৩. কালপ্রবাহ

০৩.

উৎসর্গ: দাদামশায় বিমলাচরণ সেনগুপ্ত ও দিদিমা সুবোধবালা সেনগুপ্তকে

কালপ্রবাহ এক অদ্ভুত জোড়া শব্দ। কোমোদিন এই নশ্বর তেতলার ছোট্ট বারান্দায় বসে দূরের সান্ধ্য লাল মেঘ দেখতে দেখতে সাময়িক বোধিলাভ হয়। ভাবি, কাল বলে কিছু নেই, আছে শুধু প্রবাহ। সর্বপ্রকার অস্তিত্ব নিজধর্মেই রূপান্তর পায়। এই তো চোখের সামনে দেখছি, সবাই সবাইকে পালটে দেয় সূর্যডোবা আলো মেঘকে পালটে দিয়েছে, লাল মেঘ বিকেলকে পালটে দিল, বিকেলের ব্রহ্মাণ্ড আমাকে পালটে দিচ্ছে। সবাই সবাইকে পালটে দিচ্ছে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবার মতো, সবাই মিলে উৎসবে মাতবার মতো।

চিন্তা এইখানে আসতে আসতে সন্ধে হল, আকাশে দু-চারটে তারা ফুটে উঠল, ফিসফিস করে কেউ মনের মধ্যে শুধোল, অস্তিত্বগুলির রূপান্তরিত হবার ঐ নিজধর্মই কাল নয় তো? আরো ভাবতে ভাবতে দেখি, যখন সম্পূর্ণ জগৎ প্রলয়ের সীমানার মধ্যে চলে যাবে, সেই পূর্ণ অনস্তিত্ব বা শূন্যতা ভরে যে না-থাকার মতো করে থাকে বা থাকার মতো করে না থাকে সেই হচ্ছে কাল। প্রলয়ের আগে পরে যেমন কাল নেই, শুধুই প্রবাহ, তেমনি প্রলয়ের মধ্যে প্রবাহ নেই, শুধুই কাল।

পৃথিবীতে কালের গতি মাপবার সহজ একক হল একটি দিন-রাত। দিনরাতের একক কিন্তু আপেক্ষিকতত্ত্বের অধীন। চার হাজার যুগে অর্থাৎ সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলির হাজার বার আবর্তনে ব্রহ্মার এক দিন। আর এই দীর্ঘ ব্রাহ্ম দিনের হিসেবে ব্রহ্মার আয়ু এক শো বছর। মানুষের আয়ু যেমন একশো সৌর বছর, কাছিমের আয়ু যেমন আড়াইশো সৌর বছর, মে ফ্লাইয়ের আয়ু যেমন বসন্তসাঁঝের এক প্রহর, এও সেইরকমই। তাহলে ব্রহ্মারও মৃত্যু আছে। এটা জানার পর আমার সময়ধারণা অন্য মাত্রা পায়।

দেবতাদের আকাশে সময় বড় দ্রুত, টকাটক চলে। অথবা সময় ঘনীভূত হয়ে ঠাসা আছে সেখানে। একদিন হিমালয়ে বসে শিব দুর্গা গল্প করছিলেন, এমন সময় দুম করে একটা শব্দ হল। দুর্গা জিজ্ঞেস করলেন, কী হল? শিব বললেন, রাবণ জন্মাল। তাঁরা গল্প করতে লাগলেন। খানিকক্ষণ পরে ফট করে আবার একটা শব্দ হল। দুর্গা জিজ্ঞেস করলেন, কী হল? শিব বললেন, রাবণ মারা গেল। আকাশে দেবতাদের সময় এই রকমই টকাটক চলে, নইলে কি ওঁরা ছায়াপথ, নক্ষত্ৰজগৎ, নীহারিকামণ্ডলের আলোকব মাপের নড়াচড়াকে এত নির্লিপ্ত মনে সইতে পারতেন!

সময়, আমাদের নশ্বরদের জন্য তৈরি একটি মায়া দেখতে না দেখতে, স্বাদ নিতে না নিতে ফুরিয়ে যায়। এই তো সেদিন কচি আমবউলের মতো শরীর উঁশা হল, মিহি হল, উতল হল, আর এরই মধ্যে দেখছি ঝরে পড়ার সময় এসে গেছে। আর শু কি শরীর, তার সঙ্গে নসিব আছে না! সুভাগার ভাগ্য যেন বাচ্চাদের লাল হলদে সবুজ কাগজের হাত-চরকি- একটু হাওয়া পেলেই ফুরফুর করে ঘোরে। আর অভাগার ভাগ্য কর্ণের রথচক্র কালো, ভারী, ক্রমাগত মাটিতে সেঁধোয়, আপ্রাণ টেনেও তুলতে পারি না।

.

ফিরে আসা এবং ছেড়ে যাওয়া

ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হলে অসমের সেই নদীউপত্যকার দেশ ছেড়ে দাদামশায়ের কাছে কলকাতায় না গিয়ে ফিরে এলাম গ্রামে, আমার জন্মভূমিতে, পূর্বপুরুষের ভিটেয়। ইচ্ছে করে বা কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে ফিরি নি, আর-কেউ অন্য কোথাও ডাকে নি বলেই এখানে এসেছি। কদিন থাকতে পারব তাও জানি না। এই অনিশ্চয়ের বিন্দু থেকেই বিপন্নতার শুরু। গীতায় সংশয়াত্মার খুব নিন্দে করা হয়েছে। বিপন্নেরা সংশয়াত্মা আর হৃদয়হীন হবে না তো কী হবে।

সে বাড়িতে বাসিন্দা তখন ছজন বড়মা, মা আর চারটি ছোট ছোট ভাইবোন। দাদু ঠাকুমা আর কাকার মৃত্যুর ন বছর পরেও দেখছি ঘরের খুঁটিগুলো আড়ার সঙ্গে, চালের বাতার সঙ্গে শক্ত করেই বাঁধা আছে। বাবা মাঝখানে কয়েকবার এসে গৃহসংস্কার করে গেছেন। ঘরদোর মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। তবু কোথায় যেন বাঁধন জীর্ণ হয়ে গেছে। আমি একবারও অনুমান করি নি, বাবারই সংসার এটা, বড়মা শুধু টিটিউলার হেড।

বড়পুকুরে মহিলারা মেয়েরা বাসন মাজতে, কাপড় কাঁচতে, গা ধুতে, জল ভরতে আসে। সেখানে ঐ-ঘরের-মাকে দেখি না। তিনি মারা গেছেন। তাঁর বালক ছেলে ফুচু সেও কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্ক হয়ে মারা গেছে। তাঁর মা-মরা শিশু মেয়েটি আগুনে পুড়ে গিয়েছিল পোড়ার ঘা সেরে গেছে, কিন্তু কেউ লক্ষ করে নি বলে বাঁ হাতটি বা বুকের সঙ্গে জুড়ে গেছে। কখনো ন্যাংটো, কখনো ছোট্ট জাঙিয়া পরা, বাচ্চা মেয়েটির সারা দেহে পোড়ার দাগ। আগুন কিন্তু তার মুখকে স্পর্শ করে নি, শুধু বাঁ কানের লতি এবং বাঁ কপালের রগ একটু ছুঁয়ে চলে গেছে। তার চোখদুটি নীল, ঠোঁটদুটি লাল, গালে ময়লার দাগ, চুলগুলো কেউ এবড়োখেবড়ো করে হেঁটে দিয়েছে। আমি যেমন ঐ-ঘরের মার কাছে স্নেহ নিতে যেতাম সেও তেমনি যখনতখন চলে আসে এই বাড়ির মার কাছে। সে মায়ের পায়ে পায়ে ঘোরে। মা বলে, ওর নাম ফুরতি।

এর মধ্যে বাড়ির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ধনদিদির ছোট মেয়ে সুবচনী অর্থাৎ সুবিপিসির দূর গ্রামে বিয়ে হয়েছিল, বিয়ের পরই সে বিধবা হয়েছে। বিধবা হয়ে সে মায়ের মতো মোটা হয়েছে, ফরসা গায়ের রঙে সাদা থান পরে তাকে পুষ্ট থোড়ের মতো দেখায়। ছোড়দাদু একটা গরু কিনেছেন- সে গরু গুতিয়ে তাঁর একটা চোখ কানা করে দিয়েছে। সোনাদাদুর ভিটে, কুতুকাকাদের ভিটে, রাঙাদাদুর ভিটে ফাঁকা পড়ে আছে। পরিত্যক্ত ঘরগুলোর ভাঙা জানলা দিয়ে বুনো লতা নিঃসাড়ে ভিতরে ঢুকে মাটির হাঁড়ি, বেতের ঝাঁপি হাতড়ে দেখছে। বুনো লতাগুলোর স্বভাব ঠিক বুনো সরীসৃপদের মতো। ভাঙা বেড়ার ফাঁকে উঁকি দিলে হঠাৎ চমক লাগে- কুণ্ডলী পাকানো লতার ডগাগুলো ওখানে ও কী করছে? বাড়ির চারদিকের জঙ্গল, খালপাড়ের জঙ্গল যেমন ছিল তেমনি আছে। তেঁতুলতলার কাছে বেতের বন তেমনি কাঁটায় আকীর্ণ। ধনদিদিদের ডোবার পশ্চিমে তারাবনটি তেমনি ঘন সবুজ ও দুর্ভেদ্য। আমাদের পশ্চিমপুকুরটি, ঘাটের কাছটুকু ছাড়া, কলমি আর হিঞ্চের দামে জমাট বেঁধে আছে। কলমির বেগুনি ফুলের উপর ফড়িং উড়ে বেড়ায়। সোনাদাদুদের পুবের পুকুর আগাগোড়া কচুরিপানায় ঢেকে গেছে। মাছের আশায় পুকুরপাড়ের গাছে আগে শঙ্খচিল মাছরাঙা বসে থাকত, এখন আর তারা বসে না। বড়পুকুরের দক্ষিণ পারে যে বিশাল রেইন ট্রি বা শিরীষ গাছটি ছিল, কথায় কথায় যার কাছে আমি পালিয়ে যেতাম, যার ফাটা ফাটা গায়ের বাকল শোলার মতো নরম ছিল, আমাদের পুরো বাড়িটার দক্ষিণ শিয়র যে একাই পাহারা দিয়ে রাখত, এবার এসে দেখছি সে নেই, বড় করাত দিয়ে তাকে গোড়া থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। বাড়ির দক্ষিণ দিক বেআবরু, হা হা করছে। তবু এই ক’বছরে আমাদের পুরো বাড়িটার সবুজ রং কি আরও দু-এক পোচ গাঢ় হয়েছে? অযত্নে তার মধ্যে একটা পোড়া ভাব এসেছে যেন। তেঁতুলতলা, বেতের বন, সোনাদাদুদের পুকুরপাড় চুলখোলা এক উন্মাদিনীর মতো। নীল আকাশের নিচে আমাদের পুরো বাড়িটা অসংস্কৃত একটুকরো পান্নাপাথরের মতো গাছগাছালি ক্রমশ এসে তাকে আরও ঘিরে ধরছে। আর চুনির ঠোঁট, নীলার চোখ, বিকলাঙ্গ, পোড়া ফুরতি যেন সেখানকার ড্রাইয়াড়দের শিশু মেয়ে, যখনতখন এ বাড়ি ও বাড়ি আর জঙ্গলে তাকে দেখা যায়।

দক্ষিণে রেইন ট্রি গাছটি নেই বাড়ির সবচেয়ে বিশাল স্তব্ধতা আর হালকা পাতার তিরতির কাঁপন আর গভীর অস্তিত্ব অতখানি জায়গা ফাঁকা করে চুপচাপ চলে গেছে। তার গুঁড়িতে বাকলের ফাটলের ডেয়ো পিঁপড়ে আর সাধারণ খুদে পিঁপড়ে চলাফেরা করত। আমি পুকুরপাড়ে বসে কল্পনা করি আমরা যেমন কৈলাস-মানসসরোবরে যাই তেমনি হয়তো এক অভিযাত্রী খুদে পিঁপড়ে একদিন শিকড় থেকে হেঁটে হেঁটে মগডালের দিকে তীর্থযাত্রা করেছিল। একেবারে ডগায় পৌঁছতে হয়তো তার মাসখানেক লেগেছিল। উঠে কিন্তু সে সত্যিই দেখতে পেল: মানসসরোবর আঃ! কত বড় নীল হ্রদের মতো আকাশ! তার শুঙ্গে এসে লাগছে হ্রদের শীতল হালকা জলকণা, দূরে আবছা কৈলাসের মতো সুদূর মেঘ। তার জন্ম সার্থক।

সেই রেইন ট্রি গাছটি নেই। গতবছর বাবা এসে করাতিদের দিয়ে তাকে গোড়া থেকে কাটিয়েছেন। বাবার ইচ্ছে কাঠের একটি বাড়ি বানাবার। কিন্তু হঠাৎ কী যে হল কে জানে তৈজসপত্রসমেত আমাদের পুরনো বাড়ি বেওয়ারিশ পড়ে রইল, বাবা তাঁর সংসার গুটিয়ে জীবিকাস্থলে তুলে নিয়ে গেলেন। এই ঠাইনাড়ার সময় বড়মা একটা সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন, সেই পরিত্যক্ত বাড়িতে জনহীন সন্ধ্যায় লণ্ঠন হাতে এঘর ওঘর করার জীবন থেকে নিজেকে অব্যাহতি দিয়ে তিনি কাশী চলে গেলেন। সেই চলে যাওয়া, সেই বিচ্ছেদ আমি দেখি নি। তার আগেই আমি কলকাতায় চলে এসেছিলাম।

মাঝে মাঝে মনে পড়ে। সব যদি ঠিকঠাক থাকত, যদি বাড়ি থাকত, দেশ থাকত, গাছটি বেঁচে থাকত তবে আজ তার বয়স অন্তত দুশো বছর হত। দাদু ঠাকুমা কাকা বাবা রাঙাদাদু ছোড়দাদু সবাই চলে গেছেন, কিন্তু গাছটি তো থাকতে পারত, আমার অতিবৃদ্ধ দাদুদের বংশাবলিতে এক অমর পুরুষ হয়ে অন্য দেশেই না হয় অনন্তকাল ছায়া দিত সে।

১৯৪১। এই সময় আমার সবে সোল বছর পূর্ণ হয়েছে। এখন আমার পড়াশোনা নেই। পরীক্ষা দিয়েছি বটে, কিন্তু কেমন দিয়েছি সে কেবল আমিই জানি। মাঝে মাঝেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অদৃষ্টবাদী বালকের মতো ফলনির্ণয় করি- এক দমে যদি দূরের ঐ গাছটা পর্যন্ত যেতে পারি তবে পাশ, দম ছুটে গেলে ফেল। এই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম– পাঁচ মিনিটের মধ্যে যদি একটা পাতা খসে পড়ে তা হলে পাশ, না পড়লে ফেল। আসলে আমি খুব খারাপ ছাত্র। শিশুকাল থেকেই পড়ার বই না পড়ে কেবল না-পড়ার বই পড়েছি। ফলে সারা জীবন অনিশ্চিত এবং মলিন হয়ে কাটাতে হল। কী বলব, এত বয়স হল, এখনও মৃত্যুর স্বপ্ন দেখি না, অথচ একজামিনেশন ড্রিম দেখি রাত্রে, অন্ধকারে, পরীক্ষায় নানারকম বিপৎপাতের স্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায়– গলা শুকিয়ে বুক ধকধক করে, সব সত্যি বলে মনে হয়। অনেকক্ষণ পরে বুঝতে পারি, নাঃ, সবই তো ঠিক আছে।

কিশোরশরীরে তারুণ্য আর বলিষ্ঠতা যুগপৎ আসে। আমার শরীরে বলিষ্ঠতা আসছিল, কিন্তু তারুণ্য এল না। এ হল যেমন কোনো বর্ষার দিনে ঘন মেঘ করে এল, দূর থেকে ভিজে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে, মাঠের ঘাসে ছায়া তিন পোঁচ গাঢ় হয়ে নেমেছে, বৃষ্টি এই এসে পড়ল বলে। কিন্তু নাঃ, দু-চার বার বিদ্যুৎ চমক দিয়ে ধীরে ধীরে মেঘ কেটে গেল। মনের গুঞ্জরন, কথাবার্তা, কলস্বর যখন অন্যের কাছ থেকে প্রতিধ্বনি পায় না তখন তারুণ্য মুখচোরার মতো সরে পড়ে। তারুণ্য একটি প্রদোষকাল। দোসরের অভাবে তারুণ্যহীন আমার বলিষ্ঠতা নিওলিথ হাতুড়ির মতো নির্মম আর ভোতা হয়ে উঠছিল।

কেউ আমাকে উৎসাহ দেয় নি, আমি নিজেই দিনগুলোকে নিয়মানুবর্তিতায় বেঁধে ফেলেছিলাম। ভোরে স্নান করে সকালের খাবার খেয়ে একটি বই নিয়ে বড়পুকুরের ওপারে আমাদের শ্মশানে চলে যেতাম। আমাদের শ্মশান মোটেই ভয়ংকর বা বৈরাগ্যসঞ্চারী নয়, বরং অযত্নে ফেলে রাখা গাছপালায় ভরা একটি উপবনের মতো। বই পড়ার পক্ষে চমৎকার জায়গা।

ঘরে বসে পড়া একরকম, কিন্তু শ্মশানের কাছে গাছের ছায়ায় বই পড়তে বসলে পড়া অন্যরকম হয়ে যায়। একটা অনুচ্ছেদ পড়ে কতক্ষণ ধরে ভাবি, তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছি এমন কমই ঘটে। আনমনে তাকাই। সঁড়িপথে দেখি বেজি চলেছে লুকিয়ে, ঝোপের মধ্যে শেয়াল উঁকি দিল বোধ হয় ওখানে তারা বাসা করেছে, একটু দূরে চিরস্থায়ী ছায়ার মধ্যে একজোড়া ডাহুক এসে সাবধানে হাঁটছে। বেজি শেয়াল ডাহুক কারো মুখে কথা নেই। বেজি কি আদৌ ডাকে? কোনোদিন শুনি নি। একটু বুঝি হাওয়া বইছে, পোকা কিটকিট শব্দ করছে– সেই শব্দ মিশে গেল বইটির একটা বাক্যের গায়ে। কেমন যেন অর্থহীনতা পেয়ে বসে। অনেকক্ষণ পরে চটকা ভাঙলে আমি পরের অনুচ্ছেদের উপর চোখ রাখি। হঠাৎ মনে কামড় লাগল, পরীক্ষার ফল বেরুতে আর বেশি দিন বাকি নেই বইটার সেই পৃষ্ঠায় দুঃখ অনিশ্চয়তা হঠকারী চিন্তা মিশে গেল।

বেলা চড়লে ঘরে ফিরি। একই রান্নাঘরের দুই প্রান্তে দুই আলাদা উনুনে মা আর বড়মা রান্না করেন। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বড়মার রান্না করা দেখি। তাঁর বাসনপত্র সংক্ষেপের কঠোর দৃষ্টান্ত বোখনো, কড়াই, একটি বড় বাটি, ভাত খাবার একখানা কালো পাথরের থালা, জলের ঘটি, হাতা, খস্তি, বেড়ি। এছাড়া নারকেলের মালায় তৈরি নুনের পাত্র, ঘিয়ের শিশি, তেলের বোতল। সারা দিনে বড়মা এক বারই রাঁধেন, এক বারই খান। খাবার পরে উনুন নিকিয়ে আদ্যোপান্ত বাসন বড়পুকুরে নিয়ে গিয়ে মাজেন। ক্রমশ রোদ নরম হয়ে আসে। তাঁর নিজের তৈরি পাটিতে শুয়ে একটু গড়িয়ে নেবার সময় আর নেই। বড়মা দেখতে পান, দুপুরের তাপে যে-শোলমাছটি পুকুরের তলায় চলে গিয়েছিল সে এখন উঠে এসে পাড়ের কাছে নিথর হয়ে আছে।

মায়ের হেঁশেল ছড়ানো-ছিটনো বিশৃঙ্খল। তার তিনটে ছেলেমেয়ে কে কোথায় বাসন ছড়াচ্ছে, ডালা কুলো নিয়ে যাচ্ছে, জামাকাপড় ফেলে আসছে কে এত দেখে রাখে! হাঁসেরা যে-পুকুরে চরে বেড়ায় সেখানে জলে, শৈবালে, পাড়ের ঝোপে পালক পড়ে থাকে সন্ধেবেলা।

এই মলিন গাৰ্হস্থ্যের মায়া বড় বেশি ঘরে জিনিস কম, যাও বা আছে তা তুচ্ছ জিনিস, ফাঁকা জায়গাগুলি ভরে রেখেছে মায়া। ছায়া পড়ে এলে উঠোনের ধুলো পায়ের নিচে স্নিগ্ধ লাগে। ভাইবোনদের চুল অযত্নে তামাটে সে করুণতা হঠাৎ মায়া টেনে নেয়। জীর্ণ বিছানা সারা দিন রোদ খাইয়ে বিকেলে ঘরে তোলা হলে তার শরীরী স্পর্শে গভীর সুখ পাই। এই জায়গা ছেড়ে আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না আমার।

দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত যতক্ষণ দিনের আলো থাকে আমি ছবি কপি করি, কখনো স্টাডি করি, সব রেখাচিত্র, পেনসিলে। আমার সবচেয়ে ছোট ভাইয়ের বয়স এক মাস। একটা মস্ত বড় তক্তপোশের এক পাশে আমি আমার কাজ করি, অন্য পাশে সে শুয়ে থাকে, হাত-পা ছোঁড়ে। দুপুরটা ছবি এঁকে কাটে। সন্ধেবেলা বারান্দায় বসে দেখি, নিচের আকাশ দিয়ে কাকেরা ঘরে ফিরছে, উপরের আকাশ দিয়ে বাদুড়েরা চলল রাতের অন্ধিসন্ধি খুঁজে দেখতে আমাদের উঠোনের উপর দিয়ে তাদের দুই দলের অতিক্রমরেখা চলে গেছে। দাদুর কথা মনে পড়ে ন-দশ বছর আগে দাদু আর আমি ঠিক এইখানটিতেই এইভাবে বসে আকাশে সন্ধে হয়ে আসা দেখতাম। আমি কি সেই ট্র্যাডিশনের কবলে পড়ে গেলাম? ভয় করে। ভালোও লাগে।

নিরুত্তেজ পাড়াগাঁর তুচ্ছতা আর শূন্যতা গ্রামবাসীরা ভরে তোলে ভালোবাসা আর ঝগড়া দিয়ে। প্রাণের এক দিকে ভালোবাসা, অন্য দিকে কলহ। আর মেয়েরা তো প্রাণময়ী যেমন সহজে ভালোবাসে তেমনি সহজে কোন্দল করে। তারা পুকুরঘাটে এ ওর মাথা ঘষে দেয়। শীতের দুপুরে ননদ ভাজ সখীরা মিলে গল্প করতে করতে চালতা মেখে তারিয়ে তারিয়ে খায়। শোকের বাড়ির ছেলেপুলেকে নিজের কোলের মধ্যে এনে খাওয়ায় দাওয়ায়, আড়াল করে রাখে। একদিন সন্ধ্যায় হয়তো কোনো বউয়ের মন নেই, রাঁধতে ইচ্ছে করছে না- পাশের বাড়ির বউ নিজেদের হাঁড়িতে তার রাতের দুটো ভাত একসঙ্গে ফুটিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসে। আবার পরের দিনই ভোরে এক ঝুড়ি আমের ভাগ বা রাত্তিরে খসা একটা শুকনো নারকেলের অধিকার নিয়ে কোনো প্রৌঢ়া তুমুল শাপশাপান্ত করে: যেন তিন রাত্তির না পেরোয়, যেন বাড়িসুদ্দ ওলাউঠো হয়ে মরে। মেয়েদের ঝগড়া শেষপর্যন্ত হাস্যকরতায় পর্যবসিত হলেও পুরুষদের ঝগড়া তত নিষ্পাপ নয়। এক ঝাড় বাঁশের মালিকানা বা নতুন জাগা কোনো চরের আবাদ নিয়ে যখন তারা মুখোমুখি হয় তখন মোষবলির রামদার এক কোপে ধড় মুণ্ড আলাদা হয়ে যায়, তীক্ষ্ণধার সড়কির এক খোঁচায় পেটের নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসে।

কিন্তু গ্রামে মানুষের চেয়ে বিরাট হয়ে আছে গাছপালা আকাশ বাতাস। রাস্তাঘাট বনপথ মাঠ আমাকে পোকার মতো, ধুলোর মতো বুকে টেনে নেয়। রাত্রে আকাশ ভরে যখন তারা ওঠে তখন তাকিয়ে তাকিয়ে মনে হয় তুলনাহীন এই জীবন। এ জায়গা ছেড়ে কোথায় যাব।

না, এ জায়গা ছেড়ে আমাকে কেউ যেতে বলবে না, যেতে চাইলে আটকাবেও না। কিন্তু এখানে আমার জীবিকা কোথায়? খাব কী? আমাদের পোড়ো জমির অভাব নেই–আমার সেই কয়েক বছর আগেকার কলাবাগানের পরিকল্পনা আবার মনে পড়ল। কিন্তু ‘উত্থায় হৃদি লীয়ন্তে’ মনেই তা লীন হল। গভীর রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে ভাবি, ফেল করলে কী হবে? কোনক্রমে পাশ করলেই বা কী হবে? কোনো দিকেই কোনো উত্তর নেই। আমার নৌকো তো পাড় ঘেঁষে চলছে না, চলছে মধ্যগাঙ দিয়ে, সেখানে দিনে রাত্রে কখনোই কূল দেখা যায় না।

এর মধ্যে একদিন কলকাতা থেকে মামার টেলিগ্রাম এল: তুমি তৃতীয় বিভাগে পাশ করিয়াছ। সপ্তাহখানেক পরে দাদুর পাঠানো পাঁচ টাকার একটি মানি অর্ডার এল, সঙ্গের কুপনে মাসিমার হাতে লেখা একটি সংক্ষিপ্ত চিঠি: এই মাসের অমুক তারিখে খোকার বিবাহ ধার্য হইয়াছে। তুমি তার আগে অবশ্যই আমাদের এখানে চলিয়া আসিবা। ইতি আশীর্বাদিকা দিদিমা।

পথখরচ হিসেবে পাঁচ টাকা যথেষ্ট। গ্রাম থেকে একটি পুরো রাত নৌকোয়, তার পরে স্টিমারে খুলনা, আর শেষে বরিশাল মেইলে একদৌড়ে শেয়ালদা। শেয়ালদা থেকে জৈডকাদের সবুজ রঙের বাসে টালিগঞ্জ- সব মিলিয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন টাকা ভাড়া। এই পথ পুরবৈয়া বাঙালিদের গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড। বছরে বছরে, মাসে মাসে, ছুটিতে ছুটিতে এই পথে আমাদের চাকুরেরা, কলেজপড়ুয়ারা, ভাগ্যান্বেষীরা কতকাল ধরে যাতায়াত করছে। এই প্রথম আমিও তাদের মতো উৎসবে ও ভাগ্যান্বেষণে যাচ্ছি। তারা যেমন বার বার দেশে ফেরে আমিও নিশ্চয় তেমনি ফিরে আসব। সামান্য এই যাওয়া নিয়ে মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু আজ জানি, ঐ যাওয়াটা ছিল ঠিক মৃত্যুর মতো। মৃত্যুকালে কেউ কি বোঝে, এই যে চলে যাচ্ছে আর ফিরবে না। তাকে বার বার সবাই বলেছে, আবার জন্মবি, আবার ফিরে আসবি। এই বাড়ি ঘর নদী নক্ষত্র সব তো রইল তোর।

.

১৯৪১-এর কলকাতা

এখন এই একুশ শতকে এসপ্ল্যানেড-ধর্মতলার মোড়ে রোজ বিকেলে ঘরে ফেরা মানুষের আর ঘরে না-ফেরা মানুষের ঢল নামে। আজকের (২৩.১০.২০০১) কাগজে দেখছি, এবার সপ্তমীর রাতের রাস্তায় প্রতিমাদর্শনার্থীর সংখ্যা নাকি কোটি ছাড়িয়ে যাবে। রাক্ষুসে, অশ্লীল এই জনসংখ্যায় আমি আতঙ্কিত হই। অথচ সেই ১৯৪১-এ নিজে নিজে হেঁটে বা ট্রামে ট্রামে ঘুরে যখন কলকাতাকে প্রথম দেখি তখন তার সাজানো দোকান আর অজানা নরনারীর রহস্যে আকৃষ্ট হয়ে কী-যে সুখে পথ চলেছি! মফস্বলের আকাশ-বাতাসের মতোই কোমল সতেজ আকাশ-বাতাস ছিল এই নগরীর। ট্রাম বাস ঘোড়ার গাড়ি জিনরিকশা হল প্রধান যানবাহন। বসন্তে দক্ষিণ থেকে হাওয়া আসে সে বাতাস বড় সুখাবহ সাদার্ন অ্যাভিনিয়ুর রাস্তায় বা টালিগঞ্জের তেতলার ছাদে মিহি সুতোর সাদা ধুতি শাড়ি যখন ত্বকের উপর উসুখুসু করে তখন রোমাঞ্চ হয়, উদাসও লাগে। আমি বসন্তে প্রথম এসেছিলাম বলে ঐ অনুভূতিগুলি মনে আছে।

তখন কলকাতা বেশ মাপসই ছিল উত্তরে বাগবাজার খাল আর বেলগাছিয়ার খাল। পুবে মানিকতলা, শেয়ালদা, পাকন্সার্কাস, গড়িয়াহাট। দক্ষিণে ঢাকুরিয়া লেক, লেকের ওপারে বজবজের রেললাইন। আর পশ্চিমে আদিগঙ্গা, আলিপুর জেল, কেল্লা, হুগলি নদী। এই চৌহদ্দির বাইরে মোটামুটি শহরতলি- এঁদো বস্তি, পোড়ো বনবাগান, স্পেকুলেটরের তারকাঁটাঘেরা জমি, পানাপুকুর, তাড়ির হাঁড়িঝোলানো তাল গাছ, বাঁশ বন, হোগলাবন, পাড়াগাঁ। পুবে, আরও দূরে, আমাদের গতিবিধির বাইরে জনহীন এবং বিস্তীর্ণ হয়ে ছিল লবণ হ্রদ, ধাপা এবং তিলজলা। প্রাচীন বাসিন্দাদের মনস্তাত্ত্বিক কলকাতা ছিল আরও ছোট। ভবানীপুরের পুরনো লোকেরা বড়বাজার, কলেজ স্ট্রিট বা ধর্মতলায় যাবার সময় বলতেন, কলকাতায় যাচ্ছি।

বেশির ভাগ বাড়িই তখন একতলা বা দোতলা। উত্তর কলকাতা ঘনবসতিপূর্ণ হলেও দক্ষিণ কলকাতায় মধ্যবিত্তের বাড়ি বানাবার মতো প্রচুর ফাঁকা জমি ছিল। কেল্লা থেকে চৌরঙ্গি রোড পর্যন্ত এক অবাধ প্রান্তর গড়ের মাঠ– সবুজ ঘাসে ছেয়ে আছে। সারা কলকাতা জুড়ে কঠোরভাবে তিন আইন বলবৎ। পাড়ায় পাড়ায় আবর্জনা জমার আগেই সাফ করা হয়। রোজ ভোরে হাইড্রান্ট থেকে লম্বা হোস পাইপে তোড়ে জল ছিটিয়ে রাস্তা ধুয়ে দেয় পুরসভার লোকেরা। অনেক বাড়িতেই দু রকম জল আসে- পরিসুত জল আর অপরিসুত গঙ্গাজল। রাস্তার তলা দিয়ে বাড়িতে বাড়িতে কলঘরে জলের পাইপলাইন এসেছে সমস্ত শহরটা ভালো জল ও ঘোলা জলের লাইনে এবং ভূগর্ভ পয়ঃপ্রণালীর হিউম পাইপে আচ্ছন্ন হয়ে তলায় তলায় অন্য একটা নল ও ঝাঁঝরির গোলকধাঁধা শহর হয়ে আছে। ঐ অপরিসুত জলে এত চাপ যে বিনা পাম্পেই জল সোজা উঠে যায় দোতলার ছাদের ট্যাংকে। সেই জলে গঙ্গার পলি থাকে, কখনো কখনো দু-একটা চকচকে ছোট মাছও এসে পড়ে। আমার চাইতে পঁচিশ বছরের বড় জীবনানন্দ দাশ কলকাতার এই ভূগর্ভ পাইপের জলধারা এবং কেবল লাইনের ধাবমান বিদ্যুৎকে নিয়ে তাঁর অকৃতার্থ ঘুমভাঙা রাতে আরো কত অসম্ভব ভেবেছেন: ‘বাইরে কোথাও জলঝরার শব্দ- প্রায় সারা রাতই শুনতে পাওয়া যায়; কার বিরাট চৌবাচ্চা ভরছে হয়তো কিংবা অন্যমনস্কভাবে কল খুলে রেখে গেছে কেউ হয়তো রসাতলবাহী পাইপের জলধারা রাতের নিস্তব্ধতায় মানুষের আধোঘুমের কানে ছলছলিয়ে চলকে ছলছলিয়ে কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন। না, তা নয়। তা যদি হত, তা হলে কলকাতার মাটি ও দেওয়ালের ভিতরের পাইপগুলোতে কত যে জলদেবী ধরা পড়ত। আধো-ঘুমন্ত মানুষের হৃদয় এমন নির্জন রাতে একজন দেবিকাকেই চায় তবুও; জলের থেকে উঠে আসুক উঠে আসুক রাস্তার শামদানের বিদ্যুতের থেকে।

রাজপথে বিদ্যুতের আলো ক্রমশ একচ্ছত্র হলেও কোনো কোনো নিভৃত গলিতে তখনও কিছু গ্যাসের বাতি ছিল। গ্যাসের খুঁটিগুলো বেঁটে, পলতোলা, দেখতে সুন্দর। এই খুঁটির মাথায় আলোর ম্যান্টলকে ঘিরে কাঁচের চিমনি। ভূগর্ভপথে আসছে। গ্যাসের জোগান। ছেলেবেলায় একটা ঢ্যাঙা লোকের গল্প পড়েছিলাম লোকটা অনেক রাতে বাড়ি ফিরত আর রাতের রাস্তায় গ্যাসের বাতির চিমনি খুলে সিগারেট ধরাত।

গ্যাসের আলোর মতো একটি সুন্দর, ক্ল্যাসিক জিনিস ধীরে ধীরে কলকাতার বুক থেকে নিঃশব্দে লুপ্ত হয়ে গেল। ঢালাই লোহার এরকম আরো দু-একটি জিনিস ছিল যা এখন আর নেই– যেমন কিছু পুরনো বনেদি বাড়ির রেলিং ও অলংকৃত গেট, যেমন ট্রামের ঘোড়াদের ফেলে যাওয়া জলপাত্র। চৌরঙ্গির ট্রামলাইনের পাশে পড়ে থাকা আয়তক্ষেত্রাকার পাত্রগুলো গভীর ট্রের মতো, চমৎকার গড়ন। ট্রামে যেতে যেতে চোখে পড়ত, গাছের ছায়ায় উচ্ছল ঘাসের মধ্যে অনাদৃত পাত্রগুলিতে বৃষ্টির জল জমে আছে, শালিকরা আর কাকেরা খাচ্ছে।

পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে চোখ টেনে নিত ঢালাই ব্রঞ্জের জেনারেল আউট্রামের অতিকায় মূর্তিটি ছুটন্ত ঘোড়ায় যেতে যেতে পিছন ফিরে এক ঝলক তাকিয়ে দেখছে এক সৈনিকপুরুষ। পাশের সরু রাস্তার গাছের ছায়া আর ঝরা পাতা উড়ে উড়ে পড়ে তার উপর। সম্ভবত সেইটিই ছিল কলকাতার শ্রেষ্ঠ অনিকেত ভাস্কর্য। কিন্তু ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আর আউট্রামের মূর্তি নিশ্চয় একে অন্যের পরিপন্থী ছিল, অতএব স্বাধীনতার পরে বিরাট ঐ ব্ৰঞ্জখণ্ডটিকে লোকচক্ষুর অগোচরে সরিয়ে ফেলা হল।

.

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিশ্চয় একটা ব্র্যহস্পর্শ দোষ লেগেছিল, নইলে তার শুরুর তারিখটা কেন বিশ শতকের ৩. ৯. ‘৩৯ হবে? যা হোক, যুদ্ধ দেড় বছর গড়িয়ে গেলেও আমি অসমে বা পুববাংলায় একটা শিশুর নখের আঁচড়ের মতোও তার কোনো আক্রমণ টের পাই নি। দিন যেমন বয়ে চলেছিল তেমনি চলেছে, মাঠ খেত নদীজল খাল বিল যেমন নিশ্চিন্ত আর টলটলে ছিল তেমনই আছে, স্টিমার ট্রেন আগের নিয়মেই আসছে যাচ্ছে। শুধু কলকাতায় এসে একটা পরিবর্তন দেখলাম: রাত্রে বিমানহানার ভয়ে শহরটিকে অন্ধকারের আড়ালে লুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। সন্ধে হলেই ব্ল্যাক আউট নামের একটা নতুন জাতের পাচা যেন ডানায় পালকে আকাশ বিমর্ষ করে বাড়ি-বাড়ির ছাদে নামে।

তখনও কালো বাজার কাকে বলে আমরা জানি না। বাজারে গেলেই সব জিনিস অজস্র পাওয়া যায়, দামও আগের মতোই সস্তা। সেই সময়কার কোনো মধ্যবিত্ত বাড়ির সংসারখরচের খাতা এখন দেখলে অবিশ্বাস্য মনে হবে। গ্রামে আমি দশ থেকে পনেরো টাকায় ছ জনের পরিবারকে মাস চালাতে দেখেছি, অবশ্য একটু টানাটানি করে। চলবেই বা না কেন? তিন থেকে চার টাকা মন চাল, আড়াই থেকে তিন টাকা মন আস্ত মসুর। তাছাড়া, বেড়ার গায়ের শিম লতা, লম্বা গাছ বেয়ে ওঠা বরবটি, শুকনো মরা আম গাছকে ঝোপের মতো ঘন হয়ে ঘিরে ধরা ঝিঙে লতা, তারাও সাহায্য করে। এদিকে কলকাতাতেও তখন দেখছি, পাঞ্জাবী হোটেলে কোয়ার্টার প্লেট মাংস ২ আনা, তন্দুরি রুটি ২ পয়সা, লস্যি এক গ্লাস ১০ পয়সা। পবিত্র হিন্দু হোটেলে পেটভরতি ভাত ডাল আলুভাজা তরকারি মাছ অম্বল সাকুল্যে ৩ আনা। বাজারে হাঁসের ডিম ২ পয়সা, ফিরপোর কোয়ার্টার পাউন্ড মিল্ক ব্রেড ৪ পয়সা। এর সঙ্গে দু চা-চামচে তেল হলেই ফ্রেঞ্চ টোস্ট খেয়ে এক বেলার মতো নিশ্চিন্দি। কে সি দাশের ‘আবার খাব’ সন্দেশ ৪ আনা। ফিরলোর ছোট কেক, উপরে লাল চেরি, ৪ আনা। মেট্রোতে ম্যাটিনি শো-র টিকিট ৬ আনা। ট্রামে প্রথম শ্রেণীর ভাড়া ৪ পয়সা, দ্বিতীয় শ্রেণীর ভাড়া ৩ পয়সা, সস্তা মধ্যদিনের ভাড়া ২ পয়সা। ইভ্যাকিউয়েশনের সময় আমার চেনা এক যুবা ভবানীপুরের পূর্ণ থিয়েটারের পিছনে একটা একতলা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল মাসিক ৫ টাকায়। এই সময়েই সাদার্ন মার্কেট থেকে তিন মিনিটের দূরত্বে দাদামশায় একটি আনকোরা নতুন বাড়ি কিনলেন। তাতে দুটো শোবার ঘর, একটা বসবার ঘর, তাছাড়া রান্নাঘর, স্নানঘর, ডাবলিউ সি, সিঁড়ি, প্যারাপেটঘেরা ছাদ, দুটো ছোট্ট ছোট্ট বারান্দা। কালোবর্ডারঘেরা লাল সিমেন্টের মেঝে। দাম? ৮ হাজার টাকা।

এই রকম প্রাচুর্য আর সৌভাগ্যের দিনে মামার বিয়ে হল। সেদিনের সন্ধেটা ছিল ভারি মনোরম। কনের বাড়ি সাদার্ন অ্যাভিনিয়ুতে শহরের দক্ষিণ বীথিকায়, বরের বাড়ি থেকে হাঁটাপথে পনের মিনিট। সন্ধে খানিকটা উতরে গেলে মামা গাড়িতে রওনা হয়ে গেল। চমৎকার দক্ষিণে হাওয়া দিচ্ছিল। আমরা বরযাত্রীরা ভাবলাম, এইটুকু রাস্তা, বেশ হাসি গল্প করতে করতে হেঁটেই চলে যাই। চারদিক নিরিবিলি। রাস্তা নিষ্প্রদীপ। রাতের আকাশ কালচে নীল। মুদিয়ালিতে পৌঁছে দেখি, ব্ল্যাক আউটকে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে ঘনীভূত সাদা জ্যোৎস্নাভরা ফানুসের মতো চাঁদ অনেকখানি উপরে উঠে গেছে। চাঁদের আলোয় সাদার্ন অ্যাভিনিয়ু ভেসে যাচ্ছে। সবার পরনে সাদা ধুতি সাদা পাঞ্জাবি। কনের বাড়িতে পৌঁছতে তারা সাদা গোড়ে মালা হাতে জড়িয়ে দিল, স্প্রে করে গোলাপজ ছিটিয়ে দিল। তাদের দোতলা বাড়িটার রং সাদা, সাদা মারবেল বসানো বড় বারান্দা। এই সাদায় সাদা বিবাহদৃশ্যের চারদিকের উপকূলে ঘিরে আছে রাত। ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে। কাছে কোথাও নহবত বসানো হয়েছে সানাইয়ে সন্ধ্যারাতের সুর আসছে। বর কনে দুজনের রংই দারুণ ফরসা সাদায় একটু লাল মেশান। টুকরো দৃশ্যটাকে আকাশে গন্ধর্বদের বিয়ের মতো লাগছিল।

উৎসবের জোয়ারের পর সংসার আবার তার স্বাভাবিক ভাটায় ফিরে গেল। এবং এইবার এই ছোট পরিবারের মধ্যে আমার অস্তিত্ব এক অস্বস্তিকর প্রশ্নচিহ্নের মতো এসে দাঁড়াতে লাগল। এখানে এরা সবাই আমার মাতৃকুলের, অর্থাৎ এই গোষ্ঠীতে আমি বাইরের লোক, দাঁড়কাকের মধ্যে পাতিকাকের মতো, গোবকদের মধ্যে কোঁচবকের মতো বা আঙ্গামি নাগাদের মধ্যে আও নাগার বাচ্চার মতো। এদের চোখে যেমন অনুমোদন নেই, মুখেও কিন্তু কোনো কুবাক্য নেই। আমার সমবয়সী এক সম্পর্কিত মামা আর বোন আমার সঙ্গেই পাশ করেছিল, তারা নিঃশব্দে কলেজে ভরতি হল। এই কদিনে তারা আমার বন্ধু হয়েছে। আমরা অন্য গল্প করি কিন্তু পড়াশোনার কথা কেউই আর তুলি না। আমি একলা হয়ে মনে মনে ভাবি, আমার যা পরীক্ষার ফল তাতে আরও পড়তে চাওয়া আবদারের মতো শোনাবে। যত দিন যায় আমার অস্বস্তি হয় তাহলে এখানে কী কারণে আছি? দিন যায় আমি একটা প্রান্তিক অবস্থানে পৌঁছই। দুপুরের খাবার পর অপেক্ষা করি, যেই রোদ একটু পড়ে, বাড়িগুলোর নড়বড়ে ছায়া পুবের দিকে হেলে, আমি পথে বেরিয়ে পড়ি। পথে বেরিয়ে একটু একটু করে মন ভুলে যায়, একা একা লোকজন, বাড়িঘর, দোকানপসার দেখতে দেখতে চলি। পুরো কলকাতাকে পুব আর পশ্চিমে দুই ভাগ করে একটাই রাস্তা উত্তরে দক্ষিণে লম্বা হয়ে আছে। যদি দক্ষিণ থেকে ধরি, রাস্তাটা টালিগঞ্জের রসা থেকে বেরিয়ে কালীঘাট ভবানীপুর চৌরঙ্গি হয়ে, চিতপুর জোড়াসাঁকো টিরেট্টাবাজার শোভাবাজার হয়ে বাগবাজারের খাল পর্যন্ত গেছে। একই নদীর নাম যেমন সাংপো, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা তেমনি ঐ একই রাস্তার নাম বাগবাজার স্ট্রিট, চিতপুর রোড, বেন্টিংক স্ট্রিট, চৌরঙ্গি রোড আর রসা রোড। আমি কোনোদিন লেকের পাড়ে হাঁটি, জলের কোল ঘেঁষে বসে থাকি, কোনোদিন সাদার্ন অ্যাভিনিয়ু বা রাসবিহারী অ্যাভিনিয়ু ধরে হেঁটে যাই। কোনোদিন টালিগঞ্জ থেকে সোজা হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই চৌরঙ্গিতে। পথ হেঁটে আমি ব্যথা এবং ভার ক্ষয় করতে চাই। এখন গ্রীষ্মকাল। লেকের পাড়ে জলের ধারে বসে দেখি কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠল- কালো আকাশে আধভাঙা চাঁদ যেন একটা পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া কাগজের মধ্যে তখনও খানিকটা কাগজ না পুড়ে সাদা আর হলদেটে হয়ে আছে। ওদিকে জীবন কিন্তু ইন্ধন জ্বালিয়ে রেখেছিল তখন আমার বয়স মাত্র ষোলো পেরিয়েছে পরাজয় ও শঙ্কার সঙ্গে খ্যাপামি আর হঠকারিতা এক হাঁড়িতে চড়িয়ে যেন কেউ জ্বাল দিচ্ছে- অদ্ভুত ঝাঁজালো বলশালী সেই অরিষ্ট।

আমরা ভাবি ঘটনাই বুঝি মানুষকে পালটে দেয়, না-ঘটনাও যে মানুষকে পালটায় সে কথা এখন বুঝলাম। যদি আমার স্কুলের পরে কলেজ, তার পর চাকরি– এইসব স্বাভাবিক ঘটনা পর পর ঘটত তবে হয়তো আমার স্বাভাবিক বিকাশ হত। কিন্তু তা তো হল না। আমার ঘটনাগুলি না ঘটে অপমানিত মাথা নিচু করে স্তব্ধ বসে রইল বলে আমি উলটোপালটা লোক হলাম। দিন চলে যেতে লাগল আর নীরবে আমার ছাত্রজীবন শেষ হল। আরো দিন গেল, আমি নিঃশব্দে একজন স্বীকৃত বেকার হলাম। এই অকালবয়স্কতা মেনে নিতে মন চায় না। আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা হলে ভিতরে সতর্ক হয়ে উঠি- কথাবার্তা যেন ‘আর পড়লে না কেন’ বা ‘এখন কী করবে ভেবেছ’ বা ‘আর কদিন আছে এখানে’-র দিকে গড়িয়ে না যায়। আমি লোকব্যবহারে ক্রমশ সন্দিগ্ধ, সতর্ক, কুটিল এবং বেপরোয়া হতে থাকলাম। কিন্তু নিজেকে ঐরকম বানাতে আমার কষ্টও হচ্ছিল।

যা হোক, আমি অকর্মা হলেও দু-একটা টুকটাক কাজ করে দিই। অসমে দাদুর পুরনো বাড়িটি বিক্রি হয়ে যাবার পর সেখানকার খাটপালঙ্ক, বাসনপত্র, অস্থাবর আরও যা ছিল সব নদীপথে জগন্নাথ ঘাটে এসে পৌঁছেছিল। আমি রসিদ নিয়ে একদিন সেগুলো ছাড়িয়ে আনতে গেলাম। জগন্নাথ ঘাটের বিরাট টিনশেডের এক জায়গায় একটা খাঁচার মধ্যে খাতাপত্র নিয়ে কেরানিবাবুটি বসেছিলেন। রসিদ দেখে বললেন- “ঠিক আছে, সব বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। চৌধ্রি, দেখ তো, এই মাল এই ঠিকানায় যাবে। আমাকে বললেন, “আমাকে পান খাবার জন্যে দু আনা দাও। আমি অবাক। উনি পান খাবেন তো তার পয়সা আমাকে কেন দিতে হবে? আর, এভাবে কেউ চায় নাকি? যা হোক, আবছাভাবে বুঝে বা না বুঝে একটা দোআনি তাঁর খাঁচার টেবিলে রাখলাম। চৌধুরীর লোকেরা তিনটে ঠেলা এনে তার উপর মাল চাপাল। জিনিসগুলো আমার কতকালের চেনা। আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আজ অনেকদিন পরে তাদের দেখা পেয়ে শুকনো মন কেমন যেন স্নেহে ভিজে উঠল– অতখানি রাস্তা আমি খেয়াল না করে ঠেলার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চললাম। রাস্তায় কড়া রোদ ছিল, কিন্তু গায়ে যেন লাগল না। কেউ বিশ্বাস করবে, কাঠের আসবাবও আপনজন হয়?

লেখাপড়া যখন হলই না তখন আমি বেপরোয়া হয়ে ইচ্ছেমতো বই পড়ার দিকে মন দিলাম। ঘটনাচক্রে এই সময়েই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সত্যিকারের প্রথম পরিচয় হল। মামা আর মামি বিয়েতে অনেকগুলো বই পেয়েছিল, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথেরও কিছু কবিতার বই ছিল। প্রাপক-প্রাপিকার তখন বইয়ে মন দেবার সময় নেই, অতএব রবীন্দ্রনাথকে আমি নিজের হেফাজতে নিয়ে নিলাম। ছড়ার ছবি আর মহুয়া আমার মন ভুলিয়ে দিল। এই ভাষায় তো আমরা কথা বলি না, লিখি না। আমাদের ভাষা কুটিল পরুষ আবিল অচক্ষু অসমাপ্ত স্বপ্নহীন ধ্যানহীন। নতুন এই ভাষার আলো লেগে মেয়েপুরুষকে, জগৎকে অনির্বচনীয় দেখাল। মহুয়ার তিন চারটে পাতা ওলটাতেই পেলাম:

আমি যেন গোধূলিগগন
ধেয়ানে মগন,
স্তব্ধ হয়ে ধরা-পানে চাই;
কোথা কিছু নাই,
শুধু শূন্য বিরাট প্রান্তরভূমি।
তারি প্রান্তে নিরালা পিয়ালতরু তুমি।

কবিতার ঐ ‘আমি’ আমি নই জেনেও, আমার অপ্রাপ্তবয়স্ক শরীরে-মনে একজন বয়স্ক পুরুষের উদাসীন আর প্রতীক্ষমাণ আত্মা ছড়িয়ে যেতে লাগল। স্তব্ধ প্রচেষ্টাহীন কমলারঙের গোধূলিগগন আমি অনুভব করি, কিন্তু পৃথিবীপারের পিয়ালতরুর মতো মেয়েটিকে চিনি না, আমার তুচ্ছতা নিয়ে তাকে কাছে এনে ভাবতে সাহস পাই না, দূরের আবছায়াতে কল্পনা করে চলি।

আরও কিছুদূর গিয়ে আর-একটা কবিতা–

বিদেশের ঐ সৌধশিখর-’পরে
ক্ষণকালের তরে
পথ হতে যে দেখেছিলেম, ওগো আধেক-দেখা।
মনে হল তুমি অসীম একা। ..
সামনে তোমার মুক্ত আকাশ, অরণ্যতল নিচে,
ক্ষণে ক্ষণে ঝাউয়ের শাখা প্রলাপ মর্মরিছে।

কিছু না। একটি মেয়েকে দূরত্বে একাকিত্বে আকাশলগ্ন বাড়িতে মুহূর্তচিত্রের মতো দেখা গেল। কিন্তু কী করে যেন ঐ কটামাত্র ছত্রে চিরকাল, অসীম, এবং অনন্ত লাবণ্য এসে জড়িয়ে গেল। ক্রমশ কবিতার অলৌকিক শক্তি আমি টের পাই। এবং ভবিষ্যতে আমি যে কবিতা লেখার দিকে মন দিতে পারি সেই সম্ভাবনা তৈরি হতে থাকে।

ছড়ার ছবি-তে এক জায়গায় পড়ি–

নৌকোখানা বাঁধা আমার মধ্যিখানের গাঙে
অস্তরবির কাছে নয়ন কী যেন ধন মাঙে।

লাইন দুটো আমি কয়েক বার আওড়াই। শেষে চোখ বুজে জপ করতে থাকি অস্তরবির কাছে নয়ন কী যেন ধন মাঙে। আমার বোজা চোখের মধ্যে অন্ধের দেখার মতো অস্তায়মান সূর্যের রঙিন আলো জগৎকে পূর্ণ করে সর্বব্যাপী হয়ে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের ঘরোয়া কিংবা ঐতিহাসিক বর্ণনা অনেকেই দিয়েছেন। আমারটুকু আমি এখানে বলি। বাইশে শ্রাবণের তারিখটা তো সবারই জানা। আমি সেদিন বারোটা সাড়ে বারোটা নাগাদ শিবপুর থেকে ফিরছিলাম। মেঘলা আকাশ– মাঝে মাঝে মেঘ ফেটে গিয়ে কড়া রোদ বেরিয়ে আসছে, মাঝে মাঝে ফুরফুরে ইলশেগুঁড়ি কদমরেণুর মতো উড়ছে। আমি যখন ওপারে যাবার জন্য পনটুন ব্রিজ পেরোচ্ছি, হঠাৎ উত্তেজিত পথিকদের মুখে শোনা গেল, রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন। ওপারে গিয়ে দেখি, কলকাতাটা যেন এই খবরের জন্য অপেক্ষা করছিল এবং খবরটা শোনামাত্র পড়িমরি করে ছুটল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দিকে। আমি ঐ ভিড়ে গিয়ে কী করব ভেবে বাড়ি ফিরে এলাম। তার পর সারা দিন ধরে কত খবর কানে এল মানুষের চাপে ঠাকুরবাড়ির লোহার ফটক ভেঙে পড়েছে, মৃত রবীন্দ্রনাথের পায়ের নখ নাকি এক ভদ্রমহিলা দাঁত দিয়ে কামড়ে ছিঁড়ে নিচ্ছিলেন, জোড়াসাঁকোর একতলার ঘরে সজনী দাস নাকি তিন দিন ধরে নন্দলাল বসুর নকশায় শেষযাত্রার খাট বানাচ্ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের দাড়ি নাকি অনেকে মুঠো মুঠো ছিঁড়ে নিয়েছে, দেহ বাড়ির বাইরে বেরোনোমাত্র অপেক্ষমাণ জনসমুদ্র নাকি সেটি মাথার উপর দিয়ে জিনের মতো হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে গেছে, ভিড় ঠেলে রথী ঠাকুর নাকি শ্মশানেই পৌঁছতে পারেন নি, এবং মুখাগ্নির জন্য আপনজন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় নি।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে অনেক পত্রিকা তাদের রবীন্দ্রস্মরণ সংখ্যা বার করল। এদের মধ্যে অমল হোম-সম্পাদিত ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট স্থায়ী বিশ্রুতি পেয়েছে। মিউনিসিপ্যাল গেজেটে রবীন্দ্রনাথের প্রচুর ছবি বেরিয়েছিল। বিভিন্ন কাগজে এবং বইতে তখন রবীন্দ্রনাথের নানারকম ছবি বেরুত নিচে লেখা থাকত শ্যামলীর সামনে রবীন্দ্রনাথ, শালবীথিকায় রবীন্দ্রনাথ, সুরুল কুঠিতে রবীন্দ্রনাথ, চিত্র অঙ্কনরত রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি। শনিবারের চিঠি দুষ্টুমি করে একটি চৌকো সলিড ব্লকে কালি লাগিয়ে ছেপে দিয়ে নিচে লিখল, অন্ধকারে রবীন্দ্রনাথ।

মজার কথা থাক। রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বেশি লেখা ছেপেছে যে-প্রবাসী তারা কিন্তু তেমন কোনো বিশেষ সংখ্যা করল না, তবে পরের সংখ্যার মুখপাতে এমন একটি ছবি ছাপল যাতে বাঙালির মনে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু চিরমুদ্রিত হয়ে রইল।

ছবিটি অবনীন্দ্রনাথের একটি বোয়া জলরং: সন্ধ্যার প্রদোষছায়ায় রবীন্দ্রনাথের শয়ান দেহ ভেসে চলেছে। আকাশে এবং জলে একই রঙের ধূসরতা। বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের চোখ বোজা। দেহটিই যেন একটি নুলিয়ার নৌকো সরল, জীর্ণ। অদৃশ্য মাঝি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। জোব্বার কাপড়ে, বুকের উপর কারো পায়ের আবছা লাল দু-তিনটি ছাপ। ছবির নিচে লেখা–

সমুখে শান্তিপারাবার
ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।

ছবির সেই প্রিন্টটির বাষট্টি বছর বয়স হল। এখনও সযত্নে রেখে দিয়েছি।

.

 আমার প্রথম চাকরি

অমিয়মামা একমাত্র ব্যক্তি যিনি মাঝে মাঝে আমার স্বাস্থ্যের তারিফ করেন। জিজ্ঞেস করেন, আমি ব্যায়াম করি কি না। একদিন তিনি খুব নরম গলায় জানতে চাইলেন, আমি যদি তাঁদের অফিসে কোনো কাজ পাই তো করব কি না। আমি বললাম- করব। দু দিন পরে আমি ট্রামে চেপে অমিয়মামার সঙ্গে চললাম তাঁর অফিসে। ডালহৌসি স্কোয়ারে ক্লাইভ বিল্ডিংসে এক ইংরেজ ব্যবসায়ী অফিসে উনি অফিসার। টাকপড়া, ক্রিকেটারের মতো চেহারা মেইলস নামে এক সাহেব আমার ইন্টারভিউ নিলেন। এক মিনিটের ইন্টারভিউ- তোমার বয়স কত? আঠারো। ঠিক তো? আমি চুপ। আচ্ছা, কাজ তো কয়রা, ..। ক্লাইভ বিলডিংসের তিনতলায় দক্ষিণখোলা একটা মস্ত জানলার পাশে টেবিল চেয়ার পাওয়া গেল। তিরিশ টাকা মাইনে। কাজ খুব সোজা। বিমানহানার আশঙ্কা করে দরকারি নথিপত্র নকল করে রাখা হচ্ছিল। সেই কাজ। এখনও মনে হয়, জীবনে এইরকম সুখের দিন আমার অল্পই এসেছে। এই প্রথম আমি স্বাধীন, স্বনির্ভর, ভরা-পকেট। মাংসাশী প্রাণীদের কোনো নিঃসঙ্গ শাবক একাকী সাভানায় তার প্রথম শিকার ধরার পরে যেরকম উল্লসিত আদেখলে আচরণ করে, টের পাই, আমিও তেমনই করছি। বিশ্বাস হচ্ছে না শিকার পুরো মরেছে- থাবা দিয়ে চাপড় মেরে দেখছি, কলজের কাছে মুখ ঢুকিয়ে রক্ত খাচ্ছি, গোঁফে চিবুকে রক্ত লেগে আছে, মুছছি না। মাঝে মাঝে মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাচ্ছি। তখন তিরিশ টাকা অনেক টাকা। তার থেকে পাঁচ টাকা যায় ট্রামের মাসিক টিকিটে। তার পরেও পঁচিশ টাকা- সেও অনেক। শনিবারে মেট্রোয় ম্যাটিনিতে ছ আনায় সিনেমা দেখি। কে সি দাশে চার আনায় আবার খাব সন্দেশ খাই। হাঁটতে হাঁটতে ফিরি ভবানীপুরে, দ্বারিকের দোতলায় লুচি আর ছোলার ডাল খাই।

এসপ্ল্যানেডের চত্বরে মাটিতে ত্রিপল বিছিয়ে খাকি হাফশার্টপরা কালোমতো একটা লোক যাবতীয় ইংরেজি বাংলা ম্যাগাজিনের গোছা সাজিয়ে বসে। সেখানে দাঁড়িয়ে পত্রিকা দেখি, বুদ্ধদেব বসুর ‘এক পয়সায় একটি’ সিরিজের রঙিন মলাটের চটি বইগুলো দেখি। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আর্মি অ্যান্ড নেভি স্টোর্স, হল অ্যান্ড অ্যান্ডারসন, ওয়াছেল মোল্লা, হোয়াইটওয়ে লেডল এবং আরো সব বড় দোকানের সাজানো বাতায়ন দেখি। বড়দিনের হগসাহেবের বাজারে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে যাই- কত রকমের সুন্দর জিনিস যে পৃথিবীতে আছে! দরকার না থাকলেও কিনতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কিনে রাখব কোথায়? আমার তো বাড়ি, আলমারি, সিন্দুক, গুদাম সবই সেই রাঙাদিদির দেওয়া একচিলতে টিনের সুটকেস।

অত বড় অফিসে আমিই বয়ঃকনিষ্ঠ। বুড়ো লিফটম্যান আমাকে বয়স নিয়ে কখনো একটু আলতো ঠাট্টা করে। বাচ্চা কেরানি হিসেবে আমি তখনকার ডালহৌসি স্কোয়ারকে চিনতে শুরু করলাম। পুজো শেষ হয়ে গেছে। হেমন্ত গড়ের মাঠে অনেক শিশির ঝরিয়েছে। কাজ করতে করতে জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বেলা সাড়ে এগারোটার বিদেহী চাঁদ শুকনো চন্দনের মতো নীল আকাশের কপালে ফুটে আছে। দুটো চিল চক্কর মারছে উঁচুতে। দুপুরবেলায় নিচে নেমে গিয়ে রেস্তরাঁয় আলু কপির ঝোল দিয়ে বান রুটি খাই। দারুণ লাগে। তখন লালদিঘির পাড়গুলো ছিল ঘাসে ঢাকা। সেখানে মিষ্টি রোদ্দুরে একটু বসি। লালদিঘিকে প্রদক্ষিণ করে ট্রাম যায়। কোথাও হৈ চৈ, ঠেলাঠেলি, স্থানাভাব নেই। ট্রামে চেপে, স্কার্ট ব্লাউজ উঁচু-গোড়ালি জুতো পরে স্টেনো টাইপিস্ট কিছু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে অফিস করতে এলেও কোনো বাঙালি মেয়ের এ তল্লাটে পা পড়ে না। এবং দিনে যে-জায়গাটা এত কর্মব্যস্ত, সন্ধের পরই সেটা জনশূন্য আর কেমন যেন ভুতুড়ে হয়ে যায়। এক ছুটির দিনের সন্ধ্যায় হাওড়া থেকে শর্টকাটে এসপ্ল্যানেড যেতে গিয়ে পনটুন ব্রিজ পেরিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম ডালহৌসিতে। জনহীন পরিত্যক্ত নগরীতে বেলাশেষের ছায়া নামলে হঠাৎ যেমন ভয়ভয় করে এই অট্টালিকাশ্রেণীর মাথার উপরে বিমর্ষ রোদ্দুরের মিলিয়ে যাওয়া দেখে মন তেমনি ত্রস্ত হল। ঐ নিঃশব্দ স্কোয়ারের অ্যাসফল্টে-পাথরে বাঁধানো পথ আমি যতদূর সম্ভব দ্রুত পেরিয়ে গেলাম।

যুদ্ধের আঁচ না লাগলেও কলকাতায় যুদ্ধের আবহাওয়া ঘনিয়ে আসছিল। আমাদের বড়সাহেব বুড়ো মানুষ, হঠাৎ দেখছি উনি ফৌজি উর্দি চড়িয়ে অফিসে আসছেন। পার্কে, পথপাশের ফাঁকা জমিতে সোজা বা জিগজ্যাগ ট্রেঞ্চ কাটা হয়েছে। দোকান আর অফিসের বড় বড় কাঁচের জানলায় কাগজের পট্টি সাঁটা, ঢুকবার দরজার সামনে ইটের ব্যাফল দেয়াল, লাল রঙের বালতিগুলিতে ভরতি বালি– এ সবই বিমানহানার জন্য সতর্কতা। এ আর পি অর্থাৎ এয়ার রেইড প্রিকশনের বিরাট অফিস খোলা হয়েছে। প্রচুর বেকার যুবক ঢুকেছে সেখানে, তাদের খালাসি-নীল উর্দি। তারা বাড়িতে বাড়িতে স্টিরাপ পাম্প, রবারের লম্বা নল আর দুটো করে বালতি বিনি পয়সায় দিয়েছে। গঙ্গা আর ময়দানের উপরে আকাশের অনেক উঁচুতে জেপেলিনের মতো বেলুন ব্যারাজ ভাসিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের লম্বা দড়ি বাঁধা আছে মাটিতে। বিমানে যারা আক্রমণ করতে আসবে তাদের ধোঁকা দেবার জন্যে তাল গাছের গুঁড়ির ডামি কামান বসানো হয়েছে লেকের পাড়ে। মাঝে মাঝে সাইরেন বাজিয়ে, বিমানহানা হলে কী করতে হবে, তার মহড়া হয়। যারা বাইরে আছে তারা তখন ট্রেঞ্চে ঢুকবে, যারা ঘরে আছে তারা সিঁড়িকোঠায় আশ্রয় নেবে। অল্পবয়সীরা কিন্তু কথা শোনে না, সাইরেন বাজলে তাড়াতাড়ি ছাদে উঠে দ্যাখে– কোথায় কী ঘটছে।

এর মধ্যে শোনা গেল, কলকাতায় বোমা পড়বে। ক্রমশ এই শোনা কথা গড়াতে গড়াতে তার নিজস্ব গতিবেগ পেয়ে কলকাতার নিরাপত্তাবোধে আঘাত করল। কলকাতাবাসীরা, যাদের একটু উপায় আছে তারা মফস্বলে, শহরে, গ্রামে পালাতে লাগল। বিশেষ করে বাঙালি, বিহারী, ওড়িয়া, মারোয়াড়ী কলকাতা ফাঁকা করে, ট্রেনে গাদাগাদি করে, পড়িমরি করে পালাল। এই গণপলায়নের নাম হল ইভ্যাকিউয়েশন। সত্যি, পলায়নের যে কত রকম নাম ইভ্যাকিউয়েশন, এক্সোডাস, রিট্রিট। দাদুরা চলে গেলেন খুলনা শহরে। আমি চাকুরে মানুষ, তাঁর ফাঁকা বাড়িতে আমি, অমিয়মামা, পুতুলমামা থাকলাম। আমরা একই অফিসে চাকরি করি। সর্দারী নামে এক বিহারী পালোয়ান কোত্থেকে যেন এসে জুটে গেল আমাদের বেঁধে দেবার জন্যে।

প্রত্যেক মাসে তিরিশ টাকা করে পাই। নটায় বেরোই আর সন্ধে বাজিয়ে বাড়ি ফিরি। চমৎকার কাটছিল দিনগুলো। এইভাবে শীত গেল, বসন্ত এল। গ্রামেও বসন্ত দক্ষিণ দিক দিয়েই ঢোকে। কিন্তু ঢোকার পর হাওয়া চারদিকের বনজঙ্গল গাছপালায় ধাক্কা খেয়ে নানা অচিহ্নিত পথে বইতে থাকে, মিহি ধুলো উড়ে এসে পুরনো পাতায় বসে সেই ধূলিস্লান পাতার পাশে নতুন পাতা কখনো সবুজ কখনো তামারং সদ্যোজাত আগুনের মতো ঝকমক করে। কলকাতায়, ছাদের উপর উঠে সন্ধেবেলা স্পষ্ট টের পাই- টালিগঞ্জের ছাদগুলি ছুঁয়ে ছুঁয়ে একটা লম্বা চিরুনির মতো বাতাস হু হু করে চলল শ্যামবাজার বাগবাজারের দিকে।

বসন্তকালটা যাচ্ছিল ভালো। কিন্তু একদিন রাত্তিরে বেশ মাথা ধরল, জ্বর হল। পরদিন বিকেলের মধ্যে দেখি জলবসন্তের গুটি বেরিয়েছে মুখে, বুকে। তার পর অসঙ্গ মশারির মধ্যে একগাদা বই নিয়ে তিনটি সীমাহীন সপ্তাহ কাটল। অসুখ থেকে উঠে আর অফিসে যেতে হল না- তিন ছত্রের একটি চিঠি এল: অনুপস্থিতির কারণে তোমাকে আর আমাদের দরকার নেই।

কদিন পরে, জাপানী বোমার ভয়ে পুরো অফিসটি কাগজপত্র এবং কর্মচারীসমেত ট্রেনে চেপে লখনৌ চলে গেল।

অমিয়মামারা চলে গেলেন, সর্দারিও চলে গেল। এইবার আমি সত্যিই একা হয়ে পড়লাম, নিছক একা। কলকাতা ফাঁকা হয়ে গেছে। দিনের বেলা শুনশান আর রাত্রে মনে হয় ভূতের শহর আগুন লাগলেও বাড়িগুলি থেকে আধপোড়া কেউ চেঁচাতে চেঁচাতে বেরিয়ে আসবে না। অনেক বাড়ির গায়েই ‘টু লেট’ টাঙানো, কিছু কিছু বাড়ির গায়ে ‘ফর সেল’। পাঁচ টাকা, দশ টাকা, তিরিশ টাকা, চল্লিশ টাকায় আস্ত আস্ত বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়।

ভোর হয়, সন্ধ্যা হয়, রাত হয় আমার কোনো কাজকর্ম নেই। হাঁটতে হাঁটতে দশটা-এগারোটার সময় বালিগঞ্জের ত্রিকোণ পার্কে গিয়ে জুটি। সেখানে আসে আমার সমবয়সী এক আত্মীয়, যে তখন খুব বন্ধুও। খানিকক্ষণ এলোমলো বকি, একটু ঝিম ধরে, বেলা গড়াতে থাকে। ত্রিকোণ পার্কের পাশেই একটা হোটেল। দুজনায় সেখানে গিয়ে দুপুরের খাওয়া খাই। খেয়েদেয়ে বাড়ি ফিরি, বিছানায় গড়াই, বিকেলে স্নান করি, সূর্য ডোবার আগে আবার বেরোই, যেখানে-সেখানে আটটা-নটা পর্যন্ত ঘুরি। এইরকম ঘুরতে ঘুরতে জনক রোড বা পরাশর রোডের কাছাকাছি কোনো ফুটপাথে দেহাতিদের একটা ডালরুটির ঠেক আবিষ্কার করলাম– বগি থালার মতো বড় এবং মোটা রুটি, দাম চার পয়সা, এবং তার সঙ্গে এক বাটি ঘন ডাল মাগনা। দুটো রুটি, দু বাটি ডাল খেলে পেটে আর জায়গা থাকে না। বাড়ি ফিরে দেখি, চাঁদের জ্যোৎস্নায় বাড়ির ছাদ দেয়াল আলো অন্ধকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশের বাড়িগুলির দরজায় খিল পড়ে গেছে। বাড়িতে ঢুকে প্রথমটায় ভালো লাগে না, তার পর ধীরে ধীরে লাগতে থাকে।

কিছুদিন পরে সেই পলাতকেরা, যারা ভীরু হাঁস ও সন্দিগ্ধ হরিণের মতো পালিয়েছিল, আবার ফিরে এল। কলকাতা যেমন চলছিল তেমনি চলতে লাগল। ইতিমধ্যে ভারত ছাড় আন্দোলন হল, মাতঙ্গিনী হাজরা মারা গেলেন, সুভাষচন্দ্র বসু ইংরেজের চোখে ধুলো দিয়ে ভারতের বাইরে চলে গেলেন, জাপান যুদ্ধটাকে আমাদের দোরগোড়ায় নিয়ে এল। কমিউনিস্ট পার্টি রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রভাবশালী হয়ে উঠছিল নাটক গান সাহিত্য ইশতেহার এবং যুবকযুবতীদের সংযোগ এই পার্টিকে রাজনীতি ছাড়িয়েও অধিক কোনো মূল্য দিয়েছিল। যুদ্ধ অনেকগুলো রণাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ছিল। সাদা কালো দুই বর্ণেরই আমেরিকান সৈন্য, তাদের প্রচুর সাজসরঞ্জামসমেত, ভিনগ্রহের বাসিন্দার মতো কলকাতায় দেখা দিল।

দাদু-দিদিমাও সংসার নিয়ে আবার ফিরে এসেছেন। খাওয়াদাওয়ায় আবার গাৰ্হস্থ্যের রস লাগল। কিন্তু হঠাৎ আমার কাছে কলকাতা এবং এই মধ্যবিত্ত সংসার অসহনীয় হয়ে উঠল। আলগা উঁটা থেকে আমি এখন শুকনো পাতার মতো খসে পড়েছি- যদি এখন হাওয়ায় উড়ে যাই তবেই মঙ্গল। কোথায় যাই, কোথায় যাই ভাবতে ভাবতে ঠিক করলাম বাবার কাছেই যাই বাবা এখন যেখানে আছেন সেখানটা দেখা হয় নি।

.

বেতনা নদীর পাড়ে

ষাট বছর আগের যাত্রাপথ আজ নিখুঁত মনে নেই, তাছাড়া ম্যাপও তো পালটে গেছে। সম্ভবত হাসনাবাদ পর্যন্ত ট্রেনে, সেখান থেকে নদীপথে কালীগঞ্জ আশাশুনি হয়ে গিয়েছিলাম। নদীটির নাম বেতনা- যেমন নাম তেমনি স্বভাব। মিষ্টি জলের ভাগ্যশালিনী চন্দ্রভাগা নদী নয়, নোনা জলের হতভাগা গাঙ। এতদিন কাটল বরাক নদীর কাছে বড় বক্র থেকে বরাক, যেন নামের অর্থ নিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে। মেঘনা- আকাশের আয়নার মতো নাম। আর আড়িয়ল খাঁ– বেমক্কা এক যবন পুরুষের নাম। জানি না অন্য কোনো দেশে, অন্য কোনো ভাষায় নদের এ রকম মৌলিক নাম আছে কি না।

একটু বেশি রাতেই পৌঁছেছিলাম। প্রায় নদীতীরেই বাড়ি। কাদা ভেঙে রাস্তায় উঠতে হল। রাত্রে জায়গাটা কিছুই দেখতে পাই নি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ভালো লাগল– জায়গাটা একেবারে অন্য রকম, নদীপারে একটি ছোটখাটো গঞ্জ- কয়েকটা স্থায়ী দোকান, আড়ত, পোস্ট অফিস, স্কুল। রোজ জমজমাট বাজার বসে, কিন্তু দীর্ঘায়ত দুপুর হেলে গেলেই জায়গাটা ফাঁকা আর শান্ত হয়ে আসে। বিকেলে, সন্ধ্যায় নোনা নদীর পারে জায়গাটা একেবারে স্নান এবং নিঃশব্দ। শুধু কয়েকজন স্থানীয় বুড়ো লোক বন্ধ পোস্ট অফিসের বারান্দায় বসে পোস্টমাস্টারের সঙ্গে বৈকালিক আড্ডা দেয়। বুধবার বুধবার এখানে হাট বসে বলে জায়গাটার নাম বুধহাটা। হাটের দিন জায়গাটা একেবারেই অন্য রকম– সকাল থেকে পায়ে হেঁটে, গরুর গাড়ি করে, নৌকোয় ব্যাপারীরা সওদা নিয়ে হাটে আসে। বিকেলবেলা কেনাবেচা হৈ চৈ তুঙ্গে ওঠে। রাত ঘন হবার পরে হাট ক্রমশ ভাঙে। অন্ধকারে ক্রমশ পেট্রোম্যাক্স নেভে, লণ্ঠন নেভে, কারবাইডের আলো নেভে, কেরোসিনের ডিবে নেভে, বিড়ির আগুন নেভে।

চাষবাস, খাদ্যবস্ত্র এবং গেরস্থালি জিনিসের এই হাটে টি বোর্ড থেকে এক ভদ্রলোক এসে গ্রামের হাটুরেদের চায়ের নেশা ধরাবার চেষ্টা করতেন। মঙ্গলবার বিকেলে চায়ের পেটি, হান্ডা, ডেকচি, লোকজন নিয়ে তাঁর ঋষ্যশৃঙ্গকে ভোলাবার তরণী বেতনার ঘাটে এসে ভিড়ত। রাতে নদীতীরে রান্নাবান্না করে খেয়ে, ঘুমিয়ে, পরদিন ভোরে তাঁর লোকেরা কাজে লাগত। হাটে খানিকটা জায়গা নিয়ে বড় বড় কেরোসিন স্টোভে বিশাল বিশাল হাঁড়িতে চায়ের পাতা, দুধ আর আখের গুড় পাঁচনের মতো জ্বাল দেওয়া হত, হাটে আসা মানুষজনকে ডেকে ডেকে সেই চা ঘটি ঘটি, গেলাস গেলাস বিনিপয়সায় খাওয়ানো হত। সারা দিনই চা সেদ্ধ হচ্ছে একই নোক যে কত বার এসে খেয়ে গেল। লোকেরা যত চা খায় টি বোর্ডের ভদ্রলোকও ততই খুশি। তাঁর নৌকো আজকে বুধহাটা তো কালকে আশাশুনি চলল হাটে চা খাওয়াতে।

ভোরবেলা মনে আশা নিয়ে নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কাছেই একটা অশথ গাছ, তার নতুন পাতা হাওয়ায় চটরপটর করছিল। নদী দেখে তবু ভালো লাগল না। এই জায়গা থেকে মাইল চল্লিশ দূরে সুন্দরবন, আর একটু দূরে বঙ্গোপসাগর। সমুদ্রের নোনা জলে নদী ভরতি সমুদ্রের জোয়ারভাটার সঙ্গে নদীতেও জোয়ারভাটা বয়- দুই তীরে বিশ্রী কাদা, ঘাস নেই, শৈবাল নেই, কাদার স্তরের কিনারায় মাটির কাছাকাছি ঘনসন্নিবদ্ধ ম্যাংগ্রোভবনশ্রেণী। ম্যাংগ্রোভের নিচের পাতাগুলি কাদায় ডোবা, উপরের পাতাগুলিতে কাদা শুকিয়ে লেগে আছে, আরও উপরের পাতায় বকের বিষ্ঠা। হাওয়া যদি-বা বয়, পাতা নড়ে না। নদীর ঘোলাটে জলেও বিশেষ সাড়া নেই। দেখলে শঙ্কা জাগে। নদীতে এপার ওপার খেয়া চলে। মাঝে মাঝে গোলপাতা নিয়ে নৌকো আসে। আমাদের দেশে ভাড়ার নৌকোকে বলে কেরায়া নৌকো, এখানে বলে টাপুরে নৌকো। ভাড়ার নৌকো, মাছ ধরার নৌকো, মাটির হাঁড়ি-কলসির নৌকো, ধান-চালের পেটমোটা নৌকো নাকছাবি, ইয়ারিং, টায়রা, চন্দ্রহারের মতো উজ্জ্বল করে রাখে আমাদের নদী আর খালের মুখগুলিকে। এই নদীতে সেইসব নৌকোর বিশেষ আনাগোনা নেই। কামটের ভয়ে এই নদীতে কেউ স্নান করে না, চলন্ত নৌকোয় বসেও কেউ জলে ঈশ্বরী পাটনীর মতো পা ডুবিয়ে রাখে না। লোকালয়ের মধ্য দিয়ে এতখানি অস্পৃশ্য জল কি অকারণেই বয়ে চলেছে?

আমি নদীকে ছেড়ে, বাজার চত্বর পেরিয়ে মাটির বড় রাস্তা ধরি, গাঁয়ের মধ্যে এগোতে থাকি। বুনো, জংলা জায়গা। উর্বর মাটি। গৃহস্থবাড়িতে কলা গাছের পাতা ফনফন করছে। বড় বড় গাছের ছায়ায় হলুদবন শটিবন নিজে নিজেই বাড়ছে। গাছ আগাছা-লতায় ভরা প্রাচীন জংলা বন যেমন আছে, তেমনি আছে নতুন হাসিল করা ফাঁকা জমিতে নতুন বাস্তু। ফাঁকা জমিতে হু হু করে হাওয়া বয়- গৃহস্থ চাষি কলার ঝাড় বসিয়েছিল হাওয়ায় ছিঁড়ে যাওয়া পাতা ফতফত করে ওড়ে। মাটি এমন জিনিস, তাকে নিয়ে একটু খাটলেই বেঁচে থাকার অন্ন মেলে।

বাড়ি থেকে এক পা দূরে বাজার। সবজি মাছ দই মিষ্টি গুড় প্রচুর এবং অভাবিত সস্তা। কত রকমের চিংড়ি কুচো, ছটকা, বাগদা, গলদা। হাত পা বাদ দিয়েও এক ফুট ব্যাসের কাঁকড়া। মাটির কলসিতে আনা ঘোলের রং লালচে বাদামী উপরে মাখম ভাসে আর তলার দিকে গাঢ় হয়ে থাকে চূর্ণ দইয়ের কশা। দধির অগ্র, ঘোলের শেষ। আমাদের পুরুষেরা জীবিকার জন্য পুর্নিয়া, ঝরিয়া, অসম, ব্রহ্মদেশে যেত– বাবা তল্লাট খুঁজে খুঁজে এই জায়গাটি বার করেছিলেন। এইরকম খাবার খেলে লোকের স্বাস্থ্য ফেটে পড়ার কথা। কিন্তু তা যে হয় নি তার কারণ ম্যালেরিয়া। হেমন্তে কিছু কিছু গাছ পাতা ঝরার মুখে হলদে হয়ে যায়, এখানে যাকে ম্যালেরিয়ায় ধরে বারো মাস তারও ঐ গাছের দশা। বেতনা নদীর নোনা জল আর ম্যালেরিয়ার পাঙাশ রং এই জায়গাটাকে যেন একটা ঘোরের মধ্যে রেখে দিয়েছে। মানুষগুলো উলটেপালটে ম্যালেরিয়ায় পড়ে, তবু হাটের দিন ঠিক হাটে আসে, চিংড়ি মাছ, গুলে মাছ কেনে, বাড়িতে গিয়ে ঝাল চচ্চড়ি খায়। নোনা নৈশ বাতাসের চল্লিশ মাইল দূরে সুন্দরবন- এই জায়গাটা যেন সেই বাঘের জঙ্গলের ঘুমন্ত কিনারা। এইখানে একদিন হরিণের মাংস খেয়েছিলাম– চর্বির চিহ্নহীন টগবগে দৌড়বাজ লাল মাংস।

ভোরবেলা ঘুম ভাঙলে ঘরে থাকতে ইচ্ছে করে না। দু পা হেঁটে বেতনার পাড়ে গিয়ে দাঁড়াই। নির্জন। এখনও খেয়া চলাচল শুরু হয় নি। এদিককার দোকানঘর আড়ত সব ঝাঁপ বন্ধ। এখানে আমার অদ্ভুতভাবে দিন কাটে। কোনো কাজ বা দায় কিচ্ছু নেই। আমি হাঁটি বা না হাঁটি, চলি বা না চলি, দিন যেভাবে সূর্যকে নিঃশব্দে আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঠেলে নিয়ে যায় তেমনি আমিও ভোর থেকে সন্ধ্যায় পৌঁছই। রাত্রি দেড় প্রহর হলে লণ্ঠনের পাশে বিছানায় শুয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি।

মায়ের স্বভাবে ছিল জলীয় ভাব। দেশের বাড়িতে আমাদের তিনটে পুকুরের সঙ্গে মা ছিল যেন চতুর্থ পুকুরটি ছোট পুকুর, সুখী, কলমিলতা-ভাসা জলে ছোট্ট মাছ হঠাৎ লাফিয়ে উঠে আবার ডুব দেয়, পাড়ের ঘন গাছে কোকিল লুকিয়ে বসে দুপুরে কখনো ডাকে। গঞ্জের এই ঘেরা বাড়িতে এসে সেই পুকুরটি এখন পাতকুয়ো। আত্মীয় বন্ধু কেউ নেই যাদের বাড়িতে যাওয়া যায়, পথে বেরুনো নেই, তাই গায়ের গাছপালার ডুরে ছায়া তার মাথায় মুখে আর পড়ে না।

চারপাঁচটা ছোট ভাইবোন এখানকার বেড়াল, ব্যাঙাচি, পাখির মতোই এই জায়গার সঙ্গে মিশে আছে কেউ এ ঝোপে কু দিচ্ছে তো কেউ অন্য ঝোপে মুখে শস্যদানা নিয়ে পালাল।

বাবা কি একটু পালটেছেন? আমার পড়া ছেড়ে দেওয়া বা কাজের চেষ্টা না করে এই অলস বসে থাকা নিয়ে একটা কথাও বলেন না। বরং সন্ধের পর অদ্ভুত সব বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো গল্প করার চেষ্টা করেন। নিঃশর্তে খাদ্য বাসস্থান ও বিছানা দেবার জন্য বাবার কাছে আমি ভিতর থেকে কৃতজ্ঞ বোধ করি। তাঁর দুঃখ দৈন্যও আমি টের পাই। কিন্তু যেই কথাবার্তা শুরু হয় অমনি আমাদের অসেতুসম্ভব মতদ্বৈধ প্রকট হয়ে ওঠে। কোনো গভীর বিষয় নিয়ে যে আমাদের আলোচনা হয় তাও না। একবার তো, এখনো মনে আছে, শালিকের আকার নিয়ে আমাদের তর্ক বাধল। বাবা নাকি কোথায় কাগের মতো বড় শালিক দেখেছিলেন। আমি শালিককে ছাতারের চেয়ে বড় বলে মানতে রাজি নই। বাবাকে আমি মনে মনে বললাম, বোগাস। বাবা আমাকে অস্ফুটে বললেন, ইমপিউডন্ট, ধৃষ্ট। যে-কোনো কথা, সে শালিক বা ঈশ্বর যাই হোক, আমাদের দুজনার মধ্যে পড়লে অনেক দূর ঝগড়ায় গড়িয়ে যায়। এর চেয়ে বাক্যালাপ না করাই শ্রেয়।

সেই দিনগুলির পর ষাট বছর কেটে গেছে। আবার এই বাড়িতে বাপ ছেলের ঐ চিরকালীন দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা দেখা দেয়। আমার ছেলে এসে নানা বিষয়ে তার মতামত শুনিয়ে আমার মতামত জানতে চায়। আমার সঙ্গে তার মতে মেলে না, তবু আদার ব্যাপারী আমাকে তার জাহাজের খবর জানানো চাই। উত্তপ্ত তর্কে নেমে পড়বার মুখে হঠাৎ আমার বাবার কথা মনে পড়ে আমি তৎক্ষণাৎ সাবধান হয়ে তর্ক থেকে পা তুলে নিয়ে ছেলেকে তার জাহাজসুদ্ধ ঠেলে দিই দূর জলে।

মাসখানেক গেল। জায়গাটা যেন তামসিকতায় আচ্ছন্ন। খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে দশ পা গেলেই পণ্ডিতমশাইয়ের পুরনো আমবাগান। তার মধ্যে পুরনো এক পুকুর। সেখানে দুপুরে যাই স্নানে। আঁটির আম গাছগুলি মহাকায়, ফলন কম। ঐ বনে কেউ ঢোকে না। ঝোঁপঝাড়, আগাছা, কুগাছা, পচা পাতা, সবুজ শ্যাওলা আর ছায়া ঢেকে রেখেছে মাটি। সেই ঢাকনার নিচে, অগোচরে কেউ বা কারা শামুকে ডিমের মতো বিয়ে চলেছে তমোগুণ। পুকুরের পাড় থেকে অনেক নিচে নেমে আছে জল। জলে আকাশের ছায়া পড়ে না। সেখানে অনেকক্ষণ একলা থাকার পর কোনে সরীসৃপের শব্দে অকস্মাৎ সংবিৎ ফিরলে তাকিয়ে দেখি, বাগানের দূরের এক কোণে হলদে রোদ্দুর লম্বা আর তেরছা হয়ে গাছের গা বেয়ে শাড়ির মতো ঝুলছে শ্মশানে শুকুতে দেওয়া মড়ার শাড়ি বা গলায় দড়ির শাড়ি। একটু পরে সে-কাপড় ঈথারে মিলিয়ে যায়।

কিন্তু আমার দিন আর যায় না। হাট যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে স্থানীয় হাই। স্কুল। স্কুলের লাইব্রেরির দায়িত্বে ছিলেন অঙ্কের শিক্ষক আদ্যনাথবাবু। তিন-চার আলমারি বই ছিল, আরও নতুন বই কেনা হচ্ছিল। আমি আদ্যনাথবাবুর কাছ থেকে দু-তিনখানা করে বই একসঙ্গে নিয়ে আসি। বইয়ের তালিকা বিচিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাশে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের চার খণ্ড ডিসক, বিভূতিভূষণের সদ্যপ্রকাশিত অনুবর্তনের পাশে কান্তিচন্দ্র ঘোষের রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম। আমি নির্বিচারে তৃষিতের মতো পড়ি। বাদা অঞ্চলের এই অজ গঞ্জে বসে রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণের সংকলন ‘যাত্রী পড়ি। নতুন ঝকঝকে বই। রবীন্দ্রনাথ যখন ‘জাপানযাত্রীতে চা অনুষ্ঠানের বর্ণনা বা হারা সান-এর বাড়ির ছবির ঘরে দেখা টাইকানের ছবির বর্ণনা দেন তখন অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকি নিষ্কলঙ্ক শান্ত সৌন্দর্যের অনুভব তো বাক্যরচনা জানে না, এক মাত্রা সূচিকাভরণে চেতনায় কোথাও যেন একটা ব্যথা বোধ করি। কখনো মনে হয়, আমি যেন দেড় আঙুলে ছেলেটি, রবীন্দ্রনাথের জোব্বার খুঁট ধরে লুকিয়ে ঢুকেছি শান্ত এক ছায়াধূসর রূপকথার দেশে।

সাড়ে পাঁচ ফুটের এক যুবক কেন দেড় আঙুলে বাচ্চা হতে চাইছে? দেড় আঙুলে থেকে আধ আঙুলে হলে তার আরো সুবিধে হয়। সাড়ে পাঁচ ফুটের অনেক কর্তব্য, নিজের প্রতি, অন্যের প্রতি। সে কিছুই পারে না। পারে না যে তা তো দেখাই গেল। অতএব নিজেকে বাঁচাতে সাড়ে পাঁচ ফুটের অস্তিত্বকে সে আড়াল করে বইয়ের পাতা দিয়ে বই তার পালাবার ইগলু, বই তার পালাবার ইগলুর এক-একটি রামধনু ঠিকরোনো বরফ-ইট।

আমি তখনই বুঝেছিলাম, আমি আসলে কাপুরুষ। সারা জীবনে যত সাহসের কাজ করেছি, অ্যাডভেঞ্চার করেছি তা কেবল বিপদের মুখে পড়ে ভয়ে মাথা ঠিক ছিল না বলেই। এ হচ্ছে বাঘের বীরত্বের মতো। সামান্য ছাগলছানা দেখেও সে ভয়ে থরহরি হয় বলেই দাঁত খিঁচিয়ে, চোখ ঘুরিয়ে, পাঁচ নখ বার করা থাবায় উড়িয়ে দেয় বাচ্চাটাকে। সাহস অনেক সময়েই ভীরুর রিফ্লেকস অ্যাকশন। কয়েক বছর পরে, যখন ছবি আঁকায় মন দিয়েছি তখন পলাতকের স্বর্গ নামে একটা সিরিজ করলাম। সে ছবিগুলোও আসলে রূঢ় বাস্তব এড়িয়ে পালাবার ফিকির, আমার পলায়নী মনোভাবের উপর অনিকেত তাঁবু আর সূর্যাস্ত ছড়িয়ে দেওয়া ছবি।

.

 শটিবন ও ম্যালেরিয়া

এখানে আসার পরে কখনও কখনও ভাবি, যদি আমি কোনো জনহীন বনের মধ্যে নিজেকে পুঁতে ফেলি তবে আর কোনো ঝাট থাকে না, অথচ আমি বন্য লিলির মতো জ্যান্ত থাকব মাটির নিচে আমার হালকা শ্মশ্রুময় অণ্ডকোষ শিকড়ওয়ালা কন্দের মতো বাড়বে। কানের দুই ফুটো, নাকের দুই ফুটো থেকে লম্বা উঁটিতে দল বেরুবে, কেশর বেরুবে– বিরল অর্কিডের মতো তাদের শোভা আর হিংস্রতা। সেই ফুল সাপের ফণার মতো উদ্যত হয়ে থাকে বনের মধ্যে, আবার অবসাদে গা ছেড়ে দিয়ে লুটিয়ে পড়ে জলে ডোবা ছেলের পাজামার মতো। ইচ্ছে হলে আমি মাটির তলায় ফুলকে টেনে নিতে পারি, আবার বাইরে আগুনের শিখার মতো ঠেলেও দিতে পারি। এইসব ভাবতে ভাবতে, এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে দেখি পোড়ো জমি জুড়ে প্রাচীন শটি গাছের মূলে শর্করা জমে নীল হয়ে আছে। শটি গাছ ছায়ায় জন্মায়। হলুদ, দোলনচাঁপা, এলাচ আর শটি– এরা সব এক জাতের গাছ। কয়েক দিন ছায়ায় ছায়ায় ঘুরে শটি গাছ দেখে দেখে বিনি পয়সার এই পড়ে-পাওয়া কাঁচা মাল থেকে অর্থকরী শটি ফুড বা পাতলা তৈরির মতলব মাথায় এল। আমাদের দেশে কেউ কেউ ঘরে খাবার জন্যই বাড়িতে পালা তৈরি করে। পালোর পায়েস চায়না গ্রাসের পায়েসের মতোই জমাট এবং সুস্বাদ। শটির মূল থেকে পালো বানাবার পদ্ধতি মোটেই কঠিন নয়। আমি যদি এটাকে কুটির শিল্প করতে পারি তো নিশ্চয় লাভ হবে। এখন বড়মা থাকলে খুব ভালো হত। এসব ব্যাপারে বড়মার মতো আর কার পারদর্শিতা।

পণ্ডিতমশায়ের ছেলে গোপী আমার সমবয়সী, তার সঙ্গে পরামর্শ করে পরদিন দুপুরে দুজনাতে কোদাল আর বস্তা হাতে বেরুলাম। শিকড়ে কোপ দিতেই বোঝা গেল, বাইরে থেকে এদের যেমন সাধারণ শটি গাছ মনে হয়েছিল, এরা মোটেই তা নয়। শটির শিকড় পাঁচ বছর, দশ বছর নিশ্চিন্তে মাটির তলায় থেকে বানরসৈন্যদের তৈরি পাথরে জাঙালের মতো শক্ত আর জটিল গোলকধাঁধা হয়ে আছে– গাছের গোড়া থেকে কন এঁকেবেঁকে দূরে চলে গেছে, শিলাজতুর রেখার মতো নীল দাগ পড়েছে সেই প্রাচীন মূলগুলির বাকলের নিচে। আমার বিশ্বাস হল, এতে দারুণ পালো হবে, এর মজ্জায় ঘনীভূত হয়ে আছে স্টার্চ। আমি আর গোপী মহা উৎসাহে কোদাল চালিয়ে কন্দগুলি তুলছি কাজটা সোজা নয়, বেশ পরিশ্রম হচ্ছে। কয়েক ঘণ্টা কন্দমূল তুলে, বস্তায় ভরে নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরলাম।

পরের দিন দুপুরে গোপী এল একটা গরুর গাড়ি নিয়ে। গরু নেই, গোপী নিজেই ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এসেছে সেটা। আজকে আরো বেশি শটির মূল আনা যাবে। সেদিন বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে আমরা সূর্যাস্ত পর্যন্ত কাজ করলাম। সন্ধেবেলা একগাড়ি শিকড়বাকড় এনে রান্নাঘরের দাওয়ায় স্কুপ করে রাখলাম। বাবা বা মা কেউ কিছু বলল না, কিন্তু হঠাৎ আমার নিজেকে অন্ধকারে শ্মশানফেরত ভূতের মতো লাগল। আমি, যেন শিকড়বাকড় নয়, শ্মশান খুঁড়ে কতগুলো হাড়গোড় নিয়ে এসেছি। পাতকুয়োয় বালতি নামিয়ে হাতপা ধোবার সময় হঠাৎ কেমন চিনচিনে শীত করল। রাত্রে তেমন খিদে পেল না, তবু খেলাম, শুতে গেলাম। আর গ্রীষ্মের গভীর রাত্রে হঠাৎ দারুণ শীতে হাড়মজ্জার ভিতর থেকে কাঁপুনি উঠল। যেন পাহাড়ী শীত। আমি অর্ধেক তোশকে শরীর মুড়ে নিলাম, ঘুম ভেঙে গেছে, যেন শীতের চেয়েও গভীর কোনো শীতে শরীর কাঁপাচ্ছে। ঘণ্টাখানেক কেঁপে শরীর নিস্তেজ হয়ে গেল- তপ্ত হবার একটা সুখানুভূতি এল, ক্রমশ শরীরে তাপ উঠছে। এখন বেশ ভালো লাগছে। পায়ের পাতা বেশ গরম হয়েছে। সকালবেলা গরম বিস্বাদ মুখ আর লাল চোখ নিয়ে মশারির ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রইলাম। সবাই বেশ নড়াচড়া করছে, দিনের কাজ শুরু হয়েছে। এর পর পাঁচ-ছ দিন সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রবল জ্বরে আমার সমস্ত দুশ্চিন্তা আর দুশ্চেষ্টা ধুয়ে মুছে গেল। তার পর একদিন ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেল এবং ম্যালেরিয়া তার স্বরূপ প্রকাশ করল।

এখন রোজ অপরাহ্নে কম্প দিয়ে জ্বর আসে। ঘন্টাখানেক হাড়সুদ্ধ কাঁপাবার পরে দৌড় করানো কুকুরের মতো হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাঁপাতে থাকি- শরীর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসে আর জ্বর চড়তে থাকে। সন্ধের মুখে শরীর জ্বরে টং হয়ে যায় ভালো লাগে, নেশার মতো লাগে। জানলার বাইরে আম গাছে অন্ধকার হুতুম প্যাঁচা কিংবা শামুকখোল পাখির মতো ঝুপ করে এসে বসে। আমার মধ্যে যেটুকু যুবকত্ব এসেছিল জ্বরের তাপে সেটুকুও যেন মাখমের মতো গলে খসে পড়েছে। আবার যেন ছেলেবেলার অবুঝ জাতের মধ্যে ঢুকছি। রাত্রে জ্বরের মধ্যে আবছামতো কত কী ভাবি– মুখ শুকিয়ে যায়, তেষ্টা পায়। রাত পোহাবার জন্য অপেক্ষা করি, শেষরাতে অকারণে আশা জাগে। ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরবেলা আলো দেখে আবার একটু ভালো লাগে। ছোট ছোট ভাইবোনেরা নিজেদের খেয়ালে চারদিকে ঘোরে। মা জলখাবার বানিয়ে দেয়, খাই। রোদ দরজা দিয়ে ভিতরে এসেছে, দেখি। মাছি ওড়ে, দেখি। এখন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ছে। রোদ সরে যায়, দেখি। মা বিছানা রোদে দেয়। আমি চাদর গায়ে দিয়ে বসি। বসে বসে ক্লান্ত লাগে। আবার শুই। মা এসে মাথা ধুইয়ে দেয়। জ্বর ছেড়ে গিয়ে শরীর ঠাণ্ডা। ভাতের জন্য দারুণ লোভ হয়। ভাত মাছ আরো যা যা ইচ্ছে খাই। পেট ভরার পরে শরীরে আরাম ফিরে আসে। আকাশের দিকে তাকাই। নীল আকাশ। চালের উপর কাক উড়ে এসে ডাকে। খিড়কির দুয়ার থেকে উঠোনে পাতা উড়ে আসে। সূর্য একটু ঢলে গেলেই ভয় হতে থাকে এক্ষুনি আবার কাঁপুনি শুরু হবে। কুইনিন মিকশ্চার খাই, কেমোকুইন খাই, মেপাক্রিন খাই। কিছুতেই কিছু হয় না। অপরাহ্নে সূর্য যখন আমাদের বাড়ি ছেড়ে দূরের বাড়িটার নারকেল গাছ অতিক্রম করে ঠিক তখনই রোজ জ্বর আসে। জ্বরের আসা যাওয়া সময় ধরে চলে। সন্ধে উতরে গেলে মা আমার বিছানার পাশে একটি নোতা সুজি আর একবাটি তরকারি এনে রাখে। দুধ ভালো লাগে না, মা বিশ্বনাথ পরামানিকের দোকান থেকে কাঁচাগোল্লা আনিয়ে দেয়।

মাসের পর মাস ভুগে আমি ক্রমশ পাঙাশবর্ণ, আখুটে আর স্বার্থপর হয়ে গেলাম। লিভারে টিপলে ব্যথা করে, পিলে বড় হয়ে পেটের বাঁ দিকটা ফুলেছে। রক্তাল্পতার জন্য পাও ফুলেছে। এ ঘর থেকে ও ঘরে যেতে কষ্ট হয়, মা কিংবা ছোটভাইয়ের কাঁধে ভর দিয়ে যাই। খুব অসহিষ্ণুতা বেড়ে গেছে, ছোটভাইকে অকারণে খাটাই। আমার অত্যাচার বাবা লক্ষ করেছিলেন, একদিন বললেন– ব্যাপার কী? তুই ওকে ক্রীতদাসের মতো খাটাস কেন? একটা ধাক্কা লাগল- এইরকম কথা বাবা এই প্রথম আমাকে বললেন। কেন, আমি কি ওদের ভালোবাসি না? ওরা মার আপন গর্ভের ছেলেমেয়ে, মা কিন্তু আমাকে কোনদিন এমন কথা বলে নি। তবু এই কথার জন্যই বাবাকে আমার অনেকদিন পরে ভালো লাগল। বাবা তাহলে সব লক্ষ করেন, নিজের সব সন্তানের সম্মান সম্বন্ধেই সজাগ। এর পর আমি ভিতরে ভিতরে সাবধান হয়ে গেলাম।

একটু দূরে গোলপাতায় ছাওয়া আমাদের আর একটা ঘর ছিল। জায়গা পালটালে যদি সেরে উঠি এই ভেবে সেই ঘরে থাকতে গেলাম। দিনে সবাই সেখানে আসে। রাত্রে আমি সেই কুটিরে একলা থাকি। এই কুটিরে ছোটখাটো জিনিস খুঁটিয়ে লক্ষ করি চিনির ক্রিস্টাল, মাছির চোখ, পিঁপড়ে… বাষ্পহীন গভীর রাতে জ্যোৎস্নায় চিনির দানাগুলি উড়িয়ে দিলে তারা পরীর মতো ওড়ে। হাতের পাতা দিয়ে পশ্চিমের রোদ আড়াল করে দেখি, আমার লম্বা লম্বা আঙুলের ফাঁকে রোদের সঙ্গে মিশে থাকা সূর্যের আত্মহত্যার রক্ত টকটকে লাল। আঙুল ছড়িয়ে দিলে কিছু নেই। ম্যাজিক! দিনরাত জানলা খুলে রাখি, রাত্রে চাঁদের আলো এসে পড়ে বিছানার সাদা চাদরে। আমি সেখানে আমার হাতের আঙুলগুলো রেখে দেখি, যেন কাঠি কাঠি কালোজামের ডাল। আমার নিজের জিনিস বলতে এই হাত পা মাথা আর একখাবলা চুলের বাইরে আর কিছু নেই। কত দূরের, যেন অন্য আকাশের চাঁদ তারা সূর্যের রশ্মিকে আমার বিশ আঙুলের ডগা আর দশ হাজার চুলের চুম্বক উঁচ দাঁড়িয়ে উঠে সসম্ভ্রমে স্পর্শ করে। এ সবই পরীক্ষিত সত্য।

আসলে, মনে মনে অস্থির আর আর্ত হয়ে উঠছি বেতনা নদীর ভাটায় ভেসে এসে জলে কাদায় আটকে পড়েছিল শব, এখন উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আমার ছোট বোন দেখে এল ট্যাংরা মাছ সেই মড়ার মধ্যে গিয়ে ঢুকছে, আবার একটু পরে বেরিয়ে আসছে, আবার ঢুকছে, আবার বেরোচ্ছে। অর্থাৎ মড়ার নাড়িভুড়ি সে টুকে টুকে খাচ্ছে। শুনে আমি চমকে উঠলাম। আমি বুঝেছি, এখনই বেরিয়ে যেতে না পারলে ঐ উপুড় হয়ে থাকা শবের মতো আমাকেও এখানেই থেকে যেতে হবে।

আমি চোখমুখ বুজে দাদুকে সব জানিয়ে একটি চিঠি লিখলাম। সংক্ষিপ্ত উত্তরে দাদু আমাকে কলকাতায় চলে আসতে বললেন। এরই মধ্যে ঈশ্বরপ্রেরিতের মতো আমার পিসতুতো ভাই এবং পুরনো বন্ধু ননিদা এসে হাজির। তারা এখন বাটানগরে থাকে। মাঝে মাঝে, পুরনো অভ্যাসবশত, মামা-মাসিদের খবর নিতে বেরিয়ে পড়ে সে। স্থির করলাম, ননিদা যেদিন বাড়ি ফিরবে সেদিন আমিও তার সঙ্গী হব। হাঁটাপথে সাতক্ষীরা হয়ে, ইটিল্ডা ঘাটে ইছামতী পেরিয়ে কলকাতার বাস ধরব। পা ফুলে থাকে, লিভারে ব্যথা, এ ঘর থেকে ও ঘরে যেতে কষ্ট হয়, আমি কি পারব অতটা পথ হাঁটতে? কিন্তু আমি যাবই। যেখানে যাব সে জায়গা এবার ভালো কি মন্দ হবে জানি না, কিন্তু আমি যাবই।

যাবার আগের দিন ছ মাস আগেকার সেই স্তূপীকৃত শটির শেকড়বাকড় রান্নাঘরের পিছনে ফেলে দিয়ে বাড়ি সাফ করলাম। মূলগুলি শুকিয়ে গেছে, কিন্তু পচে নি, অদ্ভুত বিকলাঙ্গ ভাস্কর্যের রূপ ধরেছে। পিশাচ যেমন রক্ত খেয়ে আয়ু পায় ওরা তেমনি রান্নাঘরের পিছনে মাটি পেয়ে এবার পালা মেলবে, নিশ্বাস ফেলে জাগবে। জাগুক।

পাখার বাতাসে জুড়োনো ফ্যানসা ভাত খেয়ে ধেনু চরাবার মতো প্রভাতবেলায়। আমরা পথে নামলাম। মা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল। বাবা কাছাকাছি কোথাও নেই। পথে নেমে, মোড় নিয়ে, দৃষ্টির বাইরে যেতে যেতে আমি যেন হঠাই টের পেলাম, প্রথম সন্তানের জন্য তাঁর নির্বাক দুর্বলতা, তাঁর বিপন্নতা। পাঁচ-ছটা ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে পিতৃস্নেহ সমান ভাগে ভাগ করে দিতে দিতে তাঁর ভাণ্ডার ফুরিয়ে যাচ্ছে।

কতদিন হাঁটাচলা নেই, মাথা আর পা টলমল করছিল। আমি কথা না পেড়ে মুখ বুজে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে ঘাম দিল, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের খিল খুলে শরীর অভ্যস্ত হয়ে এল। খেত, জংলা জায়গা, গাছের সারি পাড়াগাঁর পর পাড়াগাঁ পেরোতে পেরোতে এক সময়ে ইটের বাড়ি, বাগান, ঘাটবাঁধানো পুকুর আর ইটের শক্ত রাস্তা দেখা দিল। দোকানের সাইনবোর্ডে দেখলাম: সাতক্ষীরা। সাতক্ষীরা হচ্ছে মহকুমা শহর। সেখানে, পথে এক জায়গায় হঠাৎ ঘন ছায়া ছায়া, টাটকা বকুল ঝরে আছে তাকিয়ে দেখি, এক বিশাল বকুল গাছ। কতকালের পুরনো গাছ কে জানে, মিশকালো তার গুঁড়ি আর ডালপালা।

বেলা পড়ে যাবার আগেই ইটিল্ডা ঘাটে পৌঁছলাম। ইছামতী পেরুলাম নৌকোয়। ওপারে শ্যামবাজারের বাস। দাদুর বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে রাত প্রথম প্রহর পেরিয়ে গেল। আশ্চর্যের ব্যাপার, সেদিন আর জ্বর এল না। কিন্তু হেঁটে হেঁটে কুঁচকিতে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সেদিন রাত্রে জ্বর এল না, পরের দিন সকাল গেল, দুপুর গেল, জ্বর এল না। বিকেলে রিকশায় চেপে একজন বুড়ো ডাক্তারবাবু এলেন। আমার পা ফোলা দেখলেন, নাড়ি দেখলেন, চোখের কোল টেনে ধরে দেখলেন, স্টেথো দিয়ে বুক পরীক্ষা করলেন, লিভার পিলে টিপে টিপে দেখে কালো রঙের একটা বড়ির বিধান দিলেন। আমার ছ সাত মাসের পুরনো জ্বর যেন মন্ত্রবলে মিলিয়ে গেল।

.

আবার কলকাতায়, দ্বিতীয় চাকরি

ম্যালেরিয়ায় ভুগে আমার মুখে করুণ ছায়া পড়েছে, মাথার চুল উঠে গিয়ে মোষের বাচ্চার রোমের মতো হয়েছে। বুকের ছাতি ইঞ্চি দেড়েক কমে গেছে। অহংকার দু-তিন ডিগ্রি নেমে গেছে। সাহস বেড়েছে কি কমেছে বুঝি না। তবে এই কারুণ্য দেখে ভাগ্য বোধ হয় এ যাত্রায় কিছু প্রসন্ন হল।

যুদ্ধ ছেলেদের সামনে অনেক সুযোগ এনে দিয়েছিল নানারকমের চাকরি, নানা রকমের প্রশিক্ষণ, বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো ছেলেদের বাঁচার হরেক বন্দোবস্ত। যুদ্ধকালে সমরবিভাগ এক বিশ্বরূপমূর্তি ধরে যেখানে যা আছে সবই তার অন্তর্গত বাবলা কাঁটা থেকে বিরাট যুদ্ধজাহাজ সবই তার দরকার, রহিম হাজাম থেকে অটো হান সবাইকেই তার চাই। আমি সেই বিরাট মেশিনারিতে একটি ক্রু হয়ে লেগে গেলাম।

মেটেবুরুজের কেশোরাম কটন মিল তখন শুধু যুদ্ধের জিনিস তৈরি করছিল। গ্যাস যুদ্ধে লড়বার জন্যে সৈন্যদের গ্যাস মুখোশ আর অ্যান্টিগ্যাস কেইপ দেওয়া হত। কেশোরাম মিহি সুতোয় বোনা কেমব্রিক কাপড় বিশেষ কেমিক্যাল দ্রবণে ডুবিয়ে, উত্তপ্ত কক্ষে শুকিয়ে ঐ কেইপের কাপড় তৈরি করত। কাপড় বোনার আগে সুতোর টেনশন পরীক্ষা করে দেখা হত। অতি সহজেই এখানে আমি চাকরি পেলাম। আমার কাজ ছিল, দ্রবণে ডোবানো কাপড় শুকিয়ে যাবার পর সম্পূর্ণ নীর হয়েছে কি না দেখা। বিরাট শেডের সর্বত্রই রাসায়নিকের উগ্র গন্ধ তার ঝাঁজে চোখে জল আসে, সব সময় একটা অস্বস্তিকর গরমে কষ্ট হয়। শেডের মস্ত দরজা তিনটে শিফটেই খোলা থাকে। হঠাৎ সেই দরজা দিয়ে একঝলক হাওয়া আসে। একদিন, অনেকক্ষণ পরে এইরকম একটু হাওয়া এসেছে। মাদীন বলে একটি ছেলে আমার পাশে কাজ করছিল- ন্যাড়া মাথা, বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে ওঠা বসন্তে খোদলানো চ্যাপটা মুখ, পরনে কালো গেঞ্জি- হঠাৎ শুনি সে বলছে, আঃ! রগুল্লার চেয়েও মিষ্টি এই হাওয়া তাকিয়ে দেখি মুহূর্তের আরামে মুদে এসেছে তার চোখ। মাতাদীনের পূর্বাপর কিছুই জানি না, কিন্তু ঐ একঝলক হাওয়ার সঙ্গে তার মন্তব্যটির জন্য তাকে মনে রয়ে গেছে।

আরও একজনকে মনে আছে, সে মহেন্দ্র সিং, ভারতীয় বংশোদ্ভূত মরিশাসের লোক। কী করে সে এখানে এসে জুটল কে জানে। ছ ফিটের উপর লম্বা, বিশাল দেহ, বডিবিল্ডারদের মতো সুঠাম শরীর, শ্যামলা রং, ঝকঝকে হাসি, সুন্দর মুখশ্রী, ক্রু কাট চুল, ইংরিজিভাষী। সে হট চেম্বারে কাজ করত, একা। প্রচণ্ড উত্তপ্ত ঐ ঘরে আর কেউ যেতে চাইত না বলে সে ছুটি পেত না। মিল তাকে রোজ তিন সের দুধ এমনিই দিত। একদিন আমি, কতটা গরম দেখার জন্য, হট চেম্বারে ঢুকেছিলাম। মুহূর্তে মনে হল, রক্ত যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। চোখে, নাকের গর্তে, মাথার কোটরে, ফুসফুসের বেলোতে আগ্নেয়গিরির বাতাস ঢুকে আমাকে এখনি মমি বানিয়ে ফেলবে। সবাই বলত, মহেন্দ্রের ঐ চেহারা আর থাকবে না। ও অসুখে পড়ে যাবে।

এখানে দু মাস কাজ করে টের পাচ্ছিলাম, আমি বদলে যাচ্ছি। এখানে সারা জীবনের মতো আমার একটি শিক্ষা লাভ হল: বংশ, রক্ত, বর্ণ সব বাজে কথা তেমন তেমন বৃত্তির পাল্লায় পড়লে মানুষের ল্যাজামুড়ো পালটে যায়। ভয় হল, শেষটায় আমি কি মাতাদীন বা নুরুলের মতো হয়ে যাব? ফরসা সাদা হাফশার্টের বদলে কালো রঙের গেঞ্জি পরব? মাথায় গামছা প্যাচাব, কাবুলিদের কাছে টাকা ধার করব, বিকেলে ভিজে ছোলা আর পাইট নিয়ে বসব, চাচেরা বোনকে বিয়ে করব?

.

 বি ই কলেজ, পঞ্চাশের মন্বন্তর

সমরবিভাগের প্রয়োজনে ভারত সরকার পার্ক স্ট্রিটে একটা অফিস খুলেছিল। তাদের কাজ ছিল ইচ্ছুক ছেলেদের বিভিন্ন এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও টেকনিক্যাল স্কুলে রেখে কাজ শেখানো। শিক্ষাকাল শেষ হলে পরীক্ষা। পাশ করে যার ইচ্ছে ফৌজে যোগ দিতে পারে, যার ইচ্ছে বাড়ি ফিরে যেতে পারে। কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ব্যাপারটা আমার খুব মনমতো হল। অবিলম্বে একদিন আমি সেই অফিসে হাজির হলাম। আমার ইন্টারভিউ নিলেন ডক্টর এস আর সেনগুপ্ত, যিনি আর কয়েক বছর পরে আই আই টির ডিরেক্টর হিসেবে বিখ্যাত হবেন। অতএব এই ইন্টারভিউ যেন মশা মারতে কামান দাগা।

শিক্ষার জন্য আমাকে শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে রিপোর্ট করতে বলা হল। সেখানে আমাদের জন্য নতুন বানানো চমৎকার হস্টেল- কিচেন, ডাইনিং হল, ব্যায়ামাগার। শিক্ষাভাতা যা পাব তাতে হস্টেলের খরচ মিটিয়েও হাতে কয়েক টাকা থেকে যাবে।

এখানে ঢুকে অনেকদিন পরে আমি যেন হাঁফ ছাড়লাম। অনেকদিন পরে আবার আমি ছাত্র মন থেকে অনেক গ্লানি, অনেক ভার নেমে গেল। দিনগুলি চমৎকার।

বি ই কলেজে আমার বেশির ভাগ সময় কেটেছিল মেশিন শপে আর ড্রইং বোর্ডের সামনে। মেশিন শপের ইনচার্জ শিক্ষক সূর্যনারায়ণ কর্মকারকে ভোলা অসম্ভব। শপের বড় শেডে অজস্র মেশিনের মধ্যে দুটি হলক লেদ পাশাপাশি ছিল আমেরিকান মেশিন, ওজনে যেমন ভারী, কাজ করে তেমনি আরাম, এতটুকু জার্ক দেয় না, কাঁপে না। তার ভারী চাক বাঁধতে গেলে আমাদের একজন চাকটি দুহাতে তুলে ধরে, আর একজন বেল্ট ঘোরায়। কর্মকারের হারকিউলিসের মতো বুক আর বাহু, সিংহের মতো সরু কোমর শুধু ওঁকেই দেখতাম অনায়াসে এক হাতে চাক তুলে ধরে অন্য হাতে বেল্ট ঘোরাচ্ছেন। কর্মকার অবিরাম সিগারেট খেতেন আর কোনো-না-কোনো মেশিনে কাজ করতেন। ছাত্রদের আপনি বলতেন, রোল নাম্বার ধরে সম্বোধন করতেন যেন কিছুতেই কোনো ব্যক্তিগত স্পর্শের মধ্যে যাবেন না। সকালের পুরো শিফট কাজ করে, অনেক দিন দেখেছি, পরের শিফটে সন্ধের সময় চানটান করে, ভালো জামাকাপড় পরে আবার এসে হাজির হয়েছেন। গ্রীজ-লুব্রিক্যান্ট-লোহার বাবরির পোড়া গন্ধ আর শব্দে ঝালাপালা মেশিন শপটা যেন ওঁর বেড়াবার জায়গা।

এঞ্জিনিয়ারিং ড্রইংয়ের বিমল সেনগুপ্ত ছিলেন যেমন ভদ্র আর নরম স্বভাবের, অকৃতদার আধবুড়ো ইংরেজ কোপল্যাণ্ড ছিলেন তেমনি খিটখিটে। ড্রইং প্লেট দেখার আগে দেখতেন পেনসিল ঠিকমতো কাটা হয়েছে কি না। একটু বেঠিক হলে পেনসিলটা ধরে খট করে হাইবেঞ্চে ঠুকে সিসটা ভেঙে দিতেন। ওঁরা ছাড়া সিংহরায় নামে এক ভদ্রলোক আমাদের রোমান উর্দু শেখাতেন। সিংহরায় মিশমিশে কালো, পরনে নিষ্কলঙ্ক সাদা খদ্দর, কালো চুল, ঝকঝকে দাঁত, সম্ভবত গান্ধীবাদী মানুষ। রোমান উর্দুর নাম করে উনি গালিব, মীর তকি মীর বা অন্য কারো শের শোনাতেন। একটি শের আমার আজও মনে আছে–

বনা লে জা জো কুছ বন সকে জওয়ানী মে
রাত থোড়ী হ্যায় ঔর বহুত হ্যায় সঙ্গ।

রাত ছোট আর মজা অনেক।

এখানেও আমাদের দুটো শিফটে ক্লাস হয়, রাত ছোট আর গাওনা যে অনেক।

মেশিন শপ থেকে গঙ্গা দেখা যায় না। কিন্তু গঙ্গাতীরের ফোরশোর রোডের গাছপালার ঘন শাখাপ্রশাখা দেখা যায়। সন্ধের আগে দেখতে পাই পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবছে কালো ডালপালার জ্যামিতিক রেখাজালের ওপাশে রক্তবর্ণ মোজেইকের মতো টুকরো টুকরো আকাশ, অথবা আকাশে কারো বাড়ির লাল টালি যেন টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে আছে। মেশিন শপের বাইরে ঘাস আর চোরকাঁটার একটুখানি মাঠে আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামে।

ঐ মাঠে, খুব কাছেই একটা অকেজো প্লেন, সত্যিকারের ছোট ডাকোটা, জাংক হিসেবে পড়ে ছিল। বিকেলের শিফটে কেমন ঢিলেমি ভর করে ছায়া পড়ে গেলে আমি সুট করে বেরিয়ে অন্তত দশ মিনিটের জন্য তার ককপিটে গিয়ে বসি। বসার জায়গাটি ছোট্ট এবং অত্যন্ত আরামপ্রদ। প্লেনের বডি অ্যালুমিনিয়াম অ্যালয়ের, ভিতরে নরম লাইনিং। এঞ্জিনটা অকেজো, কিন্তু খুলে নেওয়া হয় নি। আমি এটা ওটা টেনে দেখি। জানি উড়বে না। তবু ইচ্ছে করে মনে রোমাঞ্চ আনি যদি প্রপেলার ঘোরে! যদি গোঁ গোঁ করে উঠে পড়ে!

রবিবারের ছুটিতে কোনো কোনো দিন দিদিমার বাড়ি যাই, কোনো কোনো রবিবারে হস্টেলেই থাকি, হস্টেল থেকে সকালে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে অনেক দূরে দূরে ঘুরে আসি। একদিনের কথা মনে আছে শীতের সকাল, গেস্ট কীন উইলিয়ামের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, ঘরবাড়ি বিশেষ নেই, রাস্তার ধারের গাছপালার দরুন পথে শিশির, হালকা ঘাস, ছায়া, রোদ। অচেনা পথের কৌতূহল, না কি শীতের তাজা বাতাসের নেশা, না কি কিশোরবয়সের অম্লজান কেউ আমাকে ঠেলছিল। আমি চারদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। টের পাই নি কখন বেলা চড়েছে, দুপুর হেলে পড়েছে। চার দিকে প্রায় দিগন্তছোঁয়া ধানের মাঠ ধান কাটা হয়ে গেছে আঁটি বেঁধে চাষারা নিয়ে যাচ্ছে চারদিকে সোনালি খড় দূরে মন্থর গরুর গাড়ি নীল আকাশ বাতাসে শস্যের ধুলোর হালকা রেণু- চারদিক উদাস, বিস্তীর্ণ, কর্মরত, অথচ অলস। কদিন আগে শোনা পৌষের গান আমার সামনে সেই মাঠে খড়ে ধানে আর ধুলোয় নেচে বেড়াতে লাগল। একটা ব্যথা ঘিরে এল। একেই বোধ হয় বলে একস্ট্যাসি- আনন্দ-আবেশ। সেদিন আমার ফিরতে ফিরতে সূর্য অপরাহ্নের দিকে ঢলে পড়ল। আমি আন্দুল ছাড়িয়ে চলে গিয়েছিলাম।

কোনো রবিবারে দিদিমার বাড়ি গেলে ফেরার পথে একবার কলেজ স্ট্রিটে টু মারি। প্রেসিডেন্সি কলেজের রেলিঙের সামনে দাঁড়িয়ে পুরনো বই দেখি। কখনো কখনো লোভ খুব বেশি হলে কিনে ফেলি। এখান থেকেই প্রমথ চৌধুরীর বীরবলের হালখাতা (দ্বিতীয় সংস্করণ ১৩৩৩) আর অতুলচন্দ্র গুপ্তের শিক্ষা ও সভ্যতা (প্রথম সংস্করণ ১৩৩৪) কিনেছিলাম। নিদাগ নিভাঁজ নতুন বই, আসল দাম ছিল দেড় টাকা, আমি কিনলাম দশ আনা করে। তখন বিশ্বভারতী পত্রিকা সম্পাদনা করতেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রমথনাথ বিশী। প্রতিসংখ্যার দাম এক টাকা। অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল, রামকিংকর, বিনোদবিহারী তো ওঁদেরই সম্পত্তি। এক সংখ্যায় অবনীন্দ্রনাথের একটি ছবি ছিল: উমা একটি মেয়ের মুখ, ঊর্ধ্ববক্ষ পর্যন্ত। মেয়েটির চুল লালচে পিঙ্গল, তার আরক্ত ফরসা মুখে বরফের বা ভস্মের গুঁড়োর একটু সাদা আভা। একটি ধূসর অনুদ্যত সাপ তার গলায় আশ্রিত, সাপটির গলাতেও আবার হালকা একটু লাল সুতো বাঁধা। মেয়েটির নারীলাবণ্যের মধ্যে কী করে যেন পুরুষের শান্ত বৈরাগ্য মিশে গিয়েছে– উমা একমনা হয়ে শিবের কথা ভাবতে ভাবতে শিবের সত্তা পাচ্ছেন। সারা ভারতের শৈব চিএে এই বিষয়ে এমন ছবি আমি দুটি দেখি নি। কলাভবনে কয়েক বছর পরে মূল ছবিটি দেখেছিলাম। মূলের বর্ণলেপের তুলনায় প্রিন্টের সামান্য ফ্যাকাশে রং আমার বেশি অনুষঙ্গময় লেগেছিল।

আর-একটি সংখ্যায় প্রথম ছবিটি ছিল নন্দলাল বসুর শবরীর প্রতীক্ষা। জলরঙের টেম্পারা। বুনো, কঠিনজীবন, লঘুশরীর শবরী তপ্ত দুপুরে গাছে উঠে দূরে তাকিয়ে আছে রামের প্রতীক্ষায়। দ্বিধাহীন তুলির নিশ্চিত টানটোন, নির্ভুল রং চাপানো। এ ছবিতেও কাঠিন্য এবং কোমলতা মিশে গিয়ে একটা রূপ ধরেছে- তামা গেরুয়া হলদে বাদামি রঙের পোঁচ, তপ্ত গ্রীষ্মদুপুর, ছেঁড়া কাপড় পরা গরিব বুনো মেয়ে। অভ্যাসযোগের চূড়ান্তে পৌঁছলেই কেবল এমন সিদ্ধ হাতে ছবি আঁকা যায়। এইসব ছবির প্রিন্ট আমার সারা জীবনের অমূল্য ধন। দিদিমার বাড়ি টালিগঞ্জ থেকে কলেজ স্ট্রিটে আসতাম শুধু ঐ পত্রিকাটির জন্যে। তার পর ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে পত্রিকাটি কিনে হ্যারিসন রোডের ট্রামে চড়ে দুলতে দুলতে হাওড়া হয়ে শিবপুরের হস্টেলে ফিরতাম।

১৯৪৩-এ বাংলার দুর্ভিক্ষের সময়েও আমি শিবপুরে। সে দুর্ভিক্ষে, কেউ বলে পাঁচ লক্ষ, কেউ বলে তিরিশ লক্ষ, কেউ বলে পঞ্চাশ লক্ষ বাঙালি মরেছিল। শহরের রাস্তায় রাস্তায় খেতে না পেয়ে মরা মানুষের কঙ্কালসার দেহ পড়ে থাকত। এসব বর্ণনা অনেকে লিখেছেন। পরিমল গোস্বামী একটি ছোট গল্পের সংকলন করেছিলেন, নাম ‘মন্বন্তর। মৃত এবং মুম্ষু শিশু, নারী, পুরুষদের প্রচুর রেখাচিত্র এঁকেছিলেন জয়নুল আবেদিন আর চিত্তপ্রসাদ। ডকুমেন্টারির মূল্য রয়েছে এসব গল্পের আর ছবির। এসব ছবি থেকে অনেক দূরে, একেবারে অন্য একটি কোণে বসে নন্দলাল এক চিরদুর্ভিক্ষের ছবি এঁকেছিলেন: শিব ও অন্নপূর্ণা নিচে ভারতচন্দ্রের দু ছত্র উদ্ধৃতি:

অন্নপূর্ণা যার ঘরে সে কাঁদে অন্নের তরে।
এ বড় মায়ার পরমাদ।

এবার ছবিটি বর্ণনা করি। পদ্মে আসীনা অন্নপূর্ণা, তার পিছনে ঘন নীল আকাশ, যেন কোনো গভীর দিনের আকাশ, অথচ তাতে তৃতীয়ার চন্দ্রকলা আর তারা ফুটে আছে। অন্নপূর্ণার সামনে নৃত্যপর ভিখিরি শিব তাঁর নিরন্ন শরীরের হাড়ের খাঁচা পশুর কঙ্কালের মতো স্পষ্ট, ক্ষুধায় চোয়াল এবং দন্ত বেরিয়ে পড়েছে। তাঁর চারদিকে রুক্ষ রিক্ত অগ্নিবর্ষী রৌদ্র। ছবিটি ওয়শ-টেম্পারায় আঁকা। নিচে ক্ষুধা এবং সংহারের পুরুষ, উপরে অন্ন এবং জীবনের দেবী– ওঁরা যে যার জায়গায় আছেন, কেউ কাউকে কোনোদিন পাবেন না, কোনোদিন কারো যাজ্ঞা মিটবে না। এ বড় মায়ার পরমাদ।

ঐ দু রকম ছবি দেখে আমার চোখ ফুটল। বুঝলাম, পোস্টার খুব প্রয়োজনীয় এবং কার্যকর জিনিস, তবু পোস্টার শেষ না হলে ছবি আরম্ভ হয় না।

বি ই কলেজে থাকার শেষাংশে ঐ দুর্ভিক্ষের গোপন কার্যকারণ চাক্ষুষ করলাম। ক্লাসে বসে বা মেশিন শপে দাঁড়িয়ে কদিন ধরেই দেখছিলাম, ফোরশোর রোড ধরে অবিরাম ত্রিপল ঢাকা মালবোঝাই ট্রাক চলেছে, যথাসাধ্য নিঃশব্দে। কোথায় যাচ্ছে ওরা? কেন যাচ্ছে? পরের রবিবার বটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে গিয়ে রহস্যটি উদঘাটিত হল।

ট্রাকের সারি বোঝাই হয়ে আসছে চাল- লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি মন চাল। শহরের প্রান্তে বিশাল বাগানটি নির্জন। কিছু মালী আর কৃচিৎ কয়েকজন দর্শক ছাড়া এই অশান্তির সময়ে কেউ সেখানে আসে না। খোলা গেট দিয়ে ট্রাকগুলো ভিতরে চলে আসে। বাগানের এখানে-সেখানে খোলা আকাশের নিচে স্রেফ মাটির উপর ত্রিপল পেতে সেই চাল পিরামিডের মত স্তূপ করে রাখা হয়। বিশাল বিশাল পিরামিড, পনেরো-কুড়ি ফিট উঁচু, লোকের চোখ বা পাখিপক্ষীদের ঠোঁট থেকে বাঁচাতে সামান্য ত্রিপলে ঢাকা। আমরা অবাক হয়ে যাই, এত চাল কোত্থেকে এল?

বাংলা দেশের সমস্ত গোলা, খামার, ঢেঁকিশাল উজাড় করে কেড়ে আনা হয়েছে এই শস্য। কারা আনল? শোনা যাচ্ছে, সরকারের খাদ্য সংগ্রহ বিভাগ এবং ইস্পাহানি কোম্পানির কাজ এটা। কেন আনল? কেন যে আনল তা মাসখানেকের মধ্যেই বোঝা গেল। শুধু বটানিক্যাল গার্ডেন কেন, নিশ্চয় আরো অনেক গোপন জায়গায় এরকম খোলা মাঠে গোলা বানিয়ে চাল মজুত করা হয়েছিল। ফলে পাড়াগাঁয়ে, মফস্বলের বাজারে তখন এক দানা চাল নেই। দিনের পর দিন গেঁড়ি, গুগলি, গাছের পাতা সেদ্ধ, মূল সেদ্ধ, ঘাসের দানা সেদ্ধ খেয়ে জীর্ণ শীর্ণ মেয়ে পুরুষ শিশুরা বাঁচার শেষ চেষ্টায় দলে দলে এসে কলকাতার রাস্তা ছেয়ে ফেলল। রাস্তাই তাদের বাসা, রাস্তাই তাদের শ্মশান। কয়েকটা দিন তারা নিঃসাড় গলায় একটু ফ্যান দেও মা, একটু ফ্যান দাও মা বলে ভিক্ষা করেছিল। তার পরে নিঃশব্দেই মারা গেল। এতগুলো লোককে না খাইয়ে মেরে কার কী লাভ হল কিছু বোঝা গেল না।

ওদিকে বর্ষার বা প্রাকবর্ষার মৌসুমি বাতাস বোধ হয় এসে পড়েছিল- ছিপছিপ, ঝিপঝিপ, ঝরঝর করে মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হয়। অনাচ্ছাদিত সেই চালের পিরামিডে, টিলায় বৃষ্টি পড়ে। জল ভিতরে ভিতরে চুঁইয়ে নেমে স্কুপের গোড়ায় এসে জমে থাকে। তার পর রোদ উঠল, চালের টিলাগুলি গুমসে উঠল, টিলার গায়ে সবুজ ছাতা ধরল। এর পর রোদ্দুর যখন কড়া হল চালগুলি ছোপ-ছোপ কালো আর ছাইবর্ণ হয়ে পশুখাদ্যেরও অযোগ্য হয়ে গেল। এই হল বিখ্যাত পঞ্চাশের মন্বন্তরের কার্যকারণ সম্পর্ক, আমার স্বচক্ষে দেখা।

.

 রিক্রুটজীবন ও সি ই কলেজ

বি ই কলেজ প্রাচীন প্রতিষ্ঠান, সেখানকার শিক্ষাক্রম শেষ করতে পারলে বোধ হয় ভালো হত। কিন্তু হল না, আমি পরীক্ষার আগেই পালালাম।

শুনেছিলাম ফৌজের নিজস্ব এঞ্জিনিয়ারিং কোর আছে। সেখানে ঢুকলে সমরবিভাগই তার নিজস্ব প্রয়োজনে ছেলেদের শিখিয়েপড়িয়ে নেয়। অর্থাৎ সেখানে চাকরি এবং শিক্ষা একসঙ্গে চলে। এই নিরাপত্তা আমার দরকার ছিল। ফৌজে খাওয়া পরা থাকা চিকিৎসা যানবাহন আমোদমোদ সমস্তই বিনামূল্য, উপরন্তু র‍্যাক পে এবং ট্রেড পে মিলিয়ে মাইনে অনেক বেশি। তাছাড়া সত্যিই মুক্তির জন্য আমার প্রাণ কাঁদছিল। অনেক লম্বা সময় ধরে চাপ সহ্য করেছি এইবার যে করে থোক এই টিপেটিপে-চলার ভীতু জীবন থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

যেন কোনো নিষিদ্ধ অবশ্যম্ভাবী পথে পা দিচ্ছি, এইভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে একদিন দুপুরে আই টি এফ প্যাভিলিয়নে গেলাম। উর্দি পরা একটা লোক ফৌজের সুখ সুবিধা সম্পর্কে খুব বক্তৃতা দিচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম, লোকটা প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে। যাক গে, তাতে আমার কি! আমি আর চিন্তাভাবনায় না গিয়ে বেপরোয়া জুয়াড়ীর মতোই বন্ডে সই করলাম। তখন আমার আঠারো চলছে।

হেস্টিংসে ডাক্তারী পরীক্ষা হল। হার্ট লাং লিভার কিডনি চোখ ওজন সব ঠিক আছে। ব্যস, তার পর আমি পুরোপুরি আর্মির খপ্পরে চলে গেলাম। এবার আর পালাতে পারব না, পালালে ওরা হুলিয়া বার করে ধরে আনবে।

ফৌজে গেলাম বটে, কিন্তু শুরুতে খাস কলকাতায়, বাঙালি পাড়াতেই রইলাম। বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে রাসবিহারী অ্যাভিনিয়ুর শেষ মাথায় যেখানে ট্রামগুলো ঘোরে সেখানে ক্যালকাটা এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নামে একটি প্রযুক্তি শেখার প্রতিষ্ঠান ছিল। আমাদের শেখাবার জন্য সমরবিভাগ এই শিল্প বিদ্যালয়টিকে আত্মসাৎ করেছিল। সেখানে তখন আমার সহাধ্যায়ী তিন শো সাড়ে তিন শো ছেলে। সবাই আনকোরা রংরুট। ডিপ্লোমা কোর্সের পাঠক্রম এবং মিলিটারি এঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের প্রয়োজন মিলিয়ে-মিশিয়ে একটা মোটামুটি সিলেবাস তৈরি হয়েছিল। সমরবিভাগের আনুকূল্যে মেশিন, সরঞ্জাম, কাঁচা মাল ও শিক্ষকের অভাব ছিল না, অভাব ছিল শুধু উপযুক্ত পাঠ্য এবং নির্ধারিত বইয়ের। তবু পরবর্তীকালের স্বাধীন ভারতের শিল্পোন্নয়নে যে দক্ষ কারিগরদের প্রয়োজন হবে ঐটিই হয়েছিল তাদের প্রস্তুতির আদি পর্ব। এবং আমি সেই আদি যুগ থেকে সম্পর্কের ফলে ঐ ইতিহাসের আদ্যোপান্ত সাক্ষী আছি।

যা বলছিলাম, সি ই কলেজ নিল আমাদের পড়াশোনার ভার আর ফৌজ নিল আমাদের শৃঙ্খলা শেখাবার দায়িত্ব। আমার তখন বয়স কম। এই দুই দল মিলে, অগোচরে, আমাদের ঢেলে সাজাচ্ছিল। সি ই কলেজে ঢোকামাত্র তারা আমাকে ফিটিং শপে এক অদ্ভুত, অকারণ, প্রবল ট্রেনিংয়ের মধ্যে নিক্ষেপ করল। একটুকরো লোহা নিয়ে তাকে চিপিং করে, ড্রিল করে, করাতে কেটে, উখোয় ঘষে ছোট করি, আকার দিই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চিপিং করে, ফাইল করে আমার বাহুর পেশী এক এক ইঞ্চি বেড়ে গেল। মাসখানেক ফিটিং শপে অসুরের খাটুনি খেটে এঞ্জিনিয়ারিং ড্রইংয়ের ক্লাসে এলাম। প্র্যাকটিক্যাল ঠিক আছে, কিন্তু থিয়রি ক্লাস এলোমেলো। বিষয়টার থই পেতে আমরা নিজেদের তাগিদেই বই ঘাঁটি মেশিন টুলস, স্টিম এঞ্জিন, আই সি এঞ্জিন, অ্যাপ্লায়েড মেকানিকস। ফাউন্ড্রিতে কিভাবে ধাতু গলানো হয়, মোন্ড তৈরি হয়, ঢালাই হয়। প্যাটার্ন তৈরির মাপজোক, কৌশল ও মূলসূত্র। ইত্যাদি, ইত্যাদি। অনন্ত পারং কিল প্রযুক্তিশাস্ত্রং।

এসব ছাড়াও, এখানে কমিক রিলিফের মতো যিনি রোমান উর্দু শেখাতে আসেন তাঁর নাম সত্যগোপাল রায়। সাদা পাজামা, কালো শেরওয়ানি পরা, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল, তিনি তাঁর নাম বলতেন, সৎগোপাল রায়। সৎগোপালজী কবিতা লিখতেন। বীরদর্পে আমাদের স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন

বীর চলে হ্যাঁয়
 তীর চলে হ্যাঁয়
 লড়নেবালে শির চলে হ্যাঁয়
 হিম্মৎবালে ধীর চলে হ্যাঁয়
ইত্যাদি…

সকাল নটা থেকে সারা দিন ক্লাস, দুপুরে এক ঘণ্টা লাঞ্চ-ব্রেক, বিকেল পাঁচটায় ছুটি, তার পর এক ঘণ্টা বা দেড় ঘণ্টা প্যারেড। শনিবারে পি টি। সন্ধ্যায় নৈশাহার। আটটা সাড়ে আটটায় রোল কল। ব্যস, দিন শেষ।

সি ই কলেজের কাছে, গড়িয়াহাটের মোড়ে বড় পাঁচতলা বাড়িটায় আমরা থাকি। ওটা আমাদের হস্টেল তথা ব্যারাক। আমাদের দেখাশোনা করা এবং প্যারেড ও ফৌজী নিয়ম শৃঙ্খলা শেখাবার জন্য এক ক্যাপ্টেনের অধীনে কয়েকজন নায়েক হাবিলদার জমাদার ছিলেন। বাড়িটা খুব আরামপ্রদ, খোলামেলা, স্নানের ঘরে শাওয়ারে সারা দিন প্রচুর জল। নিজের ইচ্ছেমতো রুমমেট পছন্দ করে এক একটা ঘরে দুজন বা তিনজন করে থাকি। বিশাল ছাদে হু হু করে বাতাস বয়। ঘরের লাগোয়া বারান্দায় বেরিয়ে এসে রেলিংয়ে ঝুঁকে দাঁড়ালেই দেখা যায়, রাস্তা দিয়ে কত রকমের লোক চলেছে। গড়িয়াহাট রোডের মধ্যিখানে বুলেভার্ডে কাঁটাতারের ঘের দিয়ে আমেরিকান সৈন্যেরা তাদের সাজসরঞ্জাম রেখেছিল। গড়িয়াহাট রোড তখন প্রায় ফাঁকাই থাকত, প্রায়ই দেখতাম, সেই বুলেভার্ডে, উলটো গাধায় চাপার মতো উলটো সাইকেলে চেপে এক ঢ্যাঙা নিগ্রো বাহাদুরি দেখাচ্ছে। বারান্দার শানে বসে পড়লে আকাশ ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না, শুধু বাজারের কাছাকাছি নারকেল গাছে বসা চিলের তীক্ষ্ণ ডাক মাঝে মাঝে শোনা যায়। অবাক কাণ্ড, সেই নারকেল গাছের দুটো একটা, এই ষাট বছর পরেও, দশতলা মেঘমল্লার বাড়ির পড়শী হয়ে রয়ে গেছে। হিন্দুস্থান পার্কের বাড়ি থেকে দেখছি, সেই গাছে এখনও চিল এসে বসে, এখনও তীক্ষ্ণ স্বরে ডাক দেয়। ভাবি, সোই কোকিল অব লাখ লাখ ডাকউ- সেই কোকিলই ডাকছে। সেই অফুরন্ত কোকিল! সেই অফুরন্ত চিল!

কিন্তু এখনকার গড়িয়াহাট দেখে ষাট বছর আগেকার গড়িয়াহাটকে ভেবে নেওয়া কঠিন হবে। গড়িয়াহাট বাজার বলতে তখন বড় একটা টিনের চালার নিচে নিঃশব্দ নিস্তেজ এক অপ্রস্তুত বাজার। বাজারে তরিতরকারি কিছুটা মেলে। টিনশেডের নিচে গ্রাম্য ধরনের চিড়ে-মুড়ি-মুড়কির দোকান সেখানে কাঁচের খোপে সাদা বাতাসা, লাল বাতাসা, তালপাটালি আর ছাতু। কলার ছড়া টাঙানো। গামছা আর লুঙ্গির দোকান। অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র…

শুনেছিলাম ফৌজে খাওয়াদাওয়া খুব ভালো। এখন কার্যক্ষেত্রে দেখছি কথাটা সর্বৈব মিথ্যে। ধানে ভরা বিশ্রী মোটা চালের ভাত আর লার্ডে রাঁধা ভুষিসুদ্ধ ডাল- ব্যস, দু বেলা এই খাদ্য। মাস দুয়েক এই খাবার খেয়ে আমাদের মাথা গরম হয়ে গেল। একটু মুখ বদলাবার জন্যে, বিকেলের চায়ের সঙ্গে আমরা বাইরে থেকে তেলেভাজা আনিয়ে খাই। অন্যদিকে চোখের সামনে দেখি, নায়েক হাবিলদার আর জমাদার মিলিয়ে চারজন শিখের একটা দুষ্টচক্র দোতলায় একটা হলঘর নিয়ে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। ক্রেটে করে কমলালেবু আসে, তারা খায়। কার্টনে করে ইভাপরেটেড মিল্ক আসে, শুকনো ফল আসে, তারা খায়। লঙ্গরিরা আলাদা রুটি পাকিয়ে ঘি মাখায়, মাংস পাকায়, তারা খায়। আমাদের তিন শো, সাড়ে তিন শো ছেলেকে খাওয়াবার ভার নাকি কন্ট্রাক্টরের উপর। সে ব্যাটাকে দেখা যায় না। আমাদের র‍্যাশন কোথায় যাচ্ছে কে জানে, আর এই কদই বা কোত্থেকে আসছে তাই বা কে জানে! ঐ চারটে শিখ, ক্যাপ্টেন (তাকেও দেখা যায় না) আর অদৃশ্য কন্ট্রাক্টর এই তিনে মিলে ভাগাভাগি করে পুকুরচুরি করছে। আমরা দু বেলা দেখছি। গা নিসপিস করছে। কিন্তু কাকে বলব। খাবার সময় আমরা কলাই করা থালা হাতে নিয়ে লাইন করে দাঁড়াই। বিরাট হাতা করে লঙ্গরি ভাত আর ডাল ঢেলে দেয়। ডালের হাণ্ডার পাশে ঐ চারটে শিখের একটা, রাজপুত্তুরের মতো চেহারা, গুরদয়াল সিং দাঁড়িয়ে থাকে যেন লাটের ব্যাটা।

শিখ ছাড়াও কিছু গোখা এন সি ও, ভি সি ও ছিল। গোখরা সোজাসাপটা ফৌজি, তারা চুরিচামারির মধ্যে নেই। কিন্তু কেউ বোকা নয়, ছোট ঘোট চোখে তারাও ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল।

একদিন বিকেলবেলা ক্লাস করে ফিরেছি, চা খেয়েছি, আমাদের বুড়ো গোখা জমাদার এসে বললেন- চলল, আজ আমি তোমাদের প্যারেডে নিয়ে যাব। সিংহী পার্কে বড় বড় দেবদারু গাছে ঘেরা মাঠ, সেখানে আমরা প্যারেড করি। বোধ হয় চৈত্র মাস। দেবদারু গাছে নতুন পাতা এসেছে। শেষবেলার রোদ্দুর লাল হয়ে উঠেছে, জমাদারের কানের লতিতেও রোদ্দুর আটকে লাল হয়ে আছে। ঘামে আমাদের শার্ট ভিজে উঠছে, ক্লান্ত লাগছে। জমাদার জিজ্ঞেস করছেন- এত সুস্থি কেন? ঠিক মতো খানা খাও না নাকি? জমাদার হয়তো বুঝেসুঝেই আমাদের ক্ষোভের জায়গায় হাত রাখলেন। আমরা হুড়মুড় করে আমাদের খাবারের হাল বললাম।

জমাদার শুধোলেন ঐ খানা আপনারা খান কেন?

— কি করব?

– আপলোগ পড়ালিখা আদমী, আচ্ছা ঘরের লেড়কা। আপনারা কি করবেন তা কি আমি বলে দেব?

ব্যস, ব্যস। আর বলতে হল না। রোল নাম্বার নাইনটি-নাইন বলল– অনেকদিন শালা ভালছেলে হয়ে আছি। খাবার লাইনে আজ আমিই প্রথম শুরু করে দেব, তার পর আপনারা হাতে নিয়ে নেবেন। দেরি করবেন না, তাকাবার সময় দেবেন না।

তখনও সন্ধে হয় নি, দিনের আলো স্পষ্ট। তিন-চার জনের পরেই নাইনটি-নাইন লাইনে দাঁড়ানো। লঙ্গরখানার বারান্দায় ভাতের গামলা আর ডালের হাণ্ডা রেডি করে লম্বা হাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লঙ্গরি। পাশে মুরুব্বির মতো গুরদয়াল।

নাইনটি-নাইন থালা না বাড়িয়ে বলল– ইয়ে চাবল আচ্ছা নেহি, বদবু আতা।

লঙ্গরি থমকে গেল, গুরদয়াল কটমট করে তাকাল লেনা হ্যায় তো লো, নেহি তো আগে বঢ়ো, দুসরেকো আনে দো।

– কেঁও? ইয়ে চাবল তুম কাঁহাসে মাঙ্গকে লায়া, কুত্তা ভি নেহি খাতে!

– হঠো, হঠো, নেহি মিলেগা খানা। হঠ যাঃ। গুরদয়াল হাণ্ডার পিছন থেকে বেরিয়ে এল। আর যায় কোথা! নাইনটি-নাইন এরই জন্যে অপেক্ষা করছিল- খানা নেহি মিলেগা? কেঁও, তুমহারা বাপকা খানা হ্যায়? নাইনটি-নাইনের এক থাপ্পড়ে গুরদয়ালের পাগড়ি উড়ে গেল। গুরদয়াল অসম্ভব বলিষ্ঠ, সেও তেড়ে এল, কিন্তু নাইনটি-নাইন ততক্ষণে তার লম্বা চুলের গোছা ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে সামনে নুইয়ে ফেলেছে। তিন শো ছেলে আর সুযোগ পেল না, পঁচিশ-তিরিশ জনই তাকে পিটিয়ে মাটিতে শুইয়ে দিল। তাকে বাঁচাতে তার দলের বাকি তিনটে নেমে আসছিল– আমরা ধর ধর করে ছুটে যেতেই ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। তখন সন্ধে হয়ে গেছে। লঙ্গরিরা অবস্থা দেখে কোথায় পালিয়েছে। গোখা সিপাহি আর অফিসারদের কোথাও দেখা গেল না। আমরা ভাত আর হাণ্ডাভরতি ডাল নর্দমায় ঢেলে দিলাম। একপেট খিদে আর মাথাভরতি উত্তেজনা নিয়ে আমরা যে যার ঘরে উঠে গেলাম। দেখা যাক, এবার কি হয়।

রাত আটটা সাড়ে আটটার সময় হঠাৎ নিচের উঠোনে উপর্যুপরি হুইসল বাজতে লাগল। অর্থাৎ, নেমে এসো। নেমে দেখি, অ্যাদ্দিন পরে ক্যাপ্টেন এসেছে লোকটা দেখতে ভালো, মাদাম বোভারির প্রেমিকের মতো নচ্ছার ড্যান্ডি চেহারা। আমরা উঠোনে চারদিক ঘিরে তিন লাইনে ফল ইন হলাম। সে কঠিন মুখ করে বক্তৃতা দিল– আর্মিতে ডিসিপ্লিন হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা। প্রথমে হুকুম তামিল করো, তার পরে যদি কিছু বলার থাকে বল। কিন্তু তোমরা ডিসিপ্লিন ভাঙার চেয়েও খারাপ কাজ করেছ, বিদ্রোহ করেছ। তোমাদের কঠিন শাস্তি হবে। ক্যান্টেন কয়েকজনের নাম রোল নাম্বার টুকে নিয়ে চলে গেল, বলে গেল কাল এরা আমার সামনে পেশ হবে। ঐ দলে কি করে যেন আমার নামটাও ঢুকে গেল।

পরের দিন আমরা ঘটনাটা প্রিন্সিপালকে জানালাম। বিকেলে আমাদের ক্যাপ্টেনের সামনে পেশ করা হল। দোষীদের সাত দিন বিকেলে ফেটিগ ডিউটি আর সকালে ডাবল আপ-এর বন্দোবস্ত হল। শুনলাম, গুরদয়াল সিংয়ের ধুম জ্বর। লঙ্গরিরা আবার সেই একই ভাত ডাল রাঁধছে।

কিন্তু তিন দিন পরে কি করে যেন ভোজবাজিতে সব উলটে গেল। আগের ক্যাপ্টেন বদলি হয়ে নতুন ক্যাপ্টেন এলেন। শিখদের সেই ঘুঘুর বাসাও ভাঙল। নতুন ক্যাপ্টেন পাঞ্জাবী মুসলমান, ভারী চেহারা, নিয়মিত জগ করে দেহকে বাকায়দা রাখার চেষ্টা করেন। ছুটির সকালে দৌড়তে দৌড়তে চলে আসেন আমাদের ডেরায়, লঙ্গরখানার বারান্দায় ফোল্ডিং চেয়ারে বসে গল্প করেন– আমি সিপাহি হয়ে ফৌজে ঢুকেছিলাম, এই দ্যাখো এখন আমি ক্যাপ্টেন। আর্মি বড় ভালো জায়গা এখানেই আমি ইংরেজি শিখেছি, হাতিয়ার চালাতে শিখেছি, লড়াই করতে শিখেছি।

ক্যাপ্টেন সন্ধেবেলা কখনো কখনো সোজা চলে আসেন আমাদের খাবার জায়গায়, ঘুরে ঘুরে দেখেন, কখনো প্লেটে নিয়ে একটু চেখেও দেখেন। তাঁর আসার পর থেকেই আমাদের খাদ্য পালটে গিয়েছিল পরিষ্কার ভাত, ঘন ডাল, সবজি। বিকেলে রুটি মাংস বা টিনের মাছ আর ইভাপরেটেড দুধ আর শুকনো ফল। তাছাড়া সপ্তাহে চার প্যাকেট ওয়াইল্ড উডবাইন আর দুটো দেশলাই পাই।

.

কম্যান্ড হাসপাতাল

এই পর্বে আমার আর একটা ফৌজি অভিজ্ঞতা হল। আমার জ্বর হয়েছিল, চার-পাঁচ দিনেও জ্বর কমল না দেখে আমাকে আলিপুরে কম্যান্ড হাসপাতালে পাঠানো হল। সেখানে মেডিক্যাল আর সার্জিক্যাল বিভাগ আলাদা। যুদ্ধ তখন বর্মা হয়ে অসম সীমান্তে, বাড়ির দোরগোড়ায়, এসে পড়েছে। সার্জিক্যাল বিভাগে ভিড় রোজ বাড়ছে। রোগীদের জন্য সারি সারি টালির লম্বা দোচালা, তবু জায়গায় কুলোয় নি বলে সেন্ট টমাস স্কুলের বাড়িটাকেও দখল করে নিতে হয়েছে। বেড ডাক্তার নার্স ওষুধ পথ্য সরঞ্জাম সেবা কিছুরই অভাব নেই মিলিটারি হাসপাতালের মতো এমন দরাজ হাত, দক্ষ এবং কঠোর নিয়মানুবর্তী প্রতিষ্ঠান আমি অদ্যাবধি দেখি নি। সবাই বলে ফৌজে মায়াদয়া নেই, আজ যখন কম্যান্ডিং অফিসার কর্নেল পতিতপাবন চৌধুরীর সেই হাসপাতালের কথা মনে পড়ে, ভাবি, কি দরকার মায়াদয়া মানবিকতা ও আর্তসেবার বড় বড় কথার। তার চেয়ে যে যার কাজটি করুক, কাজ না করলে বা ফাঁকি দিলে বা চুরি করলে যেন কঠোর শাস্তির বন্দোবস্ত থাকে।

চার-পাঁচ দিনে আমার জ্বর সেরে গেল। সকালে রোগীদের ডিসচার্জ সার্টিফিকেটের ডুপ্লিকেট কপি করে দিয়ে ডাক্তারকে সাহায্য করি। ক্যাপ্টেন মুখার্জি সাইপ্রাস ঘুরে এসেছেন। আমার ইচ্ছে সেইসব গল্প হোক, কিন্তু ডাক্তার তার দুঃখের কথা পাড়েন গতকাল কর্নেল চৌধুরী ইনস্পেকশনে এসেছিলেন। কথা নেই বার্তা নেই, এসেই এই ড্রয়ারটা টেনে খুলে ফেললেন– সিগারেটের পাঁচ-ছটা খালি প্যাকেট আর কিছু আজেবাজে কাগজ পড়ে ছিল, নির্দোষ জিনিস কিন্তু এতেই বুড়ো খেপে গেল।

বেশ ফুর্তিতেই সেরে উঠছিলাম। কিন্তু কি হল কে জানে, দু দিন পরে রাত্তিরে হঠাৎ আবার ধুম জ্বর এল। আবছা চেতনায় টের পাচ্ছি ক্যাপ্টেন মুখার্জির উদ্বিগ্ন স্বর, আরো কোনো ডাক্তারকে উনি ডেকে এনেছেন, আমার বিছানার পাশে ঝুঁকে পড়ে কথ বলছেন। দ্রুত লাল কম্বল চাপিয়ে আমাকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেল। তার পর বাবি রাতটা আর কিছু মনে নেই।

তখনও টাইফয়েডের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক বের হয় নি। সাধারণ ওষুধে ওঁর আমাকে শুধু এক মাস ধরে যত্ন করে আর পরিচর্যা করেই সারিয়ে তুললেন। বাড়িতে, বোধ হয় মায়ের কাছেও, ঐ শুশ্রূষা পাওয়া যাবে না। সূর্য ওঠার আগেই একজন গরম জল এনে ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দেয়। মুখ ধুই। হালকা চা দেয়। রোদ্দুর একটু ফুটতে দিনের নার্স আসে। সে গরম জলে তোয়ালে ভিজিয়ে গা মোছায়, গায়ে স্পিরিট ঘরে ঘষে তুলো দিয়ে পোঁছে, পাউডার মাখিয়ে পাংশু চামড়ার নিচে রক্তবহা শিরা আর স্নায়ুকে চাঙ্গা করে। পায়জামা স্যুট পালটে দেয়। তার পর শুইয়ে রেখেই আমাকে এপাশ ওপাশ করে চাদর আর বালিশের ওয়াড় পালটে বিছানা টানটান করে, কোমর পর্যন্ত কম্বলে ঢেকে দেয়। কী যে আরাম হয় কি বলব! তার পর ডাক্তারেরা আসেন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় নার্স টেম্পারেচার রেকর্ড করে। এই যে পরিচর্যা শুরু হল তা শেষ হবে রাত্রে মশারি ফেলার পরে, আলো ডিম করে দেবার পরে।

আমার বাঁ পাশের বেডের ছেলেটিকে নার্স করত এক তপ্তকাঞ্চনবর্ণা অ্যাংলোইন্ডিয়ান যুবতী। কঠিন রোগ থেকে ধীরে ধীরে সারিয়ে তুলতে তুলতে সে ছেলেটিকে দিদির মতো ভালোবেসে ফেলেছিল। ছেলেটি ছাড়া পাবার দু দিন আগে থেকে দেখছি, দিদি বিকেলে নার্স-কোয়ার্টার থেকে চলে আসে, কাছে বসে মগে ভেজানো আঙুর একটি একটি করে তুলে তার মুখে গুঁজে দেয়। তাহলে রোগ আর দৌর্বল্য দিয়েও মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক করা যায়!

আমাকে নার্স করত খাসিয়া, মিজোও হতে পারে, এক ক্রিশ্চান মেয়ে। তার স্তন দুটি ঘোট। হালকা কাঠামো। তেমন সুন্দরীও নয়। কিন্তু তার আপাকা পেয়ারার মতো মুখখানিতে চিবুকের ঢালে তখনও সবুজ রং, সেই রঙের আভা আস্তে আস্তে লেমনইয়েলো হয়ে কপালে এসে বোঁটার দিকের পাকা হলুদ হয়ে ছড়িয়ে আছে। সে যেভাবে আমাকে হ্যান্ড করে তাতে আমি কুঁকড়ে যাই, সেও থতমত হয়। দুজনার কারোর মুখেই কথা নেই, অথচ আমরা সমবয়সীই হব।

আমার মাথা রোগে আচ্ছন্ন, সে স্পিরিট ঘষে, পাউডার মাখায় আমার শরীর যেন প্যানট্রিতে রাখা ধুলো-জমা একটি হারমোনিয়াম। সেও কম বয়সের একটি মেয়ে, লজ্জা কাটে নি। তাকে বলা হয়েছে সকালে-বিকেলে হারমোনিয়ামে বসো, রেয়াজ করো, আঙুলে টিপে টিপে বাজাও। আমার সাদা কালো রিড– সে সাদা রিডে অপ্রতিভ আর কালো রিডে উৎসুক ডো রে মি ফা সো লা টি ডো বাজায়– তাতে আস্ত একটা ভারতীয় রাগিণী হয় না, পশ্চিমী ভাঙা ভাঙা সুরের দমক ওঠে– ট্রা লা লা।

রোগীর লিবিডো, সাপের মতো, অন্য সময় যার মাথায় মণি জ্বলে, সে এখন ঝরা পাতার রাশির নিচ দিয়ে সরসর করে পালাবার পথ খোঁজে।

কিন্তু এখানে শুধু আঠারো বছরের ছেলেরা নেই, নানা ফ্রন্ট থেকে ফেরা, মোটা গোঁফ কড়া দাড়ির তিরিশ-চল্লিশ বছরের আখাম্বা লোকগুলোও আছে। তাদের বেয়াদবী সামলাবার জন্যে পুরুষ নার্সও আছে। মাঝে মাঝে এই বয়স্ক লোকগুলো অবশ্য নেহাত বাচ্চার মতো ব্যবহার করে। সে আর এক কাণ্ড।

সকাল থেকে দফায় দফায় কত রকম যে খাবার আসে- ভোরের চা বিস্কুট, তার পর মাখন রুটি দুধ ডিম, দুপুরে ভাতের মধ্যে টুকরো টুকরো চিকেন, দু ঘণ্টা পরে আবার দুটো ডিম, কলা, কমলালেবু, বিকেলের চা, সন্ধ্যায় আবার দুধ, রাত্তিরে কি দিত কিছুতেই মনে পড়ছে না। সন্ধের পর নার্সরা চলে যেত। রাত্রে মেট্রন এসে ওয়ার্ডের ভার নিতেন। মেট্রন বয়স্কা, অতি স্বাস্থ্যবতী ব্রিটিশ মহিলা। রাতভর ঘণ্টায় ঘণ্টায় দুই সারি বেডের মধ্যিখান দিয়ে ওয়ার্ডের এ মাথা ও মাথা পায়চারি করতেন আর তাঁর উঁচু হিলের টকটক শব্দ হত। হাঁটতে হাঁটতে একঘেয়েমি পেয়ে বসলেই ঘুটঘাট করে কফি বা হরলিকস্ বানাতেন, হুঁকছোঁক করে কড়াইশুটি ভাজতেন। খেতে খেতে আবার পায়চারি– দুটো আড়াইটে বাজে, আমার ঘুম ভেঙে গেছে, আর ঘুম আসছে না। দেখতে পেয়ে উনি হরলিকসের মগ হাতে কাছে এসে দাঁড়ান- খিদে পেয়েছে? খাবে নাকি একটু হরলিকস?

বিকেলে কলকাতার ছেলেদের বাবা মা ভাই বোন আত্মীয় স্বজন দেখা করতে আসে। কোনো কোনো বেডের চারদিক কলকাকলিতে ভরে যায়। নির্জন বেডের রোগীরা দূর থেকে আগন্তুকদের দ্যাখে। কোনো বেড অন্ধকারে স্তব্ধ হয়ে আছে বিরক্তিতে, রাগে, হতাশায় জীবনের তুচ্ছতা জেনে মুখ ফিরিয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে ভগ্নস্বাস্থ্য সৈনিক।

আমার বাঁ পাশের নতুন ছেলেটির মা আর বোন প্রায় রোজই আসে। একদিন দেখি খুঁজে খুঁজে দাদু আসছেন। মামা পারে না, মাসিমা পারে না, এই বুড়ো লোকটাকেই কি আসতে হল! দাদু আর আমি কেউই বেশি কথা বলতে পারি না। দেখাশোনার সময়। শেষ হলে দাদু নীরবে চলে গেলেন। আমিই বা কি বলি।

আমার বেডের বাঁ পাশের ছেলেটি নেভির, ডান পাশের যুবকটি এয়ারফোর্সের, মধ্যিখানে আমি আর্মির। এয়ারফোর্সের যুবকটি গল্প করতে ভালোবাসে, তার বাড়ি ফরিদপুরে, তার অনেক স্মৃতি। বিকেল ফুরোলে সবাই ফিরে গেলে যখন সন্ধ্যা নামে, ওয়ার্ডে মৃদু আলো জ্বলে তখন রোজই সে নানারকম গ্রামীণ সুখাদ্যের গল্প জোড়ে এ খাবার ও খাবারের কথা বলতে বলতে সে অবধারিতভাবে শেষে ধানবনের চিংড়িতে এসে পৌঁছয়– ওঃ খেয়েছেন কখনো- ওঃ ধানবনের চিংড়ির যা টেস্ট! ধান গাছের গলা পর্যন্ত যখন জল চলে আসে তখন সেখানে জন্মায়, ধান গাছ থেকে ধান খায়, পোকামাকড় খায়, ধানবনের জলে ছিটকে ছিটকে খেলে বেড়ায়। খেলে আর ভোলা যায় না।

শুনে শুনে আমারও কেমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, সন্ধে হলেই কেমন উত লাগত– যেন দারুণ কোনো খাদ্য আসার কথা ছিল, এখনো কেন এল না! আমি ডা পাশ ফিরে বলতাম- কই মশায়, কি হল আজ? আপনার ধানবনের চিংড়ির গল্প আরম্ভ করুন।

আমাদের জীবন বড় আশ্চর্যের সমন্বয়। একই সময়ে কত যে বিন্দু স্পর্শ ক আমরা বাঁচি! তাতে এয়ারফোর্সের যুবাটির ধানবনের চিংড়ি যেমন থাকে তেমনি থানে আমার শিল্পসাহিত্য। একজন হকার বাংলা ইংরেজি পত্রিকা বিক্রি করতে মাঝে মাঝে ওয়ার্ডে আসে। তার কাছ থেকে এক সংখ্যা শনিবারের চিঠি কিনেছিলাম। তাতে তখ পঁচিশ তিরিশ পৃষ্ঠা করে মহাস্থবির জাতক কিস্তিতে বেরোচ্ছিল। অসাধারণ লেখা পাশের বেড যেমন রোজ এক বার ধানবনের চিংড়ির গল্প বলে, আমিও তেমনি রোড মহাস্থবির জাতকের কিস্তি পড়ি। যার যেখানে নাড়ী বাঁধা।

সেরে উঠে দু-এক দিন বিকেলে সার্জিক্যাল বিভাগ দেখতে গিয়েছিলাম। সার্জিক্যাল ওয়ার্ড না দেখলে যুদ্ধ কি বস্তু বোঝা যায় না। পুবদেশে যুদ্ধ চলছিল। আসাম-বর্মা সীমান্ত থেকে দলে দলে আহত সৈনিকদের প্লেনে এখানে আনা হচ্ছিল। কারো হাত, কারো পা, কারো হাত পা দুইই কাটা গেছে- দড়ির টানা দিয়ে তাদের ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কারো বুকে মুখে পেটে ব্যান্ডেজ জড়ানো, কাউকে কচ্ছপ বা মাংসপিণ্ডের মতো মনে হয়। শুধু বীভৎস ধড় আর অর্ধেক মুণ্ড নিয়েও কি বেঁচে থাকা যায়? ভয়ানক এই কুরুক্ষেত্রের শিবিরে শুধু নার্স ও ডাক্তারেরা ছাড়া তাদের কাছে কোনো আপনজন নেই।

এখানে দাঁড়িয়ে শিউরে উঠি–

সেদিনকার সেই গা ছমছমে অনুভূতি বোঝাতে গিয়ে আজ আমার একটি ছবির কথা মনে পড়ছে। নন্দলাল বসু ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর একটি ছবি এঁকেছিলেন। ছবিটিতে তেমন কিছুই নেই, শুধু একজোড়া পুরুষের পা আর একজোড়া নারীর পা পাশাপাশি, পরস্পরনির্ভর, চাপ চাপ রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আছে। দু জোড়া পায়ের মধ্যিখানে একটি অন্ধের লাঠির খানিকটা। ছোট ছবি।

এর পর গল্পের বাকিটুকু: ছবিটি দেখে অ্যান্ড্রুজ সাহেবের খুব পছন্দ হল। সবে করা নতুন ছবি, নন্দলালের হাতছাড়া করার ইচ্ছে নেই, তবু ভদ্রতার জন্যে সেটি তাঁকে উপহার দিতে হল। দু দিন পরেই কিন্তু সাহেব শুকনো মুখে এসে হাজির। ছবিটি ফেরত দিয়ে বললেন, ঐ ছবি দেয়ালে টাঙাবার পর থেকে রাত্রে আর তিনি ঘুমোতে পারছেন না।

এইখানে, যুদ্ধের আহতদের মধ্যে দাঁড়িয়ে বুঝি, মানুষের এও এক চরম মুখ, যা রক্তে ভিজে আছে, ক্রমাগত রক্তে ভিজে ভিজে উঠছে। আর ঐ মৃত্যু-উন্মুখ মুখকে আঁকড়ে বেঁচে আছে কত যে মানুষ।

এবারের যুদ্ধে এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানুষ মরেছিল ৫ কোটির উপর। আর মৃত ঐ ৫ কোটির মরণের ছায়ায় বেঁচে ছিল পৃথিবীর বাকি ২০৮ কোটি।

আর দুটো একটা ছোটখাটো অভিজ্ঞতা শুনিয়ে আমার হাসপাতালের গল্প শেষ করি।

বছর দু-এক পরে লাহোরে মিলিটারি হাসপাতালে ভরতি হয়েছিলাম। সেখানে আমার পাশের দুটি পর পর বেডে দুই আফ্রিকান এসে জুটল। ঘোর কালো, না-বেঁটে না-লম্বা স্বাভাবিক উচ্চতার শক্ত চেহারা, লোহার স্প্রিংয়ের মতো কোঁকড়ানো চুল। ওদের কি অসুখ কে জানে! ভোরের বেলা দেখতাম ওরা বিছানায় বসে বসে খবরের কাগজ মশালের মতো পাকিয়ে দাঁতে চিবিয়ে চিবিয়ে নরম করছে। জিজ্ঞেস করতে বলল, ঐটে হল তাদের টয়লেট পেপার। সকালবেলা সাধারণ ব্রেকফাস্টের সঙ্গে তাদের আরও এক ছড়া কলা এবং এক পাউন্ড করে পাউরুটি দিয়ে যেত। তারা সেইসব খেয়ে অম্লানবদনে টিউব টিপে খানিকটা দাঁত মাজার পেস্ট খেয়ে জলযোগ সম্পন্ন করত। আমি বিছানায় বসে বসে অবাক হয়ে দেখতাম। কথাবার্তায় কিন্তু তারা স্বাভাবিক এবং ভদ্র। একদিন সিংহের কথা জিজ্ঞেস করাতে হেসে বলল– আরে না, না, রাস্তাঘাটে কি আর সিংহ ঘুরে বেড়ায়! ওরা সব আছে দূরে জঙ্গলে, আমাদের সঙ্গে অল্পই দেখাসাক্ষাৎ হয়।

সন্ধেবেলা একত্র বসে গপ্লেদের মধ্যে বেশ গপ্পসপ্প হয়। একদিন সেই আড্ডায় এক বর্মী ক্রিশ্চান যুবক তার দেশের গল্প করছিল। দেশের গল্প, বাড়ির গল্প, নিজের গল্প বলতে বলতে অতি স্বাভাবিক স্বরে সে বলল, সে হচ্ছে একজন ব্যাস্টার্ড। কথাটায় আমাদের ভারতীয় কান চমকে উঠল– মানে?

– ব্যাস্টার্ড মানে হল যে ছেলে তার বাবা কে জানে না। আমাদের চমকানি তার বোধগম্য হল না, সরল গলায় বলল সে।

তার সারল্য আমাদের সংস্কারের উপরে জিতে গেল। আমরা আবার স্বাভাবিকভাবে গল্প করতে লাগলাম। কিন্তু সত্যি কি এমন সমাজ আছে যেখানে ব্যাস্টার্ড সন্তানকে বেজন্মা বা জারজ শব্দের অশ্লীলতা স্পর্শ করে না।

লিখতে লিখতে, আজ এতদিনের দুঃখকষ্টের পরে, ব্যাস্টার্ডের, সেই যুবকের দেওয়া অর্থটাকেই ঠিক মনে হয়– যে ছেলে তার বাবা কে জানে না। বাবা লুকিয়ে আছে, পালিয়ে আছে, ধরা দিতে চায় নি।

.

নাম্বার থ্রী কনস্ট্রাকশন গ্রুপ

কয়েকটা শিংশপা অর্থাৎ শিশু গাছের জটলার নিচে ছায়ায় একটি লোহার সাইনপোস্ট, তাতে লেখা–

NO. 3 CONSTRUCTION GROUP
RIE
LAHORE CANTT.

দেড়মানুষ উঁচু কাঁটাতারে ঘেরা সেই বিরাট সীমানার মধ্যে গিয়ে গাড়ি থামল। রাভি নদী থেকে বরফগলা জলের স্রোতোবহা খাল কেটে আনা হয়েছে সেচের জন্য। সেই নাহার থেকে সাত-আট মিনিট হাঁটলেই আমাদের এই ছাউনি। দীর্ঘ শুষ্ক ট্রেনযাত্রার পর জায়গাটা দেখে ভালো লাগল। পরে ধীরে ধীরে সময়মতো আমি এই খালের কথা আর জায়গাটার কথা বলব।

রিপোর্ট করার পর দেখি সেদিন সকালে কুড়ি-পঁচিশ জন নতুন ছেলে এসেছে। আমাকেও সেই দলে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। আমাদের প্রথম কাজ হল ভাঁড়ারে পুরনো সব জামাকাপড় জমা দিয়ে নতুন প্রস্থ নেওয়া। এই দলে অনেকেই খেটে খাওয়া বাড়ির ছেলে, খেতিবাড়ি করা মানুষ। অবশ্য একজন ছিল রাজপুত জমিদারবাড়ির, আর একজন ছিল কুমায়ুনের পুজোআচ্চা করা পুরুতবাড়ির ছেলে। ঢিলে-ঢোলা জোড়া জোড়া প্যান্ট বুশশার্ট পেয়ে এদের মুখে যেমন হাসি ফুটল, চোখে তেমনি কৌতুকও ফুটল। তারা একটুও না দমে, অলটার করাবার জন্যে সেগুলো নিয়ে দরজির কাছে চলল। আমি দেখলাম, জাঠ ও পাঞ্জাবীরা বেশ হাসিখুশি, পরিহাসপ্রিয় এবং আশাবাদী। আমার ভাগ্য ভালো, আমার হালকা পাতলা শরীরে শেষ মাপের জামাকাপড়গুলো ঠিক ঠিক লেগে গেল। আমার পুরনো বুটজোড়াটি চমৎকার। সেটি আমি পালটাব না। আমার অস্ট্রেলিয়ান কম্বলও আমি পালটাব না। হ্যাভারস্যাক, রুকস্যাক, কিট ব্যাগ, জলের বোতল, মেস টিন, হাজিফ এসব তো রাইফেল, টমিগান, এল এম জি, গ্রেনেডের মতোই ফ্রি সাইজ। এখন গ্রীষ্মকাল, এখন এই পর্যন্ত। শীতকাল এলে গরম ভেস্ট, গ্রেট কোট, ব্যাটল ড্রেস আর লেপ দেবে। আমি ভাবছি, ব্যারাকে এই নতুন দলটির সঙ্গেই থাকব। এই শিখ আর জাঠদের আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।

বাইরে প্রচণ্ড রোদের তাপ। বাতাস নেই, ছায়া নেই। আকাশ ব্যেপে একা সূর্য সমস্ত শুষে নিয়ে যেন ক্রমাগত অতিকায় হচ্ছে। হিন্দু পাকশালায় খাওয়া সেরে ব্যারাকে এসে শুয়েছি। কেউ পাগড়ির নতুন কাপড় ভাঁজ করছে, কেউ বুট পালিশ করছে, কেউ বেল্টের পিতলে ব্রাসো ঘষছে। আমি চিত হয়ে চালের আড়ার দিকে অপলক তাকিয়ে আছি কিং রুফ ট্রাস না কুইন রুফ ট্রাস? এমন সময় আধবুড়ো কেঠো চেহারার একটা আর্দালি গোছের লোক তুছিমুছি করে স্থানীয় পাঞ্জাবীতে কি বলল। সবাই উঠল– চলো, চলো, চুল কাটাতে যেতে হবে। খেয়েদেয়ে এই অবেলায় আবার চুল কাটানো কী!

চুল কাটাতে গিয়ে আমার কিন্তু মহা উপকার হল। ছাউনির মধ্যে কাছেই সেলুন। চোদ্দ-পনেরোজন নাপিত বড় বড় সাদা আয়নার সামনে কাঠের চেয়ারে বিনি পয়সার খদ্দেরকে বসিয়ে মনের আনন্দে চুল ছাঁটছে। চার-পাঁচ মিনিটে মাথা সাফ। টুপি বা পাগড়ির বাইরে যেন চুল দেখা না যায়। শৌখিন ছেলেদের কান্নাকাটি রাগারাগির উত্তরে সেই আধবুড়ো লোকটা অবাক হয়ে বলতে লাগল ‘আরে, তোমরা কাঁদছ কেন? এ তো ঘরের খেতিবাড়ি, এক মাসে বড় হয়ে যাবে। আমারও মনে হল, চুল বাঁকা করে কাটো, তেড়া করে কাটো, মুড়িয়ে কাটো, ঘুরিয়ে কাটো এখানে কে চেনে আমাকে!

কিন্তু দেখা গেল কেউ কেউ চেনে। আমার আগের ব্যাচের একজন ছেলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল সেই সেলুনে। সে আমাকে একটি মূল্যবান উপদেশ দিল ‘ছুটি, ট্রেনজার্নি মিলিয়ে এই কদিনে আপনার দাড়িটি তো বেশ বড় হয়েছে দেখছি। কচি দাড়ি, মনে হয় যেন কোনোদিন কামানো হয় নি। ভালো হয়েছে। বাঁচতে চান তো এই সুযোগে দাড়িটি রেখে দিন, নইলে এই আমাদের দশা হবে। আমি দেখলাম তার মুখময় কড়া দাড়ির কালো কালো গোড়াগুলি র‍্যাম্প ফাইলের শুলোর মতো উঁচু উঁচু হয়ে ফুলে আছে।

সে বুদ্ধি দিল ‘কাল ইনস্পেকশনের সময় বলবেন, দাড়ি কাটা আমার ধর্মে মানা’।

পরদিন সকালবেলায় যথাবিহিত সাজগোজ করে প্যারেডে হাজির হলাম। আমাদের তিরিশজনের নতুন প্ল্যাটুন। ট্রেনার হাবিলদার মহম্মদ সফি ফাইলে দাঁড়ানো আমাদের এক এক করে দেখতে লাগল। সফি লম্বা, কৃশ, শৌখিন, ত্রিশ-বত্রিশ বছরের যুবা। তার চুল সুন্দর করে ছাঁটা, মেহেদি করা, মোগল রাজপুত্র সেলিমের মতো সরু লম্বা ঝুলন্ত গোঁফ, হালকা দাড়ি পরিষ্কার কামানো, মাথায় কুল্লা পেঁচিয়ে বাঁধা পাগড়িতে পাখির ছড়ানো পুচ্ছের মতো তোররা গোঁজা। এক এক জন করে দেখতে দেখতে সে আমার কাছে এসে ভুরু কুঁচকে দাঁড়াল, ভাববাচ্যে জিজ্ঞেস করল, ‘দাড়ি কামানো হয় নি কেন?’ আমি বললাম, ‘আমার ধর্মে নিষেধ আছে’। সফি কিছু বলল না, তার এক চোখে কৌতুকহাসি অন্য চোখে বাঁকাহাসি ফুটে উঠল। এর পর প্যারেডের মাঠে এক ইংরেজ ছোকরা লেফটেন্যান্ট এসে ধরল, রোমান উর্দু শেখা উচ্চারণে বলল- ‘হাজাম কিউ নহি কিয়া?’

যে হও সে হও তুমি, আমার একই উত্তর- ‘ধর্মে নিষেধ’।

– তুমি শিখ, হিন্দু না মুসলমান?

— আমি বৈদ্য, আ স্পেশাল সেক্ট অব হিন্ডুজ।

— ফলোয়ার অব বুডঢা? আ বুডঢিস্টি?

– ওই হল। আমার বাবার এত বড় গোঁফ। পেট পর্যন্ত হাত নামিয়ে দেখালাম, আমার দাদুর এত বড় দাড়ি।

লেফটেন্যান্ট ইমপ্রেসড হয়ে বলল– আচ্ছা, ঠিক আছে।

সন্ধেবেলা রোল-কলের সময় বুড়ো সুবাদার এসে গোঁফে হাত বুলোতে বুলোতে হাঁকলেন– ‘হিন্দু হয়ে যে লেড়কা দাড়ি রেখেছ সে বেরিয়ে এসো। আমি ফল আউট হয়ে দাঁড়ালাম। সুবাদার সাহেব সামনে এসে বিরাট গোঁফের আড়ালে লুকিয়ে হেসে আপনজনের মতো আমার থুতনিতে হাত দিয়ে বললেন- “কেন বেটা, দাড়ি বানাচ্ছ না। কেন? বার বার মিথ্যে কথার পুনরাবৃত্তি আমার ভালো লাগছিল না। আমি চুপ করে রইলাম। তখন সূর্য ডুবে গেছে, ছায়া পড়েছে, কিন্তু ভারতবর্ষের শিয়রের দিকে উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে আকাশ থেকে আলো চলে যেতে আরো অনেক দেরি হবে। আমরা সবাই সবাইকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। সারা দিনের অসম্ভব পরিশ্রমের পর আমরা ক্লান্ত। সুবাদার মজার হাসি হেসে বললেন- “আচ্ছা, রেখে দাও, দ্যাখো কেমন দাঁড়ায়। সেই থেকে আর দাড়ি নিয়ে আমাকে কেউ কিছু বলে নি।

পাতলা, তরুণ দাড়ি ক্রমশ বাড়তে লাগল। আঁচাবার পর দাড়িতে জল লেগে থাকে, শীতের সন্ধ্যায় তাতে বেশ অস্বস্তি হয়। আর, একমাত্র হিন্দু যে দাড়ি রেখেছে, এই চিহ্নে তিন নম্বর কনস্ট্রাকশন গ্রুপের সবাই আমাকে চিনে রাখল।

.

হাওড়া-লাহোর ফৌজি স্পেশাল ট্রেন

লাহোরগামী ফৌজি স্পেশাল ট্রেন হাওড়া থেকে সপ্তাহে দু বার ছাড়ে। রাত দশটা এগারোটায় কলকাতা ছেড়ে, চার রাত, তিন দিন পরে সে ট্রেন লাহোরে পৌঁছয়। কখনো দ্রুত, কখনো মন্থর, ড্রাইভার ও গার্ডের যেমন খুশি চলে সে ট্রেন। দুপুরবেলা যে-কোনো স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে রাঁধুনীরা প্ল্যাটফর্মে উনুন পেতে সরঞ্জাম নামিয়ে ট্রেনসুদ্ধ লোকের রান্না করে। সবাই লাইন দিয়ে খাবার নিলে পরে ট্রেন আবার চলতে শুরু করে। দিল্লি ছাড়িয়ে ধূ ধূ বালির মাঠ, সেখানে হাড়গিলা আর ময়ূর ঘুরে বেড়ায়। কাঁকুড় লতায় সরস সবুজ কাঁকড়ি আঁকাবাঁকা ভঙ্গি করে ফলে আছে দেখে ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে ধীরেসুস্থে সেই কাঁকড়ি তুলতে যায়। যদি গ্রীষ্মের দুপুর দুঃসহ হয় তবে স্টেশনে দুমদাম করে বড় বড় বরফের চাঁই কামরায় কামরায় ঢুকিয়ে দিয়ে যায়। জলের সঙ্গে মিশিয়ে আমরা জল ঠাণ্ডা করে খাই।

প্রথম বার যখন যাই, পথের প্রথম দিনটি শেষ হয়ে এল সাসারাম স্টেশনে। কিছুক্ষণের জন্য গাড়ি থামল। অবনীন্দ্রনাথের উটের মরণের ছবি শেষ বোঝর গাঢ় লাল আকাশের মতো আকাশ। সেই আকাশের সামনে, অন্ধকারে সামান্য মলিন হয়ে আসা শের শাহের সমাধি গাট্টাগোট্টা বেঁটে ইমারতের মাথায় গম্বুজ। পরের দিন তিনটে সাড়ে তিনটের সময় গাড়ি থামল এলাহাবাদে। প্ল্যাটফর্মে নেমেই দেখি হুইলারের স্টল, তাতে বাংলা বই আর বাংলা পত্রিকাই বেশি। রবীন্দ্রনাথের অনেক বই কাগজ-মলাটের সংস্করণ। আমি ঘেঁটেঘুঁটে একখানা ফাল্গুনী কিনলাম, তার সবুজ মলাট, এক টাকা দাম। সে বই কঁহা হা মুল্লুক, কত কত ভাড়াটে বাড়ি ঘুরল আমার সঙ্গে। তার পরের দিন প্রথম প্রহরে গাড়ি যখন টুণ্ডলার কাছাকাছি, অনেকেই জানলা দিয়ে মুখ বাড়াল- ঐ, ঐ, ঐ যে দেখা যায় কয়েক মাইল দূরে তাজমহল! তাকে, চেষ্টা করেও প্রেমিকের অশ্রু ভাবতে পারলাম না। বরং আরো কি ভাবা যায় ভাবতে ভাবতেই সে চিনির মঠের মতো, সাদা সাবানের বুদ্বুদের মতে, ঝিনুকের বোতামের মতো মিলিয়ে গেল। পরের দিন সকাল আটটা-নটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম লাহোরে।

লাহোরকে উত্তরদিকে ঘিরে আছে রাভি নদী। তার পোশাকী নাম ইরাবতী, বৈদিক নাম পরুষ্ণী। গ্রীকরা তার নাম দিয়েছিল হাইড্রায়েটিস বা আদ্রিস বা বোনাডিস। এই নদীকে পতঞ্জলি জানতেন। ট্রেন এল পুব-দক্ষিণ থেকে। সুতরাং রাভির সঙ্গে প্রথমে মুলাকাত হল না। শহরটি পুরনো, ঘিঞ্জি। সংকীর্ণ পথগুলিতে টাঙ্গা, সাইকেল আর পদচারীদের ভিড়, মোগল সম্রাটেরা এই পথে আসাযাওয়া করেছেন, এই শহরে থেকেছেন।

খেয়া নৌকোয় রাভি পেরিয়ে গেলে ওপারে জাহাঙ্গীরের কবর। ছোট ছোট ইটে গাঁথা ছড়ানো ইমারত। কিন্তু সাজসজ্জা দূরে থাক, সেই আদুড় ইটের গায়ে, তিন শো বছর পেরিয়ে গেল, আজ পর্যন্ত এক পোঁচ পলেস্তারা পড়ল না। জাহাঙ্গীর কাশ্মীর থেকে ফিরছিলেন, পথে মারা যান। কবরটি শক্তপোক্ত ঠিকই, কিন্তু পুরো সৌধটিতে যেন পথপাশে-জীবন-শেষ-হবার অনিশ্চয়তা এবং উদাসীনতা লেগে আছে। রাভির পাড়ে লম্বা লম্বা ঝটিঘাসের ঝোঁপ। ঝোপের গোড়ায়, শিকড়ে ঠাণ্ডা শিরশিরে জল, চিকচিকে বালি নিস্তব্ধতায় আর হলদে রোদে জায়গাটা যেন কুঁদ হয়ে আছে।

শহরে ডাক্তার, উকিল, অধ্যাপক, চাকুরে অনেক বাঙালি। আনারকলি অঞ্চলে বাঙালিদের বাস। কিন্তু শহরে না, আমি যাব ক্যান্টনমেন্টের দিকে। শহরের পর খানিকটা শহরতলি, স্থানীয় লোকেরা বলে সদর। সেখানে কাঁচা সবজি, ফল, মাংসের বাজার, সার বাঁধা স্টেশনারি দোকান– তাতে ক্যালকাটা কেমিক্যাল, বেঙ্গল কেমিক্যালের তেল সাবান টুথপেস্ট ঠাসা। বাসিন্দারা বেশির ভাগই শ্রমজীবী মানুষ। শহর আর ক্যান্টনমেন্টকে আলাদা করে দিয়ে বইছে রাভি থেকে কেটে আনা সেচের খাল। দীর্ঘ সেই খাল চওড়া না হলেও গভীর ও স্রোতস্বান্। ফৌজি গাড়ি এবং লোকজন সব সময়েই আসে যায় তাই খালের উপর শক্ত একটি লোহার পুল। খালের দুই পাড়েই বেশ হালকা বন, লোকজন নেই, নিরিবিলি। সেখানে প্রচুর বন্য ভাঙের গাছ নিজে নিজেই হয়ে আছে। লোকালয়ের মেয়েরা কখনো কখনো সেই খালে কাপড় কাঁচতে আসে। সাবানমাখা কাপড়চোপড় কাঠের সিঁড়ির উপর রেখে বেঁটে বেঁটে দুটি লাঠি দিয়ে দু হাতে পিটিয়ে পিটিয়ে কাঁচে। সাদা জলের কিনারায় সাদা শালওয়ার কুর্তা পরা খুব ফরসা পাঁচ-ছটি তরুণী কাপড় কাঁচছে, জলে ধুচ্ছে, নিজেদের মধ্যে গল্প করছে- যেন ছবি যেন গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকে দেখতে ইচ্ছে করে এমন ছবি। সেই খাল শেষে চলে গেছে গমের খেতের দিকে মূল খাল থেকে শিরা-উপশিরার মতো জলের নালা ঢুকেছে খেতের মধ্যে।

ক্যান্টনমেন্টের বড় রাস্তার দু দিকেই আমাদের তিন নম্বর কনস্ট্রাকশন ডিপোর জমি। সেখানে সমস্তই আছে যেন শিক্ষানবিস স্পার্টানদের জন্য একটি আস্ত ছোট শহর। দশ পনেরো হাজার সৈন্য স্কোয়াডে স্কোয়াডে ভাগ হয়ে একসঙ্গে কুচকাওয়াজ করতে পারে এত বড় মাঠ। জঙ্গলে একাকী-লড়াইয়ের কৌশল শিখবার জন্যে উঁচুনিচু এবড়োখেবড়ো একটা বিস্তীর্ণ জংলা জায়গা। ছোট একটা রাইফেল রেঞ্জ। নৈশ আক্রমণ শেখাবার জন্য কাঁটাতার ঘেরা জায়গা, অস্ত্রাগার, থাকবার জন্য সারিবদ্ধ ব্যারাক, চারটে পাকশালা ও খাবার ঘর, তিনটি উপাসনালয়, ভাঁড়ার, অফিস, ডাক্তারখানা, ক্যানটিন, পানশালা, সিনেমা হল, সুইমিং পুল, বক্সিং রিং, সান্ধ্য স্কুল, দরজিঘর, হাজামখানা, ধোবিখানা। এছাড়া আছে বিরাট একটি কারখানা। যুদ্ধ এক মহাযজ্ঞ। বড় আকারের যুদ্ধ করতে গেলে রাস্তা চাই, ঘাট চাই, সেতু চাই, এয়ারস্ট্রিপ চাই, যানবাহন চাই, আনুষঙ্গিক আরো বহু কিছু চাই। এসব বানাবার ভার স্যাপার্স অ্যান্ড মাইনার্সের উপর। তাদের হাতে থাকে সম্পূর্ণাঙ্গ কারখানা সেখানে তারা কাজের সরঞ্জামগুলি তৈরি করে, অ্যাসেম করে, নষ্ট হলে সারাই করে।

ক্যান্টনমেন্টে, রাস্তার দু পাশে কয়েকটি হোল্ডিং মিলিয়ে আমাদের বিরাট ছাউনির ম্যাপটি বোধ হয় এতক্ষণে স্পষ্ট হয়েছে। রাভির খালের পাড়ে যে ফৌজি এলাকার শুরু তার প্রথমেই আছি আমরা। আর আমাদের ছাউনির শেষ মাথায় ছ নম্বর হোল্ডিংয়ের পাশের জমিতে আছে আমাদের কারখানা। কারখানার উলটোদিকে, রাস্তার ওপারে বি ও আর অর্থাৎ ব্রিটিশ অ্যান্ড আদার র্যাংকস-এর শিবির। বি ও আর ক্যাম্পের গা ঘেঁষে ওয়াকাইদের (উইমিন অগজিলিয়ারি কোর) ব্যারাক, নিভৃত এবং মেয়েলি।

আমাদের জীবননাট্য এখানে একেবারেই স্ত্রীভূমিকাবর্জিত। অত বড় চৌহদ্দির মধ্যে খুঁজলে কোথাও একটা চুলের কাঁটা বা ব্রোচ বা কাঁচের চুড়ির ভাঙা টুকরো পাওয়া যাবে না। কিন্তু হাসপাতালের নার্স এবং ফৌজি দিলখুশ সভার নাচিয়ে-গাইয়ে মেয়েরা ছাড়াও যুদ্ধে আরও কিছু মেয়ের দরকার ছিল সেই মেয়েরা ওয়াকাই দলে জায়গা পেল, তারা অফিসে কেরানীর কাজও করত। বি ও আর ক্যাম্প এবং ওয়াকাইদের বাসস্থান পাশাপাশি রাখার পিছনে কোনো মতলব ও হিসেব ছিল না একথা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

আমাদের কারখানা আর ব্রিটিশ শিবিরকে দু পাশে রেখে এর পর মসৃণ পাকা রাস্তা চলে গেছে পাড়াগাঁর ভিতরের দিকে। হঠাৎ রাস্তাটা বহুদূর পর্যন্ত ফাঁকা ও জনহীন। বিকেলবেলা এই পথে এসে যেন দেশটার আকাশ বাতাস জমিটিকে বুঝতে পারতাম। পাকা গোধূমখেতের মধ্যে দূরে দূরে পারসিক জলচাক্কি। অপরাহু এখানে বড় দীর্ঘায়ত।

.

 প্রথম সন্ধ্যার উপদেশ

ফৌজি রীতি হচ্ছে, কোনো কিছু ফেলে না রাখা যা করতে হবে তা এখনই করতে হবে। সুতরাং প্রথম দিনেই পোশাক-পরিচ্ছদ নেওয়া এবং চুল কাটানোর পর, বিকেল নামার আগেই থাকবার ব্যারাক ও নিজস্ব চারপাইয়ের বিলিব্যবস্থা হল। এবং তার পর, সেদিনই, সময় নষ্ট না করে, সন্ধেবেলাতেই ট্রেনিং শুরু হল।

রাতের খাওয়াদাওয়ার পরে সন্ধেবেলা শোনা গেল, সিনেমা দেখতে যেতে হবে। এবং এ ফিল্মটি দেখা বাধ্যতামূলক। কি নিয়ে নাটক? না, এক ফৌজি নিষিদ্ধ পাড়ায় এক স্ত্রীলোকের কাছে গেছে এবং যৌনসংসর্গ করেছে। এই সাক্ষাৎসংসর্গের ফলে লোকটির ভয়ংকর সিফিলিস রোগ হল। অতঃপর সে ছুটিতে বাড়ি গেল এবং তার কাছ থেকে রোগ তার স্ত্রীর মধ্যে সংক্রামিত হল। আর এর ফলে তাদের নতুন বাচ্চাটি বিনা অপরাধে জন্মান্ধ, বিকলাঙ্গ, ঘেয়ো এবং সিফিলিস রোগী হয়ে ভূমিষ্ঠ হল। ফৌজিটির সাময়িক অসংযম এবং অবিবেচনার জন্য তার সোনার সংসার নষ্ট হয়ে গেল। এটি ফিল্মের প্রথম পর্ব। এই অংশ ভেঁড়া পিটিয়ে বলছে- খবরদার, রেডলাইট এরিয়ার মেয়েদের কাছে যেয়ো না। গেলে সর্বনাশ হবে।

এর পর দ্বিতীয় পর্ব। দ্বিতীয় পর্ব একটু অন্যরকম। সমরবিভাগ এবং বিশেষজ্ঞেরা স্থির জানেন, যে-লোকটা আজকে আছে কালকে নাও থাকতে পারে, যার জীবন সত্যিই পদ্মপাতায় জল, তাকে যোষিৎসঙ্গ থেকে আটকানো যাবে না। বেশি কড়াকড়ি করলে হিতে বিপরীত হবে, সে বন্য জন্তুর মতো খেপে যাবে। অতএব দ্বিতীয় পর্ব কুণ্ঠিত অনুমতি দিয়ে বলছে- নিষিদ্ধ এলাকায় যাচ্ছ যাও, তবে সাবধানতার এই নিয়মগুলো মেনে যেয়ো।

ফিল্মটা সাদা-কালো, বড় নিরানন্দ, বিবর্ণ ও কেজো। প্রথমাংশে সস্তা ভারতীয় বেশ্যা এবং তার আকাট খদ্দেরের মিলন-নাটক, তার পর ঘেয়ো জননেন্দ্রিয়ের ক্লোজ আপ। মায়ের কান্না, পিতার প্রস্তরমূর্তি। ফিল্মটা কাঁচা বাস্তব। মনে হয় সস্তা কোনো বেশ্যাবাড়িতে এর শুটিং হয়েছিল। আর যে জানে সে জানে ভারতীয় গরিব বেশ্যার খুপরির মতো নিরানন্দ পুরী পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।

দ্বিতীয়ার্ধ প্রয়োগমূলক। এবারেও সেই একই বেশ্যাবাড়ির দৃশ্য। কিন্তু ক্লোজ আপে দেখানো হচ্ছে রতিক্রিয়ার আগে কিভাবে পুরুষাঙ্গে এক নম্বর মলমটি মাখিয়ে নিতে হবে, কন্ডোম পরে নিতে হবে। রতির পরে কিভাবে কন্ডোম খুলে দু নম্বর মলম লাগাতে হবে। কোথাও কোনো ঢাকাটুকি নেই, অস্পষ্টতা নেই।

এসব কথার কথা না। পরের রবিবার সকালেই দেখা গেল এম আই রুমে একটা বড় সার্জিক্যাল ট্রেতে প্রচুর প্যাকেট সাজানো রয়েছে। প্রত্যেক প্যাকেটে দুটি করে পাতলা সাদা কন্ডোম আর এক নম্বর দু নম্বর মলমের দুটি ছোট টিউব। কেউ দেখছে না, কারো কাছে চাইতে হবে না, কোথাও সই করতে হবে না তুমি শুধু নিয়ে যাও। সময়মতো ব্যবহার কোরো, ভুলো না।

সেদিন ঐ ফিল্মটি দেখে কেউ হাসাহাসি করে নি। বরং সবাইকে কেমন বিষণ্ণ ও ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। বেশ্যাবাড়ি যেতে কে চায়! অথচ তাদের কাছে মাসের পর মাস এছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা থাকবে না। ভাড়াটে সৈন্য ও বেশ্যা দুটি জীবিকাই আদিম, দুজনই অবস্থার দাস এবং দাসী।

টেইলপিস: সেদিন রাত্তিরে মনে হয়েছিল জীবন যেন এক কাটাসুতো ঘুড়ি যা এখন উড়তে উড়তে গাঢ় ঘোরদর্শন বজ্রগর্ভ মেঘের মধ্যে প্রবেশ করেছে। রবিবার দেখি, সেই ঘুড়িটার লম্বা লেজ বাকি আকাশের আলোর মধ্যে বাচ্চা ছেলের নেংটির মতো ফুড়ৎ ফুড়ুৎ করে উড়ছে আঠারো-উনিশ বছরের হালকা-পাতলা ন্যাড়ামাথা টিকি-রাখা মাঙ্গীরাম সেই প্যাকেট এনে কন্ডোম দুটোকে লম্বা বেলুনের মতো ফুলিয়ে হাসতে হাসতে ব্যারাকের টানা বারান্দায় দৌড়চ্ছে।

.

সখা রাইফেল

সপ্তাহ না ফুরোতেই রাইফেল কোট থেকে আমাদের প্রত্যেককে একটি করে লী এনফিল্ড রাইফেল দেওয়া হল। ঐ রাইফেলগুলো দারুণ মজবুত ও নিখুঁত লক্ষ্যভেদী, কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল কারখানায় তৈরি। বন্দুকের গায়ে তার নিজস্ব নম্বর খোদাই করা আছে। এখন থেকে আমি যতদিন এখানে থাকব এই বন্দুকটি আমার, আমি ছাড়া আর কেউ এর গায়ে হাত দেবে না।

এর পর রাইফেলের ক্লাসে প্রথমেই শেখানো হল- রাইফেলের কোন অংশের কি নাম, কি কাজ তাদের। ক্লাসের শেষে ওস্তাদ বলল, মনে রেখো, তোমার রাইফেলটিই বিপদে তোমার সবচেয়ে বড় বন্ধু, হয়তো একমাত্র বন্ধু। রণক্ষেত্রে তুমি দলছুট হয়ে পড়বে শত্ৰু কোত্থেকে আসবে তুমি জান না। তুমি আড়াল পাকড়াবে। তখন একমাত্র এই রাইফেলই তোমাকে বাঁচাবে। অজানা জঙ্গলে যখন তুমি একলা, কোথাও ভরসা নেই- তখন এই রাইফেলই তোমাকে ভরসা দেবে। লড়াইয়ের সময় খবরদার কখনো একে অলগ রেখো না। এখন একে একটা বোঝা বলে মনে হচ্ছে, এক মাস পরে দেখবে এ একটা লাঠির মতো হালকা। আমাদের ওস্তাদ চাইলে বেশ সুন্দর করে, অলংকার দিয়ে কথা বলতে পারে। ওস্তাদের কথায় রাইফেলের উপর আমার অগাধ ভক্তি হল, স্নেহও হল। চোখ সরু করে ব্যারেলের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখি সেখানে এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত সর্পিল প্যাঁচ কাটা। থ্রী নট থ্রী কার্তুজ নল থেকে ঘুরতে ঘুরতে বেরুবে, ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে ঢুকবে শত্রুর দেহে। নিজেকে মোচড় দিতে দিতে হাড়মাংস ছাদা করবে। ফলে গুলির নিজের মাপের চেয়ে ক্ষতের ছ্যাদাটা বড় হবে।

সারা দিন অনেক লাফঝাঁপ হাঁটাচলা গেছে। আমি এবং রাইফেল দুজনেই সমান ধূলিধূসর। বিকেল চারটেয় তাকে পরিষ্কার করে, নলের মধ্যে তেল দিয়ে পুল থু টেনে রাতের মতো কোটে জমা করে দিলাম। কাল সকালে আবার এসে নেব।

রোজ সকালে প্যারেডগ্রাউন্ডে জমায়েত হবার পর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি চিরকুটে দিনের প্রোগ্রাম আসে। দশ মাসের মধ্যে শিক্ষা শেষ হওয়া চাই। ম্যাপ রিডিং, বেয়নেট ফাইটিং, সাঁতার বা শুটিং বিষয় যাই হোক, প্রত্যেকটি ক্লাস ছিল পঞ্চাশ মিনিটের আর দুই ক্লাসের মধ্যিখানে দশ মিনিটের বিরতি। বিরতি হওয়ামাত্র আমি ক্যানটিনে ছুটি, দ্রুত এক গ্লাস লস্যি নিই। দুপুরের আগে এইভাবে আমার তিন গ্লাস লস্যি খাওয়া হয়ে যায়। প্রচণ্ড গরমে আর দারুণ ক্লান্তিতে দুপুরের খাওয়া প্রায় খেতে পারি না। তাছাড়া খাবার পরের পিরিয়ডেই যদি বেয়নেট ফাইটিং থাকে তবে পেট ফাঁকা রাখতেই হয়। ভরাপেটে ঐ লাফঝাঁপ হয় না, পেট ব্যথা করে। যদি কোনোদিন দুপুরের খাবার আগের পিরিয়ডে সাঁতার এবং পরের পিরিয়ডে থিওরিটিক্যাল ক্লাস থাকে তো সেদিনটা সবচেয়ে ভালো। সেদিন ফুরফুরে বিকেলে নিজেই কিচেনে গিয়ে মগভরতি চা নিয়ে এসে একটু একটু করে চুমুক দিই আর সামান্য দূরের চার-পাঁচটা শিশু গাছের জটলার দিকে তাকিয়ে থাকি। সারা দিনের ঝাঁ ঝাঁ রোদ এখন নিস্তেজ হয়ে পাতার ফাঁকে ঢুকেছে, বেলা পড়ে আসার হাওয়াও এসে ঢুকেছে। পাতাগুলি ছোট, নীলচে, পাতলা তিরতির করে কাঁপে। এখানে বিকেল ফুরোতে অনেক দেরি হয়। কোনো কোনো দিন দেখি, দীর্ঘ করিডরের মতো সেই বিকেলের প্রান্তে ঐ গাছতলায় কয়েকজন মিলে কাওয়ালির আসর জমিয়েছে। মূল গায়ক একজন, বাকি সবাই গোল হয়ে বসে হাতে তালি দিয়ে তাল রাখছে আর ধুয়া ধরছে বিস্তর বিছা দিয়া তেরে ঘরকে সামনে।

যেদিন খাটুনি মাত্রা ছাড়িয়ে যায় সেদিন আর চা আনতে যাই না। বুটপটি খুলি, শার্ট খুলি না, খাঁটিয়ার উপর লুটিয়ে পড়ি। আমার পাশের বা পায়ের কাছের বা শিয়রের কাছের কেউ নিজের চায়ের সঙ্গে আমার মগেও চা ভরতি করে এনে দেয়। আমি যাদের মধ্যে থাকি তারা কর্নাল-রোহতকের জাঠ, অমৃতসর-লুধিয়ানার শিখ, আর লালামুসার মুসলমান। পাতলা দুবলা বিদেশী ছেলে দেখে ওরা আমাকে অনেক ছাড় দেয়, সাহায্য করে, হয়তো খানিকটা ভালোও বাসে। দু পাশের দু জন নিজেদের জায়গা যখন পরিষ্কার করে তখন আধাআধি করে আমার জায়গাটাও নিকিয়ে দেয়। পায়ের কাছে কৈলাস সিং সবসময় টিপটপ। নিজের পোশাক ধোপাকে দেবার সময় সে আমার জামাকাপড়ও নিয়ে যায়। ফেটিগ ডিউটি পড়লে সবাই আমাকে শুকনো লংকার বস্তাটা দিয়ে নিজেরা অবলীলাক্রমে আটার বস্তা, নুনের বস্তা তুলে নেয়। পরিবর্তে অবশ্য, আমি লক্ষ করি, মৃদু একটা তুচ্ছের হাসি ফুটে ওঠে ওদের ঠোঁটে। তুচ্ছতা কিন্তু আমাকে নয়, বস্তার ঐ ওজনটাকে।

ক্রমশ যত দিন যেতে লাগল আমি এদের সঙ্গে মিশে যেতে লাগলাম। আমার বাক্সে চয়নিকা আছে, ফান্ধুনী আছে তাতে কিছু যায় আসে না। সারা দিন একই পোশাক, একই খাওয়া, একই পরিশ্রমে ঘর্মাক্ত হই। রাত্রে, দশটার পরে আলো নিবে গেলে যার যার খাঁটিয়ায় শুয়ে ওরা গল্প করে। চার-পাঁচ জন অল্পবয়সী শিখ ছিল– হঠাৎ আমার অস্তিত্ব তাদের খেয়াল হয়। মজা করে বলে- গুতোজি, একটু পাঞ্জাবী বলল। মজা করে আমিও বলি আহো প্ৰাজী, কি অইয়া তেনু? কি অইয়া পুত্তর? ইত্যাদি ইত্যাদি। ঐ সরল যুবকেরা নিজেদের ভাষা বিদেশীর মুখে শুনে প্রাণ খুলে হাসে। আরো বলল, আরো বলো। আর দু-চারটে কথার পরই আমার স্টক ফুরিয়ে যায়। ঐটুকু যেন ছিল সারা দিনের শেষে ঘুমের আগের গুডনাইট চুমু। তার পর কারো ঘুম আসত, কারো ঘুম আসত না। বিউগলে টানা লয়ে তিন বার ঘুমের সুর বাজত। রাত নীরব হয়ে গেলে দূরের গমের খেত থেকে হালকা কাঁচরকোঁচর শব্দ ভেসে আসত। সেখানে গরু দিয়ে পারসিক জলচাকি ঘুরিয়ে বর্ষীয়সী পাঞ্জাবিনীরা সারা রাত নাহার থেকে খেতে জল দিচ্ছেন।

.

চরম আবহাওয়া

পাঞ্জাব এবং উত্তরপশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের চরম আবহাওয়ায় যত কষ্ট গ্রীষ্মে তত কষ্ট শীতে। গ্রীষ্মে সর্গিমি থেকে বাঁচার জন্য রোজ আমাদের আধ বাটি করে নুনজল খেতে হয়। সারা দিনমান এবং রাত দুপুর পর্যন্ত আমরা শ্বাপদপ্রাণীর মতো তাপে আর তৃষ্ণায় হা হা করি। বাইরে খাঁটিয়া এনে খোলা আকাশের নিচে শুই। তখনও পৃথিবী এক আগুনভরা তন্দুর। রাতের আকাশ ফ্যাকফেকে সাদা দিগন্তে কোথাও একটু খোঁচখাঁচ নেই যেখানে অন্ধকারের কাজল সামান্য গাঢ় হয়ে জমতে পারে। আকাশ প্রায় নক্ষত্রহীন অনেক তারা উবে গেছে, অনেক তারা দূরে চলে গেছে, বাকি যারা আছে। তারা ঝাপসা, শুকনো। শেষ রাতে মাটির কাছ থেকে ক্লান্ত একটু ঘুম উঠতে না উঠতেই আবার দাহ শুরু হয়ে যায়।

এই রকম গ্রীষ্মে একদিন বিকেলে হঠাৎ দেখা গেল, দিগন্ত থেকে, মেঘ নয়, মেঘের মতন একটা বিরাট ছায়া আকাশপথে দ্রুত এগিয়ে আসছে। সবাই হৈ হৈ করে উঠল আঁধি আসছে, আঁধি! ঢোকো, ঢোকো, ঘরে ঢোকো, দরজা-জানলা বন্ধ করো।

আমি কখনো আঁধি দেখি নি। ব্যারাকে না ঢুকে আমি বারান্দা থেকে একটু দেখতে চেষ্টা করলাম, আর মুহূর্তে আমার গায়ে মাথায় ভাঙা পাথরের, নুড়ির, বালির দানার হাজার হাজার ছবরা এসে লাগল। তার পরই, আপূৰ্যমাণ সমুদ্র যেমন সৈকত গ্রাস করে তেমনি ধুলোর সমুদ্র আমাদের গ্রাস করে নিল। আমি এক লাফে ভিতরে এসে কম্বল মুড়ি দিলাম। দু-তিন মিনিট তোলপাড় করে আঁধি তার পথে চলে গেল। আর হঠাৎ আকাশ স্নিগ্ধ নীল হল, আবহাওয়ার তাপ কয়েক ডিগ্রি নেমে গেল, যেন ভারী এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কিন্তু কম্বল থেকে বেরিয়ে দেখি, কম্বলের উপর, বন্ধ ব্যারাকের মেঝেয় আর জানলার তাকে সর্বত্র সিকি ইঞ্চি পুরু মিহি ধুলোর স্তর জমেছে। আমাদের বন্ধ মুখেও ধুলো ঢুকে কিচকিচ করছে।

শীতের দিনে এর ঠিক উলটো কষ্ট। শীতে সারা রাত ঘুমোতে পারি না। গরম মোজা, গরম গেঞ্জি, ছাইনীল ফ্লানেলের শার্ট, সোয়েটার, গ্রেট কোট পরে, কম্বল লেপ গায়ে দিয়ে শুই তবু শীতে কাঁপি। রাত এত দীর্ঘ যে ভোরেও অন্ধকার জড়িয়ে থাকে। তারই মধ্যে তৈরি হতে হয়। সবচেয়ে মুশকিল, হাতের দশটা আঙুলই ঠাণ্ডায় অসাড়, তাদের দিয়ে কোনো কাজ হয় না যেন কুঠের হাত, আঙুল খসে গিয়ে শুধু পাতা দুখানি আছে। কোনক্রমে বুট পায়ে গলিয়েছি কিন্তু ফিতে বাঁধতে পারি না, প্যান্ট বুশশার্ট পরেছি কিন্তু বোতাম আটকাতে পারি না। ব্যারাকের শেষ মাথায় ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালিয়ে নায়েক গোলাম মহম্মদ হাত সেঁকতে সেঁকতে অপেক্ষা করে সামনে গিয়ে দাঁড়ালে বোতাম আটকে দেয়, দরকার হলে অম্লান বদনে বুটের ফিতেও বেঁধে দেয়। বিরাট গোঁফওয়ালা, গৌরবর্ণ গোলাম মহম্মদকে তখন দাদার মতো লাগে। প্যারেডে রাইফেল হাত থেকে খসে পড়ে যায়। মহম্মদ শফি, স্কোয়াডকে দাঁড় করিয়ে খানিকটা ডবল আপ করায়, যদি তাতে রক্ত চলাচল বাড়ে। দুপুরে যখন খেতে আসি আঙুল তখনও অসাড় রুটি ছিঁড়তে পারি না। মেস-টিন ভরতি ধোঁয়া ওঠা গরম ডালে হাত ডুবিয়ে রাখি, একটু একটু করে সাড় আসে। শীতের দিনে এর মধ্যে আবার ছিপছিপ করে বৃষ্টি নামে। তখন জিমনাসিয়ামে লম্বা সময় ধরে ত্রিবাঙ্কোর-কোচিনের ওস্তাদেরা পি টি করায়। সব সময় চোখে পড়ে হাতের কাছেই নিরিবিলি ওয়েট ক্যানটিন। সেখানে সস্তায় রাম, হুইস্কি, ব্র্যান্ডি মেলে। দু-এক চুমুক ব্র্যান্ডি খেলেই শীত যায়, কিন্তু সেদিকে আমার বুদ্ধি খেলে না। তখন বিনি পয়সার সিগারেটই খাই না, তায় মদ!

ফৌজে যেমন পোশাকআশাকের বাহুল্য নেই তেমনি অভাবও নেই। কিন্তু তিন রকম শিরস্ত্রাণ থেকে তিন রকম পাদুকা- এত যে সরঞ্জাম তার মধ্যে কোনো রকম জাঙ্গিয়া বা ট্রাংক বা আন্ডারউইয়্যার নেই কেন? আজ ভেবেচিন্তে মনে হয়, সৈনিকবৃত্তিতে বর্মচর্মের, মুখে বীভৎস রং মাখার যেমন দরকার আছে তেমনি নিরস্তু উলঙ্গ হবারও একটা প্রাচীন ঐতিহ্য আছে। প্রাচীন গ্রীকেরা বা নেটিভ আমেরিকানদের কোনো কোনো জাতি শেষ লড়াইয়ে যাবার সময় পুরো ন্যাংটো হয়ে যেত। তিন নম্বর কনস্ট্রাকশন গ্রুপে এসে দেখছি, এদের পোশাকের তালিকায় যেমন জাঙ্গিয়া নেই তেমনি সারি সারি পায়খানা ও স্নানঘরে কোনো দরজাও নেই, ইচ্ছে করেই রাখা হয় নি। আমার সন্দেহ হয় এই দুয়ের মধ্যে কোথাও একটা লুকনো যোগসূত্র আছে। পায়খানার ব্যাপারটাতে প্রথম প্রথম আমার খুব অসুবিধে হত- দরজা নেই, সমুখ দিয়ে সবসময় শৌচার্থীরা যাতায়াত করছে। শ্রীরামপুরের শশাঙ্কসুন্দর একদিন বলল– আ মোলো যা, আজ সকালে আমি টাট্টিতে বসেছি, এক ব্যাটা তেলুগু এসে সামনে ডাঁড়িয়ে রইল– আমি উঠলে সে বোসবে। আমি পোঁ পোঁ করে সিগারেট টানচি, সে কাঁচুমাচু হয়ে উড়িয়ে আচে। থাক ব্যাটা উঁাড়িয়ে। হঠাৎ দেখি, ও মা, লোকটা কোত্থেকে একটা সিগারেট বার। করে সোজা কাঁচে এসে হাত বাড়িয়ে বলচে তোেড়া আগ দিজিয়ে।

এতকাল পরে আমার ইতিহাস-দর্শনের চিন্তা জাগে: আদি সমরবিশারদেরা হয়তো ভাবতেন, সৈনিকের আবার গোপনাঙ্গ কী! তার আছে জননাঙ্গ, রাইফেলের নলের মতোই যা সোজাসুজি তাক করা যায়। দেশ দখলের সময় ঐ দুই দিক থেকে আক্রমণ করলে তার ফল হয় মারাত্মক। অতএব ব্যারাকে দেহকে এমনভাবে রাখো যাতে সে লজ্জা ভুলে রহস্যহীন এবং হৃদয়হীন হতে থাকে।

.

 স্নানের গল্প

টাট্টিখানার গল্প তো হল, এইবার গোসলখানার গল্প বলি।

আমাদের সারবাঁধা স্নানঘরগুলো সারা সকাল-দুপুর শুকনো খটখটে হয়ে খালি পড়ে থাকে। কিন্তু বিকেল যেই হল, রাইফেল জমা করে দিয়েই পাঞ্জাবী জাঠ মাদ্রাজী সারা ভারতবর্ষ তোয়ালে হাতে পড়িমরি করে ছোটে সেই দিকে, শাওয়ার দখল করতে। বেশিক্ষণ জল থাকবে না। ওদিকে ছটা বাজলেই বিউগল বাজবে, বিউগল বাজলেই ম্যালেরিয়ার মশারা বেরুবে। তখন ফুলপ্যান্ট, হাতা নামিয়ে বুশশার্ট এবং মোজা পরা বাধ্যতামূলক। অতএব সময়াভাবে অলস বাঙালিদের আর স্নান হয় না। অবশ্য ঐ বিধিবদ্ধ পোশাকে দেহটি মুড়ে স্নান করা যায়। কিন্তু তাতেও বাঙালিদের উৎসাহ নেই। সে যা হোক, ঐ দীর্ঘ গ্রীষ্মে এক সপ্তাহ স্নান না করে যখন আমাদের মাথার মধ্যে ভো ভোঁ মৃগতৃষ্ণিকা দেখা শুরু হয়েছে তখন একদিন আকস্মিকভাবেই মুশকিল আসান হয়ে গেল।

সেদিন সন্ধের পর রোল কল হয়ে গেলে আমরা পাঁচ-ছ জন সিনেমা হল, ক্যানটিন বা ক্লাবের দিকে না গিয়ে সদর বাজারের দিকে গিয়েছিলাম। পাশের ছোট গেটে সান্ত্রী কম, জিজ্ঞাসাবাদ কম, আলো কম। সদরে যাবার এই রাস্তাটা নিরিবিলি, পথের পাশে কয়েকটা গাছ অন্ধকারেও স্পষ্ট হয়ে আছে কেননা রাত হলেও মাটি, গাছপালা, বাড়িঘর, বস্তুজগৎ এত উত্তপ্ত যে তাপের একটা আভা পৃথিবী থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। আকাশেও তারাগুলো বিবর্ণ– যেন পাতলা গ্যাস হয়ে আরো উপরে উঠে গেছে। যাবার সময় রাভির সেই বরফগলা জলের খাল পেরিয়ে চলে গেছি, তখন কিছু মনে পড়ে নি। কিন্তু ফিরবার সময় খালের সাঁকোটি পেরোতে গিয়ে হঠাৎ একজন দাঁড়িয়ে পড়ল দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমি দুটো ডুব দিয়ে নিই, বলেই সেই খালপাড়ের ভাঙের বনের আলোআঁধারিতে প্যান্টশার্ট জুতোমোজা খুলে রেখে লাফ দিয়ে জলে পড়ল। আর বলতে হল না। আমরা পাঁচজনেই এক মুহূর্তে যার যার জামাকাপড় খুলে ঝুপঝুপ করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আঃ! কী ঠাণ্ডা বরফগলা রাভির জল! মুহূর্তে শরীর জুড়িয়ে গেল।

খালটি গভীর নয়, কিন্তু প্রখরস্রোত। একটুও ঢেউ নেই, কিন্তু গা ছেড়ে দিলেই ভাসিয়ে নেয়। আমি ভাসতে ভাসতে ভাবছি একদিকে সূর্যের আগুনে পৃথিবী গনগন করছে অন্যদিকে চাঁদ বোধ হয় রাত্তিরে কোনো গোপন পাহাড়ের ফাটলে বসে বরফ তৈরি করেছিল রাভির এই খাল সেই বরফগলা জল বয়ে নিয়ে চলেছে। সেই হিমঠাণ্ডার গোপন নেশাটুকু আছে বলেই খালের দুই পাড়ে নিজে নিজেই ভাঙের বন সৃষ্টি হয়েছে।

এর পর থেকে আমরা রোজ সন্ধেবেলা সেখানে আসি। জায়গাটা এমনিতেই জনহীন, সন্ধের পর দু-একজন মাত্র লোক চলাচল করে। আমরা আনন্দে চেঁচামেচি করে স্নান করে গোপনে ফিরে যাই।

আমরা ভাবি জায়গাটা বুঝি জনহীন। ভুল ভাবি। একদিন রোজকার মতো চেঁচিয়ে মেচিয়ে গল্প করতে করতে চান করছি- হঠাৎ খেয়াল হল, খালের অন্ধকার তীরে সারি দিয়ে কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। অন্তত দশজন লোক। মনে হচ্ছে, তারা মন দিয়ে আমাদের কথা শুনছে। দু-একজন সিগারেট খাচ্ছে। আমরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছিলাম, লোকগুলোকে দেখে থমকে গেলাম। তাদের সামনে যে উপরে উঠে জামাকাপড় পরব তারও উপায় নেই। আমরা সম্পূর্ণ উলঙ্গ। পাড়ে উঠে আমরা কেউ কারো দিকে তাকাই না। কিন্তু এই ব্যাটারা তো তাকাবে। হয়তো ঐ আশাতেই এখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা খিস্তি করে করে গালাগাল মিশিয়ে এইসব কথা যখন উচ্চহাস্যে বলাবলি করছি তখন একবারও সন্দেহ হয় নি যে এরা বাংলা বুঝবে। কিন্তু আমাদের খিস্তির তোড়ে আর থাকতে না পেরে একজন বলল, আইজ্ঞা আপনাদের মুখে বাংলা শুইনা এখানে একটু দাঁড়াইছি। কতকাল ভালো কইরা বাংলা শুনি না।

এই ‘বাংলা’ শোনার জন্য দশজন বাঙালি উদগ্রীব হয়ে খালপাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন ভেবে আমার লজ্জা হল। কিন্তু উত্তর কলকাতার ভটচার্জি ছিল হাজির-জবান মানুষ। সে বলল- মশাইরা, আমরা ন্যাংটো হয়ে শিশুর মতো এখানে চান করছি। আপনারা দয়া করে একটু পেছন ফিরে দাঁড়ান। আমরা উঠে পেন্টুলটা গলিয়ে নিই, তার পর আরো বাংলা শোনাব।

যা হোক, উঠে জামাকাপড় পরে উভয় দলে আলাপ হল। এদিকপানে কোথায় যেন একটা নতুন কারখানা হয়েছে। এই বাঙালি কারিগরের দল মাসখানেক হল কাজ নিয়ে দেশ থেকে এসেছে। এখানে এদের ভালো লাগছে না। কিন্তু উপায় নেই, পেটের জন্য থাকতে হবে। এরা নেহাত সাদামাটা, ছাপোষা শ্রমজীবী। আমাদের পেয়ে মহাখুশি। বলে চলেন, দুকানে বইসা একটু চা-পানি খাই। আমাদের বাঙালিত্ব এতদিনে অনেক ফিকে হয়ে গেছে। আমরা ভাবছি, এই দলটি যদি সন্ধেয় ফেরার পথে রোজ এই নাহারের পাড়ে এসে দাঁড়ায় তো আমাদের স্নানের দফা রফা।

.

ফৌজি পরিবার

সবাই বলে যত সব বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো ছেলেরাই এসে ঢোকে সৈন্যদলে। কথাটা মিথ্যে নয়। সৎ সুবুদ্ধি, সভ্য পরিবারেও কিছু ছেলে বেমানান হয়ে জন্মায় চোর ডাকাত

আউটকাস্ট অঞ্ছতের মতো তারা ছিটকে বেরিয়ে যায় সমাজ থেকে। কিন্তু সবাইকে জায়গা। দেয় সৈন্যবাহিনী। সৈন্যবাহিনী একটি বিশাল একান্নবর্তী পরিবার। রান্নাঘর আলাদা হলেও র‍্যাশনে কোনো তফাত নেই। কেউ পাঠান-পাগড়ি, কেউ শিখ-পাগড়ি, কেউ মন্টগোমারি ক্যাপ, কেউ গোখা হ্যাট পরলেও ভিতরে ভিতরে সব সময় একটা জোরালো পারিবারিক মেজাজ আর তেজ কাজ করে। এটা শুরু থেকেই টের পেয়েছিলাম। প্যারেডের ফাঁকে ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি- পাকাগোফ সুবাদার ঘামে ভেজা পিঠে একটু হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। ইনস্পেকশনের জন্য সার বেঁধে দাঁড়িয়েছি মেজরকে নিয়ে বুড়ো কর্নেল এক এক করে দেখতে দেখতে সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমার বুট যথেষ্ট চকচকে নয়, বুকপকেটের বোতাম খোলা- ওস্তাদের চোখ লাল হয়ে উঠেছে। কর্নেল স্নেহভরে নিজের হাতে বোতামটা লাগিয়ে দিয়ে পরের ছেলেটার সামনে পা বাড়ালেন।

এই পারিবারিক বন্ধন আরো টের পাওয়া যেত যখন আমরা বাইরে গিয়ে পুলিশ বা অন্য কোনো লোকজনের সঙ্গে মারামারি করে ফিরতাম। ক্যাপ্টেন বা মেজর, কোম্পানির দায়িত্বে যিনিই থাকুন না কেন, প্রথমেই খবর নিতেন আমরা মার খেয়েছি না দিয়েছি। মার দিয়ে এসেছি শুনলে খুশি এবং নিশ্চিন্ত হয়ে প্রথমেই অপরাধীদের লুকিয়ে ফেলতেন, তার পর অভিযোগ এমনভাবে অস্বীকার করতেন যাতে অসামরিক শাসনবিভাগ আমাদের টিকিটি না ছুঁতে পারে। বকাঝকা যা করা সে কেবল পরিবারের মধ্যে।

 সৈনিকদের র্যাংকগুলির জন্য আর্মি আরো পারিবারিক সৌগন্ধে ভরে থাকত। ছোকরা লেফটেন্যান্টরা যেন রাঙাদা ফুলদা। ক্যাপ্টেনরা বড়দা, কখনো বা ছোটকাকা। মেজররা, কেন জানি না, সাধারণত একটু দূরের, কড়া ধাতের। আবার কর্নেল হলেন স্নেহশীল বড় জেঠু। তবু সবাই কি সমান? এর মধ্যেও ভালো, মন্দ, ধূর্ত এবং পাগলাটে, সাত্ত্বিক ও তামসিক সব রকমই ছিল। চোর, নৃশংসও ছিল।

এই পরিবার-স্পিরিট থাকার জন্যে মাঝে মাঝে খুব মজার ঘটনাও ঘটত।

সে সময় আমাদের কোম্পানিগুলিতে অন্তত ১০% লোক বিবাহিত ছিল। বাঙালিদের মধ্যেও অন্তত জনাচারেকের দারপরিগ্রহ করা হয়ে গিয়েছিল। তারাই দেখতাম প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহে নিয়মিত চিঠি পায়, চিঠি লেখে। যে চিঠি যেত আর যে চিঠি আসত দুটোই অবশ্য খোলা, সেন্সর করা। আমাদের ব্যারাকের গৌরহরি মজুমদার বছর দুই আগে বিয়ে করেছে, তার পর পালিয়ে যুদ্ধে এসেছে। সেও সপ্তাহে সপ্তাহে চিঠি পায়। মজুমদার একটু শুচিবায়ুগ্রস্ত লোক আমাদের থেকে একটু দূরে বসে খায়। ওয়াটার বটলে মুখ লাগিয়ে জল খায় না, আলগোছে খায়।

একদিন সন্ধেবেলা শোনা গেল, মজুমদার কি যেন অপরাধ করেছে। কলকাতা থেকে নালিশ এসেছে। কাল তাকে অফিসার কমান্ডিংয়ের কাছে পেশ করা হবে। কি অপরাধ মজুমদারও জানে না, আমরাও জানি না। পরদিন আমরা প্যারেডে চলে গেলাম। মজুমদার বলির পাঁঠার মতো ব্যারাকে থেকে গেল। পেশ হওয়া মানেই নিশ্চিত শাস্তি। বিকেলে ধূলিধূসর আমরা ব্যারাকে ফিরে দেখি মজুমদার ঘুমিয়েটুমিয়ে তেল চুকচুকে টুবুটাবু হয়ে তার চারপাইতে বসে চা খাচ্ছে।

-কী হল, কী হল, মজুমদার?

আমাদের কৌতূহল দেখে মজুমদার তারিয়ে তারিয়ে তার গল্পটি বলল। ব্যাপার হল, তার বউ তাকে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই চিঠি দেয়, সেও প্রথম প্রথম তার উত্তর দিয়েছে, এখন মাস তিনেক হল নীরব হয়ে আছে। তার ভালো লাগে না। সারা দিনের এই হাড়ভাঙা খাটুনির পর প্রেমপত্তর লেখা অসম্ভব। চিঠি না পেয়ে পেয়ে বউ কাকুতিমিনতি করে চিঠি লিখত, শেষে রেগে গিয়ে এখন অফিসার কম্যান্ডিংয়ের কাছে নালিশ করেছে।

মজুমদার পেশী হয়ে সামনে দাঁড়ালে বউয়ের নালিশের চিঠি হাতে নিয়ে মেজর বললেন, ‘তুমি নববিবাহিত? পত্নীর চিঠির জবাব দাও না? তিন মাস ধরে চিঠি না লিখে পত্নীকে দুর্ভাবনায় রেখেছ? এর কারণ দর্শাও।

–আজ্ঞে সময় পাই না।

–সবাই সময় পায়, তুমি পাও না?

–‘আজ্ঞে পাঁচটায় উঠে টাট্টিখানায় যাই, ফিরে এসে হাজামৎ করি, বিছানা ভাঁজ করি, পোশাক পরি, বুট পরি, হোলস্টারের বাকস্ আঁটি, চা খেতে যাই, কোট থেকে রাইফেল নিই। তার পর প্যারেড. .. সাঁতার, .. ক্লোজ কমব্যাট. ..’।

-‘চোপ রও’। মেজরের দগদগে ঘামাচিভরা লাল মুখ আরো লাল হয়ে উঠল। নিচের পাটির সোনা বাঁধানো দাঁতটা ঝিলিক দিল ‘আমি কোনো অজুহাত শুনতে চাই না। একজন ভদ্রমহিলা, ঘটনাচক্রে তিনি তোমার স্ত্রী, স্বামীর অবিবেচনায় কষ্ট পেয়ে প্রতিবিধান চেয়েছেন। ছি ছি! তোমার মতো লোকের জন্যই সেনাবিভাগের বদনাম। কত সময় চাই তোমার চিঠি লেখার জন্যে?

-আজ্ঞে ভালো করে লিখতে গেলে একটু সময় তো লাগবেই।

-ঠিক আছে, দু দিন তোমার ডিউটি অফ। পরশু ঠিক এই সময়ে এসে আমার হাতে চিঠি দেবে, আমিই পোস্ট করে দেব। আর শোনো, এর পর থেকে প্রত্যেক ফর্টনাইটে তোমার অর্ধদিবস ছুটি- প্রত্যেক ফর্টনাইটে তুমি চিঠি লিখবে। তোমার স্ত্রীর কাছ থেকে দ্বিতীয় বার নালিশ এলে তোমাকে কোয়ার্টার গার্ডে ঢুকতে হবে। ডিসমিস।

ঘটনা শুনে আমরা হেসে বাঁচি না– সাদামাটা গৌরহরি তো কম না।

রাঙামাটির সার্ভে স্কুল থেকে আসা ময়মনসিংহের গুপাল বলল- ‘গৌরহরিদা, তুমি মেজররে এমন বুকা বানাইলা।

গৌরহরি বলল– ‘আমি মেজরকে বানাব বোকা? আসলে উনিই আমাকে বোকা বানিয়েছেন। সব বুঝেছেন উনি হয়তো তখন খুব মুডে ছিলেন।

ফচকে ছোঁড়া সুলতান বলল- ‘উনি, তেনি গৌরহরিদা, তোমার খুব ভক্তি দেখতাছি মেজরের উপর।

-শোন্ সুলতান, ডিসমিস বলার সঙ্গে সঙ্গে মেজর কি করলেন জানিস? আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মুচকি হেসে বাঁ চোখ খোলা রেখে ডান চোখ বন্ধ করলেন।

-তোমাকে চোখ মারলেন?

–তবে আর বলছি কি।

.

রাস্তায় রাস্তায়

ছুটির দিনের বিকেলে শহরের রাস্তায় না গিয়ে, আমার ভালো লাগত, তার উলটো রাস্তায় হেঁটে হেঁটে যদ্র পারা যায় চলে যেতে। আমাদের ছাউনিকে লম্বালম্বি দু ভাগ করে পাকা রাস্তার মাথার দিকটা গেছে নাহারের পুল পেরিয়ে, সদরের দোকানবাজার পেরিয়ে শহরের দিকে আর ল্যাজটা নেমে এসেছে বি ও আর ক্যাম্প ও কারখানা ছুঁয়ে ধূ ধূ করা গমখেতের মধ্যে।

একদিন সেই বিস্তীর্ণ পাকা গমখেতের পাশ দিয়ে চলেছি। বিকেলের নির্জন রাস্তা। হঠাৎ দেখি এক লম্বাচওড়া ব্রিটিশ মেজর আসছে আরো ভিতরের দিক থেকে। এখানে তো এরা সাধারণত আসে না। এই সাহেব কি বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়েছিল নাকি? যাক গে। কিন্তু আমি পেরিয়ে যেতেই লোকটা আমাকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ডাকল- ‘তুমি স্যালুট না করে যাচ্ছ কোথায়?’

এমন চমৎকার বিকেলবেলা এ কী ঝঞ্জাট! লোকটা আর আমি গোলাইয়াথ আর ডেভিডের মতো গমখেতের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। আমি বললাম- ‘দুঃখিত, স্যার। আমি আনমনা ছিলাম, খেয়াল করি নি।

–আচ্ছা যাও, ঠিক আছে।

 আমি পিছন ফিরতেই মেজর আবার ডাকল– কি হল? তুমি এবারও যে স্যালুট করে পালাচ্ছ?

‘দুঃখিত, স্যার। এবার আমি পথের মধ্যে খট করে গোড়ালি ঠুকে স্যালুট করে অ্যাটেনশনে দাঁড়ালাম। প্রত্যুত্তরে মেজরও আমাকে বাকায়দা স্যালুট করল। তার পর যোগ করল ‘বৎস, তুমি আমাকে স্যালুট করছ না, স্যালুট করছে এই এঁকে। মেজর নিজের কাঁধের এমব্রয়ডরি করা ক্রাউনটিতে আঙুল রাখল। তার পর মুচকি হেসে চোখ টিপল। ভাবখানা যেন, দ্যাখো, পথিমধ্যে কেমন একখানি অর্থহীন ফৌজি নাটক অভিনীত হল। আমি আবার গোড়ালি ঠুকে স্যালুট দিয়ে অ্যাবাউট টার্ন করে নিজের পথে চললাম।

.

সদরবাজারে ঢোকার শুরুতে ডানহাতি আরেকটা নতুন ফাঁকা রাস্তা অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। একদিন অপরাহ্নে সেই পথে যেতে যেতে দেখি, একটা জায়গায় খোড় চালের কুঁড়েঘরের দোকানগুলি আস্তে আস্তে বেশ জমে উঠেছে। রাস্তার পাশে মাটিতে চাটাই আর কাপড় পেতে স্কুপ করে আঙুর বিক্রি হচ্ছে। ছ আনা করে সের। এক এক স্কুপে কয়েক মন করে আঙুর। পাকা টসটসে আঙুর, নিজেদের চাপে নিজেরা ফেটে গিয়েছে, রস গড়িয়ে নেমেছে রাস্তায়। মাছি ভনভন করছে। এক সের কিনলে জোর করে এক পো ফাউ দিয়ে দেয়। পর পর এইরকম স্তূপ স্তূপ আঙুরের দোকান। মাঝে মাঝে আখরোট কিসমিস শুকনো ফলের দোকান। সে বেসাতিও মাটিতে পাতা। এইসব খোলা দোকানের পরে দুধের দোকান বিশাল কড়াইয়ে দুধ জ্বাল পেয়ে পেয়ে ঘন হচ্ছে, পুরু করে সর পড়ছে। বিরাট কাঁচের গ্লাসে চিনি দেওয়া মালাই দুধ তিন আনা করে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু তবু দোকানের তুলনায় খদ্দের কম। ফাঁকা জায়গায় বিকেলের আলো আর তেরচা রোদ, আঙুরের গন্ধ, দুধের গন্ধ, পাগড়ির রং, সাদাকালো দাড়ি, টাকাপয়সার দেনাপাওনা আর বাতাসে ভেসে যাওয়া কথাবার্তার সোরগোল মিলিয়ে একটুকরা বিদেশ তৈরি হয়েছে।

একদিন সন্ধ্যায় সদরবাজারের কাছাকাছি এসে একটা সত্যিকারের চমক লাগল। রাস্তার পাশে এক মাঝবয়েসী শিখ মাটিতে কিছু পত্রিকা সাজিয়ে বসেছে। অন্ধকার হয়ে গেছে। দোকানী একটি কারবাইডের আলো জ্বালিয়েছে। উর্দু আর গুরমুখী পত্রিকার মধ্যে একখানা ছিল পুজাসংখ্যা যুগান্তর। আমি নিচু হয়ে বসে কারবাইডের আলোয় পাতা ওলটাতে লাগলাম। পাতা ওলটাতে ওলটাতে মনের পিছনে চলচ্চিত্রের ফিতের রিল যেন কিরকির করে ঘুরে চলে: কলকাতায় কি এখন পুজো হচ্ছে, না কি হয়ে গেছে? এটা কি মাস? শরতের দিন বলেই বোধ হয় আজ বিকেলে আকাশ তত প্রখর ছিল না। আলোর রঙেও কেমন একটা গোলাপী আভা মিশে গিয়েছিল।

পত্রিকাটি বগলদাবা করে আমি ব্যারাকে ফিরলাম। সেই সংখ্যাটিতে ছিল কালীকিংকর ঘোষদস্তিদারের প্রচুর ইলাস্ট্রেশন। প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প তেলেনাপোতা আবিষ্কার সেই সংখ্যাতেই বেরিয়েছিল। গল্পটার জন্যেই কাগজটাকে মনে আছে, দিনটাকেও মনে আছে।

.

খাওয়াদাওয়ার গল্প এবং জাদুঘর

অগ্রহণীয় কুখাদ্য গলাধঃকরণ করে আমার ফৌজি জীবন শুরু হয়েছিল। কিন্তু সে কদিন মাত্র। তার পর থেকে খাদ্যের ব্যাপারে সুখেই ছিলাম। বরং কখনও কখনও এমনও মনে হয়েছে, বুঝি দেশের লোককে ফাঁকি দিয়ে আমাদের ভালো ভালো জিনিস খাওয়ানোনা হচ্ছে।

লাহোরে আমাদের বিরাট ছাউনিটি ছিল চওড়া রাস্তার এপারে ওপারে দু ভাগে ভাগ করা। দুটি ভাগই স্বয়ংসম্পূর্ণ। পৌঁছবার পর প্রথম যে-ভাগে আমার ঠাঁই হল সেখানে লঙ্গরখানা ছিল চারটি হিন্দু, শিখ, মুসলমান এবং দক্ষিণী লঙ্গরখানা। হিন্দু শিখ মুসলমান রান্নাঘরে মোটামুটি একই ধরনের পাঞ্জাবী রান্না হত– লার্ড মাখানো রুটি, ঘন ডাল, পরিচ্ছন্ন সবজি, সুস্বাদু মাংস। ছুটির দিনে পায়েস বা হালুয়া, এবং বিকেলে প্রায়ই শুকনো ফল। দক্ষিণী কিচেনে রুটির পাট নেই সকালসন্ধ্যা শুধুই ভাত। ভাত, সম্বর, ডাল, রসম, জোলো দই, মাংস- সব দক্ষিণী খাদ্য। দক্ষিণীদের ভাত না দিয়ে উপায় নেই। ওরা হাসতে হাসতে বলত- ‘চাবল ইল্লে তো প্রেড ইল্লে। অর্থাৎ ভাত নেই তো প্যারেডও নেই।

পাঞ্জাবীদের মধ্যে মাছ খাবার তেমন চলন নেই। র‍্যাশনে কাঁচা মাছ কখনই আসত না, টিনের মাছ আসত সার্ডিন, ম্যাকরল। মুসলমান লঙ্গরে গোমাংস আসত কিনা জানি না। তবে, ওদের মাংসের স্বাদ-গন্ধে একটা অন্য আভিজাত্য ছিল। স্থানীয় সরবরাহ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া থেকে শুকনো মাংস আসত। একদিন ভাড়ার ঘরে ঢুকে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে চমৎকৃত হয়েছিলাম ছালছাড়ানো, নাড়িভুড়ি বার করে নেওয়া একটা শুকনো ছাগল আংটায় ঝুলছে ছাগলটার আকার টাটুঘোড়া কিংবা একটা পূর্ণবয়স্ক নীলগাইয়ের সমান। সেই বন্ধ ঘরে, অপ্রাণ আটা ডাল নুন লঙ্কার বস্তার পিরামিড গন্ধের মধ্যে তার বিশাল শুকনো শরীরে তার প্রাণীত্বের স্মৃতি যেন তখনও রয়ে গেছে।

মাস দুয়েক পরে আমাদের প্ল্যাটুন রাস্তার ওপারে ৬ নং হোল্ডিংয়ে বদলি হল। এখানেও চারটে লঙ্গরখানা, তিনটি উপাসনালয় ইত্যাদি। ৬ নং হোল্ডিংয়ে এসে প্রথম দিনই আমার এক বিপত্তি হল। নতুন ব্যারাকে চারপাই বাক্স কিটব্যাগ গুছিয়েটুছিয়ে চানটান করে হিন্দু লঙ্গরখানায় খেতে গেছি। এখানে কেউ আমাকে চেনে না। কিচেনের ইন-চার্জ বলল- “তুমি তো দেখছি মুসলমান। এখানে তো খেতে পাবে না। তুমি মুসলমান লঙ্গরে যাও। বুঝলাম, দাড়ি দেখে সে ভুল করেছে।

তখন দুপুর ঝাঁ ঝাঁ করছে। খিদেও পেয়েছে খুব। আমি কথা না বাড়িয়ে মুসলমান রসুইখানার দিকে চললাম। কিন্তু সেখানে কেউ কেউ হয়তো আমাকে চিনত, তারা বলল, আরে এ তো হিন্দু, এখানে খাবে কি করে?

আমি বললাম, তাহোক গে, আমি তোমাদের সঙ্গেই খাব।

– আরে, তা কি হয়! ওরা তোমার র‍্যাশন ড্র করেছে। কোনো অসুবিধে হবে না, তুমি ওখানেই চলে যাও।

আমি আবার ফিরে চললাম হিন্দু পাকশালায়। গাট হয়ে বসে বললাম, চালাকি করার চেষ্টা কোরো না। আমি হিন্দু– বোনাফাইডি হিন্দু। আমি এখানেই খাব। দরকার হলে সন্ধেবেলা পে-বুক এনে দেখিয়ে দেব।

এবার কেউ আর আমাকে ঘাঁটাল না। একটু মুচকি হেসে, নিজেদের মধ্যে তাকাতাকি করে বিনা বাক্যে খেতে দিল।

কদিন গেলে ৬ নং হোল্ডিংয়ে আমাদের সন্ধেবেলায় খাওয়াটা হয়ে দাঁড়াল যাকে বলে আন্তধর্মীয় মহাভোজ। ধর্মভেদের জন্য আমরা হিন্দুরা হিন্দু লঙ্গরখানায় যাই আর সুলতান মমতাজ রহমানেরা যায় মুসলমান রসুইখানায়। দিনের বেলায় যেমন-তেমন, কিন্তু বিকেলে দুই হেঁশেল থেকে খাবার নিয়ে আমরা দুই দলই একটি শিশু গাছের নিচে ঘাসের উপরে এসে বসি। দুই হেঁশেলের খাবার ভাগাভাগি করে, আড্ডায় মজে, হাসিঠাট্টা করতে করতে রাতের খাওয়া যখন শেষ হয় তখন পশ্চিমের আকাশে সূর্য ডুবে গেলেও সারা আকাশ জুড়ে তার আভা ভেসে আছে। ঐটুকু সময়ের জন্যে ঐ দূর বিদেশের গাছতলায় ফরিদপুর নোয়াখালি হুগলি খুলনার এক বাংলাদেশ বানিয়ে নিয়ে আমরা পরম সুখে আমাদের বাঙালিত্ব উপভোগ করি।

কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বের হোতা পাঞ্জাবী মুসলমানেরা আমাদের ঐ প্রতিদিনের সুখটুকুকে বক্ৰচোখে দেখল। তারা আমাদের ফরিদপুর নোয়াখালির মুসলমানদের বোঝাল, তাদের মতো এমন আপনজন থাকতে ওরা কেন হিন্দুদের সঙ্গে বসে খাবে। এই মন্ত্রণায় ফল ফলল। একদিন দেখলাম, সুলতান রহমান মমতাজউদ্দীনেরা আর বিকেলে মেস-টিন হাতে শিশু গাছটির তলায় এল না।

আমরা ব্যাপারটা বুঝেছিলাম। সুতরাং কেউই কাউকে কোনো প্রশ্ন করি নি। কিন্তু সাত দিনের মধ্যে ওরা আবার ফিরে এল। এসে নিজেরাই সব বলল- ‘হালার পো হালা পাঞ্জাবীরা এই কয়, ওই কয়। কয়, হিন্দুর লগে খানা খাও ক্যান? হালাগো ভাষা বোঝা যায় না। কয়দিন বৈকালের খাওয়াটাই নষ্ট হৈল। কয়েকটা মুখভার বিকেলের পরে সেদিন ফরিদপুরের বাংলা আর শ্রীরামপুরের বাংলা মিশে গিয়ে খুব হাসাহাসি হল।

সাতাশ বছর পরে ঐ ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হল। এবারেও, ভাষার মিল ছিল না বলে বাঙালি মুসলমানেরা ওদের ছেড়ে এল। কিন্তু এবার তারা ফিরে আর আমাদের কাছে আসে নি। কারণ আমরা কাছাকাছি কোথাও ছিলাম না।

এবার একটা মজার গল্প বলি। একদিন শোনা গেল মচ্ছিখোর বাঙালিদের জন্য আজ দারুণ খবর, বাঙালিদের সম্মানে আজ হিন্দু লঙ্গরে ইলিশ মাছ এসেছে, ডিনারে খাওয়ানো হবে।

সমুদ্র থেকে এত দূরে ইলিশের আগমন এক অলৌকিক ব্যাপার। পাঞ্জাবীরা কোনোদিন সেই বিখ্যাত মাছ চোখে দেখে নি। আজ নামডাক শুনে তাদেরও মনে একটা আশা তৈরি হয়েছে, যেন কি না কী খেতে পাবে। কিন্তু খেতে গিয়ে মেস-টিনে যখন সেই মাছ পড়ল তখন আমরা বাঙালিরা সবাই থ হয়ে গেলাম। চমৎকার চ্যাপটা এক এক হাত লম্বা, রুপোর আঁশে মোড়া আস্ত মাছগুলোকে আড়াআড়ি মাঝখান দিয়ে কেটে লার্ড আর নুন-হলুদের জলে সেদ্ধ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আঁশ ছাড়ানো হয় নি, কানকো ফেলা হয় নি, পোঁটা গালা হয় নি। প্রত্যেকের ভাগে আধখানা মাছ কেউ মুডোর দিক, কেউ লেজার দিক। ইলিশের দুর্গতি দেখে আমাদের কান্না পেল। বাঙালি পাঞ্জাবী নির্বিশেষে সবাই সে মাছ থু থু করে ফেলে দিল। মচ্ছিখোর বাঙালিদের দিকে বাকি লঙ্গরখানা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাল। আর র‍্যাশনের ইন-চার্জ, যিনি অতি কষ্টে ঐ দশ ক্রেট মাছ জোগাড় করেছিলেন, মনোদুঃখ উড়িয়ে দিয়ে ঘোষণা করলেন- আমি শিগগিরি আবার দশ ক্রেট মাছ আনছি, এবং এবার বাঙালি কায়দায় রান্না করে খাওয়াব।

সত্যিই পরের সপ্তাহে সেই মাছ এল। এবার কজন করিতকর্মা বাঙালি জুটে গেল। তারা গিয়ে সদর থেকে মেয়েদের ডেকে এনে মাছ কোটাল। লার্ডের বদলে সরষের তেল, সরষে আর কাঁচা লঙ্কা আনা হল। রান্নার কাছে দুজন দাঁড়িয়ে রইল। ইলিশ মাছ ভাজা আর ইলিশের ঝাল হল। শুধু বাঙালিদের জন্য সেদিন ভাতও হল। সবাই বাঙালি রান্না খেয়ে মহা খুশি। সংস্কৃতিক্ষেত্রে এক সপ্তাহ আগে যে গৌরব আমরা হারিয়েছিলাম তা আবার ফিরে পাওয়া গেল।

তবু তখন থেকেই, অগোচর বিধাতার মতো উঁচু মহলে বসে কেউ হয়তো আমাদের হেনস্তা করার ষড়যন্ত্র আঁটত।

আমাদের সিনেমা হলে সন্ধে থেকে নাগাড়ে ফিল্ম দেখানো হয় বেশির ভাগই উর্দু, হিন্দি এবং কৃচিৎ ইংরেজি। একদিন শোনা গেল, বাঙালিদের জন্য বাংলা ছবি এসেছে। ফিল্ম আরম্ভ হলে দেখলাম, ফিল্মের নাম: চিনাবাদাম চাষের পদ্ধতি। পরিচালকের নাম দেবেন্দ্রনাথ মিত্র।

যা হোক, আমাদের যে এত গুণ, দেশে থাকতে তা জানতাম না, এখানে এসে টের পেলাম। আর্যাবর্তে জনশ্রুতি আছে- বাঙালি খুব আলমন্দ, দুবলা-পাতলা হলেও বেপরোয়া সাহসী এবং বাঙালি জাদু জানে।

ফৌজি ছাউনিতে সবচেয়ে প্রিয় দুই বাঙালি ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং পঙ্কজকুমার মল্লিক। হিন্দু মুসলমান শিখ সবাই একবাক্যে নেতাজীকে বীরশ্রেষ্ঠ এবং আপনজন বলে মেনে নিয়েছিল। তাঁর অন্তর্ধান রহস্যকেও ওরা বাঙালির বুদ্ধিমত্তা তথা জাদুবিদ্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করত।

ফৌজিদের মধ্যে নেতাজীপ্রীতি না হয় বুঝলাম, কিন্তু পঙ্কজকুমার মল্লিক? ওরা বলত, পঙ্কজ মল্লিকের মতো গাইয়ে হিন্দুস্তানে আর কে আছে? আহা কী গান অ্যায় দর্দভরি দিলকী আওয়াজ সুনায়েংগে।

বাঙালিদের আরেকটা পরিচয় রাখা আছে লাহোর জাদুঘরে। মিউজিয়ামের ছবির সংগ্রহে বাংলা স্কুলকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। গ্যালারিতে পর পর প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়, ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার, সারদা উকিল, বরদা উকিলের কয়েকখানা করে মৌলিক ছবি দেখে যুগপৎ খুশি এবং অবাক হয়েছিলাম।

তবে লাহোর মিউজিয়ামে সবচেয়ে দর্শনীয় বস্তু ছিল মোগল এবং রাজপুত বীরদের অস্ত্র ও বর্ম। মোগল-পাঠানদের লম্বা তলোয়ার, বেঁটে তলোয়ার, নানা মাপের ছোরা, কোমরে গোঁজার খঞ্জর। তলোয়ারের কত রকমের ভঙ্গিমা, ছোরার কত রকম কুটিল বক্রতা! আমীর, ওমরাহ, সম্রাটদের তলোয়ার ও ছোরার বাঁটে চমৎকার অলংকরণ ও মূল্যবান পাথর বসানোআফগানদের গাদা বন্দুকগুলো ছিল অত্যন্ত লম্বা। রাণা প্রতাপ সিংহের ব্রেস্ট প্লেট, আর্ম প্লেট ও তলোয়ার দেখে রোমহর্ষ হয়– উনি কি মানুষ ছিলেন না দৈত্য! কবাটবক্ষ সেই যোদ্ধার বর্মের মধ্যে আমার মতো তিনজন ঢুকে যেতে পারে।

বর্মগুলির আবার কতরকম কৃৎকৌশল- মাছের আঁশের মতো ছোট ছোট ইম্পাতের পাত জুড়ে জুড়ে বানানো, ইস্পাতের তারে জালি গেঞ্জির মতো বুননো, বুক পেট ও পিঠের মাপে টুকরো টুকরো লোহার পাত খিল করে জুড়ে দেওয়া। মানুষের কতরকমের যে উদ্ভাবনী শক্তি এবং প্রয়োজন। আর, এত অক্লান্ত উদ্ভাবনী শক্তি আছে বলেই এত উলটোপালটা প্রয়োজন।

.

হীরা মণ্ডি

শহরের মধ্যে জমজমাট রেডলাইট এরিয়ার নাম ছিল হীরা মণ্ডি। মণ্ডি মানে বাজার। হীরা মালিনীর বাড়ির মতো ‘ঐ দেখা যায় বাড়ি আমার চৌদিকে মালঞ্চ ঘেরা’ একেবারেই নয়। প্রাচীন মোগল আমলের ঘিঞ্জি জায়গা পুরনো চিতপুরের গলির মতোই সরু গলি। ছুটির দিনের দুপুর খানিকটা ঢলতে না ঢলতেই সেখানে বেচাকেনার ভিড় লেগে যায়।

রবিবার ছুটির দিন। ভালো করে চানটান করে, খেয়েদেয়ে, ফিটফাট হয়ে ক্যান্টনমেন্টের সৈন্যেরা হীরা মণ্ডির দিকে ছোটে। ছাউনি থেকে একটু এগোলেই সেদিন প্রচুর টাঙ্গা। টাঙ্গাঅলাদের মধ্যেও যেন জোশ এসে গেছে ঘোড়া আর সওয়ারি দুই-ই টগবগ করছে। সওয়ারি তুলেই টাঙ্গাঅলা ঘোড়ার পাছায় শপাং করে ছিপটি মারছে তেজে টাঙ্গা ছুটছে। মনে হচ্ছে যেন মহাভারতের রথ, রথী আর সারথিদের অজস্র টুকরো চলচ্ছবি খর রোদে, হলদে ধূমল আকাশের নিচে নারীহরণ কিংবা নারীমৃগয়ায় চলেছে বীরের দল।

অনেকেই যায়। একদিন আমিও টাঙ্গায় সওয়ারি হয়ে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি সে এক বিরাট ব্যাপার। মেয়েরা সব একেকজন একেকটি খুপরি নিয়ে রয়েছে, তাদের দোরের সামনে খদ্দেরদের লাইন পড়েছে সিপাহি, হাবিলদার, জমাদার সবাই আছেন। লাইন ক্রমশ অবিশ্বাস্য রকম লম্বা হচ্ছে। গলির এ মাথায় ও মাথায় সুঠামদেহ মিলিটারি পুলিশ জিপ থেকে নেমে টহল দিয়ে যাচ্ছে। সৈন্যদের লাইন স্বভাবতই নিখুঁত নিয়ন্ত্রিত কেউ হুড়োহুড়ি করছে না, আগে-পিছে যাবার চেষ্টা করছে না। কোথায় আর ঘুরব? আমিও একটা লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দাঁড়িয়ে লক্ষ করলাম একজন করে লোক ঢুকছে- খানিক পরেই লোকটি প্যান্টের বোতাম আঁটতে আঁটতে বেরিয়ে আসছে। পরমুহূর্তেই মেয়েটি দরজায় এসে দাঁড়াল, ঐটে হল সংকেত এবার পরের লোকটি ঢুকল। এইরকম ক্রমাগত চলতে লাগল।

আমি যার দোরে লাইন দিয়েছিলাম সে মেয়েটি বেশ বড়সড় চেহারার, বোধ হয় পাঠান কিংবা পাঞ্জাবী। কয়েকজন লোক যাওয়া-আসার পর তার চুল এলোমেলো হয়ে বিনুনি লটপট করতে লাগল, ঠোঁটের গাঢ় রঙ মুছে গেল, এখন সে বুকের দোপাট্টা ছাড়াই দরজায় দেখা দিচ্ছে। এদিকে লাইনের লোকগুলো বার বার তাকে দেখে, তার আলুথালু চেহারা দেখে ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠছে। লোকগুলো ঘরে ঢুকছে আর বেরুচ্ছে, থাকবার সময় ক্রমশ কমছে, আর মেয়েটা ক্রমশ আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। দুই হাত তুলে পালোয়ানের ভঙ্গি করে যেন ডাকছে চলে আও। তার রোখ চেপে গেছে। দ্রুত, অতি দ্রুত টাকা কামাচ্ছে সে। লাইনের একটা লোককেও আজ সে ফিরে যেতে দেবে না। আমার সামনের লোকটি আমার চেয়ে ইঞ্চি ছয়েক লম্বা। কালো টুপির নিচে তার ফরসা ঘাড় দেখছি, তার কানের লতি চুনির মতো টকটকে লাল। দোরগোড়ায় পৌঁছবার আগেই আমি টুপ করে লাইন থেকে খসে প্রত্যুৎপন্নমতি মাছটির মতো সরে পড়লাম।

যখন ব্যারাকে ফিরলাম তখন অন্ধকার হয়ে গেছে, তারা উঠেছে, একটু হাওয়াও দিয়েছে। একটা নতুন কালোকোলো রোগা চেহারার বাঙালি ছেলে ব্যারাকে বসে মিটিমিটি হাসছিল আর তার কীর্তি ফলাও করে বলছিল সে হীরা মণ্ডিতে প্রায়ই যায়, আজও গিয়েছিল। আমি গলির দৃশ্য একটু আগে দেখে এসেছি, এবার তার বর্ণনায় ঘরের ভিতরের দৃশ্য দেখতে পেলাম। খদ্দের ঢোকামাত্র মেয়েরা আর সময় বা বাক্য ব্যয় করে না হাত বাড়িয়ে প্রথমেই টাকাটা নিয়ে নেয়, টাকাটা বাক্সে ভরারও ফুরসত নেই, বালিশের নিচে মুদ্রাগুলি ঠেলে দিয়েই পট করে সালোয়ারের ফিতে খুলে ফেলে। ঢিলে সালোয়ার ঝপ করে পায়ের কাছে পড়ে যায় এবং সে একটানে কামিজটা খুলেই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। বাঙালি ছেলেটা পুরোটাই লক্ষ করেছিল। সেও বিনা বাক্যে মেয়েটার উপর শুতে শুতেই হাত চালিয়ে দেয় বালিশের নিচে। ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক ওঠা নামায় মেয়েটা কিছু বুঝতে পারে না। দু মিনিট পরে আমাদের খদ্দেরটি যেটুকু দিয়েছিল তার চেয়ে বেশি নিয়ে নিষ্ক্রান্ত হয়।

ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক। ঝিক ঝিক ইউ এস মেরিনদের মধ্যে খুব চালু শব্দ, যার অর্থ স্ত্রীপুরুষসঙ্গম। শব্দটি শুনতে মিষ্টি, যদিও আমেরিকান সৈন্যগুলো এইসব ব্যাপারে মহা হতচ্ছাড়া। একবার কর্মব্যপদেশে এক জায়গায় গিয়ে দেখি কতগুলো আমেরিকান সৈন্য একগোছা ফোটোগ্রাফ নিয়ে মজা করছে। কি ব্যাপার? ফোটোগুলি কয়েকটা চীনে মেয়ের, মেয়েগুলোকে পুরো উলঙ্গ করে নানা ভঙ্গিতে তোলা, আর সব ছবিতেই, কী বিচিত্র, ওদের যোনিগুলি লম্বালম্বি নয়, আড়াআড়ি। ব্যাপারটা আরো বীভৎস কেননা কোনো কোনো মেয়ে আবার সে জায়গাটা দু আঙুলে টেনে দেখাচ্ছে। মেয়েগুলো সত্যি, কিন্তু আসল দ্রষ্টব্যটি ক্যামেরার কৌশল।

লোকগুলো এবার আমাকে নিয়ে পড়ল। এই দ্যাখো, চীনে মেয়েদের সুনু আমাদের মেয়েদের মতো ভার্টিকল না, হরিজ। ঠিক কিনা বলল। ক্যামেরা তো আর মিথ্যে বলতে পারে না! হোঃ হোঃ চীনে মেয়েদের সুনু হরিজনট।

মুক্ত নাগরিক আর ছাউনিবাসী সৈনিকদের মিথুনজীবনের তফাত আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যুদ্ধের সময়। অসামরিকদের শান্তির জগতে নারী-পুরুষের সম্পর্ক সংসারস্বপ্নের, সন্তানস্বপ্নের যেন প্রথমে মধুর লিরিক এবং পরে বিশাল মহাকাব্য জড়িয়ে আছে দুজনকে। যুদ্ধের সৈন্যেরা এই জীবনের একেবারেই বাইরে। একমাত্র প্রাণের ভয়ে বা পেটের খিদেয় বাধ্য না হলে মেয়েরা সৈন্যদের কাছে যায় না কারুর সঙ্গে কারুর বন্ধন তৈরি হয় না, ভালোবাসা তৈরি হয় না। তবু কখনো কখনো একটা বেদনাসন্ধি, একটা ক্ষতমুখ তৈরি হয় নিকষ সন্ধ্যায় বুকফাটা রক্তমেঘের মতো কোনো সৈনিককে দেখে সহসৈনিকেরা হয়তো টের পায়।

ফৌজিদের এই ব্যথার কথা আমি অন্য দিক থেকে এবার একটু বলার চেষ্টা করি। রেল স্টেশনের মেইন লাইন থেকে নিভৃত একটা ট্রাক টেনে আনা হয়েছে একেবারে আমাদের ছাউনির কিনারে। সেখানে একটা নিরিবিলি প্ল্যাটফর্ম। সেই প্ল্যাটফর্ম এমনিতে অব্যবহৃতই পড়ে থাকে, শুধু সৈন্যদল যখন ফ্রন্টে যায় তখন তাদের নিয়ে সেখান থেকে স্পেশাল ট্রেন ছাড়ে। এটা সম্মান, হয়তো খানিকটা আদরও। যারা রইল তারা বিদায় দিতে আসে- একফেরতা ফুলের মালা পরায়, মুহ মিঠা করায়। জায়গাটায় কয়েকটা বড় বড় শিমুল গাছ, শিশু গাছ, কাঁটাগাছ সবুজ পাতার নিচ দিয়ে খাকি পোশাক পরা লোকগুলো মচমচ করে যায়, বাদামী বা ছাইধূসর রঙের কামরায় ওঠে। কিট ব্যাগ গুছিয়ে রাখে। তাদের সঠিক গন্তব্য কোথায় তখনও তারা জানে না। পোশাকের তখন দুটো মাত্র রং খাকি আর জলপাইসবুজ। খাকি পরা সৈন্যেরা যায় ইরাক ইরানের মরুভূমির দিকে, সবুজ পরা সৈন্যেরা যায় আসাম বর্মার জঙ্গলের দিকে। প্ল্যাটফর্মে কোথাও স্ত্রীলোক নেই মা বোন স্ত্রী প্রেয়সী পড়োশিনী কেউ না। কুকুরের কান্নার মতো নিরানন্দ জয়ধ্বনি ওঠে। ট্রেন ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

এই যে যাওয়ার সময় কয়েকটা আস্ত দল গেল, কয়েক মাস পরে ফেরার সময় ফিরে আসবে ভাঙাচোরা কিছু লোক। এই ফিরে আসা ভাঙা দল, বিশেষ করে ইরাক ইরান থেকে আসা দলগুলিকে, ছাউনির বাইরে তাঁবু খাঁটিয়ে রাখা হয়। বেশির ভাগ লোকই সিফিলিসে আক্রান্ত। ডাক্তারি পরীক্ষার পরে তারা ফৌজি হাসপাতালে চলে যায়, বাকিরা ফিরে আসে তাদের সাবেক রেজিমেন্টে। হাসপাতালেও ভি ডি. ওয়ার্ড জেলখানার মতো আলাদা। নার্সেরা সবাই পুরুষ। তখনও পেনিসিলিন আবিষ্কার হয় নি। রোগীরা অকথ্য কষ্ট ভোগ করে।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরা সৈন্যেরা কেমন যেন ঝিম মেরে থাকে কোথাও যেন কিছু খুইয়ে এসেছে। রোগ আর মেয়েদের কথা নিয়ে চাপাচাপি করলেও কিছু বলতে চায় না। কিংবা শেষে হয়তো বলে- ‘কী বুঝবে তোমরা ইরাক ইরানের মেয়েদের তত তোমরা দেখ নি। হুরী পরীর মতো। ঐখানে বিমারী কোথায় ছিল?… বিমারীর কথা কে মনে রেখেছিল…’ লোকটা কথা খুঁজে না পেয়ে চুপ করে যায়।

আজ, এত বছর পরে তাদের কথা ভাবতে ভাবতে আমার মনে পড়ল বালজাকের ‘প্যাশন ইন দ্য ডেজার্ট’ গল্পটার কথা। নিঃসঙ্গ মরুভূমিতে বাঘিনী আর সৈনিকে মৈথুন। এবং সেই ভয়ংকর ভবিতব্য।

.

 শুটিং ও বেয়নেট যুদ্ধ

লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ খুব সুচিন্তিতভাবে ধাপে ধাপে এগোচ্ছিল। কুচকাওয়াজ, রাইফেল প্যারেড, কামুফ্রেজ, কাঁকড়া চলন, জঙ্গল লড়াই, নিশা আক্রমণ, খালি হাতে লড়াই, সাঁতার, ম্যাপ পড়া খুঁটিনাটি আরো যেন চৌষট্টি কলা। আমাদের ছাউনির মধ্যেই একটা ছোট্ট রাইফেল রেঞ্জ ছিল। যার যার রাইফেল সরিয়ে রেখে সেখানে আমরা সরু বোরের বন্দুকে .২২ কার্তুজে চাঁদমারি অভ্যাস করতাম। খাওয়াদাওয়ার পর উপুড় হয়ে শুয়ে বালির বস্তার উপর নিশ্চল হাত রেখে পুটপুট করে গুলি করা। ব্যাপারটা ছেলেখেলার মতোই মজাদার। কিন্তু আমার ছিল গোড়ায় গলদ ডান চোখ বন্ধ করে বাঁ চোখ খোলা রাখতে পারি, কিন্তু বাঁ চোখ বন্ধ করে কিছুতেই ডান চোখ খুলতে পারি না। বাঁ চোখ বন্ধ করলে আমার ডান চোখও বুজে যায়। অতএব আমি দু চোখ খুলেই গুলি করি এবং প্রতিবারই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে রাইফেল রেঞ্জের ধুলো ওড়াই।

শুটিংয়ের ট্রেনিং দিতেন আবদুর রহমান। হাবিলদার আবদুর রহমান ছোটখাটো চেহারার মানুষ, তাঁর গোল গোল চোখ, বার বার এ চোখ খুলে ও চোখ বন্ধ করে ব্যাপারটা যে কত সোজা আমাকে দেখাতেন। কিন্তু কিছুতেই আমার হল না দেখে শেষটায় পরামর্শ দিলেন, রুমালের মধ্যে একটা পয়সা জড়িয়ে, রুমালটা বাঁ চোখের উপর দিয়ে জলদস্যুদের কায়দায় বেঁধে রাখো। এতে বাধ্য হয়ে বাঁ চোখ বন্ধ এবং ডান চোখ খোলা থাকবে, এবং শেষে ব্যাপারটা অভ্যাস হয়ে যাবে।

আবদুর রহমান আরো শেখালেন, দুশমন যদি দৌড়ে তোমার দিকে আসে তবে তার মাথায় তাক করলে গুলি লাগবে বুকে, যদি দৌড়ে তোমার কাছ থেকে দূরে পালাতে থাকে তবে কোমরে তাক করলে গুলি লাগবে পিঠে, আর যদি তোমার সমুখ দিয়ে আড়াআড়ি দৌড়য় তবে এক মানুষ আগে তাক করো।

তবে শত্রু খুব কাছে, গায়ের উপর চলে এলে অত বড় একটা রাইফেল আর তেমন কাজে আসে না। দুটো দেহের মধ্যে খানিকটা ফাঁক না থাকলে গুলি করার অবকাশ কোথায়? তখন বেয়নেট চালিয়ে শত্রুকে নিপাত করতে হয়।

বেয়নেট যুদ্ধ শেখাত মহম্মদ তাজ খান। তাজ খান পাঠান, যুবক এবং দারুণ সুপুরুষ। তাজ খানের অধীনে কোনো প্ল্যাটুন নেই- সে স্বাধীনচিত্ত পাঠান। যে-প্ল্যাটুনের যখন প্রোগ্রাম থাকে সে এসে বেয়নেট শিখিয়ে যায়। বিকেলবেলা তাকে দেখি, ঢিলে সালোয়ার, আজানুলম্বা শার্ট আর মাথায় একটি চমৎকার পাগড়ি, আস্তেসুস্থে মুসলমান লঙ্গরখানার দিকে চলেছে। সূর্য দেখা যায় না, কিন্তু বেলাশেষের রোদ্দুর এসে পড়েছে তার পাগড়ির তাোয়গাঢ় রঙ, কড়া মাড় দেওয়া, পাখির ঝুঁটির মতো ভাঁজ ভাজ খাড়া তোরায় অভ্রের কুচি ঝিকমিক করে। তাজ খান কারো সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলে না, কারো সঙ্গে তেমন দোস্তিও নেই। ঐ একটু সাজসজ্জায় তার মন আছে নইলে সে মোটামুটি নিস্পৃহ।

বেয়নেট দুভাবে চালানো হয়। প্রথম পদ্ধতিটি অতি সহজ। বেয়নেট লাগানো রাইফেল সঠিক ভঙ্গিতে দু হাতে শক্ত করে ধরে দৌড়ে গিয়ে একের পর এক শত্রুকে গেঁথে ফেলতে হয়। আক্রমণের সময় রণহুংকার বা বীভৎস চিৎকার করতে হয় যাতে শত্রু ভয় পায়, তার স্নায়ুদৌর্বল্য ঘটে আর অন্যদিকে আক্রমণকারীর মধ্যে বীররস স্ফুরিত হয়, হিতাহিতজ্ঞান লুপ্ত হয়ে মুহূর্তে সে খুনী হয়ে উঠতে পারে। বেয়নেট চালাতে হয় পুরো শরীরের ভার দিয়ে বেয়নেট ছুরির মতো কাটে না, বল্লমের মতো ফোঁড়ে।

আর একটা কথা– বুকে ঢোকাবার পর অনেক সময় বেয়নেট পাজরের হাড়ে আটকে যায়- ভূপাতিত শত্রুকে পা দিয়ে চেপে ধরেও টেনে খোলা যায় না। তখন কালক্ষয় না করে গুলি করো। গুলি করলেই হাড় ভেঙে বেয়নেট খুলে আসবে।

কিন্তু হলই বা ট্রেনিং, তবু মারবে না ধরবে না, পর পর দাঁড়িয়ে থাকবে আর বেয়নেটের খোঁচা খেয়ে যাবে এ রকম শত্রু কোথায় পাব? অতএব মাঠে পাশাপাশি কয়েক সারি খড়পোরা জাপানি সৈন্যের ডামি কাঠের ফ্রেমে আটকানো থাকে। আমরা তাদেরই উপর বেয়নেট অভ্যাস করি। রোজ বেয়নেটের খোঁচা খেয়ে খেয়ে বেচারাদের খড়ের শরীর ঝাঁজরা, মাথা লটপট করে। মাঝে মাঝে দয়াপরবশ হয়ে আমরা তাদের ঝেড়েঝুড়ে, হাত বুলিয়ে আবার ঠিকঠাক করে দাঁড় করিয়ে দিই।

এই আক্রমণ এমনিতে খুবই সোজা, কিন্তু বিপদ হত যখন ওস্তাদ অতি দ্রুত পর পর ছেলেদের চার্জ করার জন্য ছাড়তে থাকত– খোলা বেয়নেট, শরীরের সব ঝোঁকটা সামনে, আগের জনের পিঠ থেকে পরের জনের বেয়নেটের ডগার দূরত্ব মাত্র ফুটখানেক। একটু এদিক ওদিক হলে নীলচে ইস্পাতের লম্বা ফলায় যে কোনো পিঠ গেঁথে যাবে।

এবার শুনুন বেয়নেট ফাইটিং শিক্ষার দুসরা তরিকা অর্থাৎ দ্বিতীয় পদ্ধতি। এবার দুশমনের ভূমিকায় স্বয়ং ওস্তাদ এবং তার ট্রেনিং স্টিক।

ভরদুপুরে ওস্তাদ আমাদের প্ল্যাটুনকে তপ্ত বালির মাঠে নিয়ে আসে। সূর্য একেবারে মাথার উপরে। আক্রমণের ভঙ্গিতে দাঁড়ালে পায়ের নিচে নিজের বেঁটে ছায়াটাকে জাপানি সৈন্যের মতো গাট্টাগোট্টা দেখায়। আমরা গোল হয়ে মাটিতে বসি আর বৃত্তের কেন্দ্রে ওস্তাদ ট্রেনিং স্টিক হাতে দাঁড়ায় ট্রেনিং স্টিক হচ্ছে একটা বাঁশের লম্বা লাঠি, তার একমাথায় তারের একটি লুপ। ওস্তাদ এক এক করে আমাদের ডাকে। আমরা চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ে গিয়ে তাকে চার্জ করি- প্রথমে বেয়নেট দিয়ে তার ডান রগে সপাটে মারি: কাট। তারপরই রাইফেলের কুঁদো ডান বাহুর সঙ্গে সাঁটিয়ে নিয়ে, লাফিয়ে উঠে তার বাঁ রগে মারি: বাট। ওস্তাদ মাটিতে পড়ে গেলে তার বুক্টা ফুঁড়ে দিয়ে, বেয়নেট টেনে বার করে এগিয়ে যাই। অন গার্ড।

আসলে যা ঘটে তা হল: ডান রগে কাট মারার আগেই ওস্তাদ একপা পিছিয়ে নিজেকে বাঁচায়। পরমুহূর্তেই দ্রুত কদম নিয়ে যখন লাফ দিয়ে তার বা রগে বাট মারি তখন আরো একপা পিছিয়ে ট্রেনিং স্টিক দিয়ে আঘাতটা আলতো করে ঠেকিয়েই লুপের দিকটা নামিয়ে ধরে যেন ঐটে ভূপাতিত শত্রুর বুক। আমরা ঐখানে বেয়নেট চালিয়ে উইদড্র করে চলে যাই।

এতগুলো লাফঝাপের অনুক্রমে কোথাও একটু ভুল তো হতেই পারে। কিন্তু ভুল থাকলে ওস্তাদ ছাড়ে না, শুরু থেকে ফিরে ফিরে করায়। নিজের ডান রগে বা রগে চাপড় মেরে মেরে বলে- য়হাঁ মারো, য়হাঁ মারো।

– লেগে যাবে, ওস্তাদ।

— কই ফিকর নহী। আমার শরীরের জিম্মাদার আমি।

একদিন, এইরকম আমাদের তিন-চারজনের কিছুতেই হচ্ছিল না। ওস্তাদ ফিরে ফিরে করাচ্ছে। পরিশ্রমে রৌদ্রে আমার হাতপা কাঁপছিল। যাদের ঠিকঠাক হয়েছে তারা বসে বসে দেখছে। পাঁচ-ছ বার ফিরে ফিরে করার পর মাথায় যেন খুন চাপে। হাঁ মারো, য়হ মারোE দেব নাকি শালা বা রগে রাইফেলের একখানা বাট জমিয়ে! কিন্তু ট্রেনিং স্টিক বাগিয়ে ধরা ছিপছিপে তাজ খানের রোদে পোড়া মুখ দেখে মায়া লাগে।

পাঠানরা অন্যরকমের লোক। গ্রামের কেউ দেখা করতে এলে কী যে খুশি হয়– চেঁচিয়েমেচিয়ে, বুকে জাপটে ধরে, আনন্দে অশ্লীল কথার বান ডাকায়। তার পর যেখান থেকে পারে উৎকৃষ্ট খাবার কিনে আনে। পাঞ্জাবী মুসলমানেরা একেবারে অন্য গোষ্ঠীর, এই খোলামেলা বিমল আনন্দ তাদের নেই।

.

 জলে, ফাটলে সেতু বানানো

এর পর ট্রেনিং সম্পূর্ণ করার জন্য তিন বারে আমাদের তিনটি জনহীন, অন্য স্বভাবের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল।

সৈন্যেরা যুদ্ধ করতে যাবে, জমি দখল করবে, ঘাঁটি গাড়বে তার জন্যে তাদের রাস্তা চাই, নদীনালার উপর সেতু চাই, বাংকার চাই, ট্রেঞ্চ চাই, এয়ারবেস চাই, হেলিপ্যাড চাই। এসব তৈরি করবে, রক্ষণাবেক্ষণ করবে স্যাপার্স অ্যান্ড মাইনার্স।

তাছাড়া, যুদ্ধে সৈন্যেরা তো একা যায় না– সঙ্গে যায় সাঁজোয়া গাড়ি, ট্যাংক, জিপ, ওয়েপন ক্যারিয়ার, বিমানধ্বংসী কামান, গুলিগোলা, অস্ত্রশস্ত্র, খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ, তাঁবু এবং আরও বিচিত্র সব সরঞ্জাম। মূল ঘাঁটি থেকে, এগিয়ে যাওয়া প্রথম দলটি পর্যন্ত, সরবরাহের পথ যাতে কখনও বন্ধ না হয় সেইজন্যে রাস্তাঘাট সুগম এবং নিরাপদ রাখা অত্যন্ত জরুরি। শত্রুরা যদি কোথাও রাস্তার দখল নিয়ে সাপ্লাইলাইন কেটে দিতে পারে তো অগ্রবর্তী সৈন্যদলের বিপদ অবশ্যম্ভাবী।

অতএব বেপোট জায়গায় রাস্তা এবং ছোট নদী ও খাদের উপর সেতু তৈরি করা শেখাতে, ছাউনি থেকে বহুদূরে একটা অদ্ভুত ধূ ধূ জায়গায় আমাদের এক সপ্তাহের জন্য নিয়ে যাওয়া হল।

সকালবেলা রওনা হয়েছিলাম, দুপুর পেরিয়ে গেল পৌঁছতে। কোথাও হালকা বসতির পাড়াগাঁ, কিছু কিছু গমের খেত, অনেকটাই ফাঁকা ঘাসহীন মাঠ– এইরকম একটা দেশের রাস্তা ধরে গাড়ি চলল। ষাট বছর আগেকার সেইসব পথের কথা ভাবি আর মনে হয় কত জনশূন্য ছিল পৃথিবী তখন।

যেখানে এসে গাড়ি থামল সেই জায়গাটা যেন মঙ্গল গ্রহের একটা টুকরো শক্ত গাঢ় লাল মাটি, তাতে কয়েকটা গভীর ফাটল, আর অনেকখানি জায়গা জুড়ে একটা এলোমেলো বিস্তীর্ণ ঝিল বা হ্রদ। সেই ঝিলে জল টলটল করছে। তীরের লাল রং আর আকাশের ধোয়াটে রঙের ছায়া পড়েছে জলে। কোথাও একটা গাছ নেই, অতখানি জলে কোথাও একটা জলচর পাখি নেই। জলের কিনারায় কাঠের হালকা জেটি, চার-পাঁচখানা বিদেশী ধরনের নৌকো বাঁধা। লঙ্গরখানার জন্য একটি চালাঘর সমাজ-স্বজনহীন সেই। হু হু করা জায়গার ঐটুকু ঘরেও হিন্দু-মুসলমানের আলাদা হেঁশেল। দূরে দুটো সাদা তাঁবু, সেখানে ওস্তাদেরা থাকে।

দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষ হলে আমাদের ছোট ছোট তাঁবু দেওয়া হল, নিজেদেরই খাঁটিয়ে নিতে হবে। ছোট্ট সরলতম তাঁবু তার মধ্যে মাটিতে বিছানা পেতে দুই সারিতে তিনজন তিনজন ছজন শোব। তাঁবু খাটাবার কয়েকটা নিয়ম আছে- বড় খুঁটিগুলো গভীর করে পুঁততে হয়, টানা দেবার ফিতে শক্ত করে আটকে লোহার খুঁটোগুলি হাম্বর মেরে মেরে মাটিতে শেষ পর্যন্ত সেঁধিয়ে দিতে হয়। সবাই মহোৎসাহে ঘন্টা দেড়েক ধস্তাধস্তি করে তাঁবু খাটাল, আর আমরা দুজন বাঙালি আগের ব্যাচের ফেলে যাওয়া গর্তে খুঁটি পুঁজে তাঁবুটাকে দশ মিনিটে দাঁড় করিয়ে ঝাড়াহাতপা হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।

পরের দিন সকালে আমাদের বেইলি ব্রিজ বানানো শুরু হল। একটা গভীর এবং চওড়া খাদের দুই পাড় লেভেল করে দুটি ফালক্রাম হিসেবে সেখানে বেয়ারিং বসানো হল। তার পর স্ট্রাকচরল সেতুটির টুকরো টুকরো প্রিফ্যাব্রিকেটেড অংশ জোড়া দিয়ে দুই পাড় থেকে সেতুটি বানাতে বানাতে এগিয়ে যাওয়া। ব্যাপারটা সহজ: প্রত্যেক বারে সেতুর যতটা অংশ জোড়া হয় তার অর্ধেকের কম বেয়ারিংয়ের উপর দিয়ে ঠেলে দিই খাদের শূন্যতার দিকে। এইভাবে বার বার জোড়া দেওয়া আর ঠেলে এগিয়ে দেওয়া। ক্রমশ দুই তীর থেকে দুটি ক্যান্টিলিভার এসে খাদের মধ্যশূন্যে যখন মেশে তখন তাদের যুক্ত করে আটকে দিলেই হল। এখন অনায়াসে এর উপর দিয়ে সৈন্যদল মার্চ করবে, ভারী গাড়িও নির্ভয়ে চলে যাবে। এই সেতুর সমস্তটাই আগেভাগে বানিয়ে রাখা লৌহকাঠামো, শুধু জুড়ে দিলেই হল।

বেইলি ব্রিজ বার কয়েক তৈরি করা এবং খুলে ফেলার পর শেখানো হল জলের উপর ভাসমান সেতু বানানো। হুগলি নদীর উপর পনটুন ব্রিজ তো আগেই দেখেছি, এই ভাসমান সেতু প্রায় সেইরকমই। এই কাজে বিকেল পর্যন্ত আমাদের কত বার যে ঝুপঝাঁপ জলের মধ্যে নেমে যেতে হয়। কিন্তু ভালো লাগে। খুব হালকা, নির্মল জল। উঠে এলে এক মিনিটে গা শুকিয়ে যায়, দশ মিনিটে প্যান্ট শুকিয়ে যায়। হাওয়া দেয় হ্রদের ছোট ছোট ঢেউ দূর থেকে ভাঙতে ভাঙতে কাছে এসে ছলাৎ ছলাৎ করে লাগে।

বিকেলটা এখানে ভারি সুন্দর ধূ ধূ দিগন্ত ছাড়িয়ে সূর্যাস্তে মিশে গেছে আরক্ত গিরিমাটি, রেড ওকার। মাটির ঢেউ, দীর্ঘ ফাটল, জলে নেমে যাওয়া পাথুরে রেখাগুলি নরম, ক্রমশ আবছা। সূর্য ঝিলের জলে অর্ধেক ডুবেছে। ফলে এই মুহূর্তে আকাশে জলে আর স্থলে এক অদ্ভুত আভা। এই দিনশেষের আলোয় মন ছিঁড়ে ছিঁড়ে ব্যথিত হতে থাকে।

কিন্তু সকালবেলায়, ঘুম থেকে উঠে, কোনো কষ্ট আর মনে পড়ে না দিন শুরু হয়ে যায়।

তৃতীয় দিনে দুপুরবেলায় একটা মজার ঘটনা ঘটল, আমাদের উচিতশিক্ষা হল। খাওয়াদাওয়ার পরে জলে নেমে কাজ করছিলাম, হঠাৎ দেখলাম দূর দিগন্ত থেকে একটা মেঘের মতন ছায়া এগিয়ে আসছে। এতদিনে আমার এক বার আঁধির অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। ছুট ছুট ছুট জল থেকে উঠে ছুটে গিয়ে তাঁবুতে ঢুকে যে-যার কম্বল মুড়ি দিলাম। আধ মিনিটের মধ্যে আঁধি এসে এক ঝটকায় খাকি তাঁবুটাকে শূন্যে তুলে ফেলল। আলাদিনের জাদু-কার্পেটের মতো সেটা আকাশে উঠল আর আমরা দুজন তার কিনারা ধরে লটপট করে ঝুলতে লাগলাম, যাতে সেটা হাতছাড়া হয়ে না উড়ে যায়। ধুলো আর পাথরকুচির ছররা বর্ষণ করে মিনিট তিনেক পরে আঁধি চলে গেল। আমরা বিধ্বস্ত হয়ে মাটিতে নামামাত্র তাঁবুটা নেতিয়ে ঝুপ করে আমাদের উপর পড়ল। সবাই আমাদের অবস্থা দেখে হেসে আকুল। বুদ্ধিমানের মতো আমরাও তাদের সঙ্গে খানিকটা হেসে নতুন করে এবং এবার শক্ত করে তাঁবু খাটাতে লাগলাম। আমাদের কম্বল, জামাকাপড় এবং মেস-টিন দূরে দূরে উড়ে গিয়েছিল, সন্ধ্যা নামার আগেই আবার সেগুলো খুঁজেপেতে নিয়ে এলাম।

সপ্তাহের শেষদিকে আমরা রেকি বোট চালাতে শিখলাম। রেকি বোট হচ্ছে হাওয়া ভরা রবারের নৌকো। কিছুতেই ডোবে না, কিন্তু একটু এদিক ওদিক হলেই উলটে যায়। বসে বসে বৈঠা বাইতে হয়। আমার বর্ষাকালে তালডোঙা আর কলার ভেলা বাইবার কথা মনে পড়ে।

.

চাঁদমারির মাঠে

রাইফেল ট্রেনিংয়ের শেষ পর্যায়ে আমাদের আবার এক সপ্তাহের জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে অনেকগুলি দূর চাঁদমারির রাইফেল রেঞ্জ। যখন-তখন গুলি চলার কারণে ঐ বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে লোকালয় উচ্ছিন্ন। ক্রমশ জায়গাটা পোড়ো জঙ্গলের রূপ নিয়েছে। দূরে দূরে গ্রাম। গ্রামের লোকজন ভুলেও এদিকে আসে না। এখানে খাকি রঙের কয়েকটা বড় তাঁবু, ভিতরে সার সার চারপাই। সব বন্দোবস্ত করাই ছিল। তিনটে তাঁবুতেই আমাদের। পুরো প্ল্যাটুনের জায়গা হয়ে গেল। এই প্রথম, এখানে দেখছি ডিসিপ্লিনের তেমন কড়াকড়ি নেই। এর কারণ কি এই যে সারা দিন আমাদের কাছে রাইফেল আছে এবং সকাল থেকে সন্ধে আমরা চাঁদমারির মাঠে মুড়িমুড়কির মতো থ্র নট থ্রী কার্তুজ ওড়াই। এখানে গুলির হিসেব কেউ চায় না, খোল জমা দিলেই হল। ফ্রন্টে তাও দিতে হয় না। সুতরাং সেখানে হেঁদো ডিসিপ্লিনের কথা বলবে এমন বুকের পাটা কার!

সেটা ছিল প্রথম শীতের সময়। সকালে উঠে যার ইচ্ছে করে না সে দাড়ি কামায় না, অগোছালো হাফপ্যান্ট বুশশার্ট পরে রাইফেল নিয়ে মার্চ করে রেঞ্জে যায়। মার্চ করা রক্তে মিশে গেছে তাই ঘুমোতে ঘুমোতে গেলেও পা ফেলায় ভুল হয় না। চারদিকে তাকাতে তাকাতে যাই। দেখি, উঁচু নিষ্পত্র গাছে শকুন বসে আছে, ঝোপে ছোট্ট কালো পাখি ইতিউতি নেচে বেড়াচ্ছে। আমার বাঁ চোখ নিয়ে এখনও সমস্যা কখনও বন্ধ হয়, কখনও হয় না।

এই কদিনে অনেক রকম অভ্যাস করা হল। সবচেয়ে প্রশস্ত হল উপুড় হয়ে শুয়ে বালির বস্তার উপর হাত এবং রাইফেল রেখে তাক করা, তার পর আছে হাঁটুগাড়া পজিশন, তার পর দাঁড়ানো পজিশন। চাঁদমারিও কয়েক রকম সাধারণ সহজ চাঁদমারি হল টার্গেটের কেন্দ্রে গুলি করা। কেন্দ্র থেকে গুলি যত দূরে লাগবে তত নম্বর কাটা যাবে। এর পর হল পুঞ্জ গুলিবর্ষণ– এই চাঁদমারিতে প্রথম গুলিটি যদি টার্গেটে কেন্দ্র থেকে একটু দূরেও লাগে তাতে খুব ক্ষতি নেই, কিন্তু পরবর্তী কার্তুজগুলি যেন সেই প্রথম আঘাতের গায়ে গায়ে লাগে। এর পর আছে স্ন্যাপ শুটিং। এতে লক্ষ্যবস্তু এত দ্রুত আবির্ভূত এবং তিরোহিত হয় অথবা এত দ্রুত জায়গা থেকে সরে যায় যে ঝটপট তাক করতে না পারলে মারা যায় না।

এখানে চতুর্থ রাত্রে আমার একটি অভিজ্ঞতা হল। সারা দিন যার যার রাইফেল তার তার কাছে থাকে, দিনের শেষে সেগুলো জমা পড়ে। তাঁবু থেকে একটু দূরে দুটো-বড় গাছের অন্ধকার ছায়ায় বাঘের খাঁচার মতো একটা লোহার খাঁচা- তার মধ্যে শিকল-তালা পরিয়ে রাইফেলগুলোকে আটকে রাখা হয়। খাঁচার সামনে মাটিতে ট্রেঞ্চ খোঁড়া, বালির বস্তা সাজানো। রাত্রে সেখানে এক-এক জনের দু ঘন্টা করে সান্ত্রীর ডিউটি পড়ে। সে রাত্রে আমার ডিউটি। গভীর রাতে গভীর করে শীত নেমেছে। আমি বাঘের খাঁচাকে এক বার প্রদক্ষিণ করে এলাম। সব ঠিক আছে। আগের সান্ত্রী চলে গেল। এখন কি করি! আমি খাঁচার চার দিকে পা মেপে মেপে ঘুরতে লাগলাম। ঘাড়ে আর কানে শীতের কামড় টের পাচ্ছি। গ্রেটকোটের কলার তুলে ঘাড় আর কান যতটা পারি ঢেকে নিলাম। ট্রেঞ্চে নেমে দেখি ঠাণ্ডা অনেক কম। বালির বস্তায় জুত করে বসি। মাটির গর্ভটি সত্যিই বড় আরামের। সময় কাটবে না বুঝেই গ্রেটকোটের পকেট ভরে তিলের রেউড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। অন্ধকারে গর্তে বসে একটি একটি করে সেই রেউড়ি খাই। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি গাছের ঝুপসি পাতায় গাঢ় অন্ধকার, পাতার ফাঁকে তারাগুলি কখনও নিবুনিবু, কখনও স্পষ্ট। দূরে কাছে কোথাও একটা পোকার ডাকের শব্দ নেই।

ফৌজে গেলে কি হবে, তখনও আমার ভূতের ভয় যায় নি। তাঁদের কথা শুধু মনে পড়ে নি বলেই এতক্ষণ ভয় পাই নি। এখন চমকে উঠে হঠাৎ দেখলাম, আকাশ থেকে কি যেন একটা লাফিয়ে নামল গাছের উপর। উপরের শুকনো ডাল ভেঙে পড়ল নিচের ডালে। কঁ কঁ কঁ কঁ করে অশরীরী কেউ তীক্ষ্ণ স্বরে ককিয়ে উঠল। ভয়ে হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়েই আবার স্টার্ট নিয়ে ধকধক করে চলতে লাগল। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মতোই আমি কিছু না ভেবে বেল্টের খাপ থেকে এক চার্জল গুলি বার করে ম্যাগাজিনে ভরি, একটা গুলি চেম্বারে ঠেলে দিই। ট্রিগারে আঙুল রাখতে রাখতেই আমার সাহস ফিরে এল। আশ্চর্য! এতটা ভাবি নি গুলিভরা রাইফেল দিনের আলোর মতো, হাতে থাকলে ভূতের ভয় মিলিয়ে যায়।

আস্তে আস্তে আমার স্নায়ু নিরুদ্বেগ হল। দিনের বেলা লম্বা একটা গাছে শকুনি দেখেছিলাম হয়তো সেটাই বা অন্য কোনো রাতচরা পাখি এই গাছের উপর নেমেছিল, ডালটা হয়তো শুকনো ছিল, ভেঙে পড়েছে। আমি সেফটি ক্যাচটা টেনে দিয়ে রাইফেলটি দুই হাঁটুর মধ্যে রেখে পকেট থেকে আবার রেউড়ি বার করে খেতে লাগলাম। অন্ধকারে তাকিয়ে আছি স্নায়ু শান্ত হয়েছে। শীতে পাতা খসে পড়ে তার হালকা শব্দ, উলটে-পালটে পড়া আমি টের পাই।

.

 লড়াই শিক্ষা

অ্যাসল্ট কোর্সের পরে, এবং সবশেষে ছিল ব্যাটল ট্রেনিং। এতকাল ধরে ব্যাটলই তো শেখানো হল, তবে আবার কেন এই পনের দিনের ব্যাটল? হয়তো এটাই লড়াইয়ের পরম শিক্ষা: সাপের মতো, কাঁকড়ার মতো কি করে হাঁটতে হয়, চরম অবস্থায় কি করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু মানুষ মারা? অসম্ভব। দাঙ্গা বা গ্ল্যাডিয়েটারদের আখড়া ছাড়া ঐ জিনিস হাতে কলমে শেখানো যায় না।

যাচ্ছিলাম গাড়িতে, হঠাৎ পাঠানকোটের আশেপাশে কোথাও আমাদের নামিয়ে দিয়ে বলা হল- হাঁটো। রাস্তা দিয়ে ফাঁকা গাড়ি চলল আর আমরা হাঁটতে লাগলাম। যেখানে ট্রেনিং হবে সে জায়গাটা ঢেউ খেলানো উঁচুনিচু, কোথাও জঙ্গল, কোথাও ঘাসে মোড়া ছোট টিলা। নানা খোপে নানা কৌশল ও হরকত করার ফাঁদ পাতা আছে। তখন শীতের দিন। এই বনপ্রদেশে আরো শীত পড়েছে। জামাকাপড় ছাড়া হয় না, স্নান করা হয় না- জলের খরচ খুব কম। তবু তার মধ্যেও দু দিন এক ওয়াটার বটল জল র‍্যাশন করে দেওয়া হল। হাত ধোও, মুখ ধোও, খাও, সবই ঐ এক বোতল জলের মধ্যে। খাওয়াদাওয়া মোটামুটি ছিল, কিন্তু এর মধ্যে তিন দিন আমাদের প্রায় না খাইয়েই রাখা হল। প্রথম দিন লম্বা রুটমার্চ ছিল- পথের মধ্যে, দুপুরে, তৈরি খাদ্যের বদলে প্রত্যেককে কিছুটা কাঁচা আটা আর ডাল দিয়ে বলল- বেঁধে খাও। এই বিভূঁইয়ে কি করে রান্না হবে তারও পদ্ধতি বাতলে দিল- জঙ্গল থেকে শুকনো ডালপালা ভেঙে আনন, মেস-টিনে আটা মাখো, আগুন জ্বালো, মেস-টিনের উলটো পিঠে রুটি সেঁকো, মেস টিনে ডাল সেদ্ধ করো।

কাঁচা আটা কাঁচা ডাল হাতে নিয়ে মনে হল ছুঁড়ে ফেলে দিই। হঠাৎ সত্যনারায়ণের সিন্নির কথা মনে পড়ল। আমি একটা গাছের আড়ালে গিয়ে আটায় জল ঢালোম, প্যান্টের পকেটে মিষ্টি রেউড়ি ছিল, তার গোটা কয়েক সেই আটায় দিয়ে সিন্নি বানিয়ে আরামে বসে খেতে লাগলাম। রান্না না করায় একটু সময়ও জুটেছে। শীতের দুপুরে, ময়লা পোশাকে, ফেক্টে মোড়া জলের বোতল মাথার নিচে দিয়ে গাছতলায় শুয়ে আছি। আঃ আহা, জীবন বড় চমৎকার জিনিস। আঃ, রাস্তার দিক থেকে শিখ জাঠ আর মুসলমানদের গরম রুটি সেঁকার তাজা গন্ধ আসছে।

এর পর এক দিন আধপেটা খাইয়ে রাখা হল। বলা হল, রসদে ঘাটতি পড়েছে। আর এক দিন কুকুরের বিস্কুটের মতো কয়েকখানা বিস্কুট জুটল। এই করে খাবার কষ্টের প্রশিক্ষণ হল। শুনলাম, জাপানিরা নাকি ফ্রন্টে শুকনো ভাত সঙ্গে নিয়ে আসে, খিদে পেলে ভিজিয়ে খায়। আমার তো মনে হয়, এরকম ক্ষেত্রে লোকায়ত চিড়েগুড় বা ছাতুলঙ্কা নিয়ে যুদ্ধযাত্রাই বা মন্দ কি। একটা দৃশ্য কল্পনা করে মনে মনে খুব হাসি : একদল তোক ন্যাংটো, ন্যাড়া মাথা, কাঁধে চিড়েগুড়ের থলে, হাতে রাইফেল– যুদ্ধে চলেছে। তার উপর, তারা যদি আমার মতন বাঁ চোখ বুজে ডান চোখে তাক করতে পারে তো কেল্লা ফতে!

শত্রুর ঘাঁটি বা গুরুত্বপূর্ণ চৌকি দখল করতে গেলে যতদূর পারা যায় দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে বা গা ঢাকা দিয়ে এগোও তার পর অজানিতে অপ্রস্তুত অবস্থায় আক্রমণ করো। কিন্তু বিপক্ষও তো সজাগ অতএব নড়াচড়ার ঢেউ চাপা দিয়ে, মাটিতে শুয়ে বুকে হেঁটে এগোও। শেষে বিপক্ষ সৈন্যকে ঠেলে দূরে রাখতে এবং নিজেদের দলকে নিরাপদে আরও এগিয়ে দিতে পিছন দিক থেকে কাভারিং ফায়ার দাও।

কাভারিং ফায়ারের নিচে আমাদের ক্রল করা শিখতে হল। কাভারিং ফায়ার দিত ওস্তাদেরা। শুরু করার আগে তারা বার বার সাবধান করে দিত- খবরদার, মাথা তুলো না। যদি দ্যাখো মাথা না তুলে এগোতে পারছ না- তো এগিয়ো না, উপুড় হয়ে শুয়ে থেকো। আমরা ক্রলিং শুরু করার পরে হুইসল বাজত, আর তার পরই শব্দ শুনতে পাই মাথার উপর দিয়ে গুলি ছুটে যাচ্ছে- সক সক সক সক। মাথার উপরে ঘাসের ডগা কাঁপে। খোলা মাঠে গুলির শব্দ তীক্ষ্ণ শিসের মতো শুনি। খানিকক্ষণ পরে আবার হুইসল বাজে অল ক্লিয়ার।

জঙ্গলে সামান্য গাছের আড়ালে বা ঝোপে কি করে নিজেকে লুকোতে হয়, মাইন কিভাবে পাততে হয়, খুঁজে দেখতে হয়, কি রকম ভঙ্গিতে গ্রেনেড ছোড়ে সারা দিন এইসব, তার উপর রাত্তিরেও জ্বালাতন। টিলার মাথায় আমাদের থাকার বন্দোবস্ত। কিন্তু প্রায়ই গভীর রাত্রে টিলার গোড়ায় দাঁড়িয়ে ওস্তাদেরা হুইসল বাজায়। হুইসল শোনামাত্র ঘুমচোখে দুদ্দাড় করে নিচে নেমে এসে দাঁড়াতে হবে। কোনো জরুরি কিছু না–একটি নিরিমিষ রোল কল হবে তার পর ডিসমিস। আবার উপরে ওঠো, আবার নতুন করে ঘুমোও। নিচে নেমে আসতে এক মিনিট দেরি হলে ওস্তাদ শীতের রাত্রে অন্ধকারে পাঁচ মিনিট দাঁড় করিয়ে রেখে বক্তৃতা দেবে। আমরা সবাই তাড়াতাড়ি নামি, কিন্তু আউধবিহারী সুস্থি লোক, তার দেরি হবেই। একদিন ঘোর অন্ধকারে বাঁশির ডাকে নেমে দেখি, আউধবিহারী সবার আগে এসে গেছে। ব্যাপার কি? আউধবিহারী বলল, অন্ধকারে ঘুমের ঘোরে পা হড়কে গেল আর সোজা গড়িয়ে এখানে চলে এলাম। এর পর থেকে আউধবিহারী রাত্রে এবং দিনেও গড়িয়েই নামত। এই হল কঠিন কাজের সহজ সমাধান।

দু সপ্তাহ এরা এমন খাটুনি খাটাল যে আমাদের মেজাজ ও মন নিজেদের অজান্তেই একটু একটু করে পালটে গেল। এইভাবেই সৈন্যদের নিজস্ব জীবনদর্শন তৈরি হয়, আচরণও বদলায়।

আমাদের তিন নম্বর কনস্ট্রাকশনে পঁচিশ-তিরিশ ফুট উঁচু থেকে হনুমানের লেজের মতো মোটা দড়ি ঝোলানো ছিল সেই দড়ি বেয়ে উঠে, শূন্যে মাত্র দুখানা দড়ির লম্বা সাঁকো, সে সাঁকো পা রাখলেই দোলে। সেই দোলা-সাঁকো পেরিয়ে ওমাথায় আবার লম্বা দড়ি বেয়ে নেমে আসা। তার পর ফুট তিনেক উঁচুতে খুঁটির উপর ছ ইঞ্চি তক্তার জিগজ্যাগ সাঁকো সেই সরু তক্তার উপর দিয়ে বুটপট্টি পায়ে, পিঠে পিঠঠু এবং কাঁধে স্লিং করা রাইফেল নিয়ে এঁকেবেঁকে দৌড়ে যাওয়া। শেষে ন-দশ ফুট উঁচু বাঁশের দেয়াল এবং ভাঙা কাঁচ ও কাঁটায় ভরা এক চওড়া খানা লাফিয়ে ডিঙোনো। খানাভরতি ভাঙা কাঁচ আর মারাত্মক কাঁটা দেখে আমরা দৌড়ে গিয়ে থমকে যাই। ওস্তাদেরা বলে- লাফাও, লাফাও। খানায় পড়ে যদি হাতপা ভাঙে, কাঁচে যদি বুকপেট কাটে তো তোমার কি? হাড় জোড়া দেবে ডাক্তারসাহেব, সেলাইফেঁড়াই করবে ডাক্তারসাহেব, তনদুরস্তি করে দেবে নার্স মেট্রন। তুমি তো শুধু হাসপাতালে আরামে শুয়ে থাকবে। দেখেশুনে ক্রমশ আমারও বিশ্বাস হতে থাকে আমার শরীরের জিম্মাদার আমি নই, ফৌজ।

.

কসম প্যারেড

ট্রেনিং শেষ হল। একজন কমব্যাটান্ট সৈন্যের মোটামুটি যা যা শিক্ষণীয় সব শেখানো হয়েছে। এবার কসম প্যারেড হবে। যারা শপথ নেবে তারা সেদিন সরস্বতী পুজোর ছেলেদের মতো সকালে চানটান করে, চুলে গন্ধতেল মেখে, কড়া ইস্ত্রি করা পোশাক, আয়নার মতো চকচকে বুট আর ব্রাসো ঘষা পিতল পরে প্যারেডের মাঠে এল। সেই প্যারেডে আমাদের সমস্ত কোম্পানি, সমস্ত ব্যাটেলিয়ান- প্রায় পনের-কুড়ি হাজার সৈন্য এসে অংশ নেয়। ব্যান্ডমাস্টার তার দল নিয়ে সেজেগুজে বাজনা বাজিয়ে মার্চ করে। আমরা যারা কসম নিতে এসেছি তারা খুব সহজ হালকা ছন্দে প্যারেড করি এতদিনে আমাদের পা ফেলা, হাত দোলানো, ডাইনে বাঁয়ে ঘোরা, শোল্ডার আর্ম, প্রেজেন্ট আর্ম যন্ত্রের মতো নিখুঁত এবং মনোহীন হয়েছে।

কি কসম খেয়েছিলাম মনে নেই। তার ভাষা কি ছিল, উর্দু না ইংরেজি তাও মনে নেই।

বিকেলে, ছায়া পড়লে, সেদিন একটি অন্য রকম ঘটনা ঘটল। ওস্তাদ মহম্মদ শফি আর আবদুর রহমান ভাঁজ ভাঙা সালোয়ার শার্ট আর অভ্রের কুচিতে চিকমিকে পাগড়ি পরে, যেন সামাজিকতা রক্ষা করতে প্রসন্ন লাজুক মুখে আমাদের ব্যারাকে এল। আমরা খুব খাতির করে তাদের চারপাইতে বসালাম।

ওস্তাদেরা আমাদের তুমি করে বলত, এখন হঠাৎ আপনি দিয়ে শুরু করল- এতদিন আপনাদের আমরা কড়া কথা বলেছি, ধমকধামক দিয়েছি, পরিশ্রম করিয়েছি, কষ্ট সইয়েছি শেখাবার জন্যে, ডিসিপ্লিনের জন্যে এসব আমাদের করতে হয়েছে। আজ ওস্তাদ ও ছাত্রের সম্পর্ক আমাদের শেষ হল। এখন আমরা বন্ধু। আমাদের কোনো কথায় যদি কারো মনে কোনো কষ্ট হয়ে থাকে তবে তার জন্যে আমরা মাফ চাই। মনে কোনো রাগ। পুষে রাখবেন না। শফি চমৎকার কথা বলে। আমরা বললাম- আরে না, না, এ কী বলছেন! আপনারা চিরদিনই আমাদের ওস্তাদ থাকবেন। দুই ওস্তাদই এক এক করে প্রত্যেকের সঙ্গে করমর্দন করল। আমাদের চোখে প্রায় জল এসে গেল।

এর পর আমরা দু মাসের ছুটিতে বাড়ি যাব। নিশ্চয় ওস্তাদরাও যাবে।

.

 ছুটির তোড়জোড়

ছোট ছোট চুলের সঙ্গে প্রায় এক বছরের না কামানো কোঁকড়ানো দাড়িগোঁফ- এতদিন পরে এই চেহারা নিয়ে কলকাতায় ফিরব? যাই, আজকেই সদর-বাজারের সেলুন থেকে দাড়িগোঁফটা কামিয়ে আসি গে।

আমার মতলব শুনে ভাগ সিং বলল- এতকালের দাড়িগোঁফ, দেশের লোককে একবার দেখাবে না? তবে যদি নাই দেখাও, এর একটা ছবি অন্তত নিয়ে যাও। এসো, তোমাকে পাগড়ি বেঁধে দিই- পাটিয়ালা স্টাইল না অমৃতসর স্টাইল? ভাগ সিং তার নিজের পাগড়ির কাপড় লম্বা করে ভাঁজ করল। আমার দুই কান ঢেকে পাগড়ি বেঁধে দিয়ে সামনে আয়না ধরল : উনিশ-কুড়ি বছরের কালোকোলো তাজা এক বাচ্চা শিখ!

ভাগ সিং, পাল সিং আর আমি তিন শিখ প্রাণ খুলে হাসতে হাসতে বেরুলাম। প্রথমে সদরের একটা স্টুডিওতে গিয়ে গোটা তিনেক ছবি তোলা হল, তার পর একটু ঘোরাঘুরি, একটু খাওয়াদাওয়া। অতঃপর শেষ দ্বিধা ঘুচিয়ে একটি নিরিবিলি সেলুনে ঢোকা। ষাট বছর আগে, প্রাকস্বাধীন ভারতবর্ষে, খোদ লাহোর শহরে তিনজন শিখ ছোকরা নাইয়ের দোকানে ঢুকল- ব্লাসফেমির এই দৃশ্য অচিন্তনীয়। নাপিত হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেখে তাড়াতাড়ি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম দাড়ি কামাব। আয়নার সামনের চেয়ারে বসে পাগড়ি খুললাম- নাপিত তখনও হাঁ করে আছে। যা হোক, আমার নরম দাড়ি ক্ষুরের দুই টানেই সাফ হয়ে গেল।

কিন্তু ফেরার সময়ে এক মুশকিল- দাড়িগোফহীন মুখে শিখপাগড়ি কী যে অশ্লীল কি বলব! আমার মন খারাপ হয়ে গেল লুকিয়ে, কোনোক্রমে গা ঢাকা দিয়ে আমি ব্যারাকে ফিরলাম। পাগড়ি খুলে ফেলার পরে চেহারা খানিকটা ধাতস্থ হল। তবু যে আমাকে দ্যাখে সেই খানিকটা অবাক হয়, তার পর হা হা করে হাসে।

সন্ধেবেলার রোল-কলে সেই বুড়ো সুবাদার এসে আমাকে ধরলেন– কি হল বেটা, তোমার ধর্মের কি হল?

আমি চুপ করে রইলাম।

 –চুঃ চুঃ, দাড়ি কামিয়ে তুমি ঠিক কাজ করো নি।

আমি চুপ।

–আগে কেমন শেরের মতো দেখাত, এখন চুহার মতো দেখাচ্ছে।

.

ড্রইং অফিস, ফৌজি স্কুল, যুদ্ধের শেষ পর্ব

দু মাস ছুটি কাটিয়ে ফিরে এলে আমার কাজের শেডিউল পালটে গেল। এখন সকালে প্যারেডের মাঠের বদলে কারখানায় যাই। সেখানে ড্রইং অফিসে দুটো কামরা। একটা কামরায় আমি আর বিল নামের এক ব্রিটিশ কর্পোরাল বসি। ঘরে দুটো মাত্র ড্রইং বোর্ড, দুটো স্টুল, দুটো টেবিলপাখা– সব একটা করে বিলের আর আমার। আমাদের কাজ বেশি নেই। বিল ফৌজি সংস্করণ গল্পের বই নিয়ে আসে। বই পড়ে আর কলাই করা মগে সবুজ আর কালো আঙুর ভিজিয়ে খায়। তার ঠোঁট দুটি মেয়েদের লিপস্টিক মাখা ঠোঁটের মতো লাল। নরম স্বভাব, বেশি কথা বলে না, নিজেকে জাহির করে না, আমার বয়সীই হবে সে। তার কাছ থেকে এইচ জি ওয়েলসের দি ইনভিজিবল ম্যান আর আন্দ্রে মারোয়ার দি এরিয়েল নিয়ে পড়েছিলাম। বিল ঘরে বসে থাকলে কখনও মনে হত না যে ঘরে একটা লোক আছে।

বিলকে যেমন মনে আছে তেমনই মনে আছে সার্জেন্ট জর্ডানকে। জর্ডান দীর্ঘকায়, চওড়া হাড়, সুপুরুষ। বিল আসবার আগে এই ঘরে সে একা বসত। তখন তার সঙ্গে একটু-আধটু পরিচয় হয়েছিল। ছুটি থেকে এসে দেখছি, জর্ডান ওয়ারেন্ট অফিসার হয়েছে, অন্য জায়গায় তার সিট। ওয়ারেন্ট অফিসার সেকন্ড লেফটেন্যান্টেরও নিচে, তবু জর্ডান এই কদিনেই পালটে গেছে– হুকুম করে কথা বলে। ফ্রন্টে গেলে এরাই নিজের লোকের হাতে খুন হয়।

কারখানা থেকে ফিরে চা পরোটা আলুহেঁচকি খাই। এর পর কিছু শরীরচালনা করতে হয়। পিটি করতে পারি, বক্সিং লড়তে পারি, হকি বা ভলিবল খেলতে পারি। কিন্তু আমি পিটি-ই করি- ঐটেই আমার পক্ষে সুবিধাজনক। এর পর রাতের খাবার খেয়ে স্কুলে যাই।

ফৌজি স্কুল এক অভিনব, কার্যকর ও সহজ শিক্ষাপন্থা। ফৌজি ব্যারাক যেমন সরল নকশার খোলামেলা বাড়ি, ফৌজি পোশাক যেমন মরুভূমির বালিতে, বনের ঝোপে, নদীর কাদায়, বরফান মুলুকে চুটিয়ে পরা যায় ফৌজি স্কুলের সিলেবাসও সেইরকম উজ্জ্বল, সরল ও প্রাকৃতিক। ভূগোল ইতিহাস অঙ্ক ইংরেজি- এই চারটি ছিল প্রধান বিষয়। নতুন ধরনের কয়েকটা ঝকঝকে পাঠ্য বই পাওয়া গেল। পড়াটা যেহেতু পুরোপুরি ঐচ্ছিক অতএব কুড়ি হাজার লোকের মধ্যে মাত্র কুড়ি-পঁচিশজন ছাত্র হল। আমাদের তিন নম্বর কনস্ট্রাকশন গ্রুপে ফৌজি অফিসার হয়ে কিছু অধ্যাপক ও পণ্ডিত এসে জুটেছিলেন। ওঁরাই পড়াতেন। চমৎকার পড়াতেন। ওঁদের পড়াবার গুণে মন ভালো হয়ে যেত, সময়টা ভালো কাটত: কলমের গাছে গাছে যেন ফল ভরে উঠেছে।

কিন্তু শিক্ষকদের একজন ছিলেন অজ্ঞাতকুলশীল। সে আসত শহর থেকে। লোকটা পাঞ্জাবী মুসলমান, চল্লিশের কোঠায় বয়স, নাসপাতির মতো বর্ণ, পাতলা চুল, রোগা, ইনটেলেকচুয়ালদের মতো না-খাওয়া চেহারা। পড়ানোর বদলে সে এসে শহরের উত্তেজক ঘটনা বলত, এই দেশের উপর মুসলমানদের রাজনৈতিক ও নৈতিক হকের কথা প্রচার করত, উদ্ধৃতি দিয়ে দিয়ে দ্বিজাতিতত্ত্ব বোঝাত। আশ্চর্য! ওকে কি ভারত সরকার মাইনে দিয়ে এইসব প্রচার করার জন্যে রেখেছে? সেটা অসম্ভব। ফৌজে মুসলমানের বিপরীতে হিন্দু ও শিখ মিলিয়ে তোকসংখ্যা অনেক বেশি। নিজেদের মধ্যে কিছু একটা বেধে গেলে ফল হবে মারাত্মক।

এতদিন পরে, এখন সন্দেহ হয়, হ্যাঁ, ওকে বোধ হয় ইংরেজরা মাইনে দিয়ে ঐ জন্যেই রেখেছিল। যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে, এখন পৃথিবী যদি শান্তির মুখ দ্যাখে এই ভয়ে শ্বেতাঙ্গেরা পৃথিবীর নানা জায়গায় মাইন পুঁতে রাখার মতো দেশভাগের ষড়যন্ত্র করে রাখছিল। ১৯৪৭ সালে, যে বছর ভারত ভাগ হল, সেই বছরই ইংরেজরা প্যালেস্টাইনকেও আরব ও ইহুদি বলয়ে ভাগ করার প্রস্তাব দিয়েছিল।

আসলে ফৌজে থেকেও আমরা যুদ্ধের অবস্থা কিছুই জানি না, স্বাধীনতার সূচনায় দেশে যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র চলেছে সে খবরও রাখি না। আমাদের ক্লাবে খবরের কাগজ বলতে শুধু ফৌজি আখবর আসে। রেডিও অবশ্য সব সময়েই খোলা থাকে। কিন্তু ঐ সুদূর যান্ত্রিক গলার কাছে কান পেতে কে বসে থাকবে। ১৯৪৫ সালের অর্ধেকের বেশি চলে গেছে। মুসোলিনি মারা গেছে, হিটলার আত্মহত্যা করেছে, হিরোশিমা নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলা হয়েছে। যুদ্ধে মারা গেছে সাড়ে পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষ। এসব আমাদের কিছুই জানানো হয় নি। শুধু অগাস্টের মাঝামাঝি একদিন শোনা গেল জাপান আত্মসমর্পণ করেছে। অতঃপর ছাউনিতে সার্কুলার দিয়ে তিন দিন নিয়মকানুন ঢিলে, তিন দিন ধরে লঙ্গরখানায় ভোজের খাওয়াদাওয়া। বি ও আর ক্যাম্পে, শুনলাম, ফুর্তির আর মদের স্রোত বইছে।

অক্ষশক্তির জাপান আত্মসমর্পণ করেছে মিত্রশক্তির সাহেবদের কাছে। এর পর কি হবে না হবে তাও সাহেবরাই জানে। আমরা মাইনে পাওয়া সৈন্য, আমাদের এখনও ফ্রন্টে পাঠানো হচ্ছে, যদ্দিন হবে যাব। ব্যাটল ট্রেনিংয়ের সময় বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমাদের শরীর আমাদের না, ভাঙলেচুরলে ওরাই ঠিক করে দেবে। অতএব যুদ্ধ যে থেমে গেল, এবার যে সৈন্যদল ভেঙে দেওয়া হবে এবং বেসামরিক লোক হয়ে যেখানে ফিরে যাব সেই স্বদেশ যে ইংরেজ-ইয়াংকি ও দেশী নেতাদের ইচ্ছায় দু-ভাগে ভাগ হয়ে যাবে এবং তার পর যে আরো বীভৎস ঘটনার অবতারণা হবে সেসব ছিল আমাদের কল্পনার বাইরে। দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রচারক ঐ পাঞ্জাবী মুসলমানটি ছিল দু বছর পরের দেশভাগ ও খুনোখুনির একজন অগ্রদূত। প্রথমদর্শনে তাকে চিনতে পারি নি।

সৈন্যেরা হুকুমে চলে, সুতরাং ফ্রন্টে যদি কোনোক্রমে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তো মহা মুশকিল। জাপানের আত্মসমর্পণের সময় বিভিন্ন দ্বীপে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা জাপানি সৈন্যেরা খবরও পায় নি, নতুন হুকুমও পায় নি বলে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরেও তারা যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। এ বিষয়ে একটা অদ্ভুত ঘটনা বলি।

জাপানি ঘাঁটি প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জগুলির কোন কোন ছোট দ্বীপ ছিল সম্পূর্ণ জনহীন। যুদ্ধ শেষ হবার তিন-চার বছর পরে ছোট একটি ট্যুরিস্ট দল বা সার্ভে পার্টি ঐরকম একটি বিজন দ্বীপে গিয়েছিল। দু-এক দিন থাকার পরই তাদের কেমন একটা অনুভূতি হল- এই ছোট্ট দ্বীপটা পুরোপুরি জনহীন নয়, কেউ যেন আছে, তাদের গতিবিধির উপর নজর রাখছে, লুকিয়ে তাদের ক্যাম্পে এসে দেখে যাচ্ছে। লোকগুলোর অস্বস্তি হয় কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না, মনে হয় ঝোপের আড়ালে কেউ বুঝি দ্রুত চলে গেল। ক্রমশ জানা যায় ঐ গোপন লোকটি হল এক মাঝারি থাকের জাপানি অফিসার, তার ফৌজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা এখানে রয়ে গেছে। তার পরনে ভেঁড়া ময়লা উর্দি, কোমরে তলোয়ার, বন্দুকে গুলি আছে কি না সন্দেহ! সে মিকাডোর নামে একলা এই দ্বীপ আগলাচ্ছে। এই আগন্তুক লোকগুলো তার শত্রুপক্ষ। দূর থেকে সার্ভে পার্টি যত বোঝায়– আরে, চার বছর আগে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। এখন আমরা কেউ কারো শত্রু নই। তুমি এসো, আমাদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করো। সে একবর্ণও বিশ্বাস করে না। সার্ভে পার্টি যত বলে চলো, আমাদের সঙ্গে, আমরা তোমাকে দেশে পৌঁছে দেব। সে অসহায় বোধ করে। তার এই সমুদ্রবেষ্টিত নিঃসঙ্গ নির্বাক ঘাঁটি থেকে সে কোথায় ফিরে যাবে? কোন হেরো দেশে গিয়ে হেরোদের দলে মিশবে?

বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার আর একটা ঘটনা বলি। এটা আরো রোমহর্ষক।

জায়গাটা বোধ হয় পোল্যান্ড, অবশ্য চেকোশ্লোভাকিয়াও হতে পারে। কাগজে পড়া ঘটনা, এখন আর অত অনুপুঙ্খ মনে নেই। সাত-আট বছর হল ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। জার্মানরা পর্যদস্ত হয়ে ফিরে গেছে। এখন ওখানে চাষের মাঠে চাষীরা চাষ করে। একটা খেতে, কিছুদিন ধরে চাষীরা লক্ষ করছে, মাটির নিচে থেকে কারা যেন ঘা দেয় যেন মাটির নিচে বিরাট লোহার সিন্দুক, তার মধ্যে থেকে যক ডালা ভেঙে বেরুতে চায়। শাবলের ঠং ঠং শব্দ হয়। অবশেষে চাষীরা খেতের মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে দ্যাখে, নিচে এক ঢালাই কংক্রিটের লম্বা বাংকার। শাবল গাঁইতি দিয়ে সেই বাংকারে গর্ত করার পরে ছজন ভূতের মতো কংকালসার লোক বেরিয়ে এসে মাঠের উপর দিয়ে দৌড় দিল এবং কয়েক পা গিয়েই পড়ে গেল। চাষীরা ছুটে গিয়ে দেখল দুজনের মধ্যে একজন মারা গেছে, বাকি পাঁচজন পুঁকছে। লোকগুলো জার্মান, ময়লা নোংরা চেহারা, প্রায় অন্ধ, চামড়ার রং গামলা-চাপা ঘাসের মতো ফ্যাকাশে। ওদের জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে একে একে বোধ হয় সবাই মারা যায়।

ব্যাপারটা কি? ঐ বাংকারটি ছিল জার্মানদের একটি রসদঘর। তখন, যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে, দ্রুত পালাবার মুখে কয়েকজন সৈন্য কিছু রসদ নেবার জন্যে ঐ বাংকারে ঢুকেছিল। তাড়াহুড়োতে তালা দিয়ে বেরোবার সময় দশ-বারো জন সঙ্গী যে ভিতরে পড়ে রইল তারা আর সে খেয়াল করে নি।

রসদঘরে প্রচুর খাবার ছিল, পানীয় ছিল, টর্চের ব্যাটারি ছিল, বিশুদ্ধ বাতাস ঢোকার এবং বিষাক্ত বাতাস বেরোবার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু নীল আকাশ ছিল না, সূর্য বা তারার আলো ছিল না, মাটি নদী গাছপালা ছিল না। এক বছর বা দুই বছর পরে আলোর ব্যাটারি শেষ হয়ে গেল, তার পরে কুপকুপে অন্ধকার। একজন পাগল হয়ে গেল, দুইজন মারা গেল। মৃতদের ময়দার মধ্যে কবর দেওয়া হল। তার পর একজন আত্মহত্যা করল না অসুখে মরল বোঝা গেল না। তার পর, এত অনন্ত কাল কেটে যাবার পরে এই খোলা আকাশ-বাতাসের তেজ আর হৃৎপিণ্ডের উত্তেজনা তাদের ছায়ার মতো শরীরে আর সহ্য হল না।

.

প্রত্যাবর্তন

ইউরোপে যুদ্ধান্ত এবং এশিয়ায় জাপানের হার স্বীকার করার পরেও যুদ্ধের জের কাটতে কয়েক মাস লাগল। প্রকৃত অবস্থাটা আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।

একদিন সন্ধেবেলা রোল কলের সময় সুবাদার কোনো ভনিতা ছাড়াই অকস্মাৎ বললেন মন দিয়ে শুনুন, আগে আপনারা কেউ কেউ ফৌজ থেকে ছাড়া পাবার কথা ভেবেছেন। তখন হয় নি। কিন্তু এখন যারা ছাড়া পেতে চান তাঁরা ফল আউট হয়ে এক কদম এগিয়ে আসুন।

আমার কি হল জানি না, যা এক পলক আগেও ভাবি নি সেই কথা– এই কঠিন বাধ্যতার জীবন– মনে হল, অসহ্য। আমি আগুপেছু না দেখে, অন্ধের পাশার দানের মতো সেই প্রায়ান্ধকারে এক পা এগিয়ে এলাম। জীবনের অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত নেবার সময়, আমি দেখেছি, হঠকারী প্রবৃত্তি আমার ঘাড়ে চেপে বসে।

পরের দিন ড্রইং অফিসে পাখা চালিয়ে, ডাংরির বোতাম খুলে, বসে দেখছি, বিল আগেই এসেছে যথারীতি আমার মুখোমুখি বসে একটি একটি করে মগে ভেজানো আঙুর তুলে খাচ্ছে। আমি বিলকে ডিমবের কথাটা বললাম। লাল ঠোঁট, নরমসরম বিল দেখছি মেয়েদের মতোই বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন। প্রথমেই সে জিজ্ঞেস করল- ফিরে গিয়ে কি করবে?

– দেখি, একটা কিছু নিশ্চয় করব।

 –কি করবে, কী ধরনের কাজ, কিছু ভেবেছ?

— নাঃ, আগে ফিরি, তার পর দেখা যাবে।

বিল বলল- খুব ভুল করলে। এভাবে কেউ চলে যায়? তোমার কিছু ঠিকঠাক নেই, তুমি কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছ! বিলের কথায় আমার মনে মেঘের ছায়া পড়ল ভুলই করলাম বোধ হয়। আমি সেই মেঘ কাটাবার জন্যে দুম করে বললাম- ফিরে গিয়ে আমি পড়াশোনা করব। জীবনটাকে যেমন ইচ্ছে চালাবার চেষ্টা করব।

বিল বলল- তোমার এমন কি কেউ আছে যে তোমার পড়াশোনা করার খরচ জোগাবে?

— না। কিন্তু আমি নিজে কি কিছু রোজগার করতে পারব না?

বিল বলল- কেন, আর্মিতে তোমার অসুবিধাটা হচ্ছিল কোথায়? এখানে ধীরে ধীরে উন্নতি হত, মাইনে বাড়ত। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাচ্ছে, বাইরে এখন চাকরি কমে যাবে। ফিরে গিয়ে তুমি আনসার্টনিটির মধ্যে পড়ে যাবে।

আমি চুপ করে বসে রইলাম। মনটা যেন চুপসে গেল। অনেক দিন পরে আবার দুর্ভাবনা ঘিরে আসছে। বিল আনমনা হয়ে একটি একটি করে আঙুর খেতে লাগল। আমি ভাবতে লাগলাম।

বিল যা-ই বলুক না, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেখা গেল বেশ কিছু লোক ডিমব-এ যাচ্ছে। রিক্রুটমেন্টের সময় যেমন হৈ চৈ ডিমোবিলাইজেশনের সময়েও সেইরকম জোয়ারের সময় জলের কলকল শব্দ, ভাটার সময় স্রোতের টানের দীর্ঘনিশ্বাস।

ইতোমধ্যে, সমরবিভাগ থেকে আমাদের ডিমব-পরবর্তী পুনর্বাসনের নানারকম প্রস্তাব এবং বিজ্ঞপ্তি এল। সবচেয়ে মজার বিজ্ঞপ্তিটি এল বিবাহপ্রস্তাব নিয়ে। কোনো ফৌজি যদি ওয়াকাইদের কাউকে বিয়ে করতে চায় তবে সে তিন কপি ফোটো জমা দিক। ফোটো দেখে যদি প্রাথমিকভাবে পরস্পরের পছন্দ হয় তবে পাত্রপাত্রীকে আলাপ করিয়ে দেওয়া হবে। কথাবার্তা বলে যদি তারা বিয়ে করবে স্থির করে তবে. বরপোশাক, কনেপোশাক এবং বিয়ের খরচ বাবদ হাজার চারেক টাকা দেওয়া হবে।

ওয়াকাইদের অনেকেই বেশ সুন্দরী ছিল। স্মৃতিরেখা বিশ্বাস চিত্রাভিনেত্রী হবার আগে ওয়াকাই ছিলেন। কিন্তু তবু কোনো বীরকে সাহস অবলম্বন করে এই প্রস্তাব গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে দেখি নি।

না এদিক, না ওদিক- মনটা দিনে দিনে নিরালম্ব হয়ে গেল। রোজ যথাসময়ে ড্রইং অফিসে ড্রইং বোর্ডের সামনে গিয়ে বসি রোজ একদিনের করে টাকা বাড়ে, অতএব রোজ নতুন করে হিসেব করি, সাকুল্যে কত টাকা পাওনা হবে। এক ধাপ এক ধাপ করে হিসেব করি, আর দেখি বিল সামনে বসে একটি একটি করে আঙুর খাচ্ছে।

ইতোমধ্যে আমাদের ভদ্রতা, সভ্যতা ও সুসামাজিকতার কয়েকটি ক্লাস হল। ফিরে গিয়ে আমরা সহনাগরিকদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করব সেসব শেখানো হল। আমাদের চলাফেরায়, অন্যের প্রতি ব্যবহারে ফৌজের সুনাম যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। আসলে আমাদের মধ্যে যে রুক্ষতা, উগ্রতা ও মারদাঙ্গাভাব এসে গিয়েছিল কর্তৃপক্ষ সেগুলোকে একটু ঘষে ভোঁতা এবং পালিশ করে দিতে চেয়েছিলেন। যত দিন চাকরি হয়েছে তার অনুপাত কষে টাকাপয়সারও একটা ব্যবস্থা হল। ফিরে গিয়ে এতে কয়েক মাস গুজরান হবে। যাবার আগে বুশ শার্ট প্যান্ট বিছানা তোয়ালে পুলওভার সম্পূর্ণ নতুন কিটের সঙ্গে পাজামা আর শার্ট বানাবার জন্যে এক থান লংক্লথও দিয়েছিল।

আমার একটা আনকোরা নতুন ওয়াটার বটলের শখ ছিল। যাবার আগে যদি পাওয়া যায় তো বেশ হয়। কোয়ার্টার মাস্টারের ওখানে তখন জিনিসপত্রের পাহাড়। ওরা বলল, পুরনো বটলটা রেখে যাও, নতুন একটা পরে এসে নিয়ে যেয়ো। যাবার আগের দিন আবার গেলাম। ঐ তো নতুন ওয়াটার বটল উঁই হয়ে আছে। কিন্তু তখনও পাওয়া গেল না। লোকটা হেসে বলল- কাল যাবার আগে তোমার ব্যারাকে পৌঁছে দেব। আমি মনে মনে বললাম হুঁ।

পরদিন আর কিছুই মনে পড়ল না। ডিমবের কাগজপত্র, সার্টিফিকেট, রেলের ওয়ারেন্ট সবই পেয়ে গেছি। দুপুরের খাওয়া হয়ে গেল। কোথাও আর মন লাগছে না। মন যেন ছিন্নভিন্ন উড়ো মেঘ চলে যাব। চলে যাব। ক্যান্টনমেন্টের এই জায়গাটা দূর অতীত দিনের মতো পড়ে থাকবে আর কোনোদিন আসা হবে না। কলকাতার অপেক্ষমাণ ভবিষ্যৎ যেন দূরবীনে দেখা ঢেউভাঙা সমুদ্র। সেই সফেন গড়িয়ে আসা জলে গুপালের, মুমতাজের, শশাঙ্কসুন্দরের মাথা একবার ভাসছে একবার ডুবছে।

সন্ধের পর রাত্রে ট্রেন। আমি বিকেলের আগেই স্টেশনে যেতে চাই। যতক্ষণ গাড়ি না আসে কিটব্যাগের উপর বসে দেখছি শিশু গাছের জটলার নিচে শালিকের চোখের বলয়ের মতো মেটে হলুদ রোদ্র সরে সরে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল, গুবরে পোকার মতো অতি ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিতে দিতে যদি আমি ঐ অপস্রিয়মাণের মধ্যে ঢুকে যেতে পারতাম। গুবরেনীর দেখা পেয়ে সংসার পেতে যদি ঐখানে জীবন কাটিয়ে দিতাম তাহলেই বা কি এই জন্ম কম কৃতার্থ হত?

ডামাডোলের মধ্যে একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম কিন্তু গাড়ি ছাড়ার মুখে সেই লোকটি নতুন ওয়াটার বটল নিয়ে হাজির হল। নতুন ফেন্টে মোড়া নতুন বটল। লোকটি হেসে বলল– ভরে দিয়েছি। শেষ মুহূর্তে আধচেনা লোকটি যেন রাভির জলতল থেকে স্নিগ্ধ হাত বাড়িয়ে বিদায়ের করমর্দন করে গেল। বহোত বহোত শুক্রিয়া অনেক অনেক ধন্যবাদ।

এখন শেষ বিকেল। ট্রেন সন্ধেরাত্রে ছাড়বে। সময় কাটাবার জন্যে বড় এক পট চা নিয়ে একটি কোণ-ঘেঁষা টেবিলে বসলাম। টেবিলে রোদ এসে পড়েছে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে রোদের নড়াচড়ার শব্দ কি কেউ টের পায়? আবার বিলের কথা মনে পড়ল বিল সাবধানী। শ্বেতাঙ্গ বিল এই রোদের নড়াচড়ার মতো সাবধানী। কৃষ্ণাঙ্গ আমি স্টেশনের ঐ সিগনাল পোস্টে নামা আরক্ত সন্ধ্যার মতো দুঃসাহসী।

ট্রেন পুবের দিকে ছুটছে মানে ভোর হবার আগেই ভোরের মধ্যে ঢুকছে। ট্রেনে লম্বা রাতের শেষে ভোরে উঠে তেষ্টা পেয়েছে। ঐ তো ভরতি ওয়াটার বটল হুকে টাঙানো রয়েছে সারা রাত হাওয়ার ঝাঁপট লেগে লেগে শীতল হয়ে আছে জল। কিন্তু আমি ছিপি খুলেই চমকে উঠলাম চলকে ওঠা রামের গন্ধে কামরাটা ভরে গেল। জলের বদলে লোকটা রাম ভরে দিয়েছে। কেন? ভালবেসে? মজা করার জন্যে? লোকটা কি গোপন মেফিস্টফিলিস, না কি ছদ্মবেশী ব্যাকাস।

আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম– সকালবেলা নির্জলা রাম খাবার মতো প্রতিভা নেই আমার। তাহলে আমি এক সেপাই যে বাঁ হাতে বাঁ চোখ টিপে রেখে শুধু ডান হাতে ফায়ার করে, যে এক বোতল রাম উপহার পেয়ে কী করবে ভেবে পায় না। এইরকমই আমি লেখাপড়া, চাকরি, সংসার, সব যুদ্ধেই বাইরে বীর, কিন্তু ভিতরে খেলনা সেপাইয়ের বেশি নই।

আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখে সহযাত্রী সেপাইরা খুশি হয়ে বোতলটি চেটেপুটে সাফ করে দিল। তাদের ক্যানভাসের ছাগল থেকে ঠাণ্ডা ঝকঝকে জল খাওয়াল, ভারী প্রাতরাশ খাওয়াল।

কলকাতায় ফিরে, ধোবার পরেও, বোতলটাতে বহুদিন রামের গন্ধ লেগে ছিল। আমার ভালো লাগত। একটা দূরে রেখে আসা জীবনের কথা মনে পড়ত।

.

প্রাসঙ্গিক

সৃজনশীল মানুষের ছেলেবেলার কাহিনীতে লুকিয়ে আছে তার প্রবণতা, আছে তার মুছে যাওয়া যাত্রাপথের সন্ধান। এই ধারণা থেকে আমি পরমা কাগজের শেষ দিকের সংখ্যাগুলিতে একজন করে কবি বা শিল্পীর বালকবেলার আত্মকথা ছাপছিলাম। এই পর্যায়ে কয়েকজনের লেখা ছাপার পর মনে হল, আমিই বা না লিখি কেন। আবার শিশুকালের কথা মনে আনাগোনা করতে লাগল কিন্তু কলকাতার আকাশ-বাতাস এইরকম লেখার পক্ষে খুব অনুকূল নয়। এই যখন অবস্থা তখন ১৯৮১ সালে কর্মসূত্রে আমাকে বীরভূমে তিলপাড়া ব্যারাজের কাছে কয়েক মাসের জন্য ডেরা বাঁধতে হল।

আমাদের ক্যাম্পাসটি ছিল দু ভাগে ভাগ করা এক ভাগে কর্মস্থল, অন্য ভাগে কর্মী-আবাসন। জায়গাটা ময়ূরাক্ষীর পারে, ক’বছর আগেও ছিল জনশূন্য, এখন কয়েকটা সরকারী ঘর বাড়ি অট্টালিকা মেশিনপত্তরের শেড হওয়ায় ছোট্ট একটা উপনিবেশের রূপ নিয়েছে।

আমি যখন সেই উপনিবেশে হাজির হলাম তখন শেষ অপরাহু। ঢুকবার আগেই বাঁ দিকে দৃষ্টি গেল ধূ ধূ করছে বিরাট জলাধার। তখন রোদ্দুর ওপারে সরে গেছে, জলের ওপর ছায়া পড়েছে আকাশ কোমল হয়ে এসেছে। পরিযায়ী বিদেশী হাঁসের লম্বা ঝক এসে জলের ওপর রাতের মতো থিতু হচ্ছে। হাতের কাছে এতখানি ফাঁকা আকাশ আর জল দেখতে পাব আমি ভাবি নি।

একা থাকব। সুতরাং স্থানীয় সহকর্মীরা মোটামুটি একটা থাকবার আর খাবার জায়গা ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু আবাসনে ঢুকে সেই আসন্ন সন্ধ্যায় প্রথমেই চোখে পড়ল একটি ‘এ’ ক্যাটিগরির পরিত্যক্ত বাড়ি। দেখেই বোঝা যায় কেউ সেখানে থাকে না। ব্যাপার কি? জানা গেল, বাড়িটা তৈরি হয়েছিল প্রতিষ্ঠানের কর্তার জন্য। কয়েক মাস থাকার পর হঠাৎ বাড়িটার ভিত চৌচির হয়ে ফেটে গেলে কর্তা সেটি ছেড়ে অন্য কোয়ার্টারে উঠে গেলেন। পি ডাবলিউ। ডি দেখেশুনে বাড়িটাকে বিপদজনক ও পরিত্যক্ত ঘোষণা করল। সেই থেকে বাড়িটা জনহীন পড়ে আছে।

আমি আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। আমি তদানীন্তন কর্তার কাছে বাড়িটিতে থাকার অনুমতি চেয়ে নিলাম। তখন সন্ধ্যা হয়েছে। তালা খুলিয়ে বাড়িটাতে ঢুকে দেখি ঘরদোর মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। একটা লিভিং রুম, তিনটে বেডরুম, বাথ, কিচেন, ডাবলিউ সি, সামনে খোলা বারান্দা। আশ্চর্যের ব্যাপার ঐ পোড়ো বাড়িতে ইলেকট্রিক আলো পাখা এবং জলের লাইন তখনও সচল। প্রথম শোবার ঘরটাতেই পাশাপাশি দুটো নিরাভরণ খাট পাতা- কোনো বিছানা নেই। একটা টেবিল এবং দুটো হাতলওয়ালা চেয়ার। চমৎকার। এই একটা ঘরই আমার পক্ষে যথেষ্ট। চৌকিদার পাঁচ মিনিটে ঘরটা পরিষ্কার করে, টেবিল চেয়ারে ঝাড়ন বুলিয়ে, আলো জ্বালিয়ে, পাখা চালিয়ে চলে গেল। এই ডেরার সবচেয়ে কাছের গৃহস্থ কোয়ার্টারেই আমার দু বেলা খাবার বন্দোবস্ত।

শেষরাতে পাখির ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। ঐরকম একসঙ্গে বত্রিশ জাতের পাখির ডাকের ঝড় আমি জীবনে শুনি নি। শুয়ে শুয়ে শুনতে শুনতে মনে হল পাখিরা বোধ হয় চেঁচামেচি করেই আগন্তুককে তাড়াবার মতলব এঁটেছে। আলো ফুটলে বাইরে এসে দেখি এ বাড়িটা যেন অন্য বাড়িগুলো থেকে স্বাতন্ত্র রক্ষা করে একটেরেতে গড়া। বারান্দা থেকে দশ হাতের মধ্যে মোরামের রাস্তার পারে গমের খেত। বাঁ পাশে ও পেছনে বড় বড় প্রাচীন গাছের জটলায় বনের আভাস। দূরে লোকালয়। নিঃসঙ্গ, একা, অত বড় বাড়ি চারদিকে বীরভূমের গ্রামাঞ্চল সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে ভোর। মাসে দু বার কলকাতার বাড়িতে যাই। জীবনে এমন নিরাময়কারী, নির্ভাবনার বাসস্থান পাই নি। অথচ অযাচিতভাবে সবাই ভয় দেখায়। মেঝেতে এ মাথা ও মাথা লম্বা মোটা ফাটল আমারও চোখে পড়ে। একদিন দেখি দরজার ফ্রেমে একটা সাপের খোলস আটকে একটু একটু হাওয়ায় দুলছে।

তিলপাড়ার ঐ কয়েক মাসে আমি অক্ষয় মালবেরি, প্রথম পর্ব শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লিখলাম। ঐ বাড়িটার শান্তি, বৈরাগ্য, নির্জনতা এবং চারদিক ঘিরে থাকা প্রকৃতি আমাকে গভীর সাহায্য করল। প্রথম পর্বের আসল বিষয় ছিল পুববাংলায় আমাদের গ্রাম আর গৌণ বিষয় ছিল আমার জন্ম থেকে বালককাল।

পরমা-র শরৎ ১৩৮৮ সংখ্যায় লেখাটা প্রকাশিত হল। আমি ছাপাখানার সঙ্গে ব্যবস্থা করে দু শো কপি অফ-প্রিন্ট রেখেছিলাম, তার থেকে দু শো কপি বই হল। কেউ কেউ সে বই তিন চার কপিও কিনলেন। দ্বিতীয় সংস্করণ বেরুল ১৯৯৫ সালে। এবার ক্রাউন সাইজ, চিত্রসংবলিত।

অক্ষয় মালবেরি, দ্বিতীয় পর্ব– বরাক উপত্যকায় আমার কিশোরকালের কথা বেরুল চিত্ৰক পাবলিকেশন থেকে ১৯৯৮-এর শীতে। চিত্রকের পার্থপ্রিয় বসু ঘটা করে তার প্রকাশ-অনুষ্ঠান করলেন বাংলা আকাঁদেমি সভাঘরে।

চার বছর পরে ২০০২ সালের শরতে অক্ষয় মালবেরির তৃতীয় পর্বের প্রথমার্ধ বেরুল জলার্ক পত্রিকায় আর শেষার্ধ বেরুল বিষয়মুখ পত্রিকায়।

ইতিমধ্যে প্রথম পর্ব আবার ফুরিয়ে গিয়েছিল। অতএব ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে একই সময়ে চিত্ৰক পাবলিকেশন থেকে প্রকাশ পেল অক্ষয় মালবেরি, প্রথম পর্বের তৃতীয় সংস্করণ এবং নতুন তৃতীয় পর্ব।

দ্বিতীয় পর্বও ফুরিয়ে গিয়েছিল। অবভাস ছাপাল তার দ্বিতীয় সংস্করণ জানুয়ারী, ২০০৬ সালে।

এখন তিনটি পর্বই নিঃশেষিত। এবার অবভাসের পরিকল্পনায় তিনটি পর্ব একত্রিত করে এক ভলমে অখণ্ড অক্ষয় মালবেরি প্রকাশিত হল। এতদিন দ্বিতীয় পর্বে কোনো ছবি ছিল না। এই নতুন অখণ্ড সংস্করণে পুরো বইটাই লেখক-কর্তৃক চিত্রালংকৃত।

তিন পর্বে সম্পর্ণ অক্ষয় মালবেরিতে আছে জন্ম থেকে যৌবনারম্ভ পর্যন্ত জীবনের কথা। কিন্তু এই তিন পর্বের পরেও, অনেকেই আমাকে বলেন, চতুর্থ পর্ব কোথায়? তার পরে কি হল? পর্বে পর্বে আমরা বর্তমান পর্যন্ত আপনার জীবনকথা জানতে চাই।

কী বলব! এই কৌতূহলের জন্য আমি সম্মানিত। কিন্তু মনের মধ্যে এই কাহিনীকে আরো বাড়াবার মতো উদ্যম খুঁজে পাই না। যতদিন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলাম ততদিন অসীম মুগ্ধতা, বিস্ময় এবং অপরিণামদর্শিতা নিয়ে আমি অনন্য ছিলাম। বয়স্ক হবার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ অন্যান্যদের মতোই হয়ে গেছি। এখন আপনার আমার সবারই তো এক গল্প। অতএব অক্ষয় মালবেরির কাহিনী আমার বাইশ বছর বয়সে এসে শেষ হয়েছে। বাইশ বছরেও নিজেকে অপ্রাপ্তবয়স্ক বলছি- এটা আদুরেপনা নয়। হয়তো অতীতের একটা সময়ে কিছু কিছু মানুষের ছেলেবেলাটা একটু বেশি সম্প্রসারিত ছিল।

1 Comment
Collapse Comments
পর্দা করা ফরজ December 2, 2022 at 10:27 pm

অসাধারণ একটি রচনা, ফেসবুকে মাসরুফ হোসেনের (SP) রিকমেন্ডেশন পেয়ে পড়ি এই ব‌ই। অমৃতকথা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *