০৫০. পাঞ্চালরাজ সোমক

৫০.

পাঞ্চালরাজ সোমক বড় অসহায় বোধ করছিলেন। একমাত্র পুত্র সামান্য পিঁপড়ের কামড় খেলেই যদি তার একশ জননী মরণ-চিৎকার করে ওঠেন, তবে ক্ষত্রিয়ের ছেলে বড় হবে কী করে? অনেক অনুনয়-বিনয় করে ঋত্বি-পুরোহিতকে সোমক বললেন–আপনি এমন একটা ব্যবস্থা করুন যাতে আমার একটি পুত্র হয়। ভাল কাজ, মন্দ কাজ, এমন কি সে কাজ অসাধ্য হলেও আমি করব–মহতা লঘুনা বাপি কর্মণা দুস্করণে,বা। ঋত্বিক বললেন–উপায় যে একটা নেই, তা নয়। তবে তুমি কি সেটা পারবে? সোমক বললেন-কার্য হোক, অকার্য হোক, আপনি বলুন, আমি নিশ্চয় পারব। আপনি ধরে নিন–সে কাজ হয়েই গেছে–কৃতমেবেতি তদ্বিদ্ধি ভগবন্ প্রব্রবীতু মে!

রাজার আগ্রহ দেখে ঋত্বিক বললেন–যেভাবে আমরা পশুমেধ যজ্ঞ করি, সেইভাবে আপনার ওই একমাত্র পুত্রকেই যজ্ঞের পশু হিসেবে আমরা ব্যবহার করব। পুত্রটিকে বলি দিয়ে তার মেদ-পা যজ্ঞে আহুতি দিতে হবে। তখন প্রজ্জ্বলিত হোমাগ্নি থেকে ধোঁয়া উঠতে থাকবে। একশ রানী সেই ধুমগন্ধ আঘ্রাণ করে শতপুত্রের অধিকারী হবেন-বপায়াং হয়ামানাং ধূমমাঘ্রায় মাতরঃ। ঋত্বিকরা বলে দিলেন-আপনার যে পুত্রটি আছে, সেই পুত্রই শত পুত্র হয়ে জন্মাবে। রাজা সম্মত হয়ে বললেন–আপনারা যজ্ঞ আরম্ভ করুন, আমি প্রস্তুত।

যজ্ঞ আরম্ভ হল। রানীরা তো কেউ সেই পুত্রকে ছাড়বেন না। তারা যদি পুত্রের ডান হাত ধরে টানেন, তো ঋত্বিকরা ছেলের বাঁ হাত ধরে টানেন যজ্ঞস্থলের দিকে–

রুদন্ত্যঃ করুশং চাপি গৃহীত্ব দক্ষিণে করে।
সব্যে পাণৌ গৃহীত্বা তু যাজকোপি স্ম কৰ্ষতি।

রানীমাদের করুণ কান্না তুচ্ছ করেও ঋত্বিক-যাজকরা রাজার একমাত্র পুত্রকে বলি দিয়ে যজ্ঞে আহুতি দিলেন। যজ্ঞের উৰ্গীৰ্ণ ধূম আঘ্রাণ করে মুহূর্তের মধ্যে তারা অজ্ঞান হয়ে পড়লেন এবং তাদের প্রত্যেকের গর্ভসঞ্চার হল। গর্ভের কাল সম্পূর্ণ হলে তাদের প্রত্যেকের একটি করে পুত্র হল, যদিও পূর্বের সেই রাজপুত্র তাঁরই জননীর গর্ভে পুনরায় জন্ম নিলেন এবং তার নাম হল জন্তু। একশ রানীমা তাদের নিজের কোলে পুত্র লাভ করলেও জন্তুর ওপর তাদের আগের ভালবাসাই ছিল, সেই ছেলেটি তাদের নিজেদের ছেলের থেকেও প্রিয়তর–স তাসামিষ্ট এবাসীৎ ন তথা তে নিজাঃ সুতাঃ।

মহাভারতে দেখছি–সোমকের যখন একটি পুত্র ছিল তখনও তার নাম ছিল জন্তু। আমাদের তা মনে হয় না। সোমকের একমাত্র পুত্রকে পশুর মতো বলি দিয়ে পুত্র লাভ করেছিলেন বলেই পরে তার নাম হয় জন্তু। ঋত্বিক পূর্বে বলেছিলেন–যজস্ব জন্তুনা রাজংস্কং ময়া বিততে ক্ৰতৌ। নীলকণ্ঠ লিখেছেন–জনা পশুভূতেন–অর্থাৎ ছেলেটিকে জন্তুর মতো বলি দিতে হবে। আমাদের ধারণা–ছেলেটির সঙ্গে যজ্ঞীয় পশুর মতো ব্যবহার করা হয়েছিল বলেই রাজার ওই পুত্রের নাম অন্তু। আমরা অবশ্য অতিলৌকিকতার মধ্যে না গিয়ে বলতে চাই–পুত্রহীন মায়েরা যা করেন, সেইভাবেই একটি জন্তুর সঙ্গেই রানীমায়েরা পুত্র ব্যবহার করতেন। নইলে একটি রাজপুত্রের নাম ‘জন্তু’ হওয়া স্বাভাবিক নয়। যজ্ঞ করার জন্য হয়তো পুত্রস্নেহে পালিত সেই জন্তুটিকে বলি দেওয়া হয়েছিল। প্রথম যে রানী সেই জন্তুটিকে লালন-পালন করেছিলেন, তার পুত্রটি হয়তো জন্তু নামে পরিচিত হন এবং তিনি সব রানীর প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন।

আমাদের ধারণা–সোমক বৃদ্ধ বয়সে অনেক যাগ-যজ্ঞ এবং পশুমেধ যজ্ঞ করে শেষ পর্যন্ত অনেক পুত্র লাভ করেন। ক্ষীণ পাঞ্চাল বংশে এত পুত্রের জনক হয়েই সোমক রাজা বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তবে এতক্ষণ জন্তুর সম্বন্ধে যা বললাম, তা সবই মহাভারতের বৃত্তান্ত অনুসারে। বস্তুত পুরাণগুলির মধ্যে জন্তুকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা নেই। বায়ু, মৎস্য অথবা খিল-হরিবংশে কোথাও আমরা এমন খবর পাইনি যে সোমক রাজার পুত্র জন্তুকে বলি দিয়ে তার একশ ছেলে হয়েছিল। যা পাই, তা হল–সোমকের একটি পুত্র এবং তার নাম জন্তু। জন্তু মারা গেলে সোমকের একশটি পুত্র হয়–সোমকত্স্য সুতো জন্তু হতে তস্মিন্ শতং বভৌ। এই ঘটনা থেকে স্বাভাবিকভাবে মনে হয়–সোমকের একটিই পুত্র ছিল, এবং যেভাবেই হোক সে পুত্রটি মারা গেলে সোমক তাঁর একপুত্রতার জন্য মনে মনে অসম্ভব পীড়িত হন। তিনি ঘটনার প্রতিকার করেন বহুবিবাহের মাধ্যমে এবং বৃদ্ধ বয়সে অনেক সন্তানের জনক হন।

হরিবংশ অবশ্য এই পাঠ গ্রহণ করেনি। সেখানে দেখা যাচ্ছে সোমকের পুত্রের নাম জন্তু এবং জন্তুরই একশটি পুত্র হয়-সোমক’স্য সুতো জন্তু যস্য পুত্রশতং বভৌ। আমরা অবশ্য মহাভারতে জন্তুর সম্বন্ধে বিশদ বৃত্তান্তটি বিবেচনা করে বায়ু-মৎস্যের নীরস তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চাই। অর্থাৎ সোমকের একমাত্র পুত্রসন্তান জন্তু অল্প বয়সেই স্বর্গত হন। ক্ষীণ পাঞ্চাল বংশের অসহায় অবস্থার কথা চিন্তা করে সোমক একেবারেই ভেঙে পড়েন এবং ঋত্বিক-পুরোহিতের কাছে তিনি নিজের বৃদ্ধ বয়সের কথা বলে সুপরামর্শ চান। ঋত্বিকরা যাগ-যজ্ঞ করেন এবং সেই যাগ-যজ্ঞ সদ্যোমৃত জন্তুর মেদবপার দ্বারাও সম্পন্ন হয়ে থাকতে পারে। এর পরের সম্ভাব্য ঘটনা হল–সোমক অনেক বিবাহ করে অনেক পুত্র লাভ করেন।

আশ্চর্য ঘটনা হল–এই শত পুত্রের কনিষ্ঠ পুত্রটি যিনি, তিনি হলেন আমাদের অতিপরিচিত পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের পিতা, যার নাম পৃষত–তেষাং যবীয়ান পৃষতো দ্রুপদস্য পিতা প্রভুঃ। পরিষ্কার কথা হল–জন্তু সোমকের সবার বড় ছেলে আর পৃষত সর্বকনিষ্ঠ। এই যে হঠাৎ করে একশ ছেলের একটি তালিকা দেখিয়ে পৃষতকে নিয়ে আসা হল–এর মধ্যে একটু গরমিল আছে বই কি। এত শীঘ্র দ্রুপদের পিতা পৃষতকে পেয়ে গেলে ওদিকে কুরুবংশের পুত্র-পরম্পরার সঙ্গে মিলবে না। পণ্ডিতেরা তাই সন্দেহ করেন–সোমকের পরেই পাঞ্চাল বংশ ক্ষীণ হয়ে যায় এবং there was also a long gap between Jantu and Prisata, during which Panchala was dominated by Hastinapura.

এটা তো আমরা আগেই দেখেছি যে, সম্বরণ রাজা পুত্রের সঙ্গে হস্তিনাপুর পুনরুদ্ধার করার সময়েই পঞ্চাল অধিকার করে ফেলেছিলেন। বৌদ্ধগ্রন্থ সোমনস জাতকেও উত্তর-পাঞ্চল নগরকে কুরুরাষ্ট্রের (কুরুঠি) মধ্যেই গণ্য করা হয়েছে। হয়তো পাঞ্চাল রাজ্যে কুরুদের এই অধিকার চলেছিল জন্তু থেকে আরম্ভ করে কনিষ্ঠ সেই পৃষত পর্যন্ত। পৃষত এই জন্যই কনিষ্ঠ, যেহেতু তিনিই হয়তো পাঞ্চাল রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তাও হয়তো কুরুবংশের অখ্যাত রাজাদের আমলে।

পাঞ্চালবংশে জন্তু থেকে পৃষত পর্যন্ত যেমন একটা শূন্যতা আছে একইভাবে কুরুবংশেও মহারাজ কুরুর পরে কতগুলি অখ্যাত রাজা আছেন। সেইসব রাজার সংখ্যা পুরাণ এবং মহাভারতের তালিকা অনুযায়ী অন্তত দশ থেকে পনেরজন। কুরুবংশের এই অখ্যাত রাজাদের নাম এখানে আমরা স্মরণ করছি না, কিন্তু সঙ্গে এটাও আমাদের বলতে হবে যে, এঁদের আমলে হস্তিনাপুর, কুরুজাঙ্গল বা কুরুক্ষেত্র– কোনটাই হাতছাড়া হয়ে যায়নি। কিন্তু এই বংশে আর বিশিষ্ট কোনও রাজা না জন্মানোর ফলে কুরুর নামে এই বংশধারা চলছিল। কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ শেষ হবার পরে পরীক্ষিৎ, জনমেজয়–এইসব রাজার নাম আপনারা শুনতে পাবেন। কিন্তু মনে রাখবেন– সমনামের আরও কয়েকজন রাজা মহারাজ কুরুর পর হস্তিনাপুর শাসন করে গেছেন। এদের মধ্যে একজন–ভীমসেনও আছেন। লক্ষণীয়, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর অভিমন্যুর পুত্র পরীক্ষিতের নামকরণ করা হয়েছিল ক্ষীণ বা পরিক্ষীণ বংশের উত্তরাধিকারী রক্ষার অর্থ-কল্পনায়। আমাদের জিজ্ঞাসা-মহারাজ কুরুর অব্যবহিত পরেই যে পরীক্ষিৎকে আমরা পাই, তিনি কি ভরত অথবা কুরু মহারাজের সুনাম বজায় রাখতে পারেননি বলেই পরীক্ষিৎ নামে অভিহিত হয়েছিলেন? যাই হোক, কুরুর পর পারীক্ষিৎ-জনমেজয়, সার্বভৌম-মহাভৌম, দেবাতিথি-দিলীপদের মতো অখ্যাত কুরুবংশীয়দের একটা ধারা শেষ হবার পরেই আমরা যাকে পাচ্ছি, তিনি হলেন মহারাজ প্রতীপ–যিনি মহামতি ভীষ্মের পিতামহ।

 পাঞ্চালরাজ্যে মহারাজ জন্তুর অন্তত দশ-বার পুরুষ পরে আমরা দ্রুপদপিতা পৃষতকে অধিষ্ঠিত দেখেছি। সমান্তরালভাবে কুরুরাজ্যের রাজধানী হস্তিনাপুরে মহারাজ প্রতীপকেও আমরা অধিষ্ঠিত দেখলাম। কিন্তু এবারে আমাদের একটু মথুরায় যেতে হয়। আমরা যাদব-হৈয়েদের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছি। মহারাজ যযাতির কনিষ্ঠ পুত্র পুরুর গৌরবে এতক্ষণ ধরে শুধু পৌরববংশের মূল ধারায় দুষ্যন্ত, ভরত, সম্বরণ, কুরু–এঁদেরই ইতিহাস কীর্তন করলাম। কিন্তু যাদবদের কথা আর বলাই হয়নি। যাদবদের কথা বলতে গিয়ে তাদের মধ্যে বিক্রত-কীর্তি শশবিন্দু অথবা কার্তবীর্য-অর্জুনের কথা বলেছি, তালজ অথবা বীতিহোত্র (বীতহব্য) কথাও বলেছি। কিন্তু খুব সংক্ষেপে বললেও আরও দু-চারজনের কথা না বললে কুরু-পাঞ্চালদের সঙ্গে তাদের ‘ইন্টার্যাকশন’ দেখাতে পারব না–এটা একটা কথা। দ্বিতীয় কথা, যাদবরা দু-চারটে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজেদের নামে বা পুত্রের নামে-সেগুলো ঐতিহাসিক দিক দিয়ে ভীষণ মূল্যবান।

আমরা এর আগে যাদবদের সাধারণ আবাসস্থান মথুরার নাম করেছি, শূরসেনের নামও করেছি। কার্তবীর্য-অর্জুনের দুটি পুত্রের নাম শূর এবং শূরসেন হওয়ায় আমরা অনুমান করেছিলাম যে, তাঁর নাম থেকেই হয়ত শূরসেন নামে জায়গাটার উৎপত্তি এবং মেগাস্থিনিস হয়তো শূরসেনাই’ বলতে ওই জায়গাটাই বুঝিয়েছেন। এখন কিন্তু আমরা একটা বিকল্প সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করব–যাতে মথুরা এবং শূরসেনের নামকরণের নতুন ইতিহাস জানা যেতে পারে। তবে মথুরার সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটো দেশের জন্মকথা আমাদের বলে নিতে হবে কেন না ওই দেশ দুটিও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দিক দিয়ে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

আমরা আবার সেই যযাতিপুত্র যদু থেকে আরম্ভ করছি না। শুধু এইটুকু বলি–যদুর পুত্র ক্রোঙ্গুর বংশে শশবিন্দু যেমন জন্মেছিলেন, তেমনই বহু পরবর্তীকালে সেই বংশে ভগবান বলে চিহ্নিত নামক বিখ্যাত পুরুষটিও জন্মেছিলেন। আমরা এই বংশের মাঝামাঝি একটা জায়গায় জ্যামঘ বলে এক রাজার নাম পাব। জ্যামঘ ছিলেন পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে মধ্যম। তার দুই দাদার প্রথমজন রাজা হয়ে তাকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেন। জ্যামঘ বনে চলে যেতে বাধ্য হন এবং একটি আশ্রমে বাস করতে আরম্ভ করেন–তাভ্যাং ব্রাজিতো রাজ্যাজ-জ্যামঘো’বসদাশ্রমে। বনবাসী ব্রাহ্মণেরা জ্যামঘকে নানা পৌরুষের কার্যে উৎসাহ দিতে থাকেন। নিজের শক্তিতে বিশ্বস্ত হয়ে জ্যামঘ একটি নতুন রাজ্য জয় করেন নর্মদা নদী পেরিয়ে এই রাজ্য। তার নাম মৃত্তিকাবতী–নর্মদাকুলমেকাকী নগরীং মৃত্তিকাবতীম।

নর্মদার পাড়ে মৃত্তিকাবতী নগরীর মধ্যে আবার একটা রাজপুরী তৈরি করলেন জ্যামঘ। তার নাম দিলেন শুক্তিমতী। ভালই চলছিল। জ্যামঘের স্ত্রীর নাম ছিল শৈব্যা, কোনও পুরাণ-মতে চিত্রা। এই শৈব্যার গায়ে যেমন শক্তি ছিল, তেমনই ছিল তার ব্যক্তিত্ব। আর বয়সও বোধ হয় তার জ্যামঘের থেকে বেশি ছিল–শৈব্যা বলবতী ভূশম্শৈব্যা পরিণতা সতী। পত্নীর ভয়ে জ্যামঘ সেকালের স্বর্ণযুগেও দ্বিতীয় একটি বিবাহ করতে পারেননি; এমন কি তার একটিও পুত্র ছিল না, কিন্তু সেই বাহানাতেও রাজা দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে পারেননি–অপুত্রোপি স বৈ রাজা ভার্যামন্যাং ন বিন্দতি।

যাই হোক, জ্যামঘ একবার নিজের রাজ্য ছেড়ে আরও দক্ষিণ দিকে রাজ্যবিস্তারে মন দিলেন। রাজ্য জয়ের পর শত্রু রাজ্যের একটি অতি সুন্দরী কন্যা তার হস্তগত হল। কন্যাটি যে আর্যগোষ্ঠীর কেউ নন, সেটা তার নাম থেকেই বোঝা যায়। কন্যার নাম উপদানবী। জ্যামঘ রাজ্যজয় করে সেই কন্যাকে রথে চড়িয়ে স্বদেশে ফিরলেন বটে, তবে স্ত্রী শৈব্যার সম্মুখীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার চটকা ভেঙে গেল। স্ত্রীর ভয়ে জ্যামঘ বললেন-দেখ, দেখ। তোমার ছেলের বউ নিয়ে এসেছি কেমন, দেখ।

 মাথাই নেই তার মাথাব্যথা। রাজার কোনও ছেলেই নেই, তার ছেলের বউ! শৈব্যা বললেন-এই কন্যাটি কার ছেলের বউ, তোমার কি মাথা খারাপ হল–এতচ্ছুত্বাব্রবীদেবী কস্য চেয়ং সুষেতি বৈ। জ্যামঘ জোর দিয়ে বললেন-তোমার যে পুত্র হবে, এ কন্যা তারই বউ হবে। রাজার মনের জোর আর সেই উপদানবী কন্যার ভাগ্য–শেষ পর্যন্ত জ্যামঘর একটি ছেলে হল। রাজা পুত্রের নাম দিলেন বিদর্ভ। হয়তো নতুন যে রাজ্য জয় করেছিলেন জ্যামঘ, সেই রাজ্যের নামেই পুত্রের নাম রাখেন তিনি, নয়তো পুত্রের নামেই সেই নতুন রাজ্যের নাম দেন বিদর্ভ। বিদর্ভের থেকে বয়সে অনেক বড় সেই উপদানবীর সঙ্গেই কিন্তু বিদর্ভের বিয়ে হল এবং তাদের তিনটি পুত্র জন্মাল। তাদের নাম হল ক্ৰথ, কৌশিক এবং লোমপাদ।

আমরা আগেই বলেছি–বিদর্ভ দেশে যাদবদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই হল সেই প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। ভবিষ্যতে বিদর্ভ দেশটাকে আমাদের প্রয়োজন হবে–মহামতি কৃষ্ণ এই রাজ্যে বিবাহ করতে আসবেন, আমরা তাই নগরীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে রাখলাম। বিদর্ভের প্রথম পুত্ৰ ক্ৰথ বোধহয় স্বদেশে অর্থাৎ বিদর্ভেই রাজা হন এবং সেই কারণেই পুরাণাদিতে তাঁকে–কথো বিদর্ভপুত্রস্তু–বলে বিদর্ভেই তার অধিষ্ঠান নির্ণীত হয়েছে। কিন্তু বিদর্ভের দ্বিতীয় পুত্র কৌশিক কৈশিক) বোধহয় অন্য একটি রাজ্য জয় করেন এবং নিজ পুত্রের নামে সেই দেশের নাম রাখেন চিদি। এই চিদি রাজ্যে পরবর্তীকালে শিশুপাল জন্মাবেন এবং বিদর্ভনন্দিনী রুক্মিণীর পাণিগ্রহণ করার জন্য কৃষ্ণের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হবেন। ক্ৰথ এবং কৌশিকের অনেক অনেক পুরুষ পরে কৃষ্ণের জন্ম হবে ঠিকই, কিন্তু এই দুই রাজা বিদর্ভ রাজ্য এবং চেদি রাজ্যের প্রতিষ্ঠার কারণেই এত বিখ্যাত হয়েছিলেন যে, চৈতন্যদেবের পরম পার্ষদ রূপ গোস্বামী তার ললিতমা নামক নাটকে রুক্মিনীর বিবাহের প্রসঙ্গে এই ক্ৰথ-কৌশিককে চরিত্র হিসাবে আমদানি করেছেন। ইতিহাসের ‘অ্যানাক্রনিজম’ দেশকালের কতটা বিপর্যয় ঘটাতে পারে, এটা তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

 এই জ্যামঘর কথা বললাম, তার সাত-আট পুরুষ পরেই যদুবংশে মধু নামে এক রাজার উৎপত্তি ঘটে এবং এই মধু নামের রহস্য থেকেই মধুরা বা মথুরা নামের উৎপত্তি। পণ্ডিতেরা সন্দেহ করেন যে, ইক্ষাকু বংশের নরচন্দ্রমা রামচন্দ্র যখন অযযাধ্যায় রাজত্ব করছেন, তখন ভীম সাত রাজা হয়েছেন যাদবদের। রামায়ণ থেকে আরম্ভ করে অনেক পুরাণেই দেখা যাবে–রামচন্দ্রের ভাই শত্রুঘ্ন দিগবিজয় করার সময় মাধব লবণকে বধ করে মধুবনে গিয়ে মথুরা পুরী স্থাপন করেন-মাধবং লবণং হত্বা গত্বা মধুবনঞ্চ তৎ।

 ‘মাধব লবণ’ বলতে কেউ বলেছেন–মধুর ছেলে লবণ, আবার কোনও কোনও পুরাণ-কাহিনীতে, এমন কি রামায়ণেও লবণ একজন দানব অথবা দৈত্য। হরিবংশের বক্তব্য-যমুনার তীরে বহুজনপদযুক্তা মথুরা-নগরীর মধ্যেই মধুবন নামে এক ভীষণ বন ছিল এবং লবণ নামে এক দানব বাস করত সেই মহাবনে–ঘোরং মধুবনং নাম যত্রাসৌ ন্যবসৎ পুরা। সন্দেহ নেই–মহাবন হলেই সেখানে দৈত্য-দানবের অধিবাস, অথবা কেউ যদি দানব নামেই পরিচিত হন তবে তাকে বনেই থাকতে হবে–এই পুরা-কল্পনা থেকেই লবণ আর মধুবনের সৃষ্টি। তবে পণ্ডিতরা মনে করেন–অযোধ্যায় রামচন্দ্র যখন রাজত্ব করছেন, তখন মথুরা অঞ্চলে হয়তো তখনও মথুরার নাম মথুরা হয়নি-মথুরা অঞ্চলে রাজত্ব করছেন ভীম সাদ্ভূত, যাঁকে মধুবংশীয় মাধব বলা হত। মধু নামে একজন যাদব রাজা অবশ্যই ছিলেন এবং তিনি যদুবংশজাত সত্ত্বা রাজার উধ্ব-পুরুষ ছিলেন। হরিবংশ জানিয়েছে–মধু রাজা এতই ভাল মানুষ ছিলেন এবং তিনি এমনই মিষ্টি কথা বলতেন যে, পিতৃপরম্পরায় তার নাম দেবক্ষত্রি হওয়া সত্ত্বেও লোকে তাকে মধু বলেই ডাকত। হয়তো এত জনপ্রিয় ছিলেন বলেই তার নামে যাদবরা একসময় মাধব নামে পরিচিত হতে থাকবেন–মধুনাং বংশকৃ রাজা মধু-মধুরবাগপি–এবং পরবর্তীকালে এই বংশের অলংকার হিসেবেই কৃষ্ণের এক নাম হয়তো মাধব।

 আমাদের ধারণা–জনপ্রিয়তার জন্য যদুবংশীয় দেবক্ষত্রির নাম যেমন মধু হয়ে গেল, তেমনই নিজের নামেই তিনি একটি অসাধারণ সুন্দর কাননভূমির নাম রেখেছিলেন মধুবন। রামায়ণে কিংবা অন্যান্য পুরাণে মাধব লবণ–অর্থাৎ মধুবংশীয় লবণ নামে যে তথাকথিত দানবের নাম পাচ্ছি-সে একটা কথার কথা। বাস্তবে মধুবংশীয়দের মধ্যে লবণ নামে কেউ ছিলেন না। লক্ষণীয় বিষয় হল–আমাদের পূর্বোক্ত মধু অযোধ্যার ইক্ষাকুবংশীয়া একটি রমণীকেই বিবাহ করেছিলেন এবং তার পুত্রের নাম সত্ত্বান্–ঐক্ষাকী চাভবদৃভার‍্যা সাংস্তস্যামজায়ত। সত্ত্বা এতই বিখ্যাত এবং এতই তিনি গুণবান যে তার নামেই যদুবংশের ধারা পুনর্গঠিক হয় সাত্ত্বত-বংশ নামে। পণ্ডিতেরা সন্দেহ করেন–মাধব লবণ নয়, মাধব অর্থাৎ মধুর পুত্র সত্ত্বাই কোনও সময় রামচন্দ্রের ছোটভাই শত্রুঘ্ন কর্তৃক পরাজিত হন এবং তিনিই মধুবন কাটিয়ে নতুন একটি নগরী প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা করেন–ছিত্ত্বা বনং তৎ সৌমিত্রি নিবেশং সোভরোচয়ৎ। এই উচ্ছিন্ন বনভূমিতেই শেষ পর্যন্ত মথুরা নগরীর প্রতিষ্ঠা করেন রাম-কনিষ্ঠ শয়তস্মিন মধুবন-স্থানে মথুরা নাম সা পুরী। মথুরাপুরী পূর্বে ‘মধুরা’ নামেই বিখ্যাত ছিল কিন্তু লোকমুখের অপভ্রংশে মধুর স্মৃতি লুপ্ত হয়ে মধুরা মথুরায় পরিণত হয়।

 ইক্ষবাকুবংশের পরম কীর্তিমান পুরুষ রামচন্দ্র যখন লীলা সম্বরণ করেন, তখন অযোধ্যার মূল রাজ্যভূমির উত্তরাধিকার পান তারই পুত্র কুশ। শত্রুঘ্নের দুই পুত্র সুবাহু এবং শূরসেন রাজ্য পান পিতার অধিকৃত মথুরায়–সুবাহুঃ শূরসেনশ্চ শত্রুঘুসাহিতাবুভৌ। পালয়ামাসতুঃ সুতৌ বৈদেহৌ মথুরাং পুরীম্। শত্রুয়ের পুত্র শূরসেনের নাম থেকেই হয়তো মথুরা অঞ্চলের নাম। হয় শূরসেন, মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকায় যার পরিচয় শূরসেনাই।

পণ্ডিতেরা মধুপুরীতে শত্রুয়ের অধিকার লক্ষ্য করে যে অনুমানই করুন, আমরা ইতিহাস-পুরাণে কোথাও এমন খবর পাইনি যে, মধুরপুত্র সত্ত্বা একবারও তার রাজ্য হারিয়েছিলেন; অথবা কোনও সময়ে বা তাঁকে রাজ্য পুনরুদ্ধারও করতেও হয়েছে–সে খবরও আমরা পাইনি। পুনশ্চ যদুর্বংশীয় মধুর সঙ্গে যেহেতু একজন ইক্ষাকুবংশীয়ার পরিণয় ঘটেছিল; সেই হেতু তারই পুত্র সত্ত্বানের রাজ্য হারানোর কথাটা মোটেই অনুমানযোগ্য নয়, আদরণীয়ও নয়। আমরা তাই কার্তবীর্য অর্জুনের দুই পুত্র শূর এবং শূরসেনের নামেই শূরসেন অঞ্চলের প্রসিদ্ধি অনুমান করি এবং মধুর নাম থেকেই মধুরা বা মথুরা। শত্রুঘ্ন হয়তো মথুরার। নিকটবর্তী অঞ্চলে লবন নামে কোনও অনার্য গোষ্ঠীর নেতাকে পরাভূত করেছিলেন এবং বন কেটে তাকে নতুন বসতি গড়তে হয়েছিল। অন্যথায় উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে লবনকে কোনওভাবেই সত্ত্বা বলে প্রমাণ করা বড়ই কঠিন।

যাই হোক, মথুরাপুরীতে এই যে সত্ত্বা বা সত্ত্বত নামে যে যাদব রাজার নাম পেলাম, ইনি একদিক দিয়ে যযাতি বা অজমীঢ়ের মতোই বিখ্যাত। কারণ এরই পুত্র-পরম্পরায় পরবর্তীকালে মহামতি কৃষ্ণ, অক্রুর অথবা মহাভারত-খ্যাত কৃতবর্মা, সত্যভামা-এমন কি কংসও জন্মাবেন। কৃষ্ণকে ডাকা হবে সত্ত্বতবংশের স্বামী বা শ্রেষ্ঠ পুরুষ হিসেবে-ভগবান্ সাত্ত্বতাং পতিঃ।

সত্ত্বান বা সত্ত্বতের সঙ্গে কোশল দেশের এক রমণীর বিবাহ হয়, যার নাম আমরা জানি না। তাকে শুধু কৌশল্যা বলেই জানি। কৌশল্যার গর্ভে সত্ত্বতের সাত ছেলে–ভজিন, ভজমান, দিব্য, অন্ধক, দেবাবৃধ, মহাভোজ এবং বৃষ্ণি। এদের মধ্যে সবাই যে খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা নয়। তবে আগেই আমরা জানিয়েছি যে, সত্ত্বতের দ্বিতীয় পুত্র ভজমানের সঙ্গে পাঞ্চাল-রাজ সৃঞ্জয়ের দুই মেয়ে বাহ্যকা এবং উপবাহ্যকার বিয়ে হয়। কিন্তু তাদের পুত্রেরা খুব একটা কেউ বিখ্যাত নন। সত্ত্বতের এই সাত ছেলের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলেন অন্ধক এবং বৃষ্ণি। কৃষ্ণকে পরে অন্ধক এবং বৃষ্ণির উত্তরপুরুষরূপে কল্পনা করা হবে। সত্ত্বত, বৃষ্টি, অন্ধক–এঁরা সবাই কিন্তু সমভাবে ভোজ নামে পরিচিত।

পুরাণকারেরা অন্ধক-বৃষ্ণির সন্ধান পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই খুব তাড়াতাড়ি কৃষ্ণের পিতামহ, শ্বশুর এবং মাতামহের কাছাকাছি নামগুলিতে চলে এসেছেন কিন্তু অন্ধক-বৃষ্ণির বড় দাদা ভজমান পাঞ্চালরাজ সৃঞ্জয়ের সমসাময়িক হওয়ায় আমরা বুঝতে পারি–বৃষ্ণি-অন্ধকদের বংশতালিকায় মাঝে মাঝে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। সে যাই হোক, আমরা তো আর নতুন নাম সৃষ্টি করে সে তালিকা পূরণ করতে পারব না। তাই অন্ধক-বৃষ্ণিবংশের দু-চারজন বিখ্যাত পুরুষের নাম করেই আমরা সেই জায়গায় চলে আসব যেখানে সমান্তরালভাবে কুরুবংশের শান্তনুর পিতা মহারাজ প্রতীপকে পাব অথবা পাঞ্চালবংশে দ্রুপদপিতা মহারাজ পৃষতকে পাব।

সাত্ত্বতবংশে অন্ধকের বিখ্যাত পুত্রটির নাম হল কুকুর। ভগবান কৃষ্ণকে মহাভারতের মধ্যে সত্ত্বত-অন্ধকের সঙ্গে একযোগে কুকুর-বংশীয় বলেও ডাকা হয়েছে। এই কুকুর থেকে পৌরাণিক মতে আট-দশ পুরুষ পরে অথবা আধুনিক গবেষকের মতে অন্তত পনের/সোল পুরুষ পরে জন্মান অভিজিৎ বলে এক রাজা। অভিজিতের একটি কন্যা এবং একটি পুত্র। তাদের নাম আহুক আর আহকী। এই আছকই হলেন মথুরার অত্যাচারী রাজা কংসের পিতামহ। আমরা যেহেতু আহুকের নাম পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পূর্বোক্ত কুরু-পাঞ্চালবংশীয় প্রতীপ এবং পৃষতের সম-সময়ে পৌঁছলাম, তাই এরপর থেকে আমাদের নতুন পর্ব শুরু করতে হবে।

.

৫১.

যাঁরা দিন-রাত ব্যাকরণের কচকচি নিয়ে সময় কাটান, লোকে তাদের রুক্ষ-শুষ্ক মানুষ বলে ভাবেন। কিন্তু পাণিনি-ব্যাকরণের ওপর মহাভাষ্য রচনা করে খ্রিস্টপূর্ব দেড়শ শতাব্দীতে যিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন, সেই পতঞ্জলির রসবোধ নেই– এ কথা বোধ করি কেউ বলবেন না। অব্যয়ীভাব সমাসের একটা উদাহরণ দিতে গিয়ে পতঞ্জলি লিখলেন-অনুগল্পং হস্তিনাপুর। অর্থাৎ গঙ্গার তীরেই হস্তিনাপুর। ইতিহাসের রসবোধ যাদের আছে, তারা বুঝবেন যে, হস্তিনাপুর শহরটা গঙ্গা নদীর সঙ্গে এমনভাবেই জড়িত যে গঙ্গাকে বাদ দিয়ে হস্তিনাপুরের অস্তিত্বই যেন কল্পনা করা যায় না। আর ঠিক এই কারণেই গঙ্গাকে আমরা সুন্দরী এক রমণীর রূপ ধরে হস্তিনাপুরের রাজার কাছে সমাগত দেখতে পাচ্ছি।

মহাকাব্যের ইতিহাসে এমন উদাহরণ কিছু বিচিত্র নয়। জলবাহিনী নদী যে দেশের শোভা এবং শস্য বর্ধন করে সেই দেশের রাজার সঙ্গে তার প্রণয়-পরিণয়ের সম্পর্ক মহাকাব্যে খুব পরিচিত। মথুরা-বৃন্দাবনে যমুনার সঙ্গে কৃষ্ণের সম্পর্কও একই রকম। একটু আগে আমরা যদুবংশীয় সত্ত্বা রাজার কথা বলেছি। তারই এক পুত্র হলেন দেবাবৃধ। তিনি বোধহয় এখনকার রাজস্থানের দেওলি-সওয়াই-মধোপুর অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। এইসব জায়গায় তখন যাদবদেরই বাস ছিল। দেবাবুধের রাজ্য ঠিক ঠিক পর্ণাশা নদীর ওপর। পর্ণাশা এখনকার বনসা। হরিবংশে দেখছি দেবাধ সর্বগুণসম্পন্ন একটি পুত্র কামনা করে তপস্যা আরম্ভ করলেন এবং তপস্যার সময় সারাক্ষণ তিনি পর্ণাশা নদীর জল স্পর্শ করে রইলেন- সংযুজ্যাত্মনমেবং তু পর্ণাশায়া জলং শৃশ।

 দেশের রাজার এমন একাগ্র মনের স্পর্শ সদোপম্পৃশতস্তস্য তরঙ্গ-ভঙ্গ-শোভিনী কোন নদী-রমণী সইতে পারে? রাজা দেবাবুধের সর্বগুণসম্পন্ন পুত্রের জন্ম দেবার জন্য পর্ণাশা নিজেই গর্ভধারণ করবেন বলে স্থির করলেন। কুমারীর বেশে সুন্দরী নদী-রমণী পর্ণাশা রাজার কাছে গিয়ে তাকে কামনা করলেন। রাজা দেবাবৃধও তাকে দেখে মোহিত হলেন-বরয়ামাস নৃপতিং তামিয়েষ চ প্রভুঃ।

পর্ণাশা গর্ভে ল্গযে মহান পুত্রের জন্ম হল- সেটা আমাদের কাছে বড় কথা নয়। বড় কথা হল- নদীর এই রমণীরূপ ধারণ। যদি অলৌকিকতায় বিশ্বাস করেন, তো ঠিক আছে। কিন্তু আপনি যদি আমারই মতো কুতার্কিক হন, তাহলে একটা কথা বলার আছে। আমাদের ধারণা পুরাণে-ইতিহাসে নদীর রমণীরূপ ধারণ করার মধ্যে একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। এইসব ক্ষেত্রে অজ্ঞাতকুলশীলা কোনও সুন্দরী রমণীই এই তাৎপর্যের বিষয়। নদীর জলস্পর্শ করে বসে থাকা অথবা নদীর ধারে বসে আছেন রাজা, আর ঠিক এই সময়ে সুন্দরী রমণীর রূপ পরিগ্রহ করে নদী এসে রাজার পাণি প্রার্থনা করছেন- এর একটাই মানে। এমনই এক সুন্দরীর সঙ্গে রাজার দেখা হয়েছে যার জাতি-কুল-মান জানা নেই অথচ রমণী সুন্দরী। মোহিত রাজার তাকে প্রত্যাখ্যান করার উপায় নেই। আর রমণীর নাম নদীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে পর্ণাশা হতেই পারে অথবা হতেই পারে গঙ্গা।

 হস্তিনাপুরের রাজা প্রতীপ। ভরত-কুরুবংশের শেষ জাতক। তিনি এই মুহূর্তে বসে আছেন গঙ্গাদ্বারে গঙ্গার ধারে। মন্ত্র জপ করছেন, মান-আহ্নিক করছেন আর গঙ্গার শোভা দেখছেন–নিষসাদ সমা বীৰ্গন্ধদ্বারগতো জপন। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে– মহারাজ প্রতীপ এখন রাজধানীতে নেই। তিনি গঙ্গার তীরবর্তী নির্জন কোন প্রদেশে এসে অস্থায়ী বাসা বেঁধেছেন এবং সেখানে আছেনও বহুকাল–সমা বহ্ববীঃ। এই সময়েই একদিন গঙ্গা নদীরূপিণী গঙ্গা রাজার রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে মনোহরা রমণীর রূপ ধারণ করে উঠে এলেন নদীর মধ্য থেকে উত্তৰ্য্য সলিলাত্তস্মাল ফলাভনীয়তমাকৃতিঃ।

 সংস্কৃত কাব্য এবং অলংকারগ্রন্থগুলিতে নদীর সঙ্গে রমণীদেহের তুলনা করে মহাকবিরা অতি উপভোগ্য রসসৃষ্টি করেছেন নানা বিভঙ্গে রমণীর চলা-হাসা এবং নৃত্যের সঙ্গে নদীর সাযুজ্য কল্পনা করে মহাকবিরা শেষ পর্যন্ত নদীর তরঙ্গকে রমণীর উচ্ছল চুম্বনদায়ী ওষ্ঠের সঙ্গেও তুলনা করেছেন। আর কালিদাস তো উপলব্যথিত গতি বেত্রবতীর নাভিদেশ পর্যন্ত আবিষ্কার করে মেঘদূতের পাঠককে এক কল্পনার জগতে পৌঁছে দিয়েছেন। কাজেই মনোহারিণী চঞ্চলা নদীর সঙ্গে উচ্ছল স্বভাবের রমণীর কোনও তফাত নেই। গঙ্গা তো এতই উচ্ছল যে, তিনি বিনাবাক্যে একটুও ভণিতা না করে মহারাজ প্রতীপের শালবৃক্ষসদৃশ দক্ষিণ উরুর ওপর এসে বসে পড়লেন–দক্ষিণং শালসঙ্কাশম্ উরুং ভেজে শুভাননা।

মহারাজ প্রতীপ একটু গম্ভীর হলেন। আমাদের ধারণা তাঁর একটু বয়সও হয়েছে। একটি যুবক পুরুষের মতো রমণীর স্পর্শে তিনি বিচলিত হলেন না। বললেন– কল্যাণী। (সম্বোধনটা খেয়াল করবেন) কী করতে পারি তোমার জন্য, কী তোমার ইচ্ছে, খুলে বলো দেখি- করোমি কিন্তু কল্যাণি প্রিয়ং যত্তেভিকাক্ষিত। রমণী নির্দ্বিধায় জবাব দিলেন তুমি কুরুবংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষ। আমি তোমাকে আমার ঈপ্সিততম নায়ক হিসেবে পেতে চাই। আর তুমি তো জান কোনও রমণী যদি নিজেই মিলনেচ্ছা প্রকাশ করে, তাকে অবহেলা করাটা কত খারাপ কাজ। প্রতীপ বললেন- তোমাকে ভাল লাগছে বলেই আমি পরস্ত্রীর প্রতি আসক্ত হব, অসবর্ণা এক রমণীকে বিবাহ করে বসব– এ আমি করতে পারি না। তাতে অধর্ম হবে, কল্যাণী ন চাসবর্ণাং কল্যাণি ধৰ্মং তদ্ধি ব্রতং চ মে।

মাত্র দুটি শব্দ, মহারাজ প্রতীপের প্রত্যাখ্যানের মধ্যে মাত্র দুটি শব্দ ‘পরস্ত্রী’ এবং ‘অসবর্ণা’– এই শব্দ দুটো শুনলেই স্পষ্ট বোঝা যায় এই গঙ্গা কোনও নদীও নন, কোনও অলৌকিক দেবীও নন। রমণী সাধারণী, জাতি-কুলের মাত্রায় তার কিছু হীনতাও আছে যা হস্তিনাপুরের রাজা কুরুবংশের অলংকার মহারাজ প্রতীপকে মানায় না। তাছাড়া গৃহে তার স্ত্রী বর্তমান। পরম দয়ালু শিবি রাজা যে বংশে জন্মেছিলেন, সেই বংশের মেয়ে সুনন্দার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে কতকাল। আজকে তার এই প্রৌঢ় বয়সে অজ্ঞাতকুলশীলা এক নারী হঠাৎ করে তার দক্ষিণ উরু স্পর্শ করে বিবাহের প্রস্তাব করায় প্রতীপ একেবারে অপ্রতিভ হয়ে গেলেন। তার প্রত্যাখ্যানের উপায় এখানে ওই দুটি মাত্র শব্দ– ‘পরস্ত্রী’ এবং ‘অসবর্ণা’। পরস্ত্রী বলতে পরের বউ না বুঝিয়ে পরের মেয়েও বোঝাতে পারে–এমন কথা আমরা বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে পড়েছি। কিন্তু এখানে পরস্ত্রী বলতে প্রতীপ যদি পরের মেয়েও বোঝেন, সেখানেও কার না কার মেয়ে’- এমন একটা তাচ্ছিল্য প্রকাশিত হয়েছে, আর সেটা খুব ভালই প্রমাণ হয়ে যায় অসবর্ণা কথাটার মধ্যেই।

রাজার মুখে এমন প্রত্যাখ্যান শুনেই রমণী সপ্রতিভভাবে জবাব দিলেন-কেন আমি কি দেখতে এতই খারাপ! কোনও দুর্লক্ষণও তো নেই আমার শরীরে–উঁচু কপাল, কী চুল নেই, কী গায়ের লোমগুলো পুরুষ মানুষের মতো এসব তো আমার কিছুই নেই। আর অসবর্ণা বলে আমি কি অগম্যা হলাম নাকি? অমন কথা বোলো না, রাজা- নাশ্রেয়স্যাস্মি নাগম্যান বক্তব্যা চ কহিচিৎ। জেনে রেখ– আমি রীতিমত স্বর্গীয়া এক রমণী, আর পরস্ত্রী কিসের, আমি রীতিমত কুমারী। সবচেয়ে বড় কথা—আমি তোমাকে চাইছি, অতএব তুমিও আমাকে চাইবে– ভজন্তীং ভজ মাং রাজন্ দিব্যাং কন্যাং বরষ্ক্রিয়ম্।

রমণী সুন্দরী, অতএব স্বর্গীয়া তো বটেই। আর যেভাবে সে নাছোড়বান্দা হয়ে মহারাজ প্রতীপের দক্ষিণ উরুখানি স্পর্শ করে বসেছে, তাকে ফিরিয়ে দেওয়া কঠিন। প্রতীপ তার গম্ভীরতা বজায় রেখেও একটু প্রশ্রয় দিয়ে বললেন- আমার ভাল লাগার জন্য যে কাজ তুমি করতে বলছ, ভাল লাগার সেই বয়স আমি পার করে এসেছি- মমাতিবৃত্তমেতন্তু যং চোদ্দয়সি প্রিয়ম। তোমার পথ এখন একরকম, আমার অন্যরকম। এখন যদি তোমাকে আমি বিয়ে করে বসি, সে বড় অধর্ম হবে। সে হয় না। মহারাজ প্রতীপ রমণীকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য একটু কৌশল করে বললেন- তুমি আমার কাছে এসেই আমার ডান উরুখানি জড়িয়ে ধরে বসেছ। এই ডান উরুটি কাদের বসার জায়গা জান? আত্মজ পুত্র আর পুত্রবধূদের আদর করে বসাতে হয় ডান উরুতে অপত্যানাং সুষাণাঞ্চ ভীরু বিদ্ধেত আসন। আর তুমি কিনা আমার কাছে এসেই বোকার মতো প্রেমিকার যোগ্য আমার বাম উরুটি বাদ দিয়ে বসলে গিয়ে আমার দক্ষিণ উরুতে। কাজেই এখন তো আর কোনও উপায় নেই। আমি আর তোমার সঙ্গে সকাম ব্যবহার করতে পারি না। সে বড় অধর্ম হবে।

আমরা আগেই বলেছিলাম- মহারাজ প্রতীপের বয়স হয়েছে। তিনি স্ত্ৰিআর যুবকটি নেই। তবু কিনা এই নির্জন গঙ্গার তীরে এক অসামান্যা রূপবতী রমণীকে সম্পূর্ণ নিরাশ করতে তার ইচ্ছে হল না। তিনি বুঝলেন- কুরুবংশের মহারাজকে রমণীর বড় পছন্দ হয়েছে, রাজার চটক রমণীকে মোহিত করেছে। প্রতীপ তাই প্রশ্রয় দিয়ে বললেন– তুমি যদি আমার পুত্রবধু হতে চাও, তবে আমি তোমাকে সেই সম্মান দিতে পারি। আমার দক্ষিণ উরুদেশে উপবেশন করে তুমি আমার পুত্রবধুর স্নেহ লাভ করেছ জেনো। অতএব আমার পুত্রের জন্য আমি তোমাকে বরণ করছি, কন্যে– সুষা মে ভব কল্যাণ পুত্ৰার্থং তাং বৃণোম্যহম্।

রমণী সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়েই বললেন– তবে তাই হোক, মহারাজ। আমি তোমার পুত্রের সঙ্গেই মিলিত হব। তোমাকে দেখেই আমি মনে মনে কেবলই ভেবেছি– আমি প্রখ্যাত ভরত-বংশের কুলবধু হব– ত্বভক্ত্যা তু ভজিষ্যামি প্রখ্যাতং ভরতং কুলম্। রমণীর কথা শুনে বোঝা যায় নির্জন গঙ্গার তীরে প্রৌঢ় মহারাজ প্রতীপের ভাব-গম্ভীর আচরণ দেখে তিনি শুধু মুগ্ধই হননি, তার ইচ্ছে শুধু ভরতবংশের কুলবধু হবার। রমণী এবার তুমি থেকে আপনি’তে চলে গেলেন। সোচ্চারে বললেন– পৃথিবীতে যত রাজা আছেন, আপনারা হলেন তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আপনাদের গুণের কথা একশ বছর ধরে গান গাইলেও শেষ হবে না। পূর্বে যারা আপনাদের বংশজাত, তারা সব মহান ব্যক্তি। আপনি যখন আপনার পুত্রের হয়ে কথা দিলেন, আশা করি, তিনি তা ফেলবেন না, অন্য কোনও বিচারও করবেন না– তৎ সর্বমেব পূত্ৰস্তে ন মীমাংসেত কহিচিৎ। হয়তো এই মহান ভরত-বংশের গৌরবেই সমস্ত লজ্জা ত্যাগ করে এই অভাতকুলশীলা রমণী প্রায় বৃদ্ধ এক রাজার দক্ষিণ ঊরু জড়িয়ে ধরেছিলেন। আপাতত তার সংকট সৃষ্টি হল বটে, কিন্তু মহারাজ প্রতীপ ভরতবংশের বধূমর্যাদা প্রার্থিনীর কাছে পুত্রকে বাগদত্ত করে রাখলেন।

এই ঘটনার পর মহাভারতের কবির কাহিনী খানিকটা অবিশ্বাস্য মনে হয়। কবি বলেছেন–তারপরে মহারাজ, প্রতীপ পুত্রের জন্য সস্ত্রীক তপস্যা আরম্ভ করলেন এবং তার পুত্র জন্মাল– যার নাম শান্তনু। শান্তনু যখন বড় হয়ে যৌবনে পদার্পণ করলেন, তখন মহারাজ প্রতীপ তাকে সেই অপরিচিতা রমণীর কথা বলে তাঁকে বিয়ে করার কথা বললেন।

আমাদের কাছে এই উপাখ্যান তত বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। কেন, সে কথা খুলেই বলি। আপনারা জানেন– শান্তনু এবং গঙ্গার মিলনের পিছনে আরও একটা কাহিনী আছে। ইক্বাকুবংশীয় মহারাজ মহাভিষ নাকি এক সময় দেবতাদের সঙ্গে ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন, নদীশ্রেষ্ঠা গঙ্গাও সেখানে পৌঁছেছিলেন অন্য কোনও কারণে। ব্রহ্মার সঙ্গে কথোপকথনের সময় গঙ্গার আবরণ-বস্ত্রখানি হাওয়ায় উড়ে গেলে দেবতারা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করেন কিন্তু মহাভিষ রাজা– কী করবেন, মানুষের স্বভাব তো তিনি নাকি হাঁ করে তাকিয়ে ছিলেন অসংবৃতা গঙ্গার দিকে মহাভিষ আজষিরশঙ্কো দৃষ্টবান্ নদী। ব্রহ্ম তখন মহাভিষ রাজাকে অভিশাপ দেন যে, তিনি মর্ত্যলোকে জন্মাবেন। মহাভিষ রাজা অনেক চিন্তা করে কুরুবংশীয় মহারাজ প্রতীপের ছেলে হয়েই জন্মাবেন ঠিক করলেন। ওদিকে গঙ্গা মহাভিষ রাজার ধৈর্যচ্যুতি দেখে, তারই কথা চিন্তা করতে করতে স্বস্থানে ফিরে গেলেন– তমেব মনসা ধ্যায়পাবর্তং সরিরা।

আমরা কিন্তু অভিশপ্ত ঘটনার মধ্যেই মহারাজ শান্তনুর প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। আমাদের কাছে অভিশপ্ত মহাভিষ রাজা বা পরবর্তীকালে গঙ্গার গর্ভজাত অষ্টবসুর সলিল-সমাধি, কোনওটাই খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। লক্ষণীয় ব্যাপার হল– তথাকথিত গঙ্গার সঙ্গে যখন শান্তনুর প্রথম দর্শন বা মিলন হয়, তখনও তিনি রাজা হননি বলেই মনে হয়। অন্যদিকে মহারাজ প্রতীপের সঙ্গে যখন গঙ্গার দেখা হয় তখনও শান্তনুর জন্ম হয়নি- এটাও ঘটনা নয়। আসল কথা হল– শান্তনু তখন অবশ্যই জন্মেছেন এবং সেই অজ্ঞাতকুলশীলা সেই রমণীর সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। কোনও ব্রহ্মলোকে নয়, এই মর্ত্যলোকেই হয়তো দেখা হয়েছে। শান্তনু তখনও রাজা হননি। ইস্ফাকুবংশীয় অভিশপ্ত মহাভিষের সেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকাটা সোজাসুজি শান্তনুরই কাজ। নির্জন গঙ্গার তীরে অজ্ঞাতকুলশীলা সেই রমণী ভরতবংশের এক প্রসিদ্ধ জাতককে এই ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তখনকার মতো লজ্জা পেয়েছিলেন। কিন্তু রমণী নিজেও শান্তনুর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ায় একদিন লজ্জা ত্যাগ করে শান্তনুর পিতা মহারাজ প্রতীপের দক্ষিণ পাখানি জড়িয়ে ধরেছিলেন।

এটা তার বোকামি নয়, বুদ্ধি। প্রতীপ সস্নেহে সেই অজ্ঞাতকুলশীলা রমণীকে পুত্রবধূর মর্যাদা দিয়েছেন এবং ঘরে এসে যৌবনপ্রাপ্ত কুমার শান্তনুকে বলেছেন–শান্তনু! একটি পরম সুন্দরী রমণী যদি কোনওদিন তোমার কাছে প্রণয়প্রার্থিনী হয়ে তোমাকে কামনা করে, ত্বমিব্রজে যদি রহঃ সা পুত্র বরবর্ণিনী– তবে তুমি যেন তাকে প্রত্যাখ্যান কোরো না। তাকে যেন তুমি জিজ্ঞাসা কোরো না তুমি কে, কার মেয়ে ইত্যাদি। আমার আদেশে তুমি সেই অনুরক্তা রমণীর ইচ্ছাপূরণ কোরো সে যা করতে চায়, বাধা দিও না তাকে। মহারাজ প্রতীপ তাকে এই কথা বলে শান্তনুকে নিজের রাজ্যে অভিষিক্ত করে বনে চলে গেলেন স্বেচ রাজ্যেভিষিচ্যৈনং বনং রাজা বিবেশ হ।

মহাভারতের কবি ভারতবর্ষের প্রাণপ্রদায়িণী গঙ্গাকে ভরতবংশের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য নানা কাহিনীর নিবেশ ঘটিয়ে আমাদের কী বিপদেই না ফেলেছেন। বস্তুত মহারাজ শান্তনুর রাজা হওয়ার মধ্যেও একটা বড় ঘটনা আছে। অপরিচিতা রমণীকে গঙ্গার মাহাত্ম্য দান এতে গিয়ে কবি সে কথা এখনও বলতেই পারেননি। তাঁকে সে ঘটনা উল্লেখ করতে হয়েছে মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে গিয়ে। আমরা সেটা বলে নিয়ে আবারও গঙ্গার কথায় আসব। মহারাজ প্রতীপের তিন পুত্র প্রথম পুত্রের নাম দেবাপি, দ্বিতীয় শান্তনু, তৃতীয় হলেন বাহ্লীক। নিয়ম অনুসারে জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবাপিরই রাজা হওয়ার কথা। কিন্তু রাজা হওয়া তার হল না। মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে যখন পাণ্ডব-কৌরবের যুদ্ধোদ্যোগ শুরু হয়েছে, তখন কৃষ্ণ শান্তির বাণী বহন করে কৌরব-সভায় এলেন। সেখানে ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, গান্ধারী– সবাই মিলে দুর্যোধনকে বোঝনোর চেষ্টা করলেন যে, তার পিতা ধৃতরাষ্ট্র রাজ্য পাননি অঙ্গহীনতার জন্য। সেই কারণে কনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পাণ্ডুর রাজ্যের উত্তরাধিকার ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রে বর্তায় না। সবার কথা শেষ হলে স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র নিজেই নিজের অধিকার খর্ব করে দুর্যোধনকে বেঝালেন। আর ঠিক এই সময়েই প্রতীপের জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবাপির কথা এল।

মহাভারতের আদিপর্বে যেখানে আমরা কুরুবংশের পরম্পরা, দেখেছি, সেখানে দেবাপি সবার বড় ছেলে, শান্তনু মেজ ছেলে এবং বাকি সবার ছোট। কিন্তু মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের বয়ানে দেখছি– দেবাপি ঠিক আছেন, কিন্তু বাহ্রীক মেজ এবং শান্তনু সবার ছোট। ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনকে বুঝিয়ে বললেন-আমার পিতার পিতামহ যিনি, সেই মহারাজ প্রতীপ কি কম বড় মানুষ ছিলেন নাকি। অর্থশাস্ত্র, রাজনীতি শাস্ত্র সব তার জানা। রাজা হিসেবে নাম-ডাকও তার কম ছিল না–প্রতীপঃ পৃথিবীপাল-স্ত্রিযুলোকে বিশ্রুতঃ। তার তিন পুত্র- দেবাপি, বাহ্লীক এবং শান্তনু–যিনি আমার পিতামহ- তৃতীয় শান্তনুস্তাত ধৃতিমান্ মে পিতামহঃ। ধৃতরাষ্ট্র প্রতীপের পুত্রদের কথা বলে বিশেষভাবে দেবাপির পরিচয় দিচ্ছেন– আমার জ্যেষ্ঠ পিতামহ দেবাপি ছিলেন মহাশক্তিধর পুরুষ এবং রাজা হবার পক্ষে সত্তম ব্যক্তি। কিন্তু তার দেহে চর্মরোগ ছিল, ত্বকের দোষ তাঁর সমস্ত শরীরে বড় বেশি প্রকট হয়ে উঠেছিল–দেবাপি মহাতেজা ত্বদোষী রাজসত্তমঃ।

 ধৃতরাষ্ট্রর তথ্য বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে- হস্তিনাপুরের জনপদবাসীরা দেবাপিকে বেশ পছন্দই করতেন, ত্বকের দোষ থাকা সত্ত্বেও পুরবাসীরা তাকে যথেষ্ট আদর-যত্নও করতেন পৌর-জানপদানাঞ্চ সম্মতঃ সাধুসকৃতঃ। মানুষ হিসেবে দেবাপি ছিলেন অতি চমৎকার ধার্মিক, সত্যবাদী, পিতার সমস্ত ইচ্ছাপূরণে আগ্রহী একটি পুত্র। রাজ্যের ঘোট ঘোট বাচ্চা থেকে বুড়ো মানুষটি পর্যন্ত তাকে খুব পছন্দ করতেন। সমস্ত মানুষের প্রতি দেবাপিরও বড় দয়া। সবার যাতে ভাল হয় সে জন্য তার চেষ্টার অন্ত ছিল না-বদান্যঃ সত্যসন্ধশ্চ সর্বভূতহিতে রতঃ। ছোট ভাই বাহ্লীক এবং শান্তনুর সঙ্গেও তার কোনও বিরোধ নেই। তারাও দেবাপিকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন– সৌভ্রাত্ৰঞ্চ পরং তেষাং সহিতানাং মহাত্মনাম।

সকলের পছন্দসই এই জ্যেষ্ঠ পুত্রকেই মহারাজ প্রতীপ রাজ্য দিয়ে যাবেন বলে ঠিক করলেন। তিনি বুড়ো হয়েছেন, আজ আছেন কাল নেই-কালস্য পর্যায়ে বৃদ্ধো নৃপতিসত্তমঃ- অতএব জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবাপির রাজ-অভিষেকের জন্য শুভ সময় দেখে তিনি শাস্ত্র অনুযায়ী সমস্ত উপকরণ এবং অভিষেক-সম্ভার যোগাড় করতে বললেন রাজ কর্মচারীদের-সম্ভারা অভিষেকাৰ্থং কারয়ামাস যতুতঃ। শুভ দিনে দেবাপির অভিষেকের মঙ্গলকাও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ঠিক এই সময়ে রাজ্যের ব্রাহ্মণ-সজ্জনেরা, বৃদ্ধরা, পুর-জনপদবাসীদের সঙ্গে নিয়ে মহারাজ প্রতীপকে দেবাপির পুণ্য-অভিষেক-কার্য থেকে বিরত হতে বললেন–সর্বে নিবারয়ামাসুদেবাপেরভিষেচন। কারণ সেই ত্বকের দোষ, চর্মরোগ। অবালবৃদ্ধ জনসাধারণ সবাই দেবাপিকে ভালোবাসলেও দেবাপির চর্মদোষ যে তার রাজকার্য পরিচালনার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে–এই যুক্তিতেই সকলে মহারাজ প্রতীপকে দেবাপির অভিষেককার্য সম্পন্ন করতে নিষেধ করলেন।

দেবাপির তৃগদোষ হয়তো খুব সাধারণ নয়। তবে তা যে প্রাচীন ভয়ঙ্কর সেই কুষ্ঠরোগও নয়, তা আমরা হলফ করে বলতে পারি। কারণ কুষ্ঠ-রোগ মহাভারতের কালেও খুব অস্পৃশ্য এবং ঘৃণ্য ছিল। ঠিক ওরকমটি হলে দেবাপি আবালবৃদ্ধ সকলের তত প্রিয় হতেন না– সর্বেষাং বালবৃদ্ধানাং দেবাপি-হর্দয়ঙ্গমঃ। কিন্তু কুষ্ঠ না হলেও ব্রাহ্মণ এবং বৃদ্ধরা নানা সন্দেহে দেবাপিকে নিজেদের রাজা হিসেবে চাইলেন না। কারণ রাজা যদি প্রথম দর্শনেই পৌর-জনপদের কাছে ঘৃণ্য হয়ে ওঠেন, তবে সে রাজা প্রজাসাধারণের গ্রহণীয় হন না। আর রাজার কাছে প্রজারাই তার দেবতা। তারা পছন্দ না করলে সে রাজার মূল্য কী– হীনাঙ্গং পৃথিবীপালং নাভিনন্দতি দেবতাঃ।

 প্রজাদের দিক থেকে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই বোঝা গেল। কিন্তু হঠাৎ এই সর্বত্র উচ্চাৰ্য্যমান অভিষেক-কার্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবাপির মনের অবস্থা হল শোচনীয়। মহারাজ প্রতীপের চোখে নেমে এল অর ধারা। প্রাণপ্রিয় পুত্র রাজ্য লাভ করল না দেখে প্রতীপ অত্যন্ত শোকগ্রস্ত হলেন। নিজের অসহায় অবস্থা বুঝে শোকক্লিষ্ট পিতাকে তিনি মুক্তি দিলেন নিজে ত্যাগ স্বীকার করে। দেবাপি রাজভবন ছেড়ে মুনিবৃত্তি গ্রহণ করে বনে চলে গেলেন। ত্বগদোষের জন্য রাজ্য না পেলেও মুনি হিসেবে দেবাপির সফলতার অন্ত নেই। মহাভারতে দেখছি– যখন তিনি বনে প্রস্থান করেন তখন তাঁর বয়স খুবই কম- দেবাপিঃ খলু বাল এবারণ্যং বিবেশ। কিন্তু প্রায় বালক বয়সে বনে গিয়েও দেবাপি ঋষি-মুনির তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করেন। তপস্যার। বীর্যে তিনি শেষ পর্যন্ত দেবতাদের আচার্য নিযুক্ত হন–উপাধ্যায়স্তু দেবানাং দেবাপিরভন্মুনিঃ।

বৈদিক গ্রন্থ বৃহদ্দেবতা এবং নিরুক্তে বলা হয়েছে- দেবাপিকে প্রায় অবৈধভাবে অতিক্রম করে শান্তনু যে রাজা হয়েছিলেন, তাতে একভাবে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল শান্তনুকে। শান্তনুর রাজ্যে বার বছর বৃষ্টি না হওয়ায় তাঁর রাজ্য ধ্বংসোন্মুখ হয়। ঘটনাটা সবিস্তারে বলা হয়েছে বিষ্ণুপুরাণে। অনাবৃষ্টির প্রকোপ অত্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় মহারাজ শান্তনু শেষ পর্যন্ত। মন্ত্রিসভা ডেকে ব্রাহ্মণদের জিজ্ঞাসা করলেন মহাশয়েরা! আমার রাজ্যে বৃষ্টি হচ্ছে না কেন? এখানে আমার অপরাধটা কী? ব্রাহ্মণরা বললেন– মহারাজ! এ রাজ্য আপনার বড় ভাইয়ের প্রাপ্য ছিল। তাঁর রাজ্য আপনি ভোগ করছেন। এ তো অনেকটা বিবাহবিধির মত বড় ভাইয়ের বিয়ে হল না, ছোট ভাই আগেই বিয়ে করে বসল- এ তো সেইরকম– অগ্রজস্য তেহেঁয় অবনিয়া ভুজ্যতে, পরিবেত্তা ত্বম্।

 ব্রাহ্মণদের এই বাক্য থেকে বোঝা যায়- দেবাপির চর্মদোষ যাই থাক, তা অন্তত কুষ্ঠরোগ ছিল না। রাজার কাছে পৃথিবীও অনেকটা ভোগ্যা স্ত্রীর মতো। বড় ভাইয়ের বিয়ে হওয়ার আগেই কনিষ্ঠের বিয়ে হলে একটা বড় অন্যায় হয় বলে ধর্মশাস্ত্রকারেরা বলেছেন। যে ক্ষেত্রে কনষ্ঠের এই দোষ হয় না, তা হল- বড় ভাই যদি জন্মান্ধ বধির বা মূক হন জাতান্ধে বধিরে মূকে ন দোষঃ পরিবেদনে। শামুজ্যেষ্ঠ দেবাপি অন্ধ, বধির কিংবা মূক নন। অথচ তিনি রাজ্য পাননি। আরও আশ্চর্য, চর্মদোষের জন্য জর আসন্ন অভিষেক নিবারিত হয়েছে ব্রাহ্মণদের দ্বারাই, এখন সেই ব্রাহ্মণরই আবার বলছেন–এটা তোমার অন্যায়। বড় ভাইয়ের রাজা তুমি ভোগ করছ।

 বিষ্ণুপুরাণের কাহিনী থেকে ধারণা হয়–দেবাপির আসন্ন অভিষেক নিবারণ করার ব্যাপারে শান্তনুর কোনও হাত ছিল না তো? পূর্বতন ব্রাহ্মণদের তিনিই উত্তেজিত করেননি তো? এখন শান্তনু বিপদে পড়েছেন, এখন রাজসভার মন্ত্রণালয়ে দেবাপির পক্ষপাতী ব্রাহ্মণ মন্ত্রীরাও মুখ খুলেছেন। শান্তনু জিজ্ঞাসা করলেন– তাহলে এখন কী করা যায়? আমার কর্তব্য কী? ব্রাহ্মণরা বললেন- যতক্ষণ না দেবাপির পাতিত্য-দোষ ঘটছে, ততক্ষণ এ রাজ্য তার। অতএব আপনি আপনার রাজাধিকার ত্যাগ করুন। দেবাপিকে বন থেকে ডেকে এনে এই রাজ্য তাকেই দিয়ে দিন- ত অলমেতেন। তস্য অর্হং রাজ্যং… তস্মৈ দীয়তা।

পাতিত্য-দোষ মানে পতিত হওয়া। সে যেমন অন্ধ, বধিরতা বা মূকতার জন্যও একজন রাজার পাতিত্য ঘটতে পারে, তেমনই তিনি যদি ব্রাহ্মণ সমাজের সদাচার ছেড়ে বেদবিরুদ্ধ মত পোষণ করেন, তবে সে রাজা অবশ্যই পতিত হবেন। বিষ্ণুপুরাণে দেখা যাচ্ছে-মন্ত্রিসভার আলোচনা শ্রবণমাত্রেই রাজার প্রধানমন্ত্রী-অসারী তার নাম। তিনি কত বেদচার-সদাচার বিরোধী মানুষকে দেবাপির কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তাদের কাজ হল–বেদোক্ত যজ্ঞ-দান, ত্যাগ-বৈরাগ্যের বিরুদ্ধ কথা বলে দেবাপিকে প্রায় নাস্তিকের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া মন্ত্রিপ্রবরেণ অশ্মসারিণা তারণ্যে তপস্বিনে বেদবাদবিরোধ-বক্তারঃ প্রযোজিতাঃ। এই লোকগুলি নাকি সরলমতি দেবাপিকে নানাভাবে বুঝিয়ে বেদবিরোধী করে তুলল।

এদিকে মহারাজ শান্তনু ব্রাহ্মণদের তিরস্কারে দুঃখিত হয়ে সেই ব্রাহ্মণদের নিয়েই বনের পথে চললেন দেবাপির কাছে। জ্যেষ্ঠ দেবাপিকে তিনি পৈতৃক রাজ্য গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানাবেন। দেবাপির কাছে পৌঁছে ব্রাহ্মণেরা তাকে অগ্রজের অধিকার স্বীকার করতে বললেন। উত্তরে দেবাপি নাকি বেদাচারবিরুদ্ধ নানা কথায় উত্তেজিত করে তুললেন সমাগত ব্রাহ্মণ মন্ত্রীদের। ব্রাহ্মণেরা তখন শান্তনুকেই বললেন– অনেক হয়েছে, মহারাজ! একে আর বেশি কিছু বলে লাভ নেই- আগচ্ছ ভো রাজ! অলমত্রাতিনির্বন্ধন। এ লোকটা একেবারে পতিত হয়ে গেছে। শান্তনু রাজ্যে ফিরে এলেন এবং তার পূর্বোক্ত দোষমুক্তি ঘটায় রাজ্যে সুবৃষ্টি হল।

বিষ্ণুপুরাণে দেবাপির বিরুদ্ধে যেভাবে ষড়যন্ত্র ঘটিয়ে তাঁর পাতিত্য-দোষ ঘটানো হল– এর মধ্যে আর কিছু না হোক মহারাজ শান্তনুর কিছু দায় থেকে যায়। যে মানুষটি হস্তস্পৃষ্ট রাজমুকুট মাটিতে নামিয়ে রেখে তপস্যা করতে বনে চলে গেলেন, তিনি দু-পাটি বদ লোকের বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে বৈদিক বিধি লঙ্ঘন করবেন এ ঘটনা তত আদরণীয় নয়। বিষ্ণুপুরাণের ঘটনায় শুধু এইটুকু বলা যেতে পারে যে, জ্যেষ্ঠকে রাজ্য থেকে বিতাড়নের ব্যাপারে শান্তনুর কিছু হাত থাকতে পারে। উপরন্তু মেজভাই বাহ্লীকই বা কেন মাতুল রাজ্যে চলে যাবেন, দেবাপির পরে তারই তো রাজা হওয়ার কথা। আর তিনি কোনও এলেবেলে লোক ছিলেন না। ধৃতরাষ্ট্রের নিজের ভাষায়–বাপ-ভাই ছেড়ে তিনি মাতুল রাজ্যে চলে গেলেও রাজ্যশাসনে তিনি পরম ঋদ্ধি অর্জন করেছিলেন।

বৃহদ্দেবতা বা নিরুক্তের মতো প্রাচীন বৈদিক গ্রন্থে কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম। এখানকার বক্তব্য শুনলে মনে হয় দেবাপির মুনিবৃত্তি, ত্যাগ-বৈরাগ্যে শান্তনু খানিকটা অনুতপ্ত হয়েই তাকে বন থেকে ফিরিয়ে আনতে যান। অনাবৃষ্টির অজুহাতটা অবশ্যই ছিল। দেবাপিকে বন থেকে নিয়ে এসে শান্তনু তাকে অনেক মান্যি করে নিজের রাজ্যটাই তাকে সমর্পণ করেন। দেবাপি অবশ্যই রাজ্য গ্রহণ করেননি, শুধু তিনি কনিষ্ঠ ভ্রাতার পৌরোহিত্য স্বীকার করেন। সবচেয়ে বড় ঘটনা- ঋগবেদের দশম মণ্ডলের একখানি সূক্ত (১০,৯৮) এই দেবাপির রচনা। খোদ ঋগবেদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি– শান্তনুর পুরোহিত দেবাপি হোম করার জন্য উদ্যোগী হয়ে বৃষ্টি-উৎপাদনকারী দেবস্তব রচনা করেছিলেন ধ্যানের দ্বারা- যদ্ দেবাপিঃ শক্তনবে পুরোহিতো হোত্রায় বৃতঃ কৃপয়দীধেৎ।… বৃষ্টিনিং রবাণঃ…। লক্ষণীয় ঋগবেদের দশম মণ্ডলের সম্পূর্ণ একখানি সূক্তই দেবাপির রচনা (ঋগবেদ ১০.৯৮)। এমন একটি মানুষ বিষ্ণুপুরাণে বেদ-বিরুদ্ধ কথা বলছেন– অবিশ্বাস্য। কবিস্বভাব এই মানুষটিকে প্রজাদের অতি প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও শুধু এক চর্মরোগের জন্য রাজ্য হারাতে হয়েছিল- প্রিয়ঃ প্ৰজানামপি স তৃগদোষেণ প্ৰদূষিতঃ- এবং সেটা হয়তো অন্যায়ভাবেই। এমনকি শান্তনুর সামান্য ষড়যন্ত্রেও সেটা ঘটে থাকতে পারে। অন্তত বিষ্ণুপুরাণ দেখলে তাই মনে হয়।

যাই হোক, মহাভারতে দেখতে পাচ্ছি, দেবাপি রাজ্য ছেড়ে চলে গেলে মেজ ভাই বাহ্লীকও পিতার রাজ্য স্বীকার করলেন না। সেটা অবশ্য বড় দাদার প্রতি কোনও সমব্যথায় নয়। তিনি তার মামার রাজ্য পেয়েছিলেন কোনও কারণে-বাহ্রীকো মাতুলকুলং ত্যক্তা রাজ্যং সমাশিতঃ। বাপ-ভাইদের ছেড়ে গেলেও তার অবশ্য সমৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। কনিষ্ঠ শান্তনুকে তিনি স্বেচ্ছায় রাজত্ব ছেড়ে দিয়েছেন এবং সমস্ত সময়েই ভাইয়ের রাজ্যের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। পিতা প্রতীপ স্বর্গত হলে মেজ দাদা বাহ্লীকের অনুমতি নিয়ে শান্তনু রাজা হয়ে বসলেন হস্তিনাপুরে বাহীকেন নুজ্ঞাতঃ শান্তনু লোকবিশ্রুতঃ।

শান্তনুর সম্বন্ধে তাঁরই সময়ে একটি প্রবাদ তৈরি হয়েছিল, যে প্রবাদ লোক-পরম্পরায় বাহিত হয়ে পৌরাণিক কালে একটি শ্লোকে পরিণত হয়েছিল। সেই প্রবাদের ভাষায়– শান্তনু যদি তার দুই হাত দিয়ে একটি বৃদ্ধ লোককেও স্পর্শ করতেন, তবে তার বৃদ্ধজনোচিত জরাজীর্ণ ভাবটি মুহূর্তের মধ্যে চলে যেত। তিনি যুবক হয়ে যেতেন এবং এই যৌবনের নবায়ন তার হস্তস্পর্শেই সংঘটিত হত বলে লোকে তাকে শান্তনু বলে ডাকত– পুনর্যবা চ ভবতি তস্মাত্তং শান্তনুং বিদুঃ। আসল কথা শাক্তনু বোধহয় একটি বুড়ো মানুষের মধ্যেও সেই উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারতেন যাতে করে একটি বৃদ্ধও যুবক-জনের মতো ব্যবহার করতেন।

.

৫২.

মহারাজ ভরতের বংশে, অথবা আরও আগে থেকে যদি বলি, তবে বলতে হবে মহারাজ যযাতির বংশে কনিষ্ঠের রাজ্য-প্রাপ্তি কিছু অসম্ভব ব্যাপার নয়। অপিচ রাজা হিসেবে শান্তনু যোগ্যতম ব্যক্তি ছিলেন। মহারাজ প্রতীপ শম-দম সাধন করে শান্তনুকে পুত্র হিসেবে লাভ করেছিলেন বলেই যেমন তার নাম শান্তনু-শান্তস্য জজ্ঞে সন্তানস্তস্মাদাসীৎ স শান্তনুঃ তেমনই বৃদ্ধ মানুষও যার স্পর্শে যুবকের উদ্দীপনা লাভ করতেন, সে শান্তনু রাজা হিসেবে যে যথেষ্ট সফল ছিলেন, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

 জ্যেষ্ঠ দেবাপি বা মধ্যম বাহ্রীক রাজ্য না পাওয়ায় মহারাজ প্রতীপের অন্তরে যদি বা কোন দুঃখ থেকেও থাকে, মহাভারতের কবি সে কথা স্বকণ্ঠে উচ্চারণ করেননি। কিন্তু অজ্ঞাতকুলশীলা সেই রমণীকে প্রতীপ যে কথা দিয়েছিলেন, সে কথা আদেশের অক্ষরে লেখা ছিল শান্তনুর মনে। শান্তনুর মনে ছিল–পিতাঠাকুর তাকে বলেছিলেন–পরমা সুন্দরী এক রমণী তোমার কাছে বিবাহের যাচনা নিয়ে আসবে। তুমি তার পরিচয় জিজ্ঞাসা কোরো না, এমনকি সে যা করতে চায় তাতে বাধাও দিও না। আমার আদেশে তুমি সেই অনুরক্তা রমণীর ইচ্ছা পূরণ কোরোমন্নিযোগা ভজন্তীং তাং ভজেথা ইত্যুবাচ তম্।

 আমাদের ধারণা, শান্তনু তখনও রাজা হননি অথবা হলেও সদ্যই রাজা হয়েছেন। শান্তনুর মৃগয়ার অভ্যাস ছিল ভালরকম। রাজ্যপ্রাপ্তিতে যদি কোনও শান্তি এসে থাকে মনে, তবে সেই শাস্তি উপভোগ করার জন্যই হয়তো তিনি মৃগয়ায় বেরলেন। মৃগয়া চলতে থাকল রাজার ইচ্ছামত। তারপর একদিন গঙ্গার তীর বেয়ে একাকী যেতে যেতে সেই অপূর্বদর্শন রমণীর সঙ্গে শান্তনুর দেখা হল। তার রূপে গঙ্গার তীর আলো হয়ে উঠেছে–জাজ্বল্যমানাং বপুষ। গা-ভর্তি গহনা, পরিধানের বস্ত্র কিছু সূক্ষ্ম, গায়ের রঙ পদ্মকোষের মতো গৌর।

শান্তনুর শরীর রোমাঞ্চিত হল। ভাবলেন বোধহয়– এমন রূপসীর জন্য পিতাঠাকুরের আদেশের প্রয়োজন ছিল না। আমাদের ধারণা–এমন কোনও আদেশ হয়তো ছিলও না। এক অপরিচিতা রমণীকে গঙ্গার মাহাত্মে গৌরবান্বিত করার জন্যই হয়তো ওই আদেশ এবং বসুদেবতার উপাখ্যান। রূপে মুগ্ধ হয়ে রমণীর দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিলেন শান্তনু, যাতে। বলা যায়, তিনি চোখ দিয়ে পান করছিলেন রমণীর প্রত্যঙ্গ-রূপ-রাশি–পিবন্নিব চ নেত্রাভ্যাং নাতৃপ্যত নরাধিপঃ। অন্যদিকে লক্ষণীয়, সেই রমণীও কিছু কম মুগ্ধ ছিলেন না শান্তনুর রূপে। রাজাকে দেখে তারও অনুরাগ এতটাই উদ্বেল যে, বিলাসিনী রমণীর সপ্রণয় দৃষ্টিতে তিনিও হাঁ করে তাকিয়ে ছিলেন রাজার দিকে। শান্তনু আর দেরি না করে বললেন–তুমি দেবী না, দানবী? গন্ধর্বী না অপ্সরা? তুমি যে হও সে হও, তোমাকে আমি স্ত্রী হিসেবে চাই–যাচে ত্বং সুরগর্ভাভে ভার‍্যা মে ভব শোভনে।

 রমণী এক কথায় রাজি হলেন। কিন্তু একটা শর্তও দিলেন। রমণী বললেন–আমি তোমার বশবর্তিনী স্ত্রী হতেই পারি। কিন্তু মহারাজ আমি যা কিছুই করব তুমি বাধা দেবে না, কিংবা আমাকে কোনও কটু কথাও বলবে না। আমাকে বাধা দিলে বা কটু কথা বললে আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাব-বারিতা বিপ্রিয়ঞ্চোক্তা ত্যজেয়ং ত্বমসংশয়। শান্তনুও সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন।

তৎকালীন দিনের সামাজিক অবস্থার নিরিখে এক রমণীর মুখে এ হেন শর্তের কথা শুনেই বোঝা যায়–রমণীই চালিকার আসনে বসেছিলেন, মহারাজ শান্তনু এই রূপসী জাদুকরীর হাতে পুত্তলিকামাত্র। রমণী নিজের পরিচয় দিলেন না, শান্তনুও সে পরিচয় জিজ্ঞাসা করেননি, তার পিতাঠাকুরও তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে বারণ করেছেন। আমাদের ধারণা হয়–পরিচয় দেবার মতো কোনও পরিচয় হয়তো তাঁর ছিলও না। আর রমণীর ভাব-ভঙ্গি দেখুন-রমণীকে দেখে শান্তনু তো মুগ্ধ হয়েইছিলেন কিন্তু শান্তনুকে দেখে রমণী যে ব্যবহার করেছিলেন, তা। মহাভারতের কবির ভাষায় ‘বিলাসিনী’র মতো। শান্তনুকে দেখে তারও আবেগ ধারণ করার ক্ষমতা ছিল না- নাতৃপ্যত বিলাসিনী।

আরও একটা ঘটনা লক্ষ করার মতো। মহারাজ শান্তনু এই রমণীকে হস্তিনাপুরের রাজধানীতে নিয়ে আসেননি। হস্তিনাপুরের রাজরানী বলে তার বধু-পরিচয় হয়নি একবারও। মহাভারতের কবি এই রমণীর ওপর দেবনদীর মাহাত্ম্য অর্পণ করে তার নাম দিয়েছেন গঙ্গা। কিন্তু ওই যে নীতিশাস্ত্র বলেছে–নদীনাঞ্চ নখিনাঞ্চ-নদী আর নখযুক্ত জন্তুর জন্মমূল খুঁজতে যেও না বাপু, ধন্দে পড়ে যাবে। মহাভারত সসম্মানে জানিয়েছে–স্বর্গের দেবী বা দেবনদী হওয়া সত্ত্বেও গঙ্গা শান্তনুর সঙ্গে কামব্যবহার করতেন শান্তনুর সৌভাগ্যে; কিন্তু তার পরের পংক্তিতেই বলা হয়েছে–শান্তনু যাতে গঙ্গার সঙ্গে রমণ-সুখ অনুভব করেন, তার জন্য গঙ্গার চেষ্টার অন্ত ছিল না। কখনও রমণপূর্বের শৃঙ্গার, কখনও সম্পূর্ণ সম্ভোগ, কখনও একটু নাচ, কখনও বা মনোহর ভাবভঙ্গি-সম্ভোগ-স্নেহ-চাতুর্যৈহাব-লাস্যমনোহরৈঃ–যখন যেটি প্রয়োজন, সেইরকম রমণ-নৈপুণ্য ব্যবহার করেই রাজাকে সন্তুষ্ট করতে লাগলেন গঙ্গা।

আমাদের জিজ্ঞাসা- এই কি দেবী অথবা দেবনদীর মতো ব্যবহার? মহাভারতের কবি উপাখ্যানের বহিরঙ্গে বসুদেবতা এবং গঙ্গার দেবীত্ব প্রকট করে অনেক কথার মাঝে একটি মাত্র কথা বলে বুঝিয়ে দিয়েছেন গঙ্গা ঠিক বিবাহিতা রমণীর মতো শান্তনুর সঙ্গে সম্ভোগ ব্যবহার করছিলেন বটে, তবে বাস্তবে কোনও পরিণীতা পত্নীর গৌরব গঙ্গার ছিল না। ঠিক বিবাহিতা নয়, বিবাহিতা স্ত্রীর মতো–ভাৰ্য্যেবোপস্থিতাবৎ। সামান্য এই মতো’ শব্দটির মধ্যেই গঙ্গার আসল পরিচয়টি লুক্কায়িত আছে বলে মনে করি। শান্তনু তাকে রাজবধুর মর্যাদায় হস্তিনাপুরে নিয়ে আসতে পারেননি, অথবা বলি–নিয়ে আসেননি। ভাবে বুঝি-গঙ্গা, তিনি দেবীরূপিণীই হোন, অথবা বিলাসিনী’–সেই দেবরূপের মধ্যে বিলাসিনী রমণীর আঙ্গিকটাই বড় হয়ে উঠেছে, দেবীর মাহাত্ম্য সেখানে উপাখ্যানমাত্র।

বছর বছর সন্তানের জন্ম দিয়ে তাকে জলে ভাসিয়ে দেবার মধ্যেও উপাখ্যানের আঙ্গিকটাই বড় কথা। বাস্তবে মহাত্মা ভীষ্মদেব যে অজ্ঞাতপরিচয় রমণীর গর্ভে জন্মাবেন, তাকে গৌরব প্রদান করার জন্যই গঙ্গা নাম্নী এক রমণীকে বসুজননী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক মনোরম উপাখ্যানেরও জননী হতে হয়েছে। অথবা এমন হতেও বা পারে যে, সেই রমণী তার প্রথমজাত পুত্রগুলিকে ভাসিয়েই দিয়েছিলেন নদীতে এবং শান্তনুও এই বিলাসিনী’ রমণীর কুরতায় বিপন্ন বোধ করেছিলেন কখনও। অথবা অষ্টম গর্ভের সন্তানের অন্য কোনও মাহাত্ম্য আছে কিনা, তাই বা কে জানে? নইলে অষ্টম গর্ভের কৃষ্ণ এবং অষ্টম গর্ভের দেবব্রত ভীষ্মের জন্মেই বা এত সাদৃশ্য কেন? আর কী আশ্চর্য, অষ্টম গর্ভে জন্মে যারা পরবর্তীকালে বিখ্যাত হবেন, তাদের পূর্বজন্মাদের মৃত্যু সব সময়েই কুরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। যেমন কৃষ্ণের অগ্রজম্ম অন্য পুত্রেরা কংসের হাতে আছাড় খেয়ে মরেছেন আর ভীষ্মের পূর্বজরা মায়ের ক্রুরতায় নদীর জলে শাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এ

তবে সমস্ত এই অনুমানের ওপরেও আমাদের তর্কে এই রমণীর চেয়েও বড় ঘটনা হল ভীষ্মের জন্ম। ভীষ্ম জন্মাবেন বলেই তাঁর মাতৃদেবী গঙ্গার মাহাত্ম্য ভূষিত। ভীষ্ম জন্মাবেন বলেই অষ্টবসুর মর্ত্যে অবতরণের উপাখ্যান। যাই হোক, মহাভারতের কথামতো সাতটি সন্তানকে পরপর জলে ডুবিয়ে দেবার পর শান্তনুর ধৈর্য অতিক্রান্ত হল। তারপর অষ্টবসুর তেজে সমৃদ্ধ হয়ে গঙ্গার অষ্টম গর্ভের যে পুত্রটি জন্মান, গঙ্গা তাকে দেখে হেসে উঠলেন–অথ তামষ্টমে জাতে পুত্রে প্রহসতীমিব। মহারাজ শান্তনু প্রমাদ গণলেন–এই কি সেই ক্রুর হাসিটি যা অষ্টম বার তাকে পুত্ৰশোক দেবে। শান্তনু চেঁচিয়ে উঠলেন–আর নয়। কী রকম মেয়ে তুমি? কে তুমি? কার মেয়ে? কেনই বা এমন করে পুত্রহত্যা করছ-মা বধীঃ কাসি ক্যাসি কিঞ্চ হংসি সুতানিতি? স্বামীর মতো ব্যক্তিটিকে বেশি করে পাবার জন্যই কি গঙ্গার এই পুত্রহত্যা?

রমণী সহাস্যে বললেন–আর তোমার পুত্রবধ করব না। কিন্তু আজই তোমার সঙ্গে আমার শেষ প্রহরের বসবাস সমাপ্ত হন। তোমার সঙ্গে কথা ছিল–তুমি আমার কোনও কাজে বাধা দেবে না–জীর্ণোস্তু মম বাসোয়ং যথা স সময়ঃ কৃতঃ। গঙ্গা এবার আপন পরিচয় দিলেন শান্তনুর কাছে এবং তিনি যে দেবকার্য সিদ্ধ করার জন্যই শান্তনুর স্ত্রীত্ব বরণ করেছিলেন, সে কথাও জানালেন। কথায় কথায় বসুগণের প্রতি বশিষ্ঠের অভিশাপ সুব্যক্ত হল শান্তনুর কাছে। যথার্থ হয়ে উঠল গঙ্গার পুত্রবধের কাহিনী।

আধুনিক গবেষকরা অবশ্য গঙ্গাকে সুরনদী গঙ্গা বলে মানেন না। তাঁরা বলেন–শান্তনুর সঙ্গে গঙ্গার প্রণয়-সম্পর্কের মতো ঘটনাগুলি মূলত সাময়িক প্রেমের উদাহরণ–Other in stances of Gandharva marriage, such as Ganga and Santanu… also present the free love union of some nymphs and dolphins, very probably women from some non-Aryan tribes.

মনুষ্যরূপিণী দেবনদীকে এক অনার্যজাতীয়া রমণী বলব কিনা সে সম্বন্ধে তর্কযুক্তির অবকাশ আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু এও তো ঘটনা যে, শান্তনু তাকে রাজধানীতে নিয়ে যেতে পারেননি। কোন ধরনের রমণীর পক্ষেই বা এক রাজপুরুষকে রাজধানীর বাইরে শুধু কামব্যবহারেই সন্তুষ্ট রাখা সম্ভব। এমনই সেই সন্তুষ্টির প্রক্রিয়া, যাতে শান্তনুর পক্ষে অন্যত্র মন দেওয়া সম্ভব ছিল না–রাজানাং রময়ামাস যথা রেমে তয়ৈব সঃ। সবচেয়ে বড় কথা হল–শান্তনুর আগ্রহে যে পুত্রটিকে গঙ্গা বাঁচিয়ে রাখলেন, সেই পুত্রটিকে রাজা রাজধানীতে নিয়ে যেতে পারলেন না সঙ্গে সঙ্গে। গঙ্গা সেই পুত্রকে নিজের সঙ্গে নিয়ে গেলেন–রাজার গৌরহানি না করে–আদায় চ কুমারং তং জগামাথ যথেতি।

মহাভারতের অনুবাদক পণ্ডিতেরা গঙ্গার মাহাত্ম রক্ষা করে এখানে অনুবাদ করেছেন, ‘বালকটিকে লইয়া সেইখানেই অন্তর্হিত হইলেন’। কিন্তু সংস্কৃত ‘জগাম’ ক্রিয়ার অর্থ সোজাসুজি ‘চলে গেলেন’ বলাটাই যথার্থ। আরও একটা কথা–চলে যাবার আগে গঙ্গা বলেছিলেন-এই যে তোমার ছেলেটি, সে বড় হলে তোমার কাছে আবার ফিরে আসবে– বিবৃদ্ধঃ পুনরেষ্যতি–আর তুমি ডাকলে আমিও তোমার কাছে আসব–অহষ্ণ তে ভবিষ্যামি আহ্বানোপগতা নৃপ। এই পরিষ্কার লৌকিক প্রতিজ্ঞার মধ্যে বালকটিকে লইয়া অলৌকিক অন্তর্ধানের কথাও আসে না, পুনরায় আবির্ভাবের কথাও আসে না। যে ছেলের মা স্বয়ং হস্তিনাপুরের রাজধানীতে প্রবেশ করতে পারেননি, তার শিশুপুত্রকে নিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করলে শান্তনুর যে স্বস্তি বিঘ্নিত হবে, সে কথা এই বিচক্ষণা রমণী বুঝেছেন। আর ‘বিবৃদ্ধঃ পুনরেষ্যতি’ কথাটার মানে সিদ্ধান্তবাগীশ যে কী করে আপনার পুত্র এই বালক অত্যন্ত বৃদ্ধ হইয়া পুনরায় স্বর্গে যাইবেন–এইরকম করলেন তা আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে কুলোয় না। কেননা ‘পুনরায়’ শব্দটাই এখানে ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি না বলি–তোমার এই পুত্র বড় হয়ে আবার তোমার কাছে ফিরে আসবে–পুনরেষাতি।

মনে রাখবেন–ভবিষ্যতে ভীমপত্নী হিড়িম্বা, অর্জুনপত্নী উলুপী–এঁরাও ওই একই কথা বলবেন–তুমি ডাকলেই আসব। গঙ্গাও তাই বলেছেন–তুমি ডাকলেই তোমার কাছে ফিরে আসব–আহ্বানোপগত নৃপ। হিড়িম্বা-উলুপীদের পুত্রেরাও রাজধানীতে আসেননি, তারা মায়ের কাছেই ছিলেন। গঙ্গাকে যদি হিড়িম্বা, উলুপী অথবা চিত্রাঙ্গদার থেকে বেশি মাহাত্ম্য না দিই, তাহলেই কিন্তু মহাকাব্যের কবির আশয় আরও বেশি যুক্তিগ্রাহ্য হয়। আমাদের কাছে অলৌকিক চমকৃতির চেয়েও বাস্তবের যুক্তিগ্রাহ্যতা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গঙ্গা আপন পুত্রকে নিয়ে নিজের জায়গায় চলে গেলেন আর মহারাজ শান্তনু গঙ্গা এবং নিজপুত্রের বিচ্ছেদ-যন্ত্রণা হৃদয়ে বহন করে হস্তিনাপুরের রাজধানীতে ফিরে এলেন–শান্তনুশ্চাপি শোকার্তো জগাম স্বপুরং ততঃ।

দেখা যাচ্ছে, মহাভারতের কবি এক প্রণয়িনী রমণীর সঙ্গে শান্তনুর মিলন ঘটিয়ে, তারপর শান্তনুকে রাজধানীতে ফিরিয়ে এনেছেন। কিন্তু শান্তনুর অসাধারণ রাজগুণের বর্ণনা আরম্ভ হয়েছে তারও পরে। ফলত মহাভারতের গবেষকরা বলবেন–বসুগণের কাহিনী পরবর্তী সংযোজন। শান্তনুর কাহিনীর আরম্ভ এইখান থেকেই। আমরা বলি–অভিশপ্ত বসুগণের কাহিনী না হয় উড়িয়েই দিলেন, কিন্তু ওই লাস্যময়ী নদীর মতো বিলাসিনী রমণী আর তার গর্ভজাত পুত্রটিকে তো আর উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। বরঞ্চ বলা ভাল এই ঘটনা ঘটার পরে শান্তনুর রাজগুণ বর্ণিত হওয়ায় আমাদের কেবলই মনে হয়–শান্তনু রাজা হবার আগেই গঙ্গার সঙ্গে তার প্রণয়মিলন সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। দেবব্রতর জন্মও হয়ে গিয়েছিল আগেই। রাজা হবার পরে হয়তো তিনি সগৌরবে তার প্রথমজাত গূঢ় পুত্রটিকে হস্তিনাপুরে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন।

শান্তনুর রাজগুণের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাতে বোঝা যায় একজন আদর্শ রাজার যে যে গুণ থাকলে রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ঘটে, সে সবই তার মধ্যে ছিল। ধর্মনীতি এবং অর্থনীতির সম্যক বোধের সঙ্গে বুদ্ধি এবং বিনীত আচরণ একত্র যুক্ত হওয়ায় সামন্ত রাজারা আপনিই তার বশ্যতা স্বীকার করে শান্তনুকেই তাদের নেতা হিসেবে মনোনীত করেছিলেন–তং মহীপা মহীপালং রাজরাজ্যে’ভ্যষেচয়। শান্তনু সেইভাবেই রাজ্য পরিচালনা করছিলেন, যাতে তার রাজ্যে অন্যায়-অবিচার কিছু না ঘটে। বর্ণধর্ম এবং আশ্রমধর্ম তৎকালীন সামাজিক নীতি অনুসারেই পালিত হচ্ছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র–সকলেই আপন বৃত্তিতে প্রতিষ্ঠিত থাকার ফলে শান্তনুর অশান্তির কোনও কারণ ছিল না এবং তার রাজ্য চলছিল তৎকালীন সমাজমুখ্য ব্রাহ্মণদের নীতি এবং আইন মেনেই–ব্রহ্মধর্মোত্তরে রাজ্যে শান্তনুনিয়াত্মবান্।

রাজ্য যখন ভালই চলছে, তখন রাজার মনে কিছু চপলতা ঘটেই। পথের নেশা, দূরের নেশা তাকে পেয়ে বসে। আর আগেই বলেছি–মৃগয়ার ব্যাপারে শান্তনুর কিছু দুর্বলতা ছিলই। শান্তনু একা বেরিয়ে পড়লেন মৃগয়ায়। একটি মৃগকে বাণবিদ্ধ করার পর সেই মৃগকে অনুসরণ করতে করতে তিনি গঙ্গার তীরে এসে উপস্থিত হলেন। মহাভারতের কবি শান্তনুকে যতই মৃগয়ার ছলে গঙ্গার তীরভূমিতে নিয়ে আসুন, আমরা মনে মনে জানি–শান্তনু ফিরে এসেছিলেন সেই রমণীর খোঁজে, যাকে তিনি বেশ কয়েক বছর আগে বিদায় দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। যদি তার সঙ্গে একবার দেখা হয়। আর সেই স্বাঙ্গজাত পুত্রটি–সে এখন কত বড় হয়েছে? শান্তনুর মনে এইসব জল্পনা নিশ্চয়ই ছিল। মৃগয়া অথবা এই শব্দের আক্ষরিক অর্থে যদি অন্বেষণ বুঝি তবে যে হরিণীটিকে তিনি অনেককাল আগে প্রেমবাণে বিদ্ধ করে ফিরে গিয়েছিলেন, তারই অনুসরণক্রমে তিনি উপস্থিত হলেন গঙ্গার তীরভূমিতে।

 শান্তনু দেখলেন–গঙ্গার জল অল্প। কী ব্যাপার, এমন তো হবার কথা নয়। নদীশ্রেষ্ঠা গঙ্গার জলপ্রবাহ শীর্ণ হল কী করে, এমন তো আগে ছিল না–স্যন্দতে কিং ত্বিয়ং নাদ্য সরিচ্ছ্রেষ্ঠা যথা পুরা? কারণ অনুসন্ধান করার জন্য শান্তনু গঙ্গার তীর ধরে এগোতে লাগলেন। খানিক দূর গিয়েই তিনি দেখলেন–অপূর্বদর্শন এক কৈশোরগন্ধী বালক। অতি দীর্ঘ তার শরীর। মহাবলবান, মহাতেজস্বী। শান্তনু দেখলেন–বালক একটার পর একটা বাণ ছুঁড়ে গঙ্গার স্রোত যেন আটকে রেখে দিয়েছে–কৃৎস্রাং গঙ্গাং সমাবৃত্য শরৈস্তীরৈবস্থিত। গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে প্রবাহিনী গঙ্গার এই রুদ্ধগতি শরাচ্ছন্ন অবস্থা দেখে মহারাজ শান্তনু একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। বালককে তিনি চিনতে পারলেন না, কিন্তু বালকের অলৌকিক অস্ত্রবীর্য লক্ষ্য করে তিনি অভিভূত হলেন। আশ্চর্য ঘটনা হল, বালকটি কিন্তু মহারাজ শান্তনুকে দেখে বেশ খুশি হল এবং তাকে বেশ কাছের লোক বলেই মনে করল।

 বালক বেশিক্ষণ দাঁড়াল না। শান্তনুকে দেখে তার ভাল লেগেছে এবং তাকে দেখে কী যেন ভাবল আচম্বিতে এবং মুহূর্তের মধ্যে সেখান থেকে উধাও হয়ে গেল। শান্তনুর বোধহয় মনে পড়ল–সেই শিশু পুত্রটির কথা। যাকে তিনি কোনও কালে মায়ের সঙ্গে চলে যেতে দেখেছেন। এই কিশোরমুখ বলবান বালকটিকে দেখে তার বুঝি সেই শিশু পুত্রটির কথা মনে পড়ল। শান্তনু গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে তার পুরাতনী প্রণয়িনীকে একবার ডাকলেন–গঙ্গা! গঙ্গা! আমার সেই ছেলেটিকে একবার দেখাবে?

শান্তনুর ডাকার দরকার ছিল না। শান্তনু সবিস্ময়ে দেখলেন–শ্বেতশুভ্র বসন পরা সালংকারা এক রমণী ডান হাতে সেই বালকটিকে ধরে শান্তনুর সামনে উপস্থিত হয়েছেন। শান্তনু একটু আগেই এই বালকটিকে বাণ ছুঁড়ে নদীর স্রোতধারা রুদ্ধ করতে দেখেছেন। আমাদের ধারণা–শান্তনুকে দেখামাত্রই বালকটি তার মাকে ডাকতে গেছে। মায়ের কাছে রাজার বর্ণনা সে বহুবার শুনেছে হয়তো। ফলে রাজাকে পিতা বলে চিনতে বালকের একটুও অসুবিধে হয়নি। বস্তুত শান্তনুকে পিতা বলে চিনতে পেরেই মুগ্ধ-নয়নে তার দিকে তাকিয়ে ছিল বালক। আর তারপরেই মোহাবিষ্টের মতো ছুটে গিয়েছিল মায়ের কাছে–সংমোহ্য তু ততঃ ক্ষিপ্রং তত্রৈবান্তরধীয়ত। যার জন্য শান্তনু ‘গঙ্গা’ বলে ডাকার পর একটুও তাকে অপেক্ষা করতে হয়নি। গঙ্গা সপুত্ৰক এসে দাঁড়িয়েছেন রাজার কাছে। শান্তনু এতদিন পরে গঙ্গাকে দেখে ঠিকমত চিনতেও পারেননি ভাল করে–দৃষ্টপূর্বামপি স তাং নাভ্যজানত শান্তনুঃ। এই কথা থেকেই বুঝি গঙ্গা কোন অলৌকিকী দেবী নন। তার চেহারার পরিবর্তন হয়েছে বলেই শান্তনু তাকে চিনতে পারেননি। গঙ্গা বললেন-মহারাজ! এই তোমার সেই পুত্র, আমার অষ্টম গর্ভে যার জন্ম হয়েছিল।

শান্তনু অপলক-নয়নে চেয়ে রইলেন দীর্ঘদেহী পুত্রের দিকে। গঙ্গা বললেন–তোমার এই পুত্র এখন সমস্ত অস্ত্রবীরদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আমি একে মানুষ করেছি, বড় করেছি। এখন তুমি একে নিজের ঘরে নিয়ে যাও-গৃহাশেমং মহারাজ ময়া সংবর্ধিত সুত। এখানে। এই ‘বড় করেছি–সংবর্ধিতং’ শব্দটির থেকেই গঙ্গার মুখে পূর্বে বলা বিবৃদ্ধঃ পুনরেষ্যতি’ বড় হয়ে আবার তোমার কাছে ফিরে আসবে’–এই কথাগুলি যথার্থ হয়ে যায়। পুরাকালে আশ্রমবাসিনী শকুন্তলা যেমন ভরতকে দুষ্যন্তের কাছে নিয়ে এসে বলেছিলেন–তোমার সন্তান আমি মানুষ করেছি, এখন তুমি একে গ্রহণ করো। এখানে গঙ্গার মুখেও সেই একই কথা। উচ্চারিত হল। গঙ্গা এবার মায়ের ঘরে মানুষ হওয়া পুত্রের শিক্ষা-দীক্ষার খবর জানাচ্ছেন স্বামীকে।

গঙ্গা বললেন–একটু বড় হতেই আমি তোমার পুত্রকে মহর্ষি বশিষ্ঠের কাছে শিক্ষা নিতে পাঠিয়েছি। সেখানে বেদ-বেদাঙ্গ সবই অধ্যয়ন করেছে সে। আর অস্ত্রশিক্ষার কথা যদি বল, তবে বলতে হবে যুদ্ধে তোমার এই পুত্র এখন দেবরাজ ইন্দ্রের সমকক্ষ–দেবরাজসমো যুধি। গঙ্গা অবশ্য জানেন–ক্ষত্রিয়ের ছেলেকে শুধু অস্ত্রবিদ্যা শিখলেই চলে না, তাকে রাজনীতি, অর্থনীতি সব শিখতে হয়। আর রাজনীতি অর্থনীতি মানেই সেকালের দিনে অসুরগুরু শুক্রাচার্যের রচিত পুস্তক অথবা দেবগুরু বৃহস্পতি রচিত শাস্ত্র। যারা রাজনীতির পাঠ নিতেন তারা নিজেদের পছন্দমত এক পক্ষকে মেনে নিতেন, অর্থাৎ কেউ শুক্ৰনীতি অনুসরণ করতেন, কেউ বা বৃহস্পতিনীতি।

গঙ্গা বললেন-তোমার এই পুত্র দেবতা এবং অসুর–সবারই বড় প্রিয়পাত্র। তুমি জেনো-স্বয়ং শুক্রাচার্য রাজনীতির যত বিষয় জানেন, তোমার এই পুত্রও তা জানে–উশনা বেদ যচ্ছাস্ত্রময়ং তদ্বেদ সর্বশঃ। আবার দেবগুরু বৃহস্পতি রাজনীতি এবং অর্থনীতির সম্পর্কে যত বিধান দিয়েছেন, তা সবই এই বালকের অধিগত-কৃৎমস্মিন্ প্রতিষ্ঠিত। সব কথার শেষে গঙ্গা এবার তার পুত্রের অস্ত্রবিশক্ষার বিস্তারিত বিবরণ দিলেন। সেকালের দিনে অস্ত্রশিক্ষার সর্বশ্রেষ্ট গুরু ছিলেন পরশুরাম জামদগ্ন্য। রামায়ণে পরশুরামের ক্ষমতার কথা আমরা শুনেছি এবং পরশুরামের দ্বারা পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করার ঘটনাও আমাদের কানে এসেছে। ইনি সেই মূল পরশুরাম নাও হতে পারেন, কিন্তু অস্ত্রশিক্ষা দানের ক্ষেত্রে পরশুরামের একটি ‘ইনস্টিটিউশন’ নিশ্চয়ই ছিল। সেখানে যিনি অস্ত্রগুরু হতেন তিনিই হয়ত পরশুরামের নামে খ্যাতি করতেন। গঙ্গা সগর্বে জানালেন–মহাবীর পরশুরাম অস্ত্রবিদ্যার যে গুঢ়তত্ত্ব জ্ঞাত আছেন, তোমার এই ছেলেও সে সব বিদ্যা অধিকার করেছে–যদস্ত্রং বেদ রামশ্চ তদপ্যস্মিন প্রতিষ্ঠিত।

গঙ্গা এবার শেষ অনুরোধ করলেন পুরাতন প্রণয়ীর কাছে। বললেন–অস্ত্রবিদ্যা এবং রাজধর্ম সব যাকে সযত্নে শেখানো হয়েছে, তোমার সেই বীর পুত্রকে তুমি এবার গ্রহণ করো আমি তাকে তোমার হাতে সমর্পণ করছি, তুমি তাকে রাজধানীতে নিয়ে যাও-ময়া দত্তং নিজং পুত্রং বীরং বীর গৃহং নয়। গঙ্গা আর উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেলেন। কোন মায়ের না ইচ্ছে থাকে–সর্বগুণসম্পন্ন পুত্র রাজ্য লাভ করে সমৃদ্ধ হোক। গঙ্গাপুত্রকে শান্তনুর হাতে দিয়ে সেই ইচ্ছেই পূরণ করতে চাইলেন।

 মহারাজ শান্তনু উপযুক্ত পুত্রের হাত ধরে রাজধানীতে ফিরে এলেন। রাজধানীর মন্ত্রী-অমাত্যেরা কেউ তাকে কোনও অস্বস্তিকর প্রশ্ন করল না। আমাদের ধারণা–বষ্কাল পূর্বে শান্তনু যখন রাজধানী ত্যাগ করে গিয়ে গঙ্গার সঙ্গে বাস করেছিলেন, সেই সময়ের কথা কারও অবিদিত ছিল না। রাজধানীর সকলেই জানতেন– রাজা কী করছেন অথবা কোথায় আছেন। শান্তনুকে তাই রাজধানীতে এসে কোনও জবাবদিহিও করতে হয়নি।

 শান্তনুর পুত্রের নাম গঙ্গাই রেখেছিলেন দেবব্রত। আদরের ছেলে, পিতার সঙ্গ পায় না। তাই সকলে তাকে গাঙ্গেয় বলেও ডাকে। মায়ের নামেই তার বেশি পরিচয়। পিতা শান্তনু দীর্ঘদর্শন এই পুত্রটিকে রাজ্যপ্রান্ত গঙ্গার তীরভূমির আবাস থেকে রাজভবনে নিয়ে এসে জ্ঞাতিগুষ্টি, মন্ত্রী-অমাত্য–সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পুত্রের প্রতি সমস্ত বাৎসল্য প্রকাশ করে শান্তনু নিজেকে পিতা হিসেবে যেমন সফল মনে করলেন, তেমনই আরও একটি কাজ তিনি করে ফেললেন প্রখর বাস্তববোধে। এতকাল এই পুত্র রাজভবনের বাইরে ছিল, এখন যদি পুরু-ভরতবংশের লতায়-পাতায় জন্মানো জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যে তার রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে? তাই খুব তাড়াতাড়ি পৌরব-বংশে আপন পুত্রের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দেবব্রত গাঙ্গেয়কে তিনি যুবরাজ-পদে মনোনীত করলেন সমস্ত পৌরবদের আহ্বান করে-পৌরবে ততঃ পুত্রং রাজ্যার্থ…অভ্যযযচয়ৎ।

গুণবান পুত্রকে পুরু-ভরতবংশের পরম্পরায় স্থাপন করে শানুর আপন কর্তব্য পালন করার সঙ্গে সঙ্গে গাঙ্গেয় দেবব্রতও তার যুবরাজ-পদের সার্থকতা প্রমাণ করলেন আপন গুণে। তার অপূর্ব ব্যবহারে পিতা শান্তনু যেমন নন্দিত হলেন, তেমনই কিছুদিনের মধ্যে দেবব্রতর গুণে রাজ্যের প্রবাসী জনপদবাসীরা তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠল-রাষ্ট্রঞ্চ রঞ্জয়ামাস বৃত্তেন ভরতষভ। তখনও শান্তনুর কোনও পত্নী রাজরানী হয়ে সিংহাসনে তার পাশে বসেননি, কিন্তু অসাধারণ মেধাবী পুত্রকে নিয়েই শান্তনুর দিন কাটতে লাগল। অল্পদিন নয়, চার-চারটি বছর এইভাবে কেটে গেল–বর্তয়ামাস বর্ষাণি চত্বৰ্য্যমিতবিক্রমঃ।

.

৫৩.

এর আগে আমরা মহারাজ সংবরণের পুত্র কুরুর নাম করেছি। সেই কুরুরাজ, যার নামে মহাভারতের কুরুক্ষেত্র এবং কুরুজ্জাঙ্গল প্রদেশ। মহারাজ কুরুর চারটি পুত্র সুধম্বা, জহু, পরীক্ষিত এবং অরিমেজয়। এঁদের মধ্যে পরীক্ষিত, যাকে আমরা প্রথম পরীক্ষিত বলতে চাই, তিনিই হস্তিনাপুরে কুরুবংশের প্রধান রাজ-পরম্পরা রক্ষা করছিলেন। দেখা যাচ্ছে, এখানে জ্যেষ্ঠ পুত্র হওয়া সত্ত্বেও কুরুপুত্র সুধম্বা পিতৃরাজ্য পাননি। পেয়েছেন তৃতীয় পুত্র পরীক্ষিত। এটা অবশ্য খুব স্বাভাবিক যে, ক্ষত্রিয়ের রাজবংশে জন্মে জ্যেষ্ঠ সুধবা কনিষ্ঠের রাজ্যে বসে নিজের অঙ্গুলি-চোষণ করছিলেন না। তিনি তার ভাগ্য অন্বেষণ করতে বেরিয়েছিলেন অন্যত্র। এমন হতেই পারে যে, তিনি যুদ্ধ জয় করে কোন রাজ্য অধিকার করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। হতে পারে–তার পুত্র এবং পৌত্রও এই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন এবং ব্যর্থতা ছিল তাদেরও।

কিন্তু এই কুরুজ্যেষ্ঠ সুধম্বার প্রপৌত্র অর্থাৎ এই বংশের চতুর্থ পুরুষকে দেখছি–তিনি একটি রাজ্যের অধিকার পেয়েছেন। কুরুর জ্যেষ্ঠপুলের ধারায় এই চতুর্থ পুরুষের নাম বসু। কিন্তু একে কেউ বসু বলে ডাকে না। পুরাণে-ইতিহাসে সর্বত্র তার নামের আগে একটি বিশেষণ আছে। সকলে তাকে উপরিচর বসু বলে ডাকে। এমনকি তিনি নতুন যে দেশটি জয় করেছিলেন, সেই চেদি দেশও তার নামের বিশেষণে পরিণত–চৈদ্য উপরিচর বসু।

 এখনকার দিনে যে জায়গাটাকে আমরা বুন্দেলখণ্ড বলি, সেকালের দিনে সেইটাই হল চেদি রাজ্য। একপাশ দিয়ে শুক্তিমতী নদী বয়ে যাচ্ছে, অন্যপাশে কালিদাসের মেঘদূত-বিখ্যাত উপলব্যথিতগতি বেত্রবতী। দুই নদীর মাঝখানের অংশটুকুই বোধহয় সেকালের চেদিরাজ্য। ভারি সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। কুরুবংশের চতুর্থ পুরুষ বসু-রাজা প্রখর বাস্তব-বোধে হস্তিনাপুর বা পাঞ্চালদেশের দিকে হাত বাড়াননি। আপন ভাগ্যান্বেষণের জন্য হস্তিনাপুর ছেড়ে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব রাজ্যগুলির দিকে চলে এসেছিলেন। তারপর শুক্তিমতী নদীর ওপর শুক্তির মতো এই অপূর্ব রাজ্যটিই তার পছন্দ হয়ে গেল। তিনি পিতৃ-পিতামহের যুদ্ধ-বাহিনী একত্র করে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এই রাজ্যের ওপর। এই ঝাঁপিয়ে পড়াটা ছিল এতই আকস্মিক, এতই অতর্কিত যে অনেকটাই ছিল উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো। হয়তো এই কারণেই তার নাম-উপরিচর বসু।

মহাভারত অবশ্য অন্য একটা খবর দিয়েছে। মহাভারত বলেছে–দেবরাজ ইন্দ্র ছিলেন বসু-মহাশয়ের বন্ধু মানুষ। প্রধানত তারই পরামর্শেই বসু-রাজ চেদিরাজ্যে নিজের আবাস স্থাপন করেন–ইন্ট্রোপদেশান্ জগ্রাহ রমণীয়ং মহীপতিঃ। দেবরাজ ইন্দ্র বসুকে কাছে ডেকে বলেছিলেন–তুমি আমার বন্ধু মানুষ–সখাভূত মম প্রিয়। আমার ইচ্ছে–পৃথিবীর একটি সুরম্য স্থানে তোমার আবাস হোক। আর রম্য বলতে আছে একমাত্র চেদি-রাজ্য। ধনধান্যে পূর্ণ দেশ। সরস মাটির সব গুণই এতে আছে–ভোগৈৰ্ভূমিগুণৈ-যুতঃ। দেবরাজ বললেন–শস্য আর অর্থের সম্ভাবনায় পূর্ণ এই দেশেই তুমি বসতি স্থাপন করো, আমি তাই চাই–বপূর্ণা চ বসুধা বস চেদি চেদিপ।

দেবরাজ নাকি তার বন্ধুত্বের স্মৃতি হিসেবে বসুরাজকে একটি দিব্য বিমান দিয়েছিলেন। এই বিমানে চড়ে রাজ্যের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়াতেন বলেই তিনি উপরিচর বসু-চরিষ্যসি উপরিস্থাে দেবো বিগ্রহবানিব। নতুন রাজ্যের অধিপতিকে বরণ করে দোজ বসু-মহাশয়ের গলায় পদ্মফুলের জয়মাল্য পরিয়ে দিয়েছিলেন। দেবরাজের আন্তরিক ইচ্ছায় সুরম্য জনস্থান চেদিরাজ্যের ভার নিলেন বসুরাজ-সম্পূজিতো মেঘবতা বসুশ্চেদীশ্বরো নৃপঃ।

মহাভারতের এই বর্ণনায় বসুরাজের সঙ্গে ইন্দ্রের বন্ধুত্ব, তার দেওয়া দিব্য বিমান এবং অম্লান পঙ্কজের মালাখানির কথা কোথা থেকে এসেছে তা বুঝতে আমাদের সময় লাগে না। আসল কথা–খোদ ঋগবেদের দানস্তুতির মধ্যে আমরা জনৈক ‘কশু চৈদ্যে’র নাম পাই। তার প্রশংসাও শুনতে পাই ভূরি ভূরি। চেদির রাজা এই কশু চৈদ্য’ই মহাভারতীয় নামে চৈদ্য বসু হয়েছেন বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা, অন্তত র‍্যাপসন এই মতই পোষণ করেন। আমরা এই নামের বিপর্যয়ের কথাটা যথেষ্টই বুঝি। কিন্তু সবচেয়ে বড় যেটা বোঝার ব্যাপার, সেটা হল খোদ ঋগবেদের মধ্যে কশু চৈদ্যের এত প্রশংসা আছে বলেই মহাভারতে বসু চৈদ্যের সঙ্গে বৈদিক দেবতা ইন্দ্রের এত বন্ধুত্ব, এত দানাদানের কথা কষ্মিত হয়েছে।

তবে বিমানে চড়ে বসুরাজ যতই ‘উপরিচর’ হোন, আমাদের গভীর বিশ্বাস–বসু মহাশয় ভাগ্যন্বেষণে এসে এই মনোরম রাজ্যটির ওপর অতর্কিতে অর্থাৎ যেন উপর থেকে হানা দিয়েছিলেন। সেই জন্য চেদি-দেশের এই বিখ্যাত রাজার নাম হয়ে গেল চৈদ্য উপরিচর বসু। চেদি দেশের রাজা বলে এই যে ‘চৈদ্য’ নামের বিশেষণটি পেলেন বসু-মহাশয়, তারপর থেকে এই দেশের রাজারা নিজেদের ‘চৈদ্য’ বলতেই বেশি পছন্দ করতেন। পরবর্তী সময়ে মহাভারতখ্যাত শিশুপালকে অন্তত একশবার চৈদ্য নামে ডাকা হবে। আরও কিছুদিন পর আমরা খারবেল নামে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ:যে কলিঙ্গ-রাজার নাম পাব, তার বহুপূর্ব পিতামহরা বোধহয় এই দেশের লোক ছিলেন। খারবেল যে বংশে জন্মেছিলেন তার নাম চেত-বংশ। রমাপ্রসাদ চন্দ দেখিয়েছেন-’চেত’ রাজপুত্রেরা আসলে চেদিদেশের লোক। বৌদ্ধ উপাখ্যান বেসন্তর জাতকে সেইরকমই বলা আছে।

আমরা বলি–এত কল্পনার দরকারই নেই কোনও। বৌদ্ধগ্রন্থ মিলিন্দপহোতে (রাজা মিনান্দারের প্রশ্ন) এক ‘চেত’ রাজার নাম করা হয়েছে, তাঁর নাম ‘সুর’ অথবা ‘শূর পরিচর’। এবার ভাবুন, এই শূর পরিচর নামটির সঙ্গে কোনওভাবেই কি আমাদের চৈদ্য রাজার বসু উপরিচরের পার্থক্য নির্ণয় করা যায়? স্টেন কোনো সাহেব আবার সামান্য একটু বাগড়া দিয়ে বলেছেন–কলিঙ্গরাজ বারবেল চেত-বংশে নয়, তিনি চেতি-বংশে জন্মেছিলেন, সাহেব খেয়াল করলেন না ‘চেতি’ বলার ফলে চৈদ্য-রাজাদের কথা আরও বেশি করে প্রমাণিত হয়। কেন না, বৌদ্ধ জাতকমালায় একটি জাতকের গল্পের নামই হল চেতিয় জাতক এবং এই। জাতকে এক চৈদ্য রাজার বংশকাহিনী উদ্ধার করা হয়েছে–যে রাজার নাম উপচর।

দেখা যাচ্ছে-উপরিচর বসু-মহাশয়কে কোনও বৌদ্ধগ্রন্থ বলছে–পরিচর, কোনটি বলছে উপচর। তাতে প্রমাণ হয়ে যায় কুরুবংশের প্রথম গৌরব কুরুর জ্যেষ্ঠপুত্র সুধম্বা হস্তিনাপুরে রাজ্য না পেলেও তার প্রপৌত্র উপরিচর বসু চেদিরাজ্যে নিজের অধিকার কায়েম করে কতটা হই-হই ফেলে দিয়েছিলেন সেকালে। আমাদের ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে আর্যস্থান রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ। আর পাঞ্জাব ছেড়ে পূর্বভারত এবং দক্ষিণে কুরুবংশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন এই উপরিচয় বসু। দুর্ভাগ্যের বিষয়, হস্তিনাপুরের মহারাজই কুরুবংশের ধুরন্ধর পুরুষ হিসেবে পরিচিত হয়ে রইলেন, আর উপরিচর বসু নিজ পরাক্রমে রাজ্য দখল করে নিজের নামেই বিখ্যাত হলেন। কথায় বলে–স্বনামা পুরুষো ধন্যঃ পিতৃনামা তু মধ্যমঃ। অতএব উপরিচর বসু সেই স্বনামধন্য ব্যক্তি, যার কথা উচ্চারণ করলে আর তার পূর্বপুরুষ কুরুর নাম স্মরণ করতে হয় না। ঋগবেদ থেকে আরম্ভ করে খারবেলের বংশ পর্যন্ত তিনি একভাবে উপস্থিত আছেন–স্বমহিমায় স্বপরাক্রমে। কুরুর নাম বাদ দিয়ে উপরিচর বসুর নামেই তাঁর পরবর্তী বংশধারা চলেছে, যার নাম বাসব (বসু+ঞ্চ) বংশ–বাসবাঃ পঞ্চ রাজানঃ পৃথবংশাশ্চ শাশ্বতাঃ।

নতুন দেশ জয় করে উপরিচর বসু চেদিরাজ্যের রাজা হয়ে বসলেন, কিন্তু এখনও তার কোনও রানী নেই। তিনি আর্যাবর্ত ব্রহ্মাবর্তের রাজা নন, কাজেই কাশী-কোশল বা অযোধ্যা-শূরসেন থেকে কোনও পতিংবরা কন্যা তাকে বরণ করেননি। আর ওই সব দেশের জামাতা হিসেবে বৃত হওয়ার জন্য কোনও চেষ্টাও বোধহয় তার ছিল না। মহাভারতে বসুরাজের বিবাহ নিয়ে একটি কল্পকাহিনী আছে। বলা হয়েছে–চেদিরাজ্যের কোল-ঘেঁষা শুক্তিমতী নদীকে সেই রাজ্যের এক পর্বত আটকে রেখেছিল আপন করে–পুরোপবাহিনীং তস্য নদীং শুক্তিমতীং গিরিঃ অরৌৎসীৎ চেতনাযুক্ত…. পর্বতটির নাম কোলাহল। বীরবাহিনী শুক্তিমতী নদীকে দেখে পর্বতপুরুষ কোলাহল মুগ্ধ হয়ে নির্জনে উপভোগ করতে চেয়েছিলেন–কামাৎ কোলাহলঃ কিল।

মহারাজ উপরিচর বসুর কাছে এই ধর্ষণের সংবাদ অচিরেই পৌঁছল। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে পদাঘাত করলেন পর্বতের দেহে। পদাঘাতের ফলে পর্বত-পুরুষ শুক্তিমতী নদীকে ছেড়ে দিল বটে, কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। শুক্তিমতীর কোলে ততক্ষণে যমজ পুত্র-কন্যার জন্ম হয়েছে এবং অলৌকিকভাবে তারা বড়ও হয়ে গেছে। বলাকারী পর্বতের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ায় শুক্তিমতী এতই খুশি হয়েছিলেন যে, তিনি বসু মহারাজকে বললেন–এই কন্যাটি তোমার পত্নী হবে, আর আমার এই পুত্র তোমার সেনাপতির কাজ করবে। বসুরাজ শুক্তিমতীর অনুনয় মেনে নিলেন।’শুক্তিমতীর পুত্রটিকে সেনাপতিত্বে নিযুক্ত করে, কন্যাটিকে তিনি বিবাহ করলেন। কন্যার নাম গিরিকা।

মহাভারতের এই কল্পকাহিনীর মধ্যে গভীর এক বাস্তব লুকিয়ে আছে। আমরা গভীরভাবে বিশ্বাস করি–উত্তরভারতের কোনও আর‍্যা রমণীর পাণিগ্রহণে আগ্রহ দেখাননি মহারাজ উপরিচর বসু। বরং তার রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা এতটাই প্রখর যে, তিনি যে রাজ্যে ‘উপরিচর’ হয়ে জুড়ে বসেছিলেন, যে রাজ্যে আপন অধিকার কায়েম করেছিলেন, তিনি সে রাজ্যেরই নদী-পর্বতের গন্ধমাখা এক রমণীকে বিবাহ করেছিলেন। হয়তো চেদিরাজ্যের পুরাতন আবাসিনী সেই রমণীর নাম গিরিকা।

ভূগোলের সামান্য জ্ঞান থাকলেই বোঝা যায়–শ্রীময়ী শুক্তিমতী, যাঁকে আধুনিকেরা কেন বলে ডাকেন, সেই নদীটি বেরিয়েছে কোলাহল পর্বত থেকে। কোলাহল পর্বত এখনকার বুন্দেলখণ্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বন্দেইর পর্বত বলে চিহ্নিত হয়েছে। শুক্তিমতীর উৎসভূমি এই পর্বত। বসুরাজের মহিমা বর্ধন করার জন্যই কোলাহল পর্বতের শিলা-বাহুর আলিঙ্গন থেকে অবরুদ্ধা শুক্তিমতীর ধারামুক্তির কল্পনা। এই কল্পনার অবসান ঘটে কোলাহল-শুক্তিমতীর ভূমিকন্যা গিরিকার সঙ্গে চৈদ্য উপরিচর বসুরাজার মিলনের পর। লক্ষণীয় বিষয় হল, পৌরাণিক তালিকায় অপ্সরাসুন্দরীদের অনেক নামের মধ্যে আমরা গিরিকার নামও পেয়েছি। মহাভারতে পদাবন্ধে এও দেখেছি যে, মহারাজ বসু যখন বিমানে চড়ে ঘুরে বেড়াতেন, তখন গন্ধর্ব-অপ্সরারা অনেকেই তাকে ঘিরে থাকতেন। কাজেই শুক্তিমতীর নদীর তীরবাসিনী কোনও দেশজা রমণীকে দেখেই মহারাজ হয়তো মুগ্ধ হয়েছিলেন। হয়ত তার পিতৃনাম-মাতৃনাম কোনও পরিশীলিত ব্যক্তিত্বের মর্যাদা বহন করে না। হয়তো বা এই রমণী কোনও স্বেচ্ছাবিহারিণী নদীর মতোই উচ্ছল। কিন্তু তবু বসু চৈদ্যের মনে সে দোলা দিয়েছিল; দেশজা সাধারণী গিরিকা তাই রাজরানী হলেন চেদিরাজ্যে।

উপরিচর বসুর কথা আবারও আসবে পরে। অন্য প্রসঙ্গে। তার আগেই জানাতে হবে যে, এই গিরিকার গর্ভে বসুরাজের পাঁচটি মহাবলশালী পুত্র হয়। তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ হলেন বৃহদ্রথ। দ্বিতীয় পুত্র প্রত্যগ্রহ, তৃতীয় কুশাম্ব, চতুর্থ যদু এবং পঞ্চম মাবেল্ল। মহারাজ বসু এই পঞ্চ পুত্রের জন্ম দিয়েই বসে থাকেননি, তিনি পুত্রদের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তা করেছিলেন যথেষ্ট। হয়তো তার মনে ছিল তার প্রপিতামহ কুরুপুত্র সুধকে পিতৃরাজ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছিল। মনে মনে তিনি এও জানতেন যে, তার মৃত্যুর পর তার চেদিরাজ্যটি নিয়ে ভাই-ভাই বিবাদ বাধতে পারে। অথবা এক পুত্র পৈতৃক রাজ্য পেলে অন্যের মন খারাপ হয়ে যেতে পারে। ফলত নিজের জীবৎকালেই তিনি রাজ্যবিস্তারে মন দিয়েছিলেন। চেদিরাজ্যের ভূমিলগ্ন অন্যান্য অনেক রাজ্যই তিনি আপন বাহুবলে অধিকার করে নিয়েছিলেন। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল মগধ।

পূর্বভারতের মগধরাজ্যের তখন সেরকম কোনও আভিজাত্য ছিল না। উত্তরভারতের আর্যায়ণের পরেও মগধের দিকে আর্যরা তেমন মিন্ধ চোখে তাকিয়ে দেখেননি কোনওদিন। সেকালের দিনে যে পাঁচটি জায়গায় এলে আর্যদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হত, তারমধ্যে চারটি দেশই পূর্বভারতে অবস্থিত। অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ এবং মগধ–এইসব রাজ্যের মৃত্তিকার মর্যাদা ছিল অত্যন্ত লঘু। অন্তত উত্তরভারতের তুলনায় তাই। মহারাজ উপারচর বসু এই মগধ রাজ্য জয় করে সেখানে তার জ্যেষ্ঠপুত্র বৃহদ্রথকে বসিয়ে দিলেন এবং এই বৃহদ্রথের নামেই মগধে বাহদ্রথ বংশের সূচনা হল। বসুরাজের দ্বিতীয় পুত্র প্রত্যগ্রহ পৈতৃক রাজ্যের অধিকার পেলেন। চেদিদেশেই তৃতীয় পুত্র কুশাম্ব নিজের নামেই কৌশাখী নগরী স্থাপন করলেন। রাজপুত্র কুশাম্বকে লোকে মণিবাহন বলেও ডাকত। চতুর্থপুত্র যদু রাজ্য পেলেন করূষ দেশে, যার আধুনিক নাম বাঘেলাখণ্ড। আর সর্বশেষ মাবে–অথবা বিভিন্ন পুরাণ অনুসারে এই পঞ্চম পুত্রটির নাম মাথৈল্য, এমনকি মারুতও হতে পারে–তিনি রাজত্ব পেলেন মৎস্যদেশে, যা এখনকার রাজস্থানের ভরতপুর-জয়পুর-আলোয়ার অঞ্চল। এই পঞ্চম পুত্রটিকে নিয়েও পরে কথা আসবে।

চৈদ্য উপরিচর বসু আপন বাহুবলে পাঁচ রাজ্য জয় করে তার পাঁচ পুত্রকে সেই সব রাজ্যের সিংহাসনে বসিয়েছিলেন–নানারাজ্যেষু চ সুতান্ স সম্রাড়ভ্যষেচয়ৎ। আগেই বলেছি–এই সব রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল মগধ, যেখানে রাজা হয়েছিলেন বাসব-জ্যেষ্ঠ বৃহদ্রথ। উপরিচর বসু স্বয়ং এই মগধদেশ জয় করেছিলেন বলেই হয়তো এই দেশের আরেক নাম বসুমতী। খোদ বাশ্মীকি রামায়ণেও মগধকে বসুমতী বলেই চিহ্নিত করা হয়েছে। আসলে মগধের নাম আগে মগধও ছিল না, বসুমতীও ছিল না। এই দেশের নাম আগে ছিল কীট-দেশ। ঋগবেদে কীটদেশের এক জননেতার নাম পাচ্ছি বটে, কিন্তু নিরুক্তকার যাস্কের মত বৃদ্ধ বৈদিক লিখেছেন কী-দেশ হল অনার্যদের বাসস্থান ককটা নাম দেশো’নার্যনিবাস। এদেশে গোমাতার মর্যাদা নেই, এখানকার লোকেরা ধর্মাচার মানে না-নাশিরং দুহেন তপত্তি ধর্ম-ঝগবেদের এই পংক্তি উল্লেখ করে মহামতি যাস্ক কীটদেশের নেতাটির নামও বলে দিয়েছেন। সেই নেতার নাম প্রমগন্দ। যাস্কের মতে মগন্দ মানে কুসীদজীবী, মহাজন। আর প্রমগন্দ মানে কুসীদী-কুলীন অপবিত্র ব্যক্তিটি। ভাষাতাত্ত্বিকরা কী বলবেন জানি না, তবে বেদে উল্লিখিত মগন্দ শব্দটা থেকেই মগধ শব্দটা আসেনি তো?

কীকট সম্বন্ধে বেদের ঋমন্ত্র এবং যাস্কের বিরুদ্ধ মত থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় বৈদিক কালে এই দেশের আর্যায়ণ সম্পন্ন হয়নি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যখন পূর্বভারতের অনেকাংশেই আর্যদের অধিকার ছড়িয়ে পড়েছে, তখনও কীকটদেশের অস্পৃশ্যতা ঘোচেনি। বৃহদ্ধর্ম পুরাণে কীটদেশের অন্তর্গত কয়েকটি পূণ্যস্থানের মহিমা কীর্তিত হলেও বলা হয়েছে এখানকার রাজা কাককর্ণ অত্যন্ত ব্রাহ্মণ-দ্বেষী মানুষ এবং এ জায়গায় কেউ মারা গেলেও বলতে হবে সে পাপ-ভূমিতেই মারা গেল–কীকটেষু মতো’প্যেষ পাপভূমৌন সংশয়ঃ/ অথচ আশ্চর্য, একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত কীটদেশের ‘গয়া’ জায়গাটা কিন্তু পিতৃপুরুষের স্বর্গদায়ী এক পুণ্যদেশ। ঐতিহাসিকেরা বৃহদ্ধর্ম কথিত কাককর্ণ রাজাকে শৈশুনাগ-বংশীয় কাক-বর্ণের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করেন।

কিন্তু শৈশুনাগ বংশের কাহিনী তো অনেক পরে। আমরা যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে কীট-দেশের আর্যয়ণই সম্পূর্ণ হয়নি। কীট-দেশই যে মগধ, সে কথা অভিধানচিন্তামণির মতো প্রাচীন গ্রন্থেই বলা আছে-কীটা মগধাদ্বয়াঃ যদিও মগধ নামটা আমরা প্রথম পাই অথর্ববেদে। আর্যায়ণের প্রথম কল্পে যে সমস্ত ব্রাহ্মণ মগধরাজ্যে বসতি। স্থাপন করেন, তাদেরও ভাগ্যে সুখ ছিল না। ব্রাত্য, ব্রহ্মবন্ধু এই সমস্ত অনাচারীর সঙ্গে তারা একই সগন্ধতায় উচ্চারিত। তবে মগধ সম্বন্ধে এই সমস্ত নিন্দাবাদের কারণ একটাই, মগধে আর্যদের অধিকার সহজে প্রোথিত হয়নি।

 এ হেন মগধ-দেশে সাহস করে যিনি প্রথম কুরুবংশের অঙ্কুর প্রোথিত করে নিজের ছেলেকে সিংহাসনে বসালেন, তিনি হলেন উপরিচর বসু। কুরুবংশের পূর্বগন্ধ নিয়ে তার অবশ্য মাথাব্যথা ছিল না। তিনি আপন শক্তিতে রাজ্যের অধিকার পেয়েছিলেন, অতএব তার পুত্র বৃহদ্রথও হস্তিনাপুরে প্রতিষ্ঠিত কুরুবংশের মূলধারার সঙ্গে একাত্ম হতে চেষ্টা করেননি কখনও। বৃহদ্রথের স্বাতন্ত্র্যবোধ ছিল অন্যরকম। মগধদেশে তার নিজের নামে একটি স্বতন্ত্র নগরও প্রতিষ্ঠিত হয়, যার নাম বৃহদ্রথপুর-বাৰ্হস্রথপুরং প্রতি। অবশ্য বৃহদ্রথপুর নামটি শুধু রাজা বৃহদ্রথের জায়গা বা সামান্যভাবে মগধ রাজ্য বলে মনে করলেও কোনও অসুবিধা নেই। কারণ, মগধের রাজা বৃহদ্রথের রাজধানী ছিল গিরিব্রজ।

হস্তিনাপুরের রাজা বলুন, মথুরা-শূরসেনের অধিপতি বলুন অথবা সরযুপারে অযোধ্যার রাজার কথাই বলুন, মগধের রাজধানী গিরিব্রজের মতো সুরক্ষিত রাজধানী কোনও রাজারই ছিল না। দক্ষিণ বিহারের পাটনা আর গয়া জেলা নিয়েই ছিল তখনকার গিরিব্রজের ভৌগোলিক স্থিতি। গিরিব্রজ আপনা আপনিই এক দুর্গের মতো, যার উত্তরে এবং পশ্চিমে দুই মহানদী–গঙ্গা এবং শোন। পশ্চিমে বিন্ধ্য পর্বতমালার ছিন্নাংশ আর পূর্বে আছে চম্পা নদী। এ হল মগধের সাধারণ অবস্থিতি। এর মধ্যে আবার স্বয়ং বৃহদ্রথ যে জায়গায় নিজের আবাস-গৃহটি বানিয়েছিলেন, সে জায়গাটা ছিল একটি আদর্শ গিরিদুর্গের মতো।

মনু মহারাজ রাজাদের বাসের জন্য যে সমস্ত দুর্গের কথা বলেছেন, তার মধ্যে আদর্শ হল গিরিদুর্গ। তিনি বলেছেন, রাজা যদি নিজের রাজধানীর চারপাশে পাহাড়ের সুবিধা পান, তাহলে তার মতো সুবিধে আর কিছুতে হয় না-এষাং হি বাহুগুণেন গিরিদুর্গং বিশিষ্যতে। মহাভারতের কবি মহারাজ বৃহদ্রথের রাজধানীকে বাইদ্রথপুর বলবার আগে তার নামকরণ করেছেন গিরিব্রজ অথবা রাজগৃহ। পাঁচটি পর্বতের দ্বারা রাজগৃহ সুরক্ষিত। আমাদের মনে হয় রাজগৃহকে হয়তো বা রাজগিরিও বলত কেউ কেউ, যার ফলে আজকের অপভ্রংশে রাজগির শহরটিকে পেয়েছি আমরা। অবশ্য রাজগৃহ শব্দ থেকেও রাজগির শব্দের উৎপত্তি সম্ভব।

যাইহোক মহাভারতে দেখতে পাচ্ছি–বার্হদ্রথপুরের চারদিকে যে পাহাড়গুলি আছে তাদের প্রথমটির নাম হল বইহার। মহাভারতের কবি এই শব্দটার বানান করেছেন ঐকার দিয়ে–বৈহার। সংস্কৃতের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করে শব্দটাকে আগে আমি বিহার’ শব্দ থেকে উৎপন্ন বলে ভাবতাম। কিন্তু বিভূতিভূষণের মহাকাব্যে লবটুলিয়া-বইহারের কথা পড়ার পর আমরা ‘বৈহার’ শব্দটিকে ভেঙে বইহারই বলতে ভালবাসি। এখানে এটাও অবশ্য জানিয়ে দিতে হবে যে, মহাভারতের কবিও ‘বৈহার’ বিহার শব্দজাত কোনও নিষ্পন্ন শব্দ হিসেবে ব্যবহার করেননি। বৈহার তাঁর মতে আলাদা একটি শব্দ, যেটা বিপুল-বৈহার বলে একটি পাহাড়ের নামও যেমন হতে পারে, তেমনি এই শব্দের মানে হতে পারে একটি বড় পাহাড়, কবি যাকে বলেছেনবৈহারো বিপুলঃ শৈলঃ।

মহাভারতের বর্ণনায়–বৈহার, বরাহ, বৃষভ, ঋষিগিরি এবং চৈত্যক–এই পাঁচটি পাহাড়ের নামে পাঠভেদ আছে। তবে প্রাচীন বৌদ্রগ্রন্থ মঝিমনিকায় এবং আধুনিক রাজগিরে প্রচলিত আধুনিক নামগুলির মঙ্গে মহাভারতোক্ত নামগুলির তুলনামূলক বিচার করে পণ্ডিতেরা সিদ্ধান্ত করেছেন যে বাহদ্রথপুরের চারপাশের পাহাড়গুলি এইভাবে সাজানো যায়–

মহাভারত              মঝঝিমনিকায়              আধুনিক

১ বিপুল বৈহার         বেপুল                       বিপুলগিরি

২ বরাহ                  বৈভার                      বৈভার

৩ বৃষভ                  পাণ্ডব                       সোনাগিরি

৪ ঋষিগিরি               ইসসিগিল্লি                    উদয়গিরি

 ৫ চৈত্যক                 গৃধ্রকূট                      ছত্রগিরি + রত্নগিরি

আমরা যে এত গুরুত্ব দিয়ে মগধের রাজধানী গিরিব্রজ অথবা বাহদ্রথপুরের ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয় করার চেষ্টা করছি, তার কারণ একটাই। বসুপুত্র মহারাজ বৃহদ্রথ তার নিজের নামে এমনই একটি বংশ-পরম্পরা তৈরি করেছিলেন ব্রাহ্মণ্য আচারভূমির বাইরে, যা হস্তিনাপুরের মহারাজ শান্তনুর সম-সময়েই এক প্রবল পরাক্রান্ত রূপ ধারণ করেছিল। একথা ঠিক যে বৃহদ্রথের পুত্র-পৌত্র-প্রপৌত্ররা সকলেই খুব নামী রাজা ছিলেন না এবং তাদের সবার নামও সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। কিন্তু বৃহদ্রথের পাঁচ-সাত পুরুষ পরেই এই বংশে যিনি জন্মগ্রহণ করলেন, তার জন্য এই অনার্যপ্ৰায় জনপদ ভারতবর্ষের সবচেয়ে নামী জনস্থানে পরিণত হল। মগধের রাজ-সিংহাসনে যেদিন মহারাজ জরাসন্ধের রাজ্যাভিষেক হল, সেদিন। কেউ ভাবেনি যে, ভারতবর্ষের সমস্ত রাজা মগধের অনুশাসনে আবর্তিত হবে। জরাসন্ধ এমনই এক রাজা যিনি সমগ্র পূর্ব-ভারতকে এক বিশাল মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রখর রাজনৈতিক বুদ্ধি এবং পরাক্রমশালিতার মিশ্রণে জরাসন্ধের ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছিল। ভারতবর্ষের আর্যস্থানে তখন এমন কোনও আর্য রাজা ছিলেন না, যিনি মাগধ জরাসন্ধের সঙ্গে পাঞ্জা কষতে পারেন। তার একটা সুবিধে ছিল—চেদি, করূষ অথবা কৌশাম্বীতে তার নিজের জ্ঞাতি-গুষ্ঠিরাই অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু এঁরা যেমন জরাসন্ধের অনুসরণ করতেন আত্মীয়তার কারণে, তেমন অনাত্মীয় যারা, তারা জরাসন্ধের অনুগমন করতেন ভয়ে, শাস্তির ভয়ে।

আশ্চর্য ব্যাপার হল, জরাসন্ধ হস্তিনাপুরবাসী কৌরবদের সঙ্গে কখনও নিজে থেকে শত্রুতা আচরণ করেননি। হয়তো এর পিছনে তার বংশমূল কুরুরাজার পূর্ব-স্মৃতি কাজ করেছে। কিন্তু জরাসন্ধের মনের গভীরে যদি বা এই ভাবনা-গৌরব কিছু থেকেও থাকে, কৌরব শান্তনু বা মহামতি ভীষ্ম সে কথা মনে রেখেছিলেন বলে মনে হয় না। হস্তিনাপুরের মহারাজ শান্তনুর সঙ্গে যখন গঙ্গার দেখা হল, তখনও জরাসন্ধের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস আমরা কিছু শুনতে পাইনি বটে, কিন্তু তিনি তখন জন্মেছিলেন নিশ্চয়ই। অন্যদিকে এই অনুমান অবশ্যই সার্থক যে, মহামতি ভীষ্ম যখন যৌবনে পদার্পণ করেছেন, তখন জরাসন্ধ শুধু পূর্বভারত নয়, প্রায় সমস্ত ভারতবর্ষের সবচেয়ে বিক্রান্ত রাজা। এই অনুমানের প্রমাণ একটাই। মথুরা শূরসেনের রাজা কংস, যিনি যাদব-কুলপতি উগ্রসেনের পুত্র ছিলেন, তিনি ছিলেন মগধরাজ জরাসন্ধের জামাই। পরিষ্কার বোঝা যায়, মথুরাধিপতি উগ্রসেন, মগধরাজ জরাসন্ধ এবং হস্তিনাপুরের বৈধ রাজপুত্র শান্তনব ভীষ্ম ছিলেন পরস্পর পরস্পরের ছোট-বড় সমসাময়িক, যাকে ইংরেজি ভাষায় বলি younger বা older contemporaries.

.

৫৪.

হস্তিনাপুরে মহারাজ শান্তনু যখন রাজত্ব করছেন, পাঞ্চালে যখন দ্রুপদ-পিতা পৃষতের অধিকার চলছে অথবা মগধে জরাসন্ধ যখন যৌবনে পদার্পণ করেননি, তখনও কিন্তু রাজনৈতিকভাবে যাদবদের অবস্থা খুব ভাল। আমরা আগেই জানিয়েছি– যাদবদের মধ্যে কার্তবীর্য অর্জুন অথবা তারও আগে শশবিন্দুর মতো বিরাট পুরুষ জন্মেছিলেন। মহারাজ সত্ব বা সাত্বত জন্মানোর পর যাদবদের বিশাল বংশ খানিকটা খণ্ডিত হল বোধহয়। সাত্বতের প্রত্যেকটি পুত্ৰই এত বিখ্যাত ছিলেন যে, সেই সময় থেকে বংশ-পরম্পরায় একজনকে রাজা বানিয়ে দেওয়াটা খুব কঠিন ছিল। সাত্বত্ত-পুত্রদের একেক জন পুরুষ থেকে একেকটি প্রখ্যাত বংশধারার সূত্রপাত হয়। ভোজ, অন্ধক, ভজমান, বৃষ্ণি–এঁদের মধ্যে কাকে ছেড়ে কাকে ধরবেন? এঁরা প্রত্যেকেই খ্যাতিমান পুরুষ।

আবারও এঁদেরও পুত্র-পৌত্রদের মধ্যে এত বিখ্যাত মানুষ আছেন, যাতে যে কোনও একজনকে সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে আর সবাই তার মত মেনে চলবেন- এমন কল্পনা করাটা যেমন অসম্ভব, তেমনই অবাস্তব। যদুবংশের অধস্তনরা, বিশেষত সাত্বতবংশীয়রা যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিলেন, তারাওঁ ব্যাপারটা বুঝতেন। অতএব রাজ্য শাসনের জন্য সেইকালেই তারা এক অভিনব উপায় সৃষ্টি করেন। সাত্বতের পুত্রেরা বৃষ্টি, অন্ধক, ভোজেরা প্রত্যেকেই তাদের পুত্র-পরিবার সহ একেকটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যান, যে গোষ্ঠীর নাম ছিল সংঘ। যেমন ভোজসংঘ, বৃষ্ণিসংঘ, অন্ধক-সংঘ।

মনে রাখা দরকার, এই ‘সংঘ’ শব্দটি আমাদের স্বকপোলকল্পিত কোনও শব্দমাত্র নয়। খোদ মহাভারতের শান্তিপর্বেই যাদবদের নানা গোষ্ঠীর সম্বন্ধে সংঘ শব্দটি প্রযুক্ত হয়েছে এবং ভগবান নামে চিহ্নিত সেই কৃষ্ণকে সংঘমুখ্য’ বলে ডাকা হয়েছে—সংঘমুখ্যো’সি কেশব। মহামতি কৌটিল্যও অর্থশাস্ত্র রচনার সময় যদু-বৃষ্ণি-সংঘের কথা উল্লেখ করেছেন। বস্তুত ভোজ-বৃষ্ণি-অন্ধকেরা সংঘ-নায়ক হিসেবে এতটাই প্রসিদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে, খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীগুলিতে বৈয়াকরণ পাণিনি থেকে আরম্ভ করে পতঞ্জলির সময় পর্যন্ত তাদের অধস্তন বিশাল ব্যক্তিত্বদের নামের পরে কী ধরনের তদ্ধিত প্রত্যয় ব্যবহার করা হবে তাই নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে হয়েছে- ঋষ্যদ্ধবৃষ্ণি-কুরুভ্যশ্চ।

পণ্ডিতেরা কৌটিল্য এবং পাণিনির শব্দচয়ন মাথায় রেখে অন্ধক-বৃষ্ণিদের গোষ্ঠীগুলিকে ‘রিপাবলিক’ বা ‘কর্পোরেশন’ নামে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। অন্যেরা বলেন, এগুলি ‘রিপাবলিক’ ঠিক নয়, বরং এগুলিকে ‘অলিগার্কি’ বলাটা বেশ যুক্তিসঙ্গত। আমরা এইসব মতের কোনওটাই অস্বীকার করছি না। কেন না, ‘রিপাবলিক’ বলুন, ‘কর্পোরেশন’ বলুন, অথবা ‘অলিগার্কি’ই বলুন-যদু-বৃষ্ণিদের শাসনতন্ত্র আধুনিকনামা এই সমস্ত তন্ত্রেরই মিশ্রণ, যে নামেই ডাকুন খুব একটা অসঙ্গত হবে না।

তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে একটি সম্পূর্ণ রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি কতিপয় সংঘমুখ্যের বিবেচনায় চলে, সেখানে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের মধ্যে বিরোধ ঘটাটাও খুব স্বাভাবিক। হস্তিনাপুরের শান্তনুর সময়ে আমরা যাদবদের শাসন ব্যবস্থার যা পরিমণ্ডল লক্ষ্য করেছি, তাতে অন্ধক-কুকুর বংশের ধারার প্রধান পুরুষটিকেই সকলে মিলে রাজা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। হস্তিনাপুরের মহারাজ শান্তনুর সম-সময়ে যিনি অন্ধক-বৃষ্ণিদের সর্বসম্মত সংঘমুখ্য বা রাজা হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন তাঁর নাম আহুক। আহুকের পিতার নাম অভিজিৎ এবং আহুক নিজে এতই বিখ্যাত ছিলেন যে তার বোনের নামও হয় তাঁরই নামে– আহুকী।

আমরা পূর্বে পৌরাণিকদের সঙ্কলিত গাথার মাহাত্ম কীর্তন করেছি। পুরাণের মধ্যে যেখানে গাথা বলে কারও কথা উলেখ করা হয়, বুঝতে হবে সেই অংশ পুরাণ-রচনার পূর্বে মানুষের শ্রুতি-পরম্পরায় সেই কথা এসেছে। আহুকের উৎসাহ এবং উদ্যম ছিল বেগবান অশ্বের মতো। তিনি যখন সপরিবারে কোথাও যেতেন, তখন অন্তত আশি জন মানুষ তার সিংহাসন বয়ে নিয়ে যেত। যে মানুষের পুত্রসন্তানের জনক হওয়ার ভাগ্য নেই, যে মানুষ অন্তত একশ জন ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা দেননি, যে মানুষ শুদ্ধ যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করেননি তেমন মানুষ কোনও দিন আহুকের ধারেকাছে যেতে পারতেন না।

আহুকের গুণকীর্তন করে যে গাথা তৈরি হয়েছে, তার আশয় থেকে বোঝা যায়, সেকালের দিনের নিরিখে যাদের খুব সংস্কৃতিসম্পন্ন বলে মনে করা হত, আহুকের সাঙ্গোপাঙ্গ ছিলেন তারাই। আহুকের রাজোচিত আড়ম্বরও কম ছিল না। দশ হাজার হাতির সওয়ার আর দশ হাজার সপতাক রথে চড়ে তার সৈন্যবাহিনী তাকে অভিনন্দন জানাত। এটা মার্চ পাস্টে ‘স্যালুট’ নেবার মতো কোনও ব্যাপার। এর পরেই বলা হচ্ছে–ভোজবংশীয় সমস্ত রাজাই তাকে সবসময় অভ্যর্থনা জানাতেন এবং মহারাজ আঙ্ক বোধহয় সমস্ত যদু-বৃষ্ণি সংঘকে নিজের আয়ত্তে আনার জন্য মথুরা-শূরাসেনের পূর্ব এবং উত্তরদিকে কিছু কিছু যুদ্ধযাত্রাও করেছিলেন পূর্বস্যাং দিশি নাগাং ভোজস্য প্রতিমোভবৎ।

বিভিন্ন পুরাণ এবং হরিবংশে আহুকের সম্বন্ধে যে গাথাগুলি প্রচলিত আছে, সেগুলির মধ্যে বিস্তর পাঠভেদ আছে। এগুলির বাংলা অনুবাদেও কোনও সমতা নেই, কোথাও কোথাও তা উদ্ভটও বটে। তবে সমস্ত শ্লোকের মর্মার্থ বিবেচনা করে যা বোঝা যায়, তাতে মথুরা শূরসেনের পূর্ব এবং উত্তরদিকে যে সব ভোজ-যাদব ছিলেন তাদের তিনি আপন ব্যক্তিত্বে একত্র করতে পেরেছিলেন হয়তো। তবে আহুকের পরে যাদব-ভোজদের এই রাজনৈতিক বন্ধন সামান্য শিথিল হয়েছিল বলে মনে হয়।

আহুকের বিয়ে হয়েছিল কাশীর রাজার মেয়ের সঙ্গে এবং তার গর্ভে আহুকের দুটি পুত্র হয়। তাদের নাম হল দেবক এবং উগ্রসেন। মহাভারত এবং পুরাণগুলির বক্তব্য থেকে দেবককেই আহুকের জ্যেষ্ঠ পুত্র বলে মনে হয়। কিন্তু জ্যেষ্ঠপুত্র হওয়া সত্ত্বেও কেন তিনি রাজা হননি, সে কথা কোথাও বলা নেই। আহুকের পরে উগ্রসেনই রাজা হন এবং তিনি ভালই রাজত্ব চালাতে থাকেন। এমন কি উগ্রসেনের জন্য অন্ধক-কুকুরের বংশধারার সুনামও হয় যথেষ্ট। পতঞ্জলির মতো বিশালবুদ্ধি বৈয়াকরণ সামান্য একটা তদ্ধিতপ্রত্যয়ের উদাহরণ দিতে গিয়ে উগ্রসেনের সঙ্গে তার বংশেরও নামোল্লেখ করেছেন– অন্ধকে নাম উগ্রসেনঃ। স্বভাবতই বোঝা যায় যাদবদের মধ্যে তিনিই নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। অন্ধকেরা তো বটেই ভোজ, বৃষ্ণি, কুকুর, শর–এইসব ছোট ছোট যাদব গোষ্ঠীর নেতারা সকলেই উগ্রসেনকে নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। রাজ্যও ভাল চলছিল।

হস্তিনাপুরের অধিপতি শান্তনুর সঙ্গে যাদবদের যেহেতু সরাসরি কোনও বিবাদ হয়নি, অতএব যাদবরা এবং কৌরবরা পাশাপাশি ভালই ছিলেন। কিন্তু কুরুপুত্র সুধর বংশধর জরাসন্ধ, যিনি মগধে রাজা হয়েছিলেন, তার সঙ্গে যাদবদের সম্পর্ক মোটেই ভাল রইল না তার কারণও আছে যথেষ্ট। সুধম্বার চতুর্থ পুরুষ উপরিচর বসু, যিনি হঠাৎ চড়াও হয়ে চেদিরাজ্য দখল করে নিয়েছিলেন, সেই চেদি কিন্তু পূর্বে যাদবদের অধিকারে ছিল।

আমরা ইতঃপূর্বে যাদব রাজা জ্যামঘর কথা বলেছি। সেই জ্যামঘ, যিনি যুদ্ধ জয় করে এক রমণীকে রথে চড়িয়ে নিয়ে এসেছিলেন এবং স্ত্রীর কাছে ভয়ে ভয়ে নিবেদন করেছিলেন এই রমণী তোমার পুত্রবধু হবে। এই জ্যামঘ কিন্তু প্রথম শুক্তিমতী নদীর তীরভূমি থেকে আরম্ভ করে নর্মদা নদীর তীরভূমি পর্যন্ত জয় করে নেন। চেদি, বিদর্ভ এই সমস্ত নগরের পত্তন করেন যাদবরাই এবং এইসব জায়গায় জ্যামঘের বংশধরেরাই রাজত্ব করছিল। পুরাণ অনুসারে বিদর্ভ জ্যামঘের পুত্র এবং বিদর্ভের অধস্তন ক্ৰথ-কৈশিকের অন্যতম কৈশিকের পুত্র হলেন চেদি, যাঁর নামে তার বংশধরেরা চৈদ্য নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন-চেদিঃ পুত্রঃ কৈশিকত্স্য তস্মাচ্চৈদ্যা নৃপাঃ স্মৃতাঃ।

যাদব চৈদ্যদের ওপর চড়াও হয়ে যিনি চেদি রাজ্য দখল করে নিলেন, তিনিই তো উপরিচর বসু চৈদ্য। শুধু চেদি কেন উপরিচর বসুর পাঁচ ছেলে যখন পাঁচ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেন তখন চেদি, কারুষ, মগধ (বুন্দেলখণ্ড, বাঘেলাখণ্ড, এবং গয়া-পাটনা)- এগুলি তো মগধরাজ জরাসন্ধের অধিকারে বা আয়ত্তে ছিলই, এমন কি মৎস্য দেশও (জয়পুর+ভরতপুর +আলোয়ার) যখন জরাসন্ধের শাসনে নাই হোক অনুশাসনে এসে গেছে। মহাভারতের মধ্যে যেসব জায়গায়—‘চেদি-মৎস্য-কারুষাশ্চ’ কিংবা চুদি-মৎস্যানাম বলে দ্বন্দ-সমাস করা হয়েছে, সেইসব জায়গাতেই বাহদ্রথ পরিবার জরাসন্ধের সাম্রাজ্যবাদ অনুস্মৃত হয়েছে,

বস্তুত জরাসন্ধ মগধদেশে রাজত্ব করছিলেন বটে, কিন্তু তার প্রতিপত্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, পূর্ব ভারতের মগধরাজ্যকে তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিলেন। লক্ষ্য করে দেখুন ভারতবর্ষের মানচিত্রে মথুরা-শূরসেন, হস্তিনাপুর, এবং পাঞ্চাল ছাড়া দক্ষিণে, উত্তরে এবং পূর্বে সর্বত্রই তখন জরাসন্ধের লোকজনেরাই রাজত্ব করছেন। দক্ষিণে এবং উত্তর ভারতের মৎস্য দেশের আগে যেহেতু যাদবদেরই একচ্ছত্র অধিকার ছিল অতএব যাদবদের প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়ালেন জরাসন্ধ। যাদবরা জরাসন্ধের অগ্রগতি রোধও করতে পারেননি, তাঁর সঙ্গে সন্ধিও করতে পারেননি। অন্যদিকে জরাসন্ধ মথুরা-শূরসেনের অর্থাৎ যাদবদের মূল ঘাঁটিতে ঢুকতে চাইছিলেন, কিন্তু ওই একটি জায়গায় যাদবদের অধিকার অত্যন্ত দৃঢ়পোথিত থাকায় জরাসন্ধ সোজাসুজি সশস্ত্র আক্রমণের মধ্যে যাননি। তিনি উপায় খুঁজছিলেন, যে উপায়ে সুদূর মগধরাজ্য থেকে কোনও আক্রমণ না চালিয়েও মথুরা-শূরসেনে নিজের শাসন কায়েম রাখা যায়।

মহারাজ উগ্রসেনের পুত্রসংখ্যা কম নয়। সব মিলে তাঁর নয়টি পুত্র। এদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ হলেন কংসনবোগ্রসেনস্য সুতাস্তেষাং কংসস্তু পূর্বজঃ। অন্য পুত্রদের নাম নগ্রোধ, সুনামা, কঙ্ক, সভূমিপ, শঙ্কু, রাষ্ট্রপাল, সুনু, অনাবৃষ্টি এবং পুষ্টিমান। কংস যদিও উগ্রসেনের একান্ত আত্মজ বলে পরিচিত, তবুও এই ছেলেটি তার আপন ঔরসজাত কিনা, সে সম্বন্ধে সন্দেহ আছে। পৌরাণিক্রো কংসকে কৃষ্ণের শত্রুপক্ষে স্থাপন করে, কে রাক্ষস, দানব- যা ইচ্ছে তাই বলেছেন। কিন্তু কংস রাক্ষসও নন, দানবও নন। তবে তার জন্মের মধ্যে কিছু রহস্যও আছে, কলঙ্কও আছে। পুরাণকারেরা কৃষ্ণ-সমর্থিত উগ্রসেনের মাহাত্ম্য স্থাপনের জন্য সেইসব পারিবারিক কলঙ্কের কথা প্রায় উল্লেখই করেননি। একমাত্র হরিবংশের একটি কাহিনীতে দেখা যাচ্ছে সহজ দাম্পত্যসুখে কংসের জন্ম হয়নি, তাঁর জন্ম হয়েছে উগ্রসেনের স্ত্রীর গর্ভেই, কিন্তু অন্যকৃত ধর্ষণে।

 শোনা যায়, মহারাজ উগ্রসেনের স্ত্রী একবার রাজবাড়ির বউ-ঝিদের সঙ্গে পর্বতের শোভা দেখার জন্য কৌহলী হয়ে সুমুন পর্বতের উপত্যকায় বেড়াতে গিয়েছিলেন-প্রেক্ষিতুং সহিতা স্ত্রীভি গত বৈ সা কুতুহলাৎ। সুযামুন পর্বত যমুনা নদীর তীরবর্তী কোনও ক্ষুদ্র পর্বত ছাড়া আর কিছুই নয়, কেন না এই নামে কোনও পাহাড়ের নাম আমরা শুনিনি। যাই হোক, মথুরাপুরীর অন্তর্গহের অবরোধ থেকে মুক্তি পেয়ে উগ্রসেনের গৃহিণী পরমানন্দে চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। একবার পাহাড়ে উঠছিলেন, একবার নদীর তীর বেয়ে উচ্ছলভাবে ছুটে যাচ্ছিলেন, কখনও বা পর্বতকন্দরে বসে বসে প্রাকৃতিক শোভা দেখছিলেন–চচার নগশৃঙ্গেযু করে নদীযু চ। প্রাকৃতিক পরিবেশও ছিল বড় মধুর। পৌরাণিকদের চিরাচরিত বর্ণনা অনুযায়ী ময়ূর, ভ্রমর কিংবা নাগকেশর ফুলেরও কোনও অভাব ছিল না সেখানে। সমীরণ-মথিত কদম্ব-পুষ্পের সর্বত্র মধুকরের আভরণ। নীচে পাচারের ভূমি নবতৃণচ্ছন্ন। বসন্তের ঋতুস্নাতা সমগ্র পার্বত্য বনাঞ্চলের শোভা যেন ঋতুস্নাতা যৌবনস্থা বনিতার মতো।

চিরাচরিত এই বর্ণনার মধ্যে আমরা যেতাম না, যদি না আমরা উগ্রসেনের পত্নীকে এই বাসন্তিক শোভায় বিহ্বলা না দেখতাম। প্রকৃতির বিহ্বলতায় আতুরা রমণীর মনে এই মুহূর্তে আমরা পুরুষের সঙ্গকামনার উৎস দেখতে পাচ্ছি। তিনি মহারাজ উগ্রসেনের কথা ভাবছিলেন, তাকে কাছে পেতে চাইছিলেন–স্ত্রীধর্ম অভিরোচয়ৎ। ঠিক এই মুহূর্তে, মহারাজ উগ্রসেন নয়, আরও একটি মানুষকে সেই সুমুন পর্বতের উদ্ধত ভূমিতে রথ থেকে অবতরণ করতে দেখছি। হরিবংশ ঠাকুর আমাদের পৌরাণিক কল্পনাপুষ্ট করে এই পুরুষটিকে ‘দানব’ বলে ডেকেছেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাকে সৌভপতি বলে চিহ্নিত করে এই পুরুষটির মনুষ্য-পরিচয়ও আচ্ছন্ন করেননি–অথ সৌভপতিঃ শ্রীমান্ দ্রুমিলো নাম দানবঃ।

সৌভপতি দ্রুমিল। সেই রথচারী পুরুষের নাম। হরিবংশের কম্বক ঠাকুর যই বলুন দ্রুমিল দানব বিমানে চড়ে মনোরথগতিতে এসে নামলেন সেই পর্বত্রে শিখরে, আমরা জানি সৌভদেশটার ভূগোল জানলেই আর কোনও দানবের গোল থাকবে না এই কাহিনীর মধ্যে। বস্তুত সৌভপুর বলে এষ্টা জায়গা আছে যেখানে শাম্বরা থাকতেন। মহাভারতে এক শাম্ব রাজার সঙ্গে ভীষ্মের এবং অন্য এক শাত্ব রাজার সঙ্গে কৃষ্ণের যুদ্ধ হয়েছিল। এই শা রাজারাই সৌভদেশে থাকতেন। শাম্ব শব্দটা একটি মানুষের নামমাত্র নয়, এটি একটি জাতির নাম, যাঁদের রাজধানী ছিল সৌভপুর।

পারজিটার লিখেছেন- শাল্ব-রাজারা থাকতেন রাজস্থানের আবু পাহাড়ের কাছাকাছি। অন্যেরা বলেন শাম্বরা যমুনা থেকে সিন্ধু নদীর তীর পর্যন্ত মোটামুটি ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রাচীন ব্রাহ্মণ-গ্রন্থগুলিতে অবশ্য যমুনা নদীর তীরেই শাহুদের নিবাস নির্ণীত হয়েছে। মহাভারতে শাশ্ব-মৎস্যদের দ্বন্দ্ব সমাস (শা-মৎস্যাস্তথা) দেখে মনে হয় শাদের সঙ্গে মৎস্য-দেশের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। সে যাই হোক, যমুনাপারের দেশই হোক আর রাজস্থানের কোনও জায়গার মানুষই হোন সৌভপতি মিল যমুনা নদী বা হরিবংশ কথিত সুমুন পর্বতের থেকে বহু দুরে। কোথাও থাকতেন না। অন্যদিকে মৎস্যদেশে আলোয়ার বা আবু-পাহাড়ের কাছাকাছি যেহেতু মগধরাজ জরাসন্ধের আত্মীয়-পরিজনেরাই রাজত্ব করতেন, তাই আমাদের দৃঢ় অনুমান এই সৌভপতি জরাসন্ধেরই অনুগত কেউ। রাজা বলে তাকে প্রথমে ডাকা হয়নি, কারণ তিনি রাজা ছিলেন না। আমদের এই অনুমান আরও সুদৃঢ় হবে যখন পরে আমরা জরাসন্ধের সঙ্গে শাব রাজার প্রগাঢ় বন্ধুত্বের প্রমাণ দেব। মহাভারতের শাল্বকেই সৌভপতি বলা হয়েছে কাজেই হরিবংশে যে সৌভপতি দ্রুমিলকে এক্ষুণি সুযামুন পর্বতে এসে পৌঁছতে দেখলাম, তিনি অবশ্যই শাল্বরাজের লোক ওরফে জরাসন্ধের লোক

পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী দানব দ্রুমিল একচারিণী উগ্রসেন-পত্নীকে পর্বতের শোভা-বিবর্তের মধ্যগত অবস্থায় নিরীক্ষণ করে রূপমুগ্ধ হলেন এবং তিনি নাকি ধ্যানযোগে জানতে পারলেন যে, রমণী উগ্রসেনের পত্নী। সৌভপতি তখন উগ্রসেনের রূপ ধরে সামা সেই রমণীর সঙ্গে সুরত-ক্রীড়ায় মত্ত হলেন। উগ্রসেনের পত্নী প্রথমে কিছুই নাকি বোঝেননি, তারপর দানব দেহের অতিরিক্ত ভারে তিনি সচেতন হন এবং সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, ধৃষ্ট নায়ক উগ্রসেন নন।

আমাদের ধারণা–এ সব কথা উগ্রসেনের পত্নীর সতীত্ব রক্ষার জন্যই ব্যবহৃত। নইলে সৌভপতি পর্বত-বন-বিহারিণী একাকিনী রমণীকে ধর্ষণ করেছেন সুযোগ বুঝে এবং উগ্রসেনের পত্নী তা মেনে নিয়েছেন নিরুপায় এবং বাধ্য হয়ে। ঘটনা যা ঘটার ঘটে গেল। ধর্ষিতা উগ্রসেনপত্নী স্বামী ছাড়া অন্য মানুষের দ্বারা ধর্ষিত হলেন এবং ধর্ষণ একান্তভাবেই দানবোচিত বলেই তিনি দানবরাজ দ্রুমিল। যাই হোক, উগ্রসেনের পত্নী সক্রোধে বলে উঠলেন–তুই কে? এমন করে আমার স্বামীর রূপ ধারণ করে আমার সতীত্ব নষ্ট করলি? আমার আত্মীয়-স্বজন এখন আমাকে কীই বা না বলবে এবং সেইসব নিন্দাবাদ শুনে কীভাবেই বা আমি বেঁচে থাকব–কিং মা’ বক্ষ্যন্তি রুষি বান্ধবাঃ কুলপাংসনীম?

সৌভপতি অনেকক্ষণ গালাগালি শুনলেন, তারপর এক সময় ধৈর্য হারিয়ে বলে উঠলেন– দেখ রমণী। অনেকক্ষণ তুমি বিজ্ঞের মতো কথা বলছ-মুড়ে পণ্ডিতমানিনি। আমি সৌভপতি দ্রুমিল, এমন কিছু হেঁজি-পেজি লোক নই আমি যে এত বকতে হবে। দেবতা-দানবদের সঙ্গে একটু ব্যভিচার করলে তোমার মতো মানুষের এমন কিছু দোষ হয়ে যায়না। এই রকম ব্যভিচারের ফলে কত কত মানুষী রমণীর গর্ভে কত শত নামকরা দেবতার মতো ছেলে হয়েছে শুনেছি। সেখানে তুমি এমন করে চুল-ফুল-কাঁপিয়ে ঘৃতশুদ্ধ সতীত্বের বড়াই করছ যেন কীই না কী ঘটে গেছে– শুদ্ধা কেশান্ বিধুম্বন্তী ভাষণে য যদিচ্ছসি? আমি বলি কি, ওগো বড়ো মানুষের মেয়ে! তুমি যে আমাকে বড় মুখ করে জিজ্ঞাসা করলে-স্য তুং- তুই কার ছেলে, এর থেকেই তোমার ছেলের নাম হবে কংস।

হরিবংশে অন্যত্র উগ্রসেনের নয় ছেলের লিস্টি দেবার সময় কংসের নাম করে আলাদাভাবে বলেছেন- কংসন্তু পূর্বজঃ। এখন এই পূর্বজ’ মানে সবার আগে জন্মানো জ্যেষ্ঠ পুত্রও যেমন হতে পারে তেমনই হতে পারে-কংস অন্য সময়ে অন্যভাবে আগে জন্মেছিলেন। দাম্পত্য সরসতার ফল তিনি নন, তিনি উগ্রসেনের ক্ষেত্রজ পুত্রমাত্র। কংসের নিজের মুখ দিয়েই এ কথা পরে বেরিয়েছে ক্ষেত্রজোহং সুতস্তস্য উগ্রসেনস্য হস্তিপ।

সেকালের দিনে পত্নীগর্ভজাত এইরকম ক্ষেত্ৰজ পুত্রকে ত্যাগ করার রীতি ছিল না। বরং সে পুত্রকে সাদরে মানুষ করার মধ্যেই বংশের সম্মান ছিল। কিন্তু কংস বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে সেইসব দুর্লক্ষণ প্রকাশ পেতে আরম্ভ করল, যা একজন বড় বংশের ছেলের মানায় না। অত্যাচার এবং রাজ্যকামিতা তাকে পেয়ে বসল। আমাদের ধারণা, তার জন্মদাতা। সৌভপতির সঙ্গে কংসের যোগাযোগ নাই থাক, কিন্তু মগধরাজ জরাসন্ধের সঙ্গে তার দৃঢ় যোগাযোগ ছিল। হয়তো কংসের আনুক্রমিক দুর্ব্যবহারে তার মাতা-পিতাও তার প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে পড়েন। তারা সাময়িকভাবে তাদের জ্যেষ্ঠপুত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। কংস নিজেই এক সময় এ কথা বলেছেন–আমি নিজের ক্ষমতায় বড় হয়েছি, বাপ-মা আমাকে কোনও সুযোগ দেননি, তাঁরা আমায় ত্যাগ করেছেন- মার্তৃভ্যাং সত্যক্তঃ স্থাপিতঃ স্বেন তেজসা।

উগ্রসেনের সঙ্গে তার ক্ষেত্রজ পুত্রের তিক্ত সম্পর্কের সম্পূর্ণ সুযোগ নেন মগধরাজ জরাসন্ধ। কংসের সঙ্গে তিনি আত্মসম্পর্ক গড়ে তোলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। জরাসন্ধের দুটি মেয়ে ছিল। তাদের নাম অস্তি আর প্রাপ্তি। মথুরা-শূরসেন অঞ্চলে উঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরবার জন্য তিনি এই মেয়ে দুটির বিয়ে দেন কংসের সঙ্গে। কংস জরাসন্ধের এই ব্যবহারে ধন্য হয়ে যান। বলা বাহুল্য, কংসের এই বিবাহ হয়েছিল পিতা-মাতার বিনা অনুমতিতে। জামাই কংসকে জরাসন্ধ এরপর রাজনৈতিক মদত দিতে থাকেন, যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে মধুরা-শূরসেনের রাজনৈতিক পরিবর্তনে।

কংস জরাসন্ধের সাহায্যে নিজ পিতা উগ্রসেনকে সিংহাসন থেকে হঠিয়ে দিয়ে নিজে মথুরার সিংহাসন দখল করেন। এর মধ্যে যে জরাসন্ধের সাহায্য বহুল পরিমাণে ছিল, তার প্রমাণ আছে মহাভারতের সভাপর্বে, যেখানে জরাসন্ধবধের পরিকল্পনা করার সময় বাসুদেব কৃষ্ণ নিজ মুখে যুধিষ্ঠিরকে জানিয়েছেন–বাহদ্রথ কুলে জাত জরাসন্ধের দুই মেয়ে অস্তি এবং প্রাপ্তিকে বিয়ে করে শ্বশুরের বলে বলীয়ান হয়ে কংস আমাদের যাদবকুলের আত্মীয়-জ্ঞাতিদের দলিত পিষ্ট করে ছেড়েছিল- বলেন তেন স্বজ্ঞাতী অভিভূয় বৃথামতিঃ।

পিতা উগ্রসেনকে সিংহাসনচ্যুত করেই কংস নিশ্চিন্ত থাকেননি। তিনি তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিলেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। আমরা আগেই বলেছি– যাদবদের রাজ্য ছিল প্রধানত সংঘনির্ভর অলিগার্কি-গোছের। অন্ধক, কুকুর, বৃষ্টি, শৈনেয়- এইভাবে অন্তত আঠারটা সংঘের কথা আমরা কৃষ্ণের মুখে পরবর্তীকালে শুনব। উগ্রসেন যদি কারাগারের বাইরে থাকেন, তবে যদি তিনি যদু-বৃষ্ণি সংঘের সকলকে একত্রিত করে কংসের বিরুদ্ধে প্রত্যাক্রমণ রচনা করেন, তবে যে স্বনিযুক্ত মথুরাধিপতি কংসের সমূহ বিপদ হবে, সে কথা কংস খুব ভাল করেই জানতেন।

ছবি। পেজ ৩৮০।

খেয়াল রাখতে হবে–যদুবৃষ্ণি সংঘের যারা প্রধান ছিলেন, তাদের ব্যবহার ছিল অনেকটা সুলতানি আমলের আমির-ওমরাহদের মতো। উগ্রসেন যেমন এঁদেরই মদতে নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তেমনই রাজা হওয়ার পর কংসেরও প্রধান কাজ ছিল– এইসব সংঘমুখ্যের মদত সংগ্রহ করা। আমরা সময়মতো প্রমাণ করে দেখাব যে অন্ধকসংঘ, কুকুরসংঘ, বৃষ্ণিসংঘ, পৃঞ্চিসংঘ, ভোজসংঘ, শিনিসংঘ–এইসব যদুসংঘের বেশিরভাগ প্রধান পুরুষেরাই সাময়িকভাবে কংসের রাজসভা অলঙ্কৃত করেছেন। অর্থাৎ ভয়েই হোক অথবা ঝামেলা এড়ানোর জন্য সংঘমুখ্যরা অনেকেই কংসকে মদত দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু রাজসভার অলংকার হলেও এঁদের মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চয়ই ছিলেন যারা সামনাসামনি কংসের মন যুগিয়ে চললেও আড়ালে সিংহাসনচ্যুত রাজা উগ্রসেনের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন এরকমই একজন সংঘমুখ্য হলেন কৃষ্ণের পিতা বসুদেব।

এই তালিকাটি সম্পূর্ণ নয়। একেবারে নির্ভুলও নয়। তবে এটা থেকে যদুবৃষ্ণিদের সংঘ-মুখ্যদের একটা আঁচ পাওয়া যাবে। এঁদের মধ্যে বয়সেরও সমস্যা আছে। সমসাময়িক হলেও কেউ বয়োজ্যেষ্ঠ, কেউ বা বয়ঃকনিষ্ঠ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *