৯. ক্লান্ত প্রাণ এক

আমার দ্বিতীয় অসুবিধা আমার ওই বন্ধুর পরিবারটি নিয়ে। ১৯৭১ সালে ওই পরিবারটি বারবার আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল। ৯ মার্চ থেকে ঢাকা ছিলাম না। ঢাকায় ফিরেছিলাম মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। তখন সবাই ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে। আর আমি কোটালীপাড়া থেকে নৌকায়, লঞ্চে এবং হেঁটে ঢাকা পৌঁছলাম সকলের অজান্তে। এপ্রিলে বরিশাল গিয়েছিলাম। বন্ধুদের সাথে আলোচনা হয়েছিল। বলেছিলাম–এ যুদ্ধ দীর্ঘদিন চলবে। অস্ত্র সংগ্রহ করে রাখতে হবে। প্রশিক্ষণ নিতে হবে। বরিশাল থেকে ফিরে গেলাম টুঙ্গীপাড়ায়। ফিরলাম বাড়িতে। তারপর ঢাকা। আশ্রয় মিলল ওই বন্ধুর বাড়িতে।

তখন পোশাক পাল্টেছি। কিন্তু দাড়ি তখনো বড় হয়নি। রাস্তায় নামলে মানুষ চিনতে পারে। এমন সময় ওই বন্ধুর বাড়ির গৃহশিক্ষক এক মওলানা সাহেব ছুটিতে যেতে চাইলেন। তাঁর বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। তার শূন্যপদে আমি নিয়োজিত হলাম। আমার দায়িত্ব কোরআন পড়ানো এবং নামাজ রোজা শেখানো। মওলানা সাহেব কিছুদিন আমার পড়ানো লক্ষ্য করলেন। বললেন–হুজুর আপনি বড় বেশি কথা বলেন। আর নকশালদের মতো গল্প করেন। বুঝলাম, এখানে থাকা নিরাপদ নয়। সিদ্ধান্ত হলো ভারতে চলে যাব। কিন্তু কিভাবে যাব। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী হোমনা-রামচন্দ্রপুর অভিযান চালাচ্ছে। আমাকে যেতে হবে ডেমরা, মাধবদী হয়ে নরসিংদী। সেদিন ঠিক দুপুরবেলা ওই বন্ধুর মোটরসাইকেলে চড়ে ডেমরা ঘাটে পৌঁছলাম। ওপারে আমার জন্যে অপেক্ষা করেছিল নরসিংদীর কাজী হাতে আলী। তার সাথে আগরতলা রওনা হয়ে গেলাম। সে অনেক কথা।

আবার জুলাইয়ের প্রথমে ঢাকায় ফিরলাম। ওই বন্ধুর বাসায়ই আবার উঠলাম। জুলাইয়ের শেষে আবার ভারত যাত্রা করলাম। সীমান্ত পাড়ি দিতে পারলাম না। আবার ফিরলাম ওই বন্ধুর আশ্রয়ে। শুনলাম, আমার মতো কেউ আছে জেনে ওই বাড়ি দু’বার তল্লাশি হয়েছে। আমার বন্ধু এককালে সামরিক বাহিনীর লোক ছিলেন। তাই পরিস্থিতি সামলাতে পেরেছেন।

এবার বিপদ এল ভিন্ন দিক থেকে। ওই এলাকায় একটি মসজিদ আছে। ওই মসজিদের ইমাম সাহেব অসুস্থ। পাড়ার লোক আমার আশ্রয়দাতাকে অনুরোধ জানাল। আমি যেন ওই মসজিদে শুক্রবার ইমামের ভূমিকা পালন করি। বন্ধু স্তব্ধ হয়ে গেলেন। এবারও শেষ রক্ষা হলো। তিনি বললেন, আমাদের মওলানা সাহেব কোথাও ইমামতি করেন না। তাঁর পীর সাহেবের নিষেধ আছে। এ পরিস্থিতিতে আমাকে আবার ঢাকা ত্যাগ করতে হলো। তিনি আমাকে ঢাকার বাইরে যাবার ব্যবস্থা করলেন। আমাদের এক দলীয় কর্মী তার আত্মীয় আমার সাথে ঢাকা থেকে লঞ্চে বৃহত্তর নোয়াখালীর রায়পুরা গেলেন। রায়পুরা, লক্ষ্মীপুর, বেগমগঞ্জ এবং কুমিল্লা জেলার গুণবতী হয়ে আমি দ্বিতীয়বারের জন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পৌঁছালাম।

এবার সেই বন্ধুর পরিবার বিপর্যস্ত। স্ত্রী গ্রেফতার হয়েছেন অস্ত্র আইনে। আমি এখন কী করবো। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতেই হবে। তবে আমার দলের অভিযোগ হলেও আমি এ ধরনের ঘটনা আদৌ জানতাম না।

সে এক বিতর্ক ছিল স্বাধীনতার পরবর্তীকালে। সকলের হাতেই অস্ত্র। অস্ত্র রাখা নিষিদ্ধ নয়। যুদ্ধকালে অস্ত্র নিয়েছি হাতে। সে অস্ত্র কেন দেব? কাকে দেব। ফলে শুরু হলো অস্ত্রের ঝনঝনানি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অস্ত্র ব্যবহৃত হলো বাড়ি গাড়ি জমি দখলে! যে ঐতিহ্য থেকে আজো রেহাই পাওয়া যায়নি।

কিন্তু রাজনীতিকরা কী করবে। অস্ত্র আছে। প্রশিক্ষণ আছে। অস্ত্র জমা দেবো কেন। ভবিষ্যৎ বিপ্লবে কাজে লাগবে এ অস্ত্র। কিন্তু বিপ্লব কবে কখন হবে–এ অস্ত্র ততদিন আদৌ কার্যকর থাকবে কিনা এ বিতর্কের শেষ কোথায়। আমার বক্তব্য ছিল বিপ্লবের জন্য অস্ত্র মজুদ রাখার প্রয়োজন নেই। বিপ্লবের বড় অস্ত্র জনতার ঐক্য। আর বিপ্লবের কালে সামরিক বাহিনী বিপ্লবের শরিক হবে। তাই অস্ত্র মজুদ করে লাভ হবে না। এতে ব্যক্তিগতভাবে সন্ত্রাস হবে। এ সন্ত্রাস দিয়ে বিপ্লব হবে না। গণঅভ্যুত্থান দিয়ে বিপ্লব করতে হবে। কিন্তু এ তত্ত্ব শুনতে ভালো হলেও কাজে আসেনি। বারবার ঘটা করে অস্ত্র সমর্পণের নাটক করা হয়েছে। সবাই অস্ত্র জমা দেয়নি। আর এক সময় সরকারি বাহিনী সন্ত্রাস শুরু করলে নিজেদের বাঁচার জন্যে অস্ত্র রাখতে হয়েছে। কারণ শান্তি প্রতিষ্ঠার উপযোগী কোনো ব্যবস্থা তখন ছিল না। সর্বত্রই একটা সন্দেহ, বিভ্রান্তি, আশঙ্কা। কে মুক্তিযোদ্ধা, কে রাজকার। মা মুক্তিযোদ্ধা, বাবা শান্তি কমিটির লোক। ভাই আলবদর, অপর ভাই মুক্তিযোদ্ধা।

অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিল চরম মতবিবাদ। কেউ এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার্স) গ্রুপ, কেউ মুজিববাহিনী (বিএলএফ)-বেঙ্গল লিবারেল গ্রুপ, কেউ মামা গ্রুপ, কেউ কাদের সিদ্দিকী গ্রুপ-এ নিয়ে বিতর্ক এবং হানাহানির শেষ ছিল না। প্রতিহীন অপরিকল্পিত অস্ত্র যুদ্ধের অনিবার্য পরিণত মোকাবেলা করতে হলো দেশবাসীকে। তাই অস্ত্র কে কোথায় কেন রেখেছে তার হদিস বোধ হয় আরো মিলবে না। এ পরিস্থিতিতে খবর এল বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার। অঙ্গুলি নির্দেশ করা হতে থাকল আমাদের দলের দিকে।

শেষ পর্যন্ত আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে গেলাম। তাকে ঘটনাটি বললাম। তিনি ঘটনা শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন। দু’দিন পরে আমাকে আসতে বললেন। আমি এই সময় বিভিন্ন মহলে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলাম। বুঝতে পারলাম ওই মামলা থেকে রেহাই পাওয়া খুব কঠিন হবে। কারণ অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে তখন সকলেই সোচ্চার। অপরদিকে রক্ষীবাহিনীর ভয়ে সকলেই তটস্থ। তাই প্রথমে আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম প্রধানমন্ত্রীকে একটি অনুরোধ জানাব। অনুরোধ হচ্ছে–তদন্ত সাপেক্ষে আমাদের দলের কর্মী ও নেতাদের গ্রেফতার বন্ধ রাখার জন্যে। আমার চিন্তা হচ্ছিল আমাদের অন্যতম নেতা কমরেড রুহুল আমিন কায়সার সম্পর্কে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি টিবিতে ভুগছেন। একটি ফুসফুস নেই। অপরটিরও তিনভাগের এক ভাগ গিয়েছে। রায়েরবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। অসাধারণ মনোবলের অধিকারী। শেখ সাহেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। পঞ্চাশের দশকে এক সাথে ছাত্র আন্দোলন করেছেন। আমার ভয় ছিল, তিনি রক্ষীবাহিনীর হাতে পড়লে আর বাঁচবেন না। তাই রুহুল আমিন কায়সারের নাম করে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম আমার বন্ধুদের হয়রানি না করার জন্যে। প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং আমাকে বলেছিলেন দু’দিন পরে আসতে।

আর আমি ভেবেছিলাম–এ ঘটনা থেকে রেহাই পেতে হলে আমাকে ভিন্ন পথ নিতে হবে। আমি প্রধানমন্ত্রীর নামে একটি দরখাস্ত দিলাম। আমি লিখলাম–যে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে তার জন্যে আমিই দায়ি। আমার বন্ধু বা তার পরিবার আদৌ কোনো কিছু জানে না। ৭১ সালে বারবার আমি ওই বাড়িতে এসেছি, আশ্রয় নিয়েছি। আমার সাথে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ওই বাড়িতে যাতায়াত করেছে। আমরা কে কখন কী করেছি সে কথা বাড়ির কর্তাদের জানার কথা না। সুতরাং সকল দায়িত্ব আমার। এজন্যে যে কোনো দণ্ড আমি মাথা পেতে নিতে রাজি। দরখাস্তটি লিখে আমি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়ে দিলাম।

দু’দিন পরে পুরোনো গণভবনে গেলাম। প্রধানমন্ত্রী যেন চিৎকার করেই বললেন–আপনি কী করেছেন জানেন? আপনি যে অস্ত্র রেখেছেন সে অস্ত্র দিয়ে ঢাকা দখল করা যায় এবং ঢাকা ধ্বংস করে দেয়া যায়। গোয়েন্দাদের রিপোর্ট হচ্ছে–এমন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কেউ কোথাও অস্ত্র লুকিয়ে রাখেনি। আমার কিছু বলার ছিল না। প্রধানমন্ত্রী কিছুক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ থাকলেন। পরে জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি দরখাস্ত করেছেন কেন? কে আপনাকে বলেছে সব দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে? এ কাজটি কি না করলে চলত না। আমি চুপ করে থাকলাম। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ঠিক আছে আদালতে মামলা হোক। কমপক্ষে আপনার পনের বছর সাজা হবে। থাকেন স্বাধীন বাংলার জেলখানায়। সাথে সাথেই প্রধানমন্ত্রী হেসে ফেললেন। বললেন–আদালতের রায়ের পর আমি দণ্ড মাফ করে দেব আপনার দিকে তাকিয়ে। আমি বললাম–আমি কারো কাছে মাফ চাইতে শিখিনি। এই বলে প্রধানমন্ত্রীর কক্ষ থেকে বের হয়ে এলাম। দেখা হলো প্রধানমন্ত্রীর সচিব রফিকুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে। রফিকুল্লাহ আমাদের সাথে ছাত্রলীগ করত। তার সঙ্গে ছিল দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। মাঝখানে তাকে দিয়ে অনেক কাজও করিয়েছি। অনেক কিছুই এখন মনে নেই। তবে কিছু ঘটনা এখনো ভুলতে পারিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর খুন হলেন। এই খুনের বৃত্তান্ত সঠিকভাবে এখনো কেউ বলতে পারে না। পুলিশ কোনো হদিস করতে পেরেছে বলে আমি জানি না। হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী সুলতানা রেবু এক। সময় আমাদের দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। হুমায়ুন কবীর খুন হয়ে যাওয়ায় পারিবারিকভাবে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয়। আমি বঙ্গভবনে গেলাম। দেখলামদূরে তার কক্ষে প্রধানমন্ত্রী বসে আছেন। পাশে দাঁড়িয়ে রফিকুল্লাহ চৌধুরী। রফিকুল্লাহকে বললাম, চেক বইটা নিয়ে আসুন। প্রধানমন্ত্রী, আপনার তহবিল থেকে দুই হাজার টাকার একটি চেক লেখেন সুলতানা রেবুর নামে। তার টাকার বড় প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী হেসে বললেন, আপনি কি প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন নাকি। হুমায়ুন কবীর কি মুক্তিযোদ্ধা? তার পরিবারকে টাকা দেবো কেন। আমি বললাম–টাকা দিতে হবে এটাই শেষ কথা। আমার যুক্তি হচ্ছে–আপনি প্রধানমন্ত্রী। আপনার আমলে হুমায়ুন কবীর খুন হয়েছে। আপনার সরকার এখনো আততায়ীকে ধরতে পারেনি। তাই আপনাকে জরিমানা দিতে হবে দুই হাজার টাকা। প্রধানমন্ত্রী জোরে হেসে ফেললেন। রফিকুল্লাহ চৌধুরী চেক লিখে নিয়ে এল। প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষর করলেন। এ ঘটনার কী ব্যাখ্যা হতে পারে সে কথা আমি কোনোদিন ভাবিনি। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আমাকে সেই সরকারের খাস দালাল বলা যেতে পারে। বলা যেতে পারে খয়ের খা। খয়ের খা না হলে এ কাজটি করা কি আদৌ সম্ভব এবং সকলেই ধারণা করতে পারে, গোপনে শেখ সাহেবের সাথে সম্পর্ক রেখে আমি প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে কড়া কড়া কথা লিখছি। এ অভিযোগ আমি কম শুনিনি। কিন্তু কোনোদিন গায়ে মাখিনি। এ ঘটনার ভিন্ন চিত্রও আছে।

গণভবনে ঢুকলেই রফিকুল্লাহ চৌধুরী আমাকে বলতেন এই যে বিহারিদের দালাল দাদা আবার তদবিরে এসেছেন। আমি সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা। আমাদের পেশায় তখন অসংখ্য অবাঙালি সাংবাদিক ছিলেন। তাদের জীবনের নিরাপত্তা ছিল না। নিশ্চয়তা ছিল না চাকরিতে। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম ওরা এদেশে থাকতে চাইলে ওদের চাকরি খতম করা যাবে না। ওরা পাকিস্তানে যেতে চাইলে তাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমার সে অনুরোধ প্রধানমন্ত্রী রেখেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর জীবনের এই দিকটি আমার মনে হয় কেউ কোনোদিন আবিস্কার করার চেষ্টা করেননি। আর সেই সুবাদে গণভবনে গেলে আমাকে বিহারিদের দালাল বলা হতো। এ হচ্ছে নানা সময়ের নানা ঘটনার কিছু বিবরণ।

সেদিন প্রধানমন্ত্রীর কক্ষ থেকে তার সচিব রফিকুল্লাহ চৌধুরীর কক্ষে এলাম। বললাম রফিকুল্লাহ একটি কাজ করতে হবে। অস্ত্র উদ্ধারের যে ঘটনাটি নিয়ে হইচই হচ্ছে তার সঙ্গে আমি জড়িত। আপনি ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্তৃপক্ষকে বলবেন, একটু ধীর গতিতে যেন এ ঘটনার তদন্ত করা হয়। কারণ আমার মনে হচ্ছে এ ঘটনার সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। এই কথাগুলো বলে আমি গণভবন থেকে বের হয়ে এলাম।

পরের দিন গণভবনের ঢুকতেই রফিকুল্লাহ চৌধুরী বললেন, আপনার জন্য আমার বিপদ হয়েছে। আমি পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে আপনার ব্যাপারটি বলেছিলাম। এর পরেই ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা দল বেঁধে গণভবনে আসে। তারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে বেশ কিছু কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছেন। একথা শুনে আমি প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে ঢুকে গেলাম। বললাম-রফিকুল্লাহ চৌধুরীকে ডাকুন। রফিকুল্লাহ এল, প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, আপনি নাকি রফিকুল্লাহকে গালাগাল দিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রফিকুল্লাহ নির্দোষ। আমি রফিকুল্লাহকে বলেছিলাম পুলিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে। রফিকুল্লাহ আমার কথা তাদের বলেছে। প্রধানমন্ত্রী বললেন, একথা রফিকুল্লাহ আমাকে বলেনি। তার বলা উচিত ছিল, আপনি তাকে ওই অনুরোধ জানিয়েছেন। এবার রফিকুল্লাহ মুখ খুলল। সে বলল-দাদা, আপনার মামলা নিয়ে অনেক গণ্ডগোল হবে। আমাদের দফতরে অসংখ্য চিঠি এসেছে আপনার বিরুদ্ধে। অভিযোগ করা হয়েছে, আপনার মামলা বলেই কোনো কিছু করা হচ্ছে না। অপরাধীদের ধরা হচ্ছে না। আর আমাদেরও বলার কিছু থাকছে না।

আমার তখন উভয় সঙ্কট। সাংবাদিকদের ব্যাপার নিয়ে সরকারের সাথে মতানৈক্য হচ্ছে। কোনো ব্যাপারেই সরকারের সঙ্গে সমঝোতা হচ্ছে না। তার মধ্যে এ মামলার দেন-দরবারও করতে হচ্ছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থান এমন দাঁড়াচ্ছে, সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষ হতে হতেও এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী একদিন আমাকে ডেকে বললেন-তাড়াতাড়ি আপনার মামলার সুহারা করা যাবে না। ভিন্নপথ অবলম্বন করতে হবে।

ঘটনাটি আমিও বুঝতে পারছিলাম। আমার ধারণা হচ্ছিল পুলিশের কর্মকর্তারা তাদের হিসাবে প্রধান আসামীকে তারা গ্রেফতার করতে চান। প্রধান আসামী আমার আশ্রয়দাতা বন্ধু। কেউ গ্রেফতার হোক বা তার বিরুদ্ধে মামলা হোক তাতে আমার আপত্তি করার কথা নয়। অপরাধ করলে শাস্তি পেতেই হবে। কিন্তু আমার ভয় আদালতে বিচারের নয়। আমার ভয় হচ্ছে পুলিশি নির্যাতনের। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে পুলিশি নির্যাতন তুঙ্গে উঠেছিল। তদন্তের নামে অভিযুক্তদের ওপর এমন অত্যাচার চালানো হতো, অনেক নির্দোষ ব্যক্তিও সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে। অনেকে সুস্থ শরীরে বাড়ি ফিরতে পারেনি। আর এ ব্যাপারে আমিও খুব কম বড় সাক্ষী ছিলাম না।

সেকালে অনেক দল নিষিদ্ধ না হলেও গোপনে কাজ করত। কখনো প্রকাশ্যে আসত না। এরা গ্রেফতার হলে তার খোঁজ পাওয়া যেতো না। এদের অনেকেই আমার বাসায় আসত। অনুরোধ জানাতে তাদের গ্রেফতারের খবর পত্রিকায় ছাপিয়ে দিতে। পত্রিকায় ছাপা হলে তাদের আর চির জীবনের জন্য অদৃশ্য হতে হতো না।

এ পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রী জানতেন। তিনি আমার ভয় বুঝতে পেরেছিলেন–কেন আমি বন্ধুকে আদৌ গ্রেফতার করতে দিতে চাচ্ছি না। কারণ তিনি যতো নির্দেশই দেন না কেন তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ যে আমার বন্ধুর হাত-পা ভেঙে দেবে না তার নিশ্চয়তা দেয়া খুবই কঠিন ছিল।

এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী একটি অদ্ভুত পরামর্শ দিলেন। জানি না কোনো দেশের কোনো প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন কিনা। কেন আমার জন্যে নিয়েছিলেন আজও আমার কাছে বোধগম্য নয়। তিনি বললেন, আপনার বন্ধুকে ছ’মাসের জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দিন। আরএসপির ধর্মতলা স্ট্রিটে আপনাদের এককালের পার্টি অফিস আছে। কোলকাতায় থাকতে আপনার পার্টির সকল নেতারাই আমার পরিচিত ছিল। ওখানে গিয়ে সে ছ’মাস থাকুক। ছ’মাস পরে বাংলাদেশে ফিরুক। তখন পরিস্থিতি অনেক সহজ হবে। পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে তখন একটা সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।

প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল, এ মানুষটাকে আমি বুঝতে পারছি না। আমি বললাম আমার বন্ধুর পাসপোর্ট ভিসা কিছুই নেই। সে কী করে যাবে। তাকে কে পাসপোর্ট দেবে। প্রধানমন্ত্রী বললেন, তাকে সিলেট সীমান্ত দিয়ে পাঠিয়ে দিন। ওই সীমান্ত দিয়ে সহজেই ওপারে চলে যেতে পারবে। আমাকে সে কাজই করতে হলো।

বলতে পারেন–কে এই প্রধানমন্ত্রী, কী তার পরিচয়। তার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক। কী সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক। আমার বন্ধুকে তিনি কোনোদিন দেখেননি। তার সঙ্গে কোনো পরিচয় নেই। কিন্তু শুধুমাত্র আমার কথায় যে পরমার্শ তিনি দিলেন তা আইনের চোখে অবৈধ। আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী আমাকে পরামর্শ দিলেন আমার বন্ধুকে বাঁচাবার জন্য। আমার ধারণা হচ্ছে তিনি তখন কোনো কিছুই করতে পারছিলেন না আমার জন্যে। অথচ তার কিছু করার গভীর ইচ্ছা ছিল। আমার আরো মনে হয়েছে, সেই ইচ্ছার ভিত্তিটি ছিল একান্তই রাজনৈতিক। রাজনীতির সঙ্গে আবেগ এবং মতামত সম্পর্ক বড় গভীর। রাজনীতির ধারক ও বাহকেরা যেমন বন্ধুর জন্য জীবনবাজি রাখতে পারে। তেমনি শত্রুর বিরুদ্ধে হতে পারে চরম হিংস্র।

এটাই ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত উপনিবেশগুলোর জাতীয় নেতৃত্বের একটি চিত্র। ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ থেকে শুরু করে বার্মার অং সান সুচি, ভারতের নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহেরু, মিসরের নাসের ও বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমানের একই চরিত্র। এরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছেন। ফলে সৃষ্টি হয়েছে অকুণ্ঠ অহমিকা। এই অহমিকার জন্যে তারা নিজের শ্রেণি চরিত্রের বাইরে গিয়ে কথা বলে ফেলেন। কখনো ধমক দেন পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে। এই চরিত্রগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা না হলে ইতিহাসে তারা কখনো চম বাম আবার কখনো চরম ডানপন্থী হিসেবে চিত্রিত হন। তাঁদের পক্ষে ভালোবাসা হয় পর্বত প্রমাণ। আর এক সময় বিরুদ্ধবাদিদের ঘৃণা হয় সাগরের মতো অতলান্ত। এই প্রেক্ষাপটে বিচার না হলে আমি মনে করি শেখ সাহেবের সেদিনের ভূমিকার সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়।

শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শে বন্ধুকে ভারতে পাঠালাম। আপাতত এ ব্যাপারে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া গেল। কিন্তু ১৯৭৩ সালে আমার কাছে আদৌ স্বস্তিপূর্ণ ছিল না। শুরু হয়েছিল ভিন্নভাবে। ‘৭৩ সালের প্রথম দিকে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অখণ্ড এশিয়া সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সম্মেলনের উদ্যোগ নিয়েছিল ভারতের জাতীয় সাংবাদিক সমিতি (ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট) এবং আনন্দবাজার পত্রিকা। আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ওই সম্মেলনে। যদিও সাংগঠনিকভাবে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ভারতের জার্নালিস্ট ফেডারেশনের। আনন্দবাজারের দৃষ্টিতে ওই সংগঠনটি ছিল বামপন্থীদের দখলে। একথা আমাকে বলেছিলেন আনন্দবাজারের মালিক সম্পাদক অশোক কুমার সরকার। নয়াদিল্পি সম্মেলনে কোলকাতা থেকে তাঁর সঙ্গে বিমানে যাচ্ছিলাম। তিনি আমাকে কমিউনিস্টদের আকৃতি-প্রকৃতি এবং চরিত্র খুব গভীরভাবে বুঝাচ্ছিলেন।

এ সম্মেলনে রওনা হওয়ার আগে ঢাকায় একটি ঘটনা ঘটে। হঠাৎ শুনতে পেলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের এই সম্মেলনে যেতে বারণ করেছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে–দেশে নির্বাচন আসন্ন। সুতরাং আমাদের যাওয়া ঠিক হবে না। আমাদের অর্থ হচ্ছে–কে জি মুস্তফা ও আমি। তখন আবার প্রতিনিধি হিসেবে বিদেশ যেতে হলে সরকারি অনুমতি লাগত। আমরা ঠিক করলাম প্রধানমন্ত্রীকে কোনো কিছু জানাব না। আমরা বিমান বন্দরে চলে যাব। কোনো পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি এলে তখন ভেবে দেখা যাবে। আমরা নির্বিঘ্নেই চলে গেলাম।

দিল্লি বিমানবন্দরে আর একটি ঘটনা ঘটল। তখন নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার অর্থাৎ বিএসএস-এর প্রতিনিধি ছিলেন আতাউস সামাদ। বিমানবন্দরে তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, দাদা, আপনিও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর সম্মেলনে এলেন? এ সম্মেলন নিয়ে সেকালে আমি দীর্ঘদিন লিখেছিলাম অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলায়। সে ঘটনার আমি পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। তবে দুই একটি ঘটনা এখনো আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।

সে সম্মেলনে গিয়েছিলাম আর একটি ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে। সে সম্মেলনে এসেছিলেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ গুনার মৃডাল দম্পত্তি। তাঁর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে ছিল আমার প্রবল। তাঁর সঙ্গে দেখাও হয়েছিল। তার কথাগুলো আজো আমার কানে বাজছে। তুমি এমন একটি দেশ থেকে এসেছ যাদের নিচে নামবার এখন আর জায়গা নেই। বাঁচতে হলে উপরের দিকে উঠতে হবে। নামবে কোথায়? তোমরা তো শেষ সীমান্তে দাঁড়িয়ে। বাংলাদেশের সম্পর্কে আর বেশি কিছু তিনি বললেন না। অনেকদিন আগের কথা। এখন স্মৃতিচারণের অঙ্গ। আজ লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে-এশিয়ান ড্রামার লেখক শুনার মৃডাল সঠিক কথা বলেননি। আমাদের নামবার জায়গা ছিল। এখনো মামছি। এ নামার শেষ দেখা না গেলে আর উপরে ওঠা যাবে না।

অখণ্ড এশিয়া সম্মেলনের শেষ দৃশ্যটি ছিল আরো উল্লেখ্যযোগ্য। সংবাদ সম্মেলন হচ্ছিল। সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্নে জবাব দিচ্ছিলেন তকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। সংবাদ সম্মেলন উপস্থাপনা করেছিলেন জাতিসংঘের ভারতের খ্যাতিমান প্রতিনিধি নেনেগাল রনসীমা রাও। এই সম্মেলনে শেষ প্রশ্ন করেছিলাম আমি। আমি লিখিত প্রশ্নে জানতে চেয়েছিলাম, গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের অংশগ্রহণ ব্যতীত এ ধরনের অখণ্ড এশিয়া সম্মেলন আদৌ কোনো সাফল্য বয়ে আনবে কি? চীনের সঙ্গে তখন ভারতের শীতল সম্পর্ক চলছিল। আর চীন বাংলাদেশকে তখনও স্বীকৃতি দেয়নি। তাই আমার প্রশ্নটি উত্থাপনের পর হেসে ফেললেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। তিনি বললেন, এ প্রশ্নটি আমাদের থেকে করা হয়েছে? তিনি বললেন, চীন যদি এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ না করে আমাদের বলার কিছু নেই। আমার জানা মতে, সে সম্মেলনে চীনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

সংবাদ সম্মেলনের পর শুরু হলো চা-পর্ব। চা-পর্বে দেখা হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংবাদিকদের সাথে। বৃহত্তর এশিয়ার অংশ বলে ওই সম্মেলনে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রতিনিধি এসেছিল। তারা আমাকে বললেন, তুমি তো সেই নির্মল সেন। তুমি মস্কো গিয়েছিলে এবং তুমি এ ধরনের আলোচনা করেছিলে মস্কোতে। তোমার নাম পরিবর্তন হয়নি।

নয়াদিল্লি থেকে ফেরার পথে আসানসোলে গিয়েছিলাম। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল তখন আমার মা থাকতেন। মায়ের সাথে দেখা করে ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে গেল।

তখন ১৯৭৩ সালের বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড় চলছিল। ঢাকায় ফিরে আর একটি খবর পেলাম। খবরটি খুব ভয়ের না হলেও নিঃশঙ্ক হওয়ার মতো নয়। খবরটি দিলেন এক সংবাদিক বন্ধু। এককালে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টি। তিনি চীনের অনুসারী ছিলেন। বর্তমানে বিএনপি করেন। তিনি বললেন, আপনি একটু সাবধানে থাকবেন। সর্বহারা পার্টির পক্ষ থেকে আপনাকে খুন করার চেষ্টা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সফল হয়নি। যারা আপনাকে খুন করতে গিয়েছিল তাদের মধ্যে নোয়াখালীর একটি ছেলে ছিল। সে ইত্তেফাকের সাংবাদিক বজলুর রহমান অর্থাৎ বজলু ভাইয়ের বাড়িতে গৃহশিক্ষক ছিল। সে সর্বহারা পার্টির সদস্য। একদিন তাদের একটি দল নাকি আমার নতুন পল্টনের বাসায় যায়। তাদের দলীয় নেতা আমার বাসায় যাওয়ার পর সকলকে জানানো হয়, সেদিনের অভিযুক্ত ছিলাম আমি। আমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এই গৃহশিক্ষক নাকি সকলের সঙ্গে একমত হতে পারেনি। সে বলেছিল, বর্তমান সরকার অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ওই একজন লোকই লিখছে এবং বলছে। সুতরাং তাকে হত্যা করা হবে কেন? তার এই কথায় সেদিনের অভিযান অসমাপ্ত থেকে যায়। শুনেছি ওদের নিয়ম হচ্ছে সকলে একমত না হতে পারলে কোনো সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয় না। পরবর্তীকালে ওই গৃহশিক্ষক সর্বহারা দল ছেড়ে দেয়। রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার পরেই সে আমার পরিচিত সাংবাদিককে এ কথা জানায়। তার বার্তা ছিল, নির্মল সেনকে সাবধান থাকতে বলবেন। আমার জন্যে তিনি এবার বেঁচেছেন। পরের বার হয়তো তিনি বাঁচবেন না।

আমি এ ব্যাপার নিয়ে তখন খুব একটা হইচই করিনি। আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুরাও এ কথা জানতে পারেনি। আর আজ পর্যন্ত আমি এ ঘটনারও কিনারা করতে পারিনি।

প্রকৃতপক্ষে কোনোদিনই এ গোপন বামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে আমার তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। তাদের ভালোবাসার বা বিরোধিতার প্রশ্নও কোনোদিন দেখা দেয়নি। তারাই আমাদের নামে তাদের কাগজপত্র প্রেস ক্লাবে পাঠিয়ে দিত। প্রেসক্লাবে এ কাগজপত্রের প্রাপক ছিলাম আমি ও এনায়েতুল্লাহ খান। সেকালে সাম্যবাদী দলের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা আত্মগোপন করেছিলেন। তার সন্ধান আমার জানা ছিল। কোনো বাইরের লোক তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে সে ব্যবস্থাও কম করিনি। বাংলাদেশের রাজনীতির সুবিধা বা ক্ষতিকর দিক হচ্ছে সেকালের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান থেকে শুরু করে আত্মগোপনকারী বাম নেতা মোহাম্মদ তোয়াহাসহ অনেকেই ব্যক্তিগত জীবনে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল। পর্বতপ্রমাণ রাজনৈতিক মতান্তরের মধ্যেও এ ধরনের সম্পর্ক অটুট ছিল। তাই এদের সকলের সঙ্গে আমাদের একটা সহজ ও স্বাভাবিক সম্পর্ক বিরাজ করত। আমি আজও বুঝতে অক্ষম সেকালে সর্বহারা পার্টি আমাকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিল। পরবর্তীকালে মনে হয় পশ্চিমবঙ্গের নকশাল নেতা চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর পরিস্থিতির কিছু পরিবর্তন হয়েছে। চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর দৈনিক বাংলায় আমি একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম। আমার সেই লেখা নিয়ে বিতর্ক হয়। লেখা ছাপা হয় সাপ্তাহিক হলিডেতে। ওই সময় আর একটি চিঠি আসে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। সে চিঠিও সাপ্তাহিক হলিডেতে প্রকাশিত হয়। সে চিঠিতে দাবি করা হয় যে নির্মল সেনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সঠিক।

এর কিছুদিন পর আমি বরিশাল যাই। বরিশালে এক বন্ধুর বাসায় ছিলাম। ওই বাসায় সর্বহারা পার্টির দুটি ছেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। আমাকে বলা হলো–রাত বারটায় কোনো একটি জায়গায় তাদের সঙ্গে আমাকে যেতে হবে। তারা চারু মজুমদার সম্পর্কে আমার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। আমি রাজি হলাম। তবে আমার শর্ত ছিল আমার সঙ্গে বৈঠককালে সিরাজ সিকদারকে হাজির থাকতে হবে। যদি সিরাজ সিকদার সম্মত হয় তা হলে রাত বারটায় আমি তাদের সঙ্গে যাব। তারা আমার সঙ্গে কথা বলে চলে যায়। কিন্তু আর ফিরে আসেনি।

এমনি করে অসংখ্য ঘটনার মধ্যদিয়ে ১৯৭৩ সাল কেটে যায়। ১৯৭৪ সালে নতুন করে আমন্ত্রণ আসে পূর্ব জার্মান অর্থাৎ জিডিআর-এর পক্ষ থেকে। দীর্ঘদিন থেকে পূর্ব জার্মান সাংবাদিক সমিতির পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের অনুরোধ জানানো হয়েছিল। ১৯৭২ সালে জিডিআর সফরকালে একই প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। আমি সম্মত হইনি। আমি তখন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। কোনো জাতীয় সাংবাদিক ইউনিয়ন তখনো গঠিত হয়নি। এছাড়া সরকারের সঙ্গে আলোচনা ব্যতীত দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ১৯৭২ সালে কোনো দেশের সঙ্গে আমাদের চুক্তি করা সঠিক হবে কিনা তাও আমার কাছে স্পষ্ট ছিল না। ১৯৭২ সালে সে চুক্তি আমি স্বাক্ষর করিনি। এতে আমার কমিউনিস্ট বন্ধুরা অখুশি হয়েছিল। জিডিআর-এর সাংবাদিক ইউনিয়নও আদৌ আমার প্রতি খুশি ছিল না।

কিন্তু আমি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রথম নির্বাচিত সভাপতি। এবার আবার নতুন করে জিডিআর সাংবাদিক ইউনিয়ন আমাদের কাছে প্রস্তাব পাঠায়। আমরা তাদের সঙ্গে চুক্তি খসড়া নিয়ে আলোচনা করি। উভয় সরকারকে অবহিত করি এবং এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্যে আমি ও তৎকালীন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কামাল লোহানী জিডিআর যাই।

জিডিআর যাত্রার আগের দিন সন্ধ্যায় আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে যাই। ঢুকেই আমি প্রধানমন্ত্রীর তল্কালীন সচিব এককালের পুলিশ প্রধান আব্দুর রহিমকে লেখার কাগজ নিয়ে আসার অনুরোধ জানাই। তাকে বলি, আমার সেই মামলাটা প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি লিখে দিন। কারণ ওই মামলা চলতে পারে না।

প্রকৃতপক্ষে ঘটনা ছিল ভিন্নরকম। আমার বন্ধু কোলকাতায় ছ’মাস থেকে চলে এসেছে। কিন্তু মামলা নিয়ে আদৌ এগোনো যাচ্ছিল না। পুলিশ কর্তৃপক্ষ বারবার বাধা দিচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী কোনো কিছু করতে পারছিলেন না। আমার বন্ধুকে বাঁচানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। এ সময় জানা গেল, পুলিশের সকল কর্মকাণ্ডই একটি ভুল তথ্যের উপর নির্ভর করে রচনা করা হয়েছে। যে বাড়িতে অস্ত্র পাওয়া গেছে সে বাড়ির মালিক আমার বন্ধুর এক পড়শি। অথচ রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক আছে বলে মামলায় জড়ানো হয়েছে আমার বন্ধু এবং তার পরিবারকে। আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল–বিদেশ যাওয়ার আগে এর একটি ফয়সালা করে না গেলে আমার বন্ধুর বিপদ হবে। আমার অনুপস্থিতিতে দুঃখজনক কিছু ঘটে যেতে পারে।

আমিও তাই প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে ঢুকেই মামলা প্রত্যাহারের কথা বললাম। রহিম সাহেবকে কাগজ আনতে বলে প্রধানমন্ত্রীকে সব ঘটনা জানালাম। তিনি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, আপনি বিদেশ চলে যান। আমি দেখছি কী করা যায়। আমাদের সঙ্গে সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী গিয়াস কামালকে বললেন–তুই এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখবি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা রেখেছিলেন। দেশে ফিরে এ মামলা নিয়ে আমাকে তেমন আর ঝামেলা পোহাতে হয়নি। শুধুমাত্র এসব দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া দরখাস্তটি ফিরিয়ে আনা হয়নি।

প্রায় মাস খানেক পর ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরেই খবর পেলাম ভিন্ন। ধরনের। ১৭ মার্চ জাসদের মিছিলে গুলি হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছেন গণকণ্ঠ সম্পাদক কবি আল মাহমুদ।

মনটা খিঁচিয়ে গেল। ভাবলাম দেশে ফিরে আরেক গোলমালে পড়তে হবে। আবার সরকারের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় যেতে হবে। এক অপূর্ব দেশে জন্মগ্রহণ করেছি আমরা। অন্য কোনো দেশের সঙ্গে তার যেনো তুলনা নেই।

পৃথিবীর যে কোনো দেশে পত্রিকা বন্ধ হলে বা সম্পাদক গ্রেফতার হলে প্রতিবাদী ভূমিকা গ্রহণ করে রাজনৈতিক দল। তারা মিছিল করে। সমাবেশ করে। প্রতিবাদ করে। তাদের কাছে পত্রিকা বন্ধ হওয়া বা সম্পাদক গ্রেফতার হওয়া গণতন্ত্রের ওপর হস্তক্ষেপ। তাই গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং শ্রমিক সংগঠন সামনে এগিয়ে আসে।

কিন্তু পাকিস্তান আমল থেকে আমাদের দেশে তেমনটি ঘটেনি। সব দায়িত্ব নিতে হয়েছে সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র কর্মচারীদের। কাউকে বোঝানো যায়নি, পত্রিকা বন্ধ হলে সকলের বাকরুদ্ধ হবে। এখানে মুখ্য প্রশ্ন সাংবাদিক ও সংবাদপত্র কর্মচারীদের রুটি-রুজির নয়। এ ক্ষেত্রে মুখ্য প্রশ্ন গণতন্ত্র। কিন্তু তবুও রাজনৈতিক দলগুলোর টনক নড়েনি। দু’একটি বিবৃতি দিয়ে তারা দায়িত্ব শেষ করেছে। পাকিস্তান আমলে বারবার সংবাদপত্র বন্ধ হয়েছে। আইয়ুব আমলে ইত্তেফাক বন্ধ হয়েছে। সেকালে ইত্তেফাক ছিল তল্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ ও দাবি আদায়ের মুখপত্র। সেই ইত্তেফাক বন্ধ করা হলে কেউ হরতাল বা ধর্মঘট ডাকেনি। ধর্মঘট ডেকেছে সংবাদপত্র শিল্পের কর্মচারীরা।

এ ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের এবং এ ঐতিহ্যের একটি ভিন্ন কারণও আছে। এই ঐতিহ্যের জন্যে লক্ষ করা গেছে সেকালের পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলো কখনো কখনো রাজনৈতিক দলের ভূমিকা পালন করেছে।

তাই লক্ষ করেছি এদেশের মানুষ কোনো অঘটন ঘটলে প্রেস ক্লাবের দিকে তাকিয়েছে। দেখার চেষ্টা করেছে সাংবাদিকরা কিছু করছে কিনা। তারা তাকিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। সকলের প্রত্যাশা কেউ প্রতিবাদ না করলেও এদেশের ছাত্র সমাজ প্রতিবাদ করবেই। তাই লক্ষ করা গেছে পাকিস্তান আমলে রাজনীতির দুই প্রধান কেন্দ্র ছিল প্রেসক্লাব ও বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন।

এ প্রেক্ষিতেই ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় রাজনৈতিক নেতারা প্রেস ক্লাবে গিয়েছিলেন। সাংবাদিকরাই সেকালের ঐতিহাসিক ঘোষণা ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ প্রণয়ন করেছিলেন। সেকালের পূর্ব পাকিস্তানের সব ক’টি প্রধান দৈনিকের এ ঘোষণা প্রথম সংবাদ হিসেবে ছাপা হয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলনে প্রেস ক্লাব এবং সাংবাদিকরা ছিল প্রথম সারিতে।

ঠিক একইভাবে আর একটি ঘটনা ঘটেছিল আইয়ুব আমলে। খাজা সাহাবুদ্দিন তখন পাকিস্তানের তথ্য ও বেতার মন্ত্রী। তিনি ঢাকার প্রেস ক্লাবে এসে ঘোষণা দিলেন, বেতার-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হলো।

সে সময় কৌতুক করে বলা হতো, গভর্নর মোনায়েম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান আবদুল হাইকে নাকি প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখতে পারেন না কেন?

খাজা সাহাবুদ্দিনের এ ঘোষণার পর সারাদেশে বুদ্ধিজীবীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। তার নেতৃত্বেও ছিল ছাত্র সমাজ ও প্রেস ক্লাব। এর পেছনে ছিল আর একটি ইতিহাস।

সে ইতিহাসের জন্য পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই। সেকালে যারা সংবাদপত্রে কাজ করত তাদের অধিকাংশই ছিল বাম দলের সদস্য। পরবর্তীকালে সংবাদপত্রই বামপন্থীদের আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়াল। বামপন্থীরা গ্রেফতার হতো রাজনৈতিক কারণে। তারা কোথাও চাকরি পেত না। চাকরি পেতে হলে পুলিশের সার্টিফিকেট প্রয়োজন হতো। সংবাদপত্রে চাকরিতে পুলিশের সার্টিফিকেট প্রয়োজন হতো না এবং বাঁচার স্বার্থে যে কোনো মাইনেতে বামপন্থীরা সংবাদপত্রে চাকরি নিত। চাকরিতে তারা ছিল একনিষ্ঠ। রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, কে জি মুস্তফা, হাসানুজ্জামান খান, শহিদুল্লাহ কায়সার, আমি, আমরা এরকম কিছু পেশাদার রাজনীতিক হিসেবে সংবাদপত্রে এসেছিলাম।

১৯৫৯ সালের কথা। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের এক বছর কাটতে চলল। ডাকসুর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২৪ ঘণ্টার নোটিসে ঢাকা হল অর্থাৎ শহিদুল্লাহ হল থেকে আমাকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৫৯ সালের আগস্ট মাসে আমাকে কলা ভবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। তখন বন্ধু আহমেদুর রহমান ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক ছিলেন। ভীমরুল ছদ্মনামে কলাম লিখতেন। ইত্তেফাকের অন্যতম সহকারী সম্পাদক ছিলেন এমএ আউয়াল। তিনি দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আমি ছিলাম দফতর সম্পাদক। একদিন আহমেদুর রহমান এসে বললেন, আপনাকে ইত্তেফাকে জয়েন করতে হবে। আউয়াল সাহেবের সঙ্গে কথা হয়েছে। মি বলেছিলাম, আমি রাজনীতি করি। কারো অধীনে চাকরি করব না। টিউশনি করেই বেঁচে থাকব। বন্ধুরা বললেন, এভাবে বেঁচে থাকা যাবে না। গ্রেফতার হলে সাংবাদিক হিসেবেই মুক্তি দাবি করা যাবে। বন্ধুদের কথায় ১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বরে ইত্তেফাকে যোগ দিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। অক্টোবরে শেষ সপ্তাহে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হয়ে গেলাম। ১৯৬২ সালে জেলখানা থেকে এসে যোগ দিয়েছিলাম দৈনিক জেহাদে। তখন থেকে রাজনীতির সঙ্গে আমার অন্যতম পেশা হচ্ছে সাংবাদিকতা। আমার মতোই অধিকাংশ সাংবাদিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকায় আমাদের দেশের সাংবাদিকদের একটি রাজনৈতিক পরিচয় ও অবস্থান ছিল সর্বকালের। ফলে কোনো জাতীয় সমস্যা দেখা দিলে সাংবাদিক এবং একই সঙ্গে রাজনীতিকের ভূমিকা পালন করতে হতো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার স্বাক্ষর আছে।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও সে ঐতিহ্য অব্যাহত ছিল। গণতন্ত্রের সংগ্রামে সাংবাদিকদের বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। মানুষ মনে করতো সাংবাদিকরা সব সমস্যার সমাধান দেবে। তারাই গণতন্ত্রের লড়াই করবে।

কিন্তু কেউ লক্ষ করলো না যে, ১৯৭১ সালের পর জাতীয় জীবনে একটি মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে একটি ঐক্য ছিল। সেই ঐক্য থাকার জন্যে সাংবাদিকদের মধ্যেও ঐক্য ছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এককালের সংগ্রামের শরিক আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায়। বাকি সব বিরোধী দলে। তাই সাংবাদিকদের সমস্যাও এখন অভিন্ন নয়। এ পরিস্থিতি কেউ অনুধাবন করল না। সংবাদপত্র শিল্পে একের পর এক সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকল। ওই সমস্যা জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও সকলে আগের মতো পাশ কাটিয়ে থাকল যে সাংবাদিকরাই সকল সমস্যার সমাধান করবে।

এ সময় সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলাম আমি। তাই ঢাকা বিমানবন্দরের পৌঁছে গণকণ্ঠ সম্পাদক কবি আল মাহমুদের গ্রেফতারের খবর শুনে মনটা খিঁচিয়ে গেল।

বুঝলাম ঘটনাটি জাসদ ও আওয়ামী লীগ সরকার ঘটালেও এর দায় বহন করতে হবে আমাদের অর্থাৎ সাংবাদিকদের।

জাসদ ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাও করেছিল। সেই ঘেরাওকে কেন্দ্র করে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য আছে। বলা হয় জাসদের মিছিল থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভবন লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়েছিল। অপর পক্ষে বলা হয় রক্ষীবাহিনী জাসদের মিছিলে বেধড়ক গুলিবর্ষণ ও লাঠিপেটা করেছিল। কোন পক্ষের বক্তব্য সত্য সে নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ওই দিন যে অসংখ্য জাসদ কর্মী ও নেতা আহত ও নিহত হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি তখন পূর্ব ইউরোপে ছিলাম। কোনো খবরই পাইনি। ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছাতেই বিমান কর্মীরা বলল, আবার গণকণ্ঠ বন্ধ হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছেন গণকণ্ঠের সম্পাদক।

আমি খানিকটা অবাক হলাম। বুঝতে পারলাম যে জাসদ এ ধরনের একটি ঘেরাও কেন করল। ঘেরাও করতে হলে প্রধানমন্ত্রী ভবন ঘেরাও করাই স্বাভাবিক ছিল। তারা সে কাজটি করল না। সকলেরই জানা ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন বাসায় ছিলেন না। এরপরও কেন যে জাসদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসা ঘেরাও করেছিল সে ব্যাখ্যা আজো আমি পাইনি। তবে বেশ কিছুদিন যাবত জাসদের মধ্যে একটি অস্থিরতা লক্ষ্য করেছিলাম। আমার ধারণা জাসদের এ অস্থিরতা ছিল জন্মলগ্ন থেকেই।

জাসদের জন্য আমার কাছে অনেকটা রহস্যময় ছিল। আমার রাজনীতির প্রথম দিন থেকেই আমি সমাজতন্ত্রের একটি দলের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। দীর্ঘদিন তাদের ছাত্রফ্রন্টের কাজ করেছি। কিন্তু দলের সদস্যপদ পাইনি। এমনকি সদস্য পদের জন্যে আবেদনের অনুমতিও দেয়া হয়নি। ছাত্রফ্রন্টের সেল-এর সদস্যপদও পাইনি। এ ধরনের দলের সদস্যপদ পাওয়া খুবই কঠিন। দীর্ঘ দিনের পরীক্ষা ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে এসকল দলের সদস্যপদ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। অথচ একদিন সুপ্রভাতে ঘোষণা হলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ নামে একটি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী দলের জন্ম। এ দলের লক্ষ্য হচ্ছে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র এবং লক্ষ করলাম রাতারাতি এ দলের সদস্যসংখ্যা হাজার থেকে লক্ষের কোঠায় পৌঁছাতে যাচ্ছে। এ দলের লক্ষ্য সম্পর্কে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল দলটি যদি সমাজতন্ত্র চায় তাহলে ঘটা করে বৈজ্ঞানিক কথাটি লেখার দরকার কী। তাতে কী বাড়াবাড়ি হয়ে যায় না কি।

কেউ নিশ্চয়ই প্রশ্ন করতে পারেন এই উপমহাদেশে অনেক আগে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম নিয়েছে। কমিউনিস্ট শব্দের আগে বিপ্লবী শব্দটি বসানো গেলে সমাজতন্ত্রের আগে বৈজ্ঞানিক শব্দটি বসাতে আপত্তি কোথায়? আমার জবাব হচ্ছে, ভারতে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি গঠনেরও একটি ইতিহাস ও তাৎপর্য আছে। বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (Revolutionary Communist Party of India–RCI) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সৌমেন্দ্র ঠাকুর লেনিনের সমসাময়িক ছিলেন। এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের বলশেভিক পার্টির সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিনের সাথে তাঁর মতানৈক্য হয়। ফলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাথেও তাঁর মতবিরোধ দেখা দেয়। সেই পটভূমিতে সৌমেন ঠাকুর বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন। বাংলাদেশের জাসদের কাছে এ সমস্যা ছিল না। জাসদ-জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ইংরেজিতে National Socialist Party। জার্মানির হিটলারের দলেরও একই নাম ছিল। সেই নাম গ্রহণ করে ললাটে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র লিখে দিলে যে সংশয় এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দেয় এ ধরনের দল গঠনের কারণ কী। আওয়ামী লীগ থেকে ভেসে এসে এ ধরনের একটি সমাজতান্ত্রিক দল গঠনের তখন কোনো কার্যকারিতা ছিল কি এবং তখন থেকেই আমার ধারণা ছিল রাজনীতিতে একটি গোজামিল দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। একথা আমি পূর্বেও লিখেছি এবং লক্ষ করা গেছে, এ ধরনের গোজামিলের ফলে জাসদ প্রথম থেকেই অস্থিরতায় ভুগছে। তাদের পক্ষে কখনো সম্ভব ছিল তাদের আশু এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণের।

জাসদ ছিল মূখ্যত একটি দুঃসাহসী টগবগে তরুণের দল। এরা অস্ত্র হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তাদের চোখে অনেক স্বপ্ন। তাদের জীবন দেবার নেশা অফুরন্ত। তাদের চোখে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন। কিন্তু এই স্বপ্ন রূপায়নের কোনো পরিকল্পনা তাদের চোখের সামনে নেই। অভিজ্ঞতা নেই নেতৃত্ব নেই। আছে অশান্ত তারুণ্য। এই তরুণদের স্বপ্ন ধারণ করা আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ কোনো সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনে বিশ্বাসী দল নয়। আওয়ামী লীগ উঠতি বাঙালি ধনীদের একটি নড়বড়ে প্রতিষ্ঠান। এই আওয়ামী লীগ থেকে বিপ্লবের চিন্তা করা বাতুলতা মাত্র। এই অশান্ত তরুণদের বাঁচাতে হলে আওয়ামী লীগ ছাড়তেই হবে।

কিন্তু তারপর? তারপর কী হবে? এই তরুণেরা কেন সংগঠন গড়ে তুলবে। এই তরুণরা সবাই কি একই মত-পথে বিশ্বাসী? শুধুমাত্র তারুণ্যের উসই কাউকে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী করে তোলে না। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে ত্যাগ, তিতীক্ষা ও অনিশ্চিত সংগ্রামী জীবনকে গ্রহণ করে সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের পথে এগুতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হয় দলীয় কাঠামো। সব প্রশ্নের সিদ্ধান্ত নিতে হয় শ্রেণির ভিত্তিতে। জাসদের ক্ষেত্রে তার কোনোটাই ঘটেনি। আওয়ামী লীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগের মতো একটি সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে জাসদ প্রতিষ্ঠিত হয়। অবস্থা এমন না হলে মেজর জলিলের মতো রাজনীতিতে একান্ত অপরিচিত ব্যক্তি হুট করে জাসদের সভাপতি হতে পারতেন না। অর্থাৎ প্রথম থেকেই একটি গোজামিলের ভিত্তিতে জাসদের সৃষ্টি হলো। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসে আওয়ামী লীগের মতোই একটি রাজনৈতিক দল দাঁড় করাবার চেষ্টা হলো। আর প্রশ্ন দেখা দিল ভিন্ন ক্ষেত্রে।

লক্ষ্য সমাজতন্ত্র অথচ সাংগঠনিক কাঠামো আওয়ামী লীগের। এই কাঠামো নিয়েই সংগ্রাম করতে হবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। তাহলে সরকারি দলের সাথে তফাৎ কোথায়? এ তফাৎ দেখাতে গিয়ে বিপত্তি ঘটল। একমাত্র কড়া কড়া কথা, প্রতিদিন হুমকি এবং যখন তখন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি জাসদের নিত্যদিনের কাজ হয়ে দাঁড়াল। কারণ এই অশান্ত তরুণদের হাতে রাখতে হলে তাদের কাজ দিতে হয়। একটি সমাজতন্ত্রী দল সে কাজ খুঁজে নেয় শ্রমিক কৃষক এবং মেহনতি মানুষের এলাকায়। খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে শক্তিশালী সংগঠন থাকলেই রাজপথের আন্দোলন শক্তিশালী হয়। একটি শ্রেণি ভিত্তি পায়। জাসদ তার জন্মলগ্নে এভাবে শ্রেণিভিত্তি ও শক্তি অর্জনের পূর্বেই প্রকাশ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এটা ছিল নেতৃত্বের এক ধরনের চমক। নিজেদের ভেজাল রাজনীতি গ্রহণযোগ্য করার জন্যে কথায় কথায় তরুণদের ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে সশস্ত্র সংগ্রামে। এ ধরনের একটি কাজই ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ জাসদ করেছিল। আমি যতদূর জানি কোনো পূর্ব সিদ্ধান্ত ছাড়াই সেদিন পল্টন ময়দান থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করার জন্যে জাসদের মিছিল গিয়েছিল। সেদিন কেন মিছিল গিয়েছিল তার প্রকৃত ব্যাখ্যা কোনোদিন পাওয়া যায়নি। আর আমার মনে হয়েছিল এটাও ছিল জাসদের লক্ষ্যহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি।

তবে এর একটা ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। একজন রাজনৈতিক ভাষ্যকারের মতে জাসদ ছিল একটি তরুণের দল। এরাই ছিল ১৯৭১ সালের সংগ্রামের স্থপতি। এরা ছয়কে নয় করতে পারে। ১৯৭১ সালের সংগ্রামের পর তাদের নিয়ে জাতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরের একটি ভয় ও শঙ্কা ছিল। ভয় ছিল এরা হয়তো বাম রাজনীতিতে ঝুকবে। সমাজতন্ত্রের পথ ধরবে। এরা এখন স্বপ্নীল। এরা ঐক্যবদ্ধ হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন অনিবার্য। তাই এদের ঠেকাতে হবে। লাল পতাকা দিয়ে লাল পতাকা ঠেকাতে হবে। লাল পতাকা দিয়ে লাল পতাকা ঠেকাবার মতোই সমাজতন্ত্রের শ্লোগান দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে হবে। এই হঠকারী শ্লোগানের ভিত্তিতে প্রতিদিন আন্দোলন করতে গিয়ে ওই টগবগে তরুণগুলো নিঃশেষিত হবে। আর সাধারণ মানুষের কাছে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটাই হবে ভয় এবং শঙ্কার। প্রশ্ন উঠতে পারে সমাজতন্ত্র বিরোধীরা যদি সবকিছু বুঝেশুনে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে তবে বামপন্থীরা কিছু করল না কেন? আজকে আমার কথায় নিশ্চয়ই প্রমাণিত হয়, আমার মতো বামপন্থী সবকিছুই বুঝতে পেরেছিলাম। আবার একথাও প্রমাণিত হয় যে, আমাদের ব্যর্থতা পর্বতপ্রমাণ। এরও একটি পটভূমি আছে।

প্রশ্ন উঠেছিল সেকালের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নিয়ে এমন ষড়যন্ত্র করতে পারলে তৎকালীন। বামপন্থীরা কী করেছিল। একদল অশান্ত মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণ দেশের প্রতিষ্ঠিত বাম দলগুলোতে যোগ না দিয়ে নতুন দল গড়তে গেল কেন? বিদেশিরা ষড়যন্ত্র করল একথা বললেই কি এ প্রশ্নের জবাব হয়ে যায়?

আমার জবানবন্দিতে এ প্রশ্নের জবাব আমি বারবার দিতে চেষ্টা করেছি। আজকেও আমার জবাব হচ্ছে সেকালে বাংলাদেশে বামপন্থীদের জীর্ণ দশা। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর নতুন করে কোনো বামপন্থী দল জন্মগ্রহণ করেনি। সর্ব ভারতীয় সূত্রে বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি ও বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল (আরএসপি)-এর অস্তিত্ব ছিল। দু’টি দলের নেতৃত্বে ছিল মধ্যবিত্ত হিন্দু সম্প্রদায়। দেশ বিভাগের ফলে নেতৃত্বের শূন্যতা দেখা দেয়। অপরদিকে নেমে আসে পাকিস্তান সরকারের চরম নির্যাতন। কমিউনিস্ট পার্টি তার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ফলে কোনোরকম টিকে থাকলেও আরএসপির অস্তিত্ব নড়বড়ে হয়ে যায়। আত্মগোপন করে কমিউনিস্ট পার্টি অস্তিত্ব রক্ষা করতে চেষ্টা করে। অপরদিকে আরএসপি শিল্প এলাকায় শ্রমিকদের মধ্যে কোনোমতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে।

এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনকে কেন্দ্র করে বিভক্তি দেখা দেয়। আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টি একান্তভাবেই বিদেশ নির্ভর বলে একেবারে যান্ত্রিকভাবে এদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতেও মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী হিসেবে বিভক্তি দেখা দেয়। ১৯৫৭ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপ গঠন করে। কমিউনিস্ট পার্টির কথায় এ দলটি ছিল প্রগতিশীল জাতীয় বুর্জোয়াদের প্রতিষ্ঠান। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় এ দলের মাধ্যমে তারা কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইতিপূর্বে কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের মাধ্যমে কিছুটা কাজ করতো। কিন্তু শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসার পর বামপন্থীদের পক্ষে আওয়ামী লীগে কাজ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন কট্টর কমিউনিস্ট বিরোধী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক। আর সেটা ছিল আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ঠাণ্ডা যুদ্ধের যুগ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তখন তীব্র সংঘর্ষ ছিল। এই সবকিছু মিলেই এদেশের কমিউনিস্টদের আওয়ামী লীগ করা সম্ভব ছিল না এবং তাদের উদ্যোগেই গঠিত হয় ন্যাপ। আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষণীয় যে পিকিং মস্কো দ্বন্দ্ব ন্যাপেও প্রভাব ফেলে। ন্যাপ বিভক্ত হয়ে যায়। ন্যাপের প্রথম সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। আর মস্কোপন্থী অংশের প্রেসিডেন্ট হলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের এ বিভক্তি বামপন্থী আন্দোলনে বিপর্যয় ডেকে আনে। পরবর্তীকালে দুই ন্যাপেই ভাঙন সৃষ্টি হয়। মস্কোপন্থী নামের ভাঙন সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে হলেও পিকিংপন্থী ন্যাপের ভাঙনের কোনো শেষ ছিল না। এদের কোনো কোনো অংশ ৭১-এর যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। আর মস্কোপন্থী ন্যাপের বন্ধুরা মস্কোর নির্দেশ ব্যতীত কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে গোপনে। তারা যতই দলিল লিখুক না কেন প্রকাশ্যে তাদের ভূমিকা ছিল বিভ্রান্তিমূলক। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের পূর্বে তাদের কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পক্ষে ভূমিকা গ্রহণ করেনি। এ হলো কমিউনিস্ট বামপন্থীদের কথা। আর আমরা যারা আরএসপি করতাম তাদের বিপদ ছিল নানা দিক থেকে। শুধুমাত্র সরকার বা বুর্জোয়া দলগুলোর পক্ষ থেকে নয়, মস্কো এবং পিকিংপন্থী দুই কমিউনিস্ট পার্টি ছিল আমাদের ঘোর বিরোধী। আমাদের সম্পর্কে কোনো তাত্ত্বিক লেখাপড়া না করেই আমাদের ট্রটস্কিবাদী বলে অভিহিত করত। আমার ছাত্রজীবন থেকে আমি নিশ্চিত যে আমাদের ওই বন্ধুদের অধিকাংশ ট্রটস্কির কোনো বইয়ের একটি পাতাও উল্টিয়ে দেখেনি। অনেককে আমি হেসে ইংরেজিতে ট্রটস্কি নামের বানান জিজ্ঞেস করে কোনো উত্তর পাইনি। তাদের এই অন্ধতা ও অন্ধ বিরোধিতা আমাদের পদে পদে বিব্রত করত। মস্কো পিকিং বিভক্তির আগে ঐক্যবদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির বন্ধুরা বলতেন তাঁরাই একমাত্র কমিউনিস্ট। অন্য সবাই আমেরিকার এজেন্ট। এই মনোভাব থেকেই তারা ৬০-এর দশকে আমাদের নেতৃত্বে আইয়ুব আমলে ঐতিহাসিক চটকল শ্রমিক ধর্মঘটের সময় তারা মালিকের সাথে সহযোগিতা করেছে। শ্রমিক স্বার্থবিরোধী চুক্তি করে ধর্মঘট ভেঙেছে। আর এই চটকল শ্রমিকদের ধর্মঘটের সাফল্যের মধ্য দিয়েই ষাটের দশকে আমরা রাজনীতিতে পথে উঠেছিলাম। ১৯৬৯ সালে এককালের আরএসপির নেতা ও কর্মীদের উদ্যোগে আমরা গঠন করেছিলাম শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল। এ দল গঠনের এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আসন্ন হয়ে উঠল। এ কথা সত্য, চটকল শ্রমিকদের ধর্মঘট শিল্প এলাকায় এক নতুন সংগ্রামের পরিবেশ সৃষ্টি করে। খুলনা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সকল শিল্প এলাকায় শ্রমিকরা আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠে। তখন শ্রমিক এলাকায় আমরা ছাড়া কাজী জাফরদের সংগঠন ছিল টঙ্গী এলাকায়। আমরা আন্দোলন করেছিলাম কঠোর সামরিক সরকারের আমলে। আইয়ুব খান তখন প্রেসিডেন্ট। মোনায়েম খান গভর্নর। এই আন্দোলনে আমাদের সাফল্যে শ্রমিকরা সাহসী হয়ে উঠল। ষাটের দশকের শেষ দিকে ঘেরাও আন্দোলনের শরিক হয় এবং সেই জোয়ারেই তারা ১৯৭১ সালের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আমাদের বাম প্রগতিশীল কোনো লেখকের লেখায় এই ইতিহাস পাওয়া যাবে না। তাঁরা লিখবেন না যে আমাদের কোনো ভূমিকা ছিল। এককভাবে সবকিছু যেন তারা করেছেন। অথচ একাত্তরের পূর্বেও সে আন্দোলনে তাঁদের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না।

কিন্তু ৭১-এর সংগ্রামে আমাদের তেমন ইতিবাচক ভূমিকা ছিল না। আমরা আমাদের শ্রমিকদের ৭১-এর সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলাম কি? আদৌ নয়। আমি ইতোপূর্বে বারবার উল্লেখ করেছি বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা। এ ব্যাপারে সেকালের বিভিন্ন আত্মগোপনকারী বামপন্থী দলসহ ছাত্রলীগের নেতারাও আমাদের সাথে কথা বলেছেন। আমরা বারবারই বলেছি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপরেখা আমরা জানতে চাই। আমরা আর একটা পাকিস্তান গড়তে চাই না। আমরা শোষণমুক্ত বাংলাদেশ চাই। এ কথায় আমাদের সাথে আলোচনা ভেঙে গেছে।

আমাদের ভূমিকা ওই পর্যন্তই। এর পরে আমরা দেশ স্বাধীন কর নিজস্ব লেনো উদ্যোগ গ্রহণ করিনি। হাত-পা গুটিয়ে বসে থেকেছি। ১৯৭১ সালে সশ্রাম শুরু হওয়ার পর আমরা গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছি। আমার জানা মতে এটাই ছিল মোটামুটিভাবে বামপন্থীদের ভূমিকা।

পরিস্থিতি এমন হলে একাত্তরের পরে টগবগে অশান্ত তরুণদের দলে টানা যেত। তাদের আকৃষ্ট করা যেত। আমি মনে করি বামপন্থীদের ভূমিকার জন্যেই আওয়ামী লীগের সেই অশান্ত তরুণরা ভিন্ন দল করেছে। প্রতিষ্ঠিত কোনো বাম দল তাদের টেনে নিতে পারেনি।

তবে ষাটের দশকের শেষ দিকে পূর্ব বাংলা স্বাধীনতার ডাক দিয়ে একটি নতুন দল আত্মপ্রকাশ করেছিল। দলটির নাম সর্বহারা পার্টি। নেতৃত্বে ছিলেন কমরেড সিরাজ সিকদার। দলটি কখনো ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্যে আসেনি। এ দলের অনেক সদস্যই অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু এক সময় কোনো অর্জন ছাড়া এ দলের জীবন দেয়াটাই বড় হয়ে উঠেছিল। ফলে দেখা দেয় অভ্যন্তরীণ সঙ্কট এবং নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব। এ দলটি চমক সৃষ্টি করলেও কোনো বিকল্প রাজনীতির ছবি তরুণদের চোখের সামনে তুলে ধরতে পারেনি।

এই প্রেক্ষাপটেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে একটি নতুন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। একটি রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলোর ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ করে দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। জন্ম নিয়েছিল একটি সংগ্রামী তরুণ গোষ্ঠী। সেকালের বামপন্থীরা তাদের ধারণ করতে পারেনি। ধারণ করতে পারলে এদেশের ইতিহাস ভিন্নভাবে লিখিত হতো।

সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন তখন বিপর্যস্ত। আমরা মাত্র কয়েকটি দল। অলি আহাদ সাহেবের জাতীয় লীগ, লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি, ভাসানীপন্থী ন্যাপ ও আমাদের দল শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল। আন্দোলনে জাসদের ভূমিকা নড়বড়ে। মলানা ভাসানীর ভূমিকাও স্পষ্ট নয়। তিনি কোনো যৌশ সিদ্ধান্ত মানেন না। আমরা এক সময় আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছিলাম। তিনি নির্দিষ্ট দিনের আগেই এসে নিজে নিজেই আইন অমান্য করলেন। কাগমারি চলে গেলেন। শুনলাম তিনি অন্তরীণ হয়েছেন। এ ব্যাপারে আমার বরাবরই সংশয় ছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে মওলানা সাহেব গ্রেফতার হতে পারেন বা তাকে অন্তরীণ করা হতে পারে এ কথা আমি আজো বিশ্বাস করি না। এ সময় কখনো কখনো গ্রেফতার হতেন মশিউর রহমান এবং অলি আহাদ। এর মধ্যে মশিউর রহমান সম্পর্কে নানারকম কথা ছিল। সবচে’ বেশি বিভ্রান্তি ছিল এককালের পিকিংপন্থীদের নিয়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা যে কত ভাগে বিভক্ত হয়েছিল সে হিসাব করা আজো কঠিন। মতিন, আলাউদ্দিন, হক, তোয়াহা, জাফর-মেনন, এর পরে সর্বহারা পার্টি। এ নামগুলো তখন পিকিংপন্থী বলে বলা হতো। আবার এদের মধ্যেও দল-উপদল ছিল। কারো সাথে কারো সদ্ভাব ছিল না। অপরদিকে মস্কোপন্থী বলে কথিত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, দুই ন্যাপ এবং একতা পার্টি তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে। ফলে আন্দোলন গড়ে তোলাই ছিল কষ্টকর। আত্মগোপন করা সর্বহারা পার্টি কখনো কখনো হরতাল ডেকে বা থানা লুট করে চমক সৃষ্টি করত। আন্দোলনের পরিবর্তে সৃষ্টি হতো ভয় এবং শঙ্কা।

তখন আমার নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হতো। দেশ স্বাধীন হয়েছে। পাকিস্তান আমলের কাঠামো নেই। আমাদের দল সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। দু’বছর না কাটতেই স্বাধীনতা সংগ্রাম। দল দাঁড়াতেই পারছে না। এককালে শিল্প এলাকায় শক্তিশালী ছিলাম। তাই সকলের লক্ষ্যবস্তু আমরা। আমাদের দলছুটরাই জাতীয় শ্রমিক লীগ গঠন করে এবং সরকারের ছায়ায় একের পর এক আমাদের ইউনিয়ন হাইজ্যাক করতে শুরু করে। ঢাকায় প্রতিবাদ সভা করা যায় না। সরকারি দল হামলা করে। থানায় এজাহার করা যায় না। আমি সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি বলে কিছু কিছু সামাল দিতে পারি। কিন্তু সাংবাদিক ইউনিয়নের অবস্থাও ভালো নয়।

আমি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হয়েছি। কিন্তু সাংবাদিক ইউনিয়নে আমার দলের একজন সদস্য নেই। ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ, মোজাফফর ন্যাপ, ভাসানী এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যাই বেশি। এদের মধ্যে অনেককেই অন্ধ সরকার বিরোধী। আবার অনেকে সরকারের অন্ধ সমর্থক। যারা দেশের স্বাধীনতা চায়নি ইউনিয়নের তাদের সংখ্যাও কম নয়। অপরদিকে ইউনিয়নের প্রবীণ নেতারা অধিকাংশ পেশা ছেড়ে চলে গেছেন। অনেকে খুন হয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। এই পরিস্থিতিতে ভারসাম্য বিধান করা আদৌ সহজ ছিল না। এরপরে ছিল স্বাধীনতা উত্তর অস্থিরতা। হুমকি এবং সন্ত্রাস। আমি নিতান্তই বিব্রত। দেশ স্বাধীন হলো ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ঢাকা ফিরতে ফিরতে ডিসেম্বর শেষ। তারপর ৭২-৭৩ চলে গেছে। বাড়ি ফিরতে পারিনি। ঢাকায়ই থাকতে হয়েছে। আমার ভাবনার মধ্যে হয়তো একটা বাড়াবাড়ি ছিল। ভাবতাম ঢাকা ছেড়ে গেলে কী অবস্থা হবে। দলের প্রতিদিনের সমস্যা, ইউনিয়নের প্রতিদিনের সঙ্কট। এ সঙ্কটকে মোকাবেলা করবে কে?

এর মধ্যে গ্রাম থেকে একটি খবর এল। খবর হচ্ছে কোটালীপাড়া আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নাম হয়েছে শেখ লুত্যর রহমান আদর্শ মহাবিদ্যালয়। নাম পরিবর্তন করেছে আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা, যারা কোনোদিন এই কলেজ প্রতিষ্ঠার ধারে কাছেও ছিল না। দেশ স্বাধীন হবার পর তারা সব ব্যাপারেই কর্তা সেজে বসেছিল। এরপর একদিন কলেজের অধ্যক্ষ প্রেসক্লাবে এসে আমার সাথে দেখা করলেন। তিনি বললেন, তিনি কলেজে একটি নতুন বিভাগ খুলেছেন। এই বিভাগে মুজিববাদ পড়ানো হবে। আমি অবাক বিস্ময়ে অধ্যক্ষের দিকে তাকালাম। মনে পড়ল ৭১ সালে তার ভূমিকা এবং মনে হলো সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্যে তিনি এ কাজটি করেছেন। তিনি আমাকে জোর করেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যেতে চাইলেন। আমি বললাম, আপনি মুজিববাদের অর্থ জানেন? কলেজে এই বিভাগ খোলবার আগে আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে এই বাদের ব্যাখ্যা কী। পুঁজিবাদ, সমাজবাদ, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, সাম্যবাদের সংজ্ঞা বই পুস্তকে আছে। মুজিববাদের এমন একটা সংজ্ঞা আপনি দিতে পারবেন? তিনি চুপ করে গেলেন।

কোটালীপাড়া কলেজের একটি ইতিহাস আছে। ষাটের দশকের শেষ দিকে ঢাকায় আমরা কয়েক বন্ধু কোটালীপাড়ায় একটি কলেজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এর মধ্যে আমি ছাড়া অ্যাডভোকেট শরাফত চৌধুরী, অ্যাডভোকেট বজলুর রহমান এবং প্রতিষ্ঠার পুরোভাগে ছিলেন অ্যাডভোকেট কাজী হারুনার রশিদ। যিনি মুংও কাজী নামে পরিচিত। টাকা, ধান, চাল ও জমি দিয়ে এলাকার মানুষের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় এ কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় আলোচনা হয়েছিল কলেজের নাম নিয়ে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী বা শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এই কলেজের নাম রাখার প্রস্তাব হয়েছিল। কিন্তু সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল কোনো ব্যক্তির নামে নয়, কোটালীপাড়ার নামে এই কলেজের নামকরণ করা হবে এবং এই নামেই কলেজ স্বীকৃতি পায়।

সবকিছু পাল্টে গেল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। যারা কলেজের প্রতিষ্ঠার সময় কাছাকাছি ছিল না তারা কোন জাদুবলে সব কিছু করার এখতিয়ার পেয়ে গেল। আমার মনে হয় শুধুমাত্র তঙ্কালীন প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্যেই প্রধানমন্ত্রীর পিতার নামে কলেজের নামকরণ করল। আমাদের মতামত নেয়ার প্রয়োজনও অনুভব করল না। আর এ ঘটনার পরে অধ্যক্ষ আমার কাছে এলেন কলেজে মুজিববাদ পড়াবার জন্যে বিভাগ খুলবার কথা শোনাতে। আমার সেদিন ঘৃণা হয়েছিল শিক্ষক নামক এই প্রাণিটির জন্যে। চামচাগিরি করে নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্যে শিক্ষিত বলে কথিত এই প্রাণিগুলো যে কত নিচে নামতে পারে, এই ভভদ্রলোক ছিলেন তার অন্যতম উদাহরণ।

আমি ভভদ্রলোককে বিদায় দিয়ে গণভবনে গেলাম। তখন গণভবনে ছিল আমার অবারিত দ্বার। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের কলেজের নাম পাল্টাল কেন। তিনি বললেন, আপনাদের কথা আমি জানব কী করে। আমি বললাম, আপনি না জানলে এ কাজ হতে পারে না। আপনি জানেন, আমরা কারো নামে কলেজ করতে রাজি হইনি। পাকিস্তান আমলে আপনাদের সঙ্গে আলাপ করেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল কোনো ব্যক্তির নামে কলেজ হবে না। অথচ আপনারা ক্ষমতায় আসার সাথে সাথেই সে পরিস্থিতি পাল্টে গেল। আমরা বরাবরই একটি নির্দিষ্ট অর্থে কোনো ব্যক্তির নামে কলেজ করতে রাজি হইনি। সে ব্যাখ্যা আপনি জানেন। আদর্শ কলেজ হতে হলে আদর্শ ব্যক্তির প্রয়োজন। আমাদের দেশে আদর্শ ব্যক্তির খুব অভাব। এ কথা ভেবেই আমরা কোটালীপাড়া কলেজ নামকরণ করেছিলাম। এ কথা জেনে আপনিও কিছু বলেননি। ঠিক আছে–আপনারা যদি চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, কলেজের নাম পরিবর্তন করবেনই, তাহলে প্রয়োজনীয় টাকাটা আপনাদের সংগ্রহ করতে হবে। কারণ কলেজের নাম পাল্টাতে হলে বিরাট অংকের টাকা দিতে হয়।

আমার কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী গম্ভীর হয়ে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে বললেন, কলেজের নাম যারা পাল্টিয়েছে এই টাকা তারাই দেবে। আমি দিতে যাব কেন? আমাদের কথা সেখানেই শেষ হয়ে গেল। ইচ্ছে ছিল সব জানতে বাড়ি যাব। দেশ স্বাধীন হয়েছে তিন বছর হতে চলল। কিন্তু আমি বাড়ি যেতে পারছি না। এ সময় আবার সংকট দেখা দিল সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের নিয়ে। সরকার নিউজ প্রিন্ট নিয়ন্ত্রণ আইন জারি করেছে। সংসদের লবণ সংক্রান্ত একটি খবর রিপোর্ট করতে গিয়ে দু’জন পূর্ববঙ্গের রিপোর্টার চাকরি হারিয়েছে। আমার আর বাড়ি যাওয়া হলো না।

এসময় মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগত। নিজেকে মনে হতো লেখাপড়া না করলে ভালো হতো। আমার পড়া কিতাবের কোনো কিছুই কাজে লাগছে না। দেশে মুখ্যত তখন তিন দলের রাজনীতি। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি, গণতান্ত্রিক জোট ‘গজ’ গঠন করেছে। মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের মালিকানা তাদের। অন্য কারো কিছু বলার নেই। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা ভিয়েতনামে মার্কিন হামলার বিরুদ্ধে মিছিল করতে গিয়ে গুলি খেয়েছিল। প্রায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। এবার ভিন্ন শ্লোগান দিচ্ছে। শ্লোগান হচ্ছে-দেশ স্বাধীন করেছি, এবার দেশ গড়ার পালা। সত্যি সত্যি ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা অধিক খাদ্য ফলাও অভিযানের অঙ্গ হিসেবে বীজতলা গড়ে তুলল। জিজ্ঞাসা করলে বলত ওটা আপনারা বুঝবেন না। আপনারা হটকারী। প্রকৃতপক্ষে সেকালে কমিউনিস্ট পার্টি চলত মস্কোর নির্দেশে। তাদের তত্ত্ব হচ্ছে, মস্কোর সাথে যে দেশের সম্পর্ক ভালো সে দেশের সরকারও ভালো। সেই অনুসারে বাংলাদেশ সরকারও ভালো। বাংলাদেশের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের সুসম্পর্ক। তাই বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন করতে হবে। ন্যাপের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকলেও রাজনীতি একই।

অপরদিকে সক্রিয় জাসদের গণবাহিনী আর সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি। এদের কাজ থানা লুট, ফাঁড়ি লুট এবং নির্বাচিত হওয়া। এছাড়াও কোনো কোনো এলাকায় সক্রিয় ছিল পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি। এদের রাজনীতি ছিল আমার কাছে দুর্বোধ্য। ১৯৭৪ সালের ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায় শ্লোগান শুনেছি। তাদের সাথে জেল খেটেছি। দিনের পর দিন অনশন করেছি। তাদের রাজনীতি আমি বুঝতাম। ১৯৪৭ সালের আজাদী গরিব মানুষের জন্যে ঝুটা ছিল তাতে সন্দেহ নেই। তবে প্রশ্ন ছিল ওই সময় ওই শ্লোগানের ভিত্তিতে ওই আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব ছিল কিনা। আমার ধারণা সে সময়ে শ্লোগান দিয়ে অসহ্য নির্যাতন সহ্য করেছে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা। তবে সংগঠন মজবুত থাকায় এত নির্যাতনের পরেও টিকে গিয়েছে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে কেন যে আমাদের বন্ধুরা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়াকে একেবারে তোয়াক্কা না করে পূর্ব বাংলা আবার কেউ পূর্ব পাকিস্তান নাম বহাল রেখেই বিপ্লব করতে চাইল তা আজো আমার বোধগম্য নয়। এ ভুল কৌশলের ফলে প্রথমেই ডেকে আনা হলো সরকারি হামলা। কেউ বুঝতে চাইলেন না, অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করার পর ওই নাম দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো কঠিন হবে এবং এ কৌশল গ্রহণযোগ্য হবে না ইতিহাসের বিচারে। এই দু’রাজনীতির যাঁতাকলে আমি বিপর্যস্ত। আমি সর্বত্র আসামির কাঠগড়ায়। কখনো সংবাদপত্রে লিখি, রাজনীতি করি। সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। সকলের সকল অধিকার রক্ষার একটি দায়িত্ব এই সাংবাদিকদের।

এরপরে আছে সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষা। প্রকৃতপক্ষে তাদের জন্যে কিছুই করা যায়নি। পাকিস্তান আমলে সাংবাদিকদের জন্যে দ্বিতীয় বেতন বোর্ড কাঠামো হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। পাকিস্তান থাকলে এতদিনে বেতন বোর্ডের রোয়েদাদ প্রকাশিত হতো। সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা বাড়ত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দ্বিতীয় বেতন বোর্ড গঠিত হয়েছিল। কোনো বাজেট আসছে না। সরকার এগোচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে সকল পত্রিকা বন্ধ হবে। দেশে একদলীয় রাজনীতি হবে। হাতেগোনা কয়েকটি পত্র-পত্রিকা থাকবে। এ সংবাদে সাংবাদিক মহলে নানা শঙ্কা।

সাংবাদিকদের বাসস্থানের সমস্যা আছে। পাকিস্তান আমল থেকে এ দায়িত্বে আমি ছিলাম। এখন দেশ স্বাধীন। সকলের ধারণা আমি ইউনিয়নের সভাপতি না হলে অনেক কিছু পাওয়া যেত। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখোমুখি তর্ক করি। কোনো ব্যাপারে কারো কথা শুনি না। তাই সরকার আমার উপর খুশি নয়। এ নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। সরকারের সাথে মতান্তর চলছেই।

১৯৭৪ সালে নিউজপ্রিন্ট নিয়ন্ত্রণ আইন জারি হলো। সংসদে লবণ নিয়ে বিতর্ক রিপোর্ট করতে গিয়ে চাকরি হারাল দু’জন সাংবাদিক। সব নিয়েই ইউনিয়নকে লড়তে হচ্ছে। আর প্রতিবারই প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমাকে বিতর্কে নামতে হচ্ছে। এর মধ্যে একটি ঘটনা ঘটলো পাবনায়। আমার এক বন্ধুর শ্যালকের বিয়ে। নাম গোবিন্দ দত্ত। ঢাকা থেকে বিমানে ঈশ্বরদী হয়ে পাবনা পৌঁছালাম। দুপুরের দিকে একটি গুলির শব্দ শুনলাম। কৌতূহল হলো। শুনলাম পাবনায় ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে একটি রিজার্ভ হাউস আছে। এই রিজার্ভ হাউসে নাকি যে কোনো লোককে ডেকে এনে যখন তখন হত্যা করা যায়। আমাকে আরো বলা হলো–দীর্ঘদিন ধরে পাবনার আদালতে নাকি কোনো বিচার বসছে না। বিচারকরা শঙ্কিত। তাদের নাকি কোনো বিচারের কাজ করতে দেয়া হয় না। জেলা ছাত্রলীগের নির্দেশে রায় দিতে হয়।

একথা শুনে আমি খানিকটা অবাক হলাম। মনে হলো এ আমি কোন দেশে আছি। একটি জেলা শহরে যে কোনো সময় যে কাউকে ডেকে এনে গুলি করা যায়। আদালতে বিচারক বসে না। অথচ দেশে একটি সরকার আছে। সাধারণ মানুষ এ ব্যাপারে কোনো কথা বলে না। অর্থাৎ ওই শহরে বিরাজ করছে একমাত্র ভয়, শঙ্কা আর সন্ত্রাস। এ ব্যাপারে আমি নিজেই কিছুটা খবর নেবার চেষ্টা করলাম। চেষ্টা করলাম মহকুমা হাকিমের সাথে দেখা করতে। তার দফতরে ঢুকেই আমার আক্কেল গুড়ুম। আমি তাঁর দফতরের বাইরে বসা। ভেতরে তিনি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। কথা বলছেন, আটঘরিয়া থানার একটি অভিযান নিয়ে। ওই থানা নাকি জাসদের ঘাঁটি। সেই থানা অভিযান নিয়ে বিস্তারিত কথা শুনলাম। কিছুক্ষণ পর মহকুমা হাকিমের সঙ্গে কথা হলো। আমি কথা না বাড়িয়ে ঢাকায় ফিরে এলাম। দৈনিক বাংলায় উপ-সম্পাদকীয় লিখলাম। যতদূর মনে আছে শিরোনাম ছিল পাবনায় একটি রিজার্ভ হাউস। আমার লেখার পরে মনে হলো সকলের ভয় ভাঙল। সাম্যবাদী দলের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা বিবৃতি দিলেন সংবাদপত্রে। সরকারি মহলেও কিছুটা প্রতিক্রিয়া হলো। শুনেছি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কথা তুলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নাকি বলেছিলেন, আমার সাথে নয়, নির্মল সেনের সাথে কথা বলো। আমার সঙ্গে কেউ কোনোদিন কথা বলেনি।

তবে আমার লেখার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল পাবনায়। আমার লেখায় ক্ষুব্ধ হয় ছাত্রলীগ। আমাকে তারা প্রেস ক্লাবে খুঁজতে যায়। সেখানে না পেয়ে গোবিন্দ দত্তের বাড়িতে চড়াও হয়। গোবিন্দ ওরফে রণজিৎ দত্ত পাবনা শহরে তখন দুটি রেশন দোকানের মালিক। শুনেছি আমাকে আশ্রয় দেওয়ার খেসারত হিসেবে তাকে একটি রেশন দোকানের মালিকানা ছেড়ে দিতে হয়। পরবর্তীকালে রণজিৎ দত্ত দেশান্তরী হন। কয়েক বছর আগে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

এই ১৯৭৪ সালেই প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। খুন-ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্তরা বাদে ৭১-এর অপরাধীদের মুক্তিদানের নির্দেশ দেয়া হয়। আমি আগেই উল্লেখ করেছি এই ক্ষমা ঘোষণার খবরটি তকালীন রাষ্ট্রপতিও জানতেন না। সেদিন বিকালের দিকে বঙ্গভবন থেকে দৈনিক বাংলায় ফোন করে এ খবরের সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করা হয়।

আমার সেদিন অদ্ভুত লাগছিল। ১৯৭২ সালের শেষের দিকে আমি শ্রেণি বিভাগ করে ৭১-এর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছিলাম। আমি লিখেছিলাম এই অপরাধীদের মধ্যে চিহ্নিতদের ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠানো হোক। অন্যদের বিরুদ্ধে ভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। আমি সব কিছুই লিখেছিলাম পূর্ব জার্মানির অভিজ্ঞতা থেকে। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি সাংবাদিক প্রতিনিধি দল নিয়ে আমি পূর্ব ইউরোপে যাই। আমার সফরের প্রথম দেশ ছিল পূর্ব জার্মান। অর্থাৎ সেকালের কমিউনিস্ট জার্মান। আমি কমিউনিস্ট নেতাদের কাছ থেকে জার্মান যুদ্ধবন্দিদের খবরাখবর নিয়েছিলাম এবং যেখানে তারা নাৎসী যুদ্ধ অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল সেই ব্যবস্থার কথাই সুপারিশ করেছিলাম বাংলাদেশে। কিন্তু কেউই আমার কথা মেনে নেয়নি। তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল বিভিন্ন মহলে। দৈনিক বাংলার বাণীতে লেখা হয়েছিল–সরকারি পত্রিকায় চাকরি করে এত সাহস আমি কোথায় পাই? মুক্তিযুদ্ধের ১৮ মাস না কাটতেই আমি কী করে ৭১-এর অপরাধীদের মুক্তির কথা বলতে পারি? এ নিয়ে পরবর্তীকালে আমাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে।

কিন্তু এখনো আমি বিশ্বাস করি সেদিন আমি সঠিক কথা বলেছিলাম। ১৯৭৪ সালের পরিবর্তে ১৯৭২ সালে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলে দেশ ও জাতি অনেক লাভবান হতো। আরো দুঃখের হচ্ছে এ কাজটি আমাদের করতে হলো সিমলাচুক্তি অনুযায়ী। অথচ এ চুক্তির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। এ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ভারতে আটক ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে ছেড়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এ চুক্তি কেন আমাদের মানতে হলো সে প্রশ্নের ব্যাখ্যা কেউ কোনোদিনই দেননি।

এই সাধারণ ক্ষমার পর আমাকেই আবার নতুন ঝামেলায় পড়তে হলো। সিলেটের কুলাউড়া থেকে এক ভদ্রমহিলা আমার নামে দৈনিক বাংলায় একটি চিঠি লিখলেন। তিনি লিখেছিলেন–সাহস থাকলে এ চিঠি কাগজে ছাপাবেন। চিঠিতে সাধারণ ক্ষমা এবং শেখ মুজিবুর রহমানের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছিল। তিনি লিখেছিলেন, ৭১-এর যুদ্ধে তিনি ইজ্জত হারিয়েছেন। তাঁর স্বামী হারিয়েছেন। আগরতলা ত্রাণ শিবিরে তিনি খুঁজে পেয়েছেন তাঁর শিশু পুত্রকে। লাখ লাখ মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছে। প্রাণ দিয়েছে। এদের শবের ওপর দাঁড়িয়ে রাজাকারদের ক্ষমা করার অধিকার প্রধানমন্ত্রীকে কে দিয়েছে? তিনি প্রশ্ন করেছিলেন এভাবে প্রধানমন্ত্রীর কোনো ঘনিষ্ঠজন কি আদৌ প্রাণ দিয়েছে? তাঁর বক্তব্য হচ্ছে–অন্যের শবের উপর দাঁড়িয়ে কাউকে ক্ষমা করার অধিকার প্রধানমন্ত্রীর নেই।

এ চিঠি আমি ছেপে দিলাম দৈনিক বাংলায়। তবে তার সাথে আমার কিছু মন্তব্য ছিল। আমি বলতে চেষ্টা করেছিলাম, শুধুমাত্র আবেগ দিয়ে কোনোদিন রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায় না। আজ হোক কাল হোক আবেগকে যুক্তিগ্রাহ্য করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।

১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। এ সফর নিয়ে তীব্র বিতর্ক ছিল। ভুট্টো আসার আগে প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ আমাকে ফোন করেন। কিছু একটা লিখুন। ভুট্টো আসছে অথচ আপনারা কেউ কিছু লিখছেন না। এ কেমন কথা। একজনকে কিছু লিখতে হবে।

সেদিন আমার পক্ষে লেখা ছিল খুবই কষ্টকর। তবুও লিখেছিলাম। সে লেখার কিছু কিছু কথা এখনো আমার মনে আছে। আমি লিখেছিলাম ভুট্টো আসবে। আর সেদিন হয়তো সংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেন ও শহিদুল্লাহ কায়সারকে আমার মনে পড়বে। আমার চোখে জল নামবে। তবুও ভুট্টো আসবে। এটাই বাস্তব। কিছুদিন পর গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা। তিনি বললেন, আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। ভুট্টো আসবে, এ বাস্তবতা অস্বীকার করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা আদৌ সম্ভব কি!

১৯৭৪ সালে আর এক ঘটনা হচ্ছে দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষ নাকি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে তাঁর তত্ত্ব লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। অমর্ত্য সেন তার জীবনে দুটি দুর্ভিক্ষ দেখেছেন। একটি ১৯৪৩ সালে। অপরটি ১৯৭৪ সালে। এই দুই দুর্ভিক্ষ থেকে তার অভিজ্ঞতা হচ্ছে-খাদ্যের অভাবই দুর্ভিক্ষের কারণ নয়। প্রচুর পরিমাণ খাদ্য জমা থাকলেও দুর্ভিক্ষ হয়। সেই খাদ্য জনসাধারণের কাছে পৌঁছাচ্ছে কিনা সেটাই বড় কথা। এই পৌঁছানোর সাথে জড়িত সরকারি নীতি এবং জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতা। তাঁর মতে, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের জন্যে খাদ্য অভাব দায়ী ছিল না। আর আমার মতে, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশে একটি ভিন্ন সমস্যাও ছিল। সমস্যাটি হচ্ছে যোগাযোগের অভাব। আমি যতদূর জানি তখন রাজনৈতিক কারণে খাদ্যের অভাব ছিল। বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখে দুটি অপরাধ করেছিল। একটি অপরাধ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরম শত্রু কিউবার সাথে সম্পর্ক স্থাপন। দ্বিতীয় অপরাধ হচ্ছে ঢাকায় বিশ্ব শান্তি পরিষদের উদ্যোগে দক্ষিণ এশিয়া শান্তি সম্মেলন। এই দুই অপরাধের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশগামী খাদ্যশস্যবাহী জাহাজ বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশে খাদ্যের অভাব সৃষ্টি করে। দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে অমর্ত্য সেনের তত্ত্ব বোঝাও আমাদের মতো দরিদ্র দেশের জন্য কঠিন নয়। কিন্তু ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের যে এমন একটি রাজনৈতিক কারণ ছিল এবং সত্যি সত্যি যে খাদ্যশস্যের অভাব ছিল একথা ভুললে চলবে না।

তবে দুর্ভিক্ষের ভিন্ন কারণও ছিল। সে কারণটি হচ্ছে সরকারি দলের দুর্নীতি, দূরদৃষ্টির অভাব এবং সমস্যা মোকাবেলায় নিদারুণ ব্যর্থতা।

এই দুর্ভিক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশে এক অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। সকলের মনে প্রশ্ন দেখা দেয়–এই জন্যই কি আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম? এর চেয়ে তো পাকিস্তান ভালোই ছিল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চিৎকার করা যেত। কিন্তু এখন তো কিছু বলা বা করা যাচ্ছে না। সভা-সমাবেশ মিছিলে সরকারি দল হামলা করে। ট্রেড ইউনিয়ন হাইজ্যাক করে। কোথাও কোনো নিরাপত্তা নেই। রক্ষী বাহিনীর হাতে কবে কতজন নিহত হচ্ছে সে খবর কেউ দিতে পারে না। অসংখ্য তরুণ গ্রেফতার হয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তাদের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে আছে সংশয় ও বিভ্রান্তি। কেউ জানে না দুর্ভিক্ষে কত লোক মারা গেছে। এ নিয়ে জনমনে প্রচণ্ড অসন্তোষ। এ সময় সংসদে জানানো হয় দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা ২৭ হাজারের কিছু বেশি। এ তথ্য সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করল না।

অথচ দেশে রাজনৈতিক কোনো আন্দোলন নেই। কথায় কথায় জাসদ বা সর্বহারা পার্টির কিছু খবর পাওয়া গেলেও অন্যান্য রাজনৈতিক দল একেবারে চুপ। সকলেরই ধারণা একটা কিছু হতে যাচ্ছে। সরকার হয়তো কোনো নতুন পদক্ষেপ নেবে।

সত্যি সত্যি সরকার নতুন পদক্ষেপ নিল। দেশে বিদেশে ক্ষমতা আইন জারি করা হলো। সংবাদপত্রের উপর কড়া নির্দেশ দেয়া হলো। শেষ পর্যন্ত দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলো। সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ হলো। সাপ্তাহিক অভিমত নিষিদ্ধ করা হলো। অভিমত-এর সম্পাদক শেখ আলী আশরাফকে গ্রেফতারের নির্দেশ জারি করা হলো। আমি তখন বাড়িতে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাড়ি যাওয়া হয়নি। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে বাড়ি ছেড়েছিলাম। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। দেশে ফিরলাম জানুয়ারির প্রথমে। কিন্তু ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বাড়ি যেতে পারিনি। একের পর এক ঝামেলা আমাকে ঢাকায় থাকতে বাধ্য করেছে। এছাড়া দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এলাকায় ছিল অস্বস্তিকর পরিবেশ। ক্ষুদে আওয়ামী লীগওয়ালারা রাতারাতি নেতা বনে গেল। যাদের কোনোদিন কোথাও দেখা যায়নি তারা মুক্তিযোদ্ধা বনে গেল। রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান হলো। কলেজ স্কুলের হর্তাকর্তা হয়ে বসল। এলাকায় গেলে এদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা সম্ভব নয়। সংঘাত অনিবার্য। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একটু অপেক্ষা করি। নতুন নেতৃত্বের উচ্ছ্বাস হ্রাস পাক। লুটপাট শেষ হোক। তারপর বাড়ি যাব। এমনকি ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময়ও বাড়ি যাইনি। আর এ সময় হলো এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। প্রকাশ্য দিবালোকে কোটালীপাড়ার মুক্তিযুদ্ধের নেতা কমলেশ বেদজ্ঞ, গোপালগঞ্জের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা লেবুসহ কয়েকজনকে হত্যা করা হলো। বাড়ি পৌঁছে শুনলাম জরুরি আইন জারি হয়েছে। বাড়ি থাকা হলো না। বরিশাল থেকে ঢাকা। দৈনিক বাংলার সম্পাদকীয় তখন বন্ধ করেছে। নির্দেশ দিয়েছে অনিকেত ছদ্মনামে নির্মল সেনের উপসম্পাদকীয় আর দৈনিক বাংলায় ছাপা হবে না।

মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে পড়লো অবজারভারের সহকারী সম্পাদক জোয়াদুর রহমানের কথা। জোয়াদুর রহমান আওয়ামী লীগের ঘোরতর সমর্থক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে দু’জন সাংবাদিক প্রেস ক্লাবে আওয়ামী লীগের কথা বলত তার মধ্যে একজন জোয়াদুর রহমান অপরজন আমিনুল হক বাদশা।

ক্ষমতায় যাবার পর আওয়ামী লীগের আচরণ জোয়াদুর রহমানকে ব্যথিত করেছে। জোয়াদুর রহমান বলত নির্মল দা, আপনি ও মিন্টু অর্থাৎ হলিডের এনায়েতুল্লাহ খান লিখে লিখে প্রমাণ করেছেন, দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে। দেশে কেউ কিছু লিখতে পারছে না। একদিকে সরকার অপরদিকে তাদের সন্ত্রাসী গ্রুপ। তাদের হাত থেকে সাংবাদিকদের রেহাই নেই। এ কথা সত্য, সেকালে আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত জনপদ পত্রিকায় মাঝে মাঝে সরকারের তীব্র সমালোচনা করা হতো। এমনকি দৈনিক বঙ্গবার্তায় ফয়েজ আহমেদও শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে লিখতেন। কিন্তু সকলের ধারণা এরা শেখ সাহেবের নিজের লোক। এরা সকালে লিখলে বিকেলে এদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দেখা হয়। কিন্তু বিপদ হয়েছিল আমাকে এবং এনায়েতুল্লাহ খানকে নিয়ে। আমার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দেখা হতো কিন্তু লেখালেখি সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তিনি করতেন না। শুনেছি দৈনিক বাংলায় আমার লেখা থাকলে তিনি ভোরবেলাই পড়তেন এবং তাৎক্ষণিক নির্দেশ দিতেন। এর প্রমাণ আমি বারবার পেয়েছি। জোয়াদুর রহমানের অভিযোগ আমি ও এনায়েতুল্লাহ খান লিখছি বলে সাধারণ মানুষের ধারণা দেশে সংবাদপত্রে স্বাধীনতা ছিল।

এ সময় ব্যবস্থা নেয়া হলো সাপ্তাহিক হলিডের বিরুদ্ধে। হলিডে বন্ধ করে দেয়া হলো। এনায়েতুল্লাহ খান আমাকে একদিন ফোনে জানালেন তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। আমার বিশ্বাস হলো না। আমি গিয়াস কামাল চৌধুরীকে বললাম, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করো। গিয়াস কামাল চৌধুরী ব্যবস্থা করল। কিন্তু আমাকে ওই দিন ভোরবেলা জানানো হলো–প্রধানমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন না। আমি বললাম, তবু যাব। সকাল ৯-১০টার দিকে বঙ্গভবনে পৌঁছালাম। আমি, গিয়াস কামাল, কামাল লোহানী, রিয়াজ উদ্দিন আহমদ ও এনায়েতুল্লাহ খান। আমাকে দেখে সচিব আবদুর রইস বললেন, আজ আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে না। আমি চেয়ে দেখলাম পেছনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী। বললেন, এসে গেছেন–আবার সাথে এনায়েতুল্লাহ খান। আমি বললাম, দোতলায় চলুন। পুরান গণভবনের দোতলায় উঠেই ডান দিকে কক্ষ। ওই কক্ষের কাছে একটি ছোট কক্ষ আছে। উপরে উঠে ওই কক্ষে গেলাম। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, আপনি ও এনায়েতুল্লাহ খান ওই কক্ষে যান। আপনাদের কথা শেষ করুন।

প্রায় আধঘন্টা পর প্রধানমন্ত্রী এবং এনায়েতুল্লাহ খান ওই কক্ষ থেকে বের হলেন। দেখলাম দু’জনের মুখ অপ্রসন্ন। এনায়েতুল্লাহকে বললাম, প্রেস ক্লাবে যান–আমরা আসছি।

প্রধানমন্ত্রী আমাকে তার কাছে বসালেন, তারপর হঠাৎ উত্তপ্ত হলেন। তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন, এই এনায়েতুল্লাহ খান কে! তার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয় না। সে পত্রিকা কী করে চলে? এ পত্রিকা জুলফিকার আলী ভুট্টোর। আমার পুত্রকে নিয়ে আমি মস্কো সফরে গিয়েছি। এটা কি কোনো সমালোচনার বিষয়বস্তু? পণ্ডিত নেহেরুর সাথে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী গেছেন তাতে কি কোনোদিন কেউ সমালোচনা করেছে? হলিডে আমাদের পক্ষে না লিখে মিথ্যাচার করে। তাদের জন্যে আপনি এসেছেন আমার কাছে। নিজে কোনোদিন আমার পক্ষে একটা লাইন লিখেননি।

প্রধানমন্ত্রী এত উত্তপ্ত ছিলেন, আমি প্রথমে কিছু বলতে পারিনি। এক সময় আমি বললাম, আপনি কার সঙ্গে কথা বলছেন? আমি গোপালগঞ্জের নির্মল সেন নই। বিএফইউজের সভাপতি। প্রধানমন্ত্রী বললেন, বলুন তাহলে আমাকে কী করতে হবে? আমি বললাম–১. এনায়েতুল্লাহ খানের গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করতে হবে। ২. হলিডে বের করতে দিতে হবে। ৩. হলিডে’র আটক কপি ফেরত দিতে হবে। ৪. হলিডে’র নতুন ডিক্লারেশন দিতে হবে। ৫. হলিডে ছাপাবার জন্যে নিউজপ্রিন্ট দিতে হবে। ৬, তথ্য ও বেতার মন্ত্রী শেখ আব্দুল আজিজকে পাল্টাতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী কামাল লোহানীকে জিজ্ঞাসা করলেন, লোহানী, এগুলো করতে হবে নাকি? লোহানী বলল, হ্যাঁ। প্রধানমন্ত্রী বললেন–ঠিক আছে আপনারা যান। কিছুক্ষণ পরে নিচে এসে দেখি শেখ আজিজ এসে হাজির। তিনি আবার ডাক-তার মন্ত্রী হলেন।

যতদূর মনে আছে তখন ছিল রমজান মাস। বিকেলের দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি জিপ পাঠালেন আমার বাসায়। ইফতার পার্টিতে যেতে হবে। ইফতার পার্টিতে গিয়ে দেখলাম এনায়েতুল্লাহসহ সকলে হাজির। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মালেক উকিল খাঁটি নোয়াখালীর ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন। বললেন, আপনি নির্মল সেন-আপনি স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই লিখেছেন। এ লেখা আমি গ্রামে গ্রামে জনসভায় পড়ে শুনিয়ে বলি আমার মানুষকে স্বাভাবিকভাবে মরতেও দিতে পারছি না। এখন কথা হলো, বঙ্গবন্ধু আমাকে একটি সবুজ সংকেত দিয়েছেন। আপনার সকল দাবি মানা হবে।

আমি বললাম, আমার প্রথম প্রশ্ন, সংসদে এনায়েতুল্লাহ খানের বাবার নাম তুলে গালি দিলেন কেন? নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে সংসদে যাদের কথা বলার সুযোগ নেই তাদের সম্পর্কে অবমাননাসূচক কথা বলা যায় না।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মালেক উকিল বললেন–ওই সব কথা আর না। দোষ স্বীকার করছি। আপনার সঙ্গে বসতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, প্রেস অর্ডিন্যান্স সম্পর্কে আপনাদের আপত্তি আছে। আপনাদের সঙ্গে বসে অর্ডিন্যান্স সংশোধনের ব্যবস্থা করতে বলেছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা রেখেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। এরপরেও এনায়েতুল্লাহ খানকে জেলে যেতে হয়েছিল। সে প্রেক্ষিত ভিন্ন। আর আমারও কোনোদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বসা হয়নি প্রেস অর্ডিন্যান্স সংশোধনের জন্যে।

এই পটভূমিতে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। বিশেষ ক্ষমতা আইন জারি করা হয়। এ আইনে বিনা বিচারে আটকসহ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের সব ব্যবস্থা করা হয়। আগেই বলেছি আমি তখন বাড়িতে ছিলাম। দেশ স্বাধীন হবার ৩ বছর পরেও বাড়ি যেতে পারিনি। সব সময় একটা আশঙ্কা থাকত কোথায় কী একটা ঘটবে। আমার ঢাকা ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। এবার বাড়ি গিয়ে সেই অবস্থারই মুখোমুখি দাঁড়ালাম। জরুরি অবস্থার কথা শুনে ঢাকায় ফিরলাম। ঢাকায় ফিরে শুনি দৈনিক বাংলায় আমার উপসম্পাদকীয় লেখা বন্ধ। সম্পাদকদের মিটিং ডেকে নাকি এই নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। মাথাটা বিগড়ে গেল। পরের দিন সন্ধ্যায় নতুন গণভবনে গেলাম প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে। আমার সাথে ছিলেন গিয়াস কামাল চৌধুরী, কামাল লোহানী ও রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। আমাকে দেখেই প্রধানমন্ত্রী বললেন, জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরপর আপনি নাকি আত্মগোপন করেছেন। বিবিসি বলেছে, নির্মল সেন ঢাকায় নেই; ঢাকার বাইরে চলে গেছে। আমি বিবিসির খবর শুনিনি। বললাম, আমি বাড়ি গিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী বললেন, শুধু বাড়ি নয়, আপনি বরিশালও গিয়েছিলেন। আমি সবই জানি। আপনি কোথায় কখন যান।

আমি বললাম-–ঠিক আছে, আমি বরিশালও গিয়েছিলাম। আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনি সাপ্তাহিক অভিমত বন্ধ করেছেন কেন? অভিমতের সম্পাদক আলী আশরাফকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন। আমি নই, আলী আশরাফ আত্মগোপন করেছে। প্রধানমন্ত্রী বললেন, আলী আশরাফ কোথায় আছে আমি জানি। তার পত্রিকা বের করার দরকার নেই। আলী আশরাফ বরিশালের বগুড়া রোডে তার বোনের বাসায় সন্তোষ ভবনে আছে। তাকে ইচ্ছে হলেই গ্রেফতার করা যায়। তাকে গ্রেফতার করার ইচ্ছে আমার নেই। তাকে কিছুদিন গোপনে থাকতে বলুন। প্রয়োজন হলে সে ঢাকায় এসে আপনার বাসায় থাকুক। তবে পথে যদি তাকে পুলিশ গ্রেফতার করে আমি কিছু করতে পারব না। কারণ বিশেষ ক্ষমতা আইনে জামিনের ব্যবস্থা নেই। ওকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

আমি বললাম-এবার আমার কথায় আসা যাক। আপনি আমার লেখা বন্ধ করলেন কেন? আর সে কথা আমাকে না জানিয়ে সম্পাদক সাহেবকে জানালেন কেন? তারা তো আপনার সামনেই ভয়ে কথা বলে না। তাদের কাছে এ কথা বলে লাভ আছে? তবে আপনার কথা আমি মানব না। আমি আজকেই এই গণভবন থেকে ফোনে দৈনিক বাংলায় আমার লেখা দেবো। প্রধানমন্ত্রী খানিকটা গম্ভীর হলেন। ইংরেজিতে বললেন নির্মল সেন, আপনাকে আমি জেলে পুরব না; আপনি জনপ্রিয় হবেন। আপনার জন্য একটি সিসার গুলিই যথেষ্ট। আমি বললাম, প্রধানমন্ত্রী, একই কথা আপনার জন্যেও প্রযোজ্য। আপনার জন্যেও একটি সিসার গুলিই যথেষ্ট। প্রধানমন্ত্রী হেসে ফেললেন। বললেন, শুনুন, একটি ঘটনার কথা বলি। সেদিন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে এক সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়েছিলাম। ফিরতে ফিরতে মাধাইয়ার কাছে সন্ধ্যা হয়ে গেল। হঠাৎ মনে হলো কেউ যদি একটা গুলি করে দেয়। তাহলে কী হবে। সবাই চুপ হয়ে গেলাম। আমি বললাম, সব কথাইতো শুনলাম। আমি কিন্তু আজই দৈনিক বাংলায় অনিকেত নামে আবার লিখব। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ঠিক আছে। তবে একটি শর্ত আছে। শর্তটি হচ্ছে আপনি গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়া নিয়ে লিখতে পারবেন না। আমি বললাম, নিজের এলাকা নিয়ে লিখতে পারব না কেন। সেখানে তো হাজার হাজার মানুষ এখনও পুনর্বাসিত হয়নি। এখনও তাঁবুতে আছে ভারত থেকে ফিরে আসা শরণার্থী। প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমি সবই জানি। আপনিও লিখেছেন। কিন্তু নিজের এলাকায় আগে কিছু করা যাবে না। আমি বললাম, গোপালগঞ্জ কোটালীপাড়া সড়ক সম্পর্কে আপনি একই কথা বলেছেন। এ সড়ক শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। আজ পর্যন্ত সে সড়ক সমাপ্ত হলো না। আপনি মাটি কাটার জন্যে একটি বার্জ দিয়েছেন। সেই বার্জ থেকে তেল চুরি হচ্ছে। কোনো কাজের কাজ হচ্ছে না। এ কথা আমি বারবার লিখেছি। আপনি জবাব দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এলাকার কাজ আগে করতে নেই। এতে দুর্নাম হয়।

এরপর আমাদের বৈঠক শেষ হলো। আমি গণভবন থেকে দৈনিক বাংলার জন্যে ফোনে একটি লেখা দিলাম। লেখাটি ছিল বস্তি উচ্ছেদ নিয়ে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর ৬৪ ঘণ্টার নোটিশ দিয়ে বস্তি উচ্ছেদ শুরু হয়। এই বস্তি এলাকায় এককালে আমাদের ও পরবর্তীকালে জাসদের সংগঠন ছিল। আমি মনে করি ১৯৬৯ সালের গণঅভুত্থানে বস্তিবাসীরাই সবচে’ বড় ভূমিকা পালন করেছে। তাদের খবর কেউ রাখে না। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এদের উপরই প্রথম হামলা হয়েছে। আবার ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে কেন্দ্রে হাজির করেছে। প্রতিশ্রুতি দেয়া ছাড়া তাদের পুনর্বাসনের কথা কেউ ভেবে দেখেনি। এবারও তারা জরুরি অবস্থার প্রথম শিকার হয়েছে। আমি আমার লেখায় প্রশ্ন করেছিলাম, বছর বছর কি এরাই নির্যাতিত হবে? এদের বলির পাঠার মতো ব্যবহার করা হবে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার কি এদের পুনর্বাসনের কথা ভাবতেও পারত না।

এর কদিন পরে আমার একটি লেখা বের হলো দৈনিক বাংলায়। সে লেখা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। তখন বিশ্ববিদ্যালয় হলে সস্তায় খাবারের ব্যবস্থা ছিল এবং সব খরচই ছিল দুর্নীতিমূলক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি হলে হাজার হাজার বাড়তি রেশন কার্ড দেয়া হতো। বাড়তি রেশন কার্ড দিয়ে সস্তায় খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। আমি লিখেছিলাম, এ অস্বাভাবিক ব্যবস্থা চলতে পারে না। শিক্ষাঙ্গনে যদি এভাবে দুর্নীতি চালু করা হয়, সেখানে সুশিক্ষার অবকাশ কোথায়। আমি তো দেখছি সরকারি উদ্যোগে ছাত্রদের চৌর্যবৃত্তি শেখানো হচ্ছে। ছাত্রদের হাতে রাখার জন্যে এটা কোনো কৌশল হতে পারে না। এটা একান্তভাবেই অপকৌশল। অবিলম্বে এটা বন্ধ করা হোক।

তখন বাকশাল আইন জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। সর্বত্র একটি ভয় ও শঙ্কার পরিবেশ। সকল বিরোধী দল, বিরোধী দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছাত্র, যুব শ্রমিক সকল সংগঠন ভেঙে দেয়া হয়েছে। দেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকবে। দলের নাম বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। ছাত্রফ্রন্টের নাম হবে জাতীয় ছাত্রলীগ। এমনি করে জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় কৃষক লীগ নামে বিভিন্ন ফ্রন্ট থাকবে। বাংলাদেশে কাউকে রাজনীতি করতে হলে এই সংগঠনে যোগ দিতে হবে। ভিন্ন কোনো সংগঠন করা যাবে না।

তখন আমাদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। স্কুল জীবন থেকে রাজনীতি করেছি। বাবা-মা, ভাই-বোন কারো দিকে ফিরে তাকাইনি। বছরের পর বছর জেল খেটেছি। একাত্তরে যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। সেই স্বাধীন দেশে একটি দল ক্ষমতায় এসে বলল–আর কারো দল থাকবে না। শুধুমাত্র থাকবে তাদের দল। রাজনীতি করতে হলে আমাদের দল অর্থাৎ বাকশালে যোগ দিতে হবে। এই আমাদের দল বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, মোজাফফর ন্যাপ ও একতা পার্টি। তারা সবাই মিলে আমাদের দল ভেঙে দিলেন। আমাদের সাথে একটি কথাও বলা হলো না। জিজ্ঞাসাও করা হলো না এ সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে। অথচ আমরা তার কারো খাস তালুকে বাস করতাম না। আমাদের দল ভেঙে রাজনীতি শেষ করে দেবার জন্যে কাউকে আমরা সংসদে নির্বাচিত করিনি। সরকারি দলের নির্বাচনী ইশতেহারে এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও ছিল না। সবচেয়ে বিস্ময়ের এবং দুঃখের হচ্ছে সেকালে যাঁরা এ রাজনীতি করতেন তারা আমাদের মনের অবস্থা ভাবতে চেষ্টা করতেন না। আমাদের দীর্ঘদিনের ত্যাগ তিতিক্ষাকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চাইলেন। তাঁরা আমার বুকের কাছে যেন ছুরি ধরে বললেন-আমরা তোমাদের রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছি। তোমাদের সমস্ত অতীত সংগ্রামের ইতিহাস নস্যাৎ করে দিচ্ছি। তবে এরপরেও তোমাদের বাকশালকে ভালোবাসতে হবে। এই ভালোবাসা চাওয়া-পাওয়ার বাক বিতণ্ডা এখনো চলছে। আর এ পটভূমিতে আমাকে ডেকে পাঠালেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এখন প্রধানমন্ত্রী নন। তিনি বাকশালের প্রেসিডেন্ট এবং দেশেরও। আমি সেদিন সংসদ ভবনে গিয়েছিলাম। আমাকে খবর দেয়া হলো প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে ডেকেছেন। আমার সাথে আর কেউ নয়। আমাকে একাই যেতে হবে। সংসদে প্রেসিডেন্টের কক্ষে ঢুকে দেখলাম শেখ সাহেবের সাথে আছেন সংসদ সদস্য মহিউদ্দীন আহমদ। কোটালীপাড়ার সংসদ সদস্য সন্তোষ বিশ্বাস ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা। আমি ঢুকতেই প্রেসিডেন্ট বললেন, কাল থেকে দৈনিক বাংলায় আপনার লেখা বন্ধ। আপনি উপসম্পাদকীয় লিখতে পারবেন না। আপনি দৈনিক বাংলায় চাকরি করবেন, বেতন নেবেন, এর বেশি কিছু নয়। আমি বললাম, আপনার এ নির্দেশ আমি মানতে বাধ্য নই। আমি আজই দৈনিক বাংলায় আবার লিখব। কারণ এ পত্রিকার মালিক আপনি নন। দৈনিক বাংলা আমাদের রক্তে গড়ে উঠেছে। আপনারা এ পত্রিকার দখলদার মাত্র।

অনেকে বলেন, আমি শেখ সাহেব খুন হওয়ার পর আর সরকারের বিরুদ্ধে লিখিনি। আজো আওয়ামী লীগের বন্ধুরা এ কথা বিশ্বাস করেন এবং মানুষকে বলে বেড়ান। এ কথা সত্যি, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন করার পর ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাকে লিখতে কেউ বারণ করেনি বা বাধা দেয়নি। মনে রাখতে হবে তখন দেশ স্বাধীন হয়েছে সবেমাত্র। আমাদের কলাম নিষিদ্ধ করা বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হাত দেয়া সম্ভব ছিল না এবং ১৯৭৩ সালের আগস্টে সেকালের সরকার পাকিস্তান আমলের প্রেস আইন নামক কালাকানুন বাতিল করেছিলেন। আর ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে জরুরি আইন জারি করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আমার লেখা বন্ধ করেন। আমি বারবার এ কথা লিখেছি। কিন্তু এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতা এবং সাংবাদিক আজো বলেন–আওয়ামী লীগের আমলে আমার স্বাধীনতা ছিল। তারপর ছিল না এবং লিখিওনি। একথা সত্যি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আমার লেখার স্বাধীনতা ছিল। মনে রাখতে হবে আমি বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত প্রথম সভাপতি ছিলাম। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। বাকশাল আইন পাস হওয়ার পর তকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে ডেকে নিয়ে জানান–দৈনিক বাংলায় অনিকেত ছদ্মনামে আপনার লেখা আর চলবে না। আপনি চাকরি করবেন–বেতন নিবেন। আপনাকে উপ-সম্পাদকীয় লিখতে হবে না।

ওই সময় সেখানে তল্কালীন সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন আহমদ উপস্থিত ছিলেন। তিনি শেখ সাহেবকে লক্ষ্য করে বললেন, উনি তো ভালো লেখেন। লেখা তুমি কেন বন্ধ করবে? শেখ সাহেব বললেন, জানি ভালো লেখে। আর লিখলে ছ’টি এজেন্সির ফোন আসে। আরো লক্ষ করেছি তার লেখার শেষ দিকে হুল থাকে, যা আমাদের লোকদের কাছে সমস্যা। আমি বললাম, এতে কিছু আসে যায় না। আমার কথা আমি লিখি। মহিউদ্দিন সাহেব আবার মুখ খুললেন। বললেন, দেখুন আমরা বাকশাল গঠন করেছি। আপনি বাকশালের বিরুদ্ধে লিখলে আমাদের পক্ষে অসুবিধা হবে। মানুষ আমাদের চেয়ে আপনাকে বেশি বিশ্বাস করে। তাই আপনার লেখা বন্ধ করা প্রয়োজন কিছুদিনের জন্যে হলেও। আমি বললাম, আমার পক্ষে কোনো অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব নয়। এবার শেখ সাহেব তার পুরানো কৌশল নিলেন। তিনি হাত জোড় করে বললেন–বলুন তো আমি কে?

আমি বললাম, বর্তমানে রাষ্ট্রপতি। পূর্বে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। শেখ সাহেব বললেন, রাষ্ট্রপতির অনুরোধ–আপনি তিন মাসের জন্যে লিখবেন না। আপনি চাকরি করবেন–বেতন নিবেন। এ কথা আপনার সম্পাদকও জানবেন না। আমি বললাম, এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি ইউনিয়নের সভাপতি।

অবস্থা এমন হলে আমি দৈনিক বাংলা থেকে পদত্যাগ করব। শেখ সাহেব বললেন, ঠিক আছে পদত্যাগ করুন–And join my Government. আমি বললাম, You have chosen a wrong person. I will not join your Government

শেখ সাহেব চুপ করে থাকলেন। আমি বললাম, আমি আসি। এই বলে রাষ্ট্রপতির কক্ষ থেকে বের হয়ে এলাম। বাইরে এসে দেখলাম সাংবাদিকদের ভিড়। সামনে বাংলাদেশ টাইমস-এর সম্পাদক শহীদুল হক। জিজ্ঞাসা করলেন, কী হলো রে, নির্মল? আমি বললাম, দৈনিক বাংলা থেকে পদত্যাগ করব। চাকরি করব, বেতন নেব, লিখব না, এটা হতে পারে না। শহীদুল হক চিৎকার করে উঠলেন, না নির্মল, তা হয় না। আপনি না থাকলে কেউ থাকবে না। আমাদের কী অবস্থা হবে?

ক্লাবে ফিরে এলাম। বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করলাম। রাজনীতির বন্ধুরা বলল–এ পরিপ্রেক্ষিতে দৈনিক বাংলায় চাকরি করা ঠিক হবে না। তবে ইউনিয়নে থাকতে হবে। কারণ সকল রাজনৈতিক দল ভেঙে দেয়া হয়েছে। কথা বলার কেউ নেই। আপনাকে ইউনিয়ন ছেড়ে গেলে চলবে না।

কিন্তু আমি কী করব? বাকশাল আসছে। মাত্র চারটি দৈনিক থাকবে। তাও ঢাকায়। পরে দুটি দৈনিক বের হতে পারে। আরো থাকবে শতাধিক সাপ্তাহিক। সিনেমা, বিনোদন পত্রিকা। শত শত সাংবাদিক চাকরি হারাবে। আমি এদের কী জবাব দেব? এখন ইউনিয়ন ছাড়লে বলা হবে নির্মল সেন গোপালগঞ্জের লোক, শেখ সাহেবের লোক। আমাদের বিপদে ফেলে চলে গেছে। নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম। পত্রিকা থেকে ছুটি নেব। তারপর দেখব কোথার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? এরপর একটির পর একটি ঘটনা ঘটতে থাকল। একদিন প্রেসিডেন্ট ইউনিয়নকে ডাকলেন পত্রিকা বন্ধ করা নিয়ে। এনায়েতুল্লাহ খান গ্রেফতার হলেন। বন্ধ হলো দ্য পিপল। সম্প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকল। কখনো সে সম্পর্কের আর উন্নতি হয়নি।

নির্দিষ্ট তারিখ মনে নেই। একদিন দুপুরে শুনলাম হঠাৎ সরকার দ্য পিপল পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে প্রথম পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এই পত্রিকাটি পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল। আমি অবাক হলাম। কারণ সরকারের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছিল ইউনিয়নকে না জিজ্ঞেস করে কোনো পত্রিকা বন্ধ করা হবে না। কারণ বাকশাল আমলে ওই সব ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে আলোচনার মাধ্যমে।

আমি, গিয়াস কামাল, কামাল লোহানী ও রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ নতুন গণভবনে গেলাম। সন্ধ্যা আসছে। গিয়ে শুনলাম কেবিনেট মিটিং শেষ হয়েছে। মন্ত্রিসভার সকল সদস্য লনে পাঁয়তারা করছেন। আমরা ওখানে পৌঁছালে দেখলাম কেউ তেমন অভ্যর্থনা জানায় না। সবাই চুপ। আমি শেখ সাহেবকে বললাম, আমাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমি বললাম, আপনি পিপল বন্ধ করেছেন কেন? আমাদের সকলকে চমকে দিয়ে তিনি বললেন, Nirmal Sen, You are going far. আমি বললাম–প্রেসিডেন্ট, তাহলে You are a Liar. শেখ সাহেব আরো জোরে বললেন, You are going too far. আমি আবার বললাম, Then You are a Liar. একথা বলে আমি বসতে গেলাম। চারদিকে পিনপতন নিস্তব্ধতা। আমি বললাম, আপনার সাথে কথা ছিল আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে কোনো পত্রিকা বন্ধ হবে না। অথচ আজ দুপুরে আমাদের না জানিয়ে পিপল বন্ধ করা হয়েছে। এবার শেখ সাহেবের গলা চড়া হলো। বললেন, মনসুর, পিপল কি বন্ধ হয়েছে? প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী বললেন, পিপল বন্ধ করা হয়েছে। শেখ সাহেব বললেন, ঠিক আছে, আমি জ্যামাইকা যাচ্ছি। জ্যামাইকা থেকে ফিরে আসার পূর্বে সকলের টাকা পয়সা দিয়ে দেব। আমি বললাম, আমি টাকা চাইতে আসিনি, পত্রিকা চাইতে এসেছি। শেখ সাহেব বললেন, ঠিক আছে, আমি ফিরে আসি।

চারদিকে আবছা অন্ধকার। দূরে বড় কালো গাড়িটার দিকে শেখ সাহেব দাঁড়ানো। দূরে কামাল লোহানীর সঙ্গে দেখা করলেন মনসুর আলী। এ সময় শেখ সাহেব আমাকে কাছে ডাকলেন। বললেন–দেখছেন, পাবনার মানুষ কি ভালো? মনসুর আর লোহানী কথা বলছে। তখন বললাম, হ্যাঁ, হেমায়েতপুরে তাদের বাড়ি।

এবার শেখ সাহেব অন্ধকারের দিকে তাকালেন। বললেন, নির্মল সেন সত্যি সত্যি দেশটা গুণ্ডার দেশ হয়ে গেছে। কিছু করতে পারলাম না। আপনি ঠিক বলেছেন, দেশটা হবে গুণ্ডার দেশ। ছোট মামাকে কোলকাতা থেকে না এনে ভালো হয়েছে।

এখানে বলে রাখা ভালো যে, শেখ সাহেবের মা আমার ছোট কাকাকে ভাই ডেকেছিলেন। সেই সুবাদে আমার ছোট কাকা শেখ সাহেবের ছোট মামা। আমার ছোট কাকা ১৯৬৫ সালে কোলকাতা চলে যান। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে শেখ সাহেব বলেছিলেন, ছোট মামাকে নিয়ে আসুন। আমি বলেছিলাম, তাঁকে আনা ঠিক হবে না। দেশটা হবে গুণ্ডার দেশ। কাকা ভারতের নাগরিক। বিপদ হবে।

এরপরে একটি অদ্ভুত কথা বললেন তিনি। বললেন, নির্মল সেন, আপনি আর কামালের মা আমাকে সমর্থন দিলেন না কোনো ব্যাপারে। কিছু করতে পারল না। দিন দিন অন্ধকার গম্ভীর হচ্ছে। আমার কিছু বলার ছিল না। কারণ শেখ সাহেবের পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ঘনিষ্ঠ ছিলাম না। আমি শেখ সাহেবের মৃত্যুর পূর্বে মাত্র দু’দিন তাঁর ৩২ নম্বরের বাসায় গিয়েছি। তবে এ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ছাত্রজীবনে। আমি গিমাডাঙ্গা-টুঙ্গিপাড়া নিম্নমাধ্যমিক স্কুলে পড়েছি। একই শিক্ষক আমাদের পড়িয়েছেন তবে বিভিন্ন সময়ে। আমরা দু’কাকা ওই এলাকায় পাটগাতীতে ডাক্তারি করতেন।

শেখ সাহেবের সাথে আমাকেও ভাবতে হলো বারবার। সত্যি সত্যি আমি কী করব। বাকশাল গঠিত হতে যাচ্ছে। সকল রাজনৈতিক দল ভেঙে দেয়া হয়েছে। একটি মাত্র রাজনৈতিক দল অর্থাৎ বাকশাল থাকবে। এমনি করে থাকবে জাতীয় ছাত্রলীগ, জাতীয় যুবলীগ, কৃষক লীগ। সর্বত্র আওয়ামী লীগ পন্থীদের খবরদারি। সাথে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও জনতা পার্টি। এদেরও খুব পাত্তা দেয়া হবে বলে আমার ধারণা নেই। আমাদের আর কারো রাজনৈতিক অস্তিত্ব থাকবে

তাহলে আমরা বাঁচব কী করে? আমরা কি আত্মগোপন করব? কিন্তু দল তো সেভাবে গঠিত হয়নি। এমনিতেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের বিপর্যস্ত অবস্থা।

এই তোপের মুখে কেউ দাঁড়াতে পারছে না। আমি সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা হওয়ায় কিছুটা হালে পানি পাচ্ছি। আমার লেখার জন্যে দেশবাসীর কাছে আমি পরিচিত। সাংবাদিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকায় হয়তো আমার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ইতোমধ্যে তিন মাসের নোটিশে আমাদের দলের পুরনো অফিস থেকে উৎখাত করা হয়েছে। এরপরে সংসদে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সব দল ভেঙে দেয়া হবে। একটি মাত্র দল থাকবে। এই দলের নাম হবে বাকশাল।

এরপরেও আমার একটা বাড়তি অস্তিত্ব আছে। অস্তিত্ব হচ্ছে সাংবাদিক ইউনিয়ন নিয়ে। এই একটি মাত্র ইউনিয়ন দেশ স্বাধীন হবার পর সরকারের কাছে মাথা নত করেনি। কিন্তু এখন কী করবে? সাংবাদিক ইউনিয়ন কোনো জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত নয়। একক এবং স্বাধীন। দেশের আইন মানতে হলে সাংবাদিক ইউনিয়নকে শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। অথচ মরে গেলেও আমরা অনেকেই শ্রমিক লীগে যাব না, সে কথা সবাই জানে।

কিন্তু আমি কিংবা আমরা শ্রমিক লীগে না গেলেও সাংবাদিকদের সমস্যা থাকবে। এ সমস্যা আমি এড়াব কী করে? তাই একমাত্র বিকল্প পথ হচ্ছে বাকশালের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা বা সব কিছু থেকে সরে দাঁড়ানো।

কিন্তু সরে দাঁড়ানো কি সম্ভব? সংবাদপত্রের কয়েক হাজার সাংবাদিক ও কর্মচারী কর্মচ্যুত হবে। তাদের সমস্যার সমাধান কী করে হবে? ভুল করে হোক আর শুদ্ধ করে থোক তখন আমার মতো তিন-চারজন নেতাই সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমার বন্ধুরা আমার ওপর খুবই নির্ভরশীল। আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ। শেখ সাহেবের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। আমি সরকারের কাছ থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা নিইনি। আমি মন্ত্রীদের সাথে মুখে মুখে তর্ক করি। ফলে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল, আমার অধিকাংশ বন্ধুরা আমার ওপর বেশি নির্ভর করত। এ নির্ভরতা আদৌ সঠিক ছিল না।

এছাড়া আমার নিজস্ব একটি রাজনৈতিক দর্শন ছিল। আমি একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য। আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি, বাকশাল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। বাকশাল একটি রাজনৈতিক আদর্শ। বিকল্প রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে বাকশালকে ঠেকানো যাবে না। এ দায়িত্ব না ইউনিয়নের না রাজনীতিকদের।

কিন্তু বাকশাল গঠনের পর লক্ষ করলাম কোনো দলই তেমন কথা বলল না। রাজনৈতিকভাবে কেউ বাকশালের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টাও করল না। মনে হলো সকলেই যেন সাংবাদিক ইউনিয়নের দিকে তাকিয়ে আছে। এ ঐতিহ্য দীর্ঘদিন আগের। পাকিস্তান আমলে বিশেষ কারণে সাংবাদিকদের একটি রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল। রাজনৈতিক অঙ্গনে শূন্যতার জন্য সাংবাদিকদের মাঠে নামতে হতো। সেকালে যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকত সাংবাদিকরা। সংবাদপত্রের। স্বাধীনতার জন্যে তাদের মুখ্য ভূমিকা নিতে হতো। অথচ মুখ্যত এ দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের। কারণ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ব্যাহত হলে দেশবাসী ক্ষন্ত্রিস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল। তাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার আন্দোলন মুখ্যত রাজনীতিকদের। সাংবাদিকরা সেখানে সহায়ক শক্তি। ভারতেও লক্ষ করা গেছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্যে মুখ্যত লড়ছে রাজনৈতিক দল। অপরদিকে পাকিস্তান এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে কোনো কিছু হলেই সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাজনীতিকদের দিকে নয়। এ প্রেক্ষিতে বাকশাল গঠনের পর বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলো সাংবাদিক ইউনিয়ন।

বাকশাল গঠনের পর মুখ্য হয়ে উঠলো সংবাদপত্রের কথা। দেশে মাত্র ৪টি সংবাদপত্র থাকবে। হাজার হাজার সাংবাদিক কর্মচারী চাকরি হারাবে। ‘ এটাই বড় হয়ে দেখা দিল এবং সকলের মুখে একই কথা, দেখি না সাংবাদিকরা কত দূর যায়। অথচ কেউ প্রশ্ন করল না, দেশে একদলীয় শাসন হচ্ছে। রাজনৈতিক দল ভেঙে দেয়া হচ্ছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের যুগ শেষ হচ্ছে। অথচ কোনো রাজনৈতিক দলই মাঠে নামছে না। এমনকি মওলানা ভাসানী পর্যন্ত একটি হুঙ্কার দিচ্ছেন না। কেন? তিনি ডাকলে তো অনেক কিছু হয়। সেই রাজনীতিকরা টু-শব্দটি করলেন না। সকল প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো সাংবাদিক ইউনিয়নকে।

এই পরিস্থিতিতে দেশের প্রেসিডেন্ট ও বাকশালের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি ইউনিয়ন নেতাদের সাথে কথা বলবেন। আমার সাথে তখন শেখ সাহেবের সম্পর্ক ভালো নয়। তবু আমাকে যেতে হবে। বন্ধুরা বললেন–আপনি কোনো কথা বলবেন না। সব কথাই আমরা বলব। আপনি কথা বললে শেখ সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে যান। কোনো আলোচনাই এগোয় না। এবার আপনি কোনো কথা বলবেন না।

কিন্তু ঘটনা সেখানে ঘটল না। আমি নতুন গণভবনে ঢুকতেই শেখ সাহেব বললেন, কেমন আছেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব? আমার পাশেই বসুন। আমি তার পাশে বসলাম। শেখ সাহেব তাঁর কথা শুরু করলেন। তিনি বললেন, বাকশাল গঠন করেছি। ৪টি পত্রিকা থাকবে। পরবর্তীকালে আরো দুটি পত্রিকা বের করা হবে। কিন্তু সাপ্তাহিক ও মাসিক থাকবে। এসব হবে বিনোদনমূলক কাগজ। চাকরিচ্যুত সাংবাদিক ও কর্মচারীরা নতুন চাকরি পাবে। যতদিন তারা চাকরি না পায় ততদিন তাদের মূল বেতনের সমপরিমাণ টাকা সরকার দিয়ে যাবে। তাদের চাকরির ধারাবাহিকতা ও মূল বেতন সংরক্ষণ করা হবে। আপনাদের কাউকে আমি কর্মচ্যুত করতে চাই না।

আমরা চুপ করে শেখ সাহেবের কথা শুনছিলাম। আমার বন্ধুরাও চুপ। আমার সাথে ছিলেন গিয়াস কামাল চৌধুরী, কামাল লোহানী ও রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। শেখ সাহেব আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, কোনো কথা বলছেন না কেন। আমি বললাম–আমার বলার কিছু নেই। আমি বিএফইউজের সভা ডাকব। এ সভায় কী সিদ্ধান্ত হয় তা আপনাকে জানাব। ব্যক্তিগতভাবে আমার বলার কিছু নেই। আমার কথার প্রতিক্রিয়া হলো। শেখ সাহেব তীব্র কণ্ঠে বললেন–এ দেশে কোনো ইউনিয়ন-টিউনিয়ন নেই। সব বাতিল হয়ে গেছে। আপনাদের ডেকেছি সমস্যা সমাধানের জন্যে। অন্য কিছু বলার অবকাশ নেই। আমি বললাম, আমি যা বলেছি তারচে’ বেশি কিছু বলতে পারব না। শেখ সাহেব বললেন, ঠিক আছে, মিটিং করুন। কিন্তু সংবাদপত্রে কোনো বিজ্ঞপ্তি যাবে না। এ কথা যেন মনে থাকে।

বৈঠক শেষ হলো। ফেরার পথে শেখ সাহেবের সচিব আবদুর রহিমের সাথে দেখা হলো। তিনি বললেন, দাদা এটা আপনি কী করলেন? কোনো প্রতিবাদ না করে বঙ্গবন্ধুর কথা মেনে নিলেন? ভোরবেলা থেকে তিনি বড় বিচলিত ছিলেন। তিনি বারবার বলেছেন, আমি সকলকে মানাতে পারব। নির্মল সেনকে মানাতে পারব না। নির্মল সেন বাকশাল মানবে না। পত্রিকাও বন্ধু হতে দেবে না। সে ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। তাকে নিয়ে কী করব। এই বলে রহিম সাহেব কিছুটা থামলেন। বললেন, কাজটা আপনি ভালো করেননি। আপনিই একমাত্র পত্রিকা বন্ধ ঠেকাতে পারতেন। আমি এর কোনো জবাব না দিয়ে নতুন গণভবন থেকে চলে এলাম।

প্রেস ক্লাবে ফিরে দেখি প্রায় একই পরিস্থিতি। বিদেশি সাংবাদিকরা বসে আছে। সব কথা শুনে তারা বললেন–নির্মল সেন, আপনি ভুল করেছেন। আপনি স্ট্যান্ড নিলে পত্রিকাগুলো বাঁচত। প্রয়োজন হলে আপনি আজই ঘোষণা দিয়ে আমরণ অনশন করুন। সরকার আপনার কথা শুনবে।

আমি বললাম–আপনারা বিচ্ছিন্নভাবে শুধু পত্রিকার কথা ভাবলেন। বাকশাল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও আদর্শ। রাজনীতিকরাই বাকশাল ঠেকাতে পারে। সেই রাজনৈতিক শক্তি আমার নেই। আমি রাজনীতি করি। তাই ব্যক্তিগত অহমিকায় ভুগে কোনো একক সিদ্ধান্ত নেব না। যৌথভাবে ইউনিয়ন যে সিদ্ধান্ত নেয় সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করব। আমি শেখ সাহেবকে কোনো কথা দিয়ে আসিনি। আসছে সপ্তাহ চট্টগ্রাম ইউনিয়নের বৈঠক বসবে। সেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না।

আমার সাথে শেখ সাহেবের সম্পর্কের অবনতি ঘটায় অনেকের মন খারাপ। তাদের ধারণা ছিল হয়তো আমি কিছু একটা করতে পারব। কিন্তু এমন বিশ্বাস আমার কোনোদিন ছিল না। শেখ সাহেব আমার অনেক কথা শুনেছেন। কিন্তু বাকশালের ব্যাপারে আমার কথা শুনবার কোনো অবকাশ নেই। বাকশাল একটি রাজনৈতিক দর্শন। এ দর্শনের মূল কথা হচ্ছে অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো। এ দর্শন সোভিয়েত ইউনিয়নের তাত্ত্বিক উলিয়ানভের।

এ দর্শনের মূল কথা যে সকল দেশে শিল্প বিপ্লব হয়নি বা জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব হয়নি, সে সকল দেশে জাতীয় বুর্জোয়াদের সহযোগিতায় করতে হবে। শিল্প না হওয়ায় শ্রমিক নেতৃত্ব দুর্বল। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো এ দেশে বিপ্লব হবে না। এ জন্যে বলা হয় যে, জাতীয় বুর্জোয়াদের এখনো একটি বিপ্লবী ভূমিকা আছে। তাই প্রগতিশীল শ্রেণির দলের কাজ হবে জাতীয় বুর্জোয়াদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমাজতন্ত্রের পক্ষে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদন করা। এ রাজনীতি তকালীন কমিউনিস্ট পার্টি তানজানিয়া, সোমালিয়ায় এ বিপ্লব করেছে এবং শেষ পর্যন্ত এ বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে ইথিওপিয়ায়। এ তত্ত্ব অনুযায়ী রাজনীতির ধরন হচ্ছে একদলীয় গণতন্ত্র। সম্পন্ন হয়েছে ইথিওপিয়ায়। এ তত্ত্ব অনুযায়ী রাজনীতির ধরন হচ্ছে একদলীয় গণতন্ত্র। প্রগতিশীল শ্রেণির সহযোগিতায় দক্ষ একটি রাজনৈতিক, শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্র সংস্থা গড়ে তোলা। তার ভিত্তিতে সেকালে বাকশাল গঠিত হয়েছিল। সেকালে এ তত্ত্বের সমর্থনে মোজাফফর ন্যাপ তানজানিয়া, সোমালিয়ার অভিযোগের ভিত্তিতে বই ছাপাত এবং আমাদের কাছে বিলি করত।

আমার দলের মতে, এ ছিল ভুল, মহাভুল। লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিনের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে যে ভুল শুরু হয়েছিল এ হচ্ছে তার শেষ পরিণতি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর লাল ফৌজের সহায়তায় পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে যেন বলা হয়েছিল জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছে। এবার শান্তিপূর্ণভাবেই সমাজতন্ত্রে উত্তরণ হবে। শেষ পর্যন্ত ওই একই অগণতান্ত্রিক পন্থায় সমাজতন্ত্রে পৌঁছবার দাওয়াই দেয়। তার ফসল বাকশাল। আমাদের মতে, বাংলাদেশে সনাতন ধারার কোনো বুর্জোয়া শ্রেণি গড়ে ওঠেনি। এদের কোনো দলীয় শ্রেণি চরিত্র নেই। এরা মুখ্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল। সঙ্কটকালে এরা সাম্রাজ্যবাদের আশ্রয় নেবে। এদের কাছে বাকশাল ছিল সমাজতন্ত্রের লেবেল। এ লেবেল এটে বামপন্থীদের ভাওতা দিয়ে একদলীয় শাসন কায়েম করা। জনতার রোষ থেকে বেঁচে যাওয়া। একই সঙ্গে অন্যান্য দল ভেঙে দেবার অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করা এবং এ কথা প্রমাণিত, কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাপ, একটা পার্টি ভেঙে যাওয়ায় সেদিনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কোনো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ছিল না। তখন মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক দলগুলো ছিল নিষিদ্ধ। ফলে বাকশাল হয়ে উঠবে একটি একদলীয় শাসনের স্টিম রোলার। জনগণের আন্দোলন বিপর্যস্ত হবে। এটাই ছিল আমাদের ধারণা। তাই আমার ব্যক্তি বা পরিবারের সম্পর্কের জন্যে শেখ সাহেবের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো থাকবে, এ বিশ্বাস ঠিক ছিল না। তবু শেখ সাহেব নাকি আমার সম্পর্কে বলেছেন, নির্মল সেন একটি আদর্শবাদী রাজনীতি করে। সে বাকশালে আসবে না। তাই ওকে এ অনুরোধ কেউ করবেন না। এ আমার শোনা কথা। তাই আমার কাছে স্পষ্ট ছিল আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নয়, একেবারে রাজনৈতিক। আমার পক্ষে পত্রিকা বাঁচানো সম্ভব নয়। পত্রিকা থাকবে কি থাকবে না তা হবে দলীয় সিদ্ধান্ত। একটি দলীয় সরকারের শাসনে একদলীয় মুখপত্র থাকে। বহুদলীয় পত্রিকা থাকতে পারে না। অথচ আমাদের ইউনিয়নের মুখ্য লক্ষ্য হচ্ছে বহুদলীয় ধারাকে বাঁচিয়ে রাখা। তাই এখানে সমঝোতার অবকাশ কোথায়!

এছাড়া তখন লক্ষ্য করেছিলাম আমার সাথে শেখ সাহেবের বনিবনা হচ্ছে না। তিনি আগে কথা শুনতেন। কিন্তু এখন দেখছি কথা শুরু হলেই তিনি উগ্র হয়ে যান। এর একটা কারণ হলো আমার লেখালেখি, কাউকে তোয়াক্কা না করার ভাব এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সকল দলের সঙ্গে মতানৈক্য। কারণ আমি সমাজবাদে বিশ্বাসী হলেও মস্কোপন্থী এবং পিকিং দু’দলকে ভুল বলে মনে করতাম। মনে করতাম আমাদের দেশে মস্কোপন্থী পিকিংপন্থীরা নির্ভেজাল মস্কো-পিকিংর দালালি করছে। সমাজের বারোটা বাজাচ্ছে। ফলে বাম রাজনীতির ক্ষেত্রেও তেমন কোনো বন্ধু ছিল না। এক সময় শিল্প এলাকায় আমাদের প্রবল প্রতাপ ছিল। তাও ভেঙেচুড়ে প্রায় নিঃশেষ আওয়ামী লীগ আমলে। তাই রাজনীতির ক্ষেত্রে আমার প্রায় একক। হাতে একটি কলম, মুখে তীক্ষ্ণ কথা এবং বাকশাল গঠনের প্রাক্কালে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাই আমার পক্ষে আসছিল না।

মাঝখানে শেখ সাহেবের বাবা শেখ লুত্যর রহমান মারা গেলেন। সন্ধ্যার দিকে আমি ও গিয়াস কামাল শেখ সাহেবের বাসায় গেলাম। চারদিকে অনেক লোক। শেখ সাহেবের কাছে দাঁড়ানো তাজউদ্দীন আহমদ, কোরবান আলীসহ অনেক নেতা। শেখ সাহেব কাঁদছিলেন। দূরে আমাকে দেখে গিয়াস কামালকে ডেকে বললেন, নির্মল সেনকে ডেকে নিয়ে আয়। আমাকে বললেন, দেখি এবার নির্মল সেনকে কে বাঁচায়। মা মারা গেছে আগে, এবার বাবা গেলেন। এবার নির্মল সেন বুঝবে শেখ মুজিবুর রহমান কে এবং কেমন। আমি বললাম–তা পরে দেখতে পাবেন, আপনি আজ একি বলছেন? কাছাকাছি সকলে অবাক বিস্ময়ে চুপচাপ। কারণ এদের কারোরই আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক জানার কথা নয়। এবার শেখ সাহেব কথা ঘোরালেন। বললেন, বাবার লাশের সঙ্গে টুঙ্গীপাড়া যাবেন। মার লাশের সঙ্গে যাননি। এবার যেন ভুল না হয়। শেষ পর্যন্ত আমার লাশের সঙ্গে যাওয়া হয়নি।

চেহলামের দিন টুঙ্গীপাড়ায় গেলাম। সঙ্গে সেনাবাহিনীর তিন প্রধান, হুইপ আব্দুস সামাদ আজাদ ও তাহের উদ্দীন ঠাকুর। শেখ সাহেব আমাকে দেখে ফরিদপুরের ডিসি মোহাম্মদ আলীকে ডাকলেন–বললেন, একটা স্পিড বোট ঠিক করেন, নির্মল সেন কোটালীপাড়া যাবে। আমি বললাম, আমি আপনার স্পিড বোটে যাব না। হেলিকপ্টারে টুঙ্গীপাড়ায় এসেছি তাতেই প্রেস ক্লাবে কথা শুনতে হবে। আমি ঢাকা ফিরে যাব। শেখ সাহেব চুপ করে গেলেন। তিনি বসে আছেন গাজী স্টিমারে। সঙ্গে খন্দকার মোশতাক, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, কোরবান আলী এবং অনেকে। ফনি বাবু বললেন, তিনি স্পিড বোটে মাদারীপুরে যাবেন। এর মধ্যে হঠাৎ যেন শেখ সাহেব গর্জে উঠলেন-তাহের ঠাকুর, তুই কোন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। তুই মোশতাকের সঙ্গে ঘুরিস কেন। তোরে আমি ঠ্যাং পিটিয়ে ভেঙে দেব। তাহের ঠাকুর বললেন, বঙ্গবন্ধু, আমি কুমিল্লার লোক তাই। শেখ সাহেব বললেন, থাম, তুই তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, মনে থাকে যেন। সমস্ত পরিবেশটা একটু হোঁচট খেল। এর মধ্যেই কথা বললেন খোন্দকার মোশতাক। বললেন, ঠাকুর মনে থাকে যেন তুমি এক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। শেখ সাহেব আমাকে লক্ষ করে বললেন, চলুন বাইরে যাই। আপনি তো সবাইকে চেনেন। আমরা দুজনেই বের হলাম।

স্টিমারের সামনের দিকে অনেক ছেলেমেয়ের ভিড়। শেখ সাহেব তার স্ত্রীকে ডাকলেন। বললেন, রেনু তোমার কুটুম এসেছে। শেখ সাহেবের স্ত্রী এলেন এবং শেখ সাহেব বললেন, তোমার কুটুম আমার বিরুদ্ধে কাগজে লেখে। তার লেখা বন্ধ করে দিয়েছি। আমি বললাম, প্রধানমন্ত্রী হলে আমিও এরকম লেখা বন্ধ করে দিতে পারতাম। হঠাৎ শেখ সাহেবের স্ত্রী মুখ খুললেন। বললেন, উনি তোমার বিরুদ্ধে তো লেখেন। এ পরিবারের মানুষ তোমার বিরুদ্ধে লিখলে তোমার পক্ষে কি কেউ নেই দেশে? আমরা দুজনই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। দূরে দেখলাম সাধারণ একজন গ্রামের মানুষের মতো গাজী গোলাম মোস্তফা কাজ করছেন। একেবারে ঘরের মানুষ। তার কোনো বিকল্প নেই। সেদিন এ দৃশ্য না দেখলে এ মানুষটির জীবনের ভিন্ন রূপটি দেখা হতো না। আমি আর খেলাম না। বিকেলে হেলিকপ্টারে ঢাকা ফিরলাম। বাড়ি যাবার সকল প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন হেলিকপ্টারের কমান্ডার ছিল এক প্রিয় ছাত্র। তাকে বললাম, আমাদের বাড়ির উপর একটু দাঁড়াবি। বাড়ি যাওয়া আর হলো না।

সব দল ভেঙে দিয়ে একটি দল বাকশাল গঠন, সকল বৈধ রাজনৈতিক দলকে আত্মগোপন করতে বাধ্য করা এবং আমাদের সাংবাদিকদের বাকশালে যোগদানে বাধ্য করার জন্য অভিযান–কোনোটাই আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হলো না। মনে হতো সারাদেশে একটি অস্বস্তি। কোথায় যেন একটা গোলমাল আছে।

এ গোলমাল বিস্ফোরিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকা সফরকালে। ভুট্টোর ঢাকা সফর নিয়ে মন্ত্রিসভা একমত ছিল না। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। সকলকেই বলা হয়েছে ১৯৭১ সালের গণহত্যার মূল নায়ক ভুট্টো। ভুট্টোর যা বাসনা ছিল পাকিস্তানে তা সম্ভব ছিল না। তিনি তাই ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য বছরে দুমাসের প্রধানমন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তানের এবং বাকি দু’মাসের প্রধানমন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তানে দেবার প্রয়াস নিয়েছিলেন। এ প্রস্তাব কেউ গ্রাহ্য করেনি। তাই ভুট্টোর পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতা হবার জন্যে পাকিস্তান ভাঙার প্রয়োজন ছিল। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভুট্টো ছিল ১৯৭১ সালের গণহত্যার সবচে বড় নায়ক। সেই ভুট্টো পরে ভাঙা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সেই ভুট্টো বাংলাদেশে আসুক তা জনগণের কাছে কাম্য ছিল না।

কিন্তু শেখ সাহেব ভেবেছিলেন অন্যভাবে। তিনি পাকিস্তান থেকে ফিরে দেখলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও পাকিস্তানসহ মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ বা চীনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে ভারতের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশকে বাঁচতে হচ্ছে। তিনি চাইলেন ভারসাম্য বিধানের জন্যে এবং কাজ শুরু হলো ইসলামি সম্মেলনে যোগদান এবং ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণের মধ্যদিয়ে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের ইসলামি সম্মেলনে যোগদান মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ভালো লাগেনি। পরবর্তীকালে ভুট্টোকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ নতুন প্রশ্নের জন্ম দিতে থাকে। তাহলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান কী চান। তিনি কি ভাবতে পারছেন না, ভুট্টো এদেশে এলে কী প্রতিক্রিয়া হবে।

আমার ধারণা শেখ সাহেব ভেবেছিলেন তার নেতৃত্বে মুগ্ধ বাঙালি সবই মেনে নেবে। ভুট্টো নির্বিঘ্নে বাংলাদেশ সফর করে যাবেন এবং পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তিনি সাফল্য লাভ করবেন। পাকিস্তানসহ মুসলিম দেশসমূহের স্বীকৃতি পাওয়া সহজ হবে। কিন্তু ঘটনা সে রকম ঘটল না। ভুট্টোর সফরকালে প্রমাণ হলো সেদিনের বাংলাদেশের একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে পাকিস্তান ভাঙা কাম্য ছিল না। এরা ইয়াহিয়াকে চায়নি।

এরা গণহত্যার বিরোধী। কিন্তু পাকিস্তান থাকুক, ক্ষমতা পরিবর্তন হোক–এটাই চেয়েছে। এরা হাজারে হাজারে রাজপথে নামল ভুট্টোকে সংবর্ধনা জানাতে। বিমানবন্দর থেকে ফিরতি পথে এরা ভারতীয় হাইকমিশনারের গাড়ি থেকে ভারতীয় পতাকা ছিনিয়ে নিল। ভুট্টোকে অভিনন্দন জানাল পাকিস্তানের পক্ষে স্লোগান দিয়ে। ফলে ভুট্টো ফিরে যাবার দিন জনতা ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকারকে রাজপথে পুলিশ নামাতে হয়েছে। জনতা ঠেকাতে কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ করতে হয়েছে।

আমার কাছে এ ঘটনা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু এ বাস্তবতা আদৌ গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। মনে হয়েছে কোনো কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আর এ মুহূর্তে দেশে সরকার একদল গঠন করে সকল জনমত বন্ধ করতে যাচ্ছে। দেশে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ। তারপর নিষিদ্ধ হলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতির একটি অংশ বাকশালের নামে। কারণ বাকশালে যোগদানকারী ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং একতা পার্টি ব্যতীত অনেক পার্টি এবং গ্রুপ ছিল যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। কিন্তু বাকশালে যোগ দেয়নি।

আমার কাছে পরিষ্কার ছিল না কেন শেখ সাহেব এ পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এমনিতে মন্ত্রিসভা থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান নেতা তাজউদ্দীন আহমদকে বের করে দেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান শক্তি ছাত্রলীগ বিভক্ত এবং এদের সংগ্রামী অংশটি তখন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ নামে বিরোধী শিবিরে। অথচ পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং চিহ্নিত পাকিস্তানপন্থী আমলাদের পুনর্বাসিত করা হচ্ছে। মুখে বলা হচ্ছে সমাজতন্ত্র এবং প্রগতির কথা।

এছাড়া বাকশালে যোগদানকারী অন্য দলের সঙ্গেও যে তেমন আলাপ আলোচনা ছিল শেখ সাহেবের তা আমার মনে হচ্ছিল না। নিজের তত্ত্বের গরজে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি বাকশালের গেলেও বাকশাল গঠনে যে তাদের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল তাও মনে হচ্ছিল না।

ঠিক এ সময় একদিন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (আজকের হোটেল রূপসী বাংলা) একদিন একটি পাটিতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মনি সিং অর্থাৎ মনিদার সঙ্গে দেখা। তিনি আমাকে আদর করে নির্মল দা ডাকতেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী হচ্ছে বলতে পারেন? চেষ্টা করে সংবাদ পত্রিকাটি কি রক্ষা করা যায় না?

আগে উল্লেখ করেছি সরকারি সিদ্ধান্ত হচ্ছে দেশে মাত্র চারটি সংবাদপত্র থাকবে (ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, অবজারভার, বাংলাদেশ টাইমস)। অন্যান্য সকল পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হবে। বন্ধ হবে দীর্ঘদিনের প্রগতিশীল পত্রিকা দৈনিক সংবাদ।

মনি দার কথায় আমি হতভম্ব। আমি বাকশাল বিরোধী। আমার সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। অন্যদিকে সকলের ধারণা কমিউনিস্ট পার্টি বাকশাল গঠনের অন্যতম উদ্যোগী। অথচ মনি দা এ আবেদন আমাকে করছেন। ব্যাপারটা কী? আমি বললাম, মনি দা, বাকশালের তত্ত্ব আপনাদের। এ তত্ত্ব দেশে দেশে অগণতান্ত্রিক পন্থায় সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর জন্যে আপনাদের জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্ব। আপনাদের তত্তে পত্রিকা বন্ধ হচ্ছে। বিপদে পড়েছি আমরা। আর আপনি আমাকে সংবাদ পত্রিকা বাঁচার কথা বলছেন। আপনারা শেখ সাহেবকে বলতে পারেন। একটি পত্রিকা বাঁচলেও আমরা উপকৃত হয়। মনি দা বললেন, দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। চেষ্টা করেও সাক্ষাৎ পাচ্ছি না।

মনি দা’র সঙ্গে আমার কথা শেষ হলো না। অসংখ্য আওয়ামী লীগ নেতা আমাকে ঘিরে ধরলেন। তাদের প্রশ্ন, আপনি জানেন কী হতে যাচ্ছে। কবে আপনার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা হয়েছে। আপনার সঙ্গে নিশ্চয়ই কথা হয়েছে। আপনি জানেন না এমন কিছু হতে পারে না।

আমি অবাক হলাম। সকলের ধারণা আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ। তাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। আমি দৈনিক বাংলায় অনিকেত ছদ্মনামে কড়া কড়া কথা লিখতাম। তাই নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার আলোচনা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, একমাত্র এনায়েতুল্লাহ খান ও আমি বাদে তখন সকল কলামিস্টরা তাদের লেখা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখত এবং সে থেকেই ধারণা হতো, আমাকে নিশ্চয়ই শেখ সাহেব সব কিছু বলেন এবং আমার সঙ্গে সব আলোচনা করেন। অথচ আমার সঙ্গে কোনোদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কোনো আলাপ হয়নি। যেমন হয়নি প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। শুধু সকলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার দুর্নাম বা সুনাম নিয়ে আমি সাংবাদিকতা ও রাজনীতি করছি। সেদিন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মনি দা এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার ফলে মনে হলো দেশ একটি গভীর সঙ্কটের দিকে এগোচ্ছে। দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সকলের আশঙ্কা আছে। কিন্তু কেউ কিছু জানে না। বাকশাল বিরোধিরা ভাবছে এবার সব শেষ। দীর্ঘদিনের রাজনীতি আর করা হলো না। তাই বাকশালপন্থীরাও জানেন না কী হবে, কী হতে পারে। ফলে এক শ্রেণির শিক্ষিত মানুষ বাকশালে যাচ্ছে, যাবার প্রশ্নে প্রথম সারিতে থেকে কিছু সুযোগ সুবিধা পাবার জন্যে। অপর দল যাচ্ছে চাকরির ভয়ে, জীবনের ভয়ে, সম্মানের ভয়ে। সে কী এক মর্মান্তিক জ্বালা! এক অসহনীয় অপমানজনক পরিবেশ।

বাকশালে যোগদানের জন্যে সাংবাদিকদের মধ্যে প্রচারণা তখন তুঙ্গে। বাকশাল একটি রাজনৈতিক দল। এ দলে যোগ দিতে হবে। এটাই ছিল এ প্রচারকদের বক্তব্য। অথচ এ সাংবাদিকরা একসময় আমার সমালোচনা করত, আমি রাজনীতি করি বলে। এরা বলত ইউনিয়ন হবে দল নিরপেক্ষ। ইউনিয়ন কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না। সেকালের পরিবেশে আমিও এ নীতি অনুসরণ করতাম। আমি যতদিন ইউনিয়নের সভাপতি ছিলাম ততদিন দলের কোনো সভা সমাবেশে বক্তৃতা দেইনি, দলের পরিচয়ে কোথাও প্রতিনিধিত্ব করিনি।

আমি শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। আমি সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা বলে দলের নামে কোনোদিন কোথাও একটি বিবৃতি পর্যন্ত দেইনি। সাংবাদিক মহল এ জন্য খুশি ছিল। আমি আমার দলের জন্য কখনো সাংবাদিক ইউনিয়নের পদটি ব্যবহার করিনি। আমি শেষ দিন পর্যন্ত এই নীতি অনুসরণ করেছি।

কিন্তু বাকশাল গঠন করার পর লক্ষ করলাম একদল অতি উৎসাহী বাকশালপন্থী সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে এরা অনেকেই আওয়ামী লীগের সমর্থক নয়। এদের মুখে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভূমিকা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি আছে। কিছুদিন আগেও এরা ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে বাঘাবাঘা কথা বলেছে। তাদের কথা ছিল কিছুতেই ইউনিয়নে রাজনীতি আনতে দেবে না। দেয়া হবে না।

হঠাৎ করে পট পরিবর্তন হয়ে গেল। এরা বাকশালী হয়ে গেলেন। সাংবাদিকদের বাকশালে যোগ দেয়াতে চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করলেন। ভয় দেখাতে লাগলেন। বলতে শুরু করলেন–বাকশালে যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না। কারণ চারটি দৈনিক ব্যতীত অন্যান্য সকল দৈনিক বন্ধ হয়ে যাবে। শত শত সাংবাদিক বেকার হয়ে যাবে। তাই তাদের কথায় অনেক সাংবাদিক ভয় পেলেন। বিভ্রান্ত হলেন। বাকশালে যোগ দিতে রাজি হলেন।

অথচ শেখ সাহেবের সঙ্গে ইউনিয়নের ভিন্ন ধরনের কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন রাজনৈতিক পরিচয় নয়, বেকার সাংবাদিক পরিচয়ে সকলকে চাকরি দেয়া হবে। এখানে ভয় শঙ্কার কোনো কারণ নেই। আর নব্য বাকশালীরা বলতে শুরু করল, বাকশালে যোগ না দিলে চাকরি হবে না। এরা ইউনিয়নকে রাজনৈতিক দলের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ষড়যন্ত্র শুরু করল।

কিন্তু কেন? বারবার আমি এ কথাটি ভাবতে চেষ্টা করেছি। এ অরাজনৈতিক সাংবাদিকরা কেন হঠাৎ বাকশালের প্রতি অনুরক্ত হলো। কেন হঠাৎ রাজনীতির প্রতি এতো অনুরক্ত হলো। আমার সন্দেহ হলে তাদের নিশ্চয়ই ভিন্ন একটি লক্ষ্য আছে। এ লক্ষ্যটি হচ্ছে আখের গোছানো। নিশ্চয়ই তাদের কোনো মহল থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে, সাংবাদিকদের গরু খেদানোর মতো তাড়িয়ে বাকশালে ঢোকাতে পারলে ভবিষ্যতে পুরস্কৃত করা হবে। তাদের নিশ্চয়ই আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, তাদের চাকরির আর অভাব হবে না। প্রয়োজন হলে তাদের ওই পদে নিয়োগ করা হবে। তারা তাদের দালালির পুরস্কার পাবে।

পরবর্তীকালে আমার এ অনুমানই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। বাকশাল গঠনের প্রাথমিক পর্ব শেষ হবার পর শুনেছিলাম এদের অনেককেই তথ্য দফতর ও টেলিভিশনে উচ্চপদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল এবং ৭২-এর সরকার পরিবর্তনের পর এদের অনেকের প্রতিশ্রুত চাকরি দেয়ার জন্য আমি তদবির করেছি। তথ্য দফতরে কর্মকর্তাদের প্রতিবাদের জন্য এরা তথ্য দফতরে চাকরি পাননি। তবে কেউ কেউ চাকরি পেয়েছিলেন টেলিভিশনে শুষ্ক বিভাগ বা থানায় সার্কেল অফিসার হিসেবে। এদের মধ্যে অনেকেই এখন প্রচুর অর্থের মালিক। সুতরাং যারা সেদিন বাকশালে যোগ দেয়ার জন্য ভীত সাংবাদিকদের বাধ্য করেছিলেন তাদের আদর্শ ছিল ব্যক্তি স্বার্থ, নিজের মঙ্গল ও অন্য কারো মঙ্গল নয়। আবার এদের অনেকেই শেখ সাহেবের মৃত্যুর পর নিজ মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছিল।

এখন আবার পূর্বের কথায় ফিরে যাই। বাকশালে যোগ দেয়ার হিড়িকের সময় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের একটি বৈঠক বসে। এ বৈঠকের আলোচ্যসূচি ছিল বাকশালে যোগদান প্রসঙ্গে। প্রশ্ন উঠেছিল সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্যরা বাকশালে যোগ দেবে কিনা। একদল সাংবাদিক যখন বাকশালে যোগ দেয়ার পক্ষে তখন অন্য সাংবাদিকরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। তাঁরা স্বাভাবিকভাবে ইউনিয়নের কাছে মতামত চান।

কিন্তু এ ব্যাপারে ইউনিয়ন কী সিদ্ধান্ত নেবে? ইউনিয়ন কোনোদিন এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। ইউনিয়নের সদস্যরা বিভিন্ন দলের সদস্য হতে পারে। আর সাংবাদিক ইউনিয়ন কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন নয়। সুতরাং এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার ইউনিয়নের ছিল না। কিন্তু এমন পরিস্থিতিও আমাদের দেশে কোনোদিন সৃষ্টি হয়নি এবং হয়নি বলেই এ পরিস্থিতিতে ইউনিয়নকে বৈঠকে বসতে হয়েছিল।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ সাংবাদিকদের মধ্যে সবচে’ বড় ইউনিয়ন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নকে ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন। সুতরাং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের মতামত ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কী করার ছিল ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের। তখনো এ ব্যাপারে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সর্বশেষ বৈঠক বসেনি। কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। এছাড়া কে কোন দলে যোগ দেবে সে ব্যাপারে সাংবাদিক ইউনিয়নে কিছু বলার আছে আমি মনে করি না। কারণ আমিও সাংবাদিক ইউনিয়নের মতামত নিয়ে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলে যোগ দেইনি। তবে আমি জানি সেদিনের পরিস্থিতিতে আমার এ বক্তব্য ছিল একান্তই একাডেমিক। সমস্যা এড়িয়ে যাবার কথা।

তবে যদি আমরা বন্ধুরা উৎসাহী হয়ে বাকশালে যোগদানের জন্য সাংবাদিকদের বাধ্য না করতাম তাহলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। অন্যান্য সংগঠনের মতোই সাংবাদিক ইউনিয়নের নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যতদূর সম্ভব কাজ চালিয়ে যেতাম। কিন্তু সংকট সৃষ্টি করেছিল আমাদের সেই স্বার্থপর সুবিধাবাদী বন্ধুরা। নিজের আখের গোছাবার জন্য তারা ইউনিয়ন এবং সমগ্র সাংবাদিক সমাজকে ঠেলে দিয়েছিল নৈরাজ্যের দিকে। এদের ব্যক্তিস্বার্থের যূপকাষ্ঠে বলি হয়েছিল সাংবাদিকরা। কারণ এ সমস্যা শুধু সাংবাদিকদের নয়। বাকশাল গঠনের পর সকল ইউনিয়নকে এ সমস্যায় পড়তে হয়। কিন্তু কোনো ইউনিয়নের সদস্যকে ভয় দেখিয়ে বাকশালে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়নি। তাদের কেউ বলেনি, বাকশালে যোগ না দিলে তাদের চাকরি থাকবে না বা তাদের জীবন বিপন্ন হবে। অথচ এ ধরনের একটি প্রচারণা চালানো হয়েছিল সাংবাদিকদের মধ্যে। একটি মহলের ধারণা এই কর্মকাণ্ডের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ইউনিয়নকে ভাঙা। সেদিনের সরকার কখনোই ইউনিয়নের নেতৃত্ব মেনে নেয়নি। সরকারি মহল থেকে বলা হতো দেশে দুটি সরকার চালু আছে-একটি গণভবনে, অপরটি প্রেস ক্লাবে। গণভবনের কোনো নির্দেশই প্রেসক্লাব অর্থাৎ সাংবাদিক ইউনিয়ন মানে না। প্রতিরোধ করে। এ মহলের আশঙ্কা সাংবাদিক ইউনিয়ন হয়তো বাকশাল মানবে না। সাংবাদিক ইউনিয়ন বাকশাল না মানলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। এই হিসাব থেকে সেকালের সরকার প্রথমেই সাংবাদিক ইউনিয়নকে আঘাত করেছিল। তারা মনে করেছিল সাংবাদিক ইউনিয়ন বাকশাল মেনে নিলে প্রতিরোধ বা প্রতিবাদ করার কেউ থাকবে না। কারণ ইতোমধ্যে কেউ প্রকাশ্যে বাকশাল গঠনের বিরোধিতা করেনি। সকল রাজনৈতিক দল ছাত্র, কৃষক, মহিলা সংগঠন ভেঙে দেয়া হয়েছে বাকশালের মাধ্যমে। একমাত্র বাকি সাংবাদিক ইউনিয়ন। সাংবাদিক ইউনিয়নকে শায়েস্তা করতে পারলে প্রকাশ্যে প্রতিরোধ করার মতো আর কেউ এ দেশে থাকবে না। আমারও ধারণা এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া তখন সাংবাদিক ইউনিয়ন ভাঙার জন্য ন্যক্কারজনক উদ্যোগ নেবার কোনো কারণ ছিল না। তারা বুঝতে চেষ্টা করেননি যে এ ধরনের ছলে-বলে-কৌশলে ছাগল-ভেড়ার মতো সাংবাদিকদের ধরে কোনো দলে ঢোকালে সে দল আদৌ সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারবে না। এ পরিস্থিতিতে সেদিন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাকশালে যোগ না দেয়ার। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত কাজে আসেনি।

সাংবাদিক সমাজ আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মতো ত্রিধারায় বিভক্ত। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আজ বড্ড জানতে ইচ্ছে করে শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে তরুণরা যুদ্ধে গিয়েছিল, তাদের অনেকেই আজ রাষ্ট্রক্ষমতায় সরকারের অংশ। কেউ কেউ এর আগে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু যে চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেই শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ কি আমরা এই ৪০ বছরে পেয়েছি? কিংবা বর্তমান অবস্থা ও বাস্তবতায় তা পাওয়ার সম্ভাবনা আদৌ আছে কি? আর কত পথ হাঁটলে ধরা দেবে আমাদের স্বপ্নের সেই সোনার হরিণ?

পাঠক, আপনাদের কাছেই ছেড়ে দিলাম এ প্রশ্নের উত্তর। আপনারা বুঝে নিন। বেছে নিন। আমি এখন ‘ক্লান্ত প্রাণ এক’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *