২. যাদের সাথে জেলে ছিলাম

যাদের সাথে জেলে ছিলাম তাদের মধ্যে তিনজনের সাথে এক সময় নৈকট্য গড়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে একজন আনোয়ার। গরীবের ছেলে। দৌলতপুর কলেজের ছাত্র। আমাদের সাথে বেশ কিছুদিন ছিল ঢাকা জেলে। মুক্তি পেয়ে চলে যায় খুলনায়। আবার গ্রেফতার হয়। ১৯৫০ সালে ২৪ জানুয়ারি রাজশাহী জেলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। আনোয়ার মারা যায়।

১৯৪৯ সালে আরো দু’জন রাজবন্দি আসে আমাদের এলাকায়। একজন মুন্সিগঞ্জের সামসুদ্দিন আহমেদ। অপরজন এমএ আউয়াল। পরবর্তীকালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। ইত্তেফাকের সহকারি সম্পাদক ছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর আদমজী জুট মিলের প্রশাসক হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে যোগ দিয়েছিলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদে।

রাজনীতিতে সামসুদ্দিন আহমেদের জীবন বৈচিত্র্যপূর্ণ। তিনি এককালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। আবার ঢাকা জেলা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এটা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির এক ধরনের কৌশল। তাদের কৌশল ছিল অন্যান্যদের প্রতিষ্ঠান দখল করা। যে প্রচেষ্টা তারা করেছে পাকিস্তান আমলে। ন্যাপ ও আওয়ামী লীগে নিজস্ব লোক ঢুকিয়ে দিয়েছে। লক্ষ করা গেছে, এ কৌশল কাজে আসেনি। এ কৌশল ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার জর্জ ডিমিট্টভের পপুলার ফ্রন্ট তত্তের পরিণতি।

এই উপমহাদেশে এই তত্ত্বের পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। কমিউনিস্ট পার্টি থেকে যারা কংগ্রেস বা মুসলিম লীগে ঢুকেছিল তারা কেউ আর নিজ দলে ফিরে আসতে পারেনি। নিজ দলে ফিরে এসেও শেষ রক্ষা হয়নি। কমিউনিস্ট পার্টির যে সদস্য একালে আওয়ামী লীগ, ভাসানী ন্যাপ বা মোজাফফর ন্যাপে ঢুকেছে তারাই সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে।

সামসুদ্দিনের ক্ষেত্রে প্রায় তেমনটি ঘটেছিল। ঢাকা জেলা মুসলিম লীগের সম্পাদক হিসেবে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে তাঁর বিশেষ গুরুত্ব ছিল। মুসলিম লীগের রাজনীতিতে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো তরফের আস্থা অর্জন করতে পারেননি।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর সামসুদ্দিন আহমেদ খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলেন। সব আন্দোলনেই তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু এক সময় তিনি দলের আস্থা হারিয়ে ফেলেন। কমিউনিস্ট পার্টির সন্দেহ হয় যে, সামসুদ্দিন আহমেদ পুলিশের এজেন্ট হয়ে গেছেন। সুতরাং তাঁকে এড়াতে হবে। সার্কুলার চলে গেল দলের সব সদস্যদের কাছে। সামসুদ্দিনের ছোট ভাই সফিউদ্দিন আহমেদ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। সেও সার্কুলার পেল। আর দুই ভাই এক সাথে জেলে এল আমাদের ওয়ার্ডে।

আমি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য নই। ফলে সামসুদ্দিন আহমেদের আড্ডা হলো আমার এলাকায়। বড় দুঃখ করতেন তিনি। পার্টির জন্য তিনি জিন্নাহর সাথে টক্কর ধরেছেন। সকলের বিরাগভাজন হয়েছেন। সেই পার্টিই এখন তাকে বিশ্বাস করে না। এক গভীর বিক্ষোভ ছিল সামসুদ্দিন আহমেদের মনে। শেষ পর্যন্ত সামসুদ্দিন আহমেদের অবস্থান হলো আবার সেই মুসিলম লীগের সাথে। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। এককালের মুসলিম লীগের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের সাথে পাকিস্তান চলে গেছেন। পাকিস্তানের নূরুল আমীন ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। সামসুদ্দিন আহমেদ ছিলেন তার একান্ত সচিব। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ঢাকা এসেছিলেন। আমার সাথে আর দেখা হয়নি।

১৯৪৯ সাল। দেখলাম ঢাকা জেলে আমাদের ওয়ার্ডে এক তরুণ এল জেল পুলিশের সাথে। তার সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষার অনেক বইপত্র। শুনলাম তরুণের নাম এমএ আউয়াল। ভাবলাম এই বয়সে ভভদ্রলোক প্রবেশিকা পরীক্ষা দিচ্ছেন–ব্যাপারটি কী!

এমএ আউয়ালের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব থানার আশ্বিনপুর। শৈশবে তার বাবা মারা যান। চলে যান কলকাতায়। কলকাতায় খিদিরপুর ডক এলাকায় তাঁর পরিচয় হয় ড, মালেকের সাথে। সেখানে তিনি শ্রমিক রাজনীতি শুরু করেন এবং শুরু করেন লেখালেখি। আমি পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথমদিকে এমএ আউয়ালের লেখা পড়েছি। আরএসপির সাপ্তাহিক গণবার্তায় ও কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক স্বাধীনতায়। সেকালে এই দলগুলো মুসলিম ছেলেদের নিয়ে খুব টানা-হেঁচড়া করত। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী দলগুলোতে তখন মুসলমান ছেলেদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। ফলে এদের দলে টানার একটা উদ্যোগ ছিল সকল দলে। সেভাবেই এমএ আউয়াল গুরুত্বপূর্ণ হয়েছিলেন। প্রবেশিকার চৌকাঠ পার হয়েই।

যে ছাত্রটি তখন প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেনি, তখন কিন্তু সে খ্যাতি অর্জন করেছিল ছাত্রনেতা হিসাবে। পূর্ববাংলায় ৯টি জেলায় তার প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত প্রবেশ নিষিদ্ধ হলো ঢাকা জেলায়। তাই জেলখানায় আসতে হলো। তার কথায়, লেখাপড়া করার তেমন ইচ্ছা তার ছিল না। কিন্তু শিক্ষা বোর্ডের তকালীন চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ সাহেব নাকি তাকে উৎসাহিত করেছেন লেখাপড়ার জন্য এবং কথা দিয়েছেন বোর্ডের অনুমতি তাকে দেয়া হবে। তার বইপত্র সবই সংগ্রহ করে দেয়া হলো। সেই প্রতিশ্রুতিতেই তার পরীক্ষা দেবার বাসনা।

তবে এই সামসুদ্দিন সাহেব কিংবা আউয়াল সাহেব কেউই দীর্ঘদিন জেলখানায় থাকেননি। কেউ এসেছেন। কেউ গিয়েছেন। শুধুমাত্র আমরা কিছু লোক জেলখানায় রয়ে গেছি বছরের পর বছর।

জেলখানায় আউয়াল সাহেবের সাথে আমার দীর্ঘ আলাপ হয়েছে। আমি তখন আরএসপি’র ছাত্র ফ্রন্ট, পাকিস্তান ছাত্র এসোসিয়েশনের সদস্য। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে পূর্ব বাংলার নিখিল বঙ্গ ছাত্র কংগ্রেসের নাম পাল্টানা হয়। পাল্টিয়ে করা হয় পাকিস্তান ছাত্র এসোসিয়েশন। আউয়ালের প্রস্তাব ছিল এক সাথে ছাত্রলীগ করবার। আমি বললাম ছাত্রলীগ সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। আউয়াল বলল–কালক্রমে এই সংগঠনের নাম থেকে মুসলিম’ শব্দ তুলে দেয়া হবে। পরবর্তীতে ১৯৫১ সালের সেপ্টেম্বরে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের মুসলিম শব্দটি তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। অপেক্ষায় ছিল কাউন্সিল অধিবেশনে এই সিদ্ধান্ত অনুমোদনের। কিন্তু এর মধ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এসে যায়। তাই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর ছাত্র আন্দোলনের একটি নতুন ঘটনা ঘটে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়। এই সংগঠনের উদ্যোক্তারা জানান, দেশে কোনো অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান না থাকায় ভাষা আন্দোলনের আলোকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত হয়েছে। কিন্তু এই বক্তব্য ইতিহাসের দৃষ্টিতে সঠিক নয়। কারণ ইতিপূর্বেই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ অসাম্প্রদায়িক হবার ঘোষণা দিয়েছে। অপরদিকে এ কথাও সত্য যে, যারা এককালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেছিলেন তাঁদের অনেক নেতাই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন গঠনের নেতৃত্ব দিলেন। সুতং প্রশ্নটি নীতিগত বা আদর্শগত নয়। কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র ফ্রন্টছাত্র ফেডারেশনের নামে তখন কাজ করতে পারছিল না। তাই এককভাবে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে একটি ছাত্রফ্রন্ট প্রয়োজন। কারণ পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের হাতে চলে গিয়েছে। এই পটভূমিতেই ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম হয়। যারা বলেন, একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের তাগিদেই ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত হয়েছিল তারা জেনেশুনে বা অজ্ঞতাবশত এই ব্যাখ্যা দেন।

যদিও এ ঘটনা আমি অনেক পরে জেনেছি। এমএ আউয়ালের কথা এল বলে প্রাসঙ্গিকভাবে এ কথাগুলো উল্লেখ করলাম। ১৯৫৩ সালে আমাদের দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা ছাত্রলীগে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিই। সে কাহিনিও অনেক দীর্ঘ।

এমএ আউয়াল দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন না। সামসুদ্দিন আহমেদও তাড়াতাড়ি মুক্তি পেয়ে যান। ভাষা আন্দোলনের সময় আউয়ালের নামে আবার হুলিয়া জারি করা হয়। ভাষা আন্দোলনে আউয়াল গ্রেফতার হয়েছিল কিনা মনে নেই। তবে জেলখানায় তার সাথে আমার আর দেখা হয়নি।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যারা জেলে এসেছিলেন আস্তে আস্তে ‘ সবাই ছাড়া পেতে থাকেন। তখন জেলখানায় আমার শরীর খুবই খারাপ। সিভিল সার্জন লিখলেন, এই রাজবন্দিকে বাইরে ছেড়ে দেয়া না হলে বেশিদিন বাঁচবে না। সুতরাং তাকে মুক্তি দেয়া যায়।

আমার মুক্তির জন্য তদ্বির করছিলেন দেবেন দা। অর্থাৎ বরিশালের দেবেন ঘোষ। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি কুমিল্লার ধীরেন দত্তের সাথে আলোচনা করেন আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কে। একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে দেখা করেন পূর্ববাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনের সাথে। নূরুল আমীন সিভিল সার্জনকে রিপোর্ট দিতে বলেন এবং রিপোর্টের ভিত্তিতেই আমার মুক্তির নির্দেশ দেয়া হয়।

এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। ভাবতাম, যতদিন পাকিস্তান আছে ততদিন জেলে থাকতে হবে। তখন ঢাকা জেলের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন নাসির উদ্দিন সরকার। খ্যাতনামা চিকিৎসক। তিনি আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। একদিন তিনি বললেন, এদেশে আপনার কোনো চিকিৎসা হবে না। মুক্তি পেয়ে কলকাতায় যান। হয়তো কলকাতার ট্রপিক্যাল মেডিসিন হাসপাতালে আপনার চিকিৎসা হতে পারে। কিন্তু ডাক্তার সাহেব জানতেন না, আমি মুক্তি পেলেই কলকাতায় যেতে পারব তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

তখন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পাসপোর্ট-ভিসা চালু হয়েছে। পাকিস্তান সরকার এ কাজটি করেছেন ভাষা আন্দোলনের পর। পাসপোর্ট-ভিসা চালু হবার আগে যে কেউ যখন খুশি ভারত যেতে পারত। ভারত থেকে পাকিস্তান আসতে পারত। পাকিস্তান সরকারের সন্দেহ হলো এই অবাধ যাতায়াতের সুযোগ নিয়ে ওপার থেকে দুস্কৃতিকারীরা আসছে। তারাই আন্দোলনে ইন্ধন যোগাচ্ছে। দৈনিক মর্নিং নিউজ খবর ছাপাল, নারায়ণগঞ্জে হাজার হাজার ধুতিপরা হিন্দু ভাষা আন্দোলনের পক্ষে মিছিল করছে। সুতরাং অবাধ যাতায়াত বন্ধ করতে হবে। পাসপোর্ট-ভিসা চালু করতে হবে। কিন্তু কাজটি সহজ হলো না। তখন ভারত থেকে আসা অসংখ্য চাকরিজীবী পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। তাদেরও বাড়িতে যাতায়াত করতে হয়। তারা হুমকি দিলো পাসপোর্ট-ভিসা চালু হলে দল বেঁধে তারা ভারতে চলে যাবে। এবার নূরুল আমীন ভিন্ন প্রস্তাব দিলেন। বললেন, আপাতত পাসপোর্ট-ভিসা চালু হচ্ছে না। পরবর্তীকালে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। কিন্তু রাজি হলেন না পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধান রায়। তিনি পাসপোর্ট ও ভিসা চালুর পক্ষে নন। তিনি বললেন, তবে এ নিয়ে বারবার বিতর্ক করা যাবে না। পাসপোর্ট-ভিসা চালু করতে হলে এখনি করতে হবে। নইলে কোনোদিনই নয়। পাকিস্তান সরকার পাসপোর্ট-ভিসা চালু করতে বাধ্য হলো।

ঠিক এই সময় একদিন দুপুরের দিকে আমাকে জেল অফিসে ডাকা হলো। ভাবলাম নিশ্চয়ই অন্য জেলে পাঠিয়ে দেয়া হবে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এমনিতেই শরীর খারাপ। অন্য জেলে গেলে ঢোকাই মুশকিল হবে। ঢাকা জেল কর্তৃপক্ষের কাছে আমি কোনোদিন প্রিয়ভাজন ছিলাম না। আমার সাথে বাঙালি, বিহারি সকল জেল পুলিশেরই ভালো সম্পর্ক ছিল। জেলের খবরাখবর ছিল আমার নখদর্পণে। বাইরের খবর আদান-প্রদান করতে পারতাম অতি সহজেই। তাই ভয় ছিল হয়তো আমাকে অন্যত্র পাঠানো হচ্ছে। জেল গেটে নিয়ে ঠিক এমন কথাই আমাকে বলা হয়। বলা হলো–এত খবর আপনি রাখেন কী করে? তবে আপনাকে অন্য জেলে পাঠানো হচ্ছে না। বলা হলো, অন্য জেলে বদলি নয়–আপনার মুক্তির নির্দেশ এসেছে। আমি চমকে গেলাম। আমি এখন কোথায় যাব?

জেল গেটে ডেপুটি জেলার বললেন, আপনি রিলিজড। রিলিজ? আমি জিজ্ঞাসা করলাম, নিঃশর্ত? নইলে কিন্তু আমি জেলের বাইরে যাব না। ডেপুটি জেলার জামান সাহেব (বৃহত্তর ফরিদপুরের এ যাবতকালীন সর্বকনিষ্ঠ ডেপুটি জেলার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কারাগারসমূহের মহাধ্যক্ষ হয়েছিলেন) হাসলেন। বললেন, এবার আপনার নিঃশর্ত মুক্তি। কিন্তু কত টাকা চান? কত টাকা আপনার বাড়ি যেতে লাগবে? পাঁচ টাকা, দশ টাকা, পনের টাকা।

ডেপুটি জেলারের কথা শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বললাম, এক পয়সাও না। আপনার মতো অনেক ডেপুটি জেলার আমাদের বাড়িতে থেকে মানুষ হয়েছে। তাই আপনার বুঝবার কথা নয়, আমার কত টাকা প্রয়োজন হবে।

পরিবেশ খারাপ হতে থাকলে হস্তক্ষেপ করলেন একজন পুলিশ অফিসার। তাকে আমি চিনি না। তিনি বললেন, ডেপুটি জেলার সাহেব, নির্মল সেনকে নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না। তিনি অসুস্থ। তিনি কোথায় যাবেন কেউ জানে না। তাঁর বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া। পড়েছেন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে। রাজনৈতিক অনেক বন্ধু আছেন ঢাকায়। উচ্চ মহল থেকে তাঁর সম্পর্কে আমাদেরকে বিশেষভাবে বলে দেয়া হয়েছে। বলে দেয়া হয়েছে–যেখানে তিনি যেতে চান সেখানে তাঁকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়ে ঢাকায় এসে আমাদের রিপোর্ট করতে হবে। তাই সব দায়িত্ব আমাদের। এমনকি তিনি দেশান্তরী হতে চাইলেও সে ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে।

পুলিশ কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির হাত থেকে বের হলাম বেলা দুটার দিকে। সবকিছুই তখন নতুন মনে হচ্ছে। প্রথম ঢাকা এসেছিলাম ১৯৩৯ সালে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হবার পর বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার ঢাকা এসেছিলাম ১৯৪৮ সালের ময়মনসিংহ সম্মেলনে যাবার পথে। সেটা ছিল জানুয়ারি মাস। ১৯৪৮ সালের অক্টোবরেই ঢাকা জেলে এলাম রাজবন্দি হিসেবে। এই ৪ বছরে ঢাকা জেল থেকে মাত্র একবার বের হয়েছি। ডাক্তার দেখাতে অনেক পুলিশ দিয়ে আমাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। তারপর আর বাইরের বোদ দেখার সুযোগ হয়নি।

১৯৫২ সালের শেষে মুক্তি পেয়ে মনে হলো আমি কোথায় যাব? ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর দল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বাইরে কে কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জানি না। শুনেছিলাম মোজাম্মেল দা কলকাতায় গিয়েছিলেন। সেখানে আরএসপি’র মুখপত্র দৈনিক গণবার্তার প্রধান বার্তা পরিবেশক হয়েছিলেন। শুনেছি পাসপোর্ট-ভিসা চালু হবার আগেই তিনি দেশে ফিরে এসেছেন। ঢাকার একটি সংবাদপত্রে কাজ করছেন। খালেক দাও নাকি ঢাকায়। তিনিও নাকি সংবাদপত্রে কাজ করেন। দলের অন্যতম নেতা শ্রমিক নেতা নেপাল সাহা দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন। মুক্তি পেয়ে কোথায় আছেন জানি না। শুনেছি রুহুল আমীন কায়সার অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গেছেন। শুনেছি আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকায় আছেন। ঢাকা বেতারে কাজ করছেন আবুল কালাম শামসুদ্দিন। যিনি শামসুদ্দিন আবুল কালাম নামে পরিচিত।

আমার এক মামা ছিলেন মালিটোলায়। বাংলাবাজারে বইয়ের দোকান ছিল। শিক্ষকতা করতেন প্রিয়নাথ স্কুলে (বর্তমান নবাবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে)। তিনি এককভাবে ঢাকা বোর্ডের বই সরবরাহ করতেন। ১৯৫০ সালের দাঙ্গায় তিনি সব কিছু হারিয়েছেন। সবকিছু হারিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেছেন। এক মেসোমশাইর বাসা ছিল গোয়ালনগরে। তিনি লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলের অন্যতম মালিক ছিলেন। তিনিও দেশান্তরী দেশ বিভাগের পর।

জেলখানার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম আমি কোথায় যাব। বাড়িতে কে আছে তাও জানি না। মা দেশান্তরী হয়েছে অনেকদিন আগে। দেশে তিন কাকা আছেন। একজন কোটালীপাড়ায়। অপর দু’জন টুঙ্গীপাড়ার পাটগাতীতে। শুনেছি ছোট কাকা পাসপোর্ট-ভিসা চালু হবার আগেই চলে গেছেন ভারতে। এছাড়া ঢাকা থেকে বাড়ি যেতে হলেও অনেক ঝামেলা। স্টিমারে বরিশাল। বরিশাল থেকে খুলনাগামী স্টিমারে পাটগাতী স্টেশনে নামতে হবে। তারপর ঘণ্টা তিনেক নৌকায়। সে পথের কী হাল তাও জানি না।

হঠাৎ মনে এল ঢাকার মোহন দাস রোডের কথা। যতদূর মনে ছিল হেমেন দাস রোডে অগ্নিযুগের বিপ্লবী স্বদেশ নাগের একটি বাড়ি আছে। স্বদেশ নাগ এককালে আরএসপি করতেন। পরবর্তীকালে জয়প্রকাশের সমাজতন্ত্রী দলে যোগ দেন। সে যুগের বিপ্লবীরা ঢাকা এলে স্বদেশ নাগের বাড়িতেই থাকতেন। এখানে উঠতেন মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, ধীরেন দত্ত, ফণী মজুমদার এবং দেবেন ঘোষ প্রমুখ। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম হেমেন দাস রোডেই যাব।

হেমেন দাস রোডে স্বদেশ বাবুর সাথে দেখা হলো। তিনি খুব খুশি হলেন বলে মনে হলো না। কারণ তখন সারা দেশে ভয়ের রাজত্ব। মুসলিম লীগের ত্রাসের শেষ ছিল না। বিশেষ করে হিন্দু ছিল ভীষণভাবে শঙ্কিত। তারপর আমি রাজবন্দি এবং ধর্মের বিচারে মুসলমান নই।

স্বদেশ বাবু খুব দুঃখ সুলেন। বললেন, এখানে থাকো। চেষ্টা করে দেখো কোনো বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা যায় কিনা। তোমার বাড়ি যাবার একটা ব্যবস্থা হবেই। তবে একবার শামসুদ্দিনের কাছে যাও। শামসুদ্দিন রেডিওতে চাকরি করে। ঢাকা জেলের কাছেই রেডিও অফিস। শামসুদ্দিন তোমাকে নিশ্চয়ই খবর দিতে পারবে।

বিকেলের দিকে আমি রেডিও অফিসে গেলাম। আমার সাথে গোয়েন্দা বাহিনীর দু’জন লোক। ওরা কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। আমার নাম করে অফিসে স্লিপ পাঠালাম। শামসুদ্দিন দা যেন কেমন হয়ে গেলেন। বললেন, তুই কোথায় থেকে এলি? কোথায় ছিলি এতদিন? আমার যেন মনে হলো শামসুদ্দিন দা কোনো খবরই রাখেন না।

শামসুদ্দিন দা’র সাথে দেখা হয়নি দীর্ঘদিন। তার সাথে পরিচয় বরিশালে ছাত্রজীবনে। তিনি তখন আরএসপি’র ছাত্র ফ্রন্টের অন্যতম নেতা। কবিতা লেখেন। গল্প লেখেন। শামসুদ্দিন দা তখন বিশেষ আকর্ষণ। ছাত্রজীবনেই তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘শাহেব-বানু’ প্রকাশিত হয়েছে। লিখেছেন ছোটদের জন্য উপন্যাস ‘কাকলী মুখর। মুসলিম লীগের তখন প্রচণ্ড প্রতাপ। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের ছাত্র আবুল কালাম শামসুদ্দিন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেন না। তিনি নিখিল বঙ্গ ছাত্র কংগ্রেসের অন্যতম নেতা। শামসুদ্দিন দা ছিলেন আমাদের কাছে একটি গল্প।

দেশভাগের আগে শামসুদ্দিন দা ব্রজমোহন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। যতদূর মনে আছে তিনি এমএ পড়ার জন্য কলকাতা যান। পাকিস্তান সৃষ্টি হবার সময় শামসুদ্দিন দা বললেন–তিনি পাকিস্তানে থাকবেন না। তাঁর কথায় পাকিস্তান হবে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র। ঐ রাষ্ট্রে তিনি থাকবেন না। তাই চলে গেলেন কলকাতায়। ১৯৪৮ সালের ২৯ মার্চ আমি কলকাতা যাই একটি পরিবারকে পৌঁছে দিতে। কলকাতা গিয়ে শামসুদ্দিন দা’র খোঁজ নিলাম। তিনি থাকেন পার্ক সার্কাসের কংগ্রেস একজিবিশন রো-তে। তাকে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। লোয়ার সার্কুলার রোডে আরএসপি’র রাজ্য দফতরে গেলাম। তখন সেখানে থাকতেন ড. অরবিন্দ পোদ্দার। তখন ‘ক্রান্তি’ নামে আরএসপির একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা বের হতো। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ড. নীহার রায় ও ত্রিদিব চৌধুরী। তবে পত্রিকাটির সব কাজ চালাতেন ড, অরবিন্দ পোদ্দার। অরবিন্দ পোদ্দারকে জিজ্ঞেস করলাম শামসুদ্দিন দা’র কথা। তিনি বললেন, আপনার দাদা এখন বড্ড ব্যস্ত। খুব লেখালেখি করছেন। তাঁকে। এখন খুঁজে পাওয়া ভার। শামসুদ্দিন দা’র সাথে দেখা না করেই বরিশাল ফিলাম। তার কয়েক মাস পর গ্রেফতার হলাম। এই দীর্ঘদিন তেমন খবর রাখিনি। শুনেছিলাম শামসুদ্দিন দা পূর্ববাংলায় ফিরে রেডিওতে কাজ নিয়েছেন। আর তাঁকে নিয়ে একটি ভিন্ন ধরনের বিতর্ক চলছে শিল্পী-সাহিত্যিক মহলে।

তবে এ বিতর্কের জন্মসূত্র রাজনীতি। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে মতানৈক্য ছিল আরএসপি’র। এ ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টির বন্ধুরা দুঃখজনকভাবে অসহনশীল। আরএসপি’র কাউকে তারা সহ্য করতে পারতেন না। আরএসপিকে কোণঠাসা করতে মুসলিম লীগ, পরবর্তীকালে আওয়ামী মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ এবং ন্যাপের সাথেও তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আবার কমিউনিস্ট বন্ধুদের কথায় তারাই একমাত্র সাচ্চা সমাজতন্ত্রী। যারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধিতা করবে তারা নিশ্চয়ই মার্কিনপন্থী। আরএসপি অন্ধভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের নীতি অনুসরণের পক্ষপাতি ছিল না এবং এই মৌলিক পার্থক্যের জন্যই আরএসপি’র জন্ম হয়েছিল। সুতরাং আরএসপিকে ঠেকানো ছিল যেন কমিউনিস্ট পার্টির বন্ধুদের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের অংশ। তার চরম শিকার হতে হয়েছিল শামসুদ্দিন আবুল কালাম ও আবদুল গাফফার চৌধুরীকে।

এই দুজনের সাথে আমি সব প্রশ্নে একমত ছিলাম, তাও নয়। কিন্তু এদেশে ডিগবাজির ইতিহাসও কম নয়। যারা পাকিস্তান আমলে আদমজী পুরস্কার পাবার জন্য দৌড়-ঝাঁপ করেছেন, পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে তকমা পেয়ে গলায় ঝুলিয়ে বুক ফুলিয়ে হেঁটেছেন তারা কিন্তু আজো প্রগতিবাদী। তাঁরা সবচেয়ে বড় মুক্তিযোদ্ধা এবং বাঙালি। কিন্তু আজো আবদুল গাফফার চৌধুরী কোনো নিবন্ধ লিখলে সাত রকমের প্রশ্ন ওঠে। আমার প্রগতিবাদী বন্ধুরা বলেন, ধ্যাৎ! গাফফার চৌধুরী তো সারাজীবনই দালালি করেছে। একে নিয়ে বিতর্ক করে লাভ নেই। আমি গাফফার চৌধুরীর পক্ষে কিছু বলছি না। গাফফারকে যারা প্রতিদিন গালি দেন তাদের বলব-বন্ধুরা, একটু নিজেদের অতীত স্মরণ করুন। একবার হলেও আয়নার কাছে দাঁড়িয়ে নিজেদের অতীতের কথা চিন্তা করুন। এমনকি ‘৭১ সালেও আপনারা সকলে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পেরেছেন তার প্রমাণ কিন্তু মিলছে না।

শামসুদ্দিন দা’র কথায় তেমন ঘাবড়ে গেলাম না। জানতাম, তিনি খুব অসুবিধায় আছেন। প্রথমে মনে হয়েছিল জেলখানা থেকে বের হয়ে গোয়েন্দা নিয়ে সরাসরি রেডিও পাকিস্তানে যাওয়া ঠিক হবে কি না। শামসুদ্দিন দা বিপদে পড়বেন কি না। তবুও আমার উপায় ছিল না। তাই বন্ধুদের খোঁজ-খবর করতে শামসুদ্দিন দা’র কাছে গিয়েছিলাম। তিনি কারো ঠিকানা দিতে পারছিলেন না। নিজের দাদার ঠিকানা দিলেন। বললেন, কাল ভোরে আমার বাসায় আসবি। তোর সাথে অনেক কথা আছে।

ঐ দুই গোয়েন্দা সাথে নিয়ে আমি আবার বের হলাম। এবার হাঁটছি ফুলবাড়িয়া স্টেশনের দিকে। কোথায় যাব ঠিক জানি না। স্টেশনের কাছে পৌঁছাতে দূর থেকে দেখি খালেক দা আসছেন। খালেক দা আমাকে দেখে অবাক হলেন। বললেন, তুমি কোথা থেকে এলে! কখন মুক্তি পেলে? কোথায় থাকছ? কোথায় খাচ্ছ? আমি তখন নির্বাক। আদৌ ভাবিনি খালেক দা’র সাথে আমার রাস্তায় দেখা হবে। বললাম, আপনাদের খুঁজছিলাম। শামসুদ্দিন দা’র কাছ থেকে এলাম।

খালেক দা গোয়েন্দাদের বিদায় নিতে বললেন। বললেন, তুমি আমার সাথে চলো। বললেন, চলো বংশাল রোডে। ওখানে মোজাম্মেল আছে। একটি দৈনিক পত্রিকায় চাকরি করে। যতদূর মনে আছে দৈনিকটির নাম ‘আমার দেশ’। সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ। আমাকে দেখে মোজাম্মেল দা যেন চিৎকার করে উঠলেন। আমার হাতে তখন বাড়ি যাবার একটা স্টিমার টিকেট। তিনি টিকেটটি নিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন। বললেন, তোমার বাড়ি যাওয়া হবে না। তুমি কিছুদিন ঢাকা থাকবে। তোমার জন্য পাসপোর্ট করতে হবে। কলকাতায় গিয়ে তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে হবে। কলকাতায় তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি খুব দুঃখ করছিলেন–তোমাকে ফেলে কেন আমরা সবাই ভারতে চলে এলাম। মোজাম্মেল দা বললেন, কলকাতায় যাওয়া তোমার প্রথম কাজ। তারপর তুমি কোটালীপাড়া যাবে।

আমি সেই পড়ন্ত বেলায় মোজাম্মেল দা’র মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম। এই সেই মোজাম্মেল দা। ১৯৪৭ সালে আমি বরিশাল বিএম কলেজে পড়ি। তিনি আমাদের নেতা। দেশ বিভাগের পর মা চলে গেলেন পশ্চিমবঙ্গে। আমি বরিশালে, জানতেন তিনি। আমি মোজাম্মেল দা’কে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কী করব। তিনি বললেন, তোমার যাওয়া হবে না। তুমি রাজনীতি করবে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২। ঢাকা বংশাল রোডের একটি অফিসে আমি মোজাম্মেল দা’র সামনে দাঁড়িয়ে। আমি বললাম, মোজাম্মেল দা, আমার একটি কথা আছে। ১৯৪৭ সালে আপনি বলেছিলেন, তোমার দেশ ছেড়ে যাওয়া হবে না। এবার আমি বলছি–আমি দেশ ছেড়ে কোথাও যাব না। আমি আগে কোটালীপাড়া যাব। আপনি পাসপোর্ট-ভিসার চেষ্টা করতে পারেন। পাসপোর্ট ভিসা পেলে আমি যাব মাকে দেখতে।

মোজাম্মেল দা আমার পাসপোর্টের চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৫৩ সালে আমি পাসপোর্ট পেয়েছিলাম দুই মাসের জন্য। সে পাসপোর্ট আমার হাতে আসতে আসতে দুই মাস কেটে গেছে। এরপর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার আমাকে কোনো পাসপোর্ট দেয়নি।

মোজাম্মেল দা আমার কা শুনে বললেন, ঠিক আছে। চলো, পাতলাখান লেনে যাই। পাতলাখান লেনে গাফফার আছে। অর্থাৎ আবদুল গাফফার চৌধুরী। যতদূর মনে পড়ে গাফফার দোতলায় থাকত। আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।

১৯৪৮ সালে বিএসসি প্ৰীক্ষার্থী ছিলাম। ১৯৫৩ সালে আবার চেষ্টা করছি ঐ বিএসসি পড়বার। দুটি সেশন চলে গেছে, তাই নতুন অনুমতি নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেলখানায় বিজ্ঞান পড়া যায় না। তাই জেলার দিনগুলো আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ায় কোনো কাজে আসেনি।

কিন্তু আমার জন্যে তদ্বির করবে কে? বরিশাল এসে দেখলাম পুরনো বন্ধু তেমন কেউ নেই। দলের অন্যতম নেতা সুধীর সেন জেলখানায়। বরিশাল শহরে অসংখ্য চেনাজানা লোক আছে। রাজনৈতিক দলের সদস্য আছে। কিন্তু থাকব কোথায়। শেষ পর্যন্ত ঐ দেবেন দা অর্থাৎ দেবেন ঘোষের বাসায়ই উঠতে হলো। ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ এডওয়ার্ড ম্যাক-ই-নানীর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কমিটির সদস্য। ক্যাথলিক চার্চের লোক। বাড়ি আয়ারল্যান্ড। আইসিএল। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় নোয়াখালীর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বর্ষায় ব্রিটিশের পক্ষে গোয়েন্দাগিরিও করেছেন।

একটি বিশেষ লক্ষ্যে তাঁকে ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ করা হয়েছিল। ছাত্র আন্দোলনের জন্যে তখন ঢাকার বাইরের ৩টি কলেজ চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই তিনটি কলেজ হলো– বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ এবং রংপুরের কারমাইকেল কলেজ। পাকিস্তান সরকার এ কলেজগুলোতে প্রাক্তন সিভিল সার্ভেন্টদের নিযুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সুবাদে ব্রজমোহন কলেজে আসেন ম্যাক-ই-নানী।

এডওয়ার্ড ম্যাক-ই-নানী আমার সঙ্গে ভালো আচরণ করলেন। বললেন, তিনি ঢাকা গিয়ে আমার জন্যে তদ্বির করবেন। তদ্বিরের জন্যে আমিও ঢাকা গেলাম। আবদুল গাফফার চৌধুরীর ভগ্নিপতি আব্দুল হামিদ তালুকদার তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। তাঁর কাছে গেলাম গাফফারকে নিয়ে।

শেষ পর্যন্ত আবার ব্রজমোহন কলেজে পড়বার অনুমতি মিলল। দেবেন দা একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন বরিশালে এক বাসায় পড়াবার বিনিময়ে। বিপদ দেখা দিল ভর্তি নিয়ে। পাকিস্তান আমলে কড়া নিয়ম ছিল। মুচলেকা দিতে হতো যে রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করব না এবং সে জন্য প্রয়োজন হতো একজন স্থানীয় অভিভাবকের।

বরিশাল শহরে কে আমার স্থানীয় অভিভাবক হবেন? আমি জেলখানা থেকে এসেছি। সরকারের সুনজরে নেই। কেউ রাজি হবেন না আমার স্থানীয় অভিভাবক হতে। এবার সহযোগিতা করলেন জাহিদ হোসেন জাহাঙ্গীর। তিনি জাহাঙ্গীর হোসেন নামে পরিচিত। ছাত্র জীবনে আরএসপি করতেন। তাঁর ব্যক্তিগতভাবে পারিবারিক দিক থেকে বরিশালে বেশ প্রভাব ছিল। তিনি আমাকে ব্রজমোহন কলেজের তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল দেবেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জির কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি ডিএনসি নামে পরিচিত। ইংরেজির অধ্যাপক ডিএনসি আমার স্থানীয় অভিভাবক হলেন। ১৯৫৩ সালের জুলাইতে আমি পুনরায় ব্রজমোহন কলেজে বিএসসি শেষ বর্ষের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হলাম। সামনে পরীক্ষা।

আমি কলেজে ভর্তি হবার পর প্রিন্সিপালের আচরণ পাল্টে গেল। তিনি আমাদের ক্লাসের কাছাকাছি আসতেন। দেখতেন, আমি ক্লাসে আছি কি না। কোনো ছাত্র আমার সঙ্গে কলেজ প্রাঙ্গণে কথা বললে তিনি ডেকে পাঠাতেন। বলতেন–Do not spoil yourself he is a maxist (নিজেকে নষ্ট করো না–ঐ ছেলে মার্কসবাদী)। বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের ডেকে বলতেন, সাবধান, ওর সঙ্গে ঘুরলে বৃত্তি কাটা যাবে। অর্থাৎ প্রিন্সিপালের জন্যেই কলেজে আমি আমার অজান্তে ভয়ের বস্তুতে পরিণত হলাম।

এই রাজনীতি নিয়ে একটি ঘটনা আছে ম্যাক-ই-নানীর আমলে ব্রজমোহন কলেজে। ১৯৫৩ সালে স্ট্যালিন মারা যান। ছাত্র সংঘের পক্ষ থেকে কলেজ ছুটি ঘোষণা দাবি জানানো হলে তিনি উচ্চকণ্ঠে হেসে দিলেন-দ্য ক্যান্সার ইজ আউট। তিনি ছুটি দিতে রাজি হলেন না। পরদিন কলেজ ধর্মঘট। ফলে ছাত্র সংসদের সঙ্গে প্রিন্সিপালের বিরোধ দেখা দেয় এবং তিনি ভিপিসহ ছাত্র সংসদের সদস্যদের বহিষ্কার করেন। এ সময় আমি কলেজে ভর্তি হই।

তবে আমার তখন রাজনৈতিক তেমন পরিচিতি ছিল না ছাত্রদের মধ্যে। ছাত্র সংসদ ছিল ছাত্র ইউনিয়নের দখলে। ছাত্রলীগ দুর্বল। এ সময় আমাদের দল ছাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছাত্রলীগে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আমি বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হই। সাধারণ সম্পাদক হন হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি গোলাম রাব্বানী। কলেজের রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে।

অপরদিকে পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন ঘোষিত হয়। ঘোষণা করা হয় ৫৪ সালের প্রথম দিকে পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচন হবে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পর এটাই ছিল প্রথম সাধারণ নির্বাচন। সুতরাং রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে। এ সময় ঘোষণা হয়, ব্রজমোহন কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে।

১৯৫৪ সাল। পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন। এর আগে কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয়া হলো। বিরোধী দলের পক্ষে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হলো। নাম–কলিজিয়েট ফ্রন্ট। টিকল না। আমি ভিপি প্রার্থী কলিজিয়েট ফ্রন্ট থেকে।

এ নির্বাচন নিয়ে একটি ঘটনা ঘটল। এ নির্বাচন আমার মনে তখন বেশ দাগ কেটেছিল। নির্বাচনের পূর্বদিন রাতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তাঁরা বললেন, সামনে সাধারণ নির্বাচন ব্রজমোহন কলেজে আমাদের জিততে হবে। না হলে সাধারণ নির্বাচনে তার ছাপ পড়বে। তা ছাড়া ব্রজমোহন কলেজের ছাত্রদের মধ্যে মাত্র ২০০ হিন্দু ছাত্র। আপনি দাঁড়ালে নির্বাচনে জেতা যাবে না। আপনি সরে দাঁড়ান।

তাদের বক্তব্য আমার অযৌক্তিক মনে হয়নি। তবে খারাপ লেগেছিল হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নটি উত্থাপন করায়। সব সময় রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখেছি কমিউনিস্ট পার্টি বরাবরই সাধারণ মানুষকে শ্রেণি ভিত্তিতে না দেখে সম্প্রদায় হিসেবে দেখেছেন। এ হিসেবে পাকিস্তান সমর্থন করেছে। মুসলিম লীগের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল কমরেড’ খুঁজেছে। এবারও তাদের মুখ্য যুক্তি হচ্ছে আপনি হিন্দু–তাই আপনার দাঁড়ানো ঠিক হবে না।

আমি রাজি হলাম না। ভাবলাম এই সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে চিন্তার রাজনীতি সঠিক নয়। আমি পরাজিত হতে রাজি। তবে হিন্দু বা মুসলমান হিসেবে নয়। সুতরাং নির্বাচন হবে আগামীকাল এবং আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব।

তবে সরকার সেভাবে ভাবেনি। আমাদের ভাবনার বাইরে একটি সিদ্ধান্ত ছিল সরকারে। সে সিদ্ধান্ত কার্যকর করলেন ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ। নির্বাচনের দিন দুপুরের দিকে তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন তাঁর কক্ষে। ইতোমধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিল যে আমাকে দাঁড়াতে দেয়া হবে না। অধ্যক্ষ শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করে আগেই তাঁর কথা বলেছেন। অধ্যক্ষের শঙ্কা হচ্ছে, আমি নির্বাচিত হলে শ্লোগান উঠবে-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক।’ আমি দাবি করব বহিষ্কৃত ছাত্রদের ফিরিয়ে নেয়া হোক। সুতরাং আমাকে দাঁড়াতে দেয়া হবে না। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তাহলে নির্মল সেনের মনোনয়নপত্র কেন গ্রহণ করা হয়েছিল? কোন ভিত্তিতে? তখনই বলা উচিত ছিল যে তুমি দাঁড়াতে পারবে না। জবাবে অধ্যক্ষ বলেছিলেন–তিনি নাকি ধারণাই করতে পারেননি যে, আমি নির্বাচিত হব। ভেবেছিলেন আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে ক্ষতি নেই। কারণ আমি পরাজিত হবই। সেদিন নাকি তাঁর ধারণা হয়েছে আমি জিতে যাব। সুতরাং তার সিদ্ধান্ত, আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেই দেয়া হবে না। এ ক্ষমতা নাকি ছাত্র সংসদের প্রধান হিসেবে তার আছে। তিনি শিক্ষকদের আশ্বাস দিলেন যে কলেজে হাঙ্গামা এড়াবার জন্যে এ পথ নেয়া হচ্ছে এবং আমার নির্বাচনের জন্যে কোনো টাকা ব্যয় হয়ে থাকলে কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাকে দিয়ে দেবে।

আমি এ খবর পেয়েই অধ্যক্ষের কক্ষে ঢুকলাম। ঢোকামাত্র অধ্যক্ষ ম্যাক ই-নানী বললেন–তুমি কলেজে গণ্ডগোল করছ। তোমার ছেলেরা সন্ত্রাস করছে। আমি বললাম, আপনি মিথ্যা বলছেন। কলেজে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে। অধ্যক্ষ বললেন, তোমাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেয়া হবে না।

আমি বললাম, কেনো?

তিনি বললেন, আমার ইচ্ছে। তুমি নির্বাচিত হয়ে ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’ বলবে। বহিষ্কৃত ছাত্রদের কলেজে ফিরিয়ে নিতে বলবে। কলেজে গোলমাল হবে। আমি বললাম, আমাকে নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করতে না দেবার আপনি কে? তিনি বললেন, আই অ্যাম দি কনস্টিটিউশন-আমি ছাত্র সংসদের গঠনতন্ত্র। আমি বললাম, আমি আপনার নির্দেশ মানি না। আমি বললাম, আমি নির্বাচন করব। আপনি পারলে ঠেকাবেন। আপনার সঙ্গে নির্বাচনের কক্ষে দেখা হবে। আমি অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলাম।

তখন ব্রজমোহন কলেজে সরাসরি ভাইস প্রেসিডেন্ট, সাধারণ সম্পাদক বা সহ-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতো না। নির্বাচনী কলেজ প্রতিনিধি গঠিত হতো প্রতিটি শ্রেণির প্রতিনিধি নিয়ে। বিভিন্ন শ্রেণির জন্যে বিভিন্ন পদ নির্ধারিত থাকত। নির্বাচিত কলেজ প্রতিনিধি ঐ তিনটি পদে নির্বাচন করত। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো কলেজ মিলনায়তন কালী প্রসন্ন হলে, অর্থাৎ কেপি হলে।

আমি নির্বাচন হলে ঢোকামাত্র আমাদের পক্ষে একজন আমার নাম ভিপি হিসেবে প্রস্তাব করল। অন্য দু’জনের নামও প্রস্তাবিত হলো। ভিপি প্রার্থী ছিল তিনজন–আমি, কলেজিয়েট ফ্রন্টের অন্যতম প্রার্থী হাবিবুল্লাহ ও মুসলিম ছাত্র সংঘের আব্দুল বারী। নাম প্রস্তাবিত হবার সঙ্গে সঙ্গে অধ্যক্ষ উঠে দাঁড়ালেন, বললেন–নির্মল সেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না। কারণ সে ভর্তির সময় মুচলেকা দিয়েছিল যে কলেজে রাজনীতি করবে না।

আমি উঠে বললাম, আপনি ডাহা মিথ্যা কথা বলছেন। এমন কোনো মুচলেকা আমি দিইনি। আর ছাত্র সংসদ নির্বাচন আদৌ রাজনীতিও নয়। এবার অধ্যক্ষ বললেন, আমি সংসদের প্রধান হিসেবে তার প্রার্থীপদ বাতিল করলাম। আমি তখন আমাদের সমর্থকদের কলেজিয়েট ফ্রন্টের প্রার্থী হাবিবুল্লাহকে ভোট দেবার জন্যে বললাম। অধ্যক্ষ বললেন, তুমি কাউকে সমর্থন করতে পারবে না। তোমার সদস্যপদ বাতিল। আমি বললাম, তাহলে অধ্যক্ষ হিসেবে আপনি নিরপেক্ষ নন। আপনাকেও আমার সাথে কক্ষের বাইরে যেতে হবে। দীর্ঘদেহী ব্রিটিশ আইসিএস এডওয়ার্ড ম্যাক-ই-নানী আমার সঙ্গে কক্ষ থেকে বের হলেন। কিছুক্ষণ পরে নির্বাচনের ফল বের হলো। আমাদের সমর্থিত তিনজন প্রার্থীই জিতে গেল। অধ্যক্ষ বললেন, নির্মল সেন একজন গুণ্ডা। পরদিন তিনি আমার স্থানীয় অভিভাবক অধ্যাপক দেবেন চ্যাটার্জিকে বললেন-নির্মলকে টেস্ট দিয়ে চলে যেতে বলুন–আমি ওকে আটকাব না।

ইতিমধ্যে নির্বাচনী গোলমাল শুরু হলো। আমি খুনের মামলায় জড়িয়ে। গেলাম। খুন হলো তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের বরিশাল সফর নিয়ে।

১৯৪৮ সালে গ্রেফতার হয়ে বরিশাল ছেড়েছিলাম। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বরিশালে এলাম ১৯৫৩ সালে। ১৯৪৮ সালে জেলে যাবার ফলে বিএসসি পরীক্ষা দেয়া হয়নি। ভেবেছিলাম বিএসসি পরীক্ষাটা শেষ করব। তাই বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে আবার ভর্তি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এবার হয়তো হুড়-হাঙ্গামা হবে না। কিন্তু ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা হলো। নতুন করে হাঙ্গামা শুরু হলো। মনে হচ্ছিল সেবারও পরীক্ষা দেয়া হবে না।

জেলখানা থেকে ফিরে বরিশালে এক ভিন্ন চিত্র দেখলাম। এককালের বরিশালের রাজনীতিতে কমিউনিস্ট পার্টি, আরএসপি এই দুটি বামপন্থী দলের প্রভাব ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর নির্যাতনের ফলে দুটি দলই বিপর্যস্ত। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন নিয়ে এ দুটি দলের মৌলিক পার্থক্য ছিল। পার্থক্য ছিল জাতীয় রাজনীতি নিয়েও। কমিউনিস্ট পার্টি পাকিস্তান সমর্থন করেছিল। আরএসপি সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সার্বভৌম বাংলার আন্দোলনে নেমেছিল। পাকিস্তান আমলে আরএসপি ও কমিউনিস্ট পার্টির তত্ত্ব ও চিন্তার দিক থেকে পার্থক্য থাকলেও সরকারি নির্যাতনের ফলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনেরই চেষ্টা করা হতো।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে রুখবার জন্যে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। এই যুক্তফ্রন্টে ছিল আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, শেরে বাংলা ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি, মওলানা আতাহার আলীর নেজামে ইসলাম এবং গণতন্ত্রী দল। প্রথম দিকে আরএসপি এই নেতৃত্বের সম্পর্কে প্রশ্ন তুললেও পরবর্তীকালে সকল বামপন্থী দলই যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন দেয়। ১৯৫৩ সালে আরএসপি পুনর্গঠিত হয়। এই কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক হলেন রুহুল আমিন কায়সার, নিতাই গাঙ্গুলী ও এবিএম মূসা। এই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কাজ করা শুরু করি এবং বরিশালে আমি ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হই।

১৯৫৪ সাল। নির্বাচন এগিয়ে আসছে। বরিশালে নির্বাচনী সফরে আসবেন পূর্ব পাকিস্তানের তক্কালীন প্রধানমন্ত্রী জনাব নূরুল আমীন। সঙ্গে আসবেন উত্তর প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী আব্দুল কাইয়ুম খান। বরিশালের ছাত্রদের সিদ্ধান্ত-এ সফর ঠেকাতে হবে।

আমি তখন কলেজ নিয়ে বিব্রত। কলেজ নির্বাচন নিয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। ইতিমধ্যে আর এক কাণ্ড ঘটিয়েছে আইএসসির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্ররা। তারা একদিন পড়ন্ত বেলায় পদার্থবিদ্যার ক্লাসের আগে ছুটি দেবার জন্যে শিক্ষকের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিল। কিন্তু ক্লাসের শিক্ষক রাজি হননি। তখন তিনজন ছাত্র কলম থেকে কালি ছিটিয়ে দিয়েছে সামনে বসা ছাত্রীদের শাড়িতে। ছাত্রীরা চিৎকার করে উঠলে ক্লাস ছুটি হয়ে যায়। অভিযোগ চলে যায় অধ্যক্ষের কাছে। তিনি নির্দেশ দিলেন, তিনজন ছাত্রকে কলেজ থেকে বহিষ্কারের। তবে এ নির্দেশ কার্যকর করার পূর্বে ভাইস প্রিন্সিপালকে বললেন–আমার মতামত জানার জন্যে। আমি তখন কলেজে যাই না। টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে গেছি। তবুও অধ্যক্ষের আশঙ্কা এ ছাত্রদের বহিষ্কার করা হলে আমি হয়তো কলেজে গণ্ডগোল করব। তাই আমাকে ডেকে পাঠানো হলো কলেজে।

কলেজের ভাইস প্রিন্সিপালের কক্ষে কথা শুরু হলো। ভাইস প্রিন্সিপাল দেবেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি (ডিএনসি) আমার স্থানীয় অভিভাবক। তিনি বললেন–নির্মল, তুমি কোনো প্রতিবাদ করো না। তোমার সামনে অনেক বিপদ। গণ্ডগোল করলে পরীক্ষা দেয়া হবে না। আমরা সকলেই চাই তুমি পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে যাও কলেজ থেকে।

আমি বললাম, স্যার লঘু পাপে গুরু দণ্ড হয়ে যাচ্ছে। এই বয়সের ছেলেরা মেয়েদের দেখলে শিস দেয়। শাড়িতে কালি দেয়াটাও অসম্ভব কিছু নয়। এই বয়সের এটাই ধর্ম। ছেলেগুলো আমার কাছে এসেছিল। আমি বলেছি, তোমাদের মনে এমন কিছু থাকলে চিঠিপত্র লিখতে পারতে। এভাবে কালি দেয়া ঠিক হয়নি। ওরা আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে। ক্ষমাও চেয়েছে। আমি ওই মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করতে বলেছি।

ভাইস প্রিন্সিপাল বললেন, তোমার কথা শুনতে ভালো। কিন্তু প্রিন্সিপাল তোমার কথা মানবেন না। তুমি এ ব্যাপারে নাক গলাবে না। আমি বললাম, তাহলে এ ব্যাপারে আমার অভিযোগ আছে। আমার অভিযোগ হচ্ছে বিজ্ঞানের অনেক শিক্ষকই ঘণ্টার পর ঘন্টা প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে দাঁড়িয়ে ছাত্রীদের সবকিছু বোঝানোর চেষ্টা করেন। ছাত্ররা ডাকলে কাছেও আসেন না। তাই আমাদের ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে হলে ঐ শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি কিন্তু ছাত্রদের এসব কথা বলব।

ভাইস প্রিন্সিপাল বললেন, তাহলে তোমার এ ব্যাপারে প্রস্তাব কী? আমি বললাম, শুধুমাত্র একটা ওয়ার্নিং। ঐ ছাত্রদের আপনি ডেকে সতর্ক করে দিন যে, ভবিষ্যতে এমন ঘটলে তোমাদের বহিষ্কার করা হবে। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। ছাত্ররা বেঁচে গেল।

যতদূর মনে আছে–এ হচ্ছে ১৯৫৪ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের কথা। জানুয়ারি মাসের ১৯ তারিখ নূরুল আমীন বরিশাল সফরে আসবেন। বরিশাল তখন উত্তপ্ত। এক সন্ধ্যায় মিছিলের সামনে পড়ায় এক মুসলিম লীগ নেতার মুখে থুতু দেয়া হয়েছে। মিছিলে গোন উঠেছে নরুল আমীনকে জুতা মারো। এ পরিস্থিতিতে ১৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় সকল দলকে ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে ডাকা হলো। কমিউনিস্ট পার্টি এবং ইউনিয়নের কথা হচ্ছে নূরুল আমীনের বিরুদ্ধে কঠিন কিছু করা ঠিক হবে না। কোনো খুন জখম হলে এই অজুহাত দেখিয়ে সারা দেশে হয়তো নির্বাচনই বন্ধ করে দেয়া হবে। এ ঝুঁকি আমাদের নেয়া ঠিক হবে না। আমি বললাম, আপনাদের কথা আমি মানতে রাজি আছি। কিন্তু সরকার পক্ষ কিছু ঘটালে ছাত্রলীগ তার প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ করবেই। শেষ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই সভা শেষ হলো।

১৯ জানুয়ারি সকাল থেকেই বরিশাল শহর থমথমে। আমরা তেমন কোনো বিক্ষোভের ব্যবস্থা করিনি। সদর রোডে ছাত্রলীগ অফিসে মাইক থেকে বক্তৃতা দিচ্ছি। নূরুল আমীন সদলবদলে ঢাকা থেকে বরিশালে পৌঁছাবেন স্টিমারে। আমাদের বারণ সত্ত্বেও ডজন খানেক ছাত্র পকেটে কালো রুমাল নিয়ে স্টিমার স্টেশনে যায়। নূরুল আমীন স্টিমার থেকে নামবার সঙ্গে সঙ্গে তারা কালো রুমাল দেখায়। তাদের গ্রেফতার করা হয়। এই গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মধ্যে ছিল নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের এককালের সভাপতি আকতার উদ্দিন এবং ছাত্রলীগ নেতা নুরুল ইসলাম মঞ্জুর। এদের গ্রেফতারের খবর আগুনের মতো ছড়িয়ে গেল শহরে। তখন শর্ষিনার পীরের মুরিদেরা মুসলিম লীগের সমর্থনে মিছিল করেছিল সারা বরিশালে। ছাত্রলীগের অফিস থেকে সব স্কুল এবং কলেজে ধর্মঘটের খবর পাঠানো হলো। খবর এল কলেজে মাত্র একটি ক্লাস হচ্ছে। ঐ কলেজে ধর্মঘটের খবর পাঠানো হলো। ঐ ক্লাসের নেতৃত্বে আছে মুসলিম ছাত্রলীগের ছেলেরা। আমি কলেজে পৌঁছালাম। শিক্ষকরা বললেন, কী করব? পার্সেন্টেজ দিয়ে ছুটি দেব না এমনিই ছুটি দিয়ে দেব? আমি বললাম, পার্সেন্টেজের দরকার নাই। এমনিই ছুটি দিয়ে দেন। মুসলিম লীগের নেতৃত্বের ক্লাসটিতে ঢুকলাম। ওদের নেতা নুরুল উল্লা (পরবর্তীকালে ইঞ্জিনিয়ার নূরুল উল্লা নামে খ্যাত], যিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে জগন্নাথ হলের হত্যাকাণ্ডের ছবি তুলে খ্যাতি লাভ করেছিলেন]। নূরুল উল্লার ডাক নাম ছিল ভানু। ভানু আমাকে দেখেই সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এল।

তারপর শুরু হলো মিছিল। সকলের মুখে এক কথা, নূরুল আমীন কোথায়? তাকে ঘেরাও করতে হবে। ছাত্রদের মুক্তি দিতে হবে। ইতিমধ্যে প্রিন্সিপাল ম্যাক-ই-নানী একটি ভিন্ন পদক্ষেপ নিলেন। তিনি লিখিতভাবে কলেজে জানালেন যে তার কলেজের ছাত্রদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি জেলে গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করলেন। জেল কর্তৃপক্ষকে জানালেন ছাত্রদের জেলে রেখে নূরুল আমীনের সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজনে তাঁর যোগ দেয়া সম্ভব নয়।

এ খবর ছাত্রদের সাহসী করে তুলল। মিছিল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেল। জানা গেল নূরুল আমীন সার্কিট হাউসে চলে গেছেন। আমার ইচ্ছা ছিল সংঘর্ষ এড়াবার। চেষ্টা করলাম সার্কিট হাউস এড়িয়ে মিছিল নিয়ে যাবার। কিন্তু সম্ভব হলো না। মিছিল গিয়ে সার্কিট হাউস ঘিরে ফেলল।

তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। ছেলেরা অস্থির হয়ে উঠেছে। পুরো সার্কিট হাউসের লনে দাঁড়িয়ে আছেন ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি, বিভাগীয় কমিশনার জিএম ফারুকী এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী খান আব্দুল কাইউম খান। নূরুল আমীন সার্কিট হাউসের ভেতরে, এমন সময় এসপি আমাকে ডেকে পাঠালেন, বললেন কী চান? আমি বললাম গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের ছেড়ে দিতে হবে। তিনি বললেন, ছেড়ে দেয়া হবে। আমি বললাম, তাদের ছেড়ে দেয়া নয়, এখানে এনে দেখাতে হবে। তাহলে মিছিল চলে যাবে।

এসপি বললেন, তাই হবে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের আমাদের সামনে হাজির করা হবে। আমি মিছিল নিয়ে টাউন হলের দিকে চলে যাবার কথা বললাম। ছাত্র-জনতা কেউই রাজি হলো না। ঘেরাও চলল। ইতিমধ্যে দক্ষিণ দিক থেকে মুসলিম লীগের লাঠিয়াল বাহিনী এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের মিছিলের ওপর। সার্কিট হাউসের সামনে তখন নির্মিত হচ্ছিল একটি পেট্রোল পাম্পের ভবন। পড়ে ছিল ইট-কাঠ। জনতার হাতিয়ার হয়ে উঠল এই ইট। দু’পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে এক সময় এসপি মুসলিম লীগের নেতাদের নিয়ে সার্কিট হাউসের পেছন দিক থেকে বের হয়ে চলে গেলেন এ কে স্কুলের মাঠে জনসভা করতে। সে জনসভা ভণ্ডুল হয়ে গেল।

বিকেলের দিকে সারা শহরে যেন উন্মত্ততা চলছে। শর্ষিনার পীরের মুরিদদের ধরে আনা হচ্ছে। খোঁজা হচ্ছে মুসলিম লীগের লাঠিয়াল বাহিনীকে। এদের ওপর যুক্তফ্রন্টের কর্মিদের প্রচণ্ড রাগ। কারণ ওদের মধ্যেই অনেকে ছিল চেনাজানা। বলেছিল মুসলিম লীগের এতদিনের ভাড়া খাটব, আবার ফিরে আসব। কোনো গোলমাল করব না। অথচ তারাই আমাদের মিছিলে হামলা করেছে লাঠি নিয়ে।

আমি ছাত্রলীগ অফিসে বসা। খবর এল মুসলিম লীগের লাঠিয়াল বাহিনী এ কে স্কুলে স্থান নিয়েছে। যুক্তফ্রন্টের ছেলেরা জিন্দেগী রেস্টুরেন্ট থেকে সুন্দরী কাঠের লাঠি নিয়ে ছুটেছে। আমিও ছুটলাম। জনতা তখন মারমুখী। আমাকে বলছে, আপনি বারণ করতে পারবেন না। ওদের আমরা মেরে ফেলব।

আমি ঠেকাতে পারলাম না। আমরা এ কে স্কুলে ঢুকবার আগেই মুসলিম লীগ বাহিনীর অনেকে পালিয়েছিল। কিন্তু পালাতে পারেনি আব্দুল মালেক। আমার সামনে তার মাথায় ছুঁড়ে দেয়া হলো একটি বিরাট পাথর। মালেক পড়ে গেল। আমি ফিরলাম টাউন হলে। টাউন হলের সামনে তখন হাজার হাজার জনতা। সকল দলের নেতারা বক্তৃতা দিলেন। আমি কাউকে জিজ্ঞাসা না করেই ঘোষণা করলাম, আমরা পরবর্তী ঘোষণা দেবার পূর্বে বরিশাল জেলার কোনো স্কুল-কলেজ আর খুলবে না।

জনসভা থেকে বের হয়ে আসতেই অন্যান্য দলের বন্ধুরা ধরল। বলল, এ ঘোষণা কেন দিলেন? পদস্থ পুলিশ অফিসাররা এলেন। বললেন, স্কুল-কলেজ কবে খুলবে। কারো কথার জবাব দিলাম না। সেদি’ এ ঘোষণা কেন দিয়েছিলাম আজ আর মনে নেই। বড় ক্লান্ত ছিলাম। ফিরে গেলাম কালীবাড়ি রোডের আস্তানায়। ছাত্র পড়িয়ে থাকি। শুনলাম আহত মালেকের তাপমাত্রা ৯৫ ডিগ্রিতে নেমে গেছে।

২০ জানুয়ারি ১৯৫৪। সারা বরিশাল শহরে একটি অস্থিরতা। সকলের মনে আশঙ্কা। কী হবে। সরকার পক্ষ কালকের ঘটনার বিরুদ্ধে কী ধরনের ভূমিকা নেবে। আহত আব্দুল মালেক বাঁচবে কি না।

বিকালের দিকে ছাত্রলীগ অফিসে এলাম। এ সময় ছাত্রলীগ অফিসের সামনের দেয়ালে প্রতি ঘণ্টার খবর লিখে কাগজে লাগিয়ে দিচ্ছিলাম। দাবি করছিলাম, আব্দুল মালেক আমাদের লোক। কিছুক্ষণ পরে খবর এল মালেক মারা গেছে। সকলেই খানিকটা থমকে গেলাম। অফিসে নামলাম। জানতাম এবার পুলিশ তৎপর হবে।

সে রাতে ইচ্ছে করেই বাসায় থাকলাম। বাড়ির মালিক ধনী ব্যবসায়ী। পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো। দুপুর রাতে আমার ঘুম ভাঙানো হলো। বাড়ির মালিকের হাতে থানার এজাহারের অনুলিপি। পুলিশ প্রায় দু’শ জনের বিরুদ্ধে। মামলা দায়ের করেছে বরিশাল সদর থানায়। আমি তিন নম্বর আসামী–এজাহারে লেখা হয়েছে, নির্মল সেন (কমিউনিস্ট)। পিতার নাম নেই। ঠিকানা নেই। এজাহারে বয়ানে লেখা, একজন হিন্দু ছেলে মুসলমানের পোশাকে মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিল। সেদিন আমার পরনে ছিল পাজামা পাঞ্জাবি। আমাকে রাতে বাসা ছাড়তে হলো। রাতে থাকতে হলো বাড়ির মালিকের দোকানের দোতলায়।

কিন্তু কোথায় যাব! স্থির হলো বাড়ির মালিকের গ্রামের বাড়ি গৌরনদী থানার মেদাকুলে যাব। দুদিন পর বরিশালের উত্তরে মহামায়ার মেলা। দুপুরে বোরখা পরে রিকশায় উঠলাম। চারদিকে কাপড়ের ঘের দেয়া রিকশায়। মহামায়ায় গিয়ে বাস ধরলাম। বাস যাচ্ছিল বরিশাল থেকে অধুনা মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার ভুরঘাটা। ভুরঘাটার পথে ইল্লা নেমে হাঁটা পথে মেদাকুল। মেদাকুলে একটি সুবিধা ছিল। যে বাড়িতে থাকতাম সে বাড়ির পাশে খাল। খালের ওপারে ফরিদপুর জেলা। মেদাকুল বরিশাল জেলায়। সুতরাং দু’জেলার পুলিশ এড়ানো সম্ভব ছিল।

কিন্তু গ্রামে দিন কাটানো কঠিন। একদিন গৌরনদীর দারোগা সাহেব এলেন ঐ বাড়িতে আমার সন্ধানে। বাড়ির কর্তা বললেন, আপনার কোনো ভয় নেই। ঐ দারোগা আপনার কক্ষেই ঘুমাবে। আমাদের টাকায় ওদের সংসার চলে। আপনাকে ধরবার মুরোদ নেই। বাড়ির মালিক বড় ব্যবসায়ী। আন্তঃদেশ সুতা ব্যবসায়ী। তাঁকে এড়ানো সেকালের গৌরনদী থানার কোনো দারোগার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এবং তাই-ই হলো। রাতে দারোগা সাহেব আমার কক্ষে ঘুমালেন। তেমন কোনো কথা হলো না। তিনি আমাকে চিনলেন মনে হলো না। ভোরবেলা চলে গেলেন।

আমি বুঝলাম এ বাড়িতে থাকা যাবে না। পুলিশ জেনে ফেলেছে আমি কোথায়। তাই ভাবলাম বরিশাল ফিরব। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস। হয়তো সরকার কিছুটা শিথিল করবে বাড়াবাড়ি। ২২ ফেব্রুয়ারি বরিশাল এলাম। পুরান আস্তানায় জায়গা নিলাম। সকালে বলল–এভাবে থাকলে ধরা পড়বে। আমি বললাম, পুলিশ ভাবতে পারবে না যে আমি পুরান আস্তানায় ফিরে এসেছি। তবে পুলিশ সত্যি সত্যি আমাকে খুঁজেছিল হন্যে হয়ে। মাঝখানে পুলিশ প্রধান বিখ্যাত সামসুদ্দোহা সাহেব বরিশাল সফর করে গেছে। তাই পুলিশ সতর্ক এবং সন্ত্রস্ত।

সারা দেশে তখন নির্বাচনী জোয়ার। শেরেবাংলা ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট হক ভাসানী যুক্তফ্রন্ট নামে পরিচিত। এদের সঙ্গে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রচারে যোগ দিয়েছেন সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গাফফার খান। পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৩০৯। এর মধ্যে অমুসলমানদের জন্যে ৭২। তারা স্বতন্ত্রভাবেই নির্বাচনে নেমেছে। মুসলিম আসন সংখ্যা ২৩৭। নির্বাচনের সময়কালেই বোঝা গেলো মুসলিম লীগ গো হারা হারবে। যুক্তফ্রন্টের নেতাদের মোকাবেলা করার মতো তাদের কোনো নেতা নেই। শুধু পাকিস্তান সৃষ্টির পর ৭ বছরের ইতিহাস আছে নির্যাতন ও বঞ্চনার। এই নির্যাতন ও বঞ্চনার প্রতিবাদে প্রণীত হয়েছিল যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা। ঐ ২১ দফায় ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, শহীদমিনার নির্মাণ, ২১ ফেব্রুয়ারি ছুটি, প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের বাসভবন বাংলা ভাষা প্রচারের জন্যে ব্যবহারের দাবি নুরুল আমিনের বাসভবন বর্ধমান হাউস এখন বাংলা একাডেমী], দাবি ছিল কেন্দ্রের হাতে পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও মুদ্রা ব্যবস্থা রেখে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেবার। এ দাবি সারাদেশে নতুন উন্মাদনা সৃষ্টি করল। এর বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের কোনো যুক্তিই গ্রহণযোগ্য হলো না কোনো মহলে। তাদের পক্ষে সভা সমাবেশ করাই সম্ভব হলো না।

মেদাকুল থেকে বরিশাল এসে বুঝেছিলাম মুসলিম লীগ হেরে গেছে। আমাদের বেশিদিন আত্মগোপন করে থাকতে হবে না। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো ৮ মার্চ।

নির্বাচনের ফলাফল শুনতে সকল রাস্তায় ভিড়। সকল বাড়িতে এবং দোকানে তখন রেডিও ছিল না। রেডিওয়ালা দোকানের সামনে ভিড় হতো। মাইক্রোফোন লাগিয়ে খবর শোনানো হতো। তখন ভয়েস অব আমেরিকা বা বিবিসি’র তেমন নামধাম ছিল না। উল্লেখযোগ্য ছিল আকাশবাণী।

খবর আসতে থাকল যুক্তফ্রন্টের জয়ী হবার। প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীন পরাজিত হলেন ছাত্রলীগের এককালীন সম্পাদক খালেক নওয়াজ খানের কাছে। ২৩৭ আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট জিতল ২২৭টি আসনে। ৯ আসন পেল মুসলিম লীগ। পাকিস্তান সৃষ্টির দাবিদার মুসলিম লীগ পাকিস্তান সৃষ্টির ৭ বছরের মধ্যে পরাজিত হলো শতকরা ৯৭ ভাগ ভোটে। বাকি ৭২ অমুসলমান আসনে যারা জয়ী হলেন তারাও চরম মুসলিম লীগ বিরোধী। ব্যালটে একটি সংসদীয় বিপ্লব হয়ে গেলো সেকালের পূর্ব পাকিস্তানে।

সকলের ধারণা তখন বাইরে যাওয়া যায়। যুক্তফ্রন্ট জিতেছে। পুলিশ দেখলেও গ্রেফতার করবে না। তেমন বিশ্বাস না হলেও একদিন সন্ধ্যার দিকে বের হলাম। হঠাৎ দেখা হলো এসপি সাহেবের সঙ্গে। বললেন, আপনি খুনের মামলার আসামী। এভাবে বের হলে আমাদের চাকরি থাকে না। আদালতে যান। জামিন পেয়ে যাবেন। অন্যান্য সকলে জামিন পেয়েছেন। বুঝলাম আমার বের হওয়া নিরাপদ নয়। যুক্তফ্রন্ট জিতেছে বলে আমাকে ধরতে পারছে না পুলিশ।

দিন সাতেক পর সিদ্ধান্ত হলো আদালতে আত্মসমর্পণ করব। এতদিনে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। আমাকে জামিন দিতেই হবে। কিন্তু তেমনটি হলো না। আমিসহ দশজন ছাত্র আদালতে হাজির হলাম। আমাদের উকিল সদ্য নির্বাচিত পরিষদ সদস্য এন ডব্লিউ লিয়াকতউল্লাহ এবং অ্যাডভোকেট শমসের আলীসহ অসংখ্য আইনজীবী। ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে ব্যতীত ৯ জনকে জামিন দিলেন। বললেন আমার বিরুদ্ধে খুন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, লুটপাটের অভিযোগ আছে। আমি বরিশাল নয়, ফরিদপুর জেলার অধিবাসী অর্থাৎ ভিন্ন। জেলার লোক। তাই আমাকে জামিন দেয়া যাবে না।

আমাকে জামিন না দেয়ার তীব্র প্রতিক্রিয়া হলো। আদালত প্রাঙ্গণে ছাত্রদের ভিড় জমতে শুরু করল। তাদের থামানো মুশকিল। অবস্থা সামাল দেয়া না হলে হয়তো ভাঙচুর হবে। ছাত্রলীগ নেতারা উকিলদের কাছে বললেন, পরিস্থিতি সামলানো মুশকিল হবে। উকিলেরা হাকিমের সঙ্গে কথা বললেন। এবার আমার জামিন হলো। তবে শর্ত দেয়া হলো শুধু উকিল নয়, নগদ অর্থ জামিন থাকিবে। সেই হাকিম সাহেবের কথা এখনো মনে আছে। তিনি পরবর্তী হাজিরার দিনও আমার জামিন বাতিলের চেষ্টা করেছিলেন। আবার সেই হাকিম সাহেবই দেশে ৯২(ক) ধারা জারি হলে আমার অনুপস্থিতিতে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণে রাজি হননি। আমি তখন পলাতক। যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিয়ে পাকিস্তান সরকার জেলে পুরেছে হাজার হাজার যুক্তফ্রন্টের নেতা ও কর্মীদের।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জামিন পেলাম। ভেবেছিলাম ভালো থাকব। বিএসসি পরীক্ষা জুন মাসে। এবার পরীক্ষা দিতে পারব। এ পরীক্ষা দেবার কথা ছিল ১৯৪৮ সালে। গ্রেফতার হবার কারণে পরীক্ষা দেয়া হয়নি। আশা ছিল এবার জেল এড়াতে পারব। পরীক্ষা দেবো নিয়মিত। কিছুদিন পর মনে হলো এবারও পরীক্ষা দেয়া হবে না। বিপুল ভোট যুক্তফ্রন্ট নির্বাচিত হলো। কিন্তু সরকার গঠন নিয়ে একমত হতে পারল না।

ঠিক হলো ২ এপ্রিল যুক্তফ্রন্টের নেতা নির্বাচিত করা হবে। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক যুক্তফ্রন্টের নেতা নির্বাচিত হলেন। কিন্তু মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে শেরেবাংলা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে একমত হলেন না। অনেক বাদানুবাদ হলো। শেষ পর্যন্ত তিনজন সদস্য নিয়ে শেরেবাংলা, প্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। অনেক কাঠখড় পোড়ানার পর ১৫ জন সদস্য নিয়ে যুক্তফ্রন্ট সম্প্রসারিত হলো ১৫ মে।

প্রতিপক্ষ এ সুযোগই খুঁজছিলেন। প্রতিপক্ষ হচ্ছে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার। সামরিক বেসামরিক আমলা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তখন পাকিস্তান সরকারের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচণ্ড প্রভাব। তখন সারাবিশ্বে ঠাণ্ডা যুদ্ধের কাল। এই ঠাণ্ডা যুদ্ধের শুরু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মান জাপান ইতালির বিরুদ্ধে মিত্রশক্তি অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে নেমেছিল। এবং জিতেছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের রাজনৈতিক আদর্শ ছিল একেবারে বিপরীতমুখী। প্রথম মহাযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছিল। পাশ্চাত্যের শাসকবর্গ অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের ভয় ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরেও এমন ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাদের লক্ষ্য ছিল শুধু জার্মানিকে পরাজিত করা নয়, পরবর্তী সময়ে কমিউনিজম অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব খর্ব করা। অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের লক্ষ্য ছিল

সমাজতান্ত্রিক শিবিরে প্রভাব বলয় বৃদ্ধি। এই দুশিবিরের প্রভাব বলয় বৃদ্ধির প্রতিযোগিতার নামই ছিল ঠাণ্ডা যুদ্ধ। এ যুদ্ধ প্রকাশ্যরূপ নিয়েছিল কোরিয়ায়। এ প্রতিযোগিতায় পৃথিবী তিনভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এই তিনটি ভাগ হচ্ছে (১) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিরোধী শিবির; (২) সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক শিবির; (৩) যুগোস্লাভিয়া, ভারত, মিসর, ইন্দোনেশিয়ার নেতৃত্বে জোট নিরপেক্ষ শিবির। এই তিন ভাগের প্রথম ভাগের সঙ্গে ছিল পাকিস্তান। দ্বিতীয় ভাগে নিরপেক্ষ ভারত। অপরদিকে কমিউনিস্ট চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের কাছে পাকিস্তান ছিল গুরুত্বপূর্ণ তার ভৌগলিক অবস্থানের জন্যে। এবং অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তানে মুসলিম লীগ সরকারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সেই পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুসলিম লীগ উৎখাত হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল তাদের কাছে। তাই পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ হেরে যাওয়ার পর তঙ্কালীন পাকিস্তানের মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে এ নির্বাচনের প্রভাব পড়বে না। ভাবখানা যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই সকল নীতি নির্ধারক। তবে প্রকৃতপক্ষে অবস্থা তেমনই ছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের পরাজয়ের পর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ভেঙে খান খান করার। এর অন্যতম কারণ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত সদস্যদের প্রকাশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা এবং ষড়যন্ত্রে প্রত্যক্ষ শরিক ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল পাকিস্তানকে কমিউনিস্টবিরোধী ঘাঁটি বানাতে। পেশোয়ারে বিমান ঘাঁটি মার্কিন বিমানকে ব্যবহার করতে দেয়া হতো সোভিয়েত ইউনিয়নে গোয়েন্দাবৃত্তি করার জন্যে। আর প্রস্তুতি চলছিল পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরের। পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের পূর্বেই এ চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে। নবনির্বাচিত পরিষদের অধিকাংশ সদস্য এ চুক্তির বিরুদ্ধে স্বাক্ষর অভিযানে সাড়া দেয়। তাই পূর্ব পাকিস্তানের বিজয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে উদ্বেগের কারণ হয়। পূর্ব পাকিস্তান সরকারকে উৎখাত করা তাদের কর্মসূচির অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় কালাহান নামক একজন মার্কিন সাংবাদিক পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। তিনি প্রচার শুরু করেন যে, হক সাহেব দু’বাংলার ঐক্য চান। আর এই ষড়যন্ত্রের অপর এক পর্যায়ে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত হওয়ার দিন ১৫ মে আদমজীতে ভয়াবহ বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা হয়। প্রমাণ করার চেষ্টা হয় যে–পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকারের অধীনে অবাঙালিরা আদৌ নিরাপদ নয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ক্ষমতা সংকোচন করতে শুরু করে এবং সদলবলে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে করাচি ডেকে পাঠানো হয়।

অভিযোগ আনা হয় যে, যুক্তফ্রন্ট সরকার দু’বাংলা এক করতে চাচ্ছে। নির্বাচনের পর পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কলকাতা গেলে তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা দেয়া হয়। সেই সংবর্ধনা সভায় হক সাহেব নাকি এমন কথা বলেছেন, যার অর্থ হচ্ছে, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান। অপমানজনকভাবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কালাহানকে সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করায়। হক সাহেবদের বিবৃতি দিতে হয় যে, তারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা চান না।

কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। হক সাহেব ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা ঢাকা ফিরতে ফিরতে পূর্ব পাকিস্তানে ৯২(ক) ধারা অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট শাসন জারি হলো। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়া হলো। গভর্নর হয়ে এলেন ইস্কান্দার মীর্জা ও চিফ সেক্রেটারি হয়ে এলেন এনএম খান। গ্রেফতার হলেন শেখ মুজিবুর রহমানসহ হাজার হাজার নেতা ও কর্মী।

বরিশালে আমরা কী করব? গ্রেফতার অনিবার্য। এমনই খুনের আসামী এবার পুলিশ কিছুতেই ছাড়বে না। মাত্র কিছুদিন আগে স্কুল-কলেজ খুলেছে। নতুন করে ধর্মঘট ডাকাও কঠিন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, আদালতে হাজির হতে পারবো না। জামিন বাতিল হবে। হুলিয়া জারি হবে। বরিশাল থাকা যাবে না। থাকা যাবে না বাড়িতে। অপরদিকে কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে বা না নিয়ে অন্যান্য দলের সকল নেতারা গা ঢাকা দিয়েছে। ক্ষেপে গেছে ছাত্ররা। তাদের দাবি একটা কিছু করা প্রয়োজন এবং করতে হবে।

কিন্তু হরতাল করা কি আদৌ সম্ভব? সিদ্ধান্ত হলো বরিশালের একটি স্কুলে উদ্যোগ নিয়ে দেখা যাক। বরিশাল শহরের ব্রজমোহন স্কুল অর্থাৎ বিএম স্কুলে ছাত্রসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সেখানে তখন আব্দুল মান্নান হাওলাদার পড়ত। আবদুল মান্নান হাওলাদার আবদুল মান্নান নামে পরিচিত। প্রথমে আমাদের দল আরএসপি করত। ঢাকায় এসে পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হয়। পরে আমাদের ছেড়ে শ্রমিক লীগে যোগ দেয়। দেশ স্বাধীন হবার পর লালবাহিনী গঠন করে। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়।

সিদ্ধান্ত হয় ওই স্কুলেই একদিনের ধর্মঘট ডাকতে হবে। আমি একটা ছোটো কাগজে স্বাক্ষর দিয়ে লিখে পাঠালাম। কাগজটি স্কুলের দেয়ালে সেঁটে দেয়া হলো। ধর্মঘট হলো। বিএম স্কুলে কোনো ঘোষণা ব্যতীতই।

এবার পুলিশ তৎপর হলো। আমার আর বরিশাল থাকা সম্ভব নয়। সে সময়ের একটি মজার ঘটনা এখনো আমার মনে আছে। বিএম স্কুলে ধর্মঘট করতে গিয়ে আমাদের একজন ছাত্রকর্মী তিমির রায় চৌধুরী গ্রেফতার হয়ে গেল। সেদিন কালীপূজা। রাতে অন্য ছেলেরা এসে বলল, তিমিরের মা কালী মায়ের কাছে প্রার্থনা করেছেন–এতে লোক মারা যাচ্ছে, নির্মল সেন মারা যাচ্ছে না কোনো। নির্মল সেন মারা গেলে আমার ছেলেটাকে জেলে যেতে হতো না। সেদিন অনেক সঙ্কটের মধ্যেও হাসি পেয়েছিল। তিমিরের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল সর্বশেষ ১৯৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গে। তিমির একটি কলেজের বাংলার অধ্যাপক। জানি না এখন কোথায় কিভাবে আছে।

আমার তখন মারা যাবার সময় ছিল না। কোথায় যাব? শেষ পর্যন্ত বরিশাল ছাড়বার সিদ্ধান্ত নিলাম। ক’দিন পর বিএসসি পরীক্ষা। এবারে পরীক্ষা দেয়া হবে না। আবার গৌরদী থানার মেদাকুল। মেদাকুল থেকে মাদারীপুর। মাদারীপুর থেকে একদিন লঞ্চে সুরেশ্বর। সুরেশ্বর থেকে। গোয়ালন্দ-নারায়ণগঞ্জের স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকা। তখন ১৯৫৪ সালের জুন মাস।

নারায়ণগঞ্জ থেকে সন্ধ্যার দিকে ঢাকায় পৌঁছালাম। শৈশবে ঢাকায় ছিলাম। বাবা ইস্টবেঙ্গল ইন্সটিটিউশনে শিক্ষকতা করতেন। বই লিখতেন। তারপর আবার ঢাকা এলাম দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। বাবা বই লিখতেন বিভিন্ন লাইব্রেরির। ভিন্ন নামে সে বই বিক্রি হতো। আমার মেসো প্রিয়নাথ সেন ছিলেন লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলের অন্যতম মালিক। মামা ছিলেন বাংলাবাজার বইয়ের দোকানের মালিক, শিক্ষক। ঢাকা বোর্ডের বইয়ের একমাত্র সরবরাহকারী। আর এক মেসো ছিলেন উকিল। সে সব বিভাগপূর্ব ১৯৪৭ সালে। দেশ বিভাগের পর যাঁরাও বা ছিলেন তাঁরাও চলে গেছেন ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর। সুতরাং এবার ১৯৫৪ সালে ঢাকায় থাকার সমস্যা প্রকট। পকেটে আট টাকা দশ আনা। চশমার বাট ভেঙে গেছে। দু’টি জামা, দু’টি পাজামা, দুটি লুঙ্গি, দুটি হাফপ্যান্ট সম্বল। উঠলাম দলনেতা অর্থাৎ আরএসপির নেতা নিতাই গাঙ্গুলীর মেসে।

নিতাই গাঙ্গুলী দেশ বিভাগের পূর্বে ঢাকা জেলা আরএসপি’র সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারিদের আন্দোলনের সময় ১৯৪৯ সালে গ্রেফতার হন শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতার সঙ্গে। অন্যান্য সকলে মুক্তি পেলেও নিতাই গাঙ্গুলী মুক্তি পেলেন ১৯৫৩ সালে। তাঁকে মুক্তি দিয়ে বলা হলো–আপনাকে আপনার মামাবাড়ি কেরানীগঞ্জ থানার  শুভাড্ডায় অন্তরীণ করা হলো। শুভাড্ডায় গিয়ে দেখা গেলো আমাদের ভিটি পর্যন্ত অপরের দখলে। কেউ কোথাও নেই। নিতাই গাঙ্গুলী ঐ নির্দেশ অমান্য করে ঢাকায় থেকে গেলেন। চাকরি পেলেন ঢাকেশ্বরী মিলের সদর দফতর ঢাকায়। এর একটি ইতিহাস আছে। ব্রিটিশ যুগে বাঙালি মালিকানায় অনেক মিলকারখানা গড়ে উঠেছিল। এরা সেকালের স্বদেশী আন্দোলনে সাহায্য সহযোগিতা করত। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অগ্নিযুগের বিপ্লবী দল অনুশীলন সমিতিকে সবদিক থেকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। তাই ঢাকেশ্বরী মিলে প্রথমদিকে নিতাই গাঙ্গুলীর চাকরি পেতে বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু সে চাকরিও টেকেনি ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি হবার পর। ঢাকেশ্বরীর চাকরি ছেড়ে তাকে সংগ্রহ করতে হয়েছিল দৈনিক মিল্লাতে সহ সম্পাদকের চাকরি। ১৯৫৯ সালে শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার এড়াতে তিনি দেশান্তরী হন।

হাটখোলা রোডে ঢাকেশ্বরী মিলের প্রধান দফতর ছিল। পাশে ছিল মেস। একদিন সন্ধ্যায় মেসে এসে উঠলাম। নিতাই বাবুর চাকরিও খুব বড়ো চাকরি নয়। তার ওপর কদিন থাকব। আমিই বা কোথায় যাব। খুনের আসামী। দিনে-দুপুরে বের হওয়া মুশকিল।

ঠিক হলো ছাত্র পড়াব। যতদূর লুকিয়ে সম্ভব অন্যত্র থাকব। নাম পাল্টাব। এ ব্যাপারে সাহায্য করলেন মানিকগঞ্জের অনিল চৌধুরী। এককালে কংগ্রেস করে জেল খেটেছেন। অনেক মহলে পরিচিত। তিনি বললেন, এক বাসায় ছাত্র পড়াবার কথা। রাজি হয়ে গেলাম। এর আগে তেমন ছাত্র পড়াইনি। বরিশালে দু’একটি ছাত্র পড়িয়েছি। তাও বেশিদিন নয়। কিন্তু উপায় নেই। কী করা যাবে।

অনিল বাবু বললেন, শিক্ষকতা করতে হলে ইন্টারভিউ দিতে হবে। সেই ইন্টারভিউ দিতে হলো দুপুর বেলা। রিকশায় হুড দিয়ে হাটখোলা থেকে পুরান মোগলটুলিতে মুকুল ফৌজের অফিস। মুকুল ফৌজের পরিচালক মোহাম্মদ মোদাব্বের হোসেন। ওই বাসা থেকে অর্ধসাপ্তাহিক পাকিস্তান নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ওই বাসায় পড়াতে হলে আমাকে কথা বলতে হবে মোহাম্মদ মোদাব্বের-এর সাথে। মোহাম্মদ মোদাব্বের কলকাতার দৈনিক আজাদের বাঘা বার্তা সম্পাদক ছিলেন। ঢাকায় মিল্লাতের সম্পাদক ছিলেন। বরিশাল থাকতে তার নাম শুনেছি। স্কুলে পড়াবার সময় তার লেখা ‘সন্ধানী আলো’ বইটি পুরস্কার পেয়েছিল। রাজনীতির দিক থেকে কড়া মুসলিম লীগ হলেও বিশ্বাসের দিক থেকে ছিলেন র‍্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট অর্থাৎ মানবেন্দ্র রায় (এমএন রায়)-এর অনুসারী। আর আমাদের দল আরএসপি সম্পর্কে তিনি ভালো করেই জানতেন। আরো জানতেন যে, বরিশালে তাঁর মুকুল ফৌজের অনেকেই আমাদের প্রতি অনুরক্ত।

সঙ্গে অনিল চৌধুরী। দুপুর রোদে গিয়ে হাজির হলাম মোদাব্বের সাহেবের বাসায়। দেখা হতেই জিজ্ঞাসা করলেন-তোমার নাম?

–নির্মল সেন।

নির্মল সেন? তুমি পাঁচ বছর জেলে ছিলে। তুমি খুনের আসামী। তোমার নামে হুলিয়া আছে–ধরে দিলে ৫ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে এমন কথা আমি শুনেছি।

মোদাব্বের সাহেব যেনো এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন। অনিল বাবু আমার দিকে বারবার তাকাতে থাকলেন। আমিও অবাক হতে থাকলাম। ভাবলাম এ ভভদ্রলোক এতো কথা জানেন কী করে? বুঝলাম এখানে শিক্ষকতা করা আমার হবে না।

আমি বললাম, সবই সত্যি। তবে পাঁচ হাজার টাকা ঘোষণার কথা শুনিনি। এবার মোদাব্বের সাহেব ভিন্ন কথা তুললেন। বললেন, তুমি ভয় পেও না। তোমার কাকা ড, ধীরেন্দ্রনাথ সেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান–হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদক। তাঁর সঙ্গে আমার কলকাতায় দেখা হয়েছিল। তিনি একবার তোমার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনকে বলতে। নাজিমুদ্দীন-সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তোমার কাকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আমি তোমার কথা নাজিমুদ্দীন সাহেবকে বলতে ভুলে গেছি। আজ হঠাৎ তোমার নাম শুনে সে কথা মনে হলো। কিন্তু আমার প্রশ্ন–তুমি এভাবে ছাত্র পড়াতে এলে কেন? তোমার তো ছাত্র পড়িয়ে বাঁচার কথা নয়।

আমি বললাম, এ প্রশ্ন আপনার করবার কথা নয়। আমি এসেছি এটাই সত্য। মোদাব্বের সাহেব চুপ করে গেলেন। বললেন ঠিক আছে, এখানে পড়াবে। আমি বললাম, থাকার জায়গা নেই? তিনি বললেন, তা হবে না। তবে তোমাকে কথা দিতে পারি আমার বাসায় পড়ালে তুমি জেলে গেলেও আমি সাহায্য করতে পারব।

আমি আর বেশি কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম। হাটখোলা নিতাই বাবুর মেস থেকে চলে এলাম। নাম পাল্টালাম। বনগ্রামে একটি মেসে জায়গা নিলাম। থাকা খাওয়া ৪৫ টাকা। ঐ টাকাও মাসে আয় করতে পারতাম না। বাড়ির লোক জানে না আমি কোথায়। কলকাতায় মা জানেন না আমি কোথায়। তার ধারণা আমার জেলে থাকা অনেক ভালো। তাহলে মা জানতে পারেন আমার স্থায়ী ঠিকানা। চিঠি লিখতে পারেন নিয়মিত।

পূর্ব পাকিস্তানে ৯২(ক) ধারা চলছে। ৯২(ক) ধারার শাসন হচ্ছে প্রেসিডেন্টের শাসন। অর্থাৎ প্রদেশে কোনো মন্ত্রিসভা থাকবে না। প্রেসিডেন্টের নির্দেশ অনুযায়ী চার এজেন্ট প্রদেশের গভর্নর আমলাদের নিয়ে শাসন চালাবে। এই আমলাদের দিয়ে শাসন চালু রাখতে হলে প্রয়োজন হবে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের বিশ্বস্ত লোক। তাই পূর্ব পাকিস্তানে ৯২(ক) ধারা জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গভর্নর ও চিফ সেক্রেটারি পাল্টানো হয়। তখন গভর্নর ছিলেন চৌধুরী খালিকুজ্জামান। তিনি ভারতের উত্তর প্রদেশের অধিবাসী। ভারত বিভাগের সময় মোহাম্মদ আলী জিন্নার পরিবর্তে ভারতের মুসলিম লীগের সভাপতি হন। ১৫ আগস্ট ভারতীয় গণপরিষদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে ভাষণ দেন। তারপর একদিন ভারতীয় মুসলমানদের নেতৃত্ব ছেড়ে পাকিস্তানে চলে আসেন এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগের এক সময় সভাপতি হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনি মুখ্যত রাজনীতিক। শোনা যায় এই রাজনীতিক গভর্নর একটি নির্বাচিত সরকারকে বাতিল করে পূর্ব পাকিস্তানে ৯২(ক) ধারা জারি পছন্দ করেননি। পাকিস্তান সরকার যাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেননি। তাই পূর্ব পাকিস্তানে ৯২(ক) ধারা জারির সঙ্গে সঙ্গে তাকে পাল্টানো হয়। গভর্নর হয়ে আসেন প্রতিরক্ষা সচিব মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা। একই সঙ্গে চিফ সেক্রেটারি ইসহাক সাহেবকেও পাল্টে দেয়া হয়। তিনিও নাকি নরমপন্থী ছিলেন, পরবর্তীকালে যিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ইসহাক সাহেবের পরিবর্তে চিফ সেক্রেটারি হয়ে এলেন জাঁদরেল আমলা এনএম খান। এনএম খান ইতিপূর্বে পূর্ব পাকিস্তানে চাকরি করেছেন। সেই সুবাদে অনেক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে পরিচিতি ছিলেন। তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্তির অন্যতম কারণ ছিল এক শ্রেণির রাজনীতিবিদের কেনাবেচার চেষ্টা করা।

পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে ৯২(ক) ধারা জারি করলেও প্রাদেশিক পরিষদ বাতিল করেননি। প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য তাঁদের সদস্যপদেই আছেন। পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশ্য ছিল এই সদস্যদের কেনাবেচা করে যদি একটি সরকার গঠন করা যায় এবং সে কাজটিই ইস্কান্দার মীর্জা ও এনএম খান শুরু করলেন পূর্ব পাকিস্তানে এসে। অর্থাৎ তাদের লক্ষ্য ছিল যুক্তফ্রন্ট ভাঙতে হবে। একটি অনুগত সরকার গঠন করতে হবে পূর্ব পাকিস্তানে। এ উদ্যোগের পেছনে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদ।

আগেই উল্লেখ করেছি যে, পৃথিবীর রাজনীতিতে তখন তিনটি ভাগ। একান্তই স্পষ্ট- (১) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেততে পাশ্চাত্যের শিবির, (২) সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক শিবির, (৩) যুগোশ্লাভ-ভারতের নেতৃত্বে জোট নিরপেক্ষ শিবির। সেকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো নর্থ আটলান্টিক চুক্তিসহ একের পর এক সমাজতান্ত্রিক শিবির বিরোধী জোট গঠন করা হচ্ছিল। অপরপক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ওয়ারশ চুক্তি। তৃতীয় বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র এই দু’জোটের সঙ্গে না গিয়ে একটি তৃতীয় জোট-জোট নিরপেক্ষ ধারা গঠন করে। পাকিস্তানের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত। ভারতের এই রাজনীতি পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনেও এই রাজনীতির প্রভাব পড়ে। সেই সময়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক চুক্তি সম্পাদনের উদ্যোগ নিচ্ছিল। আর সেই সময়ই পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র জয়লাভ করে। বিরাট সংখ্যক নবনির্বাচিত পরিষদ সদস্য পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিবৃতি দেয়। তাই যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দেয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। কারণ এই এলাকায় পাকিস্তানই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বস্ত বন্ধু।

এই দল ভাঙা শুরু হলো পূর্ব পাকিস্তানে ৯২(ক) ধারা জারির পর। পাকিস্তানের সরকার মুখ্যত আঘাত হানল আওয়ামী লীগ ও গণতন্ত্রী দলের বিরুদ্ধে। বেশি ক্ষত্রিস্ত হলো না হক সাহেবের কৃষক শ্রমিক পার্টি বা মওলানা আতাহার আলীর নেজামে ইসলাম। যুক্তফ্রন্টের তখন বেহাল অবস্থা। শেখ সাহেবসহ হাজার কয়েক কর্মী বন্দি। যুক্তফ্রন্টের সরকার তাকে নজরবন্দি করেছেন। আশরাফ উদ্দীন আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে যুক্তফ্রন্ট পরিষদ দলের সভা হলো। সিদ্ধান্ত হলো সাবেক মন্ত্রী এবং জাতীয় পরিষদের সদস্যগণ দলে দলে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করবেন। তবে সভাও শান্তিতে হলো না। পুলিশ এসে সকলকে চলে যাবার নির্দেশ দিলে সভা ভেঙে গেল। তবুও শেষ চেষ্টা করা হলো। হক সাহেবের কাছে যাওয়া হলো। তিনি এ কর্মসূচিতে রাজি হলেন না। সকলকে এলাকায় গিয়ে বিপ্লবাত্মক কর্মসূচি গ্রহণের পরামর্শ দিলেন। তাই যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে আর তেমন কিছু করা হলো না।

ইতোমধ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ১৬ জুন এক বক্তৃতা দিলেন। হক সাহেবদের দেশদ্রোহী বলে ঘোষণা করলেন। অভিযোগ করলেন হক সাহেব নাকি এ ব্যাপারে স্বীকারোক্তি করেছেন। এরপরে হক সাহেবের বাসায় পুলিশ পাহারা কড়াকড়ি করা হলো। তিনি কিছুতেই কোনো প্রতিবাদ করলেন না। মাওলানা ভাসানী তখন ইউরোপে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী অসুস্থ অবস্থায় বিদেশে। হক সাহেব নজরবন্দি। সুতরাং ৯২(ক) ধারার বিরুদ্ধে আন্দোলন তেমন জমল না। জমল ষড়যন্ত্র আর কোন্দল।

দেশে ৯২(ক) ধারা জারি। রাজনীতি সীমিত। আত্মগোপন করে আমার পক্ষে আর রাজনীতি করাও সম্ভব নয়। এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে গেল। আমি বিশ্ববিদ্যালয় যাবার পথে কার্জন হলের সামনে বাস থেকে নামতেই কয়েকজন গোয়েন্দা বিভাগের লোক আমার কাছে এল। পালাবার কোনো পথ। ছিল না। তাদের মধ্যে একজন বললেন, আপনার ভয় পাবার কিছু নেই। মনে হয় ভভদ্রলোককে আমি বরিশালে দেখেছি। তিনি বললেন, আপনাকে ধরা হবে না। যে কোনো কারণেই হোক, বরিশাল জেলা গোয়েন্দা বিভাগের দ্বিতীয় কর্মকর্তা (ডিআইও-২) ইউসুফ সাহেব আপনার প্রতি সদয়। তিনি বলেছেন, এ ছেলেটি বারবার ভুগছে। জেলে যাচ্ছে। পরীক্ষা দিতে পারছে না। এবার তাকে ডিস্টার্ব করবে না। তাকে ঢাকায় পড়াশুনা করতে বলো। তার গ্রেফতারি পরোয়ানা বরিশাল থেকে তার নিজের জেলা ফরিদপুরের গোপালগঞ্জে পাঠিয়ে দেবে। সে যেন বরিশাল না আসে বা বাড়ি না যায়।

কথাগুলো আমার তেমন বিশ্বাস হয়নি। তবে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও স্বস্তি পেলাম। গ্রেফতার না হয়েও চলে এলাম। সেদিন থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হব। আবার বিএসসি পরীক্ষা দেব। রাজনীতি শুরু করব। বরিশাল ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। ঢাকায় ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। আমি ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হলাম। তখন ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হলেন আবদুল মতিন তালুকদার এবং সম্পাদক ছিলেন এমএ আউয়াল।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার টাকা কোথায়? ছাত্র পড়ানো নিয়ে একদফা গোলমাল হয়ে গেছে। রাগ করে ছেড়ে দিলাম ছাত্র পড়ানো। ঘটনাটি ঘটেছিল মাইনের টাকা নিয়ে। জীবনে কোনোদিন পড়িয়ে টাকা নিইনি। তাই মাস চলে গেলেও টাকা চাইতে পারিনি। একদিন মোদাব্বের সাহেবের স্ত্রী বললেন, তোমার কি টাকার প্রয়োজন নেই? এই বলে আমার পকেটে টাকা খুঁজে দিলেন। আমি টাকা গুনিনি। মেসে এসে দেখলাম টাকার অংশ নির্ধারিত টাকার চেয়ে বেশি। অর্থাৎ আমাকে বেশি টাকা দেয়া হয়েছে না বলে। মাথা টনটন করে উঠল। ভাবলাম, আমাকে কি বকশিশ দেয়া হলো আমাকে না বলে! পরদিন পড়াতে গিয়ে বললাম, আপনাদের টাকা ফিরিয়ে নিন। আমি আর আপনাদের বাসায় পড়াব না। তারা বিস্মিত হলেন।

মোদাব্বের সাহেবের স্ত্রী হোসনে আরা। ড. শহীদুল্লার ভাইয়ের মেয়ে। শিক্ষা জীবনে কংগ্রেসী রাজনীতি করেছেন। কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে মাউন্ট পুলিশ ডিঙিয়ে কংগ্রেসের পতাকা উড়িয়েছেন। দেশ ভাগ হওয়ার পর ঢাকায় এসেছেন। সারাদিন তিনি সাপ্তাহিক পাকিস্তানের কাজ করেন। ঘর গোছান, ছড়া লেখেন। অতিথিদের আপ্যায়ন করেন। প্রতি শুক্রবার অর্ধ-সাপ্তাহিক পাকিস্তান বের হবার দিন। চার ছেলে এক মেয়ে নিয়ে কাগজ ভাঁজ করেন। টিকিট লাগান। ডাকে পাঠান। সে এক আশ্চর্য কাণ্ড। সারাদিন বাড়ির সকলে ব্যস্ত।

আমার কথা শুনে বিস্মিত হলেন। বললেন, তুমি ভুল বুঝেছ। তুমি খুব ভালো পড়াও। তোমাকে দ্বিগুণ টাকা দেয়া উচিত। তাই আমি আর সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু টাকা বেশি দিয়েছি। তাতে মনে করার কী আছে। আমার মেজাজ তখন তিরিক্ষি। বললাম, আপনি আমাকে বললেন না কেন? রিকশাওয়ালাকে দশ আনার পরিবর্তে বারো আনা দিলে খুশি হয়, আমি রিকশাওয়ালা নই। এ টাকা আমি নেবো না। এই বলে টাকা রেখে চলে গেলাম।

কিন্তু এরপর কী করবো। মেসের টাকা বাকি পড়েছে। আত্মীয়স্বজন কেউ আমার কথা জানে না। শুনেছি আমি বরিশাল ছাড়বার পর মেজো কাকার ছেলে নাকি এসেছিল বরিশালে আমার খোঁজে। ফিরে চলে গেছে আমাকে না পেয়ে। আমিও তাদের কোনো খোঁজ দিইনি। কারণ বারবার পুলিশ যাবে বাড়িতে। হেনস্তা হবে। যাদের আমি কোনোদিন সাহায্য করতে পারিনি তারা হেনস্তা হোক আমার জন্যে তা আমি চাইনি। কলকাতায়ও চিঠি লিখিনি মা বা ভাইয়ের কাছে। জেলে থাকা পর্যন্ত কলকাতা থেকে ডাকে টাকা আসত। কিন্তু পাসপোর্ট চালু হবার পর সে পথও বন্ধ।

এর মধ্যে একদিন অনিল চৌধুরী এলেন আমার মেসে। বললেন, তুমি নাকি টিউশনি ছেড়ে দিয়েছ? বললাম, হ্যাঁ। বললেন, এবার কী করবে? তুমি পলাতক খুনের আসামী, এ পরিচয়ে কোথাও আর ছাত্র পড়াতে পারবে কি? যে বাসায় তুমি পড়াতে তারাও তোমাকে চিনে ফেলেছে। তুমি এক বাসায়ই পরিচিত থাকো মামলা থাকা পর্যন্ত। মোদাব্বের সাহেবের স্ত্রী তোমাকে যেতে বলেছেন।

আবার সে বাসায় গেলাম। এবার সমঝোতা হলো আগামী মাস থেকে আমাকে বর্ধিত বেতন দেয়া হবে। আগের মাসে দেয়া বাড়তি টাকা আমি নেব না। মোদাব্বের সাহেবের স্ত্রী দুঃখ পেলেন। বললেন, তোমার বাবা মার মতো আমাদের বয়স। এতে অপমান বোধ করছ কেনো? আমি এবার সব টাকাই নিলাম। দোকানে গিয়ে বাড়তি টাকা দিয়ে বই কিনে ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে দিলাম।

ছাত্রছাত্রী পড়াতে গিয়ে এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমার বারবার হয়েছে। লক্ষ করেছি প্রতিটি বাসায় প্রাইভেট টিউটর কাজের মানুষের মতোই একজন। এরা বাড়ির কাজের লোকের মতো টাকা নেয়। অথচ চাকর নয়। এরা রক্তের সম্পর্কে অভিভাবক নয়। অথচ উপদেশ দেয়। অনেক ক্ষেত্রে এই অবস্থানটি টিকিয়ে রাখা কষ্টকর। অনেকে প্রাইভেট টিউশনি করতে গিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকে। জল খাবার প্রত্যাশা করে। মাসের পর মাস টাকা না দিলে মুখ ফুটে বলতে পারে না। অনেক বাসায় মেয়ে পড়াতে গেলে দোরগোড়ায় ঝি বসিয়ে রাখা হয়। কখনোবা হঠাৎ করে অভিভাবকদের মধ্যে কেউ এসে মাস্টারের চরিত্রের পরীক্ষা নেয়।

কথাটি আমাকে মোজাম্মেল দা বলেছিলেন প্রথমে। আগেই বলেছি, মোজাম্মেল হক আমাকে রাজনীতিতে এনেছিলেন। এককালে আরএসপি করতেন। সাংবাদিক ইউনিয়নের সম্পাদক হয়েছিলেন। অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলাসেকালের দৈনিক পাকিস্তানের প্রথম বার্তা সম্পাদক ছিলেন। তিনি চাননি আমি পাকিস্তানে থাকি। তিনি বলেছিলেন, কী করে থাকবে? বললাম, টিউশনি করব। মোজাম্মেল দা বললেন, তুমি পারবে না, নির্মল। যে সমাজে তুমি মানুষ হয়েছে-মুসলিম সমাজ সেটা নয়। এখানে কোনো বাড়িতে গেলে তোমাকে চাকর দিয়ে চা দেবে। তুমি কোনো চুড়ির শব্দ শুনবে না। তুমি কলকাতায় চলে যাও। আমি বলেছিলাম, মোজাম্মেল দা, আমি পারব। দেখুন না কী হয়।

পরে বুঝেছি আমার মানসিকতা নিয়ে টিউশনি করা মুশকিল। আমি বলতাম–আমি সপ্তাহে প্রতিদিন আসতে পারি। কোনোদিন নাও আসতে পারি। তবে শর্ত হচ্ছে–আমাকে কোনোদিন জিজ্ঞাসা করা যাবে না–আমি কেন গতকাল আসিনি। অনেক বাসায়ই এ শর্তটি মনে রাখতে পারত না। কোনোদিন অনুপস্থিত থাকলে জানতে চাইত, কেনো আগের দিন আসিনি। আমাকে সঙ্গে সঙ্গে কোনো চিন্তা-ভাবনা না করেই বলতে হতো, কাল থেকে আমি আর পড়াব না। আমি তোমাদের কোনো ফার্ম-এ চাকরি করি না যে কৈফিয়ত দিতে হবে। এভাবে অনেক টিউশনি আমি মাসের মাঝখানে ছেড়ে দিয়েছি। পকেটে পয়সা থাকেনি। মুড়ি খেয়ে দিন কাটিয়েছি ঢাকা শহরে। কেউ কোনোদিন জানতে পারেনি।

পাকিস্তানের রাজনীতি আবার সেই নির্দিষ্ট বলয়ে ঘুরপাক খেতে শুরু করল। পাকিস্তান মার্কিন ব্লকের রাষ্ট্র। কমিউনিস্ট বিরোধী শক্ত ঘাঁটি। পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচিত হলে কমিউনিস্টরা দেশ দখল করবে। পাশে ধর্ম নিরপেক্ষ জোটনিরপেক্ষ ভারত। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে সরকারে। সেই ভারতের পূর্বাঞ্চলে পূর্ব পাকিস্তান। তাই পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকার বহাল থাকা সঠিক নয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এ ধারণা দিতে পেরেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। তাই পূর্ব পাকিস্তানে ৯২(ক) ধারা জারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় সাহায্য-সহযোগিতা ছিল।

কিন্তু ইচ্ছে হলেই পূর্ব পাকিস্তানে সে সময় ৯২(ক) ধারা জারি না করে কোনো সরকারের পক্ষে নিরাপদ থাকা সম্ভব নয়। তাই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়ায় শেরেবাংলা ফজলুল হকের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার অভিযোগ করলেন।

ঘটনাটি ছিল এমন–পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করলে হক সাহেব প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি জীবনে শেষবারের মতো কলকাতা শহরে যান, যে শহরে তাঁর কর্মজীবন কেটেছে যে শহরে তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এখন কোলকাতা আর তার পার্শ্ববর্তী এলাকা পূর্ব পাকিস্তানে উদ্বাস্তুদের ভিড়। হক সাহেব কোলকাতায় গিয়ে বিপুল সংবর্ধনা পেলেন। সংবর্ধনার জবাবে হক সাহেব বললেন, বঙ্গদেশ খণ্ডনের দ্বারা বাঙালিকে, বাঙালি সত্তাকে, বাঙালি স্বকীয়তাকে, বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি ও বাঙালি মনের কামনাকে দু’টুকরো করা যায় না। যাবেও না। মতলববাজরা দেশটাকে দু’টুকরো করলেও এপার বাংলা, ওপার বাংলার ভাষা ঐ বাংলা ভাষা। মিথ্যার প্রাচীর থাকলেও এপার বাংলা, ওপার বাংলার মানুষ একই ভাষায় কথা বলে। সংস্কৃতিগতভাবে একইভাবে চলাফেরা করে। ইতিহাসের প্রয়োজনে আবার তারা একে অপরের নিকটবর্তী হবে।

কোলকাতায় দি স্টেটসম্যান এ ভাষণের শিরোনাম করল-হক সাহেব আশা করছেন, দু’বাংলার কৃত্রিম প্রাচীর থাকবে না। আনন্দবাজারের শিরোনাম–উভয়বঙ্গের মিথ্যার প্রাচীর ভেঙে ফেলার সংকল্প।

কোলকাতার পত্রিকার এই খবরকে কেন্দ্র করে ষড়যন্ত্র শুরু হলো। পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল হলো। হক সাহেব নজরবন্দি হলেন। পূর্ব পাকিস্তানের নতুন নিযুক্ত গভর্নর মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা সংবাদ সম্মেলনে বললেন, কোথায় মওলানা ভাসানী। আমি তাকে প্রয়োজনে গুলি করব। আমার শাসনের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করলে সহ্য করা হবে না। দরকার হলে আমি পূর্ব বাংলার জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে সৈন্যবাহিনী নিয়োগ করব। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করতে দশ বিশ হাজার মানুষ হত্যা করতেও পিছপা হব না।’ ২৩ জুলাই অন্তরীণ অবস্থায় হক সাহেব রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের ঘোষণা দিরেন।

পূর্ব পাকিস্তানে ৯২(ক) ধারা জারি হওয়ায় মুসলিম লীগের নেতারা খুশি হলেন। কিন্তু তাদের এ আনন্দও দীর্ঘস্থায়ী হলো না। গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ২৩ অক্টোবর গণপরিষদ ভেঙে দিলেন। মুসলিম লীগের অধিকাংশ নেতা ১৯৪৬ সালে নির্বাচন হওয়ায় গণপরিষদের সদস্য ছিল। এবার সে সদস্যপদও গেল। গভর্নর জেনারেলের কাজটি ছিল একান্তই অগণতান্ত্রিক। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে আনন্দের ঢেউ দেখা গেল। শত্রুর শত্রু আমার মিত্র। আমার শত্রু মুসলিম লীগ। সেই মুসলিম লীগ অধ্যুষিত গণপরিষদ গোলাম মোহাম্মদ ভেঙে দিয়েছে। সুতরাং গোলাম মোহাম্মদ আমার বন্ধু। তাই হঠাৎ যুক্তফ্রন্টের শরিক দল আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, গণতন্ত্রী দল এবং নেজামে ইসলাম গভর্নর জেনারেল ওপর খুশি হলো।

২৩ অক্টোবর গভর্নর জেনারেল গণপরিষদ ভেঙে দিলেন। প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফরে গিয়েছিলেন। তাঁকে দেশে ফিরবার জন্যে জরুরি বার্তা পাঠানো হলো। তিনি করাচি ফিরে এলে তাকে নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের নির্দেশ দেয়া হলো। ২৫ অক্টোবর মোহাম্মদ আলী দেশে ফিরে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। এই মন্ত্রিসভাকে বলা হলো মিনিস্ট্রি অব ট্যালেন্ট। বিজ্ঞজনদের মন্ত্রিসভা। এ মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হলো সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা, এককালের সীমান্ত প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী ড, খান সাহেব, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কৃষক শ্রমিক পার্টি নেতা আবু হোসেন সরকার, শিল্পপতি ইস্পাহানী, মোঃ শোয়েব চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী, মরি গোলাম আলী প্রমুখ। আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী তখন জুরিখে চিকিৎসাধীন।

আমরা হতভম্ব হলাম। এ কোন রাজনীতি। দীর্ঘদিন পর জনতার আশা আকাক্ষা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে মার্চ মাসে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচিত হলো। ২ এপ্রিল যুক্তফ্রন্টের পরিষদ দলের নেতা নির্বাচিত হলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। কিন্তু একটি যৌথ মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারলেন না। তিনি কৃষক শ্রমিক পার্টির আবু হোসেন সরকার, ভাগ্নে সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া এবং নেজামে ইসলামের আশরাফ উদ্দীন চৌধুরীকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল (সোহরাওয়ার্দী সাহেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও)। হক সাহেব রাজি হলেন না। ইতোমধ্যে চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলি পেপার মিলে বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা। অনেক আলোচনার পর ১৫ মে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত হলো–মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিবুর রহমান অন্তর্ভুক্ত হলেন। সে দিনই আদমজীতে বাঙালি-বিহারী দাঙ্গা হলো। হক সাহেবের কোলকাতার সংবর্ধনা সভায় একটি কথিত উক্তিকে ভিত্তি করে ৩০ মে পূর্ব পাকিস্তানে ৯২(ক) ধারা জারি হলো। বলা হলো, কমিউনিস্ট বিশৃঙ্খলা দমনে ব্যর্থ শেরেবাংলার মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করা হলো। ২ জুলাই বিবৃতি দিয়ে হক সাহেব রাজ চাকরি ছেড়ে দিলেন।

তখন দেশে এক চরম হতাশা। সেই মুহূর্তে নজরবন্দি হক সাহেবের সহকর্মী আবু হোসেন সরকার আর কারগারে আটক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার মন্ত্রী হলেন বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর অধীনে। এই মোহাম্মদ আলী অবিভক্ত বাংলার শেষ মন্ত্রিসভায় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অধীনে অর্থমন্ত্রী ছিলেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন বিদেশে ছিলেন। অনেকে আশা করলেন হয়তো বা তিনি দেশে ফিরে মন্ত্রিসভায় যোগ দেবেন না। এ সময়কার উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ৯২(ক) ধারার শাসনকালেই পাকিস্তান কমিউনিস্ট বিরোধী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া রক্ষা চুক্তি (সিটো)-এর সদস্য হয়।

এ মন্ত্রিসভা গঠনের পর ১৫ ডিসেম্বর গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ঢাকায় আসবেন বলে ঘোষণা করা হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের ধারণা হলো শহীদ সাহেব মন্ত্রিসভায় যাবেন। তাই কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের পক্ষে। সুতরাং গোলাম মোহাম্মদকে সংবর্ধনা জানালে তাদেরই মন্ত্রিসভা গঠনের জন্যে ডাকা হবে ৯২(ক) ধারা প্রত্যাহারের পর।

অপরদিকে ঢাকা আসার পূর্বে গোলাম মোহাম্মদ ঘোষণা দিলেন, শেরেবাংলা ফজলুল হক তার একান্ত বন্ধু। তিনি দেশের আদৌ শত্রু নন। ফলে কৃষক শ্রমিক পাটি ভাবল গোলাম মোহাম্মদকে সংবর্ধনা জানালে মন্ত্রিত্ব তারাই পাবে।

সুতরাং ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় কার্জন হলের সংবর্ধনা সভায় আতাউর রহমান এবং আবু হোসেন সরকার উভয়েই গোলাম মোহাম্মদকে মালা দিলেন। তখন পূর্ব পাকিস্তানের জেলে বন্দি হাজার হাজার নেতা ও কর্মী। আমরা আত্মগোপন করে আছি। আর আমাদের নির্বাচিত নেতারা মালা নিয়ে ছুটছেন–কে আগে স্বৈরশাসককে মালা দেবে।

১৯৫৪ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। সকলের তখন প্রতীক্ষা শহীদ সোহরাওয়ার্দী কবে দেশে ফিরবেন। তিনি বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভায় যোগ দেবেন কিনা।

আর এদিকে আমার জীবনে ১৯৫৪ সালের জুলাই মাস। অনেক দেনদরবার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অনুমতি পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ৯৮ টাকা প্রয়োজন। অনেক কষ্ট করে ৪৮ টাকা সংগ্রহ করেছি। বাকি ৫০ টাকার খবর নেই। হাতে মাত্র একদিন। বের হবার উপায় নেই। মনে হচ্ছে পুলিশ আবার সতর্ক হয়েছে। একদিন বন্যার জল দেখতে গিয়ে প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিলাম।

সেবার ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। ঢাকার বিভিন্ন সড়কে নৌকা চলত। ভাবলাম কোন এলাকায় কেমন বন্যা হয়েছে তা দেখে আসি। শুনেছিলাম মুন্সীগঞ্জ শহরে নাকি একহাঁটু জল। অনেক কষ্ট করে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে একটি ছোট লঞ্চে মুন্সীগঞ্জ পৌঁছলাম। সত্যি সত্যি মুন্সীগঞ্জে জল আর জল। বেশ কিছুক্ষণ জলের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করলাম। একটু একটু বৃষ্টি পড়ছে। এমন সময় দেখলাম এক ভভদ্রলোক ছাতি মাথায় দিয়ে আমাকে অনুসরণ করছেন। কিছুক্ষণ পর আমার কাছে এসে বললেন, আমি বরিশালের লোক। মুন্সীগঞ্জ থানার ওসি। আপনাকে আমি চিনি। এখনই ঢাকায় ফিরে যান। কেন এসেছেন এখানে গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে?

আমার আর বন্যা দেখা হলো না। আমি মুন্সীগঞ্জ গিয়েছি তাই কেউ জানে না। তাড়াতাড়ি ফিরতে হলো বৃষ্টির মধ্যেই। ঢাকা ফিরে বুঝলাম বিপদ কাটেনি। সব সময় বাইরে যাওয়া যাবে না। বাইরে না যেতে পারলে টাকা পাব কোথায়। দেশের কোনো লোকই আমার প্রকৃত পরিচয় জানে না। মাসে যা আয় করি তাতে মেসের খাওয়া এবং থাকার ভাড়া হয় না। হোটেল রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস নেই। আর পয়সাও নেই।

এই হোটেল রেস্টুরেন্টে খাওয়া নিয়েও কম বিপদে পড়িনি জীবনে। ছোটবেলায় শুনেছি খারাপ ছেলেরা হোটেল রেস্টুরেন্টে খায় এবং আজ্ঞা মারে। ভালো ছেলেদের এটা করণীয় নয়। সুতরাং বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে পড়বার প্রথম যুগে আমি কোনোদিন কোনো রেস্টুরেন্টে ঢুকিনি। আড্ডা মারিনি। চা খাইনি। কলকাতায় গিয়ে এই রেস্টুরেন্টে খাওয়া নিয়েই একবার বিপত্তি ঘটল।

আমার সঙ্গে আমার এক বোনের বর। কলকাতায় শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কে গিয়েছি। তিনি বললেন, এখানে রেস্টুরেন্টে ভালো চপকাটলেট আছে। চল রেস্টুরেন্টে খাই। আমি বললাম, ভালো ছেলেরা রেস্টুরেন্টে যায় না বা খায় না। তিনি আমাকে জোর করে নিয়ে গেলেন। একটি চপ কিনে দিলেন। আমার চোখে তখন জল। চোখের জলে আমার খাওয়া হলো না। শুধু ভাবলাম আমি খারাপ হয়ে গেলাম।

সেই আমি ঢাকায় ১৯৫৪ সালে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে বিপদে পড়লাম। শৈশবে শুনেছি ভালো ছেলেরা নেশা করে না। বিড়ি, সিগারেট, চা খায় না। তাই রেস্টুরেন্টে আমাকে নিয়ে গেলে অন্যের বিপদ হয়। মোজাম্মেল দা বলতেন, নির্মল চা খাও। তুমি চা খেলে সস্তায় হয়। চায়ের বদলে অন্য কিছু খেতে অনেক পয়সা প্রয়োজন। ১৯৪৮ সালে নতুন করে ভালো ছেলে হবার জন্যে চা ছেড়ে দিলাম। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় এসে সস্তায় কিছু খাবার জন্যে আবার চা খাওয়া শুরু করতে হলো।

প্রকৃতপক্ষে নিয়মিত চা খাওয়া ভুলে গিয়েছিলাম। একান্ত দু-একজন পরিচিত ব্যতীত কারো পয়সায় খাওয়া আমার ধাতে সইত না। সেই দিক থেকে নির্ভর ছিলেন একমাত্র নিতাই গাঙ্গুলী। তিনিও অল্প মাইনের চাকুরে।

সেই নিতাই গাঙ্গুলীই দুপুরের দিকে আমার মেসে এলেন। তখন শুয়ে শুয়ে ভাবছি কী করা যায়। আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির শেষ তারিখ। নিতাই বাবু বললেন, ব্যাপার কী অনেক দিন দেখা নেই। বললাম, টাকা নেই। আরো ৫০ টাকা প্রয়োজন। কালকে ভর্তির শেষ তারিখ। বললেন, শুয়ে থাকলে কি সমস্যার সমাধান হবে? আমি বললাম, আমি চার্লস ডিকেনস-এর ডেভিড কপারফিল্ডের মিকবার চরিত্র পছন্দ করি। এই বই আমাদের পাঠ্য ছিল ম্যাট্রিকে। মিকবার প্রায় সব সময়ই কপর্দকশূন্য থাকত। বলত একটা কিছু ঘটবেই (সামথিং উইল টার্ন আপ)। আমি সেই একটা কিছু ঘটবার আদর্শে বিশ্বাসী। তাই শুয়ে আছি। করার কিছু নেই।

নিতাই বাবু হাসলেন। পরের দিন ৫০ টাকা পাঠিয়ে দিলেন। আমি ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসির শেষ পর্বে। মাস খানেক পরে ঢাকা হলে (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল) সিট পেয়ে চলে গেলাম। আমার জীবনের আর এক অধ্যায় শুরু হলো।

হলে থেকেও আমার আত্মগোপনের একটি রাস্তা জুটে গেল। আস্তানা ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের টিবি ওয়ার্ড। আমাদের দলের সদস্য। পরবর্তীকালে দীর্ঘদিন দলের প্রথম সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান তখন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের আইএসসি’র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ১৯৫৪ সালের জুলাই মাসে ধরা পড়ল তার যক্ষ্মা হয়েছে। তখন ঢাকায় কোনো টিবি হাসপাতাল ছিল না। মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রধান ভবনের চারতলায় টিবি রোগীদের জন্যে একটি ওয়ার্ড ছিল। সিদ্দিকুর রহমান ভর্তি হলেন ওই ওয়ার্ডে। ৫৬ জন রোগী আর আমি। দিনের পর দিন মাসের পর মাস ওই হাসপাতালে গিয়েছি। ডাক্তার লুঙ্কর রহমান আমাকে ধমকাতেন। বলতেন, আপনি মারা পড়বেন। তখন দেখতাম রোগীদের নিকটতম আত্মীয়েরা নাকে রুমাল দিয়ে ওয়ার্ডে ঢুকত। তারা বুঝত না যে এতে রোগীরা মনে করে আমরা পরিত্যক্ত। নিঃসহায়। আমরা বড় একাকী। আমি কোনোদিন নাকে রুমাল দিয়ে যাইনি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দক্ষিণের জানালা খুলে বসে বসে গল্প করেছি। দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা। ওপারে জিনজিরা দেখেছি। দেখেছি বুড়িগঙ্গায় নৌকা চলা আর স্টিমারের হুল্লোড়। আমি নিশ্চিত ছিলাম এই ওয়ার্ডে পুলিশের লোক আমাকে খুঁজতে আসবে না।

তাও রাজনীতি এড়ানো গেল না। ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের। ১৯৫৪ সালে চারদিকে বন্যা। ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ সিদ্ধান্ত রিলিফ দিতে হবে। টাকা, কাপড় তুলতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের গ্রুপ ভাগ করে পাঠাতে হবে বিভিন্ন এলাকায়। এ নিয়ে একদিন বৈঠক বসল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠন ডাকসুর অফিসে। বৈঠকে একজন ছাত্রী বলল, তারা কিছুতেই ছেলেদের সঙ্গে যাবে না। তাকে আমি চিনি না। মনে হলো সে নেত্ৰীস্তরের হবে। এ নিয়ে সকলেই উত্তেজিত, বিতর্কে লিপ্ত। এক সময় হঠাৎ আমি বলে ফেললাম, তোমরা কেউ গেলে ভোরবেলা হলে গিয়ে কানধরে নিয়ে আসা হবে।

সকলে একেবারে নীরব হয়ে গেল। বিতর্কের ছাত্রীটি আমার কাছে এল। বলল, ঠিক আছে আমরা যাব। তবে আপনি ভোরবেলা এসে গ্রুপ ভাগ করে দেবেন। আপনাদের বিগলিত ব্যানার্জি মার্কা ছাত্রদের সঙ্গে আমরা যাব না। শুনলাম ছাত্রীটির নাম কামরুন্নাহার লায়লী। বাড়ি পিরোজপুরে। ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী। পরদিন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাইনি। শুনেছি ছাত্রছাত্রী সকলে এসেছে। গ্রুপ ভাগ করে চলে গেছে রিলিফের জন্যে টাকা আদায় করতে। ক’দিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলের কিছু ছাত্রীর বরাত দিয়ে আমার কাছে একটি চিঠি এল। সে চিঠিতে লেখা ছিল, আমরা শুনেছি আপনি আত্মগোপন করে আছেন। অর্থকষ্টে আছেন। আমরা আপনাকে অর্থ সাহায্য করতে চাই। কী করা যায়, আমাদের জানাবেন।

আমি জানতাম এদের মধ্যে অধিকাংশ ছাত্র ইউনিয়ন অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক। হয়তো এরা আমাকে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বলে ধারণা করেছে এবং সাহায্য করতে চাচ্ছে। আর সেকালে একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল–সকল বিপ্লবীরাই কমিউনিস্ট পার্টি করে। সকল মার্কসবাদী, লেনিনবাদীরাই কমিউনিস্ট। পূর্ব বাংলায় যে এককালে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল (আরএসপি)সহ অনেক বামপন্থী দল ছিল তা অনেকেরই জানা ছিল না। দেশ বিভাগের পর অনেক নির্যাতন সহ্য করেও কমিউনিস্ট পার্টি নিজস্ব কাঠামো ধরে রাখতে পারলেও অন্যান্য বামপন্থী দলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল চরমভাবে। আমি ভাবলাম নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলার প্রয়োজন। অন্যের পরিচয়ে সাহায্য নেয়া অন্যায়। তাই তাদের জানালাম, আমি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য নই। আমি বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল করি। সুতরাং আপনারা নিজের দলের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। আর এ মুহূর্তে আমার সাহায্যের প্রয়োজন নেই।

এবার প্রশ্ন উঠল আরএসপি কী? কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাদের তফাৎ কী। এ দুটি দল কি এক হতে পারে না? একদিন কামরুন্নাহার লাইলী এসে বললো, আপনাদের দু’দলের বসতে হবে। আমরা চাই আপনারা এক হোন। আমি বললাম, তুমি ব্যবস্থা করো। আমরা রাজি। লাইলীর সঙ্গে তখন আমার সম্পর্ক অনেক সহজ এবং তখন এই একটি ছাত্রীই দেখেছি আপাদমস্তক রাজনীতিক। বৈঠকের তারিখ নির্ধারিত হলো ২৯ আগস্ট। কামরুন্নাহার লাইলী জানাল, কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আলোচনার কথা তাকে জানিয়েছে তাদের খালেদা আপা। তাদের কাছে যতদূর শুনেছি খালেদা আপার প্রকৃত নাম যুঁইফুল বসু। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা কমরেড খোকা রায়ের স্ত্রী। এই ভদ্রমহিলার নাম আমি বরিশালে শুনেছি। তাঁর বাড়িও এককালে বরিশাল ছিল। তাঁর এক বোন আমাদের দল আরএসপি করত। সেই খালেদা আপাই নাকি কমিউনিস্ট পার্টির মেয়েদের নেতৃত্ব দিতেন। যদিও আজ পর্যন্ত কোনোদিন এ খবর আমি যাচাই করিনি। আমার এ ব্যাপারে একেবারেই আগ্রহ কম। ছদ্ম নামটি খালেদার পরিবর্তে রাবেয়া হতে পারে।

কিন্তু আমাদের পক্ষে কে আলোচনা করবে? আলোচনার বিষয়বস্তু কী হবে কামরুন্নাহার লাইলী বারবার এ প্রশ্ন নিয়ে এল। আমাদের সিদ্ধান্ত হলো আমরা কেউ নই, সিদ্দিকুর রহমানই আলোচনা করবেন। তিনি হাসপাতালে থাকলেও অনেকটা সেরে উঠেছেন। তাই কোথাও গেলে পুলিশ তাকে তেমন খোঁজ খবর নেবে না।

এখন তা হলে আলোচনার বিষয়বস্তু কী হবে? আমি লাইলীকে বললাম, সিদ্দিক দু’টি প্রশ্নের জবাব চাইবে। এ দু’টি প্রশ্ন হচ্ছে আরএসপি-কমিউনিস্ট পার্টির পার্থক্যের মূলকথা। (১) আরএসপি মনে করে লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিন সঠিক পথ গ্রহণ করেননি। লেনিন কখনো বলেননি যে একটি দেশে সমাজতন্ত্রের পূর্ণ বিজয় সম্ভব। কিন্তু স্ট্যালিন ক্ষমতায় এসে লেনিনের এ নীতি পরিহার করেন। অন্যদেশে বিপ্লবের দায়িত্ব না নিয়ে পৃথিবীর কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে সোভিয়েত পররাষ্ট্রনীতির লেজুড়ে পরিণত করেন। এক্ষেত্রে ট্রটস্কির নীতির সঙ্গে আরএসপি’র তফাৎ আছে। ট্রটস্কি বিশ্বাস করতেন ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে বিপ্লব না হলে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পূর্ণ বিজয়ও সম্ভব নয়। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রের বিনির্মাণ শুরু করাও সম্ভব নয়–আরএসপি’র মত হচ্ছে–অন্যদেশে বিপ্লব না করেও সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণের কাজ শুরু করা সম্ভব।

(২) আরএসপি মনে করে স্ট্যালিনের এই নীতি ত্রিশের দশকে ডিমিট্রিভ তত্ত্বের জন্ম দেয়। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক প্রস্তাবে বলা হয় যে, পৃথিবী তিনভাগে বিভক্ত–১. সোভিয়েত সমাজবাদ, ২. গণতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ, ৩. ফ্যাসিবাদ। ডিমিট্ৰিভের পপুলার ফ্রন্ট তত্ত্বে বলা হয়েছিল ফ্যাসিবাদকে রুখতে গণতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ঐক্য করা যায়। আরএসপি মনে করে ওই গণতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ঐক্যের নীতিই পরবর্তীকালে সহ-অবস্থানের নীতির জন্ম দেয়। ১৯৪৩ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের চাপে তৃতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে দেয়।

আমাদের এ দু’টি প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া গেলে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সমঝোতা কঠিন নয়। তবুও কামরুন্নাহার লাইলী চাপ দিতে থাকল আমাদের আলোচনায় বসাবার জন্যে। সর্বশেষ আমি বললাম, লাইলী এত ভেবে লাভ নেই। তোদর পার্টি আমাদের সঙ্গে বসবে না। বললেন, নির্মল সেন আত্মগোপন করলেও ৯২(ক) ধারায় আদলে তাদের নেতা নিতাই গাঙ্গুলী তার কার্যে বহাল তবিয়তে আছে। এরা সরকারের দালাল। তাদের সঙ্গে বসা যাবে না না। ঝুঁকি আছে। কারণ আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টি অন্য কাউকে কমিউনিস্ট মনে করে না। মনে করে মার্কিন দালাল। ওরা ছাড়া সাচ্চা কমিউনিস্ট বা প্রগতিশীল আর কেউ নেই। লাইলী আমাদের কথা বিশ্বাস করল না।

এরপর ক’দিন লাইলীর দেখা নেই। লাইলী এল ২৭ আগস্ট। সিদ্দিককে বলে গেল কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বৈঠক হবে না। কারণ তারা মনে করে আরএসপি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল। ওদের সঙ্গে বসলে ঝুঁকি আছে। সিদ্দিক মাস তিনেক হাসপাতালে থাকার পর বরিশাল চলে গেল। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বৈঠকের পর্ব এভাবে শেষ হলো। দেশের রাজনীতিতে তখন ভিন্ন। নাটক।

রাজনীতিতে সকলের দৃষ্টি তখন করাচির দিকে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রী হবেন-এ ঘোষণা দেয়া হয়েছে কিন্তু তিনি দেশে নেই বলে মন্ত্রিসভায় যোগ দেননি। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগের সিদ্ধান্ত, শহীদ সোহরাওয়াদীকে ঠেকাতে হবে। তিনি মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে আর রাজনীতি করা যাবে না।

ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে শহীদ সোহরাওয়ার্দী করাচি ফিরলেন। করাচিতে আওয়ামী লীগের আট নেতার বৈঠক। সকলেরই মত প্রধানমন্ত্রীত্ব পেলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভায় গেলে আপত্তি নেই। কিন্তু শহীদ সাহেব ভিন্ন কথা বললেন। তিনি বললেন, গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ তাকে ছ’টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রতিশ্রুতি ছ’টি হচ্ছে–(১) শহীদ সাহেব মন্ত্রিসভায় ঢুকবার তিনদিন (মতান্তরে তিন সপ্তাহ) পরে তাকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে। (২) আওয়ামী লীগের আরো দু’জন মন্ত্রী নেয়া হবে। (৩) সংবিধান রচনার ভার শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ওপর দেয়া হবে। (৪) ছ’মাসের মধ্যে সংবিধান রচনা শেষ করে একটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করা হবে। (৫) এক বছরের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন হবে। (৬) নতুন সংসদে সংবিধান সংশোধনের পূর্ণ অধিকার থাকবে।

আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ রাজি হলেন না। তাদের যুক্তি-কদিন পরেই যখন শহীদ সাহেব প্রধানমন্ত্রী হবেন, তখন আর আগে যোগ দিয়ে লাভ কি? কদিন পরে শহীদ সাহেব প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই মন্ত্রিসভা গঠন করুক। কিন্তু শহীদ সোহরাওয়ার্দী কোনো কিছুই মানলেন না। তিনি বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন ২০ ডিসেম্বর। পরবর্তী সময়ে দেখা গেলো, কেন্দ্রীয় সরকার শহীদ সাহেবকে দেয়া কোনো প্রতিশ্রুতিই মানছে না। একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব মুক্তি পেলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের নতুন কোনো মন্ত্রী নেয়া হলো না। উপরন্তু কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা আবু হোসেন সরকারকে মন্ত্রিসভার সদস্য করা হলো।

আমরা তখন সকল ঘটনার নীরব সাক্ষী। দেশে ৯২(ক) ধারা অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট শাসন। সভা মিছিল সমাবেশ করা মুশকিল। অপরদিকে নেতৃত্বের কোন্দল। প্রগতিশীল শক্তি বিভ্রান্ত। ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সমর্থক হলেও যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাক তা কেউ চায়নি। অথচ মনে হচ্ছে ষড়যন্ত্রকারীরা যুক্তফ্রন্ট ভাঙতে চাচ্ছে। সেই ষড়যন্ত্রে জেনে হোক না জেনে হোক শরিক হয়েছেন সকল দলের নেতবৃন্দ। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যুক্তফ্রন্টের নেতা শেরেবাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা হয়।

কিন্তু অনাস্থা প্রস্তাব এনে আওয়ামী লীগ লাভবান হলো না। কারণ পরিষদের সকলেই ছিল যুক্তফ্রন্টের মনোনীত সদস্য। কেউ আওয়ামী লীগ বা কেএসপির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়নি। তাই আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির সদস্য যুক্তি দেখাল–আমরা আওয়ামী লীগের নির্দেশ মানতে রাজি নই। নির্দেশ হতে হবে যুক্তফ্রন্টের। ফলে হক সাহেবের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনে আওয়ামী লীগ জিততে পারল না। আমরা শুধু দেখলাম। ১৯৫৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তফ্রন্টের নতুন নেতা নির্বাচিত হলো। ভোট নিয়ে অনেক হইচই হলো। বিকেলে টেলিগ্রাম বের হলো। উভয় পক্ষই দাবি করলেন তারাই জিতেছেন। আওয়ামী লীগ গ্রুপের নেতা হলেন আতাউর রহমান খান। কৃষক শ্রমিকের পার্টি কেএসপি দাবি করল অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয়নি। তাই তাঁরা জিতেছেন।

আমাদের মনে হলো, জিতেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদদে পাকিস্তানের সামরিক বেসামরিক আমলার নেতৃত্বে মুসলিম লীগের রাজনীতি। পূর্ব পাকিস্তানে যুজফ্রন্টের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর তারা আতঙ্কিত হয়েছিল। এবার তাদের শঙ্কা দূর হলো। আনুষ্ঠানিকভাবে বিভক্ত হলো পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট। এগিয়ে এলো ২১ ফেব্রুয়ারি।

২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস। ১৯৫৪ সালের সাড়ম্বরে পালিত হয়েছিল। এবার ১৯৫৫ সালে দেশে কোনো মন্ত্রিসভা নেই। মিছিল করা যাবে না। কোথাও গোপন বৈঠকও করা যাচ্ছে না। হলে হলে পুলিশের এজেন্ট। তাদের মধ্যে অনেকে এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। তখনকার লালবাগ থানার ওসির বাড়ি ছিল বরিশালে। তার এক ছোট ভাই একদিন আমার কাছে ঢাকা হলে এল। বললো, সরে যান। ভাইজান পাঠিয়েছে, আজ আপনাদের গ্রেফতার করতে পারে। আপনি গ্রেফতার হলে বিপদ হবে। আপনার বিরুদ্ধে খুনের মামলা আছে।

প্রকৃতপক্ষে আমার পক্ষে গ্রেফতার হওয়া সম্ভব ছিল না। হল থেকে দূরে চলে গেলাম। তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ আউয়াল। সভাপতি আব্দুল মমিন তালুকদার। যতদূর মনে আছে ২০ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে মিছিল করার চেষ্টা করায় ২১ ছাত্রীসহ অনেক ছাত্র গ্রেফতার হয়ে গেল। পরের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হলো-পুলিশ প্রহরায়। গ্রেফতারের মধ্যে ছিল এমএ আউয়ালসহ অনেক ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। মাসখানেক পরে জেলখানা থেকে সকলে ছাড়া পেল।

জেলখানা থেকে বের হয়ে আউয়াল আমাকে জানাল-ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে ঐক্যের প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ছাত্র ইউনিয়ন নেতারা জেলে আলাপ-আলোচনায় সম্মত হয়েছে ছাত্রলীগ নামে ঐক্যবদ্ধ হতে। ছাত্র ইউনিয়ন আগামীতে তাঁদের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ডাকবে। কাউন্সিল ডাকবে এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছে ছাত্রলীগের ফরিদপুর জেলা কমিটির নেতা লিয়াকত হোসেন। লিয়াকত তখন জেলে ছিল। অনেকে বলল, লিয়াকত বিশ্বাসের দিক থেকে কমিউনিস্ট পার্টির কাছাকাছি এবং বরাবরই সে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে ঐক্যের কথা বলেছে। ঐক্যের প্রশ্নটি খুব জোরালো ছিল দেশের ছাত্র রাজনীতিতে। ছাত্রলীগের প্রতীক ছিল-শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি। ছাত্র ইউনিয়নের ঐক্য, শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি। প্রশ্ন হতো, ছাত্রলীগের প্রতীক ঐক্য নয় কেন? তাহলে কি ছাত্রলীগ ঐক্য চায় না?

একবার রাজশাহীতে ছাত্রসভায় এ ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়েছিলাম আমি ও মমিন তালুকদার। ছাত্রসভায় প্রশ্ন উঠল–আপনাদের প্রতীক ঐক্য নয় কেনো? আপনারা কি ঐক্য চান না? ছাত্রলীগের সভাপতি তালুকদার সাহেব জবাব দিলেন–যে শিক্ষা ঐক্য শেখায় না সে শিক্ষা আদৌ শিক্ষাই নয়। তাই আমাদের সংগঠনের প্রতাঁকের মধ্যে ঐক্য নেই।

মনে হলো, ছাত্ররা খুশি হলো না। আমি বললাম, দেখুন আমি জবাব দিতে পারি। আপনারা রাগ করবেন না তো? কারণ যারা প্রশ্ন করছেন তাঁরা সকলে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য। আমার কথা কিন্তু ছাত্র ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যাবে।

আমার কথা হচ্ছে-ছাত্রলীগ গঠিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। তখন ঐ প্রতিষ্ঠানেরই সদস্য ছিলেন পরবর্তীকালে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতারা। তাই সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সংগঠন করায় ঐক্যের প্রশ্ন ওঠেনি। পরবর্তীকালে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পর একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত হয়। এ ব্যাপারে আমি পূর্বেই লিখেছি যে, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন গঠন ছিল তৎকালীন আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগের ফসল। দেশ বিভাগের কালে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল ছাত্র ফেডারেশন [এই ছাত্র ফেডারেশন ছিল নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন অনুমোদিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের অঙ্গ]। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এ নামে পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করায় অসুবিধা দেখা দেয়। এ নামের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি জড়িত এবং প্রতিষ্ঠান ভারতের একটি সংগঠনের অঙ্গ। ফলে পাকিস্তান ছাত্র সংগঠনের নাম পাল্টাবার প্রশ্ন দেখা দেয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত নতুন কোনো সংগঠন। করা সম্ভব ছিল না। তাই কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর নিজস্ব ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগ পর্যন্ত এরা কেউ ছাত্র ফেডারেশনের নামে, কেউ আবার ছাত্রলীগের নামে কাজ করত। এমনকি ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর ও ময়মনসিংহে ছাত্র ইউনিয়ন কোনো কমিটি গঠন করেনি। ঐ দুটি জেলায় তারা ছাত্রলীগের মাধ্যমে কাজ করত। এ দু’টি জেলা কমিটি মুখ্যত কমিউনিস্ট পার্টির পরামর্শেই চলত।

একই কাজ আরএসপি করেছিল ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। তাদের প্রভাবিত ছাত্র প্রতিষ্ঠান নিখিল বঙ্গ ছাত্র কংগ্রেসের নাম পাল্টে রাখা হয় পাকিস্তান ছাত্র এসোসিয়েশন–পিএসএ।

এ পটভূমি মনে রেখেই আমি রাজশাহীতে ছাত্রসভায় বলেছিলাম, ছাত্র ইউনিয়ন গঠন করে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে প্রথম ভাঙন সৃষ্টি করা হয়। এবং যারা এই ভাঙন সৃষ্টি করেছিল তারাই প্রতীক নিয়েছিল ঐক্য। ছাত্রলীগ যখন গঠন হয়েছিল ১৯৪৮ সালে, তখন ঐক্যের প্রশ্ন ওঠেনি। যারা ভেঙেছে তারাই ঐক্যের কথা বেশি বলছে। কারণ ১৯৫২ সালে শুধুমাত্র অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে নতুন সংগঠন গঠনের প্রয়োজন ছিল না। কারণ ১৯৫১ সালের সেপ্টেম্বরে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দ তুলে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ফলে কাউন্সিলে ঐ প্রস্তাব পাস করা সম্ভব হয়নি। ১৯৫৩ সালে এ সিদ্ধান্ত কাউন্সিলে চূড়ান্ত হয়। সকলেই জানত এ ঘটনা ঘটবে–যেমন ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দ তুলে দেয়া হলেও এর আগে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা মোহাম্মদ তোয়াহার মনোনয়ন নিতে অসুবিধা হয়নি। এমনটি ১৯৫৪ সালে অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রী দলের টিকেটে নির্বাচিত হয়ে বরিশালের মহিউদ্দীন আহমেদ এবং আব্দুল করিম পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিলেন। সুতরাং এ নিয়ে কথা না বাড়ানো অনেক ভালো। সবকিছু হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্তের ফলে। তাই আমি আউয়ালকে বলেছিলাম, ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রলীগ নামে ঐক্যবদ্ধ হবে না। কমিউনিস্ট পার্টি এ সিদ্ধান্ত মানতে পারে না।

একটি নির্দিষ্ট রাজনীতির এই ধারাবাহিকতায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রফ্রন্ট হিসেবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলেছিলাম-ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রলীগ নামে ঐক্যবদ্ধ হবে না। হতে পারে না। এর মধ্যে একদিন আউয়াল জানাল, নির্মল ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সভা হয়েছে-সাতজন সভায় উপস্থিত ছিল। সর্বসম্মত হয়েছে তারা ছাত্রলীগ নামে ঐক্যবদ্ধ হবার। আমার তেমন বিশ্বাস হলো না।

কিছুদিন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে দেখি মহা হইচই। ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। সে বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রলীগকে ঐক্যের জন্যে আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ইউনাইটেড স্টুডেন্টস লীগ নামে ঐক্যবদ্ধ হবার। ছাত্র ইউনিয়নের বিজ্ঞপ্তি পড়লে মনে হবে, তারাই ঐক্যের অগ্রদূত। তারাই এগিয়ে এসে আহ্বান জানিয়েছে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের। তাদেরই ত্যাগের ফল ঐক্যবদ্ধ অর্থাৎ ইউনাইটেড স্টুডেন্টস লীগ নামে নতুন প্রতিষ্ঠান গঠনের আহ্বান।

সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। অনেকেই জানত যে, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের ঐক্যবদ্ধ হবার প্রচেষ্টা চলছে। হঠাৎ এ ধরনের প্রচারপত্র আমাদের সবাইকে হতভম্ব করে দিল। তবে আমার কাছে ছাত্র ইউনিয়নের এই প্রস্তাব সঠিক বলে মনে হলো না। দীর্ঘদিন পরে একটি সংগঠনের অপর একটি সংগঠনে অবলুপ্ত হওয়া সহজ নয়। এতে মতানৈক্য হতেই পারে। শুনলাম ছাত্র ইউনিয়নের কমিটির পূর্ণাঙ্গ সভায় এবং কাউন্সিলে ছাত্রলীগের নামে ঐক্যবদ্ধ হবার প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। তারা নতুন প্রস্তাব দিয়েছে ইউনাইটেড স্টুডেন্টস লীগ নামে ঐক্যবদ্ধ হবার। তাদের কাছে এটাই স্বাভাবিক ছিল।

কিন্তু বিপদে পড়লাম আমরা। ব্যক্তিগতভাবে আমিও খুশি হয়েছিলাম ঐক্যবদ্ধ হবার প্রস্তাবে। কারণ ছাত্রলীগ থেকে আওয়ামী লীগের জন্ম। তাই এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক ছিল। ঢাকার বাইরে দু’টি সংগঠনকে পৃথক করে দেখা হতো না। আওয়ামী লীগের সকল সভায়ই ছাত্রলীগ নেতারা বক্তৃতা দিতেন। সাধারণ সম্পাদক এমএ আউয়াল ও আমি এর বিপক্ষে ছিলাম। আমাদের বক্তব্য ছিল–ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের লেজুড় নয়। তাই আওয়ামী লীগের সভায় ছাত্রলীগ নেতাদের বক্তৃতা দিতে হলে আগে লিখিতভাবে ছাত্রলীগকে অনুরোধ করতে হবে। ছাত্রলীগ অনুমোদন করলেই একমাত্র ছাত্রলীগ নেতারা আওয়ামী লীগের মঞ্চে বক্তৃতা দিতে পারবে। আমাদের মনোভাবের ফলে এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, আমি একদিন পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভার মঞ্চ থেকে বক্তৃতাদানকারী একজন ছাত্রলীগ নেতাকে নামিয়ে দিয়েছিলাম। এ ঘটনা অনেকেই ভালো চোখে দেখত না। অপর দিকে তখন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন। ছাত্রলীগের ওপর আওয়ামী লীগের প্রভাব বাড়ছে। ব্যক্তিগতভাবে এমএ আউয়াল শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রিয়পাত্র। ফলে পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ে অসুবিধা দেখা দিতে পারে। আমি ভেবেছিলাম ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হলে হয়তো ছাত্রলীগকে নিরপেক্ষ রাখা যাবে। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়নের এই বিজ্ঞপ্তির পর মনে হলো সবকিছু ভেস্তে যাচ্ছে।

তবুও একটা বৈঠকের ব্যবস্থা করা হলো। বৈঠক বসবে ১৫৭ নম্বর। নবাবপুর রোডে। ছাত্রলীগ অফিসে। জন্মলগ্নে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম অফিস ছিল ৯০ মোগলটুলীতে। মুসলিম শব্দটি তুলে দেবার প্রশ্নে ছাত্রলীগ দু’ভাগ হয়ে যায়। যারা মুসলিম শব্দ তুলে দেবার পক্ষে ছিল তাদের অফিস স্থানান্তরিত হয়ে ১৫৭ নম্বর নবাবপুর রোডে। এই দফতরটিও আমরা বিনা ভাড়ায় পেয়েছিলাম। ছাত্রলীগের জন্মের প্রথম দিকে এক বন্ধু এই দফতরটি আমাদের দিয়েছিলেন। আমি ছাত্রলীগে থাকা পর্যন্ত এ ভবনেই ছাত্রলীগের অফিস ছিল।

সেদিন ঐক্য সম্পর্কিত বৈঠক বসার কথা ছিল বেলা ৯টায়। ৯টার মধ্যেই ছাত্র ইউনিয়নের নেতা এসএ বারী এটি, আনোয়ারুল আজিম এবং আব্দুস সাত্তারসহ অনেকেই আমাদের অফিসে উপস্থিত হলেন। ছাত্রলীগের সম্পাদক এমএ আউয়াল পৌঁছালেন বেলা দশটায়। তাকে আমি বিলম্বে আসার কারণ জিজ্ঞেস করতেই এমএ আউয়াল ক্ষিপ্ত হলেন। তিনি বললেন-ছাত্র ইউনিয়নের এই নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের কোনো প্রয়োজনই পড়ে না। তারা কথা দিয়ে কথা রাখেনি। আমাদের না জানিয়ে তারা তাদের নিজস্ব প্রস্তাব বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করেছেন। সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে ধারণা হয়েছে আমরাই ঐক্য চাই না। এ পরিস্থিতিতে তাদের সাথে নতুন করে ঐক্য নিয়ে আলোচনা করার কোনো অবকাশ নেই। তারা জানে, ইউনাইটেড স্টুডেন্টস লীগ গঠনের দাবি আমরা কিছুতেই মেনে নেব না। সাধারণ ছাত্ররা এ ঐক্য প্রক্রিয়ার পূর্ব ইতিহাস জানে না। তাই মনে করবে ছাত্র ঐক্য না হবার জন্যে আমরাই দায়ী।

আমার মনে হলো দুই সংগঠনের ঐক্যের আর কোনো সম্ভাবনা নেই। আউয়ালের মন্তব্যগুলো অপমানজনক। ভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিজেদের দফতরে আমন্ত্রণ জানিয়ে এ ধরনের কথাবার্তা আদৌ রুচিকর নয়। তবুও আমি শেষ চেষ্টা করলাম। আমি একটি নতুন প্রস্তাব দিলাম ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের কাছে। আমি বললাম, আমাদের সভাপতি আব্দুল মোমিন তালুকদার, সম্পাদক এমএ আউয়াল এবং দফতর সম্পাদক আমি নির্মল সেন একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে দিচ্ছি। আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে-দুটি সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ হবার পর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগই নাম থাকবে। তবে ঐ সংগঠনের কর্মকর্তা হিসেবে যাদের নামই আপনারা লিখে দেবেন আমরা তিনজন সে কমিটি মেনে নেব। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে দিচ্ছি।

আমি এ প্রস্তাব সম্পর্কে পূর্বে কারো সঙ্গে আলাপ করিনি। তবে জানতাম সভাপতি ও সম্পাদক আমার প্রস্তাব পছন্দ না করলেও প্রকাশ্যে কিছু বলবেন না। আমার প্রস্তাব শুনে দু’জনেই গম্ভীর হয়ে গেলেন। ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ বললেন, ইউনাইটেড স্টুডেন্টস লীগ ব্যতীত কোনো প্রস্তাবে একমত হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

আমাদের বৈঠক ভেঙে গেল। আমার ধারণা ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনয়নের ঐক্যের এটাই বোধ হয় ছিল সর্বশেষ প্রচেষ্টা। আমি ছাত্র রাজনীতি থাকাকালীন ভিন্ন কোনো প্রচেষ্টা হয়েছে বলে শুনিনি। এ প্রচেষ্টা ভেঙে যাবার পর আমারও ছাত্রলীগ থেকে যাবার দিন ঘনিয়ে এল। বিপদ বাড়ল আমার এবং আমাদের। আমরা যারা কোনোদিনই চাইনি যে ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের লেজুড় হোক তাদের অসুবিধা হলো। শহীদ সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী। সুতরাং কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো নীতির বিরু কোনো কিছু করা বা বলা আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে গেল। অপরদিকে কৃষক শ্রমিক পার্টির আবু হোসেন সরকারও কেন্দ্রীয় সরকারের সকল নীতির প্রতিবাদ করতে থাকলেন। আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুখ চেয়ে। কিছুই বলতে পারল না।

এ মুহূর্তে নতুন সঙ্কট দেখা দিল গণপরিষদ নিয়ে। ইতোপূর্বে ২৩ অক্টোবর গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ গণপরিষদ ভেঙে দিয়েছিলেন। ৭ নভেম্বর সিন্ধুর চিফ কোর্ট গণপরিষদ বিলুপ্তির আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করে। গভর্নর জেনারেল এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। ২১ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট সিন্ধু চিফ কোর্টের রায় বাতিল করেন এবং অবিলম্বে সংবিধান প্রণয়নের জন্যে একটি সংস্থা গঠনের আদেশ দেন। সেই আদেশ অনুযায়ী গভর্নর জেনারেল ১৫ এপ্রিল আর একটি আদেশ জারি করেন। এই আদেশের নাম হচ্ছে সংবিধান কনভেনশন আদেশ। এই আদেশের সঙ্গে যুক্ত ছিল আরো কিছু শর্ত। এই শর্তে বলা হয় পাকিস্তান দুই ইউনিটে বিভক্ত হবে। পূর্ব পাকিস্তান হবে একটি ইউনিট এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে গঠিত হবে আর একটি ইউনিট। পশ্চিম পাকিস্তানের ৪ প্রদেশের স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। সর্বক্ষেত্রে সংখ্যা সাম্যনীতি প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা শতকরা ৫৬ ভাগ হলেও তারা পশ্চিম পাকিস্তানের মতোই ৫০ ভাগ সুযোগ-সুবিধা পাবে। এর নাম ছিল সংখ্যাসাম্য। এই প্রস্তাবনার ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন আপোষহীন। তিনি হুমকি দিলেন যে, প্রয়োজনবোধে সামরিক বিধানের মাধ্যমে এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করা হবে।

এই নির্দেশের বিরুদ্ধে সমগ্র পূর্ব বাংলার সকল মহল বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। কৃষক শ্রমিক পার্টি, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলো। তারা সংবিধান কনভেনশন বয়কটের প্রস্তাব গ্রহণ করল। এ সময় ইস্কান্দার মীর্জা ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় এলেন। ইস্কান্দার মীর্জা কৃষক শ্রমিক পার্টিকে তাদের প্রস্তাবনা বোঝাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কৃষক শ্রমিক পার্টি মীর্জার প্রস্তাবে রাজি হলো না। শুধুমাত্র শহীদ সোহরাওয়াদী আওয়ামী লীগকে সম্মত করালেন। আওয়ামী লীগ কনভেনশনে যোগ দিতে সম্মত হলো। সারাদেশে তখন আওয়ামী লীগ সমালোচিত। আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানী লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পথে কলকাতাতে অবস্থান করছেন। তিনি কলকাতা থেকে বিবৃতি দিয়ে সংবিধান কনভেনশনের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করলেন। কিছুটা হলেও আওয়ামী লীগের মুখ রক্ষা হলো।

কিন্তু সবকিছু পাল্টে গেল মওলানা ভাসানীর ঢাকা আগমনের পর। ২৫ এপ্রিল মওলানা সাহেবকে নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় পৌঁছালেন। সেই একটি রাতের কথা আমার এখনও মনে আছে। আমি তখন ঢাকা হলে থাকি। গভীর রাতে আমাদের হলে এলেন ছাত্রলীগের এককালীন সভাপতি বর্তমান শিক্ষক নেতা কামরুজ্জামান সাহেব। বলা হলো–ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের মওলানা ভাসানী ডেকেছেন। আমাদের যেতে হবে পুরান ঢাকার কারকুন বাড়ি লেনে জনাব ইয়ার মোহাম্মদের বাড়ি। গভীর রাতে আমরা সেখানে হাজির হলাম। আমাদের মধ্যে ছিল আব্দুল মোমিন তালুকদার, এমএ আউয়াল, নূরুল ইসলাম, আবদুল গাফফার চৌধুরী, আব্দুল জলিল এবং ছাত্র ইউনিয়নের এসএ বারী, আব্দুস সাত্তার প্রমুখ। আমরা জানতাম না কেন আমাদের ডাকা হয়েছে। শুধু এটুকু জানতাম যে সংবিধান সম্মেলনে যোগদান নিয়ে আওয়ামী লীগে বিরোধ চলছে। ওই সম্মেলনে যোগ দেয়া নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তখনও হয়নি। আমাদের ধারণা ছিল শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এই প্রস্তাব গ্রহণ করবে না।

আমরা নিজেদের মধ্যে এই আলোচনাই করছিলাম। ইতোমধ্যে মওলানা সাহেব আমাদের কক্ষে এসে ঢুকলেন। কুশল বিনিময় করলেন। বললেন, গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ এবং প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী তাঁকে কথা দিয়েছেন যে, আওয়ামী লীগের তিনটি শর্ত তারা মেনে নেবে। শর্ত তিনটি হচ্ছে–(১) প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, (২) রাজবন্দিদের মুক্তি, (৩) যুক্ত নির্বাচন। মওলানা সাহেব বললেন, এই তিন শর্তে তিনি সংবিধান সম্মেলনে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরপর তিনি আমাদের মতামত জিজ্ঞেস করলেন।

আমরা ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলাম। আদৌ ভাবতে পারিনি যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা মওলানা সাহেবের কথা মেনে নিতে পারলাম না। বললাম, এই ঝানু আমলাদের বিশ্বাস করবার কোনো কারণ নেই। এছাড়া আমরা সংখ্যাসাম্য মানব কেন? এমনিতেই সব ব্যাপারে বাঙালিরা বঞ্চিত হচ্ছে। এবার সাংবিধানিকভাবে আমাদের বঞ্চিত করার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা গভর্নর জেনারেল বা প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করি না। মওলানা সাহেব আমাদের সঙ্গে তেমন বিতর্কে যোগ দিলেন না।

আমাদের এই কথাবার্তার মধ্যে তার চিরপরিচিত ভাঙা বাংলায় কথা বলতে বলতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী আমাদের কক্ষে ঢুকলেন। তিনি আমাদের লক্ষ্য করে বললেন-তোমাদের কথা আমি বুঝি। কিন্তু কাউকে তো বিশ্বাস করতে হবে। সকলকে অবিশ্বাস করলে তো চলবে না। গভর্নর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রী আমাদের পাকা কথা দিয়েছেন। বলেছেন, আমাদের শর্ত মেনে নেবেন।

এবার বিস্ফোরণ ঘটল–আবদুল গাফফার চৌধুরী বললো–শহীদ সাহেব, আপনার সব কথাই আমরা বুঝি। তবে আমাদের ধারণা হচ্ছে আপনাদের দিয়ে সব কাজ করিয়ে নিয়ে একদিন আপনাকেই মন্ত্রিসভা থেকে কিক আউট করবে। গাফফারের কথার তীব্র প্রতিক্রিয়া হলো। মোমিন তালুকদার ও নুরুল ইসলাম ক্ষিপ্ত হলো। আমাদের আলোচনা তেমন আর এগুল না। এক সময় মওলানা সাহেব ও শহীদ সাহেব আমাদের কক্ষ থেকে। চলে গেলেন। রাত তখন শেষ। আমরা ইয়ার মোহাম্মদের বাড়ি দোতলা থেকে নিচতলায় নামলাম। দেখলাম কতিপয় তরুণ কিছু হ্যান্ডবিল বিতরণ করছে। তারা আওয়ামী লীগের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এবং তারা আওয়ামী লীগেরই লোক।

ভোরের আকাশের দিকে তাকিয়ে নবাবপুর রোড দিয়ে হাঁটছিলাম। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। যতদূর প্রতিবাদ করার কথা ছিল তা করতে পারলাম না। আওয়ামী লীগ এ প্রস্তাব মেনে নিল। প্রতিরোধ করার মতো কোনো শক্তিই দেশে থাকল না। কারণ শেরেবাংলার কৃষক শ্রমিক পার্টি শেষ পর্যন্ত আপোষ করবেই। মৃত মুসলিম লীগ ও অর্ধমৃত কংগ্রেস কাগজপত্রে বয়কট করলেও রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না। আর ৯২(ক) ধারার যাতাকলে বামপন্থীরা বিপর্যস্ত। কেউ জেলে। কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

২৭ ফেব্রুয়ারি শুনলাম অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে এ প্রস্তাব পাস করাতে হয়েছে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদে। তিনি লিখিতভাবে মুচলেকা দিয়েছেন… আমি এতদ্বারা ঘোষণা করছি যে, ২২ দফা ও যুক্ত নির্বাচন প্রস্তাবাবলি কনিস্টিটিউশন কনভেনশনে গ্রহণ করবার লক্ষ্যে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব–যতদূর পর্যন্ত প্রস্তাবগুলো সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত। ব্যর্থ হলে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করব।

কিন্তু এত করেও আওয়ামী লীগ হালে পানি পেল না। দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সদস্যরা মনোনয়নপত্র দাখিল করল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান, তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) ও আলি আহমাদসহ আওয়ামী লীগ সদস্যরা মনোনয়নপত্র দাখিল করলেন। অন্য কোনো দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল না। ধারণা সৃষ্টি হলো যে, পূর্ববাংলা থেকে আওয়ামী লীগের শতকরা একশ জন সদস্যই নির্বাচিত হবে। কিন্তু গভর্নর জেনারেলের তখন অনেক খেলা বাকি। তিনি মনোনয়নের তারিখ পিছিয়ে দিলেন। ইতোমধ্যে ফেডারেল কোর্ট গভর্নর জেনারেলের সংবিধান কনভেনশনের নির্দেশ বাতিল করে দিল। ফেডারেল কোর্টের পক্ষ থেকে বলা হলো–সংবিধান কনভেনশন নয়, সংবিধান প্রণয়নের জন্যে গণপরিষদ গঠন করতে হবে। এই গণপরিষদ গঠনের জন্যে ২৮ মে নতুন নির্দেশ জারি করা হলো। গভর্নর জেনারেল নির্দেশ দিলেন ১৯৫৫ সালে ২৮ মে গণপরিষদ গঠনের। এই গণপরিষদের দুই ইউনিটের ভিত্তিতে গণপরিষদ গঠিত হবে। গণপরিষদে সংখ্যাসাম্য থাকবে। পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের ৪০ জন করে সদস্য থাকবেন। নির্বাচনে পূর্ববাংলার ৩১ জন মুসলমান ও ৯ জন অমুসলমান নির্বাচিত হলো। কারণ তখন স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতি চালু ছিল। ৩১ জন মুসলিম সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেল ১২; কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম ও গণতন্ত্র দলের কোয়ালিশন পেলো ১৬, মুসলিম লীগ একটি ও স্বতন্ত্র দুটি। মুসলিম লীগ সদস্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন বগুড়ার মোহাম্মদ আলী। শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন কেন্দ্রের আইনমন্ত্রী। গণপরিষদে তার সমর্থক সংখ্যা ১২। এর পরেও তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চাচ্ছেন। এ আশ্বাসই নাকি গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দিয়েছেন।

কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতি কাজে এল না। প্রতিশ্রুতি ভাঙার পালা শুরু হলো পূর্ববাংলার নতুন সরকার গঠন নিয়ে। পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। কিন্তু তাদের ক্ষমতা দেয়া হলো না। অসুস্থতার জন্যে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ সুইজারল্যান্ড গিয়েছিলেন। আইনমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীও সুইজারল্যান্ড গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে কিছু সমস্যা নিয়ে আলাপের জন্যে। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী এ সুযোগ নিলেন। ১৯৫৫ সালের ৬ জুন পূর্ব বাংলা থেকে ৯২(ক) ধারা তুলে নেয়া হলো। আওয়ামী লীগ ভেবেছিল মন্ত্রিসভা গঠনের জন্যে তাদেরই ডাকা হবে। কিন্তু ডাকা হলো যুক্তফ্রন্টের নামে কৃষক শ্রমিক পার্টি, গণতন্ত্রী দল ও নেজামে ইসলামকে। পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী হলেন আবু হোসেন সরকার। তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন।

শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্যের অজুহাতে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ৫ আগস্ট পদত্যাগ করলেন। এবার ভারপ্রাপ্ত গভর্নর জেনারেল হলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইস্কান্দার মীর্জা। প্রধানমন্ত্রী হলেন মুসলিম লীগের চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন একে ফজলুল হক, যাকে মাত্র কিছুদিন আগে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করে পূর্ববাংলায় ৯২(ক) ধারা জারি করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী পুনরায় রাষ্ট্রদূত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিরোধী দলের নেতা হলেন। তিনি মন্ত্রিসভার সদস্যপদ ত্যাগ করলেন। এবার শুরু হলো পাকিস্তানের রাজনীতিতে আরেক অধ্যায়।

সারা পাকিস্তানজুড়ে তখন এক অভাবনীয় রাজনীতির খেলা চলছিল। কোনো আদর্শ বা নীতির বালাই ছিল না। ব্যক্তিস্বার্থ ছিল মূলকথা এবং এটাই ছিল স্বাভাবিক। পাকিস্তানের জন্ম কোনো স্থির বিশ্বাসের পরিণতি নয়। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের দাবি সফল হবে এ কথা অনেক মুসলিম লীগ নেতা বিশ্বাস করতেন না। ভারত বিভাগের সময় পাকিস্তানের দু’অংশে রাজনৈতিক চিত্র ছিল পরস্পরবিরোধী। সিন্ধু, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ (বেলুচিস্তান) ছিল জোতদার ও জমিদারের দেশ। একশ্রেণির পাঞ্জাবিরা সেনাবাহিনীতে ছিল। সিন্ধু এবং পাঞ্জাবের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সর্বকালে জোতদার ও জমিদারদের হাতে ছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এককালে তীব্র ছিল পাঞ্জাবে। কিন্তু সে নেতৃত্ব ছিল শিখ ও হিন্দুদের হাতে। সিন্ধু ও পাঞ্জাবের অধিকাংশ মুসলিম নেতৃত্ব ছিল জমিদার ও ব্রিটিশ সরকারের অনুগত। রাজনৈতিক আদর্শের বালাই ছিল না। দলত্যাগ ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। সিন্ধু ও পাঞ্জাবে এককলে কিছুটা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় তা চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়।

অপরদিকে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের চিত্র ছিল একান্তই ভিন্ন। এরা ধর্মবিশ্বাসে গোড়া মুসলমান। কোনোদিনই ব্রিটিশ সরকারের কাছে মাথা নত করেনি। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে এরা কংগ্রেসের সহযোগিতা ও সহানুভূতি পেয়েছে। এই প্রদেশে কংগ্রেস শক্তিশালী ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় এই প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা ছিল। নেতৃত্বে ছিলেন সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গাফফার খান। সীমান্ত প্রদেশের কংগ্রেস দেশবিভাগের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। এ প্রদেশটি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতার শিকার। এদের সান্তনা দেবার জন্যে ব্রিটিশ ও কংগ্রেস সীমান্ত প্রদেশে গণভোটের ব্যবস্থা করে। বলা হয়েছিল, সীমান্ত প্রদেশের অধিবাসীরা ভারত কিংবা পাকিস্তানে যাবে। গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে। সীমান্তের কংগ্রেস এ গণভোট পাত্তা দেয়নি। গণভোটে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তানে যোগ দেয়।

উপরের চিত্র থেকে পরিষ্কার যে, পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো একক রাজনীতি বা একক নেতৃত্ব ছিল না। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে কোনো প্রদেশেই মুসলিম লীগ সরকার ছিল না। ফলে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মুসলিম লীগ তেমন শক্তিশালী ছিল না পশ্চিম পাকিস্তানে। তবুও জিন্নাহ-লিয়াকত আলী জীবিত থাকা পর্যন্ত রাজনীতিতে মুসলিম লীগের কিছুটা নেতৃত্ব ছিল। তাদের মৃত্যুর পর সে নেতৃত্ব ভেঙে পড়ে।

তখন আর একটি ঘটনা ঘটে পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে। দেশ বিভাগের ফলে এ দুটি প্রদেশ থেকে লাখ লাখ হিন্দু ও শিখ ভারতে চলে যায়। ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে আসে লাখ লাখ মুসলমান। একই সঙ্গে ভারত থেকে পাকিস্তানে আসে ব্রিটিশ আমলের আমলারা, বম্বে ও গুজরাটের ব্যবসায়ীরা। নিজস্ব ব্যক্তি ও শ্রেণিস্বার্থেই এরা পরবর্তীকালে পাকিস্তানের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ শুরু করে। পাকিস্তানের রাজনীতিকদের দুর্বলতার জন্যে এবং অনিবার্য কারণে পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে সামরিক বাহিনী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিকাংশ কর্মকর্তা জন্মসূত্রে পাঞ্জাবি এবং জমিদার শ্রেণির। দেশ বিভাগের মুহূর্তে কাশ্মীর নিয়ে সংঘর্ষসহ বিভিন্ন কারণে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং তারাও রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করে।

এর আবার একটি ভিন্ন কারণও ছিল। এ কারণটি হচ্ছে পাকিস্তানে প্রভাব বিস্তার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশের প্রতিযোগিতা। পাকিস্তান ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। পাকিস্তানে ব্রিটিশ সহায়-সম্পত্তি ছিল। পাকিস্তান ব্রিটিশ কমনওয়েলথে ছিল। অর্থনৈতিক দিক থেকেও ছিল ব্রিটিশ মুদ্রা অর্থাৎ স্টার্লিং ব্লকে।

অথচ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী পরিবেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তান হয়ে ওঠে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান সীমান্তে বৃহৎ দু’টি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। পাকিস্তানের পাশে ভারত জোটনিরপেক্ষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাষায় সোভিয়েতপন্থী।

এ পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছিল পাকিস্তানকে কজায় নিতে। এক সময় সাহায্যের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর একটি অংশের ব্যয়ভার বহন করত। পেশোয়ারের বিমানঘাঁটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করতে দিত। ফলে ব্রিটিশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব তুঙ্গে ওঠে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে অনেকের ধারণা এই দ্বন্দ্বেই রাওয়ালপিণ্ডির ষড়যন্ত্রের নামে সামরিক বাহিনীর একশ্রেণির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করা হয়। আইয়ুব খান অনেককে ডিঙিয়ে প্রধান সেনাপতি হন। সোভিয়েত ইউনিয়নের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। পরবর্তীকালে রাওয়ালপিণ্ডির এক জনসভায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। সে হত্যা মামলার কোনো তদন্ত হয়নি। লিয়াকত আলীকে হত্যা করেছিল সীমান্ত প্রদেশের হাজরা জেলার সৈয়দ আকবর। সে তখন অন্তরীণ ছিল। তখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন খাজা শাহাবুদ্দিন। খাজা শাহাবুদ্দিনের বড়ো ভাই খাজা নাজিমুদ্দিন তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। লিয়াকত আলী নিহত হবার পর খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। গভর্নর জেনারেল হন আমলাদের প্রখ্যাত নেতা গোলাম মোহাম্মদ। এই গোলাম মোহাম্মদই পরবর্তীকালে খাজা নাজিমুদ্দিনকে পদচ্যুত করেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে ডেকে এনে প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়। অর্থাৎ পাকিস্তানের রাজনীতিতে তখন পিছু হটছে ব্রিটিশ। এগিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানই ছিল তৎকালীন রাজনীতির কেন্দ্র।

তবে পূর্ববাংলার চিত্র ছিল একান্তই ভিন্ন। পাকিস্তান সৃষ্টির সময় পূর্ববাংলার মুসলিম লীগের নেতৃত্বে সীমিত সংখ্যক জোতদার-জমিদার থাকলেও অধিকাংশ নেতা ছিলেন উকিল ও মোক্তার। মুসলিম লীগের মূল শক্তি ছিল ছাত্র সংগঠন। এ ছাত্র সংগঠনের তরুণরা অনেক সময়ই নেতাদের পাত্তা দিত না। তাদের কাছে পাকিস্তান ছিল হিন্দুদের প্রতিযোগিতামুক্ত ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরি পাবার একটি স্বপ্নের আবাস। তারা পাকিস্তানকে দেখেছে নিত্যদিনের জীবনের দেনাপাওনার হিসেবের ভিত্তিতে। তাই তারা প্রথম থেকেই ছিল অধিকার সচেতন। তাদের কাছে রাষ্ট্র ভাষার আন্দোলন প্রথমদিকে কোনো আবেগ বা ঐতিহ্যের আন্দোলন ছিল না। ছিল অধিকার রক্ষার আন্দোলন। তাদের কাছে ইংরেজির সঙ্গে উর্দুর কোনো পার্থক্য ছিল না। ইংরেজি তাদের পদে পদে পরাভূত করেছে হিন্দুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়। তাই তারা বিদেশি ভাষা উর্দু মেনে নিয়ে আর একবার পরাভূত হতে চায়নি।

এছাড়া পূর্ববাংলায় ছিল অবিভক্ত বাংলার বামপন্থী আন্দোলনের রেশ এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের ঐতিহ্য। এ বাঙালি তরুণরাই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ১৯৪৬ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির দাবিতে রাজপথে নেমেছিল। এ ঐতিহ্যের তারতম্যের জন্যেই পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক চিত্রের তারতম্য ছিল। এখানে লক্ষণীয় যে, এ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বামপন্থী তরুণরাই ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে একই মঞ্চে দাঁড় করিয়েছিল। পরাজিত করেছিল মুসলিম লীগকে। পূর্ববাংলা পরিণত হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের ঘাঁটিতে। পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। পূর্ববাংলার রাজনীতিতে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ত্রাতা হিসেবেই আবির্ভূত হন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাসাম্য ও এক ইউনিট মেনে নেয়। আর পশ্চিমাদের এ সুযোগ দিয়ে বিনিময়ে ৮০ জনের পার্লামেন্টে মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হবার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে আদর্শের কোনো বালাই ছিল না।

একই প্রতিযোগিতায় নামেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক কৃষক শ্রমিক পার্টি নিয়ে। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন পাকিস্তান মন্ত্রিসভায়। দুটি দলই সব আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়েছিল ব্যক্তিস্বার্থে। তখন সঠিক বুর্জোয়া আদর্শ ধারণ করেও কোনো রাজনৈতিক দল দেশে আত্মপ্রকাশ করেনি। ব্যক্তি বড় হয়ে উঠেছিল–দলটির মূল চরিত্র ছিল সুবিধাবাদী।

এই আওয়ামী লীগ ও কেএসপি তখন পূর্ববাংলার রাজনীতির নেতৃত্বে। দেনা-পাওনাই ছিল তাদের মূল চালিকা শক্তি। এই দেনাপাওনার জন্যেই দু’টি দল বারবার পূর্ববাংলার স্বার্থ বিক্রি করেছে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্বের কাছে।

অপরদিকে মুসলিম লীগ না থাকলেও তার ভাবাদর্শ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে তখন সামরিক বেসামরিক আমলার নেতৃত্বে গড়ে উঠছিল একটি পুঁজিপতি শ্রেণি। রাজনীতির মঞ্চ থেকে একের পর এক বিদায় নিচ্ছিল রাজনীতিকরা। পশ্চিম পাকিস্তানে পুঁজির বিকাশ হচ্ছিল আমলাদের নেতৃত্বে। রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে আসছিল আমলারা। এরা ছিল একান্তই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্ভর। এরা তাই নিজস্ব প্রয়োজনে পূর্ববাংলায় নিজস্ব মিত্র খুঁজছিল এবং রাজনীতির দিক থেকে তাদের পছন্দ ছিল মার্কিন ঘেঁষা শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

৯২(ক) ধারা আমলে পাকিস্তান কমিউনিস্ট বিরোধী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থার (সাউথ ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশন) এবং বাগদাদ চুক্তি স্বাক্ষর করে। পূর্ববাংলার নেতাদের মধ্যে একমাত্র শহীদ সোহরাওয়ার্দী এই দুই কমিউনিস্ট বিরোধী জোটের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মূল রাজনৈতিক সংগঠন পূর্ববাংলার আওয়ামী মুসলিম লীগ এ চুক্তি সমর্থন করল না–তাই পশ্চিম পাকিস্তানের আমলা নেতৃত্বের সঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কোনো সমঝোতাই স্থায়ী হচ্ছিল না। পার্লামেন্টে ১২ সদস্যের নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী ব্যক্তিগতভাবে যতই পশ্চিম ঘেঁষা হোক না কেনো, রাজনীতির বাস্তব ক্ষেত্রে তার গুরুত্ব তেমন ছিল না।

তবুও তকালীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন পাকিস্তানের উভয় অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য শেষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁকে রাজনীতি থেকে অপসারণ না করে সামরিক-বেসামরিক আমলাদের পক্ষে ক্ষমতায় আসা সম্ভব ছিল না। তাই একবার শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ক্ষমতায় এনে ছুঁড়ে ফেলে দেবার ষড়যন্ত্রেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বারবার প্রধানমন্ত্রী হবার টোপ দেয়া হয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আওয়ামী লীগকে সে সত্যটি অনুধাবন করতে হয়েছে পরবর্তীকালে।

১৯৫৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ অক্টোবর ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি তুলে দেয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। তবে এ প্রস্তাব গ্রহণও সহজ ছিল না। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঘণ্টার পর ঘন্টা এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যুক্তি দিতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান এ প্রস্তাবের পক্ষে দাঁড়ালে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পিছু হটতে হয়। ভোর ৪টায় এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৪৯ সালে জন্মের ৬ বছর পর ১৯৫৫ সালে এসে আওয়ামী মুসলিম লীগ আওয়ামী লীগে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবার পরেই যুক্ত নির্বাচনের প্রশ্ন গুরুত্ব লাভ করে। ব্রিটিশ আমলের মুসলিম লীগ দাবি করেছিল তারাই মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি। তাই তারা পৃথকভাবে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। অপরদিকে কংগ্রেস নিজেকে অসাম্প্রদায়িক ও সকল ভারতবাসীর প্রতিষ্ঠান বলে মনে করত। তাই তারা যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ ও মুসলিম লীগের আঁতাতে স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতি চালু হয় এবং একই সময় অনুন্নত বলে তফশিল সম্প্রদায়ের জন্যে আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। নির্বাচন সম্পর্কে এই উত্তরাধিকার নিয়ে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভারত ও পাকিস্তান নামে বিভক্ত হয়। তাই পাকিস্তান মুসলিম লীগের নীতিগতভাবেই যুক্ত নির্বাচন করার কোনো উপায় ছিল না। আওয়ামী মুসলিম লীগ মুসলিম শব্দটি তুলে দেয়ার পরে এ দাবি নিয়ে সামনে এগিয়ে আসে।

এ যুক্ত নির্বাচন নিয়ে কিছু কিছু ঘটনা এখনও আমার মনে আছে। ১৯৫৬ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানে সংবিধান প্রণয়ন শুরু হয়। সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে তমুল বিতর্কের সষ্টি হয় পূর্ব বাংলায়। বিশেষ করে এক ইউনিট ও সংখ্যা সাম্যের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলায় সভা সমাবেশ শুরু হয়। একের পর এক মিছিল হতে থাকে ঢাকায়। তখন আমি ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক। আমাদের দল বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল (আরএসপি) তখন নিষিদ্ধ। কমিউনিস্ট পার্টিও তখন নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। আমাদের তখন প্রকাশ্যে কাজ করার কোনো সুযোগ ছিল না। প্রকাশ্যে কাজ করার অর্থ হচ্ছে-নির্যাতন এবং কারাবরণ। আমাদের অনেক বন্ধুদেরই মত ছিল প্রয়োজন হলে ঝুঁকি নিয়েই প্রকাশ্যে কাজ করতে হবে। তখন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আবু হোসেন সরকার। তাঁর আমলে রাজারবাগে পুলিশ ধর্মঘট হয়। এ ধর্মঘটের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে কতিপয় রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। আমাদেরও আবার নতুন করে গা ঢাকার চেষ্টা করতে হয়। শুধু আমি থেকে গেলাম ছাত্রলীগ হিসেবে প্রকাশ্যে কাজ করার জন্যে। এ সময়ে সংবিধানে যুক্ত নির্বাচনের সংযোজনের দাবি উঠতে থাকে।

এ যুক্ত নির্বাচন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রলীগের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় বক্তা আমি এবং ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আবদুল মোমিন তালুকদার। আমরা যুক্ত নির্বাচন সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করাতে সমর্থ নই। তখন পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের অধিবেশনে চলছিল (বর্তমান জগন্নাথ হল মিলনায়তনে)। আমরা পরিষদ ভবনে গিয়ে আমাদের প্রস্তাব পেশ করি।

তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন বিচারপতি ইব্রাহিম। এ সময় একদিন আমি তাঁর বাসায় যাই। তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল বরিশাল থেকে। বরিশালে তিনি দীর্ঘদিন বিচারপতি হিসেবে ছিলেন। ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান সৃষ্টির পর তাঁর আদালতে প্রতিবারই আমরা সুবিচার পেয়েছি। তাই তাঁর সম্পর্কে একটি ভিন্ন ধারণা ছিল আমার ছাত্র জীবনের প্রারম্ভে। সেই বিচারপতি ইব্রাহিমের সঙ্গে দেখা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায়, যুক্ত নির্বাচন প্রস্তাব পাস হবার পর। তিনি আমাকে বললেন-নির্মল, কাজটি তুই ঠিক করিসনি। আমি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিশ্বাস করি না। তুই নিশ্চয়ই লক্ষ করে থাকবি বরিশালে আমি কোনোদিন মুকুল ফৌজের অনুষ্ঠানে যাইনি। আমি মুসলিম লীগের রাজনীতি পছন্দ করি না। আমি শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বিশ্বাস করি না। তিনি যুক্ত নির্বাচনের প্রস্তাব এনেছেন তোদের অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের বঞ্চিত করার জন্যে। স্বতন্ত্র নির্বাচন থাকলে সংখ্যালঘুরা রাজনীতির রদবদলের নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হবে। তারা যে দলকে সমর্থন করবে তারাই মন্ত্রিসভা গঠন করবে। যুক্ত নির্বাচন হলে সংখ্যালঘুরা তেমন নির্বাচিত হতে পারবে না। রাজনৈতিকভাবে তারা পরাজিত হয়ে যাবে। তোর এ প্রশ্নটি লক্ষ করা উচিত ছিল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী কোনো আদর্শের তাড়নায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি।

ঠিক একই কথা বলেছিলেন প্রয়াত রসরাজ মণ্ডল। তফশিল ফেডারেশনের নেতা রসরাজ মণ্ডল তখন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিমন্ত্রী। তার কাছে আমি ছাত্রলীগের আমতলার প্রস্তাবের অনুলিপি দিয়েছিলাম। তিনি প্রস্তাব হাতে নিয়ে বললেন, আপনি শেষ পর্যন্ত আমাদের সর্বনাশ করলেন। আপনাদের প্রস্তাবই হচ্ছে যুক্ত নির্বাচন সম্পর্কে ছাত্রদের প্রথম প্রস্তাব।

আমি সেদিন কোনো জবাব না দিয়ে চলে এসেছিলাম। কিন্তু আমার প্রিয় ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি ইব্রাহিমের কথার জবাব আমাকে দিতে হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, স্যার আপনার কথার জবাব আমি আজকে না। আপনার কথাই সত্য কিন্তু আমি একটি আদর্শে বিশ্বাস করে রাজনীতি করি। আমার আদর্শ সাম্প্রদায়িক গণ্ডি মানে না। আমি বিশ্বাস করি, যে কোনো জায়গা থেকেই হোক অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে হবে। স্যার, আপনি অনেক কিছু জানলেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জ্বালা আপনার পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এ জ্বালা অনুধাবন করতে পারে পূর্ব বাংলার হিন্দু, পশ্চিম পাঞ্জাবের হিন্দু ও শিখ এবং সারা ভারতের মুসলমান। কেউই ইচ্ছে করে পূর্ব পুরুষের ভিটা ছেড়ে চলে যায় না। যায় অনেক চোখের জলে। সে ঘটনাই ঘটছে এ উপমহাদেশে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্যে। এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাতিয়ার ছিল স্বতন্ত্র রাজনীতি পদ্ধতি। সাধারণ মানুষের মতো বাঁচতে হলে এ পদ্ধতির ইতি টানতেই হবে। সেদিন বিচারপতি ইব্রাহিম আমার কথা শুনে হেসেছিলেন। বললেন–তোর মতো বয়সে আদর্শবোধ থাকাই স্বাভাবিক। ঠিক আছে, তুই যা করছিস ভালোই করেছিস। কিন্তু আমি তোর সঙ্গে একমত নই।

সেদিন নির্বিবাদে স্যারের ভবন থেকে বের হয়েছিলাম। বিপদে পড়লাম গভীর রাতে একটি পত্রিকা অফিসে। পত্রিকাটির নাম সাপ্তাহিক যুগবাণী। সম্পাদক বহু বিতর্কিত চিত্তরঞ্জন সুতার। তিনি তখন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। আমি তখন ঐ পত্রিকার বিনা পয়সার কলাম লেখক। আমি উপসম্পাদকীয় লিখি। আমি সে রাতে যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম, কী করে যেনো তার কাছে খবর পৌঁছেছিল। তিনি গভীর রাতে পত্রিকা অফিসে পৌঁছালেন। বললেন, এমনি করে ঢালাওভাবে যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে লেখা যাবে না। আমি বললাম, তাহলে আমি লিখব না। আজ থেকেই আপনার পত্রিকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ। সেদিন দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের মধ্যে আলাপ হলো। তারপর আমি নতুন করে উপসম্পাদকীয় লিখলাম। আমার লেখায় নতুন করে একটু ঘুরিয়ে একটি বাক্যবিন্যাস করলাম। আমাকে লিখতে হলো–আমরা যুক্ত নির্বাচন চাই। তবে অনুন্নত সম্প্রদায়ের জন্যে কিছুদিনের জন্যে আসন সংরক্ষণ করা বাঞ্ছনীয়।

যদিও শেষ পর্যন্ত কোনো সুপারিশ কাজে আসেনি। পাকিস্তানের সংবিধানে একটি অদ্ভুত ধারা সংযোজিত হয়েছিল নির্বাচন সম্পর্কে। রাতভর বিতর্কের পর সিদ্ধান্ত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে যুক্ত নির্বাচন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যে স্বতন্ত্র নির্বাচন। সেই সংবিধানের পূর্ব পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ আর পশ্চিম পাকিস্তান এখন পাকিস্তান। বাংলাদেশে এখন চালু আছে যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি। আর পাকিস্তানে এখনও চালু আছে স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতি।

১৯৫৬ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের সংবিধান রচনা শুরু হলো। এবার সে সংবিধানের বিরুদ্ধে বিরোধীদলীয় নেতা হলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সংবিধান সম্পর্কে বিতর্কে শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর ইতিহাস বিখ্যাত ভাষণ দিয়েছিলেন। সে যেনো আর এক সোহরাওয়ার্দী। যে সংবিধানের কাঠামো তিনিই প্রণয়ন করেছিলেন পূর্ববর্তী সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবে, সেই সংবিধানের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়ালেন হিমালয়ের মতো। কিন্তু কাজে এল না।

পূর্ব বাংলায় তখন প্রতিদিন মিটিং এবং মিছিল। আমি তখন আজকের শহীদুল্লাহ হল তৎকালীন ঢাকা হলে থাকি। হরতালে আমার দায়িত্ব পড়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন ভবন এবং চানখারপুল এলাকায়। হরতাল থাক বা না থাক প্রতিদিন হরতালের জন্যে টোকাইরা আমার রুমের সামনে ভোরবেলা ভিড় জমাত। আমি তখন ঢাকা হলের তিনতলার পশ্চিম দিকের একটি কক্ষে থাকতাম।

এ কক্ষটিতে থাকার একটা শর্ত ছিল। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এ কক্ষে তালা লাগানো যাবে না। অর্থাৎ নকল তালা থাকবে। এ কক্ষে জানালার কপাট খুলে ঘুমাতে হবে। কোনো কিছু বন্ধ রাখা যাবে না। এ সিদ্ধান্তের একটা ভিন্ন প্রেক্ষিত ছিল। প্রেক্ষিত হচ্ছে তঙ্কালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডা. এস এন মিত্রকে কেন্দ্র করে। ছাত্রছাত্রীরা তাঁর কাছে গেলে তিনি তাদের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করতেন, কোন হলের ছাত্র? হলের নাম শুনে ওষুধ লিখতে শুরু করতেন। খুব বেশি হলে জিজ্ঞেস করতেন ঘুমাবার সময় দরোজা জানালা খোলা থাকে কিনা। যারা দরোজা জানালা খোলা রেখে ঘুমাত তাদের তিনি ভালো করে দেখতেন। অন্যথায় কথাই বলতেন না। তাই আমি ডা, মিত্রর কাছে গেলে প্রতিদিনই ঝগড়া হতো এবং এ পরিপ্রেক্ষিতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমাদের রুমে থাকতে হলে দরোজা-জানালা খুলে ঘুমাতে হবে। এভাবে ঘুমাতে অনেকেই রাজি হতো না। অনেকে অসুস্থ হয়ে যেত। আমাদের কক্ষ থেকে অন্যত্র চলে যেত। ওই কক্ষে আমরা যারা দীর্ঘদিন টিকেছিলাম তার মধ্যে ছিলেন জহিরুল ইসলাম, আহমদ হোসেন, মনমোহন রায় এবং হিমাংশুরঞ্জন দত্ত। পরের তিনজনের কেউ কেউ পরবর্তীকালে চাকরিতে যুগ্মসচিব এবং অতিরিক্ত সচিব স্তরে পৌঁছেছিলেন।

আমাদের এ কক্ষের সামনে প্রতি ভোরে টোকাই জমতো। হরতাল না থাকলে তারা বিরক্ত হতো। হরতালের দিন আমাদের সঙ্গে নিয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেত। তবে তারা আমাকে বিশেষ পছন্দ করতো না। কারণ আমি ঢিল মারতে দিতাম না। গাড়িতে আগুন দিতে দিতাম না। এমনকি রিকশার দমও ছেড়ে দিতে দিতাম না। হরতালের দিন গাড়ি দেখলে টোকাইদের খুব আনন্দ হতো। সঙ্গে সঙ্গে ওরা ইট নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যেতো। আমাকে কিছুতেই সামনে যেতে দিতো না। এমনকি একটি হরতালের দিনে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো হলের সামনে একটি গাড়ি দেখা দিল। টোকাইরা তখন গাড়ির আরোহীকে নামিয়ে ফেলেছে। সামনে এগিয়ে চিনলাম গাড়ির আরোহী ঢাকার ডিসি হায়দার সাহেব। হায়দার সাহেব অবাঙালি। আমি তাকে বললাম, আপনি একটু সামনে হেঁটে এগিয়ে যান। গাড়িটি আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে এমনি করে আজকে আপনার বের হওয়া ঠিক হয়নি। টোকাইরা বিক্ষুব্ধ হলো। তারা গাড়ি ছাড়তে কিছুতেই রাজি নয়। অনেক অনুনয় বিনয় করে গাড়ি ছাড়াতে হলো।

এ হরতাল নিয়ে আর একটি ভিন্ন ঘটনা ঘটল পরবর্তীকালে। সেদিন আমি টোকাইদের নিয়ে পুরোনো বেতার ভবনের দিকে এগিয়েছি। এমন সময় ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সের এক মানুষ আমার কাছে এগিয়ে এল। আমাকে বলল, চলুন হিন্দুদের দোকানগুলো পুড়িয়ে দেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? সে জবাব দিল, ১৯৫০ সালের দাঙ্গার সময় আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অথচ কারো বাড়ি আমি আগুন দেইনি বা লুটও করিনি। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে ৫ বছর আমাকে জেল খাটানো হয়েছে। মিথ্যা মামলায় যখন জেল খাটলাম তখন রায়ট করতে অসুবিধা কী? আমি বললাম, ঠিক আছে। পরে একদিন রায়ট করা যাবে। আজকে রায়টের হরতাল নয়। আজকে আমাদের দাবিদাওয়া আদায়ের হরতাল। পরে একদিন সবাই মিলে রায়ট করা যাবে। সে মানুষটি আমার কথা শুনল। আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকল। সন্ধ্যা পর্যন্ত হরতাল করল আমার সঙ্গে।

এ হরতাল আর বিক্ষোভের মধ্যে একদিন পাকিস্তান সংবিধান প্রণয়ন করা হলো। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভালো বক্তৃতা করলেন ঠিকই কিন্তু দাবি আদায় হলো না। প্রকৃতপক্ষে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ছাড়া কোনো দাবি আদায় করা গেল না। প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ঘোষণা করলেন, ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে ওই সংবিধান চালু করা হবে। উল্লেখ্য, ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরের মুসলিম লীগ অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। সে পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস পালন করা হতো। কিন্তু সংবিধান নিয়ে একমত হওয়া গেল না। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সংসদ থেকে বেরিয়ে আসলেন। সংবিধানে স্বাক্ষর করলেন না। তারা ২৩ মার্চ প্রজাতন্ত্র দিবসও পালন করলেন না। এ নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মতানৈক্য হলো। শহীদ সোহরাওয়ার্দী পরবর্তীকালে সংবিধানে সই করেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারা সংবিধানে স্বাক্ষর করেননি। ১৯৫৬ সালে সংবিধান প্রণয়নের পর পূর্ববাংলার নাম হলো পূর্ব পাকিস্তান।

পূর্ব পাকিস্তানে তখন প্রধানমন্ত্রী কৃষক শ্রমিক পার্টির আবু হোসেন সরকার। প্রদেশের গভর্নর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। কেন্দ্রে মুসলিম লীগ ও কেএসপি। পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগ অথচ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় নেই। আবু হোসেন সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রতিদিনই সভা মিছিল হরতাল হতে শুরু করল। অপরদিকে কোন্দল দেখা দিল কেএসপির কোয়ালিশন সরকারে। আওয়ামী লীগেও বিরোধ দেখা দিল বৈদেশিক নীতি নিয়ে। পাকিস্তানের সংবিধানে অর্থবছর পরিবর্তন করা হলো। নতুন অর্থবছর হলো জুলাই থেকে জুন। অথচ আবু হোসেন সরকার ভয় পাচ্ছিল প্রাদেশিক পরিষদ ডাকতে। বাজেট পাস করতে। কারণ ভয় ছিল পরাজয়ের। অপরদিকে আওয়ামী লীগ দাবি জানাচিছল প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন ডাকতে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার আবু হোসেন সরকারকে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করার নির্দেশ দেয়। পরিবর্তে আবু হোসেন সরকার পদত্যাগ করেন ৩০ আগস্ট।

আবু হোসেন সরকার পদত্যাগ করায় দেশে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তানে তখন দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন চালের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। মিছিল হচ্ছে চালের দাবিতে। ৪ সেপ্টেম্বর এমন একটি মিছিল জিঞ্জিরা থেকে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে চকবাজার হয়ে নতুন ঢাকার দিকে আসছিল। পুলিশ এই মিছিলে গুলি করে। চার জন নিহত হয়। আওয়ামী লীগসহ সকল ছাত্র প্রতিষ্ঠান সারাদেশে এই হত্যার প্রতিবাদে হরতাল আহ্বান করে ৫ সেপ্টেম্বর।

৫ সেপ্টেম্বর আমার হরতালের দায়িত্ব পড়ে হাইকোর্ট এলাকায়। আমার সঙ্গে ছিলেন ফজলুল হক হলের ছাত্র আবদুর রহিম। যিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তথ্য অফিসার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন।

আমাদের এলাকা ছিল হাইকোর্ট মোড় থেকে মেডিক্যাল কলেজের মোড় পর্যন্ত। সেদিন এই এলাকায় কতগুলো দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। ওইদিন প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন ছিল। আবু হোসেন সরকার পদত্যাগ করলেও গভর্নর ফজলুল হক তখনো কাউকে নতুন সরকার গঠন করতে বলেননি। তাই সেদিন পরিষদ অধিবেশন থাকায় অসংখ্য সদস্যকে তকালীন পরিষদ ভবন (জগন্নাথ হল) মিলনায়তনে যেতে হচ্ছিল আমাদের এলাকা হয়ে এবং প্রতিটি গাড়ি নিয়েই বিবাদ হচ্ছিল।

এক সময় দেখা গেল, সামরিক বাহিনীর পাহারায় কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস আসছেন। স্বাভাবিকভাবেই জনতা উত্তেজিত হয়ে উঠল। লতিফ বিশ্বাস কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী। আর ঢাকায় গুলি হয়েছে ভুখা মিছিলের ওপর। তাই জনতার বিক্ষুব্ধ হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। এ পরিস্থিতিতে আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের গাড়িবহর হাইকোর্টের কাছে এলে আমরা তাঁকে গাড়ি ছেড়ে দিতে বললাম। বললাম, আপনাকে পৌঁছে দেব পরিষদ ভবনে। তিনি আমাদের কথায় রাজি হলেন। হেঁটে চললেন আমাদের সঙ্গে।

কিন্তু আমরা রমনা গেটের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মিছিল হিংস্র হয়ে উঠল। মিছিল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না। ভাবলাম পরিষদ ভবন নয়, লতিফ বিশ্বাসকে বাঁচাতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীনিবাসে পৌঁছে দেব। কারণ তাঁকে নিরাপদে পরিষদ ভবন পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারব বলে মনে হচ্ছিলো না। ইতোমধ্যে কে যেন তার মুখে গোবর মাখিয়ে দিল।

রমনা গেটের উত্তরে মিছিলে গোলযোগ শুরু হলো। বাংলা একাডেমীতে মিছিল পৌঁছাতে পারল না। সিদ্ধান্ত নিলাম যে কোনো ভবনে তাঁকে ঢুকিয়ে দিতে হবে। বাংলা একাডেমীর দক্ষিণ পাশে আজকের পুষ্টি ভবনে তাঁকে ঢুকিয়ে দিলাম। কিন্তু জনতা তখন মারমুখি। আর সঙ্গী তখনকার ছাত্রলীগের সদস্য আজকের জাতীয় পার্টি নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। তাঁকে বললাম, মোয়াজ্জেম একটা বক্তৃতা দিয়ে মিছিল ফিরিয়ে নাও।

সেদিন মোয়াজ্জেমের বক্তৃতা আজো আমার মনে আছে। মোয়াজ্জেম হোসেন বলল, ভাইসব মানুষ দেখে কারা পালায়?-কুকুর। আপনারা কি কুকুরের পিছু ছুটবেন? না, মিছিলে যাবেন আমাদের সঙ্গে?

মিছিল চলে এল আমাদের সঙ্গে। তখনো জানতাম না যে, এর চেয়েও বড়ো সমস্যা অপেক্ষা করছে রমনা গেটে। আবদুস সালাম খান এবং হাশেমুদ্দীন সাহেব তখন গাড়িতে যাচ্ছিলেন পরিষদ ভবনের দিকে। এ দু’জন এক সময় আওয়ামী লীগ করতেন। এরা আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভায় গিয়েছিলেন দল ছেড়ে। তাই এদের বিরুদ্ধে জনতার স্বাভাবিক আক্রোশ ছিল। রমনা গেটের মোড়ে এদের গাড়ি এলে আমি গাড়ি থামালাম। বললাম, নামুন। পৌঁছে দিচ্ছি পরিষদ ভবনে। গাড়িতে যেতে পারবেন না। তারা গাড়ি থেকে নামতেই মিছিল থেকে এক লোক গিয়ে তাদের মুখে গোবর মাখিয়ে দিল। কোনো মতে তাঁদের নিয়ে মেডিক্যাল কলেজের দিকে এগোলাম। কিছুটা পশ্চিমে গিয়ে তুলে দিলাম ফজলুল হক হলের প্রভোস্ট ড. মযহারুল হকের বাসায়। কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলাম ভিড় বাড়ছে। জনতা ক্ষিপ্ত হচ্ছে। ফজলুল হক হলের প্রভোস্টের বাসা বাঁচানো দায়। আমি একটি রিকশা নিয়ে পরিষদ ভবনের দিকে গেলাম। ভাবলাম মাওলানা সাহেব বা শেখ সাহেবকে ছাড়া এ জনতা ঠেকানো যাবে না। তাদের একজন প্রয়োজন। নইলে অঘটন ঘটে যেতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *