সুখ অসুখ

সুখ অসুখ

সেদিন টিফিনের ঘণ্টা শেষ হলেও আমরা আর ক্লাসে যাইনি। হাসু বলল, ‘লোটাসের নানা মারা গেছে, ওরা সব ওখানে। চল, ওদের গাছে ডালিম পেকে ফাটি ফাটি, খেয়ে আসি। আমি চললাম ওর পিছু পিছু। লোটাস আমাদের খুব কাছের বন্ধু। যাবার পথে অলিলকে সাথে নিলাম। সর্দিজ্বর হওয়ার কারণে আজ ও স্কুলে আসেনি। বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে প্রাচীর টপকে লোটাসদের বাড়িতে প্রবেশ করলাম। শরীর ভারী হলেও হাসু প্রাচীর টপকানোতে ওস্তাদ। অলিল লম্বা তাই ওর খুব একটা সমস্যা হলো না। প্রাচীরের হাইট মিডিয়াম, কিন্তু আমার হাইটে ঘাটতি থাকার কারণে বেশ কয়েকবার লাফিয়েও প্রাচীরের প্রান্ত হাতের নাগালে পেলাম না। বরাবরের মতো হাসু আমাকে টেনে ওঠাল। ভেতরে গিয়ে দেখি বাড়ির সদর দরজা আলগা। যা বাবা, এত কষ্ট করে প্রাচীর টপকালাম কী জন্যে!’ অলিল বলল। বাড়িতে বোধ হয় কেউ আছে, চল কেটে পড়ি। হাসুকে উদ্দেশ্য করে বললাম আমি। এসেছি যখন, একটা ডালিম না ছিঁড়ে যাচ্ছি না! আমাদের মধ্য থেকে হাসু এগিয়ে গেল উঠানের উত্তর দিকে দাঁড়িয়ে থাকা ডালিম গাছটিকে তাক করে। ভেতর থেকে দরজা খোলার শব্দ, হাসু তখন উঠানের মাঝখানে, আমি আর অলিল কলের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গা ঢাকা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছি। আরে তোরা, কখন আসলি? যাক, বাঁচলাম!’- অলিল ফিসফিস করে বলল। আমরা লোটাসের দিকে এগিয়ে গেলাম। শুনলাম, তোর নাকি নানা মারা গেছে, তাই…! তাই তোকে দেখতে আসলাম।’ হাসু আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল। ভালো করেছিস। মারা যায়নি, স্ট্রোক করেছে।’ শ্যালা হাবু, এত বড় ভুল সংবাদ দিয়েছিস! আজ তোর রক্ষা নেই!’ হাসু ফিসফিস করে বলল। আমরা বিকেল পর্যন্ত লোটাসদের বাড়িতে ছিলাম। লোটাস ওদের ফ্রিজ থেকে আয়েশ করে খাচ্ছিলাম। ডালিম খাওয়ার কথা কি আর তখন মনে থাকে! গ্রামে এই একটাই দোতলা বাড়ি। তাই সুযোগ পেলেই আমরা ছাদে উঠে আশপাশের বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটি। সেদিন আরও একটা কাজ আমরা করেছিলাম। লোটাসের বাড়ির পেছন দিকে ছিল মিলাদের বাড়ি। মিলা তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে আমাদের দু’ক্লাস নিচে। তবে ঘটনার পাত্রী মিলা না, মিলার ভাবি। ডুমুরগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে লোটাসদের বাড়ির দিকে মুখ করে ভেজা শাড়ি পাল্টাচ্ছিল মিলার ভাবি। সেদিনই আমরা প্রথম উদোম মেয়ে মানুষ দেখেছিলাম। সে এক অন্যরকম অনুভূতি!

 তারপর আমরা যা করলাম, হাসুই বলল প্রথম, ‘আমি জানি এখন আমাদের কী করা উচিৎ। আমাদের চোখে-মুখে রাজ্যের বিস্ময়। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি দু’একবার করেছি। শুনেছি, বড়রা তো প্রতিদিনই করে। আমরা চারজন ছাদে একসঙ্গে বসে মাস্টারবেট করেছিলাম। সে এক অন্যরকম অনুভূতি!

বিকেলে আমরা আর খেলতে গেলাম না। পশ্চিমের মাঠে একটা বিল ছিল। যখন আমরা কোনো বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা আঁটতাম, তখন ওই বিলের ধারে চলে যেতাম। মাঝেমধ্যে চাম-গুলতি নিয়ে পাখি মারতে, কিংবা ছিপ-বঁড়শি নিয়ে মাছ ধরতেও গেছি। তবে আমরা কোনো দিনই পাখি কিংবা মাছ কোনোটাই ধরতে পারিনি। একবার নোটাসের গুলতি একটা বকের লেজে লেগেছিল, শেষ পর্যন্ত ওইটাই ছিল আমাদের সম্মিলিত সর্বোচ্চ সাফল্য। আর একবার আমরা একটা পানির সাপ মেরেছিলাম এপিটিয়ে। তবে সাপের রেসপন্স দেখে মনে হয়েছিল, হয় সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল, আমাদের প্রথম আঘাতটা এত জোরে ছিল যে ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই সে মারা গিয়েছিল, নচেৎ আমাদের আগেই কেউ সাপটাকে মেরে রেখে গিয়েছিল। সেদিন বিকেলে আমরা কোনো পাখি কিংবা মাছ মারতে যাইনি। নতুন কোনো পরিকল্পনাও ছিল না মাথায়। আমরা কিছুক্ষণ আগে যে ঘটনাটা ঘটিয়েছি সেটা নিয়েও কেউ কথা বলতে চাইছিলাম না। কোনো কথা না বলেই আমরা বিলের ধারে হাঁটাহাঁটি করে যে যার বাড়ি চলে এসেছিলাম।

 তার পর থেকে ছাদে ওঠা আমাদের নেশায় ধরে গেল, টিফিন পালানোটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়াল।

.

খ.

বাড়ি বলতে আমাদের যা ছিল তা হলো চৌচালা টিনের ঘর। দুইখানা ঘর আর লম্বা একটি বারান্দা। একটি ঘরে মা-বাবা আর ছোট বোন কুমকুম থাকত। আর অন্য ঘরে আমি আর আমার বড় দু’ভাই থাকতাম। এক কোণায় আটি বাঁধা থাকত গরু-ছাগলের জন্য কেটে আনা ঘাস। ঘুমের ঘোরে আমি মাঝেমধ্যে সবুজের গন্ধ পেতাম। শ্যামা ঘাসের গন্ধ ছাড়া ঘুম হতো না কিছুতেই। বাবা ছিলেন গরুর ব্যাপারি। বড় দুই ভাই মাঠে কাজ করত। উঠানের এক কোণে ছিল গরুর নাদা বসানো, অন্য দিকে ছিল গোয়ালঘর। নাদার চারপাশজুড়ে কাদা আর গোবরে খ্যাঁতখ্যাঁত করত। উঠোনের মাঝখানের এক ঢিবিতে বসে রান্না করত মা। ওখানে বসেই আমরা খেতাম। মাঝেমধ্যে গরুর চুনা এসে ছিটকে পড়ত খাবারে। একবার আমাদের একটি গাভি বাছুর প্রসব করতে গিয়ে মারা যায়; তারপর মা সেই বাছুরটিকে মাতৃস্নেহে বড় করে তোলে। তার নাম রাখা হয়েছিল কুমকুম। মা কুমকুম বলে ডাক দিলে উত্তর নিত সে। আমার ছোটবোন কুমকুমের জন্মের সময় মাকে অপারেশন করতে হয়, সেই টাকা জোগাড়ের জন্য বাবা বাধ্য হন কুমকুমকে বিক্রি করে দিতে। বাবা-মা তাদের নতুন সন্তানের নাম রাখেন কুমকুম। মা প্রায়ই বলতেন, “আল্লাহ আমার এক মেয়ি নি আরেক মেয়ি দি’ছে। অভাবের সংসার হলেও বাবা আমাকে কোনো কাজ করতে দিত না। এর অন্যতম কারণ ছিল আমাকে দিয়ে কোনো কাজ হতো না। বাবা স্বপ্ন দেখত, আমি লেখাপড়া শিখে ডাক্তার হয়ে গ্রামে ফিরছি। আর প্রতিবারই আমার পরীক্ষার ফল শুনে হতাশ হত। ‘আমি রক্ত দেখতে খুব ভয় পাই, মানুষের পেট-বুক কাটব কী করে? একদিন ভাত খেতে খেতে মাকে বললাম। বাবার স্বপ্নের বিষয়বস্তু পরিবর্তন করাটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। মা জানাল, বাবা চায় আমি পশুর ডাক্তার হই; মানুষের ডাক্তারের তো অভাব নেই। লোটাস, হাসু আর অলিলকে এই কথা বলার পর থেকে ওরা আমাকে দেখা মাত্রই ‘হাম্বা’ বলে ডাকত। আমি ক্ষ্যাপতাম না বলে অবশ্য ওদের এই মজাটা বেশি দিন টেকসই হয়নি।

দক্ষিণ পাড়াতে ছিল হাসুদের বাড়ি। যতদূর জানি, হাসুর মা মারা গেছে যখন ও খুব ছোট ছিল। তারপর হাসুর ছোট খালাকে ওর বাবা আবার বিয়ে করেছে। বিয়ের পরপরই হাসুর বাবা নাকি বলে বেড়াত, ‘বিয়ে-টিয়ে আর করবার ইচ্ছা ছিল না, হাসুর কথা ভেবেই ওর খালাকে ঘরে তুললাম। লোকমুখে এ কথাও শুনেছি হাসুর বাবার সাথে ওর ছোট খালার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। হাসুর মা সে কথা জেনে ফেলায় হাসুর বাবা তাকে বালিশচাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে। যখন মারে তখন হাসু নাকি তার মার বুকের দুধ খাচ্ছিল। আহা, বেচারা! হাসুর বাবা মেম্বার, বেশ কিছু জমিজমা আছে। হাসুর নামেও আছে এক বিঘা, ওর মা মারা গেলে নানা ভবিষ্যতের কথা ভেবে ওর নামে লিখে দিয়েছে। হাসুর ছোট এক ভাই ও বোন আছে। অবশ্য সৎ ভাই-বোন। সংসারে হাসুর কোনো কদর ছিল না। কদর যা ছিল তা ওই জমিটার। ও যতটা সম্ভব বাড়ির বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াত।

অলিলের বাড়ি গ্রামের উত্তর পাড়ায়। ওর বাবা মসজিদের ইমাম আর একটা মাদ্রাসায় আরবি পড়ায়। বাড়িতে ওদের সাথে ওর এক বিধবা ফুপু থাকেন। ওদের বাড়িতে আমি খুব বেশি যাইনি। ও খুব কম কথা বলে। খালি কী যেন ভাবে! ভাবতেই থাকে। মাঝেমধ্যে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা বলে, শুনতে খুব ভালো লাগে, যদিও তার কিছুই বুঝি না আমি। পরে জানতে পেরেছিলাম, ওগুলো সব কবিতা- কিছু ওর লেখা, কিছু অন্যদের।

আর লোটাসের বাড়ি ছিল আমাদের পাড়াতেই। কথাটা এভাবে না বলে যদি বলি লোটাসের পাড়াতেই আমাদের বাড়ি ছিল, তাহলেই ভালো শোনাবে। ওর বাবা ছোটখাটো একটা জমিদার বললে ভুল বলা হবে না। ওরা এক ভাই, এক বোন। বিশাল বাড়ি, কাজের লোকে ভরা। আমাদের যখন খুব অভাব ছিল, তখন নাকি মা ওদের বাড়িতে কাজ করেছে। কাজ করেছে বলতে কাঁথা সেলাই করে দিয়েছে, পাটি বুনে দিয়েছে, কুমড়োর বড়ি দিয়ে দিয়েছে, ধান সিদ্ধ করে দিয়েছে এই সব। ছোটবেলায় আমি লোটাসের ব্যবহার করা পোশাক অনেক পরেছি। লেখাপড়াতেও ও খুব ভালো। ছবিও আঁকত বেশ। আরও অনেক কিছু পারে ও। আমাদের মধ্যে ওই ছিল সবচেয়ে সুখী। অনেক সুখী।

.

গ.

দেখতে দেখতে আমাদের মেট্রিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। দেশের অবস্থা তখন ভালো না। ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান চলছে। আমরা একটু একটু করে দেশ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি। এসব ব্যাপারে হাসু আর লোটাসই বেশি কথা বলত। আমি খালি শুনতাম। আর বরাবরের মতো অলিল কী যেন একটা ভাবনায় ডুবে থাকত। কবিতার নেশা ওকে আরও পেয়ে বসেছিল। মেট্রিক পরীক্ষা শেষ করে লোটাস চলে গেল আমেরিকায়, মামার কাছে। যেকোন সময় যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে ভেবে ওর বাবা ওকে দেশে আর রাখল না। হাসু চলে গেল ঢাকায়, মামার বাড়ি। অলিলের মামার বাড়ি পাশের গায়ে, আমার এ গাঁয়েই। কাজেই আমরা পড়ে রইলাম। শহরের কলেজে ভর্তি হলাম। লোটাস আর হাসু চলে যাওয়ার পর আমার আর অলিলের মাঝে আর দেখা হতো না বললেই চলে। সবাই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি গেলাম অলিলের কাছে। ও তেমন কিছুই বলল না। আমিও কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। যুদ্ধ শুরু হলে বাবা মা, কুমকুম ও আমাকে ভারতের শরণার্থী শিবিরে রেখে গেলেন। আমাকে আলাদা করে বললেন, ‘জানি নে আমাদের কী হবে, আর দেখা হবে কি না! ওদের দায়িত্ব এখন তোর হাতে। আমি আর কিছুই বলিনি। শরণার্থী শিবির থেকেই যুদ্ধের খোঁজখবর নিতাম। হাসু আর অলিল কোথায়, কী করছে, কিছুই জানি না।

দেশ স্বাধীন হলো। আমরা ফিরে এলাম। বাবার খবর কেউ দিতে পারল না। বড় দুই ভাই যুদ্ধে মারা গেছে। মেজো ভাই নাকি গ্রামের মৌলানার প্ররোচনায় রাজাকারদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। এর বেশি জানতে পারিনি। আমি পড়াশোনা ছেড়ে শহরের পোস্ট অফিসে চাকরি নিলাম।

.

ঘ.

পোস্ট অফিসে একদিন অলিলের সাথে দেখা। প্রথমটাই ওকে চিনতে পারিনি। মুখভর্তি দাড়ি। লম্বা পাঞ্জাবি। কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ। অলিলের মুখে শুনলাম, হাসু যুদ্ধে বীরের মতো লড়াই করে প্রাণ দিয়েছে। আর ও অল্পের জন্যে বেঁচে এসেছে, গুলিটা বাম পায়ে লেগেছিল। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম। অনেকক্ষণ। বাবা, ভাইদের মৃত্যুসংবাদ শুনেও এতটা কাঁদিনি। কারণ হয়ত, ওটার জন্যে আস্তে আস্তে নিজেকে প্রস্তুত করে তুলেছিলাম। হাসুর মৃত্যু আমি মেনে নিতে পারিনি। এখনো। অলিল হনহন করে চলে গেল। বলল, আবার আসবে। তার পর থেকে মাঝেমধ্যেই আসত। ও তখন ফুলটাইম কবি। পেপারে ওর কবিতা আসত। আমি কবিতা বুঝি না, ওর নামটার ওপর বেশ কয়েকবার চোখ বুলিয়ে রেখে দিতাম। পিয়নকে দেখিয়ে গর্ব করতাম। অলিল তখন একাই থাকত। শরণার্থী শিবিরেই মারা যায় তার বাবা আর ফুফু। আমরা সময় পেলে সেই বিলের ধারে চলে যেতাম। দু’জন পাশাপাশি হাঁটতাম; খুব কম কথা হতো আমাদের। যুদ্ধ অনেক কিছুই পাল্টে দিয়েছিল।

একদিন এক ঘন বর্ষায় আমি আর অলিল ছিপ হাতে বেরিয়ে পড়লাম উদ্দেশ্য, মাছ ধরার বৃথা চেষ্টায় কাটিয়ে দেব সারাটা বেলা। বছরের অন্যান্য সময় বিলে পানি না থাকলেও এই সময় বেশ খানিকটা পানি এদিক ওদিক থেকে জমা হয়ে একটা ছোটখাটো নদীর আকার ধারণ করে। এবারেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ছিপ ফেলে আমরা বসেছিলাম। বৃষ্টি পড়ছিল হালকা বাতাসে ধুলোবালি উড়বার মতো করে, আস্তে আস্তে আমাদের মাথাটা ভিজে উঠছিল। বর্ষা নিয়ে একটি কবিতা আবৃত্তি করল অলিল। বোধ হয় খুব ভালো কবিতা। তুই লিখেছিস? আমি জানতে চাইলাম। হুম, না। রবীন্দ্রনাথ। অলিল, তুই কবিতা লিখে সুখ পাস? ‘পাই বৈকি। কবিতাই তো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আচ্ছা, সুখ পেতে হলে কি মানুষকে কিছু করতেই হয়? কোনো কারণ ছাড়া বেঁচে থাকতে ভালো লাগবার কথা না, তাই না?–আমি প্রশ্ন করলাম। সুখ পেতে কোনো কারণ লাগে না। লাগে বিশ্বাস! তাহলে কি আমিও সুখী হতে পারব? আমার কথায় হো হো করে হাসতে হাসতে ও বলল, “হ্যাঁ, পারবি যদি ওই ধুমড়ি বউকে ছেড়ে আমার মতো একা হতে পারিস। সাথে তোর আল্লাহকেও ছাড়তে হবে। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না, অলিল মজা করছে নাকি সত্যি সত্যিই বলছে। আল্লাহ তোর না? তুই কি তাঁকে ছাড়তে পেরেছিস?’–ঐ প্রথমবারের মতো আমরা যে যার বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম।

কবেই। বুঝতে শেখার পর থেকে ওই যুদ্ধটাই তো করে আসছিলাম। আমি এখন মুক্তিযোদ্ধা। অলিলের কথাগুলো আমার ভালো লাগছিল না। মনে হলো ভয়ংকর কিছু একটা এসে আমাকে আঘাত করছে। আমার রূপ পরিবর্তন করে দিতে চাইছে। যে বিশ্বাসটা আমি মা-বাবার রক্ত থেকে সঞ্চয় করেছি, তাকে আমি যুক্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাই না। আমি চাইছিলাম অন্য বিষয়ে আমরা কথা বলি। অলিল বলেই চলে, জানিস, আমি খুব করে ভাবতাম। বাবা যখন সুরা পড়তেন, আমার মনে হতো ওগুলো কবিতা। চমৎকার চমৎকার সব কবিতা। কবিতা বিশ্বাস হতে পারে না। আমিও মানতে পারছিলাম না তিনি নেই। বেরিয়ে পড়লাম সন্ধানে, খুব করে খুঁজলাম- গাছের ডালে ডালে, পাখির চোখে চোখে, প্রতিটা বৃষ্টি ফোঁটায়, প্রতি ধূলিকণায়, প্রতি আলোকচ্ছটায়। তন্ন তন্ন করে হাতড়ালাম নিজের ভেতরেও। কোথাও পেলাম না। তবুও তার না থাকাটাকে আমি মানতে পারছিলাম না। তিনি না থাকলে যে আমার কবিতা গন্তব্য খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে লীন হয়ে যাবে শূন্যে। তাঁকে যে আমার বড় দরকার! যুদ্ধের মাঝেও আমি অনেক খুঁজেছি। অস্ত্র হাতে যখন সবাই ধেয়ে যেত পাক হানাদারদের দিকে। পশুর মতো তেড়ে আসত ওরা। আমি গুলি মারতাম শূন্যে। বিশ্বাস কর এই দেশ স্বাধীন হওয়াতে আমার বিন্দুমাত্র অবদান নেই। আমার যুদ্ধ তখন অন্যখানে। একদিন এক গ্রামে ঢুকে দেখি- গ্রামের নারী, শিশু, বৃদ্ধ সকলকে…! একটি শিশুর দেহ ঝুলছে বাঁশগাছে। বকুলগাছে ঝুলছে একটি মেয়ে- শরীরের বস্ত্র নিয়ে টানাটানি করছে কয়েকটি কুকুর।

আমাদের যোদ্ধারা সেদিন মাতালের মতো টলতে টলতে উড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের মস্ত একটা ক্যাম্প। ওরা কেউ বাঁচতে পারেনি। সেদিন রাতে আমি প্রচণ্ড জ্বরে থর থর করে কাঁপছিলাম। স্বপ্নে দেখছিলাম- একটা কুকুর এসে আমার পা ধরে টানাটানি করছে, কিছুক্ষণ পর কুকুরটার পা ধরে টানছি আমি। একটু পরে দুটো কুকুর একটা ছিন্নভিন্ন অণ্ডকোষ নিয়ে মারামারি করছে। অণ্ডকোষটা আমার, কুকুর দুটোর একটি আমি। তার পর থেকে রাতে ঘুমানোর সাহস পেতাম না। মহাকাশের প্রতিটা গ্রহ-নক্ষত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজতাম সৃষ্টিকর্তাকে। একদিন গভীর এক অন্ধকার থেকে উদয় ঘটল তার। দেশ তখন স্বাধীন হবার পথে। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম তাকে। হাত ঢুকিয়ে দিলাম ভেতরে। গভীর থেকে গভীরে। সব শূন্য, বাকওয়াস!”

 আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর কথাগুলোর মাথামুণ্ডু কিছুই উদ্ধার করতে পারলাম না। অবশ্য না বুঝতে পেরেই আমার ভালো হয়েছিল।

 সেদিন আমরা অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। আমি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার জন্যে এটা-ওটা নিয়ে পাগলের মতো বকে যাচ্ছিলাম। অলিল একটা কথাও বলেনি।

.

ঙ.

আমার দুই সন্তান, আরও একটা পৃথিবীর পথে। অলিল একটা বেসরকারি কলেজে বাংলা পড়ায়। বিয়ের কথা বললে বলত, কবিতা-টবিতা নিয়ে এই তো বেশ আছি, আবার ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কী বল! বিয়ে করা যে একপ্রকার ঝামেলাই, সেটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। তাই আর ওকে বেশি জোরাজুরি করতাম না। আমার বেতনের তুলনায় সংসারটা বেশ বড়। তার ওপর আমার বউ একাই দু’তিনটা মানুষের সমান। দিন দিন যেন বর্ষার নদীর মতো ওর পেট ফুলে ফেঁপে উঠছে। একদিন এ কথায় সে কথায় বরকত আমাকে লোটাসের কথা বলল। ওর মুখ থেকেই জানতে পারলাম, লোটাস এখন দেশে। একটা নামকরা কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। সে দেশে আসার পর থেকেই আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। অলিল পাত্তা দেয়নি। আমি জানি, একধরনের অভিমান বশতই ও এই কাজটি করেছে। আমি কোনো কথা বলিনি। সত্যি বলতে, আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল লোটাসকে। মনে হচ্ছিল সেই আগের দিনগুলোতে ফিরে যেতে। হাসুকে আর পাব না। লোটাস ফিরে এসেছে। আমরা কি আর আগের মতো হতে পারি না? আমার কথা শুনে অলিল বলল, ‘ও এখন বিরাট বড় কোম্পানি চালায়। ঢাকায় ফ্ল্যাট বাড়ি, গাড়ি- সবই আছে। যত কাছেই আসুক না কেন, ও অনেক দূরে চলে গেছে।’

 ও বরাবরই অনেক সুখী। আমি বিড়বিড় করে বললাম।

কিছুদিন পর অলিলের স্কুলের পিয়ন এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। অলিলের জরুরি তলব। গিয়ে দেখি অলিলের পাশে বসা সাহেব গোছের এক ভদ্রলোক। আমি একটু অপ্রতিভ হয়ে গেলাম। পিয়ন হারামজাদা যদি বলত শহর থেকে এক ভদ্রলোক এসেছে তাহলে তো বগলঘেঁড়া এই পাঞ্জাবিটা চেঞ্জ করে আসতে পারতাম। বৌটাও যেমন হয়েছে, কত করে বললাম ছেঁড়াটা বুজিয়ে দিতে, কে শোনে কার কথা! খালি খায় আর ঘুমায়। আর একটু জড়িয়ে ধরলেই পেট ফুলিয়ে ফেলে! ভদ্রলোক উঠে আসলেন আমাকে তাক করে। যেন সাতসমুদ্র পাড়ি দিয়ে উনি আমাকেই দেখতে এসেছেন। কাছে এসে বললেন, তুই তো দেখছি একটুও বড় হসনি। আগের ততটুকুই আছিস! বরকত যে বলল তোর আবার ছেলেপুলেও হয়েছে। তা কী করে হলো রে? আমি এতক্ষণে বুঝতে পারলাম। কেউ না বলে দিলে কারও বাপেরও সাধ্যি হবে না বোঝার যে, এটা আমাদের লোটাস। কী যে দেখাচ্ছিল না মাইরি! আমাদের সাথে সারা দিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় চলে গেল। বলে গেল পরের বার আসবে আমাদের নিতে। হাসুর কথা শুনে ও কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, “ও নিশ্চয়ই পাকিস্তানি ক্যাম্পে ডালিম চুরি করতে গিয়েছিল! এত দিনে বুঝতে পারলাম–সেই দিন আমরা ঠিকই ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। আমি হো। হো করে হাসছিলাম। লোটাসের চোখের কোণায় জল ছলছল করছিল। আমার পিয়নগিরি শুনে বলল, “দেশে গরুর ডাক্তারের অভাবটা তাহলে আর ঘুচল না! আহা! গো বেচারি!’ বুঝলাম এত দিনে ও কিছুই ভোলেনি। ওকে পেয়ে আমরা সেই বিকেলেই ছুটে গিয়েছিলাম আমাদের গ্রামে, ফেলে আসা দিনগুলোতে। বিলের ধারে যাওয়ার সময় হয়নি। লোটাস বলল, পরের বার এসে যাবে। অবশ্য গেলেও খুব একটা লাভ হতো না। সেই বিল আর নেই। এখন ওখানে ধান চাষ হয়। দেখে বুঝবার জো নেই, এইখানে একসময় প্রবাহিত হতো ছোটখাটো একটা নদী। আমাদের জন্যে সেটা নদীই বটে। গ্রামও আর সেই গ্রাম নেই। খুব কষ্ট করে চিনে নিতে হয়। সেদিন খুব করে মনে হচ্ছিল, সময়কে থামিয়ে রাখতে পারতাম কিংবা সমস্ত আগামী দিয়ে যদি ফেলে আসা একটা দিন কিনতে পারতাম!

 আচ্ছা, সব পরিবর্তন কি সুখের? ফেলে আসা দুঃখগুলোকেও এত আপন মনে হয়

কেন, এত সুখ কেন তাতে! আমরা ফিরে আসলাম মেহেরপুর শহরে। মনে হলো এতক্ষণ কাদা ঘেঁটে ঘেঁটে শুধু শুধু গন্ধটাই পেলাম, যে জিনিসটা হারিয়ে ফেলেছিলাম, তা কিছুতেই পেলাম না।’–আসতে আসতে গাড়িতে লোটাস বলল।

বুকের ভেতরটা বড় দগদগে, ওখানে খুঁজে দেখ, ঠিকই পেয়ে যাবি।’ অলিলের কথায় সাহস ফিরে পেলাম। তাহলে একেবারে হারায় না, পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ঠিকই রয়ে যায় হয়তো সবচেয়ে মূল্যবান জায়গাটাতেই রয়ে যায়।

একদিন হঠাৎ করে লোটাস এসে আমাদের ঢাকায় নিয়ে গেল। আমি গেলাম মূলত ঢাকা শহরটা দেখতে। বাবা স্বপ্ন দেখতেন, একদিন আমি এই শহর থেকে গরুর ডাক্তার হয়ে গ্রামে ফিরছি। ডাক্তার না হতে পারলেও শহরটা তো দেখে যায়। পরকালে তাও তো বাবাকে বলতে পারব! আর অলিল গেল বিদেশি মদ খেতে। দেশি মদে নাকি আজকাল ওর কবিতা বেরোয় না। আমরা প্রথমে গেলাম ওর অফিসে, পরে ফ্ল্যাটে। এত সুন্দরভাবে গোছান সব কিছু, মানুষ নিজ চোখে না দেখলে কল্পনাও করতে পারবে না। লোটাসের ফ্ল্যাট দেখে আমার স্বর্গ দেখার স্বাদ যেন মিটে গেল, আর ওর বৌয়ের কাছে হুররাও ফেল মারবে। ভদ্রমহিলা যতক্ষণ আমাদের সঙ্গে ছিল, আমি যেন হ্যাংলার মতোন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলাম। যেন বাপেরকালে কোনো মেয়েলোক দেখিনি। নারী আমি দেখেছি খুব নেড়েচেড়ে দেখেছি। কিন্তু হুরদের গল্প শুনেছি মাত্র, মসজিদের ইমাম বলতেন, আয়তলোচন আঁখি, নূরের আলো ঝড়ে পড়ে দেহ থেকে। স্বর্গ মর্ত্যের কেউ স্পর্শ করেনি। মসজিদে বসে তিনি এর বেশি বলতে পারতেন না, বাকিটা আমি কল্পনা করার চেষ্টা করতাম, মিলার ভাবির নগ্ন শরীর এসে সব ভেস্তে দিত।

 অলিল মাতাল হয়ে পড়ে রইল। লোটাস দরজা বন্ধ করে বিরাট একটা টিভিতে সিনেমা খাটাল। “দেখ, তোদের দারুণ একটা জিনিস দেখাব। বাপের কালেও দেখিসনি। শুরু হলো চারটা মেয়ের নগ্ন হওয়ার দৃশ্য। একটা সুইমিং পুলে একটা ছেলেকে নিয়ে তারা যা-তা করছে। অলিল মাতাল হয়ে আবোলতাবোল বকছে। ‘সব মিথ্যে। কিছু নেই। এই দুটো শব্দ বোঝা যাচ্ছে। মিথ্যে হবে কেন রে? এগুলো ইউরোপে সত্যি সত্যিই হয়।’–লোটাস ওকে বোঝাবার চেষ্টা করছে। আমার মন তখন অন্যখানে পড়ে।

আমরা দুই দিন থেকে চলে আসলাম। লোটাস বারবার করে অলিলকে থেকে যেতে বলছিল। ওসব কবিতা-টবিতা ছেড়ে চলে আয়, বিলভর্তি বিদেশি মদ পাবি, চাইলে সাথে টদও পাবি। অলিল রাজি হয়নি। ও কবিতা ছেড়ে কোথাও থাকতে পারবে না। আমার বৌ-বাচ্চা আছে শুনে হয়ত থাকতে বলার সাহস পায়নি। লোটাসের এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেটা আমেরিকায়, মেয়েটা কানাডায় পড়াশোনা করছে। ওরাও নাকি লোটাসের মতোই মেধাবী। বাপকা বেটা, বাপকা বেটি। আর আমার ছেলেটা দুইবার দিয়েও ম্যাট্রিক পাস করতে পারল না। বড় মেয়েটা এইটে পড়াকালীন এক রিকশাচালকের সাথে ভেগে গেল। ছোট মেয়েটাও শুনছি নাকি প্রেম করছে কোনো এক ফেরিওয়ালার সাথে। সত্যিই, বাপকা বেটা!

তার পর থেকে আমরা মাঝেমধ্যেই লোটাসের বাড়িতে যেতাম। অলিলের বিদেশি মদে নেশা ধরে গিয়েছিল। আমাকে টানত অন্য কিছু একটু একটু করে আমি লোটাসের সুখে ভাগ বসাতে শুরু করেছিলাম। লোটাস মাঝেমধ্যে অলিলকে খ্যাপানোর জন্য বলত, “শালা, গুলি খেয়ে দেশ স্বাধীন করল। দেশের অবস্থা দেখেছিস বঙ্গবন্ধু গেল, জিয়া গেল, জাতীয় নেতারা গেল। ক্রমেই ইটস টার্নিং ইনটু অ্যা পারফেক্ট হেল। নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দাবি করতে লজ্জা লাগে না? রাসকেল, সামলাতে পারবি না তো যুদ্ধে গেলি কেন? অলিল কিছুই বলত না। আজ হাসু থাকলে হয়ত আরও কত বিষয় নিয়ে জমে উঠত আড্ডা। আমরা পদে পদে হাসুকে খুব মিস করতাম। কিন্তু কখনোই আমরা ওকে নিয়ে আলোচনা করতাম না। আমরা তিনজনই অতীত থেকে পালাতে চাইতাম। ওদের হয়ত একটা ভবিষ্যৎ ছিল, আমার তো তাও ছিল না। আমার ছিল একটা বর্ণহীন বর্তমান–এজন্যই একেক সময় একেকটা রং এসে রাঙিয়ে যেত।

কিছুদিন আগে আবার আমার একটা ছেলে হয়েছে। বৌয়ের বয়স কম হলেও আমার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেল। এই বয়সে সন্তান হবার কথা না। তবুও হয়েছে। ভেবেছিলাম এইটা অন্তত দেখতে আমার মতো হবে। কিন্তু হয়নি। অন্যদের মতোই বেশ লম্বা, চওড়া আর ফর্সা হয়েছে। আমাকে যখন ওরা বাবা বলে ডাকে বড্ড বেমানান ঠেকে। সংসারের কোনো কিছুই আপন মনে হয় না-না বৌ, না সন্তান; বাড়িটাও ভীষণ অচেনা মনে হয়। একবার বিলের ধার থেকে একগুচ্ছ শ্যামা ঘাস তুলে এনে বিছানার তলে লুকিয়ে রেখেছিলাম। খুব শান্তিতে ঘুমিয়ে ছিলাম দুই দিন। তৃতীয় দিন বৌ বলল, দুই দিন ধরে বিশ্রী গন্ধ আসছে কোথা থেকে? খুঁজে খুঁজে শ্যামা ঘাসগুলো বের করে ময়লার ভেতর ফেলে আসল। গরু কেনার সাহস আর হয়নি। মাঝেমধ্যে গোহাটে গিয়ে পায়চারি করতাম। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে বৌ বলেছিল, তোমার গরুরোগ ধরেছে। কুকুরের পেটে কি আর ঘি ভাত সহ্য হয়!

.

চ.

একদিন দুপুরবেলা লোটাসের গাড়ি এসে আমাদের উঠিয়ে নিয়ে গেল। খাঁ খাঁ রৌদ্রে যেন পৃথিবী পরিশ্রান্ত কুকুরের মতো জিহ্বা বের করে শ্বাস নিচ্ছে। লোটাসের এসি গাড়িতে ঢুকে মনে হলো যেন সময়কে ছয় মাস পিছিয়ে আমরা জানুয়ারিতে পৌঁছে গেছি। আমেরিকায় পৌঁছানোর কথাও চিন্তা করতে পারতাম, কিন্তু সেটা অতি উচ্চাভিলাষী ভাবনা হয়ে যেত। ঢাকায় পৌঁছেই আমরা আবার রওনা হলাম কক্সবাজারের উদ্দেশে। লোটাসকে জোরাজুরি করলে বলল, “অনেক দিনের ইচ্ছে মধ্যরাতে সমুদসৈকতে বসে পান করার, তাই ওখানে যাচ্ছি। তোদের ইচ্ছে না হলে যাস না। আমি চুপ করে থাকলাম। অলিলও কোনো কথা বলল না। মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ। সমুদ্র দেখার কথা আমার কোনো দিনই মাথায় আসেনি। বিলের ধারে গল্প করতে করতে হাসু একবার বলেছিল চল, সমুদ্র থেকে কিছু জল এনে বিলে ছেড়ে দিই। দেখি শালা কত ভাব নিতে পারে! শালা, বিলের ধারে বসে খুব ভাব নিচ্ছ। সমুদ্রের একটা ডাক শুনলেই ভয়ে জানটা শুকিয়ে কিশমিশ হয়ে যাবে!’ নোটাসের কথা শুনে বুঝেছিলাম, ওটা বিশাল কিছু। আমার ওসব নিয়ে না ভাবলেও চলবে। আজ সমুদ্রে যাচ্ছি। গ্রামের বিলটা থাকলে সত্যি সত্যি ওখান থেকে কিছু জল এনে ছেড়ে দিতাম।

রাত দশটার পর কয়েক বোতল মদ নিয়ে বিচে চলে গেলাম। খুব কাছের একটা হোটেলে আমরা উঠেছি। আমি আর অলিল অনেকটা সময় সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ঠায়। অলিল বিড়বিড় করে কী যেন বলছিল। কোনো কবিতা-টবিতা হবে হয়ত। লোটাস আমাদের থেকে খানিকটা দূরে বসেছিল। থেকে থেকে সমুদ্রের ডাকে চমকে চমকে উঠছিলাম। মধ্যবিত্তের গণ্ডি পেরিয়ে আজ যেন আমি আসমানে উঠে গেছি, ভয় তো একটু লাগবারই কথা। রাত বাড়তে থাকে। আমি আর অলিল পান করতে করতে মাতাল হয়ে পড়ি। আমার মদ খাওয়ার অভ্যেস নেই; তাই একটুতেই মাতলামি শুরু করে দিই। আর অলিল মাতাল হওয়ার জন্যেই পান করে। লোটাস আমাদের মদ ঢেলে ঢেলে দিচ্ছিল। হোটেলে বলা আছে মধ্যরাতের দিকে আমাদের উঠিয়ে নিয়ে যাবে। আমি বেশ ঘোরের মধ্যে ছিলাম। লোটাস বলল, এই অলিল, আমাকে একটা কবিতা দিবি, সমুদ্রের বুকে লিখে আসব, আজ খুব কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছে। বিনিময়ে, এই নে আমার গোল্ড-ওয়াস, গাড়ির চাবি, ক্রেডিট কার্ড সব দিয়ে দিলাম। আমি হাসতে হাসতে বললাম–শ্যালা, বোধ হয় একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছে। জীবনে এই প্রথম আমি লোটাসকে শ্যালা বললাম। আমার বেশ মনে আছে। অলিল মুখে হাত রেখে বলল—‘চুপ, একদম চুপ! সমুদ্র এখন ঘুমাবে। যাহ্, তোকে আমার সব কবিতা দিয়ে দিলাম। পৃথিবীর সমস্ত কবিতা এখন তোর, যা সমুদ্রের বুকে লিখে একেবারে পাকিয়ে ফেল!’ তারপর আমরা আরো কী কী যেন বলেছিলাম। মাতলামি করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল পুলিশের গুঁতোগুতিতে। ভোর হতে তখনো খানিকটা বাকি। আমাদের সব কিছু বুঝে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। খানিকটা দূরে দেখি কিছু মানুষের জটলা। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না কিছুই।

.

ছ.

এক সপ্তাহ হলো থানায়। লোটাসের বৌ থানায় এসে আমাদের বিরুদ্ধে কেস ডায়েরি করে গেছে। লোটাসের আত্মহত্যা নিয়ে অলিল অনেকগুলো সম্ভাবনা দাঁড় করিয়েছে : বউয়ের সাথে বনিবনা ছিল না, অথবা, সন্তানদের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল না, কিংবা ব্যবসায় খুব খারাপ সময় যাচ্ছিল–এইসব। প্রকৃত সত্যটা ওর মাথায় এখনো আসেনি। আমি জানি, বেশ ভালো করেই জানি, অতিরিক্ত সুখই ওর আত্মহত্যার কারণ!

ধুমড়ি বৌকে ছেড়ে এখন আমি অলিলের সাথে আছি, সৃষ্টিকর্তাকে ছাড়তে পারিনি। অলিল কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছে। জেলখানায় নাকি কবিতারা আসতে চায় না। আমরা এখন মাঝেমধ্যে বিলের ধারে বসে লোটাস আর হাসুর সাথে প্রচণ্ড আড্ডায় মেতে উঠি। বিলের ধারের পাকুড়গাছটার মগডালে বসে আমাদের আচ্ছা শোনে একঝাক কবিতা। অলিল ওদের সাথে কী যেন ফিসফাস করে! জেলখানার কনস্টেবল এসে আমাদের ঘরে ফেরার কথা মনে করিয়ে দেয়। লোটাস আর হাসু ভেসে যায় মেঘে, আমরা ডুব দিই জলে। আর কবিতারা সবুজের সাথে লেপ্টে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *