২. বিশ্বাসের ভাইরাস : থাবা বাবার রক্তবীজ

০২. বিশ্বাসের ভাইরাস : থাবা বাবার রক্তবীজ

শাহবাগ আন্দোলন এবং কাদের মোল্লার ফাঁসি

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। কাদের মোল্লা সহ সকল যুদ্ধাপরাধীদের সঠিক বিচারের প্রত্যাশায় শাহবাগ তখন উত্তাল। শুরুটা হয়েছিল কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লার রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। শতাধিক হত্যা ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী ছয়টি অভিযোগে কাদের মোল্লার জড়িত থাকার বিষয়গুলো ‘সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও মাননীয় আদালত ফাঁসি না দিয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন।

কাদের মোল্লার এ রাযের খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুক ও ব্লগসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফুঁসে ওঠে অনলাইন ব্লগার এবং অ্যাক্টিভিস্টরা। তাদের মাধ্যমেই সূচনা হয় এক অবিস্মরণীয় মহাজাগরণের।

কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি নিয়ে ‘ব্লগার এন্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক’র ব্যানারে ওইদিন বিকেলেই শাহবাগে জড়ো হয় একদল তরুণ। আর এ খবর ছড়িযে পড়লে তাদের দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ একত্রিত হতে শুরু করে শাহবাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্ররা দলে দলে যোগ দিতে থাকেন শাহবাগে। আশেপাশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও শিক্ষার্থীরা ছুটে যান শাহবাগে। ছুটে যান নারীরা। ধীরে ধীরে এই আন্দোলনের জোয়ার ঢাকা শহরকে অতিক্রম করে যায়। কাদের মোল্লাসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ছাত্রজনতাসহ সর্বস্তরের মানুষের টানা গণ অবস্থান শুরু হয় সেখানে।

সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সে খবর ছড়িয়ে পড়ে সব জায়গায়। দ্রুতই শাহবাগের জনসমাবেশ পরিণত হয় এক বিশাল জনসমুদ্রে। সকল শ্রেণির মানুষের পাশাপাশি এ আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী মহল সহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

ছবি। পেজ ৫১

চিত্র: শাহবাগ আন্দোলন : কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের দাবীতে অনলাইন ব্লগার এবং অ্যাক্টিভিস্টরা সূচনা করেছিল এক অভূতপূর্ব গণজাগরণের।

একাত্তরের জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা শাহবাগের এ আন্দোলনকে আখ্যায়িত করেন ২য় মুক্তিযুদ্ধ’ হিসেবে এবং তরুণদের আখ্যায়িত করেন, “২য় প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। শাহবাগ নামাঙ্কিত হয় ‘প্রজন্ম চত্বর’ হিসেবে। ১৪ই ফেব্রুয়ারি তরুণদের এ অবস্থানের নাম দেওয়া হয় ‘গণজাগরণ মঞ্চ। দেশীয় মিডিয়াগুলো সহ আন্তর্জাতিক সকল মিডিয়াও ফলাও করে প্রচার করে শাহবাগের এই ‘গণজোয়ার’-এর খবর।

এদিকে কয়েক লাখ লোকের এ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় ট্রাইব্যুনালের আইন নিয়ে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস) আইনে আদালতের দণ্ডাদেশের পর আসামি পক্ষের আপিলের সুযোগ থাকলেও বাদীপক্ষ বা সরকারের আপিলের সুযোগ ছিল না। আইনের এ ‘মারাত্মক ত্রুটি’ ও ‘অসম সুযোগ পরিবর্তন করার দাবি জানায় গণজাগরণ মঞ্চ।

এ জন্য রাজপথে আন্দোলনের পাশাপাশি তারা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে। এরপর সরকারও এ আইন সংশোধনে উদ্যোগী হয়। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে সরকারের আপিলের সুযোগ রেখে ১৭ই ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) সংশোধন বিল ২০১৩ জাতীয় সংসদে পাস হয়। এ আইন পাস হওয়ায় কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এর ধারাবাহিকতায় ১৭ই সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে (৪:১) আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেন।

তবে ফাঁসির দণ্ডাদেশ হলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে কম নাটক হয়নি। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৩ সালের ৫ই ডিসেম্বর। এই রায়ের অনুলিপি সুপ্রিম কোর্ট থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। গত ৮ই ডিসেম্বর বিকেলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু ঘোষিত সময়ের দেড় ঘন্টা আগে হঠাৎ করেই কাদের মোল্লার ফাঁসির কার্যক্রম স্থগিত করেন চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তিনি ১১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ফাঁসির কার্যক্রম স্থগিত করে বিষয়টি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান। এভাবে ফাঁসি শেষ মুহূর্তে স্থগিত করে শুনানির জন্য পাঠানোর ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একেবারেই ‘তুলনারহিত’ বলা চলে। অনেকের হৃদযেই বাজছিল দুরাশার অশনি সংকেত।

কিন্তু সেই অশনি সংকেতকে মিথ্যে প্রমাণ করে শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দেন। এর ফলে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে আইনগত আর কোনো বাধা থাকলো না।

বৃহস্পতিবার রাত ১০টা এক মিনিটে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। শাহবাগ আন্দোলনের সূচনা না হলে কাদের মোল্লার ফাঁসি আমরা দেখতে পেতাম না, এ কথা আজ নির্দ্বিধায় বলা যায়। সেই শাহবাগ আন্দোলনেরই এক উদ্দীপিত তরুণ ছিলেন। রাজীব হায়দার, অনলাইনে যার পরিচয় ছিল ‘থাবা বাবা’ নামে। থাবা বাবাদের মত তরুণদের কারণেই শাহবাগ আন্দোলন সফল হতে পেরেছে এটা বোধ হয় অতিশয়োক্তি নয়।

.

বিজয়ের এই দিনে, থাবা তোমায় মনে পড়ে

কাদের মোল্লার ফাঁসির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, তা থাবা বাবা দেখে যেতে পারেননি। তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল ১৫ই ফেব্রুয়ারি। আগেই বলেছি, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগের গণজাগরণ চত্বরের গণআন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন। তিনি শুধু একজন ব্লগারই ছিলেন না, পেশাগত জীবনে ছিলেন স্থপতি। তার অপরিসীম মেধার স্বাক্ষর হয়ে থাকবে ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধের নকশা’ যা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়েছে[৪৬]।

রাজীবকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পল্লবী থানার পলাশনগরের বাড়ির অদূরে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

ছবি। পেজ ৫৩

চিত্র: রাজীব হায়দার, যার মত অ্যাক্টিভিস্টদের কারণে শাহবাগ আন্দোলন সফলতার মুখ দেখেছে।

কারা খুন করেছিল রাজীবকে? কেন? রাজীবকে হত্যার চার দিন আগে জামাতি ব্লগ বলে পরিচিত (অধুনা বিলুপ্ত) সোনার বাংলা ব্লগে ‘থাবা বাবা’ তথা রাজীবের নামে উস্কানিমূলক পোস্ট দেয়া হয়েছিল। এমনকি রাজীব মারা যাবার পরেও শাফিউর রহমান ফারাবী নামে এক হিযবুত তাহরীরের প্রাক্তন সদস্য ফেসবুকে তার স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন এই বলে, যেই ইমাম থাবা বাবার (রাজীব) জানাজা পড়াবে, সেই ইমামকেও হত্যা করা হবে।’

আরো পরিষ্কার উত্তর পাওয়া গেল মার্চ মাসের ২ তারিখে যখন রাজীব হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে প্রখ্যাত বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন ছাত্র ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দ্বীপ, মাকসুদুল হাসান অনিক, এহসান রেজা রুম্মন, নাঈম সিকদার ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজকে আটক করা হল। তারা পাঁচজনই এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়ার কথা স্বীকার করেছিলেন। নর্থ সাউথের আরেক ছাত্র সাদমান ইয়াছির মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয় ১৪ অগাস্ট রাজধানীর ধানমণ্ডি থেকে। তিনিও রাজীব হত্যায় জড়িত ছিলেন বলে পুলিশ দাবী করেছে। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ব্লগার রাজীবকে হত্যা করেছে বলে পত্রিকায় এসেছে। এদের নির্দেশদাতা ছিলেন শিবেরের ‘বড় ভাই রেজওয়ানুল আজাদ রানা। তিনি অবশ্য এখনো পলাতক। সম্প্রতি (এ বছরের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে) ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসীমউদ্দিন ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাত শিক্ষার্থীসহ মোট আটজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। পুলিশের অভিযোগে বলা হয়েছে— “আটক থাকা সাতজনসহ মোট আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে চার্জশিটে। এর মধ্যে অভিযুক্ত মুফতি মো: জসিমউদ্দিন রহমানী জঙ্গী এবং উগ্র তৎপরতার সাথে জড়িত ছিলেন। এই জসিমউদ্দিন রহমানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে দু’টি মসজিদে জুম্মার নামাজের আগে খুতবা দিতেন এবং তিনি ধর্মবিরোধী ব্লগারদের হত্যার ফতোয়াও দিতেন। অন্য আসামীরা সবাই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং তারা ঐ খুতবা শুনতে যেতো। এভাবে তাদের মধ্যে একটা যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল।”

ছবি। পেজ ৫৪

চিত্র: রাজীব হত্যায় গ্রেফতারকৃত আসামীরা। ‘ঈমানী দায়িত্ব পালনের জন্য এই হত্যাকাণ্ড’ তারা ঘটিযেছে বলে তারা স্বীকার করেছিল পত্রিকায়।

রাজীব মারা যাবার পর পরই আমি একটি পত্রিকায় লেখা লিখেছিলাম— কেন কেবল তারাই আক্রান্ত হচ্ছেন?” শিরোনামে[৪৭]। সে লেখায় আমি অনুমান করেছিলাম যে মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং মুক্তমত প্রকাশের কারণেই রাজীব ধর্মান্ধ শক্তির উষ্মার কারণ হয়েছেন, তিনি আক্রান্ত হয়েছেন এবং তাকে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে, ঠিক যেমনিভাবে ঘাতকাহত হয়ে প্রলম্বিত মৃত্যুর দিকে চলে যেতে হয়েছিল প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদকে। আমার অনুমান যে মিথ্যা ছিল না তা ধরা পড়ার পর অভিযুক্তদের স্বীকারোক্তিতে প্রমাণ পাওয়া যায়। অভিযুক্ত আততায়ীদের বিভিন্ন ব্লগের ঠিকানা এবং ব্লগ থেকে ডাউনলোড করে তথ্য দিয়ে প্ররোচিত করেন শিবিরের এক ব্যক্তি। রাজীবের লেখা তাদের ধর্মানুভূতি’কে আহত করেছিল, তাই ‘ঈমানী দায়িত্ব পালনের জন্য এই হত্যাকাণ্ড’ তারা ঘটিয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উগ্রবাদী আচরণের নিদর্শন এটাই প্রথম নয়। বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস নামের যে ছেলেটি গত বছরের নভেম্বর মাসে নিউইয়র্কে বোমা হামলা করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল, সেই ছেলেটিও বাংলাদেশে থাকাকালীন সময়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। এখন রাজীবের হত্যাকারীরাও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ায় এ প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে— কেন নর্থ সাউথের মত বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে মূলত উচ্চমধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ছেলে মেয়েরা পড়তে যায় বলে সার্বিকভাবে অনুমিত হয়, সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি জঙ্গিবাদের প্রজনন-ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে? ডাল কুছ মে কালা হ্যায়?[৪৮]

নর্থ সাউথ এর ব্যাপারে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ খবর নিতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য পেয়েছিলাম সে সময় বেশ কিছু পত্রিকার (যেমন ৩ মার্চ, ২০১৩ জনকণ্ঠ দ্রঃ) খবরেই এসেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত উগ্রপন্থী দল হিযবুত তাহরীরের আস্তানায় পরিণত হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি[৪৯]। অনেকেই হয়তো জেনে অবাক হতে পারেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীর ও শিবিরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি সক্রিয় থাকা দেশের একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে নর্থ সাউথ। এর পেছনে শক্তি হিসেবে কাজ করছে বিশ্ববিদ্যালযেরই শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন শিক্ষক-পরিচালনা পরিষদের কর্মকর্তা। বাইরে থেকে একটা ‘সুবেশিত এবং আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেজ তৈরি হলেও দিনের পর দিন জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ট্রাস্টি বোর্ডের দুই সদস্য ও পাঁচ শিক্ষকের প্রত্যক্ষ মদদে উগ্র মৌলবাদীদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি এমন আলামত বেরিয়ে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পাঠচক্রের আড়ালে নিয়মিতভাবে হয় শিবির ও হিযবুত তাহরীরের ‘ঐক্যবদ্ধ বৈঠক’। এর পেছনে শক্তি হিসেবে কাজ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়েরই শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন শিক্ষক-পরিচালনা পরিষদ কর্মকর্তা। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই অংশটি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে হিযবুত তাহরীর লালনকারী হিসেবে পরিচিত একজন শিক্ষককে ২০ লাখ টাকা বেতনে উপাচার্য হিসেবে নিযোগের চেষ্টা চালায়[৫০]। জানা গেছে, হিযবুত তাহরীর নামে জঙ্গিবাদের বিস্তার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি বেশ কিছুদিন ধরেই গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৯২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে হিযবুত তাহরীরের বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা ভিসি ছিলেন বিএনপি মতাদর্শী অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল আহাদ। উদ্যোক্তা হিসেবে আরও ছিলেন শায়েস্তা আহমদ, ব্যবসায়ী নুরুল এইচ খান, মাহবুব হোসেন ও জামায়াতের নীতিনির্ধারক সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান। এই শাহ আবুল হান্নান ইন্টারনেটে (বিভিন্ন ফোরাম এবং ইয়াহু এবং গুগল গ্রুপে) ‘জামাতি প্রোপাগান্ডা চালানোর কাজে সদা তৎপর। তার সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারসহ অনেক সিনিয়র নেতার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। শাহবাগ আন্দোলন চলাকালীন সময় শাহ আব্দুল হান্নান, এমবি আই মুন্সি এবং শমশের মোবিন চৌধুরীর একটি কথোপকথন ইন্টারনেটে ফাঁস হয়ে যায়। BJI International Relations (বাংলাদেশ জামাতে ইসলামী ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস) এর গ্রুপ ইমেইল চালাচালিতে এই জামাতি মতাদর্শের সৈনিকেরা শাহবাগ আন্দোলনকে ‘ফ্যাসিবাদী আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করেন। ব্যাপারটা খুবই তাৎপর্যময় এজন্য যে, আমার দেশ’ জামাতে ইসলামীর প্রপাগান্ডিস্ট এম বি আই মুন্সি এবং হান্নান শাহ-এর লাইনগুলোই হুবহু টুকে নিয়ে এর পর দিন পত্রিকার শিরোনাম করেছিল ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’ শিরোনামে। এ নিয়ে (অধুনা পরলোকগত) নিউ অরলিন্স প্রবাসী গবেষক ড. জাফর উল্লাহ তাঁর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে এই জামাতি-ত্রয়ীর গুমোর ফাঁস করে দেন মুক্তমনার ইংরেজি ব্লগে[৫১]। এই শাহ হান্নানের মত মৌলবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী উগ্রপন্থী মানুষ কিভাবে বিশ্ববিদ্যালযের ট্রাস্টি বোর্ডের দায়িত্ব পেতে পারেন তা আমার বোধগম্য নয়।

যা হোক, শায়েস্তা আহমদ, নুরুল এইচ খান, মাহবুব হোসেন ও শাহ আবদুল হান্নানের সুপারিশে এবং প্রভাবে প্রথম থেকেই বিএনপি-জামায়াত মতাদর্শের শিক্ষকেরা নিযোগ লাভ করে। প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক হাফিজ জিএ সিদ্দিকী রাজনৈতিক ভাবে জামাত মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন বলে পত্রিকায় এসেছে (পরে গত বছর অস্থায়ী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সাত্তার)। জামাত এবং হিযবুত তাহরীর কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার মানসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ড. মঞ্জুরুল হক খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার কথাও শোনা গেছে। মাঝখানে খবর এসেছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের ভাগ্নে ও সাবেক ইসলামী ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় নেতাকে উপাচার্য বানাতে চাচ্ছিলেন[৫২]। কিন্তু নাফিসের ঘটনার পর সাধারণ শিক্ষকদের চাপে সেটা তাদের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। হয়নি। এর আগে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সে সময়কার উপাচার্য হাফিজ জিএ সিদ্দিকী বিশ্ববিদ্যালয়ে হিযবুত তাহরীরের জঙ্গি কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ড. মঞ্জুরুল হক, কতিপয় শিক্ষক ও পরিচালনা পরিষদ সদস্যদের নিয়ে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছিলেন। পরিচালনা পরিষদের তিন সদস্যের বিরুদ্ধে হিযবুত তাহরীরের কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোত জড়িত থাকার বিষয়টি খুব পরিষ্কার বলে জানা যায়। শাহ আবুল হান্নানের মতোই আরেক হান্নান (ড. আব্দুল হান্নান চৌধুরী) রযেছেন নর্থ সাউথের শিক্ষক হিসেবে; এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ প্রোগ্রামের পরিচালক হিসেবে কাজ করছিলেন এবং বর্তমানে স্কুল অব বিজনেসের ডিন হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। তিনি জামায়াতের অন্যতম নীতিনির্ধারক হিসেবে পরিচিত। এছাড়া জামাতি মতাদর্শের আরেক প্রভাবশালী শিক্ষক ড. গোলাম মোহাম্মদের কথাও ২০১০ সালের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এসেছিল যিনি অর্থনীতির শিক্ষক হলেও মূলত ছাত্রছাত্রীদের হিযবুত তাহরীরের আদর্শ প্রচারে তৎপর ছিলেন। এই স্বনামধন্য শিক্ষকের বিরুদ্ধে তার নিজের স্ত্রীই ২০০৪ সালে নারী নির্যাতন মামলা করেছিলেন বলে জানা গেছে (তিনি ২০১১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেছেন)। শেখ তৌফিক নামে আরেক শিক্ষক যিনি অ্যাকশন এইড নামের এনজিওর সাথে জড়িত ছিলেন, এবং বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক কর্মরত আছেন, তিনি হিযবুত তাহরীরের নীতি গবেষণা কেন্দ্রের ট্রাস্টি এবং রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত। এরা সবাই মিলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি করেছে এক জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্য। ২০১৩ সালের মার্চ মাসের তিন তারিখে প্রথম আলো পত্রিকাতেও এইসব গুণধর শিক্ষকদের নাম উহ্য রেখে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে—’কিছু শিক্ষকের ছায়ায় জঙ্গি হচ্ছেন নর্থ সাউথের ছাত্ররা শিরোনামে[৫৩]।

এ ধরণের অভ্যারণ্য তৈরির খেসারত হিসেবে এখানে নিয়মিতভাবে দেখা গেছে উগ্রপন্থী ছাত্রদের নানামুখী বিচরণ। দৈনিক সমকালে সম্প্রতি প্রকাশিত লোমহর্ষক বর্ণনা দিল ঘাতকরা শিরোনামের লেখাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে রাজীব হত্যার সাথে জড়িত দুইজনের সঙ্গে হিযবুত তাহরীরেরও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। ওই দু’জনের পরিবারও ডিবিকে জানিয়েছেন, তাদের সন্তান হিযবুতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ওই দু’জনের বাসা থেকেও হিযবুতের মতাদর্শের বিভিন্ন জিহাদি বইপত্র পাওয়া গেছে। বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, জামায়াতের প্রত্যক্ষ মদদে জেএমবি ও হুজি সৃষ্টি হয়েছিল। এ দু’টি দল নিষিদ্ধ হলে জামায়াত আন্তর্জাতিক মানের জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর গঠনে মদদ যোগানো শুরু করে। হিযবুত তাহরীরের নেতাকর্মীদের শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগই ছাত্রশিবিরের সদস্য বলে জানা গেছে।

এ সময়ই আলোচনায় উঠে আসে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ নামে নতুন উগ্রবাদী সংগঠনের কথা। মূলত ছাত্রশিবির ও হিযবুত মিলে গঠিত এ দলটির সদস্যরা রাজীব হত্যায় ইন্ধন যুগিয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে[৫৪]। একটা সময় পর বাংলাদেশ সরকার আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মূল হোতা মুফতি জসিমউদ্দীনসহ তার ত্রিশ জন অনুসারীকে গ্রেফতার করে। মুফতি জসিমউদ্দীন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদে লিপ্ত হতে বাংলাদেশী তরুণদের উস্কানি দিত এবং এই কাজে মসজিদ ও মাদ্রাসার মত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করতো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এ সময় বিভিন্ন আলোচনায় উঠে আসতে থাকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামাজ ঘরটি নাকি জঙ্গি সদস্য নিয়োগের আখড়া হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পত্রিকাতেই এসেছে রাজীব হত্যাকারীরা একে অপরের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন সেখানেই। শুধু ছেলেদের নামাজ ঘরটিই নয়, একই ভাবে জঙ্গি মনন চাষাবাদে ব্যবহৃত হচ্ছিল মেয়েদের নামাজের ঘরটিও। সে সময় সচলায়তন ব্লগে নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি’ শিরোনামের একটি লেখা লিখেছিলেন, যেখানে তিনি নিজের স্ত্রীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়কার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেন এভাবে—

“মেয়েদের নামাযের ঘরে নিয়মিত বোরকায় আবৃত এক বা একাধিক মেয়ে গোল হয়ে বসে অন্যান্য সাধারণ মেয়ে যারা নামায পড়তে আসে তাদের নিয়ে আলোচনা সভা করে। আপাত দৃষ্টিতে এ ধরনের সভা করা খারাপ কিছু না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই সভাগুলো একটা সময় সাধারণ ছাত্রীদের ব্রেইন ওয়াশের ক্ষেত্র হয়ে উঠে। আমার স্ত্রী প্রথমে কৌতূহল বশত এবং পরে তাদের আলোচনার ধরন ও প্রকৃতি বোঝার জন্য নামাযের ঘরে নিয়মিত গিয়ে তাদের সাথে মিশে শোনার চেষ্টা করতো তারা কী বলছে। খুব দ্রুতই সে লক্ষ্য করে ঐ নির্দিষ্ট মেয়েদের বক্তব্য এবং দাওয়াত দেয়ার ধরণ জামাত-শিবিরের রাজনীতির সাথে হুবহু মিলে যায়। ঐ মেয়েগুলো সাধারণ ছাত্রীদের সাথে প্রথমে মিষ্টি ভাষায় কথা শুরু করলেও ধীরেধীরে তাদের উগ্র মতবাদ চাপিয়ে দিতে শুরু করে। আমার স্ত্রীর মুখে শুনেছি, মানুষকে কনভিন্স করার ভয়াবহ ক্ষমতা রয়েছে এই মেয়েগুলোর মাঝে। তাদের ধৈর্য অপরিসীম। এভাবে দিনের পর দিন ব্রেইন ওয়াশের ফলে তারা এক সময় ঠিকই তাদের দল ভারী করতে সক্ষম হচ্ছে। সব কথা উন্মুক্ত ব্লগে লেখা সম্ভব না। শুধু এতটুকু বলবো, আমার স্ত্রীর কিছু বান্ধবী যারা এক সময় আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতই উচ্ছল ছিল, আজ এদের সাথে মিশে পুরোপুরি বদলে গেছে। ফেসবুক থেকে তারা নিয়মিত ছড়াচ্ছে। ঘৃণা আর উগ্রবাদ।”।

নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনার অভিযোগে নর্থ সাউথের কামেল প্রাক্তন ছাত্র কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান (যার কথা প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে) কিংবা রাজীব হত্যায় জড়িত নর্থ সাউথের ছাত্রদের মুখগুলোর দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ কত প্রকটভাবে মস্তিষ্ককে অধিকার করে ফেলতে পারে, যার ফলে একজনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে খুন করতেও তাদের বাধে না, বরং এটাকে তারা ‘ঈমানী দায়িত্ব বলে মনে করে।

আমরা আগের অধ্যায়ে ল্যাংসেট ক্ষুক নামে প্যারাসাইটের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। পিপড়ার মগজে থাকা ল্যাংসেট ক্ষুক নামে এক ধরনের প্যারাসাইটের সংক্রমণে পিপড়ারা কেবল পাথরের গা বেয়ে উঠানামা করতে থাকে কলুর বলদের মতো। সেই একই অধ্যাযে আমরা জেনেছিলাম নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্মের কথাও। এদের প্রভাবে ঘাস ফড়িং পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। আর জলাতঙ্ক রোগের প্রভাবে মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার উদাহরণ তো কমবেশি সবারই জানা।

রাজীবকে হত্যার বিবরণ পড়লে হতবাক হতে হয়, কিভাবে তাদের মস্তিষ্ক ব্রেন ওয়াশড’ হয়েছে প্যারাসাইটিক জিহাদি ধারণা দিয়ে। তারা রাজীবকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে ‘ইনটেল গ্রুপ গঠন করেছিল। এই দলের কাজ ছিল ব্লগ ও ফেসবুক থেকে তাঁর সম্পর্কে নানা তথ্য সংগ্রহ করা ও তাঁর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। আর রাজীবকে হত্যার জন্য তারা তৈরি করেছিল ‘এক্সিকিউশন গ্রুপ’। প্রায় এক মাস তাঁরা রাজীবকে অনুসরণ করেছেন। দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইনটেল গ্রুপের সদস্যরা গত ৯ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে যায় এবং ব্লগার রাজীবকে খোঁজা শুরু করে। এর এক থেকে দুই দিনের মধ্যে রাজীবের বন্ধুদের চিহ্নিত করার মাধ্যমে তারা রাজীবকে চিনতে পারে। এরপর এই দলের সদস্য এহসান রেজা রুম্মন শাহবাগ থেকে সাইকেলে করে রাজীবকে অনুসরণ করে মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত গিয়ে বাসা চিহ্নিত করে আসে। ১৫ ফেব্রুয়ারি দলের সদস্যরা সাইকেল ও বাসে চড়ে বিকেল চারটার দিকে পলাশনগরে রাজীবদের বাসার গলিতে অবস্থান নেয়। সন্ধ্যার দিকে রাজীব বাসার গেটের কাছাকাছি পৌঁছার পর এক্সিকিউশন গ্রুপের সদস্য মো. ফয়সাল বিন নাঈম দীপ, মো. মাকসুদুল হাসান অনিক চাপাতি ও ছোরা দিয়ে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় এবং রাজীবকে নির্মম ভাবে কুপিয়ে হত্যা করে।

ছবি। পেজ ৬০

চিত্র: এভাবেই পড়ে ছিল রাজীব ওরফে থাবা বাবার লাশ

রাজীবের রক্তাক্ত লাশ মাটিতে পড়ে ছিল বহু সময় ধরে। পলাশনগর এলাকায় রক্তমাখা লাশ দেখে স্থানীয় লোকজন রাত ১০টার কিছু পরে থানা পুলিশকে খবর দেয়। এরপরেই ব্যাপারটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

.

ধর্মের প্যারাসাইটিক ধারণাই কি দায়ী নয়?

রাজীবকে হত্যাকারীরা নিজেদের স্বীকারোক্তিতেই বলেছে যে, “ঈমানী দায়িত্ব পালনের জন্য’ রাজীবকে হত্যা করা হয়েছে। তারা যেভাবে কিংবা যে কারণে রাজীবকে হত্যা করেছে, সেটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়, এর সমর্থন খোদ ধর্মগ্রন্থেই আছে, আছে পয়গম্বরদের বিবিধ কাজকর্মে। বহু গবেষকই দেখিয়েছেন যে, ইসলামের সূচনাকালে মহানবী মুহাম্মদ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যেসব সহিংস পন্থা ব্যবহার করেছিলেন, গুপ্তহত্যা ছিল তার অন্যতম। আবু আফাক, কাব ইবনে আশরাফ, আসমা বিন্তে মারওয়ান, আবু রাফে প্রমুখেরা ছিলেন এর অন্যতম শিকার।

আবু আফাক ছিলেন আরবের এক বিখ্যাত বয়োবৃদ্ধ কবি। নবী মুহম্মদ আল হারিথ নামে শত্রুপক্ষের একজনকে অন্যায়ভাবে হত্যার পর আবু আফাক এই কাজের সমালোচনা করে একটি কবিতা লিখেছিলেন। তার অন্য কিছু কবিতাতেও ইসলামের এবং নবীর সমালোচনা ছিল। মুহম্মদের অনুসারীরা যে ধর্মের নামে নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে, তা নিয়ে তিনি ব্যঙ্গ করেছিলেন। ব্যাপারটা নবীর কানে গেলে তিনি অতিশয় বিরক্ত হন, এবং এই কবিকে হত্যার দায়িত্ব দেন তার এক শিষ্যকে। সেলিম বিন উমাযের নামের সেই শিষ্য গিয়ে গভীর রাতে ঘুমন্ত কবি আফাককে হত্যা করে আসে। ইবনে ইসহাকের ‘দ্য লাইফ অব মুহম্মদ’ বইয়ে এই ঘটনার বিবরণ আছে[৫৫। বর্ণনা আছে ইবনে সাদের তাবকাতেও[৫৬]।

আসমা ]বিন্তে মারওয়ান নামের আরেক নারী কবি ছিলেন আরবে সেসময়। আবু আফাককে অন্যায়ভাবে হত্যার পর পাঁচ সন্তানের জননী এই আসমা ভীষণ ক্ষুব্ধ হন এবং এ নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন। যথারীতি এটাও মুহম্মদের পছন্দ হয়নি। তিনি উমাযের বিন আদি আল খাতমি নামের এক শিষ্যকে আদেশ দিলেন আসমাকে হত্যা করার। নবীর নির্দেশে সে রাতেই আসমার বাড়িতে গিয়ে তাকে হত্যা করে আসে উমাযের ইবনে ইসহাকের বর্ণনা থেকে জানা যায়, আসমার ঘরে ঢোকার পর উমাযের দেখতে পায় যে তার এক শিশুপুত্র তার বুকের উপর ঘুমিয়ে আছে। উমাযের অতি সতর্কতার সাথে বাচ্চাটিকে আসমার বুকের উপর থেকে সরিয়ে নিয়ে এতো জোরে আসমার বুকে তলোয়ার চালিয়েছিল যে সেটা তার বুক ভেদ করে তার খাটের সাথে আটকে গিয়েছিল। পরদিন সকালে সে আসমার হত্যার কথা মহানবীকে জানালে, মহানবী উৎফুল্ল হয়ে বলেছিলেন, “হে উমাযের, তুমি আল্লাহ ও তার রসুলকে সাহায্য করেছো।’ এই হত্যার জন্য কোন প্রতিফল বহন করতে হবে কিনা এ প্রশ্ন করলে মুহম্মদ উত্তরে বলেছিলেন, “ঐ মহিলাকে কোন ছাগলেও পুছে দেখবে না”[৫৭]।

কাব ইবনে আশরাফ নামের আরেক তরুণ কবির কথাও জানা যায় ইতিহাস থেকে। কাব ছিলেন একজন ইহুদী কবি ও মহানবীর প্রচারিত ধর্মের এক কঠোর সমালোচনাকারী। বানু নাদির গোত্রের নেতা ছিলেন তিনি। বানু কাইনুকা নামের আরেকটা ইহুদী গোত্রকে মুহম্মদ আক্রমণ করে নির্মমভাবে ধ্বংস করেছিলেন কিছুদিন আগেই। এ দেখে কাব প্রচণ্ড ভাবে বিমর্ষ হন, ক্ষুব্ধ হন, এবং কবিতা লিখে মক্কাবাসীকে নবীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে উৎসাহিত করেন[৫৮]। এর পর কি ঘটেছিল সেটা আল-বুখারীর একটি হাদিস থেকে জানা যায়[৫৯]:

“হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ কাব বিন আশরাফের ব্যাপারে কে আছো? কেননা সে আল্লাহ ও তার রাসূলকে কষ্ট দেয়। তখন মুহাম্মদ বিন মাসলামা দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি চান আমি তাকে হত্যা করি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। বিন মাসলামা আরও বললেন, কাবকে হত্যা করা সম্ভব, কিন্তু তা করার জন্য তাকে মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিতে হবে। নবী কি সেই অনুমতি দেবেন? নবী তাতে অনুমতি দিলেন। তারপর এক রাতে মাসলামা কোন জরুরী বিষয়ে আলোচনার ছুতায় কাবকে তার বাড়ি থেকে বের করে আনার ফন্দি আঁটে। স্ত্রীর বারণ অগ্রাহ্য করে কাব রাস্তায় বেরিয়ে এলে মাসলামার সঙ্গে আসা লুক্কায়িত দুই সহযোগী বেরিয়ে এসে কাবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করে।”

আবু রাফে বিন আবি আল হকাইক ছিলেন খাইবারে বসবাসকারী একজন ইহুদী নেতা, এবং বিখ্যাত ব্যবসায়ী। তিনি কবিতা লিখতেন এবং সেগুলোতে নবীর সমালোচনা থাকতো। মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি নাকি টাকা পয়সা দিয়েও সাহায্য করতেন। এ সমস্ত ‘ইসলামবিরোধী কাজের জন্য খুব সম্ভবত ৫ম হিজরী সনের যুলহজ্জ মাসে মহানবীর আবু রাফেকে হত্যা করা হয়। এই এই অভিযানে পাঁচজন সাহাবীর একটি দল অংশ নিয়েছিল বলে কথিত আছে। তারা হলেন (১) আব্দুল্লাহ ইবনে আতীক, (২) মাসউদ বিন সিনান, (৩) আব্দুল্লাহ বিন উনায়স, (৪) আবু কাতাদা বিন হারিস, (৫) খুযায়ী বিন আল আসওয়াদ (রাঃ)।

সহীহ আল বুখারির একটি হাদিসে আবু রাফেকে হত্যার বিবরণ পাওয়া যায়[৬০]:

“হযরত বারা ইবনে আজেব রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসারদের একটি দলকে ইহুদী আবু রাফে’কে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। তাদের মধ্য থেকে একজন (আবু আতীক রাঃ) এগিয়ে গিয়ে ইহুদীদের দুর্গে প্রবেশ করেন। তিনি বলেন, অতঃপর আমি গিয়ে তাদের পশুর আস্তাবলে প্রবেশ করলাম আর তারা দুর্গের প্রধান ফটক বন্ধ করে দিল। এদিকে তাদের একজনের একটি গাধা হারিয়ে গিয়েছিলো; তারা গাধাটি খুঁজতে বেরিয়ে পড়লে আমিও গাধা খোঁজার ভান ধরে তাদের সাথে বেরিয়ে পড়লাম। আমি তাদেরকে বুঝাতে চাচ্ছিলাম যে আমিও তাদের সাথে গাধা খোঁজ করছি। অবশেষে গাধাটি পেয়ে গেলে তারা যখন দুর্গে প্রবেশ করে তখন আমিও তাদের সাথে আবার দুর্গে প্রবেশ করি।

তারপর আমি লক্ষ করলাম যে তারা দুর্গের ফটক বন্ধ করে চাবিটি একটি কুলুঙ্গির মধ্যে রেখে দিলো। অতঃপর তারা ঘুমিয়ে পড়লে আমি চাবি নিয়ে ফটক খুলে রেখে (অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে) আবু রাফে’র ঘরে গিয়ে পৌঁছলাম। আমি ‘ও আবু রাফে’ বলে ডাক দিলে সে আমার ডাকে সাড়া দিলো। আমি তার আওযাজ দ্বারা তার অবস্থান অনুমান করে তরবারির আঘাত হানলাম, আর। অমনি সে চিৎকার করে উঠলো; আর আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। যেন। তার সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে এসেছে এমন ভান করে আমি আবার ঘরে প্রবেশ করে গলার স্বর পরিবর্তন করে জিজ্ঞাসা করলাম, ও আবু রাফে’ (চিৎকার করলে কেন) তোমার কী হয়েছে?

সে বলল, তোমার মা ধ্বংস হোক (তাড়াতাড়ি আসছো না কেন) কি হল তোমার, কে যেন আমার ঘরে ঢুকে আমাকে আঘাত করেছে। তিনি (আবু আতীক) বলেন, অতঃপর আমি আমার তরবারি তার পেটের উপর রেখে শরীরের সকল শক্তি দিয়ে এমন জোরে চেপে ধরলাম যে তার (মেরুদণ্ডের) হাড্ডি পর্যন্ত গিয়ে ঠেকার শব্দ হল। (এরপর তার চিৎকারে ও বাচ্চাদের কান্নাকাটির শব্দে অন্যরাও জেগে উঠে দরজা খুলতে লাগলো)।

অতঃপর আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে গিয়ে পড়ে গেলাম এবং এতে আমার পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পেলাম। যাই হোক, কোন মতে আমি বেরিয়ে এসে আমার সঙ্গীদের সাথে মিলিত হলাম। আমি তাদেরকে বললাম,

যতক্ষণ পর্যন্ত আমি (আবু রাফে’র) মৃত্যু সংবাদ প্রচারকারীর ঘোষণা শুনতে না পাই ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এ স্থান ত্যাগ করবো না। সত্যিই হিজাযের বিখ্যাত ব্যবসায়ী আবুরাফে’র মৃত্যু সংবাদ না শুনে আমি সে স্থান ত্যাগ করলাম না। মৃত্যু সংবাদ যখন আমি শুনলাম তখন আমি দাঁড়িয়ে গেলাম এবং আমার যেন কোন ব্যথাই ছিলো না। অবশেষে আমি আল্লাহর রসূলের কাছে গিয়ে আবু রাফে’কে হত্যার খবর দিলাম”।

মহানবী কেবল এই চার কবিকেই নয়, আরো অনেককেই বিভিন্ন সময় গুপ্তহত্যার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন যেগুলো কখনো সফল হয়েছিল, কখনো বা ব্যর্থ। যেমন, ওহুদ যুদ্ধের পর পরই মক্কার নেতা আবু সুফিয়ানকে হত্যার জন্য তিনি কিছু সহযোগী পাঠিয়েছিলেন। যদিও তারা ব্যর্থ হয়েছিল এ কাজে, কিন্তু অন্য তিনজন কোরাইশকে গুপ্ত হত্যা করে এসেছিল সে দিন[৬১] নবী তার সমালোচনাকারীদের এভাবে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার নিয়ম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বলবত রেখেছিলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় মহানবীর মৃত্যুর এমনকি একদিন আগেও আইহালা ইবনে কাব (আল-আসওয়াদ’ বা ‘কালো মানুষ’ নামে মুসলিম মধ্যে পরিচিত ছিলেন) নামক এক ইয়েমেনি প্রতিপক্ষকে মুহম্মদের আদেশে হত্যা করা হয়েছিল[৬২]। উইকিইসলাম সাইটে এমন চল্লিশ জনের একটি তালিকা আছে, যাদেরকে হত্যার জন্য নবী মুহম্মদ কখনো না কখনো নির্দেশ দিযেছিলেন, নিজের ক্ষমতার মসনদ সুরক্ষিত রাখার জন্য[৬৩]।

মুহম্মদের পরবর্তীকালের অনুসারীরা মুহম্মদের প্রদর্শিত কাজগুলোই ভাইরাসের মত কপি করে করে একনিষ্ঠভাবে পালন করেছেন বিভিন্ন সময়ে। ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ লেখার অপরাধে সালমান রুশদীকে হত্যার ফতোয়া দেয়া হয়েছিল খোমেনির পক্ষ থেকে ১৯৮৯ সালে। কয়েক বছর আগে আগে ডাচ চলচ্চিত্রকার থিও ভ্যানগগকে ও একইভাবে হত্যা করা হয় ইসলামকে অপমান করার অজুহাতে বাংলাদেশে থাবা বাবার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে বলে আমি মনে করি। এক্ষেত্রে মূল অভিযোগ ছিল অবশ্যই তার ইসলামবিদ্বেষী লেখালিখির ‘নুরানী চাপা’ নামের একটি ওয়ার্ডপ্রেস ব্লগসাইটকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছিল রাজীবের ইসলামবিদ্বেষিতার প্রমাণ হিসেবে। যদিও বিতর্ক করা যেতে পারে থাবা বাবার লেখাগুলোর মান নিয়ে, এমনকি এই ‘নুরানী চাপা সত্যই রাজীবের কিনা সেটা নিয়েও বিতর্ক আছে[৬৪], তারপরেও অভিযোগগুলো যদি সত্যি বলেও ধরে নেই, কেবল লেখার কারণে যেভাবে রাজীবকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তা বোধ হয়। রূপকথাকেও হার মানায়। নবী মুহম্মদের আমলে ‘ইসলামবিদ্বেষী আবু রাফেকে হত্যার জন্য যেভাবে পাঁচজন সাহাবীর একটি দল গুপ্ত হত্যায় অংশ নিয়েছিল মুহম্মদের নির্দেশে, একই কায়দায় মুফতি জসিমের নির্দেশে সাতজনের দল গঠন করে থাবা বাবাকে পল্লবী থানার পলাশনগরের বাড়ির সামনে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি। যারা এই অভূতপূর্ব সাদৃশ্য দেখেও না দেখার বা বোঝার ভান করেন, তারা হয় ‘বোকার স্বর্গে বাস করছেন, নয়তো নিজেদেরকেই প্রতারিত করে চলেছেন অহর্নিশি।

রাজীবের এই ঘটনা নতুন করে আমাদের কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করে দিয়েছে। পরিষ্কার করে দিয়েছে এই জিহাদি ভাইরাসের প্রকটতা। আমার মনে আছে, রাজীব হত্যার পর পরই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের পক্ষ থেকে একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দ্যো হয়েছিল। সে ভিডিওতে খুব স্পষ্ট করেই বলা হয়েছিল, নবী মুহম্মদ যেভাবে কাব ইবনে আশরাফ, আসমা বিন্তে মারওয়ানের মত কবিদের হত্যা করেছিলেন ইসলামের আর নবীর বিষেদগার করার শাস্তি হিসেবে, ঠিক একইভাবে ‘কুলাঙ্গার ব্লোগার’ (ঠিক এভাবেই উচ্চারিত হয়েছে ভিডিওতে) থাবা বাবাকে মেরে ফেলাও জায়েজ হয়েছে। ভিডিওটি শেষ করা হয়েছিল এই বলে যে রাজীব হত্যায় অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলামের সৈনিকেরা অন্য সকল নাস্তিক ব্লগার’দেরও হত্যা করুক, এটাই প্রত্যাশিত। বহু মানুষই সেই ভিডিওর লিঙ্ক তখন দেখেছিল। এখনো অনেক জায়গাতেই সেটা বহাল তবিয়তেই আছে। হয়তো সংক্রমিত করছে নাফিস কিংবা রাজীব হত্যার সাথে জড়িত নর্থ সাউথের ছাত্রদের মতোই অন্য কাউকে। এই জিহাদি ভাইরাস জলাতঙ্ক রোগীর মতো মস্তিষ্ককে অধিকার করে ফেলছে ক্রমশ। জিন বা বংশাণুর মতোই কপি করে করে সংক্রমিত করে ফেলছে শতাধিক, সহস্রাধিক মননকে। বহু অসুস্থ ভাইরাসাক্রান্ত মনন এভাবেই শাহবাগ কিংবা বিভিন্ন জায়গায় ওত পেতে বসে আছে গুপ্তহত্যার জন্য। এ ভাইরাস প্রতিরোধ না করতে পারলে এ সভ্যতার ক্যান্সারে রূপ নিয়ে আমাদের সমস্ত অর্জনকে ধ্বংস করবে বলাই বাহুল্য। তাই এই ভাইরাস সম্বন্ধে সচেতন থাকাটা জরুরী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *