিত–বিশ্বস্ত পুরুষদের নিযুক্ত করেই ক্ষান্ত হননি, ভীষ্ম তার এই উদ্বেগের কথা দুটি লোককে জানিয়েছেন। একজন নারদ, অন্যজন মহাভারতের কবি স্বয়ং ব্যাস। নারদ সেকালের রাজনীতি সংক্রান্ত তাত্ত্বিক পুরুষদের অন্যতম, আর ব্যাস এক অর্থে তার আপন বৈমাত্রেয় ভাই এবং সর্বদশী ঋষি। অম্বা তপস্যা করছেন এই অবস্থায় ভীষ্মের করণীয় কী–এ সম্বন্ধেই তার প্রশ্ন ছিল ব্যাস এবং নারদের কাছে–ব্যাসে চৈব তথা কার্যং…নারদেপি নিবেদিত এই দুই ঋষিই অম্বার ব্যাপারে তাকে কোনও স্বস্তির নির্দেশ দিতে পারেননি। পুরুষকারের চেয়ে দৈবই যে এখানে বলবান হয়ে দাঁড়াবে–শুধু এই সান্ত্বনায় ভীষ্মকে স্থির থাকতে হয়েছে নারদের কথায়, ব্যাসের কথায়।

এই সান্ত্বনার পরেও অম্বার প্রাত্যহিক গতিবিধির ওপর নজর রাখা অবশ্য বন্ধ হয়নি। কবে, কোথায়, কী খেয়ে অম্বা তপস্যা করে যাচ্ছেন ভীষ্ম তার খবর রাখেন। এর মধ্যে কুমার। বিচিত্রবীর্যের দেহান্ত ঘটেছে, কিন্তু ভীষ্মর দিক থেকে অম্বার খবর নেওয়া বন্ধ হয়নি। অন্যদিকে অম্বার এই ঘোর তপস্যাকালও নানা বাধা-বিঘ্ন এবং জটিলতার মধ্যে দিয়ে কেটেছে। ব্রহ্মর্ষিরা তাকে তপস্যা বন্ধ করার জন্যও অনুরোধ করেছেন। এই অবস্থায় অম্বার একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য আমাদের কাছে ভীষণ প্রনিধানযোগ্য হয়ে পড়ে। অম্বা ঋষিদের বলেছেন–ভীষ্মের বধের জন্যই আমার যত উদ্যোগ, চেষ্টা। তাঁকে বধ করে তবেই আমার শান্তি হবে। অম্বা এর পরে বলেছেন–ভীষ্মের জন্যই আমি চিরকাল দুঃখিনী হয়ে রইলাম, তার জন্যই আমার সারাজীবন স্বামী সুখ জুটল না কপালে, তার জন্যই আমি যেন কেমন হয়ে গেলাম–আমি যেন স্ত্রীও নই, পুরুষও নই–পতিলোকান্ বিহীনা চ নৈব স্ত্রী ন পুমানিহ। অতএব গাঙ্গেয় ভীষ্মকে শেষ না করে আমি ছাড়ব না।

মহাভারতের এক জটিল আখ্যায়িকা বোঝবার জন্য অম্বার এই মন্তব্যটি আমাদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমি যেন স্ত্রীও নই এবং পুরুষও নই–নৈব স্ত্রী ন পুমানিহ-ভীষ্মের কারণে অম্বার এই পরিণতি আমাদের কাছে নতুন এক তথ্য সরবরাহ করে। আপনারা মানবেন–অন্তত এই পর্যায়েও অস্থা শিখণ্ডীতে রূপান্তরিত হননি। অম্বা শুধু নিজের করুণ অবস্থা বর্ণনা করেছেন মাত্র। ভীষ্ম একদিন তাকে তুলে নিয়ে এসেছিলেন বলে তার জীবনে যে বিপর্যয় এসেছে, তার ফলেই অম্বার এহেন অবস্থা–আমি যেন স্ত্রীও নই পুরুষও নই। অম্বা। স্ত্রী নন, কেননা, স্বামীসুখ তার কপালে জুটল না। আবার পুরুষও নন, কেননা একজন পুরুষ মানুষ স্বাধিকারে, ক্ষমতায়, বলে করতে পারে, অম্বা তা করতে পারছেন না। অম্বার নপুংসকত্ব এখানেই।

স্বামী-সুখ, সংসার-সুখ যে নারীর অপ্রাপ্ত রয়ে গেল, সে নারী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষের স্বাধিকারটুকু চাইবে–এইটাই স্বাভাবিক। অম্বা নিজ মুখে তাই বলেছেন। বলেছেন। –শুধুমাত্র পুরুষ মানুষ হওয়ার সুবিধে পেয়ে ভীষ্ম যেভাবে আমাকে অপমান করেছেন, তাতে নারী জন্মে আমার ঘেন্ন ধরে গেছে, আমি এখন পুরুষ হতে চাই–স্ত্রীভাবে পরিনির্বিন্না পুংস্বার্থে কৃতনিশ্চয়।

মহাভারতের উপাখ্যানে যা দেখা যাচ্ছে, তাতে অম্বা এরপর মহাদেবের কাছে পুরুষ হবার বর পেয়েছেন, ওদিকে অপুত্রক পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ ওই একই মহাদেবের কাছে পুত্রলাভের বর পেলেন এবং তিনিও নাকি ভীষ্মের ওপর শত্রুতার শোধ নেবার জন্যই এই বর চেয়েছিলেন ভগবন্ পুত্রমিচ্ছামি ভীষ্মং প্রতিচিকীর্ষয়া। ভীষ্মের ওপর পাঞ্চাল দ্রুপদের ক্ষোভ কেন হল, সে কথা পরে আসবে। আপাতত এইটুকু বলা যায় যে, দ্রুপদের পুত্রলাভেচ্ছা এবং অম্বার পুরুষত্বের ইচ্ছা, অপিচ উভয়ের ইচ্ছাপূরণের জন্য মহাদেবের বর–এইসব কিছু মিলে শিখণ্ডীর জন্ম প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হল। এবারে আমাদের ভাবনায় আসি।

প্রথম কথা হল–মহাদেব দ্রুপদকে বর দিয়ে দিলেন–তোমার প্রথমে একটি কন্যা হবে এবং সেই ভবিষ্যতে পুরুষ হবে-কন্যা ভূত্ব পুমা ভাবী। কিন্তু দ্রুপদ-পত্নী যখন সন্তান লাভ করেন, তখন তিনি একটি পরম রূপবতী কন্যাই লাভ করেছিলেন-কন্যাং পরমরূপাঞ্চ প্রাজায়ত নরাধিপ। লক্ষণীয় ব্যাপার হল–মহাদেবের বর দ্রুপদ কিংবা দ্রুপদ-মহিষীর মনে কতটা ক্রিয়া করেছিল, জানি না, কিন্তু মহাভারতের কবি বলেছেন–দ্রুপদের বুদ্ধিমতী মহিষীটি নিজের মেয়েটিকে পুত্র বলে প্রচার করেছিলেন–দ্রুপদস্য মনস্বিনী খ্যাপয়ামাস…পুত্রো হেনং মমেতি বৈ। অন্যদিকে দ্রুপদও তার কন্যাটির সমস্ত স্বরূপ চেপে গিয়ে পুত্রের প্রাপ্য স্মার্ট প্রক্রিয়াগুলি সম্পন্ন করালেন–প্রচ্ছন্নয়া মরাধিপ/পুত্রবৎ পুত্ৰকার্যাণি সর্বাণি সমকারয়ৎ। পুরুষের মতো তার একটা নামও রাখা হল–শিখণ্ডী।

আমাদের জিজ্ঞাসা, মহাদেবের বরের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে দ্রুপদমহিষীর বুদ্ধিমত্তা এবং দ্রুপদের এত চাপাচাপি-কোনওটারই প্রশ্ন আসে কি না সন্দেহরক্ষণঞ্চৈব মন্ত্রস্য। নগরের প্রত্যেকটি লোকের কাছে কন্যার স্বরূপ লুকিয়ে প্রচার করা হল-দ্রুপদ পুত্র লাভ করেছেন– ছায়ামাস তাং কন্যাং পুমানিতি চ সো’ব্রবীৎ। অন্যদিকে ভীষ্ম বলেছেন–আমি কিন্তু গুপ্তচরের বাক্য, নারদের সংবাদ এবং অম্বার তপস্যার কথা জেনে দ্রুপদের বাড়ির মেয়েটিকে মেয়ে বলেই জানতাম–অহমেকন্তু চারেণ বচনান্নারদস্য চ। জ্ঞাতবান…।

আমাদের দ্বিতীয় ভাবনা হল–দ্রুপদ রাজা তাঁর মেয়েটির লোকশিক্ষা, শিল্পশিক্ষার ব্যবস্থা শেষ করে ধনুর্বেদ শেখার জন্য দ্রোণাচার্যের কাছে পাঠিয়ে দেন-ইস্ত্রে চৈব রাজেন্দ্র দ্রোণশিয্যো বভূব হ।

তাহলে দেখুন, দ্রুপদ-দম্পতি একটি মেয়েকে ছেলে বলে প্রচার করেছিলেন এবং দ্রোণাচার্যও একটি ছেলে-সাজা মেয়েকে অস্ত্র শিক্ষা দিচ্ছিলেন। এমনকি মেয়েকে ছেলে বলে প্রচারের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে দ্রুপদ দশার্ণ-রাজার মেয়েকে নিয়ে এসে বিয়েও দিয়েছেন শিখণ্ডীর সঙ্গে। এই বিয়ের ঘটনার পর থেকেই শিখণ্ডীর কাহিনীতে যত গণ্ডগোলের শুরু। দশার্ণ রাজার মেয়ে শিখণ্ডীকে পুরুষ না ভেবে শিখণ্ডিনী বলেই চিনল–হিরণ্যবর্মণঃ কন্যা জ্ঞাত্ব তাং তু শিখণ্ডিনীম্। দশার্ণপতি হিরণ্যবর্মা দ্রুপদের বিরুদ্ধে প্রবঞ্চনার অভিযোগ আনলেন এবং ক্রুদ্ধ হয়ে তার রাজ্য আক্রমণ করবেন বলে ঠিক করলেন। দ্রুপদ রাজা বিপন্ন হয়ে আপন মহিষীকেও খানিকটা ভর্ৎসনা করলেন।

মহাভারতের কাহিনীতে দশর্ণরাজ হিরণ্যবর্মার আক্রমণ পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের ওপর নেমে আসবে এবং এই ভাবী আক্রমণের জন্য দ্রুপদ এবং তাঁর মহিষী দুঃখিত হয়ে আছেন–এই অবস্থায় শিখণ্ডিনী গৃহত্যাগ করে নিবিড় বনে উপস্থিত হলেন। বনের মধ্যে যক্ষ স্থূণাকর্ণের সঙ্গে শিখণ্ডিনীর দেখা হয়। চিন্তায় জর্জর, শুষ্ক-শীর্ণ শিখণ্ডিনীকে দেখে যক্ষ স্কুণাকর্শ করুণায় বিগলিত হয়। সে প্রস্তাব করে–আমি তোমাকে কিছুকালের জন্য আমার পুংচিহ্ন দান করব, পরিবর্তে তোমার স্ত্রীচিহ্নও আমি সাময়িকভাবে ধারণ করব–কিঞ্চিৎ কালান্তরং দাস্যে পুংলিঙ্গং স্বমিদং তব।

মহাভারতের কালে লিঙ্গ পরিবর্তন করে লিঙ্গ প্রতিস্থাপনের কোনও শৈলী জানা ছিল–ঠিক এই রকম একটা দাবি অথবা অতীতের মাহাত্ম্য-খ্যাপন শুধুমাত্র মহাকাব্যের ভিত্তিতে করা উচিত হবে না হয়তো। আমাদের মতে মহাদেবের বর থেকে আরম্ভ করে দশার্ণ রাজার মেয়ের সঙ্গে শিখণ্ডিনীর বিবাহ এবং যক্ষ স্কুণাকর্ণের সঙ্গে লিঙ্গ-বিনিময় করে শিখণ্ডীর পুরুষ হয়ে যাওয়ার মধ্যে যে অলৌকিকতা আছে, সেই অলৌকিকতা ছাড়াও লৌকিক এবং রাজনৈতিকভাবেই শিখণ্ডীর নিজস্ব সত্তা ব্যাখ্যা করা যায়।

আমরা আগে বলেছি–অম্বার সেই কথাটি বড়ই গুরুত্বপূর্ণ যেখানে তিনি বলেছেন–আমি যেন কেমন হয়ে গেছি। আমি যেন স্ত্রীও নই, পুরুষও নই–ন স্ত্রী ন পুমান্ ইহ। বস্তুত এই ভাবটুকুর মধ্যেই অম্বা কিংবা শিখণ্ডীর নপুংসকত্ব লুকিয়ে আছে। দ্বিতীয়ত মনে রাখা দরকার–পাঞ্চাল হোত্রবাহন, যাকে আমরা অম্বার মাতামহের পরিচয়ে দেখেছি, তিনি এক সময় অম্বাকে কথা দিয়ে বলেছিলেন-তোমার কোনও চিন্তা নেই, তুমি আমার কাছেই থাকবে, আমি তোমার দুঃখ দূর করব-দুঃখং ছিলাম্যহং তে বৈ ময়ি বর্তস্ব পুত্রিকে। আমাদের ধারণা-পরশুরামের যুদ্ধ বিফল হয়ে যাবার পর সৃঞ্জয় হোত্ৰবাহন তাকে পাঞ্চালে নিয়ে গেছেন এবং তাকে পাঞ্চাল দ্রুপদের হাতে তুলে দিয়েছেন। কারণ হোত্ৰবাহন নিজে পাঞ্চলের লোক এবং যে সৃঞ্জয় বংশে দ্রুপদের জন্ম সেই সৃঞ্জয়ের বংশে অম্বার মাতামহ হোত্রবাহনেরও জন্ম।

যদি বলেন তাহলে অম্বার এত তপস্যা ভী-বধের বর লাভ সবই কি মিথ্যা? আমরা এগুলিকে মিথ্যা বলছি না, তবে তর্কের বুদ্ধিতে জানাই অম্বার পুরুষত্ব লাভের ইচ্ছা অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। আসলে অম্বার পুরুষত্বের পর্যবসান পুংলিঙ্গলাভে নয়, পুরুষের যোগ্য বিদ্যা লাভে। যে রমণী ‘পুরুষের বিদ্যা করেছিনু শিক্ষা’র গান করে পরবর্তী সময়ে অর্জুনের মন ভোলাবেন, সেই চিত্রাঙ্গদার উদাহরণে যথেষ্টই ধারণা করা যেতে পারে-অম্বার তপস্যা পুরুষ-সুলভ অসুশিক্ষা ছাড়া আর কিছুই নয়।

কোনও সন্দেহ নেই–অপুত্রক দ্রুপদ যখন অশ্বকে লাভ করলেন তখন তিনি তার অস্ত্রশিক্ষার তপস্যা সুচরিতার্থ করবার জন্য তাকে পুরুষ বলেই প্রচার করেছেন। মহাভারতের বচনে জেনেছি–অম্বা তপস্যার অন্তে মহাদেবের বর লাভ করে নিজে আগুন জ্বেলে তাতে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। তারপর নাকি তিনি দ্রুপদের ছেলে হয়ে জন্মান। আমাদের বিশ্বসে–এই আত্মাহুতি অম্বার স্ত্রী স্বভাবের অন্ত সূচনা করে। এরপর থেকেই তিনি পুরুষ-সুলভ আচরণ করতে থাকেন এবং পূর্বকথিত হোত্ৰবাহনের চেষ্টায় পাঞ্চালে দ্রুপদের কাছে পুরুষের মতোই মানুষ হতে থাকেন। ভীষ্মও আপ্তপুরুষের মাধ্যমে খবর পেয়েছেন শিখণ্ডী আসলে কন্যা। মাঝখানে দশার্ণ রাজার কাহিনী এবং স্কুণাকর্ণের সঙ্গে শিখণ্ডিনী অম্বার লিঙ্গ-বিনিময়ের প্রস্তাব মহাকাব্যের এক চরিত্রের বৈচিত্র্য বাড়িয়েছে মাত্র।

আরও একটা কথা–দ্রুপদ যখন শিখণ্ডীকে লাভ করেন, তখন দ্রোণাচার্যের সঙ্গে তার রাজ্যভাগ নিয়ে গণ্ডগোল সম্পূর্ণ মেটেনি। কিন্তু দ্ৰোণাচার্য যে দ্রুপদের ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্যই কুরুরাজ্যে গিয়ে পৌঁছেছেন, সে কথা তিনি অবশ্যই জানতেন। পাণ্ডব-কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষা দিয়ে দ্রোণাচার্য অর্জুনের মাধ্যমে দ্রুপদকে উচিত শিক্ষা দেন। প্রতিশোধ-স্পৃহায় দ্রুপদ ধৃষ্টদ্যুম্নকে লাভ করেন দ্রোণ বধের জন্য। কিন্তু দ্রোণ বধের জন্য ধৃষ্টদ্যুম্নের জন্ম হয়েছে জেনেও দ্রোণ তাকে অশিক্ষা দিতে কুণ্ঠিত হননি। ভীষ্ম নিজে বলেছেন–ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং পাণ্ডব-কৌরবদের সঙ্গে শিখণ্ডী দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছিলেন এবং এই শিখণ্ডী পূর্বে ছিল স্ত্রী–শিখণ্ডিনং মহারাজ পুত্রং স্ত্রীপনিং তথা।

দ্রোণাচার্যের ওপর দ্রুপদের যে রাগ ছিল, সেই রাগ ভীষ্মের ওপরেও গিয়ে পড়েছিল দ্রোণাচার্যের কারণেই। কারণ একটাই। দ্রুপদের কাছে দ্রোণাচার্য প্রত্যাখ্যাত হবার পর ভীষ্ম পরম গৌরবে দ্রোণাচার্যকে আশ্রয় দিয়েছিলেন হস্তিনাপুরে। কাজেই দ্রুপদ যখন দেখলেন একটি রমণী পুরুষের যোগ্য অস্ত্রবিদ্যা আয়ত্ত করে ভীষ্মবধের প্রতিজ্ঞা করেছেন, তখন সেই রমণীর ইচ্ছামতো তাকে পুরুষ হিসেবে প্রচার করতে তিনি কুণ্ঠিত হননি। ভীষ্ম যে। ক্ষত্রিয়বীরের ধর্ম অতিক্রম করে স্ত্রীলোকের গায়ে হাত তুলবেন না বা অস্ত্রসন্ধান করবেন না–এটা দ্রুপদের ভালই জানা ছিল এবং জানা ছিল বলেই শিখণ্ডীকে পুরুষ হিসেবে তিনি যতই প্রচার করুন, তিনি যে আদতে স্ত্রীলোক–এই খবরটাও তিনি পরে কখনও লুকাননি। দ্রুপদ চেয়েছিলেন অস্ত্রের সুশিক্ষায় পুরুষের সুবিধে শিখণ্ডী যতটুকু পাচ্ছে পাক, উপরন্তু ভীষ্মবধের সময় স্ত্রীত্বের সুবিধেটুকুও সে পাবে।

শিখণ্ডী যে আদতে স্ত্রী–সে কথা ভীষ্ম যেমন তার নিযুক্ত বিশ্বস্ত চরদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ জানতেন–মম ত্বেতচ্চারা স্তাত…যে মুক্তা দ্রুপদে ময়া–তেমনই তিনি যে স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও পুরুষ সেজে থাকেন সে কথাও ভীষ্মের মন্তব্য থেকেই বোঝা যায়।

আমি কোনও স্ত্রীলোক বা নপুংসকের গায়ে অস্ত্র-সন্ধান করি না–এই বীরমানিতাই যেখানে ভীষ্মের পক্ষে যথেষ্ট ছিল সেখানে মহাকাব্যের উপাখ্যান-শৈলী ঠিক রাখার জন্যই যেন ভীষ্মকে প্রতিজ্ঞা উচ্চারণের সময় অন্তত চারটে বিকল্পের কথা বলতে হয়েছে। ভীষ্ম। দুর্যোধনকে উদ্যোগপর্বে বলেছেন–আমার এই নিয়ম আমি কোনও স্ত্রীলোক, কোনও পুরুষ যে আগে স্ত্রী ছিল, যে পুরুষকে কোনও স্ত্রীর নামে ডাকা হয় এবং যে স্ত্রী পুরুষের মতো সাজে, তার প্রতি আমি বাণ নিক্ষেপ করি না–স্ত্রিয়াং স্ত্রীপূর্বকে চৈব স্ত্রীনামি স্ত্রীস্বরূপিণি। এই কারণে আমি শিখণ্ডীকে মারতে পারি না। এই হল ভীষ্মের চতুর্বিকল্প প্রতিজ্ঞা।

লক্ষ্য করে দেখবেন–ভীষ্মের এই চারটে বিকল্পের মধ্যেই অম্বা থেকে শিখণ্ডীর পরিণতি বিধৃত আছে। অম্বা আদতে স্ত্রী–তিনি কাশীরাজের কন্যা-জ্যেষ্ঠা কাশীপতেঃ কন্যা অম্বা নামেতি বিঞতা। তিনি দ্রুপদের ঘরে এসে শিখণ্ডী নামে পরিচিত হলেন–যাঁকে মহাকাব্যের কল্পনায় দ্রুপদের ঘরে জন্মালেন বলা যায়–দ্রুপদস্য কুলে জাতা শিখণ্ডী ভারতভ। এই গেল দ্বিতীয় বিকল্প অর্থাৎ সে আগে স্ত্রী ছিল, এখন পুরুষ হয়েছে–শ্রীপূর্বকে চৈব। তৃতীয়। বিকল্প–ভীষ্ম এমন পুরুষের গায়ে বাণ নিক্ষেপ করেন না, যার একটি স্ত্রী-নাম আছে। স্ত্রী-নামটি অম্বা। এবার চতুর্থ বিকল্প যেটাকে আমরা সবচেয়ে সত্য বলে মনে করি, সেটা হল–স্ত্রীস্বরূপিণি–অর্থাৎ ভীষ্ম এমন কোনও মানুষের প্রতি অস্ত্র-সন্ধান করেন না, যিনি আদতে স্ত্রী কিন্তু পুরুষের মতো সাজেন। ইনিই শিখণ্ডী, যিনি স্বরূপত একটি স্ত্রী, অর্থাৎ অম্বা।

শিখণ্ডী যদি পুরুষের মতো না সাজতেন, তাহলে ভীষ্মকে এত বিকল্পের সন্ধান করতে হত না। শুধুমাত্র স্ত্রীলোক অথবা নপুংসকের প্রতি বাণ নিক্ষেপ করি না, এইটুকু বললেই চলত। কিন্তু শিখণ্ডীই যেহেতু অম্বা তাই ভীষ্মকে স্ত্রী-নাম এবং স্ত্রীস্বরূপ পুরুষের বিকল্প-দুটি জুড়তে হয়েছে। পরবর্তীকালে দেখব–ভীষ্ম অনেক সময়েই শিখণ্ডীকে নপুংসক না বলে, শুধুমাত্র স্ত্রী হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। বস্তুত শিখণ্ডীর নপুংসকত্ব লিঙ্গকেন্দ্রিক নয়, এই নপুংসকত্ব স্ত্রীলিঙ্গ এবং পুরুষ স্বভাবের মিশ্রচারিতা। শিখণ্ডী স্ত্রীলোকই, যিনি ক্ষত্রিয় পুরুষের ব্যবহার অঙ্গীকার করেছেন মাত্র। শিখণ্ডী পুরুষের সাজে অস্ত্র-শস্ত্রে সুশিক্ষিত এক মহিলা।

.

৬৩.

 মথুরার রাজা উগ্রসেন যখন কারাগারে বন্দি হয়ে আছেন, কংস যখন আপন অত্যাচারে সমস্ত মথুরাপুরীর প্রজাদের উত্যক্ত করে তুলেছেন, ঠিক এইরকম একটা সময়ে উগ্রসেনের সহোদর দেবক মহামতি বসুদেবের সঙ্গে নিজের সাত মেয়ের বিয়ে দেবেন ঠিক করলেন। সাত মেয়ের মধ্যে দেবকীই জ্যেষ্ঠা না কনিষ্ঠাতা নিয়ে সন্দেহ করার কোনও কারণ নেই। যতদূর মনে হয় তাতে দেবকীই জ্যেষ্ঠা হয়তো, কারণ একসঙ্গে সাতটি মেয়ের বিয়ে হলে বিবাহের বিধিসম্মত স্মার্ত ক্রিয়াকলাপগুলি সাধারণত জ্যেষ্ঠার সঙ্গেই সম্পন্ন হয়। দেবকীর সঙ্গেও তাই হয়েছে। অন্যদের ক্ষেত্রে পাণিগ্রহণ বা সপ্তপদী গমনের মতো সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। হয়তো অন্যদের সঙ্গে এই অনুষ্ঠানই হয়েছে।

যাই হোক দেবকীর সঙ্গে বসুদেবের বিয়ে হলে কংস মোটামুটি খুশিই হলেন। পিতৃব্যের এই কন্যাটিকে তিনি যথেষ্ট ভালবাসতেন। অপিচ তার খুশির কারণ আরও একটা ছিল। বসুদেব কংসের মন্ত্রিসভার অন্যতম মন্ত্রী। কংসের কাজকর্মে তিনি মোটেই সন্তুষ্ট নন। অতএব এই বিক্ষুব্ধ তরুণ মন্ত্রীর সঙ্গে যদি কংসের ঘরের মেয়ের বিয়ে হয়, তবে রাজনৈতিক দিক দিয়ে তার সুবিধে হবে–এই ছিল কংসের ধারণা।

বসুদেব-দেবকীর বিবাহ-প্রসঙ্গে অবতরণ করার আগেই জানাই–অষ্টাদশ পর্ব মহাভারতের মধ্যে এই বিবাহ-প্ৰসঙ্গ কোথাও নেই। মহাভারতের মধ্যে শত-শতবার কৃষ্ণকে ‘বাসুদেব’, ‘বসুদেবপুত্র’ বা ‘দেবকীনন্দন’ বলে ডাকা হলেও তার জন্ম-কাহিনী বা বাল্য-বয়সের কথা মোটেই উল্লিখিত হয়নি। আরও আশ্চর্য হল–এ বিষয়ে মহা-মহাপণ্ডিতদের তর্ক-যুক্তির ধারা মাঝে মাঝে এতই অযৌক্তিক রকমের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে যে, আমরাও খানিকটা বিল হয়ে পড়ি। মহাভারতের মধ্যে রাজনীতি-ধুরন্ধর এক পাকাপোক্ত কৃষ্ণকে দেখে, অনেক পণ্ডিত ব্যক্তিই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে বৃন্দাবনের রাখাল কৃষ্ণ এবং মহাভারতের কৃষ্ণ এক ব্যক্তি নন। সুযোগ বুঝে আরও পাণ্ডিত্য দেখিয়ে অন্য পণ্ডিতেরা আবার বৃন্দাবনের কৃষ্ণ, মথুরার কৃষ্ণ এবং দ্বারকার কৃষ্ণ নামক তিনটি শ্রেণীর উল্লেখ করেছেন। বলা বাহুল্য, এঁদের পাণ্ডিত্যপ্রকর্ষ মূলচ্ছেদী এবং অনেকাংশেই সাহেবদের উচ্ছিষ্ট-শেষমাত্র।

 কৃষ্ণের কথায় পরে আসব। আপাতত শুধু এইটুকু জানিয়ে রাখি যে, মহাভারতে যেহেতু পাণ্ডব-কৌরবদের জ্ঞাতিবিরোধের ঘটনাই প্রধানত স্থান পেয়েছে, তাই কৃষ্ণের জন্ম বা বাল্য-বয়সের কথা সেখানে অপ্রাসঙ্গিক। মহাভারতের কবি যেহেতু মহাকাব্যের কবি তাই। কথ্যমান বিষয়ে অনেক অপরিচিত উপাখ্যানই প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে, কিন্তু কৃষ্ণের বাল্য-পৌগও সেখানে কোনওভাবেই প্রাসঙ্গিক ছিল না। অতএব তিনি তা লেখেননি। কিন্তু পণ্ডিতদের বোঝা উচিত–মহাভারতের মধ্যে যে মানুষটির সার্বত্রিক উপস্থিতি তাকে ভগবত্তায় উপনীত করেছে, তার জন্ম, বাল্য, পৌগণ্ড এবং প্রথম যৌবনও যে যথেষ্ট রোমাঞ্চকর হবে সে কথা সহজেই অনুমেয়। কৃষ্ণের প্রসঙ্গে যাবার আগে আমরা তাই পরিষ্কার জানিয়ে দিতে চাই যে, কৃষ্ণের পূর্বজীবন আমাদের খুঁজে বার করতে হবে আমাদের পুরাণগুলি থেকেই। কারণ পুরাণগুলিই ভারতবর্ষের ইতিহাস-প্রতিম।

এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়–সাহেব-সুবোদের নানা ঢক্কা-নিনাদ এবং তদুচ্ছিষ্টভোগী ঢাকের কাঠি স্বরূপ কতগুলি বাঙালি-সাহেবের একতান করতাল-ধ্বনি শুনে খুব একটা বিচলিত হবার যুক্তি নেই। এর কারণ এই নয় যে, তারা জ্ঞানী-গুণী নন। বরঞ্চ কারণ এই যে তারা জ্ঞানী-গুণী হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় ইতিহাসের একান্ত সহজ ধারা পরিহার করে বৈদেশিক বিচার-বিশ্লেষণের বিচিত্র পদ্ধতি প্রয়োগ করে সহজ বস্তুকে অনর্থক জটিল করে তোলেন। যেহেতু ভারতবর্ষের একান্ত আপন শাস্ত্রীয় ইতিহাসের পরম্পরা মোহমুক্তভাবেই বোঝবার চেষ্টা করা যায়, তাই কৃষ্ণের জীবন তথা চরিত্র ব্যাখ্যায় দেশজ বিচারশৈলী প্রযুক্ত হওয়া উচিত।

কোনও সন্দেহ নেই–আমাদের পৌরাণিকেরা গল্প করতেন বেশি, তথ্য দিতেন কম। কিন্তু তাতে আমাদের অসুবিধে কী? কারণ, সে গল্প তো আমাদের ঠাকুরদাদা-ঠাকুমার মতোই। আমার জন্ম-সনের খবর দিতে গেলে তারা আগে বলবেন–সেবারে ছিল অতি বৃষ্টির বছর, লোকজন বন্যায় মারা যাচ্ছে, ঠাকুর-দালানের পিছনের আম গাছটা সেইবার ভাঙল, যদু গোস্বামীর মেজ মেয়ে সেইবার জন্মাল, আর ঠিক তার পরের সনের ওই তারিখেই তোর জন্ম। হল। তাহলে দেখুন–আমার জন্মের খবর জানতে হলে আমার ঠাকুমার মুখে যদু গোস্বামীর মেয়ে থেকে আরম্ভ করে আষ বৃক্ষের পতন পর্যন্ত–তাও এক বছর আগের ঘটনা–সব আপনাকে জানতে হবে। মহাভারতের কৃষ্ণের আদ্যিকাল জানতে হলেও, আপনাকে তাই পুরাণ, হরিবংশ, সংস্কৃত নাটক, দর্শন, উপনিষদ–সব জানতে হবে; আর এই জানাটা ঠিক হলে মহাভারতের সূত্রধার রাজনীতির ধুরন্ধর ব্যক্তিটিকেও আপনি সঠিক বুঝতে পারবেন। মহাভারতের কৃষ্ণের জন্য কোনও উর্বর মস্তিষ্ক প্লেকে বাল্য-পৌগণ্ডহীন এক নতুন কৃষ্ণের উৎপাদন করতে হবে না।

যাঁরা বলেন ‘গ্রন্থরূপে ভাগবত কৃষ্ণ-অবতার’–তাদের সঙ্গে এই মুহূর্তে আমরা খুব সহৃদয়তা বোধ করছি না, কারণ ভাগবত পুরাণে বসুদেব-দেবকীর বিবাহের মধ্যে অতিকথন কিছু আছে, অলৌকিকতাও কিছু আছে। তা ছাড়া পণ্ডিতদের মতে পুরাণগুলির মধ্যে ভাগবত পুরাণের বয়স বড় অল্প। ভাগবত-পুরাণে বসুদেব-দেবকী এবং কৃষ্ণের কথাতেও তাই অল্পবয়সী রোম্যান্টিকের হৃদয়স্পর্শ আছে। সে অতি মধুর, তাতে সন্দেহ নেই।

কিন্তু অতি-মধুরতা অনেক সময় অন্যান্য বস্তুর বৈশিষ্ট্য প্রতিহত করে, ভাগবত পুরাণেও তাই ঘটেছে। সুমধুর পায়সান্নর প্রকৃত আস্বাদ পেতে গেলে যেরকম ঘনীভূত দুগ্ধের আস্বাদও প্রয়োজন, শর্করার আস্বাদও প্রয়োজন এবং ক্ষুদ্র এলাচী-চূর্ণের আস্বাদও প্রয়োজন, তেমনই কৃষ্ণ জীবনের প্রকৃত আস্বাদ পেতে হলে হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ, মহাভারত এবং অবশ্যই এলাচী-চুর্ণের সুবাসের মতো ভাগবত পুরাণেরও প্রয়োজন। সব কিছু মিলিয়েই আমাদের কৃষ্ণ-জীবনের আস্বাদ-যোগ্যতা উপভোগ করতে হবে। একটা ঘটনা বলি।

চৈতন্য-পার্ষদ রূপ গোস্বামী ললিতমাধব নামে কৃষ্ণলীলা সংক্রান্ত একটি নাটক লিখেছিলেন। নাটকের আরম্ভে দ্বিতীয় শ্লোকে রূপ গোস্বামী চৈতন্য-মহাপ্রভুর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন এবং তার আশীর্বাদ যাচনা করে একটি শ্লোক রচনা করেন। ঘটনা হল–কৃষ্ণলীলাময় এই নাটকখানি কেমন হয়েছে সেটা শোনানোর জন্য রূপ পুরীতে আসেন মহাপ্রভুর কাছে। মহাপ্রভুর সামনে নাটক পড়বার সময় মহাপ্রভুর অন্যতম জীবন-সঙ্গী রায় রামানন্দও উপস্থিত ছিলেন। তিনি নিজে কবি এবং অত্যন্ত রসিক ভক্ত। ললিতমাধব নাটকের আরম্ভশ্লোক নান্দী-পাঠ সেরেই রূপ গোস্বামী শ্রীচৈতন্যের প্রশংসাসূচক শ্লোকখানি পড়লেন। মহাপ্রভু রূপের ভক্তিতে খুশি হলেও তৃণাদপি সুনীচের নম্রতায় খানিকটা লজ্জিতও হলেন। সামান্য কপট কোপ প্রকাশ করে রূপের উদ্দেশে তিনি বললেন–

কঁহা তোমার কৃষ্ণ-রস-বার্কসুধাসিন্ধু
তার মধ্যে মিথ্যা কেনে স্তুতি-ক্ষার-বিন্দু।

 রায় রামানন্দ প্রভুর এই রোষাভাস মেনে নিলেন না। বরঞ্চ রূপের প্রশংসা করে তার শ্লোকের যৌক্তিকতা মেনে নিলেন। কবিরাজের ভাষায়–

রায় কহেলিপের কাব্য অমৃতের পর।
তার মধ্যে এক বিন্দু দিয়াছে কর্পূর।

ভাগবতপুরাণে কৃষ্ণ-জীবন এবং চরিত্র-বর্ণনায় সর্বত্র এই কর্পূরের সুবাস ছড়ানো আছে। অমৃতপুর বর্ণনার মধ্যে এই কর্পূরের সুবাস নিঃসন্দেহে এই পুরাণের পাঠ এবং শ্রবণযোগ্যতা অনেকাংশে বাড়িয়ে তুলেছে, কিন্তু তাতে নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকের বড় জ্বালা হয়েছে। সে এই মহাপুরাণের অপূর্ব আস্বাদকে নিছক কাব্য-ভ্রমি বলে উড়িয়েও দিতে পারে না, আবার তথ্য-বর্ণনার সময় একে একেবারে বাদ দিতেও পারে না। বাদ দিতে পারে না, কারণ প্রাচীন পুরাণগুলির মূল তথ্যের সঙ্গে ভাগবত পুরাণের তথ্যের মিল আছে, তবে হ্যাঁ, তার সঙ্গে কর্পূরের সুবাসটুকু আমাদের উপরি পাওনা।

ভাগবত পুরাণের সূত্র ধরেই যদি আরম্ভ করি, তাহলে দেখব–আরম্ভটা বড়ই নাটকীয়। বসুদেবের সঙ্গে দেবকীর বিয়ে হয়েছে এবং আদরের বোন খুশি হবেন বলেই মথুরাধিপতি কংস স্বয়ং দেবকীকে রথে করে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে দেবেন বলে ঠিক করেছেন-উগ্রসেনসুতঃ কংসঃ স্বঃ প্রিয়চিকীর্ষয়া। ঘোড়ার লাগাম কংসের হাতে, আর মথুরার রাজা স্বয়ং আজ বসুদেব-দেবকীর রথের সারথি হয়েছেন বলে তাঁর অনুগামী সমস্ত রাজারা, অভিজাত ব্যক্তিরা রথে চড়ে, হাতি-ঘোড়া-পালকির পংক্তি সাজিয়ে কংসের পিছন পিছন চললেন–রৌক্সৈ রথদশতৈবৃতঃ। বাড়ির মেয়ে-বউরা শঙ্খ বাজিয়ে যাত্রা-মঙ্গল সূচনা করলেন, বাদ্যিকরেরা বাদ্যি বাজাতে লাগল। কংস চললেন বসুদেব-দেবকীকে নিয়ে–প্রয়াণপ্রক্রমে তস্য বরবধ্বঃ সূমঙ্গলম। এমন সময় সেই বঙ্কথিত, বহুশ্রুত দৈববাণী হল–ওরে বোকা! তুই যাকে এই রথ সাজিয়ে আদর করে নিয়ে যাচ্ছিস, এই রমণীর অষ্টম গর্ভের সন্তান তোকে হত্যা করবে।

ভাগবত পুরাণের এই বর্ণনার সঙ্গে প্রাচীন বিষ্ণুপুরাণের বর্ণনার কোনও তফাৎ নেই। দৈববাণীর কথা সেখানেও আছে। যারা দৈববাণী, বরদান এবং অভিশাপের তাৎপর্যে বিশ্বাস করেন, তারা নিশ্চয়ই মানবেন যে কংসের কাল ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু দৈববাণী, আকাশবাণীতে যাদের বিশ্বাস নেই, তারা মনে করেন–ঘটনা ঘটার পর কবি–পৌরাণিকে দৈববাণী, অভিশাপ অথবা বরদানকে যথাস্থানে সন্নিবেশিত করে বিশিষ্ট বর্ণনায় নতুন মাত্রা যোগ করেন। আমরা অবশ্য কংসের নিদারুণ অত্যাচারের নিরিখে দৈববাণীর চেয়ে সাধারণ মানুষের অপ্রীতি বা জনরোষকেই প্রধান বলে গণ্য করি। মথুরার জনগণ বসুদেবকে কংসের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর সবচেয়ে সসাচ্চার নেতা হিসেবে জানত এবং বিশ্বাসও করত যে, কোনও না কোনও দিন এই মানুষটির তরফ থেকেই কংসের বিপন্নতা তৈরি হবে। সেই নেতৃস্বরূপ বসুদেবকে কংস নিজে রথে বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন দেখে প্রেক্ষক জনগণ স্থির থাকতে পারেনি। তারাই হয়তো কেউ চেঁচিয়ে বলেছে–ব্যাটা বোকা পাঠা! যাকে তুই বয়ে নিয়ে যাচ্ছিস, ওর ছেলেই তোর সর্বনাশ করবে একদিন-সংস্কৃতে এই পংক্তির পৌরাণিক চেহারা দাঁড়াবে এইরকম–

যামেতাং বহসে মৃঢ় সহ ভর্তা: রথে স্থিতাম্।
অস্যান্তে চাষ্টমো গর্ভঃ প্রাণানপরিষ্যতি।

 দেববাণীই হোক অথবা জনবাণীই হোক, কথাটা শোনামাত্রই মধুরাধিপতি কংসের সম্মানে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দেবকীর চুলের মুঠিটি চেপে ধরলেন বাঁ হাতে। ডান হাতে খড়গ। তাঁর ইচ্ছে দেবককে এই মুহূর্তে মেরে ফেলবেন তিনি– ভগিনীং হমারব্ধঃ খড়গপাণিঃ কচে’গ্রহী।

স্বাভাবিকভাবেই দেবকী খানিকটা হতচকিত হয়ে গেলেন। এই তিনি প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন। স্বামীর সঙ্গে এখনও তাঁর ভাল করে পরিচয়ই হয়নি। সেই অবস্থায় স্বামীর সামনে তার ভাই তাকে চুলের মুঠি ধরে হত্যার উদ্যোগ নিয়েছেন-এ হেন অবস্থায় তার বাক্য রুদ্ধ হয়ে গেল। বসুদেব কিন্তু একটুও ভেঙে পড়লেন না। কংসকে তিনি চেনেন। বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য যখন হয়, তখন বিরোধী নেতা হিসেবে অনেকবারই কংসের সঙ্গে তার তর্কাতর্কি হয়েছে। কিন্তু এই সদ্য-বিবাহের পর একটি রমণী যখন তার ভাগ্যের অভাগিনী হয়ে আছেন, তখন বসুদেবের পক্ষে গলা চড়িয়ে কোনও কথা বলা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া কৌশল হিসেবে নিকৃষ্ট লোকের সঙ্গে কথাবার্তায় প্রথমে মধুর ভাষণই শ্রেয় মনে করেন বসুদেব।

বসুদেব কংসকে একটু তৈলসিক্ত করে বললেন–আপনি হলেন ভোজ-বংশের অলঙ্কার। পৃথিবীর সমস্ত বীরপুরুষ আপনার গুণের প্রশংসা করেন সব সময়। আর সেই আপনি এত গুণী মানুষ হয়েও, এত বড় বীর হওয়া সত্ত্বেও আপনি কিনা এক অবলা রমণীকে বধ করার জন্য উদ্যত হয়েছেন? আর সবচেয়ে বড় কথা, এই অবলা রমণী আপনার বোন। তার ওপরে আজই তার বিয়ে হয়েছে, স কথং ভগিনীং হন্যাৎ স্ত্রিয়মুদ্বাহপর্বনি?

ভাগবত-পুরাণে বসুদেবের মুখে এই প্রশংসা-বাক্যের পরে অনেক দার্শনিক কথাবার্তা শোনা যায়। বাস্তব ক্ষেত্রে কংসের প্রতি এই দার্শনিক উপদেশ খুব যুক্তিযুক্ত নয় বোধহয়। আমাদের যুক্তিতে ওইটুকু সেই কর্পূরের সুবাস এবং এই সুবাসে কংসের মনও সুবাসিত হয়নি ন নিবৰ্তত কৌরব্য পুরুষাদাননুব্রতঃ। বিষ্ণু পুরাণে বসুদেব কিন্তু অত্যন্ত বাস্তব ভাবেই কোনও দার্শনিকতার মধ্যে যাননি। কংস খড়গ তোলার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বলেছেন–এইভাবে দেবকীকে মেরো না কংস। এর গর্ভে যত পুত্র জন্মাবে, তাদের জন্মলগ্নেই আমি তোমার হাতে তুলে দেব-সমর্পয়িষ্যে সকান্ গর্ভানস্যোদরোত্তবান।

ভাগবত-পুরাণে এই শেষ কথাটা বলার আগে বসুদেবের মনে সামান্য যুক্তি-তর্ক আছে। বসুদেব সেখানে ভাবছেন–ছেলেপিলে তো পরের ভাবনা। মাথায় যতক্ষণ বুদ্ধি আছে ততক্ষণ ওই বুদ্ধি দিয়েই দেবকীর মৃত্যুটা আগে ঠেকাতে হবে–মৃত্যু-বুদ্ধিমতাহ্য যাব বুদ্ধিবলোদয়। অতএব পুত্রের মৃত্যু মৌখিকভাবে স্বীকার করে নিয়েই আগে এই বেচারা দেবকীকে বাঁচাতে হবে-প্রদায় মৃত্যবে পুত্রা মোচয়ে কৃপণামিমা। তাছাড়া-বসুদেব আরও ভাবলেন–ছেলে যদি আমার হয়ই এবং কংসও যদি তার মধ্যে মা মরে যায়, তবে সে কি কংসের কিছুই করতে পারবে না? আর অদৃষ্টের ফের, ভবিষ্যতে কীই বা না হতে পারে–বিপর্যয়ে বা কিং ন স্যাদ গতি ধাতুরত্যয়া?

আমরা জানি, ভাগবত-পুরাণে বসুদেবের এই ভাবনাগুলি মিথ্যা নয়। কিন্তু বিপন্ন মুহূর্তে এই ভাবনাগুলি এক লহমার মধ্যে মস্তিষ্কের কোষে ক্রিয়া করে যায় এবং সিদ্ধান্তটাও নিঃসৃত হয় এক লহমার মধ্যেই–তোমার কিছু ভয় নেই কংসন হ্যস্যাস্তে’ভয়ং সৌম্য–আকাশবাণী থেকে তোমার কোনও ভয় নেই। আমার যে ছেলেদের কাছ থেকে তোমার এত ভয়, সেই ছেলেদের তোমার হাতেই তুলে দেব, ভাই–পুত্ৰান্ সমর্পয়িয্যে’স্যা যতস্তে ভয়মুতিম্।

বসুদেবের কথার একটা অন্য মূল্য ছিল–সেটা এক কথা। আর বসুদেবের কথায় যুক্তি ছিল–সেটা আরেক কথা। ভাগবত-পুরাণ বসুদেবের ভাবনা-চিন্তা, যুক্তি-তর্কের বিবরণ। দিয়েছে। অতএব কংস সেখানে তার বাক্যের যৌক্তিকতা মেনে নিলেন– কংসস্তবাক্যসারবিৎ। আর আমরা যেহেতু বসুদেবকে বিরোধী গোষ্ঠীর অন্যতম নেতা মনে করি এবং অপেক্ষাকৃত প্রাচীন পুরাণগুলিতে যেহেতু এই নেতৃত্বের ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ পাব, তাই বিষ্ণু পুরাণের বক্তব্য মেনে নিয়ে বলিবসুদেবের মতো এক বিশিষ্ট ব্যক্তি এই কথা দিলেন বলেই কংস তাঁর কথা মেনে নিলেন। কংস দেবকীকে মারলেন নান ঘাতয়ামাস চ তাং দেবীং তস্য গৌরবাৎ।

ভগবত-পুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ এবং হরিবংশ–সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে-কৃষ্ণ জন্মাবার আগে কংসের অত্যাচার-পীড়িতা ধরণী বিষ্ণুর কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। ব্রহ্মা এবং অন্যান্য দেবতাদের সনির্বন্ধ অনুরোধে ভগবান নিজে মানুষরূপে অবতার গ্রহণ করবেন বলে কথা দিয়েছেন। বসুদেব এবং দেবকীর পুর্ব-তপস্যা ছিল এবং তারা পরম ঈশ্বরকে পুত্ররূপে পেতে চেয়েছিলেন। ভগবানের দিক থেকেও এবার সুযোগ এল দেবকীর গর্ভে জন্ম নিয়ে মনুষ্য-লীলার অভিলাষ পূরণ করার।

তবে এ সবই ধর্মের কথা। কৃষ্ণের ভাগবত্তায় যারা বিশ্বাসী, তারা এইরকম একটা বিশ্বাস হৃদয়ে ধারণ করতেই পারেন, তাতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু কৃষ্ণের জীবনকে যদি লৌকিক দৃষ্টিতেও দেখা যায়, তবেও কিন্তু কোনও সন্দেহের কারণই নেই, যে কৃষ্ণের জন্ম হবে দেবকীর গর্ভেই, কারণ তার জন্মের পরেই আমরা সঠিক জেনেছি যে, কৃষ্ণ দেবকীরই পুত্র। যাইহোক সে জন্মের কথা পরে আসবে, আগে দেখতে হবে বসুদেব-দেবকী এখন কী অবস্থায় আছেন।

দেবকীর পক্ষে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া আর সম্ভব হয়নি। তবে কারাগারের মধ্যে তাদের দুজনকেই কঠিন শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় বেঁধে রাখা হয়েছিল কিনা, সে সম্বন্ধে সন্দেহ করা যেতেই পারে। ভাগবত-পুরাণে দেখা যায়–দেবকীর প্রথম পুত্রটি জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই বসুদেব তার প্রতিজ্ঞাত বাক্য স্মরণ করে সেই শিশু সন্তানকে কংসের হাতে তুলে দেন। তাঁর মনে কষ্ট ছিল–অর্পয়ামাস কৃচ্ছ্রেণ-তবুও বসুদেব আপন সত্যে প্রতিষ্ঠিত রইলেন। কংসও তার এই ব্যবহার দেখে খুশি হয়ে বললেন-তোমার এই ছেলেটাকে ফিরিয়েই নিয়ে যাও, বসুদেব! এর থেকে আমার ভয় নেই কোনও-প্রতিযাতু কুমারোয়ং ন হ্যম্মাদস্তি মে ভয়। তোমার সেই অষ্টম সন্তানটি ভূমিষ্ঠ হোক, তখন দেখা যাবে। ভাগবত-পুরাণে এই ঘটনার পরেই কংসের সভায় দেবর্ষি নারদের আগমন হচ্ছে। নারদ কংসকে বোঝালেন–বসুদেব-দেবকী, তাঁর আত্মীয়-স্বজন, বৃন্দাবনে বসুদেবের বন্ধুবর্গ–এঁরা সবাই প্রায় দেবতা–সর্বে বৈ দেবতায়াঃ। কাজেই সাবধানে থেকো। স্বয়ং ভগবান যে কংসের মৃত্যু ঘটিয়ে পৃথিবীকে ভারমুক্ত করবেন–এই চরম কথাটাও বলতে নারদ ভুললেন না।

নারদ এইসব কটু-তিক্ত কাহিনী শুনিয়ে চলে যেতেই কংস বসুদেবের কাছ থেকে তার প্রথমজন্মা পুত্রটিকে চেয়ে নিলেন নির্মম শত্রুতায়। পাষাণে আঘাত করে মেরে ফেললেন। বসুদেবের পুত্রটিকে। বিষ্ণু-পুরাণে এবং হরিবংশে অবশ্য নারদ বসুদেবের কোনও পুত্র হওয়ার আগেই কংসকে বসুদেবের পুত্রগুলি থেকে সাবধানে থাকতে বলেছেন। ওই পুত্রদের ভগবত্তা খ্যাপনও বাদ যায়নি। নারদের কাছ থেকে বসুদেবের পুত্রদের অলৌকিক শক্তি সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার পরেই নাকি দেবকী-বসুদেবকে লোহার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয় এবং ভাগবতের পৌরাণিক এইরকমই বর্ণনা দিতে পছন্দ করেছেন– দেবকীং বসুদেবঞ্চ নিগৃহ্য নিগড়ৈর্গহে। বিষ্ণুপুরাণে অবশ্য বসুদেবকে একটি গুপ্ত গৃহের মধ্যে অন্তরীণ রাখা হয়েছে এবং বসুদেবের ব্যক্তিত্বের নিরিখে আমরাও বসুদেবের এই নজরবন্দী অবস্থাটুকুই বিশ্বাস করতে ভালবাসি। তার কারণ পরে বলব–দেবকীং বসুদেবঞ্চ গৃহে গুপ্তাবধারয়ৎ।

একটি করে দেবকীর পুত্র জন্মায়, আর বসুদেব তাকে দিয়ে আসেন কংসের হাতে। কংস তাকে পাষাণে আছড়ে মারেন, বসুদেব দেখেন, অথবা শব্দ পান, অথবা উপলব্ধি করেন এই নৃশংস হত্যা। সামগ্রিকভাবেই কংসের অত্যাচার আরও বেড়ে গেল, কারণ তার নির্ধারিত সময় ঘনিয়ে আসছে। দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান তাকে হত্যা করবে–এই দৈববাণী মিথ্যে করে দেবার জন্য বদ্ধপরিকর হলেন কংস।

দেবকীর সপ্তম গর্ভের সন্তানটির সম্বন্ধে সমস্ত পুরাণেই প্রচুর অলৌকিকতা আছে। সপ্তম গর্ভের সম্ভাবনা-মাত্রই পরম ঈশ্বর বিষ্ণু যোগমায়া দেবীকে আদেশ করেন–দেবকীর সপ্তম গর্ভটি আকর্ষণ করে বসুদেবের জ্যেষ্ঠা পত্নী পুরু-ভরত বংশের মেয়ে রোহিণীর গর্ভে স্থাপন করতে–তৎ সন্নিকৃষ্য রোহিণ্যা উদরে সন্নিবেশয়। ভগবান স্বয়ং যোগমায়াকেও নির্দেশ দিলেন বসুদেবের পরম বন্ধু নন্দপত্নী যশোমতীর উদরে প্রবেশ করতে।

যোগমায়া মহাবিষ্ণুর আদেশমতো দেবকীর সপ্তম গর্ভ আকর্ষণ করে পৌরবী রোহিণীর গর্ভে স্থাপন করলেন। কংসের অনুচরেরা, যারা বসুদেব-দেবকীকে পাহারা দিচ্ছিল, তারা দেবকীর পূর্বদৃষ্ট গর্ভলক্ষণ নিশ্চিহ্ন হতে দেখে কংসের কাছে গিয়ে খবর দিল–দেবকীর গর্ভ নষ্ট হয়ে গেছে–অহহা বিংসিততা গর্ভ ইতি পৌরা বিচুকু। গর্ভ আকর্ষণ করে রোহিণীর গর্ভে স্থাপন করা হয়েছিল বলে রোহিণীর পুত্রের অন্য নাম সঙ্কৰ্ষণ। বৃন্দাবনে অবশ্য তার ডাক নাম চালু হল বলদেব, বলভদ্র ইত্যাদি সংজ্ঞায়।

.

৬৪.

হস্তিনাপুরে প্রতিষ্ঠিত পুরু-ভরত-কুরু-বংশের অঙ্কুর রীতিমতো বড় হয়ে ফুল-ফল না ফলিয়েই অকালে ঝড়ে পড়ল। কুমার বিচিত্রবীর্য যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। এই মৃত্যুতে যিনি সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়লেন, তিনি হলেন মহামতি ভীষ্ম। স্বামীর মৃত্যুতে আরও যে দুইজন বিপন্না মহিলার নাম এখানে করতেই হবে, সেই অম্বিকা ও অম্বালিকা ছাড়াও তৃতীয় যে প্রৌঢ়া রমণীটি মনে মনে বিপর্যস্ত হলেন, তিনি মনস্বিনী সত্যবতী। তবে যেহেতু তিনি অন্য কোনও সাধারণ রমণী নন, তিনি যেহেতু সত্যবতী, তার যৌবনস্থিত পুত্রের। অকালমৃত্যুতেও তিনি একটুও ভেঙে পড়লেন না।

আসলে ছোটবেলা থেকে সত্যবতী যে সব ঘটনা-পরম্পরার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন সেই কৈবর্তপল্লীতে মানুষ হওয়া থেকে আরম্ভ করে মহামুনি পরাশরের সঙ্গে তার অনৈসর্গিক মিলন, শান্তনুর সঙ্গে তার বিবাহ, প্রথম পুত্রের মৃত্যু, দ্বিতীয় পুত্রের মৃত্যু–এই সমস্ত সুখ-দুঃখের ঘটনা-পরম্পরা এবং ঘটনার বৈচিত্র্য সত্যবতীর স্নায়ুশক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিল। এর ওপরে ছিল মহামতি ভীষ্মের মতো এক বিশাল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন ‘ইনটার‍্যাকশন’, যা তাকে হস্তিনাপুরের রাজনীতিতে এক লৌহময়ী প্রতিমার মতো দৃঢ়ভাবে স্থাপন করেছে। মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনায় অন্তদৃষ্টি দিলে বোঝা যাবে যে, বহিরঙ্গ রাজ্য-শাসনের সমস্ত ব্যাপারে ভীষ্ম তার সর্বাঙ্গীণ প্রয়াস চালালেও হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির মধ্যে সত্যবতীই ছিলেন সর্বেসর্বা। বিশেষত রাজবাড়ির সঙ্কটগুলিতে সত্যবতীর ভূমিকা ছিল যে কোনও রাজনীতি-সচেতন প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রনেতার মতোই।

 শুধু নিজের ক্ষমতা জাহির করা নয়, হস্তিনাপুরের জনসাধারণের প্রয়োজনে এই রাজবংশের পূর্বাবদান স্মরণ করেই সত্যবতী চিন্তিত হলেন। রাজতন্ত্রের অনুশাসনে যে প্রজাদের দিন চলে, তারা বংশজ শাসনেই বিশ্বাস করেন। বিশেষত যে রাজা প্রজারঞ্জনের ক্ষেত্রে যশের অধিকারী হন, প্রজারা আশা করেন, সেই রাজার বংশধরেরাই তাদের আশাপূরণে সফল হবেন, অন্য কেউ নয়। রাজতন্ত্রীয় শাসনের এই মনস্তত্ত্ব গণতন্ত্রের পরিবর্তনশীল নেতাদের অনুশাসনে থাকা নাগরিক-হৃদয় দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু এই মানসিকতা বা জনগণের আশা বস্তুটি এই বাবদে কী রকম হয়, সেটা গণতন্ত্রে বসেও বুঝতে পারবেন–যদি ভারতবর্ষে নেহেরু-পরিবারের বংশজ শাসনের জনপ্রিয়তা আপনারা সাধারণভাবেও খেয়াল করেন।

রাষ্ট্রপ্রধানের মৃত্যুতে যেমনটি হয়–শোক-তাপ-প্রেতকার্য-শ্রাদ্ধাদি, সবই হল এবং তা হল সত্যবতী এবং ভীষ্মের পারস্পরিক আলোচনার পথ ধরেই। সত্যবতী বড় বংশের মেয়ে বলে পরিচিত ছিলেন না, কিন্তু তার বুদ্ধিটা ছিল যে কোনও বিশাল বংশের কুলজা রমণীর মতো। তার ওপরে যে ঘরে তিনি বউ হয়ে এসেছিলেন, সেই হস্তিনাপুরের রাজবংশের মর্যাদা সম্পর্কে সত্যবতী ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। তার নিজের দুটি পুত্রই এক-এক করে মারা গেল, অথচ তাদের কোনও সন্তান রইল না যে, ভরত-কুরুদের রাজমর্যাদা জনমনে অঞ্জ রাখতে পারে। চিত্রাঙ্গদ অথবা বিচিত্রবীর্য-শান্তনুর এই দুই পুত্রের একটি পুত্রও নেই, অর্থাৎ সত্যবতীর শ্বশুরকুল এবং পিতৃকুল-দুইই লুপ্ত হয়ে গেল–এই বংশবিলুপ্তির জন্য সত্যবতী বোধহয় নিজেকেই দায়ী করলেন–ধর্মঞ্চ পতিবংশঞ্চ মাতৃবংশঞ্চ ভাবিনী।

এতদিনে বুঝি তার পূর্বস্মৃতিগুলি একে একে ফিরে এল, মনে পড়ল সেই অন্যায়ের ইতিহাস, যা তার বিবাহের সময়েই কলঙ্কিত হয়ে গেছে। কোনও সন্দেহই নেই যে, ধর্ম, বংশমর্যাদা এবং রাজধর্মের কথা বলেই সত্যবতী একান্তভাবে দায়মুক্ত হতে পারেন না। এর সঙ্গে অবশ্যই যুক্ত আছে সেই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চেতনা যাতে সত্যবতীর মতো প্রাজ্ঞা রমণী বিচলিত হয়ে পড়েন। শুধুমাত্র একটি পুত্র-সন্তানের অভাবে আজ হস্তিনাপুরের রাজ-ঐশ্বর্য ভোগ করার মতো কেউ রইল না–এই মানসিক পীড়নের কারণের সঙ্গে যে সত্যবতীর স্বার্থই সবচেয়ে বেশি জড়িত ছিল, সে কথা সত্যবতীর মতো বুদ্ধিমতী রমণী অনুভব করতে পারছেন না, তা হতেই পারে না। বংশবিলুপ্তির জন্য ভাগ্যের পরিহাসের চেয়েও তিনি যে বেশি দায়ী, সে কথা সত্যবতী বোঝেন বলেই এতদিনে তারও যেন বোধধাদয় হল।

 সত্যবতী জানেন–শান্তনুর সঙ্গে বিয়ে হবার সময় তাঁর পিতা যেশর্তে তাকে বিবাহ দিয়েছিলেন, তার মধ্যেই হস্তিনাপুরের প্রথম সুযোগ্য বংশধরের প্রতি এক গভীর বঞ্চনা ছিল। সে সময় পালক পিতা কৈবর্তরাজের ব্যক্তিত্বে তার পক্ষে কোনও কথাও বলা সম্ভব ছিল না। ভীষ্ম বিবাহ করবেন না, ভীষ্ম রাজা হবেন না-এই সমস্ত প্রতিজ্ঞাত সত্য হস্তিনাপুরের একদা যুবরাজকে একভাবে বঞ্চিত করেছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু এই বঞ্চনার কথা সত্যবতী মনে মনে অনুভব করতেন বলেই তিনি তার এই সমবয়সী অথবা বেশি-বয়সী পুত্রটিকে অসীম মমতায় যথাসাধ্য গুরুত্ব দিয়ে চলতেন।

 সত্যবতীর দুই পুত্র মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞাগুলি কী বিপরীত পরিহাস নিয়েই না ফিরে এল সত্যবতীর কাছে। সত্যবতীর যে পুত্রদের হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসানোর জন্য ভীষ্মকে আগে থেকেই প্রতিজ্ঞা করে রাজ্য-শাসনের প্রত্যক্ষ পরিধি থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল, আজকে ভাগ্যের পরিহাসে সত্যবতীকে তারই সামনে এসে দাঁড়াতে হচ্ছে।

বিচিত্রবীর্যের শ্রাদ্ধক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে পুত্রবধূ অম্বিকা অম্বালিকাকে যথাসাধ্য সান্ত্বনা দিয়ে মনস্বিনী সত্যবতী ভীষ্মের কাছে এলেন এবং সামান্য ভণিতা করেই বললেন–ভীষ্ম! তোমার পিতা মহারাজ শান্তনু ধার্মিক এবং যশস্বী–দুইই ছিলেন। কিন্তু আজ যে অবস্থা হল, তাতে তার পিণ্ড, বংশ এবং যশ-সবই তোমার ওপর নির্ভর করছে–ত্বয়ি পিণ্ডশ্চ কীর্তিশ্চ সন্তান প্রতিষ্ঠিতঃ। সত্যবতী ভীষ্মকে যথেষ্ট মর্যাদা দিয়ে তার ধর্মজ্ঞান, কৌলিক আচারের বোধ, এবং বিপৎকালে তার রাজনৈতিক চেতনার প্রতিপত্তিশ্চ কৃচ্ছ্রেষু শুক্রাঙ্গিরসয়োরিব– ভূয়সী প্রশংসা করলেন।

প্রশংসায় মানুষ খানিকটা দ্রবীভূত হয় এবং এই দ্রবীভবনের মধ্যে সত্যবতী নিজের ব্যক্তিত্ব আরোপ করলে কাজ হবে, এই কথা ভেবেই সত্যবতী বললেন–ভীষ্ম! আমি তোমার ওপর ভরসা করে–তস্মাৎ সুভূশমাখস্য ত্বয়ি–একটা কাজ করতে বলেছি তোমাকে। তুমি মন দিয়ে শোনো। সত্যবতী বললেন–আমার পুত্র ছিল তোমার ভাই। তাকে তুমি যথেষ্ট ভালওবাসতে। তা সে তো অল্প বয়সেই মারা গেল। একটা ছেলেপিলেও রইল না যে বংশে বাতি দেবে–বাল এব গতঃ স্বর্গ অপুত্রঃ পুরুষভঃ। আমি বলি কী–আমার ছেলের বউ দুটি তো রয়েছে ইমে মহিষ্যৌ ভ্রাতুস্তে কাশীরাজসুতে শুভে।

সত্যবতী নিজের বক্তব্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার পুত্রবধূদের রমণীয়তা এবং তাদের উপাদেয়তাও বর্ণনা করেছেন। ভীষ্ম নিজে পছন্দ করে কাশীরাজের মেয়ে দুটিকে ভাইয়ের। বিয়ের জন্য হরণ করে নিয়ে এসেছিলেন বলেই সত্যবতীর কথা বলবার যুক্তি হল-ওরা তো দেখতে শুনতে খারাপ নয়। যথেষ্ট রূপবতী এবং যৌবনবতী। তাছাড়া বেচারাদের দুঃখ দেখ-স্বামীটি মারা গেল, যাক। বেচারারা কোল-আলো করা ছেলে পেল না একটিও রূপযৌবনসম্পন্নে পুত্ৰকামে চ ভার

সম্বোধনটা দেখুন কেমন তেল-মাখানো-ভারত। অর্থাৎ ভরতবংশের মর্যাদা সম্বন্ধে যিনি সদা-সচেতন। পুত্রসম্বন্ধী ভীষ্মের সামনে আপন পুত্রবধূদের রূপযৌবনের থেকেও পুত্রকামনাটাই বড় করে দেখিয়ে সত্যবতী বললেন–তা আমি বলি এই মহান কুলের স্বার্থেই তুমি আমার পুত্রবধূদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করো। সত্যবতী মাতৃসুলভ আদেশ দিয়ে বললেন–মনে কোরো না এতে কোনও অধর্ম হবে। তুমি আমার আদেশে–মন্নিয়োগাৎ মহাবাহো-এই পুত্রবধুদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করে। এটাই এখন ধর্ম–ধর্মংকর্তুমিহাহসি।

এমন যুক্তি ভীষ্মের মনে আসতেই পারে যে, পুত্ৰই যদি চাইব, তবে তো নিজেই বিয়ে-থা করতে পারি। অনুজের রতোচ্ছিষ্ট ভ্রাতৃবধুদের সঙ্গে আমার কিসের প্রয়োজন? হ্যাঁ, এই যুক্তি আসতেই পারে এমনটি ভেবে মনস্বিনী সত্যবতী ভীষ্মকে বিকল্প-ব্যবস্থাও অনুমোদন করে বলছেন–আর না হয় তুমি বিধিসম্মতভাবে নিজেই একটা বিয়ে করো পুত্র!–দারাংশ্চ কুরু ধর্মেণ। আর পিতৃরাজ্যও তোমাকেই গ্রহণ করতে হবে। ভরত বংশের প্রজাদের তো আর ফেলে দেওয়া যাবে না-রাজ্যে চৈবাভিষিচ্যস্ব ভারতা অনুশাধি চ। তুমি তোমার পুত্রবধুদের গর্ভেও পুত্র উৎপাদন করতে পার, আবার নিজেও বিয়ে করতে পার। কিন্তু যা হোক একটা কিছু করতে হবে। এইভাবে বংশলুপ্তির প্রসঙ্গ যেখানে এসে পড়েছে, সেখানে তুমি নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পার না। তুমি তোমার বাপ-ঠাকুরদার পিণ্ডলোপ করে তাদের নরকে ডোবাতে পার না কিছুতেই–মা নিমজ্জীঃ পিতামহান্।

সত্যবতীর কথার মধ্যে মমতা ছিল, ব্যক্তিত্ব ছিল এবং গুরুজনোচিত আদেশও ছিল। তিনি বলেছিলেন–আমার আদেশে আমারই পুত্রবধূদের গর্ভে তুমি পুত্র উৎপাদন করো। আমাদের কুলের বৃদ্ধি হবে তাতে–তয়োরুৎপাদয়াপত্যং সন্তানায় কুলস্য নঃ।

আপনারা জানেন–সেকালে এই নিয়ম প্রচলিত ছিল। যে রমণী অপুত্রক অবস্থায় বিধবা হলেন অথবা যাঁর স্বামী পুত্র উৎপাদনে অক্ষম, সেই রমণীকে পুত্রহীনতার অভিশাপ নিয়েই সারা জীবন কাটাতে হত না। বিধবা রমণী হলে একই বংশজ দেবরের দ্বারা পুত্রোৎপত্তি সামাজিকরা মেনে নিতেন। দেবর কিংবা স্বামীর বংশজ কেউ না থাকলে ধার্মিক ব্রাহ্মণকেও পুত্র উৎপাদন করার জন্য অনুরোধ করা হত। কিন্তু অপুত্রক রমণী নিজের ইচ্ছামতো যাকে পছন্দ তাকে দিয়েই নিজের গর্ভাধান করাতে পারতেন না। এক্ষেত্রে বাড়ির বয়োজ্যষ্ঠ বা হিতৈষী বৃদ্ধদের অনুমতি প্রয়োজন হত। তার বংশরক্ষার প্রয়োজনে উপযুক্ত ব্যক্তিকে পুত্রোৎপাদনে নিয়োগ করতেন বলেই–এই প্রথার নাম নিয়োগ-প্রথা। সত্যবতীর মুখেও ভীষ্মের প্রতি এই নিয়োগের উচ্চারণ শুনতে পাই–তোমাকে আমি এই কাজে নিযুক্ত করছি–কার্যে ত্বাং বিনিযোক্ষ্যামি তদ্ভুত্ব কর্তুমহসি। অথবা সত্যবতী বলছেন–আমার আদেশে তুমি এই ধর্মকার্য সম্পন্ন করো–মন্নিয়োগাহাবাহো ধর্মং কর্তৃমিহাইসি।

ভীষ্ম সত্যবতীর কথার উত্তর দিলেন আনুপূর্বিক যুক্তি সহকারে। বললেন–মা! আপনি যে প্রস্তাব করেছেন, তা অবশ্যই ধর্মসম্মত, কিন্তু পুত্র উৎপাদন করার ব্যাপারে আমি পূর্বে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, সে তো আপনি ভালই জানেন– প্রতিজ্ঞাং বে মে পুরা। আপনার বিবাহের পণ হিসেবেই আমাকে এই প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছিল এবং তাও আপনার না জানা থাকার কথা নয়-জানাসি চ যথাবৃত্তং শুল্কহেতোস্তদন্তরে। আমি এই তিন ভুবন ত্যাগ করতে পারি, আমি যদি দেবতাদের রাজা হই, তো সেই রাজত্বও আমি ত্যাগ করতে পারি, কিন্তু আমার প্রতিজ্ঞা ত্যাগ করতে পারি না। আজকে যদি সূর্য তার প্রভা ত্যাগ করে অথবা চাঁদ ত্যাগ করে তার শীতলতা–প্রভাং সমুৎসুদকঃ..সোমঃ শীতাংশুতাং ত্যজেৎ–তবু আমি আমার প্রতিজ্ঞা ত্যাগ করতে পারি না।

সত্যবতী ভীষ্মের কাছে যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাতে যে এই বয়স্ক পুত্রটির কাছে বেশ খানিকটা কটু কথা শুনতে হবে, সে কথা তিনি বেশ ভালই জানতেন। এর জন্য তিনি রাগও করলেন না ভীষ্মের ওপর। কারণ, তিনি জানেন–ভীষ্মের প্রতি যে অসম্ভব বঞ্চনা পূর্বেই হয়ে গেছে, তার জন্য এই সামান্য প্রায়শ্চিত্তটুকু তাকে করতেই হবে। ভীষ্মের মুখে এত কঠিন কথা শুনেও সত্যবতী তবু অবুঝের মতো বলে উঠলেন–জানি। আমি জানি। তুমি যে দৃঢ়ভাবে সত্যে প্রতিষ্ঠিত–তা জানি। আমি এও জানি–আমারই কারণে এই কঠিন প্রতিজ্ঞা তুমি করেছিলে–জানামি চৈব সত্যং তম্মমার্থে যচ্চ ভাষিত। কিন্তু দেখ, আপদ-ধর্মের কথা তো তোমাকে বুঝতে হবে। তোমাকে তো ভাবতেই হবে, যাতে তোমাদের এই বিশাল বংশের ধারাটি ছিন্ন না হয়ে যায়, যাতে ধর্ম বিপন্ন না হয়ে পড়ে–যথা তে কুলতশ্চ ধর্মশ্চ ন পরাভবেৎ।

আপদ-ধর্ম, বংশ-রক্ষা, কুল-ধর্ম–সত্যবতী অনেক ধর্মের কথা বলেছেন। সন্দেহ নেই–অতিরিক্ত বিপন্নতার মধ্যে মানুষকে তার নীতি-ধর্ম থেকে সরে আসতে হয়। এই সরে আসাটা আপদ-ধর্মের মধ্যে গণ্য হয় বলেই শাস্ত্ৰকারেরা তার মধ্যে কাপদৃষ্টি করেন না। প্রচণ্ড অন্নকষ্ট এবং দুর্ভিক্ষের মধ্যে এক মুনিকে কুকুরের মাংস খেয়ে জীবনরক্ষা করতে হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক খবর আমরা মহাভারত থেকেই ভবিষ্যতে উদ্ধার করব। সত্যবতী মনে করেন-আজ ভরতবংশের কুলতন্তু ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় এই রকমই এক বিপন্নতা তৈরি হয়েছে, যা জীবনরক্ষার চেয়ে কম কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়। সত্যবতী যা বলেছেন, তা ভরতবংশের প্রতি মমতাবশতই বলেছেন, কিন্তু এই বলাটার মধ্যে এমনই এক বিলম্বের বিড়ম্বনা আছে, যা ভীষ্মের প্রতি সুবিচারের তথ্য বহন করে না।

পিতা শান্তনুর সঙ্গে সত্যবতীর বিবাহের সময় ভরতবংশের যুবরাজ যুবক ভীষ্মকে যে অসম্ভব প্রতিজ্ঞা করে নিজের যৌবনকে প্রতিহত করতে হয়েছিল, এখন সেই ভীষ্মকেই যদি তার পরিণত বয়সের পরিণতিকে অস্বীকার করে শুধু ভরতবংশের ধারা রক্ষা করার জন্য, তিনি পূর্বে যা করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন, তাই করতে হয়, তবে সেটা ভীষ্মের প্রতিই অবিচার করা হয়। মহাভারতের কবির নিরপেক্ষ দৃষ্টিতেও ভীষ্মের প্রতি এই সহানুভূতিটুকু আছে। অতএব কবির জননী হওয়া সত্ত্বেও সত্যবতী যা বলেছেন–তা সে আপ-ধর্মই হোক অথবা কুলধর্ম-মহাভারতের কবির মতে সত্যবতী যা বলেছেন, তা ভীষ্মের ওপর অবিচার করে বলেই তা অধর্ম-ধৰ্মাদ অপেতং ধ্রুবতীং…কৃপণাং পুত্ৰগৃদ্ধিনীম্।

ভীষ্ম সত্যবতীর আপদ্ধর্মের কথার সূত্র ধরেই উত্তর দিলেন। সত্যবতী ভীষ্মকে বলেছিলেন–আমি তোমায় নিয়োগ করছি, আদেশ করছি–কার্যে ত্বং বিনিযোক্ষ্যামি… মন্নিয়োগামহাবাহো–ভীষ্ম সেই আদেশেরও প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন। এই প্রত্যুত্তর জননীর প্রতি নয়, কারণ প্রকৃত জননী হলে ভীষ্মের মনোব্যথা তিনি বুঝতেন। এই এক মুহূর্তের আদেশের মধ্যে সত্যবতী তার প্রায় সমবয়স্ক অথবা উত্তরবয়সী বন্ধুটির বন্ধুত্ব এবং অবশ্যই পুত্রত্বও অতিক্রম করে অন্যায়ভাবে ভীষ্মের ওপর জোর খাটাচ্ছেন। এই জোর খাটানোটা অন্তত সেই মুহূর্তের জন্য তার কাছে প্রয়োজনীয় মনে হলেও, সেটা জননীর মতো নয়। ভীষ্মও তাই জননীকে উত্তর দিচ্ছেন না। উত্তর দিচ্ছেন পুরু-ভরতবংশের রাজমাতাকে, রাজরানীকে। বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পর হস্তিনাপুরের রাজ-সিংহাসন এখন রিক্ত। এখানে অফিসিয়ালি আদেশ দেবার মতো এখন কেউ নেই। কিন্তু মহারাজ শান্তনুর পরিণীতা পত্নী এবং রাজা বিচিত্রবীর্যের মাতা মহারাজ শান্তনুর সমস্ত রাজকার্যে উপস্থিত। তিনি রাজবংশের স্থিতিশীলতা নিয়ে চিন্তা করছেন। অতএব ভীষ্ম তাকে বোধহয় নিতান্ত ইচ্ছাকৃতভাবেই সম্বোধন করলেন রাজ্ঞী বলে।

ভীষ্ম বললেন–রানীমা! আপনি যে এত ধর্ম-ধর্ম করছেন, আপনি ধর্মের দিকেই একবার তাকিয়ে দেখুন। আমাদের সবাইকে এইভাবে ডুবিয়ে দেবেন না-রাত্রি ধর্মান্ অবেক্ষস্ব মা নঃ সর্বান্ ব্যনীনশঃ। ভীখ এবার ক্ষত্রিয়ের চিরন্তন ধর্ম স্মরণ করিয়ে সত্যবতীকে বললেন–সত্য থেকে চ্যুত হওয়া অথবা নিজের প্রতিজ্ঞা থেকে সরে আসাটা কি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম হতে পারে, না সেটা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে মানানসই হয়–সত্যাঙ্ক্ষতিঃ ক্ষত্রিয়স্য ন ধর্মেধু প্ৰশস্যতে। ভীষ্মের এই কথায় মহারাজ শান্তনুর রাজ্ঞী, সত্যবতী যদি দুঃখ পান, তাই ভীষ্ম তার দুশ্চিন্তার অংশীদার। হয়ে প্রস্তাব করলেন–মহারাজ শান্তনুর সন্তানধারা যাতে অব্যাহত থাকে, সেই বংশধর্মের কথা আপনাকে আমি নিশ্চয় বলব এবং যা বলব, তা আপনি হস্তিনাপুরের রাজপুরোহিত এবং অন্যান্য ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আলোচনা করুন। আপদ্ধর্ম তো আর একরকম নয়। সমস্ত ব্রাহ্মণ এবং স্বয়ং পুরোহিত যারা আপদ্ধর্মের নানা বিধানের সঙ্গে পরিচিত, তারা সামাজিক নীতি-নিয়মের সম্বন্ধে অভিজ্ঞ, আপনি তাদের সঙ্গে আলোচনা করে করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিন– আপদ্ধর্মার্থকুশলৈলোকতন্ত্রমবেক্ষ্য চ।

 ভীষ্মের ভাবটা এই–বংশরক্ষার মতো আপধর্মের প্রসঙ্গ যদি থাকে, তো সেখানে। মুশকিল আসান হলেন ব্রাহ্মণেরা; আমি কেন? ভীষ্ম সত্যবতীর কাছে পরশুরামের একটি ঘটনা বললেন। পরশুরাম পিতাকে হত্যা করেছিলেন হৈহয়-যাদবদের বিখ্যাত রাজা কার্তবীর্য–অর্জুন। প্রতিহিংসা নেবার জন্য পরশুরাম কার্তবীর্য-অর্জুনকে আপন কুঠারের আঘাতে নৃশংসভাবে মেরে ফেলেন এবং তার রক্ত দিয়ে পিতার তর্পণ করেন। কিন্তু শুধু পিতৃহন্তাকে শাস্তি দিয়েই পরশুরামের ক্রোধাগ্নি প্রশমিত হল না। তিনি রথে চড়ে কাঁধে কুঠার নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন–কোথায় কোন ক্ষত্রিয় আছে, তাদের সবাইকে মারবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে।

পৌরাণিকেরা বলেন–পরশুরাম একুশবার পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়শূন্য করে দেন। ক্ষত্রিয় পুরষেরা যখন কেউই আর বেঁচে রইলেন না, তখন তাদের বিধবা পত্নীরা ক্ষত্রিয়দের বংশধারা কোনওমতে জিইয়ে রাখবার জন্য বেদবিৎ শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণদের কাছে পুত্রার্থিনী হয়ে মিলন কামনা করলেন। ব্রাহ্মণরাও ক্ষত্রিয়াণী রমণীদের আপদগ্রস্ত দেখে আপধর্মের বিধানে তাদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করলেন–উৎপাদিতন্যপত্যানি ব্রাহ্মণৈর্বেদপারগৈঃ। সেকালের দিনের বৈদিক আচার এবং সামাজিক নিয়ম অনুযায়ী অন্যের দ্বারা উৎপাদিত ক্ষেত্রজ পুত্ৰও পরিণেতার পুত্র বলে গণ্য হতেন–পাণিগ্রাহস্য তনয়ঃ ইতি বেদেষু নিশ্চিতম।

ব্যাপারটা বোঝাতে গেলে এই রকম দাঁড়ায় : ক্ষেত্র মানে জমি। যে কোনও স্ত্রীলোকই ক্ষেত্র বলে পরিচিত, কেন না, ক্ষেত্র থেকে যেমন ধান-গম পাওয়া যায়, স্ত্রীলোকেন্দ্র গর্ভ থেকেও তেমনি আমরা পুত্র-কন্যার ফল লাভ করি। অতএব ক্ষেত্র অর্থ স্ত্রীলোক। বিবাহিত পুরুষের নিজের স্ত্রী হলেন তার স্বক্ষেত্র। এখন স্বক্ষেত্রে যদি বিধিসম্মতভাবে বিবাহিত পরিণেতা (যিনি বিয়ে করেছেন) পুরুষের সন্তান না হয়, তবে স্বামী ইচ্ছা করলে অন্য উচ্চকুলজাত শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পুরুষকে টাকা-পয়সা দিয়েই হোক, অথবা ব্যাকুলচিত্তে আহ্বান করেই হোক, অথবা যেভাবে হোক–তিনি তার নিজের স্ত্রী বা স্বক্ষেত্রে পুত্র উৎপাদন করার জন্য তাকে আহ্বান জানাতে পারেন।

এই প্রক্রিয়ার মধ্যে যেহেতু স্বামীর অনুমতি, তার অর্থ অথবা তার নিজকৃত নিমন্ত্রণ-প্রক্রিয়া জড়িত থাকে, তাই পুত্রটি তার নিজের বলেই পরিচিত হয়–ধনাদিনা উপনিমন্ত্রনা ক্ষেত্রপতেরেব সা সন্ততির্ন বিপ্রস্যেতি। এখানে নিয়োগকর্তা স্বামী, পুত্রও তারই। যে সব ঘটনায় স্বামী জীবিত না থাকেন, সেখানে স্ববংশীয় বৃদ্ধরা এই বিষয়ে অনুমতি করেন। আবার যেখানে স্বামীও নেই, বৃদ্ধরাও নেই, সেখানে স্ত্রী স্বয়ং উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে পুত্র যাচনা করতে পারেন, যেমন এই পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় হবার পর তাদের ক্ষত্রিয় স্ত্রীলোকদের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। লক্ষণীয়, এই পুত্র-যাচনার মধ্যে স্বামীর বংশধারা রক্ষা করার তাগিদটাই যেহেতু বেশি থাকে, তাই এই ‘তথাকথিত’ অবৈধ মিলনের মধ্যে রতি, রমণ বা ইন্দ্রিয়চরিতার্থতার বৃত্তি পুষ্ট হওয়ার কথাটা গৌণ হয়ে যেত। পুত্র-প্রাপ্তিই যেহেতু প্রধান লক্ষ্য, তাই এই ব্রাহ্মণ-সংসর্গের মধ্যেও ধর্মবুদ্ধিই প্রধান কার্যকরী শক্তি বলে মনে করা হত-ধর্মং মনসি সংস্থাপ্য ব্রাহ্মণাংস্তা সমভ্যয়ুঃ।

ভীষ্ম সত্যবতীর কাছে সাধারণভাবে প্রথমে জানালেন যে, কীভাবে উচ্ছিন্ন ক্ষত্রিয় বংশ ব্রাহ্মণদের দ্বারা পুনঃস্থাপিত হয়েছিল। দ্বিতীয় উদাহরণে তিনি সেই অন্ধ ঋষি দীর্ঘতমার প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন। দীর্ঘতমার কথা আমরা পূর্বে বলেছি। বলেছি–উতথ্য এবং বৃহস্পতির প্রসঙ্গে। বৃহস্পতি তার অগ্রজ উতথ্যের পত্নী মমতার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে গর্ভবতী অবস্থায় ধর্ষণ করেন। মমতার গর্ভস্থ সন্তান বৃহস্পতির শাপ লাভ করে অন্ধ অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন। অথবা গর্ভবতী অবস্থায় ধর্ষিতা হবার কারণেই হয়তো তিনি অন্ধ দীর্ঘতমার জননী হন।

দীর্ঘতমার নিজের জন্ম-কাহিনী যাই হোক, মহাভারত এবং অন্যান্য পুরাণগুলিতে যেমন খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখছি তার মধ্যেও কিছু কিছু যৌন বিকার তৈরি হয়েছিল। তিনি নিজে মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি ছিলেন। খোদ ঋগবেদে তার নামে কতগুলি সূক্ত আছে। কিন্তু বিদ্যাবত্তা এবং শাস্ত্রজ্ঞান যথেষ্ট থাকা সত্ত্বেও তিনি এতটাই ইন্দ্রিয়পরায়ণ হয়ে পড়েছিলেন যে, তার স্ত্রী-পুত্র তাকে ভেলায় করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেন। ভেলায় ভাসতে ভাসতেই দীর্ঘতমা এসে পৌঁছন আনব বা অনুবংশীয় রাজার দেশে। এখনকার দেশস্থিতিতে এই দেশ হল মুঙ্গের-ভাগলপুর অঞ্চল। এই দেশের রাজা বলির কোনও পুত্র ছিল না। রানী সুদেষ্ণা অপুত্রক অবস্থায় দিন কাটান। রাজবংশের ধারা বজায় রাখতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন এবং এই ব্যর্থতা বোধহয় অনেকটাই তার স্বামীর কারণেই। যাই হোক বলিরাজ দীর্ঘতমার কাছে প্রার্থনা জানালেন তার স্ত্রীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করার জন্য–সন্তানার্থং মহাভাগ ভার্যাসু মম মানদ।

দীর্ঘতমা বলিরাজের অনুরোধে স্বীকৃত হলেন বটে, কিন্তু রানী সুদেষ্ণা দীর্ঘতমাকে অন্ধ এবং বৃদ্ধ দেখে রাজার অজ্ঞাতসারে তার দাসীটিকে পাঠিয়ে দিলেন মুনির কাছে। মুনি সবই বুঝলেন এবং পরে অবশ্য বলিরাজের অনুরোধে এবং তিরস্কারে সুদেষ্ণাও দীর্ঘতমার সঙ্গে মিলিত হন। দীর্ঘতমার ঔরসে সুদেষ্ণার গর্ভে যে পুত্ররা জন্মাল, তাদের নাম জড়িয়ে আছে আমাদেরই পূর্ব ভারতের দেশগুলির সঙ্গে। এই পুত্রগুলির নাম অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পড় এবং সুহ্ম। বলিরাজের পুত্রদের নাম থেকেই না হয় আমরা আমাদের পরিচিত দেশগুলির নাম পেলাম, কিন্তু এই সম্পূর্ণ ঘটনা এবং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের যেটা লক্ষ্য করতে হবে, সেটা হল পরক্ষেত্রে উৎপাদিত দীর্ঘতমার এই পুত্রেরা কেউ দীর্ঘতমার পিতৃত্ব নিয়ে বিখ্যাত হলেন না। বলিরাজের নামেই তারা সবাই বালেয় ক্ষত্রিয় বলেই পরিচিত হলেন।

মহামতি ভীষ্মও সত্যবতীর কাছে এই ঘটনার উল্লেখ করে বুঝিয়ে দিতে চাইলেন যে, ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন করার জন্য ভীষ্মের দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ না করে উপযুক্ত ব্রাহ্মণ-ঋষিদের স্মরণ নিলে তার পূর্বকৃত সত্য-প্রতিজ্ঞা থেকেও তিনি ভ্রষ্ট হবেন না, অপরদিকে অম্বিকা ও অম্বালিকার সন্তানরাও বিচিত্রবীর্যের নামে পুরু-ভরত-কুরুবংশের গৌরবেই বিখ্যাত হবেন। ভীষ্ম শেষ সিদ্ধান্ত জানালেন–এই পৃথিবীতে মহাধনুর্ধর, মহা বলবান এবং পরম-ধার্মিক অনেক রাজাই আছেন–জাতাঃ পরমধর্মজ্ঞা বীর্যবন্তো মহারথাঃ যারা ব্রাহ্মণের বীজে পরক্ষেত্রে উৎপন্ন হয়েছেন–এমন্যে মহেসা ব্রাহ্মণৈঃ ক্ষত্রিয়া ভুবি। অতএব আপনিও সেই ব্যবস্থা করুন, মা! সেই ব্যবস্থা করুন। সিদ্ধান্তের শেষে ভীষ্ম আবারও সত্যবতীকে জননীর সম্বোধনে সম্বোধন করলেন, কারণ সত্যবতী এখন তার প্রায় সমবয়স্ক পুত্রটির কথা বন্ধুর মতো শুনছেন। ভীষ্ম বললেন–আমার কথা শুনে আপনার যেমনটি মনে চায় তাই করুন মা–এত্যুত্ব ত্বমপ্যত্র মাতঃ কুরু যথোঙ্গিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *