০১০. সমুদ্র মন্থনের প্রস্তাব

১০.

সেই যখন ভগবান বিষ্ণু সমুদ্র মন্থনের প্রস্তাব নিয়ে দেবতাদের বললেন, দৈত্যরাজ বলির কাছে যেতে, তখন তাঁদের তিনি বলেছিলেন, দৈত্য-দানবেরা যা চায় তাই মেনে নিও যুয়ং তদনুমোদধ্বং যদিচ্ছত্যসুরাঃ সুরাঃ। সমুদ্র থেকে মহামূল্য বস্তু কিছু উঠলে, তা নিয়ে যেন ‘এটা চাই সেটা চাই’ বলে লোভ কোরো না। অথবা জিনিসটা না পেলে ক্রোধবশে কিছু করে বোস না। দেবতারা বিষ্ণুর পরামর্শ শুনেছিলেন। দেব-দানব সকলেই যখন সমুদ্র মন্থনে উদযুক্ত হলেন, তখন স্বয়ং বিষ্ণু, দেবতাদের নিজ বুদ্ধি খাটাবার কোনও সুযোগ না দিয়ে কারণ বুদ্ধি খাটালে হয়তো দেবতারা বোকামিই করতেন–অতএব সেই ভয়েই বিষ্ণু নিজে এসে প্রথমে নাগরাজ বাসুকির মুখের দিকটা ধরলেন। যদিও মহাভারত কিংবা মৎস্যপুরাণের মতে ইনি নাগরাজ বাসুকি নন, ইনি অনন্ত বা শেষ নাগ। ইনি অনন্তই হোন অথবা বাসুকি, বিষ্ণু তার মুখের দিকটা ধরতেই তাকে অনুসরণ করে দেবতারাও সবাই বিষ্ণুর পিছনে দাঁড়িয়ে গেলেন।

বিষ্ণুর বুদ্ধিটা ছিল সেই অভিজ্ঞা জননীটির মতো। জননীর দুই বালক পুত্র পিঠোপিঠি ভাই। তারা মাছের টুকরো বড় না ছোট তাই নিয়ে প্রতিদিন ঝগড়া করে। ছোট জন প্রতিদিন জেদের বশে বড় টুকরোটি চায় এবং পুরো খেতে পারে না, শেষ পর্যন্ত ফেলে দেয়। অথচ বড় জনের পাতে বড় টুকরোটি দেখলেই ক্ষোভে অভিমানে সে কেঁদেকেটে একসা করে এবং অবশ্যই ক্রন্দনের অস্ত্রে বড় টুকরোটি ছিনিয়ে নিতে সফল হয়। অভিজ্ঞা জননী শেষে ছোট মাছটাই প্রথমে দিতে আরম্ভ করলেন বড় ছেলের পাতে। ছোট জন নিজস্ব ধারণায় আগের মতোই দাদার থালা থেকে মাছ-ভাজা ছিনিয়ে নিত এবং জননী আপন অভীষ্ট সিদ্ধ হওয়ায় বড় ছেলেকে বলতেন, দে বাবা দিয়ে দে। তুই না বড়। ছোট ভাই হয় না? ওই না হয় বড় টুকরোটা খাক। ছোটজন ছোট টুকরো বড় ভেবে পরমানন্দে মাছ ভাজা খায়। তিনজনেই আপন আপন নিয়মে খুশি হয়ে থাকলেন।

বিষ্ণুর ব্যাপারটাও প্রায় এইরকম। যেই না তিনি বাসুকি নাগের মুখের দিকটা গিয়ে ধরলেন অমনি দানব রাজা বলি সপার্ষদ এসে বিষ্ণুকে বললেন, আমরা কি এতই হেয়? অত্যন্ত অমঙ্গলের চিহ্ন, সাপের এই পুচ্ছদেশ আমরা ধরব কেন, আমরা কি এতই ফেলনা? দেখুন, নিত্য বেদপাঠ কি যাগযজ্ঞ আমরা সেগুলো যথেষ্ট করি। তাছাড়া কতবড় বংশে আমাদের জন্ম। স্বাধ্যায়–শ্রুত সম্পন্নাঃ প্রখাতা জন্মকৰ্মভিঃ। আমরা কি লেজের দিকটা ধরতে পারি, না সেটা আমাদের মানায়? বিষ্ণু সঙ্গে সঙ্গে মুচকি হেসে দেবতাদের পেছনে নিয়ে বাসুকির পুচ্ছভাগ স্পর্শ করে দাঁড়ালেন স্বয়মান বিসৃজ্যাগ্রং পুচ্ছং জগ্রাহ সামরঃ।

স্থান বিভাগ অর্থাৎ কে কোনদিকে দাঁড়াবেন ঠিক ঠাক হয়ে গেল। দেবতা এবং দানব দুই পক্ষই আপন আপন নেতাদের জয়ঘোষ উচ্চারণ করে বাসুকির রঞ্জু দিয়ে মন্দর পর্বতকে ঘোরাতে লাগলেন। অসুরদের দেহে শক্তি অনেক বেশি; স্বয়ং বলিরাজ বাঁ হাতে নাগরাজের মাথাটি ধরলেন আর ডান হাতে টান দিলেন তাঁর অগ্ৰশরীরে। বিষ-ভীত দেবতারা টান দিলেন পুচ্ছ দেশে। সমুদ্র মন্থন আরম্ভ হল।

ভারি আশ্চর্যের ব্যাপার হল–মহাভারত থেকে অধিকাংশ পুরাণ–সর্বত্রই দেখা যাবে যে, ভগবান বিষ্ণু সমস্ত দেবতাকে বলেছেন- তোমরা সমস্ত রকমের ওষধি আর লতা সমুদ্রের মধ্যে ফেলল, তারপর সমুদ্র মন্থন করো। দেব-দানবেরা সকলেই অতঃপর বহুতর বৃক্ষ-লতা ওষধি সমুদ্রে ফেলেছিলেন, তাছাড়া মন্দর পর্বতের গাছ গাছড়া, শিকড়ও প্রচুর পড়েছিল সমুদ্রে। সমুদ্র মন্থনের উপাখ্যান যেভাবে আরম্ভ এবং শেষ হয়েছে, তার সঙ্গে এই গাছ-গাছড়া শিকড় বাকড়ের সম্পর্ক কী, সে কথা পরে আসবে, আপাতত শুধু এই ঘটনাটির উল্লেখ করে রাখলাম।

সমুদ্র মন্থন করে কখন কী উঠল, কোনটা প্রথম পাওয়া গেল, তা নিয়ে মহাভারত পুরাণে, পরাণে পুরাণে নানা ভেদ বিকল্প আছে। মহাভারত বলেছে– নানা বৃক্ষের নির্যাস আর মথিত লতার রসের সঙ্গে কিছু সোনা মিশে যাওয়ায় যে তরল মিশ্রণ তৈরি হল, তাতে নাকি লবণ সমুদ্র ক্ষীর সমুদ্রে পরিণত হল। সেই দুগ্ধ–সাগর থেকে প্রথম পাওয়া গেল ঘৃত যা মানুষের আয়ুবর্ধক এক অতি উৎকৃষ্ট বস্তু বলে আমাদের মধ্যে পরিচিত রোত্তমৈ-বিমিশ্রঞ্চ ততঃ ক্ষীরাদভূদ ঘৃত। টীকাকার নীলকণ্ঠ টিপ্পনি কেটে বলেছেন– এতে আজগুবি ভাবার কিছু নেই। বাপু। আমাদের চিরকালের দেখা গরুগুলি কখনও এমনি জলও খায়। আবার নুন-জলও খায়। গরু সেই জলের সঙ্গে ঘাস পাতা আর অন্যান্য বর্জ্য বস্তু ভক্ষণ করেও উত্তম দুগ্ধই প্রসব করে, তাহলে বৃক্ষ লতার সমন্বয়ে লবণোদধি মন্থন করেই বা ঘি উঠবে না কেন- যথা ক্ষার অক্ষারং বা জলং গবি তৃণাদিরসং প্রাপ্য ক্ষীরং ভবতি, তদিত্যৰ্থঃ। আমাদের হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয় কিন্তু আরও একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, একে অলীক কল্পনা বলার কিছু নেইনালীকম্ ইদং সম্ভারয়িতুং শক্যতে। আসলে সিদ্ধান্তবাগীশ তার জীবকালেই ডালডা কিংবা ভেষজ বনস্পতি ঘৃতের আগমনী শুনতে পেয়েছেন। অতএব তার বক্তব্য–কেন বাবা আজকে ভেষজ বিজ্ঞানীরাও তত তৃণ বনস্পতি থেকে ঘি বানাচ্ছেন, অতএব এটাই বা অলীক হবে কেন- বৈজ্ঞানিকাশ্চ তৃণা ঘৃতমুৎপাদয়ন্তীতি নালীকমিদং সম্ভাবয়িং শক্যতে।

যাই হোক, সমুদ্রমন্থন করে উৎকৃষ্ট ঘৃতই উঠুক আর ভেষজ বনস্পতিই উঠুক, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল এই প্রাপ্তিটুকু অথবা আবিষ্কার। পণ্ডিতেরা অনেকে বলেন আর্যরা তাদের পূর্বভূমি থেকে এদিকে আসতে আসতে যত নতুন জিনিস দেখতে পেয়েছেন, সবই তারা সমুদ্র মন্থনের ফল বলে বর্ণনা করেছেন। সে যাই হোক, সমুদ্র থেকে ঘি ওঠার পরেই কিন্তু দেব-দানব সবারই দম ফুরিয়ে গেল। সামনে সমাসীন ব্রহ্মার কাছে গিয়ে দেবতারা আর্জি জানালেন, কতকাল ধরে এই সমুদ্র মন্থন করে যাচ্ছি, অমৃত যে ওঠেই না প্রভু। একমাত্র বিষ্ণু ছাড়া দেব-দানব সবাই যে বড় ক্লান্ত হয়ে গেলেন ঋতে নারায়ণং দেবং সর্বে’ন্যে দেবদানবাঃ। সবার অবস্থা দেখে ব্রহ্মা বিষ্ণুকে বললেন, আপনি সবাইকে বল দিন, ভগবান! সবাই যে ক্লান্ত হয়ে গেল।

বিষ্ণু বললেন, আমি সবাইকে শক্তি দিচ্ছি, তোমরা সমুদ্র মন্থন চালিয়ে যাও। এই শক্তি কোনও অলৌকিক ঐশ্বর্য কিনা জানি না, তবে বিষ্ণু হয়তো কর্মরত সমস্ত দেব-দানবকে সেইভাবে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন, যাতে আবার সবাই সমুদ্র মন্থনে লেগে পড়েন। সেই মন্থনের ফলে এবার পাওয়া গেল চাঁদকে। পূর্ব-দিগবধুর মুখ-চুম্বন করে চাঁদ উঠল আকাশে। পুরাণ-ইতিহাসের উদাসীন অকিঞ্চন বৈরাগী শিব সেই চাঁদকে চেয়ে নিলেন আপন জটাকলাপের আভূষণ হিসেবে–যযাচে শঙ্করা দেবো জটাভূষণকৃম্মম। এ খবর আমরা অবশ্য মহাভারতে পাইনি, মহাদেবের এই শশাঙ্ক-প্রার্থনার সংবাদ দিয়েছে পদ্মপুরাণ। স্বয়ং মহাদেব যেহেতু আহ্লাদ করে চন্দ্রকে যাচনা করে নিয়েছেন, তাই দেব-দানব কেউ সে ব্যাপারে কথা বললেন না।

মহাভারতের সমুদ্রমন্থন বর্ণনায় এবারে যাঁকে পাওয়া গেল, তিনি হলেন লক্ষ্মী। লক্ষ্মীকে নিয়ে দেব-দানবদের মধ্যে যে একটা বিশাল গণ্ডগোল পেকে গিয়েছিল, তার সম্বন্ধে মহাভারতের কবি একটি দুর্দান্ত ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন পরে। কিন্তু লক্ষ্মীর আবির্ভাবের সময় কবি একেবারে নিশ্চুপ। ভাগবত পুরাণ কিম্বা পদ্ম পুরাণ কিন্তু জানিয়েছে যে, লক্ষ্মী লাভের জন্য দেবতা দানব সবার মধ্যে রীতিমতো হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল। দানব দৈত্যরা অবশ্য বেশি কিছু করেননি। তারা শুধু একবার লোলদৃষ্টিতে লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়েছিলেন। তা সে দেবতারাও তাকিয়েছিলেন। আর না তাকানোর মতো অহেতুক কিছু ছিল না। পৌরাণিক বর্ণনায় লক্ষ্মী যেভাবে সবার মধ্যে সলজ্জ হাসিতে, পায়ে নুপুরের ধ্বনি তুলে হাঁটতে আরম্ভ করেছিলেন–ততস্ততে নূপুরবস্তু শিঞ্জিতে / বিসপতী হেমলতেব সাবভৌ –তাতে দেব দানব সবারই দৃষ্টি পড়তে বাধ্য। যাই হোক, লক্ষ্মীর নিজের পছন্দটি কিন্তু একেবারে সপ্তম সুরে বাঁধা। দেব-দানব তার দিকে তাকিয়েই রইলেন শুধু, আর তিনি সাবহেলে বিসর্পিণী স্বর্ণলতার মতো আস্তে আস্তে গিয়ে ত্রিভুবনপতি ভগবান শ্রীহরির বুকে মুখ লুকোলেন- পশ্যতাং সর্বদেবানাং যযৌ বক্ষঃস্থলং হরেঃ। কিছু কিছু পুরাণ অবশ্য বলেছে যে, লক্ষ্মীকে দেখে দেব-দানবের সোচ্ছ্বাস অগ্রসর-ভাব পিতামহ ব্রহ্মাকে একটু চিন্তিত করে তুলেছিল। তিনি তাই দেব-সংসারে সবচেয়ে বুড়ো অভিভাবকের মতো লক্ষ্মীকে নারায়ণের হাতে তুলে দিলেন।

সমুদ্র মন্থন আবারও আরম্ভ হল। মহাভারতে কালকূট বিষ উঠেছে সবার শেষে। কিন্তু পৌরাণিকেরা অমৃত-মন্থনের উপাখ্যানে নাটকীয়তা সৃষ্টি করার জন্য বাসুকির মুখ দিয়ে বিষোদগার দেখতে পেয়েছেন আগেই। ভাগবত এবং অগ্নিপুরাণের মতো আবার প্রথমেই বিষ সৃষ্টি। বিষ্ণুপুরাণ এবং পদ্ম-পুরাণে দেখা যাচ্ছে সুরভি’র মতো আকুল মনমাতানো গন্ধ পাওয়া গেল আগে। অন্য মতে এই সুরভি হল স্বর্গের কামধেনুটি আর স্বর্গের সুগন্ধ বয়ে এনেছিল পারিজাত ফুল। সুরভির পরেই মন্থনের মুখে উঠে এসেছে উৎকৃষ্ট বারুণী মদ্য। মহাভারতে এই সুরার নামমাত্র উল্লেখ থাকলেও পদ্মপুরাণ এই সুরা-দেবীকে নায়িকার প্রতিরূপে চিহ্নিত করেছে। সে মদঘূর্ণিতলোচনা, স্বলিতপদা এবং টলটলে কাপড় পরা–দেবতারা নাকি ত্যাগ করেছিল তাকে, আর ঠিক সেই কারণেই অসুরেরা তাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন।

আমাদের মৎস্য পুরাণ অবশ্য বারুশী মদ্যের ব্যাপারে সবচেয়ে বাস্তব তথ্যটি দিয়েছেন। একথা কিছুই অবোধ্য নয় যে, এতক্ষণ মন্দর-দণ্ড ঘুরিয়ে সমুদ্র মন্থন করে। দেব-দানব-দু’পক্ষেরই যা পরিশ্রম হয়েছিল, তাতে তাদের শক্তি উদ্ৰিক্ত করবার প্রয়োজন ছিল। মৎস্য পুরাণ তাই বলেছে– নানা ওষধি আর জীব জন্তুর বসা মেদে তৈরি হল উৎকৃষ্ট বারুণী মদতদঘুমেদ-সোৎসর্গাবারুণী সমপদ্যত। বারুণীর গন্ধে দেব-দানব সাবই আকুল হলেন এবং অন্য পুরাণগুলি দেবতাদের সম্মান রক্ষার জন্য যতই বলুন–তারা মদ্য স্পর্শ করেননি, আমরা জানি- দেব দানবেরা সবাই বানিকটা করে বারুণী পান করে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করে নিলেন তদাস্বাদেন বলিনো দেবদৈত্যাদয়ো’ভব। দ্বিগুণ শক্তিতে পুনরায় মন্দর পরিবর্তন আরম্ভ হল।

দেব দানব সকলের মিলিত শক্তিতে সমুদ্র থেকে অনেক কিছুই উঠেছিল। ঐরাবত হস্তী, উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব, নন্দনের মন্দার মঞ্জরী– এগুলি তো মন্থনের সাধারণ ফল। বিষ যা উঠেছিল মহাদেব তা পান করে নীলকণ্ঠ হলেন। পৌরাণিকদের অনেক কাহিনী এবং মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের পরম্পরায় অনেকের মধ্যে এইরকম ধারণা আছে যে, স্বয়ং লক্ষ্মী অমৃতের পাত্র হাতে উঠেছিলেন সমুদ্রের গভীর থেকে। কিন্তু আমাদের মহাভারত এবং অধিকাংশ পুরাণে যা পাই তাতে দেখা যায় অমৃতের ভাণ্ড হাতে নিয়ে যিনি সমুদ্র থেকে উঠলেন, তিনি হলেন দেব বৈদ্য ধন্বন্তরী। শুভ্র কমণ্ডলুর মধ্যে অমৃত ধারণ করে ধন্বন্তরী দাঁড়ালেন দেব-দানবে সবার সামনে–শ্বেতং কমণ্ডলুং বিভ্র অমৃতং যত্র তিষ্ঠতি।

যে বস্তুর জন্য এত অপেক্ষা এত পরিশ্রম, এমনকি যার জন্য দেব-দানবের চিরন্তন বিরোধ পর্যন্ত সাময়িকভাবে মিটে গেছে, সেই অমৃত উঠেছে–এবারে কিন্তু প্রথমে দৈত্য-দানবের মধ্যে একেবারে শশারগোল পড়ে গেল। সবাই বলে আমি নেব অমৃত। এ বলে, আমি খাব ও বলে, আমি খাব –অমৃতার্থে মহান্নাদো মমেদমিতি জল্পতা। মহাভারত, কী পুরাণ এতক্ষণ যেমন দেখেছেন, তাতে সম্পূর্ণ সমুদ্র মন্থনকালে অসুর দানবেরা সবাই একেবারে নীরব ছিলেন। দেবতারা যেভাবে কথাটা বলেছিলেন, অর্থাৎ অমৃত পাওয়া গেলে সমান ভাগে ভাগ করে নেব আমরা, সেই কথাটায় অসুরেরা এত বিশ্বাস করেছিলেন যে, অন্য কোনও পদার্থ-হাতি ঘোড়া পারিজাত ফুল,কৌস্তভ মণি কিচ্ছুটি তারা চাননি। একটি একটি করে ভাল জিনিস উঠেছে, সবই দেবতারা ভাগ করে নিয়েছেন–যতে দেবাস্তবতা জগুরাদিত্যপথমাশ্রিতা। তারপর তিন ভুবনের ধনৈশ্বর্যবিধায়িনী লক্ষ্মীও যখন ভগবান নারায়ণের বক্ষঃলগ্না হলেন, তখন তারা তাদের একমাত্র ভরসা ধন্বন্তরীর হাতে রাখা অমৃত পাত্রের দিকে হাত বাড়ালেন

ততস্তে জগৃহ দৈত্যা ধৰন্তরিকরে স্থিত।
কমণ্ডলুং মহাবী যত্রাস্তে ত দ্বিজামৃত।

এত চেষ্টা সত্ত্বেও অমৃত লাভ করা সম্ভব হল না দৈত্যদের পক্ষে। ভগবান নারায়ণ দেবতাদের আগেই কথা দিয়েছিলেন অতএব সেই মতো তিনি অপূর্ব মোহিনী মূর্তি ধারণ করে দাঁড়ালেন দৈত্যদের সামনে। মোহিনী রমণীর রূপ দেখে অসুরেরা এতটাই মোহিত হলেন যে, তারা পরম বিশ্বাসে ধন্বন্তরীর হাত থেকে কেড়ে নেওয়া সেই অমৃতের কমণ্ডলু দিয়ে দিলেন রমণীর হাতে। রমণী মায়াবিনী– সমস্ত দৈত্যকে তিনি পংক্তি ভোজনে বসিয়ে দিলেন, কিন্তু অমৃতের ভাগ তিনি দিলেন না। দৈত্যরা শুধু চেয়ে চেয়ে রমণীর ললিত-গতি, উচ্চাবচ শরীর বিভঙ্গ দেখে মেতে রইল।

ভারি আশ্চর্য, লোকের ধারণা– কালো মেয়ে নাকি (সৌন্দর্যের) কোনও কনসেপ্টের’ মধ্যে আসে না, কিন্তু মহাভারতের কবি যেহেতু পরেও বিশেষত দ্রৌপদীর মধ্যে কালো মেয়ের শ্ৰেষ্ঠতা নিরূপণ করবেন, অতএব এই মোহিনী মূর্তির মধ্যেও আমরা সেই কালো রূপের মর্যাদা দেখতে পাব। মহাভারতের কবি যেহেতু অতি সংক্ষেপে এই বর্ণনা সেরেছেন, অতএব এখানে না পেলেও আমরা ভাগবত পুরাণে খবর পেয়েছি যে, বিষ্ণুর সেই মোহিনী মায়া মুর্তি ছিল নিকষ কালো–প্রেক্ষনীয়োৎপলশ্যামাং সাবয়ব-সুন্দর। নবীন বয়সী রমণীর কাঞ্চী দামে উদ্বেলিত হাঁটা চলায় তথা স্তনভারকৃশোদরী’ মোহিনীর উদ্দাম কটাক্ষে বশীভূত দৈত্য দানবদের মনে জেগে উঠল কামনার আগুন–দৈত্য-যুথপ চেতঃস্ কামম্ উদ্দীপয়ন্ মুহুঃ। যারা এতক্ষণ, অমৃত পানের জন্য ‘অহং পূর্বং অহং পূর্বং’–আমি আগে আমি আগে–করছিলেন, তাঁরা স্তব্ধ হয়ে বসে শুধু রমণীর কটাক্ষ ভিক্ষা করছিলেন।

আর এই মোহিনীও তো যে সে নয়, স্বয়ং বিষ্ণু দৈত্যদের প্রতারণা করার নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই মোহিনী মূর্তি ধারণ করেছিলেন। তাছাড় মনোহরণ শরীর বিভঙ্গেই শুধু নয়, পদ্মপুরাণ বলেছে– মোহিনী দৈত্যদের আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন– আমি তোমাদের, তোমাদের ঘরেই আমি থাকব– যুস্মাকং বশগা ভূত্বা স্থস্যামি ভবতাং গৃহে। বিলুব্ধ দৈত্যরা রমণীকে লাভ করার বিশ্বাসে তারই হাতে অমৃতের পাত্র ন্যস্ত করলেন। আর তখনই তারা দেখতে। পেলেন–মোহিনী সেই অমৃত দেবতাদের পান করিয়ে দিলেন তাদেরই সামনে, আর এক একটি লোল অপাঙ্গ-পাতে দৈত্যদের থামিয়ে রাখলেন শুধুই।

সময় বেশি লাগেনি। দৈত্য-দানবেরা খানিক পরেই বুঝলেন–সব মায়া; বিষ্ণুর মোহিনী মায়ায় তারা প্রতারিত হয়েছেন। দেবতা এবং দানবদের মধ্যে আবার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এরই মাঝখানে অমৃত বিন্দু লাভ করে রাহু কেতুর কী অবস্থা হল, সে ঘটনা আর বলছি না। কারণ সূর্যগ্রহণ আর চন্দ্রগ্রহণ এই রাহু-কেতুর রূপক আবরণে বাঁধা আছে। আমাদের বক্তব্য সেই দেবাসুর যুদ্ধে অসুরদের শেষ পর্যন্ত পরাজয় ঘটেছিল, কারণ দেবতারা পূর্বাহ্নেই অমৃত পানে বলীয়ান হয়েছিলেন।

অমৃত জিনিসটা যে কী, তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে রীতিমতো মতভেদ আছে। কেউ বলেন–সোমরস, কেউ বলেন-সোম অর্থাৎ চাঁদের জ্যোৎস্নাই অমৃত আবার কেউ বলেন–অমৃত অমৃতই, সোম বা চাঁদ হলেন সেই অমৃত ধারণ করার পাত্র-মাত্র। এ বিষয়ে আমাদের একটা নিজস্ব প্রস্তাব আছে। সহৃদয় পাঠকুল সে প্রস্তাব মানতেও পারেন আবার উপযুক্ততর প্রমাণ দিয়ে সে প্রস্তাব অমূলক প্রতিপন্ন করতে পারেন। বস্তুত অমৃত বস্তুটা কী তার সম্বন্ধে কিছু ধারণা পাওয়া যাবে।

আমি আগে অন্যান্য পুরাণের প্রমাণে জানিয়েছি যে, অমৃত মন্থনের আগে দেবতারা কোনওভাবেই অসুরদের সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না। তারা বারংবার অসুরদের হাতে প্রহার লাভ করছিলেন এবং অনেকে মারাও পড়ছিলেন। এখন যেহেতু সমুদ্র মন্থন করে অমৃত উঠে এসেছে, অতএব কথাটা আরও একটু অন্যভাবে বলতে চাই। আপনারা মৎস্য পুরাণের মতো প্রধান এবং প্রাচীন পুরাণে দেখবেন-সেকালে দেবতা এবং অসুরদের যুদ্ধ আরম্ভ হলে বেশি সংখ্যায় মারা পড়তেন দেবতারাই–পুরা দেবাসুরে যুদ্ধে হতাসবঃ সুরাঃ। কিন্তু দানব-দৈত্যরা যদি ভীষণভাবে আহত হয়ে মরণোন্মুখও হতেন, তবে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য তার সঞ্জীবনী মন্ত্রে বাঁচিয়ে তুলতেন তাদের। শুধুই মন্ত্র কিনা জানি না, কিন্তু দৈত্যগুরু মন্ত্রের সঙ্গে এমন ওষুধ দিতেন তার শিষ্য দৈত্যদের যাতে ক্ষত নিরাময় তো হতই, তারা মৃত্যুর মুখ থেকে জেগে উঠতেন সুপ্তোখিতের মতো জীবাপয়তি দৈত্যেন্দ্রা যথা সুপ্তোপিতানিব। এই মৃত সঞ্জীবনের মন্ত্র নাকি শুক্ৰ শিখেছিলেন দেবদেব মহেশ্বরের কাছ থেকে। একমাত্র শুক্র ছাড়া যেহেতু ব্ৰহ্মা বিষ্ণু, সুর নর দানব কেউই এই মাহেশ্বরী বিদ্যা জানতেন না, অতএব সর্বত্র শুক্রাচার্যের মর্যাদা ছিল আলাদা, তার মেজাজও ছিল আলাদা। এই প্রসঙ্গেই কচ-দেবযানীর কথাই পরে আসবে, তবে সে কথা পরেই হবে। আপাতত জানাই–শুক্রাচার্য যেহেতু অসুরপক্ষপাতী ছিলেন, তাই এই বিদ্যার প্রভাবে অসুরদের সবটাই ছিল সুবিধা আর অন্যদিকে দেবতাদের অসহায় মৃত্যু। তবে আমার মতে এই বিদ্যা যতটা মন্ত্রময়ী তার থেকেও বেশি ওষধিময়ী। ঠিক এই রকম একটা অবস্থায় অসুরদের বাড়বাড়ন্ত দেখে দেবরাজ ইন্দ্র, দেবগুরু বৃহস্পতি এবং অন্যান্য দেবতা একেবারে হতাশ হয়ে সমুদ্র মন্থনের কথা ভাবতে আরম্ভ করেন।

 হাতি ঘোড়া, পারিজাত অথবা কৌস্তভ মণি, কি লক্ষ্মীদেবী সমুদ্র মন্থনের গৌণ ফল মাত্র। কিন্তু মুখ্য ফল যে অমৃত, তার শক্তি যে দেবতাদের সুস্থ করে তোলার কাজেই নিযুক্ত হবে, সেটা অসুরদের মৃতসঞ্জীবনীর প্রতি তুলনা থেকেই অনুমান করা যায়। দ্বিতীয় কথা হল-সমুদ্র মন্থনের সময় যত বৃক্ষ লতা, ওষধিকে সমুদ্রে এনে ফেলতে বলা হচ্ছে বারবার। এটা একটা ‘পয়েন্টার’ মন্থনের ফলে যা উঠেছে– হাতিঘোড়া বাদ দিয়ে তার ক্রমিক পর্যায়টি লক্ষ করুন। মৎস্য পুরাণ বলেছে বিশাল বিস্তার মন্দর পর্বত ঘুরতে থাকলে অমৃত লক্ষ শ্বাপদ এবং ফল সমন্বিত বৃক্ষের সারাংশে পুষ্ট ওষধির রসে দুগ্ধসাগর দধিসাগরে পরিণত হল। তারপর সহস্র জীব শ্বাপদের বসামেদে দধিসাগর সুরায় পরিণত হল।

 দেখুন, এখানে দুগ্ধ দধি অথবা ঘৃত সুরা এগুলি কিন্তু বড় কথা নয়। বড় হল–ক্রমিক পর্যায়গুলি। পুষ্পৌষধি বা বসা-মাংসের মিশ্রণে কী তৈরি হতে পারে তা নিয়ে পৌরাণিকদের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে কিন্তু যে সমস্ত পৌরাণিকের বিভ্রান্তি নেই, তারা তাদের বক্তব্যে যথেষ্টই ঋজু। মহাভারতের পরিশিষ্ট বলে পরিচিত হরিবংশ পুরাণে এই ঋজুতা দেখতে পাই। পৌরাণিক বলেছেন

সমস্ত দেবতা এবং অসুর লবণ সমুদ্রের জলে মন্দর পর্বতকে মন্থন-দণ্ড বানিয়ে সমুদ্র মন্থন করলেন। সমুদ্রের জলে ছিল হাজারো রকমের ওষধি-বীরুঘো হিমবদরসম্। সম্পূর্ণ হাজার বছর ধরে মন্থন করার ফলে সমস্ত ওষধি দুগ্ধে পরিণত হল এবং তা থেকেই উঠে এল অমৃত

সমাঃ সহস্রং মথিতং জল ওষধিভিঃ সহ।
ক্ষীরভূতং সমাযোগা অমৃতং প্রত্যপদ্যত।।

হরিবংশের এই ঋজু কথাগুলি কবি থেকে আরম্ভ করে ঐতিহাসিক এবং বৈজ্ঞানিক সবাই মেনে নিতে পারে। দেবতাদের প্রয়োজন ছিল ওষধিজাত এমন এক মৃত্যুঞ্জয়ী প্রলেপ যা তাদের বাঁচিয়ে রাখবে, যা তাদের মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে তুলবে অবলীলায়। এবারে মহাভারতে লক্ষ্য করে দেখুন–এই অমৃতের ঔষধ হাতে নিয়ে উঠে এলেন যিনি, তিনি কিন্তু আর কেউ নন, তিনি দেব-বৈদ্য ধন্বন্তরি। দেবকুলে তিনি আয়ুর্বেদের চিকিৎসক বলে বিখ্যাত। গরুড় পুরাণ ধন্বন্তরির হাতে ধরা অমৃতকে ঔষধের মর্যাদা দিয়েই সমুদ্র মন্থনের কাহিনী শেষ করেছে। পৌরাণিক বলেছেন- ভগবান শ্রীহরি ক্ষীরসাগর মন্থনের সময় ধন্বন্তরির অবতার গ্রহণ করেছিলেন। অমৃতের কমণ্ডলু হাতে নিয়ে তিনি ক্ষীর সাগর থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আর তারপর? তারপর দেব-দানবের যুদ্ধ যতই লাগুক, ভগবান ধন্বন্তরি তার অমৃত বিদ্যা শিখিয়ে দিলেন তার প্রিয় শিষ্য সুতকে–

ক্ষীরোদমথনে বৈদ্যো দেবো ধন্বন্তরি হর্ভূৎ।
বিভ্রৎ কমণ্ডলুং পূর্ণ অমৃতেন সমুখিতঃ।
আয়ুর্বেদমষ্টাঙ্গং সুতায় স উক্তবান্।

 দুগ্ধ, ঘৃত, ওষধি, ‘ফার্মেন্টেশন’- সুরা, অমৃত, ধন্বন্তরি এবং সুশ্রুত এক পংক্তিতে এগুলি যদি পর পর ঋজুভাবে সাজিয়ে দিই তবে অমৃতের অর্থ গিয়ে দাঁড়াবে সেই অশেষ রোগহর নিরাময়কারী ঔষধ, যা দেব দানবের যুক্ত পরিশ্রমের আবিষ্কার এবং যা হয়তো শুক্রাচার্যের মৃত-সঞ্জীবনীর তুলনায় আরও বেশি ফলপ্রদ, আরও বেশি আকাক্ষিত। তাই ছলে-বলে দেবতারাই সেই অমৃত অধিকার করতে ব্যস্ত হয়েছিলেন, আর অসুরেরা বাদ পড়েছিলেন মোহিনী মায়ায়। আমার মূল বক্তব্য কিন্তু বাকি রয়েই গেল। কারণ সমুদ্র মন্থন করে যে অমৃত উঠল, সেই অমৃতটুকু কিন্তু আমার প্রতিপাদ্য নয়, আমার প্রতিপাদ্য হল সেই বিষয়টুকু সে বিষ, যা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে দেবতারা জেতেন, সেই ছলনা, যাতে অসুরেরা পরাজিত হন।

.

১১.

 অসুর-দানবেরা শত পরিশ্রম করেও অমৃতের অধিকার লাভ করতে পারলেন না, অন্যদিকে দেবতারা-মানুষ যাদের উদ্দেশে স্তুতি গান করেছে, মানুষ যাদের কাছে সহায়হীন হয়ে আশ্রয় নিয়েছে-সেই দেবতারা অসুরদের সঙ্গে ছলনা করলেন। নিরপেক্ষ জনে ভাবতে আরম্ভ করল–দেবত্বের মধ্যে যদি সত্য, সত্ত্ব, সমদর্শিতা না থাকল, তাহলে কীসের দেবত্ব? কী হবে মনুষ্যত্বকে দেবত্বের পর্যায়ে উন্নীত করে? বস্তুত অমৃত নিয়ে চিরকালীন এক কপট- নাটকের এই যে প্রস্তাবনা হল–তার নিন্দা সইতে হয়েছে দেবতাদেরই। লক্ষ্মী আর অমৃত–অন্য কিছু নয়, মহাভারতের মতে শুধু লক্ষ্মী আর অমৃতের অধিকার নিয়েই দেবতা আর অসুরদের বিরোধ শাশ্বতিক রূপ ধারণ করল-অমৃতার্থে চ লম্ফর্থে মহান্তং বৈরমাশ্রিতাঃ।

এই ঘটনার পর দেবতার প্রতি মানুষের নম্র নেত্রগাত, ধূপের ধোঁয়া আর সুমঙ্গলী স্তুতির নিরিখে দেবতাদের দেখতে চাই না, দেখতে চাই দেবতার বিরুদ্ধ পক্ষ অসুরদের অনুভব আর তর্ক-যুক্তিতে। বাস্তবিক পক্ষে বর্তমান গণতন্ত্রে ক্ষমতাসীন দলের বিপরীত পক্ষে থেকে যে রাজনৈতিক দল অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে, সেই বিষময় শব্দরাশির মধ্যে আতিশয্য থাকলেও কখনও যেমন সত্যও থাকে, ঠিক তেমনই অসুরদের চরম আক্ষেপের মধ্যে অতিশয়োক্তি কিছু থাকলেও সত্যও আছে কিছু। বিশেষ করে অমৃত না পাওয়ার যন্ত্রণায় অসুরদের যে সব কথাবার্তা পৌরাণিকেরা লিপিবদ্ধ করেছেন, সে সব কথা মহাভারতের মধ্যে স্পষ্টভাবে বলা না থাকলেও সৌতি উগ্রশ্রবা অমৃত-মন্থনের কাহিনী বলে দেবতা, অসুর এবং অবশ্যই মানুষের পারস্পরিক স্থিতিটি নির্ণয় করে দিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কী, পুরাণকারের কথা বুঝলেই মহাভারতের মধ্যে অমৃত-মন্থনের কাহিনীটিও যথাযোগ্য হয়ে পড়বে।

দেবী-ভাগবত পুরাণের বর্ণনা মতো তখন দৈত্যদের অধিপতি ছিলেন বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদ। তার রাজত্বকালে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য একবার তপস্যা করতে গেলে দেবতারা দেবগুরু বৃহস্পতিকে পাঠালেন দৈত্যদের সঙ্গে ছলনা করতে। দেবগুরু শুক্রাচার্যের রূপ ধরে দৈত্যদের বিশ্বাস উৎপাদন করে নিলেন প্রথমে। তারপর তাদের নানা ভুল শিক্ষা দিলেন বছরের পর বছর। তপস্যা সেরে স্বয়ং শুক্রাচার্য যখন ফিরে এলেন তখন দৈত্যরা তাকে মানতেই চাইলেন না। যা হোক, শেষ পর্যন্ত শুক্রাচার্য নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন এবং দৈত্যরা সেই জোরে আবারও লিপ্ত হল সংগ্রামে। পৌরাণিক সংখ্যায় এই যুদ্ধ হয়েছিল সম্পূর্ণ একশো বছর ধরে এবং প্রহ্লাদ প্রথমে ভেবেছিলেন–যুদ্ধে আর জেতা যাবে না। কিন্তু দৈত্য-প্রধানেরা সাহস দিয়ে বললেন, দেখুন মহারাজ, জয়-পরাজয় অদৃষ্টের খেলা। অদৃষ্ট কেউ দেখেনি, কে সেই অদৃষ্ট নির্মাণ করে তাও জানি না–কেন দৃষ্টং ক বা দৃষ্টং কীদৃশং কেন নির্মিত। কাজেই আরও একবার যুদ্ধে যাব–যা হবার তা হোক।

একশো বছর নাই হোক, শত সংখ্যার গৌরবে অন্তত কয়েক বছর যুদ্ধ তো হয়েইছিল এবং শেষমেশ প্রহ্লাদের দল শুক্রাচার্যের কল্যাণে জিতে নিলেন দেবতাদের। ভীত সন্ত্রস্ত দেবতারা তখন আশ্রয় নিলেন মহামায়া চণ্ডিকার কাছে। তাকে স্তব করে তুষ্ট করলেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। সিংহবাহিনী দেবী দেবতাদের আর্ত প্রার্থনা শুনে দেখা দিলেন এবং বললেন, ভয় পেয়ো না তোমরা। এই আমি যাচ্ছি, তোমাদের যাতে শুভ হয়, আমি সেই চেষ্টাই করব–ভয়ং ত্যজন্তু ভো দেবাঃ শং বিধাস্যে কিলাধুনা। দেবতাদের আশ্বাস দিয়েই সিংহারূঢ়াতি সুন্দরী দেবী প্রহ্লাদ এবং তার দৈত্য সেনাপতিদের সামনে এসে উপস্থিত হলেন। প্রহ্লাদ এবং তার দল-বল সবাই একটু ভয়ই পেলেন। তবুও মুহূর্তের মধ্যে সামলে নিয়ে প্রহ্লাদ বললেন, পালিয়ে যাবার কোনও কারণ নেই। দরকার হলে যুদ্ধ করব। ইনি অবশ্যই উপস্থিত হয়েছেন দেবতাদের রক্ষা করার জন্য। কিন্তু তবু আমরা পালাব না–যোদ্ধব্যং নাথ গন্তব্যং পলায্য দানবোত্তমাঃ। তোমরা ভয় পেয়ো না। আমি এখন এই ত্রিভুবন-পূজা মহামায়ার স্তুতি করব, কারণ তিনি সবার জননী এবং ভক্তদের তিনি সব সময় দেখেন–সর্বেষাং জননীং শক্তিং ভক্তানামভয়ঙ্করীম্।

খানিকক্ষণ স্তব করেই প্রহ্লাদ কিন্তু দেবীর কাছে দৈত্য-দানবদের চিরকালের সমস্যাগুলি অত্যন্ত সযৌক্তিকভাবে নিবেদন করতে আরম্ভ করলেন। বললেন, শত কোটি প্রণাম জানিয়েই তোমাকে বলছি মা। দেবতা কি দানব-তাতে তোমার কী যা, আসে মা? ছেলেরা ভালই হোক আর মন্দ, তুমি মা হয়ে ভিন্ন দৃষ্টিতে তাদের দেখবে কী করে–মাতুঃ পুত্ৰেযু কো ভেদো’ পশুভেযু শুভেষু চ? দেবতারা যেমন তোমার ছেলে, আমরাও তো তেমনই। তুমি না। বিশ্বজননী! তা তুমি যদি বল-তোরা অসুরেরা বড় স্বার্থপর, নিজেরটা ছাড়া কারোরটা বুঝিস না, তাহলে বলি মা, আমরা যেমন স্বার্থপর, দেবতারাও তেমনই স্বার্থপর-তেপি স্বার্থপরা নূনং তথৈব বয়মপত। যদি বল–তোরা দিন-রাত ভোগ-সুখ আর কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে আছিস, তাহলে বলব–দেবতারাও ওই নিয়েই আছে। তারাও বৈষয়িক সুখ-ভোগে মত্ত আছে, আমরাও আছি। তাহলেই দেখ–দেবতা আর অসুরে আদতে কোনও ভেদই নেই, তবুও যে তোমরা এরকম একটা ভেবে যাচ্ছ–ওরা ভাল, এরা খারাপ–এই ধারণাটা একেবারে ভুল গো জননী, এই ভেদটা তোমাদের মোহ–নান্তরং দৈত্য-সুরয়োর্ভেদো’য়ং মোহসম্ভব।

বিশ্বজননী চণ্ডিকার কাছে প্রহ্লাদ আজকে আর কিছু লুকোতে চান না। প্রহ্লাদ জানেন–স্বার্থপর, দোষী, ভোগী–এই কথাগুলি নিতান্তই সাধারণীকরণের মাত্রা। এতে কিছুই প্রতিপন্ন হয় না। তবু এই পদ্ধতিতেই তিনি সমস্ত ব্যাপারটা আরও একটু ফিলসফাইজ’ করে দিলেন-কারণ পরমেশ্বরী চণ্ডিকা পূর্বাহ্নেই দেবতাদের আর্তি শুনে এসেছেন, তার মনটাও এখনও দেবতাদের ব্যাপারে করুণাঘন হয়ে আছে। অতএব সাধারণীকরণের পদ্ধতিই আপাতত যুক্তিযুক্ত।

তার মধ্যে প্রহ্লাদ পরম বিষ্ণুভক্ত, বেদ-বেদান্ত, দর্শন তার ভালই জানা আছে। তিনি তাই একেবারে দার্শনিক যুক্তি সাজিয়ে বললেন, দেখ মা! দেবতারাও প্রজাপতি কাশ্যপের বংশধর, দৈত্য-দানবেরাও তাই। আমাদের মধ্যে তো কোনও বিরোধই থাকবার কথা নয়। তবে আমাদের ওপরেই কেন এই বিরুদ্ধ ভাব, মা জননী! তুমি অসুর আর দেবতাদের মধ্যে সাম্যভাব দেখাও, বিশ্বজননীকে সেটাই যে মানায়। দেখ মা, সত্ত্ব, রজঃ আর তমোগুণের ইতরবিশেষে দেবতা, অসুর–সবারই জন্ম হয়েছে, দেহধারী জীব মাত্রেই কাম, ক্রোধ, লোভ আছে, থাকবে। সেখানে তুমি দেবতাদের মধ্যেই শুধু গুণ দেখতে পাবে–এ কথাটা কেমন হল মা-গুণান্বিতা ভবেয়ুস্তে কথং দেবভূতোমরা?

 প্রহ্লাদ এবার অভিমান করে বললেন, আমার তো মনে হয়, মা-যুদ্ধ দেখতে তোমার ভাল লাগে, তাই তুমি তোমার কৌতুকের সাধ পূরণ করার জন্য আমাদের মধ্যে এমন বিরোধ বাধিয়ে রেখেছ–ত্বয়া মিথথা বিরোধোয়ং কল্পিতঃ কিল কৌতুকাৎ। বাস্তবিক তোমার যদি ঝগড়া দেখতে ভাল না লাগত, তাহলে ভাইতে ভাইতে এমন বিরোধ লেগে থাকবে কেন? তোমার ইচ্ছেতেই এমনটি ঘটছে। প্রহ্লাদ এবার চরম আত্মবিশ্বাস নিয়ে দেবীকে বললেন, ধর্মের তত্ত্ব আমার কিছু জানা আছে মা—জানামি ধর্মং ধর্মজ্ঞে–আর ইন্দ্রকেও আমি ভালমতো জানি। কিন্তু শুধু বিষয়-আশয় নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝগড়া লেগে রয়েছে সব সময়। তা এই তিন ভুবনের ভার তো মা তোমার হাতে, তুমি সবাইকেই শাসন করতে পার। কিন্তু বিষয়-লালসার সওয়াল যেখানে, সেখানে কোন পণ্ডিত কথা রাখে, তুমিই বল মা?

প্রহ্লাদ ধাপে ধাপে উঠছেন। বিশ্বজননীর যুক্তি এবং নীতিবোধের কাছে তার প্রতিবেদন। প্রহ্লাদ দার্শনিকতার সঙ্গে পুত্রের অভিমান মিশিয়ে দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের সাধারণীকরণের যুক্তিতে কথা বলেছেন এতক্ষণ। এবার তিনি দেবতাদের অন্যায় এবং স্বার্থপরতাগুলি একে একে দৃষ্টান্তের মতো উপস্থিত করছেন বিশ্বেশ্বরী জগজ্জননীর সামনে। সত্যি কথা বলতে কি, এই অংশটুকুর জন্যই আমি এই পুরাণ কথার অবতারণা করেছি, কারণ সমুদ্রমন্থন নিয়ে অসুরদের মধ্যে, বিশেষত মহামতি প্রহ্লাদের মনেও কত বিরূপ সমালোচনা অবদমিত হয়ে ছিল, তা এই অংশে প্রকট হয়ে উঠবে।

 প্রহ্লাদ দেবতা এবং অসুরদের বিষয়-লালসার সাজাত্য দেখিয়ে এবারে দেবতাদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। বললেন, এই যে এত বড় সমুদ্র মন্থন হয়ে গেল, দেবতা-অসুর সমানভাবেই কত পরিশ্রম করল, কিন্তু তার ফল কী? অমৃত বন্টনের ছলে ভগবান বিষ্ণুই তো দেবতা আর অসুরদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করলেন। আর বিষ্ণু! তিনি তো এই তিন ভুবন পালন-পোষণ করেন বলে জানি। তিনি নিজে কী করলেন? আপন লোভ চরিতার্থ করার জন্য তিনি নিজে স্বর্গসুন্দরী লক্ষ্মীকে আত্মসাৎ করলেন। তাও বুঝতাম–তিনি একটা বস্তু গ্রহণ করেছেন, ঠিক আছে। কিন্তু তার প্রত্যক্ষ মদত পেয়ে ইন্দ্র তো সবই হস্তগত করল–অশ্বরাজ উচ্চৈঃশ্রবা, গজরাজ ঐরাবত অথবা সুরভির মতো একটি কামধেনু সবই বিষ্ণুর ইচ্ছায় ইন্দ্রের ভাগে গেল–সুরৈঃ সর্বং গৃহীতং বৈষ্ণবেচ্ছয়া। এত বড় বড় সব অন্যায় করেও দেবতারা তবু সাধু বলে নাম কিনলেন-অনয়ং তাদৃশং কৃত্বা জাতা দেবাস্তু সাধবঃ। আর আমরা হলাম যত খারাপ।

প্রহ্লাদ এবার দেবতাদের সম্বন্ধে নিজের মত পরিষ্কার করে জানালেন। সমুদ্রমন্থনের সময় দেবতাদের নানান স্বার্থপরতা উল্লেখ করে প্রহ্লাদ বললেন, তুমি যাই ভাব–দেবতারাই যত অন্যায় অনীতির মূল, অন্তত ধর্মনীতির দিক দিয়ে দেখলে তাদের দুর্নীতি-পরায়ণ বলে স্বীকার করতেই হবে–অন্যায়িনঃ সুরা নং পশ্য ত্বং ধর্মলক্ষণ। নীতি-ধর্মের কথা যখন উঠলই, তখন বিষ্ণুর দিকেই তাকাও না। ভগবান বিষ্ণু দরকার পড়লেই দেবতাদের ঠিক নিজের নিজের জায়গায় বসিয়ে দেন, আর আমাদের তিনি দেন শুধু পরাজয়ের যন্ত্রণা। বিষ্ণুর দিক থেকে এটা কি অন্যায় নয়? অন্তত ধর্মনীতি তো তাই বলে যে, এটা অন্যায়।

প্রহ্লাদ ধর্মের প্রশ্ন তুলে পূর্ব মীমাংসা, যুক্তিবাদ, বেদ, ব্রাহ্মণ, ধর্ম মীমাংসা–সবই ছুঁয়ে গেলেন, তারপরেই অনবদ্য তার্কিক যুক্তি সাজিয়ে সমুদ্রমন্থনে দেবতাদের স্বার্থপরতার কথা শেষ করে তাদের কামবশতার কথাও তুললেন, কারণ কামনা-বাসনার ব্যাপারে লোকে শুধু এককভাবে অসুরদেরই দায়ী করে, দেবতাদের নয়।

প্রহ্লাদ তাই রীতিমতো হতাশার ভাব ফুটিয়ে বললেন, কোথায় ধর্ম, কেমন ধর্ম, সাধুতাই বা কোথায়–আমাকে একটু বুঝিয়ে দাও। এই সংসারে স্পৃহাহীন বৈরাগী কে আছেন অথবা কোনওদিন সেই বৈরাগীকে আমরা দেখতে পাব কি–নিঃস্পৃহঃ কোপি সংসারে ন ভবেন্ন ভবিষ্যতি। এই যে চন্দ্র, দেবসমাজে তো তার যথেষ্ট বড় জায়গা। তিনি তার পূজনীয় আচার্য-পত্নীকে জেনে-শুনে জোর করে হরণ করে নিলেন। আর দেবরাজ ইন্দ্র? ধর্মের সিদ্ধান্ত কি তিনি জানেন না? তিনিও তো গৌতম-গুরুর প্রিয়া পত্নীকে ধর্ষণ করলেন। আবার যদি দেবগুরু বৃহস্পতির কথাই ধর, তিনি তার অনুজ-পত্নীকে গর্ভবতী অবস্থায় ধর্ষণ করলেন এবং গর্ভদ্রুত তার শিশু-পুত্রটিকে অভিশাপ দিয়ে অন্ধ করলেন।

 প্রহ্লাদ যতগুলি ঘটনার উল্লেখ করলেন, এগুলি পুরাণ-কথায় প্রত্যেকটিই দেবতাদের মানসিক বিচ্যুতির ঘটনা। কিন্তু সব কথা বলে প্রহ্লাদ আবারও এলেন বিষ্ণুর কথায়। তিনি নিজে বিষ্ণুভক্ত, অতএব বিষ্ণুর দিক থেকে কোনও অন্যায় ঘটলে তার সবচেয়ে বেশি বুকে বাজে। সমুদ্র-মন্থনে অমৃত লাভ করার পর তিনি যে বঞ্চনা করেছেন এবং আপন পৌত্র বলি-রাজার সঙ্গেও যে অন্যায় করেছেন বিষ্ণু, তাতে তার ক্ষোভ আছে যথেষ্টই। প্রহ্লাদ বললেন–সমুদ্র মন্থনের পর আমাদের রাহু যে লুকিয়ে একটু অমৃত পান করেছিল, তাতে কী এমন অপরাধ ঘটেছিল? ভগবান বিষ্ণু এত বড় সত্ত্বগুণের আধার হয়ে তিনি কিনা রাহুল মাথাটাই কেটে নিলেন–অপরাধং বিনা কামং তদা সত্ত্ববম্বিকে?

সবার শেষে প্রহ্লাদের নিজের বাড়ির ঘটনা এল। প্রহ্লাদ একেবারে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। জগজ্জননী চণ্ডিকার কাছে নালিশ জানিয়ে বললেন, অমন যে আমার ধার্মিক নাতিটি, তার কী হল? ধার্মিক, সত্যনিষ্ঠ বলে জগতে যাঁদের সুনাম আছে, আমার নাতি বলিরাজ তাদের মধ্যে অন্যতম। তার দান-ধ্যানের সীমা নেই। শান্ত, বিনয়ী, বেদবিহিত যজ্ঞ-কর্মে তিনি সর্বদাই ব্যস্ত-যজ্বা দানপতিঃ শান্তঃ সত্ত্বজ্ঞঃ সর্বপূজক। এমন যে ধর্মপরায়ণ আমার নাতিটি, ভগবান শ্রীবিষ্ণু বামন রূপ ধারণ করে ছলনা করলেন। শুধু কি তাই? তার রাজ্য হরণ করে তাকে নিঃশেষ করে দিলেন একেবারে! অথচ দেখ মা, তবু মনীষী সজ্জনেরা দেবতাদেরই শুধু ধার্মিক বলে। আসলে কী জান, ধর্ম-টর্ম জগতে এখন কিছু নেই, এ জগতে যারা চাটুকার তারাই জেতে, ধর্ম এখন চুলোয় গেছে–জয়ন্তি চাটুবাদাশ্চ ধর্মবাদাঃ ক্ষয়ং গতাঃ।

 প্রহাদ তার বক্তব্য শেষ করলেন একেবারে অভিজ্ঞ যুক্তিবাদী আধুনিক বৃদ্ধটির মত। এত যুক্তি জগজ্জননী চণ্ডিকার পক্ষে একেবারে উড়িয়ে দেওয়াও সম্ভব হয়নি। দেবতাদের স্বার্থপরতা এবং ত্রুটিগুলি তিনি স্বীকার করে নিতেও বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু তাই বলে অসুরদের তিনি স্বর্গরাজ্যে প্রতিষ্ঠিতও হতে দেননি। তাদের বাবা-বাছা’করে পাঠিয়ে দিয়েছেন পাতালে।

এতক্ষণ ধরে দেবী-ভাগবত পুরাণ থেকে অসুরদের জবানীতে এই যে দেব-সমালোচনা শোনালাম, তার কারণ এই নয় যে, এই পুরাণখানিকে আমি সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ বলে মনে করি। দেবী-ভাগবত পুরাণে দেবী চণ্ডিকার মাহাত্ম্যই প্রথম এবং শেষ কথা, ফলত স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু পর্যন্ত এখানে এক বিষ্ণুভক্তের মুখেই সমালোচনার পাত্র। কিন্তু তবুও দেবী-ভাগবতের এই অংশটুকু স্মরণ করলাম এই কারণে যে, দেবতা এবং অসুরদের পারস্পরিক স্থিতিটা এই সমালোচনা থেকে বুঝতে সুবিধা হবে। মহাভারতের অমৃত-মন্থন-পর্বে দেবতা এবং অসুরদের ন্যায়-অন্যায়ের বাহ্যিক একটা ইঙ্গিত আছে, সেই ইঙ্গিতটা পুরাণগুলির মধ্যে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু দেবী-ভাগবত পুরাণে যেহেতু আলোচনার সঙ্গে সমালোচনাটাও বাড়তি পাওয়া গেল, তাই সেটা উল্লেখ করে আমি আমার অন্য উদ্দেশ্যগুলিও সাধন করতে চাইছি, যদিও সেই সাধনায় অন্যান্য পুরাণ তথা ভারতীয় দর্শনগুলিও আমাদের সাহায্য করবে।

বস্তুত ছলনা, হিংসা, অসংযম, স্বার্থপরতা, ধর্ষণ–এই অন্যায় আচরণগুলিকে আমরা সব সময় অসুর-রাক্ষসদের ক্রিয়া-কাণ্ড বলেই এতকাল ভেবে এসেছি। এমনকি মনুষ্য-সমাজের মধ্যেও যাদের মধ্যে আমরা ইন্দ্রিয়-বৈকল্য তথা কাম-ক্রোধ-হিংসা বেশি দেখতে পাই, আমরা আর তাদের মানুষ বলি না। অসুরদের সম্বন্ধে কোনও ধারণা না থাকলেও আমরা সংযমহীন, অনিয়ন্ত্রিত মানুষের মধ্যে অসুরের চিহ্ন দেখতে পাই। একটি মানুষের গায়ে অসম্ভব শক্তি থাকলে আমরা তার মধ্যে আসুরিক শক্তি লক্ষ্য করি; এমনকি একটি মানুষ অতিরিক্ত ভোজন করলেও তাকে আমরা তুলনা দিই রাক্ষসের সঙ্গে এবং এর মধ্যে যদি কারও অতিরিক্ত খিদে থাকে, তো সেই খিদে রাক্ষুসে খিদে না হয়ে যায় না।

অন্যদিকে, এর বিপরীত কোটিতে যে সমস্ত মানুষের মধ্যে পবিত্রতা, সততা অথবা সত্ত্বগুণ বেশি লক্ষ্য করা যায়, আমরা তাদের দেবতা বলে সম্বোধন করি। যাঁদের মধ্যে দয়া এবং সহৃদয়তার মাত্রা সমধিক, তারা দেবতুল্য মানুষ বলে প্রতিনিয়ত তাদের কাছে আমরা নত হই। সংযতেন্দ্রিয়, নিঃস্বার্থ, নীতিযুক্ত মানুষ আমাদের কাছে দেবতার সম্মানেই সম্মানিত। মানুষই যখন এই পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেন, সেখানে দেবতা মানেই তো তিনি পবিত্রতা, সততা অথবা নীতি-ধর্মের প্রতিমূর্তি।

 বাস্তবে কিন্তু ঘটনাগুলি এত সাধারণ বা বৈচিত্র্যহীন নয়। পুরাণ ইতিহাসে দেবতাদের চরিত্র যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাতে মনুষ্য-সমাজকে যদি বাদ দিয়ে পুরোপুরি আলাদা করেও ফেলা। যায়, তবে দেবতাদের মধ্যেও প্রচুর আসুরিক গুণ দেখা যাবে, আবার বহু অসুরের মধ্যেও লক্ষ্য করা যাবে পবিত্র দেব-গুণ। আর মানুষের গুণ? সে তো দেবতা এবং অসুর–দুই পক্ষেরই সাধারণ ধর্ম। এই নিরিখে দেখতে গেলে একমাত্র মানুষই আমার কাছে শেষ পর্যন্ত দেবতা কিংবা রাক্ষসে পরিণত হবেন। সত্যি কথা বলতে কি-দেবতা কিংবা অসুর–এঁরা মানুষই কিনা সেটা প্রমাণ করতে হলে আমাকে বেগ পেতে হবে রীতিমতো।

এই বেগের আগেও অবশ্য আবেগের একটা ব্যাপার আছে। মনে রাখতে হবে–ভারতীয় দর্শনে ঈশ্বর’ বলে একটা কথা আছে। অনেকেই ঈশ্বর বা পরমেশ্বরের সঙ্গে দেবতাকে এক করে ফেলেন। বেদ-উপনিষৎ-পুরাণের মধ্যে ভারতীয় দেবতার যে বিবর্তন পাওয়া যায়, তাতে বেদের যুগ শেষ হতে না হতেই নূতন এক পরম তত্তের অন্বেষণ আরম্ভ হয়ে গেছে। পুরাণ-ইতিহাসের বর্ণনায় সমুদ্রমন্থনে নিযুক্ত যে সমস্ত দেবতাকে দেখলেন অথবা যে সমস্ত দেবতার সমালোচনা শুনলেন বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের কাছে, সেই ইন্দ্রাদি দেবতারা কিন্তু বেদের বর্ণনায় অসীম শক্তিধর। তবে কিনা বেদে ইন্দ্র, বায়ু, সোম, সূর্য ইত্যাদি যে যে দেবতার স্তুতি যখন যখন রচিত হয়েছে, তখন সেই সেই স্তুতি-সূক্তের মধ্যে কিন্তু সেই ব্যক্তি দেবতাই চরম মাহাত্ম্যে ধরা দিয়েছেন। অর্থাৎ বৈদিক ঋষি যখন ইন্দ্র-সম্বন্ধীয় সূক্ত রচনা করছেন, তখন অন্য দেবতারা গৌণ, ইন্দ্রই প্রথম এবং শেষ কথা। আবার যখন সূর্য-সূক্ত রচনা করছেন ঋষি, তখন সূর্যই সব, তিনিই মুখ্যতম, অন্যেরা অপ্রধান।

পণ্ডিতেরা বলেন, এইরকম বহু-দেবতার ব্যক্তি স্তুতির চরম পর্বে ক্লান্ত ঋষির হৃদয়ে এক এবং অদ্বৈত তত্ত্বের অন্বেষণ জেগেছে। দিনের পর দিন শত-সহস্র যজ্ঞে বৈদিক দেবতার ব্যক্তি-স্তুতি রচনা করতে করতে বৈদিক ঋষির মুখ দিয়ে এক অদ্ভুত হতাশা ধ্বনিত হয়েছে–কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেমঃ-এত ঘি পুড়িয়ে হব্য-কব্য নিবেদন করে কোন্ দেবতার উদ্দেশ্যে আর আহুতি দেব আমরা? পণ্ডিতেরা বলেন, এই হতাশা থেকেই অদ্বৈত তত্ত্বের অন্বেষণ আরম্ভ হয়–যার চরম পরিণতি উপনিষদ আর বেদান্ত দর্শনের মধ্যে। উপনিষদের মধ্যে দেখা যাবে ইন্দ্র-বায়ু-সূর্যের মতো দেবতাদের স্থান নিতান্তই গৌণ, প্রায় মানুষের মতোই তাদের স্থিতি এবং অবস্থান। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল-উপনিষদের তত্ত্ব বা ব্ৰহ্মতত্ত্ব জানবার জন্য আমরা যাদের আগ্রহান্বিত দেখতে পাচ্ছি, তাদের মধ্যে দেবতা, অসুর এবং মানুষদের জায়গাটা একেবারেই সমান, একস্তর।

অবশ্য উপনিষদ বা বেদান্ত-দর্শনের চরম উপাস্য তত্ত্ব যে ব্রহ্ম, সেই তিনিও কিন্তু বেশিদিন তার কাঠিন্য বজায় রাখতে পারেননি। উপনিষদের জ্ঞান সাধনার ধারা এতই কঠিন, এতই তা গভীর এবং সূক্ষ্ম যে সেই পথে–ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া/দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি–সাধারণ জনের ঈশ্বর বিষয়িনী তৃষ্ণা একটুও নিবারিত হয়নি। উপনিষদের পূর্ব যুগের ইন্দ্রাদি দেবতার মূর্ত কল্পনা তখনও মানুষের মনে অম্লান, এবং বেদের প্রামাণ্য অবিসংবাদিতভাবে চিরন্তন। অন্যদিকে উপনিষদ বা বেদান্ত দর্শনের চরম দার্শনিক তত্ত্বগুলিও মানুষকে গভীরতা দেয়, তার দার্শনিক জিজ্ঞাসা পরিতৃপ্ত করে, তাকে মুক্ত পুরুষের মাহাত্ম্য দেয়। ঠিক এই রকম একটা অবস্থা থেকেই মানুষ-দার্শনিক এমন একটি দেবতাকে কামনা করে বসল–যাঁর রূপ-রস এবং আঙ্গিক হবে বৈদিক দেবতার মতো, আর তার অন্তরে থাকবে উপনিষদের সেই পরম তত্ত্ব-জ্যোতি। অর্থাৎ যিনি মানুষের প্রার্থনায় এবং ভালবাসায় ধরা দেবেন অথচ তার তত্ত্বটি হবে গভীর এবং জ্ঞানগম্য। আমাদের আলোচ্য মহাভারতে যেহেতু এইরকমই এক পরম দেবতার সন্ধান পাব আমরা, তাই আগেভাগেই আমরা তার আগমনী রচনা করছি।

মহাভারতের আখ্যান-উপাখ্যান মুলতুবি রেখে এই পরম দেবতার প্রতিষ্ঠা আমার সহৃদয় পাঠক-মণ্ডলীর কাছে যে হৃদয়গ্রাহী হবে না, তা জানি। আর আমি আনুষ্ঠানিক বা দার্শনিকভাবে সে প্রতিষ্ঠার বিস্তারে যাবও না। তার কারণ কৃষ্ণ যে কী করে আস্তে আস্তে ভগবান হয়ে গেলেন–মহাভারতের প্রক্ষেপবাদীদের কাছে তা যত আশ্চর্যের ঘটনাই হোক, আমার পক্ষে মহাভারতের প্রমাণ দিয়েই সেটা দেখানো কিছু অসম্ভব নয়। আরও অসম্ভব নয় এই জন্য যে, তিনি এক ঐতিহাসিক চরিত্র। কিন্তু কৃষ্ণকে নিয়ে আমি একটুও চিন্তিত নই, কারণ মহাভারতে তিনি স্বয়ং-প্রকাশ। আমি শুধু চিন্তিত সেই পরম ঈশ্বর নিয়ে–যাকে ক্কচিৎ আমরা কৃষ্ণ বলে ডেকেছি, শিব বলে ডেকেছি অথবা দুর্গা বলেও ডেকেছি–সেই পরম ঈশ্বর তত্ত্বকে যেন দেবতা বলে গুলিয়ে না ফেলি। আবারও বলছি, পরম ঈশ্বর বা ভগবান নয়, আপাতত আমার আলোচ্য শুধু দেবতা, অসুর এবং মনুষ্য। এই তিনটি প্রাণীকে বুঝে নিয়েই আমরা সৌতি উগ্রশ্রবার আসর ছেড়ে একেবারে মহারাজ জনমেজয়ের রাজসভায় উপস্থিত হব। কারণ নাগ, অসুর অথবা দেবতাদের কাহিনী বলে সৌতি উগ্রশ্রবা ততক্ষণে আমাদের মহাভারত-কথার মূল আসরে বসার যোগ্যতা তৈরি করে দেবেন।

.

১২.

ওঁরা বলেছেন, মনে বড় আনন্দ হয়। এমন আনন্দ, যা লাভ করলে পৃথিবীর সমস্ত সুখ এবং আনন্দ তার কাছে লঘু হয়ে যায়–যং লধ্বা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ। শম-দমের সাধন, এখানেও কিছু চাই না, মরে যাবার পরেও কিছু চাই না’–এমন একটা নিঃস্বার্থ ভাব, আর মুক্তির জন্য উদগ্র একটা ইচ্ছে–এই সব দুর্লভ যোগ্যতা যার আছে, তিনিই–একমাত্র তিনিই হলেন ব্রহ্মবিদ্যায় অধিকারী।

বেশ তো, ব্রহ্মবিদ্যার ছাত্র কী রকম হবে–সেটা তো বোঝা গেল, তা এই বিদ্যায় কার দেখা মিলবে? কী পাব? দেখা মিলবে সেই অমৃত জ্যোতির, পাবে পরম আনন্দ। তিনি কোথায় থাকেন? কোথাও না, কিন্তু সর্বত্র–তিনি অণুর থেকেও ছোট, সব চেয়ে বড়র থেকেও তিনি বড়।

এ তো কিছুই বুঝলাম না। ভীষণ কঠিন। হ্যাঁ কঠিন। ব্রহ্মতত্ত্ব বড় কঠিনই বটে। সহজ কিছু চাও তো ভগবানকে ডাক। তিনি ব্রহ্ম-স্বরূপ। তাকে কেমন দেখতে? ভারি সুন্দর। গোপবেশ বেণুকর, নবকিশোর নটবর। থাকেন কোথায়? গোলোকে, বৈকুণ্ঠে। হ্যাঁ, এই চেহারাটা বেশ পছন্দ হয়েছে। তা একে পেতে হলে কী কী যোগ্যতা থাকার দরকার? ভক্তি, শরণাগতি, ভালবাসা। বাঃ এ তো বেশ সহজ, আমি পারব, আমি এঁকেই চাই।

দুটো পরম উপাস্য তত্ত্বের পার্থক্য দেখলেন? প্রথমটা বুঝতেই পারছি না। কিন্তু দ্বিতীয়টা বেশ বুঝতে পারছি। কেন বুঝতে পারছি জানেন? পরম উপাস্য তত্ত্ব হলেও তার একটা চেহারা আছে, তার কিছু ক্রিয়াকলাপ আছে, এবং থাকবার একটা ঠিকানা আছে। অর্থাৎ আমরা ভারতের মানুষেরা অদ্বৈত, দ্বৈত দ্বৈতাদ্বৈত, শুদ্ধাদ্বৈত–এমনই হাজার কিসিমের সূক্ষ্ম আলোচনা সেরে নিয়ে যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, তাতে পরম ঈশ্বরের চেহারা, ঠিকানা এবং সারা জীবনের ‘অ্যাকটিভিটি’ ভাল রকম বিচার না করে তাকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বা ভগবান বলে মানতে রাজি হইনি।

আমার বক্তব্য–স্বয়ং ভগবানেরই যখন এই অবস্থা, তখন সাধারণ দেবতাদের কথা আর কী বলব? তাদের ঠিকানা, তাদের রূপ, ক্রিয়া-কলাপ, ঝগড়া-ঝাটি, মারামারি, লোভ, হিংসা, ভালবাসা–সবই আমরা দেখতে পেয়েছি ইতিহাসে পুরাণে। বলতে পারেন–পৌরাণিক কথক ঠাকুরের কল্পনা আর আমাদের অফুরান বিশ্বাস–এই দুয়ের যোগফল হল আমাদের দেবতা।

বলতেই পারেন। অনেকে অনেক কথাই বলছেন, তো আপনারা বললে আর ক্ষতি কী! তবে কিনা, এই আধুনিক যুগে বসে মহাভারতের অমৃত-কথা আরম্ভ করেছি, তাই পৌরাণিকের কথার ভিতরে কোথায় ইতিহাসের অভিসন্ধি মেশানো আছে, সেটুকু আমরা অসীম সমব্যথায় দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব, না হলে, আমার মহাকবির হৃদয়টাই যে একেবারে ব্যর্থ হয়ে যাবে। বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করে উত্তরাধিকারী কি কখনও পূর্বপুরুষের সঙ্গে কৃতঘ্নতা করে? অতএব শুনুন মহাশয়! স্বর্গ নামে একটা জায়গা আছে।

ঠাকুমা-দিদিমা, কৃত্তিবাস-কাশীদাসের বর্ণনায় স্বর্গের কথা শুনেছি কত। বড় মনোরম সে জায়গা। সেখানে দেবতারা থাকেন। গন্ধর্ব-কিন্নরেরা সেখানে নাচে, গান গায়। স্বর্গসুন্দরী অপ্সরারা বিলোভনী নৃত্যভঙ্গিতে সবার মনোরঞ্জন করে, রূপে-রসে মন ভোলায়। মানুষ বেঁচে। থাকতে সেখানে যেতে পারে না। মানুষ যদি অনেক পুণ্য করে, ইহলোকে যদি ভাল ভাল কাজকর্ম করে, তবে নাকি মৃত্যুর পর স্বর্গে যায়। আমাদের বেদ, মহাভারত, পুরাণ, ধর্মশাস্ত্র এবং অন্যান্য শাস্ত্রও তাই বলে। এমনভাবে বুলে যাতে মনে হয়–স্বর্গ যেন পৃথিবীর ওপর, অন্তরীক্ষ-লোকের ওপর এক দুর্লভ জায়গা। আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে কোনও কল্পনার জগৎ।

‘কল্পনার জগৎ’ কথাটা ঠিকই আছে, কিন্তু ধরা-ছোঁয়ার বাইরে কি না সেটাই শুধু বোঝবার। ভারি আশ্চর্য লাগে শুনতে, যখন মহাভারতেই দেখতে পাই–পৃথিবীবাসী কত রাজা স্বর্গে গেছেন দেবরাজ ইন্দ্রকে রণক্ষেত্রে সাহায্য করতে। রামায়ণের দশরথ গেছেন, পাণ্ডব কৌরবের পূর্বপুরুষ পুরূরবা গেছেন, দুষ্মন্ত গেছেন, আরও কত মানী রাজা, তাঁদের নাম। করতে চাই না। কালিদাসের কুমার রঘু তো স্বর্গরাজ্য আক্রমণই করেছিলেন। অপরদিকে মানুষের এই কর্মভূমি পৃথিবীতে দেবরাজ ইন্দ্রের গতায়াতও কিছু কম ছিল না। মানুষের মানসিক উন্নতি হলে, অথবা মর্ত্য রাজা যদি শতবার অশ্বমেধ করতেন তো ইন্দ্রের ভয় হত–তার ইন্দ্ৰত্বই চলে যাবে হয়তো। আরও একটা কথা, এই পৃথিবীর মানবী রমণীরাও দেবতাদের কম প্রিয় ছিলেন না–মহাভারতের অন্যতম প্রসঙ্গে সে সব কথা পরে জানাব। এখন শুধু একটা গল্প বলব–সোমদেব-ভট্টের কথাসরিৎসাগর থেকে।

গল্পটা বলব, কেননা, স্বর্গের সঙ্গে মর্ত্যভূমির যোগাযোগ কত গভীর, কত সহজ হতে পারে, সেটা বোঝা যাবে এই কাহিনী থেকে। আরও বলব এই কারণে যে, গল্পটা পাণ্ডব বংশেরই উত্তরপুরুষ জনমেজয়ের ছেলেকে নিয়ে। অবশ্য গল্প শোনার আগে মনে রাখবেন–কথাসরিৎসাগরের কবির পক্ষে মহাভারত-পুরাণ বা ভারতের ঐতিহ্যবিরোধী কোনও কথা বলা সম্ভব নয়। তাই কথাসরিতের কাহিনীকে শুধুই গল্প বলে উড়িয়ে দেবেন না। গল্পের অন্তরে যে বিশ্বাসটুকু আছে, সেই বিশ্বাস যে সাধারণ বিশ্বাস, সেটা মনে রেখেই গল্পটা শুনবেন।

গল্পের পটভূমি-ইতিহাস-বিখ্যাত সেই বৎস-দেশ। এমন সুন্দর সে দেশ যে মনে হয় বিধাতা যেন স্বর্গভূমির সঙ্গে পাল্লা দেবার জন্য প্রতিযোদ্ধার মতো তৈরি করেছিলেন এই দেশ-স্বর্গস্য নির্মিতো ধাত্রা প্রতিমন্নু ইব ক্ষিতৌ। এই বৎস দেশের মধ্যে আবার কৌশাম্বী নগরী, যেন পদ্মফুলের হলুদ-বরণ হৃদয়খানি। এই কৌশাম্বীতেই থাকতেন রাজা শতানীক, জনমেজয়ের ছেলে পরীক্ষিতের নাতি। অসীম তার প্রতাপ, প্রবল তার ক্ষমতা। রাজার স্ত্রীর নাম বিষ্ণুমতী। রাজার ঘরে এত ঐশ্বর্য, এত সম্পত্তি কিন্তু তার ছেলে নেই। মনের দুঃখে রাজা মৃগয়া করতে বেরিয়েছেন এবং হঠাৎ করে শাণ্ডিত্য মুনির সঙ্গে তার পরিচয় হয়ে যায়। মুনি যাগ-যজ্ঞ করে মন্ত্রপূত পায়েস খাইয়ে দিলেন রানিকে। যথাসময়ে রানির ছেলে হল, তার নাম হল সহস্রানীক। ছেলে বড় হতে তাকে যুবরাজ করে দিয়ে রাজা শতানীক ভাবলেন কিঞ্চিৎ ভোগ-বিলাস করবেন এবার। ছেলে বড় হয়ে গেছে, আর কত রাজকর্ম করবেন তিনি।

 কিন্তু ক্ষত্রিয়ের ঘরে আরাম বেশিদিন সয় না। ভোগ করব ভাবলেই ভোগ করা যায় না। রাজা সুখেই আছেন, তার মধ্যে স্বর্গরাজ্য থেকে ইন্দ্রের দূত মাতলি এসে পৌঁছলেন শতানীকের কাছে-দূতস্তস্মৈ বিসৃষ্টো’ভূদ রাজ্ঞে শক্রেণ মাতলিঃ। কী? না, স্বর্গে বড় বিপদ চলছে, অসুরদের সঙ্গে লড়াই লেগেছে দেবতাদের। অতএব এই বিপন্ন অবস্থায় ইন্দ্র শতানীককে স্মরণ করেছেন সাহায্য করার জন্য সাহায়কেচ্ছয়া। রাজা শতানীক সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী-সেনাপতি আর প্রিয় পুত্রের হাতে রাজ্যের ভার সঁপে দিয়ে মাতলির রথে চড়ে গিয়ে পৌঁছলেন স্বর্গরাজ্যে ইন্দ্রের কাছে। যুদ্ধের ভার বুঝে নিয়ে তিনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রণাঙ্গনে নেমে পড়লেন।

পাণ্ডবকুলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মানুষটির ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। অসুরদের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ হল তার। যম-দংষ্ট্রা নামে এক অসুর দলের অনেককেই তিনি মেরেও ফেললেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, স্বয়ং ইন্দ্র দেখছেন এই অবস্থায় অসুরদের সঙ্গে লড়াইতে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। এই অবস্থায় ইন্দ্র কী করেন? একে তো লড়াই তখনও চলছে, এদিকে মর্ত-বন্ধুর মৃত্যু ঘটল। অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি নিজের প্রিয় সারথি মালিকে পাঠিয়ে দিলেন কৌশাম্বীতে। মাতলি অশেষ শ্রদ্ধায় রথে করে বয়ে নিয়ে চললেন রাজা শতানীকের মৃতদেহ মাতল্যানীতদেহ।

কৌশাম্বীতে যখন রাজার মরদেহ এসে পৌঁছল, তখন হাহাকার পড়ল রাজবাড়িতে। রানি বিষ্ণুমতী শতানীকের অনুগামিনী হলেন চিতাগ্নিতে। রাজলক্ষ্মী আশ্রয় লাভ করলেন শতানীকের পুত্র সহস্রানীকের কাছে।

ঘটনাটা খুব সামান্য। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল-কৌশাখী থেকে কতদূর এই স্বর্গরাজ্য, যেখান থেকে ইন্দ্রের বার্তাবহ দূত এসে পৌঁছয় মর্থ্য রাজার কাছে? কতদূর এই স্বর্গরাজ্য, যেখান থেকে কোনও অলৌকিক পদ্ধতিতে নয়, বায়ুপথে নয়, একেবারে রথে করে সংগ্রাম-ভূমি থেকে মরদেহ বয়ে আনা যায় কৌশাম্বীতে?

গল্পটা আরও একটু বলি। শতানীকের মৃত্যুর পর নবীন রাজা সহস্রানীক রাজ্য চালাতে আরম্ভ করেছেন। ওদিকে কোনও মতে স্বর্গের রাজা ইন্দ্রও হটিয়ে দিয়েছেন অসুরদের। স্বর্গে বিজয় মহোৎসব আরম্ভ হল আর এই আনন্দ-বিজয়ের দিনে ইন্দ্রের মনে পড়ে গেল এই মর্তসধার কথা। তার দুঃখের দিনে মর্ত্য থেকে শতানীক এসেছিলেন তারই হয়ে যুদ্ধ করার জন্য। তিনি মারা গেছেন তারই জন্য। ইন্দ্র আবারও মাতলিকে পাঠালেন কৌশাখীতে, যাতে বন্ধুপুত্র সহস্রানীক তার এই বিজয়োৎসবে যোগ দেন

ততঃ শত্রু? সুহৃৎপুত্রং বিপক্ষ-বিজয়োৎসবে।
স্বর্গং সহস্রানীকং তং নিনায় প্ৰেষ্য মাতলিম্।

আমার কাছে এটা খুব বড় কথা নয় যে, সহস্রানীক স্বর্গের বিজয় মহোৎসবে অবশ্য যোগ দিয়েছিলেন। বড় কথা নয় এটাও যে, মর্ত্যের রাজাকে স্বর্গসুন্দরী তিলোত্তমা ডেকেছিলেন ক্ষণিক ভালবাসার জন্য। এত সব কাহিনীর বিস্তারে আমি আর যাব না। কারণ, আমার প্রশ্ন রয়ে গেছে সেই একটাই–কৌশাম্বী থেকে কত দূর সেই স্বর্গভূমি, যেখানে পৃথিবী রাজা সহস্রানীক নন্দন-বনের অন্তরালে দেব-পুরুষদের রমণী-বিলাসে মত্ত দেখেছিলেন? কোথায়, কত দূর সেই স্বর্গভূমি যেখান থেকে ফেরবার সময় মাতলির রথ-ঘর্ঘরে ডুবে গিয়েছিল তিলোত্তমার প্রেমের আহ্বান? আমরা সেই স্বর্গের ঠিকানা চাই।

আচ্ছা, গল্প শুনে মনটা যখন হালকাই আছে, তবে স্বর্গভূমির দার্শনিক চর্চা করে প্রাথমিকভাবে বিষয়টাকে একটু গভীর করে নেওয়াই ভাল। বস্তুত স্বর্ণ ব্যাপারটা একটা স্থান-বিশেষ, নাকি এই জায়গাটা একটা কল্পিত সুখের ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’–তা নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে প্রবল মতভেদ আছে। বেদান্ত দর্শনের পণ্ডিতেরা বলেন-বেদের মন্ত্রে, উপনিষদের নানা তথ্য এবং পুরাণ-ইতিহাসের মধ্যে যেহেতু দেবলোক বা স্বর্গলোকের নানা বর্ণনা আছে, অতএব এ রকম একটা স্বতন্ত্র সুখভোগের স্থান অবশ্যই আছে, যেখানে দেবদেহ লাভ করে স্বর্গসুখ ভোগ করা যাবে। বেদাতীদের যুক্তি খুব সোজা। তারা বলেন–ধর, তুমি একটি শুয়োর। সারাক্ষণ নোংরা-কাদায় শুয়ে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করা সেই শুয়োরের দেহ ধারণ করে অথবা শুয়োরের ভাবনা-চিন্তা মাথায় নিয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের মতো স্বর্গসুখ ভোগ করবে, তা কি হয় বিড়-বরাহাদি-দেহেন ন হ্যৈং ভুজ্যতে ফলম্? স্বর্গসুখ চাইলে বাপু বেদ-বিহিত কর্ম করো, চিত্ত শুদ্ধ করো, তাহলে মরণান্তে দেবদেহ লাভ হবে, ভোগ করবে অনন্ত স্বর্গসুখ।

একই ভাবে খারাপ ভাবে জীবন চালিয়ে হাজারো অন্যায় করার পর নরক ভোগ করার জন্যও যে অন্য কোনও স্বতন্ত্র দেহ লাগবে, সেটাও মেনে নিয়েছেন দার্শনিকেরা। বাচস্পতি মিত্রের মতো সর্বদর্শনস্বতন্ত্র পণ্ডিত পর্যন্ত বলেছেন–ধর, তোমার অন্যায়-অভব্যতার নিরিখে বহু বহু বছর নরক-যন্ত্রণা নির্দিষ্ট হল। তত তোমার আয়ু যদি ষাট, সত্তর কি আশি হয়, তাহলে তো আর এই মানবদেহে শতবর্ষের শাস্তি-যন্ত্রণা ভোগ করা সম্ভব নয়। তাই নরক-ভোগ করার জন্যও স্বতন্ত্র দেহ চাই। দেহ যেমন চাই, তেমনই নরক নামে আলাদা কোনও জায়গাও আছে, তার প্রমাণ-কঠোপনিষদে যম-নচিকেতার কথোপকথনের জায়গাটা, অথবা ঋগবেদে বর্ণিত–বৈবস্বতং সংগমনং জনানাং/যমং রাজানমিহ তৰ্পয়ধ্ব–এই রকম একটা জায়গা।

বেদান্ত-দর্শনের পণ্ডিত যাঁরা, তাদের কাছে স্বর্গের যে ঠিকানা পেলাম, তা অবশ্যই পৃথিবীর বাইরে অবস্থিত বায়ুমণ্ডলের ওপরে কোনও জায়গা। আমাদের এই পৃথিবীতে নূতন দেহধারী নানা জীবকুলে আকীর্ণ এমন একটা জায়গা খুঁজে বার করা মুশকিল। বরং এ ব্যাপারে আমাদের পূর্ব-মীমাংসা দর্শনের আচার্যরা অনেক বেশি বাস্তব জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন। ওঁরা বলেন, স্বর্গ বলতে আলাদা কোনও জায়গা, অথবা বিশেষ কোনও লোক বোঝায় না। স্বর্গ মানেই সুখ অথবা প্রীতি। এমন সুখ, যার মধ্যে দুঃখের স্পর্শমাত্র নেই এবং নিজের ইচ্ছামতো যেখানে সুখের বস্তু লাভ করা যায়–সেটাই স্বর্গ। তাহলে কি স্বর্গ বলে আলাদা কোনও জায়গা নেই? দুঃখস্পর্শহীন সুখই কি তাহলে স্বর্গকিং লোকবিশেষঃ স্বর্গঃ? উত সুখমাত্রম্?

পণ্ডিতেরা বলেন–মীমাংসক আচার্যদের চিন্তাভাবনা ভাল করে বিচার করলে দেখা যাবে–স্বর্গ বা নরকের জন্য আলাদা কোনও জায়গা স্বীকার করার কোনও প্রয়োজনই নেই। বিবরণ-জামেয়সংগ্রহ নামের একখানি গ্রন্থে বেদান্তীরা মীমাংসকদের মত উল্লেখ করে বলেছেন–ওঁদের মতে স্বৰ্গই বল আর নরকই বল–সে সবই এইখানে, এই মাটির পৃথিবীর ভোগসুখের মধ্যেইহৈব নরকস্বর্গাবিতি মাতঃ প্রচক্ষতে। জানি না, এই শ্লোক থেকেই ছোটবেলায় সেই কবিতা তৈরি হয়েছিল কি না–কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর? মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক… ইত্যাদি ইত্যাদি। ওঁদের মতে–মানুষ যদি মনে সুখ পায়, তাহলে স্বর্গ সেইখানেই। আর যদি সুখের বদলে যন্ত্রণাটাই প্রবল আকারে মনকে আচ্ছন্ন করে, তবে নরক-যন্ত্রণা সেইটাই-মনঃপ্রীতিকরঃ স্বর্গো নরক-স্ত-বিপর্যয়ঃ।

মীমাংসকদের কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন–অখণ্ড এবং নিরবচ্ছিন্ন সুখ অনুভব করার জন্য এমন একটা জায়গা চাই যেখানে শীত-উষ্ণ, এসবের দ্বন্দ নেই–যা প্রীতিঃ নিরতিশয়া অনুভবিতব্য, সা চ উষ্ণ-শীতাদি-দ্বন্দ-রহিতে দেশে শক্যা অনুভবিতু। আর আমাদের এই দেশটা এমনই যেখানে জীবনের একটা মুহূর্তও বুঝি কাটে না যেখানে এই দ্বন্দ্ব নেই–অস্মিংশ্চ দেশে মুহূর্তশতভাগো’পি দ্বন্দে ন মুচ্যতে।

 বুঝেছি, বেশ ঝামেলার কথা বলে ফেলেছি আমি। আসলে ‘দ্বন্দ’ শব্দের দ্বন্দটা ঘুচলেই সব দ্বন্দ্ব মিটে যাবে। এই যে দার্শনিক বললেন–”শীত উষ্ণ এসবের দ্বন্দ্ব’–এই দ্বন্দ্ব মানে জোড়া, আর এই জোড়াটা শুধু শীত-উষ্ণ বা ঠাণ্ডা গরমের নয়, দুঃখ-সুখ, লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয়এই সবই দ্বন্দ্ব। ভগবদ্গীতায় দেখবেন–প্রথম দিকেই কৃষ্ণ বলেছেন–বাপু! নিদ্বন্দ্ব হতে হবে, দ্বন্দাতীত হতে হবে—শীতোষ্ণ-সুখদুঃখেষু লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ। মীমাংসক সেই কথাটাই বলেছেন অন্যভাবে, দুঃখ করে–জগতে এমন একটা জায়গা নেই, যেখানে এক মুহূর্তও দ্বন্দহীন নিরবচ্ছিন্ন সুখে কাটবে। অতএব নিরবচ্ছিন্ন সুখের জন্য একটা আলাদা জায়গা থাকবেই, আর সেটাই দেবলোক, মানে স্বর্গ।

মুশকিল হল–যে দার্শনিক-মীমাংসক এই মত ব্যক্ত করেছেন, তিনি এমনই বড় মানুষ যে তাকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না মোটেই। আর ঠিক সেই জন্যই আর এক মীমাংসক-ধুরন্ধর দুদিক বাঁচিয়ে বললেন–শ্রুতি-স্মৃতি, ইতিহাস-পুরাণে স্বর্গ শব্দের দ্বারা যে অখণ্ড সুখের কথা বোঝানো হয়, সেই সুখ মর্ত্যলোকে সম্ভব নয়-এমন কথা বলে যদি স্বর্গভূমির মতো সুখের উপযোগী তেমন কোনও বিশেষ স্থান কল্পনাও করে নেওয়া যায়, তবুও কিন্তু এটা অপ্রমাণ হয় না যে–নিরতিশয় সুখই আসলে স্বর্গ। অর্থাৎ মীমাংসক মতে স্বর্গ বলে একটা নির্দিষ্ট সুখ-স্থানের কল্পনা করার প্রয়োজন কিছু নেই, সুখ কিংবা প্রীতিই স্বর্গ বলে মীমাংসকদের সাধারণ সিদ্ধান্ত।

আমরা যে পথে স্বর্গের ঠিকানা দেখাতে চাইছি, তাতে মীমাংসকদের বলা–মনের প্রীতিকর স্থানই স্বর্গ এবং সেটা এই পৃথিবীতেই–অত্রৈব নরক-স্বর্গেী–এই কথাটা আমার কাছে বড়ই জরুরি। তবে এই কল্পনার সুখস্থানের সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট জায়গাও পুরাণ-ইতিহাসের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায় কি না সেটাই এখন দেখবার। পরলোক দেব-দেহ লাভ করে স্বর্গসুখ ভোগ করার কথাটা নাই বা মিলল, কিন্তু হিন্দুস্থান-পাকিস্তানের মতো দেবস্থান বা স্বর্গ বলে এই পৃথিবীতেই কিছু ছিল কি না, সেটা পুরাণকারদের বর্ণনার আনুকুল্য থেকে বোঝাও যেতে পারে হয়তো।

মনে রাখতে হবে-মানুষের যেমন ঘরবাড়ি আছে, দেবতাদেরও তেমনই ঘরবাড়ি আছে। তবে হ্যাঁ, দেবতা বলে কথা, তাদের ঘরবাড়ি কি আর সাধারণ খড়ের চালায় কুঁড়ে-ঘরের মতো হবে? বরং ইন্দ্রাদি দেবতার বাসস্থান প্রাচীন কালের রাজা-মহারাজাদের রাজবাড়ির সঙ্গে খানিকটা তুলনীয় সুতে পারে।

স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র যেখানে থাকেন, সেই সুবিশাল জায়গাটার নাম অমরাবতী-স্বর্গের মধ্যে আরেক স্বর্গ। সেই অমরাবতীর মধ্যে আবার যে প্রাসাদ তার নাম বৈজয়ন্ত প্রাসাদ। তার একপাশে আছে নন্দনকানন, যেখানে পারিজাত ফুলের সমারোহ। সেই প্রাসাদের মধ্যে ইন্দ্র-সভার বর্ণনা খোদ মহাভারতেই পাওয়া যাবে, যদিও সে বর্ণনা কোনও কল্পিত স্বর্গের ছবি নয়, তার মধ্যে বাস্তবতাও আছে যথেষ্ট।

 ইন্দ্রসভার স্থপতি স্বয়ং বিশ্বকর্মা। অনেক জায়গা নিয়ে যে এই সভা তৈরি হয়েছে, কিংবা এটির চূড়া যে হবে খুব উঁচু, সেটা খুব বড় কথা নয়। বড় কথা হল–সভার দুপাশে অনেক ঘর এবং সভায় আসন আছে প্রচুর–বেশ্যাসনবতী রম্যা। এই সভার সু-উচ্চ আসনে ইন্দ্রের পাশে যে ইন্দ্রাণী শচী বসে থাকবেন, সেটা কিন্তু বড় কথা নয়। বড় কথা হল–এই সভার সভাসদদের মধ্যে আমরা সেইসব মানুষ, মুনি-ঋষিদের দেখছি, মর্ত্যলোকে যাদের সব সময় দেখি। পরাশর, পর্বত, দুর্বাসা, যাজ্ঞবল্ক্য–এ রকম বিশিষ্ট মুনির নাম দিয়েই মহাভারতের কবি ইন্দ্রসভার অধ্যায় প্রায় শেষ করে দিয়েছেন। মাঝখানে ক্ষণিকের অতিথির মতো কতগুলি অপ্সরা-গন্ধর্ব আর গায়েন কিন্নরদের কথা এসেছে এবং তা এসেছে নিতান্তই গৌণভাবে। মর্ত্য মুনি-ঋষিদের নামগুলি যেখানে সংখ্যায় এবং ভাস্বরতায় এতই বেশি উজ্জ্বল যে মহাভারতের কবির আশয়টা বেশ খায়। বোঝা যায়, তিনি কোনও অতিলৌকিক বর্ণনা করছেন না, ইন্দ্রসভার মাহাত্মে দিব্যভাব থাকতে পারে, কিন্তু মর্ত্যর মানুষের সঙ্গে তার বেশ যোগ আছে।

 ইন্দ্রসভার পর মহাভারতে যম-সভ্যর বর্ণনা এবং তার বৈশিষ্ট্য হল প্রখ্যাতকীর্তি মর্তের রাজারা, যারা মৃত্যুর পর যম-সভার সদস্য হয়েছেন। যম যেহেতু মৃত্যুলোকের অধিপতি, অতএব তার রূপ-কল্পনা হয়েছে সেইভাবেই; কিন্তু মনুষ্যলোকের বেশিরভাগ রাজাদেরই সেই সভায় দেখতে পাচ্ছি বলে এটাকেও আমি অতিলোক বলে কিছু ভাবছি না। যম-সভার পরেই বরুণ-সভা এবং সবকিছু ছাপিয়ে এই সভার বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে নদী-নামের মধ্যে। সিন্ধু, কাবেরী, গঙ্গা-সরস্বতীই শুধু নয়, ভারতের তাবৎ চেনা নদীগুলিকে যদি বরুণ-সভায় হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন–এমন দেখতে পাই, তবে আমি অন্তত সে সভাকে পৃথিবীর বাইরে কোনও স্থান বলে মানতে রাজি নই।

এরপর আছে কুবের সভা। ধনেশ্বর কুবেরের বাসস্থান কল্পনা করা হয় হিমালয়ে, কৈলাস পর্বতের পাশে। শিব তার সখা। শিবের জটালগ্ন চন্দ্র-শকলের জ্যোৎস্না-ছায়া পড়ে তার গৃহের প্রাঙ্গণে। কুবের-সভার বৈশিষ্ট্য হল সেখানকার লোকগুলি। সমভূমির মানুষের মতো তাদের চেহারা নয়। কবি তাদের যক্ষ বলেছেন, রাক্ষস বলেছেন–বলুন। কিন্তু ওই নামগুলি! হেমনেত্রঃ–যদি বলি কটা চোখ! পিঙ্গলকঃ–যদি বলি হলদেটে লালচে গায়ের রঙ। শোনিতোদঃ প্রবালকঃ-যাঁদের গায়ের রঙ কিছু লালচে। পাহাড়ি এলাকার লোক, অতএব মহাভারতের বর্ণনায়–শকর্ণ-মুখাঃ সর্বে। কান, মুখ সব পেরেকের মতো। উপমাটা পেরেকের চেহারায় নয়; সমভূমির মানুষের মতো নয় বলেই এই উপমা।

কিন্তু যক্ষনামের মধ্যে–বৃক্ষবাসী, অনিকেতঃ চীরবাসা–এগুলো কি কোনও নাম? নাকি ধনেশ্বর কুবেরের পার্ষদ হয়েও পাহাড়িয়াদের দৈন্যদশা ফুটে উঠেছে এখানে–গাছের কোটরে থাকে, বাড়ি-ঘর ভাল করে বানাতে পারে না এবং গাছের বাকল পরে। পাহাড়ে চলতে হয় বলেই এদের হাত-পা চলে তাড়াতাড়ি, নিরলস-বাতৈরিব মহাজবৈঃ। আবার আবহাওয়ার কারণে শরীর গরম রাখতে হয় বলেই কুবের-পার্ষদের উপাধি জুটেছে–ক্রব্যাদ, পিশাচ, রাক্ষস এবং এরা ভীষণ রকমের মাংসাশী–মেদোমাংসাশনৈরুগ্রৈঃ উগ্ৰধৰা মহাবল। বস্তুত আমি কুবেরের সভাতেও কোনও অলৌকিকতা দেখিনি। তার ওপরে হিমালয়, পারিযাত্র, বিন্ধ্য, মহেন্দ্র আর কৈলাস পর্বত-যেখানে কুবেরের উপাসনা করছে, সেই কুবের-সভা আমার কাছে খুব অপরিচিত নয়, অতিলৌকিক তো নয়ই।

সবার শেষে নারদের মুখে ব্রহ্ম-সভার বর্ণনা। সমস্ত দেবতা, রাক্ষস, গন্ধর্ব, কিন্নর পিতামহ ব্রহ্মার সভায় গতায়াত করছেন–সেটা আমার কাছে বড় কথা নয়। বড় কথা–সেই চেনা-পরিচিত ঋষি মুনি আর নারদের শেষ কথাটি। নারদ যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, তেমন সুন্দরসভা আমি কোথাও দেখিনি। লোক-দুর্লভ সেই সভা। কিন্তু একটাই তার উপমা আছে। এই তোমার সভাটি যেমন, ঠিক তেমনই সেই ব্ৰহ্ম-সভা-সভেয়ং রাজশার্দুল মনুষ্যেষু যথা তব। এই শেষ কথার পর ধরে নিতে পারি ব্রহ্মা, ইন্দ্র, যম, বরুণ–যিনি যত বড় দেবতাই হোন না কেন, তাদের বাড়ি-ঘর রাজসভা সব মানুষের আদলেই তৈরি হয়েছে, কারণ মহারাজ যুধিষ্ঠিরের সভাটিই একেবারে ব্রহ্মসভার মতো–মনুষ্যেষু যথা তব।

.

১৩.

রাগ করবেন অনেকেই। এমন কি রাগ করার সঙ্গত কারণও আছে। এতদিন বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে রয়েছি-ইন্দ্র, যম, বরুণ, ব্রহ্ম–এত বড় বড় সব দেবতা। আর তাদের বাড়ি-ঘর নাকি সব আমাদের মতো। এসব অলক্ষুণে কথা বললে কার না রাগ হয়? রেগে গিয়ে বলতেই পারেন–এতক্ষণ বাড়িঘর দেখালে, এবার বলবে-দেবতাদের চেহারাও বুঝি বা আমাদের মতোই।

 বলব, হয়তো এই কথাই বলব। কিন্তু আপনারা যে সব গ্রন্থ বা সাহিত্যকে শাস্ত্রের মূল্য দিয়ে থাকেন, তার প্রমাণ দিয়েই বলব। তবে কিনা রাগ আপনাদের হতেই পারে। আজকেই তো নয় শুধু, ব্যাস, বাল্মীকি আর যত পৌরাণিকের দল তাদেরও তো দেবতাদের ওপর শ্রদ্ধা-ভক্তি কিছু কম ছিল না, কিন্তু হাজার শ্রদ্ধা নিয়েও তারা দেবতাদের চেহারা, চরিত্র, ছলনা এমন কি চরিত্রহীনতাও যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তা কি কোনওভাবেই মনুষ্য-চরিত্রের বাইরে? আপনারা দেবতাদের করুণায় বিশ্বাস করবেন, তাদের অঘটনঘটনপটীয়সী শক্তিতে বিশ্বাস করবেন, তাদের ভক্তবশ্যতা স্বীকার করবেন–অথচ তাদের মনুষ্যোচিত চেহারা, ভাব-ভঙ্গি অথবা অন্য কোনও রসাবেশ স্বীকার করবেন না–এ কেমন একগুয়ে কথা!

 তবে ব্যাস-বাল্মীকির ভাগ্য ভাল, তারা এ দেশে জন্মেছেন। আরও ভাগ্য কেন না, হিন্দুধর্মের মতো এক বিরাট-বিশাল সর্বংসহ ধর্মের তারা প্রাণদাতা। আমাদের দেশে ব্যাস-বাল্মীকির প্রামাণ্য এবং শ্রদ্ধেয়তা এতই বেশি যে, যারা তাদের ধর্ম বা ঈশ্বরানুসন্ধান মানেন না, তারাও কিন্তু এই দুই মহাপুরুষকে সমালোচনার আগে এবং পরে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারেন না। আমার ধারণা, এই দুই ঋষি যদি পৃথিবীর মধ্য-মরুভূমিতে জন্মাতেন, তবে তারা জীবৎকালেই মহাভারতের আদিপর্ব এবং রামায়ণের বালকাণ্ড লিখেই অকালে যমদণ্ড লাভ করতেন। আর যদি অন্য দুটি প্রাচীন দেশ গ্রিস কিংবা রোমে এঁদের জন্ম হত, তবে একেবারে প্রাণে না মারা পড়লেও এঁদের চড়-চাপাটি খেতে হত নির্ঘাত।

যদি বলেন–কী হলে কী হতে পারত–এসব কথা আমার প্রথমোক্ত দেশ সম্বন্ধে অনালোচ্য, তো ঠিক আছে, সেটা আলোচনার বাইরে থাকাই শ্রেয়। কারণ অনুমানযোগ্য। কিন্তু গ্রিস-দেশীয়দের সম্বন্ধে আমার অনুমান আমি ব্যাখ্যা করতে পারি। এসব কথা আমি অন্যত্র কিছু লিখেছি, কিন্তু পাঠকের একাংশ আমাকে সাভিমানে অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন–কোথায় কী লিখেছেন মশায়! ওসব রেফারেন্স জানতে চাই না, পাঠক হিসেবে আমরা কী এইটুকু একসঙ্গে পেতে পারি না? অতএব আমি নাচার।

 তাছাড়া গ্রিস-দেশীয় সেই দার্শনিকের কথা আমায় আরও একবার তুলতেই হত, কারণ তার রাগও ঠিক আপনাদের মতোই। অর্থাৎ আপনাদের রাগ যে কারণে, তারও রাগ সেই কারণেই। পৃথিবীর অনবদ্য আরেক মহাকাব্য ইলিয়াড-ওডিসির নাম আপনাদের জানাই আছে। সেই মহাকাব্যের লেখক হোমার যেহেতু দেবতাদের চেহারা, চরিত্র, চরিত্রহীনতা, মহত্ত্ব, দাক্ষিণ্য এবং করুণা–সবই বর্ণনা করেছেন; অতএব দার্শনিকেরা অনেকেই তার ওপরে ক্ষিপ্ত হয়েছেন। গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন–ওসব বকানি, মকানি তাও কবিত্বের ভাব-মাখা; হোমার যা করেছেন, তার একমাত্র শান্তি তাকে বেতিয়ে সোজা করা। আর শুধু হোমারই নয়, তার ভাব-শিষ্য আর্চিলোকাসকেও ধরে বেত মারা উচিৎ–Homer should be whipped and Archilochus likewise.

 সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের দেশে যাঁরা পরম উপাস্য তত্ত্বকে কোনও সাকার সবিশেষ বাঁধনে বাঁধতে চান না, তারা পর্যন্ত কেউ ব্যাসদেবকে বেতিয়ে সোজা করার কথা বলেননি। এমন কি দার্শনিক স্থিতিতে যারা নিতান্ত বিরুদ্ধবাদী, তেমন বৌদ্ধ দার্শনিকেরা পর্যন্ত মহাভারতের কবিকে এমন হেনস্থা করেননি। আর যদি শঙ্করাচার্যের মতো অদ্বৈতবাদী। তার্কিক-ধুরন্ধরকে প্রশ্ন করেন, তবে তিনি হয়তো সেই পরম তত্ত্বকে নিরাকার, নির্বিশেষ, নির্গুণ বলে প্রায় বৌদ্ধদের শূন্যের পর্যায়ে ফেলে দেবেন, কিন্তু কদাপি ব্যাস-বাদবায়ণকে পেটানোর প্রস্তাব দেবেন না। নিন্দুকেরা বলে-শঙ্কর নাকি একদিকে ব্রহ্মকে নিরাকার নির্বিশেষ বলেছেন, আর আমজনতার সুখের জন্য ব্রহ্মের রূপ-কল্পনা করে লুকিয়ে লুকিয়ে হরি-হর-ভবানীর অপূর্ব স্তোত্র রচনা করেছেন। অধিকতর পণ্ডিতেরা অবশ্য বলেন–শারীরিক ভাষ্যকার শঙ্কর এক লোক, আর স্তোত্রকার শঙ্কর আরেক লোক। এসব অবশ্য সেই প্রক্ষিপ্তবাদীদের জ্ঞান-প্রপঞ্চ, যাঁদের পড়তে হয়েছে অনেক, কিন্তু বুঝতে হয়েছে কম।

যাক এসব কথা, আমাদের দেশের ঠাকুর-দেবতার হাত-পা না থাকলে চলে না, ভাল করে মিষ্টি করে ডাকলে, তাদের বৈকুণ্ঠ কি স্বর্গ থেকে পড়িমরি করে ছুটে আসতে হয়। আর ভাব-ভালবাসার ক্ষেত্রে তো তাকে আমার যত প্রয়োজন, আমাকেও তার ঠিক ততটাই প্রয়োজন। পঙ্কজ মল্লিকের সানুনাসিক অনবদ্য কণ্ঠ প্রসঙ্গত স্মরণীয়–তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে, তুমি তাই এসেছ নীচে ইত্যাদি। আমাদের দেশে চরম সাধনা করে কেউ যদি ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিয়ে যাবার বর লাভ করেন, অথবা কেউ যদি ঈশ্বরের সমান আকৃতি লাভ করার বর লাভ করেন, তাহলে সেই বর অনেকে নিতে চান না, তা জানেন? তারা বলেন, ধুচ্ছাই, মুক্তি দিয়ে আমি কী করব, ঠাকুরের সঙ্গে মিশে গিয়ে কী আনন্দটা হবে আমার?

মা গো! নির্বাণে কি আছে ফল,
জলেতে মিশায়ে জল,
 চিনি হওয়া ভাল নয় মন,
তিনি খেতে ভালবাসি।

 আমাদের ঠাকুর-দেবতা হলেন চিনি। স্পষ্ট গোটা গোটা পরিষ্কার চেহারা, রূপ আছে, রঙ আছে, স্বাদ আছে। হাত-পা-ওয়ালা রূপী, গুণী, রসিক ঠাকুর চাই আমাদের। ঘরের মধ্যে যোগে বসে জ্যোতিঃস্বরূপকে জেনে যাঁরা মুক্তি লাভ করছেন, করুন,-কিন্তু সে মুক্তি রামপ্রসাদ চান না–দেখলেনই তো। আবার বৈষ্ণবদের কথা বলুন, তারা আরও কড়া। চৈতন্যপীরা হেসে বলেন, আমাদের ঠাকুর আমাদের যদি সেধেও মুক্তির বর-দান করেন, তবে আমরা নিই না, আমরা ওই ধরনের বর সাধারণত প্রত্যাখ্যান করে থাকি। স্বয়ং ভগবানও এটা জানেন, তাই তিনি নাকি নিজেই ভাগবত পুরাণে কবুল করেছেন যে–ওদের মুক্তি দিতে চাইলেও ওরা নেবে না, কী সাংঘাতিক! ওরা খালি আমাকে চায়। আমাকে দেখতে চায়, আমাকে কাছে পেতে চায়, আর কাজ-কর্ম করে দিতে চায়–দীয়মানং ন গৃহৃত্তি বিনা মৎসেবনং জনাঃ।

শাক্ত গেল, বৈষ্ণব গেল, এবার শৈবের কথা শুনবেন? তাহলে একটা শ্লোক বলতে গিয়ে আমাকে রীতিমতো একটা ছোট্ট গল্প বলতে হবে–শ্লোকের গল্প। এই শ্লোকটি আছে মোটামুটি কঠিন একটি সংস্কৃত অলংকার গ্রন্থে। কাশ্মীরের প্রসিদ্ধ আলংকারিক মম্মটাচার্য তার কাব্যপ্রকাশের মধ্যে একটি অলংকারের উদাহরণ দিতে গিয়ে এক শৈব-ভক্তের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। শ্লোকটি বলার আগে জানাই–এই শিব-ভক্ত সাধুটি স্বাভাবিক কারণেই রুদ্রাক্ষমালা পরেন গলায়। গায়ে ভস্ম মাখেন, আর তার আরাধ্য দেবতা শিব যে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত, সেই শিব-মন্দিরের সিঁড়িগুলি তিনি সযত্নে মুছে দেন প্রতিদিন।

 কিন্তু একদিন সব গণ্ডগোল হয়ে গেল। আশুতোষ শিব তার ভক্তের সেবা-পরিচর্যায় তুষ্ট হয়ে তাকে মুক্তির-বর দান করে বসলেন। শিব সোজা-সরল ভোলেভালা মানুষ, তিনি জানেন-মোকের জন্যই লোকে এত সাধ্যি-সাধনা, উপাসনা করে। অতএব ভক্তটিকে তিনি কোনও প্রশ্ন-ট্রশ্ন না করে লোক-দুর্লভ মুক্তির বর দিয়ে পূর্বাহ্নেই আপ্লুত করে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু এ ভক্তটি সে-রকম নয়। মোক্ষ-লাভ করে সে পরমানন্দে ‘শিবোহং শিবো’হং’ করে মোটেই জলদ-গম্ভীর স্বরে কথা কয়ে উঠল না। উলটে সে একটু রেগেই গেল। যদিও পরমারাধ্য দেবতা তাকে বর দিয়েছেন এবং বরও লৌকিক দৃষ্টিতে বড় সুলভ নয়, অতএব ঠার ক্রোধ এবং ক্ষোভ অভিমানে পরিণত হল।

দেখা গেল–এক জায়গায় দাঁড়িয়ে তার পূর্ব-পরিচিত উপাসনার সাধনগুলির সঙ্গে সে সাভিমানে কথা বলতে আরম্ভ করেছে। গলার রুদ্রাক্ষ মালাটি–যা তাকে এতকাল শিব-সাধনার প্রেরণা জাগিয়েছে, সেই মালাটি সে খুলে ফেলেছে গলা থেকে। গায়ের যে ভস্মরাগ, সর্বাঙ্গে যে বিভূতি তাকে এতকাল বৈরাগ্যের অনুভূতি দিয়েছে, সেই অতি-পরিচিত অচেতন পদার্থটিকে সে বিদায় জানিয়ে বলে–ছাইভস্ম আমার! এতকাল কত ভক্তিতে প্রতিদিন তোমাকে গায়ে মেখেছি বৈরাগ্যের সাধন হিসেবে। কাল থেকে আর তোমার প্রয়োজন থাকবে না, বিদায় তোমাকে, চিরবিদায়। তোমার ভাল হোক। ভাই রুদ্রাক্ষ-মালা! এতকাল শিব-মন্ত্র জপ করার সময় কত শক্তি জুগিয়েছ তুমি, রুদ্রাক্ষ-মালা ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই যেন শিবের উদ্ভাস জেগে উঠত মনে–বিদায় ভাই, আর তোমার কোনও প্রয়োজন নেই আমার কাছে। তোমার মঙ্গল হোক। আমি মোক্ষলাভ করেছি–ভস্ম, মালা–এসব এখন মূল্যহীন, বৃথা। ভম্মোচূলন ভদ্রমস্তু ভবতে রুদ্রাক্ষমালে শুভ।

 সবার শেষে শিবমন্দিরের শুভ্র-শীতল সোপানগুলি দেখে এই ভক্তের প্রাণ একেবারে কেঁদে উঠল। মনের গভীর থেকে তার আর্তি বেরিয়ে এল–হা সোপান-পরম্পরাং গিরি কান্তালয়ালংকৃতি। কী রকম সে সোপান–যা নাকি হিমালয়-দুহিতা পার্বতীর ভালবাসার ধন যে শিব, তার বাস-গৃহের অলংকারের মতো। হায় সেই সোপানাবলি! বিদায়, আর সেই শিব-মন্দিরের সোপানগুলিকে পরিমার্জনা করার কোনও দায়ই রইল না আমার।

যদি সেই ভস্ম, সেই সোপান-পংক্তি আর রুদ্রাক্ষমালা একযোগে প্রশ্ন করে বলে-কেন বাপু! আজ থেকে তোমার এই নির্বিকার ভাব কেন? শিবভক্ত শৈব তাতে রেগে যায়, ক্ষোভে সে বলে–এই দেখ না। প্রভু কত খুশি হয়েছেন আমার আরাধনায়, উপাসনায়। তিনি বড় সুখী হয়ে আমাকে মোলাভের বর দিয়েছেন। কী রকম সে মোক্ষ? শৈব বলে–অন্যের কাছে তা। যত বড়ই হোক আমার কাছে তা এক মহা অন্ধকারের নামান্তর। আরও এক মহামোহের প্রতিরূপ? আরও এক বিপন্ন বিস্ময়। কেন কেন? এমন বলছ কেন? মোক্ষকে কেউ কী অন্ধকার বলে? শৈব এবার আপন দুঃখের কথাটা বলে–হায়! যে শিবের সেবা করার জন্য আমি গায়ে ভস্ম মাখতাম, রুদ্রাক্ষ-মালা পরতাম, প্রতিদিন সযতনে মুছে দিতাম শ্বেত-শুভ্র মন্দিরের সোপান-পংক্তি, সেই তোমার সেবা করার আনন্দটুকু যে ছিন্নভিন্ন করে দিল এই মোক্ষের অন্ধকার–আমি এমনটি চাইনি। তুষ্ট হয়ে এ তুমি আমায় কী দিলে প্রভু যুৎ-সপৰ্যাসুখাল/লোকচ্ছেদিনি মোক্ষনামণি মহামোহে নিধীয়ামহে। এই শিবভক্তটি কী চায়, তা শুধু একটি পংক্তির ব্যঞ্জনায় এই কবিতার মধ্যে ফুটে উঠেছে। সোপানপংক্তির বর্ণনায় সে বলেছিল—গিরিসুকান্তালয়ালংকৃতিম–শৈলদুহিতা পার্বতীর ভালবাসার ধন যে শিব তার মন্দির সোপান। অর্থাৎ এই শৈব শিব-পার্বতী ভালবাসাটা বোঝে। সে এই ভালবাসা না চাইলেও শিবের ভৃত্য হওয়ার সুখটুকু চায়। মোক্ষ-লাভে সেই শিব-পরিচর্যা-সুখের সমস্ত সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় শিবভক্ত এখন ক্ষুব্ধ, বিরক্ত।

বৈষ্ণবদের কথা স্বল্পমাত্র বলেই আমি শেষ করছি, বস্তুত রসিক শেখর কৃষ্ণের নিত্যসেবার। সুখ আর লীলা-মাধুর্য আস্বাদন করার জন্য বৈষ্ণবদের যে আকুতি আছে, তার বিবরণ দিতে গেলে মহাভারত-কথার অর্ধেকই তাতে চলে যাবে। বরং শাক্ত-শৈব-বৈষ্ণবের উদাহরণ দিয়ে যেটা বোঝাতে চাইলাম, সেটা হল–সাধারণ দেবতার কথা ছেড়েই দিলাম, সাক্ষাৎ পরমেশ্বরের ক্ষেত্রেও মনুষ্যোচিত হাব-ভাব, রসবত্তা আমাদের প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করে। আমাদের দেশে সর্বশক্তিমান দেবতাপুরুষেরও জন্ম আছে, শৈশব, যৌবন, বার্ধক্য এমন কি মৃত্যুও আছে এবং এই মনুষ্যোচিত রূপকার কিন্তু ব্যাস-বাল্মীকি এবং পৌরাণিকেরাই।

উপনিষদের মধ্যে যে অনাদি অনন্ত পরব্রহ্মের স্বরূপ আমরা জেনেছি, তাঁকে স্বরূপত সেই রকম জেনেও যে কোনও মুহূর্তে তাকে আমার রামচন্দ্র, কৃষ্ণ, শিব কিংবা উমা হৈমবতীর সাকার রূপ দিতে আমাদের অসুবিধে হয়নি এবং তাদের জন্ম-মরণের কল্পনা করতেও আমাদের হৃদয় কম্পিত হয়নি। তার কারণ, আমরা যতখানি দার্শনিক, তার চেয়েও বেশি ভাবুক-রসিক। রসবত্তা আর দার্শনিকতা একই হৃদয়ে থাকার ফলেই বেদব্যাস কিংবা বামীকিকে আমাদের অতি সূক্ষ্মদশী দার্শনিকেরাও কেউ চাবুক মারার সাহস দেখাননি। আবার অন্যদিকে মহাকাব্যের কবিকেও দার্শনিকদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলতে হয়নি-বাপু হে! তোমরা যা করছ, এ শুধুই তর্ক, শুধুই যুক্তি, হৃদয়ের কাছে এর কোনও আবেদন নেই। বলতে হয়নি এসব কথা। আর বলতে হবেই বা কেন? আমাদের কবিরা মূলত দার্শনিক, আবার দার্শনিকেরাও মূলত কবি। এই পারস্পরিক পরিপূরণ এমনি-এমনিই তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এবং তার কারণ, আমাদের চরম সূক্ষ্ম যে ব্রহ্মতত্ত্ব–তিনি একদিকে অদ্বৈত এবং বিজ্ঞানস্বরূপ অন্যদিকে তিনি রসস্বরূপ এবং আনন্দস্বরূপ। একদিকে তাকে বলতে হয়-অশব্দম্ অস্পর্শ অরূপ অব্যয়’অন্যদিকে তাকে বলতে হয়-”এষ আত্মা সর্বগন্ধঃ সৰ্বরসঃ’ ইত্যাদি। এ দেশে একদিকে আপনারা যেমন শঙ্করের মতো সূক্ষ্মদর্শী দার্শনিকের মুখে হরিহর-ভবানীর স্তোত্র শুনবেন, অন্যদিকে দেবতার গল্প-বলা বেদব্যাসের মুখে অদ্ভুত এক কবিতা শুনবেন।

কবিতাটা মহাভারতে নেই, তবে বেদব্যাসের নামেই এ কবিতা চলে, যেমন চলে শঙ্করাচার্যের মুখে হরিহর-ভবানীর স্তোত্র। ব্যাস বলছেন, ক্ষমা কোরো প্রভু! ক্ষমা কোরো আমাকে। আমি তিনটে বড় দোষের কাজ করে ফেলেছি, প্রভু! তুমি আমায় ক্ষমা করে দিয়ে–ক্ষন্তব্যং জগদীশ ত-বিকলতা-দোষত্ৰয়ং মক্তৃতম্। মুনি-কুলের তিলক বেদব্যাস, তিনি কী দোষ করেছেন এমন, যার জন্য শেষ জীবনে এসে ক্ষমা চাইতে হচ্ছে তাকে? ব্যাস বলছেন, দোষ করেছি তিনটে। প্রথম দোষ-তুমি নীরূপ, নিরাকার। মানুষের আপন সৃষ্ট কোনও রূপের মধ্যে তোমাকে সীমাবদ্ধ করা যায় না। কিন্তু তবু আমি ধ্যানযোগে সেই অনন্ত-রূপ-নীরূপ ঈশ্বরের রূপ-কল্পনা করেছি–রূপং রূপবিবর্জিতস্য ভবতঃ ধ্যানেন যৎ কল্পিত। আমার দ্বিতীয় দোষ-তুমি সর্বব্যাপী, বিভূ। কিন্তু  নানা তীর্থস্থানের মধ্যে তুমি জাগ্রত আছ–এই রকম তীর্থ-মাহাত্ম্য কল্পনা করে আমি তোমার সেই বিভূত্ব, ব্যাপি নষ্ট করে দিয়েছি। যিনি অগ্নিতে যিনি জলেতে যিনি তৃণ-তরুময় স্থলেতে, সেই বিশাল-ব্যাপ্ত সত্তাকে আমি সীমিত করে ফেলেছি কতগুলি তীর্থ স্থানের চতুঃসীমার মধ্যে। আর আমার শেষ এবং তৃতীয় দোষ-তুমি অনির্বচনীয়, অনির্দেশ্য-স্বরূপ। শব্দ-অর্থ-অলংকার, আর ভাষা ছন্দে তোমাকে প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু পরম ঈশ্বরের স্তব-স্তুতি রচনা করে শব্দের গৌরব-সীমায় তোমাকে যে আমি বেঁধে ফেলেছি, এতে তোমার অনির্বচনীয়তা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। আমার এই তিনটে দোষ তুমি ক্ষমা করে দিও, প্রভু।

দেখুন, অরূপ, অব্যয়, অসীম, অনির্দেশ্য ব্রহ্ম-স্বরূপকে কৃষ্ণের রূপে, শিবের রূপে, দুর্গার রূপে বেঁধে ফেলার জন্য পৌরাণিক ব্যাসকে যেমন ক্ষমা চাইতে হচ্ছে, তেমনই শঙ্করাচার্যেরও এমনই ক্ষমা চাওয়ার কথা–তিনি ওই একই কাজ জেনেশুনে করেছেন বলে। অথচ কার্যক্ষেত্রে ব্যাস এবং শঙ্কর পরস্পরের প্রতিপূরক। কারও সঙ্গে কোনও বিরোধই নেই। তবে ব্যাস যা করেছেন, বিভিন্ন পুরাণের মধ্যে কৃষ্ণ, শিব, দুর্গার জন্ম-মরণ পর্যন্ত দেখিয়ে তিনি যা করেছেন, তাতে অন্য কোনও দেশে জন্মালেও তার মহা-বিপদ হত।

প্রাক্-সক্রেটিস যুগের দার্শনিক জেনোফেনিস্ ছিলেন নিজের কালের মহান পণ্ডিত। ভগবানের সম্বন্ধে তার ধারণাটা প্রায় ঔপনিষদিক। ঈশ্বরের সম্বন্ধে তার অতি উচ্চ ধারণা ছিল এবং এই পৃথিবীর নানান সৃষ্টি-বিষয়ে ঈশ্বরের করুণা-স্পর্শ তাকে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করত। ঈশ্বরের প্রতি তার নির্ভরতা এতটাই যে, তিনি ভাবতেন-ভগবান যদি এই পৃথিবীতে মধু সৃষ্টি না করতেন, তাহলে লোকে ডুমুর গাছ কিংবা বটের ফলকেই অনেক বেশি মিষ্টি বলে ভাবত–If God had not made yellow honey, men would consider figs far sweeter. এ হেন জেনোফেনিস যখন দেখলেন– হোমার-হেসিয়ড অন্তরীক্ষ-লোকের দেবতাদের নানা কুকীর্তি, বঞ্চনা, ছলনার কথা লিখে মহাকাব্য রচনা করেছেন এবং সুধী-জনতা। সে লেখা পড়ে বিমলানন্দ লাভ করছেন, তখন তিনি আর থাকতে পারেননি। রাগে ক্ষোভে তিনি বলে উঠেছেন–এ কী অসভ্যতা? দেবতারা কি সব মানুষ নাকি? দেবতারা কি এতই ক্ষুদ্র-সত্ত্ব যে, মানুষের সমাজে যা লজ্জাকর এবং ঘৃণ্য–সেইসব চুরি-জোচ্চুরি, ধর্ষণ ইত্যাদি জঘন্য সব বৃত্তি দেবতাদের ওপর চাপিয়ে হোমার একটা মহাকাব্য লিখে ফেললেন। আর হেসিয়ড ‘থিওগনি’ লিখে খুব নাম কিনলেন?

 জেনোফেনিস্ হোমার-হেসিয়ডকে নিতান্ত মূর্থের পর্যায়ে নামিয়ে দিয়ে নাম না করে মন্তব্য করেছেন–সাধারণ লোকেরা ভাবে–দেবতাদের বুঝি জন্ম হয়, তারা বুঝি মানুষের মতোই জামা-কাপড় পরেন, অথবা দেবতার আকৃতি বা মুখের ভাব বুঝি মানুষের মতোই হবে। মানুষেরা কেন নিজেদের মতো করে দেব-কল্পনা করে তার একটা যুতসই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। জেনোফেনি। তিনি বলেছেন–এই যে ইথিওপিয়ানরা বলে–তাদের দেবতারা নাকি নাক-খাদা আর তাদের চেহারা নাকি কালো-কোলো, তার কারণ ওরা নিজেরাই নাক খাদা আর। কালো। আবার অন্যদিকে ব্রেসিয়ানরা যে বলে–তাদের দেবতাদের চক্ষু দুটি নাকি হালকা নীল আর চুলগুলি নাকি লাল–তার কারণ, ওদের নিজেদের চোখই নীল আর চুলগুলি লাল।

দুটি উদাহরণ দেওয়ার পর জেনোফেনি ব্যঙ্গ করে মন্তব্য করেছেন–তা ইথিওপিয়ান, আর ব্রেসিয়ানদের দোষ কী দেব? গোরুরা যদি আর্টিস্ট হত, আর মানুষ যা করে তা যদি গোরুরাও করতে পারত, তাহলে গোররা দেবতার ছবি আঁকত গোরর আদলেই। আর যদি ঘোড়া বা সিংহের মনুষ্যোচিত ক্ষমতা থাকত তাহলে ঘোড়ারা দেবতার ছবি আঁকত ঘোড়ার আদলে, আর সিংহেরা সিংহের আদলে—But if cattle and horses or lions had hands, or were able to draw with their hands and do the works that men can do, horses would draw the forms of the Gods like horses and cattle like cattle, and they would make their bodies such as they each had themselves.

আর বাকি কী রাখলেন জেনোফেনিস্? হোমার-হেসিয়ডকেও তিনি নিশ্চয় ওই গোরু-ঘোড়ার পর্যায়েই ফেলে দিয়েছেন। আমার ভয়–আমাদের ব্যাস-বাল্মীকি যদি এই গ্রিক-দেশীয় কঠিন মানুষটির হাতে পড়তেন, তা হলে তাদের কী বেগতিকই না হত! সে যাই হোক, জেনোফেনিস যত কড়া মন্তব্যই করুন, অন্তত দার্শনিক সূক্ষ্মতার ক্ষেত্রে আমাদের। সাংখ্য-বেদান্ত বৌদ্ধদের ধারেকাছে যে তিনি যেতে পারবেন না, সে কথা আমি হলফ করে বলতে পারি। এই হলফ-নামা করার পর আমার দায়িত্ব আছে যৎসামান্য। আমি ব্ৰহ্মা-পরমাত্মা-ভগবানের কঠিন তত্ত্বের মধ্যে আর একটুও যাব না এবং এই তত্ত্বকে কী চোখে আমরা দেখি তা আগেই সামান্য বলেছি। আমরা এখন শুধু ইন্দ্র-বায়ু ইত্যাদি দেবতা এবং অসুর-রাক্ষসদের সামাজিক স্থিতিটা সংক্ষেপে বলে দিয়েই জনমেজয়ের সভায় বসে মহাভারতের কথা শুনব। এ কথা আগেই বলব, কারণ পরবর্তী সময়ে সূর্য, ইন্দ্র, বায়ুর মতো। দেবতার ঔরস থেকেই আমরা পাণ্ডব-ধুরন্ধরদের জন্মলাভ করতে দেখব। আবার অসুর-রাক্ষসদের বিচারও একটু করব, কারণ আর্য-শক্তির গৌরবে ভীম-পুত্ৰ ঘটোৎকচের জম্মটাও আমাদের লক্ষ্য করতে হবে। অতএব আর সামান্যতম ধৈর্য ধরলেই–উপাখ্যান আর ইতিহাসে ডুবে যাব আমরা।

.

১৪.

মহাভারতের শান্তিপর্বে দেখা যাবে–দৈত্যরাজ বলির সঙ্গে ইন্দ্রের দেখা হয়েছে। অবশ্য দেখাটা খুব সহজে হয়নি, অনেক কাঠ-খড় পোড়ানোর পরেই দেবতাদের রাজার সঙ্গে দৈত্যদের রাজার এই একান্ত শান্ত সাক্ষাৎকার ঘটেছে। দেবাসুরের যুদ্ধ নেই, অশান্তি নেই, পরস্পর ধেয়ে যাওয়া নেই, একেবারে শান্ত সাক্ষাৎকার। তবে এই কথার আগে দুটো কথা আছে। প্রথমেই জানাই, আবারও মনে রাখবেন–ইন্দ্র’ নামের মধ্যে যতখানি দেবত্ব আছে, তার থেকে বেশি আছে ‘রাজত্ব। অর্থাৎ ইন্দ্র একটা উপাধি মাত্র। ইহলৌকিক এবং প্রাক্তন পুণ্যবলেই ইন্দ্র’ হওয়া যায়। অসুর-রাক্ষসও এই ইন্দ্র হতে পারেন, মানুষও হতে পারেন ইন্দ্র। তবে কিনা একবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলে তার যেমন আর নাম থাকে না, শুধু পি এম’ আসছেন, পি এম’ বলছেন–এই রকম একটা ব্যাপার ঘটে যায়, অপিচ প্রধানমন্ত্রিত্ব চলে গেলেও যেমন তার পুরনো তকমাটা যায় না, ইন্দ্রের ব্যাপারও খানিকটা সেইরকম। এই মুহূর্তে যে দৈত্যকুলতিলক বলি-রাজার সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্রের দেখা হবে, সেই বলি-রাজার বংশে অন্তত তিনজন ইন্দ্র আছে। পৌরাণিকেরা জানিয়েছেন-দৈত্য-কুলে পরপর তিন পুরুষ ধরে যাঁদের ইন্দ্রত্ব লাভ করার ইতিহাস আছে, সেই বংশে এই বলি-রাজার জন্ম।

সেই দৈত্যরাজ বলির সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্রের সাক্ষাৎকারের পটভূমিকা এইরকম। দেবরাজ ইন্দ্র শক্তি লাভ করে তখন সমস্ত দৈত্যকে স্বর্গ থেকে হটিয়ে দিয়েছেন। স্বয়ং দৈত্যরাজ বলি স্বর্গ থেকে বিতাড়িত। সিংহাসনে আসীন অবস্থায় বলির সঙ্গে দেবরাজের দু-একবার যে সাক্ষাৎ হয়নি, তা মোটেই নয়। কিন্তু দৈত্যরাজের ক্রিয়া-কর্ম, বৃত্তি তথা লোক-ব্যবহার সম্বন্ধে ইন্দ্রের যতটুকু বোঝা আছে, তার থেকে না-বোঝার অংশ বেশি এবং সেই কারণে বলির সম্বন্ধে কৌতূহলও তার কম নয়। তা ইন্দ্রের এখন সুখের সময়, তিনি প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে পৌঁছলেন, মনে ইচ্ছা–দুদণ্ড গল্পও করবেন, স্বর্গজয়ের সুখ-সংবাদও দেবেন, আর দৈত্যরাজ বলির সম্বন্ধে দুটো প্রশ্নও করবেন, কারণ, বলির সঙ্গে ব্রহ্মার যোগাযোগও কিছু কম ছিল না।

ইন্দ্র ব্রহ্মাকে বললেন, পিতামহ। এই দৈত্যরাজ বলিকে আমি ঠিক চিনতেও পারছি না, বুঝতেও পারছি না। ব্যাপারটা কী, একটু বুঝিয়ে বলুন তো-তং বলিং নাধিগচ্ছামি ব্ৰহ্মম্নাচক্ষব মে বলি। বলি এত দান-ধ্যান করত, এত তার সহায়-সম্পদ, অথচ এখন তার কী অবস্থা, তা কিছুই বুঝতে পারছি না, আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন।

আসলে ইন্দ্র তার স্বর্গের সিংহাসন লাভ করার পরেও বলির প্রভাব ব্যাপ্ত দেখেছেন সর্বত্র। ব্রহ্মাকে তিনি বলেছেন যে মনে হচ্ছে, বলিই যেন বায়ু হয়ে চারদিকে বইছেন, বলিই যেন বরুশ হয়ে জলে আছেন, সূর্য-চন্দ্রের প্রখর-মৃদুল কিরণমালায় তারই জ্যোতি যেন ফুটে বেরচ্ছে–স বায়ুৰ্বরুশশ্চৈব স রবিঃ স চ চন্দ্রমা। এই যে অগ্নি, বায়ু, সূর্য-চন্দ্রের মধ্যে ইন্দ্র বলিকে দেখতে পেলেন এটাই দৈত্যরাজ বলির প্রভাব এবং ব্যাপ্তি। এই প্রভাব বলির সিংহাসনচ্যুতির পরেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে–অধিকারী শাসক হিসেবে তিনি এতটাই বড়। ইন্দ্র তাই ব্রহ্মার কাছে ছুটে এসেছেন–বলির ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দিন তো, পিতামহ। তিনি এখন কোথায় কীভাবে রয়েছেন?

ব্ৰহ্ম বুঝতে পারলেন-বলির অবিচ্ছিন্ন প্রভাব-প্রতিপত্তির ব্যাপারে দেবরাজ ইন্দ্রের রীতিমতো ঈর্ষা আছে। উত্তর দেওয়ার সময় ইন্দ্রকে সে কথাটা না বুঝতে দিলেও ব্রহ্মা একটু কড়া করেই বলেন, কাজটা তুমি ভাল করলে না, দেবরাজ! বলি কোথায় কীভাবে রয়েছেন সেটা জিজ্ঞাসা করে তুমি ভাল কাজ করলে না–নৈতত্তে সাধু মঘব যদেমনুপৃচ্ছসি। যাই হোক, জিজ্ঞাসা যখন করেছ, তখন মিথ্যা বলব না। একটি শূন্য গৃহ যেখানে কেউ থাকে না, এমন জায়গায় বলি রয়েছেন। কিন্তু তার চেহারাটা আর দৈত্যরাজের মতো নেই। একটি খালি বাড়ির ভিতর তিনি উট, ষাঁড়, ঘোড়া অথবা গাধা-এদের যে কোনও একটির রূপ ধারণ করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

বলির করুণ অবস্থা শুনে ইন্দ্র বললেন, যদি কোনও রিক্ত-নির্জন বাড়িতে আমার সঙ্গে বলির দেখা হয়ে যায়, তবে আমি কি তাকে মেরে ফেলব পিতামহ? ব্রহ্মা এই আশঙ্কাই করছিলেন। তিনি বললেন, বলির ওপর একেবারেই কোনও হিংসা আচরণ কোরো না দেবরাজ! বলি কিন্তু হত্যার যোগ্য নন মোটেইমাম্ম শত্রু বলিং হিংসীন বলির্বধমতি। বরং যদি পার তো তার কাছে ন্যায়-নীতির উপদেশ শুনতে চেয়ে কিছু।

ইন্দ্র রাজকীয় মর্যাদায় ঐরাবতে চড়ে বলিকে খুঁজতে চললেন পৃথিবীতে। এক জায়গায় তার দেখাও মিলল, লোকপরিত্যক্ত এক শূন্য গৃহে বলি একটি গাধার রূপ ধারণ করে বাস করছেন। আমার মতে–এই গাধার ছদ্মবেশ কিছুই নয়। দৈত্যরাজ বলি স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। অতএব দেবতাদের ফাঁকি দেবার জন্য অত্যন্ত দীন-হীন বেশে মূর্খের ভাব-বিকার দেখিয়ে একটি লোক পরিত্যক্ত গৃহে বাস করছিলেন বলি। ইন্দ্রের সঙ্গে তার দেখা হল একান্ত অনাড়ম্বর পরিবেশে।

ইন্দ্র খোটা দিলেন প্রথমেই। বললেন, দানবরাজ! আপনি যে পুরো গাধা হয়ে রয়েছেন, আর গাধারা যেমন তুষ খায়, আপনিও তো তেমন তুষই খাচ্ছেন। সত্যি করে বলুন তো, আপনার খারাপ লাগে না? কষ্ট হয় না–ইয়ং তে যোনিরধমা শোস্যথ ন শোচসি? আর এ কী জঘন্য অবস্থা হয়েছে আপনার? কী দূরদৃষ্ট? শত্রুরা এখন আপনার মাথার ওপর। রাজলক্ষ্মী অন্যের কণ্ঠলগ্ন। বন্ধু-বান্ধব সহায় কেউ নেই। আপনার পরাক্রম এবং উৎসাহও কিছু দেখছি না।

ব্রহ্মা ইন্দ্রকে বলেছিলেন-বলিকে হিংসা কোরো না। তার কাছ থেকে বরং নীতিশাস্ত্রের উপদেশ শুনো। কিন্তু চিরকালের শত্রু যখন বিপদে পড়ে, তখন কি তাকে একটু কথা না শুনিয়ে পারা যায়, নাকি নিজের হর্ষোক্কাসই বা চেপে রাখা যায়। ইন্দ্রও তাই কথা শোনাচ্ছেন বলিকে। ইন্দ্র বললেন, এককালে আপনার আত্মীয়-স্বজনেরা হাতি-ঘোড়ায় চড়ত আর সব সময়েই আপনাকে ঘিরে রাখত। আপনি নিজের প্রতাপে সমস্ত লোককে অভিভূত করে রাখতেন, আর আমাদের তো গণনার মধ্যে আনতেন না-লোকান্ প্রতাপয় সর্বান্ যাস্যম্মা অবিতর্কয়। এসব কি আপনার মনে পড়ে? দৈত্য-দানবরা এক সময়–আপনি কখন কী আজ্ঞা করেন, তা পালন করার জন্য মুখিয়ে থাকত। আপনার রাজ্য পালন করার মর্যাদাও তো কিছু কম ছিল না। এমনই আপনার মহিমা যে, হাল চাষ না করলেও জমিতে শস্য ফলত আপনার প্রভাবে। সে সব এখন কোথায়? এখন এই সমুদ্রের পূর্বতীরে পরিত্যক্ত শূন্যগৃহে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনি তুষ খেয়ে যাচ্ছেন। আপনার কষ্ট হয় না বলিরাজ-শোচসি আহো ন শোচসি?

 ইন্দ্র এবার দেবরাজ ইন্দ্রের প্রতি তুলনায় বলির মনে আঘাত দিয়ে বললেন, কী দিন ছিল আপনার। আপনি যখন আত্মীয়-স্বজনদের ধন দান করতেন, তারা যখন আপনাকে ধন্যধ্বনি দিত, তখন কেমন লাগত আপনার–তদাসীত্তে মনঃ কথম্? কেমন লাগত–যখন দারুণ সেজেগুজে স্বর্গের বিলাস-ভবনে গিয়ে বসতেন, আর শত শত স্বর্গসুন্দরীরা, সালংকারা দেবরমণীরা আপনার সামনে ঝুমুর নাচত– ননৃতু দেবযোষিতঃ–তখন কেমন লাগত আপনার? আচ্ছা, আপনার সেই সোনার ছাতাটাই বা কোথায় গেল, হিরা-পান্না খচিত সেই সোনার ছাতাটা, যেটা আপনার মাথার ওপর ধরা থাকত সব সময়? সেই সোনার পানপাত্র? ভৃঙ্গার-ভরা সুবাসিত বারি? সেই চামর দুটি? স্বয়ং ব্রহ্মার দেওয়া সেই মালাটা? কিছুই তো দেখছি না, বলিরাজ-ব্রহ্মদত্তাঞ্চ তে মালাং ন পশ্যামসুরাধিপ।

দানবরাজ বলি অনেকক্ষণ ধরে ইন্দ্রের পিত্তি-জ্বলানো কথাগুলি শুনলেন। সাময়িকভাবে একটু রাগও হল তার। একটু রাগের নিঃশ্বাসও পড়ল। কিন্তু বলি ধৈর্য হারালেন না। বরং একটু মজা করেই বললেন, আমার পানপাত্র, সোনার ছাতা, চামর-দুটি, এমনকি সেই ব্ৰহ্মদত্ত মালাটাও তুমি এখন দেখতে পাবে না, দেবরাজ। সব গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছি। সময় যখন আসবে, তখন টুক-টু করে সব বার করব, তখন দেখবে–যদা মে ভবিতা কালস্তদা ত্বং তানি দ্রক্ষ্যাসি। এখন আমার সৌভাগ্য-সমৃদ্ধি সব গেছে, আর আপনার হয়েছে বাড়-বাড়ন্ত, কিন্তু তাই বলে আপনি যেমন হামবড়াই করছেন–এটা আপনার বংশ এবং যশ-কোনওটার সঙ্গেই খাপ খাচ্ছে না।

 দানবরাজ বলি এবার তত্ত্বকথা বলতে আরম্ভ করলেন। সুখে স্পৃহা নেই, দুঃখে মন অনুদ্বিগ্ন, সমস্ত পার্থিব সুখেরই শেষ আছে-অতএব গাধার মতো জীবন যাপন করেও বলির মনে কোনও দুঃখ নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। সুখ এবং দুঃখ-দু’য়েরই স্বরূপ তিনি জানেন। অতএব বলি দুঃখ পান না–যদেবমভিজানাসি কা ব্যথা মে বিজানতঃ! বলি বিরাট আলোচনা করলেন মহাকাল নিয়ে। মানুষের ভাল-মন্দ, লাভ-ক্ষতি, সমৃদ্ধি-পতন, জয়-পরাজয়–সবই মহাকালের ছন্দে বাঁধা আছে। বলি বললেন, আজকে আমি গাধা হয়ে তুষ খাচ্ছি বলে আপনি পরিহাস করছেন, কিন্তু আপনিও বেশি পৌরুষ দেখাবেন না-মা কৃথাঃ শক্র পৌরুষম। আপনি যে আজকে ভাল অবস্থায় আছেন–এটা আপনি করেননি। আবার আমি যে এখানে গাধা হয়ে আছি–এটাও আমি করিনি–নৈতদস্মৎকৃতং শত্রু নৈতচ্ছ ত্বয়া কৃত। যে করেছে, সে হল মহাকাল, তার হাত থেকে রেহাই নেই কোনও।

বলি এবার একটা লৌকিক উপমা দিলেন। বললেন, কত সুন্দরী সুলক্ষণা রমণীকে দেখি, কী খারাপ ভাগ্য তাদের, কী কষ্টেই না তারা থাকে। আবার কুৎসিত কুরূপা কত মহিলা পরম সৌভাগ্য-সমৃদ্ধির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, তাও দেখি। মহাকালের কাজটাই এইরকম। সমস্ত চরাচরে প্রাণীরা যে গতি লাভ করে, সেই গতি আপনি এড়িয়ে যাবেন কোথায়–গতিং হি সর্বভূতানামগত্বা ক গমিষ্যতি?

বৈরোচন বলি ইন্দ্রকে ভালরকম চেনেন। অমৃত-মন্থন থেকে আরম্ভ করে অনেক ক্ষেত্রে তার সঙ্গে ইন্দ্রের দেখা হয়েছে। দুজনেই পৃথিবীকে দেখেছেন, চিনেছেন অনেক। কিন্তু ইন্দ্র যেভাবে যেচে বলিকে নানা কথায় পরিহাস করেছেন, বলি তার জবাব দিচ্ছেন একটু একটু করে। বলি বললেন, আগেও যেমন আপনার ছেলেমানুষি দেখেছি, এখনও দেখছি আপনি সেইরকমই ছেলেমানুষ আছেন–কৌমারমেব তে চিত্তং যথৈবাদ্য তথা পুরা। আরে, আমাকে তো আপনি এককালে দেখেছেন। দেবতা, গন্ধর্ব, রাক্ষস, নাগ, মানুষ, সকলেই আমার শাসনে ছিল। এমনকি আমি যে দিকে দাঁড়িয়ে থাকতাম, শুত্রুরা সে দিকটাকেই নমস্কার করে বলত–যে দিকে বৈরোচন বলি রয়েছেন, সেই দিককে নমস্কার–নমস্তস্যৈ দিশে’পস্তু যস্যাং বৈরোচনো বলিঃ।

বলি নিজের উদাহরণ দিয়ে ইন্দ্রকে বোঝালেন–আর আজকে আমার অবস্থা দেখছেন তো? বসে বসে তুষ খাচ্ছি। সেইরকম আপনিও যেমন আজকে রাজলক্ষ্মীর অধিকার লাভ করে ভাবছেন যে, তিনি আপনার কাছে আছেন–ও ধারণাটা মিথ্যে। সম্পূর্ণ মিথ্যে–স্থিতা ময়ীতি তস্মিথ্যা। বলি এবার কেটে কেটে বললেন, আরে! আপনার চেয়ে গুণী আরও হাজারটা ইন্দ্র আগে চলে গেছেন। এই রাজলক্ষ্মী তাদের কাছেও ছিলেন, তারপর আমার কাছেও ছিলেন, আবার এখন গেছেন আপনার কাছে, কাজেই মাথাটা বেশি গরম করবেন না, এত

মেজাজও দেখাবেন না–মৈবং শক্র পুনঃ কাষীঃ শাস্তো ভবিতুমহসি। শুধু মনে রাখবেন আপনার আগে আপনার মতো আরও হাজারটা ইন্দ্রের জমানা চলে গেছে এবং তারা কেউ শক্তি বা ক্ষমতায় আপনার চেয়ে কোনও অংশে কম ছিলেন না–

বহুনীসহস্রাণি সমতীতানি বাসব।
বলবীর্যোগপন্নানি যথৈব ত্বং শচীপতে।

মহাভারতে বলি-বাসব-সংবাদ যেমনটি আছে, আলোচনা বেশ বড়, তত্ত্বও অনেক গভীর। সম্পূর্ণ অধ্যায়টিকে ছোট করে আমি আপনাদের একটা ধারণা দিতে চেয়েছি এবং তার উদ্দেশ্য একটাই। দানবরাজ বলির জবানিতে আমি শুধু দেখাতে চাইলাম যে, দেবতারা বিষ্ণু-স্বরূপিনী মোহিনীর নবীন-নবনীনিন্দিত হস্ত থেকে যতই অমৃত পান করে থাকুন, দেবতারা কেউ অমর নন। এমনকি এই প্রসঙ্গে অমর শব্দটার গুঢ়ার্থও কিছু বোঝা যেতে পারে। পৌরাণিকেরা কথাত্তরে বলেছেন, আমাদের এই সংসার-যাত্রা কোনকালে আরম্ভ হয়েছে, তা যেহেতু জানি না, অতএব সংসারচক্রকে আমরা অনাদি বলি, কিন্তু দেহ আছে যাদের, তাদের দীর্ঘ জীবন কখনওই দেখি না–ন হ্যস্য জীবিতং দীর্ঘং দৃষ্টং দেহে তু কুচিৎ। কেউ বালক বয়সেই মরে যাচ্ছে, কেউ বা একশো বছর বেঁচেও থাকছে। কিন্তু একশো বছর যে বেঁচে আছে, তাকে যে লোকে ‘অনন্ত’জীবী বলে, তা কিন্তু অল্পজীবীদের তুলনায়। আর একশো বছর বেঁচেও যে মরল না, যাকে দেখে মনে হয়–কী দীর্ঘ আয়ু! আহা এঁর বুঝি মরণ নেই, ইনি বেঁচেই থাকবেন, তাকেই লোকে ‘অমর’ বলে–জীবিতো ন ম্রিয়ত্যগ্রে তস্মাদ অমর উচ্যতে। এই নিরিখে দেবতারাও কেউ অমর নন। তাদের জন্ম-মৃত্যু সবই প্রায় মানুষের মতোই।

বলা যেতে পারে–এ তো মানুষের কথা হল। মানুষের মধ্যে যারা দীর্ঘজীবী, তাদের কথাপ্রসঙ্গে আমরা অনেক সময় বলি–উনি অমর। স্বর্গের দেবতাদের কি ওরকম মানুষের মতো ভাবলে চলে? ধম্মে সইবে এসব কথা? তাহলে প্রশ্ন আসবে–দেবতাদের শরীর আছে কি না, অথবা তাদের আকৃতি-প্রকৃতিও বা মানুষের সঙ্গে মেলে কি না? যদি শরীর থাকে, আর মানুষের আচার-ব্যবহারের সঙ্গেও তাদের মিল থাকে, তবে তাদেরও জন্ম-মরণ থাকবে তাতে আশ্চর্য কী?

 দেবতাদের শরীর আছে কি না-এ তর্ক আজ থেকে নয়, এ তর্ক বেদের আমল, মানে ধরুন অন্তত তিন-সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে এই তর্ক চলছে। কথাটা আমাদের ধরতে হবে যাস্ক মুনির অভিধান নিরুক্ত থাকে। যাস্কই বোধ হয় প্রথম লোক যিনি চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দ অর্থাৎ পাণিনিরও আগে শব্দের নিরুক্তি বিচার করে একটা অভিধান লিখেছিলেন। এই অভিধানের মধ্যে বৈদিক দেবতাদের নিয়ে একটা বড় সড় বিচার আছে। দেবতাদের শরীরের কথাটা আমাদের এখান থেকেই শুরু করতে হবে।

দেবতাদের শরীর আছে, কি নেই–এই নিয়ে যাস্কের সময়েই দু’রকম মত ছিল। এক পক্ষ বলতেন, দেবতাদের দেখতে হয়তো মানুষের মতোই–পুরুষবিধাঃ সুরিত্যেক। আর অন্যরা বলেন, মোটেই তা নয়। দেবতাদের শরীর-টরীর কিছু নেই। তারা সব আকাশস্থ অদৃষ্টির জীব। মানুষের মনোলোকেই তার প্রতিমা। যারা ভাবেন-দেবতার শরীর নেই, যাস্ক তাদেরকে ঠেলে ফেলে দেননি ঠিকই, কিন্তু তার নিজের পক্ষপাতটা যেন শরীরবাদীদের দিকেই, যদিও শেষ পর্যন্ত অশরীরবাদীদের কথা বলে তিনি দুই মতই স্বীকার করে নিয়েছেন–অপি বা উভয়বিধাঃ স্যুঃ। বৈদিক দেবতাদের শরীর এবং ক্রিয়াকাণ্ড মানুষের মতো বলেই যাঁরা ভাবেন, তাদের কতগুলি যুক্তি আছে। যুক্তিগুলি যাস্ক যেভাবে সাজিয়েছেন আমি তা এক এক করে বলছি।

প্রথম কথা হল, ঋষিরা সমস্ত বেদের মন্ত্রবর্ণের মধ্যে দেবতাদের এমন ভাবে স্তুতি করেছেন, যাতে মনে হবে দেবতাদের মানুষের মতোই চেতনা আছে। আর চেতনা যাঁদের আছে, তাদের শরীর থাকবে না? এও কি কোনও কথা? বলতে পারেন–চেতনা তো গোরু-ঘোড়রও আছে, তাহলে দেবতাদের গোরু-ঘোড়ার মতোও দেখতে হতে পারে। যাস্ক বললেন, বাবা! ওই জন্যই আগে বলেছি–দেবতাদের হয়তো মানুষের মতোই দেখতে হবে–পুরুষবিধাঃ স্যুরিতি। গোরু-ঘোড়ার তো আর হিতাহিত বোধ নেই, কাল কী হবে–বোধ নেই, কাজেই ওই রকম চেতনার কথা আমরা বলছিও না। মানুষের যেমন চেতনা, মানুষের যেমন কাজকর্ম দেবতাদেরও তেমনই হওয়া সম্ভব। নইলে দেবতাদের উদ্দেশে বেদের অর্ধেক স্তুতি-সূক্ত উন্মত্তের প্রলাপ বলে মনে হবে।

পরিচিত ব্যক্তি বাড়িতে এলে আমরা যেমন বলি–আসুন, বসুন, তামাক খান, তেমনই ঋষিদের মুখে শোনা যাবে-ইন্দ্র! তুমি এস এস। এই কুশের আসনে বস, সোমরস তৈরিই আছে–পান কর–আ যাহি সুষমাহিত ইন্দ্র সোমং পিবা ইম। এদং বহিঃসদে মম। স্তুতির ভাষায় এই অভিবাদন-অভিনন্দনের মাত্রাটা চেতন মানুষের প্রতিরূপ কোনও চেতন শরীরী দেবতার উদ্দেশেই ব্যবহার করা যায়। নইলে বলতে হয়–যিনি এই অভিবাদন করছেন, তিনি পাগল। ঋগবেদের প্রায় প্রতিটি সূক্তেই ঋষিরা ইন্দ্র, বায়ু, অগ্নি, সূর্য ইত্যাদি দেবতার উদ্দেশে–এস’, যাও’, ‘খাও’, ‘পান কর’, ‘আমাদের শত্রু জবাই কর’, ‘আমাদের এটা দাও, সেটা দাও’–ইত্যাদি ভাব ব্যক্ত করে দেবতাদের চেতন সত্তা মেনে নিয়েছেন-চেতনাবদ্ভিঃ স্বতায়ো ভবন্তি।

যাস্ক তার দ্বিতীয় যুক্তি সাজিয়েছেন দেবতাদের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে। তিনি বলেছেন, বেদের মন্ত্রের মধ্যে দেবতাদের হাত, পা, চোখ, মুখ, কান-সব কিছুরই বর্ণনা আছে মানুষের মতো করেই। ইন্দ্রের বলিষ্ঠ বাহুর ওপর নির্ভর করে স্তুতিকারী ঋষিরা নির্ভয়ে জীবন কাটাতে চেয়েছেন-ঋম্বা ত ইন্দ্র স্থবিরস্য বাহু উপ স্বেয়াম শরণা বৃহন্তা। একই শরীরে বেদ-বর্ণিত আদিত্য সূর্যের ভাস্বর মুখ, সবিতা-সুর্যের হিরণ্যহস্ত আর মিত্রের চক্ষুকে সন্নিবেশ করলে যে দেব-পুরুষের রূপ বৈদিকদের হৃদয়গোচর হয়েছিল, বস্তুত সেই রূপই পরবর্তী কালে পাণ্ডবজননী কুন্তীরও নয়নগোচর হয়েছিল। ইন্দ্রের বজ্রমুষ্টির আশ্রয় গ্রহণ করাটাকে যদি একটা রূপকের মতো ধরে নিই–যদি ধরে নিই শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই তার বজ্রমুষ্ঠির কথাটা কল্পনা করেছেন ঋষিরা, তাহলে ইন্দ্রের হনু-দুটিকে নিশ্চয় শত্রুদমনে রূপক বলে ভাবা যাবে না। অথচ ইন্দ্রের মুষ্টির মতো তার হনুর প্রশংসাও তো কিছু কম নেই বেদে-মৎস্বা সুশি হরিবস্তদীমহে ত্বে আর ভূষন্তি বেধসঃ। আর শুধু, ইন্দ্র অথবা সূর্যই নয়, অগ্নি, অশ্বিনীকুমার, বায়ু–এই সব দেবতারই নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বর্ণনা থাকায় দেবতার শরীরবাদীরা বলেছেন দেবতার চেহারা মানুষের মতোই হবে।

দেবতাদের যান-বাহন, বাড়ি-ঘর, দুর্গের কথাও বেদের মধ্যে অনেক পাওয়া যাবে। পাওয়া। যাবে নানা ধরনের ক্রিয়া-কাণ্ড-খাওয়া, পান করা, যুদ্ধ করা, বধ করা, অশ্ব অথবা রথ-চালনা করা, বাঁশি বাজানো, গর্জন করা ইত্যাদি। এতগুলি মনুষ্যোচিত ক্রিয়াকলাপ দেখে বৈদিকরা অনেকেই দেবতার শরীরে বিশ্বাস করেছেন।

ভারি আশ্চর্য ব্যাপার হল, শুধু বৈদিকদের একাংশমাত্রই নয়, দেবতাদের বিশিষ্ট শরীরের অস্তিত্ব নিয়ে বৈদান্তিকরাও কম মাথা ঘামাননি। স্বয়ং শঙ্করাচার্য, যিনি নিরাকার-নির্বিশেষ ব্রহ্ম ছাড়া কিছুই মানেন না, তিনি পর্যন্ত বলেছেন, দেবতাদের রূপ আছে, শরীরও আছে। সেরকম না হলে আমরা একেকজন দেবতা সম্বন্ধে কোনও ধারণাই করতে পারতাম না–ন হি স্বরূপরহিতা ইন্দ্রাদয়ঃ চেতসি আরোপয়িতুং শক্যন্তে। আমাদের কাছে যেটা বড় প্রয়োজন, সেটা হল–দার্শনিক শঙ্কর দেবতার শরীর স্বীকার করে নেওয়ার জন্য যে উদাহরণটি দিয়েছেন, সেটা মহাভারতের উদাহরণ। কন্যাবস্থায় কুন্তীর সানন্দ সপ্রেম আহ্বান লাভ করে সূর্য যে তার বাহুপাশে ধরা দিয়েছিলেন, এই ঘটনাটাই দেবতার শরীর-প্রমাণে সাহায্য করেছে শঙ্করকে।

তবে মানুষের সঙ্গে দেবতাদের তুলনা দিতে গিয়ে শঙ্কর বলেছেন–দেবতারা মানুষের মতো জীবই বটে, তবে তারা উন্নত শ্রেণীর জীব। ক্ষমতায়, বুদ্ধিতে এবং ঐশ্বর্যে তারা মানুষের চেয়ে অনেক বড়। ঠিক এই কথাটাই অন্যভাবে বলেছেন পৌরাণিকেরা। পৌরাণিক

বলেছেন–আমরা নিজেদের কথা বলছি না, তত্তদশী ঋষিরাই এই কথা বলেন। তারা বলেন, মানুষের শরীর, আকার অথবা চেহারা যেমন, দেবতাদেরও প্রায় তাই

মানুষস্য শরীরস্য সন্নিবেশস্তু যাদৃশঃ।
তক্ষণন্তু দেবানা দৃশ্যতে তত্ত্বদর্শনাৎ৷৷

তবে কিনা মানুষের বুদ্ধি যত, দেবতাদের বুদ্ধি তার থেকে অনেক বেশি–বুদ্ধতিশয়যুক্ত দেবানাং কায়মুচ্যতে। লক্ষণীয় বিষয় হল, শুধু দেবতা নয়, বুদ্ধির আতিশয্য জিনিসটা অসুর-রাক্ষসদেরও যথেষ্ট পরিমাণ আছে এবং তা মানুষের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ অসুর-রাক্ষস-নাগরাও কিন্তু মানুষের চেয়ে উচ্চ স্তরের জীব। এই ধারাণাটা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন সাংখ্য-দর্শনের প্রবক্তা ঈশ্বরকৃষ্ণ। পরে আসছি সে কথায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *