প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

উপত্যকার পাদদেশে মানুষখেকো বাঘ

গুংগি (অপ্রকাশিত রচনা)

[এটি জিম করবেটের একটি অপ্রকাশিত রচনা। এটির উল্লেখ ভূমিকায় পাওয়া যায়। করবেটের বন্ধু এবং অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি প্রেসের প্রাক্তন সর্বাধ্যক্ষ আর. ই. হকি আমাকে লেখাটির কথা জানান। “মাই ইন্ডিয়া” বইয়ের জন্য করবেট এটি লেখেন এবং পরে বই থেকে বাদ দেন। লেখাটি আমরা অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি প্রেসের সৌজন্যে পেয়েছি। গুংগি’ মানে বোবা। ১৯১৪ সালে নৈনিতালের কাছে একটি মেয়েকে পাওয়া যায়। তখনকার খবরের কাগজে তাকে ‘নেকড়ে শিশু’ বলা হয়েছিল। এ তারই কাহিনী-সম্পাদিকা।]

যে উপত্যকার পাদদেশে মানুষখেকো বাঘটির তল্লাস করেছিলাম বলে আগের অধ্যায়ে বলেছি, সেখান দিয়ে একটি মোটর চলাচলের রাস্তা আলমোড়া আর রাণীক্ষেতের সঙ্গে মিটারগেজ রেলের টারমিনাস কাঠগুদামের সংযোগ ঘটিয়েছে। এই রাস্তাতেই, রতিঘাট থেকে তেমন দূরের নয়, একদিন একদল লোক কাজ করছিল। তারা দেখতে পেল রাস্তার ওপরে পাহাড়ে, দেখে মনে হল একটা অদ্ভুত জন্তু, একটা ঝোপের আড়াল থেকে আরেকটায় যাচ্ছে। গাঁইতি-শাবল ফেলে দিয়ে তোকগুলো সে ঝোপটা ঘিরে ফেলে আর ঘিরে কাছে এগোতেই দেখে একটি উলঙ্গ মানুষ একটা ঝোপের নিচে গুটিসুটি মেরে আছে। লোকেরা কাছে যেতেই সে চার হাত-পায়ে জোরসে ছুটে মানুষের গণ্ডী পেরিয়ে চলে যায়। অনেক দূর তাড়া করে তাকে ধরে কাবু করে কেবল দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে একটা কাণ্ডীতে (পাহাড়ীদের মাল বইবার কোনাচে ঝুড়ি) করে নৈনিতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

আমি তখন মোকামাঘাটে ছিলাম। যাকে নেকড়ে-শিশু বলা হচ্ছে, নৈনিতালের কাছে তাকে পাওয়া যাবার খবর কাগজে পড়েছিলাম। কাগজে পড়ে আমি পেশাদারী ফোটোগ্রাফার লরীকে টেলিগ্রাম করে আমার জন্যে ওই শিশুর অনেকগুলো ছবি তুলতে বললাম। যে হাসপাতালে শিশুটিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, লরী সেখানে গেল বটে, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে কোনো ছবিই তুলতে পারল না। কারণ যে ঘরে শিশুটিকে আটকে রাখা হয়েছিল, তার এক কোণে খড়ের গাদার নিচে সে লুকিয়ে থাকে। সেখান থেকে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বের করতে পারে নি লরী। পরের কয়েক সপ্তাহ ধরে শিশুটি খবর হয়ে রইল। ও নেকড়ে শিশু না বানর-শিশু তা নিয়ে প্রচুর জল্পনা-কল্পনা চলল। কালে উৎসাহে ভাটা পড়ল। সবাই ভুলে গেল তাকে।

কয়েক মাস বাদে যখন নৈনিতালে গেলাম, একটি চিঠি পেলাম। সেটি ইংলন্ডের একটি অ্যাসোসিয়েশনের ভারত-সরকারকে লেখা। সংস্থাটির সভাপতি স্যার বামফিল্ড ফুরাল। সে চিঠিতে নৈনিতালের নেকড়ে শিশু বিষয়ে সব খবর চাওয়া হয়েছিল।

এ চিঠি পেয়ে, গত পনের বছরে রতিঘাটের দশ মাইলের মধ্যে কোনো গ্রাম থেকে কোনো শিশু হারিয়েছে কি না তার তদন্ত করতে; আর নেকড়ে-শিশুর বর্ণনার সঙ্গে মেলে এমন কিছু ও অঞ্চলের কোনো লোক কোনো দিন দেখেছে কি না তারও খোঁজ নিতে আমার বন্ধু মোতি সিংকে পাঠালাম। ও আমার সঙ্গে বিশ বছর আছে।

মোতি সিং যখন খোঁজখবর চালাচ্ছে, আমি গেলাম নৈনিতালের তহশীলদারের অফিসে। সেখানে সব নথিপত্র রাখা হয়। নৈনিতাল জেলায় কোনো শিশু হারাবার রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্যে তহশীলদারের সহায়তায় ওর পনের বছরেরও বেশি সময়ের নথিপত্র দেখলাম। কি মোতি সিংয়ের, কি আমার তদন্তে কিছুতেই, কোনো শিশু হারিয়েছে অথবা ও অঞ্চলের জঙ্গলে শিশুর মত দেখতে, কোনো কিছু দেখতে পাওয়া গেছে বলে জানা গেল না।

তারপর আমি গেলাম ক্ৰসথোয়েইট হাসপাতালে। সেখানে শিশুটিকে ভর্তি করা হয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত লেডী মিস মিশ্র আমাদের পরিবারের পুরনো এবং প্রিয় বন্ধু। যখন তাঁকে আমার উদ্দেশ্যের কথা বললাম, তিনি অসীম অনুগ্রহে যতভাবে পারেন সাহায্য করতে চাইলেন। মিস মিশ্র ছাড়া একজন নার্স আর একজন ওআর্ড অ্যাটেনডেন্ট শিশুটিকে দেখাশোনা করছিলেন। এই তিনজন মহিলার কাছ থেকে আর হাসপাতালের নথিপত্র থেকে আমি নিচের খবরগুলো বের করতে পারলাম :

১৫.৭.১৯১৪ তারিখে আন্দাজ ১৪ বছরের একটি মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রেজিস্টারে তার নাম লেখা হয়েছিল গুংগি। দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থায়, একজন পাহাড়ীর পিঠে কাণ্ডীতে চাপিয়ে মেয়েটিকে হাসপাতালে আনা হয়। তার সঙ্গে ছিল একটি পুলিস আর বেশ বড়সড় এক জনতার ভিড়। মেয়েটিকে দেখে মনে হয়েছিল মানুষে ও ভয় পাচ্ছে। ওকে একটি খালি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। যে দড়িতে বাঁধা ছিল তা যখন ভোলা হচ্ছে, ও নার্সকে কামড়ে দেয়, ভীষণ গর্জন করে তিনটি মহিলাকেই ভয় খাইয়ে দেয়। ছাড়া পেতেই চার পাত-পায়ে ছুটে মেয়েটি ঘর পেরিয়ে চলে গিয়ে এক কোণে গুটিসুটি মেরে থাকে।– মিস মিশ্র নার্স আর ওআর্ড অ্যাটেনডেন্টের কাছ থেকে আমি এই সব খুঁটিনাটি জানতে পারলাম।

(১) মিস মিশ্র ওকে গুংগি (বোবা নাম দিয়েছিলেন, কেননা মেয়েটি কথা বলতে পারত না)।

(২ ) ওর বয়ন্স আন্দাজ চোদ্দ বছর।

(৩) ও বেশ সরল আর স্বাস্থ্যবতী। অপুষ্টির কোনো লক্ষণ দেখা যায় নি।

(৪) শরীর খুব নোংরা আর ঘনলোমে ভরা।

(৫) মাথার চুল ছোট আর জটপরা।

(৬) কাঁধে আর শরীরের উপর দিকে অনেক গভীর আঁচড়ানি। কতকগুলো সেরে যাচ্ছিল, কতকগুলো শুধু জখমের দাগ।

(৭) যে সব জামাকাপড় ওকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়, তা ও দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল। কিন্তু এক বোঝা খড় খুশি হয়েই নিয়েছিল। সেটি ঘরের এক কোণে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিল মেয়েটি তারপর থেকে তার নিচেই লুকিয়ে থেকে গিয়েছিল।

(৮)সব রকম রান্না খাবারই খেতে ও নারাজ হয়েছিল। তবে কাঁচা মাংস ফল শাকসবজি খেত।

(৯) ও সন্তোষ জানাত পাখির কুজনের মত এক রকম শব্দ করে অসন্তোষ জানাত গর্জন করে।

(১০) ঘরে যে কাঁচা মাংস, ফল অথবা তরিতরকারী ছুঁড়ে দেওয়া হত, তা মুখে ঢোকাবার জন্যে মানুষ আর বাঁদর যেমন হাত ব্যবহার করে, ও তা করত না। তবে হাতের পেছন দিয়ে ওগুলো ওর সমানে জড়ো করত। তারপর ঘরের যে কোণটিতেও বাসা বানিয়ে নিয়েছিল সেখানে ওগুলো দাঁত দিয়ে তুলে তুলে নিয়ে যেত।

(১১) চার হাত পায়ে অর্থাৎ হাত ও পায়ের চেটো ও পাতায় ভর করে ও খুব তাড়াতাড়ি চলাফেরা করত, কনুই আর হাঁটুর ভরে চলত না।

(১২) অভ্যাসগুলোর খুব নোংরা ছিল ওর, মলমূত্র ত্যাগের আর শৌচের শিক্ষা ওর হয় নি। যখন ঘর ধোয়ার দরকার হত ওর কোমরে দড়ি বেঁধে টেনে বারান্দায় নিয়ে যাওয়া হত। কাঠের খামের ঠেকনোর ওপর বারান্দার ছাত। থামগুলোর একটায় শক্ত করে দড়িটা বাঁধা হলে পরে তখনি, দেখে মনে হত যেন বিনা আয়াসেই ও থামের ওপর অব্দি বেয়ে উঠে যেত। আবার টেনে না নামানো অব্দি ও ওখানেই থাকত।

১৩) মিস মিশ্র, নার্স আর ওয়ার্ড অ্যাটেনডেন্ট, তিনজনই পাহাড়ী মেয়ে। মেয়েটির গায়ের রং, মুখচোখ আর গড়ন পেটন দেখে ওদের স্থির বিশ্বাস হয়েছিল ও পাহাড়ী মেয়ে। ওদের সুনিশ্চিত অভিমত হল, সব বন্য প্রাণী যে অর্থে নিরীহ আর বন্য, মেয়েটিও সে অর্থে নিরীহ আর বন্য। তা বাদ দিলে মেয়েটি সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ আর বুদ্ধিমতী।

ওর ক্রসথোয়েইট হাসপাতালে থাকার শেষের দিকে, গুংগি আর ওর অ্যাটেনডেন্টদের কামড়ে দিতে চেষ্টা করত না। ওকে স্নান করাত, চুল আঁচড়ে দিত, নখ কাটতে দিত। প্রতিবার কয়েক ঘণ্টার জন্যে একে একটা ঢিলে এককাটের জামা পরতে দিত। সদয় ব্যবহারে এতখানি কাজ হয়েছিল ওর। তবে বিছানা বা কম্বল ব্যবহার করতে ওকে মোটে রাজী করানো যায় নি। কোণের সেই খড়ের নিচেই সর্বক্ষণ থাকত। ওর সন্তোষের রকমফের জানাবার জন্য সেই কুজন ধ্বনিটিরই রকমফের করে করে সন্তোয় জানাত

২৫-৭-১৯১৪ তারিখে প্রহরাধীন অবস্থায় গুংগিকে বেরিলির পাগলা গারদে পাঠানো হয়। ভর্তি হবার অল্পদিন বাদেই ও সর্দিগর্মি লেগে মারা যায়। সভ্যতার সঙ্গে অল্প কয়েকদিনের পরিচয়ের পরই এমনি করেই নেকড়ে-শিশু পুংগি বিদায় নিল। ও কে, কোথা থেকে ও এসেছিল। এই জল্পনা-কল্পনাটুকু শুধু রেখে গেল পেছনে।

শুধু নৈনিতালে, আর চারপাশের পাহাড়েই নয়, গুংরির আবির্ভাব সারা ভরতরর্ষেই স্বাভাবিকভাবেই দারুণ আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছিল। ওর আবির্ভাবকে ব্যাখ্যা করার জন্যে অনেক তত্ব গড়ে উঠেছিল। শ্বেতাঙ্গ অধিবাসীদের মত হল, ও নেকড়ে-শিশু, নয় তো বানর শিশু! ভারতীয়দের মত হল ও নেকড়ে-শিশু।

গুংগি যে বানর শিশু, সে তত্ত্বটি এই সব কারণে খারিজ করা চলে– মুখে খাবার পোরার জন্যে গুংগি হাত ব্যবহার করত না; ও কাঁচা মাংস খেত, ও যদি দীর্ঘদিন বানরদের দলে থাকত,  তাহলে নিঃসন্দেহে ওকে বানরদের সঙ্গে দেখা যেত; কেন না পাহাড় অঞ্চলে বানররা কখনো আবাদী জমি থেকে বেশি দূরে থাকে না। ওদের অভ্যেসগুলো এমন যে সেজন্যে ওরা খুবই চোখে পড়ে, কিন্তু কখনোই বানরদের দলে দেখা যায়নি।

তাহলে রইল এই কথাটি, ও তবে নেকড়ে-শিশু। নেকড়েরা যে শিশুদের লালন-পালন করে, সেই বমুলাস আর রেমাসের কাল থেকেই এই অতি প্রাচীন বিশ্বাসটি চলে আসছে। ভারতবর্ষের আগাগোড়া জুড়ে এ বিশাসটি আজও প্রচলিত। এমন কি যেসব জায়গায় শত শত বছর আগেই নেকড়ে লোপ পেয়েছে, সেখানেও। এই বিশ্বব্যাপী বিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে আমি যদি বলি যে কোনো নেকড়ে কোনো শিশুকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে লালন-পালন করেছে এরকম একটি ঘটনাও বাস্তবে ঘটেছে বলে আমি বিশ্বাস করি না, তাহলে আমি যে শুধু তামাশার পাত্রই হব, সে আমি জানি।

এমন কি ইদানীংকার বছরেও নেকড়ের বাসা বলে পরিচিত মাটির গর্ত থেকে শিশুদের খুঁড়ে বের করে আনার ঘটনার রিপোর্ট মিলেছে। কিন্তু আমি যতগুলো ঘটনা জানি, তাতে প্রতিবারই দেখা গেছে শিশুটি অপ্রকৃতিস্থ। আর মাটির বুকে কোনো অপ্রকৃতিস্থ শিশুকে পাওয়া গেলে তাতে এই প্রমাণ হয় না, যে কোনো নেকড়েই শিশুটিকে গর্তে রেখেছিল, তাকে খাইয়েছিল।

নেকড়ে শিশুদের এইসব গল্প আমি এই কারণে বিশ্বাস করি নাঃ

(ক) ভারতীয় নেকড়ে একটি নিরীহ প্রাণী। অমন এক নিরীহ প্রাণীকে জনবসতিতে ঢুকে শিশুকে তুলে নিয়ে যেতে হলে সে তা করবে চরম উপবাসের অবস্থায় পৌঁছে। তাই যদি হয়, তাহলে উপসী জানোয়ারটি পেটের খিদে না মিটিয়ে বাচ্চাটাকে নিয়ে গিয়ে নিজের ছানাদের উপহার দেবে, অথবা ছানা না থাকলে ওকে পোষার জন্যে রাখবে, এ ধারণা করা যায় না। আমি যা জানি, বন্যজগতে জীবনযাত্রা এমনই কষ্টকর এক ব্যাপার যে, বন্য জন্তুরা খেলার জন্য বা পোষার জন্য কোনো কিছু রাখতে পারে না। তাছাড়া সে অবস্থায় শিশুটিকে যে খদ্য খেতে হবে তা খেলেই সে বাঁচবেই না।

(খ) ভারতীর শিশুদের মধ্যে যারা খানিকটা গরিব ঘরের, তারা তাঁদের মা-বাবার সঙ্গেই ঘুমোয়। নেকড়েরা সেই গরিব ঘরের শিশুদের তুলে নিয়ে গেছে বলেই বারবার শোনা যায়। যখন গায়ে দাঁত বসিয়ে তাকে জ্যান্ত তুলে নিয়ে যাচ্ছে নেকড়ে, তখন কোনো শিশু চুপ করে থাকবে; সে শিশুর বাবা-মা, অথবা পাড়াপড়শি, অথবা প্রতি ভারতীয় গ্রামে যে নেড়ি কুকুরদের দল থাকে তারা কি হচ্ছে তা জানতেই পারবে না, এ আমি বিশ্বাসই করব না।

(গ) ভারতীয় নেকড়ে শেয়ালের চেয়ে সামান্যই বড় হয়। সে কিছুদূর পর্যন্ত কোনো শিশুকে মাটি দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে পারে বটে; কিন্তু কোনো শিশুকে মাটি থেকে তুলে তাকে বহুমাইল দূরে নিজের বাসায় জ্যান্ত বয়ে নিয়ে চলে যাবে, তত গায়ের জোর নেকড়ের আছে বলে আমি মানি না।

 (ঘ) আর শেষ কথাটি বলি। হয়ত নিজের অজান্তেই জাহির করছি একথা বলে। যেখানে নেকড়ে বিরল এবং আকারে ছোট, সেই ভারতবর্ষে কেন নেকড়ে-শিশু দেখা যায়? যেখানে নেকড়ে সংখ্যায় অনেক, আর আকারেও– বড়, সেই রাশিয়া আর কানাডায় নেকড়ে-শিশু দেখা যায় না কেন?

গুংগি যদি অপ্রকৃতিস্থ হত; জনবসতির কাছাকাছি গর্ত থেকে বের করে আনা শিশুদের যেরকম শরীর স্বাস্থ্যের অবস্থায় পাওয়া যায় বলে বলা হয়–ওকেও যদি তেমনি অবস্থাতেই পাওয়া যেত; মোতি সিংয়ের তদন্ত আর তহশীলদারের নথিপত্র সত্ত্বেও আমি তাহলে কোনো ইতস্তত না করে বলতাম, ও হচ্ছে ভারতের অবাঞ্ছিত মেয়েদের একজন। নিজে যেমন পারে করে খাক গে, বলে ওকে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

 কিন্তু গুংগি অপ্রকৃতিস্থ ছিল না। ওর শরীর স্বাস্থ্যের অবস্থা খুবই ভাল ছিল। ওর চেয়ে ভাল হয় না। ও ধরা পড়েছিল জনবসতি থেকে অনেক দূরে। বহুদিন ও মানুষের থেকে দূরে ছিল, মানুষদের দেখে বন্য প্রাণীদের অমনি আচরণ করতেই দেখেছিল। এইসব কারণ দিয়ে ওর নিরীহতা, বন্যতা আর মানুষ-ভীতিকে ব্যাখ্যা করা যায়।

যেসব কারণ দেখানো হল সেজন্য তো বটেই, তাছাড়ও গুংগিকে যেখানে পাওয়া যায় তার একশো মাইলের মধ্যেও নেকড়ে নেই,–এই কারণেও বানর আর নেকড়ে বাদ যাচ্ছে। তাহলে রইল একটি অত্যন্ত সুদূর সম্ভাবনা। ও হয়তো জংলী কুকুর অথবা ভাল্লুকদের দলে ভিড়েছিল। তারা ওকে লালনপালন করেছিল এত বড় কথা আমি বলব না। যে অঞ্চলে ওকে পাওয়া যায় সেখানে ওই দুটি প্রাণীই দেখা যায়। দুটি প্রাণীই ওকে কাঁচা মাংস খেতে শেখাতে পারত।

গুংগি যখন রাস্তার কুলিদের হাতে ধরা পড়ে, ওর পরিচয় ঠিক ঠিক জানবার জন্যে, পরে আমি যে খোঁজখবর করি তা ছাড়া কোনোরকম তদন্তই করা হয় নি এ খুবই দুঃখের কথা। পাহাড়ী মেয়ে গুংগি, ঠাণ্ডা আবহাওয়ার দেশে বুনো হয়ে গিয়েছিল। একটা গরম সমতলের শহরে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী রাখার জন্যে তাকে পাঠানো হল, এও খুবই দুঃখের কথা।

এজন্য ক্রসথোয়েইট হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত লেভী ডাক্তারকে দোষ দেবার কিছু নেই। গুংগির কোনো ডাক্তারী চিকিৎসার দরকার ছিল না। ও ছিল বলে শত শত লোক কৌতূহলে সেখানে যেত। তারা হাসপাতালের নিয়মিত কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। তাই গুংগিকে সরিয়ে নিতে বলা মিস মিশ্রের পক্ষে ঠিকই হয়েছিল।

তবে, কুমায়ুনে যেসব জীবজন্তু পাওয়া যায় তাদের কোনোটির সঙ্গে গুংগি মিশেছিল কি না তা জানবার এটি সুযোগ হারিয়ে গেল। এমন সুযোগ আর না মিলতেও পারে। সবচেয়ে কাছের চিড়িয়াখানায় ওইসব জানোয়ারের সঙ্গে ওকে মুখোমুখি রাখলে পরে এ খবরটি জানা যেত। তাছাড়াও, গুংগি যে কথা কইতে পারত না, তার মানে এই নয় যে, ও একেবারে বোবা।

ওকে কথা কইতে শেখানো যেত এ খুবই সম্ভব। লিখতে শেখানো তো যেতই। সত্যি সত্যিই বন্য প্রাণীরা শিশুদের লালন করবার ভার নেয় কি না, ওদের সঙ্গে কাছাকাছি হয়ে শিশুদের বাস করতে দেয় কি না, গুংগির কাহিনী তাহলে সে ব্যাপারটির পাকাপাকি ফয়সালা করে দিত।

কেন না, অত্যন্ত ভালোভাবে ট্রেনিং পাওয়া যে তিনজন মহিলা ওকে দেখাশোনা করেছিলেন, তাদের সাক্ষ্য অনুসারে গুংগি ছিল সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ, খুবই বুদ্ধিমতী। তাহলে ওর ধরা পড়বার আগের জীবনের অভিজ্ঞতাটি গুংগির তরুণ স্মৃতিতে এমন করে ধরা থাকত, যা মুছে যায় না কিছুতে। ওকে যখন কথা কইতে বা লিখতে শেখানো যেত, তখন সে অভিজ্ঞতার একটা রেকর্ডও থাকত। সে রকম কোনো রেকর্ড তৈরি হলে পরে আমি আশা করতাম, গুংগি বলবে, ও ভাল্লুকদের দলেই মিশেছিল। তার কারণ হল এই :

ভাল্লুকরা সামনের থাবা দিয়ে ওদের খাবার কাছে টেনে আনে, তারপর দাঁতে কামড়ে মাটি থেকে খাবার তুলে নেয়। গুংগি তাই করত।

ভাল্লুকরা কাঁচা মাংস, ফল, আর তরিতরকারী খায়। গুংগিকে যখন প্রথম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, ও শুধু ওইসব খাবারই খেত।

হিমালয়ের সব জায়গায় ভালুকরাই মেয়েদের জখম করে বলে একটা কথা চালু আছে। এ বিশ্বাসটি এমন জোরদার, যে কয়েক রকম ফলের মরসুমে মেয়েরা গ্রামের কাছের জঙ্গলে যায় না। গুংগির কাঁধ আর শরীরের ওপরভাগের আঁচড়ের ব্যাখ্যা মেলা দরকার। কাঁটাবন দিয়ে যাবার সময়ে যদি ওর গায়ে আঁচড়গুলো লাগত, তাহলে ওর শরীরের নিচের দিকে হাতে আর পায়েও আঁচড় থাকত।

একজন ফরেস্ট গার্ড একটা কথা চালু করেছিল। একজন ফরেস্ট অফিসার একটি ভাল্লুককে গুলি করে মারেন। ভাল্লুকটির পেছন পেছন চার হাতে পায়ে গুংগিকে নাকি যেতে দেখা গিয়েছিল। যে ফরেস্ট অফিসারের কথা বলা হয়, তিনি হলেন আইদি। আগের অধ্যায়ে যে মানুষখেকো বাঘের কথা বলেছি। সেটিকে উনি মেরেছিলেন। স্মাইদি আমাকে বলেন, যে অঞ্চলে গুংগিকে পাওয়া যায়, সেখানে একটি ভাল্লুক তিনি মেরেছিলেন বটে, তবে তিনি যতদূর জানেন, ভাল্লুকটিকে মারার সময়ে তার সঙ্গে কোনো শিশু ছিল না।

আর তাই, গুংগি যে কে ছিল; কারা ছিল ওর সঙ্গী, যতদিন না চোদ্দ বছর বয়স হল, ততদিন ও জঙ্গলে টিকে রইল কি করে; সে কাহিনী এক রহস্যই থেকে যাবে।