কথা অমৃতসমান – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী (১ম খণ্ড)
প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর ২০১৩, অগ্রহায়ণ ১৪২০
ধর্মে চার্থে চ কামে চ মোক্ষে চ ভরতষভ।
যদিহাস্তি তদন্যত্র যন্নেহাস্তি ন কুচিৎ।
—ধর্মশাস্ত্র বলুন কিংবা অর্থশাস্ত্রই বলুন, কামশাস্ত্রই বলুন অথবা মুক্তির শাস্ত্রই বলুন–যা এই মহাভারতে আছে, তা অন্যত্রও আছে; আর যা এখানে নেই, তা অন্য কোথাও নেই।
মহাভারত মানে মহা-ভারত। যা এখানে নেই, তা অন্য কোথাও নেই। আর আর এখানে যা আছে, তা অন্য কোথাও নিশ্চয়ই আছে। আমরা এই নিরিখেই গ্রন্থটাকে দেখতে চেয়েছি–তারা সবাই অন্য নামে আছেন মর্ত্যলোকে। আজকের এই সর্ব-সমালোচনামুখর, ঈর্ষাসূয়ায় হন্যমান শতাব্দীর মধ্যে দাঁড়িয়ে শত শত শতাব্দী-প্রাচীন আরো এক সাসূয় সমাজের কথা বলতে লেগেছি, যদিও সেখানে প্রাতিপদিক বিচলনের সঙ্গে সঙ্গে একটা শব্দ বার বার নিনাদিত হয় এবং সেটা ধর্ম–সে ধর্ম একদিকে নীতি এবং নৈতিকতা, অন্যদিকে সেটা ‘জাস্টিস’, শৃঙ্খলা, ‘অরডিন্যান্স’ এমন কী আইনও। মহাভারত অন্যায় এবং অধর্মকে সামাজিক সত্যের মতো ধ্রুব বলে মনে করে, কিন্তু সেটা যাতে না ঘটে তার জন্য অহরহ সচেতন করতে থাকে প্রিয়া রমণীর মতো। আমরা সেই মহা-ভারতকথা বলেছি এখানে, যা শতাব্দীর প্রাচীনতম আধুনিক উপন্যাস।
.
লেখক পরিচিতি
এখনকার বাংলাদেশের পূর্ব-প্রারন্ধের মতো পাক-চক্র ছিল এক। লেখকের জন্ম সেখানে পাবনা জেলার গোপালপুর গ্রামে, ১৯৫০ সালে। কলকাতায় প্রবেশ ৫৭ সালে। শিক্ষাগত উপাধিগুলি ব্যাধির মতো সামনে-পিছনে আসতে চাইলেও বর্তমান লেখক সেগুলিকে মহাভারত-পাঠের সোপান হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যে আস্বাদন মহাভারতের স্বাধ্যায়-অধ্যয়নের মধ্যে আছে, তার প্রতিপদ-পাঠ বুঝতে গেলে অন্যান্য জাগতিক বিদ্যার প্রয়োজন হয়। লেখকের জীবন চলে শুধু মাধুকরী বিদ্যায়, সাংগ্ৰাহিক আস্বাদনে। লেখালেখির জীবনে এসে পড়াটা একেবারেই আকস্মিক ছিল। প্রবীণ সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী তার লেখক জীবনের পরিণতি ঘটিয়েছেন বাঁচিক তিরস্কারে এবং বাঁচিক পুরস্কারে। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রথম লেখা এবং আনন্দ থেকে তাঁর প্রথম বই এককালে শিহরণ জাগাত লেখকের মনে। এখন। শিহরণের বিষয়–মহাভারত-পুরাণের অজ্ঞান তমোভেদী এক-একটি বিচিত্র শব্দ। গুরুদাস কলেজে অধ্যাপনা-কাল শেষ করে এখন। মহাভারত-পুরাণের বিশাল বিশ্বকোষ রচনায় ব্যস্ত আছেন লেখক।
.
সিন্ধু-বিন্দু
২০১০ সালে পুজোর পর প্রখ্যাত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে আড্ডা দিতে বসেছি। সে আড্ডায় অবধারিতভাবে মহাভারতের প্রসঙ্গ চলে আসে। নানা কথার মধ্যে হঠাৎই ঋতু বলে –তুমি আমাদের জন্য লিখতে আরম্ভ করো ‘রোববার’-এ। আমি এই কাগজের সম্পাদনার দায়িত্বে আছি। তুমি নিশ্চিন্তে লেখো। মহাভারত বুঝিয়ে দাও আমাদের। আমি বলেছিলাম, মহাভারত কখনো নিশ্চিন্তে লেখা যায় না। এই মহাকাব্যের বিশালতা এবং গভীরতা দুটোই এত বেশী যে, আমি যেভাবে মহাভারত বোঝাতে চাই, সেটা বোঝাতে গেলে জীবন কেটে যাবে। ঋতু বলল– লেখার মতো করে লেখো, ভেবে নাও তোমার চোখের বাইরে বসে-থাকা শত শত পাঠকের আকুল জিজ্ঞাসা। তাদের ছোট করে দেখো না। তাদের প্রশ্ন তুমি তৈরী করবে, তুমিই উত্তর দেবে।
ঋতুর কথা আমি মেনেছি। রোববারে আমার ‘কথা অমৃতসমান’ চলছে, কিন্তু এরই মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় পাঠক আমাদের ছেড়ে চলে গেছে বিশ্বময় নিজেকে ছাড়িয়ে দিয়ে। ঋতুকে বলেছিলাম আমি আগেও মহাভারত-কথা লিখতে আরম্ভ করেছিলাম তৎকালীন বর্তমান পত্রিকার সম্পাদক বরুশ সেনগুপ্ত-মশায়ের অনুরোধে। সাড়ে তিন বছর ফি-হপ্তায় লিখে আমি পাণ্ডবদের জতুগৃহ-দাহ পর্যন্ত এগোতে পেরেছিলাম। তদবধি ভেবেছি–আমাকে তিনি অশেষ করেননি, এমন লীলা আমার ক্ষেত্রে হবেও না। কাজেই আবার নতুন করে মহাভারতকে পাকড়ে ধরা কী ঠিক হবে? ঋতু বলেছিল-তোমরাই কীসব বলল না–যারা বিদ্যে লাভ কস্তুতে চায়, যারা খুব টাকা-পয়সা পেতে চায়, তারা নিজেদের অজর, অমর মনে করে। তুমি তাই ভেবে লেখা আরম্ভ করো।
ঋতুকে আমি ফেলতে পারিনি। ‘কথা অমৃতসমান’ আরম্ভ করেছিলাম ‘রোববার’-এ। এখনও চলছে, আমিও চলেছি। এরই মধ্যে একটা নতুন প্রয়োজন দেখা দিল। একদিন ‘দেজ পাবলিশিং’-এর নব্যযুবক অপু সুধাংশুদের যোগ্য উত্তরাধিকারী, আমার কাছে এসে কথা অমৃতসমান’ছাপতে চাইল বই আকারে। আমি বললাম–শর্ত আছে। এখন ‘রোববারে’ যে লেখা চলছে, সেটা আমার আগের লেখার ‘কনটিনিউয়েশন’। কাজেই মহাভারত নিয়ে যদি এই বই ছাপতে চাও, তবে আগে বরুণদার দপ্তরী লেখাটা ছাপতে হবে। অপু বলল–তাই দিন-আমরা তিন-চার খণ্ডে ‘কথা অমৃতসমান’ বার করবো। ওর এই সাহসটা আমার ভাল লেগেছিল। এখন লেখকদের ওপর হুলিয়া আছে–লেখা পুরো শেষ করুন, তবে ছাপাবো। এটা কী সমরেশদার ‘দেখি নাই ফিরে’-র ফলশ্রুতি কীনা কে জানে! লেখকের বুঝি মরেও শান্তি নেই। তবে কিনা মহাভারত তো সত্যিই আয়ু-শেষ-করা মহাকাব্য। ধন-জন, মান-যশ, আশা-আকাঙ্ক্ষার আকস্মিক ছেদে যে শান্তরসের বৈরাগ্য তৈরী হয়, সেই তো মহাভারতের চরম প্রতিপাদ্য তত্ত্ব। কাজেই মহাভারতের কথা শেষ না হতেই আমিও যে ঋতুর মতো কোথাও চলে যাবো না, এ-কথা জোর দিয়ে কে বলতে পারে? এখানে অপু সাহস দেখিয়েছে প্রকাশক হিসেবে।
আমি যে সেই বরুণদার সময় থেকে মহাভারতের বারুণী নিয়ে বসে আছি, তার একটা কারণ আছে। আমার মনে হয়েছে–মহাভারতকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে এবং তা এমন করেই যাতে মানুষ এই একবিংশ শতাব্দীতে বসে বুঝতে পারে যে, মহাভারত এক চলমান জীবনের কথা বলে। এটা ইলিয়াড-ওডিসির মতো সামান্য মহাকাব্য নয়। মহাভারতীয় ঘৃণা, মান, অপমান, ভালবাসা, লজ্জা, ভয় এখনও এই একবিংশ শতাব্দীতেও সমানভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এটা তো ঠিকই যে, মহাভারতের মূল কাহিনীটাই যদি ধরি শুধু, তাহলেও সেখানে বৈচিত্র্য কিছু কম নেই। অথচ সে বৈচিত্র্য কল্পনার মতো বায়ুভূত নিরালম্ব নয়। গ্রামে-গঞ্জে তিন পুরুষ আগে জমির উত্তরাধিকার নিয়ে শরিকি বিবাদ যারা দেখেছেন, তারা বুঝবেন-মহাভারতের কাহিনী কোনো অমূলক অবাস্তব থেকে উঠে আসেনি। ভারতবর্ষের আইনে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী যারা হতেন, সেখানে কাকা, ভাই কিন্তু জম্মজাত শত্রু হিসেবে চিহ্নিত। এই বাস্তব থেকে মহাভারতের কাহিনী আরম্ভ হয়। অথচ উপপাদ্য জায়গাগুলিতে এমন সব কাহিনী একের পর এক আসতে থাকে, যা আজিও হইলেই হইতে পারিত। অর্থাৎ সেখানেও বাস্তব। মহাভারত কখনোই শুধু কাহিনী বলে না, সে তার সমসাময়িকতার সঙ্গে প্রাচীন পরম্পরাও উল্লেখ করে বলে কথা প্রসঙ্গে রাজনীতি, অর্থনীতি, জাতিতত্ত্ব, বর্ণব্যবস্থা, স্ত্রীলোকের। সামাজিক অবস্থান, নীতি-অনীতি এমনকি যৌনতার কথাও পরিষ্কারভাবে জানায়। ফলত মহাভারতের কাহিনী একসময় এক বিরাট ইতিহাস হয়ে ওঠে।
একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এই গ্রন্থের মধ্যে যে নীরসিংহী কথাকথা আরম্ভ হয়েছে, তার প্রয়োজন শুধু এইটুকুই যে, আমরা মহাভারতের নায়ক-প্রতিনায়কদের তাদের গ্রাহ্য-বর্জ্য বৃহত্তর সমাজ এবং রাজনৈতিক, পরিমণ্ডলের মধ্য দিয়ে পরিভ্রমণ করিয়ে নিতে চাই। এটা করতে গিয়ে আমি কখনো ‘দিলোত’-দের (dilettante) পথে চলিনি, অবশ্য এমনও মহান ভ্রান্তিতেও আমি বিশ্বাস করিনা যে, একবিংশ শতাব্দীর পরিখালিত সংস্কারে আমার সাংস্কৃতিক মানস দিয়ে তৎকালীন ‘বিরাট’ এবং ‘বিশাল’-এর সমালোচনা করবো। বরঞ্চ মহাভারতের অন্তর্গত প্রমাণ দিয়েই আমি সেই সমাজের অন্তর্বেদনা, সুখ এবং আধুনিকতার কথা আমি ধরতে চেয়েছি কখনো মহাভারতীয় মূলকে অতিক্রম না করে।
এটা ঠিক যে, ইনটারটেক্সচুয়ালিটি নিশ্চয়ই আমার কাছে খুব বড়ো একটা ব্যাপার, কেননা এটা মহাভারত, এবং এটাও আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, মহাভারতের মধ্যে মাঝে-মাঝেই যে প্রক্ষেপগুলি ঘটেছে, সেটা আমাদের সামাজিক ইতিহাসের পরম্পরা বোঝার পক্ষে আরো বেশী সুবিধে দেয়, কাজেই মহাভারতকে যাঁরা কলোনিয়াল ‘হ্যাংইওভারে’ পরিশুদ্ধ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তাদের চেষ্টা-পরিশ্রমের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রইল, কিন্তু তাদের মানসিকতা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথমত প্রক্ষেপ যা কিছু এখানে ঘটেছে, তার প্রাচীনত্বের বিচার করাটা অতটা সহজ নয়, যতটা পূর্বাহ্নেই সংকল্পিত গবেষককুল মনে করেন। আর ওই যে এক প্রবাদ–তাতে মহাভারত কিছু অশুদ্ধ হয় না’–এই প্রবাদটা চিরকালীন মানুষের এই মানসটুকু বুঝিয়ে দেয় যে, প্রক্ষেপবাদিতার পঙ্কবাদী পণ্ডিতেরা ব্যবচ্ছিন্ন বুদ্ধিতে ভারতবর্ষের এক বিরাট সময়কে শুধু কাটাছেঁড়া করেই পণ্ডিতমানিতা প্রকাশ করেন, কিন্তু তাতে লেখনীর বামতা তৈরী হয়। কবিজনোচিত বেদনাবোধ সেখানে পদে-পদে নিগৃহীত হয়। আমরা এই নৌকায় সাগর পাড়ি দিতে চাই না।
মহাভারত যেহেতু একটা বৃহৎ সময় ধরে আমাদের প্রাচীনদের চলার ইতিহাস, তাই মহাভারত বুঝতে গেলে প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে তার রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, জাতি-বর্ণ, ভোজনাভ্যাস এবং ভোজ্য সবই জানতে হয়। আমরা সেই সর্বত্রিক দিগন্দার্শনিকতার মধ্যে মহাভারতের কাহিনী প্রবেশ করিয়েছি মণিমালার মধ্যে সুতার মতো। অথবা কাহিনীর মধ্যে তার পারিপার্শ্বিক নিয়ে এসেছি ব্যক্তিচিত্রের পিছনে ক্যাম্পাসের মতো। তপোবনবাসিনী শকুন্তলার ছবি আঁকতে গেলে তার পূর্ণকুটীরে পাশ দিয়ে সৈকত-লীন-হংস-মিথুনা স্রোতোবহা মালিনী’ নদীকে আঁকতেই হবে। আঁকতে হবে কুটীরের পাশে বড়ো গাছের ডালে শুকোতে দেওয়া ঋষিদের বলবাস আর আঁকতে হবে। অদুরে অলসে দাঁড়িয়ে থাকা এক কৃষ্ণসার মৃগ, যার বাম চোখে হরিণী তার শি দিয়ে চুলকে দিচ্ছে সান্নিধ্যের প্রশ্রয়ে-শৃঙ্গে কৃষ্ণমৃগস্য বামনয়নং কয়মানাং মৃগী। এমন লিখেছেন কবি কালিদাস।
তার মানে, আমাদের বিশ্বাস-মহাভারতে কৌরব-পাণ্ডবদের জীবন-চর্যা দেখাতে গেলে মথুরা-মগধ থেকে আরম্ভ করে পঞ্চাল-কেকয়দের কথাও বলতে হবে। বলতে হবে অনন্ত প্রান্তিক জীবনের কথাও। আমরা সেইভাবেই কথা আরম্ভ করেছি। এর শেষ কোথায় জানি না। তবে আমার মাথার ওপর সেই ত্রিভঙ্গিম প্রাণারাম মানুষটি আছেন, আমার আয়ু এবং আমার অক্ষয়-গতি সবটাই নির্ভর করছে সেই অক্ষর-পুরুষের ওপর। তার বাঁশীর সুর যতদিন শুনতে পাবো, ততদিনই হয়তো চলবে এই মহাভারতী লেখনী।
আমার এই গ্রন্থের মধ্যে সহায়িকার গ্রন্থি আছে অনেক। কেউ সেইকালে আমার হিজিবিজি সাপ্তাহিকী লেখা পুনরায় কপি করে সাজিয়ে দিয়েছেন, যেমন তাপসী মুখোপাধ্যায়। তিনি আমার সহকর্মী ছিলেন, তবে শিষ্যাও। প্রাথমিক প্রুফ দেখে দিয়েছেন–আমার ছাত্রী সুচেতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অবশেষে সম্পূর্ণ গ্রন্থটির শব্দ এব শৈলী-পরিবর্তনের দায়িত্ব থেকে পূর্ণ গ্রন্থটির পরিকল্পনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন আমার স্ত্রী সুষমা। চাকরী ছাড়ার পর তিনি কাজ পাচ্ছিলেন না, কিন্তু এই গ্রন্থ ক্ষেত্রে তিনি আমার অকাজ পেয়েছেন প্রচুর–আমার নাতি ঋষভ ভাদুড়ীর প্রচুর লাফালাফি সেই অকাজ বাছাইতে সাহায্য করেছে বলে তার কাছে শুনতে পাই। প্রবীণ শ্রদ্ধেয় রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় এই গ্রন্থের প্রচ্ছদ সৃষ্টি করেছেন, তাকে আমার প্রণাম। অবশেষে সেই অপুদে’জ পাবলিশিং-এর নব্য যুবক-তাকে অশেষ স্নেহ জানাই ঘাট থেকে নৌকা ছাড়ার জন্য, ওপারে নিয়ে যাবার জন্য তার গতির ওপর আমার ঠাকুর কৃষ্ণের আশীর্বাদ থাকুক।
—নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
.
.
০১.
নৈমিষারণ্য। ইতিহাস-পুরাণ খুললেই দেখবেন নৈমিষারণ্য। মহর্ষিদের তপোবন। সেখানে বারো বচ্ছর ধরে যজ্ঞ হবে এবং সেই যজ্ঞ চলছে। মহাভারত বলবে–এটি কুলপতি শৌনকের আশ্রম। শুধু মহাভারত কেন আঠারোটা মহাপুরাণের বেশির ভাগটার আরম্ভেই সেই একই কথা–নৈমিষারণ্যে কুলপতি শৌনকের তত্ত্বাবধানে বারো বচ্ছরের যাগ-যজ্ঞ আরম্ভ হয়েছে। নানা দেশ থেকে নানা মুনি-ঋষি এসেছেন এখানে। যজ্ঞ চলছে। ঋগবেদের ঋত্বিক ঋক-মন্ত্রে দেবতার আহ্বান করছেন। সামবেদীরা সাম-গান করছেন। যজুর্বেদের পুরোহিত অধ্বর্যু–ইন্দ্রায় বৌষট, অগ্নয়ে স্বাহা–করে আগুনে আহুতি দিচ্ছেন। আর অথর্ব-বেদের পুরোহিত ‘ব্রহ্মা’ এই বিশাল যজ্ঞের সমস্তটার ওপর দৃষ্টি রাখছেন। কিন্তু সবার ওপরে আছেন কুলপতি শৌনক। বারো বচ্ছরের যজ্ঞ। সোজা ব্যাপার তো নয়। সমস্ত দায়টাই তাঁর। তিনি কুলপতি। মহাভারতের ভাষায়–নৈমিষারণ্যে শৌনক্য কুলপতের্দ্বাদশবার্ষিকে সত্রে।
পিতৃকুল, মাতৃকুল, পক্ষিকুল, এমনকি কুলগুরু এরকম অনেক কুলের কথা শুনেছি, কিন্তু কুলপতি কথাটা তো শুনিনি। বাবা-টাবা গোছের কেউ হবে বুঝি। পণ্ডিতেরা বলবেন– শুনেছ, মনে নেই। এমনকি এই ঘোর কলিযুগে কুলপতি তুমি দেখেওছ। খেয়াল করে দেখো–কালিদাসের অভিজ্ঞান-শকুন্তলে, রাজার সঙ্গে শকুন্তলার তখনও দেখা হয়নি। ঋষি বালকেরা রাজাকে মহর্ষি কণ্বের খোঁজ দিয়ে বলল, এই তো মালিনী নদীর তীরে কুলপতি কণ্বের আশ্রম দেখা যাচ্ছে–এষ খলু কাশ্যপস্য কুলপতেরনুমালিনীতীরম আশ্রমো দৃশ্যতে।
যখন এসব পড়েছিলুম, তখন সিদ্ধবাবা, কাঠিয়াবাবা প্রমুখের সাম্যে কাশ্যপ-কণ্বকেও একজন মুনি-বাবাই ভেবেছিলুম। পরে সত্যিকারের পড়াশুনোর মধ্যে এসে দেখেছি–কুলপতি শব্দটার অর্থ নৈমিষারণ্যের মতোই বিশাল। এবং সত্যি কথা, কুলপতি গোছের মানুষ আমি দেখেওছি। কুলপতি হলেন এমনই একজন বিশাল-বুদ্ধি অধ্যাপক ঋষি, যিনি নিজের জীবনে অন্তত দশ হাজার সংযমী বৈদিককে খাইয়ে-পরিয়ে লেখা-পড়া শিখিয়েছেন–মুনীনাং দশ-সাহস্রম্ অন্নদানাদিপোষণাৎ। অধ্যাপয়তি বিপ্রর্ষিঃ– তা দশ হাজার না হলেও অনেক ছাত্রকে বাড়িতে রেখে, খাইয়ে দাইয়ে মানুষ করে পড়াশুনোর সুযোগ করে দিয়েছেন–এমন অনেক ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতকে আমি দেখেছি এবং অনেক অব্রাহ্মণ বিশাল-বুদ্ধি মানুষও আমি দেখেছি, যাঁরা এই কুলপতির গোত্রে পড়তে পারেন।
শৌনক এই মাপেরই মানুষ। হয়তো আরও বড়। কারণ বৃহদ্দেবতার মতো বৈদিক গ্রন্থ তাঁরই রচনা। মহাভারত কিংবা অন্যান্য পুরাণের আরম্ভে কুলপতি শৌনককে আমরা দেখেছি, তিনি হয়তো বৃহদ্দেবতার লেখক নন, কিন্তু তিনি যে বিশাল এক মহর্ষি, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কারণ তা নইলে সমস্ত পুরাণকারই এই নৈমিষারণ্যের কুলপতি শৌনকের নাম ব্যবহার করতেন না।
কুলপতি কণ্বের আশ্রম যেমন মালিনীর তীরে, কুলপতি শৌনকের আশ্রমও তেমনই গোমতীর কোলঘেঁষা। গোটা ভারতে নৈমিষারণ্যের মতো এত বিশাল এবং এত সুন্দর তপোবন বোধহয় দ্বিতীয়টি ছিল না। এখনকার উত্তরপ্রদেশের লখনউ ছেড়ে মাইল পাঁচেক উত্তর-পশ্চিমে গেলেই দেখা যাবে তির-তির করে বয়ে যাচ্ছে গোমতী নদী। বর্ষাকালের জলোচ্ছ্বাস যাতে তপোবনের নিরুদ্বেগ শান্তি বিঘ্নিত না করে, তাই নৈমিষারণ্যের তপোবন গোমতী নদী থেকে একটু তফাতে, বাঁ-দিকে।
জায়গাটাও ভারি সুন্দর। ময়ূর কোকিল আর হাঁসের ছড়াছড়ি। গরু আর হরিণ একই সঙ্গে চরে বেড়াচ্ছে, অথচ বাঘ-সিংহের হিংসা নেই। শান্ত আশ্রম–শান্তস্বভাবৈর্ব্যাঘ্রাদ্যৈরাবৃতে নৈমিষে বনে। এই নৈমিষারণ্যে এলে কোটি-তীর্থ ভ্রমণের পুণ্য হয়। ‘নিমিষ’ মানে চোখের পলক। পুরাণ কাহিনীতে শোনা যায়, গৌরমুখ মুনি নাকি এখানে এক নিমেষে দুর্জয়-দানবের সৈন্য-সামন্ত পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিলেন–যতম্ভ নিমিষেণেদং নিহতং দানবং বলম– সেই থেকেই এই জায়গার নাম নৈমিষারণ্য। সুপ্রতীকের ছেলে দুর্জয় রাজত্ব করতেন এই অঞ্চলে। অসামান্য তাঁর শক্তি। তিনি একদিন শুনলেন যে, তাঁরই রাজ্যের অধিবাসী গৌরমুখ মুনির কাছে নাকি চিন্তামণি আছে। সেই চিন্তামণির কাছে যা চাইবে তাই পাবে। দুর্জয় দানব মণিটি চেয়ে পাঠালেন। মুনি দেখলেন–ওই মণি অপাত্রে পড়লে পৃথিবী এবং মানুষের ক্ষতি হবে অনেক। তিনি মণি দিলেন না।
কিন্তু দানব দুর্জয় মুনির এই পরার্থচিন্তা মানবেন কেন? তিনি সসৈন্যে মুনির আশ্রমে রওনা দিলেন মণির দখল নিতে। দুর্জয়কে দেখতে পেয়েই বিরক্ত গৌরমুখ চোখের নিমেষে পুড়িয়ে দিলেন তাঁর সৈন্যবাহিনী এবং স্বয়ং দানবকেও। দুর্জয়ের সেই ভস্মপীঠের ওপরেই গজিয়ে উঠল ঘন বন, যার নাম নৈমিষারণ্য।
এখন ওঁরা বলেন, নিমখারবন বা নিমসর। নিমসর নামে একটা রেল-স্টেশনও আছে ওখানে। নৈমিষারণ্য থেকে নিমখারবন বা নিমসর কী করে হল, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে তা বোঝানো মুশকিল। তবে গোমতী নদী, যেমন নব-নব জলোচ্ছ্বাসে প্রতিদিন কূল ভেঙে নতুন চর তৈরি করে, তেমনই সাধারণের ভাষাও বহতা নদীর মতো নৈমিষারণ্য নামটিও ভেঙে-চুরে নতুন নাম তৈরি করেছে। প্রথম কথা, সাধারণ মানুষ ‘অরণ্য’ বলে না, বলে ‘বন’। এমনকি সাধারণ জনে এটাও খেয়াল করেনি যে, নৈমিষারণ্য দুটো শব্দের সন্ধি–নৈমিষ+অরণ্য। তাঁরা শুধু শেষের ‘ণ্য’টাকে ছেঁটে দিয়ে প্রথমে বলতে আরম্ভ করেছিলেন নৈমিষার-বন, যেন নৈমিষার একটা কথা। আপনারা হয়তো জানেনই যে, ‘ষ’ বর্ণটাকে উত্তরভারতে অনেকই ‘খ’ উচ্চারণ করেন। ‘সহস্ৰশীর্ষা’ পুরুষঃ এই মন্ত্রটাকে বৈদিকরা অনেকেই ‘পুরুখঃ’ বলেন। কবিরা ‘অনিমিষে’ শব্দটাকে কাব্যি করে বলেছেন ‘রইব চেয়ে অনিমিখে’। ফলে নৈমিষার-বন থেকে প্রথমে নৈমিখার-বন, আর তার থেকে নিমখার-বন শব্দটা বলতে আর কত সময় লাগবে। ছোট শব্দটা অর্থাৎ ‘নিমসর’ আরও সোজা। অর্থাৎ বনটাকেও ছেঁটে দিন। থাকে নৈমিষার। তার থেকে সোজা করে নিমসর।
এই নিমসর, নিমখারবন বা নৈমিষারণ্যেই কুলপতি শৌনকের বারো বচ্ছরের যজ্ঞ-প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে। কম কথা তো নয়। এক একটি বিশেষ বৈদিক ক্রিয়াকলাপের জন্য একাধিক মুনি-ঋষি-ব্রাহ্মণ নিযুক্ত হয়েছেন। দিনভর ঋক-মন্ত্রের উচ্চারণ, সামগান, যজ্ঞ-হোম, অগ্নি-সমিন্ধন, সোম-রস-নিষ্কাসন, আহুতি– এত সব চলছে। প্রতিদিনের অভ্যস্ত প্রক্রিয়ায় শান্ত-সমাহিত ঋষিরাও হাঁপিয়ে ওঠেন। তার ওপরে নিজেদের বিশেষ বৈদিক কর্মটি সাঙ্গ হওয়ার পর তাঁদের অবসরও জুটে যায় অনেক। তবু তো তখন অন্য মুনি-ঋষিদের সঙ্গে গল্প জোড়া চলে না। কেন না, একজনের কাজ শেষ হলে অন্যজনের বৈদিক ক্রিয়া-কলাপ আরম্ভ হয়।
তবে হ্যাঁ, দৈনন্দিন যজ্ঞক্রিয়ার পৌনঃপুনিকতা, ঋষিদের একঘেয়েমি অথবা তাঁদের অবসরের কথাগুলি মহাভারতে লেখা নেই। মহাভারতের কবির এসব কথা লেখা চলে না। মহাকাব্যের আরম্ভে তিনি শুধু জয়-শ্লোকটি উচ্চারণ করেই লিখে ফেলেছেন–বারো বচ্ছরের চলমান যজ্ঞ-ক্রিয়ার মধ্যেই এক পৌরাণিক এসে উপস্থিত হয়েছেন নৈমিষারণ্যে, শৌনকের তপোবনে। যে সে পৌরাণিক নন, একেবারে পৌরাণিকোত্তম লোমহর্ষণের পুত্ৰ উগ্রশ্রবা।
সেকালে লোমহর্ষণের মতো কথক ঠাকুর দ্বিতীয় ছিলেন না। জাতের বিচারে তিনি বামুনদের থেকে সামান্য খাটো, কেন না তাঁর জন্ম হয়েছিল বামুন-মায়ের গর্ভে কিন্তু তাঁর বাবা ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয় কুলের যুদ্ধ-গৌরব আর বামুন-মায়ের শুদ্ধশীল বৈদিক ব্রাহ্মণ্য-ভাবনা এই সংকর-জন্মা ছেলেটির মনে এমন এক মিশ্ৰক্ৰিয়া তৈরি করেছিল যে, সে শুধু গল্প বলাই শিখেছে, গল্প বলাই তার প্রথম প্রেম। ক্ষত্রিয় হয়েও যার বাবা বামুনের ঘরের মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছিল, সেই ভালবাসার মধ্যেও গল্প ছিল, স্বপ্ন ছিল। গল্প আর স্বপ্নের মিলনেই সূত-জাতির জন্ম। লোমহর্ষণ সেই সূত-জাতির লোক।
সূতজাতি নাকি ভারতের প্রথম বর্ণসংকর। শোনা যায় রাজা পৃথু, যাঁর নামে এই পৃথিবী শব্দটি, সেই পৃথুর যজ্ঞে দেবতাদের গুরু বৃহস্পতির জন্য যে ঘৃতাহুতি প্রস্তুত করা হয়েছিল, সেই ঘিয়ের সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্রের ঘৃতাহুতি মিশে যায়। এদিকে আহুতি দেওয়ার সময় বৃহস্পতির ঘৃতাহুতি হাতে নিয়ে ইন্দ্রের উদ্দেশে মন্ত্র উচ্চারিত হয়। ইন্দ্র হলেন দেবতাদের রাজা, ক্ষত্রিয়ত্বই রাজার সংজ্ঞা। ফল যা হওয়ার তাই হল, এই হবির্মিশ্রণের ঘটনা থেকেই সূত জাতির উৎপত্তি। পৃথিবীর প্রথম বর্ণসংকর–সূত্যায়ামভবৎ সূতঃ প্রথমং বর্ণবৈকৃতম্। ক্ষত্রিয় পিতার ঔরসে ব্রাহ্মণ-কন্যার গর্ভে তাঁর জন্ম। রাজাদের সারথিবৃত্তি অথবা তাঁদের মন্ত্রিসভায় একজন মাননীয় মন্ত্রী হওয়াটা তাঁর কাছে মুখ্য কোনও কাজ নয়। তার প্রধান কাজ- রাজা, মুনি-ঋষিদের বংশগৌরব কীর্তন করা, সৃষ্টি-প্রলয়-মন্বন্তরের বিচিত্র কথা শোনানো। আর ঠিক এই কাজেই সূত লোমহর্ষণের ভারত-জোড়া নাম।
লোমহর্ষণের আসল নাম কী ছিল, তাও বোধহয় সবাই ভুলে গেছে। তাঁর কথকতা, গল্প বলার ঢঙ ছিল এমনই উঁচু মানের যে তাঁর কথকতার আসরে শ্রোতাদের গায়ের লোম খুশিতে খাড়া হয়ে উঠত। তাই তাঁর নামই হয়ে গেল লোমহর্ষণ। লোমানি হর্ষয়াঞ্চক্রে শ্রোতৃণাং যঃ সুভাষিতৈঃ। স্বয়ং ব্যাসের তিনি প্রিয় শিষ্য। ব্যাস মহাকাব্য লিখেছেন, অষ্টাদশ পুরাণ লিখেছেন। তিনি লেখক–লেখার ‘অডিও-এফেক্ট’ তাঁর ভাল জানা নেই। যেদিন তিনি দেখলেন–তাঁরই লেখা জমিয়ে গল্প করে যে মানুষ শ্রোতাদের লোম খাড়া করে দিতে পারেন, সেদিনই বোধহয় তিনি এই সূতজাতীয় মেধাবী মানুষটির নাম দিয়েছিলেন লোমহর্ষণ এবং তাঁকে শিষ্যত্ব বরণ করে তাঁর মহাকাব্যের রসে দীক্ষা দিয়েছিলেন- শিষ্যো বভুব মেধাবী ত্রিষু লোকেষু বিশ্রুতঃ।
সেই লোমহর্ষণের ছেলে এসে উপস্থিত হয়েছেন শৌনকের আশ্রমে। উগ্রশ্রবা তাঁর নাম। কথকতায় লোম খাড়া করার ক্ষমতা তাঁরও আছে। লোকে তাঁকে যত না উগ্রশ্রবা নামে জানে, তার থেকে বেশি জানে–সে বাপকা বেটা– অর্থাৎ ভাবটা এই– আরে ও হচ্ছে লোমহর্ষণের ছেলে লৌমহর্ষণি, সূতের ছেলে সৌতি। আসলে লোমহর্ষণের কথকতা শুনলে যেমন শ্রোতার লোম খাড়া হয়ে ওঠে, তেমনই তাঁর ছেলেরও সেই ক্ষমতা আছে। এই জন্যই তাঁকে সবাই– লোমহর্ষণি বলেই বেশি ডাকে। মহাভারত তাই বলেছে– লোমহর্ষণপুত্রঃ উগ্রশ্রবাঃ সৌতিঃ। বাপের সুবাদে উগ্রশ্রবা সৌতিও ব্যাসের সঙ্গ পেয়েছেন। ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়নের তিনি বড় স্নেহভাজন।
লৌমহর্ষণ উগ্রশ্রবা যখন শৌনকের আশ্রমে এসে উপস্থিত হয়েছেন, তখন হয়তো সূর্য অস্ত গেছে। সারাদিন যজ্ঞক্রিয়ার পর তখন ঋষিদের অনন্ত অবসর। সবাই একসঙ্গে বসে আছেন, কথা দিয়ে কথা বাড়াচ্ছেন। ব্রহ্মচারী বালকেরা সমিৎ কুড়িয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। এই অবসর আর প্রশান্তির মধ্যেই লৌমহর্ষণি উগ্রশ্রবা তপোবনে প্রবেশ করেছেন।
লৌমহর্ষণিকে দেখে ঋষি-মুনিরা সব একেবারে হই-হই করে উঠলেন। সবাই মনে মনে একেবারে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। অনন্ত অবসর, অথচ বৃথা কাল না যায়– কেন হ্যবসরঃ কালো যাপনীয়ো বৃথা ন হি–কথক ঠাকুরের আগমন এই অবসর সফল করার একমাত্র উপায়। কথক ঠাকুর উগ্রশ্রবা সৎ-প্রসঙ্গ আর ধর্মকথা যতই বলুন, তার মধ্যে প্রধান আকর্ষণ হল গল্প। রাজা-রাজড়ার গল্প, ঋষি-মুনি অথবা ভগবানের বিচিত্র কাহিনী, লীলা প্রসঙ্গ। দিনভর বৈদিক ক্রিয়া-কলাপে ব্যস্ত ঋষিরা গল্প শোনার আনন্দে সবাই মিলে একেবারে ঘিরে ধরলেন সৌতি উগ্রশ্রবাকে–চিত্রা শ্রোতুং কথাত্ৰস্ত পরিবব্ৰুস্তপস্বিনঃ।
সৌতি সমবেত মুনি-ঋষিদের হাত-জোড় করে নমস্কার জানালেন। বললেন, ঠাকুরদের সব কুশল তো? আপনাদের ধর্ম-কর্ম-তপস্যা ঠিক মতো চলছে তো?
ঋষিরা কুশল বিনিময় করলেন উগ্রশ্রবা সৌতির সঙ্গে। এই বিশাল যজ্ঞ চলা-কালীন যদি কোনও পৌরাণিক এসে পড়েন– এই রকম একটা প্রত্যাশার ভাবনা ঋষিদের মনে ছিল বলে তাঁরা একটা বিশেষ আসন ঠিক করেই রেখেছিলেন। মুনিরা সবাই উগ্রশ্রবাকে ঘিরে বসে পড়লে তিনিও তাঁর নির্দিষ্ট আসনে বসলেন। এত দূরের পথ বেয়ে এসেছেন, জল-মিষ্টি খেয়ে তিনি খানিক জিরোলেন। ঋষি-ব্রাহ্মণেরা যখন দেখলেন–তাঁর শ্রান্তি আর নেই, তিনি বেশ আরাম করে জমিয়ে বসেছেন নিজের আসনে–সুখাসীনং ততস্তং বৈ বিশ্রান্তমুপলক্ষ্য চ– তখন তাঁরা বললেন, কোত্থেকে আসছ, সৌতি? এতদিন কোথায় কোথায় ঘুরলে?
উগ্রশ্রবা লৌমহর্ষণি বুঝলেন, ঋষিরা গল্প শোনার জন্য একেবারে মুখিয়ে আছেন। ঋষীণাং ভাবিতাত্মনাম। তিনি বললেন–পরীক্ষিতের ছেলে মহারাজ জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ চলছিল, ঠাকুর। আমি সেইখানেই ছিলাম। সেখানে মহর্ষি বৈশম্পায়ন ব্যাসের বলা মহাভারতের কথা শোনালেন সবিস্তারে। এতদিন সেই সব ভারত-কাহিনীই শুনলাম বসে বসে। তারপর সর্পষজ্ঞ সেরে এ তীর্থ সে তীর্থ ঘুরে পৌঁছলাম সমন্তপঞ্চকে, সেই যেখানে কৌরব-পাণ্ডবের যুদ্ধ হল–গতবানস্মি তং দেশং যুদ্ধং যত্রাভবৎ পুরা। সব দেখার পর মনে হল–একবার আপনাদের সঙ্গে দেখা করে যাই। তাই চলে এলাম।
এই দুটো কথা থেকেই উগ্রশ্রবা সৌতির গল্প বলার ক্ষমতা বোঝা যায়। উম্মুখ শ্রোতার কানে দুটো অব্যর্থ শব্দ সে ঢেলে দিয়েছে। এক জনমেজয়ের সপর্যজ্ঞ, দুই কুরু-পাণ্ডবের মহাযুদ্ধ। নৈমিষারণ্যের ব্রতক্লিষ্ট ঋষিরা অনেক দিন থেকেই জানতেন যে, মহান কৌরব-কুলে এক বিরাট জ্ঞাতি-বিরোধ ধুমিয়ে উঠছে কতকাল ধরে। কখনও কৌরবদের অবস্থা ভাল, কখনও পাণ্ডবদের–এই রকমই চলছিল। কিন্তু মাঝখানে এত বড় যুদ্ধ ঘটে গেছে, পরীক্ষিত রাজা হয়েও বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেননি– এই সব খবর তাঁরা সবিস্তারে জানেন না। আর জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞটা তো একেবারেই নতুন খবর। অতএব উগ্রশ্রবা সৌতির কথার সূত্রপাতেই সমুৎসুক ঋষিদের শ্রবণেচ্ছা শানিত হল।
আর এই সৌতির নিজের বোধ-বুদ্ধিও কম নয়। বৈশম্পায়নের বলা কথা শুনেই তিনি সন্তুষ্ট হননি। তিনি সরেজমিনে সমন্তপঞ্চকে গিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রের পরিবেশ পরিণতি দেখতে। জায়গাটা ভাল করে দেখা না থাকলে জ্ঞানী-গুণী ঋষি-মুনির সামনে ঘটনার বিবরণ দেবেন কী করে? তাছাড়া সমস্তপঞ্চক শব্দটা উপস্থিত ঋষি-মুনিদের কানটা খাড়া করে তুলল। কারণ, এই জায়গাটা অনেক কাহিনীর আকর। সেই সমস্তপঞ্চকে আবারও একটা নতুন ঘটনা ঘটেছে– এটা শ্রোতা ঋষিদের প্রশ্রয় উদ্রেক করার পক্ষে যথেষ্ট।
ঋষিরাও বুদ্ধিমান। তাঁরা শুধু সমন্তপঞ্চকের পরিণতি শুনে বিশাল এক উপন্যাস কাহিনীর মজা নষ্ট করতে চাইলেন না। তাঁরা বললেন, ওই যে বললে, দ্বৈপায়ন ব্যাসের কাহিনী, পুরাণ-কথা। তা ব্যাসের কথা মানেই তো বেদ-উপনিষদের নির্যাস, সূক্ষ্ম তত্ত্বের কথা, যার বহিরঙ্গে ভারতের ইতিহাস, বিচিত্র উপাখ্যান– ভারতস্যেতিহাসস্য পুণ্যাং গ্রন্থার্থসংযুতাম।
আসলে ঋষিদের মনে একটা পাপবোধ কাজ করছে। তাঁরা যজ্ঞ করতে এসেছেন। তাঁদের মনটা সদা সর্বদা যজ্ঞ অথবা যজ্ঞাঙ্গীয় কাজেই ব্যাপৃত রাখার কথা। কিন্তু যজ্ঞের প্রাত্যহিক পৌনঃপুনিকতা এধং অবসর তাঁদের ঠেলে দিয়েছে অভিনব কাহিনীর সন্ধানে। কিন্তু কাহিনী, আখ্যান-উপাখ্যান যদি ব্যাসের লেখা হয়, তবে তাঁদের বিরাট সুবিধে। যে মহাকবি চতুর্বেদের বিভাগ করেছেন, অষ্টাদশ পুরাণ লিখে তবে মহাভারত লিখতে বসেছেন, তিনি যে বেদ-উপনিষদ-পুরাণ উলটে দিয়ে শুধুই প্রাকৃতজনের গল্প-কথা বলে যাবেন না, সে কথা নিশ্চিত। ঋষিদের এইটাই বাঁচোয়া। যজ্ঞ-কার্যহীন একটা সময়েও তাঁরা বৃথা সময় কাটাচ্ছেন না–তাঁরা এমন একটা কাব্য-ইতিহাস শুনতে চাইছেন, যার মধ্যে পাপনাশিনী ধর্মকথাও যেমন আছে, তেমনই আছে বেদের হবির্গন্ধ এবং উপনিষদের শান্ত জ্ঞান- সূক্ষ্ণার্থন্যায়যুক্তস্য বেদার্থৈভূষিতস্য চ।
ঋষিরা বললেন– তুমি আরম্ভ করো, সৌতি। আমরা শুনতে চাই দ্বৈপায়ন ব্যাসের লেখা সেই কাহিনী। অদ্ভূত তাঁর ক্ষমতা, যিনি মহাভারতের মতো বিশাল গ্রন্থ রচনা করেছেন– ব্যাসস্য অদ্ভুতকর্মণঃ। মহারাজ জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে গিয়ে বৈশম্পায়নের মুখে সেই কাহিনীই তো তুমি শুনে এলে– জনমেজয়স্য যাং রাজ্ঞো বৈশম্পায়ন উক্তবান্। আরম্ভ করো তুমি।
.
০২.
সৌতি উগ্রশ্রবা এবার কথক-ঠাকুরের নিয়ম-কানুন মেনে–তাঁর গাওনা যাতে ভাল হয়, যাতে নির্বিঘ্নে মহাভারতের বিচিত্র পদ-পর্বগুলি শ্রোতার সামনে একের পর এক তিনি পরিবেশন করতে পারেন, তার জন্য পরম ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করে বললেন–
শুনুন তাহলে ঋষি-ঠাকুররা। এই জগতের আদি পুরুষ ভগবান শ্রীহরিকে নমস্কার। অদ্ভুতকর্মা দ্বৈপায়ন ব্যাসের লেখা মহাভারতের কথা বলব আমি। তবে দেখুন–আমিই কিন্তু সেই প্রথম লোকটি নই যে এই কাহিনী প্রথম বলছে। আমার আগেও অন্য কবিওয়ালারা এই কাহিনী বলে গেছেন, আমার সমসাময়িকেরাও বলছেন– আচখ্যুঃ কবয়ঃ কেচিৎ সম্প্রত্যাচক্ষতে পরে– আবার ভবিষ্যতেও অন্য কবিরাও আমারই মতো এই মহাভারতের ইতিহাস বলবেন।
সৌতির মুখে এই কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই একটু টান-টান হয়ে বসতে হয়। আজকের গবেষকরা অনেক তত্ত্ব-তথ্য প্রয়োগ করে, মহাভারতের নানান জায়গা খুঁজে নানান অসামঞ্জস্য খুঁজে বার করেন। এই অসামঞ্জস্যের সূত্রগুলি হল–বিভিন্ন চরিত্রের বয়স, ঘটনার সময় অসময়, শব্দ-ব্যবহার, স্টাইল, ছন্দ সব কিছু।
সব বিচারের পর একেক পণ্ডিতের একেক রকম ব্যবচ্ছেদ-পর্ব শুরু হয় মহাভারতের শরীরে। কেউ বলবেন– ভীমের রক্তপান, সে যে একেবারে আদিম সমাজের প্রতিহিংসা-প্রবণতা। এই প্রবণতার সঙ্গে মহাভারতের পরিশীলিত ব্যাপারগুলি মেলে না। অতএব ওই পরিশীলিত অংশটুকু পরে লেখা হয়েছে, ওটা প্রক্ষেপ। আরেক পণ্ডিত বলবেন– মহাভারতের মূল ক্ষত্রিয়-কাহিনীর সঙ্গে মহাভারতের নানা ঋষির জ্ঞান-দান, নীতি-কথা মোটেই মেলে না– ওগুলি সব ব্রাহ্মণ্য সংযোজন অর্থাৎ প্রক্ষেপ। আরেক দল কড়া পণ্ডিত– যাঁরা মহাভারত অশুদ্ধ হলেই ভীষণ রেগে যান– তাঁরা আবার শুধু মহাভারতের জ্ঞাতিবিরোধ আর যুদ্ধ কাহিনীটুকুই ধরে রাখতে চান। সেটাই শুধু মহাভারতের শুদ্ধ কাহিনী। আর সব পরে সংযযাজিত এবং সেই সংযোজন নাকি ভার্গব বংশীয় ব্রাহ্মণদের তৈরি; ঘটা করে তার নাম দেওয়া হল ভার্গব-প্রক্ষেপ। পণ্ডিতদের বুদ্ধি-ব্যায়ামে শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়িয়েছে, তাতে দেখা যাবে মহাভারতের মূল কাহিনী মোটেই বড় নয়। শুধু জ্ঞাতিবিরোধ, মন-কষাকষি এবং যুদ্ধ, তারপর আর সবই প্রক্ষেপ।
এইসব অসামান্য গবেষকের চিন্তা-দৃপ্ত পত্ররচনা দেখলে মনে মনে যুগপৎ প্রশংসা এবং মায়া-দুয়েরই উদয় হয়। প্রশংসা এই কারণে যে, এঁদের পড়াশুনো এবং বিদ্যার বিন্যাস-কৌশল সত্যিই অপূর্ব। আর মায়া এই জন্য যে, এঁরা কোনও কিছুই আর সামগ্রিকভাবে, স্বচ্ছ দৃষ্টিতে দেখতে পান না। সহজ জিনিসকে অনর্থকভাবে জটিল করে ফেলতে এঁরা এতই দক্ষ যে, প্রক্ষেপ-প্ৰক্ষেপ করতে করতে এরা মহাভারতের বিশাল আখ্যান-রসটাই আর অনুভব করতে পারেন না। এদের অবস্থা দেখলে একটা খারাপ কথা আমার মনে আসে যদিও সেটা সংস্কৃত নীতিশাস্ত্রের কথা। একজন রসিক-সুজন বলেছেন- কাব্যার্থ আস্বাদন করার সময় যারা শব্দের উৎপত্তি নিয়ে চিন্তা করেন, তারা আসলে শৃঙ্গারকালে রমণীর আবরণ উন্মোচনের সময় কাপড়ের দাম নিয়ে ভাবেন-নীবীমোক্ষণকালে তু বস্ত্র-মৌল্য-বিচিন্তকাঃ।
নতুন কিছু করার মতো ব্যবসায়-সম্পন্ন তথা পাটোয়ারি-বুদ্ধি-সমম্বিত এই সব পণ্ডিত-ধুরন্ধরের বক্তব্য কখনওই অকাট্য নয়; তবে তা কাটার মতো উপযুক্ত ইচ্ছা আমার কখনওই হয় না। হয় না, কারণ, আমরা জানি মহাভারতের গল্প এতই জনপ্রিয় যে, সেই জনপ্রিয়তার সুযোগে কথক-ঠাকুরদের অনেক গল্প, ঋষি-মুনিদের অনেক তত্ত্বজ্ঞান, মানুষের অনেক হৃদয়-স্পন্দন মিশে গেছে ভারত-কথার প্রবাহে। ভারত-কথা হয়ে উঠেছে মহা-ভারত।
কথক ঠাকুর সে কথা জানেন। ভারত-কথার আরম্ভেই তিনি স্বীকার করেন, আমিই কিন্তু প্রথম লোক নই যে এই কাহিনী শোনাচ্ছে। আমার আগেও কবিরা এই কথা বলেছেন, পরেও বলবেন- আখ্যাস্যন্তি তথৈবান্যে ইতিহাস মিমং ভুবি। সেই প্রাচীন কাল থেকে যে কথা গঙ্গার জলধারার মতো আজও বয়ে চলেছে, সেই জল-ধারার মধ্যে কবে কখন কোন গল্পের নদী এসে মিলল, কবে কখন কোন তত্ত্বের প্রবাহ এসে প্রবেশ করল, কখন কোন স্বার্থে স্বার্থান্বেষীর নালার জল ইচ্ছে করে গঙ্গার জলে খাল কেটে বইয়ে দেওয়া হল-গবেষণা করলে সে সবই অনেকটা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া যেতে পারে বটে, তবে সম্পূর্ণ জলধারার। মধ্য থেকে সেই ছোট ছোট নদীর জল, নালার জল আর চেনা যাবে কি? সব রকমের জল-প্রবাহ যখন গঙ্গায় পড়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল, তখন গঙ্গা যেমন সব জলকেই নিজের পবিত্রতার মাহাত্ম্য দান করে, তেমনই প্রক্ষিপ্ত অংশগুলিও মহাভারতের বিশাল শরীরে সম্পূর্ণ আত্মীকৃত হয়ে যাওয়ার ফলে স্পষ্ট করে তাদের যেমন আর চেনাও যায় না, তেমনই মহাভারতের প্রাপ্য মর্যাদা থেকেও সেই প্রক্ষিপ্তাংশগুলিকে বঞ্চিত করা যায় না।
বস্তুত বিরাট সুরধুনী-ধারার মধ্য থেকে দুই অঞ্জলি জল তুলে নিয়ে যেমন নির্দিষ্ট করে বলা যায় না- এটা অমুক শাখা-নদীর জল অথবা তমুক শাখা-নদীর, তেমনই মহাভারতের মধ্যেও প্রক্ষিপ্ত অংশগুলিকে আমাদের পরিশীলিত গবেষণার সূত্রে অনুমান-চিহ্নিত করা যায় মাত্র, তার বেশি কিছু করা যায় না। বলা যায় না– এটা অবশ্যই প্রক্ষিপ্ত অথবা এইটাই মূলাংশ। আমার ব্যক্তিগত মত হল, মহাভারত শুনতে হলে বা বুঝতে হলে অথবা আরও স্পষ্ট করে বলা ভাল– এই ভারতকে সামগ্রিকভাবে বুঝতে হলে মহাভারত যেমনটি আছে, তেমন ভাবেই তাকে ধরা ভাল। এরমধ্যে কোনটা ব্রাহ্মণ্য সংযোজন কোনটা ক্ষত্রিয়-সংযোজন এইসব অপোদ্ধার পদ্ধতি নিয়ে যারা বেশি মাথা ঘামান জানতে ইচ্ছে করে তাঁরা কি ভারতের জনজীবনেও রক্তের বিশুদ্ধতা নিয়েও মাথা ঘামান?
মহাভারতের শরীর ব্যবচ্ছেদ করে, অথবা পরতে পরতে তার লেয়ার তৈরি করে যারা ঢাকাই পরোটায় পরিণত করেছেন, তাদের যত রাগ ব্রাহ্মণ্য সংযোজনের ওপর। বিশেষত যেখানে নারীর অধিকার খর্বিত, শূদ্রেরা নিন্দিত অথবা আচার-ব্রতের জয়গান- সেই সব জায়গা পরিশীলিত গবেষকের চোখে ব্রাহ্মণ্য সংযোজনের উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মুশকিল হল- এগুলির কোন কোনটি যে পরবর্তীকালে সংযোজিত, আমিও মানি এবং এতদ্বারা নারী-শূদ্র এবং তথাকথিত নিম্নস্তরের জন-জাতির অধিকার যে বিপন্ন হয়েছে, তাও মানি, কিন্তু এগুলিকে শুধুই ব্রাহ্মণ্য সংযোজন বলে শুধু একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর ওপর জনরোষ তৈরি করারও কোনও অর্থ আছে বলে আমার মনে হয় না। যারা তা করছেন, তারা পূর্বতন অন্যায়ের প্রতিকার করার জন্য অন্যতর আরও এক অন্যায়ের আশ্রয় নিচ্ছেন।
তাছাড়া মনে রাখা দরকার, মহাভারতের যে অংশগুলি আধুনিক সমাজে নিন্দিত এবং প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হচ্ছে, সেগুলি যদি তর্কের খাতিরে ব্রাহ্মণ্য সংযোজন বলেও মেনে নেওয়া যায়– সত্যি বলতে কি আমিও তাই মানি– তবুও প্রশ্ন থেকে যায় যে, মহাভারতের মূল অংশ কি তাহলে ব্রাহ্মণেতর অন্য কোনও জাতির লেখা? ক্ষত্রিয় বৈশ্য বা শুদ্রের লেখা? বলতে দ্বিধা নেই–এ কথা বোধহয় গবেষণার শত সূত্রেও প্রমাণ করা যাবে না। তাহলে বলি- মহাকাব্যের প্রকৃষ্ট অংশটুকু যদি ব্রাহ্মণদের লেখা হয় এবং সংযোজনগুলিতেও যদি ব্রাহ্মণদেরই কর্তৃত্ব থাকে, তাহলে সিদ্ধান্ত হয়–সমাজে মহাকবি গোছের ভাল ব্রাহ্মণও যেমন ছিলেন আবার তেমনই অকবি, স্বেচ্ছাবিহারী, স্বার্থান্বেষী ব্রাহ্মণেরাও ছিলেন। একই জাতির একটি বিশেষ গোষ্ঠীর দোষে সমগ্র ব্রাহ্মণ জাতি গালাগালি ধান কেন? মানব সমাজের মুক্তি যাদের কাছে কাম্য, তাদের কাছে নিবেদন হয় এই বিভেদ সৃষ্টির খেলা বন্ধ করুন, নয়তো ব্রাহ্মণ্য সংযোজন’–এই শব্দটির সাধারণীকরণ বর্জন করে ‘দুষ্ট ব্রাহ্মণ্য সংযোজন’ বলুন। সাধারণভাবে বললে স্বীকার করতেই হবে যে, ব্রাহ্মণরা নারী-শূদ্র বা বহু জন-জাতির প্রতি অন্যায় আচরণ যেমন করেছে, তেমনই সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভাল কাজও কিছু করেছে। তার উদাহরণ দিতে পারি ভূরি ভূরি।
থাক এসব কথা। উগ্রশ্রবা সৌতি যে মুহূর্তে মহাভারতের আখ্যান আরম্ভ করেছেন, সে মুহূর্তেই তিনি জানেন–তিনি যা বলছেন, সেই কথা-কাহিনী তার পূর্বজরা হয়তো আরও একভাবে শুনেছেন এবং আরও অন্য কোনওভাবে বর্ণনাও করেছেন হয়তো ব্যাখ্যঃ কবয়ঃ কেচিৎ। তিনি জানেন- মহাভারতের কথা ভারতের মতোই বিচিত্র এবং ততোধিক বিচিত্র এক মানবগোষ্ঠীর জীবনের প্রতিফলন। তিনি জানেন–ভারতের তথাকথিত আর্য সম্প্রদায় কোনো ভাবেই রক্তের বিশুদ্ধতা টিকিয়ে রাখতে পারে না। শত কবির দর্শন মনন এবং কখনও বা স্কুল হস্তের অবলেপও ঘটেছে এখানে। একটি বিশাল জাতির ইতিহাস কখনও কোনও একক কবির মনন-সীমায় আবদ্ধ হতে পারে না। জন-জাতির শরীরে মনে যখন যে প্রভাব এসেছে, কবিরাও তা ধরে রেখেছেন মহাকাব্য-ইতিহাসের প্যানোরমায়।
হয়তো এই কারণেই-কথাটা ভেবে দেখবেন একটু–মহাভারত বিশালবুদ্ধি ব্রাহ্মণ ব্যাসের লেখা হলেও, সে কাহিনী বৈশম্পায়নের মতো এক ব্রাহ্মণের মুখে প্রাথমিকভাবে উচ্চারিত হলেও আমরা যে কথক-ঠাকুরের মুখে মহাভারতের কথা শুনছি, তিনি কিন্তু একজন সংকরজ কবি, তিনি সূত-জাতীয়। মহাভারতের বিচিত্র সংযোজন-পর্বের নিরিখে যে সাস্কর্যের সৃষ্টি হয়েছে, সেই সাক্কর্য এই সূতজাতীয় কথক ঠাকুরের মধ্যেও আছে। হয়তো সেই কারণেই কোনও ব্রাহ্মণ নয়, ক্ষত্রিয়ও নয়, কিংবা বৈশ্যও নয়, একজন সূত-জাতীয় ব্যক্তিই মহাভারতের বক্তা নির্বাচিত হয়েছেন।
সূত কাকে বলে জানেন? প্রাচীন নৃতত্তের সূত্রে দুভাবে ‘সূত’-শব্দটির ব্যাখ্যা করা যায়। যদি মনু মহারাজকে আমরা প্রাচীন নৃতত্ত্ব অথবা জাতিতত্ত্বের প্রধান ভাষ্যকার বলে মেনে নিই, তাহলে ‘সূত’ শব্দের প্রধান ব্যাখ্যা হল–ক্ষত্রিয় বীর-পুরুষ যদি ব্রাহ্মণী বিয়ে করে বসতেন তবে তাদের ছেলেদের জাতিগত উপাধি হত সূত– ক্ষত্রিয়া বিপ্রকন্যায়াং সূতো ভবতি জাতিতঃ। মহাভারতের বক্তা সূত লোমহর্ষণকে অথবা সৌতি উগ্রশ্রবাকে যদি এই ব্যাখ্যায় বিচার করি, তাহলে বোধহয় ঠিক হবে না।
বস্তুত মহাভারত বা পুরাণের যুগে সূত বলে একটা আলাদা ক্লাসই ছিল। পুরাণগুলির মধ্যে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীতে যেদিন আমরা প্রথম রাজা পেয়েছি, সেদিন থেকে আমরা সূত’কেও পেয়েছি। পুরাণ মতে এই পৃথিবীর প্রথম সার্থক রাজা হলেন পৃথু–যার নামে এই পৃথ্বী বা পৃথিবী। তা পৃথু যেদিন জন্মালেন, সেইদিনই পিতামহ ব্রহ্ম সোমযজ্ঞের আহুতি-ভূমিতে সূত এবং মাগধদের সৃষ্টি করলেন। সমাগত মুনি-ঋষিরা সূত-মাগধদের অনুরোধ করলেন মহান পৃধুর স্তব করতে
সেই যে প্রথম সূত-মাগধেরা পৃথুর স্তব করেছিলেন, তার পর থেকেই এঁরা চিহ্নিত হয়ে গেলেন রাজবংশের কীর্তি-গায়ক হিসেবে। বিভিন্ন রাজবংশের কীর্তিখ্যাতি, মুনি-ঋষিদের আশ্চর্য সব তপশ্চর্যা– সব এই সূতেরা স্মৃতিতে ধরে রাখতেন বলেই সূতেরাই ছিলেন সে যুগের ঐতিহাসিক, যাকে তৎকালীন পুরাণের ভাষায় বলা হয় পৌরাণিক’–সূতাঃ পৌরাণিকা থোক্তাঃ।
মহাভারতে দেখবেন প্রথমেই বলা হচ্ছে লোমহর্ষণ সূতের ছেলে ‘পৌরাণিক উগ্রশ্রবা এসেছেন শৌনকের আশ্রমে লোমহর্ষণপুত্র উগ্রশ্রবাঃ সৌতিঃ পৌরাণিকো নৈমিষারণ্যে। প্রাচীন সমাজের মুনি-ঋষিরা সূতদের যথেষ্ট সম্মান করতেন, কারণ তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি পড়াশুনো ছিল ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মতোই গভীর–পুরাণের ভাষায়–অমলপ্রজ্ঞাঃ। যদি ধরে নিই–মনুর বিধান মতো ক্ষত্রিয়-পুরুষ আর ব্রাহ্মণী সুন্দরীর মিলনে যে সূত-জাতি তৈরি হয়েছিল, কালক্রমে তারাই পৌরাণিক, ঐতিহাসিক হয়ে গেলেন, তাহলেও বলতে হবে– রাজবংশ এবং মুনিবংশের ইতিহাসই শুধু নয়, মহাভারতের মতো বিশাল এই ইতিহাস শোনানোর জন্যও নয়, কালে কালে মহাভারতের বিভিন্ন সংযোজন-পর্ব শোনাবার পক্ষে তারাই সবচেয়ে উপযুক্ত লোক– যাঁদের ভাষ্য দেওয়ার ক্ষমতা পৃথুরাজের সময় থেকেই চিহ্নিত এবং যারা জন্মগতভাবে সংকর।
সংকর বলেই ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের এমন বিচিত্র সংকর মহাভারতের ইতিহাস বলার ভার সূতেরই ওপর। সংকর বলেই কালে কালে ভিন্ন ভিন্ন কবির ভিন্ন ভিন্ন সংবোজন তার কাছে অচ্ছুৎ নয়, তারা সব মিলিয়ে দিতে পারেন। মহাভারতের প্রত্যেক ঘটনার ওপর, প্রত্যেক আগন্তুক তত্ত্ব এবং তথ্যের ওপর সূতের মায়া আছে। আর মায়া আছে তাদের ওপর–যারা পূর্বে তাদেরই মতো করে মহাভারতের কথা শুনিয়েছেন। সহমর্মিতা আছে তাদের ওপর যারা তার সম-সময়ে মহাভারতের আখ্যান বলে যাচ্ছেন। শুভেচ্ছা আছে তাদের জন্য যারা ভবিষ্যতে ভারত-কথার মর্যাদাতেই মহাভারত শোনাবেন- আখ্যাস্যন্তি তথৈবান্যে ইতিহাসমিমং ভুবি। আমার গর্ব আমি সেই সংকরজম্মা সূতের আশীর্বাদ-ভাগী –যে আজও মহাভারতের কাহিনী সূতের আশ্রয় নিয়ে বোঝাতে চায়। পাঠকেরা আমাকে কিছু কাল সহ্য করুন যাতে উগ্রশ্রবা সৌতির বিচিত্র কাহিনী আজকের দিনের মানসিকতায় আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি।
একটি কথা মহাভারতের কবির সমান হৃদয় নিয়ে বোঝা দরকার যে, মহাভারতের বিভিন্ন পর্বে ব্রাহ্মণের সংযোজন যাই থাকুক, কিন্তু সেই ব্রাহ্মণের স্পর্শদোষে মহাভারতের সার্বত্রিকতা নষ্ট হয়ে যায় না। সহানুভূতি নিয়ে স্মরণ করুন মহাপ্রস্থান পর্বের সেই আশ্রিত অস্পৃশ্য কুকুরের কাহিনী। মহারাজ যুধিষ্ঠির তাকে ধর্মরূপী বুঝে সঙ্গে নিয়ে যাননি, ঘৃণিত কুকুরত্বের মর্যাদা বা অমর্যাদাতেই যে যুধিষ্ঠিরের আশ্রয়-সরসতা ভোগ করেছিল। মহাভারতের শেষ, মহাপ্রস্থানের পথে একটি কুকুরেরও যে মর্যাদা বা সম্মান আছে, মহাভারতের আদিতেও তাই।
আমরা পণ্ডিত-অধ্যাপকদের কাছে শুনেছি যে, প্রাচীন কবি-নাট্যকারদের লেখার একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল। তারা নাকি যে ঘটনা দিয়ে কাব্যারম্ভ করেন, কাব্য-বা নাটকের শেষেও নাকি সেই ঘটনা অথবা অনুরূপ ঘটনার সূচনা থাকে। অথবা কাব্য-নাটকের প্রথম ভাগটা যদি সমস্যা দিয়ে শুরু হয়, তবে শেষ হয় সমাধান দিয়ে। যেমন ধরুন কালিদাসের অভিজ্ঞান-শকুন্তল নাটকের প্রথম অঙ্কে কণ্বমুনির আশ্রমে আমরা প্রথম শকুন্তলা-দুষ্যন্তকে মিলিত হতে দেখেছি। তারপর অনেক বাধা, অনেক ঝড়-ঝঞ্জার পর নাটক-শেষের সপ্তম। অঙ্কে মঞ্চ স্থাপিত হয়েছে মহর্ষি মারীচের আশ্রমে। সেখানে আবার আমরা শকুন্তলা-দুষ্যন্তকে মিলিত হতে দেখছি। মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে যে প্রণয়-কুসুম প্রস্ফুটিত হয়েছিল, মহর্ষি মারীচের আশ্রমে সেই প্রণয়-কুসুম ত্যাগের মাহাত্মে সুমধুর ফলে পরিণত হল। অন্য ক্ষেত্রে যদি ভগবদ্ গীতার মতো একটা দার্শনিক গ্রন্থের দৃষ্টান্ত গ্রহণ করি, তাহলে দেখবেন–গীতার আরম্ভ হচ্ছে অর্জুনের বিষাদ এবং মোহে। যুদ্ধক্ষেত্রে ভাই-বেরাদরকে দেখে অর্জুন একই সঙ্গে কৃপাবিষ্ট এবং মোহগ্রস্ত। তারপর অধ্যায়ের পর অধ্যায় জুড়ে দার্শনিক তত্ত্ব এবং তাত্ত্বিক বিবৃতি। অধ্যায়ের শেষে দেখা যাচ্ছে আবার সেই মোহের কথা ফিরে এসেছে। কৃষ্ণের উপদেশে। অর্জুন এখন সম্পূর্ণ মোহমুক্ত। সমস্যা যা ছিল তার সমাধান হয়ে গেছে। উপদেশদীপ্ত অর্জুনের মুখে তখন সদর্প ঘোষণা শোনা যাচ্ছে আর আমার কোনও মোহ নেই, কৃষ্ণ! আমি আবার। স্ব-রূপে প্রতিষ্ঠিত–নষ্টো মোহঃ স্মৃতি লা ত্বৎপ্রসাদাৎ ময়াচ্যুত। স্থিতোস্মি গতসন্দেহঃ করিষ্যে বচনং তব।
মহাভারত মহাকাব্যখানিকেও এই নিরিখে দেখা যায়। এখানেও মহাকাব্যের শেষে আমরা যেমন এক অধম কুকুরের কাহিনী দিয়ে মহাপ্রস্থানের শেষ সূচনা দেখতে পাচ্ছি, তেমনই ভারতকথার আরম্ভেও উগ্রশ্রবা সৌতি এক কুকুরের কাহিনী দিয়েই শুরু করেছেন। মহাভারতের মূল আরম্ভে অধ্যায়-সূত্র ছাড়াও আরও দু-চারখানা গল্প আছে বটে, তবে মহাভারতে যেহেতু কৌরব-পাণ্ডবের বংশ বিস্তার এবং তাদের যুদ্ধই প্রাধান্য পেয়েছে, তাই পাণ্ডবের শেষ বংশধর জনমেজয়ের কথা না বলে মহাভারতের কথায় প্রবেশই করা যায় না। জনমেজয়ই হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি তার সর্পযজ্ঞে ব্যাসদেবের কাছে মহাভারতের কথা শুনতে চান। অতএব মহাভারতের ঘটনা-সূচি বর্ণনা করেই সৌতি উগ্রশ্রবা জনমেজয়ের প্রসঙ্গে এসেছেন এবং জনমেজয়ের প্রসঙ্গ-মাত্রেই এসেছে একটি কুকুরের কাহিনী।
মনে রাখতে হবে একটি প্রাণী হিসেবে কুকুর যতই প্রভুভক্ত এবং মহনীয় হোক, কুকুর নিয়ে প্রাচীনদের কিছু শুচিবাইও ছিল। অবশ্য কুকুরদের দোষও কম ছিল না। কোনও জায়গায় হয়তো ঋষিরা মন দিয়ে যজ্ঞ করছেন। কোত্থেকে একটা কুকুর এসে যজ্ঞের ঘি খানিকটা চেটে দিয়ে গেল, অথবা মুখে করে নিয়ে গেল খানিকটা পুরোডাশ। চপলমতি কুকুরের এই অবিমৃশ্যকারিতায় ঋষিরা এতটাই পীড়িত বোধ করতেন যে, কুকুরের চেটে দেওয়া ঘি তারা অপবিত্রবোধে যজ্ঞে ব্যবহার করতেন না। স্বয়ং মনু মহারাজ আবার এতটাই শঙ্কাপ্রবণ ছিলেন যে, তিনি বলেছেন–দেশ যদি অরাজক হয়, তবে সেই অরাজকতার জন্য এতটাই অমঙ্গল দেখা দিতে পারে যে, কুকুরও যজ্ঞের ঘি চেটে দেবে, কাকও যজ্ঞের পুরোডাশ নিয়ে উড়ে পালাবে অদ্যাৎ কাকঃ পুরোডাশং শাবলিহাদ হবিস্তথা। কুকুরের এই হবিলেহন-প্রবৃত্তি, এবং সেই কারণেই তাদের ওপর ব্রাহ্মণ-সমাজের বিরক্তি–এই দুটিই প্রাচীনকালে প্রায় বাদিক স্তরে পৌঁছেছিল- এই কথাটি মনে রেখেই আমরা জনমেজয়ের প্রসঙ্গে আসছি।
পরীক্ষিতের পুত্র জনমেজয় ভাইদের সঙ্গে মিলে এক যজ্ঞ আরম্ভ করেছিলেন। জনমেজয়ের ভাইরা হলেন- শ্রুতসেন, উগ্রসেন এবং ভীমসেন। তাদের যজ্ঞ চলার সময়। একটি কুকুর সেখানে উপস্থিত হল। জনমেজয়ের ভাইরা যজ্ঞস্থলে কুকুর দেখে সেটিকে যথেষ্ট মারধর করে তাড়িয়ে দিলেন। কুকুরটি কাঁদতে কাঁদতে কুকুর-মায়ের কাছে গিয়ে উপস্থিত হল। তার মা ছেলেকে চেটে আদর করে বলল, কাঁদছিস কেন? কে তোকে মেরেছে? সে বলল, রাজা জনমেজয়ের ভাইরা আমাকে খুব মেরেছে মা। মা-কুকুর বলল, তুই নিশ্চয়ই কোনও অন্যায় করেছিস, নইলে শুধু শুধু তারা তোকে মারবে কেন? ছেলে কুকুর বলল, না গো মা। আমি কিচ্ছুটি করিনি। আমি যজ্ঞের ঘিয়ের দিকে ফিরেও তাকাইনি, চাটিওনি সেই ঘিনাপরাধ্যামি কিঞ্চিৎ, নাবেক্ষে হবীংষি নাবলিহে ইতি। বস্তুত এই বাচ্চা কুকুরটিও জানে অথবা কুকুর-মায়ের কাছে সে প্রশিক্ষণ পেয়েছে যে, যজ্ঞের ঘি চাটতে নেই, দেবতার অগ্রভাগ লোভের দৃষ্টিতে দেখতে নেই।
কুকুর-মা ছেলের অভিযোগ শুনে রাজা জনমেজয়ের কাছে যজ্ঞস্থলেই উপস্থিত হল। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে সে রাজাকে বলল, এই আমার ছেলে। একটা কোনও অপরাধ করেনি সে, না চেটেছে ঘি, না ফিরেও সেদিকে চেয়ে দেখেছে; ততো কেন তাকে মারা হল? জনমেজয় সামান্যা কুকুরীর কথার জবাব দিতে পারলেন না। লজ্জায় তার ভায়েরা মাথা নিচু করলেন। কুকুর-মা বলল, যেহেতু কোনও অন্যায় না করেও আমার ছেলে শুধু শুধু মার খেল, তার ফল ভুগতে হবে এই রাজাকে। দেখবে, এমন কোনও ভয় তোমাদের সামনে এসে উপস্থিত হবে, যা তোমরা ভাবতেও পারছ না–যৗঁদভিহতোনপকারী তস্মাদদৃষ্টং ত্বাং ভয়মাগমিষ্যতি।
এখানে দুটি-তিনটি জিনিস ভাবার আছে। এখনকার দিনে–অন্যায় না করে যদি মার খেতেন, তাহলে সেটাই হত স্বাভাবিকতা। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক হয়ে উঠবে তখনই, যদি নিরপরাধে মার খাওয়ার পরেও আপনি যদি ন্যায়বিচার চাইতে যান। উকিলে ছুঁলে তো ছত্রিশ ঘা, আর যদি সোজাসুজি পুলিশের কাছে যান, তবে আরও মার খাওয়ার ভয়, আর যদি গণতন্ত্রের রাজদ্বারে যান, তবে শুনবেন, এমন তো হয়েই থাকে, কী আর করা যাবে। কিন্তু সে যুগে একটি সামান্য কুকুরও কিন্তু স্বয়ং যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়ে খোদ রাজার বিরুদ্ধেই অভিযোগ জানিয়েছে। বলতেই পারেন- কুকুরের কথাটা রূপকমাত্র, কুকুর কী আর কথা বলে? অভিযোগ জানায়? আমাদের বক্তব্য, রূপক বলেই এই ঘটনার সামাজিক মূল্য আরও বেশি। অর্থাৎ একজন সামান্য প্রাণী-মাত্রেরও রাজার দরবারে যাওয়া এবং স্বয়ং তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনার ক্ষমতা ছিল, আজকের এই সোনার গণতন্ত্রে যা অসম্ভব।
দ্বিতীয়ত, যে সমাজের স্বার্থান্বেষীরা বিধান দিয়েছিলেন-শকুনের অভিশাপে গরু মরে না– এ সমাজ তার থেকে প্রগতিশীল। পরবর্তীকালে যে সময়ে উচ্চবর্ণের ব্যক্তিরা নিজেরা সৎ আচরণ না করে অন্যকে অভিশাপের ভয় দেখাতেন, সেই সমাজে নিম্নবর্ণের ব্যক্তিরা যদি অতিষ্ঠ হয়ে উচ্চতরের প্রতি অপশব্দ উচ্চারণ করতেন, তবে শুনতে হত- শকুনের অভিশাপে গরু মরে না। কিন্তু এখানে দেখছি-শকুন না হোক, কুকুরের অভিশাপে রাজা। লজ্জিত, চিন্তিত, ব্যতিব্যস্ত-ভূশং সম্রান্তো বিষণ্ণশ্চাসীং। যজ্ঞ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজা হস্তিনানগরীতে ফিরে এসেছেন এবং ভীষণভাবে চিন্তা করতে আরম্ভ করেছেন। তিনি একজন উপযুক্ত পুরোহিতের খোঁজে বেরিয়েছেন, যিনি কুকুরীর ওই অভিশাপ নিরস্ত করতে পারেন। এমনি খুঁজে পুরোহিত পাওয়া যায়নি। শেষে একদিন মৃগয়ায় বেরিয়ে একটি মুনির আশ্রম চোখে পড়ে রাজার। মুনির নাম শ্রুতবা। তার উপযুক্ত পুত্র সোমশ্ৰবাকে পৌরোহিত্যে বরণ করে নিয়ে আসেন জনমেজয়।
ঋষির পৌরোহিত্যে কুকুরীর শাপ কতটা কেটে গিয়েছিল মহাভারতের কবি তা বলেননি, কিন্তু একজন রাজা সামান্যা কুকুরীর অভিযোগ এবং আক্ষেপে কতটা উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, সেটা এযুগেও ভাবার মতো। আমাদের কাছে এই কুকুরীর বিবরণ তৃতীয় এক কারণে মূল্যবান। মহাভারতের মধ্যে যারা ব্রাহ্মণ্য-সংযোজনের চিহ্নে আতঙ্কিত হন, তাদের কাছে আমার নিবেদন- মহাশয়! এই কুকুরীর মর্যাদা-রক্ষার জন্য ক্ষত্রিয় রাজার দুশ্চিন্তা এবং লজ্জাবোধও কিন্তু ব্রাহ্মণদেরই সংযোজন। আমি অবশ্য এটাকে সংযোজন মনে করি না। আমি এটাকে মহাভারতের উপক্রমণিকা মনে করি। অপিচ আমি এটাকে ব্রাহ্মণ্য সংযোজনও মনে করি না, আমি এটাকে কবিওয়ালার গৌরচন্দ্রিকা মনে করি। যদি তাই হয়, তবে এটি সৌতি উগ্রশ্রবার সংযোজন অর্থাৎ অব্রাহ্মণের সংযোজন।
কথাটা অবশ্য এখানেও নয়, কথাটা হল- যা পেয়েছি প্রথম দিনে তাই যেন পাই শেষে। মহাভারতের মহাপ্রস্থানিক কুকুরের কাহিনী দিয়ে তার ভারতবংশের ইতিহাস শেষ করেছেন, সৌতি উগ্রশ্রবাও তাই আরম্ভ করেছেন এক কুকুরের কাহিনী দিয়ে। সারা মহাভারত জুড়ে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের ওপরে যে আপাত পক্ষপাত নিয়ে নব্য গবেষকেরা আহত বোধ করেন, তারা যেন এই মহাকাব্যের আদি এবং অন্তে সামান্য কুকুরের চরিত্র দেখে খানিকটা আশ্বস্ত বোধ করেন। তথাকথিত অধম প্রাণীর প্রতি করুশার চিহ্নে যে মহাভারতের আদি এবং অন্ত চিহ্নিত, তার সমস্ত মধ্যভাগ জুড়ে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের প্রতি নিরঙ্কুশ পক্ষপাতই যে শুধু থাকবে না সে কথা আমি শুরুতেই জানিয়ে রাখলাম।
আজকের দিনে ফিল্মের ভাষায় আপনারা যাকে ফ্ল্যাশব্যাক বলেন, সেই ফ্ল্যাশব্যাকের কায়দাতেই মহাভারতের কাহিনীর আরম্ভ। কুরু-পাণ্ডবের বিরাট যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে মহারাজ যুধিষ্ঠির খুব বেশি দিন রাজত্ব করতে পারেননি। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে মহারাজ দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন–সারা জীবনে যা পাবার আমি পেয়েছি। ভোগ ও লাভ করেছি ইচ্ছামতো। কিন্তু সমস্ত জ্ঞাতি-বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন হারিয়ে তুমি কোথায় রাজত্ব করবে, যুধিষ্ঠির? তোমার রাজ্যের বাসিন্দা হবেন কতগুলি বিধবা আর কতগুলি সন্তানহীন মাতা।
কথাটা একেবারে মিথ্যে বলেননি দুর্যোধন। রাজ-সিংহাসনে বসে যুধিষ্ঠির মোটেই সুখ পাননি। মাত্র ছত্রিশ বছর সে কালের দিনের আন্দাজে সময়টা কিছুই নয়; মাত্র ছত্রিশ বছর রাজত্ব করে, পাণ্ডব-কৌরবের একমাত্র সন্তান-বীজ পরীক্ষিতকে সিংহাসনে বসিয়ে যুধিষ্ঠির মহাপ্রস্থানের যাত্রা শুরু করেছেন। যখন সিংহাসনে বসেছেন পরীক্ষিতের বয়সও তখন ছত্রিশ। কারণ, পাণ্ডব-কৌরবের মহাযুদ্ধের শেষেই তার জন্ম। তারও রাজত্বকাল অতি অল্প। মাত্র চব্বিশ বছর। তিনি অকালে মারা গেলেন তক্ষক সাপের দংশনে। রাজা হয়ে বসলেন তার পুত্র জনমেজয়।
জনমেজয় পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে সর্প-যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। সেই সর্প-যজ্ঞেই মহাভারত-কথার সূচনা। আস্তীক মুনি এসে জনমেজয়ের সর্প-যজ্ঞের ছেদ টানলেন। যজ্ঞ স্তব্ধ হল এবং মহাভারতের কথা আরম্ভ হল। সর্পযজ্ঞে যোগদান করেছিলেন যত রাজ্যের মুনি-ঋষিরা। আর উপস্থিত ছিলেন মহামুনি ব্যাস। কুরু-পাণ্ডবের বংশধারায় ব্যাসের নিজের রক্ত আছে, মমত্ব আছে। ফলে বাণপ্রস্থে ধৃতরাষ্টের মৃত্যু, যুধিষ্ঠিরের মহাপ্রস্থানের পরেই তিনি মহাভারত রচনা করেন। রচনা করেন কৌরব-পাণ্ডববংশের পূর্ব এবং উত্তর ইতিহাস। গোটা মহাভারতটা লিখতে তার তিন বচ্ছর সময় লেগেছিল। হয়তো হাতে-কলমে লেখা যাকে বলে সেভাবে তিনি মহাভারত লেখেননি কিন্তু মহাভারতের পুরো বয়ানটা মনে মনে পুরো ছকে নিতে তার সময় লেগেছিল তিন বচ্ছর ত্রিভিবর্ষে মহাভাগঃ কৃষ্ণদ্বৈপায়নো’ব্রবীৎ। মহাভারত কীভাবে শব্দ-ছন্দ-অলংকারের পরিসরে বাঁধা পড়ল–সে কথায় পরে আসছি। কিন্তু দুটি ভিন্নতর পরিস্থিতিতে মহাভারতের কথা কী ভাবে আরম্ভ হচ্ছে সেটা আগে বুঝে নিতে হবে।
মনে রাখা দরকার–উগ্রশ্রবা সৌতি মহাভারতের কথা বলছেন নৈমিষারণ্যে বসে। এখানে তিনি বক্তা। কিন্তু তিনিই আবার শ্রোতা হিসেবে ছিলেন মহারাজ জনমেজয়ের সভায়। সেখানে বক্তা ছিলেন ব্যাস-শিষ্য বৈশম্পায়ন। খেয়াল করে দেখবেন– মূল মহাভারত বলার আগে নৈমিষারণ্যে বসে উগ্রশ্রবা সৌতি মহাভারতের মূল ঘটনাগুলি সূত্রাকারে বলে গেছেন। এতে সমবেত ঋষিদের মনে বিস্তারিত কাহিনী শোনবার স্পৃহা জেগেছে। অন্যদিকে জনমেজয়ের সভায় বৈশম্পায়নও প্রথমে একই ভাবে সূত্রাকারেই মহাভারতের কথা বলেছেন এবং তাতে জনমেজয়ের বক্তব্য আপনি বিস্তারিতভাবে সব কাহিনী বলুন মহর্ষি! আমার পূর্বজ মহান পাণ্ডব-কৌরবদের কীর্তিকলাপ এত অল্প শুনে মোটেই তৃপ্তি হচ্ছে না আমার- ন হি তৃপ্যামি পূর্বেষাং শূনশ্চরিতং মহৎ। বৈশম্পায়ন বিস্তারিতভাবে কাহিনী আরম্ভ করলেন।
.
০৩.
জনমেজয়ের সর্প-যজ্ঞের সভা এবং নৈমিষারণ্য–এই দুয়ের মধ্যে যে ভৌগোলিক দূরত্ব আছে, তার সঙ্গে আছে সময়ের দূরত্ব। ব্যাস যে কাহিনী রচনা করেছিলেন, তার শেষে ছিল ধৃতরাষ্ট্র-বিদুরের জীবন-শেষের পর্ব আর ছিল যদুবংশের ধ্বংস এবং যুধিষ্ঠিরের মহাপ্রস্থান। বৈশম্পায়ন এই পর্যন্তই মহাভারত জানেন। কিন্তু উগ্রশ্রবা সৌতি যখন মহাভারত বলছেন, তখন ক্ষীয়মাণ পাণ্ডব-বংশের অঙ্কুর পরীক্ষিতের মৃত্যু হয়ে গেছে। আর সেই প্রতিশোধে যে সর্পষজ্ঞ হয়েছিল, সেই যজ্ঞসভায় সৌতি উপস্থিত ছিলেন। ফলত পরীক্ষিতের মৃত্যু এবং জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞের বিবরণ আমাদের শুনতে হবে নতুন এই কবিওয়ালার কাছে। তিনি উগ্রশ্রবা সৌতি।
মুশকিল হল– উগ্রশ্রবা সৌতি নতুন কবিওয়ালা। তিনি কেমন বলেন, কেমন তার কথকতা, সে সম্বন্ধে সমবেত ঋষিদের ধারণা নেই। সৌতি অবশ্য এসে ইস্তক থেমে থাকেননি। তিনি ঋষিদের কাছে এ কাহিনী সে কাহিনী বলে যাচ্ছেন। নৈমিষারণ্যের কুলপতি শৌনক অভিজ্ঞ লোক। তিনি নতুন কবিওয়ালাকে স্বাগত জানিয়েছেন বটে, বসতে দিয়েছেন, ফল-মূল সেবা করতে দিয়েছেন বটে, কিন্তু মূল মহাভারতের কথকতার ব্যাপারে শৌনক এই নতুন কবিওয়ালাকে আগেই তত পাত্তা দেননি। তিনি সৌতিকে বসিয়ে রেখেই চলে গেছেন অগ্নিশরণ গৃহে- যেখানে তার বারো বছরের যজ্ঞের ক্রিয়াকলাপ চলছে।
সৌতি উগ্রশ্রবা অবশ্য থেমে থাকেননি। তিনি তার কথকতার ক্ষমতা দেখিয়ে যাচ্ছেন। দু-চারটে উটকো কাহিনী তিনি বলে যাচ্ছেন নিতান্ত খাপছাড়া ভাবে। যদিও খাপছাড়া হলেও এগুলি অর্থহীন নয়। তিনি একবার মহাভারতের সংক্ষেপ-সূত্রগুলি বলে যাচ্ছেন, একবার জনমেজয়ের সপত্রের কথা বলছেন, একবার পরীক্ষিতের মৃত্যুর কথাও বলছেন। আবার কখনও বা সাপের কথায়, জনমেজয়ের কথার সূত্র ধরে উপমন্যর কাহিনী, উতঙ্কের কাহিনী, রুরু-প্রমদ্বরার কাহিনীও বলে যাচ্ছেন। পণ্ডিতেরা মহাভারতের মূল কাহিনীর সঙ্গে বেমিল দেখে এই সব কাহিনীর মধ্যে প্রক্ষেপের গন্ধ পেয়েছেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে এই কাহিনীগুলির মধ্যে নতুন কথক-ঠাকুরের আত্মঘোষণা দেখতে পাই। সে-কালের কবিওয়ালাকে ইতিহাস-পুরাণের তত্ত্ব-কাহিনী, লোক-কথা ভাল করে জানতে হত। একইভাবে সেকালের কথক-ঠাকুরদেরও বেদ-উপনিষদের মর্মকথাও জানতে হত। তাদের সময়েই যেহেতু ইতিহাস-পুরাণের কথকতা আরম্ভ হয়েছে, অতএব পূর্ববর্তী বেদ-উপনিষদের কল্প-কাহিনীগুলি বলে তারা কথকতার নমুনা দেখাতেন।
মহাভারতের মূল কাহিনী আরম্ভ করার আগে উগ্রশ্রবা সৌতি দেখাতে চাইছেন। তিনি পারবেন। বেদ-উপনিষদের নিগুঢ় তত্ত্ব তার জানা আছে। জানা আছে, পূর্ববর্তী কালের কাহিনীগুলিও। খেয়াল করে দেখবেন- মহাভারতের মূল কাহিনী সবিস্তারে বলার আগে তিনি যতগুলি গল্প বলেছেন তার মধ্যে উপমনু, আরুণি ইত্যাদি ঔপনিষদিক কাহিনী যেমন আছে, তেমনই আছে ইন্দ্ৰস্তুতি, অশ্বিনীকুমারের স্তুতি এবং সূর্য-বিষ্ণুর একাত্মতা। তার মানে মহাভারতের ঠিক আগের যুগের বৈদিক এবং উপনিষদীয় পরিমণ্ডলের সঙ্গে আমাদের কথক-ঠাকুর পরিচিত। কাহিনী বর্ণনার এই পরম্পরার মাধ্যমে উগ্রশ্রবা সৌতি বেদ উপনিষদের সঙ্গে মহাভারতের কাহিনীর পরম্পরা তৈরি করছেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক পালাবদলের টাটকা খবরও তার কাছে পাওয়া যাচ্ছে।
মনে রাখতে হবে, এ সব কথা তিনি বলছেন যজ্ঞ থেকে অবসর লাভ-করা ঋষিদের কাছে। মহাভারতের মূল কাহিনী তিনি আরম্ভ করতে পারছেন না, কারণ কুলপতি শৌনক তখনও এসে পৌঁছোননি। তিনি সে সময় অগ্নিশরণ-গৃহে। অগত্যা তিনি শুধু জনমেজয়ের কাহিনী বলে যাচ্ছেন। জনমেজয়কে তিনি দেখেছেন। তিনি তার সর্পযজ্ঞে গেছেন এবং সবচেয়ে বড় কথা সেখানে তিনি মহাভারত শুনেছেন। পুরুবংশের শেষ পুরুষের সঙ্গে তার একটা পরিচয় আছে এই মর্যাদাতেই তিনি এখন শুধু জনমেজয়ের কথা বলছেন। বলতে পারেন, আমরা মহাভারত শুনতে বসেছি, ওসব জনমেজয়ের গল্প শুনব কেন? আমরা বলব, একটা বিয়ে করতে গেলে মশাই আপনার মাতুল অমুক চন্দ্র অমুকের মেয়ের সঙ্গে আমার শালার ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে, আপনার বন্ধুর পিতৃদেব আমার পিসেমশাই হন ইত্যাদি সম্পর্ক খুঁজে কথা জমাবার চেষ্টা করেন। আর এখানে মহাভারতের মতো একটা মহাকাব্য শুনবেন, অথচ জনমেজয়ের কথা শুনবেন না, তার দুঃখ-সুখের কথা শুনবেন না, তা কি হয়? তাছাড়া ভারতে সমাজ-সম্বন্ধ অনেক। পাশ্চাত্যের ব্যক্তি-কেন্দ্রিক সমাজ আমাদের আদর্শ নয়। আমাদের আদর্শ গোষ্ঠীতন্ত্র, গুষ্টিসুখ। এখানে একজনের পরিচয় জানতে গেলে, তার বাবার। কথা শুনতে হয়, গুরুস্থানের কথা শুনতে হয়, এমনকি সেই গুরুর অন্য শিষ্যদের কথাও। শুনতে হয়। তবে বোঝা যায় যার কথা বলছি, তিনি লোকটা কী রকম? সৌতি উগ্রশ্রবাও তাই জনমেজয়ের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। যতক্ষণ কুলপতি শৌনক অগ্নিশরণ-গৃহ থেকে সন্ধ্যা-আহ্নিক সেরে ফিরে না আসেন, ততক্ষণ আমরাও একটু জনমেজয়কে বুঝে নিই।
সৌতি উগ্রশ্রবা সপর্যজ্ঞের কথা বলতে বলেছিলেন- এই আমি উতঙ্কের চরিত্র কীর্তন করলাম। জনমেজয়ের সর্প-যজ্ঞের অন্য কারণ এই উতঙ্ক –ময়া উতস্য চরিতমশেষমুক্তং, জনমেজয়স্য সপত্রে নিমিত্তান্তরমিদমপি। উতঙ্কের কথাটা আমরাও বলতে উদযুক্ত হয়েছি এই কারণে যে, মহারাজ জনমেজয়ের তিনি গুরুভাই। অবশ্য এখনকার দিনে শাক্ত বৈষ্ণব সমাজে যেমন গুরুভাই দেখি, তেমন গুরুভাই তিনি নন। ব্যাপারটা একটু অন্যরকম।
উতঙ্কের গুরুর নাম বেদ। গৃহস্থ, ব্রহ্মর্ষি, মহা পণ্ডিত। জনমেজয় এই বেদকে এক সময় নিজের উপাধ্যায় হিসেবে বরণ করেন। উপাধ্যায় হিসেবে বেদ ছিলেন ভারি ভাল মানুষ। সেকালের দিনে বিদ্যা লাভ করার জন্য শিষ্যদের অসম্ভব কষ্ট করতে হত। সংযমের শিক্ষা এবং নির্বিচারে গুরুবাক্য পালন করার মধ্যে এতটাই কাঠিন্য ছিল যে, তাদের গুরুগৃহ-বাসের সময়গুলি গল্পে পরিণত হয়েছে। মহর্ষি বেদের অন্য দুই গুরু-ভাই আরুণি এবং উপমন্যর গুরু-সেবার স্তরগুলি আমাদের কাছে কল্প-কাহিনীর মর্যাদা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেদ যখন গুরুগৃহে ছিলেন তখন তাকেও ভার বইতে হত গোরুর মতো। শীত নেই গ্রীষ্ম নেই, ক্ষুধা-তৃষ্ণার বালাই নেই। সমস্ত সময়টা শুধু গুরুর আদেশ নির্বিচারে পালন করা। এমনিভাবে চলতে চলতে শুরু একদিন প্রসন্ন হলেন, বেদকে বিদ্যা দান করলেন। গুরুর কাছে বিদায় নিয়ে বাড়িতে এসে বেদ বিয়ে করে গৃহস্থ হলেন।
মানুষ যখন ছাত্র থাকে, তখন সে যে যে কষ্ট পায়, যেভাবে কষ্ট পায়–বড় হয়ে তা দূর করার চেষ্টা করে। মহর্ষি বেদ এখন গুরু আসনে বসেছেন। তবু ছাত্রাবস্থায় গুরুর আশ্রমের দিনগুলি তাঁর স্মরণে আসে। তিনি শিষ্যদের দিয়ে কোনও কষ্ট করাতে চান না, তাদের খাঁটিয়ে নিতে চান না, এমনকি গুরুষাও করতে বলেন না- স শিষ্যান্ন কিঞ্চিদুবাচ কৰ্ম বা ক্রিয়তাং গুরুশুশ্রূষা বেতি। গুরুগৃহবাসের দুঃখ তিনি জানেন, অতএব তিনি সেই কষ্ট শিষ্যদের দিতে চান না।
মহর্ষি বেদের তিন শিষ্যের মধ্যে প্রধান ছিলেন উতঙ্ক। উতঙ্ক ব্রহ্মচারী গুরুগৃহবাসী। বেদের অন্য দুই শিষ্য দুই ক্ষত্রিয় রাজা–একজন তো জনমেজয়, অন্যজন রাজা পৌষ্য।
উতঙ্ক যখন গুরুগৃহে বিদ্যাভ্যাস করছেন, তখন এক সময় মহর্ষি বেদের প্রয়োজন হল অন্য জায়গায় যাওয়ার। সেকালের দিনে বেদের মতো ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা নিজের পড়া এবং অন্যকে পড়ানো নিয়েই দিন কাটাতেন। এর মধ্যে তাদের কাছে মাঝে মাঝে অন্যের যজ্ঞ করার নিমন্ত্রণ আসত। তারা যেতেন, যজমান ধনী হলে দক্ষিণাও পেতেন ভাল। দুধেলা গোরুও মিলত। এই দক্ষিণার টাকা আর গোরুর দুধ খেয়ে অন্য সময় তাদের কষ্টে-সৃষ্টে চলে যেত। এর মধ্যে বাড়িতে যে দু-চারজন শিষ্য থাকতেন, তাদের ভরণ-পোষণও চলত।
ব্রহ্মচারী উতঙ্কও, এইভাবেই ছিলেন গুরুর বাড়িতে। যজ্ঞের নিমন্ত্রণ পেয়ে গুরু বেদ শিষ্যকে বললেন, বাড়িতে তুমি রইলে। যদি কোনও অসুবিধে হয় একটু দেখো। যদি কোনও ঝামেলাও হয় সামাল দিও। বেদ চলে গেলেন। বাড়িতে থাকলেন তার যুবতী স্ত্রী এবং ব্রহ্মচারী উতঙ্ক। ইতিমধ্যে বেদের পত্নী ঋতুমতী হলেন। সেকালে স্ত্রীলোকের ঋতুরক্ষার একটা ধর্মীয় তাৎপর্য ছিল। অর্থাৎ স্ত্রী ঋতুমতী হলে ঋতুস্নানের পর যে কোনও উপায়েই তার সঙ্গমের ব্যবস্থা করতেই হবে। হয়তো সমাজে এই নিয়ম যখন চালু হয়েছিল, তখন স্ত্রীলোকের সংখ্যা ছিল অল্প এবং সন্তানের চাহিদা ছিল বেশি। তাছাড়া কামশাস্ত্রের মতে এই সময়টাতে নাকি স্ত্রীলোকের আসঙ্গলিপ্সা প্রবল হয় এবং সন্তান ধারণের পক্ষেও নাকি সময়টা যথেষ্ট উপযোগী এবং উর্বর। ফলে যেনতেন প্রকারেণ ঋতুস্নাতা স্ত্রীলোকের সঙ্গমেচ্ছা পূরণ করাটা তখন ধর্মের তাৎপর্যে গ্রহণ করা হত।
মহর্ষি বেদের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রীর বান্ধবীরা এসে উতষ্ককে জানাল, তোমার অধ্যাপকের স্ত্রী ঋতুমতী হয়েছেন। এদিকে তোমার অধ্যাপক বিদেশে। তুমি এমন ব্যবস্থা কর যাতে এঁর ঋতুকাল নিষ্ফল না হয়। তাছাড়া এই কারণে তোমার অধ্যাপক-পত্নীও যথেষ্ট বিষণ্ণ হয়ে আছেন এষা বিষীদতি ইতি। একেবারে শেষ বাক্যে অধ্যাপকের স্ত্রীর যে পুরুষান্তর-সংসর্গে আপত্তি নেই সেটাও জানিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু উতঙ্ক সংসর্গকামিনী এই রমণীর ইচ্ছা একেবারে নস্যাৎ করে দিলেন।
হয়তো দীর্ঘদিন স্বামীর অনুপস্থিতিতে বেদ-পত্নীর মন এই যুবক পুরুষটির প্রতি সরস হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এই সরসতার সুযোগ উতঙ্ক নেননি। এখানে একটা কথা বলে নেওয়া ভাল যে, সেকালের সমাজে যারা একটা সময়ে শুরু হয়ে বসতেন, তাদের জীবনের বহুলাংশ কেটে যেত বিদ্যালাভে। ফলে গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করতে তাদের দেরি হয়ে যেত। বিয়ে করার পক্ষে বয়স বেশি হয়ে গেলেও বিদ্যা এবং ব্রাহ্মণ্যের কারণে অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়ে পেতেও তাদের অসুবিধে হত না। তাছাড়া বয়স বেশি হলেও ব্রাহ্মণ-শ্রেষ্ঠ ঋষি-মুনিদের সরসতা কম ছিল না। বড় ঘরের মেয়ে, রাজার ঘরের সুন্দরী মেয়েদের তারা মন দিতে ভালবাসতেন। কবি যতই বলুন
সত্য থাকুন ধরিত্রীতে
শুষ্ক-রুক্ষ মুনির চিতে
জ্যামিতি আর বীজগণিতে-
আমরা জানি ঋষি-মুনির হৃদয় মোটেই জ্যামিতি আর বীজগণিতের তত্ত্বের মতো ছিল না। ভাগবত পুরাণের সৌভরি মুনি, অথবা রামায়ণ-মহাভারতের বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র, পরাশর ভরদ্বাজ–কেউই স্ত্রীলোকের মন নিয়ে কাঠিন্য প্রকাশ করেননি। সময়কালে সে সব কথা আসবে।
আমি যা বলছিলাম সেটা একটা সমস্যার কথা। প্রৌঢ়-বৃদ্ধ মুনি-ঋষিরা যে সব মেয়েকে বিয়ে করে আনতেন, তাদের বয়স যেহেতু কম হত, তাই তাদের নিয়ে সমস্যাও কিছু ছিল। এঁদের মধ্যে স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষ জানি না- এমন সতী-সাধ্বী মহিলা যথেষ্টই ছিলেন। কিন্তু সেকালের কতগুলি সাবধানবাণী থেকে কতগুলি সমস্যাও সঠিক ধরা যায়। যেমন রামায়ণ, মহাভারত বা মনু সংহিতার মতো প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে গুরুগৃহবাসী শিষ্যদের বারবার শাসন করা হয়েছে যে, তারা যেন গুরুপত্নীর সঙ্গে বেশি মেশামিশি না করে। মনু মহারাজ তো একেবারে চোখ রাঙিয়ে বলে দিয়েছেন যে, দেখ বাপু। শিষ্য যদি বিশ বছরের যুবক হন- আর গুরুর গিন্নিটি যদি হন যুবতী, তাহলে গুরু সেবার নাম করে গুরুমার গায়ে তেল মাখানো, কি স্নান। করানো, কি ঝামা দিয়ে পিঠ ঘষে দেওয়া– এ সব তো বারণই, এমনকি প্রণাম করার ছুতো করে গুরুপত্নীর পা ছোঁয়াও একেবারে বারণ।
এই বারণ-সাবধান থেকে যে কথাটা বেরিয়ে আসে, তা হল গুরুগৃহে যুবক শিষ্য এবং যুবতী গুরুপত্নীর অধিকরণ-সামীপ্য। দূরত্বটা বহির্বাটী এবং অন্তর্বাটীর হলেও ইনিও আছেন, উনিও আছেন। এখন সমস্যাটা হল– প্রৌঢ় অথবা অতিরিক্ত বিদ্যাব্যসনী স্বামীর ঘর কতে করতে কখনও কোনও বসন্তের উতলা হাওয়ায় কোনও যুবতী গুরুপত্নী যদি একটি সমান-বয়সী শিষ্যের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন, তবে সেটা অন্যায় হলেও অস্বাভাবিক ছিল না। অন্যদিকে গুরুপত্নী-গমনের জন্য গুরুগৃহবাসী শিষ্যের অনন্ত নরকবাস নির্দিষ্ট থাকলেও যুবক শিষ্য বয়সের ধর্মে ব্রহ্মচর্য ভেঙে রমণে প্রবৃত্ত হতেন। ছোট-খাটোদের কথা ছেড়েই দিন, দেবতা বলে পরিচিত ইন্দ্ৰ গৌতম পত্নী অহল্যার রূপ-মুগ্ধ হয়ে গুরু গৌতমের সাজ নিয়েই অহল্যাকে ধর্ষণ করেছিলেন। আর রামায়ণের কবি সেখানে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, অহল্যা তার স্বামীর শিষ্যটিকে শেষ পর্যন্ত চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু তবু যে তিনি ইন্দ্রের বাহুবন্ধনে শয্যাশায়িনী হয়েছিলেন, তার কারণ নাকি দেবরাজ ইন্দ্রের রমণ কেমনতর, তাই দেখবার জন্য দেবরাজ-কুতূহলা। আর প্রসিদ্ধ পাণ্ডব-কৌরব বংশের উৎপত্তিই যে হয়েছিল গুরুপত্নী-গমনের ফলে- সে কথায় আমি পরে আসব।
তাই বলছিলাম– যুবক শিষ্য এবং যুবতী গুরুপত্নীর সমানাধিকরণ যদি প্রৌঢ়-বৃদ্ধ গুরুগৃহটি হয়, তবে তাদের পারস্পরিক সরসতা অন্যায় হলেও অস্বাভাবিক ছিল না সেকালে এবং তার সামাজিক কারণ তো ছিলই। গুরুর অনুপস্থিতিতে এবং গুরুপত্নীর বান্ধবীদের তাড়নায় বেদ-শিষ্য উতঙ্ক তো রীতিমতো এক ধর্মীয় সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু ঋতু-রক্ষার কাজটা যতই ধর্মীয় হোক, উতঃ রাজি হলেন না। গুরু-পত্নীর বান্ধবীদের তিনি বললেন তোমাদের মতো মেয়েদের কথায় আমি মোটেই নাচতে রাজি নই। আমার গুরুমশাই আমাকে নানা কাজের কথা বলে তার ঘর সামলাতে বলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু তাই বলে আমায় তিনি এটা বলে যাননি যে, দরকার হলে আমার স্ত্রীর ঋতুরক্ষার মতো অকাজটাও তুমি করে দিও ন হ্যহপাধ্যায়েন সন্দিষ্টঃ অকাৰ্য্যমপি ত্বয়া কাৰ্যমিতি।
উতঙ্ক রাজি হলেন না। গুরুপত্নীর বান্ধবীরাও সলজ্জ্বে চলে গেল। মহর্ষি বেদ ফিরে এলেন প্রবাস থেকে। বাড়িতে এসে সব কথা শুনে উতঙ্কের ওপর ভারি খুশি হলেন তিনি। ঋতু-রক্ষার ছুতোয় উতঙ্ক যে তার প্রিয়া পত্নীকে লঙ্ঘন করেননি– এই স্বস্তিটুকু তাকে আরও সুখী করে তুলল। উতষ্ককে তিনি সমস্ত বিদ্যার অধিকার দিয়ে বাড়ি যেতে বললেন।
বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পাওয়াটা যে কোনও ক্লিষ্ট ছাত্রের পক্ষে অত্যন্ত আনন্দের কথা। কিন্তু যাওয়ার আগে উতঙ্কের মনে হল যে, তিনি গুরুর কাছে পেয়েছেন অনেক, দেননি কিছুই। একে তো মহর্ষি বেদ শিষ্যদের পরিশ্রম বেশি করান না, অন্যদিকে তার সন্তুষ্টি বিধান করায় উতঙ্ককে তিনি অন্যদের থেকে তাড়াতাড়ি বিদ্যায় অধিকার দিয়েছেন। সব কিছু মিলে উতঙ্কের মনে হল–প্রতিদান না হোক, অন্তত কৃতজ্ঞতা হিসেবে। তার কিছু গুরুদক্ষিণা দেওয়া উচিত গুরুকে। উতঙ্ক বললেন, আপনি যদি অনুমতি করেন, তবে আমি আপনাকে কিছু গুরুদক্ষিণা দিয়ে ধন্য হই।
মহর্ষি বেদ এতই খুশি ছিলেন উতঙ্কের ওপর যে, একবারও তিনি চাননি যে, তার শিষ্য কোনওভাবে গুরুদক্ষিণার জন্য কোথাও বিড়ম্বনা লাভ করেন। কারণ সেকালে অনেক গুরুই বিদ্যাদানের শেষ কল্পে এমন সব অকল্পনীয় গুরুদক্ষিণা চাইতেন যে, শিষ্যদের পক্ষে তা জোগাড় করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ত। বস্তুত যে ছাত্র গুরুগৃহে স্নাতক পর্যায়ে উত্তীর্ণ হল অথবা কঠিন কোনও বিদ্যা লাভ করল গুরুর কাছ থেকে, তার দক্ষিণা দেওয়ার ক্ষমতা ছাত্রদের হত না। তাদের টাকা-পয়সা, ঐশ্বর্য-বিত্ত এমন কিছু থাকত না যে, তাই দিয়ে গুরুদক্ষিণা মেটানো যায়। স্নাতক বা বিদ্যাবান ছাত্রেরা গুরুদক্ষিণার জন্য প্রায় সব সময়েই রাজা বা অন্যান্য বিত্তশালী লোকের দ্বারস্থ হতেন এবং বিত্তশালী লোকেরা যেহেতু প্রায় সব সময়েই বিদ্যোৎসাহী হতেন, অতএব উপায় থাকলে গুরুদক্ষিশার ব্যাপারে তারা কখনও নিরাশ করতেন না। আমরা রঘুবংশের রঘু, হরিশ্চন্দ্র এবং আরও অনেক রাজার নাম করতে পারি, যাঁরা গুরুদক্ষিণার ব্যাপারে অশেষ উদারতা দেখিয়েছেন। সেই তুলনায় মহর্ষি বেদের দক্ষিণা-কামিতা সামান্যই।
উতঙ্কের মুখে গুরুদক্ষিণার প্রস্তাব শুনে মহর্ষি বেদ প্রথমে বলেছিলেন, বৎস উতঙ্ক! আরও কিছুদিন থাকো এখানে, পরে যা হোক বলব। কিছু দিন গেল। উতঙ্ক আবার বললেন, আপনি আদেশ করুন। কী প্রিয়কার্য করব আপনার জন্য। বেদ একটু রেগেই গেলেন। বললেন, সেদিন থেকে বার বার তুমি এই ‘গুরুদক্ষিণা-গুরুদক্ষিণা করে আমায় বিরক্ত করছ। তুমি তোমার গুরুপত্নীকে জিজ্ঞাসা করে তিনি যা বলবেন, তাই এনে দাও– এষা য ব্রবীতি তদুপহরস্ব ইতি।
ব্রাহ্মণ-গুরু মহর্ষি বেদের কথা ভেবে আশ্চর্য হই। নিজেকে গুরুগৃহে কষ্ট করতে হয়েছে বলে কোনওদিন তিনি কোনও শিষ্যকে গুরুসেবার কষ্ট দেননি। অন্যদিকে আপন পরিবারের জন্য তার কত মমতা। দরিদ্র ব্রাহ্মণ স্ত্রীর সাধ-আহ্লাদ কোনওদিন পূরণ করতে পারেননি। শিষ্য পড়িয়ে আর সাংসারিক দু-এক বারের যজমানিতে তার এমন কিছু সাচ্ছল্যের উদয় হত না, যা দিয়ে তিনি পত্নীর জাগতিক সাধ আহ্লাদ পুরণ করবেন। তাই আজকে উতঙ্ক বারবার গুরুদক্ষিণা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করছে, সেই সুযোগে তিনি স্বাধিকার ত্যাগ করে আপন প্রিয়া পত্নীর কাছেই তাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন তদগচ্ছ এনাং প্রবিশ্য উপাধ্যায়ানীং পৃচ্ছ।
দরিদ্র ব্রাহ্মণের পত্নীর স্বপ্নই বা কতটুকু? তিনি বললেন, পৌষ্য রাজার ক্ষত্রিয়া পত্নী কানে যে কুণ্ডল-দুটি পরে থাকেন, সেই কুণ্ডল-দুটি তুমি রাজার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এস। উতঙ্ক চললেন পৌষ্য রাজার কাছে। মনে রাখবেন—এই পৌষ্য রাজা কিন্তু সম্পর্কে উতঙ্কের গুরুভাই। কারণ মহর্ষি বেদের অন্য দুই শিষ্য হলেন পৌষ্য এবং জনমেজয়। হয়তো পৌষ্য রাজা কোনওদিন সস্ত্রীক এসেছিলেন গুরুদর্শন করতে, আর বেদপত্নী হয়তো সেই অবসরে রাজরানির রত্নখচিত কানের দুল-দুটি দেখেছিলেন, বড় ভাল লেগেছিল, কানের দুটি কুণ্ডল মাত্র এক রমণীকে এত রমনীয় করে তোলে! গরিব ব্রাহ্মণীর সেই থেকে বড় শখ ছিল– এমন দুটি কুণ্ডল যদি তিনি পেতেন? ব্রাহ্মণ-গুরু মহর্ষি বেদকে এ কথা তিনি কোনওদিন বলতে পারেননি। বলা কি যায়? যাঁর সম্বল একটি দুগ্ধবতী গাভী আর কতগুলি শিষ্য, তিনি কোথা থেকে এই সোনার কুণ্ডল এনে দেবেন তাকে? কিন্তু বেদ বোধহয় এই শখের কথা জানতেন এবং জানতেন বলেই উতঙ্কের কাছে নিজে কিচ্ছুটি না চেয়ে প্রিয়া পত্নীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
পৌষ্য রাজার বাড়ির পথ খুব সুখের হয়নি উতঙ্কের কাছে। যাই হোক নানা ঝামেলা পুইয়ে শেষ পর্যন্ত রাজার বাড়ি পৌঁছলেন তিনি। পৌষ্য ব্রাহ্মণ স্নাতক দেখামাত্রই দান দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। উতঙ্ক বললেন, আপনার স্ত্রী যে কুণ্ডল দুটি পরেন, আমি সেই দুটি চাই গুরুদক্ষিণার জন্য। পৌষ্য বললেন, তাহলে আমি কেন, আপনি আমার স্ত্রীর কাছেই কুণ্ডল দুটি প্রার্থনা করুন–প্রবিশ্যান্তঃপুরং ক্ষত্রিয়া যাচ্যতা। যাঁরা ভাবেন সেকালে স্ত্রীলোকের কোনও অধিকারই ছিল না, তাদের জানাই অন্তত স্ত্রীলোকের গয়না-গাটির ওপরে তার নিজস্ব আইনসঙ্গত অধিকার ছিল। একে বলা হত স্ত্রী-ধন। মনুসংহিতাই বলুন অথবা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র–এঁরা কেউই পুরুষকে স্ত্রীধন ব্যবহারের অনুমতি দেননি। রাজা পৌষ্য বুঝিয়ে দিয়েছেন- পত্নীর কানের দুল দান করার অধিকার তার নেই। তিনি নিজেও সে কথা স্ত্রীকে বলতে পারবেন না। কাজেই স্ত্রীর কানের দুল নিতে হলে উতঙ্ককে তার কাছেই যাচনা করে নিতে হবে।
উতঙ্ক পৌষ্য-পত্নীর কাছে গেলেন। প্রথমে তার সঙ্গে সাক্ষাতে বিলম্ব হলেও পৌষ্য-রাজার ক্ষত্রিয়া পত্নী উতঙ্কের কথা শোনামাত্র তার কানের কুণ্ডল দুটি খুলে তার হাতে দিলেন। কিন্তু কুণ্ডল দুটি দেওয়ার সময় পৌষ্য-পত্নী উতঙ্ককে সাবধান করে দিয়ে বললেন, দেখুন এই দুল-দুটির ওপর নাগরাজ তক্ষকের খুব লোভ আছে। কাজেই মহর্ষি বেদের গৃহে ফিরে যাওয়ার সময় আপনি সাবধানে যাবেন। উতঙ্ক বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, দেবী! নাগরাজ তক্ষক আমার কিছুই করতে পারবে না।
নাগরাজ তক্ষকের কথায় আমি পরে আসছি। তার আগে পৌষ্য রাজার সঙ্গে উতরে কিছু উতোর-চাপান আছে, সেটা সেরে নিই। রাজমহিষীর কাছ থেকে কুণ্ডল দুটি নিয়ে উতঙ্ক পৌষ্য রাজার কাছে এসে বললেন, আমি খুব খুশি হয়েছি পৌষ্য, কুণ্ডল দুটি আমি পেয়েছি। পৌষ্য বললেন, এতকাল পরে এমন সৎপাত্র পেলাম, এমন গুণবান অতিথি পেলাম, তো একটু অন্ন-জল মুখে দিয়ে যাবেন না। একটু বসুন আপনি। রাজার আগ্রহ দেখে উতঙ্ক বললেন, ঠিক আছে বসছি। কিন্তু আপনার ঘরে খাবার-দাবার যা কিছু যে অবস্থায় আছে, তেমনই দেবেন। আমার তাড়া আছে খুব শীঘ্রমিচ্ছামি যথোপপন্ন অন্তমূপস্কৃতং ভবতা। পৌষ্য বললেন, ঠিক আছে, তাই হবে যেমনটি আপনি চান। এই কথা বলে তার ঘরে অন্ন-পান যেমনটি যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থাতেই নিয়ে এলেন উতঙ্কের কাছে।
রাজামশাই বলে কথা। তিনি তো আর রান্নাঘরের খবর রাখেন না। ব্রাহ্মণ স্নাতক ঘরে উপস্থিত, তিনি তাড়াহুড়ো করছেন, অতএব বিনা দ্বিধায় ভাত-ডাল যেমনটি পেয়েছেন, তেমনটিই এক অনুপযুক্ত দাসীকে দিয়ে উপস্থিত করেছেন উতঙ্কের সামনে। কিছুই ভাল করে দেখেননি, আর উতষ্ক দেখতে বলেনওনি। ভাত ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল একেবারে এবং সেই ভাতের মধ্যে একটি চুলও পড়ে ছিল। রাজা পৌষ্য একটুও খেয়াল করেননি সেদিকে।
খাবারের পাত্রখানি দেখেই উতঙ্কের খুব খারাপ লাগল। চুল দেখে হয়তো ঘেন্নাও। রাগ করে বললেন, তুমি আমাকে এই রকম অপবিত্র খাবার খেতে দিলে? তুমি অন্ধ হবে জেনো অশুচ্যম্নং দদাসি, তস্মাদন্ধো ভবিষ্যসি। আসলে উতঙ্ক ভেবেছেন– রাজা ভাতের ওপর চুলটি দেখেও অন্ধের মতো তাই খেতে দিয়েছেন, অতএব অন্ধ হওয়ার অভিশাপ। রাজা ভাবলেন আচ্ছা বিপদ। উতঙ্ক নিজের তাড়াহুড়ো আছে বলে ভাত-ডাল যেমন রাঁধা আছে, তেমনই চাইলেন। আর এখন তাকেই অভিশাপ দিচ্ছেন? পৌষ্য রাজাও কিছু কম নন। তিনিও মহর্ষি বেদের শিষ্য। সৎ জীবন যাপন করেন, আপন কর্তব্যে স্থির। উতঙ্কের অন্যায় অভিশাপ শুনে তিনিও প্রতিশাপ উচ্চারণ করলেন উতঙ্কের উদ্দেশে আমার নির্দোষ অন্ন-পানে তুমিও যখন অন্যায়ভাবে দোষারোপ করছ, তখন তুমিও নির্বংশ হবে।
.
০৪.
চার কত সাধারণ ঘটনা থেকে কত অসাধারণ ঘটনা ঘটে গেল। উতঙ্কের ভাবটা আমরা বুঝি। তুমি খেতে বলছ আগ্রহ করে, কিন্তু আমারও তাড়া আছে। কিন্তু তাড়া আছে বলেই তুই চুল-পড়া ঠাণ্ডা ভাত অতিথিকে খেতে দিবি? পেটে সয় না বলে নেমন্তন্ন-বাড়িতে যদি বলি– ঠিক আছে, একটা রসগোল্লা দিন, তাহলে সেই একটাই দিবি? পাত্র ভরে না দিলে যে অবহেলার মতো মনে হয়। তুই পাত্র সাজিয়ে দে, আমিও একটাই তুলে নেব। তোরও ভদ্রতা থাকল, আমারও ভদ্রতা থাকল। উতঙ্কেরও এই দশা। যেমনটি আছে দিতে বলেছেন বলে, তেমনটিই দিতে হবে! এত দূর পথ বেয়ে এসেছেন, খিদের মুখে একটু গরম ভাত, ঝরঝরে পরিষ্কার করে খেতে দিয়ে পৌষ্য যদি বলতেন, সামান্য দেরি হল, ঠাকুর! সজ্জন অতিথি ব্রাহ্মণকে ঠাণ্ডা ভাত দিই কী করে তাহলে কি উতঙ্ক মেনে নিতেন না?
আবার রাজার দিক থেকেও ব্যাপারটা দেখুন। ব্রাহ্মণ-অতিথি তাড়াতাড়ি ফিরে যাবেন, কারণ মহর্ষি বেদের পত্নী উতঙ্কের ফিরে আসার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন আগেই। উতঙ্কও যথেষ্ট তাড়াহুড়ো করছেন এবং যেমন ঘরে আছে তেমন খাবার প্রস্তাব তিনিই দিয়েছেন। যেখানে শীঘ্রই প্রধান গুরুত্বের বিষয়, সেখানে দেরি করলেও তো অভিশাপ জোটার কথা। কিন্তু রাজার কপাল এমনই অভিশাপ জুটেই গেল। কিন্তু তিনি যেহেতু উতঙ্ক যেমন বলেছেন, তেমনই করেছেন তাই জোরটা তার দিক থেকে বেশি। সেইজন্য প্রতিশাপ দিতে তার দেরি হয়নি। উতষ্কও সেটা বুঝেছেন; আর বুঝেছেন বলেই তিনি রাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, আপনি যে উলটে আমাকে শাপ দিলেন, এটা বোধহয় ঠিক নয়। আপনি যে খাবারটা আমাকে দিলেন, একটু ভাল করে দেখুন সেটা। রাজা পৌষ্য দেখলেন এবং বুঝলেন। যে দাসী এই অন্ন নিয়ে এসেছিল, সে রাজবাড়িতে কাজের অবসরে চুল খুলে বসে ছিল। রাজার তাড়া দেখে খোলা চুলেই সে অন্ন নিয়ে ছুটেছিল। মাথার ঝাঁকুনি অথবা হাওয়ায় চুল উড়ে এসে পড়েছিল উতঙ্কের খাবারে। রাজা অন্ন দেখেই নিজের অন্যায় স্বীকার করে উতঙ্ককে খুশি করার চেষ্টা করলেন। বললেন, না জেনে অন্যায় করেছি, আপনি অভিশাপ-মুক্ত করুন আমাকে। আমি যেন অন্ধ না হই।
উতঙ্ক বললেন, আমি তো মিথ্যা কথা বলি না। তবে আপনি একবার অন্ধ হয়েই আবার চোখ ফিরে পাবেন। তবে আপনিও একটু ভাবুন–আপনি যে আমায় নির্বংশ হওয়ার অভিশাপ দিলেন- সেটাও আর খাটবে না তো? রাজা বললেন, আপনার করুণার কথা শুনে আমার ভাল লাগল। কিন্তু আমি আমার শাপ ফিরিয়ে নিতে পারব না। সে ক্ষমতাই আমার নেই। কারণ আমার রাগ এখনও যায়নি। উতষ্ক ভাবলেন-এ তো বেশ মজা! তিনি শাপটি প্রত্যাহার করে নিলেন, আর রাজার অভিশাপটা রয়েই গেল? রাজা পৌষ্য বললেন, দেখুন ঠাকুর! আপনি ব্রাহ্মণ মানুষ, দয়ার শরীর। আপনাদের মুখের কথার ধার খুব বেশি, কিন্তু হৃদয়টা ননীর মতো। একেবারে গলে যায়- নবনীতং হৃদয়ং ব্রাহ্মণস্য বাঁচি ক্ষুরো নিহিতস্তীক্ষ্ণধারঃ। আর আমরা হলাম ক্ষত্রিয় আপনাদের উলটো জাত। আমাদের মুখের কথা খুব মিষ্টি একেবারে ননী ঝরছে মুখে, গলে গলে যাচ্ছে–ক্ষত্রিয়স্য বাঙু-নবনীত। কিন্তু হৃদয়টা ক্ষুরের মতো ধারালো, তীক্ষ্ণ-কঠিন।
নাগরাজ তক্ষকের কাহিনীর আগেই উগ্রশ্রবা সৌতি ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের এই যে সামান্য চরিত্র-বিচারটুকু করে নিলেন, তার কারণ মহাভারতের তাবৎ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়কুলের মধ্যে এই হৃদয়বৃত্তিগুলি আমরা দেখতে পাব। ইতিহাস পুরাণ জুড়ে ব্রাহ্মণ মুনি-ঋষির সম্বন্ধে যে সামাজিক আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে পরবর্তীকালে, তার পেছনে ব্রাহ্মণের সামাজিক মর্যাদা বা সুবিধাভোগ যতবড় কারণ, তার চেয়েও বড় কারণ এই আপাত-কঠিন স্বভাব। অন্যায়, অভব্যতা দেখামাত্র, শোনামাত্র সিদ্ধান্তে পৌঁছনো এবং তা থেকে অভিশাপ পর্যন্ত গড়িয়ে। যাওয়া। কুত্রাপি এমনও দেখা যাবে, যেমন এই উতঙ্ক-পৌষ্যের কাহিনীতেও দেখা গেল যে, অপরাধ তত না থাকা সত্ত্বেও অপরাধের অনুমানমাত্রেই অভিশাপ উচ্চারিত হয়েছে ব্রাহ্মণের মুখে। লৌকিক দৃষ্টিতে ব্রাহ্মণের আপাতিক এই দুঃস্বভাব অত্যন্ত কঠিন মনে হলেও লোক-ব্যবহারে এর তাৎপর্য আছে। অন্য উদাহরণ টেনে এনে কথা বাড়াব না, তাৎপৰ্যটা এই উতঙ্ক-পৌষ্যের কাহিনী থেকেই একটু বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।
তৈত্তিরীয় উপনিষদের এক জায়গায় পিতাকে দেবতার মতো দেখো, মাকে দেবতার মতো দেখো, আচার্যকে দেবতার মতো সম্মান করো ইত্যাদি বাণী পড়তে হত। ছোটবেলায় এগুলো বাণীর মতোই লাগত, এখন সেটা খানিকটা উপলব্ধিতে আসে। তৈত্তিরীয়ের এই একই প্রসঙ্গে বলা আছে-কাউকে যদি কিছু দাও, তো সাহংকারে দিও না, মনে বিনয় রেখে সলজ্জে দিও। যদি দিতে হয়, তো তার মধ্যে মধ্যে যেন শ্রী থাকে সৌন্দর্য থাকে, ছিছিক্কার করে ছুঁড়েমুড়ে দিও না, দেওয়ার মধ্যে যে শ্রী অর্থাৎ ছিরি’ থাকে- হিয়া দেয়। শ্রিয়া দেয়। এর পরে আছে মোক্ষম কথাটা। তৈত্তিরীয় বলেছে- যদি দিতে শ্রদ্ধা হয়, তবেই দিও। আর দিতে যদি ইচ্ছা না হয়, যদি শ্রদ্ধা না হয়, তবে দিও না বরং, তাও ভাল- শ্রদ্ধায় দেয়ম। অশ্রদ্ধয়া অদেয়ম।
এই যে শেষে নেতিবাচক কথাটা শুধু শ্রদ্ধার প্রসঙ্গে বলা হল অর্থাৎ শ্রদ্ধা না থাকলে দিও না, এই নেতিবাচক ভাবটুকু অন্যত্রও প্রযোজ্য অর্থাৎ দেওয়ার মধ্যে ‘ছিরি’ না থাকলে দিও না, অবিনয় থাকলে দিও না। রাজা পৌষ্য ব্রাহ্মণ স্নাতককে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেই খেতে দিয়েছিলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু তার খেতে দেওয়ার মধ্যে সেই শ্ৰী, সেই পরিচ্ছন্নতা ছিল না। অন্ন শীতল, কেশযুক্ত। শুধুমাত্র এই নিরীক্ষণী শ্ৰীর অভাবেই উতঙ্ক আজ দুঃখিত। তবে রাজা ভুল স্বীকার করে নিতেই উতঙ্ক তাকে শাপমুক্ত করেছেন এবং রাজাকে বুঝিয়ে গেছেন যে, শাপ প্রত্যাহারের ক্ষমতা তার না থাকলেও রাজাই যেহেতু দোষী, অতএব তার শাপ উতঙ্কের গায়ে লাগবে না। যাই হোক পৌষ্য-পত্নীর কানের দুল দুটি নিয়ে উতঙ্ক পথ চলতে আরম্ভ করলেন। রাজমহিষীর কথায় নাগরাজ তক্ষক সম্বন্ধে মনে তার সাবধানতা আছে ঠিকই, তবে তত ভীত তিনি নন, যতখানি রাজমহিষী তাকে বলেছেন।
এখানে একটা কথা আমায় বলে নিতে হবে। পণ্ডিতেরা উতঙ্ক পৌষ্যের কাহিনীকে মহাভারতের মৌলাংশে স্থান দেবেন না। অর্থাৎ তাদের মতে এটা প্রক্ষেপ। কিন্তু মনে রাখতে হবে–ইতিহাসের দিক থেকে এ কাহিনীর গুরুত্ব অপরিসীম। মহাভারতের কথকঠাকুর সৌতি উগ্রশ্রবা যখন এ কাহিনী বলছেন, তখন বৌদ্ধ ধর্মের হাওয়া এসে গেছে ভালরকম। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বৌদ্ধধর্মের প্রভাব রুখবার জন্য সবরকম ভাবে চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় বৌদ্ধ-ক্ষপণকদের চোর সাজিয়ে নিন্দা করে উগ্রশ্রবা সৌতি তার নিজের কালের হাওয়া লাগিয়ে দিয়েছেন মহাভারতের গায়ে। এবারে আসল ঘটনায় আসি।
উতঙ্ক পথে নেমেই দেখতে পেলেন একজন উলঙ্গ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তার পিছন পিছন আসছেন। তাকে কখনও দেখা যাচ্ছে আবার কখনও সে লুকিয়ে পড়ছে উতঙ্কের দৃষ্টিকে কি দিয়ে। এইভাবে একসময় উতঙ্ক তাকে দেখতে পেলেন না এবং নিশ্চিন্তে কুণ্ডল দুটি একটি পুকুরের পাড়ে রেখে জলে নেমে স্নান-আহ্নিক সেরে নেবার ইচ্ছা করলেন। উতঃ পুকুরে নেমেছেন–এই অবসরে সেই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এসে রাজরানির কানের দুল-দুটি নিয়ে পালালেন। উতঙ্ক সন্ধ্যা-বন্দনা কোনওরকমে সেরে পুকুর থেকে উঠে দেখলেন-সন্ন্যাসী পালাচ্ছেন। উতঙ্ক তার পিছু নিলেন।
এই যে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর সঙ্গে আপনার পরিচয় হল, ইনিই কিন্তু নাগরাজ তক্ষক। তিনিই নগ্ন ক্ষপণকের বেশ ধরে রাজরানির কুণ্ডল চুরি করেছেন। বস্তুত এই চুরির দায়টা সোজাসুজি তক্ষকের ওপর চাপালেই হত। কিন্তু তৎকালীন বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে বৌদ্ধরা কত খারাপ, চুরি-তঞ্চকতার মতো হীন কাজ তারা কী রকম নির্দ্বিধায় করে– ধর্মের বৌদ্ধিক স্তরে এটা প্রমাণ করা ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের পক্ষে জরুরি ছিল। সৌতি উগ্রশ্রবা সমাজের এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মহাভারতের কথা বলছেন। অতএব বৌদ্ধ ক্ষপণকের ভণ্ড বেশ তিনি কাজে লাগিয়ে দিলেন ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের পক্ষে জনমত তৈরি করার জন্য। ইতিহাসের দৃষ্টিতে এই প্রক্ষেপ তাই ভয়ঙ্কর রকমের গুরুত্বপূর্ণ।
উতঙ্ক ছুটতে ছুটতে বৌদ্ধ-সন্ন্যাসীকে ধরে ফেললেন। সন্ন্যাসী সঙ্গে সঙ্গে আপন বেশ ত্যাগ করে নাগরাজ তক্ষকে পরিণত হল এবং তাকে ধরার সাধ্য হল না উতঙ্কের। সামনে একটি গর্ত দেখেই সর্পরাজ সেখানে ঢুকে পড়লেন এবং সেই গর্তের ভিতর দিয়েই সোজা চলে গেলেন পাতালে, একেবারে সটান নিজের বাড়িতে। যেন সাপ বলেই তার এত সুবিধে হল, আর মানুষ বলে উতষ্ক আর তাকে ধরতে পারলেন না। বুঝতে পারছি এখানে আরও দুটো কথা আমায় বলতে হবে।
দেখুন, আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেছেন, আরে মশাই! কী যে আপনারা বলেন? তক্ষকের দংশনে নাকি পাণ্ডব-কুলের কনিষ্ঠ পুরুষ পরীক্ষিতের মৃত্যু হল। বলি, সাপের ব্যাপারে খবর রাখেন কিছু? এই যে তক্ষক সাপ বলছেন, সর্পতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতেরা তক্ষকের কোনও বিষই নেই বলে রায় দিয়েছেন। আর আপনারা মহাভারত খুলে, ভাগবত পুরাণ খুলে বারবার বলতে থাকবেন তারপর সেই ফলের ভিতরে থাকা তক্ষক সাপের বিষের জ্বালায় পরীক্ষিত মরলেন। এটা কী কোনও যুক্তি হল?
আমরা বলি, আপনারা হাজার হাজার বছর আগের লেখা পূরাণ কথা শুনছেন, মহাভারত শুনছেন। সেটাকে কি ওইভাবে বিচার করলে চলবে? পৌরাণিকদের কথাবার্তা, ভাব-মর্ম শুধু কি এক জায়গা থেকে বুঝলেই হবে? পূর্বাপর বিচার করতে হবে না? তার ওপরে কাহিনীর খোলস আছে, আছে পৌরাণিকদের নানা আবরণ। এই তো এই উতঙ্কের কাহিনীতে এখনই শুনবেন- তক্ষক গর্তে ঢুকে পড়ার পর উতঙ্ক লাঠি-খোস্তা দিয়ে গর্তটাকে বড় করার চেষ্টা করলেন। নিজে পারলেন না, তখন দেবরাজ ইন্দ্র তার বজ্র ফাটিয়ে সেই গর্তটাকে বড় করলেন। আর সেই বিস্তৃত গর্তপথে প্রবেশ করে উতঙ্ক যখন পাতালে এসে পৌঁছলেন, তখন তার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। তিনি দেখলেন- নাগলোকের কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। সেখানে মন্দির আছে, রাজভবন আছে, বড় বড় বিল্ডিং আছে, চিলে কোঠা আছে, এবং নাগেদের বড় বড় বাড়িতে নানারকমের ‘হুক’ পর্যন্ত সাটা আছে, এমনকি খেলার মাঠও আছে–অনেকবিধ-প্রাসাদ- হর্ম্য-বলভী-নির্যূহ-শত-সঙ্কুলম-উচ্চাবচ-ক্রীড়াশ্চর্য- স্থানাবকীর্ণমপশ্যৎ।
তক্ষকের বিষে আপনার বিশ্বাস নাই থাকতে পারি, কিন্তু সর্পরাজ্যে যে রকম ঘর-বাড়ি আর প্রাসাদ-হ-বলভী দেখলাম তক্ষককে সাপের দৃষ্টিতে দেখলে এগুলিও তাহলে বিশ্বাস করা যায় না। তাই বলছিলাম, পুরাণকারদের কথা-বার্তা, ভাবনা-চিন্তা অত হঠাৎ সিদ্ধান্তের জিনিস নয়। তার পিছনে আমাদেরও একটু ভাবনা-চিন্তা করতে হবে। যে কথাটা প্রথমেই মনে রাখা দরকার, সেটা হল– দেবতা, অসুর, যক্ষ-রক্ষ, গন্ধর্ব-কিন্নর, হনুমান, জাম্ববান অথবা সৰ্পনাগ–এঁদের অন্তরীক্ষ লোকের কোনও বাসিন্দা ভাবার কোনও কারণ নেই। আমি অবশ্যই পরম ঈশ্বর, ব্ৰহ্ম বা অন্তর্যামী পরমাত্মা সম্বন্ধে কোনও কথা বলছি না। কিন্তু মহাভারত-পুরাণ এবং ভারতীয় দর্শন শাস্ত্র থেকেও দেবতা-রাক্ষস অথবা নাগ-সর্পদের সামাজিক অবস্থান নির্ণয় করা যাবে। এঁদের ঠিকানার জন্য অলৌকিক কোনও স্বর্গ অথবা পৃথিবীর গভীরে কোনও পাতাল-প্রবেশের দরকার নেই– এঁরা সবাই এই সুন্দরী পৃথিবীর চিরকালের বাসিন্দা। স্বর্গ, নরক, গন্ধর্বলোক, নাগলোক- এগুলির ভৌগোলিক অবস্থান, পরে সময়মতো নির্ণয় করে দেখাব। কিন্তু এখন জেনে নিন তক্ষক এবং অন্যান্য নাগের কথা।
আর্যায়ণের প্রথম কল্পে যাদের আমরা দেবতাদের বিরোধী গোষ্ঠী হিসেবে পেয়েছি। ঋগবেদে তাদের নাম দাস বা দস্য। মহাকাব্যের পূর্ব যুগ থেকেই এই বিরোধী গোষ্ঠীকে আমরা অসুর-রাক্ষস নাম দিয়েছি এবং দেবতাদের সঙ্গে তাদের চিরন্তনী শত্রুতা সর্বজনবিদিত। মহাকাব্যের যুগে প্রধানত মহাভারতের যুগেই অসুর-রাক্ষসদের আর তত দেখতে পাবেন না, আস্তে আস্তে চতুবর্ণ-বিভাগে তারা স্থান করে নিতে পেরেছেন। আর্যরা যখন সুপরিকল্পিতভাবে ভারতের উত্তরখণ্ডে ছড়িয়ে পড়তে থাকলেন, তখন এই নাগদের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। নাগেরা অবশ্যই আরণ্যক গোষ্ঠী, বনে-জঙ্গলেই তাদের বাস ছিল, গঙ্গা, যমুনা, নর্মদার মতো নদীর ধারেও তাদের বসতি দেখা যাচ্ছে।
প্রথম দিকে নাগ জন-জাতিরা তাদের এই নতুন শত্রুদের তত আমল দেননি, কিন্তু আর্যরা যখন শহর গড়ার দিকে মন দিলেন, তখন এদের বসতির ওপর আর্যদের হাত পড়ল, আর সেই থেকেই শত্রুতার শুরু। মহাভারত আলোচনার পরবর্তী সময়ে দেখবেন– অর্জুন যখন পাণ্ডবদের রাজধানী বানানোর জন্য খাণ্ডব-বন পুড়িয়ে দিলেন, তখন সেখান থেকে তক্ষক-নাগকে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। এই তক্ষক আর কেউ নয়, কোনও সাপ তো নয়ই, প্রাচীন নাগগোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান। পণ্ডিতদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে বলি- ওই যে হস্তিনাপুর, ইন্দ্রপ্রস্থ, মথুরা, তক্ষশিলার নাম শোনেন-কুরু-পাণ্ডবদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের রমরমা হওয়ার আগে এইসব জায়গায় নাগ-জনজাতিরই রাজত্ব ছিল। যমুনার মধ্যে বিষধর কালীয়-নাগের মাথায় কৃষ্ণের নন-কুর্দন নাগ-জনজাতির পরাজয় যতটুকু সূচনা করে, তার চেয়ে অনেক বেশি সূচনা করে তার পূর্বাধিপত্য।
ভাগবত পুরাণ অথবা ২য়/৩য় শতাব্দীর বিখ্যাত ভাসের নাটক- যাই খুলুন, দেখবেন যমুনার জল কেউ স্পর্শ করে না, তাতে নাকি কালীয়-নাগের বিষ মেশানো আছে। আসলে এখানে যমুনা বলতে আমরা যমুনা নদী বুঝি না, যমুনার উপকূলবর্তী অঞ্চল বুঝি। ঠিক যেমন ‘আমি দক্ষিণেশ্বরে থাকি’ বললে দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দির বোঝায় না, তার কাছাকাছি অঞ্চল বোঝায়, তেমনই এইসব জায়গাতেও মুখ্যার্থের বাধা হয়। আসলে কালীয় কিংবা বাসুকি কেউই যমুনার জলে বা সাগরের জলে থাকেন না; তাদের জায়গা পণ্ডিতদের মতে জলা জায়গা, বন-জঙ্গল অরণ্যভূমি। কৃষ্ণ কালীয়কে তাড়িয়ে দিয়ে যমুনার জলকে বিষমুক্ত করেছিলেন বলে যে মাহাত্ম আছে, তা আসলে নাগ জন-জাতির আরেক প্রধানকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার ঘটনা।
এ বিষয়ে পণ্ডিতদের মতামত ব্যক্ত করে আরও দশ পাতা লেখা যায়, কিন্তু তাতে মূল ঘটনার খেই হারিয়ে যাওয়ার ভয় আছে। এখানে শুধু এইটুকু মাথায় রাখতে হবে যে, খাণ্ডবদাহের সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডবদের সঙ্গে তক্ষকের শত্রুতা শুরু হয়। এবং পরিক্ষীণ পাণ্ডব-বংশের শেষ পুরুষ পরীক্ষিতের ওপর প্রতিশোধের মধ্য দিয়ে এই পালার শেষ সূচনা হয়। ধাতু-প্রত্যয় নিষ্পন্ন করে বাননটা পরীক্ষিত’, ‘পরীক্ষিত’ অনেক রকম হয়। আমরা চালু বানান পরীক্ষিতই বলব।
তক্ষক কি কালীয়, বাসুকি কি অনন্ত–এঁদের ঘরবাড়ি মানুষের মতোই, ভাষাও যথেষ্ট সংস্কৃত এবং আর্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এঁদের ওঠাবসা বিয়ে-থাও যথেষ্ট হয়েছে। আপাতত তক্ষক আর উতঙ্কের বৃত্তান্তে দেখব– উতঙ্ক বড় বড় নাগগোষ্ঠীর প্রধানদের মনোরম-স্তুতি রচনা করেছেন এবং নাগরাজ তক্ষক পৌষ্য-পত্নীর দুল দুটি ফিরিয়েও দিয়েছেন। উতঙ্ক গুরুপত্নীর কাছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই উপস্থিত হয়েছেন এবং তার আশীর্বাদও পেয়েছেন। কিন্তু তক্ষক তার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে এবং তাকে যে পরিমাণ হেনস্তা করেছে, তাতে তার ক্রোধ চূড়ান্ত হয় এবং তিনি তার গুরুভাই হস্তিনাপুরের রাজা জনমেজয়ের কাছে উপস্থিত হয়েছেন তক্ষকের ওপর প্রতিশোধ তুলতে ক্রুদ্ধঃ তক্ষক প্রতিচিকীর্ষমাণো হস্তিনাপুরং প্রস্থে। অন্য রাজা বাদ দিয়ে জনমেজয়ের কাছে তার যাওয়ার কারণও ছিল। কারণ একটাই। জনমেজয়ও তক্ষকের শত্রু। তক্ষক তার পিতা পরীক্ষিতকে মেরেছেন।
উতঙ্ক হস্তিনাপুরের রাজসভায় পৌঁছনোর আগে আগেই জনমেজয় তক্ষশিলা জয় করে ফিরে এসেছেন। গবেষকরা এমনও মনে করেন যে, জনমেজয়ের তক্ষশিলা-অভিযানও নাগ-জাতীয় জন-জাতিকে পর্যুদস্ত করার জন্য। কারণ ইতিহাস-মতে এই অঞ্চলে নাগদের প্রভুত্ব এবং ক্ষমতা দুই ছিল। ‘তক্ষক’ শব্দের সঙ্গে তক্ষশিলার মিল এবং সেখানে বৌদ্ধ-প্রভাবের অনুষঙ্গে তক্ষকের নগ্ন ক্ষপণকের বেশ ধারণও এই নিরিখে ব্যাখ্যা করা। যাই হোক এত তর্কের মধ্যে না গিয়ে আমরা আপাতত উতষ্কের আক্রোশ লক্ষ্য করব। উতঙ্ক বললেন, যে কাজ আপনার করা উচিত ছিল, মহারাজ সেই কাজ বাদ দিয়ে অন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
ইঙ্গিতটা অবশ্যই তক্ষশিলা-বিজয়ের দিকে। তক্ষশীলার নাগজাতীয়দের অনেকেই জনমেজয়ের হাতে পর্যদস্ত হলেও তক্ষকের এখনও কিছুই হয়নি। উতঙ্ক তাই বললেন, সেই তক্ষক নাগ আপনার বাবাকে মেরেছে–তক্ষকেশ মহীন্দ্রে যেন তে হিংসিতঃ পিতা- আপনি তাকে মারার কথা ভাবুন, আপনি বালকের মতো অন্য কাজ করে যাচ্ছেন–বাল্যদিবান্যদেব ত্বং কুরুতে নৃপসত্তম। উতঙ্ক জনমেজয়কে চেতিয়ে দিয়ে বললেন,তক্ষক বিনা অপরাধে আপনার বাবা পরীক্ষিতকে দংশন করেছে। শুধু কি তাই? আপনার পিতার চিকিৎসার জন্য মহামুনি কাশ্যপ আসছিলেন, তক্ষক তাকেও কায়দা করে ফিরিয়ে দিয়েছে। অতএব এই অবস্থায় অন্য কিছু নয়, আপনি সর্প-যজ্ঞ করুন যাতে তক্ষককে পুড়িয়ে মারা যায়। উতষ্ক এবার রাজাকে জানালেন- তক্ষক তাকে হেনস্তা করেছে। সব শুনে জনমেজয় একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, মহাভারতের উপমায় সেটা–আগুনে ঘি–দীপ্তোগ্নি ইবিষা যথা।
এখানে শুধু প্রথম খন্ড রয়েছে। বাকি খণ্ডগুলো আপলোড করলে উপকৃত হবো।