বাঁশিওয়ালা মজ্জেল

বাঁশিওয়ালা মজ্জেল

আজ এতকাল পর মজ্জেলের সাথে দেখা। যত দূর মনে পড়ে, ও মারা গিয়েছিল বছরপনেরো আগে, মে কি জুন মাসে। দিনটি ছিল ওই বছর সবচেয়ে গরমপড়া দিনগুলোর একটি। অবশ্য ওর সাথে আমার শেষ দেখা হয় ওর মৃত্যুরও বছরদুয়েক আগে। দু’বছর নিরুদ্দেশ থাকার পর আমাদের ব্যাঙগাড়ির মাঠে এক শ্যালো মেশিনের পাশে লাশটা মেলে। শরীরের কোনো অংশে কাটাছেঁড়ার দাগ ছিল না। লোকমুখে মৃত্যুর কত কারণ শুনেছি–কোনো একটা ঠিক ছিল হয়তো, কিংবা কোনোটাই না। এ নিয়ে পরে কোনো উচ্চবাচ্য হওয়ায় এর কোনো একটা ভার্সন আমাদের সত্য বলে মেনে নিতে হয়েছে। যেমন, আমাদের এক বাড়িতেই চারটা ভার্সন তৈরি হলো। বাবা বললেন, ‘সব সুময় মরার কারণ থাকবি, এমুনটা আশা করা ভুল।’ মা বললেন, ‘মৃগীব্যারাম, গরমে ওর সমস্যাটা আরু বাড়তুক।’ কাজের মেয়ে মুশির মা বলল, ‘জিনের দোষে মরিচে। ওমুন ধু-ধু ফাঁকা মাঠে একা মানুষ বাঁচে নাকি! দেকো গে তিষ্টা মিটাতি গিলো, অমনি গলা মটকি দিচে।’

আমি মেনে নিয়েছি দাদির ভার্সনটা–দাদির ধারণা, মজ্জেল বাঁশিতে ফুঁ দিতে না পেরে দম আটকে মারা গেছে!

মৃত মজ্জেলকে দেখতে যেতে আমার মন সায় দেয়নি। ওর লুঙ্গির কোচরে বাঁশিটা গোঁজা ছিল, আর কিছু ছিল না সঙ্গে–যারা দেখতে গিয়েছিল তাদের মুখে শোনা।

.

এভাবে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে দেখা হয়ে যাবে, ভাবতেই পারিনি। প্রথমটায় আমি ওকে চিনতে পারিনি। ওর বাঁশির সুর শুনে চেনা বলে আন্দাজ করেছিলাম মাত্র। মজ্জেলই আমাকে প্রথম চিনল, তাও চাঁদনি রাতে একসমুদ্র আলোয় আমার কাঁপা কাঁপা অবয়ব দেখে; অথবা হতে পারে আগে থেকেই ও আমাকে চিনতে পেরে অনুসরণ করছিল।

‘কী দাদাভাই, মিঠুন-কাট লাগবি নাকি?’ মজ্জেল বাঁশিটা মুখ থেকে নামিয়ে ওর সেই গালটানা হাসিটা হেসে বলল।

‘এখন আর তোমার মিঠুনের যুগ না। এটা হলো রণবীরদের যুগ- এক রণবীর সিং আর এক রণবীর কাপুর! ওদের অবশ্য তুমি চিনবে না।’ আমিও যথারীতি হাসতে হাসতে উত্তর দিলাম। আমরা পাশেই একটি গাছের গুঁড়ির ওপর দু’জন দু’দিকে মুখ করে বসলাম। ২০০৯ সালে আইলাতে সমুদ্রের শরীরের এদিকটাতে আরো কিছুটা জল ধরে, বেদখল হয় লোকালয়ের অংশবিশেষ, দু-একটা গাছের গুঁড়ি এখনো ভাটার সময় জেগে ওঠে।

‘তুমি এখানে যে? আমি জানতে চাইলাম।’

‘গাঙের ধারে বসি বাপজানের কাছে সাগরের মেলা গল্প শুনছি। বাপজান শুনছে তার বাপজানের কাছে। সেই শুনছে আবার তার বাপজানের কাছে। চৌদুপুরুষে কেউ সাগর দেকিনি। গাঙ শুকি খাল হলু, খাল শুকি খটখটি মাঠ। মরার আগে বাপজান আমার হাতখান ধরি বুলিলো, তুই দেখিস বাপ। তোর কাছে আর কিছুই আমার চাওয়ার নেই। মাসে তার ছেলির কাছে কত কিছু চায়–ছেলি ডাক্তার হবি, হাকিম হবি, মাতব্বর হবি-দশ গাঁয়ির মানুষ তাকে মান্য করি চলবি। আমার বাজান চেইছিল, আমি সাগর দেখবু। গেল বছর একিনে এসিচি। তার আগে কক্সবাজারে ছিলাম।

‘সমুদ্র তোমার ভালো লাগে? আমি আনমনা হয়ে জানতে চাই।’

‘কি জানি! তয় ডাঙায় আর মন টেকে না। মনটা খালি তড়পায়। জল বড় মায়া ডাক ডাকে রে ভাই!’

‘বাঁশিতে একটু ফুঁ দাও না মজ্জেল। কত দিন জলের কিনারে বসে তোমার বাঁশি শোনা হয়নি। তুমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমাদের শান বাঁধানো পুকুড়পাড়ে বসে বাঁশি বাজাতে, আর আমরা তোমার পাশে গোল করে বসে তন্ময় হয়ে সেই বাঁশি শুনতাম–মনে পড়ে?’

মজ্জেল কোনো কথা বলে না। সমুদ্রের জলের মতো ওর চোখেও চাঁদের চিকন আলো গলে-মিশে একাকার হয়ে যায়। বাঁশিটা মুখে তোলে মজ্জেল। বাঁশি বাজায় চোখ বন্ধ করে, ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো একমনা হয়ে। সেই মজ্জেল, তেমনই আছে, তেমন সুরেলা বাজায় সে।

আমার বয়স যেদিন সাত দিন হলো, সেদিনই আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ। আমার আঁতুরে চুল ফেলার জন্যে মা ডেকেছিল। তপ্ত দুপুরে গোলাঘরের চালের তলে বসে আমার চুল কেটেছিল। আমি ছিলাম দাদির কোলে ধরা। শুধু আমি না, প্রথম চুলকাটা থেকে অনেক বড় হওয়া অবধি আমার চার ভাইয়ের চুল কেটেছে ও। গাঁয়ের প্রায় সকল আবালবৃদ্ধবনিতার চুল মজ্জেলই কাটত। গুরুদায়িত্ব বটে। আমার চুল কাটা শেষ হলে ও কাঁঠালের সার দিয়ে গরম ভাতে জল ঢেলে পান্তা বানিয়ে খেয়েছিল। ছেলের প্রথম চুল কাটা, মা বাড়ির পোষা মুরগির ঝালমাংস রান্না করেছিল, মজ্জেল খায়নি। ক’টা টাকা বকশিশ দিতে চেয়েছিল মা, তাও নেয়নি। বরাবরের মতো কেজিখানেক চাল গামছায় বেঁধে হাঁটা দিয়েছিল। এসব কথা আমার মায়ের মুখে শোনা। মজ্জেল যেদিন মারা গেছে বলে সংবাদ এল, সেদিন মা আমাকে দুঃখ করে কথাগুলো বলছিল। কোনো এক শুক্রবারে জুম্মার আগে মজ্জেলকে বাড়িতে ডাকা হতো। আমরা পিঠাপিঠি দু’ভাই খালি-গা হয়ে বসে পড়তাম। মজ্জেল বাবার চাকু-কাস্তে ধার করা বেলিটে বালু দিয়ে তার খুর ধার দিত। আমরা বসতাম, মজ্জেল তার স্বভাবজাত ঢঙে জানতে চাইত, ‘মিঠুন না অমিতাভ? আমি বলতাম, মিঠুন। মেজো ভাইয়ের পছন্দ ছিল অমিতাভ। মজার ব্যাপার হলো, আমরা কেউই তখন অমিতাভ বা মিঠুনকে চিনতাম না। গায়ে তখনো টেলিভিশন ঢোকেনি। আমার ধারণা মজ্জেলও দেখিনি। তবে সেই ধারণা ভুলও হতে পারে পাশের গায়ে চুল কাটতে গিয়ে হয়ত কারো বাড়ি দেখে থাকতে পারে। কারণ পাশের গায়ে তখন তিনটা টিভি আছে বলে আমাদের কাছে খবর ছিল। গায়ে গায়ে কাজিয়া বাঁধলে ওরা এই টেলিভিশন থাকা নিয়ে বড় বড়াই করত। চুল কাটা হলে আয়নায় দেখতাম, দু’জনের চুল কাটার স্টাইল হুবহু এক। মজ্জেলের চুল কাটার ভ্যারিয়েশনটা ছিল ওর মুখেই, কাঁচিতে না। সারা গায়ে একভাবেই চুল কেটেছে বড়-ছোট সবার। বৈচিত্র্য ছিল না ওর বাঁশির সুরেও। সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত একটানা একসুরে বাজত ওর বাঁশি। একসুরা হলেও বেসুরা ছিল না। প্রতিদিনই মনে হতো নতুন করে শুনছি, এমনই দরদ দিয়ে বাজাত ও।

‘চল একটু হাঁটি। বাঁশিটা মুখ থেকে নামিয়ে বলল মজ্জেল। আমরা হাঁটতে থাকি।

‘আচ্ছা, রাত বিশেষ হয়নি, ওদিকটায় মানুষ যা আছে একেবারে কম না। এদিকটা এমন ফাঁকা কেন? আমি জানতে চাই।

‘আমি আছি বুলি!’ সরলভাবে উত্তর করে মজ্জেল। রাতে বাতাসে বাঁশির সুর শুনি কেউ আসার সাহস পায় না। আমাকে তো আর কেউ দেখতি পায় না! ভয় দেখি বিশ্বজয়, বুঝলি দাদা?’ মজ্জেল বাঁকা হাসি হেসে বলে।‘

 ‘সেদিন তুমিও যদি কোনো ভয় ওদের দেখাতে পারতে, তাহলে তো আর তোমাকে ওইভাবে নিরুদ্দেশ হতে হতো না। বলি আমি।

 মজ্জেল কোনো কথা বলে না। আনমনা হয়ে কী যেন ভাবে।

 ‘বিশ্বাস করো, আমি ওদের দলে কোনো দিনই ছিলাম না। সবাই একজোট ছিল বলে, আমি বিরোধিতা করতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, যদি বলো নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ, তবে আমার অপরাধ মেনে নিতে আপত্তি নেই। আমি মজ্জেলকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি।

 ‘সব বুঝি, দাদাভাই। তুমি আমার বাঁশির সুর ভালোবাসতি বুলিই তো আবার আমাদের ফের দেখা হয়িচে। আবার এত দিন পর আমি কারু জন্যি বাজাচ্ছি।’

‘তাহলে মাঝে এত দিন কার জন্যে বাজিয়েছ?

‘অভ্যেসে। অভ্যেসে বাজাই এখন।

নাকি নিজের জন্যে?

হতিও পারে। মজ্জেলের নির্বিকার উত্তর। সমুদ্রের দিকে বোবাদৃষ্টি দিয়ে বাঁশিটা আবার তুলে নেয় সে।

আমাদের সবাইকে রাতে ঘুম পাড়িয়ে তবেই ঘুমাতে যেত। আমার ঘুম আসত একটু দেরিতে। মজ্জেল যখন হেঁটে হেঁটে বাঁশি বাজাতে বাজাতে গাঁয়ের ও প্রান্তে চলে যেত, তখন মনে হতো অন্য কোনো জগৎ থেকে ভেসে আসছে সুরটা। একবার মনে হতো, স্বপ্নের ওপাশ থেকে, আর একবার মনে হতো, মনের কোনো গোপন স্থান থেকে। ফজরের আযানের কিছু আগে বিশ্রামে যেত সে। প্রতিদিনই দেরিতে ওঠার জন্যে মা’র বকা শুনতে হতো আমাকে। মজ্জেলকে একবার বলেওছিলাম সে কথা। ও হাসতে হাসতে বলেছিল, আমি তো অত রাত পর্যন্ত বাজাইনি, দাদাভাই। এশার আযান হলিই আমার ফুঁ ফুরিয়ে যায় যে!

 বাতাস কমে আসার সাথে সাথে সমুদ্রের কণ্ঠস্বরে খানিক পরিবর্তন আসে। আমার এমন শান্ত-নীরব সমুদ্র দেখলেই বেশি ভয় করত। এখন অবশ্য আর কিছুতেই ভয় করে না। এখন এই অবস্থায় একভাবে টানা কিছুক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, সমুদ্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, যে শব্দটা আসছে, ওটা ওর নাক ডাকার শব্দ। আমি একটু একটু করে সমুদ্রকে বুঝে উঠতে শুরু করেছি।

 ‘গাটা মেলা বদলি গিচে, তাই না দাদাভাই? মজ্জেল বাজানো থামিয়ে জিজ্ঞেস করে।

হুম। অনেক বদলেছে। বাড়ি বাড়ি লম্বা প্রাচীর উঠেছে, হুটহাট কারো বাড়ি যাবার জো নেই। বাড়ির মেয়েরা আর যখন-তখন বের হয় না। পাড়ার ছেলেরা এখন সীমান্তে ফেনসিডিলের কারবার করে। গাঁয়ে আগে মসজিদ ছিল একটা, তাও যেমন তেমন করে বাঁধানো; এখন অনেকগুলো মসজিদ উঠেছে, অট্টালিকার মতো, গায়ে গায়ে বৈদ্যুতিক ফ্যান লাগানো। মোড়ে মোড়ে সেলুন হয়েছে। আধুনিক সব মেশিনে চুল কাটা হয়।

বাহ!’ এটুকু বলেই মজ্জেল থেমে গেল। কিছু একটা যোগ করতে গিয়ে করল না।

‘এখন বাড়ি বাড়ি টেলিভিশন, কত গান-বাজনা হয়, অথচ বাঁশি বাজানোর অপরাধে তোমাকে গ্রামছাড়া করা হলো। কোথা থেকে এসে সাফি হুজুর কি ফতোয়া দিল, আর অমনি গ্রামবাসী ঝাঁপিয়ে পড়ল। অথচ এই গ্রামবাসীই তুমি একরাত অসুস্থ হলে বাঁশি শুনতে পাবে না বলে বিচলিত হয়ে পড়ত। তোমার ত্বরিত চিকিৎসার ব্যবস্থা করত।

‘একবার আমার গা-গরম কিছুতেই বাগে আসছিল না। মিনু কবিরাজ তার চিকিৎসা ফেল মেরি গেল দেকি পাবনার এক বড় কবিরাজকে ধরি এনিছেল। আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে যোগ করে মজ্জেল।

 ‘অথচ তোমাকে গ্রামছাড়া করার মিছিলে নেতৃত্বস্থানে ছিল সেই মিনু কবিরাজ। মনে পড়ে তোমার?

 সমুদ্র কত মহান দেখ দাদাভাই। একটা আস্ত জগৎ কেমন মায়ের মতোন মমতা দি পেটের ভেতর বেঁধি রেকিচে।’ প্রসঙ্গ বদলায় মজ্জেল।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে আরো একটা গুঁড়ি পেয়ে যাই। দু’জনের অখণ্ড সময়, বসে পড়ি আগপিছ করে। মজ্জেলকে বাঁশিটা ধরতে আবারো অনুরোধ করি। সে ফুঁ দেয়। আমি চোখ বন্ধ করে অনুভব করি, বহুদূর থেকে ভেসে আসছে সুরটি। আমি বালিশ থেকে মাথা তুলে চেটেপুটে সমস্ত সুরটা উপভোগ করার চেষ্টা করছি। এটা ছিল আমার রোজকার কাজ। মজ্জেল বাঁশি বাজাতে বাজাতেই কোনো একগাছের গুঁড়িতে বসে কিংবা কারো বাঁশের মাচানে শুয়ে অথবা কারো বাঁধানো পুকুরে পানির ভেতর চাঁদের প্রস্থান দেখতে দেখতে রাতটা কাটিয়ে দিত। ঘরসংসারহীন মানুষ সে ছিল না। সে তখন আট সন্তানের বাবা- পাঁচ মেয়ে, তিন ছেলে। একটির সঙ্গেও তার চেহারার মিল নেই। মাঝরাতে মজ্জেলের বৌয়ের বিছানা থেকে একেকদিন একেক জনকে উঠে আসতে দেখা যেত বলে রটনা আছে। বছর বিয়াতো মজ্জেলের বৌ। যদিও গাঁয়েই বাড়ি, তবুও বেশ কয়েক দিন পর পর নিজের বাড়ি যেত সে। বাড়ি থেকে বের হতো দুকাঁধে দুই মেয়েকে নিয়ে। সব সময় দুকাঁধে দুজন থাকত, একজোড়া বড় হলে পিঠাপিঠি অন্য জোড়া আসত। মজ্জেল গভীর মমতা দিয়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খানিকটা সময় বা গোটা দিন কাটিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ত বাঁশি আর চুলকাটার সরঞ্জাম নিয়ে। সংসারে তার অবদান বলতে ছিল, ছেলেমেয়েদের জন্যে মাঝে-মধ্যে মুঠোভর্তি চার আনা দামের লজেন্স নিয়ে যাওয়া। বৌ মেজাজ খিঁচিয়ে তার অর্ধেক ফেলে দিত রান্নাঘরের ঝাঁপির ওপাশে গা ঘিন ঘিন করা কাদার ভেতর। ছেলেমেয়েরা সেটাই কুড়িয়ে পুকুরের পানিতে ধুয়ে পলিথিন ছাড়িয়ে অন্য ছেলেমেয়েদের লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে চুষে বেড়াত। মজ্জেলের সেজো মেয়েটা আট বছর বয়সে বাগানে রক্তাক্ত অবস্থায় মারা যায়। রক্তাক্ত কেন হলো, সেটি নিয়ে গায়ে খুব বেশি আলোচনা। হয়নি। চেয়ারম্যান চোখ রাঙিয়ে সবাইকে চুপ করে দিল। মেয়েটিকে কোলে তুলে মজ্জেলের সেকি কান্না–ওই প্রথম এবং ওই শেষ কাঁদতে দেখি তাকে। মজ্জেলের লাশ যেদিন পাওয়া যায়, ঠিক তার দিনসাতেক পরে তার বৌ এক পুত্রসন্তান প্রসব করে। অবিকল মজ্জেলের মতো দেখতে। গাঁয়ের মানুষ ভেঙেছিল শিশুটিকে দেখতে। আমিও গিয়েছিলাম। নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। এগার দিনের মাথায় মারা যায় শিশুটি। ভাবলাম কথাগুলো মজ্জেলকে বলি। আবার মনে হলো থাক, এত দিন বাদ সেসব কথা না তোলাই ভালো। আছি যখন, অন্য দিন আরো কথা পাড়া যাবে।

মজ্জেল বাঁশিটা মুখ থেকে নামিয়ে লুঙ্গির ভাঁজে গোঁজে। আমাকে তুমি মাফ করি দাও দাদাভাই। মজ্জেল বলে।

 ‘তুমি তো কোনো অন্যায় করোনি আমার কাছে। ক্ষমা চাচ্ছ যে?’ জিজ্ঞেস করি।

‘জলের স্রোত যকুন তুমাকে টেনি নি যাচ্ছিল, তকুন আমি তুমাকে অনেক বাঁচানুর চেষ্টা করিচি। পারিনি। দেহহীন ইচ্ছাশক্তি বড্ড অকেজো।

 ‘তোমাকে আর বলতে হবে না সেসব। এ কয় দিনে আমিও কিছুটা বুঝেছি।’

 আমরা আর কেউ কোনো কথা পাড়ি না। সহসা যেন দুজন দুটো প্রাচীন বৃক্ষের ন্যায় অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হয়ে প্রায় কোনো ঘটনাকেই আর ঘটনা মনে না করে নির্বিকার বসে থাকি। মাথার ওপর দিয়ে রোজকার মতো পথ কেটে কেটে নিঃশব্দে বাড়ি ফেরে একথালা চাঁদ। সমুদ্র শেষবারের মতো পাড়ে আছড়ে পড়ে গুটিয়ে যেতে থাকে। ভাটা যে কেবলই ভাটা নয়, বিশাল সমুদ্রের ছোট হয়ে যাওয়ার চেষ্টা, সিসিফাসের সেই ব্যর্থ চেষ্টার নামান্তর তা আর কজনেই বা বোঝে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *