৩. সরস্বতী : বাস্তবে এবং অবাস্তবে

সরস্বতী : বাস্তবে এবং অবাস্তবে

ভৌগোলিক দিক থেকে নিশ্চিতভাবেই বলা যাবে কি সরস্বতী নদী শতদ্রু ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল? অনুমান করা যায় যে বৈদিক সরস্বতী (আঞ্চলিক নাম সরসুতী) হরিয়ানার থানেশ্বর অঞ্চলে প্রবাহিত। ঋগ্বেদে (অষ্টম মণ্ডল, ৩৬.৬ সূক্ত) বলা হয়েছে সপ্তথি সরস্বতী নদীগুলির মাতা (সিন্ধুমাতা) একসঙ্গে দুগ্ধ ও স্রোতস্বিনীদের নিয়ে বিপুল গর্জনে তীব্র স্রোতে প্রভূত জলধারায় স্ফীত হয়ে প্রবাহিত।

ঋগ্বেদে দুই ধরনের সরস্বতীর উল্লেখ আছে। একটি ত্রিলোক্য ব্যাপিনী সূর্যাগ্নি, অন্যটি নদী। সরস্ ধাতু তদুত্তরে অস্থর্থে বতু এবং স্ত্রী লিঙ্গে ঈ প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন হয়েছে সরস্বতী– এ মত স্বামী নির্মলানন্দের। আলোকময়ী বলে সর্বশুক্লা। শংকরনাথ ভট্টাচার্যের মতে, সরস + বতী = সরস্বতী। অর্থ জ্যোতিময়ী। ঋগ্বেদে এবং যর্জুবেদে অনেক জায়গায় ইড়া, ভারতী, সরস্বতাঁকে একসঙ্গে দেখা যায়। বেদের মন্ত্রগুলো পর্যালোচনায় প্রতীতী জন্মে যে, সরস্বতী মূলত সূর্যাগ্নি। দেবীভাগবতে সরস্বতী জ্যোতিরূপা। ভৃগুপনিষদে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী ও জলময়ী সরস্বতীর সমীকরণ করা হয়েছে। এই উপনিষদে জলে জ্যোতি প্রতিষ্ঠিত, জ্যোতিতে জল প্রতিষ্ঠিত। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী সারদামঙ্গল কাব্যে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতীর আবির্ভাব বর্ণনা করেছেন। রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকি যখন ক্রৌঞ্চ হননের শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন, সে সময় জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী তার ললাটে বিদ্যুৎ রেখার মতো প্রকাশিত হয়েছিলেন।

পুরাণগুলো একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই পেয়ে যাবেন ঋগ্বেদে ইন্দ্রের সঙ্গে সরস্বতীর সম্পর্ক যেমন ঘনিষ্ঠ ছিল, তেমনি ঘনিষ্ঠ মরুদ ও অশ্বিনীদ্বয়ের সঙ্গেও ছিল। সরস্বতী কখনো ইন্দ্রের পত্নী, আবার কখনো শত্রু, কখনো-বা ইন্দ্রের চিকিৎসক। শুক্ল যজুর্বেদে তিনি চিকিৎসক রূপে রুদ্র অশ্বিনীদ্বয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। সরস্বতীর রোগ নিরাময় শক্তির কথা পরবর্তী সময়েও জনশ্রুতিতে ছিল। ‘কথাসরিৎসাগর’ গ্রন্থে রচয়িতা সোমদেব (একাদশ শতক) জানিয়েছেন, পাটলিপুত্রের নারীরা রুগ্ন ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য সরস্বতীর ওষুধ ব্যবহার করতেন।

নিরুক্তকার যাস্কের মতে, সরস্বতী শব্দের অর্থ যাতে জল আছে। সৃ ধাতু নিস্পন্ন করে সর শব্দের অর্থ জল। অর্থাৎ যাতে জল আছে তাই সরস্বতী। নদী সরস্বতী আর্যভূমির অন্যতম নদীরূপে ঋগ্বেদে বহুবার কীতি ও স্তোত হয়েছে। ঋগ্বেদে সরস্বতী সিন্দু ও তার পাঁচটি উপনদী নিয়ে সপ্তসিন্ধুর বারংবার উল্লেখ আর্যভূমিতে এদের অপরিসীম গুরুত্ব প্রমাণ করে। ‘অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী’ –অর্থাৎ নদী হিসাবে সরস্বতীকে দেখা হয়েছে। সম্ভবত সরস্বতী নদীর তীরেই বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উদ্ভব। তাই হয়ত শিক্ষার সঙ্গে সরস্বতীর অচ্ছেদ্য বন্ধন এবং এর জন্যই পৌরাণিক যুগে সরস্বতী বিদ্যার দেবী হয়ে উঠেছেন। সরস্বতীর আর-এক নাম ভারতী। তিনি ‘ব্রাহ্মণ’-এ বাক্ নামে পরিচিতা। দেবী সরস্বতীর সঙ্গে নদী সরস্বতীর এই একাত্মতা সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত থাকলেও সরস্বতাঁকে ব্রহ্মার মানসকন্যা হিসাবে কল্পনা করা হয়।

ষোড়শ ঋকে সরস্বতী মাতৃগণের, নদীগণের ও দেবগণের শ্রেষ্ঠা বলে বর্ণিত হয়েছেন। ইনি ব্রহ্মাবতের একতর সীমা এবং কুরুক্ষেত্রে অন্তরিত হয়ে প্রয়াগে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। তাই পরবর্তী বৈদিক যুগে নদীদেবতা হিসাবে মাহাত্ম্য হারিয়ে সরস্বতী সাহিত্য, শিল্প ও সঙ্গীতকলার দেবী হিসাবে পরিচিত হন।

স্কন্দপুরাণে সরস্বতীর উৎস হলেন বিষ্ণু এবং সরস্বতীর অবস্থান হল বিষ্ণুর জিহ্বাতে। নারদপুরাণে বলা হয়েছে, চরম অবস্থায় রাধা এবং কৃষ্ণ একই দেহে বিরাজ করেন এবং তাঁদের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। এই অবস্থায় রাধা থেকে পাঁচটি রূপ আবির্ভূত হয়। তাঁরা হলেন– লক্ষ্মী, দুর্গা, সাবিত্রী, সরস্বতী এবং রাধার নিজেরই আর-একটি রূপ। কারও কারও মতে শক্তির রূপভেদ পাঁচটি নয় আটটি। যেমন –শ্রীদেবী, ভূদেবী, প্রীতি, কৃতি, শান্তি, তান্তি এবং পুন্তি।

বামনপুরাণে বিশ্বামিত্র ও বশিষ্ঠের কোন্দলের ঘটনা উল্লেখ আছে। বশিষ্ঠ তাঁর আশ্রমে একটি প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গ এবং সরস্বতীর একটি বিরাট মূর্তির পুজো করতেন। বশিষ্ঠের ওখানে এভাবে পুজো করা বিশ্বামিত্রের মনে ক্রোধ উৎপন্ন হওয়ায় তিনি নদী সরস্বতাঁকে বলেন বশিষ্ঠকে ধরে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে। যাতে উপযুক্ত সাজাটা তিনি বসে বসেই দিতে পারেন। সরস্বতী বিশ্বামিত্রের ক্ষমতা জানতেন। তাই তিনি বিশ্বামিত্রের কাছে বশিষ্ঠকে নিয়ে যেই হাজির হলেন অমনি বিশ্বামিত্র তাঁকে (বশিষ্ঠকে) হত্যার জন্য একটা অস্ত্র আনতে গেলেন। ইত্যবসরে সরস্বতী, যিনি ছিলেন নদী, তিনি নিজের জলধারার মাঝে বশিষ্ঠকে লুকিয়ে রাখলেন। বিশ্বামিত্র রেগে গিয়ে অভিশাপ দিলেন সরস্বতাঁকে– সরস্বতী এবার রক্তনদী হবেন। আর যত অসুর রাক্ষস আছে, তাঁদের পান করে স্ফুর্তি করবে। সেটাই ফলে গেল! শেষে একদল সাধুর প্রার্থনায় সৃষ্টি হল প্রয়াগে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর সঙ্গম –আর যত দুরাত্মা সেখানে স্নান করল এবং সবাই পবিত্ৰাত্মা হয়ে গেল।

হিন্দু পুরাণে বলা হয়েছে, ব্রহ্মা তাঁর কন্যার সঙ্গে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হন। এহেন বিষয়ে কলকাতার জাদুঘরের একটি প্রস্তর মূর্তি থেকে তার যথেষ্ট প্রমাণ মেলে। এই মূর্তিটি ব্রহ্মার বামজানুর উপর সরস্বতী বসে আছেন, তাঁর এক হাতে ব্রহ্মার স্কন্ধবেষ্টিত। সরস্বতীর সঙ্গে ব্রহ্মার এই সম্বন্ধের সন্ধান ঋগ্বেদেও পাওয়া যায়। এখানে ব্রহ্মার সঙ্গে বাকদেবীর একটি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ সূচিত হয়েছে। বাই যে সরস্বতী তা নিয়ে তো কোনো দ্বিমত নেই। ব্রাহ্মণ যুগে এই সম্বন্ধ আরও ঘনিষ্ঠতর। এখানে দেখা যাচ্ছে “প্রজাপতি ব্রহ্মা পুনরায় নিজেকে আপ্যায়িত করিলেন, বাক্ তাঁহার দিকে ফিরিয়া আসিলেন। তিনি বাককে আত্মবশ করিলেন। এখানে তিনি বাক্য দ্বারা আপ্যায়িত হইলেন, বলবান হইলেন।” এইভাবেই বোধহয় আমরা সরস্বতাঁকে ব্রহ্মার অঙ্কশায়িনী তথা স্ত্রী হিসাবে পাই। বেদের উষাকেও পরবর্তীতে সরস্বতী রূপে পাই। তাই উষার মতো সরস্বতীও শুভ্র এবং জ্ঞানের প্রতীক। সেই কারণে সরস্বতী একদিকে সূর্যের কন্যা ও অন্যদিকে স্ত্রী।

মহাভারতের শল্যপর্বে উল্লেখ আছে যে, দধীচি একবার এক অপ্সরাকে অবলোকন করে উত্তেজিত হয়ে বীর্যস্খলন করে ফেলেন। সেই বীর্য সরস্বতী নদীতে পতিত হয়, আর সেটা অতি যত্নে ধারণ করে সরস্বতী এক শিশুর জন্ম দেন। মহাভারতের আদিপর্বেও শান্তনু যিনি গঙ্গাকে বিবাহ করেছিলেন, তার এক পূর্বপুরুষ সরস্বতীর পুত্র ছিলেন বলে বলা হয়েছে –এক্ষেত্রে ছিলেন এক মুনি।

সরস্বতীর বাহন হাঁস ছাড়াও মেষ আর বরাহকে পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক এন এস ভট্টসারি একটি লেখায় বলেছেন, “একসময় ইন্দ্রের শরীরের শক্তি চলে যাওয়ার ফলে তিনি মেষ আকৃতি গ্রহণ করেন। সেসময় ইন্দ্রের চিকিৎসার দায়িত্ব ছিল স্বর্গের অশ্বিনীদ্বয়ের উপর এবং সেবা-শুশ্রূষার ভার ছিল সরস্বতীর হাতে। সংগীত ও নৃত্যপ্রেমী ইন্দ্র সরস্বতীর গানবাজনা ও সেবায় সুস্থ হওয়ার পর তাকে মেষটি দান করেন। সেই থেকেই সরস্বতীর সঙ্গী এই মেষ। তাহলে কি সরস্বতী স্বর্গের সেবাদাসীও! সরস্বতীর বাহন বরাহ (শুয়োর), কারণ তিনি নাকি বিষ্ণুরও স্ত্রী ছিলেন। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ রচিত ‘সরস্বতী’ গ্রন্থটিতে এ তথ্য পাওয়া যায়। শ্রীকৃষ্ণকেও স্বামী হিসাবে কামনা করেছিলেন তিনি —

“ইয়েষ কৃষ্ণং কামেন কামুকী কামরূপিনী”

“ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’-এ শ্রীকৃষ্ণ-সরস্বতীর কেচ্ছাকাহিনি যথাযথভাবেই বর্ণিত আছে। ডঃ শ্যামল চক্রবর্তী ‘নারী’ প্রবন্ধে বলেছেন, সরস্বতী গণেশেরও স্ত্রী। মহারাষ্ট্রের কোনো কোনো পূজারী মনে করেন, গণেশের পত্নী সরস্বতী কিংবা সারদা। হয়তো সরস্বতী এবং গণেশ দুজনই বিদ্যা ও সংগীতের অধিষ্ঠাতা দেবতা বলেই এই পতি-পত্নীর কল্পভিত্তি। আর-এক তথ্য অনুসারে জানা যাচ্ছে, দুর্গার কন্যা এই সরস্বতী দুর্গার কুমারী সত্তা। আবার বাঙালিরা মনে করেন গণেশ ও সরস্বতী ভাইবোন, দুর্গার সন্তান। অথচ চিরকুমারী (!) সরস্বতাঁকে স্বর্গের দেবতারা কখনও স্ত্রী, কখনও সেবাদাসী, কখনও গণিকা, আবার কখনও অসুরদের রূপে ভুলিয়ে কাত করাবার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।

পণ্ডিতদের মতে সরস্বতী হলেন সৃজন শক্তি। অর্থাৎ ‘Essence of the self’। আপন সত্তার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক গুণাবলি। তাঁর চারটি হাত। এক হাতে গোলাপ, এক হাতে বই –এ দুটি হল পিছনের হাত। সামনের দু-হাতে তিনি বীণা বাজাচ্ছেন। তাঁর পরিধানে সাদা বস্ত্র, যা শুদ্ধ জ্ঞানের প্রতীক। বীণাবাদন জাগতিক কর্ম আর পদ্মধারণ আধ্যাত্মিক জগতের প্রতীক বলা হয়েছে। পদ্ম পরম সত্তার প্রতীক। এর দ্বারা মনোযোগ, ধ্যানসমাধি এবং পরম সত্তার সঙ্গে একাত্মতা বোঝায়। তাঁর কাছ একটি ময়ুর থাকলেও বাহন রাজহাঁস। ময়ুরের মেজাজ আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। তাই তিনি পছন্দ করেননি। অপরদিকে রাজহাঁস অসার-সার একসঙ্গে মেশানো দ্রব্য থেকে অসার দ্রব্য নিখুঁতভাবে ত্যাগ করে সারদ্রব্য গ্রহণ করে বলে বাহন হিসাবে বেশি পছন্দ।

হিন্দুদের দেবী হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ ও জৈনদের কাছেও পুজো পেয়েছেন সরস্বতী। গান্ধারের পাওয়া বীণাবাদিনী সরস্বতীর মূর্তি থেকে বা সারনাথে সংরক্ষিত মূর্তিতে এর প্রমাণ মেলে। পাথরের একটি ছোটো মূর্তি আছে তাতে সরস্বতী বীণা বাজাচ্ছেন, এর সঙ্গে হিন্দুদের সরস্বতীর কোনো পার্থক্য নেই। মথুরায় জৈনদের প্রাচীন কীর্তির আবিষ্কৃত নিদর্শনে সরস্বতীর যে মূর্তি পাওয়া গেছে সেখানে দেবী জানু উঁচু করে একটি চৌকো পীঠের উপর বসে আছেন, এক হাতে বই। শ্বেতাম্বরদের মধ্যে সরস্বতী পুজোর অনুমোদিত ছিল। জৈনদের ২৪ জন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং ১৬ জন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অন্যতম হলেন সরস্বতী। শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর জৈন সম্প্রদায় উভয়েই সরস্বতাঁকে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে গৃহীত একজন প্রধান দেবীরূপে স্থান হয়ে গেল।

শ্রীপঞ্চমীর ‘শ্রী’ অর্থে লক্ষীকে বোঝায়। অর্থাৎ এই তিথি লক্ষ্মীর। তাই শ্রীপঞ্চমীর পুজো ধনের বা শস্যের বা তাঁর অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মীরও পুজো। এই কারণে দেখা যায় কৃষিজীবী মানুষের কৃষি উৎপাদনের উপাদানগুলি এই পুজোয় অন্তর্ভুক্ত। তাই সরস্বতী পুজোর অন্যতম উপাচার পঞ্চশস্য (ধান, যব, সাদা সর্ষে, মুগ ও মাসকলাই) এবং পঞ্চপল্লব (কাঁঠাল, আম, অশন্থ, বট ও বকুল)। অনেকে মনে করেন সরস্বতী নামে দেবী কৃষিকর্মের সহায়ক এবং উৎপাদক ব্যবস্থার সঙ্গেই বেশি যুক্ত। অমরসিংহের সময় পর্যন্ত প্রাচীন কোনো কোশগ্রন্থে ‘শ্রী’ শব্দের অর্থ সরস্বতী না থাকলেও মধ্যযুগের আচার্য রেদিনীবর হেমচন্দ্র প্রমুখের অভিধানে সরস্বতী আর-একটি নাম হিসাবে ‘শ্রী”-র সন্ধান পাওয়া যায়।

সরস্বতী আলোচনা প্রসঙ্গে লক্ষ্মীর প্রসঙ্গও এসে যায়। কারণ আমরা লক্ষ্মী ও সরস্বতীর দ্বন্দ্বের কাহিনি আমরা শুনেছি। দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে, লক্ষ্মী কৃষ্ণের জিহ্বাগ্র থেকে উৎপন্ন হয়েছেন। ব্রহ্মা প্রথম তাঁকে পুজো করেন। পরে জগতে তাঁর পুজো প্রতিষ্ঠিত হয়। দেবীপুরাণে বলা হয়েছে, একবার সত্যযুগের শুরুতে ভগবান বিষ্ণু ক্ষীর সাগরে যোগনিদ্রায় শায়িত ছিলেন। সেইসময় লক্ষ্মী তাঁর পদসেবা করছিলেন। সেইসময় হঠাৎ বৈকুণ্ঠলোকে সরস্বতী চলে আসেন। বিষ্ণুর পদসেবায় নিয়োজিত লক্ষ্মীকে দেখে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন সরস্বতী এবং লক্ষ্মীকে বৈকুণ্ঠ ছেড়ে চলে যেতে বললেন। তাঁর ক্রুব্ধ হওয়ার একমাত্র কারণ হল তিনি তখন ভেবেছিলেন বিষ্ণুই হয়তো তাঁর স্বামী। লক্ষ্মী অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন সরস্বতাঁকে। কিন্তু সরস্বতী কিছুতেই বুঝতে চাননি যে, বিষ্ণুই লক্ষ্মীর স্বামী। লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মধ্যে এ নিয়ে তুমুল দ্বন্দ্বের উৎপত্তি হল। লক্ষ্মী ও সরস্বতীর তুমুল দ্বন্দ্ব দেখে গঙ্গা তাঁদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে উদ্যোগী হন। গঙ্গা স্বাভাবিকভাবে লক্ষ্মীর পক্ষ নিলেন এবং সরস্বতীর বিপক্ষে দাঁড়ালেন। গঙ্গা সরস্বতাঁকে যারপরনাই বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, বিষ্ণুই একমাত্র লক্ষ্মীর স্বামী। এ ঘটনা কি এটাই প্রমাণ করে যে, সরস্বতী বিষ্ণুকে নিজের স্বামী করছিলেন? সরাসরি সদার্থক উত্তর পাওয়া না গেলেও বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। যাই হোক, সরস্বতী কি গঙ্গার এই বিচার মেনে নিলেন? না, মানেননি। তিনি লক্ষ্মীকে অভিশাপ দিলেন, বললেন– “লক্ষ্মী মর্ত্যলোকে মানবী হয়ে জন্মাবেন, অসুরের স্ত্রী হয়ে দুঃখ সহ্য করবেন এবং অবশেষে বৃক্ষতে রূপান্তরিত হবেন।” সরস্বতী লক্ষ্মীকে অভিশাপ দিতেই গঙ্গাও সরস্বতাঁকে অভিশাপ দিলেন– সরস্বতী নদীরূপে পৃথিবীতে প্রবাহিত হবে। সরস্বতীও গঙ্গাকে পাল্টা অভিশাপ দিলেন –গঙ্গাও পৃথিবীতে নদীরূপে প্রবাহিত হবেন।

এক বিষ্ণুকে ঘিরে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গঙ্গা তিনজনেই একে অপরকে অভিশাপ দিলেন। এই পুরাণ-কাহিনি থেকে হিন্দুরা বিশ্বাস করে –সরস্বতীর অভিশাপে লক্ষ্মী তুলসীগাছ হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছেন, গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতী পৃথিবীর বুকে নদীরূপে প্রবাহিত হচ্ছেন এবং গঙ্গাও সরস্বতীর অভিশাপে পৃথিবীর বুকে নদীরূপে প্রবাহিত হচ্ছেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে বলেন– সরস্বতী, গঙ্গা ও লক্ষ্মীর মধ্যে যে, দ্বন্দ্ব-বিবাদ হয়েছে, তা নিছকই দেবলীলা। আবার অনেকেই বলেন, এসব নিছকই মনোরঞ্জক গালগপ্পো, রূপকথা।

মহাভারতের এক জায়গায় উল্লেখ আছে, নগরে প্রবেশের আগে যুধিষ্ঠির তাঁকে প্রীতি ও সাদর সম্ভাষণ জানাতে গণিকাদের লোক মারফত প্রেরণ করেন। প্রাচীন ভারতে গণিকারাই ছিলেন নারীদের মধ্যে একমাত্র শিক্ষিত শ্রেণি। এঁদের চৌষট্টি কলায় পারদর্শিনী হতেই হয়। শুধু তাই নয়, অলংকার, ছন্দ ও কাব্য সম্পর্কেও তাঁদের বিশেষ জ্ঞান ছিল। সেই কারণেই তাঁরা রাজদরবারে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে আমন্ত্রণ পেতেন। যে সময় সাধারণ নারীরা পড়াশোনা করতেন, সে সময় গণিকারাই কেবল কেবলমাত্র বিদ্যা, সঙ্গীত ও অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞানী ছিলেন। আর এইসব জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রীদেবী হিসাবে ছিলেন সরস্বতী। ধনী নাগরিক ও গণিকাদের দ্বারা পূজিত হতেন, সে বিষয়ে উল্লেখ আছে বাৎসায়নের কামসূত্র গ্রন্থে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে প্রাচীন যুগে ধনী নাগরিক ও গণিকাদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। বিদ্যা আজও গরিবদের জন্য নয়।

তবে গণিকাদের লক্ষ্মীপুজো থেকে বঞ্চিত করা হলেও সরস্বতী পুজো করতে পারেন। সরস্বতী কেন? সরস্বতীর অধিষ্ঠান কী তবে গণিকালয়ে? তা না-হলে লক্ষ্মী নয় কেন? গণিকাদের তো লক্ষ্মী বা ধনসম্পদের প্রয়োজন। দক্ষিণ ভারতে যে ময়ূরবাহন সরস্বতীর মূর্তি পাওয়া গেছে সেটা কৌমারীর সঙ্গে অনেকটা মিলজুল হয়। কৌমারী কার্তিকের পত্নী। তাই বোধহয় গণিকাদের দেবতা কার্তিকের পাশাপাশি সরস্বতীর পুজোও গণিকালয়ে হয়ে থাকে। যুগে যুগে ইতিহাসবিদরা জানিয়েছেন উপাসনালয় থেকে গণিকালয়– সর্বত্র পুজো পায় সরস্বতী। সরস্বতী তাঁর কৌমার্য হারিয়েছে বহু পুরুষের বাহুডোরে। নেপালে চতুর্দশ শতকের পাওয়া শিলালিপিতে লেখা আছে– “সারদা তুমি মাতৃরূপী, তুমি কামমূর্তি”। তাই কি স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের উচ্চারণ করতে হয়– “ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে”। তিব্বতে এমন অনেক সরস্বতী পাওয়া গেছে যাঁর উর্ধ্বাঙ্গে কোনো বসনই ছিল না। তাই হয়তো মকবুল ফিদা হোসেনের সরস্বতীর পরনে আব্রু নেই! সরস্বতী, লক্ষ্মী, কার্তিক, গণেশ– এরা কেউ কারোর ভাই-বোন নয়, এটা বাঙালিদের মনগড়া রূপকল্প। ভিত্তি নেই, সমর্থনও নেই।

আমরা বাঙালিরা সাধারণত সরস্বতীর যে মূর্তি কল্পনা করি, তা হল তিনি চতুর্ভুজা, শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা, শ্বেত পদ্মাসনা, শ্বেত হংস। এছাড়াও আমরা সরস্বতীর আরও দুটি রূপ পাচ্ছি– (১) মহা সরস্বতী ও (২) মহাবিদ্যা নীল সরস্বতী।

মহা সরস্বতী : দেবীমাহাত্ম অনুসারে ইনি মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতীর মিলিত রূপ। ইনি অষ্টভুজা, শ্বেত পদ্মাসনা, বীণাবাদনরত। তাঁর হাতে ঘণ্টা, ত্রিশূল, লাঙলের ফলা, শাঁখ, মুষল, চাকতি, ধনুক ও শর। শারদ পূর্ণিমার চন্দ্রের মতো তাঁর দীপ্তি। গৌরীর শরীর থেকে তাঁর জন্ম এবং তিনি শুম্ভ ইত্যাদি অসুরদের বধকারিণী। শুম্ভ ও নিশুম্ভ অসুরদ্বয়কে বধ করার সময় দেবী দুর্গার শরীর থেকে কৌশিকী দেবীর উৎপত্তি হয়েছিল।

মহাবিদ্যা নীল সরস্বতী : ইনি মহাবিদ্যা তারার আর-এক রূপ। তন্ত্রসারে তাঁর ধ্যানমন্ত্র পাওয়া যায়। কথিত আছে –বিদ্যাবতীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বনের মধ্যে এক জলাশয়ে কালিদাস যখন প্রাণ বিসর্জন দিতে যান, তখন নীল সরস্বতী আবির্ভূত হয়ে তাঁকে আত্মহত্যা থেকে নিরস্ত্র করেন। এরপর কালিদাসের প্রর্থনায় তুষ্ট হয়ে তিনি কালিদাসের জিহ্বার অগ্রভাগে সদা বিরাজ করতে থাকেন। এর ফলে কালিদাস মূর্খ থেকে মহাপণ্ডিত হয়ে একের পর এক মহাকাব্য লিখে ফেলেন।

আদি পুরাণ বলছে, সরস্বতী ব্রহ্মার মুখজাত। মুখজাত– এর অর্থ জ্ঞান। মুখনিঃসৃত কথাই তো বেদ। ফলে ব্রহ্মার মুখজাত সৃষ্টি সরস্বতী জ্ঞানেরই। আবার শিবপুরাণ তো অন্য কথা বলছে। কী বলছে? বলছে– ব্রহ্মা কাম পরবশ হয়ে সরস্বতীর পিছনে পিছনে গিয়েছিলেন, ছেলেদের বাধায় ব্রহ্মা দেহত্যাগ করেছিলেন। এখানেই আছে ব্রহ্মার এই কুপ্রস্তাবে সরস্বতী ব্রহ্মাকে অভিশাপ দেন, ফলে তার একটি মাথা খসে পড়ে। সেই থেকে ব্রহ্মা চতুরানন। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণেও সরস্বতী বিষ্ণুর মুখজাত, কিন্তু ব্রহ্মার স্ত্রী। বিষ্ণু ব্রহ্মাকে গোলকে পাঠাচ্ছেন। প্রকৃতির অংশরূপী ভারতাঁকে সেখানে মানে গোলকে দেখতে পাবেন এবং তাঁকে দেখার পর তাঁর সঙ্গে যৌনমিলনে ব্যস্ত হবেন। এও আছে ব্রহ্মা ভারতীর সঙ্গে রতিক্রিয়া করেছেন স্থানে স্থানে নির্জনে নির্জনে। যিনি ভারতী, তিনিই সরস্বতী।

‘মৎসপুরাণ’ অনুসারে পরমাত্মার মুখনিঃসৃত শক্তিগুলির মধ্যে সরস্বতী সর্বশ্রেষ্ঠা। তিনি রূপে দেবীর ন্যায় পরমা সুন্দরী। মহাশ্বেতা (সর্বশুক্ল বা যার সর্বাঙ্গ শ্বেতবর্ণের) ও বীণাবাদিনী। কিন্তু জন্ম নেওয়ার পর তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে ‘সৃষ্টিকর্তা’ ব্রহ্মা সরস্বতীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ব্রহ্মার কুদৃষ্টি থেকে বাঁচতে অগোচরে চলে যেতে থাকে সরে সরে। যেদিকেই তিনি সরছেন সেদিকেই ব্রহ্মার মাথা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। সরস্বতাঁকে নজরের বাইরে যেতে দিচ্ছেন না রূপে মুগ্ধ ব্ৰহ্মা। এইভাবেই তৈরি হয়ে যায় পাঁচটি মাথা। এই রূপেই আমরা ব্রহ্মার মূর্তি পাই। অবশেষে সরস্বতী রাজহংসীর রূপ ধরে বনে পালিয়ে যান। ব্ৰহ্মাও রাজহংসীরূপী সরস্বতীর পিছু নেন এবং সেখানে জোর করে সরস্বতাঁকে ভোগ করেন।

স্কন্দপুরাণে আমরা অন্য এক কাহিনি পাই। সেখানে ব্রহ্মা তাঁর কন্যা সরস্বতীর প্রতি দুর্ব্যবহার করলে শিব তাঁকে শরবিদ্ধ করে হত্যা করেন। তখন ব্রহ্মার স্ত্রী গায়ত্রী কন্যা সরস্বতাঁকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য গন্ধমাদন পর্বতে তপস্যা শুরু করে দেন। সেই থেকে শিবের নির্দেশে গায়ত্রী ও সরস্বতীর তপস্যাস্থলে দুটি প্রসিদ্ধ তীর্থ সৃষ্টি হয়। পৃথিবীতে সকল দেবতার তীর্থক্ষেত্র আছে, কেবল ‘সৃষ্টিকর্তা’ ব্রহ্মার নেই। একথা ভেবে ব্রহ্মা পৃথিবীতে নিজের তীর্থ স্থাপনে উদ্যোগী হলেন। তিনি একটি সর্বরত্নময়ী শিলা পৃথিবীতে নিক্ষেপ করলেন। সেটি চমৎকারপুরে এসে পড়ল। ব্রহ্মার সেখানেই নিজের তীর্থ স্থাপন। করবেন বলে ভাবলেন। ব্রহ্মার নির্দেশে সরস্বতী পাতাল থেকে উঠে এলেন। তখন ব্রহ্মা তাঁকে বললেন –“তুমি এখানে আমার কাছে সবসময় থাকো। আমি তোমার জলে ত্রিসন্ধ্যা তপণ করব।” সরস্বতী ভীত হয়ে বললেন– “আমি লোকের স্পর্শ ভয় পাই বলে সবসময় পাতালে থাক। কিন্তু আপনার আদেশ আমি অমান্যও করতে পারি না। আপনি সবদিক বিচার করে একটা ব্যবস্থা করুন।” তখন ব্রহ্মা সরস্বতীর অবস্থানের জন্য হ্রদ খনন করলেন। সরস্বতী সেই হ্রদে অবস্থান করতে লাগলেন। ব্রহ্মা ভয়ংকর সাপেদের সেই হ্রদে ও সরস্বতীর রক্ষক হিসাবে রাখলেন।

শুধু বৈদিক যুগে নয় পরবর্তীকালে মহাভারত, পুরাণ, কাব্যে পূতসলিলা সরস্বতীর মহিমা বর্ণিত হয়েছে। সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল ছিল হিমালয়ের সিমুর পর্বতে, এখান থেকে পাঞ্জাবের আম্বালা জেলার আদবদ্রী নামক স্থানে সমভূমিতে অবতরণ করেছিল। যে প্রসবণ থেকে এই নদীর উৎপত্তি তা ছিল প্লক্ষাবৃক্ষের কাছে, তাই একে বলা হতো প্লহ্মাবতরণ। এতি হিন্দুদের তীর্থস্থান। ঋগ্বেদের যুগে গঙ্গা যমুনা ছিল অপ্রধান নদী, পক্ষান্তরে সরস্বতী নদী ছিল সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়। এর তীরে ছিল প্রসিদ্ধ তীর্থভূমি। সরস্বতী ও দৃষদ্বতীর মধ্যস্থান দেবনির্মিত স্থান হিসেবে বিবেচ্য হত। ব্রাহ্মণ ও মহাভারতে উল্লেখিত সারস্বত যজ্ঞ এই নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হত। মহাভারত রচনা হওয়ার আগেই রাজপুতনার মরূভূমিতে সরস্বতী নদী অদৃশ্য হয়ে গেলেও কয়েকটি স্রোতধারা অবশিষ্ট ছিল। এই স্রোতধারা হল চমসেসাদ্ভেদ, শিবোদ্ভেদ ও নাগোদ্ভেদ। রাজস্থানের মরূভূমির বালির মধ্যে চলুর গ্রামের নিকটে সরস্বতী অদৃশ্য হয়ে ভবানীপুরে দৃশ্য হয়। আবার বলিচ্ছপুর নামকস্থানে অদৃশ্য হয়ে বরখের নামক স্থানে দৃশ্য হয়। তান্ডমহাব্রাহ্মণে সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল হিসাবে প্লপ্রস্রবণ ও বিনাশস্থল হিসেবে বিনশনের নামোল্লেখ আছে। ভারতের বর্তমান উদয়পুর, মেওয়াড় ও রাজপুতনার পশ্চিমপ্রান্তে মরু অঞ্চলে সিরসা অতিক্রম করে ভূটানের মরূভূমিতে সরস্বতীর বিলোপ স্থানই বিনশন। লাট্যায়ণের শ্রৌতসূত্র মতে, “সরস্বতী নামক নদী পশ্চিম মুখে প্রবাহিত, তার প্রথম ও শেষভাগ সকলের প্রত্যক্ষ গোচর, মধ্যভাগ ভূমিতে নিমগ্ন হয়ে প্রবাহিত, সে অংশ কেউ দেখতে পায় না, তাকেই বিনশন বলা হয়”। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের মতে, বৈদিক সরস্বতীর লুপ্তাবশেষ আজও কচ্ছ ও দ্বারকার কাছে সমুদ্রের খাড়িতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। সরস্বতী নদীর বিনাশ ঘটেছিল অবশ্যই বৈদিক যুগের শেষভাগে। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, খ্রিস্টের দেড় হাজার বছরেরও আগে। মহাভারতে আছে যে নিষাদদের চোখের আড়ালে থাকার জন্য বিনাশণ নামক স্থানে মরুভূমিতে অদৃশ্য হয়েছে। নদীর স্থানীয় নামই এই ঐতিহ্য বহন করছে। অনেকেই বলেন, সিন্ধুনদই সরস্বতী। সরস্বতী ও সিন্ধু দুটি শব্দের অর্থই নদী।

সরস্বতী পুজো হিন্দু বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠেয় একটি অন্যতম প্রধান হিন্দু উৎসব। পুরোহিত দর্পণ (শাস্ত্রীয় বিধান?) অনুসারে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পুজো আয়োজিত হয়। তিথিটি শ্রীপঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত। উত্তর ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, নেপাল ও বাংলাদেশে সরস্বতী পুজো উপলক্ষ্যে বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। শ্রীপঞ্চমীর দিন অতি প্রত্যূষে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্রছাত্রীদের গৃহ ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপে দেবী সরস্বতীর পুজো করা হয়। ধর্মপ্রাণ হিন্দু পরিবারে এই দিন শিশুদের হাতেখড়ি, ব্রাহ্মণভোজন ও পিতৃতর্পণের প্রথাও প্রচলিত। পূজার দিন সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সর্বজনীন পুজোমণ্ডপগুলিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়। পুজোর পরের দিনটি শীতলষষ্ঠী নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে কোনো কোনো হিন্দু পরিবারে সরস্বতী পুজোর পরদিন অরন্ধন পালনের প্রথা রয়েছে।

নদী সরস্বতী বৈদিক সাহিত্য থেকে পুরোপুরি বাগ দেবী হয়ে দাঁড়ান ব্রাহ্মণ গ্রন্থে। সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পুজো বর্তমান রূপটি আধুনিক কালে প্রচলিত হয়েছে। তবে প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতী-সদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পুজো করতেন বলে জানা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির উপর তালপাতার তাড়ি ও দোয়াতকলম রেখে পুজো করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্রেরা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পুজো করত। ইংরেজি স্লেচ্ছ ভাষা হওয়ায় সরস্বতী পুজোর দিন ইংরেজি বইয়ের পুজো নিষিদ্ধ ছিল। গ্রামাঞ্চলে এই প্রথা বিংশ শতাব্দীতেও প্রচলিত ছিল। শহরে ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পুজো করতেন। বর্ধমান মহারাজার পূজায় বিশেষ সমারোহের আয়োজন করা হয়। দূর দুরান্ত থেকে মানুষ এই পুজোর বিসর্জন দেখতে আসত। পুজো উপলক্ষে দুই ঘণ্টা আতসবাজিও পোড়ানো হত। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পুজোর প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে সরস্বতী দেবী হলেও মেয়েরা অঞ্জলি দিতে পারত না। কিছু পণ্ডিতের মতে সমাজপতিরা ভয় পেতেন হয়তো এই সুযোগে ধর্মের নামে মেয়েরা দাবি করে বসেন লেখাপড়ার স্বাধীনতা!

শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পুজো সম্পন্ন করা যায়। সরস্বতীর পুজো সাধারণ পুজোর নিয়মানুসারেই হয়। তবে এই পুজোয় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। যেমন অভ্র-আবীর, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ। পুজোর জন্য বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুলও প্রয়োজন হয়। লোকাঁচার অনুসারে, ছাত্রছাত্রীরা পুজোর পূর্বে কুল ভক্ষণ করেন না পুজোর দিন কিছু লেখাও নিষিদ্ধ। যথাবিহিত পুজোর পর লক্ষ্মী, নারায়ণ, লেখনী-মস্যাধার (দোয়াত-কলম), পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পুজো করার প্রথা প্রচলিত আছে। পুজোর শেষে পুস্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের দল বেঁধে অঞ্জলি দিয়ে থাকে।

কেউ কেউ বলেন, মর্ত্যধামে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে প্রথম বারের মতো শ্রীশ্রী সরস্বতী দেবী পুজোর প্রচলন করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর শৈশব কাল থেকেই সরস্বতী পুজো প্রচলন করে সমগ্র পৃথিবীর শিক্ষার্থীদের সরস্বতী পুজোর গুরুত্ববহ বিদ্যার্জন ও বিদ্যালয়সমূহে সরস্বতী পুজোর প্রচলন করে গেছেন, যা এখনও পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত রয়েছে। সরস্বতী পুজো স্বৰ্গমর্তে, উভয়লোকে দেবতা, গন্ধর্ব, কিন্নর, ঋষি, মহর্ষি, রাজা-প্রজা সবাই শ্রদ্ধার সঙ্গে করে আসছে। সরস্বতী পুজোর অঞ্জলি দেওয়ার সময় পলাশ ফুলের ব্যবহার ভগবান শ্রীকৃষ্ণই প্রচলন করেন। বলে অনেকে মনে করেন। শ্রীকৃষ্ণের বয়স তখন ৭ বছর।

পুস্পাঞ্জলী মন্ত্রঃ

ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।
নমঃভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।।
বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ।।
এস স-চন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।।

প্রণাম মন্ত্রঃ

নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।।
জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।

সরস্বতীর স্তবঃ

শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষ্পোপশোভিতা।
শ্বেতাম্ভরধরা নিত্যা শ্বেতাগন্ধানুলেপনা।।
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চ্চিতা।
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারবভূষিতা
বন্দিতা সিদ্ধগন্ধর্বৈৰ্চিতা দেবদানবৈঃ।
পূজিতা মুনিভি: সৰ্ব্বৈঋষিভিঃ স্কয়তে সদা।।
স্তোত্রেণানেন তাং দেবীং জগদ্ধাত্রীং সরস্বতীম্।
যে স্মরতি ত্রিসন্ধ্যায়ং সৰ্বাং বিদ্যাং লভন্তি তে।।

নদী সরস্বতীর মহিমা ভারতবাসীর মনে এত রেখাপাত করেছিল যে, পরবর্তীকালে গঙ্গা সরস্বতীর স্থান দখল করলেও তাঁরা তাঁকে ভুলতে পারেনি। প্রয়োগে অন্তঃসলিলারূপে গুপ্তভাবে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গে সরস্বতীর সঙ্গম, পশ্চিমবঙ্গে হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে গঙ্গার স্রোত ধারা থেকে সরস্বতীর মুক্তি হিন্দুদের প্রিয় ও পবিত্র বিশ্বাস। সরস্বতী নিয়ে নানা ব্যাখ্যা নানা বিশ্লেষণ প্রচলিত আছে। তাই সঠিক সিদ্ধান্তে যাওয়ার চেষ্টা করা বৃথা, তবে অসম্ভব নয়। অতএব আমরা দেখলাম নদীরূপে, ব্রহ্মার কন্যারূপে, বিষ্ণুর জিহ্বায় অবস্থানকারী রূপে ইত্যাদি নানাভাবে আদি কাহিনিগুলিতে বারবার সরস্বতী এসে হাজির হয়েছেন। সরস্বতী শব্দের যা অর্থ তা নদীর সঙ্গে মিল খায় না। যদিও সেইকালে নদীর অপরিসীম গুরুত্ব ছিল। পরবর্তীকালে তাঁকে বাগদেবী হিসাব পুজো করা শুরু হয়। এইখানে আমরা বিগ ব্যাং থিয়োরির কথাটা একবার মনে করতে পারি, যা শব্দ থেকে ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি কথাটার সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করে। এবার আমরা যদি সহজ করে ভাবি তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে একটা পরমসত্তা ছিল, একটা শব্দ নির্গত হল আর ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি হল। সরস্বতী যদি সেই শব্দ হয় তবে সারা সৃষ্টির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ রয়েছে।

এতক্ষণ যাঁরা সরস্বতীর বিচিত্র কাহিনি পাঠ করলেন, তাঁদের বলি এইসব সরস্বতী একজন কেউ নন। ভিন্ন ভিন্ন সরস্বতী। একই নামে একাধিক সরস্বতীর একত্র রূপ। যেহেতু প্রাচীনকালে কারোর পদবি ছিল না বা পদবির উৎপত্তি হয়নি, তাই কারোকেই পৃথক করা যায় না। সবাইকেই একই সত্তা বলে মনে হয়।

লেখক মনোবর বলছেন–“সমস্ত জ্ঞান, যা শব্দ বা বাক্য দ্বারা ধারণা করা যায় তার এক চিন্ময়ী মূর্তি হিসাবে দেবী সরস্বতীর পুজো করা হয় এইটা হচ্ছে মোদ্দা কথা। সমস্ত প্রকার শক্তিকেই দেবীরূপে কল্পনা বা ব্যাখ্যা করা হয়েছে তাই সরস্বতী হলেন বিদ্যাশক্তির অধিষ্ঠাত্রী। ব্যস! এবার আর কোনো সমস্যা নেই। এই প্রবল শক্তি, যা জগতের বিকাশের অন্যতম ভিত্তি তার পুজো পাওয়া মানে ওই বিদ্যার বিকাশের পথ সুগম হওয়া সেটা আমাদের জন্য আনন্দদায়ক হওয়ার কোন কারণ নেই। যা আমরা গুরুত্বপুর্ণ ভাবি তাকে শ্রদ্ধাভক্তি করায় দ্বিধার কোন কারণ তো নেই। এখানে আমরা বা আমাদের বলতে শুধুমাত্র হিন্দুদের কথা বলা হয়েছে বুঝতে হবে। কারণ মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের দেবী সরস্বতী নেই। তাঁরা কেউই সরস্বতীর বরে বিদ্যালাভ করে বিদ্বান হননি। তাঁরা সরস্বতীর বর বা আশীর্বাদ না পেলেও বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, গবেষক, দার্শনিক হওয়া তাঁদের আটকায়নি। আইনস্টাইন, নিউটন, কোপারনিকাস, প্লেটো, ডেকার্ত, পিট সিগার, ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাঙ, আলেকজান্ডার ফ্লেমিং, রুজভেল্ট, সামসুর রহমান, হুমায়ুন আজাদ, আবদুল্লাহ আবু সয়ীদ, হুমায়ুন আহমেদ, মোহাম্মদ জাফর ইকবাল, সৈয়দ মুজতবা সিরাজ, আল্লামা ইকবাল, জসিমউদ্দিন, কার্ল মার্ক্স, লেনিন, স্তালিন হয়ে উঠতে কারোরই সরস্বতীর প্রয়োজন হয়নি।

উপসংহারে একটা বলতে চাই, সরস্বতী মূলত হিন্দুদের দেবী। বিশেষ করে বাঙালি বিদ্যার্থীদের কাছে একমাত্র উপাস্য। খ্রিস্টান, মুসলমান, শিখ এবং অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীদের দেবী নয়। তবে স্কুল-কলেজে সরস্বতী পুজোর আয়োজন। করা শুধু অশোভনীয়ই নয়, অন্যায়। ভারতবর্ষ কোনো হিন্দু রাষ্ট্র নয়, এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ভারতবর্ষের কোনায় কোনায় স্কুল-কলেজগুলিতে শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাত্রছাত্রীরাই পাঠ নেন না, পাঠ নেয় সব ধর্মের ছাত্রছাত্রীরা। অন্য ধর্মের ছাত্রছাত্রীদের ভিন্ন ধর্মের সরস্বতী বন্দনা চাপিয়ে দেওয়া অসাংবিধানিক। যদি জোর করে সরস্বতী-বন্দনা চাপিয়ে হয়, তবে তা হবে সাংবিধানিক অধিকার হরণের সামিল। সরকারি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় পুজোর কোনো নিয়ম নেই, তবু বিদ্যার দেবী হিসাবে সরস্বতী স্কুল, পাঠশালা কিংবা কলেজে পুজো পেয়ে থাকে। হিন্দু ধ্বজাধারী কোনো স্কুল কলেজে পুজো-পার্বণ হতেই পারে, তাই বলে সর্বসাধারণের স্কুল-কলেজগুলিতে এই পুজো কতটা প্রাসঙ্গিক, প্রশ্ন উঠতে পারে। ভেবে দেখতে বলি সবাইকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *