৮. পুরনো কথায় ফিরে আসি

এবার আমি পুরনো কথায় ফিরে আসি। আমি কথা শুরু করেছিলাম শেখ সাহেবকে কেন্দ্র করে। বলেছিলাম আজো অনেকে অভিযোগ করে থাকেন–সেকালে আমার জন্যেই অনেক কিছু সুযোগ-সুবিধা থেকে সাংবাদিকরা বঞ্চিত হয়েছে। শেখ সাহেবের কাছে চাইলে অনেক কিছু পাওয়া যেত। শেখ সাহেব তখন প্রধানমন্ত্রী, তাজউদ্দিন আহমেদ অর্থমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক গিয়াস কামাল চৌধুরী। আমি আগেই উল্লেখ করেছি, দৈনিক আজাদ তখন মালিকহীন। প্রশাসক নিয়োগ করে কাগজটি চালানো হচ্ছে। কাগজটির নিদারুণ অর্থ সঙ্কট। কাগজ চলছে না। আমি তখন সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাহী সদস্য। গিয়াস কামাল এসে বলল–আপনাকে আমাদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে হবে। টাকা আনতে হবে তাঁর কাছ থেকে। আজাদ ইউনিয়নের নেতৃত্বে আছেন সৈয়দ জাফর, আব্দুর রহিম, আজাদ ও ফকির আশরাফ। আমরা কোনো খবর না দিয়েই প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে পুরনো গণভবনে গেলাম। গণভবনের গেটে গিয়ে খবর দিলাম, আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে চাই।

তারপর আমরা সবাই অবাক বিস্ময়ে চুপ হয়ে গেলাম। সামনে দেখি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান দাঁড়িয়ে। আমি বললাম, আপনি এখানে! প্রধানমন্ত্রী বললেন, এ কী কথা বলছেন? আপনারা আসবেন, আমি গেটে আসব না? আপনারা একটা খবর দিয়ে আসবেন তো। আমি কিছুই জানব না অথচ আপনারা আসবেন আমার সাথে দেখা করতে। গণভবনের গেটে তখন তেমন আঁধার নামেনি। সন্ধ্যার বিজলী বাতি জ্বলছে। অদ্ভুত বিস্ময়ে তাঁর পেছনে আমরা হাঁটতে থাকলাম। প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন আমার আত্মীয় স্বজনের খবর। আর কথায় কথায় বললেন, আমি সব জানি।… আমি সব জানি।

তাহলে আপনারা কেন এসেছেন? গণভবনে বৈঠকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন প্রধানমন্ত্রী। গিয়াস কামাল বলল, আজাদের মালিক পালিয়েছে, কাগজটির দায়িত্ব সরকার নিয়েছে। অথচ চালাবার টাকা নেই। কারো বেতন হচ্ছে না। এভাবে তো চলতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী বললেন, নির্মল সেন, বলুন, এবার কী করা যাবে? আমি একটি অদ্ভুত প্রস্তাব দিলাম। আমি বললাম, আজাদ পত্রিকা ইউবিএল অর্থাৎ বর্তমান জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল। সে ঋণ পরিশোধ করেনি। জনতা ব্যাংককে বলুন পত্রিকাটির ঋণের দায় গ্রহণ করতে এবং সাংবাদিক কর্মচারীদের টাকা দিতে। এরপর অদ্ভুত একটা কণ্ঠ আমার কাছে এল। প্রধানমন্ত্রী ফোন তুললেন। চাইলেন জনতা ব্যাংকের এমডি জনাব খায়রুল কবিরকে। বললেন, কবির ভাই, নির্মল সেন ও গিয়াস কামাল এসেছে। নির্মল সেন তো বিপ্লবী, ওকে তো কথা শোনানো যাবে না। গিয়াস কামাল আমাদের লোক। ওরা বলছে, আজাদ পত্রিকা নাকি আপনাদের কাছে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেনি। আপনারা ঋণের দায়ে ওই পত্রিকাটি টেকওভার করেন। ওদের কিছু টাকা দেন।

আমি বললাম, প্রধানমন্ত্রী, এ তো হয় না। এ ব্যাপারে আইন করতে হবে তো। আইন না করে আজাদ তো টেকওভার করতে পারবেন না। আপনি আপাতত কবির ভাইকে আমাদের কিছু টাকা ধার দিতে বলুন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন–আইনের কথা পরে হবে। আগে আপনাদের বাঁচাতে হবে। ঠিক আছে, কবির ভাইকে বলে দিচ্ছি আপনাদের কিছু টাকা দেয়ার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর কথামতো আজাদ পত্রিকায় কিছু টাকা দেয়া হয়েছিল। যাদের টাকা দেয়া হয়েছিল, তাদের আমি চিনি। আজাদ কর্তৃপক্ষ কোনোদিন সে টাকা পরিশোধ করেছেন বলে আমার মনে হয় না। আর আজাদ পত্রিকা নিয়ে পরবর্তীকালে কাহিনী অনেক দীর্ঘ। সে কাহিনীতে আমি আরো পরে আসব। আর নিশ্চয়ই আমি মেনে নেব, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে সেকালে চাইলে অনেক কিছুই পাওয়া যেত। সে চেষ্টা আমি করিনি। কেন করিনি সে কথা আমি আগেই বলেছি।

সমস্যা শুধু আজাদ পত্রিকা নিয়ে নয়। সমস্যা ছিল দৈনিক পয়গাম নিয়েও। পয়গাম ছিল পূর্ব পাকিস্তানের এক সময়ের গভর্নর মোনায়েম খানের পত্রিকা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পত্রিকাটি মালিকবিহীন হয়ে যায়। সরকারি তত্ত্বাবধানে আসে। পরিবর্তিত নাম হয়–স্বদেশ। কিন্তু এ পত্রিকা চালাবে কে? এ পত্রিকার সাংবাদিক কর্মচারীদের বেতন কোথা থেকে আসবে? পয়গাম কোনোদিন লাভজনক পত্রিকা ছিল না। সরকারি বিজ্ঞাপনে চলত। পয়গামের প্রচার সংখ্যাও তেমন বেশি ছিল না। এ পরিস্থিতিতে দেশ স্বাধীন হবার পরে ওই কাগজের দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তায়। আজকে যারা আমার লেখা পড়ছেন তাদের পক্ষে সেদিনের পরিস্থিতি অনুধাবন করা সম্ভব নয়। আমি সেদিন ভেবেছি আজকেও ভাবছি, তখন সরকারের কী করার ছিল? দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ, পাকিস্তান অবজারভার, পূর্বদেশ, আজাদ ও স্বদেশ চালাবার দায়িত্ব সরকারের ওপর পড়েছে। দৈনিক পাকিস্তান দৈনিক বাংলা হয়েছে। পাকিস্তান অবজারভার হয়েছে বাংলাদেশ অবজারভার। দৈনিক বাংলা, মর্নিং নিউজ, বাংলাদেশ ও পূর্বদেশে নিজেদের চলবার মতো কিছু সঞ্চয় ছিল। কিন্তু আজাদ ও স্বদেশে তেমন কোনো সঞ্চয় ছিল না। তাহলে এ দায়িত্ব কে নেবে? দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এ ধরনের সমস্যার কথা কেউ নিশ্চয় ভাবেনি। কেউ ভাবেনি যে পত্রিকা চালাবার দায়িত্বও সরকারের ওপর ন্যস্ত হবে। ফলে এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত কোনো মহলে ছিল না। তাই সাধারণ বিবেচনায় এই পত্রিকাগুলো পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত হলো তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর। কোনো নির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন করা হলো না। এ পত্রিকাগুলোর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো চিন্তা-ভাবনা হলো না। তাৎক্ষণিকভাবে খবরদারি দেয়া হলো তথ্য মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু পত্রিকাগুলোকে অধিক হারে বিজ্ঞাপন দিলেও রাতারাতি বিজ্ঞাপনের টাকা পাওয়া যাবে না। অর্থ সাহায্যের জন্যে যেতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়কে বোঝানো অত সহজ নয়। তখন অর্থমন্ত্রী মরহুম তাজউদ্দিন আহমদ। তাঁকে কথায় ভোলানো যায় না। যুক্তিগ্রাহ্য না হলে কোনো কথাই তিনি শুনবেন না। তাঁর কাছ থেকে পত্রিকার জন্য টাকা আনা আদৌ সহজ নয়। তাঁর প্রথম কথা হলো–এ অর্থ কেন দেব? অর্থের মালিক আমি বা সরকার নয়। এ অর্থের মালিক রাষ্ট্রের জনগণ। এ অর্থ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা কোথায়? এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার সাধ্য আমাদের ছিল না। কারণ ওই পত্রিকাগুলো নিয়ে কী করা হবে, আদৌ এ পত্রিকাগুলো চালু রাখা হবে কিনা সে সিদ্ধান্ত একান্তভাবেই সরকারকে নিতে হবে। এ ব্যাপারে ইউনিয়নের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। ইউনিয়নের দায়িত্ব হচ্ছে সাংবাদিক কর্মচারীদের স্বার্থ রক্ষা করা। কোনো শিল্প কারখানা বা সংবাদপত্র বন্ধ হলে কর্মচারীদের পাওনা আদায়ে নিশ্চয়তা বিধান এবং সম্ভব হলে প্রতিষ্ঠানটি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা।

কিন্তু পাকিস্তানে তখনো সংবাদপত্র শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠেনি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পত্রিকাগুলো ছিল ব্যক্তি মালিকানায়। মাত্র দৈনিক বাংলা ও মর্নিং নিউজ-এর মালিক ছিল পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্ট। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই মালিকানার প্রশ্নই মুখ্য হয়ে দেখা দিল। সঙ্কট দেখা দিল পত্রিকাগুলো চালু রাখা নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে আজাদ পত্রিকার জন্যে কিছু টাকা পেলেও শেষ রক্ষা হলো না। অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এ ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্ত চাইলেন। জানতে চাইলেন পত্রিকাগুলোর ভবিষ্যৎ। ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো কিছুই বলার সুযোগ ছিল না।

সরকারের পক্ষে দৈনিক স্বদেশের প্রশাসক নিযুক্ত হলেন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা কোরবান আলী। কোরবান আলীর বিরুদ্ধে স্বদেশের সব সম্পদ বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ উঠল। শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেলো স্বদেশ। আমাদের শুধুমাত্র দেখা ছাড়া কোনো কিছু করার অবকাশ ছিল না। তবে ইউনিয়নের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হয়েছিল সাংবাদিকদের পুনর্বাসনের। আজাদ পত্রিকার সমস্যাও মিটল না। আজাদ পত্রিকার মালিকানা নিয়ে বিরোধ ছিল। সমস্যার সাময়িক সমাধান হিসেবে আজাদের মালিকদের একটি অংশের হাতে আজাদের মালিকানা দিয়ে দেয়া হয়। শেষ হলো সরকারি নেতৃত্ব। কিন্তু সমস্যার সমাধান হলো না। সংবাদ সংস্থা বিপিআই অর্থাৎ বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনাল নতুন নাম নিল। নাম হলো ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সি এনা। এ প্রতিষ্ঠানটিও দীর্ঘদিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলল। সেই এনাও পরবর্তীতে নিজগুণে বন্ধ হয়ে গেল।

পত্রিকা জগতের এই পরিস্থিতিতে ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচন হলো। আমি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি হলাম। সাধারণ সম্পাদক হলেন গিয়াস কামাল চৌধুরী। একটি অস্থির পরিবেশে আমি ইউনিয়নের সভাপতি হলাম। চারদিকে অস্থিরতা। একাত্তরের সংগ্রামের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই সর্বত্রই অস্ত্র ছড়িয়ে গেছে। সকলেই মুক্তিযোদ্ধা এবং সশস্ত্র। সকলেই নিজের সংবাদ ছাপাতে চায়। সংবাদ না ছাপালে এসএলআর নিয়ে অফিসে হাজির হয়ে যায়। প্রকাশ্যে জীবননাশের হুমকি দেয়। এর মাঝখানে অধিকাংশ পত্রিকায় অনিশ্চয়তা। একাত্তরের সংগ্রামের কালে সংবাদ বন্ধ ছিল। সংবাদ তখনো সে বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠেনি। পাকবাহিনী ইত্তেফাক পুড়িয়ে দিয়েছিল। একাত্তরে সংগ্রামের সময় ইত্তেফাক প্রকাশিত হয়। কিন্তু ইত্তেফাক যুদ্ধের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। প্রচার সংখ্যার দিক থেকে তখন দৈনিক বাংলা এগিয়ে। যুদ্ধ শেষে দৈনিক বাংলায় আমার চাকরির পরিবর্তন হয়েছে। দৈনিক পাকিস্তানে চাকরি নিয়েছিলাম সহসম্পাদক হিসেবে। দৈনিক বাংলায় আমি সহকারী সম্পাদক। আমি ঢাকায় ফিরেছি। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেছি জানুয়ারিতে। আমি অনিকেত ছদ্মনামে উপসম্পাদকীয় লিখছি দৈনিক বাংলায়। আমার লেখা তখন একান্তই বিতর্কিত। আমার লেখায় সরকার পক্ষ কিছুতেই খুশি নয়। আর এই সময়েই আমি ইউনিয়নের সভাপতি হলাম। তখন সাংবাদিকদের জাতীয়ভিত্তিক কোনো সংগঠন ছিল না। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নই জাতীয়ভিত্তিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিত। ফলে আমার অবস্থাও সঙ্গীন হয়ে উঠল।

অপরদিকে রাজনৈতিক দিক থেকেও আমি তখন মার খাচ্ছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আমাদের অর্থাৎ শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের প্রভাবশালী শ্রমিক সংগঠন ছিল। দেশের সমস্ত চটকলে ছিল আমাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। ঢাকা শহরের হোটেল কর্মচারীদের ইউনিয়ন আমাদের হাতে ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমাদের হোটেল শ্রমিক প্রতিষ্ঠান শাহবাগ হোটেল ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে মিছিল করেছি। সে মিছিলে গুলি হয়েছিল। এটাই ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোনো মিছিলে প্রথম গুলি।

এই প্রেক্ষাপটে আমাদের উপর হামলা নেমে এল। সরকারি শ্রমিক প্রতিষ্ঠান শ্রমিক লীগ একের পর এক আমাদের ইউনিয়ন হাইজ্যাক করতে শুরু করল। আমাদের ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে নতুন রেজিস্ট্রেশন দেয়া হতে থাকল। আমাদের সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মওলানা সাইদুর রহমানকে হাইজ্যাক করে শ্রমিক লীগের সভাপতি করা হয়।

এ সময় আমি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। সারাদেশে তখন এক ধরনের নৈরাজ্য। মুক্তিযোদ্ধা নামে পরিচয় দিয়ে এক শ্রেণির যুবক সবকিছু দখল করছে। এর বিরুদ্ধে লেখা যাচ্ছে না। সরকারি কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা আছে সন্ত্রাসীদের। সেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস থাকা খুব সহজ ছিল না।

অপরদিকে বামপন্থী মহলে তখন বিভাজন চরম। মস্কোর অনুসারী কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে সরকারের সাথে সহযোগিতা করছে। পিকিংপন্থী বলে পরিচিত রাজনীতিকরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত। সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে সর্বহারা পার্টি ক্ষমতা দখলের ডাক দিচ্ছে। একের পর এক থানা লুট হচ্ছে। ১৬ ডিসেম্বর অর্ধ দিবস হরতাল ডেকেছে সর্বহারা পার্টি। বিজয় দিবসের এ হরতাল হঠাৎ সমর্থন জানালেন মওলানা ভাসানী। কেন জানালেন, কোন ভিত্তিতে জানালেন সে ব্যাখ্যা আজো আমার কাছে পরিষ্কার নয়। শুধু একটি ব্যাখ্যাই পরিষ্কার ছিল যে, ডান-বাম রাজনীতির অঙ্গনে নৈরাজ্য বিরাজ করছিল।

ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। সহযোগিতা করছে কমিউনিস্ট পার্টি এবং একতা পার্টি। এ সহযোগিতার ভিত্তি কখনো আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তাদের শ্লোগান হচ্ছে-দেশ স্বাধীন করেছি। এবার দেশ গড়তে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। কমিউনিস্ট পার্টির এ ঐক্যের শ্লোগানটি আদৌ পরিষ্কার নয়। প্রশ্ন হচ্ছে-ঐক্য কার সাথে। কোনো শ্রেণির সাথে। সমাজতন্ত্রের কথা বলা হলে আওয়ামী লীগের সাথে কি ঐক্য করা যায়। আওয়ামী লীগ কি সমাজতন্ত্রের দল? তাহলে আওয়ামী লীগের শ্রেণি চরিত্র কি? আওয়ামী লীগের সাথে কমিউনিস্ট পার্টি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পূর্বে এ প্রশ্নগুলো আলোচিত হতো বিভিন্ন অঙ্গনে। তবে এ কথা ঠিক যে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও একতা পার্টির রাজনীতির একটি উত্তরাধিকারের ঐকমত্য ছিল। এরা মস্কোর অনুসারী ছিল এবং মস্কোর তত্ত্ব অনুযায়ী খুব সোজা হিসেব ছিল মস্কোর সাথে দিল্লির ভালো সম্পর্ক। দিল্লি সরকারের সাথে ঢাকা সরকারের ভালো সম্পর্ক। ঢাকা সরকারে আছে আওয়ামী লীগ। সুতরাং আওয়ামী লীগের সাথে বাংলাদেশের মস্কোপন্থীদের ঐক্য হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এ ঐক্য নিয়ে মতান্তর ছিল আওয়ামী লীগেই দীর্ঘদিন। এই মতান্তরের শিকার আমিও হয়েছিলাম ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে, সে কাহিনীতে পরে আসছি।

আমি ঢাকা সংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হলাম জুলাই মাসে। মনে হলো ওই মাস থেকে আমার শক্ৰসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো। সম্মেলনে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন তকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি একটি সুন্দর ভাষণও দিয়েছিলেন। উল্লেখ করেছিলেন পাকিস্তান যুগে সাংবাদিকদের আন্দোলনের কথা। সেই আন্দোলনে তাঁর সমর্থনের কথা। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পূর্বে নতুন সভাপতি হিসেবে আমি ভাষণ দিয়েছিলাম। আমার কণ্ঠে ছিল ক্ষোভের সুর। আমাদের সভার প্রথম সারিতে পত্রিকার সম্পাদকেরা বসেছিলেন। এক সময় আমি তাঁদের উদ্দেশে বললাম, আপনারা সকলে সরকারের স্তুতি গাইছেন কেন? সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিচ্ছেন সাংবাদিকদের মাথায়। নিজেরা কোনো ভূমিকা পালন করছেন না। প্রবীণ সাংবাদিকরা সুযোগ খুঁজছে উঁচু পদ পাওয়ার জন্যে। অবস্থা এমন হলে এ দেশের সাংবাদিকতাই থাকবে না।

সাধারণ শ্রোতারা খুশি হলেও রুষ্ট হলেন সম্পাদকেরা। আব্দুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত দৈনিক জনপদে আমার নাম করেই চিঠি বের হলো। কিছু কিছু উপদেশ দেয়া হলো সম্পাদকীয় ও সাংবাদিকতা সম্পর্কে। এই সময় বিপদ দেখা দিল দৈনিক গণকণ্ঠ নিয়ে। গণকণ্ঠ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের মুখপত্র। মাত্র কিছুদিন আগে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়েছে। এই দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্রলীগের এককালের নামিদামী নেতারা। আমার আগের লেখায় ছাত্রলীগের এই গ্রুপটি সম্পর্কে আমি লিখেছি। আমি বলতে চেয়েছি ৭১-এর সংগ্রামের মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রলীগের এই অংশটি। তাদের ত্যাগ তিতিক্ষা কিংবা সাহস সম্পর্কে প্রশ্ন তুলবার অবকাশ নেই।

আমার প্রশ্ন ছিল এরা কারা। এরা কী চায়? একটি ছাত্র সংগঠন দিয়ে বিপ্লব করা সম্ভব নয়। তাই আওয়ামী লীগের আশ্রয়ে থেকেই এদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলতে হয়েছে। প্রথম থেকে আমার ধারণা ছিল দেশের স্বাধীনতা এদের কাছে শেষ কথা নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্থবহ করতে হলে সমাজ পরিবর্তনের কথা বলতে হয়। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এমন কথা তারা বলতে রাজি হননি। আমি আগেই লিখেছি ৭১-এর সংগ্রামের আগে এই গ্রুপটির সাথে আমাদের দলের বারবার আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি, আমরা স্বাধীনতা চাই। সাথে সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের একটা রূপরেখাও চাই। আমরা পাকিস্তানের মতো আর একটি শোষণমূলক রাষ্ট্র গঠনে রাজি নই। এই প্রশ্নটি ছাত্রলীগের নেতারা বারবার এড়িয়ে গেছেন। স্বাধীনতার পরে মনে হলো ছাত্রলীগের এ গ্রুপটি প্রচণ্ড শক্তিশালী। কিন্তু এ শক্তির ভবিষ্যৎ কী? প্রথমে লক্ষ করলাম এ গ্রুপটি মুজিববাদের শ্লোগান দিচ্ছে। পরবর্তীকালে শুনলাম এরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলছে। প্রথম প্রথম সেই শব্দটা আমার মনে কৌতুক সৃষ্টি করত। আমার বোধগম্য হতো না সমাজতন্ত্রের সাথে তারা এ বৈজ্ঞানিক বিশেষণটি কেন লাগিয়েছে। একদিন শুনলাম ওরা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে কমরেড শেখ মুজিব বলে সম্বোধন করছে। ওদের শ্লোগান হচ্ছে, কমরেড শেখ মুজিব লও সালাম, লও সালাম। আমি বুঝতে পারিনি কোন ভিত্তিতে ওরা শেখ সাহেবকে কমরেড বলছে। তাহলে ওরা কি ভাবছে যে দেশে সমাজতন্ত্র হবে এবং সেই সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের নেতা হবেন শেখ মুজিব। পরবর্তীকালে আমার মনে হয়েছে ভিন্ন কথা। দুঃখ হয়েছে এই ত্যাগ এবং সাহসী তরুণদের জন্যে এবং মনে হয়েছে যে কোনো মহল থেকেই হোক এ তরুণদের নিদারুণভাবে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। এদের বলা হয়নি, পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। বলা হয়নি আওয়ামী লীগ সমাজ পরিবর্তনের রাজনৈতিক সংগঠন নয়। এও বলা হয়নি যে অন্য দেশের সহযোগিতায় স্বাধীনতা অর্জন করলে আমরা পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ব। আমার যতদূর ধারণা এদের কাছে স্বাধীনতার একটি রঙিন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। হয়তো এও বলা হতে পারে, ছাত্রলীগ থেকে যেভাবে আওয়ামী লীগকে ৭১-এর সংগ্রামে ঠেলে দেয়া গেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তেমনিভাবে আওয়ামী লীগকে ঠেলে দেয়া যাবে সমাজ পরিবর্তনের দিকে। এ ধরনের ধারণা ছাড়া শেখ সাহেবকে কমরেড বলার কোনো অর্থ আছে বলে আজো আমার মনে হয় না। আমার আর ধারণা হচ্ছে–এ কাজটি যারা করেছেন তাঁরা ভীষণ ধুরন্ধর। অথচ একেবারেই নির্বোধ। ধুরন্ধর না হলে একের পর এক এমন মিথ্যা তত্ত্ব সাজিয়ে একটি বিরাট সাহসী তরুণ গোষ্ঠীকে এমন বিভ্রান্ত করা সম্ভব হতো না। এমনো হতে পারে, এই ধূরন্ধর গোষ্ঠীটি জানত যে আজ হোক কাল হোক পাকিস্তান ভাঙবেই। এই পাকিস্তান ভাঙার আন্দোলন বামপন্থীদের হাতে গেলে দেশি বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বিপর্যস্ত হবে। অশান্তপূর্ব ভারতের বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু হবে স্বাধীন বাংলাদেশ। লক্ষণীয় যে তখন এই অঞ্চলের কতিপয় দল স্বাধীন বাংলা গঠনের শ্লোগান দিচ্ছিল।

সেকালের পূর্ব পাকিস্তানের পঞ্চম আন্দোলন সীমান্তের বিরাট এলাকা জুড়ে শুরু করেছিল নকশালপন্থীরা। সে পটভূমিতে কেউ যদি মনে করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন নিজেদের কজায় রাখতে হবে, এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করতে হবে যেখানে সমাজ ব্যবস্থা অটুট থাকবে, সেকালের পরিস্থিতিতে এমন ধারণা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু ইতিহাস কারো আঙ্গুলি হেলানে চলে না। ইতিহাসের গর্ভেই নতুন শক্তির সৃষ্টি হয়। এমনি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের সাহায্যে হলেও এই স্বাধীনতা আন্দোলন বাংলাদেশের একটি মৌলিক পরিবর্তন ঘটায়। ৭১-এর যুদ্ধে সাধারণ মানুষ যোগ দেয়। নিজের বাঁচার তাগিদে অস্ত্র ধরে। যুদ্ধ শেষে তাদের মনে একটি প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়। প্রত্যাশা হচ্ছে জীবনে সুদিন আসবে। পাকিস্তান আমলের মতো দুঃখ-বেদনা থাকবে না। অনাচার, অবিচার, স্বজনপ্রীতি থাকবে না। ৭১-এর যুদ্ধ তরুণদের নতুন সমাজ গঠনের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে।

আর এখানেই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় সেই ধূরন্দর নেতৃত্বের সাথে সাহসী ত্যাগী, তরুণদের। এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পুরানো কথায় কাজ হবে না। সমাজ পরিবর্তন এবং সমাজতন্ত্রের কথা বলতে হবে, নইলে এ তরুণদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। অথচ যে নেতৃত্ব এদের অনুপ্রাণিত করেছিল, এদের মৃত্যু হাতে নিয়ে জীবন যুদ্ধ ঠেলে দিয়েছিল, সে নেতৃত্ব আদৌ সমাজতন্ত্র বা সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী ছিল না। আমার মতে সেই পটভূমিতেই তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র আবিষ্কার করেছিল এবং শেখ সাহেবকে কমরেড বলে সম্বোধন করেছিল। আমি মনে করি তরুণদের বিভ্রান্ত করার জন্যে তারা এ পথ নিয়েছিল। অন্যথায় যে কথা আমি আগেই বলেছি তা হচ্ছে–এই মহলটি একেবারেই নির্বোধ ছিল। রাজনীতির ব্যাকরণে নিমতম জ্ঞান যাদের আছে তারা নিশ্চয়ই শেখ সাহেবকে কমরেড বলবে না। তরুণদের বোঝাবার চেষ্টা করবে না যে, শেখ সাহেব বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবেন।

তবে যে ব্যাখ্যায়ই তোক দেখা গেলো ছাত্রলীগের এই অংশটি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের শ্লোগান দিচ্ছে। একই দিনে ছাত্রলীগের দু’টি অংশের সম্মেলন। হচ্ছে। এই পক্ষ থেকেই বলা হচ্ছে যে, শেখ সাহেব তাদের সম্মেলনে যাবেন। কিন্তু শেখ সাহেব তাঁর শ্রেণি চরিত্রে বিশ্বস্ত ছিলেন। তিনি পল্টন ময়দানে আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজের সম্মেলনে না গিয়ে পল্টন ময়দানে নূরে আলম সিদ্দিক, আব্দুল কুদুস মাখনের সম্মেলনে যোগ দিলেন। রব-সিরাজের সম্মেলনে নতুন ছাত্রলীগ গঠিত হলো। যার লক্ষ্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। পরবর্তীকালে দল হিসেবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ আত্মপ্রকাশ করল। বিস্ময়ে দেখলাম মেজর এমএ জলিল এই দলের সভাপতি হয়েছেন। সমাজতান্ত্রিক দল হিসেবেই গঠিত দলটি একটি বিভিন্ন শ্রেণির সমন্বয়ে দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। বিশ্বাস বা আদর্শের কোনো বালাই থাকল না এই দলের। আর এই দলের মুখপাত্র হিসেবে প্রকাশিত হলো দৈনিক গণকণ্ঠ। এই দলটি তখন চরমভাবে নির্যাতিত। আর এদের হঠকারিতার কোনো শেষ নেই। তারা প্রায় প্রতি সপ্তাহে সরকারকে আলটিমেটাম দিছে। কখনো কখনো থানা, পুলিশ ফাঁড়ি দখল করছে। প্রাণ দিচ্ছে। আহত হচ্ছে তার যেন কোনো হিসাব নেই। পুলিশ এদের তাড়াচ্ছে আর তাড়াচ্ছে। গ্রেফতারের খবরটি পত্রিকায় ছেপে দিন। পত্রিকায় ছাপা না হলে এই ছেলের আর খোঁজ পাওয়া যাবে না। অদৃশ্য হয়ে যাবে এই পৃথিবী থেকে। আমি দিনের পর দিন এই খবর ছাপাতে চেষ্টা করেছি। এদের বাঁচাতে চেষ্টা করেছি। এই ত্যাগী এবং সাহসী তরুণদের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করা যায় কিন্তু সহমর্মিতা প্রকাশ না করে পারা যায় না। আমার মনে আছে রব-সিরাজ ছাত্রলীগের সম্মেলনে আবুল হাশেম ও আমি গিয়েছিলাম। যাননি শেখ সাহেব। তাই তত্ত্বের দিক থেকে চরম বিরোধিতা থাকলেও এই তরুণদের সাথে অজান্তে একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমার। আর ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের পত্রিকা গণকণ্ঠ নিয়ে সমস্যা মোকাবেলা করতে হলো।

গণকণ্ঠ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকার অনমনীয়। এ ব্যাপারে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভা ডাকা হলো। সবাই চুপচাপ। শেখ সাহেবের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে দ্বিধান্বিত। সকলেই প্রতিবাদ করছেন কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট প্রস্তাব দিলেন না। সকলের সাথে আলাপ হলো। সাংবাদিক এমএন হারুন পরামর্শ দিলেন একটি সীমিত কর্মসূচি নিতে। কর্মসূচি হচ্ছে সকল পত্রিকায় দু’ঘণ্টার ধর্মঘট। শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। সরকার বিব্রত হলেন। পরের দিন তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আমাদের ডেকে পাঠালেন। তিনি বললেন, আপনাদের সব দাবি মেনে নেয়া হবে। কিন্তু তার আগে আপনাদের ধর্মঘট তুলে নিতে হবে। আমরা বললাম তা হয় না। এ প্রস্তাব পাল্টাতে হলে ইউনিয়নের বৈঠক করতে হবে। সে সময় এখন আর নেই। আমি তখনো বুঝতে পারিনি আমাদের সাথে আলাপের জন্যে যুগ্ম সচিবকে প্রতি মুহূর্তে নির্দেশ দিচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

আমরা সরকারি প্রস্তাবের সাথে একমত হলাম না। ইউনিয়নের প্রবীণ সদস্যদের মত, জরুরি ভিত্তিতে ইউনিয়নের সাধারণ সভা ডাকা হোক। তখন ইউনিয়ন তেমন বড় ছিল না। বিকেলে প্রেস ক্লাবের আমতলায় সাধারণ সভা বসল। একজন মাত্র সদস্য ইউনিয়নের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল। তাই ভোটাভুটির প্রয়োজন হয়নি।

গণকণ্ঠের দু’ঘণ্টা ধর্মঘট হয়ে গেল। সরকার সব দাবিই মেনে নিলো। কিছুদিন পরে একটি অদ্ভুত প্রশ্ন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ সাহেব বললেন, আপনাদের দাবি তো মানলাম। কিন্তু কোনো দেশের কোনো সরকার কি এ ধরনের দাবি মানে?

গণকণ্ঠ জাসদের পত্রিকা। গণকণ্ঠ ছাপা হয় জনতা প্যাকেজিং-এ। প্রকৃতপক্ষে এ প্রেসটি ছিল দৈনিক সংগ্রামের। দেশ স্বাধীন হবার পর এই প্রেসটির মালিকানা সরকার গ্রহণ করে। প্রশাসক নিযুক্ত হন জাসদের এক নেতা। ওই নেতাই আবার গণকণ্ঠের পরিচালক। তিনি গণকণ্ঠের পরিচালক হিসেবে ওই প্রেসের পরিচালকের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। চুক্তিতে বলা হয়েছে, গণকণ্ঠ ওই প্রেসে ছাপা হবে। সে জন্যে প্রেসকে গণকণ্ঠ কর্তৃপক্ষ মাসে পাঁচ হাজার টাকা দেবে। ঘটনাটি দু’দিক থেকেই অভিনব। প্রথম হচ্ছে, একই ব্যক্তি একটি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসক হিসেবে অপর একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি চুক্তি করেছেন। উভয় প্রতিষ্ঠানের স্বাক্ষরদানকারী একই ব্যক্তি। দ্বিতীয় হচ্ছে একটি দৈনিক পত্রিকা ছাপার জন্যে প্রেসকে মাত্র মাসে ৫ হাজার টাকা দেয়া হবে।

তবে খবরের শেষ এখানেই নয়। শেখ সাহেব বললেন, গণকণ্ঠের জন্যে বাড়ি দেব, পানি দেব, ফোন দেব, টেলিপ্রিন্টার দেব, নিউজপ্রিন্ট দেব–এ বাবদ তারা কোনো পয়সাই পরিশোধ করবে না। পরিবর্তে তারা শুধু আমাদের সরকারের সমালোচনা করবে। আপনাদের এ দাবি পৃথিবীর কোনো দেশের সরকার মানবে কি? প্রকৃতপক্ষে সেদিন আমার কাছে এ প্রশ্নের কোনো জবাব ছিল না। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সাথে জড়িত আছি। অনেক সময়ই অনেক কাজ করেছি, যা আমার মনপুত ছিল না। আর আমার করারও কিছু ছিল না।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হয়েছি জুলাই মাসে। আগস্ট মাসে আমন্ত্রণ এল পূর্ব জার্মানি অর্থাৎ (জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকান) জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। সেকালের কমিউনিস্ট জার্মানির পক্ষ থেকে। পূর্ব জার্মানের লাইপজিগ শহরে প্রতি বছর শিল্পমেলা অনুষ্ঠিত হয়। সেই শিল্পমেলায় আমাদের আমন্ত্রণ। পূর্ব জার্মানি তখনও জাতিসংঘের সদস্য নয়। তাই জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিদের নিতে তাদের বেশি আগ্রহ। এছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে তারা অকুণ্ঠ সমর্থন করেছে। সাহায্য করেছে অঢেল। সেদিক থেকে আমাদের আমন্ত্রণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

সিদ্ধান্ত হলো ইউনিয়নের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল পূর্ব জার্মানিতে যাবে। ইউনিয়নের সভাপতি আমি, যুগ্ম সম্পাদক শামসুল হক, আল নূর ও অন্যতম সদস্য মোজাম্মেল হোসেন। প্রশ্ন দেখা দিলো আমার যাওয়া নিয়ে। পাকিস্তান আমলে আমি কোনোদিন পাসপোর্ট পাইনি। এ আমলেও পাওয়া যাবে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না। ১৯৬২ সালের কথা। আইয়ুব খানের আমল। জেল থেকে এসেছি। তখন পাসপোর্টের অন্যতম কর্মকর্তা কাজী বাহাউদ্দিন আহমেদের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে দেখে বলেছিলেন, আপনি এসেছেন কেন? আমাদের কাছে ৫ ব্যক্তির একটি নামের তালিকা আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জিজ্ঞেস না করে তাদের পাসপোর্ট দেয়া বারণ। এর মধ্যে আপনি একজন। এ তালিকায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ বড় নেতাদের কারো নাম নেই। আমি বললাম, আমি নিজের পাসপোর্টের জন্যে আসিনি। এসেছি আমার কাকার পাসপোর্টের জন্যে। বাহাউদ্দিন সাহেব বললেন, এ পাসপোর্টও দেয়া হবে না। ওই দরখাস্ত আপনি বহন করছেন। মাস কয়েক পর অন্য কাউকে দিয়ে একটি দরখাস্ত পাঠিয়ে দেবেন। আপনার কাকাকে পাসপোর্ট দেয়া হবে। বাহাউদ্দিন সাহেব কথা রেখেছিলেন। আমার কাকাকে পাসপোর্ট দিয়েছিলেন তাও মাত্র দু’মাসের জন্য।

দেশ স্বাধীন হলো ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু এ ধরনের কোনো ঘটনাই আমি ভুলতে পারিনি। আমি ও আলী নূর পাসপোর্টের জন্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেলাম। স্বরাষ্ট্র সচিব টি আহমেদ। আমি বললাম, আমাদের দরখাস্তে একটি সই করে দিন। তিনি প্রথমে কোনো কথা বললেন না। তিনি আমার কথায় খানিকটা বিস্মিত হলেন। বললেন, দরখাস্তটা রেখে যান। পরে জানাব। আমি বললাম, তা হবে না। পাকিস্তান আমলে অনেক জ্বালিয়েছেন। এবার আমি আপনাকে কোনো সময় দিতে রাজি নই। আমাদের ব্যাপারে তদন্তের কোনো অবকাশ নেই। তখন দুপুর একটা। আমি বললাম, আপনাকে বেলা তিনটা পর্যন্ত সময় দিলাম। আলী নূর এখানে থাকবে। আমি প্রেস ক্লাবে অপেক্ষা করব। তিনটার মধ্যেই আলী নূর স্বরাষ্ট্র সচিবের সই নিয়ে এসেছিল। খুশি হয়েছিলেন বাহাউদ্দিন সাহেব। পাসপোর্টের জন্যে তার কাছে গেলাম। তিনি হাসলেন।

বললেন, আজ বড্ড ভালো লাগছে। আমার চাকরিকালেই আপনাকে আমি পাসপোর্ট দিতে পারলাম।

সেপ্টেম্বরে প্রথম সপ্তাহে পূর্ব বার্লিন যেতে হবে। ঢাকা থেকে দিল্লি। দিল্লিতে একরাত হোটেলে। পরদিন ভোরে তেহরান হয়ে মস্কো। মস্কো থেকে পূর্ব বার্লিন। জীবনের প্রথম বিদেশ যাত্রা। ইতিপূর্বে শৈশবের স্বদেশ, যৌবনের বিদেশ ভারতে গিয়েছি। গিয়েছি যৌবনের স্বদেশ ও পরবর্তীকালে বিদেশ পাকিস্তান। পাকিস্তান গিয়ে তুরখাম সীমান্তে আফগানিস্তানে পা রেখেছি। ওটাই আমার বিদেশ পদার্পণ। সে অর্থে এবারই আমার বিদেশে পদার্পণ। শুধু বিদেশ নয়, সমাজতান্ত্রিক দেশ। ঠিক হয়েছে শুধু পূর্ব জার্মানি নয়, ফেরার পথে হাঙ্গেরি ও সোভিয়েত ইউনিয়নে যাব। তাই দীর্ঘদিন ধরেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছিলাম।

আমি মার্কসবাদ, লেনিনবাদ, শ্রেণিসগ্রাম এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে বিশ্বাস করি এবং সেই রাজনীতিই করি। কিন্তু রাজনীতির হাতেখড়ি থেকে অনেক প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে আমি একমত নই। আমি মনে করি লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিন ভুল পথে চলেছে। আমাদের দলের ব্যাখ্যা হচ্ছে স্ট্যালিনের জন্যেই বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের দলের ব্যাখ্যা হচ্ছে পূর্ব ইউরোপের পূর্ব জার্মানি, পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া বা হাঙ্গেরি কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবই হয়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে সোভিয়েত বাহিনী এই সকল দেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে জগাখিচুরির এই সরকারগুলোকে বলা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক সরকার। আমার দলের বক্তব্য হচ্ছে-পূর্ব ইউরোপের এই সকল দেশে প্রতি বিপ্লব অনিবার্য। আমার সঙ্কট হচ্ছে এই ধারণা এই বিশ্বাস নিয়েই আমি বাংলাদেশের প্রথম সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের নেতা হয়ে ওই দেশ সফরে যাচ্ছি। আমার বিশ্বাস তারা আমার খবর রাখে। সেখানে কমিউনিস্টদের ভাষায় আমি ট্রটস্কিপন্থী মার্কিন দালাল। আর আমি হলাম স্বাধীন বাংলাদেশের সাংবাদিক প্রতিনিধিদের নেতা।

ফলে এই সকল দেশগুলোতে প্রতি মুহূর্তে আমার সাথে বিতর্ক হবে। জানি না সেই বিতর্ক কতদূর গড়াবে। এছাড়া ভয় ছিল নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পর্কে। আগে এ ধরনের সফরে যাইনি। আমি একটি দেশের প্রতিনিধিত্ব করব। সেখানে দলবাজি ছেড়ে দেশের কথা বলতে হবে। আবার নিজের আদর্শকেও পরিহার করা চলবে না।

পূর্ব জার্মানির রাত ১২টায় বার্লিন বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। আমাদের ঘড়িতে তখন ভোর ৫টা। নয়াদিল্লি থেকে যাত্রা করেছিলাম আমার ঘড়িতে বেলা সাড়ে ন’টায়। বিমানবন্দরের ভেতরেই পূর্ব জার্মানির সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ গাড়ি নিয়ে এলেন। আমার পোশাক দেখে নেতৃবৃন্দ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন–তুমি কি বাংলাদেশ থেকে এসেছ? সেপ্টেম্বরে সেখানে কিছু শীত পড়লেও আমার পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি, পায়ে স্যান্ডেল। ওদের তাই চিনে নিতে অসুবিধা হয়নি যে আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। যারা নিতে এসেছিলেন তাদের মধ্যে একজন পূর্ব জার্মানির বিদেশ দফতরের ভদ্রমহিলা ছিলেন। বিমানবন্দরে চা খেতে খেতে তার সাথে আলাপ হলো। খানিকটা স্বস্তি পেলাম। নিজের কাছে মনে হলো জ্ঞানের গভীরতায় পাল্লা দেয়া আদৌ কোনো অসুবিধা হবে না। মনে হলো সাম্প্রতিক অনেক ঘটনা ওদের জানা নেই, বিশেষ করে পশ্চিম জগতের।

আমাদের একটি সুন্দর বাড়িতে থাকতে দেয়া হলো। আদৌ কোনো হোটেল নয়, কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার আগে এক ধনবান ব্যক্তির বাড়ি ছিল। এ বাড়িতে সাধারণত বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের থাকতে দেয়া হয়। আমাদের বার্লিনের অবস্থান ছিল স্বল্পকালীন। তাই হোটেলে নেয়া হয়নি। পরদিন আমাদের যেতে হবে লাইপজিগ। সেখানে প্রথম অনুষ্ঠান আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সম্মেলন। আমাদের দোভাষী গানথার লিন্ডে। ষাট বছরের বৃদ্ধ। সাংবাদিক। রান্নার উপর বই লেখেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের বন্দিশিবিরে ছিলেন। পালিয়ে গিয়ে লন্ডনের বিবিসিতে কাজ করেছেন। পটাসডাম কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। লিন্ডে শিশুর মতো সরল। স্ত্রী ও একমাত্র পুত্র নিয়ে তার সংসার। লিন্ডে প্রকাশ্যে তাঁর সরকারের সমালোচনা করেন। গভীর রাতে লিন্ডে ফিরে গেলেন। ভোরবেলা এক বাঙালির কণ্ঠস্বরে চমকিত হলাম। বাঙালি রামদা নামে পরিচিত। নাম সুনীল দাশগুপ্ত। এককালের বাড়ি বরিশালের গৌরনদী থানার গৈলা। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। ভারত থেকে গিয়েছিলেন পশ্চিম জার্মানি, সেখান থেকে পূর্ব জার্মানি। বিয়ে করেছেন জার্মানির এক মহিলাকে। নাম বারবারা দাশগুপ্ত। থাকেন কোপেনেকে। বার্লিনের বাঙালি সমাজে রামুদা বিশেষ পরিচিত। সকলের সুখে-দুঃখে আছেন। পূর্ব জার্মানিতে গেলে সকলেরই তাদের বাড়ি যেতে হয়। সেই রামুদা ভোরবেলা আমাদের কাছে এলেন। আঁটি বরিশালের ভাষায় বললেন, কোনো ভয় নেই। আমিও লাইপজিগে যাব। সংবাদ সম্মেলনে আপনাদের সাথে আমি যাব। সংবাদ সম্মেলনে ইচ্ছে হলেই প্রশ্ন করা যায় না। আমি সব ব্যবস্থা করব। আর এই সংবাদ সম্মেলন থেকে আমার সাথে বিতর্কের শুরু। মনে হলো আমি একাই স্বতন্ত্র। আর কেউ যেন এমন প্রশ্ন করছে না। সবাই এসেছে যেন খেয়েদেয়ে ঘুরে ফিরে চলে যাবার জন্যে।

জীবনের প্রথম বিদেশ সফর সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব জার্মান ও হাঙ্গেরি। এই তিন রাষ্ট্রেরই কমিউনিস্ট পার্টি সরকারে। এই কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর সাথে আমার রাজনৈতিক মতানৈক্য ছিল। তাই বিতর্ক হয়েছিল তিনটি দেশেই। ১৯৭৪ সালে আবার ওই এলাকায় গিয়েছিলাম। সেবার সফর করেছি পূর্ব জার্মান, হাঙ্গেরি ও চেকোশ্লোভাকিয়া। দ্বিতীয় বারও আমার সাথে বিতর্ক হয়েছে। তবে সে বিতর্কের ধারা ভিন্ন। এই বিতর্ক সম্পর্কে আমার লেখা একটি বই আছে। বইটির নাম ‘বার্লিন থেকে মস্কো’। সেই বইতে এ ব্যাপারে বিশদ বিবরণ আছে। তবুও সেই বইতে তকালীন বাস্তব কারণে অনেক কিছু লেখা হয়নি। আমি সে বিশদ বিবরণে যাব না। শুধু কিছু কিছু ঘটনা তুলে ধরব। পূর্ব ইউরোপের এ দেশগুলোতে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সফর শেষে ঢাকায় ফিরে আমি দীর্ঘদিন দৈনিক বাংলায় আমার সফরগুলো লিখেছিলাম। এই দেশগুলো সম্পর্কে আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা লিখেছিলাম। লিখতে লিখতে তল্কালীন চিলির সালবের আলেন্দের কথা লিখেছিলাম। বিতর্ককালে আমি পূর্ব জার্মান, হাঙ্গেরি এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার নেতাদের বলেছিলাম, তোমাদের দেশে প্রতি বিপ্লব হতে পারে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট বন্ধুরা আমার লেখার সমালোচনা করেছিলেন। আমাকে মার্কিন দালাল বানানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেকালের সেই বিতর্কের কিছু কিছু অংশ নিয়েই হবে আমার এই লেখা।

পূর্ব বার্লিন পৌঁছুবার পরের দিন লাইপজিগ পৌঁছেছিলাম। পরের দিন আন্তর্জাতিক সংবাদ সম্মেলন। লাইপজিগে একটি ভালো হোটেলেই আছি। বিকেলে দোষাভী লিন্ডে আমার কক্ষে এলেন। বললেন, তুমি কী প্রশ্ন করতে চাও তা লিখে দাও। আমি তার প্রস্তাবে রাজি হলাম না। পরের দিন সাংবাদিক সম্মেলনে দেখলাম রামুদা প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রথমেই হাত তুলেছেন। রামুদা আমাকে বললেন, এবার আপনি প্রশ্ন করুন। আমার প্রশ্ন ছিল, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের সাহায্য নিয়ে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমরা দাবি করছ তোমরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গঠন করেছ। আমাদের সরকারও সমাজতন্ত্রের কথা বলছে। তোমরা আমাদের সাহায্য করবার জন্যে বাংলাদেশে গিয়েছিলে। বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রশ্নে তোমাদের কোনো সিদ্ধান্ত আছে কি? তোমরা কিছু ভেবেছ কি? তোমাদের অভিজ্ঞতা আমাদের দেশে আদৌ প্রযোজ্য কি? আমার প্রশ্নের তেমন কোনো সদুত্তর পেলাম না। বলা হলো, তোমার সাথে পরে আলোচনা করা হবে। আমার পরে ভারতসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা প্রশ্ন করল। ঘন্টাখানেক পরে সংবাদ সম্মেলন শেষ হলো। মনটা খুবই ভালো ছিল না। সংবাদ সম্মেলন শেষ হলেই ভারতের প্রতিনিধিরা আমাকে ঘিরে ধরলেন। বললেন, দাদা জবাব কিছু পেলেন? এদেশে সব কিছুর জবাব পাওয়া যায় না। তাই বুঝেশুনে প্রশ্ন করতে হয়। যতদূর মনে হয় ভারতীয় প্রতিনিধিরা প্রশ্ন করেছিলেন মূলত প্রিন্টিং প্রেস সম্পর্কে। পরে চা খাবার পালা।

পাশের কক্ষে চাসহ অন্যান্য খাবার দেয়া হচ্ছিল। দেখলাম কতিপয় তরুণ বিভিন্ন প্রতিনিধিদের কাছে সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে মতামত জিজ্ঞেস করছে। খাতায় টুকে নিচ্ছে। আমার পাশে দাঁড়ানো ভারতীয় প্রতিনিধি দল। শুনলাম ভারতীয় দলনেতা সংবাদ সম্মেলনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন। আমি অবাক হলাম। কারণে এই ভভদ্রলোক এইমাত্র কিছুক্ষণ আগে আমার সাথে ভিন্ন সুরে কথা বলেছেন।

এবার আমার পালা। তরুণরা আমার কাছে এল। আমি বললাম, এখনো সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে আমি ভেবে উঠতে পারিনি। আর তোমরাও বা এ ধরনের প্রশ্ন করছ কেন? কী জানতে চাচ্ছ আমাদের কাছে? তোমরা তো দেখছি পুঁজিবাদী দেশের সরকারের মতোই আচরণ করছ। পুঁজিবাদী দেশে জরিপের শেষ নেই। ওই সকল দেশে কথায় কথায় জরিপ হয়। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজস্ব শ্রেণি স্বার্থে ওই জরিপ দিয়ে জনমনে সংশয় ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়। আমি বুঝছি না তোমরাও কী চাও। সংবাদ সম্মেলন শেষ হবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তোমরা কী জানতে চাও? আমাদের এই প্রতিক্রিয়া তোমাদের কোনো কাজে আসবে কি? আর এভাবে প্রতিক্রিয়া দিতে আমি অভ্যস্ত নই।

তরুণরা চুপ হয়ে গেল। দেখলাম দূর থেকে এক ভভদ্রলোক আমাদের লক্ষ্য করছেন। এবার তিনি কাছাকাছি এলেন। বললেন, তিনি পূর্ব জার্মান সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের লোক। নাম কার্ল মার্ক। তিনি বললেন, তুমি কী জানতে চাচ্ছ। আমি বললাম, দেখো প্রথমে তোমাদের এ প্রশ্নের ধরন সম্পর্কে আমার আপত্তি আছে। এ ধরনটি একেবারেই পুঁজিবাদী দেশের মতো। চা খেতে খেতে প্রশ্ন করে জবাব নিয়ে কোনো কাজ হয় তা আমি অন্তত বিশ্বাস করি না। এগুলো হচ্ছে লোক দেখানো ভড়ং। দ্বিতীয়ত সংবাদ সম্মেলনে তোমাদের উত্থাপিত বক্তব্য নিয়েই আমার আপত্তি আছে। তোমাদের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে–তোমরা একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতির দেশ। এ বক্তব্য কিন্তু সঠিক নয়। তোমরা কমিউনিস্ট সাধারণ বাজার কমিশনের সদস্য। আদৌ স্বনির্ভর নয়। তোমাদের চারদিকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। তাই তোমাদের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন ধরনের। কার্ল মার্ক আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বললেন, পরে তোমার সাথে আলাপ হবে, এখন নয়। চা খেয়ে আমি হোটেলে ফিরে গেলাম। শুনলাম বিকেলে একটি সমবায় দেখতে যেতে হবে। এই সমবায়ের নেত্রী নাকি লেনিন পুরস্কার পেয়েছেন। তার সাথে আমাকে আলাপ করতে হবে। দুপুরের খাবার পর কিছুটা বিশ্রাম। দোভাষী লিন্ডে এল গাড়ি নিয়ে। লাইপজিগ শহর থেকে সেই সময় খুব দূরে নয়। সেই সমবায়ের দিকে যতো এগুচ্ছিলাম, চারদিক তাকাতে তাকাতে ততোধিক মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম। চারদিকে মাঠ আর মাঠ। জমিতে আল নেই। সবুজের ছড়াছড়ি। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে সারি সারি আপেলের গাছ। আকাশের সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। শীতের গরম। আদৌ উত্তাপ নেই। সেই সময়ে গিয়ে আবার একই বিতর্কে জড়িয়ে গেলাম। আমি বললাম, তোমরা সমবায় খামার করবে, যৌথ খামার করবে, কৃষকেরা মাঠে খাটবে, প্রচুর ফসল ফলাবে। এমনকি শিল্প শ্রমিকের চেয়ে মজুরিও বেশি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের অভিজ্ঞতায় বলে শিল্প শ্রমিকদের সাথে কৃষি শ্রমিকের একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। কৃষক জমি বড় ভালোবাসে। ভালোবাসে জমির ফসল। জমিতে ধানের চারা বাড়তে থাকলে সেই চারার গায়ে সে সোহাগে হাত বুলায়। আমাদের দেশের কৃষক স্ত্রীর চেয়ে গরুকে বেশ ভালোবাসে। ওদের মাটির জন্য দরদ। কৃষককে এই দরদমুক্ত করা কঠিন ব্যাপার। এ কাজটি তোমরা কী করে করবে। তোমাদের দেশে ব্যক্তি মালিকানা নেই। কোনো কৃষকই জমির মালিক নয়। তত্ত্ব হিসেবে এ কথা বলা সহজ। কিন্তু কার্যকর করা বড় কঠিন। তোমরা এ কাজটি কী করে করলে?

আমার দোভাষী বা সমবায়ের সেই প্রখ্যাত মহিলা আমার কথার জবাব দিতে পারলেন না। অথবা আমি তাদের বোঝাতেই পারলাম না আমার কথা। তাঁরা আমাকে দৈনিক নয়া জার্মানি পত্রিকায় যাবার অনুরোধ জানালেন। বললেন, ওই পত্রিকার কৃষি বিভাগ আমাকে তথ্য দিতে পারে। পরবর্তীকালে ওই পত্রিকায় গিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমাকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে যেতে হয়নি। সে অনেক কথা এবং অনেক পরের কথা।

তবে এ প্রশ্নের জবাব পেয়েছিলাম হাঙ্গেরিতে। হাঙ্গেরির কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আলোচনাকালে একই প্রশ্ন তুলেছিলাম। প্রশ্নটি শুনে তারা যেন চমকে গেলেন। বললেন, এ জমি নিয়ে আমরা বিপাকে পড়েছিলাম। কৃষক জমি দিতে চায়নি। এর ফলে ১৯৫৬ সালে আমাদের দেশে বিপ্লব হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম–সকলের সকল জমি প্রথমেই নিয়ে নেয়া হবে না। যে সকল পরিবারের পুরান যুগের মানুষ আছে, যাদের সাথে জমির এক ধরনের আত্মীয়তা আছে–সে সকল পরিবারের কিছু জমি রেখে দেয়া হবে ব্যক্তি মালিকানায়। ওই বৃদ্ধদের মৃত্যু হলে সে জমি রাষ্ট্রায়ত্ত করা হবে।

সমবায় খামারে সন্তোষজনক জবাব মিলছে না। সকালে সংবাদ সম্মেলনের তেমন জবাব পেলাম না। সারাক্ষণ আর একদফা বিতর্ক করেছি একটি সংবাদ সংস্থার সাথে। এই সংস্থাটি পূর্ব জার্মান সংস্থাকে বিভিন্ন তথ্য প্রচার করে। সংস্থার নাম প্যানরোমা। সংবাদ সম্মেলনের পর সেখানে গিয়েছিল সকল দেশের প্রতিনিধি। প্যানরোমার পথ থেকে জানতে চাওয়া এক পূর্ব জার্মান সম্পর্কে আপনার ধারণা কী। সকল দেশের প্রতিনিধি গড়গড় করে জবাব দিচ্ছিল। আমি বললাম, মাত্র দু’দিন হলো পূর্ব জার্মানিতে। তেমন কিছু দেখিনি, শুনিনি। আলোচনা হয়নি কারো সাথে। কী করে তোমাদের প্রশ্নের জবাব দেব? এ মুহূর্তে এ ব্যাপারে আমার কোনো জবাব নেই। প্যানরোমার প্রধান এলেন। বললেন, তুমি কী বলতে চাও? আমি বললাম যা জানি না সে সম্পর্কে কী করে বলব? তুমি আমাকে তোমাদের প্রচারপত্রগুলো দাও। আমি পড়ব। তোমাদের লোকদের সাথে আলোচনা করব। সম্ভব হলে আমার মতামত লিখে পাঠাব তোমার কাছে। আজ কোনো কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই তিন দফা মতান্তরের পরে চতুর্থ দফা মতান্তর হলো সন্ধ্যায়। সন্ধ্যায় এক হোটেলে এক পার্টি। আমাকে বলা হয় তোমার দোভাষী লিন্ডে আর থাকছে না। পরিবর্তে আসবে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী বারবারা পাফ। বারবারা এক সময় ক্যাস্ট্রো এবং এনজেলা ডেভিসের দোভাষী ছিল। তোমার সাথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে। তাই তোমার দোভাষী পরিবর্তন করা হলো।

আমি বললাম, তা হবে না। সাংবাদিক লিন্ডে আমার সাথে থাকবেই। অনেক বলার পর ঠিক হলো আমার জন্যে দুজন দোভাষী থাকবে। ইতিমধ্যে আর এক ভভদ্রলোক এলেন। বললেন, সংবাদ সম্মেলনে তুমি আমাদের বিপদে ফেলেছ। তোমার সাথে কথা বলবেন ভভদ্রলোক, তিনি পূর্ব জার্মান সরকারের তথ্য দফতরের প্রধান। পরে সাথে এলেন অর্থ দফতরের আর এক ভভদ্রলোক।

এবার দোভাষী লিন্ডে নয়, বারবারা। আলোচনা নয়, বিতর্ক। এবার বিতর্ক লেনিন নিয়ে। প্রায় তিন ঘণ্টা দেখলাম দোভাষী বারবারা শ্রান্ত। আমি জার্মান বন্ধুদের বললাম, দেখো লেনিন সম্পর্কে তোমাদের সাথে আমি একমত নই। লেনিন মৃত। তাই তোমাদের সাথে বিতর্কের শেষ হবে না। এসো, আমরা একমত হই যে লেনিন সম্পর্কে আমাদের ঐকমত্য নেই। এর বেশি কিছু নয়। আলোচনা শেষ হলো। হোটেলে ফিরতে ফিরতে দোভাষী বারবারা বলল, তুমি আচ্ছা তোক দেখছি। তুমি কি ভেবেছ ওদের তুমি বোঝাতে পারবে? ওরা কোনোদিন তোমার সাথে একমত হবে না।

পরবর্তীকালে আমার প্রধান দোভাষী বারবারা পাফ। দীর্ঘ সময় কারো সাথে বিতর্ক হলে বারবারা হাসত। সে বলত, এই আলোচনায় কোনো লাভ নেই। তুমি তাদের বুঝতে পারবে না। শুধু শুধু পণ্ডশ্রম করছে। পরে জেনেছিলাম বারবারা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য নয়। কমিউনিস্ট পার্টিকে সমর্থনও করে না। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি পশ্চিম জার্মানি চলে যাচ্ছ না কেন? তোমার মতো দোভাষী সে দেশে হাজার হাজার ডলার কামাতে পারবে। বারবারা বলত পশ্চিম জার্মানিতে গেলে আমি হাজার হাজার ডলার পাব। কিন্তু আমার পরিবারের অন্য সদস্যদের কী হবে। আমি কৃষক পরিবারের মেয়ে। বাবা-মা বৃদ্ধকালীন ভাতা পাচ্ছেন। আমার ভাই বোন বিনে পয়সায় লেখাপড়া করছে। পরীক্ষায় পাস করলে ওরা চাকরি পাবে। আমি বিয়ে করলে বার্লিন শহরে ফ্ল্যাট পাব। সন্তান হলে এককালীন সাহায্য পাব সন্তান বড় করার জন্যে। এ সুযোগ তো পশ্চিম জার্মানিতে পাওয়া যাবে না। তাই দেশ ছেড়ে যাবার প্রশ্নই ওঠে না।

এই দেশ ছেড়ে যাবার প্রশ্ন তুঙ্গে উঠল একদিন বার্লিন দেয়ালের কাছে গিয়ে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জার্মানি ভাগ হয়ে যায়। পূর্ব জার্মানি এবং পশ্চিম জার্মানির সৃষ্টি হয়। পশ্চিম জার্মানি তত্ত্বাবধান করত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং ব্রিটেন। পূর্ব জার্মানির কর্তৃত্ব ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে। পঞ্চাশের দশকে ক্রুশ্চেভের আমলে পূর্ব পশ্চিম সংঘর্ষ চরমে ওঠে। তখন বার্লিন শহরের মাঝখানে দেয়াল দেয়া হয়। এই দেয়ালই ঐতিহাসিক বার্লিনের প্রাচীর নামে খ্যাত। এই দেয়াল ভেঙে ফেলা হয় নব্বই-এর দশকে। যখন একর পর এক সমাজতান্ত্রিক শিবিরের রাষ্ট্রগুলোর পতন হতে থাকে। এই দেয়াল সম্পর্কে পূর্ব জার্মানির ব্যাখ্যা হচ্ছে–দেয়াল না থাকলে পশ্চিমা শক্তিবর্গ দিনের পর দিন নাশকতামূলক কাজ চালাবে। পাশ্চাত্যের পচা গলা সংস্কৃতি দিয়ে প্রলুব্ধ করে নিয়ে যাবে আমাদের তরুণ-তরুণীদের।

বার্লিন দেয়ালের কাছে গিয়ে এমন কথাই শুনলাম। আমার পাশে দোভাষী বারবারা। আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন সামরিক বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। দেয়ালের কাছে উঁচু একটি টাওয়ার আছে। ওই টাওয়ারে একটি রেস্টুরেন্ট আছে। লিফটে ওই রেস্টুরেন্টে পৌঁছাতে ৩৬ সেকেন্ড লাগে। রেস্টুরেন্টটি ঘুরছে। চা খেতে খেতে কখনো রেস্টুরেন্ট থেকে পূর্ব বার্লিন এবং পশ্চিম বার্লিন দেখছি। এক সময় নিচে নেমে এলাম। ক্যাপ্টেনকে বললাম, তোমাদের এই রেস্টুরেন্ট কিন্তু তোমাদের একদিন সর্বনাশ করবে। আর তোমাদের দেয়াল দিয়ে সমাজতন্ত্র রক্ষার তত্ত্ব আমি বিশ্বাস করি না। মনে হলো ক্যাপ্টেন একটু উষ্ণ হলেন।

আমি বললাম, জার্মান ভাগ হলেও তোমরা কিন্তু একই জাতি। তোমাদের ধর্ম, ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য সবই এক। তোমাদের মানুষ যখন ওই টাওয়ারে উঠে পশ্চিম বার্লিনের কাছাকাছি যাবে তখন সে কিন্তু আবেগমথিত হবে। ওপারের আত্মীয়-স্বজনের কথা মনে হবে। এই আবেগ কিন্তু দেয়াল দিয়ে ঠেকাতে পারবে না।

এরপর কথা আছে তোমাদের দেয়াল তত্ত্ব নিয়ে। তুমি বলছো গত কয়েক দশকে তোমাদের লাখ লাখ তরুণ ডাক্তার ও প্রকৌশলী নাকি দেয়াল টপকে পালিয়ে গেছে। তোমরা বলছ এটা নাকি সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র। তোমাদের কথা সত্য হলে এর একটি উল্টো দিকও আছে। উল্টো দিক থেকে বলা যায় যে তোমরা দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও এই তরুণদের অনুপ্রাণিত করতে পারনি। সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রই সফল হচ্ছে। এছাড়া তুমি বলছো বারবনিতাদের লোভে নাকি তোমাদের তরুণেরা ওপারে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এই যুক্তি খুব ধোপে টেকেনি। এক রাত ঘুমাবার জন্যে তোমাদের দেশে মেয়ে পাওয়া কি খুবই দুর্লভ? আমার পাশের দোভাষীকেই জিজ্ঞেস করো না কেন। সে-ই প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে। এবার মনে হলো ক্যাপ্টেন সাহেব রেগে গেলেন। তিনি বললেন, তুমি আমাদের নেতাদের সাথে কথা বলতে পার। আমার কাছে এর বেশি জবাব নেই। এবার আমার আলোচনায় ক্ষুব্ধ হলো বারবারা। তার অভিযোগ হচ্ছে সে অনেক প্রতিনিধি দলের দোভাষী ছিল। কিন্তু আমার মতো; নাকি উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন করতে শোনেনি। এ পর্ব এখানেই শেষ হলো।

সন্ধ্যার দিকে পূর্ব জার্মানের সাংবাদিক ইউনিয়ন ও সরকারি নেতাদের। সাথে বৈঠক শুরু হলো। বুঝতে পারলাম আমার সকল মন্তব্যই তাদের কানে পৌঁছেছে। এক সময় কথায় কথায় আমি আমার কথা বলতে শুরু করলাম। আমি বললাম, আমার রাজনীতির সাথে তোমাদের রাজনীতির মৌলিক তফাৎ আছে। তবুও সমাজতান্ত্রিক দেশ সম্পর্কে আমাদের একটা স্বপ্ন আছে। দীর্ঘদিন সে স্বপ্ন আমরা লালন করেছি। সমাজতান্ত্রিক দেশ সম্পর্কে আমাদের অনেক প্রশ্ন আছে। কারণ এদেশগুলো সম্পর্কে পশ্চিমাদের প্রচার আমাদের কাছে অপপ্রচার বলে মনে হয়। তাই এদেশগুলো সফরে এলে আমরা তোমাদের নাজেহাল করার জন্যে এ ধরনের প্রশ্ন করি। আমরা ভাবি, তোমারা আমাদের প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করছ। তোমাদের পছন্দের জায়গাগুলো আমাদের দেখিয়ে এবং ভালো ভালো কথা বলে আমাদের বিদায় দিতে চাও। এ ব্যাপারে আমি একটি সুস্পষ্ট ঘটনার উল্লেখ করতে চাই।

এর আগে আমি কোনোদিন কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশে যাইনি। প্রথমে এলাম তোমাদের বার্লিন শহরে। বড্ড ভালো লাগল। বড় ছিমছাম, পরিষ্কার। কোথাও বিশৃঙ্খলার চিহ্ন মাত্র নেই। এক রাত থেকে পরের দিন গেলাম লাইপজিগ শহরে। পড়ন্ত রোদের বিকেলে লাইপজিগের রাজপথে অসংখ্য তরুণ-তরুণী দেখলাম। তারা নাচছে-গাইছে। জড়াজড়ি করে হাঁটছে। হিপ্লিদের মতো তালি দেয়া জামা-কাপড় তাদের অঙ্গে। তারা দেদার চুমু খাচ্ছে। আমি খানিকটা বিপর্যস্ত হলাম। দোভাষী লিন্ডেকে বললাম এটা কি তোমাদের সমাজতন্ত্র? এটা তোমাদের সংস্কৃতি? তাহলে পশ্চিম জার্মানির সাথে তোমাদের তফাটা কী? তোমাদের এ সমাজতন্ত্র থাকবে না। বিকল্প সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে না পারলে দেয়াল দিয়ে সমাজতন্ত্র বাঁচাতে পারবে না। লিন্ডে বিষণ্ণ হলো। বৃদ্ধ লিন্ডের মুখে তখন মলিন হাসি। সে বলল, আমি তোমার সাথে একমত। কিন্তু করার কিছু নেই। নেতাদের আমি আরো বললাম, আমি ক’দিন ধরে তোমাদের সাথে আলোচনা করে এ কথাগুলো বলেছি। তোমরা তেমন পাত্তা দাওনি।

এবারও তেমনই ঘটল। সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং পূর্ব জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা তেমন কথা বললেন না। প্রকৃতপক্ষে আমার সাথে কথা আর তেমন জমল না। অন্যান্য কথা বলেই আলোচনা শেষ হলো।

তবে ভিন্ন চিত্র দেখেছিলাম ১৯৭৪ সালে। ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে ওই লাইপজিগ মেলায় গিয়েছিলাম। তখন আমি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। আমার সাথে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কামাল লোহানী।

একদিন হঠাৎ করে আমন্ত্রণ এল সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতাদের পক্ষ থেকে। আমাদের সাথে আলোচনা করতে চায়। সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নিজেই প্রশ্ন তুললেন। তিনি বললেন, তুমি গতবার বিকল্প সংস্কৃতির কথা বলেছিলে। প্রকৃতপক্ষে আমরা বিপদে আছি তরুণদের নিয়ে। এখন সুইচ টিপলেই পশ্চিম জার্মানির টেলিভিশন দেখা যায়। এদের প্রভাব পড়ছে ব্যাপকভাবে আমাদের তরুণদের ওপর। সমস্যাটি ভাবিয়ে তুলেছে সকলকে।

এ নিয়ে আমার নতুন কিছু বলার অবকাশ ছিল না। এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল এবং প্রথমবারের জন্যে ভালো লেগেছিল। পূর্ব জার্মানিতে যে কোনো আলোচনা প্রথমবারের জন্যেই একটি প্রশ্নে তাদের সাথে একমত হতে পেরেছিলাম।

তবে অন্যান্য কোনো ব্যাপারেই তাদের বক্তব্যের মিল হচ্ছিল না। তাই আমার সফর সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল। হঠাৎ একদিন জানানো হলো আমার হাঙ্গেরি যাবার টিকেট হয়ে গেছে। আমাকে দু’দিন পরেই বার্লিন ছেড়ে বুদাপেস্ট যেতে হবে। তবে এর একটি পটভূমি আছে।

আমি আগেই বলেছি পূর্ব জার্মানি তখনও জাতিসংঘের সদস্য হতে পারেনি। তাই তাদের একটি ইচ্ছে হচ্ছে জাতিসংঘের সদস্য একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য এবং সে সাথে নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাই পূর্ব জার্মানির সাংবাদিক ইউনিয়নের একটি সিদ্ধান্ত এবং ইচ্ছা ছিল আমাদের সাংবাদিক ইউনিয়নের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা এবং সে জন্য লিন্ডের পরিবর্তে বারবারা পাফকে আমাদের দোভাষী নিযুক্ত করা হয়েছিল। পূর্ব জার্মানির সাংবাদিক ইউনিয়নের এ প্রস্তাব প্রথমেই আমাকে দিয়েছিল। বারবারাও বলেছিল, তোমরা এ চুক্তি স্বাক্ষর করলে আমার সুনাম হবে। আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশে তখন জাতীয় সাংবাদিক ইউনিয়ন গঠিত হয়নি। আমি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। আমার পক্ষে কোনো ভিন্ন দেশের ইউনিয়নের সাথে চুক্তি করা সম্ভব নয়। এ ধরনের চুক্তি করতে হলে আমাকে বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে। ঢাকার সাংবাদিক ইউনিয়নের সাথে কথা বলতে হবে। সরকারের সাথেও কথা বলতে হবে। মনে হলো আমার এ কথায় জার্মানের বন্ধুরা খুশি হয়নি। জার্মান প্রবাসী বাঙালিরাও আমার যুক্তি ভালোভাবে গ্রহণ করল না। আমার সফরসঙ্গী দুই বন্ধুও আমার বক্তব্য সহজভাবে নিলেন না। তবু আজও আমি মনে করি, সেদিন আমার বক্তব্য সঠিক ছিল। আমার ধারণা আমি চুক্তি স্বাক্ষর করতে রাজি না হওয়ায় আমার সফরসূচি সংক্ষিপ্ত করা হয়। আমাকে হাঙ্গেরি পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং হাঙ্গেরিতে এই নাটকের শেষ দৃশ্যের অবতারণা করা হয়। তবে এর পরেও আর একটি ব্যাপারে নিয়ে দুঃখজনক বিতর্ক হয়েছে বার্লিনে। অর্থাৎ সেবারের সফরে আমি কাউকে খুশি করতে পারিনি।

বার্লিনে আমার সর্বশেষ বিতর্ক হলো নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুকে নিয়ে। আমি জার্মান সাংবাদিক বন্ধুদের জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমরা কি নেতাজী সুভাষ বসুকে চেন? প্রথমে কেউ তাকে চিনতেই পারলো না। আমি বললাম, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যে ভারতীয় নেতা এখানে এসেছিলেন। তাকে কি কেউই তোমরা চেন না। তিনি জার্মান থেকে জাপান গিয়েছিলেন এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্যে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেছিলেন। এবার তাদের মধ্যে একজন চিৎকার করে উঠল। বলল সেই ফ্যাসিস্ট, যে যুদ্ধের সময় ভারত থেকে জার্মানিতে এসেছিল?

তার কথায় আমি খানিকটা উষ্ণ হলাম। বললাম, তোমরা শেখ মুজিবুর রহমানকে চেন। এবার তারা সবাই মিলে চিৎকার করে উঠল। বলল, শেখ মুজিবুর রহমান তোমাদের মহান নেতা। তাকে চিনব না এটা কি হতে পারে। আমি বললাম, তোমরা কি জান যে শেখ মুজিবুর রহমান নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুকে নেতা বলে মানতেন। আমার কথা শুনে তারা অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকাল। এক সময় মলিন হয়ে চুপ হয়ে গেল। আমি বললাম কিছু মনে করবেন না। ভিন দেশের কোনো নেতা সম্পর্কে কিছু বলতে হলে ভেবেচিন্তে বলা উচিত। তোমরাই একমাত্র সঠিক, এ ধরনের চিন্তাধারা ইতিহাস সম্মত নয়। তোমরা বুঝতে চাও না যে তোমাদের এ ধরনের মন্তব্য অন্যকে আঘাত করতে পারে।

এই ঘটনার পরের দিন আমাকে পূর্ব জার্মান ছাড়তে হয়। তবে তাদের আত্মীয়তা বন্ধুত্ব আদৌ ভুলবার নয়। আমরা বাংলাদেশের প্রথম সাংবাদিক প্রতিনিধি দল। আমাদের আগে অনেকে পূর্ব জার্মানিতে গিয়েছে। কেউ সফরে গিয়েছে, কেউ চিকিৎসার জন্যে গিয়েছে, কেউ পড়াশুনো করতে গিয়েছে। আমাদের মতো খুঁটে খুঁটে জিজ্ঞেস করতে কেউ হয়তো যায়নি। আমরা এমন দেশে গেলাম, অদ্ভুত আথিথেয়তা পেলাম, মর্যাদা পেলাম। কিন্তু তাদের প্রস্তাবিত চুক্তি স্বাক্ষর না করে চলে এলাম। আমরা চুক্তি স্বাক্ষর না করায় বিপর্যস্ত হলো বারবারা পাফ। সে বলল, তোমার জন্য এ চুক্তি সম্ভব হলো না।

তাই বিমানবন্দরে তোমাদের বিদায় দিতে আমাকে যেতে দেয়া হলো না। তবে। এত বিতর্ক সত্ত্বেও দুটি সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। সে আলোচনা ছিল অর্থবহ ১, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার এবং ২. পূর্ব জার্মানসহ অন্যান্য পূর্ব ইউরোপের কথিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে।

আমি পূর্বেই বলেছি সেকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের রাজনীতির সাথে আমার মৌলিক তফাৎ ছিল। পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোতে তারা নয়া গণতান্ত্রিক বা জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে অভিহিত করতো। আমার বক্তব্য ছিল মার্কস ও লেনিনের পরিভাষায় দু’টি গণতন্ত্রের কথাই আমরা জানি। তা হচ্ছে–বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র। এর মাঝখানে কোনো গণতন্ত্র আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। সেকালে পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোতে বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে গঠিত সরকার ক্ষমতায় ছিল। আমরা বক্তব্য ছিল ওই সমন্বয়ের সরকার টিকবে না। এ নিয়ে বারবার আমার বিতর্ক হয়েছে জার্মান সফরকালে।

তখন পূর্ব জার্মানিতে ক্ষমতায় ছিল পাঁচটি দল। এ পাঁচটি দল হচ্ছে পূর্ব জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি ও এককালের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি মিলে সোস্যালিস্ট ইউনিটি পার্টি। এই সোস্যালিস্ট ইউনিটি পার্টি মুখ্যত কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচিত। এছাড়া ছিল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, ডেমোক্র্যাটিক ফার্মার পার্টি এবং ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। এই পাঁচটি দলের সমন্বয়ে পূর্ব জার্মান সরকার গঠিত। প্রতিটি দলেই নাকি ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের আদর্শে অনুপ্রাণিত। এ দলগুলোর নিজস্ব মুখপাত্র এবং দৈনিক পত্রিকা আছে। পত্রিকার মূল আদর্শ শান্তি, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র।

লাইপজিগে সোশ্যালিস্ট ইউনিটি পার্টির দৈনিক মুখপাত্রের নাম পিপলস ডেইলি। এই পত্রিকার অফিসেই একদিন সম্পাদকের সাথে আমার বিতর্ক শুরু হলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম–আপনাদের পাঁচটি পার্টির সরকার এবং পাঁচটি পত্রিকা আছে। এই পাঁচটি পত্রিকাই কি সমাজবাদে বিশ্বাসী? তাদের সবাই কি দেশপ্রেমিক। এদের মধ্যে কেউ কি জনতার শত্রু নয়।

সম্পাদক আমার প্রতিটি প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর দিলেন। আমার শেষ প্রশ্ন ছিল আপনাদের পত্রিকাগুলো কি অন্যদলের খবর ছাপিয়ে থাকে।

তিনি বললেন, না। আমি বললাম, কেন এমন হবে? সব দলই যদি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হয় এবং দেশপ্রেমিক হয় তাহলে তাদের খবর ছাপাতে বাধা কোথায়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই ঐকফ্রন্টের আদর্শগত বিশ্বাস এক হলে আর এক দল অন্যদলের খবর না ছাপালে সংশয় সৃষ্টি হবে না কি। পিপলস ডেইলির সম্পাদক আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না।

তিনি বললেন, আমরা অন্যদলের খবর ছাপাই না সেটাই হচ্ছে আমাদের শেষ কথা।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। বার্লিনে ফিরলাম। আবার দেখা হলো সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতাদের সাথে। আমি বললাম, তোমাদের দেশে তো পাঁচ পার্টির সরকার। মার্কসবাদ লেনিনবাদ আমরা যতদূর পড়েছি তাতে তো আমাদের ধারণা যে শ্রেণি ভিন্ন দল হয় না। প্রতিটি দলই এক একটি শ্রেণির প্রতিনিধি। সে অর্থে কি তোমাদের দেশের পাঁচটি দল বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধি না! এবং তাহলে কি তোমাদের সরকার বিভিন্ন শ্রেণির সরকার নয়? তোমাদের সরকার কি বহুদলীয় সরকার নয়? সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ আমার কথার জবাব দিলেন না। শুধু বললেন, এ প্রশ্ন আমাদের দেশে উঠেছে এবং আলোচনা হচ্ছে। একই আলোচনা আবার উঠেছিল। হাঙ্গেরির অর্থনীতিতে তখন নতুন হাওয়া লেগেছে। হাঙ্গেরিতে তখন ম্যানেজারিয়াল অর্থনীতি চালু হচ্ছে। কথা উঠেছে প্রোটি মোটিভের। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমাদের এই অর্থনীতি কি একটি নতুন শ্রেণির জন্ম দিচ্ছে না। তোমাদের একটি ম্যানেজারিয়াল শ্রেণির জন্ম দিচ্ছে। ফলে একটি আমলাতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে উঠবে নাকি? আমার কথায় তারা একমত হলেন না। তাঁরা বললেন, লাল ফিতার দৌরাত্ম থাকবে।

এ মুহূর্তে এ দৌরাত্ম আমরা এড়াতে পারব না। তবে একথা ঠিক যে ভুল আমরা প্রথমে করেছিলাম। ১৯৪৫ সালে ফ্যাসিস্টদের পরাজয়ের পর আমরা ক্ষমতায় আসি। আমরা চেষ্টা করেছিলাম সোভিয়েত ইউনিয়নকে হুবহু নকল করতে। তার প্রতিক্রিয়া হয়েছে ১৯৫৬ সালের প্রতিবিপ্লবে। আমি বললাম–ব্যাপারটা অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। আমি যতটুকু লেনিন পড়েছি তাতে আমার মনে হয় তোমরা আরেক ভুলের দিকে এগোচ্ছ। তোমরা এবার শ্রেণি সমন্বয়ের পথ বেছে নিয়েছ। তোমাদের ম্যানেজারিয়াল অর্থনীতি কেন্দ্র করে নতুন শ্রেণি বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে প্রশাসনে। তাতে শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের পথে বাধা আসবে নাকি। হাঙ্গেরির বন্ধু হাসলেন। বললেন, তোমাদের ভুলটা কি জান, তোমরা পূর্বাপর সম্পর্ক না রেখে লেনিনের উদ্ধৃতি দাও। আমি বললাম–এ অভিযোগ তোমাদের বিরুদ্ধেও আছে। তোমরা সত্যিকার প্রেক্ষিতে লেনিনের উদ্ধৃতি দাও আর আমরা দিই না, এ বিচার করল কে? এবার তিনি আরো স্পষ্ট হলেন। বললেন–লেনিন জীবিত থাকলে তোমার কথাই মানতেন তার নিশ্চয়তা কোথায়? আমি বললাম-ভোমার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

সেদিন কথা তেমন জমেনি। লেনিন নিয়ে এ ধরনের কথা পরবর্তীকালেও হয়েছে। বিতর্ক হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোতে। সে বিতর্কের পর আমার দোভাষী বলেছিলেন–তোমার জন্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। সে অনেক পরের কথা।

পূর্ব জার্মানিতে আমার সর্বশেষ আলোচনা হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে। আমি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি। আমাদের দেশে তখন হাজার হাজার রাজাকার ও আলবদর কারাগারে। তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি ভারতে অবস্থান করছে। এদের ভবিষ্যৎ নিয়ে লেখালেখি এবং জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। তাই আমার কৌতূহল হয়েছিল জার্মানের বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু জানবার। ১৯৪৫ সালে ফ্যাসিবাদী জার্মানি পরাজিত হয়। পূর্ব জার্মানিতে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসে। তাদের সামনে সমস্যা ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের। তাই আমার ইচ্ছা ছিল কীভাবে যুদ্ধাপরাধীদের সমস্যা মোকাবেলা করেছে তা জানবার।

যুদ্ধ বন্দিদের সম্পর্কে একটি পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরেছিল জার্মানের বন্ধুরা। তাদের মুখ্য বক্তব্য হচ্ছে–যুদ্ধবন্দি হিসেবে সকলকে এক কাতারে ফেলা যাবে না। সকলে এক প্রকার অপরাধ করেনি। তাই সকলের শাস্তিও একরকম হবে না। মনে রাখতে হবে কোনো দেশের হাজার হাজার সাধারণ মানুষ অপরাধী হতে পারে না। তারা পরিবেশের শিকার। প্রথমে হয়তো তারা তোমাদের পক্ষেই ছিল। পরবর্তীকালে নানা কারণে হয়তো তারা বিপক্ষে যোগ দিয়েছিল। এই আম-জনতাকে রেহাই দেয়াই বাঞ্ছনীয়। ধরতে হবে পালের গোদাকে। যারা এই অপরাধী দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের আদৌ ক্ষমা নেই। তাদের চরম শাস্তি দিতে হবে। জার্মান বন্ধুদের পরামর্শ ছিল–যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে তড়িঘড়ি করে নয়, ধীরে-সুস্থে ব্যবস্থা নিতে হবে। সবাইকে একই দণ্ড দেয়া যাবে না। তাদের কথায় আমি যুক্তি খুঁজে পেয়েছিলাম। ঢাকায় ফিরে পূর্ব জার্মানের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে আমি দৈনিক বাংলায় উপসম্পাদকীয় লিখলাম। হয়তো আমিই প্রথম স্বাধীন বাংলায় যুদ্ধাপরাধীদের শ্রেণি বিভাগের কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম–আম-জনতাকে ক্ষমতা করে দেয়া হোক। বড় বড় নেতাদের ফায়ারিং স্কোয়াডে নেয়া হোক। কোনো বিচার না করে বছরের পর বছর কাউকে জেলে ফেলে রাখা ঠিক হবে না। ৭১ সালে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিঘরেই যুদ্ধ নিয়ে মতানৈক্য ছিল। সে মতানৈক্যের পটভূমি বুঝতে হবে। লঘু অপরাধে গুরু দণ্ড দিয়ে একটি বিরাট জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতা বিরোধীদের শিবিরে ঠেলে দেয়া যাবে না। সুতরাং সবাইকে শাস্তি দেয়া নয়। নেতাদের পৃথক করে শাস্তি দেয়া হোক। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হোক। আমার এ লেখা কোনো মহলকেই খুশি করতে পারল না। একটি মহল ক্ষুব্ধ হলো। কেউ বিস্মিত হলো। কেউ তীব্র প্রতিবাদ জানাল। তাদের বক্তব্য হচ্ছে–আমি রাজাকারদের ক্ষমা করার কথা বলে অন্যায় করেছি। দৈনিক বাংলার বাণীতে আমার বিরুদ্ধে উপসম্পাদকীয় লেখা হলো। লেখা হলো–সরকারি পত্রিকায় চাকরি করে এই ঔদ্ধত্য দেখাবার সাহস কোথা থেকে আসে? আজও আমার সেই লেখা উল্লেখ করে একটি মহল থেকে বলা হয়–আমি নাকি রাজাকারদের ক্ষমা করার কথা বলেছিলাম। আমার ধারণা, আমার এ সমালোচক বন্ধুরা কখনো পুরোপুরি আমার লেখাটি পড়ে দেখেনি। বুঝতে চেষ্টা করেনি–আমার লেখার তাৎপর্য ও পটভূমি। আমি আজো মনে করি–আমি সেদিন সাহস সরে সঠিক কথা লিখেছিলাম। সেদিন আমার কথা মেনে নিয়ে ক্ষমা করা হলে তাদের অনুশোচনা থাকত। কিন্তু ১৯৭৪ সালে ক্ষমা পেয়ে তারা ভাবল, স্বাভাবিক নিয়মেই তারা ক্ষমা পেয়েছে। তারা ক্ষমা পেয়েছে–সিমলা স্বাক্ষরিত ভারত-পাকিস্তান চুক্তির শর্তানুসারে। এতে বাংলাদেশ সরকারের কোনো কৃতিত্ব নেই। সেকালের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমা ঘোষণা করলেও সকলেই জানত যে এই ক্ষমা ঘোষণার পেছনের দু’জন ব্যক্তি হচ্ছেন–ভারতের শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো। অর্থাৎ আমাদের নামেই ক্ষমা ঘোষণা করা হলো, কিন্তু সেই ক্ষমা ঘোষণা আমাদের জাতীয় জীবনে কোনো সুফল বয়ে আনল না। আমার আজকের সমালোচক বন্ধুরা একটু সমস্যার গভীরে গেলে আমার সমালোচনায় নামতেন না।

বার্লিন থেকে বুদাপেস্ট এলাম। পূর্ব জার্মানি থেকে হাঙ্গেরি। বুদাপেস্ট ফিটফাট ছিমছাপ সুন্দর শহর। রাতের বুদাপেস্ট লোভনীয়। বলা হয়, সৌন্দর্যের দিক থেকে প্যারিসের পরেই বুদাপেস্ট। বুদাপেস্ট-এ একটি সাংবাদিক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট আছে। এই ইন্সটিটিউটি চালায় আন্তর্জাতিক Seating 31 (International Organization of Journalists) i face তখন মুখ্যত দুটি প্রধান সাংবাদিকদের সংগঠন। একটি আইওজে, অপরটি আন্তর্জাতিক জার্নালিস্ট ফেডারেশন। প্রথমটি কমিউনিস্ট প্রভাবিত। দ্বিতীয়টি তথাকথিত স্বাধীন বিশ্বের। প্রথমটির প্রধান দফতর প্রাগে। দ্বিতীয়টির প্রধান দফতর বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস শহরে।

বুদাপেস্টে বাংলাদেশের সতের জন সাংবাদিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। আমার বুদাপেস্ট যাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাদের সঙ্গে দেখা করা। বুদাপেস্টে পা দিয়েই মনে হয় এক সর্বনাশা দেশে এসেছি। এটা পূর্ব জার্মান বা বার্লিন নয়। পূর্ব জার্মানের সমাজে নিয়মানুবর্তিতা দেখার মতো, অনুকরণ করার মতো। কিন্তু বুদাপেস্টের পরিবেশ একেবারেই উল্টো। এখানে ছেলে মেয়েদের সম্পর্ক অনেক খোলামেলা, অনেক উদার। তাই আমি অনেকটা শঙ্কিত হলাম। তাই মনে হলো কী করে আমাদের সাংবাদিকরা এই পরিবেশের মোকাবেলা করবে।

সাংবাদিক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের প্রধান হচ্ছেন মিস মাৰ্ধা। আমি তাকে প্রথমে প্রশ্ন করেছিলাম তোমাদের দেশে এসে ভয় হচ্ছে। তোমাদের দেশ থেকে বিদায় নেবার সময় আমাদের ছেলেরা কোনো আবেগের টান রেখে যাবে না তো। মার্থা হেসে ফেলল। ইংরেজিতে বলল, Mr. President, you are too much intelligent for this country. Nothing will happen to your boys.

এভাবেই আমার হাঙ্গেরি সফর শুরু হয়েছিল। কিন্তু এ সফরও আমার খুব সুখকর ছিল না। বার্লিনে আমি পূর্ব জার্মান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করতে রাজি হইনি। দেখলাম এ কথা সবাই জানে। লক্ষ্য করলাম ম্নি কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে আমাকে দলে টানবার জন্যে। অর্থাৎ তারা সবাই চাইছিল, বাংলাদেশ তাদের সংগঠন আইওজের অন্তর্ভুক্ত থোক।

কিন্তু এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এছাড়া বাংলাদেশ নীতিগতভাবে নির্জোট আন্দোলনের সদস্য।

বাংলাদেশের জন্মলগ্নে সেকালের সরকারের সাথে আলোচনা না করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ আমি আদৌ সমীচীন মনে করিনি। আমার এ সিদ্ধান্ত ছিল একক এবং এই একক সিদ্ধান্তের কারণেই প্রতি পদে পদে আমাকে

হোঁচট খেতে হয়েছে। হাঙ্গেরিতেও তার ব্যতিক্রম হলো না। হাঙ্গেরিতে তখন। আইওজে নির্বাহী কমিটির বৈঠক চলছিল। ওই বৈঠকে আমাকে ডাকা হলো আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে। বৈঠকে ঢুকে প্রথমে এক দফা বিতর্ক হয়ে গেল মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিনিধিদের সাথে। আমি বললাম, কোন যুক্তিতে তোমরা বাংলাদেশের সংগ্রামের বিরুদ্ধে গেলে? কেন পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলে ১৯৭১ সালে। তাদের বক্তব্য আমাকে চমকে দিল। তাদের জানা মতে, বাংলাদেশের শতকরা ৮০ জন অধিবাসী মুসলমান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল ভারতের চক্রান্ত। অনেক কষ্টে তাদের বোঝাতে সক্ষম হলাম, তাদের তথ্য ঠিক নয়। এ প্রশ্নে আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন সুদান সাংবাদিক ইউনিয়নের একজন মহিলা। তিনি দক্ষিণ সুদানের অধিবাসী। দক্ষিণ সুদান স্বাধীনতা চাচ্ছে। সুতরাং তার পক্ষে আমাদের সমস্যাটি অনুধাবন করা সহজ ছিল। তবে এরপরও একটি মোক্ষম সমস্যা আমাদের মোকাবেলা করতে হয়েছিল। তাদের প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের শতকরা ৮০ জন অধিবাসী মুসলিম হলে নির্মল সেন তোমাদের প্রেসিডেন্ট কেন? তিনি তো মুসলমান নন। আমার বন্ধুরা হেসে এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছিল।

তবে আমার বিপদ হয়েছিল অন্যত্র। আইওজের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হলো একটি যুক্ত বিবৃতি দেবার। আমি বললাম, আইওজের সঙ্গে যুক্ত বিবৃতি দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার দেশে ফিরে বন্ধুদের সাথে আলাপ করে বিবৃতি দেয়া সম্ভব। আমি একক দায়িত্বে কোনো বিবৃতি দেব না। আমি প্রস্তাব করলাম একটি বিবৃতির খসড়া করা হোক। এই খসড়া বিবৃতি নিয়ে আমি ঢাকায় ফিরে যাব। ঢাকায় বন্ধুরা একমত হলে একই দিনে ঢাকা ও বুদাপেস্ট থেকে একটি যুক্ত ইশতেহারে প্রকাশিত হবে। আইওজের বন্ধুরা একমত হলেন। কিন্তু ঘটনা ঘটল ভিন্ন। ইতিমধ্যে হাঙ্গেরির বিভিন্ন এলাকায় সফর করেছি। আলাপ হয়েছে কমিউনিস্ট নেতাদের। হাঙ্গেরিতে দেখলাম নতুন হাওয়া। কমিউনিস্ট মহলে ভিন্ন চিন্তা শুরু হয়েছে। ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে যুদ্ধের স্মৃতিফলক হিসেবে নির্মিত সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়ী সেনা এক মর্মর মূর্তি ভেঙে ফেলেছিল। লক্ষ্য করলাম তরুণরা নিদারুণভাবে সোভিয়েত বিরোধী। অর্থনীতিবিদদের সাথে কথা হলে তারা কিছু নতুন বই দিল। তাদের বইয়ের এক নতুন অর্থনীতির সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে মুনাফার কথা। মোটামুটিভাবে ম্যানেজারিয়েল অর্থনীতির নামে একটি বাজার অর্থনীতি গড়ে উঠছে হাঙ্গরিতে। এই অর্থনীতির প্রবক্তা হচ্ছেন আন্দ্রেপভ। তিনি হাঙ্গেরিতে রাশিয়ান দূত। পরবর্তীকালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা হয়েছিলেন। আন্দ্রেপভের শিষ্য হিসেবে ক্ষমতায় এসেছিলেন গর্বাচেভ। সে অনেক পরের কথা। তখন আঁচ করতে পারিনি আদ্রেপভ ও গর্বাচেভ শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয় ডেকে আনবে। তবে হাঙ্গেরিতে গিয়ে মনে হয়েছিল কোথায় যেন বেসুরে বাজছে। সবাই এক সুরে কথা বলছেন। দ্বিতীয়বার হাঙ্গেরিতে গেলাম ১৯৭৪ সালে। এক সাংবাদিক বন্ধুর সাথে তার গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলাম। সড়কের পাশে এক রাশিয়ান ট্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে। এই সাংবাদিক চিৎকার করে উঠল। বলল, দেখেছ দূরে আমার পিতৃভূমির ট্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে আছে। ওরা আমাদের রক্ষা করতে এসেছে। আমি অবাক হয়ে তরুণ সাংবাদিকের দিকে তাকালাম। বললাম, এসব তুমি কী বলছ। কিন্তু আমার কথায় তার মুখে কোনো ভাবান্তর হলো না। আগেই বলেছি এ দৃশ্য ১৯৭৪ সালের। ১৯৭২ সালে এমন প্রকাশ্যে কাউকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বলতে শুনিনি। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে তখন একটি প্রবণতা ছিল বিদেশীদের বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদের দলভুক্ত করা।

এমন একটি পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলাম আমি ১৯৭২ সালে। হাঙ্গেরির সাংবাদিক জর্জ কলমার, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনি ঢাকায় ছিলেন। তখন খবর বিশ্বে আদৃত হয়েছিল। তিনি এক রাতে আমাকে এক হোটেলে নিমন্ত্রণ করলেন। ঘণ্টা দুই তার সঙ্গে আলাপ হলো। আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান। সিরাজ থেকে শুরু করে মওলানা ভাসানী পর্যন্ত সকলের কথা শুনতে চাইলেন। তিনি মওলানা সাহেবের কিছু কথায় ক্ষুব্ধ। তিনি বললেন, মওলানা সাহেবের কথা নাকি চীন ও পাকিস্তানের পক্ষে যাচ্ছে। এক সময় বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে। আমি বললাম, তুমি যত কথাই বলো না কেন মওলানা ভাসানী একজন জাতীয় নেতা হিসেবে থাকবেন। অর্থাৎ মওলানা ভাসানী সম্পর্কে তোমার সাথে একমত হতে পারলাম না।

এবার তিনি একটি ভিন্ন প্রস্তাব করলেন। বললেন আইওজে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সম্মেলন করতে চায়। সব খরচ তাদের। ঢাকার সাংবাদিক ইউনিয়নের শুধুমাত্র আয়োজনের দায়িত্ব নিতে হবে। আমি একমত হলাম না। আমি বললাম, কোনো আন্তর্জাতিক সংগঠনেরই অনুমোদিত সংগঠন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন নয়। আমরা তোমাদের অঙ্গ সংগঠন হলে এ দায়িত্ব নিতে পারতাম। কিন্তু আজকের পরিস্থিতিতে আমাদের পক্ষে এ দায়িত্ব নেয়া সম্ভব নয়।

জর্জ কলমার ক্ষুব্ধ হলেন। আমিও দুঃখ পেলাম। আমার সমস্যা হচ্ছে কারো সঙ্গে একমত হতে পারছি না। এমনিতে কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থক বা সদস্য না হওয়ায় মার্কিন দালাল বলে পরিচিত। এরপর সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে গিয়ে বিতর্ক করছি এবং তাদের কোনো প্রস্তাবে সায় দিতে পারছি না। ফলে এক সময় নীরবে জর্জ কলমার সাথে আলোচনা শেষ হলো। পরিস্থিতি তুঙ্গে উঠল পরের দিন বিকেলে। বুদাপেস্ট থেকে এক ঘণ্টার পথ। ব্যালটন থেকে আইওজের তাবু। ৮০ কিমি দীর্ঘ এই লেক। এককালে রবীন্দ্রনাথ এখানে বেড়াতে এসেছিলেন। তাঁর নামে একটি সড়কও আছে। আমার দোভাষী অ্যাগনিস একসময় একজন ড্রাইভারকে আমার কাছে হাজির করলেন। সে নাকি বিশ্বকবির গাড়ির ড্রাইভার ছিল। অথচ সে তখন বুঝতে পারেনি যে রবীন্দ্রনাথ একজন বিশ্ববিখ্যাত কবি।

এই ব্যালটন থেকেই শুরু হলো আইওজের অধিবেশন। বিকেলের দিকে আমার সামনে একটি যুক্ত ইশতেহার হাজির করা হয়। বলা হলো এ ইশতেহার স্বাক্ষর করো। আমি খানিকটা হতচকিয়ে গেলাম। আমি বললাম, আমার সাথে কথা ছিল যুক্ত ইশতেহারের একটি খসড়া হবে। সেই খসড়া নিয়ে আমি ঢাকায় যাব। ঢাকার বন্ধুরা সম্মত হলে যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হবে-নইলে নয়। আমি দেখলাম আমার প্রস্তাব উল্টে দিয়ে তারা চূড়ান্ত ইশতেহারটি হাজির করেছে স্বাক্ষরের জন্যে। আমি স্বাক্ষর দিতে রাজি হলাম না। বললাম, তোমরা ভুল করেছ। আমি কিনবার মতো পণ্য নই। আমার প্রস্তাব রাখা না হলে আমি স্বাক্ষর করব না। খসড়া ইশতেহার হিসেবে তোমরা এ ইশতেহার আমাকে দিতে পার। আমি ঢাকায় গিয়ে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব।

তারা রাজি হলেন না। দেখলাম তারাও অনড়। পরে জানতে পেরেছি। তারা আমার জন্যে বন্ধুদের সাথে আলোচনা করে তাদের রাজি করিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন আমি তাদের কথা শুনব। কিন্তু তেমনটি ঘটল না। আমি স্বাক্ষর করলাম না। তার প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল রাতে। রাতে আমাকে জানানো হলো, পরদিন ভোরে আমাকে মস্কো যেতে হবে। আমার মস্কো যাবার টিকেট কনফার্ম হয়েছে। অর্থাৎ পূর্ব জার্মানির মতোই আমাকে হাঙ্গেরি থেকে বিদায় নিতে হলো। তারা আমাকে মস্কো পাঠালেন ভিসা না করেই।

হাঙ্গেরি থেকে দুঃখজনকভাবে বিদায় নিলাম। মস্কো বিমানবন্দরে পৌঁছে বুঝলাম–সত্যি সত্যি হাঙ্গেরির বন্ধুরা আমার আচরণে সন্তুষ্ট হননি। তাই ভিসা ছাড়াই আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন মস্কোতে। মস্কো বিমানবন্দরে এসে বুঝলাম ভিসা না থাকায় কী বিপদ!

বিমানবন্দরে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান সাংবাদিকরা এসেছিলেন। আমাদের তিনজনের ভিসা না থাকায় তাঁরা বিচলিত হলেন। বললেন, ব্যাপারটা ঠিক হয়নি। তারপরও ভালো আচরণ করলেন তাঁরা। একটি ভিভিআইপি কক্ষে আমাদের নিয়ে গেলেন। বললেন, এ কক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু এবং রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান বসেছেন। তোমরা এখানে অপেক্ষা করো। পাঁচ ঘণ্টা কেটে গেল। ভিসার কোনো পাত্তা নেই। এক সময় এক সাংবাদিক বন্ধু উষ্ণ কণ্ঠে বললেন, আমলাদের জন্যে কোনো কিছুই করা যাবে না। আমরা তোমাদের শহরে নিয়ে যাচ্ছি। মস্কো শহরে পিকিং হোটেলে তোমরা থাকবে। তবে কোথাও বের হবে না। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা তোমাদের ভিসা নিয়ে আসব। ভিসা পাবার পরেই তোমরা বের হতে পারবে। নইলে নয়। এ আলোচনার পরেই আমরা মস্কো বিমানবন্দর ত্যাগ করলাম। গেলাম হোটেলে। সেদিন রাতে তেমন আলাপ হলো না। আমাদের সফর শুরু পরের দিন ভোরবেলা। তবে সে সফরসূচিতে নতুনত্ব কিছুই ছিল না। পূর্ব জার্মান বা হাঙ্গেরির মতোই বিভিন্ন অফিসে যাওয়া, চা খাওয়া এবং আলোচনা করা। সে আলোচনা কখনো বিতর্কে পৌঁছত না। আমি একবার প্রস্তাব করলাম লেনিনগ্রাদ সফরের। আমার বড় ইচ্ছে ছিল–লেনিনের নামের সাথে জড়িত এই শহরটি দেখার। আমাকে জানানো হলো–তোমাদের সফরসূচিতে লেনিনগ্রাদ নেই। তোমরা শুধু মস্কো শহরই দেখতে পারবে। কথাগুলো আমার ভালো লাগল না। তবে বুঝলাম যে আমাদের সম্পর্কে সব কথাই ওদের জানা। আমাদের সব খবর ওরা রাখে। হাঙ্গেরি এবং পূর্ব জার্মানিতে আমাদের আলোচনার খবর ওদের কাছে পৌঁছেছে। ওরা জানতে পেরেছে যে তাদের অনেক প্রস্তাবেই আমরা রাজি হইনি।

আমাদের সম্পর্কে তারা যে কত জানে তার প্রমাণ পেয়েছিলাম পরবর্তী সফরে ১৯৭৪ সালে। ১৯৭৪ সালে আমি ও কামাল লোহানী পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরি ও চেকোস্লোভাকিয়ায় গিয়েছিলাম। আমাদের সম্পর্কে বিস্তারিত খবর পেলাম রাজধানী প্ৰাগে। সেকালের সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে চেকোশ্লোভাকিয়ার রাজধানী প্ৰাগ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। প্রাগে যেমন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সাংবাদিক ইউনিয়ন আইওজের সদর দফতর ছিল তেমনিভাবে অসংখ্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সদর দফতর ছিল প্রাগে। আন্তর্জাতিক পরিবহন শ্রমিকদের ইউনিয়নের প্রধান দফতর ছিল প্রাগে। এই ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ভারতের দেবু গাঙ্গুলী। এককালে দেবু গাঙ্গুলীর বাড়ি ছিল বাংলাদেশের বরিশালে। তিনি ভারতের সিপিআই-এর সদস্য। দীর্ঘদিন প্রাগে আছেন। ১৯৭৪ সালে প্রাগে গিয়ে প্রথমে তার বাসায় উঠেছিলাম। কথায় কথায় তিনি বললেন, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আমাকে নাকি চেনে। দেবু বাবু বললেন, আপনি নির্মল সেন বরিশাল বিএম কলেজে পড়তেন। আরএসপি করতেন। বিড়ি সিগারেট খান না। আপনার কোনো নেশা নেই। একথা আমরা সকলেই জানি। আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন সব দেশেই আপনাকে বিশেষ ধরনের দোভাষী দেয়া হয়েছে। এরা কখনোই আপনার সাথে খেতে বসে তেমন কোনো নেশা করেননি। সুতরাং আপনার ভয় পাবার কারণ নেই।

তবে এই চেকোশ্লোভাকিয়ায় সফরকালেই একটা ভিন্ন ঘটনা ঘটেছিল। চেকোশ্লোভাকিয়ায় গিয়ে আমার মনে হয়েছিল কোথায় যেন একটা ভয় ভয় আছে। মাত্র কয়েক বছর আগে চেকোস্লোভাকিয়ায় প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা হয়েছিল। সেই প্রতিবিপ্লব ঠেকাতে ট্যাঙ্ক এসেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। হয়তো একথা স্মরণ করেই চেকোস্লোভাকিয়াকে একটু বিশিষ্ট বলে আমার মনে হতো। আর এ জন্যে আমি প্রাগের বিমানবন্দরে নেমে বন্ধুদের বলেছিলাম, আমি ব্রাতিস্লাভা যাব। সকলেই হয়তো জানেন যে চেক ও ব্রাতিশ্লাভা এই দুই রাজ্য মিলেই চেকোশ্লোভাকিয়া। সমাজতান্ত্রিক

আমার জবানবন্দি-৩৩

চেকোস্লোভাকিয়ার পতনের পর চেকোশ্লোভাকিয়া চেক ও স্লোভাকিয়া নামে এখন দুটি রাষ্ট্র হয়ে গেছে। চেকোস্লোভাকিয়া সফরে যাবার আগেই আমি জানতাম যে সেখানে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে গোলমাল চলছে। এই গোলমালের কেন্দ্র ব্রাতিশ্লাভা। তাই আমার ব্রাতিস্লাভা যাবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বন্ধুরা রাজি হলো না। তারা জানাল–তোমার সফরসূচিতে ব্রাতিস্লাভা নেই। আমি দশদিন চেকোস্লোভাকিয়ায় ছিলাম কিন্তু ব্রাতিস্লাভায় যেতে পারিনি। তবুও আলোচনা বিতর্ক হয়েছে অনেক।

চেকোশ্লোভাকিয়ায় বন্ধুরা কথায় কথায় বলতেন তোমরা যে কোনো প্রশ্ন করো, আমরা জবাব দেব। আমরা বলতাম, সব প্রশ্নের জবাব তোমরা দিতে পারবে না। একদিন এক প্রশ্ন নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। আমি বললাম, এবার আমি তোমাদের একটি প্রশ্ন করব। চেসকালিপার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা বলল, সব প্রশ্নের জবাব তুমি পাবে। আমি বললাম, ঠিক আছে। আমাদের চেকোস্লোভাকিয়া সফরকালে ওয়ারশ প্যাকট ও ন্যাটোর সাথে কথা হচ্ছিল। পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের যৌথ সামরিক বাহিনীর সদর দফতর। উষ্ণ আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা অর্থাৎ ন্যাটোর সদর দফতর ব্রাসেলস। কিছুকাল ধরে এ দুই বাহিনীর মধ্যে আলোচনা হচ্ছিলো সৈন্য সংখ্যা কমাবার। এমনোও কথা হচ্ছিলো যে ন্যাটো বাহিনী ভেঙে দেয়া হলে ওয়ারশ বাহিনীও ভেঙে দেয়া হবে। উল্লেখ্য, ওয়ারশ চুক্তি অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক শিবিরের প্রতিটি দেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল ফৌজের সদস্যরা অবস্থান করছে।

এ পটভূমিতে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, কয়েক বছর আগে চেকোস্লোভাকিয়ায় প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা হয়েছিল। এই প্রতিবিপ্লব দমনের জন্যে এখনো ওয়ারশ বাহিনী চেকোশ্লোভাকিয়ায় অবস্থান করছে। ন্যাটোর সাথে চুক্তি করে ওয়ারশ বাহিনী ভেঙে দেয়া হলে বাইরের সৈন্য তো চেকোশ্লোভাকিয়ায় থাকবে না। এ পরিস্থিতিতে প্রতিবিপ্লব কি ঠেকানো যাবে?

আমার প্রশ্নে কমিউনিষ্ট বন্ধুরা চুপ করে গেলেন। বললেন, এ প্রশ্ন রাষ্ট্রীয় নীতির সাথে জড়িত। শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় নেতারাই এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন। তুমি আগে গিয়ে প্রশ্ন করে দেখতে পার। জবাব পাবে। যদিও তেমন ইচ্ছে আমার ছিল না। আমি জানতাম এ প্রশ্নের জবাব তাদের কাছে নেই। বারবার আমার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সফরকালে।

তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিল ভিন্ন রকম। দুটি দেশ সফর করে সোভিয়েত ইউনিয়নে এসেছি। দেশ দুটি হচ্ছে পূর্ব জার্মান ও হাঙ্গেরি। পূর্ব জার্মানের সর্বত্রই একটা কঠোর নিয়ন্ত্রণ। নিয়মের বাইরে কেউ যায় না। কেউ পছন্দ না করলেও এ চিত্রটি আমার ভালো লেগেছে। পূর্ব জার্মানিতে তেমন প্রাণ খোলা উচ্ছ্বাস কিংবা উল্লাস দেখিনি, আর হাঙ্গেরিতে কিছুটা বিপরীত। সেখানে সবকিছু খোলামেলা। পূর্ব জার্মান ও হাঙ্গেরির পার্থক্যটা বড় স্পষ্ট। হাঙ্গেরির সাংবাদিক জর্জ কমার একটি ঘটনা দিয়ে আমাকে তা বুঝিয়েছিলেন। ঘটনাটি হচ্ছে–সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভের পদত্যাগ নিয়ে। কুশ্চেভ পদত্যাগ করলে পরের দিন হাঙ্গেরির সকল কাগজে সে খবর ছাপা হলো। কিন্তু পূর্ব জার্মানির কাগজে ছাপা হলো না। জর্জ কলমার বলেছিলেন, মস্কো থেকে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশ না আসায় পূর্ব জার্মানির কাগজে এ খবর ছাপা হলো একদিন পর।

এ পটভূমিতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আমার মনে হয়েছিল অনেক ধীর এবং গম্ভীর। সকলে বড় চুপচাপ। যেন মেনে মেনে কথা বলে। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নে পৌঁছে প্রথমেই মনটা কেমন হয়ে গেল। এক দুঃখজনক বিতর্ক হয়ে গেলো দ্বিতীয় দিন সংবর্ধনা সভায়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংবাদিক ইউনিয়ন এক হোটেলে আমাদের সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। পরিবেশন করেছিল ভদকাসহ অন্যান্য পানীয়। আমি বললাম, আমি ভদকা খাব না। অন্য কোনো পানীয় দাও। মস্কোর বন্ধুরা যেন কিছুটা ক্ষুণ্ণ হলেন। বললেন, তুমি আমাদের অপমান করছ। ভদকা আমাদের জাতীয় পানীয়। সব অনুষ্ঠানে আমরা পরিবেশন করে থাকি। তোমার ভদকা না খাওয়াটা হবে আমাদের অপমানের সামিল। আমি বললাম, আমি কিন্তু একই অভিযোগ করতে পারি তোমাদের বিরুদ্ধে। তুমি নিশ্চয়ই জান আমাদের দেশে সরকারিভাবে কোনো অনুষ্ঠানে এ জাতীয় পানীয় পরিবেশন নিষিদ্ধ। আমার মতে, বিদেশে গিয়েও আমাদের পক্ষে এই নিষিদ্ধ পানীয় গ্রহণ করা সঠিক নয়। তুমি আমাকে কোমল পানীয় দাও। আমি আপত্তি করব না। কিন্তু ভদকা আমি খাব না। আমার কথায় যেন তারা একটু অপ্রস্তুত হলো। বলল, দুঃখিত মনে কিছু করো না। তোমাকে কোমল পানীয় দেয়া হচ্ছে। তবে এর আগে তোমাদের দেশের অনেক প্রতিনিধি দল এদেশে এসেছে। কিন্তু কেউই এ ধরনের কথা তোলেননি।

আমাদের আগে যারা এসেছে তাদের কথা উল্লেখ করেই একদিন চরম বিতর্ক হলো প্রাভদা অফিসে। প্রাভদা সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র। একদিন সন্ধ্যাবেলা আমাদের খবর দেয়া হলো আমাদের প্রাভদার সম্পাদক কমরেড জিমিনিনের সাথে আলাপ করতে হবে। আমাদের বলা হলো তোমরা খুবই ভাগ্যবান। তোমাদের সাথে কথা বলবেন সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য যিনি প্রাভদার সম্পাদক। সন্ধ্যার পর আমরা প্রাভদা অফিসে গেলাম। আলোচনা শুরু হলো সম্পাদকের কক্ষে। জানানো হলো আমাদের সাথে আলোচনাকালে উপস্থিত আছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্র দফতরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তবে আলোচনা শুরু হবার প্রাক্কালেই সব কিছু যেন গোলমেলে হয়ে গেল। আমার সফরসঙ্গী আলোকচিত্র শিল্পী মোজাম্মেল ও সাংবাদিক শামসুল হক, আলী নূর। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর প্রথম প্রশ্ন করল আলী নূর। আলী নূরের প্রশ্ন হচ্ছে–বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন কোনো সাহায্য দিতে পারবে কিনা। মনে হলো প্রাভদা সম্পাদক এই প্রশ্নটিকে ভিন্নভাবে নিলেন। তিনি যেন একটু রুক্ষ হলেন। বললেন, তোমাদের দেশ থেকে যারা আসছে সকলেই সাহায্যের কথা বলছে। আমাদের দেশের সাধারণ কৃষক শ্রমিক শুধুমাত্র তোমাদের সাহায্য করার জন্যে তো আর কাজ করছে না। প্রাভদার সম্পাদকের উত্তর আমার কাছে অপমানকর মনে হলো। আমি বললাম, দেখুন, আমরা গরিব হতে পারি, আমরা কিন্তু ভিখারী নই। এর আগে কারা আপনাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছে জানি না। আমরাই আমাদের দেশকে গড়ে তুলতে পারব। মনে হলো আমার জবাবে প্রাভদা সম্পাদক ক্ষেপে গেলেন। তিনি বললেন–তুমি কি জান, কী করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে মোকাবেলা করতে হয়। আমি বললাম–এ শিক্ষা আপনার কাছে থেকে নেব না। আমরা ন’মাস যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি। যুদ্ধের শেষের দিকে আপনারা আমাদের সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন এ জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু কারো সহযোগিতা ছাড়াই আমরা জিততে পারতাম। সারা বিশ্ব আমাদের সমর্থন কত। এবার প্রাভদা সম্পাদক একটু ভিন্ন সুরে কথা বললেন। তিনি বললেন, তুমি কি আন্তর্জাতিকতাবাদ বোঝ এবং জান যে আমাদের বন্ধুরা ভিয়েতনাম এবং হাভানায় যুদ্ধ করছে? তোমাদের কি এ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে? আমি বললাম, অভিজ্ঞতা ছিল বলেই তোমাদের সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার আগে ২৩ বছর আমরাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। আর আন্তর্জাতিক সম্পর্কে আমার একটি ভিন্ন ধারণা আছে। আমাদের আন্তর্জাতিকতাবাদ ঢাকা থেকে শুরু হয়ে হাভানা যায়। ভিয়েতনাম যায়। ভিয়েতনাম থেকে শুরু হয়ে ঢাকা আসে না। সেদিক থেকেই তুমি বলতে পার এ ব্যাপারে আমি একবারেই গেঁয়ো। আমি জাতীয়তাবাদী বলেই আন্তর্জাতিকতাবাদী। আমার কথার মধ্যে পররাষ্ট্র বিভাগের এক কর্মকর্তা বাধা দিলেন। বললেন, আপনি বড্ড সেন্টিমেটাল। আমি বললাম, সেন্টিমেটাল বলেই আমরা এত বড় শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পেরেছি। আমাদের প্রচণ্ড আবেগ আমাদের সাহসী করেছে। আমি আবারও বলতে চাই, আমি জাতীয়তাবাদী বলেই আন্তর্জাতিকতাবাদী আর আমি যতদূর জানি এটাই লেনিনের কথা।

এবার মুখ খুললেন প্রাভদার সম্পাদক। বললেন, শুনেছি, তুমি সর্বত্রই লেনিন নিয়ে কথা বলেছ। কারো সাথে তোমার ঐকমত্য হয়নি। আমি বললাম, দেখো লেনিন মারা গেছে। তার সম্পর্কে তোমাদের এবং আমার ব্যাখ্যা এক হচ্ছে না। তাই সর্বত্রই আমি বলেছি লেনিন নিয়ে বিতর্ক করে লাভ নেই। কারণ কেউই চূড়ান্ত কথা বলতে পারবে না।

কমরেড জিমেনিন এবার ভিন্ন কথা তুললেন। বললেন, তোমাদের ইউনিয়ন কি আমাদের ইউনিয়নের সাথে কোনো চুক্তি করতে রাজি। আগামী সপ্তাহে ভারতের সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারা আসবেন। তারাও চুক্তি করবেন। তোমরা এলে আপত্তি কি? আমি বললাম, আমি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। বাংলাদেশে জাতীয় সাংবাদিক ইউনিয়ন গঠিত হয়নি। তাই আমার পক্ষে কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব নয়। এ কথা আমি প্রথম থেকেই বলেছি।

এ সময় চা এল। পরিস্থিতি অনেক শান্ত হলো। প্রাভদা সম্পাদক জানালেন, আমার সাথে তোমার আলোচনার খবর কাল প্রাভদার প্রথম পৃষ্ঠায় যাবে। আর তোমার কাছে আমার একটি অনুরোধ তুমি ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে কিছু লিখো না। আমি বললাম, এ অভ্যাস আমার নেই। বুঝলাম আমাদের সম্পর্ক জোড়া লাগল না। প্রাভদার সম্পাদকের কক্ষ থেকে বের হতেই আমার দোভাষী বলল, তোমার জন্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের দরজা চিরতরে বন্ধ। তুমি এত তর্ক করবে না। সত্যি সত্যি দোভাষী এ কথা অনুধাবন করেছিলেন ১৯৭৪ সালে। সেবার পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরি এবং চেকোশ্লোভাকিয়া গিয়েছিলাম। কিন্তু চেষ্টা করেও সোভিয়েত ইউনিয়নে যেতে পারিনি। আমার লেনিনগ্রাদ দেখা হয়নি। আর সে লেনিনগ্রাদ এখন আবার পিটার্সবার্গ।

সমাজতান্ত্রিক শিবির সফর করে এসে এক নতুন বিতর্কে পড়লাম। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে প্রকৃত পক্ষে এক বছরও হয়নি। সংঘবদ্ধ কোনো বিরোধিতাও নেই। সারা দেশে সন্ত্রাস। অপরদিকে সকলেই মুক্তিযোদ্ধা। একটি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর নাম হয়েছে মোলই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যারা সুযোগ বুঝে মুক্তিবাহিনী সেজেছিল তাদেরই এ নাম দেয়া হয়েছিল। অনেকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই মোড়শ ডিভিশনের অধিকাংশ লোক এককালে রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সদস্য ছিল। এরা ৯ মাস সশন্ত্র ছিল। নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাট করেছে। ১৬ ডিসেম্বর তারা ভোল পাল্টেছে। মনে হচ্ছিলো তারাই সবচেয়ে বড় মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধার লেবাস লাগিয়ে তারা আরো ভয়ানক হয়ে উঠেছিল।

অপরদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্বও কোনো উন্নতমানের ভূমিকা পালন করেনি। সকলেই যেন কোনো কিছু দখল করতে ব্যস্ত। ইতিমধ্যে অনেকেই বাড়ি গাড়ি এবং দোকান দখল করেছে। একের পর এক সাইনবোর্ড পাল্টাচ্ছে বিভিন্ন দোকান। বায়তুল মোকাররমে গিয়ে দেখি এককালের অবাঙালিদের দোকানে যারা কর্মচারি ছিল তারাই মালিক সেজে বসেছে। সে এক অদ্ভুত লুটপাটের জগৎ। এ পরিবেশ থেকে আমরাও মুক্ত থাকতে পারিনি। আমরাও অবাঙালিদের ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত ভবন দখল করে দলের অফিস বানিয়েছি। আমাদের কারো কোনো বৈধ কাগজপত্র ছিল না। কিন্তু সকলেই গায়ের জোরে পরিত্যক্ত সম্পত্তির মালিক হয়ে বসেছি। খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে সেকালের জোর করে দখল করা অনেক ভবনে এখনোও অনেক রাজনৈতিক দলের অফিস বিরাজ করছে। পরবর্তীকালে এ দখল নিশ্চয়ই বৈধ করা হয়েছে। কিন্তু ৭২-এ যে মানসিকতা নিয়ে আমরা অন্যের বাড়ি দখল করে দলের অফিস বানিয়েছিলাম সে মানসিকতা কোনোক্রমেই সঠিক ছিল না।

এ পরিবেশে শাসক শ্রেণির বিভিন্ন সংগঠন নতুন নতুন বাহিনী গঠন করা শুরু করে। সরকারি শ্রমিক লীগের নেতৃত্বে লালবাহিনী গঠন করা হয়। বলা হয়েছিল এ লালবাহিনী শিল্প এলাকার শান্তি রক্ষা করবে। উৎপাদন ব্যবস্থা দেখাশোনা করবে। পরবর্তীকালে শুনেছি, বিপ্লব উত্তর রাশিয়ার রেডগার্ডের আদলে নাকি বাংলাদেশে লালবাহিনী গঠিত হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের লালবাহিনীর মতো পুনর্গঠন নয়, বাংলাদেশের ঢংয়েই তারা শিল্প এলাকায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল।

তখন শিল্প এলাকায় আমাদের সংগঠন সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের প্রায় একাধিপত্য ছিল। আমাদের এ আধিপত্য সরকার বরদাস্ত করেনি। রাতারাতি একের পর এক ইউনিয়ন তারা জোর করে দখল করে নেয়। এম দফতরের সহযোগিতায় আমাদের ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দেয়। নতুন ইউনিয়ন গঠন করতে থাকে। অর্থাৎ সর্বত্রই তখন নৈরাজ্য। একদিন লক্ষ্য করলাম রাজপথে নীল পোশাক পরিহিত একদল শ্রমিক ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে। শুনলাম এরা নাকি নীল বাহিনী। এরা তাঁতি লীগের লোক। এরা নীল বাহিনী গঠন করে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়েছে। কে তাদের এ দায়িত্ব দিয়েছে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। এখন সকলেই সার্বভৌম।

এক সময় দেখা গেল-পত্রিকার পাতায় রাজাকাররা একের পর এক শহীদ হয়ে যাচ্ছে। নিখোঁজ রাজাকারদের ছবি ছাপা হচ্ছে নিখোঁজ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। প্রথমে আমরা কেউই বুঝতে পারিনি। নিখোঁজ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাদের আমরা ছবি ছাপাচ্ছি তাদের অধিকাংশই নিখোঁজ রাজাকার, আল বদর, আল শামস। তাদের আত্মীয়-স্বজনরা সাংবাদিকদের এ অজ্ঞতার সুযোগ নিয়েছে। ছবি ছাপাবার পেছনের এ তথ্যটি জানতে দীর্ঘদিন কেটে গেছে। এ পরিস্থিতিতে আমি ‘অনিকেত’ নামে দৈনিক বাংলায় উপসম্পাদকীয় লিখতে শুরু করি। এ ধরনের প্রতিটি ঘটনার বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে আমি অসম্ভব বিতর্কিত হয়ে পড়ি। এ পরিবেশে সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে ফিরে এসে আমি যুদ্ধাপরাধীদের শ্রেণি বিভাগের দাবি তুলি। বলতে চেষ্টা করি, সব অপরাধ এক কাতারে নয়। হাজার হাজার মানুষকে রাজাকার আখ্যা দিয়ে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে বিচার করা সঠিক হবে না। জার্মানির উদাহরণ তুলে ধরে বলার চেষ্টা করি, সাধারণ অপরাধে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতা করা হোক। দেশে ফিরে এ কথা লিখে আমি যেন তোপের মুখে পড়ে গেলাম। সে পরিস্থিতিতে আমাকে বাঁচিয়েছে শুধু আমার কলম নয়, আমার রাজনৈতিক দল নয়, আমার পেশা সাংবাদিকতাও।

সাংবাদিকতার জগতে তখন পরিবর্তন এসেছে। ৭১ সালের সংগ্রামের সময় আগুনে পুড়ে যাওয়া ইত্তেফাক সরকারি সাহায্য পেয়ে দাঁড়ার চেষ্টা করছে। পাসবান অফিস থেকে সরকারি সহযোগিতায় শেখ ফজলুল হক মনি বের করছে বাংলার বাণী। ট্রাস্ট সম্পর্কে তখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তথ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে দৈনিক বাংলা, মর্নিং নিউজ ও বিচিত্রা প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাদেশ অবজারভার, পূর্বদেশ এবং চিত্রালী প্রকাশিত হচ্ছে সরকারি তত্ত্বাবধানে। রাজনীতির ক্ষেত্রে তখন কিছুটা সক্রিয় সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি। কখনো রাজনৈতিক খুন, আবার কখনো থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি দখলের অভিযোগ আসছে এই দলের বিরুদ্ধে। রাজনীতিতে মওলানা ভাসানীর ভূমিকাও বিতর্কিত হয়ে উঠছে। এ পরিস্থিতিতে এল ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি।

ঘটনাটি ছিল অপ্রত্যাশিত। আমরা অনেকেই প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরে লক্ষ্য করলাম ছাত্র ইউনিয়নের একটি মিছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে প্রেস ক্লাবের দিকে আসছে। হঠাৎ শুনলাম গুলির শব্দ। মিছিলকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। এদিক-ওদিক ছুটে পালাল। একদল মিছিলকারী প্রেস ক্লাবের ভেতরে ঢুকে গেল। পুলিশ প্রেস ক্লাব তাক করেও গুলি ছুঁড়ল। প্রেস ক্লাবের জানালার কাঁচ ভেঙে একটি গুলি বাংলার বাণীর আলোকচিত্রী রফিকুর রহমানকে আঘাত করল। আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমাদের চোখের সামনে ছাত্র ইউনিয়নের মতিউল-কাদের মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ল। আমরা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ সভা করলাম এবং মিছিল নিয়ে সচিবালয়ে দিকে গেলাম। আব্দুল গনি রোড হয়ে আমরা সচিবালয়ে ঢুকতে চেষ্টা করলাম। এসময় গেটে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমদ এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন, আপনি নির্মল সেন এবং গিয়াস কামাল চৌধুরীকে প্রধানমন্ত্রী ডেকেছেন। আপনারা দুজন আমার সাথে চলুন। আপনাদের স্লোগান বন্ধ করতে হবে। আমরা রাজি হলাম না। বললাম, আমরা সকলেই যাব এবং শ্লোগান দিতে দিতেই যাব। তোফায়েল সাহেব আমাদের কথার জবাব দিলেন না। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে পৌঁছে। দিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে তখন অনেক মানুষ। আমরা কেউই জানতাম না, তখন মন্ত্রিসভার বৈঠক চলছে। আমি ছিলাম অসম্ভব ক্ষুব্ধ। কোনো দিক না তাকিয়েই প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলাম–আপনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মান্নান সাহেব কোথায়। আমরা মান্নান সাহেবকে চাই। পাকিস্তানের রাজত্বে তেইশ বছর ছিলাম। ১৯৭১ সালের মার্চের পূর্বে পাকিস্তানিরা প্রেস ক্লাবে গুলি করতে সাহস পায়নি। প্রধানমন্ত্রী, আপনি দেশে ফিরেছেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। আজ ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি। এক বছর না যেতেই আপনারা প্রেস ক্লাবে গুলি চালিয়েছেন। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মান্নান সাহেবকে আমরা দেখতে চাই। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ওই তো মান্নান বসে আছে। আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। সত্যি সত্যি তো ভাবিনি যে মান্নান ভাই ওখানে থাকবেন। এবার প্রধানমন্ত্রী বললেন, কী ঘটনা ঘটেছে আমি জানি। এবার আপনারা কী চান তা বলুন। গিয়াস কামাল বললেন, নির্মল দা-ই সব বলবেন। আমি বললাম, আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে। গুলিবর্ষণের তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করতে হবে। এসপিকে সাসপেন্ড করতে হবে। তদন্তের পর দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

এবার প্রধানমন্ত্রী অদ্ভুত ভঙ্গি করলেন। তিনি হেসে হাতজোড় করে বললেন, এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়া কি মানায়? আমি কথা দিচ্ছি। প্রেসনোট দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করা হবে। এছাড়া আপনাদের বাদ বাকি সব দাবিই মেনে নেয়া হবে। তাহলে আপনারা খুশি তো, কী বলেন?

প্রকৃতপক্ষে তখন আমাদের বলার কিছু ছিল না। আমরা প্রেস ক্লাবে ফিরলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম ছাত্রলীগের একটি মিছিল। মিছিল থেকে শ্লোগান উঠছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মান্নানের পদত্যাগ চাই। প্রথমে আমার ব্যাপারটি বোধগম্য হলো না। পরে বুঝলাম–আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ এবারে রাজপথে ঘটতে শুরু করল। ১ জানুয়ারির এ ঘটনা নিয়ে বিকেলে দৈনিক বাংলা ও দৈনিক সংবাদের পক্ষ থেকে দুটি টেলিগ্রাম বের করা হলো। দৈনিক সংবাদের সাংবাদিকদের ভূমিকা বড় করে তুলে ধরা হলো। পরের দিন দৈনিক সংবাদে সে খবর ছিল অনেক নরম। আর টেলিগ্রাম ছাপাতে গিয়ে বিপদে পড়ল দৈনিক বাংলা এবং দৈনিক বাংলার প্রখ্যাত দুই সাংবাদিক তোয়াব খান ও হাসান হাফিজুর রহমান।

১৯৭৩ সাল। ১ জানুয়ারি প্রেসক্লাবের সামনে গুলি হলো। ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যরা ভিয়েতনামের স্বপক্ষে মার্কিন বিরোধী মিছিল করতে এসেছিল। কোনো সতর্কবাণী ছাড়াই পুলিশ সে মিছিলে গুলি করে। মতিউল ও কাদের নামে দু’জন ছাত্র নিহত হয়। আগের দিনের টেলিগ্রামের মতো সংবাদের সুর তেমন কঠিন নয়। অনেকটা আপোষের সুর।

দেশবাসীর কাছে দৈনিক সংবাদের একটি পরিচয় ছিল। সংবাদের মালিক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি অর্থাৎ ন্যাপের সদস্য। ন্যাপের সাথে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্কও ঘনিষ্ঠ। সংবাদের অধিকাংশ সাংবাদিক ও কর্মচারী কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য, সমর্থক অথবা শুভানুধ্যায়ী। তাই একটা সাধারণ ধারণা ছিল সংবাদ ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি ঘেঁষা এবং মোটামুটিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থক। তাই সংবাদ পড়ে আঁচ করা যেত ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য ও নীতি। একথা জানা থাকলেও ২ জানুয়ারির সংবাদ পড়ে আমার তেমন কোনো ধারণা হয়নি।

২ জানুয়ারি হরতাল। প্রেস ক্লাবে এসে দেখলাম প্রেস ক্লাবের সামনে সাবেক ইউএসআইএস-এর সামনে অঙ্গনে মতিউল ও কাঁদেরের নামে একটি স্মৃতিসৌধ হচ্ছে। একদল সাংবাদিক আমাকে ওখানে নিয়ে গেল। ওই স্মৃতিসৌধে আমি মালা দিলাম। প্রেস ক্লাবে গিয়ে তুমুল বিতর্কের সামনে পড়ে গেলাম। সবার অভিযোগ হচ্ছে–আপনি মস্কোপন্থীদের ফাঁদে পড়েছেন। যদিও তাতে আমার কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হলো না। কারণ সর্বকালেই আমি এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতেই অভ্যস্ত।

সন্ধ্যার দিকে দৈনিক বাংলা অফিসে গেলাম। সিঁড়িতে উঠতে একজন সহ-সম্পাদককে দেখলাম। সে প্রেসে যাচ্ছে। সে বলল–কিছু কিছু খবর দ্ধ করার জন্য প্রেসে যাচ্ছি। ওই দিন বিকালে পল্টন ময়দানে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিবাদ সভা ছিল। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ অর্থাৎ ডাকসুর ভিপি ছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। সভায় তিনি নাকি ঘোষণা করেছেন, শেখ সাহেবের ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। ডাকসুর তরফ থেকে ১৯৬৯ সালে শেখ সাহেবকে বঙ্গবন্ধু খেতাব দেয়া হয়েছিল। সেই সুবাদেই ডাকসু’র পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু খেতাব প্রত্যাহার করা হলো। আমার দৈনিক বাংলার সাংবাদিক বন্ধু একটি ছবির ক্যাপশন থেকে বঙ্গবন্ধু শব্দটি তুলে দেয়ার জন্যে প্রেসে যাচ্ছিল। আমি তার কাছেই এ কথা শুনলাম। কিন্তু তখনও গভীরভাবে তলিয়ে দেখিনি এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। আমরা দৈনিক বাংলায় কাজ করি। বরাবরই একটি ট্রাস্ট কিংবা সরকারি মালিকানায় থাকলেও দৈনিক বাংলার সাংবাদিকদের এক ধরনের স্বাধীনতা সর্বকালেই ছিল। যেমন ১৯৭১ সালে কর্তৃপক্ষের সমস্ত চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে দৈনিক বাংলা শেখ সাহেবের ৭ মার্চের ভাষণ দাড়ি, কমা, সেমিকোলনসহ ছেপে দিয়েছিল। আমার ধারণা ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ ধরনের স্বাধীনতা আরো পাওয়া যাবে। সুতরাং আমি নতুন করে কিছুই ভাবতে চেষ্টা করিনি।

কিন্তু প্রতিক্রিয়া হলো সরকারি মহলে। শেখ সাহেব তখন ঢাকায় ছিলেন না। আমাদের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হাসান হাফিজুর রহমান, নির্বাহী সম্পাদক তোয়াব খানকে ডেকে পাঠানো হলো। তাদের অভিযুক্ত করা হলো টেলিগ্রাম বের করার জন্যে।

আমি খবর পেলাম সবচেয়ে শেষে। ইতিমধ্যেই সরকার আর একটি পদক্ষেপ নিয়েছে। হাসান হাফিজুর রহমান ও তোয়াব খানকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি অর্থাৎ ওএসডি করা হয়েছে। নতুন সম্পাদক হয়ে আসছেন ইত্তেফাকের প্রবীণ সাংবাদিক নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী। আমি খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। দৈনিক বাংলায় তোয়ব খানের সাথে দেখা হলো। একটি মহল থেকে বলা হলো এ সিদ্ধান্ত নেবার আগে শেখ সাহেব নাকি কথা বলেছেন খন্দকার গোলাম মুস্তফার সাথে। যিনি কে জি মুস্তফা নামে পরিচিত। পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন এবং মোটামুটিভাবে তৎকালীন বাংলাদেশেও সাংবাদিকদের স্বীকৃত নেতা। আমি তাঁকে ফোন করলাম। তিনি বললেন প্রধানমন্ত্রী আমাকে ফোন করে তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন মাত্র। সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমার মতামত নেননি। এ পরিস্থিতিতে আমাকে বিপদে ঠেলে দিল। কারণ আমি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। আবার দৈনিক বাংলায় চাকরি করি। আমার পক্ষে পিছু হটবার কোনো পথ ছিল না।

আমি দৈনিক বাংলার প্রেস, শ্রমিক ইউনিয়ন ও কর্মচারী ইউনিয়নের দুই নেতাকে নিয়ে পুরনো গণভবনে গেলাম। দুপুরের দিকে প্রধানমন্ত্রী ওখানে বিশ্রাম নিতেন। গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সচিব রফিকুল্লাহ চৌধুরীর সাথে দেখা হলো। তিনি বললেন, প্রধানমন্ত্রী বিশ্রাম নিচ্ছেন। আমি বললাম, আমার জরুরি কথা আছে। রফিকুল্লাহ চৌধুরীর সাথে দীর্ঘদিন আমার ছাত্রলীগের সম্পর্ক ছিল। আইয়ুব আমলে জেলে যাবার আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে একই হোটেলে থাকতাম। রফিকুল্লাহ চৌধুরীকে বললাম আমার প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে হবেই। তাঁর সাথে আমি একা পুরনো গণভবনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলার বামপাশে একটি কক্ষে গেলাম। আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম তিনি খাটে শুয়ে আছেন। মাথার কাছে গাজী গোলাম মুস্তাফা। প্রধানমন্ত্রীর গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি। আমাকে দেখেই তিনি একটি হাওয়াই শার্ট গায়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

আমি সেদিন অবাক হয়ে একজন ভিন্ন মানুষের দিকে তাকাচ্ছিলাম। তিনি আমার হাত ধরে বললেন, আপনি আমার ভাই, একটা ভুল হয়ে গেছে। সাংবাদিকদের অসাংবাদিক করা ঠিক নয়। হাসান হাফিজুর রহমান ও তোয়ব খানকে ওএসডি করা ঠিক হয়নি। এ ঘটনায় আমি দুঃখিত। এখন আমার করার কিছু নেই। এ ব্যাপারে আপনাকে একটু ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। আমি বারবার বলছি, আমি নিরুপায়। আপনি আমার ভাই। আপনাকে ক্ষমা করতে হবে।

কিন্তু আমারও করার কিছু ছিল না। প্রধানমন্ত্রী আমার হাত ছেড়ে দিলেন। আমি বললাম, আমি গোপালগঞ্জের নির্মল সেন নই। আমি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। আমারো করার কিছু নেই। আমি চাই তাদের দৈনিক বাংলায় ফিরিয়ে দেয়া হোক। এ প্রশ্নে আমার আপোষ করার কোনো পথ নেই। এবার দেখলাম-প্রধানমন্ত্রীর মুখমণ্ডল পাল্টে যাচ্ছে। বললেন, চলুন, আপনার সাথে যারা এসেছে তাদের সঙ্গে কথা বলব। এবার ভিন্ন কক্ষে গেলাম। শেখ সাহেব তার কথা বললেন। তাকিয়ে দেখলাম আমার অপর দুই বন্ধু একেবারে নীরব। তারা কেউ টু-শব্দটি করছে না। দেরিতে হলেও আমি বুঝতে পারলাম–আমি ব্যতীত সকলের সাথেই প্রধানমন্ত্রী আগে আলাপ করেছেন এবং তারা সম্মতি দিয়েছেন।

আমি কোনো কিছু ঘুণাক্ষরে জানতে পারিনি। আমার বলার কিছু ছিল না। আমার নির্বাক দুই বন্ধুকে নিয়ে আমি দৈনিক বাংলায় ফিরে এলাম। পরের দিন মিছিল হলো। দৈনিক বাংলার তিনশ কর্মচারী দৈনিক বাংলা থেকে হেঁটে মিছিল করে পুরনো গণভবনে গেল। সকলের পক্ষ থেকে অনেক আবেদন নিবেদন করা হলো। প্রধানমন্ত্রী কারো কথা শুনলেন না। পরে আমাকে ডেকে বললেন হাসান হাফিজুর রহমানকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেস মিনিস্টার করা হবে। আপনাদের মুখ চেয়ে তাঁকে যুগ সচিবের পদমর্যাদা দেয়া হবে। তোয়াবেরও একটা ব্যবস্থা করা হবে। আপনাকে অতো ভাবতে হবে না।

আমি তখন বিপর্যস্ত এবং বিধ্বস্ত। দীর্ঘদিন ট্রেড ইউনিয়ন করেছি। আইয়ুব আমলে মাসের পর মাস চটকল ধর্মঘট করেছি। কোনোদিন পরাজিত হইনি। এবার আমাকে পিছু হটতে হলো। পরবর্তীকালে শুনতে পেলাম সরকারও দুই সাংবাদিককে ওএসডি করে খুব নিরাপদ অবস্থানে ছিলেন না। কারণ আইনের দিক থেকে এ দুই সাংবাদিক আদৌ সরকারি কর্মচারি ছিলেন না। তাই তাদের সরকারি কর্মচারিদের হিসেবে ওএসডি করাও যায় না।

এর কদিন পরে দৈনিক সংবাদের সুর নরম হয়ে যাবার তাৎপর্য বুঝলাম। জানা গেল, ছাত্র ইউনিয়নের এই ভূমিকায় সোভিয়েত ইউনিয়ন খুশি নয়। এর পরবর্তীকালেই আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্কে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট (গজ) গঠন করে। একদিন দেখলাম প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে মতিউল-কাঁদেরের স্মৃতিসৌধ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনের চত্বরে। সেখানে এরশাদের আমলে একটি ফোয়ারা স্থাপন করা হয়েছে। এ সকল ঘটনা ঘটেছিল পর্দার অন্তরালে। আমি বা আমরা অর্থাৎ সাংবাদিকরা এ ব্যাপারে কোনো কিছুই জানতে পারিনি।

দৈনিক বাংলায় ফিরে এলাম। নতুন সমস্যা দেখা দিল নতুন সম্পাদক নিয়ে। ইত্তেফাকের প্রবীণ সাংবাদিক নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী আমাদের সকলের পরিচিত। আপনজন বললেও বেশি বলা হয় না। হাসান হাফিজুর রহমান ও তোয়াব খানের পরিবর্তে পাটোয়ারী সাহেব এলেন দৈনিক বাংলার সম্পাদক হিসেবে। হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন দৈনিক বাংলার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ও প্রশাসক। তোয়ব খান ছিলেন নির্বাহী সম্পাদক। এবার সম্পাদক ও প্রশাসকের পদ নিয়ে এলেন নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী। নির্বাহী সম্পাদকের পদ থাকল না।

পাটোয়ারী সাহেব আসায় আমাদের সকলেরই অসুবিধা হলো। আমরা হাসান হাফিজুর রহমান ও তোয়াব খানের পক্ষে আন্দোলন করেছি। আমাদের পক্ষে পাটোয়ারী সাহেবকে গ্রহণ করা খুবই মুশকিল। কিন্তু কোনো উপায়ও ছিল না।

এসময় আমার একটি ভিন্ন কথা মনে হতো। পাটোয়ারী সাহেবের তুলনায় আমরা ছিলাম সাংবাদিকতায় নতুন। এক সময় ভাবতাম সাংবাদিকদের তুলনা হয় না। এরা আদর্শ, এরা নমস্য। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে বিশ্বাসে চির ধরতে শুরু করে। লক্ষ করলাম আমরা একেবারেই সাধারণ মানুষ। আমাদের আদর্শবাদী ও সাহসী বলা হয়ে থাকলেও প্রায় কেউ আদর্শবাদ এবং সাহস দেখাতে পারলাম না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অন্য পেশায় মানুষের মতো আমরাও দৌড়-ঝাঁপ শুরু করলাম। আমরা ভালো চাকরি চাই। আমরা মন্ত্রী হতে চাই। সংসদ সদস্য হতে চাই। কেউ রাষ্ট্রদূত হতে চাই। সাংবাদিকতা পেশা আমাদের কাছে গৌণ হয়ে গেল।

এমন ধারণা আমার ছিল না। পাকিস্তান আমলে যারা সাংবাদিকতা করতেন তাদের একটা ভিন্ন পরিচয় ছিল। এককালে তাদের মধ্যে অনেক প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হয়েছেন। কিন্তু স্বকীয়তা হারায়নি। নিজের পেশাও ছাড়েননি। আমি একমাত্র ব্যতিক্রম দেখেছিলাম করাচির ডন পত্রিকার সম্পাদক মরহুম আলতাফ হোসেনের ক্ষেত্রে। তিনি আইয়ুব মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে দেখলাম তিনি খাঁটি আমলা হয়ে গেছেন। তাঁকে কেন্দ্র করে একটি ঘটনাও আজকে আমার মনে পড়ছে।

ষাটের দশকের কথা। তখন দৈনিক বাংলার নাম দৈনিক পাকিস্তান। আমি টেবিলে শিফট ইনচার্জ। বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হক কায়রোগামী বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। নতুন বার্তা সম্পাদক তোয়াব খান। প্রধান সহ সম্পাদক ফজলুল করিম। পাকিস্তান সরকার ইত্তেফাক নিষিদ্ধ করেছে। প্রতিবাদে ধর্মঘট ডেকেছিল পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন। পরের দিন রাতের পালায় আমি কাজ করছি। গভীর রাতে দৈনিক পাকিস্তানের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আহসান আহমদ ফোন করলেন। বললেন এপিপি (পরবর্তীতে বাসস) একটি খবর পাঠাবে হুবহু ছেপে দিতে হবে। কিছুক্ষণ পর খবর এল। সে খবরে বলা হয়েছে সাংবাদিক ইউনিয়নের ধর্মঘট আহ্বান সত্ত্বেও সেদিন পূর্ব পাকিস্তান পাঁচটি দৈনিক প্রকাশিত হয়েছিল। পড়ে দেখলাম, সেই খবরে দৈনিক পাকিস্তানের নাম নেই। তাই খবরটি অনুবাদ না করে আমি বসে থাকলাম। এবার ফোন করলেন আলতাফ হোসেন। জানতে চাইলেন ওই খবর এসেছে কিনা। আমি বললাম খবর এসেছে। কিন্তু ওই খবরে দৈনিক পাকিস্তানের নাম নেই। তিনি বললেন, আপনি দৈনিক পাকিস্তানের নাম লিখে দিন। আমি বললাম, সংবাদটি এপিপির; আমি সংশোধন করতে পারব না। তিনি বললেন, নতুন করে খবরটি যাচ্ছে। ওই খবরে দৈনিক পাকিস্তানের নাম থাকবে। খবরটি দৈনিক পাকিস্তানে ছাপাতেই হবে। এটা সরকারি নির্দেশ। তখন রাত ১২টা বেজে গেছে। শিফটের সকলে চলে গেছে। আমি একা। এবার নতুন করে খবরটি এল। ওই খবরে দৈনিক পাকিস্তানের নাম ছিল। আমি খবরটি অনুবাদ করলাম না। দৈনিক পাকিস্তানের খবরটি ছাপা হলো না। আমি বার্তা সম্পাদক বরাবরে একটি চিঠি লিখলাম। চিঠিতে লিখলাম এই খবরটি রাত বারোটার পর এসেছে। টেবিলে আমি ব্যতীত কোনো সহ সম্পাদক নেই। চাকরির শর্ত অনুযায়ী আমার অনুবাদ করার কথা নয়। তাই খবরটি আমি রেখে গেলাম। আমি জানি, এ খবরটি আদৌ সত্য নয়। তবুও এ খবরটি ছাপাবার জন্যে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।

পরের দিন আমার চাকরিতে তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। তখন ইউনিয়ন ছিল শক্তিশালী। মালিক বা সরকার ইচ্ছে করলেই যা কিছু করতে পারত না। আমার কথা হচ্ছে আমি সেদিন হাড়ে হাড়ে একজন আমলা মন্ত্রীকে চিনেছিলাম। যিনি এককালে সাংবাদিক ছিলেন। এদেশের ইতিহাসে সাংবাদিক হিসেবে তাঁর খ্যাতিও ছিল। এছাড়া কোনো সাংবাদিকের আমলা হওয়া বা কোনো সাংবাদিককে উচ্চপদের পেছনে ছুটতে আমি দেখিনি। দু’একজন যারা ভিন্ন পেশায় চলে গেছেন, তাদের মধ্যেই অনেকেই মৌলিক চরিত্র হারায়নি। নিজের পত্রিকায় পদোন্নতির প্রতিযোগিতা দেখেছি। কিন্তু পেশার বাইরে চাকরির জন্যে তেমন দৌড়-ঝাঁপ করতে দেখিনি। তাই আমার ধারণা ছিল হাসান হাফিজুর রহমান কিংবা তোয়াব খানের শূন্যপদে কোনো সাংবাদিক যোগ দিতে রাজি হবেন না। হলে আমরাই জিতে যাবো।

এ প্রশ্নটি আমি ভিন্নভাবেও দেখেছিলাম। তখন স্বাধীনতার পক্ষে ও বিপক্ষে প্রশ্নটি খুবই সামনে এসেছিল। এই বিতর্কে অনেককে চাকরি হারাতে হয়েছে। সে বিতর্কেও আমাদের জিতবার কথা ছিল। কারণ হাসান হাফিজুর রহমান ও তোয়াব খান স্বাধীনতার পক্ষের লোক ছিলেন। তোয়ব খান স্বাধীন বাংলা বেতারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাই ভেবেছিলাম এদের শূন্যপদে স্বাধীনতার পক্ষের কেউ আসবে না। কিন্তু আমার ভাবনা সত্যি হয়নি। আমাদের সাথে কোনো কথা না বলেই নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী দৈনিক বাংলার সম্পাদকের পদ গ্রহণ করলেন। তখন তথ্যমন্ত্রী ছিলেন

মিজানুর রহমান চৌধুরী। শুনেছি পাটোয়ারী সাহেব তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তবুও একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি বিশ্বাস করতে চাইনি, শুধুমাত্র আত্মীয়তার সুবাদে কেউ এ ধরনের চাকরি গ্রহণ করতে পারে। অনেকে বলেন, পদটিও কম বড় কথা নয়। পাটোয়ারী সাহেব ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী বার্তা সম্পাদক। সেই চাকরির পরে একটি পত্রিকার সম্পাদক হওয়া কম কথা নয়। হয়তো সেই বিচারেই তিনি পদটি গ্রহণ করেছিলেন। হয়তো তিনি আমার মতো ভাবেননি। আমি ভেবেছিলাম হাসান হাফিজুর রহমান ও তোয়ব খানের পরিবর্তে কাউকে পাওয়া যাবে না। সুতরাং তারাই থেকে যাচ্ছেন।

তবে আরো চমক ভাঙল আর একটি সংবাদে। এ সময় পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের একটি জনসভা হয়। এই জনসভায় দৈনিক বাংলার ঘটনার উল্লেখ করা হয়। সভায় যুবলীগ নেতা ফজলুল হক, শফি মান্নান বলেন, দৈনিক বাংলা থেকে দুজন স্বাধীনতা বিরোধীকে অপসারণ করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। এ বক্তব্য আমাকে চমকে দিল। তাহলে স্বাধীনতার পক্ষের লোক কে? স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুন সংজ্ঞা দেয়া হচ্ছে কি? এরা একেবারেই শুধুমাত্র নিজেদের স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে দাবি করতে চায়। তাহলে অন্যদের অবস্থান কী? একথা সত্য, হাসান হাফিজুর রহমান ও তোয়াব খান আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন না। আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন না বলেই কি তারা স্বাধীনতা বিরোধী? এ পরিস্থিতিতে পাটোয়ারী সাহেব এলেন দৈনিক বাংলায়। এরপর একটি ঘটনা ঘটল। আমি বিকেল বেলা গণভবনে গেলাম। প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা হচ্ছিল একটি সমস্যা নিয়ে। সেদিন দুপুরে এক ব্যক্তিকে রাজাকার বলে ধাওয়া করে পিটিয়ে হত্যা করা হয় মতিঝিলে। শুনে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম এটা কোন পক্ষের ষড়যন্ত্র?

গণভবনে আমার অবারিত দ্বার। আমি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে চলে গেলাম। ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রীকে বললাম। তিনি খাঁটি গোপালগঞ্জের ভাষায় কথা বললেন, আমি পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছি। রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের যেখানে পাবি মেরে ফেলবি। এদের ক্ষমা নেই।

আমি প্রথম চুপ হয়ে গেলাম। বললাম, আমি একটু কথা ঘুরিয়ে বলি। ধরুন, কামাল ও জামাল মতিঝিল দিয়ে যাচ্ছে। কেউ পেছন থেকে চিৎকার করছে, ওরা রাজাকার ওদের ধর এবং মার। অবস্থা এমন হলে আমিওতো রাজপথে বের হয়ে বাঁচাবো না।

প্রধানমন্ত্রী স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তার বাঁ হাত দিয়ে কপালের একটি পাশ চেপে ধরলেন। ফোন তুললেন, এই দেখিস, রাজাকার-ফাজাকার বলে কেউ যেন রাস্তায় কাউকে পিটিয়ে না মারে। আমি অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি বারবার এই মানুষটির কাছে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়েছি। এত সহজে কথা বলে কোনোকালে কোনো দেশে কেউ একজন প্রধানমন্ত্রীকে কথা শোনাতে পেরেছে বলে আমার জানা নেই। তিনি ফোন করেছিলেন হুইপ প্রধানকে।

ব্যক্তিগতভাবে আমার অবস্থান তখন চরমভাবে বিতর্কিত। সকলেই জানে আমি রাজনীতি করি। শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। রাজনীতিতে এ দলটির অবস্থান বিরোধী শিবিরে। অবস্থান এমন যে সরকারি সন্ত্রাসীরা আমাদের দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড সিদ্দিকুর রহমানকে তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে গুলিবিদ্ধ করেছে। পল্টন ময়দানে আমাদের জনসভা ভেঙে দিয়েছে। দেশের শিল্প এলাকায় চটকলগুলোয় আমাদের শ্রমিক ইউনিয়নগুলো শ্রমিক লীগ একের পর এক হাইজ্যাক করছে। আমাদের কেন্দ্রীয় অফিস তখন ১৬/ক বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে। হঠাৎ একদিন আর সবাইকে বাদ দিয়ে আমাদের এক মাসের মধ্যে বাড়ি ছাড়বার নোটিশ দেয়া হয়েছে। আমাদের শ্রমিক সংগঠন সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতিকে দিনেদুপুরে হাইজ্যাক করে শ্রমিক লীগের সভাপতি করা হয়েছে। তখন আমি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি এবং জড়িয়ে পড়লাম দৈনিক বাংলা নিয়ে সরকারের সাথে সংঘর্ষে।

আমার বিরুদ্ধে প্রচার হচ্ছে আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ। কৈশোরে টুঙ্গিপাড়া স্কুলের ছাত্র। আমাদের পরিবারের দীর্ঘদিন ধরেই টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারের সাথে সম্পর্ক আছে। এছাড়া ব্যক্তিগত জীবনে নির্মল সেন হিন্দু হওয়ায় তার তো ভারতীয় এজেন্ট হওয়ার কথা। আওয়ামী লীগ ভারতীয় এজেন্ট সুতরাং নির্মল সেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কেন যাবে?

অপরদিকে সংবাদপত্র জগতেও আমাকে নিয়ে মতানৈক্য আছে। আমি ছাড়া আমার দলের একজন সদস্য তখন সংবাদপত্র জগতে নেই। অথচ পাকিস্তান আমল থেকেই প্রেস ক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচনে আমি কোনোদিন পরাজিত হইনি। প্রেস ক্লাবের নির্বাচনে একাধিকবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছি। সাংবাদিক ইউনিয়নের তখন নেতৃত্বে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। প্রকৃতপক্ষে কমিউনিস্ট পার্টি যাদের মনোনয়ন দিত তারাই সেকালের সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেসক্লাবে নির্বাচিত হতো। ভিন্নমতের রাজনীতিক হিসেবে আমিই একমাত্র একক দাঁড়িয়ে নির্বাচিত হতাম। এছাড়াও আরো দু’একজন নির্বাচিত হতেন, তবে তাঁদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। ষাটের দশকের মাঝামাঝি কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয় রুশ ও চীনপন্থী হিসেবে। এ সময় থেকে প্রেস ক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে শুরু করে। এ সময়েও আমি এককভাবে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছি। আমার নাম কোনো প্যানেলেই থাকত না। তবে এক সময় রুশপন্থীরা আমাকে অপছন্দ করতে শুরু করে। কারণ আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে আমার মতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভুল পথ অনুসরণ করছে লেনিনের মৃত্যুর পর থেকে। আমরা বলতাম, স্টালিন সঠিক নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভুল করছে। ভিন্নভাবে হলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের মত ও পথ নিয়ে কমিউনিস্ট বিশ্বের নতুন মতানৈক্য শুরু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির ২০ কংগ্রেসের পথ থেকে স্বাভাবিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমালোচনাকারীদের সাথে আমাদের মতের নৈকট্য সৃষ্টি হয়। কিন্তু সেখানেও বিভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। দেখা গেল–যারা স্ট্যালিনের সমালোচনায় নেমেছেন, তারা স্ট্যালিনের চেয়েও অনেক সংশোধনবাদী। ফলে এক নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি হলো। আমাদের মনে হলো অন্তত কিছু কিছু প্রশ্নে চীন কমিউনিস্ট পার্টির অনেক সমালোচনা সঠিক। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও মতানৈক্য সৃষ্টি হলো মাও সেতুং-এর শত ফুল ফুটতে দাও, উৎপাদন উল্লম্ফন এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কর্মসূচি নিয়ে। অর্থাৎ রুশ বা চীন কোনো পন্থীদের সাথে কৌশলগত ব্যাপারেও আমি একমত হতে পারছি না। এ ঘটনা বিশেষভাবে ঘটেছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে সংবাদপত্রের জগতে। আমি সেই সংবাদপত্র শিল্পের একজন সদস্য।

সেকালের রাজনীতি আজকের মন নিয়ে তেমন করে বোঝা যায় না। আমার রাজনীতির একাকীত্বের একটি কারণ ছিল। কিন্তু ১৯৭২ ও ৭৩ সালে দেশের রাজনীতির আদৌ কোনো রূপরেখা কারো কাছে স্পষ্ট ছিল না। একটি কথা কোনো মহলই স্বীকার করতে চাইত না, আমাদের স্বাধীনতা স্বাভাবিকভাবে আসেনি। যারা নেতৃত্বের দাবিদার তারাও জানতেন না যে কী হতে যাচ্ছে বা হবে। এমনকি তাজউদ্দিনও জানতেন না শেখ সাহেবের সর্বশেষ কথা। অথচ এ নিয়ে কোনো দিন কোনো মহলে আলাপ করেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোন গ্রুপ ক্ষমতায় যাবে এটাই ছিল লক্ষ্য। তাই ঐক্যবদ্ধভাবে সমস্যা মোকাবেলা না করে প্রথম থেকেই কোন্দল শুরু হলো আওয়ামী লীগে।

মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে সরানো হলো লজ্জাজনকভাবে। তার কোনো ব্যাখ্যা আজো দেয়া হয়নি। সবচেয়ে বেশি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের ব্যাখ্যা নিয়ে। এটা কি আদৌ মুক্তিযুদ্ধ ছিল? মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে হয়? কারা করে? এ মুক্তিযুদ্ধ কি শুধুমাত্র পাকিস্তান থেকে মুক্তি পাওয়া, না শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাওয়ার যুদ্ধ। এ প্রশ্নে কেউ আলোচনা করলেন না। কেউ সঠিক ব্যাখ্যা দিলেন না। সকলে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে ৭১-এর যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধ বলে ধরে নিয়ে নিজের ছক সাজাতে শুরু করলেন। কিন্তু ইতিহাস তো কারো নির্দেশে চলে। কেউ নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে ব্যাখ্যা দিলেই আমাদের যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ হয়ে যায় না।

একথা সকলের জানা, শোষণমুক্তির আন্দোলন করতে হলে যারা শোষণ মুক্তির আদর্শে বিশ্বাস করে তারা নেতৃত্বে থাকে। তাদের দলীয় আদর্শ, ঘোষণাপত্র একটি শোষণমুক্ত সমাজের কথাই বলে। বলে সমাজ পরিবর্তনের কথা। কিন্তু ৭১-এর সংগ্রামের প্রধান দল আওয়ামী লীগ এমন কথা কখনো বলেনি। তাদের ঘোষণার সুর ছিল অবাঙালির প্রভুত্ব মানব না। বাঙালি বাঙালিকেই শাসন করবে। কীভাবে শাসন করবে সেটা পরের কথা অর্থাৎ সমাজ যেমন ছিল তেমন রেখেই বাংলার স্বাধীনতার কথা আওয়ামী লীগ বলেছিল। সেখানে শোষণমুক্তির কোনো কথা ছিল না এবং এ ধরনের যুদ্ধকে নির্দ্বিধায় পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সংগ্রামকে অভিহিত করা যায়। এককালে যে ধরনের সংগ্রাম চলছিল ভারতের পাঞ্জাব থেকে শুরু করে নাগাল্যান্ড পর্যন্ত বিভিন্ন রাজ্যে। নাগাল্যান্ডের সংগ্রাম কোনো অর্থেই শোষণমুক্তির সংগ্রাম নয়। ১৯৭১ সালে আমাদের সংগ্রামও তেমন সগ্রাম ছিল।

কিন্তু বিপদ দেখা দিলো সংগ্রাম শেষ হওয়ার পর। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করা ও শেষ করা এক কথা নয়। এ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নতুন চেতনার জন্ম হয়েছে। নতুন আকাক্ষার সৃষ্টি হয়। তেমনি একটি চেতনা ও আকাক্ষার জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালের সময়।

সেই সংগ্রামের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল একটি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন। তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে এই স্বপ্নকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই সংবিধানে সমাজতন্ত্র শব্দটি স্থান পেয়েছিল। স্বাধীন বাংলার সংবিধান দেখে মনে হতো সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের জন্যেই ৭১-এর সংগ্রাম করা হয়েছিল। কিন্তু এটা ছিল রাজনীতিক মিথ্যাচার। ভারতের সহযোগিতায় এবং ভারতের সাথে গোপন চুক্তি স্বাক্ষর করে আর যাই হোক সমাজতন্ত্র অভিমুখে সরকার বা সমাজ গঠন করা যায় না এবং এখান থেকেই শুরু হলো আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্কট। অর্থাৎ যা বিশ্বাস করি না তাকেই প্রতিপাদ্য হিসেবে ধরে সমাজ গঠনের চিন্তা আদৌ সম্ভব নয়। বলা হলো আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি আমরাই সমাজতন্ত্র করব। এই বক্তব্য থেকেই কর্মপন্থা প্রণীত হতে থাকল এবং বাস্তবের আঘাতে সব স্বপ্নই ভাঙতে থাকল বছর না ঘুরতেই।

মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি হলো, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি মিলিশিয়া গঠন করা হোক। কর্নেল তাহের জনগণের সামরিক বাহিনী গঠনের সুপারিশ করলেন এবং তিনিও তাঁর কথায় আচরণে তাঁর তত্ত্ব প্রকাশের চেষ্টা করলেন। কিন্তু কেউই মনে রাখলেন না, আমাদের মূল সেনাবাহিনী ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক কাঠামোতে তৈরি। এদের মধ্যে মনন স্বপ্নের শোষণমুক্ত সমাজের মতো নয়। তাই লক্ষ করা গেলো, সামরিক বাহিনী আর মুক্তিযোদ্ধারা এক হতে পারলেন না।

মিলিশিয়া গঠন করতে গিয়ে মারামারি হলো পিলখানায়। সেই সংঘর্ষ ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে পিলখানা যেতে হয়েছিল। বাদ দিতে হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মিলিশিয়া গঠনের কর্মসূচি। পরিবর্তে গঠিত হয়েছিল বিতর্কিত জাতীয় রক্ষীবাহিনী। আর এই রক্ষীবাহিনীভুক্ত ৮০ ভাগই ছিল মুজিববাহিনীভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা।

সম্প্রতি আমার এ বক্তব্যের সমর্থন মিলেছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতাদের কথায়। জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু লিখেছেন ৭ নভেম্বরের ঘটনা। তিনি লিখেছেন, জেনারেল জিয়া যতক্ষণ তাদের কজায় ছিল ততক্ষণ সাধারণ সৈনিকেরা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সাথে সহযোগিতা করেছে। আর জিয়া হাতছাড়া হয়ে যাবার পর তারা দুর্বল হয়ে যেতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের নির্দেশেই তারা গ্রেফতার হয়। অর্থাৎ ৭ নভেম্বরের জাসদের ব্যর্থতা আরেকবার প্রমাণ করে ৭১-এর সংগ্রাম আদর্শের ভিত্তিতে কোনো শোষণমুক্তির সংগ্রাম ছিল না। আমাদের সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাঙালি বলে বঞ্চিত হবার ক্ষোভে এবং দুঃখে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। এই ক্ষোভ ও বেদনা ছিল তাদের যুদ্ধে যোগদানের ভিত্তি। সমাজ পরিবর্তন বা সমাজতন্ত্রের কোনো কথাই তাদের মনে কখনো জাগেনি। তাই গণবিচ্ছিন্নভাবে তাদের দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম করতে যাওয়া হঠকারিতার সামিল এবং এই হঠকারিতার জন্ম হয়েছে ৭১-এর সগ্রামকে মুক্তিসংগ্রাম হিসেবে ব্যাখ্যা করার জন্যে। এ ব্যাখ্যা যেমন সেকালের সরকারকে বিপর্যস্ত করেছে তেমনি বিপর্যস্ত করেছে বিরোধী শিবিরের এক শ্রেণির বামপন্থীদের।

৭১-এর যুদ্ধ সম্পর্কে মূল্যায়ন কারো যে খুব স্পষ্ট ছিল না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই মূল্যায়ন নিয়ে বিভ্রান্তির প্রথম শিকার হয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সমাজতন্ত্র শব্দটি সংবিধানে বসানো হলো। তার কোনো প্রয়োগগত ব্যবস্থা থাকল না। অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের বিধি বিধান লঙ্ঘন করা সম্পর্কে কারও কিছু বলার বা করার ঘোষণা ছিল না। সমাজতন্ত্র চাই। সমাজতন্ত্র পৌঁছবার জন্যে কী পথ অবলম্বন করতে হবে সে ব্যাপারে সংবিধানে কোনো নির্দেশনা থাকল না।

এই পটভূমিতে পাটকল, বস্ত্ৰকল, ব্যাংক, বীমা রাষ্ট্রায়ত্ত করা হলো। এক শ্রেণির লোকের ধারণা হলো এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে। অথচ এ কথা আদৌ সত্য ছিল না। তকালীন ক্ষমতাসীন সরকারকে বাধ্য হয়ে সে কালের পাটকল, বস্ত্রকল, ব্যাংক, বীমা রাষ্ট্রায়ত্ত করতে হয়। এর কারণ হিসেবে ছিল এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ মালিক পাকিস্তানের অধিবাসী। পাকিস্তানের সহযোগী দালাল। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান ছিল একান্তই রুগ্ন। এই মালিকানাবিহীন শিল্প কারখানা ও অন্যান্য সম্পত্তিগুলোকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি বলা হতো। সেই অর্থেই এই সম্পত্তি সরকারের হাতে নিতে হয়। এর একটা ভিন্ন দিকও ছিল। একাত্তরের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগ-এর সাথে শিল্প কারখানার কোনো সম্পর্ক ছিল না। মুখ্যত খুব নগণ্য সংখ্যক শিল্প কারখানার মালিক ছিল আওয়ামী লীগ। উৎপাদনের সাথে ক্ষমতাসীন সরকার আওয়ামী লীগ-এর তেমন সম্পর্কও ছিল না। ফলে এ ধরনের সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করতে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আওয়ামী লীগ-এর আপত্তি ছিল না। এর পরেও অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতাদেরই পরিত্যক্ত শিল্প কারখানা কিনবার মতো পুঁজিও ছিল না। আমার মতে, এটাই ছিল তকালে শিল্প কারখানা, ব্যাংক, বীমা জাতীয়করণের প্রধান কারণ। কিন্তু সাধারণ মানুষকে ধারণা দেয়া হলো, সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে এই কাজগুলো করা হয়েছে। সমাজতন্ত্র বিরোধীদের অপপ্রচারে সুবিধা হলো।

এই রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি চালাবার দায়িত্ব দেয়া হলো একেবারেই অনভিজ্ঞ আত্মীয়-স্বজন এবং দলীয় কর্মীদের। এদের প্রথম এবং শেষ দায়িত্ব হলো লুটেপুটে খাওয়া। এদের সহযোগী হয়েছিলেন সর্বকালের আমলা সম্প্রদায়। একটি হিসেব নিলে দেখা যাবে এই সকল সম্পত্তির যারা তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন তাদের মধ্যে অধিকাংশেরই এখন ঢাকায় কোটি কোটি টাকার সম্পদ আছে। এর সুযোগ নিয়েছে এবং আরো সুযোগ নিচ্ছে সমাজতন্ত্রী বিরোধী মহল। তারা এখনো লিখছে বাংলাদেশের সকল সর্বনাশের কারণ সেকালের সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করা। তাদের ভাষায় শ্রমিকরাই নাকি সবকিছু লুটপাট করেছে। ওই শিল্পগুলো ব্যক্তি মালিকানায় দিয়ে দেয়া হলে নাকি এমন হতো না।

এ পরিস্থিতিতে পরিষ্কার যে রাষ্ট্রায়ত্ত করার নামে তখন শিল্প এলাকায় এক ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। উৎপাদন বন্ধ হয়। একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে এটা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। সড়ক সেতু কল-কারখানা না থাকলে উৎপাদন বন্ধ হয়েছে। এই বাস্তবতা মেনে নেয়া হলে সেকালে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বা পণ্যের অভাবের একটি সহজ যুক্তি পাওয়া যেত। কিন্তু ঘটনা ঘটলো ভিন্নরকম। অথচ পাকিস্তান আমলে আমাদের টাকার মূল্য বেশি ছিল। অপরদিকে বিনা বাধায় ভারতীয় পণ্য আমাদের শূন্য বাজার দখল করে নিল এবং স্বাভাবিকভাবেই একটি ভারত বিরোধী মনোভাবের জন্ম নিল। কেউ বুঝতে চাইল না, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হয়েছিল। আমাদের ভারত বিরোধিতার উত্তরাধিকার একাত্তর এর বিশেষ পরিস্থিতিতে থেমেছিল। কিন্তু ন’মাসের সংগ্রামে সমাজের শত শত বছরের কালিমা মুক্ত হতে পারে না। এছাড়া আমাদের প্রতিপক্ষ বসে ছিল না। একাত্তরে আমরা সকলে স্বাধীনতা চাইনি। একটি বিরাট অংশ পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। সুতরাং সুযোগ পেলেই যে তারা মাথাচাড়া দেবে এ কথা কারো না বুঝবার কথা ছিল না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ছিল নির্বিকার। স্বাধীনতার পক্ষে বলে পরিচিত একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী মুর্ধের মতো ভাবতে শুরু করলেন, দেশ পাকিস্তান মুক্ত হয়েছে। শুধু বাকি শোষণমুক্ত সমাজ গঠন। আমার নিজের ধারণা একাত্তরের সংগ্রামের চরিত্রের সঠিক মূল্যায়ন না হওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র আমাদের দল শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল সংবিধান প্রণয়নকালে সংসদের সামনে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমাদের মিছিলের খবর পেয়ে সংসদ মুলতুবি হয়ে যায়।

সংবিধান প্রণয়নের পর ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসন দখল করেছিল। সে নির্বাচন কেমন হয়েছিল তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার আছে। আমাদের দলের প্রার্থী কাজী হাতেম আলী নরসিংদী থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। টেলিভিশনে প্রথম দিকে কাজী হাতেম আলী এগিয়ে আছেন বলে বারবার ঘোষণা দেয়া হলো। তারপর এই ঘোষণা বন্ধ হয়ে যায়। পরের দিন ভোরে আমি গণভবনে যাই। প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম একান্ত সচিব নূরুল ইসলামের সাথে আমার দেখা হয়। তিনি আমাকে জানান, আপনাদের এই বাচ্চা প্রার্থী কাজী হাতেম আলী সারারাত আমাদের জ্বালিয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রার্থী অর্থাৎ আওয়ামী লীগের মোসলে উদ্দিন ভূঁইয়াই জয়লাভ করেছে। আর একথা সকলেরই জানা, ওই নির্বাচনে আমাদের প্রার্থী কাজী হাতেম আলী তেতাল্লিশ হাজার ভোট পেয়েছিল। আওয়ামী লীগ প্রার্থী পেয়েছিল ছত্রিশ হাজার। আর নির্বাচন কমিশনের ঘোষণায় বলা হয়েছিল আওয়ামী লীগ প্রার্থী তেতাল্লিশ হাজার ভোট পেয়েছে। কাজী হাতেম আলী পরাজিত হয়েছে সাত হাজার ভোটে। নরসিংদীতে যারা এই কাজটি করেছেন তারা আমাদের চেনা। পরবর্তীকালে এক সময় আমাদের সাথে তারা শ্রমিক রাজনীতি করত। শুনেছি এখন তারা জাতীয় পার্টিতে আছে। শুধু কাজী হাতেম আলী নয়, সেকালের জাসদ সভাপতি মেজর জলিলকে এমনিভাবে পরাজিত করা হয়েছিল বরিশালের উজিরপুর আসনে। জাসদের রশিদ ইঞ্জিনিয়ারকে হারিয়ে দাউদকান্দির আসনে খন্দকার মোশতাক আহমেদকে বিজয়ী করা হয়েছিল। এটাই ছিল সেকালের আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনের চিত্র। তখন বিরোধীদল সংগঠিত ছিল না। ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি তখন সরকারের কাছাকাছি। বাদবাকি যারা আন্দোলন করার চেষ্টা করেছিল তারাও আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিরোধীদলকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা যে হয়নি তা নয়। কিন্তু বিরোধীদল বলতে তখন শুধুমাত্র কিছু বামপন্থী দল। মুসলিম লীগ থেকে জামায়াতে ইসলাম পর্যন্ত সকল মৌলবাদ দল নিষিদ্ধ। বামপন্থী দলের মধ্যে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ও মোজাফফর ন্যাপ মোটামুটিভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থক। বাদ বাকি আমাদের শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, ভাসানী ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি নামে পরিচিত আরো দু’একটি দল এবং অলি আহাদের জাতীয় লীগ। সবাইকে জড়ো করলেও তাদের শক্তি খুব বেশি নয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তখন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্ব। এ সময় তিনি রহস্যজনক ভূমিকা পালন করেন।

উপরিউক্ত দলগুলোকে নিয়ে ১৯৭৩ সালে নির্বাচনের পূর্বে একটি জোট গঠনের চেষ্টা করা হয়। স্থির হয় ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করা হবে। এ সময় মওলানা সাহেব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যান। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান হাসপাতালে মওলানা সাহেবের সাথে সাক্ষাত করেন। মওলানা সাহেবের সাথে কী আলোচনা হয়েছিল তা আজো জানা যায়নি। তবে লক্ষণীয় যে মওলানা সাহেব আরোগ্য লাভ করলেন। হাসপাতাল ত্যাগ করলেন। নির্বাচন নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ঢালাও কারচুপির অভিযোগ করলেন। কিন্তু তিনি বিরোধীদলের কারো পক্ষে নির্বাচনের প্রচারে গেলেন না। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনে বিরোধীদলের পক্ষে তেমন জোর হাওয়াও ছিল না।

এর মধ্যে আর একটি ঘটনা ঘটে। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ গঠিত হয়। জাসদ গঠনের ইতিহাস আজো আমার কাছে রহস্যাবৃত। এ নিয়ে আমি ইতিপূর্বে দীর্ঘ আলোচনা করেছি। যারা জাসদ গঠন করলেন তারা তৎকালীন ছাত্রলীগের সবচাইতে পোড় খাওয়া কর্মী। তাঁদের সাহস অতুলণীয়। হঠাৎ তাঁরা একদিন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের শ্লোগান দিলেন এবং একটি দল গঠন করলেন; যে দল নিয়ে আদৌ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব নয়। সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল একটি বিশেষ শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে। এ সংগঠনের বহুদলীয় রাজনীতির কোনো সুযোগ নেই। এ দলের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ব্যক্তিত্বেরই থাকার কথা। কিন্তু দেখা গেলো বহুদলীয় দলের ধাচে মেজর জলিলকে সভাপতি করে এ দলটি গঠিত হলো। মোটামুটিভাবে এদের সকলেই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ থেকে এসেছে। এদের আচরণে একই ছাপ আছে। শুধু মুখে আছে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা এবং এখানটাই তাদের আওয়ামী লীগের সাথে একমাত্র পার্থক্য। তবুও এ দলটি তাদের কর্মীদের সংগ্রামী ঐতিহ্যের জন্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কাপন সৃষ্টি করেছিল। এদের রাজনীতির একটি বিশিষ্ট ধরন ছিল। এরা প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সরকারের প্রতি চরমপত্র দিত। মিছিল-সমাবেশ করত। ভাঙচুর হতো। এক ভাঙচুরের পরিবেশে আরেক প্রতিবাদ দিবসের ডাক দেয়া হতো। স্বাভাবিকভাবেই তারা রাজনীতির অঙ্গনে একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবার পরিবেশ সৃষ্টি করল।

কিন্তু লক্ষ করা গেলো–নির্বাচনের প্রশ্নে তারা আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে রাজি হলো না। তারা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়ার চেষ্টা করল। তাদের সেকালের কথাবার্তা শুনে আমার মনে হতো নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার জন্যেই তারা মাঠে নেমেছে। কারণ তখন নির্বাচনবিরোধী একটি মনোভাবের জন্ম হচ্ছিল। সকলের কাছেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল যে অবাধ নির্বাচন হবে না। সুতরাং এ নির্বাচন করে কোনো লাভ নেই। কিন্তু মুস্কিল হলো জাসদ নির্বাচনের মাঠে থাকলে নির্বাচন বর্জনের অবকাশ কোথায়? অপরদিকে তখন আওয়ামী লীগের মূল সংঘর্ষ হচ্ছিল জাসদের সাথে। জাসদের প্রার্থী হাইজ্যাক হচ্ছিল। আর জাসদ নেতৃবৃন্দ প্রতিদিনই হুমকি দিচ্ছিলেন, এ ধরনের আর একটি ঘটনা ঘটলে তারা হয়তো নির্বাচন করবে না। এ ধরনের বিবৃতি দিয়ে তারা নির্বাচনের পর্ব পার করে দিল। অন্য কেউই নির্বাচন সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। এ সময় রাজনীতির অঙ্গনে সর্বহারা পার্টির নাম ডাক ছিল। একজন রহস্যময় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সিরাজ সিকদারের নামও সামনে আসছিল। সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি ১৯৭১-এর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে সেই অংশগ্রহণেরও ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। তখন পশ্চিমবঙ্গে চারু মজুমদার, জঙ্গল সাঁওতাল ও কানু সান্যালের নেতৃত্বে নকশালবাড়ি আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তার ছাপ পড়েছিল আমাদের দেশের অনেক বামপন্থী দলের ওপর। তার মধ্যে সর্বহারা পার্টি একটি। এক সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে নকশালবাড়ি আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। সে মতানৈক্যের ছাপ বাংলাদেশেও পড়ে। সেকালে নকশালবাড়ি আন্দোলনের নেতাদের চীনপন্থী বলে পরিচিত ছিল এবং সেই সুবাদে আমাদের দেশে চীনপন্থী রাজনীতিকদের বিভিন্ন অংশ নিজেদের চেয়ে নকশালবাড়ি আন্দোলনের অনুরূপ আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে। ফলে ৭১-এর সংগ্রামে তাদের মধ্যে কারো কারো বলিষ্ঠ ভূমিকা থাকলেও নকশালবাড়ি আন্দোলনকে অনুকরণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাদের ভূমিকা কখনোই সংশয় বিভ্রান্তিহীন সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। এই পটভূমিতে দেশ স্বাধীন হবার পর সর্বহারা পার্টি আত্মগোপন করেই রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে থাকে। তারা শ্রেণিশত্রু খতমের শ্লোগান দিতে থাকে। অথচ সে শ্লোগান তখন বিতর্কিত হয়ে গেছে খোদ পশ্চিমবঙ্গে। তবুও শ্রেণিশত্রু খতমের রাজনীতি বেশ কিছু দিন হলেও তীব্র প্রভাব ফেলেছিল জনমনে।

মোটামুটিভাবে এটাই ছিল তৎকালীন স্বীকৃত বিরোধীদলগুলোর আন্দোলনের চিত্র। সব দল মিলিয়ে মওলানা ভাসানী ছিলেন বিরোধী আন্দোলনের নেতা। কিন্তু শেখ সাহেবের আমলে কোনোদিনই তার ভূমিকা খুব স্পষ্ট ছিল না। তবুও বিরোধীদলগুলো তাঁর দিকেই চেয়ে থাকত। এই পরিবেশে মওলানা ভাসানী ১৯৭৩ সালের মে মাসে আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। তিনি তখন ভাসানী ন্যাপের মতিঝিল অফিসে অবস্থান করছিলেন। ভাসানী অনশন শুরু করলেও সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করা হলো না। একদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ন্যাপ অফিসে গেলেন। মওলানা সাহেবকে অনুরোধ করলেন অনশন ভাঙতে। শেষ পর্যন্ত অনুরোধ করলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাবার জন্যে। কিন্তু মওলানা সাহেব রাজি হলেন না। তখন আমি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। গিয়াস কামাল চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক। আমরা কয়েকজন সাংবাদিক সঙ্গে নিয়ে মওলানা সাহেবের কাছে গেলাম। বললাম, আপনাকে হাসপাতালে যেতে হবে। মওলানা সাহেব বললেন, আমি সাংবাদিকদের কথায় কোনোদিন দ্বিমত করিনি। আমি অনশন ভাঙব না, হাসপাতালে যাব। মওলানা সাহেব হাসপাতালে চলে গেলেন।

মওলানা সাহেব হাসপাতালে গেলেন। মওলানা সাহেবের সমর্থনে হরতালের ডাক দেয়া হলো। হরতালের দিন ছিল শঙ্কা ও ভয়ের এক পরিবেশ। আজকের হাইকোর্টের সামনে শিক্ষাভবনের কাছ থেকে বাংলাদেশ বিমানের কর্মচারী নূর হোসেনকে অপহরণ করা হলো। নূর হোসেন আর ফিরে আসেনি। এ খবর শুনে আমি দৈনিক বাংলায় গেলাম। দেখলাম ইতিমধ্যে সরকার থেকে একটি নির্দেশ এসেছে। নির্দেশে বলা হয়েছে, হরতাল সম্পর্কিত কোনো খবর যাবে না। তখন আজকের মতো পরিবেশ ছিল না। আজকের সরকারের আদেশ অমান্য করে কোনো কোনো খবর ছাপা যায়। কিন্তু সে সুবিধা তখন ছিল না। তখনো পাকিস্তান আমলের সংবাদপত্র সম্পর্কিত কালাকানুন বহাল আছে। তখন দেশের সকল বিজ্ঞাপনের মালিক সরকার। আর এছাড়া আছে সশস্ত্র ক্যাডার। অধিকাংশ পত্রিকা সরকারের ব্যবস্থাপনায় চলছে। তাই ইচ্ছা থাকলেও সাহস করে লেখা লোকের খুবই অভাব ছিল। আমাকে দৈনিক বাংলার সাংবাদিকরা ঘিরে ধরল। তারা বলল, একটা কিছু করতে হবে। আমি ভাবলাম আমার করার কী আছে। জরুরি ভিত্তিতে সে মুহূর্তে ইউনিয়নের সভা ডাকাও সম্ভব নয়। কোনো প্রস্তাব নিয়ে কার্যকর করাও কঠিন। আমি বন্ধুদের কথা দিলাম। ব্যক্তিগতভাবে হলেও আমি কিছু করব। ঝুঁকিটা আমিই নেব।

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমার কলামে আমি হরতাল নিয়ে লিখব। সেদিনই আমি লিখেছিলাম আমার বহু আলোচিত উপসম্পাদকীয়। যার শিরোনাম ছিল–হরতাল হয়েছে–হরতাল হয়নি। আমি চেষ্টা করেছি আমার লেখার মধ্য দিয়ে সরকারের নির্দেশ অমান্য করতে। আমি আমার লেখার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছি হরতাল হয়েছে। যতটুকু হরতাল হয়েছে ততটুকু খবর দেয়ার অধিকার আমার আছে। আমি লিখতে পারব না যে আদৌ হরতাল হয়নি। সেদিন আমি লিখেছিলাম–রাজধানী ঢাকা শহরে বড় বড় সড়কে কোনো গাড়ি ছিল না। হরতাল হয়েছে। হরতাল হয়নি। আমি লিখেছিলাম সরকারি ও বেসরকারি দফতরে অসংখ্য কর্মচারী উপস্থিত হয়নি। আবার কেউ কেউ হাজির হয়েছে। হরতাল হয়েছে। হরতাল হয়নি। এ ছিল আমার এক ধরনের প্রতিবাদ। সরকারি নির্দেশের ফলে আমি যা দেখেছি তা লিখতে পারছিলাম না। এই মর্মান্তিক জ্বালার কথা আমি কোনোকালেও কাউকে বোঝাতে পারিনি। আজও পারছি না। আমি সাংবাদিক হিসেবে রাজপথে দেখে এলাম পুলিশের গুলিতে মানুষ মারা গেল। অফিসে এসে দেখলাম পত্রিকায় ছাপানো যাবে না যে কেউ পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। এ ঘটনার বিবরণ ছাপা যাচ্ছে না, তাও পত্রিকায় উল্লেখ করা যাবে না। অর্থাৎ সরকার বোঝাতে চাচ্ছে-এই মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের জন্যে সাংবাদিকরাই দায়ী। তাদের কোনো দায়িত্ব নেই।

এ এক মর্মান্তিক জ্বালা। কখনো সরকারি নির্দেশ, কখনো মালিকের নির্দেশ, কখনো সন্ত্রাসীর বা কখনো ঋণখেলাপীর হুমকিতে সাংবাদিকদের যে লেখার কথা তা লিখতে পারে না। বলতেও পারে না যে পত্রিকায় এই লেখালেখির ব্যাপারে তাদের ভূমিকা গৌণ। প্রকৃতপক্ষে তারা দায়ী নয়। কিন্তু কে শুনবে এ কথা।

এ পরিস্থিতিতেই আমাকে সেদিন এ উপসম্পাদকীয় লিখতে হয়েছিল। আজো সে কথা শুনতে হয়। অনেকে পরিহাস করেন। কিন্তু অনুধাবন করতে চেষ্টা করেন না আমার সেকালের অবস্থা। আমি নিজে জানি যে নূর হোসেন অপহৃত হয়েছে। সে আর ফিরে আসছে না। আমি জানি অনশনরত ভাসানীর জন্য হরতাল হয়েছে। কিন্তু সে কথা আমি লিখতে পারব না। আমি যে সরকারি নির্দেশে সেকথা লিখতে পারছি না–সে কথাও উল্লেখ করতে পারব না। তাহলে আমার কী করার ছিল?

তবে মওলানা ভাসানীর অনশন নিয়ে ঘটনার এখানেই শেষ নয়। তকালীন বিরোধীদলগুলো মওলানা সাহেবের অনশনকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এ দলগুলোর মধ্যে ছিল জাসদ, ভাসানী ন্যাপ, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি। সবার সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২২ মে বিকেলে এক সর্বদলীয় জনসভা ডাকা হবে। ২৯ মে থেকে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হবে। কিন্তু পরবর্তীকালে আন্দোলনের কর্মসূচির প্রশ্নে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়। শুধুমাত্র একটি বিবৃতি দিতে সক্ষম হয়। তখন পল্টন ময়দানের জনসভা ডেকেছিল ভাসানী ন্যাপ। সেই জনসভাকেই সর্বদলীয় সভায় রূপান্তরিত করা হয়েছিল। কিন্তু সে জনসভা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা সে জনসভা পণ্ড করে দেয়। পরবর্তীকালে আমাদের অর্থাৎ শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের পক্ষ থেকে একটি জনসভা আহ্বান করা হয়। সেকালে ঢাকার প্রায় সব হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নগুলো আমাদের সাথে ছিল। প্রতিদিন এদের নিয়ে গণ্ডগোল হতো। মিছিল হতো। এ সমস্যা নিয়েই আমরা পল্টনে জনসভা করতে চেয়েছিলাম। আওয়ামী লীগের সদস্যরা এই জনসভা ভেঙে দেয়।

প্রকৃতপক্ষে এটাই ছিল সেকালের ছবি। কোথাও ১৪৪ ধারা জারি নেই। কিন্তু সভা-সমাবেশ করার কোনো উপায় ছিল না। পত্র-পত্রিকা সরকারি দখলে ছিল। বেতার টেলিভিশনও একই অবস্থা। গণতন্ত্র ছিল সরকারি নেতাদের প্রতিশ্রুতিতে সীমাবদ্ধ। এই পরিবেশে মওলানা সাহেবের অনশনের সময় বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেয়া হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল জনসভার পরে মওলানা সাহেবের কাছে যাওয়া হবে এবং তাকে অনশন ভাঙবার অনুরোধ জানানো হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কারোরই হাসপাতালে মওলানা সাহেবের সাথে দেখা করতে যাওয়া হয়নি। মওলানা সাহেব নিজ সিদ্ধান্তেই অনশন ভাঙেন।

এ হচ্ছে ১৯৭৩ সালের প্রথমদিকের কথা। মনে হচ্ছিল পরিবেশ যেন রুদ্ধ হয়ে আসছে। দেশে হয়তো বা একটা অঘটন ঘটে যাবে। এমন সময় আমরা সাংবাদিক ইউনিয়নের জাতীয় রূপ দেওয়ার চেষ্টা করি। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানের একটি জাতীয় সাংবাদিক ইউনিয়ন ছিল। সে ইউনিয়নের নাম ছিল পাকিস্তান ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রশ্ন দেখা দিলো নতুন করে জাতীয় ভিত্তিতে সাংবাদিক ইউনিয়ন গঠন করা হবে কিনা। পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন কে জি মোস্তফা। সদস্য ছিলেন–পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ থেকে শহিদুল হক, ফজলুর রহমান ও তোয়াব খান। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম–জাতীয় ভিত্তিতে বাংলাদেশ সাংবাদিক ইউনিয়ন গঠন করতে হবে। এ জন্য একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হলো। নতুন প্রতিষ্ঠানের নাম হলো বাংলাদেশ সাংবাদিক ফেডারেশন। সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি হলেন কে জি মোস্তফা। সদস্য হলেন–তোয়াব খান, ফজলুর রহমান আতাউস সামাদ, গিয়াস কামাল চৌধুরী এবং আমি। কমিটির আহ্বায়ক হলেন–আতাউস সামাদ। শহীদুল হক তখন পাকিস্তানের থাকায় তাকে সদস্য করা গেলো না। ফজলুর রহমান সম্পর্কে আপত্তি এল। তিনি পাকিস্তান টাইমস-এর চট্টগ্রামের সংবাদদদাতা ছিলেন। ৭১-এ যুদ্ধের সময় তার ভূমিকা স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে ছিল না। তাই তাকে বাদ দিতে হলো। তোয়াব খান চাকরি হারালেন দৈনিক বাংলার। প্রধানমন্ত্রী প্রেস সেক্রেটারি হয়ে গেলেন। তার সদস্যপদ থাকল না। আতাউস সামাদ বিএসএস-এর প্রতিনিধি হয়ে নয়াদিল্লি গেলেন। তিনিও সদস্য থাকলেন না। এবার আমি সংগঠনের আহ্বায়ক হলাম। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে সভা ডাকলে কেউ উপস্থিত হয় না। কোনো কোনো দিন আমি আর গিয়াস কামাল দু’জনে সভা করেছি। পরবর্তীকালে সকলের স্বাক্ষর নিয়েছি। আমাদের কোনো গণতন্ত্র ছিল না। আমরা পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের গঠনতন্ত্রই অনুসরণ করতাম। এ পরিস্থিতিতে কে জি মোস্তফা জানালেন–তিনি পেশা পরিবর্তন করতে চান এবং তিনি লেবাননের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সাংবাদিক ফেডারেশনের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনের প্রথম বৈঠক কে জি মোস্তফার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী। এই অনুষ্ঠানে ইউনিয়নের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) রাখার সিদ্ধান্ত হয়। প্রবীণ সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তকে গঠনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। আমি বিএফইউজের সভাপতি নির্বাচিত হলাম। গিয়াস কামাল সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ জাফর সহসাধারণ সম্পাদক। আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী কোষাধ্যক্ষ। বিএফইউজে গঠনের পর প্রথম অধিবেশন হয় চট্টগ্রামে। সেই অধিবেশনে খসড়া গঠনতন্ত্র গৃহীত হয়। যদিও পরবর্তীকালে অভিজ্ঞতার আলোকে একেবারে বেআইনিভাবে ওই গঠনতন্ত্র আমি বারবার সংশোধন করেছি এবং ওই গঠনতন্ত্র ছাপাতে শেষ পর্যন্ত পাঁচ বছর লেগেছে।

বিএফইউজে’র প্রথম অধিবেশনেই সরকারের প্রতি একটি চরমপত্র দেয়া হয়। তখন সংবাদপত্রের জগতে পাকিস্তান আমলের কালাকানুন বহাল ছিল। বিএফইউজের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় যে ৩১ আগস্টের মধ্যে এই কালাকানুন বাতিল করা না হলে ১ সেপ্টেম্বর থেকে কোনো কাগজ বের হবে না। তখন সরকারের বিশ্বাস ছিল যে এ আইন বাতিল হবেই। কারণ পাকিস্তান আমলে এ আইনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন হয়েছে। সে আন্দোলন সমর্থন করেছে আওয়ামী লীগ। সুতরাং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই আইন বাতিল করবেই। এই আইন বাতিল নিয়ে তখন একটি ঘটনা ঘটে। ২৮ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তল্কালীন সাংবাদিকতা বিভাগের নবীনবরণ উৎসব ছিল। এ অনুষ্ঠানের আমি ছিলাম বিশেষ অতিথি। প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন তথ্য ও বেতার মন্ত্রী শেখ আব্দুল আজিজ। টিএসসিতে অনুষ্ঠান হচ্ছিল। তথ্যমন্ত্রী আমার পরে কক্ষে ঢুকলেন। তিনি আমাকে দেখেই বললেন, নির্মল বাবু, আপনি আমাকে গালি দিতে পারবেন না। আমি কালাকানুন বাতিল করে এসেছি। আমাকে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, কালাকানুন বাতিল না করে আজকের সভায় গেলে নির্মল সেন তোমাকে ধোলাই করবে। আগে কালাকানুন বাতিল করো, তারপরে অনুষ্ঠানে যাও। মন্ত্রীর কথা আমার ভালো লাগল। ভাবলাম ইউনিয়নের প্রথম বিজয় হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেষ রক্ষা হলো না। সকল মহলের দাবি ছিল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে আমাকে কথা বলতে হবে। আর বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রসঙ্গত একটি ঘটনার কথা আমি উল্লেখ করলাম। উল্লেখিত ঘটনাটি হচ্ছে মাত্র একদিন আগে সরকারি এক প্রেসনোটে বলা হয়েছে–লৌহজং শান্ত। ভালো কথা। কিন্তু অশান্ত থাকার খবরটি আপনারা আমাদের ছাপাতে দেননি। আবার লৌহজং শান্ত থাকার খবর দিয়ে মানুষের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি করা হয়েছে লৌহজংয়ের ঘটনা সম্পর্কে। অথচ এ ব্যাপারে আমাদের হাত-পা বাঁধা আমরা কিন্তু লিখতে পারছি না লৌহজং-এ

কী ঘটেছিল। আমার যতদূর মনে আছে–লৌহজংয়ের খবরটি ছিল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে কোন্দল তুঙ্গে ওঠায় সে খবর আসতে দেয়া হয়নি পত্রিকায়।

আমার দ্বিতীয় বক্তব্য ছিল–যুবলীগ নেতা মরহুম শেখ ফজলুল হক মনির একটি নির্দেশ নিয়ে। তখন ছাত্রলীগ ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে নূরে আলম সিদ্দিকী ও আব্দুল কুদুস মাখন। অপরদিকে আসম আব্দুর রব ও শাহজাহান সিরাজ। এ ব্যাপারে মনি ফোন করেছিলেন দৈনিক বাংলায়। তিনি অনুরোধ জানিয়েছিলেন রব-সিরাজের খবর না দেয়ার জন্যে। সে প্রসঙ্গ টেনে আমি বললাম-পরিস্থিতি পাল্টে গেলে কেমন হবে? যদি রব-সিরাজ ক্ষমতায় যায় এবং বলে যে নূরে আলম সিদ্দিকী ও আব্দুল কুদুস মাখনের সংবাদ যাবে না, তখন দৈনিক বাংলার সাংবাদিকরা কী করবে? সুতরাং এ ধরনের নির্দেশ দেয়া বাঞ্ছনীয় নয়। আমার বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী শেখ আজিজ উত্তপ্ত হলেন। উত্তেজিত হয়ে সভা ছেড়ে যেতে চাইলেন। আমাকে থামতে হলো। পরে তিনি মাইকে এলেন এবং পুরো বক্তৃতাটাই দিলেন আমার বিরুদ্ধে। অপরদিকে সরকার প্রেম আইন বাতিল করলেও নতুন নামে আরেক কালাকানুন জারি করল।

কিন্তু বিপদ কাটল না। গণকণ্ঠর পর সমস্যা দেখা দিলো চট্টগ্রামের দৈনিক দেশবাংলা নিয়ে। একদিন দেশবাংলায় প্রথম পাতায় বড় হরফে লেখা হলো, যে কোনো মুহূর্তে রাঙামাটির পতন ঘটতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামে তখন অশান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। তিনি এক সময় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। পাকিস্তানের মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রী হন। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের একাত্তরের সংগ্রামের ভূমিকা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।

সমস্যাটি ভিন্নরূপ নেয় কিছুদিন পর। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পরে একটি নতুন স্লোগান শোনা যেতে থাকে। এই শ্লোগানটি হচ্ছে মুসলিম বাংলা গঠনের। মাঝে মাঝে খবর আসত পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার থেকে। একটি ধারণা জন্মেছিল সত্যি সত্যি কে বা কারা মুসলিম বাংলা গঠনের চেষ্টা করছে। এ নিয়ে তখন খুব লেখালেখি হচ্ছিল। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল আমরা যখন তখন সরকারের বিরুদ্ধে লিখতাম। সরকারের একটি মহল তাদেরও মুসিলম বাংলা সমর্থক বলে অভিহিত করত।

এ ব্যাপারে আমার কাছে কিছু কিছু চিঠিপত্র আসত। চিঠিতে কোনো নাম, ঠিকানা থাকত না। চিঠি হুমকির ভাষায় লেখা হতো। একখানি চিঠি এসেছিল ঢাকায় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকী পালন নিয়ে। চিঠিতে বলা হয়েছিলে দেশে জাকজমক করে দুর্গা পূজা, সরস্বতী পূজা হচ্ছে। এবার হলো নেতাজী দিবস। দেশটাকে তো ভারতই বানিয়ে ফেলবৈন। চিঠির নিচে লেখা থাকত, ইতি পলাতক রাজাকার ও আলবদর।

এ ধরনের চিঠি পেতে পেতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার তেমন কিছু মনে হতো না। অনেক সময় পলাতক আলবদররা তাদের দুঃখের কথা লিখত। অনেকে লিখতেন তাদের নাকি বিনা দোষে হয়রানি করা হচ্ছে। এসময় কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকের কাছ থেকেও চিঠি পেতাম। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে লিখছি বলে তারা অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করতেন। তাঁরা নাম ঠিকানা দিতেন। কিন্তু সেই ঠিকানায় তাদের কোনোদিন পাওয়া যেত না। আমার বরাবরের অভ্যাস ছিল ঠিকানা থাকলে পত্র লেখকদের চিঠি জবাব দেওয়ার। ঠিকানা না থাকলে বা আমার লেখা ফেরত এলে আমি পত্রিকার পাতায় সে চিঠির জবাব দেওয়ার চেষ্টা করতাম। তারপরও আমাকে কম গালি শুনতে হতো না।

এই পরিবেশে মুসলিম বাংলার শ্লোগান শুনেছি। অনেকই দায়ী করেছেন, কে বা কারা নাকি মুসলিম বাংলার সদস্যদের কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্যে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কেউ কেউ মুসলিম বাংলার পোস্টারের কথাও বলেছেন। কিন্তু আমার চোখে তেমন কোনো পোস্টার পড়েনি। আমার কাছে সব পরিস্থিতিটাই গোলামাল মনে হয়েছে। যারা পাকিস্তান চাননি তারা ষড়যন্ত্র করছে ঠিকই। কিন্তু সে ষড়যন্ত্র আমার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার সেই আবেগময় মুহূর্তে কোনো মহল ষড়যন্ত্র করে সফল হবে আমি তা কখনও ভাবিনি। বিদেশি রাষ্ট্রের সক্রিয় সাহায্য ছাড়া ওই ধরনের ষড়যন্ত্র আদৌ সফল হবে বলে আমার কখনোও মনে হয়নি।

কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ষড়যন্ত্র হচ্ছে বা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে এই সংবাদের প্রেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি ভিন্ন অবস্থা ছিল। প্রশ্নটি বাংলাদেশের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়। মুখ্য প্রশ্ন হচ্ছে বাংলা ভাষাভাষীদের স্বাধীনতা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের ঐক্য সূত্র কোথায়? যে ভাষাগত আবেগের ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের সে ধরনের আবেগ থাকাই স্বাভাবিক নয় কি? পাকিস্তান আমলে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা শহর রাঙ্গামাটিকে ডুবিয়ে দিয়ে লেক সৃষ্টি করা হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন। পাকিস্তান সরকারের সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোটি কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে রাঙ্গামাটিকে। নগরের সাথে এলাকার মানুষের শত শত বছরের ঐতিহ্য ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। ছিন্ন হয়েছে অতীতের সাথে ঐতিহ্যের যোগসূত্র। সেই আবেগ মথিত এলাকায় কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি পাকিস্তান আমলে। কেউই বুঝতে চায়নি যে একটি ঐতিহাসিক শহরকে ডুবিয়ে দিয়ে তাদের উদ্বাস্তু অধিবাসীদের অন্যত্র পুনর্বাসিত করলেও আবেগের স্থানটি শূন্যই থেকে যায়। সেই শূন্যস্থান পূরণ সময়সাপেক্ষ। এছাড়া পাকিস্তান সরকার এই অসহায় মানুষগুলোকে পুনর্বাসিত করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের হাজার হাজার অধিবাসী সে সময় পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয় অনেক চোখের জলে। তাদের সেই চোখের জলের সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ করেনি কোনো বাঙালি। তাদের বাস্তুচ্যুত করে বাঙালিরা একটি লেক পেয়েছে। ওই লেকের জলে কাপ্তাইতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। কাপ্তাই এর বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে আলোকিত করছে। কিন্তু আলোকিত করতে পারেনি পার্বত্য এলাকার মানুষকে। এই অনুভূতি ও ক্ষত বড় বাস্তব। এই ক্ষত না শুকাতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। যে স্বাধীনতা নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল সকল মহলে। এক শ্রেণির সরকারি মহল বাহাত্তর সাল থেকেই সন্দেহ করতে শুরু করেছিল যে পাহাড়িদের সাথে মিলছে না। মিলবে না। এখানে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, এ পরিস্থিতি সঠিকভাবে কেউ অনুধাবন করার চেষ্টা করেনি। সকলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের ষড়যন্ত্র জুজু দেখেছে। এক শ্রেণির সংবাদপত্রে উল্টাপাল্টা খবর ছাপা হয়েছে। মনে হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আমাদের সাথে আসছে না। আর এ সময় চট্টগ্রামের দৈনিক দেশবাংলার প্রথম পাতায় খবর হলো যে কোনো মুহূর্তে রাঙ্গামাটির পতন ঘটতে পারে। এ খবর প্রকাশের পর পত্রিকাটি নিষিদ্ধ হলো। বার্তা সম্পাদকসহ অসংখ্য সাংবাদিক কর্মচারি গ্রেফতার হয়ে গেল। আমরা অর্থাৎ সাংবাদিক ইউনিয়ন আরেক দফা বিপদে পড়ে গেলাম। অভিযোগ গুরুতর। এই সাংবাদিক কর্মচারীদের সহজে মুক্ত করা যাবে তা মনে হলো না। শুধুমাত্র ভরসা সেকালের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। আমার বিশ্বাস ছিল তাঁর কাছে কথা বললে হয়তো তাদের মুক্ত করা যাবে।

কিন্তু সহজে কাউকে মুক্ত করা গেল না। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেয়া হলো। বন্দিদের মুক্তি দাবি করা হলো। কিছু কিছু সাংবাদিক কর্মচারীদের মুক্তি দেয়া হলেও বার্তা সম্পাদক মৃণাল চক্রবর্তীকে জেলেই থাকতে হলো। এ পরিস্থিতিতে আমি গিয়াস কামাল চৌধুরী পুরাতন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে গেলাম। তিনি আমাদের দেখে হেসে ফেললেন। বললেন, জানি আপনারা কেন এসেছেন। পৃথিবীর কোনো সরকার এ পরিস্থিতিতে কাউকে জামিনে মুক্তি দেয় না। আমি জামিনের ব্যবস্থা করব। তবে নির্মল সেনের ভাষার পরিবর্তন করতে হবে। তিনি সব ব্যাপারেই ডিমান্ড অর্থাৎ দাবি করেন। কোনো বিবৃতিতেই সরকারের কাছে আবেদন জানান না। এবার আবেদন অর্থাৎ আপিল করতে হবে। আপিল না করলে আমি মৃণালকে মুক্তি দেব না। আমি হেসে বললাম, শুধু একটি শব্দের জন্যে মৃণাল জেলে থাকবে? প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমি প্রধানমন্ত্রী হলেও মানুষ। সেন্টিমেন্ট আছে। আপনাকে বিবৃতি দিতে হবে। বলতে হবে আমি প্রধানন্ত্রীর কাছে আবেদন করছি। তাহলেই সে মুক্তি পাবে। অন্যথায় নয়।

আমি বললাম, ঠিক আছে। আমি একটি সমঝোতার সূত্র দিচ্ছি। সূত্র হচ্ছে সাংবাদিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি বলা হবে–সাংবাদিক ইউনিয়ন চট্টগ্রামের দেশবাংলার বার্তা সম্পাদক মৃণাল চক্রবর্তীর মুক্তি দাবি করছে। মৃণাল চক্রবর্তীর পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁর মুক্তির জন্যে আবেদন জানানো হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী হেসে ফেললেন। তাঁর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদকে ডাকলেন। বললেন, চট্টগ্রামের ডিসিকে ফোন করে দাও, মৃণালকে যেন ছেড়ে দেয়। আর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন মুক্তি পেয়ে মৃণালকে ঢাকায় আসতে বলবেন। সে যেন আমার সাথে দেখা করে।

মৃণাল চক্রবর্তী মুক্তি পান। তাঁকে নিয়ে পুরানো গণভবনে গেলাম। শেখ সাহেব মৃণাল চক্রবর্তীকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, জেলে বড্ড কষ্ট, আমি জানি। তোর বাবা মাকে বলবি আমার কোনো দোষ নেই। নির্মল সেন ডিমান্ড না করলে তুই অনেক আগেই মুক্তি পেতি। আমি জেলে ছিলাম। আমি জেলের কষ্ট বুঝি। তারপর তিনি তার অন্যতম সচিব মোহাম্মদ হানিফকে ডাকলেন। বললেন, মৃণাল চক্রবর্তীকে কিছু টাকা দিয়ে দিতে। আমি তখন দর্শক মাত্র।

কিন্তু সেকালে পত্রিকার সমস্যাই মুখ্য সমস্যা ছিল না। মূল সমস্যা ছিল রাজনীতির। এক অদ্ভুত অস্থিরতা বিরাজ করছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে এটাই ছিল স্বাভাবিক। তবু আমাকে বিব্রত করল সেকালের অনেক সমস্যা। অনেক সমস্যা আমার বোধগম্য হতো না। আমার কাছে প্রথম এবং প্রধান সমস্যা মনে হতো সাধারণ মানুষের ধ্যান-ধারণা নিয়ে। লক্ষ্য করেছি যে মানুষটি ১৯৭০ সালে আমার কাছে আসত, আমাকে তার বাসায় নিয়ে যেত। বলত–আমি ঢাকা শহরে একটি হোটেল দেবো। এই হোটেলের নাম হবে বাঙালি। ওই হোটলে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী শত রকমের খাবার রান্না হবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেখলাম মানুষটিকে সবাই রাজাকার বলছে। সেই মানুষটি কারাগারে যাচ্ছে। অপরাধ তিনি দুটি সাপ্তাহিক কাগজ প্রকাশ করেছিলেন। তাতে যাচ্ছেতাই আওয়ামী লীগ সরকারকে সমালোচনা করা হতো। আমারও মনে হতো এ ধরনের সমালোচনা সাংবাদিকতার নীতিমালা পরিপন্থী। অনেকদিন সে কথা কাউকে বলিনি। আজ তা বলছি। ভদ্রলোকের নাম ফয়জুর রহমান। যতটুকু মনে আছে তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ছাত্রজীবনে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন।

এ রাজনীতির একটি ভিন্ন ইতিহাস আছে। ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে মুসলিম শব্দটি তুলে দেয়া হয়। ছাত্রলীগের একটি অংশ এর বিরোধিতা করে। তাদের মধ্যে ছিলেন আজকের আইনজীবীদের অন্যতম নেতা শামসুল হক চৌধুরী। এদের অফিস ছিল ৯০ মোগলটুলি আর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অফিস ছিল ১৫৭ নবাবপুর রোড। এই ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন কামারুজ্জামান (শিক্ষক নেতা) আবদুল ওয়াদুদ পাটোয়ারী এবং পরবর্তীকালে আবদুল মোমিন তালুকদার, এমএ আউয়াল।

যারা শামসুল হক চৌধুরীর সাথে থেকে যান তাঁদের সাথে ছিলেন ফয়জুর রহমান সাহেব। যতদুর মনে আছে তিনি সরকারি চাকরি করতেন। যে কোনো উপায়েই হোক ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা প্রকল্প (ডিএনডি) এলাকায় কিছু জমি নিয়ে তিনি একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। এ বাড়ির নাম ছিল খামারবাড়ি। সেকালে ডিএনডি এলাকায় বসতবাড়ি করার কোনো অনুমতি দেয়া হতো না। পরিকল্পনা ছিল এটা হবে ঢাকার পার্শ্ববর্তী সবুজ বলয়। এ সবুজ বলয় থেকে ঢাকা শহরে শাকসবজি আসবে। সে পরিকল্পনা কিভাবে যে ভেস্তে গেল তা আজো আমি জানি না। আজ এই এলাকায় জমির দাম আকাশ ছোঁয়া। এর প্রতিযোগিতা আকাশছোঁয়া।

ফয়জুর রহমান সাহেব কী করে ওখানে সেকালে জমি পেয়েছিলেন আমার কাছে আদৌ স্পষ্ট নয়। তার এই খামারবাড়িতে আমাকে তিনি একদিন আমন্ত্রণ জানালেন। সাথে আর এক ভভদ্রলোক ছিলেন। তিনিও এখন লোকান্তরিত। ফয়জুর রহমান প্রস্তাব দিলেন-বাংলাদেশ স্বাধীন করতে হবে–তিনি সেই লক্ষ্যে সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদার করতে যাচ্ছেন। তখন একাধিক ব্যক্তি এবং গ্রুপ আমাদের কাছে আসত। যখন আমরা ছিলাম চটকল শিল্প এলাকায় একচ্ছত্র নেতা তখন শিল্পের অর্থই ছিল মূলত চটকল। তবুও আমি অবাক হলাম এর কথায়। ভাবলাম আমাদের পরীক্ষা করছে না তো? জানতে চাচ্ছে না তো আমাদের মনোভাব। আমরা বললাম–আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করতে রাজি। কিন্তু আগে বলতে হবে-এটা কোন বাংলাদেশ হবে। আর একটি পাকিস্তান হবে না তো? সবকিছুই একই থাকবে–আর পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশ নাম হবে–এ ধরনের সংগ্রামের জন্য জান দিতে রাজি নই। ফলে আমাদের সমালোচনা জমল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে তার সাথে কোনোদিন আমার আর দেখা হয়নি। শুধু মনে গেঁথে গিয়েছিল, তার ওই প্রস্তাব। প্রস্তাব হচ্ছে একটি খাঁটি বাঙালি হোটেল খোলার প্রস্তাব। দেশ স্বাধীন হলো। তিনি হোটেল খুললেন না। মুখপাত্র এবং স্পেকসম্যান নামে দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করলেন। পত্রিকা দুটি বাজারে কাটছে। একদিন তার পত্রিকায় শিরোনাম হলো–আমি যদি গ্রেফতার হয়ে যাই।’ শিরোনাম পড়ে অবাক হলাম। একদিকে গণকণ্ঠ। মওলানা ভাসানীর হক কথায় যেমন খুশি তেমন লিখছেন। অপরদিকে এ ধরনের পত্রিকার অজুহাত দিয়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যে ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টায় আমরা চিড়েচ্যাপ্টা। বুঝতে পারছি না মওলানা সাহেবই বা কী চাচ্ছেন এবং করছেন–তিনি শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো চূড়ান্ত আন্দোলনে যাবেন না। তা খুবই স্পষ্ট। অপরদিকে সর্বহারা পার্টির হরতাল সমর্থন করছেন। এ পরিস্থিতিতে সত্যি সত্যি কেনো রাজনীতিই বোধগম্য হচ্ছিল না। সরকার সবকিছুর মধ্যে ষড়যন্ত্র দেখছেন। আর অন্য সকলে ভাবছে বাংলাদেশ ভারতের তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।

বিতর্ক তুঙ্গে উঠল সচিবালয়ে। প্রধান বিবেচ্য ১৯৭১ সালে সরকারি কর্মচারিদের ভূমিকা। আমি দৈনিক বাংলায় লিখলাম আর ওপার-এপার সেপার তিন মিলে এই স্পর্শ। বিতর্ক হচ্ছে ১৯৭১ সালে কারা সংগ্রামে ছিল। কোলকাতায় মুজিবনগর সরকারের যারা কর্মচারী ছিলেন তারা দেশে ফিরে যেন কেউকেটা হয়ে গেলেন। তারা চেষ্টা করলেন ভালো ভালো পদ দখল করতে। যারা দেশে ছিলেন তারা বলেন, আমরা কম কিসে? আমরা বন্দুকের সামনে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছি। আমাদের জীবন ছিল প্রতিমুহূর্তে হাতের মুঠোয়। সেপার অর্থাৎ যারা পাকিস্তান ছিলেন–তাঁদের কথা হচ্ছে। আমরা আসতে পারিনি–এ জন্য আমরা দায়ী হবো কেন। আমরা পাকিস্তানে বদ্ধ জীবনযাপন করেছি। আমরা কম ভুগিনি। তাই আমাদের দোষী করা হবে কেন?

আমার মনে হয় সরকারি কর্মচারিদের সে বিতর্ক আজো শেষ হয়নি। এখন সংগ্রাম চলছে পদোন্নতি নিয়ে। সচিবালয়ে কোনো কাজ হোক বা না হোক, এ বিতর্কের শেষ নেই।

আর এ পরিস্থিতিতে সবচে’ বিপদে পড়ল সাংবাদিকরা। এ বিপদ সাংবাদিকদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। সকলেরই ধারণা ছিল সব ব্যাপারেই সাংবাদিকরা কথা বলবে। এ ঘটনার শুরু পাকিস্তান আমলে। পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক শূন্যতার জন্যে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের অনেক সময় রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। মানুষ তাকিয়ে থেকেছে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের দিকে। আর সে যুগে রাজনীতিতে এটি সাধারণ ঐকমত্য ছিল। সে ঐকমত্যের ভিত্তি ছিল বাঙালির স্বার্থের প্রশ্নে। এ স্বার্থের প্রশ্নে পত্রিকাগুলোর এবং সাংবাদিকদের মোটামুটি এক সূর ছিল। মানুষ তকালীন সংবাদপত্রে একটি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইঙ্গিত পেতো। দেশ স্বাধীন হবার পর পত্রিকার সে ভূমিকা থাকার কথা নয়, তা বলাই বাহুল্য। অপরদিকে অধিকাংশ পত্রিকার মালিকই তখন সরকার। তাই আমাদের করার তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু সাংবাদিকদের এ সমস্যা কাকে বোঝানো যাবে। তাই সকল ব্যাপারেই আমাদের জড়িয়ে পড়তে হতো। আর অপরদিকে সাংবাদিকরা এখন নিজেদের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। মনে হতো দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের নামে সকলেই স্বাধীন। বাড়ি দখল, গাড়ি দখলের মতো অনেক সংবাদপত্র দখল করলেন। কেউ আবার এসএলআর কাঁধে ঝুলিয়ে সংবাদপত্র অফিসে এসে নির্দেশ দিত। সে নির্দেশ পালন করা না হলে জীবন বাঁচা মুশকিল। ফলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল, দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে। সে স্বাধীনতা ভোগ করার সুযোগ নেই। একথা বলার অবকাশ নেই।

এ সময়ে সাংবাদিকদের একটি নিজস্ব আন্দোলনে জড়িয়ে পড়তে হয়। এই আন্দোলন ছিল তাদের বেতন ভাতা নির্ধারণের। পাকিস্তান আমলে সাংবাদিকদের বেতন ভাতা নির্ধারণের। পাকিস্তান আমলে সাংবাদিকদের বেতন ভাতা নির্ধারিত হয়েছিল ১৯৬০ সালে। বেতন ভাতা নির্ধারণ করেছিল সাংবাদিক বেতন বোর্ড। বলা হয়েছিল ১৯৬৫ সালে ষাট বছর কেটে গেলে সাংবাদিকদের জন্যে দ্বিতীয় বেতন বোর্ড গঠন করতে হবে। নতুন করে বেতন ভাতা নির্ধারণ করতে হবে। পাকিস্তান আমলে বেতন বোর্ড গঠনের জন্যে আন্দোলন হয়। পাকিস্তান সরকার দ্বিতীয় বেতন বোর্ড গঠন করেছিল। কিন্তু বেতন বোর্ড রোয়েদাদ ঘোষণা করার পূর্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। ফলে নতুন করে বেতন বোর্ড গঠনের প্রশ্ন দেখা দেয় এবং দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠে।

সাংবাদিকতা পেশায় বারবারই একটি প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্নটি হচ্ছে প্রুফ রিডাররা সাংবাদিক হলো কী করে। প্রথম বেতন বোর্ডের সংজ্ঞায় এরা তো সাংবাদিক হতে পারে না। এ প্রশ্নটি বিতর্কিত। পাকিস্তান আমলে এ প্রশ্নের সুরাহা হয়নি। সেকালের পূর্ব পাকিস্তানে এ প্রশ্নের একটি সমাধান হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে হয়নি।

ষাটের দশকে প্রথম দিকে আমি জেলে ছিলাম। ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক হিসেবে জেলে গিয়েছিলাম রাজনৈতিক কারণে। তখন ইউনিয়নের নেতা ছিলেন সালাউদ্দিন মোহাম্মদ। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মোজাম্মেল হক। তাদের সময় প্রুফ রিডারদের সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য পদ দেয়া হয়। সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার সুবাদে প্রুফ রিডাররা সাংবাদিক হয়ে যায়। অনেকে বলেন, নির্বাচনে জিতবার জন্যে প্রুফ রিডারদের ইউনিয়নের সদস্যপদ দেয়া হয়েছিল। সে বিতর্কে আমি যাব না। কারণ সবকিছুর দায়-দায়িত্ব আমার পূর্বসূরিদের। তবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এই সিদ্ধান্ত সহজে গ্রহণযোগ্য হলেও পশ্চিম পাকিস্তানে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যায়নি। পশ্চিম পাকিস্তানে একটি ভিন্ন সমস্যা ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ সংবাদপত্রের ভাষা হচ্ছে উর্দু। উর্দু পত্রিকায় প্রুফ রিডার নেই। আছে ক্যালিওগ্রাফিস্ট। প্রুফ রিডার ও ক্যালিওগ্রাফিস্ট সমার্থক নয়। সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তানের সাংবাদিক পূর্ব পাকিস্তানের এ প্রস্তাব মেনে নিলো না। একটি অসঙ্গতি থেকেই গেলো। অর্থাৎ পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নে দু’ধরনের সদস্য থেকে গেলো। পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের অনুমোদিত শাখা হলেও দু’ইউনিয়নের সদস্য পদের বিভিন্নতা ছিল। অবিভক্ত পাকিস্তানের সাংবাদিক ইউনিয়নের শেষ সম্মেলনে এ ব্যাপারে আমি একটি প্রস্তাব তুলেছিলাম।

সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো ১৯৮৮ সালে ইসলামাবাদে। আমি প্রস্তাব তুলেছিলাম–এ সম্মেলনে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রুফ রিডার ও ক্যালিওগ্রাফিস্টদের সদস্য পদ দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হোক। প্রস্তাব তুলবার সাথে সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের সাংবাদিকরা তীব্র প্রতিবাদ জানায়। আমি জানালাম-আমার প্রস্তাবের সমর্থক খোন্দকার গোলাম মুস্তফা–অর্থাৎ কে জি মুস্তফা। তখন কেজি মুস্তফা ছিলেন সাংবাদিকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। তিনি আমাকে সমর্থন করায় প্রস্তাব উত্থাপন করা গেলো। সিদ্ধান্ত হলো পরবর্তী সম্মেলনে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। অর্থাৎ যা ছিল তা-ই থেকে গেল। পশ্চিম পাকিস্তানে এক ধরনের এবং পূর্ব পাকিস্তানে অন্য ধরনের সদস্যই থেকে গেল। এ পরিস্থিতিতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বাংলাদেশের জন্মের পূর্বে প্রুফ রিডার ও ক্যালিওগ্রাফিস্টরা সাংবাদিক হিসেবে পরিগণিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে দৈনিক পাসবান নামে একটি মাত্র উর্দু দৈনিক ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই দৈনিকটি বন্ধ হয়ে যায়। সেই দৈনিকের ভবনই পরে বাংলার বাণী ভবন নামে পরিচিত। আমার বক্তব্য হচ্ছে প্রুফ রিডারদের সাংবাদিক হিসেবে গ্রহণ করা উচিত কি অনুচিত সে বিতর্ক আমাদের ক্ষেত্রে পাকিস্তান আমলেই শেষ হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে আমার কোনো দায়িত্ব ছিল না।

সাংবাদিক পেশায় দ্বিতীয় বিতর্ক হচ্ছে–সাংবাদিক বেতন বোর্ডের পরিবর্তে সংবাদপত্র কর্মচারীদের বেতন বোর্ড গঠন। এ ব্যাপারে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না তা সত্য নয়। আমি যতদূর জানি অন্য কোনো দেশে এ ধরনের বেতন বোর্ড নেই। সংবাদপত্র কর্মচারীদের জন্য বেতনের ভিন্ন ভিন্ন। সুপারিশ আছে। কিন্তু সাংবাদিকদের সাথে মিলিয়ে মিশিয়ে নয়। প্রেস শ্রমিক ও সাধারণ কর্মচারীদের বেতন ভাতার প্রশ্ন এসেছে সাংবাদিকদের পরবর্তীতে। একটির সাথে অপরটির কোনো সম্পর্ক নেই। আজকের পাকিস্তানেও নেই। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কেন হলো?

আমি আগেই বলেছি সাংবাদিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে এক সময় আমাদের বিপাকে পড়তে হয়েছিল। প্রেস শ্রমিক এবং সাধারণ কর্মচারীরা আমাদের আন্দোলনে অসহযোগিতা করতে থাকে। এ পটভূমিতে আমাদের পূর্বসূরিরা কথা দিয়েছিল, প্রেস শ্রমিক ও সাধারণ কর্মচারীদের বেতন বোর্ড গঠনের আন্দোলন হলে আমরা সহযোগিতা করবে। এ প্রশ্নটি সামনে আসে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। আমি তখন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। তখন পরিস্থিতিও পরিবর্তিত। অধিকাংশ পত্রিকা সরকারি পরচালনায় এবং আমার মনে হচ্ছিল–এক সময় সব পত্রিকার মালিক সরকারই হবে। এ সময় প্রেস শ্রমিক ফেডারেশনের একটি সম্মেলন হয়। সেই সম্মেলনে তারা প্রেস শ্রমিকদের জন্যে প্রথম বেতন বোর্ড গঠনের দাবি জানায়।

সাংবাদিকদের প্রথম বোর্ড গঠিত হয়েছিল ১৯৬০ সালে। সাংবাদিকদের আন্দোলন ছিল দ্বিতীয় বেতন বোর্ড গঠনের। প্রেস শ্রমিকদের সম্মেলনে আমি প্রধান অতিথি ছিলাম। আমি তাদের বললাম, বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন সফল হবে না। আপনারা আমাদের সাথেই থাকুন। পরবর্তীকালে সংবাদপত্রের সাধারণ কর্মচারীদের সাথেও আলাপ হলো। সাংবাদিক ইউনিয়নের বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়, সংবাদপত্রের সকল কর্মচারীর জন্য একটি বেতন বোর্ড গঠিত হবে। এই বেতন বোর্ডের সুপারিশ ভিন্ন ভিন্ন পূর্ব থাকবে এবং ভিন্নভাবে নির্ধারিত হবে সাংবাদিক প্রেস শ্রমিক ও সাধারণ কর্মচারীর বেতন ভাতা। তখন কোনো মহলেই এর প্রতিবাদ উত্থাপিত হয়নি। এই প্রস্তাব নিয়ে আমরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মজিবুর রহমানের সাথে দেখা করলাম। তিনি একমত হলেন না। তিনি বললেন, অন্যান্য প্রেসের কর্মচারীদের সাথে সংবাদপত্রের প্রেসের কর্মচারীদের কোনো মৌলিক তফাৎ নেই। সাধারণ কর্মচারী অর্থাৎ ম্যানেজার কেরানি বা টাইপিস্টেরও তফাৎ নেই অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীর সাথে। সুতরাং তারা সাংবাদিকদের বেতন বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত হবে কী করে। তিনি প্রস্তাব দিলেন সাংবাদিকদের সরকারি কর্মচারীদের জন্যে নির্ধারিত বেতন কাঠামো মেনে নিতে। তখন রব কমিশনের রিপোর্ট বের হয়েছে। রিপোর্টে সরকারি কর্মচারীদের জন্যে দশটি গ্রেড নির্ধারিত হয়েছে। শেখ সাহেব বললেন, সাংবাদিকরা এই দশ গ্রেডের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজস্ব অবস্থান নির্ণয় করে নিক। তাদের জন্য নতুন বেতন বোর্ড করার কোনো প্রয়োজন নেই।

আমি রাজি হলাম না। আমাদের যুক্তি সাংবাদিকতা ও সরকারি কর্মচারীদের পেশা এক নয়। তারা একই ধরনের কাজ করে না। তাদের সামাজিক অবস্থানও এক নয়। এই যুক্তির ভিত্তিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের জন্যে ভিন্ন বেতন বোর্ড গঠিত হয়। পাকিস্তানেও তাই ছিল। বাংলাদেশেও তাই হবে। এ ব্যাপারে আমাদের নতুন কিছু বলার নেই। শেখ সাহেব রাজি হলেন। আমি জানতাম তাঁকে রাজি হতে হবে। সাংবাদিকদের ব্যাপারে তিনি কোনোদিনই খুব কঠোর ছিলেন না। আর বেশিক্ষণ আমাদের সাথে বিতর্কেও যেতেন না। সুতরাং ১৯৭৪ সালে সংবাদপত্র কর্মচারীদের জন্যে বেতন বোর্ড গঠিত হলো। শেখ সাহেব বলেছিলেন, এ বেতন বোর্ড কার্যকর হতে বিলম্ব হবে। আপনারা কিন্তু ঠকবেন। আজ আমার মনে হচ্ছে শেখ সাহেবের কথা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারিনি। তখনো বুঝতে পারিনি, একদিন দেশের সমস্ত পত্রিকা বন্ধ করে মাত্র চারটি পত্রিকা রাখা হবে। দেশের সব দল ভেঙে দিয়ে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকবে। সব পত্রিকায়ই হবে সরকারি পত্রিকা এবং সরকারের মুখপাত্র। সাংবাদিকরা হবে সরকারি কর্মচারী এবং সে ঘটনা ঘটল সংবাদপত্র কর্মচারীদের জন্য বেতন বোর্ড গঠনের এক বছরের মধ্যেই।

জাতীয় সংসদে সংবাদপত্র কর্মচারী বেতন বোর্ড উপস্থাপিত হলো এবং গৃহীত হলো। তখন আমি কোনো সাংবাদিককে অখুশি হতে দেখিনি। কেউ টু শব্দটি করেননি। কেউ কোনো প্রশ্নও তোলেননি। সকলেই খুশি হয়েছিলেন। সকলের কাছে মনে হয়েছিল একটা বিজয়।

প্রশ্ন উঠেছিল বেতন বোর্ডের চেয়ারম্যান কে হবেন? পাকিস্তান আমলে চেয়ারম্যান ছিলেন একজন বিচারপতি। তাই একজন বিচারপতির অনুসন্ধান করা হলো। তখন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার পাকিস্তান থেকে ফিরেছেন। তিনি পাকিস্তান আমলের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। একাত্তরের যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটকা পড়ে যান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আফগানিস্তান হয়ে দেশে ফিরে আসেন। তখন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তাহের উদ্দিন ঠাকুর। তিনি প্রস্তাব দিলেন সাত্তার সাহেবকে চেয়ারম্যান করা হোক। এ ব্যাপারে আলোচনা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে। তিনি অনুমোদন করলেন। কিন্তু আবদুস সাত্তার সাহেব চেয়ারম্যান হলেও সেই বেতন বোর্ড কাজে আসেনি। তখন বুঝতে পারেনি, আওয়ামী লীগ সরকার আদৌ ওই বেতন বোর্ড কার্যকর করবে না। তাদের লক্ষ্য ছিল একদলীয় শাসন চালু করা। একদলীয় সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের সরকারি কর্মচারীতে পরিণত করা। এ পরিস্থিতি বুঝতে আমার দীর্ঘদিন লেগেছিল।

আজ অকপটে বলতে পারি, সেকালের রাজনীতি আমার কাছে পরিষ্কার ছিল না। পরিষ্কার ছিল না একটি প্রস্তুতিহীন যুদ্ধে কীভাবে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। ভারত সহযোগিতা করলেও পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রই প্রথমদিকে আমাদের সহযোগিতা করেনি। পাশের দেশ নেপাল শেষ দিন পর্যন্ত আমাদের বিরোধিতা করেছে। পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো আমাদের সহযোগিতা করলেও সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুরোপুরি আমাদের সমর্থনে আনতে দীর্ঘদিন চেষ্টা করতে হয়েছে। কারো কাছে স্পষ্ট ছিল না বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির চরিত্র কী হবে। কে তার নেতৃত্ব করবে। কোন শ্রেণি ক্ষমতায় আসবে। বাংলাদেশের দিকে তাকালে তখন এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া ছিল কষ্টকর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগ কোনোদিনই প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দাবি করে দলীয়ভাবে প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। আওয়ামী লীগের ছ’দফায় প্রচ্ছন্নভাবে স্বাধীনতা ইঙ্গিত থাকলেও স্বাধীনতার সুস্পষ্ট দাবি ছিল না। শুধুমাত্র সম্বল ছিল শেখ সাহেবের ৭ মার্চের জনসভার ঘোষণা। আমি যতদূর জানি শেখ সাহেবের ৬ দফা ঘোষণার পূর্বে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটিতে পেশ করা হয়নি এবং পাস করাও হয়নি। এ ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে আমার সাথে শেখ সাহেবের আলোচনা হয়েছে ছ’দফা ঘোষণার পর। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ ঘোষণা সঠিক হলো কি? কেউ জানল না অথচ আপনি ঘোষণা দিয়ে ফেললেন? শেখ সাহেব হাসলেন। আঁটি গোপালগঞ্জের ভাষায় বললেন, সময় সময় এমন করতে হয়। দেখেন না কী হয়। আমি তো বল ছুঁড়ে দিয়েছি। আমার কিন্তু তখনও মনে হয়নি, তিনি নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আওয়ামী লীগ ব্যতীত কোনো দলেরই এ ধরনের মানসিক প্রস্তুতিও তখন ছিল না। সদ্যগঠিত সর্বহারা পার্টি পূর্ববাংলা স্বাধীন করার স্লোগান দিচ্ছিল। আরো লক্ষণীয়, আওয়ামী লীগ ব্যতীত কোনো দলেরই এ ধরনের মানসিক প্রস্তুতিও তখন ছিল না। কিন্তু তারাও প্রকাশ্যে আসছিল না। আর আমি যতদূর জানি বাংলাদেশের মানচিত্র সম্বলিত জাতীয় পতাকাটি সর্বহারা পার্টিরই সৃষ্টি। ঝালকাঠির কোনো একটি এলাকায় ১৯৭০ সালে ১ জানুয়ারি উত্তোলন করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে কেউ ভিন্ন তথ্য দিতে পারলে আমি মেনে নিতে রাজি আছি।

এ পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ আসে। ৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করেন। সেকালের পূর্ব পাকিস্তান। অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে, রাতারাতি প্রায় সকল রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান শব্দটি কেটে বাংলাদেশ শব্দটি জুড়ে দিতে থাকে এবং সকলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দাবি জানাতে থাকে। আমার কাছে কোনোদিনই এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হয়নি। রাতারাতি দলের নাম পাল্টালেই জনগণের মন-মানসিকতা উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্যের সূত্রে পাওয়া। ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন হয় তা আমি বিশ্বাস করি না। আমি তাই আমার সেদিনের বন্ধুদের কাছে বলেছিলাম, এভাবে একটি দেশ স্বাধীন হয় না। খুব বেশি হলে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করা যায়। আমি বলেছি, ভারত আমাদের যুদ্ধে সহযোগিতা বা সাহায্য করবে এ ধারণা আমি করিনি। আমি সমাজতন্ত্রের রাজনীতি করি। এ রাজনীতি সম্পর্কে যতদূর লেখাপড়া করেছি তাতে আমাদের ধারণা এ ধরনের ঘটনা ঘটার কথা নয়। আমার কাছেও মনে হয় আমার ধারণা একান্তই সঠিক। এ মুহূর্তে সে বিতর্কে আমি যাব না।

তবে আমি আজো বলতে চাই, আমাদের একাত্তরের সংগ্রাম ছিল একেবারেই প্রস্তুতিহীন। চিন্তা ভাবনার স্বাধীনতার কথা থাকলেও মুহূর্তে সংগ্রাম শুরু হবে তা কেউই চিন্তা করেনি। ওই ধরনের চিন্তা-ভাবনা থাকলে প্রস্তুতি থাকত। আঘাত এলে প্রত্যাঘাতের ব্যবস্থা থাকতো। পলায়নই একমাত্র কাজ হতো না। অথচ একাত্তরে তাই ঘটল। সারা পৃথিবী জানল, সমঝোতার জন্যে আলোচনা হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা ভেঙে দেয়া হলো না। হামলা শুরু হলো। আন্দোলনের প্রথম নেতা তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে ধরা দিলেন। অন্যান্য নেতারা কেউ কোনো খবরই পেলেন না। নিজের উদ্যোগে পালাতে থাকলেন। আশ্রয় গ্রহণ করলেন পাকিস্তানের এক নম্বর বৈরী রাষ্ট্র ভারতে। সবাই ভারতে আশ্রয় নিলেন বা কোনো শর্তে ভারত আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল, সে প্রশ্নের জবাব আজো পরিষ্কার নয়। ১৯৭১ সালের মে মাসে আগরতলা গিয়েছিলাম। ত্রিপুরার এককালীন মুখ্যমন্ত্রী সুখময় সেনগুপ্তকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা আমাদের ঢুকতে দিলেন কেন? আমরা তো আপনাদের এক নম্বর শত্রু। এমন হতে পারে, পাকিস্তানে হিন্দুরা নিগৃহীত হচ্ছে এজন্যই হিন্দুদের ঢুকতে দিচ্ছেন। কিন্তু মুসলমানদের ঢুকতে দিচ্ছেন কেন! কেন ঢুকতে দিচ্ছেন রাজনীতিকদের। এটা কি মানবতা, না অন্য কিছু? সুখময় বাবু বলেছিলেন–আমাকে নয়, নয়াদিল্লিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীকে জিজ্ঞেস করুন। প্রশ্ন উঠতে পারে এতদিন পরে এ কথাগুলো লিখছি কেন? আমার লেখার লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের জন্মের সময়কার নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তুলে ধরা। আমি বলতে চাচ্ছি কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া, জাতীয় ভিত্তিতে কোনো ঐকমত্য ছাড়া এবং আদৌ কোনো প্রস্তুতি ছাড়া একটি যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। সে যুদ্ধে আমরা যেমনভাবে পেরেছি–তেমনভাবে ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগতভাবে অংশগ্রহণ করেছি। সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনামাফিক এ যুদ্ধে কেউ যায়নি। সাধারণ মানুষের কাছে একটি কথাই ছিল মুখ্য। সে কথাটি হচ্ছে–যুদ্ধে জয়লাভ করতে না পারলে বাড়ি ফেরা যাবে না। মা-বোনের ইজ্জত থাকবে না। বাঁচানো যাবে না স্বজনকে। আমি বলতে চাচ্ছি যুদ্ধের হাল এমন হলে বিদেশিরা সাহায্য করতে আসবে কোন ভিত্তিতে। এ যুদ্ধের কোনো নেতা নেই, এ যুদ্ধ পরিচালনার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ যুদ্ধে কোনো কিছুই সংগঠিত নেই। পরিস্থিতি এমন না হলে কোনো দেশ কি সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসে? এ যুদ্ধের একটি মাত্র ইতিবাচক দিক ছিল বাঙালিয়ানা। পূর্ব দিকে ত্রিপুরার বাঙালি, পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি। বাঙালিয়ানার জন্যেই প্রাথমিকভাবে তারা আমাদের কোলে টেনে নিয়েছিল। মনে হয় আমাদের গবেষকরা এখনো ভাবতে পারেনি, আমাদের পাশে বিহার কিংবা পাঞ্জাব থাকলে আমাদের সংগ্রামের রূপ কী হতো!

এ পরিস্থিতিতে আমাদের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় বিশ্ব জনমতের চাপে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম। অনেকে বলতে পারেন আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকাই ছিল নিয়ামক শক্তি। আমরা এই যুদ্ধের নেতা। একথা সর্বৈব সত্য। কিন্তু তার চেয়ে বড় সত্য হচ্ছে–আমাদের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। শেষ দিন পর্যন্ত নেতৃত্বের জন্যে আমরা কোন্দল করেছি। কেউ কেউ ষড়যন্ত্র করেছি পাকিস্তানে ফিরে যেতে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দলবাজি হয়েছে। মুজিববাহিনী হয়েছে বামপন্থীদের শেষ করার জন্যে। স্বাধীন বাংলাদেশে তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্ব নিরাপদ নয়। অথচ আমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। আমরা সোনার বাংলা গঠনের জন্য যুদ্ধ করেছি। কিন্তু সোনার পাথরবাটি হয় না। তাই সোনার বাংলাও হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। এই ঘটনা সঠিকভাবে অনুধাবন করিনি। কখনো মনে হয়নি যে, বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে কতগুলো শকুনী ও গৃধিণীর জন্যে। সবাই সবকিছু পেতে চায়। সবাই বাড়ি, গাড়ি, নারী দখল করতে চায়। এ পরিস্থিতি বুঝতে পারলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারতাম যে, বেতন বোর্ড আন্দোলনে জিতেছি। সংবাদপত্রের কর্মচারীদের জন্যে বেতন বোর্ড গঠিত হয়েছে। সংবাদপত্রের কর্মচারীরা এবার সচ্ছল জীবন যাপন করতে পারবে। কিন্তু তা হয়নি। দেশের রাজনীতি তখন ভিন্ন মোড় নিয়েছে।

সংবাদপত্র কর্মচারীদের বেতন বোর্ড গঠনের আগেই আমাদের দল-শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল নিয়ে একটি ঘটনা ঘটে যায়। আমাদের এক বন্ধুর বাড়িতে পুলিশ হানা দেয়। যে বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার হয়ে যায় আমাদের বন্ধুর পত্নী। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় আমার বন্ধুর পরিবারের বিরুদ্ধে। কিছুদিন পর ওই পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট আমাদের আরেক বন্ধু গ্রেফতার হয়ে যায়। তিনি আমাদের দলে শ্রমিক ফ্রন্টের সাথে জড়িত ছিলেন।

আমি এ খবরে শঙ্কিত হয়ে যাই। তখন রক্ষীবাহিনীর নির্যাতন চলছে সারাদেশে। রক্ষীবাহিনীর কবলে পড়লে অনেকেই ফিরে আসে না। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম আমার বন্ধুর মধ্যে কেউ গ্রেফতার হলে হয়তো তারা ফিরে আসবে না। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই দেখা করা নিয়েও আমার মনে দ্বন্দ্ব ছিল। আমি তখন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। আমি দৈনিক বাংলায় অনিকেত নামে সরকার বিরোধী কড়া কড়া উপসম্পাদকীয় লিখছি। আমি যদি অস্ত্র মামলার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাই তাহলে আমার সমালোচনা হবেই। এর পরেও আমি গোপালগঞ্জের লোক। টুঙ্গীপাড়া স্কুলের ছাত্র। আমাদের পরিবারের সাথে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের দীর্ঘদিন সম্পর্কের কথা সকলের জানা। এ পরিস্থিতিতে আমার সমালোচনা হবেই। অন্তত সাংবাদিক বন্ধুরা বলবে, সাংবাদিকদের দাবি-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে আমি নিজের দলীয় স্বার্থে সরকারের সাথে আপোষ করেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *