মৎস্যজীবন

মৎস্যজীবন

ইরার সঙ্গে প্রথম দেখা মাছের বাজারে। মাছের দাম জিজ্ঞেস করতে করতে হঠাৎ অমন সুন্দরী দেখে চমকে উঠেছিলাম, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিলাম। ইরা আরো চমকে দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল: কী হলো, কী দেখছেন অমন বরফচোবানো মাছের মতোন করে?

আমিও বেহায়ার মতো উত্তর দিলাম : আপনাকে!

কেন? জীবনে নারী দেখেননি বুঝি!

 হুম, রোজই দেখি। কিন্তু মাছের বাজারে এমন মৎস্যকন্যা এই প্রথম দেখছি কিনা!

মাছের বাজারে এসব কাব্যকথা কিন্তু বড্ড বেমানান! প্রতি শনিবার এই সময় আসবেন দেখতে পাবেন। হি! হি! মেয়েটি হাসে। বাজারের আর সব শব্দ কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ায়। আমি শুধু হাসির শব্দখানা শুনতে পাই।

তার পর থেকে প্রতি শনিবার স্ত্রীর কাছে এটা-সেটা কেনার বায়না ধরি। উটকো প্রয়োজন খাড়া করি। সাথী তো সত্যি সত্যি সূর্য পশ্চিম দিকে উঠলো কিনা পরখ করার জন্য জানালার পর্দা সরিয়ে দেখে। তারপর মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলে জান্, কী হয়েছে তোমার? এত রোমান্টিক হয়ে সেজেগুজে বাজারে গিয়ে আমাকে আর পটাতে হবে না। এমনিতেই অনেক পটেছি, নতুন করে আর কোনো সর্বনাশ আমি চাই না, বাবা।

আমি মূল কারণটা চেপে যাই, কৌশলে। নিজের অভিনয় দক্ষতা দেখে নিজেই নিজের ভক্ত বনে যাই। আর তাছাড়া, বাজার যে আমার ডেটিংস্পট হয়ে উঠেছে, এ কথা বললেই বা কে বিশ্বাস করবে? মাছের বাজার থেকে আস্তে আস্তে মাংসের বাজারে যাই, মাংস থেকে মুরগির, মুরগি থেকে সবজির। এমনি করে আমাদের সম্পর্ক বাজারময় মাখতে থাকে। আমি আর সাথী বিয়ের পরপর কয়েকবার একসঙ্গে গেছি বাজারে। পরিচিত জনদের ওকে দেখিয়ে আগ বাড়িয়ে বলেছি, বাড়ির অর্থমন্ত্রী–এখন থেকে এই ডিপার্টমেন্টটা ও-ই সামলাবে। এখন যখন ইরাকে নিয়ে ওদের সামনে দিয়ে গটগট করে হেঁটে যাই, এটা-সেটা কিনি, পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি, ওরা দিনের আলোয় ভূত দেখার মতো বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। কেউ হয়ত আগ বাড়িয়ে বুঝে নেয় গণ্ডগোলটা।

আজ শনিবার। এই সাতসকালে সদ্য বানানো স্যুটটা পরে বের হলাম। সাথী তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। বাজারে পা দিলেই ইদানীং সবাই কেমন সার্কাসের জোকার দেখার মতো করে তাকিয়ে থাকে। আজ ঢুকেই মনে হলো, এমন কর্পোরেট পোশাকে এখানে আসাটা বোকামিই হয়ে গেছে। প্রেমে পড়লে এমন বোকামি হয় ভেবে মনকে আশ্বস্ত করি। পরিচিত সবজি বিক্রেতা ছেলেটার কাছে গিয়ে এক কেজি পেঁয়াজ দিতে বলি। সব কিছু বেশি বেশি নিলে আবার পরের সপ্তাহে আসার অজুহাত থাকবে না। ছেলেটা পেঁয়াজ না তুলে আমার দিকে কেমন হ্যাংলার মতো তাকিয়ে আছে। ও বুঝে উঠতে চেষ্টা করে আমি আসলেই পেঁয়াজ চাইছি কি না! বিষয়টা স্বাভাবিক করতে হাত দুটো আড়মোড়া ভোলার ভঙ্গিতে বললাম, আজ কেমন চনমনে সকাল, না? কথাটি শুনে ও আরো বড় বড় চোখ করে তাকাল। চনমনে শব্দের মানে না বুঝতে পারলেও বুঝেছে এমন মেঘলা ভ্যাপসা সকালে আমার ভাবটা বেখাপ্পা হয়ে গেছে। বুঝলাম, ভুল জায়গায় ভাব মেরে ফেলেছি। ইরা এল তখনই।

 কী হলো স্যার? আজ না আপনার ডে অফ!

যে কাজে এসেছি তার গুরুত্বই কি এমন কম শুনি! বদলা জবাব দিই আমি।

চলুন ওদিকটায় যাই। আজ আমার তেমন কিছু কেনার নেই। দেখে যদি কিনতে কিছু মন বলে!

তাহলে বাইরে কোথাও বসি আমরা? সুযোগ পেয়ে বলি আমি।

আপনার কী হয়েছে বলুন তো? কেবলই ভুলে যান, আমি না মৎস্যকন্যা!

মৎস্যকন্যাদের জলের বাইরে পা রাখতে মানা স্যার! কানের কাছে ফিসফিস করে বলে ইরা।

আমি না হয় একসমুদ্র জল নিয়ে সঙ্গী হব মৎস্যকন্যার। আমিও ফিসফিস করে বলি।

এমন বেমানান জায়গায় ভাবের কথা মানায় না, বুঝলে? হি! হি! ইরা হাসে।

বাচ্চা মেয়েদের মতো ওর হাসির শব্দ বাতাসে মিশে অন্য এক স্বর তৈরি করে। আমি চোখটা বন্ধ করে বলি, সকালটা সত্যিই চনমনে! আমরা কেনাকাটায় ইস্তফা দিয়ে বাজারের এক কোনায় দাঁড়িয়ে চা খাই।

আজ যেতে হবে। ইরা বলে।

কেন? বাসায় কাজ আছে বুঝি? আমি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাই।

কাজ না ছাই? একদিন এলে বুঝবেন। বলেই চমকে ওঠে ইরা।

আসব। আজই আসি? আমি সুযোগ পেয়ে নাছোড়বান্দার মতো পেয়ে বসি।

না না। আমি এমনি বললাম। আপনিও না!

আমরা আর কোনো কথা বাড়াই না।

শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। আজ একবার ডাক্তারের কাছে যাব। ইরা বলে।

 সেই ভালো। আমি আনমনা হয়ে উত্তর দিই।

ইরা হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা রাখতে যায়। পেটের কাছে প্রহরায় থাকা শাড়িটা ডিউটি ছেড়ে খানিকটা সরে দাঁড়ায়। নিথর নদীর স্রোতের মতো হালকা ভাঁজপড়া পেট ইরার। নিখুঁত পূর্ণচন্দ্র নাভিতে গভীর অন্ধকার। ইরা টের পেয়ে শাসিয়ে দেয় প্রহরীকে, শাড়ি সরে আসে কর্তব্যে। আমার বেয়াড়া চোখ ইরার প্রহরীকে গোপন সন্ধিতে আনার চেষ্টা করে।

আজ আসি। সন্ধ্যায় কলেজগেটে আসেন। বলেই ইরা দ্রুত পা বাড়ায়। আমি পেছন থেকে ওর নিতম্বের ছন্দ মেপে দেখি। এই প্রথম আমার কাছে এত দেহময় হয়ে ওঠে ইরা। ইরার ওই অন্ধকার গভীরতা, নিতম্বের তাললয়, কিছুতেই মাথা থেকে নামাতে পারি না। বাসায় ফিরেই পোশাক ছেড়ে শোয়ার ঘরে যাই। সাথী তখনও বিছানায়। আমি ইরাকে দেখতে পাই। এই প্রথম সাথীকে জোর করে নিজেকে তৃপ্ত করার চেষ্টা করি। বিয়ের কাগজপত্র না থাকলে নির্ঘাত সাথী এটাকে ধর্ষণ বলে চালিয়ে দিতে পারত। আমার অনুশোচনা হওয়ার কথা; হয়নি। মাথাজুড়ে তখন কেবলই ইরা, ইরার শরীর। সন্ধ্যায় হালকা বেগুনি রঙের পাঞ্জাবিটা পরে বেরিয়ে পড়ি। আজ প্রথম ইরা আর আমি শাকসবজি আর মাংসের বাইরে দেখা করব। ইরা কি ওই মেরুন শাড়িটা পরে আসবে? কি জানি! আমি ভাবতে ভাবতে এগোই। প্রতীক্ষা করি প্রতিটা সেকেন্ড গুণে গুণে। ইরা আসে না। ইরা আসেনি। বাসার ঠিকানা দেয়নি। মোবাইল নম্বরটাও নেওয়া হয়নি। কেমন কুয়াশাচ্ছন্ন মনে হয় সব কিছু।

অপেক্ষা করতে করতে শনিবার চলে আসে। আজ আর অত সাজগোজে মন আসে না। কোনোরকম মুখে পানি দিয়েই বেরিয়ে পড়ি। বাজারে যেতেই আমাদের দুজনের পরিচিত সেই সবজিওয়ালা ছোঁকড়াটা এগিয়ে আসে। ভাইজান, আপায় ভোরে এই কাগজখানা দিয়ে আপনারে দিতে কইল। আমি ওর হাত থেকে চিলের মতো ছোবল মেরে ছিনিয়ে নিই ইরার দেওয়া এক টুকরো কাগজ। আমরা কেউ কাউকে কোনো দিন কিছু দিইনি। আজ ইরাই প্রথম দিল।

ইরার হাতের লেখা : আমি দিন বদল করছি, বদল করছি সময়ও। মৎস্যকন্যা ডাঙায় উঠবার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু স্বামী আর সন্তানের কথা ভেবে আবারও ডুব দিয়েছে গভীরে। ওই গল্পটা জানেন না, ইংরেজ কবি আর্নল্ড যেটি নিয়ে কবিতা লিখেছিল, একবার এক মৎস্যকন্যা ডাঙায় উঠে এসেছিল। সে আসলে একসময় ডাঙারই মানুষ ছিল। আবার ডাঙায় ফিরে এসে জলের কথা ভুলে যায়। ভুলে যায় মৎস্যজীবন, মৎস্যের সংসার। মৎস্যস্বামী আর মৎস্যশিশুরা রোজই জলের কিনারে এসে অপেক্ষা করে মৎস্যকন্যার। মৎস্যকন্যা বেমালুম ভুলে যায়। আমি ভুলে যাওয়ার আগেই ফিরে আসতে চাই। আপনারও সংসার আছে, না বললেও আমি বুঝেছি। ফিরে যান। কেউ একজন অপেক্ষায় আছে। আর হ্যাঁ, বাজারে আসা আপনাকে মানায় না। এবার থেকে স্ত্রীকেই পাঠাবেন। আমিও ভাবছি, আমার স্বামীকে বলব। ওদেরও একবার সুযোগ দেওয়া দরকার মৎস্যজীবন যাপনের। হি! হি!

 ইরার হাসি বাতাসে ভাসতে থাকে। আমাকে ব্যঙ্গ করার হাসি। দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর প্রেম করার পর সাথীকে বিয়ে করেছি ভুলেই গিয়েছিলাম, ফিরতে ফিরতে মনে পড়ে সবই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *