০৫. ধর্মের শিকড়

পঞ্চম অধ্যায়– ধর্মের শিকড়

একজন বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সর্বজনীন আড়ম্বরময় বাহুল্যতা এবং সময়, সম্পদ, কষ্ট এবং আত্মবিসর্জনের মানদণ্ডে তাদের মূল্যে, মানড্রিলের পশ্চাৎদেশের মতই সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়া উচিৎ যে ধর্ম হয়তো অভিযোজনীয় একটি কৌশল।
— মারেক কোন (১)

ডারউইনীয় আবশ্যিকতা

ধর্ম কোথা থেকে আসলো এবং কেন প্রতিটি মানব সংস্কৃতিতে বিষয়টি বিদ্যমান এ বিষয়ে সবারই নিজস্ব কোনো না কোনো পছন্দের তত্ত্ব আছে। এটি আমাদের সান্ত্বনা দেয়, স্বস্তি দেয়; গোষ্ঠী অভ্যন্তরে সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা আর নৈকট্যকে লালন করে। কেন আমরা বেঁচে আছি? অস্তিত্বের এই প্রশ্নের উত্তরটিকে বোঝার জন্য এটি আমাদের তীব্র আকাঙ্খাকে সন্তুষ্ট করে। আমি কিছুক্ষণ পরেই এই সব তত্ত্বগুলোর ব্যাখ্যা দেবো, কিন্তু তার আগে আমি একটি পূর্ববর্তী প্রশ্ন দিয়েই শুরু করতে চাই, যে প্রশ্নটি অগ্রাধিকার পাবে বিভিন্ন কারণে, যা আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখবো: সেটি প্রাকৃতিক নির্বাচন সংক্রান্ত একটি ডারউইনীয় প্রশ্ন।

আমরা যে ডারউইনীয় বিবর্তনের ফসল সেই বিষয়টি মনে রেখেই, আমাদের প্রশ্ন করা উচিৎ, প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আরোপিত কোন চাপ বা চাপসমূহ মূলত ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি আমাদের তাড়নাকে উৎসাহিত করেছে। এই প্রশ্নটা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সাধারণ ডারউইনীয় বিবেচনায় মিতব্যয়িতা অর্থাৎ অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে। ধর্ম এত বেশী অপচয়পূর্ণ, বাহুল্যময় এবং ডারউইনীয় নির্বাচন স্বভাবগত প্রক্রিয়ায় যে কোন ধরনের অমিতব্যয়িতাকে এর নিশানা করে ও নির্মূল করে। প্রকৃতি খুবই কুপন স্বভাবে একজন হিসাব রক্ষকের মত, যে প্রতিটি পয়সা যেন টিপে টিপে খরচ করে, সময়ের দিকে নজর রেখে, সামান্যতম বাহুল্যতাকে যে শাস্তি দেয়; যেমন ডারউইন ব্যাখ্যা করেছিলেন, “অবধারিত এবং অবিরামভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রতি দিন, প্রতি ঘন্টায় সারা বিশ্বজুড়ে এর নজরদারী অব্যাহত রাখে, প্রতিটি বৈচিত্রতা, তা যত সামান্যই হোক না কেন; যা ক্ষতিকর সেগুলো বর্জন করে, এবং রক্ষা ও ক্রমশ জমা করতে থাকে যা কিছু উপকারী; নীরবে, অনুভূতিহীনভাবে সে কাজ করে যাচ্ছে, যেখানে এবং যখনই সেই সুযোগ আসছে, প্রতিটি জীবের উন্নতির লক্ষ্য। যদি কোনো বন্য জীব স্বভাববশত প্রতিদিনই অর্থহীন কোনো কর্মকাণ্ড করে যেতে থাকে, প্রাকৃতিক নির্বাচন তার প্রতিদ্বন্দ্বী সদস্যদের বিশেষ সহায়তা করবে যারা তাদের সময় এবং শক্তি ও শ্রম, অর্থহীন কোনো কর্মকাণ্ডর পরিবর্তে বরং ব্যয় করে বেঁচে থাকা ও বংশ বিস্তারের জন্য। খামখেয়ালী অপ্রয়োজনীয় কাজ বা Jeux d’espirit কে প্রশ্রয় দেয়ার কোন উপায় নেই প্রকৃতির। নিষ্ঠুর উপযোগিতাবাদেরই জয় হয়, এমনকি যখন আপাতদৃষ্টিতে বহু ক্ষেত্রে সেরকম কিছু হচ্ছে বলে আমাদের কাছে মনে হয় না।

প্রথম দৃষ্টিতে মনে হবে, ময়ুরের পুচ্ছ হচ্ছে অন্যতম সেরা খামখেয়ালী একটি ইচ্ছার উদাহরণ। নিশ্চয়ই এটি এর বাহককে বেঁচে থাকার জন্য কোনো বাড়তি সুবিধা প্রদান করছে না। কিন্তু এটি অবশ্যই সহায়তা করছে এর বাহকের জিনকে, কম দৃষ্টিনন্দন কিংবা বিশেষত্ব সম্পন্ন পুচ্ছসহ অন্য বাহক থেকে পৃথক করার মাধ্যমে। ময়ুরের এই পুচ্ছ আসলে বিজ্ঞাপন, যা তাকে তার প্রজনন সঙ্গিনীকে আকর্ষণ করার জায়গাটা ক্রয় করার সুযোগ করে দেয় প্রকৃতির অর্থনীতিতে। এবং বিষয়টি ঠিক একই ভাবে সত্য পুরুষ বোয়ার (২) পাখিদের ক্ষেত্রে, যারা বিস্ময়কর পরিমান শ্রম ও সময় ব্যয় করে তাদের বোয়ার তৈরী করতে : বোয়ার হচ্ছে গাছের ডালপালা দিয়ে তৈরী একটি স্থাপনা, যাকে বলা যায় একধরনের শরীরের বাইরে তৈরী করা পুচ্ছ, যা পুরুষ বোয়ার পাখীরা গাছের ডাল, ঘাস, রঙ্গীন কোনো ফল বা বেরী, এবং যদি পাওয়া যায় নানা রঙ্গের পুতি, বোতলে ছিপি বা কোনো রঙ্গীন কোনো কিছু দিয়ে সাজায় নারী বোয়ার পাখিকে আকর্ষণ করার জন্য। বা আরো একটি উদাহরণ পছন্দ করা যেতে পারে, যা এরকম কোনো বিজ্ঞাপন এর সাথে জড়িত না, যেমন, অ্যান্টিং (৩), বেশ কিছু পাখিদের অদ্ভুত একটি অভ্যাস আছে সেটি হলো, হলো ‘পিপড়ার ডিবি’তে ‘গোছল করা বা অন্য কোনো উপায়ে পাখিগুলো তাদের নিজেদের ডানায় পিপড়াদের ছড়িয়ে দেবার প্রক্রিয়া। কেউই নিশ্চিৎ না এই কাজটা করার কি উপকারিতা আছে– হতে পারে এটি কোনো ধরনের স্বাস্থ্য রক্ষার একটি উপায়, পালক থেকে পরজীবি জীবাণুগুলো পরিষ্কার করার একটি প্রক্রিয়া; আরো অনেক হাইপোথিসিস আছে এ বিষয়ে, কিন্তু কোনোটারই সপক্ষে তেমন কোনো জোরালো প্রমাণ আপাতত নেই। কিন্তু এধরনের কোনো খুঁটিনাটি বিষয়ে অনিশ্চয়তা কখনোই (এবং কখনোও উচিৎ না) কোনো ডারউইনবাদীদের বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে ধারণা করতে কোনো বাধা দেয়না যে, এই অ্যান্টিং এর অবশ্যই কোনো কারণ আছে। এই ক্ষেত্রে আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানও হয়তো একমত হবে, কিন্তু ডারউইনীয় যুক্তির এভাবে চিন্তা করার কিছু নির্দিষ্ট কারণ আছে, যেমন, যদি পাখীরা এভাবে কাজটি না করে, তাহলে হয়তো দেখা যেতে পারে তাদের জিনগত সাফল্যের পরিসংখ্যানগত প্রত্যাশিত সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, এমন কি যদিও আমরা বর্তমানে জানিনা ঠিক কিভাবে এই ক্ষতিটি হতে পারে। কারণ এই উপসংহারের মূলে আছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের জোড় ভিত্তিটি, প্রাকৃতিক নির্বাচন, সময় এবং শক্তি, এ দুটোর অপচয়কেই শাস্তি দেয় এবং এই সব পাখীদের সময় এবং শক্তি ব্যয় করে অ্যান্টিং করতে দেখা যায় নিয়মিতভাবেই। যদি এক বাক্যের কোনো ম্যানিফেষ্টো দিয়ে এই অ্যাডাপশনিষ্ট বা অভিযোজনবাদী মূলমন্ত্রকে প্রকাশ করা যায়, কোনো সন্দেহ নেই এটিকে চূড়ান্ত এবং বাড়াবাড়ি রকমের গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ। করেছিলেন হার্ভার্ড এর বিখ্যাত জিনতত্ত্ববিদ রিচার্ড লিওনটিন: ‘আমার মনে হয় এই বিষয়ে বিবর্তনবাদীরা সবাই একমত হবেন যে, তাদের নিজস্ব পরিবেশে কোনো একটি জীব অভিযোজনের জন্য যা করছে তারচেয়ে আরো ভালো কোন ভাবে সেই কাজটি করা প্রায় অসম্ভব’ (৪)। যদি অ্যান্টিং এর আচরণটি বেঁচে থাকার এবং প্রজনন এই দুটি ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক উপযোগিতা না রাখতে, বহু আগেই প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রজাতির যে সদস্যরা এটি করছে না তাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাতো। একজন ডারউইনবাদীও ধর্ম সম্বন্ধে সেভাবে বলার জন্য কোনো তাড়না অনুভব করতে পারেন, আর সে কারণেই এই আলোচনা।

একজন বিবর্তনবাদীর কাছে ধর্মীয় আচারগুলো সূর্যের আলোয় উদ্ভাবিত বনের কোনো খোলা মাঠে ঝকমক করে দৃষ্টি আকর্ষণ করা ময়ুরের পেখম (ড্যান ডেনেট এর ভাষায়) এর মতই মনে হতে পারে। ধর্মীয় আচরণ অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবেই পাখিদের অ্যান্টিং বা বোয়ার বানানো মত কাজগুলোর মনুষ্য সমতুল্য একটি কাজ। অবশ্যই এই কাজটি সময় সাপেক্ষ, শক্তি খরচকারী, প্রায়ই অতিমাত্রায় বাহুল্যপূর্ণ বা আলঙ্কারিক, বার্ড অব প্যারাডাইসের পালকপুঞ্জের মতই। কখনো ধর্ম, কোন ধার্মিক ব্যক্তির জন্য এবং এমন কি অন্যদের জন্যও জীবন নাশক হতে পারে; লক্ষ হাজার মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার করা হয়েছে কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি তাদের প্রদর্শিত আনুগত্যের জন্য, অতি উৎসাহী ধর্মান্ধদের হাতে তাদের সহ্য করতে সীমাহীন নিপীড়ন হয়তো এমন কোনো বিশ্বাসের জন্য যা প্রায় ক্ষেত্রেই বিকল্প অন্য বিশ্বাসটি (যাদের অনুসারীদের হাতে নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে) থেকে খুব সামান্যই আসলে ভিন্ন। ধর্ম অর্জিত সম্পদকে গ্রাস করে, এবং কখনো তার মাত্রা অতিরিক্ত। মধ্যযুগীয় কোনো ক্যাথিড্রাল বানানোর জন্য শত মানুষের শতাব্দী কালব্যাপী পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়, অথচ সেই স্থাপনাটি যার পেছনে এত সময়, শ্রম আর সম্পদের ব্যবহার হচ্ছে, সেই স্থাপনাটি কখনোই বসবাসের জন্য বা স্বীকৃত এমন কোনো উপযোগী কারণেও নির্মাণ করা হয় না। এটা তাহলে এক ধরনের স্থাপত্যকর্মের ময়ুর পুচ্ছ? যদি তাই হয়, তাহলে এর বিজ্ঞাপনটি কাদের প্রতি নির্দেশিত। পবিত্র ভক্তিসঙ্গীত এবং ভক্তিময় চিত্রকলা মধ্যযুগীয় এবং রেনেসাঁর প্রতিভায় প্রায় একচেটিয়া প্রভাব ফেলেছিল। ভক্তিপূর্ণ ধর্মে নিবেদিত কোনো মানুষ তার ঈশ্বরের জন্য যেমন মরতেও পারে, অন্যকেও অনায়াসে মারতেও পারে। তারা নিজেদের চাবুক দিয়ে পিটিয়ে শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করে রক্তক্ষরণ করে, বা কঠোরতম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় আজীবন কুমার হয়ে একাকী নির্জনতায় জীবন কাটাতে, সবই ধর্মের জন্য নিবেদিত। কেন? কিসের জন্য এই সব? ধর্মের কি আসলেই কোনো উপকারিতা আছে?

এই ‘উপকারিতা’ শব্দটি দিয়ে ডারউইনবাদীরা সাধারণত বোঝান কোন একক সদস্যের বহনকারী জিনগুলো বেঁচে থাকার জন্য কোন ধরনের উপকারী ও উপযোগী পরিবর্ধন। আর এই ধারণার মধ্যে যে বিষয়টি অনুপস্থিত তা হলো ডারউইনীয় কোন উপকারিতা কোন। একক জীব সদস্যর জিনের প্রতি সীমাবদ্ধ নয়। উপকারিতার সম্ভাব্য আরো তিনটি বিকল্প নিশানাও থাকতে পারে। একটি আসছে গ্রুপ সিলেকশন তত্ত্ব থেকে, আর সে বিষয়ে আমি পরে আলোচনায় আসছি। দ্বিতীয়টি আসছে সেই তত্ত্ব থেকে যা আমি ব্যাখ্যা ও সমর্থন করেছিলাম আমার ‘দ্য এক্সটেন্ডেড ফেনোটাইপ’ বইটিতে কোনো একটি একক জীব যাকে আপনারা দেখছেন, সে হয়তো অন্য আরো একটি একক জীবের জিনের নিয়ন্ত্রণকারী প্রভাবের আওতায় কাজ করছে, হয়তো সেটা হতে পারে কোনো পরজীবি। ড্যান ডেনেট আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, সাধারণ সর্দিজ্বরের মতই ধর্মও সব মানুষের মধ্যে সর্বজনীন, তাসত্ত্বেও আমরা কিন্তু এমন প্রস্তাব করছি না যে, সর্দিজ্বর আমাদের কোনোভাবে উপকার করছে। প্রাণী জগতে এমন অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে কোনো পরজীবির এক পোষক থেকে অন্য পোষকে বিস্তার লাভ করার সুবিধার জন্য তারা তাদের পোপাষক জীবটির আচরণগত পরিবর্তন ঘটাতে প্ররোচিত করতে সক্ষম। আমি এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছিলাম আমার দ্য এক্সটেন্ডেড ফেনোটাইপের কেন্দ্রীয় সূত্র হিসাবে কোনো জীবের আচরণ, সেই আচরণের ‘জন্য নির্দিষ্ট জিনগুলোকে টিকিয়ে রাখার বিষয়টি সর্বোচ্চভাবে নিশ্চিৎ করার চেষ্টা করে, জিনগুলো সেই আচরণ করা প্রাণীর শরীরে থাকুক বা না থাকুক।

তৃতীয়, কেন্দ্রীয় তত্ত্বটি হয়ত জিন শব্দটিকে আরো সাধারণ বহুব্যবহৃত রেপ্লিকেটর বা অনুলিপিকারী শব্দটি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে পারে। একটি ফ্যাক্ট বা বাস্তব সত্য হলো ধর্মের সর্বব্যাপীতা সম্ভবত ইঙ্গিত করছে যে, ধর্মের কোন না কোন কিছুর উপকারিতার জন্য বিষয়টি কাজ করছে কিন্তু সেটা আমাদের বা আমাদের জিনের প্রতি নির্দেশিত নাও হতে পারে। হতে পারে এটি উপকারী শুধু ধর্মীয় ধারণাগুলোর নিজেদের জন্য; এবং তা এমন পর্যায় অবধি যে সেই অর্থে তাদের আচরণ অনেকটাই জিন বা রেপ্লিকেটরদের মত। বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে আমি আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছি, “সাবধানে হাটুন, কারণ আপনি আমার মিমের উপর দিয়ে হাটছেন এই শিরোনামের অধীনে। তবে তার আগে আমি ডারউইনবাদের আরো বেশ ঐতিহ্যবাহী ব্যাখ্যাটা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে চাই। যেখানে বেনিফিট বা উপকার বলতে মনে করা হয়েছে কোনো একক জীব সদস্যর বেঁচে থাকা এবং প্রজনন ক্ষেত্রে উপকার বা ইতিবাচক প্রভাব।

ধারণা করা হয় আদি পূর্বসূরিরা যেভাবে বাস করতেন অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসী শিকারী-সংগ্রহকারী বা ‘হান্টার-গ্যাদারার’ মানবগোষ্ঠী খুব সম্ভবত সেরকম উপায়ে জীবন যাপন করে। নিউ জিল্যা/অষ্ট্রেলীয় বিজ্ঞানের দার্শনিক কিম স্টেরেলনাই তাদের জীবনের নাটকীয় কিছু স্ববিরোধীতা বা বৈপরিত্যকে তুলে ধরেছেন। একদিকে যেমন, আদিবাসীরা বেঁচে থাকার জন্য দুর্দান্ত কৌশলী, বিশেষ করে যে বৈরী পরিবেশে ও পরিস্থিতিতে তাদের সকল ব্যবহারিক আর প্রায়োগিক দক্ষতাগুলোকে পরীক্ষা দিতে হয়; কিন্তু স্টেরেলনাই আরো যোগ করেন, ‘আমরা প্রজাতি হিসাবে বুদ্ধিমান হতে পারি, তবে এই বুদ্ধিমত্তাটা খানিকটা বিকৃত। যে মানুষগুলো প্রাকৃতিক বিশ্ব সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান রাখে, জানে সেখানে কিভাবে বেঁচে থাকতে হয় তারাই আবার কি করে একই সাথে তাদের মনের ভিতরে নানা উদ্ভট বিশ্বাস এলোমেলো করে ভরে রাখে, যে বিশ্বাসগুলো একেবারে স্পষ্টভাবেই মিথ্যা, যার জন্য ‘অর্থহীন’ শব্দটিও হবে অতিমাত্রায় একটি স্বল্পভাষণ। কিম স্টেরেলনাই নিজে সুপরিচিত ছিলেন পাপুয়া নিউ গিনির আদিবাসীদের সম্বন্ধে। তারা বেঁচে থাকে ভীষণ কঠিন একটি পরিবেশে যেখানে খাদ্যর সন্ধান পাওয়া খুবই কঠিন একটি বিষয়, আর সেটা সম্ভব হয় শুধুমাত্র তাদের চারপাশের জৈববৈজ্ঞানিক পরিবেশ সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান প্রয়োগ করার মাধ্যমেই, কিন্তু তারা তাদের এই প্রাকৃতিক জ্ঞানটার সাথেই যুক্ত করে রেখেছে নারীর মাসিককালীন দূষিতকরণ এবং ডাকিনীবিদ্যা সম্বন্ধে তাদের গভীরভাবে ক্ষতিকর বদ্ধমূল কিছু ধারণা। অসংখ্য স্থানীয় গোত্র নানা ধরনের যাদুকরী এবং ডাকিনীবিদ্যার ভয় এবং সেই ভয়ের সাথে জড়িত সহিংস অত্যাচারের শঙ্কায় শঙ্কিত। স্টেরেলনাই আমাদের সামনে একটি চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করেন, কেমন করে আমরা একই সাথে এত বুদ্ধিমান এবং এক নির্বোধ হতে পারি (৫)?

খুঁটিনাটি বিষয়ে পার্থক্য হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু সারা পৃথিবী জুড়ে এমন কোনো সংস্কৃতিতে নেই, যেখানে কোন না কোন এক সংস্করনের এ ধরনের সময় বিনষ্টকারী, সম্পদ নষ্টকারী, শক্রতার অনুভূতি উস্কে দেবার মত আচার আচরণ, অবাস্তব অনুৎপাদনশীল ধর্মীয় কল্পকাহিনীর অস্তিত্ব নেই। কিছু শিক্ষিত মানুষ হয়তো ধর্মকে ত্যাগ করেছেন, কিন্তু তারা সবাই প্রতিপালিত হয়েছেন কোন না কোন ধর্মীয় সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সাধারণত তাদের সচেতনভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। উত্তর আয়ারল্যান্ডের বেশ পুরোনো কৌতুকটি: ‘বেশ ভালো কথা, বুঝলাম আপনি নাস্তিক,কিন্তু আপনি কি প্রটেস্টান্ট নাস্তিক? নাকি ক্যাথলিক নাস্তিক?’ এখানে কিন্তু মিশ্রিত আছে তিক্ত সত্যটি। বিষমকামী (হেঁটেরোসেক্সয়াল) যৌনতার বিষয়টি যেমন সর্বজনীন বলা হয়, ধর্মীয় আচরণও তেমন মানুষের জন্য সর্বজনীন একটি আচরণ বলা যেতে পারে। দুই সাধারণীকরনের মধ্যেই সুযোগ আছে এককভাবে ব্যক্তিগত এর থেকে ভিন্ন কোনো আচরণের বিষয়টি মেনে নেবার, কিন্তু সেই সব ব্যতিক্রমকেও ব্যাখ্যা দেয়া হয় বা বোঝানো হয় যে, তারা আসলে মূল নিয়ম থেকে সরে এসেছে। আর কোনো প্রজাতির মধ্য বিদ্যমান সর্বজনীন কোনো বৈশিষ্ট্য অবশ্যই ডারউইনীয় ব্যাখ্যা দাবী করে।

অবশ্যই কোনো জীবের যৌন আচরণের ডারউইনীয় উপযোগিতা ব্যাখ্যা করা তেমন কোনো কঠিন কাজ না; এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্তান উৎপাদন করা, এমন কি যখন জন্মনিরোধক ব্যবহার বা সমকামিতা আপাতদৃষ্টিতে এ বিষয়টি মিথ্যা এমন একটি ধারণা দেয়। কিন্তু ধর্মীয় আচরণ তাহলে কি? কেন মানুষ নিয়ম মাফিক উপবাস করে, নতজানু হয়ে মাথা নত করে, নিজেদের চাবুক দিয়ে পেটায়, দেয়ালের দিকে তাকিয়ে পাগলের মত মাথা নাড়ায়, ধর্মযুদ্ধ করে বা অন্যায় এমন কিছু কষ্ট আর সময়সাপেক্ষ আচরণের ব্যস্ত হয়, যা তাদের সমস্ত জীবনকে অধিগ্রহণ আর গ্রাস করে এবং চরম কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুও নিশ্চিৎ করে।

ধর্মের প্রস্তাবিত কিছু প্রত্যক্ষ উপকারিতা

ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষকে স্ট্রেস বা মানসিক চাপ থেকে সৃষ্ট নানা অসুখ থেকে রক্ষা করছে এমন প্রস্তাবের সপক্ষে খুব সামান্যই প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়। এমনকি যে প্রমাণগুলো আছে তারা কোনোটাই তেমন মজবুত না। কিন্তু যদি বিষয়টি সত্যিও হয়। তাহলেও কিন্তু এটি অবাক হবার মত কোনো বিষয় হবে না, কারণ সেই একই, বিশ্বাস নির্ভর নিরাময় যেমন কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে কারণে কাজে লেগে যায়। ধর্মের দাবীর আসল মূল্যকে আরো জোরদার করতে, আমি মনে করিনা এই উপকারী প্রভাবের বিষয়টি এর সাথে যোগ করার কোনো দরকার থাকতে পারে। জর্জ বার্নার্ড শ (৬) এর ভাষায়, কোন সন্দেহবাদীর তুলনায় কোন বিশ্বাসী যে সুখে আছে এই সত্যটা একজন মাতাল ব্যক্তি যেমন নেশাগ্রস্থ নয় এমন কারো চেয়ে সুখী যে কারণে, তার চেয়ে অতিরিক্ত কিছু নয়।

কোনো একজন রোগীকে চিকিৎসাসেবা হিসাবে কোনো একজন ডাক্তার যা দিতে পারেন, তার একটি অংশ হচ্ছে সান্ত্বনা এবং আশ্বাস। রোগীর উপর এই বিষয়টির প্রভাব কিন্তু একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। আমার ডাক্তার হয়তো তার হাত দিয়ে আক্ষরিক অর্থে ‘বিশ্বাস নির্ভর নিরাময়’ বা যাকে বলে ‘ফেইথ হিলিং’–এর কোনো অনুশীলন করেন না, কিন্তু অনেকবারই ছোটোখাটো রোগব্যাধি থেকে আমি প্রায় সাথে সাথেই নিরাময় লাভ করেছি, যখনই স্টেথোস্কোপ পরা একটি বুদ্ধিদ্বীপ্ত মানুষের আশ্বস্ত করার মত কণ্ঠ আমি শুনেছি। প্ল্যাসিবো প্রভাব নিয়ে বেশ গবেষণাও হয়েছে এবং এবং এটি খুব রহস্যময়ও কোনো ব্যপারও না; ডামি পিল বা ঔষধকল্প, যাদের কোনো ধরনেরই ফার্মাকোলজী নির্ভর বা ঔষধীয় কোনো প্রভাব নেই, কিন্তু দেখা গেছে সেটি রোগীর অবস্থার উন্নতি করছে। একারণেই সব ডাবল ব্লাই গবেষণা (গবেষক এবং রোগী উভয়ের কাছে যখন অজানা থাকে তারা কি চিকিৎসা পাচ্ছেন, আসল ঔষধ নাকি ঔষধ কল্প যাকে বলা হয় প্লাসিবো পিল) গবেষণায় প্লাসিবোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় কন্ট্রোল (যার সাথে মূল ঔষধটি আসলেই কার্যকরী কিনা তা তুলনা করে দেখা হয়) হিসাবে। এবং একারণেই হোমিওপ্যাথীর ‘চিকিৎসাগুলো’ কাজ করে বলে মনে হয়, এমনকি তারা এমনই লঘু মাত্রার যে, একই মাত্রায় প্লাসিবো কন্ট্রোলদের মতই তাদেরও একই পরিমান সক্রিয় (!) উপাদান থাকে অর্থাৎ শূন্য সংখ্যক অণু। ঘটনাচক্রে, আইনজীবিদের ডাক্তারদের ক্ষমতার এখতিয়ারে হস্তক্ষেপ করার একটি দুর্ভাগ্যজনক বাই-প্রোডাক্ট বা উপজাত বিষয় হচ্ছে, ডাক্তাররা এখন তাদের সাধারণ চিকিৎসা সেবা দেবার সময় ব্যবস্থাপত্রে প্লাসিবো পিল উল্লেখ করতে ভয় পান বা আমলাতান্ত্রিকতা তাদের বাধ্য করে কোনোটি প্লাসিবো সেটি লিখিতভাবে চিহ্নিত করার জন্য, যা কিনা রোগী নিজেই দেখতে পায়, এবং যে কারণে অবশ্যই প্লাসিবো পিলের মূল উদ্দেশ্যটাই ব্যহত হয়। হোমিওপ্যাথরা এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত সফলতা অর্জন করেছেন কারণ তারা প্রচলিত চিকিৎসকদের ব্যতিক্রম, কেননা রোগীদের এখনও অন্য নামে (ঔষধ হিসাবে) প্লাসিবো ঔষধ দেবার জন্য তাদের অনুমতি আছে, উপরন্তু তাদের হাতেও সময়ও থাকে বেশী, ফলে তারা রোগীর সাথে অনেক সময় ধরে কথা বলার ও বাড়তি সহানুভুতিশীল ও দয়াপরবশ হবারও সুযোগও পান অপেক্ষাকৃতভাবে বেশী। হোমিও চিকিৎসার দীর্ঘ ইতিহাসের প্রথমাংশে, এর সুনাম কিন্তু বৃদ্ধি পেয়েছিল ঘটনাচক্রে, যার প্রধান একটি কারণ ছিল এর ঔষধগুলো কোনো কিছুই করে না এবং যা স্পষ্টতই ব্যতিক্রম ছিল তৎকালীন প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো থেকে, যেমন, রক্তপাত করানো; যা সরাসরি রোগীর ক্ষতির কারণ হতো।

তাহলে ধর্ম কি একটি প্ল্যাসিবো যা জীবনকে প্রলম্বিত করে মানসিক চাপ ও অবসাদ হ্রাস করে? সম্ভবত, যদিও এই তত্ত্বটিকে সন্দেহবাদীদের ছাকুনী অতিক্রম করতে হয়েছে, যা সফলভাবেই দেখিয়েছেন, যে অনেক পরিস্থিতিতেই কমানোর চেয়ে ধর্ম বরং মানসিক চাপের পরিমান বাড়িয়ে দেয়। যেমন, বিশ্বাস করা খুবই কঠিন যে, সারাজীবন ধরে বয়ে বেড়ানো ভয়াবহ অপরাধবোধের প্রায় চিরস্থায়ী কোনো অবস্থায় কারো স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হতে পারে, যা কিনা সাধারণ মানবিক দুর্বলতা সম্পন্ন ও অপেক্ষাকৃত কম বুদ্ধিমান কোনো রোমান ক্যাথলিকরা ভুগে থাকেন। হয়তো শুধু মাত্র ক্যাথলিকদের আলাদা করে চিহ্নিত করাটা তাদের প্রতি সুবিচার হচ্ছে না। যুক্তরাষ্টের কমেডিয়ান ক্যাথি ল্যাডমানের পর্যবেক্ষণ: ‘সব ধর্মই তো এক; মূলত ধর্মই হচ্ছে অপরাধবোধ, যাদের ছুটির দিনগুলো শুধু ভিন্ন ভিন্ন দিনে।’; তবে যাই হোক না কেন, আমি মনে করি ধর্ম ফেনোমেনা বা প্রপঞ্চটি ব্যাপকভাবে বিশ্বব্যাপী সর্বব্যাপী ব্যাখ্যা করার জন্য এ ধরনের প্লাসিবো তত্ত্বটি যথেষ্ট নয়। আমি মনে করিনা, আমাদের পূর্বপুরুষদের স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কমাতো বলেই ধর্মের অস্তিত্বটি টিকে গেছে,এই কার্যকারণটি ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে প্লাসিবো তত্ত্বটি যথেষ্ট ব্যাপক কোনো তত্ত্ব নয়, যদিও এটি একধরনের সহায়ক বা সাবসিডিয়ারী কোনো দায়িত্ব পালন করে থাকতেও পারে। ধর্ম একটি বিশাল ব্যপার, বড় মাপের একটি প্রপঞ্চ, পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব এমন একটি বিষয়, এর ব্যাখ্যার জন্য প্রয়োজন আরো বড় কোনো একটি তত্ত্ব।

অন্য তত্ত্বগুলো ডারউইনীয় ব্যাখ্যার মূল বিষয়টি আদৌ স্পর্শ করতে পারেনি। আমি সেই ব্যাখ্যাগুলোর কথা বলছি যেমন: ‘ধর্ম মহাবিশ্ব এবং সেখানে আমাদের অবস্থান সম্বন্ধে আমাদের কৌতূহলকে নিবৃত্ত করে’ বা ‘ধর্ম সান্ত্বনাদায়ক’; কিছু মনস্তাত্ত্বিক সত্যতা হয়তো এখানে আছে, যা আমরা অধ্যায় ১০ এ আলোচনায় দেখবো, কিন্তু কোনোটাই এককভাবে ডারউইনীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা নয়। যেমন স্টিভেন পিংকার সরাসরি সান্ত্বনাদায়ক বা আশ্বস্তকারী তত্ত্বের বিষয়ে বলেছেন তার ‘হাউ দ্য মাইণ্ড ওয়ার্কস বইটিতে: ‘এটি শুধুমাত্র আরেকটি প্রশ্নের জন্ম দেয়, ‘কেন এমন একটি মন বা মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর বিবর্তন হবে, যা কিনা এমন কোনো একটি বিশ্বাসে স্বস্তি পাবে, যাকে কিনা এটি সুস্পষ্টভাবে মিথ্যা বলেও বুঝতে পারে। একজন শীতার্ত ব্যক্তি শুধু নিজেকে উষ্ণ ভেবে কোনো স্বস্তি পেতে পারে না কিংবা সিংহের মুখোমুখি দাঁড়ানো কোনো মানুষ, সিংহকে খরগোশ ভেবে বিশ্বাস করে কখনই সহজ হতে পারে না (৮)।’ কমপক্ষে এই কনসোলেশন বা সান্ত্বনা প্রদানের তত্ত্বটিকে ডারউইনীয় শব্দমালায় অর্থবহ হতে হবে, এবং আপনি যা ভাবছেন বিষয়টি তার চেয়ে বেশ কঠিন। কিছু বিশ্বাসকে মানুষদের পছন্দ বা অপছন্দ করার প্রক্রিয়াটির মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাগুলো প্রক্সিমেট পকৃতির, অর্থাৎ এটি তাৎক্ষণিক অবশ্যই চূড়ান্ত বা মূল বা আল্টিমেট কারণগুলোর ব্যাখ্যা নয়।

ডারউইনবাদীরা এই প্রক্সিমেট এবং আলটিমেট বা যথাক্রমে তাৎক্ষণিক ও চূড়ান্ত, এই দুটির মধ্যে পার্থক্যকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। ইন্টারনাল কমবাশন’ ইঞ্জিনের সিলিন্ডারে বিস্ফোরনের তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা হিসাবে প্রতীয়মান হয়, স্পর্কিং প্লাগ। কিন্তু আল্টিমেট বা চূড়ান্ত ব্যাখ্যা হলো কি উদ্দেশ্যে এই বিস্ফোরণটি পরিকল্পনা করা হয়েছে: সিলিন্ডার থেকে পিস্টনটা বাইরের দিকে বের করে গতিশীল করা বা চালানোর জন্য, এবং তার মাধ্যমে মূল ক্র্যাঙ্ক শ্যাফটটিকে ঘোরানো। ধর্মের প্রক্সিমেট কারণ হতে পারে। আমাদের মস্তিস্কের কোনো একটি অংশ বা অংশসমুহ বা নোড এর অতিসক্রিয়তা। আমি স্নায়ু বৈজ্ঞানিক সেই ‘গড সেন্টার’ এর ধারণা এখানে আলোচনা করবো না, কারণ প্রক্সিমেট কারণ নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাচ্ছিনা। তার মানে এই না, আমি এদের খাটো করে দেখছি, আমি পাঠকদের মাইকেল শেরমারের (৯) হাউ উই বিলিভ: দ্য সার্চ ফর গড ইন এজ অব সায়েন্স’ (৯) বইটা পড়ার জন্য বিশেষ অনুরোধ করছি এ বিষয়ে স্বচ্ছ এবং সুনির্দিষ্ট একটি আলোচনার জন্য, যেখানে মাইকেল পেরসিংগার (১১) এবং অন্যদের প্রস্তাবও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যা প্রস্তাব করছে যে, বড় কোনো ধরনের এবং উজ্জ্বল নানা দৃশ্যকল্প সমৃদ্ধ কোনো ধর্মীয় অভিজ্ঞতার সাথে টেম্পোরাল লোব এপিলেপসি (মৃগী রোগ, যা মস্তিষ্কের কোন কোন অংশের অতিসক্রিয়তার কারণে সৃষ্ট হতে পারে, যেমন এখানে টেমপোরাল লোবের সংশ্লিষ্টতা আছে।)।

কিন্তু এই অধ্যায়ে আমার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ডারউইনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ‘আলটিমেট ব্যাখ্যাটি অনুসন্ধান করা। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা মস্তিস্কের মধ্যে কোনো ‘গড় সেন্টার’ যদি খুঁজেও পান, আমার মত ডারউইনীয় বিজ্ঞানীরা তারপরও সেই বিশেষ প্রাকৃতিক নির্বাচনী চাপ বা সিলেকশন প্রেশারটি বুঝতে চাইবে, যা এমন কোন ‘গড সেন্টার এর বিবর্তনে বিশেষ সহায়তা ও পক্ষপাতিত্ব করেছে। কেন আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে যাদের ‘গড সেন্টার’ তৈরী হবার জিনগত প্রবণতা ছিল,তারা বেশী বেঁচে ছিলেন এবং বেশী সংখ্যক বংশধর সৃষ্টি করে গেছেন তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায়, যাদের এ ধরনের কোনো প্রবণতা ছিলনা। ডারউইনীয় আল্টিমেট প্রশ্ন কিন্তু স্নায়ুবিজ্ঞানীদের প্রক্সিমেট প্রশ্নের তুলনায় অপেক্ষাকৃত উত্তম প্রশ্ন নয় কিংবা অপেক্ষাগত গভীর বা প্রগাঢ় কোনো প্রশ্নও না, এমন কি বেশী বৈজ্ঞানিক প্রশ্নও বলা যাবে না; কিন্তু সেই প্রশ্নটাই নিয়ে আমি এখানে কথা বলছি।

ডারউইনবাদীরা কোনো রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দ্বারাও সন্তুষ্ট হবেন না, যেমন, ধর্ম একটি কৌশল বা উপকরণ যার দ্বারা শাসক শ্ৰেনীগোষ্ঠী তাদের অধস্তন শোষিত শ্ৰেণীগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করে; নিশ্চিভাবে এটা সত্য যে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসরা অন্য জীবনের প্রতিশ্রুতিতে সান্ত্বনা খুঁজে পেত, যা তাদের বর্তমান জীবন নিয়ে অসন্তুষ্টি ও কষ্টের অনুভূতিকে সহনশীল করে তুলতো, যা প্রকারন্তরে সহায়তা করতে তাদের শোষক মালিকদেরকেই। কিন্তু আসলেই দূরভীসন্ধিপূর্ণ কোনো যাজক বা শাসকরা সুচিন্তিতভাবে ধর্ম পরিকল্পনা করেছিল কিনা এই প্রশ্নটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক, যার উত্তর খুঁজতে পারেন কেবল ঐতিহাসিকরা, কিন্তু এটিও স্বতন্ত্রভাবে ডারউইনীয় প্রশ্ন না। ডারউইনবাদীরা তারপরও জানতে চান, কেন মানুষ ধমের মাদকতায় সহজে মোহাচ্ছন্ন হয়, শিকার হয় ধমের নানা ছল চাতুরী আর প্রতিশ্রুতিতে, আর সেকারণেই যাজক, রাজনীতিবিদ এবং রাজাদের শোষণের শিকার হবারও তাদের সম্ভাবনা থাকে বেশী।

দুরভিসন্ধিপূর্ণ কোনো নৈরাশ্যবাদী ধূর্ত কেউ যৌন লালসাকে রাজেনৈতিক শক্তি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু তারপরও আমাদের ডারউইনীয় একটি ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে কেন এটি কাজ করে তার অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে। যৌন লালসার ক্ষেত্রে এই উত্তরটা সহজ: আমাদের মস্তিস্কের কাঠামো গঠিত হয়েছে এমন ভাবে যে আমরা যৌনকর্মকে উপভোগ করি কারণ, যৌনকর্ম তার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অবস্থায় সন্তান উৎপাদন করে। অথবা কোনো রাজনৈতিক কলকাঠি নিয়ন্ত্রক কূটকৌশলী হয়ত শারীরিক নিপীড়ন বা নির্যাতনকে বেছে নিতে পারে তার মতলব হাসিলের জন্য। আবারো ডারউইনবাদীদের অবশ্যই ব্যাখ্যার যোগান দিতে হবে কেন নির্যাতন কার্যকরী ফলাফল দিচ্ছে এখানে, কেন আমরা প্রচণ্ড শারীরিক যন্ত্রণাকে এড়ানোর জন্য প্রায় যে কোনো কিছু করতে রাজী আছি। আবারো স্পষ্টভাবে এর কারণ খুবই আটপৌরে সাধারণ হওয়া সত্ত্বেও ডারউইনবাদীদের সেটা স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা দিতে হবে যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন শারীরিক ব্যাথা বা যন্ত্রণা অনুভব করার ক্ষমতাকে জীবননাশী শারীরিক কোন ক্ষতির চিহ্ন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, এবং এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য এটি আমাদের ভেতর শক্তিশালী জৈবিক তাড়না সৃষ্টির প্রয়োজনীয় নির্দেশও বিবর্তিত করেছে। কিছু দুর্লভ মানুষ আছেন, যারা কোনো কষ্ট বা যন্ত্রণা অনুভব করতে পারেন না বা সেটা নিয়ে আদৌ চিন্তিত না, তারা সাধারণত অল্প বয়সে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা যান, যে আঘাতগুলো আমরা অন্যরা বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে এড়িয়ে চলি। কেউ কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করুক কিংবা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এটি নিজেকে প্রকাশ করুক না কেন, কি সেই চূড়ান্ত কারণ যা আসলে ব্যাখ্যা করে দেবদেবী বা ঈশ্বরদের পূজা করার প্রতি আমাদের সর্বজনীন লালসাটিকে।

গ্রুপ সিলেকশন বা গোষ্ঠী নির্বাচন।

কিছু প্রস্তাবিত আল্টিমেট বা চূড়ান্ত ব্যাখ্যা আসলে দেখা যাচ্ছে প্রায় অথবা পুরোপুরিভাবেই গ্রুপ সিলেকশন বা গোষ্ঠী নির্বাচন তত্ত্ব নির্ভর। গ্রুপ সিলেকশন’ একটি বিতর্কিত ধারণা যা দাবী করে, ডারউইনীয় নির্বাচন বিভিন্ন প্রজাতিদের মধ্যে বা অন্য কোনো জীবসদস্যদের ‘গ্রুপ’ বা গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বাছাই করে। কেমব্রিজের প্রত্নতত্ত্ববিদ কলিন রেফ্রিউ (১২) প্রস্তাব করেছিলেন যে, খ্রিষ্ট ধর্ম এক ধরনের গ্রুপ সিলেকশনের মাধ্যমেই তার অস্তিত্ব রক্ষা করেছে কারণ এটি গ্রুপের মধ্যে বা অন্তঃগ্রুপ আনুগত্য ও ভাতৃপ্রতিম ভালোবাসাকে প্রতিপালন করেছিল, যা বেশী ধার্মিক গোষ্ঠীগুলোকে অপেক্ষাকৃত কম ধার্মিক গ্রুপগুলোর চেয়ে সফলতার সাথে টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রুপ সিলেকশন তত্ত্বের অন্যতম প্রচারক ডি. এস, উইলসন (১৩) স্বতন্ত্রভাবে একই ধরনের একটি প্রস্তাব দাঁড় করিয়েছিলেন আরো বিস্তারিতভাবে তার ‘ডারউইনস ক্যাথিড্রাল’ বইটিতে (১৪)।

ধর্মের ‘গ্রুপ সিলেকশন’ তত্ত্ব আসলে কি বলছে, তা বোঝানোর জন্য একটি কল্পিত উদাহরণ দেয়া যাক: একটি গোত্র, যারা অতিমাত্রায় এক যুদ্ধবাজ ‘যুদ্ধের দেবতার উপাসনা করে, তারা শান্তি আর ঐক্যের তাগিদ দেয় এমন কোনো দেবতার পূজারী প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্র বা কোনো দেবতারই পূজা করে না এমন কোনো গোত্রের সাথে সংঘটিত যুদ্ধে জয় লাভ করে; যোদ্ধারা দৃড়ভাবে বিশ্বাস করে যে, যুদ্ধে শহীদ হিসাবে তাদের মৃত্যু তাদেরকে সরাসরি স্বর্গে জায়গা করে দেবে, তারা অত্যন্ত সাহসের সাথে যুদ্ধ করে এবং নিজের জীবন উৎসর্গ করে স্বেচ্ছায় দ্বিধাহীন ভাবে। সুতরাং এমন ধর্ম বিশ্বাসে বিশ্বাসী গোত্রদের আন্তঃগোত্র যুদ্ধ বিগ্রহে জয়ী হয়ে টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশী, তারা তাদের প্রতিপক্ষ গোত্রের গবাদীপশু দখল ও তাদের নারীদের অপহরণ করে উপপত্নী বানাবে। এধরনের গোত্র আরো সমমনা কন্যা গোত্রের জন্ম দেবে দ্রুত উৎপাদনশীল হারে,যারা সবাই একই গোত্র দেবতার পূজা করবে। এই গ্রুপের অন্য কন্যা গ্রুপের জন্ম দেয়ার ধারণাটি, অনেকটা কোনো মৌচাক থেকে একগুচ্ছ মৌমাছিকে ছুঁড়ে ফেলে দেবার মত, একেবারে অসম্ভব, নয় যদিও। নৃতত্ত্ববিদ নেপোলিয়ন শ্যানন (১৫), এধরনের বিভিন্ন গ্রামের সংযুক্তিকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন জঙ্গলে ইয়ানোমামো আদিবাসী নিয়ে তার গবেষণায় (১৬)।

শ্যানন গ্রুপ সিলেকশন তত্ত্বের সমর্থক নন, আমিও না। কারণ এর বিরুদ্ধে বেশ কিছু শক্ত যুক্তি আছে। এই বিতর্কের একজন যোদ্ধা হিসাবে আমাকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে এটি নিয়ে আলোচনা করার সময় যেন এই বইটির মূল বিষয়ের বেশী বাইরে যেন চলে যাই। অনেক জীববিজ্ঞানীরই সংশয় আছে “সত্যিকারের’ গ্রুপ সিলেকশন বিষয়টি নিয়ে, যা আমি আমার যুদ্ধের দেবতা পূজারী গোত্রের কাল্পনিক উদহারণের ব্যাখ্যা করেছি এবং অন্য একটি বিষয়ের মধ্যে, যাদের তারা ভ্রান্তভাবেই গ্রুপ সিলেকশন বলছেন, অথচ ভালো করে যা লক্ষ করলেই বোঝা যাবে আসলে সেটি হয় কিন সিলেকশন’ কিংবা ‘রেসিপ্রোকাল আলট্রইজম বা পারস্পরিক পরোপকারিতা (অধ্যায় ৬ এ যা ব্যাখ্যা করবো বিশেষ ভাবে)।

আমরা যারা গ্রুপ সিলেকশনকে খাটো করে দেখি তারা স্বীকার করি নীতিগতভাবে এটা হতেও পারে। তবে আসল প্রশ্নটি হচ্ছে, বিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি সেটি হতে পারে কিনা? যখন আরো নীচের স্তরের নির্বাচনে সাথে তুলনা করা হয়, যেমন যখন গ্রুপ সিলেকশনকে ব্যক্তিগত আত্মবিসর্জনের ব্যাখ্যা হিসাবে তুলনামূলক প্রস্তাব করা হয়, তখন নীচের স্তরের নির্বাচনই প্রমাণিত হয় আরো শক্তিশালী হিসাবে; আমাদের কাল্পনিক সেই গোত্রে একজন স্বার্থপর যোদ্ধাকে কল্পনা করুন, যেখানে মূলত প্রাধান্য বিস্তার করে আছে গোত্রের জন্য শহীদ হয়ে স্বর্গীয় পুরষ্কার পেতে উৎসুক যোদ্ধারা; নিজের প্রাণ বাঁচানো প্রচেষ্টায় যুদ্ধে পেছনের দিকে সাবধানে থাকার কারণে জয়ী দলে শেষ পর্যন্ত তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খানিকটা বেশী হবে; গড়পড়তা তাদের সবার যতটুকু উপকার করার কথা, তার সহযোদ্ধাদের আত্মদান তাকেই খানিকটা বেশী উপকার করবে, কারণ সে ছাড়া বাকীরা তখন মৃত। সুতরাং মৃত সহযোদ্ধাদের তুলনায় তার প্রজনন সুযোগ ও পরবর্তী প্রজন্ম সৃষ্টি করার সম্ভাবনাও বেশী, সুতরাং এই আত্মত্যাগের প্রবণতার হারও ক্রমান্বয়ে কমে যাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মেগুলোর মধ্যে।

এটি একটি সরলীকৃত খেলনা সুলভ উদাহরণ, কিন্তু গ্রুপ সিলেকশন সম্বন্ধে একটি চিরন্তন সমস্যার এটি ব্যাখ্যা দিচ্ছে। ব্যক্তিগত আত্মত্যাগের গ্রুপ সিলেকশন তত্ত্বটি সবসময়ই এর ভিতর থেকে ব্যর্থ হবার সম্ভাবনায় থাকে; পুরো গ্রুপের বিলুপ্তি বা সংযুক্তির তুলনায়, ব্যক্তিগত মৃত্যু ও প্রজনন সময়ের মাপকাঠিতে বেশ দ্রুত ঘটে: গাণিতিক মডেলও তৈরী করা যেতে পারে কিছু বিশেষ পরিস্থিতির যেখানে গ্রুপ সিলেকশন শক্তিশালী বিবর্তনীয়। চালিকা শক্তি হিসাবে দেখানো যায়। এই বিশেষ পরিস্থিতিগুলো সাধারণত প্রকৃতিতে কল্পনা করাটা খানিকটা বাস্তবতা বিবর্জিত, কিন্তু যুক্তি দেখানো যেতে পারে মানুষের গোত্রগত দলবদ্ধতায়। ধর্মগুলো সেই বাস্তবতা বিবর্জিত বিশেষ পরিস্থিতিগুলো প্রতিপালন করতে পারে। এটিও একটি কৌতূহলোদ্দীপক তত্ত্ব, আমি বিষয়টি নিয়ে আর বিস্তারিত আলোচনায় যাবো না, শুধু মেনে নেয়া ছাড়া যে ডারউইন নিজেই, যদিও তিনি প্রজাতির একক সদস্যর ক্ষেত্রে নির্বাচন কাজ করে এমন ধারণার দৃঢ় সমর্থক ছিলেন, তিনিও গ্রুপ সিলেকশন ধারণার যতটুকু কাছে আসা সম্ভব, ততটুকুই এসেছিলেন, মানুষের গোত্র বা ট্রাইব নিয়ে আলোচনার সময়:

যখন একই দেশে বসবাসকারী আদি মানবদের দুটি গোত্র বা গোষ্ঠী পারস্পরিক কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসে, যদি একটি গ্রুপে (অন্য সব পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকবে এমন শর্তে) বেশী সংখ্যক সাহসী, সহানুভূতিশীল এবং অনুগত বিশ্বাসী সদস্য থাকে, যারা সবসময় একে অপরকে বিপদ থেকে সতর্ক করতে সাহায্য করতে এবং একে অপরকে রক্ষা করতে প্রস্তুত, তাহলে সন্দেহ নেই এই গোত্রটি সবচেয়ে সফল হবে এবং অন্য গোত্রদের জয় করতে সক্ষম হবে। স্বার্থপর বিবাদপ্রিয় মানুষরা একসাথে জোট বাঁধতে বা সহাবস্থান করতে পারেনা,আর সহযোগিতা ছাড়া কোনো কিছুরই ফলাফল মেলে না। কোনো গোত্র যাদের সদস্যদের মধ্যে উপরে বর্ণিত সব গুণাবলী সৰ্বোচ্চভাবে বিদ্যমান, তারা আকারে দ্রুত সম্প্রসারিত হবে এবং অন্য সব গোত্রকে জয় করে নেবে। কিন্তু সময়ের ধারাবাহিকতায়, এই গোত্রটিও, অতীতের সকল ইতিহাস যা বলে, আরো উন্নত গুণাবলী সম্পন্ন কোনো গোত্র দ্বারা বিজিত হবে (১৭)।

জীববিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ যারা হয়তো এই বইটি পড়তে পারেন,তাদের আশ্বস্ত করার জন্য আমার উচিৎ হবে যোগ করা যে, ডারউইনের এই ধারণাটি পুরোপরি গ্রুপ সিলেকশন নয়, সফল গ্রুপ সিলেকশন সত্যিকার অর্থে যা বোঝায়, সফল গ্রুপগুলো কন্যা গ্রুপ সৃষ্টি করবে, যাদের হার গননা করা যাবে নানা গ্রুপের একটি মেটাপপুলেশনে বা জনসংখ্যায়; বরং ডারউইন গোত্রগুলোকে দেখেছেন পরার্থবাদী পরোপকারী পরস্পর সহযোগিতাকারী সদস্যদের বিস্তার এবং সদস্যদের সংখ্যায় ক্রমেই বেড়ে যাবার দৃষ্টিকোণ থেকে; ডারউইনের মডেল, ব্রিটেনে অনেকটা লাল কাঠবিড়ালীদের জায়গায় ধুসর কাঠবিড়ালীদের বিস্তারের মত: ইকোলজিক্যাল রিপ্লেসমেন্ট বা পরিবেশগত প্রতিস্থাপন, সত্যিকারের গ্রুপ সিলেকশন নয়।

অন্য কোনো কিছুর বাই-প্রোডাক্ট বা উপজাত হিসাবে ধর্ম

যাই হোক, আমি এখন গ্রুপ সিলেকশনকে একপাশে সরিয়ে রাখতে চাই এবং ধর্মের ডারউইনীয় সারভাইভাল ভ্যালু বা বেঁচে থাকার জন্য এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করতে চাই। সংখ্যায় ক্রমশ বাড়তে থাকা জীববিজ্ঞানীদের মত আমিও ধর্মকে দেখি অন্য কোনো কিছু একটির ‘বাই প্রোডাক্ট’বা উপজাত হিসাবে। আরো সাধারণভাবে, আমি বিশ্বাস করি যে, ডারউইনীয় সারভাইভাল ভ্যালু সম্বন্ধে আমরা যারা ধারণা করার চেষ্টা করছি তাদের প্রয়োজন বাই-পোডাক্ট এর চিন্তা করা; যখন আমরা কোনো কিছুর বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে তার কি উপযোগিতা মূল্য আছে তা জানতে চাই, তখন হয়তো ভুল প্রশ্নটি করে থাকি; আমাদের আরো খানিকটা সহায়ক পন্থায় প্রশ্নটি নতুন করে লিখতে হবে। যে বৈশিষ্ট্যটি নিয়ে আমাদের বিশেষ উৎসাহ (এই ক্ষেত্রে যেমন ধর্ম), হয়তো তার সরাসরি কোনো নিজস্ব সারভাইভাল ভ্যালুই নেই (বা এমন কোনো গুণাবলী নেই যা বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে ডারউইনীয় অর্থে সহায়ক হতে পারে) কিন্তু এটি এমন কিছু একটির বাই-প্রোডাক্ট বা উপজাত, যার সেই সারভাইভাল ভ্যালুটি আছে। আমার নিজের গবেষণার ক্ষেত্র, প্রাণী আচরণের একটি উদাহরণ দিয়ে এই উপজাত বা বাই-প্রোডাক্ট এর ধারণাটাকে ব্যাখ্যা করলে আমি মনে করি সেটি বোঝার জন্য সহায়ক হতে পারে।

মোমবাতির জ্বলন্ত শিখায় মথদের সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায় এবং ভালো করে লক্ষ করলে কিন্তু মনে হয়না এটি কোন দুর্ঘটনা; তারা যেন অতি উদ্যোগী হয়ে নিজেদের পুড়িয়ে আত্মাহুতি দেয়; তাদের এই অদ্ভুত আচরণকে আমরা নাম দিতে পারি ‘আত্মহত্যা করার উদ্দেশ্যে নিজেকে আগুনে পোড়ানো’ বা ‘সেলফ ইমোলেশন’ আচরণ এবং এই রহস্যময় নামের আড়ালে আমরা বিস্মিত হই কেমন করে, প্রাকৃতিক নির্বাচন এধরনের একটি আচরণ বিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে; আর এখানে আমার বক্তব্য হচ্ছে, অবশ্যই আমাদেরকে নতুন করে প্রশ্নটি লিখতে হবে, এমনকি কোন বুদ্ধিমান উত্তর খোঁজার চেষ্টা করার আগেই। এটি আত্মহত্যা নয়। আপাতদৃষ্টিতে এই আত্মহত্যা অন্য কোন একটা কিছুর অযাচিত বা অনাকাঙ্খিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা উপজাত বা বাই-প্রোডাক্ট। উপজাত বা বাই-প্রোডাক্ট, কিন্তু কার? বেশ, নীচে বর্ণিত হয়েছে এমন একটি সম্ভাবনা, যা হতে পারে এবং বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।

রাতের পৃথিবীকে কৃত্রিম আলোর আবির্ভাব বেশ সাম্প্রতিক, এর আগে রাতে আলো যা চোখে পড়তো তার উৎস ছিল চাঁদ আর তারা, কিন্তু আলোর উৎস হিসাবে তাদের অবস্থান ছিল দৃষ্টিসীমার অসীমে বা অপটিক্যাল ইনফিনিটিতে, সুতরাং সেই উৎস থেকে আসা আলোক রশ্মিগুলো সমান্তরাল, কম্পাস বা দিক নির্দেশনার চিহ্ন হিসাবে ব্যবহার করার জন্য তাদেরকে উপযোগী করে এই বৈশিষ্ট্যটি; জীববিজ্ঞানীদের কাছেও বিষয়টি অজ্ঞাত নয় যে, সাধারণত পতঙ্গরা মহাকাশে অবস্থিত বস্তু যেমন সূর্য কিংবা চাঁদ থেকে আসা আলোর রশ্মি ব্যবহার করে সরাসরি পথে বা সরল রেখায় যাতায়াত করার জন্য এবং খাদ্য সন্ধানের অভিযান শেষে ঠিক সেই কম্পাসটাই তারা ব্যবহার করে বিপরীতমুখী পথে ঘরে ফেরার জন্য; পতঙ্গদের স্নায়ুতন্ত্র খুব দক্ষ একটি সাময়িক গড়পড়তা বা রুল অব থাম্ব নিয়ম বেধে দেয়ার জন্যে, যেমন: ‘এমন পথ ধরে যেতে হবে যেন আলোক রশ্মি তোমার চোখে ঠিক ৩০ ডিগ্রী কোণে আঘাত করতে পারে’; যেহেতু পতঙ্গদের চোখ হচ্ছে যৌগিক (যেখানে লম্বা সোজা টিউব বা আলোকে গাইড করার টিউব চোখের কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে ছড়িয়ে থাকার মত সাজানো থাকে, হেজহগদের (বা সজারুর গায়ের কাটাগুলোর মত), তাদের কাছে এই নিয়মের অর্থ হচ্ছে নির্দিষ্ট একটি অংশের লাইট টিউব বা ওমাটিডিয়ামে শুধু আলোটাকে ধরে রাখার জন্য তাদের অনুশীলন করতে হয়।

কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে লাইট কম্পাসটির সফলভাবে কাজ করার বিষয়টি অপরিহার্যভাবে নির্ভর করে এই সব মহাজাগতিক আলোর উৎসগুলোর দৃষ্টিসীমার অসীমে থাকার উপর। যদি তা না হয়, আলোর রশ্মিগুলো আর সমান্তরাল থাকে না বরং কোনো চাকার স্পোকগুলোর মত চারিদিকে ছড়িয়ে থাকে রশ্মিগুলো; একটি স্নায়ুতন্ত্র ৩০ ডিগ্রী কোণ (বা যে কোনো সূক্ষ্ম কোণ হতে পারে বা অ্যাঙ্গেল এর ধরাবাধা নিয়ম যদি চাপিয়ে দেয়া হয় কাছাকাছি থাকা কোনো মোমবাতির আলোক উৎসের উপর, যেন সেই মোমবাতিটি হলো অসীম দৃষ্টিসীমায় থাকা চাঁদ, এটি মথকে সর্পিলকার একটা পথের দিকে চালিত করে নিয়ে যাবে, সরাসরি আগুনের শিখার দিকে; আপনার নিজের বোঝার জন্য বিষয়টি একে দেখুন, আপনিও মোমবাতির শিখা বরাবর লগারিদম নির্ভর চমৎকার একটি সর্পিলাকার ট্রাজেক্টরী বা গতিপথ পাবেন।

যদিও এই বিশেষ পরিস্থিতির জন্য বিষয়টি প্রাণঘাতী, তবে মথদের মস্তিস্কের এই গড়পড়তা একটি ধরাবাধা নিয়ম কিন্তু বেশ ভালো, কারণ গড়পড়তা কোনো একটি মথের জন্য চাঁদের চেয়ে বরং মোমবাতির দেখা পাওয়াটাই বেশী দূর্লভ; আমরা কখনো খেয়াল করি না, শত শত মথ নীরবে এবং খুব কার্যকরীভাবেই চাঁদের বা কোনো উজ্জল তারার আলো এবং এমনকি দূর শহর থেকে আসা হালকা আলোর আভা ব্যবহার করে তাদের পথ খুঁজে নিচ্ছে রাতের অন্ধকারে। শুধু মথগুলোকে আমরা মোমবাতির শিখার দিখে ঘুরে ঘুরে পড়তে দেখি এবং ভুল প্রশ্নটা করি: কেন এই মথগুলো আত্মহত্যা করছে? বরং আমাদের জিজ্ঞাসা করা উচিৎ কেন তাদের এমন একটি স্নায়ুতন্ত্র আছে যা তাদের আলোক রশ্মির সাথে একটি নির্দিষ্ট কোণ বা অ্যাঙ্গেল অবলম্বন করে উড়তে নির্দেশ দেয়, যে কৌশলটা শুধুমাত্র আমাদের নজরে পড়বে কোথাও ভুল হলে। যখন প্রশ্নটা নতুনভাবে করা হয়, রহস্যও বাষ্পীভূত হয়ে উবে যায়। এটিকে আত্মহনন কখনোই বলা ঠিক না, এটি সাধারণত সবসময় কাজ করে এমন একটি উপযোগী কম্পাসের হঠাৎ ভুল করে ঘটে যাওয়া একটি উপজাত বা বাই প্রোডাক্ট।

এখন এই বাই-প্রোডাক্ট উদাহরণটির শিক্ষা মানুষের ধর্মীয়। আচরণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করুন। আমরা লক্ষ করতে পারি যে বহু মানুষ, কোন কোন জায়গায় যা শতকরা ১০০ ভাগ, তারা এমন কিছু বিশ্বাসকে ধারণ করে যা সরাসরি প্রমাণযোগ্য সকল বৈজ্ঞানিক সত্যকে এবং সেই সাথে অন্যদের বিশ্বাস করা ধর্মকেও অস্বীকার করে; আর এই বিশ্বাসগুলো লালন করে তীব্র আবেগময়তায় চরম সত্য হিসাবে মানুষ যে মেনে নেয় শুধু তাই নয়, উপরন্তু তারা এই বিশ্বাস ধারণ করার কারণে সৃষ্ট বা এর নির্দেশিত নানা ব্যয়বহুল কর্মকাণ্ডে তাদের সময় এবং কষ্টার্জিত সম্পদও ব্যয় করে।

এই বিশ্বাসের কারণে তারা মৃত্যুকে বরণ করে বা এর জন্য হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করে না। আমরা এটি দেখে বিস্মিত বোধ করি, ঠিক যেমন অবাক হই মথদের মোমবাতির শিখায় আত্মহননের আচরণ দেখে (সেলফ ইমমোলেশন বা আত্ম-দহনের মাধ্যমে); হতভম্ব আমরা জানতে চাই, কেন? কিন্তু এখানে আমার বক্তব্যটা হচ্ছে, হয়তো আমরা ভুল প্রশ্নটা করছি। ধর্মীয় আচরণ হয়েতো যা হবার কথা ছিল না এমন কোনো মিসফায়ারিং, হয়তো কোন অন্তর্নিহিত মানসিক প্রবণতার একটি দূর্ভাগ্যজনক উপজাত বা বাই-প্রোডাক্ট, যা অন্য কোনো পরিস্থিতিতে, কিংবা অতীতের কোন একসময় উপযোগী ছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে এই প্রবণতাটি যা প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়েছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে তা হয়তো সেই অর্থে ধর্ম ছিল না; এর অন্য কিছু উপকারিতা ছিল এবং শুধুমাত্র ঘটনাচক্রে এটি প্রকাশিত হয়েছে ধর্মীয় আচরণের মধ্য দিয়ে। আমরা ধর্মীয় আচরণকে বুঝতে পারবো শুধুমাত্র এটিকে পুনরায় নামকরণ করার মাধ্যমে।

তাহলে, যদি ধর্ম অন্যকিছু একটি উপজাত বা বাই-প্রোডাক্টই হয়ে থাকে, তাহলে সেই অন্য কিছুটি আসলে কি? মহাজাগতিক আলোক রশ্মির কম্পাস ব্যবহার করে দিক নির্দেশনা ও চলাফেরা করার মথদের সেই আচরণটির অপর সংস্করণটি কি? কি সেই আদিমভাবে সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্য যেটা কখনো মিসফায়ার বা ভুল করে ধর্মের উদ্ভব করে? আমি একটি প্রস্তাব দেবো, উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে; কিন্তু আমি জোর দিতে চাই একটি বিষয়ে, সেটি হচ্ছে আমি সেই ধরনের বিষয় বোঝাতে চাইছি এটি শুধু তার একটি উদাহরণ মাত্র; এবং আমি এর সমান্তরালে অন্যরা যা প্রস্তাব দিয়েছেন, তারও ব্যাখ্যা দেবো ক্রমান্বয়ে যে কোনো একটি নির্দিষ্ট উত্তরের চেয়ে বরং আমি সেই মূলনীতির ধারণাটিরই বেশী সমর্থন করি: প্রশ্নটাই আসলে ঠিক মত হওয়া উচিৎ, প্রয়োজন হলে নতুন করে লিখতে হবে।

আমার নির্দিষ্ট হাইপোথিসিসটি শিশুদের নিয়ে। অন্য যে কোনো প্রজাতির চেয়ে, আমরা বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে বেশী নির্ভর করি আমাদের পূর্বের প্রজন্মগুলোর পুঞ্জীভুত অভিজ্ঞতার উপর, আর সেই অভিজ্ঞতাকে পরবর্তী প্রজন্মের শিশুদের কাছে হস্তান্তরিত করা প্রয়োজন, তাদের সুরক্ষা ও কল্যানের জন্য। তাত্ত্বিকভাবে শিশুরা কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে পারে, যেমন, খাড়া পাহাড়ের খুব কিনারায় না যাওয়া, আগে পরীক্ষা করে খেয়ে দেখা হয়নি এমন কোনো বুনো ফল না খাওয়া, কুমির আছে এমন পানিতে সাঁতার না কাটা ইত্যাদি। কিন্তু নিদেনপক্ষে এটা স্পষ্ট যে সেই শিশুদের মস্তিস্ক একটি বিশেষ সিলেকটিভ বা নির্বাচনী সুবিধা। পাবে, যে মস্তিস্ক একটি গড়পড়তা তা নিয়ম বা “রুল অব থাম্ব’ ধারণ করে: কোনো প্রশ্ন ছাড়াই বিশ্বাস করো, তোমাদের গুরুজনরা যা বলেন, তোমাদের পিতামাতাকে মান্য করো, গোত্রের গুরুজনদের মান্য কর, বিশেষ করে যখন তারা গম্ভীর এবং ভীতি প্রদর্শন করার মত কণ্ঠ ধারণ করে, কোনো প্রশ্ন ছাড়া তোমাদের গুরুজনদের বিশ্বাস করো। কোনো শিশুর জন্য সাধারণত এটি মূল্যবান একটি নিয়ম, কিন্তু মথদের যেমন হয়, এটির ফলাফল খারাপও হতে পারে।

শৈশবে আমার স্কুলের গীর্জায় যাজকের দেয়া একটি ভয়াবহ উপদেশময় বক্তৃতা আমি কখনোই ভুলতে পারিনি; এখন ভাবলে এর ভয়াবহতাটা বোধগম্য হয়,অর্থাৎ সেটি সেই সময় আমার শিশু মস্তিস্ক গ্রহন করে নিয়েছিল যাজক যে উদ্দেশ্যে তা বলেছিলেন সেভাবেই; তিনি আমাদের একদল সেনাদের গল্প বলেছিলেন, যারা রেলওয়ে লাইনের পাশে কুচকাওয়াজ করছিলেন, কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যখন ড্রিল সার্জেন্ট এর মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে, তিনি তাদের থামবার নির্দেশটি দিতে ভুলে যান; কিন্তু সেনারা কোনো প্রশ্ন ছাড়া সেই নির্দেশ মান্য করার শিক্ষায় এমনই দীক্ষা পেয়েছিল যে তারা সরাসরি এগিয়ে আসা একটি ট্রেনের অভিমুখে তাদের কুচকাওয়াজ অব্যাহত রাখে; অবশ্যই আমি গল্পটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করিনা এবং আমি আশা করি ধর্মযাজক নিজেও সেটা বিশ্বাস করেননি। কিন্তু আমার বয়স যখন নয় আমি তা বিশ্বাস করেছিলাম, কারণ আমি এটা শুনেছিলাম একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও আমার উপর কর্তৃত্ব আছে এমন একজন মানুষের নিকট থেকে। তিনি সেটা বিশ্বাস করুন বা না করুন, যাজক সৈন্যদের সেই ক্রীতদাসের মতো কোনো প্রশ্ন ছাড়াই কোনো কর্তৃত্ব স্থানীয় কারো নির্দেশ, যেটা যত ভয়াবহই আর অবিশ্বাস্য হোক না কেন, নির্দেশ মান্য করার মানসিকতাকে যেন আমরা শিশুরা প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখি এবং নিজেদের সেই আদলে গড়ে তুলি। আমার কথা যদি বলি, আমি মনে করি আমরা ব্যপারটা সপ্রশংস দৃষ্টি নিয়ে দেখেছিলাম, কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে পরবর্তীতে আমার শৈশবে সেই আমিকে কোন কৃতিত্ব দিতে পারিনি, যে কিনা ভেবেছিল ট্রেনের নীচে অবধারিত মৃত্যু জেনে কুচকাওয়াজ অব্যাহত রাখার মত সেই সাহস আছে কিনা। কিন্তু যাই হোক, এভাবেই আমার সেই অনুভূতিটাকে মনে পড়ে। যাজকের সেই সামন অবশ্যই আমার মনে গভীর একটি দাগ ফেলেছিল, কারণ আমি এটা মনে করেছি এবং এখানে প্রকাশ করার মাধ্যমে আপনাদের সাথে সেটা ভাগ করে নিয়েছি।

নিরপেক্ষভাবে যদি ভাবি, আমার মনে হয় না যাজক আদৌ মনে করেছেন যে তিনি আমাদের কোনো ধর্মীয় উপদেশ বিতরণ করছেন, ধর্মীয় কোনো বিষয়ের তুলনায়, এটি মূলত সামরিক, টেনিসনের (১৮) বিখ্যাত ‘চার্জ অব দ্য লাইট ব্রিগেড এর মূলসুরে, সম্ভবত যার উদ্ধৃতি তিনি দিয়েছিলেন (১৯)।

Forward the Light Brigade!
Was there a man dismayed?
 Not though the soldiers knew
Some one had blundered:
Theirs not to make reply,
Theirs not to reason why,
Theirs but to do and die:
 Into the valley of Death
Rode the six hundred.

সামরিক কোনো হাই কমাণ্ডের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যপারটাকে চূড়ান্ত পাগলামি মনে হতে পারে যে, প্রতিটি সৈনিক কোন নির্দেশ মানবে কি মানবে না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার নেয়ার অনুমতি তাদের উপর ন্যস্ত করা; যে জাতির পদাতিক সৈন্যরা তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজ করে, অনুমতি না মেনেই যুদ্ধে যায়, সাধারণত তাদের পরাজয় ঘটে। সুতরাং কোনো জাতির দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি সরল সহজ গড়পড়তা নিয়ম হিসাবে উপযোগী এমনকি যদিও কখনো কখনো এটি ব্যক্তিগত ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণ হতে পারে। সৈন্যরা এমনভাবে প্রশিক্ষিত হয় যেন তারা যতটা সম্ভব অটোমাটা বা কম্পিউটারের মত হয়।

কম্পিউটারকে যা নির্দেশ দেয়া হয় তারা সেটা করে। তারা ক্রীতদাসের মত যে কোনো নির্দেশ মান্য করে তাদের নিজস্ব প্রোগ্রামিং এর ভাষায়। এভাবেই তারা নানা উপযোগী কাজ করতে পারে যেমন ওয়ার্ড প্রসেসিং বা স্প্রেডশীটের নানা গণনা। কিন্তু, এরই একটি অবশ্যম্ভাবী উপজাত বা বাই-প্রোডাক্ট হিসাবে, তারা পুরোপুরি রোবটের মতই আচরণ করে কোনো বাজে নির্দেশ মান্য করার ক্ষেত্রে। তাদের কোনোভাবেই বলার কোন উপায় নেই, কোন নির্দেশের কি ফলাফল হতে পারে, খারাপ কিংবা ভালো। তাদের কাজ শুধমাত্র সেই কম্যান্ড বা নির্দেশগুলো মেনে চলে, সৈনিকরা যেমন করতে বাধ্য। তাদের এই শর্তহীন আনুগত্য কম্পিউটারকে যেমন পরিণত করেছে একটি উপযোগী যন্ত্র হিসাবে আবার সেই ঠিক একই জিনিস তাদের নিশ্চিতভাবে অবশ্যই কোনো সফটওয়্যার ভাইরাস বা ওয়ার্ম কোডের আক্রমণের শিকারে পরিণত করে; কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে লেখা একটি প্রোগাম যে বলে, ‘আমাকে কপি করে, এবং হার্ড ডিস্কে তুমি যে কয়টা ঠিকানা পাও, সব ঠিকানায় আমাকে পাঠাও’, কম্পিউটারের পক্ষে সেটি অমান্য করা অসম্ভব, আর এই অনুগত ভাবে নির্দেশ মানার ঘটনাটি ঘটবে প্রতিটি কম্পিউটারেই, যারা সেই নির্দেশ পেয়েছে, খুবই কঠিন একটি কাজ হবে, হয়তোবা এমন কোনো কম্পিউটার পরিকল্পনা করা অসম্ভব, যা কাজে লাগবার মত অনুগত অবার একই সাথে কোন ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত।

বিষয়টিকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে আমি যদি সফল হয়ে থাকি, তাহলে আপনি হয়তো ইতিমধ্যেই শিশুর মস্তিস্ক ও ধর্ম নিয়ে আমার যুক্তিটি সমাপ্ত করে ফেলেছেন; প্রাকৃতিক নির্বাচন শিশুর ব্রেইনকে এমন করে গড়ে তোলে যে, তারা তাদের পিতামাতা বা গোত্রের গুরুজনরা যা বলে,তারা সেটাই পুরোপুরি বিশ্বাস করে। এ ধরনের বিশ্বাস নিষ্ঠ আনুগত্য বেঁচে থাকার জন্য খুবই মূল্যবান: চাঁদের আলোক রশ্মির সহায়তায় মথদের পথ চলার মত। কিন্তু বিশ্বাসনিষ্ঠ আনুগত্যের অপর পিঠ হচ্ছে অতিমাত্রায় নির্বিচারে বিশ্বাস করার দাস সুলভ প্রবণতা। এর একটি অবশ্যম্ভাবী উপজাত বা বাই-প্রোডাক্ট হল মনের ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হবার প্রবণতা। ডারউইনীয় সারভাইভাল বা টিকে থাকার সাথে খুবই সঙ্গত কারণে সংশ্লিষ্ট, কোন শিশুর মস্তিস্কের প্রয়োজন আছে তার বাবা মাকে এবং বাবা মার নির্দেশিত গুরুজনদের বিশ্বাস করা। এর একটি অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে যে বিশ্বাসকারীর ভালো একটি উপদেশ থেকে খারাপ কোনো উপদেশকে পৃথক করার কোনো উপায়ই জানা নেই; শিশুদের জানার উপায় নেই, ‘কুমির ভরা লিম্পোপো নদীতে সাঁতার কাটবে না’ হচ্ছে একটি ভালো উপদেশ, কিন্তু ‘তোমাকে একটা ছাগল কোরবানি দিতে হবে পূর্ণিমার দিনে, নয়তো বৃষ্টি হবে না, এই উপদেশটি বড় জোর সময় আর ছাগলের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। শিশুর মনে এই নির্দেশ একই রকম বিশ্বাসযোগ্য লাগবে শুনতে; দুটোই এসেছে ভক্তি করা হয় এমন একটি উৎস থেকে এবং তাদের যে ভাবগম্ভীর আন্তরিকতার সাথে প্রদান করা হয় হয়, তা অনায়াসে যেমন সমীহ জাগায় তেমনি এর প্রতি নিশর্ত আনুগত্যও দাবী করে। এবং ঠিক একই ঘটনা ঘটে এই পৃথিবী সম্বন্ধে বিভিন্ন ধারণার ক্ষেত্রেও, যেমন মহাবিশ্ব বিষয়ে, নৈতিকতা প্রসঙ্গে এবং মানুষের প্রকৃতি সংক্রান্ত বিষয়ে; এবং খুব সম্ভবত, যখন শিশুটি বড় হয় এবং তাদের নিজেদেরও সন্তান হয়, খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সেও তার পরবর্তী প্রজন্মকে, সেই একই সংক্রমণযোগ্য ভাবগম্ভীর আচরণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক অর্থহীন এবং অর্থবহ জ্ঞান হস্তান্তর করে।

এই মডেলে আমাদের প্রত্যাশা করা উচিৎ যে, বিভিন্ন ভৌগলিক অঞ্চলে, বিভিন্ন কাল্পনিক বিশ্বাসগুলো, যাদের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই হস্তান্তরিত হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে,বহু প্রজন্মের উপযোগী ঐতিহ্যগত কোনো জ্ঞানের মতই একই দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে, যেমন, ফসলের জন্য সার উপকারী এমন বিশ্বাসটি। আমাদের আরো প্রত্যাশা করা উচিৎ যে কুসংস্কার এবং অবাস্তব বিশ্বাসগুলো স্থানীয়ভাবে বিবর্তিত হবে, কয়েক প্রজন্মের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তিত হবে- হয় এলোমেলো কোনো পরিবর্তন বা ড্রিফট এর মাধ্যমে নয়তো ডারউইনীয় নির্বাচনের সমরুপী কোনো প্রক্রিয়ায় যা কোনো এক সময় এর মূল উৎস থেকে উল্লেখযোগ্য রকমের ভিন্নতা প্রদর্শন করবে (এই বিষয়ে আমি কয়েক মুহূর্ত পর আবার আলোচনায় আসবো); সম্ভবত একই ভাবে বিষয়টা সত্য ভিত্তিহীন কাল্পনিক বিশ্বাস এবং নানা নিষেধাজ্ঞাগুলোর ক্ষেত্রেও, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিত হয়েছে সেই বিশ্বাসগুলো, শিশু মস্তিস্কের সহজে প্রোগামিং করার ক্ষমতা যাদের একটা ভিত্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।

আর ধর্মীয় নেতারা কিন্তু খুব ভালো করেই শিশু মস্তিস্কের এই প্রবণতার কথা জানেন, আর একারণে শৈশবেই দীক্ষা দেবার তাগিদটা তারা এত গুরুত্বর সাথে প্রচার করে থাকেন। জেসুইটদের গর্বিত উদ্ধৃতি, জীবনের প্রথম সাত বছরে কোনো শিশুকে আমার কাছে দাও,আমি তোমাকে একটি পূর্ণবয়স্ক মানুষ হিসাবে ফেরত দেব’- কিন্তু বহু ব্যবহারে তার সত্যতা (বা এর ভয়াবহতা) হারায়নি। আধুনিক সময়ে যেমন জেমস ডবসন, বর্তমান সময়ের কুখ্যাত ‘ফোকাস অন দি ফ্যামিলি মুভমেন্ট (২০) এর প্রতিষ্ঠাতা, খুব ভালো করে এই মূলনীতির সাথে পরিচিত:”তরুণদের কি হয়তো শেখানো হবে বা তারা কি ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবে-কি তারা দেখবে, চিন্তা করবে ও বিশ্বাস করবে, এ সব কিছু যারা নিয়ন্ত্রণ করেন,তারাই জাতির ভবিষ্যতের পথ নির্দেশ করে (২১)।

কিন্তু মনে রাখবেন, শিশুর উপকারী বিশ্বাসপ্রবণ মন সম্বন্ধে আমার এই বিশেষ প্রস্তাব শুধু একটি উদাহরণ সেই সব কিছুর যা কিনা চাঁদের বা তারার আলোক রশ্মির সাহায্যে মথদের পথ খুঁজে চলা। প্রক্রিয়ার সমতুল্য বা সমরুপ কোনো একটি প্রক্রিয়া হতে পারে। প্রাণীদের আচরণ বিশেষজ্ঞ বা ইথোলজিষ্ট রবার্ট হিল্ড (২২) তাঁর ‘হোয়াই গড পারসিস্ট’ (২৩) এ এবং নৃতত্ত্ববিদ পাসকাল বয়ের (২৪) তাঁর ‘রেলিজিয়ন এক্সপ্লেইনড’ (২৫) ও স্কট আটরান (২৬) ‘ইন গড উই ট্রাষ্ট (২৭) এ স্বতন্ত্রভাবে যে সাধারণ ধারণাটি প্রস্তাব করেছেন তাহলো, ধর্ম হচ্ছে স্বাভাবিক মনোবৈজ্ঞানিক বা মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর বাই-প্রোডাক্ট বা উপজাত–আমার বরং বলা উচিৎ ‘অনেকগুলো’ বাই-প্রোডাক্ট কারণ নৃতত্ত্ববিদরা বিশেষভাবে ব্যস্ত বিশ্বের নানা ধর্মের বৈচিত্র্যটি ব্যাখ্যা করার মাধ্যমেই তাদের মধ্যে পারস্পরিক সদৃশ্যতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা। নৃতত্ত্ববিজ্ঞানীদের নানা গবেষণার ফলাফল ও আবিষ্কার আমাদের কাছে বিস্ময়কর আর অদ্ভুত মনে হয় কারণ তারা অপরিচিত আমাদের কাছে; প্রতিটি ধর্মীয় বিশ্বাসই যারা সেই বিশ্বাসের আবহে বড় হয়নি তাদের কাছে অদ্ভুতই মনে হবে; বয়ের ক্যামেরুনের ফাঙ (Fang) নৃগোষ্ঠীর মধ্যে গবেষণা করেছিলেন,যারা বিশ্বাস করে যে:

‘ডাইনীদের শরীরে একটির বাড়তি আভ্যন্তরীণ অঙ্গ থাকে, যা রাতের বেলায় উড়ে গিয়ে অন্য মানুষের ফসল নষ্ট করে বা তাদের রক্ত বিষাক্ত করে। এবং তারা এটাও মনে করে যে, কখনো কখনো এই ডাইনীরা একসাথে জড়ো হয়ে বিশাল ভোজের আয়োজন করে সেখানে তারা তাদের শিকারদের খায় এবং ভবিষ্যৎ আক্রমণের পরিকল্পনা করে। অনেকেই আপনাকে বলবে, যে তার কোনো বন্ধুর বন্ধু, সত্যি সত্যি গ্রামের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া ডাইনীদের দেখেছে কলা পাতার উপর চড়ে, তারা অতর্কিতে যাদূর তীর ছুঁড়ে ঘায়েল করছে তাদের শিকারদের।

বয়ের তার ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা এর সাথে যোগ করেন:

‘কেমব্রিজ কলেজে এক নৈশভোজের সময় আমি এইসব এবং আরো কিছু বিচিত্র চমকপ্রদ কাহিনী বলছিলাম, তখন একজন অতিথি, কেমব্রিজ প্রখ্যাত একজন ধর্মতত্ত্ববিদ, আমার দিকে ঘুরে তাকান এবং মন্তব্য করেন:’এই কারণে নৃতত্ত্ববিদ্যা এত বিস্ময়কর এবং কঠিনও বটে। কারণ আপনাকে ব্যাখ্যা করতে হয়, কিভাবে মানুষ এই সব আজগুবি জিনিস বিশ্বাস করতে পারে। কিছুক্ষণের জন্য মন্তব্যটি আমাকে হতবাক করে দিয়েছিল, কেতলী কিংবা চায়ের পট সম্বন্ধে প্রাসঙ্গিক কোনো প্রত্যুত্তর খুঁজে পাবার আগে কথপোকথনটি ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছিল।

কেমব্রিজ এই ধর্মতাত্ত্বিক মূলধারার একজন খ্রিষ্ট ধর্ম বিশ্বাসী হবেন এমন ধারণা করে নিয়ে আমরা বলতে পারি যে,তিনি সম্ভবত নিমে উল্লেখিত এমন কিছু এক বা একাধিক বিষয়ে বিশ্বাস করে থাকেন:

  • আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই প্রাচীন সময়ে, একজন পুরুষ, যিনি জন্মগ্রহন করেছিলেন একজন কুমারী মায়ের গর্ভে, যেখানে তার জন্মের জন্য কোনো মানব (জৈববৈজ্ঞানিক) পিতার ভূমিকাই ছিল না।
  • সেই একই পিতৃহীন পুরুষ ব্যক্তিটি ল্যাজারাস নামক তার একজন বন্ধুকে আহবান করেছিলেন, যিনি পচন ধরে যাবার মত সময়কাল ধরে মৃত ছিলেন এবং তার সেই আহবান শুনে ল্যাজারাস দ্রুত জীবন্ত হয়ে উঠেছিলেন।
  • পিতৃহীন এই পুরুষ মানুষটি নিজেও মৃতাবস্থা এবং কবর দেবার পর তৃতীয় দিনে জীবিত স্বশরীরে ফিরে আসেন।
  • এবং এর চল্লিশ দিন পর এই পিতৃহীন মানুষটি নিজেই একটি পাহাড়ের চুড়ায় আরোহন করেন এবং স্বশরীরে তিনি আকাশে অদৃশ্য হয়ে যান।
  • যদি আপনি কোনো চিন্তা আমার মাথার মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে ফিসফিস করে উচ্চারণ করেন, পিতৃহীন ব্যক্তিটি এবং তার পিতা (তিনি নিজেও সেই জন) আপনার সেই চিন্তা শুনতে পান এবং যদি তিনি চান সে বিষয়ে কিছু পদক্ষেপও নিতে পারেন। এছাড়াও তিনি একই সাথে সারা পৃথিবীর অন্য সবাই কি চিন্তা করছেন সেটা শুনতে পান।
  • আপনি খারাপ যদি কিছু করে থাকেন, বা ভালো কিছু, সেই একই পিতৃহীন পুরুষ সবই দেখতে পাবেন,এমনকি যখন আর কেউই সেটা না দেখতে পান না। আপনার কর্মানুযায়ী আপনি হয়তো পুরষ্কার কিংবা শাস্তি পেতে পারেন, বর্তমানে এবং আপনার মৃত্যুর পরেও।
  • পিতৃহীন এই পুরুষটির কুমারী মা কখনো মৃত্যুবরণ করেননি, তিনিও স্বশরীরে স্বর্গে ‘আরোহণ করেছিলেন।
  • রুটি এবং মদ, যদি কোনো যাজক দ্বারা আর্শীবাদপুষ্ট হয় ( যার অবশ্যই অণ্ডকোষ থাকতে হবে), সেগুলো তাহলে সেই পিতৃহীন পুরুষ মানুষটির শরীর এবং রক্তে পরিণত হয়;

এবার ভাবুন, কেমব্রিজে ফিল্ডওয়ার্কের সময় যদি কোনো একজন নৈর্ব্যক্তিক নৃতত্ত্ববিদ এই ধরনের বিশ্বাসের মুখোমুখি হন, তাহলে তিনি এর কি ব্যাখ্যা দেবেন?

ধর্মবিশ্বাসী হবার জন্য মনস্তাত্তিক পূর্বপ্রস্তুতি

মনস্তাত্ত্বিক উপজাত বা বাই-প্রোডাক্ট এর ধারণাটি খুব স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ ও ক্রমবর্ধমান বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্র থেকে। বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীরা প্রস্তাব করেন যে, চোখ যেমন দেখার জন্য বিবর্তিত একটি অঙ্গ, ডানা যেমন উড়বার জন্য বিবর্তিত একটি অঙ্গ, আমাদের মস্তিস্ক বা ব্রেইন ও একটি গুচ্ছ প্রত্যঙ্গের (বা মডিউল) একটি সমষ্টি, যাদের মূল কাজ হচ্ছে বিশেষায়িত তথ্য ও উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ। সেখানে একটি মডিউল আছে, যা আত্মীয়তা বা কিনশীপের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে, একটি মডিউলের কাজ যেমন পারস্পরিক আদান প্রদান (রেসিপ্রোকাল এক্সচেঞ্জ), একটি মডিউলের কাজ সহমর্মিতা বা এমপ্যাথী নিয়ে এবং এভাবে আরো বেশ কিছু মডিউলের সমন্বয়; এবং ধর্মকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, এধরনের একাধিক মডিউলের মিসফায়ারিং (বা যে কাজটি এর মূল উদ্দেশ্য না) এর উপজাত বা বাই-প্রোডাক্ট ফলাফল হিসাবে। যেমন, থিওরী অব আদার মাইণ্ড (বা মানসিক অবস্থা আরোপ করার ক্ষমতা, যেমন বিশ্বাস, উদ্দেশ্য, আকাঙ্খ, ভান করা বা জ্ঞান ইত্যাদি, নিজের উপর কিংবা অন্যদের এবং বুঝতে পারার ক্ষমতা যে, অন্যদেরও বিশ্বাস, আকাঙ্খ কিংবা উদ্দেশ্য কারো নিজের থেকে ভিন্ন হতে পারে) তৈরীর মডিউল, কোয়ালিশন বা সহযোগী জোট তৈরী করার জন্য মডিউল,আগন্তুকদের তুলনায় একই গ্রুপের সদস্যদের সহযোগীতা করা পক্ষপাতমূলক আচরণের মডিউল; এর যে কোনোটি মথদের তারা কিংবা চাঁদের আলো ব্যবহার করে দিক নির্দেশনা দেবার মানবীয় একটি সংস্করণ হতে পারে, যার মিসফায়ারিং হবার স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে, শৈশবের অতি বিশ্বাসপ্রবণতার ক্ষেত্রে আমি যেমন করে ব্যাখ্যা দিয়েছি। মনোবিজ্ঞানী পল রুম (২৭), বাই-প্রোডাক্ট হিসাবে ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত ধারণার আরো একজন প্রস্তাবক, সেই বিষয়টিকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তা হলো, শিশুদের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে ‘মনের দ্বৈততা বা ভুয়ালিস্টিক’ তত্ত্বের জন্য। ধর্ম তার মতে, এই সহজাত দ্বৈতোর একটি বাই-প্রোডাক্ট বা উপজাত। তার প্রস্তাব অনুযায়ী আমরা মানুষরা, বিশেষ করে শিশুরা, জন্মগতভাবেই দ্বৈতবাদী (২৮)।

একজন দ্বৈতবাদী মন এবং বস্তুর মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য স্বীকার করে নেন, মোনিষ্ট বা অদ্বৈতবাদ বিশ্বাস করেন মন হচ্ছে বস্তুর বা ম্যাটারের-মস্তিষ্কের কোনো অংশ, বা হয়তো বা একটি কম্পিউটারের একটি প্রকাশ এবং বস্তু থেকে এর আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। দ্বৈতবাদী বা ভুয়ালিস্টরা বিশ্বাস করেন, মন হচ্ছে এক ধরনের শরীর বিচ্ছিন্ন কোনো আত্মা যা শরীরের মধ্যে বসবাস করে এবং সুতরাং বোধগম্য কারণে এটি শরীরকে ত্যাগ করতে পারে এবং অন্য কোথাও থাকতে পারে। ডুয়ালিস্টরা মানসিক অসুখকে খুব সহজে ব্যাখ্যা করে, “অশুভ শয়তানের দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়া একটি অবস্থা হিসাবে। এই শয়তানগুলো যেহেতু ‘আত্মা’, শরীরে তাই তাদের অবস্থান সাময়িক, এবং সেকারণে তাদের শরীর থেকে বিতাড়িত করাও সম্ভব। দ্বৈতবাদীরা সুযোগ পেলেই প্রাণহীন যে কোনো ভৌত বস্তুকে পারসোনিফাই বা তার উপর ব্যক্তিরুপ বৈশিষ্ট্য আরোপ করেন, তারা জলপ্রপাত কিংবা মেঘে আত্মা এবং দানবের উপস্থিতিও দেখতে পান।

এফ আন্সটের (২৯) ১৮৮২ সালের উপন্যাস ভাইস ভার্সা (৩০) যে। কোনো দ্বৈতবাদীর কাছেই অর্থবহ মনে হতে পারে,কিন্তু বিষয়টি আমার মত খাঁটি অদৈত্ববাদী বা মোনিষ্টদের কাছে অবোধ্য হওয়া উচিৎ। যেখানে জনাব বাল্টিটুড (৩১) এবং তার পুত্র রহস্যজনকভাবে লক্ষ করেন, তাদের শরীরের অদল বদল ঘটেছে। পুত্রের বিশেষ আনন্দ যেহেতু, বাবাকে পুত্রের শরীরে স্কুলে যেতে হচ্ছে এবং অন্যদিকে পুত্র বাবা শরীরের তার অপরিপক্ক সিদ্ধান্তের জন্য বাবার ব্যবসাকে প্রায় ধ্বংস কার প্রান্তে নিয়ে যায়। পি. জি. উডহাউস (৩২) এর লাফিং গ্যাসে (৩৩) প্রায় একই ধরনের একটি কাহিনীসূত্র ব্যবহার করেছিলেন, যেখানে হ্যাঁভারশটের আর্ল এবং একজন শিশু চলচ্চিত্র তারকা একই সাথে পাশাপাশি দাঁতের ডাক্তারের চেম্বারে অজ্ঞান করার ঔষধ পান এবং একে অপরের শরীরে তাদের ঘুম ভাঙ্গে; আবারো এই গল্পের কাহিনীসূত্র অর্থবহ হতে পারে শুধু দ্বৈতবাদীদের কাছে, লর্ড হ্যাঁভারশটের এমন কিছু আছে যা তার শরীরের অংশ নয়, নতুবা কি করে তিনি শিশু অভিনেতা শরীরে জেগে উঠতে পারেন?

বেশীর ভাগ বিজ্ঞানীদের মতই আমি দ্বৈতবাদী নই, কিন্তু তাসত্ত্বেও ভাইস ভার্সা এবং লাফিং গ্যাস বইগুলোর মজা আমি সহজেই উপভোগ করতে পারি। এ বিষয়ে পল রুম যা বলবেন তা হলো, যদিও আমি বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে মানিষ্ট বা অদ্বৈতবাদী হতে শিখেছি, যেহেতু আমি একজন মানুষ নামক প্রাণী সুতরাং সহজাতভাবে দ্বৈতবাদী বা ভুয়ালিস্ট হিসাবে বিবর্তিত হয়েছি। আমার চোখের পেছনে একটা ‘আমি’ যে ঘাপটি মেরে বসে আছে এবং অন্ততপক্ষে যে কিনা গল্পে আরেকজনের মস্তিস্কে প্রবেশ করতে পারে- এই ধারণাটি আমার এবং অন্য যেকোনো মানব মস্তিস্কের অনেক গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে, অদৈত্ববাদ বা মোনিজম এর প্রতি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক যে অবস্থানই থাকুক না কেন; ব্লুম তার এই দাবীর সপক্ষে বেশ কিছু পরীক্ষামূলক প্রমাণও প্রস্তাব করেন, তিনি দেখান যে, শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় আরো বেশী দ্বৈতবাদী, বিশেষ করে খুবই অল্প বয়সের শিশুরা। এটাই ইঙ্গিত করে যে দৈত্ববাদ বা ভুয়ালিজমের একটি প্রবণতা আছে আমাদের মস্তিস্কের অন্তর্গত একটি সহজাত প্রক্রিয়া হিসাবে তার পূর্বাপস্থিতি বজায় রাখা এবং ব্লম এর মতে যা আমাদের ধর্মীয় ধারণাকে সাদরে গ্রহন করার জন্য স্বাভাবিক একটি পরিস্থিতি ও প্রাক-প্রস্তুতিমূলক একটি অবস্থা সৃষ্টি করেই রাখে।

ব্লম আরো প্রস্তাব করেন যে, জন্মগতভাবেই আমাদের সৃষ্টিতত্ত্ববাদী হবার প্রবণতা থাকে। প্রাকৃতিক নির্বাচন ইনটুইটিভ বা সহজাতভাবেই অর্থবহ হয়না আমাদের কাছে; শিশুরা, বিশেষ করে সবকিছুর উপরে কারণ বা উদ্দেশ্য আরোপ করে, যা মনোবিজ্ঞানী ডেবোরাহ কেলেমান (৩৪) তার Are children intuitive theists? প্রবন্ধটিতে আমাদের জানিয়েছেন; “বৃষ্টির জন্য মেঘ বলে কিছু আছে, পাথরের সূঁচালো কোণ থাকে কারণ কোনো জন্তুর যখন গা চুলকায় তারা সেখানে গা ঘষে চুলকিয়ে নিতে পারে’; সবকিছুর পেছনের এভাবে কোনো উদ্দেশ্য আরোপ করাকে বলে টেলিওলজী বা পরমকারণবাদ। শিশুরা জন্মগতভাবেই টেলিওলজিষ্ট বা পরমকারণবাদী এবং অনেকেই এর থেকে আর বের হতে পারেনা।

এই পুর্বেই উপস্থিত ডুয়ালিজম (দৈত্ববাদ) এবং টেলিওলজী (পরমকারণবাদ), উপযুক্ত শর্তাবলীর উপস্থিতিতে আমাদের ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হবার প্রবণতা সৃষ্টি করে,ঠিক যেমন করে আমার ইতিপুর্বে উদাহরণ দেয়া মথদের আলো-কম্পাসের প্রতি প্রতিক্রিয়া যেমন তাদের ভুল অনিচ্ছাকৃত তথাকথিত ‘আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি করে। আমাদের সহজাত দ্বৈতবাদ আমাদেরকে ‘আত্মা’র ধারণায় বিশ্বাস করতে প্রস্তাব করে, যা শরীরের প্রত্যক্ষ অংশ হবার বদলে আমাদের ভিতরে বসবাস করে পৃথক সত্তা বজায় রেখে। এই ধরনের শরীর বিচ্ছিন্ন আত্মাকে নিয়ে খুব সহজেই কিন্তু ভাবা যায়,আমাদের মৃত্যুর পর এটি অন্য কোথায় চলে যায়; এছাড়া কোনো জটিল কোনো বস্তুর বিকশিত কোনো বৈশিষ্ট্য হিসাবে না বরং বস্তু থেকে স্বাধীন হিসাবে আমরা খুব সহজে ‘বিশুদ্ধ আত্মা হিসাবে ঈশ্বরকে বা দেবদেবীদের কল্পনা করতে পারি এবং আরো স্পষ্টভাবে, শিশুসুলভ টেলিওলজী ধর্মের জন্য আমাদের প্রস্তুত করে। যদি সবকিছুরই কোনো কারণ বা উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে সেগুলো কার উদ্দেশ্য? অবশ্যই ঈশ্বরের।

কিন্তু মথদের আলোক কম্পাসের যে উপযোগিতা’ এখানে তার সমতুল্য কি? তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচন কেন দ্বৈতবাদ এবং পরমকারণবাদকে সহায়তা করেছে আমাদের পূর্বপুরুষ ও তাদের সন্তানদের মস্তিস্কে? আপাতত, ‘জন্মগত জুয়ালিস্ট বা দ্বৈতবাদী’ তত্ত্ব সম্বন্ধে আমার ব্যাখ্যা প্রস্তাব করছে যে, মানুষ হচ্ছে জন্মগতভাবেই ভুয়ালিস্ট এবং টেলিওলজিষ্ট, কিন্তু এর ডারউইনীয় সুবিধাটি কি হতে পারে? আমাদের চারপাশের জগতে উপস্থিত নানা এনটিটি বা সত্তার আচরণ সম্বন্ধে পূর্ব ধারণা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং আমরা প্রত্যাশা হয়তো করতে পারি যে প্রাকৃতিক নির্বাচন আমাদের মস্তিস্কের গঠনটিকে এই কাজটি দ্রুত ও দক্ষতার সাথে করার উপযোগী করে গড়ে তুলেছে। ডুয়ালিজম আর টেলিওলজী কি আমাদের এই ক্ষমতায় কোনো সহায়তা করে? এই হাইপোথিসিসটাকে আমরা হয়তো ভালো বুঝতে পারি দার্শনিক ড্যানিয়েল ডেনেট যাকে বলেছেন ইনটেনশনাল স্ট্যান্স বা উদ্দেশ্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে।

ডেনেট স্ট্যান্স (Stance) বা দৃষ্টিভঙ্গির ত্রিমুখী শ্রেনীবিভাগের একটি বোধগম্য প্রস্তাব করেছেন, যে স্ট্যান্স আমরা অবলম্বন করি বুঝবার চেষ্টা করার জন্য এবং সেকারণেই নানা সত্তার আচরণ সম্বন্ধে পূর্বধারণা করতে পারি, যেমন কোনো প্রাণী বা যন্ত্র বা একে অন্যের এই স্ট্যান্সগুলো হচ্ছে, ফিজিক্যাল স্ট্যান্স, ডিজাইন স্ট্যান্স এবং ইনটেনশনাল স্ট্যান্স। “ফিজিক্যাল স্ট্যান্স’ সবসময় নীতি মেনে কাজ করে,কারণ সবকিছুই পদার্থবিদ্যার সূত্র মেনে চলে। কিন্তু ফিজিকাল স্ট্যান্স ব্যবহার করে কোনো কিছুর ব্যাখ্যা করার পক্রিয়া বেশ মন্থর গতির হতে পারে; যতক্ষণে আমরা কোনো একটি জটিল বস্তুর নানা চলমান অংশগুলোর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াগুলো হিসাব নিকেশ শেষ করবো, ততক্ষণে এর আচরণ সংক্রান্ত কোনো পূর্বধারণা সম্ভবত আমাদের জন্য বেশ দেরী হয়ে যাবে। কোনো একটি বস্তু যা আসলেই ডিজাইন করা হয়েছে, যেমন ওয়াশিং মেশিন বা একটি ক্রশবো, ডিজাইন স্ট্যান্স একটি মিতব্যায়ী শর্টকার্ট হতে পারে; আমরা পদার্থবিদ্যার ব্যাখ্যা একপাশে সরিয়ে রেখে কিন্তু অনুমান করতে পারে বস্তুটির আচরণ কি হতে পারে, সরাসরি এর ডিজাইন বা পরিকল্পনার দিকে নজর দিয়ে। যেমন ডেনেট বলেছেন (৩৫):

এর বাইরের দিকটাকে একটু ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেই প্রায়ই কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবেন একটি অ্যালার্ম ঘড়ি কখন শব্দ করবে; এটা কি স্প্রিং প্যাচানো,নাকি ব্যাটারী চালিত,নাকি সূর্যালোক, তামার চাকা, নাকি রত্নের বিয়ারিং বা সিলিকন চিপস এ বিষয় নিয়ে কারো এত মাথাব্যাথা নেই– শুধু ধারণা করে নেয়া যায়,এমনভাবে এটি ডিজাইন করা যে ঠিক তখনই অ্যালার্মের শব্দ বাজবে ঠিক যখন বাজবার জন্য এটি সেট করা হয়েছে।

জীবিত প্রাণীরা ডিজাইন বা পরিকল্পিত নয়,কিন্তু ডারউইনীয় প্রাকৃতিক নির্বাচন ডিজাইন দৃষ্টিভঙ্গির একটি সংস্করণকে এখানে অনুমতি দেয় তাদের ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য; এভাবেই আমরা আমাদের হৃৎপিণ্ডকে বোঝার জন্য একটি শর্টকাট পাই, যদি আমরা ধরে নেই রক্তকে পাম্প করার জন্য এটিকে ডিজাইন করা হয়েছে। কার্ল ভন ফ্রিশ (৩৬) মৌমাছিদের কালার ভিশন নিয়ে। একটি গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন (বিশেষ করে যখন মূলত সবার ধারণা ছিল মৌমাছিরা রঙ দেখতে পারেনা বা তারা কালার ব্লাইও) কারণ তিনি ধারণা করেছিলে ফুলদের উজ্জ্বল রং আসলে ‘পরিকল্পিত’ হয়েছে মৌমাছিদের আকর্ষণ করার জন্য। পরিকল্পিত বা ডিজাইন শব্দটিকে উদ্ধৃতির চিহ্ন দিয়ে আবদ্ধ করার উদ্দেশ্য মিথ্যাচারী সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের খানিকটা ভয় দেখিয়ে দূরে সরিয়ে দেবার জন্য নয়তো তারা হয়তো দাবী করে বসবেন বিখ্যাত অষ্ট্রিয় প্রাণীবিজ্ঞানী তাদের মতই একজন সৃষ্টিতত্ত্ববাদী ছিলেন। বলাবাহুল্য তিনি পুরোপুরি দক্ষ ছিলেন ডিজাইন দৃষ্টিভঙ্গিটাকে সঠিক ডারউইনীয় ভাষায় ব্যাখ্যা করার জন্য।

ইনটেশনাল স্ট্যান্স (উদ্দেশ্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি) হচ্ছে আরেকটি শর্টকাট এবং এটি ডিজাইন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আরো একধাপ উপরে: কোনো এনটিটি বা সত্তাকে ধরে নেয়া হয়– শুধু বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যেই তাদের ডিজাইনই শুধু করা হয়নি, উপরন্তু এরা হচ্ছে। ‘এজেন্ট’ বা কোনো ‘এজেন্ট’ ধারণ করে,তাদের সব কর্ম উদ্দেশ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করার লক্ষ্যে। আপনি যখন কোনো বাঘকে দেখেন,আপনার তখন দেরী করা উচিৎ হবে না তার সম্ভাব্য আচরণ সম্বন্ধে অনুমান করতে। এর অণু পরমাণুর পদার্থবিদ্যা নিয়ে বা এর পা, নোখ, দাঁতের আকৃতির ডিজাইন সম্বন্ধে তখন আর কোনো চিন্তার অবকাশ নেই; বাঘ আপনাকে খেতে চাইছে,এবং এটি তার পা, নোখ এবং দাঁত অত্যন্ত দক্ষতা আর সাবলীলতার সাথে ব্যবহার করতে পারে তার সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য সবচেয়ে দ্রুত এর সম্ভাব্য আচরণ অনুমান করার একমাত্র উপায় হল, পদার্থবিদ্যা আর শরীরবৃত্তীয় নানা খুঁটিনাটি সব ভুলে গিয়ে এর উদ্দেশ্য বা ইনটেনশন সম্বন্ধে ধারণা করে নেয়া; লক্ষ করতে হবে, ডিজাইন দৃষ্টিভঙ্গি ডিজাইন করা এমন কিছুর ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য তেমনি কাজে লাগানো যায়। ডিজাইন করা নয় এমন কিছুর ক্ষেত্রেও সুতরাং এই উদ্দেশ্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিও সেভাবে কাজ করে যাদের কোনো সুনির্দিষ্ট সচেতন কোনো উদ্দেশ্য নেই সেই সব জিনিসের ক্ষেত্রেও, যাদের তা আছে তাদের ক্ষেত্রে যেমন কাজ করে।

আমার মনে হয় এটা খুবই সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে, যে বেঁচে থাকার জন্য এই ইনটেনশনাল বা উদ্দেশ্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির একটা গুরুত্ব আছে, যা মস্তিস্কের একটি প্রক্রিয়া হিসাবে সিদ্ধান্ত নেবার প্রক্রিয়াটি দ্রুততর করে যে কোনো বিপজ্জনক এবং গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পরিস্থিতিতে। সহজেই কিন্তু স্পষ্ট হয়না যে দ্বৈতবাদী উদ্দেশ্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিরই একটি অপরিহার্য অনুসঙ্গ। আমি ব্যপারটা এখানে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করত যাবো না, কিন্তু আমি মনে করি কোনো এক ধরনের ‘থিওরী অব আদার মাইণ্ড সংক্রান্ত একটি কেস এখানে গড়ে তালা যেতে পারে ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে, যাকে অনায়াসে বর্ণনা করা যেতে পারে ডুয়ালিস্টিক বা দ্বৈতবাদী, যা ইনটেনশনাল স্ট্যান্সের বা উদ্দেশ্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি গড়তে পারে বিশেষ করে জটিল কোনো সামাজিক পরিস্থিতিতে,এমন কি বিশেষ করে যেখানে আরো উঁচু পর্যায়ে ইনটেনশনালাটির বা উদ্দেশ্যময়তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়।

ডেনেট তৃতীয় মাত্রার ইনটেনশনালিটি (থার্ড অর্ডার ইনটেনশনালটি) বা উদ্দেশ্যমূলকতার (পুরুষটি বিশ্বাস করে যে, নারীটি জানে সে তাকে কামনা করছে); চতুর্থ মাত্রার বা ফোর্থ অর্ডার (নারীটি বুঝতে পারছেন যে,পুরুষটি বিশ্বাস করে নারীটি জানে সে তাকে কামনা করে); এমনকি পঞ্চম মাত্রার উদ্দেশ্যমূলকতারও (শামান অনুমান করছেন যে নারীটি বুঝতে পেরেছে, পুরুষটি বিশ্বাস করে যে নারীটি জানে সে তাকে কামনা করছে) কথা উল্লেখ করেছেন; খুব বেশী মাত্রার ইনটেনশনালিটি সম্ভবত সীমাবদ্ধ কল্পকাহিনীতে, মাইকেল ফ্রায়ান (৩৭) তার অত্যন্ত কৌতুকপ্রদ উপন্যাস ‘দ্য টিন ম্যান এ যেমন শ্লেষাত্মক ভাষায় লিখেছিলেন,’নুনোপুলোসকে দেখে, রিক জানতো যে সে প্রায় নিশ্চিৎ যে, অ্যানা তীব্র ঘৃণা অনুভব করেছিল ফিডলিংচাইল্ড এর তার অনুভূতিগুলো বুঝতে না পারার ব্যর্থতার প্রতি এবং সে (অ্যানা) জানতো যে, নীনা আগে থেকেই জানতো যে সে (অ্যানা) জানে নুনোপুলোস এর এ বিষয়ে ধারণা…।’ কিন্তু বাস্তব সত্যটি হলো, আমরা এই অন্য কারো মন সম্বন্ধে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে একরম জটিল দ্বন্দ্ব দেখে যে হাসতে পারছি সম্ভবত এটি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেমন আমাদের মন কেমন করে বাস্তব জগতে কাজ করার জন্য প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত হয়েছে।

নিদেনপক্ষে কম মাত্রায় ইনটেনশনাল স্ট্যান্স, ডিজাইন স্ট্যান্স এর মত সময় বাঁচায়,যা বাঁচার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ফলাফলে প্রাকৃতিক নির্বাচন শর্টকাট হিসাবে ইনটেনশনাল স্ট্যান্সকে ব্যবহার করার উপযোগি করে আমাদের মস্তিস্ক গড়ে তুলেছে; আমরা জৈববৈজ্ঞানিকভাবেই প্রোগ্রাম করা, যে কোনো সত্তা উপর উদ্দেশ্য আরোপ করা যাদের আচরণ আমাদের কাছে। গুরুত্বপূর্ণ। আরো একবার, পল বুম শিশুদের মধ্যে এর পরীক্ষামূলক প্রমাণ উল্লেখ করে বলেছেন, যে শিশুরা বিশেষভাবে ইনটেনশনাল স্ট্যান্সটিকেই বেছে নেয়। যখন ছোট শিশুরা কোনো বস্তু দেখে অপর একটি বস্তুকে অনুসরণ করছে (যেমন কোনো কম্পিউটার স্ক্রিন),তারা ধরে নেয় সক্রিয়ভাবে একটি আরেকটির পিছু নিচ্ছে, আর এই অনুগমন একটি উদ্দেশ্যসহ এজেন্টের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং তারা সত্যিকারের বিস্ময় প্রকাশ করে যখন কাল্পনিক সেই এজেন্টটি ব্যার্থ হয় তার এই ধাওয়া করে ধরার প্রচেষ্টায়।

ডিজাইন স্ট্যান্স ও ইনটেনশনাল স্ট্যান্স খুব উপকারী দুটি ব্রেন মেকানিজম, কোনো সত্তা সম্বন্ধে ধারণার প্রক্রিয়াটিকে এরা দ্রুত করে, যা সার্ভাইভাল বা বাঁচার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, যেমন আক্রমণ করতে পারে এমন শিকারী প্রাণী বা সম্ভাব্য প্রজনন সঙ্গী। কিন্তু অন্য ব্রেইন মেকানিজমের মত এই স্ট্যান্সগুলো ভুল করতে পারে। শিশুরা ও আদি মানুষরা আবহাওয়ার,ঢেউ, স্রোত, গড়িয়ে পড়া পাথরের উপর উদ্দেশ্য আরোপ করে আমাদের সবারই যন্ত্রের সাথে সেই একই কাজ করার প্রবণতা আছে,বিশেষ করে যখন তারা ঠিক মত কাজ না করে আমাদের হতাশ করে। অনেকেই হয়তো খানিকটা ভালোলাগার সাথে মনে রাখতে পারেন, যেদিন বাসিল ফল্টির (৩৯) গাড়ী নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বিশেষ একটি রাতের ভোজসভার আয়োজন বাঁচানোর প্রচেষ্টায় নেয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি মিশনের সম তার গাড়ীটি হঠাৎ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তিনি গাড়ীটিকে প্রথমে সাবধান বাণী শোনান,তিন পর্যন্ত গণনা করেন,এরপর গাড়ী থেকে বের হয়ে একটা গাছের ডাল যোগাড় করেন,সমানে গাড়ীটিকে পেটাতে থাকেন যেন প্রায় মেরে ফেলবার অভিপ্রায়ে; আমাদের অনেকের জীবনে এই পরিস্থিতি হয়েছে, ক্ষণকালের জন্য হলেও, সে অভিজ্ঞতা গাড়ী নিয়ে না হলে হয়েতো কম্পিউটার নিয়ে। জাস্টিন ব্যারেট (৪০) একটি সংক্ষিপ্ত রুপ প্রস্তাব করেছিলেন, Hyperactive Agent Detection Device এর জন্য, HADD; আমরা অতিসক্রিয় হয়ে যে কোনো কিছুর কারণ হিসাবে কোনো না কোনো এজেন্টকে খুঁজে বের করি,যখন হয়তো সেখানে কোনো এজেন্টরই অস্তিত্ব আসলে নেই এবং এটাই আমাদের সন্দেহ প্রবণ করে তোলে এমন কোথাও খারাপ বা ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে, যেখানে আসলে প্রকৃতি শুধুমাত্র নির্বিকার। আমি আমাকে ক্ষণিকের জন্য হলেও লক্ষ করেছি মনে তীব্র বুনো বিতৃষ্ণা পোষণ করতে, কোনো নির্দোষ প্রাণহীন বস্তদের প্রতি, যেমন আমার সাইকেলের চেইন; একটি দুঃখজনক সাম্প্রতিক ঘটনা জানাচ্ছে, এক ব্যক্তি তার ঠিকমত বাধা না থাকা জুতোর ফিতায় জড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে গড়িয়ে গিয়েছিল কেমব্রিজের ফিজউইলিয়াম মিউজিয়ামে,এই নীচে গড়িয়ে পড়ার সময় তিনি দুর্লভ এবং অমূল্য একটি কিং রাজবংশকালীন সময়ের একটি চিনামাটির পাত্রের উপর এসে পড়ে, যা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল। মিউজিয়াম কর্মচারীরা সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখতে পান ব্যক্তিটি সেই ভেঙ্গে যাওয়া পাত্রটির অজস্র টুকরোর ঠিক মাঝখানে বসে আছেন হতবাক হয়ে, যেন তীব্র ধাক্কায় বাকরুদ্ধ হয়ে চারদিকে সবাই যখন গভীর নীরবতায় চুপ করে আছেন, ব্যক্তিটি বার বার তার জুতার ফিতার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলছিল, এই যে, এটাই আসল অপরাধী (৪১)।

ধর্মের অন্য বাই-প্রোডাক্ট ব্যাখ্যাগুলো প্রস্তাব করেছিলেন হিও,শেরমার, বয়ের,ডেনেট,আটরান,ব্লম,কোলম্যান সহ অনেকে। একটি বিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক সম্ভবনার কথা উল্লেখ করেছিলেন ডেনেট, ধর্মের অযৌক্তিকতা হচ্ছে আমাদের মস্তিস্কের একটি নির্দিষ্ট ইনবিল্ট বা অন্তর্গত অযৌক্তিকতারই একটি বাই-প্রোডাক্ট বা উপজাত: সেটি হচ্ছে আমাদের প্রেমে পড়ার প্রবণতা, যার সম্ভবত জিনগত কিছু সুবিধা আছে।

নৃতত্ত্ববিদ হেলেন ফিশার (৪২), তার ‘হোয়াই উই লাভ’ (৪৩) বইটিতে রোমান্টিক ভালোবাসার উন্মত্ত পাগলামোটাকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছিলেন এবং কিভাবে একে অতি মাত্রায়। তুলনা করা হয় এমন কিছুর সাথে, যা মনে হতে পারে অবশ্যই প্রয়োজনীয়। বিষয়টি এভাবে লক্ষ করুন: কোনো পুরুষর দৃষ্টিভঙ্গিতে তার পরিচিতদের মধ্যে শুধু মাত্র একজন নারী অন্যান্য নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীঅপেক্ষা শতগুণ বেশী ভালোবাসার যোগ্য হবার সম্ভাবনা কিন্তু খুবই কম। কিন্তু তারপরেও পুরুষটি এভাবেই তার ভালোবাসার পাত্রীকে বর্ণনা করে থাকে যখন সে তার প্রেমে পড়ে। এই উন্মত্ত গোঁড়া একগামী আনুগত্যের প্রবণতা যার শিকার হবার সম্ভাবনা আমাদের সবারই,তার তুলনা কিন্তু একধরনের পলিআমমারী বা বহুপ্রেম এর চেয়ে বেশী যৌক্তিক মনে হতে পারে (পলিঅ্যামোরী, হচ্ছে সেই বিশ্বাস, যে কেউ একই সাথে বিপরীত লিঙ্গর কয়েকজন সদস্যকে ভালোবাসতে পারে, ঠিক যেমন করে কেউ একাধিক মদ,সুরকার,বই কিংবা খেলা ভালোবাসতে পারে);আমরা আনন্দের সাথে মেনে নেই যে, আমরা একাধিক শিশু, পিতামাতা, ভাইবোন, শিক্ষক, বন্ধু কিংবা পোষা প্রাণীদের ভালোবাসতে পারি। আপনি যখন বিষয়টা এভাবে ভাবেন,তখন এই স্পাউজাল বা স্বামী-স্ত্রী বা সঙ্গী, সঙ্গিনীর ভালোবাসার মধ্যে আমরা যে একচেটিয়া অধিকার দাবী করি সেটা কি অবশ্যই বেশ অদ্ভুত মনে হয় না? তারপরও আমরা ঠিক ‘সেটাই প্রত্যাশা করি এবং সেটা অর্জন করার জন্য জন্যই আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে; নিশ্চয়ই কোনো একটি কারণ আছে এর পেছনে।

হেলেন ফিশার এবং অন্যান্যরা আমাদের দেখিয়েছেন যে, ভালোবাসায় আপ্লুত থাকার সাথে সংশ্লিষ্টদের আমাদের মস্তিস্কের অন্যন্য কিছু পরিস্থিতি,যেমন কিছু স্নায়বিক প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্য (যাদের আসলে প্রাকৃতিক মাদক দ্রব্য) যারা এই ধরনের পরিস্থিতির জন্য বিশেষভাবে নির্দিষ্ট এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা একমত তাঁর (ফিশার) সাথে, এই অযৌক্তিক বজ্রাঘাত (Coup de foudre) হতে পারে অপর সহ মাতা বা সহ-পিতার প্রতি আনুগত্যকে নিশ্চিৎ করার একটি প্রক্রিয়া, যা যথেষ্ট দীর্ঘ হয় যেন তারা একসাথে একটি সন্তানের প্রতিপালন করতে পারেন। ডারউইনীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে,কোনো সন্দেহ নেই,একজন ভালো জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনী নির্বাচন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, নানাবিধ কারণে। কিন্তু একবার নির্বাচন করে ফেলার পর–এমনকি সেটা খারাপ হোক– এবং একটি সন্তান ধারণ করার পর,যে কোনো পরিস্থিতিতে একে অপরের সাথে থাকাটা আরো বেশী প্রয়োজনীয়, কমপক্ষে শিশুটি যতদিন মায়ের বুকের দুধ না ছাড়ে।

অযৌক্তিক ধর্ম বিশ্বাস কি সেই অযৌক্তিকতার প্রক্রিয়াটির একটি বাই-প্রোডাক্ট, যা প্রাকৃতিক নির্বাচন মূলত আমাদের ব্রেইনের একটি অন্তর্গত প্রক্রিয়া হিসাবে সৃষ্টি করেছে প্রেমে পড়ার জন্য? নিশ্চয়ই, ধর্মীয় বিশ্বাস এর বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা প্রেমে পড়ার মতই (দুই অবস্থারই অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য মনে হতে পারে মাদকদ্রব্যে আসক্ত হয়ে থাকার মতই) (৪৪); স্নায়ুমনোচিকিৎসাবিদ জন স্মিথিস (৪৫) আমাদের সতর্ক করেছেন যে, মস্তিস্কের যে এলাকাগুলো এই দুই ম্যানিয়া বা উন্মত্ততায় সক্রিয় হয় তার মধ্যে স্পষ্ট কিছু তারতম্য আছে,তবে তাসত্ত্বেও বেশ কিছু মিলও আছে তাদের মধ্যে:

ধর্মের বহুরুপের একটি রুপ হচ্ছে, একটি অতিপ্রাকৃত সত্তার প্রতি নিবেদিত তীব্র ভালোবাসা,যেমন, ঈশ্বর; এছাড়া এই সত্তার নানা আইকন বা নিদর্শনের প্রতি তীব্র শ্রদ্ধা।মানুষের জীবন প্রধানত পরিচালিত হয় আমাদের স্বার্থপর জিনগুলো এবং রিইনফোর্সমেন্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে; ইতিবাচক বা পজিটিভ রিইনফোর্সমেন্ট এর অনেকটাই আসে ধর্ম থেকে: ভালোবাসা পাবার সেই উষ্ণ এবং স্বস্তি জাগানো অনুভূতি এবং বিপদজ্জনক এই পৃথিবী থেকে সুরক্ষিত বোধ করার সেই অনুভূতি, মৃত্যুভয়কে হারানো, খারাপ সময়ে সেই পাহাড়ের চুড়া (I will lift up my eyes to the hills, from where comes my help: Psalm 121:1) থেকে প্রার্থনার উত্তরে আসা সহযোগিতা ইত্যাদি। ঠিক সেভাবেই বাস্তবে উপস্থিত সত্যিকার কোনো মানুষের প্রতি (সাধারণত অন্য লিঙ্গের) রোমান্টিক ভালোবাসা সেই একই গভীর মনোসংযোগের উপস্থিতি নিদর্শন বহন করে এবং এটাও পজিটিভ রিইনফোর্সমেন্টর সাথে যুক্ত। এই অনুভূতি গুলো সুচনা করতে পারে অন্যজনের কোনো নির্দশন এর দেখার মাধ্যমে, যেমন, চিঠি, ফটোগ্রাফ, আর সেই ভিক্টোরিয়ার যুগে এক গোছা চুল,ভালোবাসায় নিমজ্জিত হয়ে থাকার সেই অবস্থায় অনেক শরীরবৃত্তীয় অনুসঙ্গ আছে, যেমন, ফার্নেসের মত দীর্ঘশ্বাস ফেলা (৪৬)।

১৯৯৩ সালে আমি ভালোবাসায় নিমজ্জিত হওয়া এবং ধর্মের মধ্যে তুলনামূলক একটি আলোচনা করেছিলাম, যেখানে আমি উল্লেখ করেছিলাম,খুব বিস্ময়করভাবে ধর্ম দ্বারা সংক্রমিত হওয়া কোনো ব্যক্তির উপসর্গগুলো, সাধারণত যৌন ভালোবাসার সাথে সংশ্লিষ্ট উপসর্গগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। আমাদের মস্তিস্কে এটি অত্যন্ত জোরালো একটি শক্তি এবং আদৌ বিস্ময়কর কোনো ব্যপার না যে কিছু ‘ভাইরাস’ বিবর্তিত হতেই পারে এটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারার ক্ষমতা অর্জন করার ক্ষেত্রে (ভাইরাস’ এখানে ধর্মের রুপাকার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আমার সেই নিবন্ধের নাম ছিল ‘ভাইরাসেস অব দ্য মাইন্ড’(৪৭)); সেইন্ট টেরেসা অব আভিলার (৪৮) সেই তীব্র সুখানুভূতি বা অর্গাজম এর মত বিখ্যাত ভিশন বা স্বপ্ন তো যথেষ্ট কুখ্যাত এখানে পুনরায়। উল্লেখ করার জন্য। তবে আরো গুরুত্বের সাথে এবং আরো খানিকটা কম স্কুল ইন্দ্রিয়পরায়নতার পর্যায়ে, দার্শনিক অ্যান্থনী কেনী (৪৯) চমৎকার কিছু স্বাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করেছেন যে কি বিশুদ্ধ তীব্র আনন্দ অপেক্ষা করছে তাদের জন্য,যারা ট্রান্সসাবস্টানসিয়েশন (রোমান ক্যাথলিক ধর্মমতে ট্রান্সসাবস্টানসিয়েশন হচ্ছে একটি মতবাদ যা প্রস্তাব করছে, ইউক্যারিষ্ট বা হলি কমিউনিয়ন এর সময়, গমের রুটি এবং আঙ্গুরের রসের মদ রুপান্তরিত হয় যীশু খৃষ্টের শরীর এবং রক্তে) এর রহস্যটিতে কোনোভাবে তাদের বিশ্বাস স্থাপন করতে পারবেন; রোমান ক্যাথলিক যাজক হিসাবে তার দীক্ষা নেবার এবং মাস। অনুষ্ঠান পরিচালনা করার তাকে বিশেষ ক্ষমতায়ন করেছিলো কিভাবে তা ব্যাখ্যা করে তিনি বেশ জীবন্ত ভাবে তার স্মৃতিচারণ করেন;

প্রথম মাসগুলোর সেই তীব্র আনন্দের কথা যখন আমার রোববারের প্রার্থনা সভা বা মাস পরিচালনা করার ক্ষমতা ছিল; সাধারণত দেরী করে ধীরে আর অলসতার সাথে বিছানা থেকে উঠতে অভ্যস্ত আমি সকালে প্রায় লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠতাম,পুরোপুরি সজাগ এবং তীব্র উত্তেজনা অনুভব করতাম,যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করার জন্য সুযোগ আমি পেয়েছি সেটি চিন্তা করে…

খ্রিষ্টের শরীর স্পর্শ করা, যীশুর যাজকদের সান্নিধ্য, আমাকে মুগ্ধ করতো। কনসেক্রেশন এর শব্দগুলো উচ্চারণ করার পর আমি শান্ত দৃষ্টি মেলে হোস্ট এর দিকে তাকাতাম, যেমন করে কোনো প্রেমিক বা প্রেমিকা প্রিয়জনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে, যাজক জীবনের সেই শুরুর দিনগুলো আমার স্মৃতিতে রয়ে গেছে পূর্ণ তৃপ্তি আর তীব্র সুখের দিন হিসাবে, যা অমূল্য এবং দীর্ঘস্থায়ী হবার নয় এমন ভঙ্গুর, যেমন কোনো রোমান্টিক ভালোবাসা যার সমাপ্তি ঘটে কোনো অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিবাহের বাস্তবতায়।

মথদের আলো-কম্পাসের প্রতিক্রিয়ার সমতুল্য হচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে অযৌক্তিক তবে একজন এবং শুধুমাত্র বিপরীত লিঙ্গের একজন মাত্র সদস্যের সাথে প্রেমে পড়ার উপযোগী কার্যকর আচরণটি। মিস ফায়ারিং বা ভুল প্রতিক্রিয়ার উপজাত যেমন মোমবাতির আগুনে উড়ে আত্মাহুতি দেবার সমতুল্য হচ্ছে ইয়াহয়ে বা ঈশ্বরের প্রেমে পড়া (বা কুমারী মেরী বা আল্লাহ) এবং এধরনের ভালোবাসা দ্বারা তাড়িত হয়ে অযৌক্তিক আচরণ করা।

জীববিজ্ঞানী লুইস ওলপার্ট (৫০), তার ‘সিক্স ইমপসিবল থিংস বিফোর ব্রেকফাষ্ট’ (৫১) বইটিতে একটি প্রস্তাব করেছিলেন, যা গঠনমূলক অযৌক্তিকতার ধারণাটির একটি সাধারণীকরণ রুপ হিসাবে দেখা যেতে পারে। তার বক্তব্য ছিল অযৌক্তিকভাবে ধারণ করা কোনো দৃঢ় বিশ্বাস মনের প্রায়শই দ্রুত পরিবর্তনশীলতার বিরুদ্ধে রক্ষা করে: যে বিশ্বাসগুলো জীবন বাঁচিয়েছিল, যদি তাদের দৃঢ়ভাবে ধারণ করা না হত, সেটা আদি মানুষের বিবর্তনের জন্য সুবিধাজনক হতো না। বরং খুবই অসুবিধার কারণ হতো সেটি, যেমন, শিকার করার সময় বা টুল বা হাতিয়ার তৈরীর সময়, দ্রুত মন পরিবর্তন করা। ওলপার্টের যুক্তির একটি অর্থ হলো নিদেনপক্ষে কোনো কোনো পরিস্থিতিতে, দোদুল্যমান অনিশ্চয়তায় না বরং অযৌক্তিক বিশ্বাসে অটল থাকা শ্রেয়, এমনকি যখন নতুন প্রমাণ বা যুক্তি পরিবর্তনের সপক্ষে অবস্থান করে। খুবই সহজ কিন্তু প্রেমে পড়ার যুক্তিটি একটি বিশেষ কেস হিসাবে দেখা এবং একই ভাবে খুব সহজ এটি দেখা যে ওলপার্টের এই ‘অযৌক্তিক স্থিতিশীলতা আরো একটি উপযোগী মানসিক প্রবণতা যা অযৌক্তিক ধর্মীয় আচরণের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ব্যাখ্যা করতে পারে: আরো একটি উপজাত বা বাই-প্রোডাক্ট।

রবার্ট ট্রিভার্স (৫২) তার সোস্যাল ইভ্যোলুশন (৫৩) বইটিতে ১৯৭৬ সালের আত্মপ্রবঞ্চনার বিবর্তনীয় তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করেছিলেন বিস্তারিতভাবে:

আত্ম-প্রবঞ্চনা হলো সচেতন মন থেকে সত্যকে লুকিয়ে রাখা, যেন সেটি অন্যদের কাছ থেকেও লুকিয়ে রাখা যায় উত্তমভাবে। আমাদের প্রজাতিতে আমরা সেটা শনাক্ত করতে পারি, দৃষ্টি এড়ানোর প্রচেষ্টা, ঘেমে ওঠা হাতের তালু এবং ফেটে যাওয়া গলার আওয়াজ হয়তো সেই ছলনা করার সচেতন জ্ঞান থেকে উদ্ভুত চাপের বহিঃপ্রকাশ। এই ছলনার ব্যপারটিকে সচেতন স্তরে উপেক্ষা করার মাধ্যমে,ছলনাকারী এই সব চিহ্ন একজন পর্যবেক্ষককারীর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে পারে; সেই ব্যক্তিটি অনায়াসে মিথ্যা কথা বলতে পারে ছলনার সংশ্লিষ্ট উত্তেজনা, অস্থিরতা ছাড়াই।

নৃতত্ত্ববিদ লায়োনেল টাইগার (৫৪) এধরনের কিছু কথা বলেছেন তাঁর ‘অপটিমিজম: দ্য বায়োলজী অফ হোপ’ (৫৫) বইটিতে। গঠনমূলক অযৌক্তিকতা যা আমরা আলোচনা করছিলাম সেটা দেখা যাবে ট্রিভার্স এর ‘উপলদ্ধিগত প্রতিরক্ষা বিষয়ক একটি অনুচ্ছেদে

মানুষের একটি প্রবণতা আছে, সচেতনভাবে তারা যা চায় তা দেখতে পারে। নেতিবাচক কোনো কিছু দেখতে তাদের আক্ষরিক অর্থেই কষ্ট হয় যেমন ঠিক ততটাই সহজে তারা ইতিবাচক বিষয়গুলো দেখতে পায়। যেমন যে শব্দগুলো চিন্তার উদ্রেক করে, হয়তো এর সাথে সংশ্লিষ্ট কারো ব্যক্তিগত ইতিহাস বা পরীক্ষামূলক কোনো ম্যানিপুলেশন, সেগুলো বোধগম্য হবার আগেই প্রয়োজন আরো বিষদ ব্যাখ্যা। ধর্মের খামখেয়ালী চিন্তার সাথে এর প্রাসঙ্গিকতার বিষদ ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন পড়ে না।

দুর্ঘটনাবশত সৃষ্ট উপজাত হিসাবে ধর্ম–কোনো উপযোগী কিছুর মিসফায়ারিং এই সাধারণ তত্ত্বটির সপক্ষে আমার অবস্থান। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা বহুরুপের, জটিল এবং বিতর্কিত। উদাহরণ দেবার খাতিরে, আমি আমার ‘অতি বিশ্বাসপ্রবণ’ শিশুর তত্ত্বটি সাধারণ বাই-প্রোডাক্ট তত্ত্বের একটি প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে ধরে আলোচনায় অগ্রসর হবো। এই তত্ত্বটি যে, শিশুর মস্তিস্ক, কিছু উত্তম কারণেই, মানসিক ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হবার প্রবণতা থাকে–পাঠকদের কাছে হয়তো অসমাপ্ত মনে হতে পারে। হতে পারে মন আক্রম্য, সহজেই যে আক্রান্ত হচ্ছে, কিন্তু কেন এটি ‘এই’ ভাইরাস দিয়ে, অন্য কিছু না, আক্রান্ত হবে? কোনো কোনো ভাইরাস কি বিশেষভাবে দক্ষ এধরনের সহজে আক্রম্য কোনো মনকে সংক্রমিত করার জন্য? কেন এই ‘সংক্রমণ’ আত্মপ্রকাশ করে ধর্ম হিসাবে, অন্য কোনো ভাবে না কেন? আমি যা বলতে চাইছি তার অংশ বিশেষ হচ্ছে, বিশেষ কোনো ধরনের অর্থহীনতা শিশুর মস্তিস্কে আক্রান্ত করে তাতে কিছু যায় আসেনা, একবার সংক্রমিত হলে, শিশুটি প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর তার পরবর্তী প্রজন্মকে সংক্রমিত করে একটি অর্থহীনতা দিয়ে, সেটা যাই হোক না কেন?

নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ যেমন ফ্রেজারের(৫৬) ‘গোল্ডেন বোহ’ (৫৭) আমাদের চমৎকৃত করে মানুষের বৈচিত্র্যময় অযৌক্তিক বিশ্বাস সমুহের বিবরণ। একবার যখন সংস্কৃতির গভীরে এরা প্রোথিত হয়, তারা টিকে থাকে, বিবর্তিত হয় এবং নানা ধারায় বিভাজিত হয়, জীববিজ্ঞানের বিবর্তনের কথা মনে করিয়ে দেয় তাদের বিবর্তনের প্রক্রিয়া। তারপরও ফ্রেজার কিছু সাধারণ নীতিমালা চিহ্নিত করেছেন, যেমন, ‘হোমিওপ্যাথীর ম্যাজিক’; যেখানে নানা মন্ত্র বাস্তব পৃথিবীর কোনো কিছুর প্রতীকী রুপকে ধার করে যাকে তারা প্রভাবিত করতে চাইছে। এধরনের বিশ্বাসের দুঃখজনক ফলাফলের একটি উদাহরণ হচ্ছে, গণ্ডারের শিং এর গুড়ার যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি করার গুণাবলী আছে; অসার তো বটেই, দৃঢ় উত্থিত পুরুষাঙ্গের সাথে গণ্ডারের শিং (যদি এটি শিং নয়) এর সাদৃশ্য থেকে এই ভ্রান্ত ধারণার জন্ম। হোমিওপ্যাথীর যাদুময়তার সর্বব্যাপি প্রস্তাব করে যে, এই অর্থহীনতা যা আক্রম্য মস্তিস্ককে সংক্রমণ করে আসলে পুরোপুরিভাবে র‍্যানডোম বা এলোমেলো, কাল্পনিক অর্থহীনতা নয়।

একটি জীববিজ্ঞানীয় সমতুল্য কিছুর কল্পনা করাটা বেশ লোভনীয়, যেমন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মতো কি কোনো কিছু কি এখানে কাজ করছে? কিছু ধারণা কি আসলেই অন্য ধারণাদের চেয়ে বেশী দ্রুত বিস্তার লাভ করে, এর অন্তর্নিহিত আবেদন বা গুণ বা বিদ্যমান মানসিক গঠনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবার কারণে, আর এটা কি সত্যিকার ধর্মে, আমরা তাদের যেভাবে দেখি, তার প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা দিতে পারে, যেমন প্রাকৃতিক নির্বাচন যেমন সকল জীবের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে পারে? গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি মনে রাখতে হবে সেটা হলো: এর ‘গুণ বা মেরিট’ এর অর্থ এখানে শুধু বেঁচে থাকা আর বিস্তার লাভ করা; এর অর্থ এই না যে এটি ইতিবাচক মানের বিচার প্রত্যাশা করে– এমন কোনো কিছু যা নিয়ে আমরা মানবিকভাবে গর্ব করতে পারি।

এমনকি কোনো বিবর্তনীয় মডেলে, সেখানে কোনো প্রাকৃতিক নির্বাচন থাকার বাধ্যবাধকতা নেই। জীববিজ্ঞানীরা মেনে নিয়েছেন যে কোনো একটি জিন জনসংখ্যার মধ্যে বিস্তার লাভ করতে পারে, কারণ যে এটা কোনো ভালো জিন তাই না বরং শুধু এর কারণ ভাগ্য; আমরা একে জেনেটিক ড্রিফট বলি; প্রাকৃতিক নির্বাচন এর মুখোমুখি এটি কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা বিতর্কিত। কিন্তু বর্তমানে এটি ব্যাপকভাবে গ্রহনযোগ্য তথাকথিত নিউট্রাল থিওরী অব মলিকুলার জেনেটিক্স এর একটি রুপ হিসাবে। যদি কোনো জিন। মিউটেশন হয়ে তার নিজেরই একটি ভিন্ন সংস্করণ সৃষ্টি করে যা ঠিক একই ধরনের প্রভাব আছে, তখন এই পার্থক্যটা নিউট্রাল বা নিরপেক্ষ; প্রাকৃতিক নির্বাচন কোনোটার প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব করতে পারেনা। যাই হোক পরিসংখ্যানবিদদের ভাষায় যাকে বলা হয় “সাম্পলিং এরর বহু প্রজন্ম ধরে; নতুন মিউট্যান্ট জনসংখ্যায় জিন পুলে এই জিনটি ধীরে ধীরে মূল রুপটিকে প্রতিস্থাপিত করবে। পরমাণুর পর্যায়ে এটা সত্যিকারে বিবর্তনীয় পরিবর্তন (এমনকি যখন পুরো প্রাণীর পর্যায়ে কোনো পরিবর্তন যদি লক্ষ করাও না যায়); এটি একটি নিরপেক্ষ বিবর্তনীয় পরিবর্তন যার উপর নির্বাচনী চাপ বা সুবিধার কোনো প্রভাব নেই।

জেনেটিক ড্রিফট এর সাংস্কৃতিক সমতুল্য একটি জোরালো সম্ভাবনা যা আমরা উপেক্ষা করতে পারিনা যখন ধর্মের বিবর্তন নিয়ে আমরা চিন্তা করি। ভাষা বিবর্তিত হয় একটি প্রায় জৈববৈজ্ঞানিক একটি উপায়ে এবং এর বিবর্তনে যে দিকটি সে অনুসরণ করে মনে হতে পারে তা অনির্দিষ্ট, অনেকটা র‍্যানডোম ড্রিফট এর মত; জেনেটিক এর একটি সাংস্কৃতিক অনুরুপ এর মাধ্যমে এটি হস্তান্তরিত হয়, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয় যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রতিটি সুত্রই এতোটাই বদলে যায়, পারস্পরিক বোধগম্যতা আর থাকে না। সম্ভব হতে পারে যে, ভাষার বিবর্তনের কিছু অংশ এক ধরনের প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু এর সপক্ষে যুক্তিগুলো তেমন জোরালো নয়। আমি নীচে ব্যাখ্যা দেব, এধরনের কিছু ধারণা যা প্রস্তাব করা হয়েছে ভাষার প্রধান ধারাগুলোকে ব্যাখ্যা করতে, যেমন, দ্য গ্রেট ভাওয়েল শিফট, যা ইংরেজী ভাষায় ঘটেছে পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে। কিন্তু এধরনের ‘ফাঙ্কশনাল হাইপোথিসিস’ যথেষ্ট আমরা যা দেখি তা ব্যাখ্যা করার জন্য। সম্ভবত মনে হতে পারে যে ভাষা সাধারণত বিবর্তিত হয়েছে র‍্যানডোম জেনেটিক ড্রিফট এর কোনো সাংস্কৃতিক সমরুপ প্রক্রিয়ায়; ইউরোপের বিভিন্ন অংশে ল্যাটিন ভাষা বদলে হয়েছে স্প্যানিশ, পর্তুগীজ, ইতালীয়, ফরাসী, রোমানশ এবং এই ভাষাগুলোর নানা ডায়ালেক্ট এ। নিদেনপক্ষে বলতেই হবে, এইসব বিবর্তনীয় পরিবর্তন স্থানীয় সুবিধা বা কোনো ‘নির্বাচনী চাপ’কে প্রতিফলিত করছে সেই বিষয়টি কিন্তু স্পষ্ট না।

আমি সারাংশ করবো যে, ধর্ম, ভাষার মত, বিবর্তিত হয়েছে যথেষ্ট র‍্যানডোমনেস নিয়ে, যার শুরুটা ছিল যথেষ্ট কাল্পনিক যা জন্ম দিয়েছে হতবাক করা-এবং কখনো বিপজ্জনক-বৈচিত্র্যময়তার সমাহার যা আমরা দেখছি। এবং একই সাথে সম্ভবত প্রাকৃতিক নির্বাচনের মতো কোনো একটি কিছু, মানব মনস্তাত্ত্বিকতার মৌলিক সমরুপতার সাথে যা যুক্ত হয়ে নিশ্চিৎ করেছে, বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন ধর্মগুলোর গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে যেন সাদৃশ্যতা থাকে। অনেক ধর্ম, যেমন, শিক্ষা দেয় নৈর্ব্যাক্তিকভাবে অসম্ভব, ব্যাখ্যার অতীত, তবে নিজস্ব ধারণাগতভাবে আকর্ষণীয় সেই মতবাদ যে, আমাদের ব্যক্তিত্ব শরীরের মুত্যুর পরও বেচে থাকে। অমরত্বের ধারণা নিজেই টিকে থাকে এবং বিস্তার লাভ করে কারণ এটি পছন্দনীয় অভিলাষী চিন্তাকে প্রশ্রয় দেয়। এবং এই সব চিন্তারও গুরুত্ব আছে, কারণ মানুষের মনোজগত প্রায় সর্বজনীন প্রবণতা আছে বিশ্বাসকে তাদের নানা আকাঙ্খর রঙে রঞ্জিত করার (“হ্যারী, তোমার ইচ্ছাটাই হচ্ছে সেই চিন্তার জনক’, শেক্সপিয়ার এর হেনরী ফোর্থ পার্ট ২, তার পুত্রের উদ্দেশ্যে) (৫৮)।

মনে হয় এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, ধর্মের অনেক বৈশিষ্ট্যই আসলে ধর্মের নিজের এবং মানুষের সংস্কৃতির মিশ্রণে সেই সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উপযোগী; এখন প্রশ্ন যে তাহলে এই। ভালো সামঞ্জস্যতাটি কি অর্জিত হয়েছে ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ দিয়ে নাকি ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন দিয়ে। উত্তর সম্ভবত দুটোই। ডিজাইনের পক্ষে ধর্মীয় নেতারা সম্পূর্ণভাবে দক্ষ ধর্মকে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় শব্দাবলী, আচার এবং কৌশল ব্যবহার করার ক্ষেত্রে। মার্টিন লুথার (৫৯) খুব ভালো করে জানতেন যুক্তি হচ্ছে ধর্মের সবচেয়ে বড় শত্রু। এবং তিনি প্রায়শই যুক্তির বিপজ্জনক রুপটি নিয়ে সাবধান বাণী উচ্চারণ করে গেছেন: ‘যুক্তি হচ্ছে বিশ্বাসের সবচেয়ে বড় শত্রু, আত্মিক কোনো বিষয়ে এটি কখনোই সাহায্যে আসেনা এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এটি স্বর্গীয়। জগতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, এবং ঈশ্বরের কাছ থেকে যা কিছু এসেছে সব কিছুর প্রতি এটি অবজ্ঞা পোষণ করে (৬০)। আবার যেমন বলেছেন: “যারাই খ্রিষ্টান হতে চান, তাদের চোখ সরাতে হবে তার যুক্তির বাইরে। এবং আবারো, যেমন: “ খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী সবার মধ্যে যুক্তিকে নিশ্চিহ্ন করা উচিৎ; লুথারের কোনো সমস্যাই হোত না ধর্মকে টিকে থাকতে সাহায্য করার এর বুদ্ধিমত্তাহীন অংশটিকে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ডিজাইন করতে। কিন্তু তার অর্থ এই না যে, তিনি বা অন্য কেউ এটি ডিজাইন করেছেন। এটি বিবর্তিত হতে পারে একটি (জেনেটিক বা জিন নির্ভর) নয় এমন কোনো প্রাকৃতিক নির্বাচনের একটি রুপের মাধ্যমে, যা ডিজাইনার লুথার নন, তবে তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান যিনি এর কার্যকারীতা ভালোভাবে লক্ষ করেছিলেন।

যদিও প্রথাভিত্তিক জিনদের ডারউইনীয় নির্বাচন হয়তো সহায়তা করেছে সেই ধরনের মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোগুলোকে তৈরী করতে যা উপজাত বা বাই-প্রোডাক্ট হিসাবে ধর্মকে সৃষ্টি করেছে, তবে এর খুঁটিনাটি বিষয়গুলোর আকার দেবার ব্যপারে এর ভূমিকা না থাকারণ কথা। আমি এর আগেই এ ব্যপারে কিছু ইঙ্গিত দিয়েছিলাম যে, যদি আমার কোনো এধরনের নির্বাচনী তত্ত্ব এর খুঁটিনাটি বিস্তারিত বিষয়গুলোর উপর প্রয়োগ করার বিষয়টি ভাবতে চাই, আমাদের জিনের দিকে না বরং তাদের সাংস্কৃতিক কোনো সমতুল্যর দিকে তাকানো উচিৎ; ধর্মগুলো মিমদের (৬১) মতই এমন কিছু?

সাবধানে, কারণ আপনি আমার মিমের উপর দিয়ে হাটছেন।

ধর্মের ক্ষেত্রে সত্যি হচ্ছে শুধুমাত্র সেই মতামতটা যা টিকে গেছে।
–অস্কার ওয়াইল্ড (৬২)

এই অধ্যায়টি শুরু হয়েছিল একটি পর্যবেক্ষণ দিয়ে যেহেতু ডারউইনীয় প্রাকৃতিক নির্বাচন যে কোনো ধরনের অপচয়কে সহ্য করতে পারেনা, সে কারণেই কোনো প্রজাতির মধ্যে সর্বব্যাপী দৃশ্যমান কোনো বৈশিষ্ট্য, যেমন ধর্ম, নিশ্চয়ই কিছু উপযোগিতা প্রদান করেছিল নতুবা এটি টিকে থাকতো না। কিন্তু আমি ইঙ্গিত করেছিলাম সেই উপযোগিতা বা সুবিধাটির, প্রজাতির কোনো সদস্যর বেঁচে থাকা বা প্রজনন সাফল্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আমরা যেমনটি দেখেছি, সর্দি জ্বরের ভাইরাসের জিনগুলোর প্রদর্শিত উপযোগিতাই স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট, আমাদের প্রজাতির মধ্যে কেন এই কষ্টকর অসুস্থতার অভিযোগের সর্বব্যাপীতা (৬৩)। এবং আমাদের উপকার করার মতো কোনো জিন এর থাকতে হবে এমন কোনো প্রয়োজনীয়তাও নেই। যে কোনো একটা রেপ্লিকেটর বা অনুলিপিকারক হলেই চলে। রেপ্লিকেটরের সবচেয়ে সুস্পষ্ট উদাহরণ হচ্ছে শুধুমাত্র জিনরা, তবে এই মর্যাদা পাবার অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা হচ্ছে, কম্পিউটার ভাইরাস এবং সাংস্কৃতিক বংশগতির বাহক মিম ইউনিটগুলো এবং এই অংশের যেটি আলোচ্য বিষয়; আমাদের যদি মিমদের বুঝতে হয়, আমাদের একটু বিশেষভাবে লক্ষ করতে হবে ঠিক প্রাকৃতিক নির্বাচন কিভাবে তার কাজ করে।

এর সবচেয়ে সাধারণতম রুপে, প্রাকৃতিক নির্বাচনকে অবশ্যই বিকল্প রেপ্লিকেটরদের বা স্বঅনুলিপিকারকদের মধ্য থেকে কোনো একটিকে বেছে নিতে হয়। একটি রেপ্লিকেটর হচ্ছে কোড কৃত তথ্যমালা যা ঠিক তার হুবুহু অনুলিপি সৃষ্টি করতে সক্ষম, তবে কখনো কখনো একেবারে হুবুহু না হয়ে সামান্য ভিন্ন অনুলিপির সৃষ্টি করে (মিউটেশন); এর একটি কারণ হচ্ছে ডারউইনীয়, যে ধরনের রেপ্লিকেটরগুলো নিজেদের অনুলিপি তৈরী করার প্রক্রিয়ায়। দক্ষ, তারা সংখ্যায় ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে অনুলিপি সৃষ্টিতে অপেক্ষাকৃত অদক্ষ রেপ্লিকেটরদের তুলনায়। এটাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের একেবারে মূল কথা। সবচেয়ে আদর্শ রেপ্লিকেটর হচ্ছে জিন, ডিএনএ এর বেস অনুক্রম একটি অংশ যার অনুলিপি সৃষ্টি হয় প্রায় সবসময় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে, অসীম সংখ্যক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। মিম তত্ত্বের কেন্দ্রীয় প্রশ্নটি হচ্ছে, সাংস্কৃতিক অনুকরণেরও কি অনুরুপ কোনো একক আছে, যারা সত্যিকারের রেপ্লিকেটর, যেমন জিনের মত আচরণ করে? আমি বলছি না যে, মিমরা অবশ্যেই জিনের সবচেয়ে নিকটবর্তী অনুরুপ, শুধু, যতই তারা জিনদের মত আচরণ করে, মিম তত্ত্বটি ততই ভালো ভাবে কাজ করতে পারে;এবং এই অংশটির উদ্দেশ্য হচ্ছে এই প্রশ্নটাই জিজ্ঞাসা করা মিম তত্ত্বটি ধর্মের এই বিশেষ ক্ষেত্রে হয়তো কাজ কিনা?

জিনদের জগতে, অনুলিপি করার প্রক্রিয়ায় মাঝে মাঝে ঘটা ক্রটি (মিউটেশন) যে দ্বায়িত্ব পালন করে তা হলো মূল জিন সম্ভার বা পুলে যে কোনো জিনের বিকল্প রুপগুলোর উপস্থিতি নিশ্চিৎ করা ‘অ্যালিল’– সুতরাং যে বিকল্প রুপগুলোকে হয়তো মনে করা যেতে পারে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, কিন্তু কিসের জন্য সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা; ক্রোমোজোমের একটি নির্দিষ্ট জায়গা বা লোকাসের জন্য কি, যেখানে সেই সেট অ্যালিলগুলো অবস্থান করতে পারে এবং কিভাবে তারা প্রতিযোগিতা করে? সরাসরি একটি অণু সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী অণুর যুদ্ধ নয়, তাদের প্রতিনিধি প্রক্সির মাধ্যমে। এই প্রক্সিটি হলো তাদের ফেনোটাইপিক ট্রেইট– কিছু বাহ্যিক দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্য যেমন, পায়ের দৈর্ঘ্য বা লোমের রং : জিনের যে প্রকাশ প্রতিফলিত হয় গঠনগত, শরীরবত্তীয়, প্রাণ রসায়নিক কিংবা আচরণের মাধ্যমে। কোনো জিনের নিয়তি নির্ভর করে সেই শরীরগুলোর উপর যেখানে তারা ধারাবাহিকভাবেই অবস্থান করে। শরীরের উপর তাদের প্রভাব কেমন, এই বিষয়টি প্রজাতির সামগ্রিক জিনপুলে তার টিকে থাকার সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করে; জিন পুলে অনেক প্রজন্মান্তরে জিনগুলোর উপস্থিতির হার বাড়ে কিংবা কমে মূলত তাদের ফেনোটাইপিক (বাহ্যিক বা প্রকাশিত বৈশিষ্ট্যর) প্রক্সির কল্যাণে।

মিমদের ক্ষেত্রেও কি এমন কিছু সত্য হতে পারে? একটি ক্ষেত্রে তারা জিনদের মত না কারণ, এখানে সুস্পষ্টভাবে ক্রোমোজোম বা লোকাই বা আলিল বা যৌন পুনর্বিন্যাস বা রিকম্বিনেশনের অনুরুপ কিছু নেই। মিম পুলের গঠন জিন পুল অপেক্ষা সংগঠিত না। তাসত্ত্বেও কোনো একটি মিম পুলের কথা বলাটা খুব একটা অর্থহীন হবে বলে মনে হয়না, যেখানে কোনো নির্দিষ্ট মিমের উপস্থিতির হার হয়তো পরিবর্তিত হতে পারে বিকল্প মিমগুলোর পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলাফল হিসাবে।

অনেকেই মিম নির্ভর ব্যাখ্যার বিরোধীতা করেছেন; বিরোধীতার কারণও ভিন্ন, তবে মোটামুটিভাবে সব কারণগুলো সাধারণত উদ্ভূত হয়েছে মিমরা আসলে পুরোপরিভাবে জিনদের মত না– সেই সত্য থেকে। জিনের সঠিক ভৌত বৈশিষ্ট্য এবং প্রকৃতি এখন আমাদের জানা (এটি ডিএনএ এর বেস বা নিউক্লিওটাইডদের অনুক্রম), মিমদের সম্বন্ধে সেকরম কিছু জানা যায়নি। এবং বিভিন্ন মিমতত্ত্ববিদরাও কোনো একটি ভৌত মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে মীমের উপস্থিতি পরিবর্তন করার মাধ্যমেও একে অপরকে সংশয়ে ফেলে দিয়েছেন। শুধুমাত্র আমাদের মস্তিস্কে কি মিমদের অস্তিত্ব আছে? বা ধরা যাক, কোনো একটি লিমেরিক এর প্রতিটি পেপার কপি এবং ইলেক্ট্রনিক কপিকেও কি মিম বলা যেতে পারে? তাছাড়া জিন তার অনুলিপি তৈরী করে যথেষ্ট নিখুঁত ভাবে, যদি মিমরা আদৌ তাদের অনুলিপি সৃষ্টি করতে পারে, তারা কি যথেষ্ট কম নিখুঁত ভাবে সেটা করবে না?

মিমদের নিয়ে প্রস্তাবিত এই সমস্যাগুলো খানিকটা অতিরঞ্জিত। মিম তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রস্তাবিত সকল অভিযোগগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে, ডারউইনীয় ‘রেপ্লিকেটর হিসাবে কাজ করার জন্য মিমগুলো যথেষ্ট নিখুঁতভাবে তাদের অনুলিপিগুলো সৃষ্টি করতে পারেনা। মূল সন্দেহটা হচ্ছে, যদি প্রতিটি প্রজনই মিউটেশনের বা পরিবর্তনের হার গ্রহনযোগ্য সীমা অতিক্রম করে যায়, তাহলে মিম পুলে তাদের উপস্থিতির হারের উপর ডারউইনীয় প্রাকৃতিক নির্বাচন কোনো প্রভাব ফেলার আগেই মিমরা মিউটেশনের মাধ্যমেই নিজেদের অস্তিত্ব বিলোপ করে ফেলবে; কিন্তু সমস্যাটা কাল্পনিক, একজন মাষ্টার কাঠের কারিগরের কথা ভাবুন কিংবা প্রাগৈতিহাসিক সময়ের কোনো ফ্লিন্ট পাথরের হাতিয়ার তৈরীর কারিগর, যিনি তার নবীন শিক্ষার্থীকে কোনো একটি বিশেষ কৌশল শেখাচ্ছেন হাতে কলমে দেখিয়ে, যদি শিক্ষার্থীটি সম্পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে তার শিক্ষকের প্রতিটি হাতের কাজ ধাপ অনুক্রমে পুনরাবৃত্তি করেন, তারপরও কি সত্যিই আপনি আশা করতে পারেন যে, এই মিমটি পরিবর্তিত হবে পুরোপুরি, শিক্ষক/শিক্ষার্থীদের কয়েক প্রজন্মের মধ্য সেটি বিস্তারিত হবার। পর। কিন্তু অবশ্যই শিক্ষার্থী তার শিক্ষকের দেখানো হাতের প্রতিটি নাড়াচাড়াকে হুবুহু নকল করে না। আর খুবই হাস্যকর হবে এমন করাটা, বরং সে লক্ষ করে মূল চূড়ান্ত সেই ফলাফলটিকে, যা তার শিক্ষক অর্জন করার চেষ্টা করছেন এবং সেটাকেই সে অনুকরণ করে। যেমন, পেরেকটাকে হাতুড়ী দিয়ে ঠুকতে হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত সেটি পুরোপুরি ঢুকে যায়, যত সংখ্যক হাতড়ীর আঘাত লাগুক না কেন, তার সেই সংখ্যাটি তার শিক্ষকের প্রদর্শিত সংখ্যার সাথে নাও মিলতে পারে। এই ধরনের নিয়মগুলোই যা অপরিবর্তিত হয়ে হস্তান্তর হয় অসীম সংখ্যক অনুকরন ‘প্রজন্ম হিসাবে, তাদের কাজটি সম্পাদন করার প্রক্রিয়াটি ব্যক্তি বিশেষে এবং কেস বিশেষে ভিন্ন হতে পারে। কোনো কিছু বোনার কাজের সময় সেলাই, দড়িতে বাধা গিট বা মাছ ধরার জাল, অরিগ্যামীর কাগজ ভাজ করা, কাঠের বা পটারী বা মৃৎশিল্পের নানা উপযোগী কৌশল, এই সব কিছুকে পৃথক উপাদান হিসাবে ভাবা সম্ভব যা আসলেই অসংখ্য সংখ্যক অনুকরণ প্রজন্ম হিসাবে অপরিবর্তিত অবস্থায় হস্তান্তরিত হতে পারে। খুঁটিনাটি বিষয়গুলো একক ব্যক্তি পর্যায়ে যতই বৈচিত্র্যময় হোক না কেন মূল বিষয়টি কিন্তুটি অপরিবর্তিত হয়ে বিস্তার লাভ লাভ করে এবং জিন এর সাথে মিমের সমরুপ ব্যাখ্যাটিকে কাজ করার জন্য আসলে শুধু সেটুকুই প্রয়োজন।

সুজান ব্ল্যাকমোর (৬৪) এর বই ‘দ্য মিম মেশিন’ (৬৫) এর ভূমিকা লেখার সময় আমি চাইনীজ জাঙ্ক (৬৬) এর মডেল বানানোর অরিগ্যামী (৬৭) প্রক্রিয়ার একটি উদাহরণ বর্ণনা করেছিলাম; প্রক্রিয়াটি এমনিতেই একটি জটিল পদ্ধতি, প্রায় ৩২ টি ভাজ (বা সে রকম কিছু) ছিল। শেষ ফলাফল (চাইনীজ জাঙ্ক বা কাগজের জাহাজটি) এবং সেই সাথে পুরো ক্রমবিকাশে মধ্যবর্তী কমপক্ষে এর তিনটি ধাপ: ‘কাটামারান’, ‘দুটি ঢাকনী সহ একটি বাক্স’, এবং ‘ছবির ফ্রেম’ খুবই দৃষ্টিনন্দন; পুরো প্রক্রিয়াটি আসলেই মনে করিয়ে দেয়, নানা ভাজ আর খাজ সহ কোনো ভ্রূণ যেন নিজেকে রুপান্তরিত করছে ব্ল্যাস্টুলা (৬৮) থেকে গ্যাস্ট্রলা (৬৯) হয়ে নিউরালা (৭০); আমি চাইনীজ জাঙ্ক বানাতে শিখেছিলাম শৈশবে আমার বাবার কাছ থেকে, যিনি ঠিক একই বয়সে সেই দক্ষতাটা অর্জন করেছিলেন তার বোর্ডিং স্কুলে পড়ার সময়; তিনি স্কুলে থাকার সময় চাইনীজ জাঙ্ক বানানো ধুম পড়ে গিয়েছিল যার সুচনা করেছিলেন তার স্কুলের মেট্রন, পুরো স্কুলে এটি ছড়িয়ে পড়েছিল যেন হামের মহামারী মত, অবশ্য হামের মহামারী মতোই এই কাগজের জাঙ্ক বানানোর গন উৎসাহেও ভাটাও পড়ে একসময়। ছাব্বিশ বছর পর, যখন সেই মেট্রণ যখন রুপান্তরিত হয়েছেন পুরোনো স্মৃতিতে, আমিও সেই একই স্কুলে পড়তে গিয়েছিলেন, চাইনীজ জাঙ্ক বানানোর ধুমটা আমি আবার নতুন করে শুরু করি, এবং আবারো এটি ছড়িয়ে পড়ে আরেকটি হামের মহামারীর মত এবং আবারো ম্লান হয়ে হারিয়ে যায় তা একসময়। এখানে মূল বিষয়টি হলো, এধরনে হাতে কলমে শেখানো সম্ভব কোনো দক্ষতা মহামারীর মত যে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এই বিষয়টা আমাদের কিছু মিম নির্ভর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বিস্তারে ত্রুটিহীনতা সম্বন্ধে কিছু ইঙ্গিত দেয়। আমরা নিশ্চিৎ ভাবেই বলতে পারি, ১৯২০ এর দশকে আমার বাবার প্রজন্মের স্কুলের শিক্ষার্থীদের বানানো জাঙ্ক, আমার ১৯৫০ এর প্রজন্মের স্কুল ছাত্রদের বানানো জাঙ্ক থেকে সাধারণ বৈশিষ্ট্যে খুব একটা আলাদা কিছু ছিল না।

আমরা এই ফেনোমেননটা আরো একটু পদ্ধতিগতভাবে অনুসন্ধান করতে পারি একটি পরীক্ষার মাধ্যমে: শিশুতোষ একটি খেলা, চাইনীজ হুইসপারের (যুক্তরাষ্ট্রের শিশুরা যাকে টেলিফোন নামে চেনে) একটি ভিন্ন রুপের মাধ্যমে। প্রথমে দুইশ মানুষকে একত্র করুন যারা কোনোদিনও চাইনীজ জাঙ্ক বানাননি, এবার প্রতি দশ জনকে নিয়ে একটি টিম করে মোট বিশটি টিম গঠন করুন। তারপর প্রতিটি টীমের যারা প্রধান, তাদেরকে একসাথে জড়ো করুন এবং তাদের সবার সামনে একটি চাইনীজ জাঙ্ক বানিয়ে হাতে কলমে শেখান কিভাবে চাইনীজ জাঙ্ক বানাতে হয়। এরপর তাদের নিজেদের টিমে ফেরত পাঠান এবং নির্দেশ দেন যেন তারা প্রত্যেকে তাদের টিম থেকে নিজের বাছাই করা শুধু দ্বিতীয়। আরেকজনকে নির্বাচন করবেন এবং তিনি যাকে চাইনীজ জাঙ্ক হাতে কলমে বানিয়ে দেখানোর মাধ্যমে শেখাবেন; প্রতিটি দ্বিতীয় প্রজন্মের শিক্ষার্থী তার টিমে এরপর তৃতীয় অন্য একজনকে শেখাবে কিভাবে চাইনীজ জাঙ্ক বানাতে হয়, এবং প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে প্রতিটি টিমের দশম সদস্যকে পর্যন্ত শেখাবে তার আগের প্রজন্মের শিক্ষকরা এই ধারাবাহিকতায়; এই প্রশিক্ষণের সময় তৈরী করা প্রতিটি জাঙ্ক সঠিকভাবে চিহ্নিত করে রাখতে হবে, টীম ও প্রজন্ম নম্বর দিয়ে,পরবর্তীতে পর্যবেক্ষণের জন্য।

আমি নিজে এই পরীক্ষাটি করিনি (অবশ্যই আমি করতে চাই), কিন্তু খুব দৃঢ়ভাবেই আমার মনে হয় যে, আমি পূর্বধারণা করতে পারি, এর ফলাফলটি কি হতে পারে। আমার ধারণা হচ্ছে, এই বিশটি টীমের সবকটি টীম তাদের টীমের দশম সদস্য পর্যন্ত এই কৌশলটি শেখাতে বা হস্তান্তর করতে সফল হবে না। তবে মোটামুটি একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্ষেত্রে তারা সফল হবেন; কোনো কোনো টিমে ভুল ভ্রান্তি হবে; হয়তো শিক্ষকদের ধারাবাহিকতায় কোনো একটি দুর্বল যোগসূত্রে কেউ হয়তো একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অনুকরণ করতে ভুলে যেতে পারেন এবং তার পরবর্তী সবাই সেই একই ভুল করার মাধ্যমে তাদের কাজটির উদ্দেশ্য সফলে ব্যর্থ হবেন; যেমন, হয়তো টীম ৪ ‘কাটামারান’ পর্যায় পৌঁছাতে পারে, তবে এরপর আর না। হয়তো ১৩ নং টিমের অষ্টম সদস্য একটি পরিবর্তিত বা মিউট্যান্ট রুপ, যা বক্স উইথ টু লিডস বা দুটি ঢাকনী সহ বাক্স’ এবং পিকচার ফ্রেম’ এর মাঝামাঝি কোনো রুপ সৃষ্টি করে বসেন এবং তার টীমের নবম এবং দশম সদস্য এই পরিবর্তিত রুপটাই অনুকরণের মাধ্যমে সৃষ্টি করবেন।

এখন যে সব টীমে যেখানে শেখানো এই দক্ষতাটি দশম প্রজন্ম পর্যন্ত হস্তান্তরিত হয়েছে সফল ভাবে, সেখানে আমি আরো একটি ভবিষ্যদ্বাণী করতে চাই। আপনি যদি তাদের তৈরী জাঙ্কগুলোকে তাদের প্রজন্মানুযায়ী ক্রমানুসারে সাজান আপনি প্রজন্ম সংখ্যার সাথে ক্রমান্বয়ে পদ্ধতিগত পর্যায়ে কোনো গুনগত অবনতি লক্ষ করতে পারবেন না। কিন্তু যদি আপনি এমন কোনো একটি পরীক্ষা পরিচালনা করেন, যা সবদিক থেকে হুবুহু শুধু মাত্র যে দক্ষতা হস্তান্তরিত হয়েছে সেটা কোনো অরিগ্যামী নয় বরং জাঙ্ক এর ‘ড্রইং এর একটি অনুলিপি আঁকা, তাহলে সেখানে আপনি পদ্ধতিগতভাবেই অবশ্যই গুনগত মানের অবমুল্যায়ন দেখতে পাবেন এর নিখুঁততায়, যেভাবে প্রজন্ম ১ থেকে প্রজন্ম ১০ অবধি টিকে যায় প্যাটার্ন বা নকশাটি।

পরীক্ষাটির ড্রইং সংস্করণে, প্রজন্ম ১০ এর সবকটি ড্রইং প্রজন্ম ১ এর সব ড্রইংগুলোর সাথে খানিকটা সদৃশ্যতা বহন করবে। এবং প্রতিটি টীমের মধ্যে এই সদৃশ্যতা কম স্থিরভাবে অবনতি হতে থাকে প্রজন্মান্তরে। এর থেকে ভিন্ন অরিগ্যামি সংস্করনের পরীক্ষায়, এই ভুলটি হয় সম্পূর্ণ নয়তো একেবারে না। তাদের পরিবর্তনটা হবে ‘ডিজিটাল মিউটেশনের মত। হয় কোনো টীম কোনো ভুলই করবে না এবং প্রজন্ম ১০ এর জাঙ্ক খুব খারাপও হবে না, আবার ভালো হবে নাম গড় পড়তায় তা প্রজন্ম ৫ বা প্রজন্ম ১ এর বানানো জাঙ্কের মতই হবে বা হয়তো কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রজন্মে কোনো একটি মিউটেশন হবে ফলে এর পরবর্তী প্রজন্মের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে পুরোপুরি, হুবুহু মিউটেশনটিকে অনুলিপি করার মাধ্যমে।

এই দুই দক্ষতার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যটা কি? সেটা হচ্ছে, অরিগ্যামির ক্ষেত্রে দক্ষতাটা হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে করতে হবে এমন কতগুলো সুনির্দিষ্ট ক্রিয়া, যাদের কোনোটাই এককভাবে করা কোনো কঠিন কাজ নয়, বেশীর ভাগই সেই ক্রিয়াগুলো যেমন, ‘ঠিক মাঝখানে ভাজ করুন, দুই পাশে’; টীমের কোনো একটি নির্দিষ্ট সদস্য হয়তো এই ধাপটি অনুকরণ করেন অদক্ষভাবে, তবে পরবর্তী সদস্যটি যিনি শিখছেন তার কাছে স্পষ্ট অনুভূত হবে, সে আসলে কি করার চেষ্টা করছে। অরিগ্যামী ধাপগুলো আসলে ‘সেলফ নরমালাইজিং’, এবং এটাই একে ডিজিটাল বৈশিষ্ট্য দিয়েছে; এটা আমার কাঠের মিস্ত্রির মাষ্টারের উদাহরণটির মত, যার ‘কাঠের মধ্যে পেরেকের মাথাটা পুরোপুরি ঢুকাতে হবে এই উদ্দেশ্যটা তার শিক্ষার্থীর কাছে পরিষ্কার, হাতুড়ী আঘাত এর খুঁটিনাটি যাই হোক না কেন। অরিগ্যামীর ক্ষেত্রে আপনি হয় কোনো একটি ধাপ ঠিকমত ধরতে পারবেন অথবা পারবেন না। অন্যদিকে আঁকার দক্ষতা মূলত অ্যানালগ একটি দক্ষতা, প্রত্যেকেই একবার চেষ্ঠা করে দেখতে পারেন, তবে কোনো কোনো মানুষের অনুলিপি অপেক্ষাকৃত বেশী নিখুঁততর হবে অন্যদের তুলনায় এবং কেউ একেবারে সঠিকভাবে এর হুবুহ অনুলিপি তৈরী করতে পারবেন না। কোনো একটি ড্রইং এর সংস্করণ এর নিখুঁততাও নির্ভর করে, কি পরিমান সময় এবং সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছে এর প্রতি এবং এটি ক্রমাগতভাবে পরিবর্তনশীল একটি নিয়ামক। দলের কিছু সদস্য উপরন্তু আরো খানিকটা অলঙ্করণ এবং গুণগতমানের উন্নতি বৃদ্ধি করবে শুধুমাত্র এর আগের প্রতিলিপিটি হুবুহু নকল করতে দেবার বদলে।

শব্দ– অন্ততপক্ষে তাদের অর্থ যখন বোধগম্য হয় –সেটিও সেলফ নরমালাইজিং বা স্ব-স্বাভাবিকীকরণ হয়, যেমন অরিগ্যামি অপারেশনের ক্ষেত্রে হয়। চাইনীজ হুইসপারের (টেলিফোন) মূল খেলায় প্রথম শিশুকে একটি গল্প বা বাক্য শোনানো হয়, এরপর তাকে বলা হয় সেটি তার পরবর্তী শিশুকে কানে কানে জানাতে এবং এভাবে খেলাটি অগ্রসর হয়; যদি বাক্যটি সাত শব্দের কম হয়, এবং তা প্রত্যেকটি শিশুর মাতৃভাষায় হয়ে থাকে, খুবই সম্ভাবনা আছে শেষ অবধি বাক্যটি টিকে যাওয়ার, অপরিবর্তিত হয়ে দশটি প্রজন্ম অবধি। যদি সেটা অচেনা কোনো ভীন দেশী ভাষার হয়ে থাকে এবং প্রতিটি শব্দ শব্দ হিসাবে উচ্চারণ না করে যদি শিশুরা বাধ্য হয় তাদের ধ্বনি অনুযায়ী বা ফোনেটিক ভাবে সেটা উচ্চারণ করার জন্য, তাহলে বার্তাটি শেষ অবধি টিকতে পারেনা, প্রজন্মের ক্রমানুসারে এই অবনতি সেই ড্রইং এর মতই আরো অস্পষ্ট,অবোধ্য হয়ে যায়। যখন বার্তাটি শিশুর নিজের ভাষায় কোনো অর্থ বহন করে এবং যদি কোনো অপরিচিত শব্দ যেমন ‘ফেনোটাইপ’বা ‘অ্যালিল’ না থাকে, এটি টিকে থাকে, তখন শব্দগুলোকে তাদের ধ্বনি অনুযায়ী উচ্চারণ না করে, শিশুরা প্রতিটি শব্দকে তাদের সীমাবদ্ধ শব্দভাণ্ডারের সদস্য হিসাবে চিহ্নিত করে, এবং একই শব্দগুলাকে বাছাই করে, যদিও যখন তারা পরবর্তী শিশুর নিকট বার্তাটি হস্তান্তর করে, খুব সম্ভবত তারা তা উচ্চারণ করে ভিন্ন কোনো বাচনভঙ্গীতে; লিখিত ভাষাও সেলফ নরমালাইজিং, কারণ কাগজে লেখা নানা বর্ণ, তাদের খুঁটিনাটি বিষয়ে যতই ভিন্নতা থাকুক না কেন, তাদের একটি সীমাবদ্ধ (ধরা যাক) ছাব্বিশটি বর্ণের পরিবার থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে।

মিমরা কখনো কখনো তাদের অনুলিপিকরণ প্রক্রিয়ায় খুব বেশী মাত্রার নিখুঁততা প্রদর্শন করতে পারে এধরনের সেলফ নরমালাইজেশন প্রক্রিয়ার জন্য, এই সত্যটাই যথেষ্ট মিম/জিন সমরুপতা সংক্রান্ত কোনো ধরনের অভিযোগের উত্তর দেবার জন্য। এছাড়া যাই হোক না কেন, এর বিকাশের এই আদি পর্যায়ে মিম তত্ত্বের মূল উদ্দেশ্য,ওয়াটসন-ক্রিক এর জিনতত্ত্বের সমমানের সংস্কৃতি সংক্রান্ত কোনো ধরনের বোধগম্য পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব প্রদান করা না; মিমকে সমর্থন করার আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল, আসলে সেই ধারণাটির মোকাবেলা করা, যে জিনরাই শুধু একমাত্র ডারউইনীয় প্রভাবের বিষয়, যে ধারণাটি নয়তো ‘দ্য সেলফিশ জিন(৭১) প্রচার করছে এমন একটা ঝুঁকি থেকে যাবার সম্ভাবনা ছিল। পিটার রিচারসন ও রবার্ট বয়েড এই বিষয়টির উপর জোর দিয়েছিলেন তাদের মূল্যবান এবং চিন্তার খোরাক যোগানো বই ‘নট বাই জিনস এলোন’(৭২) এর শিরোনামের মাধ্যমে। যদিও তারা তাদের কারণ বলেছেন কেন মিম শব্দটি গ্রহন করেননি, বরং কালচারাল ভ্যারিয়ান্ট শব্দটা পছন্দ করেছেন; স্টিফেল শেনান এর ‘জিনস, মিমস অ্যাণ্ড হিউমান হিস্টোরী (৭৩) আংশিক অনুপ্রেরণা বয়েড ও রিচারসনের এর আগের একটি অসাধারণ ‘বই কালচার অ্যাণ্ড ইভোলুশনারি প্রসেস’(৭৪); মিম নিয়ে আলোচনা করা অন্য পূর্ণাঙ্গ বইগুলো মধ্যে আছে রবার্ট আঙ্গার এর ‘দি ইলেকট্রিক মিম’ (৭৫), কেট ডাস্টিন এর ‘দ্য সেলফিশ মিম’ (৭৬) এবং রিচার্ড ব্রডির ‘ভাইরাস অব দ্য মাইণ্ড: দ্য নিউ সায়েন্স অব মিম’ (৭৭)।

কিন্তু সুজান ব্ল্যাকমোর তার দ্য মিম মেশিন বইয়ে মিমেটিক তত্ত্বটি যে কোনো কারোর চেয়েই বেশী বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তিনি বারবার মস্তিস্কের ( বা অন্য কোনো গ্রহন বা ধারণকারী বা কোনো চ্যানেল বা মাধ্যম) দিয়ে পূর্ণ একটি পৃথিবী এবং যেখানে মিমরা একে অপরের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে সেই জায়গাগুলো দখল করার চেষ্টা করছে, এমন একটি দৃশ্যকল্পের কথা বলেছেন; জিনপুলের জিনদের মত, মিমরা যারা শেষ অবধি টিকে যাবে, সেগুলো আসলে সেই মিমগুলো, যারা কিনা নিজেদের অনুলিপি করতে দক্ষ। এর কারণ হতে পারে তাদের একটি সরাসরি আবেদন আছে, যেমন, ধারণা করা যেতে পারে ‘অমরত্বের’ মিম, কিছু মানুষের কাছে যেমন বিশেষ আবেদন আছে। অথবা হতে পারে তারা সবচেয়ে বেশী বিকশিত হয় অন্য কিছু মিমদের উপস্থিতিতে যারা ইতিমধ্যেই মিম পুলে অসংখ্য। এটি মিম পুলে মিম-কমপ্লেক্স বা মিমপ্লেক্স এর সৃষ্টি করে। মিমদের ব্যপারে যথারীতি আমরা আরো ভালো করে বুঝতে পারি এর সাথে জিনতাত্ত্বিক তুলনার উৎসে ফেরত গিয়ে।

বোঝনোর জন্যই আমি জিনদের এমন ভাবে ব্যাখ্যা করেছি যেন, তারা স্বতন্ত্র একক, যারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম; কিন্তু অবশ্যই তারা পরস্পর থেকে স্বাধীন নয়, এই বিষয়টি প্রকাশ পায় দুটি উপায়ে: প্রথম, ক্রোমোজোমের উপর সরলরৈখিকভাবে জিনগুলো সাজানো থাকে, এবং প্রজন্মান্তরে তারা তাদের নিকটবর্তী ক্রোমোজমের লোকাই এর অন্যান্য জিনগুলোকে নিয়ে বিস্তার লাভ করে। আমরা যে যোগসুত্রকে বলি লিংকেজ এবং আমি এই বিষয়ে আর বলছি না কারণ মিমদের জিনদের মত কোনো ক্রোমোজোম কিংবা অ্যালিল নেই বা যৌন পুনসন্নিবেশনও ঘটে না। অন্য আরেকটি ক্ষেত্রে জিনগুলো যে স্বাধীন নয় তা জেনেটিক লিংকেজ থেকে খুবই ভিন্ন এবং এখানে বেশ ভালো মিমেটিকের অনুরুপ একটি তুলনা আছে, এটি জ্বণতত্ত্ব বিষয়ক-এবং যে সত্যটি প্রায়ই ভুল বোঝা হয় –এটি জিনতত্ত্ব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন; আমাদের শরীর জিগশ পাজলের এর মত টুকরো টুকরো জোড়া লাগানো নানা ফেনোটাইপের অংশ না, যারা কিনা প্রত্যেকে আলাদা ভাবে ভিন্ন ভিন্ন জিনের অবদান; কোনো সরাসরি একক ভাবে কোনো জিনের সাথে সংযোগ নেই শরীরের গঠন বা আচরণগত বৈশিষ্ট্যর; আরো শতাধিক অন্যান্য জিনের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কোনো একটি বিভিন্ন বিকাশ প্রক্রিয়া পরিচালনা করে যার ফলাফল পূর্ণ হয়-শরীর সৃষ্টির মাধ্যমে। ঠিক যেমন করে কোনো রেসিপির নানা শব্দ রান্না করার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি বিশেষ ডিশ তৈরী করে। রেসিপির প্রতিটি শব্দ ডিশটির নানা টুকরোকে সরাসরি প্রতিনিধিত্ব করছে, এমনটি কিন্তু না।

সুতরাং জিনরা আসলে দলবদ্ধ হয়ে একসাথে সহযোগিতার মাধ্যমে শরীরকে তৈরী করে এবং এটি জ্বণতত্ত্বের একটি মূলনীতি। প্রাকৃতিক নির্বাচন এক দল জিনকে সহায়তা করে অন্যান্য বিকল্প একদল জিনদের তুলনায় এমন ভাবে বলার একটা প্রলোভন এড়ানো কঠিন। এবং এখানেই সংশয়; আসলে যেটা ঘটে, তাহলে জিনপুলে অন্যান্য জিনরা সেই পরিবেশের একটি বড় অংশ তৈরী করে, যেখানে প্রতিটি জিন বনাম তার বিকল্প অ্যালিল নির্বাচিত হয়। যেহেতু প্রতিটি জিন নির্বাচিত হবার ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করে অন্য জিনদের উপস্থিতিতে– যারা নিজেরাও একই ভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়েছে– এভাবে সহযোগী জিনদের গুচ্ছ বা কার্টেল নির্বাচনের মাধ্যমে ‘উদ্ভব হয়। আমাদের যেটা আছে সেটা পরিকল্পিত নিয়মিত অর্থনীতির তুলনায় বরং অনেকটাই মুক্ত বাজার অর্থনীতির মত। এখানে কসাই আছে একজন, বেকার আছে একজন, কিন্তু বাজারে একটি শূন্যস্থান হয়তো আছে একজন মোমবাতির কারিগরের। প্রাকৃতিক নির্বাচনের অদৃশ্য হাত সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করে। এটি কিন্তু একজন কেন্দ্রিয় পরিকল্পনাকারীর উপস্থিতির ধারণা থেকে ভিন্ন, যিনি কসাই-বেকার আর মোমবাতির কারিগরের এই ত্রিমুখী সহযোগী গ্রুপগুলোকে সমর্থন করেন; পরস্পর সহযোগিতা পূর্ণ জিনগুচ্ছ বা কার্টেল অদৃশ্য হাত দিয়ে এক জায়গায় জড়ো করার ধারণাটি ধর্মের মিমগুলো এবং কিভাবে তারা কাজ করে বুঝতে আমাদের সাহায্য করে।

বিভিন্ন ধরনের জিনদের গ্রুপ বা কার্টেলের উদ্ভব হয় বিভিন্ন জিন পুলে। মাংসাশী জিন পুলে এমন জিন থাকবে যা শিকার ধরার ইন্দ্রিয়, শিকার ধরার মত নখর, মাংসাশী দাঁত, মাংশ হজম করার জন্য প্রয়োজনীয় উৎসেচক এবং আরো অন্যান্য জিন, সবাই বিশেষভাবে একে অপরের সাথে সহযোগীতা করবে প্রয়োজনীয় অঙ্গ এবং নানা শারীরবৃত্তীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেতে। এবং একই সাথে, নিরামিষভোজীদের প্রানীদের জিন পুলে ভিন্ন পারস্পরিক সামঞ্জস্যপূর্ণ জিনগুলো সহায়তা পাবে তাদের নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা করার জন্য। আমরা সেই ধারণার সাথে পরিচিত যে, একটি জিন প্রজাতির বহিঃপরিবেশের সাথে এর প্রকাশ বা ফেনোটাইপের পারস্পরিক সামঞ্জস্যতার কারণে বিশেষ সহায়তার জন্য নির্বাচিত হয়, মরুভুমি, বনভুমি বা সেটা যেখানে হোক না কেন। আমি যে বিষয়টা এখানে উল্লেখ করতে চাইছি তা হলো, এছাড়াও সহায়তার জন্য এটি নির্বাচিত হয় কোনো একটি নির্দিষ্ট জিনপুলে অন্যান্য জিনের সাথে এর পারস্পরিক সামঞ্জস্যতার উপরেও ভিত্তি করে। কোনো মাংসাশী জিন নিরামিশভোজী প্রাণীদের জিনপুলে টিকতে পারবেনা এবং এর উল্টোটাই ঘটে মাংসাশী জিন পুলে কোনো নিরামিশাষী জিনগুলোর ক্ষেত্রে। যদি জিনের দীর্ঘদৃষ্টি দিয়ে ব্যপারটা দেখা হয়, কোনো প্রজাতির জিন পুল– জিনদের সেই সেট যা বারবার বিন্যাস এবং পুনর্বিন্যাস হচ্ছে যৌন প্রজননের মাধ্যমে– তারা সেই জিনতাত্ত্বিক পরিবেশ তৈরী করে যেখানে প্রতিটি জিন নির্বাচিত হয় তাদের পারস্পরিক সহযোগিতা করার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। যদিও মিমদের পুল জিনপুলের মত এতো নিয়ম নিভর বা গোছানো নয়, তাসত্ত্বেও আমরা একটি মিম পুলের কথা বলতে পারি মিমপ্লেক্স এর প্রতিটি মিমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ হিসাবে।

মিমপ্লেক্স হচ্ছে এক সেট মিম যারা, নিজেরা এককভাবে টিকে থাকতে তেমন দক্ষ না হলেও, মিমপ্লেক্সে অন্যান্য সদস্যদের উপস্থিতিতে এরা সফলভাবে টিকে থাকতে সক্ষম। এর আগের সেকশনে আমি সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম ভাষার বিবর্তনের খুঁটিনাটি ক্ষেত্রগুলো বিশেষ কোনো সুবিধা পায়না একধরনের প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায়। আমার ধারণা যে ভাষার বিবর্তন বরং নিয়ন্ত্রণ করে র‍্যানডোম ড্রিফট; অনুমান করা সম্ভব যে কিছু স্বরবর্ণ বা ব্যাঞ্জনবর্ণ পাহাড়ী পরিবেশে অন্য স্বরবর্ণ বা ব্যাঞ্জন বর্ণ অপেক্ষা বেশী প্রযোজ্য এবং সেকারণে সেগুলো বৈশিষ্ট্যমূলক যেমন, সুইস, তীব্বতীয় এবং আন্দেজ পর্বতাঞ্চলের ভাষার ডায়ালেক্ট। অন্যদিকে যেমন কিছু শব্দ ফিসফিস করে বলার জন্য উপযুক্ত, যেমন গভীর জঙ্গলে, একারণে বৈশিষ্ট্যমূলক পিগমী বা আমাজনীয় ভাষায়। কিন্তু ভাষা নিয়ে যে উদাহরণ আমি উল্লেখ করেছিলাম সেগুলো প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত হয়েছে– গ্রেট ভাওয়েল শিফট এর তত্ত্বটি হয়তো একটি ব্যাখ্যা আছে– যদি সেই ব্যাখ্যাটি এই ধরনের না হতে পারে। বরং এটি হতে পারে পারস্পরিক সামঞ্জস্যপূর্ণ মিমপ্লেক্স এ মিমদের উপযুক্ত জায়গা খুঁজে নেবার মাধ্যমে। একটি স্বরবর্ণ প্রথমে শিফট বা পরিবর্তিত হয়, অজানা কোনো কারণে– হয়তো কোনো প্রশংসার পাত্র বা শক্তিশালী কোনো ব্যক্তির মত করে ফ্যাশন দূরস্ত উচ্চারণ অনুকরণের মাধ্যমে, যেমনটা বলা হয় স্প্যানিশ লিস্প’ এর কারণ হিসাবে; কিভাবে গ্রেট ভাওয়েল শিফট হলো সেটা যাই হোক না কেন: এই তত্ত্বানুযায়ী একবার যখন প্রথম স্বরবর্ণ পরিবর্তিত হয়, অন্য স্বরবর্ণ সেটি পালাক্রমে অনুসরণ করে যে কোনো ধরনের অস্পষ্টতাকে হ্রাস করার প্রচেষ্টায়, এভাবে ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে। এবং দ্বিতীয় পর্বে ইতিমধ্যে বিদ্যমান মিমপুল থেকে মিমরা নির্বাচিত হয়, যারা পারস্পরিক সামঞ্জস্যপূর্ণ মিমদের নিয়ে মিমপ্লেক্স তৈরী করে।

অবশেষে ধর্মের মিমেটিক তত্ত্বটি নিয়ে আলোচনা করার জন্য এখন আমরা যথেষ্ট উপকরণ সংগ্রহ করেছি; কিছু ধর্মীয় ধারণা, কিছু জিনের মতই হয়তো টিকে সাথে শুধুমাত্র এর নিজের যোগ্যতায়। এই মিমগুলো টিকে থাকতে পারে যে কোনো মিম পুলে, তাদের চারপাশে যে মিমরাই থাকুক না কেন (এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে আমি অবশ্যই আবার বলছি যে যোগ্যতা বা মেরিট এই অর্থে মিম পুলে টিকে থাকার যোগ্যতা’ মাত্র, এর বাইরে এই শব্দটির বিশেষ চড়ান্ত কোনো মূল্য বিচার নেই); কিছু ধর্মীয় ধারণা টিকে যায় কারণ তারা অন্য মিমগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবার কারণে এবং ইতিমধ্যেই মিমপুলে যাদের সংখ্যাও অনেক মিম কমপ্লেক্স বা মিমপ্লেক্স এর অংশ হিসাবে। নীচে আমি ধর্মীয় মিমদের একটি আংশিক তালিকা উল্লেখ করলাম, যা সম্ভবত মিম পুলে টিকে থাকার বিশেষ যোগ্যতা আছে, হয় সম্পূর্ণ তাদের একক ‘যোগ্যতা অথবা বিদ্যমান মিমপ্লেক্সগুলোর সাথে এর সামঞ্জস্যতার কারণে।

  • আপনার মৃত্যুর পরও আপনি বেঁচে থাকবেন।
  • যদি আপনি শহীদ হিসাবে মৃত্যুবরণ করেন তবে আপনার জায়গা হবে বেহেশতের বিশেষ একটি স্থানে যেখানে আপনি বাহাত্তরটি কুমারী নারী ভোগ করতে পারবেন (সেই দুর্ভাগা কুমারীর জন্য একটু ভেবে দেখুন)।
  • ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বী বা হেরেটিক, অবমাননাকারী এবং স্বধর্মত্যাগীদের হত্যা করা উচিৎ (বা তাদের অন্য কোনোভাবে শাস্তিপ্রদান করা উচিৎ যেমন তাদের পরিবার থেকে তাদের সম্পর্কচ্যুত করা ইত্যাদি)
  •  ঈশ্বরে বিশ্বাস করা হচ্ছে সবচে বড় সদগুণ বা ভার্চু। আপনি যদি কখনো অনুভব করেন যে, আপনার বিশ্বাস দোদুল্যমান, তবে সেটিকে স্থির ও দৃঢ় করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করুন এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করুন আপনার অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে তিনি যেন আপনাকে সাহায্য করেন (পাসকালের বাজী সম্বন্ধে আলোচনার সময় আমি উল্লেখ করেছিলাম, সেই অদ্ভুত ধারণাটি কথা, যে ঈশ্বর আমাদের কাছে আসলে যে জিনিসটা চান সেটা হচ্ছে তার উপর আমাদের বিশ্বাস। সেই সময় আমি এটাকে একটি ব্যতিক্রম হিসাবে চিহ্নিত করেছিলাম, তবে এখন এর জন্য একটি কারণ আছে আমাদের);
  • ফেইথ (কোনো ধরনের প্রমাণ ছাড়াই যে বিশ্বাস) হচ্ছে একটি উত্তম গুণ। আপনার বিশ্বাস যত বেশী প্রমাণকে উপেক্ষা করবে, ততবেশী ধর্মীয় গুণে গুণান্বিত হবেন আপনি। একনিষ্ঠ গুনবান বিশ্বাসীরা যত বেশী অদ্ভুত কিছু বিশ্বাস করতে সক্ষম হন, যা অসমর্থিত এবং কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য না কোনো প্রমাণের আলোকে বা যুক্তিতে, তারা তাদের এই অন্ধবিশ্বাসের জন্য বিশেষভাবে পুরস্কৃত হবেন।
  •  প্রত্যেকেই, এমনকি যাদের কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস নেই, ধর্ম বিশ্বাসীদের বিশ্বাসকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এবং প্রশ্নাতীতভাবে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে, এবং অন্য ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি সাধারণত যা করা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশী মাত্রায় তাদের সেই বিশ্বাসের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে (অধ্যায় ১ এ বিষয়টি আলোচনায় এসেছে);
  • বেশ অদ্ভুত কিছু বিষয় আছে (যেমন, ট্রিনিটি, ট্রান্সসাবস্টাবষ্টিয়েশন, ইনকারণেশন) যা আমাদের ‘বোঝার জন্য না; এমনকি এসব কোনো কিছু বোঝার কোনো চেষ্টা করারও দরকার নেই কারণ বিষয়গুলো বোঝার প্রচেষ্টার প্রক্রিয়া সেগুলোকে ধ্বংশ করে দিতে পারে। বরং শিখুন এগুলোকে ‘রহস্য হিসাবে চিহ্নিত করে কিভাবে পূর্ণতা এবং সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়।
  • সুন্দর সঙ্গীত, শিল্পকলা এবং ধর্মীয় গ্রন্থ হলো নিজেরাই স্বপ্রতিলিপিকারী ধর্মীয় ধারণার টোকেন।

উপরে তালিকায় বর্ণিত কিছু মিমের সম্ভবত চূড়ান্ত সারভাইভাল মূল্য আছে এবং সেটি যে কোনো মিমপ্লেক্সে ভালোভাবেই টিকে থাকতে পারে সফলতার সাথে। কিন্তু, জিনের ক্ষেত্রে যেমন হয়, কিছু মিম টিকে থাকে অন্য বেশ কিছু মিমের উপস্থিতিতে সৃষ্ট একটি উপযুক্ত পরিবেশে, যা বিকল্প নানা মিমপ্লেক্সগুলো গড়ে উঠতে সহায়তা করে। দুটি ভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসকে দেখা যেতে পারে, দুটি বিকল্প মিমপ্লেক্স হিসাবে, যেমন, হয়তো ইসলাম হচ্ছে। মাংসাশী জিন কমপ্লেক্স এর অনুরুপ, এবং বৌদ্ধধর্মবাদ যেমন নিরামিশাষী জিন কমপ্লেক্স এর অনুরুপ। চূড়ান্ত কোনো অর্থে কিন্তু কোনো ধর্মের ধারণাগুলো অন্য কোনো একটি ধর্মের ‘ধারণাগুলোর চেয়ে উত্তম না; ঠিক যেমন মাংসাশী জিন নিরাষাশী জিন থেকে উত্তম না যে অর্থে। এধরনের ধর্মীয় মিমগুলোর চেয়ে চূড়ান্তভাবে টিকে থাকার থাকার কোনো বিশেষ গুণাবলী থাকতেই হবে এমন কোনো প্রয়োজনীয়তাও কিন্তু নেই। তাসত্ত্বেও, তারা টিকে থাকার ক্ষেত্রে দক্ষ এই অর্থে যে, তারা শুধু তাদের ধর্মের অন্য মিমদের উপস্থিতিতে ভালোভাবেই তাদের জায়গা করে নিতে পারে, বিকশিত হতে পারে, যা অন্য ধর্মের মিমদের উপস্থিতিতে ঘটে না। এই মডেলে, রোমান ক্যাথোলিকবাদ ও ইসলাম, ধরুন অবশ্যই কোনো একক ব্যক্তির সৃষ্টি নয়, বরং তারা বিবর্তিত হয়েছে পৃথক পৃথক ভাবে বিকল্প মিমদের একটি গুচ্ছ হিসেবে যারা পূর্ণ বিকাশ হবার সুযোগ পেয়েছে একই মিমপ্লেক্সদের সহাবস্থানে।

সংগঠিত ধর্ম সংগঠিত হয়েছে মানুষের দ্বারাই: যাজক এবং বিশপ, রাবাই, ইমাম, আয়াতোল্লাহদের দ্বারাই। কিন্তু আমি মার্টিন লুথারের সংক্রান্ত যে বিষয়টির অবতারণা করেছিলাম আগে, সেই বিষয়টির পুনরাবৃত্তি করেই বলছি, এর অর্থ কিন্তু এটা নয়, যে ধর্মের প্রথম ধারণার সূত্রপাত বা পরিকল্পনা করেছে কোনো মানুষ; এমনকি যেখানে ধর্মকে অপব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে ক্ষমতায় থাকা মানুষগুলোর স্বার্থে। প্রবল সম্ভাবনা আছে যে, প্রতিটি ধর্মের খুঁটিনাটি অনেক বিষয়ই মূলত তার আকৃতি পেয়েছে অচেতন বিবর্তনের প্রক্রিয়ায়। কোনো জিনতাত্ত্বিক প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে না, কারণ সেই প্রক্রিয়া খুবই ধীর, যা ধর্মের বিবর্তন ও এবং নানা বিভাজনকে ব্যাখ্যা করতে পারেনা। এই কাহিনীতে জিনতাত্ত্বিক প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভুমিকা হলো, প্রয়োজনীয় প্রাক প্রবণতা এবং পক্ষপাতিত্ব সহ সেই মস্তিস্কেকে সরবরাহ করা-একটি হার্ডওয়ার প্ল্যাটফর্ম ও লো লেভেল সিস্টেম সফটওয়্যারটি যা মিমেটিক বা মিম নির্ভর নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তৈরী করে। এই প্রেক্ষাপটে আমার কাছে মনে হয় কোনো একধরনের মিম নির্ভর প্রাকৃতিক নির্বাচনই ব্যাখ্যা করতে পারে কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মের বিস্তারিত বিবর্তন প্রক্রিয়াটিকে। ধর্মীয় বিবর্তনের প্রাথমিক ধাপগুলোতে, এটি কোনো সংগঠিত রুপ নেবার আগে, সাধারণ মিমগুলো টিকে থাকে মানুষের মনস্তত্ত্বের প্রতি তাদের বিশেষ আবেদনের জন্য; এবং এখানেই ধর্মের মিমতত্ত্ব এবং মানসিক কোনো প্রক্রিয়ার উপজাত হিসাবে ধর্মের উৎপত্তি তত্ত্বটি একে অপরের সাথে মিশে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে যখন ধর্ম রুপান্তরিত হয় সংগঠনে, বিস্তারিত নানা ধরনের আচার এবং কাল্পনিক নানা নিয়মকানুনের মাধ্যমে ভিন্নতা পায় অন্যান্য ধর্মগুলো থেকে, সেই পর্যায়ে ধর্মের নানা বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করার জন্য মিমপ্লেক্স তত্ত্বটি বেশ যথেষ্ট– পারস্পরিক সামঞ্জস্যপূর্ণ মিমদের কার্টেল বা গ্রুপ; এটি অবশ্য যাজক কিংবা অন্যদের পরিকল্পনা মাফিক বাড়তি কিছু ম্যানিপুলেশনের ভুমিকা থাকার সম্ভবনাকে বাতিল করেনা; ধর্ম সম্ভবত কিছুটা অংশ, ইন্টেলিজেন্টলি ডিজাইন করা হয়েছে, যেমন করে শিল্পকলার ক্ষেত্রে নানা স্কুল বা ঘরানা বা ফ্যাশনগুলো সৃষ্টি করা হয়ে থাকে।

প্রায় সম্পূর্ণ একটি ধর্ম যাকে ইন্টেলিজেন্টভাবে ‘ডিজাইন করা হয়েছে, তাহলে সায়েন্টোলজী (৭৮), কিন্তু আমার সন্দেহ এটি ধারার ব্যতিক্রম হবার সম্ভাবনাই বেশী। পুরোপুরি ডিজাইনকৃত ধর্মের খেতাব পাবার আরেকটি দাবীদার হচ্ছে মরমনিজম (৭৯)। জোসেফ স্মিথ, এই ধর্মটির অত্যন্ত বিশেষ প্রকৃতির সৃজনশীল ও মিথ্যাচারী আবিষ্কারক, এক অস্বাভাবিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন একটি পবিত্র গ্রন্থ সৃষ্টি করেছিলেন, বুক অব মর্মন, যেখানে একেবারে শূন্য থেকে তিনি নতুন একটি আমেরিকার মিথ্যা কাল্পনিক ইতিহাসের অবতারণা করেন ভুয়া সপ্তদশ শতকের ইংরেজী ভাষা ব্যবহার করে। এছাড়াও উনবিংশ শতাব্দীতে এর সৃষ্টি হবার পর মর্মনবাদ বিবর্তিত হয়েছে অনেকটাই এবং এখন এটি যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার সম্মানজনক একটি ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত; আসলেই, দাবী করা হচ্ছে এটি সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্মগুলোর একটি এবং এখন কথা হচ্ছে তাদের ভবিষ্যত একজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী খুঁজে বের করার ব্যপারে।

সব ধর্মই বিবর্তিত হয়। ধর্মীয় বিবর্তনের যে তত্ত্বই আমরা গ্রহন করিনা কেন, সেই তত্ত্বটিকে উপযুক্ত পরিবেশ পেলে যে বিস্ময়কর হারে ধর্মীয় বিবর্তন প্রক্রিয়া অগ্রসর হতে পারে, সেটি ব্যাখ্যা করতে হবে।একটি কেস স্টাডি আলোচনা করা যাক:

কেস স্টাডি: কার্গো কাল্ট

দ্য লাইফ অব ব্রায়ান (৮০) এ, মন্টি পাইথন টিমের (৮১) অনেকগুলো সঠিক ধারণার একটি ছিল, কিভাবে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে একটি নতুন ধর্মীয় কাল্ট বা গোষ্ঠী তার যাত্রা শুরু করতে পারে। রাতারাতি এরা গজিয়ে উঠতে পারে, প্রায় একরাতের মধ্যেই এবং এরপর যা মূলধারার সংস্কৃতির সাথে নিজেদের আত্মীকরণ করে ফেলে, যেখানে অস্বস্তিকর প্রভাবশালী ভূমিকায় এদের দেখা যায়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় মেলানেশিয়া এবং নিউ গিনি ভিত্তিক কার্গো কাল্ট (Cargo Cult) সম্ভবত এর সবচেয়ে বিখ্যাত বাস্তব একটি উদাহরণ হতে পারে। এধরনের বেশ কিছু কাল্টের, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত,আমাদের বর্তমান স্মৃতিতেই রক্ষিত আছে; কাল্ট অব জিসাস হয়তো একটি ব্যতিক্রম, যার সূচনা খুব বিশ্বাসযোগ্যভাবে চিহ্নিত করা যাবে না, তবে বেশীর ভাগে ক্ষেত্রেই এধরনের ধর্মীয় গোষ্ঠীর জীবনচক্রটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো ব্যপারটা ঘটে যায় আমাদের চোখের সামনেই (এবং এমনকি তারপরেও, আমরা পরে যে বিষয়টি দেখবো, বেশ কিছু খুঁটিনাটি বিষয় কিন্তু তারপরও হারিয়ে যায়); খ্রিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠী বা কাল্ট যে একইভাবে শুরু হয়েছিল এবং শুরুর দিকে সেই একই দ্রুততার সাথে এটি ছড়িয়ে পড়েছিল এমন অনুমানের একটি আকর্ষণীয় শক্তি উপেক্ষা করা কষ্ঠসাধ্য।

‘কার্গো কাল্ট’ সম্পর্কে আমার মূল তথ্যসূত্র ডেভিড অ্যাটেনবুরোর(৮২) কোয়েষ্ট ইন প্যারাডাইস (৮৩), অনুগ্রহ করে আমাকে যার একটি কপি তিনি উপহার দিয়েছিলেন। এখানে সেই উনবিংশ শতাব্দীর আদি কাল্ট থেকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালের সবগুলোর বিখ্যাত কাল্টগুলো, সব ক্ষেত্রেই একই প্যাটার্ন লক্ষ করা যায়; মনে হয় যেন প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের দ্বীপে আসা সাদা চামড়ার অভিবাসীদের, যেমন নতুন শাসক, মিশনারী কিংবা সেনাদের সঙ্গে করা আনা নানা জিনিশপত্র দেখে পুরোপুরি বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিল দ্বীপবাসীরা। তারা সম্ভবত (আর্থার সি) ক্লার্ক (৮৪) এর তৃতীয় সুত্রের স্বীকার, আমি দ্বিতীয় অধ্যায়ে যেটি উল্লেখ করেছিলাম, কোনো যথেষ্ট পরিমান অগ্রসর প্রযুক্তিকে ম্যাজিক থেকে পার্থক্য করা যায় না।

দ্বীপের অধিবাসীরা যেটা লক্ষ করেছিলো তা হলো, এই সাদা মানুষগুলো, যারা এই বিস্ময়কর সামগ্রীগুলো উপভোগ করে, তারা সেগুলো নিজেরা তৈরী করেনা। যখন কোনো সামগ্রী মেরামতের প্রয়োজন হয় তারা সেগুলো অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয় এবং সেই জায়গায় নতুন সেই সামগ্রীগুলো ‘কার্গো হিসাবে জাহাজে বা পরে উড়োজাহাজে করে সেখানে ক্রমাগত আসতেই থাকে; কোনো সাদা মানুষকে কোনোদিনও সেই সব সামগ্রী বানাতে বা মেরামত করতে দ্বীপবাসীদের কেউ দেখেনি, এবং আসলেই তাদের এমন কিছু করতেও কখনোও দেখা যায়না যাকে বলা যেতে উপযোগী। (ডেস্কের পিছনের বসে সারাদিন কাগজ নাড়াচড়া করা নিশ্চয়ই কোনো ধরনের ধর্মীয় ভক্তি আচারেরই প্রকাশ); স্পষ্টতই, সুতরাং এই ‘কার্গো’ অবশ্যই কোনো অতিপ্রাকৃত উৎস থেকেই আসছে, এবং যেন দ্বীপবাসীদের এই ধারণা সমর্থন করতেই সাদা চামড়ার মানুষগুলো এমন কিছু নির্দিষ্ট কাজ করে, যাকে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান হিসাবে শুধুমাত্র দেখা যেতে পারে:

তারা উঁচু উঁচু মাস্তুল বানায়, যার সাথে সংযোগ করা থাকে তার; সাদা মানুষগুলো বসে বসে ছোট বাক্স মধ্যে কি যেন শোনে, সেখানে বিচিত্র নানা রঙ এর আলো জলে নেভে এবং বিচিত্র শব্দ এবং চাপা গলার আওয়াজ সেখানে শোনা যায়; তারা স্থানীয় মানুষগুলোকে একই ধরনের পোষাক পরার জন্য রাজী করায় এবং সেই কাপড় পরিয়ে তাদের কুচকাওয়াজ করানো হয়– এবং এর চেয়ে আর কোনো অযথা কালক্ষেপন করার মত পেশ উদ্ভাবন করা খুবেই কষ্টসাধ্য। এবং তারপর স্থানীয় অধিবাসীরা অনুধাবন করতে পেরেছিল, এই রহস্য সমাধানের সুত্রটি অবশেষে তারা খুঁজে পেয়েছে; এই সব অবোধ্য কর্মকাণ্ডগুলো আসলে সেইসব ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান যা সাদা মানুষগুলো ব্যবহার করে ঈশ্বরকে যথাসময়ে সেখানে কার্গো’ প্রেরণ করার জন্য রাজী করানোর উদ্দেশ্যে। যদি স্থানীয় অধিবাসীরা কার্গো চায়, তাহলে তাদেরও অবশ্যই সেই একই আচার অনুষ্ঠানগুলো পালন করতে হবে।

সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যপার হলো এমন অনেক ‘কার্গো কাল্ট’ গড়ে উঠেছিল স্বতন্ত্রভাবে, ভৌগলিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন দ্বীপগুলোয়। ডেভিড অ্যাটেনবুরো আমাদের যা বলছেন:

নৃতত্ত্ববিদরা দুটি পৃথক এধরনের ঘটনাগুচ্ছ লক্ষ করেছিলেন নিউ ক্যালিডোনিয়ায়, সোলোমন দ্বীপপুঞ্জে চারটি, ফিজিতে চারটি, নিউ হেরিডিজে সাতটি, নিউ গিনিতে পঞ্চাশের অধিক, বেশীর ভাগই মূলত পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন, কোনো যোগসূত্রতাও ছিলনা একটি ঘটনার সাথে অন্যটির। এই ধর্মগুলোর অনুসারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠের দাবী যে, একটি নির্দিষ্ট মেসাইয়াহ বা ঈশ্বরের প্রতিনিধি যেদিন মহাপ্রলয় বা অ্যাপোক্যালিপ্স ঘটবে সেদিন তাদের জন্য কার্গো নিয়ে আসবেন।

এই স্বতন্ত্রভাবে বিকশিত হওয়া এতগুলো ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু অনুরুপ কাল্টগুলো ইঙ্গিত দেয় মানুষের মনস্তাত্বিক জগতের সাধারণভাবে একাত্মকারী কিছু বৈশিষ্ট্য সমুহের।

একটি বিখ্যাত কাল্ট হচ্ছে নিউ হেবরিডেস (১৯৮০ সাল থেকে যা পরিচিত ভানুয়াতু দ্বীপপুঞ্জ হিসাবে) দ্বীপপুঞ্জের তাননা (Tanna) দ্বীপে, যা এখনও টিকে আছে। এটি কেন্দ্রে আছেন ‘জন ফ্রাম’ নামক একজন মহামানবীয় চরিত্র। সরকারী দলিল পত্রে জন ফ্রাম সংক্রান্ত তথ্য লক্ষ করা যায় প্রায় ১৯৪০ সাল থেকেই। কিন্তু এমনকি এত সাম্প্রতিক একটি কিংবদন্তী হওয়া সত্ত্বেও, নিশ্চিৎভাবে কারোরই জানা নেই, আসলেই সত্যিকার কোনো মানুষ হিসাবে জন ফ্রাম এর আদৌ কোনো অস্তিত্ব ছিল কিনা। একটি কিংবদন্তী তাকে বর্ণনা করেছে, ছোটখাট একজন পুরুষ হিসাবে, যার গলার স্বর ছিল তীক্ষ্ম, বিবর্ণ রঙের চুল ছিল তার, চকচকে বোম সহ পরনে থাকত একটি কোট; তিনি বেশ কিছু অদ্ভুত সব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং তার বিশেষ প্রচেষ্টার একটি ছিল স্থানীয় মানুষগুলোকে মিশনারীদের প্রতি ক্ষেপিয়ে তোলা। একসময় তিনি তার পূর্বপুরুষদের কাছে ফিরে যান, যাবার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান যে বিজয়ীরে বেশে তিনি আবার ফিরে আসবে, প্রচুর পরিমানে সুন্দর ‘কার্গো সাথে নিয়ে। তার অ্যাপোক্যালিপটিক ভিশন বা মহাপ্রলয়ের ধারণাটি হচ্ছে, একটি ভয়াবহ বিশ্বব্যপী বিপর্যয়ের ঘটনা; যখন পর্বত ভেঙ্গে সমতলের সাথে মিশে যাবে সমান হয়ে, উপত্যাকাগুলো পূর্ণ হবে; বৃদ্ধ মানুষরা তাদের যৌবন ফিরে পারে এবং সকল ব্যাধি হবে অদৃশ্য, সাদা মানুষগুলোকে দ্বীপ থেকে বিড়াতিত করা হবে চিরকালের জন্য এবং তাদের কাছে “কার্গো’ পৌঁছাবে বিশাল পরিমানে এবং যে যতটুকু চায় ততটুকুই তারা নিতে পারবে (৮৫)।

স্থানীয় সরকারের জন্য সবচেয়ে বেশী চিন্তার বিষয়টি ছিল, জন ফ্রাম আরো একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তার দ্বিতীয়বার আসার সময়, তিনি নতুন পয়সা নিয়ে আসবেন, যেখানে নারিকেল এর ছবির ছাপ থাকবে। সেকারণে সবাইকে অবশ্যই সাদা মানুষের টাকা পয়সা পরিত্যাগ করতে হবে। ১৯৪১ সালে এধরনের বার্তা অধিবাসীদের মধ্যে অতিমাত্রায় কেনাকাটা করার ধুম ফেলে দিয়েছিল, মানুষরা কাজে যাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং দ্বীপের সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্থ হয় ব্যাপকভাবে। দ্বীপের ঔপনিবেশিক প্রশাসকরা এদের মূলনেতাদের গ্রেফতার করেছিলেন, কিন্তু তারা এমন কিছুই করতে পারেননি যাতে কাল্টটি বিলুপ্ত হয় এবং মিশন চার্চগুলো, স্কুল সবকিছু জনশূন্য হয়ে পড়ে।

এবং কিছুদিন পর, ধর্মগোষ্ঠীটির মধ্যে একটি নতুন মতবাদ শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছিল: জন ফ্রাম একসময় যুক্তরাষ্ট্রের রাজা ছিলেন; এবং দৈবঘটনার মতই, সেই সমসাময়িক সময়ে যুক্তরাষ্টের সেনারা নিউ হেবরিডেস এ আসতে শুরু করে এবং দ্বীপবাসীদের বিস্ময়ের মধ্যে আরো বিস্ময় ছিল, সেই নতুন আগত সেনাবহরে কৃষ্ণাঙ্গরাও ছিল, যারা দ্বীপের অধিবাসীদের মত দরিদ্র নয় বরং সাদা সেনাদের মত তারাও নানা সামগ্রীরও (কার্গো) মালিক; তীব্র উত্তেজনা ঘিরে ছিল তখন তাননা দ্বীপের অধিবাসীদের। অ্যাপোক্যালিপস দিন তাহলে অতি সন্নিকটে। আপাতদৃষ্টিতে সবাই যেন প্রস্তুত হচ্ছিল জন ফ্রাম এর দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তনের জন্য। তাননার অন্যতম একজন নেতা অভিমত দিয়েছিলেন, জন ফ্রাম আসবেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়োজাহাজে চড়ে এবং শত শত মানুষ দ্বীপের ঠিক মধ্যখানে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে যেন তার সেই উড়োজাহাজ অবতরণ করার জন্য জায়গা বা এয়ারস্ট্রিপ পায়।

এই আদিবাসীদের বানানো সেই এয়ারস্ট্রিপে ছিল, একটি বাশের তৈরী কন্ট্রোল টাওয়ার, সেখানে কাঠের তৈরী মিথ্যা হেডফোন পরা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররাও ছিল। এমন কি এয়ারস্ট্রিপের সেই তথাকথিত রানওয়েতে ডিকয় হিসাবে সাজানো মিথ্যা উড়োজাহাজও ছিলো, যেন তারা জন ফ্রামকে বহনকারী উড়োজাহাজকে সেখানে অবতরণ করার জন্য প্রলোভিত করতে পারে।

১৯৫০ এর দশকে তরুণ ডেভিড অ্যাটেনবরো, ক্যামেরাম্যান জিওফ্রে মুলিগানকে নিয়ে সেই তাননা দ্বীপে গিয়েছিলেন, জন ফ্রাম এর ‘কাল্ট’ সম্বন্ধে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরী করতে। তারা সেখানে সেই ধর্মের বহু প্রমাণ আবিষ্কার করেন এবং একপর্যায়ে তাদের দেখা মেলে ধর্মটি সবচেয়ে উঁচু স্তরের যাজক ‘নামবাস’ নামক এক ব্যক্তির।

নামবাস তার মেসিয়াহ জন ফ্রামকে অন্তরঙ্গভাবেই পরিচিত এমন কেউ হিসাবে শুধু জন নামেই উল্লেখ করেছিলেন এবং তার দাবী ছিল যে, নিয়মিত তার এই জনের সাথে কথোপকথন হয়, ‘রেডিও’র মাধ্যমে। এই ( ‘জনের রেডিও’) জিনিসটি হচ্ছে মূলত একজন বৃদ্ধা, যার কোমরে চারপাশে প্যাচানো রয়েছে একটি ইলেক্টিক তার, যে এক ধরনের ঘোরের মধ্যে গিয়ে অবোধ্য ভাষায় কিছু শব্দ সৃষ্টি করে থাকে আর নামবাস যা অনুবাদ করেন জন ফ্রামের প্রেরিত বার্তা হিসাবে। নামবাস দাবী করেছিলেন, তিনি আগে থেকে ডেভিড অ্যাটেনবরোর তার সাথে দেখা করতে আসার কথা জানতেন কারণ জন ফ্রাম তাকে সেটা রেডিওর মাধ্যমে আগেই জানিয়েছিলেন। অ্যাটেনবুরো নামবাস এর কাছে এই বিশেষ ‘রেডিওটি দেখতে চাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তা ( বোধগম্য কারণেই) প্রত্যাখ্যান করা হয়। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে নামবাস এর কাছে অ্যাটেনবরো জানতে চান, তিনি কি কখনো জন ফ্রামকে স্বচক্ষে দেখেছেন কিনা?

নামবাস খুব দৃঢ়তার সাথে মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দেন, ‘আমি তাকে বহুবার দেখেছি। “কেমন দেখতে তিনি? নামবাস আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলে, “সে তোমার মত দেখতে, তার সাদা মুখ আছে, সে লম্বা এবং দক্ষিন আমেরিকায় বাস করে।

উপরে বর্ণিত এই বিষয়টি দীর্ঘদিনের সেই জন এর কিংবদন্তীর সাথে স্ববিরোধী হয়ে যায়, যেখানে তাকে একজন খাটো মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিবর্তিত কিংবদন্তীগুলোর সাথে সাধারণত এমনটাই ঘটে থাকে।

এই ধর্মানুসারীরা বিশ্বাস করেন যে জন ফ্রাম এর প্রত্যাবর্তনের দিনটি হবে ১৫ ফেব্রুয়ারী, কিন্তু কোনো বছরে সেটা কেউ জানেন না। সেকারণে প্রতি বছর ১৫ ফেব্রুয়ারী তার অনুসারীরা নানা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের জন্য জড়ো হয় তাকে স্বাগত জানানোর জন্য। এখনও পর্যন্ত তিনি ফিরে আসেননি, কিন্তু এজন্য তার অনুসারীদের উৎসাহেও কোনো ভাটা পড়েনি। ডেভিড অ্যাটেনবুরো একজন কাল্ট সদস্য যার নাম স্যাম, তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন:

কিন্তু স্যাম, প্রায় ১৯ বছর তো হয়ে গেল, জন বলেছিলে সে কার্গো নিয়ে আসবে, তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন এর পরে আবারো প্রতিজ্ঞা করেছেন, কিন্তু কার্গোতো এখনও আসলো না। এই ১৯ বছর কি অপেক্ষা করার জন্য যথেষ্ট দীর্ঘ সময় না? স্যাম মাটির দিক থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, যদি তুমি যীশু খ্রিষ্টের জন্য দুই হাজার বছর অপেক্ষা করতে পারো, সে যদি না আসে, তাহলে আমি জনের জন্য ১৯ বছরেরও বেশী অপেক্ষা করতে পারি না?

রবার্ট বাকমান (৮৬) এর বই ‘ক্যান উই বি গুড উইদাউট গড?(৮৭) এ জন ফ্রামের কোনো ভক্তের প্রশংসাযোগ্য সেই একই উদ্ধৃতির উল্লেখ আছে, তবে সেটি করা হয়েছে একজন কানাডীয় সাংবাদিকের কাছে এবং ডেভিড অ্যাটেনবুরোর সাথে দেখা হবার পর প্রায় ৪০ বছর পরে।

যুক্তরাজ্যের রানী এবং তার স্বামী প্রিন্স ফিলিপ ১৯৭৪ সালে এই এলাকায় সফরে এসেছিলেন, এবং প্রিন্স যথারীতি পরবর্তীতে জন ফ্রামের কাল্টের মতই ঐশ্বরিক রুপ পেয়েছিলেন (আবারো লক্ষ করুন কত দ্রুত ধর্মীয় বিবর্তনের বিস্তারিত খুঁটিনাটি বিষয়গুলো পরিবর্তিত হতে পারে); প্রিন্স ফিলিপ নিঃসন্দেহে একজন সুদর্শন পুরুষ, তার নৌবাহিনীর ইউনিফর্ম এবং পালক লাগানো হেলমেট এ স্থানীয় অধিবাসীদের মনে তিনি বিশেষ রুপে দৃশ্যমান হতেই পারেন এবং এটা হয়তো বিস্ময়কর না, রানীকে নয়, তাকেই এই বিশেষ মর্যাদায় আসীন করা হয়েছিল, এটি কিন্তু দ্বীপের অধিবাসীদের সংস্কৃতিতে কোনো নারীকে দেবী হিসাবে স্বীকার করার বিষয়টি তাদের জন্য যে জটিল সেই পরিস্থিতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।

দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কার্গো কাল্ট নিয়ে আমি খুব। বেশী কিছু আর বলতে চাইছি না। তবে তারা দারুণ বিস্ময়কর একটি সমসাময়িক মডেল আমাদের সামনে তুল ধরে, যা ব্যাখ্যা করতে পারে কিভাবে ধর্ম একেবারে শূন্য গজিয়ে উঠতে পারে; বিশেষ করে সাধারণভাবে এই ধর্মগুলোর উৎপত্তিরে ক্ষেত্রে মডেলটি চারটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রস্তাব করে। আমি সংক্ষেপে নীচে তারই ব্যাখ্যা দেবো। প্রথমটি হচ্ছে, অবিশ্বাস্যরকম বিস্ময়কর দ্রুত গতিতে একটি ধর্মীয় কাল্ট গড়ে উঠেতে পারে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, কি বিস্ময়কর দ্রুততায় এটি এর উৎপত্তি প্রক্রিয়ার বিষয়গুলো লুকিয়ে ফেলতে পারে। জন ফ্রাম, যদি তার আদৌ কোনো অস্তিত্ব থেকে থাকে, তবে সেটা আমাদের স্মরণকালের অতীতের মধ্যেই ছিল। তারপরও, এত সাম্প্রতিক হওয়ার সম্ভাবনা সত্ত্বেও কারো কাছেই কোনো নিশ্চিৎ তথ্য নেই আসলেই আদৌ তার অস্তিত্ব ছিল কিনা। তৃতীয় শিক্ষাটি আসছে, বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতে একই ধরনের ধর্মীয় গোষ্ঠী বা কাল্টগুলোর উৎপত্তির বিষয়টি থেকে; এই সদৃশ্যতাগুলোর পদ্ধতিগত গবেষণা আমাদের মানুষের মনস্তাত্ত্বিকতা এবং সহজেই ধর্ম বিশ্বাসের শিকার হবার প্রবণতা সম্বন্ধে বলছে, চতুর্থত, কার্গো কাল্টগুলো একই ধরনের, এই সদৃশ্যটা শুধু তাদের নিজেদের মধ্যেই না, বরং মিল আছে অন্যান্য প্রাচীন ধর্মগুলোর সাথেও। খ্রিষ্ট ধর্ম এবং অন্যান্য প্রাচীন প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুলো যারা সারা বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে তাদেরও উৎপত্তি ঘটেছিল স্থানীয় কাল্ট হিসাবে, যেমন জন ফ্রামের কাল্ট। আসলেই গেজা ভারমেস (৮৮) এর মত গবেষক, যিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জিউইশ স্টাডির অধ্যাপক, প্রস্তাব করেছিলেন, জিসাস হচ্ছে প্যালেস্টাইনে তার সেই সময়ে জীবিত বেশ কয়েকজন ক্যারিশমাটিক বা আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের একজন, যাদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল একই ধরনের নানা কিংবদন্তী। বেশীর ভাগ কাল্টই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল; এই দৃষ্টিভঙ্গিতে যে একটি টিকে গেছে, সেটাকেই আমরা এখন মূলধারা হিসাবে দেখতে পাচ্ছি। এবং বহু শতাব্দী পেরিয়ে গেলে এটি আরো সুক্ষ্ম সংগঠিত হয়েছে হয়েছে বিবর্তনের মাধ্যমে একটি জটিল বিস্তৃত পদ্ধতিতে (মিমেটিক নির্বাচন, আপনি যদি সেটা এভাবে বলতে চান, আর না চাইলে নয়) অথবা উত্তরসূরী বেশ কিছু ধারায় বিভাজিত হয়েছে– যা এখন বিশ্বের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রাজত্ব করছে। ক্যারিশম্যাটিক আধুনিক কিছু ব্যক্তিত্বদের, যেমন, হাইলে সেলাসী (৮৯), এলভিস প্রিসলী (৯০), প্রিন্সেস ডায়ানা (৯১)– মৃত্যুগুলো, আমাদের সুযোগ করে দেয়, দ্রুত কাল্টদের কিভাবে উত্থান ঘটে এবং পরবর্তীতে মিমেটিক বিবর্তনের বিষয়টি অধ্যয়ন করার জন্য।

ধর্মের উৎপত্তির ব্যপারে আমি যা বলতে চাই সেটাই হচ্ছে উপরের এই আলোচনা। যদিও অধ্যায় দশে এই আলোচনায় আবার সংক্ষিপ্তভাবে ফিরে আসবো, যখন আমি শৈশবের কাল্পনিক বন্ধুত্বের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছি, আমাদের মনস্তাত্ত্বিক যে ‘প্রয়োজনগুলো’ যা ধর্ম পূরণ করে এই শিরোনামের নীচে।

নৈতিকতা সম্বন্ধে প্রায়ই মনে করা হয়, ধর্মের মধ্য থেকেই এটির উৎপত্তি হয়েছে, এবং পরবর্তী অধ্যায়ে আমি সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্ন করে দেখাতে চাই, আমি যুক্তি দেবো যে, নৈতিকতার জন্ম নিজেই একটি ডারউইনীয় প্রশ্নের বিষয়, যেমন আমরা জিজ্ঞাসা করেছি, ধর্মের ডারউইনীয় সারভাইভাল মূল্যটি কি; সেকারণে নৈতিকতা নিয়ে আমরা সেই একই প্রশ্ন করতে পারি। নৈতিকতা, আসলেই, আবির্ভূত হয়েছে ধর্মের উদ্ভব হবার আগেই। ধর্মের ক্ষেত্রে যেমন আমরা একটি প্রশ্ন থেকে শুরু করেছিলাম এবং নতুন করে প্রশ্নটির একটি ভিন্ন রুপ দিয়েছিলাম; নৈতিকতা সম্বন্ধে আমরা খুঁজে পাবো, এটিও অন্য কোনো কিছুর বাই-প্রোডাক্ট বা উপজাত হিসাবে গণ্য করাটাই সবচেয়ে উত্তম হবে।

পাদটীকা:

(১) মারেক কোন: ব্রিটিশ বিজ্ঞান লেখক।

 (২) Bower, ফ্যামিলি: Ptilonorhynchidae

(৩) Anting

(8) Dawkins, R. (1982). The Extended Phenotype. Oxford: W. H. Freeman

(৫) K. Sterelny, The perverse primate, in Grafen, A. and Ridley, M., eds (2006). Richard Dawkins: How a Scientist Changed the Way We Think. Oxford: Oxford University Press.

(৬) জর্জ বার্নাড শ (১৮৫৬-১৯৫০) আইরিশ নাট্যকার, লেখক।

(৭) স্টিভেন পিংকার (জন্ম ১৯৫৪) কানাডীয়-আমেরিকান কগনিটিভ মনোবিজ্ঞানী, ভাষাতাত্ত্বিক ও লেখক।

 (৮) Pinker, S. How the Mind Works (Norton, 1997)

(৯) মাইকেল শেরমার, যুক্তরাষ্ট্রে বিজ্ঞান লেখক, বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ, স্কেপটিকস সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা এবং স্কেপটিকস পত্রিকার সম্পাদক।

 (১০) How We Believe: The Search for God in an Age of Science 2001

(১১) মাইকেল পেরসিংগার, বর্তমানে কানাডায় কর্মরত যুক্তরাষ্ট্রের কগনিটিভ নিউরোসায়েন্টিষ্ট, যার গবেষণা একটি বিশেষ ক্ষেত্রে হচ্ছে নিউরোথিওলজী বা স্পিরিচুয়াল নিউরোসায়েন্স।

(১২) আর্থার কলিন রেনফ্রিউ (জন্ম ১৯৩৭) ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ, প্রত্নভাষাতত্ত্ববিদ।

(১৩) ডেভিড স্লোয়ান উলসন (David Sloan Wilson) (জন্ম ১৯৪২) আমেরিকার বিবর্তন জীববিজ্ঞানী।

(১৪) Darwin’s Cathedral: Evolution, Religion, and the Nature of Society, 2002 book

(১৫) নেপোলিয়ন শ্যানন (জন্ম ১৯৩৪) আমেরিকার নৃতত্ত্ববিদ।

(১৬) N. A. Chagnon, Terminological kinship, genealogical relatedness and village fissioning among the Yanomamo Indians, in Alexander and Tinkle (1981: ch, 28).

 (১৭) C. Darwin, The Descent of Man (New York: Appleton, 1871),vol. 1, 156

(১৮) আলফ্রেড টেনিসন (১৮০৯-১৮৯২) ইংরেজ কবি।

 (১৯) চার্জ অব দি লাইট ব্রিগেড কবিতার মূল বিষয়টি ক্রিমিয়ার যুদ্ধের একটি ঘটনা। চেইন অব কম্যান্ডের ভুল বার্তার কারণে ব্রিটিশ এই লাইট ব্রিগেডটি সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে অনেক হতাহতের কারণ হয়। মানুষের কণ্ঠস্বরের রেকর্ডিং এর অন্যতম পুরোনো নিদর্শনের একটি হচ্ছে লর্ড টেনিসনের নিজের কণ্ঠে আবৃত্তি করা এই কবিতাটি, এবং যেন অতীতের গভীর থেকে বেরিয়ে কোনো দীর্ঘ সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে ভেসে আসা আসা ফাপা সেই আওয়াজ শিহরণ জাগানোর জন্য খুবই প্রযোজ্য।

সামনে এগিয়ে যাও লাইট ব্রিগেড!
এমন কেউ কি সেখানে ছিল যে আতঙ্কিত?
যদিও সেনারা জানতো।
কেউ একজন বড় ভুল করেছে:
উত্তর দেয়া তাদের কাজ নয়,
কোনো প্রশ্ন করা তাদের কাজ নয়,
বরং নির্দেশ মানা ও মৃত্যু তাদের কাজ,
 মৃত্যুর উপত্যাকায়।
এগিয়ে চলে ছয়শ প্রাণ। (টেনিসন, চার্জ অব দ্য লাইট
ব্রিগেড)

(২০) আমি বেশ মজা পেয়েছিলাম যখন Focus on your own damn family লেখা একটি বাম্পার স্টিকার কলোরাডোতে একটি গাড়ীর পেছনে লাগানো দেখেছিলাম। কিন্তু এখন ব্যপারটা ঠিক সেরকম কৌতুককর মনে হয়না আর। কোনো কোনো শিশুর সত্যি তাদের নিজেদের পিতা মাতাদের দ্বারা মন্ত্রে দীক্ষিত হবার প্রক্রিয়া থেকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা আছে, নবম অধ্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি।

(২১) Barker, D. (1992). Losing Faith in Faith. Madison, WI: Freedom From Religion Foundation

(২২) রবার্ট হিণ্ড (জন্ম ১৯২৩) ব্রিটিশ প্রাণীবিজ্ঞানী।

(২৩) R A. Hinde. Why Gods Persist: A Scientific Approach to Religion 2nd ed. London: Routledge

(২৩) পাসকাল বয়ের, ফরাসী নতত্তবিদ।

(২8) P. Boyer. Religion Explained: The Human Instincts That Fashion Gods, Spirits and Ancestors.

(২৫) স্কট আটরান, আমেরিকার নৃতত্ত্ববিদ।

 (২৬) S. Atran. In Gods We Trust: The Evolutionary Landscape of Religion.

(২৭) পল ব্লুম, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান এবং কগিনিটিভ সায়েন্স এর অধ্যাপক।

 (২৮) দুয়ালিজম বা দ্বৈতবাদ দাবী করে মন আর শরীর পৃথক।

(২৯) থমাস আন্সটে গুথরী (১৮৫৬-১৯৩৪) ইংরেজ লেখক।

(৩০) Vice Versa: A Lesson to Fathers, Thomas Anstey Guthrie (pseudonym “F. Anstey”)

(৩১) আন্সটের উপন্যাস ভাইস ভার্সার চরিত্র।

(৩২) পেলহাম গ্রেনভিল উডহাউস (১৮৮১-১৯৭৫) ইংরেজ লেখক, বিশেষ পরিচিত তার কৌতুক রচনায়।

(৩৩) Laughing Gas: P. G. Wodehouse

(৩৪) ডেবোরাহ এফ কোলমান, ক্লিনিকাল মনোবিজ্ঞানী।

(৩৫) The Intentional Stance. Daniel C. Dennett

 (৩৬) কার্ল রিটার ভন ফ্রিশ ( ১৮৮৬-১৯৮২), নোবেল পুরষ্কার জয়ী অষ্ট্রিয় প্রাণী আচরণবিদ।

(৩৭) মাইকেল ফ্রেইন ( জন্ম ১৯৩৩) ইংরেজ নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক।

(৩৮) The Tin Men; Michael Frayn,

 (৩৯) ব্রিটিশ টেলিভিশন কমেডি, The Faulty Towers এর প্রধান চরিত্র, জন ক্লীজ অভিনয় করেছিলেন।

(৪০) জাস্টিন এল ব্যারেট, মনোবিজ্ঞানী।

 (৪১) Guardian, 31 Jan, 2006.

 (৪২) হেলেন ফিশার, মনোবিজ্ঞানী।

(৪৩) Why We Love: The Nature and Chemistry of Romantic Love: Helen Fisher

(৪৪) ভয়ঙ্কর মাদক Gerin Oil নিয়ে আমার নিবন্ধ: ‘Gerin Oil’, Free Inquiry 24: 1, 2003, 9-11. Gerin oil: Gerin oil বা Gerinioএকটি কাল্পনিক মাদকদ্রব্য, এই নিবন্ধে। যা ব্যবহার করা হয়েছিল ধর্ম বা religion কে সমালোচনা করার জন্য। শব্দটি Religion শব্দটির একটি অ্যানাগ্রাম। প্রথম নিবন্ধ Gerin Oil প্রকাশিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী প্রকাশনা ফ্রি এনকোয়ারীর, ডিসেম্বর ২০০৩ সংখ্যায়। Opiate of the Masses শীর্ষক অপর একটি প্রবন্ধে শব্দটিকে জনপ্রিয়করণ করা হয়েছিল। Gerin oil বা Geriniol কে সেখানে বর্নিত করা হয়েছে ভয়ঙ্কর একটি বৈধ মাদক দ্রব্য রুপে। রিচার্ড ডকিন্স সেখানে দাবী করেছিলেন এই মাদকটি ঐতিহাসিকভাবে অসংখ্য সহিংস ঘটনার জন্য দায়ী, যেমন সেপ্টেম্বর ১১ সন্ত্রাসী আক্রমণ, দক্ষিন আমেরিকার আদিবাসী গণহত্যা এবং সালেম এর ডাইনী বিচার। ডকিন্স তার এই প্রহসনমূলক রচনায় বর্ণনা করেন যে, ব্যবহারকারীরা এই মাদকের সংস্পর্শে আসেন সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে,যেমন কোনো বিয়ে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ইত্যাদি। সামান্য পরিমানে এর ব্যবহার কোনো ক্ষতি না করলেও এর ব্যবহারের মাত্রা দিনের পর দিন বাড়তে থাকে। মাঝারি মাত্রায় এর ব্যবহার কাউকে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে,যেখানে ব্যবহারকারীরা আশা করেন তাদের সব ব্যক্তিগত ইচ্ছার পূরণ হবে, এর সাথে মাংশপেশীর সংকোচন ও প্রসারণ হতে পারে। বেশীমাত্রায় এর ব্যবহার শব্দ ও দৃষ্টি বিভ্রমের কারণ। এছাড়াও এটি শিশু বিকালঙ্গ করণ, যৌণ দমন এবং গণহত্যাকারী হিসাবে চিহ্নিত হবার সময় মুখে স্মিত হাসি থাকার প্রবণতা থাকে।

(৪৫) জন রেমণ্ড স্মিথিস, নিউরোসাইক্রিয়াটিষ্ট।

(৪৬) Smythies J. (2006). Bitter Fruit. Charleston, SC: Booksurge.

(৪৭) Viruses of the mind: http://www.inf.fu berlin.de/lehre/pmo/eng/Dawkins-MindViruses.pdf

(৪৮) Saint Teresa of Avila, স্প্যানিশ নান, ধর্মতাত্ত্বিক ও বিখ্যাত ক্যাথলিক সেইন্ট।

(৪৯) অ্যান্থনী জন প্যাট্রিক কেনী (জন্ম ১৯৩১) ব্রিটিশ দার্শনিক।

(৫০) লুই ওলপার্ট (জন্ম ১৯২৩) দক্ষিন আফ্রিকায় জন্ম নেয়া ব্রিটিশ ভ্রণতাত্ত্বিক জীববিজ্ঞানী ও লেখক।

(৫১) Six Impossible Things Before Breakfast: The Evolutionary Origins of Belief. Lewis Wolpert

(৫২) রবার্ট লুডলো ট্রিভার্স (জন্ম ১৯৪০) বিবর্তন জীববিজ্ঞানী ও সোসিওবায়োলজিষ্ট, জীববিজ্ঞানের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ধারণার প্রণেতা।

(৫৩) Social Evolution: Robert Trivers

(৫৪) লাওনেল টাইগার, কানাডায় জন্ম নেয়া আমেরিকাবাসী নৃতত্ত্ববিদ।

 (৫৫) Optimism: The Biology of Hope, Lionel Tiger

(৫৬) জেমস জন ফ্রেজার (১৮৫৪-১৯৪১),স্কটিশ নৃতত্ত্ববিদ।

 (৫৭) The Golden Bough: A Study in Comparative Religion (পুননামকরণ The Golden Bough: A Study in Magic and Religion) James George Frazer, von প্রভাবশালী এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯০ সালে।

(৫৮) কৌতুকটি আমার না, এর উৎস হচ্ছে: 1066 and All That. ডাবলিউ সি সেলার এবং আর সি ইয়েটম্যান (১৯৩০)।

(৫৯) মার্টিন লুথার, জার্মান যাজক, যিনি প্রটেষ্টান্ট রিফরমেশন আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন।

 (৬০) http://jmm.aaa.net.au/articles/14223.htm.

(৬১) মিম (Meme) হচ্ছে কোনো ধারণা, আচরণ বা রীতি যা কোনো একটি সংস্কৃতিতে একজন ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে বিস্তার লাভ করে। মিম সাংস্কৃতিক ধারণা, রীতি বা প্রতীক বহনকারী একটি একক হিসাবে কাজ করে, যা একটি মন থেকে অন্য মনে বিস্তার লাভ করতে পারে, লেখা, কথা, আচরণ, আচার বা অন্য কোনো অনুকরণ করা সম্ভব এমন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যারা মিম তত্ত্বের সমর্থক তারা একে জিন এর সমতুল্য একটি রুপ হিসাবে দেখেন, যারা নিজেদের প্রতিলিপি করতে পারে, পরিবর্তিত হতে পারে (মিউটেশন) এবং নির্বাচনী চাপের প্রতি সংবেদনশীল; মিম শব্দটি mimeme শব্দটির একটি সংক্ষিপ্ত রুপ ( জিনের মত একই মডেলে) (শব্দটির উৎপত্তি প্রাচীন গ্রীক miméma শব্দ থেকে যার অর্থ কোনো কিছুর অনুকরণ করা); শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ব্রিটিশ বিবর্তন জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স ১৯৭৬ সালে তার দ্য সেলফিশ জিন বইটিতে বিভিন্ন আইডিয়া এবং সাংস্কৃতিক ফেনোমেনাগুলোর বিস্তারের ক্ষেত্রে বিবর্তনীয় ধারণাটি আলোচনা করার জন্য। কিছু মিম এর উদাহরণ যেমন সেখানে ছিল .. মেলোডি, কিছু বহুব্যবহৃত বাক্য, ফ্যাশন, এছাড়া আর্চ বা খিলান বানানোর কৌশল ইত্যাদি।

(৬২) অস্কার ওয়াইল্ড, বিখ্যাত আইরিশ লেখক।

(৬৩) বিশেষ করে আমার নিজের জাতি, জাতীয় বৈশিষ্ট্যসূচক আচরণের পুরাণ কাহিনী মোতাবেক: ‘Voicianglais avec son sang froid habituell (Here is the Englishman with his habitual bloody cold অর্থাৎ এই যে একজন ইংরেজ যথারীতি সর্দি সহ); এটি এসেছে এফ এস পিয়ারসনের কাছ থেকে, এছাড়া যেমন ‘coup de grace’ (lawnmower).

(৬৪) সুজান জেন ব্ল্যাকমোর, মনোবিজ্ঞানী, লেখক।

(৬৫) he Meme Machine, Susan Blackmore. Oxford University Press.

 (৬৬) Chinese Junk: প্রাচীন চীনা জাহাজ

(৬৭) অরিগামী: কাগজ ভাজ করার জাপানী শিল্পকলা।

(৬৮) দ্রুণ বিকাশের একটি পর্ব, একটি ফাঁপা গোলকের মত, যার চারিদিকে ঘিরে থাকে এক স্তরের কোষ, ব্লাস্টোমেয়ার।

(৬৯) ব্লাঙ্কুলার পরে আসে গ্যাস্টুলা, যখন এককোষী স্তরটি তিনটি স্তরে সজ্জিত হয়।

(৭০) গ্যাস্ট্রলার পরের পর্ব নিউরালা, যখন প্রথম স্নায়ুতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে।

(৭১) The Selfish Gene, Richard Dawkins

(৭২) Not by Genes Alone: How Culture Transformed Human Evolution: Peter J. Richerson, Robert Boyd

(৭৩) Genes, Memes and Human History: Darwinian Archaeology and Cultural Evolution, Stephen Shennan

(৭৪) Culture and the Evolutionary Process:Robert Boyd, Peter J. Richerson

(৭৫) The Electric Meme: A New Theory of How We Thin, Robert Aunger

(৭৬) The Selfish Meme: A Critical Reassessment, Kate Distin

(৭৭) Virus of the Mind: The New Science of the Meme. Richard Brodie

 (৭৮) সায়েন্টোলজী (Scientology) বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক রন হুবার্ড এর সৃষ্ট একটি ধর্ম।

(৭৯) মরমনিজম (Mormonism), জোসেফ স্মিথ এর প্রবর্তিত ধর্ম।

(৮০) Life of Brian (1979) British comedy by the comedy group Monty Python (Graham Chapman, John Cleese, Terry Gilliam, Eric Idle, Terry Jones and Michael Palin), directed by Terry Jones.

(৮১) Monty Python: জনপ্রিয় ব্রিটিশ কমেডি সিরিজ/টিম।

(৮২) ডেভিড অ্যাটেনবুরো (জন্ম ১৯২৩) ব্রিটিশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী, টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা ও উপস্থাপক।

(৮৩) Quest in Paradise, David Attenborough

(৮৪) আর্থার সি ক্লার্ক, বিজ্ঞান লেখক, ফিউচারিষ্ট।

(৮৫) ঈসাইয়া ৪০:৪ এর সাথে তুলনা করুন: প্রতিটি উপত্যকা উপরে উঠে আসবে এবং প্রতিটি পর্বতমালা এবং পাহাড় নীচু হয়ে যাবে; এই সাদৃশ্যতা কিন্তু আবশ্যিকভাবেই কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে মানুষের মনস্তাত্ত্বিকতার কোনো মৌলিক বৈশিষ্ট্যে বা কার্ল ইয়ুং এর ‘সম্মিলিত অবচেতন’ এর, কারণ এই দ্বীপগুলোতে মিশনারীদের উপস্থিতি বহুদিন ধরেই।

(৮৬) রবার্ট আলেক্সজান্ডার অ্যামিয়েল বাকমান, ব্রিটিশ কানাডীয় চিকিৎসক,লেখক, টিভি উপস্থাপক।

(৮৭) Can We be Good Without God?: Biology, Behavior, and the Need to Believe. Rob Buckman

(৮৮) গেজা ভেরমেস (১৯২৪-২০১৩) হাঙ্গেরিয় ব্রিটিশ গবেষক, ধর্মীয় ইতিহাসবিদ।

(৮৯) হাইলে সেলাসী, ইথিওপিয়ার সম্রাট (১৯১৬-১৯৭৪), তাকে কেন্দ্র করে রাসফারিয়াবাদের জন্ম হয়েছিল জ্যামাইকাতে ১৯৩০ এর দশকে।

(৯০) এলভিস অ্যারন প্রিসলী (১৯৩৫-১৯৭৭) আমেরিকার অত্যন্ত জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী ও অভিনেতা ছিলেন।

(৯১) ডায়ানা ফ্রান্সেস স্পেন্সার (১৯৬১-১৯৯৭), প্রিন্সেস অব ওয়েলস ছিলেন, প্রিন্স উইলিয়াম ও হ্যারীর মা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *