০৬. নৈতিকতার শিকড়: কেন আমরা ভালো?

ষষ্ঠ অধ্যায়– নৈতিকতার শিকড়: কেন আমরা ভালো?

এই পৃথিবীতে আমাদের পরিস্থিতি খুবই অদ্ভুত; এখানে প্রত্যেকেই আমরা স্বল্প সময়ের অতিথি, আর আমাদের জানাও নেই কেন, তারপরও, মাঝে মাঝে আপাতদৃষ্টিতে স্বর্গীয় রুপ দিয়ে সৃষ্টি করি কোনো একটি উদ্দেশ্য। যদিও, দৈনন্দিন জীবনের দৃষ্টিকোণ থেকে অন্তত একটা বিষয় আমাদের জানা আছে তা হলো: আমরা মানুষরা এখানে, অন্য মানুষের জন্য– আর সবার উপরে, বিশেষ করে তাদের জন্য, যাদের মুখের হাসি এবং ভালো থাকার উপরে আমাদের নিজেদের সুখী হবার বিষয়টি নির্ভরশীল।
— আলবার্ট আইনস্টাইন

অনেক ধার্মিক মানুষের জন্য কল্পনা করা বেশ কঠিন, কিভাবে, ধর্ম ছাড়া, কোনো একজন মানুষ ভালো হতে পারেন বা ভালো হবার জন্য আদৌ কোনো ইচ্ছা বোধ করতে পারেন। আমি এ ধরনের প্রশ্নগুলোই আলোচনা করবো এই অধ্যায়ে। কিন্তু সন্দেহ আসলে আরো সর্বব্যপী এবং কিছু ধার্মিক মানুষদের যা প্ররোচিত করে, তাদের বিশ্বাসকে ‘বিশ্বাস করে না যারা তাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃনায় আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ার জন্য। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অন্যান্য বিষয়গুলোর প্রতি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে যে নৈতিকতার বিবেচ্য বিষয়গুলি লুকিয়ে থাকে, আসলেই নৈতিকতার সাথে তাদের সত্যিকারের কোনো যোগসূত্র নেই। বিবর্তনের বিষয়গুলো নিয়ে শিক্ষাদান করার ক্ষেত্রে বিরোধীতার একটি বিশাল অংশেরই আসলে বিবর্তনের সাথে কিংবা বৈজ্ঞানিক কিছুর সাথে কোনো সম্পর্কই নেই, এটি উস্কে দিয়েছে দিয়েছে নৈতিকতা নির্ভর তীব্র কিছু ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া, যা হতে পারে একেবারে সরল বুঝতে না পারা থেকে উদ্ভূত, যেমন, আপনি যদি আপনার সন্তানকে শেখান যে, তারা বানর থেকে বিবর্তিত হয়েছে, তাহলে তারা সবাই বানরের মতই আচরণ করবে’ থেকে আরো জটিল অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য যেখানে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন মতবাতীদের ‘ওয়েজ স্ট্রাটেজী (১) বা কৌশল, যে অশুভ উদ্দেশ্যটির বিষয় নির্দয়ভাবে উন্মোচন করেছে বারবারা ফরেষ্ট (২) এবং পল গ্রস (৩) তাদের ‘ক্রিয়েশনিজম’স ট্রোজান হর্স’ (৪) বইটিতে।

আমার বইগুলোর জন্য আমি পাঠকদের কাছ থেকে অসংখ্য চিঠি পাই (৫); যাদের বেশীর ভাগই অত্যন্ত উৎসাহব্যজ্ঞক ভাবে বন্ধুভাবাপন্ন, তাদের কিছু গঠনমূলক সমালোচনাপূর্ণ, কিছু খুবই নোংরা মানসিকতার এবং এমনকি খুবই হিংস্র; এবং আমি দুঃখের সাথে বলছি সবচেয়ে নোংরা মানসিকতার চিঠিগুলোর মূল প্রণোদনা দায়ক বিষয়টি হচ্ছে ধর্ম; এধরনের অখ্রিষ্টসূলভ দুর্ব্যবহার সচরাচরই মুখোমুখি হতে হয় তাদের, যাদেরকে খ্রিষ্ট ধর্মের শত্রু হিসাবে মনে করা হয়; উদাহরণ হিসাবে একটি চিঠি, যা ইন্টারনেটে পোষ্ট করা হয়েছিল ব্রায়ান ফ্লেমিংকে (৬) উদ্দেশ্য করে, যিনি নিরীশ্বরবাদকে সমর্থন করে চমৎকার হৃদয়স্পর্শী এবং আন্তরিক একটি চলচ্চিত্র ‘দ্য গড হু ওয়াজন্ট দেয়ার (৭) এর লেখক এবং পরিচালক, বার্ন হোয়াইল উই লাফ’ শিরোনামে ব্রায়ানের উদ্দেশ্যে লেখা এই চিঠিটির সময়কাল ২১ ডিসেম্বর, ২০০৫, এবং যার ভাষা ছিল এরকম:

আপনার যে যথেষ্ট পরিমান সাহস আছে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিৎ; আমি খুবই চাই তোমাদের মত নির্বোধদের একটি ছুরি নিয়ে কুপিয়ে পেটের নাড়ি ভুড়ি বের করে দেই এবং আনন্দে চিৎকার করি, যখন আপনাদের সামনেই আপনাদের নাড়িভুড়িগুলো বের হয়ে আসতে থাকবে– আপনি সেই পবিত্র যুদ্ধটি শুরু করার চেষ্টা করছেন, যখন কোনো একদিন আমি এবং আমার মত অনেকেই উপরে বর্ণিত কাজটি করতে আনন্দের সাথে দায়িত্ব নেবে।

চিঠির এই পর্যায়ে লেখক দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছিলেন, তার ভাষাটা আদৌ খুব খ্রিষ্ট সুলভ না, কারণ এর পর খানিকটা উদারতার সুরে তিনি উল্লেখ করতে থাকেন,

যদিও ঈশ্বর আমাদের প্রতিশোধ না নেবার জন্য বরং তোমাদের মত সবার জন্য প্রার্থনা করার জন্যই শিক্ষা দেন।

অবশ্য তার এই দয়াশীলতা খুবই ক্ষণস্থায়ী:

তবে আমি শান্তি পাবো এই জেনে যে, আপনার উপর ঈশ্বর যে শাস্তি আরোপ করবেন, তা আমার দেয়া যে কোনো শাস্তির তুলনায় তার দ্বারা আপনি ১০০০ গুণ বেশী যন্ত্রণা ভোগ করবেন। সবচেয়ে ভালো ব্যপারটা হচ্ছে আপনি অনন্তকাল ধরে নরক যন্ত্রণা ভোগ করবেন এই সব পাপের জন্য, যা সম্বন্ধে আপনি সম্পূর্ণ অজ্ঞ; ঈশ্বরের ক্রোধ কোনো দয়া প্রদর্শন করেনা। আপনার জন্যই, আমি আশা করি, সত্যটা আপনার কাছে উন্মোচিত হোক, ছুরি আপনার মাংশে স্পর্শ করার আগেই। শুভ বড়দিন!

পুনশ্চ: আপনার মতো মানুষদের আসলে কোনো ধারণা নেই কি আপনাদের নিয়তিতে কি নির্দিষ্ট করা আছে, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই– কারণ আমি আপনাদের মত নই।

আমার কাছে আসলেই ধাঁধার মত মনে হয়, ধর্মীয় চিন্তাধারার সামান্যতম মত পার্থক্য কি পরিমান বিষাক্ততার জন্ম দিতে পারে; আরো একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ফ্রি থট টুডে ম্যাগাজিনের সম্পাদকের পোষ্টব্যাগ থেকে যা সংগ্রহ করা হয়েছে। ফ্রি থট টুডে প্রকাশ করে ফ্রিডম ফ্রম রেলিজিয়ন ফাউণ্ডেশন (৯), যারা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করে আসছেন, চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত পৃথক অবস্থানকে যখনই যেখানে উপেক্ষা করা হচ্ছে।

হ্যালো, পনির-খেকো জঘন্য ব্যক্তিরা, আপনাদের মত অপদার্থদের তুলনায় আমরা খ্রিষ্টানরা সংখ্যায় অনেক বেশী। চার্চ এবং রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো পৃথকীকরণ হবে না এবং আপনারা নরকের কীটরা অবশ্যই পরাজয় স্বীকার করবেন।

পনির খাওয়া সংক্রান্ত তথ্য ইঙ্গিতের বিষয়টা আসলে কি? আমার যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরা অবশ্য প্রস্তাব করেছেন, কিছুটা ‘কুখ্যাত ভাবে উদারপন্থী যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যটির সাথে এর একটা সম্পর্ক থাকতে পারে; ফ্রিডম ফ্রম রেলিজিয়ন ফাউণ্ডেশন এর কার্যালয় এবং ডেয়ারী শিল্পের কেন্দ্র হচ্ছে উইসকনসিন; কিন্তু নিশ্চয়ই ব্যাখ্যাটা এত সরল নয়, আর তাহলে ঐসব ফরাসী ‘পনির-খেকো আত্মসমপর্নকারী-বানররা’ (১০) তাহলে কি? এখানে পনির শব্দটি ভাষায় ব্যবহারে শব্দগত আইকনোগ্রাফীটি কি?

চিঠিটির ভাষায় ফিরে আসা যাক আবার–

শয়তান পূজারী অপদার্থ.. দয়া করে মরো এবং নরকে যাও … আমি আশা করি আপনাদের যেন মলনালীতে ক্যান্সারের মত খুব কষ্টদায়ক কোনো অসুখ হয় এবং ধীরে ধীরে খুব কষ্ট ভোগ করে যেন মৃত্যু হয়, তাহলে আপনি আপনার ঈশ্বর, শয়তানের সাথে দেখা করতে পারবেন,, এই ধর্ম থেকে স্বাধীনতা বিষয়টি খুবই খারাপ, সুতরাং আপনারা সব ফ্যাগ (fag: পুরুষ সমকামিদের প্রতি অবজ্ঞাসূচক শব্দ) এবং ডাইকসদের (dykes; নারী সমকামিদের প্রতি অবজ্ঞাসূচক শব্দ) বেশী উত্তেজিত হবার কোনো কারণ নেই বরং চিন্তা করেন কোথায় আপনারা যাচ্ছেন, কারণ যখন আপনারা আদৌ খেয়াল করবেন না ঠিক তখনই ঈশ্বর আপনাদের শায়েস্তা করবে, যদি আপনাদের এই দেশ এই দেশ যা কিছুর উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটা ভালো না লাগে, এই দেশ থেকে দূর হয়ে যান, সরাসরি নরকে যান..

পুনশ্চ : কমিউনিষ্ট বেশ্যা, আপনার কৃষ্ণাঙ্গ পশ্চাৎদেশটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূর হয়ে যান। আপনাদের দেবার মত কোনো অজুহাত আর নেই; সৃষ্টি যথেষ্ট প্রমাণ মহান যীশু খ্রিষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার।

কেন আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতা না? বা ব্রহ্মারই বা না কেন? বা এমন কি ইয়াহয়ের বা না কেন?

আমরা নীরবে সরে যাবো না, ভবিষ্যতে যদি সহিংসতার প্রয়োজন হয়, মনে রাখবেন এর জন্য আপনারাই দায়ী। আমার রাইফেলে গুলি ভরা আছে।

কেন? আমি না ভেবে থাকতে পারছি না, কেন এই ঈশ্বরের এ ধরনের ভয়ঙ্কর হিংস্রতার সাথে প্রতিরক্ষার প্রয়োজন আছে বলে মনে করা হয়? যে কারোরই তো মনে হবার কথা, তিনি নিজেকে সুরক্ষা করার জন্য যথেষ্ট পরিমানে যোগ্য। মনে রাখতে হবে, এই সব কুৎসিত হিংস্র বাক্যের অপমান আর হুমকির নিশানা কিন্তু শান্ত শিষ্ট ভদ্র, সুশীল চমৎকার একজন তরুণী।

হয়তো আমি আমেরিকায় বসবাস করিনা বলে আমাকে লেখা বেশীর ভাগ ঘৃণা প্রকাশ করা চিঠির ভাষা পুরোপুরি এই স্তরের না, তবে তারা সেই দয়া প্রদর্শনের যোগ্য হবার বিষয়টির কথাও বলেন না, যে দয়াশীলতার জন্য খ্রিষ্ট ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বিশেষভাবে সুপরিচিত। মে ২০০৫ তারিখ লেখা পরের এই চিঠিটির লেখক একজন ব্রিটিশ চিকিৎসক। যদিও এটি নিঃসন্দেহে ঘৃণা সমৃদ্ধ, তবে পুরোপুরি নোংরা হবার চেয়ে বরং আমার কাছে মনে হয়েছে। পত্র লেখকের অন্তর্দ্বন্দ্বের কষ্ট এবং যা তিনি প্রকাশ করেছেন কেমন করে নৈতিকতার পুরো বিষয়টি নিরীশ্বরবাদীতার বিরুদ্ধে সকল সহিংসতার উৎস। শুরুতেই বেশ কিছু অনুচ্ছেদে বিবর্তনকে ব্যবচ্ছেদ করার পর (এবং শ্লেষাত্মকভাবে জিজ্ঞাসা সহ যে তাহলে নিগ্রোরা কি এখনও বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় আছে?), ব্যক্তিগত পর্যায়ে ডারউইনকে অপমান করে, ভ্রান্তভাবে হাক্সলীকে বিবর্তন বিরোধী হিসাবে উল্লেখ করার পর এবং আমাকে একটি বিশেষ বই পড়ার জন্য উৎসাহ প্রদান করে– (যা আমি পড়ছি, যেখানে যুক্তি দেখানো হয়েছে পৃথিবী মাত্র আট হাজার বছর প্রাচীন ( তিনি কি আসলেই একজন চিকিৎসক হতে পারেন?)– তিনি পরিশেষে লিখেছিলেন:

আপনার নিজের বইগুলো, অক্সফোর্ডে আপনার সম্মান, যা কিছু আপনি জীবনে ভালোবাসেন, এবং অর্জন করেছেন, সবই ব্যর্থ প্রচেষ্টা কামু’র প্রশ্ন– চ্যালেঞ্জ এখানে এড়ানো অসম্ভব, কেন আমরা সবাই আত্মহত্যা করি না (১১)? সত্যি, আপনার বিশ্বধারণা ছাত্রদের এবং আরো অনেকের উপর এই ধরনের প্রভাব ফেলে, যে আমরা সবাই বিবর্তিত হয়েছি অন্ধ আপতন বা চান্সের মাধ্যমে, কোনো কিছু থেকে না, কোনো কিছুতেই আমরা প্রত্যাবর্তন করবো না, এমন কি ধর্ম যদি সত্যিও না হয়, তাও উত্তম, অনেক বেশী উত্তম, একটি মহান পুরাণ কাহিনীকে বিশ্বাস করা, প্লেটোর মত, যদি তা কারো মনে শান্তি দিতে পারে আমাদের এই জীবনকালে; কিন্তু আপনার বিশ্ব ধারণা সৃষ্টি করে দুশ্চিন্তা মাদকাসক্তি, হিংস্রতা, নৈরাজ্যবাদ, ভোগবাদীতা, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনীয় বিজ্ঞান এবং পৃথিবীতে নরক ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ; আমি ভাবছি আপনি আপনার ব্যক্তিগত জীবনে কতটা সুখী? তালাকপ্রাপ্ত? বিপত্নীক? সমকামি? আপনাদের মত মানুষরা কখনো সুখী হতে পারেনা; বা তারা খুবই চেষ্টা করে প্রমাণ করতে কোন সুখ নেই বা কোনো কিছুরই কোনো অর্থ নেই।

এই চিঠির আবেগ, যদিও এর ভাষা নয়, অন্য অনেক চিঠির মতই বৈশিষ্ট্যসূচক; এই ব্যক্তিটি বিশ্বাস করেন ডারউইনবাদ, অন্তর্গতভাবেই এর প্রকৃতিতে নৈরাশ্যবাদী, যা শিক্ষা দেয় আমরা বিবর্তিত হয়েছি অন্ধ চান্স বা আপতনের মাধ্যমে (অসংখ্যবারের মত আবারও বলছি, প্রাকৃতিক নির্বাচন চান্স বা আপতন প্রক্রিয়ার ঠিক বিপরীত) এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো আমরা যখন মারা যাবো; এধরনের অভিযোগকৃত নেতিবাচকতার সরাসরি ফলাফল হিসাবে সব ধরনের অশুভ জিনিস প্রবাহিত হয়; ধরে নেয়া যেতে পারে, তিনি সত্যি বলতে চাননি যে, বৈধব্য আমার ডারউইনবাদের প্রতি সমর্থনের সরাসরি ফলাফল হতে পারে; কিন্তু এই বিষয়টির দ্বারা, তার চিঠি, এমন একটি উন্মত্ত অশুভ কামনা পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বারবার আমি সেটি শনাক্ত করেছি আমার খ্রিষ্টীয় পত্র লেখকদের; আমি আমার পুরো একটি বই, “আনউইভিং দ্য রেইনবো’ (১২) উৎসর্গ করেছি সেই জীবনের মূল অর্থ বিজ্ঞানের কাব্যময়তার প্রতি, এবং যুক্তি খণ্ডন করেছি হালকা এবং বিস্তারিতভাবে এই নৈরাশ্যবাদী নেতিবাচকতার অভিযোগটির, সুতরাং এখানে আমি নিজেকে সংযত করছি; এই অধ্যায়টি খারাপ এবং এর বিপরীত, ভালো বিষয় নিয়ে; নৈতিকতা বিষয়ে, কোথা থেকে এটি এসেছে, কেন আমাদের এটিকে সাদরে গ্রহন করা উচিৎ এবং তা করতে কি আমাদের ধর্মের কি কোনো প্রয়োজন আছে কিনা।

আমাদের নৈতিকতাবোধের কি কোনো ডারউইনীয় উৎস আছে?

বেশ কিছু বই যেমন রবার্ট হিন্ডের ‘হোয়াই গুড ইস গুড’ (১৩), মাইকেল শেরমারের ‘দ্য সায়েন্স অব গুড অ্যাণ্ড ইভিল’ (১৪), রবার্ট বাকমানের ‘ক্যান উই বি গুড উইথআউট গড?” (১৫) এবং মার্ক হাউজারের (১৬) ‘মোরাল মাইন্ডস’ (১৭) যুক্তি দেখিয়েছে যে, আমাদের ভালো ও মন্দ বোঝার ক্ষমতার উৎপত্তি হয়েছে আমাদের ডারউইনীয় অতীতে; এই অংশে আমি সেই যুক্তিগুলোর নিজস্ব সংস্করণ উপস্থাপন করবো।

বাহ্যিক দিক থেকে ডারউইনীয় ধারণাটি, প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা পরিচালিত বিবর্তন প্রক্রিয়াকে মনে হয় আমাদের ধারণা করা সব মানবিক শুভ বৈশিষ্ট্যগুলো বা আমাদের নৈতিকতা, শ্লীলতা, সমমর্মিতা এবং করুণা সংক্রান্ত অনুভূতিগুলো ব্যাখ্যা করার অনুপোযুক্ত; প্রাকৃতিক নির্বাচন খুব সহজেই ব্যাখ্যা করতে পারে ক্ষুধা, ভয়, এবং যৌন তাড়নার মত বৈশিষ্ট্যগুলো। যেগুলো সরাসরি আমাদের বেঁচে থাকা এবং আমাদের জিনের ধারাবাহিকতা সুরক্ষা করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে; কিন্তু সেই হৃদয় নিংড়ানো সহানুভুতির ব্যাখ্যা আসলে কি, যা আমরা কোনো এতিম শিশুকে কাঁদতে বা বৃদ্ধ বিধবার একাকীত্বের হতাশায় বা যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা কোনো প্রাণীকে দেখে অনুভব করি? কোন জিনিসটি বা কি আমাদের তীব্রভাবে তাড়িত করে নাম গোপন রেখে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে ঘটা সুনামীর শিকার অসহায় মানুষদের জন্য অর্থ সাহায্য কিংবা কাপড় পাঠাতে, যাদের কারোর সাথেই আমাদের জীবনে কোনোদিনও দেখা হবে না এবং খুব সম্ভবত কোনোদিনও এই সহায়তার কোনো প্রতিদানও দিতে পারবে না? আমাদের মধ্যে এই ভালো পরোপকারী বা সামারিটান বৈশিষ্ট্যগুলো কোথা থেকে আসলো? ভালো আর মহত এই বৈশিষ্ট্যগুলোর তো স্বার্থপর জিন তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার কথা না, তাই নয় কি? না, এই তত্ত্বটি সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণাগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে সুপরিচিত, হতাশাব্যঞ্জক (এবং পূর্বধারণা সাপেক্ষে পূর্বপ্রত্যাশিত) ভুল ধারণা (১৮)। সঠিক শব্দটির উপর এখানে জোর দেয়া প্রয়োজন; সেলফিশ বা স্বার্থপর না ‘জিন’ শব্দটার উপর জোর দেয়া ঠিক হবে, কারণ এটি স্বার্থপর কোনো ‘জীব’ বা ধরা যাক, প্রজাতি ধারণাটির সাথে পার্থক্য সৃষ্টি করে; আমি বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি। ডারউইনবাদের যুক্তি বলছে যে এককটি জীবনের হায়ারার্কি বা প্রাধান্য পরম্পরায় টিকে থাকে এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের ছাকুনী অতিক্রম করতে পারে তার স্বার্থপর হবার প্রবণতা থাকার কথা; এই পৃথিবীতে টিকে থাকবে সেই একক বা ইউনিটগুলো, যারা তাদের নিজস্ব স্তরে প্রাধান্য পরম্পরায় অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী ইউনিটগুলোর সাথে প্রতিদ্বন্দিতায় সফল হয়েছে; এই প্রাসঙ্গিকতায় স্বার্থপর বলতে ঠিক এটাকেই বোঝায়; এখন প্রশ্ন হলো, এই প্রক্রিয়াটি ঠিক কোন পর্যায়ে বা স্তরে ঘটছে? স্বার্থপর জিনের পুরো ধারণাটি ‘জিন’ শব্দটির উপর যথাযোগ্য গুরুত্ব আরোপ করা সাপেক্ষে হচ্ছে যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের একক (বা আত্মস্বার্থের একক) কোনো স্বার্থপর অর্গানিজম বা জীব নয়, স্বার্থপর কোনো গ্রুপও না বা স্বার্থপর প্রজাতি না বা স্বার্থপর কোনো ইকোসিস্টেম বা পরিবেশমণ্ডল না, বরং স্বার্থপর হচ্ছে ‘জিন’; এবং এই জিনটি, যা তথ্য রুপে, হয় বহু প্রজন্ম ধরে টিকে থাকে, নয়তো নয়; জিনের মত করে (এবং তর্ক সাপেক্ষে মিম) কোনো অর্গানিজম বা জীব, গ্রুপ কিংবা প্রজাতি সেই অর্থে একক হিসাবে কাজ করতে পারেনা, কারণ তারা তাদের হুবহু প্রতিলিপি তৈরী করতে পারেনা, এবং এ ধরনের অনুলিপিকারী সত্তাদের সম্ভারে বা পুলে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও করতে পারে না; এবং জিনরা ঠিক সেটাই করে এবং সেটাই হচ্ছে মূলত যৌক্তিক– ডারউইনীয় বিশেষ স্বার্থপর অর্থে জিনকে স্বার্থপরতার একক হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য বেছে নেবার সপক্ষে যৌক্তিকতা।

সবচেয়ে সুস্পষ্ট যে উপায়ে জিনগুলো অন্যান্য জিনের সাপেক্ষে তাদের নিজস্ব স্বার্থপর বেঁচে থাকাটা নিশ্চিৎ করে তা হলো তাদের বহনকারী কোনো একক অর্গানিজম বা জীবকে স্বার্থপর করে তোলার মাধ্যমে। আসলেই এমন বহু পরিস্থিতি আছে যেখানে কোনো একটি অর্গানিজমের টিকে থাকার মাধ্যমে তার বহন করা জিনগুলোকে টিকে থাকতে সহায়তা করে; কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল প্রাধান্য পায়, কিছু পরিস্থিতি আছে– খুব বেশী দুর্লভ নয়– যেখানে জিন তাদের নিজেদের স্বার্থপর টিকে থাকাটা নিশ্চিৎ করে তাদের বহনকারী জীবদের নিঃস্বার্থ, পরোপকারী বা পরার্থে আচরণ করানোর মাধ্যমে; এই পরিস্থিতিগুলো সম্বন্ধে আমাদের এখন ভালো ধারণা আছে এবং এদেরকে মূল দুটি ভাগে ভাগ করা যায়: কোনো জিন, যা কোনো অর্গানিজম বা জীবদের একক কোনো সদস্যদের প্রোগ্রাম করে তাদের জিনগত আত্মীয় বা জেনেটিক কিনদের সহায়তা করার জন্য পরিসংখ্যাগতভাবে সেই জিন এর অনুলিপি হবার ক্ষেত্রে সুবিধা পাবার সম্ভাবনাও বেশী; এই ধরনের জিনের সংখ্যা প্রজাতির জিনপুলে বেড়ে যেতে পারে এমন হারে যে যেখানে জিনগত আত্মীয় বা কিন পার্থবাদীতা বা অ্যালুটুইজম খুব স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াতে পারে; নিজেদের সন্তানদের প্রতি উপকারী হওয়া এর একটি স্পষ্ট উদাহরণ, কিন্তু এটাই একমাত্র এমন উদাহরণ নয়; মৌমাছি, ওয়াস্প, পিপড়া, টারমাইট এবং খানিকটা, কিছু নির্দিষ্ট মেরুদণ্ডী প্রাণী যেমন ন্যাকেড মোল র‍্যাটস, মীরকাটস এবং অ্যাকন উড়পেকাররা এমন একটি সমাজের বিবর্তন ঘটিয়েছে যেমন বড় ভাইবোনরা তাদের ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনা করে (যাদের সাথে তাদের জিনগুলোকে ভাগ করে নেবার সম্ভাবনা থাকে);সাধারণত যা আমার প্রয়াত সহকর্মী ডাবলিউ, ডি, হ্যামিলটন (১৯) দেখিয়েছিলেন, প্রাণীদের প্রবণতা আছে নিজেদের আত্মীয় বা জিনগত কিনদের দেখাশোনা করার, বিপদ থেকে রক্ষা করার, সম্পদ ভাগাভাগি, বিপদের সতর্ক করার বা কোনো না কোনো ভাবে নিঃস্বার্থ ব্যবহার করার কারণ স্পষ্টতই পরিসংখ্যানগতভাবে সম্ভাবনা থাকে তাদের আত্মীয়রা তাদের মত একই জিনগুলোর অনুলিপি বহন করে।

অ্যালটুইজম বা পরার্থবাদিতার অন্য প্রধান প্রকারটি, যার জন্য আমাদের খুব ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা ডারউইনীয় যুক্তি আছে, তা হলো পারস্পরিক বা রেসিপ্রোকাল পরার্থবাদিতা (তুমি আমার পিঠ চুলকিয়ে দাও আমিও তার বিনিময়ে তোমার পিঠ চুলকিয়ে দেব); এই তত্ত্বটি বিবর্তন জীববিজ্ঞানে প্রথম উপস্থাপন করেন রবার্ট ট্রিভার্স (২০) এবং প্রায়ই এটিকে প্রকাশ করা হয় গেম থিওরীর গাণিতিক ভাষায়, এবং এটি শেয়ার করা বা একই জিন ভাগাভাগি করার মত কোনো পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে না। আসলেই এটা একই ভাবে কাজ করে, সম্ভবত আরো ভালোভাবে, পুরোপুরি ভিন্ন প্রজাতিদের মধ্যে, যখন অনেক সময় এদের বলা হয় সিমবায়োসিস বা মিথোজীবিতা; একই নীতি মানুষেরও সকল বাণিজ্য এবং আদান প্রদান কর্মকাণ্ডেরও ভিত্তি; শিকারীর প্রয়োজন বর্শা আর কুমারের প্রয়োজন মাংশ, চাহিদার এই অসাম্যতা একটি বাণিজ্যের ভিত্তি হিসাবে চুক্তি রচনা করে, মৌমাছির দরকার মধু আর ফুলের দরকার পরাগায়ন; ফুল যেহেতু উড়তে পারেনা, তারা নেকটার এর মাধ্যমে মৌমাছিকে বিনিময় মূল্য পরিশোধ করে তাদের পাখনার ভাড়া হিসাবে; হানিগাইড নামের পাখি মধু কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে তা জানে কারণ তারা মৌচাক খুঁজে বের করে জানে, তবে মৌচাক তারা ভাঙ্গতে পারেনা; কিন্তু হানি ব্যাজার (রাটেল) মৌচাক ভাঙ্গতে পারে, তবে পাখিদের মত তাদের ডানা নেই যে তারা মৌচাক খুঁজে বের করতে পারবে; হানিগাইডরা রাটেলদের (এবং কখনও মানুষদেরও) মধুর উৎসের দিকে নিয়ে যায় একটি বিশেষ প্রলুদ্ধকর ওড়ার কৌশল ব্যবহার করার মাধ্যমে, যে কৌশল হানিগাইড শুধুমাত্র এই কাজটির জন্যই ব্যবহার করে থাকে; উভয় পক্ষই এই আদান প্রদানের মাধ্যমে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়; একটি বড় পাথরের নীচে হয়তো সোনার বড় একটি টুকরো চাপা দেয়া আছে, আর পাথরটা খুবই ভারী কারোর একার পক্ষে সেটি সরানো সম্ভব নয়, সে তখন অন্যদের সাহায্য নেয় কাজটা করার জন্য, যদিও এজন্য তাকে ভাগ দিতে হবে সেই সোনার, কারণ তা না করলে সে তো কিছুই পাবেনা। জীবজগতে এধরনের পারস্পরিক সাহায্য নির্ভর সম্পর্কের সংখ্যা অগণিত; ষাঢ় এবং অক্সপেকারস, লাল নলাকৃতির ফুল এবং হামিংবার্ড, গ্রুপার এবং ক্লিনার র‍্যাস মাছেরা, গরু এবং তাদের পেটের অণুজীবরা; পারস্পরিক পরহিতকারী বা পরার্থবাদী সম্পর্ক কাজ করে কারণ তাদের নিজস্ব প্রয়োজন এবং সেই প্রয়োজনীয় মেটানোর ক্ষেত্রে এককভাবে তাদের নিজেদের দক্ষতা বা ক্ষমতায় ভিন্নতা বা অসাম্যতা আছে; একারণে এটি বিশেষভাবে কার্যকরী হয় দুটি ভিন্ন প্রজাতির জীবের মধ্যে: যেখানে দুটি প্রজাতির প্রয়োজন বা চাহিদায় অসাম্যতাও অনেক বেশী।

মানুষের ক্ষেত্রে ঋণপত্র এবং অর্থ হচ্ছে সে রকম কিছু উপকরণ যা কোনো কিছু আদান প্রদানের ক্ষেত্রে বিলম্ব সৃষ্টি করে; বানিজ্য করছে এমন পক্ষগুলো কিন্তু সাথেই সাথেই তাদের দ্রব্য একে অপরকে হস্তান্তর করছে না কিন্তু তারা সেটি ঋণ গচ্ছিত রাখতে পারে ভবিষ্যতের জন্য বা এমনকি ঋনটি অন্য বানিজ্যের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করতে পারে; আমি যতদূর জানি, মানুষ ছাড়া আর অন্য কোনো বন্য প্রাণী সরাসরি টাকার অনুরুপ কোনো মাধ্যম ব্যবহার করে না। কিন্তু এককভাবে কোনো সদস্যর পরিচয় সম্পর্কে স্মৃতি খানিকটা অনানুষ্ঠানিকভাবে সেই একই দায়িত্ব এখানে পালন করে; ভ্যাম্পায়ার ব্যাটরা শিখে নেয় তাদের সামাজিক গ্রুপের কোন সদস্যর উপর নির্ভর করা যেতে পারে, যারা কিনা তাদের ঋণ শোধ করবে ( রিগার্জিটেটেড রক্ত বা গিলে ফেলা আংশিক পরিপাক হওয়া রক্ত পুনরায় গলা দিয়ে বের করে আনা) এবং কারা তাদের সাথে প্রতারনা করবে; প্রাকৃতিক নির্বাচন সেই সব জিনগুলোকে টিকে থাকতে সহায়তা করে, যা কোনো জীবের একক সদস্যদের, যারা একটি অপ্রতিসম ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজন ও সুযোগ এর পারস্পরিক সম্পর্কে বজায় রাখছে, তাদের কোনো কিছু দান করতে বা দিতে যখন তারা পারে বা সক্ষম হয় এবং যখন তারা তা পারেনা তখন তারা সেই রকমই প্রতিদানের জন্য অন্য সদস্যদের কাছে অনুরোধ করার বা চেয়ে নেবার প্রবণতার কারণ হয়; এটি কোনো দ্বায়িত্ব ও কর্তব্য মনে রাখা, কোনো বিদ্বেষ মনে রাখা, পারস্পরিক আদান প্রদানের সম্পর্কটি নজরদারি করার, এবং যারা নেয় কিন্তু তাদের সময় হলে বিনিময়ে কিছু দেয় না এমন প্রতারকদের শাস্তি দেবার প্রবণতা গড়ে উঠতে সহায়তা করে।

যেহেতু সবসময়ই প্রতারকরা থাকবে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার গেম তত্ত্বের এই ধাঁধাটির স্থায়ী সমাধানে সব সময় এমন কিছু থাকে যা প্রতারকদের শাস্তির ব্যপারটা নিশ্চিৎ করে; গাণিতিক তত্ত্ব দুটি বড় শ্রেনীর স্থায়ী সমাধানের অনুমতি দেয় এ ধরনের ‘গেম’ এর ক্ষেত্রে, সবসময় ‘খারাপ’ হতে হবে, এটি স্থায়ী এই অর্থে যে, যদি সবাই একই কাজ করে তাহলে একজন ভালো কোনো সদস্যর একার পক্ষে তার চেয়ে ভালো কিছু করতে পারেনা; কিন্তু এছাড়া আরেকটি সুস্থির সমাধান বা কৌশল হচ্ছে (এখানে সুস্থির অর্থ যখন কোনো জনসংখ্যায় এটি একটি নির্দিষ্ট সীমার হার অতিক্রম করবে, এর কোনো বিকল্প তার চেয়ে ভালো কিছু করতে পারেনা); এই কৌশলটা হলো, প্রথমে সবার সাথে ভালো ভাবে লেনদেন শুরু করা, অন্যদের বিশ্বাস করে কিছু সুযোগ দেয়া, এরপর ভালো কাজের প্রতিদান ভালো কাজের মাধ্যমে শোধ করা, তবে খারাপ কাজের জন্য যথাযথ প্রতিশোধ নেয়া; গেম থিওরীর ভাষায় এই কৌশল (বা একই ধরনে কৌশলগুলোর সমষ্টি) এর নানা নাম আছে, যেমন, টিট ফর ট্যাট (ইটের বদলে পাটকেলটা), সমুচিত পাল্টা জবাব এবং পারস্পরিক দেয়া নেয়া; কিছু কিছু পরিস্থিতিতে এটি বিবর্তনীয়ভাবে স্থিতিশীল এই অর্থে যে, যদি কোনো জনসংখ্যায় পারস্পরিক দেয়া নেয়া কারীদের সংখ্যা প্রাধান্য বিস্তার করে, যেখানে কোনো খারাপ যেমন কেউ নেই এবং একজনও নিঃশর্তভাবে ভালো সদস্য নেই, বেশ ভালো ভাবে কাজ করবে; আরো একটা বেশ জটিল টিট ফর ট্যাট এর ভিন্নরুপ আছে, যা কোনো কোনো পরিস্থিতিতে আরো ভালো ব্যাখ্যার কাজ করে।

আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, আত্মীয়তা বা কিনশিপ এবং পারস্পরিক দেয়া নেয়ার সম্পর্কটি ডারউইনীয় বিশ্বে আলট্রইজম বা পরার্থবাদিতার জোড় স্তম্ভ। কিন্তু এছাড়া আরো কিছু কাঠামো এই দুই প্রধান স্তম্ভেও উপর ভর করে আছে; বিশেষ করে মানুষের সমাজে, ভাষা এবং কথোপকথন গল্পগুজবের ব্যাপকতা যেখানে প্রকট, সেখানে সুনাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কোনো এক ব্যক্তির হয়তো তার দয়াশীলতা ও উদারতা বৈশিষ্ট্যের সুখ্যাতি আছে, অন্য কারো হয়তো অবিশ্বস্ততার জন্য, প্রতারনার জন্য বা কোনো চুক্তিকে অসম্মান করার জন্য কুখ্যাতি আছে; আবার অন্য কারো হয়তো দয়াশীলতার সুখ্যাতি আছে, যখন পারস্পরিক বিশ্বাসর ভিত্তিটা গড়ে উঠে সম্পর্কের মধ্যে। তবে কোনো ধরনের প্রতারণার নিষ্ঠুর শাস্তি দিতে যে ইতস্তত বোধ করেনা; পারস্পরিক পরার্থবাদিতার অনাড়ম্বর তত্ত্বটি আশা করছে যে, কোনো প্রজাতির সদস্যরা তাদের স্বপ্রজাতির অন্যান্য সদস্যদের এ ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতি সৃষ্ট অচেতন একটি প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করবে। মানুষের সমাজগুলোয় আমরা ভাষার শক্তি যুক্ত করেছি, যে ভাষা কারো সুনাম বা দুর্নাম ছড়িয়ে দেয়, সাধারণ গসিপ বা গালগল্পের আকারে; ধরুন, জনাব ‘ক’ যখন কোনো পানশালায় বা পাবে সবাইকে পান করানোর জন্য তার দ্বায়িত্বটা এড়িয়ে গিয়েছিল, সে সময় আপনার সেখানে থাকার দরকার নেই, বা আপনার সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হবারও দরকার নেই তার আচরণে, কারণ আপনি, লতায় পাতায় কিংবা বাতাসে ভেসে আসা নানা গুজবে তার সম্বন্ধে জানতে পারবেন, ‘খ’ খুবই কৃপন বা একটি বিরুপ প্রতিক্রিয়া এই উদহারণে যোগ হতে পারে যে, জনাব ‘খ হচ্ছে মিথ্যা গল্পবাজ, ‘ক’ সম্বন্ধে এসব কথা ছড়িয়েছে, কারো জন্য তার খ্যাতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং শুধুমাত্র একজন ভালো রেসিপ্রেটের বা যে কোনো কিছুর পাওয়ার বিনিময়ে কিছু দিতে প্রস্তুত এমন হওয়াটাই যথেষ্ট না উপরন্তু এই দেয়া নেয়ার ব্যপারে তার সততা সংক্রান্ত একটি সুনামও লালন করার মধ্যে যে একটি ডারউইনীয় টিকে থাকার মূল্যবান বিষয় আছে তা জীববিজ্ঞানীরা স্বীকার করেন; ম্যাট রিডলির (২১) ‘দি অরিজিন অফ ভার্চু’ (২২) বইটি ডারউইনীয় নৈতিকতার পুরো ক্ষেত্রটির চমৎকার স্পষ্ট একটি বিবরণ ছাড়াও, এটি বিশেষ দক্ষতার সাথে ব্যাখ্যা করতে পেরেছে, সুনাম বা দুর্নাম বা খ্যাতির বিষয়টি (২৩)।

নরওয়েজীয় অর্থনীতিবিদ খরস্টেইন ভেলেন (২৪) এবং খানিকটা ভিন্নভাবে ইসরায়েলীয় প্রাণিবিজ্ঞানী আমোজ জাহাবী (২৫) আরো একটি চমৎকার ধারণা এর সাথে যুক্ত করেছিলেন, পরহিতকর কোনো কাজে বা পরার্থে কোনো কিছু দেয়া হতে পারে প্রাধান্য বিস্তার বা নিজের শ্রেষ্টত্ব প্রমাণের জন্য একটি বিজ্ঞাপন; নৃতত্ত্ববিদদের কাছে পটল্যাচ ইফেক্ট (২৬) হিসাবে এটি পরিচিত, এর নামটি এসেছে একটি সামাজিক প্রথা থেকে, উত্তর পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপবাসী নানা গোত্রগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্র প্রধানরা একে অপরের সাথে দ্বন্দ্বরত হয় খুবই উদারতার সাথে নিজেদের ধ্বংস করে দেবার মত বিশাল ভোজসভার আয়োজন করার মাধ্যমে; কিছু চরম ক্ষেত্রে এই পাল্টা ভোজ সভা চলতে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত একপক্ষ সম্পূর্ণভাবে নিঃস্ব না হয়, আর অন্য পক্ষও কিন্তু তার চেয়ে খুব একটা ভালো অবস্থায় থাকে না; ভেবলেন এর conspicuous consumption বা দৃষ্টিগ্রাহ্য বা লোক দেখানো ভোগ করার ধারণাটি আধুনিক গবেষণার দৃশ্যপটে অনেকেরই দৃষ্টি আকষর্ণ করেছিল। জাহাভীর অবদান, যা জীববিজ্ঞানীরা বহুবছর ধরেই তেমন কোনো গুরুত্ব দেননি অতি সাম্প্রতিককাল অবধি যখন তার প্রস্তাবটির সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে তাত্ত্বিক অ্যালান গ্রাফেন (২৭) এর অসাধারণ গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে, যা আমাদের পটল্যাচ ইফেক্টের একটি বিবর্তনীয় সংস্করণ প্রদান করেছে। জাহাভীর গবেষণার বিষয় ছিল অ্যারাবিয়ান ব্যাবলার (২৮), ছোট বাদামী পাখি যারা সমাজবদ্ধ গোষ্ঠী হিসাবে বসবাস করে এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমবায়ের মাধ্যমে। প্রজনন, বংশবিস্তার ও প্রজন্ম প্রতিপালন করে; অন্য অনেক ছোট পাখিদের মতই ব্যাবলাররা বিপদের হুশিয়ারী সংকেত হিসাবে চিৎকার করে অন্যদের সতর্ক করে এবং তারা একে অন্যকে খাবারও দান করে; এ ধরনের পরার্থে বা পরোপকারিতার লক্ষ্যে করা কোনো কাজকে একটি মানসম্পন্ন ডারউইনীয় নীরিক্ষা দিয়ে যদি পর্যালোচনা করতে হয়, তাহলে দেখা উচিৎ প্রথমত,পাখিদের মধ্যে পারস্পরিক আদান প্রদান ও জিনগত আত্মীয়তার সম্পর্কটিকে, যখন কোনো ব্যাবলার তার সঙ্গীকে তার নিজের সংগ্রহ করা খাদ্য খাওয়ায়, তার কারণটি এই আশায় যে ভবিষ্যতে তাকেও কোনোদিন একইভাবে এভাবে খাদ্য খাওয়ানো হবে? নাকি যারা এই সাহায্য পাচ্ছে তাদের সাথে সাহায্যদাতার নিকটবর্তী জিনগত কোনো সম্পর্ক আছে? বা তারা জিনগত আত্মীয়? এ বিষয়ে জাহাবীর ব্যাখ্যাটি ছিল ভীষণভাবে অপ্রত্যাশিত; প্রধান বা প্রাধান্য বিস্তারকারী ব্যবলাররা সামাজিক অবস্থানে তাদের প্রাধান্যটিকে দৃঢ় করে তাদের অধীনস্থদের খাওয়ানোর মাধ্যমে, জাহাবীর প্রিয় মানুষের ভাষায় এই ধরনের আচরণকে নরাত্বরোপ করলে বলা যায়, প্রধান পাখিটি হয়তো সমতুল্য এধরনের কিছু বলে, দেখো, আমি তোমার চেয়ে কত শ্রেষ্ঠ, আমি তোমাকে খাওয়া দান করতে পারি’ বা ‘আমি তোমার চেয়ে কত শ্রেষ্ঠ, আমি উঁচু ডালে বনে বাজপাখীর সামনে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহারাদারের মতো মাটিতে খেতে থাকা তোমাদের দলকে সতর্ক করতে পারি। জাহাবী ও তার সহকর্মীদের পর্যবেক্ষণ প্রস্তাব করছে যে, ব্যাবলাররা নিজেদের মধ্যে সক্রিয়ভাবে প্রতিযোগিতা করে, কে ঝুঁকিপূর্ণ এই পাহারাদারের কাজটি করবে; এবং যখনই কোনো অধীনস্থ কেউ প্রাধান্য বিস্তারকারী কোনো ব্যবলারকে খাদ্য দান করার চেষ্টা করে, আপাতদৃষ্টিতে তার এই দানশীলতাকে হিংস্রভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়; জাহাভীর ধারণার মূল বিষয়টি হলো, শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ বা প্রদর্শনের এই বিজ্ঞাপন সত্যায়িত হয় এর জন্য পরিশোধিত মুল্যে মাধ্যমে, শুধুমাত্র একজন সত্যিকারের শ্রেষ্ঠ সদস্যই পারে সেই সত্যের বিজ্ঞাপন করতে কোনো মূল্যবান উপহার দান করার মাধ্যমে; প্রজাতির সদস্যরা সাফল্য কেনে, যেমন, প্রজনন সঙ্গী আকর্ষণ করতে, শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের ব্যয়সাপেক্ষ প্রদর্শনীর মাধ্যমে, যার মধ্যে আছে সুস্পষ্টভাবে অতিমাত্রায় প্রদর্শন করা দানশীলতা এবং প্রকাশ্যে সবাইকে দেখিয়ে করা ঝুঁকি নেয়ার মাধ্যমে।

তাহলে আমাদের কাছে এখন চারটি জোরালো ডারউইনীয় কারণ আছে, কেন প্রজাতির কোনো সদস্য পরোপকারী, অন্যান্য সদস্যদের প্রতি দয়াশীল ও দানশীল হয় ও নৈতিক আচরণ প্রদর্শন করে, তা ব্যাখ্যা করার জন্য; প্রথম, জিনগত আত্মীয়তা বা কিনশীপের একটি বিশেষ ব্যপারতো আছেই; দ্বিতীয়, রেসিপ্রোকেশন, বা কোনো কিছু পাওয়ার বিনিময়ে কিছু দেয়া, পারস্পরিক আদান প্রদান: কোনো উপকারের প্রতিদান দেয়া এবং ভবিষ্যতে প্রতিদান পাওয়ার সম্ভাবনার কথা মনে রেখেই উপকার করতে সচেষ্ট হওয়া; এখান থেকে শুরু করে আসছে তৃতীয়। কারণটি: দয়াশীলতার ও দানশীলতার সুনাম অর্জন করার বিশেষ ডারউইনীয় সুবিধা, চতুর্থত, যদি জাহাভীর ধারণা সঠিক হয়, এই বিশেষ প্রদর্শন মূলক বা সবাইকে দেখানো দানশীলতা বা দয়াশীলতার বাড়তি সুবিধা হচ্ছে একেবারে খাঁটি অনুকরণযোগ্য নয় এমন বিজ্ঞাপন ক্রয় করা।

আমাদের প্রাগৈতিহাসিক সময়ের বিশাল একট অংশ জুড়ে, মানুষ এমন পরিস্থিতিতে বসবাস করেছে যা খুব দৃঢ়ভাবে এই চার ধরনেরই পরার্থবাদীতার বিবর্তনে সহায়তা করেছে; আমরা গ্রামে বসবাস করতাম বা তার আরো আগে বেবুনদের মত আলাদা আলাদা যাযাবর দল হিসাবে, যারা পার্শ্ববর্তী কোনো দল বা গ্রাম থেকে আংশিকভাবে বিচ্ছিন্ন ছিল; তখন দলের সদস্যদের বেশীরভাগই হয়তো পরস্পরের নিকটাত্মীয়; পার্শ্ববর্তী কোনো আলাদা দলের সদস্যদের চেয়ে, নিজ দলের সদস্যদের সাথে সেই দলের যে কোনো সদস্য অবশ্যই বেশী ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল..আর এ ধরনের পরিস্থিতিতে কিন বা আত্মীয়দের প্রতি পরোপকারিতা বা পরার্থবাদীতা বিবর্তনের প্রচুর সুযোগও ছিল; এবং আত্মীয় হোক বা না হোক, সেই দলের যে কোনো সদস্য দলের অন্য একজন সদস্যকে বার বার বহুবারই, সারাজীবন ধরেই সাক্ষাৎ করবেন, পারস্পরিক পরার্থবাদীতা বা রেসিপ্রকাল অ্যালটুইজিম বিবর্তন হবার জন্য যা অত্যন্ত আদর্শ একটি পরিস্থিতি এবং এই পরিস্থিতিগুলো অবশ্যই পরোপকারিতার সুনাম গড়ে তোলার জন্যও আদর্শ পরিস্থিতি। এবং এটা অবশ্যই একই ভাবে সেরকমই একটি আদর্শ পরিস্থিতি যেখানে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা বা প্রদর্শন করার মত দয়াশীলতা ও উদারতা বিজ্ঞাপন করার জন্য; এই চারটি উপায়ের যে কোনো একটি কিংবা সবগুলো উপায়ে পরার্থবাদীতার প্রতি আদি মানুষের। জিনগত প্রবণতা বিশেষ সহায়তা পেয়েছিল প্রাকৃতিক নির্বাচনের ছাকুনীতে; খুব সহজেই বোঝা যায়, কেন আমাদের প্রাগৈতিহাসিক পূর্বপুরুষরা তাদের নিজেদের গ্রুপের সদস্যদের প্রতি সদয় এবং উপকারী ছিল তাদের আচরণে কিন্তু ভিন্ন গোত্রীয়দের প্রতি অহেতুক ভয়,অবিশ্বাস আর সন্দেহপূর্ণ ছিল তাদের আচরণ; কিন্তু কেন? এখন যখন আমরা বেশীর ভাগ মানুষ বড় শহরগুলোতে বাস করি, যেখানে চারপাশে আমরা আর আগের মত আমাদের নিজেদের আত্মীয় দ্বারা পরিবেষ্টিত নেই, এবং যেখানে প্রতিদিন আমাদের বহু বিভিন্ন মানুষের সাথে দেখা হয়; যাদের সাথে আর কখনোই আমাদের আর দেখা হবে না; তাহলে কেন আমরা একে অপরের সাথে ভালো আচরণ করি, এমন কি কখনো এমন কারো সাথে, যাকে ভাবা যেতে পারে আমাদের গ্রুপের বহিরাগত?

প্রাকৃতিক নির্বাচনের নাগাল সম্বন্ধে ভুল কথা না বলা খুব জরুরী; নির্বাচন আপনার জিনের জন্য কি ভালো সে বিষয়ে কগনিটিভ বা অবধারণগত সচেতনতা বিবর্তনে কোনো সহায়তা করেনি; সেই সচেতনাতাকে কগনিটিভ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে অপেক্ষা করতে হয়েছে বিংশ শতাব্দী অবধি এবং এখনও পুরো বিষয়টি সম্বন্ধে জ্ঞান সীমাবদ্ধ আছে অল্প কিছু বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞদের কাছেই; প্রাকৃতিক নির্বাচন যেটিকে গড়ে উঠতে এবং টিকে থাকতে সহায়তা করে সেটি হলো ‘রুলস অব থাম্ব বা গড়পড়তা কোনো নিয়ম, যা আসলে কাজ করে সেই সব জিনগুলোকে প্রোমোট করার মাধ্যমে যারা তাদের বা সেই নিয়মগুলোকেই তৈরী করে; কিন্তু তাদের বৈশিষ্ট্যগত কারণেই এই সব ‘রুলস অব থাম্বস’ মাঝে মাঝে ভুল করে বসে; যেমন পাখিদের মস্তিস্কে, সেই নিয়ম বা রুল অব থাম্ব, “তোমার বাসায় চিৎকার করা ছোট ছোট প্রাণীগুলোকে ভালো করে দেখাশুনা করতে হবে এবং তাদের হা করা লাল মুখের গর্তে খাওয়া ফেলতে হবে, এটির বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে প্রভাব পড়েছে সেই সব জিনগুলোকে রক্ষা করার মাধ্যমে যারা এই রুলটি তৈরী করেছে, কারণ কোনো পূর্ণবয়স্ক পাখির নীড়ে এই চিৎকার করতে থাকা ও হা করে থাকা লাল গর্তসহ জিনিসগুলো সাধারণত তার নিজের সন্তান, এই রুলটি মিসফায়ার বা ভুল করে বসে, যখন অন্য কোনো পাখির বাচ্চা কোনোভাবে এই নীড়ে ঢুকে পড়ে (যেমন ব্রুড প্যারাসাইট বা প্রজনন পরজীবি কিছু পাখি প্রজাতির ক্ষেত্রে ), এরকম একটি পরিস্থিতি তৈরী করে তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে কোকিলরা; তাহলে আমাদের এই ভালমানুষি পরোপকার করার প্রবণতাটি কি এরকমই কোনো মিসফায়ারিং বা ভুল ক্ষেত্রে সক্রিয় হতে পারে, যা রীড ওয়ালার মাতাপিতাসুলভ সহজাত প্রবৃত্তির মিসফায়ারিং এর অনুরুপ, যখন এই প্রবৃত্তির তাড়নায় এই পাখিগুলো অমানুষিক প্ররিশ্রম করে এবং না জেনেই কোকিলের বাচ্চাকে প্রতিপালন করে বড়ে করে? কিংবা আরো একটি নিকটবর্তী অনুরুপ দৃষ্টান্ত হতে পারে কোনো শিশুকে দত্তক নেবার ব্যপারে মানুষদের নিজস্ব সেই তাড়নাটি; অতিসত্বর আমাকে অবশ্যই এখানে যোগ করতে হবে যে এই ‘মিসফায়ারিং’ বিষয়টির অবতারণার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র ডারউইনীয় অর্থে, নিন্দাসূচক কোনো অর্থে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে না।

এই ‘ভুল’ বা উপজাত বা “বাই- প্রোডাক্ট’ ধারণা যা আমি সমর্থন করছি, এভাবেই কাজ করে; পূর্বসূরিদের সেই আদি কালে, যখন আমরা বেবুনদের মত ক্ষুদ্র কিন্তু স্থিতিশীল গ্রুপ বা গোষ্ঠী হিসাবে বসবাস করতাম, প্রাকৃতিক নির্বাচন আমাদের মস্তিস্কে পরোপকারিতা বা পরার্থবাদীতার তাড়নাকে প্রোগ্রাম করেছিল, অন্যান্য আরো প্রয়োজনীয় তাড়নাগুলোর সাথে, যেমন যৌন কামনা, ক্ষুধা, ভীন দেশীদের প্রতি প্রদর্শিত সন্দেহপ্রবণতা ইত্যাদি সহ আরো অনেক তাড়না; একটি বুদ্ধিমান দম্পতি, তারা ডারউইন পড়তে থাকতে পারেন এবং তারা হয়তো জানেন, তাদের যৌনতাড়নার মূল কারণটি হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্ম সৃষ্টি করা, তারা এটাও জানেন নারীটি গর্ভধারণ করতে পারবে না কারণ সে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল খাচ্ছে, তারপরও তারা আবিষ্কার করেন তাদের যৌন ইচ্ছাগুলো সেটা জানার কারণে কোনো অংশেই কমে যাচ্ছে না; যৌন কামনা হচ্ছে যৌন কামনা এবং এর শক্তি, কোনো একটি ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক স্তরে, সেই মূল ডারউইনীয় চাপ যা এটি পরিচালিত করে, তার থেকে স্বাধীন; এটি একটি তীব্র শক্তিশালী তাড়না যা তার মূল যৌক্তিক কারণ ছাড়াই স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল হতে পারে।

আমি প্রস্তাব করছি দয়াশীলতার তাড়না বা কারো প্রতি দয়াশীল হবার প্রবৃত্তিটাও একই ভাবে সত্য, পরার্থবাদীতা, বা পরোপকার করার তাড়না, উদারতা, সহমর্মিতা প্রকাশ করা, করুণা করা ইত্যাদিও; পূর্বসূরিদের সেই অতীতে, আমাদের সুযোগ ছিল শুধু কাছের আত্মীয় বা সম্ভাব্য যারা আমাদের দানের প্রতিদান দিতে পারবে শুধু তাদের প্রতি পরোপকারী মনোভাবাপন্ন হবার; কিন্তু পরবর্তীতে কিংবা এই বিধিনিষেধ আর নেই, তবে সেই গড়পড়তা নিয়মটি টিকে আছে; আর কেনই বা তা থাকবে না? এটিও ঠিক যৌন তাড়নার মতই, আমরা আমাদের অন্য লিঙ্গের সদস্যদের প্রতি যৌন কামনার উদ্রেক হওয়া থেকে যতটুকু নিজেদের রক্ষা করতে পারি (সে অনুর্বর বা বন্ধ্যা হতে পারে, অথবা অন্য কোনো কারণে প্রজননে অক্ষমও হতে পারে), কোনো ক্রন্দনরত দুর্ভাগার প্রতি করুণার উদ্রেক হওয়া থেকে তারচেয়ে বেশী কোনোভাবে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারিনা (যার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্কই নেই এবং আমাদের দানের প্রতিদান দেবার কোনো সম্ভাবনাও নেই যখন তাদের); এই দুটোই মিসফায়ারিং; ডারউইনীয় ভুল: আশীর্বাদপুষ্ট, কাঙ্খিত মহামূল্যবান সেই ভ্রান্তি; একমুহূর্তের জন্যও দয়া করে চিন্তা করবেন না এধরনের ডারউইনীয় বিবরণ বা ব্যাখ্যা সহমর্মিতা এবং উদারতার মত মহান অনুভূতি আর আবেগকে মর্যাদাহীন করছে বা লঘু করছে; যৌনকামনাকেও না; যৌনকামনা যখন ভাষাগত সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেটি প্রকাশ পায় অসাধারণ কবিতা আর নাটকের মাধ্যমে, জন ডানের প্রেমের কবিতা, কিংবা রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট; এবং অবশ্যই একই ঘটনা করে মিসফায়ার হওয়া আত্মীয় প্রতি পরার্থবাদীতা বা দান প্রতিদান নির্ভর সহমর্মিতার ক্ষেত্রে; ঋণগ্রন্থ কারোর প্রতি দয়া, যখন মূল প্রাসঙ্গিকতার বাইরে দেখা হয়, অন্য কারো শিশু দত্তক নেবার মতই সেটাকেও অ ডারউইনীয় মনে হয় { দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিসে যেমন পোর্শিয়া। উচ্চারণ করে) (২৯):

The quality of mercy is not strained. It droppeth as the gentle rain from heaven upon the place beneath.

যৌন কামনা মানবিক উচ্চাশা আর সংগ্রামের সিংহভাগ একটি অংশের চালিকা শক্তি এবং এর বেশীর ভাগ অংশই মূলত মিসফায়ারিং (যার জন্য এটি বিবর্তিত হয়নি); একই ভাবে উদার এবং সহমর্মী হতে চাইবার কামনার ক্ষেত্রে সত্যি না হবারও কোনো কারণই নেই; যদি এটি আমাদের পূর্বসূরিদের গ্রামীন জীবনের মিসফায়ার থেকে সৃষ্ট ফলাফল হয়েই থাকে। আমাদের পূর্বসূরিদের সেই অতীতে এই দুই ধরনের কামনার তাড়না গড়ে তুলতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে আমাদের মস্তিস্কেও মধ্যে একটি ধরা বাধা নিয়ম বা রুল অব থাম্ব গেথে দেয়া, আর সেই নিয়মগুলো এখনও আমাদের প্রভাবিত করে চলছে, এমন কি যখন অবস্থা বা পরিস্থিতি তাদের মূল কাজগুলোর জন্য যখন অপ্রযোজ্য হয়ে গেছে।

এই সব রুল অব থাম্ব বা ধরা বাধা নিয়মগুলো এখনও আমাদের প্রভাবিত করছে; তবে ক্যালিভিনিয় ডিটারমিনিষ্টিক বা পরিণামবাদী উপায়ে না, বরং সামাজিক প্রথা এবং সাহিত্যে, আইন এবং ঐতিহ্যগত নানা প্রথার সভ্যতা সৃষ্টিকারী প্রভাবের ছাকুনীর মধ্য দিয়ে– এবং অবশ্যই ধর্ম। ঠিক যেমন করে আদিম মস্তিস্কে যৌন কামনার আইনটি সভ্যতার ছাকুনি দিয়ে অতিক্রম করে। রোমিও ও জুলিয়েট এর ভালোবাসার দৃশ্যে আবির্ভুত হয়েছে, একই ভাবে আদিম মস্তিস্কের সেই আমরা বনাম অন্যরা সংক্রান্ত ভেনডেট্টো বা পূর্বপুরুষদের প্রতিহিংসারও পুনরাবির্ভাব ঘটে ক্যাপুলেট ও মন্টেগিউদের (৩০) চলমান যুদ্ধ রুপে; যখন আদিম মস্তিস্কের সেই পার্থবাদীতা এবং সহমর্মিতার নিয়মের মিসফায়ার ঘটে,আমাদের তা আনন্দিত করে শেক্সপিয়ারের শেষ দৃশ্যে দ্বন্দ্বরত দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে পুনরায় বিশুদ্ধ মিত্রতা সৃষ্টি হতে দেখে।

নৈতিকতার শিকড় সংক্রান্ত একটি কেস স্টাডি

আমাদের নৈতিকতাবোধ, যৌন কামনার মত, যদি আসলেই আমাদের ডারউইনীয় অতীতের গভীরে প্রোথিত হয়ে থাকে, যা কিনা ধর্মের উৎপত্তিরও বহু আগে, মানুষের মনের উপর কোনো গবেষণায় আমাদের তাহলে আশা করা উচিৎ যে এমন কিছু মোরাল ইউনিভার্সাল বা নৈতিকভাবে কিছু ধ্রুব বিষয়গুলো লক্ষ করা যাবে, যা কিনা সকল ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক এবং গুরুত্বপূর্ণভাবে ধর্মীয় পরিমণ্ডলেও স্থির থাকবে; হার্ভার্ড জীববিজ্ঞানী মার্ক হাউসার, তার ‘মোরাল মাইন্ডস’ বইটিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার সুত্রকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন চিন্তার পরীক্ষা বা থট এক্সপেরিমেন্ট এর উপযোগী মাধ্যম ব্যবহার করে। ইতিপূর্বে যা মূলত প্রস্তাব করেছিলেন নীতিশাস্ত্রের দার্শনিকরা; হাউসারের গবেষণায় সেগুলো আরো একটি বাড়তি উদ্দেশ্য পূরণ করেছিল, তা হলো নীতিশাস্ত্রের দার্শনিকরা কিভাবে চিন্তা করেন এটি তারও একটি ভূমিকা আমাদের জন্য উপস্থাপন করে। একটি কাল্পনিক বা হাইপোথেটিকাল নৈতিক দ্বন্দ্ব বা উভয় সঙ্কটময় পরিস্থিতি উপস্থাপন করা হয় এবং সেই পরিস্থিতিতে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবার ক্ষেত্রে আমরা যে সমস্যার সম্মুখীন হই, সেটি আমাদের ভালো মন্দ বোঝার বোধ সম্বন্ধে কিছু ধারণা দেয়; যেখানে হাউসার দার্শনিকদের থেকে আরো বেশ খানিকটা এগিয়ে যান, তিনি মানুষের নৈতিকতাবোধ পরীক্ষা করার জন্য আসলেই পরিসংখ্যানগত জরিপ এবং মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা পরিচালনা করেন, যেমন, ইন্টারনেটে করা প্রশ্নের মাধ্যমে আসল মানুষের নৈতিকতাবোধ নিয়ে গবেষণা করেন। বর্তমান আলোচনার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক ব্যপারটা হচ্ছে বেশীর ভাগ। মানুষই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যখন তাদের এইসব উভয় সঙ্কটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি করা হয়, এবং তাদের নেয়া সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে সদৃশ্যতা সেই সিদ্ধান্তগুলোয় পৌঁছানোর নেপথ্যে কারণগুলো ব্যাখ্যা করার ক্ষমতার অনেক বেশী শক্তিশালী এবং সেটাই আমরা আশা করতে পারি যদি আমাদের নৈতিকতা বোধ আমাদের মস্তিস্কের ভিতর আগে থেকেই প্রোগ্রাম করা বা দৃঢ়ভাবে গাথা থাকে, যেমন আমাদের সহজাত যৌন প্রবৃত্তি বা আমাদের উচ্চতা সংক্রান্ত ভীতি বা হাউসার নিজে যেভাবে বলতে শ্রেয় মনে করেন, আমাদের ভাষা ব্যবহারে দক্ষতা (খুঁটিনাটি বিষয়গুলো সংস্কৃতি সাপেক্ষে ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু এর গভীরে মূল ব্যকরণের সুত্রগুলো সর্বজনীন); আমরা পরে যা দেখবো, মানুষরা এই সব নৈতিক পরীক্ষাগুলোর যেভাবে প্রত্যুত্তর করে এবং সেই উত্তরের কারণকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে তাদের অক্ষমতা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের ধর্মবিশ্বাস থাকা বা না থাকা উপর নির্ভরশীল নয়। বলেই প্রতীয়মান হয়; হাউসারের বই এর বার্তা তার নিজের শব্দে, যা আশা করতে পারি তা হোললা: আমাদের নৈতিকতা নির্ভর কোনো কিছু বিচার করার ক্ষমতা হচ্ছে সর্বজনীন একটি নৈতিক ব্যকরণের মত, আমাদের মনের একটি ফ্যাকাল্টি বা ক্ষমতা যা বিবর্তিত হয়েছে মিলিয়ন বছর ধরে, যা একগুচ্ছ মূল নীতির উপর ভিত্তির উপর গড়ে তুলে সম্ভাব্য বেশ কিছু নৈতিক সিস্টেম এর সীমানা; ভাষার মতই, মূলনীতিগুলো যা আমাদের নৈতিক ব্যকরণের মূলনীতিগুলোর ভিত্তি রচনা করে তা আমাদের সচেতনতার স্তরে ধরা পড়ে না।

গবেষণাটিতে হাউজার এর ব্যবহৃত বৈশিষ্ট্যসূচক নৈতিক উভয়। সঙ্কটময় পরিস্থিতিগুলো যেমন, রেললাইনের উপর লাগামহীনভাবে ছুটে চলা ( বা রানাওয়ে) ট্রাক বা ট্রলির দৃশ্যপটের যা লাইনের উপর দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কিছু মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে এমন মূলভাবেরই রকমফের; সবচয়ে সরলতম কাহিনীটি কল্পনা করছে একজন ব্যক্তি, যার নাম ডেনিস, এমন একটি বিশেষ অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, সে চাইলে ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে সজোরে ধেয়ে আসা ট্রলিটিকে পার্শ্ববর্তী ভিন্ন একটি ট্রাকে ঘুরিয়ে দিতে পারে, এবং তার মাধ্যমে মূল ট্র্যাক লাইনের উপর আটকে পড়া পাঁচ জন ব্যক্তির জীবন সে বাঁচাতে পারবে; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাশের সেই লাইনের উপরও একজন মানুষ আটকে আছে, কিন্তু যেহেতু সে একা, মূল লাইনে আটকে থাকা বাকী পাঁচজন মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সে হেরে যায় এবং গবেষণায় অংশ নেয়া বেশীর ভাগ মানুষই মনে করেন ডেনিসের জন্য ট্রলিটির গতিপথ পরিবর্তন করার সুইচ নাড়ানো এবং পাশের লাইনে একজনের মৃত্যুও বদলে বাকী পাঁচ জনকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য, যদিও কেউ মনে করেননি কাজটি ডেনিস এর জন্য বাধ্যতামূলক; আমরা এখানে হাইপোথেটিক্যাল কিছু সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করেছি, যেমন যে মানুষটা সেই সাইড রেললাইনে দাঁড়িয়ে আছে, তিনি হতে পারেন বিটহোভেন কিংবা ডেনিসেরই কোনো ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু।

চিন্তার এই এক্সপেরিমেন্টটির বিস্তারিত বিবরণ ক্রমান্বয়ে ধারাবাহিকভাবে আমাদের আরো কঠিন নৈতিক উভয়সংকটময় পরিস্থিতিগুলো ও ধাঁধার মুখোমুখি করে; কি হতে পারে যদি, ধেয়ে আসা ট্রলিটাকে আমরা থামিয়ে দিতে পারি উপরের একটি ব্রীজ থেকে ভারী কোনো বস্তু এর সামনে ফেলে? খুবই সহজ প্রশ্ন, অবশ্যই আমরা ভারী ওজনটা নীচে ফেলবো সেই কাজটি করার জন্য; কিন্তু কি হবে যদি ভারী ওজনদার কিছু বলতে ব্রীজের উপর বসে থাকা খুব মোটা একটা মানুষ ছাড়া আর কিছুই যদি আমাদের কাছে না থাকে, যে মানুষটি সেখানে বসে সুর্যাস্তের শোভা উপভোগ করছেন? গবেষণায় প্রায় সবাই একমত হয়েছিলেন, মোটা এই মানুষটিকে ব্রীজের উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিয়ে। ট্রলিটি থামানো অনৈতিক বা নৈতিকভাবে গ্রহনযোগ্য নয়; লক্ষ করে দেখুন, এমনকি একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই উভয় সংকটটি কিন্তু একটু আগেই উল্লেখ করা ডেনিসের সংকটের মতই; যেখানে সে ট্র্যাক পরিবর্তনের সুইচ নামালে একজন হয়তো মারা যাবেন, তবে বাকী পাঁচ জনের জীবন বাঁচবে; উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হচ্ছে, আমাদের বেশীরভাগ মানুষের মনে একটি শক্তিশালী সহজাত ধারণাগত অন্তর্দৃষ্টি বা ইনটুইশন আছে, সেটা হলো, এই দুটি কেস বা দৃশ্যপটের মধ্যে অবশ্যই কিছু মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে, যদিও আমরা হয়তো স্পষ্ট করে বলতে পারবো না সেই পার্থক্যটি আসলে কি।

ব্রীজের উপর থেকে মোটা মানুষটাকে নীচে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার দৃশ্যপটটি হাউসারের প্রস্তাবিত অন্য একটি উভয় সঙ্কটের। কথা মনে করিয়ে দেয়। এই দৃশ্যপটে আমরা দেখি পাঁচ জন রোগী যারা হাসপাতালে ভর্তি এবং যারা মরণাপন্ন, প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রয়োজন যা অকেজো হয়ে গেছে; প্রত্যেককেই বাঁচানো যাবে যদি কোনো দাতাকে খুঁজে পাওয়া যায় তাদের প্রত্যেকের প্রয়োজনীয় সেই নির্দিষ্ট অঙ্গটি দান করার জন্য, কিন্তু কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু হঠাৎ করে চিকিৎসক সার্জন লক্ষ করলেন, হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে আছেন একজন সুস্থ্য সবল মানুষ, যার মধ্যে এই পাঁচটি অঙ্গই ভালোভাবে কাজ করছে এবং সেগুলো প্রতিস্থাপন করারও যোগ্য, এরকম একটি পরিস্থিতি সম্ভবত একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা বলবেন এই একজনকে মেরে বাকী পাঁচ জনকে বাঁচানো কোনো নৈতিক কাজ হবে।

ব্রীজের উপর দাঁড়ানো মোটা মানুষটির দৃশ্যপটের সেই ক্ষেত্রের মতই যে সহজাত তাড়নাগত অন্তদৃষ্টি, যা আমরা সবাই অনুভব করি তা হলো, সেখানে উপস্থিত কোনো নিরপরাধ কাউকে তার পূর্ব অনুমতি ছাড়া অন্যদের জন্য হঠাৎ করে কোনো খারাপ পরিস্থিতিতে টেনে আনা উচিৎ না; ইমানুয়েল কান্ট বিখ্যাতভাবে এই মূলনীতিটাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন এভাবে: কখনোই কোনো পরিস্থিতিতেই যৌক্তিক বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন কোনো সত্তাকে, শুধুমাত্র সম্মতিহীন কোনো একটি উপায় হিসাবে কোনো উদ্দেশ্যপুরণের লক্ষ্যে ব্যবহার করা উচিৎ নয়, এমন কি অন্যদের উপকার করার স্বার্থেও না। এই বিষয়টি মনে হচ্ছে, তিনটি দৃশ্যপট, ব্রীজের উপর বসা মোটা মানুষ (বা হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসা মানুষ) বা ডেনিসের ক্ষেত্রে সাইড লাইনে দাঁড়ানো মানুষের মধ্যে মূল পার্থক্যটা সৃষ্টি করছে; ব্রীজের উপর বসা মোটা মানুষটিকে সরাসরি ব্যবহার করা হচ্ছে বেপরোয়াভাবে ধেয়ে আসা ট্রলিটির গতিরোধ করতে, এটি সরাসরি কান্টিয় মূলনীতিকে অস্বীকার। করছে; পাশের সাইড লাইনে দাঁড়ানো মানুষটি কিন্তু সরাসরি ব্যবহার করা হচ্ছে না পাঁচ জন মানুষের জীবন বাঁচানোর স্বার্থে এবং সেখানে শুধু পাশের লাইনটি ব্যবহার করা হচ্ছে ট্রলির গতিপথ বদলে দেবার জন্য আর সেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাটা তার জন্য দুর্ভাগ্য মাত্র; কিন্তু আপনি যখন এভাবে বিভেদ রেখাটা টানেন দুজনের মধ্যে, সেটা আসলে আমাদের কোন ইচ্ছাকে সন্তুষ্ট করছে? কান্টের জন্য এটি হচ্ছে একটি নৈতিক ধ্রুব বা মোরাল অ্যাবসসালুট; আর হাউসারের মতে, এটি আমাদের ভিতর দৃঢ়ভাবে গেথে দিয়েছে আমাদের বিবর্তন প্রক্রিয়া।

বেপরোয়া ছুটে আসা ট্রলির এই কাল্পনিক পরিস্থিতিটি ক্রমান্বয়ে আরো ব্যতিক্রমী জটিল রুপ ধারণ করে এবং সেই সাথে সংশ্লিষ্ট নৈতিক উভয়সঙ্কটও আরো জটিলতর হয়ে উঠে, হাউসার দুজন কাল্পনিক ব্যক্তি, নেড ও অস্কারের অনুভুত অন্তর্ঘটির পার্থক্যটা আমাদের প্রদর্শন করেন; ট্র্যাক বা রেলওয়ের লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আছে নেড, ডেনিসের মতো সে ধেয়ে আসা ট্রলিটাকে সম্পূর্ণ অন্য একটা পাশের লাইনে সরিয়ে দিতে পারে না ঠিকই তবে নেড এর সুইচ ট্রলিকে একটি সাইড লুপের দিকে সরিয়ে দেয়য় যা আবার কিছুটা দূরে মূল লাইনে ফিরে আসে ঠিক পাঁচ জন মানুষ যেখানে আটকে আছে তার আগে; সুতরাং এই বিন্দুতে শুধুমাত্র সুইচ দিয়ে কিছু হচ্ছে না, ট্রলি ঠিকই পাঁচ জনকে মাড়িয়ে চলে যাবে, যখন সেই বিকল্প লাইনটি আবার মূল লাইনের সাথে যুক্ত হয়; তবে ঘটনাচক্রে সেই ডাইভারশন বা বিকল্প লাইনে একটি খুবই মোটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে যার ওজন ট্রলিটিকে থামানোর জন্য যথেষ্ট; এখানে নেড কি সুইচের পয়েন্টটা বদলাবে এবং ট্রেনটিকে বিকল্প পথের দিকে সরিয়ে নিয়ে যাবে, বেশীরভাগ মানুষের সহজাত ইনটুইশন বা অন্তৰ্জ্জনই বলবে নেড এর সেটা করা উচিৎ হবে না; কিন্তু নেড এর উভয় সংকট বা নৈতিক দ্বন্দ্বের সাথে ডেনিস এর দ্বন্দ্বটির কি পার্থক্য আছে? ধারণা করা যেতে পারে, মানুষ তার প্রবৃত্তিগত ভাবে কান্টিয়। মূলনীতি প্রয়োগ করছে এখানে; ডেনিস ট্রলিটির গতিপথ অন্য দিকে সরিয়ে দেয় পাঁচজন মানুষকে বাঁচাতে, এবং এর দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি হয় এর পাশের লাইনে দাঁড়ানো একজন, সেটি হচ্ছে কোল্যাটেরাল (অনিচ্ছাকৃত ও এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়) ক্ষতি, রামসফেল্টীয় চটকদার শব্দ যদি ব্যবহার করা হয়, যে লোকটি চাপা পড়বে তাকে ডেনিস ইচ্ছা করে ব্যবহার করছে না, অন্যদের বাঁচানোর জন্য; নেড আসলেই মোটা মানুষটিকে ব্যবহার করছে ঐলিটাকে থামানোর জন্য এবং বেশীভাগ মানুষই (কোনো চিন্তা ছাড়াই হয়ত), কান্টের (বিস্তারিতভাবে যিনি তা ভেবেছেন) মতই এই দুটি ক্ষেত্রে একটি বড় পার্থক্য করছে।

এই পার্থক্যটা আবার দেখা যায় অস্কারের উভয় সংকটে; অস্কারের পরিস্থিতিটা নেডের মতই একই রকম, শুধু সেখানে ডাইভারশন লুপের সেই লাইনে পাথরের একটি ভারী জিনিস আছে যা ট্রলিটাকে থামাতে পারবে, স্পষ্টতই অস্কারের কোনো সমস্যা হবার কথা না, সুইচ টেনে ট্রলিটাকে বিকল্প পথের দিকে নিয়ে যাওয়া, শুধুমাত্র ঘটনাচক্রে সেখানে একজন পথচারী সেই লোহার ওজনের ভারটির সামনে হেঁটে এসে পড়ে সে অবশ্য মারা পড়বে যদি অস্কার সুইচটা টানে, যেমন, নেডের ক্ষেত্রে মোটা মানুষটার মত, পার্থক্যটা হচ্ছে ট্রলিটিকে থামানোর জন্য অস্কার এই পথচারীকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করছে না, সে হচ্ছে এই পরিস্থিতির কোল্যাটেরাল (অনিচ্ছাকৃত ও অনিবার্য) ক্ষতি, ডেনিসের দ্বন্দ্বের মত; হাউসার ও তার গবেষণায় বেশীভাগ অংশগ্রহনকারীদের মত, আমিও মনে করি অস্কারকে অনুমতি দেয়া যায় সুইচ দেবার জন্য, কিন্তু নেডকে না; কিন্তু এই সহজাত চিন্তা বা ইনটুইশনকে ব্যাখ্যা করাও আমার জন্য কঠিন, হাউসারের বক্তব্য হচ্ছে, এধরনের নৈতিক অন্তর্দৃষ্টি প্রায়শই খুব ভালো করে করা কোনো চিন্তার বহিঃপ্রকাশ না ঠিকই কিন্তু সেগুলো আমরা খুবই দৃঢ়ভাবে অনুভব করতে পারি, আমাদের বিবর্তনীয় ঐতিহ্যের কারণে।

নৃতত্ত্ববিদ্যা ক্ষেত্রে এই গবেষণাটি নিয়ে একটি কৌতূহলোদ্দীপক উদ্যোগ গ্রহন করেন হাউসার ও তার সহকর্মীরা; নৈতিকতার এই পরীক্ষাগুলো তারা উপযোগি করে প্রয়োগ করেছিলেন কুনা আদিবাসীদের উপর; কুনা, মধ্য আমেরিকার ক্ষুদ্র একটি নৃগোষ্ঠী, যারা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধর্ম এবং পশ্চিমাদের সংস্পর্শে খুব একটা আসেনি কখনো। গবেষকরা লাইনের উপর দিয়ে ধেয়ে আসা ট্রলির ট্রলি বদলে স্থানীয়ভাবে বোধগম্য বিকল্প রুপক ব্যবহার করেন, যেমন নৌকার দিকে দ্রুত সাঁতার কেটে এগিয়ে আসা কুমীর; সংশিষ্ট কিছু সামান্য পার্থক্য ছাড়া, কুনা আদিবাসীরাও আমাদের মতই একই নৈতিক বিচার বিবেচনার প্রমাণ দেয় তাদের গবেষণায়।

সবচেয়ে বিশেষভাবে যে বিষয়টি চিন্তার উদ্রেক করে এই বইটিতে, তা হলো হাউসার এর একটি ভাবনা। তাহলো ধর্মবাদী মানুষরা কি তাদের নৈতিক অন্তর্দষ্টির দিক থেকে নিরীশ্বরবাদীদের থেকে ভিন্ন কিনা; নিশ্চয়ই, যদি আমরা আমাদের নৈতিকতাবোধ পাই ধর্ম থেকে, তাহলে তো তাদের মধ্যে পার্থক্যটা থাকাই উচিৎ; কিন্তু যা দেখা গেল তা হলো, তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই; নীতিশাস্ত্রের দার্শনিক পিটার সিংগারকে (৩১) নিয়ে হাউসার তিনটি হাইপোথেটিকাল উভয়-সংকটের উপর দৃষ্টি দেন এবং এই তিনটি পরিস্থিতিতে নিরীশ্বরবাদীদের রায়ের সাথে ধর্মবাদীদের রায়কে একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা করেন (৩২)। প্রত্যেক ক্ষেত্রে অংশগ্রহনকারীদের জিজ্ঞাসা করা হয়, কোনো একটি কাল্পনিক সিদ্ধান্ত বা কাজ নৈতিকভাবে ‘আবশ্যিক’, ‘অনুমতিযোগ্য’ বা ‘নিষিদ্ধ’ কিনা তা চিহ্নিত করা; তিনটি ডাইলেমা বা উভয় সঙ্কটময় কাল্পনিক পরিস্তিতিগুলো হোলো:

(১) ডেনিসের উভয়-সঙ্কট: নব্বই শতাংশ মানুষ বলেছে ট্রলিটিকে বিকল্প পথে ঘুরিয়ে দেয়া অনুমতিযোগ্য, পাঁচ জনকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে একজনকে মারা যেতে পারে।

(২) আপনি একজন বাচ্চাকে পুকুরে ডুবতে দেখছেন এবং আশে পাশে কেউ নেই যে তাকে বাঁচাতে পারে একমাত্র আপনি ছাড়া; আপনি বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারবেন, কিন্তু আপনার প্যান্টটি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে; ৯৭ শতাংশ মানুষই মনে করেন আপনার বাচ্চাকে উদ্ধার করা উচিৎ (আশ্চর্যজনকভাবে ৩ শতাংশ মানুষ মনে করেন তাদের জন্য প্যান্ট বাঁচানোটা শ্রেয়তর!!);

(৩) অঙ্গ প্রতিস্থাপনের দৃশ্যপটটা যা উপরে বর্ণনা করা হয়েছে: ৯৭ শতাংশ মানুষই মনে করেন ওয়েটিং রুমে বসা একটা সুস্থ মানুষকে হত্যা করে তার শরীরের অঙ্গগুলো সংগ্রহ করা অবশ্যই নৈতিকভাবে নিষিদ্ধ একটি কাজ, যা এমনকি আরো পাঁচ জনের জীবন বাঁচাতে পারবে;

হাউসার এবং সিঙ্গার এর গবেষণাটির মূল উপসংহার হলো, পরিসংখ্যানগত দিক থেকে ধর্মবাদী এবং নিরীশ্বরবাদীদের এই বিষয়গুলো নিয়ে মতামত বা নৈতিক বিচারের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই; ব্যপারটা কিন্তু সেই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা আমি সহ আরো অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি, যে ভালো কিংবা খারাপ বা অশুভ হবার জন্য আমাদের ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই।

যদি ঈশ্বরই না থাকে, তাহলে আমরাই বা কেন ভালো হবো?

এভাবে যদি উপস্থাপন করা হয়, উপরের এই প্রশ্নটা নিঃসন্দেহে আর মহান বা সম্মানজনক শোনায় না; যখন কোনো ধর্মীয় ব্যক্তি আমার কাছে এভাবে প্রশ্নটি উত্থাপন করেন এবং অনেকেই তাই করেন), আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয় নীচের এই চ্যালেঞ্জটি ছুঁড়ে দেবার জন্য : আপনি কি আসলেই আমাকে বলতে চাইছেন, আপনার ভালো হবার প্রচেষ্টার একমাত্র কারণ ঈশ্বরের কৃপা আর পুরষ্কার অর্জন করা বা তার রোষানল বা শাস্তি এড়াতে? কিন্তু সেটা নৈতিকতা না, এটা পদলেহন করা, চাটুকারিতা করা, আকাশের মহান সার্ভেইলেন্স ক্যামেরার দিকে বার বার ঘাড় ফিরিয়ে দেখা, এখনও আপনার মাথার মধ্যে ছোট একটি আড়ি পাতা যন্ত্র আছে, যা আপনার সমস্ত কর্মকাণ্ড যা পর্যবেক্ষণ করছে, আপানার সকল খারাপ চিন্তা সম্বন্ধে তিনি সর্বজ্ঞ; আইনস্টাইন যেমন বলেছিলেন, ‘যদি মানুষ শুধুমাত্র ভালো হয় কারণ তারা শাস্তির ভয় পায় আর পুরষ্কারের আশা করে, তাহলে সত্যি আমরা বড়ই হতভাগ্য। মাইকেল শেরমার তার ‘দ্য সায়েন্স অব গুড অ্যান্ড ইভিল’ বইটিতে এই বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন বিতর্ক সমাপনকারী যুক্তি হিসাবে; ‘আপনি যদি একমত হন যে, ঈশ্বরের অনুপস্থিতিতে আপনি ডাকাতি, ধর্ষণ আর খুন করতে পারবেন, আপনি তাহলে নিজেকে একজন অনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত করলেন এবং আপনার থেকে যত দূরে থাকা সম্ভব ততদূরে থাকা উচিৎ এই উপদেশটি আমাদের অবশ্যই মেনে চলা প্রয়োজন, আবার অন্যদিকে যদি ঐশ্বরিক নিবিড় পর্যবেক্ষণ আর নজরদারি ছাড়াও আপনি সত্যি ভালো মানুষ হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি নিজেই “আমাদের ভালো মানুষ হবার জন্য ঈশ্বর অবশ্য প্রয়োজনীয় এমন দাবীটিকে চূড়ান্তভাবে অবমূল্যায়ন করলেন। আমার সন্দেহ একটি বিশাল সংখ্যক ধার্মিক ব্যক্তিরা মনে করেন যে, তাদের ভালোমানুষ হবার জন্য ধর্মই মূল প্রণোদনাকারী দায়িত্ব পালন করে, বিশেষ করে তারা যদি সেই সব বিশেষ ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী হয়ে থাকেন যে ধর্মগুলো পদ্ধতিগতভাবে ব্যক্তিগত অপরাধবোধগুলোকে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই অপব্যবহার করে থাকে তাদের নিজেদের স্বার্থে।

আমার মনে হয়, বেশ অনেকটুকু পরিমান নীচু আত্মসম্মানবোধের প্রয়োজন আছে এমন কোনো কিছু ভাবতে পারার জন্য যে, যদি পৃথিবী থেকে হঠাৎ করেই ঈশ্বর বিশ্বাস সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় আমরা সবাই উদাসীন, দয়ামায়াহীন, অনুদার স্বার্থপর ভোগবাদীতে রুপান্তরিত হবো, ভালো বা শুভ গুণাবলীর কোনো লেশ মাত্র থাকবে না; প্রচলিত ধারণা মতে দস্তয়ইয়েভস্কী (৩৩) এই ধরনের মতামত ধারণ করতেন, সম্ভবত যার কারণ তার সৃষ্ট চরিত্র ইভান কারামাজভ এর মুখে উচ্চারিত কিছু বাক্য (৩৪):

(ইভান) গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে উপলব্ধি করেছিল যে, প্রকৃতিতে এমন কোনো আইন নেই যা মানুষকে মানবতাকে ভালোবাসতে উদ্বুদ্ধ করে এবং সেই ভালোবাসাটার যদি অস্তিত্ব থাকে, বা আজ অবধি পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব থেকে থাকে, তাহলে এটি অবশ্যই কোনো প্রাকৃতিক কারণে নয়, এর কারণ সম্পূর্ণভাবে নিজেদের অমরত্বের প্রতি মানুষের ধারণকৃত বিশ্বাস; এর। পাশাপাশি তিনি যোগ করেন যে, ঠিক সেই জিনিসটাই যা প্রাকৃতিক আইন গঠন করে, যেমন, নিজের অমরত্বের প্রতি মানুষের বিশ্বাস যখন ধ্বংস হয়ে যাবে, শুধুমাত্র তার ভালোবাসার ক্ষমতাই নিঃশেষ হবে না এই পৃথিবীতে জীবনকে টিকিয়ে রাখার মূল প্রেরণাদায়ক শক্তিটিও নিঃশেষ হয়ে যাবে; এবং উপরন্তু তখন কিছুই আর অনৈতিক বলে বিবেচিত হবে না, সবকিছুরই অনুমতি থাকবে এমন কি নরমাংস ভক্ষণও; এবং পরিশেষে, এটুকুই যেন যথেষ্ট না, তিনি ঘোষণা করেন, প্রতিটি মানুষ, যেমন আপনি এবং আমি, যেমন যারা ঈশ্বর বা তার নিজের অমরত্বে বিশ্বাস করেন না, প্রাকৃতিক নিয়মাবলী তাৎক্ষণিকভাবে ধর্ম ভিত্তিক আইন যা এর আগে ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত হতে বাধ্য এবং এই আত্মকেন্দ্রিকতা এমনকি সম্প্রসারিত হয় নানা অপরাধ ঘটানোর প্রেরণাদায়ক হিসাবে, তা শুধু অনুমতিই পাবে না, বরং চিহ্নিত হবে অবশ্য প্রয়োজনীয় হিসাবে, সবচেয়ে যৌক্তিক, এমনকি মানুষের অবস্থান ও অস্তিত্বের সবচেয়ে মহত্ত্বতম কারণ হিসাবে।

হয়তো খানিকটা সরলভাবেই, ইভান কারামাজভের চেয়ে আমি মানব প্রকৃতি সম্বন্ধে অপেক্ষাকৃত কম নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করি। আমাদের কি সত্যি সত্যি নজরদারীর প্রয়োজন আছে, ঈশ্বরের কিংবা একে অপরের– যা আমাদের স্বার্থপর এবং অপরাধী সুলভ আচরণ থেকে বিরত রাখতে পারে? আমি তীব্রভাবে বিশ্বাস করতে চাই যে আমার জন্য এ ধরনের কোনো নজরদারী প্রয়োজন নেই; এবং প্রিয় পাঠকরা, আপনাদেরও প্রয়োজন নেই; আবার অন্যদিকে, আমাদের আত্মবিশ্বাসে খানিকটা ফাটল ধরিয়ে দুর্বল করে স্টিফেন পিংকারের (৩৫) মন্ট্রিয়ল পুলিশ ধর্মঘটের। সময় তার মোহমুক্তির অভিজ্ঞতাটি– যা তিনি তাঁর দ্য ব্ল্যাঙ্ক স্লেট বইটিতে বর্ণনা করেছিলেন:

গর্বিতভাবে শান্তিপ্রিয় কানাডায় কল্পনাবিলাসী ষাটের দশকে অল্পবয়সী কিশোর হিসাবে আমি বাকুনিন (মিখাইল বাকুনিন) এর অ্যানৰ্কিজম বা নৈরাজ্যবাদের একনিষ্ঠ বিশ্বাসী ছিলাম; আমি আমার বাবা-মায়ের যুক্তি, যদি সরকার কোনোদিন তার অস্ত্র সমর্পন করে তাহলে ভয়াবহ নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে, হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম।এই প্রতিদ্বন্দ্বী ভবিষ্যদ্বাণী দুটির পরীক্ষার সম্মুখীন হয় ১৯৬৯ সালের ১৭ অক্টোবর সকাল ৮ টায়, সেদিন যখন মন্ট্রিয়লের পুলিশ বাহিনী তাদের ধর্মঘট শুরু করে। ১১;২০ মিনিটে, প্রথম ব্যাঙ্ক ডাকাতিটি হয়, দুপুরের মধ্যে শহরের সব দোকান পাট বন্ধ হয়ে যায় বেপরোয়া লুটতরাজের ভয়ে আর কয়েক ঘন্টার মধ্যে ট্যাক্সি ড্রাইভাররা একটি লিমোজিন সার্ভিসের গ্যারেজে আগুন জ্বালিয়ে দেয়, যারা তাদের সাথে বিমান বন্দরের খদ্দের নিয়ে দ্বন্দ্বরত ছিল; ছাদের উপরে লকিয়ে থাকা এক বন্দুকধারী একজন পুলিশ অফিসারকে খুন করে, দাঙ্গাবাজরা বেশ কিছু হোটেল আর রেস্টুরেন্ট ভাঙ্গচুর করে, উপশহরে নিজের বাসায় অনুপ্রবেশ করা এক আগন্তুককে গুলি করে হত্যা করে একজন ডাক্তার; দিনের শেষে দেখা যায় মোট ছয়টি ব্যাঙ্ক আর শতাধিক দোকান লুট করা হয়েছে, বারোটি জায়গায় আগুন ধরানো হয়েছে, চল্লিশটি গাড়ি ভর্তি দোকানের সামনের কাঁচ ভাঙ্গা হয়েছে, সম্পদ ধ্বংসের হিসাবে তার পরিমান প্রায় ৩ মিলিয়ন ডলার স্পর্শ করেছিল– নগর কর্মকর্তাদের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনাবাহিনী এবং অবশ্যই কেন্দ্রীয় পুলিশকে তলব করার আগে। এবং তারা যথারীতি ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে; এই সুস্পষ্ট চাক্ষুষ পরীক্ষা আমার রাজনৈতিক চিন্তা আর ধারণাকে এলোমেলো করে দিয়েছিল।

হয়তো আমিও একজন পলিয়ানা (৩৭), (অর্থাৎ অতিমাত্রায় হাসিখুশী আর আশাবাদী মানুষ), ঈশ্বরের পর্যবেক্ষণ আর নজরদারী নিয়ন্ত্রণ ছাড়া মানুষ ভালো থাকতে পারবে এমনটাই যে বিশ্বাস করে। কিন্তু অন্যদিকে মন্ট্রিয়লের বেশীর ভাগ জনগোষ্ঠী মূলত ধর্মবিশ্বাসী, তাহলে ঈশ্বর ভয় কেন তাদেরকে এসব কাজ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি, যখন পৃথিবীর সেই মানব পুলিশরা সাময়িকভাবে দৃশ্য থেকে বিদায় নিয়েছিল? মন্ট্রিয়লের এই পুলিশ ধর্মঘটটি কি খুব ভালো একটি প্রাকৃতিক পরীক্ষা ছিল না, যা আমাদের ঈশ্বর বিশ্বাস আমাদের ভালো মানুষ বানায় এমন হাইপোথিসিসটি হাতে কলমে পরীক্ষা করার সুযোগ করে দিয়েছিল? বা নৈরাশ্যবাদী এইচ, এল, মেনকেন (৩৮) ঠিক বলেছিলেন, যখন তিনি তার বুদ্ধিদীপ্ত তীর্যক পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, মানুষ যখন বলে আমাদের ধর্ম প্রয়োজন যখন তারা আসলে বোঝাতে চায় আমাদের আসলে পুলিশের প্রয়োজন।

স্পষ্টতই মন্ট্রিয়লের সবাই কিন্তু সেদিন খারাপভাবে আচরণ করেননি যখনই দৃশ্য থেকে পুলিশ চলে গিয়েছিল; একটি বিষয় জানা খুব কৌতূহলোদ্দীপক হবে যদি দেখা সম্ভব হয়, সেখানে কোনো ধরনের পরিসংখ্যানগত প্রবণতা আছে কিনা, তা যত সামান্য হোক না কেন, অবিশ্বাসীদের ধর্মবিশ্বাসীদের তুলনায় বেশী লুটপাট এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল কিন?; তবে এ বিষয়ে আমার তথ্যপুষ্টহীন ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে, ঠিক এর বিপরীতটাই ঘটেছে; নৈরাশ্যবাদী সুরে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, ‘ফক্সহোলে কোনো নিরীশ্বরবাদী নেই’ (এটি একটি প্রচলিত প্রবাদ, There are no atheists in foxholes, যা প্রায়শই যুক্তি হিসাবে ব্যবহার করা হয় এই বলে যে, প্রচন্ড বিপদের মুখে, বা চাপে, যেমন বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্রে, প্রত্যেকেই কোনো না কোনো স্বর্গীয় শক্তিতে বিশ্বাস করে বা আশা করে এমন কোনো শক্তির উপস্থিতি আছে); তবে আমি সন্দেহ করতে ইচ্ছা পোষণ করছি (কিছুটা প্রমাণসহ, যদিও সেখান থেকে উপসংহার টানা বেশী সরলীকরণ হয়ে যাবে) জেলখানায় খুব কমই নিরীশ্বরবাদী আছেন; আমি অবশ্যই দাবী করছিনা নিরীশ্বরবাদ নৈতিকতা বৃদ্ধি করে, যদিও হিউম্যানিজম বা মানবতাবাদ– যে এথিকাল বা নীতিগত দর্শনটি নিরীশ্বরবাদীদের সাথে প্রায়ই যুগপৎ অবস্থান করে- সম্ভবত সেই কাজটি করে; আরেকটি ভালো সম্ভাবনা হতে পারে যে নিরীশ্বরবাদীতা আরো একটি তৃতীয় নিয়ামকের সাথে সম্পর্কযুক্ত, যেমন, উচ্চ শিক্ষা, বুদ্ধিমত্তা এবং কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করার প্রবণতা, যা অপরাধ করার প্রবণতাকে প্রতিরোধ করতে পারে; এই ধরনের গবেষণাগত প্রমাণ যতটুকু আছে, সেগুলো অবশ্যই ধর্মীয় বিশ্বাস এর সাথে নৈতিকতার কোনো ইতিবাচক বা ধনাত্মক সম্পর্ক আছে এমন কোনো সাধারণ ধারণাকে সমর্থন করেনা; পারস্পরিক সম্পর্কের বা কোরিলেশন প্রমাণ কখনই চূড়ান্ত নয় ঠিকই তবে নীচের উপাত্তগুলো, যা স্যাম হ্যারিস (৩৯) তার লেটার টু এ ক্রিশ্চিয়ান নেশন’ বইটিতে বর্ণনা করেছিলেন সেগুলো নিঃসন্দেহে দৃষ্টি আকর্ষণ করে (৪০):

যদিও যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক মতাদর্শ কিংবা সংশ্লিষ্টতা ধর্মীয় মানসিকতার একেবারে নির্ভুল সূচক হিসাবে গ্রহন করা যাবে না, তবে বিষয়টি আদৌ গোপন না যে, লাল বা রেড (রিপাবলিকান) অঙ্গরাজ্যগুলো প্রধানত রেড, কারণ সেখানে বসবাসরত বিশেষভাবে রক্ষণশীল খ্রিষ্টানদের সংখ্যাগরিষ্ট রাজনৈতিক প্রভাবের জন্য। যদি খ্রিষ্টীয় রক্ষণশীলতা ও সামাজিক স্বাস্থ্য-সূচকগুলোর মধ্যে কোনো শক্তিশালী সম্পর্ক থাকতো, তবে রেড-স্টেট যুক্তরাষ্ট্রে তার নির্দশন আমাদের দেখতে পারার কথা; যা আমরা কিন্তু দেখি না; যে ২৫ টি শহর, যেখানে ভয়ঙ্কর অপরাধের হার সর্বনিন্ম, তার শতকরা ৬২ শতাংশ অবস্থিত নীল (ডেমোক্র্যাটিক প্রধান আর ৩৮ শতাংশ লাল (রিপাবিলিকান প্রধান) অঙ্গরাজ্যগুলোতে; আর যে পঁচিশটি শহর যেখানে ভয়ঙ্কর অপরাধের হার সবচেয়ে বেশী, সেই তালিকার শহরগুলোর ৭৬ শতাংশ লাল ও ২৪ শতাংশ নীল অঙ্গরাজ্যগুলোতে অবস্থিত; বাস্তবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটি সবচেয়ে অপরাধ প্রবণ শহরের তিনটি অবস্থিত বিশেষভাবে ধার্মিক অঙ্গরাজ্য টেক্সাসে; গৃহ অনুপ্রবেশ ও চুরির হার বেশী এমন শীর্ষ বারোটি অঙ্গরাজ্যে লাল বা রিপাবলিকান প্রধান; এছাড়া চুরির হার বেশী এমন ২৯ টি রাজ্যের ২৪টি লাল; খুনের হারের দিক থেকে শীর্ষে থাকা মোট ২২ টি রাজ্যের মধ্যে ১৭টি লাল (৪১)।

পদ্ধতিগত গবেষণা যদি কিছু থাকে সেটাও এই সম্পর্কগুলোকে সমর্থন করারই প্রবণতা প্রদর্শন করে; জার্নাল অব রেলিজিয়ন অ্যান্ড সোসাইটিতে ২০০৫ এ প্রকাশিত গ্রেগরী এন, পল, তার একটি প্রবন্ধে ১৭ টি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের মধ্যে একটি তুলনামূলক আলোচনা করেন (৪২) এবং ধর্মীয় দাবীকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবার মত একটি উপসংহারে উপনীত হন: উন্নত গণতন্ত্রর দেশগুলোতে সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাসের এবং উপাসনার উচ্চ হার মানব হত্যা, শিশু, কিশোর এবং অল্প বয়সে মৃত্যুর উচ্চ হার, যৌনরোগের প্রাদুর্ভাবের উচ্চ হার, অল্পবয়সে গর্ভধারণ, গর্ভপাতে উচ্চ হার এর সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত; ড্যান ডেনেট, তার ‘ব্রেকিং দ্য স্পেল’ বইটিকে এ বিষয়ে শ্লেষাত্মক মন্তব্য করেছিলেন, যদিও স্যাম হ্যারিসের নির্দিষ্ট এই বইটির তথ্য প্রসঙ্গে না, সাধারণভাবে এ ধরনের গবেষণার ফলাফল নিয়ে।

‘মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন যে, এই ফলাফলগুলো, ধর্মমনাদের মধ্যে নৈতিকতাবোধ অপেক্ষাকৃত বেশী এ ধরনের প্রচলিত দাবীকে এত দৃঢ়ভাবে আঘাত করেছিল যে, পরবর্তীতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গবেষণা হাতে নেয় ধর্মীয় সংস্থাগুলো এই উপসংহার খণ্ডানোর জন্য– একটা বিষয়ে আমরা নিশ্চিৎ হতে পারি যে, যদি নৈতিক আচরণ ও ধর্মীয় সংশ্লিষ্টতা, বিশ্বাস ও আচরণের মধ্যে গুরুত্বপর্ণ কোনো সম্পর্ক থেকে থাকে খুব শীঘ্রই তা জানা যাবে; বিশেষ করে যখন অসংখ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান উৎসাহের সাথে তাদের এই প্রথাগত বিশ্বাসকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন তারা সাধারণত বিজ্ঞানের সত্য সন্ধানের প্রক্রিয়াটি দেখে বেশ মুগ্ধ হন, যখন তারা যা ইতিমধ্যে বিশ্বাস করেন, সেটিকে বিজ্ঞান সমর্থন করে); প্রতিটি মাস অতিক্রান্ত হচ্ছে যখন এ ধরনের কিছু প্রমাণ উপস্থাপন ছাড়া, আসলে এই বিষয়টি সেই সন্দেহের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে, আদৌ সে রকম কিছু হবে না।

চিন্তাক্ষম বেশীর ভাগ মানুষই স্বীকার করবেন, কোনো ধরনের পুলিশের মত নজরদারী ছাড়া বিদ্যমান যে নৈতিকতাবোধ কোনো কোনো ভাবে আসলেই সত্যিকারের নৈতিকতাবোধ, সেই মিথ্যা নৈতিকতাবোধের তুলনায় অনেক শ্রেয়তর। যে মিথ্যা নৈতিকতাবোধ উধাও হয়ে যায় যে মুহূর্তে পুলিশরা ধর্মঘটে যায় বা লুকানো গোপন ক্যামেরা বন্ধ হয়; সেই স্পাই ক্যামেরা সত্যিকারের হোক, যা কিনা পুলিশ নজর রাখে কিংবা স্বর্গে থাকা কোনো কাল্পনিক ক্যামেরাই হোক না কেন। কিন্তু নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে, যদি ঈশ্বর না থাকেন তাহলে ভালো হবার কি প্রয়োজন এই প্রশ্নটি ব্যবচ্ছেদ করা হয়তো পক্ষপাতমুক্ত না (এইচ এল, মেনকেন, আবারও তার বৈশিষ্ট্যসূচক নৈরাশ্যবাদীতায় বিবেককে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন, ভিতরের সেই কণ্ঠস্বর হিসাবে যা আমাদের সাবধান করে দেয় কেউ হয়তো আপনাকে দেখছে)। কোনো ধর্মীয় চিন্তাবিদ হয়তো আরো আন্তরিক কোনো নৈতিকতা পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে পারবেন কাল্পনিক কোনো ধর্মের পক্ষে সাফাই গাওয়া কোনো সমর্থনবাদীদের নীচের বক্তব্যের আদলে.. ‘আপনি যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেন, তাহলে আপনি নৈতিকতার কোনো চূড়ান্ত মানদণ্ডে বিশ্বাস করেন না; পৃথিবী সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম সদিচ্ছা নিয়ে আমি হয়তো ভালো মানুষ হবার চেষ্টা করবেন, কিন্তু আপনি কিভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন কোনোটা ভালো আর কোনোটা খারাপ? শুধু ধর্মই পারে আপনাকে সেই ভালো আর মন্দের চূড়ান্ত মানদণ্ডটি দিতে। ধর্মের অনুপস্থিতিতে আপনাকে এটি প্রয়োজন মাফিক বানিয়ে নিতে হবে; সেই নৈতিকতা হবে কোনো নিয়ম গ্রহুহীন; যখন প্রয়োজন তখন তৈরী করা নৈতিকতা; যদি নৈতিকতা শুধু মাত্র পছন্দ অপছন্দের ব্যপার হয়, তাহলে হিটলারও নিজেকে নৈতিক বলেই দাবী করতে পারে যখন সে তার নিজস্ব ভ্রান্ত জিনগত বিশুদ্ধতা ধারণাপুষ্ট চিন্তাধারার ধারা অনুপ্রাণিত হয়; এবং সব নাস্তিকরা যা করতে পারে তা হলো একটি ব্যক্তিগত পছন্দ বেছে নিতে যা দিয়ে তারা ভিন্নভাবে জীবনযাপন করবে; খ্রিস্টান, ইহুদী বা মুসলিমরা এর ব্যতিক্রম, তারা অশুভ কোনো কিছুর একটি চূড়ান্ত অর্থ দিতে পারে, যা স্থান কাল পাত্র ভেদে অভিন্ন এবং সেটি অনুযায়ী হিটলার চূড়ান্তভাবে অশুভ একটি চরিত্র।

এমন কি যদি সত্যিও হয়, আমাদের নৈতিকতা সম্পন্ন হতে ঈশ্বরের প্রয়োজন আছে, সেটা অবশ্যই ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়না, শুধু তার অস্তিত্বকে বেশী কাঙ্খিত করে তোলে (বেশীর ভাগ মানুষই এই দুটির মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না), কিন্তু সেটা বিবেচ্য বিষয় না এখানে; আমার কাল্পনিক ধর্ম সমর্থনকারী ব্যক্তিটির কোনো প্রয়োজন নেই স্বীকার করার যে ঈশ্বরের তোষামদ করা হচ্ছে তার ভালো কাজ করার ধর্মীয় প্রণোদনা; বরং তিনি দাবী করছেন যে ভালো কিছু করার ‘উদ্দেশ্য যেখান থেকেই আসুক না কেন, ঈশ্বর ছাড়া কোনো মানদণ্ড সিদ্ধান্তকারক নেই যা দিয়ে আমরা নির্ধারন করতে পারি কোনটি ভালো।আমরা প্রত্যেকেই ভালোর একটি নিজস্ব সংজ্ঞা তৈরী করে নিতে পারি এবং সেভাবে আচরণ করতে পারি; শুধু ধর্মের উপর ভিত্তি করে থাকা নৈতিক মূলনীতিকে (এর বীপরিতে ধরুন গোল্ডেন রুল, যা ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট করা হচ্ছে অহরহ কিন্তু তাদের উৎপত্তি অন্য কোথাও বলা যেতে পারে অ্যাবসটিষ্ট বা চূড়ান্তবাদী; ভালো হচ্ছে ভালো আর খারাপ হচ্ছে খারাপ এবং কোন বিশেষ ক্ষেত্রে কি হবে যেমন কেউ কষ্ট সহ্য করছে, তা নিয়ে মাথা ঘামাই না আমরা, আমার ধর্মীয় সমর্থনকারী দাবী করবে যে শুধু ধর্মই পারে কোনটা ভালো, সেটার সিদ্ধান্ত নেবার ভিত্তি রচনা করতে।

বেশ কয়েকজন দার্শনিক, উল্লেখযোগ্যভাবে কান্ট (৪২), চূড়ান্ত বা অ্যাবসোট নৈতিকতার উৎস খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন ধর্মীয় পরিমণ্ডলের বাইরে; যদিও তিনি নিজে একজন ধার্মিক মানুষ ছিলেন, তার সময়ে যা অবশ্যম্ভাবী ছিল (৪৩)। কান্ট নৈতিকতাকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন তার ঈশ্বরের উপর নয় বরং কর্তব্যের খাতিরে কর্তব্য সম্পাদনের উপর; তার বিখ্যাত ক্যাটেগরিক্যাল ইম্পেরাটিভ আমাদের নির্দেশ দেয়: ‘act only on that maxim whereby thou canst at the same time will that it should become a universal law’ (কান্টের নৈতিক দর্শনে কেন্দ্রে আছে ক্যাটেগরিক্যাল ইম্পেটিভ বা Categorical imperative, যা মূলত কোনো কাজের উদ্দেশ্য বা মোটিভেশনকে মূল্যায়ন করার জন্য ব্যবহৃত হয়; তার ভাষায় ইম্পেরাটিভ হচ্ছে যে কোনো একটি প্রস্তাব যা কোনো কাজকে চিহ্নিত করে আবশ্যিক হিসাবে; দুই ধরনের ইম্পেরাটিভ এর প্রস্তাব করেছিলেন তিনি, হাইপোথেটিক্যাল ইমপেরাটিভ (Hypothetical imperative) যার প্রযোজ্য হয় যখন কেউ সেই কাজের উপর নির্ভর করে কোনো একটি নির্দিষ্ট ফলাফল অর্জন করতে; যেমন যদি আমার তৃষ্ণা পায়, আমাকে পান করতে হবে; কিন্তু ক্যাটেগরিক্যাল ইম্পেরাটিভ হচ্ছে কোনো চূড়ান্ত বা অ্যাবসসালুট, নিঃশর্ত প্রয়োজন যা যে কোনো পরিস্থিতিতে যে কারো জন্য প্রযোজ্য, যা প্রয়োজনীয় এবং এর মূল উদ্দেশ্যও সেই কাজটির মধ্যে নিহিত। যে দাবীটির যৌক্তিকতা কোনো উদ্দেশ্য বা ফলাফল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়; যেমন, চুরি করা যাবে না, একটি ক্যাটেগরিকাল ইম্পেটিভ, যা Hypothetical imperative থেকে আলাদা, যেমন, যদি জনপ্রিয় হতে চাও তাহলে চুরি করো না। কান্টের সবচেয়ে বিখ্যাত Categorical imperative টি আমাদের নির্দেশ দেয়, আপনি যদি কোনো কাজ সম্পাদন করতে উদ্যত হন (যা সারারণ নীতি হিসাবে সংজ্ঞায়িত), তাহলে আপনি শুধুমাত্র সেই কাজটি করতে পারবেন, যদি কাজটি করা সবার জন্য সঠিক হয়।)

এটা বেশ ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে মিথ্যা কথা বলার উদাহরণের সাথে। একটি পৃথিবী কল্পনা করুন, যেখানে মানুষ নীতিগত ভাবে মিথ্যা কথা বলে, যেখানে মিথ্যা বলার কাজটিকে একটি ভালো এবং নৈতিক গুণ হিসাবে বিবেচ্য, এই ধরনের পৃথিবীতে, মিথ্যা কথা বলার ব্যপারটারই কোনো অর্থ থাকবে না একসময়। মিথ্যার সংজ্ঞার জন্যেই প্রয়োজন ‘সত্য সম্বন্ধে পূর্বধারণার উপস্থিতি।( মূল ধারণাটি হচ্ছে কোনো একটি কাজ শুধুমাত্র তখনই নৈতিক হবে যদি কোনো পরস্পরবিরোধীতা ছাড়াই সেটিকে সর্বজনীন রুপ দেয়া যেতে পারে। যেমন, আগের পরিস্থিতির রুপ দেই, মিথ্যা বলার অনুমতি আছে, যদি সবাই সবসময় মিথ্যা বলে তাহলে সবাই ধরে নিতে পারবে বাকীরা সবাই সবসময় মিথ্যা বলছে। বিষয়টি মিথ্যা বলা অসম্ভব করে তোলে, কারণ বাকী সবাই আগেই থেকে জানে আপনি সত্য কথা বলছেন না। সুতরাং এখানে অসঙ্গতিটা আছে, সেকারণে মিথ্যা বলা অনৈতিক।) যদি কোনো নৈতিক মূলনীতি হচ্ছে এমন কিছু যা কিনা সবাই অনুসরণ করবে বলে আমরা ইচ্ছা পোষণ করে থাকি, তাহলে মিথ্যা কথা বলা কখনোই নৈতিক মূলনীতি হতে পারবে না কারণ এই মূলনীতিটি নিজেই এর অর্থহীনতার কারণে অকেজো হয়ে পড়বে; মিথ্যা কথা বলা, জীবনের একটি আইন হিসাবে, অন্তর্গতভাবেই অস্থিতিশীল; আরো সাধারণ অর্থে, স্বার্থপরতা বা ফ্রি-রাইডিং বা বিনাশ্রমে আরেকজনের সদিচ্ছার উপর ভর করে নিজের উপকার আদায় করে নেয়া বা পরজীবিতা হয়তো আমার একার জন্য কাজ করবে, একজন একাকী স্বার্থপর ব্যক্তি হিসাবে এবং আমার নিজেকে ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি দেবে; কিন্তু নিশ্চয়ই আমি আশা করতে পারিনা যে নৈতিক মূলনীতি হিসাবে সবাই স্বার্থপর পরজীবিতার নীতি অনুসরণ করবে, এর কারণ শুধুমাত্র একটি হলেও তাহলো, কারো উপর তাহলে আমি আমার পরজীবিতার জীবন চাপিয়ে দিতে পারবো না।

কান্টীয় ইম্পেটিভ বা আবশ্যিকতাগুলো আপাতদৃষ্টিতে কাজ করে, সত্যি কথা বলা এবং অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে; খুব সহজ নয়। এটা বোঝা যে এই ধারণাটিকে কিভাবে সামগ্রিকভাবে সাধারণ নৈতিকতার ক্ষেত্রেও সম্প্রসারণ করা যায়; কান্ট সত্ত্বেও, আমার সেই কাল্পনিক ধর্মীয় সমর্থকের সাথে একমত হবার প্রতি একটি প্রলোভন কাজ করে তা হলো চরম বা অ্যাবসটিষ্ট নৈতিকতার বিষয়গুলো সাধারণত পরিচালনা করে থাকে ধর্ম; কোনো অনারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত মুমুর্ষ রোগীর নিজের অনুরোধের উপর ভিত্তি করে তাকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়াটা কি আসলেই সবসময় ভুল হবে? একই লিঙ্গের কারো সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়াটি আসলেই কি সবসময় ভুল হবে? কোনো একটি জ্বণকে হত্যা করা কি আসলেই সবসময় ভুল? অবশ্য এমন মানুষ আছেন যারা ঠিক তাই বিশ্বাস করেন এবং তারা এর বিরুদ্ধে কোনো তর্ক বা যুক্তির জায়গা রাখেন না; তারা মনে করে, যারা এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করবেন তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা যেতে পারে: অবশ্যই রুপকার্থে, আক্ষরিক অর্থে না শুধু মাত্র আমেরিকার অ্যাবরশন ক্লিনিকের কিছু চিকিৎসক ছাড়া (পরবর্তী অধ্যায়ে দেখুন); সৌভাগ্যজনকভাবে যদিও নৈতিকতার কোনো বিষয়কে যে চূড়ান্তই হতে হবে এমন কোনো কারণ নেই।

নীতিশাস্ত্রের দার্শনিকরা হচ্ছেন মূলত পেশাজীবি দার্শনিক, যারা কোনটি ভালো আর কোনটি খারাপ সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করেন; রবার্ট হিন্ড চমৎকারভাবে যা বলেছিলেন, তারা একমত যে, নৈতিক ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর যুক্তি দ্বারা তৈরী হতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই, তবে তা যুক্তি দিয়ে রক্ষা করতে পারার মত অবশ্যই হতে হবে (৪৪)। নীতিশাস্ত্রের দার্শনিকরা নিজেদেরকে নানাভাবে শ্রেণীবিন্যাস করে থাকেন, তবে আধুনিক শব্দমালায় মূল বিভাজনটি হচ্ছে: deontologists বা ডিওন্টোলজিষ্ট (যেমন কান্ট) এবং consequentialists বা কনসিকোয়েন্সশিয়ালিস্ট (যেমন উটিলিটারিয়ান, জেরেমি বেনথাম, ১৭৪৮-১৮৩২)। ডিওন্টোলজী হচ্ছে সেই বিশ্বাসের একটি পোষাকী নাম, যা দাবী করে নৈতিকতা মূলত বিধি বা নিয়ম মেনে চলা, আক্ষরিক অর্থে এটি কর্তব্যের বিজ্ঞান, শব্দটির গ্রিক অর্থ ‘যা কিছুর শর্ত দেয়া আছে’; ডিওন্টোলজী কিন্তু নৈতিক চরমবাদীতার মত একই জিনিস নয়, কিন্তু বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ম বিষয়ক কোনো বইয়ে এই দুটির পার্থক্য নিয়ে সময় নষ্ট করার কোনো প্রয়োজন নেই; চরমবাদীরা বিশ্বাস করেন, সঠিক এবং ভুলের নিরঙ্কুশ বা চূড়ান্ত একটি অবস্থান আছে; যে অবশ্য কর্তব্য বা ইম্পেটিভগুলো যাদের দঢ় আঁটসাঁট বাধুনী তাদের ফলাফল বা পরিণতি সম্পর্কে কোনো ধরনের তথ্য দেয় না; পরিণতিবাদী বা। কনসিকোয়েন্সশিয়ালিস্টরা আরো প্রাগম্যাটিক বা প্রয়োগবাদী মানসিকতায় বিশ্বাস করে যে, কোনো একটি কাজের নৈতিকতাকে বিচার করা যাবে তার পরিণতি বা ফলাফল বিচার করার মাধ্যমে; কনসিকোয়েন্সশিয়ালিস্টদের একটি সংস্করণ হচ্ছে উপযোগিতাবাদ বা ইউটিলিটারিয়ানিজম, বেনথাম (৪৫) ও তার বন্ধু জেমস মিলস এর ছেলে জন স্টুয়ার্ট মিলস (৪৬) সাথে যে দর্শন সংশ্লিষ্ট। উপযোগিতাবাদের এর সারাংশটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রায়শই বেনথামের খানিকটা অসঠিক মন্তব্য দিয়ে প্রকাশ করা হয়: ‘সবচেয়ে বেশী সংখ্যক মানুষের জন্য সবেচেয়ে বেশী সুখ হচ্ছে নৈতিকতা এবং আইনের মূল ভিত্তি’ (৪৭)।

সব চূড়ান্তবাদ কিন্তু ধর্ম থেকে আসেনি; তাসত্ত্বেও, চরমবাদীদের নৈতিকতাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ছাড়া অন্য কোনো প্রেক্ষাপটে বিচার করাটা খুব কঠিন; একটি প্রতিদ্বন্দ্বী যা আমি চিন্তা করতে পারি তা হলো ‘দেশপ্রেম, বিশেষ করে যুদ্ধের সময়; বিখ্যাত স্পেনের চিত্র পরিচালক লুইস বুনুয়েল বলেছিলেন, “ঈশ্বর এবং দেশ হচ্ছে অপরাজিত একটি টিম; তারা নিপীড়ন এবং রক্তপাতের সকল রেকর্ড ভঙ্গকারী। সেনাবাহিনীর নিয়োগকর্তারা বিশেষভাবে নির্ভর করেন তাদের শিকারদের দেশপ্রেমের উপর; প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নারীরা যে সমস্ত তরুণরা সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়নি তাদের সাদা পালক বিতরণ করতো এই বলে যে:

ওহ, আমরা তোমাদের হারাতে চাইনা, কিন্তু আমরা মনে করি তোমাদের যুদ্ধে যাওয়া উচিৎ, কারণ রাজা এবং দেশ উভয়েরই প্রয়োজন আছে তোমরা যেন সেভাবে দ্বায়িত্ব নাও।

যারা কনসায়েনশাস অবজেক্টর বা বিবেকের তাড়নায় যুদ্ধে অংশগ্রহন করেনি, তাদের মানুষ ঘৃণা করেছিল, এমন কি যারা দেশের শক্র তাদের ক্ষেত্রেও। কারণ দেশপ্রেমকে চূড়ান্ত বা অ্যাবসট গুণ হিসাবে মনে করা হয়, কোনো পেশাগত সৈন্যর বিশ্বাস করা ‘সঠিক কিংবা ভুল হোক আমার দেশ’ এর চেয়ে চূড়ান্ত কিছু খুঁজে পাওয়া কঠিন; কারণ এই শ্লোগান আপনাকে বাধ্য করবে যে কাউকে হত্যা করার জন্য, যাকে ভবিষ্যতে কোনো রাজনীতিবিদরা হয়তো শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করবে; পরিণতিবাদী যুক্তিতর্ক হয়তো যুদ্ধে যাবার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তটিকে প্রভাবিত করতে পারে কিন্তু একবার যখন যুদ্ধ ঘোষণা হয়, চূড়ান্ত দেশপ্রেম তার দৃঢ় শক্তি দিয়ে সব কিছু অধিগ্রহন করে, যে ধরনের শক্তি সাধারণত ধর্মের বাইরে দেখা যায় না; একজন সৈন্য যে তার নিজস্ব পরিণতিবাদী চিন্তাকে অনুমতি দেয় বেশী বাড়াবাড়ি না করতে, তার নিজেকে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি দেখবার ও এমনকি মৃত্যুদণ্ডে প্রাণ হারাবার সম্ভবনা বেশী।

নৈতিক দর্শন নিয়ে এই আলোচনার সূত্র ছিল ধর্মবাদীদের একটি হাইপোথেটিক্যাল দাবী যে, ঈশ্বর ছাড়া, নৈতিকতা হচ্ছে আপেক্ষিক এবং কাল্পনিক; কান্ট এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত নীতিশাস্ত্রের দার্শনিকরা বাদে এবং দেশপ্রেমের অনুভূতির তীব্রতার প্রতি যথাযোগ্য নজরসহ, চূড়ান্ত বা চরমবাদী নৈতিকতার শ্রেয়তর উৎস হচ্ছে সাধারণত কোনো না কোনো একটি পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ, যাদের ব্যাখ্যা করা হয় এমন কর্তৃত্বশালী হিসাবে যার কর্তৃত্ব ইতিহাসের যৌক্তিকতা প্রমাণের তোয়াক্কা করে না; আসলেই ধর্মগ্রন্থের কর্তৃত্বের অনুসারীরা হতাশাজনকভাবে তাদের ধর্মগ্রন্থের ঐতিহাসিক উৎপত্তি সম্বন্ধে খুব সামান্যই কৌতূহল প্রদর্শন করে (সাধারণত যা খুবই সন্দেহজনক)।

পরবর্তী অধ্যায়ে যে বিষয়টি প্রদর্শন করবে তাহলো যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক না কেন, যে মানুষগুলো দাবী করে তাদের নৈতিকতাবোধগুলো তারা পেয়েছে ধর্মগ্রন্থ থেকে, তারা আসলে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তা কিন্তু ব্যবহার করছে না; এবং সেটি অবশ্যই ভালো, যা তারা নিজেদেরও, বিষয়টি নিয়ে কিছুটা ভাবলে সত্যটি স্বীকার করে নেয়া উচিৎ।

পাদটীকা:

(১) ওয়েজ স্ট্রাটেজী রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মপন্থা যার সূচনা করেছে ডিসকভারী ইন্সস্টিটিউট, যে প্রতিষ্ঠানটি ইন্টেলিজেন্ট মতবাদের মূল কেন্দ্র। এই কৌশলটি বর্ণিত হয়েছে ডিসকভারী ইন্সস্টিটিউট এর ইশতেহারে, যা পরিচিত ওয়েজ ডকুমেন্ট নামে (Wedge Document)। এই ডকুমেন্টটি মূলত ব্যাখ্যা করেছে একটি ব্যাপক সামাজিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষাভিত্তিক কর্মপন্থা যার মূল উদ্দেশ্য বস্তুবাদিতা, প্রকৃতিবাদ এবং বিবর্তনের ধারণার বিরোধিতা করা। ওয়েজ রুপকটি এসেছে ফিলিপ ই জনসন এর নিকট থেকে এবং রুপকটি মূলত একটি ধাতু নির্মিত গোঁজ, যা কোনো কাঠের গুঁড়িকে চিরে দুই টুকরো করছে, এটি প্রতিনিধিত্ব করছে আগ্রাসী জনসংযোগ কর্মসূচীর যা একই ভাবে জনগনের বিজ্ঞান সংক্রান্ত ধারণার মধ্যে অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলোর প্রবেশ করার একটি পথ সৃষ্টি করতে পারে। মূল বিষয়টি হচ্ছে সৃষ্টিতত্ত্ববাদী বা ক্রিয়েশনিষ্টরা ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের ছদ্র রুপে ওয়েজ স্ট্রাটেজী ব্যবহার করে ছলনার কৌশল নিয়ে বিজ্ঞান শিক্ষার মধ্যে প্রবেশ করতে চাইছে।

(২) বারবার ক্যারল ফরেষ্ট, যুক্তরাষ্ট্রের দার্শনিক।

(৩) পল গ্রস, জীববিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান লেখক।

(8) Creationism’s Trojan Horse: The Wedge of Intelligent Design, Barbara Forrest and Paul R. Gross.

(৫) সঠিকভাবে উত্তর দেবার ইচ্ছা সত্ত্বে সংখ্যায় যার পরিমান অনেক বেশী, এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

 (৬) ব্রায়ান ফ্লেমিং, আমেরিকার চিত্রপরিচালক, লেখক, নাট্যকার এবং অ্যাক্টিভিষ্ট।

(৭) The God Who Wasn’t There, documentary film, Brian Flemming.

(৮) রবার্ট বাকমান (১৯৪৮-২০১১) ব্রিটিশ কানাডিয়ান চিকিৎসক, লেখক, টিভি উপস্থাপক।

 (৯) https://ffrf.org/publications/freethought-today

(১০) “Cheese-eating surrender monkeys”, কখনো সংক্ষিপ্তরুপে “surrender monkeys” ব্যঙ্গাত্মক শব্দ যা ফরাসীদের প্রতি নির্দেশ করে। ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় টেলিভিশন ধারাবাহিক The Simpsons এ উচ্চারিত হয়েছিল, লেখক কেন কিলার এর মাধ্যমে।

(১১) আলবেয়ার্ত কামু, ফরাসী লেখক ও দার্শনিক।

(১২) Unweaving the Rainbow, Richard Dawkins

(১৩) Robert Hinde. Why Good is Good: the Sources of Morality

(১৪) Michael Shermer. The Science of Good and Evil: Why People Cheat, Gossip, Care, Share, and Follow the Golden Rule

 (১৫) Rob Buckman. Can We be Good Without God? Biology, Behavior, and the Need to Believe.

(১৬) মার্ক ডি হাউজার, বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, হিউম্যান ও অ্যানিম্যাল কগনিশন গবেষণায় অগ্রদুত।

(১৭) Marc Hauser, Moral Minds: How Nature Designed Our Universal Sense of Right and Wrong.

(১৮) আমি রীতিমত শঙ্কিত হয়েছিলাম গার্ডিয়ান পত্রিকায় ( অ্যানিমাল ইনস্টিস, ২৭ মে ২০০৬) পড়ে যে কুখ্যাত এনরন কর্পোরেশনের সিইও জেফ স্কিলিং এর প্রিয় বই হচ্ছে দ্য সেলফিশ জিন এবং এর সোস্যাল ডারউইনিজমের একটি রুপ থেকে তিনি নাকি অনুপ্রাণিত হয়েছেন। গার্ডিয়ানের সাংবাদিক রিচার্ড কনিফ এই ভুল বোঝাবুঝির একটি ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এখানে: http://money. guardian.co.uk/ workweekly/ story/o,,1783900,00.html; আমিও ভবিষ্যতে এধরনের ভুল বোঝার সম্ভাবনাকে প্রতিহত করার জন্য অক্সফার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের দ্য সেলফিশ জিন এর ত্রিশতম প্রকাশনা বার্ষিকী সংস্করণের ভূমিকায় এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছি।

(১৯) উইলিয়াম ডোনাল্ড ‘বিল’ হ্যামিলটন (১৯৩৬-২০০০) ব্রিটিশ বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, তাঁকে বিংশ শতাব্দীর সেরা বিবর্তন তাত্ত্বিক হিসাবে মনে করা হয়।

 (২০) রবার্ট ট্রিভার্স, যুক্তরাষ্ট্রের বিবর্তন জীববিজ্ঞানী ও তাত্ত্বিক।

(২১) ম্যাথিউ রিডলি, ব্রিটিশ সাংবাদিক,রাজনীতিবিদ,লেখক।

(২২) Matt Ridley. The Origins of Virtue: Human Instincts and the Evolution of Cooperation.

 (২৩) রেপুটেশন বা সুনামের ব্যপারটি শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; সম্প্রতি দেখা গেছে এটি প্রাণী জগতে পারস্পরিক পরার্থবাদীতার অন্যতম একটি ধ্রুপদী উদহারণের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করে করা যায়: ক্ষুদ্র ক্লিনার ফিস এবং তাদের খদ্দের বড় মাছের পারস্পরিক মিথোজীবিতা সম্পর্কে একটি অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষার মাধ্যমে গবেষকরা লক্ষ করেছেন যে, একক কোনো ক্লিনার র‍্যাস মাছকে (Labroides dimidiatus) যখন কোনো সম্ভাব্য খদ্দের লক্ষ করে যে সে খুব ভালোভাবে তার কাজটি করছে আর তার অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী Labroides dimidiatus, তার কাজে অবহেলা করছে, এদের দুজনের মধ্য থেকে তাদের খদ্দের বড় মাছগুলোর পরিশ্রমী Labroides dimidiatus কে বেছে নেবার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তথ্যসূত্র: R. Bshary and A. S, Grutter, Image scoring and cooperation in a cleaner fishmutualism, Nature 441, 22 June 2006,

(২৪) থরস্টেইন বুন্ড ভেলেন (১৮৫৭-১৯২৯), নরওয়ে আমেরিকার অর্থনীতিবিদ।

(২৫) আমোজ জাহাভী (জন্ম ১৯২৮) ইসরায়েলী বিবর্তন জীববিজ্ঞানী।

(২৬) Potlatch Effect

(২৭) অ্যালেন গ্রাফেন, অক্সফোর্ড এর প্রাণীবিজ্ঞানের অধ্যাপক, তাত্ত্বিক জীববিজ্ঞানী।

(২৮) Turdoides squamiceps

(২৯) উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের একটি নাটক:

কিন্তু দয়ার গুণাবলী থাকে অক্ষুণ্ণ, শান্ত বৃষ্টির ধারার মতই এটি স্বর্গ থেকে নীচে মর্তে নেমে আসে;

(৩০) উইলিয়াম শেক্সপিয়ার এর রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নাটকে দুই দ্বন্দ্বরত পরিবার।

(৩১) পিটার সিংগার,অষ্ট্রেলিয় দার্শনিক।

(৩২) M, Hauser,P. Singer, ‘Morality without religion’, Free Inquiry 26:1, 2006, 18-19.

(৩৩) ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়ইয়েভস্কী (১৮২১-১৮৮৮) রুশ ঔপন্যাসিক, গল্পলেখক,সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক।

(৩৪) F. Dostoevsky. The Karamazov Brothers. Oxford: Oxford University Press. (1994: bk 2, ch. 6, p. 87).

 (৩৫) স্টিভেন পিংকার, কানাডিয়-আমেরিকান কসনিটিভ সায়েন্টিষ্ট ও এক্সপেরিমেন্টাল সাইকোলজীষ্ট, লেখক।

 (৩৬) S. Pinker. The Blank Slate,, (2002). New York, NY: Viking.

 (৩৭) পলিয়ানা হচ্ছে এমন কেউ যার অদম্য আশাবাদ আছে, সবকিছুর মধ্যে কিছু না কিছু ভালো খোঁজার প্রবণতা আছে। শব্দটির উৎপত্তি পলিয়ানা (Pollyanna), Eleanor Porter এর ১৯১৩ সালে প্রকাশিত Pollyanna উপন্যাসের নায়িকা।

(৩৮) এইচ, এল, মেনকেন (১৮৮০-১৯৫৬) আমেরিকার সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।

(৩৯) স্যাম হারিস, যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুবিজ্ঞানী এবং দার্শনিক লেখক।

(৪০) Letter to a Christian Nation: Sam Harris

(৪১) লক্ষ করুন এই লাল আর নীল রঙ এর বন্টন যা অ্যামেরিকায় আমরা দেখি, ব্রিটেন এ কিন্তু তা ঠিক এর বিপরীত, যেখানে নীল হচ্ছে কনজারভেটিভ পার্টির রঙ, এবং লাল, সারা পৃথিবীর মতই ঐতিহ্যগত ভাবে রাজনৈতিক বাম মতাদর্শদের সাথে সম্পর্ক যুক্ত।

 (৪২) Gregory S. Paul. Cross-National Correlations of Quantifiable Societal Health with Popular Religiosity and Secularism in the Prosperous Democracies. Journal of Religion & Society Volume (2005)। 1522-5658 (http://moses.creighton.edu/jrs/2005/2005-11.pdf)

 (৪২) ইমানুয়েল কান্ট: জার্মান দার্শনিক

 (৪৩) এটি কান্টের দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর একটি মানসম্পন্ন ব্যাখ্যা; তবে বিখ্যাত দার্শনিক এ সি গ্রেলিং ব্যাখ্যা সহ যুক্তি দিয়েলেন (নিউ হিউম্যানিষ্ট জুলাই-আগষ্ট ২০০৬)) যে, যদি কান্ট বাহ্যিকভাবে তার সময়ে ধর্মীয় প্রধান সব আচার অনুষ্ঠানই মেনে চলতেন তবে তিনি আসলে সত্যি একজন নাস্তিক ছিলেন।

(88) Hinde, R. A. Why Good Is Good: The Sources of Morality.London: Routledge

(৪৫) জেরেমী বেনথাম (১৭৪৮-১৮৩২) ব্রিটিশ দার্শনিক, আধুনিক ইউটিলিটিটারিয়ানিজম এর জনক।

(৪৬) জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-১৮৭৩) ব্রিটিশ দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, তাত্ত্বিক।

(৪৭) Greatest happiness of the greatest number is the foundation of morals and legislation

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *