১. অনেকে আমাকে সাংবাদিক বলে চেনে

আমার জবানবন্দি (আত্মজীবনী) – নির্মল সেন

প্রকাশক : ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ
প্রথম ইত্যাদি সংস্করণ : ফেব্রুয়ারি ২০১২

উৎসর্গ

বাবা
সুরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত

মা
লাবণ্যপ্রভা সেনগুপ্ত

.

[আমার জবানবন্দী। এটি নির্মল সেনের আত্মজীবনী নয়। তবে তার লেখার মধ্যে আত্মজীবনীর একটি ছায়া পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে পুরো পাকিস্তান আমলের রাজনৈতিক বাস্তবতার চিত্র এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতীয় উপমহাদেশের তথা বিশ্বরাজনীতির একটি চলমান চিত্র বা ঘটনাপুঞ্জি। একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের চোখে সেই সময়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। আমাদের মাঝে যে বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধ এসেছিল তার নানামাত্রিক ব্যাখ্যা এবং কঠোর কঠিন এক বাস্তবতার কথা নিজস্ব চিন্তায় তুলে ধরেছেন লেখক।

পাকিস্তান আমলের সামরিকতন্ত্র আর মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা তিনি যেভাবে দেখেছেন তা বোধকরি এভাবে এর আগে কেউ ব্যাখ্যা করার সাহস দেখাননি। সময় এবং ঘটনা তিনি যেভাবে অকাট্য যুক্তি, অকপট স্বীকারোক্তি এবং কঠিন বাস্তবতাকে একজন রাজনীতিকে চোখে ব্যাখ্যা করেছেন তা কেবল তার পক্ষেই সম্ভব। স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতাকে তিনি যেভবে সাহস করে তার কলমে তুলে ধরেছেন তা দ্বিতীয় কেউ পারেননি। তার এ লেখা এককথায় বিগত শতাব্দীর উপমহাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন ও তার ইতিহাস এবং বাস্তবতার এক অখণ্ড দলিল; যেখানে প্রকাশ পেয়েছে জন্মভূমি বাংলাদেশের প্রতি আজন্ম দায়বদ্ধ থাকা একজন রাজনীতিকের তীব্র হাহাকার।]

.

মুখবন্ধ

প্রায় এক দশক ধরে আমি অসুস্থ। এখন আমি আমার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় থাকি। শুনতে পারি, বুঝতে পারি, কিন্তু লিখতে পারি না। চোখে দেখি না। আমার কথা আমার একান্ত কাছের স্বজনেরা ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না। এ অবস্থার মধ্যেও নানাজন তাগিদ দেয় কিছু একটা লিখবার। এ কাজে আমাকে এখন সহযোগিতা করে আমার ভাইয়ের ছেলে কংকন সেন ও আমার পড়শি স্থানীয় সাংবাদিক মিজানুর রহমান বুলু। অসুস্থ হওয়ার আগে ঢাকায় থাকতে এ কাজে সহযোগিতা করতে সাংবাদিক হোসেন শহীদ মজনু এবং প্রশান্ত অধিকারী।

আমার জবানবন্দি বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলাম ২০০০ সালে। তারও আগে বিভিন্ন ম্যাগাজিনে এই বইয়ের কিছু লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল সাংবাদিক দীপঙ্কর গৌতমের সহযোগিতায়। সর্বশেষ কাজটি যখন করছিলাম তখন আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাই কাজটি আর এগোয়নি। ফলে যেভাবে পাণ্ডুলিপিটি ছিল সেভাবেই তরফদার প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মাহবুব আলম বইটি প্রকাশ করে। সেখানে নানা ভুলত্রুটি ছিল। পরবর্তীতে আমার এক সময়ের সার্বক্ষণিক সহযোগী প্রশান্ত অধিকারীর সহযোগিতায় ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ-এর স্বত্তাধিকারী জহিরুল আবেদীন জুয়েল ও আদিত্য অন্তর বইটি প্রকাশের আগ্রহ দেখায়। তারা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছে বইটি নির্ভুলভাবে প্রকাশের। আমি তাদের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।

অনুসন্ধিৎসু পাঠক যদি বইটি পড়ে সেকালের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেন এবং জানতে পারেন সে সময়ের ইতিহাস সে লক্ষ্যেই আমার এ প্রয়াস। এ লেখায় আমার অনেক রাজনৈতিক ও সাংবাদিক বন্ধুদের কথা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে উল্লেখ করেছি। অনেকে মনে করতে পারেন আমি তাদের সমালোচনা করেছি। আসলে তা নয়। এটা একান্তই আমার রাজনৈতিক চিন্তা ও অভিজ্ঞতাপ্রসূত মতামতের বহিপ্রকাশ। আশা করি এ নিয়ে আমার বন্ধুরা ভুল বুঝবেন না।

নির্মল সেন
দিঘীরপাড়, কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ
৩১ জানুয়ারি ২০১২

.

আজকে অনেকে আমাকে সাংবাদিক বলে চেনে। অথচ সাংবাদিক হবার কোনোই কথা ছিল না। ভবিষ্যতে কী হব সে নিয়ে এমন কোনো চিন্তা-ভাবনা শৈশবে ছিল না। বাবার এক খুড়তুতো ভাই ড. ধীরেন্দ্রনাথ সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ছিলেন, এক সময় হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড-এর সম্পাদক ছিলেন। সেই সূত্রে সাংবাদিকতা সম্পর্কে কৌতূহল ছিল স্কুল জীবন থেকে। কাকা বাড়ি এলে অসংখ্য পত্রিকা আসত। আমরাও কখনো কখনো হাতে লিখে কাগজ বের করতাম। তবে সে পটভূমিও আমাকে সাংবাদিক বানায়নি।

আমাদের গ্রামে মোটামুটি একটি ভালো লাইব্রেরি ছিল। যেখানে শীতিনেক ভালো ভালো বই ছিল। ঐ লাইব্রেরি চালাতে গিয়ে ব্রিটিশ শাসকদের কোপানলে পড়লেন আমার এক কাকা। আমার এক বোনকে পুলিশ ডেকে নিয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের নটির পূজা ও রক্তকরবী পড়ার জন্যে। তখন থেকেই কিছুটা ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব জন্ম নেয়। তবে তাও খুব একটা উল্লেখযোগ্য কিছু নয়।

নানা কারণে আমার বাড়িতে থেকে পড়ালেখা হয়নি। পাঠশালায় পড়া শেষ করে আমি ভর্তি হয়েছিলাম গিমাডাঙ্গা টুঙ্গিপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এই স্কুলটি আজকের টুঙ্গিপাড়া থানায় অবস্থিত। কাকারা সেখানে ডাক্তারি করতেন। ঐ স্কুলের শিক্ষকদের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানও লেখাপড়া করেছেন। টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতিতে অবস্থান করার জন্যে শেখ সাহেবদের পরিবারের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তবে সে ছিল একান্তই পারিবারিক আত্মীয়তা, এর সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না।

আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন। বইও লিখতেন। হঠাৎ বই লেখার জন্যে তিনি ১৯৩৯ সালে ঢাকায় আসেন। আমিও ঢাকায় এলাম। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছিল যুদ্ধ নিয়ে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহেরুর মতৈক্য হচ্ছে না। এ সময় সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েও সভাপতির পদ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করে সুভাষচন্দ্র বসু ঢাকায় আসেন। আমাদের বাসা ছিল তকালীন দয়াগঞ্জ রোডে। ১৩ নম্বর বাড়িতে আমরা থাকতাম। একদিন দেখলাম সুভাষচন্দ্র বসুর মিছিল যাচ্ছে। তিনি যাচ্ছিলেন শক্তি ঔষধালয় দেখতে। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে তিনি মিছিল করে গেলেন। এর পরে ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ঢাকায় তখন যুদ্ধের খবর নিয়ে। প্রতিদিন একটি টেলিগ্রাম বের হতো। টেলিগ্রামটির নাম ছিল ‘অবন্তিকা’।

যুদ্ধের জন্যে আমরা ঢাকা থেকে বাড়ি চলে যাই। বাড়িতে পড়াশোনা হলো না। সেই কাহিনী আমার জীবনের গল্পের মতো। হঠাৎ একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে ডেকে তুললেন মা। বাড়ির প্রায় সকলে ঘুমিয়ে। মা বললেন, হাত-মুখ ধুয়ে নাও। বিকেলে বরিশালের কলসকাঠি যেতে হবে। বাড়িতে পড়া হবে না। দূরে দেখলাম দাঁড়িয়ে নৌকার মাঝি। মাঝির মাখায় আমার স্যুটকেস।

আমার চোখে জল আসছিল। আগের রাতে বাড়িতে নাটক হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর। আমি অভিনয় করেছি। ভেবেছি ভোরবেলা সকলের সাথে দেখাশুনা হবে। শুনব নিজের অভিনয়ের কথা। না, সব ভেস্তে গেল। মার হাতে নারকেল তেল। মা বললেন, মুখে তোমার নাটকের মেক-আপ আছে। মুখে নারকেল তেল মাখো। তারপর মুখ ধুয়ে ফেলো। আমার চোখে জল। আমি কলের পুতুলের মতো সব করলাম। তারপর রওনা হলাম। বাড়ির সামনে সড়ক। তারপর সুবিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠের পরে কচুরিপানা। এখানে নৌকা। নৌকা যাবে স্টিমার স্টেশন পাটগাতি। স্টিমার আসবে খুলনা থেকে। ঐ স্টিমারে আমাকে বরিশাল যেতে হবে।

আমি হাঁটছি আর হাঁটছি। পিছনে তাকাচ্ছি। শ্বেতশুভ্র কাপড়ে আমার মা তাকিয়ে আছেন, এক সময় চোখের কোণ থেকে মা হারিয়ে গেলেন। আমি নৌকায় উঠলাম। সেদিন যেমন করে বাড়ি ছেড়েছিলাম, তেমন করে আর আমার বাড়ি ফেরা হলো না।

চলে গেলাম বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ থানার কলসকাঠিতে। ভর্তি হলাম কলসকাঠি বরদাকান্ত মুক্তাকেশী একাডেমিতে। এই কলসকাঠিতে এসেই হয়তো আমার ভবিষ্যৎ জীবন নির্ধারিত হয়ে গেল। স্কুল জীবন থেকেই ধারণা ছিল বড় একটা কিছু হতে হবে। অনেক সময় ভেবেছি ভালো শিক্ষক হব, গবেষক হব। একটির পর একটি বিষয়ে থিসিস করব এবং ডক্টরেট হব। কাকা ডক্টরেট বলে ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল ডক্টরেট হতেই হবে। সুবোধ বালকের মতো লেখাপড়া করতে হবে এবং শিক্ষাবিদ হিসাবে খ্যাতি লাভ করতে হবে। কিন্তু কলসকাঠিতে এসে সবই যেন পাল্টে গেল।

এই কলসকাঠির একটি ইতিহাস আছে। কলসকাঠিতে এক সময় স্টিমার স্টেশন ছিল। ইংরেজিতে স্টেশনের নাম ছিল কলুষকঠি। তাহলে কি কলসকাঠিতে কলুষিত হবার মতো কোনো ঘটনা ঘটেছিল? কলসকাঠিতে ১৩ ঘর জমিদার ছিল। জমিদারদের বাগানবাড়ি ছিল, ছিল ছোটখাটো চিড়িয়াখানাও। আজ থেকে এক-দেড়শ’ বছর আগে প্রিন্টিং প্রেস ছিল। এই জমিদারদের অনেক ভবনের কক্ষের সংখ্যা কোনোদিনই হিসাব করা যায়নি। অনেক জমিদারের বাড়ির ভেতরে ছোট ছোট পিলার আছে। লোকে বলে প্রজাদের ধরে এনে খুন করে রাতারাতি কবর দিয়ে ঐ পিলার তৈরি করা হয়েছে। তবে এই জমিদারেরা লোক দেখানো জনকল্যাণের জন্যেও কিছু কিছু কাজ করেছে। স্কুল করেছে নিজ খরচে। ডাকঘর দিয়েছে। গ্রামে ইট বিছানো সড়ক করেছে। তবে আমি যখন কলসকাঠিতে গিয়েছি তখন সবকিছুই অতীতের স্মৃতি মাত্র।

কলসকাঠির একটি ঐতিহ্য ছিল। এই ঐতিহ্য হচ্ছে রাজনীতির। কংগ্রেসের প্রথম যুগে গ্রাম গ্রামান্তরে নেতা ছিলেন জমিদার শ্রেণির লোক। এক শ্রেণির জমিদার ও তহশিলদার কংগ্রেসকে সহযোগিতা কত এবং অর্থ যোগাত। জমিদার সন্তানেরা নির্বিরোধ বিলাসী জীবনযাপন করত। রাজনীতি করায় তাদের খুব অসুবিধা ছিল না। এছাড়াও ছিল এ সকল এলাকায় এককালের গুপ্ত বিপ্লবী দলের প্রভাব। তখন কমিউনিস্ট পাটি গঠিত হয়েছে ঐ এলাকায়। কলসকাঠি স্কুলে ভর্তি হয়ে আমার প্রথম দেখা হলো ফরওয়ার্ড ব্লকের ছাত্রদের সাথে। ফরওয়ার্ড ব্লক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ওদের সাথে যখন আমার দেখা হলো, তখন সুভাষচন্দ্র বসু এক রহস্যময় পুরুষ। তিনি ভারত থেকে ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গেছেন। জার্মানিতে। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে নতুন সেনাবাহিনী গড়বেন এবং ভারতকে স্বাধীন করবেন। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই সুভাষচন্দ্র বসু দেশ ত্যাগ করেছিলেন। তিনি যুদ্ধের প্রথম দিকেই ব্রিটিশকে আঘাত করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু গান্ধী ও নেহেরু সে প্রস্তাবে রাজি হননি। অথচ ১৯৪২ সালে ঐ প্রস্তাবেই রাজি হলেন গান্ধী ও নেহেরুর নেতৃত্বের কংগ্রেস। ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট মুম্বাইতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসল। ব্রিটিশ সরকারকে আলটিমেটাম দেয়া হলো ভারত ছাড়ার। এই আন্দোলনের নাম হলো ‘কুইট ইন্ডিয়া’ অর্থাৎ ভারত ছাড়ো আন্দোলন। গান্ধীজীর শ্লোগান হলো ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’। গান্ধী, জওহরলাল, মাওলানা আজাদসহ কংগ্রেসের সকল নেতারা ঐ দিনই গ্রেফতার হয়ে গেলেন। এর প্রতিক্রিয়া হলো সারা ভারতবর্ষে। সে ঢেউ কলসকাঠিকেও তছনছ করে দিল। আমার জীবনও পাল্টে গেল।

১৯৪২ সাল এসেছিল আমার কাছে ভিন্নভাবে। কলসকাঠি পড়তে এসে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব আরো তীব্র হয়ে উঠল। শৈশব থেকে আমার অভ্যাস ছিল পত্র-পত্রিকা খুঁটেখুটে পড়া। স্কুল জীবনেই সংবাদপত্রের খবর রাখতাম। কংগ্রেস-এর নাম জানতাম। মুসলিম লীগের নাম জানতাম। কমিউনিস্ট পার্টির কথাও শুনেছি। সুভাষচন্দ্র বসুর জন্যে আবেগও ছিল।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর দেখেছি কংগ্রেসের সাথে ব্রিটিশ সরকারের বনিবনা হচ্ছে না। কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারকে শর্ত দিয়েছে স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি না দিলে যুদ্ধে সহযোগিতা করবে না। মুসলিম লীগের অভিমত একটু ভিন্ন ধরনের। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণ করে। এ প্রস্তাবের মর্মকথা হচ্ছে, ব্রিটিশকে ভারত ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু যাওয়ার আগে ভারত ভাগ করে যেতে হবে। মুসলমানদের জন্যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টি করতে হবে। অপরদিকে কংগ্রেসের ছিল অখণ্ড ভারতের আন্দোলন। মুসলিম লীগ কংগ্রেস ব্রিটিশবিরোধী প্রতিটি আন্দোলনকেই অখণ্ড ভারতের আন্দোলন বলে মনে করত। তাই কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এ ধরনের পরিস্থিতি তখন ছিল না। অথচ ঐ বয়সে আমি অন্তত এ ধরনের একটি ঐক্যের পক্ষপাতি ছিলাম না। ভাবতাম এমন হলে কেমন হয়। সবসময় মনে হতো হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধ না হলে ভারতের স্বাধীনতা আসবে না।

আমার এ চিন্তার হয়তো একটি পটভূমি ছিল। আমার বাড়ি আজকের গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া হলেও পাঠশালা ব্যতীত কোটালীপাড়ার কোনো বিদ্যালয়েই আমি পড়িনি। পাঠশালার পরে আমার প্রথম পাঠ শুরু হয় গোপালগঞ্জের গিমাডাঙ্গা টুঙ্গিপাড়া এম.ই স্কুলে।

এই এলাকায় শতকরা ৯০ জনই মুসলমানের বসবাস। আমার দুই কাকা এখানে চিকিৎসা পেশায় খ্যাতিলাভ করেছিলেন। এই স্কুলে পড়ার ফলে আমার ভিন্ন মানসিকতার জন্ম হয়। হয়তো সেই মানসিকতাই পরবর্তীকালে আমার জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। আমি সপ্তম শ্রেণিতে এসে কলসকাঠিতে ভর্তি হই। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়েছে। কংগ্রেসের সাথে ব্রিটিশের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রশ্নে আপসহীন ভূমিকা নিয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ব্রিটিশ শ্রমিক দলের নেতা স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস-এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পাঠাল ভারতে। উদ্দেশ্য আপসে কংগ্রেসের সাথে একটি রফা করা। মূল বক্তব্য হচ্ছে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেয়া হবে। তার পূর্বে নয়। তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন উইনস্টন চার্চিল। এই ভভদ্রলোককে আমি আদৌ পছন্দ করতাম না। তিনি বলেছিলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে ভেঙে ভেঙে টুকরো করার জন্যে তিনি ক্ষমতায় আসেননি। তাঁর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তিনি ক্ষমতাসীন থাকা পর্যন্ত ভারত স্বাধীন হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস-এর দৌড় ব্যর্থ হয়ে গেল। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে চরমপত্র দেয়া হলো। ১৯৪২ সালের ৮ আগস্টের মধ্যে ভারতকে স্বাধীনতা দেয়া না হলে ৯ আগস্ট থেকে কংগ্রেস ভারত স্বাধীন করার লক্ষ্যে চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু করবে।

ব্রিটিশ সরকার কোনো হুমকিতেই কান দিল না। ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট বোষেতে কংগ্রেসের অধিবেশন থেকে ঘোষণা হলো সংগ্রামের কর্মসূচি। তখন কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। মহাত্মা গান্ধী শ্লোগান দিলেন, করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে-ডু অর ডাই। বোম্বেতে কংগ্রেসের অধিবেশন থেকেই কংগ্রেস নেতাদের গ্রেফতার করা হলো। কংগ্রেস নেতারা সংগ্রামের কৌশল সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা না দিয়েই জেলে চলে গেলেন। সারা ভারতবর্ষে অসংগঠিত বিক্ষুব্ধ জনতা রেল লাইন উপড়ে ফেলল। ডাকঘর এবং সরকারি ভবনে আগুন দেয়া শুরু হলো। সেই সংগ্রামের ঢেউ বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ থানার কলসকাঠিতেও আঘাত হানল। আমরা আন্দোলনে শরিক হলাম। আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। ক্লাসে বয়সের দিক থেকে সর্বকনিষ্ঠ। স্কুলের গেটে শুয়ে ১৬ দিন ধর্মঘট করলাম। এর মধ্যে অনেক ঘটনা ঘটে গেল।

১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন দুটি দিকে আমার চোখ খুলে দিল। কৈশোরে নিজের চোখে দেখলাম ব্রিটিশের দণ্ডনীতি, বিভেদ নীতি এবং কমিউনিস্ট পার্টির দুঃখজনক আচরণ।

কলসকাঠিতে তেমন কোনো স্বদেশী আন্দোলন ছিল বলে আমি জানতাম না। মাইলখানেক উত্তরে বেবাজ গ্রাম। সে গ্রামে রাজনৈতিক কর্মীদের একটি আশ্রম ছিল। আশ্রমের নাম ‘গান্ধী আশ্রম’। সে আশ্রমের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল না। কলসকাঠি স্কুলের কাছে কোয়ার্টারে থাকতাম। স্কুলের দক্ষিণে ডাকঘরের সামনে ছোট একটি মাঠ ছিল। সেই মাঠেই একদিন সভা জমে উঠল। সভায় বক্তারা তীব্র ভাষায় ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনা করল। গান্ধী, নেহেরু ও মওলানা আজাদের মুক্তির দাবি হলো। পত্রিকায় খবর আসছিল সারা ভারতে বিক্ষোভের। বিক্ষুব্ধ জনতা ট্রেন লাইন উপড়ে ফেলছে। ডাকঘর ও স্টেশনে স্টেশনে আগুন দিচ্ছে। আগুন দিচ্ছে সরকারি বাসভবনে। কলসকাঠিতে তেমন সরকারি ভবন ছিল না। তারও একটি ইতিহাস আছে।

কলসকাঠি উন্নত গ্রাম। তের ঘর জমিদারের বসবাস। তাদের একটি ডাকঘর চাই। টেলিগ্রাফ অফিস চাই। কিন্তু সেকালে থানা সদরের বাইরে টেলিগ্রাফ অফিস দেয়া হতো না। সরকারের শর্ত ছিল প্রয়োজনীয় সংখ্যক টেলিগ্রাফ না হলে টেলিগ্রাফ অফিস দেয়া যাবে না। কলসকাঠির জমিদারেরা এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। তারা প্রতিদিন সকালে ও বিকালে বরিশাল থেকে কলসকাঠিতে টেলিগ্রাফে খবর পাঠানো রু করলেন। ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে কলসকাঠি বাজারে টেলিগ্রাফ অফিস চালু করল।

সেই টেলিগ্রাফ অফিস আক্রান্ত হলো ১৯৪২ সালে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে। স্টিমার অফিসও পুড়িয়ে দেয়া হলো। আমরা তখন উৎসাহী দর্শক। কলসকাঠি বাকেরগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত। মাঝখানে নদী। নদীর ওপারে থানা। সেখানে স্পিডবোট ছিল না। পুলিশকে নৌকায় যাতায়াত করতে হতো। জরুরি প্রয়োজন দেখা দিলে পুলিশ লঞ্চ ব্যবহার করত। কলসকাঠি থানা সদর থেকে দূরে হওয়ায় সেদিনই পুলিশের আবির্ভাব ঘটল না। পুলিশ এল পরের দিন। নেতৃস্থানীয় চারজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। প্রথমদিনে আর কাউকে গ্রেফতার করতে পারল না।

সে এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি। পুলিশ নেতাদের গ্রেফতার করে বাকেরগঞ্জ থানায় নিয়ে যাচ্ছে। পরদিন তাদের পাঠানো হবে স্টিমারে বরিশাল। আমরা তাদের বিদায় দেবার জন্যে বাকেরগঞ্জ থানায় গেলাম। স্টিমার স্টেশনের নাম রঙ্গশ্রী। দুপুরের দিকে পটুয়াখালী থেকে বরিশালগামী স্টিমার আসত। স্টেশনে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমত। মেয়েরা গান গাইত। বন্দিদের গলায় মালা দিত। পুলিশ তেমন কিছু বলত না।

রঙ্গশ্রীর কথা মনে হলে এখনও আমার চঞ্চলাদির কথা মনে পড়ে। কলসকাঠিতে আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন চঞ্চলাদির আত্মীয়রা। চঞ্চলাদির বাড়ি ছিল বিক্রমপুরের শ্যামসিদ্ধি, থানা শ্রীনগর। স্বামী বাকেরগঞ্জে চাকরি করতেন। কী চাকরি করতেন তা আর এখন মনে নেই। চঞ্চলাদি বড্ড ফর্সা ছিলেন। ফর্সা ছিল তার চোখের তারা। সেই চঞ্চলাদিকেও দেখতাম বন্দিদের বিদায় দেয়ার জন্যে স্টিমার স্টেশনে আসতেন। চঞ্চলাদি আদর্শ গৃহবধূ। সাত চড়ে কথা বলেন না। তিনি কী করে স্টিমার স্টেশনে আসতেন বা কেন আসতেন তা আমিও বুঝতে পারিনি।

ঐ চঞ্চলাদিদের বাকেরগঞ্জের রঙ্গশ্রী ছেড়ে সন্ধ্যার দিকে আমরা কলসকাঠি ফিরতাম। ইতোমধ্যে আমাদের কর্মসূচি নির্ধারণ হয়ে গেছে। আমাদের একমাত্র কাজ নেতাদের খবর দেয়া এবং নেয়া। পুলিশের পক্ষ থেকে অসংখ্য লোকের নামে ইতোমধ্যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। নেতারা আত্মগোপন করেছেন। প্রতিদিন রাতে পুলিশ ঘেরাও করছে বাড়ি। আমরা কয়েকটা ঘন্টার ব্যবস্থা করেছি। পুলিশের খবর পেলেই ঘন্টা পিটানো হতো। নেতারা পালিয়ে যেতেন। দিনের পর দিন পুলিশ এসে ফিরে যেত। সেকালের এক জমাদারের কথা এখনও মনে পড়ে। পুরো নাম কখনো শুনিনি। নাম ছিল গাঙ্গুলী জমাদার। গাঙ্গুলী খুব ধুরন্ধর। কোনো নেতাকে খুঁজে না পেয়ে তিনি আমাদের খোঁজ করতেন। কাছে এসে নানা কথা জিজ্ঞাসা করতেন। কিন্তু কোনো দিনই কোনো কথা বের করতে পারেননি। কিন্তু আমাদের সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করেননি।

তখন প্রতিদিন বিকালে মিছিল হতো। একদিন মিছিলে কয়েকজন কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের দেখলাম। দেখলাম তারা আমাদের মিছিলে যোগ দিয়েছে। কিছুটা অবাক হলাম। শুনেছিলাম কমিউনিস্ট পার্টি ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন সমর্থন করে না। তারা সে মুহূর্তে ব্রিটিশকে বিব্রত করতে চায় না। তাই তাদের দেখে প্রথমে খুব ভালো লাগল। ভাবলাম কমিউনিস্ট পার্টি বোধ হয় আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। আমাদের মধ্যে যাদের বয়স কম ছিল সবাই ভাবতাম আন্দোলনে সকলের আসা উচিত। একদিন মিছিল করতে করতে শুনলাম, মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও নাকি গ্রেফতার হয়েছেন। এ খবরে মিছিলটা যেন অগ্নিগর্ভ হয়ে গেল। ভাবলাম এবার ব্রিটিশের রক্ষা নেই। এবার ব্রিটিশকে যেতেই হবে।

কিন্তু খবরটা সত্যি ছিল না। বাসায় ফিরে পিসেমশাইয়ের কাছে শুনলাম খবরটা সত্যি নয়। পিসেমশাই কলসকাঠি স্কুলের গণিতের নামজাদা শিক্ষক ছিলেন। পিসেমশাইর সুবাদেই আমার কলসকাঠি যাওয়া। তাঁর বাসায় থেকেই স্কুলে পড়তাম। সেদিন পিসেমশাইর কাছে খবর শুনে যেমন বিমর্ষ হয়েছিলাম তেমনি আবার কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের দেখে উফুল্লও হয়েছিলাম।

কলসকাঠির পাশের গ্রাম গাডুরিয়া। গাডুরিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির কিছু লোক আছে জানতাম। তারাই সেদিন এসেছিলেন মিছিলে। শেষ পর্যন্ত তাঁদের কথায় আমার চমক ভাঙল। কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা আমাদের কয়েকজন ছাত্রকে ডেকে মিছিল থেকে দূরে নিয়ে গেলেন। মাথায় হাত বুলালেন, আমাদের খুব প্রশংসা করলেন। তারপর এক সময় বললেন, তোমরা ভুল করছ। এভাবে স্বাধীনতা আসবে না। কংগ্রেস নেতারা জার্মানি ও জাপানের দালাল। সুভাষচন্দ্র বসু বিশ্বাসঘাতক। ওরা ভারতবর্ষকে জাপানের হাতে তুলে দিতে চায়। এ যুদ্ধ হচ্ছে জনযুদ্ধ। জার্মান সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করেছে। জার্মান আগে আক্রমণ করেছে ব্রিটেনকে। আক্রান্ত ব্রিটেন এবং আক্রান্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন বন্ধু। সমাজতন্ত্র বাঁচাতে হলে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাঁচাতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাঁচাতে হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র ব্রিটেনকে এখন বিব্রত করা চলবে না। সুতরাং এখন ব্রিটিশকে বিব্রত করলে ফ্যাসিবাদী জার্মান ও জাপান জিতে যাবে। তাই এখন যারা ব্রিটিশকে বিব্রত করতে চায় তারা বিশ্বাসঘাতক এবং ফ্যাসিবাদী শক্তির মিত্র। সুভাষ বসু এই ষড়যন্ত্র করার জন্যে জার্মান গেছেন। বার্লিন বেতার থেকে ভাষণ দিয়েছেন। তিনিও ফ্যাসিস্টদের দালাল। তাই কংগ্রেস ও সুভাষচন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। সমাজতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে, জাপানের হাত থেকে ভারতকে রক্ষা করতে হলে ব্রিটেনের সাথে সহযোগিতা করতে হবে। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করতে হবে। তখন আমি নবম শ্রেণির ছাত্র। রাজনীতিতত্ত্ব তেমন বুঝতাম না। অবাক বিস্ময়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের কথা শুনলাম। তাদের সাথে বিতর্ক করার মতো বুদ্ধি আমার ছিল না। শুধুমাত্র সুভাষচন্দ্র বসুকে গালি দেয়ায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে তেমন দুর্বলতা আমার সে বয়সেও ছিল না। গালভরা আবুল কালাম আজাদ নামটি বলতে গেলে তা ভালো লাগত।

কংগ্রেসের সভাপতি না বলে আমরা বলতাম রাষ্ট্রপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। তাকে মুসলিম লীগের ছেলেরা গালাগালি করত। কমিউনিস্ট পার্টির নেতারাও তাঁকে সমালোচনা করল। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এরপর থেকে তাদের এড়িয়ে চলতাম। কলসকাঠি থাকাকালীন এরপর কোনোদিন তাদের সাথে ভালোভাবে কথাও বলিনি। এর মাঝখানে আর একটি ঘটনা ঘটে গেল। একদিন ভোরের দিকে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল লঞ্চের বাঁশিতে। ছুটে স্কুলের পাশে খালপাড়ে এলাম। এসে দেখি লঞ্চ ভর্তি পুলিশ আর গুর্খা সৈন্য। প্রায় সব নেতাই গ্রেফতার হয়ে গেছেন। সবাইকে লঞ্চে তোলা হচ্ছে। আমাকে দেখে গাঙ্গুলী জমাদার কাছে এলেন। বললেন তোমাদের ঘন্টার কী হলো? আজ ঘণ্টা বাজল না! বুঝলাম, কেউ টের পাইনি। কাউকে খবর দিতেও পারিনি। চারদিকে তখন ভয় আর ভয়। পুলিশ কাকে গ্রেফতার করবে তা কেউ বলতে পারে না। তখন কেউ গ্রেফতার হলে আমরা রঙ্গী যাই না। বন্দিদের বিদায় দিতে কেউ স্টিমার ঘাটে যায় না। গ্রামে গ্রামে পুলিশ নেমেছে। নেমেছে পুলিশের কেউ। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। আর এমন সময় ব্রিটিশ সরকার নামল নতুন দণ্ডনীতি নিয়ে। দশ হাজার টাকা পাইকারি জরিমানা ঘোষণা করা হলো। বলা হলো, যে সম্প্রদায়ের লোক গ্রেফতার হবে বা গ্রেফতারের তালিকায় যাদের নাম থাকবে সেই সম্প্রদায়ের লোককেই এই জরিমানা দিতে হবে। এই ঘোষণার সাথে সাথে এক শ্রেণির মানুষ জরিমানা না দেয়ার ফিকিরে নামলেন। দালালির খাতায় নাম লেখালেন অনেকে। সকলেরই চেষ্টা নিজের সম্প্রদায়কে বাঁচাবার। এ আন্দোলনে মুসলমান সম্প্রদায়ের কাউকে জরিমানা দিতে হলো না। ভাগ করা হলো হিন্দুদের মধ্যেও। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, কামার-কুমার, কুলি বা শাঁখারীর ভিত্তিতে। যাদের সম্প্রদায়ের লোক অভিযুক্ত নয় তাদের জরিমানা নেই।

কলসকাঠির স্কুলের কাছে আমি থাকতাম। ঐ স্কুলেই সরকারি কর্মকর্তারা এলেন। সারাদিন ভরে জরিমানা আদায় করলেন। আমরা দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। প্রতিবাদ করার কেউ ছিল না। বরিশাল জেলায় শুধুমাত্র কলসকাঠি ও রহমতপুরে ভারত ছাড়ো আন্দোলন তীব্র হয়েছিল। আর কোথাও আন্দোলন তেমন ছড়িয়ে পড়েনি। গান্ধীবাদী কংগ্রেস এই আন্দোলনে এসেছিল নেহায়েত বাধ্য হয়ে। কমিউনিস্ট পার্টি আন্দোলনে আসেনি। বরিশালে সুভাষচন্দ্র বসুর ফরোয়ার্ড ব্লক কোনোদিনও গঠিত হয়নি। মোটামুটিভাবে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল আরএসপি বরিশালে সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতিনিধিত্ব করত। আরএসপিও তখন তেমনভাবে সংগঠিত হয়নি। এককালের অনুশীলন সমিতির অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা জেলখানায় মার্কসবাদ গ্রহণ করেন। কিন্তু লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা তাঁরা সঠিক বলে মনে করেননি। ১৯৪০ সালের ১৯ মার্চ তাঁরা আরএসপি গঠন করেন এবং ঘোষণা করেন যে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সুযোগে ব্রিটিশকে হটাতে হবে। এ ঘোষণা দিয়ে এরা কেউই বেশিদিন বাইরে থাকতে পারেননি। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর ১৯৩৮ সালে তারা মুক্তি পেয়েছিলেন। দল গঠনের ছয় মাসের মধ্যে প্রথম শ্রেণির সকল নেতাই আবার গ্রেফতার হয়ে গেলেন। তবুও তাঁদের নেতৃত্বেই রহমতপুরে আন্দোলন হয়েছিল। কলসকাঠিতে মুখ্যত আন্দোলন ছিল গান্ধীবাদীদের হাতে।

১৯৪৪ সালে আমি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হলাম। ১৯৪৫ সালের শেষের দিকে এককালীন অনুশীলন সমিতির প্রবীণ বিপ্লবীদের সাথে আমার পরিচয় হয়। এ পরিচয় আমাকে কৌতূহলী করে। এ বিপ্লবীরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ গ্রহণ করেছেন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করতে চান। অথচ কমিউনিস্ট পার্টি করেন না। এঁদের সুস্পষ্ট বক্তব্য, লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভুল পথ অনুসরণ করেছে। ফলে বিশ্ববিপ্লব হয়নি এবং এই মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের দ্বারা কোনো দেশেই বিপ্লব হবে না।

তাহলে লেনিনের পথটা কী? কোন পথ থেকে স্ট্যালিন বিচ্যুত হয়েছেন? প্রবীণ বিপ্লবীদের কথায় এ বিতর্ক বিশ্বসমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নিয়ে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে রক্ষা নিয়ে এ প্রশ্নে বিপ্লবের তিন নেতা-লেনিন, ট্রটস্কি এবং স্ট্যালিন একমত হলেন না। প্রথমদিকে স্ট্যালিন লেনিনের মতই পোষণ করতেন। দু’জনেরই বক্তব্য হচ্ছে–একটি দেশের সমাজতন্ত্রের বিজয় সম্ভব হলেও পূর্ণ বিজয় আদৌ সম্ভব নয়। তাঁদের অভিমত বুর্জোয়া দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠন শুরু করা যায়নি। কিন্তু একাধিক উন্নত ধনবাদী দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন না হলে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র রক্ষা করা সম্ভব নয়। সমাজতন্ত্রের পূর্ণ বিজয়ও সম্ভব নয়।

ট্রটস্কির বক্তব্য ছিল পুঁজিবাদী বেষ্টনের পরিবেশে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণও শুরু করা যাবে না। তাঁর কথায় এক দেশে সমাজতন্ত্রের বিজয়ও সম্ভব নয়। অর্থাৎ এক দেশে সমাজতন্ত্রের বিজয়ের প্রশ্নে একদিকে লেনিন ও স্ট্যালিন অপরদিকে ট্রটস্কি অবস্থান নিলেন। এ চিত্রের পরিবর্তন ঘটল ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর। ১৯২৫ সালে স্ট্যালিন বললেন, অপর কোনো দেশে বিপ্লব ছাড়াই সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রের পূর্ণ বিজয় সম্ভব। তাঁর কথা হচ্ছে বিপ্লবের পরিবর্তে অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের সহযোগিতা ও সাহায্যের উপর নির্ভর করে পূর্ণ বিজয় সম্ভব।

কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিল এ সহযোগিতা ও সাহায্যের সংজ্ঞা নিয়ে। বিপ্লব ব্যতীত অপর দেশের শ্রমিকশ্রেণি কীভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করবে, তার ব্যাখ্যা নিয়ে। স্ট্যালিনের বক্তব্য হলো, অপর দেশের শ্রমিকশ্রেণি তার নিজ দেশের সরকার সম্পর্কে নীতি নির্ধারণ করবে সেই দেশের সরকারের সোভিয়েত ইউনিয়ন সংক্রান্ত নীতির ওপর ভিত্তি করে। কোনো দেশের সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে হলে সে দেশের কমিউনিস্ট পার্টি সে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করবে। একইভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে কোনো দেশের সরকারের সম্পর্ক ভালো থাকলে কমিউনিস্ট পার্টি সে দেশের সরকারের সাথে সহযোগিতা করবে।

প্রবীণ বিপ্লবীদের ভাষায়–এ হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নকে অন্ধ অনুকরণের নীতি। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর এ নীতি অনুসরণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টি। প্রথমে এরা জার্মানির বিরুদ্ধে টু শব্দটি করেনি। কারণ জার্মানির সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনাক্রমণ চুক্তি ছিল। জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করার পরই তারা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এবার তারা বলেছেন-জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করেছে। সুতরাং জার্মানি আমাদের শত্রু। জার্মানি ব্রিটেনকে আক্রমণ করেছে-সুতরাং আক্রান্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন পরস্পরের মিত্র। ব্রিটিশ সোসাভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র হওয়ায় ব্রিটিশ ভারতেরও মিত্র। সুতরাং যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় ব্রিটিশকে বিপর্যস্ত করা যাবে না। এতে ভারতের স্বাধীনতা বিলম্বিত হলেও করার কিছু নেই। সোভিয়েত সমাজতন্ত্র রক্ষার জন্য সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশকে সহযোগিতা করারই একমাত্র কাজ।

অনুশীলন সমিতির প্রবীণ বিপ্লবীরা এ তত্ত্ব মেনে নেননি। তাই তাঁরা লেনিনের পথকে অনুসরণ করে গড়ে তুলেছিলেন বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল। সেই অর্থে বলা যায়, বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল আরএসপি ছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে গঠিত কমিউনিস্ট পার্টির বিকল্প বিপ্লবী দল। এ দুটি দলের তাত্ত্বিক বিতর্ক ছিল তীক্ষ্ণ এবং তীব্র। ১৯৪৫ সালের শেষের দিকে এই বিপ্লবীদের সাথে আমার পরিচয় ঘটে। এ দলের নেতারা তখনও জেল থেকে মুক্তি পাননি। এক নাগাড়ে প্রায় চৌদ্দ-পনের বছর এদের জেলে থাকতে হয়েছে।

১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনের সময় এদের গ্রেফতার করা হয়। ১৯৩৮ সালে এঁদের মুক্তি দেয়া হয়। আবার ১৯৪০ সালে আরএসপি গঠনের ছ’মাসের মধ্যে সকলেই গ্রেফতার হয়ে যান। তবে সকলেই ছাড়া পান ১৯৪৬ সালে সাধারণ নির্বাচনের পর। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়ে সকল বন্দিদের মুক্তি দেন।

এই প্রবীণ বিপ্লবীদের সাথে আলোচনার ফলে আমাদের দীর্ঘদিনের সংশয় কেটে যায়। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় কমিউনিস্ট পার্টির আচরণ আমাকে বেদনার্ত করেছিল। আরএসপির বিপ্লবীদের সংস্পর্শে এসে আমি সেদিনের কমিউনিস্ট পার্টির আচরণের একটি ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম। এই ব্যাখ্যাই আমাকে বলে দিল–কমিউনিস্ট পার্টিতে অনেক সংগ্রামী এবং বিশ্বস্ত নেতা কর্মী থাকলেও অন্ধ অনুকরণ তাদের বিপর্যস্ত করবে। অন্ধ অনুসরণ ও অনুকরণের নীতির ফলে ভারতের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে সুদূর পরাহত। কারণ ‘আমি চাই বা না চাই কমিউনিস্ট পার্টিই তখন সমাজতন্ত্রের পক্ষে সবচেয়ে বড় শক্তি বলে পরিগণিত’-এই পটভূমিতেই আমার আরএসপির সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

তবে সে সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৪৬ সালে সকল নেতাই মুক্তিলাভ করেন। ১৯৪৬ সালেই সারা ভারতবর্ষে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়। আর এর পূর্বে ঘটে যায় কয়েকটি যুগান্তকারী ঘটনা। প্রথম ঘটনাটি ঘটে ১৯৪৫ সালে ২১ নভেম্বর। কলকাতার ছাত্ররা আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতাদের যুক্তির দাবিতে মিছিল করছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। লক্ষ্য ছিল নিজের শক্তিতে সশস্ত্র অভিযানের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করা। জাপান সরকার আজাদ হিন্দ ফৌজকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ ইলের কোহিমা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছিল ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে। সেই সময় পেছন থেকে জাপান বিশ্বাসঘাতকতা করল। সর্বশেষে জাপান বুঝতে পেরেছিল যে, সুভাষচন্দ্র বসু তাদের ওপর নির্ভর করবেন না। তাদের কথা শুনবেন না। সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের বিরোধের সুযোগ নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বে ভারতবাসীরাই ভারতবর্ষ স্বাধীন করবে। এ পরিস্থিতি জাপানের কাছে কাম্য ছিল না। তারা ভেবেছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের কাঁধে সওয়ার হয়ে ভারতবর্ষ দখল করবে। সে স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ায় তারা আজাদ হিন্দ ফৌজকে সকল সাহায্য ও সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়। পর্যদস্ত আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে বন্দি হলেন। ইতোপূর্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের দুই প্রতিনিধি হরিদাস মিত্র ও পবিত্র রায় বিশেষ বার্তা নিয়ে সাবমেরিনে উড়িষ্যার উপকূলে পৌঁছলে গ্রেফতার হয়ে যান। বিচারে তাদের প্রাণদণ্ড হয়। গান্ধীজীর হস্তক্ষেপে প্রাণদণ্ড স্থগিত হয়ে যায়।

আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের খবরে সারাদেশ তখন অগ্নিগর্ভ। এর মধ্যে খবর এল যে, তাইপেতে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজী সুভাষ বসু মারা গেছেন। তিনি তাইপে থেকে বিমানে ব্যাংকক যাচ্ছিলেন। তাঁর এই মৃত্যুর খবর কেউ বিশ্বাস করল না। সন্দেহ আরো গম্ভীর হলো। এ সময় ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিল আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দি সেনানায়কদের বিচারের। বিচার হবে নয়াদিল্লির লালকেল্লায়। অভিযুক্ত নেতৃবৃন্দ হলেন কর্নেল শাহনেওয়াজ, ধীলন, সায়গল, রশিদ আলী, ঝাঁসির লক্ষ্মী বাই প্রমুখ। সারা ভারতবর্ষ ভেঙে পড়ল। উকিলের পোশাক পরলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু থেকে শুরু করে কংগ্রেসের সকল ডাকসাইটে নেতবৃন্দ। উল্লেখ্য যে, এঁরা ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় এ পেশা ত্যাগ ছিল।

আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃবৃন্দের বিচার বসবে নয়াদিল্লির লালকেল্লায়। সারা ভারতের মানুষের মুখে তখন আজাদ হিন্দ ফৌজের নাম। ঘরে ঘরে সুভাষচন্দ্র বসু, কর্নেল শাহনেওয়াজ, ধীলন, সায়গল, রশীদ আলী, লক্ষ্মী বাঈ-এর ছবি।

এই বিচারের বিরুদ্ধে ১৯৪৫ সালের ২১ নভেম্বর কলকাতায় মিছিল হলো। মিছিলে পুলিশের গুলিতে মার গেলেন রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। ঢাকায় বাড়ি। কলকাতার ছাত্র। ঢাকার বাসা হাটখোলা রোডে ঢাকেশ্বরী কটন মিলের কেন্দ্রীয় দফতরের কাছে। তাঁর কাকা সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এককালীন অনুশীলন সমিতি ও পরবর্তীকালের আরএসপি নেতা। দ্বিতীয় ঘটনা ঘটল ফেব্রুয়ারি মাসে। আমি তখন আইএসসি পরীক্ষার্থী। আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যতম সদস্য রশিদ আলীর মুক্তির দাবিতে মিছিল নেমেছে কলকাতায়। মিছিলে গুলি হলো। নিহত হলেন আবদুস সামাদ। মুসলিম লীগ আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিকে নিজস্ব দাবি হিসেবে সাম্প্রদায়িক রং দেবার চেষ্টা করেও সফল হলো না। ব্রিটিশ সরকারের গুলি আবার সকলকে ঐক্যবদ্ধ করল।

আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতাদের মুক্তির দাবিতে সারা ভারতে আন্দোলন কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ নেতাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিল। এককালে কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহেরু নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে ফ্যাসিস্টদের সহযোগী বলে অভিহিত করেছিলেন। সেই নেহেরুকে উকিল কোর্ট পরতে হয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবির তীব্রতায়।

অপরদিকে মুসলিম লীগ দেখল–এ আন্দোলন সফল হলে ভারত স্বাধীন হবে, পাকিস্তান হবে না। তাই তারা আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সীমারেখা টানবার চেষ্টা করল। কর্নেল রশীদ আলীকে মুসলিম লীগের লোক বলে অভিহিত করে রশীদ আলী দিবস পালনের ডাক দিলেন। তাঁরা শাহনেওয়াজ, সায়গল বা লক্ষ্মী বাঈয়ের কথা বললেন না। কিন্তু কাজ হলো না। রশীদ আলীর মুক্তি আন্দোলনও সর্বজনীন রূপ পেল। ব্রিটিশের পুলিশ কাউকে ক্ষমা করল না মুসলমান বলে। আন্দোলন আরো তীব্র হলো। তৃতীর ঘটনা হলো–নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীতে বিদ্রোহ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সারা ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্র হয়। সামরিক বাহিনীতে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে থাকে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বামপন্থীরা পরিকল্পনামাফিক কিছু রাজনৈতিক কর্মীকে সেনাবাহিনীতে ঢুকিয়েছিল। এরাই পরবর্তীকালে এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলব।

এ পরিস্থিতিতে রাওয়ালপিন্ডিতে বিমানবাহিনীর সদস্যরা বিদ্রোহ করল। প্রকাশ্যে নৌবাহিনীর সদস্যরা বিদ্রোহ করুল বোম্বেতে। বোরে বিদ্রোহে শঙ্কিত হলো ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু এ বিদ্রোহ থামানো যাবে কিভাবে। বিদ্রোহীরা জাহাজে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্টদের লালঝাণ্ডা উড়িয়েছে। বোম্বেতে কার্ফু জারি করা হয়েছে। বিদ্রোহ দমন করা গেল না।

ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারলো কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ নেতাদের সহযোগিতা ব্যতীত এ বিদ্রোহ দমন করা যাবে না। তখন মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কলকাতা সফর করছিলেন। তাকে জরুরি ভিত্তিতে বম্বে আনা হলো। কংগ্রেসের দু’নম্বর জাঁদরেল নেতা বল্লভভাই প্যাটেল বম্বেতে ছিলেন। জিন্নাহ ও বল্লভভাই প্যাটেলকে বম্বের সমুদ্রতীরে কার্ফুর ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। তাঁরা মাইকে বিদ্রোহী নৌবাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। বললেন, শান্ত হও। দেশ স্বাধীন হবে।

কী অভিনব দৃশ্য! একজন ভারত ভাগ করে পাকিস্তান করতে চান–অপরজন অখণ্ড ভারত চান। এঁরা এক হলেন ব্রিটিশ সরকারের অনুরোধে বিদ্রোহ থামাতে। অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকারের মতোই এঁরা কেউই চাইতেন না যে, ভারতবর্ষ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন হোক। কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ আসে স্বাধীনতা চেয়েছে। আপসে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চেয়েছে ব্রিটিশ সরকার। ভারতবর্ষে তার কোটি কোটি টাকার পুঁজি খাটছে। ভারতের উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। সেই ভারতবর্ষ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন হলে সবকিছু হারাতে হবে ব্রিটিশকে। সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা এলে মুসলিম লীগের পাকিস্তান হবে না। ক্ষমতা আসবে না কংগ্রেসের হাতে। তাই বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ তিনপক্ষই একমত এবং ঐক্যবদ্ধ।

চতুর্থ ঘটনা ঘটলো ২৯ জুলাই। ডাক ও তার কর্মচারীদের সমর্থনে সারা ভারতে হল। বক্ষের বিদ্রোহ থামানো কংগ্রেস, মুসলিম লীগ নেতাদের পক্ষে সম্ভব হলেও ২৯ জুলাইয়ের ঘটনায় রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হলো। ভারতের রাজনীতিতে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক সমাজের নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে শঙ্কিত করে তুলল। দীর্ঘদিন ধরে সারা ভারতে ডাক ও তার কর্মচারীরা ধর্মঘট করে আসছিল। তাদের সমর্থনে সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলো প্রথমবারের মতো সারা ভারতে হরতাল আহ্বান করে। ২৯ জুলাই সারা ভারতে হরতাল পালিত হলো। এবার শঙ্কিত হলো ব্রিটিশ, কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ। পাকিস্তানের দাবিতে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম আহ্বান করলো মুসলিম লীগ। ইংরেজিতে বলা হলো ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে। কিন্তু এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কার বিরুদ্ধে? জিন্নাহ সাহেব বা মুসলিম লীগ এ প্রশ্নের জবাব দিলেন না। ২৯ জুলাইয়ের ১৬ দিন পর ১৬ আগস্ট এলো। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের পরিণতি কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দেশে-বিদেশে প্রচারিত হলো গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং বলে। প্রমাণিত হলো ২৯ জুলাইয়ের শ্রমিক-জনতার ঐক্য ঠুনকো ঐক্য। ১৬ আগস্ট প্রমাণিত হলো হিন্দু-মুসলমান এক নয়। তারা পৃথক জাতি। তাদের পৃথকভাবে বসবাস করতে হবে। তাই মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র বাসভূমি চাই। সংখ্যালঘু মুসলমানদের বাঁচতে হবে মান-সম্মান, ইজ্জত এবং মর্যাদা নিয়ে। সুতরাং পাকিস্তান চাই।

আমি বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র। সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে প্রায় জড়িয়ে গেছি। নিয়মিত আরএসপি অফিসে যাই। প্রবীণ নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। এদের গোটা জীবনের ইতিহাস কারাবরণের ইতিহাস। বরিশালে বিশেষ করে ছাত্রদের মধ্যে এদের প্রভাব প্রতিপত্তি প্রবল। ঐ চরম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দিনেও এদের ছাত্র ফ্রন্টের প্রথম সারিতে মরহুম মোজাম্মেল হক, আবুল কালাম শামসুদ্দীন (পরবর্তীকালে শামসুদ্দীন আবুল কালাম), আব্দুল খালেক খান (পরবর্তীকালে সাংবাদিক), জাহিদ হোসেন জাহাঙ্গীর প্রমুখ। তখন দেখা হয়েছিল প্রণব ঘোষের সাথে। সদ্য জেলখানা থেকে এসেছেন। বিএ ক্লাসের ছাত্র। সরকারি নির্দেশে গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত। কলেজে আসতে পারতেন। তবে ক্লাসে ঢুকবার অনুমতি ছিল না। ক্লাসে ঢুকবার দুয়ারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনতেন।

তখন আমরা ছাত্র ফেডারেশন (১৮ মির্জাপুর স্ট্রিট)-এর সদস্য। এই ছাত্র সংগঠনের ইতিহাসও বিচিত্র। ত্রিশের দশকে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হয়। এই ছাত্র ফেডারেশনের ভাঙন আসে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এন এফ) নামে কাজ করত। ১৯৪১ সালের জুন মাসে জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করলে কমিউনিস্ট পার্টি যুদ্ধকে জনযুদ্ধ বলে ঘোষণা করে। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির তখন কোনো প্রকাশ্য সংগঠন না থাকায় ছাত্র ফেডারেশনের মঞ্চ থেকে তারা যুদ্ধকে জনযুদ্ধ ঘোষণা দেয়। এতে তীব্র আপত্তি করে কংগ্রেস, ফরোয়ার্ড ব্লক, জয়প্রকাশ নারায়ণের কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টি ও বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল (আরএসপি)। এর পরিণতিতে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন দুভাগ হয়। নিখিল ভারত ছাত্র কংগ্রেস গঠিত হয়।

তবে কংগ্রেসের নেতৃত্বে নিখিল ভারত ছাত্র কংগ্রেস গঠিত হলেও বাংলাদেশে তার ভিন্ন রূপ ছিল। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন ভেঙে গেলেও বাংলাদেশে আরএসপি’র নাম পাল্টাল না। কমিউনিস্ট প্রভাবিত ছাত্র সংগঠনটির নাম থাকল ছাত্র ফেডারেশন (১৮ মির্জাপুর স্ট্রিট)। কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনের নাম হলো বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র কংগ্রেস। আর সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে মুসলিম লীগের ছাত্র প্রতিষ্ঠানের নাম নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন হলেও বাংলাদেশে তাদের ছাত্র সংগঠনের নাম হলো মুসলিম ছাত্রলীগ।

একদিন বরিশালে অশ্বিনীকুমার টাউন হলে গেলাম হিন্দু মহাসভার জনসভা শুনতে। ভাষণ দিচ্ছিলেন প্রখ্যাত ব্যারিস্টার নির্মল চ্যাটার্জি। তিনি খুব ঔদ্ধত্যপূর্ণ সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিচ্ছিলেন। আমি উত্তেজিত হয়ে গেলাম। খেয়াল হলো আমার কাছে দাঁড়ানো আমার এক প্রাক্তন শিক্ষক। তার নাম রমেশ চ্যাটার্জি। কলসকাঠি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমাকে থামাতে চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন, তুমি কি জান নোয়াখালীতে মুসলমানেরা হিন্দু মেয়েদের স্তন কেটে নিয়েছে? আমি বললাম, আমি এও জানি যে বিহারের হিন্দুরাও মুসলমান মেয়েদের স্তন কেটে নিয়েছে। মাস্টারমশায় আমার দিকে গভীরভাবে তাকালেন। আমি চলে এলাম। ঠিক বুঝতে পারলাম না শিক্ষকের মুখে জবাব দেয়া ঠিক হয়েছে কি না। সেকালে ছোটবেলা থেকে আমাদের শেখানো হতো গুরুজনদের কথায় জবাব দিতে নেই।

তবে এ ধরনের কথাবার্তা আমি কোনোদিনই মানিনি। তারও একটা পটভূমি ছিল। ১৯৪৪ সালে আমি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হই। আমাদের বয়স তখন কম ছিল। আমরা জনাত্রিশ ছাত্র হাফপ্যান্ট পরে কলেজে আসতাম। সামনের বেঞ্চে বসতাম। লেখাপড়ায় খুব ভালো না হলেও সকলের ধারণা ছিল ছাত্র হিসেবে আমরা মন্দ নয়। পেছনের বেঞ্চের ছাত্ররা আমাদের এড়িয়ে যেত। তাই কথা বলায় আমাদের একটা অহমিকা ছিল। এই অহমিকা প্রকাশ পেত বিতর্ক শুরু হলে। দাঙ্গা আর সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে তর্ক শুরু হলে প্রায় একঘরে হয়ে যেতাম। কারো সাথে একমত হতে পারতাম না। কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম সাম্প্রদায়িক মনোভাব লক্ষ্য করতাম।

ঠিক এ সময় পার্টির সিদ্ধান্ত হলো গ্রামে যাবার। দাঙ্গার ভয়ে গ্রামের মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত। গ্রামে যেতে হবে। দাঙ্গার পরিবেশ ঠেকাতে হবে। পার্টির নেতা অনিল দাশ চৌধুরী। আমাকে তার সাথে যেতে হবে ভোলা মহকুমায়। সপ্তাহখানেক ভোলায় কাটালাম। তখনই চিনেছিলাম দৌলতখান, গুপ্তেরবন্দর, রাধাবল্লভ, বোরহানউদ্দিন, লালমোহন।

ভোলা থেকে ফিরে মন আরো খারাপ হয়ে গেল। দেখলাম সর্বত্র একটা দুঃখজনক অবিশ্বাস বিরাজ করছে। শতাব্দী ধরে যারা পাশাপাশি বাস করছিল তারা বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে মনে হচ্ছিল ভারতবর্ষ বিভক্ত হলে কোনো চিন্তাভাবনা না করে হিন্দুরা এ দেশ ছেড়ে চলে যাবে।

কিন্তু আমরা কী করবো। বায়োজ্যেষ্ঠ অনিল দাশ চৌধুরী। মোজাম্মেল হক এমপ্লয়মেন্ট এক্সপ্রেসে চাকরি করেন। শামসুদ্দীনদা বিএ পাস করে কলকাতা চলে গেছেন। খালেকদা আছেন। এর পরে আমরা সবাই বয়সের দিক থেকে সমান।

নয়াদিল্লিতে তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে। এ সরকার হয়েছে সর্বদলীয়। এ সরকারের প্রেসিডেন্ট বড় লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভভাই প্যাটেল। আর অর্থমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। ঠিক এ বছরই নয়াদিল্লিতে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল আরএসপির প্রথম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। সম্মেলনে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয় যে, ভারতবর্ষ বিভক্ত হলে এই উপমহাদেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত হবে। আর এই ঘাটি ব্যবহৃত হবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে।

তবে আমাদের কাছে মুখ্য প্রশ্ন হলো সে মুহূর্তে আমাদের ভূমিকা কী হবে? আমরা কিভাবে মূল্যায়ন করব ভারতের অন্তবর্তীকালীন সরকারকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ছাত্র ফ্রন্টের কাছে নির্দেশ এল ছাত্রদের নিজস্ব দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু করার। আমার এখন মনে পড়ে আমরা শিক্ষামন্ত্রীকে একটি স্মারকলিপি পাঠিয়েছিলাম এই নির্দেশ পাবার পর। তখন অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন সাফায়েত আহম্মদ খান।

আমরা তখন নিখিল বঙ্গ ছাত্র কংগ্রেসের সদস্য। আমাদের ছাত্র ফেডারেশনের নাম পাল্টাতে হয়েছে নিখিল ভারত কংগ্রেসের নির্দেশে। এ নির্দেশ মানতে মানতে উপমহাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন এসে যায়।

ভারত বিভাগ তখন অবশ্যম্ভাবী। এবার দাবি উঠেছে পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাগের জন্য। মনে হচ্ছে সারা ভারতবর্ষে ভারতবাসী বলে কেউ নেই। সকলেই হিন্দু বা মুসলমান। তাই দাবি উঠছে হিন্দু এলাকাগুলো ভারতের অন্তর্ভুক্ত হোক। মুসলিম এলাকাগুলো থাক পাকিস্তানে। এক সময় যারা বাংলা বিভাগকে মায়ের অঙ্গচ্ছেদ বলে মনে করত তারাই বাংলা বিভাগের দাবি করল সবচেয়ে আগে।

তখনকার একটি ঘটনা আমার চোখের সামনে ভাসে। নয়াদিল্লিতে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির মিটিং বসেছে। এ বৈঠকে ভারত বিভাগ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হবে। এই বৈঠকে ভারত বিভাগের বিরুদ্ধে মাত্র দু’জন বক্তাই কথা বলছেন। একজন জয় প্রকাশের সমাজতান্ত্রিক দলের অরুণা আসফ আলী। অপরজন বাংলাদেশের রংপুরের অধিবাসী বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল আরএসপি’র সদস্য কমরেড সুনীল দেব।

কংগ্রেসের সভায় ভারত বিভাগ প্রস্তাব পাস হয়ে গেল। কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ হলে সাংবাদিকরা এল অরুণা আসফ আলীর কাছে। সাংবাদিকরা বললেন বামপন্থীরা হেরে গেছে। বিক্ষুব্ধ অরুণা আসফ আলী বললেন, না দক্ষিণপন্থীরা জিতে গেছে। এটাই ছিল অরুণা আসফ আলীর কথা বলার ধরন। অরুণা আসফ আলীর জন্ম বরিশাল শহরে। নাম অরুণা গাঙ্গুলি। গ্রামের বাড়ি বরিশালের গৌরনদী। বিয়ে করেছিলেন কংগ্রেস নেতা আসফ আলীকে। খ্যাতি লাভ করেছিলেন ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়। আত্মগোপন করে আন্দোলন করেছিলেন। আবার একদিন ঘোষণা দিয়ে ব্রিটিশের চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন কলকাতার এক জনসভায়।

কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ দেশ বিভাগ মেনে নেবার পর বাংলা বিভাগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার চেষ্টা হয়েছিল বাংলাদেশে। দাবি করা হয়েছিল সার্বভৌম বাংলার। এ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু, শহীদ সোহরাওয়াদী, অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগ সম্পাদক জনাব আবুল হাশিম, বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল আরএসপি ও ফরোয়ার্ড ব্লক। কিন্তু সে আন্দোলন তেমন কাজে আসেনি। সিন্ধু, গঙ্গা ও যমুনায় তখন অনেক জল গড়িয়েছে। আমাদের তখন ঘর গোছাবার পালা।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট গভীর রাতে দেশ ভাগ হয়ে গেল। গ্রামের পর গ্রাম থেকে হিন্দুরা চলে যেতে থাকল। ওপার থেকে এল পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের মুসলমানরা। ১৯৪৭ সালে পূজায় বাড়ি গেলাম। দেশের প্রায় সকলেই শঙ্কিত। সকলেই শেষ সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে। সকলেরই ধারণা এদেশে থাকা যাবে না। এদিকে আবার আরেক ঘটনা ঘটিয়েছে আমার আর এক কাকা। তিনি কংগ্রেস করতেন। ব্রিটিশ আমলে গহে অন্তরীণ ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট বাড়িতে পাকিস্তানের পতাকা উড়ালেন না। উড়ালেন কংগ্রেসের দলীয় পতাকা। যদিও কংগ্রেসের দলীয় পতাকা এবং ভারতের জাতীয় পতাকা এক নয়। তবুও এই দুই পতাকার অনেকটা মিল আছে। ভুল বুঝবার অবকাশ আছে। অনেকেই কাকার কংগ্রেসের পতাকা ওড়ানোকে ভারতের পতাকা বলে মনে করল। কাকার যুক্তি হচ্ছে যে কোনো উৎসব বা অনুষ্ঠানে আমার দলীয় পতাকা ওড়াবার অধিকার আছে। পাকিস্তান কংগ্রেস অবলুপ্ত হচ্ছে না। পাকিস্তানে কংগ্রেস থাকবে তাই তার পতাকাও থাকবে। তাই পতাকা ওড়াবার অধিকারও থাকবে।

পূজার সময় আমার সাংবাদিক ও অধ্যাপক কাকা ড. ধীরেন্দ্রনাথ সেন বাড়ি এলেন। সেটাই তাঁর শেষবারের মতো বাড়ি আসা। তিনি একটা অদ্ভুত কথা বললেন। তিনি বললেন, তোমরা কেউ দেশ ছেড়ে চলে যেও না। তোমরা দেশ ছেড়ে গেলে এসকল গ্রামে অবাঙালিদের পুনর্বাসিত করা হবে। পাকিস্তান হবে দুই অর্থনীতির দেশ। অর্থনৈতিক কারণেই পাকিস্তান টিকবে না। টিকতে পারে না।

সেই আমার কাকার সাথে শেষ দেখা। কাকা বাড়ি থেকে চলে যাবার পর আমাদের বাড়িতে পুলিশের হামলা হলো। হঠাৎ পুলিশ এসে দালানের সিঁড়ির নিচ থেকে একটি অকেজো বন্দুক আবিষ্কার করল। ঘন্টার পর ঘন্টা মেয়েদের আটকে রাখল। সারা বাড়ি জুড়ে এক তোগলকি কাণ্ড। পুলিশের নেতৃত্ব দিলেন বর্ডার মিলিশিয়ার নর্টর জোন্স। আমার সেই কংগ্রেসি কাকাকে গ্রেফতার করা হলো। আমাদের বাড়িতে হামলা চালাবার আগে বেছে বেছে ১৬ জন তফশিলি নেতাকে গ্রেফতার করা হলো। গোপালগঞ্জে তখনও হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তফশিলি নেতারা খুবই প্রভাবশালী। আমাদের বাড়িতে হামলার প্রতিক্রিয়া হলো তীব্র। গ্রামের পর গ্রাম শূন্য হতে থাকল। শতকরা ৯৫ জন মধ্যবিত্ত হিন্দু দেশ ছেড়ে চলে গেল। আমি তখন বরিশালে। চতুর্থ বর্ষ বিএসসির ছাত্র। বিএসসি পরীক্ষা এগিয়ে আসছে। পড়াশোনার খোঁজ নেই। অনার্স পড়া ছেড়েছি বছরখানেক আগে। রাজনীতি করে অনার্স পড়া হয় না। দল থেকে বলা হয়েছে অনার্স পড়া চলবে না। নিয়মিত বিএসসি পরীক্ষা দেবে কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে। তোমরা বিএসসি পরীক্ষা দিয়ে চলে গেলে নেতৃত্বের শূন্যতা দেখা দেবে। এ পরিস্থিতিতে বিএসসি টেস্ট পরীক্ষা এগিয়ে এল। আমি তখন বরিশাল শহরের কালিবাড়ি রোড বাণীপীঠ স্কুলের একটি কক্ষে থাকি। সে স্কুলটি এখন নেই। বরিশাল বিএম স্কুলের পশ্চিমে সেই এলাকায় এখন পরিবার পরিকল্পনার বিরাট দালান। ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর বাণীপীঠ স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্নেহাংশু সেনগুপ্তকে গ্রেফতার করা হয়। স্কুলটি উঠে যায়। সেই স্কুলের জমিতে পরবর্তীকালে ধান চাষ করতে দেখেছি। পরে উঠেছে পরিবার পরিকল্পনার দালান।

সেই বাণীপীঠ স্কুলের কক্ষে মোমবাতি জ্বালিয়ে পরীক্ষার পড়া পড়ছিলাম। পরের দিন টেস্ট পরীক্ষা। সন্ধ্যার পরে অনিলদা এলেন। অনিলদা অর্থাৎ দলের নেতা অনিল দাশ চৌধুরী এসে বললেন, তোমার কাল পরীক্ষা দেয়া হবে না। কলকাতা থেকে কৃষ্ণ সেন এসেছেন। বাড়ি খলিশাকোঠা। কৃষ্ণ সেন কৃষক ফ্রন্টে কাজ করছেন। আমাদের কৃষক ফ্রন্টে কিছু কাজ আছে গৌরনদীর মেদাকূলে। তোমাকে কৃষ্ণ সেনের সঙ্গে মোকূল যেতে হবে।

সুবোধ বালকের মতো ব্যাগে জামা কাপড় গোছালাম। মোমবাতি নেভালাম। ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বুঝলাম এবার বিএসসি পরীক্ষা দেয়া আমার হবে না। তখন জানতাম না, আর এক ঘটনা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

চারদিন পরে বরিশাল ফিরলাম। এসে দেখলাম আমার রুম খোলা। কাপড় জামা বই বিছানা কিছুই নেই। পার্টি অফিসে ছুটলাম। অনিলদা বললেন, তোমার সব কিছু নিয়ে গেছে পিনাকী বোস। তুমি পিনাকীর খুড়তুতো বোনদের গালি দিয়েছিলে। তুমি নাকি বলেছিলে এ বয়সের মেয়েদের ড্যাং ড্যাং করে রাস্তায় বের হওয়া ঠিক নয়। পার্টির কাজ থাকলে তাদের বাড়িতে খবর দেয়া হবে। পিনাকীর কাকীমা একথা শুনে ক্ষেপে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শাসন করতে হলে ঐ ছেলে যেন আমাদের বাড়িতে এসে শাসন করে। রাস্তায় আমাদের মেয়েদের শাসন করা যাবে না। তাই তোমার অনুপস্থিতিতে ওরা তালা খুলে সবকিছু নিয়ে গেছে। ঘটনাটি এমন দাঁড়াবে তা আমি কোনোদিন ভাবিনি। সেকালে রাজনীতির মেয়েদের নিয়ে অনেক কথা হতো। এ ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টির দুর্নাম ছিল সবচেয়ে বেশি। ইতোমধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির অসংখ্য কমরেড নিজেরা নিজেরা বিয়ে করে ফেলেছেন। অনেকে কৌতুক করে কমিউনিস্ট পার্টির অফিসকে প্রজাপতির অফিস বলত। তাই পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়াচ্ছিল ভিন্নতর।

আমাদের দলে অনেক মেয়ে ছিল। আমরা আবার অনুশীলন সমিতির উত্তরাধিকার। অনুশীলন সমিতির অধিকাংশ নেতা অকৃতদার, সংযমী, উদার এবং আদর্শ চরিত্রের অধিকারী। তাই মেয়েদের রাজনীতি নিয়ে আমাদের অফিসেও আলোচনা হতো। একদিন ছাত্র বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিল আমাদের অফিসে এমন ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমাকে। তাই যা ঘটবার তাই ঘটেছে। পিনাকীর বোন শান্তি, তার কাকার মেয়ে সাধনা ও বাসনা প্রায় প্রতিদিন আমাদের অফিসে আসত। আমি তাদের একদিন ধমকে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, কাজ না থাকলে অফিসে না আসতে। যার পরিণতিতে পিনাকীদের বাসায় আমার যেতে হলো। তবে সেখানেও আমার বেশি দিন থাকা হয়নি। তারাও এদেশে থাকেনি। ১৯৪৮ সালের ২৯ মার্চ ওদের আমি পৌঁছে দিয়েছিলাম শিয়ালদহ। শিয়ালদহ স্টেশনে পিনাকীর কাকিমা বলেছিলেন আমি কলকাতায় বাড়ি করব। তোমার জন্য একটি কক্ষ থাকবে সেই বাড়িতে। যদি কোনোদিন ভারতে আস তাহলে আমার খোঁজ কোরো।

তারপর ৪৮ বছর কেটে গেছে। ১৯৭১ সাল থেকে ভারতে যাতায়াত করছি। কোনোদিনই কাকীমাকে খোঁজ করা হয়নি। খোঁজ করিনি সাধনা, বাসনা বা শান্তির। আর এতদিন নিশ্চিয়ই কাকিমা বেঁচে নেই। আর সবচেয়ে মর্মান্তিক হচ্ছে বেঁচে নেই আরএসপির এককালের একনিষ্ঠ কর্মী পিনাকী বোস। গৌরনদী থানার চাঁদসী বোস বাড়ির ছেলে পিনাকী বোস। আত্মীয় স্বজন সব চলে গেলেও পিনাকী বোস পাকিস্তান ছাড়েনি। তাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে ‘৭১ সালে। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী পিনাকী বোসকে খুন করেছে। আমার কাকীমার কাছে যাবার যোগাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেছে। শুধু পিনাকী বোসের কাকীমা-বরিশালের চাঁদসীর সতীশ বোসের স্ত্রী নন, এমন অনেক মা-বোনের কথা আজ মনে পড়ে। ১৯৪৭ সালের জুন মাস। রাজনীতির কারণে গিয়েছিলাম বানারীপাড়া, স্বরূপকাঠি, কামারখালী, জলাবাড়ি ও সমুদয়কাঠি। স্বরূপকাঠিতে খালের পাড়ে এক ক্লাবঘরে সভা করছিলাম। সভায় বাদল দত্ত নামে একটি ছেলে এল। স্কুলের ছাত্র। বলল, মা আপনাকে ডেকেছে। আমি বললাম, তোমার মা। তিনি আমাকে দেখলেন কী করে? বাদল বলল, আপনি যখন খালপাড় দিয়ে আসছিলেন মা আপনাকে দেখেছেন।

সভা শেষে বাদলদের বাড়ি গেলাম। বাদলের মা বললেন, তুমি বসো। তুমি দুপুরে এখানে খাবে, ঘুমাবে। বিকালে তোমাকে নৌকা করে দেব। তুমি যেখানে খুশি যাবে। আমি বললাম, আমি খেয়ে এসেছি। বাদলের মা হেসে ফেললেন। বললেন, তুমি লক্ষ করনি যে যাবার সময় তোমাকে আমি দেখেছি। বুঝেছিলাম তুমি কিছুই খাওনি ভোর থেকে। আমার রান্না হয়ে গেছে। তুমি খেয়ে যাবে।

বাদলের মা’র কথা অসত্য ছিল না। আগের দিন বরিশাল থেকে বানারীপাড়ায় পৌঁছেছিলাম। থাকার জায়গা ছিল না। উঠেছিলাম নরত্তোমপুরের রামকৃষ্ণ মিশনে। মিশনে বড় বড় পাথরের বাটি, জল, নিরামিশ আর বড় বড় লাল চালের ভাত। রাতে তেমন খাওয়া হয়নি। ভোরে সেখানে খাবার প্রত্যাশাও ছিল না। ভোরে রওনা হয়ে এসেছি স্বরূপকাঠি।

সেকালে ভাটা ও জোয়ারের উপর নির্ভর করে নৌকা চলাচল করত। বানারীপাড়া থেকে ভাটিতে স্বরূপকাঠি জলবাড়ি, কাউখালী হয়ে পিরোজপুর যাওয়া যেত। জোয়ারের সময় আবার ফেরা যেত একই পথে নৌকায়। পয়সা অনেক কম লাগত। সেদিনও সূর্য পশ্চিমে হেলে যেতে থাকলে বাদলের বাড়ি স্বরূপকাঠি থেকে হুলারহাট যাবার নৌকায় উঠেছিলাম। নেমেছিলাম সমুদয়কাঠি। গন্তব্যস্থান উপেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি। উপেন্দ্রনাথ দত্ত পিরোজপুরের হিন্দু স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর ছেলে সরোজ আমাদের সাথে রাজনীতি করত। সে অনেক কাল আগের কথা। অনেক ঘটনার এক ঘটনা। কোনোদিন মনে করিনি বাদল আর বাদলের মা’কে। যিনি বলেছিলেন, তুমি কার ছেলে জানি না। আমার বাড়ি থেকে না খেয়ে যেতে পারবে না। তুমি খেয়ে ঘুমাও। বিকালে আমি নৌকা ঠিক করে দেব।

তবে টেস্ট পরীক্ষা না দিলেও পরীক্ষার জন্য এলাউ হতে আমার তেমন কষ্ট হয়নি। কলেজের অধ্যাপকরা আমাকে বড্ড ভালবাসতেন। বিশেষ করে ভালোবাসতেন পদার্থবিদ্যার শিক্ষক বিমলাপ্রসন্ন রায়। তিনি কলেজের সব কিছু নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। লেখাপড়া থেকে খেলাধুলা সবই তাঁর নেতৃত্বে হতো। শিক্ষক হিসেবে তিনি তেমন নাম করতে পারেননি। কিন্তু নাম করেছিলেন পরোপকারে। বিমলাপ্রসন্ন রায় সব ছাত্রদের বন্ধু।

টেস্ট পরীক্ষার পর কলেজে ঢোকামাত্র তিনি চিৎকার করে উঠলেন। বললেন, কোথায় ছিলে? পরীক্ষা দাওনি কেন? আমি বললাম, আমি এবার পরীক্ষা দেব না। আমার প্রস্তুতি নেই, টাকাও নেই। বিমলা বাবু বললেন, কোনো চিন্তা নেই, সবই হবে। তুমি টেস্টে অ্যালাউ হবে। তোমার টাকাও জোগাড় করা হবে। তিনি আমাকে সঙ্গে করে অধ্যক্ষ সুরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের কাছে নিয়ে গেলেন। আমি পরীক্ষায় অ্যালাউ হলাম। আমার ৫ মাসের মাইনে মাফ করা হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক অবস্থায় পরীক্ষা দিতে পারলাম না।

১৯৪৮ সালের ২৮ আগস্ট আমার বিএসসি পরীক্ষা শুরু। গ্রেফতার হয়ে গেলাম ২০ আগস্ট। অদ্ভুত এক স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলো। কোথায় মানুষ উল্লাস করবে, উৎসব করবে! সেই উৎসব এল খণ্ডিত রূপে। পাকিস্তানে হিন্দু, শিখ সম্প্রদায় এবং ভারতে মুসলমানরা ভয়ে ভয়ে থাকল। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ ব্যতীত কংগ্রেসসহ সকল রাজনৈতিক দলের মনে হলো কখন জেলে যেতে হবে। বিশেষ করে শঙ্কিত হলো কমিউনিস্ট পার্টি ও আরএসপি। এরা মার্কসবাদে বিশ্বাস করে। এরা সমাজতন্ত্রী। নাস্তিক। পাকিস্তান ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র। পাকিস্তানে কোরান-সুন্নার অনুসরণে সংবিধান হবে। এ রাষ্ট্রে এই বামপন্থীদের স্থান কোথায়!

বিশেষ করে ভয় দেখা দিল আরএসপি’র। কমিউনিস্ট পার্টি ভারত বিভাগ সমর্থন করেছে। কমিউনিস্ট পার্টির জ্যোতি বসু ও রতন লাল ব্রাহ্মণ, রূপনারায়ণ রায় আইনসভায় বাংলা ভাগের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। দেশ বিভাগের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু আরএসপি আন্দোলন করেছে সার্বভৌম বাংলার জন্য।

এছাড়া বরিশালে আছে আর এক বিপদ। বরিশালের মুসলিম লীগে নাজিমুদ্দিন গ্রুপের মুসলিম ছাত্রলীগের প্রভাব বেশি। তাদের সাথে এক হয়ে আরএসপি’র ছাত্র কংগ্রেস গান্ধী নিহত হবার পর বরিশালে মিছিল ও আন্দোলন করেছে। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে নাজিমুদ্দিন গ্রুপ মুসলিম ছাত্রলীগের সাথে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে হরতাল করেছে। ক্ষমতাসীন মহলে এ নিয়ে উমা আছে। আছে উদ্বেগ। ইতোমধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছে কলকাতায়। সাবেক সম্পাদক পিসি যোশীকে সরে যেতে হয়েছে। সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন বিটি রনদিতে। কমিউনিস্ট পার্টি জঙ্গি লাইন নিয়েছে। ঘোষণা করেছে, ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হায়, লাখ ইনসান ভুখা হ্যায়’। সুতরাং এবার আন্দোলন।

কংগ্রেসের পর কমিউনিস্ট পার্টিও আন্দোলনে নেমেছে। দেয়ালে পোস্টার পড়েছে। গ্রেফতার হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা। তাদের ওপর চরম নির্যাতন নেমে আসছে। একদিনে বরিশাল সদর রোডে আমাদের পার্টি অফিসের কাছাকাছি গিয়ে শুনলাম, পুলিশ অফিস ঘেরাও করেছে। গ্রেফতার হয়েছে তিনজন কর্মী। পার্টি অফিসে নাকি বোমা পাওয়া গিয়েছে। একেবারে তাজা বোমা।

এ বোমা রেখেছিলেন আমাদের মুসলিম ছাত্রলীগের এক বন্ধু পুলিশের সহযোগিতায়। এখানেও শেষ রক্ষা হলো না। কমিউনিস্ট পার্টি মে দিবস পালনের অনুমতি চাইল। জেলা কর্তৃপক্ষ রাজি হলো না। বলা হলো রাশিয়ার কোনো দিবস পাকিস্তানে পালিত হবে না। অন্ধ কমিউনিস্ট বিদ্বেষ তাদের বিচার-বুদ্ধিকেও লুপ্ত করেছিল।

২১ এপ্রিল ইকবাল দিবস। আমাদের ছাত্র প্রতিষ্ঠান পাকিস্তান ছাত্র এসোসিয়েশন (পিএসএ) ইকবাল দিবস পালনের অনুমতি চেয়েছিল। অনুমতি দেয়া হলো না। উপরন্তু ইকবাল দিবস পালনের পোস্টারটিও বাজেয়াপ্ত করা হলো।

উল্লেখ্য, পাকিস্তান সৃষ্টির পর আমরা ছাত্র কংগ্রেস নামে একটি প্রতিষ্ঠান কাগজে-কলমে বাঁচিয়ে রাখলেও, মূল ছাত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি পাকিস্তান ছাত্র এসোসিয়েশন নামে। আরএসপি এ সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে ময়মনসিংহ শহরে। এ সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক নির্বাচিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মৃণাল দত্ত ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র রুহুল আমিন কায়সার।

১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের শেষে কাকীমাকে দিতে যাই কলকাতায়। টেলিগ্রাম এল তাড়াতাড়ি চলে এসো। মা, ভাইবোন সকলে কলকাতা চলে গেছে। সকলকে বোঝাতে হলো, বিএসসি পাস করেই চলে আসব। বরিশালে ফিরে দেখি সব গোলমাল হয়ে গেছে। বোমার মামলার পর জুন মাসে আমাদের এক পোস্টার নিয়ে মামলা হলো। পোস্টারে লেখা হয়েছিল খাদ্য সমস্যা নিয়ে। আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল–আবারও কি পঞ্চাশ সালের মতো দুর্ভিক্ষ আসছে! এবার গ্রেফতার হয়ে গেলেন দলের নেতা অনিল দাশ চৌধুরী, মোজাম্মেল হক, আব্দুল খালেক খান ও ছাত্রনেতা নারায়ণ দাশ শর্মা। নারায়ণ আমার সাথে বিএসসি পরীক্ষার্থী।

রাজনীতিকদের কাছে বরিশাল তখন এক বিপন্ন শহর। হাঁটতে গেলে লোক পিছু লাগে। উকিল-মোক্তার মামলা নিতে চায় না। কারো কাছে গেলে ভয় পায়। আমাদের পক্ষে দেন দরবার করার লোকও বিরল। হিন্দুদের মনে আশঙ্কা। জড়িয়ে পড়ে বিপদ ডেকে আনব নাকি।

আমার একমাত্র কাজ আইবি অফিসে যাওয়া। থানায় যাওয়া। আদালতে জামিনের জন্য চেষ্টা করা। আমার সুবিধে হচ্ছে দেশভাগের আগে আমার কাকা বরিশাল সদর থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার ছিলেন। আমি সকলের চেনা।

কিন্তু তদ্বিরে তেমন কাজ হলো না। বোমা মামলায় জামিন পাওয়া গেলো। পোস্টারের মামলায় জামিন মিলল না। ইতোমধ্যে এগিয়ে এসেছে নারায়ণের পরীক্ষা। পরীক্ষার আগে তার জামিন প্রয়োজন। ২৮ আগস্ট আমারও পরীক্ষা। নারায়ণ জামিনে মুক্তি পেল ১৮ আগস্ট। আমাকে গ্রেফতার করা হলো ২০ আগস্ট। মনে হলো এবার পরীক্ষা আর দেয়া হবে না। গ্রেফতার হয়ে বরিশালে রাজনীতির এক পর্ব শেষ হলো।

তবে পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছিলেন জেল কর্তৃপক্ষ। বরিশাল জেলখানা থেকে জনাদশেক পুলিশ আমার হাতে হাতকড়া দিয়ে মিছিল করে হেঁটে যেত বিএম কলেজে। রাস্তায় লোকের ভিড় হতো। পরীক্ষার হলে যেতাম। পড়ার বই ছিল না। তবুও পরীক্ষার নাম করে হলে যেতাম। বন্ধুদের চিঠি লিখতাম। দলের খবর আদান-প্রদান করতাম। দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমার প্রিয় শিক্ষকেরা দেখতেন। সকলেই বিষণ্ণ। কারণ কারো কিছু করার নেই বা ছিল না। এমনি করে পরীক্ষার ভান করতে করতে জেলে ফিরে দেখি নারায়ণ আবার গ্রেফতার হয়ে এসেছে। কারণ তার লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বিজ্ঞানের ছাত্র। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা বাকি। তাই তাকে আর বাইরে রাখা ঠিক নয়। আমরা বাইরে থাকলে পাকিস্তান কি টিকবে!

এবার দুজনেই প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা দেবার জন্য কলেজে গেলাম। আজ দীর্ঘদিন পরে সেকালের শিক্ষক আর ল্যাবরেটরির পিওনদের জন্য দুঃখ বেদনায় মন ভারাক্রান্ত হয়। ওরা প্রত্যেকে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষায় আমাকে সাহায্য করেছিল সব দিক থেকে। কেউ জানত না আমি পরীক্ষা দিচ্ছি না। প্রতিদিন ভান করছি পরীক্ষার নামে।

আমি জেলে যাব এ কথা আমি আদৌ ভাবিনি। ভেবেছিলাম সবাই গ্রেফতার হলে আমি বেঁচে যাব। দেশ ভাগের আগে আমার কাকা বরিশালের পুলিশ বিভাগে ছিলেন। পারিবারিক সূত্রে পুলিশ বিভাগের বড় বড় কর্মকর্তাদের সাথে আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তখন আমার একমাত্র কাজ ছিল সকল দলের বন্দিদের জন্য তদবির করা। প্রতিদিন আমাকে থানায় যেতে হতো। আইবি অফিসে যেতে হতো। আদালতে যেতে হতো। তখন আমি বিএম কলেজের বিএসসি শেষ বর্ষের ছাত্র। আমাদের পার্টি অফিস সদর রোডের আর্ট ভিলার দোতলায়। নিচতলায় বাড়ির মালিক অনিল ঘোষ। অনিল দা আমাদের দলের সমর্থক ছিলেন। অনিল দার কাকা প্রবীণ বিপ্লবী দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ। অনিলদার ওখানে বসতাম। এক কাপ চা খেতাম। অনিলদা বলতেন–এবার তুমি চলে যাও। তোমার পাহারাদার এসে গেছে। আমি উঠবার সাথে সাথে ৪ বার আমার পিছু নিত। প্রায় সারা দিন এ চারজনের পাহারায় আমাকে ঘুরতে হতো। মাঝে মাঝে কেমন যেন মনে। হতো। আমি হাফ প্যান্ট ও হাফ শার্ট পরা এক তরুণ। আমার পেছনে চার জন লোক প্রকাশ্য দিবালোকে ঘুরছে। আমাকে পাহারা না দিলে নাকি পাকিস্তান টিকবে না। সেই পাহারা দেবার পালা শেষ হলে ২০ আগস্ট। আমি বিকালে আর্টভিলার কাছে এসে দাঁড়িয়েছি। সাদা পোশাকের দুই ভভদ্রলোক এসে বললেন-আমরা পুলিশের লোক। আপনাকে থানায় ওসি সাহেব ডেকেছেন। আমি বললাম, আমার যাবার সময় নেই। আমার সাথে ছিল আমার বন্ধু নারায়ণ দাশ শর্মা। নারায়ণ জামিনে মুক্তি পেয়েছে ১৮ আগস্ট। নারায়ণ বলল, তুই থানায় গিয়ে দেখে আয় তোকে কেন ডেকেছে। আমি বাসায় যাচ্ছি।

থানায় যাবার সাথে সাথে ওসি সাহেব বললেন, আপনার বাসায় যেতে হবে। আমি বললাম, কেন? আর বাসায় যেতে হলে আমি হেঁটে যেতে পারব না, রিকশায় যেতে হবে। আমার বাসার চারপাশে জল। আমি আর পিনাকী বোস কাকীমার বাসা পাহারা দিতাম। আমাদের এক কাজের মেয়ে ছিল। আর ছিল তার স্বামী। সেদিন পিনাকী বরিশালে ছিল না। কাজের মেয়েটির স্বামীও বাড়ি গিয়েছিল। ইতোমধ্যে কলেরা হয়ে কাজের মেয়েটি মারা গেল। আমি তখন একেবারে একা। কোনোমতে সকালের দিকে ওর সকারের ব্যবস্থা করে বাইরে বেরিয়েছি। এমন সময় পুলিশ এল বাসায়। আমাকে সাথে করে নিয়ে আমার বাসায় পৌঁছাল সন্ধ্যার পর।

এবার শুরু হলো তল্লাশি। আমার বাসায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পত্র-পত্রিকা ছিল। প্রতিটি পত্রিকা পেয়েই পুলিশ চমকে যাচ্ছিল। হঠাৎ এক পুলিশ বলল–একটি রিভলবার পাওয়া গেছে। রিভলবারের কথা শুনে আমিও চমকে উঠলাম। দেখলাম একটি খেলনা রিভলবার। যাদের ফেলে যাওয়া বাড়িতে আমি ছিলাম এ খেলনা রিভলবার তাদের বাচ্চাদের। কিন্তু পুলিশকে কিছু বিশ্বাস করানো যায় না।

তারা বলছিল অনুশীলন সমিতির কথা। বলছিল, আপনার রাজনীতির হাতেখড়ি অনুশীলন সমিতির কাছে। অনুশীলন সমিতির নেতারা এই খেলনা রিভলবার দিয়েই ডাকাতি করত। সুতরাং এই রিভলবার আপনার নামেই থানায় জমা হবে।

থানায় ফিরতে ফিরতে রাত ১০টা হয়ে গেল। ওসি সাহেব খুব ভদ্র ব্যবহার করলেন। কাগজে লিখলেন নির্মল সেনের বাড়ি তল্লাশি করা হয়েছে এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে…। এ কথা লিখতেই আমি বললাম, লিখুন, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বিশেষ ক্ষমতা আইনের সাতের তিন ধারায়। ওসি সাহেব বললেন, না আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৮ ধারায়।

আমি একদম চুপসে গেলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ১৮ ধারার অর্থ হচ্ছে বিনা বিচারে আটক। বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দি রাখা। আমি কোনো আদালতে যেতে পারব না। মামলা করতে পারব না। সরকারের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী যতদিন ইচ্ছে আমাকে জেলে রাখা যাবে। মাত্র ৮ দিন পর আমার বিএসসি পরীক্ষা। ভেবে পাচ্ছিলাম না কী করব।

তবে থানা কর্তৃপক্ষ খুবই ভালো ব্যবহার করেছিলেন আমার সাথে। ওসি সাহেব তাঁর বাসা থেকে বিছানা দিয়েছিলেন। খাবার দিয়েছিলেন। পরের দিন ভোরে এসে বললেন–আপনাকে তাড়াতাড়ি জেলে পাঠাতে হবে। আমি গোয়েন্দা বিভাগের লোকদের ডাকছি। আপনার সাথে ওরা কথা বলতে পারে। ওদের হেফাজতে আপনাকে দেব না, তাহলে ওরা মারপিট করবে। আপনার আগে কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের ওপর বেদম অত্যাচার করা হয়েছে। আমি আপনাকে আগেই জেলে পাঠিয়ে দেব।

ওসি সাহেবের কথামতো গোয়েন্দা বিভাগ থেকে একজন লোক এল। আমার সাথে ঘন্টা দুয়েক কথাবার্তা হলো এবং কথাবার্তার শেষে আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো জেলখানায়। সে হচ্ছে আমার জেলজীবনের শুরু। দু’দিন বাদে গ্রাম থেকে কাকা এলেন আমার সাথে দেখা করতে। তিনি বাড়িতে খবর পেয়েছেন পুলিশের কাছ থেকে। পুলিশের বড় কর্মকর্তারা বাড়িতে চিঠি লিখেছেন, আপনাদের ছেলেকে বরিশাল থেকে নিয়ে যান। নইলে গ্রেফতার হতে পারে যে কোনোদিন। সে চিঠি বাড়ি পৌঁছেছিল আমি গ্রেফতার হয়ে যাবার পর।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে তখন এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ শুধুমাত্র ইসলামের কথা বলে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিলেন। পাকিস্তানের কোনো রূপরেখা তাদের সামনে ছিল না। সমস্যা দেখা দিল পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে। পাকিস্তান সৃষ্টি হলো মুসলমানদের স্বতন্ত্র বাসভূমির দাবিতে। বলা হলো–হিন্দু, মুসলমান দুই জাতি। তাদের সংস্কৃতি এবং কৃষ্টি আলাদা। তাদের একই সাথে বসবাস করা সম্ভব নয়। তাই এই দুই জাতির জন্য দুটি রাষ্ট্রের প্রয়োজন। কিন্তু পাকিস্তান প্রস্তাবে দুই রাষ্ট্রের হিন্দু ও মুসলমান জনগোষ্ঠী বিনিময়ের কোনো প্রস্তাব ছিল না। পাকিস্তান প্রস্তাব মতে, ভারত ভেঙে দুটি রাষ্ট্র হলেও উভয় রাষ্ট্রে হিন্দু এবং মুসলমান উভয় জাতিই থাকবে। লোক বিনিময় হবে না। পাকিস্তান প্রস্তাবের এটাই ছিল সবচেয়ে দুর্বল দিক। মুসলমানদের জন্যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র চাই। মুসলমানদের জন্যে ভারত ভেঙে পাকিস্তান করতে হবে। অথচ খণ্ডিত ভারতবর্ষের ভারত অংশে ৬ কোটি মুসলমানকে হিন্দুদের সাথেই বসবাস করতে হবে। আবার হিন্দুদের সাথে এক সাথে বসবাস করা যাবে না–এই চুক্তিতে মুসলমানদের জন্যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান হলেও পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গে দেড় কোটি হিন্দু থেকে গেল।

দেশ বিভাগের পূর্বে মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র কাছে এ প্রশ্নটি তুলেছিলেন ভারতীয় মুসলমানরা। তারা বলেছিলেন, হিন্দুদের সাথে থাকা যাবে না, এ চুক্তিতে আমরা পাকিস্তান আন্দোলন করেছি। অথচ আমাদের ভারতেই থেকে যেতে হচ্ছে। তাহলে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়? হিন্দুরা আমাদের বিশ্বাস করবে কেন? মুসলিম লীগ সভাপতি জিন্নাহ তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হয়েছেন। এ কথার জবাব তিনি ভারতের মাটিতে দিলেন না। পাকিস্তান পৌঁছে জিন্নাহ বিমানবন্দরে বললেন, রাজনৈতিকভাবে কোনো মুসলমান এখন আর মুসলমান নয়, কোনো হিন্দু আর কোনো হিন্দু নয়, সকলেই পাকিস্তানি। অর্থাৎ ভারতীয় মুসলমানদের ভারতীয় নাগরিক হিসাবেই থাকতে হবে। পাকিস্তান প্রস্তাবকে তিনি জোড়াতালি দিয়ে বাঁচাতে চাইলেন। প্রকৃতপক্ষে এভাবে জোড়াতালি দিয়ে পাকিস্তান প্রস্তাবকে বারবার বাঁচিয়ে ভারতকে ভাগ করা হয়েছিল ১৯৪৭ সালে।

এ প্রশ্ন উঠেছিল ভারত বিভাগ সম্পর্কিত আলোচনায়। আলোচনা হচ্ছিল ভারতের শেষ ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ও মোহাম্মদ আলী জিন্নার মধ্যে। তখন ভারত বিভাগের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠেছে পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাগ নিয়ে। জিন্নাহ প্রথম থেকেই বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের বিরোধিতা করেন।

লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন জিন্নাকে বলেন যে, আপনি নিশ্চয়ই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা চান। সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্যই আপনি পাকিস্তান চেয়েছেন। যে পরিপ্রেক্ষিতে আশা করা যায় যে, আপনি নিশ্চয়ই হিন্দু শিখ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে অসম্মত হবেন না। কংগ্রেস ও শিখ সম্প্রদায় বাংলা ও পাঞ্জাবের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা চেয়েছে। তাদের প্রস্তাব বাংলা ও পাঞ্জাবের ভারত সংলগ্ন সংখ্যালঘু এলাকা ভারতের সাথে যুক্ত থোক অর্থাৎ পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাগ করা হোক।

মি. জিন্নাহ এ প্রস্তাবে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, বাংলার একজন হিন্দু বা মুসলমান প্রথমে বাঙালি, পরে হিন্দু বা মুসলমান। পাঞ্জাবের একজন শিখ, মুসলমান বা হিন্দু প্রথমে পাঞ্জাবি, পরে হিন্দু, মুসলিম বা শিখ। সুতরাং সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে বাংলা বা পাঞ্জাবকে ভাগ করা যায় না। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন বললেন, মি. জিন্নাহ, আপনার কথা মেনে নিতে হলে ভারতও ভাগ করা যায় না। কারণ ভারতের নাগরিকেরা প্রথমে ভারতীয়, পরে হিন্দু, মুসলমান বা শিখ। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের এই কথার পর জিন্নাহ তেমন কোনো জবাব দেননি এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের প্রস্তাব মেনে নিতে হয়।

এছাড়া লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের সাথে আলোচনায় বিভক্ত ভারতের ভারত ও পাকিস্তান অংশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিলেন কংগ্রেস নেতা আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেছিলেন, ভারতবর্ষ হিন্দু ও মুসলমানের ভিত্তিতে ভাগ হচ্ছে। অথচ পাকিস্তানে হিন্দুরা থাকছে, ভারতেও থাকছে মুসলমানেরা। তাদের নিরাপত্তা কী হবে? এ প্রশ্নের একটি অদ্ভুত জবাব দিয়েছিলেন লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন। তিনি বলেছিলেন, এই দুই দেশের সংখ্যালঘু একে অপরের জামানত হিসাবে বসবাস করবে। ভারতবর্ষের মুসলমানদের ওপর অত্যাচার হলে, অত্যাচার হবে পাকিস্তানি হিন্দুদের ওপর। আবার পাকিস্তানি হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হলে, অত্যাচার হবে ভারতীয় মুসলমানদের ওপর। মাওলানা আজাদ এ মন্তব্য শুনে বলেছিলেন–এ উক্তি বর্বরের। বর্বরের এ সিদ্ধান্তের সাথে আমি আদৌ একমত নই। এর পরে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ আর ভারত বিভাগ সংক্রান্ত আলোচনায় যোগ দেননি।

তবে জিন্নাহর জন্যে শুধু সম্প্রদায়গত সমস্যা না, ভিন্ন সমস্যা ছিল পাকিস্তানে। মুসলিম লীগ কংগ্রেসের মতো সংগঠিত ছিল না। মুসলিম লীগের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ঐতিহ্য ছিল না। এছাড়া উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেস ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পূর্বে নির্বাচনের ও সীমান্ত প্রদেশে সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গাফফার খানের নেতৃতে কংগ্রেস জিতেছিল। সিন্ধু এবং পাঞ্জাবেও মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না। সুতরাং পাকিস্তান অর্জনে মুসলিম লীগ নেতৃত্ব দিলেও সমগ্র পাকিস্তানে মুসলিম লীগের নেতৃত্ব ছিল না। মি. জিন্নাহ বুঝেছিলেন, সাম্প্রদায়িক শ্লোগান দিয়ে দেশ শাসন সম্ভব নয়। তাই তিনি লোক দেখানো চাল দিলেন। পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম সভাপতি হলেন তপশীলি সম্প্রদায়ের নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল।

১৯৫০ সালের হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার সময় তিনি ঢাকা থেকে ভারতে পালিয়ে যান। উল্লেখ্য, তফশীল ফেডারেশন ভিআর অম্বেদকর ও যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডলের নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিল।

কিন্তু জিন্নাহ সাহেবের কোনো কৌশলই কাজে এল না। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান হিসেবে শক্তিশালী না হওয়ায় আমলা এবং সামরিক বাহিনী সক্রিয় এবং শক্তিশালী হয়ে উঠল। বিশেষ করে সামরিক বাহিনীতে এবং আমলাদের সঙ্গে পাঞ্জাবিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় পাঞ্জাবিরা পাকিস্তানে শক্তিশালী হয়ে উঠল।

বিরোধ দেখা দিল করাচি নিয়ে। অবিভক্ত ভারতে করাচি ছিল সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী। করাচি পাকিস্তানের রাজধানী হওয়ায় সিন্ধুর রাজধানী স্থানান্তরিত হলো হায়দারাবাদে। সিন্ধু নেতারা এ সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন না। ইতোমধ্যে জিন্নাহ সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁকে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য পাঠান হলো কোয়েটার জিয়ারতে। সিন্ধুর নেতৃবৃন্দ সেখানে জিন্না সাহেবের সাথে দেখা করে বললেন, তারা করাচিতে সিন্ধুর রাজধানী চান। এই প্রতিনিধি দলের সাথে গভর্নর জেনালের জিন্নাহর কথা কাটাকাটি হলো। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠল।

আমি জেলে গিয়েছিলাম ১৯৪৮ সালের ২১ আগস্ট। তখন পূর্ববঙ্গে কোনো সংবাদপত্র ছিল না। কলকাতা থেকে ইত্তেহাদ, স্টেটসম্যান, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, আনন্দবাজার, যুগান্তর আসত। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জেলখানায় হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডর একটি সংখ্যা হাতে এল। সে কাগজে একটি খবরে বলা হয়েছে–পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মরতে বসেছেন বা মারা গেছেন জিয়ারতে। তাঁকে দেখার কেউ নেই। তার চিকিৎসা হচ্ছে না। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর এক সময় দেখলাম জেলখানার ভবনে ওড়ানো পাকিস্তানি জাতীয় পতাকা নামানো হচ্ছে। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করা হয়েছে। জিন্নাহ সাহেব মারা গেছেন। কোথায় মারা গেলেন জিন্নাহ সাহেব–জিয়ারতে? জিয়ারত থেকে বিমানে করাচি পৌঁছাবার সময় বিমানে? না করাচিতে তার বাসভবনে? এ প্রশ্নের জবাব আজো মেলেনি।

বরিশাল জেলে তখন নতুন নতুন বন্দি আসছে। প্রায় প্রতিদিনই নিরাপত্তা আইনে রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ বামপন্থী দলের সদস্য। তবে যারা গ্রেফতার হয়ে আসেন তাঁদের সকলের সাথে আমাদের দেখা হয় না। কারণ অধিকাংশ বন্দিকে তৃতীয় শ্রেণিতে রাখা হয়। রাখা হয় আমাদের চেয়ে দূরে। তাই তাঁদের সাথে দেখা হয় কদাচিৎ।

এর মধ্যে তিনজন বন্দি আমাদের এলাকায় এলেন। এঁরা হচ্ছেন–কমিউনিস্ট পার্টির নেতা নরেন্দ্রনাথ রায়, হিন্দু ছাত্র ফেডারেশনর প্রশান্ত দাশগুপ্ত এবং অন্যতম নেতা অজিত বসু। শুনেছি নরেন বাবু জীবিত নেই। প্রশান্ত দাশগুপ্ত’র সাথে দেখা হয়েছিল ১৯৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত স্টেশনে। তিনি বললেন–অনেক নির্যাতন সহ্য করলেও আপনারা জিতে গেলেন। অজিত বসুর কোনো খোঁজ আজো পাইনি। সেকালের পূর্ববাংলার জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে তাঁরা সকলেই দেশান্তরী হয়েছিলেন।

এই তিনজনের সাথে একই স্টিমারে বরিশাল থেকে ঢাকা এসেছিলাম ১৯৪৮ সালের অক্টোবরে। তখন স্টিমার ঘাট বাদামতলীতেই ছিল। ঢাকায় এমন ভিড় ছিল না। পুলিশ প্রহরায় ঢাকা জেলে এলাম ঘোড়ার গাড়িতে। এই ঘোড়ার গাড়ি ও বুড়িগঙ্গা নদীর এক দীর্ঘ স্মৃতি আছে আমার শৈশব জীবনের। বাবা তখন বই লিখতেন ঢাকায়। বিভিন্ন প্রকাশের সাথে চুক্তিতে বই লেখা। মূল লেখক বাবা হলেও বাজারে সেই বই বিক্রি হতো ভিন্ন নামে। আমরা তখন থাকতাম নারিন্দার ১৩ নম্বর দয়াগঞ্জ রোডে। সে সড়কের নতুন নাম শরৎগুপ্ত রোড। ঐ সড়ক থেকে স্বামীবাগের দিকে গেলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কের রেল লাইন। ঐ রেল লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখনো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেতাম। আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, এককালে রমনা কালীবাড়ি এলাকা অর্থাৎ রেসকোর্স ময়দানে এসে ঘোড়ার দৌড় দেখতাম। ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশন থেকে ৮ পয়সা অর্থাৎ দু’আনা ঘোড়ার গাড়িতে নারিন্দা যেতাম। বিকালে যেতাম বাবার বই’র এলাকা বাংলাবাজারে। সেখান থেকে বুড়িগঙ্গার তীরে করোনেশন পার্ক। করোনেশন পার্কে রাত ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বসে থাকতাম। সন্ধ্যার পরে বরিশাল থেকে স্টিমার আসত। আলোতে চিকচিক করতো বুড়িগঙ্গার জল। তবে বুড়িগঙ্গা বরাবরই বড় নিস্তরঙ্গ। বরিশালের স্টিমার বাদামতলীর ঘাটে ভিড়লে বাসায় ফিরতাম। সে ১৯৩৯ সালের কথা।

১৯৪৮ সালের অক্টোবরে বরিশালের স্টিমারে বাদামতলীর ঘাটে এলাম। আবার ঘোড়ার গাড়িতে উঠলাম। এবার নারিন্দার বাসা নয়, একেবারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো পুরনো হাজতে। ঐ এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়া মুশকিল। আন্দামান থেকে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের ফিরিয়ে এনে পুরনো জেলে রাখা হয়েছিল। সে পুরনো জেল এখন সংস্কার করা হয়েছে।

১৯৪৮ সালের অক্টোবরে ঢাকা জেলে ঢুকে অবাক হলাম। বুঝতে শুরু করলাম পাকিস্তান কাকে বলে এবং কী প্রকার। উত্তরাধিকার সূত্রে পাকিস্তান সরকার অনেক কালাকানুন পেয়েছিল ব্রিটিশের কাছ থেকে। ঐ আইনে কোনো কারণ না দেখিয়ে যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা যায়। আটক রাখা যায় অনির্দিষ্টকালের জন্যে। দেখলাম পাকিস্তান সরকার জন্মলগ্ন থেকেই এ আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু করেছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নয়, ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পাকিস্তান সরকার যাকে খুশি গ্রেফতার করছে এবং আটক রাখছে। এর কোনো বাছ-বিছার নেই।

এই আইনে গ্রেফতার করে আটক রাখা হয়েছে নোয়াখালীর রামগঞ্জ থানার খিলপাড়া গ্রামের আবুল কাসেম চৌধুরীকে। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় অনেক খুনের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। সরকারি ভাষ্য হচ্ছে–ঐ আইনে আটক করা না হলে কাসেম চৌধুরীকে খুনের আসামী হতে হয়। তাকে বাঁচাবার জন্যে সরকার তাকে নিরাপত্তাবন্দি করেছিল। অথচ কাসেম চৌধুরীর বক্তব্য ভিন্নরূপ।

ঐ কালো আইনে আটক রাখা হয়েছে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী ও তোফাজ্জল হোসেন পাটোয়ারীকে। একেবারেই তুচ্ছ ঘটনার জন্যেই তাদের আটক করা হয়েছে। পাড়া প্রতিবেশীর বিবাদ এবং থানার সাথে ঝগড়াই এই আটকের কারণ। ছোট ভাই তোফাজ্জল তখন ছাত্র। তাকে দেখতাম মুক্তির জন্যে প্রতিদিন সরকারের কাছে চিঠি লিখত। সে দরখাস্তে লেখা হতো পাকিস্তান আন্দোলনে তাদের ভূমিকার কথা। আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে সিলেটের গণভোটে অংশগ্রহণ। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় সিলেট ভারত না পাকিস্তানের অংশ হবে, এ প্রশ্নে গণভোট হয়। গণভোটে সিদ্ধান্ত হয় সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে।

অদ্ভুত বিশেষ ক্ষমতা আইনে তিনজন ব্যক্তিকে আটক করে আনা হয়েছিল কুমিল্লা থেকে। এদের নাম ফজর আলী, অম্বর আলী ও সেকেন্দার আলী। তখন কুমিল্লা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন আইএ খান। ভারতের প্রথম পাকিস্তান হাইকমিশনার ইসমাইল খানের ছেলে। অপর এক বিখ্যাত আমলা মাদানীর ভাই। ঐ তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা আইএ খানের আর্দালিকে প্রহার করেছিল। এ অভিযোগে তিন ব্যক্তিকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার করা হলো। কুমিল্লার পুলিশ লিখে পাঠান, এই তিন ব্যক্তি জেলের বাইরে থাকলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। সুতরাং তকালীন স্বরাষ্ট্র দফতর সবকিছু অনুধাবন করে নির্দেশ দিলেন, এদের অনির্দিষ্টকালের জন্যে কারাগারে আটক রাখা হোক। এ হচ্ছে সেকালের পাকিস্তান ও পাকিস্তানের শাসকদের চিত্র।

সেকালের কথা মনে হলে আমার কুমিল্লার সেই সেকেন্দার আলীর কথা মনে পড়ে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আর্দালিকে প্রহারের দায়ে অভিযুক্ত সেকেন্দার আলী। ফজর আলীর নেতৃত্বে কাজ করে। দিন আনে দিন খায়। ৬ মাস হয়ে গেছে জেলখানায় এসেছে। প্রতিরাতে চোখের জল ফেলে স্ত্রী-পুত্রের জন্য। স্ত্রীর নাম ছমিরন বিবি। সপ্তাহে সপ্তাহে স্ত্রীকে চিঠি লিখত সেকেন্দার আলী। চিঠির লেখক আমি। সেকেন্দার আলীর বড় ভয়– দীর্ঘদিন অনুপস্থিতির ফলে স্ত্রী যদি ভিন্ন ঘরে চলে যায়! কী হবে তার উপায়? জেলখানায় সেকেন্দার আলীর সাথে তারপর বেশিদিন দেখা হয়নি। আমরা অনশন করার ফলে আমাদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। শুনেছি মাস ছয়েক পর সেকেন্দার আলীকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। আমার মুক্তি পেতে পেতে বছর পাঁচেক। তারপর অনেকবার জেলে যাওয়া-আসা করেছি। কুমিল্লা গিয়েছি অসংখ্যবার। ফজর আলী, সেকেন্দার আলী ও অম্বর আলীর খোঁজ করা হয়নি।

ঢাকা জেলে প্রথম রাতে ঘুম ভাঙল এক বন্দির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নায়। উজ্জ্বল এক তরুণ ভারতীয় বিমানবাহিনীর পাইলট। বাড়ি মানিকগঞ্জের জামিয়তা। ঢাকায় আসা-যাওয়া ছিল দীর্ঘদিন ধরে। প্রেমে পড়েছিলেন এক গায়িকার। গায়িকার দু’বোন তখন নজরুল সঙ্গীত গাইতেন ঢাকা বেতারে। এই প্রেমের উপাখ্যান শুরু ভারত বিভাগের পূর্বে।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হলো। গায়িকা দুই বোন ঢাকায় ওয়ারীতে থেকে গেলেন। বিমানবাহিনী পাইলট জামিয়তার শচীন রায় অপসন দিয়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীতে যোগ দিলেন। ভারত ভাগের পরেও শচীন রায় দু’একবার ঢাকায় এসেছেন। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ শুরু হওয়ায়। শচীন রায়ের কাছে শুনেছি সে নাকি ভারতীয় বিমান নিয়ে কাশ্মীর ফ্রন্টে এক দফা যুদ্ধ করেছে। তারপর এসেছিল ঢাকায় বেড়াতে। পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেফতার করেছে। কোনো মামলা দেয়নি। আটক রেখেছে অনির্দিষ্টকালের জন্যে।

শচীন রায় জানে না সে কবে মুক্তি পাবে। কোথায় যাবে? কিভাবে যাবে? যাদের জন্যে ঢাকা এসেছিল তারাও দূরে সরে গেছে। কারণ তখন পাকিস্তানে চলছে ভয়াবহ এক ভয়ের রাজত্ব। কবে কিভাবে শচীন রায় জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়েছে তা জানি না। শুনেছি সে দেশ ছাড়েনি। জামিয়তা ঘর বেঁধেছে। তবে সে খবরও দীর্ঘদিন পূর্বের।

ঢাকা জেলে ঘুম ভাঙার সাথে সাথে ধরণী বাবুর কণ্ঠ শোনা গেল। ঢাকা জেলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ধরণী রায় রেল শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে প্রথম থেকে ছিলেন। গেফতার হয়ে এসেছিলেন অনেকের সাথে। প্রথমবার মুক্তি পেলেও দ্বিতীয়বার তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়নি। দেখা হয় রণেশ দাশগুপ্তের সাথে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভভদ্রলোক রণেশ দাশগুপ্ত। উচ্চকণ্ঠে কথা বলেন না। নিজের মত কখনও অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চান না। সকলেই তাঁর বন্ধু। কারণ শত্রু হবার উপায় নেই। দেখা হলো বরিশালের জ্যোতি ব্যানার্জির সাথে। ডাক নাম নুটু ব্যানার্জি। বরিশালের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। লেখাপড়া করেন। দীর্ঘকাল পাকিস্তানের জেলে ছিলেন। মুক্তি পেয়ে দেশান্তরী হলেন। পরবর্তীকালে শিক্ষকতা করতেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ঢাকা জেলে দেখা হলো হরিগঙ্গা বসাকের সাথে। আদি বাড়ি ঢাকার বনগ্রাম লেনে। রাজনীতি করতেন আগরতলায়। আগতলায় ত্রিপুরা কংগ্রেসের নেতা ছিলেন। তার গ্রেফতার এবং বন্দি জীবন এক আশ্চর্য ঘটনা।

ভারত বিভাগের সময় একটি কাউন্সিল করা হয়েছিল। কাউন্সিলের নাম ডিভিশনাল কাউন্সিল। এই কাউন্সিলে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি থাকত। ত্রিপুরা তখন দেশীয় রাজ্য। ত্রিপুরা কংগ্রেসের নেতা হিসাবে হরিগঙ্গা বসাক এ ডিভিশন কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে রাগ ছিল পাকিস্তান সরকারের। ১৯৪৮ সালে অসুস্থ মাকে দেখার জন্য হরিগঙ্গা বসাক আগরতলা থেকে ঢাকা এসেছিলেন। তখন তাকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর গ্রেফতারের নির্দেশ তারিখ ছিল ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের। অথচ তিনি ঢাকা এসেছিলেন ২৯ জুলাই। এ নিয়ে হরিগঙ্গা বাবু অনেক লেখালেখি করেছিলেন। কিন্তু কোনো কাজে আসেনি। ১৯৫০ সালে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন হরিগঙ্গা বসাক ঢাকা জেলে। যারা আগরতলা গেছেন তারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন সেই শহরের একটি সড়কের নাম হরিগঙ্গা বসাক সড়ক। তখন জেলখানার রাজনীতির একটি বিশেষ দিক ছিল। ব্রিটিশ আমলে যাঁরা জেলে ছিলেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন কংগ্রেসের নেতা ও কর্মী। কংগ্রেস, আরএসপি, ফরোয়ার্ড ব্লক, কমিউনিস্ট পার্টি ও কংগ্রেস সমাজতান্ত্রিক দল সিএসপির সদস্য থাকলেও সকলেই আবার কংগ্রেসের সদস্য ছিল। জেলখানায় তারা কংগ্রেসি বলে পরিচিত ছিল। অধিকাংশ কংগ্রেস নেতা ও কর্মী ছিলেন হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আসা। ব্রিটিশ সরকার এই সকল রাজবন্দিদেরই ভারত স্বাধীন হবার আগে মুক্তি দিয়েছিল।

কিন্তু পাকিস্তানে সেই মুক্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই আবার রাজনৈতিক ধরপাকড় শুরু হয়। যারা গ্রেফতার হলেন তাদের অধিকাংশই এককালের কংগ্রেস কর্মী ও নেতা হলেও তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ ছিলেন বামদলের নেতা ও কর্মী। অধিকাংশই হিন্দু মধ্যবিত্ত ঘর থেকে আসা। তাই জেলখানার কর্মচারী ও কয়েদিদের কাছে নতুন রাজবন্দিদের নতুন কোনো পরিচয় হলো না। তাদের কাছে এরা কংগ্রেসি। এরা হিন্দু এবং এককালের পাকিস্তান-বিরোধী। তাদের ধারণা হলো পাকিস্তান-বিরোধী বলেই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এ জন্যে পাকিস্তান সরকারকে তেমন দোষ দেয়া যায় না।

এই ঐতিহ্য ধরে ঢাকা জেলের কর্মকর্তারা আমাদের সাথে তেমন আচরণ করতেন। ইতোমধ্যে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার হয়ে এলেন কমিউনিস্ট পার্টির ফরিদ খান। জেল কর্তৃপক্ষ কিছুতেই তাঁকে আমাদের ওয়ার্ডে দিলেন না। একদিন তাকে ভিন্ন সেলে রাখা হলো। বলা হলো–আপনি মুসলমান, আপনি হিন্দু বন্দিদের সাথে কেন থাকবেন? আপনার জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা করা হবে। জবাবে ফরিদ খান বললেন, আমি মুসলমান বা হিন্দু নই। আমি কমিউনিস্ট। আমাকে অন্যান্য রাজবন্দিদের সাথেই থাকতে দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত ফরিদ খানকে আমাদের ওয়ার্ডেই পাঠিয়ে দেয়া হয়।

ঢাকা জেলে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে দীর্ঘ সময় লাগে। পরবর্তীকালে অসংখ্য মুসলমান কমরেড জেলে আসতে থাকায় এক সময় পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করে ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর।

তবে জেলের সমস্যা আদৌ সাম্প্রদায়িক সমস্যা ছিল না। মুখ্য ছিল রাজনৈতিক সমস্যা। সেকালে রাজবন্দি হিসাবে যারা ছিল তাদের মধ্যে শতকরা ৯০ জনই কমিউনিস্ট পার্টির। এছাড়াও ছিল কংগ্রেস, আরএসপি, ফরোয়ার্ড ব্লক, হিন্দু মহাসভার সদস্য। আমরা সকলেই রাজনীতি করি বলে এই রাজনীতির ছাপ পড়েছিল জেলখানায়। সে রাজনীতির উদ্যোক্তা ছিল মুখ্যত কমিউনিস্ট পার্টি। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আন্দোলনের নতুন কৌশল নিয়েছে। ভারত বিভক্ত হলেও কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়নি। তাই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কৌশল প্রয়োগ ছিল পাকিস্তানের জন্যে।

ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য হচ্ছে ব্রিটিশ চলে গেলেও ভারত বা পাকিস্তান প্রকৃতার্থে স্বাধীন হয়নি। তাই ক্ষমতাসীন সরকারকে আঘাতের পর আঘাত করে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে। জেলখানায় কৌশল হবে জেলখানার যে কোনো ছুতায় সঙ্কট সৃষ্টি করতে হবে। জেলখানার সঙ্কটে অঘটন ঘটলে বাইরে তার প্রতিক্রিয়া হবে। মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করবে। সরকারকে আঘাত করবে। সরকারের পতন ঘটবে।

কিন্তু জেলখানায় এ কাজটি কী করে করা যাবে? বলা হলো–জেল কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি দাওয়া পেশ করো। দাবি মানা না হলে অনশন ধর্মঘট করো। আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে অনশনকে ভিত্তি করে।

আমাদের দল বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল আরএসপি। আমাদের দলের মূল্যায়ন হলো, কমিউনিস্ট পার্টির এ সিদ্ধান্ত ভুল। হঠকারী কৌশল। দেশ স্বাধীন হলেও সমাজ পরিবর্তন করা না গেলে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না–এ বক্তব্য সঠিক। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হবার পরপরই এ তত্ত্ব গ্রহণ করার মতো মানসিক প্রস্তুতি হয়নি। এ ছাড়া এ আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবার মতো শক্তিশালী শ্রেণি সংগঠনের অভাব আছে। আর সমগ্র উপমহাদেশে তখন সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ভয়াবহ। সুতরাং কমিউনিস্ট পার্টির এ তত্ত্ব আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। জেলখানার কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার সদস্যদের এ আন্দোলনে যাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু জেলখানায় রাজবন্দিদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর সর্বকনিষ্ঠ রাজবন্দি হিসেবে জেলে এসেছিল প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা অনিল মুখার্জির ভাইয়ের ছেলে অতীশ মুখার্জি। আমি ঢাকা জেলে আসার পূর্বে সে মুক্তি পায়। আমার সাথে পরবর্তীকালে আরো দু’জন বয়সে কম রাজবন্দি ছিল। এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন মুন্সীগঞ্জের শফিউদ্দীন আহমদ যিনি সাংবাদিক হিসাবে পরিচিত। আর একজন খুলনার আনোয়ার হোসেন। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজবন্দি অবস্থায় জেল পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। আমার সিদ্ধান্ত হলো অন্য সবাই অনশন করলে আমার পক্ষে ভাত খাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং আমিও অনশনের সিদ্ধান্ত নিলাম।

আমাদের অনশনের পূর্বে কয়েকটি ঘটনা ঘটল। আমাদের প্রতিনিধি কমরেড জ্যোতি ব্যানার্জিকে ঢাকা জেল থেকে অন্য জেলে পাঠানো হলো। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর সাথে আমার দেখা হয়নি। আমাদের নতুন প্রতিনিধি হলেন রণেশ দাশগুপ্ত। আমাদের পক্ষ হয়ে তিনি জেল কর্তৃপক্ষের সাথে দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা করতেন।

এর মধ্যে একদিন জেলখানার সবচেয়ে বড় কর্মকর্তা সার্জন জেনারেল কর্নেল টিডি আহমেদ জেলখানায় এলেন। তিনি নাকি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজনস (আইজি) অর্থাৎ কারাগারসমূহের মহাপরিদর্শক। কর্নেল টিডি আহমদ আমাদের ওয়ার্ডে এসে আমার দিকে এগিয়ে এলেন, বললেন–এই বাচ্চা, তুমি এখানে কেন? সুপারিন্টেডেন্টকে বললেন, রেকর্ড নিয়ে এসো। একে রিলিজ করে দাও। একজন ডেপুটি জেলার এগিয়ে এসে বললেন, স্যার উনি রাজবন্দি। এদের বিচার নেই। জামিন নেই। তাই মুক্তি দেয়া যাবে না। কর্নেল টিডি আহমদ বললেন, ইজ ইট পাকিস্তান?

আমাদের অনশনের দিন নির্ধারিত হলো। ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ। ঐ দিন পশ্চিমবাংলা ও পূর্ববাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির রোড ইউনিয়নের ডাকে রেল ধর্মঘট। আমার কাছে এ সিদ্ধান্ত সঠিক মনে হলো না। এমনিতে আমাদের ভারতের দালাল বলা হয়, তারপরে একই দিনে দু’দেশে হরতাল ডাকা আদৌ সঠিক কি!

কমিউনিস্ট পার্টির এক বন্ধুর সাথে আলোচনা করলাম। নাম নরেশ চক্রবর্তী। বাড়ি কুমিল্লা। এক সময় আরএসপি করতেন। পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টিতে গিয়েছেন। তিনি আমার কথা শুনে হেসে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ শ্লোগান দিই। আমাদের এত ভয় কেন? আমি শুধু বুঝতে পারলাম না–ঢাকা জেলের অনশনের সাথে কলকাতার রেল শ্রমিকদের আন্দোলনের সম্পর্ক কী। জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে নরেশ বাবু কলকাতায় যান। ১৯৭১ সালে শুনেছি নাকতলায় আছেন। সিপিআই(এম) এর সদস্য।

১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ ঢাকা জেলে অনশন শুরু হলো। অনশন টিকল না। পূর্ববাংলা সরকারের মৌখিক বিশ্বাসে ১৫ মার্চ অনশন প্রত্যাহার করা হলো। পূর্ব বাংলার রাজবন্দিদের জীবনে এক ভয়াবহ নতুন নির্যাতন নেমে এল।

ব্রিটিশ আমলে জেলখানায় রাজবন্দিদের বছরের পর বছর সংগ্রাম করতে হয়েছিল নিজেদের সম্মান ও মর্যাদার জন্য। শেষ দিকে ব্রিটিশ সরকার তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলে। ১৯৪০ সালে প্রণীত হয়েছিল সিকিউরিটি প্রিজনার্স রুল ১৯৪০। এই বিধান বলেই জেলখানায় বিশেষ সুবিধা দেয়া হতো রাজবন্দিদের।

১৯৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের সাথে সাথে পাকিস্তান সরকার বিনা কারণে ধরপাকড় এবং বিনা বিচারে আটক রাখার আইন উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল ব্রিটিশের কাছ থেকে। তেমনি ১৯৪০ সালের রাজবন্দিদের জন্য প্রণীত রুলসও পেয়েছিল। ১৯৪৯ সালের মার্চের অনশন ধর্মঘটের পর পূর্ববঙ্গ সরকার রাজবন্দিদের ঐ আইন বাতিল করলেন। মৌখিক আশ্বাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাজবন্দিদের সুবিধাগুলো কেড়ে নিলেন।

এবার রাজবন্দিরা পরিণত হলো সাধারণ কয়েদীতে। কোনো মর্যাদা নয়। তাদের সাথে আচরণ শুরু হলো চোর-ডাকাতের মতো। এ সকল অপরাধে যারা গ্রেফতার হয় বা যাদের সাজা হয় তাদের তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে জেলে রাখা হয়। এই শ্রেণির প্রাপ্তি নির্ভর করত সামাজিক-পারিবারিক অবস্থান, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং পেশার ওপর। বিনা বিচারে আটক রাজনীতিকদের প্রশ্নে এ ধরনের কোনো শ্রেণি বিভাগ ছিল না ব্রিটিশ আমলে। এ কাজটি করলেন পাকিস্তান সরকার ১৯৪৯ সালে।

আমাদের হাতে গোনা কয়েকজনকে দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেয়া হলো। বাকি সবাইকে পরিণত করা হলো তৃতীয় শ্রেণির কয়েদীতে। অর্থাৎ থালা-বাটি কম্বল জেলখানার সম্বলের অধিকারী বানানো হলো তাদের। অথচ এই অনশনের আগে তাদের সকল সুযোগ-সুবিধা ছিল। খাট, লেপ, তোষক, মশারি, জুতো, জামা, স্যুট, ব্রাশ, সাবান, পেস্ট, কোট, উন্নতমানের খাবার ব্রিটিশ প্রণীত বিধি অনুযায়ী সব কিছুই ছিল। ১৯৪৯ সালের মার্চের প্রথম অনশন ধর্মঘটের পর এদের সামনে এদের খাট-তোষক, লেপ নিয়ে যাওয়া হলো। পাঠানো হলো থালা বাটি কম্বল। আমাদের অন্য ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা পৃথক হলাম। সেই পৃথক হবার পরে অনেকের সাথেই আর আমার আজো দেখা হয়নি। এদের মধ্যে অধিকাংশই পরবর্তীকালে দেশান্তরী। আর এদেশে যারা ছিল তারা লোকান্তরিত বা রাজনীতিতে আদৌ নেই।

সুতরাং শুধুমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির তত্ত্ব বা কৌশল নয়। রাজবন্দিদের হৃত অধিকার ফিরিয়ে আনার দাবিতেই আবার আন্দোলনে যেতে হলো। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দ্বিতীয় অনশন শুরু হলো মে মাসে। সে মাসে অনশন ধর্মঘট শুরু হবার পূর্বে ঢাকায় আন্দোলন হচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম বেতনভুক্ত কর্মচারীদের নিয়ে। এপ্রিল মাসে এ আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। এই আন্দোলনে শরিক হবার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ৬ জনকে ৪ বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার, ১৫ জনকে হল থেকে বহিষ্কার। ৫ জনের ১৫ টাকা ও ১ জনের ১০ টাকা জরিমানা করা হয়।

১৫ টাকা যাঁদের জরিমানা হয় তাদের তালিকায় ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ আন্দোলনের সময় গ্রেফতার হন আব্দুল মতিন, এনায়েত করিম, খালেক নওয়াজ, আজিজুর রহমান, বাহাউদ্দিন চৌধুরী ও নিতাই গাঙ্গুলী। পরবর্তীকালে নিতাই গাঙ্গুলী ব্যতীত সকলকেই মুক্তি দেয়া হয়। ঢাকা জেলা বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল আরএসপি’র সম্পাদক নিতাই গাঙ্গুলী আমাদের সাথেই থেকে গেলেন। তিনি আমাদের সাথে দ্বিতীয় অনশনে অংশ নিলেন।

দ্বিতীয় অনশনের সময় নগ্নরূপ প্রকাশিত হলো মুসলিম লীগ সরকারের। পূর্ববাংলা সরকার একটি প্রেসনোট দিল জেলখানায় অনশন সম্পর্কে। প্রেসনোটের মর্মার্থ হলো–ব্রিটিশ আমলে রাজবন্দিরা দেশপ্রেমিক ছিল তাই তাদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হতো। এখন আর তারা দেশপ্রেমিক নয়। সুতরাং সে সুবিধা দেয়া যাচ্ছে না।

এ ধরনের প্রেসনোটের অন্যতম কারণ হলো–প্রকৃতপক্ষে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্রিটিশবিরোধী তেমন কোনো আন্দোলন করেনি। পূর্ববাংলায় যারা সরকারে এসেছিলেন তাদের মধ্যে কেউ কোনোদিন জেল খাটেনি। রাজবন্দিদের সম্মান বা মর্যাদা সম্পর্কে এদের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। একমাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের কিছুটা বাম ঘেঁষা গন্ধ ছিল। আর সকলেই ছিল উকিল-মোক্তার এবং চাকরিজীবী। রাজনীতি এদের মুখ্য পেশা ছিল না। শুধু ছিল অন্ধ কংগ্রেস এবং বাম রাজনীতির বিরোধিতা।

২৪ দিন পর দ্বিতীয় অনশন ধর্মঘট শেষ হলো জেলমন্ত্রী মফিজউদ্দীন, মুসলিম লীগ নেতা ফকির আবদুল মান্নান ও কংগ্রেস নেতা মনোরঞ্জন ধরের সাথে আলোচনার পর। তবে সে আলোচনা কোনো কাজে আসেনি।

আমাদের অনশন ধর্মঘট রাজবন্দিদের দাবি আদায়ের নামে হলেও মুখ্যত ছিল তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির ভুল কর্মপন্থার ফল। ফলে তৃতীয়বারের মতো আবার অনশন শুরু হলো আগস্ট মাসে। এ অনশন স্থায়ী হয় ৪০ দিন। এবারও কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়।

আমি কমিউনিস্ট পার্টি করি না। ভিন্ন দলের লোক। তাদের সমর্থনে বার বার অনশন করছি। শরীর ভেঙে গেছে। তাই প্রতিবারই অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহারে সময় আমার সাথে মতানৈক্য হতো। ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিরোধী ছিলেন–দিনাজপুরের ঋষিকেশ ভট্টাচার্য, কিশোরগঞ্জের নগেন সরকার, চট্টগ্রামের আব্দুস সাত্তার। আমি এদের পক্ষে থাকতাম।

তৃতীয় অনশন অর্থহীনভাবে প্রত্যাহার হওয়ায় আমাদের মনে ভিন্ন প্রশ্ন দেখা দিল। দেখা গেল কমিউনিস্ট পার্টি নতুন করে অনশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শুধু অপেক্ষা করছে একটা অজুহাতের। সে অজুহাত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে সৃষ্টি করলেন নাদেরা বেগম। শুনলাম নাদেরা বেগম ও দেবপ্রসাদ মুখার্জি নতুন নির্দেশ নিয়ে এসেছে জেলখানায়। অর্থাৎ জেলের আন্দোলন তীব্র করতে হবে। তাই চতুর্থবারের জন্য অনশন শুরু হলো ঢাকা জেলে ১৯৪৯ সালের ২ ডিসেম্বর।

শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বরের অনশন ধর্মঘটে আমাদের যাওয়া হয়নি। দলের কঠিন নির্দেশ হলো–কমিউনিস্ট পার্টির অনশনের সিদ্ধান্ত হটকারী। এই কৌশল আদৌ রাজনৈতিক কৌশল নয়। এই অনশন ধর্মঘট আদৌ রাজনৈতিক দিক থেকেও সঠিক নয়। তবুও আমরা প্রথম দিকে এই অনশনে ছিলাম। আমরা অর্থাৎ আরএসপি’র আমি ও নিতাই গাঙ্গুলী। প্রথমে কথা হয়েছিল মহিলা ওয়ার্ডে হামলার জন্য ৭ দিন অনশন করা হবে। দাবি মানা না হলে অনশন ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়া হবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কমিউনিস্ট পার্টি তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনশন অব্যাহত রাখে। কারো সাথে আলোচনা না করেই এ অনশন ৫২ দিন চলেছিল এবং এই অনশন শেষ হয় ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে।

১৯৪৯ সালে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল টাঙ্গাইলের উপনির্বাচন। এই আসনে এককালে নির্বাচিত হয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মাওলানা ভাসানীর নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়, তিনি নির্বাচনের হিসাব দাখিল করেননি বলে। ১৯৪৯ সালে এই আসনে উপনির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থী হলেন মোহাম্মদ শামসুল হক। শামসুল হক মুসলিম লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে জয়লাভ করেন। কিন্তু তার জয়লাভও কোনো কাজে আসেনি। তার নির্বাচনও ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেয়। আমাদের কাছে ছিল এ এক দারুণ খবর। মাসের পর মাস অনশনের মধ্যে এ খবর ছিল আশার খবর। পাকিস্তান সৃষ্টির দু’বছরের মধ্যে পাকিস্তানের উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয় রাজনৈতিক দিক থেকে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই শামসুল হক আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্মলগ্নে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।

১৯৫০ সালের জেল জীবন শুরু হলো এক নতুন প্রেক্ষিতে। মনে হলো ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নীতির পরিবর্তন হচ্ছে। এছাড়া জেলখানায় অনশন করার মতো অবস্থাও কারো ছিল না। দীর্ঘদিন অনশনের ফলে প্রায় সকলেরই স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গিয়েছিল। এরমধ্যে একদিন দিনাজপুরে ক্ষেমেশ চ্যাটার্জি পত্রিকা হাতে নিয়ে সোরগোল শুরু করেছেন। ক্ষেমেশ চ্যাটার্জি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির লোক (রিভলুশনারি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-আরসিপিআই)। তাঁর নেতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের সৌমেন্দ্র নাথ ঠাকুর। সৌমেন্দ্র ঠাকুর লেনিনের সমসাময়িক ছিলেন। তিনি সপ্তম কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন। স্ট্যালিনের সাথে মতের মিল না হওয়ায় তিনি ভারতে এসে আরসিপিআই গঠন করেন। তারই দলের ক্ষেমেশ চ্যাটার্জি মাত্র কিছুদিন আগে দিনাজপুর থেকে ঢাকা জেলে এসেছিলেন। ক্ষেমেশ বাবু অনশনে অংশগ্রহণ করেননি। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির ঘোরতর বিরোধী।

ক্ষেমেশ বাবুর হাতে স্টেটসম্যান পত্রিকা ছিল। ঐ পত্রিকা পড়েই তিনি চিৎকার করছিলেন। খবরটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি এশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে আপাতত সরকার বিরোধী আন্দোলন স্তিমিত করার নির্দেশ দিয়েছে। ক্ষেমেশ বাবুর ধারণা হচ্ছে-নিশ্চয়ই এশিয়ায় কোনো বড় ধরনের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। যে ঘটনায় সোভিয়েত ইউনিয়ন জড়িয়ে পড়তে পারে।

ক্ষেমেশ বাবু এই মন্তব্য করেছিলেন ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে। তার মন্তব্য সত্যে প্রমাণিত হলো জুন মাসে। জুন মাসে কোরিয়া সীমান্তে সংঘর্ষ শুরু হয়। উত্তর কোরিয়াকে সাহায্য সহযোগিতা করে সোভিয়েন ইউনিয়ন ও চীন। দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে দাঁড়ায় জাতিসংঘের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পাশ্চাত্যের শক্তিবর্গ। এ যুদ্ধ তিন বছর স্থায়ী হয়েছিল।

এই ১৯৫০ সালে আরেক ঘটনা ঘটল হাইকোর্টে। আমি ঢাকা হাইকোর্টে আমার আটকাদেশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলাম। জেলখানা থেকে আমার আবেদনপত্র লিখে দিয়েছিলেন দেবেশ ভট্টাচার্য। দেবেশ বাবু বিশিষ্ট আইনজ্ঞ। ময়মনসিংহে প্র্যাকটিস করতেন। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ময়মনসিংহের আদালতে আন্দোলনে গ্রেফতার ও দণ্ডিত ব্যক্তিদের পক্ষে মামলা করতেন। এটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় অপরাধ। তাই বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাকে গ্রেফতার ও আটক রাখা হয়। দেবেশ বাবু পরবর্তীকালে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি হন।

আমার আবেদপত্র হাইকোর্ট গ্রহণ করে। আমি কলকাতায় আমার আত্মীয়দের কাছে ভালো উকিল নিযুক্ত করার জন্য চিঠি লিখি। ঢাকায় তখন ওকালতি করতেন বর্মা প্রত্যাগত রায় বাহাদুর রমেশ তালুকদার। তাঁকে কলকাতায় ডেকে পাঠিয়ে ব্রিফ করে আমার মামলার জন্য নিয়োগ করা হয়। এ সকল খবর জেলখানায় খুব পাওয়া যেত না। শুধু জানতাম হাইকোর্টে আমার মামলার শুনানি হবে। আমার মামলা ছিল সেকালের পূর্ব বাংলার দ্বিতীয় মামলা। নিরাপত্তা বন্দি হিসাবে প্রথম মামলা হয়েছিল দবিরুল ইসলামের। সে মামলায় উকিল ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

এর মাঝখানে হঠাৎ একদিন জেল অফিসে আমার ডাক পড়ল। দেখলাম এক আইবি অফিসার বসে আছেন। তিনি বললেন, আপনার নাম কি নির্মল সেন? আপনি রাশিয়ার লোক। আপনি কোনোদিন জেল থেকে মুক্তি পাবেন না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? তখন তিনি হাইকোর্টের শুনানির এক অপূর্ব বিবরণ দিলেন। হাইকোর্টে তখন আমার মামলার বিচারপতি ছিলেন জাস্টিস এলিস, জাস্টিস ইস্পাহানি ও জাস্টিস ইব্রাহিম। আমার পক্ষের উকিল অ্যাডভোকেট রায়বাহাদুর রমেশ তালুকদার নাকি বলেছিলেন, মাননীয় বিচারপতি, আমার মক্কেল নির্মল সেনের বয়স খুব কম। সে গান্ধী পরবর্তী যুগের রাজনৈতিক কর্মী এবং সহিংসতায় বিশ্বাস করে না। বিচারপতি এলিস অ্যাডভোকেট তালুকদারকে জিজ্ঞেস করলেন আপনি লেনিনের নাম শুনেছেন? লেনিন সোভিয়েত ইউনিয়নে সহিংস বিপ্লব করেছিল। আপনার মক্কেল নির্মল সেন বরিশালে লেনিন দিবস পালন করেছেন। সুতরাং নির্মল সেন অহিংসায় বিশ্বাস করে, এ তথ্য সঠিক নয়।

গোয়েন্দা বাহিনীর ভভদ্রলোক হাইকোর্টের শুনানির এই অংশটুকু শুনেই জেলখানায় চলে এসেছিলেন এবং তার ধারণা বলেছিলেন আমাকে। তিনি নিঃসংশয় যে আমি রাশিয়ার লোক এবং কোনোদিনই আমার মুক্তি হবে না। তবে এ কথা সত্য যে ঢাকা হাইকোর্ট আমার রিট পিটিশন অগ্রাহ্য করেছিল। একই রায়ে আমার সাথে আরো ২১ জনের রিট পিটিশন অগ্রাহ্য হয়ে গেল।

তবে এ চিত্রের অপর পিঠও আছে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন কারাগারে আটক রাজবন্দিদের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করা হয়। আমাদের পক্ষে উকিল ছিলেন হামিদুর রহমান ও বীরেন চৌধুরী। হামিদুর রহমান পরবর্তীকালে হাইকোর্টের বিচারপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছিলেন এবং পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরিচিত হয়েছিলেন বিভিন্ন কারণে। তখন অ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। এবার হাইকোর্টের রায়ে আমাদের মুক্তির আদেশ দেয়া হলো। অ্যাডভোকেট জেনারেল তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনকে আমাদের মুক্তি দেবার অনুরোধ জানালেন। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার অনড়। তারা নতুন অর্ডিন্যান্স জারি করল। ঢাকা জেলের চারপাশে ঘিরে ফেলা হলো পুলিশ ও পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলের লোক দিয়ে। আমাদের জেল গেটে নিয়ে যাওয়া হলো। এক এক করে মুক্ত করে জেলের বাইরে দাঁড় করানো হল। আর সাথে সাথে ভিন্ন পুলিশ অফিসার আমাদের নতুন নির্দেশ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আপনাদের এই আইনে গ্রেফতার করা হলো এবং আপনাদের ঢাকা জেলেই আটক রাখা হবে।

সে এক অপূর্ব নাটক। হাইকোর্টের নির্দেশে আমাদের ছেড়ে দেয়া হতে পারে এমন একটা খবর পাওয়া গিয়েছিল আগেই। অনেকে উৎফুল্ল হয়েছিল। ভেবেছিল লৌহ কপাটের বাইরে হয়তো নিজের বাড়ি যাওয়া যাবে। অনেকে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু তেমনটি ঘটল না। সকলকে নতুন আটকাদেশ দিয়ে আবার জেলখানায় ঢুকতে হলো। তখনকার মনের অবস্থা যারা কোনোদিন জেলে যায়নি, তাদের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। কিছুদিন পরে আরেকটি ঘটনা ঘটল আমাকে নিয়ে। বিকালের দিকে জেল গেটে আমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হলো। একটা ক্ষীণ ধারণা হয়েছিল হয়তো আমাকে ছেড়ে দেয়া হবে। কারণ জেলখানায় ৬ মাস পরপর নতুন আটকাদেশ দিতে হয়। একটি অর্ডিন্যান্সের মেয়াদ ৬ মাস হলে নতুন নির্দেশ না দিয়ে ৬ মাসের বেশি আটক রাখা যায় না। আমার সেদিন ছিল ৬ মাস পরে আদেশ দেবার আরেক ৬ মাসের শেষদিন। ৬ মাসের শেষ দিনে জেল গেটে ডাকলে অনেকেরই ধারণা হয়–ঐ রাজবন্দিকে মনে হয় ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। আমার ক্ষেত্রে হলো আরেক নতুন নাটক।

জেল গেটে গিয়ে দেখলাম উচ্চপদস্থ পুলিশের কর্মকর্তারা বসে আছেন। সাথে আমার অ্যাডভোকেট রায়বাহাদুর রমেশ তালুকদার। তাঁরা জানালেন-পূর্ব বাংলার সরকার আমাকে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে একটি শর্ত আছে। শর্ত হচ্ছে, জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে আমার বাড়ি বা অন্য কোথাও যাওয়া চলবে না। পুলিশ আমাকে সাথে করে পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে পৌঁছে দিয়ে আসবে। আমাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে ভারতে।

অ্যাডভোকেট রমেশ তালুকদার অনেক কাকুতি মিনতি করলেন। বললেন-আমার আত্মীয়-স্বজনের সাথে নাকি তাঁর কথা হয়েছে। আমি জেলে আসায় আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। জেলখানায় পড়াশোনা করা সম্ভব নয়। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় প্রাইভেট পরীক্ষা দেয়া সম্ভব নয়। তিনি আরো বললেন, এ ব্যাপারে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের চাচা খান সাহেব মোশাররফ হোসেনের সাথেও কথা বলেছেন। এ ব্যবস্থা নাকি তিনিই করেছেন।

একথা আংশিক হলেও সত্য ছিল। ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে খান সাহেব আমার সাথে ঢাকা জেলে দেখা করতে এসেছিলেন। সাথে ছিল আমার ছোট কাকা। আমার নওয়া কাকা ও ছোট কাকা টুঙ্গীপাড়া থানার পাটগাতীতে ডাক্তারি করতেন। ছোট কাকা টুঙ্গীপাড়ার শেখ পরিবারের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন। আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল গভীর এবং সকল প্রকার জাত-পাত ও সম্প্রদায়ের গণ্ডি পেরিয়ে। নাইলে খান সাহেব আমার সাথে দেখা করতে আসতেন না। পাকিস্তান আমলে আত্মীয়-স্বজনের পক্ষে রাজবন্দিদের সাথে দেখা করা দুঃসাধ্য ছিল। সেকালে পাকিস্তান সরকারের একমাত্র নীতি ছিল কাউকে বিশ্বাস না করা। এই নীতির ফলে অনেকে আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করতে এসে গ্রেফতার হয়ে গেছে। ঢাকা জেলে সেবারের প্রায় ৫ বছরের জেল জীবনে বাইরের কারো সাথে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল আমার মাত্র তিনবার।

সে পরিস্থিতিতে খান সাহেবের পক্ষে আমার সাথে দেখা করা ছিল দুঃসাধ্য কাজ। এ কাজটি তিনি করেছিলেন। গোয়েন্দা বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন ঢাকায়। সাথে ছোট কাকা। তাদের একমাত্র অনুরোধ সরকারের কাছে মুচলেকা দিতে হবে আমি রাজনীতি করব না। এই মুচলেকা দেবার সাথে সাথে আমি মুক্তি পেয়ে যাব। আমি রাজি হলাম না। খান সাহেব ক্ষুব্ধ হলেন। কাকা বিদায় নিলেন চোখের জলে।

সেই ঘটনারই যেন আরেক ধরনের পুনরাবৃত্তি হচ্ছিল ১৯৫০ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে। অ্যাডভোকেট রমেশ তালুকদারের কথা শুনে আমার মাথা যেন বিগড়ে গেল। আমি বললাম, আমি কোনো শর্তে মুক্তি চাই না। আমার লেখাপড়ার কথা আপনাদের ভাবতে হবে না। আমি কোথায় যাব, কোন দেশে থাকব সে সিদ্ধান্ত আমিই নেব। আর আপনারা আমার কেউ অভিভাবক নন। এ ব্যাপারে আমাকে উপদেশ দেবার চেষ্টা করবেন না। আমার কথা শুনে রমেশ বাবুর মুখ কালো হয়ে গেল। মনে হয় তিনি সরকার পক্ষকে বুঝিয়েছিলেন যে তিনি আমাকে রাজি করাতে পারবেন। আমার কথায় সব কিছু ভেস্তে গেল।

এরপর আর কথা জমল না। পুলিশ অফিসার একটি নতুন নির্দেশ বের করলেন। ঐ নির্দেশে আমার আটকাদেশ আরো ৬ মাস বাড়িয়ে দেয়া হলো। আমি জেলখানায় আমার ওয়ার্ডে ফিরে এলাম। জেলখানার বন্ধুরা অনেক খুশি হলেন। অনেকে ভিন্ন কথা বললেন। তখন একটা ভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল ঢাকা জেলে। দীর্ঘদিন অনশনে আমার স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে। কোনোকিছুই হজম হচ্ছে না। মাসের পর মাস দু’বেলা বার্লি খেয়ে কাটাতে হচ্ছে। ভিন্ন পরিবেশে ঘটে যায় ৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। আমি আর একটি আটকাদেশ নিয়ে ঢাকা জেলে ফিরে এলাম। পাকিস্তান সরকারের প্রস্তাব ছিল–আমাকে মুক্তি দেয়া হবে। শর্ত হচ্ছে–আমাকে পাকিস্তান ছাড়তে হবে। কিন্তু সে প্রস্তাবে আমি রাজি হলাম না। ফলে আটকাদেশ আরো ৬ মাস বৃদ্ধি পেল। তখন প্রায় ২ বছর জেল খাটা হয়ে গেছে।

জেলে তখন ভিন্ন পরিস্থিতি। কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনশন করে সকলেরই শরীর ভেঙে গেছে। চতুর্থ অনশন ধর্মঘটের সময় কুষ্টিয়ার শিবেন রায় মারা গেছেন। সে এক মর্মান্তিক কাহিনী। ঢাকা জেলে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে শিবেন রায়কে রাখা হয়েছিল তৃতীয় শ্রেণির কয়েদীর মতো। শুয়ে থাকতে হতো মেঝেতে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৬ নম্বর সেলে কখনো সূর্যের আলো পাওয়া যায় না। ব্রিটিশ আমলের নির্জন সেল। কুষ্টিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শিবেন রায়। ঐ সেলেই তিনি অনশন শুরু করেন। ডাক্তাররা অনশনের ৪ দিন পর অন্য বন্দির মতো তাকেও জোর করে নাক দিয়ে দুধ খাওয়াবার চেষ্টা করেন।

নাক দিয়ে দুধ খাওয়ানোর একটা বিপদ আছে। দুধ খাওয়ার নলটি নাক দিয়ে ঢুকে পাকস্থলিতে না গিয়ে সাংসে চলে যেতে পারে। সাংসে চলে গেলে মৃত্যু অনিবার্য।

শিবেন রায়ের ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল। সেই দুধ খাওয়ানোর পদ্ধতি ছিল বীভৎস। জেলের সিপাইরা জোর করে রাজবন্দিদের মেঝেতে ফেলে দিত। হাত পায়ের ওপর বসত। কখনো বুকের ওপরও বসত। তারপর ডাক্তার নাকে নল ঢুকিয়ে নাড়াচাড়া করত। ফলে দুধের নল সরে যাবার সম্ভাবনা থাকত। শিবেন রায়কে দুধ খাওয়ার সময় নলটি লাংসে চলে যায়। নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়। অন্যান্য সেলে খবর গেলে প্রতিবাদে রাজবন্দিরা শ্লোগান দিতে থাকে। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ কোনো ক্ৰক্ষেপ করল না। আবার জোর করে একইভাবে তাকে দুধ খাওয়ানো হলো। ফলে মৃত্যু হলো শিবেন রায়ের। এবারের অনশনে রাজবন্দিরা কিছুটা জয়ের মুখ দেখল। রাজবন্দিদের অন্যান্য বন্দিদের চেয়ে পৃথক মর্যাদা দেয়া হলো। রাজবন্দিদের দু’শ্রেণিতে বিভক্ত করা হলো। শিবেন রায়ের মৃত্যু ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন জেলখানার আন্দোলনে প্রভাব বিস্তার করল।

সঙ্কট দেখা দিল ভিন্ন প্রশ্নে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি, পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাইকারি হারে বামপন্থীদের ধরপাকড় শুরু হয়। এদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারের। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দেশ ভাগ হওয়ায় প্রতিটি পরিবারে শঙ্কা। কোনো পরিবারই স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি আদৌ তারা পাকিস্তানে থাকবে কিনা। বাড়তি অসুবিধা দেখা দিয়েছে ঘরে ঘরে রাজনৈতিক কর্মী থাকায়। তাদের ধারণা হয়েছে রাজনৈতিক কারণেই হয়তো তাদের দেশান্তরী হতে হবে।

পারিবারিক এই সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যেই গ্রেফতার হয়ে জেলখানায় এসেছে অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা। তারা জেলে আসার পর তাদের ঘরবাড়ি তছনছ হয়েছে। নির্যাতিত হয়েছে আত্মীয়-স্বজন। জেলে থাকাকালে অনেকের পরিবার দেশ ত্যাগ করে চলে গেছে। অর্থাৎ এদের পারিবারিক ও রাজনৈতিক জীবন একান্তভাবেই অনিশ্চিত।

জেলখানায়ও এই অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই স্থির করতে পারেনি মুক্তি পেলে তারা কোথায় যাবে। আদৌ পাকিস্তানে থাকবে কিনা। অনেকে আবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মুক্তি পেলেই দেশ ছেড়ে চলে যাবে। এ ব্যাপারে লেখালেখিও করেছে পূর্ববাংলার সরকারের সাথে। এদের মধ্যে অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টির বিশিষ্ট নেতা ও কর্মী।

আর এর মাঝখানেই কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সংগ্রামের ডাক এসেছে। জেলখানায় একের পর এক অনশন ধর্মঘট হচ্ছে। সংঘর্ষ হচ্ছে। আর বিপাকে পড়েছে এই রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা। তাদের সাথীরা জেলখানায় অনশন করছে। সংঘর্ষ করে জীবন দিচ্ছে। অথচ তারা এই সংগ্রামের শরিক হতে পারছে না। সে ছিল এক মর্মান্তিক জ্বালা।

এ পরিস্থিতিতে আমি সরকারি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলো। অনেকে সাধুবাদ জানালেন। অনেকে স্পষ্টতই বললেন, সরকারের এ প্রস্তাব গ্রহণ করা উচিত ছিল। কারণ কোন কালে মুক্তি পাওয়া যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পাকিস্তানে কবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হবে এবং তারপরে আমরা মুক্তি পাব সে কথা সঠিক করে বলা আদৌ সম্ভব নয়। তাই তাদের মতে, এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা আদৌ সঠিক ছিল না।

এর পরপরই এক মর্মান্তিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দুই বাংলার বড় খবর হয়ে উঠল। জেলখানায় কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। একমাত্র পত্রিকা দৈনিক আজাদ আর কলকাতার স্টেটসম্যান। কোনো কাগজ থেকেই প্রথম দিকে দাঙ্গার ভয়াবহতা অনুধাবন করা যায়নি। মাস তিনেক পরে এক খ্রিস্টান যাজক বরিশালের দাঙ্গা সম্পর্কে স্টেসসম্যানে ধারাবাহিক লিখতে শুরু করেন। এই ধর্ম যাজকের নাম এডওয়ার্ড ম্যাক-ই নার্নি। ১৯৪৬ সালে দাঙ্গার সময় তিনি নোয়াখালীর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। সেই সুবাদে আমার সাথে মৈত্রী ও বৈরী সম্পর্ক হয়েছিল তার সাথে বরিশালে। সে কাহিনীতে পরে আসব।

ম্যাক-ই নার্নির রিপোর্ট থেকে বোঝা গেল যে, পূর্ববাংলার অবস্থা আদৌ স্বাভাবিক নয়। বরিশালের বন্দিরা উদগ্রীব হলেন। দীর্ঘদিন যাবত পরিবার পরিজনের কোনো খবর নেই। চারদিকে অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা এবং চরম অসহায়ত্ব।

এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চুক্তি হলো। এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। এ চুক্তি নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি নামে পরিচিত। এ চুক্তিতে বলা হলো–পূর্ববাংলার যে হিন্দুরা পশ্চিম বাংলায় যেতে চান বা পশ্চিম বাংলার যেসব মুসলমান পূর্ব বাংলায় যেতে চান দুই সরকার যৌথভাবে তাঁদের স্থানান্তরের দায়িত্ব নেবে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কলকাতা, বরিশাল, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জের মধ্যে স্টিমার চলাচল শুরু হলো। লাখ লাখ মানুষ দেশান্তরী হলো।

আমার তখন বারবার জেলখানায় মাওলানা আবুল কালাম আজাদের কথা মনে হলো। দেশ বিভাগের সময় তিনি এ প্রশ্নটি তুলেছিলেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন উভয় দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার প্রশ্নে। সে প্রশ্নের জবাব মিলল ১৯৫০ সালে। প্রমাণিত হলো সাম্প্রদায়িক বিভক্তির ভিত্তিতে স্বাধীনতা সাম্প্রদায়িক সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেয় না। দিতে পারে না।

সে এক অদ্ভুত স্বাধীনতা। ভারতের মুসলমান জানে না সে তার জন্মভূমিতে থাকতে পারবে কিনা। পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা জানে না তারা আদৌ নিরাপদ কিনা। দুটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা চুক্তি করে নিজের দেশের নাগরিকদের ভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দিল। পৃথিবীতে এর কোনো নজির নেই। তাহলে এ স্বাধীনতা কার? কাদের জন্য এ স্বাধীনতা? হিন্দু মুসলিম যদি দুই জাতিই হয়ে থাকে, যদি এক সাথে তাদের না থাকা হয়, সে জন্য যদি দেশ ত্যাগ করতে হয়, তাহলে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে লোক বিনিময় কেন করা হলো না? কেন জানমালের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা না করে এই উপমহাদেশকে ভাগ করা হলো সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে?

জেলখানায় আমার এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া সম্ভব ছিল না। কাউকেই স্বাভাবিক মনে হতো না। সকলেই মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কারো কোনো ধারণা নেই। ১৯৫০ সালে দাঙ্গার পর পরিস্থিতি এমন হলো, কেউই জানে না এ মুহূর্তে তাকে মুক্তি দেয়া হলে সে কোথায় যাবে, কোথায় গিয়ে উঠবে। কে তাকে আশ্রয় দেবে। আদৌ পূর্ববাংলা নামক জন্মভূমিতে তার জন্য কোনো আশ্রয় আছে কিনা।

একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল ভারত থেকে আসা কমরেডদের নিয়ে। তখন কমিউনিস্ট পার্টি ও আরএসপি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পাকিস্তানে মুসলিম কমরেড ও ভারতে হিন্দু কমরেডরা রাজনীতিতে মুখ্য দায়িত্ব পালন করবে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কমিউনিস্ট পার্টির অসংখ্য মুসলিম কমরেড পশ্চিমবাংলা থেকে পূর্ববাংলা চলে আসেন। তারা পূর্ববাংলার বিভিন্ন কারাগারে আমাদের সাথে দিনের পর দিন অনশন ধর্মঘট করেন। অনেকের স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। ১৯৫০ সালের দাঙ্গা ও নেহেরু-লিয়াকত চুক্তির পর তাঁদেরও নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।

জেলমন্ত্রী চলে যাবার পরেও পরীক্ষা নিয়ে তেমন কোনো সুরাহা হয়নি। দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে জানাতে থাকলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় বলে আমাকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষা দেবার অনুমতি দেয়া যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘদিন আবেদন নিবেদনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত আমার কাজে এল না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানালেন, এ সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য প্রযোজ্য নয়। নিশ্চিত হয়ে গেল যে, জেলে থাকতে আমার আর পড়াশোনা করা সম্ভব নয়।

একদিক থেকে জেলখানায় আমি ছিলাম ভাগ্যবান। ভাগ্য বলে কিছু বিশ্বাস করি কিনা সে প্রশ্ন বিতর্কিত। তবে জেলখানায় যাদের চিঠি আসত তাদের ভাগ্যবান মনে হতো। সে এক অদ্ভুত মানসিকতা। অবরুদ্ধ দেয়ালের জগতে চিঠি হচ্ছে বাইরের খবর। বাইরের সাথে যোগাযোগ। তাই সকলেই প্রতিদিন চিঠির জন্য অপেক্ষা করত। জেল অফিস থেকে কেউ এলে জিজ্ঞাসা করা হতো চিঠি এসেছে কিনা। আর জেলের ঠিকানায় চিঠি এলেই যে আমাদের হাতে পৌঁছাবে তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। জেল অফিসে চিঠি পৌঁছালে সেন্সরের জন্য গোয়েন্দা অফিসে পাঠানো হতো। অনেক চিঠি গোয়েন্দা অফিস বাজেয়াপ্ত করত। আবার কোনো চিঠির কোনো অংশ কেটে দিত। ফলে জেল অফিসে কোনো চিঠি পৌঁছাবার পর সে চিঠি রাজবন্দিদের হাতে পৌঁছাতে দীর্ঘদিন লেগে যেত। আবার অনেক চিঠিই দেয়া হতো না।

তবুও এ চিঠি নিয়ে হৈচৈ ছিল জেলখানায়। একটি চিঠি এলে সে চিঠি বারবার পড়া হতো। প্রতিটি বাক্য বিশ্লেষণ করা হতো। আবিষ্কার করার চেষ্টা হতো ঐ চিঠিতে কোনো গোপন সংকেত আছে কিনা। জেল থেকে মুক্তি পাবার ইঙ্গিত আছে কিনা। তাই যাদের চিঠি আসত না তাদের মন খারাপ হয়ে যেত। আমার সব সময় মনে হয়েছে জেলে যাদের আত্মীয়-স্বজন আছে তাদের উচিৎ ঐ বন্দিকে চিঠি লেখা। সে বন্দি রাজবন্দি হতে পারে, খুনের আসামী হতে পারে। হতে পারে ভিন্ন কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত। আমার অনুরোধ জেলখানার স্বজনদের জন্য চিঠি লিখবেন। সে যেই হোক না কেন। চিঠির অভাব আমার কোনোদিনই হয়নি। আমার চিঠি ছিল সকলের কাছে ঈর্ষার।

এ চিঠি আসা না আসা নিয়ে জেল জীবনে একটি বিরাট অংশ কাটে। আবার জেলে কোনো অপরাধ করলে চিঠি লেখা এবং চিঠি পাওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তেমনটি হতে অনশনের সময়। যারা অনশন করত তারা জেলখানার আইনে অপরাধী। তাই তাদের চিঠি বন্ধ করে দেয়া হতো। বন্ধ করা হতো বাইরের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাতকার।

১৯৫০ সালে জেলখানার চতুর্থ অনশন শেষ হবার পর এই অনশন পর্ব শেষ হলো। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নতুন সিদ্ধান্ত নিল জেলখানার আন্দোলন সম্পর্কে। কমিনফর্ম কমিউনিস্টদের কনফর্মেশন ব্যুরো ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির তীব্র সমালোচনা করে জানাল, তাদের রাজনীতি নিতান্তই ভুল। তাদের সমালোচনায় বলা হলো জেলখানা হচ্ছে শ্রেণি শত্রুর সবলতম ঘাঁটি। সেই ঘাঁটির মধ্যে তারা হচ্ছে সর্বশক্তিমান। সেখানে বিপ্লব করার চেষ্টা অথবা শত্রুর সাথে একটা সরাসরি বোঝাঁপড়ার কর্মসূচি ছিল নিতান্তই ভুল। শত্রুর এই সবলতম ঘাঁটিতে শত্রুকে আঘাত করতে গিয়ে সংগঠনের দিক থেকে পার্টি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কমিনফর্মে এই সমালোচনায় জেলখানায় আমাদের অনশনের বহর কমল। কিন্তু ইতিমধ্যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে রাজবন্দিদের ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে। রাজশাহীর সাঁওতাল এলাকায় গ্রেফতার করে ইলা মিত্রের ওপর চালানো হয়েছে ইতিহাসের জঘন্যতম অত্যাচার। রাজশাহী জেলে পাখির মতো গুলি করে মারা হয়েছে রাজবন্দিদের। সে পর্ব শেষ হলো কমিনফর্মের নির্দেশে। এ কমিনফর্ম কী? এর নির্দেশ ভারতীয় কমিউনিস্ট পাটির শুনতে হবে কেন?

১৯৫০ সালে জেলখানায় মোটামুটি তেমন কোনো গোলমাল ছিল না। কমিউনিস্ট পার্টির সেকালের কৌশল পরিবর্তন হয়েছে। জেলখানায় আন্দোলন স্তিমিত। তবে জেলখানা থেকে কবে মুক্তি পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে কেউই তেমন নিশ্চিত নয়। ১৯৫০ সালে দাঙ্গার পরে কেউই জানে না কার ভবিষ্যৎ কী হবে?

পাকিস্তানের রাজনীতিতেও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে তখন। ১৯৪৮ সালে ১১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মারা যান। একক নেতৃত্বে আসেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। লিয়াকত আলী ভারতের উত্তর প্রদেশের অধিবাসী। ভারত ভাগ হওয়ার সময় তিনি পাকিস্তানে আসেন। মুসলিম লীগের সম্পাদক হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মুসলিম লীগের নেতা হিসেবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খান-ই বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। জিন্নার মৃত্যুতে নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দেয়। পাকিস্তানে গভর্নর জেনারেল কে হবে সেই বিতর্ক উঠতে থাকে। কে মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট হবেন সে প্রশ্নও দেখা দেয়। এ সময় পাকিস্তানের আমলারা ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করেন। গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত একাউন্ট সার্ভিসের গোলাম মোহাম্মদ। তিনি ভারতের হায়দারাবাদের নিজাম সরকারের অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন। পাকিস্তানের মন্ত্রিসভার প্রথম অর্থমন্ত্রী ছিলেন। গোলাম মোহাম্মদের গভর্নর জেনারেল পদে নিযুক্তির পর পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন খেলা শুরু হয়। মুসলিম লীগের সভাপতি হন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নিজেই।

তখন মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ছিলেন জমিদার, জোতদার এবং নব্য শিল্পপতিরা। এই জমিদার ও জোতদারের স্বাভাবিক মিত্র ছিল সামরিক ও বেসামরিক আমলারা। জিন্নাহ এবং লিয়াকত আলীর মতো ব্যক্তিত্বের উপস্থিতির জন্য তাঁদের জীবিতকালেই আমলারা রাজনীতিতে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। কিন্তু জিন্নার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় প্রভাব বিস্তার করার জন্য সামরিক ও বেসামরিক আমলারা তৎপর হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর তখন পৃথিবীতেও ছিল ভিন্ন পরিস্থিতি। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিম শিবির, অপরদিকে সোভিয়েন ইউনিয়ন। পশ্চিম মহলে তখন ভয়, যে কোনো দেশে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসতে পারে। এছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশের কাছে চীন। চীনেরও বিপ্লব হয় ১৯৪৯ সালে। সারা পৃথিবীতে তখন চরম কমিউনিস্ট আতঙ্ক। কমিউনিস্টদের ঠেকাবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৎপর। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিস্ট বিরোধী উদ্যোগ দ্বিধা-বিভক্ত হলো ভারতীয় উপমহাদেশে।

১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান এই সময়ে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু তখন দুটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এক ছিল না। ব্রিটিশ আমলের প্রায় সকল শিল্প কারখানাই ভারতীয় এলাকায় পড়েছিল। ব্রিটিশ আমলেই এক শ্রেণির শিল্পপতি ভারতে জন্ম নিয়েছিল। এই শিল্পপতিরা অনেক ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পপতিদের সাথে টক্কর দিতে পারত। তাই ভারত স্বাধীন হবার পর থেকে বিভিন্ন প্রশ্নে ব্রিটিশ-মার্কিনসহ পাশ্চাত্যের সরকারের সাথে ভারতের মতানৈক্য শুরু হয়। কমিউনিস্ট বিরোধিতার নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন একের পর এক চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়। পাকিস্তান এ উদ্যোগের সামিল হলেও ভারত সরকার কোনোদিনই এ ধরনের উদ্যোগের সাথে যুক্ত হয়নি। পাকিস্তানের কাছে পরিস্থিতি ভিন্নতর। পাকিস্তানে শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন ছিল না। তাকে মূলধন সংগ্রহ করতে হতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনের কাছ থেকে। আর এই মূলধন পাওয়া কখনোই শর্তহীন ছিল না। তাদের শর্ত ছিল, কমিউনিস্টদের প্রতিরোধ করতে হবে, প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হবে, অন্যথায় সাহায্য মিলবে না। অপরদিকে পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ অর্থাৎ এককালের মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সাংগঠনিকভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের কোনো ঐতিহ্য ছিল না। ফলে পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকেই পাশ্চাত্যের শিবিরে চলে যায়।

কিন্তু ভারতের কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের একটি দীর্ঘ দিনের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের ঐতিহ্য ছিল। আবার ভারতীয় শিল্পপতিদের তেমন মূলধনের সঙ্কট ছিল না। তাই ভারতের কংগ্রেস নেতারা পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক কোনো শিবিরেই পুরোপুরি যোগ দেননি। তাঁরা দরকষাকষি করে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছেন এবং এ ভিত্তিতে ভারতের পররাষ্ট্র নীতি ছিল গোষ্ঠী নিরপেক্ষ। আর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতি ছিল পাশ্চাত্য ঘেঁষা।

তবে পশ্চিমা ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করতেও পাকিস্তানকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছিল–পাকিস্তান কোন পক্ষে যাবে? পাকিস্তান এককালে ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটেন পাকিস্তানকে কজায় রাখতে চেয়েছে। অপরদিকে পাশ্চাত্যের রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে ব্রিটেনকে হটিয়ে নেতৃত্বে এসে যায়। সে পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে ব্রিটেনের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী। এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। ফলে পাকিস্তানের ব্রিটেন লবিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। তখন পাকিস্তানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন খাজা শাহাবুদ্দীন। তকালীন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের কনিষ্ঠ ভাই, খাজা পরিবার বরাবরই ব্রিটিশ রাজনীতির পরম সুহৃদ।

শাহাবুদ্দীনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রিত্বের আমলে ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডিতে এক জনসভায় ভাষণ দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান প্রকাশ্য দিবালোকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। লিয়াকত আলীর হত্যাকারী সৈয়দ আকবর একজন জেলমুক্ত আসামী। সে সীমান্তের হাজেরা জেলায় অন্তরীণ ছিল। সে লিয়াকত আলীকে গুলি করার সাথে সাথে অপর একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা তাকে গুলি করে হত্যা করে। অর্থাৎ লিয়াকত আলীর সঙ্গে তার হত্যাকারীকেও পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। ফলে লিয়াকত হত্যার ঘটনা আর কোনোদিনই জানবার সুযোগ থাকল না। রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে, এটা ছিল পাকিস্তানের রাজনীতিতে ব্রিটিশ ও মার্কিন লবির সঙ্কটের অনিবার্য পরিণতি। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান মিত্রের সন্ধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীনের উপদল এটা পছন্দ করেনি। তাই নিহত হলেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। হত্যাকারী একজন অন্তরীণ ব্যক্তি। প্রশ্ন দেখা দিল এই অন্তরীণ মানুষটি হাজেরা থেকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে কী করে রাওয়ালপিন্ডিতে এল। কেনই বা হত্যাকারীকে মামলার স্বার্থে বাঁচিয়ে না রেখে সাথে সাথেই হত্যা করা হলো। এ রহস্যের জট আজো পাকিস্তানের রাজনীতির অঙ্গনে কেউ খুলবার চেষ্টা করেনি। লিয়াকত আলী নিহত হলেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ব্রিটিশ লবি আর মার্কিন লবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে পারলেন না।

জেলখানায় কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছিল কমিনফর্মের নির্দেশে। কমিনফর্ম হচ্ছে কমিউনিস্ট ইনফরমেশন ব্যুরো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে কমিনফর্ম গঠিত হয়েছিল ৯টি দেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিয়ে। এ ৯টি দেশ হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, হাঙ্গেরি, যুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লাভিয়া, ইতালি ও ফ্রান্স। কমিনফর্মের লক্ষ ছিল বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা, সংবাদ আদান-প্রদান। কিন্তু কমিনফর্মও এক সময় তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক কমিনটার্ন-এর ভূমিকা গ্রহণ করে। অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশ বাস্তবায়নই এককালে কমিনফর্মের কাজ হয়ে দাঁড়ায়। এ পরিস্থিতির প্রতিবাদ করলে ১৯৪৮ সালে জুন মাসে যুগোশ্লাভিয়াকে কমিনফর্ম থেকে বহিষ্কার করা হয়। কমিনফর্মের প্রধান দফতর বেলগ্রেড থেকে রুমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট স্থানান্তরিত করা হয়। আবার ক্রুশ্চেভের আমলে যুগোশ্লাভিয়াকে খুশি করতেই ১৯৫৭ সালের ১৭ এপ্রিল কমিনফর্ম ভেঙে দেয়া হয়। এই ক্ষেত্রে কমিনফর্মই হচ্ছে শেষ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সংস্থা।

রাজনীতির ইতিহাসে আন্তর্জাতিকভাবে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ করার প্রথম প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন কার্ল মার্কস। ১৮৪৮ সালে কার্ল মার্কস ও ফ্রিডারিক এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেন। এ ম্যানিফেস্টোতে বলা হয় যে-পৃথিবীর ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস এবং একদিন পুঁজি ও শ্রমের তীব্র সংঘর্ষের ফলে শ্রমিক শ্রেণি ক্ষমতায় আসবে এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে শোষণহীন সমাজ।

এই কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর পরিপ্রেক্ষিতেই মার্কস-এঙ্গেলস আন্তর্জাতিকভাবে শ্রমিক শ্রেণিকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। ১৮৬৪ সালে তিনি গড়ে তোলেন ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং মেনস অ্যাসোসিয়েশন। ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত এ সংগঠন বেঁচে ছিল। মার্ক ১৮৮৩ সালে মারা যান। মাকর্মপন্থীরা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন ১৮৮৯ সালে। প্যারিসে ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কারস কংগ্রেসের বৈঠক বসে। নামকাওয়াস্তে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বেঁচে ছিল ১৯১৪ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে মতানৈক্য ছিল চরম।

দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে মতানৈক্য দেখা দেয় বিশেষ করে যুদ্ধে সমাজতন্ত্রীদের ভূমিকা নিয়ে। তখন প্রথম মহাযুদ্ধ এগিয়ে আসছিল। প্রশ্ন উঠেছিল, যুদ্ধে সমাজতন্ত্রী কমিউনিস্টদের ভূমিকা কী হবে। সিদ্ধান্তে বলা হয়েছিল যুদ্ধ হচ্ছে সর্বহারাদের একটি সুযোগ। যুদ্ধের সময় সর্বহারা শ্রেণির রাজনৈতিক দলের কর্তব্য হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে নিজ নিজ দেশের পুঁজিবাদী সরকারকে আঘাত করা এবং এ দুর্বল মুহূর্তে আঘাত করে ক্ষমতা দখল করা।

কিন্তু একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতীত কোনো দেশেই এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলো না। গণতান্ত্রিক সমাজবাদী (সোস্যাল ডেমোক্রেটরা) যুদ্ধের সময় জাতীয়তাবাদী হয়ে গেল এবং নিজ দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সহযোগী হল। প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক হলো অর্থহীন-অস্তিত্বহীন।

এই পটভূমিতে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপ্লবের পর ১৯১৯ সালে তৃতীয়বারের মতো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন লেনিন। বৈঠক ডাকা হয় মস্কোতে, লেনিনের নেতৃত্বে গঠিত এই আন্তর্জাতিকের নাম হয় তৃতীয় আন্তর্জাতিক বা কমিনটার্ন (কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল)।

তৃতীয় আন্তর্জাতিক গঠনের ৫ বছর পর মারা যান লেনিন। সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে আসেন স্ট্যালিন। স্ট্যালিন নেতৃত্বে আসার পর প্রথম বিতর্ক শুরু হয় সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে। একক বিচ্ছিন্ন একটি দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব কিনা সমাজতন্ত্রের বিজয় বা পূর্ণ বিজয় সম্ভব কিনা এ প্রশ্নে পৃথিবীতে তিনটি মত দেখা দেয়। স্ট্যালিনের মতে, একটি দেশের শুধু সমাজতন্ত্রের বিজয় নয়, পূর্ণ বিজয় সম্ভব। ট্রটীর মতে বিজয় বা পূর্ণ বিজয় আদৌ সম্ভব নয়। এমনকি ইউরোপের অন্যান্য দেশে বিপ্লব না হলে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিনির্মাণের কাজ শুরু করা সব নয়। তৃতীয় ধারার মতে, একটি দেশের সমাজতন্ত্রের পূর্ণ বিজয় আদৌ সম্ভব নয়, তবে সমাজতন্ত্রের বিনির্মাণের কাজ শুরু করা যায়। ভারতে প্রথম ধারার অনুসারী ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, দ্বিতীয় ধারার অনুসারী ট্রটস্ফীবাদীরা এবং তৃতীয় মতের অনুসারী বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল আরএসপি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্ট্যালিনের নেতৃত্বে তৃতীয় আন্তর্জাতিক স্ট্যালিনের মতকেই গ্রহণ করে এবং প্রচার করতে থাকে।

এই তৃতীয় আন্তর্জাতিকে সঙ্কট দেখা দেয় ১৯২৮ সাল থেকে। তৃতীয় আন্তর্জাতিকে ৬ষ্ঠ কংগ্রেসে নতুন কৌশল নির্ধারণ হয়। গণতান্ত্রিক সমাজবাদীদের (সোস্যাল ডেমোক্র্যাট) ফ্যাসিস্ট বলে আখ্যায়িত করা হয়। এমনকি তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এই তত্ত্ব অনুসারে ভারতের কমিউনিস্টরা ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনের বিরোধিতা করে। কারণ কংগ্রেসের নেতৃত্বে ছিল সংস্কারবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গান্ধী এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। এই তত্ত্বের ভয়াবহ পরিণতি দেখা দেয় পরবর্তীকালে। জার্মানিতে সোস্যাল ডেমোক্র্যাট ও কমিউনিস্টরা বিভক্ত হয়ে যায়। হিটলারের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থান ঘটে ১৯৩৩ সালে। ১৯৩৫ সালে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসের বৈঠক বসে। এবার পপুলার ফ্রন্টের তত্ত্ব আনা হয়। বলা হয়, ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থানের ফলে পৃথিবীতে নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবী এখন তিন ভাগে বিভক্ত– (১) সোভিয়েট সমাজবাদ (২) গণতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ (ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) (৩) ফ্যাসিবাদ। বলা হয় ফ্যাসিবাদকে রুখবার জন্য গণতান্ত্রিক সমাজবাদীদের সাথে ঐক্য করা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লেনিনপন্থী দাবিদার কমিউনিস্ট সোসালিস্টদের পক্ষ থেকে বলা হলো–এটা সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাঁচাবার কৌশল। এতে লেনিনবাদের চিহ্নমাত্র নেই।

এ ব্যাখ্যা সত্য প্রমাণিত হলো ১৯৩৯ সালে। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঘনঘটা। যে কোনো মুহূর্তে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। ঐ মুহূর্তে আগস্ট মাসে জার্মানি রাশিয়ার সাথে অনাক্রমণ চুক্তি করল। অর্থাৎ জার্মানি তখন পশ্চিম ইউরোপ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পূর্বে রাশিয়াকে ঠেকা দেয়াই ছিল এ চুক্তির লক্ষ্য। অথচ পপুলার ফ্রন্ট তত্ত্বে ফ্যাসিবাদের সাথে চুক্তির কথা ছিল না। বিশ্বের রুশপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলো এ সত্ত্বেও বলল, এটাই সঠিক। এবার যুদ্ধ হচ্ছে জার্মানি ও ব্রিটেন-ফ্রান্সের সাথে। এ যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। এ যুদ্ধে আমাদের নিজ দেশের সরকারকে উৎখাতের সংগ্রাম করতে হবে। ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি বলল–এ যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। এ যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। কিন্তু তেমনটি ঘটল না। ১৯৪১ সালের জুন মাসে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করল। বিশ্বের মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের এবার স্লোগান পাল্টে গেল। এবার আর সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ নয়। রাশিয়া আক্রান্ত হওয়ায় এ যুদ্ধ জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছে। সুতরাং পপুলার ফ্রন্ট তত্ত্ব অনুযায়ী গণতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ, ফরাসি, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের যুদ্ধকালীন বন্ধু। এদের বিরুদ্ধে এখন কোনো আন্দোলন নয়। এখন যুদ্ধ ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করার জন্য। এ তত্ত্বের ফলে ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি যুদ্ধের সময় ব্রিটিশের সাথে সহযোগিতা করে। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে। সুভাষচন্দ্র বসুকে ফ্যাসিস্টদের দালাল বলে আখ্যা দেয়।

এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তিনটি বৃহৎ শক্তি অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধকালীন মৈত্রী হয়। ১৯৪৩ সালে আবার দু’শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে দাবি করে যে, তৃতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে দিতে হবে। কারণ তৃতীয় আন্তর্জাতিকের নির্দেশে দেশে দেশে কমিউনিস্টরা নাশকতামূলক কাজ চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক চাপে স্ট্যালিনকে রুজভেল্ট ও চার্চিলের প্রস্তাব মেনে নিতে হয়। তৃতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে দেয়া হয়। যদিও প্রকাশ্যে বলা হয় যে, বিশে কমিউনিস্ট আন্দোলন শক্তিশালী হওয়ায় এখন আর আন্তর্জাতিকের প্রয়োজন নেই। দেশে দেশে কমিউনিস্টরা নিজেরাই আন্দোলন করবে। অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের নিজস্ব প্রয়োজনেই চাপে পড়ে আন্তর্জাতিক ভেঙে দিতে হয়।

কিন্তু কমিউনিস্টদের আন্তর্জাতিকের প্রয়োজন কোনোদিন ফুরায় না। সাম্যবাদী বিশ্ব আন্তুর্জাতিক কোনো দেশের গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ নয়। তাই আবার কমিনফর্মের নামে নয়া আন্তর্জাতিক গড়ে তোলা হয় ১৯৪৭ সালে। সদর দফতর স্থাপিত হয় বেলগ্রেডে। এবার বেলগ্রেড থেকেই অভিযোগ ওঠে যে কমিনফর্মের নামে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার মতামত চাপিয়ে দিচ্ছে। ফলে যুগোশ্লাভকে কমিনফর্ম থেকে বহিষ্কার করা হয়। কমিনফর্ম ভেঙে দেয়া হয় ১৯৫৭ সালে। সেই কমিনফর্মের নির্দেশেই কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৫০ সালে জেলখানার আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করে। আন্তর্জাতিকের নামে স্ট্যালিনের নেতৃত্বে দেশে দেশে চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তের এভাবে শিকার হয় কমিউনিস্ট আন্দোলন। এই কমিনফর্ম-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলখানায় আন্দোলন স্তিমিত হলো। কিন্তু বাইরে তখন আন্দোলন নতুন করে গতি পাচ্ছে। লিয়াকত আলীর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন খাজা নাজিমুদ্দীন। গভর্নর জেনারেল হলেন আমলা গোলাম মোহাম্মদ। প্রধানমন্ত্রী হয়ে ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকা আসেন। তিনিও মোহাম্মদ আলী জিন্নার ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন। পল্টন ময়দানে তিনি এক জনসভায় বললেন- উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হলো পূর্ব বাংলায়। ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট আহ্বান করা হয় ২১ ফেব্রুয়ারি। ৩১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরিতে রাজনৈতিক দলসমূহের এক সভা হয়। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন মওলানা ভাসানী। ৪ ফেব্রুয়ারি ১০ হাজার ছাত্র ছাত্রী ঢাকায় মিছিল করে। ২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে পূর্ব বাংলায় সরকারি মহলে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। তখন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নূরুল আমিন। মুখ্য সচিব অর্থাৎ চিফ সেক্রেটারি ছিলেন জাদরেল পাঞ্জাবি আমলা আজিজ আহম্মদ। বলা হতো আজিজ আহম্মদ-ই ছিলেন তখন পূর্ব বাংলার প্রকৃত শাসনকর্তা। সিদ্ধান্ত হয় ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করার। কিন্তু ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বাসভাজন ছিলেন না। ফলে নারায়ণগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক অবাঙালি কোরেশীকে ঢাকায় রাতারাতি বদলি করে আনা হয়। ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি হয়। সেই ১৪৪ ধারা ভেঙে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল করে।

তবে ১৪৪ ধারা ভাঙা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। বলা হয়, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভাঙতে রাজি ছিল না। তারা কোনো বড় ধরনের গোলমালে যেতে রাজি হননি। মুখ্যত ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এ ব্যাপারে কার কী ভূমিকা ছিল তা এখনো অস্পষ্ট। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন অনেকেই ভাষা সৈনিক হবার দাবিদার। এই খেতাব নিয়ে তাঁদের মধ্যে অনেকে এখন সভা সমিতিতে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। তবে এ সম্মান তাঁরা পাবার যোগ্য কিনা সে প্রশ্নের জবাব তাঁদেরই দেবার কথা। তাঁরা নিজের কথা সঠিকভাবে বললে এ অস্পষ্টতা অনেকটা দূর হতো। এ প্রসঙ্গে শুধু একটি কথাই জোর দিয়ে বলা যায়, সেদিন সাধারণ ছাত্ররা বিশেষ করে মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল।

আমি তখন ঢাকা জেলে। প্রায় বছর চারেক হলো বরিশাল জেল থেকে ঢাকা জেলে এসেছি। জেলা শহরে থাকতাম। রাজধানীর খবর তেমন রাখতাম না। পূর্ব বাংলার খবরের কাগজ একমাত্র দৈনিক আজাদ। এ কাগজটিতেও বিরোধী দলের খবর তেমন থাকত না। তাই খবর পাওয়া ছিল খুব কষ্টকর। অপরদিকে ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর বামপন্থী রাজনীতি একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। কে কোথায় আছে তাও দীর্ঘদিন খবর পাইনি। দলের নেতা অনেকেই দেশান্তরী হয়ে গেছেন। এমনকি মোজাম্মেল দা-ও নাকি কলকাতায় চলে গেছেন (মোজাম্মেল হক পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। দৈনিক পাকিস্তান-এর প্রথম বার্তা সম্পাদক–যিনি কায়রোগামী পিআই-এর বিমান দুর্ঘটনায় ১৯৬৫ সালের ২০ মে মারা যান)। আমাদের নেতা অনিল দাশ চৌধুরী, আব্দুল খালেক খান ও ছাত্রনেতা নারায়ণ দাশ শর্মা কোথায় আছেন তাও জানি না। বরিশালের এই তিন নেতা মোজাম্মেল-দাসহ পাকিস্তান সৃষ্টির বছর কয়েকের মধ্যে গ্রেফতার হয়ে যান। আদালত তাদের শাস্তি দেয়। শুনেছিলাম তারা সিলেটে জেলে আছেন। মুক্তি পেয়েছেন কবে তাও জানি না। লোকমুখে শুনেছি ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর মোজাম্মেল দা ও অনিল দা কলকাতায় চলে গেছেন। ভেবেছি হয়তো নারায়ণও চলে গেছে কলকাতায়। জানতাম না খালেক দা কোথায়? খালেক দা-আব্দুল খালেক খান। পরবর্তীকালে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। খালেক দা মারা গেছেন ২০০২ সালে।

সময়টা ছিল অস্বস্তিকর ও অনিশ্চিত। তখন ফাল্গুন মাস। হঠাৎ যেন মনে হলো দক্ষিণের বাতাস এসে সব পুরনো পাতা ঝরিয়ে দিল। ঢাকা জেলের তখন পুরনো হাজতে আছি। তিন দিকে উঁচু উঁচু দেয়াল। বারবার চোখ দেয়ালে ধাক্কা খায়। এককালে ওখানে ২০ জন বন্দি ছিলেন। ৬ মাসের মধ্যে ১৯ জনকে চশমা নিতে হয়েছিল। আমি দক্ষিণ দিকে ঘরে থাকতাম। পাশে উঁচু দেয়াল। সেই দেয়াল ছাড়িয়ে একটি অশ্বথ গাছ। সেই অশথ গাছের পাতা ঝরা ও নতুন নতুন পাতা দেখে বছরের পর বছর ঋতু পরিবর্তন লক্ষ করতাম।

সেই দেয়ালের জগতে ২১ ফেব্রুয়ারি একজন সিপাহি এল। পরনে লুঙ্গি। একটি ব্যাগে তার প্যান্ট ও জামা। সে এসে বলল, দেশ দোজখ হয়ে গেছে। চারিদিকে গুলি আর গুলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি হয়েছে। অসংখ্য ছাত্র মারা গেছে। সে ভয়ে সরকারি জামা-কাপড় পরে জেলে ঢুকতে পারেনি। লুঙ্গি পরে ঢুকেছে।

আমরা চমকালাম। কিভাবে চমকেছিলাম বর্ণনা করা যাবে না। পূর্ববাংলা অর্থাৎ পাকিস্তানে এমন ঘটনা ঘটতে পারে আমরা তা আশা করিনি। সবার মনে ছিল মুক্তি পাবার চিন্তা। এটা জানা ছিল যে, সহজে মুক্তি হচ্ছে না। আমাদের মুক্তির জন্য কেউ আন্দোলনও করবে না। হঠাৎ যেন সবকিছু পাল্টে গেল। সন্ধ্যার দিকে জেলখানায় নতুন কণ্ঠের ধ্বনি শোনা গেল। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সমগ্র জেলখানা মুখরিত। একদল তরুণ ঢাকা জেলে ভরে গিয়েছে। ওরা কিছু মানে না। ওরা কিছু মানতে চায় না। কিন্তু আমাদের কারো সাথে ওদের দেখা হলো না। কারণ রাজনীতির ভাষায় আমরা ‘বি ক্লাস’। অর্থাৎ আমরা দাগী আসামী। আমাদের সাথে ওদের রাখা চলে না। আমাদের সাথে এলে ওরা খারাপ হয়ে যাবে।

কিন্তু আমরা কী করবো? দেশে গুলি হবে। হত্যা হবে। তাতে আমাদের কিছুই করার নেই। জেলে বন্দি আছি বলে কি কিছুই করতে পারব না। সিদ্ধান্ত হলো পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি আমরা ২৪ ঘন্টা অনশন করব। অথচ অনশন করবার মতো স্বাস্থ্য কারও ছিল না। ২২ ফেব্রুয়ারি ভোরে এক সিপাহি লুকিয়ে একটি আজাদ পত্রিকা দিয়ে গেল। পত্রিকাটিতে বড় করে আছে আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিনের পদত্যাগের খবর। খবর আছে খয়রাত হোসেন ও আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ-এর। ভেতরে খবর আছে মিছিল, গুলি আর আন্দোলনের।

আমরা সবাই উজ্জীবিত। কিন্তু শরীর বড্ড দুর্বল। ২৪ ঘণ্টার অনশনও যেন শেষ করা যাচ্ছিল না। রাত ১২টায় আমার জন্য চিকিৎসক এলেন। বললেন–কোনো কিছু না খেলে অঘটন ঘটে যেতে পারে। আমি বছরখানেক ধরে স্বাভাবিক খাবার খেতে পারছিলাম না। দীর্ঘদিন অনশনে শরীর ভেঙে গিয়েছিল। বছর দুয়েক ধরে দুবেলা বার্লি খেতাম। অন্য কিছু সহ্য হতো না। বন্ধুরা বললেন, কিছু খেতে হবে। আমি বললাম–শুধুমাত্র ধনে ভিজানো জল পেলেই হবে। ঐ জল খেলেই বমি বমি ভাব কেটে যাবে–আমি ঘুমিয়ে যাব। তারপর ২৩ ফেব্রুয়ারির ভোর এল। আমার আর উঠবার শক্তি ছিল না। সারা জেলখানায় তখন তারুণ্যের কলরব আর কোলাহল। জেলখানায় ২১ ফেব্রুয়ারি এল নতুন বাতাসের মতো। ১৯৪৮ সালে জেলে এসেছিলাম। ১৯৫০ সালে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল। সেই দাঙ্গার পর আন্দোলনের প্রত্যাশা দিনের পর দিন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছিল। সে আবহাওয়া একেবারে পাল্টে দিল ২১ ফেব্রুয়ারি। মনের জগতে নতুন হাওয়া। নতুন উদ্দীপনা। তবে দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে অনেক দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল।

বরিশালে গ্রেফতার হয়েছিলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী দেবেন ঘোষ। তাঁর সাথে গ্রেফতার হয়েছিলেন তার বড় ভাইয়ের ছেলে দেবকুমার ঘোষ, যিনি মনা ঘোষ নামেই বিশেষ পরিচিত। গ্রেফতার হয়েছিলেন বরিশালের বাণীপীঠ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রেমাংশু সেনগুপ্ত।

দেবেনদা অর্থাৎ দেবেন ঘোষ এবং মনাদার সাথে আমার সম্পর্ক কলেজ জীবন থেকে। এরা দুজনেই এককালে অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁরা আরএসপি গঠন করেন। দেশ ভাগ হবার পূর্ব মুহূর্তে জয়প্রকাশের নেতৃত্বে সোস্যালিস্ট পার্টিতে তারা যোগ দেন।

আমি কলেজ জীবনে আরএসপি’র সংস্পর্শে আসি। দীর্ঘদিন বরিশালে দেবেন দা-দের বাসায় থেকেছি। আমি মোজাম্মেল দা-সহ (মোজাম্মেল হক) অনেকেই দেবেন দা-দের বরিশালের কাউনিয়ার বাসায় ছিলাম। বাসাটি ছিল রাজনীতিকদের হোটেল। কে কখন আসত, কে কখন খেত, কে কখন ঘুমাত তার কোনো হিসাব ছিল না। দেবেনদার বৌদি অর্থাৎ মনাদার মা সব কিছু দেখাশোনা করতেন। বরিশালের ঐ একটিমাত্র বাসায় কোনো জাত-পাতের বিচার ছিল না।

মনাদা ছিলেন সাদাসিদে। ঘোরপ্যাঁচ বুঝতেন না। তত্ত্বের বেশি ধার ধারতেন না। মেঝ কাকা অর্থাৎ দেবেন ঘোষ যা বলবেন তাই শিরোধার্য। তবে এই সাদাসিদে মানুষটির আর একটি রূপ ছিল। অস্ত্র চালনায় তিনি ছিলেন দক্ষ। অনুশীলন সমিতি গড়ে উঠেছিল কতগুলো ক্লাবকে কেন্দ্র করে। দৈহিক কসরত থেকে শুরু করে লাঠি খেলা, ছোরা খেলা সবকিছুর প্রশিক্ষণ দেয়া হতো এই ক্লাবে। এই কাউনিয়া ক্লাব থেকে এককালে মনাদাকে পাঠানো হয়েছিল বিহারে সদাকৎ আশ্রমে। এই আশ্রমে মনাদা অস্ত্রচালনা শিক্ষা দিতেন। ব্রিটিশ আমলে মনাদা ও দেবেন দা দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন। দেবেন দা অভিযুক্ত হয়েছিলেন বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলায়। অনেকে বলেন, দেবেন দা’র পরিবার বরিশালের নাজিরপুরের উত্তরে বিস্তীর্ণ এলাকার জমির মালিক ছিলেন। বরিশালে তাদের দুটি কাটা কাপড়ের দোকান ছিল। একটির পর একটি মামলা মোকাবেলা করতে গিয়ে তাদের সবকিছু বিক্রি করতে হয়েছে। গল্পের মতো প্রচারিত আছে, বরিশাল সদর হাসপাতালের অনেকগুলো পেইং ওয়ার্ড যাদের নামে প্রতিষ্ঠিত সেই দাতারা টাকা রোজগার করেছিলেন দেবেন দা-দের বিরুদ্ধে আইনজীবী হিসেবে ব্রিটিশ পক্ষের উকিল হয়ে। শেষ জীবনে তাঁদের অনুতাপ হয়। তাই ঐ মামলায় আয় করা টাকা তারা হাসপাতালে দান করেন।

দেবেন দা’র সাথে দেখা হয় আমার ১৯৪৬ সালে। তিনি তখন ৬ বছর পর জেল থেকে এসেছেন। ১৯৩০ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত একটানা ৮ বছর জেলে ছিলেন। আবার গ্রেফতার হয়ে যান ১৯৪০ সালে। দেবেন দা তখন সর্বজনশ্রদ্ধেয়। আরএসপি’র নেতা। আমাদেরও নেতা। কিন্তু দেবেন দা-দের সাথে আমার মতানৈক্য শুরু হলো কিছুদিন পরেই। অগ্নিযুগের প্রবীণ বিপ্লবীদের অনেকে ভাবলেন-ভারতবর্ষে সমাজতন্ত্র করতে হলে বড় দল করতে হবে। আরএসপির নেতৃত্বে সারা ভারতবর্ষে বিপ্লব সম্ভব নয়। তখন সমাজতন্ত্রী নেতা হিসাবে জয়প্রকাশ নারায়ণ, অশোক মেহতা, নরেন্দ্র দেও, অরুণা আসফ আলী, রাম মনোহর লোহিয়া সারা ভারতে পরিচিত। তাঁরা আবার গান্ধীর আশীর্বাদপুষ্ট। আমাদের অনেক নেতা মনে করলেন, এঁদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হলে ভারতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ত্বরান্বিত হবে। আমাদের নেতারা বললেন ভিন্ন কথা। তারা বলেন-জয়প্রকাশ এবং তাঁদের দল প্রকৃতপক্ষে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। এরা সোস্যাল ডেমোক্রাট। এরা ভোটের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র চায়, এরা বিপ্লব করবে না। এবং গান্ধীজীর প্রভাবের বাইরে তারা যেতেও পারবে না। অর্থাৎ আরএসপি’র তরুণ নেতৃত্ব দেবেন দা-দের সাথে একমত হলেন না। মনা দা, দেবেন দা চলে গেলেন আরএসপি থেকে।

১৯৫০ সালে দাঙ্গার পর দেবেন দা ও মনা দা গ্রেফতার হলেন। তাঁদের বরিশাল থেকে ঢাকা জেলে আনা হলো। তাদের পাঠানো হলো আমাদের ওয়ার্ডে। আমি চমকে গেলাম। মনে হলো কোন দেশে জন্মেছি! পাকিস্তান সরকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গ্রেফতার করেছেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী দেবেন ঘোষ ও মনা ঘোষকে। এ কোন রাজনীতি? এ কোন পুরস্কার? সারাজীবন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে বৃদ্ধ দেবেন ঘোষ গ্রেফতার হলেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দায়ে। বরিশালের একটি মাত্র বাসায় কোনো সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। অথচ পাকিস্তান সরকার সেই বাসাটিকেই আক্রমণ করলো দাঙ্গার দায়ে। একশ্রেণির বন্ধুরা বললেন–এটাই তো হবার কথা। তাদের কথা হচ্ছে, দেবেন দা, মনা দা’র ভারতে চলে যাওয়া উচিত ছিল। সেখানে তারা অগ্নিযুগের বিপ্লবী হিসেবে সমাদর পেতেন। সাহায্য পেতেন। পাকিস্তানে তাদের ভিক্ষুকের মতো জীবনযাপন করতে হতো না।

কিন্তু শত দুঃখেও দেবেন দা মাতৃভূমি ছাড়েননি। ১৯৫৪ সালে তিনি পূর্ববাংলা আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বয়স একশ’ ছাড়িয়েছে। চোখে তেমন দেখেন না। কানে শোনেন না বললেই চলে। বরিশালের কাউনিয়ার বাসায় থাকেন। চেষ্টা করেন যতদূর সম্ভব অন্যের উপকার কতে। মনা দা মারা গেছেন দেশ স্বাধীন হবার পর। দীর্ঘদিন বহুমূত্রে ভুগছিলেন। চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বড্ড ইচ্ছে ছিল চোখের চিকিৎসার। ইচ্ছে ছিল নতুন করে পৃথিবী দেখার। আমার কাছে বার বার চিঠি আসত। অন্যের হাতের লেখায় আর মনা দা’র জবাবে। তিনি লিখতেন-নির্মল, তুমি আমাকে বিদেশে পাঠাতে পার না, আমার চোখের একটা চিকিৎসা করাতে? আমার পক্ষে কোনো কিছুই সম্ভব হয়নি। মনা দা পরিবার নিয়ে এক দুর্বিসহ জীবনযাপন করতেন। বাণীপীঠ স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রেমাংশু সেনগুপ্তের কোনো খোঁজ পাইনি। তিনি ঢাকা জেলে আমাদের ওয়ার্ডে দীর্ঘদিন ছিলেন। প্রচণ্ডভাবে ভগবানে বিশ্বাস করতেন। প্রতিদিন আমার সাথে তর্ক হতো। বড্ড দুঃখ পেতেন আমি ভগবান বিশ্বাস করি না বলে। বেদ-উপনিষদ থেকে অনেক যুক্তির অবতারণা করতেন। আমি বলতাম-ভগবান আমার সৃষ্টিকর্তা হলে ভগবানের সৃষ্টিকর্তা কে? এ প্রশ্নের জবাব কোথায়? আমি যা দেখি না তার আমি বিশ্বাস করি না।

প্রেমাংশু বাবু বলতেন, তুমি লন্ডন দেখেছ? আমি বলতাম, না। তিনি বলতেন তাহলে লন্ডন আছে বিশ্বাস কর কী করে? আমি বলতাম, পরোক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। এবার তিনি পাল্টা প্রশ্ন করতেন। বলতেন, যারা ভগবানের সান্নিধ্যে গিয়েছে তাহলে তুমি তাদের অভিজ্ঞতা মানবে না কেন? আমি বলতাম–সান্নিধ্যে যাবার কোনো প্রমাণ নেই। এরপর আর কথা জমতো না।

জেলখানা থেকে মুক্তি পাবার পর ১৯৫৩ সালে বরিশালে গিয়েছিলাম। কালীবাড়ি রোডে খুঁজতে গিয়েছিলাম বাণীপীঠ স্কুল ও প্রেমাংশু বাবুকে। কালিবাড়ি রোডের বিএম স্কুলের পশ্চিমে গিয়ে ডানে দেখলাম বাণীপীঠ স্কুলের চিহ্নমাত্র নেই। বাণীপীঠ স্কুলের ভিটিতে ধান চাষ হচ্ছে। ধানের ডগা লক লক করছে। এরপর প্রেমাংশু বাবুর খোঁজ করার মানসিক অবস্থা আমার ছিল না। বাণীপীঠ স্কুলের ভিটিতে এখন পরিবার পরিকল্পনার বিরাট দালান। এখন কে রাখে সে খবর!

১৯৫২ সাল। দেখতে দেখতে ৪ বছর কেটে গেল জেলখানায়। ১৯৪৮ সালের আগস্টে গ্রেফতার হয়েছিলাম বরিশালে। বরিশাল জেল থেকে ঢাকা এসেছিলাম অক্টোবরে। তারপর অনেক ঘটনা ঘটল। জেলখানায় দিনের পর দিন অনশন হলো। ১৯৪৯ সালে ভারত হায়দারাবাদ অভিযান চালাল। এ অভিযানকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানে গ্রেফতার হলো হাজার হাজার লোক।

ঢাকা জেল ভরতে থাকল। মাদ্রাজের এক তরুণকে গ্রেফতার করে আনা : হলো ঢাকা জেলে। সে নাকি ভারতের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী জনমাথাইর আত্মীয়। তবে তাকে প্রকৃতিস্থ মনে হতো না। মাঝে মাঝে অদ্ভুত চিঠি লিখত। চিঠির ঠিকানা লেখা থাকত–to god, P.O HEAVEN, Dominian HEAVEN…। এ সময় এক হিন্দিভাষী ভারতীয়কে ধরে আনা হয়েছিল। ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান। সে নাকি ভারতের চর। সে মাঝে মাঝে মাছি ধরে ধরে খেত। এরা বাইরে থাকলে ভারত নাকি পাকিস্তানকে দখল করে নেবে।

এই চার বছরে অনেকের সাথে দেখা হয়েছে জেলে। চট্টগ্রামের অমল সেন, আব্দুস সাত্তার, অনঙ্গ সেন, হাসি দত্ত, কালীপদ চক্রবর্তী। কুমিল্লার চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত, ইয়াকুব মিঞা, এবাদত উল্লাহ, ফরিদ খান, কান্তি সেন, সত্য ঘোষাল, অমূল্যকাঞ্চন দত্ত রায়, নরেশ চক্রবর্তী। ময়মনসিংহের আলী নেওয়াজ খান, সিরাজুল ইসলাম, সুধীন দত্ত রায়, প্রফুল্ল সেন, সতীশ সাহা, মাধব সান্যাল, আলতাফ আলী, জমির আলী, হাসি বসু, অজয় রায়। ঢাকার ধরনী রায়, রণেশ দাশগুপ্ত, শৈলেন রায়, তকিউল্লাহ, নাসির, মুনির চৌধুরী, নাদেরা বেগম, ইরা চৌধুরী, বিনয় বসু, আব্দুর রহমান মাস্টার, জিতেন ঘোষ, সিরাজুল হক। বরিশালের নরেন্দ্রনাথ রায়, নুটু ব্যানার্জি, অবনী সরকার, কাশী ব্যানার্জি, অজিত বসু, প্রশান্ত দাশগুপ্ত। এ ধরনের বিভিন্ন দলের বিভিন্ন জনের সাথে ঢাকা জেলে দেখা হয়েছে। কখনো একসাথে থেকেছি। কখনো ভিন্নভাবে থেকেছি। এছাড়াও থেকেছি ফরিদপুরের সমরেন্দ্র নাথ সিংহ ও প্রফুল্ল রায়, মুন্সিগঞ্জের শফিউদ্দিন আহমদ ও খুলনার আনোয়ার হোসেনের সাথে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *