১. শত শরদ মানুষের আয়ু

অক্ষয় মালবেরি – মণীন্দ্র গুপ্ত ॥ অখণ্ড

আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে নিজের জীবনকে কেউ দেখে দূরবিনে, কেউ দেখে অনুবীক্ষণের লেন্সের তলায়। মণীন্দ্র গুপ্ত দেখেছেন নিজের তৈরি এক ক্যালিডোস্কোপে। আপাত-বাস্তবের নেপথ্যে যেন চিরকাল বইছে এক ঘনগহন অন্য বাস্তবের স্রোত। তার দেখা ছায়া গোধূলি মেঘ হাওয়া জল ফড়িং সরীসৃপ পাখি গাছের মধ্যে আসে মানুষী ব্যক্তিত্ব, আর মানুষের মধ্যে দেখা দেয় গুনবতী প্রকৃতির অজ্ঞান সৌন্দর্য। জগৎপটে জীবনের এই সমস্ত অকিঞ্চিৎকর ভাঙা টুকরো বিন্যাসে বিন্যাসে অন্তহীন ছবির পর ছবি সাজায়। অক্ষয় মালবেরি উপন্যাস নয়, প্রচলিত আত্মজীবনীও নয়, একজন দুঃখী-না সুখী-না। মানুষের চিহ্নপত্র। কাঁচা কঞ্চির কলমে বনের সবুজ কালিতে হোগলার পাতায় লেখা–উজ্জ্বল দুরন্ত দুঃখী ক্ষণমধুর অতীত যেন স্তব্ধতা থেকে এসে আবার স্তব্ধতায় ফিরে গেছে।

.

উৎসর্গ : দেবারতিকে

.

০১.

উৎসর্গ : দাদু, ঠাকুমা ও জন্মভূমি

শত শরদ মানুষের আয়ু। কিন্তু দুঃখী-সুখী-ভ্ৰষ্টাচারী ততদিন বাঁচে না। মরণের আগে বোকাচোখে তাকিয়ে দেখে: সমস্তই অসম্পূর্ণ, তার রাকাশশী অসংলগ্ন বালি হয়ে উড়ে যায়। তবু এইটুকু জীবনের মধ্যে কত কি যে ঘটেছিল– কত মুগ্ধতা, সন্তাপ, উল্লাস, দ্রবণ! ভোলা যায় না। তবু তার উপর শান্তি নামে সময়ের শান্তি, ক্ষয়ের শান্তি। অক্ষয় মালবেরি গাছকে ঘিরে তীব্র ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ টের পাই, কখন সঙ্গীদের হাত ফসকে গেছে। প্রৌঢ় মুখের উপর ছায়া পড়ে। নিজেকে আর মানুষ বলে মনে হয় না, প্রাণী বলে মনে হয়। নিঃশ্বাস নিই তাই বেঁচে থাকি। ভিতরে একা, সুখী না, দুঃখীও না। দশদিকে অসীম শূন্য এবং চিররহস্য।

জন্ম

শরৎশেষে, কার্তিকের শুরুতে, আমাদের ভাঁড়ারের দেশে পেকে আসা ধানের উপর যখন শেষরাতে শিশির আর সন্ধ্যায় হিম জমে, যখন খালের জল স্বচ্ছ, গাছপালা গাঢ় সবুজ, আবহাওয়ায় একটু একটু শ্লথ বিষণ্ণতা তখন একদিন আমার ঠাকুরদা সুখী মনে তাঁর ডালিম গাছটির পাশে হলুদ রঙের হোগলাপাতা, সবুজ রঙের বাঁশ আর বাদামী রঙের বেত দিয়ে একটি আনকোরা আঁতুড়ঘর একাহাতে বানিয়ে ফেললেন। আমি খুব পৌরাণিক আদরের মধ্যে ভূমিষ্ঠ হলাম। ডাক্তার নেই, দাই নেই, ছুরি-কাঁচি নেই। শুধু একদল পাড়াগেঁয়ে অভিজ্ঞ বর্ষীয়সী যেন হুল্লোড় করে হাতে হাতে আমাকে নামিয়ে নিলেন। ডাক্তারী ছুরির বদলে আমাদের পশ্চিমপুকুরপারের নির্জন বাঁশঝাড় থেকে কেটে আনা কাঁচা বাঁশের চোচ দিয়ে আমার নাড়ী কাটা হয়েছিল, একথা জেনে নিজেকে খুব অন্য রকম লাগে। কাঁচা বাঁশের চোচ ব্লেডের চেয়েও ধারালো, তাতে টিটেনাসের বীজ না থাকলেও বনের সবুজ বিষ ছিল।

.

মা

আমাদের চেনাশোনা, ভালোবাসা হবার আগেই মা যখন মারা গেলেন তখন তাঁর বয়স উনিশ বছর, আর আমার দশ মাস। মায়ের এই অসমাপ্ত জীবন বা আমার জীবন থেকে তাঁর এই চিরঅপসরণ একটা প্রাকৃতিক ঘটনামাত্র। কিন্তু জন্মমৃত্যুর সঙ্গে স্ত্রীজাতির একটি অতি গহন যোগ আছে, অতএব পড়শী কুটুম্ব স্ত্রীলোকেরা আমাকে সামনে দাঁড় করিয়ে নিরীক্ষণ করতে করতে সখেদে বলতেন, হায়, পোড়াকপালিয়া, জন্মাইয়াই মায়রে খাইছ? অপেক্ষাকৃত তরুণীরা ভুরুতে দুঃখ এঁকে বলত, ‘আহা, অর মা নাই।’ কাকে খেয়েছি? কে নেই?– এসব কথায় প্রথম দিকে আমার একধরনের নির্বোধ অস্বস্তি হত। কিন্তু ক্রমাগত শুনতে শুনতে শেষে, যে নেই তার না থাকার জন্য একটা আবছা কুয়াশাভরা অপরাধ ভিতরে ছায়া ঘনিয়ে আনত। মনে হত, কোনো দুর্গম কারণে সংসারে আমি অস্বাভাবিক, এবং একা।

এই নকল দুঃখই বোধ হয় আত্মকরুণা। দুষ্টুমি করে মারধর খেলে আমি ঐ দুঃখকে খুঁজতে বেরুতাম। মুখখানা স্লান ম্লান করে একা একা ঘুরতাম খালপাড়ে অথবা উঁচু ঢিবির উপর বিশাল শিরীষ গাছের তলায় যেখানে কেউ যায় না। সেখান থেকে দেখতাম, দিগন্তে মেঘের মধ্যে কি যেন ঘনিয়ে উঠছে। আমি মুখ নিচু করে দুঃখকে খুঁজতাম, মাটিতে কোথায় সে গেঁথে আছে ভাঙা সবুজ বোতলের টুকরো হয়ে।

অবশেষে সহজাত পুরুষসংস্কার আমাকে একদিন বলল, এই জোলো হাওয়া ভালো না। তার পর থেকে স্ত্রীলোকদের ঐসব অহেতুক বাষ্পীয় মন্তব্যের সামনে পড়লে কুমোরের ঘুরন্ত চাকায় একতাল মাটি যেমন আঙুলের চাপে টলতে টলতে শীর্ণ হয়ে ওঠে শূন্যের দিকে তেমনি কাঁচা শরীরের মধ্যে আমার স্নায়ুগুচ্ছের নাল লম্বা হয়ে হয়ে মাথা নীলের দিকে উঠত। এতকাল পরে এখন জানি, আসলে সুখও নেই, দুঃখও নেই। সংসার-সমাজের এজেন্সিগুলো আমাদের মধ্যে সুখ ও দুঃখের ধারণা জন্মিয়ে দেয়, যে ব্যথা ভোগ করার নয় সেই ব্যথা ভোগ করায়।

পরে, একটু বড় হয়ে, যেদিন মার ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম, তাঁকে একমুহূর্তেই প্রত্যাখ্যান করলাম। সোজা দাঁড়ানো একটি ছিপছিপে কিশোরী, নাকে পাথর বাঁধানো নোলক। মাতৃত্ব দূরের কথা, তার ঠোঁটে চোখে চিবুকে তখনো নারীত্বই আসে নি। এই আমার মা! তবু একসময় হয়তো তাকে আমার দরকার ছিল। কিন্তু এখন, এই পঞ্চান্ন বছর বয়সে, যদি সে আমার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ায়, হয়তো তাকে বলব বোসো, একটু কিছু খাও- বিস্কুট, সন্দেশ? পারো তো আমার কাঁচাপাকা চুলে একটু বিলি কেটে দাও। যাবার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যেয়ো। তুমি গতজন্মে আমার মা ছিলে।

.

প্রথম স্মৃতি

মানুষী স্মৃতিই মানুষ। স্মৃতিই জটিলতা। মরণের পরে আমাদের যে নির্বাণ হয় না সে কেবল স্মৃতি আছে বলেই না! পুনর্জন্ম সবচেয়ে বড় ম্যাজিক ধুয়ে মুছে সব পরিষ্কার করে দেয়। জাতিস্মর হলে জন্মজন্মের দুঃখ আর জানার ভার বইতে হত। অল্প লইয়া থাকি, তাই বেঁচে থাকি। কিন্তু অনেকদিন বেঁচে থাকার ফলে আমার মধ্যে জাতিস্মর এসে যাচ্ছে। পুরনো রঙ্গমঞ্চে রঙ্গ নিজে নিজেই আবার গাঢ় হয়ে উঠছে:

জন্মের পরে আমার প্রথম স্মৃতিটি এই রকম মনে পড়ে: দিনের বেলা। দুপুর গড়িয়ে গেছে অথবা তখনও বিকেল হয় নি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে অথবা সদ্য থেমেছে। রান্নাঘরের পাশের ঘরটিতে মেঝেয় বড় পিড়ি পেতে একগাদা কাঁথা-বালিশের প্যাকিং দিয়ে আমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ঘরের মধ্যে ঘন ছায়া, মাটির মেঝের সোঁদা গন্ধ, কাঁথা-বালিশের স্যাঁতা গন্ধ, বৃষ্টির ভিজে গন্ধ। শাড়িপরা কয়েক জোড়া বিশাল বিশাল পা আমার বিছানার পাশ দিয়ে বার বার আসছে যাচ্ছে, কাছে এসে এক বারও থামছে না। একজোড়া পায়ের আবার নীল পাড় সাদা জমির শাড়ি। আমি ঐ শাড়িঘেরা পায়েদের হাঁটু পর্যন্ত দেখতে পাই, তার উপরে আমার দৃষ্টি ওঠে না। আমি উঠতে পারি না, হাঁটতে পারি না, হামা দিতে পারি না, কথা বলতে পারি না। প্রত্যেক বার ভাবছি কোনো একজোড়া পা এসে আমার কাছে থামবে, আমাকে কোলে তুলে নেবে, আমাকে একা ফেলে রাখবে না। প্রত্যেক বার আশাভঙ্গ। আমি অনেকক্ষণ ধরে ওদের নিজেদের ভিতরে কথাবার্তার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। … হঠাৎ আমার মধ্যে ক্রোধের জন্ম টের পেলাম– রক্তমাংসের পুঁটুলিটার মধ্যে বাজপাখি তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে উঠল। ক্রোধ আমার সমস্ত শরীরকে ছেয়ে ফেলছে। আমি কি করে রাগ দেখাব? … ব্যস, এইখানে এসে স্মৃতি ছিঁড়ে গেছে। তার পর গর্জন করতে গিয়ে আমি কেঁদে উঠেছিলাম কিনা, কেউ আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিল কিনা, সে কথা আর মনে নেই। ঘটনাটা সামান্য, কিন্তু ইঙ্গিতময়। পরিত্যক্ত থাকার কষ্ট এবং অসহায় ক্রোধ- এই দ্বৈতই বোধ হয় আমার সারা জীবনের সারসংকলন।

.

ঠাকুমা ও তাঁর বন্ধুরা

এই সংসারজলধিতে পরজীবী শিশু অ্যানিমোনের মতো, যাকে আমি প্রথম আশ্রয় করলাম তিনি আমার ঠাকুমা কৃষ্ণবর্ণা, কুরূপা, কিন্তু ব্যক্তিত্বময়ী এক প্রৌঢ়া। তাঁর অযত্নের, অনটনের ছিমছাম শরীর। মস্ত কালো কপালে মস্ত সিদুরের ফোঁটা, পিঠের দিকে নেমে যাওয়া সরল কালো চুল, হাতে শুধু শাখা আর নোয়া, কষ্টিপাথরে কোথাও একচিলতে সোনার দাগ নেই। ঠাকুমার একমাত্র ব্যসন ছিল ফুরসত পেলেই পান এবং র তামাকপাতা তুষের আগুনে সেঁকে গুঁড়িয়ে খাওয়া। বন্ধুদের সঙ্গে এই পানের আসর জমত খুব। প্রান্তদুপুরে বন্ধুরা আসত। ছায়াচ্ছন্ন ঘরে মাটির মেঝেয় চট আর পিড়ি বিছিয়ে বসত সবাই। মধ্যিখানে থাকত ডাবরভরতি পানের গোছা, চুন, সুপুরি, খয়ের, আঁতি। একপাশে মাটির মালসায় তুষের আগুনে আস্ত তামাকপাতা কুঁকড়ে উঠে কটু গন্ধ ছড়াত। ঠাকুমা সামনের দিকে লম্বা করে পা ছড়িয়ে বসতেন। তাঁর দুই জানুর মধ্যে আমি শুয়ে, বসে, বায়নাক্কা করে এঁটুলির মতো লেগে থাকতাম। তাঁর কত যুগ আগেকার শুকিয়ে যাওয়া স্তন মুখে পুরে টেনে টেনে মিথ্যেদুধ খেতাম। ঠাকুমা বন্ধুদের বলতেন, ‘শত্তুর! শত্তুর! আমার প্রেস্রাব করতে যাবারও উপায় নাই। লগে লগে যাইবে।’

ঠাকুমার মধ্যে কোনো শ্রেণীচেতনা ছিল না। তাঁর বেশির ভাগ বন্ধুই প্রতিবেশী কামারবাড়ি, গোয়ালবাড়ির বর্ষীয়সীরা। শেষদুপুর থেকে শেষসায়াহ্ন পর্যন্ত তাদের সুখদুঃখের কথা চলত। আমি গভীর মনোযোগে প্রত্যেককে নিরীক্ষণ করতাম: সবাই প্রৌঢ়ত্বে স্নিগ্ধ, লোলস্তনী, পান এবং তামাকের গুঁড়োয় ঘন ছোপ ধরা দাঁত, তবু কত বৈচিত্র্য তাদের। উন্দি নাম্নী যুবতীর মা, রাধু ঘোষের বউ, শশী কর্মকারের দিদি, সূর্য কর্মকারের মা, মাণিক্য বুড়ী– দুঃখের এবং বয়সের আলাদা এক এক রূপ। কারো চোখের পাতা ভারী হয়ে নেমে চোখের কোলে ছায়া ফেলেছে, কারো কাঁচাপাকা চুলের গোছায় ঘেরা ধূসর অস্পষ্ট মুখখানা যেন কঠিন বট-অশ্বথের ঝুরি নামা মন্দিরের কবাটভাঙা দুয়ারের অন্ধকার, কারো মুখে অজস্র কাটাকুটি রেখা যেন বিকেলের নদীর চরে পাখিপক্ষীর সারা দিনের পায়ের দাগ, একজনের সামনের দাঁত ক্ষয়ে গিয়ে দুপাশের দাঁতদুটো লম্বা আর বাঁকা হয়ে এমনভাবে নিচের ঠোঁটের উপর চেপে বসেছে যেন মনে হয় সে মানবী না, প্রত্নযুগের বৃহৎদংষ্ট্রা বাঘিনী, এখন বিরক্ত, মন্থর। আর মাণিক্য বুড়ী তো প্রাচীন মাতৃকাগোষ্ঠীর একজন ঘন সাদা চুল পুরুষদের মতো ছোট করে ছাঁটা, কঠিন সোজা নাক, কঠিনভাঁজ চিবুক, রোখা সাবলীল–দেহ সে যে-কোনো যুদ্ধে তলোয়ার হাতে এগিয়ে যেতে পারে, যদিও এখন শুধু ছাগল পোষে এবং সুদ নিয়ে টাকা ধার দেয়। ঐ দলের মধ্যে শুধু সেই পান খেত না, তামাকপাতা খেত।

আমাদের কুটুম্ব মহিলারা, কদাচিৎ হলেও, যখন আসতেন পরিপাটি সেজেই আসতেন। তাদের দেহ ও ব্যক্তিত্বে আমি একটা অচেনা রহস্যের আভাস পেতাম। আর একটা উন্মোচনও হত: আমরাও ভদ্ৰশ্রেণীর।

ঠাকুমার আরেকজন বন্ধু ছিল বাবুরালি-আমরালি শেখের মা। ওরা দু ভাই ঢুলি সেজে আমাদের দুর্গাপুজো, কালীপুজো, রটন্তীপুজোয় ঢোল বাজাত আর ধুনকর হয়ে শীতকালে লেপ-তোশক তৈরি করে দিত। বাবুরালির মা, যেহেতু মুসলমানী, এলে আমাদের দাওয়ার নিচে ছাঁচতলায় বসত পিঁড়ি পেতে। ঠাকুমা বসতেন দাওয়ায়। সেখান থেকেই দুই সখীতে আদানপ্রদান হত। আমি ঐ বয়সেই বুঝতে পারতাম, নেহাত ছোঁয়া নিষেধ তাই, নইলে ঠাকুমা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন।

একদিন বাবুরালির কাঁধে চেপে ঠাকুমার সঙ্গে তাদের বাড়ি গেলাম। বড় বড় গাছের অপরাহুছায়ায় তাদের পাটকাঠির কুঁড়ের বাইরে বাবুরালির মা বসেছিল, বিধবা, সাদা সন্ধ্যামণির হালকা ঝোপের মতো। আমি ইতস্তত ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম- অযত্নে, বন্য গুল্ম-লতা ঘন হয়ে এগিয়ে আসছে চারদিক থেকে। ঘরের মধ্যে অন্ধকার। একটা কানাভাঙা আমানির কলসি এক জায়গায় বসানো। হাঁস মুরগি কিছু নেই, গাছে বনের পাখি ছাড়া আর কোনো জীবজন্তু নেই। ওরা বোধ হয় জীবনেও গোমাংস খায় নি। পাবে কোত্থেকে?

ঠাকুমার সঙ্গে, এবং পরে আমি একা একা, সাঁকো পেরিয়ে কামারবাড়ি, গোয়ালবাড়ির অনেক ঘরে বহুবার গেছি। ওরা আমাদের চেয়ে বর্ধিষ্ণু, কিন্তু জান্তব। সোনারুপোর স্যাকরাদের চেয়ে লোহার কামাররা বেশি শক্তিশালী এবং বেশি জান্তব। ওদের বিয়ের পাট অতি অল্প বয়সেই চুকে যেত। বিয়ের উষা থেকে স্ত্রীলোকেরা একঘেয়ে সুরে বিয়ের গ্রাম্য গান গাইত। বিয়ের পর মেয়ে যখন প্রথম ঋতুমতী হত তখন তাকে নিয়ে রীতিমতো মেয়েলি উৎসব হত। ওরা বলত, অমুক ফল দেখেছে। ফিসফিস করে মেয়েরাই এ পাড়ায় ও পাড়ায় সেই খবর ছড়াত। আমি বুঝতে পারতাম না, ফল দেখা কি। আমাদের মেয়েরা কোনদিন ফল দেখত না। অথচ কী গভীর ব্যঞ্জনাময় এই লৌকিক শব্দটি!

ওদের কিশোরী এবং যুবতী মেয়েরা খুব চ্যাপটা করে মস্ত খোঁপা বেঁধে তাতে গোছা গোছা ঝুমকো ঝোলানো কাঁটা গুঁজে বিকেলে সাজ করত, পাছাপেড়ে শাড়ি আর ভারী ভারী গোট মল অনন্ত পরে ঝর ঝর করে এ ঘর ও ঘর করত, বিনবাতাসে হেলেদুলে খালের ঘাটে এসে পেপাষা হাঁসদের ডাকত– চৈ চৈ চৈ চৈ চৈ!

গোয়ালাদের মেয়েরা কিন্তু কামারদের তুলনায় ছিল সুকুমারী। কামার-রমণীদের দেহে ধাতুর ধার এবং কলঙ্ক, গোয়ালিনীদের শরীরে ক্ষীরের গভীর লাবণি। কিন্তু গোয়ালাদের মেয়েরাও ফল দেখত।

.

কলকাতা

মা মারা যাবার বছরখানেক পরে দিদিমা আমাকে দেখতে চাইলেন। ঠাকুমার সঙ্গে আমি সেই প্রথম কলকাতায় এলাম। সেই আধ শতাব্দী আগেকার কয়েকটি নগরদৃশ্য আজও আমার মনে আছে। মিরজাপুর কিংবা অখিল মিস্ত্রি লেনে ছিল সেই বাড়িটা। শানবাঁধানো ছোট্ট উঠোনের একধারে বিরাট চৌবাচ্চা জলে টইটুম্বুর, তলাটা নিস্পন্দ সবুজ, রহস্যময় আমি নামলে তলিয়ে যেতে পারি। সমস্ত জায়গাটা ছালা পড়া, রোদহীন। বাড়িওলা সোনার বেনে এবং মাতাল। গভীর রাত্রে তার দোতলার মহল থেকে অপ্রকৃতিস্থ চেঁচামেচি শোনা যেত। তাকে দেখি নি। তার যুবতী বোন নীহারকে দেখেছি যখনতখন গল্প করতে নেমে আসত। প্রগাঢ় সুন্দরী এবং প্রগম্ভ। ঐ রকম চুম্বক রহস্য এর আগে দেখি নি। সে আমাকে বুকে চেপে ধরে চুমু খেলে ভিতরের পাখি ছটফট করে উঠত, কিন্তু আমি নড়তে পারতাম না। দিদিমা তার রূপের সুখ্যাতি করলে অলজ্জভাবে বলত, ‘আপনার ছেলে আমার চে বড় হলে বে দিতেন বুঝি?’

ভিতর-উঠোনের বারান্দায় একটা তক্তপোশ পাতা ছিল। সেখানে আমার তরুণী ছোটমাসি পড়াশোনা করত। তার মুখে সরু দড়ির লাগাম দিয়ে আমি ঘোড়ায় চেপে ছিপটি লাগাতাম। ছোটমাসি চমৎকার মেয়ে। ঐ সংসারের দেনা-পাওনায় জড়িয়ে যাবার জন্য সে আসে নি। কয়েক বছরের মধ্যেই টাইফয়েড হয়ে মরে গেল। অনেক কাল পরে, এক দূরদেশে, ভুলে যাওয়া বাতিল জিনিসের আস্তানায় একটা স্টিল ট্রাংকের মধ্যে আমি তার লম্বা চুলের গোছা এবং গানের খাতা আবিষ্কার করেছিলাম। শুকনো চুলের গোছা হাতে নিয়ে স্তম্ভিত আমি যেন স্পষ্ট দেখলাম: ছোটমাসি দৌড়ে চলে যাচ্ছে নাগালের বাইরে– তার দীর্ঘ দীর্ঘ চুলের প্রান্ত এখনও উড়ছে ইহলোকে। ইহজগৎও স্থির পরজগৎও স্থির, মাঝখানে শুধু আমিই কাঁপি।

সন্ধ্যারাত্রে একদিন হগসাহেবের বাজারে যাওয়া হল। কী আলোর বাহার! কী অবাক করা জিনিসপত্র! একটা দোকানে মস্ত শো-উইন্ডো জুড়ে একটা মানুষপ্রমাণ আলুর পুতুল কেবল ডাইনে বাঁয়ে যান্ত্রিকভাবে মাথা নাড়ছিল। আমাকে বোঝানো হল, ওটা মাতাল পুতুল। পুতুলটা উজ্জ্বল, বিরাট এবং অস্বস্তিকর বলেই তাকে মনে আছে।

একদিন রাত্রির কলকাতায় একটা দোতলা ছাদহীন বাসে সবাই মিলে উঠেছিলাম। মাথার উপর কী সুন্দর কালো তারাভরা আকাশ, আর গ্রীষ্মের গভীর বাতাস। রাস্তায় গ্যাসের মৃদু আলোর সারি। চারদিকের সীটে সুবেশ মানুষ। শহরে যে-সুখ বাস করে এতক্ষণে ঠিক তার গন্ধটি পেলাম।

গভীর রাত্রে বাড়ির গলি দিয়ে কুলপি বরফ হেঁকে গেলেই একটি আদায় করতাম। অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে সাদা কুলপি থেকে ধোঁয়া উড়ত। মুখে দিলেই যেন জিভ পুড়ে যেত। গরম কুলপি আস্তে আস্তে শীতল হত আর গলত। খুব ঠাণ্ডার স্পর্শানুভূতি যে পোড়ানির তা মনস্তত্ত্বের বই পড়ার বহু আগেই হাতেকলমে জানা হল।

কলকাতায় এলেই গঙ্গাস্নানে যেতে হয়। একদিন দুই বেয়ান গঙ্গাস্নানে চললেন, সঙ্গে আমি। তাঁদের বুক পর্যন্ত জলে গঙ্গা ঢেউ দিচ্ছেন। আমাকে ঠাকুমা বুকে জড়িয়ে আছেন ডুব দেওয়াবেন বলে। হঠাৎ সেই অবস্থায়, আমাকে নিয়ে দুই বেয়ানে একটা প্যাকট হল: বড় বেয়ানের দেহরক্ষার পর আমি ছোট বেয়ানের কাছে হস্তান্তরিত হব। আমি তখনই আক্ষরিকভাবে ছোট বেয়ানের কাছে হস্তান্তরিত হলাম। আমাকে বুকে নিয়ে দিদিমা ভুস ভুস করে তিন বার গঙ্গায় ডুব দিয়ে ঐ মর্মে তিনসত্য করলেন। দু মিনিটে আমার পরভৃত জীবনের বীজ পত্তন হয়ে গেল। এবং যথাকালে ঐ সত্যের কথা সবারই মনে পড়েছিল।

এর পর কলকাতার স্বল্পকালীন নবাবী শেষ করে আমি আবার গ্রামের মন্থর এবং গভীর জীবনে ফিরে এলাম।

.

 ছোটমা

আমার যখন আড়াই বছর বয়স তখন বাবার আবার বিয়ে হল। বাবার এই জায়গায় বিয়ের আমিই নাকি ছিলাম প্রধান ঘটক। ব্যাপারটা ঘটেছিল এই রকম: একজন গৌরবর্ণ, লম্বা, প্রকটহাড় বুড়ো মানুষ প্রায়ই বিকেলের দিকে দাদুর কাছে আসছিলেন। দাওয়ায় বসে তিনি কথাবার্তা বলেন, আমি দাদুর পাশটিতে থাকি। বুড়ো মানুষটি, আমি টের পেতাম, অন্য রকম বিনীত, আমার প্রতি মনোযোগী এবং কিছু একটা নিয়ে দাদুকে ধরাধরি করছেন। আসলে কন্যাদায়গ্রস্ত ঐ ভদ্রলোক ছিলেন আমাদের চেয়েও গরিব, আর আগের পক্ষের আমার অস্তিত্বও ছিল একটি সমস্যা। দাদু ও ঠাকুমা ঠিক মত দিতে পারছিলেন না। একদিন নাকি, যখন কথাবার্তা নিষ্কল হবার মুখে, আমি হঠাৎ উঠে গিয়ে ক্লিষ্ট লোকটিকে দাদু বলে ডেকে কোলে বসে তাঁকে আপ্যায়ন করলাম। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে নিমজ্জমান ভদ্রলোক আমার ঐ সম্বোধন এবং অভ্যর্থনাকে বিধাতারই ইঙ্গিত হিসেবে। দাঁড় করালেন। দাদু ও ঠাকুমাও আর আপত্তি করলেন না। ব্যাপারটার যেন দৈবনিষ্পত্তি হয়ে গেল। আজ আমরা পাঁচ ভাই এবং চার বোন সবাই জানি, আমাদের ডেসপট, রাগী এবং আজীবন ভাগ্যতাড়িত বাবার পক্ষে আমার ঠিক করে দেওয়া মেয়েটির চেয়ে ভালো পাত্রী আর হয় না।

একই গ্রামে, হাঁটাপথে আধ ঘণ্টা দূরে বাবার নতুন শ্বশুরবাড়ি। একদিন সন্ধ্যা উতরে যাবার পর বাবার সঙ্গে নতুন বউ এসে দাঁড়াল আমাদের বেলেমাটির রুপোলি সাদা উঠোনে। তখন উঠোনের ছ দিকে ছড়ানো ছটি বাড়ি থেকে স্ত্রীলোকেরা ও বাচ্চারা কোলাহল করে বেরিয়ে এসে ভিড় করেছে। ফিকে জ্যোৎস্নায় মস্ত সাদা উঠোন। বারান্দায় হ্যাঁজাক বাতি টাঙানো। বাড়িগুলোর পিছনে হালকা জঙ্গলে-গাছে নরম অন্ধকার অনেক দূরের জঙ্গল-জলের মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে গেছে। ঘন ছোট্ট কোলাহলের মধ্যে আকাশকে খুব স্থির আর নীরব লাগছিল। ঘরে তুলবার আগে, উঠোনেই, বড় একটা কালো পাথরের থালায় মেয়েরা কাঁচা দুধে আলতা গুলে সেই সুন্দর গোলাপী জলে নতুন বউকে দাঁড় করাল। হালকা পায়ের দুটি পাতা সেই পাথরের থালার মধ্যে ছবির মতো লাগছিল। আমাদের বড়পুকুরের জলে বিকেলে হিজলফুল আর সকালে আগের দিনের পুজোর গন্ধরাজ ভেসে থাকত- আমার এই নতুন মাকে কখনো এ ফুল কখনো ও ফুল মনে হত।

বাবার মনে বোধ হয় এই নতুন বিয়ে সম্পর্কে কোনো দুঃখ বা অন্যায়বোধ ছিল। এই স্ত্রীকে নিয়ে তিনি সারা জীবনে কোনো ফোটো তোলান নি। অথচ মৃত স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর যে যুগলে ফোটো ছিল সেটি কলকাতা থেকে বড় করে আঁকিয়ে এনে, এই বিয়ের ছ মাসের মধ্যেই, খুব প্রকট জায়গায় টাঙিয়ে রেখে গেলেন। সে ছবি কোনোদিন স্থানচ্যুত হয় নি। বছর দু-তিন পরে কাকাকে তিনি একটা স্টেশনারি দোকান করে দিয়েছিলেন আমাদের গ্রামের বাজারে। সে দোকানের সাইন বোর্ড নিজের হাতে লিখলেন: সুপ্রভা স্টোর্স। সুপ্রভা তাঁর মৃত স্ত্রীর নাম। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে নি। কৃতজ্ঞ শোকের চেয়ে কৃতঘ্ন শোক অনেক মানবিক। অনেক অনেক বছর পরে, একেবারে অন্য দেশে, বাবা তার শেষ দোকানটির নাম দিয়েছিলেন: শান্তি ফার্মেসি। শান্তি আমার নতুন মায়ের নাম। সাইন বোর্ডটা দেখে সত্যিই খুশি হয়েছিলাম মনের মধ্যে ফুরফুরে একটা কৌতুক খেলা করেছিল। বাবা তাঁর মৃত্যুর আগে নিশ্চয় বুঝেছিলেন, দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে তাঁর যে চারটি ছেলে এবং চারটি মেয়ে জন্মেছিল, যারা দুঃখে-কষ্টে-বিষাদে তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল, তারাই তাঁর আপন, নিঃস্বার্থ, অক্ষুণ্ণ বংশধর।

.

 বাস্তু

গল্পে পড়া রাজার আসনের মতো ছোট্ট বিছানাটা শিশুদের পিঠে অনেকদিন ধরে সেঁটে থাকে। তারা হাত-পা ছোঁড়ে, পায়ের বুড়ো আঙুল টেনে এনে মুখে পোরে, কিন্তু পিঠ আলগা করতে পারে না। হয়তো কিছু না পেরেই তখন পুরুষ-শিশু উলটোমুখে এমন বেগে প্রস্রাব করে যে সেই জলধারা প্যারাবোলিক পথে তার শরীর ডিঙিয়ে, মাথা ডিঙিয়ে শিয়রের কাছে বসা মায়ের গা, দুধের বাটি ভিজিয়ে দেয়। শিশুশরীরের লীলা দেখতে দেখতে শুধু মায়া জড়ায় না, অনেক গ্রন্থিও মোচন হয়। দিনে দিনে সে উপুড় হয়, হামা টেনে মানুষের পিছে ঘোরে, টলতে টলতে দাঁড়ায়, পড়তে পড়তে হাঁটে– সব কঠিন লড়াই একা একা সে নিজে ছাড়া এইসব জয় কেউ বোঝে না। শিশুর জগৎ কুয়াশার মধ্যে কুয়াশা। তবু এইসব ক্রিয়ার সময়ে তার ভীমের মতো উত্তেজিত মুখ দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় আচ্ছন্নতার মধ্যেও কি প্রচণ্ড ভলিশন কাজ করছে। কিন্তু তার সত্যিকারের অ্যাডভেঞ্চার ঘটে যায় সেই দিন, যেদিন সে একা একা সবার চোখ এড়িয়ে ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে উঠোনে পা দেয়। চৌকাঠ ডিঙিয়ে যেতে পোষা ছেলের অনেক সাহস লাগে। কিন্তু ভয়কে ছাপিয়ে ওঠে অন্য রকম ডাক। এই ডাকে সাড়া না দিলে কোনো শিশুর প্রাণ বাঁচে না।

আমিও একদিন দাওয়া থেকে উঠোনে নামলাম, দিনে দিনে উঠোন থেকে গাছের কাছে, গাছ থেকে বনের মধ্যে, এ বন সে বন থেকে পুকুরপাড়ে, তিনখানা পুকুরপার ঘুরে মাটির রাস্তা ধরে খালের পাড়ে গিয়ে আটকে গেলাম। আমাদের পাঁচ শো বিঘের হালকা বন এবং ঘোর জঙ্গল, পুকুর, খেতের মাঠ ও শ্মশান নিয়ে শরিকী বাড়িটা ঘিরে আছে পরিখার মতো খাল। তার জোয়ার-ভাটা-খেলা জলের উপরে বাঁশের উঁচু সাঁকো। ওপারে অন্য বাড়ি। বড়দের কোলে চেপে দূরদূরান্ত কলকাতায় যাওয়া, আর। একা পায়ে পায়ে এই নির্জন খালপাড়ে আসা– এ দুইয়ে অনেক তফাত।

কিন্তু প্রথমে বন্দনা এবং বর্ণনা করি আমাদের বাস্তভিটেটির। এজমালি বিশাল উঠোনটার পশ্চিম দিকে আমাদের ভিটে। মাটির ভিত, বাঁশের খুঁটি, কাঠের পাটাতন, টিনের চাল। আস্ত আস্ত ত্রিশিরা হোগলাপাতা, চাছা চেরা বাঁশ ও বেতের বাঁধন দিয়ে তৈরি হালকা বেড়া। উপরে আদ্যিকালের অক্ষয় করুগেটেড শীট আর নিচে স্থাবর মাটির ভিতটি ছাড়া সমস্ত বাড়িটাই পলকা। খুঁটির পাকা বাঁশগুলো মানুষের হাত লেগে লেগে চিক্কণ এবং রক্তাভ হলদে। পাকা হোগলাপাতার বেড়া নরম এবং সোনালি বাইরে কড়া রোদ থাকলে হোগলাপাতার ফাঁপা শরীর ভেদ করে ঘরের মধ্যে আভা আসে। রাত্রে, বনের অন্ধকারে রেড ইন্ডিয়ান টিপিতে রান্নার আগুন জ্বললে বাইরে থেকে তাকে আলোভরা ফানুসের মতো দেখায়, দিনের বেলা তেমনি আমাদের ঘরের ভিতরটা। –বাড়িটা যেন দিনের মণ্ডলের মধ্যে আছে। বেড়ার সমান্তরাল ঠাসা হোগলাপাতায় যদি কোথাও কোনো সূক্ষ্ম ফাঁক থাকত সেখান দিয়ে সূর্যের কিরণ ঢুকত তীক্ষ্ণ ব্লেডের পাতের মতো। হঠাৎ সেই কিরণের মধ্যে দেখতাম সাত রঙের কণার বিচ্ছুরণ।

ঝড়ে এই পলকা বাড়ি উড়ে যেতে পারে, একবার রাত্তিরে গিয়েছিল। সেদিন আমরা অন্ধকারে, ঝড়ে-জলে লণ্ঠন নিয়ে খুব ছুটোছুটি করেছিলাম। সমস্ত রাত ধরে বাড়িটা পাখির ছেঁড়া বাসার মতো আমাদের কয়েকটা অস্থাবর সম্পত্তি বুকে নিয়ে ভিজল। পরদিনই দাদু আর কাকা দুজন ঘরামিকে নিয়ে সকাল থেকে খেটে বিকেলের দিকে গভীর নীল আকাশের নিচে বাড়িটাকে যথাস্থানে দাঁড় করিয়ে ফেললেন।

আমি লক্ষ করতাম, বাড়িটার চারখানা কামরায় চার রকমের আলোবাতাস। পুবখোলা বারান্দার লাগোয়া, উত্তর দক্ষিণে লম্বা কামরাটায় তাজা এবং ঝকঝকে আবহাওয়া রোদ সকালে সরাসরি আসে, সাদা উঠোন থেকে প্রতিফলিত আলো দুপুরে বাদামী হয়ে ঘরে ঢোকে। বিকেলে ওদিকেই আগে ছায়া পড়ে শুষ্ক ছায়া। ঘরটায় সংসারের গন্ধ কম। ঐ সরু ঘরটা সারা দিন দাদুর, রাত দ্বিতীয় প্রহরের পরে কাকার।

এর পিছনের কামরাটা বড়, প্রায় চৌকো। এখানে হাওয়া এবং রোদ দুইই কম, ছায়া এবং আভা বেশি। এখানেই দুপুরে ঠাকুমার আজ্ঞা এবং সন্ধ্যা হলেই আমাদের ঢালাও গড়াবার ব্যবস্থা। এই ঘরের মেঝের মাটিতে আমি তারার দেশের, কিন্নরলোকের এবং প্রেতলোকের রং আবিষ্কার করেছিলাম। ঘটনাটা এই রকম: একদিন বাইরে খুব ছোটাছুটি ঘোরাঘুরি করে এসে সটান মেঝেতে গড়িয়ে পড়েছি। ঘরে কেউ নেই। ঠাণ্ডা মাটির স্পর্শ চমৎকার লাগছে। আমি সাপের মতো উপুড় হয়ে মাটিতে চিবুক লাগিয়ে লম্বা শুয়ে আছি। আমার নিচু চোখের দৃষ্টি জ্যামিতির স্পর্শকের মতো হাত দুয়েক দূরের মাটির সমতল আলগাভাবে ছুঁয়ে আছে। এই রকম অবস্থিতিতে চোখের ফোকাস হয় না। আমার শরীর কেমন যেন শান্ত আর মন নিস্তব্ধ হয়ে এল। আমি ঐভাবে থেকে দেখতে পাচ্ছি মাটির ধূসর শান্তি। হঠাৎ ঐ ধূসর আবছায়ার গায়ে দেখলাম, জেগে উঠছে অস্পষ্ট রঙের গুঁড়ো সিঁদুরের ধুলোর মতো ছড়িয়ে ছড়িয়ে আছে সবুজ, খয়েরী, লাল, বেগুনী, নীল, ময়ূরকণ্ঠী। সেই অতি সূক্ষ্ম গুঁড়ো ক্রমশ নড়ছে, জায়গা পালটাচ্ছে, কখনো চক্রের মতো ঘুরছে। দেখতে দেখতে ক্রমশ মনে হতে লাগল, মেঝেটা যেন একটা ধূসরছায়া আকাশ, তার মধ্যে অসংখ্য অগণ্য নানা রঙের কণা কণা গ্রহ নক্ষত্র রছে। সেই শুরু। তার পর থেকে আমি প্রায়ই মেঝেতে ঐভাবে শুয়ে নিস্পন্দ হয়ে মাটির রং দেখতাম। এক এক দিন রং এমন ঘোর এবং তার কমবিনেশন এমন ভয়ংকর হয়ে উঠত যে আমি ভয় পেতাম। আর এক এক দিন শান্ত, নরম, আবছা যেন পরীর পাখায় ফুলের রেণু। এক এক দিন ঐ রঙের কণার মধ্যে থেকে দ্যুতি বেরুত। আবার খানিকক্ষণ পরে, মেঘ এসে যেমন তারা ঢেকে দেয় তেমনি তাদের উপর ছায়া পড়ে যেত। আমি বুঝেছিলাম, আমি ছাড়া আর কেউ ঐ রং দেখতে পায় না। সবাই অন্যমনস্কভাবে ওদের উপর দিয়ে বড় বড় পায়ের পাতা ফেলে হেঁটে যায়।

ঐ দু নম্বর ঘরের সংলগ্ন উত্তরে, পুব পশ্চিমে লম্বা তিন নম্বর ঘর। এখানে একটু মেয়েলি গন্ধ। ছোটমা, বড়মা বাড়ির দুই বউ থাকে এখানে। দুপুরে বড়মা পুরনো কাপড় টানটান করে বিছিয়ে রঙিন পাড়ের সুতোয় কথায় ফোড় দেন। পাথরের আঁতায় ভাল ভাঙেন। ঘুঘুর গায়ের বুটির মতো খোসাসুদ্ধ মুসুর ডাল ভেঙে গিয়ে আঁতার দুই পাথরের ফাঁক দিয়ে রক্তাভ চন্দনটিপের ফোয়ারা ছোটে। ছোটমা চটের উপর রঙিন সুতো দিয়ে আসন তৈরির চেষ্টা করে। পুকুরপাড়ে আর বাগানে পাখি ডাকলে এই ঘর থেকে স্পষ্ট শোনা যায়। দুপুর হেলে পড়লে আলো ছায়া হাওয়া আর পড়ন্ত রোদ এই ঘরে লতার মতো দোলে সধবা, বিধবা দুই বউ আর তাদের চার অচিন সই।

এই ঘরের পুব দিকের জানলায় শিউলি গাছ, ডালিম গাছ, আর পশ্চিমের দরজা দিয়ে নিচে নামলেই বাঁ দিকে বেলফুলের সারি, শশার মাচা, বাতাবি লেবুর গাছ। সামনের দিকে জামিরের গাছ ঝোঁপ হয়ে আছে, করমচা গাছে রত্নের মতো পাকা করমচা। তার পিছনে আরো গাছ, জিয়লের বেড়া, কলমি লতায় ভরা পশ্চিমপুকুর। পুকুরের ওপারে বড় বড় গাছের বন-বাগান।

এই ঘরের ঠিক মধ্যিখানটিতে একটা বাঁশের খুঁটি। সিঁদুরসোনালি খুঁটিটা তৈলধারার মতো পিচ্ছিল। আমি ঐ খুঁটি এক হাতে ধরে লাট্রর মতো বনবন করে ঘুরতাম। খুঁটির পাশেই বাঁশের একটা আলগা মই। মইয়ের মাথায় পাটাতনের চৌকো ফোকর। ঐ ফোকর দিয়ে উপরে উঠলেই হাতের কাছে সারি সারি মুখবন্ধ জালার মধ্যে মুড়ি, ছাতু, মোয়া, গুড়, ঝুনো নারকেলের পাহাড় আর বাসন। সেখানে ধেড়ে ইঁদুরেরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বাস করত। পিসতুতো ভাইয়েরা এলে, তাদের সঙ্গে রাত্রে আমিও ঐ পাটাতনে শুতে যেতাম। টিনের চালের উপর শিশির পড়ত। চাল এবং বেড়ার জোড়ের ফাঁক দিয়ে ফুরফুর করে হাওয়া আসত। ফাঁকে চোখ রেখে দেখতাম, ভাঙা চাঁদ হেলে পড়েছে। আমরা যেন এক অচল জাহাজের কেবিনে শুয়ে আছি।

তিন নম্বর ঘরের পাশেই রান্নাঘর। তার ভিত দুই সিঁড়ি নিচু, গোলপাতার ছাউনি। সে ঘরে তিনটি উনুন, পাঁজা সাজানো কাঠ, কলসিভরা জল। সেই ঘরটাই দুপুর তিনটে পর্যন্ত বাড়িটার হৃৎকেন্দ্র, যজ্ঞস্থলী।

.

আমাদের ভাঁড়ার

আমাদের গ্রামের জীবনে, চার বেলা খাবার নানান উপকরণ সংগ্রহ, রান্না করা এবং শিশুদের অনন্ত খাওয়া– এই তিনেতেই ভরে থাকত আমাদের দিনক্রিয়া, আমাদের আনন্দ, আমাদের দুঃখও। সকালবেলা দাদু কোনোদিন কাঁটায় ভরা বেত লতার জঙ্গল থেকে সবুজ একগোছা বেতের ডগা কেটে এনে নামিয়ে দিলেন রান্নাঘরে। বড়মা স্নান করতে গিয়ে ডুব দিয়ে দিয়ে তুললেন ফুলসুদ্ধ সজল শাপলা। ছোটমা আঁকশি দিয়ে পশ্চিমপুকুর থেকে টেনে টেনে নিয়ে এল কলমি আর হিঞ্চে। গিমে শাক, থানকুনি আর বিলিতি ধনেপাতা তো রান্নাঘরের ছাঁচতলায় হয়েই আছে, আমিই খুঁটে খুঁটে তুলে আনতে পারি। এসব হল হাতের কাছে পাওয়া প্রথমভোরের জিনিস।

এ ছাড়া আরো অন্য রকম জিনিস ছিল, যাদের জন্য বনেবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে কিছু খোঁজখবর রাখা দরকার। এ বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন বড়মা আর দাদু। বনের ছায়াচ্ছন্ন জায়গায় কোথায় সবুজ অলংকারের মতো ঢেঁকির শাক জন্মেছে, কচি ডুমুর কবে খাওয়ার মতো ডাঁশা হল, কোথায় নতুন তেলাকুচো লতা গাছ বাইতে শুরু করেছে, ওলের ভাটারা কবে লম্বা হয়ে ফণা তুলল বনের এসব নিঃশব্দ ঘটনা কখনো বড়মার চোখ এড়াত না। দাদুর মন যদিও এসব মেয়েলি কাজে নেই তবু বনবাগানের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা ছিল আরো গভীর। তিনি চিনতেন সমস্ত ভেষজ লতাগুল্ম। ফলে সারা শীতকালটা আমাকে তাঁর তৈরি পাঁচন খেতে হত।

একবার দুর্দিনে দাদু দুপুরের পর খন্তা হাতে বেরিয়ে একটা দুর্গম জায়গা থেকে মন দেড়েক ওজনের এক বিশালকায় মেটে আলু নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছিলেন। সেই রোমাঞ্চকর অভিযানে আমি তাঁর সঙ্গী ছিলাম। আদিম জগতে প্রাচীন শিকারীর সঙ্গে বালক যেদিন প্রথম শিকারে যায় তার কেমন লাগে, আমি একটু একটু তার স্বাদ পেয়েছিলাম সেদিন। আমাদের পশ্চিমপুকুরের পাড় দিয়ে যে শুড়িপথটা খালের দিকে গেছে সেই পথের বাঁ পাশে ঘন বন। দাদু আর আমি সেই বনে ঢুকতেই মানুষের সাড়া পেয়ে দুটো বিরাট গোসাপ হুড়মুড় করে যেন কোন্ দিকে চলে গেল। কী ঠাণ্ডা ছায়া চারদিকে! বড় বড় কড়ুই গাছ, শিরীষ গাছ, জারুল গাছ তাদের পেঁচিয়ে উঠেছে চই লতা, অনন্ত লতা, আরো কত বুনো লতা। মাটির বুক আঁকড়ে আছে অজস্র আসশ্যাওড়া, অন্যান্য ক্ষুপ আর গুল্মঝোঁপ। দাদু চারদিক একবার দেখে নিয়ে নিশ্চিত পায়ে গিয়ে বনের মধ্যে একটা জায়গায় থামলেন। সেখানে দু হাত দিয়ে ঝরা পাতা সরাতেই দেখা গেল একটা শক্ত লতা সরস কালো মাটির মধ্যে মুখ সেঁধিয়ে আছে সাপের মতো, তার ল্যাজের দিকটা বেয়ে উঠেছে পাশের গাছের উঁচু মগডালে। দাদু নীরব মনোযোগে লতাটার গোড়া বাঁচিয়ে প্রায় দু হাত বেড় জায়গা নিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগলেন। আমি নারকেলের মালায় করে সেই মাটি তুলছি। মাটির সোঁদা গন্ধ, গাছপালার কবোষ্ণ গন্ধ, চারদিকের নীরবতা আর ঝিরঝিরে হাওয়া আমাদের ঘিরে আছে। বনের মধ্যে এক বুড়ো আর এক বালক–আমরা দুজনে মিলে একটা কাজের খেলা খেলছি। মাঝে মাঝে খন্তার ধারালো ফলায় দু-একটা কেঁচো, মাটির নরম কুমুরে পোকা দু-আধখানা হয়ে যাচ্ছে। দাদু গর্ত ক্রমশ গভীর করে চলেছেন আর গর্তের মাঝখানে মাটিতে ডোবা সুবিশাল কন্দ তার কালচে বেগুনী রঙের পাঁজর, বিস্তৃত পাছা এবং শক্তিশালী উরু নিয়ে ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু মাটি আঁকড়ে থাকা সেই মহাবল কন্দকে উপড়ে তোলে কার সাধ্য! দাদু ঘেমে নেয়ে উঠলেন। গর্ত আরো গভীর ও বিস্তৃত হতে লাগল। আমার সারা গায়ে মাটি মাখামাখি হয়ে গেল। মাটির সঙ্গে ঘাম আর আনন্দ। শেষটায়, অপরাহুঁকালে দৌড়ে গিয়ে বাড়ি থেকে মোটা দড়ি নিয়ে এলাম। দাদু সেই দড়ি কন্দের কোমরে বেঁধে খন্তায় আটকে চাড় দিলেন। চড়চড় শব্দে তার নিচের শিকড় ছিঁড়ে গেল। তার পর যখন সেই বিশাল কন্দকে টেনে উপরে তোলা হল, আমি দেখলাম, যেন কালো পাথরের তৈরি মহীরাবণ উঠল মাটি থেকে। সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে নিয়ে যখন তাকে ফেলা হল, সবাই বলল, এত বড় মেটে আলু তারা জীবনে দেখে নি। বেগুনীকালো ছালের তলায় তার দেহ খোয়া ক্ষীরের মতো সাদা, ভরাট।

এইসব বনের খাদ্য ছাড়াও ছিল আরেক রকমের খাদ্য, মাঠের। শীতকালের শিশিরে ভিজে থাকা গাঢ় সবুজ কলাই শাক আর হালকা সবুজ মটর শাকের কী স্বাদ! তা ছাড়া বড়মার ছিল কিচেন গার্ডেনের শখ। তাঁর ঝাঁপিতে মজুত থাকত শশা, কুমড়ো, লাউ, রাঙা শাক, ডেঙোডাটার বিচি। বর্ষায়, শরতে, হেমন্তে, শীতে আমাদের কত প্রাচুর্য!

এ ছাড়া, শিশুদের ছিল বনে, মাঠে, বাগানে, ভিটের এদিকে সেদিকে চিরদিনের নিজস্ব ভাণ্ডার। গ্রীষ্মের দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে যখন বাড়িটা শুনশান তখন আমরা আঁকশি হাতে বেরুতাম। তেজী রোদ্দুরে চারদিক খাঁ খাঁ করছে, নীল আকাশের মধ্যে পৃথিবী আপন ভারে উদাস হয়ে গেছে, মেয়েরা পুকুরঘাটে কিংবা অন্দরে, বুড়োরা ঘুমিয়ে। আমরা বেতবনে গিয়ে খুঁজে খুঁজে সাদা থোপা হোপা বেতফল পাড়তাম। খোসা ছাড়িয়ে সেই গভীর চোখের তারার মতো ফল তেল হলুদ নুন মাখিয়ে দুখানা নারকেলের মালার মধ্যে বন্ধ করে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে যখন বার করতাম তখন তার স্বাদ, শুধু বলা যায়, অনির্বচনীয়। আমরা সেই জারানো ফল, যে যার ভাগ নিয়ে, একটি একটি করে জিভ আর টাকরার মধ্যে রেখে আলতো একটু চাপ দিতাম আর আমাদের দেহমনসত্তা সুখে ভরে যেত।

রোদ্দুর একটু হেলে পড়লে, বড়পুকুরের ওপারে আমাদের নিজস্ব শ্মশানের গা ঘেঁষে যে প্রাচীন কাঁটাবোহরের গাছ, তার তলায় গিয়ে দেখতাম বোহর পেকেছে কোন ডালে। একসঙ্গে দু-তিনজন গাছে উঠে আমরা বাঁদরের মতো সেই ডালের দিকে এগোতাম যেখানে ঐ খুদে খুদে ফল লালচে হয়ে আছে। বোহরের গাছে উঠলে কাঁটায় হাত-পা ছড়ে যাবেই, আর ফলগুলোও মটরদানার চেয়ে বড় না। তবু কোন টানে অত কষ্ট করতাম? সেই কষায় স্বাদ রুক্ষ ফলের সঙ্গে মিশে ছিল বড়পুকুরের জলের আভা, শ্মশান সংলগ্ন হাওয়া, বিকেলের আলো ফল পাড়তে পাড়তে বাঁ পাশে তাকালেই দেখা যেত কর্মকারদের কালীতলা পেরিয়ে, খাল পেরিয়ে, অনেক দূর ধূসর হয়ে ছলছল করছে।

বোহর গাছের পাশেই ছিল প্রকাণ্ড গাব গাছ। ঘোর কালো তার কাণ্ড, অঘোর কালো তার শাখাপ্রশাখা। ঘন গাঢ় পাতায় তার মাথার ভিতরটা অন্ধকার করে আছে। বছরের একটা সময় সবুজ গাব পেকে হলদে হয়ে যায়। ‘আমি পাকা গাবের লোভে গাছে উঠতাম। কিন্তু পাতার ঐ থমথমে অন্ধকারের মধ্যে মহা ভয় করত। গাব গাছের মাথার মধ্যে এক নিস্তব্ধ ব্যক্তিত্ব- অন্য জগৎ। আমি ভয় পেয়ে পালিয়ে আসতাম।

পশ্চিমপুকুরের পারে বাঁশঝাড়ের কাছে ছিল জামরুল গাছ। বর্ষায় জামরুল ধরত, আর বৃষ্টি হলে জল খেয়ে খেয়ে তারা টোবাটোবা হয়ে থাকত। কিন্তু সেই গাছে ছিল লাল নালশে পিঁপড়ের বাসা। জামরুলপল্লবের পাতা সূক্ষ্ম উর্ণায় জড়িয়ে জড়িয়ে তারা দশ-বারোখানা ঝুলন্ত পিঁপড়ে-গ্রাম তৈরি করেছে। সারা দিন গাছটা জুড়ে তাদের ব্যস্ত যাতায়াত যেন হাজার হাজার সান্ত্রী রাজত্ব পাহারা দিচ্ছে। ওখানে পা দেয় কার সাধ্যি! বৃষ্টির পরে দেখতাম, থোলো থোলো সাদা জামরুল রসে টসটসে হয়ে আছে। আমি চটের বস্তা গায়ে জড়িয়ে দ্রুত উঠে পড়তাম গাছে, ঝপাঝপ কয়েকটা থোলো ছিঁড়ে মাটিতে ফেলেই দুড়দাড় নেমে পড়ে গায়ের বস্তা ছুঁড়ে ফেলতাম। তাতে তখন কয়েক শো পিঁপড়ে কামড়ে আটকে আছে। আর, এত বর্মচর্ম সত্ত্বেও বেশ কয়েকটা আমার মাংসে সাঁড়াশির দাঁত বসিয়ে দিয়েছে। কালবিলম্ব না করে গায়েই তাদের ডলে মেরে ফেলতাম।

জামরুল গাছের পাশেই ছিল গোলাপজাম গাছ। তারাঝুমকোর মতো তার সাদা ফুল পাতাপল্লবের ছায়াচ্ছন্নতার মধ্যে অপরূপ লাগত। গোলাপজাম পাকলে ফলের মধ্যে তার বিচিটি আলগা হয়ে ঠনঠন করে।

ধনদিদিদের ঘরের কোণ ঘেঁষে ছিল এক সটান উঁচু কালোজাম গাছ। সেই গাছে কত্রীর অনুমতি ছাড়া ওঠা যেত না। কিন্তু এক বার অনুমতি পেলে কখন নামছি তাও কেউ দেখত না। জাম খেতে খেতে জিভ বেগুনীনীল এবং পুরু হয়ে যেত। তখন ডালে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে গাছের তলায় অপেক্ষমাণ বালিকাদের জন্যে হরির লুট দিতাম।

কৃশ ঋতুতেও বনবাগানে ঘুরতে ঘুরতে কিছু না কিছু পাওয়া যেত। একবার বহেড়া গাছের তলায় শুকনো পাতার মধ্যে ঝরে পড়া কয়েকটা বহেড়া পাওয়া গেল শক্ত, খাবার অযোগ্য ফল। কিন্তু একজন আমাকে শেখাল, বহেড়ার মধ্যে ছোট্ট একটি বাদাম আছে– দা দিয়ে খোলাটাকে কাটলেই তাকে পাওয়া যাবে।

পশ্চিমপুকুরের পাড় দিয়ে যে পায়ে চলা পথ খালের দিকে চলে গেছে, একটু এগোলেই, তার দু দিকে দুটো বিস্তৃত কৃষিখেত। সেখানে চাষীরা চাষ দিত– বাঁ দিকের খেতে বর্ষায় পাট, ডান দিকের খেতে শীতে মটর, কলাই। আমরা শীতের দুপুরে মটরশুঁটির লোভে সেই খেতে ঢুকতাম। মাটির উপর শুয়ে পড়লে সবুজ ফুরফুরে মটর লতা আমাদের ঢেকে দিত, কেউ আমাদের অস্তিত্ব টের পেত না। আমরা মটরশুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে প্রাণ ভরে তাদের কচি দানা খেতাম। টনটনে এবড়োখেবড়ো মাটির উপর শুয়ে সবুজ মটর লতার ফাঁক দিয়ে দেখা যেত শীতের নীল আকাশ। মটর লতার শম্পগন্ধ আর নরম রোদ আমাদের গায়ে জড়িয়ে যেত। হঠাৎ হঠাৎ কুবোপাখির কু কু কুব কুব আর শঙ্খচিলের টি টি টি টি-ই ডাক সেই ফুরফুরে জালের গায়ে অন্য সুতোর ফোঁড় দিয়ে যেন রহস্যজগতের ফুল এঁকে দিত। আমাদের সাহস ক্রমে বাড়ছিল। আমরা একটা ভাঙা কড়াই জোগাড় করে তেল নুন দেশলাই নিয়ে সেই মাঠে যেতে লাগলাম। সেই মটর লতার বনে বসেই শুটি ছাড়াই, পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বালি আর কড়াইতে তেল নুন দিয়ে শুটি ভেজে খাই। কেউ আমাদের দেখতে পায় না। একদিন শুটি ভেজে পেট পুরে খেয়ে সবুজ লতার তলায় মৌতাতের মতো লাগল। আমরা গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন শীতের ঠাণ্ডা কাঁপুনিতে ঘুম ভাঙল তখন দেখি, সর্বনাশ! চারদিক ঘোর অন্ধকার, মাথার উপর আকাশ তারায় ছেয়ে গেছে। আমরা রিপ ভ্যান উইংকলের মতো কতক্ষণ ঘুমিয়েছি। কিন্তু এখন বাড়ি ফিরব কি করে? বাঁ দিকে খালপাড়ের সেই বিরাট তেঁতুল গাছে জোনাকিরা ঝমঝম করছে। আমাদের শরীর ভয়ে ভারী হয়ে গেছে। তেঁতুল গাছে কিসের যেন ঝটাপটি। কে যেন কার ঘাড় মটকে রক্ত খাচ্ছে। এমন সময়, দূরে, বাড়ি থেকে আমাদের নাম ধরে ডাকাডাকি শোনা গেল। আমরা অনেকক্ষণ পরে ভাঙা গলায় সাড়া দিতে পারলাম। মিনিট কয়েক পরেই কাকা লন্ঠন হাতে এসে আমাদের উদ্ধার করল।

আমাদের বাড়ির বেশির ভাগ আম গাছই ছিল এজমালি। ঐ গাছগুলো থেকে টুপটাপ ঝরা কচি আম, কালবৈশাখীর ঝড়ে বোঁটা ছিঁড়ে ছিটকে পড়া আঁটো আম আর গভীর রাত্রে খসে যাওয়া পাকা আমগুলোর উপর কারো স্বত্ব নেই– যে কুড়িয়ে নিতে পারে, আম তার। বোল থেকে কবে গুটি ধরেছে খেয়াল করি নি হঠাৎ একদিন বড়মা মুঠো খুলে দেখাতেন একটি সবুজ কচি আম। আগন্তুক সেই প্রথম আমটি আমাদের গ্রীষ্মের নিশান। তার পর থেকে আমের পাতলা অম্বল, টক ডাল, ঘন চাটনি আমাদের খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন আনত। ঝাঁ ঝাঁ রোদ্র, সরষের ঝাঁঝ আর আম মিলিয়ে, মেয়েদের নিজস্ব রিয়ালের পর, টনটনে মাটির হাঁড়িতে তৈরি হত কাসুন্দি। কালবৈশাখী ছুটলে বালক-বালিকাদের সঙ্গে আমিও ছুটতাম আম কুড়োতে। বনের মধ্যে আমতলায় ঝড়ের কী বেগ! সাঁই সাঁই, কড়কড়, সোঁ সোঁ বাতাসের, বাজের, গাছের শব্দ। পাতা ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে, মুচড়ে ভাঙছে বড় বড় ডাল, আমগুলো ভয়ংকর ট্রাপিজে দোল খেতে খেতে দড়ি ছিঁড়ে কোথায় যে গিয়ে পড়ছে! আমরা ঝড়ের মধ্যে হুলুস্থুল করছি। হুলুস্থুলটাই আমি বেশি করতাম। দেখছি আম ছিটকে পড়ছে, কিন্তু আমার আগেই গিয়ে কেউ সেটাকে কবজা করে নিল। খালি হাতে ফিরছি দেখে কেউ তার নিজের সম্পত্তি থেকে দু-চারটে দিয়ে দিত। তবু আমি প্রত্যেক বার প্রতিযোগিতায় যেতাম- আমের চেয়েও, ঝড়ের কেন্দ্রে, জমাট কালো মেঘের কেন্দ্রে নিজেকে পাখির পাখার মতো উড়োতে বড্ড ইচ্ছে করত।

আম পেকে ওঠার পর থেকেই বড়মা রাত্রে মাচায়-বসা-শিকারীর মতো সজাগ হয়ে যেতেন। মশারির বাইরে তাঁর মাথার কাছে লন্ঠন মিটমিট করত। গভীর রাত্রে বনের মধ্যে বাতাস এবং গাছেরা অনেক রকম শব্দ করে। তার মধ্যে পাকা আমটি খসে পড়ার নিঃসঙ্গ শব্দটা তিনি শুনতে পেতেন। আর অদ্ভুত শব্দভেদী কান তাঁর শোনামাত্র লণ্ঠন হাতে ছুটে যেতেন ঠিক অকুস্থলে। আম আর লণ্ঠন দু হাতে নিয়ে ফিরে এসে আবার শুয়ে পড়তেন। এই রকম এক এক রাত্তিরে কত যে বার! পুকুরপাড়ের আম গাছ থেকে ভারী আম ঝুপ করে জলে পড়ে কাদায় গেঁথে যেত, বড়মা তাও টের পেতেন। তাঁর গুণপনা এবং দয়ায় আমরা প্রচুর আম খেতে পেতাম। একবার মনে আছে, বিকেলবেলা রান্নাঘরে বঁটি পেতে বড়মা আম কেটে কেটে দিচ্ছেন, আমি আর আমার ছোট ভাই খাচ্ছি। খাবার পরে আঁটি গুনে দেখা গেল, ৭২ টা।

পিসতুতো ভাইয়েরা এলে, এজমালি গাছ থেকে রাত্রে ডাব চুরি করে চাঁদের আলোয় বসে খাওয়া হত। আমার মনে হত, আমরা যেন সাতভাই চোর। সকালবেলা গাছতলায় কাঁদি কাঁদি ডাবের খোলা কাটা মুণ্ডের মতো পড়ে আছে দেখে ধনদিদি তারস্বরে গালাগাল। দিতেন, শাপ দিতেন– যেন তেরাত্তির না পোয়ায়, অতিসারিয়ারা যেন কলেরা হইয়া, মরে! আমরা মুখ লুকিয়ে হাসতাম। ছোটমা আমাদের কীর্তি কি করে যেন টের পেত, কিন্তু কাউকে বলত না।

আমার পিসতুতো ভাইয়েরা বুনো ফল নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করত। বনের মধ্যে ছোট ঘোট একরকম গাছে আতার বিচির মতো কালো কালো ফল ধরত। তারা আমাকে ঐ ফল খেতে শেখাল বেরিজাতীয়, বেশ মিষ্টি। তারা বলত, আগে দেখে নিবি পিঁপড়ে লাগছে কিনা। যে ফল পিঁপড়েরা খেতে পারে সে ফল মানুষরাও খেতে পারে। কিন্তু একবার বিষফল খেয়ে একজন ভিরমি গেল। ছোটপিসিমা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, মরুক, দু-একটা মরলে আমার হাড় জুড়োবে না। আমার পিসতুতো ভাইয়েরা ছিল পঙ্গপালের মতো। দু-এক মাস থেকে ওরা যখন চলে যেত তার পরে অনেক দিন আমাদের বনবাগান। গাছপালা উষর হয়ে থাকত।

বড়মা তার বাপের বাড়ির গ্রাম থেকে একটি অনবদ্য খাবার সঙ্গে করে আনতেন। তার নাম হোগলগুঁড়ি। পৃথিবীতে অমন সুখাদ্য আর আছে কিনা সন্দেহ। মিশরের প্যাপায়ারাসের মতো হোগলা গাছ জন্মায় জলাতে। জলের উপর সবুজ কিরিচের মতো তন্বী, সরল হোগলা গাছ। তার ডাঁটায় ফুল ফোটে। সূক্ষ্ম গুঁড়ো গুঁড়ো রেণুতে ভরে থাকে সেই ফুল। নৌকো বেয়ে বেয়ে লোকেরা ফুলের গা থেকে ঐ রেণু সংগ্রহ করে। সুগন্ধ হলদে রেণু রৌদ্রে শুকিয়ে নিলেই তৈরি হল সোনার গুড়োর মতো হোগলগুঁড়ি। গুড় আর নারকেলকোরা মিশিয়ে খেতে হয়।

আমরা ছাড়তাম না কিছুই। বসন্তকালে রক্তিম পলাশ আর শীতের মাঠে যেতে যেতে সাদা দ্রোণফুল তুলে তাদের অকিঞ্চিৎকর মধুও চুষতাম। সেই কণিকামাত্র মধু শুধু জিভের ডগায় মুহূর্তের মিষ্টি স্পর্শানুভূতি দিয়ে মিলিয়ে যেত। তাও কত সুখ!

চালতা ছিল মেয়েদের প্রিয়, কিন্তু আমি রহস্যময়ভাবে আকৃষ্ট হতাম চালতার ফুলে। বিরাট গাছে, উঁচুতে, জমাট টুকরো টুকরো জ্যোৎস্না দিয়ে গড়া যেন স্বপ্নের দেশের ফুল। তার শুভ্রতা আর পাপড়ির গড়ন দেখতে দেখতে কোনো গভীর সৌন্দর্যের কথা অস্পষ্টভাবে মনে পড়ে, নির্জন মনের মধ্যে অন্য কোনো দূর জন্মের স্মৃতি ফুটব ফুটব করেও অন্ধ হয়ে যায়। আমি আস্তে আস্তে তার পাপড়িতে হাত বোলাই।

.

ধান চাল মাছ

যুগ যুগ ধরে আমাদের সাধারণ খাদ্য ভাত, মসুর ডাল আর মাছ। শীতের পর থেকেই চালের বিশাল বিশাল নৌকো সারি বেঁধে এসে লাগত আমাদের বাজারের খালে। মাছের পেটে যেমন ডিম থাকে নৌকোগুলোর পাটাতনের নিচে খোল ভরতি থাকত চাল। এক একখানি নৌকো একাধারে চালের ভাসমান দোকান ও গুদোম এবং ব্যাপারীর বাসস্থান। ব্যাপারীরা বেশির ভাগই মুসলমান। তাদের পরনে মার্কিন কাপড়ের লুঙ্গি, গায়ে সাদা পিরান, মাথায় চাঁদির মাপে বসানো সাদা কাপড়ের ইহুদি স্ক্যালপ ক্যাপ। দামদর করার সময় তাদের মৃদু গম্ভীর কথাবার্তা সম্ভ্রম উদ্রেক করত। আমার মনে হত, ওরা গাছের মতো অভিজ্ঞ। বিকেলের শেষে তারা ছইয়ের বাইরে পাটাতনের উপর গামছা বিছিয়ে নিয়ে নমাজ পড়ে। তখন তারা মনের মধ্যে কিছু বলে, তাদের মিশকালো দাড়ি নড়ে। খালের জলে স্তব্ধতা, আকাশে স্তব্ধতা, তার মধ্যে তাদের বার বার স্তব্ধ দাঁড়ানো এবং হাঁটু গাড়া সন্ধ্যার শান্তির লগ্নকে আরও গাঢ়তা দিত। দূর অস্তসূর্যরেখার এপারে ওপারে শান্ত আকাশের জারক রস অদৃশ্য হয়ে ছড়িয়ে আছে।

ধান কিনে চাল করলে গৃহস্থের সাশ্রয় হয়। ধান থেকে চাল করার খুঁটিনাটির মধ্যে মেয়েদের কতকালের জ্ঞান আর গৃহস্থছন্দ। দুপুরে রোদ তেতে উঠলে গোবর নিকনো চাটাই পেতে ঠাকুমা সেদ্ধ করা ভিজে ধান শুকোতে দিতেন। বড়মা-ছোটমা মাঝে মাঝে এসে উলটেপালটে দিয়ে আবার ঘরকন্নার কাজে চলে যেত। আমি দাওয়ায় বসে পাহারা দিতাম। ঝাক দিয়ে পায়রা নামত ধানে– সাদা, ময়ূরকণ্ঠী, কালো তাদের লাল ঠোঁট, রাঙা পায়ে নরম আলতা, চোখের মণি দুটো চুনিপাথর দিয়ে তৈরি, কারো কারো আবার মাথায় ঝুঁটি। তারা ধানের উপর হেঁটে হেঁটে গলা বাঁকিয়ে ধান খেত। আমার তাড়াতে মন সরে না। তবু হৈ হৈ করে উঠে হাততালি দিতাম, তারা কলকল করে উড়ে যেত। শালিকরা যত না ধান খেত তার চেয়ে ঝগড়া করত বেশি। আমার ডালিম গাছের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ত, ‘ডালিম গাছে পিরভু নাচে। পিরভু কি রকম? সে কি পাখির মতো কেউ? হলদে রং গা? সোনালি ধানের উপর দুপুরের রূপ ঝরে পড়ত। ধানের চারদিকে আমাদের বালির উঠোন ঝমক দিত। ঘুম পেলে বন্ধ চোখের পাতার বাইরেও যেন পাকা খেজুরের রং দেখা যায়। অনেক দূরে মাঠের মধ্যে দিকশূন্য সূর্য নীলপুজোর ঢাকে কাঠি দিয়েছে—চড়াচ্চড়- চড়াচ্চড়- চররররররর- চরাচর।

আমাদের ঢেঁকিঘর থাকা সত্ত্বেও, কেন জানি না, ছোটমা-বড়মা সুরেন কর্মকারের বাড়ির ঢেঁকিতে ধান ভানতে যেত। আমাদের বড়পুকুরের পুব পারে সুরাকাকার বাড়ি ঘন বনের মধ্যে নির্জন, একলা। সুরাকাকা আর তার বউ নির্বিরোধী এবং অনুগত। শুনতাম, তারা নাকি আমাদের প্রজা। কিসের প্রজা ভগবান জানেন! ঢেঁকিতে ধান ভানতে দিয়ে কি তারা খাজনা শুধত? আমার কিন্তু খুব অদ্ভুত লাগত, অমন নির্জন বনালয়ে একজন যুবক স্যাকরা সোনারুপোর কাজ করে একা, এই কথা ভেবে।

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে বড় বড় গাছের নিবিড় ছায়ার বনপথে ধামায় ধান নিয়ে বড়মা-ছোটমার সঙ্গে আমি তাদের খোলা চেঁকিঘরে পৌঁছতাম। ঢেঁকিতে পাড় পড়ত ক্যাচর ধপ্ কাঁচর ধপ কাঁচর ধপ। বিজন শান্তির মধ্যে ঘুঘু ডাকত। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অস্ফুট মেয়েলি গল্পগাছা চলত। ধান ভানুনীদের ঠোঁটে কপালে ঘাম বিন্দু বিন্দু হয়ে ফুটে রেখা হয়ে গড়িয়ে নামত।

সুরাকাকার বাড়ি যেতে বনপথের একটা বিশেষ জায়গা বড় অপরূপ। আমি চেঁকিঘর থেকে পায়ে পায়ে সেই মায়াবী জায়গাটিতে চলে যেতাম। সেই শুড়িপথের দু দিকে উঁচু উঁচু গাছ, লতা এবং ঝোঁপ- এ রকম তো আমাদের আরো আছে। আমাকে যে-সৌন্দর্য টানত তার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট না। আমি লক্ষ করেছিলাম, ঐ জায়গাটুকুর মাটিই অন্য রকম উজ্জ্বল। তার নীরবতা ও ছায়া বড় কল্পনাপ্রবণ। সাধুরা যেখানে বাস করেন সেখানে যেমন শক্তি জমে তেমনি যে জায়গাটাকে মানুষ নিজের সম্পত্তি বলে মনে করে সেখানে ধীরে ধীরে সৌন্দর্য অবতরণ করে।

রোজকার মাছ দাদু রোজ বাজার থেকেই কিনতেন। কিন্তু আমাদের তিনটে পুকুরে প্রচুর মাছ, আর তেঁতুলতলার খাল দিয়েও দূর দূর দেশের মাছেরা এসে দূর দূর দেশে ভেসে যায়। কাকা, যেদিন ইচ্ছে হয়, ঐসব জলাশয়ে গিয়ে মাছ ধরে, একেবারে আদিম কালের কৌশলে। আমাদের দেশে লম্বা গলা, সরু পেট এক ধরনের মাটির কলসি পাওয়া যায়, যার গায়ে মনসার মূর্তি এঁকে পুজো হয়। কাকা সেই মনসার কলসির তলায় কয়েকটা ছাদা করে ভিতরে কিছু শুকনো পাতা পুরে পুকুরের যেখানে কোলাহল নেই সেই গভীর জলে ডুবিয়ে রেখে আসত। আস্তে আস্তে মাছেরা সেখানে বাস করত। একদিন তরুণ নাগপুরুষের মতো ডুবসাঁতার কেটে কাকা নিঃশব্দে হানা দিত সেই মাছের পুরীতে পুরো কলসিটিকে নিয়ে সাঁতরে চলে আসত পাড়ে। ফুটো কলসি থেকে জল বেরিয়ে গেলে এক এক হাত লম্বা ডজনখানেক শিঙ্গি মাছ বেরিয়ে পড়ে কঁৎ কং শব্দ করত।

এ ছাড়া রাত্রে কাকা কখনোসখনো তেঁতুলতলার খালে আমাকে নিয়ে মাছ মারতে যেত। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার জলে কাকা ধারালো দা হাতে তীক্ষ্ণ চোখে অপেক্ষা করত। আমি বুকজলে নেমে লন্ঠন উঁচিয়ে ধরতাম। কালো আকাশ, কালো জলের মধ্যে লণ্ঠনের লাল আলোর নিচে মাছের ছায়া নিঃশব্দে এসে নিথর হয়ে ভেসে থাকত। কাকা ক্ষিপ্র হাতে জলের মধ্যে দা চালিয়ে এক এক কোপে তাদের দু-আধখানা করে ফেলত। খালে বেশ ভালো জাতের বড় মাছ পেতাম আমরা।

উত্তরপশ্চিম দিকে বড়পুকুরের একটা উপসংহারের মতো অংশ ছিল। সেখানটা সবুজ কচুরিপানায় জমাট, পাড় ঘেঁষে কালো হিজল গাছ। সেখানে কেউ কখনো নামত না। একবার একটা খোসপাঁচড়ায় ঘেয়ো ছেলে সেখানে ছুঁচোতে গিয়ে পা হড়কে পড়ল। আর পড়ামাত্র মাছেরা তার ঘা ঠুকরে ঠুকরে এমন অস্থির করল যে সে মহা উত্তেজিত হয়ে এসে খবর দিল, ওখানে যত না জল তার চেয়ে মাছ বেশি। সেই দিনই বাঁশের চিক দিয়ে বড়পুকুরের সঙ্গে ঐ অংশের মুখ আটকে দেওয়া হল। পরদিন কচুরিপানা সাফ করে দেখা গেল, সত্যিই সেখানে সরপুঁটি মাছের এক অদ্ভুত বংশবিস্তার ঘটেছে। পুরো বাড়ি আর প্রতিবেশীদের জন্য প্রচুর মাছ ধরা হল- সব সরপুঁটি, বিঘতপ্রমাণ, অতিকায়। তার পরেও ঐ জায়গাটার নির্জনতা আমরা অনেকদিন ভাঙি নি, ওটা আমাদের শৌখিন ফিশারি হয়ে রইল।

মাঝে মাঝে কলকাতা থেকে বাবা টিনের চমৎকার বাক্সয় ভরা বিস্কুট আর মনক্কা, খেজুর, আনার এবং বাদামের তক্তি পাঠাতেন। বাক্সের টিনের ডালা খোলামাত্র অপূর্ব গন্ধ বেরুত, দেখতাম তার মধ্যে ফালি ফালি ফিনফিনে সাদা কাগজের ফিতে-লেসের বিছানায় বিস্কুটেরা অতি আদরে খুকিপুতুলের মতো শুয়ে আছে। এইসব শখের খাবার উপহার পেয়ে নিজেকেও হঠাৎ কাঁচকড়ার পুতুলের মতো লাগত।

.

এজমালি বাড়ি ও জ্ঞাতিবর্গ

কাকভোরে ঘুম ভেঙে গেলে শুয়ে শুয়ে টের পেতাম বাড়িটা আস্তে আস্তে জেগে উঠছে। টের পেতাম নিঃশব্দ কি করে শব্দের মধ্যে ঢোকে, অতল কি করে উপরে ভেসে ওঠে। ঘুমভাঙা মানুষের গলার স্বর অন্ধকারে পাখির ভাষার মতো। বাসনের ঘষটানি, জলের ছচ্ছর বা ছলাৎ যেন অন্ধকারের পেটের মধ্যে নোঙর নড়ে উঠে নখ টানছে। বড়মা মশারির কোণ হঠাৎ খুলে দিলে মনে হত, শেষরাত্রের আচ্ছন্ন-নীল সুপুরি গাছের গাঢ় মাথা থেকে যেন বলতো খসে গেল।

এরই মধ্যে উঠোনে ঝাঁটপাট পড়েছে, বিছানা গুটনো হয়েছে, ঘর নিকনো প্রায় সারা। ভেজা গোবরমাটির গন্ধের সঙ্গে আমি এতক্ষণ শরৎ-উষার আধোঘুমে শিউলির গন্ধ পাচ্ছিলাম। এখন পুবের জানলার চেরা বাঁশের জালির মধ্য দিয়ে ঠাণ্ডা প্রথমবোদ এসে পড়ল। ছোটমা স্নান করে এসে উনুনের কাঠে আগুন দিয়েছে। ঘরের কোনো অদৃশ্য ফোকর দিয়ে কাঁচা কাঠের ধোঁয়া ঐ জানলাভরা কিরণের মধ্যে গিয়ে স্পষ্ট হয়ে খেলতে লাগল। প্রথম সূর্যকিরণের গায়ে জড়িয়ে ধোঁয়াদের কত রকম আঁকাবাঁকা সর্পিল ভঙ্গিমা। কখনো তারা অসম্ভব সুন্দ্র কলকা হয়ে এঁকেবেঁকে ওঠে, কখনো ডিমের কলি থেকে জেগে পেখম মেলে, কখনো ডোরাকাটা ছায়ার কোলে শুয়ে শিশুর মতো আঁকুবাকু করে পরীর ঘাগরা, জলের মৎস্যভঙ্গি, মায়াবী ঝালর, মাথার মধ্যে ঘুমের কুয়াশাদৃশ্য, আরো কত কি! সুখাসীন বাতাসে ধোঁয়াদের মন্থর রেখা জানলার ফ্রেমের মধ্যে এসে এক লাবণ্যগাথা, চলচ্চিত্রপর্যায় দেখিয়ে যেত। ধূমজ্যোতিসলিলমরুতের সন্নিপাতের কী আশ্চর্য বিভূতি! জানলা থেকে রোদ সরে গেলে আমার এই সুখের খেলা শেষ হত।

দাওয়ায় এসে দেখতাম জনহীন পুবের বাড়ির বিরাট টিনের চালের কাঁধে লালচক্ষু সূর্য। সেই রক্তবর্ণ মুখমণ্ডলে আকৰ্ণবিস্তৃত চৌকো চৌকো ফাঁক ফাঁক দাঁত। তিনি শব্দহীন হয়ে কড়মড় করে টিনের চাল চিবিয়ে খাচ্ছেন।

আমি উঠোনে নেমে, দুর্গামণ্ডপ পেরিয়ে, পশ্চিমপুকুরের বাঁ পাশের রাস্তা ধরে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতাম। সেখানে গাছপালায় ঢাকা এক ছোট্ট খাড়াই পাড় ডোবার উপর একবগগা বাঁশের একখানা ছোট সাঁকো। সেটা আমার পায়খানা। সেখানে চিরছায়ার শীতলতার মধ্যে জলের পাড়ে একজোড়া ডাহুক এসে ঘুরত, একেবারে চোখের নিচে। কখনো দুটো বিরাট গোসাপ লড়তে লড়তে হুড়মুড় করে ঝোঁপ ভেঙে আচম্বিতে এসে লাফিয়ে পড়ত জলে। কী তাদের লেজের ঝাঁপট আর ফোঁসফোসানি! আমি ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম। কোনোদিন একটা একলা গোসাপ গুঁড়ি মেরে নিঃশব্দে জলের দিকে এগোত। নিষ্প্রভ তার ভাবলেশহীন চোখ আর সারা শরীরে প্রাগৈতিহাসিক শীতলতা। গভীর লাল বর্ম পরা পোকা ভোঁ করে কোত্থেকে উড়ে এসে সবুজ পাতায় বসত। লতার আকর্ষী উন্মুখ হয়ে থাকত কিছু একটা আঁকড়াবার জন্যে। হঠাৎ কালো আর পাটকিলে মেশানো কুবো পাখি ডেকে উঠত কুব কু্ব কুব কু্ব কুব। আমি পুকুরের জলে বুক পর্যন্ত নেমে পরিষ্কার হয়ে বাড়ি ফিরতাম।

আমার একখানা ছোট্ট বেতের তৈরি ধামা ছিল। সক্কালবেলা নারকেলনাড়ুর সঙ্গে সেই ধামাভরতি মুড়ি চিবোতে চিবোতে চোয়াল ব্যথা হয়ে যেত। শেষে ধামা ফেলে রেখে ধনদিদিদের বাড়ি যেতাম। সেখানে দুই ভাইবোন পাঁচুকাকা আর সুবিপিসি দুই কাঁসি পান্তাভাত নিয়ে বসেছে। পোড়ানো শুকনো লঙ্কা, লেবুপাতা আর নুন দিয়ে তারা পান্তা মেখে তারিয়ে তারিয়ে খায়। তাদের জীবনযাত্রা বড় মন্থর। নাইতে খেতে দুপুর গড়িয়ে যায়, তার পর তারা মা-ছেলে-মেয়ে দু-একজন পড়শীকে নিয়ে গোধূলি পর্যন্ত দাওয়ায় বসে তাস খেলে। আমাদের অফিস-আদালতহীন বিস্তীর্ণ দেশে বহু দূরে দূরে ইস্কুলের পেটা ঘণ্টা ছাড়া ঘড়ির শব্দ নেই। এক এক দিন, তাস খেলা যেদিন আগে ভেঙে যায়, ধনদিদি সুর করে মনসামঙ্গল পড়েন। আরো একখানা মলাটছেঁড়া বই আমি এ তাসের আসরের পাশে পড়ে থাকতে দেখতাম বটতলায় ছাপা বিদ্যাসুন্দর। পি এম বাগচীর পঞ্জিকায় যে ধরনের ছবি থাকত, বিদ্যাসুন্দরেও সেই রকমের কিছু ছবি ছিল।

ধনদিদিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি উত্তরের বাড়ি যেতাম। এই বাড়িটা এক মেয়েরাজ্য। প্রৌঢ় ছোড়দাদু ছাড়া সেখানে আর কেউ পুরুষ নেই। বাড়ির সব মেয়ে আত্মা যেন ঝেঁটিয়ে গিয়ে ঐ ঘরে জন্ম নিয়েছে। কাঠের পরিচ্ছন্ন খুঁটি, চৌকাঠ, ফ্রেমে বাঁধানো টিনের বেড়া আর কারুকার্য তোলা কাঠের দরজা নিয়ে তাদের সুন্দর প্ল্যানড বাড়ি। পুরোটাই যেন এক অন্দরমহল সব সময় একদল ভোমরা কাজে এবং গুঞ্জনে ব্যস্ত। আমি ঐ বাড়িতে যেতাম নতুন অচেনা কিছু পাবার আশায়। ছোড়দাদুর স্ত্রী, অনন্তযৌবনা ছোট্টখাট্ট ছোড়দিদি, যাকে আমরা সবাই ছোট বলে ডাকতাম, সারা বাড়ির মধ্যে ছিল সবচেয়ে বড় ঝগড়াটি। উত্তরের ঘর থেকে দক্ষিণের বড়পুকুরে মুখ ধুতে, চান করতে, জল আনতে, কাপড় কাঁচতে কত বার যে সে যাতায়াত করত তার ঠিক নেই। আর যত বার যেত সারা পথটা খরখর করে একা একা ঝগড়া করত। ভাসুরঠাকুরদের দেখলে, ঘোমটা টেনে, ঘোমটার মধ্যেই ঝগড়া করত। ঝগড়া করতে করতে তার গলার মাঝখানটা ফুলে উঠে শেষটায় গলগণ্ড হয়ে গেল। বাড়ির অন্য বউঝিরা ছোটর ঝগড়া শুনে হাসত।

আমার সঙ্গে কিন্তু ছোটর ভাব ছিল। যেহেতু সম্পর্কে নাতি হই অতএব মেজাজে থাকলে বেশ ঠাট্টা-ইয়ারকি করত। আমি ছোটমার কাছ থেকে রসিকতার উত্তরে প্রতিরসিকতা শিখে ছোটকে এসে বলে যেতাম। হেসে উঠে ছোট আর একটা রসিকতা করত। আমি আবার ছোটমার কাছে ছুটতাম উত্তর আনতে। এইভাবে আমি বেশ গ্রাম্য রসিক হয়ে উঠছিলাম।

কিন্তু এ সবই বাহ্য। আমি তাদের বাড়ি যেতাম অন্য এক নিগূঢ় টানে। সুন্দর ফ্রেমে বাঁধানো অনেক উজ্জ্বল রঙিন ছবি টাঙানো ছিল তাদের ঘরে। ঠায় দাঁড়িয়ে সেই সব ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম। আমি দেখতাম, ছবি: একটা অন্য জগৎ। আমার কোনো গুরু ছিল না, ছবিই আমাকে ছবি দেখা শিখিয়েছিল।

উত্তরের ঘর থেকে একদৌড়ে চলে যেতাম উঠোনের শেষ সীমা ছাড়িয়ে দক্ষিণের ঘরে। সেখানে একজন আছে, যে আমাকে বুকের দুধ নিজের ছেলের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাইয়েছে। তাকে আমি ঐ ঘরের মা বলে ডাকি।

বড়দাদুকে আমি জন্ম থেকে দেখে আসছি ধৃতরাষ্ট্রের মতো বৃদ্ধ কোমর বেঁকে গেছে, চোখের ভুরু ঝুলে পড়েছে, তবু শরীরে অমিত শক্তি। উনি, শোনা যায়, কলকাতায় পুলিশে কাজ করতেন এবং সেই সুবাদে রোজ একটি করে পাঁঠার মাথা ভেট পেতেন। পাঁঠার মগজ খেয়েই তাঁর এই শক্তি। তাঁর দেহে বস্ত্রখণ্ড বলতে সারা বছর একখানা বিবর্ণ হেটো লুঙ্গি, শুধু মাঘের শীত যখন বাঘের মতো আমাদের গ্রামে ঘোরে তখন তাঁর গায়ে ওঠে বেঢপ এক গেঞ্জির উপর খাকি একটা পুলিশী। শার্ট। বড়দাদু রোজ পরিষ্কার করে গোঁফদাড়ি চাছেন এবং কালো চুল লম্বা হয়ে যখন দাঁড়কাকের ঘাড়ের রোঁয়ার মতো গজায় তখন নিজেই একদিন মুঠো করে ধরে কাঁচি দিয়ে কচাকচ কেটে ঝামেলা মেটান। সকালবেলা গুড়ক গুড়ক করে হুঁকো খেতে খেতে খোলামেলা বাগানে বসে প্রাতঃকৃত্য করেন কে দেখল না দেখল তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না। তার পর কোদাল কুপিয়ে ডেঙোডাটা, কুমড়োবীজ লাগান, আগাছা নিড়োন। বাঁকানো কোমর নিয়ে সারা দিন ঠুকঠাক করে এটা সেটা করেন। দুপুরে ভাত ডাল তরকারি ডিম মাছ ভাজাভুজি, যা কিছু সেদিন রান্না হয়েছে, সব একটা কানাউঁচু থালায় একসঙ্গে চটকে তাতে খানিকটা দই ঢেলে দিয়ে সেই দলা দলা প্রেতপিণ্ড দন্তহীন মুখে গোগ্রাসে গেলেন। তাঁর কোনো কাজে কোনো লাবণ্য নেই, ভালোবাসা নেই। বিকেলে তামাক খেতে খেতে আমার সমবয়সী পুত্র গদা এবং তখনকার মতো কনিষ্ঠ পুত্র ফুচুকে পড়ান। গদা অঙ্ক কষতে কষতে সরে পড়লে ক্ষীণদৃষ্টি ধৃতরাষ্ট্র অনেকক্ষণ পরে টের পান এবং খড়ম হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হা রা মজা দা বলে হুংকার দেন।

বড়দাদু কারো সঙ্গে মেশেন না, বড়দাদুর সঙ্গেও কেউ মেশে না। আমি তাঁকে কোনোদিন হাসতে দেখি নি। আধবোজা মাইঅপিক চোখ কুঁচকে তাকান তিনি। কিন্তু টের পাই, তাঁর আপাতঅদৃশ্য চোখের মণির অনেক পিছনে যেন একজোড়া কপিশ চোখ জ্বলে।

একটা জগদ্দল লোহার সিন্দুকের পাশে তাঁর ঘরজোড়া তক্তপোশটা একটির পর একটি শিশুসন্তানের কথাকানি আর প্রস্রাবের নোনা গন্ধে সব সময় ন্যাতাজোবড়া। পর পর দুই স্ত্রী ছেলেমেয়ে রেখে মারা যাবার পর তিনি পেনশন নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে তৃতীয় বার বিয়ে করেন। এই তৃতীয়া স্ত্রীই আমার. ঐ ঘরের মা।

হাসিমুখ, জলাশয়ের মতো শিথিল যুবতী ঐ ঘরের মার কাছে তাঁকে শুয়ে থাকতে দেখলে আমার কেমন একটা সংকটের অনুভূতি হত– বার বার মনে হত, মারা যাবার পরে এই বৃদ্ধ তৃতীয় বার সংসার করছেন।

ঐ ঘরের মার সঙ্গে আমার বেশির ভাগই দেখা হত রান্নাঘরে। তখন আমি আর তার দুধ খাই না। আমাকে দেখলেই তিনি কোনোদিন হাতে দুটো ডালের বড়া গুঁজে দেন, কোনোদিন আধখানা ডিম মুখে পুরে দেন, বলেন, তড়াতড়ি খা। যেদিন পিঠে পায়েস কিংবা মাংস রাঁধেন, আঁচলের আড়ালে একটি ভরা বাটি এনে আমাদের রান্নাঘরে ছোটমার কাছে দিয়ে যান। পরে পুকুরঘাটে কিংবা পথে দেখা হলে জিজ্ঞেস করেন, খাইছস?

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি দূরে চলে যাচ্ছিলাম, তবু গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি এলে যখন গদার সঙ্গে খেলতে খেলতে আমার মারামারি বেধে যেত– আমি প্রচণ্ড হয়ে তার গলা টিপে ধরতাম, ছোটমা এসে আমাকে ছাড়াত– তখনও দেখতাম ঐ ঘরের মা আমার দিকে আলগা সুখের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাকে দেখে দুঃখে ও লজ্জায় আমি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলে হাসতে হাসতে বলতেন, বড় হইছস, অ্যাঁ বড় হইছস!

আমাদের ভিটের মুখোমুখি, উঠোনের ওপারে পুবের ভিটে বছরে ন মাসই জনহীন পড়ে থাকত। বালিহাঁসেরা যেমন হিমে আসে। গরমে যায় তেমনি ঐ বাড়ির কর্তা সোদাদু পরিজনদের নিয়ে শরতে আসতেন, নবান্ন শেষ করে চলে যেতেন। শরতে যখন খালের জল তেতুলতলা পর্যন্ত ছাপিয়ে চলে আসে, দুর্গামণ্ডপে একমেটে হওয়া মুণ্ডহীন প্রতিমা নিঃসঙ্গ দিন কাটায় তখন একদিন কেউ হৈ হৈ করে খবর আনে, সোদাদুর এসে পড়েছেন। আমরা মহানন্দে খালের পাড়ে দৌড়ই সেখানে কোন বিদেশ থেকে দুখানা নৌকো এসে লগি পুঁতেছে। মাঝিরা মাথায় বাক্সবোঁচকা তুলছে, সোনাদাপুরা কয়েকজন নেমে পড়েছেন, তাঁর নাতি সদানন্দ হাঁটুজলে ছপছপ করে পা ফেলছে, নাতন লীলাদি ছইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখে বাসী মুখে সুখের হাসি হাসছে। আমরা লাফিয়ে নৌকোর গলুই ধরে পাটাতনে উঠতাম, নিজেরা দুলে দুলে নৌকো দুটোকে দোলাতাম।

সোনাদাদু বড় আনন্দময় পুরুষ। তাঁর সাদা ঝোলা গোঁফের তলায় সর্বদা ঈষৎ হাসির আলো আমাদের নির্ভয় করে রাখে। তবু তাঁর চিলের পাখার মতো গায়ের রং, রক্তিম ঢোখ, লম্বা মেদহীন শরীর দেখে আমার কেন যেন রামায়ণের সম্পাতি পাখির কথা মনে পড়ে। মনে হয়, এই ব্যক্তি কর্কশ পাহাড়চূড়ায় বাস করেন, ভানা ছড়িয়ে অনেক উঁচুতে ওড়েন এবং বিকেলে সূর্য যখন অস্তমান তখন ন্যাড়া পাহাড়ে বসে শূন্যতা ও নিজেকে উপভোগ করেন।

কিন্তু আসলে তা নয়, সোনাদাদু পাখি নন, মানুষ তিনি আসার পর থেকেই পুজোর সব কাজকর্ম, জোগাড়যন্ত্রের ভার তাঁর। উপোস করে তিনি দুর্গাপুজোর তন্ত্রধারক হন, আবার পাঠাকে নাইয়ে এনে বলির ব্যবস্থাও করেন। কালীপুজো, রটন্তীপুজোর উপচার নিখুঁতভাবে জোগাড় করেন, গভীর রাত্রে পুজো শেষ হলে প্রসাদী মাংসের ভাগ ঘরে ঘরে পাঠিয়ে তবে তাঁর জলগ্রহণ। বিকেলবেলা পুবের ঘরের তিন দিক খোলা বারান্দায় বাড়িসুদ্ধ লোকের গল্প জমে। উদাসীনতা এবং চাঞ্চল্য, তগতি এবং লঘুতা একইসঙ্গে সোনাদাদুর মধ্যে ভাসে এবং ডোবে। বোধ হয় এই রকম মানুষকেই সাত্ত্বিক প্রকৃতির বলে।

রাঙাদাদুর ঘরটি ছিল জংলা বাগানের আড়ালে, বাড়ির একটেরেতে। ঘরটির মতো রাঙাদাও খুব গোপন মানুষ। বহুকাল আগে তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন– ছেলে কলকাতায়। চাকরি করে, মেয়ে দূরে শ্বশুরবাড়িতে গিন্নী। রাঙাদাদু একলা থাকেন, নিজেই রান্না করে খান। কি রাঁধেন কে জানে? আমি অনেকদিন দুপুরবেলা তাঁর ঘরে গেছি, কখনো তাঁকে রাঁধতে দেখি নি, খেতে দেখি নি। ফরসা, গোঁফদাড়ি পরিষ্কার করে কামানো, চুনের মতো সাদা কদমছাঁট চুল, নিকেলের গোল চশমা, তামাক খান না বলে ঠোঁট দুটি রাঙা, সাদা ছোট ছোট নিখুঁত দাঁত, পরিষ্কার সাদা ধুতি সাদা ফতুয়া পরে রাঙাদাদু তার ভারী। খাটে ধবধবে বিছানায় সুরুল কুঠিতে রবীন্দ্রনাথের মতো আধশোয়া হয়ে থাকেন। তাঁর খাটের চারখানা পায়া সিংহের চারখানা থাবাওয়ালা নখ-বার-করা পা। হোগলাপাতার বেড়ার ফাঁক দিয়ে রৌদ্রের লাল আভা এসে পড়েছে তার বিছানায়। হোগলা বেড়ার পার্টিশন দেওয়া পাশের ছোট ঘরে দুটো-একটা হাঁড়িকুড়ি, শূন্য উনুন, দুধ থেকে মাখম তোলার একটা বোতলের মধ্যে যন্ত্র, খাটের তলায় পিতলের পানের বাটা। এই রিক্ততাটুকু নিয়ে একটি চুন, শণ আর মোমের তৈরি পুতুল যেন জতুগৃহের মধ্যে গোপনে জ্বলছে। রাঙাদাদু মুখ তুলে তাকিয়ে একটু হাসতেন। যে বাড়িতে ভাড়ার শূন্য সেখানে বেড়াল যেমন ছুঁকছুঁক করে শুঁকেটুকে বেরিয়ে যায় আমিও তেমনি কথা না বলে ঘুরেফিরে বেরিয়ে আসতাম।

ছটি ভিটে নিয়ে আমাদের বাড়ি। আমি সকালবেলাতেই তিনটি পরিভ্রমণ করে নিজেদের ঘরে ফিরে আসতাম। ঘরে আমার অনেক কাজ।

.

আমার খেলা

খেলনা বলতে আমার ছিল পোড়া মাটির একটা গৌরাঙ্গ, একটা নাশপাতি, কাঠের একটা রং ওঠা বউ, আর কাঠেরই উপর গালার রং করা একটা চকচকে বল যার এক গোলার্ধ লাল অন্য গোলার্ধ সবুজ, একটা রবারের আঁকাবাঁকা সাপ এবং স্প্রিংয়ে কাজ করে এমন একটা বন্দুক। এইসব নকল জিনিসের চেয়ে একটা মুশকিলআসানের অষ্টাবক্র লাঠি কিংবা ভাঙা একটুকরো রঙিন কাঁচও ভালো খেলনা। সুতরাং আমার খেলনা ও খেলা আমি নিজেই বানিয়ে নিতে লাগলাম।

মায়ের বিয়েতে উপহার পাওয়া এবং অন্যভাবে এসে পড়া কয়েকখানা বই দেরাজের একটা খোপে জমে ছিল। আমি ঠাকুমাকে ধরে সেইসব বই হাত করেছিলাম। সকালবেলা পাড়া বেরিয়ে এসে দরজার পাশে সযত্নে একখানা চট পেতে সেই বইগুলো একটি একটি করে সাজিয়ে রাখতাম, যেভাবে এখনকার ফুটপাথের ম্যাগাজিন স্টলগুলো সাজায়। তার পর তাদের সামনে রেখে দোকানদার সেজে বাবু হয়ে বসে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আমার দোকানে কেউ খদ্দের আসে না। তখন দোকানটাকে আর একটু মনোহারী করার জন্য মাঝে মাঝে বইদের জায়গা পালটে দিই। শেষে, একলা বসে থাকতে থাকতে এক-একখানা বই তুলে নিয়ে পাতা উলটে উলটে নিজেই ছবি দেখতে থাকি। কিছু কিছু ছবির অর্থ বুঝি না মনে হয়, তাদের মধ্যে যেন একটা ঘটনার রহস্য লুকিয়ে আছে পাশের অক্ষরগুলোর গুপ্ত সংকেতে সেই ঘটনা বলা আছে কিন্তু তখনও আমি অ আ ক খ জানি না। তবে বহুকাল ধরে ঐ দোকান করতে করতে বই কিভাবে নাড়াচাড়া করতে হয় খুব ভালো করে শিখেছিলাম আমার হাতে পাতার একটি কোণও মচকাত না, সাদা কাগজে ময়লা আঙুলের একটু দাগও পড়ত না।

এও এক ইঙ্গিত। আমি জ্ঞানে অনুরক্ত হলাম না, শিক্ষায় আগ্রহী হলাম না, অথচ অকালে, অক্ষরপরিচয়ের আগেই পুস্তকপ্রেমী হয়ে গেলাম। এ হল বিদ্যার তামসিকতা। এই কৃপণ ভালোবাসার শোধ সারা জীবন ধরে দিতে হল।

দাদুর দেরাজের খোপগুলোয় কত যে অদ্ভুত জিনিসের বাসা! ঘরে কেউ না থাকলে আমি ডিঙি মেরে গোল গোল হাতল ধরে দেরাজের গা বেয়ে উঠি, অনেক কসরত করে তার উপরের টানা খুলি। খোলামাত্র একটা প্রাচীন গন্ধ যেন ডানা ঝাঁপটায়। আমি সেই গহ্বরের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে যা নাগালে আসে বার করে আনি। একদিন তার মধ্য থেকে বেরুল সুন্দর একটা কাপড়ের পুঁটুলি। সেই পুটুলিতে ছিল কালো আর বাদামী দুই প্রস্থ দাবার ঘুঁটি– পালিশ করা সেই অদ্ভুত আকৃতির কাঠেরা কি করে রাজা মন্ত্রী ঘোড়া গজ নৌকো সৈন্য হল! আকৃতি ও পরিচয় মিলিয়ে তারা এক প্রহেলিকা।

এ ছাড়া দেরাজ ঘেঁটে পেয়েছিলাম কুমিরের দাঁত, শুয়োরের দাঁত, কমলারঙের অদ্ভুত এক শামুকের খোলা, সমুদ্রের ফেনা। আর ছিল গাছ লতা গুল্ম ওষধি সম্পর্কে চিত্রসংবলিত বিশাল দু খণ্ড বই। সেই বই দুখানা নিয়ে আমার অনেক সময় কেটে যেত।

দুপুর ঘন হয়ে রৌদ্র যখন মধ্যআকাশে স্রোতের ফেনার মতো জমাট বেঁধেছে তখন স্নানে যাবার বেলা। স্নানে যাবার আগে দাদু নিজে বেশ করে তেল মাখতেন, তার পর আমাকে আচারের জলপাইটির মতো তেলে ডুবিয়ে টিপে টিপে নরম করতেন। সরষের তেলের তীব্র ঝাঁঝে আমি ছটফটিয়ে উঠতাম। সব শেষে হুঁকো এবং বাঁশের লাঠিটির গায়ে তেলের হাত বুলিয়ে আমাকে নিয়ে বড়পুকুরে যেতেন। স্নান করে ফিরবার পথেই খিদেয় পেট চন করে উঠত।

.

 সাপ

মধ্যাহ্নভোজনের পর দাদু তামাকটামাক খেয়ে অল্প একটু ঘুমোতেন। দাদুর পাশে শুয়ে আমারও ঘুমোবার কথা। কোনো কোনো দিন পি এম বাগচীর পঞ্জিকায় বৃহৎ লাল মূলা, রাক্ষুসে বাঁধাকপি, অনঙ্গ বটিকার শাড়ি-উড়ে-যাওয়া পরী, রথের জগন্নাথ, জামাইষষ্ঠীর খেতে বসা জামাই ইত্যাদির ছবি দেখতে দেখতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চোখে ঘুম নেমে আসত। কিন্তু যেদিন দেখতাম দাদু নিজেই আগে ঘুমিয়ে পড়েছেন, তাঁর লম্বা দাড়িগোঁফের মধ্যে লুকনো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে নিঃশ্বাসের হাওয়া বেরুচ্ছে আর ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ শব্দ হচ্ছে। সেদিন আস্তে আস্তে উঠে একলাফে উঠোনে পড়েই আমি হাওয়া।

একদিন, এই রকম পালিয়ে, পুবের পুকুরের পাশ দিয়ে, উত্তরের ঘরের পিছনে যে গভীর ছোট ডোবা, সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছি। তখন বর্ষার শেষ। গাছের পাতা সবুজ মরকতের মতো চিক্কণ, দ্যুতিময়। আঙুল দিয়ে ছুঁলে লতার আঁকড়াবার আকুলতা যেন হাত জড়িয়ে ধরে। একটা ঝুঁকে পড়া গাছের অদ্ভুত আঁকাবাঁকা ডালের খানিকটা টলটলে জলের মধ্যে ডুবে আছে সেখানে উড়ন্ত নীল আকাশ আর উড়ো সাদা মেঘের ছবি যেন জলের মধ্যে নীল ময়ূর আর সাদা ময়ূরীর নাচ। তন্ময় হয়ে এইসব দেখছি, এমন সময় ঝোপের ভিতর থেকে একটা কালো মসৃণ গাছের ডাল খুব ধীরে ধীরে অলসভাবে এগোতে এগোতে জলে ডোবা ডালটার অন্য প্রান্ত ধরে ফেলল। সেখানে সে কয়েক মুহূর্ত নিশ্চল হয়ে রইল, তার পর নিজেকে অদ্ভুতভাবে বাঁকিয়ে ডালটাকে একটা প্যাঁচ দিয়ে বাকি শরীরটা আস্তে আস্তে ঝুলিয়ে দিল জলের দিকে, চেরা জিভ দিয়ে যেন জলের গা কয়েক বার চেটে নিল সে, আবার নিজেকে ঢেউয়ের মতো তুলে নিল সেই ডালের উপর, প্যাঁচটা খুলল, ধীরে ধীরে আবার বাদামী ডালের উপর একটা কুচকুচে কালো ডাল হয়ে মন্থরভাবে এগুতে লাগল।

ততক্ষণে বুঝে গেছি, একটা বুনো জাতসাপের চার হাত দূরে আমি দাঁড়িয়ে আছি, নিথর। কিন্তু আশ্চর্য, ভয়ের চেয়ে তার সাবলীল শরীর এবং অলস গতির অদ্ভুত সুন্দর রূপ আমাকে যেন জাদু করে রেখেছে। ঐ ডালটা থেকে আরেক ডালে যেতে যেতে সে কয়েক বার জীবন্ত লতার মতো শরীর এলাল। তার পর ক্রমশ অন্য পাড়ের ঝোপের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

তার কথা কাউকে বলি নি। কিন্তু সাপধরারা কি করে যেন টের পেল। একদিন তাদের দু-তিনজনের একটা দল এসে ছোড়দাদুকে বলল, ‘কর্তা, আপনাগো বাড়িতে কালসাপ আছে, আমরা ধরমু। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সেই ডোবার পাড়ের জঙ্গল থেকে তারা তাকে ধরে নিয়ে এল আমাদের উঠোনে। ছোট্ট লাঠি গলায় চেপে তার বিষদাঁত কামাল। শেষে তাকে নিয়ে খেলা দেখাল। খা, খা, বকিলারে খা! খা, খা, কিরপৈণ্যারে খা! বলে তার মুখের কাছে সাপুড়ে মুঠো করে হাত ঘোরায় আর প্রচণ্ড ক্রোধে সে ছোবল মারে, হাতুড়ির মতো তার লক্ষ্যভ্রষ্ট ফণা আছড়ে পড়ে উঠোনের ধুলোয়। আমি দেখলাম, তার নাকের ডগায় ধুলো আর রক্তের ফোঁটা।

.

আমাদের ক্ষত্রিয় জীবনমৃত্যু

এই সময়ে আমার মানুষের শরীরের পরিণাম এবং পারিবারিক সম্পর্ক বিষয়ে কিছু কিছু অভিজ্ঞতা হচ্ছিল। আমাদের সময়ে বয়স্কদের জীবনস্রোত থেকে শিশুদের সরিয়ে রাখার কোনো চেষ্টা ছিল না। তারা অসহায় ফেনার মতো স্রোতের ঘূর্ণিতে পড়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে যেত, কিংবা স্রোত মন্থর হলে আপন সুখে ভেসে ভেসে দিনরাত্রির মধ্যে দিয়ে এগোত। আদরের দিন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হলে প্রকৃতির নিয়মেই তারা এসে যেত জীবনের কঠোরতা ও বিপন্নতার মুখে। ছেলে মানুষ করার ব্যাপারে ন্যাকামো ও আদিখ্যেতা বর্জন এবং অবহেলা ও উদাসীনতা প্রদর্শন যেন ধর্মীয় নিষ্ঠায় পালন করা হত। তখন বালকদের নাম হত পাঁচু, গদা, ভাসা, ফেলা, আদাড়ি, তিনকড়ি, বাঘা, ভোম্বল, ঘোঁতা, খোঁদনা।

এই অনাদর বা অকোমলতার ফলে আমরা খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে উঠতাম, অর্থাৎ আমাদের নির্ভরশীলতা ও নালিশের মনোভাব মুছে যেত। কঠোরতার সামনে উদাসীনতা আর কৌতুকের পরীক্ষা দিতে হত আমৃত্যু।

ছোড়দাদুর মা ছিলেন বাড়ির সবচেয়ে প্রাচীন ব্যক্তি। একদিন তিনি রোগশয্যায় শুলেন, ধীরে ধীরে সবাই বুঝল এই শয্যাই তাঁর মৃত্যুশয্যা। দেখতাম, তিনি আলোবাতাসময় ছোট লম্বা ঘরটিতে শুয়ে আছেন। ধবধবে থান পরা। ফরসা চেহারাটি ছোট্ট পাটকাঠির মতো ভঙ্গুর হয়ে গেছে। ক্ষীণ স্বরে কথা বললে তাঁর করুণ পাতলা জিভটি মুখের মধ্যে নড়ে। তার স্বাস্থ্যবান যুবক দৌহিত্রেরা তাঁকে দেখতে আসত, উচ্চ উচ্চ হেসে বলত, “কি বুড়ি, মরবা কবে? তোমার শ্রাদ্ধে আস্তা একখান খাসি আর দশ গণ্ডা রসগোল্লা খামু’। বৃদ্ধার মুখে ক্ষীণ হাসি দেখা দিত, ‘তোরা আগে বিয়া কর, তোগো পোলাপান হউক, হ্যাগো কান্ধে চাপমু তয় তো যামু’। আসন্ন মৃত্যুর নিষ্ঠুরতা এইসব উত্তর-প্রত্যুত্তরের কৌতুকভানের সামনে এসে ক্ষণকালের জন্যও যেন থমকে যেত।

একদিন রাত্রির তৃতীয় প্রহরে বৃদ্ধা মারা গেলেন। বাড়ির শ্মশানে দোলমঞ্চের পাশে তাঁকে চিতায় শুইয়ে আগুন দেওয়া হল। হরি-ই-ই বলল, হরি-ই-ই বলল, হরি হরি বলো বলে সবাই উচ্চৈঃস্বরে যেমনি ধ্বনি দিচ্ছে, আগুনও তেমনি লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে উঠছে। কোথায় শোক? বেশ একটা কাজ চলছে যেন একজনের দীর্ঘ জীবনের চিরকালের মতো কাজ। স্ত্রীলোকেরা ছাড়া আমরা বাড়িসুদ্ধ আবালবৃদ্ধ ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখছি। বনের মধ্যে করাত দিয়ে যেন একটা গাছ কাটা চলছে। হঠাৎ বৃদ্ধার মাথাটা ফটাস করে ফেটে গেল দেখলাম, টপটপ করে ঘি গড়িয়ে পড়ছে আর আগুন সেই ফাটলে নেচে নেচে ঢুকে যাচ্ছে।

প্রাচীনরা কেউ কেউ, দিন শেষ হয়ে আসছে টের পেলে, সুস্থ দেহ থাকতে থাকতেই প্রায়শ্চিত্ত করতেন। আমার দাদুও করেছিলেন। অনুষ্ঠানটি অনেকটা পুজো এবং শ্রাদ্ধের মাঝামাঝি। সারা দিন পুরুতঠাকুর দাদুকে মন্ত্রট পড়ালেন, পুজোআচ্চা করালেন। গাঢ় অপরাহ্নে অনুষ্ঠান সারা হলে দাদু আর পুরুতঠাকুর দাওয়ায় বসলেন, বাড়ির সব বৃদ্ধরা এসে দাদুর পাশে বসলেন। সবাই নির্বাক। আমার মনে হচ্ছিল যেন মহাভারতের বুড়োরা এক সভায় বসেছেন। তাঁদের পিছনে হোগলার বেড়ার গায়ে ছায়া পড়েছে। দাদু এমনভাবে তাকিয়ে ছিলেন যেন তার সামনে আমরাও সব ছায়া হয়ে গেছি।

মরণের সময় আমাদের দেশের মানুষ ঘরে থাকে না। তার ভিতরের প্রাণীই বোধ হয় তাকে বোঝায়, এখন সে আশ্চর্য একটা দরজার সামনে সেই দরজা দিয়ে বেরিয়েই আর কোনো ছোট বাড়ি নয়, যেন আকাশের মধ্যে তার গতি হয়। যাদের চেতনা থাকে তারা নিজেরাই বলে, ‘ওরে, আমারে এবার বাইর কর’। জোয়ান ছেলেরা তৈরীই থাকে, অভিজ্ঞ প্রবীণদের ইশারা পেয়ে মুমূর্ষুকে তারা ঘরের বাইরে খোলা আকাশের তলায় ধুলোর উঠোনে এনে শুইয়ে দেয়। এতক্ষণ ঘরের মধ্যে যে বিচ্ছেদ মর্ম ছিঁড়ে দিচ্ছিল, খোলা আকাশের ভোজবাজিতে মুহর্তে তা যেন অনেকখানি অকিঞ্চিৎকর হয়ে যায়। একজন ধূলিশয়ান মানুষকে ঘিরে কয়েকজন ঝুঁকে পড়া মানুষের উৎকণ্ঠিত ব্যথা এবং সেই বিমর্ষ জোনাকিপুঞ্জটির উপরে স্তব্ধ নীল আকাশ, গভীর সঞ্চালিত বাতাস, টুকরো মেঘের ভেসে যাওয়া বোধ হয় জীবনের সবচেয়ে অর্থময় ছবি।

আমার দাদুকে গভীর রাত্রির আকাশের তলায় বার করা হয়েছিল। এখানে ওখানে টুকরো টুকরো মলিন লন্ঠনের আলো, বাড়িগুলো অপচ্ছায়ার মতো কালো, কালো আকাশ তারায় ভরা। সোঁ সোঁ হাওয়া বইছে। মনে হচ্ছে যেন আকাশ পর্যন্ত একটা হাওয়ার পথ তৈরি হচ্ছে। বায়ু অনিলে মেশে। এই নখরযুক্ত, আত্মাকে প্রবল বেগে টেনে নেওয়া হাওয়াই কি সেই অনিল?

.

 বাবা

বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কের মধ্যে জন্ম থেকেই কোনো গ্ৰহবৈগুণ্য ছিল। তাকে আমি এইভাবে চিনতাম: একজন শক্তসমর্থ লোক যে বছরে এক বার মাসখানেকের জন্য আমাদের বাড়িতে আসে, সঙ্গে আনে নতুন জামাকাপড়, জিনিসপত্র। সে ভালো ভালো বাজার করে, আমাদের ঘরে শোয়। বাড়ির সবাই তাকে সমীহ করে, ছোটমা ভয় করে, কাকা দূরে দূরে থাকে, বড়মা আর ঠাকুমা খুশি হন, দাদু কয়েক দিনের জন্য আমার কাছ থেকে নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে নেন। লোকটা বাড়ির সব কিছু জানতে চায়, বুঝতে চায়, তদারক করতে চায়। আমাকে দুপুরবেলা তার পাশে শুতে হয়। তার খুব কড়া নজর, অতি গম্ভীর শাসনভরা গলার স্বর। সে নিজে খুব চাঁচাছোলা পরিষ্কার, অন্যেরও অগোছালো এলানো ভাব একেবারে বরদাস্ত করে না। আমাদের সুখের স্বর্গে সে চাপা অস্বস্তি নিয়ে আসে। সে একমাত্র সদয় বড়মার উপর, একমাত্র হাসিঠাট্টা করে ঘোটর সঙ্গে, একমাত্র বিনীত সোনাদাদুর কাছে। আমার ভয়ংকর রাগ হত, সবাই কেন তাকে ভয় পাবে! এমন কে সে!

তবু লোকটাকে আমার সারা দিনে দু বার মাত্র অপছন্দ হত না। এক বার, যখন সে দুপুরে খেতে বসে শেষপাতে দুধভাতের সঙ্গে প্রচুর আমকাঁঠালের রস গুলে, নিজে না খেয়ে, বাটি ভরে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে হাসিমুখে তাকাত। আর এক বার, সন্ধ্যার সময় সে যখন আমাকে সঙ্গে নিয়ে বড়পুকুরের পাড়ে গিয়ে বসত। পুকুরের ডান ধারে দক্ষিণপশ্চিম কোণে বেতবন আর বড় বড় গাছের ফাঁকে মেঘের গাঢ় বেগুনী পাথরে তখন কে যেন মকরধ্বজ মেড়েছে। হঠাৎ সেই ঘষা, দগদগে লালের মধ্যে আগুনের এক শয়ান মূর্তি ভেসে যাচ্ছে, চলেছে দক্ষিণের দিকে। খানিক পরেই সব অন্ধকার। পুকুরের বাঁ পাড়ে হিজল গাছে জোনাকিরা ঘুরছে। জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে মোলায়েম হাওয়া আসছে। সে আস্তে আস্তে গান ধরত–

এমন মধুমাখা হরির নাম নিতাই কোথা পেয়েছে।
সেই নাম শুনে হৃদয় বীণে আপনি বেজে উঠেছে।

 তার গানের গলা গম্ভীর-মধুর। অন্ধকারে সে হয়তো নিজেকে ভুলে গেছে।

একদিন বিকেলে বাবার প্রচণ্ড তর্জন শুনে ঘুম ভেঙে গেল। ভয়ে ভয়ে গিয়ে দেখি, দাদু আর ঠাকুমার সঙ্গে বাবা বিশ্রীভাবে ঝগড়া করছে। খঙ্গ হাতে বৃদ্ধ দ্রোণের প্রতি ধাবমান ধৃষ্টদ্যুম্নের মতো তার চোখের তারা রাগে ঘুরছে। দাদু স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ঠাকুমা চিৎকার করে কি যেন বলছেন। বাবা মর্মান্তিক ভাষায় তাঁকে হতবাক করে দিল। ঠাকুমার দু চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। ছোটমা আর বড়মা ত্রিসীমানায় নেই। দাদুর সেই স্তব্ধ মূর্তির দিকে তাকিয়ে আমার বুক মুচড়ে উঠল- অন্ধের মতো ক্রোধ ফুঁসে উঠল সারা শরীর জুড়ে ক্ষমতা থাকলে আমি তৎক্ষণাৎ বাবার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার টুটি ছিঁড়ে ফেলতাম। কিন্তু শুধু অসহায় হয়ে উঠোনের একপাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম, ঠাকুমা দাদুকে নিয়ে আস্তে আস্তে ঘর থেকে নেমে পশ্চিমপুকুরের দিকে চলে যাচ্ছেন। সেদিন রাত্রে বুড়োবুড়ী না খেয়ে তাঁদের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। কাকা বাড়ি এসে ভাবভঙ্গি দেখে আবার কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। যেন কিছুই হয় নি ভাব দেখিয়ে বাবা একাই খেতে বসল। আমাকেও তার পাশে বসে খেতে হল। সে রাত্রে আমাকে ঠাকুমা দাদুর কাছে শুতে দেওয়া হল না।

পরের দিন দুপুরবেলা ঘুরেটুরে এসে দেখি, আমাদের দু নম্বর আর তিন নম্বর ঘরের মাঝখানের দরজাটা নতুন একটা বেড়া দিয়ে পুরো আটকে দেওয়া হয়েছে। ঐ দিকটা দাদু আর ঠাকুমার, এই দিকটা বাবার। ঐ দিকে আমার যাওয়া নিষেধ। আমি বুকে শুয়ে, বেড়ার নিচের সরু ফাঁকে চোখ লাগিয়ে দেখি, ঠাকুমা কি করছেন। তাঁদের সঙ্গে আমার উঠোনে, পথে, পুকুরপাড়ে দেখা হয়, তাঁরা আমার দিকে তাকান না। তাদের শরীর ধুলো পড়া মলিন পাতার মতো কাঁপে।

দু দিনে পৃথিবী আমার কাছে তেতো হয়ে উঠল। হাওয়ায় যেন শুকনো ধারালো বালি উড়ছে। খেতে বসলে ভাতে সেই বালি, ঘুমোলে গলার মধ্যে সেই বালি। তিন দিনের দিন আমি আর থাকতে না পেরে চেঁচিয়ে বললাম, বাবা মরে যাক, মরে যাক, মরে যাক। সারা বাড়ি সেই কথা শুনল। বড়মা আমার মুখ চেপে ধরলেন।

আর সেই দিনই রাত্রে বাবার জ্বর হল। দু-তিন দিনে সেই জ্বর ঘোরালো হয়ে বাবা ভুল বকতে লাগল। ঠাকুমা পাছদুয়ার দিয়ে এসে বাবার কাছে বসলেন। দাদু কবিরাজমশায়কে ডাকতে গেলেন। কাকা কোত্থেকে উদয় হয়ে পকেট থেকে ছুরি বার করে বাঁধনটাধন কেটে পার্টিশনের বেড়া খুলে বাইরে ফেলে দিল।

সপ্তাহখানেক পরে, বাবা যেদিন ভালো হয়ে উঠে ভাত খেল সেদিন ঠাকুমা আমাকে খুব প্রাণভরে বকলেন। শিশুদের অভিশাপ বড় সাংঘাতিক জিনিস। ঐসব বলার পরেই বাবার অসুখ হওয়া দেখে আমি নিজেই ভয়ে আর লজ্জায় লুকিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। এখন, অসুখ সেরে যেতে আমার অপরাধ চলে গেল, বাড়িটাও আবার ঠিকঠাক হয়ে গেল।

কিন্তু সেই থেকে, ঠাকুমার কথায় আমি মনের মধ্যে এক অসম্ভব ক্ষমতা বয়ে বেড়াতে লাগলাম: আমি যাকে মরে যাক বলব, সে মরে যাবে। কয়েকদিন খুব কষ্ট করে কাটাতে হল, কাউকে যেন মরে যাক না বলে ফেলি। ঐ ক্ষমতা পাথরের মতো ভারী, কিছুদিন বয়ে বেড়াবার পরে, শেষে একদিন তার কথা ভুলে গেলাম।

.

কাকা

আমার কাকা ইস্কুলের পড়াটাও শেষ করল না। ফিঙে পাখিরা কখনো লেখাপড়া করে? পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সের কাকা ফিঙে পাখির মতোই কালো, ফিঙে পাখির মতোই সাহসী, ফিঙে পাখির মতোই ক্ষিপ্র, প্রাণসার। জীবনের সঙ্গে তার বাঁধন বড় আলগা। যত বার তাকে কাজে ঢোকাবার চেষ্টা হয়েছে তত বারই সে নিরুপদ্রবে পিছলে বেরিয়ে এসেছে। দুপুরে সে সুটসাট কখন এসে খেয়ে যায়, রাত্রে কখন এসে ভাত চায়, ছোটমা ছাড়া কেউ জানে না। সারা দুপুর সে কামার আর গোয়ালা বন্ধুদের নিয়ে বড়পুকুরের পাড়ে প্রাচীন পলাশ গাছটার ছায়ায় হোগলা বিছিয়ে তাস খেলে। আমি পলাশের ডালে বসে দেখি, চারজন যুবক নিমগ্ন হয়ে আছে একগুচ্ছ তাস সম্বল করে। পুকুরের জলে যখন খুব হাওয়া দেয়, তখন হাঁসেরা সাঁতার না দিয়েও ভেসে যায়, তারা সেই রকম সময়ের জলে ভেসে ভেসে যাচ্ছে।

কাকা সেবাশ্রমে গিয়ে প্যারালাল বারে পিকক করে, দূর দূর গ্রামে হাডুডু খেলতে যায়, যাত্রা শুনতে যায়, বাজারে গিয়ে দোকানদার বন্ধুদের সঙ্গে দই-চিড়ের ফলার লাগায়, বুক পকেটে একটা ব্ল্যাক বার্ড পেন খুঁজে শৌখিনতা করে, কদাচিৎ পকেট থেকে পাসিং শো বার করে টানে। তার জীবনযাত্রা এবং মনোভঙ্গি এতই পদ্মপাতায় জলের মতো কিংবা বনের এলোমেলো বাতাসের মতো যে আমরা কিছুই বুঝতে পারতাম না। একবার সে কি যেন একটা জিনিস বাড়িতে এনে খুব সন্তর্পণে লুকিয়ে রাখল। মাঝে মাঝে সেটা গোপনে বার করে দেখে। আমিও একদিন, যখন সে বাড়ি নেই, লুকিয়ে সেটা বার করলাম: চামড়ার খাপে ঢোকানো অদ্ভুত একটা ছুরি, অসম্ভব ধারালো তার লম্বা ফলা।

কাকাকে যখন কোনো কাজেই ঢোকানো গেল না তখন বাবা তাকে একটা মনোহারী দোকান করে দিলেন। আমাদের গ্রামের বাজারে বেশ ভালো একটা ঘর নিয়ে সেই দোকানের পত্তন হল। কলকাতা থেকে নৌকো করে জিনিসপত্র আনা হল। এক এক দিন দাদুর সঙ্গে আমিও সেই দোকানে যাই। বেশ লাগে। এক একটা জিনিসের এক এক রকম গন্ধ বিস্কুট, খেলনা, আলতা, কর্পূর, হিং, বোতাম, স্লেট, পেনসিল, কাগজ, খাতা, ফটকিরি, রজন, কুঁতে, বচ, লবঙ্গ, জাফরান, গিলা, দারুহরিদ্রা, যষ্টিমধু, জায়ফল, জয়ত্রী, আভাং, খয়ের, চন্দন, কত রকমের জিনিস- সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত গন্ধ সেই দোকানে। দোকান বড় চমৎকার জাদুঘর। কিন্তু আমি আর কাকা শুধু গন্ধ শুঁকেই খুশি থাকি নি বলে সেই দোকান বছরখানেকের মধ্যেই উঠে গেল।

দোকান উঠে গেল বটে, কিন্তু বাজারে কাকার একটি আজ্ঞা এবং আস্তানা হল।

একদিন চৈত্রের নিমসন্ধ্যাবেলা, দোয়েল চড়ুইরা যখন উঠোনের ধুলোয় খেলেটেলে ফিরে গেছে, কাকার বন্ধুরা বাড়িতে খবর দিয়ে গেল, কাকা বাজারের দোলপুজোয় ফাটাবার জন্য বোমা তৈরি করছিল, একটা বোমা তার হাতের মধ্যেই ফেটে গিয়ে পুরো হাতের পাতাটা উড়িয়ে দিয়েছে। বন্ধুরা তাকে এখনই নৌকো করে নিয়ে যাচ্ছে শহরে, ডাক্তারের কাছে। শহর আমাদের গ্রাম থেকে একরাত্রির পথ।

দিন সাতেক পরে বন্ধুরা কাকাকে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে এল। শহরের হাসপাতালে তার বাঁ হাতটা কনুইয়ের নিচ থেকে কেটে বাদ দিয়েছে। এখন রোজ সকালে গ্রামের ডাক্তার এসে ঘা ধুয়ে ক্ষতের মধ্যে গজ পুরে পুরে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে যায়। গজ পোরার সময় কাকা কাটা পাঁঠার মতো দাপায়। আর তখন, অত বড় একটা খোলা ঘায়ের বীভৎসতা দেখতে লোকেরা মাছির মতো ভিড় করে আসে। এইভাবে এক মাস হয়ে গেল কিন্তু সেই ঘা আর কমে না। তখন ঠাকুমার মনে পড়ল ছ মাস আগে ঘটে যাওয়া সেই কু-ঘটনার কথা।

আমাদের দেশে ঘরে ঘরে শ্রাবণসংক্রান্তিতে মনসাপুজো হয়। মহেঞ্জোদাড়োর সীলে যে রকম লম্বাটে কলসি আঁকা আছে ঠিক সেই রকম চেহারার কলসির গায়ে কুমোররা মনসার পট আঁকে আমরা বলি মনসার ঘট। পুজো হয়ে গেলে এক বছরের জন্য ঘটটিকে সাবধানে সরিয়ে রাখা হয়, যেন কোনক্রমে সেটি না ভাঙে। মনসার ঘট ভাঙা খুব দুর্লক্ষণ।

মাস ছয়েক আগে আমি একদিন দুপুরে চুপিচুপি মই বেয়ে পাটাতনে উঠে খুঁজে খুঁজে দেখছিলাম কোন কলসিতে গুড় আর মোয়া আছে। সেখানে দু-তিন বছরের মনসার ঘট রাখা ছিল। আমার হাতে লেগে তার একটা পাটাতনের উপর থেকে গড়িয়ে মেঝেয় পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ঠাকুমা খাচ্ছিলেন, শব্দ শুনে ছুটে এসে দেখেন, এই কাণ্ড! সবাই খুব ভয় পেয়ে গেল কি হবে কে জানে! ঠাকুমা বলতে লাগলেন, বিষহরি, রক্ষা কর! বিষহরি, রক্ষা কর! এত দিনে সেই ঘটনা ঘটল! মা মনসার কোণ থেকে কাকাকে এখন কে বাঁচাবে!

আমাদের গ্রামের মনসাবাড়ি খুব প্রসিদ্ধ। মনসামঙ্গলের কবি বিজয় গুপ্ত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ওই মনসা। ছোটমাকে বাপের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে আমি কতবার গেছি সেই মন্দিরে। চকমিলানো মন্দিরের মধ্যে পিতলের প্রমাণসই মূর্তি, পিতলের হাঁস, ফশাধরা সাপ। মূর্তির সামনে এবড়োখেবড়ো পিরামিডের মতো প্রতীক-পাথর- তার সারা গায়ে তেল-সিঁদুরের মোটা পলেস্তারা। ঠাণ্ডা ছায়ার মধ্যে মনসাদেবী রূপে আর গরলে জেগে আছেন।

মন্দিরের পাশেই ঘাটলা বাঁধানো দিঘি। কালো থমথমে জল। চাঁদিনী রাতে জলের তলা থেকে নাকি হাঁস আর সাপ উঠে খেলা করে। সেই কথা মনে করে আর গভীর কালো জল দেখে আমি দিঘিতে কোনোদিন নামতে সাহস করি নি। এখন কাকার জন্য ঠাকুমা সেই দিঘিতে স্নান করে মন্দিরে এসে হত্যা দিলেন, এবং অনাহারে তিন দিন তিন রাত্রি মনসার পায়ের কাছে পড়ে থেকে চার দিনের দিন ভোরে আবার ঐ দিঘিতে ডুব দিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। মা বিষহরি তাঁকে ওষুধ বলে দিয়েছেন। ভিজে কাপড়ে ঠাকুমা আমাদের বাড়ির জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে ঢুকলেন, একা। লোকচক্ষুর আড়ালে কোনো বন্য গুল্মের একরাশ পাতা তুলে এনে নিজেই শিলে বাটলেন। তার পর কাকার ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে সেই বীভৎস ঘা আর হলদে হয়ে যাওয়া হাড়ের উপর মোটা করে প্রলেপ দিলেন। সেই দিন থেকে ডাক্তারের গজ ভরার বদলে ঠাকুমাই মনসার ওষুধ দিয়ে কাকার চিকিৎসা করতে লাগলেন। সাত দিনের মধ্যে ক্ষত মাংসে ভরে উঠল, চোদ্দ দিনের মধ্যে কাটা হাড়ের উপর নতুন চামড়া ঘিরে এসে জুড়ে গেল।

তার পরেও ঠাকুমা ঐ পাতা-বাটা দিয়ে অনেকের বড় বড় ক্ষত সারিয়েছেন। কিন্তু কিসের সে পাতা কেউ জানে না। ছোটমা লুকিয়ে ঠাকুমার পিছনে পিছনে জঙ্গলে গিয়ে কতবার দেখার চেষ্টা করেছে, কিন্তু একবারও কিছু বুঝতে পারে নি।

সেরে ওঠার পর কাকা আবার আগেকার মতো হয়ে গেল। দেড়খানা হাত নিয়ে আবার সে দূর দূর গ্রামে হাডুডু খেলার নেমন্তন্নে যেতে লাগল। ফিরে এসে হাসতে হাসতে বলত, দুখানা হাতের চেয়ে দেড়খানা হাত আরো ভয়ংকর। কাকা সত্যিই পদ্মপাতায় জল- যতক্ষণ টলটল করে ততক্ষণ ভারি সুন্দর। একদিন সে সত্যি সত্যিই পদ্মপাতায় জলের মতো চলে গেল।

.

দাদু ও হাতে খড়ি

দাদুর দীর্ঘ ঋজু শরীরটি বৃদ্ধ কিন্নরের মতো, কিন্তু পাকা দাড়িগোঁফে ঢাকা মুখটি ফকিরের মতো। ছোট সাদা চুলের নিচে পিতলহলুদ কপাল, রক্তাভ চোখ এবং সূক্ষ্ম লাল শিরাফুট নাকটি ছাড়া তাঁর সম্পূর্ণ মুখখানা কেমন আমি জানি না। দাদুর কাছে গেলেই দা-কাটা তামাকের পুরুষগন্ধ পাওয়া যায়। নিম্নাঙ্গে সামান্য একখানা ধুতি, অর্ধেক খুট কাঁধের উপর এই চিরাচরিত পরিচ্ছদে, নির্বিকার খালি গায়ে দাদু যখন আমাকে নিয়ে কোনো লম্বা পথ ধরে হাঁটতেন তখন মনে হত আমরা দুজন মুক্তপুরুষ। বংশলতার রক্ত ক্ষীরের মতো গাঢ় হয়ে উঠত, বিশল্যকরণীর সবুজ রসে আমাদের কাঁচের ধমনী টলটল করত।

দাদু জীবনে চাকরি বা ব্যবসা বা ভিক্ষা কিছুই করেন নি। অর্থোপার্জনে তাঁর বিন্দুমাত্র মন ছিল না। তেল নুন লকড়ি কোত্থেকে আসত কে জানে। ছাত্রাবস্থায় পড়াশুনো কদ্দূর করেছিলেন সেও এক রহস্য। নিজের সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ নীরব। মনে হয়, স্মৃতিসঙ্গহীন এবং আশা-তাড়নাহীন এক সময়াতীত দেশে বাস করতেন তিনি।

শুনেছি, বিয়ের পর যখন তাঁর চারটি ছেলেমেয়ে জন্মে গেছে, তখন একদিন তিনি সম্পূর্ণ অকারণে গৃহত্যাগ করেছিলেন। সহায়-সম্বলহীন ঠাকুমা বিপদে পড়ে পিত্রালয়ে আশ্রয় নেন। কিন্তু দাদু একদিন যেমন হঠাৎ চলে গিয়েছিলেন তেমনি দীর্ঘ চার বছর পরে আরেক দিন হঠাৎ ফিরে এলেন এবং সসন্তান স্ত্রীকে নিয়ে আবার যথাপূর্বং সংসার করতে লাগলেন। দাদু কেন যে চলে গিয়েছিলেন এবং এই চার বছর কোথায় ছিলেন, কি করেছেন, কেউ জানে না।

দুখানা ধুতিতে দাদুর এক বছর চলে যায়, একজোড়া চটিজুতোয় দু বছর আর একটা ফ্লানেলের পাঞ্জাবি ও একখানা আলপাকার চাদরে চলে গেল পুরো একজীবনের বার্ধক্যের শীত। সকালবেলা প্রাতঃপরিচ্ছন্নতার পরে কুড়ি-পঁচিশ দানা কাঁচা চাল চিবিয়ে এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খান– এই তার নিত্য ব্রেকফাস্ট।

দাদু তাঁর দিন দিয়েছিলেন পরিক্রমারত সূর্যকে, আর রাত মুদিত সন্ধ্যাকে। প্রায় সারা দিনই অব্যর্থ হাতে এটা-সেটা করেন কিন্তু সন্ধ্যা হলেই তাঁর ডানা দুটি বুজে যায়। দাদুর যা কাজ বাজার করা, ধান-চাল কেনা, নেশার জন্য তামাক মাখা, বাগান দেখা, বেড়া বাঁধা, চিঠি লেখা, ঋতুবিশেষে পাঁচন বানানো উঠন্ত বেলার রোদ আর পড়ন্ত বেলার ছায়ার সঙ্গে পায়ে পায়ে চলে। তাঁর কাছে কাজ, নেশা ও বাতিকের কোনো আলাদা ভাগ নেই, সবই সমান গুরুত্বপূর্ণ। রিয়ালের গভীর প্রতীতিতে এসব সম্পন্ন করেন তিনি। অমাবস্যা-পূর্ণিমার নিশিপালন তার কাছে পাবণ, ঘরের জন্য নকশাদার বেড়া বানানো তাঁর মহা বাতিক।

তামাক খাওয়াটা তাঁর নেশা, কিন্তু তামাক তৈরি করাটা এক অনুষ্ঠান। নিজের হাতে বেছে বেছে তিনি বাজার থেকে শুকনো তামাকপাতা কেনেন। ছোট্ট দিবানিদ্রার শেষে, কসাইদের মাংস কাটার কায়দায়, কাঠের কুঁদোর উপরে তামাকপাতা রেখে দা দিয়ে তাদের কুচি কুচি করেন, শেষে সেই পাতলা কুচো তামাক কুলোয় রেখে চিটেগুড় দিয়ে ঘষে ঘষে ডলে ডলে মাখেন, মাখতে মাখতে জলের ছিটে দিয়ে চিটেগুড়ের আঠালো কামড়ানো ভাবটা ছাড়ান। তৈরী তামাক মাটির বয়ামে টাইট করে রেখে সরঞ্জামগুলো নিখুঁত যত্নে তুলে রাখবার পর পর্ব শেষ।

 তাঁর হাতে দা যেন কথা বলে। ঝাড়ের থেকে পাকা বাঁশ, ঝোপের থেকে পাকা বেত কেটে এনে পুকুরের জলে ডুবিয়ে তিনি সীজন করেন। সীজড় বাঁশ ফালা ফালা করে চেরেন, চাঁছেন। ধারালো দায়ের মুখে লাগিয়ে বেতের গা থেকে পাতলা ফিতে বার করেন। তার পর স্বর্ণাভ হোগলাপাতা মাপমতন কেটে বাঁশের ফ্রেমের খোপে খোপে নানা ছদে বসিয়ে যেন বিমূর্ত শিল্প বানান।

দাদু যখন আস্ত বাঁশ ফালি করেন তখন মাঝেমধ্যে বংশলোচন পাওয়া যায়- সাদা একটা চকচকে বস্তু, হৃদরোগের মহৌষধ।

চার বছর বয়সে আমার হাতে খড়ি হলে দাদুর আর একটা কাজ বাড়ল। হাতে খড়ি হবার পরের দিনই একতাড়া তালপাতা এনে দিলেন। সকালে বিকেলে ডালিম গাছের নিচে সেই তালপাতার তাড়া আর চার-পাঁচটা কঞ্চির কলম নিয়ে বসি, কাঠকয়লা স্লেটপাথরে ঘষে ঘষে কালি তৈরি করি। দাদু বাঁশ চাঁছতে চাঁছতে আমার অ আ ক খ লেখা দেখেন। কঞ্চির কলম কিভাবে মুঠো করে ধরতে হয় শেখান, চটের আসনের উপর আমার বসার ভঙ্গি ঠিক করে দেন, যেন এও এক অনুষ্ঠান। সোনালি তালপাতা কালো কালির অ আ ক খ-তে ভরতি হয়ে গেলে একটুকরো ভেজা ন্যাকড়া চেপে বুলিয়ে। নিলেই মুহূর্তে পরিষ্কার।

খালের জলে মাছ আটকাবার জন্যে কিছু দূর দূর যেমন বাঁশের চিক খাড়া করে বসিয়ে দেওয়া হয়, লেখাপড়া আরম্ভ করার পর আমার জীবনেও তেমনি হালকা নিয়মের দুটো-একটা বেড়া পড়ল। চিকের ফাঁক দিয়ে খালের জল বয়ে যায় ঠিকই, শুধু আটকা পড়ে মাছ। আমারও জীবন বয়ে যেতে লাগল, আটকা পড়ল নির্দোষ নিশ্চিন্ত। এখন সায়ংকালে পা ধুয়ে চটি পরি। দাওয়ায় দাদুর পাশে বসি। পুব থেকে পশ্চিমে কাক, ডাকতে ডাকতে বাড়ি ফেরে, পশ্চিম থেকে পুবে বাদুড় নীরবে উড়ে যায় আমি গুনি এক দুই তিন চার পাঁচ. .. কোনো কোনো দিন তিরিশ-পঁয়ত্রিশটা। আকাশ কোলাহল। আর আলোর উলটো দিকে ধীরে ধীরে ঘোরে– কোমল ফুলের মতো ফোটে একটা তারা, দুটো তারা, সাতটা তারা… হঠাৎ রত্নসুপ্তির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে অগণ্য তারায় আকাশ ভরে যায়। আমি একটু একটু করে নীরবতা শিখি।

পড়তে শেখার পরে স্বর্গ, নরক আর মর্ত্যপৃথিবী আমাকে মহা চিন্তায় ফেলল। ছোটদের ঘরে একটা ছবি ছিল: ‘মানুষের দশ অবস্থা জন্ম থেকে মরণ, মায়ের কোল থেকে চিতাগ্নি পর্যন্ত। দশটা ছবির নিচে দশ রকমের বর্ণনা লেখা। একই মানুষ কি রকম ধাপে ধাপে বদলে যাচ্ছে। আমি দেখলাম একটা অবস্থাও সুখের না। আমার সামনে পরিণতির প্রহেলিকা। ঐ ছবিটার কাছে আমি বিষণ্ণ বিমূঢ় হয়ে থাকতাম।

ক্ষীরোদ কর্মকারদের বাড়িতে টাঙানো ছিল আরো এক সারি ছবি– সব কখানাই অভিশপ্ত পৃথিবীর- দশমহাবিদ্যা, বৃষকেতুর আত্মোৎসর্গ, সীতাহরণ, অনন্ত শয্যায় নারায়ণ, বৈতরণীজলে প্রেতাত্মার দল, মোষের পিঠে যম। মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে একখানা ছবির সামনে এসে আমি আটকে গেলাম। ছবিটা নরকদৃশ্যের বারাখানা ছবির নিচে বারো পাপের নাম, আর ছবিতে তার নির্দিষ্ট শাস্তি আঁকা। ছবির সমস্ত স্ত্রীপুরুষ ন্যাংটো, যমদূতেরা গাঢ় নীল রঙের, ভয়ংকর। অনেক পাপই আমার কাছে দুর্বোধ, কিন্তু একপাশে মিথ্যাবাদীকে দেখছি দুটো যমদূত তার মাথায় করাত বসিয়ে কাটছে। মিথ্যাবাদী হাত জোড় করে আছে, তার ন্যাংটো চেহারাটা বালকের মতো। আমি ভয়ে শীতল হয়ে গেলাম আমি তো অনেক মিথ্যে কথা বলেছি, মরণের পরে আমাকে ঐভাবে কাটবে? এর পরে যখনই ঐ ছবির কথা মনে পড়ত তখনই ভয়ে আমার হাত-পা শিথিল হয়ে যেত। এখনো আমি ঐ শাস্তির কথা বিশ্বাস করি, কিন্তু ভয় আর পাই না, কেননা ইহজগতেই ঐ করাতেরও চেয়ে কষ্টদায়ক করাতে কাটা পড়ার ব্যথা আমার জানা হয়ে গেছে।

এই সময়ে বর্ণপরিচয়, আদর্শলিপি, বোধোদয়, হাসিরাশি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য বই ঠুকরে ঠুকরে পড়তে শুরু করলাম। আমার দোকানের কথা আগেই বলেছি। এখন দেখলাম সেখানে আছে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন, অর্ধকালী, মেজো বউ, রাজা হাম্বীর, শিশুরঞ্জন রামায়ণ, ছেলেদের মহাভারত, সাবিত্রী সত্যবান, হিতোপদেশ, কবিতা কৌস্তুভ. … আমার মুশকিল হল শব্দের অর্থ নিয়ে। আমি অর্ধেক কথাই বুঝি না। ব্রহ্মানন্দ মানে কি? কেশবচন্দ্র মানে কি? হৃদয়বত্তা মানে কি? বিরহ মানে কি? হাম্বীর আবার কোন ধরনের নাম! আমার সবচেয়ে ভালো লাগত অধকালী বইটা অতি বিস্ময়কর কাহিনী, সঙ্গে রঙিন সব ছবি: এক জমিদার ছেলের বিয়ে দিয়েছেন, সেই বউ অর্ধেক মানবী অর্ধেক দেবী। একদিন বউ পরিবেশন করছে। ঘোমটা সরে যেতে জমিদার দেখেন ফরসা বউয়ের কালো রং, মুখের অর্ধেক ত্রিনয়নী কালীর।

আমি একলা বালক, প্রকৃতি আর বই আমার দুই সঙ্গী হয়ে উঠল। দিনে দিনে প্রকৃতি আমার অবচেতনে ঢুকতে থাকল আর বই আমার চেতনাকে বহু দূরে দূরে অনির্দেশ্য। দেশে আকর্ষণ করে নিয়ে গেল। এই দুই টানই এত সুখের যে কাছের সমস্যার দিকে আমার চোখ আর কোনোদিন ফুটল না।

আমি বড়পুকুরের ওপারে প্রাচীন রেইন ট্রি গাছের গোড়াটিতে বসে বই পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি: জগৎ।

বই ও ছবিতে যেখানে প্রকৃতি বা অতিপ্রকৃতির কথা থাকত সেসব অংশ আমাকে স্বতঃআকর্ষণ করে আবিষ্ট করে ফেলত। পঞ্চভূত- আকাশ বাতাস আলো মাটি জল খেলতে খেলতে যে কিআরেকুয়েরো বানায় তা দেখা বা শোনা মাত্র আমার শরীরের নির্জন পঞ্চভূতে তার আবেগ শুরু হত। যেমন একদিন এক জায়গায় নদীর কথা পড়লাম :

পাহাড়ের ‘পরে। পাথরের ঘরে
আমার জনমস্থান,
 বিজনে যেথায় বায়ু বহে যায়
বহিয়া বিহগগান।

আমি তখনো পাহাড় দেখি নি। কিন্তু পড়ামাত্র উঁচু জনমানবহীন বিজনদেশে দীর্ঘ সরল গাছপালার মধ্যে দিয়ে বাতাস বয়ে যেতে লাগল। তার উদাসীন অলস মর্মর আমি কতভাবে শুনতে পেলাম, বাতাসের অদৃশ্য নীল ঋজু রেখা দেখতে পেলাম… পাতা উড়ে উড়ে পড়ছে। তার পর আরো অনুপুঙ্খ… আরো অনুপুঙ্খ। এই সুখ ইন্দ্রিয়নির্ভর নয়, ইন্দ্রিয়াতীতও নয়। পঞ্চেন্দ্রিয়ের গভীরে আরো পঞ্চেন্দ্রিয় আছে সেখানে এসে এই সুখ মৃদু ঢেউ দেয়।

পড়তে শেখার আগে, আরো কম বয়সে, আমি আরো একবার এই রকম বাতাসের শব্দ শুনেছিলাম। বসন্ত ধোপার কাঁধে চেপে তাদের বাড়ি যাচ্ছিলাম, পথে বেলা তপ্ত হয়ে উঠল। বসন্ত এক নির্জন মাঠে একটা তাল গাছের নিচে আমাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে ছায়ায় বসল। আমারও ক্লান্তি লাগছিল, এমন সময় শুনলাম উঁচুতে তালের পাতার মধ্য দিয়ে হাওয়া বইছে, থেমে থেমে বাতাসে তালের পাতার শব্দ উঠছে। সামান্য শব্দ, কিন্তু আমার সমস্ত চেতনা উৎকর্ণ হয়ে যেন অন্য কিছু শুনতে লাগল। তালের মগডালে। বাতাসের সেই শব্দ কোনো উপমায় বা ক্রিয়াপদেই প্রকাশ করা যাবে না। যদি কাউকে নিয়ে গিয়ে সেই ঝা ঝা তেপান্তরে আবার সেই শব্দ বাজিয়ে শোনানো যায় তবে সে হয়তো টের পাবে দূর শূন্যের পুরুষ বাতাসের স্রোত– দূর শূন্য থেকে অদৃশ্য কর্ড ধরে পুরুষ বাতাস কেমন করে পৃথিবীর কাছে ফিরে ফিরে আসে। বাতাসের করতালি, মাতলামো, উচ্ছ্বাস এসব ভাসমান সস্তা শব্দে কি করে বোঝানো যাবে সেই অনির্বচনীয় গভীরকে। এইসব আচম্বিত শব্দ আর পলকদৃশ্য হঠাৎ হঠাৎ জানিয়ে দেয়, এই পৃথিবী কিসের মমর!

সেই বয়সে, এসব আমি স্পষ্ট করে বুঝি না, শুধু বোধের গোধূলিতে দ্বিতীয়ার চাঁদের ধূসর সোনার আবছামতো রেখায় কত লেখা পড়ে। মন সুখ আর বিষাদে দু ভাগ হয়ে চিরে যায়। অনুভূতির চাপে আমি জলের মধ্যে মাছের মতো স্থির হয়ে ডুবতে থাকি, আবার কখনো আঁকুবাকু করে উঠি মহামৎস্যের মতো ঘাই মারতে চাই অনন্তে।

কয়েক বছর পরে এক সংখ্যা প্রবাসীতে আবিষ্কার করলাম বীরেশ্বর সেনের একখানা ছবি: একজন দীর্ঘদেহী লোক খালি গায়ে সূর্য-ডুবে যাওয়া আকাশের সামনে দু হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে, তার পায়ের নিচে সায়ংসন্ধ্যায় কালো-সবুজ উপত্যকা, জনহীন নিচু পাহাড়ের ঢেউ। লোকটির শুধু পিছনটা দেখা যাচ্ছে অতি ঋজু শরীর, লম্বা দুই বাহু চল্লিশ ডিগ্রিতে টানটান হয়ে যেন আকাশ স্পর্শ করছে। ছবির নিচে লেখা: কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম। আমি তখন সংস্কৃত জানি না, অর্থ বুঝতে পারছি না, কিন্তু লোকটাকে ঠিক বুঝতে পারছি। সে ঠিক আমার মতো, অনির্বচনীয়ের সামনে দাঁড়িয়ে নিথর, তার হাত ঘাই মারছে অনন্তে।

প্রকৃতি, বই আর ছবি আমাকে এইভাবে ভাবাতে লাগল। কিন্তু বয়সের ধর্ম যাবে কোথায়! সন্ধের পর লন্ঠনের আলোয় বাধ্যতামূলক পড়া আমার ভালো লাগে না। পিসতুতো ভাইয়েরা এলে রাত্তিরের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বেশ দুষ্টুমি জমে উঠত। তারা আসত অন্তত মাসখানেকের জন্যে, বইপত্তর সঙ্গে করে। দাদু বিছানায় বসে থাকতেন, তাঁর সামনে আমরা চট পেতে লন্ঠনের আলোয় যার যার পড়া করতাম। কাজকর্মে পিসিমা বা ছোটমা লণ্ঠনটা নিয়ে গেলেই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে তারা চেঁচিয়ে উঠত:

অন্ধকারে মহাঘোরে
যে যারে ভেঙ্গাইতে পারে।

সঙ্গে সঙ্গে বিতিকিচ্ছিরি মুখ করে পরস্পরকে আপ্রাণ ভেংচি কাটা শুরু হত। কিন্তু অন্ধকারে তো সেই ভেংচি দেখা যায় না। অতএব পরে আমাদের চিমটি কাটা শুরু হল। অন্ধকারে কে কাকে চিমটি কাটছে ধরা যায় না।

পিসতুতো ভাইয়েরা চলে গেলে আবার আমার নিঃসঙ্গ পড়াশোনা। এই সময় একটা ঘটনা ঘটল যা আজ ভাবলে হাসিও পায় অবাকও লাগে। উত্তরের ঘরের মনুপিসির কাছ থেকে একটা ভূতপেত্নীর বই এনেছিলাম। বইটা নীল কালিতে ছাপা আর ভূতপেত্নীদের ভয়ংকর ভয়ংকর ছবিতে ঠাসা মামদো, শাঁকচুনি, ব্রহ্মদৈত্য, গোভূত, আরো অনেক রকম। আমি বইটা নিয়ে রোজ দুপুরে আমার রেইন ট্রি গাছের গোড়ায় গিয়ে বসি, আর ফিরি বিকেলে। ছাপা বইয়ের কথা একটাও অবিশ্বাস করি না, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবি দেখি, আর ভয়ের সুখে শিরশির করি। বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কালো ঝাঁকড়া গাব গাছটার দিকে কেবল আমার দৃষ্টি যায়। কয়েক দিন এই রকম চলল আর ক্রমশ আমার ভয় বাড়তে লাগল। বইটাতে একটা গল্প ছিল– ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ এক নাপিতকে দুপুরে মাঠের পথ থেকে ধরে নিয়ে গেছে ভূতেরা, তাকে দিয়ে শ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়াবে, শেষে তারই ঘাড় মটকে রক্ত খাবে। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যায়। সারা দিন ভূতপেত্নীর কথা ভাবি, চেহারা ভাবি, সন্ধের পরে আর ঘরের বাইরে উঠোনে নামতে চাই না। কিন্তু কাউকে কিছু বলি না, বইটাও পড়া ছাড়ি না। গভীর রাত্রে আমার ঘুম ভেঙে যেতে লাগল। দাদু, ঠাকুমা আর আমি পাশাপাশি শুই। আমি ঠাকুমার ঘুমন্ত স্তনে হাত দিই, মনে হয় পেত্নীর স্তনে হাত দিয়েছি। মশারির গা ঘেঁষে অন্ধকারে সব কিম্ভুতকিমাকার অপদেবতা দাঁড়িয়ে আছে। কোন্ গাছ থেকে দু-তিনটে জোনাকি এসেছে ঘরে। দূরে অন্ধকার পথে ফেউ ডাকছে। সারা বাড়ি ঘুমে অচেতন। অন্য গ্রাম থেকে কুড়িয়ে আনা কাকার ভূতের গল্প ঠিক এই সময়ে মনে পড়ে: কলেরায় সেই গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে। বাড়িতে আসা ছেলেকে পেত্নী মা ঘর থেকে লম্বা হাত বাড়িয়ে ঝোঁপ থেকে জামির এনে দিল। হেলে পালাতে পালাতে শুনতে পায়, মা অট্টহাসি হাসতে হাসতে বলছে: যা, বড় বাঁচা বেঁচে গেলি! পাশের অন্ধকার ঘরে কি বড়মা এখন ঘুমোচ্ছে, না কি লম্বা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পুকুরপাড়ের জামিরের ঝোপে? কাউকে বিশ্বাস নেই।

আমি দিনে দিনে শুকিয়ে যেতে লাগলাম। সন্ধে হলেই চমকে চমকে উঠি। ঠাকুমা আর দাদু আমাকে নিয়ে ভাবনায় পড়লেন। এইভাবে মাস দুয়েক চলার পরে একদিন সকালে দাওয়ায় বসে আছি, এমন সময় এক বুড়ো ভিখিরি ভিক্ষে করতে এসে আমাকে একনজর দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘ও মনু, তুমি ভয় পাইছ? ঠাকুমা ঘরেই ছিলেন, বেরিয়ে এলেন। ভিখিরি বলল, “মা ঠাইরেন, এই পোলা ভয় পাইছে। একখান পান আনেন, আমি ঝাড়ফুক জানি, সারিয়া যাইবে। কি ঘটে দেখবার জন্য সবাই ভিড় করে এল। ভিখিরি পিঠে-বুকে হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বলতে বলতে কয়েক বার আমার সারা গায়ে ফুঁ দিল। তার ফুঁ বড় আরামের শরীর যেন হালকা হয়ে যায়। তার পর পান পাতায় শুধু আঙুল দিয়ে কি লিখে, মুড়ে আমাকে দিল। আমি চিবিয়ে পানপাতাটা খেয়ে ফেললাম। ব্যস, আর কিছু ঘটল না। কিন্তু সেই দিন থেকে আমার ‘ভয় ভূতের কর্পূরের মতো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।

দুষ্টুমি করলে দাদু মারতেন না, শুধু হাত দুটো গামছা দিয়ে বেঁধে বাঁশের আড়ায় আমাকে ঝুলিয়ে রাখতেন। প্রথম মনে হত, ঝোলাক গে, কি আর হবে, বেশ দুলব। কিন্তু খানিকক্ষণ যেতে না যেতেই শরীর যেন ভারী হতে থাকত, হাত যেন ছিঁড়ে যেত। আমি পরিত্রাহি চেঁচাতাম। চেঁচানি শুনে ঠাকুমা এসে আমাকে আড়া থেকে নামাতেন। তার পর হাতবাঁধা অবস্থায় আমাকে পুকুরের দিকে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে যেতে তর্জন। করতেন- ‘আমি অরে বড় করছি, আমিই আইজ অরে মারিয়া ফ্যালামু। রাগে তাঁর কালো রং বেগুনী হয়ে গেছে। মারবার জন্যে ঠাকুমা পুকুরের জলে আমার মাথা ডুবিয়ে চেপে ধরতেন, আবার তুলতেন, আবার ডোবাতেন। জল খেয়ে খেয়ে আমার হেঁচকি উঠত। মাথা ডুবিয়ে ধরলে জলের মধ্যে পড়ন্ত রোদের সৌধ দেখা যেত– ভঙ্গুর কমলারং। ঠাকুমা গর্জন করতেন, ‘তোরে আইজ মারিয়াই ফ্যালামু’।

আমি সেই বয়সেও বুঝতে পারতাম, বুড়ো বুড়ী প্রতিযোগিতায় নেমেছে। হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতেও ভিতরে একটা মজা লাগত- দেখি কে জেতে? রাজায় রানীতে যুদ্ধ, উলুখড়ের প্রাণ যায়! শেষটায় ছোটমা এসে ঠাকুমার কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিত। রানী কিন্তু ছাড়বার পাত্রী নয়, তখনও গজগজ করে চলেছে। রাজা মান বাঁচাতে ডালিম গাছের তলায় গিয়ে বাঁশ চাঁছতে লেগেছে। আমি চিরঞ্জীব উলুখড়, জলটল খেয়ে আবার ঠিক হয়ে গেছি।

ঠাকুমা আমাকে কখনো খেলা দেন নি। কিন্তু অতি শৈশবে দাদু আমাকে নিয়ে ঘুঘু সই করতেন। দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে বিছানায় শুলে আমি পায়ে পায়ে তাঁর কাছে গিয়ে বলতাম- ‘দাদু, ঘুঘু সই কর। দাদু চিত হয়ে শুয়ে আমাকে লম্বা দুই পায়ের উপর তুলে নিয়ে দোলাতেন আর তালে তালে ছড়া বলতেন:

ঘুঘু সই, ঘুঘু সই,
তোর পুত কই?
আম গাছে।
কি কাজ করে?
পিঁড়ি চাঁছে।
 কার পিড়ি?
ছোট বউর পিড়ি।
ছোট বউ কই?
 ঘাটে গেছে।
ঘাট কই?
 ডাহুক খাইছে।
 ডাহুক কই?
 তারাবনে গেছে।
 তারাবন কই?
পুড়িয়া গেছে।
ছাই মাডি কই?
ধোপায় নিছে।

তারাবন আমি চিনি। ধনদিদিদের বাড়ির পিছনে ডোবার পশ্চিমপাড় জুড়ে চিরসবুজ তারাবন। নলখাগড়াজাতীয় সেই ফাঁপা গাছেরা এত ঘন হয়ে বন বানিয়েছে যে তার মধ্যে সাপ ছাড়া কেউ ঢুকতে পারে না। তাদের শিকড়ের কাছে জল, ভিতরে গভীর অন্ধকার, পাতায় চাকলা চাকলা সবুজ রোদ্দুর। সেই তারাবন আগুনে পুড়ে গেল?

তার পরই আমি অপেক্ষা করতাম ছড়াটা সেইখানে কখন আসে–

ধোপা কই?
হাটে গেছে।
হাট কই?
ভাঙিয়া গেছে।

 দাদু আমার বুকে-পেটে তাঁর জোড়া-পায়ের পাতা লাগিয়ে পা দুটো নব্বই ডিগ্রিতে লম্ব। করে দিতেন। আমি হাত-পা ছেড়ে উঁচুতে ঝুলতাম। তার পরই

বুড়ি লো বুড়ি!
কী লো?
হাঁড়িপাতিলগুলা সরালো।
ক্যা লো?
তাল গাছটা পড়ল– টিপপুস!

দাদু আমাকে উঁচু থেকে পাশের কোলবালিশের উপরে ফেলে দিতেন- ধুপ্পুস! পড়ল, পড়ল, তালগাছসুদ্ধ ভাদ্র মাসের তাল পড়ল!

.

ছোট ভাই

আমার যখন বছর চারেক বয়স তখন ছোটমার প্রথম সন্তান হল। সে আমার ছোট ভাই। আমি যতটুকু আদরযত্ন পেয়েছিলাম সে তার ছিটেফোঁটাও পেল না। তার চেহারা রুশ শিশু কালকেতুর মতন– কালমেঘপাতার মতো রং, ড্যাবড্যাবা দুই চোখ নাটাফলের চেয়েও বড়, কিন্তু রোগা শরীরে গায়ের চামড়া কুঁচকোনো। তার গলায় কালো কারে বাঁধা কয়েকটা জালের কাঠি আর অনেকগুলো মাদুলি। আমাদের দাওয়ার একদিকে কিছু দিনের জন্য ছাগলের খোয়াড় করা হয়েছিল। সে হামাগুড়ি দিয়ে দাওয়া থেকে পড়ে যায় বলে তাকে প্রায়ই কোমরে দড়ি বেঁধে সেই খোঁয়াড়ে রাখা হত। সেখানে সে ছোট ছোট নখে মাটি খুঁটে মুখে দিত। তার শরীরে ক্রমশ ধূসর ছায়া পড়ছিল। দেড়-দু বছর। বয়সেই সে একটা বড় রকমের অসুখে পড়ল। পেটটা অস্বাভাবিক ফোলা, মাথাটা শরীরের তুলনায় অনেক বড়, হাতপাগুলো কাঠি কাঠি শুনলাম তার শরীরে নাকি জল হয়েছে। অনেক দিন চিকিৎসা করে যখন কবিরাজ কিছুই করতে পারলেন না তখন সবার সঙ্গে পরামর্শ করে পটপটি নামে একটা ভীষণ ওষুধ তাকে খাওয়ালেন। পটপটি খেলে রোগী আর একফোঁটাও জল খেতে পাবে না, ভাতটাত সব বন্ধ, তার পথ্য তখন শুধু রোদে শুকোনো দুধে সেদ্ধ মানকচু, যাকে কবিরাজী ভাষায় বলে মানমণ্ড।

একরত্তি ছেলেটা একফোঁটা জলের জন্য হা হা করে ঘরময় ঘোরে। তার নাগাল থেকে সমস্ত জলের কলসি, ঘটি সরিয়ে রাখা হয়। আমরা ভাত খেতে বসলে সে কুকুরছানার মতো এমো করুণ চোখে বসে থাকে। কিন্তু আশ্চর্য, কখনো সে খাবার জন্য কাঁদে না বা বায়না ধরে না। আমরা তার সামনে অপরাধীর মতো খাই। আমাদের খাওয়া হয়ে গেলে সে নিরাশ হয়ে উঠে চলে যায়।

এই রকম সপ্তাহ দুয়েক চলল। তার পরে একদিন গভীর রাত্রে সজাগ-ঘুম বড়মা শুনতে পেলেন, রান্নাঘরে কিসের যেন খুটখাট শব্দ। কোনো মানুষ বা জন্তু যেন সেই অন্ধকার ঘরে ঢুকেছে। বড়মা ফিসফিস করে ছোটমাকে জাগালেন, ঠাকুমা উঠলেন, কাকা উঠল। তার পর সবাই লণ্ঠন আর লাঠি নিয়ে অতর্কিতে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে, আমার ছোটভাই পান্তা করে রাখা ভাতের হাঁড়িটা নামিয়েছে, আর হাঁড়ির মধ্যে দু হাত ঢুকিয়ে সেই জলসুদ্ধ ভাত চোরের মতো নিঃশব্দে খাচ্ছে।

অসুখে ভুগে ভুগে এবং অবহেলায় আমার ছোটভাইয়ের তেমন পুষ্টি এবং তেজ হল না। তার চার-পাঁচ বছর বয়স হয়ে গেল অথচ একটা ভালো নাম রাখার কথা পর্যন্ত মনে পড়ল না কারো। এদিকে বাবা বাড়ি এলেই তাকে নিয়ে পড়াতে বসেন। হঠাৎ অতু পড়াশোনা তার মাথায় ঢোকে না। পড়াশোনা থাকে মাথার মধ্যে। সুতরাং সে এক একটা পড়া পারে না, আর বাবা তার মাথায় এত জোরে থাবড়া মারেন যে সে কাত হয়ে পড়ে যায়। সে কাঁদে না, কিন্তু ব্যথায় তার ঠোঁট কাঁপে। এ তো গেল দিনের কথা। রাত্রে পড়তে বসে যখন সে পারে না তখন দু-চার ঘা দেবার পর বিরক্ত হয়ে বাবা তাকে দরজার বাইরে অন্ধকারে বার করে দেন। সেখানে সে জন্তুর মতো বসে থাকে, একলা অন্ধকারে তার কতখানি ভয় করে কে জানে! এই রকম কয়েকদিন চলার পর একদিন যেন মাত্রা ছাড়িয়ে গেল বাবা তাকে চোরের মার দিয়ে ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে বার করে দিলেন। আমি কাছে বসে প্যারীচরণ সরকারের সেকেন্ড বুক মুখস্থ করছিলাম, আমার বুকের ভিতরটা হঠাৎ মুচড়ে উঠল, প্যারীচরণ সরকারের বই খং খং করে একটা খোনা শব্দ করে কাঁসার বাসনের মতো ভেঙে গেল। চোখে জল এবং মাথায় আগুন নিয়ে আমি একটানে দরজা খুলে বাইরে এলাম। যথেষ্ট হয়েছে, আমার গলা থেকে গর্জন বেরুল, “তোমাদের বাড়িতে আর না, আমি এক্ষুনি ওকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। বাইরে থেকে শুনলাম, বাবা গম্ভীর গলায় ছোটমাকে বলছেন, “দরজাটা বন্ধ করে দাও।

হিম বাতাস হি হি করছে। চারদিকে কেমন ঘোলা অন্ধকার। কাকাকে পেলে সে কোথাও একটা আস্তানা ঠিক খুঁজে দিতে পারত। কিন্তু কোথায় সে।

আমি ছোটভাইয়ের হাত ধরে ঐ ঘরের মার রান্নাঘরে গিয়ে উঁকি দিলাম। ঐ ঘরের মা সব জানতেন। আমাদের টেনে নিয়ে আঁচলের তলায় একবার জড়িয়ে ধরে ছেড়ে দিলেন। সে রাত্রে ঐ ঘরের মার কাছে আমরা ভাত খেলাম। তাঁদের ছোট ঘরটায় শুলাম। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম, কাল কোথায় যাব? খুব চিন্তা হতে লাগল। কাল সকালে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে চলে যাব? কেউ বাড়িতে আমাদের ডেকে নিয়ে চিরজীবনের মতো নিশ্চয় থাকতে দেবে।

পরদিন সক্কালবেলা, তখনও ঘুম ভাঙে নি, বড়মা আর ছোটমা এসে আমাদের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন।

কিন্তু এত মারধর খেয়েও আমার ছোটভাইয়ের লেখাপড়া শেষ পর্যন্ত বেশি দূর এগোল না। বাবা চিরদিন সংসারের জোয়াল একলা টানছিলেন, এইবার, অতি অল্প বয়সে তাকেও সেই জোয়ালে নিজের পাশে জুতে নিলেন। বাচ্চা বাছুরটা কিছু না বুঝেশুনেই বোঝা টানতে শুরু করল। আর আমি? আমি, খাইদাই পাখিটি, বনের দিকে আঁখিটি।

.

 দুর্গাপুজো

একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি, বর্ষার শেষে আকাশ জল হল হঠাৎ অন্যরকম হয়ে গেছে। শরদাগমে প্রথম বদলায় আকাশ, পরে ক্রমান্বয়ে জল স্থল। আকাশ নিষ্কলঙ্ক নীল কখনো মনে হয় হাত বাড়ালেই সেই নীল নবনী হাতে মাখামাখি হয়ে যাবে, কখনো মনে হয় বাঁশের সঙ্গে বাঁশ বেঁধেও ছোঁয়া যাবে না সুদূর ঐ নীলের স্রোত। কখনো ভোজরাজার শিবিরের সাদা তাঁবুর মতো উজ্জ্বল মেঘ দিগ্বলয় থেকে শূন্যে ওঠে, কখনো মেঘ কোঁকড়ানো চুলের মতো যোজন যোজন উঁচুতে কিছুক্ষণ থেকে, মাছের ঝাঁকের মতো দীর্ঘরেখায় একটা যাত্রার ভঙ্গি আনে, শেষে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিলিয়ে যায়।

আকাশ থেকে যেন কেউ নির্মলি ফেলেছে জলে। মাঠের মাটিতে, পুকুরের পাঁকে শাপলা, পদ্ম, শালুক এতদিন কোথায় ঘুমিয়েছিল– লঘু স্বচ্ছ জলে রাতারাতি তারা মৃণাল জাগায়, পাতা ছড়ায়। আমি তেঁতুলতলার খালের সাঁকোয় উঠে মধ্যিখানের খুঁটির দু দিকে পা ঝুলিয়ে বসে ঝুঁকে পড়ে দেখতাম, দশ-বারো ফুট নিচে খালের জল স্বচ্ছ হয়ে চলেছে দক্ষিণে। স্পষ্ট করে তাকালে দেখা যায় জলের অতি হালকা বেগুনী রঙের স্রোত, আর আবছা করে তাকালে দেখা যায় জলতলে স্থাণু নীল গভীর আকাশ, অস্রোত সাদা মেঘ। জলে টাটকিনা মাছের ঝাঁক যায় মনে হয় আকাশে ভেসে যাচ্ছে মাছের ঝাঁক ঐ তো মেঘের গায়ের উপর দিয়ে সাঁতরে চলে গেল! খালের পাড়ে ডুবে থাকা জলজ গুল্মের সবুজ লম্বা লম্বা পাতা কত রকম আঁকাবাঁকা হয়ে দোলে।

এতদিন ঘন ছায়ায়, বৃষ্টিধারায় মাটি স্লান দুঃখিত হয়ে ছিল। এখন সেও জেগে উঠছে। রাস্তায় আর কাদা নেই, পিছল শ্যাওলা নেই। বনে পচা ডালপালার গন্ধ ক্রমশ উবে যাচ্ছে। পাতার বুকের দিক এখন সিল্কের মতো, পিঠের দিক ভেলভেটের মতো। এখন বনের মধ্যে বালক রোদ্দুর সারা দিন ঘুরে বেড়ায়, ডালের ফাঁক দিয়ে পাতার ফুটো দিয়ে তীরধনুকের কত রকম চাঁদমারি করে।

পরিত্যক্ত, প্রতিমাহীন দুর্গামণ্ডপ এতদিন অগোচরে ধূলিম্লান হয়ে ছিল তার তালকাঠের মোটা মোটা আড়ায় কাক এসে বসত, পায়রা বকম বকম করত, শুধু মাঝে মাঝে আমরা ছেলেরা বাইরে খেলতে খেলতে ঝড়বৃষ্টি এলে সেখানে আশ্রয় নিতাম। এখন এই ভরা ভাদ্রে একদিন কার্তিক কুমোর নৌকো করে এসে হাজির হয়, খড় আর পাটের সুতলি দিয়ে সেখানে বাঁশের কাঠামোর উপরে শক্ত করে প্রতিমার বেনা বানিয়ে রেখে যায়। বিকেলবেলা ছায়াভরা দুর্গামণ্ডপে গিয়ে আচমকা দেখি দশ হাত ছড়িয়ে মুণ্ডহীন খড়ের দুর্গা দাঁড়িয়ে আছেন। দু পাশে কিশোরীশরীর উড়ন্ত পরীর মতো জয়া বিজয়া, তারাও মুণ্ডহীন।

কার্তিক, সেও নির্মুণ্ড। শুধু গণেশ, সিংহ আর অসুরের পুরো কাঠামো খড়ে বোনা মুখের এক অদ্ভুত আদল- মুখ হাঁ করা সিংহকে দেখাচ্ছে ঠিক চার পা-ওয়ালা। একটা সীলমাছের মতো। তাদের সবার গায়ে খড়ের সোনালি আভা। দুর্গা, জয়া, বিজয়ার কী সরু কোমর! জনহীন নীরবতার মধ্যে সেই খড়ের মূর্তিরা শান্ত হয়ে শূলে বসে আছে। আমি সারা বিকেল তাদের কাছে থেকে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যাই। খোলা দুর্গামণ্ডপে যখন চারদিক থেকে গভীর রাত ঢুকে আসে তখন সেই অন্ধকারে তারা কি করে?

কয়েকদিন পরে বুড়ো কার্তিক কুমোর আবার আসে দু-তিনজন শাগরেদ নিয়ে। শাগরেদরা পাট আর তুষ মিশিয়ে পা দিয়ে মাটি ছানে, খড়ের প্রতিমার গায়ে মাটি চাপায়। বুড়ো কারিগর কার্তিক তার রোগা আশ্চর্য হাতে বাঁশের কাটিম ধরে চটপট প্রতিমার গা থেকে বাড়তি মাটি কেটে, চেঁছে বুকের খাঁজ, পেটের ভাঁজ, উরু ও হাতের সন্ধি বার করে আনে। বুড়ো ওস্তাদের বিদ্যে অবাক হয়ে দেখতে দেখতে একসময় তারা কাজ শেষ করে চলে যায়। আমি একলা দাঁড়িয়ে দেখি ভিজে, নরম, কবন্ধ প্রতিমা যেন নীল জলাশয় থেকে উঠেছে। আমি গণেশের কোমল খুঁড়ে হাত দিই, সিংহের হাঁ মুখে। ভয়ে ভয়ে আঙুল ঢোকাই ভিজে, বিষণ্ণ, যেন পরিত্যক্ত সাপের গর্ত।

একমেটে হবার পর রোজ দুপুরে গিয়ে দেখি, আস্তে আস্তে ভিজে মাটিতে টান। ধরেছে, মাটি শুকোচ্ছে আর ফাট ধরছে। একদিন দেখি, শক্ত প্রতিমার বুকের ফাটল বেয়ে সারি দিয়ে পিঁপড়েরা চলেছে তুষের কুঁড়ো খেতে। বাড়ি থেকে দৌড়ে এসে বাঁক ঘুরে সামনে দাঁড়াতেই বুকটা ধক করে ওঠে– কী সব গভীর, অসমাপ্ত মানুষী মূর্তি! দেখতে দেখতে, একটু একটু করে তাদের অস্তিত্ব সয়ে আসে।

প্রথম-মাটি শুকিয়ে ঝুনো হয়ে যাবার পর আবার একদিন কুমোরেরা আসে। নতুন মাখমের মতো মাটি ছানা হয়। প্রতিমার গায়ে দ্বিতীয় বার মাটি চাপানো হয়, ফাটলগুলো মাটির প্রলেপে বুজিয়ে পাতলা কাদায় ভেজানো ন্যাকড়ার পট্টি সেঁটে দেওয়া হয়। বুড়োর হাতের ধারালো কাটিম প্রতিমার শরীরকে আরো নিখুঁত করে তোলে। ওস্তাদ বুড়ো দুর্গা, জয়া, বিজয়ার গলার উপর ছাঁচের মুখ জুড়ে দেয়। প্রমাণসই ধুতি কাদাজলে ডুবিয়ে প্রতিমাকে কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরায়। মাটি গোল গোল করে পাকিয়ে নিয়ে নুলো হাতগুলোয় পটাপট আঙুল বসায়। মাটির লেচি ছাঁচে ফেলে চাপ দিয়ে দিয়ে নিমেষে গয়না গড়ে। দক্ষ হাতে দু-তিন রকম কাটিম দিয়ে অসুর আর সিংহের মুখে, চোখে, নাকের ফুটোয় হিংসা আর দর্প, শক্তি আর ব্যথা ফোঁটায়। প্রহর কেটে যায়, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এইসব দেখি। কুমোরেরা চলে গেলেও নড়তে চাই না। প্রতিমার মধ্যে সুখী প্রাণ এসে গেছে, আমি তার সঙ্গ পাই। কিন্তু আগেকার সেই মুণ্ডহীন, নুলো দুর্গা জয়া বিজয়া এবং লেপাপোঁছা মাথার সিংহ গণেশ অসুর যে অপ্রাকৃত অস্তিত্ব নিয়ে আমাকে ধাক্কা দিত তা এখন অনেক হালকা এবং নরম হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ হতে যাওয়া প্রতিমার মুখে এখন হাসি, শরতের আকাশ থেকে তার সারা গায়ে উৎসবের হাওয়া এসে লেগেছে।

দোমেটে হয়ে শুকিয়ে যাবার পর একদিন কারিগর এসে তার গায়ে দ্রুতহাতে দু পোঁচ খড়ি লাগিয়ে যেত। তার পর পুজোর মাত্র দিন তিনেক যখন বাকি তখন একদিন কার্তিক কুমোর চার-পাঁচ জন শাগরেদ, গোটা দুই টিনের ট্রাংক আর পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে নৌকোয় এসে হাজির। ট্রাংক খুলে বেরুত কত রকমের সরঞ্জাম চাকা চাকা রং, গুঁড়ো গুঁড়ো রং, ছাগলের ঘাড়ের লোমের নানা মাপের তুলি, চুল, রাংতা, গর্জন তেল, আরো কত কি।

এখন মণ্ডপে অন্য আবহাওয়া এতদিনকার নির্জন, আমার একলার মেটে প্রতিমাকে এখন এতগুলো লোক মিলে সাজাচ্ছে– সমস্ত বাড়িটার অন্তঃশীল উৎসবের আশাভরা জলধারা এইখানে এসে রঙের আর আনন্দের ফোয়ারায় যেন মুখ খুলে দিয়েছে। ঘরে ঘরে প্রবাসী বাবা কাকারা, পিসি পিসেমশায়রা সব ফিরে আসছে, তারা আমাদের জন্য সাধ্যমতো নতুন জামাকাপড়ের বাণ্ডিল এনেছে নতুন উজানজলে যেন সুখ ভেসে এসেছে। তবু আমাদের মন পড়ে আছে মণ্ডপে যেখানে কুমোরেরা তেঁতুলবিচি সেদ্ধ করে তার সাদা পাতলা আঠায় বাটিতে বাটিতে রং গুলছে। কী তাজা সেইসব দিশি রং! দুর্গার গায়ে হলদে পাখির গাঢ় হলুদ, অসুরের গায়ে পাতালশৈবালের ঘন সবুজ, বিজয়ার গায়ে গোলাপী দোপাটির কুসুমরাগ, জয়ার গায়ে শ্বেতপদ্মের আভা, শাড়ি আর কাঁচুলির কাঁচা সবুজ, গভীর বেগুনী, ঘোর লাল, অপরাজিতা নীল– মূর্তির উপর কুমোরেরা তুলিতে ভরে এইসব রঙের পোঁচ দেয় আর আমি অবাক হয়ে দেখি, সাদা জমি যেন রঙের বিদ্যুতে ভরে উঠছে। সারি সারি মাটির সরায়, এনামেল বাটিতে কুমোরদের আঙুলে গোলা ঐ রং আমাকে জাগিয়ে দেয়– রঙের ঘন লাবণ্যের মধ্যে ক্রুরতা, পেলবতা, তেজ, অন্ধকার যেন পাত্রে পাত্রে আদিবীজ টৈটুম্বুর হয়ে আছে। আমি পাগলের মতো বুড়ো কার্তিক কুমোরকে মিনতি করি, কারিগরমশায়, জয়ার শাড়িতে ঐ বেগুনী রংটা দাও। আমি কি অবচেতনায় চাই ঐ গভীর স্তন মোহের অন্ধকারে ডুবে থাকুক। ‘কারিগরমশায়, সাপের গায়ে ঐ গোলাপী রংটা দাও- আমি কি কল্পনা করি ঐ সাপ দুর্গার জঠর থেকে বেরিয়ে এসেছে, পিচ্ছিল, সদ্যনির্মোকহীন! গাঢ় গোলাপীতেই সব চেয়ে তীব্র বিষ! কার্তিক কুমোর কখনো কখনো আমার কথা রাখে, কখনো কখনো ধমক দেয়।

আস্তে আস্তে প্রতিমা রঙে রঙে ভরন্ত হয়ে ওঠে। আমাদের হাত থেকে সে বড়দের হাতে চলে যায়। আমরা এখন তাকে দেখতে পাই, ছুঁতে পাই না। কোমল ন্যাকড়ায় তার মুখ মাজা হয়, গর্জনতেলে সে চকচক করে। নকুলকাকারা পাত পাত রঙিন রাংতা কেটে আর শোলার সাজ দিয়ে তার চালচিত্র সাজায়। কিন্তু এত করার পরে আমার মনে হত সে যেন বড়দের দামী পুতুল হয়ে গেছে। রং পড়ার আগেকার, শুধু মাটির সেই এবড়োখেবড়ো মূর্তিগুলোর মধ্যে, নির্জন মণ্ডপে আমি যে অদ্ভুত অস্তিত্ব টের পেতাম, যাদের গায়ে পিঁপড়ে উঠত, ভোমরা বাসা করত, সেই বিশাল আধিদৈবিক অদৃশ্য হয়ে গেছে।

পুজোর কদিন নৈবেদ্য, প্রসাদ, নতুন কাপড়, ঢোল, কাঁসি, পাঁঠাবলি, রক্ত, পটকা, ফুলঝুরি, চটপটি, পেট্রোম্যাক্সের আলো, আরতির ধোঁয়া, হৈ চৈ, এইসব নিয়ে একটা ঘূর্ণির মধ্যে দিন শেষ হত। রাত্রে ঢোল কাঁসি থেমে গেলে শুক্লপক্ষের কাঁচা জ্যোৎস্নায় আমার হঠাৎ বিষণ্ণ লাগত। আমি লন্ঠন নিয়ে বড়পুকুরের ঘাটে গিয়ে দেখতাম কালো জলে ডোবা ঘাটের পইঠায় নিথর হয়ে স্নিগ্ধ শামুকেরা সেঁটে আছে।

.

 লক্ষ্মীপুজো

লক্ষ্মীপুজোর কোজাগরী রাত্রে আমি বড় বিষয় হতাম। দুর্গাপুজো যত আনন্দের লক্ষ্মীপুজো তত হতাশার। আমি শুনেছিলাম, পুজোর শেষে গভীর রাত্রে লক্ষ্মীদেবী বাড়ি বাড়ি ঘোরেন, তখন তাকে ধরতে পারলে টাকাপয়সার অভাব থাকে না। টাকাপয়সা! এমনিতে মনে পড়ে না, কিন্তু এই কথায় খেয়াল হত, আমাদের টাকাপয়সার বড় অভাব। আমার মন খারাপ হয়ে যেত। বিশাল চাঁদ উঠেছে পুবের ঘরের টিনের চালের উপর দিয়ে। ঘরের মধ্যে লক্ষ্মীর পুজো হচ্ছে, সবাই সেখানে ভক্তি নিয়ে বসে আছে। আমি ভিতরে না গিয়ে একা দাওয়ায় বসে থাকতাম। পুরুতঠাকুর পুজো শেষ করে চলে গেলেন, তখনও আমি বসে আছি। ফুটফুট করছে আমাদের উঠোন। চাঁদের আলোয়, মাটির দাওয়ায় আলপনা ফুটে আছে স্পষ্ট হয়ে। আকাশ, বাতাস, দশদিক বড় নিথর, নীরব আর শীতল। জ্যোৎস্নাধূসর গাছপালার পল্লবের উপরটায় আলো পিছলে যাচ্ছে, ভিতরে ভিতরে কালো ছায়া। বসে থেকে থেকে স্পষ্টই বুঝি, সব মিথ্যে কথা– সোনার গয়না পরা, বালুচরী শাড়ি পরা সেই দেবীকিশোরী কখনোই আসবেন না আমাদের বাড়িতে। আর যদি বা আসেন, তেঁতুলতলা দিয়ে আসতে আসতে তাঁর পায়ে ধুলো লেগে যাবে, পশ্চিমপুকুরপাড়ের রাস্তায় অন্ধকারে তাঁর গয়না হারিয়ে যাবে, আমাদের বাড়ির দরজায় যখন পৌঁছবেন তখন তার শাড়ি ছোটমার শাড়ির মতো ময়লা।

.

 বাইচ

পুজোর আগে, ভাদ্রসংক্রান্তিতে যখন আমাদের খালে নতুন জলের ভরা জোয়ার তখন বাইচ হয়। সেদিন অপরাহ্নে আমরা গুড় দিয়ে মাখা ভাজা চালের ছাতুর বড় বড় ডেলা হাতে নিয়ে খেতে খেতে বাজারের খালে বাইচ দেখতে যেতাম। খালের দুই পাড় লোকে লোকারণ্য– তার মধ্য দিয়ে কাঁসর ঝাঁঝর পিটিয়ে উদ্দণ্ড গান করতে করতে নৌকোগুলো চোখের নিমেষে হুসহুস করে চলে যেত। বাইচের ছিপ নৌকো অন্য রকম- সরু, বিশ তিরিশ হাত লম্বা, সামনের গলুই ভাইকিং নৌকোর মতো বাঁকা হয়ে সাত-আট হাত উঁচু হয়ে গেছে। আলকাতরা, মেটে তেল আর গাবের আঠায় মাজা তাদের শরীর কুচকুচে কালো, তাতে আবার গলুইয়ের দু পাশে পিতলের চোখ আর রিভেট বসানো, মেটে সিঁদুরে আঁকা ভয়ংকর সব কারুকার্য। প্রতিযোগীরা নৌকোগুলোর মতোই কালো, বলিষ্ঠ এবং সুঠাম। তাদের হাঁটুর উপর ধুতি মালকোঁচা মারা, মাথার বাবরি চুলে আর কোমরে লাল গামছার ফেটি বাঁধা। এক এক নৌকোয় তারা পঁচিশ-তিরিশ জন প্রচণ্ড শক্তিতে অতি দ্রুত বৈঠা টানছে। সরু খালে পর পর নৌকো, কে কার আগে যায়! উত্তেজনায় লোকারণ্য হৈ হৈ করে ওঠে। সমস্ত জায়গাটা রণহুংকার, উত্তেজনা, ঝাঁঝ কাঁসরের আওয়াজ, পুরুষালি রঙ্গভঙ্গি এবং পলকে চলে যাবার ব্যগ্রতায় উন্মথিত। আমার অবাক লাগছিল, লম্বা গলা উঁচিয়ে পাখনাওলা প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো নৌকোগুলো কিভাবে অকস্মাৎ উদয় হয়ে মুহূর্তে কত দূর চলে যায়! একটার পিছনে আর একটা প্রাণী তাড়া করেছে।

সূর্য ডুবে গেলে বাড়ি ফিরতাম। কারা জিতল কে জানে? কর্মকারদের কালীতলা পেরুতে পেরুতে জংলা আগাছা থেকে বুনো গন্ধের ভাপ উঠত। কেমন ছায়াছায়া শান্ত ভাব। বুড়োরা বলত, ভাদ্রসংক্রান্তিতে শীতের জন্ম। সুরাকাকার বাড়ির পাশের অন্ধকারমাখা বনপথ দিয়ে যেতে যেতে মনে হত দুর্গম ঐ ঘন ঝোপের মধ্যে এই সন্ধ্যায় সাপের ডিমের মতো কোনো ডিম ফেটে গেছে। হঠাৎ উপরে তাকিয়ে দেখতাম গাছের পাতা, জোনাকি আর তারার সঙ্গে কালো জলে মাথার উপরে ছায়াপথ।

.

 নবান্ন

নবান্নের মতো অমন অবিমিশ্র সুখের উৎসব আর হয় না। হেমন্তের শেষে, কার্তিকপুজোর দিন আমরা বালক-বালিকারা কাকভোরে উঠে শীতে কাঁপতে কাঁপতে চাদর সোয়েটার যা হোক কিছু চাপিয়ে দৌড়ে যেতাম মণ্ডপে। মণ্ডপ এখন আমাদের। সেখানে পাতার আগুন জ্বেলে আমরা গোল হয়ে বসে আগুন পোহাতাম আর সুর করে চেঁচাতাম:

কাউয়া কো কো কো।
আমাগো বাড়ি তোমাগো নেমন্তন্ন।
 কাউয়া কো কো কো।
আমাগো বাড়ি আইজকে শুভ নবান্ন।

আমাদের ঘিরে আছে হিম ঊষা। দূরে বড়পুকুরের জলের উপর কুয়াশা। টুপটুপ করে শিশির পড়ছে গাছের তলা শিশিরে ভেজা, শিশিরের অজস্র বিন্দু জমেছে ঝোপের মাথায়, মাকড়সার জালে। ঝোপের মধ্যে পাতলা অন্ধকারে চাক চাক কুয়াশা। কথা বললে আমাদের মুখ থেকে কুয়াশা বেরোয়। হঠাৎ মনে হয় পৃথিবী বড় সচ্ছিদ্র।

ক্রমশ ধোঁয়ায় আমাদের চোখ লাল হয়ে যেত, আগুনের তাপে শরীর গরম হয়ে উঠত, চেঁচিয়ে গলা ভাঙত। অনেকক্ষণ পরে সূর্য যখন উঠে গেছে, রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়েছে, তখন আমাদের মধ্যে কেউ বলত, এত্তিবারে কাউয়ারা নিশ্চয় নেমন্তন্ন পাইয়া গেছে। চল বাড়ি যাই।

ততক্ষণে আমাদের এজমালি উঠোনে সাদা চাঁদোয়া টাঙানো হয়েছে। মাটি নিকিয়ে সেখানে সারি দিয়ে পিঁড়ি পাতা হয়েছে। পুরো বাড়ির পুরুষেরা এবং শিশুরা একসঙ্গে বসে নবান্ন করবে। ঘরে ঘরে নতুন সুগন্ধ ধবধবে সাদা চাল শেষরাতে ভিজিয়ে রাখা হয়েছিল, এখন শিল-নোড়ায় বাটা হচ্ছে, এতক্ষণ ধরে যে নারকেল কুরিয়ে তূপ করা হয়েছিল তাও বাটা হচ্ছে। গতরাত্রেই চাকা চাকা মিছরি ভেজানো হয়েছিল সেই মিছরির জলে ঐ চাল-বাটা, নারকেল-বাটা, ডাবের জল, গন্ধরাজ লেবুর রস মিশিয়ে কলসিতে কলসিতে স্ত্রীলোকেরা তৈরি করছে নবান্ন।

নবান্নয় বসার আগে চাল কলা পিণ্ডের মতো পাকিয়ে কলা গাছের খোলায় করে আমরা দিয়ে আসতাম বড়পুকুরের ওপারে শ্মশানের কাছে। সেই যে সকালে অত তারস্বরে চেঁচিয়ে নেমন্তন্ন করা হয়েছিল- এ সব সেই কাকেঁদের জন্য। আমরা খানিক দূরে গাছের গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতাম, কাকেরা খায় কিনা। কিন্তু আশ্চর্য, একটা কাকেরও দেখা নেই। অপেক্ষা করে করে তখন আমরা আবার মণ্ডপে ফিরে আসতাম। সেখান থেকে লক্ষ রাখতাম। কিন্তু কোথায় কাক! খানিকক্ষণ পরে অধৈর্য হয়ে আবার গিয়ে দেখি, আরো আশ্চর্য খোলা সাফ, কারা যেন এসে চেটেপুটে খেয়ে গেছে। কারা খেল? কাক, কুকুর কাউকে আমরা ওদিকপানে যেতে দেখি নি। সে যা হোক, ব্যাপারটা চেপে গিয়ে আমরা নবান্নের চাঁদোয়ার তলায় বড়দের খবর দিতাম, কাকেরা নেমন্তন্ন খেয়ে গেছে।

তখন একে একে প্রবীণেরা হাতে পাত্র নিয়ে এসে বয়স অনুসারে পর পর বসতেন, যুবকেরা বসত, সব শেষে আমরা, গেলাস, বাটি যা পেয়েছি তাই নিয়ে। আমাদের বালকদের দিকের হট্টগোল আস্তে আস্তে মৃদু হতে হতে বুড়োদের দিকে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে দীর্ঘ সারির প্রথমে সেখানে বসে আছেন আমার দাদু। ঐখান থেকে পরিবেশন শুরু হবে।

রাঙাদাদুর ঘর বাদ দিয়ে বাড়ির সব ঘর থেকে বউ-ঝিরা বড় বড় পিতলের কলসি ভরে নবান্ন এনে ইতিমধ্যে একপাশে দাঁড়িয়েছে। প্রথা অনুযায়ী সব চেয়ে বড় বউটি আগে পরিবেশন করবে, তার পরে মেজো, সেজো ইত্যাদি। কর্তারা প্রত্যেকেরটা খেয়ে মনে রাখবেন কারটা কেমন হল। মুখে কোনো রায় না দিলেও যার বানানো নবান্ন তাঁরা আরেক বার চাইবেন, বোঝা যাবে তারটিই এবার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। সেদিন সেই বউয়ের ভারি গর্ব। ছোট ঝগড়াটি হলে কি হবে, প্রতিবছর সেই ফার্স্ট হত।

আমরা অত তারতম্য বুঝতাম না, প্রত্যেকের কাছ থেকে বাটি গেলাস ভরে ভরে নিয়ে চুমুকে চুমুকে শেষ করতাম। আহা এমন অনবদ্য জিনিস আর হয় না। ছোট, ঐ ঘরের মা এবং লীলাদির মা আমাদের আরো দাও, আরো দাও’ শুনে যথাক্রমে সগর্বে, হাসতে হাসতে এবং নীরবে তাঁদের দ্বিতীয় কলসি নিয়ে আসতেন। ইতিমধ্যে বয়স্করা আমাদের লোলুপতায় যেন নীরব সায় দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হতেন। তাঁরা নিজেরাও এক এক জন ছ-সাত পাত্র খেয়েছেন। বড়রা চলে গেলে যুবারা নানা রঙ্গ করত। আমরা রঙ্গের ধার ধারি না, আমরা চাই কলসি কলসি খেতে। কিন্তু হায়, আমাদের সমুদ্রগ্রাসী জিভের ইচ্ছের সঙ্গে পেটের ছোট্ট খোলটার কোনো সামঞ্জস্য নেই। সবসুদ্ধ আট-ন গেলাস খাবার। পরে আর পারতাম না। স্পষ্ট টের পেতাম গলা পর্যন্ত সেই মধুর সুগন্ধ পানীয় টলটল করছে, পেট বেলুনের মতো ফুলে উঠেছে, একটু দৌড়লেই এখন সেখানে জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ পাওয়া যাবে।

এবেলা আর খাওয়াদাওয়ার চিন্তা নেই। বড় সুন্দর আবহাওয়া। আমি আস্তে আস্তে চলে যাই বড়পুকুরের ওপারে বিশাল রেইন ট্রি গাছটার তলায় সেই অতিকায় প্রাচীন গাছের গায়ে ফাটা ফাটা মোটা বাকল শোলার মতো নরম। প্যান্টের বেল্ট আলগা করে তার গোড়ায় হেলান দিয়ে বসি। ঘুম পায়। দুপুর গড়িয়ে যায়, অপরাহু হেলে পড়ে। পুকুরের জল থেকে যেন ঠাণ্ডা হাই উঠছে। মাছ ঘাই মারে। দিন শেষ হল।

.

 মুনশিবাড়ি

মেজোপিসিমার বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে মাইল দেড়েক দূর। বাজারের সফেন হো হো হৈ হৈ যেখানে বড় খালের পাড়ের রাস্তায় এসে বাতাসে মিলিয়ে গেছে সেখানে কালো রঙের কাঠের পুল। পুল পেরিয়ে নির্জন সরু রাস্তা। সেই রাস্তায় খানিক দূর এগিয়ে গেলে এক নবরত্ন মঠ- কার চিতা কে জানে কিন্তু মঠটা সাংঘাতিক উঁচু, চারদিকে ভাঁটফুলের জঙ্গল, ইটের কারুকার্য এখন ধূসর। মঠের মধ্যে ঢুকে আ- আ- আ- করে চিৎকার করলে অন্য গলায় প্রতিধ্বনি ওঠে: হা আ ম হা আ। সেই মঠ ছাড়িয়ে গেলে আবার একটা পঞ্চরত্ন মঠ, পলেস্তারাখসা, অতি পুরনো। তার পর খানিকটা রাস্তা একেবারে নিবিড় ছায়াচ্ছন্ন। নিচে নেমে যাওয়া ঘন গাছপালা ঝোঁপঝাড়ের মধ্য দিয়ে কলকল করে খালের জল বইছে। খালের দু পাড়ে কাদায় পায়ের দাগ গর্ত গর্ত হয়ে আছে, যেন হাড়ের পা নিয়ে সেখানে কেউ হেঁটে গেছে। পথের পাশে প্রাচীন শটিবন নীল হয়ে আছে। জায়গাটায় পা দিলেই গা ছমছম করে ওঠে। ছায়া আর ভয় হঠাৎ একঝাক পাতিকাকড়ার মতো আদুড় গায়ে ছড়িয়ে গিয়ে দাঁড়া দিয়ে পিঠের চামড়া আর ঘাড় কামড়ে ধরে। শেষে বাঁয়ে ঘুরে আর একটা কাঠের পুল পেরুলেই ফাঁকা ঐ তো মেজোপিসিমার বাড়ি দেখা যায়।

মেজোপিসিমার বাড়ি প্রায়ই যেতাম। আর ঐ গা ছমছম করা জায়গাটায় পৌঁছলেই আমার ভাবান্তর হত। মনে হত, এই জায়গাটায় অনেক কিছু ঘটে যা কেউ দেখতে পায় না।

এই রকম আশঙ্কাভরা অনুভূতি হত মুনশিবাড়িতে গেলে। কিন্তু সে ভয়ের জাত আলাদা। হয়তো তা ঠিক ভয়ও না, অন্য এক জগতের অনুভূতি। আমাদের বাড়ির পিছন দিকের পথ দিয়ে গেলে দু-তিনখানা বাড়ির পর মুনশিবাড়ি। প্রথম সেখানে গিয়েছিলাম গদার সঙ্গে।

প্রত্যেক ফুলের পাপড়ির কেন্দ্রে একটা সূক্ষ্ম ফুটো আছে, সেই ফুটো গিয়ে শেষ হয়েছে বোঁটার প্রান্তে। ঐ পথটুকু জাদুপথ। কেউ যদি অতি সূক্ষ্ম হয়ে ছুঁচের মতো ঐ পথের এক মুখ দিয়ে ঢুকে অন্য মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে তবে সে পৌঁছবে এক অন্য রাজ্যে। এক এক ফুলের পথের শেষে এক এক রাজ্য। শিউলিফুলের ফুটো দিয়ে বেরুলে পাওয়া যাবে সাদা মেঘের দেশ। লাল সন্ধ্যামণির ফুটোর ওপারে আছে খুব সুন্দরী, আবছায়ায় চলাফেরা করা মেয়েদের দেশ। জ্যোৎস্নায় ফোঁটা হাসনুহানা ফুলের সূক্ষ্ম পথটুকু পেরুলেই ঝাড়লণ্ঠন নিবে আসা এক চাঁদিনী জলসার দেশ। আর গ্রীষ্মের তাপে শুকিয়ে মুচমুচে হয়ে যাওয়া স্বর্ণচাঁপার ফুটো দিয়ে বেরুলেই মুনশিবাড়ি।

এক এক রাজ্যের দরজায় এক এক রকম হাওয়া পাহারা দেয়। আমি আর গদা মুনশিবাড়ির সামনে আসতেই হাওয়া এলোপাতাড়ি বয়ে একগাদা শুকনো পাতা উড়িয়ে নিয়ে গেল।

হঠাৎ সামনে দেখি, এক জনহীন পরিত্যক্ত ভাঙা দালানের দেশ। শুকনো গাছের ডালে মাকড়সার জাল হাওয়ার দমকে দমকে দুলছে। আমার ছোট্ট জীবনে এত ইটের বাড়ি একসঙ্গে দেখি নি। কিন্তু সব ধ্বংসস্তূপ। দেয়াল ভেঙে ভেঙে পড়েছে, ছাদের অংশ ভেঙে পড়ে মেঝে খোলা চাতাল হয়ে আছে। আর সেই চাতালে চুনসুরকির ফাঁকফোকরে গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য পাথরকুচি গাছ। একটির পর একটি বিচিত্র আকৃতির ধ্বংসস্তূপ, কিন্তু চাতালগুলো সব অতি পরিচ্ছন্ন। উঠোন-আঙিনা-ভরা ঘাস মরা শ্যামাপোকার মতো বিবর্ণ। আমরা চাতালে চাতালে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। পড়ন্ত অপরাহু লম্বা লম্বা ছায়া ফেলেছে। কয়েকটা চাতালে সাপের শুকনো খোলস বাতাসে সরসর করে নড়ছে। ন্যাড়া কড়ি-বরগা ছাদ থেকে লম্বা হয়ে এগিয়ে আছে। নীল আকাশে সাইরাস মেঘ, স্থির।

এই দালানগুলোর কোন মালিক নেই, এই দেশের কোনো সীমানা নেই। আমি আর গদা কয়াফড়িঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা উদ্ভট চিন্তা এল এই সেই দেশ যেখানে মুসাফির এসে বোঁচকা নামিয়ে বসে, একা একা হাড়ের পাশা খেলে, তার পর বোঁচকাটি রেখে শেষবেলার রোদে খানিকক্ষণ কাঁচের গুঁড়োর মতো ঝাপসা হয়ে থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মাথায় চিন্তাটা ঢোকামাত্র বুকটা ছাঁৎ করে উঠল।

কিন্তু রাস্তা চিনে নেবার পর মুনশিবাড়ি আমি প্রায়ই যেতাম। ভাঙা ছাদ, ধসে পড়া দেয়াল, বিক্ষিপ্ত ইটের পাঁজা এবং পাথরকুচি ও আকন্দ গাছে সমাচ্ছন্ন ফাটা চাতালগুলো যেন দিনমানেও নিশি ডাকে।

একদিন বিকেলে একা একা সেই নিস্তব্ধ দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি এমন সময় ইটের পাজার পাশে বনঝিঙের ফুল ফুটে উঠল– আকাশে তাকিয়ে দেখি, নরম একখানা মেঘে আবীরের লাল লেগেছে, দূরে আরেকখানা মেঘ তখনো সাদা। এইবার বাড়ি ফিরতে হয় কিন্তু হঠাৎ আমার মাথার উপরে শূন্যে কোত্থেকে কয়েক শো লাল ফড়িং এসে চক্রাকারে উড়তে লাগল। একসঙ্গে এত লাল রঙের ফড়িং আমি কোনোদিন দেখি নি। নীলাভ আকাশে অনেক উঁচুতে লাল মেঘ, আর ঠিক তারই নিচে পৃথিবীর কাছাকাছি অগণন লাল ফড়িঙের ওড়া- এর তাৎপর্য কি, ভাবতে ভাবতে মেঘ পাঁশুটে হয়ে গেল, ফড়িঙেরা লুকিয়ে পড়ল– আমি ছাড়া সেই অবিশ্বাস্য কয়েক মিনিটের জোয়ার আর কেউ দেখতে পেল না।

মুনশিবাড়িতে ভাঙা দালানের শরীরী ছায়া দেখে দেখে বাস্তব আর অলীকের ভেদাভেদে আমার সন্দেহ জন্মাচ্ছিল বাজপাখি যখন ভাঙা কার্নিসের কিনারায় এসে বসে তখন ছায়াকার্নিস স্পষ্ট বেঁকে গিয়ে কাঁপে। চাতালে যখন হাঁটি– আমার নিজের ছায়াকে দেখি পা-বাঁকা বামন। হঁটের পাঁজার ছায়া দেয়ালে পড়ে দৃঢ় এক রাজার মতন, তার চোখটি পর্যন্ত পাথরকুচিপাতায় আঁকা নিষ্ঠুর সবুজ। দীর্ঘ রোদ্দুরে তারা অতি ধীরে নড়াচড়া করে। পাল্লাহীন দরজা দিয়ে মহলের পর মহল পেরিয়ে গেলে শেষ কুঠুরির অন্ধকারে বসে আছে যক, গুপ্তঘরে ছায়া পরতে পরতে অন্ধকার হয়ে যায় সেখানে একটুকরো রোদ্দুর প্রজাপতি হয়ে ওড়ে।

জনহীন ঐ পোড়ো ভিটেগুলোয় ফকির, পরী, বাদশা, রাহী, কত কি দেখা যায়, উদ্ভট সব কার্যকলাপ মানুষের ছেড়ে যাওয়া বাড়িতে ভূত, ভবিষ্যৎ বর্তমান তিন কাল এসে একসঙ্গে ঢোকে, কোনো পারম্পর্য থাকে না।

.

কার্তিককাকার বউ

ধনদিদির বড় ছেলে কার্তিককাকা কলকাতায় কাজ করত। বেঁটে কার্তিকের মতো তার নধর ফরসা চেহারা। শুধু মুখে সামান্য কঠোর ছাপ। তার বিয়েতে আমরা চার-পাঁচখানা নৌকো করে বরযাত্রী গিয়েছিলাম। মাইল তিনেক দূরে সেই কনের বাড়ি। জীবনে এই প্রথম আমার বিয়ের আসরে যাওয়া। বেরসিক যুবাদের রুক্ষ ঠাট্টা-ইয়ারকি আর আধভরা কলসির মতো বয়স্কদের বিচক্ষণতার গম্ভীর প্রদর্শনী শেষ হলে খেতে খেতে দুপুর গড়িয়ে গেল। ভোজের পরে খোলা নৌকোয় বাড়ি ফেরার জলযাত্রাটা বড় আনন্দের হয়েছিল।

পরদিন সাঁঝবেলায় কার্তিককাকা বউ নিয়ে এল ছায়াঘন বাঁশবনের সতেজ হালকা কঞ্চির মতো তার ছোট্ট ছিপছিপে দেহ, কালোসবুজ রং। রক্তাভ ঠোঁটের আড়ালে মা কালীর মতো সুন্দর দাঁত। সোনার মাকড়ি দুটো তার ঐ রং আর সুন্দর দাঁতের হাসির সঙ্গে চমৎকার মানিয়েছিল।

আমি প্রথম কয়েকদিন তার কাছাকাছি ঘুরলাম। তার শাড়িতে, গায়ে আর নতুন কেনা বাক্সে যেন সৌরভের বাসা। তার নরম হাতের পাতায় বাপের বাড়ির সুখের সর মাখানো, চোখে একটু অপরিচিত ভয়। আমি তাকে লক্ষ করতাম বলেই বুঝলাম তার খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি তার হাতের কোমল লালিমা মুছে গিয়ে রান্নার হলুদ ছোপ লাগল, নখে পাঁশুটে ফাট ধরল। তার টকটকে লাল শাড়ি ক্রমশ ধূসর লাল আর আঁচলে ময়লার দাগ।

কার্তিককাকা মাসখানেক পরে কলকাতায় চলে গেল। তার পর থেকে সে দুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বনজঙ্গলে গাছের আড়ালে ঘুরে বেড়ায়। তার মুখে ক্লিষ্টতার ছাপ, সারা। গায়ে খড়ি ওঠা রুক্ষতা। আমি লক্ষ করতাম সে গাছের আড়ালে গিয়ে হাঁটুর উপর কাপড় তুলে ঘসঘস করে উরু চুলকোয়, বার বার প্রস্রাব করতে বসে, কোমরের কাপড় আলগা করে উবু হয়ে নিজের শরীরে কি যেন দেখে। তার মুখ তখন দিকভ্রষ্ট কাতর প্রাণীর।

ছোটমার সঙ্গে এই নতুন কাকিমার কিছুটা মনের কথা হত। একদিন ছোটমা চুপিচুপি ঐ ঘরের মাকে নতুন কাকিমা সম্বন্ধে কি কি সব বলল। আমি তার থেকে শুধু উদ্ধার করতে পারলাম, তার নাকি খারাপ অসুখ হয়েছে। সব অসুখই তো খারাপ, তবু খারাপ অসুখ কথাটা রহস্যময় লাগল।

ক্রমশ দেখলাম নতুন কাকিমা কাপড়চোপড় ঢিলে করে আঁচল লুটিয়ে যেন ঠাণ্ডা একটু ছায়ার খোঁজে আরো গভীর বনে ঢোকে। আর সে চুল বাঁধে না। শ্মশানপারের বনের মধ্যে তাকে প্রেতিনীর মতো লাগে। আড়ালে দাঁড়িয়ে সে নিজের খসখসে উরু চুলকোয় যেন খেতে না পাওয়া বিড়ালী গাছের বাকল আঁচড়াচ্ছে। তার সবুজ চোখ জ্বলজ্বল করে। হয়তো সে নিজেও তখন বোঝে নি তার সিফিলিস হয়েছে শহরের আদাড় থেকে এসে হুলো বেড়ালটা তার মধ্যে বিষ ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে।

.

 নৌকাযাত্রা, মাঝি

ধনদিদির বড় মেয়ে লাবিপিসি ছিল ডিম্ববতী মরালীর মতো দীর্ঘঅবয়ব সুন্দরী। তার বিয়ে হয়েছিল এক দূর গ্রামে। একবার নৌকো করে আমরা তার শ্বশুরবাড়িতে গেলাম। বাড়ির বউঝিরা যখন কোথাও যায় তখন বড়পুকুরের ঘাটে এসে নৌকো লাগে। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে যেখানে হিজল গাছের অন্ধকার সেখানে ছোট খালের খাঁড়ির মুখ। বাড়ির পুকুরঘাট থেকে সেই জলপথ ধরে বড় খালে পড়ে নদী-বিল-হাওড় হয়ে পৃথিবীর যে কোনো দেশে যাওয়া যায়।

লাবিপিসির নৌকো চলল সারা রাত্তির। আমি মেয়েদের মধ্যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে টের পাচ্ছিলাম নৌকোর দুলুনি, জলের কলকল, মাঝে মাঝে দুই পাড় থেকে ঝুঁকে পড়া ডালপালায় লেগে নৌকোর ছইয়ের ছররর শব্দ। ছইয়ের আর্চ করা সরু পথটুকু দিয়ে দেখা যায় ঘোর অন্ধকার আকাশে তারা। অন্ধকারে পৃথিবীর পথ নীরব সুড়ঙ্গের মতো, তার তলায় অফুরান জলধারা।

পরদিন ভোরে মেয়েদের উদ্ভাসিত কথাবার্তার মধ্যে যখন ঘুম ভাঙল তখন বাইরে এসে দেখি, নদী। ভোরের নদীজল অফুরন্ত রৌপ্যবাদামী। চারদিক জুড়ে সমান মাপের ছোট ছোট ঢেউ, যেন নদীর পুতুলেরা হাত তুলে তুলে সাঁতরাচ্ছে, ডুবছে। পুরো নদী কী জীবন্ত, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ধীরে ধীরে নৌকো ঘাটে বাঁধা নৌবহরের পাশে এসে ভিড়ল।

সেদিন সন্ধ্যায় লাবিপিসিদের বাড়ি মুকুন্দ দাসের যাত্রা হল। পালার নাম মনে নেই, শুধু মনে আছে ধবধবে সাদা পোশাকের উপর চওড়া লাল বনাতের ফেট্টি পৈতের মতো পরা, পায়ে কালো হান্টিং বুট দুজন ইংরেজ বাঙালিদের উপর চাবুক চালাচ্ছে। আর, আমার ভাগ্য, মাত্র দু হাতের দূরত্বে আমি স্বয়ং মুকুন্দ দাসকে দেখলাম- গেরুয়া লুঙ্গি, আজানুলম্বিত গেরুয়া পাঞ্জাবি এবং গেরুয়া পাগড়ি পরা, বুকে সম্ভবত মেডেলের সাতলহরী, পাকা গোঁফ দু পাশে ঝোলা, দশাসই চেহারার প্রৌঢ় সাজঘর থেকে গান গাইতে গাইতে ধেয়ে চলেছেন মঞ্চের দিকে। তাঁর গলার স্বর গম্ভীর, উঁচু, ক্রোধান্বিত এবং ঈষৎ ধরা।

আমাদের দেশে এস্কর্টকে বলে চলনদার বা চরণদার। বাপের বাড়ি বা শ্বশুরবাড়ি থেকে কাকা ভাইপো দেওর বা পুরনো ভৃত্য নিয়ে যাবার জন্য এলে বউঝিদের মধ্যে আনন্দের সাড়া পড়ে যেত, তারা বলত, ‘চরণদার আইছে। তারা গুছিয়েগাছিয়ে পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে চলনদারের সঙ্গে চেপে বসত নৌকোয়।

বালকবয়সে নৌকোয় কোনো দীর্ঘ পথে যেতে হলে আমারও চলনদার লাগত। সেইসব জলযাত্রা যেমন সুখের তেমনি বিপদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ যদি বা সামলানো যায়, ডাকাতের ভয় এড়ানো যায় না। কিন্তু আতঙ্ক তো বিশেষ বিশেষ জায়গায়, আর সুখ তো সারা পথে। শরতের জলপথ, শীতের জলপথ, গ্রীষ্মের জলপথ- সে একই জলপথ, তবু কত আলাদা তার রূপ। নৌকোয় যেতে যেতে ভোরে, রাত্রে, বিকেলে আমি পৃথিবীর গোপন গলার কত পটমঞ্জরীর গান শুনেছি।

একদিন অপরাহ্ন নির্জন। অচেনা জায়গায় খালের বাঁক ঘুরতেই দেখা গেল, ভাটায়। জল সরে গিয়ে পৃথিবীর একটু কাদার পিঠ ভেসে উঠেছে ভাটার টান তার উপর কোমল কত রেখা এঁকে রেখেছে, আর জলের কোলে শেষ রেখাঁটি চিকচিকে সোনালি। সেই কাদায় ধূসর কয়েকটা কাদাখোঁচা চঞ্চল হয়ে পোকা খুঁজছে। ব্যাপারটা কিছু নয়, কিন্তু সেই অপাপবিদ্ধ নির্জনতা এবং ঘুমে ডোবা গোধূলি-আলোর মধ্যে পদচিহ্নহীন নতুন কাদায় কয়েকটা ছোট পাখির প্রাণমন ডুবিয়ে খাবার খোঁজা যখন আর একটা বাঁক ঘুরতেই মিলিয়ে গেল তখন মনে হল আমার ঘুমন্ত প্রাণের কোনো অবোধ পিপাসা রেখে এলাম ঐখানে।

আর-একদিন, সেদিনও ভাটা, দুজন মাঝি লগি ঠেলতে না পেরে নৌকোয় লম্বা দড়ি বেঁধে গুণ টানতে গেল। তখন সূর্যাস্ত হচ্ছে। আমি নৌকো থেকে দেখছি খালের খাড়া উঁচু পাড়ের গা ঘেঁষে শুধু আকাশ সেখানে মেঘ ফেটে গিয়ে গভীর আগুন ছড়িয়ে গেল, আর সেই আরক্ত আগুনমেঘের মধ্যে দুজন মাঝির ঝুঁকে পড়া সিলুএট পায়ে পায়ে চলে যাচ্ছে। খাড়া পাড়ের জন্য খেত মাঠ গাছ কিছু দেখা যায় না, শুধু আকাশ।

মানুষ কোথায় যায়? এই কঠিন প্রশ্নের উত্তরে আমার মনে এখনো কেবল সেই ছবিটা আসে: লাল মেঘের মধ্যে দুজন মাঝি গুণ টেনে চলেছে।

বিলের মধ্য দিয়ে একবার নৌকো যাচ্ছিল, তখন ধানের ঋতু। দিগন্তবিসারী জলের মধ্যে দু-মানুষ-সমান সবুজ ধান গাছ আমাদের নৌকো ঢেকে দিচ্ছিল। তলায় গভীর জল বোঝা যায় না, যেন ধানবনের উপর দিয়েই সরসর করে চলেছে নৌকো। ধানের ধারালো পাতা দু দিকে নুয়ে পড়ে, গায়ে এসে লাগে। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ন্ত পোকা ঝাঁপিয়ে আসে, গা শিরশির করে। ভয় পেয়ে মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, ও মাঝি, এখানে সাপ আছে নাকি? মাঝি এক পায়ের বুড়ো আঙুলের গোড়ায় পুরো শরীরের ভর দিয়ে লগি আঁকড়ে নৌকো বাইছিল, আমার প্রশ্ন শুনে দ্বিতীয় ইন্দ্রনাথের মতো তাচ্ছিল্যভরে উত্তর দিল ‘হাপ? হ্যাঁ তো দুই-চাইরখান থাকপেই। আশ্চর্য, মাঝির বলার ভঙ্গিতে আমার কিন্তু ভয় কেটে গেল।

আমার তখন তের-চোদ্দ বয়স। বাবার সঙ্গে এক সুদূর শহর থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। ট্রেন, স্টিমারের লম্বা পাড়ির শেষে আমাদের বিশাল নদী, দীর্ঘ খালের দেশ। নদীর ঘাটে অগুনতি কেরায়া নৌকোর বহর, সেখান থেকে নদীপথে অনেক দূর গিয়ে যখন খালের খাঁড়িতে ঢুকলাম তখন শেষদুপুর। মাঝি বলল, রাত আটটার আগে জোয়ার আসবে না, এবং এখন ভাটার খালে নৌকো চালানো অসম্ভব। অতক্ষণ বসে থাকা! বাবা বললেন, “চল, হেঁটেই যাব। সেখান থেকে বাড়ি বাইশ-তেইশ মাইল। মাঝি সাবধান করে দিল, অমুক অমুক জায়গায় ডাকাতের ভয়, যেন নিশ্চয় আমরা সন্ধ্যার আগে সেসব জায়গা পেরিয়ে যাই।

প্রথমটা ভারি চমৎকার লাগল- ফুরফুরে দুপুরে অজানা জায়গা দেখতে দেখতে নিরিবিলি রাস্তায় হাঁটা। কিন্তু মাইল পাঁচেক যেতে না যেতে ক্লান্তি এল, হাতের সুটকেস বার বার হাঁটুতে ঠুকে যেতে লাগল। সন্ধ্যার আগে দূরে দেখা গেল বিরাট এক বট গাছ, ঐখানেই ডাকাতি হয়। আমি বাবার পিছু পিছু এগোচ্ছি আর পাখির চধুর মতো দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে দেখছি গাছের আড়ালে কোথাও ডাকাত থানা পেতে আছে কিনা। গাছটা বিশাল, কিন্তু লক্ষ করলাম, শকুন পড়লে যে রকম হয়, তার পাতাগুলো তেমনি মনমরা। কিছুই ঘটল না, আমরা নিঃসাড়ে সেই বটতলা পেরিয়ে গেলাম।

পথেই সন্ধ্যা হল, পথেই রাত্রি ঘিরল। আমার ধূলিধূসর পা আর হাঁটতে চাইছে না। অন্ধকারে আমি সুটকেসটা মুটের মতো মাথায় চাপিয়ে নিলাম। নিঃসীম আকাশের তলায় বকুলফুলের মতো হাওয়া দিচ্ছে, তারার গা থেকে পাখি বটফল ফেলছে- আমরা কিছু না বুঝে আরো দুটো ভয়ের জায়গা পেরিয়ে গেলাম। প্রথম প্রহরের শেয়াল ডাকলে বাবা বললেন, এই গ্রামে উত্তমীপিসির বাড়ি, চল একটু জিরিয়ে নিবি। উত্তমীপিসি আমাকে ঠাণ্ডা জল দিলেন, আধ ঘণ্টার মধ্যে ভাত আর ডিমসেদ্ধ করে দিলেন। খেয়েদেয়ে আবার হাঁটা। মানুষজন সব বাড়ি ফিরে গেছে। পৃথিবী থেকে আকাশে উঠেছে কালো, নীল আর নীলপ্রভ তিন স্তর অন্ধকার যেন বামন অবতারের বিরাট তিন পায়ের তলার ছায়া, ছায়া, ছায়া। তারও উপরে বলকা দুধের ফেনার মতো তারার দল পুব থেকে পশ্চিমে চলেছে। আমরা সেই তারার আলোর উদ্ভট জ্যোৎস্নায় হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে রাত তিন প্রহরে বাড়ি পৌঁছলাম।

কয়েকদিন পরে ইতিহাস বইয়ে পড়লাম আকবর না শের শা না কি বাবর দিনে চল্লিশ মাইল হাঁটতে পারতেন। আমি তেইশ মাইল হেঁটেছিলাম।

নৌকোর মাঝিদের মধ্যে হিন্দু মুসলমান দুইই ছিল। দুয়েরই চূড়ান্ত কষ্টসহিষ্ণু শরীর, হাত কাঁধ আর বুকের পেশী যেন লোহার তার পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তৈরি, হাতের তেলোর চামড়া পাথরের মতো। জলের সঙ্গে সারা জীবন বাস করে বুড়ো মাঝিদের মুখে জলের মুখের মতোই কোঁচকানো সরল দাগ। সরু গলুইয়ে দাঁড়িয়ে মাঝি যখন লগি ঠেলে তখন বোঝা যায় তার শক্তিমান শরীরের লঘুতা আর স্থিতিস্থাপকতা- এক পায়ের বুড়ো আঙুলের গোড়ায় ভর রেখে সে উড়ন্ত ভাস্কর্যের আকার নেয়, দুই হাত এবং সমস্ত শরীর যেন পেঁচিয়ে যায় লম্বা লগির সঙ্গে, নিজের চেয়ে তিন-চারগুণ লম্বা লগিটাকে জলের বুকে গেঁথে, চাপ দিয়ে প্রায় বাঁকিয়ে, সে নৌকো বায়। অবিরাম বেয়ে যায় বারো ঘণ্টা, চোদ্দ ঘণ্টা, সারা রাত। রোদে ঘাম হয় বলে ওরা পছন্দ করে রাত। সন্ধ্যারাত্রে পেটপুরে খেয়ে ওরা নৌকো ছাড়ে। ভাড়া ঠিক করার সময় বলে- ‘অ্যাকসন্ধ্যা খাওন আর অ্যাকটা ট্যাহা দেবেন। এক টাকা! কও কি মাঝির পো?– ‘আইচ্ছা, না হয় বারো গণ্ডা পয়হা দেবেন। সন্ধ্যারাত্রে এসে মাঝি আমাদের দাওয়ায় বসে লণ্ঠনের আলোয় পেট পুরে ভাত খেয়ে বাক্সবিছানা নিয়ে চলে যায়। তার পর এক কলকে তামাক খেয়ে ছাড়ে নৌকো। এখন সে-ই অভিভাবক, সে-ই ক্যাপ্টেন। পুরো জেলার খাল-বিল-নদীর ম্যাপ তার নখদর্পণে। আমাদের দেশের দিকচিহ্নহীন বিলের মধ্যে আঁধার রাতে কি করে যে সে দিক ঠিক করে, মাঝনদীতে দুই তীর যখন নীল পেনসিলের দুটি দুর্নিরীক্ষ ধূসর রেখা তখন সে কি করে ঠিক ঘাটটির হদিশ পায়, এ এক রহস্য। আমরা রাত্রে ছইয়ের নিচে ঘুমোই। তখন মাঝি আর জল মুখোমুখি, একা।

.

 কাঠুরে

মাঝিদের চেয়ে আরো নিঃসম্বল খাটুয়ে লোক ছিল কাঠুরেরা। মাঝিদের তো তাও একখানা নৌকো ছিল, তাদের কী ছিল, একখানা কুড়ুল ছাড়া? তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে খবর নিত, জ্বালানির জন্য গাছ কাটতে হবে কিনা। আমাদের বাড়ি আসত ছোলেমান, ছাব্বিশ সাতাশ বছরের যুবা। দাদু তাকে বনের মধ্যে নিয়ে গিয়ে দেখেশুনে পূর্ণবয়স্ক কোনো গাছ বেছে দিতেন। ছোলেমান গাছে উঠে উঁচু কোনো মোটা ডালে দড়ি বাঁধত, তার পর নেমে এসে টানা দিত অন্য গাছের গুঁড়িতে, যে দিকে সে গাছটাকে ফেলতে চায়। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম শিকড় ঘেঁষে গোড়ায় প্রথম কোপ পড়লে নিজের মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত গাছ নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রমশ চাকলা চাকলা হাড় কেটে কেটে ছিটকে পড়ে। সেই কাঁচা হাড়ে একটা সপ্রাণ গন্ধ। গাব হিজল কড়ই রেইন ট্রি এক এক গাছের হাড় এক এক রঙের। আঁধার ভরা গাছেদের হাড় রক্তিমাভ, আলোভরা গাছেদের হাড় ঈষৎ নীলাভ কিংবা হলদেটে। মাটির গর্ভে কোথায় রং থাকে গাছ জানে, সে তাকে ঠিক পছন্দমতো শুষে নিয়েছিল।

তিন ভাগ মতো কাটার পরে গাছ সামান্য কেঁপে কেঁপে উঠত, তার পর একটু একটু টলত। একেবারে শেষে, হঠাৎ কড়মড় মড়াৎ করে একটা কঠিন দাঁতে-দাঁত ঘষার মতো শব্দ হত। বনের মধ্যে বাতাস ও অন্য গাছেদের মুখে চড়চাপড় মেরে ডালপালাসুদ্ধ সে ঘটোৎকচের মতো মুখ থুবড়ে পড়ত মাটিতে। তার পড়ার বিরাট হুলুস্থুলুতে আমার আনন্দ হত। কিন্তু পরে যখন দেখতাম জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল, একজন গাছ কমল, তখন মনটায় হঠাৎ কেমন কামড় লাগত সামনের বর্ষায় সে আর সারা গা জলে ভিজিয়ে নাইবে না।

ছোলেমান বনের মধ্যেই তার ডালপালা কেটে গুঁড়ি এবং মোটা মোটা শাখা আড় বরাবর টুকরো করত। তার পর গড়িয়ে গড়িয়ে পুরো গাছটাকে এনে ফেলত উঠোনে। আমি পাতাসুদ্ধ ডালপালাগুলো টানতে টানতে নিয়ে আসতাম। এখন ওদের লম্বালম্বি চেলা করা হবে। সকাল থেকে অবিরাম কুড়ুল চালিয়ে ছোলেমানের ফরসা পিঠে দরদর করে ঘাম বইছে। মধ্যদুপুরে সে দু হাত আঁজলা করে হাঁক পাড়ত, ‘দ্যান, মা ঠাইরেন, অ্যাক কোশ ত্যাল দ্যান। এত্তখানি তেল মাথায় গায়ে থাবড়াতে থাবড়াতে সে পুকুরে যেত। উঠোনে বসে তিনজনের ভাত একা খেত। তার পর আবার কাঠ চেলা করতে লাগত। তার কুড়লে অসম্ভব জোর, সন্ধ্যা হবার আগেই সে পুরো গাছটাকে চেলা করে ফেলেছে। দ্যান, মা ঠাইরেন, জল খাইতে দ্যান। হাসিমুখে সে গামছায় আধসেরখানেক মুড়ি বেঁধে, নগদ আট আনা পয়সা নিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে তেঁতুলতলার পথ দিয়ে চলে যেতঐদিকে কোথায় যেন তার বাড়ি।

আড়াই-তিন ফুট ব্যাসের একটা আস্ত গাছকে একা এক দিনে চেলাকাঠ বানানো যে কী অমানুষিক কাজ সেকথা আমি তখন বুঝতাম না, বোধ হয় আট আনার কাঠুরে ছোলেমান নিজেও বুঝত না।

.

ঠাকুমার ওষুধ

অম্বলের ব্যথায় ভুগে ভুগে ঠাকুমার শরীরটা খারাপ হয়ে আসছিল। চিকিৎসা করেও কিছু উন্নতি হল না। হয়তো তেমন চিকিৎসাই হয় নি। ঠাকুমা বলতেন, “শরীলে শূলব্যথার মতো কষ্ট হয়। এমন সময় একটা অদ্ভুত ওষুধের খবর এল সাপের দেওয়া ওষুধ, অনেক দূর গ্রামে এক বুড়ীর কাছে নাকি সেই ধন্বন্তরি ওষুধ আছে। আমরা কয়েকদিন ধরে সেই ওষুধের রোমাঞ্চকর ঘটনা শুনলাম।

ঠাকুমার মতোই একজন অম্বলের রোগী বড় কষ্ট পাচ্ছিল। যখন ব্যথা উঠত তখন সে ডাক ছেড়ে কাঁদত। শেষে আর সহ্য করতে না পেরে একদিন সে ঠিক করল, এ প্রাণ আর রাখবে না। মরবার জন্য বাড়ি ছেড়ে এক ঘোর জঙ্গলে ঢুকে হারাউদ্দেশ্যে চলতে লাগল- বাঘ, সাপ যে-কেউ তাকে খেয়ে নিক, এই কষ্টের জীবনের শেষ হোক। অথচ বাড়ির দিকে তার কত মায়া– সেখানে তার বুড়ো আছে; ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনী আছে। এইসব মনে করে সে কাঁদছে আর পথ চলছে।

সন্ধ্যার মুখে সে এক ঐরান জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়ল। তখন জঙ্গলের মাথায় এক বিশাল লাল মেঘ এসে গাছের ডালে ডালে রাঙা আভা আর তলায় তলায় আন্ধার ফেলেছে। সূর্য ডুবুডুবু। কোথাও জনমানব নেই। হঠাৎ তার সামনে পথ আটকে দাঁড়াল বিশাল ফণা তুলে এক বিরাট সাপ মহানাগ। কোথা যাস তুই? অম্বলের রোগী বলল, “আমি মরতে চলেছি, তোমার ছোবলেই আমার মরণ হোক। সাপ বলল, “কেন তুই মরতে চাস, তোর কিসের দুঃখ? তখন সে আনুপূর্বিক সব বলল। শুনে সাপের দয়া হল, ‘শোন, আমি তোকে অক্ষয় ওষুধ দিচ্ছি, এই ওষুধ নিয়ে তুই বাড়ি ফিরে যা, তোর রোগ সেরে যাবে। এই বলে সাপ ওয়াক করে গলার মধ্য থেকে একটা নরম অদ্ভুত বস্তু উগরে পাতার উপর ফেলে দিল। বুড়ী বাড়ি ফিরে এসে সেই অক্ষয় ওষুধ জলে ভিজিয়ে রাখল। পরদিন দেখে সেই বস্তুটি একটির বদলে দুটি হয়ে আছে। সে একটি খেল, আরেকটিকে আবার জলে ভিজিয়ে রাখল। পরদিন আবার একটির বদলে দেখে দুটি হয়ে আছে। এই রকম রোজ। সেই অক্ষয় ওষুধ কয়েকদিন খেয়ে সে ব্যাধিমুক্ত হল।

এই কাহিনী আমাদের বাড়িতে খুব উত্তেজনা আনল। শেষে একদিন সেই দূর গ্রামে গিয়ে কাকা সেই বুড়ীর কাছ থেকে ওষুধটা নিয়ে এল। আমরা সবাই দেখলাম, কাঁচের জলভরা বয়ামের মধ্যে ইঞ্চি ছয়েক ব্যাসের একটা বার্ট সায়ানা রঙের জেলির মতো জিনিস ভাসছে, যেন একটা বড়সড় মালপোয়া। সেই মালপোয়া বা জেলি রোদ্দুরের মধ্যে ধরলে তার থেকে কেমন একটা স্বচ্ছ আভা বেরোয়। সেদিন আমাদের বাড়িতে ঐ ওষুধের গল্পই একমাত্র কথা।

পরদিন সত্যিই অবাক কাণ্ড! ঐ জেলিখানা বয়ামের জলের মধ্যে একটির বদলে দুটি হয়ে আছে- হুবহু একই মাপ, একই রং, একই আকৃতি, একটির উপর আরেকটি যেন সেঁটে আছে। ঠাকুমা সাপের দেবতা মনসাকে স্মরণ করে উপরের জেলিখানা তুলে ভক্তিভরে খেয়ে ফেললেন, নিচের জেলখানা জলে ভেসে রইল। পরদিন আবার সেই একই কাণ্ড। ঠাকুমা বেশ কিছুদিন সেই জেলি খেলেন। রোগ কিন্তু সারল না। রোগ না সারলেও অক্ষয় ওষুধ অক্ষয়ই রইল।

এতদিন পরে ভেবে ভেবে আজ আমার মনে হয় জিনিসটা বোধ হয় চোখমুখপায়ুহীন কোনো আদিম স্তরের প্রাণী, যার বেঁচে থাকার জন্য জল দরকার, এবং যার প্রজনন এবং বৃদ্ধি ঘটে এক রাত্রের মধ্যেই। জিনিসটা রহস্যময় সন্দেহ নেই।

.

 অ্যাডভেঞ্চার শরতে

একবার, তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, পুজোর ছুটিতে আমাদের উপত্যকা-শহর থেকে গ্রামে ফিরে এসেছি, আমার মাথায় একটা অ্যাডভেঞ্চারের প্ল্যান এল। শুধু শেষশরৎআকাশের উজ্জ্বল নীলিমা নয়, খগেন মিত্তিরের ডোম্বোল সর্দার আর হেমেন্দ্রকুমার রায়ের বিমল, কুমারও আমাকে ক্রমাগত ওসকাচ্ছিল। পুজোর অবসানে ছুটির মন্থর দিন কাটাতে কাটাতে মনে হল এককাপড়ে বেরিয়ে কয়েকদিন গ্রামের পর গ্রাম ঠিকঠিকানাহীন ঘুরে আসি। কিন্তু ভোম্বোলের মতো আমার সাহস নেই, অতএব পুবের ঘরের সদানন্দকে সঙ্গী হবার জন্য জপালাম। দুজনে পরামর্শ করে ঠিক হল আমরা খুব ভোরে বেরুব, যেতে যেতে যখন দুপুর হবে তখন পোটলা খুলে খাবার বার করে খাব। তার পর হাঁটতে হাঁটতে যেখানে সন্ধ্যা হবে সেখানেই রাতের আস্তানা। পরদিন ভোরে আবার হাঁটা।

খাবারের কথায় সদা স্পষ্ট জানিয়ে দিল, সে ওসব দিতে পারবে না, আর পয়সাই। বা তার কোথায়? আমি দেখলাম এই সামান্য কারণেই বুঝি প্ল্যান ভেস্তে যায়, অগত্যা ছোটমাকে গিয়ে ধরলাম। ছোটমা পরদিন শেষরাতে উঠে একতাড়া পরোটা আর আলুভাজা বানিয়ে কাগজে মুড়ে দিল। আমরা সেই রসদ আর আড়ং-খরচের জন্য পাওয়া নগদ দেড়টি টাকা নিয়ে পথে নামলাম। চাঁদসী গ্রাম ছাড়াবার পর মনে হল, অভিভাবকদের অনেক দূরে ফেলে এসেছি, এখন আমরা সাবালক। চার হাতে পায়ে জ্যামুক্ত তীরের স্বাধীনতা আর দশ দিকে পাখি ওড়ার নীল হাওয়া।

ঝোলার পরোটার দিকে মন ছোঁচা বেড়ালের মতো অনেকক্ষণ ছোঁকছোঁক করে ঘুরছিল। এইবার খালের পাড়ে একটা গাছের নিচে ঝোলা খুলে দুজনে মুখোমুখি বসলাম। আমাদের সামনে অনেকগুলো দুরূহ কৃচ্ছতার দিনরাত্রি। হিসেবী পিঁপড়ের মতো অর্ধেক খেয়ে বাকি অর্ধেক রেখে দিলাম রাতের জন্য। নিজের ভার নিজে নিলে যেন দৃষ্টি খুলে যায়। এই শরৎদুপুরে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে, তেইশ ডিগ্রি অক্ষাংশের তিন মাইল উত্তরে আর নব্বই ডিগ্রি পূর্বদ্রাঘিমার নয় মাইল পুবের বিশেষ কাটাকুটিতে বসে এই যে আমরা দুটো ছেলে ক্ষুধার্ত পাকস্থলীতে খাবার দিচ্ছি এইটুকুই প্রাণমনজীবনের সর্বার ইন্ধন।

খেয়েদেয়ে আলোয় উপচনো পৃথিবীতে আমরা হাঁটতে লাগলাম। বেলে মাটির রাস্তা এখন সুরস, আকাশ নির্মল, বাতাস তেজোময়। যত দূর চোখ যায় উঁচু রাস্তার দু পাশে ধানের খেত, মাঝে মাঝে গাছপালার আড়ালে গ্রাম।

যেতে যেতে এক জায়গায় সবুজ ধানখেতের ফাঁকে দেখা গেল, অনেক দূরে যেন এক নদী, তার সাদা জল স্পষ্ট। এখানে নদী আসবে কোত্থেকে? অবাক হয়ে ভাবতে ভাবতে আরো এগিয়ে মনে হল, নদীর সাদা জল যেন বাতাসে দুলছে। বিভ্রম ভাঙল একেবারে কাছে গিয়ে নদী না, কাশবন। ধানখেতের মধ্যে রাস্তার আড়াআড়ি দীর্ঘ বিস্তার নিয়ে এক ঘন কাশবন সেখানে ফুল ফুটেছে।

বেলা ঢলে পড়লে সদানন্দ খুঁতখুঁত শুরু করল। এভাবে পাগলের মতো রাস্তা হেঁটে কী লাভ, তার চেয়ে বাড়ি ফেরা ভালো। আমি তার কথায় কান দিলাম না, আজকের রাত পথে কাটাবই। হালে জোতা অনিচ্ছুক গরু যেমন বসে পড়ে তেমনি ইচ্ছে করে সদা পিছিয়ে পড়তে লাগল। সন্ধ্যার মুখে দূরে একটা মঠের চুড়ো দেখা গেল। আমি সদার হাত শক্ত করে ধরে সেই দিকে এগোলাম, আজকের রাতে ওখানেই থাকব।

রাস্তার বাঁ দিকে একটা শুড়িপথ চলে গেছে। সেই পথে খানিকটা এগিয়ে ছোট ছোট ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে চৌরস জমির উপর মঠ। ধারেকাছে কোনো লোকালয় নেই। মঠের মধ্যে শুকনো ঘাস-কুটো, ছাগলের নাদি। আমি ঝোঁপ থেকে ডাল ভেঙে এনে মঠের ভিতরটা ঝাঁট দিলাম। সদা বলল, এখানে রাত্রে থাকলে আর জ্যান্ত ফিরতে হবে না। এই রকম মঠে, অনেকে দেখেছে, রাত্তিরবেলা তিনখানা কাঁচা বাঁশ এসে দরজা আটকে দাঁড়ায়।

মঠের মোটা দেয়ালের ছোট্ট খুপরিটার মধ্যে প্রদোষের অন্ধকার জমে উঠেছে। সদার দুর্বোধ কথায় কেমন যেন অতিলৌকিক গন্ধ! আমি ভয় পেয়ে একটা মাটির ঢেলা এনে পাল্লাহীন দরজার মাথায় বড় করে লিখলাম: রাম।

সন্ধ্যা ঘোর হয়ে উঠল, হঠাৎ চতুর্দিকে শেয়াল ডেকে হঠাৎই থেমে গেল। মঠের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছি, আমাদের কারো মুখে কথা নেই। ঝোলা খুলে অন্ধকারে ইঁদুরের মতো পরোটা আলুভাজা শেষ করলাম। একটু দূরে নিঃসীম মাঠে হাঁটু পর্যন্ত কাদাজলে ডোবা ধান গাছেরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিকেলে দেখছিলাম তাদের ভিতরে অল্প জলে কোচবকেরা নিঃশব্দে ঘোরাফেরা করছিল। মনে হয়েছিল ঐ সবুজ তোরণের মধ্যে বকের শাস্তি। এখন ঐ খোলা, নির্বাক, অন্ধ মাঠের মধ্যে সেই ধান গাছদের ভয় করছে না? তাদের গা বেয়ে শামুক উঠছে, সাপ কিলবিল করে চলে যাচ্ছে, কই মাছেরা লাফিয়ে লাফিয়ে ফুল ছিঁড়ে খাচ্ছে। মুখ ফেরানো আকাশের নিচে গতিশক্তিহীন তৃণজীবনের দুঃখ আর ভয় আমার মধ্যে এসে ঢুকল।

ভোরে ঘুম ভাঙলে দেখি মনের কোত্থাও ভয়ের লেশমাত্র নেই। পৃথিবী যেন সাবানের বুদবুদ। কিন্তু খুব হয়েছে! সদা আর অমি হাসিমুখে বাড়ির পথ ধরলাম। পথে পেট ভরে চার আনার জিলিপি খেয়ে, এক আনার বাতাসা চার পকেটে বোঝাই করে নিশ্চিন্তে হাঁটতে লাগলাম। মনে একটু ক্ষোভ- অ্যাডভেঞ্চারটা হল না।

.

অ্যাডভেঞ্চার: বর্ষায়

এর দু বছর পর গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি এসেছি। খবর পেয়ে ছোটপিসিমা আর সেজোপিসিমার চার ছেলেমেয়ে তাদের দুই দূর গ্রামের বাড়ি থেকে একসঙ্গে এসে হাজির। আমরা সবাই দু-এক বছরের ছোট বড়। সেজোপিসিমার মেয়ে একটি পাক্কা টমবয়– সে গাছকোমর বেঁধে আমাদের আগে আগে গাছে উঠে যায়, মারামারি বাঁধলে দঙ্গলে লড়ে। তার নাকে নোলক, কিন্তু মাথাটি ন্যাড়া।

এক বাড়ির মজা যথেষ্ট না, সুতরাং ঠিক হল আমাদের দলটা এবার ছোটপিসিমার বাড়ি হয়ে সেজোপিসিমার বাড়ি যাবে।

সকালবেলা ফেনসা ভাত খেয়ে আমরা চার ভাই এক বোন বেরুলাম। আমাদের মধ্যেকার আনন্দ দিগন্ত পর্যন্ত বাতাসের সঙ্গে হু হু করে ছুটে চলেছে, শূন্যে রামধনুর মতো আমাদের ফুর্তি ঠিকরোচ্ছে। আমাদের প্রত্যেকের শরীর লঘু, পাখির মতো শিস দিতে পারি, চাইলে উড়তেও বোধ হয় পারি। আমরা যত রকম সম্ভব মজা করতে করতে পথ চলতে লাগলাম। মাটির উঁচু পথের দু পাশে নানা উচ্চতার পাটখেত। গ্রীষ্মের রোদ কড়া হতে পারছে না- পাটখেতের নীল হাওয়া এসে তাপ উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পড়ন্ত বেলায় আমরা অশ্বিনীকুমার দত্তের গ্রাম বাটাজোড় ছাড়ালাম, সন্ধ্যার আগেই পৌঁছলাম ছোটপিসিমার বাড়ি।

ছোটপিসিমা বিধবা হয়ে তখন একা একা ভিটে আগলান, ছেলেদের আগলান। কিন্তু তাঁর প্রাণশক্তি প্রচুর দিনে খলবল করে কাজ করেন, রাতে লণ্ঠন জ্বালিয়ে পাহারা দেন। চোর, ডাকাত, প্রতিবেশী এবং সন্তানেরা কেউ তাঁর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে না।

ছোটপিসিমার কাছে দু দিন নানারকম খেয়ে, তিন দিনের দিন আমাদের দলটা চলল সেজোপিসিমার বাড়ির দিকে। তাঁদের গ্রামের নাম চন্দ্রহার।

বেশ হৈ হৈ করে পথ চলছিলাম। অপরাহ্নে হঠাৎ মেঘ উঠল যেন নীল ঘাস দিয়ে বোনা পাখির বাসা। বাতাস আর বিদ্যুৎ তার মধ্যে এসে ঘোঁট পাকাতে লাগল। তার পর পুটপাট করে বৃষ্টি নামল। আমাদের পাঁচজনের তাপ্লিমারা একটামাত্র ছাতা, সেটাও হাওয়ার দমকে উলটে গেল। বৃষ্টি ঝেপে এলে পথের পাশে গাছতলায় দাঁড়াই, কমে গেলে আবার হাঁটি– এইভাবে থেমে থেমে চলতে চলতে শেষে বিরক্ত হয়ে বেপরোয়া বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটতে লাগলাম। মাঠে মাঠে জল দাঁড়িয়ে গেছে, ছোট ছোট স্রোত এসে পড়ছে খালে, দূরে দেখা যায় পাটখেতের উপর বৃষ্টি ঘুরূপাক খাচ্ছে, জলের ছায়া কত দূর পর্যন্ত আমাদের ঘিরে আছে।

সন্ধ্যার মুখে পিসিমাদের বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখি মাঠের জল একটা টুবুটুবু ভরা পুকুরের সঙ্গে এক হয়ে গেছে, আর সেই গোড়ালিডোবা ছিপছিপে জলের পথ ধরে পুকুরের আধ হাত লম্বা পুরনো কই মাছেরা সার বেঁধে মাঠ পেরিয়ে চলেছে দেশান্তরে। আমরা কালক্ষেপ না করে দেড়-দুই কুড়ি কই সেই উলটনো ছাতার মধ্যে ভরে ফেললাম।

সেজোপিসিমার বাড়ি দু দিন কাটল, তিন দিন কাটল, কিন্তু সেই নাগাড়ে বৃষ্টি আর থামে না। এই জলের মধ্যে পিসি ছাড়বে না, এদিকে আমার মন ছটফট করছে নিজের বাড়ির জন্য। এক পিসতুতো ভাই একটা তুক বলল, একশোটা পুর কাগজে লিখে পোড়ালে নাকি বৃষ্টি থেমে যায়। আমি কাশীপুর, চাঁদপুর, ফতেপুর, বদরপুর, শিবপুর, অনুরাধাপুর পৃথিবীর যত পুর আছে লিখে পোড়ালাম। কিন্তু কিছু হল না। তখন আর এক পিসতুতো ভাই একটা ব্যাং মেরে উঠোনে চিত করে ফেলে রাখল। কিন্তু তাতেও বৃষ্টি ধরল না। আমি থেকে থেকে আকাশ দেখি: অশেষ মেঘ। মন ব্যাকুল হয়ে উঠছে। শেষে দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বৃষ্টি যেই একটু ধরেছে আমি সবচেয়ে ছোট ভাইটাকে বলে লুকিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

পথঘাট জলে ভেজা, বাতাসে জলকণা। এক্ষুনি আবার বৃষ্টি আসবে। আমি হনহন করে পা চালালাম। পথ একেবারে জনহীন, একটা গরু-বাছুর পর্যন্ত নেই। দিগন্ত পর্যন্ত দু দিকে শুধু পাটখেত। মাইল দুয়েক যেতে না যেতে বৃষ্টি এল, আমি না থেমে চলতে লাগলাম, এখনো অন্তত দশ ক্রোশ অচেনা পথ পাড়ি দিতে হবে।

মাঠের বৃষ্টি বড় বিশাল। অনাবৃত পৃথিবীকে নিরাশ্রয় পেয়ে তার বল দুর্ধর্ষ। বাতাসের বেগ জলের রেখাকে থুড়ে থুড়ে ধোঁয়া করে দিচ্ছে। পিঠের উপরে বৃষ্টি আমাকে তার পেরেকগাথা থ্যাবড়া হাতে চড়ের পর চড় মারছে। কিন্তু ভালোই হল ঝড়ের ধাক্কা আমাকে তিনগুণ বেগে ঠেলে নিয়ে যেতে লাগল সামনে– শরীরটাকে শুধু খাড়া রাখতে পারলেই হল, পা বিনা আয়াসে অতি দ্রুত মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে যায়।

কিন্তু সমস্ত বাঙলা দেশ জুড়ে বৃষ্টি নেমেছে নাকি! বাতাসের গর্জনের সঙ্গে চারদিকে বাজ ডাকছে কড় কড় কড় কড় বৃষ্টির শরজাল ভেদ করে ব্রহ্মশির অস্ত্র পড়ছে- একটা ছুটে এসে আমার গলার নলীটা কেটে দিলেই হয়ে যায়। আমি চোখের সামনে দেখলাম জমাট নীল আগুনের বলথান্ডার এদিক ওদিক পাটখেতে পড়ে ব্রাহ্মণের কাটা মাথা থেকে সাদা ধোঁয়ার শিখা ওঠাচ্ছে। আমি ছাড়া এই বাঙলা দেশের মাঠে কেউ নেই।

অবিশ্রান্ত বৃষ্টি আর হাওয়ার দমকে আমার শরীরে এবার ঠাণ্ডার কাঁপুনি ধরল। আমি প্রায় দৌড়তে লাগলাম। এমন সময় দেখি সামনে চাঁদসীর লোহার পুল। আষাঢ়ান্ত বেলার তখনো খানিকটা বাকি আছে। বৃষ্টিও একটু ধরে এল। বৃষ্টি থেমে যাওয়া হাওয়ায় আমি ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে হাঁটতে লাগলাম। বাড়িতে যখন পৌঁছলাম তখন মেঘলোকে রক্তহীন শেষ সূর্যাস্তলেখা।

বড়মা ছোটমা আমাকে ঐ ঝড়জলের মধ্যে দেখে অবাক। তাড়াতাড়ি গা-মাথা মুছে, শুকনো কাপড় পরে, পুরু কাঁথার মধ্যে সেঁধিয়ে গেলাম শরীর গরম করতে।

.

 দাদু ও ঠাকুমার মৃত্যু

দাদু যখন মারা গেলেন তখন আমি সাত পেরিয়েছি। সেদিন সন্ধ্যার পর খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ আমাকে কেউ জাগিয়ে দিল– শেষ দেখা দেখে নিতে হয়। অন্ধকার রাত্রে উঠোনে দাদুর চারদিকে বাড়ির লোকেরা ঘিরে আছে আমি সরে এসে একা দাঁড়িয়ে রইলাম।

বাবা, কাকা কেউ বাড়ি নেই। একটু পরেই আমার খোঁজ পড়ল, রাতের মধ্যেই দাহ শুরু করতে হবে, জ্ঞাতি কাকারা আমাকে নিয়ে চলল পুবপুকুরের ওপারের বনে। তারা সেই আঁধার রাত্রে কুড়ল চালিয়ে আম গাছ কাটতে লাগল, আমি লন্ঠন ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম আমার মনে ভয় চিন্তা দুঃখ কিছুই নেই- আশ্চর্য, আমি তখনো আম গাছের ডাল দেখছি, কাকাদের অনুচ্চ গলার কথাবার্তা শুনছি, লন্ঠন উঁচিয়ে ধরছি।

গাছ কেটে বাড়ি ফিরে এসে তারা কাঁচা বাঁশ, নতুন হোগলা আর নতুন কাপড় দিয়ে চালি বানাল। তার পর রাত আড়াই প্রহরে দাদুকে সেই শয্যায় শুইয়ে কাঁধে তুলে হরিধ্বনি দিয়ে চলল শ্মশানে। স্ত্রীলোকেরা একঝাঁক উলুধ্বনির মতো শব্দে কেঁদে উঠল। বাবা, কাকা বাড়িতে নেই, আমি একা বংশের ছেলে, আমি দাদুর সঙ্গে সঙ্গে চললাম।

শ্মশানের পাশে দাদুকে শোয়ানো হলে কেউ আমাকে বলল, তাঁর সারা গায়ে তেল মাখিয়ে দিতে। দাদুর সর্বাঙ্গ আমার চেনা, যেভাবে আমাকে তেল মাখাতেন আমিও সেই রকম করে তাঁকে টিপে টিপে তেল মাখিয়ে দিতে লাগলাম। কেউ একজন কলসি করে জল ঢেলে দিল, আমি হাত বুলিয়ে বুলিয়ে তাঁকে স্নান করালাম। নতুন কাপড় পরিয়ে তাঁকে চিতায় শোয়ানো হল। আমি জ্বলন্ত একগোছা পাটকাঠি তাঁর মুখে ধরলাম চড়াৎ করে দাড়িগোঁফে আগুন লেগে গেল। সবাই উচ্চৈঃস্বরে হরিধ্বনি দিয়ে চিতা ধরিয়ে দিল। আমার আর কিছু করণীয় নেই।… মুখ ফিরিয়ে দেখলাম পুকুরের ওপারে এসে ছোটমারা দাঁড়িয়ে আছে- হঠাৎ যেন সমস্ত পটভূমি উলটে গেল– মনে হল, পুড়তে থাকা দাদুসমেত আমরাই জীবিতের দল- ওরা, ঐ ওপারে সারি বেঁধে দাঁড়ানো মেয়েরা পরলোকের মানুষ, দুঃখময় তাদের ময়লা চেহারা এপারে কত আগুন, ঐপারে অন্ধকার, ছায়া।

আগুনভরা চিতার মধ্যে, কাঠের ফাঁকে দেখছি, দাদুর গায়ে অসম্ভব বড় বড় ফোঁসকা পড়ছে। পাটকাঠি দিয়ে গেলে দেব কিনা ভাবতে ভাবতে আগুনই তাদের গেলে দিল জল বেরিয়ে বেরিয়ে চিতা নিভবার অবস্থা। দাদুর ডুপসি হয়েছিল।

শ্মশান থেকে বাড়ি ফিরে দেখি, সকালেই অকালছায়া পড়েছে, যেন কান্নার কষ শুকিয়ে জমে আছে বাড়িটায়, ক্লান্ত বাসী জিনিসপত্র এখানে ওখানে ছড়ানো।

কিন্তু দু দিনের মধ্যে খবর পেয়ে বাবা কাকা পিসিমা পিসেমশায়রা এসে পড়লেন তখন বর্ষার অন্তে মেঘ ছিঁড়ে ছিঁড়ে যেমন নীলাকাশ বেরিয়ে পড়ে তেমনি শোক ছিঁড়ে ছিঁড়ে উৎসব দেখা দিতে লাগল। দাওয়ায় বসে বাবা, ছোড়দাদু আর পিসেমশায়রা পুরুতঠাকুরের সঙ্গে শ্রাদ্ধের ফর্দ করেন, নিমন্ত্রিতের লিস্টি বানান। নতুন ঘটি কলসি বিছানা ছাতা ইত্যাদি কেনা হয়। পাশাপাশি পাঁচ-ছটা উনুনে হবিষ্য সেদ্ধ হয়।

ঠাকুমা কিন্তু একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। যেন তিনি ম্যাটমেটে লাল পাড় শাড়ি আর মোটা মোটা সাদা শাখার জোরেই এতদিন হাঁকডাক করতেন, সংসার শাসন করতেন– এখন শাখা ভেঙে, থান পরার পরে একেবারে নির্বাক হয়ে গেছেন। এখন যে যা করতে বলছে তাই করছেন, বাকি সময় কাদায় ভেজা অনাথ বেড়ালছানার মতো ঘরের অন্ধকার কোণটিতে বসে থাকেন, আর নিযুত রাত্রে নিস্তব্ধ স্বরে চমক ভেঙে বলেন, ঐ, ঐ, ঐ দ্যাখ, দরজার ফাঁক দিয়া বুড়া আমারে ডাকে। দাদুর মৃত্যুর চোদ্দ দিনের মধ্যে ঠাকুমা মারা গেলেন।

সেদিন সকালেই সবাই বুঝতে পেরেছিল, ঠাকুমা মারা যাবেন। ছোটপিসিমা তাড়াতাড়ি করে ছোটদের গরম ভাত খাইয়ে দিল। আমরা গোগ্রাসে খেয়ে আঁচিয়ে এসে দেখি ঠাকুমাকে ধরাধরি করে বার করে গোসাঁইঘরের আঙিনায় এনে শোয়ানো হচ্ছে। বাড়িসুদ্ধ স্ত্রীলোকেরা তাঁকে ঘিরে দাঁড়াল। ভিড় ফাঁক করে আমিও কাছে গিয়ে ঠাকুমার মরে যাওয়া দেখতে লাগলাম। কিছু বুঝলাম না। হঠাৎ ছোটপিসিমা ডুকরে কেঁদে উঠল, তার পর ছোটমা, বড়মা, সেজোপিসিমা। আর সবাই চোখ মুছতে লাগল। তখন সকাল আটটা-নটা। সকালে শোক কেমন যেন ঘনায় না, উড়ে উড়ে যায়। পুবের ঘরের পিছনের জঙ্গল থেকে পাখি ডাকছে। আকাশ ঘন নীল, ফুরফুরে লম্বা চলে-যাওয়া সাদা মেঘ। সব যেন আলগা, কিছু দানা বাঁধে না।

ঠাকুমাকে তুলে মণ্ডপে শুইয়ে দিয়ে কাকারা আম গাছ কাটতে গেল, যাবার সময় আমাকে বলে গেল ঠাকুমাকে ছুঁয়ে বসে থাকতে। পিসিমাদের অনেক কাজ, তারা বাড়িতে ছুটোছুটি করছে। আমি একা ঠাকুমাকে দেখছি আদুড় বুকের হালকা স্তন দু দিকে নেতিয়ে পড়েছে, টিপে টিপে দেখছি শরীর শক্ত হয়ে যাচ্ছে, হাত আর ভাঁজ করা যায় না, ঠোঁটের কোনায় চার-পাঁচটা পিঁপড়ে লেগেছে, লাইন দিয়ে আসছে আরো পিঁপড়ে। আমি এক হাতে তাকে ছুঁয়ে আরেক হাতে পিঁপড়ে মারতে লাগলাম।

.

তার পর

ঠাকুমার শ্রাদ্ধশান্তি চুকে গেলে আত্মীয়েরা একে একে চলে যেতে লাগলেন। কদিন পর বাবাও চলে গেলেন। বাড়িতে রইলাম শুধু বড়মা ছোটমা কাকা আমি আর আমার ছোট ভাই। লক্ষ্মীছাড়া বাড়িতে এখন কেবল খিদে পায়, কিন্তু সময়মতো খেতে পাই না। একা একা স্নান করি, তেল মাখতে ইচ্ছে করে না। সন্ধ্যায় পা ধুই না, সকালে রাত্রে পড়তেও বসি না। অফুরন্ত স্বাধীনতা, কিন্তু বড় কষ্টে যেন দিন কাটছে। ক্রমশ আমার মেজাজ রুক্ষ হয়ে উঠল।

পাটাতনের উপর মেটে জালাগুলোয় হাত ঢুকিয়ে দেখি, সব ফাঁকা ঠনঠন করছে। রাত্রে মনে হয়, লণ্ঠনের আলো অমন কেন?- চিমনিতে যেন কতকালের কালি পড়ে আছে, খানিক পরে শিখা দপদপ করে তেল নেই নাকি!

এখন মাঝে মাঝে আমাকে বাজারে যেতে হয় মুদির জিনিস কিনি, মাছ কিনি, তরকারি কিনি। উমাকাকার কামারশাল থেকে বাজার শুরু, আর শেষ হয়েছে গিয়ে পোস্ট অফিসে। মাঝখানে দুধের হাট, তরকারির হাট, মুদি-ময়রা-বস্ত্রালয়-মনোহারী দোকান। সারি বাঁধা পাতা পান, পাতা তামাকের দোকান, তার পর মেছোহাটা, হাঁড়ি কলসির আড়ত। এমনকি গাঁজা-আফিম, দরজি, ঔষধালয়ও। দুপুর পর্যন্ত অসম্ভব ভিড়, হো হো হৈ হৈ। একদিন দেখি দুধের হাটে দুধের ধারা বয়ে পিছনের দিঘিতে গিয়ে পড়ছে দুধওয়ালারা জল মিশিয়েছিল বলে সব দুধ খদ্দেররা মাটিতে ঢেলে দিয়েছে।

বিকেলে বাজারের একেবারে অন্য চেহারা যেন ঘুমের দেশের বাজারের উপর রূপকথার দেশের আলো এসে পড়েছে। লোকজন নেই, দু-পাঁচখানা মুদি মনোহারী দোকান শুধু ঝাঁপ খুলে রেখেছে। দোকানঘরের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় পিছনের খালের জল। হাটের কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে লম্বা চালাঘরের ফাঁকা রোয়াকে শুয়ে আছে। এই ঘুমের দেশে শুধু অনন্ত ময়রা উবু হয়ে বসে পাটির উপর বাতাসা কাটছে। হাঁড়িতে সে কাঠি ঘুরোয়, আর হাঁড়ির ফুটো দিয়ে মোহরের মতো বাতাসা পড়ে। গরম বাতাসা চমৎকার খেতে। আমি আধ পয়সার বাতাসা কিনি।

একদিন সন্ধ্যায় বাজারের শেষ মাথায় একজন মাঝবয়সী লোক ঢোল বাজাচ্ছিল। তার পরনে ময়লা ধুতি আর ফতুয়া, বুকে বিব-এর মতো ঝোলানো কালো কাপড়ে পঁচিশ-তিরিশখানা মেডেল আঁটা। অদ্ভুত তার বাজনা- মেঘের মতো গুরুগুরু দিয়ে শুরু হল, তার পর অতি দ্রুত টরররর শব্দে বৃষ্টির ফোঁটা ঝেপে এল, কখনো দুধের মধ্যে মন্থনদণ্ড পাক দিচ্ছে, কখনো গভীর রাত্রে আমের মুকুল ঝরে পড়ছে। প্রতিটি বোলে বাতাস চূর্ণ করে যেন ফুলঝুরির মতো কিছু একটা জেগে উঠছে, অথচ ঢোলের চামড়ায় তার প্রত্যেকটা আঘাত অতি স্পষ্ট, বিচ্ছিন্ন এবং পুরুষালি। গলায় ঢোল বেঁধে লোকটি দুলে দুলে বাজাচ্ছে, অল্প কয়েকজন দোকানী ঘিরে দাঁড়িয়ে শুনছে। সন্ধ্যা হয়ে গেলে একজন লণ্ঠন উঁচু করে ধরল, দোকানীরা এক আনা দু আনা করে দিল। শুনলাম লোকটির নাম ক্ষীরোদ নট্ট।

বিকেলের বাজার থেকে কখনো কখনো গোয়ালবাড়ি হয়ে ঘুরপথে বাড়ি ফিরতাম। তখন তাদের বাড়ির উঠোনে রাধু ঘোষের ছেলে প্রহ্লাদকাকা আর বিশাকাকা দুধ ময়– বিশাল মাটির মটকিতে ক্যানেস্তারা করে মন মন গরম দুধ তাদের বোনেরা ঢেলে দেয় আর বাঁশের চরকিতে দড়ি পেঁচিয়ে তারা দু ভাই দু দিক থেকে টানে। মটকির মধ্যে চরকি ঘুরুর ঘুরুর গম্ভীর ভাঙা গলায় শব্দ করে পাক খায়। উঁকি দিয়ে দেখি, দুধ থেকে কখন চাকা চাকা মাখম ভেসে উঠেছে। ঘোষের ছেলেদের বুক আর কাঁধের পেশী চমৎকার। দুধ মইতে মইতে তাদের দরদর ধারায় ঘাম ঝরে। এক এক মটকি থেকে এক এক বালতি মাখম ওঠে। আমাকে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাদের একজন চড়াৎ করে কলা গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে একখাবলা মাখম তুলে দিয়ে বলে, ‘খাও’।

সকালবেলা ভিড়ের বাজারে যেতে আমার ভালো লাগে না, কিন্তু কাকা নিপাত্তা থাকলে যেতেই হয়। দু আনা দিয়ে বাজারের সেরা ইলিশটাকে কিনে এনে শুনি ও রকম মাছ নাকি চার পয়সার বেশি হয় না, বেগুন কিনেও ঠকি, লাউ কিনে আরো ঠকি।

সেদিন শিঙ্গি মাছ কিনেছিলাম, খালুইয়ের ফাঁক দিয়ে তারা পায়ে কাঁটা বিঁধিয়ে দিল। বাজার থেকে ফেরার পথ কামারবাড়ির মধ্য দিয়ে। শশী কর্মকারের বাড়ির শেষে পর পর দুখানা একবাঁশের সাঁকো, তার পর আমাদের তেঁতুলতলা। প্রথম সাঁকোটা খুব উঁচু, খালের কচুরিপানায় ঠাসা একটা নিঃস্রোত বাড়তি অংশের উপর। সেখানটা গাছ গাছালির ছায়ায় অন্ধকার। পুঁটুলিবাঁধা ঠোঙা আর খালুই হাতে নিয়ে সাঁকোর মাঝখানে যখন পৌঁছেছি, হঠাৎ পা হড়কে গেল- তের-চোদ্দ ফুট নিচে পড়তে কতটুকু সময় লাগে? কিন্তু ঐ দ্রুত মুহূর্তেই বুঝলাম, হাতপাহীন লোষ্ট্রের মতো আর আমার অতীত ভবিষ্যৎ কিছু নেই। ঘন কচুরিপানার স্তর ভেদ করে জলের নিচে অন্ধ মাটিতে শাবলের মতো গেঁথে গিয়ে পরক্ষণেই বুদ্ধি ফিরে এল– আমি সাঁতার জানি না, যে করে হোক এক্ষুনি আমাকে পাড়ে পৌঁছতে হবে! আমি হাঁকড়েপাকড়ে, মাটি আঁকড়ে, জল আঁকড়ে, কচুরিপানার জটা মাথায় নিয়ে, যেন যুদ্ধ করে, সত্যিই শেষে পাড়ে উঠলাম।

তখন আশেপাশে কোথাও মানুষজন নেই। জিরাফের মতো দুটো বাঁশের সাঁকো, তাদের হাঁটুর নিচে অদৃশ্য জলে সাপের মতো হিলহিলে ঘন কচুরিপানার দাম আর খাড়া আঁকাবাঁকা বড় বড় গাছে জায়গাটা যেন একটা আধিভৌতিক দেশের ছবি! কিন্তু আমার ভয় হল না, যেন আমি জানি ঐ সবুজকালো জলের নীল কাদায় আমাকে কেউ শুইয়ে রাখতে পারবে না। আমি নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরে চললাম এবং ভেজা জামা-প্যান্ট ছেড়ে, নতুন করে পয়সা নিয়ে আবার বাজারে গেলাম সওদা করতে।

একদিকে দায়িত্বচেতনা, অন্যদিকে নির্দয়তা- এই দুয়ের মধ্যে পড়ে আমার ভিতর কাঠিন্য আসছিল। ফসল কেটে নেওয়া খড়ের মধ্যে যেমন শুকনো দুঃখ জন্মায় বুঝদার বালকদের বুকেও সেই রকম কোনো শীর্ণ রুক্ষ মনোকষ্ট জাগে।

আমি অস্থির এবং বেহাল হয়ে বনজঙ্গলে ঘুরি। কিন্তু গাছের কাছে আর সেই শাস্তি পাই না। মেঘ বাতাস আলো দৃকপাত না করে আমার ময়লা গায়ের উপর দিয়ে উড়ে যায়। শস্য ঢেলে ফেলার পর শেষ দানাটিও ঝেড়ে নেবার জন্য যেমন থলে উলটে দেওয়া হয়, আমাকেও কে যেন তেমনি উলটে দিয়েছে।

বনে বনে ঘুরতে ঘুরতে একদিন হয়তো আমি গোসাপের বিষ্ঠা কিংবা সাংঘাতিক কোনো গরল মাড়িয়েছিলাম তিন-চার দিন দুটো পায়ের পাতাই খুব চুলকোল, শেষে চামড়া ফেটে ফেটে দাগড়া দাগড়া ঘা দেখা দিল। সারা দিন সেই পা নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াই, ঘা থেকে যখন রস গড়ায় আমি ধুলো ছুঁড়ে চাপা দিই। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই ব্যথা আর চুলকনি অসহ্য হয়ে ওঠে। রোজ সন্ধ্যায় ছোটমা আমাকে তুষের আগুনের একটা মালসা এনে দেয়, তাতে পা সেঁকে একটু আরাম পাই। আজকাল রাত্রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পা সেঁকাই আমার কাজ।

এই রকম সেঁকতে সেঁকতে একদিন আগুনভরা মালসাটা পায়ের উপর উলটে গেল। পুরো দুই পায়ের পাতা পুড়ে যাবার যন্ত্রণায় আমি সারা রাত ধরে চেঁচালাম। বড়মা নারকেল তেল আর চুন ফেটিয়ে পোড়া জায়গায় লাগাতে লাগলেন, হাওয়া করতে লাগলেন। শেষরাত্রে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। পোড়া ঘা গরলের ঘাকে চাপা দিয়ে দিল। বড়মা ধুনোর গুঁড়ো আর নারকেল তেল মিশিয়ে আবার মলম বানালেন। এখন আমি রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দুই পোড়া পায়ে সেই মলম লাগাই।

জলের স্নেহে ভাসা শৈবাল যেমন ভাটার টানে টানে উপড়ে যায় তেমনি জন্ম থেকে গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আমার আট বছরের মূল এইবার কষ্টে কষ্টে ছিঁড়ে যেতে লাগল, কিংবা এমনও হতে পারে, আমি বড় হচ্ছিলাম, এই জীবনের ধূসর শুকনো বাতাস বা গ্রামের বিষাদাচ্ছন্ন কুহেলিকায় ক্লান্ত হয়ে আমি অন্য কোথাও উড়ে যেতে চাইছিলাম।

দুপুরবেলা গায়ের জামাটাকে পোঁটলা পাকিয়ে মাথার নিচে দিয়ে নিঃসঙ্গ রেইন ট্রি গাছের তলায় শুয়ে থাকি, শিকড়ের উপর পিঁপড়েদের যাওয়া আসা দেখি, শোনের জঙ্গল থেকে শেয়াল বেজি উঁকি দিয়ে যায়, আমি হিসেব করি, কিসের হিসেব তাও স্পষ্ট নয়।

রাত্রে, যে চাঁদের সঙ্গে আমার এত ভালোবাসা আমি দৌড়লে আকাশে যে আমার সঙ্গে ছুটত, যার পূর্ণিমায় আমরা ফুটফুটে উঠোনে হাডুডু খেলতাম– তার দিকে তাকিয়ে, সে যে কত দূরের, এই বিষণ্ণ কথাটাই কেবল মনে হয়।

.

 চলে যাওয়া

বড়মা ও ছোটমাকে আর গ্রাহ্য করি না। আমার শিকড় ছিঁড়ে যাচ্ছিল বলেই দৌরাত্মও বাড়ছিল। এমন সময় সবারই মনে পড়ল আট বছর বয়স হয়েছে অথচ আমি স্কুলে পড়ি না, মনে পড়ল আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে দিদিমা ঠাকুমার সেই প্যাক্ট।

মাসখানেকের মধ্যেই জানা গেল, আমার তদবধি অপরিচিত দিদিমা-দাদামশায়ের সংসারে আমি থাকতে যাচ্ছি। সেখানেই আমি স্কুলে ভরতি হব। আমার মনে হল, বেশ হয়েছে, চলে গিয়েই আমি শোধ নেব। কার উপরে শোধ? আগুন জল ক্ষুধার দেবতার উপর?

তার পর কয়েকটা দ্রুত সংক্ষিপ্ত দিন। আমাকে ওরই মধ্যে একটু ভালোমন্দ খাওয়ানো হল। জন্মভূমি ছেড়ে যেতে গিয়ে আমি একটুও কাঁদলাম না, একটুও হাসলাম না, অনেকখানি অভিমান আর কিছুটা তালগোল পাকানো চিন্তা নিয়ে আমি দিদিমার পাঠানো চলনদারের সঙ্গে চললাম এক দূর অনিশ্চিত শহরের উদ্দেশে। সেখানে হয়তো অজানা দেশের সুখের উপকূল।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *