০৪. শুরুতে?

০৪. শুরুতে?

– পৃথিবী কোথা থেকে এল?

–আমি জানি না। ভাবল সোফি। নিশ্চয়ই কেউ-ই আসলে জানে না সেটা। জীবনে এই প্রথমবারের মতো সে উপলব্ধি করল যে, পৃথিবীটা কোথা থেকে এল এ-ব্যাপারে অন্তত প্রশ্ন না করে পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই ঠিক নয় …
–সোফির জগৎ, ইয়স্তেন গার্ডার

এই সুন্দর ফল, সুন্দর ফল, মিঠা নদীর পানি ছেড়ে এবার তাকানো যাক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দিকে এই সুন্দর চাঁদ, সুন্দর তারা, অসীম শূন্যতার দিকে। বাইবেলের প্রথম বাক্য, ইন দ্য বিগিনিং… বা ‘শুরুতে …’ এবং পরবর্তীকালে আরও অনেকবার মহাবিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কিত বাক্য, কোরআনের বিভিন্ন আয়াত (৪৫ : ৩-৫, ২১ : ৩০, ৪১ : ১১, ২১ : ৩৩, ৫১ : ৪৭ ইত্যাদি) পড়ে আমরা জানতে পারি, এই অপার মহাবিশ্ব একজন মহাপরাক্রমশালী কেউ সৃষ্টি করেছিলেন শূন্য থেকে। বিভিন্ন ধর্ম বিভিন্ন ঈশ্বরকে বসিয়েছে সেই স্রষ্টার আসনে। ঈশ্বর ভিন্ন হলেও ধর্মবেত্তাদের আয়াত থেকে উদ্ধার করে আনা দেওয়া যুক্তিগুলো একদম কাছাকাছিঃ

১। প্রতিটি ঘটনারই এক বা একাধিক কারণ রয়েছে।

২। কোনো ঘটনার কারণই সেই ঘটনাটা নিজে নয়।

৩। কোনো একটা ঘটনার কারণ হিসেবে থাকে একটা পূর্ববর্তী ঘটনা। সেই পূর্ববর্তী ঘটনার কারণ হিসেবেও থাকতে পারে তার পেছনের কোনো ঘটনা। কিন্তু এভাবে ঘটনাপ্রবাহ। অনন্তকাল ধরে চলতে পারে না।

 ৪। ভাই অবশ্যই শুরুর দিকের কোনো ঘটনা প্রবাহের একটি আদি কারণ থাকবে।

৫। আর সেই আদি কারণই ঈশ্বর। অতএব ঈশ্বর আছেন।

আমরা সাধারণভাবে ধরে নেই মহাবিশ্বের একটি সূচনা ছিল। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে, বিগব্যাং নামক এক মহাবিস্ফোরণের ফলে এই সকল কিছুর উৎপত্তি হয়েছে। যেহেতু কোনোকিছুই নিজে নিজে শুরু হতে পারে না, একে অন্য কারও দ্বারা শুরু হতে হয়, সুতরাং ঈশ্বর হলেন সেই ব্যক্তি যিনি বিগব্যাং-এর মাধ্যমে প্রথম বলটা গড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমরা কি তবে। ঈশ্বরকে খুঁজে পেলাম?

যুক্তির প্রথম পয়েন্টটা এমন হওয়া উচিত ছিল যে, সকল কিছু হবার পেছনেই কারণ রয়েছে কিংবা কারণ ছাড়া কোন কিছু তৈরি হতে পারে না।’ সৃষ্টিবাদীদের কথা অনুসারে যদি সকল কিছুর হবার পেছনে একটি কারণ থাকে তাহলে সেটা ঈশ্বরের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য হবার কথা। মহাবিশ্ব সৃষ্টি করা হয়েছে, সৃষ্টিকর্তা হলেন ঈশ্বর। এবার তাহলে কথা হলো, ঈশ্বরকে সৃষ্টি করল কে? ঈশ্বরবাদীরা এক্ষেত্রে জবাব দেন, ঈশ্বরের কোনো সূচনা নেই, তিনি প্রথম থেকেই এমন ছিলেন, তাকে কেউ সৃষ্টি করেন নি, তিনি নিজে নিজেই হয়েছেন, তারপর খুব দারুণ কিছু ব্যাখ্যা করে ফেলেছেন এমন একটা ভাব ধরেন।

‘যার শুরু আছে তার পেছনে কারণ থাকতেই হবে’-এই ধরনের দর্শন কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের উদাহরণের মাধ্যমে বিজ্ঞান অনেক আগেই বাতিল করে দিয়েছে। আণবিক পরিবৃত্তি (Atomic Transition), আণবিক। নিউক্লিয়াসের তেজস্ক্রিয় অবক্ষয়ের (Radioactive decay of nuclei) মতো কোয়ান্টাম ঘটনাসমূহ ‘কারণবিহীন ঘটনা হিসেবে ইতোমধ্যেই বৈজ্ঞানিক সমাজে স্বীকৃত। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ব (uncertainty principle) অনুযায়ী সামান্য সময়ের জন্য শক্তি (যা E = mc2 সূত্রের মাধ্যমে শক্তি ও ভরের সমতুল্যতা প্রকাশ করে) উৎপন্ন ও বিনাশ ঘটতে পারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে-কোনো কারণ ছাড়াই। এগুলো সবগুলোই পরীক্ষিত সত্য[১৪৩]। তাই আমরা যদি ধরে নেই প্রাকৃতিক বিশ্ব কোনো কারণ ছাড়া বা অন্য কারও হাত ছাড়াই উদ্ভূত হয়েছে সেক্ষেত্রে অযথা ঈশ্বরকে যোগ করার ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অক্কামের ক্ষুরের (occam’s razor) মূলনীতি অনুযায়ী অপ্রয়োজনীয় সকল ধারণা কেটে ফেলতে হয়*।[* এ প্রসঙ্গে পড়ুন এই বইয়ের পরিশিষ্টে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধ অক্কামের ক্ষুর এবং বাহুল্যময় ঈশ্বর] মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে ঈশ্বরকে নিয়ে আসা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। এই নিয়ে আসার মাধ্যমে আমরা কোনো প্রশ্নেরই জবাব পাই না, উল্টো আরও প্রশ্ন সৃষ্টি করি। [১৪৪]

সৃষ্টিবাদীরা প্রাকৃতিক বিশ্ব এমন কেন, এটা এমন কীভাবে হলো, শুরু যদি হয়েই থাকে তাহলে কে প্রথম কাজটা করল?-এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দিশেহারা হয়ে একটি বাক্যই উচ্চারণ করেন, ঈশ্বর করেছেন। এখন তাহলে দুর্মুখেরা সেই একই প্রশ্ন আবার করবেন, ঈশ্বরটি কে? তিনি কীভাবে এলেন? যদি এসেই থাকেন তাহলে কে তাকে আনলেন? কথিত আছে, ঈশ্বরের মহাবিশ্ব সৃষ্টি এবং তার অপার মহিমা বর্ণনা করার সময় সেন্ট অগাস্টিনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আচ্ছা! মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগে ঈশ্বর কী করছিলেন? জবাবে তিনি রেগেমেগে উত্তর দিয়েছিলেন, যারা এই ধরনের প্রশ্ন করে তাদের জন্য জাহান্নাম তৈরি করছিলেন ঈশ্বর।

ঈশ্বরবাদীদের এই উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরও বড় প্রশ্নের উদ্ভাবন নিয়ে বার্ট্রান্ড রাসেল একটা চমৎকার গল্পের অবতারণা করেছিলেন। একবার একটা গণসম্মেলনে মহাবিশ্ব নিয়ে লেকচার দেয়ার সময় এক বৃদ্ধা নারী বললেন তার পুরাণ অনুযায়ী মহাবিশ্ব একটি হাতির ওপর, হাতিটি একটি কচ্ছপের ওপর বিশ্রাম নেয়। যখন রাসেল বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তা কচ্ছপটি কার উপর বিশ্রাম নেয়?’ তখন তিনি বলেন, ‘এসো আমরা অন্য কিছু নিয়ে কথা বলি।

না, আজকে আমরা অন্যকিছু নিয়ে কথা বলব না। আমরা এই অন্তিম। প্রশ্নগুলোই করব। শুধু প্রশ্ন উত্থাপন করেই আমরা থেমে যাব না, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় সেটাও আলোচনা করব। সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারব এ দাবি নিশ্চয় আমরা করব না, কিন্তু এটুকু বলতে পারি, বিজ্ঞানের বৈপ্লবিক অগ্রগতির ফলে আমরা এখন অনেক কিছুরই জবাব দিতে সক্ষম। যেখানে বিজ্ঞান এখনও পৌঁছাতে সক্ষম হয় নি সেখানেই আমরা ঈশ্বরকে বসিয়ে দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলব সেটাও ঠিক নয়। বিজ্ঞানের দর্শন আমাদের বুঝতে হবে। আমরা প্রশ্ন করব, আমরা উত্তর খুঁজব। সেই উত্তর খোঁজার পথটা যৌক্তিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। কেবল বিশ্বাস-নির্ভর উত্তরে আমরা আবদ্ধ থাকব না।

আসুন প্রিয় পাঠক, চোখ মেলে তাকানো যাক মহাবিশ্বের অন্তিম রহস্যগুলোর দিকে।

.

অলৌকিকতা

মহাবিশ্ব কেমন করে এলো? সহস্রবছর ধরে মানুষের মনকে আন্দোলিত করা একটি প্রশ্ন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তিনটি ধর্ম ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম অনুসারে একজন ঈশ্বর এই মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছিলেন। প্রশ্নটার এটি একটি উত্তর এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি হাইপোথিসিস। হাইপোথিসিস যে কোনো কিছুই হতে পারে। তবে সেটিকে সত্য বা বাস্তবতার পর্যায়ে যাওয়ার জন্য যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে হয়। এই অধ্যায়ে আমরা এই ঈশ্বর হাইপোথিসিসকে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা করব, আমরা খুঁজব অতিপ্রাকৃতিকভাবে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হওয়ার হাইপোথিসিসের সত্যতার কোনো প্রমাণ আছে কিনা। যে প্রমাণগুলো আমাদের দরকার তা হলো, ১) মহাবিশ্বের একটি সূচনা ছিল ২) এই সূচনা প্রাকৃতিকভাবে বা এমনি এমনি হয় নি। মহাবিশ্ব সৃষ্টির পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো একটি ক্ষেত্রে একটি। অলৌকিক ঘটনা বা মিরাকল ঘটেছিল। অর্থাৎ মহাজাগতিক উপাত্ত বা কসমোলজিক্যাল ডাটা যদি আমাদের এমন তথ্য দেয় যে, সৃষ্টির শুরুতে একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে প্রাকৃতিক নিয়মের/ সূত্রের লঙ্ঘন ঘটেছিল যা ব্যাখ্যাতীত এবং এই ব্যাখ্যাতীত ঘটনা বা মিরাকলের ফলেই মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি ঈশ্বর নামক হাইপোথিসিসটির একটি জোরালো ভিত্তি রয়েছে। হয়ত বা ঈশ্বর যে রয়েছেন সেটারও।

প্রায় শত বছর আগে দার্শনিক ডেভিড হিউম দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োগের ওপর ভিত্তি করে তিন ধরনের মিরাকলের কথা বর্ণনা করেছিলেন। তার দেওয়া সংজ্ঞা থেকে মিরাকল বা অলৌকিকতার যে বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা পাই তা হলো: মিরাকল হচ্ছে, ১) এমন কোনো ঘটনা। যা প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রাকৃতিক নিয়মের লঙ্ঘন ২) ব্যাখ্যাতীত কিছু ৩) অসম্ভব কিন্তু কাকতালীয় ভাবে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা।

ধরা যাক, নাসা অবজারভেটরির বিজ্ঞানীরা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন আমাদের সৌরজগতে পৃথিবীর পাশে নতুন একটি গ্রহ উদয় হয়েছে কিংবা একটি অতিকায় হাতি বুধ গ্রহকে কেন্দ্র করে পাক খেয়ে চলেছে। আর আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। পৃথিবীর পাশে একটি গ্রহ নতুন করে উদয় হওয়া অসম্ভব, কেননা এতে করে শক্তির নিত্যতার সূত্রের সরাসরি লঙ্ঘন হবে। ঠিক একইভাবে পদার্থবিজ্ঞান আর জীববিজ্ঞানের সমস্ত নিয়ম নীতিকে তোয়াক্কা করে অক্সিজেন বিহীন। মহাশূন্যে একটা হাতির বুধ গ্রহের চারিদিকে পাক খেতে দেখাও অবাস্তব ব্যাপার। যদি সত্যই এমনটা হয়ে থাকে তাহলে আমরা এই ঘটনাকে মিরাকল বা অতিপ্রাকৃতিক আখ্যায়িত করতে পারি।

ধর্মবেত্তা রিচার্ড সুইনবার্নও প্রাকৃতিক কোনো নিয়মের লঘনকে মিরাকল বলে আখ্যায়িত করেছেন[১৪৫]। তিনি এর সাথে আরও যোগ করেছেন, লঘন কেবল একবার সংগঠিত হলে সেটা হবে মিরাকল। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট। কারণ কোনো লঙ্ঘন যদি বার বার সংঘটিত হতে থাকে তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটি ঘটার প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা বের করা সম্ভব। যুক্তিসংগত কারণে, পর্যবেক্ষণে বিজ্ঞান পরিবর্তিত হয়। সুতরাং প্রাকৃতিক নিয়মের নিয়মিত লঙ্ঘন হতে থাকলে বিজ্ঞানীরা জানার চেষ্টা করবেন কেন এমন হচ্ছে এবং এর ব্যাখ্যা বের করার জন্য তারা জীবন দিয়ে দিবেন। অবশ্য বিজ্ঞানের এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই অনেকে আবার একে ব্রাত্য মনে করেন। অনেকটা পাশের বাসার যদুর মতো, যে আদতে কিছুই জানে না, আজকে এক কথা বলে তো কালকে অন্য!

অবশ্য বিজ্ঞান সম্পর্কে অনেকের ধারণা এমন হলেও, বর্তমানে বিজ্ঞানের জানার পরিধি তাদের অনেকেরই কল্পনাতীত। একই সাথে বিজ্ঞানের অনেক নিয়ম ও সত্যতা সহস্র বছর ধরে অপরিবর্তিত। পদার্থবিজ্ঞানের সাধারণ সূত্রগুলো নিউটনের সময় যেমন ছিল এখনও তাই আছে। বিংশ শতকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অভূতপূর্ব উন্নতিতে সেই সূত্রগুলো পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করা সবাই এখনও নিউটনিয়ান মৌলিক বিষয়গুলো, যেমন শক্তির নিত্যতার সূত্রের মতো বিষয়ে আগের মতোই ঐক্যমত প্রকাশ করেন। চারশো বছরে ধরে এই সূত্র অপরিবর্তিত[১৪৬]। নিত্যতা এবং নিউটনের গতিসূত্র এখনও আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সে ব্যবহৃত হয়। রকেটের কক্ষপথ নির্ণয়ের গাণিতিক হিসেবে এখনও নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র ব্যবহার করা হয়।

এখন, শক্তির নিত্যতা এবং ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানের অনেক নিয়ম বা সূত্র সৌরজগৎ ছাড়িয়ে লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত গ্যালাক্সির জন্যও সত্য। যেহেতু বিগব্যাং পরবর্তী তেরো বিলিয়ন বছর ধরে এই নিয়মের সত্যতা সম্পর্কে কারও কোনো সন্দেহ নেই, সুতরাং যেকোনো পর্যবেক্ষণ, যা এই সূত্রগুলোকে মিথ্যা বা ভুল প্রমাণ করে তাকে আমরা সরাসরি মিরাকল আখ্যায়িত করতে পারি।

সন্দেহ নেই, ঈশ্বর যদি আসলেই থেকে থাকেন তাহলে তার একই মিরাকল বার বার ঘটানোর সামর্থ্যও আছে। যাই হোক, আগেই বলেছি, বার বার কোনো ঘটনা ঘটলে এর সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা সম্ভব হয় এবং এইসব তথ্য পর্যালোচনার মাধ্যমে ঠিকই প্রাকৃতিক কোনো ব্যাখ্যা বের করা সম্ভব হয়। কিন্তু যেই ঘটনা একবারই ঘটে সেটা রহস্যাবৃত কাকতালীয়ই রয়ে যায়। ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানরা যেমন মাঝে মাঝেই আম্পায়ারের বেনিফিট অফ ডাউট পান-এই পুরো আলোচনায় আমরা ঈশ্বর হাইপোথিসিসকে সেই রকম বেনিফিট অফ ডাউট দিতে চাই এবং মহাবিশ্বের ঈশ্বরের মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনার সকল পথ উন্মুক্ত রাখতে চাই। কিন্তু যদি সংজ্ঞা অনুযায়ী অত্যন্ত নিম্নমানের অলৌকিকতার সন্ধানও আমরা আমাদের আলোচনায় না পাই, তাহলে সেক্ষেত্রে ঈশ্বর হাইপোথিসিসকে সরাসরি বাতিল করে দেওয়া সম্ভব; একই সাথে ঈশ্বর নামক ধারণাকে, যিনি আমাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মিরাকল ঘটানোর জন্য বসে থাকেন।

.

পদার্থের উৎপত্তি

বিংশ শতকের শুরুর দিক পর্যন্ত মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে যে একটি বা বেশ কয়েকটি অলৌকিক ঘটনার প্রয়োজন ছিল তা বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত মানতেন। আমরা জানি মহাবিশ্ব বিপুল পরিমাণ পদার্থ দিয়ে গঠিত। আর পদার্থের ধর্ম হলো এর ভর। বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত ধারণা করা হতো, ভরের সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই, এটি শুধু এক রূপ থেকে আরেকরূপে পরিবর্তিত হয়। শক্তির নিত্যতার সূত্রের মতো এটি ভরের নিত্যতার সূত্র। সুতরাং এই বিপুল পরিমাণ ভর দেখে সবাই ধারণা করে নিয়েছিলেন একদম শুরুতে ভর সৃষ্টি হওয়ার মতো অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল, যা সরাসরি ভরের নিত্যতার সূত্রের লঙ্ঘন। এবং এটি ঘটেছিল মাত্র একবারই-মহাবিশ্বের সূচনাকালে।

পদার্থের অনেক সংজ্ঞা আমরা জানি। এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ও সহজ সংজ্ঞা হলো-পদার্থ এমন একটি জিনিস যাকে লাথি মারা হলে এটি পাল্টা লাথি মারে। কোনো বস্তুর মধ্যকার পদার্থের পরিমাপ করা যায় এর ভরের সাহায্যে। একটি বস্তুর ভর যত বেশি, তাকে লাথি মারা হলে ফিরিয়ে দেওয়া লাথির শক্তি তত বেশি। বস্তু যখন চলা শুরু করে তখন সেই চলাটাকে বর্ণনা করা হয় মোমেন্টামের মাধ্যমে, যা বেশিরভাগ সময়ই বস্তুর ভর ও বস্তুর যে গতিতে চলছে তার গুণফলের সমান। মোমেন্টাম একটি ভেক্টর রাশি, এর দিক ও বস্তুর গতির দিক একই।

 ভর এবং মোমেন্টাম দুইটি জিনিসই পদার্থের আরেকটি ধর্মকে যথাযথভাবে সমর্থন করে যাকে আমরা বলি ইনারশিয়া বা জড়তা। একটি বস্তুর ভর যত বেশি তত এটিকে নাড়ানো কঠিন এবং এটি নড়তে থাকলে সেটাকে থামানো কঠিন। একই সাথে বস্তুর মোমেন্টাম যত বেশি তত একে থামানো কষ্ট, থেমে থাকলে চালাতে কষ্ট। অর্থাৎ বেশি পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন।

বস্তুর গতির আরেকটি পরিমাপযোগ্য ধর্ম হলো এর শক্তি। শক্তি, ভর ও মোমেন্টাম থেকে স্বাধীন কোনো ব্যাপার না, এই তিনটি একই সাথে সম্পর্কিত। তিনটির মধ্যে দুইটির মান জানা থাকলে অপরটি গাণিতিকভাবে বের করা সম্ভব। ভর, মোমেন্টাম এবং শক্তি এই তিনটি রাশি দিয়ে আমরা একটি সমকোণী ত্রিভুজ আঁকতে পারি। সমকোণী ত্রিভুজটির লম্ব হলো মোমেন্টাম p, ভূমি ভর m আর অতিভুজ শক্তি EI এখন পিথাগোরাসের উপপাদ্য ব্যবহার করে এই তিনটির সম্পর্ক নির্ণয় করা যায়। নিচের ছবিতে দ্রষ্টব্য–

ছবি। পেজ ১৭০

চিত্র : লক্ষ্য করুন, কোনো বস্তু যখন স্থির অবস্থায় থাকে তখন এর মোমেন্টাম শূন্য এবং এর শক্তি ভরের সমান (E=m)। এই শক্তিকে বলা হয়ে থাকে পদার্থের স্থিতি শক্তি। এটাই আইনস্টাইনের বিখ্যাত গাণিতিক সম্পর্ক E=mc2 যেখানে c-এর মান 1*। [* আমরা জানি, আলো প্রতি সেকেন্ডে যায় 300,000 কিলোমিটার (বা ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল)। কাজেই সে হিসাবে প্রতিবছরে (অর্থাৎ ৩৬৫ x ২৪ x ৬০ x ৬০ সেকেন্ড) আলো কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে তা আমরা বের করতে পারি। 9.4605284 x 105 মিটার সেটাকেই ১ আলোকবর্ষ বা 1 light year বলে। কাজেই c=1 light-year per year.] ১৯০৫ সালে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তার এই বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ব প্রকাশ করেন। তিনি প্রমাণ করে দেখান যে, শক্তি থেকে ভরের উৎপত্তি সম্ভব এবং একই সাথে শক্তির মাঝে ভরের হারিয়ে যাওয়া সম্ভব।

স্থির অবস্থায় বস্তুর স্থিতি শক্তি ও ভরের মান সমান। এখন বস্তুটি যদি চলা শুরু করে তখন এর শক্তির মান পূর্ববর্তী স্থিতি শক্তির চেয়ে বেশি। অতিরিক্ত এই শক্তিকেই আমরা বলি, গতিশক্তি। রাসায়নিক ও নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার ফলে গতিশক্তি স্থিতি শক্তিতে রূপান্তরিত হয় যা আদতে বস্তুর ভর[১৪৭]। একই সাথে উল্টো ব্যাপারও ঘটে। ভর বা স্থিতি শক্তিকে রাসায়নিক ও নিউক্লিয় বিক্রিয়ার ফলে গতিশক্তিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব, আর সেটা করে আমরা ইঞ্জিন চালাতে পারি, কিংবা বোমা মেরে সব উড়িয়ে দিতে পারি।

সুতরাং আমরা বুঝতে পারলাম মহাবিশ্বের ভরের উপস্থিতি কোনো ধরনের প্রাকৃতিক নিয়মের লঙ্ঘন করে না। শক্তি থেকে ভর উৎপত্তি সম্ভব একই সাথে ভরের শক্তিতে রূপান্তর হওয়াটাও একেবারে প্রাকৃতিক একটি ব্যাপার। সুতরাং ভর সৃষ্টিজনিত কোনো মিরাকল বা অলৌকিক ঘটনার প্রয়োজন মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় ছিল না। কিন্তু আদিতে শক্তি ভবে এলো কোথা থেকে?

শক্তির নিত্যতা সূত্র বা তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র অনুযায়ী আমরা জানি শক্তিকে অন্য কোথাও থেকে আসতে হবে। ধর্মের সৃষ্টিবাণী সত্য হবে যদি তাত্ত্বিকভাবে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় যে, আজ থেকে তেরো দশমিক সাত বিলিয়ন বছর পূর্বে বিগব্যাং-এর শুরুতে শক্তির নিত্যতার সূত্রের লঘন ঘটেছিল।

কিন্তু পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে তাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মোটেও ব্যাপারটি এমন নয়। তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র অনুযায়ী একটি বদ্ধ সিস্টেমে মোট শক্তির পরিমাপ স্থির থাকলেই কেবল শক্তি এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়। দারুণ মজার ব্যাপার হচ্ছে, মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ শূন্য[১৪৮]! বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তার ১৯৮৮ সালে সর্বাধিক বিক্রিত বই, কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বা A Brief History of Time এ উল্লেখ করেছেন, যদি এমন একটা মহাবিশ্ব ধরে নেওয়া যায়, যেটা মহাশূন্যে মোটামুটি সমসত্ব, তাহলে দেখানো সম্ভব, যে ঋণাত্মক মহাকর্ষীয় শক্তি এবং ধনাত্মক মহাকর্ষীয় শক্তি ঠিক ঠিক কাটাকাটি যায়। তাই মহাবিশ্বের মোট শক্তি থাকে শূন্য[১৪৯]। বিশেষ করে, পরিমাপের অতি সূক্ষ বিচ্যুতি ধরে নিলেও, ক্ষুদ্র কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তার মধ্যে, মহাবিশ্বের গড় শক্তির ঘনত্ব ঠিক ততটাই পাওয়া যায়, যতটা থাকা উচিৎ সবকিছু একটা শূন্য-শক্তির আদি অবস্থা থেকে শুরু হলে।[১৫০]

ধনাত্মক ও ঋণাত্মক শক্তির এই ভারসাম্যের কথা নিশ্চিত করে বিগব্যাং তত্ত্বের বর্তমান পরিবর্ধিত রূপ ইনফ্লেশনারি বিগব্যাং ধারণার সত্যতা[১৫১]। ইনফ্লেশন থিওরি প্রস্তাব করার পর একে নানাভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। যে কোনো পরীক্ষায় ব্যর্থ বা ভুল ফলাফল প্রদানই এই তত্ত্বকে বাতিল করে দেবার জন্য ছিলো যথেষ্ট। কিন্তু এটি সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে বলেই গবেষকেরা মনে করেন। [১৫২]

সংক্ষেপে মহাবিশ্বে পদার্থ ও শক্তির উপস্থিতি কোনো ধরনের প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে সাংঘর্ষিক না। ধর্মীয় সৃষ্টিবাণীগুলো এই মহাবিশ্বের সৃষ্টির পেছনে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের কাল্পনিক গালগপ্প ফেঁদে বসেছে। কিন্তু বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক তত্ব এবং পর্যবেক্ষণগুলো আমাদের দেখাচ্ছে কারও হস্তক্ষেপ নয় বরং একদম প্রাকৃতিকভাবেই এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি হওয়া সম্ভব।

এই উদাহরণের মাধ্যমে আরেকটি বিষয়েও আলোকপাত করা যায়। অনেকেই বলে থাকেন, বিজ্ঞানের ঈশ্বর সম্বন্ধে কিছু বলার সামর্থ্য বা সাধ্য নেই। যদি দেখা যেত, বিজ্ঞানীদের গণনাকৃত ভর-ঘনত্বের (mass density) মান মহাবিশ্বকে একদম শূন্য শক্তি অবস্থা (state of zero energy) থেকে উদ্ভূত হতে যা প্রয়োজন তার মতো আসে নি, সেক্ষেত্রে আমরা নির্দ্বিধায় ধরে। নিতে পারতাম, এখনে অন্য কারও হাত ছিল। সেক্ষেত্রে এমন ধারণা করাটা হতো বিজ্ঞানসম্মত সুকুমার আচরণ। এর ফলে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ না হলেও তিনি যে আছেন বা থাকতে পারেন সেটা একটি ভালো ভিত্তি পেত।

.

শৃঙ্খলার সূচনা

সৃষ্টিবাদের আরেকটি অনুমানও প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের সাথে মেলে না। যদি। মহাবিশ্বকে সৃষ্টিই করা হয়ে থাকে তাহলে সৃষ্টির আদিতে এর মধ্যে কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা থাকবে] একটি নকশা থাকবে যেটার নকশাকার স্বয়ং স্রষ্টা। এই যে আদি শৃঙ্খলা, এটার সম্ভাব্যতাকে সাধারণত প্রকাশ করা হয় তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের আকারে। এই সূত্রমতে, কোনো একটা আবদ্ধ সিস্টেমের সবকিছু হয় একইরকম সাজানো-গোছানো থাকবে (এন্ট্রপি স্থির) অথবা সময়ের সাথে সাথে বিশৃঙ্খল হতে থাকবে (অর্থাৎ এন্ট্রপি বা বিশৃঙ্খলা বাড়তেই থাকবে)। একটি সিস্টেমের এই বিক্ষিপ্ততা কমানো যেতে পারে শুধু বাইরে থেকে যদি কেউ সেটাকে গুছিয়ে দেয় তখন। তবে বাইরে থেকে কোনো কিছু সিস্টেমকে প্রভাবিত করলে সেই সিস্টেম আর আবদ্ধ সিস্টেম থাকে না।

তাপগতিবিদ্যার এই দ্বিতীয় সূত্রটি প্রকৃতির অন্যতম একটি মৌলিক সূত্র, যার কখনো অন্যখা হয় না। কিন্তু আমরা চারপাশে তাকালে এলোমেলো অনেক কিছুর সাথে সাথে সাজানো গোছানো অনেক কিছুই দেখি। আমরা একধরনের শৃঙ্খলা দেখতে পাই যেটা প্রকৃতির নিয়মেই (তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র) দিনে দিনে বিশৃঙ্খল হচ্ছে (যেমন তেজস্ক্রিয় পরমাণু ভেঙে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, অথবা ক্ষয়ে যেতে থাকে পুরনো প্রাসাদ)। তার মানে সৃষ্টির আদিতে নিশ্চয়ই সবকিছুকে একরকম ‘পরম শৃঙ্খলা’ দেওয়া হয়েছিল। প্রকৃতির সকল ক্রিয়া-বিক্রিয়া তাপগতিবিদ্যা মেনে সেই শৃঙ্খলাকে প্রতিনিয়ত বিশৃঙ্খল করে চলেছে। তাহলে শুরুতে এই শৃঙ্খলার সূচনা করল কে?

কে আবার? নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা! ১৯২৯-এর আগ পর্যন্ত সৃষ্টিবাদের পেছনে এটাই ছিল অলৌকিক সৃষ্টিবাদীদের এটা একটা শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক যুক্তি ছিল। কিন্তু সে বছর জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল পর্যবেক্ষণ করলেন যে গ্যালাক্সিসমূহ একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে নিজেদের দূরত্বের সমানুপাতিক হারে। অর্থাৎ দুইটা গ্যালাক্সির পারস্পরিক দূরত্ব যত বেশি, একে অপর থেকে দূরে সরে যাওয়ার গতিও তত বেশি। এই পর্যবেক্ষণই বিগ ব্যাং তত্ত্বের সর্বপ্রথম আলামত। আর আমরা জানি, একটা প্রসারণশীল মহাবিশ্ব চরম বিশৃঙ্খলা থেকে শুরু হলেও এর মধ্যে আঞ্চলিক শৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ সবকিছু এলোমেলোভাবে শুরু হলেও তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রকে ভঙ্গ না করেও প্রসারণশীল কোনো সিস্টেমের কোনো কোনো অংশে শৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব।

ব্যাপারটাকে একটা গৃহস্থালির উঠানের উদাহরণ দিয়ে বর্ণনা করা যায়। ধরুন, যখনই আপনি আপনার বাড়ি পরিষ্কার করেন তখন জোগাড় হওয়া ময়লাগুলো জানালা দিয়ে বাড়ির উঠানে ফেলে দেন। এভাবে যদিও দিনে দিনে উঠানটা ময়লা-আবর্জনায় ভরে যেতে থাকে, ঘরটা কিন্তু সাজানো-গোছানো ও পরিষ্কারই থাকে। এভাবে বছরের পর বছর চালিয়ে যেতে হলে যেটা করতে হবে উঠান সব আবর্জনায় ভরে গেলে আশপাশের নতুন জমি কিনে ফেলতে হবে। তারপর সেসব জমিকেও ময়লা ফেলার উঠান হিসেবে ব্যবহার করলেই হলো। তার মানে এভাবে আপনি আপনার ঘরের মধ্যে একটা আঞ্চলিক শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারছেন কিন্তু এর জন্য বাদবাকি জায়গায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে।

একইভাবে মহাবিশ্বের একটি অংশে শৃঙ্খলা রক্ষা করা যেতে পারে, যদি সেখানে সৃষ্ট এন্ট্রপি (বিশৃঙ্খলা) ক্রমাগতভাবে বাইরের সেই চিরবর্ধনশীল মহাশূন্যে ছুড়ে দেওয়া হয়। ওপরের চিত্রে আমরা দেখি, মহাবিশ্বের সার্বিক বিশৃঙ্খলা তাপগতিবিদ্যা মেনেই ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে[১৫৩]। কিন্তু মহাবিশ্বের আয়তনও আবার বাড়ছে ক্রমাগত। সেই বর্ধিত আয়তন (স্পেস)–কে পুরোপুরি বিশৃঙ্খলা ভরে ফেলতে যে বাড়তি এন্ট্রপি লাগত সেটাই হচ্ছে আমাদের সর্বোচ্চ-সম্ভাব্য-বিশৃঙ্খলা। কিন্তু ওপরের ছবি থেকেই আমরা দেখি বাস্তবে বিশৃঙ্খলার বৃদ্ধির হার ততটা নয়। আর বিশৃঙ্খলার অনুপস্থিতি মানেই শৃঙ্খলা। তাই এই বাড়তি স্থানে অনিবার্যভাবেই শৃঙ্খলার উদ্ভব হচ্ছে, এবং সেটা তাপগতিবিদ্যার কোনো সূত্রকে ভঙ্গ না করেই।

ব্যাপারটাকে এভাবে দেখা যায়। আমরা জানি, কোনো একটা গোলকের (আমরা এখানে মহাবিশ্বকে গোলক কল্পনা করছি) এপি যদি সর্বোচ্চ হয় তাহলে সেই গোলকটা কৃষ্ণগহ্বরে (Black hole) পরিণত হয়। অর্থাৎ ঐ গোলকের আয়তনের একটা ব্ল্যাক হোলই হচ্ছে একমাত্র বস্তু যার এন্ট্রপি ঐ আয়তনের জন্য সর্বোচ্চ। কিন্তু আমাদের এই ক্রমপ্রসারণশীল মহাবিশ্ব তো পুরোটাই একটা কৃষ্ণগহ্বর নয়। তার মানে মহাবিশ্বের এন্ট্রপি (বিশৃঙ্খলা) সম্ভাব্য-সর্বোচ্চের চেয়ে কিছুটা হলেও কম। অর্থাৎ সময়ের সাথে সাথে যদিও বিশৃঙ্খলা বাড়ছে ক্রমাগত, তার পরও আমাদের মহাবিশ্ব। এখনো সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল নয়। কিন্তু একসময় ছিল। একদম শুরুতে।

ধরুন, যদি আমরা মহাবিশ্বের এই প্রসারণকে পেছনের দিকে ১৩৪০ কোটি বছর ফিরিয়ে নিয়ে যাই তাহলে আমরা পৌঁছুব সংজ্ঞাযোগ্য একদম আদিতম সময়ে অর্থাৎ প্লাঙ্ক সময় ৬.৪ x ১০-৪৪ সেকেন্ডে যখন মহাবিশ্ব ছিল ততটাই ক্ষুদ্র যার চেয়ে ক্ষুদ্রতম কিছু স্পেসে থাকতে পারে না। এটাকে বলা হয় প্লাঙ্ক গোলক যার ব্যাসার্ধ হচ্ছে প্লাঙ্ক দৈর্ঘ্যের (১. ৬x১০ ৩৫ মিটার) সমান। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র থেকে যেমন অনুমান করা হয় তখন মহাবিশ্বের মোট এন্ট্রপি এখনকার মোট এন্ট্রপির চেয়ে। তেমনভাবেই কম ছিল। অবশ্য প্লাঙ্ক গোলকের মতো একটা ক্ষুদ্রতম গোলকের পক্ষে সর্বোচ্চ যতটা এন্ট্রপি ধারণ করা সম্ভব তখন মহাবিশ্বের এন্ট্রপি ঠিক ততটাই ছিল। কারণ একমাত্র কোনো ব্ল্যাক হোলের পক্ষেই প্লাঙ্ক গোলকের মতো এতটা ক্ষুদ্র আকার ধারণ করা সম্ভব। আর আমরা জানি, ব্ল্যাক হোলের এপি সব সময়ই সর্বোচ্চ।

ছবি। পেজ ১৭৬

চিত্র: এখানে মহাবিশ্বের সর্বমোট-এন্ট্রপি এবং সর্বোচ্চ-সম্ভাব্য-এপিকে মহাবিশ্বের ব্যাসার্ধের ফাংশন আকারে আঁকা হয়েছে। আমাদের মহাবিশ্ব সব সময়ই নিচের রেখা বরাবর প্রসারিত হবে, এবং সেটাই হচ্ছে। কিন্তু নিচের রেখাঁটি কেবল একটা সময়েই ওপরের রেখার সাথে মিলে যাবে সেটা হচ্ছে মহাবিশ্বের উদ্ভবের সময় (প্লাঙ্ক সময়ে)। নিচের মহাবিশ্বের প্রকৃত এন্ট্রপি সূচক রেখাঁটি ওপরের রেখার (যেটি মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ এন্ট্রপি সূচক) সাথে মিলে যাবার অর্থ হলো, সূচনালগ্নে মহাবিশ্বের এন্ট্রপি ছিল। সর্বোচ্চ। কিন্তু যেহেতু মহাবিশ্ব ক্রমপ্রসারমাণ, তাই মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ এন্ট্রপি তার প্রকৃত এন্ট্রপির চেয়ে দ্রুত হারে বাড়ছে, আর তার ফলে বাড়তি স্থানে মহাবিশ্বের কোনো কোনো অংশে শৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে, তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র ভঙ্গ না করেই (ছবির উৎস: ভিক্টর স্টেঙ্গর, গড দ্য ফেইল্ড হাইপোথিসিস, ২০০৭)।

অনেকে এই তত্ব শুনে অনেক সময়ই যে আপত্তি জানান সেটা হলো, ‘আমাদের হাতে এখনো প্লাঙ্ক সময়ের পূর্বের ঘটনাবলির ওপর প্রয়োগ করার মতো কোনো কোয়ান্টাম মহাকর্ষের তত্ব নেই। আমরা যদি সময়ের। আইনস্টাইনীয় সংজ্ঞাটাই গ্রহণ করি, মানে ঘড়ির সাহায্যে যেটা মাপা হয়। তাহলে দেখা যায় প্লাঙ্ক সময়ের চেয়ে ক্ষুদ্রতম সময়ের ব্যাপ্তি মাপতে হলে আমাদের প্লাষ্ণ দৈর্ঘ্যের চেয়ে ক্ষুদ্রতম দৈর্ঘ্যে মাপজোক করতে হবে। যেখানে প্লাঙ্ক দৈর্ঘ্য হচ্ছে প্লাঙ্ক সময়ে আলো যে পথ অতিক্রম করে তার দৈর্ঘ্য। অর্থাৎ আলোর গতি ও প্লাঙ্ক সময়ের গুণফল। কিন্তু হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি থেকে আমরা জানি, কোনো বস্তুর অবস্থান যত সূক্ষভাবে মাপা হয় তার শক্তির সম্ভাব্য মান ততই বাড়তে থাকে। এবং গাণিতিক হিসাব থেকে দেখানো যায় প্লাঙ্ক দৈর্ঘ্যের সমান কোনো বস্তুকে পরিমাপযোগ্যভাবে অস্তিত্বশীল হতে হলে তার শক্তি এতটাই বাড়তে হবে যে সেটা তখন একটা ব্ল্যাক হোলে পরিণত হবে। যে ব্ল্যাক হোল থেকে কোনো তথ্যই বের হতে পারে না। এখান থেকে বলা যায় প্লাঙ্ক সময়ের চেয়ে ক্ষুদ্রতম কোনো সময়ের বিস্তার সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়।[১৫৪]

বর্তমান সময়ের কথা চিন্তা করুন। পদার্থবিজ্ঞানের কোনো প্রতিষ্ঠিত সূত্র প্রযোগেই আমাদের দ্বিধার কিছু নেই যতক্ষণ না আমরা প্লাঙ্ক সময়ের চেয়ে ক্ষুদ্র বিস্তারের কোনো সময়ের জন্য এটার প্রয়োগ করছি। মূলত সংজ্ঞা অনুযায়ী সময়কে গণনা করা হয় প্লাঙ্ক সময়ের পূর্ণ সংখ্যার গুণিতক হিসেবে। আমরা আমাদের গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে সময়কে একটা ক্রমিক চলক হিসেবে ধরে পার পেয়ে যাই, কারণ সময়ের এই ক্ষুদ্র অবিভাজ্য একক এতই ছোট যে ব্যবহারিক ক্যালকুলাসে আমাদের এর কাছাকাছি আকারের কিছুই গণনা করতে হয় না। আমাদের সূত্রগুলো প্লাঙ্ক সময়ের মধ্যেকার অংশগুলো দিয়ে এক্সট্রাপোলেটেড হয়ে যায় যদিও এই পরিসীমার মধ্যে কিছু পরিমাপ অযোগ্য এবং অসংজ্ঞায়িত হিসেবে থেকে যাবে। এভাবে এক্সট্রাপোলেট যেহেতু আমরা এখন’ করতে পারি, সেহেতু নিশ্চয় বিগ ব্যাং এর শুরুতে প্রথম প্লাঙ্ক পরিসীমার শেষেও করতে পারব।

সেই সময়ে আমাদের এক্সট্রাপোলেশনের হিসাব থেকে আমরা জানি যে তখন এপি ছিল সর্বোচ্চ[১৫৫]। এর মানে সেখানে ছিল শুধু ‘পরম

বিশৃঙ্খলা। অর্থাৎ, কোনো ধরনের শৃঙ্খলারই অস্তিত্ব ছিল না। তাই, শুরুতে মহাবিশ্বে কোনো শৃঙ্খলাই ছিল না। এখন আমরা মহাবিশ্বে যে শৃঙ্খলা দেখি তার কারণ, এখন বর্ধিত আয়তন অনুপাতে মহাবিশ্বের এন্ট্রপি সর্বোচ্চ নয়।

সংক্ষেপে বললে, আমাদের হাতের কসমোলজিক্যাল উপাত্ত মতে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে কোনো ধরনের শৃঙ্খলা, পরিকল্পনা বা নির্মাণ ছাড়াই। শুরুতে ছিল শুধুই বিশৃঙ্খলা

বাধ্য হয়েই আমাদের বলতে হচ্ছে যে আমরা চারপাশে যে সূক্ষাতিসূক্ষ শৃঙ্খলা দেখি তা কোনো আদি স্রষ্টার দ্বারা সৃষ্ট নয়। বিগ ব্যাং-এর আগে কী হয়েছে তার কোনো চিহ্নই মহাবিশ্বে নেই। এবং সৃষ্টিকর্তার কোনো কাজের চিহ্নই বা তার কোনো নকশাই এখানে বলব নেই। তাই তার অস্তিত্বের ধারণাও অপ্রয়োজনীয়।

আবারও আমরা কিছু বৈজ্ঞানিক ফলাফল পেলাম যেগুলো একটু অন্যরকম হলেই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রমাণ হয়তো হতে পারত। যেমন মহাবিশ্ব যদি ক্রমপ্রসারণশীল না হয়ে স্থির আকৃতির হতো (যেমনটা বাইবেল বা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলো বলে) তাহলেই তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র মতে আমরা দেখতাম সৃষ্টির আদিতে এন্ট্রপির মান সর্বোচ্চ-সম্ভাব্য এন্ট্রপির চেয়ে কম ছিল। তার মানে দাঁড়াত মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে খুবই সুশৃঙ্খল একটা অবস্থায় যে শৃঙ্খলা আনা হয়েছে বাইরে থেকে। এমনকি পেছনের দিকে অসীম অতীতেও যদি মহাবিশ্বের অস্তিত্ব থাকত তাহলে আমরা যতই পেছনে যেতাম দেখতাম সবকিছুই ততই সুশৃঙ্খল হচ্ছে এবং আমরা একটা পরম শৃঙ্খলার অবস্থায় পৌঁছে যেতাম যে শৃঙ্খলার উৎস। সকল প্রাকৃতিক নিয়মকেই লঙ্ঘন করে।

.

মহাবিশ্বের সূচনা

বিগব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে এই মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারের পর ধর্মবেত্তারা বলা শুরু করেছেন এই আবিষ্কারের ফলেই প্রমাণিত হলো ঈশ্বর আছেন, তাদের ধর্মগ্রন্থে আছে বিগব্যাং-এর কথা!

১৯৭০ সালে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এবং গণিতবিদ রজার পেনরোজ, পেনরোজের আগের একটি উপপাদ্যের আলোকে প্রমাণ করেন যে, বিগব্যাং-এর শুরুতে ‘সিংগুলারিটি’-র অস্তিত্ব ছিল[১৫৬]। সাধারণ আপেক্ষিকতাকে শূন্য সময়ের আলোকে বিবেচনা করার মাধ্যমে দেখা যায় যে, বর্তমান থেকে পেছনে যেতে থাকলে মহাবিশ্বের আকার ক্রমশ ছোট এবং ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। পেছনে যেতে যেতে যখন মহাবিশ্বের আকার শূন্য হয় তখন সাধারণ আপেক্ষিকতার গণিত অনুযায়ী এর ঘনত্ব হয় অসীম। মহাবিশ্ব তখন অসীম ভর ও ঘনত্ব বিশিষ্ট একটি বিন্দু যার নাম ‘পয়েন্ট অফ সিংগুলারিটি’ বা অদ্বৈত বিন্দু ধর্মবেত্তাদের মধ্যে যারা বিগব্যাংকে ঈশ্বরের কেরামতি হিসেবে ফুটিয়ে তুলতে চান তারা বলেন, তখন সময় বলেও কিছু ছিল না।

তারপর থেকে এভাবেই চলছে। বিগব্যাং-এর আগে অসীম ভর ও ঘনত্বের বিন্দুতে সবকিছু আবদ্ধ ছিল, তখন ছিল না কোনো সময়। তারপর ঈশ্বর ফুঁ দানের মাধ্যমে এক মহাবিস্ফোরণ ঘটান, সূচনা হয় মহাবিশ্বের, সূচনা হয় সময়েরা আমেরিকার রক্ষণশীল লেখক দিনেশ ডি’সুজা তার একটি বইয়ে বলেছেন, ‘বুক অব জেনেসিস যে ঈশ্বরপ্রদত্ত মহাসত্য গ্রন্থ সেটা আরেকবার প্রমাণিত হলো। আধুনিক বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছিল শক্তি ও আলোর এক বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। এমন না যে, স্থান ও সময়ে মহাবিশ্বের সূচনা ঘটেছে, বরং মহাবিশ্বের সূচনা ছিল সময় ও স্থানেরও সূচনা[১৫৭]। ডি’সুজা আরও বলেন, ‘মহাবিশ্বের সূচনার আগে সময় বলে কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। অগাস্টিন অনেক আগেই লিখেছিলেন, মহাবিশ্বের সূচনার ফলে সময়ের সূচনা হয়েছিল। এতদিনে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান নিশ্চিত করল, অগাস্টিন এবং ইহুদি, খ্রিষ্টানদের মহাবিশ্বের সূচনা সম্পর্কে আদিম উপলব্ধির সত্যতা’[১৫৮]। একই ধরনের কথা মুসলিম জগতের জনপ্রিয় ‘দার্শনিক’ হারুন ইয়াহিয়াও (আসল নাম আদনান অকতার; যার নামে বিবর্তন তত্ত্বকে বিকৃত করে সৃষ্টিবাদের রূপকথা প্রচার, নারী ধর্ষণ, মাদক চোরাচালানসহ বহু অভিযোগ আছে, এবং তাকে বিভিন্ন সময় কারাবাসেও যেতে হয়েছিল[১৫৯]) বলেছেন একাধিকবার, প্রাচ্যের খ্রিষ্টীয় সৃষ্টিবাদীদের ধারণাগুলোর পর্যাপ্ত ‘ইসলামীকরণ” করে:

 ‘বিজ্ঞানীরা এখন জানেন, মহাবিশ্বের উদ্ভব ঘটেছে সিংগুলারিটি থেকে এক অচিন্তনীয় মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে, যাকে আমরা বিগ ব্যাং নামে চিনি। অন্য কথায় মহাবিশ্ব সৃষ্ট হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহই একে বানিয়েছে।

ইসলামি পণ্ডিত জাকির নায়েকও প্রায়ই তার বিভিন্ন লেকচারে কোরআনের একটি বিশেষ আয়াতকে বিগ ব্যাং-এর প্রমাণ হিসেবে হাজির করেন।[১৬০] ডি’সুজা, হারুন ইয়াহিয়া, আর জাকির নায়েকরা সুযোগ পেলেই এভাবে বিগ ব্যাং-এর সাথে নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থের আয়াত জুড়ে দিয়ে এর

একটা অলৌকিক মহিমা প্রদান করতে চান। কিন্তু আদতে বিজ্ঞানের এই আবিষ্কার প্রাচীন এ সমস্ত ধর্মগ্রন্থের সত্যতার কোনো রকমের নিশ্চয়তা তো দেয়ই না, বরং এই ধর্মগ্রন্থ এবং আরও অনেক ধর্মগ্রন্থে থাকা সৃষ্টির যে গল্প এত দিন ধার্মিকেরা বিশ্বাস করে এসেছেন তা কতটা ভুল এবং অদ্ভুত সেটাই প্রমাণ করে।[১৬১]

যাই হোক, সিংগুলারিটির কথা বলে ধর্মবেত্তাদের ভেতরে গভীর সাড়া ফেলা স্টিফেন হকিং এবং পেনরোজ প্রায় বিশ বছর আগে ঐক্যমতে। পৌঁছান যে, বাস্তবে সিংগুলারিটি নামের কোনো পয়েন্টের অস্তিত্ব ছিল না এবং নেই। সাধারণ আপেক্ষিকতার ধারণায় হিসাব করলে অবশ্য তাদের আগের হিসেবে কোনো ভুল ছিল না। কিন্তু সেই ধারণায় সংযুক্ত হয় নি কোয়ান্টাম মেকানিক্স। আর তাই সেই হিসাব আমলে নেওয়া যায় না। ১৯৪৮ সালে হকিং এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম বইতে বলেন, ‘There was in fact no singularity at the beginning of universe. অর্থাৎ মহাবিশ্বের সূচনার সময়ে সিংগুলারিটির অস্তিত্ব ছিল না।[১৬২]

ডি’সুজা, হারুন ইয়াহিয়া কিংবা জাকির নায়েকের মতো মানুষেরা ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ বইটিতে একনজর চোখ বুলিয়েছেন সেটা সত্যি। কিন্তু পড়ে বোঝার জন্য নয়। তাঁরা খুঁজেছেন তাঁদের মতাদর্শের সাথে যায় এমন একটি বাক্য এবং সেটা পেযেই বাকি কোনো দিকে নজর না দিয়ে লাফিয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন সময় হকিংকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে একটা বিন্দু (সিংগুলারিটি) থেকে বিগ ব্যাং-এর মাধ্যমে[১৬৩]। তাঁরা মূলত হকিং-এর কথার আংশিক উদ্ধৃত করেন, মূল বিষয়টা চেপে গিযে। উদ্ধৃতির সামনের পেছনের বাকি বাক্যগুলোকে উপেক্ষা করার মাধ্যমে এমন একটি অর্থ তাঁরা দাঁড় করান, যা আসলে হকিংযের মতের ঠিক উল্টো। হকিং আসলে বলছিলেন তাঁদের ১৯৭০-এ করা প্রাথমিক এক হিসাবের কথা, যেখানে তাঁরা সিংগুলারিটির কথা আলোচনা করেছিলেন। সম্পূর্ণ কথাটি ছিল এমন] ‘আমার ও পেনরোজের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল ১৯৭০ সালে একটি যুগ্ম প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রথম প্রকাশিত হয়, যেখানে আমরা প্রমাণ করে দেখাই যে, বিগ। ব্যাং-এর আগে অবশ্যই সিংগুলারিটির অস্তিত্ব ছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয়, এবং এ-ও ধরে নেওয়া হয় যে, বর্তমানে মহাবিশ্বে যেই পরিমাণ পদার্থ রয়েছে আগেও তাই ছিল[১৬৪]। হকিং আরও বলেন–

এক সময় আমাদের (হকিং এবং পেনরোস) ভত্ব সবাই গ্রহণ করে নিল এবং আজকাল দেখা যায় প্রায় সবাই এটা ধরে নিচ্ছে যে মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে একটা বিন্দু (সিংগুলারিটি) থেকে বিগব্যাং-এর মাধ্যমে। এটা হয়ত একটা পরিহাস যে এ বিষয়ে আমার মত পাল্টানোর পরে আমিই অন্য পদার্থবিজ্ঞানীদের আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করছি, যে এমন কোনো সিংগুলারিটি আসলে ছিল না-কারণ, কোয়ান্টাম ইফেক্টগুলো হিসেবে ধরলে এই সিংগুলারিটি আর থাকে না।[১৬৫]

অথচ ধর্মবেত্তারা আজ অবধি সেই সিংগুলারিটি পয়েন্টকে কেন্দ্র করে স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণবিষয়ক অসংখ্য বই লিথে চলছেন। বছর খানেক আগে প্রকাশিত বইয়ে র‍্যাভি জাকারিয়াস বলেন, ‘আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের পাশাপাশি বিগব্যাং তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা এখন নিশ্চিত-সবকিছুর অবশ্যই একটি সূচনা ছিল। সকল ডাটা আমাদের এই উপসংহার দেয় যে, একটি অসীম ঘনধের বিন্দু থেকেই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ শুরু হয়েছিল[১৬৬]।

স্টিফেন হকিংয়ের প্রথম প্রবন্ধ এত ভালোভাবে পড়লেও পরবর্তীকালে আর কিছু পড়ে দেখার ইচ্ছে হয়ত তাদের হয় নি। কিংবা পড়লেও নিজেদের মতের সাথে মেলে না বলে তারা সেটা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে বের করে দিয়েছেন আরেক কান দিয়ে। তারা অবিরাম ঘেঁটে চলছেন সেই পুরনো কাসুন্দি, যেই কাসুন্দি আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছেন কাসুন্দি প্রস্তুতকারী মানুষটি নিজেই।

 ‘বিগব্যাং তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিক সমাজে গৃহীত হওয়ার পর ১৯৫১ সালে Pope Pius XII পন্টিফিক্যাল অ্যাকাডেমির সভায় ঘোষণা করেছিলেন–

যদি সৃষ্টির শুরু থাকে, তবে অবশ্যই এই সৃষ্টির একজন স্রষ্টাও রয়েছে, আর সেই স্রষ্টাই হলেন ঈশ্বর।

এই কারণেই জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং ধর্মযাজক জর্জ হেনরি লেমিত্রি (যিনি ‘বিগব্যাং’ প্রতিভাসের একজন অন্যতম প্রবক্তা) পোপকে সেসময় বিনযের সঙ্গে এধরনের যুক্তিকে ‘অভ্রান্ত হিসেবে প্রচার করা থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কেন দিয়েছিলেন সেটা এখন আমরা ঠিকই বুঝতে পেরেছি। পোপ বুঝতে পারেন নি, আর তাই এখন পোপের সময় এসেছে ঈশ্বরের বাণীকে পরিবর্তন করে বিগব্যাং-এর মূল বিষয়ের সাথে ধর্মগ্রন্থকে খাপ খাওয়ানোর।

.

প্রাকৃতিকভাবে কীভাবে মহাবিশ্বের সূচনা হতে পারে

মহাবিশ্বের একটি সূচনা থাকতেই হবে এমন কিন্তু কোনো কথা নেই। একে পেছনে সীমাহীন অনন্ত সময় পর্যন্ত টেনে নেওয়া সম্ভব, যেমন সম্ভব সামনের দিকে অনন্ত সময় পর্যন্ত যাওয়া অর্থাৎ এর কোনো ধ্বংসও নেই। আজ থেকে হাজার কোটি বছর পরে হতে পারে মহাবিশ্বের আর কোনো প্রাণ। তো দূরের কথা জীবজগতের হয়তো কিছুই অবশিষ্ট রইবে না, কিন্তু নিউট্রিনো দিয়ে তৈরি একটা ঘড়ি কিন্তু তখনও চলবে-টিক টিক করে। আর লিন্ডের ‘চিরন্তন’ স্ফীতি ভত্ব, যেটাকে এই মুহূর্তে মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগামী তত্ব হিসেবে বিবেচনা হয়, সেটি ‘মহাবিশ্বের সূচনা’ কে খুব জোরেশোরে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে বলা যায়। তার তত্ব অনুযায়ী এ ধরনের স্ফীতি অবিরামভাবে স্ব-পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে প্রতি মুহূর্তেই তৈরি করছে এবং করবে নতুন নতুন মহাবিশ্ব। এই প্রক্রিয়া অনন্তকাল ধরে অতীতে যেমন চলেছে,ভবিষ্যতেও চলবে অবিরামভাবেই[১৬৭]।

সে হিসেবে ১৪০০ কোটি বছর আগে ঘটা বিগ ব্যাং আমাদের মহাবিশ্বের শুরু হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও অন্য সব মহাবিশ্বের জন্য সেটি ‘শুরু’ নয়। আসলে এই অনন্ত মহাবৈশ্বিক সিস্টেমের কোনো শুরু নেই,শেষও নেই। আজ থেকে ১০০ বিলিয়ন কিংবা ১০০ ট্রিলিয়ন বছর আগে কিংবা পরে যে সময়েই যাওয়া হোক না কেন, স্ফীতির মাধ্যমে ‘মাল্টিভার্স’ তৈরির চলমান প্রক্রিয়া অতীতে যেমন ছিল, ভবিষ্যতেও তেমনি থাকবে। আর এটা গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে খুবই সম্ভব।[১৬৮]

মাল্টিভার্সের ব্যাপারটি যদি বাদও দেই, কেবল আমাদের মহাবিশ্বকে গোনায় ধরলেও এর সূচনার ক্ষেত্রেও অতিপ্রাকৃতিক কোন কিছুর কাছে দ্বারস্থ হবার কোন প্রয়োজন আমাদের নেই। স্রেফ প্রাকৃতিক উপায়েই মহাবিশ্বের সূচনা সম্ভব। প্রাকৃতিক উপায়ে অর্থাৎ, ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের মধ্য দিয়ে শূন্য থেকে মহাবিশ্ব থেকে উৎপন্ন হতে পারে এ ধারণাটি এ ধারণাটি প্রথম ব্যক্ত করেছিলেন নিউ ইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এডওয়ার্ড ট্রিয়ন ১৯৭৩ সালে ‘নেচার’ নামক বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জার্নালে[১৬৯]। কেন এভাবে, মানে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে মহাবিশ্বের উদ্ভব ঘটল? এর উত্তরে ট্রিয়ন বলেছিলেন, ‘আমি এক্ষেত্রে একটা বিনয়ী প্রস্তাবনা হাজির করতে চাই যে, আমাদের মহাবিশ্ব হচ্ছে এমন একটি জিনিস যেটা কিনা সময় সময় উদ্ভূত হয়। তবে ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিত। ‘ইজ দ্য ইউনিভার্স এ ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন’ শিরোনামের সেই প্রবন্ধে যেভাবে মহাবিশ্ব উৎপত্তি হয়েছে বলে ট্রিয়ন ধারণা করেছিলেন, তাতে কিছু সমস্যা ছিল। প্রথমত: এই প্রক্রিয়ায় ১৪০০ কোটি বছর আগেকার মহাবিশ্বের উদ্ভবের সম্ভাবনাটি খুবই কম। কারণ ফ্লাকচুয়েশনগুলো সাধারণত। হয় খুবই অস্থায়ী। সে হিসাবে একটি ফ্লাকচুয়েশন প্রায় ১৪০০ কোটি বছর। টিকে থাকার সম্ভাবনা প্রায় অসম্ভব ব্যাপারই বলতে হবে। আসলে ফ্লাকচুয়েশনের স্থায়িত্ব বা জীবনকাল নির্ভর করে এর ভরের ওপর ভর যত বড় হবে, ফ্লাকচুয়েশনের জীবনকাল তত কম হবে। দেখা গেছে একটি ফ্লাকচুয়েশনকে তের শ কোটি বছর টিকে থাকতে হলে এর ভর ১০-৬৫ গ্রামের চেয়েও ছোট হতে হবে, যা একটি ইলেকট্রনের ভরের ১০৩৮  গুণ ছোট। আর দ্বিতীয়ত এই মহাবিশ্ব যদি শূন্যাবস্থা (empty space) থেকে উৎপত্তি হয়ে থাকে, তবে প্রশ্ন থেকে যায়, আদিতে সেই শূন্যাবস্থাই বা এল কোথা থেকে (আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী, স্পেস বা শূন্যাবস্থাকে দেশকালের বক্রতার পরিমাপে প্রকাশ করা হয়। প্রথম সমস্যাটির সমাধান ট্রিয়ন নিজেই দিয়েছিলেন। ট্রিষন আপেক্ষিক তত্ব বিশেষজ্ঞদলের (যেমন পদার্থবিদ পিটার বার্গম্যান) সাথে সে সময়ই আলোচনা করে বুঝেছিলেন, একটি আবদ্ধ মহাবিশ্বে ঋণাত্মক মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ধনাত্মক ভর শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। অর্থাৎ মহাবিশ্বে মোট শক্তির পরিমাণ (এবং এই শক্তির সমতুল্য পদার্থের পরিমাণ) শূন্য[১৭০]। সে হিসেবে প্রায় ভরশূন্য অবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করলে একটি ফ্লাকচুয়েশন প্রায় অসীম কাল টিকে থাকবে।

১৯৮২ সালে আলেকজান্ডার ভিলেঙ্কিন (Alexander Vilenkin) দ্বিতীয় সমস্যাটির একটি সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেন এভাবে: মহাবিশ্ব সৃষ্ট হয়েছে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মধ্য দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই ‘শূন্য’ থেকে, তবে এই শূন্যাবস্থা শুধু ‘পদার্থবিহীন’ শূন্যাবস্থা নয়, বরং সেইসাথে সময় শূন্যতা এবং স্থান-শূন্যতাও বটে। ভিলেক্ষিন কোয়ান্টাম টানেলিং-এর ধারণাকে ট্রিয়নের তত্বের সাথে জুড়ে দিয়ে বললেন, এ মহাবিশ্ব যাত্রা শুরু। করেছে এক শূন্য জ্যামিতি (empty geometry) থেকে এবং কোয়ান্টাম টানেলিং এর মধ্য দিয়ে উত্তোরিত হয়েছে অশূন্য অবস্থায় (non-empty state) আর অবশেষে ইনফ্লেশনের মধ্য দিয়ে বেলুনের মতো আকারে বেড়ে আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। [১৭১]

ছবি। পেজ ১৮৬

চিত্র: আলেকজান্ডার ভিলেঙ্কিন তার মডেলের সাহায্যে দেখিয়েছেন যে শূন্যতা থেকে কোয়ান্টাম টানেলিং-এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের উদ্ভব ঘটতে পারে।

ভিলেঙ্কিনের দেওয়া ‘পরম শূন্যের ধারণাটি (absolute nothingness) আত্মস্থ করা আমাদের জন্য একটু কঠিনই বটে! কারণ আমরা শূন্যাবস্থা বা স্পেসকে সব সময়ই পেছনের পটভূমি হিসেবেই চিন্তা করে এসেছি। ব্যাপারটি আমাদের অস্তিত্বের সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে মনের আঙিনা থেকে একে ভাড়ানো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। মাছ যেমন জল ছাড়া নিজের অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারে না, ঠিক তেমনি স্পেস ও সময় ছাড়া কোনো ঘটনাপ্রবাহের সংগঠন যেন আমাদের মানস-কল্পনার বাইরে। তবে একটি উপায়ে ‘অ্যাবসোলুট নাথিংনেস’-এর ধারণাটিকে বুঝবার চেষ্টা করা যেতে পারে। যদি পুরো মহাবিশ্বটিকে সসীম আয়তনের একটি আবদ্ধ ক্ষেত্র হিসেবে। চিন্তা করা হয়, এবং এর আয়তন যদি ধীরে ধীরে কমিয়ে শূন্যে নামিয়ে আনা যায়, তবে এই প্রান্তিক ব্যাপারটাকে ‘অ্যাবসোলুট নাথিংনেস’ হিসেবে। ধরে নেওয়া যেতে পারে। আমরা ছবিটিকে আমাদের মানসপটে কল্পনা করতে পারি আর না-ই পারি, ভিলেঙ্কিন কিন্তু প্রমাণ করেছেন, এই শূন্যতার ধারণা গাণিতিকভাবে সুসংজ্ঞায়িত, আর এই ধারণাটিকে মহাবিশ্বের উৎপত্তির গণিত হিসেবে প্রয়োগ করা যেতেই পারে। ভিলেনি তার। ধ্যানধারণা এবং সেই সাথে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের সামগ্রিক অগ্রগতি নিয়ে সাধারণ পাঠকদের জন্য একটি বই লিখেছেন সম্প্রতি একের ভেতর অসংখ্য–অন্য মহাবিশ্বের সন্ধান শিরোনামে[১৭২]। বইটি বৈজ্ঞানিক তত্বে সমৃদ্ধ কেবল নয়, নানা হাস্যরস এবং কৌতুকসমৃদ্ধ উপাদানেও ভরপুর।

১৯৮১ সালে স্টিফেন হকিং ও জেমস হার্টলি ভিন্নভাবে সমস্যাটির সমাধান করেন। তাঁদের মডেল পদার্থবিজ্ঞানের জগতে ‘প্রান্তহীন প্রস্তাবনা’ (no-boundary proposal) হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে[১৭৩]। তাঁদের মডেলটি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী রিচার্ড ফেইনম্যানের বিখ্যাত ইতিহাসের যোগ বা sum over histories’-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফেইনম্যান কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখিয়েছিলেন, একটি কণার কেবল একটি ইতিহাস থাকে না, থাকে বিভিন্ন সম্ভাব্য হিস্ট্রির সমাহার, অর্থাৎ গাণিতিকভাবে– অসংখ্য সম্ভাবনার অপেক্ষকের সমষ্টি। আমরা কণার দ্বিচিড় বা ডবল স্লিট এক্সপেরিমেন্টসহ বহু বিখ্যাত পরীক্ষা থেকে ব্যাপারটার সত্যতা জেনেছি। ঠিক একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে হকিং দেখিয়েছেন যে, এই ব্যাপারটা আমাদের মহাবিশ্বের জন্যও একইভাবে সত্য মহাবিশ্বেরও কেবল একক ইতিহাস আছে মনে। করলে ভুল হবে, কারণ মহাবিশ্বও কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে সেই কোয়ান্টাম স্তর থেকেই যাত্রা শুরু করেছে। হকিং তার ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল’ বইয়ে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রান্তহীন প্রস্তাবনাটা ফেইনম্যানের সেই একাধিক ইতিহাসের ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। কিন্তু ফেইনম্যানের। যোগফলে কণার ইতিহাস এখন স্থলাভিষিক্ত হয়ে গিয়েছে সর্বতোভাবে স্থানকাল দিয়ে, যেটা কিনা মহাবিশ্বের ইতিহাসের সমষ্টি তুলে ধরে’। হকিং ইতিহাসের যোগসূত্র প্রয়োগ করতে গিয়ে আরো দেখলেন, স্থান ও কালের পুরো ব্যাপারটা প্রান্তবিহীন সসীম আকারের বদ্ধ গোলকীয় ক্ষেত্রে পরিণত হয়ে যায়[১৭৪]। ব্যাপারটা যেন অনেকটা পৃথিবীর আকারের সাথে তুলনীয়। আমরা জানি, পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশও আকারে সসীম, কিন্তু প্রান্তবিহীন গোলকের মতো। গোলকের কোনো প্রান্ত থাকে না। সেজন্যই দক্ষিণ মেরুর ১ মাইল দক্ষিণে কী আছে তা বলার অর্থ হয় না। হকিং-এর দৃষ্টিতে মহাবিশ্বের আদি অবস্থাটাও তেমনি। হকিং নিজেই লিখেছেন তার গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইয়ে[১৭৫] :

আমরা যদি আপেক্ষিকতার তত্বের সাথে কোয়ান্টাম তত্বকে মেলাই তাহলে দেখা যায় প্রান্তিক ক্ষেত্রে স্থান–কালের বক্রতা এমন ব্যাপক হতে পারে যে, সময় তখন স্থানের স্রেফ আরেকটা মাত্রা হিসেবেই বিরাজ করে। একদম আদি মহাবিশ্বে, যখন মহাবিশ্ব এতটাই ক্ষুদ্র ছিল যে এর ওপর কোয়ান্টাম তত্ব এবং সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ব উভয়েই কাজ করত তথন আসলে মহাবিশ্বের চারটি মাত্রাই ছিলে স্থানিক মাত্রা এবং কোনো আলাদা সময়ের মাত্রা ছিল না। এর অর্থ, আমরা যখন মহাবিশ্বের ‘সূচনা” সম্পর্কে বলি তখন একটা ব্যাপার এড়িয়ে যাই। সেটা হলো, তখন সময় বলতে আমরা যা বুঝি, তারই কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এটা জানা থাকা প্রয়োজন যে, স্থান ও কাল নিয়ে আমাদের যে প্রচলিত ধারণা, সেটা একদম আদি মহাবিশ্বের ওপর খাটে না। অর্থাৎ সেটা আমাদের অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে, অবশ আমাদের কল্পনা এবং গণিতের ঊর্ধ্বে নয়। এখন, আদি মহাবিশ্বে চারটি মাত্রাই যদি স্থানের মাত্রা হিসেবে কাজ করে তাহলে সময়ের সূচনা হলো কিভাবে?

এই যে ধারণা যে, সময় জিনিসটাও স্থানের আরেকটি মাত্র হিসেবে আচরণ করতে পারে, সেখান থেকে আমরা সময়ের সূচনা বিষয়ক সমস্যাটি কাটিয়ে উঠতে পারি; ঠিক যেভাবে আমরা পৃথিবীর শেষ কোথায় এই প্রশ্নকেও কাটিয়ে উঠি, গোলাকার পৃথিবীর ধারণ মাথায় রেখো মনে করুন, মহাবিশ্বর সূচনা অনেকটা পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুর মতো কেউ যখন সেখান থেকে উত্তর দিকে যেতে থাকে, তখন একই অক্ষাংশের বৃত্তও বড় হতে থাকে, যেটা মহাবিশ্বের আকার ও স্ফীতি হিসেবে ভাবা যায়। তার মানে মহাবিশ্ব শুরু হয়েছে দক্ষিণ মেরুতে, কিন্তু এই দক্ষিণ মেরুবিন্দুর বৈশিষ্ট্য পৃথিবীপৃষ্ঠের আর যেকোনো সাধারণ বিন্দুর মতোই হবে।

এই প্রেক্ষাপটে মহাবিশ্বের সূচনার আগে কী ঘটেছিল, এই প্রশ্নটাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। কারণ, এই প্রশ্নটা ‘দক্ষিণ মেরুর দক্ষিণে ক আছে”,এই প্রশ্নের সমতুল। এই চিত্রে মহাবিশ্বের কোনো সীমানা নেই প্রকৃতির যে আইন দক্ষিণ মেরুতে কাজ করে, সেটা অন্য যেকোনে জায়গাতেও কাজ করবে। একই ভাবে, কোয়ান্টাম তত্ত্বে মহাবিশ্বের সূচনার আগে কী ঘটেছিল, এই প্রশ্ন অর্থহীন হয়ে পড়ে। মহাবিশ্বের ইতিহাসও যে সীমানাহীন একটা বদ্ধ তল হতে পারে, এই ধারণাকে বলে ‘নো বাউন্ডারি কন্ডিশন” বা প্রান্তহীনভার শর্ত।

এখানে মূল ব্যাপারটি হলো, হকিং-এর মডেলটিও ভিলেঙ্কিনের মডেলের মতো প্রাকৃতিক ভাবে মহাবিশ্বের উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করতে পারে। তবে হকিং-হার্টলি মডেলের সাথে ভিলেক্ষিনের মডেলের পার্থক্য এই যে, এই মডেলে ভিলেঙ্কিনের মতো ‘পরম শূন্য’র ধারণা গ্রহণ করার দরকার নেই।

ভিলেঙ্কিন ও হকিং-এর এই দুই মডেলের বাইরে আরেকটা মডেল আছে যেটা বাইভার্স (Biverse) নামে পরিচিত। এটা মূলত হকিং-হার্টলি মডেল এবং ভিলেফিনের প্রস্তাবিত মডেল দুটোর একধরনের সমন্বয় বলা যায়। পদার্থবিদ ভিক্টর স্টেঙ্গর এই মডেলের প্রবক্তা[১৭৬]। গাণিতিক মডেল তৈরি করার মাধ্যমে স্টেঙ্গর সম্পূর্ণ ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেছেন তার সাইটে এবং পরবর্তীকালে এ নিয়ে তিনি বই ও দার্শনিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।[১৭৭,১৭৮]

ছবি। পেজ ১৮৯

চিত্র: ভিক্টর স্টেরের বাইভার্স মডেল। আমাদের মহাবিশ্ব টানেলিং-এর মাধ্যমে অপর মহাবিশ্ব থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে হবে। কিন্তু অপর মহাবিশ্বের সময়ের দিক আমাদের মহাবিশ্বের সময়ের দিকের ঠিক বিপরীত বলে দুটো মহাবিশ্বই উদ্ভূত হবে আসলে একই ‘আনফিজিকাল রিজন হিসেবে। চিহ্নিত বিশেষ ধরনের শূন্যাবস্থা থেকে।

এই প্রস্তাবনা অনুযায়ী আমাদের মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল কোয়ান্টাম টানেলিং প্রক্রিয়ায় অপর একটি মহাবিশ্ব থেকে, যে মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ছিল অসীম সময় পর্যন্ত, অন্তত আমাদের সময় পরিমাপের দৃষ্টিকোণ থেকে। কোয়ান্টাম টানেলিং বিজ্ঞানের জগতে একটি প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ধারণা। সাধারণ ভাষায়, কোনো বস্তুর একটি নিউটনীয় বাধা বা দেয়ালের ভেতর গলে বের হয়ে যাওয়াই কোয়ান্টাম টানেলিং। বিগ ব্যাং-এর মাধ্যমে স্থানের প্রসারণের যে অভিজ্ঞতা আমাদের মহাবিশ্বের অধিবাসীরা উপলব্ধি করেছে, অপর মহাবিশ্বটি উপলব্ধি করবে ঠিক তার উল্টো অর্থাৎ সংকোচনের অভিজ্ঞতা।

আরও একটি ব্যাপার হলো, একটি মহাবিশ্বে সময়ের দিক নির্ধারণ করা হয়ে থাকে এনট্রপি বৃদ্ধি বা বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধির দিকের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। সেই শর্তকে সিদ্ধ করতে গেলে অপর মহাবিশ্বের সময়ের দিক আমাদের মহাবিশ্বের সময়ের দিকের ঠিক বিপরীত হতে হবে। আর তাহলেই এই বাইভার্স মডেলে আমাদের মহাবিশ্ব টানেলিং-এর মাধ্যমে অপর মহাবিশ্ব থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে হবে; ঠিক একইভাবে অপর মহাবিশ্বের অধিবাসীদের কাছে মনে হবে তাদের মহাবিশ্ব টানেলিং-এর মাধ্যমে উদ্ভূত হয়েছে আমাদের মহাবিশ্ব থেকে দুই মহাবিশ্বেরই আপাত উদ্ভব ঘটবে ছবিতে ‘আনফিজিকাল রিজন’ হিসেবে চিহ্নিত বিশেষ ধরনের শূন্যাবস্থা থেকে। গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে মডেলটি ত্রুটিপূর্ণ না হলেও প্রায়োগিক দিক থেকে মডেলটির কিছু জটিলতার কারণে মূলধারার পদার্থবিদদের কাছে এটি জনপ্রিয় নয়।

তবে ভিক্টর স্টেঙ্গর নিজেও স্বীকার করেছেন, আদতে এমনটাই হয়েছে সেটা তিনিও হলফ করে বলতে পারেন না। নিউ এখিজম’ গ্রন্থে তিনি বলেছেন[১৭৯]–

আমার বলতে দ্বিধা নেই, মহাবিশ্বের সূচনা কীভাবে হয়েছিল তা নিয়ে করা আমার ব্যাখ্যা এতটা বিখ্যাত নয় সাধারণের কাছে। অবশ্য, এই প্রস্তাবনা প্রকাশের পর কয়েক বছর কেটে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো পদার্থবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিদ এমনকি দার্শনিকরা কোনো ভুল বের করতে পারেন নি। তারপরও আমি দাবি করি না, ঠিক এইভাবেই মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল। আমি এতটুকুই বলতে চাই, এটি আমাদের বর্তমান জ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি প্রস্তাবনা যার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, প্রাকৃতিকভাবে মহাবিশ্বের উৎপত্তি অসম্ভব কোনো ধারণা নয় এবং একই সাথে আমি এটাও বলতে চাই, মহাবিশ্ব সূচনায় আসলে ব্যাখ্যাতীত কোনো বিষয় বা শূন্যস্থান নেই, যেখানে ধর্মবেত্তারা হুট করে ঈশ্বরকে বসিয়ে দিতে পারবেন।

একই ধরনের মনোভাব ব্যক্ত করেছেন এ সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংও। তিনি তার সাম্প্রতিক গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইয়ে পরিষ্কার করে বলেছেন, বিগব্যাং কোনো স্বর্গীয় হাতের ফসল কিংবা জুক ছিল না। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনেই প্রাকৃতিকভাবে বিগব্যাং-এর মাধ্যমে অনিবার্যভাবে শূন্য থেকে মহাবিশ্ব উদ্ভূত হয়েছে স্বাভাবিক নিয়মেই।[১৮০] বিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ লরেন্স ক্রাউস সম্প্রতি একটি বই। FATC2090– A Universe from Nothing: Why There Is Something Rather than Nothing[১৮১] শিরোনামে। বইটিতে পদার্থবিদ ক্রাউস পদার্থবিদের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে শূন্য থেকে আমাদের চিরচেনা বিপুল মহাবিশ্ব উদ্ভূত হতে পারে একেবারেই প্রাকৃতিক উপায়ে[১৮২]। মূলধারার অধিকাংশ বিজ্ঞানীই এর সাথে আজ একমত পোষণ করেন।

আমরাও মনে করি কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং তারপর ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের মাধ্যমে একসময় পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি এবং বিবর্তনের প্রাকৃতিক এবং যৌক্তিক ব্যাখ্যা বিজ্ঞান এই মুহূর্তে আমাদের দিতে পারছে। কাজেই এগুলোর পেছনে ঈশ্বর সম্পর্কিত অনুমান করা স্রেফ বাহুল্য মাত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *