০৫৫. বার্হদ্রথ জরাসন্ধ

৫৫.

বার্হদ্রথ জরাসন্ধ এখন কেবলই মগধে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। পূর্বভারতে কৌরব বংশধারার বীজ তখন কেবলই উপ্ত হয়েছে মাত্র। তখনও সমগ্র ভারত জরাসন্ধের পরাক্রমে পর্যদস্ত হয়নি। হস্তিনাপুরের যুবরাজ শান্তনুর সঙ্গে গঙ্গার চঞ্চল সাক্ষাৎকার কেবলই সমাপ্ত হয়েছে। মথুরা ভূখণ্ডে তখন আপুত্র উগ্রসেন আপন অধিকার কেবলই বিস্তারিত করছেন। আনুমানিক ঠিক সেই সময়ের এক গোধুলিবেলায় আধুনিক মিরাটের পশ্চিম দিকে যেখানে যমুনা নদী বয়ে যাচ্ছে, সেই যমুনা নদীর তীর ঘেঁষে একটি নৌকা দাঁড়িয়েছিল। যাতে নদীতে ভেসে না যায়, সেইজন্য একটি নির্মিত রঞ্জুর একদিকে একটি খুঁটি বেঁধে সেটি যমুনার তীরভূমিতে আটকানো রয়েছে। রঞ্জুর অন্য প্রান্ত নৌকার সঙ্গে বাঁধা।

নৌকাটি জলের ওপর ভাসছিল। নদীর কৃষ্ণবর্ণ জলতরঙ্গগুলি ছলাৎ ছলাৎ করে তীরের ওপরেও যেমন সামান্য আছড়ে পড়ছিল, তেমনই নৌকার তলদেশেও সেই তরঙ্গের অভিঘাত টের পাওয়া যাচ্ছিল। নৌকাটি একটু-আধটু দুলছে আর সেই ঈষদুচ্চলিত নৌকার হালের পিছনে একটি রমণীকে বসে থাকতে দেখা গেল। রমণী অতিশয় সুন্দরী। কিন্তু তার গায়ের রঙ ঘন কৃষ্ণবর্ণ। লোকেও তাঁকে কালী বলে ডাকে।

কালো যমুনার জলের ওপর নৌকার প্রান্তদেশে নিষগ্না কৃষ্ণবর্ণা এই রমণী চিত্রার্পিতের মতো দিগন্তের শোভা বর্ধন করছিলেন। তার কেশরাশি মাথার ওপর চূড়া করে বাঁধা। আতা ওষ্ঠাধারের মধ্যে মুক্তাঝরানো হাসি। রমণীর উত্তমাঙ্গের বস্ত্র পৃষ্ঠলম্বী গ্রন্থিতে দৃঢ়নিবদ্ধ। আর অধমাঙ্গের বস্ত্র কিছু খাটো। নৌকার ত্রিকোণ প্রান্তের ওপর বসে রমণী পা-দুটি নিবদ্ধ অবস্থায় নৌকার কাষ্ঠ-স্তরের ওপর ছড়িয়ে দেবার ফলে কদলীস্তম্ভ-সদৃশ তার পা-দুটি উরু পর্যন্ত প্রায়

আপনি সাধারণ মানুষ হোন অথবা জিতেন্দ্রিয় সিদ্ধ মহাপুরুষ, নীলোর্মিচঞ্চল যমুনার জলে একটি নৌকার ওপর এমন একটি স্বভাবসুন্দর প্রত্যঙ্গমোহিনী রমণীমূর্তি দেখতে পেলে যোগী-ধ্যানী-কারও ধৈর্য স্থির থাকবে না-অতীবরূপসম্পন্নাং সিদ্ধানামপি কাঙ্ক্ষিতা। নদীর তীরভূমিতে এইমাত্র যে এক মহর্ষি এসে পৌঁছলেন, তিনি নদীর পরপারে যাবার জন্যই এসেছিলেন। মহর্ষি তীর্থ-পরিক্রমায় বেরিয়েছেন। হয়তো যমুনা পার হয়ে মথুরা-শূরসেন অঞ্চলের কোনও তীর্থে যাবেন তিনি, হয়তো বা মৎস্যদেশের কোনও তীর্থে যাবার ইচ্ছে আছে তাঁর।

 এই অঞ্চলে যমুনা কিঞ্চিৎ শীর্ণতোয়া। ফলে নদী পারাপারের জন্য এইখানেই সকলে আসে। মহর্ষিও তাই এসেছেন। অন্য সময়েও তিনি এখানে যমুনা পার হয়েছেন এবং একটি পুরুষকেই তিনি নদী পার করে দিতে দেখেছেন। কিন্তু আজ এই গোধূলিবেলায় সূর্যের শেষ অস্তরাগ যখন নীল যমুনার জলে মাখামাখি করে এই নিকষা-কালো রমণী দেহের ঊরুদেশের ওপর বিচ্ছুরিত হল, তখন এই মহামুনির মনেও জেগে উঠল আকস্মিক আসঙ্গ-লিঙ্গা, লালসা–

দৃষষ্ট্রৈ চ তাং ধীমাংশ্চকমে চারুহাসিনীম্।
দিব্যাং তাং বাসবীং কন্যাং রাস্তারুং মুনিপুঙ্গবঃ।

তবে মনে মনে লালসা-তাড়িত হলেও সঙ্গে সঙ্গে মুনি তা প্রকাশ করলেন না। ক্রোধ, লোভ, লালসা স্তম্ভন করার অভ্যাস তার আছে। অতএব তিনি সামান্য সংযত হয়ে মৃদুহাসিনী সুন্দরীকে বললেন–হ্যাগো মেয়ে! এখানে যে চিরকাল নৌকা পারাপার করে, আমাদের সেই পরিচিত নাইয়াটি কোথায় কর্ণধারো যেন নীয়তে ক্ৰহি ভামিনি? রমণী বলল–আমার পিতার কোনও পুত্র সন্তান নেই, মহর্ষি। তাঁর যাতে বেশি কষ্ট না হয়, সেইজন্যই এই নৌকা। নিয়ে আমিই খেয়া পারাপার করি। লোক বেশি হলেও আমাকে বাইতে হয় এই নৌকা-নৌময়া বাহ্যতে দ্বিজ। মহর্ষি বললেন–সে তো খুব ভাল কথা, তাহলে আর দেরি কিসের? আমাকে নিয়ে চলো ওপারে। হয়তো আমিই তোমার শেষ আরোহী–অহং শেষো ভবিষ্যামি নীয়তামচিরেণ বৈ। নীল যমুনার জলবাহিনী নৌকার ওপরে মধুহাসিনী নাইয়া নৌকা বেয়ে চলল। আরোহী একা মহর্ষি। সে দিনের শেষ আরোহী।

এই মুনির পরিচয় আর না দিলে নয়। সূর্যবংশের বিখ্যাত পুরোহিত বশিষ্ঠের নাম আপনারা শুনেছেন। এই মুনি তার নাতি। বিশ্বামিত্র মুনির সঙ্গে বশিষ্ঠের যে দীর্ঘদিনের বিবাদ চলেছিল, তাতে বশিষ্ঠের জ্যেষ্ঠ পুত্র শক্তি মারা গিয়েছিলেন। মারা গিয়েছিলেন মানে, তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল। পুরাণ-ইতিহাসের বর্ণনা অনুযায়ী সূর্যবংশের রাজা কল্মষপাদের পুরোহিত-পদবী লাভের জন্য বিশ্বামিত্র এবং বশিষ্ঠ দুজনেরই কিছু প্রতিযোগিতা ছিল। এই অবস্থায় বশিষ্ঠপুত্র শক্তির সঙ্গে কল্মষপাদের বিবাদ বাধে একটি পথের অধিকার নিয়ে। রাজা শক্ট্রিকে অপমান করেন। শক্ট্রিও ক্রুদ্ধ হয়ে রাজাকে শাপ দেন।

রাজা কল্মাষপাদ নাকি শরি শাপে নরমাংসভোজী এক রাক্ষসে পরিণত হন এবং এই পরিণতির পর শক্ত্রিকে দিয়েই নাকি রাজা কল্মষপাদের নরমাংস ভোজনের আরম্ভ সূচিত হয়। এই উপাখ্যানের মধ্যে যে সত্য আছে, তার চেয়েও বড় সত্য হল–রাজা কল্মষপাদ মহর্ষি বিশ্বামিত্রের সহযোগিতায় বশিষ্ঠপুত্র শক্ট্রিকে অকালে বধ করেন। আসলে এটা এক ক্ষত্রিয় রাজার সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য বিবাদের ঘটনা। মহাভারতে এই ঘটনার প্রসঙ্গও এসেছে ভার্গব ব্রাহ্মণদের সঙ্গে ক্ষত্রিয় রাজাদের বিবাদের সূত্র ধরে। রাক্ষস-টাক্ষসের উপাখ্যান থাক, কল্মষপাদ শক্ট্রিকে হত্যা করেছিলেন। পরে অবশ্য শক্ট্রির পিতা বশিষ্ঠের সঙ্গে কল্মষপাদের সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়। কিন্তু এতদিনে আরও একটি ঘটনা ঘটে গেছে।

শক্ত্রি যখন মারা যান, তখন তার ঔরসজাত পুত্র গর্ভস্থ ছিলেন। শক্ত্রি স্ত্রীর নাম অদৃশ্যন্তী। ঋষি বশিষ্ঠ পুত্রশোকে পাগল হয়ে যান। নানাভাবে তিনি আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয় না। বহুকাল নানা জায়গায় ঘুরে–স গত্বা বিবিধান শৈলান্ দেশান্ বহুবিধাস্তথা। ক্লান্ত শ্রান্ত শোকাচ্ছন্ন মুনি আবার নিজের আশ্রমে ফেরার পথ ধরলেন। ঠিক এই সময়ে একটি দীনহীন বিধবা রমণী বশিষ্ঠকে অনুসরণ করে চলতে লাগল পিছন পিছন। আনমনা বশিষ্ঠের কানে হঠাৎ ভেসে এল বেদ-উচ্চারণের উদাত্ত-অনুদাত্ত-স্বরিত। মহর্ষি পিছন ফিরে অবাক বিস্ময়ে বলে উঠলেন–কে? কে আমার পিছন পিছন আসছে? বিধবা রমণী বললেন–আমি। পিতা আমি আপনার পুত্রবধূ অদৃশ্যতী। বশিষ্ঠ বললেন– তাহলে কার মুখে এই বেদধ্বনি উচ্চারিত হতে শুনলাম। এই ধ্বনি এই স্বর। এ যে আমার বহুপূর্ব-পরিচিত। আমার মৃত পুত্র শস্ত্রির মুখে আমি ঠিক এই স্বর, এই উচ্চারণ শুনেছি– পুরা সাঙ্গস্য বেদস্য শক্রেরিব ময়া ক্ষতঃ।

অদৃশ্যন্তী সলজ্জে বললেন–পিতা! আমার গর্ভে একটি পুত্র রয়েছে। আপনার পুত্র শক্ট্রির ঔরসেই এই পুত্রের উৎপত্তি। এখন তার বার বৎসর বয়স। সে গর্ভস্থ অবস্থাতেই সাঙ্গ বেদ উচ্চারণ করছে। এটি সিদ্ধান্তবাগীশের বঙ্গানুবাদের ভাবমাত্র। আমাদের বিশ্বাস বশিষ্ঠ পুত্রশোকে পাগল হয়ে বঙ্কাল আশ্রমের বাইরে ছিলেন। হয়তো তিনি যখন ফিরে এসেছেন, তখন শন্ত্রিপুত্রের বার বছর বয়েস হয়ে গেছে। মায়ের কাছে, মায়ের অনুশাসনে, একমাত্র মায়েরই অঞ্চলছায়ায় তিনি এত বছর ধরে বড় হয়েছেন বলেই হয়তো এই গর্ভাবাসের কল্পনা। সংস্কৃত শ্লোকটি থেকেও এই কথাই প্রমাণ হয়। সেখানে বলা আছে আমার গর্ভ থেকেই এই পুত্রের জন্ম। আপনার পুত্র শক্তির পুত্র এই বালক। ছোটবেলা থেকে বেদ্যাভ্যাস করতে করতে এই ছেলের এখন বার বছর বয়স হল–সমা দ্বাদশ অস্যেহ বেদান্ অভ্যস্যতো মুনে।

অদৃশ্যন্তীর মুখে এই কথা শুনে বশিষ্ঠ আহ্লাদিত হলেন। শক্ত্রি বেঁচে নেই, তবে তাঁর পুত্র তো আছে–অস্তি সন্তানম, ইত্যুত্বা-বংশের ধারাটি তো অবিচ্ছিন্ন রইল। বশিষ্ঠ পুত্রবধূর সঙ্গে আশ্রমে ফিরে চললেন। শক্ত্রির পুত্র–সে যেন শক্ত্রিরই অন্য এক রূপ, অন্য এক জীবন–পরাসু। পর-অন্য। অসু-প্রাণ, জীবন। অথবা পরাসু অর্থাৎ নিণভাবে যে এতকাল বর্তমান ছিল, শক্ত্রির সেই পুত্রের নাম তাই পরাশর।

পরাশর অদৃশ্যন্তীর সামনেই পিতামহ বশিষ্ঠকে ‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে ডাকতেন। স্নেহময় বশিষ্ঠ তাতে বাধা দিতেন না। ভাবতেন–আহা! পিতা নেই, অন্যদের দেখে দেখে কাউকে পিতা বলে ডাকতে কোন বালকের না ইচ্ছা করে। পুত্রের এই ব্যবহারে মাতা অদৃশ্যন্তী বড় অস্বস্তিতে পড়তেন। কিছু লজ্জাও হত বুঝি। তা একদিন পরাশর বশিষ্ঠকে বাবা-বাবা’ করছেন, এই অবস্থায় অদৃশ্যণ্ডী পুত্রকে বললেন-বাছা! তুমি তোমার ঠাকুরদাদাকে এমন ‘বাবা-বাবা বলে ডাক কেন। এমন কোরো না-মা তাত তাত তেতি ক্ৰহ্যেনং পিতরং পিতুঃ। বনের ভিতর তোমার পিতাকে এক রাক্ষস খেয়ে ফেলেছে।

পরাশরের ক্রোধ উদ্দীপ্ত হল। তিনি রাক্ষসবধের জন্য রাক্ষসমেধ যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। দলে দলে রাক্ষস এসে যজ্ঞের আগুনে পুড়ে মরতে লাগল। উপাখ্যান অনুযায়ী মহর্ষি অত্রি, পুলহ এবং রাক্ষসদের মূলপিতা পুলস্ত্যও পরাশরের ক্রোধ শান্ত করার জন্য যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলেন। তারা সকলে একবাক্যে নিরীহ রাক্ষসদের বধ না করার জন্য পরাশরকে অনুরোধ করলেন। পরাশর সঙ্গে সঙ্গে তার প্রদীপ্ত রোষ সম্বরণ করলেন। তিনি যজ্ঞ বন্ধ করে দিলেন। তদা সমাপয়ামাস সত্রং শাস্ত্রো মহামুনিঃ।

রাক্ষসবধের জন্য নির্দিষ্ট কোনও যজ্ঞে পর পর রাক্ষস-বধ চলছিল কিনা, তা বলা সম্ভব নয়। তবে ব্রাহ্মণ-পরাশরের সঙ্গে অনাচারী রাক্ষসদের যে একটা তুমুল বিবাদ আরম্ভ হয়েছিল, সে কথা না বললেও চলে। অনুমান করা যায়–রাক্ষস-পক্ষপাতী পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু ইত্যাদি খ্যাতনামা মুনিদের হস্তক্ষেপে পরাশর যজ্ঞ বন্ধ করে দিলেন। পরাশরকে মুনিরা বলেছিলেন–ক্রোধ নয়, শান্তিই ব্রাহ্মণের ধর্ম। পরাশর শান্ত হলেন।

 পরাশরের এই ক্রোধশান্তির ব্যাপারে অন্যান্য মুনি-ঋষিদের তর্ক-যুক্তির অবদানই বেশি বলে মহাভারতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিষ্ণুপুরাণে দেখেছি–পরাশরকে তার পিতামহ বশিষ্ঠই শান্ত করেছিলেন। পরাশরকে তিনি বুঝিয়েছিলেন–আমার এবং আমার পুত্রের কোনও অপকার যারা করেনি, সেই নিরীহ রাক্ষসদের অগ্নিদগ্ধ কোরো না–অলং নিশাচরৈন্ধৈ-দীনৈরনপারিভিঃ। পিতামহের অনুনয়ে পরাশর তৎক্ষণাৎ আরব্ধ যজ্ঞ বন্ধ করেন এবং তখনই রাক্ষস-সমাজের মূল জনক পুলস্ত্য তাকে আশীর্বাদ করে বললেন–তীব্র বৈরভাব থাকা সত্তেও তুমি যে গুরুজনের কথায় এইভাবে ক্ষমা অবলম্বন করেছ, তাতে আমার আশীর্বাদ তুমি সমস্ত শাস্ত্রে প্রবীণ হবে। আরও বড় কথা, তুমি একটি পুরাণ-সংহিতার কর্তা হবে-পুরাণসংহিতাকর্তা ভবান্ বৎস ভবিষতি। আমরা জানি বিষ্ণুপুরাণের সংকলক স্বয়ং পরাশর।

পরাশর বিষ্ণুপুরাণ রচনা করেছিলেন কিনা, অথবা তিনি বার বৎসর বয়সের মধ্যেই সাঙ্গ বেদ অধিগত করেছিলেন কিনা, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। আমরা এই উপাখ্যানের অবতারণা করেছি একটিমাত্র কারণে। পরাশর কত শীঘ্র ক্রোধ প্রশমন করতে পারেন। শাস্ত্রকারেরা বলেছেন কাম এবং ক্রোধের জন্ম হয়েছে একই উৎস থেকে। উভয়েই রজোগুণের আত্মজ-কাম এবং ক্রোধ এষ রজোগুণসমূদ্ভবঃ। যিনি এক মুহূর্তের মধ্যে নিজের উদ্যত ক্রোধকে বশীভূত করতে পারেন সেই পরাশর মুনিকেই একটু আগে আমরা যমুনার তীরে এসে দাঁড়াতে দেখেছি। খেয়াতরীর নাবিকের অনুপস্থিতিতে তার মেয়ে নৌকা নিয়ে বসে আছে ঘাটে। মুনি তার উদ্ভিন্ন যৌবন নিরীক্ষণ করেছেন, তার কালো রূপের মধ্যে আলো দেখতে পেয়েছেন তিনি।

কিন্তু মহাভারতের অন্যান্য নরনারীর মধ্যে একবারের দর্শনমাত্রেই যে কামভাব লক্ষ্য করেছি, এখানে মুনির মনেও সে কামভাব আছে, কিন্তু তার মধ্যে পরিশীলনও আছে। আর আছে কবির মতো সেই ভাষা–আমি তোমার দিনশেষের শেষ যাত্রী হব, বাসবী। আমাকে নিয়ে চল যমুনার পরপারে–অহং শেষো ভবিষ্যামি নীয়তা অচিরেণ বৈ।

‘বাসবী’! এই শব্দের অর্থ এই রমণী বোঝে। তবে মুনি তাকে কেন বাসবী’ বলে ডাকলেন, তার কারণ জানার জন্য মনে মনে এই রমণীর আগ্রহ জেগে রইল। তবে আপাতত মুনির মন টলিয়ে কালী তার নৌকায় শেষ যাত্রীকে তুলে নিলেন। নৌকা বাইতে আরম্ভ করলে হালের টানের সঙ্গে তার রমূণী-শরীরের বিভঙ্গও একাকী সেই যাত্রীর চোখে পড়ল। মুনি তার দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে রইলেন। কালো মেয়ে সব বুঝে ফেলল এক লহমায়। খানিকটা সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করে সে বলল–লোকে আমাকে মৎস্যগন্ধা বলে ডাকে। আমি ধীবররাজ দাশের কথা কন্যা। বাস্তবে আমার পিতা-মাতা যে কে, তা ঠিক জানি না। সেজন্য আমার দুঃখও আছে যথেষ্ট।

মুনি রমণীকে নিরীক্ষণ করছেন অপলকে, কিন্তু সে সম্বন্ধে কোনও কথা না বলে, কেন তিনি তাকে ‘বাসবী’ বলে ডেকেছেন, তার কারণ জানার ইচ্ছেটাই সাময়িকভাবে বড় হয়ে উঠল। পরাশর যা বললেন, অথবা মহাভারতে যেমন বলা আছে, তাতে এই রমণী সেই বিখ্যাত চৈদ্য রাজা উপরিচর বসুর কন্যা বলে প্রমাণিত। কিন্তু এ প্রমাণ মহাকাব্যের উপাখ্যানশৈলীতে সঠিক বলে মনে হলেও বাস্তবে তা হতে পারে না। উপাখ্যানে আছে–উপরিচর বসু তার স্ত্রী গিরিকার সঙ্গে মিলিত হওয়ার আশায় বসেছিলেন। ঋতুস্নাতা গিরিকাও প্রস্তুত হয়ে ছিলেন মিলন কামনায়। কিন্তু এই অবস্থায় রাজাকে পিতৃপুরুষের আদেশে পিতৃযজ্ঞের জন্য মৃগবধের উদ্দেশে চলে যেতে হয় আকস্মিকভাবে।

মৃগয়ায় রাজার মন বসল না। সুন্দরী গিরিকার কথা বারবার তার মনে পড়ল–চকার মৃগয়াং কামী গিরিকামেব সংস্মরন্। রাজার মন মানল না, কামনার তেজবিন্দু তিনি ধারণ করলেন পত্রপুটে।

তারপরের ঘটনা সবার জানা। সেই তেজবিন্দু রাজা পাঠিয়ে দেন গিরিকার কাছে, এক বাজপাখির পায়ে বেঁধে। পথিমধ্যে অন্য একটি বাজপাখির আক্রমণে এই তেজ পতিত হয় যমুনা নদীতে। সেখানে শাপগ্রস্ত অঙ্গরা অদ্রিক মৎসী হয়ে বিচরণ করছিলেন। উপরিচর বসুর তেজ সেই মৎসী ভক্ষণ করে এবং গর্ভবতী হয়। এক সময়ে যমুনা নদীতে জাল ফেলে ধীবরেরা এই মৎসীকে দৈবাৎ ধরে ফেলে। ধীবরেরা এই মৎসীর গর্ভ থেকে একটি স্ত্রী এবং একটি পুরুষ শিশু দেখতে পায়। এই আশ্চর্য ঘটনা ধীবরেরা দেশের রাজা উপরিচর বসুর কাছে নিবেদন করে। সব দেখে শুনে চৈদ্য পুরুষ শিশুটিকে গ্রহণ করেন এবং মহাভারত বলেছে–রাজার এই পালিত পুত্র ভবিষ্যতে মৎস্য নামে একটি ধার্মিক রাজা বলে পরিচিত হন–স মৎস্যো নাম রাজাসীদ ধার্মিকঃ সত্যসঙ্গরঃ। শিশুকন্যাটিকে রাজা ধীবরদের হাতেই দিয়ে দেন এবং বলে দেন। শিশুটিকে যেন তারাই মানুষ করে। মৎস্যঘাতীদের আশ্রয়ে থাকায় এই মেয়েটি মৎস্যগন্ধা নামে পরিচিত হন–সা কন্যা দুহিতা তস্যা মৎস্যা মৎস্যসগন্ধিনী। তার অপর নাম সত্যবতী এবং তার ডাকনাম হয়তো কালী।

এই উপাখ্যানের অলৌকিকতার খোলস থেকে প্রকৃত সত্য উদ্ধার করা যথেষ্টই কঠিন এবং অসম্ভবও বটে। উপরিচর বসুর বংশ-পরম্পরা বিচার করলে কোনওভাবেই তিনি মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর পিতার সমবয়সী হতে পারেন না। সত্যবতী, ব্যাসদেব, ভীষ্ম এবং শান্তনুর সঙ্গে উপরিচর বসুর সমসাময়িকতা মাথায় রাখলে কোনওভাবেই সত্যবতী উপরিচরের কন্যা হতে পারেন না। কারণ, উপরিচর বসু অনেক আগের মানুষ। তবে এখানে একটা কথাই খেয়াল করার মতো। পরাশর মৎস্যগন্ধা কালীকে ডেকেছিলেন ‘বাসবী’ বলে। আমরা পূর্বে মহাভারতের মধ্যেই দেখেছি উপরিচর বসুর সব পুত্রকে একসঙ্গে ‘বাসব’ বলে ডাকা হয়–বাসবাঃ পঞ্চ রাজানঃ পৃথশোস্ট শাশ্বতাঃ। আমাদের অনুমান-মৎস্যগন্ধা বসুরাজের। পুত্র কোনও ‘বাসব’ রাজার বংশে জন্মেছেন। সেই কারণেই পরাশর তাঁকে ডেকেছেন বাসবী বলে।

আমাদের আরও একটা অনুমানের কথা বলি। আমরা পূর্বে জানিয়েছি–উপরিচর বসুর পঞ্চম পুত্র ‘মাবেল্ল’ হয়তো বসুরাজের অধিকৃত মৎস্যদেশের রাজা ছিলেন। কিন্তু বায়ু পুরাণে দেখছি–উপরিচর বসুর পুত্রসংখ্যা পাঁচ নয়, সাত জন এবং তার সপ্তম পুত্রের নামই মৎস্য অথবা মৎস্যকাল-মাথৈল্যশ্চ (মাবেশ্চ) ললিথশ্চ মৎস্যকাল সপ্তমঃ। সংস্কৃত পংক্তিটিতে ললিখ বলে যাদের বলা হয়েছে পণ্ডিতেরা তাদের রাজপুত লাঠোরদের পূর্বপুরুষ মনে করেন। আর আগেই আমরা জানিয়েছি যে, তখনকার মৎস্যদেশ হল এখনকার রাজপুতনার জয়পুর-ভরতপুর এবং আলোয়ার অঞ্চল। অর্থাৎ ললিখ এবং মৎস্য–এঁরা দুজনেই রাজপুতনা বা মৎস্যদেশের অধিবাসী ছিলেন।

মহাভারতের উপাখ্যানে সত্যবতীর জননীকে যেভাবে এক মৎসীর রূপ দেওয়া হয়েছে এবং সত্যবতীর আপন ভ্রাতার নামেই যেহেতু মৎস্যদেশের প্রতিষ্ঠা, অপিচ এই মৎস্যও যেহেতু একজন বাসব রাজা, তাই আমরা অনুমান করি সত্যবতী মৎস্যদেশীয় কোনও রমণী ছিলেন। অথবা তত্রস্থ মৎস্যরাজার সঙ্গে তার আত্মসম্বন্ধ ছিল বলেই মহাভারত তাকে মৎস্যা মৎস্যগন্ধিনী’ বলেছে। সংস্কৃতে সগন্ধ’ শব্দের অর্থ আত্মীয় অর্থাৎ নিজের জাত। গান্ধার দেশের মেয়ে যদি গান্ধারী হতে পারেন, মদ্রদেশের মেয়ের নাম যদি মাদ্রী হয়, তবে মৎস্যদেশের মেয়েই বা মৎসী বা মৎস্যগন্ধা হবেন না কেন? অবশ্য এমন হতেই পারে সত্যবতীর জন্মের মধ্যে গৌরব ছিল না তত। আমরা উপরিচর বসুর পট্টমহিষী গিরিকার জম্মেও তেমন গৌরব কিছু দেখিনি। মহাভারতে যমুনানদীর অন্তরচারিণী যে মৎসীকে আমরা উপরিচর বসুর তেজবিন্দু ভক্ষণ করতে দেখেছি, আমাদের ধারণা, তিনি বসুরাজের পূর্বাধিকৃত মৎস্যদেশের কোনও রমণী। হয়তো সেই মৎস্যদেশীয় কোনও রমণীর বংশধারাতেই সত্যবতীর জন্ম, যার জন্মদাতা স্বয়ং কোনও বাসব বা বসুবংশীয় কোনও রাজা।

 এমন হতেই পারে–সেই রমণীর কুলশীল আর্যজনের বিগর্হিত ছিল এবং সত্যবতী পালিত হয়েছেন কোনও ধীবরপল্লীতে। কিন্তু, এই ধীবর শব্দটি মহাভারতের উপাখ্যানে এসেছে শুধুমাত্র ‘মৎস্য’ শব্দের সূত্র ধরে। আমরা মনে করি, মৎস্যগন্ধার পিতা সেই ধীবররাজ আসলে মৎস্যদেশের রাজা। সত্যবতী ধীবররাজ ওরফে মৎস্যরাজের কন্যা ছিলেন বলেই তার গায়ে আঁশটে গন্ধ ছিল,–এটা যেমন আমাদের কাছে উপাখ্যানমাত্র, তেমনই তার পিতা নৌকা পারাপার করেন–এই কাহিনীও আমাদের কাছে উপাখ্যানমাত্র। খেয়াপারের নাবিকের অনুপস্থিতিতে তার কন্যা সহস্র মানুষকে পারাপার করাচ্ছে-রমণীর শরীরে কি এতও সয়। তবে হ্যাঁ, এটা স্বীকার করি এবং স্বীকার করতে পছন্দ করি যে সেদিন সেই গোধূলিবেলায় মৎস্যরাজের কন্যা একটি ডিঙি নৌকায় একা বসেছিলেন সবিভঙ্গে, ক্ষণিকের অবসর অথবা বিনোদনে। আর সেই সময়েই মহামুনি পরাশর এসে বলেছিলেন- আমি তোমার শেষ যাত্রী হব।

নৌকার ওপরে পরাশর সপ্রেম দৃষ্টিপাতে রমণী যখন কিঞ্চিৎ আপ্লুতা বোধ করছেন, তখনই তিনি জানিয়েছেন–আমি ধীরাজার মেয়ে, আমার পিতা-মাতা কেউ নেই সেজন্য আমার মনে কষ্ট আছে জেনোজন্মশোকাভিতায়াঃ কথং জ্ঞাস্যসি কথ্যতা। সত্যবতী যদি উপরিচর বসুর মেয়েই হবেন, তবে মাতৃপিতৃহীন বলে তার শোকাতুরা হবার কোনও কারণ। নেই। তিনি আরও জানিয়েছেন–আমি দাশরাজার মেয়ে; লোকে আমাকে মৎস্যগন্ধা বলে ডাকে। বস্তুত তিনি মৎস্যরাজের মেয়ে বলে তাকে মৎস্যগন্ধা বলে ডাকে, আর তার মায়ের ব্যাপারে কোনও গৌরব না থাকায় ‘বাসব’ মৎস্যরাজ তাকে ঘরে রাখেননি। কিন্তু মহামুনি পরাশর তার জন্ম-কর্মের খবর রাখেন এবং জানেন–মৎস্যগন্ধা আসলে বসুবংশেরই মেয়ে—‘বাসবী’ যিনি মানুষ হয়েছেন, মৎস্য দেশের কোনও অপাংক্তেয় মানুষের কাছে, যার নাম অবশ্যই দাশ।

পরাশর কোনও অসভ্য ভণিতার মধ্যে যাননি। একবারও মৎস্যগন্ধার অপার রূপরাশি বর্ণনা করে তার স্তন-জঘনের প্রত্যঙ্গশোভায় মন দেননি। তিনি পরিষ্কার জানিয়েছেন বাসবী। আমি তোমার কাছে একটি পুত্র চাই, তাই তোমার সঙ্গে আমি মিলন প্রার্থনা করি। মৎস্যগন্ধা সলজ্জে জানিয়েছেন-যমুনার ওপারে ঋষি-মুনিদের দেখা যাচ্ছে–পশ্য ভগবন্ পরপারে স্থিতান্ ঋষী–এই অবস্থায় কীভাবে আপনার সঙ্গে মিলন সম্ভব? সবাই যে দেখছেন আমাদের–আবয়ো-দৃষ্টয়োরেভিঃ কথং নু স্যাৎ সমাগমঃ। পরাশরের অলৌকিক মহিমায় কুয়াশার সৃষ্টি হল মিলনপিয়াসী দুই নর-নারীর চতুর্দিকে। নাকি, গোধুলির শেষ লগ্নে অন্ধকারের ছায়া নামছিল প্রেম-নত নয়নের দীর্ঘচ্ছায়াময় পল্লবের মতো। সেটাই হয়তো অলৌকিক সেই নীহারিকা।

ঘন-সন্ধ্যার প্রায়াচ্ছন্ন অন্ধকারে কামপ্রবৃত্ত পরাশরের সামনে প্রখর বাস্তব বিদ্ধ করল কুমারী সত্যবতীকে। তিনি বললেন–মুনিবর! আমি যে কুমারী। আমার পিতা কি বলবেন? আমার কুমারীত্ব দূষিত হলে আমি ঘরে ফিরব কী করে, ঘরে থাকবই বা কী করে–গৃহং গন্তুষে চাহং ধীমন্ ন স্থাতুমুৎসহে। পরাশর প্রখর ব্যক্তিত্বময় মহামুনি। তিনি জানেন-তিনি যদি এই কুমারীর কুমারীত্ব হরণ করেও পশ্চাদজাত পুত্রের পিতৃত্ব স্বীকার করেন, তবে এই রমণীর অসুবিধে কিছু হবে না। তখনকার সমাজে এই ঘটনা দূষণীয়ও ছিল না। অতএব তিনি। আশীর্বাদের ভঙ্গি মিশিয়ে কুমারীকে বললেন– তুমি আমার প্রিয় কার্য সম্পাদন কর। তুমি আবার তোমার কন্যাভাব ফিরে পাবে। আমি সন্তুষ্ট হয়েছি, তুমি যে বর চাও তাই পাবে।

মৎস্যগন্ধা বললেন–আমার গায়ের মৎস্যগন্ধ দূর হোক, সৌগন্ধে প্রসন্ন হোক আমার শরীর। আমরা পূর্বে এই মৎস্যগন্ধের কথা বিশ্বাস করিনি, এখনও করি না। বস্তুত যে জম্মদাতা মৎস্যরাজ তার জন্ম দিয়েও তার পিতৃত্ব স্বীকার না করে তার পালনের ভার দিয়েছিলেন। অন্যের ওপর, পিতৃমাতৃহীন অভিমানিনী সেই রমণী মৎস্যরাজের সন্ধতা অথবা আত্মীয়তা অস্বীকার করলেন প্রথম সুযোগে। পরাশরের আশীর্বাদে তাঁর রমণীশরীরে পদ্মের সৌগন্ধ এসে তিনি ‘যোজনগন্ধা’ বা ‘গন্ধবতী’তে পরিণত হলেন কিনা তা জানি না, তবে এই মুহূর্ত থেকেই যে তার নাম সত্যবতী হল, সে কথা আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

 সত্যবতী মিলিত হলেন মহর্ষি পরাশরের সঙ্গে এবং অলৌকিকভাবে সদ্যই গর্ভবতী হলেন। পুত্রও প্রসব করলেন সঙ্গে সঙ্গেই। জন্মালেন মহাভারতের কবি বেদব্যাস। সদ্যগর্ভ, সদ্য-প্রসবের কথা অলৌকিকতার মহিমাতেই মহিমান্বিত থাকুক, কারণ আমাদের মহাভারতের কবি জন্ম নিয়েছেন-জয়তি পরাশর-সুনুঃ সত্যবতী-হৃদয়-নন্দনো ব্যাসঃ।

লক্ষণীয় বিষয় হল–ওদিকে গঙ্গা নামের সেই রমণী হস্তিনাপুরের মহারাজ শান্তনুর পুত্রকে নিজে নিয়ে গিয়েছিলেন মানুষ করার জন্য। আর এদিকে মহামুনি পরাশর নিজ পুত্র দ্বৈপায়ন ব্যাসকে নিয়ে গেলেন নিজের কাছে মানুষ করার জন্য। শান্তনু তবু নিজের ঔরসজাত পুত্রটিকে ফিরে পেলেন গঙ্গার কাছ থেকে। কিন্তু ব্যাস তার মাতা সত্যবতীকে জানিয়ে গেলেন–আপনার প্রয়োজন হলে আমাকে স্মরণ করবেন। সঙ্গে সঙ্গেই আমি আপনার কাছে উপস্থিত হল।

সমস্ত মহাভারত জুড়ে যে ভীষ্মের অবস্থিতি, যিনি ভবিষ্যতে পিতার বিবাহ দিয়ে প্রসিদ্ধ কুরুবংশের সন্তান-পরম্পরা রক্ষা করবেন তাদেরও মৃত্যু পর্যন্ত বেঁচে থেকে, সেই ভীষ্ম হস্তিনাপুরে পৌঁছেছেন আগেই। আর যিনি কুরুবংশের ইতিহাস রচনা করবেন, যিনি ভবিষ্যতে কুরুবংশের সন্তানবীজ বপন করবেন নির্বিকারভাবে, তিনি নির্বিকার ঐতিহাসিকের মতো, পড়ে রইলেন এক দ্বীপে। কৌরব-পাণ্ডববংশের অগাধ ঘটনাধারা তার চারপাশে বয়ে চলবে আর তিনি মাঝখানে বসে থাকবেন দ্বীপের মতো। মহান ভারতবর্ষের সমসাময়িক ঘটনাবলীর উষ্ণ-শীতল জলস্পর্শ চারদিক থেকে তার গায়ে লাগবে, লাগবে মনে, বুদ্ধিতে।  কিন্তু কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস চতুরন্ত জলধির মধ্যে জেগে থাকবেন অবিকারী দ্বীপের মতো। নির্বিকারভাবে তিনি ভারতের ইতিহাস শোনাবেন, যে ইতিহাসের মধ্যে তার আপন হৃদয়ের মমতা মাখানো আছে, যে ইতিহাসের মধ্যে তার আপন শোণিত বিন্দু ক্ষরণ হবে প্রতি পলে পলে। অবিকারী দ্বীপের মতে নির্বিকার এক ঐতিহাসিকের ভূমিকা পালন করার সময় তার কবিহৃদয়ের ব্যথা-বেদনা সেই ইতিহাসকে মহাকাব্যে উত্তরিত করবে। ঐতিহাসিকের দৃষ্টি থাকা সত্ত্বেও কেন এই মহাকাব্যের উচ্চাবছ আনন্দ-বেদনার তরঙ্গ তিনি এড়াতে পারেন না, তার কারণ একটাই–তিনি শুধুদ্বীপজ দ্বৈপায়ন ব্যাসই নন, দ্বীপের সমস্ত সান্ধতা স্মরণে রেখেও তার বিচার করতে হবে কৌরব-পাণ্ডবের জন্মদাতা পিতার হৃদয় ব্যাখ্যা করে। তিনি যখন নির্বিকার দ্বীপের মতো ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে মহাভারতের ইতিহাস বর্ণনা করবেন, তখনই তাকে জন ডানের সেই বিখ্যাত উক্তি মনে করিয়ে দিতে হবে মহাকাব্যের প্ররোচনা মিশিয়ে–

No man is an island, entire of itself; each is a piece of the continent, a part of the main; if a clod bee washed away by the sea, Europe is less, as well as if a promontory were, as well as if a Mannor of your friends or of your own were; any man’s death diminishes me, because I am involved in mankind; and therefore never send to know for whom the bell tolls; it tolls for thee. (পুরাতন ইংরেজি শব্দ কথঞ্চিৎ আধুনিকভাবে রূপান্তরিত)

.

৫৬.

 মহামুনি পরাশরের সংস্পর্শে এসে তথাকথিত কৈবর্তপল্লীর রমণী মৎস্যগন্ধা গন্ধবতী’ সত্যবতীতে পরিণত হলেন। তিনি যেখানে উপস্থিত থাকতেন, সেখান থেকে দূর দূরান্তে তার অঙ্গের সৌরভ ছড়িয়ে পড়ত, আমোদিত হত দিগদিগন্ত। আমরা এই পৃষ্পমোদের অর্থ অন্যরকম বুঝি। আমরা বুঝি–কৈবর্তপল্লীতে মানুষ হওয়া এই রমণী মহামুনি পরাশরের। সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার পূর্বতন পালক-পিতার জাতিসংস্কার কাটিয়ে উঠে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার লাভ করেছিলেন। তার সুনাম-সৌগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। হয়তো সেই কারণেই এবার গঙ্গার তীর ছেড়ে যমুনা পুলিনে এসেছিলেন শান্তনু। হস্তিনাপুরের মহারাজ। শান্তনু।

শান্তনু যমুনার তীরে এসে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, আর তখনই তার নাকে ভেসে এল মধুর গন্ধ-বসন্তের বাতাসটুকুর মতো। গন্ধের উৎস খুঁজতে খুঁজতে তিনি দেখতে পেলেন স্বর্গসুন্দরীর মতো সেই রমণীকে, যার নাম সত্যবতী, গন্ধবতী, যোজনগন্ধা। এতই তার নামের প্রচার যে একটি মাত্র নামে তাকে ডাকাও যেন সঙ্গত হয় না। দেবরূপিণী কন্যাকে দেখেই শান্তনু তাকে জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি কে? কার মেয়ে? তুমি কী করছ এখানে-কস্য ত্বমসি কা বাসি কিঞ্চ ভীরু চিকীর্ষাস। কন্যা বলল–আমি দাসরাজার কন্যা। তিনি বলেছেন, তাই আমি তার নৌকাখানি বেয়ে খেয়া পারাপার করি।

গঙ্গাতীরবর্তিনী গঙ্গার পরে যমুনাতীরবর্তিনী সত্যবতী। কত কাল পরে এমন এক সর্বাঙ্গসুন্দরী রমণীকে দেখে মুগ্ধ হলেন শান্তনু। সেই সম্ভোগসুখের কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল–গঙ্গা কীভাবে তাকে সুখী করার জন্য কত চেষ্টাই না করেছেন। নৃত্য-গীত লাস্য কীই না প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু তিনি নিজেও রইলেন না শান্তনুর গৃহবধু হয়ে অথবা তাকে রাজধানীতে নিয়ে যাবার মতো গৃহিণীর সুস্থ সত্তাও তার মধ্যে ছিল না। অধুনা শান্তনু তার ঔরসজাত পরম প্রিয় পুত্র দেবব্রতকে ফিরে পেয়েছেন বটে, কিন্তু সুচিরকাল স্ত্রী সঙ্গহীন এক রাজার দিন-রাত কাটে শুধু রাজকার্যে আর পুত্রস্নেহে। বসন্তের জ্যোৎস্নায়, শরতের প্রভাতে অথবা বর্ষার মেঘমেদুর সুনীল ছায়ায় তার অনেক কিছু বলার থাকে, বলা হয় না, অনেক কিছু শোনার থাকে, শোনা হয় না। শান্তনু তাই যমুনাপুলিনে এসেছেন নিঃসঙ্গতা এড়াতে। আর ঠিক সেই সময় তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল দাসেয়ী গন্ধবতীর সঙ্গে।

 এমন রূপ মহারাজ শান্তনু বুঝি আর দেখেননি। কী তার রূপ! কী মাধুর্য! কৃষ্ণবর্ণ শরীরে রূপের আগুন লেগেছে। শান্তনু তাকে দেখামাত্রই প্রেমে পড়লেন; কামে মোহিত হলেন সমীক্ষ্য রাজা দাসেয়ীং কাময়ামাস শান্তনু। দেবরূপিণী কন্যার দিকে তাকিয়ে রাজা বললেন–তুমি আমার হও। সহাস্যে কন্যা বলল–আমি নিজেই নিজেকে তোমার হাতে তুলে দিতে পারি না। তুমি আমার পিতাকে বলো। শান্তনু সঙ্গে সঙ্গে কৈবর্তপল্লীতে দাস রাজার কাছে গেলেন। নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন-আমি হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু। তোমার কন্যাটিকে বিবাহ করতে চাই আমি–স গত্বা পিতরং তস্যা বরয়ামাস তাং তদা।

 কৈবর্তপল্লীর দাস-রাজা মোড়ল গোছের মানুষ। মৎস্য রাজের কন্যাকে তিনি পালন করেছেন ভাতজল দিয়ে। মেয়েকে তিনি যথেষ্ট ভালবাসেন। অনার্য কৈবর্তদের প্রধান হলে কী হবে, তিনি যথেষ্ট পাটোয়ারিবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। রাজার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হল, আর তিনি ধন্য হয়ে যাবেন-এমন হীনম্মন্যতা তার নেই। তাঁর বিষয়বুদ্ধি অন্য কারও থেকে কম নয়। তিনি বুঝলেন–হস্তিনাপুরের রাজা যখন তাঁর মেয়ের অঞ্চল ধরে এই কৈবর্তবলীতে এসে উপস্থিত হয়েছেন, অতএব তাঁর কাছ থেকে মেয়ের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নিশ্চিত কথা আদায় কতে হবে।

দাসরাজা চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন– মেয়ে যখন হয়েছে, তখন তাকে তো পাত্রস্থ করতেই হবে, মহারাজ! সে আর এমন বেশি কথা কী–জাতমাত্রৈব মে দেয়া বরায় বরবণিনী। তবে কিনা আমার দুটো কথা ছিল এ বিষয়ে। অভিলাষ সামান্যই, তবু মহারাজ সে কথাটা আপনার শুনতে হবে। অর্থাৎ আপনি যদি সত্যিই এই কন্যাকে আপনার ধর্মপত্নী হিসেবে গ্রহণ করতে চান, তবে আপনাকে তিন সত্যি করে একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে। এই প্রতিজ্ঞাটি করলেই আমি আপনার হাতে মেয়ে তুলে দেব-নইলে আপনার মতো খাসা জামাই আর কোথায় পাব, মহারাজন হি মে ত্বৎসমো কশ্চিদ্ররা জাতু ভবিষ্যতি।

শান্তনু রাজা মানুষ। সহজেই তিনি বুঝে গেলেন–দাসরাজ সহজ নোক নন। শান্তনু প্রথমেই তিন সত্যি করে বসলেন না। বললেন–আগে তোমার অভিলাষটা শুনি, দাস! তবেই সেটা মেটাবার চেষ্টা করব। যদি সেটা মানার মতো হয়, তবেই তো মানব। একটা অসম্ভবকে তো সম্ভব করে ফেলা যাবে না।

 দাস-রাজা নিজের সমস্যা ব্যক্ত করলেন–মহারাজ! আমার এই কন্যার গর্ভে যে ছেলেটি হবে, আপনার পরে তাকেই দিতে হবে হস্তিনাপুরের সিংহাসন। আপনি বেঁচে থাকতেই সেই পুত্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে হবে, যাতে অন্য কোনও ভাগীদার আপনার সিংহাসনের উত্তরাধিকার দাবি না করতে পারেনান্যঃ কশ্চন পার্থিবঃ। যমুনার তীরচারিণী যে রমণী তাকে মুগ্ধ করেছিল, তার মোহন মুখটুকু ছাপিয়ে শান্তনুর মনে ভেসে উঠল গঙ্গাপুত্র, দেবব্রতের সেই কৈশোরগন্ধী মুখখানি। হস্তিনাপুরে সে তার পিতা ছাড়া আর কিছু জানে না। রাজ্যের প্রতিটি প্রজার জন্য তার মায়া ছড়ানো আছে। তাছাড়া, বহু পূর্বেই তিনি হস্তিনাপুরের যুবরাজপদে অভিষিক্ত হয়েছেন। সেই নবযৌবনোৎসুক দেবব্রতকে যৌবরাজ্য থেকে সরিয়ে দিয়ে এই স্বার্থান্বেষী কৈবর্তমুখ্যের কথা মেনে নিতে পারলেন না শান্তনু।

 কৈবর্তরাজ শান্তনুকে ভালভাবেই চিনতেন। তাঁর চরিত্রও অস্পষ্ট ছিল না তার কাছে। কৈবর্ত্যরাজ নিশ্চয় জানতেন যে, গঙ্গানামী এক রমণীর সঙ্গে মহারাজ শান্তনুর আত্মিক ঘনিষ্ঠতা ছিল এবং তাকে তিনি বিবাহ করে রাজধানীতে নিয়ে যেতে পারেননি। এমনকি শান্তনুর ঔরসে জাত গঙ্গার পুত্র দেবব্রতই যে হস্তিনাপুরের যুবরাজপদে অধিষ্ঠিত–এই সংবাদও তার অজানা নয়। সবচেয়ে বড় কথা মহারাজ শান্তনু যে স্ত্রী সঙ্গলোভী এক কামুক ব্যক্তি–এও তিনি ভালভাবেই জানতেন। যমুনাতীরবর্তিনী সত্যবতীকে দেখে শান্তনু যখন মুগ্ধ হয়েছেন, তখন তাকে দিয়ে যে খানিকটা অন্যায় কাজও করিয়ে নেওয়া যাবে-এই ছিল দাসরাজার ধারণা। কিন্তু শান্তনু আপাতত রাজি হতে পারলেন না। সাময়িকভাবে হলেও যুবক পুত্র দেবব্রতর জন্য তাঁর কিছু চক্ষুলজ্জা কাজ করল, বিশেষত মতলববাজ দাসরাজার সামনে।

কিন্তু দাসরাজার সামনে যতই তিনি ‘না’ করুন, শান্তনুর মন থেকে সত্যবতীর মোহ একটুও দূরীভূত হল না। সত্যবতীর রূপ চিন্তা করতে করতে কামনায় অধীর হয়ে তিনি হস্তিনাপুরে ফিরলেন–স চিন্তয়ন্নেব তু তাং…কামোপহতচেতনঃ। হস্তিনাপুরের রাজকার্যে তার মন লাগে না, প্রজাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনতে তাঁর ভাল লাগেনা, মন্ত্রীদের সঙ্গে রাজ্য শাসনের ভাল-মন্দ নিয়ে আর তিনি কোনও আলোচনায় বসেন না। সারাটা দিন তিনি শুধু বসে থাকেন, আর আনমনে কী যেন ভাবেন।

এইরকমই একদিন মহারাজ শান্তনু বসে বসে সত্যবতীর রূপের ধ্যানেই যেন বসেছিলেন–শান্তনুং ধ্যানমাস্থিত–আর তখনই পুত্র দেবব্রত এসে তার ধ্যান ভাঙিয়ে দিয়ে বললেন–সবদিকেই তো আপনার মঙ্গল দেখতে পাচ্ছি, পিতা! সমস্ত সামন্ত রাজাই আপনার শাসন মেনে নিয়েছেন, তবে কেন সব সময় আপনাকে খুব দুঃখিত আর শোকক্লিষ্ট দেখতে পাচ্ছি। সব সময় কেমন যেন ধ্যান-যোগীর মতো বসে আছেন। আমার সঙ্গে পর্যন্ত একটা কথা বলেন না, ঘোড়া ছুটিয়ে বাইরেও যান না আপনার পুর্বের অভ্যাস মতো। আর শরীরটাই বা কী হয়েছে আপনার–বিবর্ণ, কৃশ, পাণ্ডুর–ন চানে বিনির্যাসি বিবর্ণো হরিণঃ কৃশঃ।

দেবব্রত গাঙ্গেয় শেষ পর্যন্ত একটু অধৈর্য হয়েই বললেন–আপনার রোগটা কী জানতে পারি আমি? রোগটা জানলে তার প্রতিকারও সম্ভব-ব্যাধিমিচ্ছামি তে তুং প্রতিকুৰ্যাং হি তত্র বৈ। শান্তনু প্রত্যুত্তর দিলেন বটে এবং দেবব্রতকে খুব ভাল ভাল কথাও বললেন বটে, কিন্তু সেই ভাল ভাল কথাগুলির মধ্যে এমন একটা হাহাকার ছিল, যা পুত্রবাৎসল্য অতিক্রম করে অত্যন্ত নঞর্থকভাবেই শান্তনুর জীবনে এক নতুন সত্যোপলব্ধিকে সদর্থক করে তোলে।

শান্তনু বললেন–তুমি যেমন বলছ–আমি ধ্যানী-যোগীর মতো বসে আছি, কথা-বার্তা বলছি না–এসব কথা মিথ্যা নয়। তবে কি জান–আমার এই বিশাল বংশে তুমিই একমাত্র সন্তান। তুমি যেমন সব সময় নিজের পুরষকার প্রদর্শন করে অস্ত্রশস্ত্রের কৌশল দেখাচ্ছ তাতে আমার বড় ভয় আছে মনে। মানুষের জীবন’বড় চঞ্চল, বাবা। কখন কী হয় কিছুই ঠিক নেই। তাই বলছিলাম–তোমার যদি বিপদ ঘটে, তবে তো আমার বংশটাই লোপ হয়ে যাবে।

শান্তনু কী বলতে চাইছেন বলুন তো? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন এই পুত্রটির ভাবনা ছাড়া আর কিছুই ভাবেননি জীবনে। একমাত্র পুত্রের সম্ভাবিত কোনও বিপদের জন্য যেন তিনি বড়ই আকুল। শান্তনুর এবারের ভাষণটি মনে রাখার মতো। তিনি বললেন–তুমি আমার একশ ছেলের বাড়া এক ছেলে। আমি আর সন্তান বৃদ্ধির জন্য অনর্থক বিয়ে-টিয়ে করে। গোলমাল পাকাতে চাই না–ন চাপ্যহং বৃথা ভুয়ো দারা কর্তুমিহোৎসহে।

 এ যেন অতিরিক্ত মদ্য মাংসপ্রিয় এক অতিথি আমন্ত্রণকারী ব্যক্তিকে বলছে–না, না, ওসব ব্যবস্থা করবেন না। ওই শাক-শুক্তোতেই খুব ভাল। কিন্তু এই ভাল-মানুষির সঙ্গে শান্তনু যখন বলেন–পিতার কাছে একটি মাত্র পুত্রও যা নিঃসন্তান হওয়াও তাই–তখনই তার আসল ইচ্ছেটা বোঝা যায়। দেবব্রতকে তিনি শতপুত্রের অধিক গৌরব দান করেও যখন মন্তব্য করেন-যজ্ঞ বল, বেদ বল, এই সমস্ত কিছুই পুত্রপ্রাপ্তির সৌভাগ্য থেকে কম-তখন বোঝ যায় দেবব্রত ছাড়াও অন্য আরও কোনও পুত্রের মাহাত্ম তার কাছে বড় হয়ে উঠছে। দেবব্রতকে শান্তনু বলেছিলেন–তুমি সব সময় যুদ্ধবিগ্রহ করে বেড়াচ্ছ–তৃঞ্চ শুরঃ সদামী শনিত্যশ্চ ভারত–এই যুদ্ধবিগ্রহের ফলে তোমার যদি ভালমন্দ কোনও ঘটনা ঘটে যায়, তুমি যদি কোনওভাবে নিহত হও–নিধনং বিদ্যতে ক্কচিৎ–তাহলে এই বিশাল বংশের কী গতি হবে?

শান্তনুর কথা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়–দেবব্রত ছাড়াও তিনি অন্য পুত্রের আকাক্ষা করছেন এবং পুত্রের কথা বলাটাই যেহেতু ধর্মর্সম্মত, যেহেতু শাস্ত্রে বলে-পুত্রের প্রয়োজনেই বিবাহ–অতএব বিবাহের মতো একটি গৌণ কর্ম তাঁর অনীপ্সিত নয় এবং যেন পুত্রোৎপত্তির মতো কোনও মুখ্য কর্মের সাধন হিসেবেই এই বিবাহের প্রয়োজন। পুত্র দেবব্রত সব বুঝলেন। মহাভারতের কবি মন্তব্য করেছেন–সব বুঝেই বুদ্ধিমান দেবব্রত পিতার কাছে বিদায় নিয়ে কুরুসভার এক বৃদ্ধ মন্ত্রীর কাছে এলেন– দেবব্রতো মহাবুদ্ধিঃ পথ্যমেবানুচিত্তয়। দেবব্রত তাকে পিতার মনোদুঃখের কারণ জিজ্ঞাসা করলে সেই মন্ত্রী কোনও ঢাক-গুড়গুড় না করে স্পষ্ট বললেন–দাস রাজার কন্যা সত্যবতীর জন্য শান্তনুর মন খারাপ হয়েছে। তিনি তাকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন।

মন্ত্রীর কথা শুনে দেবব্রত সঙ্গে সঙ্গে কুরুসভার অভিজ্ঞ, বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়দের নিয়ে উপস্থিত হলেন সেই কৈবর্তপল্লীতে। পিতার বিবাহের জন্য দেবব্রত সত্যবতীকে যাচনা করলেন দাসরাজার কাছে। দাসরাজা বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি আকস্মিকভাবে কোনও উলটো কথা বলে বসলেন না। কুমার দেবব্রতকে সাদর সম্ভাষণে তুষ্ট করে আগে তাকে নিয়ে গিয়ে বসালেন নিজের সভায়। বললেন-কুমার! আপনি মহারাজ শান্তনুর পুত্র। যাঁরা অস্ত্রবিদ বলে বিখ্যাত, তাদের মধ্যে আপনি হলেন গিয়ে শ্রেষ্ঠ। পিতার উপযুক্ত অবলম্বন। আপনাকে আর কীই বা আমি বলব! সত্যি কথা বলতে কি-মহারাজ শান্তনুর মতো এক বিরাট পুরুষের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধের সুযোগ পেয়েও যদি সেটা গ্রহণ করা না যায়, তবে আমি কেন স্বর্গের দেবরাজ ইন্দ্ৰঠাকুরও অনুতপ্ত হবেন মনে মনে।

দাসরাজা লুব্ধ শান্তনুর সঙ্গে যেভাবে কথা বলেছিলেন, যেভাবে নিজের শর্তটি তাকে শুনিয়েই চুপ করে গিয়েছিলেন, এখানে কুমার দেবব্রতর সঙ্গে সেভাবে কথা বললেন না। দেবব্রত যুদ্ধবাজ মানুষ, সত্যে তার চিরপ্রতিষ্ঠা, অতএব দাসরাজা ধীরভাবে তার কথাগুলি সযৌক্তিক করে তুললেন। দাসরাজা বললেন–এ মেয়ে আমার নয়, কুমার। কন্যাটি রাজা উপরিচরের–যে উপরিচর কৌলীন্যের গুণে আপনাদেরই বার সমকক্ষ। তিনি কতবার আমাকে বলেছেন যে, এই মেয়ের উপযুক্ত স্বামী হতে পারেন একমাত্র মহারাজ শান্তনু–তেন মে বহুস্তাত পিতা তে পরিকীর্তিতঃ। অহঃ সত্যবতীং বোঢ়ম…।

কোথায় মহারাজ উপরিচর, আর কোথায় শান্তনু! ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে সময়ের একটা মস্ত ফারাক ঘটে যায়। তবে ওই যে বলেছিলাম–মৎস্যদেশে উপরিচর বসু যে পুত্রটিকে বসিয়ে দিয়েছিলেন, সেই পুত্রের পরম্পরায় জাত কোনও মৎস্যরাজের কন্যা হবেন সত্যবতী। দাসরাজা কৈবর্তপল্লীতে তাঁকে মানুষ করেছেন বটে, তবে বাসব রাজাদের কৌলীন্য তিনি ভুলে যাননি। আর কী অদ্ভুতভাবে সত্যবতীর উপাদেয়তা এবং দুর্লভতা উপস্থাপন করছেন তিনি। দাস রাজা বললেন–এই তো সেদিন দেবর্ষি অসিত এসেছিলেন আমার থানে। অসিত, দেবল–এঁরা সব দেবর্ষি। তা দেবর্ষি অসিত বললেন–সত্যবতীকে তার চাই। আমি সোজা ‘না’ বলে দিলাম-অসিতো হ্যপি দেবর্ষিঃ প্রত্যাখ্যাতঃ পুরা ময়া। রাজকন্যে বলে কথা, তাকে কি আর এক শুষ্করুক্ষ মুনির হাতে তুলে দিতে পারি!

দাস-রাজা এবার প্রকৃত প্রস্তাব করছেন। বললেন–তবে কিনা কুমার! আমি মেয়ের বাবা বলে কথা। আমার তো কিছু বলার থাকতেই পারে। আমি শুধু চাই–আমার মেয়ের ঘরে যে নাতি জন্মাবে, তার কোনও বলবান শত্রু না থাকে। আমি তো জানি রাজকুমার–তোমার মতো এক মহাবীর যদি অসুর-গন্ধর্বদেরও শত্রু হয়ে দাঁড়ায় তবে সেই অসুর-গন্ধর্বরাও রক্ষা পাবে, তাদের কাউকে আর সুখে বেঁচে থাকতে হবে না-ন স জাতু সুখং জীবেৎ ত্বয়ি ক্রুদ্ধে পরস্তূপে। তা এখানে আমার এই মেয়ের গর্ভে তোমার পিতার যে পুত্রটি জন্মাবে এবং, ভগবান না করুন, কখনও যদি তার সঙ্গে তোমার শুত্রুতা হয়, তবে তার আর বাঁচার আশা, থাকবে? শান্তনুর সঙ্গে আমার মেয়ের বৈবাহিক সম্বন্ধে আমি এইটুকুই মাত্র দোষ দেখতে পাচ্ছি। আমার আর কোনও অসুবিধেই নেই। সত্যবতীকে তার হাতে তুলে দেওয়া বা না দেওয়া–এর মধ্যে এইটুকুই যা খটকা– এতাবান অত্র দোষো হি…দানাদানে পরন্তপ।

 কুমার দেবব্রত কৈবর্ত রাজার আশ্রয় স্পষ্ট অনুধাবন করলেন। সমস্ত ক্ষত্রিয়বৃদ্ধর সামনে তিনি সোদাত্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন–তুমি তোমার মনের সত্য গোপন করনি, দাসরাজ! আমিও তাই সত্যের প্রতিজ্ঞা করছি। উপস্থিত ক্ষত্রিয়রা সবাই শুনে রাখুন–এমন প্রতিজ্ঞা আগে কেউ করেননি, পরেও কেউ করবেন না–নৈব জাতো ন চাজাত ঈদৃশং বক্তৃৎসহেৎ। দেবব্রত এবার দাসরাজের কথার সূত্র ধরে বললেন–তুমি যেমনটি বললে, আমি তাই করব। আমি কথা দিচ্ছি–এই সত্যবতীর গর্ভে যে পুত্র জন্মাবে, সেই আমাদের রাজা হবে–যোস্যাং জনিষ্যতে পুত্রঃ স নো রাজা ভবিষ্যতি।

আগেই বলেছিলাম-কৈবৰ্তরাজ পাটোয়ারিবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। তিনি বুঝলেন-সত্যবতীর ছেলের রাজা হবার পথ নিষ্কন্টক। কিন্তু রাজত্ব, রাজসুখ এমনই এক বস্তু যা পেলে বংশ-পরম্পরায় মানুষের ভোগ করতে ইচ্ছা করে। উল্কার মতো এসে যে সুখ ধূমকেতুর মতো চলে যায়, সে সুখ রাজতন্ত্রের রাজা বা গণতন্ত্রের নেতা–কেউই চান না। দাসরাজা তাই চিরস্থায়ী রাজসুখের স্বপ্ন দেখে দেবব্রতকে বললেন–আপনি যা বলেছেন, তা শুধু আপনারই উপযুক্ত। তবে কিনা আমি মেয়ের বাবা বলে কথা। মেয়ের বাবাদের স্বভাবই এমন আর সেই স্বভাবের বশেই আরও একটা কথা আমায় বলতে হচ্ছে–কৌমারিকাণাং শীলেন। বক্ষ্যাম্যহমরিন্দম।

কৈবর্ত্যরাজ বলেন–আপনার প্রতিজ্ঞা যে কখনও মিথ্যা হবে না, সে কথা আমি বেশ জানি। আমি জানি-আপনার পিতার পরে আমার সত্যবতীর ছেলেই রাজা হবে। কিন্তু কুমার! আপনার যে পুত্র হবে তার সম্বন্ধে আমার সন্দেহটা তো থেকেই যাচ্ছে–তবাপত্যং ভবে যত্ত্ব তত্র নঃ সংশয়ো মহান্ দেবব্রত দাসরাজার অভিপ্রায় বুঝে সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়দের শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন–শুনুন মহাশয়েরা, আমার পিতার জন্য আমি প্রতিজ্ঞা করছি–আমি পূর্বেই রাজ্যের অধিকার ত্যাগ করেছি, আপনারা শুনেছেন। এখন আমি বলছি–আমি বিবাহও করব না এ জীবনে। আজ থেকে আমি ব্রহ্মচর্য পালন করব–অদ্য প্রভৃতি মে দাস ব্রহ্মচর্যং ভবিষ্যতি। আমি চিরজীবন অপুত্রক অবস্থায় থাকলেও এই ব্রহ্মচর্যই আমাকে স্বর্গে নিয়ে যাবে।

সেকালের দিনে মানুষের বিশ্বাস ছিল–অপুত্রকের স্বর্গলাভ হয় না। কিন্তু ব্রহ্মচারীর জীবনে যে নিয়ম-ব্রত এবং তপস্যার সংযম আছে, সেই সংযমই তাকে স্বর্গের পথে নিয়ে যায়। দেবব্রতের প্রতিজ্ঞার পরে ব্রহ্মচর্যের সংযম তাই স্বেচ্ছাকৃত হলেও অকারণে নয়।

দেবব্রতর কঠিন প্রতিজ্ঞা শুনে অন্য কার মনে কী প্রতিক্রিয়া হল, মহাভারতের কবি সে খবর দেননি, কিন্তু দাস রাজার হৃদয় আপন স্বার্থসিদ্ধিতে প্রোফুল্ল হয়ে উঠল। সানন্দে তিনি ঘোষণা করলেন–মেয়ে দেব না মানে! তোমার পিতার নির্বাচিত বধুকে এই এখুনি তোমার সঙ্গেই পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি। পিতার মনোনীত হস্তিনাপুরের রাজবধু সত্যবতীর সামনে এসে দাঁড়ালেন দেবব্রত। তাকে আপন জননীর সম্মান দিয়ে ভীষ্ম বললেন–এস মা! রথে ওঠ। আমরা এবার নিজের ঘরে ফিরব–অধিরোহ রথং মাতঃ গচ্ছাবঃ স্বগৃহানিতি।

বয়সের দিক দিয়ে দেখতে গেলে দেবব্রত হয়তো সত্যবতীর সমবয়সী হবেন প্রায়। হয়তো বা সত্যবতী একটু বড়। দেবব্রত যখন শান্তনুর ঔরসে গঙ্গাগর্ভে জন্মেছেন, হয়তো তার সমসাময়িককালেই পরাশরের ঔরসে সত্যবতীর গর্ভে জন্মেছেন মহাভারতের কবি। কিন্তু বিবাহের বয়স যেহেতু রমণীর ক্ষেত্রে সব সময়েই কম হয় অপিচ পরাশর যেহেতু সত্যবতীর প্রথম যৌবনটুকুই লঙ্ঘন করেছিলেন তাতে অনুমান করি–সত্যবতী দেবব্রতর চেয়ে খুব বেশি বড় হবেন না বয়সে।

যাই হোক, দেবব্রত যেদিন জননীর সম্বোধনে সত্যবতীকে নিজের রথে তুলে নিয়ে হস্তিনাপুরের পথে পা বাড়ালেন, সেদিন থেকেই এই অল্পবয়স্কা জননীর সঙ্গে তার ভাব হয়ে গিয়েছিল। হস্তিনাপুরের রাজসঙ্কটে এই প্রায় সমবয়স্ক দুই মাতা-পুত্রের পরম বন্ধুত্ব বার বার। পরে আমাদের স্মরণ করতে হবে। দেবব্রত অল্পবয়স্কা জননীকে রথে চাপিয়ে–রথমারোপ্য ভাবিনী–উপস্থিত হলেন হস্তিনাপুরের রাজধানীতে, পিতার প্রকোষ্ঠে। শান্তনুকে তিনি জানালেন–কীভাবে দাসরাজাকে রাজি করাতে হয়েছে এই বৈবাহিক সম্পর্ক সুসম্পন্ন করার জন্য।

 এই মুহূর্তে শান্তনুর মুখে পুত্র দেবব্রতর স্বার্থ-সম্বন্ধীয় কোনও সুশ্চিন্তার বলিরেখা আপতিত হয়নি। একবারও উচ্চারিত হয়নি–পুত্র! তোমাকে আমি যুবরাজ পদবীতে অভিষিক্ত করেছিলাম, এখনও তুমি তাই থাকলে। একবারও শান্তনু বলেননি-দেবব্রত! তোমার মতো পুত্র থাকতে, অন্য পুত্রের প্রয়োজন নেই আমার। পরম নৈঃশব্দ্যের মধ্যে দেবব্রতর যৌবরাজ্যের সুখ সংক্রান্ত হল শান্তনু ভাবী পুত্রের জন্য। যৌবনবতী সত্যবতীকে লাভ করে শান্তনুর হৃদয়ে যে রোমাঞ্চ তৈরি হয়েছিল, সেই আকস্মিক হৃদয়াহূদ মহাভারতের কবি সলঙ্কে বর্ণনা করেননি, কারণ আপন জননী সত্যবতীর সম্পর্ক চেতনার মধ্যে রাখলে শান্তনুও মহাভারতের কবির পিতা। তাঁর পক্ষে শান্তনুর হৃদয় ব্যাখ্যা করা সাজে না। যা সাজে তিনি তাই করেছেন। শান্তনুর মুখ দিয়ে পরমেপ্সিত স্ত্রী লাভের কৃতজ্ঞতা বেরিয়ে এসেছে পুত্র দেবব্রতর জন্য। তিনি বর দিলেন–বৎস! তুমি যত কাল বেঁচে থাকতে চাও, ততকালই বেঁচে থাকবে। মৃত্যু তোমার ইচ্ছাধীন, তুমি ইচ্ছামৃত্যু–ন তে মৃত্যুঃ প্রভবিতা যাবজ্জীবিতুমিচ্ছসি।

আমরা শুধু ভাবি–শান্তনু যখন একপুত্রের জীবন নিয়ে পূর্বে এত শঙ্কিত হচ্ছিলেন, তখনই এই মহান বরদান সম্পন্ন করলে পারতেন। কিন্তু তাতে মহাভারতের কবির পক্ষে লোকচরিত্রের বৈচিত্র্য দেখানো সম্ভব হত না। পুত্রকে সারা জীবন বাঁচিয়ে রাখা বা মৃত্যুকে তার ইচ্ছাধীন করে রাখার মধ্যে পিতার সবথেকে বেশি বাৎসল্য প্রকাশ পায়, জানি। হয়তো পুত্রকে এক বৃহৎ জীবন দান করে তার নিজকৃত বঞ্চনার প্রতিদান দিয়েছেন শান্তনু। কিন্তু মহাভারতের কবির দৃষ্টিতে–এই ঘটনা বঞ্চনার অক্ষরে লিখিত হয়নি, হয়তো তার কাছে এ ঘটনা তত রূঢ়ও নয়। পরবর্তী সময়ে মহাভারতের বিশাল ঘটনা-সন্নিবেশের মধ্যে দেবব্রতকে যেভাবে উপস্থাপিত করা হবে, তাতে দেখা যাবে, পিতার বাৎসল্যে এই মহান পুরুষটি বঞ্চিত হলেও, অতিদীর্ঘ জীবনের অধিকারী হওয়ার সুবাদে তিনি এক বিশাল যুগের দ্রষ্টা বলে পরিগণিত হবেন।

 পিতার বিবাহের জন্য প্রতিজ্ঞা করে একদিকে তিনি ইচ্ছামৃত্যু হলেন, অন্যদিকে ভীষণ প্রতিজ্ঞা করার জন্য রাজা-প্রজা সকলে তাঁকে ‘ভীষ্ম’ নামকরণ করল। কিন্তু আমাদের কাছে এ সব কিছুর চাইতেও দাসরাজার ক্ষুরধার বক্তব্যটুকু বড় হয়ে উঠেছে। সত্যবতীর সঙ্গে পিতার বিবাহ দেওয়ার জন্য দেবব্রতর রাজত্ব পরিত্যাগের শপথ শুনেই দাসরাজা বলেছিলেন–আপনি এই প্রতিজ্ঞা করে শুধু মহারাজ শান্তনুরই প্রভু হলেন না, এই কন্যা সত্যবতীরও প্রভু হলেন-তবমেব মাথঃ পর্যাপ্তঃ শান্তনোরমিতদ্যুতেঃ। কন্যায়াশ্চৈব ধর্মাত্মন্…।

আমরা পরে দেখব–দেবব্রত ভীষ্ম কুরুবংশের গৌরবের জন্য সত্যবতীর পুত্র থেকে আরম্ভ করে সেই দুর্যোধন পর্যন্ত তার লোকহিতৈষিণী ভাবনা প্রসারিত করেছেন। আমরা বলব–তার এই ভাবনা আরম্ভ হয়েছে পিতার বিবাহ দেওয়া থেকে। যে ব্যক্তি পিতার বিবাহ দর্শন করে নিজের যৌবন আরম্ভ করেন, সেই ব্যক্তিকে এক মহাকাল পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখে মহাভারতের কবি তাকে এক সাক্ষী চৈতন্যের ভূমিকায় দ্রষ্টা হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। এই দ্রষ্টার দৃষ্টি থেকেই পরে মহাভারতের কর্তার সৃষ্টি হবে। সত্যবতীর এক পুত্র সত্য দর্শন করছেন, সত্যবতীর আরেক পুত্র সত্য বর্ণন করছেন–সত্য-দর্শন আর সত্যের বর্ণন থেকেই কবির জন্ম-দর্শনাৎ বর্ণনাচ্চৈব রূঢ়া লোকে কবিশ্রুতিঃ। এক অর্থে বেদব্যাস যদি মহাভারতের স্রষ্টা কবি হন, তাহলে দেবব্রত ভীষ্ম হলেন দ্রষ্টা কবি। আর শুধু ভীষণ প্রতিজ্ঞা করেই নয়–পিতার বিবাহ থেকে আরম্ভ করে দিন-দিন প্রতিদিন, তার মৃত্যুকামনা পর্যন্ত যত ভীষণ ঘটনা তাকে দেখতে হবে, সেইজন্যই নিষ্পাপ নিষ্কলুষ দেবব্রত ‘ভীষ্ম’ হলেন হয়তো। ভীষ্ম না হলে এত কঠিন ঘটনা-পরম্পরা, যা তার স্বল্পসৃষ্টি থেকে একটু একটু করে অবক্ষীণ হতে থাকবে, ‘ভীষ্ম’ না হলে, তিনি সেসব সহ্য করবেন কী করে?

.

৫৭.

এই সেদিনও নবাব আলিবর্দি খাঁকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার নবাব বলে বিমলানন্দ লাভ করতাম। বাংলা-বিহার-ওড়িশার এই একক জোটের বৈশিষ্ট্য, বলতে গেলে প্রায় খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকে চলে আসছে। মগধরাজ জরাসন্ধ যখন তার শাসন-ক্ষমতার তুঙ্গবিন্দুতে পৌঁছেছেন, তখন অঙ্গ-বঙ্গ কলিঙ্গের রাজা ছিলেন তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু। অসম বা প্ৰাগজ্যোতিষপুরের অনার্য রাজাও ছিলেন তারই মিত্রগোষ্ঠীর অন্তর্ভুত। দক্ষিণে চেদি, বিদর্ভ, দশার্ণ দেশের রাজারা জরাসন্ধের আজ্ঞায় উঠতেন এবং বসতেন, অথচ এই সমস্ত রাজ্যই আগে যাদবদের অধিকারভুক্ত ছিল। হয়তো সেই কারণেই যাদবদের যে কোনও উপায়ে পর্যুদস্ত করাটাই যেমন জরাসন্ধের ধর্মের মতো হয়ে গিয়েছিল, তেমনই যাদবরাও জরাসন্ধের চিরশত্রু হয়ে গিয়েছিলেন।

যাদবদের প্রতি জরাসন্ধের শত্রুতা চরমে পৌঁছয়, যখন মথুরার অধিপতি উগ্রসেন কারাগারে বন্দী হলেন। জরাসন্ধের এজেন্ট হিসেবে তারই ক্ষেত্রজ পুত্র কংস খুব ভালভাবে কাজ করতে আরম্ভ করলেন মথুরা-শূরসেনের ভূখণ্ডে। আমাদের ব্যক্তিগত ধারণা–যাদবরা যেহেতু বিভিন্ন সংঘমুখ্যকে নিয়ে একটি গোষ্ঠীতন্ত্র চালাতেন, তাই বিভিন্ন সংঘমুখ্যর মধ্যে যে সব অন্তর্বিবাদ ছিল, সেই বিবাদের সুযোগ নিয়েই জরাসন্ধ মথুরায় নিজের প্রতিনিধি কংসকে স্থাপন করতে পেরেছিলেন।

 লক্ষ্য করার বিষয়–অন্ধক-কুকুর বংশের প্রধান আহকের পুত্র দেবক, উগ্রসেনের বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তিনি মথুরা-শূরসেনের রাজা হতে পারেননি। রাজা হয়েছিলেন কনিষ্ঠ উগ্রসেন। দেবক স্বেচ্ছায় এই রাজ্যের অধিকার ত্যাগ করেছিলেন নাকি তার মনে এ সব ঘটনা নিয়ে কোনও ক্ষোভ ছিল, তা নিয়ে ইতিহাস-পুরাণে একটি কথাও স্পষ্ট করে বলা নেই। অন্য রাজবংশগুলিতে রাজা হিসেবে অমনোনীত জ্যেষ্ঠ পুরুষদের হয় মুনিবৃত্তি গ্রহণ করতে দেখেছি, নয়তো ব্রাহ্মণ হয়ে যেতে দেখেছি। আজকের জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবক কিন্তু নিজের রাজ্যেই অথবা কনিষ্ঠ উগ্রসেনের রাজ্যেই বসবাস করছিলেন। তার মধ্যে কোনও চাপা ক্ষোভ ছিল কি না আমরা তা জানি না, কিন্তু অন্ধক, বৃষ্ণি, ভজমান ইত্যাদি যাদবসংঘের মধ্যে সব সময়েই যে খুব সদ্ভাব ছিল এমন মোটেই নয়। নানা বিষয় নিয়ে এঁদের মতপার্থক্য ছিল এবং হয়তো এই পার্থক্যের সুযোগ নিয়েই কংস রাজা হতে পেরেছিলেন মথুরায়।

দেশে নতুন রাজা রাজত্বভার গ্রহণ করলে সর্বকালে এবং সর্বদেশে উচ্চশ্রেণীর মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, কংস রাজা হবার পর যাদব সংঘমুখ্যদের মধ্যেও সেই প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। সাধারণত ক্ষমতার পালা বদল হলে উচ্চশ্রেণীর মানুষের একাংশ রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে রাজা বা নেতার পক্ষপাতী হয়ে পড়েন, আর অন্যাংশ এই নেতৃত্বের বিরোধিতা করতে থাকেন। কংস রাজা হবার পর যাদব সংঘমুখ্যদের অনেকেই তার সঙ্গে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে আমরা কংসের রাজসভার একটি আলোচনাচক্রের কথা উল্লেখ করব। এবন তার প্রসঙ্গ নেই বলে শুধু এইটুকু জানিয়ে রাখছি যে, কংস ভোজ-বৃষ্টিমুখ্যদের অনেককেই সঙ্গে পেয়েছিলেন।

উপরিউক্ত এই সভায় প্রথম বক্তৃতা দেবার সময় কংস রাজোচিতভাবে বলেছিলেন–এই মহান যদুকুল যখন নিজের মর্যাদা থেকে ভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন–ব্যাবৰ্তমানং সুমহৎ–তখন আপনাদের মতো কীর্তিমান লোকেরাই এই যদুবংশকে আপন মর্যাদায় স্থাপন করেছিলেন, ঠিক যেমন পাহাড়ের দৃঢ়তায় ধৃত হয় এই ধরাতল–ধৃতঃ যদুকুলং বীরৈ ভূতলং পর্বতেরিব। সন্দেহ নেই-কংসের বলা ওই যদুকুলের মর্যাদাভ্রংশের সময়টি অবশ্যই কংসের পূর্বঘটিত বলেই কংস মনে করেন। তিনি নিশ্চয় মনে করেন–তার সময়েই যদুবংশের চরম প্রতিষ্ঠা এবং সম্মান সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু যাঁরা মর্যাদা পুনঃস্থাপনে সাহায্য করেছেন কংসকে, তারা অনেকেই কংসের মন যুগিয়ে চলেন। কংস নিজেই সেকথা সগর্বে উচ্চারণ করে বলেছেন আপনারা সকলেই আপন আপন স্থানে অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি এবং আপনারা প্রত্যেকেই আমার মনের অনুকূল আচরণ করেন–এবং ভবৎসু যুক্তেষু মম চিত্তানুবর্তিযু।

কংসের মনের অনুকূল আচরণ যারা করেছেন, তাদের মধ্যে এমন সব নাম আমরা পাচ্ছি, যাঁদের নাম শুনলে আমাদের কিছুটা আশ্চর্যই লাগবে। কংস এই সভায় কৃষ্ণপিতা বসুদেবকে খুব কষে গালাগালি দিয়েছিলেন। তাতে বুঝি, তিনি তার অনুকূল ছিলেন না। কিন্তু কৃতবর্মা, ভূরিশ্রবা যাদের নাম আমরা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় আবার শুনতে পাব, কিংবা অর, যাকে ভবিষ্যতে অনেক সময়েই কৃষ্ণের বিপক্ষভূমিতে দেখতে পাব, অথবা দারুক, সত্য ভবিষ্যতে যাদের কৃষ্ণের সহমর্মিতার স্থানে দেখতে পাব–এঁদের সকলকে কিন্তু এখন কংসের অনুকূল ভূমিকায় দেখতে পাচ্ছি। তার মানে কংস রাজা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের বলেই হোক, বুদ্ধিতেই হোক অথবা মগধরাজ জরাসন্ধের জুজু দেখিয়েই হোক–এঁদের সবাইকে তিনি নিজের অনুকূলে টানতে পেরেছিলেন।

মথুরা-শূরসেন অঞ্চলে কংসের রাজনৈতিক স্থিতি নিয়ে আমরা যে দু-চারটে কথা বলছি, বা বলব, তা যেমন মহাভারতে একটু-আধটু পাব, তেমনই অনেকটাই পাব হরিবংশ এবং অন্যান্য পুরাণগুলিতে। মহাভারতের স্বপ্পোল্লিখিত সংবাদগুলি আমরা যখন পুরাণগুলি থেকে ‘সাবস্ট্যানসিয়েট’ করতে পারব তখনই বুঝব, আমরা ঠিক কথা বলছি। কিন্তু এই সমস্ত প্রক্রিয়ার জন্যই আমরা এখন শুধু ভূমিকা রচনা করছি এবং তা করতে হচ্ছে হরিবংশ কিংবা পুরাণ থেকে।

অন্ধক বংশের রাজা উগ্রসেন কারাগারে বন্দী হলে কংস রাজা হলেন। কিন্তু উগ্রসেন যখন রাজা ছিলেন, তখনও কিন্তু আমরা উগ্রসেনের জ্যেষ্ঠ দেবকের মধ্যে কোনও মন্দ প্রতিক্রিয়া দেখিনি। তিনি উগ্রসেনের বড় ভাই না ছোট ভাই, সেই তর্কের মধ্যে না গিয়েও বলতে পারি–দেবক কখনও উগ্রসেনের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করেননি। কিন্তু কংস যখন রাজা হলেন এবং পিতা উগ্রসেনকে বন্দী করলেন, তখন কিন্তু তিনি কংসের বিরুদ্ধ রাজনৈতিক কোটিতে অবস্থান করছিলেন বলেই মনে করি। এই ধারণার কারণও আছে।

প্রাথমিকভাবে কংস বেশিরভাগ যাদব গোষ্ঠী বা সংঘমুখ্যর সমর্থন আদায় করে নিলেও ক্ষমতার লোভে অথবা ক্ষমতার চূড়ায় বসে তিনি নিজেকে আর নিজের বশে রাখতে পারেননি। এর ফলে মথুরাবাসীর ওপরে নেমে এসেছে অত্যাচার আর অবিচারের বোঝ। হরিবংশে বর্ণিত কংসের চেহারাটা যদি ধর্মের নির্মোক মুক্ত করে বিচার করি, তাহলে ইতিহাসের তথ্যগুলো একটু একটু করে বেরিয়ে আসতেও বা পারে।

ধর্মের রক্ষার কারণে ঈশ্বর যখন অবতার গ্রহণ করেন, তখন প্রায় রুটিনমাফিক একটা আবেদন-নিবেদনের পালা আসে ভগবান বিষ্ণুর কাছে। মুনি-ঋষি, দেবতা, অথবা স্বয়ং পৃথিবীমাতাকে আমরা এই সময় ক্রন্দনরত অবস্থায় বিষ্ণু-নারায়ণের কাছে পৌঁছতে দেখব। তারা পৃথিবীতে অত্যাচারী রাজার অত্যাচারের ফিরিস্তি দিয়ে ঈশ্বরকে অবতার গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। ঈশ্বর ভক্তের ওপর অপার করুণায় দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনের জন্য তখন পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে অত্যাচারীকে বধ করেনএবং পৃথিবীকে পাপমুক্ত করেন।

ধর্মীয় দৃষ্টিতে এই দেবতা, ঋষি বা পৃথিবীর সরোদন অনুরোধ ভগবান বিষ্ণুর কাছে এসেছিল কংসের রাজত্বকালেও। আমরা সেসবের মধ্যে যাচ্ছি না। আমরা যেহেতু পরবর্তী কালে কৃষ্ণকে এক বিশুদ্ধ রাজনৈতিক নেতা এবং ত্রাতা হিসেবে যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রতিষ্ঠা করব, তাই এই অবতারগ্রহণের প্রণালীর মধ্য থেকেই আমাদের রাজনৈতিক উপাদানগুলি চয়ন করতে হবে। কংসের অত্যাচার চরমে পৌঁছলে নারদ ঋষি বিষ্ণুর কাছে গিয়ে প্রথমে মথুরাপুরীর বর্ণনা দিলেন খানিকটা। তিনি বললেন-মথুরাপুরী এক বিরাট বিস্তৃত নগরী। বড় বড় বাড়ি অথবা অট্টালিকার শোভা তো আছেই, কিন্তু আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল মথুরাপুরীর সুবৃহৎ প্রাচীরখানি এবং তার প্রবেশদ্বারটুকু-সা পুরী পরমোদারা সাট্টাপ্রাকারতোরণা।

আমরা জানি–ইতিহাসের প্রয়োজনেই মথুরাপুরীর এই বিরাট প্রাচীর গড়ে উঠেছিল। মগধরাজ জরাসন্ধের আগ্রাসী হাত থেকে মথুরাবাসীদের বাঁচনোর জন্যই এই দুর্গপ্রায় প্রাচীর পরে ব্যবহৃত হবে বটে, তবে এই প্রাচীর নির্মিত হয়েছিল কংস রাজা হওয়ার বহু পূর্বে। পৌরাণিকদের কথা শুনে বোঝা যায়-মথুরা নগরীর মধ্যস্থিত বাসস্থানটি তৈরি করেছিলেন শূরসেন, যাকে আমরা পূর্বে যদুবংশীয় কার্তবীর্যাজুনের জ্যেষ্ঠ পুত্র বলে চিহ্নিত করেছি–নিবিষ্টবিষয়শ্চৈব শূরসেন স্তভবৎ। পৌরাণিকেরা কাব্য করে বলেছেন-মথুরা নগরীর চারদিকে যে স্বচ্ছজলের পরিখা নির্মাণ করা হয়েছিল, সেই পরিখাঁটি দেখতে লাগত উড়িয়ে দেওয়া একটি ওড়নার মতো। তার মধ্যে যমুনার প্রাকৃতিক বেষ্টনী মথুরানগরীকে অর্ধচন্দ্রের শোভায় ভূষিত করেছিল–অর্ধচন্দ্রপ্রতীকাশা যমুনাতীরশোভিতা।

দেখুন, কংসের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা প্রমাণ করার জন্য মথুরার নিসর্গশোভা বর্ণনার যে কোনও প্রয়োজন নেই সেটা আমরা যথেষ্ট জানি। কিন্তু এই বর্ণনার অনুষঙ্গে আমরা যেটা বলতে চাই, সেটা হল-মথুরা-নগরীর সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক পরিবেশ এতটাই ভাল ছিল যে, কংসকে সে দিক দিয়ে কোনও ভাবনাচিন্তাই করতে হয়নি। মনু-মহারাজ শূরসেনকে ব্রহ্মর্ষিদেশগুলির অন্যতম বলে গণ্য করেছেন, সেটা সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে মহাভারতের মন্তব্যের সঙ্গে মেলে। মহাভারত বলেছে–বৈদিক যাগযজ্ঞের ব্যাপারে মথুরা-শূরসেনীদের বিশেষজ্ঞ বলে মনে করা হত–শূরসেনাশ্চ যজ্ঞান। অন্যদিকে অর্থনীতির কথা যদি ভাবেন, তাহলে হিউয়েন সাঙের সময়ে অন্তত এই রাজ্যের সম্পন্ন এবং ভূমির উর্বরতার সংবাদ যা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষের অবস্থাও মোটেই খারাপ ছিল না। শস্যও হত প্রচুর। ক্ষেত্রাণি শস্যবস্ত্যস্যা কালে দেবশ্চ বৰ্ষতি। মথুরায় একটা ভাল বাজার ছিল, যেখানে দেশ-বিদেশের লোকেরা ব্যবসা-বাণিজ্য করত। নগরীর দোকান-পাট, রত্নসঞ্চয় সমসাময়িক অন্যান্য নগরীর তুলনায় ঈর্ষণীয় ছিল–পুণ্যাপণবতী দুর্গা রত্নসঞ্চয়গর্বিত।

মথুরা-নগরীর এই সমৃদ্ধিই এক সময় মহারাজ কংসকে লুব্ধ করে তুলল। মথুরা শুরসেনীদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে তিনি বিচ্যুত হলেন। ব্রাহ্মণ্য যাগ-যজ্ঞ অথবা সত্যধর্মের পথ তাকে কোনওভাবেই আকর্ষণ করল না। জরাসন্ধের জামাই হবার সুবাদে সমস্ত সামন্ত রাজা তাকে ভয় করে চলতে আরম্ভ করল–রাজ্ঞাং ভয়ঙ্কররা ঘোরঃ শঙ্কনীয়ো মহীক্ষিতা। আর সেই থেকেই কংস নিজেকে বেশ কেউকেটা বলে ভাবতে আরম্ভ করলেন। সমস্ত সৎ পথ থেকে তিনি যেমন বিচ্যুত হলেন, তেমনই মথুরাবাসী প্রজাদের কাছেও অত্যন্ত ভীতিজনক হয়ে উঠলেন–সৎপথা বাহ্যতাং গতঃ,…প্রজানাং রোমহর্ষণ।

অত্যন্ত অত্যাচারী হয়ে উঠলেন কংস। রাজধর্মের সমস্ত আদর্শ বিসর্জন দেওয়াটা তার কাছে সামান্য ঘটনা। আত্মম্ভরিতা এবং স্বার্থসিদ্ধির জন্য তিনি এমন সব কাণ্ড করতে আরম্ভ করলেন, যে যদুবংশীয় সংঘমুখ্যেরা আর তাঁর অন্যায় আচরণ মেনেও নিতে পারছিলেন না– ন রাজধর্মাভিরতো নাত্মপক্ষসুখাবহঃ। ঠিক এই রকম একটা অবস্থায় কংস প্রজাদের ওপর অযথা কর চাপিয়ে এমন উৎপীড়ন করা আরম্ভ করলেন, যাতে মনে হল রাজকর ছাড়া আর কিছুতেই তার স্পৃহা নেই-নাত্মরাজে বির্যশ্চঃ কারুচিঃ সদা। ঠিক এই রকম চরিত্রের জন্যই পৌরাণিক্রে যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন, সেই সংজ্ঞা হল অসুর, রাক্ষস, দানব ইত্যাদি। পৌরাণিকের নিজের ভাষায় কংসে অসুরভাবের দ্বারা আবিষ্ট অন্তঃকরণে মাংসভক্ষী রাক্ষসের মতো সমস্ত লোকের। উৎপীড়ন করতে লাগলেন–ব্যাদো বাধতে লোকান্ অসুরোত্মরাত্মনা।

আমরা উগ্রসেন-জ্যেষ্ঠ দেবকের কথা বলতে বলতে কংসের কথায় এসেছিলাম। আমাদের ধারণা–কংসের উন্মাদ অত্যাচার যাঁরা মেনে নিতে পারছিলেন না, তাঁদের মধ্যে দেবক একজন। তিনি যে কংসের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন, তা মোটেই নয়। তিনি একটা মাধ্যম খুঁজছিলেন, যে মাধ্যমটি তিনি কাজে লাগাবেন কংসের বিরোধিতার জন্য। এই মাধ্যমটি ছিলেন বসুদেব, যিনি ভবিষ্যতে কৃষ্ণের পিতা হবেন।

কংস যেমন অন্ধক উগ্রসেনের পুত্র ছিলেন, তেমনই বসুদেব ছিলেন বৃষ্ণি-সংঘের মুখ্য। পুরুষ। অবশ্য বৃষ্ণির বংশ চার-পাঁচটি ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ায় তাকে আর সোজাসুজি বৃষ্ণিসংঘের মুখ্য নায়ক না বলাই ভাল। কারণ বৃঞ্চিবংশীয় অক্রুর তখনও কংসের অন্যতম সভাসদ এবং হয়তো তখনও কংসের অনুকূল। বসুদেব ছিলেন আর্য শুরের পুত্র। বৃষ্ণির এক পুত্রের ধারায় অরের জন্ম, আরেক পুত্রের ধারায় বসুদেবের জন্ম। হরিবংশে যেমন দেখছি, তাতে বোঝা যায় বসুদেব অরের চাইতে বয়সে অনেক বড় ছিলেন এবং তিনিও ছিলেন কংসের সভাসদ। কিন্তু কংসের সভাসদ হলেও তিনি কংসের সব মত নির্বিচারে মেনে নিতে পারছিলেন না এবং মনে মনে তিনি বেশ খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলেন কংসের ব্যবহারে।

উগ্রসেন-জ্যেষ্ঠ দেবক তার নিজের মেয়ে দেবকীর সঙ্গে এই ক্ষুব্ধ যুবকের বিয়ে দেবেন বলে ঠিক করলেন, কিন্তু তার আগে দেখতে হবে এইরকম একটা পছন্দ তিনি করলেন কেন? বসুদেবের ক্ষোভটাই বা তিনি টের পেলেন কী করে? এসব কথা বলতে হলে আমাদের আরও দু-একটা কথা জানতে হবে।

মূল যদুবংশ যখন ভাগ হয়ে অন্ধক, বৃষ্টি বা ভোজ সংঘে বিভক্ত হয়ে পড়ল, তখন এই সংঘগুলির মধ্যে ঘনিষ্ঠতা যেমন ছিল, তেমনই জ্ঞাতিভেদও কিছু কিছু ছিল। এক গোষ্ঠী বা সংঘের সঙ্গে অন্য গোষ্ঠী বা সংঘ যদি ঘনিষ্ঠ হতে চাইত, তবে সব চেয়ে ঈশিত উপায় ছিল বিবাহ। লক্ষ্য করে দেখুন, বসুদেবের পিতা শূর বা মহাশূর–তিনি কিন্তু এক ভোজরাজের কন্যাকেই বিবাহ করেছিলেন। এই ভোজরাজকন্যার গর্ভেই বসুদেব জন্মান। শোনা যায় বসুদেবের জন্মের সময় স্বর্গরাজ্যে নাকি আনক’ নামে এক বাদ্য বেজে উঠেছিল এবং সেইজন্যই বসুদেবের এক নাম আনকদুন্দুভি’-আনকানাঞ্চ সংহ্রাদঃ সুমহান্ অভব দিবি।

বসুদেব যখন প্রথম বৈবাহিক সম্বন্ধের কথা ভাবলেন, তখন কিন্তু প্রথমেই তিনি ভোজ, অন্ধক বা বৃষ্ণিগোষ্ঠীর কারও সঙ্গে সম্বন্ধের কথা ভাবলেন না। বৈবাহিক সম্বন্ধের জন্য তিনি বেছে নিলেন হস্তিনাপুরের রাজবংশকে। হস্তিনাপুরে তখন রাজত্ব করছিলেন মহারাজ শান্তনু এবং আমরা জানি শান্তনুর কোনও কন্যা সন্তান হয়নি। কিন্তু শান্তনুর মেজ দাদা বাহ্লীক, যিনি শান্তনুর রাজ্যাভিষেকের পর রাজ্য ছেড়ে তার মামাবাড়ির দেশে চলে গিয়েছিলেন বলে বলেছি, তিনি কিন্তু পিতৃভূমিতে একেবারে পরবাসী ছিলেন না। শান্তনুর মন্ত্রিসভায় তিনি অন্যতম মন্ত্রী ছিলেন, এবং মহাভারতের যত্রতত্র কৌরবসভার মন্ত্রী হিসেবে আমরা বাহ্লীকের নাম পাব। বাহ্লীকের সর্বময় খ্যাতি পুরুবংশীয় বলেই।

শান্তনুর এই মেজদাদা বাহ্লীকের পাঁচটি সুন্দরী মেয়ে ছিল। এই পাঁচজনের নাম হল রোহিনী, ইন্দিরা, বৈশাখী, ভদ্রা এবং সুনাম্নী। বাহ্লীক হস্তিনাপুরের রাজ্য নাই গ্রহণ করুন, রোহিণী ইত্যাদি পাঁচটি কন্যাই কিন্তু পৌরবী বলে পরিচিত ছিলেন–পৌরবী রোহিণী নাম ইন্দিরা চ তথা বরা।

আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস–জরাসন্ধ যখন সমস্ত ভারতবর্ষে প্রবল হয়ে উঠছেন এবং মথুরাধিপতি কংস যখন তার এজেন্ট হিসেবে উত্তর-পশ্চিম ভারত প্রায় পদানত করে ফেলেছেন, তখন হস্তিনাপুরের এই নতুন রাজবংশের সঙ্গে বসুদেবের এই বৈবাহিক সম্বন্ধ রাজনৈতিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জা—িহস্তিনাপুরে মহারাজ শান্তনুর পূর্বে তেমন শক্তিধর রাজা কেউ ছিলেন না। মহারাজ প্রতীপের পর শান্তনুর হাত ধরেই হস্তিনাপুরের পূর্ব গৌরব আবার ফিরে আসছিল। মগধরাজ জরাসন্ধ আপন পূর্বতন কুরুবংশের সম্বন্ধেই হোক, অথবা অন্য কোনও কারণে-কখনই তিনি হস্তিনাপুরের রাজাদের সঙ্গে শত্রুতা করেননি। করলে, শান্তনুর ক্ষমতা হত না তাকে রোখার।

সে যাই হোক, বাহ্লীকের সঙ্গে শ্বশুর-সম্বন্ধ স্থাপন করে বসুদেব কিন্তু হস্তিনাপুরের নবোথিত রাজশক্তির সঙ্গে খানিকটা ঘনিষ্ঠ হলেন এবং এই সম্বন্ধ রাজনৈতিক দিক দিয়ে তার কাছে জরুরী ছিল বলেই আমরা মনে করি। মহামতি বসুদেবের ঘরে আরও দুটি বৈবাহিক সম্বন্ধও যথেষ্ট খেয়াল করার মতো। অবশ্য এই সম্বন্ধ তিনিই ঘটিয়েছিলেন, নাকি তার পিতা শুর, সে ব্যাপারে কোনও তর্ক না তুলেও বলতে পারি, এই সম্বন্ধগুলিও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।

আপনাদের খেয়াল থাকবে–চৈদ্য উপরিচর বসু যে রাজ্যে প্রথম এসে জাঁকিয়ে বসেছিলেন, সে রাজ্যের নাম হল চেদি। চেদি আগে যাদবদের দেশ ছিল। পরে এই দেশ দখল করে নেন উপরিচর বসু এবং তার পাঁচ পুত্রের একজনকে তিনি এখানে অধিষ্ঠিত করেন। হয়তো তাঁর নাম ছিল প্রত্যগ্রহ। অনুমান করা যায়–তারই কোনও অধস্তন পুরুষের সঙ্গে বসুদেবের এক ভগিনীর বিবাহ হয়। এই ভগিনীর নাম হল শ্রুতবা। বসুদেবের আরেক বোন হলেন পৃথুকীর্তি। এঁর বিবাহ হয় করূষ দেশের রাজা বৃদ্ধশর্মার সঙ্গে। করূষ দেশেও পূর্বে যাদবদের আধিপত্য ছিল, পরে সেখানে সিংহাসনে বসেন বসুরাজের আরেক পুত্র। মনে রাখা দরকার–চেদি এবং করূষ–এই দুই দেশই কিন্তু জরাসন্ধের দেশ মগধের সঙ্গে প্রায় লাগোয়া। সুদূর মথুরা-শূরসেনে বসে মগধ-রাজ্যের পাশাপাশি দুটি রাজ্যের রাজাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করার মধ্যে যতখানি হৃদয়ের সরসতা আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি আছে রাজনৈতিক অভিসন্ধি।

কংস যেখানে দিনে দিনে অত্যাচারী হয়ে উঠছেন, সেখানে জরাসন্ধের আত্মীয়জনের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করে শুর এবং বসুদেব–দুজনেই হয়তো খানিকটা ‘রিলিফ’ পেতে চেয়েছিলেন। আমরা পরে দেখব-বসুদেবের ভগিনীর এই সম্বন্ধ দুটি একেবারেই বিফলে গিয়েছিল। অর্থাৎ যে রাজনৈতিক অভিসন্ধিতে এই বৈবাহিক সম্বন্ধ দুটি ঘটনো হয়েছিল বলে আমাদের অনুমান, সেই অভিসন্ধি ফলপ্রসূ হয়নি। পরবর্তী সময়ে চেদিতে শিশুপাল জন্মাবেন, করূষদেশে জন্মাবেন দন্তবক্র-এঁরা চিরকাল মথুরা-শূরসেনের বিরোধিতা করবেন।

কিন্তু সে সব পরের কথা, পরেই দেখা যাবে। মথুরা-শূরসেনের অন্তঃরাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে শর কিংবা বসুদেবের স্থিতিটা আমরা আগে বুঝে নিই। চেদি-করূষে দুই বোনের বিয়ে দিয়ে এবং নিজে হস্তিনাপুরের রাজসম্বন্ধী পাঁচটি কন্যাকে বিয়ে করে বসুদেব কিন্তু মথুরা-শূরসেনে এক রীতিমতো মাননীয় ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। আমরা যেহেতু পরে তাকে মথুরাধিপতি কংসের কট্টর বিরোধী নেতার ভূমিকায় দেখতে পাব, তাই ধরে নিতে পারি, অনেক আগে। থেকেই তিনি কংসের বিরোধী মত পোষণ করতেন।

ভাগবত পুরাণ কিংবা অন্যান্য কিছু বৈষ্ণবীয় পুরাণে বসুদেবের কাহিনী শুনলে মনে হবে–তিনি একেবারে এক গোবেচারা ভাল মানুষ। রাজনৈতিক বুদ্ধি তার কিছুই ছিল না। তিনি শুধু কংসের কোপানলে দগ্ধ হয়ে সারা জীবন কংসের কারাগারে পচে মরলেন। আমরা অবশ্য এই মতের পোষণ করি না। আমরা হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ এবং মহাভারত পড়ে এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, জরাসন্ধ-কংসের আমলে যে রাজনীতির আবর্ত তৈরি হয়েছিল, বসুদেবও তার অন্যতম বলি। আমরা মনে করি পূর্বদেশীয় দেশগুলির সঙ্গে বসুদেবের ভগিনীদের বৈবাহিক সম্বন্ধ এবং হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির সঙ্গে বসুদেবের নিজের বৈবাহিক সম্বন্ধ লক্ষ্য করেই উগ্রসেনের বড় দাদা দেবক তার সাত-সাতটি মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন বসুদেবের সঙ্গে। এদের মধ্যে জ্যেষ্ঠা হলেন দেবকী।

 দেবকের সাত মেয়ের নাম হল–সহদেবা, শান্তিদেবা, শ্রীদেবা, দেবরক্ষিতা, বুকদেবী, উপদেবী এবং দেবী। এঁদের মধ্যে প্রথম ছয়জনের সঙ্গে বসুদেবের আগেই বিয়ে হয়েছিল কি না সে কথা স্পষ্ট করে কোথাও বলা নেই। কিন্তু কনিষ্ঠা অথবা জ্যেষ্ঠা দেবীর সঙ্গে বসুদেবের যে আলাদাভাবে এবং মহা আড়ম্বরে বিয়ে হয়েছিল-সেকথা আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি।

.

৫৮.

 মহামতি ভীষ্ম সত্যবতীকে রথে চড়িয়ে নিয়ে এসে পিতার সামনে সমস্ত ঘটনা নিবেদন করেই ক্ষান্ত হলেন না, শাস্ত্রের নিয়ম অনুসারে পিতার সঙ্গে সত্যবতীর শুভ-বিবাহ সম্পন্ন করলেন তিনি–বিবাহং কারয়ামাস শাস্ত্রদৃষ্টেন কর্মণা। এখানে সংস্কৃত ভাষায় ক্রিয়াটি হল প্রবর্তক ক্রিয়া-বিবাহং কারয়ামাস-বিবাহ করালেন। মন্দ লোকেরা অশ্লীল কথ্য ভাষায় কুবাক্য ব্যবহার করে বলে–বাপের বিয়ে দেখিয়ে দেব। যার প্রতি এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়, তার যে এই শব্দ শ্রবণমাত্রেই অতি কঠিন এবং কষ্টকর প্রতিক্রিয়া হবে–সে কথা ধরে নিয়েই মন্দ লোকে এমন মন্দ কথা বলে। এই নিরিখে নিজের চোখের সামনে সত্যবতীর সঙ্গে পিতার বিবাহ সম্পন্ন করতে ভীষ্মের মনে কত কষ্ট হয়েছিল–সে খবর মহাভারতের কবি দেননি।

ভীষ্ম দেখলেন–তাঁর পিতা শান্তনু সত্যবতীকে নিয়ে নিজের প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলেন– তাং কন্যাং রূপসম্পন্নাং স্বগৃহে সন্ন্যবেশয়ৎ। সেই মুহূর্ত থেকেই কোনও কষ্টের কথা তো নয়ই, মহাভারতের কবি ভীষ্মকে যেন তার পিতারও অভিভাবক হিসেবে নিযুক্ত করলেন। এমন একজন অভিভাবক, যিনি পিতার বিবাহ দিয়ে পিতার সন্তানগুলি মানুষ করার ভার নিলেন। শান্তনু খুব বেশিদিন বাঁচেননি। সত্যবতীর গর্ভে দুটি পুত্রের জন্ম দিলেন তিনি। দুই পুত্র–চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। কনিষ্ঠ বিচিত্রবীর্য যৌবনের সন্ধিলগ্নে পৌঁছনোর আগেই শান্তনু স্বর্গত হলেন।

শান্তনু প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলেই যেহেতু নিজের জননী সত্যবতীর সম্বন্ধে কথা বলতে হয়, তাই মহাভারতের কবি কোনও বিস্তারের মধ্যে যাননি। শান্তনুর জীবনে মিতাচারিতার লক্ষণ খুব প্রকট নয়। পূর্ব জীবনে গঙ্গা এবং এই এখন এই মুহূর্তে সত্যবতীর সঙ্গে তাঁর গার্হস্থ্য জীবন খুব মিতাচারিতার মধ্যে কাটেনি বলেই মনে হয়। মহাভারতের কবি নিজের মাকে কোনও রকমে শান্তনুর প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন বটে, কিন্তু সময় বুঝে তিনি খুব তাড়াতাড়ি ভীষ্মকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। শান্তনু স্বৰ্গত হলে ভীষ্ম সঙ্গে সঙ্গে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র চিত্রাঙ্গদকে হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে অভিষিক্ত করলেন। সত্যবতীর বিবাহের সময় দাস রাজার পূর্বকথা এবং শর্ত তার মনে আছে। সত্যবতীর অনুমতি নিয়ে মহামতি ভীষ্ম হস্তিনাপুরের রিক্ত সিংহাসন পূর্ণ করে দিলেন চিত্রাঙ্গদকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করে।

রাজ্য পরিচালনা করার পূর্ব অবস্থায় একজন ক্ষত্রিয়ের যে তপস্যা এবং সাধনা দরকার হয়, চিত্রাঙ্গদের তা ছিল না। শান্তনুর বয়স্ক জীবনের আদর নিয়ে তিনি মানুষ হয়েছেন, বলদর্পিত এবং দম্ভ তাকে খানিকটা পেয়ে বসেছিল। কিছু দেশ জয় করার ‘ক্রেডিট’ তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বটে, কিন্তু এই জয়কার যে কোনও রাজনামের অলংকার-ধ্বনিমাত্র। বাস্তবে তিনি ছিলেন অহংকারী বলদর্পী। কাউকেই তিনি নিজের তুল্য বলে মনে করতেন না-মনুষ্যং ন হি মেনে স কঞ্চিৎ সদৃশমাত্মনঃ।

 মহারাজ শান্তনুর মধ্যে যে অমিতাচারিতা ছিল, তার সঙ্গে যুক্ত হল ক্রোধ এবং অহংকার। দেবতা এবং অসুর, যাঁরা চিরকালই মনুষ্যবুদ্ধির উত্তর পর্যায়ে অবস্থিত, চিত্রাঙ্গদ তাদের তোয়াক্কা তো করতেন না, বরং সদা সর্বদা তাদের নিন্দায় মুখর ছিলেন। আর মানুষ তো তার গ্রাহ্যের মধ্যেই ছিল না–তং ক্ষিপন্তং সুরাংশ্চৈব মানুষ-অসুংস্তথা। মহাভারতের ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে দেবাসুর-মনুষ্যের মর্যাদা কলঙ্কিত করে কোনও রাজার পক্ষে সুস্থিরভাবে রাজ্যশাসন করা সম্ভব ছিল না। আমরা দেখতে পাচ্ছি–এক গন্ধর্বরাজ স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন হস্তিনাপুরে চিত্রাঙ্গদ রাজার কাছে রাজার কাছে। তিনি বলছেন–আমার নামও চিত্রাঙ্গদ। পৃথিবীতে একই নামের দুটো লোক তো আর থাকতে পারে না। সেইজন্য আমি তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই–ত্বয়াহং যুদ্ধমিচ্ছামি…ন গচ্ছেন্নাম তে মম।

চিত্রাঙ্গদ রাজা বলদর্পী মানুষ। দেবতাই হোন অথবা গন্ধর্ব, তাদের সব কথা তার কাছে উন্মত্তের প্রলাপ। তিনি কাউকে মানেন না। অতএব দুজনেই পরস্পরকে গালাগালি দিতে দিতে-ইত্যুক্তঃ গর্জমানৌ তৌ–যুদ্ধ করার জন্য হিরন্মতী নদীর তীরে পৌঁছলেন। জায়গাটার নাম কুরুক্ষেত্র, যা আসলে এক বিশাল যুদ্ধভূমি। দুজনের যুদ্ধ আরম্ভ হল এবং মহাভারতের সংবাদ অনুযায়ী এই যুদ্ধ চলল তিন বৎসর ধরে। আমাদের ধারণায় এই সময়ের বিস্তার হয়তো তিন দিন, তিন মাস নয়, তিন বছরও নয়। যুদ্ধের গরিমা প্রকাশ করার জন্য পৌরাণিক কল্পনায় তিন দিন তিন বছরে পরিণত হয়েছে। দুই চিত্রাঙ্গদের মধ্যে অস্ত্রযুদ্ধ হয়েছিল পরম্পর। এককভাবে এবং এই যুদ্ধে কূটকৌশলের জোরে গন্ধর্বরাজ জিতে গিয়ে কুরুরাজ চিত্রাঙ্গদকে মেরে ফেললেন।

হস্তিনাপুরের রাজপুরীতে শোকের ছায়া নেমে এল। কিশোর বিচিত্রবীর্যকে দিয়ে বড় দাদার শ্রাদ্ধ-শাস্তির কাজ শেষ করে মহামতি ভীষ্ম তাকেই সিংহাসনে বসালেন। মহাভারতের কবি চিত্রাঙ্গদার স্বল্প-পরিসর জীবনের কথা জানিয়ে বিচিত্রবীর্যকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করা মাত্রই মন্তব্য করলেন বিচিত্রবীর্য ভীষ্মের কথা মেনে চলতেন-ভীষ্মস্য বচনে স্থিতঃ–এবং পৈতৃক রাজ্যও শাসন করতেন তারই অনুশাসনে চলে।

কথাটা শুনলেই বিপ্রতীপভাবে মনে হয় শান্তনুর জেষ্ঠপুত্র ভীষ্মের কথা শুনতেন না। একটু আগেই যে কবি বলেছিলেন–চিত্রাঙ্গদ কোনও মানুষকে তার সমকক্ষ জ্ঞান করতেন না–আমাদের ধারণায়–এই মানুষটি হলেন ভীষ্ম। ভীষ্মকে তিনি গণনার মধ্যে আনতেন না বলে ভীষ্মও তার প্রতি উদাসীন ছিলেন। মহাভারতে নয়টি মাত্র শ্লোকে চিত্রাঙ্গদের কাহিনী প্রাথমিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তার মধ্যে ভীষ্মর কথা একবারও আসেনি। কথা যা এসেছে, তা সবই চিত্রাঙ্গদের বেপরোয়া ভাব নিয়ে। অথচ শান্তনুর কনিষ্ঠ পুত্র বিচিত্রবীর্য রাজা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভীষ্মের প্রসঙ্গ আসহ প্রথম থেকে। তিনিই বিচিত্রবীর্যের অভিষেক সম্পন্ন করলেন, তার মতেই বিচিত্রবীর্যের শাসন চলতে লাগল এবং সর্বোপরি মন্তব্য করা হল–বিচিত্রবীর্য ভীষ্মকে যথাবিহিত সম্মান করে চলতেন, যেহেতু ভীষ্ম ছিলেন ‘ধর্মশাস্ত্ৰকুশল’স ধর্মশাস্ত্রকুশলং ভীষ্মং শান্তনবং নৃপঃ..পূজয়ামাস ধর্মেণ…।

 ‘ধর্মশাস্ত্ৰকুশল’-এই একটি মাত্র বিশেষণ ভীষ্মের নামের সঙ্গে যোজিত হওয়ার বিশেষ অর্থ আছে। ধর্মশাস্ত্র বলতে সাধারণভাবে নিত্যনৈমিত্তিক কর্মের বিধিনিষেধ বোঝালেও, আসলে ধর্মশাস্ত্র হল সেকালের আইনের বই। রাজারা কীভাবে রাজ্য শাসন করবেন, কীভাবে করগ্রহণ করবেন, কীভাবে দণ্ড দেবেন, কীভাবে, কোন অবস্থায় শক্ররাজার সঙ্গে সন্ধি-বিগ্রহের শর্ত দেবেন–এইসব কিছুর আইনি দলিল হল প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রগুলি। মহামতি ভীষ্মের সময়ে আইনি বিধিনিষেধের যে সমস্ত নীতি-নিয়ম চালু ছিল, তা প্রধানত বৃহস্পতি এবং শুক্রাচার্যের শাস্ত্ৰ-পরম্পরা। গঙ্গা যখন ভীষ্মকে শান্তনুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন তখনই ভীষ্ম বৃহস্পতি এবং শুক্রাচার্যের রাজনীতিশাস্ত্রে পারঙ্গম–উশনা বেদ যচ্ছাং যচ্চ বেদ বৃহস্পতিঃ। পরবর্তীকালে মনুর ধর্মশাস্ত্র থেকে আরম্ভ করে নারদের রাজনীতিশাস্ত্র সবই তিনি অধিগত করেছেন। এ সবের বিস্তারিত খবর পাওয়া যাবে মহাভারতের শান্তিপর্বে।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর যুধিষ্ঠির যখন কিছুতেই রাজা হতে চাইছিলেন না এবং মহাভারতের কবি স্বয়ং যখন তাকে রাজা হবার জন্য বারবার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছিলেন, তখন সর্বদশী ব্যাসকে যুধিষ্ঠির উদভ্রান্তের মতো প্রশ্ন করে বলেছিলেন–আমি যে রাজনীতি, রাজধর্মের কিছুই জানি না, রাজনৈতিক বিপন্নতা তৈরি হলে আমার কী কর্তব্য হবে, তাও তো আমার জানা নেই। আপনিই না হয় রাজধর্মের উপদেশ করুন–রাজধৰ্মান দ্বিজশ্রেষ্ঠ। চাতুর্বর্ণস্য চাখিলান্। ব্যাস হেসে বলেছিলেন–আমি নয়, দাদাভাই! রাজধর্ম কিংবা রাজনীতির কুট জানতে চাইলে, তোমাকে যেতে হবে মহামতি ভীষ্মের কাছে, এ ব্যাপারে তিনি সবচেয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তি–প্রৈহি ভীষ্মং মহাবাহো বৃদ্ধং কুরুপিতামহম্। আশ্চর্যের ব্যাপার হল–যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করেছিলেন রাজধর্মের কথা, রাজনীতির কুট; তার উত্তরে ব্যাস বললেন–ধর্মের বিষয়ে যত তোমার সংশয়, সন্দেহ আছে, সব তিনি দূর করে দেবেন–স তে ধর্মরহস্যেষু সংশয়ান মনসি স্থিতান্।

এই যে ধর্ম শব্দের প্রয়োগ হল, এটা রাজার ধর্ম, রাজনীতির রহস্য। আমাদের মূল প্রসঙ্গে উপস্থিত হয়ে বলি-মহারাজ বিচিত্রবীর্য রাজনীতিকুশল (ধর্মার্থকুশল) ভীষ্মের সব কথা। শুনতেন, যা হয়তো তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শোনেননি এবং না শুনে গোঁয়ার-গোবিন্দের মতো মৃত্যুবরণ করেছেন। গন্ধর্বরাজ চিত্রাঙ্গদ কোনও পরিচিত ব্যক্তি নন। তিনি আকস্মিকভাবে এসে একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে (আমার নাম আর তোমার নাম এক হওয়া চলবে না) চিত্রাঙ্গদের সঙ্গে ঝগড়া আরম্ভ করেছেন, এবং তাকে আততায়ীর মতো খুন করে চলে গেছেন। কাউকে যিনি কেয়ার করতেন না, তার শত্রু অনেক। গন্ধর্বরাজকে আমরা এক আকস্মিক আততায়ী বলেই মনে করি। হয়তো সেই কারণেই তার পরিচয়–তিনি গন্ধর্বরাজ এবং চিত্রাঙ্গদকে হত্যা করেই তিনি চলে গেছেন স্বর্গে অর্থাৎ কোনও অজ্ঞাত জায়গায়–অন্তায় কৃত্বা গন্ধর্বো দিবমাচক্রমে ততঃ।

 চিত্রাঙ্গদের রাজত্বকালে ভীষ্ম উদাসীন ছিলেন। পৈতৃক রাজ্য তিনি পাননি অথচ তাঁর পিতার অন্য পুত্র রাজ্যশাসন করছেন। তিনি যদি কোনও কথাই ভীষ্মকে না জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে তিনিই বা আগ বাড়িয়ে উপদেশ দিতে যাবেন কেন? এর ফল যা হবার তাই হয়েছে। কিন্তু চিত্রাঙ্গদের মরণাস্তিক উদাহরণ দেখে তার কনিষ্ঠ, বিচিত্রবীর্য, দেখে শিখেছেন। অতএব তিনি রাজত্ব চালাতে লাগলেন ‘ধর্মার্থকুশল’ ভীষ্মের অভিভাবকতায় আস্থা রেখে। ভীষ্মও তাই। কুমার বিচিত্রবীর্যকে যথোপযুক্ত রাজনৈতিক উপদেশ দিয়ে সর্বসময় তাকে রক্ষা করে চলতেন–স চৈনং প্রত্যপালয়ৎ।

বাস্তব ঘটনা যা দাঁড়াল, কুমার বিচিত্রবীর্য হস্তিনাপুরের সিংহাসন অলংকৃত করে রাখলেও এই কিশোর বালকটির সমস্ত দায়িত্বভার ভীষ্মের হাতেই তুলে দিয়েছিলেন সত্যবতী। ফলত রাজ্যের শাসনও চালাতে হত স্বয়ং ভীষ্মকেই। যদিও শাসন সংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপারেই ভীষ্ম আগে সত্যবতীর মত গ্রহণ করতেন-পালয়ামাস তদ্রাজ্যং সত্যবত্যা মতে স্থিতঃ–এবং এটাই ছিল তার বুদ্ধিমত্তা। যিনি পিতার প্রণয়-সন্তুষ্টির জন্য নিজের সংসার-সুখ, বাৎসল্য-সুখ বলি দিলেন, সেই পিতার প্রথম পুত্র তাকে মানল না–এ দুঃখ তার কাছে সইবার নয়। কাজেই বুদ্ধিশালিনী সত্যবতীর বুদ্ধিতে কুমার বিচিত্রবীর্যের ভার যখন ভীষ্মের ওপর এসে পড়ল, তখন যেন তিনি ধন্য হয়ে গেলেন। অসীম মমতায় তিনি এই বৈমাত্রেয় ভাইটির সমস্ত দায়িত্ব আত্মসাৎ করলেন যেন।

 হস্তিনাপুরের রাজকুমার বিচিত্রবীর্য একটু বড় হতেই ভারি সুন্দর হয়ে উঠলেন। রাজকুমারের তারুণ্যের অভিসন্ধিতে ভীষ্মের নতুন দায়িত্ব এসে গেল। পিতৃকল্প সর্বজ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পুত্ৰকল্প বিচিত্রবীর্যের যৌবনসন্ধিতে চিন্তান্বিত হলেন। তার প্রথমে মনে হল–ভাইয়ের বিয়ে। দিতে হবে–ভীমো, বিচিত্রবীর্যস্য বিবাহায়াকরোল্মতি। নানা লোকের সঙ্গে নানা কথায় ভীষ্মের কানে এল–কাশীর রাজার তিনটি মেয়েই স্বয়ংবরা হবেন। ভীষ্ম জননী সত্যবতীর মতামত জানতে চাইলেন।

সেকালের দিনে কাশীর রাজার সম্মান ছিল যথেষ্ট। কাশীর উত্তরে হুল কোশল, দক্ষিণে চেদি-করূষ, পূর্বে মগধ আর পশ্চিমে বৎসদেশ। বৌদ্ধগ্রন্থ গুট্টিলজাতকে কাশীনগরীকে সেকালের সমস্ত নগরীর শ্রেষ্ঠতমা বলে বলা হয়েছে। সম্ভব-জাতক আবার সেকালের মিথিলা আর যুদ্ধিষ্ঠিরের ইন্দ্রপ্রস্থের সঙ্গে কাশীর তুলনা দিয়ে বলেছে–কাশী নগরীর আয়তন হল বার। যোজন, যেখানে মিথিলা অথবা ‘ইন্দপত্ত’র আয়তন মাত্র সাত যোজন–দ্বাদশযোজনিকং সকল-বারাণসী-নগর।

পুরাণে-ইতিহাসে কাশীর রাজা ব্রহ্মদত্তের মাহাত্ম কীর্তন করা হয়েছে একাধিকবার। এবং ব্রহ্মদও একজন নন, অনেকজন। আর শুধু পুরাণ-ইতিহাসই বা বলি কেন বৌদ্ধগ্রন্থ মহাবও এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করে। মহাবগ্নের বর্ণনায়–ব্রহ্মদত্ত ছিলেন যেমন বলী, তেমনই ধনী। যেমন ভোগী, তেমনই পরাক্রমশালী-বারানস্যাং ব্রহ্মদত্তো নাম কাশীরাজা অহহাসি অড়ঢ়ো মহদ্ধনোমহাভোগো মহাবলো মহাবাহনো মহাবিজিততা পরিপুঃ-কোষ-কোঠঠাগারো। পুরাণে একাধিক বিখ্যাত ব্ৰহ্মদত্তের নাম পাওয়া যায়। কাশীর রাজাদের মধ্যে অলক, প্রতর্দনের নামও ভারতজোড়া। বিশ্বকাসেন, উদকসেন কিংবা ভল্লাটের নামও মহকীর্তি কাশীরাজদের অন্যতম।

বৌদ্ধগ্রন্থে দেখা যাবে কাশীর রাজা ব্ৰহ্মদত্তরা (পর পর ব্রহ্মদত্তের বংশধরেরা) কোশল রাজ্যটিও জয় করে নিয়েছিলেন। আমাদের ধারণা, মহাভারতের ভীষ্ম যখন কাশীরাজের তিন কন্যার কথা শুনলেন, তখনও কোশল রাজ্যটি কাশীর অন্তর্ভুক্ত ছিল, কারণ, এই তিন কন্যাকে কাশীরাজের মেয়ে ছাড়াও বারবার ‘কৌশল্যা বলে ডাকা হয়েছে। যাই হোক সত্যবতী কাশীরাজের সম্মান জানতেন। অতএব ভীষ্ম বলামাত্রই তিনি তার তরুণ পুত্রের অভিভাবকের সমস্ত মন্ত্রণা মেনে নিলেন।

ভীষ্ম সঙ্গে কোনও সেনাবাহিনী নিলেন না। যাবার আগে তিনি শুধু জননী সত্যবতীর অনুমতি নিলেন, তারপর একটি সুসজ্জিত রথে করে একা রওনা হলেন কাশী। ভীষ্ম শুনেছেন-কাশীরাজের তিনটি মেয়েই বড় সুন্দরী-কন্যাস্তিস্রো’রোপমাঃ–অতএব মনে মনে ঠিক করলেন-তিনটি মেয়েকেই তিনি বিয়ে দেবেন তরুণ বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে। ভাইকে তিনি বড় স্নেহ করেন। ভীষ্ম কাশী পৌঁছলেন ঠিক স্বয়ংবরের দিন। দেখলেন–রাজারা সবাই এসে উপস্থিত হয়েছেন রাজসভায়। বিচিত্র আসন মঞ্চে সমাসীন হয়ে তারা কাশীরাজের তিন কন্যার অপেক্ষায় আছেন। ভীষ্মও কাশীর স্বয়ংবরসভায় একটি আসনে বসে গেলেন।

 অপরূপ সাজে সেজে বিবাহের লজ্জাবস্ত্র মাথায় দিয়ে তিন কন্যা উপস্থিত হলেন রাজার সভায়। রাজারা নড়েচড়ে বসলেন। কেউ তার কেশরাশি সুবিন্যস্ত করলেন, কেউ বা বহুমূল্য বস্ত্র, অলংকারের বিন্যাস শেষবারের মতো পরীক্ষা করে নিলেন। প্রৌঢ় বৃদ্ধপ্রায় ভীষ্ম বসে রইলেন দৃঢ়ভাবে কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে।

সভায় উপস্থিত বিবাহেচ্ছু রাজাদের নাম এবং পরিচয় দেওয়া আরম্ভ হল। ইনি বৎসদেশের রাজা, উনি অবন্তীর, তিনি শ্রাবস্তীর–এই রকম রাজনাম উচ্চারণের সঙ্গে তিন কন্যা সেই সেই রাজাদের সামনে দাঁড়িয়ে খানিক নিরীক্ষণ করে অপছন্দের মুদ্রা দেখিয়ে চলে যেতে লাগলেন। বিবাহ-কৌতুকিনী তিন কন্যা এবারে মহামতি ভীষ্মের সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং তাকে প্রৌঢ়-বৃদ্ধ দেখে প্রায় ছুটেই পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। হয়তো তারা ভাবলেন–স্বয়ংবর সভার মান বুঝি যথেষ্ট নেমে গেছে, নইলে প্রৌঢ়-বৃদ্ধরাও এসে ভিড় বাড়ান কী করে!

ভীষ্মের বৃদ্ধত্ব নিয়ে কাশীরাজের তিন কন্যা যে যথেষ্ট বিব্রত বোধ করেছিলেন, তা তাদের ভাবভঙ্গি, এবং পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থেকেই বোঝা গেল। অপাক্রান্ত তাঃ সর্বা বৃদ্ধ ইত্যেব চিন্তয়া। সভায় সমাগত রাজবৃন্দের মধ্যে শোরগোল আরম্ভ হল। সভায় যারা অল্পবুদ্ধি আর। চটুল রাজা ছিলেন, তারা অকথা-কুকথা বলতে আরম্ভ করলেন ভীষ্মের নামে। বলতে লাগলেন–ভীষ্ম লোকটাকে ধার্মিক বলে জানতাম। ব্যাটা বুড়ো ভাম, গায়ের চামড়া ঝুলে পড়েছে, মাথার চুল পুরো পাকা অথচ কেমন বেহায়া দেখুন, বিয়ে করার লোভে এখানে ঠিক এসে জুটেছে-বৃদ্ধ পরমধর্মাত্মা বলীপলিতধারণঃ। কিং কারণ ইহায়াতঃ… অন্য এক তরুণ রাজা চিমটি কেটে বললেন–আরে মশাই! আমরা তো ছোটবেলা থেকে শুনেছি–উনি নাকি আবার বেম্মচারী। উনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন–জীবনে আর বিয়ে করবেন না। তা এখন লোকে শুনলে কী বলবে? এত প্রতিজ্ঞা, এতসব ব্রহ্মচারীর ব্রত–তার কী গতি হল মশাই-ব্রহ্মচারীতি ভীষ্মে হি বৃথৈব প্রথিতো ভুবি।

রাজারা কথাও যেমন বলতে লাগলেন, হো হো করে হাসতে লাগলেন সেই রকম। রাগে ঘৃণায় তার শরীর জ্বলে উঠল। যিনি পরশুরামের অস্ত্রশিষ্য তাকে কিনা এই ধরনের অপমান। এক লহমার মধ্যে তিনি নেমে এলেন বরাসনের মঞ্চ থেকে। পলায়মান তিনটি সুন্দরী কন্যাকে যাত্রাপথেই থামিয়ে দিয়ে টেনে তুললেন নিজের রথেরথমারোপ্য কন্যাঃ ভীষ্ম প্রহরতাং বরঃ

আমাকে অনেকে ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্ন করেন–কী প্রয়োজন ছিল ভীষ্মের? কাশীরাজ্যে তার নিজের যাবার কী প্রয়োজন ছিল? আর গেলেনই যখন, তখন গিয়ে কেন বললেন না–আমি নয়। আমি আমার বৈমাত্রেয় ভাই তরুণ বিচিত্রবীর্যের জন্য কাশীরাজের মেয়ে তিনটিকে নিয়ে যেতে এসেছি। না, ভীষ্ম এসব বলেননি, বলার প্রয়োজনও বোধ করেননি। তিনি জানেন–ক্ষত্রিয়রা নিজের জোরে কন্যা হরণ করে বিয়ে করে। দরকার হলে তিনিও তাই করবেন। অত কথার দরকার কী? তিনি তো ক্ষমতার বলে, সম্মানে কারও চেয়ে খাটো নন। এই অতুল ক্ষাত্রশক্তির প্রসঙ্গ তো আছেই, তা ছাড়া আরও একটা কারণ আছে। তবে সে কারণ খুঁজতে গেলে মহামতি ভীষ্মের অবচেতন মনের মধ্যে ঢুকতে হবে এবং সেই অবচেতনার কথা মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে বলেননি।

একটা কথা ভাবুন–আমরা এমন মানুষ দেখেছি–পুরুষ অথবা স্ত্রী, যাঁরা এই জন্মে আর বিয়ের পিড়িতে বসলেন না, তাদের বয়সের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেরই মনের পরিণতি ঘটে না। অন্তত বিবাহিত মানুষের যে পরিণতি ঘটে, সেই পরিণতি ঘটে না। সেই যৌবনকাল থেকে তারা যে কৌমার্য বা কুমারীত্ব বহন করেন, বয়সকালেও সেই কৌমার্যের মনটুকু যায় না। ভীষ্মের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ভাই বিচিত্রবীর্যের জন্য তিনি মেয়ে আনতে গেছেন বটে কিন্তু স্বয়ংবর-সভার বরাসনে বসলে যে আমোদটুকু হয়, সেই আমোদমাত্রই তিনি উপলব্ধি করতে চেয়েছেন, তার বেশি কিছু নয়। তাঁর অসীম শক্তি আছে, নিপুণ অস্ত্রকৌশল তার অধিগত, অতএব তরুণ রাজাদের মতো একই সঙ্গে সমাসনে বসলেই বা আমায় কে কী করতে পারে–এইরকম বেপরোয়া ভাব নিয়েই ভীষ্ম একটু আমোদ পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রখর বাস্তব সে আমোদ পেতে দিল কই? সুন্দরী তিন কন্যা ‘বৃদ্ধ’ বলে মুখ বেঁকিয়ে চলে গেলেন, তরুণ রাজারা বৃদ্ধের আমোদে দুয়ো দিলেন। ভীষ্মের ক্রোধাগ্নি উদ্দীপ্ত হল।

এমন কি তখনও তিনি একবারও ঘোষণা করে বললেন না–আমি নই, আমার ভাইয়ের জন্য আমি এই বিবাহ-সভায় এসেছি। বিশেষত তিন রমণীর তাচ্ছিল্য দেখে তার এতই রাগ হল যে, তিনি আরও বেশি করে এমন ভাব করলেন যেন-বুড়ো তো বুড়ো, তোরা স্বয়ম্বরা হয়েছিস, আর আমিও ক্ষত্রিয় পুরুষ, জোর করে ধরে নিয়ে যাব। ভীষ্ম তিন সুন্দরীকে রথে তুললেন আর রাজাদের উদ্দেশ করে বললেন-এই যে মহাশয়রা! এতক্ষণ খুব বড় বড় কথা বলছিলেন। বিয়ে তো আর এক রকম নয়, অনেক রকম। কেউ মেয়েকে সাজিয়ে-গুজিয়ে গুণবান পুরুষের হাতে তুলে দেয়, কেউ বা বরের কাছ থেকে পণ নিয়ে মেয়েকে বিয়ে দেয়। কেউ ভালবেসে বিয়ে করে, আবার কেউ বা জোর করে ধর্ষণ করে, তারপর বিয়ে করে। যজ্ঞের মাধ্যমে কেউ বিয়ে করে আবার বাপ-মা খুশি হয়েও বিয়ে দেয়। বিয়ের এত সব উপায়, এত সব পথ। কিন্তু আমরা হলাম গিয়ে ক্ষত্রিয় পুরুষ। ক্ষত্রিয় পুরুষেরা স্বয়ম্বর ব্যাপারটাই বেশি পছন্দ করেন এবং তারা শত্রুপক্ষকে যুদ্ধে জয় করেই কন্যা হরণ করে। এইরকম বিয়েই আমাদের পক্ষে প্রশস্ত–প্রমথ্য হৃতামাহু-র্জায়সীং ধর্মবাদিনঃ।

ভীষ্ম এবার সমবেত রাজাদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বললেন–এই আমি আপনাদের সামনে এই মেয়ে তিনটিকে রথে তুললাম বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য–জিহীর্যামি বলা ইতঃ আপনাদের ক্ষমতা থাকে তো আটকান। আমি যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছি–স্থিতো’হং পৃথিবীপালা যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ। কাশীরাজকে শুনিয়ে শুনিয়ে রাজাদের যুদ্ধাহ্বান জানালেন ভীষ্ম এবং সঙ্গে সঙ্গে তিন সুন্দরীকে রথে চড়িয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চললেন হস্তিনাপুরের উদ্দেশে।

ভীষ্মের কথা শুনে বিবাহেচ্ছু রাজাদের ক্রোধ চরম বিন্দুতে পৌঁছল। যে কন্যাগুলিকে তারা নিজেদের ভবিষ্যদুভোগ্যা ভেবে আনন্দ লাভ করছিলেন, তাদের তুলে নিয়ে গেল এক বুড়ো। রাজারা হাত কামড়ে, ঠোঁট কামড়ে শেষ পর্যন্ত বরের সাজ মণিমুক্তোর মালা গলা থেকে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। যুদ্ধের জন্য পরিধান করলেন লোহার বর্ম। তারপর সবাই একযোগে হা-রে-রে-রে শব্দ তুলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ক্রমবিলীয়মান ভীষ্মের ওপর। ভীষ্ম একা, রাজারা অনেকে। ভয়ঙ্কর যুদ্ধ আরম্ভ হল–একস্য চ বহুনাঞ্চ তুমুলং লোমহর্ষণম্।

এঁরা দশ হাজার বাণ ছাড়ছেন, তো ভীষ্ম সেগুলো কেটে খান খান করে দিচ্ছেন। এঁরা এই তিন-তিনটে বাণ ছাড়েন, তো ভীষ্ম সেসব বাণ কেটে পাঁচ পাঁচটা বাণে তাদের বিদ্ধ করছেন–অস্ত্রচালনায় এমন ক্ষিপ্রতা দেখে শত্রু রাজারাও ভীষ্মের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন–শত্রবোপ অভ্যপূজয়। সোজা কথায় বলা যায়, ভীষ্ম যুদ্ধ জিতলেন এবং নিশ্চিন্ত মনে কল্পিত ভ্রাতৃবধুদের নিয়ে ফিরে চললে হস্তিনাপুরের দিকে, যেখানে তার নিজের লোকেরা আছেন–কন্যাভিঃ সহিত প্রায়াঙারত ভারতা প্রতি।

ভীষ্ম এখনও পর্যন্ত কন্যাদের বলেননি যে, তিনি তাদের পাণিপ্রার্থী নন। তিনি তাদের শুধু রথে বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন মাত্র। যাঁরা এই মুহূর্তে ভীষ্মের এই মৌনতায় ক্ষুব্ধ হন, তাদের জানাই ভীষ্মকে আমরা চিরকাল এক বৃদ্ধ-পিতামহের বৃদ্ধ মানসিকতায় দেখেছি। কিন্তু গভীর অন্তরে তিনি যে এক ভীষণ রসিক মানুষ। যৌবনের প্রথম উম্মাদনায় আত্মস্বার্থ বলি দেওয়ার মধ্যে তিনি যে সরসতা খুঁজে পেয়েছিলেন, সেই সরসতাই তাকে এমন মধুর রসিক করে তুলেছে।

মনে রাখতে হবে তিনি তার পিতার জন্য নির্দিষ্ট আপন বিমাতাকেও নিজের রথে চড়িয়েই নিয়ে এসেছিলেন পিতার সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার জন্য–রথমারোপ্য ভাবিনীম্। অতএব সেই পিতার বিবাহের দিন থেকেই তিনি যে কৌরব পরিবারের সময় স্বাত্মপ্রযুক্ত অভিভাবক নিযুক্ত হয়েছিলেন, সেই অভিভাবকত্বের জোরেই আজও তিনি ভ্রাতৃবধূদের রথে চড়িয়ে নিয়ে আসছেন। তাকে কারও কিছু বলবার নেই। পিতা শান্তনুও তাকে কিছু বলেননি, জননী সত্যবতীও তাকে কিছু বলেননি, ভাই বিচিত্রবীর্যও তাকে কিছু বলেননি। অতএব আমরাও কিছু বলব না। যিনি যৌবনের সমস্ত ভোগসুখ পরিহার করে সম্পূর্ণ পরিবারের জন্য আত্মবলি দেন, তার দোষ ধরার মতো আহাম্মক আমরা অন্তত নই।

.

৫৯.

 ভীষ্মের অসামান্য অস্ত্রনৈপুণ্যের জন্য মুগ্ধ হয়েই হোক, অথবা ভয়ের জন্যই হোক, অন্যান্য রাজারা আর যখন ভীষ্মের সঙ্গে লড়াই করতে চাইলেন না, তখনি সেই মহাবীর রাজপুরুষকে একাকী দেখা গেল ভীষ্মের পিছনে ধাবিত হতে। ইনি সৌভপতি শাশ্ব। সৌভ জায়গাটা কোথায়–আগেই আমরা বলেছি। আরও একটু ভাল করে বলি–কারও ধারণা, সেটা আরাবল্পী পাহাড়ের পশ্চিমে কোনও জায়গায়। কারও মতে শান্থরা থাকতেন যমুনাতীরবর্তী কোনও অঞ্চলে অর্থাৎ এখনকার গুজরাতের উত্তর-পূর্বে কোনও স্থানে তাদের রাজধানী ছিল। আমাদের আরকিওলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়ার বাৎসরিক রিপোর্ট অনুযায়ী শাবপুর বলে বিখ্যাত যে নগরটি শাহুদের প্রধান আবাসভূমি বলে চিহ্নিত ছিল, সেটার নাম লোকমুখে পরিবর্তিত হয়ে প্রথমে হয়েছিল শাওয়ার। তারপর সেটা থেকে ‘হালওয়ার’, (তালব্য ‘শ’ যে কেমন করে ‘হ’ হয়ে যায়, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণে ‘হালায় কয়’)। আর হালওয়ার থেকে এখনকার আলওয়ার।

আমরা এর আগে ‘আলওয়ার’ অঞ্চলটাকে প্রাচীন মৎস্যদেশের অন্তর্গত কোনও স্থান বলে। উল্লেখ করেছি। বলেছি–তখনকার মৎস্যদেশ হল জয়পুর, ভরতপুর এবং আলোয়ার অঞ্চল। কিন্তু এই যে সময়ের কথা বলছি, তখনও মৎস্যদেশের সীমা সংকুচিত ছিল হয়তো। কারণ মৎস্যদেশ তখন সবে রূপ পরিগ্রহ করছে। মহাভারতের মধ্যে শারা অনেক সময়েই মৎস্যদেশীয়দের সঙ্গে যুগ্মভাবে উল্লিখিত হয়েছেন–শামৎস্যস্তথা। এতে বোঝা যায় শাদের রাজ্য মৎস্যদেশের অব্যবহিত পাশের রাজ্য। পানিনির সূত্র এবং ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলির। প্রমাণে এ কথা জোর দিয়েই বলা যায় যে, শাশ্বরা সে যুগে যথেষ্ট পরিচিত জনজাতির অন্যতম ছিলেন। পরবর্তী সময়ে শাম্বরাজা মারা যাবার পর মৎস্যদেশের একক গুরুত্ব বেড়ে যাবার পরপরই হয়তো শাল্বপুর বা আলওয়ার (আলোয়ার) অঞ্চল মৎস্যদেশের অন্তর্ভূত হয়।

কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে যে রাজাটিকে আমরা ভীষ্মের পশ্চাদ্ধাবন করতে দেখলাম, তিনি। প্রবল পরাক্রান্ত এক নৃপতি। দেশ বা জনজাতির প্রধান হিসেবে তার নামও শাশ্ব। ভীষ্ম যে তিনটি রমণীকে নিয়ে রথ চালিয়ে দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠা যিনি, তাঁর সঙ্গে শারাজার পূর্ব-প্রণয় ছিল। কাশীরাজের স্বয়ম্বর সভাটিকে শান্ধরাজ ব্যবহার করতে। চেয়েছিলেন বিবাহের সাধন হিসেবে। ঠিক ছিল–স্বয়ম্বরসভায় অন্যান্য রাজাদের সঙ্গে শারাজাও বরাসনে বসে থাকবেন সাধারণ পাণিপ্রার্থী বিবাহেচ্ছু রাজাদের মতোই। কাশীরাজার কন্যারা সভায় আসবেন বরমাল্য হাতে করে এবং পূর্বপ্রণয়িনী রমণীটি ভাল মানুষের মতো শান্থরাজার গলায় মালা দিয়ে পূর্বপ্রণয়ের সিদ্ধি ঘটাবেন বিবাহের রূপান্তরে। কিন্তু ভীষ্মের জন্য প্রণয়ীযুগলের সমস্ত পরিকল্পনা বিপর্যস্ত হয়ে গেল। কোনও কিছু ঘটবার আগেই সমবেত রাজমণ্ডলীর সঙ্গে ভীষ্মের কথা-কাটাকাটি আরম্ভ হল এবং ভীষ্ম সদম্ভে তিন। কন্যাকে রথে চড়িয়ে রথ চালিয়ে দিলেন হস্তিনাপুরের দিকে।

রাজারা যখন ভীষ্মকে সমবেতভাবে আক্রমণ করলেন, তখন তাদের মধ্যে বিবাহভ্রষ্ট শাল্বরাজও ছিলেন। তিনিও একই সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। কিন্তু অন্যান্য রাজারা যখন রণে ভঙ্গ দিলেন, তখন শাল্বরাজ আত্মপ্রকাশ করতে বাধ্য হলেন। একান্ত ব্যক্তিগত ক্রোধে উদ্দীপিত হয়ে শাল্বরাজ একা ধাওয়া করলেন ভীষ্মের পিছন পিছুর। মহাভারতের কবি এক বন্য উপমা ব্যবহার করেছেন এই মুহূর্তে। বলেছেন–একটি সাধারণ হস্তী যখন হস্তিনীর পিছন পিছন যেতে থাকে, তখন কামোন্মত্ত হস্তী-যুথপতি যেমন হুড়মুড়িয়ে এসে পূর্বোক্ত হস্তীটির পিছনে দাঁত দিয়ে আঘাত করে তাকে সরিয়ে দেয় এবং নিজেই হস্তিনীর অনুসরণ করে,-বারণং জঘনে ভিন্ দন্ত্যাভ্যামপরো যথা–মহারাজ শাল্বও তেমনি এসে ভীষ্মের পিছনে আঘাত করে তার অভীপ্সিতা রমণীর পশ্চাদগামী হতে চাইলেন।

শাল্বরাজ জানতেন না–ভীষ্ম যে রমণীদের রথে উঠিয়েছেন, তাদের তিনি কামনা করেন না। কিন্তু শুধুমাত্র ভীষ্মের সঙ্গে একথস্থা হওয়ার কারণেই শাশ্ব ভাবলেন–ভীষ্ম বুঝি তার প্রতিদ্বন্দ্বী এক প্রণয়ী। কামনা প্রতিহত হওয়ার ফলেই শাল্বরাজের ক্রোধ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ভীমের কাছাকাছি পৌঁছেই তিনি হুহংকারে চেঁচিয়ে উঠলেন–থাম, ব্যাটা! থাম্। যাচ্ছিস কোথায়? শাল্বরাজের কথা শোনামাত্রই ভীষ্মের মনের ভিতর ক্ষত্রিয়ের আগুন জ্বলে উঠল-বিধুমো’গিরিব জ্বলন্। সারথিকে বললেন–রথ, ঘুরিয়ে একেবারে শাল্বরাজের মুখোমুখি স্থাপন করো। সারথি রথ ঘোরালেন। এবার ভীষ্ম এবং শাল্বরাজ পরস্পরের সামনাসামনি দাঁড়ালেন। সমবেত রাজারা, যাঁরা এর আগে রণে ভঙ্গ দিয়েছিলেন, তারা সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন এই দুই মহাবীরের যুদ্ধকৌশল নিরীক্ষণ করার জন্য–প্রেক্ষকাঃ সমপদ্যন্ত ভীষ্ম-শাম্বসমাগমে।

মহাভারতের কবি আবারও একটা বন্য উপমা দিলেন। বললেন–একটি গাভীর সঙ্গে মিলিত হবার জন্য দুটি বলবান বৃষ যেমন গর্জন করতে করতে পরস্পরের অভিমুখীন হয়– তৌ বৃষাবিব নদন্তৌ বলিনৌ বাসিতান্তরে–তেমনি ভীষ্ম এবং শাল্বরাজ পরস্পরের সম্মুখীন হলেন। আবারও বলি–রথস্থা রমণীর সঙ্গকামনার দৃষ্টিতে ভীকে বৃষ বলা যায় না, কিন্তু রমণীদের তিনি হরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন, অতএব অন্য রাজাদের কাছে অথবা স্বয়ং শাল্বরাজের কাছে তিনি গাভীসঙ্গলোভী এক বৃষমাত্র। সেইজন্যই তিনি বন্য উপমা।

ভীষ্মের সঙ্গে শাল্বরাজের যুদ্ধ আরম্ভ হল। ভীষ্ম প্রথমে তাকে অতটা আমল দেননি। অতএব সেই সুযোগে ক্ষিপ্রহস্তে বেশ খানিকটা বাণবৃষ্টি করে ভীষ্মকে তিনি প্রাথমিকভাবে একটু বেকায়দায় ফেলে দিলেন। তাতেও ভীষ্ম খুব একটা ব্যাকুল হননি। কিন্তু দর্শক রাজারা যখন শাল্বরাজের নামে ‘সাধু সাধু’ রব তুললেন, তখন ভীষ্মও খানিকটা নড়েচড়ে দাঁড়ালেন। সারথিকে বললেন-যেখানে ঠিক দাঁড়িয়ে আছেন শাল্বরাজ একেবারে তার সামনে গিয়ে রথটি রাখো তো দেখি। তারপর বাজপাখি যেমন ছোঁ মেরে সাপ ধরে আমিও তেমনি ধরব এই শান্থরাজকে–ভূজঙ্গমিব পক্ষিরা।

সারথি ভীষ্মের কথামতো কাজ করল। তারপর ভীষ্ম প্রথমেই অস্ত্রাঘাতে কাবু করে ফেললেন শাল্বরাজের রথের ঘোড়াগুলোকে। মুহূর্তের মধ্যে শাল্বরাজের সারথি মারা পড়লেন। ভীষ্ম এবার শান্যের ঘোড়াগুলিকে মেরে বাণে বাণে আকুল করে ফেললেন শাল্বরাজকে। শুধু প্রাণমাত্র অবশিষ্ট রেখে শাল্বরাজকে ছেড়ে দিলেন ভীষ্ম। শাল্বরাজ কোনও রকমে জীবন নিয়ে ফিরলেন নিজের রাজধানী শাবপুরে। ভীষ্মও ফিরে চললেন হস্তিনাপুরে।

শাল্বের এই বিমর্দিত অবস্থা দেখে তিন কন্যার একজন অন্তত আকুল দীর্ঘশ্বাস মুক্ত করেছিলেন কিনা ভীষ্ম তা খেয়াল করেননি। যুদ্ধে তিনি অক্ষত থাকলেন। সমস্ত শত্রু বিজয় করে হস্তিনাপুরের বিজয়-কেতন উড়িয়ে দিলেন আপন রথে। তারপর কত বন, কত নদী-পাহাড় পেরিয়ে ভীষ্ম তিন রমণীকে অপার স্নেহে নিয়ে এলেন নিজের রাজধানীতে। শাবের অনুপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে মহাভারতের কবির উপমা বদলে গেল। বললেন-যে যত্নে এক পুত্রবধূকে রথে চড়িয়ে নিয়ে আসেন পিতা, যে যত্নে বাপের বাড়ি থেকে আপন ভগিনীকে নিয়ে আসেন ভাই, ঠিক সেইভাবেই মহামতি ভীষ্ম কাশীরাজের তিন কন্যাকে নিয়ে এলেন কুরুদেশে–সুষা ইব স ধর্মাত্মা ভগিনীরিব বামুজা। পিতা যেমন যত্ন করে পুত্রের বিবাহের জন্য মেয়ে খুঁজে আনেন, ভীষ্মও সেইরকম ভাই বিচিত্রবীর্যের বিবাহের জন্য তিনটি রমণীরত্ন সংগ্রহ করে আনলেন কাশীরাজ্য থেকে– আনিন্যে স মহাবাহুঃ ভ্রাতুঃ প্রিয়চিকীর্ষয়া।

কন্যা তিনটিকে নিয়ে ভীষ্ম প্রথমে উপস্থিত হলেন জননী সত্যবতীর কাছে। সত্যবতীর চরণ বন্দনা করে ভীষ্ম বললেন-তোমার ছেলের বিয়ের জন্য তিন-তিনটি মেয়ে নিয়ে এসেছি, মা! ওঁদের স্বয়ংবর হচ্ছিল; ফলে বীরত্ব দেখিয়ে অন্য রাজাদের পরাজিত করে ওঁদের রথে তুলে নিয়ে আসার মধ্যে কোনও দোষ ছিল না। আমি তাই করেছি–বিচিত্রবীর্যস্য কৃতে বীর্যশুষ্কা হৃতা ইতি। সত্যবতী ভীষের ব্যবহারে অভিভূত হয়ে গেলেন। কোনওদিনই তিনি এই বয়স্ক পুত্রটিকে অবহেলা করেননি। আজ বৈমাত্রেয় ভাইয়ের জন্য তার ঔৎসুক্য দেখে তিনি অভিভূত হয়ে ভীষ্মের মস্তকাঘ্রাণ করে সার্থক জননীর মতোই বললেন–পুত্র! ভাগ্যিস তোমার কিছু হয়নি। এতগুলো রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করে জিতে এসেছ, ভাগ্যিস কিছু হয়নি তোমার-আহ সত্যবতী হৃষ্টা দিষ্টা পুত্র জিতং ত্বয়া।

ভীষ্ম এবার বিমাতা সত্যবতীর সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। মেয়ে তিনটিকে রাজধানীতে নিয়ে আসা হল, কিন্তু এবার তো শাস্ত্রসম্মতভাবে ধূমধাম করে তাদের বিবাহ দিতে হবে বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে। মাতা সত্যবতী সমস্ত কিছুই ছেড়ে দিলেন ভীষ্মের ওপর। ভীষ্ম এবার ঋত্বিক এবং বৈনিক ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আলোচনা আরম্ভ করলেন। বিবাহের দিন-ক্ষণ, মঙ্গল অনুষ্ঠান এবং আড়ম্বর–সব কিছু নিয়েই ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আলোচনা হবে।

ব্রাহ্মণরা সভায় বসে আছেন। ভীষ্মও বসে আছেন তাদের সঙ্গে। আলোচনাও চলছে নিয়মমতো। ঠিক এই সময়ে কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যাটি সেই ব্রাহ্মণসভায় উপস্থিত হলেন। তার মনে কোনও ভয়-ডর ছিল না। অধরে ভুবন ভোলানো হাসি। ভীষ্মের কাছে তার কিছু বক্তব্য আছে–জ্যেষ্ঠা তাসাম্ ইদং বাক্যম্ অব্রবীত্ হসতী তদা। কথা শোনার জন্য ভীষ্ম একটু উন্মুখ হতেই কাশীরাজকন্যা বললেন–ধর্মজ্ঞ! আমার সামান্য একটা অনুরোধ আছে।

সম্বোধনটা খেয়াল করবার মতো। ধর্মজ্ঞ, মানে যিনি ধর্ম জানেন। একটি সুন্দরী রমণী তার মনের কথা বলছেন। এখানে রাজার ধর্ম অনুসারে চললেই হবে না। একটি রমণীর মনের ইচ্ছে-অনিচ্ছের ব্যাপারে ভীষ্মকে এবার ধর্মজ্ঞতার প্রমাণ দিতে হবে। রমণী হেসে বললেন–অনেক আগে, ওই স্বয়ম্বর সভার অনেক আগেই আমি মনে মনে সৌভপতি শাল্বরাজকে মন দিয়েছি–ময়া সৌভপতিঃ পূর্বং মনসাভিবৃতঃ পতিঃ। আর শাল্বরাজও আমার ইচ্ছেতে সাড়া দিয়ে আমাকেই পত্নী হিসেবে বরণ করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। এমনকি আমার বাবাও চাইতেন–এই বিয়ে হোক–এষ কামশ্চ মে পিতৃঃ।

কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যার নাম অম্বা। সামান্য তিনটি কথা বলে তিনি বোঝাতে চাইলেন–তার ইচ্ছেটা একটা বিলাসমাত্র ছিল না। একটি পুরুষ এবং একটি মেয়েই শুধু নয়। সম্পূর্ণ দুটি পরিবার এই বিবাহের মন্ত্রণা করেছিলেন আগেই। অম্বা বললেন–স্বয়ম্বর যদি সম্পূর্ণ হত, তাহলে সেই স্বয়ম্বরে আমি সৌভপতি শাল্বকেই বরমাল্য দিতাম–ময়া বরয়িতব্যো ভূচ্ছা-স্তস্মিন্ স্বয়ম্বরে। কিন্তু সে তো আর হয়নি। তার মধ্যে নানা অনর্থ ঘটে গেল। ভীষ্ম সকলকে হরণ করে নিয়ে এসেছেন হস্তিনাপুরের রাজধানীতে। শাল্বরাজ যুদ্ধেও প্রতিহত হয়েছেন। অম্বার তাই কোনও উপায় ছিল না রাজধানীর নির্জন কক্ষে বিরহের দিন কাটিয়ে দেওয়া ছাড়া। কদিন সেইভাবেই গেছে। কিন্তু আজ যখন ভীষ্ম সত্যবতীর অনুমতি নিয়ে ব্রাহ্মণদের ডেকে এনেছেন বিবাহ-উৎসবকে শাস্ত্রীয় রূপ দেওয়ার জন্য, তখন আর তিনি বিলম্ব করতে চাইলেন না।

অম্বার উদ্দেশ্য ছিল দুটি। এক, ভীষ্মের শুভবুদ্ধির কাছে প্রার্থনা জানানো। দুই, যদি তিনি কোনওভাবে অস্বীকৃত হন, তার কথা না শোনেন, ভীষ্মের শুভবুদ্ধি যদি কাজ না করে, তাহলে ধর্মজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা তার পূর্বপ্রণয় এবং বাগদানের সংকল্প শুনে অবশ্যই ভীষ্মকে সদুপদেশ দেবেন এবং ব্রাহ্মণ-সভায় ভীষ্মের ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব অত প্রবলভাবে খাটবে না। অম্বা বললেন আমি সমস্ত বিষয় আপনাকে জানালাম, এখন আমার অবস্থা বুঝে যা ধর্ম বলে মনে হয়, তাই ব্যবস্থা করুন, কারণ এ বিষয়ে ধর্ম কী হওয়া উচিত, তাও আপনি জানেন–এত বিজ্ঞায় ধর্মজ্ঞ ধর্মতত্ত্ব সমায়।

 অম্বা ভীষ্মের বংশমর্যাদায় আঘাত দিয়ে আরও একটি কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন–আমি অন্য পুরুষকে ভালবেসেছি, ভীষ্ম। সেখানে আপনি রাজধর্ম অতিক্রম করে কী ভাবে আমাকে দিয়ে জোর করে আপনার ভাইকে ভালবাসাবেন? আপনি না কুরুবংশে জন্মেছেন, আপনি না কৌরব! এই কি তার পরিচয়-বাসয়েথা গৃহে ভীষ্ম কৌরবঃ সন্ বিশেষতঃ। অম্বা আরও বলেছিলেন–রাজধর্ম নয়, ভীষ্ম! রাজার অহংকারে আপনি আমাকে হরণ করে আনতে পেরেছেন মাত্র। কিন্তু আপনি আমার অবস্থা বিচার করুন আপনার বুদ্ধি দিয়ে, আপনার মন দিয়ে–এতদ বুদ্ধ্যা বিনিশ্চিত্য মনসা ভরতষভ। অম্বা জানিয়ে দিলেন–শারাজা এখনও আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন নিশ্চয়–স মাং প্রতীক্ষতে ব্যক্ত–অতএব আপনার ধর্মে যাকে সুবিচার বলে, সেই সুবিচার আমার ওপর করুন।

ব্রাহ্মণসভায় সমবেত ব্রাহ্মণদের সামনে অম্বার এই উক্তিতে যথেষ্ট বিব্রত হলেন ভীষ্ম। বুঝলেন–ব্যাপারটা ঠিক হয়নি। যাঁরা বলেন–সেকালের ভারতবর্ষে স্ত্রী-স্বাধীনতা ছিল না, তারা পদে পদে মার খেতেন, তাঁদের কাছে আমরা অম্বার উদাহরণ দিয়ে থাকি। তিনি রাজধানীর অন্দরমহল ছেড়ে বেরিয়ে এসে ব্রাহ্মণদের আলোচনা-সভায় উপস্থিত হতে পেরেছিলেন। নিজের বক্তব্যও পেশ করতে পেরেছিলেন সুশৃঙ্খলভাবে। তাকে মাঝপথে কেউ স্তব্ধ করে দেননি। সবচেয়ে বড় কথা–তার কথা শুনে মহামতি ভীষ্ম তার ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন। সমবেত ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আলোচনা করে-বিনিশ্চিত্য স ধর্মজ্ঞো ব্রাহ্মণ বেপারগৈঃ–ভীষ্ম অম্বাকে তার স্বাধীন ইচ্ছেমতো চলার অনুমতি দিলেন। পরিষ্কার ভাষায়–ভাই বিচিত্রবীর্যের বিবাহের জন্য মনোনীত কন্যাকে তিনি সমস্ত মানসিক বন্ধন থেকে মুক্তি দিলেন। অম্বা সানন্দে চললেন সৌভপতি শাল্বরাজের সঙ্গে দেখা করার জন্য।

 অম্বা হস্তিনাপুর ছেড়ে চলে যাবার জন্য মনস্থ করতেই ভীষ্ম সমস্ত ঘটনা জানিয়েছিলেন সত্যবতীকে। মন্ত্রী, পুরোহিত, ঋত্বিক সবার অনুমতি নিয়ে কয়েকজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ এবং একটি ধাত্রীকে তিনি অম্বার সঙ্গে দিলেন, যাতে হস্তিনাপুর থেকে শাপুর যাবার পথে তাঁর সুরক্ষার কোনও অসুবিধে না ঘটে। অম্বা শাপুর পৌঁছলেন, নির্বিঘ্নে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে। অন্যের দ্বারা হৃত হওয়া সত্ত্বেও অম্বা যে তার অভীপ্সিত প্রিয়তমের কাছে ফিরে আসতে পেরেছেন, তার জন্য কতই না উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শাল্বরাজ যে তাকে দেখে খুব খুশি হয়ে উঠেছিলেন, তা অবশ্য নয়। আর সেই জন্যই এক যুবতী যে কথা বলে না, সে কথাই তাকে বলতে হল শাল্বরাজের সামনে। অম্বা বললেন–বীর আমার! আমি ফিরে এসেছি তোমার কাছে–আগতাহং-মহাবাহো মুদ্দিশ্য মহামতে।

অম্বার সম্বোধনে ‘মহাবাহু’ এবং ‘মহামতি’, এই দুটি শব্দই বড় তাৎপর্যপূর্ণ। মাত্র কদিন আগে ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধে তিনি রথ, ঘোড়া, সারথি সব হারিয়ে কোনওমতে প্রাণ নিয়ে ফিরেছিলেন। সে কথা ভেবে শাল্বরাজ যদি কোনওভাবে অপ্রতিভ বোধ করেন। তাই অম্বা ভাব দেখাচ্ছেন-যুদ্ধে হারলেও তুমি সেই বীরপুরুষটিই আছ আমার কাছে অথবা সেই বুদ্ধিশালী নায়কটি–মহাবাহো…মহামতে। অম্বা বললেন–আমি তোমার জন্য ফিরে এসেছি, তুমি আমাকে আদর করবে না একটু, তুমি যা চাও, তোমার যাতে ভাল হয়, আমি তো তাই চাই, রাজা আমার! আমি শুধু তোমার আদরটুকু চাই–অভিনন্দস্ব মাং রাজন সাপ্রিয়হিতে রতাম্।

 অম্বার কথাগুলি শুধু সাময়িকতার আবেগতাড়না মাত্র নয়। সৌভদেশের রাজার ধর্মপত্নী হিসেবে বৃত হতে এসেছেন তিনি। অম্বা বললেন–রাজা আমার! তুমি আমাকে তোমার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে ধর্ম পালন করা। আমি তো মনে মনে সুচিরকাল তোমার কথাই ভেবে এসেছি আর তুমিও তো আমাকে তোমার স্ত্রী হিসেবেই চেয়েছিলে–ত্বং হি মে মনসা ধ্যাতত্ত্বয়া চাপপমন্দ্রিতা।

 শাল্ব একটু হাসলেন যেন–স্ময়ন্নিব। সে হাসির মধ্যে প্রেমিকের প্রাণ ছিল না অন্তত। ছিল না কোনও আবেগ, উচ্ছ্বাস। সে হাসির মধ্যে যা ছিল, তা অম্বার মতো প্রেমিকার কাছে বিড়ম্বনামাত্র। সেই অদ্ভুত হাসি হেসেই যেন শান্ধ বললেন–তুমি ভুলে যেও না–তোমাকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিল একজন পুরুষ। সেই পুরুষের স্ত্রী হবার জন্যই যে রমণী চলে গিয়েছিল, তাকে আমি অন্তত স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারি না–ত্বয়ানপূর্বয়া নাহং ভাৰ্য্যার্থী বরবণিীনি। ঈর্ষান্বিত, অবিশ্বস্ত প্রেমিকের সমস্ত আঘাত হেনে শাহ্ বললেন–ভদ্রে! তুমি ভীষ্মের কাছেই যাও। সে সমস্ত রাজাদের পরাজিত করে তোমাকে জোর করেই ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তোমাকে স্পর্শও করেছিল–পরামৃশ্য মহাযুদ্ধে নির্জিত্য পৃথিবীপতীন্। শান্ধ এবার অম্বার হৃদয়ে আঘাত করে বললেন–আরও একটা কথা। ভীষ্ম যখন সমস্ত রাজাদের (শা নিজেকেও এই বচনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন নিশ্চয়) যুদ্ধে পরাজিত করে তোমাকে নিয়ে গেলেন, তখন তোমাকে বেশ খুশি-খুশিই তো লাগছিল-ত্বং হি ভীষ্মেণ নির্জিত্য নীতা প্রীতিমতী তদা।

আচ্ছা স্ত্রীলোকের মনের কথা কে বলবে? দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ। যে মুহূর্তে প্রৌঢ়-বৃদ্ধ ভীষ্ম শারাজাকেও অনায়াসে যুদ্ধে প্রতিহত করে তাকে প্রাণদান করে ছেড়ে দিলেন, সেই মুহূর্তে এই যুবতীর অযান্ত্রিক মনের মধ্যে এক মুহূর্তের বিস্ময় অথবা বীরপূজার শ্রদ্ধানুরাগ কাজ করেনি তো? শাম্বকে তিনি মনে-প্রাণে ভালবাসেন সত্যি, তাই বলে শাশ্ব-ভীষ্মের অস্ত্রযুদ্ধে ভীষ্মের অপূর্ব রণকৌশল দেখে কাশীরাজবালার হৃদয় এক মুহূর্তের জন্যও অন্তত আচ্ছন্ন হয়নি তো? যদি হয়ে থাকে, তবে সেই মুহূর্তটুকুও তো মিথ্যে নয়।

শাল্ব কি সেই মুহূর্তেই অম্বার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ছিলেন? অম্বা কি তখন মুগ্ধ বিস্ময়ে ভীষ্মকে দেখছিলেন। নইলে শাল্বকে তিনি অত ভালবাসেন-সে কথা রথের ওপর দাঁড়িয়েই ভীষ্মকে বললেন না কেন? যে লজ্জা ভেঙে তিনি ব্রাহ্মণদের সভায় এসে সোচ্চারে শাল্বের নাম উচ্চারণ করেছিলেন, ভালবাসার সেই দৃঢ় উচ্চারণ হস্তিনাপুরের গমনপথেই শব্দিত হতে পারত এবং ভীষ্মের কাছেই হতে পারত। আমরা জানি ভীষ্ম বাধা দিতেন না। কিন্তু কী অদ্ভুত ঘটনা ঘটল-অম্বা তো একবারও ভীষ্মের সামনে শাল্বরাজের নামও উচ্চারণ করলেন না! না রথে উঠবার সময়, না রথে চড়ে যেতে যেতে, না তার একান্ত প্রিয়তম শাল্বরাজ যুদ্ধে প্রতিহত হওয়ার সময়! কেন যে বললেন না? অন্তত সেই মুহূর্তে ভীষ্মের মুখের মধ্যে তিনি কী দেখেছিলেন? হয়তো সেই খণ্ড মুহূর্তের মধ্যে অম্বার মুখের দিকে তাকিয়ে শাল্বরাজের মনে হয়েছিল–অম্বা দুঃখিত নন অন্তত। হয়তো একথা ঠিক, হয়তো নয়।

অম্বা আর শাল্বরাজের উত্তর-প্রত্যুত্তর শুনতে লাগে অনেকটা সেই ডেসডিমনা আর ওপেনোর শেষের সেদিনের মতোই। ওথেলো বলেছিলেন–that handkerchief which I so loved and gave thee / Thougay to Cassio.

 ডেসডিমনা প্রত্যুত্তর করেছিলেন– No, by my life and soul! Send for the man and ask him. I never did offend you in my life/ never lov’d Cassio…I never gave him token.

অম্বা বলেছিলেন–আমি চিরকাল তোমার প্রিয় কাজ করেছি, তোমারই ভাল চেয়েছি সদা প্রিয়হিতে রতাম্ অর্থাৎ I never did offend you in my life. কিন্তু যে মুহূর্তে শা বললেন–ভীমের সঙ্গে যাবার সময় তোমাকে খুশি-খুশি দেখাচ্ছিল–নীতা প্রীতিমতী তদা–তখন ঠিক ডেসমিনার never lov’d Cassio’র মতোই ভয়ঙ্কর নঞর্থক প্রতিবাদ করে উঠলেন অম্বা–এমন করে বোলো না, রাজা আমার–নৈবং বদ মহীপাল–একথা মোটেই ঠিক নয়। ভীষ্ম আমাকে জোর করে নিয়ে গেলেন, আর আমি খুশি হব? ভাবছ কী করে? আমি এতটুকু খুশি হইনি-নাস্মি প্রীতিমতী নীতা। আমি রীতিমতো কাঁদতে কাঁদতে ভীষ্মের রথে উঠেছিলাম আর তিনি যুদ্ধ জয় করে জোর করে আমাকে তুলে নিয়ে চলে গেলেন-বলাম্নীতাস্মি রুদতী বিদ্রাব্য পৃথিবীপৃতীন্।

শাল্ব বলেছিলেন–যে রমণী একবার অন্য পুরুষের হস্তগত হয়েছিল, তাকে আমি অন্তত স্ত্রী হিসেবে পেতে চাই না। শাস্ত্রবিধি আমার যতটুকু জানা আছে আর আমি যেহেতু রাজা হিসেবে অন্যান্য সকল ব্যক্তিকে ধর্মের উপদেশ দিই, সেই উপদেশকারী রাজা সব জেনেশুনে এক পরপূর্বা রমণীকে ঘরে জায়গা দিতে পারে না–কথমস্যবিধো রাজা পরপূর্বাং প্রবেশয়েৎ। তুমি তোমার যেখানে ইচ্ছে চলে যেতে পার, এখানে সময় নষ্ট করার কোনও দরকার নেই। তোমারমা ত্বং কালো ত্যগাদয়ম।

অম্বা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। যাকে তিনি এত ভালবাসেন, যার জন্য ঘর ছেড়ে, মর্যাদা ছেড়ে প্রিয়তমের সন্নিধানে পৌঁছেছেন, তার মুখে এই কথা! ভাবলেন–শারাজার অভিমান হয়েছে, একটা অন্য পুরুষ হঠাৎ করে নিয়ে গেল, অভিমান তো হতেই পারে। তাই অম্বা একটু মিনতি করে বললেন-দেখো শাল্বরাজ! আমার বয়স বেশি নয়, আমি নিজে কোনও অপরাধও করিনি, আর সবচেয়ে বড় কথা, আমি তোমাকে ভালবাসি। অতএব আমাকে স্বীকার করতেই হবে তোমায়–ভজস্ব মাং শাবপতে ভাং বালামনাগসাম্।

অম্বা ভাবলেন–ভীষ্মের আসা থেকে আরম্ভ করে বিবাহের শেষ আলোচনার সব বৃত্তান্ত ঠিক ঠিক শাল্বরাজকে বুঝিয়ে বললে হয়তো তিনি বুঝবেন। এ ছাড়া আর উপায়ও তো নেই। অম্বা একটু বুঝিয়ে বললেন-যুদ্ধে হারবেন না বলে ভীষ্মের একটা গোঁ চেপে গিয়েছিল বলেই তোমাকে তিনি অমন করে হারিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমি আমার সমস্ত বৃত্তান্ত বিয়ের আগেই ভীষ্মকে সব জানিয়েছি। তার অনুমতি নিয়েই আমি তোমার কাছে চলে এসেছি চির জীবনের মতো–অনুজ্ঞতা চ তেনাশ্মি তবৈব বশমাগতা। তাছাড়া আসল ঘটনাটা তো তুমি বুঝবে–ভীষ্ম মোটেই আমাকে চাইছেন না, তিনি নিজে কোনও বিয়েও করতে চান না–ন হি ভীষ্মে মহাবুদ্ধির্মামিচ্ছতি বিশাম্পতে। তিনি নাকি তার ভাইয়ের বিয়ের জন্য কন্যা-হরণ করেছেন শুনলাম। আমার আর দুই বোন অম্বিকা এবং অম্বালিকার সঙ্গে তিনি তার ছোট ভাই বিচিত্রবীর্যের বিয়েও দিয়ে দিয়েছেন। এ

অম্বা সমস্ত বৃত্তান্ত জানিয়েও দেখলেন–শাল্বরাজের হৃদয়ে তার জন্য কোনও দুর্বলতা তৈরি হয়নি। এই মুহূর্তে তার মতো অসহায় রমণী আর কে আছে? কাজেই নিজের সমস্ত অসহায়তা প্রতিপাদন করেই তিনি এবার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ স্পর্শ করে নিজেকে সপ্রমাণ করতে চাইলেন। অম্বা বললেন–আমি আমার মাথা ছুঁয়ে বলছি–তুমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও পুরুষের কথা আমি মনে-মনেও কখনও ভাবিনি–বামৃতে পুরুষ ব্যাঘ্র তথা মূৰ্দ্ধানমালভে। অম্বা বললেন–আমি আমার হৃদয় স্পর্শ করে বলছি–আমি কারও হইনি। কারও সঙ্গে আমার পূর্ব-সম্বন্ধ হয়নি। আমি তোমার কাছে এসেছি কুমারীর সত্তায় তোমার প্রেম এবং অনুগ্রহের যাচনা নিয়ে। তুমি আমাকে বিবাহ করো।

অম্বা অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন। মস্তক-স্পর্শ, হৃদয়-স্পর্শের মতো সর্বাঙ্গীন প্রতিজ্ঞা এবং বিশ্বাস বিপর্যস্ত হয়ে গেল শাল্বরাজের রুক্ষতার সামনে। মহাভারতের কবি মন্তব্য করেছেন–সাপ যেমন পুরনো খোলস ছেড়ে দেয়,জীর্ণাং তুচমিবোরগঃ–ঠিক সেইভাবে অম্বাকে ত্যাগ করলেন শাল্বরাজ। অম্বার এত প্রণয়-বচন, এত কাতরোক্তি–সব যে এক নিমেষে ব্যর্থ হয়ে গেল, তার পিছনে শাল্বরাজের আপন মর্মে ব্যাঘাত অজুহাত যাই থাক না কেন, এক্কেবারে শেষে তিনি সত্যি কথাটি বলেছেন।

 অম্বা বলেছিলেন–তুমি আমাকে ত্যাগ করেছ বলে আমি যে খুব অস্থানে পতিত হব, তা তুমি ভেব না। ভদ্রলোকেরা নিশ্চয়ই আমাকে আশ্রয় দেবেন। শাম্ব বলেছিলেন–তুমি এখান থেকে যাও! আমার বিনীত অনুরোধ, তুমি ফিরে যাও। যেহেতু ভীষ্ম তোমাকে একবার গ্রহণ করেছেন, অতএব আর আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিতে পারি না, কারণ আমি ভীষ্মকে ভয় করি–বিভেমি ভীষ্মৎ সুশ্রোণি ত্বঞ্চ ভীষ্মপরিগ্রহঃ। হয়তো শাল্বরাজের মুখে অতি সত্যকথনের কারণেই অম্বার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল ভীষ্মের ওপর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *