ঘুমপাড়ানো জল

ঘুমপাড়ানো জল

ক.

সুবীর ওর বাবাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে উঠেছে। বছরখানেক আগেই ওদের এখানে আসবার কথা ছিল। তখন বাবা বেঁচে ছিলেন। সুবীরের বাবা হরিশঙ্কর কাকা লোকমারফত ভাঙা ভাঙা অক্ষরে পত্র লিখে পাঠিয়েছিলেন, আসবার কথা জানিয়ে। বাবা সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে আপ্লুত হয়ে উত্তরও পাঠালেন। এরপর বাড়ির এটা ঠিক করো, ওটা ঠিক করো–এত দিন পর হরি আসছে! বাড়ির সবাইকে অস্থির করে তুলেছিলেন। সীমান্তে যারা কারবার করত তাদের রোজই একবার করে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতেন–দেখবি, হরির আসতে সমস্যা হয় না যেন! তারপর বাড়ি আর পথ করতে করতে একদিন নিজেই চলে গেলেন। গতকাল সুবীর যখন হরিশঙ্কর কাকাকে নিয়ে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেদের পরিচয় দিল, তখন কেবলই বাবার কথা মনে হচ্ছিল। আমার স্ত্রী তো পেছনে দাঁড়িয়ে কেঁদেই। ফেলল। হরিকাকাকে ও-ই ধরে নিয়ে বসবার ঘরে বসাল। বেশ ভারী শরীরের মানুষটা। হাঁটবার সময় বাচ্চাদের মতো দেখে দেখে পা ফেলেন। সুবীর আমার বয়সী হবে। মিরাকে হাত তুলে নমস্কার করে একটু ইতস্তত করে একটা হাত আমার দিকে এগিয়ে দিল। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে খানিকটা ফিসফিস করে বলল, মেহেরপুরে পা দিয়েই কাকার সংবাদটা শুনলাম। বাবাকে বুঝতে দিইনি। এমনিতেই অনেক ধকল গেছে; দাদা, এখনই কিছু বলবেন না, প্লিজ। অন্যকিছু বলে ম্যানেজ করুন।

হরিকাকার দিকে তাকিয়ে বিষয়টা বুঝতে আমার অসুবিধা হলো না। সঙ্গে সঙ্গে মিরাকে আড়ালে ডেকে বললাম কাকাকে বলল, বাবা ক’দিনের জন্য মেহেরপুরের বাইরে গেছে। চলে আসবে। শরীরটা বিশেষ ভালো না, এখনই কিছু বললে বেশি আপসেট হয়ে পড়লে সমস্যা হতে পারে। হরিকাকাকে মিরার দায়িত্বে রেখে আমি আর সুবীর গেস্টরুম-সংলগ্ন বারান্দায় গিয়ে বসলাম। সুবীর লম্বা ছিপছিপে গড়নের। ক্লিন সেভড়। ফতুয়ার মতো একধরনের শার্ট আর বেগিজাতীয় ঢিলেঢালা প্যান্ট পরে আছে। হরিকাকা সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরেছেন।

চলবে? একটা গোল্ডলিফ ধরিয়ে সুবীরকে লক্ষ করে বললাম। আমার দাড়িভর্তি মুখ আর মাথায় টুপি দেখে শুরুতেই সুবীর খানিকটা ভড়কে গিয়েছিল, ওর কথা বলবার ধরন ধরে বুঝেছিলাম। তাই মাথার টুপিটা খুলে নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে আর একটা সুবীরকে অফার করলাম।

ওতে আমার অভ্যেস নেই। খালি আলোটা দিন। সুবীর কলকাতার একটি সস্তা ব্র্যান্ড বের করে লাইটারের জন্য হাত বাড়াল।

আপনাদের এখানে বেশ গরম। কলকাতায় এখনও এত গরম পড়েনি, বুঝলেন। দাদা? কিছু একটা বলে সুবীরও আলাপটা সহজ করবার চেষ্টা করছিল।

 হুম। আজ গরমটা বেশি। তবে ভোরের দিকে আবার খানিকটা ঠাণ্ডা পড়বে। মার্চ মাসটা এভাবেই যাবে। দু’দেশের দু’জন অপরিচিত মানুষ এভাবে আবহাওয়াবার্তা শেয়ার করার ভেতর দিয়ে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করবার চেষ্টা করছিলাম।

 খানিকটা সহজ হওয়ার মতো মনে হলে সুবীর বলল, আমরা বোধহয় আপনাদের সমস্যার ভেতর ফেলে দিলাম। বাবা আসলে এত করে..! যাচ্ছি যাচ্ছি করে কত দিন তো আটকে রাখলাম, বুঝলেন, এবার আর পারলাম না। এভাবে হুট করে আসাটা ঠিক হচ্ছে না ভেবেও চলে এলাম। কাকা নেই জানলে হয়ত…।

না, মোটেও অমনটি ভাববেন না। আমরা আপনার বাবার পত্র পাওয়ার পর থেকেই তৈরি ছিলাম। তবে বাবা দেখে যেতে পারলেন না, এই আর কি! হঠাৎ এভাবে ভিনদেশী অচেনা অতিথি পেয়ে খানিকটা বিব্রত হলেও সেটা প্রকাশ না করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছিলাম। সেটা হয়ত সুবীর টেরও পাচ্ছিল।

আমরা বরং কোনো হোটেলে গিয়ে উঠি। আপনি সবকিছু দেখিয়ে দিন সেই যথেষ্ট। সুবীর বলল। মেয়ের পরীক্ষা চলছে, এর ভেতর এমন দুজন বাইরের মানুষ থাকলে কারও খুশি হবার কথা নয়। তাছাড়া, আমাদের বাসায় বহুদিন হিন্দুধর্মালম্বী কেউ এভাবে বেড়াতে আসেনি। তাই একটু যে সমস্যা হবে না সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছিল না। কিন্তু বাবার কাঙ্ক্ষিত অতিথিকে এভাবে হোটেলে পাঠানোর কথা ভাববার মতো অতটা অসামাজিক আমি নই। তাছাড়া আমি চাইলেও আমার স্ত্রী যে রাজি হবে না, সে আমি তার চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছি। তাই সুবীরকে জানিয়ে দিলাম, ওসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।

কাকা বাবাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। মিরা খুব ভালোভাবে সামলে নিলো বিষয়টি। এতটা পথ পাড়ি দিয়ে তিনি বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। বিছানায় শরীরটা এলিয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন। তখন সবে সন্ধ্যা নেমেছে। আমি সুবীরকেও বিশ্রাম নিতে বলে বাজারের ব্যাগ হাতে বেরুচ্ছিলাম। ও অনেকটা জোর করেই সঙ্গী হলো।

বাবার মুখে বাংলাদেশের খুব গল্প শুনেছি, বুঝলেন দাদা। ইনফ্যাক্ট, এই একটি গল্পই তিনি সারাজীবন বলে এসেছেন। ভালো লেগেছে আবার বিরক্তও কম হইনি। যখন দেশ ছেড়েছেন মাত্র বারো বছর বয়স। কতটুকুই বা স্মৃতি, ওই থেকে খামছা খামছা বছর বছর ঝালিয়ে যাওয়া কারই বা এত ভালো লাগে বলুন? ওসব কথা পরে হবে। চলুন শহরটা আপনাকে দেখাতে দেখাতে বাজারটা সেরে আসি। আমি থামিয়ে দিয়ে বলি। বাজারটা সেরে নিয়ে আমরা চায়ের দোকানে বসি। পরিচিত লোকজনদের সঙ্গে সুবীর, বাবার বন্ধুর ছেলে, কলকাতা থেকে এসেছেন, বলে পরিচয় করিয়ে দিই। কেউ ঠাট্টা করে বলে, তোর বাবা আবার কলকাতায় বন্ধু জোটাল কবে? আমরা কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করি না। সুবীর কলকাতার জেনে আমার বন্ধু সামছুল বাম রাজনীতি করত একসময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খবরাখবর জানতে চায়, বলে মমতাদির অবস্থান নিয়ে আপনাদের ওখানে হাওয়া কেমন? তারপর আমরা না চাইলেও আমাদের আলোচনা রাজনীতির দিকে গড় মারে। সুবীর এই একতরফা আলোচনায় মন বসাতে পারে না। বিশেষ করে সকলে যখন কলকাতার রাজনীতি-সংস্কৃতি নিয়ে নানান প্রশ্ন করে তখন এদেশ সম্পর্কে সুবীর পাল্টা কোনো জিজ্ঞাসা জাহির করতে না পেরে বেশ লজ্জিত হয়। আমাকে আসতে আসতে সে নির্দ্বিধায় জানাল সে কথা বুঝলেন দাদা, এখানে না আসলে জানতেই পারতাম না, কলকাতা নিয়ে এত ভাবেন আপনারা! সত্যি বলতে আমি নিজেও অত ভাবিনি। বলতে দ্বিধা নেই, আমি আসলে বাংলাদেশ নিয়ে তেমন কিছুই জানি না। কী করে জানব বলুন, সারাদিন কোম্পানির মালপত্র বিক্রি করার ধান্দা করি। কারবারটা টেকাতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। বোঝেন তো দাদা, আমাদেরও তো ওখানে অ্যাডজাস্ট করে চলতে হয়। ঠাকুরদা তিন ছেলে নিয়ে একেবারে খালি হাতে এদেশ থেকে পাড়ি জমান। তারপর ঠাকুরদা না পারলেন মানতে, না পারলেন ছাড়তে–এক দুর্ঘটনায় চলে গেলেন। কেউ কেউ বলে আত্মহত্যা। এরপর বাবা আর কাকারা খুড়িয়ে খুড়িয়ে কিছু একটা দাঁড় করাতে চেষ্টা চালালেন। তারপর থেকেই চলছে। কখন এত জানব বলুন?

না। ঠিক আছে। সব কিছু কি আর জানা যায়। আমি আর কথা বাড়াতে দিই না। গত আইপিএলে কলকাতার এত বাজে খেলা মোটেও ঠিক হয়নি। আমি প্রসঙ্গ বদলাতে বলি।

তা যা বলেছেন! সুবীর এবার খানিকটা চাঙা হয়। কেউ ফর্মে ছিল না, বুঝলেন দাদা। আর তাছাড়া, এসব দিয়ে না কিচ্ছু হবে না। শাহরুখ ওসব বোঝে নাকি? দাদাকে দায়িত্বটা দিলে, এমনটি হতো না।

 এভাবে আমরা খেলা, খেলা থেকে বলিউড, বলিউড থেকে টালিউড, এমনকি দক্ষিণ পর্যন্ত চলে যাই।

রাতে খাবার টেবিলে কিছু একটা বলা উচিত ভেবে হয়ত মিরা সুবীরকে প্রশ্ন করে ওর প্রিয় সিরিয়াল নিয়ে দাদা, একটু পরেই ভালোবাসা.কম শুরু হবে, দেখবেন?

 সুবীর এমন প্রশ্নতে শুরুতে একটু অপ্রস্তুত হয়, তারপর সামলে নিয়ে বলে, আমি ওসব দেখি না যে বৌদি।

সেকি, আপনারা দেখেন না? মিরা খানিকটা হতাশ হয়।

আমি দেখি না। আপনার বৌদি মানে আমার ওয়াইফ ভীষণ দেখে।

 তাই বলুন। মিরা যেন শান্তি পায় শুনে! বৌদিকে নিয়ে আসুন না একবার। সে বলে।

কেন? একসঙ্গে সিরিয়াল দেখবে বলে। আমি বলি।

 সুবীর মৃদু হাসি দিয়ে বলে, আসব নিশ্চয়ই। তার আগে আপনারা আসুন না একবার।

 আপনার দাদাকে তো বলিই। তখন তো আর আপনাদের সঙ্গে এত জানাশোনা ছিল না, তাই সেইভাবে জোর দিয়ে বলতে পারিনি। অচেনা একটা দেশ, কোথায় যায়, কে কী খাইয়ে দেয়- সেই ভয়ে।

.

খ.

বেশ ভোরেই কাকাকে নিয়ে বের হলাম। কাকা বাড়িটা দেখবেন বলে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। সঙ্গে সুবীরও। বড় বাজারের কালীমন্দিরের পেছনেই ছিল বাড়িটা। বাবার মুখে শুনেছি। আমি ঠিক জানি না কোন বাড়িটা। থাকলে কাকা নিশ্চয় চিনবেন- সেই ভরসা। কাকা বেশি কথা বলছিলেন না, থেমে থেমে ভালো করে সবকিছু দেখছিলেন আর বলছিলেন- ভগবান, এত পাল্টে গেছে! মাঝে মাঝে এটা সেটা জানতে চান, যার বেশির ভাগই আমার পক্ষে ঠিকঠাক বলা সম্ভব হয় না। কাকা মুরুব্বি কাউকে পেলে থামিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা খগেন কি বেঁচে আছে? হাসমতের বাড়িটা এদিকটাতে ছিল না? তোমরা কি মালেকের কথা বলতে পারো, আব্দুল মালেক? ওই যে মোটা করে! শুনেছিলাম রহমান নাকি এখানকার কি একটা ইলেকশনে জিতেছে? ও কি থাকে মেহেরপুর? কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তর আংশিক পান, কোনোটার উত্তর পান না। আমরা এগুতে থাকি। তবে একজনের উত্তর আমার ভালো করেই জানা ছিল। কাকা যখন হারাধন কাকার কথা জিজ্ঞেস করেছিল তখন আমার বুকের ভেতর চড়াৎ করে উঠেছিল। আমি চুপ করে ছিলাম। কাকা বললেন, এই হারাধন আমি আর তোর বাবা ছিলাম জানের জিগার। আমি আর তোর বাবা যখন যে যার বাড়ি যেতাম তার মা-ই তখন আমাদের মা বনে যেত। কিন্তু হারাধন নিচু জাতের ছিল বলে, আমাদের বাড়িতে তার আগমন অতটা সুখকর ছিল না। তবে তোর বাড়িতে কোনো সমস্যা হতো না। তখন সবাই যখন এপার-ওপার করছিল। তখন হারাধনকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, তোর দাদি যেতে দেয়নি। বলল, ওরা সবাই গুষ্টি ধরে যাচ্ছে, তোর তো আর আগেপিছে তেমন কেউ নেই, তুই আমার কাছেই থেকে যা। হারাধন আর যেতে পারল না।

আমার খুব হারাধন কাকার কথা মনে পড়ছিল। কেমন মিষ্টি একটা মানুষ ছিল। কাজও ছিল মিষ্টির কারিগর। কাকা যত দিন ছিল, আমাদের মিষ্টি কিনে খেতে হয়নি। আমরা দু’ভাই সেই ছোটবেলা থেকেই স্কুলে যাবার কিংবা ফিরবার পথে হারাধন কাকার দোকান থেকে রসগোল্লা বা পানতোয়া হাতে করে চাটতে চাটতে স্কুল যেতাম কিংবা বাড়ি ফিরতাম। সাথে যে থাকতো তার ভাগ্যেও একটা জুটতো বলে আমাদের স্কুলসঙ্গীর কমতি হতো না।

 মা প্রায়ই রাগ করতেন এ নিয়ে। বাবাকে বলতেন, হারু দাদার ব্যবসা তোমার ছেলেরাই ডোবাবে, দেখো!

দোষ কেবল আমার ছেলেদেরই, হারু যে সাধে, ওর দোষ কিছু নেই? আমি তো ভাবছি, ছেলেদের কারো ডায়াবেটিস হলে হারুকে দেখে নেব। এই বলে বাবা হো হো করে হাসতেন। হারু কাকার সামনে আলাপটা ঘটলে তিনিও পাল্লা দিয়ে হাসতেন।

 কলেজে পা দিয়েই মফেদুল, আমার ছোটভাই, ছাত্রশিবিরে নাম লেখাল। বাবা সদ্য হজ ফেরত, তাই বাবাকে তার অবস্থান বোঝাতে অসুবিধা হলো না। তখন ভোটের মৌসুম। যেই ওরা হেরে গেল, ওই রাতে হারুকাকাসহ হিন্দুপাড়ায় আরো ক’ঘর বাড়ি পুড়ল। জীবন্ত দগ্ধ হল কয়েকজন, তার ভেতর হারুকাকাও ছিল। মফেদুল এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল না বললেও বাবা মানতে পারেননি। ওকে সঙ্গে সঙ্গে আলাদা করে দিলেন। ওই ঘটনার পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাবার সামনে মিষ্টি আনা যায়নি। মিষ্টি দেখলেই ছটফট করতেন। না পারতেন কাঁদতে, না পারতেন বোঝাতে। মালোপাড়ার ঐদিকটাতেও আর কখনো যাননি। এসব কথা হরিকাকাকে বলা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি এমনিতেই চলতে-ফিরতে যথেষ্ট আহত হচ্ছিলেন, তা তার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল।

সুবীর আর আমি পালা করে কাকাকে ধরে নিয়ে হাঁটতে থাকি। তবে কাকা সুবীরের চেয়ে আমার সঙ্গে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সুবীর তো একবার ঠাট্টা করে বলেই ফেলল– দেখছেন দাদা, দেশে পা দিয়েই বাবা কেমন পর করে দিয়েছে আমাকে। আমি আর কাকা দুজনেই হাসলাম। কালীমন্দিরের সামনে এসে কাকা থ মেরে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। স্মৃতি আর সময় মেলাতে চেষ্টা করছিলেন বোধহয়। কাকা একপা একপা করে মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করেন। মনে হয় যেন চোখ বাঁধা অবস্থায় পা গুণে গুণে ভেতরে প্রবেশ করছেন। আমি আর সুবীর বাইরে এক চায়ের দোকানে বসি।

আজ খুব শান্তি লাগছে, দাদা। সুবীর বলে। বাবা প্রায় দশ বছর ধরে বাংলাদেশে আসার জন্য গোঁ ধরে বসেছিল। আমাদেরও সময় হচ্ছিল না, একবার হলো তো বাবার ওপেন হার্ট সার্জারি করা লাগল। আগে একবার হার্ট-অ্যাটাক। কিছুতেই হচ্ছিল না। এবারও হতো না। বাবার শরীরের যা অবস্থা, দাদারা মানতেই চাননি। কিন্তু, হঠাৎ করে আমারও কি যেন হয়ে গেল। ভাবলাম, আসিই না। একবার ঘুরে। শুধু আপনার বৌদিকে জানিয়ে কাগজপত্র করে বাবাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কাগজপত্র করার বিষয়টি বাবা তো কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। কী করে আর মানে বলুন, আমাদের এখানকার ঘরবাড়ি তো আর কারও নামে লিখে দিয়ে যাননি। আসবার সময় বহুবার মনে হয়েছে, কাজটা বোধহয় ঠিক হলো না। ভিনদেশে একটা কিছু হয়ে গেলে সামলাব কী করে। এখন মনে হচ্ছে, আরও আগেই আসা উচিত ছিল। সুবীর বলে চলে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবি, একদিন এভাবে বসেই হয়ত হরিকাকা আর বাবা গল্প করতো। অন্য গল্প। আমি সেই গল্পগুলো সাজানোর চেষ্টা করি। সুবীর বলে চলে–আচ্ছা দাদা, হিন্দু আর কত ঘর আছে এখানে?

আছে। একেবারে কম না।

সমস্যা হয় না? মানে, শুনি যে মাঝেমধ্যেই ঘরবাড়ি সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ওসব শুনে মনে হয়, ঠাকুরদা ঠিকই করেছিলেন। আজ হোক কাল হোক তো আসতেই হতো। না হলে যেতামই বা কোথায়।

সমস্যা কিছু হয় না, তা না। তবে এখানে তো তেমন কিছু দেখি না। দিব্যি তো যাচ্ছে। আমি একটু আনমনা হয়ে বলি।

আমাদের দেশে আসেন না একদিন। কত বাংলাদেশী তো যায়। বাবার পরিচিত অনেকেই গেছে আমাদের ওখানে। শুধু আপনারাই গেলেন না।

 হ্যাঁ। যাব ক্ষণ। আমরা আর আলাপ না বাড়িয়ে মন্দিরে গিয়ে কাকাকে নিয়ে আসি। কাকার চোখে জল। জল খানিকটা সুবীরের চোখেও। সুবীর লজ্জা পায় আমার চোখে চোখ পড়াতে। আমরা মন্দিরের পেছন দিকে পা বাড়াই। কাকার পা আর কিছুতেই চলে না। এতটা পথ যার জন্য আসলেন তার দেখা না পেলেই যেন বেঁচে যান তিনি। আমি আর সুবীর অনেকটা শূন্য করে উঠিয়ে নিয়ে গেলাম। মন্দিরের পেছনে দুটি ঘর মাজাঅবধি ভেঙে পড়ে আছে। পাড়ার বখাটেরা মাঝে মাঝে ভেতরে গিয়ে ওপার থেকে চোরাপথে আসা ফেনসিডিলের বোতল নিয়ে বসে। তাস ঠোকে। বিড়ি ফোঁকে। এর বাইরে কেউ এখানে আসে না। কাকা আসবার কথা শুনে বাবা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলেন, গুঁড়িয়ে ফেলে একটা মাদ্রাসা তৈরির পাঁয়তারা চলছিল অনেক দিন থেকেই। পাশে মন্দির বলে শেষ পর্যন্ত আটকে গেছে। তারপর কী সিদ্ধান্ত হয়েছে জানি না। জানার কোনো দরকার পড়েনি। কাকারা তো আর থাকতে আসেননি। এক কোণায় ভাঙা ইটের ফাঁক গলিয়ে একগুচ্ছ তুলসীর পাতা গজিয়ে উঠেছে। কেমন গরিব গরিব চেহারা পাতাগুলোর! কাকা তুলসীগাছটার পাতায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন, এ ঘরটায় মা থাকত। এটা ছিল পুজোর ঘর। বাড়িতে মেলা মানুষ, তাই রাতে মা এখানেই থাকত। আমি মাঝে মাঝে ঢুকতাম মার আঁচল থেকে টাকা হাতাতে। পুজো একটা ছুঁতো ছিল। মা বলতেন, ভগবানের সামনে ওসব না করে আমাকে বললেই পারিস। আমি কি না করি কখনও? সত্যিই তো, মা কখনো না করেনি। তারপরও এই অভ্যেসটা কেন যে হয়েছিল! কাকা এমন করে বলছিল কথাগুলো যেন আমরা বাদেও অন্য কেউ ছিল ওখানে।

ওদিকটায় আরো দুটো ঘর ছিল, ওই নতুন ঘর উঠেছে ঐখানে। আমি থাকতাম ঐ ঘর দুটোর একটিতে। তোর বাবা আর আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তামাক খেতাম। আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে কাকা জোর করে হাসবার চেষ্টা করেন।

সুবীর আমাকে আড়াল করে এক টুকরো ইট পকেটে তোলে। আমি দেখেও না দেখার ভান করি। কাকা হাঁটতে হাঁটতে মাটিতেই হাঁটু গেড়ে বসেন। একটা ইটকে আসন বানিয়ে বসে পড়ে সুবীরও। আমি অসহায়ের মতো ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি। ওদের পাল্টা তাকানো দেখে মনে হয়, এসবের জন্য আমিই দায়ী। অপরাধবোধে আমার মাথাটা নিচু হয়ে আসে। মাথার টুপিটা খুলে বুকপকেটে রাখি। কাকারা বসে থাকতে থাকতেই আমি মন্দিরের প্রায় লাগালাগি এক মসজিদ থেকে জুম্মার নামাজটা সেরে আসি। এই মন্দির এবং মসজিদ দুটোই আমার আর সুবীরের দাদারা একজোট হয়ে তৈরি করেছিল। আরো দূরে আলাদা করে দুটো নির্মাণ করা যেত, কিন্তু বাবার মুখে শুনেছি, এই জায়গাটা ছিল আড্ডার কেন্দ্র। তাই আড্ডার মাঝে নামাজ-পুজোয় যেতে যাতে সময় নষ্ট না হয় এই ভেবে পাশাপাশি তৈরি করা। গত দশ বছরে এ দুটো আলাদা করার অনেক পাঁয়তারা করা হয়েছে, শহরটা এখন যেহেতু মুসলমান অধ্যুষিত তাই মন্দিরটা সরানোর পেছনেই ভোট বেশি। আবার এই পাড়াটায় হিন্দু বেশি বলে জোর ওদের পক্ষেও কম নেই। তাই একধরনের হাঙ্গামার ভেতর দিয়েই সময় চলে যাচ্ছে। হরিকাকার এতসব জানবার কথা নয়। জানার দরকারও নেই। বাবা থাকলে এসবের কিছুই বলতেন না। আমিও যতটা সম্ভব সময়ের বাস্তবতা থেকে তাকে দূরে রাখার চেষ্টা করি। যে স্বপ্ন নিয়ে তিনি এসেছেন সেই স্বপ্নটা ভেঙে যাক, এটা সুবীরও যেমন চাচ্ছিল না, আমিও তেমন চাচ্ছিলাম না। আমরা অনেকটা মরা বাড়ি থেকে ফিরবার মতো বিপ্নভাবে বাড়ি ফিরলাম। কাকা অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠছিলেন। তাঁর জন্যে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে আমি সুবীর আর মিলা ড্রয়িংরুমে টেলিভিশন ছেড়ে বসলাম।

 কাকারা সেদিন না গেলে সুবীরদা আর তুমি প্রায় বন্ধুর মতোই হতে; না? প্রশ্ন করে মিরা। তোমরা আজ আর আলাদা দেশের মানুষ হতে না।

মিরার কথায় আমি আর সুবীর কেউ স্বাভাবিক হতে পারি না। দুজনেই এক অজানা কারণে অস্বস্তিতে পড়ে যাই। বৌদি, আপনার মেয়েটি কিন্তু লক্ষ্মী হয়েছে। সুবীর প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে। এসে থেকেই দেখছি পড়ার টেবিলে। আর আমার মেয়ে তো বলিউডের বাইরে কিছু বোঝে না। পড়তে বললেই শরীরে জ্বর উঠে আসে।

আমার মেয়েও কম না। পরীক্ষা আর আপনারা আছেন তাই টিভির রুমে আসছে না, নইলে তো সারা দিন হিন্দি চ্যানেলগুলো ছেড়ে বসে থাকে। সালমান আর জন ছাড়া কিছু বোঝে না! এইটুকু মেয়ে, বোঝেন?

সুবীর আর মিরা দুজনেই হাসে। আমিও হাসবার চেষ্টা করি।

কাকা উঠেই নদীতে যাওয়ার বায়না তোলেন। শিশুর মতো বলেন, চল না রে, একটু নদীর দিকটা ঘুরে আসি। তোর বাবার সঙ্গে কত গেছি মাছ ধরতে, গোসল করতে। আবার অকারণেই কম গেছি নাকি!

 নদী কি আর সেই নদী আছে। ওদিক থেকে পানি আটকে রেখে এদিকের সব নদী মেরে ফেলা হচ্ছে। সুবীরকে যেতে যেতে বললাম সেসব কথা। সুবীর বলল, পানির সমস্যা ওখানেও নাকি আছে। গঙ্গা শুকিয়ে যাচ্ছে। আমি আর কথা বাড়াই না। অটো নিয়ে সোজা ব্রিজের ওপর চলে গেলাম। নিচে সেচ দিয়ে ধান চাষ করছে কেউ কেউ। কোথাও কোথাও পানি কাদা হয়ে জমে আছে। কাকাকে অটো থেকে নামিয়ে আমি আর সুবীর ধরে নদীর ঢালে নামালাম। কাকা যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

তুমি কি এই নদীটার কথাই বলতে, বাবা? সুবীর কাকাকে প্রশ্ন করে।

 আগে পানি ভালোই ছিল। আমি নিজেও ছোটবেলায় সাঁতার কেটেছি। হালে একেবারে গেছে। কাকা কোনো উত্তর করে না দেখে আমি বলি। পানি নিয়ে মমতার সঙ্গে কত বসল সরকার, কিছুতেই কিছু হল না। এভাবেই দেশের নদীগুলো সব শেষ হয়ে গেল।

 দাদা, যদি এমন হয়েই থাকে, কাজটা নিশ্চয় মমতা ভালো করেননি। সুবীরের কথায় বুঝতে পারি, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ও এসব সাত-পাঁচে থাকে না। নির্ভেজাল কাজের মানুষ।

খানিক চোখ বুলিয়েই কাকা বললেন, চল। দমটা কেমন আঁটকে আসছে। কাকার এভাবে হঠাৎ মুড অফ হয়ে যাওয়া দেখে আমরা দুজনেই অবাক হলাম। কাকা আসতে আসতে বিড়বিড় করে বললেন, শেষ পর্যন্ত নদীটাও! তোর বাবা আমাকে ঠকিয়েছে। সব কিছু নিয়ে ভেগে গেছে। আমার আর সুবীরের বুঝতে বাকি রইল না কিছুই। ঝড় আসার আগমুহূর্তের প্রকৃতির মতো দম মেরে বসে রইলেন কাকা। কাল যত ভোরে সম্ভব রওনা দিতে পারলে ভালো হয়। সুবীর বলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *