৮. ভাইরাস থেকে মুক্তি

০৮. ভাইরাস থেকে মুক্তি

২০০৮ সালের একটি ঘটনা। আমি তখন সবেমাত্র সিঙ্গাপুরের পাট চুকিয়ে আমেরিকা এসে বসেছি। একটি খবর দাবানলের মতো আমেরিকার পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে পড়ল। উইসকনসিনের এক দম্পতি বাইবেলের উপর আক্ষরিক ভাবে বিশ্বাস রাখতে গিয়ে নিজের মেয়েকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন।

ঘটনাটা এরকমের। মেডেলিন কারা নিউম্যান নামের ১১ বছরের এক কিশোরী। একটা কিশোরীর যা কিছু থাকার কথা সবই ছিল কারার। চপলতা, কপট গাম্ভীর্য, দুষ্টুমি, পড়াশুনা, খেলাধুলা থেকে ঢেউ খেলানো চুলের মাঝে বেণী করার ইচ্ছা— সবই। কিন্তু তারপরেও একটা জায়গায় একটু সমস্যা ছিল। ডায়াবেটিসের সমস্যা। সাধারণত এই বয়সে ডায়াবেটিস হবার কথা নয়, কিন্তু কারার সেটা ছিল। আমেরিকায় প্রতি চারশো জন শিশুর একজন এ ধরণের ডায়াবেটিস থাকে। প্রচলিত ভাবে একে বলে ‘আনডায়াগনোসড ডায়াবেটিস’। কিন্তু এটা কোন জীবন ঝুঁকি তৈরি করে না, যদি সঠিক চিকিৎসা নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ মত চলা যায়। কারার ক্ষেত্রেও ভিন্ন কিছু হবার কথা ছিল না, যদি তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হত। কিন্তু সেটা হয়নি। কারণ, কারার বাবা মা ছিলেন খ্রিস্টধর্মে প্রচণ্ড ভাবে বিশ্বাসী দুজন মানুষ। তারা ডাক্তারের কাছে যাওয়ার চেয়ে প্রার্থনাকেই পছন্দনীয় বলে মনে করলেন। তাদের বিশ্বাস ছিল, কেবল প্রার্থনার মাধ্যমে যে কোন রোগীকে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ করে দেয়া সম্ভব।

কারার বাবা নিজেও একটা সময় খ্রিস্টধর্মের পেন্টেকোস্টাল মিনিস্টার হিসেবে কাজ করেছিলেন, এবং তিনি অন্য সব বাবা মার মতোই তার কন্যাকে অনেক ভালবাসতেন। তিনি কখনোই চাননি তার কন্যা মারা যাক। বরং তিনি সবসময়ই ভেবেছেন তার কন্যার মাথায় একটু তেল মালিশ করে যীশুর কাছে প্রার্থনা করলে যীশু তার কথা শুনবেন এবং তার মেয়েকে সুস্থ করে দেবেন। না বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই; বাইবেল যে সাক্ষ্য দিচ্ছে–

‘তোমাদের মধ্যে কেউ কি অসুস্থ হয়েছে? তবে সে মণ্ডলীর প্রাচীনদের ডাকুক। তারা প্রভুর নামে তার মাথায় একটু তেল দিয়ে তার জন্য প্রার্থনা করুক। বিশ্বাসপূর্ণ প্রার্থনা সেই অসুস্থ ব্যক্তিকে সুস্থ করবে, প্রভুই তাকে সুস্থতা দেবেন।

(বাইবেল, যাকোবের পত্র, ০৫:১৪-১৫)।

কারার বাবা কারার জন্য কেবল মাথায় তেল দিয়ে প্রার্থনা করে গেছেন, এমনকি তার কন্যার ওজন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, উদ্দীপনা কমে যাচ্ছে, ঘন ঘন তৃষ্ণা পাচ্ছে, অবসাদ এসে গ্রাস করেছে, এমনকি মাঝে মধ্যে চোখে অন্ধকার পর্যন্ত দেখেছে– এগুলো দেখেও গা করেননি। যে কোন ডাক্তারই এই সমস্ত লক্ষণ দেখে এক মিনিটের মধ্যেই বুঝে যেত যে মেয়েটার সম্ভবত ডায়াবেটিস আছে। একটা সময় কারা

এতোই দুর্বল হয়ে গিয়েছিল যে, হাটা চলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এমনকি কথাও। তারপরেও তার অভিভাবকেরা ডাক্তারের কাছে নেয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি। তাদের চোখের সামনেই মেডেলিন কারা নিউম্যান মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। দিনটি ছিল ২০০৮ সালের মার্চ মাসের ২৩ তারিখ।

মৃত্যুর পর কারার অভিভাবকদের অভিযুক্ত করা হয় সন্তানকে অবহেলা এবং হত্যার অভিযোগে মামলা চলাকালীন সময়ে কারার বাবা ডেল নিউম্যান আদালতে পঁড়িয়ে নিরুত্তাপ গলায় বলেন— ‘প্রার্থনা বাদ দিয়ে রোগীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়াকে আমি ঠিক মনে করি না। এটা করলে ডাক্তারকে খোদার উপর খোদকারি করার অধিকার দেয়া হয়।

‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ মনকে কতটা আচ্ছন্ন করে ফেললে কোন বাবা এভাবে চিন্তা করতে পারে কে জানে। ছেলে মেয়ে অসুস্থ হলে বাবা মা প্রথমেই ভাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। আর ডেল নিউম্যানের মনে হয়েছিল এটা ‘খোদার উপর খোদকারি’র মতন। ডাক্তারের কাছে না নিয়ে কারার অভিভাবকেরা শরণাপন্ন হয়েছিলেন এক ওঝার। ওঝা আর কেউ নয়, তার এক প্রিয় চার্চের প্রতিষ্ঠাতা ফাদার– ডেভিড ইলস। ইলস তার লেখা থেকে উদ্ধৃত করে শোনালেন,

 ‘যীশু কখনোই কাউকে ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে পাঠাননি। যীশু কেবল একটি মাধ্যমেই সকলের চিকিৎসা করেছেন। সেটা হচ্ছে বিশ্বাসের মাধ্যমে– হিলিং বাই ফেইথ।

এই স্টেটমেন্ট চার্চের ওয়েবসাইটেও একসময় লেখা ছিল। নিউম্যান দম্পতি প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির স্মরণ না নিয়ে প্রার্থনা করায় যে ঈশ্বরের কত ভালবাসার পাত্র হয়েছেন তার উল্লেখ ছিল সেখানে। অবশ্য আমরা এখন জানি সেই ভালবাসার প্রতিদান। ভালবাসার চোটে কারাকে একেবারে বিনা চিকিৎসায় পরপারেই চলে যেতে হয়েছে। কারার মৃত্যুর পর ডেভিড ইলস ঈশ্বরের ভালবাসার প্রমাণ’গুলো সাইট থেকে গায়েব করে দিয়েছিলেন।

আদালতে কারা নিউম্যানের পিতা মাতা দ্বিতীয় মাত্রার হঠকারী নরহত্যার দায়ে (second degree reckless homicide) অভিযুক্ত হন। তাদের ২৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারত, কিন্তু আইন কানুনের জটিলতা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদির বিবেচনায় বিচারে বাবা মা দুজনকেই শেষপর্যন্ত ১০ বছরের প্রবেশন এবং ৬ বছর ধরে ৬ মাস করে কারাদণ্ড ভোগ করার বিধান দেয়া হয়।

সাধারণত অপরাধ করলে মানুষের অনুতাপ আসে। কিন্তু কারার বাবা মা ছিলেন দুজনই অনুতাপহীন। কারণ বাইবেল নামক ‘বিশ্বাসের ভাইরাসে তাদের মন ছিল সংক্রমিত। অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য ঠিক কি করতে হবে, বাইবেল এ ব্যাপারে খুব স্পষ্ট— “যদি বিশ্বাস থাকে, তবে প্রার্থনায় তোমরা যা চাইবে তা পাবে। (মথি ২১:২২)। লক্ষ্য করুন– এখনে বলা হয়নি, হয়তো কিংবা মাঝে সাঝে” কিংবা “যদি ঈশ্বর চান’। বরং বিশ্বাস থাকলে প্রার্থনা করলেই সব পাওয়া যাবে’— এটাই বাইবেলের এ শ্লোকের বক্তব্য। উপরে যাকোবের পত্র এবং মথি সহ বাইবেলের শ্লোকের সত্যতা সম্বন্ধে কারার বাবা মা– ডেল এবং লেইলানি নিউম্যান এতোটাই নিঃসন্দেহ ছিলেন যে সেগুলো নিয়ে ন্যূনতম সংশয় করেননি। নিউম্যান দম্পতি সত্যই বিশ্বাস করেছিলেন যে প্রার্থনা করলে ঈশ্বর সাড়া দেবেন, এবং মেয়েকে সুস্থ করে দেবেন। যীশু নিজেও অলৌকিক উপায়ে বহু অন্ধ, খঞ্জ, কুষ্ঠরোগাক্রান্ত কিংবা পক্ষাঘাতগ্রস্তকে সুস্থ করে দিয়েছেন (মার্ক ৮:২২-২৬, মথি ৮:১-৪, মার্ক ১:৪০-৪৫, মথি ৯:১-৮ ইত্যাদি), কারার ক্ষেত্রেই বা হবে না কেন।

বাইবেলে বর্ণিত অন্যান্য যে শ্লোকগুলো ডেল এবং লেইলানি নিউম্যানকে প্রভাবিত করেছিল, তার মধ্যে—

‘চাইতে থাক, তোমাদের দেওয়া হবে। খুঁজতে থাক, পাবে। দরজায় ধাক্কা দিতে থাক, তোমাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হবে। কারণ যে চাইতে থাকে সে পায়, যে খুঁজতে থাকে সে খুঁজে পায়, আর য়ে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে তার জন্য দরজা খুলে দেওয়া হয়’ (মথি ৭:৭-৮, যীশুর উপদেশ)। কিংবা—

‘তোমরা মন্দ হয়েও যদি তোমাদের সন্তানদের ভাল ভাল জিনিস দিতে জানো, তবে তোমাদের স্বর্গের পিতা ঈশ্বরের কাছে যাঁরা চায়, তাদের তিনি নিশ্চয়ই উৎকৃষ্ট জিনিস দেবেন’ (মথি ৫:১১, যীশু সুবর্ণ উপদেশ দেওয়ার ঠিক আগেকার বক্তব্য)। অথবা–

‘আমি তোমাদের আবার বলছি, পৃথিবীতে তোমাদের মধ্যে দুজন যদি একমত হয়ে কোন বিষয় নিয়ে প্রার্থনা কর, তবে আমার স্বর্গের পিতা তাদের জন্য তা পূরণ করবেন’ (মথি ১৮:১৯)।

এধরণের অসংখ্য বাইবেলের আয়াত থেকে নিউম্যান দম্পতি নির্দেশনা পেয়েছিলেন যে, প্রার্থনায় সত্যই সুস্থ হয়ে উঠে অসুস্থ রোগী। যীশু উপদেশ দিয়েছেন সবাইকে প্রার্থনা করার, কেবল প্রার্থনা করলেই তিনি শুনবেন, ডাক্তারের কাছে গেলে নয়–

‘আমি তোমাদের সত্যি বলছি, যে আমার ওপর বিশ্বাস রাখে, আমি যে কাজই করি না কেন, সেও তা করবে, বলতে কি সে এর থেকেও মহান মহান কাজ করবে, কারণ আমি পিতার কাছে যাচ্ছি। আর তোমরা আমার নামে যা কিছু চাইবে, আমি তা পূর্ণ করব, যেন পিতা পুত্রের দ্বারা মহিমান্বিত হন। তোমরা যদি আমার নামে আমার কাছে কিছু চাও, আমি তা পূর্ণ করব’ (যোহন ১৪:১২-১৪)।

এখানে কোন ‘আউট অফ কন্টেক্সট’ কিংবা ‘মিসইন্টারপ্রিটেশনের সুযোগ নেই। যীশু বলছেন, যদি আমার নামে আমার কাছে কিছু চাও, আমি তা পূর্ণ করব। খুব সোজাসাপ্টা কথা। যীশু নিজে বহু সময়েই অসুস্থকে সুস্থ করেছেন। তার কাছে প্রার্থনা করলে আপনিও অসুস্থকে সুস্থ করতে পারবেন।

বাইবেল থেকে জানা যায়, যীশু একবার বৈথনিয়া ছেড়ে আসার সময় একটা ডুমুর (ফিগ) গাছকে অভিসম্পাত করেছিলেন, কারণ তিনি ক্ষুধার্ত ছিলেন, কিন্তু গাছটি ফলবতী ছিল না সেসময়। যীশু অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন, এখন থেকে (তামার ফল আর কেউ কোন দিন খেতে পারবে না!’। পরদিন তার শিষ্যরা গাছটির কাছে গিয়ে দেখল ডুমুর গাছটি মূল থেকে শুকিয়ে গেছে। শিষ্যরা অবাক হয়ে তাকে এই অলৌকিক ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে, যীশু বললেন,

‘ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখ! আমি তোমাদের সত্যি বলছি, কেউ যদি ঐ পাহাড়কে বলে, “উপরে যাও এবং সমুদ্রে গিয়ে পড়, আর তার মনে কোন সন্দেহ না থাকে এবং সে যদি বিশ্বাস করে যে সে যা বলছে তা হবে, তাহলে ঈশ্বর তার জন্য তাই করবেন। এইজন্য আমি তোমাদের বলি, তোমরা যা কিছুর জন্য প্রার্থনা কর, যদি বিশ্বাস কর যে, তোমরা তা পেয়েছ, তাহলে তোমাদের জন্য তা হবেই (মার্ক, ১১:২২-২৪)।

এখন কথা হচ্ছে বাইবেল সত্য হলে কারাকে মৃত্যুবরণ করতে হল কেন? যেখানে বাইবেলের ছত্রে ছত্রে বিশ্বাসের মাধ্যমে অসুস্থ রোগীকে সুস্থ করার প্রমাণ আছে, কেন ঈশ্বর কারার বিশ্বাসী বাবা মার ডাকে সারা দিয়ে তাদের সন্তানকে সুস্থ করে তুললেন? আমার মত সংশয়বাদীরা বলবেন, এর একটা বড় কারণ, প্রার্থনা আসলে কোন কাজে আসে না। মুক্তমনার একসময়কার মডারেটর ফরিদ আহমেদ একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন প্রার্থনা কি কোন কাজে আসে?” শিরোনামে। লেখাটি মুক্তমনার বহুল আলোচিত ‘বিজ্ঞান ও ধর্ম– সংঘাত নাকি সমন্বয়?” শিরোনামের গ্রন্থটির অনলাইন সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। প্রবন্ধটি তিনি শুরু করেছিলেন আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহম্মদ এরশাদের সময়কার একটি ঘটনা উল্লেখ করে[১৭৬]–

‘অনেকেরই স্বৈরাচারী এরশাদের সময়কার একটা বিশেষ ঘটনার কথা মনে থাকার কথা। সন তারিখ অবশ্য খুব ভাল করে মনে নেই আমার। তবে এইটুকু মনে আছে যে, বাংলাদেশে তখন বৈশাখ বা জ্যৈষ্ঠের ভয়াবহ দাবদাহ। খরায় পুড়ছে সারাদেশ। বৃষ্টির নাম নিশানাও নেই অনেকদিন ধরে। আল্লাহ প্রেমিক এরশাদ বেশ ঘটা করে একদিন ঢাক ঢোল পিটিয়ে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে ইসতিশকা নামাজ (বৃষ্টির জন্যে এই নামাজ পড়া হয়) পড়ার ঘোষণা দিল। নির্দিষ্ট দিনে সকালের দিকে অসংখ্য মানুষের উপস্থিতিতে সেই নামাজ পড়াও হলো। আর কি আশ্চর্য! দুপুর গড়াতে না গড়াতেই কাল বৈশাখীর ঝড় হয়ে বৃষ্টি ঝুঁপিয়ে পড়লো ঢাকাসহ মোটামুটি প্রায় সারা দেশে। এরশাদ যে আল্লাহর খুব পেয়ারের বান্দা এবং খোদা যে মুমিন মুসলমানের ডাকে সাড়া দেন সে ব্যাপারে মানুষের আর কোন সন্দেহই রইলো না। দুমুখেরা অবশ্য বলে থাকেন যে আবহাওয়া অফিস থেকে ওইদিন বিকালে বৃষ্টি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনার পূর্বাভাস পেয়েই এরশাদ জনগণকে নামাজ পড়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল। অনেকে হয়তো ভাবছেন বাংলাদেশের মত অশিক্ষিত এবং ধর্মভীরু মানুষের দেশে এটাইতো স্বাভাবিক। তাদের জন্য বলছি, এ ধরনের অন্ধবিশ্বাস শুধুমাত্র যে শুধুমাত্র আমাদের মতো পশ্চাৎপদ দেশেই রয়েছে তা কিন্তু নয়। এই সেদিনও পোলিশ পার্লামেন্টে যখন সরকারী দলের পক্ষ থেকে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করার প্রস্তাব করা হয় তখন পার্লামেন্টে বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, সত্যি সত্যিই বিশ জনেরও বেশী এমপি সংসদীয় চ্যাপেলে ঈশ্বরের কাছে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেছিল। যারা এই ঘটনাকে কৌতুক হিসাবে নিয়ে বেশ মজা পাচ্ছেন তাদের জন্য তথ্য হচ্ছে পোল্যান্ড ক্যাথলিক দেশ এবং প্রয়াত পোপ দ্বিতীয় জন পল ক্যাথলিকদেরকে আহ্বান জানিয়েছিলেন তৃষ্ণার্ত ধরিত্রীকে বৃষ্টির সুশীতল পরশ দেওয়ার জন্য সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নিকট আকুল অনুরোধ করতে।

স্বাস্থ্য, নিশ্চয়তা, নিরাপত্তা, ভাল রেজাল্ট, চাকুরীর প্রমোশন, বিত্ত বা আরো বৃহৎ কোন লক্ষ্য যেমন বিশ্ব শান্তি ও মানব জাতির দুর্দশার অবসান ইত্যাদি হাজারো নানান বিষয়ে প্রতিদিন মানুষ সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করে থাকে। প্রার্থনা যে সবসময় ভাল কিছুর জন্যই করা হবে তা কিন্তু নয়। খারাপ উদ্দেশ্যেও প্রার্থনা করা হতে পারে। কেউ কেউ দেখা যায় চুরি চোট্টামি, ডাকাতি, প্রতারণা, ধান্ধাবাজি বা ভয়ংকর প্রতিশোধের জন্যও ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ কামনা করে থাকে।

ফরিদ আহমেদ ভুল বলেননি। প্রার্থনা বর্তমানে সারাবিশ্বে যেন এক ‘নয়া কুটির শিল্পে পরিণত হয়েছে যেন। প্রার্থনার ফলে রোগ নিরাময় হয়ে যায়– এই ভ্রান্ত ধারণার উপর নামী দামী সব জার্নালে অসংখ্য তথাকথিত বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল ছাপার কথা বলা হয় মিডিয়ায়। গত দশ বছরে প্রার্থনার সাহায্যে অনেক জটিল রোগীদের নিরাময় করা গিয়েছে’ ধরণের দাবী সম্বলিত কমপক্ষে আধ ডজন বই বেস্ট-সেলারের তালিকায় উঠেছে। নিউজ উইকের মত আরো অনেক ম্যাগাজিনের কভার স্টোরিও হয়েছে এই বিষয়কে নিয়ে। ডেটলাইন এনবিসি-র মত টেলিভিশনের কোন কোন প্রোগ্রামের পুরোটাই প্রার্থনাকে কেন্দ্র করে হয়েছে। বিশেষ করে চিকিৎসক ল্যারি ডোসি তার “Prayer is Good Medicine: How to Reap the Healing Benefits of Prayer’ এবং “Healing Words: The Power of Prayer and Practice of Medicine’ প্রভৃতি ছদ্মবৈজ্ঞানিক বইয়ে প্রার্থনা যে রোগ নিরাময়ে দারুণভাবে কাজ করে তার অনেক বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে– এই ধারণাকে বিশেষভাবে জনপ্রিয় করতে যেন উঠে পড়ে লেগেছেন।

কিন্তু আদৌ কি প্রার্থনা কি কাজ করে? আসলে প্রার্থনা কাজ করার স্বপক্ষে কোন প্রমাণ তো পাওয়া যায়ই নি, বরং কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় সম্পূর্ণ উলটো ফলাফল বেরিয়ে এসেছে। যেমন, ডিউক ইউনিভার্সিটির চিকিৎসকদের তিন বছর ধরে পরিচালিত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ফলদায়ক প্রার্থনার প্রভাব যাচাইয়ের জন্য আমেরিকার নয়টি হাসপাতালের ৭৪৮ জন রোগীর উপর গবেষণা চালানো হয়। লে এবং মোনাস্টিক। ক্রিশ্চিয়ান, সুফি মুসলিম এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ সারা বিশ্বের বারোটি প্রার্থনা গ্রুপ এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। প্রার্থনা ই-মেইলের মাধ্যমে জেরুজালেমেও পাঠানো হয়েছিল। করোনারি আর্টারি অবস্ট্রাকসনের রুগীদের কম্পুটারের সাহায্যে এলোপাথাড়ি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত করা হয় এবং বারোটি প্রার্থনা গ্রুপের নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গ্রুপগুলো রোগীদের সম্পূর্ণ আরোগ্যের জন্য প্রার্থনা করে। এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছিল দ্বৈত অন্ধ (Double blind)। হাসপাতালের স্টাফ বা রোগী কেউই জানতো না কার জন্য প্রার্থনা করা হচ্ছে। The Lancet জার্নালে প্রকাশিত ফলাফল থেকে দেখা যায় যে, দুই গ্রুপের নিরাময় হওয়া এবং স্বাস্থ্যের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ কোন পার্থক্য নেই। একই রকম আরেকটা স্টাডি হয়েছিল হার্ভার্ড এবং মায়ো ক্লিনিকের তত্ত্বাবধানে– যেটা স্টেপ স্টাডি’ নামে পরিচিত। ১৮০২ জন রোগীর উপর পরীক্ষার ফলাফল আরো চমকপ্রদ। স্টেপ স্টাডি থেকে পাওয়া ফলাফলে দেখা গেছে, প্রার্থনা তো কোন কাজে আসেই না, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রার্থনা বরং মানসিক উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে। যাদের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে, দেখা গিয়েছিলো পরবর্তীতে তাদের অনেকেরই শারীরিক অবস্থার অবনমন ঘটেছে। এটা কেন হল গবেষকেরা হলফ করে বলতে পারেননি, তবে সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হিসেবে তারা বলেছেন, যে সমস্ত রোগী জানতে পেরেছে যে তাঁদের জন্য প্রার্থনা করা হচ্ছে, তারা ভেবে নিয়েছে তাদের অবস্থা এতোটাই গুরুতর যে সঙ্ঘবদ্ধ প্রার্থনার দরকার পড়ছে। ফলে তাদের মধ্যে উদ্বেগের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, আর সেই সাথে ঘটেছে শারীরিক জটিলতা বৃদ্ধি[১৭৭]। তবে ‘নেগেটিভ’ ফলাফলের ব্যাপারটা যদি আমরা বাদও দেই এটা নিশ্চিত, প্রার্থনার কোন সুপ্রভাব নেই, অন্তত নিরপেক্ষ গবেষণায় তা পাওয়া যায়নি।

আর রোগাক্রান্ত রোগীকে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে কেবল প্রার্থনা করলে কি দুর্ভোগ রোগী এবং পরিবারের জন্য বয়ে আনতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। কিশোরী মেডেলিন কারা নিউম্যান নিজের জীবন দিয়ে সেটা আমাদের দেখিয়ে গেছে। কিন্তু তারপরেও আমাদের চারিদিকের বিশ্বাসের ভাইরাসাক্রান্ত মন অনেক সময়েই সেটা বুঝতে সক্ষম হয় না।

.

বিশ্বাসের কি আদৌ দরকার আছে?

অনেকেই মনে করেন বিশ্বাস না থাকলে জীবনের কোন অর্থ থাকে না। শিক্ষা, যুক্তি, জ্ঞান প্রভৃতির যেমন দরকার হয় জীবনে, বিশ্বাসেরও দরকার আছে। নইলে জীবন নাকি ‘পরিপূর্ণ হয় না। আমি মনে করিনা সেটা সত্য। বিশ্বাস’ ব্যাপারটিই দাঁড়িয়ে আছে একটি ‘অপ-বিশ্বাসমূলক প্রক্রিয়ার উপর। ড. হুমায়ুন আজাদের একবার একটি উক্তি করেছিলেন সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে, যা এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক:

‘যে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই, যার কোনো অস্তিত্ব নেই যা প্রমাণ করা যায় না, তাতে মানুষকে বিশ্বাস করতে হয়। মানুষ ভুতে বিশ্বাস করে, পরীতে বিশ্বাস করে বা ভগবানে, ঈশ্বরে বা আল্লায় বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাস সত্য নয়, এগুলোর কোনো বাস্তবরূপ নেই। মানুষ বলে না, আমি গ্রাসে বিশ্বাস করি বা পানিতে বিশ্বাস করি, মেঘে বিশ্বাস করি। যেগুলো নেই সেগুলোই মানুষ বিশ্বাস করে। বিশ্বাস একটি অপবিশ্বাসমূলক ক্রিয়া। যা সত্য, তাতে বিশ্বাস করতে হয় না; যা মিথ্যে তাতে বিশ্বাস করতে হয়। তাই মানুষের সব বিশ্বাস ভুল বা ভ্রান্ত, তা অপবিশ্বাস।

কথাটি মিথ্যে নয়। বিশ্বাস অপ্রয়োজনীয় তো বটেই উপরন্তু এটা ক্ষতিকর, এবং এমনকি তা তৈরি করতে পারে ভাইরাসের এবং মহামারীর; এবং সেটা করেও। বিশ্বাসের একনিষ্ঠ অনুগামীরা বিধর্মীদের হত্যা করা শুরু করে, ডাইনি পোড়ানোতে কিংবা সতীদাহে মেতে উঠে, কখনো গণ-আত্মহত্যায় জীবন শেষ করে দেয় কিংবা বিমান নিয়ে সোজা হামলে পড়ে টুইন টাওয়ারের উপর।

কিন্তু তারপরেও কি বিশ্বাস বলে কি কিছু লাগে না? এমনকি আমরা মুক্তমনারাও যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, প্রগতিতে বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করি মানবতায় বলি, সেগুলো? প্রশ্নটি করেছিলেন এক পাঠক আমাকে ফেসবুকে। সত্যই তো আমরা বহু কিছুতেই ‘বিশ্বাস করি’ বলি। তাহলে বিশ্বাস বাবাজিকে এড়ানো যাচ্ছে কই? কিন্তু আমার মতে, সে ‘বিশ্বাস’গুলো আসলে বিশ্বাস নয়, আস্থার বহিঃপ্রকাশ। আমাদের আস্থা আছে গণতন্ত্রে, প্রগতিতে কিংবা মানবতায়। এই আস্থা আমাদের এমনিতে গড়ে ওঠেনি। উঠেছে বহুদিনের অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতিতে। আমরা আধুনিক বিশ্বের রাষ্ট্রপরিচালনার যে উপাত্ত পাচ্ছি– সে অভিজ্ঞতায় জেনেছি স্বৈরতন্ত্র কিংবা মোল্লাতন্ত্রের চেয়ে গণতন্ত্র অনেক বেশি কার্যকরী। তেমনি, প্রগতি কিংবা মানবতাবাদকেও আমরা বিভিন্নভাবে পাওয়া উপাত্তের কষ্টিপাথরে যাচাই করেছি বলেই এগুলোতে আমাদের আস্থার প্রতিফলন ঘটছে। এখানে বিশ্বাসের আসলে কোন স্থান নেই।

আমরা অনেক সময়ই না ভেবে কিছু বাক্য বলে ফেলি, যা থেকে মনে হতে পারে বিশ্বাসটাই মুখ্য। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই দেখা যায়, এই ধরণের বাক্যে ব্যবহৃত ‘বিশ্বাস করা (believe) শব্দটি সহজেই অন্য কোন শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়। যেমন এই বাক্যটি—

 ‘আমি বিশ্বাস করি আজ রাতে বৃষ্টি হবে। এটাকে আসলে সহজেই ‘মনে করি’ (think) দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়–

‘আমি মনে করি আজকে বৃষ্টি হবে।

এরকম অনেক কিছুই আমরা চলতি কথায় বলি। এমনকি বিজ্ঞানের সাথে জড়িত ব্যক্তিরাও মাঝে সাঝে এ ধরনের বাক্য ব্যবহার করে বসেন–

 ‘আমরা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটি বিশ্বাস করব ততক্ষণই, যতক্ষণ সেটা সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে সমর্থিত হবে’।

উনি আসলে বলতে চাইছেন—

‘আমরা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটি ব্যবহার করব ততক্ষণই, যতক্ষণ সেটা সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে সমর্থিত হবে।

কাজেই এ ব্যাপারেও বিশ্বাসের কোন দরকার পড়ছে না। বিশ্বাস বলতে আসলে সাক্ষ্য প্রমাণহীনভাবে কোন ধারনা কিংবা সত্ত্বার উপর নির্ভরতা বোঝায়, বোঝায় স্রেফ অন্ধ আনুগত্য। আর এ ধরণের অন্ধ আনুগত্যের কুফল সম্বন্ধে নতুন কিছু আর বোধ হয় দরকার নেই। প্রতিটি বিশ্বাস-নির্ভর গ্রন্থের বিভিন্ন আয়াত এবং শ্লোকে বিধর্মীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছে ঢালাওভাবে, কখনো দেয়া হয়েছে হত্যার নির্দেশ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ধর্ম আসলে জ্বিহাদ, দাসত্ব, জাতিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা, হোমোফোবিয়া, অসহিষ্ণুতা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, নারী নির্যাতন এবং সমঅধিকার হরণের মূল চাবিকাঠি হিসেবে প্রতিটি যুগেই ব্যবহৃত হয়েছে। শুধু অতীতে হয়, আজকের এই প্রযুক্তিময় একবিংশ শতকেও এটা ভয়াবহ রকমের বাস্তব। বইয়ের এই অংশটা লেখার সময় বিভিন্ন খবরে চোখ বোলাচ্ছিলাম। ফলাফল মোটেই শুভ হল না, বলাই বাহুল্য—

  • বিবর্তনীয় পথে কুকুর কিভাবে মানুষের পোষা জীবে পরিণত হয়েছে তা সবার জানা থাকলেও ইসলামী শরিয়া বিজ্ঞান বলছে ‘কুকুরকে পোষ মানানো যায় না[১৭৮]
  • বাংলাদেশে মাত্র ছয় বছর বয়সী এক মেয়ে জামে মসজিদের ইমামের যৌন হয়রানীর শিকার[১৭৯]।
  •  ১৯ জনকে হত্যা করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করছে নাইজেরিয়ার ইসলামিস্টদের দল[১৮৯]।
  • বাগদাদে একটি আত্মঘাতী বোমা হামলায় মারা গেছে কমপক্ষে ৩৮ জন[১৮১]।
  • যৌন নিপীড়নের অভিযোগে দিল্লি পুলিশ আটক করেছে আশ্রমের নারায়ণ সাঁইকে[১৮২]।
  • পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে ট্রেন হামলায় শান্তিবিরোধী ৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে[১৮৩]।
  •  ক্যাথলিক চার্চ তাদের যৌনকুকীর্তির কাহিনি জাতিসংঘকে জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে[১৮৪]।
  • অযোধ্যার সাধু সন্ন্যাসীরা হত্যা, চোরাচালান, মাদকসেবন সহ নানা অপরাধচক্রের সাথে জড়িত বলে রিপোর্টে প্রকাশ[১৮৫]।
  • খ্রিসমাসের সময়ে ইরাকে দু’টি পৃথক হামলায় ইসলামিস্টরা ৩৭ জন খ্রিষ্টানকে হত্যা করেছে[১৮৬]।
  •  মাজারে যাওয়ার অপরাধে হয় ব্যক্তির গলা কেটে ফেলেছে পাকিস্তানী তালিবানরা[১৮৭]।
  •  আফগানিস্তানে আট বছর বয়সী শিশুদের আত্মঘাতী বোমারু হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করা হচ্ছে[১৮৮]।
  •  সিরিয়ার রিফিউজি মেয়েদের দশ হাজার রিয়ালের বিনিময়ে ক্রয় করতে চাওয়ার বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে সৌদি আরবের পত্রিকায়[১৮৯]।
  •  নারী-পুরুষের অনলাইন চ্যাট নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে ইরানে[১৯০]।
  •  আই.এইচ.ইউ’র রিপোর্ট অনুযায়ী, তেরটি দেশে নাস্তিকতার ‘অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে, সবগুলোই মুসলিম প্রধান[১৯১]।
  •  নির্বাচনে পরাজয়ের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে ঋষিপল্লীর দুই গৃহবধূকে ধর্ষণ করেছে মৌলবাদীরা[১৯২]। সারা দেশেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে বিভিন্ন স্থানে বিধর্মী জনগণের উপর এরকম হামলা চালিয়েছে মৌলবাদী শক্তি। নির্যাতনের মাত্রা এতোটাই আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে গেছে যে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে[১৯৩]।

এ খবরগুলো মূলত ডিসেম্বর (২০১৩)– জানুয়ারি (২০১৪) মাসের কয়েকদিনের পত্রিকায় খবর। প্রতিদিনই বিশ্বাসের ভাইরাস সংক্রমিত করছে মানুষকে, আমাদের সমাজকে। নানা ভাবে। এর বলি হচ্ছে অজস্র নিরীহ প্রাণ।

.

বিজ্ঞানও কি বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত?

বিশ্বাসের সাথে বিজ্ঞানের দ্বন্দ্বের কথা কারো অজানা নয়। বর্তমানে যদিও খুব ফলাও করে ধর্ম-বিজ্ঞানের সমন্বয় কিংবা সম্প্রীতির কথা বলা হয়, বিজ্ঞান এবং ধর্মের দ্বন্দ্ব যুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাসের সাথে সবাই কমবেশি পরিচিত। খ্রিস্ট-জন্মের পাঁচশ বছর আগে পিথাগোরাস, এনাকু সিমন্ডের মতো অনুসন্ধিৎসু দার্শনিকেরা জানিয়েছিলেন পৃথিবী সূর্যের একটি গ্রহ মাত্র, সূর্যকে ঘিরে অন্য সকল গ্রহের মতো পৃথিবীও ঘুরছে। ধর্মবিরোধী এই মতামত প্রকাশের জন্য এদের অনেককেই সেসময় সইতে হয়েছিল নির্যাতন। এই কুফরি মতবাদকে দুই হাজার বছর পরে পুস্তকাকারে তুলে ধরেছিলেন পোল্যান্ডের নিকোলাস কোপার্নিকাস। বাইবেল বিরোধী এই সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব প্রচারের ‘অপরাধে’ কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও আর ব্রুনোর ওপর কী রকমভাবে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালানো হয়েছিল সে এক লজ্জাকর ইতিহাস। গ্যালিলিওর সাথে চার্চের দ্বন্দ্বের ব্যাপারটা আরেকবার স্মরণ করা যাক।

সেটা সেই ১৬৩৩ সাল। মানুষের মনে পৃথিবী নয়, সূর্য তখন পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে। কিন্তু গ্যালিলিও তাঁর নতুন তৈরি করা টেলিস্কোপটির পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করে, যুক্তি-তর্ক দিয়ে আস্ত একটা বই লিখে ফেললেন বাইবেলীয় মতবাদের বিরোধিতা করে। তিনি বললেন, সূর্য নয়, বরং পৃথিবীই ঘুরছে সূর্যকে কেন্দ্র করে। ব্যাস চার্চের চোখে করে ফেললেন ব্লাসফেমি[১৯৪]।

গ্যালিলিও তখন প্রায় অন্ধ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ। অসুস্থ ও বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে জোর করে ফ্লোরেন্স থেকে রোমে নিয়ে যাওয়া হলো, হাঁটু ভেঙে সবার সামনে জোড় হতে ক্ষমা প্রার্থনা করিয়ে বলতে বাধ্য করা হলো, এতদিন গ্যালিলিও যা প্রচার করেছিলেন তা ধর্মবিরোধী, ভুল ও মিথ্যা। বাইবেলে যা বলা হয়েছে সেটিই আসল, সঠিক। পৃথিবী স্থির-অনড়, সৌর জগতের কেন্দ্রে। গ্যালিলিও প্রাণ বাঁচাতে তাই করলেন। স্বীকারোক্তি ও প্রতিজ্ঞাপত্র স্বাক্ষর করে গ্যালিলিও বলেছিলেন[১৯৫]–

…সূর্য কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ও নিশ্চল- এরূপ মিথ্যা অভিমত যে কীরূপ শাস্ত্রবিরোধী সেসব বিষয় আমাকে অবহিত করা হয়েছিল; এ মিথ্যা মতবাদ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে এর সমর্থন ও শিক্ষাদান থেকে সর্বপ্রকারে নিবৃত্ত থাকতে আমি এই পবিত্র ধর্মসংস্থা কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছিলাম। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সে একই নিন্দিত ও পরিত্যক্ত মতবাদ আলোচনা করে ও কোনো সমাধানের চেষ্টার পরিবর্তে সেই মতবাদের সমর্থনে জোরালো যুক্তিতর্কের অবতারণা করে আমি একটি গ্রন্থ রচনা করেছি। এজন্য গভীর সন্দেহ এই যে আমি খ্রিস্ট ধর্মবিরুদ্ধ মত পোষণ করে থাকি। … অতএব সঙ্গত কারণে আমার প্রতি আরোপিত এই অতি ঘোর সন্দেহ ধর্মাবতারদের ও ক্যাথলিক সম্প্রদায়ভুক্ত প্রত্যেকের মন হতে দূর করার উদ্দেশ্যে সরল অন্তঃকরণে ও অকপট বিশ্বাসে শপথ করে বলছি যে পুর্বোক্ত ভ্রান্ত ও ধর্মবিরুদ্ধ মত আমি ঘৃণা ভরে পরিত্যাগ করি।…’

ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ নিয়েই গ্যালিলিওর মৃত্যু হয় ১৬৪২ সালে, নিজ গৃহে, অন্তরিন অবস্থায়। গ্যালিলিও তো তাও প্রাণে বেঁচেছিলেন, কিন্তু ব্রুনোকে তো পুড়িয়েই মারলো ঈশ্বরের সুপুত্ররা। তারপরও কি সুর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ঘোরা ঠেকানো গেল?

শুধু গ্যালিলিও কিংবা ব্রুনোই নন, তাদের সমসাময়িক লুচিলিও ভানিনি, টমাস কিড, ফ্রান্সিস কেট, বাথৌলোমিউলিগেট সহ অনেককেই ধর্মান্ধদের হাতে নিগৃহীত এবং নির্যাতিত হয়ে নিহত হতে হয়েছিল। খ্রিস্টের জন্মের চারশো পঞ্চাশ বছর আগে এনাক্সোগোরাস বলেছিলেন চন্দ্রের নিজের কোনো আলো নেই। সেই সঙ্গে সঠিকভাবে অনুসন্ধান করেছিলেন চন্দ্রের হ্রাস বৃদ্ধি আর চন্দ্রগ্রহণের কারণ। এনাক্সোগোরাসের প্রতিটি আবিষ্কারই ছিল ধর্মবাদীদের চোখে জঘন্য রকমের অসত্য। ঈশ্বর বিরোধী, ধর্ম বিরোধী আর অসত্য প্রচারের অপরাধে দীর্ঘ আর নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর তাকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হয়। ষোড়শ শতকে সুইজারল্যান্ডের বেসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শাস্ত্র এবং ভেষজবিদ্যার অধ্যাপক ফিলিপাস প্যারাসেলসাস ঘোষণা করলেন– মানুষের অসুস্থতার কারণ কোনো পাপের ফল কিংবা অশুভ শক্তি নয়, রোগের কারণ হলো জীবাণু। ওষুধ প্রয়োগে জীবাণু নাশ করতে পারলেই রোগ ভালো হয়ে যাবে। প্যারাসেলসাসের এই উদ্ভট তত্ত্ব শুনে ধর্মের ধ্বজাধারীরা হা রে রে করে উঠলেন। সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক ধর্মবিরোধী মতবাদ প্রচারের জন্য প্যারাসেলসাসকে হাজির করা হয়েছিল ‘বিচার’ নামক এক প্রহসনের মুখোমুখি। ধর্মান্ধ বিচারকেরা ব্রুনোর মতোই প্যারসেলসাসকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল। প্যারাসেলসাসকে সেদিন জীবন বাঁচাতে মাতৃভূমি ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। অত্যাচার আর নির্যাতন শুধু খ্রিস্টানদের একচেটিয়া ভেবে নিলে ভুল হবে- আজকে মুসলিমরা ইবনে খালিদ, যিরহাম, আল দিমিস্কি, ওমর খৈয়াম, ইবনে সিনা, ইবনে বাজা, আল কিন্দী, আল রাজি কিংবা ইবনে রুশদের মতো। দার্শনিকদের জন্য গর্ববোধ করে, সম তাদের সবাই দার্শনিকদের সেসব কিন্তু–য়ে বৈজ্ঞানিক সত্য কিংবা মুক্তমত প্রকাশের কারণে মৌলবাদীদের হাতে নিগৃহীত, নির্যাতিত কিংবা নিহত হয়েছিলেন।

আজকের দিনের পরিবর্তিত পরিবেশে বিজ্ঞানীদের উপর এত ঢালাওভাবে অত্যাচার করা কিংবা ডাইনি পোড়ানোর মতো তাদের পুড়িয়ে মারা না গেলেও ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের দল সুযোগ পেলে এখনো বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঠেকাতে মুখিয়ে থাকে। যখনই বিজ্ঞানের কোনো নতুন আবিষ্কার তাদের নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত বিশ্বাসের বিপরীতে যায়, খোদ বিজ্ঞানকে ফেলে দিতে চায় আস্তাকুঁড়ে। তাতে অবশ্য লাভ হয় না কিছুই। অযথা গোলমাল বাধিয়ে নিজেরাই বরং সময় সময় হাস্যাস্পদ হন। অধিকাংশ ধার্মিকেরাই এখনো বিবর্তন তত্ত্বকে মন থেকে মেনে নিতে পারেন নি কারণ ডারউইন প্রদত্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের অবস্থান ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত সৃষ্টির কল্পকাহিনিগুলোর একশ আশি ডিগ্রী বিপরীতে। এখনো সুযোগ পেলেই ধর্মান্ধ মোল্লার দল প্রগতিশীল দার্শনিক, বিজ্ঞানী কিংবা সাহিত্যিকদেরকে ‘মুরতাদ’ আখ্যা দেয়, চাপাতি দিয়ে কোপায় কিংবা দেশ থেকে নির্বাসিত করে। এ তো গেল আমাদের মতো দেশগুলোর অবস্থা। তথাকথিত ‘উন্নত বিশ্বে এখনো অশিক্ষিত আর অর্ধশিক্ষিত পাদ্রি আর মোল্লারা উপযাজক সেজে বিজ্ঞানীদের পরামর্শ দিতে আসে বিজ্ঞানীদের কোন গবেষণা নৈতিক, আর কোনটা অনৈতিক।

ইদানীং আবার কোন কোন মহল থেকে এক ধরনের কুযুক্তি বাজারে এসেছে, বিজ্ঞানও নাকি বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। আগে ব্লগে বা ফোরামে ধর্মবাদীরা এ যুক্তি দিতেন, ইদানীং কিছু বিজ্ঞানীও যুক্ত হয়েছেন এই ধরণের প্রচারে। পল ডেভিস এমন একজন। পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে ভালো তাত্ত্বিক কাজ আছে তার। সেইসাথে তিনি একজন। বিখ্যাত বিজ্ঞান লেখকও বটে। কিন্তু পল ডেভিস মাঝে মধ্যেই পদার্থবিজ্ঞানের বইপত্তরগুলো পাশে তুলে রেখে ঢুকে পড়তে চান আধ্যাত্মিক জগতে। পল ডেভিস ২০০৭ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এ লেখা একটি প্রবন্ধে বিজ্ঞানকে আখ্যায়িত করেন ধর্মের মতো নতুন এক ধরনের বিশ্বাস ব্যবস্থা হিসেবে।

ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করতে যেয়ে তিনি বলেন[১৯৬], প্রকৃতি যৌক্তিক এমন একটি বিশ্বাসকে পুঁজি করে বিজ্ঞান এগিয়ে চলে’। তিনি আরও বলেন, যদি ঈশ্বর থেকেই থাকে সেক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করে পাওয়া সিদ্ধান্ত নয় বরঞ্চ ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাই পারবে তা জানতে।

কেন? বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কাজ করে। ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা যাই হোক না কেন, সেটা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। আর যখনই কিছু পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে তখনই বিজ্ঞান সেটি নিয়ে কাজ করতে সক্ষম। পল ডেভিসের ‘বিজ্ঞানও বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত’—এই বক্তব্য যথারীতি তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তার সহকর্মী অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মাঝে।

Edge পত্রিকার পক্ষ থেকে পল ডেভিসের এই প্রবন্ধের সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিল[১৯৭]। সে সমালোচনাগুলো করেছিলেন জেরেমি বার্নস্টেইন, শন ক্যারল, স্কট অ্যাট্রান, লরেন্স ক্রাউস, নেথান মার্ভোন্ড, জেরি কয়েন প্রমুখ খ্যাতনামা বিজ্ঞানীরা। বহু বিজ্ঞানীই আবার নিউইয়র্ক টাইমসে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন পল ডেভিসের এই ধারনা একেবারেই ভ্রান্ত। যেমন, নিউইয়র্ক সিটি কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যালেন সোকাল পাঠানো চিঠিতে লিখেছিলেন,

প্রিয় সম্পাদক,
পল ডেভিসের দাবীকৃত (সম্পাদকীয়, নভেম্বর ২৪) বিজ্ঞান এবং ধর্ম উভয়েই বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত খুবই ভ্রান্ত অনুধাবন বলে আমার মনে হয়েছে। বিজ্ঞান কার্যকরী অনুকল্পের উপর উপর ভিত্তি করে কাজ করে, এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এর সত্যতা নির্ধারণ করে। এটি আমাদের বিগত চার শতকের প্রায়োগিক প্রক্রিয়া, যেটা সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এটাকে ধর্মীয় বাণী এবং বিশ্বাস নির্ভর কাঠামোর সাথে তুলনা করাটা বালখিল্যই। দুটো বিপরীত মেরুর জিনিসকে একই রকম হিসেবে চালিয়ে দেয়াটা এবং দুটোর ভিত্তিই বিশ্বাস বলে দাবী করাটা বোকামি। বিশেষত সমগ্র মানবতা যখন বিভিন্ন ধারার বিশ্বাসের পদাঘাতে প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত হয়ে চলেছে, তখন এ ধরণের দাবী পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে তুলবে। এই ধরনের দাবী সম্বলিত লেখা অপরিণামদর্শী এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনও বটে।
— অ্যালেন সোকাল

সোকাল মিথ্যে কিছু বলেন নি। সেকালের কথার মর্মার্থ বুঝতে হলে আমাদের বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে সেটা ভালমতো বোঝা চাই। বিজ্ঞান কিন্তু বিশ্বাসের উপর টিকে নেই, টিকে আছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। মোটা দাগে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পদ্ধতির অনুক্রমটি হল এরকম—

১) প্রাকৃতিক ঘটনা বা প্রপঞ্চের পর্যবেক্ষণ করা

২) প্রপঞ্চের কারণ অনুমান করে একটা সাময়িক বা অস্থায়ী ব্যাখ্যা বা অনুকল্প প্রদান।

৩) কৃত্রিম পরিবেশে পরীক্ষা করা। পরীক্ষা থেকে পাওয়া যায় ডেটা বা উপাত্ত।

৪) প্রাপ্ত উপাত্ত পূর্বোক্ত অনুকল্প বা অনুসিদ্ধান্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা যাচাই করা।

৫) প্রাপ্ত উপাত্তের বিশ্লেষণ অনুকল্পটির সাথে মিলে গেলে বার বার পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করা হয়। এতে কোন ব্যতিক্রম না পাওয়া গেলে অনুকল্পটিকে ‘তত্ত্ব হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। আর অনুকল্পের সাথে উপাত্তের বিশ্লেষণ না মিললে পুর্বের অনুকল্পটি বাতিল করা হয় এবং শুরু হয় নতুন অনুকল্পের অনুসন্ধান।

৬) তত্ত্ব থেকে আরো নতুন নতুন অনুসিদ্ধান্তে বা অবরোহে উপনীত হওয়া, পূর্বাভাস প্রদান করা। নতুন পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ দ্বারা বারংবার এগুলো সঠিক বলে প্রমাণিত হলে, প্রপঞ্চটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য কিছু প্রপঞ্চকে তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করতে পারলে, তত্ত্বটিকে প্রাকৃতিক আইনের (Natural Law) মর্যাদা প্রদান করা হয়।

কাজেই উপরের পয়েন্টগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারছি– বিজ্ঞান ভাববাদ ভাগ্যবাদ কিংবা বিশ্বাস কোন কিছুর উপরই টিকে নেই– টিকে আছে এবং থাকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নির্ভর নিগুঢ় পদ্ধতির উপরে। বিজ্ঞানে তত্ত্বের ভাঙ্গা চোরা চলে নিয়ত, হয় পুরনো তত্ত্বের পতন, কিংবা নতুন তত্ত্বের উত্থান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজয়মাল্য যায় বিজ্ঞানের গলাতেই। বিজ্ঞানে কোন কিছুই পাথরে খোদাই করে লেখা হয় না। বরং বিজ্ঞান নির্দয়ভাবে সংশয়ের তীর হানতে থাকে সর্বক্ষণ তা যে রথী মহারথীর তত্ত্বই হোক না কেন। অনেকেরই হয়তো মনে আছে ২০১১ সালে সার্নের “অপেরা” প্রজেক্টের একটি গবেষণা থেকে পাওয়া ফলাফলে আলোর চেয়ে বেশি বেগে নিউট্রিনো আসার। আলামত পাওয়া যাচ্ছিল, যা কিনা আইনস্টাইনের তত্ত্বের লঙ্ঘন বলে মনে হচ্ছিল[১৯৮]। বিজ্ঞানের এই সংশয়, এই পরিবর্তনশীলতাই বিজ্ঞানের এগিয়ে চলার শক্তি। অনেকেই সেটার মর্ম না বুঝে একে ধর্মবিশ্বাস কিংবা রাজনৈতিক বিশ্বাসের মতোই এক ধরণের বিশ্বাস বলে মনে করেন। এটি সত্য নয়। বিজ্ঞান সংশয় করে বলেই আইনস্টাইনের মত বিজ্ঞানীকেও পর্যবেক্ষণবিদেরা সেসময় ছাড় দেয়নি। তারা সতোর সাথে নিজেদের পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করেছেন এবং প্রশ্ন করেছিলেন সত্যই আইনস্টাইন ভুল প্রমাণিত হবার দ্বারপ্রান্তে কিনা। সেসময় (২০১১ সালের ২৮ শে সেপ্টেম্বর) গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি ব্যতিক্রমী নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ‘Faster than light story highlights the difference between science and religion’ শিরোনামে। সেখানে লেখক স্পষ্ট করেছেন, বিজ্ঞান কখনোই কোন কিছুকে বিশ্বাস করে বসে থাকে না, বরং পুনঃ পুনঃ পরীক্ষার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান’ এর আলোয় নিজেকে আলোকিত করে এগিয়ে যেতে চায়। বিজ্ঞান স্থবির নয়, প্রগতিশীল। পরে অবশ্য দেখা গিয়েছিল সার্নের সেই পরীক্ষায় জিপিএস ইউনিটের সাথে কম্পিউটার কানেকশনের ঝামেলার কারণে ভুল ফলাফল এসেছিল, আইনস্টাইনের তত্ত্বে আসলে ভুল নেই[১৯৯]।

কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল, আইনস্টাইনের তত্ত্বের ভুল পাওয়া গেলে সেই তত্ত্ব প্রত্যাখ্যাত হতে সময় লাগত না। পর্যবেক্ষণের সাথে তত্ত্ব না মিললে, প্রাচীন কালের কোন পয়গম্বরের কিংবা দেবদূতের বাণীর মতো আঁকড়ে ধরে ফুল চন্দন যোগে কারো পুজো চলে না বিজ্ঞানে। বিজ্ঞানে পবিত্র তত্ত্ব বলে কিছু নেই। এখনে পল ডেভিস কিংবা একশ জন বিশেষজ্ঞের অভিমতের মূল্য নগণ্য। বরং নিগুঢ় এবং নির্ভুল পরীক্ষণ, এবং সেই পরীক্ষণ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল, যা আবার অন্যদের দ্বারা পুনঃ-পরীক্ষিত এবং সমর্থিত হবে– সেটাই বিজ্ঞানের রায় বলে বিবেচিত। তাই আমাদের আস্থা থাকবে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানের প্রক্রিয়ার প্রতি, সেখান থেকে পাওয়া নির্মোহ রায়ের উপরেই, বিশ্বাসের উপরে নয়।

.

নাস্তিকতাও কি এক ধরণের বিশ্বাস?

ব্লগে তর্ক বিতর্ক করতে গিয়ে অনেককেই বলতে শুনি, আস্তিক্যবাদের মতো নাস্তিক্যবাদও নাকি এক ধরনের বিশ্বাস। আস্তিকরা যেমন ‘ঈশ্বর আছে এই মতবাদে বিশ্বাস করে, তেমন নাস্তিকরা বিশ্বাস করে ঈশ্বর নেই’- এই মতবাদে। দুটোই নাকি বিশ্বাস। যেমন, একবার মুক্তমনা ব্লগে এক ভদ্রলোক তর্ক করতে গিয়ে বলে বসলেন

‘নাস্তিক মানেই বিশ্বাসী। তারা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর নেই। কিন্তু ঈশ্বর নেই’ এটি প্রমাণিত সত্য নয়। শুধু যুক্তি দিয়েই বোঝানো সম্ভব ‘ঈশ্বর নেই’

বিবৃতিটি আসলে ফাঁকিবাজি’। নাস্তিক মানেই বিশ্বাসী, কিংবা নাস্তিকতাবাদও একটি বিশ্বাস- এগুলো ঢালাওভাবে আউরে দিয়ে নাস্তিকতাবাদকেও এক ধরনের ‘ধর্ম হিসেবে হাজির করার চেষ্টাটি আমরা বহু মহলেই দেখেছি। নাস্তিকদের এভাবে সংজ্ঞায়ন সঠিক কি ভুল, তা বুঝবার আগে ‘নাস্তিক’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থটি আমাদের জানা প্রয়োজন। নাস্তিক’ শব্দটি ভাঙলে দাঁড়ায়, নাস্তি + কন বা নাস্তি+ক। ‘নাস্তি’ শব্দের অর্থ হলো নাই, অবিদ্যমান। নাস্তি শব্দটি মূল সংস্কৃত হতে বাংলায় এসে ‘ক’ বা ‘কন’ প্রত্যয় যোগে নাস্তিক হয়েছে যা তৎসম শব্দ হিসেবে গৃহীত। ন আস্তিক = নাস্তিক– যা নঞ তৎপুরুষ সমাসে সিদ্ধ এবং আস্তিকের বিপরীত শব্দ। আরো সহজ বাংলায় বললে বলা যায়, না + আস্তিক = নাস্তিক। খুবই পরিষ্কার যে, সঙ্গত কারণেই আস্তিকের আগে ‘না’ প্রত্যয় যোগ করে নাস্তিক শব্দটি তৈরি করা হয়েছে। আস্তিকরা যে ঈশ্বর/আল্লাহ/খোদা ইত্যাদি পরম সত্তায় বিশ্বাস করে এ তো সবারই জানা। কাজেই নাস্তিক হচ্ছে তারাই, যারা এই ধরনের বিশ্বাস হতে মুক্ত। তাই সংজ্ঞানুযায়ী নাস্তিকতা কোনো বিশ্বাস নয়, বরং বিশ্বাস হতে মুক্তি বা বিশ্বাসহীনতা’। ইংরেজিতে নাস্তিকতার প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘Atheist’T সেখানেও আমরা দেখছি theist শব্দটির আগে ‘a’ প্রিফিক্সটি জুড়ে দিয়ে Atheist শব্দটি তৈরি করা হয়েছে। নাস্তিকতা এবং মুক্তচিন্তার উপর বহুল প্রচারিত গবেষণাধর্মী একটি ওয়েব সাইটে শব্দটির সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে এভাবে–

Atheism is characterized by an absence of belief in the existence of gods. This absence of belief generally comes about either through deliberate choice, or from an inherent inability to believe religious teachings which seem literally incredible. It is not a lack of belief born out of simple ignorance of religious teachings.

সহজেই অনুমেয় যে, ‘absence of belief’ শব্দমালা চয়ন করা হয়েছে বিশ্বাসহীনতা’কে তুলে ধরতেই, উল্টোটি বোঝাতে নয়। Gordon Stein তার বিখ্যাত “An Anthology of Atheism and Rationalism’ বইয়ে নাস্তিকতার (Atheism) সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে বলেন–

When we examine the components of the word ‘atheism,’ we can see this distinction more clearly. The word is made up of ‘a-’ and ‘-theism.’ Theism, we will all agree, is a belief in a God or gods. The prefix ‘a-’ can mean ‘not’ (or ‘no’) or ‘without’. If it means ‘not,’ then we have as an atheist someone who is not a theist (i.e., someone who does not have a belief in a God or gods). If it means ‘without,’ then an atheist is someone without theism, or without a belief in God’. (Atheism and Rationalism, p. 3. Prometheus, 1980)

আমরা যদি atheist শব্দটির আরো গভীরে যাই তবে দেখব যে, এটি আসলে উদ্ভূত হয়েছে গ্রিক শব্দ ‘a’ এবং ‘theos’ হতে। গ্রিক ভাষায় ‘theos’ বলতে বোঝায় ঈশ্বরকে, আর ‘a’ বলতে বোঝায় অবিশ্বাস বা বিশ্বাসহীনতাকে। সেজন্যই Michael Martin তার ‘Atheism: A Philosophical Justification’ বইয়ে বলেন–

According to its Greek roots, then, atheism is a negative view, characterized by the absence of belief in God. (Atheism: A Philosophical Justification’, p. 463., Temple University Press, 1990)

আসলে নাস্তিকদের বিশ্বাসী দলভুক্ত করার ব্যাপারটি খুবই অবিবেচনাপ্রসূত। ব্যাপারটাকে আরেকটু পরিষ্কার করা যাক। ধরা যাক, এক মুক্তমনা যুক্তিবাদী ব্যক্তি ভুতে বিশ্বাস করেন না। তবে কি সেজন্য তিনি ‘না-ভূতে বিশ্বাসী হয়ে গেলেন? উনাদের যুক্তি অনুযায়ী তাই হবার কথা। এভাবে দেখলে, প্রতিটি অপ-বিশ্বাস বিরোধিতাই তাহলে উল্টোভাবে বিশ্বাস বলে চালিয়ে দেওয়া যায়, তা সে ভুতই হোক, পঙ্খিরাজ ঘোড়াই হোক, অথবা ঘোড়ার ডিমই হোক। যিনি পঙ্খিরাজ ঘোড়া বা চাঁদের চরকা-বুড়ির অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, তিনি আসলে তার সংশয় এবং অবিশ্বাস থেকেই তা করেন না, তার ‘না-বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবার কারণে নয়। যদি ওই ব্যক্তিটিকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কেন ওগুলোতে তিনি বিশ্বাস করেন না, তিনি হয়তো জবাবে বলবেন, ওগুলোতে বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় নি বলে। কিংবা হয়তো বলতে পারেন, এখন পর্যন্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ওগুলো সত্তার বাস্তব অস্তিত্ব কেউ প্রমাণ করতে পারেন নি, তাই ওসবে বিশ্বাস করার প্রশ্ন ওঠে না। এটি পরিষ্কার যে, এই বক্তব্য থেকে তার মনের সংশয় আর অবিশ্বাসের ছবিটিই আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে, বিশ্বাসপ্রবণতাটি নয়। ঈশ্বরে অবিশ্বাসের ব্যাপারটিও কিন্তু তেমনি। নাস্তিকেরা তাদের সংশয় আর অবিশ্বাস থেকেই নাস্তিক হন, ‘না-ঈশ্বরে বিশ্বাস থেকে নয়। সে জন্যই মুক্তমনা ড্যান বার্কার তাঁর বিখ্যাত ‘Losing Faith in Faith: From Preacher to Atheist গ্রন্থে পরিষ্কার করেই বলেছেন- Basic atheism is not a belief. It is the lack of belief.’। জুবায়ের অর্ণব বাংলা ব্লগে যে উক্তিটি করেছেন, সেটা সবসময়ই নাস্তিকতাকে বোঝার জন্য একটি মাইলফলক:

‘নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে বাগান না করাও একটি শখ, ক্রিকেট না খেলাও একটি ক্রীড়া, কোকেইন সেবন না করাও একটি নেশা।

.

প্যাস্কেলের ওয়েজার

‘ভাই আমি আপনে সবাই একদিন মইরা যামু। ধরেন ঈশ্বর থাকা না থাকার সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি। ঈশ্বর যদি না থাকে তাইলে আস্তিক নাস্তিক কারোরই কোন সমস্যা নাই। হগগলেই তো মাটির তলায়। কিন্তু ঈশ্বর যদি থাকে আমরা যামু বেহেস্তে আর আপনেরা খাইবেন হের কোম্পানি। তাই আস্তিক হওয়াটাই নিরাপদ না?’

অবিশ্বাসী হওয়ার জ্বালা অনেক। এ ধরণের প্রশ্ন অহরহ শুনতে হয়। আমার মনে হয় এমন কোন নাস্তিক এই ধরাধামে নেই যিনি জীবনের কখনো না কখনো এই প্রশ্নের বিশাল ধাক্কা হজম করেননি। একটা সময় আমি এগুলো হেসে উড়িয়ে দিতাম। ভাবতাম— এই হাবিজাবি কথায় এতো গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে! এটা তো ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোন প্রমাণ নয়, কেবল বাচ্চাদের যেমন ভুতের ভয় দেখানো হয়, সেরকমের কিছু। পরে দেখি, আমার বহু ধার্মিক বন্ধুই ঈশ্বরের অস্তিত্বের পেছনে সত্য। সত্যই এটাকে একটা বিরাট দাবী বলে মনে করেন। যে কোন আড্ডায় গেলেই দেখা যায়, প্যালের ঘড়ি, হয়েলের বোয়িং, কিংবা হাল আমলের হুমায়ুনের নাইকন ক্যামেরা সহ অনেক ধরণের ‘যুক্তির পাশাপাশি[২০০] শেষ পর্যায়ে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে হাজির হয়ে যায় তাদের এই ‘নিরাপদ বাজির যুক্তি— ‘ভাই আমি মরলে তো সমস্যা নাই, আপনে নাস্তিক হইয়া মরলে তো খবর আছে! দোজখে পুড়বেন। হ্যানো ত্যানো”।

এই যুক্তিটা আসলে পুরানো। বলা হয় ফরাসী দার্শনিক কাম গণিতবিদ ব্লেই প্যাস্কেল (১৬২৩– ১৬৬২) নাকি এই যুক্তিটা একসময় দিয়েছিলেন, তাই একে বলে। প্যাস্কেলের ওয়েজার বা প্যাস্কেলের বাজি। বলা হয়, যে সমস্ত অবিশ্বাসীরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রথাগত ‘যুক্তিগুলোতে সন্তুষ্ট নন, তাদের জন্য সম্ভাবনার গণিত ব্যবহার করে যুক্তিমালা সাজিয়েছিলেন ঈশ্বর-বিশ্বাসী প্যাস্কেল। ভেবেছিলেন এটা হবে নাস্তিকদের কফিনে শেষ পেরেক। প্যাস্কেলের ভাষাতেই—

‘If you believe in God and turn out to be incorrect, you have lost nothing— but if you don’t believe in God and turn out to be incorrect, you will go to hell. Therefore it is foolish to be an atheisť.

নাস্তিকেরা যে কত বড় গাধা’ সেটা আবার নানা ধরণের ছক টক কেটে দ্বিমাত্রিক ম্যাট্রিক্স বানিয়ে একেবারে গাণিতিক ভাবে প্রমাণ করে দেন প্যাস্কেল।

কিন্তু তার গণিতের শুভঙ্করের ফাঁকি তিনি ধরতে না পারলেও অন্যরা ঠিকই ধরে ফেলেছিল। আসলে তার সম্ভাবনার সূত্রে ফাঁক ফোকর এতই বেশি যে একে গণিত না বলে গোঁজামিল বলাই ভাল। যে ব্যক্তিকে ‘ফাদার অব মডার্ন প্রোবাবিলিটি’ বলে উপাধি দেয়া হয়েছে তার মাথা থেকে এমন দুর্বল গণিতে খোঁজা যুক্তি বেরিয়ে এসেছিল, যে ভাবতেই এখন অবাক লাগে। চলুন দেখা যাক এই প্যাস্কেলীয় (মামদো) বাজির দুর্বলতাগুলো কী কী ….

কোন ধর্ম সত্য ধর্ম? আর সত্যিকার ঈশ্বরটাই বা কোনটা? এক্ষেত্রে প্রথম সমস্যাটা হল— কি করে বোঝা যাবে কোন ধর্মটা সঠিক, আর সত্যিকার ঈশ্বরই বা কোনটা? প্যাস্কেল সাহেব ছিলেন রোমান ক্যাথলিক। তার কাছে ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্মের ঈশ্বরই ছিলেন সত্যিকার ঈশ্বর। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে তার ক্যাথলিক ধর্মের ঈশ্বরকে সত্য প্রমাণের জন্য কষ্ট টষ্ট করে যে যুক্তিমালা সাজিয়েছিলেন, তা দেদারসে এখন ব্যবহার করেন প্রটেস্টান্ট, ইসলামিষ্ট, বুদ্ধি, হিন্দু, জৈন— সবাই, তারা সবাই নিজ নিজ ধর্মের ঈশ্বরকে সত্যিকারের ঈশ্বর মনে করেন। প্যাস্কেলীয় যুক্তিতে ‘ঈশ্বর যদি থাকে আমরা যামু বেহেস্তে আর আপনেরা খাইবেন হের কোপানি’— এই হুমকি থাকলেও হুমকিতে বলা নাই, কোন ধর্ম অনুসরণ করলে কোপানি থেকে শেষ পর্যন্ত বাঁচা যাবে। এটাকে ইংরেজিতে বলে ‘Avoiding the wrong hell dilemma’। হ্যাঁ, আপনি সঠিক ধর্ম অনুসরণ করলে স্বর্গে যাবেন, কিংবা নরকের আগুন থেকে হয়তো বাঁচবেন; কিন্তু আপনি যদি ভুল ধর্মের অনুসারী হয়ে মারা যান, কোন উপায় নাই— সেই নরকই হবে আপনার ভবিতব্য।

এখন কথা হল, সব ধর্মবিশ্বাসীরাই হুক্কা-হুঁয়া রব তুলে ঘোষণা দেয়, তার নিজের ধর্মটাই সঠিক। তাদের কখনোই মনে হয় না যে, সারা জীবন ধরে মিথ্যা একটা ধর্ম পালন করে মারা যাচ্ছেন আর মরার পর নরকে যাওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছেন। এটাই হল সমস্যা। জনপ্রিয় কার্টুন সিরিজ সিম্পসনের একটি চরিত্র হোমার সিম্পসনের একটা ক্লাসিক উক্তি— “Suppose we’ve chosen the wrong god. Every time we go to church we’re just making him madder and madder.’ আপনি এই দার্শনিক সমস্যাটা ধর্মবাদীদের ধরিয়ে দিলে একটুক্ষণের জন্য হয়ত তার থমকাবেন, কিন্তু আবার সম্বিত ফিরে পেয়ে আপনাকে বুঝিয়ে দিবে, আরে ‘আমার ধর্মই যে সঠিক সেটা তো দেখলেই বুঝা যায়।

একবার এক খ্রিষ্টান পাদ্রী কি কারণে যেন আমার বাসায় এসেছিল। এসেই ‘যীশু যীশু’ করে মুখে ফ্যানা তুলে ফেললো আর আমাকে ‘হেদায়েত’ শুরু করে দিল, আমদের দেশের ‘তবলীগ পার্টি’র মতন অনেকটা। যখন খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না, এবং শুনলেন আমি নাস্তিক, ওমনি যীশুর মহিমা কীর্তন বাদ দিয়ে প্যাস্কেলের (কু) যুক্তি হাজির হয়ে গেল … “ঈশ্বর যদি সত্যি সত্যি একজন থাকেন এবং … তখন আপনারা … দোজখে …”। আমি বললাম কিন্তু সত্যিকারের ঈশ্বর যে যীশুই হবেন এটা স্বতঃসিদ্ধ ভাবে বুজে গেলেন কী ভাবে, মা কালী বা গণেশ বাবা সত্যিকার ঈশ্বর হলে কিন্তু ভাই আপনার খবর আছে’! এত যীশু যীশু করার পরেও তো সেই নরকের আগুনে পুড়বেন। পাদ্রী সাব একটু থমকালেন, তারপরেই একগাল হেসে বললেন— “আহ! আরে গণেশ টনেশ আবার ঈশ্বর হৈতে পারে নাকি, যীশুই আসল ঈশ্বর’। তা তো বটেই, পেট মোটা হাতীর শুরওয়ালা মোটা মাথা গণেশ আসল ঈশ্বর হতেই পারে না, যীশুই হচ্ছেন প্রকৃত ঈশ্বর, যিনি অলৌকিক উপায়ে কুমারী মাতা মেরির গর্ভে হাজির হয়েছিলেন, এবং পরিণত বয়সে, বোবা কালা খঞ্জ পঙ্গু সবাইকে হাতের ছোঁয়ায় নীরোগ করে দিয়েছিলেন, আর ক্রুশবিদ্ধ করার পরেও পুনরুত্থিত হয়েছিলেন কবর থেকে!

এখন পাদ্রীকে কীভাবে বোঝাই— এই পৃথিবীতে হাজারটা ধর্ম, হাজারটা বিশ্বাস পাখা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। সবাই যে যার মত নিজেদের ‘সহি ধর্ম’ বলে জিকির তুলছে আর নিজের ঈশ্বরকে আসল ঈশ্বর বলে দাবী করছে। বহু ধর্ম আবার একটা আরেকটার সাথে আক্ষরিক অর্থেই দায়ে-কুমড়ায় সম্পর্ক, এক ধর্মের বিশ্বাসের সাথে আরেক ধর্মবিশ্বাসের আকাশ পাতাল তফাত। রাহুল সাংকৃত্যায়নের উদ্ধৃতি দিয়েই বলি[২০১]–

‘এমনিতে তো ধর্মগুলির পরস্পরের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। একটি যদি পূবদিকে মুখ করিয়া পূজা করিবার বিধান দেয় তো অপরটি পশ্চিম দিকে। একটি যদি মাথার চুল বড় রাখিতে বলে, অপরটি বলে দাড়িকে বড় করিতে। একটি যদি গোঁফ কাটিতে নির্দেশ দেয় তো অপরটি বলে গোঁফ রাখিতে। একটি যদি জবাই করিয়া পশু হত্যা করিতে বলে তো অপরটি বলে এক কোপে কাটিয়া ফেলিতে। এক যদি জামার গলা দক্ষিণদিকে রাখে তো অপরটি বামদিকে। একটি এঁটোর বিচার করে না, অপরটির একটি জাতির মধ্যেও অনেক ভাগ। একটি একমাত্র খোদাতালা ছাড়া পৃথিবীতে দ্বিতীয় কাহারো নাম নিতে রাজি নয়, অপরটিতে দেব দেবতাদের সীমা নাই। একটি গাভীর জীবন। রক্ষা করিতে গিয়া নিজের প্রাণ উৎসর্গ করিতে বলে তো অপরটি গো কোরবানিকে পুন্যকার্য বলিয়া মনে করে।

পাদ্রী সাহেবকে বললাম, আপনারা যেমন যীশুকে ঈশ্বর মনে করেন, মুসলিমরা তা মনে করে না। তাদের চোখে ঈশা নবী ঈশ্বর নয়, কেবল মানুষ। আপনেরা যে সূর্যমুখী ফুলের পাপড়ির মতো রং বেরঙের ‘হোলি ট্রিনিটি’র ঝাপি খুলে বসেছেন— গড দ্য ফাদার, জেসাস দ্য সন, আর হোলি স্পিরিট— এই ধরণের ত্রৈমাত্রিক ঈশ্বরে মুসলিমরা বিশ্বাস করে না। এখন ইসলাম ধর্ম যদি সত্যি হয়, তাহলে তো ‘আপনের খবরাছে। কোরআনে (সুরা সূরা আল ইমরান) আল্লাহ স্পষ্টই বলছে—

‘যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত। (৩:৮৫)।

কাজেই বোঝা যাচ্ছে যে, ইসলাম সত্য হলে খ্রিষ্টান বাবা, হিন্দু বাবা, সাঁই বাবা, মঙ্গা বাবা সবাই গুষ্টিশুদ্ধ দোজখের আগুনে বেগুন-পোড়া হবে— নাস্তিক হওয়ার জন্য নয়, বরং না জেনে ভুল একটা ধর্ম পালন করে যাবার জন্য। চিন্তা করে দেখুন– আজ যে শিশুটি সুদূর উত্তর মেরুর কাছাকাছি Inuit Religion মানে এস্কিমো পরিবারে জন্মেছে, সে কেমন করে জানবে, শত সহস্র মাইল দূরে আরব মরুর বুকে চোদ্দশ বছর আগে জন্ম নেওয়া এক বেদুইনের প্রচারিত ধর্মটার ঈশ্বরই ‘আসল ঈশ্বর’? ছেলেটি না জেনে না বুঝেই মরার পরে বেগুন পোড়া হয়ে যাবে, পরম করুণাময়ের করুণ কারসাজিতে।

কিন্তু মুসলিম ভাইদের এত শান্তিতে থাকার কারণ নেই। খ্রিষ্ট ধর্মের ঈশ্বর— হলি ট্রিনিটির সেই থ্রিসাম গড– মুসলমানদের আল্লাহ থেকে অনেক আলাদা। কাজেই যদি মরার পর যদি দেখা যায় সেই খ্রিষ্টানদের ঈশ্বরই প্রকৃত ঈশ্বর— তখন কিন্তু মুসলিম ভাইদের কম্ম সাবাড়। বাইবেলে আছে—

‘আমি এ জগতে আলো রূপে এসেছি যাতে যে আমায় বিশ্বাস করে তাকে যেন অন্ধকারে থাকতে না হয়। আর যে কেউ আমার কথা শোনে অথচ তা মেনে চলে না, তার বিচার করতে আমি চাই না, কারণ আমি জগতের বিচার করতে আসিনি, এসেছি জগতকে রক্ষা করতে। যে কেউ আমাকে অগ্রাহ্য করে ও আমার কথা গ্রহণ না করে, তার বিচার করার জন্য একজন বিচারক আছেন। আমি যে বার্তা দিয়েছি শেষ দিনে সেই বার্তাই তার বিচার করবে’ (যোহন ১২: ৪৬-৪৮)।

এর মানে হচ্ছে, খ্রিষ্টান ধর্মের দেওয়া ঈশ্বরের ফরম্যাটে আপনি বিশ্বাস না করলে আপনি যতই ধর্মমানেওয়ালা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া কামেল আদমি হন না কেন, দোজখের আগুনে পুড়বেন নিশ্চিত। কিন্তু মুসলিমদের মাথায় সেই লজিক ঢুকে না। তাদের কাছে কাছে ‘আল্লাহই প্রকৃত ঈশ্বর। কোরআনে আছে না! তারা বরং অনুসরণ করে তাদের মনমতো ‘ইসলামী যুক্তি’[২০২]–

আচ্ছা, কোরআন যে খাঁটি তা কিভাবে জানি আমরা?
— সোজা। কারণ মহান আল্লাহ তালা বলেছেন যে।

আল্লাহ যে মিথ্যে বলছেন না বুঝবো কি করে?
— খুব সহজেই। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বলেছেন যে।

 মোহাম্মদই যে সত্যি বলছে তারই বা নিশ্চয়তা কি?
–কেন? কোরআন সাক্ষী দিয়েছে না।

 বাহ! কোরআনই যে সত্যি কথা বলছে সেটাই বা কে বললো?
— কেন? জান না বুঝি? আল্লাহইতো বলেছেন যে কোরআন সত্যি।
এতো ত্যানা পাচাও ক্যান শুনি?

এখন ইহুদী, খ্রিষ্টান আর মুসলমানদের অনাদি উৎস আব্রাহামিক ধর্মগুলো সব একেশ্বরবাদ শিক্ষা দেয়। একজন ঈশ্বরই আসমানের আরশে বসে আছেন, তিনিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু তৈরি করছেন ছয় দিন ধরে। আবার অন্য দিকে প্যাগান উৎস থেকে আসা হিন্দুরা লক্ষ কোটি দেব দেবীতে বিশ্বাস করে। মুসলমানেরা মূর্তি পূজাকে শিরক সমতুল্য অপরাধ মনে করে। আর অন্যদিকে হিন্দুরা বুকে পেটে গলায় ঘন্টা বেঁধে মূর্তির সামনে জপ করতে বসে যায়। মুসলমানেরা গরু খেয়ে সাফ করে ফেলে তো হিন্দুরা তাকে মা ডেকে কুল পায় না। অন্য ধর্মের আচার ব্যবহার তুক তাক আর মন্ত্ৰ-টন্ত্রে এত ধরনের পরস্পরবিরোধিতা থাকলে কী হবে, বিধর্মীদের ক্ষেত্রে তার হুশিয়ারি একই রকমের—

‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহ।

মানে সোজা কথা হল হিন্দু ধর্মে থেকে জুতার বারি খাওয়াও বোধ হয় ভাল, অন্য ধর্মে যাওয়ার চেয়ে। কাজেই মুসলিমরা যদি পরপারে গিয়ে দেখেন, আখেরাতের ময়দানে আল্লাহ সুবানআল্লাহ তায়লা বসে নেই— বরং পীনোন্নত কালা পাহাড়সম মা-কালী খড়গ উঁচিয়ে রয়েছে এবং মোল্লা দেখলেই সমানে কোপাচ্ছে— তখন আঙ্কেল প্যাস্কেল কিংবা হুজুরেআলমপনা মুহম্মদ (সঃ) কারো নাম নিয়েই বোধ করি বাঁচতে পারবেন না। বলা বাহুল্য, তারা শাস্তি পাবেন নাস্তিকতার জন্য না, আগাগোড়া ভুল একটি ধর্মে বিশ্বাসের কারণে।

এত কথার ক্যাচকেচির আর দরকার নেই, গাণিতিক ভাবেই না হয় ব্যাপারটা দেখি বরং “ভাই আমি আপনে সবাই একদিন মইরা যামু। ধরেন ঈশ্বর থাকা না থাকার সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি …” এই সমস্যার একটা সুন্দর উত্তর অপার্থিব অনেক আগে একটা ফোরামে দিয়েছিলেন ইংরেজিতে। আমি মুক্তমনা ব্লগে বিখ্যাত ‘প্যাস্কেলের ওয়েজার’ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম, সেখানে এর বাংলা করেছিলাম এভাবে[২০৩]–

 ‘এই মৃত্যুর পর ঈশ্বর থাকা না থাকা–ফিফটি-ফিফটি (এটা স্রেফ সম্ভাবনা, কোন ‘ফ্যাক্ট’ নয়) ব্যাপারটা আসলে কী মিন্ করে? প্রথমতঃ একজন বিশ্বাসীর কাছে এই সম্ভাবনাটাই শতকরা ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা নিয়ে হাজির হয়। আর একজন অবিশ্বাসীর কাছে তা শতকরা ০ ভাগ। অজ্ঞেয়বাদী কিংবা হাল্কা ধরণের বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা ০ থেকে ১০০এর মধ্যে যে কোন জায়গায় থাকতে পারে। এখন এই শতকরা হিসেব যাই হোক না কেন, এটা নির্দেশ করে একজন বিশ্বাসীর মনোজগতে তার (ঈশ্বরে বিশ্বাসের স্তরকে, কোন ভাবেই মৃত্যুর পর প্রকৃত ঈশ্বর থাকা বা না থাকার কোন সত্যিকার প্রোবাবিলিটি নয়। কারণ, এই সম্ভাবনার হিসেব এসেছে বিশ্বাসীদের মানসপটে থাকা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে যেটা বস্তুনিষ্ঠভাবে গণনা করাই সম্ভব নয়, প্রমাণ তো পরের কথা। কাজেই এই ‘ফিফটি-ফিফটি’ এনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ বড় সড় হেত্বাভাস দোষে দুষ্ট, কারণ, মানসজগতে বিশ্বাসের স্তরের উপর ভিত্তি করে কোন কিছু অস্তিত্ব প্রমাণের যুক্তি নির্মিত হওয়া উচিৎ নয়, সেটা বরং হওয়া উচিৎ বৈজ্ঞানিক কিংবা বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ সাপেক্ষে।

এখানে ধরেই নেয়া হচ্ছে ফিফটি-ফিফটি চান্স-এর যুক্তি (যেটা আসলে কুযুক্তি উপরেই দেখান হয়েছে) উপস্থাপন করলেই বিশ্বাসের উপকারিতা বুঝা যাবে আর অবিশ্বাসের বিপদের আলামত পাওয়া যাবে। সেই কত শতক আগে প্যাস্কেলের এই বাজিকে খণ্ডন করে দেয়া হয়েছে, অথচ সেটা এই শতাব্দীতেও বিশ্বাসীদের হৃদয়ে সেটা দোলা দিয়ে চলেছে অবলীলায়। প্যাস্কেলের বাজির আরেকটা বড় ত্রুটি হল– যদি ধরেও নেয়া হয় মৃত্যুর পরে পরকাল বলে। কিছু একটা আছে, তারপরেও প্রমাণিত হয় না যে একটা নির্দিষ্ট ধর্মই (religion-X) প্রকৃত ধর্ম। যেহেতু ঐ ধর্মের বাইরেও আরো ধর্ম (religion-Y, Z etc..) আছে আর সেগুলো ও তাদের মত করে পরকালকে নির্দেশ করে, কাজেই যে কোন একটা ধর্মকে সত্য মনে করে সার্বজনীন ভীতি তৈরি করা আর এর প্রেক্ষিতে মনের মাধুরী মিশিয়ে যুক্তি সাজানো আসলে প্রতারণার নামান্তর।

কিন্তু মুশকিল হল কোন বিশ্বাসীকেই এই লজিকের দুর্বলতা বোঝানো যাবে না। তারা প্যাস্কেলের মতোই ধরে নেন তাদের ধর্মের ঈশ্বরই প্রকৃত ঈশ্বর; আর বাকি সব ঝুটা হ্যায়। ইংরেজিতে এই ধরনের হেত্বাভাসকে বলে ‘fallacy of false dilemma/false dichotomy/bifurcation। অন্য সব অপশনকে বাতিলের খাতায় পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরটাকে উপরে তুলে ধরা। বাংলা ব্লগে এই প্রজাতির একটা মজার নাম আছে— ‘আল্লামা তালগাছবাদী’!

এই (চাপা) বাজির ক্রাইটেরিয়াই বা কী? কেউ বাজি ধরতে চান, সে ভালা কথা। কিন্তু কোন নির্দিষ্ট ‘ক্রাইটেরিয়া ছাড়া বাজি ধরার তো কোন মানে নাই। আস্তিকতা একটা ব্যাপক আর বিস্তৃত বিষয়। একটা হিন্দুকেও আমরা আস্তিক বলি, একটা মুসলিমকেও বলি আস্তিক। এখন হিন্দুর আস্তিকতা আর মুসলমানের আস্তিকতা তো এক না। অথচ প্যাস্কেলের বাজিতে সবাইকেই এক করে দেখানো হয়েছে আর ধরে নেয়া হয়েছে নাস্তিক হলেই যেন পরপারে ‘গরম অগ্নিকুণ্ড। এক আস্তিকের সাথে আরেক আস্তিকের বিশ্বাসের বিরোধগুলো চেপে যাওয়া হয়েছে। এটা কোন বাজির ক্রাইটেরিয়া হল নাকি? আরো গুরুতর সমস্যা হইল, নাস্তিক হলেই সর্বনাশ, এই বিশ্বাসেরই বা হেতু কী? মনে পড়ে, আমি একবার ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, এরকমের–

‘ভেবে দেখলাম, আমাদের মহান ঈশ্বর হচ্ছেন নাস্তিককুলশিরোমনি, মানে সবচেয়ে বড় নাস্তিক (কারণ উনি বিশ্বাস করেন না যে কোন সৃষ্টিকর্তা তাকে বানিয়েছে),আমি নিবিষ্ট মনে তার দেখানো পথই অনুসরণ করছি মাত্র।

সত্যিই তো দুর্মুখেরা বলবেন, যে সৃষ্টিকর্তা নিজেই নাস্তিক, তিনি নাস্তিকদের গরম অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করবেন, আর আস্তিক-মোল্লাদের মাথায় করে রাখবেন, এটা কি এত সহজেই মেনে নেয়া যায়?

আর তাছাড়া যাকে আমরা এত ঘটা করে ঈশ্বর’ উপাধি দিচ্ছি, তার ঘটে তো একটু বুদ্ধিশুদ্ধিও আমরা আশা করি, নাকি! যে মোল্লারা নির্বিবাদে জিহাদ, জাতিভেদ, শরিয়া, ক্রুসেড সব কিছু বিশ্বাস করছে, নারীদের শস্যক্ষেত্র বানিয়ে রেখেছে, নাইন ইলেভেন ঘটিয়েছে, গুজরাতে দাঙ্গা লাগিয়েছে, পয়লা বৈশাখে রমনা বটমূলে গিয়া বোমা মেরেছে, চার্চে বসে শিশুকামিতা করেছে, গাছের মগডালে বসে ননী চুরি আর কৃষ্ণলীলা করেছে, নাবালিকা আর পালক পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করে আদর্শ স্থাপন করেছে, বিধর্মীদের মুরতাদ আখ্যা দিয়েছে, চোখ বন্ধ করে হুমায়ুন আজাদকে কিংবা থাবা বাবাকে কুপিয়েছে, পুরো পৃথিবীটাকে আবর্জনার গোডাউন বানিয়ে রেখেছে— মহান ঈশ্বর পঙ্গপালের মতো তাদেরকে বেহেস্তে পাঠাবে, আর যারা যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করে এই অমানবিকতা আর নাফরমানির বিরোধিতা করল, তাদের স্থান নাকি হবে দোজখে। এতো বড় অন্যায় কি ‘প্রকৃত ঈশ্বর’ করতে পারেন? সহজ বোধশক্তিতেই সেটা অসম্ভব বলে মনে হয়। কে জানে— তাঁর কাছে হয়তো যুক্তিবাদীরাই সবচেয়ে আপন, কারণ তারা এই পৃথিবীতে যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করেছে, ভেড়ার পালের মতোন গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয় নাই। তাদেরই তো ঈশ্বরের পরীক্ষায় ফুলমার্ক পেয়ে পাশ করার কথা। সংশয়বাদী রিচার্ড ক্যারিয়ার ২০০২ সালে একটা প্রবন্ধ লিখছিলেন, শিরোনাম ‘প্যাস্কেলের ওয়েজারের সমাপ্তি— কেবল অবিশ্বাসীরাই স্বর্গে যাবেন। সেই প্রবন্ধ থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ বয়ান করা যাক[২০৪]–

“Therefore only intellectually committed but critical nontheists (nonbelievers) are genuinely good and will go to heaven. Therefore, if a god exists, his silence and allowance of evil are explained and justified by his plan to discover the only sorts of people who deserve to populate heaven: sincere nontheists. And this makes perfect sense of many mysteries, thus explaining what theists struggle to explain themselves.”

একই কথা বলেছেন ম্যাসিমো পাগ্লিউসি তার ‘Pascal’s Wager: Is It Safer To Believe In God Even If There Is No Proof That One Exists?’ la ভিন্নভাবে[২০৫]। এই প্রবন্ধ থেকে কিছু লাইন–

“Many Agnostics, for example, have evaluated all the “proofs” for God’s existence, and all of the ‘proofs’ of God’s non-existence. They conclude that neither belief can be substantiated. They feel that they cannot rationally believe in the existence or non-existence of God; they must remain Agnostic. Under these conditions, a person can only believe in God if they violate their honesty. And God might punish a lack of honestly more severely than not being able to believe in God. It can also be argued that if people believe something on insufficient evidence, that the result is the promoting of credulity— something that harms society. Again, that could be a sin that God is particularly concerned about punishing.”

সারমর্ম হল– আসল ঈশ্বরের নিশ্চয় মাথা খারাপ না যে, কেউ বিনা প্রমাণে সমাজের যাবতীয় অপবিশ্বাস আর কুবিশ্বাসে বিশ্বাসী বলেই তাকে আদর করে বেহেস্তে পাঠিয়ে দেয়া হবে, আর নাস্তিক যুক্তিবাদীদের জায়গা হবে নরকে। বরং আমিতো বলব, অবিশ্বাসীরা ইহজগতে সে কাজটাই ভালমতো করছে যা ঈশ্বরের পছন্দ– মানবিকতা, যুক্তিবাদ আর মুক্তবুদ্ধির চর্চা। কাজেই, অবিশ্বাসী নাস্তিকেরাই ‘ঈশ্বরের পরীক্ষায় পাশ করে বেহেস্তে যাওয়ার দাবীদার!

ঈশ্বরের পরীক্ষাটা আসলে কি ধরণের পরীক্ষা? ঈশ্বরের পরীক্ষার কথা যখন আসলোই আরো একটা মজার ব্যাপার মনে হল। আরজ আলী মাতুব্বর তার “সত্যের সন্ধান গ্রন্থে লিখছিলেন–

‘বলা হয় যে, ঈশ্বরের অনিচ্ছায় কোন ঘটনা ঘটে না। এমনকি গাছের পাতাটিও নড়ে না। বিশেষত তার অনিচ্ছায় যদি কোন ঘটনা ঘটতে পারে তাহা হইলে তাহার সর্বশক্তিমান’ নামের সার্থকতা কোথায়? আর যদি ঈশ্বরের ইচ্ছায়ই সকল ঘটনা ঘটে তবে জীবের দোষ বা পাপ কী?’

এখন ঈশ্বরের অনিচ্ছায় যদি কোন ঘটনা না ঘটে, তাইলে প্যাস্কেলের পুরো বাজিই একটা তামাসায় পর্যবসিত হয়ে যায়। ঈশ্বর যেহেতু সর্বজ্ঞ, তিনি নিশ্চয় জানেন কে আস্তিক হবে আর কে নাস্তিক। যে লোকটা নাস্তিক হচ্ছে, সে আসলে কিন্তু প্রকারান্তরে কোন না কোনভাবে ঈশ্বরের ইচ্ছা আর উদ্দেশ্যই পূরণ করছে। কারো সাধ্য আছে কি ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার? নেই। ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে গেলে তো তার ‘সর্বশক্তিমান’ খেতাবটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। তাই ঈশ্বর হয়তো সত্যই চান যে নাস্তিকেরা নাস্তিকই থাকুক। এই দিক দিয়ে চিন্তা করলে প্যাস্কেলের বাজি কিন্তু ভোজবাজি মিলিয়ে যেতে বেশি দেরী লাগে না।

আসলেই কি বিশ্বাসে কিছুই হারানোর নেই? এখন কথা হচ্ছে যদি কোন ঈশ্বর কেবল অন্ধবিশ্বাসী হবার কারণে কাউকে পুরস্কৃত করে, আর অবিশ্বাসীকে কঠিন শাস্তি দেয়, তাহলে সেই ঈশ্বর তো আসলে স্তাবকতাপ্রিয় ঈশ্বর। ইনি চাটুকারিতা পছন্দ করেন। একটা লোক ইহজীবনে কেমন ছিল, কী করল, মানুষের জন্য ভালো কাজ করেছে নাকি করেনি, সেগুলো বিবেচনা না করে সারা জীবন ধরে চাটুকারিতা করেছে কিনা এইটাই যদি হয় একমাত্র ক্রাইটেরিয়া– তাহলে কোন সুস্থ-বুদ্ধির লোক তাকে “ঈশ্বর’ নামে ডাকার চেয়ে বিশ্ববেহায়া স্বৈরাচারী এরশাদের মত কিছু একটা নামেই হয়তো ডাকবে।

অনেকেরই মনে আছে বোধ করি আশির দশকে এরশাদের শাসনামলে মওদুদ, শাহ মোয়াজ্জেম এবং কাজী জাফরের মতো লোকজন মধুর লোভে মধুমক্ষিকার মতোন সারাটা সময় এরশাদকে ঘিরে থাকতেন। কিন্তু বুদ্ধিবিবেচনা সম্বলিত মানুষজনের কাছে তিনি ছিলেন একজন দুর্নীতিবাজ পতিত স্বৈরশাসক। পতিত স্বৈরশাসকের প্রতি অন্ধ আনুগত্য যেমন নিজের বিচারবুদ্ধি, বিবেচনাবোধ এবং মানবিকতাকে ধ্বংস করে দেয়, ঠিক তেমনি প্যাস্কেল এবং তার অনুসারীদের স্তাবকতাপ্রিয় ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে, তার প্রতি অন্ধ আনুগত্য আনলে আসলেই সমস্যা। পরকালে কিছুই হারানোর নাই বলে কেউ নিজেকে প্রবোধ দিলেও তিনি মূলত মানুষ হিসেবে চিন্তা করার ক্ষমতাটাই হারিয়ে ফেলবেন এরকমের অন্ধ আনুগত্যের ফলে। চাটুকারিতার কাছে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ করে তিনি তার সততা হারাবেন, সাহস হারাবেন, নিষ্ঠা হারাবেন, হারাবেন সুস্থ বিচারবোধ। তারপরেও কেউ বলবেন তার কিছুই হারানোর নেই? দার্শনিক জর্জ স্মিথ তার ‘Atheism: The Case Against God’ বইয়ে সেজন্যই বলেছেন[২০৬]–

‘ [ঈশ্বরের প্রতি অন্ধ আনুগত্যে] আমরা কী হারাবো? আমরা হারাবো বৌদ্ধিক সততা, আত্মসম্মানবোধ, হারাবো একটা চৌকস জীবন-দর্শন। সংক্ষেপে, জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে যা যা লাগে, সবই হারিয়ে ফেলব আমরা। না প্যাস্কেলের ওয়েজার কোন নিরাপদ বাজি নয়, বরং এটি জীবন আর সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের বিনিময়ে কেনা ছলনা।

.

বিশ্বাস ও শিশু নিপীড়ন

একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। শিশুদের প্রসঙ্গে। আমরা কথায় কথায় আমাদের শিশুদের পরিচয় উদ্ধৃত করে বলি ‘মুসলিম শিশু’, ‘খ্রিস্টান শিশু’, ‘হিন্দু শিশু’ ইত্যাদি। অথচ, যে শিশুটিকে মুসলিম, খ্রিষ্টান বা হিন্দু পরিচয়ে বড় করা হচ্ছে তার পুরোটুকুই আসলে ছোটবেলা থেকে অভিভাবকের জোর করে চাপানো। স্বাধীনভাবে বুঝে শুনে শিশুকে ধর্ম গ্রহণের অধিকার দেয়া হয়নি, বরং ছোটবেলা থেকে বুদ্ধি শুদ্ধি হবার আগেই ধর্মীয় সবক শুনিয়ে করা হয়েছে ব্রেন ওয়াশ! চিন্তা করে দেখুন, প্রাত্যহিক। জীবনে অন্য অনেক কিছুই আমরা শিশুদের থেকে দূরে রাখি– তার পর্যাপ্ত বয়স হয়নি বলে, অথচ ধর্মের বেলায় নিয়ম কানুন একদম উল্টো। সঠিকভাবে চিন্তা করলে বলতেই হয়– ‘মুসলিম শিশু’ বলে কিছু নেই, বলা উচিৎ ‘মুসলিম অভিভাবকের শিশু। ঠিক তেমনি ‘খ্রিস্টান সন্তান না হয়ে হওয়া উচিৎ খ্রিস্টান পিতামাতার সন্তান। হিন্দুদের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু কে বুঝবে সেটা! নিজের বিশ্বাসের ভাইরাস’ শিশুদের মানসজগতের উপর জোর খাটিয়ে প্রবেশ করানো যে একধরণের পীড়ন– এই বোধটুকুই আমাদের সমাজে গড়ে উঠেনি। তবে আশার কথা যে, পশ্চিমা বিশ্বে মানবতাবাদী এবং যুক্তিবাদী দার্শনিকদের মধ্যে এ নিয়ে কিছুটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন, বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক রিচার্ড ডকিন্স এই জোর করে অভিভাবকদের নিজেদের (অপ) বিশ্বাস এবং ধর্মীয় আচার আচরণ ও প্রথা শিশুর উপর চাপিয়ে দেয়াকে খুব সঠিকভাবেই এক ধরণের ‘শিশু নিপীড়ন হিসেবে উল্লেখ করেছেন তার ‘গড ডিলুশন’ বইয়ে[২০৭], এবং এ নিয়ে সবাইকে সচেতন হতে পরামর্শ দিয়েছেন।

মুক্তমনা সদস্য অভীক দাশ একবার একটি চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছিলেন মুক্তমনায় ‘ধর্ম:শিশু নির্যাতনের এক স্বীকৃত হাতিয়ার’ শিরোনামে। প্রবন্ধটির, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে পুরো প্রবন্ধটি এখানে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি[২০৮]–

শিরোনাম দেখে আপনাদের অনেকেই ভাবছেন আমি হয়তো পশ্চিমা চার্চগুলোর যাজকদের দ্বারা শিশু নির্যাতনের কথা বলছি। আসলে তা নয়। আমি এখানে বোঝাচ্ছি শিশুকে মানসিকভাবে পরিণত হওয়ার আগেই একটি ধর্মীয় বিশ্বাস চাপিয়ে দেয়াও এক প্রকারের ‘শিশু নির্যাতন। আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন চার্চে শিশুদের উপর যাজকদের চালানো যৌন নির্যাতনের ভয়াল কাহিনি আমরা প্রায় সবাই শুনেছি। পাশের দেশ ভারতেও ফঁস হয়ে গেছে প্রভাবশালী ধর্মগুরু নিত্যানন্দের যৌন কেলেঙ্কারির কথা। আমাদের দেশেও মাদ্রাসায় হুজুর কর্তৃক ছাত্র-ছাত্রীদের যৌন নির্যাতিত হওয়ার ঘটনার খবর কদিন পরপরই পত্রপত্রিকায় আসে। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় পাপের ও শাস্তির ভয় দেখিয়ে এসব শিশুদের ঘটনা চেপে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কখনো আবার হুজুর নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকেন এভাবে, “আমার উপর শয়তান ভর করেছিল। এতে আমার কি দোষ”। আমরা পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টকেও দেখেছি ভ্যাটিকানের যাজক, কার্ডিনালদের কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেয়ার জন্য ঘটনার মোড় অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে। তারা এমনও দাবি করেছে যে শিশুরাই যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পছন্দ করে। নির্যাতনকারী নরপশুরা ভালভাবেই জানে, শিশুদের মনে এই ভয় কতটা প্রবলভাবে কাজ করে। এমন ঘটনা ওই শিশুদেরকে মানসিকভাবে যে আঘাত হানে, সে আঘাত অনেক ক্ষেত্রে তারা সারা জীবনেও কাটিয়ে উঠতে পারে না। একইভাবে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ও সংবেদনশীল কোন শিশুর মস্তিষ্কে, কোন কিছু বোঝার মত বয়স হওয়ার আগেই কোন ধারণা বা বিশ্বাস চাপিয়ে দেয়াটাও কিন্তু শিশুদের জন্য কম ক্ষতিকর নয়।

কারও ধ্যান-ধারণাকে নিজের সন্তানের উপর চাপিয়ে দেয়ার কোন অধিকার যে কারও নেই সেটা লেবাননের বিখ্যাত কবি কাহলিল জিবরান তার ‘On Children কবিতায়ও উল্লেখ করেছেন,

‘তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়।
জীবনের নিজের প্রতি নিজের যে তৃষ্ণা, তারা হলো তারই পুত্রকন্যা।
 তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে, তোমাদের থেকে নয়।
এবং যদিও তারা থাকে তোমাদের সঙ্গে, কিন্তু তাদের মালিক তোমরা নও।
 তুমি তাদের দিতে পারো তোমার ভালোবাসা,
কিন্তু দিতে পারো না তোমার চিন্তা, কারণ তাদের নিজেদের চিন্তা আছে।
তুমি তাদের শরীরকে বাসগৃহ জোগাতে পারো, কিন্তু তাদের আত্মাকে নয়।
 কারণ তাদের আত্মা বাস করে ভবিষ্যতের ঘরে। যেখানে তুমি যেতে পারো না,
এমনকি তোমার স্বপ্নের মধ্যেও নয়।

তুমি তাদের মতো হওয়ার সাধনা করতে পারো, কিন্তু
তাদের তোমার মতো বানানোর চেষ্টা কোরো না।
 কারণ জীবন পেছনের দিকে যায় না, গতকালের জন্যে বসেও থাকে না।
তোমরা হচ্ছ ধনুক, আর তোমাদের সন্তানেরা হচ্ছে ছুটে যাওয়া তির।
ধনুর্বিদ অনন্তের পথে চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাকেন। যেন তার তির ছোটে
 দ্রুত আর দূরে।

তুমি ধনুক, তুমি বাঁকো, ধনুর্বিদের হাতে তোমার বেঁকে যাওয়া যেন আনন্দের জন্য
 হয়।
তিনি কেবল চলে যাওয়া তিরটিকে ভালোবাসেন তা-ই নয়,
 তিনি তো দৃঢ় ধনুকটিকেও ভালোবাসেন।

ইউনিসেফ, ইউনেস্কো, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা যেখানে তাদের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শিশুদের অধিকার রক্ষায়, সেখানে আমরা দেখতে পাই ধর্মীয় প্রভাবের কারণে বিভিন্নভাবে সারা বিশ্বেই শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে বিভিন্ন প্রকার ধর্মাচারণে বাধ্য করানোর মাধ্যমেই এই ধরণের নির্যাতন শুরু হয়। ধর্মানুষ্ঠান, ধর্ম প্রচার, ধর্মীয় পুস্তকাদির মাধ্যমে সব ধর্মেই চেষ্টা চালানো হয়, কীভাবে ছোট থাকতেই শিশুদের দিয়ে নিয়মিত ধর্মচর্চা চালানো যায়। মস্তিষ্কে শুরুতেই এমন বেড়ি পড়িয়ে দেয়ার পরিণতি এতটাই ভয়ানক হতে পারে যে, মানুষ বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিপূর্ণ নিয়মনীতি দেখলেও অনেক সময় নিজের পূর্ববর্তী ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। ধর্মীয় বিশ্বাস ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণা এভাবেই তাদের মাথায় তখন আঁকিয়ে বসে। শিশুরা তাদের পিতামাতা, আপনজনদের কাছ থেকে যা শোনে তাই বিশ্বাস করে। ঈশ্বর ছয় দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন, যীশু ঈশ্বরের পুত্র, যীশু পানির উপর হাঁটতে পারতেন, যীশু মৃত্যুর তিন দিন পর আবার বেঁচে উঠেছিলেন, রামায়ণ-মহাভারত হল প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, গীতা হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাক্য, দশাবতারচরিত, জন্মান্তরবাদ (মৃত্যুর পর কর্মফল অনুযায়ী আবার জন্ম হওয়া), কোরআন আল্লাহর বাণী, নবী মুহাম্মদের উপর কোরআন নাজেল হয়েছিল, নবীর আঙ্গুলের ইশারায় চঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি; বলা যায় বড়রা নিজেরা যেটাই বিশ্বাস করে সেটাকেই শিশুদের মনে ঢুকিয়ে দিতে না পারলে শান্তি পায় না। প্রাপ্তবয়স্করা তখন নিজেদের জাতি, বর্ণ, গোত্র বা ধর্ম রক্ষার নামে শিশুদেরকে যুদ্ধের ময়দানে সহজেই টেনে আনতে পারে। আল কায়েদা তাদের বাহিনীতে শিশুদের আকৃষ্ট করানোর জন্য এখন জিহাদি কার্টুন পর্যন্ত প্রচার শুরু করেছে। শুধু ২০০৪ সালেই সারা বিশ্বে প্রায় ৩ লক্ষ শিশু বিভিন্ন বাহিনীতে যোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু দেখা গেছে, যুদ্ধক্ষেত্রে শিশুদের ব্যবহার যখন ধর্মের নামে করা হয় তখন জাতিসংঘ, এর অঙ্গ সংগঠন ও প্রায় সকল দেশের সরকারই নিশ্চুপ হয়ে থাকে।

ধর্মীয় শিক্ষা যে আরেকটি ক্ষেত্রে শিশু নির্যাতনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে, সেটা হল লিঙ্গ বৈষম্য সৃষ্টি। এর মাধ্যমে ছেলে ও মেয়েদের অধিকারের মধ্যে অসমতা তৈরি হয়। জাতিসংঘ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো কিভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারী শিক্ষার প্রসারের কথা ভাবতে পারে যেখানে মেয়েশিশুদের ঘরের বাইরেই যেতে দেয়া হয় না। পাকিস্তান, আফগানিস্তানের তালিবান অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে মেয়েদের স্কুলে নিয়মিত বোমা হামলা চালানো হয়। কখনো বা ছড়িয়ে দেয়া হয় বিষাক্ত গ্যাস, যাতে পিতামাতারাও মেয়ে সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহ হারায়। কেবল নারী শিক্ষার পক্ষে কথা বলার কারণে পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার মিনগোরাতে ১৪ বছর বয়সী মালালা ও তার দুই বান্ধবীকে তাদের স্কুলের সামনে গুলি করেছিল তালেবান জঙ্গিরা ২০১২ সালে, এটা বিশ্ববাসী দেখেছে। একথা মানতে অনেকেই নারাজ যে ধর্মগুলো তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের প্রচার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। হোক সেটা পশ্চিমের সানডে স্কুল বা আমাদের দেশের মক্তব, মাদ্রাসা। আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় মাদ্রাসায় পুলিশ তল্লাশি করলেই পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন রকম দেশীয় অস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম। জেএমবির মত জঙ্গি সংগঠনগুলো মাদ্রাসাগুলোকেই বেছে নিয়েছিল তাদের ট্রেনিং ক্যাম্প হিসেবে। তাই মাদ্রাসার প্রতিশব্দই হয়ে গিয়েছিল ‘জঙ্গি তৈরির কারখানা। এখন কোন শিশুকে যদি শিশুকালেই পাঠিয়ে দেয়া হয় কোন মাদ্রাসায় তবে মাদ্রাসা। থেকে বের হওয়ার সময় তার মানসিকতা কেমন হতে পারে তা অনুমান করা কঠিন কিছু নয়।

কোন কাজটি ভাল আর কোন কাজটি মন্দ, একটা শিশুকে এমনটা শেখানো খুব কঠিন কোন কাজ নয়। আর মন্দ কাজটি কেন মন্দ এটাও বুঝিয়ে বললে একটা শিশুর মন খুব সহজেই তা গ্রহণ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ অন্যের কোন জিনিস তার অজান্তেই নিয়ে আসা বা চুরি করা কেন খারাপ কাজ এবং এমনটা করা কেন উচিত না তা খুব সহজেই একটি শিশুকে বুঝিয়ে বলা যায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার পরিবর্তে শিশুকে যদি শুধু এমন শিক্ষা দেয়া হয়, “খবরদার, চুরি করবি না। তাইলে আল্লাহপাক গুনাহ দিবে” বা “চুরি করলে মৃত্যুর পর দোযখে গিয়ে আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হতে হবে তাহলে ওই শিশুর মানসিক অবস্থাটা কেমন উঁড়াবে। সেই সাথে চুরি করাটা। কেন একটি খারাপ কাজ বা কেন এ ধরণের কাজ করা উচিত নয় তা সম্পর্কেও কিন্তু শিশুটি অজ্ঞই থেকে যাচ্ছে। একটা শিশুর মনের বিকাশ হওয়ার আগেই নরক বা দোযখের মত ভয়ঙ্কর একটি বিষয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কী প্রয়োজন থাকতে পারে? তাছাড়া নরক, জাহান্নামের ভয় দেখিয়ে কারও নৈতিকতার উন্নতি সাধন করা সম্ভব নয়। “এরকম কাজ কোরো না, কেউ একজন তোমাকে দেখছে। তোমাকে পরে শাস্তি পেতে হবে, এটা নৈতিকতা শেখানোর কোন গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হতে পারে না। একবার ভেবে দেখেছেন কি? বৌদ্ধধর্মে তো স্বর্গ-নরক, বেহেশত-দোযখ বলে কিছু নেই। তাহলে তারা তাদের শিশুদের কিসের ভয় দেখিয়ে খারাপ কাজ হতে বিরত রাখে? শিশুকাল থেকেই যখন ভয়ের মধ্য দিয়ে কোন শিশু বড় হতে থাকে, সে আর দশজন সাধারণ শিশুর মত স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না। আমরা কয়েক বছর আগে পাঁচ কি ছয় বছরের শিশু ফাহাদের ঘটনা দেখেছিলাম। এক মাদ্রাসা শিক্ষক ‘কবরের আযাব’ শীর্ষক একটি ভিডিও ফাহাদকে দেখিয়েছিল। যেখানে দেখানো হয় মৃত্যুর পর আত্মাকে কতটা ভয়ঙ্কর উপায়ে শাস্তি দেয়া হয়। ওই ভিডিওটি দেখার পর ফাহাদ তার মানসিক ভারসাম্য পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিল। ভিডিওটিতে ভয়ঙ্কর ভাবে চিত্রায়িত অত্যন্ত ভায়োলেন্ট দৃশ্যগুলি তাকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে। তার সমবয়সী খেলার সাথীরা যখন মাঠে খেলত, তখন সে নিজের বাসাতেই বসে থাকত। অসহায় বাবা-মারও তখন আর কিছুই করার ছিল না। তারা নিজেরাই যে নিজেদের সন্তানকে মাদ্রাসায় পাঠানোর মাধ্যমে এমন বিভীষিকাময় পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। যখন নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেন, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রিচার্ড ডকিন্সের উদ্দেশ্যে লেখা এক চিঠির মাধ্যমে আমরা আরও একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহিলার কাহিনি জানতে পারি। যিনি বড় হয়েছিলেন একটি রোমান ক্যাথলিক পরিবারে, আর সাত বছর বয়সেই এক যাজকের লালসার শিকার হয়েছিলেন। তার কাছ থেকে জানা যায় ওই তিক্ত অভিজ্ঞতা যেমন তার জীবনে বিভিন্ন সময়ই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে তেমনি আরও একটি ঘটনা তাকে শিশুকালে আরও বেশি আঘাত করেছিল। ছোটবেলাতেই তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি মারা যায়। বন্ধু হারানোর বেদনা তাকে যতটা ব্যথিত করেছিল তার চেয়েও বেশি বেদনাদায়ক ছিল তখন, যখন সে জানল তার বন্ধুটিকে যেতে হয়েছে। নরকের অগ্নিকুণ্ডে। কারণ সে ক্যাথলিক ছিল না। তার ভাষায়, “প্রায়ই রাতে দুঃস্বপ্ন হয়ে এটা আমার কাছে আসত, ভাবতে খুব কষ্ট হত যে আমার অত্যন্ত কাছের মানুষদের নরকে যেতে হচ্ছে। একবার ভাবুন তো, কোন মা তার সন্তানকে বলছে, “বাবা, তোমার সেলিম চাচা খুব ধার্মিক ছিলেন। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, নিয়মিত রোজা রাখতেন। বেশ কয়েকবার হজ্ব করে এসেছেন। উনি মারা যাওয়ার পর আল্লাহ উনাকে সোজা বেহেশতে নিয়ে গেছেন। কিন্তু তোমার হালিম চাচা বেনামাজি ছিলেন। তিনি রোজাও ঠিকমত রাখতেন না। তাই উনি মারা যাওয়ার পর তাকে দোযখে যেতে হয়েছে। এমন কথা শোনার পর শিশুটির মনের অবস্থা কিরূপ হতে পারে তা আপনিই অনুমান করুন। বিশেষ করে শিশুটি সেলিম চাচা অপেক্ষা তার হালিম চাচাকেই যদি বেশি পছন্দ করে তখন?

শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষাদান নিয়ে যত অনাকাঙ্ক্ষিত সব ঘটনা ঘটে থাকে সেগুলো বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। যেহেতু ধর্ম এগুলোর সাথে লেগে আছে তাই এই ধরণের অনাচার নিয়ে কেউই নিজের মুখ খুলতে চায় না। শিশুদের শৈশবের গুরুত্বপুর্ণ মুহূর্তগুলো কেড়ে নেয়ার মাধ্যমে ধর্ম তাদের কতটা ক্ষতিসাধন করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী কেটি পেরি ছোটবেলার কথা স্মৃতিচারণ করে একবার বলেছিলেন,

 “ধার্মিক ও রক্ষণশীল ক্যাথলিক পরিবারের সন্তান হওয়ার কারণে যে বয়সে আমার ডিজনি বা হ্যান্স অ্যান্ডারসনের ফেইরি টেল পড়ার কথা ছিল, সেই সময়টার পুরোটাই আমার পরিবার নষ্ট করিয়েছে আমাকে বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মীয় পুস্তক পড়িয়ে।”

এমন অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি জীবনের পরবর্তী সময়ে অনেকেরই হয়েছে। শিক্ষাবিদ টিনা ব্রুস এ প্রসঙ্গে বলেন,

“আপনি যদি আপনার শিশুর মাথায় ধর্মীয় কুসংস্কার প্রবেশ না করান তবে প্রকৃত জ্ঞান রাখার জন্য অনেকখানি জায়গা পাওয়া যায়”।

মানসিক নির্যাতনের সাথে ধর্ম শিশুদের শারীরিক নির্যাতনকেও উৎসাহ দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্রথমেই যে উদাহরণটি আসে সেটি হল ইসলাম ও ইহুদি ধর্মের Genital Mutilation বা Circumcision বা খৎনা প্রথা। ধর্মগুলো চায় শুধু মানসিকভাবে নয়, বরং শারীরিকভাবেও নিজের অনুসারীদেরকে ধর্মীয় চিহ্ন বহন করতে হবে। কোন শিশুর শরীরের সংবেদনশীলতম অঙ্গে ছুরি চালানোকে একটি সভ্য সমাজ কিভাবে গ্রহণ করে তা বুঝতে পারা আসলেই কষ্ট সাপেক্ষ। কিন্তু ধর্মীয় নির্দেশ বলে কথা। এই বীভৎস প্রথাটির শিকার কিন্তু শুধু ছেলে শিশুরাই হয় না। সোমালিয়া, সুদান, গিনি, চাঁদসহ আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলিম দেশে আজও মেয়ে শিশুদের উপর ধর্মের নামে এমন নারকীয় নির্যাতন চালানো হয়। ধর্মীয় নির্দেশ যত বর্বরই হোক না কেন, এটাকে গ্রহণযোগ্য ভাবে উপস্থাপন করার জন্য, এটাকে শরীরের জন্য উপকারী দাবি করে ধর্মবাদীরা এই বীভৎস প্রথাটির পিছনেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের অপব্যাখ্যা নিয়ে আসে। এখানে একটি প্রশ্ন তোলা যায়। শরীর-স্বাস্থ্যের উন্নতির উদ্দেশ্যে জন্মের পর যদি এই ধরণের অঙ্গহানি ঘটাতেই হয়, ঈশ্বর তবে কি মানুষের শরীরকে যথেষ্ট নিখুঁত করে ডিজাইন করেন নি? নাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষ ধর্মের অনুসারীদের যাতে আলাদা করতে সুবিধা হয় সেরকম দূরদর্শী চিন্তা মাথায় রেখেই এই ধরণের অঙ্গহানির নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন?

ধর্মগুলো মানুষকে শিশুকালেই এমন শিক্ষা দিয়ে দেয় যে তার ধর্মই একমাত্র সত্য। একমাত্র তার ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারীরাই মৃত্যুর পর স্বর্গে বা বেহেশতে পৌঁছতে পারবে। বাকি সবার স্থান হবে জাহান্নামের অগ্নিকুণ্ডে। সে এবং তার ধর্মের জাতভাইরা উৎকৃষ্ট, বাকিরা সবাই নিকৃষ্ট। শুরু থেকেই অন্যদের প্রতি এমন ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়াই ধর্মের বৈশিষ্ট্য। আমরা কি পারি না শিশুদের অন্যদেরকে ভালবাসতে শেখাতে বা মানুষ-মানুষের মধ্যে বৈষম্য না করতে?

আমরা শিশু বিবাহের (বাল্যবিবাহ) বিরুদ্ধে অবস্থান নেই, কারণ বিবাহের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক হতে হয়। আবার আমরা শিশুদের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডেও (যেমন নির্বাচন) অংশ নিতে দিই না, কারণ ভোট দেয়া বা নির্বাচনে অংশ নেয়ার মত পরিপক্বতা তাদের মধ্যে আসে নি। আমাদের এখন সময় এসেছে শিশুদের বলপূর্বক ধর্মীয় শিক্ষাপ্রদানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। অনেকেই হয়তো বলবেন যে, এটা পিতামাতার উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। কিন্তু, ধর্মীয় শিক্ষার কারণে উদ্ভূত শিশু নির্যাতনের বিষয়টি আমাদের চিন্তার উদ্রেক করে, সমাজে শিশুদের নৈতিক শিক্ষা দেয়ার জন্য ধর্ম নামক প্রতিষ্ঠানটির আদৌ কোন প্রয়োজন বা উপযোগিতা আছে কি? এর ফলে যে একটি বিতর্কিত পরিস্থিতির উদ্ভব হবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। স্রেফ ‘স্পর্শকাতর’ বলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর এবং সাধারণ মানুষের এক্ষেত্রে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলে বা এই বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে চলবে না। সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিশুদের অধিকার রক্ষায় অবশ্যই রক্ষণশীলতার খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে হবে। কিন্তু বাস্তবমুখী হলে আমরা দেখতে পারি আশা করা যত কঠিন আশার বাস্তবায়ন করাটা আরও অনেক বেশি কঠিন। তবে আমি স্বপ্ন দেখি যে একদিন সমাজের মানুষ জন গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নিয়ে সচেতন হবে। আরও বেশি চিন্তা করার ক্ষমতা তাদের মধ্যে আসবে।

ততদিনে হয়তো সারা বিশ্বের কোটি শিশুকে ধর্মের নামে নির্মম নির্যাতন নীরবে, নিভৃতে সহ্য করে যেতে হবে।

.

বিশ্বাসের ভাইরাস রুখতে হলে অব্যাহত রাখা দরকার ধর্মের কঠোর সমালোচনা

অনেকের মনেই এরকম একটা ধারণা জন্মে গেছে যে, ধর্ম ব্যাপারটা খুব স্পর্শকাতর, তাই কঠোর ভাষায় এর ব্যাশিং করা যাবে না, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, নিন্দা করা যাবে না, সমালোচনা করা যাবেনা, এমনকি আলোচনাও করা যাবে না, করলেও করতে হবে বুঝে শুনে, মাথায় ফুল চন্দন দিয়ে।

ব্যাপারটা হাস্যকর। পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যার সমালোচনা হয় না। ছাত্রদের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে কোন ঐতিহাসিক ভয় পান না এই ভেবে যে, চেঙ্গিস খানের সমালোচনা করা যাবে না, পাছে চেঙ্গিসনুিভুতি’ অহিত হয়! কেউ ইতিহাস চর্চা করতে গিয়ে ভাবেন না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের অত্যাচারের কথা কিংবা জাপানী বর্বরতার কথা অথবা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর নৃশংসতার কথা বলা যাবে না। কেউ বলেন না, এতে করে কারো ইতিহাসানুভূতিতে আঘাত লাগছে, মামলা করে দেবে। প্রথম আলো কিংবা কালের কণ্ঠের মত পত্রিকা যখন প্রতিদিনই বিজ্ঞানের নামে নানা ধরণের ‘আগডুম বাগডুম’ পরিবেশন করে, আমরা বলি না আমরা আদালতের শরণাপন্ন হব, আমাদের বিজ্ঞানুভূতি’ বিপন্ন। অথচ ধর্মের ক্ষেত্রে সব কিছু হয়ে যায় ব্যতিক্রম।

ধার্মিকদের ভঙ্গুর অনুভুতি সামান্যতেই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ধর্মযুদ্ধের নামে বিধর্মীদের উপর কি ধরণের অত্যাচার করা হয়েছিলো তা বললে তাদের ধর্মানুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, পয়গম্বর-নবী-রসুল আর ধর্মের দেবদূতদের অমানবিক কার্যকলাপ তুলে ধরলে ধর্মানুভুতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, নারীদের অন্তরিন করে তাদের অধিকার হরণ করা হয় তা বললে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত অবৈজ্ঞানিক আয়াত বা শ্লোক তুলে ধরলেও তারা আহত হন। আর ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করা হলে তো কথাই নেই; ঈশ্বর যে খুঁটি ছাড়া আকাশকে ছাদ স্বরূপ ধরে রাখেন তা যেন চৌচির হয়ে তাদের মাথায় তৎক্ষণাৎ ভেঙ্গে পড়ে। ধর্ম সব সময়ই কৌতুকের বড় উৎস হলেও ব্যঙ্গ এবং কৌতুকবোধের ব্যাপারটা ধার্মিকদের সাথে সবসময়ই কেন যেন বিপরীত। অথচ, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি চলচ্চিত্র, খেলাধুলা বা অন্যান্য যাবতীয় বিষয়কে সমালোচনা, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতে তাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। কেবল ধর্মের বেলাতেই গণেশ উল্টে যায় বরাবরই।

সমালোচনার ব্যাপারটা আরেকটু খোলসা করা যাক। আমাদের চারিদিকের সমাজ ব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখব, আওয়ামীলীগ বিএনপির সমালোচনা করছে, বিএনপি আওয়ামীলীগের। আমেরিকায় রিপাবলিকানরা করছে ডেমোক্রেটদের দর্শনের সমালোচনা কিংবা বিরোধিতা, আবার অন্যদিকে ডেমোক্রেটরা রিপাবলিকানদের। সমাজতান্ত্রিক আর পুঁজিবাদী ঘরনার লোকেরা যে যার দৃষ্টিকোণ থেকে পরস্পরের সমালোচনা করছে। সমাজ, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ক্রীড়াতত্ত্ব, প্রযুক্তি— কোনটাই সমালোচনার উর্ধে নয়, কিন্তু ধর্মের বেলাতেই ধর্মবাদীরা যেন তালগাছটি বগলে নিয়ে বসে থাকার পণ করেছেন। তারা ধর্মের যে কোন প্রাসঙ্গিক সমালোচনা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ কিংবা সংশয়কে চিরতরে নিষিদ্ধ করতে চান, কখনো ধর্মানুভূতির দোহাই দিয়ে, কখনো জনমতের দোহাই দিয়ে, কখনোবা আবার জনশৃংখলা রক্ষার ধোয়া তুলে। তারা চান ধর্মকে ‘মোমের পুতুল বানিয়ে হাতের তোলায় রেখে কিংবা পোষা বিড়ালের মতো কোলে নিয়ে অবিরত মাথায় হাত বুলিয়ে যেতে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার অপছন্দনীয় বিষয়ের নির্দয় সমালোচনা ধর্মবাদীরা করেন না তা নয়। খুব ভালভাবেই করেন। যেটা পছন্দ না সেটা বলে ফেলেন এক নিমেষেই। তারাও আমাদের মতোই কঠোর সমালোচনা করেন, ডারউইনের গলার সাথে বাঁদরের দেহ জুড়ে দিয়ে কার্টুন আঁকেন, মেয়েরা তাদের পছন্দসই কাপড় চোপড় না পড়লে ফতোয়া দেন, একে তাকে মুরতাদ ঘোষণা করে হত্যার হুমকি দেন, এমন কিছু নেই যে তারা বাদ রাখেন, অথচ ধর্মের বেলায় তারা হাস্যকর ভাবে সমস্ত নিয়মের ব্যতিক্রম চান।

ধর্মবাদীরা অবশ্য তাদের সবকিছুকেই নিয়মের বাইরে রাখতে চান। তারা মনে করেন তাদের মহান ঈশ্বর এই বিশ্বজগতসহ সব কিছু পরম মমতভরে বানিয়েছেন। কিন্তু যদি উল্টে কোন দুর্মুখ প্রশ্ন করে তবে ঈশ্বরকে কে বানালো? তখনই তারা বলবেন, ঈশ্বরকে রাখতে হবে নিয়মের বাইরে। ও সব প্রশ্ন কোরোনা– বোবা কালা হয়ে থাক’। একই ধারায় তারা চান পৃথিবীর সবকিছুর সমালোচনা, ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ চলবে, কেবল ধর্মের বেলায়– নৈব নৈব চ। আসলে ধর্মবাদীদের এই হেঁদো যুক্তিতে কান দিয়ে শুধু ধার্মিকেরা নন, আমরা মুক্তমনারাও অনেক সময় নিজেদের অজান্তেই তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলি এবং পরিশেষে আমাদের পতন ডেকে আনি। এ ব্যাপারটি সম্প্রতি স্পষ্ট করেছেন আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মী এডওয়ার্ড তাবাস। ফ্রি ইনকোয়েরি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘Atheist Must Not Self-Censor’ শিরোনামের প্রবন্ধে নাস্তিকদের সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেছেন– ধার্মিকদের কু যুক্তির কাছে মাথা নত করে নমনীয় হবার কিছু নেই[২০৯]। আসলে এমন কোন যুক্তি কারো থলিতে নেই যা মেনে ধর্মকে সমালোচনার চোখে দেখার থেকে অব্যাহতি দেওয়া যায়। বরং প্রতিটি ধর্মগ্রন্থেই রয়েছে অমানবিকতা এবং নৃশংসতার ছড়াছড়ি। আছে নারীদের অন্তরিন রাখার যাবতীয় ব্যবস্থা, আছে বিধর্মীদের প্রতি হুঙ্কার, আছে নিম্নবর্ণের মানুষদের উপর ঢালাও অত্যাচারের নির্দেশ। তাই, অন্য সব কিছুর সমালোচনা হলেও ধর্মের বেলায় মাথায় হাত বোলাতে হবে— সেটা তো হওয়া উচিত নয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রগুলোতে ধর্ম ব্যাপারটি এতটাই সমাজের হাড়ে-মজ্জায় ঢুকে গেছে যে, ধর্মকে সমালোচনার হাত থেকে বাঁচানোকেই আমরা এখন স্বতঃসিদ্ধ বলে মনে করি।

অথচ ধার্মিকদের ধর্মানুভূতির মতো আমাদেরও নাস্তিকানুভুতি কিন্তু আহত হতে পারতো। প্রতিনিয়ত হয়। আমাদের নাস্তিকানাভুতি প্রতিদিনই আহত হয়, যখন দেখি টিভি খুললেই কিংবা কোন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান শুরু হলেই কোরআন তেলোয়াত আর গীতা, ত্রিপিটক আউরে অদৃশ্য এবং অলীক ঈশ্বরকে খুশি করে অনুষ্ঠান শুরু করতে হয়; আমাদের অবিশ্বাসের দর্শনানুভূতি আহত হয় যখন জোর করে ধর্মশিক্ষার মত রূপকথাকে মাধ্যমিক স্তরে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়, আমাদের বিজ্ঞানুভুতি আহত হয় যখন মেরাজ আর বোরাকের রূপকথাকে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতত্ত্ব টেনে এনে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা হয় কিংবা বিবর্তনকে পাঠ্যপুস্তক থেকে অস্পৃশ্য করার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু এর জন্য কারো অনুভুতির বাটি চৌচির হতে দেখি না, মামলাও হয় না, হয় কেবল এর বিপরীতটি ঘটলেই।

অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ‘ধর্মানুভূতির উপকথা” নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন কয়েক বছর আগে। তিনি এই ধর্মানুভূতির উপকথা প্রবন্ধটি লেখার পর নিজেই মুক্তমনায় ইমেল করেছিলেন প্রকাশের জন্য। লেখাটি মুক্তমনা সাইটে রেখে দেয়া হয়েছিলো পিডিএফ আকারে। পরে অধ্যাপক আজাদ এই প্রবন্ধটিকে নিজের বইয়ে সংকলিত করেন যে বইটির শিরোনামও ছিল ধর্মানুভূতির উপকথা’। ব্যতিক্রমধর্মী এ প্রবন্ধটি পরবর্তীতে মুক্তমনার সংকলন গ্রন্থ ‘স্বতন্ত্র ভাবনা (২০০৮) তেও প্রকাশিত হয়। তিনি লেখাটিতে কিছু তাৎপর্যময় কথা বলেছিলেন যা, আজকের সময়েও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক–

‘একটি কথা প্রায়ই শোনা যায় আজকাল, কথাটি হচ্ছে ‘ধর্মানুভূতি’। কথাটি সাধারণত একলা উচ্চারিত হয় না, সাথে জড়িয়ে থাকে ‘আহত’ ও ‘আঘাত’ কথা দুটি; শোনা যায় ‘ধর্মানুভুতি আহত হওয়ার বা ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগার কথা। আজকাল নিরন্তর আহত আর আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে মানুষের একটি অসাধারণ অনুভূতি, যার নাম ধর্মানুভুতি। মানুষ খুবই কোমল স্পর্শকাতর জীব, তার রয়েছে ফুলের পাপড়ির মতো অজস্র অনুভূতি; স্বর্গ চ্যুত মানুষেরা বাস করছে নরকের থেকেও নির্মম পৃথিবীতে, যেখানে নিষ্ঠুরতা আর অপবিত্রতা সীমাহীন; তাই তার বিচিত্র ধরনের কোমল অনুভূতি যে প্রতিমুহূর্তে আহত রক্তাক্ত হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যখন সুদিন আসবে, সে আবার স্বর্গে ফিরে যাবে, তখন ওই বিশুদ্ধ জগতে সে পাবে বিশুদ্ধ শান্তি; সেখানে তার কোনো অনুভূতি আহত হবেনা, ফুলের টোকাটিও লাগবে না তার কোনো শুদ্ধ অনুভুতির গায়ে। অনন্ত শান্তির মধ্যে সেখানে সে বিলাস করতে থাকবে। কিন্তু পৃথিবী অশুদ্ধ এলাকা, এখানে আহত হচ্ছে, আঘাত পাচ্ছে, রক্তাক্ত হচ্ছে তার নানা অনুভুতি- এটা খুবই বেদনার কথা; এবং সবচেয়ে আহত হচ্ছে একটি অনুভূতি, যেটি পুরোপুরি পৌরাণিক উপকথার মতো, তার নাম ধর্মানুভূতি। মানুষ বিশ্বকে অনুভব করে পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে; ইন্দ্রিয়গুলো মানুষকে দেয় রূপ রস গন্ধ স্পর্শ শ্রুতির অনুভূতি; কিন্তু মানুষ, একমাত্র প্রতিভাবান সৃষ্টিশীল প্রাণী মহাবিশ্বে শুধু এ-পাঁচটি ইন্দ্রিয়েই সীমাবদ্ধ নয়, তার আছে অজস্র ইন্দ্রিয়াতীত ইন্দ্রিয়। তার আছে একটি ইন্দ্রিয়, যার নাম দিতে পারি সৌন্দর্যন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে অনুভব করে সৌন্দর্য আছে একটি ইন্দ্রিয়, নাম দিতে পারি শিল্পেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে উপভোগ করে শিল্পকলা; এমন অনেক ইন্দ্রিয় আছে তার, সেগুলোর মধ্যে এখন সবচেয়ে প্রখর প্রবল প্রচণ্ড হয়েছে হয়ে উঠেছে ধর্মেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে অনুভব করে ধর্ম, তার ভেতর বিকশিত হয় ধর্মানুভূতি, এবং আজকের অধার্মিক বিশ্বে তার স্পর্শকাতর ধর্মানুভূতি আহত হয়, আঘাতপ্রাপ্ত হয় ভোরবেলা থেকে ভোরবেলা। অন্য ইন্দ্রিয়গুলোকে পরাভূত করে এখন এটিই হয়ে উঠেছে মানুষের প্রধান ইন্দ্রিয়; ধর্মেন্দ্রিয় সারাক্ষণ জেগে থাকে, তার চোখে ঘুম নেই; জেগে থেকে সে পাহারা দেয় ধর্মানুভূতিকে, মাঝেমাঝেই আহত হয়ে চিৎকার করে ওঠে, বোধ করে প্রচণ্ড উত্তেজনা। এটি শিল্পানুভূতির মতো অনুভূতি নয় যে আহত হওয়ার যন্ত্রণা কেবল একলাই সহ্য করবে। এটা আহত হলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ধর্মানুভূতির উত্তেজনা ও ক্ষিপ্ততায় এখন বিশ্ব কাঁপছে।

 হুমায়ুন আজাদের কথা একবর্ণ মিথ্যে নয়। ধর্মানুভূতি নামক জুজুর উত্তেজনা ও ক্ষিপ্ততায় এখন সারা বিশ্ব কঁপছে। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০০৬ সালে ড্যানিশ একটি পত্রিকায় মোহাম্মদ (সঃ) এর বেশ কয়েকটি কার্টুন প্রকাশের পর ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে কিভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলো সারা মুসলিম বিশ্ব। ড্যানিশ পত্রিকায় ছাপা হওয়া কার্টুনগুলো পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে এমনকি বাংলাদেশেও রাজনীতিবিদদের কার্টুন এর মানদণ্ডে মোটামুটি গোবেচারা ধরণের। সর্বমোট বারোটি ছবির মধ্যে, তিনটি কার্টুনকে বড়জোর ইসলাম এবং সন্ত্রাসের সাথে সম্পর্কিত করা যায়। আর এই কার্টুনগুলো ছাপানোর পরে সেগুলো না দেখেই পুরো পৃথিবীতে বিক্ষোভ প্রকাশে ফেটে পড়ে মুসলমানরা। সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডেনমার্ক কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানান, এবং এমন ঘটনা যেন ভবিষ্যতে কেউ করার সাহস না পায়, তার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তি প্রদানের অনুরোধ করেন। এর ঠিক দুইবছর আগে ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে নেদারল্যান্ডের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রথমবারের মতো সম্প্রচারিত হয় চলচ্চিত্র নির্মাতা থিও ভ্যান গগের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সাবমিশন’- যার মূল বিষয় ছিলো মুসলিম নারীর উপর আরোপিত ইসলামি সমাজের নির্যাতন কথা। থিও ভ্যান গগ আর তার চলচ্চিত্রের মাঝে সময়টা মোটে এক মাস। একই বছরের নভেম্বরের দুই তারিখ, ভ্যান গগ আমস্টারডামের রাস্তায় মুহাম্মদ বোয়েরি নামের এক ধর্মান্ধ মুসলমানের গুলিতে নিহত হন। গুলি করে মেরে ফেলেই খুনি ক্ষান্ত হয়নি, ছুরি দিয়ে তার মাথা আলাদা করে ফেলা হয়। ১৯৯২ সালে মিশরের লেখক ফারাজ ফদা ইসলামকে অপমান করার জন্য খুন হন, নোবেল পুরষ্কার পাওয়া মিশরের আরেক উপন্যাসিক নাগিব মাহফুজকে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের উছিলায় ছুরিকাঘাত করা হয় ১৯৯৪ সালে, ২০০৪ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রথাভাঙ্গা লেখক হুমায়ুন আজাদের উপর হামলা চালায় এদেশের একটি ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠী। চাপাতি দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলা হয় তার দেহ,যা পরে তাকে প্রলম্বিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। দেশের সরকার অবশ্য সেসময় এটাকে সেকুলারিস্টদের কাজ বলে পার পেতে চেয়েছিলো, তৎকালীন ইসলামিষ্ট মন্ত্রী এও বলেছিলেন, ‘বাংলাভাইরা সব মিডিয়ার সৃষ্টি।

ইসলামের সাথে সন্ত্রাসের সম্পর্ক আছে কি নেই সেই চায়ের পেয়ালায় ঝড় তোলা পুরনো বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, ডেনমার্কের পত্রিকায় প্রকাশিত কার্টুনগুলো কিছু বাস্তবতার দিকে আঙ্গুল প্রদর্শন করে যে বাস্তবতায় আছে বাংলাদেশের বাংলা ভাই, বিদেশের ওসামা বিন লাদেন, আইমান আল যাওয়াহরি, আবু হামজা, মোহাম্মদ আতা সহ হাজার হাজার জিহাদি যারা কোরআন এবং হাদিসের বানী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে হত্যা করছে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে। শান্তিপ্রিয় মুসলমানরা কার্টুনটি দেখে এই বাস্তবতাটা দেখতে পারতেন, সে বাস্তবতায় সত্যতা পেলে সেটা সমাধানে সচেষ্ট হতে পারতেন, কিন্তু আমরা মানুষেরা- যা দেখতে চাই না, তা দেখিনা, তাই মুসলমানরা ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে বলে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। ডেনমার্কের পত্রিকার ব্যান চাইলেন, সম্পাদক পেলেন মৃত্যুর হুমকি।

ছবি। পেজ ২২৮

ছবি— ড্যানিশ পত্রিকায় কার্টুন ছাপানোর পরে ব্রিটেনের মুসলিমরা সন্ত্রাসের সাথে যে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই, কিংবা ইসলাম যে কত শান্তিপূর্ণ ধর্ম, তা প্রমাণ করতে রাস্তায় মিছিল করেছিল ব্যানার আর প্ল্যাকার্ড নিয়ে, যেগুলোতে লেখা ছিল যারা বলে ইসলাম ভায়োলেন্ট রিলিজিয়ন, তাদের কতল করুন’, কিংবা ‘ইসলামকে ব্যঙ্গ যারা করে তাদের ম্যাসাকার করুন।

তারচেয়েও মজাদার ছিলো ব্রিটেনের কিছু মৌলবাদী মুসলিমদের কাজকর্ম। ব্রিটেনের মুসলিমরা সন্ত্রাসের সাথে যে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই, কিংবা ইসলাম যে কত শান্তিপূর্ণ ধর্ম, তা প্রমাণ করতে রাস্তায় মিছিল করেছিল ব্যানার আর প্ল্যাকার্ড নিয়ে, (TBTO asht fact– ‘Slay those who insult Islam’, ‘Butcher those who mock islam’, ‘Behead those who say Islam is a violent religion’.

যারা বলে ইসলাম ভায়োলেন্ট রিলিজিয়ন, তাদের কতল করুন’— এর চেয়ে বড় কার্টুন আর কি হতে পারে! সাধে কি আমরা বলি ধর্মই সকল বিনোদনের উৎস? তামাসা কেবল ড্যানিশ কার্টুন নিয়েই হয়নি, তামাসা হয়েছিলো বাংলাদেশে কার্টুনিস্ট আরিফের আঁকা আপাত নিরীহ মুহম্মদ বিড়াল’ কার্টুন নিয়েও। বেচারা আরিফকে জেল খাটতে হয়েছিলো এর জন্য। অথচ সেই কার্টুন বহু আগেই প্রকাশ করেছিলো শিবিরের পত্রিকা ‘কিশোর কণ্ঠ’। তখন অবশ্য কারো ধর্মানুভুতি আহত হতে দেখা যায়নি।

ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস-এর আর্টিকেল-১৯ এ পরিষ্কার বলা আছে–

“Everyone has the right to freedom of opinion and expression; this right includes freedom to hold opinions without interference and to seek, receive and impart information and ideas through any media and regardless of frontiers.”

রাষ্ট্রের কাছে থেকে তাই বাক স্বাধীনতা রক্ষার অধিকার আশা করা যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু দুঃখের বিষয় রাষ্ট্র সেটা না দিয়ে বরঞ্চ বাক-স্বাধীনতার অধিকাররোধে বেশি সচেষ্ট থাকে; রাষ্ট্র বোস কথা বলা পছন্দ করেনা, বিরোধিতা পছন্দ করেনা। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে রাষ্ট্রযন্ত্র মূলত ক্ষমতার মসনদ ধরে রাখার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠকে ধর্মীয় আফিমে নেশাগ্রস্থ করে রাখতে অনেক আগ্রহী- তাই এ ধরণের রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো বাক স্বাধীনতা রক্ষার অধিকার দেবার পরিবর্তে হরণে বেশি আগ্রহী। আর সেইসব রাষ্ট্রের আফিমগ্রস্থ মানুষেরা বিশ্বাস করে, আত্মঘাতী বোমা হামলা করে ত্রিশ জন মারার ঘটনা থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সে ঘটনায় ইসলামকে জড়িয়ে খারাপ কিছু বলা হয়েছে কিনা। যদি হয়ে থাকে,তাহলে তারা আঘাত পায়। মূল ঘটনা ধামাচাপা পড়ে বড় হয়ে উঠে অন্য ঘটনা- যে ঘটনার খলনায়ক- ‘ব্যাটা তোরে লিখতে কইছে কে’।

লিখবোনা? আঁকবোনা? যেখানে সমালোচনা দেখলে সমালোচকের গলা টেপার পরিবর্তে সমালোচনার কারণ খতিয়ে দেখা উচিৎ- পৃথিবীর ধার্মিকেরা এতো সহজ ব্যাপারও বোঝেনা? মুখে শান্তির ধর্ম বলে ফ্যানা তুলে ফেলে সারা বিশ্বে সন্ত্রাসের চাষ করে বেড়ালে সেই দ্বিচারিতা নিয়ে কেউ ব্যঙ্গ করবে না? পৃথিবীর আলো-বাতাস বিজ্ঞান-প্রযুক্তি সব ব্যবহার করে যারা আজও গুণগান গাইছে মধ্যযুগের হিংসা বিদ্বেষভরা মতবাদগুলোর প্রতি, সেইসব বালুর মধ্যে মুখ গুঁজে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে কৌতুক করাটা দোষের? পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ আহাম্মক গোষ্ঠীর মধ্যে কতোগুলো গোষ্ঠী আজও বিশ্বাস করে পৃথিবী সমতল, কতোগুলো মনে করে এলভিস প্রিসলি বেঁচে আছেন এখনও- এই আহাম্মকদের নিয়ে উপহাস করা যাবেনা? কারণ তারা আঘাত পাবে?

আমাদের দেশটায় আজ ধর্মের জয়জয়কার। ধর্মান্ধতার জয়জয়কার। জয়জয়কার নির্বুদ্ধিতার। অথচ বিজ্ঞান- যে সত্যিকার অর্থে আমাদের পার করিয়েছে নদী, সেতু তৈরি করে, কোনো নবী বা ধর্মগ্রন্থের জ্ঞান নয়- সে বিজ্ঞানের চেতনা আমরা পরিহার করছি সযতনে। যদিও এইসব চেতনা বুঝতে একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই হয়। কিন্তু এতো সহজ একটা কাজও না করে বেঁচে থাকার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করি আমরা। ধর্মানুভূতির চাপে পড়ে আজ এদেশে বিবর্তনবিদ্যা পড়ানো হয়না, স্কুল কলেজের জীববিজ্ঞান বই থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয় জীববিজ্ঞানের মূল ভিত্তি বিবর্তন সেই বিষয়টাই। আমাদের ধর্মানুভূতির সেপাই আজও আমাদের জন্য নির্ধারণ করে দিতে চাইছেন, আমরা কী দেখবো, কী পড়বো, কী শুনবো আর কী শুনবোনা।

দেশের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াগুলোতে ধর্মের সমালোচনা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু ইন্টারনেট? সেখানে সমালোচনা বন্ধ করা দরকার না? ধর্মানুভূতির সেপাইরা রাষ্ট্রকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন সে ব্যাপারে। আমাদের ধর্মানুভূতির সেপাইরা রাত ভর মাইকিং করে অন্য ধর্মের মানুষদের, অন্য দেশের মানুষের আরাম করে। গালাগালি করে যেতে পারেন, কিন্তু ফেসবুকে তার ধর্মের বিরুদ্ধে একটা কথা শুনলে মুখ ভার করে ফেলেন। আসলেই কি ফেলেন? না ফেলেন না, কিন্তু সংগঠন ফেলে। সংগঠন তাদের পরিচালনা করে। আর যেহেতু এদেশে তাদের সংগঠন শক্তিশালী তাই রাষ্ট্র তাদের হাত করার জন্য তাদের পক্ষ নেয়, রাষ্ট্র আমাদের বিজ্ঞানানুভুতিতে নিয়ে চিন্তিত নয়, আমাদের সৌন্দার্যানুভূতি নিয়ে চিন্তিত নয়, আমাদের সভ্যতানুভূতি নিয়ে চিন্তিত নয়- হঠাৎ করে রাষ্ট্র চিন্তিত সংখ্যাধিক্য সংগঠনের ধর্মানুভূতি নিয়ে, কারণ সংখ্যালঘুদের বেইল দিয়ে লাভ নেই। মূলধারার পর ইন্টারনেটে তাই এখন ধীরে ধীরে পড়ছে ধর্মানুভূতির রক্ষার্থে কথা সেন্সরশিপের কোপানল।

.

ইন্টারনেট কি এভাবে দমানো সম্ভব?

ড্যানিশ কার্টুনের ঘটনা, থিও ভ্যান গগের ঘটনার পর সাউথ পার্কও মুসলমানদের একই রোষানলে পড়ে তাদের ২০০ এবং ২০১ তম পর্বটি সেন্সর করতে বাধ্য হয়। ভয় দেখিয়ে বর্তমান সময়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর এই নিরন্তর বাধার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ইন্টারনেটে এক অভূতপূর্ব আন্দোলনের জন্ম হয়- এভরিবডি ড্র মুহাম্মদ ডে নামে একটি ফেসবুক পাতাকে কেন্দ্র করে লক্ষ লক্ষ ছবি আঁকা হয়, মুহাম্মদের। এখানে একটি বিষয় মুসলমানদের বোঝা দরকার, মুহাম্মদের ছবি আঁকা তাদের জন্য নিষিদ্ধ হলেও যারা তাদের ধর্মভুক্ত নয়। তাদের জন্য কিন্তু এ নিয়ম খাটে না। ২০ মে ২০১০ সালে দিনটি পালনের আগের দিন পাকিস্তানের আদালত ফেসবুক ব্লক করে। কী লাভ হলো তাতে? এখানে বলে নেয়া উচিত, মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি শুনেও একজন মুসলিমের ধর্মানুভুতি আহত হওয়ার কথা, সেটার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে না, কেন? কারণ হিসেবে বলা যায়, কোন দেশের আইন বা মানুষের নৈতিকতার ভিত্তিটা গড়ে ওঠে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে। আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাস বলে, ইসলাম ধর্ম এদেশে প্রবেশ করার পূর্বে আমরা ছিলাম জাতিগতভাবে সনাতন অথবা বৌদ্ধ ধর্মানুসারী- সুতরাং আমাদের যে মিশ্র ধর্মীয় সংস্কৃতি এবং সহনশীলতার ইতিহাস আছে, মূল্যবোধ আছে- সেটা মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান ধর্মের মূল্যবোধে নেই। ক্ষেত্র বিশেষে ব্যতিক্রম হলেও, আমাদের দেশে ইসলাম প্রচারে এসেছিলো প্রধানত সূফী সাধকেরা, যাদের প্রেমের বাণী এদেশের মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছিল। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশে মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেও আমরা কিন্তু সৌদি আরব কিংবা ইরানের মতো ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করি নি হাতে কলমে, আমাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সেটা বলে না। তাহলে কেন সেই মধ্যযুগীয় অন্ধ মূল্যবোধের দোহাই দিয়ে আমাদের রাষ্ট্র বলপ্রয়োগ করবে? ধর্মানুভুতি বলে কোন সুনির্দিষ্ট অনুভূতি চিহ্নিত করে কি কোন আইন প্রণয়ন করা সম্ভব? কারণ ধর্মানুভূতির ব্যাপারটাই বিমূর্ত এবং প্রত্যেক ধর্ম একে অপরের সাথে সঙ্ঘাতপূর্ণ। কোন সনাতন ধর্মাবলম্বী গিয়ে যদি আদালতে আবেদন করে গরু কোরবানির জন্যে তার ধর্মানুভুতি রক্তাক্ত- তাহলে রাষ্ট্র কি তার ধর্মানুভুতি রক্ষার জন্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে? যেহেতু রাষ্ট্রের চোখে সবাই সমান- প্রত্যেক ধর্মানুসারীই, না কি তখন আইন প্রণয়ন করা হবে সংখ্যাগুরু মানুষের মুল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে? পরোক্ষভাবে কি এখনো সেই ব্যাপারটাই হচ্ছে না? ভয়-ভীতি দেখিয়ে বই, পত্র-পত্রিকা বন্ধ করলেও এখন কি আর আদতে মুখ চেপে ধরা সম্ভব হয়?

পুরাতন পদ্ধতি আর কাজ করছে না, রাষ্ট্র আর আমাদের সেন্সরকারীরা ঝাপিয়ে পড়ছে নতুন এই ক্ষেত্র ‘ইন্টারনেট’কে আটকে ফেলার উপায় বের করতে। উইকিলিক্স আমেরিকার আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের গোপনীয় বিশাল নথি, গুয়ানতানামু কারাগার এবং আমেরিকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অসংখ্য নথি সংগ্রহ করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতার এক নতুন দিগন্ত প্রতিষ্ঠা করে। আমরা দেখলাম, খুব আগ্রহ নিয়েই দেখলাম– পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকাও তাদের গলা টিপে ধরার প্রচেষ্টায় সফল হতে পারলো না। ২০১০-১১ সাল জুড়ে চলা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলোতে ঘনীভূত হয়ে ওঠা সংগঠিত চলমান আন্দোলনের পেছনে ইন্টারনেটের এবং সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোর প্রভাব আমরা সবাই দেখেছি। সিরিয়ার মতো একটি বদ্ধ দেশে থাকা মানুষেরা তাদের কথা, তাদের অবস্থা সারাবিশ্বকে জানাতে পেরেছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। তিউনিসিয়ায় চাকুরিবিহীন বেকার যুবকদের আগুনে আত্মাহুতি দেবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিউনিসিয়ার সরকারের প্রতি যে বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছিলো তাকে ঠেকাতে ইন্টারনেটের সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো সরকার। লাভ হয়নি, বরং তিউনিসিয়ার সফল বিপ্লবকে চিহ্নিত করা হয়েছে The Story of the First Successful Internet Revolution’ হিসেবে। মিশরের বিপ্লবীরাও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে ইন্টারনেট। মিশরের সরকার গদি বাঁচাতে ফেসবুক ইউটিউব টুইটার বন্ধ করে দিয়েছিলো, লাভ হয়নি সেখানেও। বাংলাদেশে এই আওয়ামীলীগ সরকারের আমলেও কদিন আগে যখন ধর্মানুভূতি এবং রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর ইমেজানুভূতিতে আঘাত করার জন্য ফেসবুক বন্ধ করার পায়তারা নেয়া হয়েছিলো তখন জনমানসে কী ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো, কিভাবে সরকার আবার নিজেদের হাস্যাস্পদ করে অবশেষে ফেসবুককে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো, রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা নিশ্চয় তা ভুলে যায় নি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ভুল থেকে শিক্ষা নিতে তাদের খুব কমই দেখা গেছে।

রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা এখন তাই আবার নড়ে চড়ে বসেছে, আরেকটি মহাভুল আবারো করার জন্যই বোধ হয়। আবারো ইন্টারনেটের মুখ চেপে ধরতে তারা বদ্ধপরিকর। দিকে দিকে ব্লগ, ফেসবুক, টুইটারের নামে মামলা, কনটেন্ট মোছার আবেদন, ব্লক আরও কতো কী। সম্প্রতি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (সংশোধন) অধ্যাদেশে চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রীসভা, যেখানে ৫৭ ধারা নামে একটি ধারা সংযুক্ত হয়েছে। “অনুভুতির বাণিজ্য পুঁজি করে দেশের প্রগতিশীল মুক্তমনা লেখকদের হুমকির মুখে রাখা এবং পরিস্থিতি বুঝে তাদের কারাগারে প্রেরণটাই যেন এর একমাত্র উদ্দেশ্য। ইতোমধ্যেই এর শিকার হয়ে কারাগারে গেছেন মুক্তবুদ্ধির দুই তরুণ মাহমুদুর রহমান রায়হান (রায়হান রাহী) এবং উল্লাস দাশ। যখন এগুলোতেও ফায়দা হয় না, তখন হয় শারীরিক আক্রমণ। কিন্তু তারা ভুলে যান, হুমায়ুন আজাদ, রাজীব কিংবা আসিফ মহিউদ্দীনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়েও মুক্তবুদ্ধির অগ্রযাত্রা স্তিমিত করা যায়নি; বরং আমরা বেড়েছি, চারা গাছ হিসেবে জন্ম নিয়ে মহীরুহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছি এখানে ওখানে সর্বত্র। কয়জনকে হেনস্থা করবে, কয়টা সাইট বন্ধ করবে? আজকে যে কোন ব্লগে গেলেই, কিংবা ফেসবুক, টুইটারের যে কোন জায়গাতেই মুক্তবুদ্ধির স্বপক্ষে হাজারো আলোচনা চোখে পড়ে। কেবল পাঁচ ছয়টি সাইট বন্ধ করে দিলেই সব শেষ হয়ে যাবে? মুক্তমনারা আজ আর একটি সাইটে নয়, মুক্তমনা একটি সফল আন্দোলনের নাম যা ছড়িয়ে আছে অসংখ্য সাইটে, ফেসবুক পেইজে, মানুষের মনে, চিন্তা-চেতনায়। প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিক্রিয়ায় এ আন্দোলন রাতারাতি বন্ধ হয়ে যাবে–সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই।

.

সমাজ ধর্মহীন হয়ে গেলে কি উচ্ছন্নে যাবে?

এই বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে আমরা সুইডেনের একটি সংবাদ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখে পত্রিকায় প্রকাশিত সেই সংবাদ থেকে জানা গিয়েছিল, সুইডেনের কারাগারগুলো নাকি সব ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিগত সময়গুলোতে কারাবন্দির সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়ার ফলেই এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে রাষ্ট্রকে।

আমাদের মত দেশ যেটা দুর্নীতিতে শীর্ষস্থানীয়, যেখানে বিশ্ব-বেহায়া এরশাদের মত সুযোগসন্ধানী প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কিংবা রাষ্ট্রীয় নেতা হবার গৌরব নিয়ে থাকেন, যেখানে কেউ সুযোগ পেলেই অন্যের ঘাড় ভেঙে, চুরি চামারি কিংবা প্রতারণা করে টু-পাইস কামিয়ে নিতে চায়, তাদের হয়তো ব্যাপারটা অবাক করবে। হয়তো তারা আরো অবাক হবেন জেনে যে, সুইডেন পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নাস্তিক-প্রধান দেশ (দেশটিতে নাস্তিকের হার শতকরা ৪৫ থেকে ৮৫ ভাগ হিসেবে উঠে এসেছে বিভিন্ন সমীক্ষায়)।

আমাদের দেশের অনেকেই যারা ধর্ম এবং নৈতিকতাকে এক করে দেখেন, যারা মনে করেন ধর্ম না থাকলেই সমাজ উচ্ছন্নে যাবে, তাদের কাছে প্রায় ধর্মহীন’ সুইডেনে কারাবন্দিদের সংখ্যা এভাবে কমে যাওয়ার উদাহরণটা হয়তো খানিকটা বিস্ময়ের বটে। এর কারণ আছে। সেই ছেলেবেলা থেকেই নৈতিক চরিত্র গঠনের মূলমন্ত্র হিসেবে আমাদের শেখানো হয়েছে ধর্ম যারা পালন করে তারাই ভাল। কিংবা দোষ করলে আল্লাহ গোনাহ দিবে ইত্যাদি। ছোটবেলা থেকেই এইভাবে নৈতিকতার সাথে ধর্মের খিচুড়ি একসাথে মিশিয়ে খাওয়ানোর ফলে আমরা বড় হয়েও আর ভাবতেই পারি না যে ধর্ম মানা ছাড়াও কারো পক্ষে ভালো মানুষ হওয়া সম্ভব। কিন্তু সত্যিই কি ধর্মের সাথে নৈতিক চরিত্র গঠনের কোনো বাস্তব যোগাযোগ আছে?

ব্যাপারটির অনুসন্ধান করে আমি আমার সহলেখক রায়হান আবীরের সাথে মিলে বছর দুয়েক আগে একটা বই লিখেছিলাম ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ নামে[২১০]। বইটি লিখতে গিয়ে একাডেমিয়ায় প্রকাশিত বেশ কিছু পরিসংখ্যান নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়েছিল, পরিচিত হয়ে হয়েছিল গবেষকদের প্রাসঙ্গিক কাজের সাথে। সবচেয়ে আলোচিত ছিল ফিল জুকারম্যানের উদাহরণটি। ভদ্রলোক ক্যালিফোর্নিয়ার একটি কলেজের সোশিওলজি বিভাগের অধ্যাপক। তিনি ২০০৫ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে সমীক্ষা চালিয়েছিলেন। সেসব দেশগুলোতে ঈশ্বরে বিশ্বাস এখন একেবারেই নগণ্য পর্যায়ে নেমে এসেছে। যেমন, সুইডেনের কথা আমরা আগেই বলেছি, সেখানে জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ ভাগ এবং ডেনমার্কে প্রায় ৮০ ভাগ লোক এখন ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। অথচ সেসমস্ত ‘ঈশ্বরে অনাস্থা পোষণকারী দেশগুলোই আজ পৃথিবীতে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্থ এবং সবচেয়ে কম সহিংস দেশ হিসেবে চিহ্নিত বলে ফিল সাহেবের গবেষণায় উঠে এসেছিল। ফিল জুকারম্যান তার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি বই লিখেছেন, “ঈশ্বরবিহীন সমাজ (Society without God: What the Least Religious Nations Can Tell Us About Contentment) ftcatatan

তিনি সেই বইয়ে চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন যে, ডেনমার্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আরহাসে থাকাকালীন সময়গুলোতে কোনো পুলিশের গাড়ি দেখেন নি বললেই চলে। প্রায় ৩১ দিন পার করে তিনি প্রথম একটি পুলিশের গাড়ি দেখেন রাস্তায়। পুরো ২০০৪ সালে মাত্র একজন লোক হত্যার খবর প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ, সেই ২০০৪ সালে পুরো বছর জুড়ে প্রায় পঁচিশ লক্ষাধিক মানুষ বসবাসকারী মেট্রোপলিটন শহর আরহাসে সংগঠিত খুনের সংখ্যা ছিল এক। এ থেকে বোঝা যায় এ সমস্ত দেশগুলোতে মারামারি হানাহানি কতো কম। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে ডেনমার্ক পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ।

মোদ্দাকথা হল– বেশিরভাগ ড্যানিশ এবং সুইডিশ আমাদের দশের মত ধর্ম দ্বারা সংজ্ঞায়িত ‘গুনাহ’ বা পাপ নামক কোনো ব্যাপারে বিশ্বাসী নন অথচ দেশ দু’টিতে অপরাধ প্রবণতার হার পৃথিবীর সকল দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন। এই দুই দেশের প্রায় কেউই চার্চে যায় না, পড়ে না বাইবেল। তারা কি অসুখী? ৯১ টি দেশের মধ্যে করা এক জরিপ অনুযায়ী, সুখী দেশের তালিকায় ডেনমার্কের অবস্থান প্রথম, যে ডেনমার্কে নাস্তিকতার হার মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা আশি ভাগ। স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় মাত্র ২০ শতাংশের মতো মানুষ ঈশ্বরের বিশ্বাস করেন, তারা মনে করেন ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশ্বাস করেন, মৃত্যুর পরের জগতে। আর বাকিরা স্রেফ কুসংস্কার বলে ছুঁড়ে ফেলেছেন এ চিন্তা।

‘ঈশ্বরহীন’ এইসব সমাজের অবস্থাটা তবে কেমন? দেশগুলো কি সব উচ্ছন্নে গেছে, যেভাবে আমাদেরকে ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়েছে? না, তা যায়নি। বরং, সমাজের অবস্থা মাপার সকল পরিমাপ- গড় আয়ু, শিক্ষার হার, জীবন যাপনের অবস্থা, শিশুমৃত্যুর নিম্নহার, অর্থনৈতিক সাম্যাবস্থা, লিঙ্গ সাম্যাবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, দুর্নীতির নিম্নহার, পরিবেশ সচেতনতা, গরীব দেশকে সাহায্য সবদিক দিয়েই ডেনমার্ক ও সুইডেন অন্যান্য সকল দেশকে ছাড়িয়ে সবচেয়ে উপরে। তবে পাঠকদের আমরা এই বলে বিভ্রান্ত করতে চাই না যে, এইসব দেশে কোনো ধরনের সমস্যাই নেই। অবশ্যই তাদেরও সমস্যা আছে। তবে সেই সমস্যা সমাধানের জন্য তারা যৌক্তিক পথ বেছে নেয়, উপর থেকে কারও সাহায্যের অপেক্ষা করে না, কিংবা হাজার বছর পুরনো গ্রন্থ ঘেঁটে সময় নষ্ট করে না। ইহজাগতিক সমস্ত সমস্যার সমাধান ইহজাগতিকভাবেই সমাধানের চেষ্টা এবং উদ্যোগ নিয়েছে তারা।

কেবল ফিল জুকারম্যানের কাজই নয়, অবিশ্বাসের দর্শন বইটিতে আরো অনেক পরিসংখ্যান নিয়েই গুরুত্বপুর্ণ আলোচনা করেছিলাম। আমরা দেখিয়েছিলাম, আমেরিকায় নাস্তিকদের চাইতে পুনরুজ্জীবিত খ্রিস্টানদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেশি; এও দেখা গিয়েছে, যেসব পরিবারের পরিবেশ ধর্মীয়গতভাবে অতিমাত্রায় রক্ষণশীল সেসমস্ত পরিবারেই বরং শিশুদের উপর পরিবারের অন্য কোনো সদস্যদের দ্বারা বেশি যৌন নিপীড়ন হয়। ১৯৩৪ সালে আব্রাহাম ফ্রান্সব্লাউ তার গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন ধার্মিকতা এবং সতোর মধ্যে বরং বৈরী সম্পর্কই বিদ্যমান। ১৯৫০ সালে মুর রসের গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে যে, ধার্মিকদের তুলনায় নাস্তিক এবং অজ্ঞেয়বাদীরাই বরং সমাজ এবং মানুষের প্রতি সংবেদনশীল থাকেন, তাদের উন্নয়নের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি ১৯৮৮ সালে ভারতের জেলখানায় দাগী আসামীদের মধ্যে একটি জরিপ চালিয়েছিল। জরিপের যে ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল, তা ছিল অবাক করার মতো। দেখা গিয়েছে, আসামীদের শতকরা ১০০ জনই ঈশ্বর এবং কোনো না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী। আমেরিকায়ও এরকম একটি জরিপ চালানো হয়েছিল ৫ ই মার্চ, ১৯৯৭ তারিখে। সে জরিপে দেখা গেছে যে। আমেরিকার জনসাধারণের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ (৮-১০৪) ধর্মহীন হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে অপরাধ-প্রবণতা কম, সে তুলনায় ধার্মিকদের মধ্যে শতকরা হিসেবে অপরাধ-প্রবণতা অনেক বেশি। ফেডারেল ব্যুরোর দেয়া পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় জেল হাজতে নাস্তিকর মাত্র ০.২ ভাগ, বাকিরা সবাই ধার্মিক। আমি জানি, আজ বাংলাদেশে জরিপ চালালেও ভারতের মতোই ফলাফল পাওয়া যাবে। ঈশ্বরে বিশ্বাস, পরকালে বিশ্বাস, বেহেস্তের লোভ বা দোজখের ভয় কোনোটাই কিন্তু অপরাধীদের অপরাধ থেকে নিবৃত্ত রাখতে পারে নি। আল্লাহর গোনাহ কিংবা ঈশ্বরের ভয়েই যদি মানুষ পাপ থেকে, দুর্নীতি থেকে মুক্ত হতে পারত, তবে তো বাংলাদেশ এতদিনে বেহেস্তে পরিণত হতো। অথচ বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বরাবরই থাকে তালিকার শীর্ষে। এই তো ধর্মপ্রাণ, আল্লাহ-খোদায় বিশ্বাসী বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা। অপরদিকে সুইডেন কিংবা ডেনমার্কের মতো ঈশ্বরবিহীন দেশগুলোর দিকে তাকালে বুঝতে পারি আমাদের দেশের ধর্মকেন্দ্রিক নৈতিকতার কলসিটা কতটা ফাঁপা।

দেশে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হয়েছে সম্প্রতি। কাদের মোল্লা, নিজামী, গোলাম আজম, সাকা চৌধুরী কিংবা বাচ্চু রাজাকারের মতো মানুষেরা আমাদের বারবারেই মনে করিয়ে দেয়, যে ধর্মকে নৈতিকতার উৎস বলে মনে করা হয়, সেই ধর্মের নামে মানুষেরা কতটা নৃশংস হয়ে উঠতে পারে সুযোগ পেলেই। একাত্তরে রাজাকারদের কাজকর্ম আমাদের অনেক সময়ই চোখ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মানবিকতার চেয়ে ধর্মের সৈনিকদের কাছে ধর্মবোধটাই বড় হয়ে দাঁড়ায়। শুধু একাত্তর তো কেবল নয়, বছর কয়েক আগে গুজরাটে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দাঙ্গা, আর তারও আগে অযোদ্ধায় বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে শিবসেনাদের তাণ্ডব নৃত্য ধর্মের তথা বিশ্বাসের ভাইরাসগুলোর ভয়াবহ রূপটিকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

.

ভাইরাস মুক্ত জীবন :এক চলমান যাত্রাপথের নাম

যে কোন ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য গড়ে তোলা দরকার ‘এন্টিবডি’, সহজ কথায় তৈরি করা দরকার ভাইরাস-প্রতিষেধকের। আর এই সাংস্কৃতিক ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে পারে আমার-আপনার মত বিবেকসম্পন্ন প্রগতিশীল মানুষেরাই। আমি কিন্তু আসলেই মনে করি এই এন্টিবডি তৈরি করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সামাজিক সচেতনতা। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান মনস্ক, যুক্তিবাদী সাইটগুলোর বড় সড় ভূমিকা আছে। ভুমিকা রাখতে পারে বিশ্বাসের নিগড় থেকে বেরুনো মানবতাবাদী গ্রুপগুলো এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী ব্যক্তিবর্গ। দরকার সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার, দরকার খোলস ছেড়ে বেরুনোর মত সৎ সাহসের, দরকার আমার আপনার সকলের সামগ্রিক সদিচ্ছার। আপনার আমার এবং সকলের আলোকিত প্রচেষ্টাতেই হয়ত আমরা একদিন সক্ষম হব সমস্ত বিশ্বাস-নির্ভর ‘প্যারাসাইটিক’ ধ্যান ধারণাগুলোকে তাড়াতে, এগিয়ে যেতে সক্ষম হব বিশ্বাসের ভাইরাসমুক্ত নীরোগ সমাজের অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে।

প্রিয় ব্যক্তিত্ব রবার্ট গ্রিন ইঙ্গারসোলের একটি উক্তি দিয়ে শুরু হয়েছিল আমার এই বইটি– ‘বিশ্বাসী মন খাঁচায় বন্দি পাখি, আর মুক্তমন যেন মুক্ত বিহঙ্গ— ঘন মেঘের পর্দা ভেদ করে উড়ে চলা অবিশ্রান্ত এক ডানামেলা ঈগল’। বিশ্বাসের ভাইরাসের কুফলগুলো বোঝার পর বোধ হয় কারোরই এ বিষয়ে সন্দেহ থাকা উচিৎ নয়। বইয়ের শেষ প্রান্তে এসে আমরা আবারো সেই ইঙ্গারসোলের শরণাপন্ন হব। ইঙ্গারসোল ছিলেন পেশায় আইনজীবী, অসাধারণ বাগ্মী, এবং উনবিংশ শতকের প্রখ্যাত অজ্ঞেয়বাদী মুক্তচিন্তক। Ingersoll’s Vow’ নামে ইঙ্গারসোলের ছোট একটা রচনা আছে, যেটা আমার খুব প্রিয়[২১১]। সে লেখাতে ইঙ্গারসোল ব্যক্ত করেছেন, যখন তিনি সকল বিশ্বাসের ভাইরাস থেকে মুক্ত হয়ে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছিলেন চারপাশের সবকিছুই প্রাকৃতিক, ঐশ্বরিক কিছু নেই, তখন কী ভীষণ আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল তার মন। রায়হান আবীর তাঁর ‘মানুষিকতা’ গ্রন্থে সে অংশটির অনুবাদ সংকলিত করেছিলেন ‘ইঙ্গারসোলের প্রতিজ্ঞা শিরোনামে, যেটি সবসময়ই আমার কাছে এক অনাবিল প্রেরণার উৎস[২১২]।

‘যেদিন নিশ্চিতভাবে বুঝে গেলাম আমার চারপাশের সবকিছুই প্রাকৃতিক, সকল দেবতা, অপদেবতা কিংবা ঈশ্বর মানুষের সৃষ্ট পৌরাণিক চরিত্র ব্যতীত কিছুই নন, সেদিন সত্যিকারের স্বাধীনতার তীব্র আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছিল আমার মন, শরীরের প্রতিটি কণা, রক্তবিন্দু, ইন্দ্রিয়। আমাকে সীমাবদ্ধ করে রাখা চার দেয়াল টুকরো টুকরো হয়ে মিশে গেল ধুলোয়, আলোর স্রোতে আলোকিত হয়ে গেল আমার অন্ধকূপের প্রতিটি কোণ। সেদিন থেকে আমি কারও চাকর, সেবক বা বান্দা নই। এই পৃথিবীতে আমার কোনো মনিব নেই, আমার কোনো মনিব নেই এই সীমাহীন মহাবিশ্বেও।

আমি স্বাধীন, মুক্ত– চিন্তা করতে, চিন্তারাজি প্রকাশে, আদর্শ নির্ধারণে, ভালোবাসার মানুষদের সঙ্গী করে নিজের মতো বাঁচতে। আমি স্বাধীন আমার মানসিক এবং শারীরিক ক্ষমতা ব্যবহারে, প্রতিটি ইন্দ্রিয় দিয়ে কল্পনার ডানা। মেলে উড়ে যেতে, নিজের মতো স্বপ্ন দেখতে, আশা করতে। আমি স্বাধীন– নিজের মতো ভাবতে। আমি স্বাধীন– নির্দয়, উগ্র ধর্মকে অস্বীকার করতে। আমি স্বাধীন– অসভ্য, মূখের ‘অলৌকিক’ গ্রন্থসমূহ এবং এগুলোকে পুঁজি করে ঘটা অসংখ্য নিষ্ঠুরতাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে। আমি স্বাধীন অসংখ্য মহাজাগতিক মিথ্যা থেকে, স্বাধীন সীমাহীন শাস্তির ভীতি থেকে, আমি স্বাধীন ডানাওয়ালা ফেরেশতা থেকে, শয়তান থেকে, জ্বিন-ভূত এবং ঈশ্বর থেকে। জীবনে প্রথমবারের মতো আমি স্বাধীন।

আমার চিন্তার রাজ্যে সেদিন থেকে নেই আর কোনো নিষিদ্ধ জায়গা, নেই কোনো অশরীরী শৃঙুলি যা বেঁধে রাখে আমার অবয়বকে, আমাকে রক্তাক্ত করার জন্য নেই কোনো অলৌকিক চাবুক, আমার মাংসের জন্য নেই কোনো আগুন। আমার মাঝে নেই ভয়, আমার মাঝে নেই অন্যের দেখানো পথে হাঁটার দায়বদ্ধতা, আমার প্রয়োজন নেই কারও সামনে অবনত হওয়া, কাউকে পূজা করা, আমার প্রয়োজন নেই মিথ্যে কথা বলারও। আমি মুক্ত। ভয়-ভীতি, মেরুদণ্ডহীনতা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সেদিন আমি প্রথমবারের মতো উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, জগতকে নতুন করে দেখার, ভাবার চেতনা নিয়ে।

আমার অন্তর সেদিন কৃতজ্ঞতায় ভরে গিয়েছিল। আমি কৃতজ্ঞতা বোধ করেছিলাম ইতিহাসের সেই সব নায়কদের প্রতি, মানুষের প্রতি যারা নিজের জীবন বিপন্ন, বিসর্জন করেছিল মানুষের হাত এবং মস্তিষ্কের স্বাধীনতা যুদ্ধে। আমি ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম পৃথিবীর আলোকিত সকল সন্তানদের, যাদের কেউ আত্মাহুতি দিয়েছিল মুখের সাথে যুদ্ধে, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিল অন্ধ প্রকোষ্ঠে আ-বদ্ধাবস্থায়, যাদের মাংস পুড়েছিল ধর্মান্ধদের আগুনে। আলোকিত সেইসব সাহসী মানুষেরা, যারা এসেছিল পৃথিবীর আনাচে-কানাচে, যাদের চিন্তায়-কর্মে স্বাধীনতা পেয়েছে মানুষের সন্তানেরা। অতঃপর আমি নিচু হলাম, যে আলোর মশাল তারা জ্বালিয়েছিলেন সে আলোর মশাল তুলে নিলাম নিজের হাতে, উঁচু করে তুলে ধরলাম সেটা, এ আলো নিশ্চয়ই একদিন জয় করবে সকল অন্ধকার।

ড.ডেরেল রে যে কথাগুলো বলে তার ‘গড ভাইরাস’ বইটি শেষ করেছেন, সে কথাগুলো উচ্চারণ করে আমিও সমাপ্তি টানবো আমার এই বিশ্বাসের ভাইরাস বইটির[২১৩]–

 ‘ভাইরাস মুক্ত জীবনের আস্বাদন কোন সুনির্দিষ্ট গন্তব্য নয়, বরং একটি চলমান যাত্রাপথের নাম। আমরা সবাই এই ভাইরাস দিয়ে কোন না কোন ভাবে আক্রান্ত, এবং আমরা নিজেদের অজান্তেই বয়ে নিয়ে যাই অসুস্থ বিশ্বাস, মতামত কিংবা ধারণা। আমাদের অনেকের মাথাই আক্রান্ত করে ফেলা হয়েছে আমাদের শিশু বয়সেই আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের পানপাত্র হাতে তুলে দিয়ে। আক্রান্ত মননকে প্রতিষেধক দিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ করে ফেলাই হবে আমাদের যাত্রাপথের লক্ষ্য। আমরা যদি বিশ্বাসের ভাইরাসের কুফলগুলো সম্বন্ধে সর্বদা সচেতন থাকতে পারি, তবেই আমরা ভাইরাস মুক্ত সমাজ প্রত্যাশা করতে পারি।

আর সেটা যদি আমরা পারি, তাহলে ইঙ্গারসোলের মতোই আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে। পারব, এ আলো একদিন জয় করবে সকল অন্ধকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *