০৪০. শুক্রাচার্যের অভিশাপ

৪০.

শুক্রাচার্যের অভিশাপে যযাতির শরীরে অকালে নেমে এল দুর্জয় জরা। অলৌকিক দৃষ্টিতে ব্রাহ্মণের অভিশাপে যযাতির বার্ধক্য ব্যাখ্যা করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। কিন্তু লৌকিক দৃষ্টিতে এই জরা-বস্তুটি যে কী–তা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। আমরা অবশ্য এই ঘটনার মধ্যে সেই ব্রাহ্মণ-সমাজের অধিরোহণ দেখতে পাচ্ছি। পূর্বে পুরূরবার ক্ষেত্রে এবং নহুষের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ-সমাজ ক্ষত্রিয়ের অধিকার যেভাবে খর্ব করেছিলেন, হয়তো যযাতির ক্ষেত্রেও তাই হল। জরা বা বার্ধক্য রাজত্ব ছেড়ে যাবার প্রতীক। সেকালের রাজারা বৃদ্ধ বয়সে পুত্রকে রাজত্ব দিয়ে বানপ্রস্থে যেতেন। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি আছে। এক্ষেত্রে যযাতিকে অকাল-বার্ধক্যের অভিশাপ দিয়ে অকালে রাজত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হল হয়তো। আমাদের ধারণা– একটি বৃদ্ধ লোকের জীবনে খাওয়া-দাওয়ার লঘুতা থেকে আরম্ভ করে ইন্দ্রিয় সংযমের যে স্বাভাবিক শাস্তি নেমে আসে সেই সমস্ত সংযম-নিয়মের বিধি-বাধন ‘আকালিকভাবেই যুবক যযাতির ওপর নিক্ষেপ করতে চেয়েছিলেন শুক্রাচার্য। শর্মিষ্ঠার সঙ্গরঞ্জিত যযাতির জরার তাৎপর্য হয়তো এইখানেই। এর সঙ্গে ছিল রাজত্ব কেড়ে নেওয়ার বঞ্চনা।

যযাতির যৌবন ফিরে পাবার কথা অতিলৌকিক বিশ্বাসের মধ্যেই থাক। যৌবনের প্রতীক রাজত্বটুকুই যযাতি আরও বেশিদিন ভোগ করতে চেয়েছেন বিশ্বস্ত একটি পুত্রকে রাজ্যের আশ্বাস দিয়ে। জরা, বার্ধক্য–এসব অভিশাপের তাৎপর্য যাই হোক, যযাতি দেবযানীর ‘যৌবনটুকু নিজের স্বার্থ হিসেবে দেখিয়ে তার রাজত্ব রাখতে পেরেছিলেন আরও কিছুদিন এবং পরবর্তী রাজপরম্পরাও সৃষ্ট হয়েছে তারই অধীনে। ব্রাহ্মণরা শুক্রাচার্যের আজ্ঞাবাহী ছিলেন কি না জানি না, কিন্তু তাঁরা যে ব্রাহ্মণ শুক্রাচার্যের বংশধারায় আসা দেবযানীর প্রথম সন্তানটিকে রাজা হিসেবে চেয়েছিলেন, সে কথা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে আমাদের পরবর্তী আলোচনায়।

 যযাতি রাজধানীতে ফিরে এসে তার প্রথম সন্তান যদুকে বললেন–শুক্রাচার্যের অভিশাপে আমার এই অবস্থা, চুল পেকে গেছে, শরীরের মাংস শিথিল হয়ে গেছে। আমার বার্ধক্য তুমি নাও, যৌবনসুখ অনুভব করি। হাজার বছর চলে গেলে আবার আমি তোমার জরা গ্রহণ করব, তুমি তখন যৌবন ফিরে পাবে, রাজা হবে। যদু বললেন-এখনই বার্ধক্য এলে ভালমন্দ খাওয়া-দাওয়া তো সব মাথায় উঠবে- জরায়াং বহববা দোষাঃ পানভোজনকারিতাঃ। শরীর ঝুলে যাবে, দাড়ি হবে সাদা, আমার জোয়ান বন্ধুরা এখন আমায় কী যা-তা সব বলবে বলতো-সহোপজীবিভিশ্চৈব পরিভূতঃ সযৌবনৈঃ। তুমি বাপু তোমার অন্য যেসব সুপুর ছেলে আছে, তাদের বলো তোমার জরা গ্রহণ করতে, আমি পারব না।

 যযাতি জ্যেষ্ঠ পুত্রকে অভিশাপ দিলেন–তুমি আমার হৃদয় থেকে জন্মেও যখন আমার একটা ইচ্ছা পূরণ করলে না, তখন জেনে রেখো, তোমার বংশে কেউ কোনওদিন রাজা হবে না–তদরাজ্যভাক্ তাত প্রজা তব ভবিষ্যতি। যযাতি দেবযানীর গর্ভজাত দ্বিতীয় পুত্র তুর্ককেও ওই একই কথা বললেন। উত্তরও এল একই রকম। যযাতি তাকে বংশলোপের অভিশাপের সঙ্গে অন্ত্যজ এবং ম্লেচ্ছদের রাজা হবার অভিশাপ দিলেন। শর্মিষ্ঠার প্রথম পুত্র দ্রুহ্যুকেও যযাতি জরা গ্রহণের অনুরোধ করলেন। তিনিও স্বীকৃত হলেন না। যযাতির অভিশাপ নেমে এল- যে দেশে হাতি-ঘোড়া-পালকির ব্যবহার নেই, শুধু ভেলা আর ডিঙি নৌকাই যে দেশের একমাত্র পরিবহন, সেই দেশে তুমি সন্তানদের সঙ্গে রাজা না হয়েই থাকবে। তোমার উপাধি হবে ‘ভোজ। চতুর্থ পুত্র অনু জরা নিতে অস্বীকার করায় তাকেও অভিশাপ শুনতে হল যযাতির কাছ থেকে।

এJ কনিষ্ঠ পুত্র পুরু অন্তত তাকে হতাশ করবেন না–মত্ত্বা পুরুমল ঘন–এই বিশ্বাসে যযাতি পুরুকে তার জরাগ্রহণের অনুরোধ জানালেন। সত্যিই যযাতির আশা সার্থক করে দিয়ে পুরু বললেন– আপনি যা বলবেন, আমি তাই করব– যদাখ মাং মহারাজ তং করিষ্যামি তে বচঃ। আপনি আমার যৌবন গ্রহণ করুন, আমি আপনার বয়স, রূপ এবং পাপ- সবই গ্রহণ করছি। যযাতি পরম সুখী হয়ে তাকে বর দিলেন- তোমার রাজ্যে সমস্ত প্রজা তাদের অভীষ্ট লাভ করবে। আশীর্বাদের পর যযাতি শুক্রাচার্যকে স্মরণ করে আপন জরা কনিষ্ঠ পুত্র পুরুর মধ্যে সংক্রমিত করলেন।

পুরু বৃদ্ধ হলেন, যযাতি যুবক। আমরা বলি– যযাতি আরও কিছুদিন রাজত্ব করার সুযোগ পেলেন। বয়সোচিত ভোগ-উপভোগ– এসব তো দিন দিন বেড়েই চলল। এবং শুধু দেবযানীই নয়, স্বর্গের অপ্সরা বিশ্বচী থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য কিছু রমণীও এসে পড়লেন যযাতির ভোগের উপবৃত্তে। তবে এই যৌবনের সম্ভোগসর্বস্বতার মধ্যেও যযাতিকে আমরা রাজ্যশাসনে বড়ই তৎপর দেখতে পাচ্ছি। দেবতা থেকে দারিদ্রের সেবা, পিতৃযজ্ঞ থেকে অতিথিসেবা–এই সব জনতপণের বিষয় যদি সেই রাজশাসনের অন্তরঙ্গে থেকে থাকে তবে তার বহিরঙ্গে ছিল দস্যুদের নিগ্রহ এবং সামন্ত রাজাদের দমন তথা তুষ্টি। ভোগে এবং শাসনে যযাতির মর্যাদা দেবরাজ ইন্দ্রের মাহাত্ম স্পর্শ করল–যযাতিঃ পালয়ামাস সাক্ষাদিন্দ্র ইবাপর।

যযাতির এই চরম ভোগর মধ্যে একটা চরম কষ্টও ছিল- তৃপ্তঃ খিন্নস্ট পার্থিবঃ। কনিষ্ঠপুত্র পুরুকে তিনি রাজ্যের আশ্বাস দিয়ে রেখেছেন। যযাতির অকালবার্ধক্য মাথায় বহন করে যুবক বয়সী পুরু হয়তো রাজোচিত পান-ভোজনে বিরত ছিলেন, এবং এই কষ্ট তার জ্যেষ্ঠ পুত্র যদু স্বীকার করে নিতে চাননি। হয়তো বয়সসাচিত রমণীর সঙ্গসুখ যার অভাব ঘটবে বলে যযাতির দ্বিতীয় পুত্র তুর্বসু জরা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সেই কামভোগপ্রণাশিনী’ একটি অস্বাভাবিক অবস্থা পুরু হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে বরণ করেছিলেন পিতার জন্য। যযাতির তৃতীয় পুত্র দ্রুহ্যু বলেছিলেন–জরা গ্রহণ করলে হাতি-ঘোড়া-রথে চড়া দুষ্কর হয়ে পড়বে, দুষ্কর। হবে স্ত্রী সম্ভোগ, হয়তো এই যুবক বয়সেই পুরু স্বেচ্ছায় ভোগ করতেন না রাজোচিত পরিবহন বরারোহণ-হাতি, ঘোড়া, রথ অথবা স্ত্রী সম্ভোগন গজং ন রথং নাম্বং জীর্ণো ভুক্তো ন চ স্ক্রিয়ম্।

পুরুর এই স্বেচ্ছাকৃত উপভোগ নির্বাসনেই হয়তো জরা সংক্রমণের তাৎপর্য, যা যযাতি। সাময়িকভাবে পরিহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পৌরাণিক সংখ্যায় হাজার বছর অথবা অনেক সময় যখন কেটে গেল তখন যযাতির অন্তরে কষ্ট হল। পুরুকে ডেকে তিনি বললেন পুরু! তোমার কাছ থেকে যৌবন লাভ করে আমি যেমন ইচ্ছে তেমন ভোগ করেছি। সময়ও পেয়েছি অনেক, উৎসাহও কিছু কম ছিল না। কিন্তু শরীর-মনের অন্তঃস্থিত কামনা এমনই এক বস্তু, বাছা! যা কেবল বেড়েই চলে, কমে না। আগুনে ঘি দেওয়ার মতো মনের ইন্ধন জোগালেই কামনা বাড়ে-হবিধা কৃষ্ণবর্বে ভূয় এবাভিবর্ধতে। যতি এবার একটু আত্মস্থ হয়ে বললেন–আমি ভেবেছিলাম যথেষ্ট ভোগ করলে আমার আর কোনও ভোগতৃষ্ণা থাকবে না। কিন্তু দেখলাম সেটা মস্ত ভুল। এখনও আমার লালসার কোনও নিবৃত্তি নেই। আমি তাই ঠিক করেছি এবার বামপ্রস্থে গিয়ে পরম ঈশ্বরের উপাসনায় মনোনিবেশ করব। তুমি তোমার যৌবন গ্রহণ কর এবং এই রাজাও গ্রহণ কয়রাজদং গৃহাণ ত্বং… গৃহাশেদং স্বযৌবন।

যযাতি পুনরায় পলিতকেশ বৃদ্ধে পরিণত হলেন এবং কনিষ্ঠ পুত্র পুরুকে রাজ্যের রাজা হিসেবে অভিষেক করবেন বলে ঠিক করলেন। ঠিক এই সময়ে লক্ষ্য করে দেখুন-ব্রাহ্মণ সমাজের পক্ষ থেকে একটা প্রতিবাদ জানানো হল। তারা যযাতিকে বললেন–যদু আপনার পুত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্র। শুধু তাই নয়, সে দেবযানীর পুত্র, স্বয়ং শুক্রাচার্যের নাতি। সেই যদুকে অতিক্রম করে আপনি কনিষ্ঠ পুরুকে রাজা করছেন, এটা কেমন করে সম্ভব-জ্যেষ্ঠং যদুমতিক্রম্য পুরোঃ রাজ্যং প্রযচ্ছসি?

আমি এর আগে তর্ক করে বলেছিলাম–শুক্রাচার্য যযাতিকে জরা-সংক্রমণের অনুমতি দিয়ে কোনওভাবে আশা করেছিলেন যে, যদু তার পিতার জরা গ্রহণ করতে স্বীকৃত হবেন এবং সেই সূত্রে রাজ্যের অধিকারও পাবেন। অন্যদিকে যযাতি এমনভাবেই কথাটা পেড়েছিলেন, যাতে সিদ্ধান্তটা যযাতিরই শর্তাধীন হয়ে গিয়েছিল। শুক্রাচার্যের হিসেব মেলেনি, কিন্তু তার বংশধারায় আসা দেবযানীর পুত্র যদু এবং তুর্বসু কেউই যখন রাজ্য পেলেন না, তখন ব্রাহ্মণরা খুব নৈর্ব্যক্তিক একটা ভাব দেখিয়ে প্রতিবাদ করলেন। অর্থাৎ তারা যেন শুধু দেবযানীর পুত্রদের। কথা বলছেন না। যদু, তুর্বসু, দ্রু, অনু–সবাই যখন এঁরা পুরুর জ্যেষ্ঠ, তবে কেন কনিষ্ঠ পুরু রাজা হবেন– এই কথাই যেন তারা বলছেন। কিন্তু আমরা জানি, বিশেষত ওই সামান্য কথাটির মধ্যেই সমস্ত রহস্য লুকিয়ে আছে-কথং শুক্ৰস্য নারং দেবযান্যাঃ সুতং প্রভো-শুক্রাচার্যের নাতি এবং দেবযানীর পুত্র যদুকে অতিক্রম করে কেন আপনি পুরুকে রাজ্য দিচ্ছেন? এই কথাটা বলে ফেলার পরেই সাধারণ অন্বয়ে অন্যান্য বড় ভাইদের নাম এসেছে। কিন্তু প্রতিবাদটা রয়ে গেছে বহুবচনে-কেমন করে বড় ভাইদের টপকে একজন ছোট ভাই রাজ্য পায়–কথং জ্যেষ্ঠানতিক্রম্য কনীয়ান্ রাজ্যমহতি?

যযাতি বললেন–জ্যেষ্ঠ হলেই তাকে আমি রাজ্য দিতে পারি না। যদু আমার আদেশ-অনুরোধ পালন করেনি। যে পুত্র পিতার আদেশ পালন করে না, জ্যেষ্ঠ হলেও তাকে আমি রাজ্য দিতে পারি না–আমি কোনও একটি পুরাণে দেখেছি, যদিও এখন সেই পুরাণটির নাম মনে করতে পারছি না সেখানে যযাতি বলছেন- যে ছেলে বাপ-মায়ের কথাই শোনেনি সে লক্ষ লক্ষ প্রজার অনুরোধ শুনবে কী করে? যযাতি এইভাবে যদু, তুসু প্রমুখ। পুত্রের রাজ্যপ্রাপ্তির যুক্তি প্রত্যাখ্যান করলেন এবং পরিশেষে এ বিষয়ে স্বয়ং শুক্রাচার্যের পূর্বানুমতি এবং সম্মতির কথা জানিয়ে কনিষ্ঠ হলেও পুরুর রাজ্যপ্রাপ্তির কথা প্রতিস্থাপন করলেন– শুক্রেণ চ বরো দত্তঃ কাব্যেনোশনসা স্বয়ম্।

এখানে আরও একটা ঘটনা লক্ষণীয়। জ্যেষ্ঠ পুত্র যদুর বিষয়ে যখন প্রতিবাদ এল যযাতির কাছে, তখন প্রতিবাদীদের সামাজিক অবস্থান উল্লেখ করা হচ্ছে মাত্র দুটি কথায়– ব্রাহ্মণপ্রমুখ বর্ণাঃ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ প্রভৃতি সমস্ত বর্ণের লোকেরাই যযাতির কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, যদিও ‘প্রমুখ’ শব্দটির দ্বারা প্রধানত ব্রাহ্মণদেরই বোঝায়, তাই আমরাও স্বতর্ক স্থাপনের জন্য তাই বুঝিয়েছি। এর পরে যযাতি যখন সবার সামনে নিজের যুক্তি বোঝাচ্ছেন, তখনই কিন্তু ওই সামান্য কথাটি ব্রাহ্মণ-প্রমুখ বর্ণাঃ যেন একটি বিশদাকার জন-সমুহের রূপ নিচ্ছে। যযাতি বলছেন-সবাই শুনুন, ব্রাহ্মণ প্রমুখ যত বর্ণ আছে সবাই মন দিয়ে শুনুন আমার কথা–ব্রাহ্মণপ্রমুখ বর্ণাঃ সর্বে শৃন্বন্তু মচঃ। এই যে ব্রাহ্মণপ্রমুখ বর্ণ থেকে–সবাই শুনুন এইখানে একটা জনসমর্থনের কামনা আছে অর্থাৎ শুধু ব্রাহ্মণের মতো বর্ণমুখ্যরাই নন, প্রার্থনাটা সবার কাছে, সাধারণ প্রজা জনগণের কাছে- যার শেষ পরিণতি যযাতির অনুনয়-বাক্যে–আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা পুরুকে রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করুন–ভবতো’নুনয়ামেবং পূর্নংরাজ্যে ভিষিচ্যতাম্।

লক্ষ্য করুন, এই মুহূর্তে, মহাভারতের কবি আর কাউকে দিয়ে কথা বলাননি। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় প্রমুখ বর্ণ নয়, এবার কথা বলছেন প্রজারা প্রকৃতয় উচুঃ  তাঁরা যযাতির কথা মেনে নিচ্ছেন। বাবা-মার কথা শুনছে এমন একটি প্রিয় পুত্রের কামনা তাদের নিজেদের ঘরেও রয়েছে। তারা বলছেন–হ্যাঁ হ্যাঁ এই পুরুকেই রাজ্য দেওয়া হোক, যে তোমার কথা শুনেছে– অর্থঃ পুরুরিদং রাজ্যং যঃ পুত্রঃ প্রিয়কৃত্তব। তাছাড়া মহামতি শুক্রাচার্য তো এই সম্মতি দিয়েই রেখেছেন, তারপরে আবার কথা কী? এই শেষ কথাটি ব্রাহ্মণপ্রমুখদের মুখ বন্ধ করার জন্যই। মহাভারতের কবি এবার আরও স্পষ্ট করে বললেন–যযাতিকে যারা পুরুর রাজ্যাভিষেকে সম্মতি দিলেন, তারা বর্ণশ্রেষ্ঠ কেউ নন, তারা সব পুরবাসী, জনপদবাসী সাধারণ মানুষ–পৌরজানদৈস্তুষ্টৈরিত্যুক্তো নাহুষস্তা।

বলতে পারেন–এও এক ধরনের ইলেকশন’। ব্রাহ্মণ এবং অভিজাত সম্প্রদায় রাজা-নির্বাচনের ব্যাপারে যত বড় ভূমিকাই পালন করুন, তাঁদের কথা এবং বাদ-প্রতিবাদের থেকেও বড় হয়ে উঠল পৌরজন, জানপদ-জনের সমর্থন। পরবর্তী কালের বংশ-পরম্পরায় জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র এবং কনিষ্ঠ পাণ্ডুর রাজ্যপ্রাপ্তি নিয়ে যে গণ্ডগোলের সৃষ্টি হবে, সেখানে প্রামাণিকতা বা নজির হিসেবে খেয়াল রাখতে হবে এই ঘটনাটি। আরও খেয়াল রাখতে হবে যে, চন্দ্রবংশের পরম্পরায় রাজা নির্বাচন শুধুমাত্র সমাজমুখ্যদের তর্জনী সংকেতে অনুষ্ঠিত হত না, দরকার পড়লে সাধারণ মানুষও সেখানে উপযুক্ত ভূমিকা নিতেন নীতি-যুক্তির পথে থেকেই।

রাজা হিসেবে পুরুর নির্বাচনের পর পরই মহারাজ যযাতি মুনিব্রত ধারণ করে বনে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন–দত্তা চ পুরবে রাজ্যং বনবাসায় দীক্ষিতঃ। রাজধানী ছেড়ে ব্রাহ্মণ-সজ্জনের সঙ্গে যযাতি বনে প্রস্থান করবার সঙ্গে সঙ্গেই আমরাও কিন্তু এক মহান সঙ্কটের মধ্যে পড়ে গেলাম। একদিকে আছে এক ধরনের তাত্ত্বিক সঙ্কট, যা আমাদের পাঠকদের ধৈর্য ক্লিষ্ট করবে; অন্যদিকে আছে রাজনৈতিক সঙ্কট, যা আমাদের মহাভারত-পাঠের সহায় হবে। আমাদের তাত্বিক সঙ্কট মহারাজ যযাতিকে নিয়ে। যযাতি মুনিব্রত গ্রহণ করে তপস্যার বলে স্বর্গরাজ্য লাভ করেছিলেন। কিন্তু স্বর্গরাজ্যে প্রচুরতর ভোগ এবং তারপর বহুতর তত্ত্বজ্ঞানের পরেও কোনও এক সময় ইন্দ্রের সঙ্গে কথোপকথনকালে যযাতির কিছু অহঙ্কার প্রকাশ পায়। তিনি স্বর্গ থেকে পতিত হন। এই স্বর্গচ্যুতির পর যযাতির আবাস গড়ে ওঠে রাজর্ষি অষ্টকের সাধনভূমিতে। যযাতি এবং অষ্টকের মধ্যে ধর্ম-দর্শনের যে আলোচনা চলে, তার তাত্ত্বিক মূল্য অসামান্য। কিন্তু তবু আমরা তার মধ্যে যাচ্ছি না। কেননা তাতে মহাভারতকথার মূল পরম্পরা ব্যাহত হবে। আমরা বরং স্বর্গগত যযাতির সঙ্গে ইন্দ্রের যে কথোপকথন হয়েছিল, তার মধ্য থেকে একটি কি দুটি পংক্তি উদ্ধার করতে চাই। তাতেই আমাদের পূর্বকথিত রাজনৈতিক সঙ্কটের মূল সূত্রগুলি পরিষ্কার হয়ে যাবার সম্ভাবনা।

পুরুর রাজ্যাভিষেক এবং যযাতির বনগমনের প্রসঙ্গ শেষ করেই মহাভারতের কথকঠাকুর বৈশম্পায়ন শ্রোতার আসনে বসা জনমেজয়কে বলেছিলেন–মহারাজ! মহারাজ পুরু থেকেই এই পৌরব-বংশ, যার শেষ অধস্তন পুরুষ হলেন আপনি–পুরো পৌরবো বংশো যত্র জাতোসি পার্থিব। আমাদের ধারণা রাজ্যশাসনের জন্য পুরু উত্তরাধিকার সূত্রে যে ভূখণ্ডটি পেয়েছিলেন তা হল সেই পূর্বতন ভূখণ্ড- যার নাম প্রতিষ্ঠানপুর। আগেই বলেছি প্রতিষ্ঠান হল সেই পৈঠান বা পিরান, যা ইলাহাবাদের কাছে গঙ্গা-যমুনার জল ধোয়া অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বর্গের ইন্দ্র যযাতিকে প্রশ্ন করেছিলেন- আপনি পুরুকে রাজ্য দিয়ে কী কী উপদেশ দিয়েছিলেন? উত্তর দেবার সময় যযাতি বলেছিলেন- আমি পুরুকে শেষ উপদেশ দেওয়ার সময় বলেছিলাম– পুরু! এই গঙ্গা এবং যমুনার মধ্যদেশে অবস্থিত সমস্ত ভূখণ্ডই তোমার–গঙ্গা-যমুনয়োর্মধ্যে কৃৎস্না’য়ং বিষয়স্তব। যযাতি আরও বলেছিলেন- আর তোমার ভাই-দাদারা হলেন তোমার রাজ্যের প্রান্তদেশের রাজা- ভ্রাতরোত্যাধিপাস্তব।

যাতি পুরু আরও যেসব উপদেশ দিয়েছিলেন, তা যথার্থ হলেও এখানে তার অবতারণা করছি না। কারণ আপাতত আমরা এক রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে আছি। যযাতি যে ভূখণ্ডে রাজত্ব করছিলেন, পুরু সেই ভূখণ্ডই উত্তরাধিকারসূত্রে পান এবং যযাতির মতে সেখানে রাজা। হতে পারাটাই যথার্থ রাজা হতে পারা। নইলে যযাতি তার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে অভিশাপ দিয়েছিলেন–তুমি রাজা হতে পারবে না–অথচ দেখা যাবে তিনিও কোনও না কোনওভাবে রাজাই ছিলেন, যদিও কোনওভাবেই সেটা প্রতিষ্ঠানপুরের মূল ভূখণ্ডে নয়। যদু, তুর্ক, দ্রুহ্যু এবং অনু পুরুর রাজ্য ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেন–যযাতির মতে সেটা ভারতবর্ষের প্রান্ত দেশ- ভ্রাতরো’ত্যাধিপাস্তব।

যদু, তুর্বসু, দ্রুহ্যু, কিংবা অনু কোথায় গিয়ে রাজত্ব স্থাপন করেছিলেন, তা হয়তো স্পষ্ট। করে বলা যাবে না; কিন্তু অস্পষ্ট হলেও তা বলার আগে আমরা ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের একটা প্রতিপাদ্য উল্লেখ করে নিতে চাই। রমেশচন্দ্র ইলাহাবাদের কাছের ওই ভূখণ্ডটিকে চন্দ্রবংশীয় রাজাদের পরম্পরাগত আবাসভূমি বলে মানতে চাননি। তার ধারণা, চন্দ্রবংশের উত্তরপুরুষদের মধ্যে যারা অনেকেই অতি-পরবর্তী কালের, তারা এই জায়গাটায়। থাকতেন এবং পৌরাণিকেরাও অনেকে এই রাজবংশের সঙ্গে পরিচিত থাকার ফলে তারা। ইলাহাবাদের ওই অঞ্চলটিকে চন্দ্রবংশীয় রাজাদের পূর্বতন আবাস বলে স্থির করেছেন। রমেশচন্দ্র মনে করেন, মহাভারতের যযাতির সঙ্গে একমাত্র সরস্বতী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলকেই সংশ্লিষ্ট বলে মেনে নেওয়া যায় এবং যযাতির প্রসঙ্গে সরস্বতী নদীর উল্লেখও মহাভারতে পাওয়া যাবে।

পুরু যেহেতু পৈতৃক রাজ্যই পেয়েছিলেন, অতএব তিনিও এই অঞ্চলেই রাজত্ব করতেন বলে ধরে নেওয়া যায়। রমেশচন্দ্রের এই ধারণার কারণ আছে। ঋগবেদের মধ্যে যযাতি এবং তার পিতা নহুষের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে এবং যযাতির চার ছেলে যদু, তুর্বসু, দ্রুহ্য, এবং অনু- এই চারজন রাজারও উল্লেখ ভালভাবে পাওয়া যাচ্ছে। পৈতৃক রাজ্য পুরুর হস্তগত হলে অন্যান্য ভাইরা যেহেতু প্রান্ত রাজগুলিতে চলে যান, তাতে যদুর স্থান হয় পশ্চিম দিকের প্রান্ত রাজ্যে। রমেশচন্দ্র মনে করেন- ঋগবেদে যদুকে যেহেতু সরযু নদীর তীরবর্তী অঞ্চল আক্রমণ করতে দেখা যাচ্ছে এবং যেহেতু সরযূ নদীর সঙ্গে কুভা, সিন্ধু, কুমু ইত্যাদি উত্তর পশ্চিমদেশীয় নদীর উল্লেখ আছে, অতএব যদু ছিলেন ওই অঞ্চলের রাজা।

সমস্ত ঘটনা থেকে রমেশচন্দ্রর সিদ্ধান্ত হল যে, যযাতির মতো পুরনো আর্যগোষ্ঠীর রাজারা থাকতেন পাঞ্জাব অঞ্চলেই এবং পূরুর রাজধানীও সেখানেই ছিল। বেশ বোঝা যায়– রমেশচন্দ্র বেদের মধ্যে যযাতি এবং তার ছেলেদের উল্লেখ দেখেই সরস্বতী নদীর তীর ছেড়ে আর এগোতে পারেননি। সরস্বতী এবং দৃষদ্বতীর মধ্যবর্তী অঞ্চলটাই যেহেতু ঋগবৈদিক আর্যদের পূর্বাবাস বলে চিহ্নিত, এবং ঋগবেদেই যেহেতু যযাতি, যদু তুর্বদের উল্লেখ আছে, অতএব প্রতিষ্ঠান নয়, পাঞ্জাবই যযাতি-পুরুদের ভদ্রাসন– এই হল রমেশচন্দ্রের সিদ্ধান্ত।

কথাটার যৌক্তিকতা যথেষ্টই আছে এবং পরবর্তী কালে ভাষাতত্ত্বের নিরিখেও এই যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতেও অসুবিধে হয় না। এমন হতেই পারে যে, জনমেজয়ের পূর্বপুরুষ কুরু-পাঞ্চালরা যেহেতু প্রতিষ্ঠানপুরে এসে বাসা বেঁধেছিলেন, তাই মহাভারতের কবি প্রতিষ্ঠানপুরকেই নহুষ-যযাতি-পুরুদের আদি নিবাস বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও ভাবতে হবে যে, ঋগবেদে যে যদু, তুর্বসু অথবা দ্রুহ্যু-অনুদের পাওয়া যাচ্ছে তারা সকলেই ছিলেন প্রায় যাযাবর আর্যজাতির এক-একটি গোষ্ঠী। প্রধানত যযাতির রাজ্যশাসনের। পরেই এরা নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন।

 বেদের মধ্যে সুদাস রাজার সঙ্গে বিখ্যাত দশ জন রাজার যুদ্ধ হয়েছিল। বিখ্যাত যুদ্ধ। ঐতিহাসিক যুদ্ধ, যার সত্যতা অস্বীকার করা কঠিন। এই যুদ্ধ দাশরাজ্ঞ যুদ্ধ বলে পরিচিত। সুদাস ছিলেন পিজবনের পুত্র। আর দশজন রাজার মধ্যে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন হলেন যযাতির পাঁচ পুত্ৰ-পুরু, যদু, তুর্বসু, দ্রুহু্য এবং অনু। এদের সবাইকে এক সঙ্গে ভারতাঃ বলা হয়েছে অর্থাৎ ভরতবংশীয়দের গোষ্ঠী। মনে রাখতে হবে–এই ভরতগোষ্ঠীর সঙ্গে মহাভারতে বর্ণিত ভরতবংশীয়দের পার্থক্য আছে। পণ্ডিতেরা মনে করেন বিশ্বামিত্র আগে ছিলেন সুদাস রাজার পুরোহিত। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক সুদাস এক সময় বিশ্বামিত্রকে ছেড়ে দিয়ে বশিষ্ঠকে পুরোহিত হিসেবে বরণ করেন। ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ বিশ্বামিত্র ভরতগোষ্ঠী অর্থাৎ দশ রাজার জোটে যোগ দেন।

ভারি সুন্দর বর্ণনা আছে ঋগবেদে। মন্ত্রগুলি শুনলেই বোঝা যায়–দশ রাজার দল অর্থাৎ পুরু, যদু, দ্রুরা অন্যান্য রাজাদের সঙ্গে শত বিপাশার বেলাভূমিতে উপনীত হয়েছেন, আর বিশ্বামিত্র তাদের জয়ের জন্য ইন্দ্রের কাছে স্তব করছেন। কী অসাধারণ উপমাতে যে বিশ্বামিত্র এই দুই নদীর কবিকল্প স্থাপন করেছেন, তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। কবি বলছেন– জলপ্রবাহবতী বিপাশা আর শুতুদ্রী! তোমরা কেমন পাহাড়ের কোল থেকে জন্ম নিয়ে সাগর-সঙ্গমের অভিলাষে লাগামছাড়া ঘোটকীর মতে, বৎসলেহনাভিলাষিণী গাভীর মতো ছুটে চলেছ- প্র পর্বতানামুশতী উপস্থাদশ্বে ইব বিষিতে হাসমানে।

 অনেক মধুর বর্ণনার পর বিশ্বামিত্রের বর্ণনার উচ্ছ্বাস নেমে এসেছে–আমি দূর থেকে রথ-ঘোড়া সব নিয়ে এসেছি। আমার বোনের মতো দুই নদী আমার! তোমরা একটু নিচু হয়ে বও। তোমাদের স্রোতের জল যেন আমাদের রথের চাকার তলা দিয়ে যায়। আমরা যেন ঠিক পার হয়ে যেতে পারি নি যুনমধ্বং ভবতা সুপারা অধো অক্ষাঃ সিন্ধবঃ স্রোত্যাভিঃ। বিপাশা আর শুতুস্রী (শত) বললে শুনেছি গো শুনেছি। রথ-শকট নিয়ে দূর থেকে এসেছ তোমরা। তা বাবু আমরা নিচু হয়ে যাচ্ছি- মা যেমন তার বাচ্ছা শিশুটিকে দুধ খাওয়ানোর জন্য নিচু হয়, যুবতী যেমন প্রেমিককে আলিঙ্গন করার জন্য অবনত হয়, আমরাও তেমনি নিচু হয়ে যাচ্ছি–নি তে নংসৈ পীপ্যানেব যোবা মর্যাষেব কন্যা শশচৈ তে।

বিশ্বামিত্র দেখলেন বিপাশা-শতর স্রোতোধারা ক্ষীণ হয়ে গেছে, আর তাতে পার হয়ে। যাচ্ছে ভরতগোষ্ঠীর রাজারা। বিশ্বামিত্র বললেন- যেহেতু ভরতগোষ্ঠীর রাজারা তোমাদের ওপর দিয়ে পার হবে, যেহেতু তারা ইন্দ্রের দ্বারা প্রেরিত হয়ে পার হবার অনুমতি পেয়েছে তোমাদের কাছে যদঙ্গ বা ভারতা সন্তরেয়ু- তাই তোমরা দুই নদীই আমার স্তবের যোগ্য। ভরতবংশীয়রা যখন নদী পার হয়ে গেলেন, তখন ব্রাহ্মণরা তাদের স্তুতি করলেন অতারিষুৰ্ভরতা গব্যবঃ সমভক্ত বিপ্রঃ সুমতিং নদীনাম।

শোনা যায়–দশরাজার এই যুদ্ধে সুদাস মোটেই হারেননি। বিশ্বামিত্রের নদীস্তুতিতে শত-বিপাশা পার হতে পারলেও সুদাসের কাছে ভরতগোষ্ঠীয়রা হেরে যান–The Bharatas, Matsyas, Anus, Druhyus must have crossed the Vipasa and the Satadru in order to attack the Tritus. (সুদাস তৃষ্টু বংশের ছেলে) After the two rivers were crossed, a battle took place. পণ্ডিতেরা মনে করেন দশ-রাজার এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। সুদাসের বিরুদ্ধে তারা জিততে পারেননি। সুদাসের জন্য মঙ্গল-সূক্ত রচনা করেন স্বয়ং ঋষি বশিষ্ঠ। বারবার তিনি ঘোষণা করেন, দশ রাজার জোটকে কীভাবে সমূলে বিনাশ করেছিলেন সুদাস, বশিষ্ঠ বলেছেন- ওঁরা পারেননি। দশ জন যজ্ঞহীন রাজা (বশিষ্ঠ তাদের যজ্ঞ করেননি, অতএব যজ্ঞহীন) একসঙ্গে জোট বেঁধেও সুদাস রাজার কিছুই তে পারল না– দশ রাজানঃ সমিতা অজ্যবঃ সুদাসমিন্দ্রাবরুশা ন যুযুধুঃ। অন্যান্য ঋক্‌-মন্দ্রে দুস্থ্য এবং অনুর পুত্র এবং সেনারা সুদাসের হাতে কীভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে শায়িত হয়েছিলেন সে বর্ণনাও বশিষ্ঠের জবানিতে পাওয়া যায় নি গব্যবো’নবো বশ্চ যষ্ঠিঃ শতাঃ সুষুপুঃ ষট্‌ সহস্রাঃ।

শতদ্রু, বিপাশা এবং সিন্ধুনদীর তীরবর্তী অঞ্চলে এই যে যুদ্ধগুলি হয়েছিল, তাতে বোঝ যায় দশ রাজার জোটের সকলেই প্রায় ভারতবর্ষের উত্তরাঞ্চলেরই অধিবাসী ছিলেন। কিন্তু এই জোটের মধ্যে কখনও আমরা সদস্য বা পুরুকে সুদাসের মিত্রস্থানেও দেখছি। আবার তুর্বসু এবং যদুকে দেখছি শত্রুস্থানে। অন্যত্র আরেক জায়গায় মৎস্যদেশবাসীদের সঙ্গে সুদাসের শত্রুপক্ষকে একত্র দেখছি। মৎস্যদেশ কিন্তু আধুনিক জয়পুরের কাছে। আরও একটি জায়গায় ‘ভেদ’ নামে এক রাজার ধ্বজান্তরালস্থিত তিনটি জনগোষ্ঠীর (অজস, শিশ্রু এবং যক্ষু) সঙ্গে যুদ্ধরত দেখছি সুদাস রাজাকে, কিন্তু সে যুদ্ধ হয়েছিল যমুনার তীরভূমিতে।

আমরা যে শতদ্রু, বিপাশা নদী থেকে আরম্ভ করে যমুনা পর্যন্ত সুদাস রাজার গতি-স্থিতি দেখাতে চাইছি, তার কারণ একটাই। পরবর্তী কালে অর্থাৎ মহাভারতে কুরু রাজাদের সঙ্গে ভরতগোষ্ঠীর রাজারা (যাঁদের মধ্যে যযাতি রাজার পাঁচ ছেলেও পড়েন) একাত্ম হয়ে যান কুরবো নাম ভারতাঃ। কিন্তু অঞ্চল এবং ভূখণ্ডের নিরিখে দেখতে গেলে বলতে হবে। অনু-হুঁ-যদু-তুর্বসুদের কথা ঋগবেদে যতই শতদ্রু-বিপাশা অথবা সরস্বতী-দৃষদ্বতী নদীর তীরবাহিনী কথা হোক, কুরুদের নাম কিন্তু তখনই যথেষ্ট শোনা যাচ্ছে কুরুশ্রবণমাবৃণি রাজানং ত্রাসদস্যবস্। এই কুরুশ্রবণ’-যার অর্থ অনেকে করেছেন কুরুদের নাম শোনা যাচ্ছে’- তিনি নাকি ঝগবৈদিক সদস্যুর পুত্র। অন্যদিকে শতপথব্রাহ্মণের মতো পুরাতন ব্রাহ্মণ গ্রন্থে কৃবি’দের নাম করে বলা হচ্ছে- পুরা-কালে পাঞ্চালদেশ বলতে কৃবি’দের বোঝাত-কৃব্যা (ক্ৰিব্যা) ইতি হ বৈ পুরা পাঞ্চালান আচক্ষতে। আধুনিকমতে পাঞ্চালের অবস্থান উত্তরপ্রদেশের বেরিলিতে।

শতপথব্রাহ্মণের সময়েই সেটা পুরাকাল, সে কাল নিশ্চয়ই ঋগবেদের সময় পর্যন্ত পৌঁছবে। আবার ওই শতপথব্রাহ্মণেই দেখছি পাঞ্চাল দেশের এক রাজা সাত্রাসহ যখন যজ্ঞ করছিলেন, তখন তৃসুদের উদয় হয় এবং তারা সংখ্যায় ছিলেন ছয় হাজার ছ তিরিশ জন বর্মধারী পুরুষ।

সাত্ৰাসহে যজমানেশ্বমেধেন তৌর্বশাঃ।
উদীরতে ত্রয়স্ত্রিংশাঃ ষট্‌সহস্রাণি বর্মিণা।

 তুর্বসুদের জনসংখ্যা ঝগবৈদিক দ্রুহু্য অনুদের জনগোষ্ঠীর সংখ্যার সঙ্গে প্রায় মেলে–যষ্টিঃ সুষুপুঃ ষট্‌ সহস্রাঃ।

পরিষ্কার বোঝা যায় তুর্বসুরা যুদ্ধবীরের পোশাকে এসেছিলেন পাঞ্চালে অপিচ তুর্বসু বংশীয়দের সঙ্গে পাঞ্চাল বা কৃবির যোগ বহু পূরাতন। শতপথব্রাহ্মণের এই প্রবচনের নিরিখে পাঞ্চাল দেশে যদি বহু পূর্বেই তুর্বসুদের আগমন হয়ে থাকে, তবে আমাদের সেই প্রতিষ্ঠানপুরে পুরুর রাজ্য কল্পনা করাটাও অসম্ভব নয় এবং আরও অসম্ভব নয় এই জন্য যে, মহাভারতের দৃষ্টিতে এবং প্রবীণ ঐতিহাসিকদের মতেও কুরুদের দেশটা– Stretched from the Sarasvati to the Ganges. কাজেই ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র যযাতি-যদু-তুর্ককে যতই সরস্বতী নদীর তীরে আর্যদের পূর্বাবাসে টেনে নিয়ে যান, আমরা তাদের গঙ্গা-যমুনার তীরবাহী অঞ্চলে টেনে আনতে আগ্রহী।

.

৪১.

 যতি এবং তার পাঁচ ছেলের কথা একটু বেশি করে বলতে হল এই কারণে যে, ভারতবর্ষের উত্তর-দক্ষিণ এবং পশ্চিমের একটা বড় জায়গা জুড়ে যে কটি নামী-দামি রাজবংশের নাম ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে, তাদের অনেকই এই যযাতির পুত্রদের নামে প্রসিদ্ধ। বস্তুত যযাতির পাঁচ পুত্রের অসংখ্য বংশধরই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যুদ্ধ করে ভারতবর্ষের এক বিশাল অংশ দখল করে নিয়েছিলেন।

মহাভারতে যযাতি তার প্রিয় পুত্রদের যে কঠিন অভিশাপ দিয়েছিলেন, তাতে আপাত ভাবে মনে হতে পারে যেন পুরু ছাড়া যযাতির অন্য পুত্রেরা সকলেই ম্লেচ্ছ-যবনে পরিণত হয়েছিলেন। মহাভারতে এমনও বলা হয়েছে যে, যদু থেকেই বিখ্যাত যাদব বংশের উৎপত্তি এবং তুর্কষ্ট্র থেকে জন্ম হয়েছে যবনদের-যদোস্তু যাদবা জাতা স্তুৰ্বসোর্যর্বনাঃ স্মৃতা। যযাতির তৃতীয় পুত্র দ্রুম্যা থেকে ভোজবংশীয়রা জন্মেছেন আর অনু থেকে জন্মেছেন ম্লেচ্ছরা–অনোস্ত ম্লেচ্ছজাতয়ঃ।

আমাদের দৃষ্টিতে এই ম্লেচ্ছ-যবন ইত্যাদি শব্দের ওপর খুব বেশি জোর দেবার কারণ নেই। যাতির অভিশাপের তাৎপর্য এইখানেই যে, তিনি পিতৃ-পরম্পরাগত রাজ্য জ্যেষ্ঠ পুত্রের হাতে তুলে দেননি, কিংবা অন্য তিন পুত্রকেও দেননি, সেটা দিয়েছেন কনিষ্ঠকে। কিন্তু যযাতি বিশিষ্ট রাজা ছিলেন, তার শাসন-ভুক্ত মূল রাজ্যটি ছাড়াও প্রান্তদেশীয় রাজ্যগুলিতে তার যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল। যযাতি তার চার পুত্রকে ওই প্রান্তদেশেই ঠেলে দিয়েছিলেন। বায়ুপুরাণের মতো প্রাচীন পুরাণ এই মর্মেই মন্তব্য করেছে–যযাতি নিজের রাজ্যে পুরুকে বসিয়ে সেই রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্বে স্থাপন করেন তুর্বসুকে, দক্ষিণ-পশ্চিমে বসান যদুকে। পশ্চিম ও উত্তর ভাগে ক্রমান্বয়ে দ্রুৎ আর অনুকে রাজ্য দিয়ে যযাতি তার বিশাল রাজ্য পাঁচভাগে ভাগ করে দেন–ব্যভজৎ পঞ্চধা রাজা পুত্রেভ্যো নাহুষস্তদা। তর্কের খাতিরে মেনে নিতে পারি, হয়তো এই সব রাজ্য নির্বিঘ্নে যদু-তুর্কসুদের হাতে চলে আসেনি। তাদেরকে এই রাজ্য পেতে হয়েছিল সামান্য লড়াই করে। আরও একটা কথা, নিজের চেষ্টায় এবং তেজে যে সব জায়গায় এঁরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, সেইসব জায়গায় হয়তো আর্যেতর জাতির বসতি ছিল। পুরাণের কথক ঠাকুর তাই নির্দ্বিধায় বলে দিলেন তুর ছেলেরা সব যবন আর অনুর ছেলেরা ম্লেচ্ছ।

ঋগবেদে যদু-তুবসু এবং অনুদের যেটুকু পরিচয় আমরা পেয়েছি, তাতে তাদের যথেষ্ট যুদ্ধবাজ মনে করার কারণ আছে, কিন্তু কোনওভাবেই তারা ব্রাহ্মণ্য যজ্ঞাচারহীন ম্লেচ্ছ-যবন ছিলেন না। একথা ঋগবেদের প্রমাণেই যথেষ্ট মেনে নেওয়া যায়। যাতির অভিশাপের অনিবার্যতা মাথায় না রেখে আমরা যদি এমনটি বিশ্বাস করি যে, যদু-তুর্ক অথবা অনুরা যেখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন, সেখানকার অধিবাসীদের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে পৌরাণিকেরা তাদের বংশধরদের ম্লেচ্ছ-যবন বানিয়ে দিয়েছেন, তবে বোধ করি সেই তর্কটাই বাস্তবসম্মত হবে। কারণ, ঐতিহ্যগত দৃষ্টিতে দেখলে কোনও আর্য-জাতির প্রতিভূ যদি যবনদেশ, ম্লেচ্ছদেশ অথবা শূদ্র-বসতিতে গিয়ে থাকতেন, তবে সমাজের চোখে তারা ম্লেচ্ছ যবন অথবা শূদ্রই হয়ে যেতেন। আমাদের বিশ্বাস, অনু-তুর্বসুদের ক্ষেত্রেও এই দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে।

শেফার বলে এক সাহেব আছেন, তিনি ক্ষুদ্ৰজাতি এবং দাসদের মধ্যে যদু-তুবসুর বসতির অভিশাপ শুনে তাদের বংশধরদের একেবারে ‘ভীল’ বানিয়ে দিয়েছেন–racially Bhils. অন্যদিকে অনু থেকে ম্লেচ্ছজাতির উদ্ভব শুনে তার নামে নতুন জনগোষ্ঠী চিহ্নিত করেছেন শেফার। তাদের নাম ‘আনব ম্লেচ্ছ’—an original stock of Anava Mleccha. এই বাঁচাল সাহেবের কত কথা আর শোনাব। এর মতে পাণ্ডব-কৌরবদের বহু পূর্বপুরুষ অর্থাৎ যযাতির সেই পরমপ্রিয় কনিষ্ঠ পুত্রটি—আমরা পুরুর কথা বলছি–তিনি নাকি সংস্কৃত ভাষাটাই ভাল জানতেন না। আর দ্রুহু লোকটার নামের মধ্যে যেহেতু ‘হ’ বা ‘দ্রোহে’র গন্ধ আছে, অতএব উনি শত্রু গোছর লোক অথবা ফরেনার। পুরু-তুর্কসুদের কোন শ্যালক যে শেফার সাহেবকে এই সব খবর দিয়েছিল, তা তিনিই জানেন।

 আমরা যদু-তুর্বসু অথবা দ্রু-অনুর বিশাল বংশলতার বাঁধনে আমাদের প্রিয় পাঠকদের পেঁচিয়ে বাধতে চাই না। কিন্তু পাণ্ডব-কৌরবরা যেহেতু পুরুবংশের লোক তাই যদু-তুর্বসু অথবা অনুস্থ্যদের একটু-আধটু খবরও আমাদের নিতে হবে। নইলে, পরিবার বা সমাজগতভাবে মহাভারতের প্রধান চরিত্রগুলিকেও ভাল করে চেনা যাবে না। এমনকি সঙ্গে সঙ্গে এইসব রাজবংশের ভৌগোলিক অবস্থানটাও একটু জেনে নিতে হবে।

বলতে পারেন, যযাতির ছেলেরা পাঁচ জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার মানে হল আরেক দফা আর্যায়ন। যযাতির প্রথম পুত্র যদু এবং তার বংশধর যাদবরা গঙ্গা-যমুনার মধ্যদেশ ছেড়ে প্রথমে কোন জায়গায় এসে বসতি স্থাপন করেন, সে কথা স্পষ্ট করে বলা যায় না বটে, তবে মহাভারতে এবং পুরাণে মথুরা জায়গাটাই যাদবদের বাসস্থান বলে বারংবার চিহ্নিত। মনে রাখতে হবে, ভগবান বলে কথিত সেই বহুত মানুষটি, যাঁর নাম কৃষ্ণ, তার ঠাকুরদাদা ছিলেন শূর বা শূরসেন। এই শূরসেনের নামে যে জায়গাটা বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল, মথুরা তার একটি অঞ্চল মাত্র। আলেকজান্ডারের সমসাময়িক গ্রিক লেখকেরা মথুরার নাম জানতেন ‘মেথোরা (Methora) বলে আর শূরসেনের পুরো রাজ্যটাকে জানতেন Sourasenoi বলে। তবে এখন যে সময়ের কথা বলছি, সে অনেক আগের কথা। কৃষ্ণ-পিতামহ শূরসেন তখন কোথায়? এবং এটাও মনে রাখতে হবে, কৃষ্ণ-পিতামহ শুর বা শূরসেনের বহু পূর্বে এই যদুবংশেই শুর এবং শূরসেন নামে দুই ভাই ছিলেন। তারা বিখ্যাত কার্তবীর্যাজুনের পুত্র। হয়তো তাদের নামেই Sourasenoi।

আমরা আসলে বলতে চাই–শুধু মথুরা বলে নয়, যাদবরা প্রথমত গঙ্গা ছেড়ে একটু নীচের দিকে যমুনার ওপারে চলে এসেছিলেন এবং তারপর সে জায়গাও ছেড়ে ভারতবর্ষের দক্ষিণ দিকে বেশ খানিকটা এবং পশ্চিম দিকেও বেশ খানিকটা দখল করে নেন। এইভাবে পশ্চিমে সমুদ্রতীরবর্তী দ্বারকা পর্যন্ত এবং দক্ষিণে নর্মদার পর-প্রান্তে বিদর্ভ, মাহিষ্মতী পর্যন্ত যাদবদের দখলদারি স্বীকার করে নিতে হবে। তবে এ সবের ওপরেও কিন্তু যদু বা যাদবদের প্রথম বসতি হিসেবে মথুরার কথাটাই আমাদের মনে বেশি ধরে। তার কারণ এই নয় যে, শুধু কৃষ্ণ পর্যন্ত এখানে যাদবদের স্মৃতিচিহ্ন আছে, তার কারণ আমরা শাক্যসিংহ বুদ্ধের মুখে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতেই একটা বিশাল বড়-রাস্তার খবর পাচ্ছি। এই রাস্তা একদিকে মথুরার সঙ্গে বেরঞ্জা বলে একটা জায়গায় সংযোগ ঘটিয়েছে। এই বেরঞ্জার সঙ্গে আবার যোগ রয়েছে বুদ্ধের প্রিয় শহর শ্রাবস্তীর সঙ্গে। শ্রাবস্তী হল রাপ্তী নদীর তীরে উত্তরপ্রদেশের গোন্দা জেলার বহেইচ অঞ্চল জুড়ে। কিন্তু এই বেরঞ্জা আর শ্রাবন্তীর সংযোগকারী পথটি যে সব শহর ছুঁয়ে এসেছিল সেগুলি পালি ভাষায়–সোরেয্য, সংকাসস (সাংকাশ্য) কন্নকুজ্জ (কাণ্বকুজ-কনৌজ) এবং পয়াগ-পতিষ্ঠান।

শেষ জায়গাটা যদি পালি ভাষাতেই চিনে থাকেন, তাহলে বুঝবেন, এ হল আমাদের সেই প্রয়াগের কাছে প্রতিষ্ঠানপুর। যযাতির ছেলে যদু হয়তো এইরকমই এক পুরনো রাস্তা ধরে মথুরায় এসে যাদবদের শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে একটা কথা এই সঙ্গে মনে রাখতে হবে–যদুর নামে যতবড় যদুবংশই প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন, রাজা হিসেবে যদুর ক্রিয়া-কলাপ এমন কিছু বিখ্যাত নয়, বরঞ্চ তার বংশধরদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা বিখ্যাত হয়েছেন শৌর্যে, বীর্যে, ক্ষমতায়। একইভাবে অনু কিংবা দুস্থ অথবা তুর্বসুও এমন কিছু বিখ্যাত নন। কিন্তু তাদের বংশধরদের মধ্যে অনেকেই শ্রুতকীর্তি রাজা-মহারাজা আছেন, যাঁদের নাম শুনলে এখনও আমরা মুগ্ধ হব।

প্রসঙ্গত জানাই, যদুর বিভিন্ন বংশধর যেমন মথুরা, বিদর্ভ, মাহিষ্মতী, অবন্তী প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে যমুনা নদীর ওপার থেকে একেবারে তাপ্তী নদী পর্যন্ত সমস্ত জায়গাটাই দখল করে নিয়েছিলেন, তেমনই অনুর বংশধরেরাও বিখ্যাত হয়েছিলেন পাঞ্জাব অঞ্চলে। পরবর্তীকালে অনুর চেয়েও এই বংশ উশীনর শিবির নামে বেশি বিখ্যাত হয়েছিল। উশীনর শিবি তার দয়া আর করুণার গুণে ভারতবিখ্যাত হয়েছিলেন। কার্টিয়াস অথবা ডিয়োডোররাসের মতো পূর্বতন গ্রিক লেখকেরা ঝিলাম এবং চেনাব নদীর অন্তর্বর্তী নিম্নাঞ্চলে বিখ্যাত শিবিদের নাম শুনেছেন। যযাতিপুত্র অনুর সপ্তম পুরুষ হলেন মহামনা। তাঁর দুই ছেলে। একজন উশীনর, দ্বিতীয় জন তিতিক্ষু। ঐতিহাসিকেরা বলেন–-Usinara and his descendants occupied the Punjab, and Titikshu founded a new kingdom in the east, viz, in East Behar. তার মানে অনুবংশের একটি ধারা পূর্ব বিহারেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, অনুবংশের এই পূর্বগামিনী ধারা থেকেই প্রাচীন অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গে আর্যসভ্যতার প্রথম অনুপ্রবেশ।

যযাতির অন্য পুত্র স্থাকে নিয়ে আমাদের খুব মাথাব্যথা নেই। তবে তার বংশের অন্যতম প্রধান পুরুষ প্রচেতা এবং তার পুত্রেরা ভারতবর্ষের বাইরে আরও উত্তর দিকে গিয়ে এমন জায়গায় বসতি স্থাপন করেছিলেন, যেখানে আর্তের জনজাতির প্রাধান্য ছিল বেশি। ফলে প্রচেতার সব ছেলেই ম্লেচ্ছদের রাজা হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।

প্ৰচেতসঃ পুত্রশতং রাজানঃ সর্ব এব তে।
ম্লেচ্ছরাষ্ট্রাধিপাঃ সর্বে হুদীচীং দিশমাশ্রিতাঃ।

এই যে দ্রহ্যুবংশে প্রচেতার নাম পাওয়া গেল, এই প্রচেতার এক ভাইয়ের নাম গান্ধার। অন্যমতে তিনি দ্রুহ্য বংশে জাত অরুদ্ধের পুত্র। গান্ধার বলে যে রাজ্যটা ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত, তা এঁরই নামে প্রতিষ্ঠিত এবং পণ্ডিতেরা বলেন গান্ধার রাজ্যেই দ্রু্যরা বাস করতেন। তখনকার দিনে গান্ধার কাশ্মীরের উপত্যকার খানিকটা নিয়ে তক্ষশিলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

যযাতির সব পুত্রের বসবাস নির্ণয় করার পরেও যার বসবাস নিয়ে আমরা এখনও উচ্চবাচ্য করিনি, তিনি হলেন তুর্বসু। ধারণা করা হয়, তুর্বসুরা রাজত্ব করতেন এখনকার মধ্যপ্রদেশের সাতনা-রেওয়া অঞ্চলে। পূর্বকালে এই অঞ্চলের আরও খানিকটা জুড়ে নিয়েই বৈশালী নগরীর মানচিত্র তৈরি করা যায়। আরও পরিষ্কার করে বললে বৈশালীতেই তুর্বসুদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলা যায়। এই বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা হলেন মরুত্ত, যার কথা আমরা পূর্বে বৃহস্পতি এবং সংবর্তের কাহিনীতে উল্লেখ করেছি। মহারাজ যুধিষ্ঠির রাজা হওয়ার পর যখন অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে চাইলেন, তখন নাকি তার ভীষণ অর্থাভাব চলছে। ব্যাস প্রমুখ মুনি-ঋষিরা তখন সৎপরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন–মহারাজ! মরুত্তের সম্পত্তি গচ্ছিত আছে পাহাড়ের গুহায়। সেই সম্পত্তি, ধন-রত্ন নিয়ে এসে তোমার যজ্ঞ সম্পন্ন করো।

মহাভারতের কবি হওয়া সত্ত্বেও ব্যাস যে কথাটা যুধিষ্ঠিরকে বলেননি, সেটা হল– তুৰ্ববংশীয় মরুত্ত ছিলেন এক অর্থে যুধিষ্ঠিরের পূর্বপুরুষ। কেন না, ভারত-বিখ্যাত মহারাজ দুষ্যন্ত, যাঁকে মহাকবি কালিদাস অমর করে দিয়েছেন, যাঁর পুত্রের নামে প্রখ্যাত ভরতবংশের সৃষ্টি, অথবা যার পুত্রের নামে এই দেশের নাম ভারত, সেই দুষ্যন্ত মানুষ হয়েছিলেন এই তুর্বসুবংশীয় মরুত্ত রাজার কাছে। পুরুবংশের দুষ্যন্তকে যে কোন টানে তুর্ক-বংশীয় মরুত্ত নিজের ঘরে এনে মানুষ করলেন, তার পিছনে অন্য এক ইতিহাস লুকনো আছে।

মনে রাখতে হবে–যযাতির যে পাঁচ সন্তানের নাম আমরা পেয়েছি, যযাতির মৃত্যুর পর সেই সব সন্তানের বংশধরদের মধ্যে কখনও যেমন সৌহার্দও লক্ষ্য করেছি, তেমনই কখনও দেখেছি প্রচণ্ড ঝগড়া এবং মারামারি। এইসব বিবাদ-বিসংবাদ যে খুব স্পষ্ট করে ইতিহাসের তারিখ মিলিয়ে বলে দেওয়া যাবে তা নয়, তবে মহাভারতের মূল ঘটনা কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধে এইসব পুরনো ঝগড়াঝাটির সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব যে বেশ খানিকটা আছে, সেটা বেশ ভাল করেই দেখিয়ে দেওয়া যাবে।

যযাতি গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী পৈতৃক রাজ্যটি খুব ভালবেসে পুরুকে দিয়ে গেলেন বটে, কিন্তু যযাতি যে প্রথম পুত্রটিকে রাজ্যছাড়া করেছিলেন সেই যদু কিন্তু ভিম্রাজ্যে গিয়ে এতটাই শক্তি বিস্তার করেছিলেন যে তার বংশধরেরা অতি অল্পদিনের মধ্যেই এক বিশাল মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

যদুবংশ কিছুদিনের মধ্যেই দুই বিশাল বংশে রূপান্তরিত হয়। যদুবংশের প্রথম ধারা যদুর দ্বিতীয় পুত্র ক্রোষ্ঠুর বংশ ধরে চলতে থাকে। তারা যদুর নাম বজায় রেখে মথুরা-শূরসেনী অঞ্চলে রাজত্ব করতে থাকেন। যদুপুত্রের ধারায় আছে হৈহয়-বংশ। হৈহয় হলেন যদুর প্রথম পুত্র সহস্রজিতের নাতি। এই হৈহয়বংশে বিখ্যাত কার্তবীর্যাজুনের জন্ম। যদুর দ্বিতীয়পুত্র ক্রোঙ্গুর ধারায় প্রথম বিখ্যাত রাজা হলেন শশবিন্দু। তিনি শুধু রাজা ছিলেন না, তিনি রাজচক্রবর্তী সম্রাট–চক্রবর্তী মহসত্ত্বো মহাবীর্যে মহাপ্রজঃ। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, শশবিন্দু তার পার্শ্ববর্তী পুরুবংশীয় রাজাদের রাজ্য থেকে উচ্ছেদ করে ছেড়েছিলেন, কারণ ঐতিহাসিকদের মতে–The neighbouring countries were the Paurava realm on his (Shashavindu’s) east and the Druhyu territory on his north. He appears to have conquered the Pauravas, beacuse there is a great gap in the Paurava genealogy. From this point till Dusyanta restored the dynasty long after wards, which means that the dynasty underwent an eclipse.

পুরুবংশীয় পৌরবদের বিপদ শুধু শশবিন্দুর কারণেই হয়নি। তাদের আরেক বিপদ হলেন সূর্য বা ইস্ফাকু-বংশের মান্ধাতা, যিনি রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ। রাজা হিসেবে তিনিও ছিলেন বিরাট মাপের। মান্ধাতার বাবা দ্বিতীয় যুবনাশ্বের সময় থেকেই ইক্ষাকুবংশীয়দের রাজ্যবিস্তার শুরু হয়। এবং পূর্ণতা লাভ করে মান্ধাতার সময়ে। লক্ষণীয় বিষয় হল, শশবিন্দুর পক্ষে সরফুপারের সেই দেশটি অর্থাৎ অযোধ্যা জয় করা সম্ভব হয়নি এবং দুজনের স্ব-স্ব বংশের বিরাট পুরুষ বলে শত্রুতা বন্ধুত্বের পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ইস্ফাকু বংশের মান্ধাতা বিয়ে করেছিলেন শশবিন্দুর মেয়ে যাদবসুন্দরী বিন্দুমতাঁকে। বিন্দুমতীর আরেক নাম চিত্ররথী–তস্য চৈত্ররথী ভার‍্যা শশবিলোঃ সুতাভবৎ।

মান্ধাতার পর ইক্বাকুবংশের তেজ কিছুটা কমে বটে, তবে সব দিক থেকেই ধুন্ধুমার লাগিয়ে দিয়েছিলেন যাদবরা। একদিকে শশবিন্দু এবং তার ছেলেদের দুর্দান্ত অভিযান যেমন ভারতবর্ষের মধ্যদেশ থেকে পৌরবদের অবলুপ্তি ঘটিয়েছিল, তেমনি শশবিন্দুর পরেও সাম্রাজ্যজয়ের ধারাটি চালিয়ে যান যাদবদেরই জাত ভাই হৈহয় বংশের কার্তবীর্যাজুন। ভারতবর্ষের দক্ষিণে অবন্তী, মাহিষ্মতী, বিদর্ভ অঞ্চলে যাদব-হৈহয়রা একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করার পর তারা ভারতবর্ষের উত্তরপানে ধাওয়া করেছিলেন। যুবনাশ্ব-মান্ধাতার আমলে অযোধ্যার রাজবংশের যে মর্যাদা স্থাপিত হয়েছিল, সেই মর্যাদা ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল হৈহয়-যাদবদের আক্রমণে। অযোধ্যায় তখন রাজা ছিলেন বাহু। তিনি ইস্ফাকুবংশীয় দানবীর মহারাজ হরিশ্চন্দ্রের বেশ কয়েক পুরুষ পরের মানুষ। হৈহয়রা অন্যান্য যদুবংশীয়দের সঙ্গে নিয়ে অযোধ্যার রাজা বাহুকে রাজ্যছাড়া করে ছেড়েছিলেন–হৈহয়ৈস্তালজঘৈশ্চ নিরস্তো ব্যসনী নৃপঃ।

লক্ষণীয় বিষয় হল, যাদব-হৈহয়দের এই সাম্রাজ্যবাদী অভিযান অযোধ্যার পার্শ্ববর্তী বৈশালী এবং বিদেহরাজ্যের কাছে এসে থেমে যায়। আগেই বলেছি–বৈশালীতে, আধুনিক মধ্যপ্রদেশের সাতনা-রেওয়া অঞ্চলে তখন রাজত্ব করতেন তুর্ক বংশের রাজারা। শোনা যায়, তুৰ্ববংশের করন্ধম রাজা যখন বৈশালীতে রাজত্ব করছেন তখন তিনি বিপক্ষীয় রাজাদের দ্বারা ভীষণভাবে আক্রান্ত হন। শেষ পর্যন্ত তিনি যুদ্ধে জয়ী হন এবং তার পুত্রও তাকে সর্বতোভাবে রক্ষা করতে থাকেন। এই পুত্রের নাম অবীক্ষিত। মার্কণ্ডেয় পুরাণ লিখেছে বিদিশার রাজার মেয়ের স্বয়ংবর সংক্রান্ত ঘটনা নিয়ে সমবেত রাজমণ্ডলী এবং অবীক্ষিতের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই বাধে। এই যুদ্ধে অবীক্ষিত শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে পরাজিত হন এবং বিদিশার রাজবাড়িতে বন্দি হিসেবে তাকে ঢুকতে হয়। অবীক্ষিতের পিতা করন্ধম বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে পুত্রের মুক্তির জন্য বিদিশা আক্রমণ করেন এবং পুত্রকে মুক্ত করে নিয়ে যান।

পণ্ডিতেরা মনে করেন, এই সময় বিদিশা (বেশনগর) হৈহয় রাজাদের রাজ্যভুক্ত ছিল–There can be little doubt that those enemies were the Haihayas, for Vidisa was in the Haihaya region, and that they were beaten off. তুর্বসুবংশীয় করহ্মম রীতিমতো বুড়ো হয়ে গেলেও তার পুত্র অবীক্ষিত পিতৃরাজ্য গ্রহণ করেননি। সেই যে একবার সমস্ত রাজা তাকে পরাস্ত করে বিদিশার রাজপথে বন্দি হিসেবে হাটিয়েছিল, সেই অপমান তিনি ভুলতে পারেননি। বিদিশার রাজকুমারী কিন্তু মনে মনে রাজমণ্ডল-মধ্যবর্তী সেই একক রাজবন্দিকেই আপন প্রাণেশ্বর হিসেবে অন্তরে স্থান দিয়েছিলেন। অবীক্ষিত বলেছিলেন- আমি যখন রাজকুমারীর সামনে অন্য রাজাদের দ্বারা পরাভূত হয়েছি, তখন সেই রাজকুমারীকে আমি আমার মুখ দেখাতে পারি না-সোহমস্যাঃ পুরো ভূমৌ পরৈর্ভূপৈঃ খিলীকৃতঃ। কথা শুনে রাজকুমারী পিতাকে বলেছিলেন–না, বাবা। আমি শুধু তার রূপ দেখে তাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত হইনি। এত রাজার সঙ্গে একা যুদ্ধ করে তিনি যে অসাধারণ বিক্রম প্রকাশ করেছিলেন, সেই বিক্রমই আমার মন হরণ করেছে পিতা–শৌর্য বিক্রম-ধৈর্যানি হরস্ত্যস্য মনো মম।

অবীক্ষিতের সঙ্গে এই বিয়ে তখন-তখনই হয়নি। কিন্তু বিদিশার রাজকুমারীর অনুরাগ এবং অবীক্ষিতের পিতা করন্ধমের আগ্রহে এই বিয়ে শেষ পর্যন্ত ঘটেছিল, কিন্তু সেই পুরাতন যুদ্ধস্মৃতি এবং পরাজয়ের অভিমান হৃদয়ের বহনকরে অবীক্ষিত রাজ্যগ্রহণে অস্বীকৃত হন। বৃদ্ধ করম তথন পুত্রের বদলে নাতিকে রাজ্য দিয়ে বানপ্রস্থ অবলম্বন করেন। করন্ধমের এই নিতিই হলেন মরুত্ত-আবীক্ষিত মরুত্ত। পরবর্তী অধ্যায়ে মার্কণ্ডেয় পুরাণে যে বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ হয়েছে, তাতে পণ্ডিতদের মধ্যে সন্দেহ এসেছে। বস্তুত বেশিরভাগ পুরাণের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত ভাল করে মিলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে–আবীক্ষিত মরুত্তের কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। কিন্তু মার্কণ্ডেয় পুরাণের পৌরাণিক মরুত্তের একটি পুত্রসন্তানের ব্যবস্থা করেছেন, ফলত পণ্ডিতেরা বৈশালীর করন্ধম-অবীক্ষিত-মরুত্তকে তুর্বসু-বংশের করন্ধম-অবীক্ষিত-মরুত্ত থেকে আলাদা করে দিয়েছেন। যদিও এই সন্দেহের কারণ সৃষ্টি করেছেন স্বয়ং পৌরাণিকেরাই। অবশ্য, এই অকারণ ভয় বা সন্দেহের কোনও ঘটনাই ঘটা উচিত নয়। কারণ তুর্বসু বংশ বৈশালীতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং প্রায় সমস্ত প্রাচীন পুরাণেই দেখা যাবে আবীক্ষিত মরুত্তের কোনও পুত্রসন্তান ছিল না।

বায়ুপুরাণ এবং হরিবংশ তুর্ববংশের পরিচয় দেবার সময় বলেছে–তুবসুর পুত্র হলেন বহ্নি, বহ্নির পুত্র গোভানু। গোভানুর পুত্রের নাম জিসানু, ত্রিসানুর পুত্র করন্ধম এবং তাঁর পুত্র মরুত্ত–মাঝখানে অবীক্ষিত নেই–করন্ধমস্ত্রিযানোস্তু মরুত্তস্তস্য চাত্মজঃ। মরুত্তর নামটি বলার সঙ্গে সঙ্গেই বায়ুপুরাণ এবং হরিবংশ বলে উঠেছে–আমরা আরও একজন মরুত্তের কথা শুনেছি, তিনি অবীক্ষিতের পুত্র মরুত্ত–অন্যস্তু আবীক্ষিতো রাজা মরুঃ কথিতঃ পুরা। সেই মরুত্তের কোনও পুত্র সন্তান ছিল না–অনপত্যো মরুক্তস্তু। পুরাণকারেরা এক কথা বলেছেন আর অমনি পারজিটার সাহেবও সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন–They must be carefully distinguished.

আমাদের নিবেদন–এখানে মার্কণ্ডেয় পুরাণের বিবরণ মাথায় রেখে বুঝে নিতে হবে অবীক্ষিত এক সময় নিজের অভিমানে পিতার রাজ্য গ্রহণে অস্বীকৃত হয়েছিলেন–নাহংতাত করিষ্যামি পৃথিব্যাঃ পরিপালন। এই রাজ্যগ্রহণের অস্বীকৃতিই পরবর্তীকালে পৌরাণিকদের কীর্তিত তুর্কসু রাজবংশের পরম্পরায় অবীক্ষিতের নাম মুছে দিয়েছে। অবীক্ষিতের পুত্র মরুত্তকে করন্ধম সোজাসুজি রাজ্য দিয়েছিলেন–স পিত্রা সমনুজ্ঞাতং রাজ্য প্রাপ্য পিতামহাৎ। এই কারণেই তুর্ব রাজবংশের তালিকায় অবীক্ষিতের নাম ওঠেনি এবং পৌরাণিকেরা মরুত্তের নাম শুনলেই বলে ওঠেন আমরা অবীক্ষিতের ছেলে বলে আরও একজন মরু রাজার নাম শুনেছি–অন্যস্তু আবীক্ষিতে রাজা মরুও কথিতম্ভব। আসলে এই মরুই সেই মরুত্ত। এদের আলাদা করে ‘carefully’ দেখার কোনও কারণ নেই।

অবশ্য মার্কণ্ডেয়র অন্য বিবরণ মিথ্যে করে দিয়ে এ কথা আমাদের স্বীকার করে নিতেই হবে যে মরুত্তের কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। প্রধান পুরাণগুলির এই তথ্য অবিসংবাদিত অনপত্যো’ভব রাজা যক্ষ্মা বিপুলদক্ষিণঃ-রুত্ত রাজা ভূরি দক্ষিশাযুক্ত বহু বহু যজ্ঞ করেছেন, কিন্তু তিনি অপুত্রক ছিলেন। এইবারে আবার রাজনৈতিক চিত্রে ফিরে আসি। তুর্ববংশীয় করম, অবীক্ষিত এবং মরুত্তের চেষ্টায় যাদব-হৈহয় রাজবংশের পূর্বোক্তরী গতি খানিকটা থেমে ছিল বটে কিন্তু যযাতির মূল রাজ্য প্রতিষ্ঠানপুর–যেখানে যযাতির কনিষ্ঠ পুত্র পুরুর বংশপরম্পরা চলছিল, সেখানে কখনও হৈহয়রা কখনও বা অযোধ্যার ইন্ড্রাকুবংশীয় রাজারা ধুন্ধুমার কাণ্ড চালিয়ে পৌরব রাজবংশকে প্রায় মুছে দিয়েছিলেন। রাজবংশের অর্ধেক রাজার নাম পৌরাণিকদের বংশতালিকায় লুপ্ত। এমনকি পৌরব দুষ্যন্তের ঔরস পিতার নামও আমরা ভাল করে জানি না। জানি না মায়ের নামও। এরই মধ্যে হঠাৎই পুরাণে শুনতে পাই পুরুবংশীয় দুষ্যন্তকেই বৈশালীর পুরবাসীরা মরুত্তের পুত্ররূপে স্বীকার করে নেন–দুষ্যন্তং পৌরবং চাপি সর্বে পুত্রমকল্পয়৷ (বায়ুপুরাণের পাঠে দুষ্যন্তের নাম ভুল করে ‘দুষ্কৃতং পৌরবঞ্চাপি’ করা হয়েছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে–তুৰ্ববংশীয় মরুত্ত দুষ্যন্তকে পেলে-পুষে বড় করেন।

আমরা আগে মরুত্ত রাজার যজ্ঞে বৃহস্পতির ভাই সংবর্তকে পৌরোহিত্য করতে দেখেছি। হরিবংশ বলেছে–মরুত্ত রাজা সংবর্তের পৌরোহিত্য কর্মে এতটাই সুখী হয়েছিলেন যে, অপুত্রক রাজা তার কন্যা সম্মতাকে সংবর্তের হাতেই তুলে দেন। হরিবংশের ভাষাটা এইরকম–দক্ষিণা হিসেবে নিজের মেয়ে সম্মতাকে সংবর্তের হাতে তুলে দিয়ে মরুত্ত রাজা পৌরব দুষ্যন্তকে পুত্র হিসেবে পেলেন–

দক্ষিণার্থং স্ম বৈ দত্ত্বা সংবর্তায় মহাত্মনে।
দুষ্যন্ত পৌরবং চাপি লেভে পুত্রমকল্মষ৷

মহাভারতে আদিপর্বের দ্বিতীয় বংশলতিকায় কোনও এক ইলিন’র নাম করা হয়েছে, যাকে দুষ্যন্তের পিতা বলা হয়েছে। কিন্তু এই ইলিন স্ত্রী না পুরুষ, দুষ্যন্ত তার ছেলে না নাতি সে সব নিয়ে প্রচুর বিবাদ আছে। তার ওপরে মহাভারতের ওই বংশলতিকা অন্যান্য পুরাণে পাওয়া। যায় না। কাজেই বেশির ভাগ পুরাণে মরুন্তু রাজার ঘরে দুষ্যন্তকে বাড়তে দেখে আমরা ধারণা করি–হৈহয়-যাদবরা যখন মধ্যদেশের প্রায় সবটাই দখল করে নিজেদের করায়ত্ত করেছিলেন, সেই সময় কোনও একজন পুরুবংশীয় ব্যক্তির ঔরসে দুষ্যন্ত জন্মেছিলেন। পুরোহিত সংবর্ত মরুত্তের কন্যা সম্মতাকে দানে পেয়েছিলেন বটে, তবে তাঁরই গর্ভে দুষ্যন্ত সংবর্তের ঔরসে জন্মেছিলেন কি না, তা খুব স্পষ্ট নয়। তবে আমাদের ধারণা, প্রতিষ্ঠানপুর থেকে ছিন্নমূল কোনও পুরুবংশীয় ব্যক্তির সঙ্গে সম্মতার বিয়ে দিয়ে দেন সংবর্ত এবং রাজা মরুন্তু তা জানতেন। এই বিবাহের ফলেই হয়তো দুষ্যভের জম্ম, কিন্তু জন্মলগ্নেই তিনি পৌরব বা পুরবংশীয় বলে চিহ্নিত। মরুত্ত নির্বিচারে দুষ্যতকে নিজের বাড়িতে স্থান দেন এবং দুষ্যতের প্রতি তার স্নেহ-ভালবাসা এতটাই ছিল যে তুর বংশ মরুরে পরে স্তব্ধ হয়ে যায় এবং তা মিশে যায় সুপ্রসিদ্ধ পুরুবংশে–পৌরবং তুর্বাসোর্বংশঃ পবিবেশ নৃপোত্তম। যদুবংশীয় যাদব হৈহয়দের নাশকতায় পুরুবংশের মূল স্তম্ভটাই যখন নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল তখন যযাতিপুত্রের অন্য এক ধারায় পুরুবংশের শিবরাত্রির সলতে দুষ্যন্ত মানুষ হতে লাগলেন। পুরুবংশের কীয়মাণ ধারা পৌরব দুষ্যতের মাধ্যমেই রক্ষিত হয়েছে মহাভারতে তাকে পৌরবদের বংশকর’ বলে অভিহিত করা হয়েছে–পৌরবাণাং বংশকরা দুষ্যন্তো নাম বীর্যবান্।

.

৪২.

দুষ্যন্ত তখনও মহারাজ দুষ্যন্ত হননি। হয়তো বৈশালী অথবা এখনকার সাতনা-রেওয়া অঞ্চলের রাজচক্রবর্তী মরুত্তের ঘরে মানুষ হচ্ছেন তিনি। সেই কবে যদু-তুর্বসুরা প্রতিষ্ঠানপুরে পুরুর রাজ্য ছেড়ে চলে গেছেন। আর আজ কত পুরুষ পরে পুরু রাজবংশ যখন প্রতিষ্ঠানপুর থেকে উচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, অযোধ্যার রাজা, আর যাদব-হৈহয়দের পর্যায়ক্রমিক আক্রমণে গঙ্গা-যমুনার এপার-ওপার এবং মধ্যদেশও যখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত, ঠিক তখনই কোন পূর্বপুরুষের রক্তের টানে তুর্ববংশীয় পুত্রহীন মরুত্ত রাজা পুরুবংশীয় দুষ্যন্তকে নিজের কোলে টেনে নিলেন, তা বলা সহজ নয়। বংশজ’এক জ্ঞাতির আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য আরেক। আতিকে আশ্রয় দিলেন মরুত্ত। ঐতিহাসিকদের মতে দুষ্যন্ত যখন খুবই ছোট, তখন প্রতিষ্ঠানপুরে যাদব-হৈহয়দের অবস্থা খারাপ হয়ে এসেছে। কিন্তু তার আগে যদুবংশের যাদব-হৈহয়রা সমস্ত মধ্যদেশ দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন। তার ফলে মূল পুরুবংশটাই উচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

 যদুবংশে, অথবা আরও পরিষ্কার করে বললে বলতে হয় হৈহয় বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কার্তবীর্যাজুনের ছেলের নাম ছিল জয়ধ্বজ। তিনি রাজত্ব করতেন অবন্তীতে। নর্মদা নদী থেকে তাপ্তী নদী পর্যন্ত এই জায়গার ভৌগোলিক বিস্তার। হৈহয়বংশীয় কার্তবীর্য অর্জুন কৰ্কেটক নাগদের যুদ্ধে হারিয়ে প্রথমে মাহিষ্মতী দখল করেছিলেন। মাহিষ্মতীতে যে হৈহয়দের প্রচণ্ড প্রতাপ ছিল, সে কথা এই অঞ্চলের শিলালিপিগুলি থেকেও প্রমাণিত হবে। একটি শিলালিপিতে জনৈক হৈহয় রাজাকে ‘মাহিষ্মতীপুরবরেশ্বর’ বলে ডাকাও হয়েছে। বৌদ্ধ গ্রন্থে মাহিষ্মতী অবন্তীর রাজধানী। যদিও পরে নর্মদার দুই পার ধরে উত্তরে প্রায় রাজপুতনা পর্যন্ত এবং দক্ষিণে তাপ্তী পর্যন্ত অবস্তী রাজ্যের সীমানা ছড়িয়ে যাওয়ায় দক্ষিণ অবন্তীতেই মাহিষ্মতীর ভৌগোলিক অবস্থান চিহ্নিত করা যায়।

কার্তবীর্য অর্জুনের নাতি এবং জয়ধ্বজের ছেলের নাম হল তালজ। এই তালজ এতটাই শক্তিমান ছিলেন যে তার পাঁচটি পুত্রও তারই নামে বিখ্যাত ছিলেন। তাদের সবাইকে একসঙ্গে তালজ বলেই ডাকা হত। তালজঘের পাঁচ ছেলে। তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ হলেন রাজা বীতিহোত্র, যাঁকে বীতহব্যও বলেন অনেকে। মহাভারতের অনুশাসন পর্ব খুললে এক জায়গায় দেখবেন হৈহয় বীতিহোত্র কাশীর রাজা দিবোদাসের পিতামহ হ্যশ্বকে মেরে বংশ বংশ ধরে রাজ্য-ছাড়া করে রেখেছেন। তবে তাদের যুদ্ধটা যে শুধু কাশীতে গিয়েই হচ্ছে, তা মোটেই নয়। বীতিহোত্র এবং তার ছেলেপিলে আত্মীয়স্বজনেরা গঙ্গা-যমুনার অন্তর্বর্তী অঞ্চলে ধুন্ধুমার কাও লাগিয়ে দিয়েছিলেন–গঙ্গা যমুনয়ো মধ্যে সংগ্রামে বিনিপাতিতঃ। শেষ পর্যন্ত হর্যশ্বের নাতি হৈহয় তালজঘদের আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য কাশী-নগরীর পত্তন করলেন।

বীতিহোত্রের ছেলেরা অবশ্য কাশীতে গিয়েও সংগ্রাম চালিয়েছিলেন, কিন্তু কথাটা এখানে নয়। গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে যাদব-হৈহয়রা যে আক্রমণ চালিয়েছিলেন, তাতে পণ্ডিতেরা অনুমান করেন প্রতিষ্ঠানপুরে আর পুরুবংশের চিহ্ন কিছু ছিল না। মহাভারতে পুরুর পরে দুষ্যন্ত পর্যন্ত পুরুবংশের একটা রাজতালিকা সাজানো আছে বটে, তবে সে সব রাজা নিতান্তই এলেবেলে। বিশেষত বিভিন্ন রাজবংশ এবং সেইসব রাজার সম্বন্ধে যথাসম্ভব তথ্য পরিবেশনের জন্য যেসব পুরাণ বিখ্যাত, সেই পুরাণগুলির সঙ্গে মহাভারতের বংশতালিকা মেলে না এবং বহু জায়গায় বংশের ছেদ পড়ে গেছে। এতসব দেখে পণ্ডিতেরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, পুরুবংশ কোনওমতে টিকে ছিল। কীর্তিহীন, অবলম্বনহীন, বীরের সদগতি থেকে সম্পূর্ণ ভ্রষ্ট। হয়তো এইরকমই একু উচ্ছিন্ন পৌরুব-পুরুষের ছেলের নাম দুষ্যন্ত–যিনি মরুত্ত রাজার ঘরে মানুষ হচ্ছিলেন।  

মরুত্ত রাজার ঘরে দুষ্যন্ত তখনও মানুষ হতে আসেননি, হয়তো বা তিনি তখনও জন্মানওনি; সেই সময়ে একটা বিরাট সুবিধে হয়ে গিয়েছিল। কাশীর রাজা হর্যশ্ব থেকে আরম্ভ করে দিবোদাস পর্যন্ত সকলেই যাদব-হৈয়েদের হাতে খুব মার খেয়েছিলেন বটে, কিন্তু দিবোদাসের ছেলে প্রতর্দন হৈয়েদের উচিত শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং হৈহয় বীতিহোত্র শেষ পর্যন্ত নিজের কুল-শীল জাতি ত্যাগ করে ব্রাহ্মণ হয়ে যাবার চেষ্টা করেন এবং ব্রাহ্মণের বৃত্তি গ্রহণ করে নিজেকে কোনওমতে টিকিয়ে রাখেন।

হৈহয়দের আরও ক্ষতি হয়ে গেল অযোধ্যায় ইক্ষাকু বংশের নবতর এক সমৃদ্ধির ফলে। হৈহয়রা অযোধ্যা দখল করেছিলেন অনেক আগে। অযোধ্যার রাজা বাহুকে তাড়িত হয়ে বনে ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল। সেখানেই এক বনে তিনি তার পত্নীদের নিয়ে তপস্যা করে দিন কাটাচ্ছিলেন–বনং প্রবিশ্য ধর্মাত্মা সহ পত্না পোচরৎ। হৈহয়রা বাহুর রাজ্য কেড়ে নিয়েই শুধু ক্ষান্ত হননি। রাজ্য জয় করে তারা অযোধ্যায় আর্যেতর জনজাতি শক, যবন, পহুবদের। বসিয়ে দিয়েছিলেন। তারা অযোধ্যায় এসে ভারতবর্ষীয় ক্ষত্রিয়দের মতোই দিন কাটাচ্ছিলেন– শাদীনাং ক্ষত্রিয়াণা। অরণ্যাশ্রিত বাহু বনে থাকতে থাকতেই বুড়ো হয়ে গেলেন। এর মধ্যে একদিন নদী থেকে সন্ধ্যা-আহ্নিকের জন্য জল আনতে গিয়ে তিনি মরেই গেলেন। তার স্ত্রী-লক্ষণীয় বিষয় হল, তিনি যাদবী অর্থাৎ যাদবদের মেয়ে।

আপনাদের খেয়াল আছে নিশ্চয়–সেই যে যাদব শশবিন্দুর মেয়ে বিন্দুমতীর সঙ্গে অযযাধ্যার রাজা মান্ধাতার বিয়ে হয়েছিল। হয়তো সেই সময় থেকে যাদবদের মেয়ে ঘরে আনাটা একটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল ইক্ষাকুবংশে। এমনও হতে পারে, যাদবদের মেয়ে বিয়ে করে বাহু-রাজা প্রবল প্রতাপান্বিত যাদব-হৈহয়দের খানিকটা হাতে রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু সে স্ট্র্যাটেজি’ খাটেনি। বাহু মারা গেলে তার স্ত্রী যাদবী স্বামীর চিতায় আরোহণ করার জন্য প্রস্তুত হন। তিনি গর্ভিণী ছিলেন এবং এই অবস্থাতে তার চিতারোহণ নিষিদ্ধ হতে পারে–এই ভেবেই তার সতীন তাকে বিষ খাইয়ে দেন। যাদবীর এই বিষদগ্ধ অবস্থায় বাহু-পত্নী যাদবীকে দেখতে পান ভার্গব ঔর্ব। তিনি তাকে তার আশ্রমে নিয়ে যান এবং সুস্থ করে তোলেন। বিষের অন্য সংস্কৃত নাম ‘গর’। গর’ অর্থাৎ বিষের সহজাত বলেই যাদবীর পুত্রের নাম হয় সগর–গরেণ সা তদা সহ…ব্যজায়ত মহাবাহুং সগরং নাম ধার্মিক।

 সগর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অযোধ্যার ইক্ষাকুবংশের রাজলক্ষ্মীও ফিরে এলেন। রাজ্য গ্রহণ করার পর সগরের প্রথম কাজ হয়ে দাঁড়াল পিতৃশত্রু হৈহয়-যাদবদের উচিত শিক্ষা দেওয়া। যে হৈহয়-রাজারা গঙ্গা-যমুনার মধ্যদেশ রাজ্যভুক্ত করে অযোধ্যা পর্যন্ত রাজত্ব বিস্তার করেছিলেন, সগরের হাতে তারা প্রচণ্ড মার খেলেন। সগর যেখানে জন্মেছিলেন এবং যার আশ্রমে মানুষ হয়েছিলেন তিনি ভার্গববংশীয় ঔর্ব। ঔর্বকে পৌরাণিকেরা অল্পির পর্যায় শব্দ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বস্তুত ভৃগু-বংশীয়রা ব্রাহ্মণত্বের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র চালনাও ভাল রকম আয়ত্ত করেছিলেন। জমদগ্নি, পরশুরাম, ঔর্ব–সকলেই এই কারণে বিখ্যাত। সগর ঔর্ব জামদগ্যের কাছে বেদ-পাঠের সঙ্গে সঙ্গে তার কাছ থেকে প্রভূত আগ্নেয়াস্ত্রও লাভ করলেন–জামদগ্ন্যাস্তদাগ্নেয় অসুরৈরপি দুঃসহম।

সগর নিজের সৈন্য-সামন্ত সঙ্গে নিয়ে সেইসব আগ্নেয়াস্ত্র প্রথম ব্যবহার করলেন হৈয়েদের ওপরে। বনের মধ্যে রুদ্র-শিব যেভাবে পশুহত্যা করেছিলেন সেইভাবেই যাদব-হৈহয়দের হত্যালীলায় মেতে উঠলেন সগর–জন্মান হৈহয়ান ক্রুদ্ধো রুদ্রঃ পশুগণানিব। হৈহয়রা যেসব বহির্দেশীয় শক-যবন, পহুব-পারদ জনগোষ্ঠীকে অযোধ্যায় বসিয়ে দিয়ে ক্ষত্রিয়ের ব্যবহার শিখিয়ে দিয়েছিলেন, সগর তাদের ধরে ধরে কোনও গোষ্ঠীর মাথা ন্যাড়া করে দিলেন, কাউকে লম্বা চুল রাখতে বাধ্য করলেন, কাউকে বা দাড়ি রাখতে বাধ্য করলেন। অর্থাৎ এদের সকলকে তিনি ক্ষত্রিয়ের আচার-ব্যবহার থেকে চ্যুত করে চুল-দাড়ির মার্কা মেরে দিলেন, যাতে এরা আর কখনও ভারতবর্ষীয় ক্ষত্রিয় রাজাদের সঙ্গে সমতা অনুভব না করেন।

সগরের পরাক্রমে মধ্যদেশে হৈহয়দের প্রভাব স্তব্ধ হল বটে, কিন্তু সগর যখন দুর্বল বৃদ্ধ হয়ে গেলেন, তখন তার পুত্রেরা সগরের মতো রাজ্য চালাতে পারলেন না। তার পুত্রেরা তার উপযুক্ত হননি। জ্যেষ্ঠ পুত্র অসমঞ্জ, যাঁর রাজা হবার কথা ছিল, তিনি নানা দুষ্কর্ম করতেন এবং প্রজাদের ওপর অত্যাচারও করতেন। ফলে সগর তাকে নির্বাসন দণ্ড দিয়েছিলেন পৌরাণামহিতে যুক্তং পিত্রা নির্বাসিতঃ পুরা।

অযোধ্যায় সগরের বংশজাত পুত্রেরা যখন বেশ দুর্বল হয়ে গেলেন–পণ্ডিতদের অনুমান–তখনই পুরুবংশীয় দুষ্যন্ত, যিনি এতকাল তুবংশীয় মরুত্তের ঘরে মানুষ হচ্ছিলেন, তিনি আস্তে আস্তে নিজের শক্তি বিস্তার করতে আরম্ভ করলেন। পারজিটারের ভাষায়–(Marutta) had no son and adopted Dusyanta the Paurava. Dusyanta afterwards recovered the Paurava Kingdom, revived the dynasty and, and so is styled its vamsakara. The adoption could only have taken place before he gained that position, this corroborates the conclusion that the Kingdom was in abeyance, so that Dusyanta, as the heir in exile, might naturally accept such adoption. He could only have restored the Paurava dynasty after the Haihaya power had been destroyed by Sagara and Sagara’s empire had ended, so that he would be one or two generations later than this Marutta and two later than Sagara.

এতক্ষণ যেভাবে আমরা পুরুবংশের পরম মর্যাদাসম্পন্ন মানুষটিকে উপস্থাপিত করলাম, মহাভারতে সেভাবে নেই। পুরাণগুলির মধ্যে আমরা দুষ্যন্তের উদ্ভব যেভাবে দেখতে পেয়েছি, তারই কিছু অংশ এসেছে আমাদের আলোচনায়। মহাভারতে যেখানে পুরুবংশের রাজনামগুলি দেখতে পাচ্ছি, সেখানে দুষ্যন্তের নাম প্রসঙ্গত এসেছে বটে, কিন্তু তার মর্যাদার কথা কিছু বলা নেই। দুষ্যন্তের কাহিনী সেখানে এসেছে এইভাবে-জনমেজয় মহাভারতের বক্তা বৈশম্পায়নকে জিজ্ঞাসা করেছেন–আমি কুরুদের বংশ-বিবরণ শুনতে ইচ্ছা করি, আপনি প্রথম থেকে তা বলুন-ইমন্তু ভূয় ইচ্ছামি কুরূণাং বংশমাদিতঃ। কুরুদের কথা প্রথম থেকে বলতে গেলে তো একেবারে ঐল পুরূরবা থেকে আরম্ভ করে যযাতি-পুরুকে ছুঁয়ে সেইভাবে বলতে হয়। কিন্তু বৈশম্পায়ন কোনও কিছু না বলে হঠাৎ আরম্ভ করলেন–পৌরবদের বংশকর রাজা হলেন দুষ্যন্ত। তার মানে সত্যিই কিছু ফাঁক আছে-যা আমরা এতক্ষণ ধরে ঐতিহাসিকতার স্পর্শ দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছি।

মহাভারতের কবি লিখেছেন-মহারাজ দুষ্যন্ত এই চতুরন্তা পৃথিবীর রাজা ছিলেন। পৃথিবী মানে যদি ভারতবর্ষও বুঝি, তাহলেও বলব দুষ্যন্ত সমস্ত ভারতবর্ষের রাজা ছিলেন না। আবার আধুনিক বুদ্ধিতে যদি আমরা মহারাজ দুষ্যতকে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষের রাজত্ব নাও দিই, তবু কিন্তু মহাভারতের কবির আশয়টুকুও বুঝতে হবে। বুঝতে হবে, দুষ্যন্ত যথেষ্ট বড় রাজা। তিনি তার হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করেছেন, এ কথা খুব বড় নয়। তার সাম্রাজ্য গঙ্গা-যমুনার মধ্যদেশ ছাড়িয়ে উত্তর-পশ্চিমে আরও দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। মহাভারত বলেছে–ম্লেচ্ছ রাজ্য পর্যন্ত ছিল দুষ্যন্তের রাজ্যের সীমা এবং সীমাটা উত্তর পশ্চিমেই মনে হয়–আম্লেচ্ছাবধিকা সর্বান স ভূক্তে রিপুমর্দনঃ–কারণ, দুষ্যত্তের সময়ের আগে থেকেই ভারতের উত্তরে এবং উত্তর-পশ্চিমে ম্লেচ্ছ বা আর্যেতর জনজাতির বসতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে ভারতবর্ষের দক্ষিণে দুষ্যত্তের রাজ্য বিস্তারের কোনও প্রমাণ আমরা পাই না এবং ঐতিহাসিকদের মতে, দুষ্যত্তের সময়েও যেসব রাজ্যের স্বাধীন অবস্থিতির পরিচয় পাওয়া যায়, সেগুলি হল বিদেহ (মিথিলার উপকণ্ঠে), বৈশালী (সাতনা-রেওয়া), কাশী, বিদর্ভ বেরার)। বিদর্ভে কিন্তু তখনও হৈহয়দের অথবা যাদবদের রাজত্বই চলছে।

আশ্চর্যের বিষয় হল, দুষ্যন্তের প্রসঙ্গে আমরা প্রতিষ্ঠানপুরের নামটি আর শুনতে পাচ্ছি না। হয়তো দুষ্যন্ত পূর্বপুরুষের রাজধানী ছেড়ে সরে এসেছিলেন উত্তরের দিকে। মহাভারতে শকুন্তলার পতিগৃহযাত্রার সময়ে তার স্বামীর রাজধানীকে হস্তিনাপুর বলা হয়েছে–শকুন্তলাং পুরস্কৃত্য সপুত্ৰাং গজসায়। শ্লোকোক্ত ‘গজসায়’ হস্তিনাপুরের অন্য নাম। কিন্তু মজা হল, হস্তিনাপুর তখন কোথায়? দুষ্যতের পাঁচ পুরুষ পরে তারই বংশজ রাজা হস্তীর নামে হস্তিনাপুরের প্রতিষ্ঠা হবে। কাজেই আর যেখানেই হোক দুষ্যন্ত হস্তিনাপুরে রাজত্ব করতেন না। তবে প্রতিষ্ঠানপুর ছেড়ে এসে তিনি হস্তিনাপুরের কোনও অঞ্চলে বসবাস করেই থাকতে পারেন এবং সেটা কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপারও নয়। তবে কোনও অবস্থাতেই তখনও সে রাজধানীর নাম হস্তিনাপুর ছিল না।

ইতিহাসের তথ্যানুমান ছেড়ে এবার আমরা একটু মহাকাব্যে আসি। মহাকাব্যে আসতেই হবে কারণ, মহাভারতের দুষ্যন্ত-শকুন্তলার কাহিনী অবলম্বন করেই গুপ্তযুগের কালিদাস তার অবিস্মরণীয় নাটকখানি রচনা করেছেন। শুধু কালিদাস লিখেছিলেন বলেই নয়, দুষ্যন্ত-শকুন্তলার কাহিনী মহাভারতের পূর্বযুগেই ইতিহাসের গণ্ডি ছেড়ে মহাকব্যের সরসতায় ধরা পড়েছিল; অথবা বলা যেতে পারে দুষ্যন্ত-শকুন্তলার প্রেম-কাহিনী ইতিহাস হয়ে গিয়েছিল বলেই সেই ইতিহাস থেকে মহাকাব্যের সৃষ্টি হয়েছে। একটা স্বীকার করতেই হবে যে, কালিদাস তার নাটকের উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন প্রধানত মহাভারত থেকেই। কিন্তু নাটক লিখবার সময় কালিদাসের একান্ত আপন কবি-হৃদয়ের কাব্যময়তা এমনভাবেই কাজ করেছে যে, মহাভারতের কাহিনী সেখানে রূপান্তরিত হয়েছে চুড়ান্ত কাব্যিক মহিমায়। রবীন্দ্রনাথের শ্যামা, বিদায় অভিশাপ-এর কচ-দেবযানী অথবা কর্ণ-কুন্তীর রাবীন্দ্রিক চরিত্রায়ণের মধ্যে যে শিল্পীজনোচিত বেদনাবোধ পরিস্ফুট হয়েছে, কালিদাসের শকুন্তলা-দুষ্যন্তের কাহিনী সেইরকম মহাভারতের কাব্যশরীর অতিক্রম করে নতুন এক দুষ্যন্ত অথবা নতুন এক শকুন্তলার জন্ম দিয়েছে।

 কালিদাসের নাটকে আরম্ভেই নাটক–একটি হরিণ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে, আর তার পিছন-পিছন ছুটছেন মৃগয়াবিহারী দুষ্যন্ত। হাতে ধনুকবাণ, একা। পাত্রমিত্রের পরিবার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। মহাকাব্যের বিশাল পটভূমি থেকে শুধু মৃগয়ার ইঙ্গিতটুকু ব্যবহার করে কালিদাস তার নায়ক দুষ্যত্তকে হরিণের পিছন পিছন ছোটাতে ছোটাতে একা এনে ফেলেছেন কণ্বমুনির আশ্রমে, কারণ রাজাকে প্রথম থেকেই একাকিত্বের প্রশ্রয় দিলে আশ্রমবাসিনী শকুন্তলার সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দিতে সুবিধে হয়।

কিন্তু মহাভারতের কবির বিশেষণ যে ‘বিশালবুদ্ধি’-ব্যাসস্য বিশালবুদ্ধেঃ, যিনি নানারকম সামাজিক, রাজনৈতিক ধারার পরিণতি ঘটিয়ে কুরুক্ষেত্রের বিরাট যুদ্ধ সংঘটিত করবেন, তিনি তো আর দু-পাঁচটি শ্লোকে দুষ্যন্তের রথচক্রের বর্ণনা দিয়ে তাকে তপোবনে এনে ফেলতে পারেন না। তাঁর ভঙ্গিটা সব সময়ই এক বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের ঠাকুরদাদার মতো। শূন্যতা, নির্জনতা, দুহু-দোঁহার অপাঙ্গ-ইঙ্গিত–এসব ক্ষুদ্র উদ্দীপন মহাকাব্যের কবিকে মানায় না। বনপথে দুষ্যন্ত কণ্বমুনির আশ্রমে এসে পৌঁছবেন এর জন্য তাকে পরিবেশ প্রস্তুত করতে হয়েছে প্রায় দুই অধ্যায় ধরে। মহাভারতের দুষ্যন্ত, পৌরব বংশের বংশকর’ রাজা। তিনি হাজারো সৈন্যবাহিনী নিয়ে মৃগয়ায় বেরোবেন, সে তো দুটি-চারটি শ্লোকে হয় না। রাজা। মৃগয়ায় যাবেন, তার একটা উদ্যোগপর্ব আছে রীতিমতো। সেই মৃগয়ায় হাতি-ঘোড়া পদাতিকের সমন্বিত পদশব্দের সঙ্গে রথচক্রের ঘর্ঘর, অস্ত্র-শস্ত্রের বিপুল ঝনঝনানির সঙ্গে রথী পুরুষের শঙ্খনাদ-সিংহনাদৈশ্চ যোধানাং শস্যদুন্দুভিনিঃস্বনৈ, হাতি-ঘোড়ার বৃংহণ-হ্রেষিত শব্দের সঙ্গে মজা দেখতে আসা সমবেত জনতার চিৎকার-সব কিছু মিলিয়ে রাজবাড়ির পথ এবং প্রাঙ্গণ একেবারে মুখরিত হয়ে উঠল।

বনের পশু-পক্ষী, বাঘসিংহ শিকার করার জন্য মহারাজ দুষ্যন্তের এই বিরাট উদ্যোগ মশা মারতে কামান দাগার মতো শোনাতে পারে, কিন্তু সেকালের রাজনৈতিক এবং সমাজনৈতিক পটভূমির কথা টেনে আনলে একটা গেরেমভারি শব্দও এখানে ব্যবহার করা যায়। বলা যায়–সেকালের সামন্ততন্ত্রের রেওয়াজই এইরকম। রাজা মৃগয়ায় যাবেন, তার জন্য ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র সমস্ত বর্ণের লোকেরা তাকে বিদায় অভিনন্দন জানাতে এসেছে নির্যামনুজগিরে। তারা আশীর্বাদ আর জয়শব্দ উচ্চারণ করে চলে গেলে, জনপদবাসীরা দুষ্যন্তকে অনুগমন করার জন্য প্রস্তুত হল। অন্যদিকে রাজধানীর সমস্ত গৃহের উপরিতলে ভিড় উপচে পড়ল পুরনারীদের–প্রাসাদবরশৃঙ্গস্থাঃ পরয়া নৃপ শোভয়া। দদৃশ্যস্তং স্ত্রিয়স্তত্র…।

মহারাজ দুষ্যন্তকে দেখে পুরনারীরা ভাবছিলেন যেন বজ্র হাতে স্বর্গের দেবরাজ নেমে এসেছেন ভঁয়ে। মহারাজের বীরত্বের কথা সপ্রেমে আলোচনা করতে করতে তারা প্রাসাদশৃঙ্গ থেকে ফুল ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন দুষ্যন্তের মাথায়–সজুস্তস্য মূর্ধনি। প্রশস্ত রাজপথের মধ্যে উপরিপ্রাসাদতলগতা রমণীদের সানুরাগ কথাবার্তা উদ্ধার করে মহাভারতের কবি দেখালেন– উত্তমা নাগরিকদের কাছেও দুষ্যন্ত কত কাম্য পুরুষ। সমস্ত জনপদবাসী দুষ্যন্তের পিছন পিছন অনেক দূর পর্যন্ত চলে এল। শেষে দুষ্যন্তই তাদের পাঠিয়ে দিলেন রাজধানীতে। বনের পথ আরম্ভ হয়ে গেছে।

বনের মধ্যে এবার মৃগয়ার প্রস্তুতি আরম্ভ হল। নির্জন বন দুষ্যন্তের হস্তি-অশ্ব-পদাতিকে আলোড়িত হয়ে উঠল। কোথায় সিংহ, কোথায় বাঘ, কোথায় বন্যশুকর–হাঁকে-ডাকে, হত্যায় নির্মনুষ্য বনভূমি যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নিল। যারা ধনুক-বাণ চালায় তাদের লক্ষ্যভেদ করার ক্ষমতা, যারা গদা চালায় তাদের রিফ্লেক্স’, সব কিছুর পরীক্ষা হতে থাকল বন্য পশুদের ওপর। শব্দ-আঘাত-রক্তপাতে সমস্ত বনভূমি একেবারে ঘাঁটিয়ে তুললেন দুষ্যন্ত–লোড়য়ামাস দুষ্যন্তঃ সূদয় বিবিধা মৃগান্। এই বিশাল মৃগয়া-অভিযানে দুষ্যন্তের বাহিনীর বেশ কিছু লোক মারাও পড়ল। আবার অন্যদিকে এত পশুপাখি মারা পড়ায় বনবাসী কিরাত-শবরদের কিছু সুবিধেও হল। তারা আগুন তৈরি করে মৃত পশুপাখি পুড়িয়ে ভূরি-ভোজনের সুযোগ পেল। বলা বাহুল্য, এই বনের মৃগ-পশু শেষ হয়ে গেলে দুষ্যন্ত মৃগয়া-ব্যসনী হয়ে অন্য বনে প্রবেশ করলেন। মহাভারতের মৃগয়ার বর্ণনা সুচতুর কালিদাস ব্যঞ্জনার অঙ্গুলি সংকেতে সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন দ্বিতীয় অঙ্কে, বিদূষকের মুখে।

মহাভারতে দুষ্যন্ত বনান্তরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই একটা পরিবেশগত পার্থক্য আমাদের চোখে পড়ে। কালিদাসে ছুটন্ত ভয়ার্ত হরিণ এসে প্রবেশ করেছিল তপোবনে। ঋষিবালক হাত তুলে দুষ্যন্তকে বারণ করেছিলেন–এটি আশ্রমের মৃগ, একে হত্যা কোরো না–আশ্রম মৃগোয়ং ন হন্তব্যঃ, ন হন্তব্যঃ। রবিঠাকুরের কালিদাস-অনুবাদ-মৃদু এ মৃগদেহে মেরো না। শর, আগুন দেবে কে গো ফুলের পর। দুষ্যন্ত থামেন, রথ থেকে নামেন, অভিবাদন করেন ঋষিবালককে।

মহাভারতে যে বনে মৃগয়া হল, সেই বন থেকে এ বন একেবারেই আলাদা। যে বনে শেষ পর্যন্ত আশ্রমলোমভূতা’ শকুন্তলার দেখা পাওয়া যাবে, সেই বনের আবহ তৈরি হয়েছে নতুন সরসতায়। বনের পরিবেশে শীতল সমীরণের সঙ্গে বিহঙ্গের আলাপ যুক্ত হয়েছে। বিস্তীর্ণ তৃণভূমির মধ্যে বিশাল বিশাল বটের ছায়া, বিচিত্র বন্য লতা, ফুল আর কোকিলের শব্দ। সহৃদয় পাঠক! দুষ্যন্তের সঙ্গে আশ্রমবাসিনী শকুন্তলার দেখা হবে, এ তারই প্রস্তুতি। পাগল সমীরণে, ফুলের গন্ধে, পাখির ডাকে পাঠকের মনে প্রিয়মিলনের সঙ্গীত বাজতে থাকে। যাঁরা ভট্টিকাব্যের শরবর্ণনার শেষ শ্লোকটি শুনে মোহিত হন, তারা জানবেন ভট্টির কাব্যে মহাভারতের কবির শব্দস্পর্শ লেগেছে–দুষ্যন্ত এইমাত্র যেখানে এসে পৌঁছলেন, সেখানে এমন কোনও গাছই ছিল না, যে গাছে ফুল ফোটেনি,-নাপুষ্প পাদপঃ কশ্চিৎ। এমন কোনও ফুলও ছিল না, যেখানে অনুপস্থিত মধুকরের অব্যক্ত গুঞ্জন-বল্পদৈর্নাপ্যপাকীর্ণং ন তস্মিন্ কাননে’ভব।

কালিদাসে কণ্বমুনির আশ্রমে প্রবেশ করার সময় দুষ্যন্তের মুখে একখানিই শব্দ–শামিদ আশ্রমপদ। কিন্তু মহাকাব্যের কবির অনেক সমারোহ। তার আশ্রমপদ কালিদাসের মতো পূর্বপরিকল্পিত শুন্য নয়। কালিদাসের দুটি ঋষিবালক, সে দুজনও বুঝি দুষ্যন্তকে সুযোগ দেওয়ার জন্য সমিদাহরণ করতে চলে গেল, আর কণ্বমুনি তো আশ্রমেই নেই। দুষ্যন্তের কত সুবিধে। কালিদাসেরও বা কম কী? কিন্তু মহাভারতের দুষ্যন্ত নদীর তীর ঘেঁষা আশ্রমের মধ্যে কত ঋষি-মুনি দেখলেন, কত মৃগ-পক্ষী, কত ঋষিবালক সিদ্ধ-চারণ-গন্ধর্ব, কেউ বাদ নেই। সমবেত ঋষিমুনির ওঙ্কারধ্বনি শোনা যাচ্ছে। জায়গায় জায়গায় অগ্নিস্থাপনের বেদি পুষ্পস্তর দিয়ে সাজানো। কালিদাসের শান্ত আশ্রমপদের এক মজা, এখানে ওষ্কার-সামগানে মুখরিত আরেক পরিবেশ। এরই মধ্যে মহাভারতের কবি অতি সংক্ষেপে একটি কথা বলে দিলেন–সুখশীতল সমীরণ পুষ্পরেণু বহন করে আশ্রমের বৃক্ষচুড়ার মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছিল যেন রিরংসায় ভালবেসে ছুঁয়ে যাচ্ছিল আশ্রমবৃক্ষের পুষ্পগুলিকে।–পরিক্রামন বনে বৃক্ষানুপৈতীব রিরংসয়া। এর মধ্যে কোনও ইঙ্গিত আছে কি না জানি না, তবে দুষ্যন্তও ওই সুখশীতল বায়ুর মতোই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন করে আশ্রমে; পৌরববংশের পুষ্পরেণুর কণা তিনি বহন করে এনেছিলেন, তবে তা নিষিক্ত করার জন্য কথাশ্রমের সেই যৌবনবিকশিত পুস্পটির দেখা তিনি এখনও পাননি। মহাকাব্যের সমারোহভারে এখনও তিনি দাঁড়িয়ে আছেন মালিনীর তীরে-মালিনীমভিতো রাজন্ নদীং পুণ্যাং সুখোদকাম।

.

৪৩.

 মালিনীর জল বড় স্থির। আয়নার মত,–এমন করে যিনি ছবি লিখেছিলেন, তার কল্পচিত্র এই মহাভারত থেকেই উঠে এসেছে। কণ্বমুনির আশ্রমকে বেড় দিয়ে এমনভাবেই মালিনী নদী চলে গেছে যে, কণের আশ্রমটিকে মনে হচ্ছে ঠিক একটি দ্বীপের মতো–অলংকৃতং দ্বীপবত্যা মালিন্যা রম্যতীরয়া–অথবা নদীটি আশ্রমের মালার মতো বলেই নামটি হয়তো মালিনী। মালিনীর পারে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির মাধুর্যে মুগ্ধ রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন মহর্ষি কণ্বের সঙ্গে দেখা করেই যাবেন।

কালিদাসে যেমনটি আছে–রাজা ঋষিকুমারদের কাছে যখনই জানতে পারলেন–ওটি করে আশ্রম, অমনই বললেন–তাহলে মহর্ষির সঙ্গে দেখা করে একটু প্রণাম জানিয়ে যাই। ঋষিকুমারেরা বললেন–তিনি তো আশ্রমে নেই। তাঁর মেয়ে শকুন্তলাকে অতিথি-সৎকারের ভার দিয়ে তার দুর্ভাগ্য প্রশমন করার জন্য সোমতীর্থে গেছেন। রাজা বললেন–ঠিক আছে। তাহলে তার মেয়ের সঙ্গেই দেখা করে যাই। আমি যে এখানে এসেছিলাম, আমি যে তাকে প্রণাম জানিয়ে গিয়েছি, সেটা অন্তত তিনি বলে দেবেন মহর্ষিকে–সা খলু বিদিতভক্তিং মাং মহর্ষে কথায়িষ্যতি। রাজা আশ্রমের ভিতরে ঢুকলেন।

সেকালের দিনে এটা প্রায় নিয়মের মতো ছিল। ধরুন আপনি কোনও দেবস্থানে গেছেন, অথবা বেড়াতেই গেছেন এমন কোনও জায়গায়, যেখানে এক মহাপুরুষ আছেন অথবা এসেছেন। এমন জায়গায় গিয়ে স্থানীয় দেবতা বা প্রসিদ্ধ মহাপুরুষের দর্শন না করে শুধু বেড়িয়ে আসাটা সেকালের দিনের লোকের ধাতে ছিল না। তারা মনে করতেন–পূজনীয় ব্যক্তিকে সামান্য সম্মান না দেখিয়ে চলে এলে ধৃষ্টতা হয়, তাতে গৃহস্থের অকল্যাণ হবে। অতএব মন্দিরের দেবতা হোক, আর মহাপুরুষই হোক, প্রণাম করেই আসতেন তারা। বৃদ্ধদের মুখে আরও একটা কথা শুনেছি। বৃদ্ধ বলেছিলেন–এখনও চিঠির শেষে ‘প্রণামান্তে প্রণতঃ– এই সব শব্দ ব্যবহার করে কেন জানিস? বলেছিলাম-জানি না। বৃদ্ধ বলেছিলেন–সে যুগে এমন মিথ্যাচার করা যেত না। পাঁচ লাইন চিঠি লিখে, শেষে খশখ করে প্রণতঃকথাটা লিখে দিলাম, আর হয়ে গেল? পূজনীয় স্থানে পত্র প্রেরণ করার আগে পত্রদাতা পূজনীয় ব্যক্তির উদ্দেশে গড় করে প্রণাম করতেন মাটিতে। তারপর লিখতেন–প্রণামান্তে অথবা প্রণতঃ অমুক চন্দ্র অমুক।

 কালিদাসের নাটকে দুষ্যন্তের উক্তি থেকে বুঝি–দুষ্যন্তও আশ্রমে ঢুকলেন কণ্বমুনিকে দর্শন করে প্রণাম করে যাবার জন্যই। এই পর্যন্ত কোনও সমস্যাই নেই, কারণ মহাভারতেও প্রায় একই রকম। কিন্তু তফাৎ আছে স্বভাবে। কালিদাসের দুষ্যন্ত যতখানি নায়ক-স্বভাবের, রাজোচিত ততটা নন। আর মহাভারতের দুষ্যন্ত বড় বেশি রকমের রাজগুণসমন্বিত বলেই মহাকবিকে তার চারধারের সমস্ত পরিবেশের মধ্যে গম্ভীর সমারোহের ব্যবস্থা করতে হয়। যাই হোক, রাজা স্থির করলেন-কথের আশ্রমে প্রবেশ করবেন-চারাভিপ্রবেশায় মতিং স নৃপতিস্তদা। কিন্তু রাজার প্রবেশ তো আর সোজা কথা নয়। হিংসাবৃত্তির পরিচায়ক অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করে, সৈন্যসামন্তদের তপোবনের এলাকার বাইরে রেখে রাজা প্রবেশ করলেন তপোবনে। মহাভারতের দুষ্যন্তের এই বিনীত ব্যবহার কালিদাসেও আছে। কিন্তু কালিদাসে দু-তিনটি শ্লোকের রেখায় গাছের ডালে মুনি-ঋষিদের কাপড় শুকনোর ব্যবস্থা দেখে, ইদুদীর ফল-বাটা তৈল-চিকন পাথর দেখে, অপিচ পক্ষী আর হরিণ শিশুর মুখোদগীর্ণ নীবার ধান্যের মুষ্ঠিতে আশ্রম-পরিচয় করেই মহারাজ দুষ্যন্ত শকুন্তলার কাছাকাছি চলে যেতে পেরেছেন। কিন্তু মহাভারতের রাজা দুষ্যন্তকে তপোবনে ঢুকতে হয়েছে নিজের পুরোহিতকে সঙ্গে নিয়ে–পুরোহিতসহায় জগামাশ্রম। এই পুরোহিতকে অবশ্য এখনকার দিনের পুরুতঠাকুর ভাবার কোনও কারণ নেই। পুরোহিত মহাজ্ঞানী, মহাপণ্ডিত ব্যক্তি। সেকালের যে কোনও বড় রাজা তার রাজ্য-সংক্রান্ত এবং জীবন সংক্রান্ত সমস্ত গভীর আলোচনা করতেন পুরোহিতের সঙ্গে এবং সব ব্যাপারে তার নির্দেশের মূল্য ছিল প্রায় শেষ সিদ্ধান্তের মতো অনেক ক্ষেত্রেই তিনি রাজসভায় মন্ত্রী, কখনও বা প্রধানমন্ত্রীর কাজও করতেন। অবশ্য এখানে পুরোহিতের সঙ্গে রাজার অমাত্যও ছিলেন।

অমাত্য-পুরোহিতকে নিয়ে রাজা কথাশ্রমে প্রবেশ করলেন বটে, তবে সেখানে মহর্ষি কণের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের আগেই তার আশ্রমের পরিচয় পেলেন আরও গভীরভাবে। আশ্রমে ঋগবেদের মন্ত্রে দেবতার আহ্বান চলছে, সামগান করছেন সামবেদী ঋষিরা, যজুর্বেদী পুরোহিত আহুতি দিচ্ছেন আগুনে। মন্ত্রে-গানে সমস্ত আশ্রমের পরিবেশটা এমন স্বর্গীয় হয়ে উঠেছে যে, রাজার মনে হল যেন ব্রহ্মলোকে এসে উপস্থিত হয়েছেন–ব্রহ্মলোকস্থমাত্মানং মেনে স নৃপসত্তমঃ। রাজা কণ্বমুনির আশ্রম-কুটিরের প্রান্তদেশে এসে অমাত্য-পুরোহিত সবাইকে বাইরে রেখে আশ্রম কুটীরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। :ভাবে বুঝি, অমাত্য পুরোহিতকে বসিয়ে রেখে গেলেন মন্ত্র-গানের যজ্ঞীয় আসরে।

দুষ্ট নায়ক ছিলেন বটে কালিদাসের দুষ্যন্ত। আশ্রমের উঠোনে তিন সখী শকুন্তলা, অনসূয়া, প্রিয়ংবদা যখন বৃক্ষতলায় জলসেচন করছিলেন, রাজা তখন নিজের পরিচয় না দিয়ে লুকিয়ে রইলেন লতাবিতানের অন্তরালে। তিন সখী নিজেদের মধ্যে নানারকম ঠাট্টা-ইয়ার্কি করছিলেন, রাজা প্রাণ ভরে সেসব কথা শুনছিলেন। এমন সব কথা, যা মেয়েরা নিজেদের মধ্যেই শুধু বলে। বৃক্ষের অন্তরাল থেকে সুন্দরী সখী-সমাজের একান্তে উচ্চারিত কথাগুলি শুনে দুষ্যন্তের নানা স্বগত মন্তব্যেও বোঝা যায় তিনি যতখানি নায়ক রাজা ততটা নন। এমনকি সখী-সমাজে নিজের আসল পরিচয়টি পর্যন্ত তিনি দেননি। শকুন্তলার সুঙ্গে পরিচয় হবার পর থেকে রাজাকে প্রথম প্রেমের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মানুষটির মতো দেখতে পাচ্ছি। সারা প্রথম অংক জুড়ে রাজার সঙ্গে শকুন্তলার কোনও কথাই নেই প্রায়–প্রথম পুরুষের প্রথম সপ্রেম অভিধানে মাঝে মাঝে তাকে শৃঙ্গার-লজ্জায় লজ্জিত হতে দেখছি। কথা যা বলছেন, তা সখীরাই বলছেন। রাজার সঙ্গে।

মহাভারতের দুষ্যন্ত আশ্রমের কুটীর প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে কথ মুনিকে দেখতে পেলেন না। তখন রাজার মতই হেঁকে-ডেকে–ওরে কে কোথায় আছিস, সাড়া দে, আমাকে তোরা দেখ–এইভাবে সমস্ত পোবনভূমি একেবারে কাঁপিয়ে তুললেন–উবাদ ক ইহেতুচ্চৈঃ বনং সংন্নদয়বি। হাঁক-ডাক শুনে একটি কন্যা বেরিয়ে এলেন আশ্রম থেকে, ভারি সুন্দরী আর লক্ষ্মীমতী। গায়ে তপস্বিনীর বেশ। কোনও সংকোচ নেই, লজ্জা নেই, ডাগর আঁখি মেলে কন্যা রাজাকে স্বাগত জানিয়ে বললেন–আপনার রাজ্যের কুশল তো রাজা? কোনও প্রতিকূলতা নেই তো? কন্যা রাজাকে পা ধোয়ার জল দিলেন, আসন দিলেন বসতে। হেসে বললেন–বিশেষ কোনও কাজ আছে নাকি আপনার?

রাজা অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন ধীরমধুরভাষিণী রমণীর দিকে। বললেন–আমি মহর্ষি কণ্বকে প্রণাম জানানোর জন্য এখানে এসেছিলাম। কোথায় গেছেন তিনি? সুন্দরী রমণী হেসে বললেন–এই তো কাছেই গেছেন পিতা কণ্ব। বন থেকে কিছু ফল কুড়িয়েই ফিরে আসবেন। আপনি একটু বসুন, এই তিনি এলেন বলে–মুহুর্তং সম্প্রতীক্ষস্ব দ্রষ্টাস্যেনমুপাগত।

কালিদাসের অভিজ্ঞানে রাজার হাতে অনেক সময় ছিল। নায়ক-নায়িকাকে প্রেমের অনুকূল সরস পরিস্থিতি দেওয়ার জন্য পিতা কণ্বের বহু দূরে থাকাই শুধু নয়, লজ্জাশীলা শকুন্তলাকে দিয়ে রীতিমতো প্রেম করিয়ে দেওয়ার জন্য অনসূয়া-প্রিয়ংবদার মতো দুই সখী ছিলেন কালিদাসের হাতে। রাজার খবর, শকুন্তলার খবর সবই নায়ক-নায়িকার কাছে সঞ্চারিত হয়েছে দুই সখীর মাধ্যমে। কিন্তু মহাভারতে অনসূয়া-প্রিয়ংবদার মতো সুযোগা সখীও নেই। এখানে সুন্দরী মধুরহাসিনী শকুন্তলা রাজার সামনে দাঁড়িয়ে, একা। এখানে রাজার হাতেও কোনও সময় নেই, কখন না জানি কণ্বমুনি ফল কুড়িয়ে এসে পড়েন। অতএব কণ্বমুনির গতিস্থিতি জানামাত্রই রাজার অবধারিত প্রতিক্রিয়া-প্রেম নিবেদন করা–যত কম সময়ে পারা যায়, প্রেম নিবেদন করা।

আশ্রমবাসিনী শকুন্তলার পরনে ছিল চীরবাস, যা তার অপার যৌবনরাশির তুলনায় ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। তার মধ্যে আশ্রমসুলভ শম-দমের সাধনে শকুন্তলার শরীরে ছিল সেই অদ্ভুত দীপ্তি যা নাগরিকার মধ্যে মেলে না–বিভ্ৰাজমানাং বপুষা তপসা চ দমেন চ। নাগরিক। রাজা মুগ্ধ হলেন আশ্রমবাসিনীকে দেখে। অথচ হাতে সময় নেই, মহর্ষি কণ্ব এসে পড়বেন কখন? রাজা সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি কে রমণী? কার মেয়ে? এই বনে এসেছ কী করতে, এমন সুন্দর যার চেহারা, সে কোথা থেকে এসে এই বনের মধ্যে জুটল এবংরূপগুলোপেতা কুতত্ত্বমসি শোভনে? তোমাকে দেখামাত্রই আমি মুগ্ধ হয়েছি কন্যে। তুমি তোমার সমস্ত কথা আমায় খুলে বল।

মহাভারতে যেখানে সংক্ষিপ্ত ভাষণ, কালিদাসের সুযোগ সেখানে। এমন রূপ নিয়ে তুমি বনের মধ্যে এলে কেমন করে–শুধু এই সামান্য পংক্তিটির ইঙ্গিত কালিদাসে অসাধারণ কয়েকটি শ্লোকে এসেছে। আশ্রমের মধ্যে গাছে জল দেওয়ার কাজটুকু করার যে পরিশ্রম, সেই পরিশ্রমও যেন শকুন্তলার মতো কোমলাঙ্গী সুন্দরীর যোগ্য নয় এবং মহর্ষি কথ যে তাকে এই কঠিন কাজে নিয়োগ করে পদ্মফুলের পাতা দিয়ে মোটা মোটা গাছ কাটার চেষ্টা করছেন এই সব অসাধারণ আক্ষেপও রাজা দুষ্যন্তের মুগ্ধতা জ্ঞাপন করেছে কালিদাসে। শকুন্তলার কুল-শীল জন্ম নিয়েও রাজার মনে যা কিছু সংশয় ছিল, সেগুলো অবশ্য সবই রাজার কানে এসেছে অনসূয়া-প্রিয়ংবদার সঙ্গে রাজার কথোপকথনের সূত্রে। কিন্তু কুল-শীলের জিজ্ঞাসা কালিদাসেও আছে।

মহাভারতের শকুন্তলা নিজেই নিজের সহায়। মহারাজ দুষ্যন্তের মুখে নিজের শারীরিক স্তুতি-প্রশংসা শুনেও তার লজ্জা পাবার অবকাশ নেই কোনও। তাকে নিজেই বলতে হচ্ছে নিজের জীবনের কাহিনী। তপস্বী কণ্বের আশ্রমে শকুন্তলা ঋষি-বালক আর ঋষিদের ছাড়া এমন আর কাউকে এ পর্যন্ত দেখেননি, যিনি এমন হঠাৎ করে প্রণয় প্রকাশ করতে পারেন। তাপসীবেশধারিণী এক তথাকথিত ঋষিকন্যাও যে দেশের রাজার মনোহরণ করতে পারেন–এ ধারণা শকুন্তলার ছিল না। কিন্তু রাজার মুখে অমন দুর্বাধ প্রণয়োজ্জাস শুনেও সমস্ত সুস্থিরতা নিয়ে শকুন্তলা যে প্রত্যুত্তর দিতে পেরেছেন, তাতে মহাভারতের শকুন্তলার ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে মহাকাব্যের অন্যতমা নায়িকার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাল রেখে। নিজের কথা তিনি নিজেই বলতে পারেন নির্দ্বিধায়।

মহারাজ দুষ্যন্তের প্রণয় আকুতি এবং প্রশ্ন শুনে কাশ্রমের অধিবাসিনী একটু মধুর স্বরে হাসলেন, তারপর প্রথম পরিচয় জ্ঞাপন করলেন নিজের–মহারাজ! আমি ধর্ম তপস্বী করে মেয়ে। রাজা পালটা প্রশ্ন করলেন—মুহাত্মা কণ্বকে আমরা উর্দ্ধরেতা ব্রহ্মচারী তপস্বী বলেই তো জানি। সেই জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তির এমন চরিত্রস্খলন হতে পারে–এ তো ভাবাই যায় না। তুমি কেমন করে সেই ব্রহ্মচারী মহর্ষির মেয়ে হলে তা শুনতে আমার কৌতূহল হচ্ছে রীতিমতো–কথং ত্বং তস্য দুহিতা সস্তৃতা বরবৰ্ণিনী?

শকুন্তলার স্পষ্ট উত্তরের আগে দুষ্যন্তের প্রশ্ন শুনে আমাদের যে কিছু আশ্চর্য হবার আছে, সেটা জানাই। যে দুষ্যন্ত উচ্ছিন্ন পৌরববংশের এক অনামা অখ্যাত মানুষের ঔরসে জন্মেছিলেন এবং যিনি মানুষ হয়েছিলেন তুর্বসু-বংশীয় মরুত্ত রাজার ঘরে, তিনি এক রমণীর কুলশীল জিজ্ঞাসা করছেন–এটা ভাবতে বিপরীত লাগে। এমন প্রশ্ন শুনলে, যে কথা এতক্ষণ বলিনি, তাও বলতে হয়। আগে বলেছি–দুষ্যন্ত আবীক্ষিত মরুত্তের ঘরে মানুষ হয়েছেন। পুরাণে-ইতিহাসে তুর্ক বংশের পরম্পরায় তার নাম পাই বলে আমরা সসম্মানে সে কথা মেনেও নিয়েছি। কিন্তু দুষ্যন্তের এই প্রশ্নের নিরিখে আবারও আমাদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। শতপথ ব্রাহ্মণের মতো প্রাচীন এবং বিখ্যাত ব্রাহ্মণ গ্রন্থে আমরা দেখছি–মরুপ্ত। আবীক্ষিত নামে এক আয়োগব’ রাজা অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন–মহাব্রতুমতিরাত্রনে হ মরুত্ত আবীক্ষিত ইজে আয়োগবো রাজা।

আবীক্ষিত মরুত্ত যে অনেক বড় বড় যজ্ঞ করেছিলেন, সে কথা আমরা পূর্বে সাড়ম্বরে বলেছি। কিন্তু তিনি যে আয়োগব’ রাজা সে কথা বলিনি। মরুত্তর বিশেষণ হিসেবে আবীক্ষিত’ শব্দটি থাকার ফলে ইনি যে আমাদের পূর্বকথিত মরুত্ত রাজা যিনি দুষ্যন্তকে মানুষ করেছিলেন, এই আইডেনটিটি’ নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু তার আরেকটা বিশেষণ ‘আয়োগবো রাজা’, ‘আয়োগব’ শব্দের অর্থ কাত্যায়নের শ্রোতসূত্রের টীকায় যেমনটি দেখা যায়, তা হল–শূদ্রের ঔরসে বৈশ্যা রমণীর গর্ভজাত সন্তান। মরুন্তু যদি ঠিক এই রকমই এক আয়োগর রাজা হয়ে থাকেন, তবে সেই রাজার সুরক্ষায় এবং অন্নপ্রাণে মানুষ হয়ে দুষ্যন্তের মুখে কুল-শীলের প্রশ্ন মানায় না। পণ্ডিতেরা অবশ্য আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, ধর্মসূত্রগুলির প্রণয়ন-কাল পর্যন্ত যেহেতু আয়োগব’ শব্দের কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞার্থ চোখে পড়ে না, তাই মরুত্ত রাজাকে কোনও শূদ্র রাজা না ভেবে বরং কোনও অব্রাহ্মণ রাজাকে ব্রাহ্মণ্য রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় অলীকরণের উদাহরণ হিসেবে মেনে নেওয়াই ভাল। কিন্তু এই আশ্বাসবাণীর পরেও মরুত্ত। রাজার ঘরে পালিত দুষ্যন্তের কাছ থেকে শকুন্তলার সম্বন্ধে প্রশ্নগুলি মানায় না।

আশ্রমবাসিনী শকুন্তলার মনের মধ্যে অবশ্য এত জটিলতা নেই। তিনি নিশ্চিন্তে আগন্তুক রাজাকে নিজের জীবনের গল্প শোনাতে লাগলেন। শকুন্তলা বললেন–মহারাজ! আমি কেমন করে এখানে এলাম, কেমন করেই বা একদিন মহর্ষি করে মেয়ে হয়ে গেলাম, সে এক ইতিহাস, রাজা! শুনুন তাহলে। আপনি মহর্ষি বিশ্বামিত্রের নাম শুনে থাকবেন। এক সময় তিনি এমন সাংঘাতিক তপস্যা করেছিলেন যে, দেবরাজ ইন্দ্রও সেই তপস্যা দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। ভাবলেন–হয়তো তপস্যা করে শেষ পর্যন্ত স্বর্গের ইন্দ্ৰত্বই অধিকার করে নেবেন ঋষি বিশ্বমিত্র–তপসা দীপ্তবীর্যোয়ং স্থানান্মাং চ্যাবয়েদিতি।

ভীত পুরন্দর শেষ উপায় হিসেবে ডেকে পাঠালেন স্বর্গের অন্যতম প্রধানা অলরা মেনকাকে। ইন্দ্র তাকে বললেন–অপ্সরা-সমাজে তোমার মতো গুণী আর দ্বিতীয় কে আছে? তা তুমি বাপু আমার একটা উপকার করো। তুমি কি জান–বিশ্বামিত্র এমন তপস্যা করছেন যে আমার মনটা ভয়ে কাঁপছে সব সময়—মম কম্পয়তে মনঃ। তা এই বিশ্বামিত্রের ভার আমি তোমার হাতেই সঁপে দিলাম মেনকা– মেনকে তব ভারো’য়ং বিশ্বামিত্রঃ সুমধ্যমে। এই ভার। দেওয়ার অর্থ কী, মেনকা তা জানেন। ইন্দ্র অবশ্য সবিশদে বুঝিয়েও দিলেন–কী করতে হবে মেনকাকে। বললেন–আমার ইন্দ্ৰত্ব চলে যাবে, মেনকা! বিশ্বামিত্রের ঘোর তপস্যায় সব যাবে। আমার। তুমি এখনই যাও সেই উগ্রতপা তপস্বীর কাছে, তাকে প্রলোভিত করো-তং বৈ গত্ব প্রলোভয়। যেভাবে পারো, রূপ-যৌবনের মাধুর্য প্রকাশ করেই হোক, হাত-পায়ের ভঙ্গিমাতেই হোক অথবা মধুর হাসে, মধুর ভাষেরূপযৌবন-মাধুর্য- চেষ্টিত-স্মিত-ভাষণৈঃ–যেভাবেই হোক এই তপস্বীকে প্রলুব্ধ করে তাকে তপস্যা থেকে নিবৃত্ত করতে হবে।

ইন্দ্রের কথা শুনে মেনকা জবাব দিলেন–ওরে বাবা বিশ্বামিত্র। তিনি যে কেমন রাগী মুনি, সে তো আপনি নিজেও জানেন দেবরাজ-কেপনশ্চ তথা হ্যেনং জানাতি ভগবানপি। মেনকা এক এক করে বিশ্বামিত্রের জীবনের দশ-বারোটি ঘটনা উল্লেখ করলেন ইন্দ্রের কাছে, যাতে বোঝা যায় বিশ্বামিত্র কত অসাধ্য সাধন করেছেন। বশিষ্ঠ মুনির সঙ্গে বিবাদের সময়, ত্রিশঙ্কুর স্থিতিনির্ণয় করার সময়, ক্ষত্রিয়-জন্ম থেকে ব্রাহ্মণ্য লাভের ঘটনায়, এবং আরও বেশ কয়েকটা উদাহরণ দিলেন মেনকা যে সব সময় বিশ্বামিত্র মুনির অসম্ভব সম্ভব করার ক্ষমতা দেখে স্তম্ভিত হয়েছেন সকলে। মেনকা বলেছিলেন–আপনি স্বয়ং যাকে দেখে ভয় পান, দেবরাজ আমি তাকে ভয় পাব না–মপুদ্বিজসে যস্য নোদ্বিজেয়মহং কথম্? যিনি রাগলে সবাইকে ভস্ম করে দিতে পারেন, তপস্যার তেজে যিনি সবাইকে কম্পিত করে তোলেন-সেই আগুনের মুখে, সেই কালজিহ্বার করাল গ্রাসের মধ্যে আমার মতো এক রমণী কী করে প্রবেশ করবে–হুঁতাশনমুখং দীপ্তং কথমস্মবিধা স্পৃশেৎ?

মুশকিল হল, দেবরাজ ইন্দ্র মেনকার স্মরণাপন্ন হয়েছেন, স্বর্গরাজ্যের নিয়ন্তা এক রমণীর উপকারপ্রার্থী। মেনকা তাই যত ভয়ই পান, অথবা যত অনিচ্ছাই তার থাকুক, তার পক্ষে দেবরাজকে ‘না’ বলার উপায় নেই। মেনকা তাই বললেন–আপনি বলছেন যখন, তখন আর না বলি কী করে? কিন্তু আপনি আমার বেঁচে ফেরার রাস্তাগুলো ঠিকঠাক খোলা রাখুন। আমি যখন বিশ্বামিত্রের সাৰ্ণ্যমনে আমার রূপ-যৌবন এবং মাধুর্যের বিলোভন সৃষ্টি করব, তখন বায়ুদেবতা যেন উতল হাওয়ায় আমার লজ্জাবস্তু উড়িয়ে নেন–কামং তু মে মারুতস্তত্র বাসঃ/প্রীড়িতায়া বিবৃণোতু দেব। ভালবাসার দেবতা অঙ্গহীন অনঙ্গ যেন আমার কাজে সহায় হন, যেন সহায় হন ঋতুরাজ বসন্ত। ঋষিকে প্রলুব্ধ করার সময় বনফুলের সুগন্ধ যেন আমোদিত করে দেয় সমস্ত বনস্থলী-বনাচ্চ বায়ুঃ সুরভিঃ প্রবায়াৎ।

বলা বাহুল্য, দেবরাজ রাজি হলেন মেনকার প্রস্তাবে। সদাগতি সমীরণ সাথী হলেন মেনকার। সর্বচিত্তহর মনমথন কামদেব এলেন বিশ্বামিত্রর মনে বাসনা তৈরি করার জন্য। (কালিদাসের কুমারসম্ভবে অকালবসন্তের উৎস কি এইখানে?) ইন্দ্রের যোজনায় সমস্ত ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল। স্বর্গসুন্দরী মেনকা সভায় এসে উপস্থিত হলেন তপস্যাপ্ত বিশ্বামিত্রের সামনে। তার গায়ে জ্যোৎস্নার মতো সূক্ষ্ম বসন, চলনে নটন, বলনে গান। মেনকা ঋষিকে অভিবাদন করেই নানা নৃত্যভঙ্গিমায় আকর্ষণ করতে লাগলেন মুনিকে। এমন সময় উতাল হাওয়া বনস্থলীর সমস্ত সুগন্ধ চুরি করে এমনভাবে বইতে লাগল যে, তাতে মেনকার চাঁদচুয়ান পরিধেয় বসন একেবারেই উড়ে গেল–অপোবাহ চ বাসোস্যাঃ মারুতঃ শশিসন্নিভ। হাওয়ার তাড়নাতেই যেন মেনকার ফুলের ঘায়ে মুচ্ছো যাওয়া শরীরখানি লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। এতে যে তার একটুও দায় নেই, এ দোষ যেন তার নিজের নয়, এই ভাবেই মেনা যেন তার উড়ে-যাওয়া পরিধেয় বসনখানি ধরতে চাইলেন বারবার। বসন সংগ্রহ করার এই ভয়ংকর অভিনয়-চেষ্টার মধ্যেও কল্পলোকের নায়িকার মতো মেনকার মুখের হাসিটুকু কিন্তু তার ঠোঁটে লেগে রইল, অম্লান–স্ময়মানে সব্রীড়।

উতলা হাওয়া, বনস্থলীর পুষ্প-পরিমল এবং হঠাৎ ঝড়ে উড়ে যাওয়া বসনের বিপন্নতার মধ্যে তপস্যা-ক্লান্ত বিশ্বামিত্র মেনকাকে দেখতে পেলেন সম্পূর্ণ অনাবৃতা অনির্দেশ্যবহোরূপাম্ অপশ্য বিবৃতাং তদা। মেনকার অলোকসামান্য রূপ দেখে শুষ্ক-রুক্ষ্ম মুনির কঠিন হৃদয় একেবারেই গলে গেল। মহাকাব্যের কবি লিখেছেন-মেনকার রূপ-গুণ দেখে–তস্যা রূপগুণান্ দৃষ্টা, এখানে গুণ কিছু দেখেননি ঋষি। আসলে এই সমাসের ব্যাসবাক্য রূপ এবং ‘গুণ’ নয়, হবে ‘রূপের গুণ’! সেই অমর্ত্য রূপের মোহে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বামিত্র মিলনের আহ্বান জানালেন মেনকাকে, যে মিলন দেবরাজ ইন্দ্রের চক্রান্তে একান্ত কাক্ষিত ছিল মেনকারওন্যমন্ত্ৰয়ত চাপেনাং সা চাপ্যৈচ্ছদনিন্দিতা।

শকুন্তলা এতক্ষণে যে রাজাকে নিজের জীবন-কাহিনী শোনাচ্ছিলেন তা নিজের জবানীতে নয়। রাজাকে তিনি বলেছিলেন–এক ব্রাহ্মণ ঋষি পিতা কথকে আমার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন ঠিক আপনার মতো করেই। আমি নিভৃতে সে কথা পিতা করে মুখে যেমন শুনেছি, তাই আপনাকে জানাচ্ছি। শুধু পিতা কণ্বের জবানী হলেও বিশ্বামিত্র-মেনকার মিলন কাহিনী শোনাতে শকুন্তলার একটুও লজ্জা হল না। কালিদাসে দুষ্যন্ত একই প্রশ্ন করেছিলেন শকুন্তলার সখীর কাছে। সেখানে শকুন্তলার জীবনকাহিনী বলতে গিয়ে-বসন্তকালে উদার প্রকৃতির মধ্যে মেনকার পাগল-করা রূপ দেখে বিশ্বামিত্র-এইটুকু মাত্র বলে, অর্ধবাক্য শেষ না করেই প্রিয়ংবদাকে লজ্জায় থামতে হয়েছে। নাগরিক রাজাও আর শুনতে চাননি। কিন্তু মহাকাব্যের নায়িকা কণ্বের জবানীতে নিজের কাহিনী শোনাচ্ছেন অনুপুঙ্খভাবে, রাজাও শুনছেন উৎকর্ণ হয়ে। আসলে মহাকাব্যের উদার-অপার পরিবেশের মধ্যে কোনও কাহিনীই অসম্পূর্ণ থাকে না, কথা-সুন্দরী সলজ্জে স্তম্ভিত হন না অর্ধপথে।

শকুন্তলা বললেন– রমমান বিশ্বামিত্রের ঔরসে মেনকার গর্ভে একটি মেয়ের সম্ভাবনা হল। তারপর একদিন এই হিমালয়ের কোলে মালিনী-নদীর তীরভূমিতে অঙ্গরা সুন্দরী মেনকা আপন স্বভাবে গর্ভমুক্ত হয়ে চলে গেলেন স্বর্গরাজ্যে ইন্দ্রের কাছে নিজের সাফল্য জ্ঞাপন করার জন্য। মালিনীর তীরে উন্মুক্ত আকাশের নীচে পড়ে রইল একটি শিশুকন্যা। বনের মধ্যে বাঘ-সিংহ ঘুরে বেড়াচ্ছে, হিংস্র শ্বাপদের আনাগোনা পদে পদে। ছোট্ট শিশুটিকে দেখে বনের যত পাখি ছিল, তারা অজাতপক্ষ পক্ষিশাবকের মতো ঘিরে রইল শিশুটিকে–দৃষ্টা শয়ানং শকুনাঃ সমন্তাৎ পর্যবারয়ন। ইতিমধ্যে মহর্ষি কণ্ব মালিনী নদীতে এলেন স্নান-আহ্নিক করতে। দেখলেন–পাখিরা একটি শিশুকে ঘিরে কিচির-মিচির করছে। অসহায় শিশুকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্যই যেন তাদের এই কিচির-মিচির আর্তনাদ। মহর্ষি কণ্ব পরিত্যক্তা শিশুকন্যাকে সযত্নে কোলে তুলে নিয়ে এলেন আশ্রমে। আশ্রমবাসী সকলকে জানালেন–এই আমার মেয়ে। নির্জন বনের মধ্যে শকুনেরা (পাখি শকুন্ত। শকুন মানে ‘শকুন’ নয়) পাখিরা যেহেতু একে রক্ষা করেছিল, আজ থেকে এই মেয়ের নাম তাই শকুন্তলা–যস্মাচ্ছকুন্তৈঃ পরিবারিতা/শকুন্তলেতি নামাস্যাঃ কৃতঞ্চাপি ততো ময়া।

 কণ্বের জবানীতে নিজের জন্ম-বিবরণ সম্পূর্ণ ব্যক্ত করে মহর্ষি কণ্ব ব্রহ্মচারী হওয়া সত্ত্বেও কেন তার পিতা হলেন, সে সম্বন্ধে শকুন্তলা রাজাকে শাস্ত্র কথা শুনিয়েছেন কন্তের জবানীতেই। কণ্ব আশ্রমের সকলকে বলেছিলেন– জন্মদাতা পুরুষ যেমন পিতা, তেমনই যিনি প্রাণ রক্ষা করেন, যিনি ক্ষুধার অন্ন দেন, তারাও একভাবে পিতার সংজ্ঞা লাভ করেন–শরীরকৃৎ প্রাণদাতা যস্য চান্নানি ভুঞ্জতে। শকুন্তলা এই কথার অন্য কোনও অর্থ করেননি। রাজাকে তিনি জানিয়ে দিলেন–জন্মদাতা পিতাকে আমি চোখে দেখিনি কখনও। তাই অন্তত দুটি কারণে, প্রাণ-রক্ষা এবং পালন-পোষণের গৌরবে আমি মহর্ষি কথকেই আমার পিতা বলে মনে করি–কং হি পিতরং মন্যে পিতরং স্বমজানতী।

হয়তো ‘আয়োগব’ মরুত্ত রাজার ঘরে প্রতিপালিত মানুষটি এতদিনে নিজেরই মতো এক রমণী খুঁজে পেলেন, যিনি তারই মতো পিতৃ-মাতৃ মুখ দেখেননি কখনও। অন্নে, প্রাণের সুরক্ষায় যে রমণী তারই মতো কাশ্রমে প্রতিপালিতা, হয়তো সেই রমণীর মধ্যে নিজের পূর্বজীবনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলেন দুষ্যন্ত। দুষ্যন্ত দাঁড়িয়ে উঠলেন কথা-কাহিনীর জগৎ থেকে। মহর্ষি কণ্ব ফল কুড়োতে গেছেন। তিনি ফেরার আগেই বিখ্যাত পৌরববংশের ধুরন্দর রাজা হৃদয় উন্মোচন করতে চান মহাতেজস্বী বিশ্বামিত্রের কন্যা শকুন্তলার কাছে। এই হৃদয় উন্মোচনে অন্তর্ধারায় আছে একাত্মতা-আমরা দুজনেই সমদুঃখদুঃখী, পরান্ন-প্রতিপালিত, বহির্ধারায় আছে তথাকথিত বংশগৌরব-আমি পৌরববংশ-ধুরন্ধর, তুমি বিশ্বামিত্রের ঔরসে স্বর্গসুন্দরী মেনকার কন্যা। এই হৃদয়-উন্মোচনের ফল প্রসুপ্ত আছে দূর-ভবিষ্যতের গর্ভে। সেই কারণেই বুঝি দিন বেছে বেছে আজকেই কন্বমুনি ফল কুড়োতে আশ্রমের বাইরে গেছেন দুরে!

.

৪৪.

 এখনকার দিনেও আমি অনেক যুবক-যুবতাঁকে দেখেছি, যারা জাত মিলিয়ে প্রেম করেন। এই যুবক-যুবতীরা অবশ্যই বড় জাতের শিল্পী। নইলে ঝোড়ো হাওয়া আর পোডড়া বাড়ির ভাঙা দরজাটা মিলিয়ে দেবার ভার যার ওপরে ছিল, তিনিও বুঝি চিন্তিত হতেন এই প্রেম এবং জাত একসঙ্গে মেলাতে। লক্ষণীয়, এই ট্র্যাডিশন আজকের নয়। শকুন্তলার মুখে আপন জন্মবৃত্তান্ত শোনার সঙ্গে সঙ্গে মহারাজ দুষ্যন্তের উচ্ছ্বাস শোনা যাচ্ছে। তিনি বলছেন–সুন্দরী! পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, তুমি ক্ষত্রিয়ের মেয়ে–সুব্যক্তং রাজপুত্রী ত্ব–অর্থাৎ দ্বিগুণ উচ্ছ্বাস। রূপ দেখে ভীষণ পছন্দ হয়েছে, আবার জাতেও মিলেছে। অতএব তুমি যখন ক্ষত্রিয়ের মেয়ে, রাজপুত্রী, তাহলে অবশ্যই আমার মতো ক্ষত্রিয় রাজার স্ত্রী হবার উপযুক্ত তুমি। তুমি আমার স্ত্রী হও, তোমার জন্য আমি সব করতে পারি–ভার‍্যা মে ভব সুশ্রোণি ঐহি কিং করণি তে।

কোনও এক সংস্কৃত কবি বলেছিলেন-প্রেমিক পুরুষ নাকি নিজের মতো করে দুনিয়াকে দেখে এবং দুনিয়াকে সাজিয়েও নেয় নিজের মতো করে। বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় রাজা ছিলেন, তপোবলে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেছেন। সে এক বিরাট ইতিহাস। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে এবং সঠিকভাবে ভাবলে বিশ্বামিত্রকে ব্রাহ্মণ এবং শকুন্তলাকে ব্রাহ্মণকন্যাই ভাবা উচিত। কিন্তু স্বয়ং রাজা দুষ্যন্ত নিজে এবং ব্রাহ্মণ্য-জাত্যাভিমানী মহাভারতের টীকাকারেরা বিশ্বামিত্রের সম্বন্ধে প্রথম সুযোগেই বলেছেন–রুপোর গয়নার ওপর পারদলেপনের দ্বারা সোনার ভাবটুকু আসতে পারে বটে, কিন্তু রুপো রুপোর কাজই করে। এই দৃষ্টিতে তপস্যা-টপস্যা করে। বিশ্বামিত্র যতই ব্রাহ্মণ হোন, বিশ্বামিত্র আসলে ক্ষত্রিয়। টীকাকারের সামান্য কথাটার মধ্যে একটু জাতের গোঁড়ামি আছে বটে, কিন্তু আমরা টীকাকারের থেকে মহারাজের মন বেশি বুঝি। ব্রাহ্মণ্যবাদী টীকাকার যা বলেছেন, তার মধ্যে একটা ‘ডেলিবারে’ ব্যাপার আছে, কিন্তু মহারাজ দুষ্যন্ত যে মুগ্ধ হয়েছেন; মুগ্ধতাবশতই তিনি শকুন্তলার জাতি মিলিয়ে নিয়েছেন নিজের সঙ্গে।

 জাত মেলার সঙ্গে সঙ্গে দুষ্যন্ত শকুন্তলাকে একটু লোভ দেখাতে আরম্ভ করেছেন। আসলে। ভোগ-সুখ-বিরক্ত মুনির আশ্রমে থেকে থেকে শকুন্তলাও ভোগবিমুখ। তিনি সোনা-রুপোর গয়নাও পরেন না, অপাঙ্গ শাণিত করার জন্য চোখে কাজলও লাগান না, গাল সাদা-ফরসা করার জন্য লোরেণুও দরকার হয় না তার। রাজা ভাবলেন তপস্বিনীকে লোভ দেখালে তার বিবাহের প্রস্তাব ত্বরান্বিত হবে। রাজা বললেন–তোমাকে সোনার হার দেব, কানের দুল দেব, হিরে-মণি-মুক্তো এনে দেব নানা দেশ খুঁজে-সুবর্ণমাল্যং বাসাংসি কুণ্ডলে পরিহাটকে–কত শাড়ি দেব, বুকের কাঁচুলি গড়ে দেব হিরে-মানিক বসিয়ে; আর শাড়ি পছন্দ না হলে মৃগচর্মও নিয়ে আসতে পারি নানারকম। সব চেয়ে বড় কথা–আমার সমস্ত রাজ্যটাই তোমাকে দিয়ে দেব, তুমি শুধু আমার স্ত্রী হও–সর্বং রাজ্যং তবাদ্যাস্ত ভার‍্যা মে ভব শোভনে।

তপোবনবাসিনী শকুন্তলা সামান্য একটু ভয় পেলেন। শাড়ি-গয়নার লোভে তিনি বিচলিত নন একটুও। কিন্তু দেশের রাজা তাকে এমন করে বিয়ে করতে চাইছেন, তিনি না বলেন কী করে? শকুন্তলা বললেন–একটু সবুর করো রাজা আমার। তোমাকে বললামই তো-পিতা গেছেন ফল কুড়োতে। তিনি এখনই এসে পড়বেন, তারপর আমাকে তুলে দেবেন তোমার হাতে-মুহূর্তং সংপ্রতীক্ষস্ব স মাং তুভ্যং প্রদাস্যতি। রাজা বললেন–বোকা মেয়ে! ভয় পায়! ভালবাসার বিয়েতে আবার এত বাবা-বাবা করে নাকি? আমরা ক্ষত্রিয়, ভালবাসলেই আমরা বিয়ে করতে পারি আর আমাদের পক্ষে সেই বিয়েটাই সবচেয়ে ভাল-বিবাহানাং হি রম্ভোরু গান্ধবঃ শ্রেষ্ঠ উচ্যতে। আমি তোমাকে ভালবাসি, তুমিও আমাকে ভালবাস; আমরা পরস্পর পরস্পরকে চাই–স ত্বাং মম সামস্য বরবর্ণিনী–এমন অবস্থায় গান্ধর্ব-প্রথায় বিয়ে হলেই তোমাকে আমার এখনই বিয়ে করা সম্ভব।

দুষ্যন্ত মাঝখানে সামান্য একটু বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। তপস্বিনীর মনে ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলার জন্য তিনি বিবাহের রকমফের নিয়ে বেশ একটু স্মৃতিশাস্ত্রীয় বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। বলেছিলেন–আমি যে এতক্ষণ এখানে রয়ে গেছি, সে শুধু তোমার জন্যই; তোমার জন্য আমার মনটাই পড়ে আছে এখানে-দর্থং মাং স্থিতং বিদ্ধি তগতং হি মনো মম। তাছাড়া বিবাহের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তোমার পিতা কী বলছেন, সেটা বড় কথা নয়, তুমি কী বলছ সেটাই বড় কথা। এখানে তুমিই তোমার সবচেয়ে বড় বন্ধু। তোমার যদি ইচ্ছে থাকে তবে তুমি নিজেই নিজেকে তুলে দিতে পার আমার হাতে–আত্মনৈবাত্মনো দানং কর্তুমহসি ধর্মতঃ। দুষ্যন্ত এরপর আট রকমের বিয়ে নিয়ে ব্রাহ্ম বিবাহ, দৈব, প্রাজাপত্য, রাক্ষস-ইত্যাদি নানা বিয়ের কথা বলে, ভালবেসে নিজে নিজে গান্ধর্ব বিবাহ করাই যে ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সবচেয়ে সুবিধেজনক, সেটা সরলা তপস্বিনীর কাছে প্রমাণ করে ছাড়লেন।

শকুন্তলা দেখলেন, রাজা তাকে ছাড়বেন না। আর রাজার দিক থেকে তাড়া শুধু মহর্ষি কম্বের জন্য। তিনি ফিরে এলে কী বলবেন, কোনও বাধা দেবেন কিনা, এমনকি শেষ পর্যন্ত অভিশাপের ঘটনাও যে ঘটে যেতে পারে–এত সব ভেবেই তিনি সরলা বালিকাকে মানসিক চাপে একেবারে বিপর্যস্ত করে তুললেন। শকুন্তলা বুঝলেন, তাকে কিছু একটা করতে হবে। নইলে, রাজা তাকে ছাড়বেন না। এদিকে পিতা ক এসে তাকে কী বলবেন–সে চিন্তা তারও রয়েছে। সামনে প্রেমিক পুরুষের হাতছানি, আড়ালে পিতার শুভৈষণা–দুয়ের দ্বৈরথে যুবতী রমণী যা করে শকুন্তলাও তাই করলেন। তবে রাজা যখন শকুন্তলাকে–তুমি নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় বন্ধু বলে উত্তেজিত করেছিলেন, তখন এক লহমার মধ্যে শকুন্তলার মনে সেই ব্যক্তিত্ব এবং সেই ভবিষ্যদ-যুক্তি খেলে গিয়েছিল, যা এক অভিভাবক পিতার মধ্যে থাকে।

কালিদাসের অভিজ্ঞানে কবি-প্রতিভার চরম অভিব্যক্তির মধ্যে আমরা অনসূয়া প্রিয়ংবদাকে প্রিয়সখীর জন্য চিন্তামগ্ন দেখেছি। দুষ্যন্ত-শকুন্তলার বিয়ে তখন হয়ে গেছে। প্রিয়ংবদা বলেছিলেন–পিতা কথ এখন এই বিয়ে মেনে নেন কিনা, সেটাই এখন ভাবনার। বিষয়। অনসূয়া বলেছিলেন–মহর্ষির আপত্তি হবে না। কেন না, একটি গুণবান মানুষের হাতে কন্যাদান করতে হবে–এই বাসনা যে কোনও পিতারই থাকে। তো সেই গুণবান পাত্র মেলার ঘটনা যদি ভাগ্যই ঘটিয়ে দেয়, তবে বিনা পরিশ্রমে গুরুজনের ঈঙ্গিত কাজটাই তো হয়ে গেল–ত যদি দৈবমেব সম্পাদয়তি, ননু অপ্রয়াসেন কৃতার্থো গুরুজনঃ। অতএব পিতা ঠিক রাজি হবেন।

মহাভারতে শকুন্তলার সমস্যা এত সহজ নয়। পিতা কথ আশ্রমে নেই–সে এক সমস্যা। সহায়তার জন্য মহাভারতের কবি কোনও প্রিয়ংবদা-অনসূয়ারও ব্যবস্থা করেননি শকুন্তলার জন্য। ফলত বিবাহের মতো এক চরম সিদ্ধান্ত নেবার জন্য একাকিনী শকুন্তলাকে এখানে অনেক ভাবনা করে কথা বলতে হচ্ছে। একটি বিবাহের সুত্রে মহারাজ দুষ্যতের মতো একজন পাত্রের কাছে একজন কন্যা-পিতার কী কাম্য থাকতে পারে, সেকথা এখানে এই সুকুমারী তপস্বিকন্যাকে নিজেই ভাবতে হচ্ছে। নিজের দায়িত্ব যেখানে নিজেই নিতে হচ্ছে, সেখানে ভবিষ্যতের স্বার্থের কথাও চিন্তা করতে হচ্ছে স্বয়ং শকুন্তলাকে।

রাজা বলেছিলেন–তুমি নিজেই নিজের দায়িত্ব নিয়ে নিজেকে সঁপে দিতে পার আমার কাছে। রাজার এই কথা শুনে শকুন্তলা বললেন–ধর্মের নীতিনিয়ম যদি এইরকমই হয়, আর আমাকে যদি নিজেই বিয়ে করতে হয়– যদি ধর্মপথস্তু-এষ যদি চাত্মা প্রভুর্মম–তাহলে আমার একটা শর্ত আছে, মহারাজ! আমি কণ্বাশ্রমের এই নির্জন কুটির-প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে তোমার সামনে। যে কথা বলতে যাচ্ছি মহারাজ! তার কোনও সাক্ষী নেই। তোমাকে তাই প্রতিজ্ঞা করতে হবে, মহারাজ-সত্যং মে প্রতিজানীহি যথা বক্ষ্যাম্যহং রহঃ। তোমাকে কথা দিতে হবে–আমার গর্ভে তোমার যে পুত্র হবে, সেই হবে ভবিষ্যতের যুবরাজ, তোমার অবর্তমানে সেই হবে রাজা। যদি তুমি আমার এই কথাটি মেনে নাও, তবেই তোমার সঙ্গে আমার মিলন সম্ভব হবে জেনো-যদ্যেতদেবং দুষ্যন্ত অস্তু মে সঙ্গমস্বয়া।

রাজার পূর্বেকার কথাবার্তা, ভাবভঙ্গি এবং গান্ধর্ব বিবাহের উত্তেজনার মধ্যে আধুনিক অর্থে যাকে ‘প্রেম’ বলি তা কিছুই ছিল না। অন্যদিকে শকুন্তলাকেও যে রকম ভবিষ্যতের স্বার্থভাবনায় ভাবিত দেখছি এখানে, তাতে তার মনের মধ্যেও যে রাজার আগমনে ‘বাদলদিনের প্রথম কদম ফুল ফুটে উঠল, তা বলা যায় না। মহারাজ দুষ্যন্ত এখানে এক তপস্বিকন্যার রূপ-যৌবন-লাবণ্যের শারীরিক পরিভাষায় আন্দোলিত। অন্যদিকে শকুন্তলাও সেই যৌবনোচিত ভোগবাসনার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন নিজের স্বার্থবুদ্ধি সম্পূর্ণ মাথায় রেখে। রাখাল ছেলের সঙ্গে রাজকুমারীর মিলন নাই হোক, চক্রবর্তী সম্রাটের সঙ্গে আরণ্যক তপস্বিনীর মিলন তো হল বটে, তবে কোনওভাবেই এই মিলনের মধ্যে আধুনিক সংজ্ঞায় প্রেম-ভালবাসার কোনও স্ফুরণ নেই। হয়তো দুষ্যন্ত-শকুন্তলার এই মিলন-কাহিনীর মধ্যে প্রেমের আধুনিক সংজ্ঞার অভাবটুকু পূরণ করার জন্য আমাদের আরও কয়েক শত বৎসর অপেক্ষা করতে হবে–যখন কালিদাস জন্মাবেন। তার লেখনীর অভিজ্ঞানে ফুল কীভাবে ফলে পরিণত হয়, মর্ত্য কীভাবে স্বর্গে পরিণত হয়–তা পরীক্ষা করার জন্যই যেন মহাভারতের কবি শকুন্তলা-দুষ্যন্তের মিলনের মধ্যে এক সুনির্দিষ্ট ফঁক রেখে দিলেন। আর সেই ফাঁকের মাঝখানটা ভরে রাখলেন মহারাজা দুষ্যন্তের অধৈর্য আর শকুন্তলার স্বার্থবুদ্ধি দিয়ে।

 তপস্বিনী শকুন্তলার মুখে শারীরিক মিলনের শর্ত শোনা মাত্রই দুষ্যন্ত কোনও কথা না ভেবে–প্রত্যুবাচাবিচারয়ন্”জবাব দিলেন”আমি তোমাকে আমার রাজধানীতে নিয়ে যাব, সুন্দরী! সেটাই তোমার উপযুক্ত জায়গা। শকুন্তলাকে রাজধানীতে নিয়ে যাবার আশ্বাস দিয়েই দুষ্যন্ত গান্ধর্ব বিবাহের বিধি নিয়ম মেনে শকুন্তলার পাণিগ্রহণ করলেন। এই গান্ধর্ব-বিবাহের নিয়মে–তুমি আমার স্ত্রী হও–এই প্রতিজ্ঞার সঙ্গে পাণিগ্রহণমাত্রেই বিবাহ সম্পন্ন হয়। মহর্ষি কণ্ব তখনও ফিরে আসেননি। নির্জন বনস্থলীর মধ্যে দুষ্যন্তের সঙ্গে সহবাসে অনুমতা হলেন শকুন্তলা–জগ্রাহ বিধিবং পাণৌ উবাস চ তয়া সহ।

যুবতী-তপস্বিনীর মিলন-হৃষ্ট দুষ্যন্ত কণ্বমুনির আশ্রম ছেড়ে চলে যাবার সময় বারবার, শকুন্তলাকে আশ্বাস দিয়ে গেলেন–আমি রাজধানীতে ফিরে যাচ্ছি বটে। কিন্তু গিয়েই তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য চতুরঙ্গিনী সেনা পাঠাব। রাজার রথ আসবে তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য। অনেক সান্ত্বনা বাক্য অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজা শুধু মহর্ষি কন্ধের কথা চিন্তা করতে করতে আশ্রম ছেড়ে চলে গেলেন। সুখ-সহবাসের পর আশ্রম-যুবতী শকুন্তলার সুখস্মৃতি মহারাজ দুষ্যন্তকে ততখানি উদ্বেলিত করল না, যতখানি উদ্বেলিত করল মহর্ষি কম্বের ভয়। আশ্রমে ফিরে এসে শকুন্তলার সঙ্গে দুষ্যন্তের গান্ধর্ব-মিলনের কথা শুনে মহর্ষি কণ্ব কী। ভাববেন, কী করবেন–এই চিন্তায় আকুলিত হয়ে দুষ্যন্ত রাজধানীতে ফিরে গেলেন– ভগবাংশুপসা যুক্তো ত্বা কিং’নু করিষ্যতি।

দুষ্যন্তও আশ্রম থেকে বেরলেন, মহর্ষি কণ্বও অমনি ফিরে এলেন আশ্রমে। রাজার সঙ্গে গোপন মিলন-হেতু শকুন্তলার মনে যুবতী-সুলভ লজ্জার অন্ত ছিল না। মহর্ষিকে তিনি এড়িয়ে এড়িয়ে চলতে লাগলেন এবং এই ব্যবহার তার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল না। শকুন্তলা চ পিতরং হিয়া নোপজগাম তম্। অন্য সময় ফলের বোঝা নিয়ে মহর্ষি বাড়ি ফিরলে শকুন্তলা যা যা করেন মহর্ষির ফল-ভার গ্রহণ করা থেকে আরম্ভ করে তালপত্রের ব্যজন–সে সব কিছুই করলেন না শকুন্তলা। নিজেকে তিনি লুকিয়ে রাখতে এতই ব্যস্ত হলেন যে, মহর্ষির মনে সন্দেহের উদয় হতে দেরি হল না। দিব্যজ্ঞানে ধ্যাননেত্রে মহর্ষি কণ্ব দুষ্যন্তকে দেখতে পেলেন কিনা জানি না–মহাভারত অবশ্য তাই বলেছে-কিন্তু লৌকিক বুদ্ধিতে আশ্রমের সর্বত্র খবর নিয়ে এবং সেই সঙ্গে শকুন্তলার লজ্জা-বিহ্বল ব্যবহার একত্র মিলিয়ে মহর্ষির বুঝতে দেরি হল না যে, দুষ্যন্ত এসেছিলেন এবং তিনি শকুন্তলার পাণিগ্রহণ করেছেন মহর্ষির অসাক্ষাতে।

 মহর্ষি কণ্ব সন্ন্যাসী যতই হোন, তার লৌকিক বুদ্ধি অতি প্রখর। তিনি জানেন–বয়ঃসিদ্ধ। স্বভাবেই যুবক-যুবতীর হৃদয়ে কামনার তরঙ্গ ওঠে, তাকে ধমক দিয়ে বা অভিশাপ দিয়ে রুদ্ধ করা যায় না। তিনি শকুন্তলাকে পরিষ্কার বললেন–আমাকে গুরুত্ব না দিয়েও গোপনে তুমি আজ যা করেছ–রহসি মাম্ অনাদৃত্য যঃ কৃতঃ–অর্থাৎ একটি পুরুষের সঙ্গে তোমার এই গোপন মিলনে অধর্ম কিছু হয়নি, মা! তিনি তোমাকে চেয়েছেন, তুমিও তাঁকে চেয়েছ–এই পারস্পরিক চাওয়ার মধ্যেই গান্ধর্ব বিবাহের সিদ্ধি লুকনো আছে। এমন বিয়েতে মন্ত্র-তন্ত্রের বালাই নেই কিছু–সকামায়াঃ সকামেন নির্মন্ত্রো রহসি স্মৃতঃ। ক্ষত্রিয় পুরুষেরা এমন বিবাহ করেই থাকেন। আর তোমার দিক থেকেও এতে কোনও অধর্ম ঘটেনি মান স ধর্মোপঘাতকঃ। তাছাড়া মহারাজ দুষ্যন্ত ধর্মজ্ঞ পুরুষ, মহাত্মা। পুরুষ-সমাজে তার মতো মানুষ কোথায় আছে? তুমি তার আমন্ত্রণ স্বীকার করে যথার্থ কাজই করেছ।

 হায়! আধুনিক যুবক-যুবতীর ভাগ্যে মহর্ষি কঘের মতো আরও কয়েকটি পিতার জন্ম হত যদি! মহর্ষি কথ দুষ্যন্ত-শকুন্তলার গান্ধর্ব-মিলন স্বীকার করে নিলেন এক অতি আধুনিক অনুকূলতা এবং সহজভাব দেখিয়ে। একই ভাব কালিদাসেও আছে অতি সংক্ষেপে, যদিও তা আরও কাব্যিক সরসতায় জারিত। আশ্রমিক ঋষির দৃষ্টিতে চোখে-না-দেখা দুষ্যন্ত সেখানে খানিকটা অন্তরীক্ষ লোকের দেবতার মতো। গান্ধর্ব-বিবাহে শকুন্তলার আত্মদানের ঘটনাটা তিনি যাজ্ঞিক ঋষির কল্পনায় ব্যক্ত করে বলেছেন-যজ্ঞ করার সময় যজ্ঞ-কাষ্ঠের ধোঁয়ায় দৃষ্টি অবরুদ্ধ হলেও যজমানের আহুতিটা আগুনেই পড়েছে ঠিকঠাক–দিষ্টা ধুমাকুলিতদৃষ্টেরপি যজমানস্য পাবকে এব আহুতিঃ পতিতা। মহাভারতের কণ্বমুনি শকুন্তলাকে সেই মুহূর্তেই আশীর্বাদ করে বলেছেন–তোমার গর্ভে এক বিরাট রাজপুরুষ জন্মাবেন। এই সসাগরা পৃথিবী তার অধিগত হবে। তিনি হবেন চক্রবর্তী সম্রাট।

এতক্ষণে যেন শকুন্তলার হুঁশ হল। যখন তিনি বুঝলেন–মহর্ষি কণ্ব ক্ষুব্ধ হননি তার গোপন-মিলনে, তখনই লজ্জান মুখখানি তুলে পিতার কাছে এলেন। তার ক্লান্ত স্কন্ধ থেকে নামিয়ে নিলেন সংগৃহীত সমি-ফুল-ফলের ঝোলাটি। এগিয়ে দিলেন পা ধধায়ার জল; আর কী আশ্চর্য, এরই মধ্যে ক্ষণকাল-সন্নিহিত প্রণয়ী রাজার সমৃদ্ধির জন্য কুশল-ভিক্ষা করলেন মহর্ষির কাছে। বললেন–তাঁর কোনও দোষ নেই পিতা। আমি স্বেচ্ছায় তাঁকে স্বামী হিসেবে বরণ করেছি–ময়া পতিতো রাজা দুষ্যন্তঃ পুরুষোত্তমঃ। তুমি তার প্রতি প্রসন্ন হও পিতা। শকুন্তলার কথা শুনে আধুনিক পিতা যা বলেন কণ্বও তাই বললেন। আজকের দিনে যদি আমাদের মেয়ে তার উপযুক্ত প্রণয়ীকে স্বামী হিসেবে বেছে নেয়, তবে সেই প্রণয়ী-স্বামী আমাদের একান্ত অজানা-অচেনা, এমনকি অপছন্দ হলেও, সে যেমন আমাদের মেয়ের প্রণয়-স্বার্থেই আমাদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে, মহর্ষি সেই দৃষ্টিতেই শকুন্তলাকে বললেন–আমি তো তোর জন্যেই দুষ্যন্তের ওপর খুশি হয়েছি মা। তুই তাকে নিজে পছন্দ করেছিস, আমি কি তার ওপর প্রসন্ন না হয়ে থাকতে পারি–প্রসন্ন এব তস্যাহং ত্বকৃতে বরবণিনী।

নতুন বিয়ে হলে গর্বিণী বধূটি যেমন বাপের বাড়ি এসে শ্বশুর বাড়ির সম্বন্ধে উচ্চগ্রামে নানা প্রশংসা করে কথা বলে,–আমার শ্বশুরবাড়িতে এরকমটি চলবে না, এমনটি হলে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি তুলকালাম করে ফেলবেন–এইরকম নানা কল্পিত গৌরবে বধুটি যেমন গৌরবান্বিত হয়, ঠিক তেমনই শকুন্তলাকে আমরা শ্বশুরবাড়িতে যাবার আগেই যথেষ্ট গৌরবান্বিত দেখছি। তিনি যে প্রসিদ্ধ পৌরব-বংশের বন্ধু নির্বাচিত হয়েছেন, স্বামীর বিশাল রাজ্য এবং রাজত্ব নিয়ে তারও যে কত দায়িত্ব আছে, সে কথা বেশ প্রকট হয়ে উঠল শকুন্তলার হাবে-ভাবে, কথা-বার্তায়। কণ্বমুনি প্রসন্ন হয়ে শকুন্তলাকে বর চাইতে বললে শকুন্তলা বললেন-পৌরব-বংশের রাজারা যেন আপন ধর্ম থেকে চ্যুত না হন, পৌরবরা যেন তাদের রাজ্যে চিরপ্রতিষ্ঠিত থাকেন–ততে ধর্মিষ্ঠতাং বট্রে রাজ্যাচ্চাস্থলনং তথা।

পরিষ্কার বোঝা যায়–এখনও দূষ্যন্তের রাজধানীতে প্রবেশ না করলেও শকুন্তলা এখনই পৌরব দুষ্যতের রাজবধু হবার গৌরব অনুভব করছেন। ইন্দ্রিয়-সুখের চরিতার্থতায় ক্ষণমাত্র বিচলিত হলেও কথাশ্রমের পালিতা কন্যাটি মুহূর্তের রূপান্তরে পৌরববংশের রাজবধুর ইতিকর্তব্যতার মধ্যে নিজেকে স্থাপন করেছেন। হয়তো দুষ্যন্ত-শকুন্তলার মৌর্তিক মিলনের মধ্যে প্রেম ছিল না কোনও, হয়তো যুবক-যুবতীর ইন্দ্রিয়-চরিতার্থতাই সেখানে বড় হয়ে উঠেছিল, কিন্তু প্রেম না থাকলেও বিবাহের পরক্ষণেই স্বামীর রাজধর্মের কর্তব্যে নিজেকে স্থাপন করার মধ্যেই সেকালের এক রমণীর চরম সার্থকতা ফুটে উঠছে। রাজা দুষ্যন্তের অর্থ নয়, শাড়ি-গয়না নয়, তিনি সামগ্রিক পৌরববংশের গৌরব কামনা করেন, ব্যক্তি দুষ্যন্তকে উপলক্ষ করে–ব্যাপকহিতবরণে ব্যাপ্যহিতবরণ আপনিই সিদ্ধ হয়ে যায়–শকুন্তলা পৌরবাণাং (ধর্মিষ্ঠতাং) বব্রে দুষ্যন্ত-হিতকাম্যয়া।

দুষ্যন্ত-শকুন্তলার ইন্দ্রিয় চরিতার্থতার বিষয় মহাভারতের কবির কাছে গৌণ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। দুষ্যন্তের হিতকামনা, সমগ্র পৌরববংশের হিতকামনার সমস্ত তাৎপর্য আস্তে আস্তে পর্যবসিত হয়েছে শকুন্তলার মাতৃত্বে। পৌরববংশের বীজ শকুন্তলার গর্ভে আহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্থলিতা যুবতী থেকে জননীতে পরিণত হয়েছেন। এমন মহিলা আমরাও যে দেখিনি, এমন নয়। সেকালে এমন মহিলা অনেক দেখেছি, যাঁদের মধ্যে ইউরোপীয় রোম্যান্টিসিজমের কোনও বালাই ছিল না, প্রেম-ভালবাসা বলতে কাব্যিক অর্থে যা বোঝায়, তাও খুব ভাল করে বোঝা যেত না তাদের দাম্পত্য ব্যবহারে; কিন্তু যেটা খুব বেশি করে বোঝা যেত, সেটা হল মাতৃত্ব। একটি পুত্র-কন্যা জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজের পুত্রকন্যার সাজাত্যে সমস্ত জগতের মানুষই তার কাছে পুত্র-কন্যায় পরিণত হত। এক বৎসর আগে যাঁর যুবতী-সুলভ, শরম-বিজড়িত, আটোসাটো ব্যবহারে কুণ্ঠিত বোধ করতে হত, একটি পুত্র-কন্যার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে সেই মানুষই এমন আলুথালু, মুখরা এবং আঁচল-খোলা হয়ে যেতেন যে, তাকে জননী ছাড়া আর কিছু ভাবা যেত না।

 যে কবি গুপ্তরাজাদের স্বর্ণযুগে বসে বিরহিনী শকুন্তলাকে গর্ভিণী অবস্থায় পতিগৃহে যাত্রা করিয়ে দর্শক-শ্রোতার অনুকম্পা আকর্ষণ করবেন, তাকে অন্তত এই অংশের জন্য মহাভারতের কবির কাছে ঋণী বলা যায় না। মহাভারতে দুষ্যন্ত রাজা রথ পাঠানোর প্রতিজ্ঞা করে চলে গেলেন বটে, কিন্তু কোথায় সেই প্রতিজ্ঞাত চতুরঙ্গিনী সেনা? কোথায় রাজার রথ? দুষ্যন্তের রাজধানী থেকে কেউ এল না নির্জন আশ্রম-ভবনে, শকুন্তলাকে রাজধানীতে নিয়ে যাবার জন্য। তিনটি বৎসর সম্পূর্ণ চোখের ওপর দিয়ে চলে গেল–ত্রিস্ত বর্ষে পূর্ণেষু–রাজার রথ একবারও ঘর্ঘর করে এল না কৰাশ্রমের বনপথ ধরে। কিন্তু সময়কালে শকুন্তলার পুত্র জন্মাল মহর্ষির আশ্রমেই–অস্ত গর্ভং বামোরূঃ কুমার অমিতৌজসম্।

 কী তার চেহারা! কী তার রূপ! মহর্ষির আশ্ৰম কুটিরে এক পুঞ্জ আগুন জ্বলে রইল শকুন্তলার কোল আলো করে। মহর্ষি কণ্ব পৌরব দৌষ্যন্তির জাতকর্মের সমস্ত সংস্কার সম্পন্ন করলেন। ছেলে বড় হতে লাগল ঋষির আশ্রমে। ছয় বৎসর বয়স হল ছেলের। গায়ের রঙ উজ্জ্বল হল, শরীর দৃঢ়, সম্ভাব্য সিংহের তেজ তার শারীরিক এবং মানসিক গঠনে। কুমার আরও একটু বড় হতেই তার রাজত্ব গড়ে উঠল বনস্থলীর পশু-সমাজকে নিয়ে। বাঘ, সিংহ, হাতি–সব কিছু ধরে এনে আশ্রমের কাছাকাছি গাছগুলিতে বেঁধে রাখা তার নিত্যদিনের খেলার মধ্যে পড়ত–ববন্ধ বৃক্ষে বলবান্ আশ্রমস্য সমীপতঃ। আশ্রমবাসীরা আগে কাউকে এমন দেখেননি। বন্য পশু-সমাজকে এইভাবে নিয়ন্ত্রণ-তাড়ন করা যে সে লোকের কর্ম নয়। আর সেটাই যখন এই রাজকুমার পারে–অতএব, আশ্রমবাসীরা বলল–অতএব এই রাজকুমারের নাম হোক সর্বদমন–অস্তু অয়ং সর্বদমনঃ সর্বং হি দময়ত্যয়ম্।

শক্ত-সমর্থ বালক সর্বদমনকে দেখে মহর্ষি বিচলিত হলেন। মহারাজ দুষ্যন্ত এখনও কোনও খোঁজই নেননি শকুন্তলার। তার যে একটি পুত্র এই আশ্রমের পরিবেশে বড় হয়ে উঠল, তাও তিনি ভাল করে জানেন না। মহর্ষি একদিন শিষ্যদের ডেকে বললেন–তোমরা শকুন্তলা আর তার ছেলেকে নিয়ে দুষ্যন্তের কাছে রেখে এসো। বিবাহিতা একটি রমণী যদি সুচিরকাল ধরে তার বাপের বাড়িতে পড়ে থাকে তবে পাঁচ জন পাঁচ কথা বলে-নারীণাং চিরবাসো হি বান্ধবেষু ন রোচতে। এমনি করে বেশি দিন থাকলে তার চরিত্র, ধর্ম, স্বভাব নিয়েও নানা প্রশ্ন আসবে। তোমরা তাই আর দেরি করো না, শকুন্তলাকে নিয়ে যাও দুষ্যন্তের কাছে–তস্মান্নয়ত মা চিরম্।

মহারাজ দুষ্যন্তকে শকুন্তলা যে শর্তের কথা বলেছিলেন–তোমার রাজ্যে আমার গর্ভজাত পুত্রই হবে যুবরাজ–সেই শর্তের কথা মহর্ষি কথও জানেন। ফলে বয়ঃপ্রাপ্ত সর্বদমনকে দেখে মহর্ষি শকুন্তলাকে বলেছিলেন–এখন সময় হয়েছে মা! তোমার সর্বদমন এবার যুবরাজ হবে–সময়গা যৌবরাজ্যায় ইত্যব্রবীচ্চ শকুন্তলা। শকুন্তলা আপত্তি করেননি। মহর্ষির যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে তিনি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে দুষ্যতের রাজধানীর পথে রওনা হলেন, জনান্তিকে বলি–মহাভারতের কথকঠাকুর নিজে যেখানে বসে আছেন, সেই জায়গাটার নাম করেই মুখ ফসকে বলে ফেললেন–শকুন্তলার ছেলে সর্বদমনকে নিয়ে কথষুনির শিষ্যরা হস্তিনাপুরে। চললেন দুষ্যন্তের কাছে-শকুন্তলাং পুরস্কৃত্য সপুত্রাং গজসায়। কিন্তু হস্তিনাপুর তখন কোথায়? দুষ্যন্তের বেশ কয়েক পুরুষ পরে পুরুবংশের পরম্পরায় মহারাজ হস্তীর রাজত্বকালে হস্তিনাপুরের প্রতিষ্ঠা হবে। কাজেই হস্তিনাপুরে নয়। শকুন্তলাকে নিয়ে কণের শিষ্যরা চললেন দুষ্যতের রাজধানীতে। হয়ত হস্তিনাপুরের কাছাকাছি কোনও জায়গায়।

অভিজ্ঞানশকুন্তলের কবি তার নাটকের চতুর্থ অঙ্কে গর্ভিণী শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার প্রাক্-মুহূর্তগুলি ধরে রেখেছেন ছবির মতো কয়েকটি শ্লোকে। কিন্তু মহাভারতের কবির জগৎ নিতান্তই কর্তব্যময়। এখানে কোনও মৃগশিশু অর্ধভূক্ত শম্পগ্রাস ত্যাগ করে শকুন্তলার আঁচল ধরে টানল না, নৃত্য ত্যাগ করল না ময়ূর-ময়ূরী। আশ্রমের বনবৃক্ষ থেকে অশ্রু-কুসুম ঝরে পড়ল না। কোনও প্রিয়ংবদা প্রিয়সখী ইন্দুপাণ্ড-তরু’র চীরবাস পরিয়ে দিল না শকুন্তলাকে; কেউ বনফুলের আভরণ রচনা করে দিল না শকুন্তলার কেশে, গ্রীবায়, হাতে। বাষ্পচ্ছন্ন মহর্ষির কণ্ঠ দিয়ে কোনও উদ্বেল উচ্ছ্বাস ধ্বনিত হল না, শকুন্তলাও জিজ্ঞাসা করলেন না–কবে তিনি আবার ফিরে আসবেন শান্ত আশ্ৰমপদে।

মহাভারতের কবি শকুন্তলাকে পতিগৃহযাত্রা করালেন অত্যন্ত বাস্তব-কঠোর অনাড়ম্বর। পরিবেশের মধ্যে। শকুন্তলা এখানে কোনও পুষ্পঘাতভঙ্গুরা নায়িকা নন। তিনি স্বাধীনচেতা, প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বময়ী। দুষ্যন্তের স্বভাব তিনি জেনে গেছেন, বুঝেও গেছেন।–দুষ্যন্তবিদিতাত্মনা। এতদিন পরে দুষ্যন্তের কাছে তিনি যুবতীর প্রেম, স্ত্রীর ভালবাসা ভিক্ষা কতে আসেননি। তিনি এক দীপ্তিমান পুত্রের হাত ধরে দুষ্যন্তের রাজধানীতে পৌঁছেছেন তারই পুত্রের মাতৃত্বের অধিকার নিয়ে–গৃহীত্বামরগর্ভাভং পুত্রং কমললোচন। প্রেমের দাবি নয়, পুত্রের যৌবরাজ্য দাবি করার জন্য শকুন্তলা এসেছেন তার সমস্ত শক্তি নিয়ে–দুষ্যত্তের সঙ্গে আজকে তার বোঝাপড়া হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *