প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

রবিন

রবিন

আমি ওর মা-বাবার একজনকেও কখনো দেখি নি। যে নাইট অফ দ্য ব্রু’-এর কাছ থেকে ওকে কিনেছিলাম, সে বলেছিল ও এক স্প্যানিয়াল, ওর নাম পিঞ্চা, ওর বাবা ছিল এক উৎসাহী শিকারী কুকুর। ওর বংশপরিচয় সম্পর্কে এইটুকু আপনাদের বলতে পারি আমি।

কুকুরছানা চাই নি আমি, নেহাতই ঘটনাচক্রে আমি সঙ্গে ছিলাম এক বান্ধবীর, তখন তাঁর নিরীক্ষণের জন্যে এক অতি নোংরা ঝুড়ি উপুড় করে সদ্যজাত সাতটি ছানাকে বের করা হল। ছানার দলটিতে পিঞ্চ সবচেয়ে ছোট, সবচেয়ে রোগা, এবং বোঝাই যাচ্ছিল টিকে থাকবার জন্যে লড়তে লড়তে ও একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ওর চেয়ে সামান্য কম হতভাগ্য ওর ভাইবোনদের কাছ থেকে চলে এসে ও একবারটি আমাকে ঘিরে হাঁটল আর তারপর কুঁকড়ে-মুকড়ে আমার বড় বড় পায়ের মধ্যিখানে শুয়ে পড়ল। ভীষণ শীত সে সকালে, যখন ওকে তুলে নিলাম, রাখলাম আমার কোটের ভেতর, আমার মুখ চেটে ও ওর কৃতজ্ঞতা দেখাতে চেষ্টা করল আর আমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম ওর অসহ্য দুর্গন্ধ আমি টের পাচ্ছি না।

ওর বয়স তখন প্রায় তিন মাস, আর আমি কিনেছিলাম ওকে পনের টাকায়। এখন ওর বয়স প্রায় তের বছর আর ভারতের সবটুকু সোনা দিয়েও ওকে কেনা যাবে না।

যখন ওকে বাড়ি আনলাম, ভরপেট খাওয়া, গরম জল আর সাবানের সঙ্গে ওর প্রথম পরিচয় হল, আমরা ওর সারমেয়শালায় নাম ‘পিঞ্চা’ খারিজ করে দিলাম। এক বিশ্বাসী বুড়ো কুলি কুকুর, যে একবার এক ভীষণ ক্রুদ্ধ মাদী ভাল্লুকের আক্রমণ থেকে ছ বছরের আমাকে এবং আমার চার বছরের ছোট ভাইকে বাঁচায়, তারই স্মৃতিতে ওর নতুন নামকরণ করলাম রবিন।

তৃষ্ণার্ত জমিতে যেমন বৃষ্টিপাতে ফল হয়, নিয়মিত আহারে রবিনের তেমনই হল এবং বালক আর কুকুরছানার শিক্ষারম্ভে ‘বড় আগেভাগে হচ্ছে’ বলে কিছু নেই–এই নীতিবশে; ওর থেকে খানিক দূরে সরে গিয়ে ওকে বন্দুক ছোঁড়ার শব্দে অভ্যস্ত করবার ইচ্ছেয়, ও আমাদের সঙ্গে কয়েক হপ্তা কাটাবার পরই এক সকালে বেরিয়ে পড়লাম ওকে নিয়ে।

আমাদের জমিজমার শেষ প্রান্তে আছে কয়েকটি ঘন কাঁটাঝোপ, যখন সেগুলো বেড় দিয়ে ঘুরে যাচ্ছি, একটা ময়ুরী উড়ে ওপরে উঠল। রবিন আমাকে পায়ে পায়ে অনুসরণ করছিল, ওর কথা সম্পূর্ণ ভুলে মেরে দিয়ে আমি গুলি করে পাখিটাকে ঝটপটিয়ে নিচে নামালাম। ওটা ধপ করে পড়ল কাঁটাঝোপে এবং ওকে ধাওয়া করে রবিন ছুটে ঢুকে গেল ভেতরে। আমার ভেতরে ঢোকার পক্ষে ঝোপগুলি বড় বেশি ঘন আর কাটাবোঝাই। তাই আমি ওগুলো বেড় দিয়ে দৌড়ে গেলাম ঝোপের পাশ বরাবর দূরে। সেখানে ঝোপগুলোর ওপারে ফাঁকা জমি এবং তারও ওপারে আবার গাছ ও ঘাসের নিবিড় বন; জানতাম জখম পাখিটা ওই দিকপানেই ছুটবে। সকালের রোদে ফাঁকা জমিতে বান ডেকেছে আর মুভি ক্যামেরায় সসজ্জ থাকলে পরে এক বিরল ছবি তোলার সুযোগ পেয়ে যেতাম আমি।

ময়ূরীটি এক বৃদ্ধ পাখি, ঘাড়ের পালকগুলো ওর সমকোণ রচনা করে উঠে আছে, একটা ডানা ভাঙা, ও দৌড়চ্ছিল গাছের জঙ্গলের দিকে। শরীরের পেছন ভাগটি মাটিতে সেঁটে বরিন ওর লেজ কামড়ে ধরেছিল আর হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে টান খেতে খেতে যাচ্ছিল সঙ্গে। সামনে দৌড়ে গিয়ে বেজায় বোকার মত আমি পাখিটার গলা চেপে ধরলাম আর ওকে মাটি থেকে শূন্যে তুলে ধরলাম। তাতে সঙ্গে সঙ্গে ও দুই পা ছুঁড়ল আর রবিনকে ডিগবাজি খাইয়ে ফেলে দিল দূরে। এক লহমায় সামলে নিয়ে উঠে পড়ল রবিন আর আমি যখন মরা পাখিটাকে শুইয়ে রাখলাম, একবার ওর মাথায়, একবার লেজে ছোট ছোট ঠোকনা মারতে মারতে ও ওটাকে ঘিরে নেচে বেড়াতে লাগল।

সে সকালের মত পাঠ সমাপ্ত হয়েছিল এবং যখন বাড়ি ফিরছি, আমাদের মধ্যে কে যে বেশি গর্বিত তা বলা কঠিন হত–রবিন, তার প্রথম পাখিটি বাড়িতে আনছে বলে, না একটা নোংরা ঝুড়ি থেকে আমি এক লড়াকু-রুস্তমকে তুলে নিয়েছিলাম বলে। শিকারের মৌসুম তখন শেষ হয়ে আসছে এবং পরের কয়দিন রবিনকে খুঁজে তুলে আনার জন্য কোয়েল, ঘুঘু আর মাঝেসাঝে একটা তিতিরের চেয়ে বড় কিছু দেওয়া হল না।

গ্রীষ্মটা আমরা পাহাড়েই কাটালাম, এবং পাহাড়ের পাদদেশে নভেম্বরে বাৎসরিক ঠাইবদলের সময়ে, সুদীর্ঘ পনের মাইল পদযাত্রার শেষ ভাগে আমরা যেমন একটি হঠাৎ-ঘুরতি মোড় ঘুরেছি, পাহাড়ের গা বেয়ে লাফিয়ে নামল হনুমানদের একটা বড়-সড় দলের একটি, এবং রবিনের নাকের ক ইঞ্চি সামনে দিয়ে পথটা পেরোল। আমার শিস উপেক্ষা করে, যে পাশে খাদ, সে পাশ দিয়ে রবিন ছুটল হনুমানটার পেছনে, ওটা তড়িঘড়ি এক গাছে চড়ে নিরাপত্তা খুঁজল। এখানে সেখানে কয়েকটি গাছ, জমিটি ফাঁকা–তিরিশ বা চল্লিশ গজ খাড়াই নেমে গিয়ে আবার নিচের উপত্যকায় খাড়া উত্রাইয়ে নেমে যাবার আগে কয়েক গজের মত জমিটা সমতল।

এই সমতলের ডান পাশে কয়েকটি ঝোপ, সেগুলির মধ্যে দিয়ে চলে গেছে একটি গভীর নালা, সেটি তৈরি হয়েছে ওখান দিয়ে বৃষ্টির জল বয়ে যাবার সময়ে মাটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে। ঝোপগুলোতে রবিন ঢুকতে না ঢুকতে বেরিয়ে এল। কান পেছনপানে লেপটে, লেজ গুটিয়ে ছুটতে লাগল প্রাণভয়ে। এক অতিকায় চিতা তার পেছনে লাফাতে লাফাতে ছুটছে এবং প্রতি লাফে ওর নিকটতর হচ্ছে।

আমি বে-হাতিয়ার আর ফুসফুসের সবটুকু দম নিয়ে ‘হো’ আর ‘হর চেঁচিয়েই আমি যা পারলাম, করলাম। হট্টগোল উঠল চূড়ান্তে যখন একশো বা তারও বেশি হনুমান এর সঙ্গে যোগ করল বিভিন্ন পর্দায় তাদের বিপদজ্ঞাপক ডাক। পঁচিশ বা ত্রিশ গজ অবধি চলল এই মরিয়া এবং অসম রেস আর চিতাটি যেই রবিনের নাগালের মধ্যে পৌঁছল, কোন কারণ ব্যতিরেকেই সে বেগে মোড় ঘুরল এবং উধাও হয়ে গেল উপত্যকায়। ওদিকে রবিন পাহাড়ের এক ঢাল ঘুরে রাস্তায় আবার মিলিত হল আমাদের সঙ্গে। এই এক চুলের জন্যে প্রাণে বাঁচা থেকে রবিন দুটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শিক্ষা লাভ করে, তা সে পর-জীবনে কখনো ভোলে নি। প্রথম, হনুমানদের ধাওয়া করা বিপজ্জনক; দ্বিতীয়, কোন হনুমানের বিপদজ্ঞাপক ডাক এক চিতার উপস্থিতির জানান দেয়।

ওর শিক্ষায় যেখানে বাধা পড়ে, রবিন আধার বসন্তকাল সেখান থেকে শুরু করল, কিন্তু শীঘ্রই পরিষ্কার জানা গেল যে প্রথম জীবনের অবহেলা ও উপবাস ওর হার্টকে জখম করেছে, কেননা এখন ও সামান্যতম পরিশ্রমের পরই অজ্ঞান হয়ে যায়।

যখন তার প্রভু বাইরে বেরোন, তখন বাড়িতে পড়ে থাকার চেয়ে নৈরাশ্যজনক শিকারী কুকুরের কাছে আর কিছুই হতে পারে না। এখন পাখি শিকার রবিনের কাছে নিষিদ্ধ হয়ে গেল। তাই আমি যখন বড় জানোয়ার শিকারে বেরোতাম, ওকে সঙ্গে নিয়ে বেরোতে শুরু করলাম। হাঁস যেমন তড়িঘড়ি জলে অভ্যস্ত হয়, ও তেমনি অভ্যস্ত হল শিকারের এই নতুন রীতিতে আর তখন থেকে যখনি আমি রাইফেল হাতে বেরিয়েছি, ও আমার সঙ্গে থেকেছে।

খুব ভোর ভোর বেরিয়ে পড়া, চিতা অথবা বাঘের পদচিহ্ন খুঁজে নেওয়া এবং তা অনুসরণ করা এই রীতিতে আমরা চলি। যখন থাবার ছাপ দেখা যায়, আমি খোঁজ চালাই, আর আমরা যে জানোয়ারের পিছু নিয়েছি তা যখন জঙ্গলে ঢুকে যায়, রবিন খোঁজ চালায়। এইভাবে জানোয়ারটিকে পেয়ে যাবার আগে আমরা কখনো মাইলের পর মাইলও একটি জানোয়ারকে অনুসরণ করেছি।

মাচানে অথবা হাতির পিঠ থেকে জানোয়ারকে গুলি করা হয় যখন, তখনকার চেয়ে পায়ে হেঁটে শিকারকালে একটি জানোয়ারকে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলা অনেক বেশি সোজা। একটা কথা, যখন জখম জানোয়ারকে পায়ে হেঁটে অনুসরণ করতে হবে, তখন আনতাবড়ি গুলি মারা চলে না। আরেক কথা কি ওপর থেকে নিচে গুলি করার চেয়ে জানোয়ার যেখানে আছে, মাটির সেই সমান স্তর থেকে গুলি করলে শরীরের জরুরী অংশগুলি অনেক বেশি বিধবার নাগালের মধ্যে থাকে।

যাই হক গুলি ছোঁড়া বিষয়ে সর্বোত্তম যত্ন নেওয়ার পরেও কোন কোন সময়ে আমি চিতা ও বাঘকে শুধু জখমই করেছি। দ্বিতীয় বা তৃতীয় গুলিতে খতম হবার ৩৮ আগে তারা উন্মত্ত তাণ্ডব করে বেরিয়েছে, আর যত বছর আমরা একসঙ্গে শিকার করে বেরিয়েছি, তার মধ্যে মাত্র একবার রবিন আমাকে বিপদের ভেতর ফেলে পালিয়েছিল।

সেদিন কিছুক্ষণ অনুপস্থিতির পর যখন ও আমার কাছে ফিরে আসে, আমরা ঠিক করেছিলাম ব্যাপারটির ইতি এখানেই, আর কখনো সে প্রসঙ্গের উল্লেখ করা যাবে না। তবে আমরা এখন আরো বুড়িয়েছি, সম্ভবত এখন আমাদের ভাবপ্রবণতাও কমেছে। আর রবিন–ও ত কুকুরদের চূড়ান্ত আয়ুসীমা সত্তর পেরিয়েছে এখন যখন লিখছি, আমার পায়ের কাছে শুয়ে আছে ও, আর সেই বিছানা ছেড়ে ও কোনদিন উঠবেও না–বিজ্ঞ বিজ্ঞ বাদামী চোখের হাসিতে আর ছোট্ট বেঁটে লেজের নাড়ায় ও আমাকে অনুমতি দিচ্ছে এগিয়ে এসে আপনাদের সে কাহিনী বলতে।

চিতাটি সে নিবিড় ঝোপ-জঙ্গল থেকে একেবারে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। ওর বাঁ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন পানে না-তাকানো অব্দি আমরা ওকে দেখি নি।

চিতাটি এক অতিকায় মদ্দা, চামড়া চমৎকার গাঢ় রঙা, চকচকে, চামড়ার কালো বুটিগুলো দামী ভেলভেটের ওপর সুস্পষ্ট নকশার মত জ্বলজ্বলে। কোন তাড়াহুড়ো না করে এক স্থির লক্ষে রাইফেলে ওর ডান কাঁধে গুলি ছুঁড়লাম আমি পনের গজের হ্রস্ব পাল্লায়।

কত অল্পের জন্যে ওর হার্ট ফসকে ফেললাম তাতে এসে যায় না কিছু এবং পঞ্চাশ গজ দুরে বুলেট যখন ধুলো ওড়াচ্ছে, ও তখন শূন্যে, উঁচুতে এবং যে ঘন ঝোপ-জঙ্গল থেকে এক মিনিট আগে বেরিয়ে এসেছে তার মধ্যেই পড়ল ও ধপ করে ডিগবাজি খেয়ে। বিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ গজ অব্দি ও ঝোপের ভেতর দিয়ে হুড়মুড় করে চলেছে শুনলাম আমরা এবং তারপর যেমন অতর্কিতে আওয়াজটা শুরু হয়েছিল, তেমনি অতর্কিতে তা থেমে গেল। এই সহসা শব্দে বিরতিকে দুভাবে ব্যাখ্যা করা যায়; হয় কাবু হয়ে চলতে চলতেই পড়ে গিয়ে মরেছে ও, নয় পঞ্চাশ গজ দূরে পৌঁছে গেছে ফাঁকা জমিতে।

সেদিন অনেক দূর অব্দি চলে গিয়েছিলাম আমরা। সূর্য তখন অস্ত যাবার মুখে আর আমরা তখনো বাড়ি থেকে চার মাইল দূরে। জঙ্গলের এদিকটায়, মানুষের পা ঘনঘন পড়ে না এবং রাতে সে পথে কেউ যাবার কোনো সম্ভাবনা দশ লক্ষে একবারটিও নেই। চিতাটিকে রেখে চলে যাওয়ার শেষ এবং সর্বোত্তম কারণ হল, আমি নিরস্ত্র। ওকে একা ফেলে রেখে যাওয়া যায় না, আবর জখম জানোয়ারটির অনুসরণেও নিয়ে যাওয়া যায় না। তাই আমরা উত্তর দিকে ঘুরে বাড়ির পথ ধরলাম। জায়গাটি চিহ্নিত করে রেখে যাবার দরকার ছিল না আমার, কেননা প্রায় অর্ধ শতাব্দীর কাছাকাছি সময়কাল ধরে আমি এই জঙ্গলগুলির ভেতর দিয়ে হেঁটে গিয়েছি দিনে, প্রায়ই রাতেও, এবং চোখ বেঁধে দিলেও ও-জঙ্গলের যে কোন অংশে পথ খুঁজে পেতে পারি আমি।

রবিন আমাদের সঙ্গে আগের সন্ধ্যায় ছিল না, এবং পরদিন সকালে, রাত সরে গিয়ে সবে যখন দিনকে পথ ছেড়ে দিয়েছে, আমি আর রবিন হাজির হলাম সেই জায়গাটিতে, যেখান থেকে আমি গুলি ছুঁড়েছিলাম। রবিন চলছিল আগে, যেখানে চিতাটি দাঁড়িয়েছিল, সেখানকার জমি ও অত্যন্ত হুঁশিয়ারীতে পর্যবেক্ষণ করল। তারপর বাতাস শুঁকতে শুঁকতে ও এগলো ঝোঁপঝাড়ের কিনারায়, পড়ার সময়ে সেখানে চিতাটি বড় বড় ছোপ ফেলে গেছে রক্তের। জখমটি কোথায় হয়েছে তা নিশ্চিত জানবার জন্যে সে রক্ত পরীক্ষা করে দেখার কোন প্রয়োজন ছিল না আমার, কেন না আমি বুলেটটি বিধতে দেখেছি এবং ওপাশে দূরে সেই ধূলো ছিটকে ওঠাই হল প্রমাণ, বুলেটটি জানোয়ারটির শরীর ফুটো করে বেরিয়ে গেছে।

রক্তের নিশানা অনুসরণ করার দরকার পরে হতে পারে কিন্তু এখন এই মহুর্তে, অন্ধকারে চার মাইল পথ হাঁটার পর সামান্য বিশ্রামে ক্ষতি নেই কোনো, এবং অপরপক্ষে তা আমাদের পক্ষে খুব মূল্যবান বলেও প্রমাণিত হতে পারে। সূর্য এখন উঠি উঠি এবং এই নবীন প্রত্যূষে জঙ্গলের সকল প্রাণীরা এখন চলাফেরা করছে। আরো এগোবার আগে, জখম জানোয়ারটির প্রসঙ্গে ওদের কি বলবার আছে তা শোনা উচিৎ কাজ হবে।

কাছেই একটি গাছের নিচে পেয়ে গেলাম একটি শুকনো জায়গা, শিশিরে সে জায়গাটা ভিজে যায় নি। রবিন শুয়ে পায়ের কাছে, সিগারেটটি শেষ করেছি আমি, তখন আমাদের সামনে বাঁদিকে প্রায় ষাট গজ দূরে প্রথমে একটি, তারপর দ্বিতীয়টি, তারপর তৃতীয়টি, চিতল হরিণী ডাকতে শুরু করল। রবিন উঠে বসল, আস্তে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে চাইল, আমার চোখের ইশারা বুঝে তেমনি সন্তর্পণে যেদিকে হরিণীরা ডাকছে, সেদিকে মাথা ঘোরাল। যেদিন প্রথম ও হনুমানের বিপদজ্ঞাপক ডাক শোনে সেদিনের পর থেকে ওর অভিজ্ঞতা অনেক বেড়েছে এবং সব প্রাণীর মত রবিনও ঠিক বুঝতে পেরেছিল যে হরিণীরা জঙ্গলে অন্য সব প্রাণীদের চিতার উপস্থিতি সম্পর্কে হুঁশিয়ারী করে দিচ্ছে।

চিতলগুলি যে ভাবে ডাকছিল তাতে স্পষ্ট জানা যাচ্ছিল চিতাটিকে ওরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। আরেকটু ধৈৰ্য্য ধরলে ওরা বলে দেবে সেটা বেঁচে আছে কি না। ওরা মিনিট পাঁচেক ডেকেছে, তারপর হঠাৎ একবার সবাই ডেকে উঠল এক সঙ্গে, তারপর ফিরে গিয়ে আগের পর্যায়ে ডাকতে থাকল; চিতাটি জীবিত আছে, সে নড়াচড়া করেছে, এখন আবার স্থির হয়ে বসেছে। চিতাটি কোথায় আছে তা শুধু জানা দরকার আমাদের আর চিতলগুলির পিছু নিলে আমরা সে খবর পেতে পারি।

হাওয়া উজিয়ে পঞ্চাশ গজ চলে আমরা সেই নিবিড় ঝোপে-জঙ্গলে ঢুকলাম আর হরিণগুলিকে অনুসরণ করতে থাকলাম–খুব কঠিন কাজ নয়, কেন না বেড়ালের মত নিশ্চুপ রবিন যে কোন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলতে পারে, আর কোথায় যে পা ফেলতে হবে, অনেক দিনের অনুশীলন আমাকে তা শিখিয়েছে। ওদের কয়েক ফুটের মধ্যে না পৌঁছনো অব্দি চিতলগুলিকে দেখা যায় নি। ওরা দাঁড়িয়েছিল ফাঁকায়, চেয়েছিল উত্তর পানে। আমি যতদূর বুঝতে পারলাম, যেদিকে আগের সন্ধ্যায় হুড়মুড় শব্দ থেমে গিয়েছিল, ঠিক সেদিকেই চেয়েছিল।–

এখন পর্যন্ত চিতলগুলি আমাদের প্রভূত সহায়তায় এসেছে। ওরা আমাদের বলে দিয়েছে চিতাটি শুয়ে আছে ফাঁকায়, ও বেঁচে আছে, এখন ওরা আমাদের দিক বাতলে দিল। একঘণ্টা সময়কালের বেশির ভাগটাই আমাদের লেগে গেল এই খবর যোগাড় করতে এবং এখন যদি চিতলগুলি আমাদের দেখে ফেলে আর আমাদের উপস্থিতি বিষয়ে জঙ্গুলে প্রাণীদের সতর্ক করে দেয়, এ পর্যন্ত যে উপকার করেছে এক সেকেন্ডে, তা নস্যাৎ করে দেবে।

পায়ে পায়ে ফিরে গিয়ে ডাকন্ত হরিণদলের নিচের জমি দিয়ে গিয়ে ওদের পিছন থেকে গুলি ছোঁড়ার চেষ্টা করা। অথবা চিতার ডাক ডেকে ওদের আমাদের কাছ থেকে সরিয়ে দেওয়া, কোনটি বেশি ভাল হয় এই নিয়ে যখন ভাবছি–তখন একটি হরিণী মাথা ফেরাল, সিধে চাইল আমার চোখে চোখে। পর মুহূর্তে চীৎকার করে ‘সাবধান’! মানুষ!’ জানিয়ে দিয়ে যত জোরে পারে ছুটে পালাল ওরা। ফাঁকা জমিতে পৌঁছতে তখন আমার মাত্রই পাঁচগজ দৌড়বার আছে, কিন্তু আমি যতই চটজলদি হই না কেন, চিতাটি আরো চটজলদি এবং আমি ওর শরীরের পশ্চাৎভাগ আর লেজটি কয়েকটা ঝোপের পেছনে উধাও হতে দেখবার সময় পেলাম শুধু। চিতলগুলি অত্যন্ত কার্যকারিতায় আমার গুলি ছোঁড়ার সুযোগ নষ্ট করে দিয়েছে; আর চিতাটিকে এখন ফিরে আবার খুঁজে বের করে ধরে ফেলতে হবে–এবার সে কাজ করতে হবে রবিনকে।

চিতাটিকে স্থির হয়ে বসার সময় দিতে, যাবার সময়ে ও নিজের গায়ের যে গন্ধ রেখে গেছে বাতাসে, আমাদের পেরিয়ে সে গন্ধকে বয়ে চলে যেতে দিতে, আমি ফাঁকা জমিটিতে দাঁড়িয়ে থাকলাম কয়েক মিনিট। তারপর রবিনকে নিয়ে গেলাম বাতাসের গতিপথ পেরিয়ে, বাতাস বইছিল উত্তর থেকে। আমরা ষাট কি সত্তর গজ গেছি, রবিন ছিল আগে, ও থেমে গেল আর বাতাসের মুখোমুখি হতে ঘুরে দাঁড়াল। জঙ্গলে রবিন মূক হয়ে থাকে আর নার্ভের ওপর চমৎকার নিয়ন্ত্রণ আছে ওর। তবে একটি নার্ভ ওর পেছনের পা দুটির পিঠ দিয়ে নেমে গেছে। যখন ও এক চিতার দিকে চেয়ে থাকে অথবা চিতার গায়ের গন্ধ যখন তাজা এবং কড়া, তখন সে নার্ভটিকে ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। সেই নার্ভটি, এখন কুঁচকে শিউরে উঠছে এবং পেছনের পায়ের ওপর অংশের লম্বা লোমগুলোয় নাড়া দিচ্ছে।

গত গ্রীষ্মে, বহু সংখ্যক গাছ উপড়ে ফেলে এক অত্যন্ত উন্মত্ত ঘূর্ণিঝড় জঙ্গলের এ অংশটিতে আঘাত হেনেছিল; রবিন এখন চেয়েছিল, আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে চল্লিশ গজ দূরে, সেই ঝড়ে উপড়ে ফেলা একটি গাছের দিকে। গাছটির ডালগুলো আমাদের দিকে, গুঁড়িটির দুপাশে পাতলা ঝোঁপ এবং বিক্ষিপ্ত বেঁটে ঘাসের গোছা।

 অন্য যে কোনো সময়ে রবিন আর আমি সোজা ছুটে যেতাম শিকারের দিকে। কিন্তু এবারটা সামান্য একটু বাড়তি সাবধানতা দরকার ছিল। জখম হলে যে কারো তোয়াক্কা করে না এমন এক জন্তুর সঙ্গেই শুধু মোকাবিলা করছি না আমরা; তার ওপরে, আমরা একটি চিতার সঙ্গে মোকাবিলায় নেমেছি, যে মানুষের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভকে জইয়ে রাখতে পনের ঘণ্টা সময় পেয়েছে। ফলে তার সহজাত লড়িয়ে প্রবৃত্তিগুলি সবই পরিপূর্ণ জেগে উঠেছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।

আগের সন্ধ্যায় যে ২৭৫ রাইফেলটি ব্যবহার করেছিলাম, এ সকালে বাড়ি থেকে বেরুবার সময়ে সেটিই তুলে নিয়ে চলে এসেছি। যখন বহু মাইল পথ হাঁটতে হবে তখন বইবার পক্ষে এ রাইফেল ভাল, কিন্তু এক জখমী চিতার সঙ্গে মোকাবিলা করবার সময়ে এ হাতিয়ার কেউ বেছে নেবে না। তাই সরাসরি না এগিয়ে আমি এমন একটি পথ ধরলাম যা আমাদের পতিত গাছটির সমান্তরালে ওটির পনের গজ দূর দিয়ে নিয়ে যাবে।

রবিন রইল আগে, পায়ে পায়ে আমরা একই লাইনে চললাম। ডালগুলো পেরিয়েছি, পৌঁছিয়েছি গুঁড়িটার উলটো দিকে, তখন রবিন দাঁড়িয়ে গেল। ওকে নজর করে নিশানা বুঝে নিয়ে আমি অচিরে দেখলাম কিসে ওর চোখ টেনেছে–চিতাটির লেজের ডগা ধীরে উঠল, তেমনি ধীরে নিচে নামল, আক্রমণ করার আগে সর্বদা চিতা এই হুঁশিয়ারীই দিয়ে থাকে।

গোড়ালি ভর করে বোঁ করে ডাইনে ঘুরে গিয়ে আমি রাইফেলটি কাঁধে তুলেছি মাত্র, তখন চিতাটি মধ্যপথের ঝোপগুলো দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে বেরিয়ে এসে আমাদের দিকে ঝাঁপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে গুলিটি ছুঁড়লাম, ওকে মেরে ফেলা এমন কি আঘাত হানার আশাতেও নয়, ওকে লক্ষ্যচ্যুত করে দেবার জন্যে–তা বেরিয়ে গেল ওর পেটের তলা দিয়ে এবং ওর বাঁ ঊরুর মাংসল অংশ ফুটো করে চলে গেল। জখমের চেয়েও রাইফেলের আওয়াজেই, কাজ হল। আমাকে স্পর্শমাত্র না করে আমার ডান কাঁধ পেরিয়ে বাধ্য হয়ে বেঁকে চলে গেল চিতাটি। আর আমি আরেকটি গুলি মারতে পারার আগেই ও ওপারের ঝোপে উধাও হল!

আমার পায়ের কাছ থেকে নড়ে নি রবিন, আর যে জমির ওপর দিয়ে চিতাটি গেল, আমরা এক সঙ্গে তা পরখ করে দেখলাম। প্রচুর রক্ত দেখলাম আমরা, কিন্তু চিতাটির প্রচণ্ড লাফঝাঁপের ফলে পুরনো জখমগুলোর মুখ ছিঁড়ে তা পড়েছে, না নতুন গুলি লাগার ফলে, তা বলা অসম্ভব। যাই হক, তাতে রবিনের এসে গেল না কিছু, সে এক লহমাও ইতস্তত না করে নিশানা ধরে নিল। নিবিড় ঝোপের ভেতর দিয়ে কিছুদূর যাবার পর আমরা পৌঁছলাম হাঁটু সমান উঁচু ঝোপ-জঙ্গলে, তারপর দুশো গজ খানেক এগিয়েছি, তখনি আমাদের সামনে চিতাটিকে উঠে দাঁড়াতে দেখলাম আর ওর দিকে রাইফেলটি তাকে করতে পারার আগেই ও উধাও হল একটি ল্যান্টানা ঝোপের নিচে। ঝোঁপটির ডালপালা মাটিতে বিছানো এবং সেটি একটি কামরা-আঁবুর মত বড়। চিতাটিকে গা-ঢাকা দেবার এক আদর্শ স্থানই নেয় নি ঝোঁপটি, তার ওপরে ও চিটির পরবর্তী আক্রমণ শুরু করার সব সুযোগ সুবধাই হাতে তুলে দিয়েছে।

সকালের অ্যাডভেঞ্চারে আমি এবং রবিন খুব ভালই উৎরেছি, আমি সশস্ত্র হলেও চিতাটিকে আরো দূর ধাওয়া করা এখন বোকামিই হত, তাই বেশি ঝামেলা না বাড়িয়ে আমরা পেছন ফিরে বাড়ির পথ ধরলাম।

পরদিন সকালে আমরা লড়াইয়ের ময়দানে ফিরে এলাম। খুব ভোর থেকেই রওনা হবার জন্যে গোলমাল জুড়েছিল রবিন। সকাল বেলা জঙ্গলে যে কত বিচিত্র গন্ধ, সম্ভব হলে, সব উপেক্ষা করে ও আমাকে সে চার মাইল দৌড়ে পার করিয়ে ছাড়ত।

একটি ৪০০/৪৫০ রাইফেলে সজ্জিত করেছি নিজেকে, ফলে আগের দিন যেমন, তার চেয়ে অনেক খুশি বোধ হচ্ছিল। আমরা যখন ল্যান্টানা ঝোঁপটি থেকে বহু শত গজ দুরে তখন রবিনকে গতিবেগ কমিয়ে সাবধানে এগোতে বাধ্য করলাম, কেননা বহু ঘন্টা আগে যেখানে এক জখমী জানোয়ারকে ছেড়ে আসা হয়েছে, সেখানেই তাকে পাওয়া যাবে এ ধরে নেওয়া কখনো নিরাপদ নয়। নিচের মর্মান্তিক ঘটনাটি তারই সাক্ষ্য দেয়।

আমার পরিচিত এক শিকারী এক অপরাহ্নে একটি বাঘকে জখম করেন, এবং এক উপত্যকায় বহু মাইল ধরে রক্তের নিশানা অনুসরণ করেন। যে জায়গায় নিশানা-অনুসরণ ছেড়েছেন সেখান থেকে তা আবার শুরু করার জন্যে পরদিন সকালে একদল লোকসহ রওনা হলেন তিনি, ওদের মধ্যে একজন ওঁর গুলিবিহীন রাইফেল নিয়ে পথ দেখিয়ে চলছিল। পূর্বাহ্নের রক্তের নিশানার ওপর দিয়েই ও চলছিল। যেখানে বাঘটিকে ছেড়ে আসা হয়, সেখান থেকে ওরা তখনো এক মাইল দূরে; সামনের লোকটি হল স্থানীয় শিকারী–সে জখম বাঘটির উপর গিয়ে পড়ে হাঁটতে হাঁটতে এবং নিহত হয়। দলের বাকি সবাই পালায়, কয়েকজন গাছে উঠে পড়ে ও অন্যরা স্রেফ পালিয়ে যায়।

ল্যান্টানা ঝোঁপটির নির্ভুল অবস্থিতি আমি দেখে রেখেছিলাম, এখন রবিনকে নিয়ে গেলাম একটি লাইন ধরে, সেটি ঝোঁপটির যে দিকটি আচ্ছাদিত, বহতা-বাতাসের বিপরীত, সে দিকটির কয়েক গজ ধরে যায়। বাতাসের স্রোত কেটে পার হয়ে এক জানোয়ারের অবস্থিতি হদিশ করবার এ-কৌশল বিষয়ে যা কিছু জানবার যোগ্য তা রবিন জানে। আর আমরা তখন স্বল্প পথই গিয়েছি, ঝোঁপটি থেকে তখনো আমরা একশো গজ দূরে, তখন সে দাঁড়াল, ফিরল, বাতাসের মুখোমুখি হল এবং আমাকে বুঝিয়ে দিল ও চিতাটির গন্ধ পাচ্ছে।

আগের দিনের মতই ও এক শায়িত গাছের মুখোমুখি। চিতাটি আমাদের আক্রমণ করার পর, যে নিবিড় ঝোপ-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আমরা ওকে ল্যান্টানা ঝোঁপ অব্দি অনুসরণ করেছিলাম, গাছটি একই সঙ্গে সেই ঝোপেরই কিনারেও, সমান্তরালেও। গাছটির যে দিকটি আমার দিকে, সেখানে জমি কাঁকা কিন্তু দূরের দিকটায় কোমর-সমান ব্যাসোন্টা ঝোপের নিবিড় বন। আমাদের প্রথমের লাইনটি ধরে চলার জন্যে রবিনকে ইশারা জানিয়ে আমরা ল্যান্টানা ঝোঁপটি পেরিয়ে চলে গেলাম আর সে ঝোপে রবিন কোন আগ্রহই দেখাল না, চলে এল বৃষ্টির জলে ভাসিয়ে নেওয়া একটি খালে। এখানে আমার কোট খুলে ফেলে, সেলাইয়ে যতটা ভার সয়, কোটে ততগুলো পাথর ভরে নিয়ে এই অভিনব ঝোলা কাঁধের ওপিঠে ঝুলিয়ে গাছে কাছের ফাঁকা জমিতে ফিরে এলাম।

পাথর নামিয়ে কোট পরে নিয়ে, মুহূর্তে ব্যবহারের জন্যে রাইফেলটি প্রস্তুত রেখে আমি গাছটি থেকে পনের গজ দূরে স্বস্থানে দাঁড়ালাম এবং প্রথমে গাছটির ওপর, তারপর গাছ থেকে দুরের দিকের ঝোপগুলিতে পাথরগুলি ছুঁড়তে শুরু করলাম। উদ্দেশ্য–যেখানে আমি ওর মোকাবিলা করতে পারব, সেই ফাঁকা জমিতে তেড়ে বেরিয়ে আসতে চিতাটিকে বাধ্য করা। ও এখনো জীবিত তা ধরে নিয়েই অবশ্য পাথর ছুঁড়ছি। আমার গোলাবারুদ সব ফুরিয়ে গেলে আমি কাশলাম, হাততালি দিলাম, চেঁচালাম, কিন্তু কি সে বোমাবর্ষণের সময়ে, কি তার পরে, ও বেঁচে আছে তা বোঝতে চিতাটি নড়ল না–কোন আওয়াজও করল না।

সিধে গাছটি পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে ওর দূরের দিকটায় চেয়ে দেখলে এখন আমার ঠিক কাজই করা হয় বটে, কিন্তু মনে পড়ল একটি পুরনো জঙ্গুলে শাহীবাত, ‘ছাল না ছাড়ানো অব্দি চিতা মরেছে এ ধরে নেওয়া কখনোই নিরাপদ নয়। আমি গাছটিকে চক্কর দিতে শুরু করলাম, উদ্দেশ্য–ডালগুলির ঠিক তলাটা এবং গুঁড়িটার দৈর্ঘ্যের আগা থেকে গোড়া দেখতে না পাওয়া অব্দি চক্রটি ছোট করে আনতে থাকব। প্রথম চরটির বৃত্তসীমা ঠিক করলাম প্রায় পঁচিশ গজ, এবং বৃত্তপথে দুই তৃতীয়াংশ পর্যন্ত গেছি, তখন রবিন দাঁড়িয়ে গেল। কিসে ওর মনোযোগ আকর্ষিত হল তা দেখার জন্যে আমি নিচের দিকে চেয়েছ, পরপর গুরুগম্ভীর ও ক্রুদ্ধ গর্জন হল এবং চিতাটি সিধে আমাদের উদ্দেশ্যে তেড়ে এল। আমি শুধু দেখতে পেলাম, আমাদের পানে তাক করে এক সিধে লাইন বরাবর ঝোপ-জঙ্গলটি আছাড়ি-পাছাড়ি খেতে থাকল আর বাঁই করে ডাইনে আধা পাক খাবার ও রাইফেলটি তুলে ধরবার সময়টুকুই। পেলাম শুধু; তখন কয়েক ফুট দূরে চিতাটির মাথা ও কাঁধটা ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এল।

ওর ঝাঁপিয়ে পড়া, ও আমার গুলি ছোঁড়া একই সময়ে ঘটল, আর ও যেমন আমাকে পেরিয়ে চলে গেল, তেমনি আমি বাঁ দিকে পাশে সরে গিয়ে যদ্র পারি পিছন পানে হেলে আমার কোমরের কাছে রাইফেল ধরে দ্বিতীয় ব্যারেলটা থেকে গুলি ছুঁড়লাম।

কোন জখম জানোয়ার, তা সে চিতাই হক বা বাঘই হ’ক সে যখন মাথা বরাবর ঝাঁপ দেয় এবং উদ্দেশ্যে ব্যর্থ হয়, সর্বদাই, বিনা ব্যতিক্রমে সে সামনে চলে যেতে থাকে, আর আবার উত্যক্ত করা না হলে ফিরে এসে আক্রমণ করে না।

রবিনকে মাড়িয়ে-দেওয়া এড়াতেই বাঁ পাশে সরে গিয়েছিলাম আমি। আর এখন যখন তাকে খুঁজতে নিচের দিকে চাইলাম, কোথাও দেখা গেল না ওকে। যত বছর ধরে আমরা একসঙ্গে শিকার করছি, এই প্রথম এক সংকটকালে আমাদের ছাড়াছাড়ি হল, আর ও বোধহয় এখন বাড়ি ফেরার পথ খুঁজতে চেষ্টা করছে–মধ্যবর্তী চার মাইল জঙ্গলে ওর জন্যে যত বিপদ অপেক্ষা করে আছে, সেগুলি এড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা অতীব সামান্য। জঙ্গলটি বাড়ি থেকে দূরে হওয়ার দরুন, এটির সঙ্গে ওপরিচিত নয়, আর সেখানে ওকে যেসব স্বাভাবিক বিপদের মুখোমুখি পড়তে হতে পারে, তার ওপরে আছে ওর হার্টের দুর্বল অবস্থার কারণে শঙ্কা।

তাই প্রবল উদ্বেগে. ওর খোঁজে বেরুবার জন্যে আমি পেছনে ফিরলাম আর যখন ফিরছি.. চোখে পড়ল মাত্র একশো গজ দূরে একটি ছোট ফাঁকা জমির কিনারে একটি গাছের গুঁড়ির পেছন থেকে ওর মাথাটি বেরোচ্ছে। হাত তুলে যখন ইশারা করলাম, ও ঝোপ-জঙ্গলে অন্তর্ধান করল, তবে একটু বাদে, চোখ নামিয়ে কান ঝুলিয়ে ও নীরবে আমার পায়ের কাছে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে এল। রাইফেল নামিয়ে রেখে ওকে তুলে নিলাম কোলে। জীবনে এই দ্বিতীয়বার ও আমার মুখ চেটে দিল–চাটতে চাটতে গলার ছোট ছোট শব্দে ও বলে চলল, আমাকে অক্ষত দেখে ও কত খুশি হয়েছে, আমাকে ফেলে পালিয়ে যাবার জন্যে ও কি ভীষণ লজ্জিত নিজের আচরণে।

যে অপ্রত্যাশিত বিপদ আকস্মিক আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, তাতে আমাদের দুজনের আচরণ যেন দৃষ্টান্তের মত বুঝিয়ে দিয়ে গেল যে বিপদ ভয় দেখাচ্ছে, তা যদি কানে-শোনা যায়, চোখে দেখা না যায়, তাহলে সে অনিশ্চিত বিপদের মুখে মানুষ কি করে আর কুকুর কি করে। রবিনের ক্ষেত্রে ‘বিপদটি’, নীরবে দ্রুত পিঠ ফিরিয়ে পালিয়ে ওকে নিরাপত্তা খুঁজতে বাধ্য করেছিল; আর আমার বেলা ‘বিপদটি আমার পা দুটো মাটির সঙ্গে আঠার মত সেঁটে দিয়েছিল আর দ্রুত বা যে কোন রকমে পিঠ ফিরিয়ে পালানো অসম্ভব করে তুলেছিল।

আমাদের অস্থায়ী বিচ্ছেদের জন্যে ওকে দোষ দেবার কিছু নেই একথা যখন রবিনকে মন-খুশ করে বোঝাতে সক্ষম হলাম, ওর ছোট্ট শরীরের কাপুনি যখন থামল, ওকে নামিয়ে দিলাম। যে চিতাটি এমন হিম্মতে লড়েছে, শেষ দান যে জিতে গিয়েছিল প্রায়, সে যেখানে মরে পড়ে আছে, দুজনে সেখানে এগিয়ে গেলাম।

আমি আপনাদের গল্পটি বললাম, আর যখন বলছিলাম, তার মধ্যেই রবিন-মানুষ সবচেয়ে বিশাল হৃদয়, সবচেয়ে বিশ্বাসী যে বন্ধুকে পেয়েছে–সেই রবিন চলে গেছে আনন্দ-মৃগয়া- ক্ষেত্রে আমি জানি, সেখানে দেখব সে আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।