প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

৫. তল্লাদেশের মানুষখেকো বাঘ

৫. তল্লাদেশের মানুষখেকো বাঘ

সারা হিমালয়ের পাদদেশ জুড়ে বিন্দুখেড়ার মত এমন একটা সুন্দর ক্যাম্প করার জায়গা খুঁজে মেলা ভার। বিশেষ করে যখন পলাশের আগুন রঙে সারা গ্রামটা রাঙা হয়ে থাকে। আপনি মনে মনে একটা ছবি এঁকে নিন। মাথার ওপর লাল পলাশের চাঁদোয়া, নিচে ছোট্ট ছোট্ট সাদা তাবু আর এ-গাছ থেকে ও-গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে অসংখ্য রামধনুকের রঙ পাখায় মাখা বেনে, সাতসয়ালী, সোনা বউ, টিয়া, সোনালী কাঠ ঠোকরা, চুড়ো ফিঙে। তাদের লাফালাফিতে অজস্র পলাশ ফুল ঝরে ঝরে তাবুর বাইরের জমিটা একটা আগুন রঙা গালচের মত হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে তাকান। ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাদদেশের ওপরে একের পর এক মাথা তুলে উঠেছে হিমালয়ের পর্বতশ্রেণী, মিশেছে চিরতুষারাবৃত চুড়ায়। এই ছবিটা মনে মনে আঁচ করে নিলেই বিন্দুখেড়ায় ১৯২৯ সালের এক ফেব্রুয়ারির সকালে আমাদের ক্যাম্পটি সম্বন্ধে আপনার মোটামুটি একটা ধারণা হবে।

বিন্দুখেড়া, প্রায় বার মাইল লম্বা আর দশ মাইল চওড়া এক বিস্তীর্ণ ঘেসো জমির পশ্চিমপ্রান্তে এই ক্যাম্পের জায়গাটির নাম। স্যার হেনরী র‍্যামসে যখন কুমায়ুনের রাজা ছিলেন তখন এই সমতলভূমি নিবিড়-চাষাবাসের আওতায় আনা হয়েছিল। কিন্তু আমার গল্প যখন শুরু তখন এখানে তিনটে মাত্র ছোট ছোট গ্রাম আর সমতলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ক্ষীণস্রোতা পার্বত্য নদীটির দুইধার দিয়ে সামান্য কয়েক একর জমির চাষবাস। আমরা পৌঁছনোর কয়েক সপ্তাহ আগেই সেই সমতল ভূমির ঘাস। পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল তবে জায়গায় জায়গায় যেখানে জমি ভিজে, সে জায়গাগুলি বিভিন্ন আকারের দ্বীপের মত দাঁড়িয়েছিল সবুজ ঘাস বুকে নিয়ে। এই রকম একটা ঘাসের দ্বীপের মধ্যেই আমরা আমাদের শিকার খুঁজে পাব আশা করেছিলাম। যার জন্যে আমাদের এই এক সপ্তাহের জন্যে বিন্দুখেড়ায় আসা। এই জায়গাটিতে আমার প্রায় বছর দশেক শিকারের অভিজ্ঞতা তাই জমির প্রতিটি ফুট জায়গা আমার চেনা। স্বভাবতই শিকার খুঁজে বার করার ভারও ছিল আমারই ওপর।

তরাই অঞ্চলে যতরকম শিকারের কথা আমি জানি তার মধ্যে সবচেয়ে আনন্দের হচ্ছে পোষা, শেখানো হাতির পিঠে বসে বন্দুক চালানো। দিন যতই দীর্ঘ হক না এতে প্রতিটি মুহূর্ত ভরে ওঠে আনন্দে আর উত্তেজনায়। কারণ এভাবে শিকার করলে রকমারি শিকার পাওয়া যায়। একটা ভাল দিনে আমরা সুন্দরি, কাদাখোঁচা পাখি থেকে আরম্ভ করে চিতা, বার শিঙা হরিণ পর্যন্ত প্রায় আঠার রকমের বিভিন্ন শিকার পেয়েছিলাম। আর একটা বড় কারণ হচ্ছে যে এভাবে শিকার করলে বহু বিচিত্র ধরনের পাখি চোখে পড়ে। ঘাসের ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে গেলে পাখির জগতের এই বৈচিত্র্যের সম্ভার সাধারণত চোখের আড়ালেই থেকে যায়।

ফেব্রুয়ারির সকালে যেদিন আমরা প্রথম শিকারে বেরোলাম সেদিন আমাদের সঙ্গে ছিল নয়টি বন্দুক আর পাঁচজন ছিলেন দর্শকের ভূমিকায়। সকাল সকাল প্রাতরাশ সেরে আমরা হাতির পিঠে চড়ে বসলাম। দু’ধারে দু’জন করে বন্দুকধারীর মধ্যে একটি করে হাতি। এইভাবে লাইন সাজানো হল। আমি ছিলাম লাইনের ঠিক মাঝখানটিতে। আমার দু’দিকেই চারজন করে বন্দুকধারী চারটি হাতি। দক্ষিণদিকে মুখ করে আমরা রওনা দিলাম। আমাদের লাইনের প্রায় পঞ্চাশ গজ আগে একজন বন্দুক নিয়ে চলল। আমাদের বন্দুকের সীমানার বাইরে গিয়ে কোনো পাখির ঝাঁক যদি ডানদিকের জঙ্গলের দিকে মোড় নেয় তাহলে ও গুলি করবে। হাতির লাইনে যদি কখনও রকমারি শিকারে বেরোন সব সময়ে লাইনের পাশে জায়গা নেবেন। তবে, বন্দুক আর রাইফেল এ দুটো চালানোতেই আপনাকে সমান দক্ষ হতে হবে। কারণ হাতির লাইনে ধরা পড়লে শিকার সব সময় একপাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আর যে জানোয়ার অন্য শিকারীদের গুলি থেকে বেঁচে পালাবার চেষ্টা করে তাকে তাক করে মারার মত কঠিন কাজ বড় একটা নেই।

ভারতবর্ষের জঙ্গলগুলি, ঝকঝকে সুন্দর ভোরে ফুলফলের নানারকম মিষ্টি গন্ধে যেন মেতে থাকে। সেই গন্ধ বেশিক্ষণ নাকে গেলে একটা শ্যাম্পেনের মত আমেজ আসে। শুধু মানুষের নয়, পাখিদেরও সেই গন্ধে নেশা হয়। আর শিকারী আর শিকার দু’জনেই নেশার ঘোরে লক্ষ্যবিন্দুতে স্থির থাকতে না পারলে পাখি মারা কিরকম কঠিন কাজ হয়ে ওঠে ভেবে দেখুন।

তাই অতি উৎসাহী শিকারীর বন্দুকের সঙ্গে উড়ন্ত বুনো পাখির যোগ প্রায়শই ঘটে না। এরকম ঝকঝকে সুন্দর শিকারের দিনে সকাল আর সন্ধ্যের কয়েকটা মিনিট বড় ক্লান্তিকর। তাক করে করে চোখ টনটন করে, সারা শরীরে ব্যথা ধরে যায়। সেদিন সকালে পাখি অনেক ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিকারীদের হাত ঠিক হয়ে এল। আমরা মারলাম পাঁচটা ময়ূর, তিনটে লাল বুনো মুরগি, দশটা কালো তিতির, চারটে গৌর তিতির, দুটো ঝোপের গুন্দরি আর তিনটে খরগোশ। একটা ভাল সম্বর হরিণেরও দেখা পেয়েছিলাম কিন্তু বন্দুক ঠিক মত তাক করার আগেই হরিণটা দৌড়ে জঙ্গলের মধ্যে আশ্রয় নিল।

যেখানে জঙ্গলের একটা দিক অনেকটা জিভের মত সমতলভূমিতে এগিয়ে এসেছে কয়েকশো গজ, সেখানে শিকারের দলটিকে দাঁড় করালাম। এখানে সবসময়ে অসংখ্য ময়ূর ও বুনো মুরগি পাওয়া যায় বলে জঙ্গলটি বিখ্যাত। কিন্তু বহু নালা খাল খন্দ জঙ্গলের রাস্তাটিকে দুর্গম করে রেখেছে যার ফলে আমাদের লাইনটি সোজাসুজি এগোতে পারবে না। আমাদের লাইনের পেছনে একজন বন্দুক নিয়ে ছিলেন যার এ ধরনের শিকারের অভিজ্ঞতা জীবনে প্রথম। তাই হাতির দলকে আঁকাবাঁকা পথে না নিয়ে যাওয়াই স্থির করলাম। কয়েক বছর আগে এই জঙ্গলেই আমি বসেছিলাম উইন্ডহ্যামের সঙ্গে একটা বাঘের সন্ধানে। তখনই আমি জীবনে প্রথম দেখি একটি রঙিন বাদুড়। এই সুন্দর বাদুড়গুলো যখন এক গাছের ছায়া থেকে আরেক গাছের ছায়ায় দৌড়াদৌড়ি করে তখন মনে হয় যেন রঙচঙে প্রজাপতি। এগুলি সাধারণত দেখা যায় গভীর শরবনের মধ্যে।

শিকারের দলটিকে দাঁড় করিয়ে আমি হাতির দলকে পুবমুখো করে এক লাইনে রওনা করে দিলাম। জমির ওপর থেকে শেষ হাতিটি পা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমি লাইনটিকে আবার দাঁড় করালাম আর মুখ ঘুরিয়ে দিলাম উত্তরদিকে। এবার আমাদের সোজাসুজি সামনে নাগাধিরাজ হিমালয়। আকাশ থেকে একখণ্ড শুভ্র মেঘ নেমে এসেছে পৃথিবীর খুব কাছাকাছি। এত ঘন, যেন মনে হয় পরীরা ওর ওপর দাঁড়িয়ে নাচতে পারে।

যখন সতেরটি হাতি একসঙ্গে এক লাইনে চলে তখন পায়ের নিচের জমির ওপর নির্ভর করে তাদের গতিবেগ পরস্পরের মধ্যের ব্যবধান। যেখানে ঘাস খুব গভীর সেখানে লাইনটির দৈর্ঘ্য আমি একশো গজের মধ্যে কমিয়ে এনেছিলাম। যেখানে ঘাস কম সেখানে দৈর্ঘ্য ছিল দুশো গজের মতন। উত্তরদিকে প্রায় মাইলখানেক এগনোর পথে আমরা আরো গোটা তিরিশেক পাখি আর একটা চিতা পেয়েছিলাম। হঠাৎ লাইনের সামনে লাফ দিয়ে উঠল একটা ভুই পাচা। এই পাচাগুলো সাধারণত থাকে বনরুই, শজারুর পরিত্যক্ত গর্তে। অনেকগুলো বন্দুক উঁচিয়ে ধরা হয়েছিল বটে কিন্তু পাখিটা কি মালুম হওয়ার পর বন্দুকগুলো নামিয়ে নেওয়া হয়। এগুলোর আকার তিতিরের প্রায় দ্বিগুণ, ডানাটা সাদা আর পাগুলো সাধারণ পাচার থেকেও লম্বা। যখন এরকমভাবে শিকারী হাতির বেড়াজালে পড়ে যায় তখন এই প্যাচাগুলি মাটিতে নামার আগে প্রায় পঞ্চাশ ষাট গজ খুব নিচে দিয়েও উড়ে যায়। আমার মনে হয় ওরা এটা ইচ্ছে করেই করে যাতে হাতির পাল ওদের গর্তগুলো পেরিয়ে যায়। কিন্তু দ্বিতীয়বার হাতির দল এগিয়ে এলেই ওরা মাথার ওপর দিয়ে উড়ে ফিরে যায় ওদের গর্তের দিকে। এ নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম আমি বড় একটা দেখি নি। কিন্তু আজকের পাচাটার ধরণ’ধারণ একটু অন্যরকম মনে হল। পঞ্চাশ ষাট গজ সোজা উড়ে গিয়ে পাচাটা মাটিতে নামল না হঠাৎ ঘুরে ঘুরে আরো ওপরে উঠতে লাগল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ব্যাপারটা আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। বাঁ দিকের জঙ্গল থেকে হঠাৎ বিদ্যুৎগতিতে উড়ে এল একটা বাজ। পাচাটা গর্তে ফিরতে না পেরে প্রাণ বাঁচানোর জন্যে বাজটার থেকেও উঁচুতে থাকার চেষ্টা করছিল। ওপরে ওঠার জন্যে প্রাণপণে ডানা ঝাঁপটাচ্ছিল সেটা। বাজটাও বিশাল ডানার বিস্তারে হাওয়া কেটে ঘুরে ঘুরে উঠছিল তার শিকারের ওপরে। সবাইয়ের এমন কি মাহুতদেরও দৃষ্টি তখন ওই দিকে–তাই লাইনটি আমি সেখানেই দাঁড় করিয়ে দিলাম।

উচ্চতা পরিমাপের কোনো নির্দিষ্ট মাপকাটি না থাকলে উচ্চতা বোঝা কঠিন। তবে আমার মনে হয় দুটো পাখিই তখন প্রায় হাজার ফুট মতন উঁচুতে। পাচাটা তখন চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে প্রায় সাদা মেঘটার কোণা ছুঁই ছুঁই করছে। আমার মনে হল মেঘের পরীরা যেন নাচ থামিয়ে রুদ্ধশ্বাসে হাত বাড়িয়ে আছে প্যাচাটাকে বুকে টেনে নেওয়ার জন্যে। একবার মেঘের আড়ালে ডুব মারতে পারলেই পাঁচটা নিশ্চিন্ত। বাজটাও বুঝতে পেরেছিল পাচার মতলব। সেও ডানা ঝাঁপটিয়ে, চক্রটিকে ক্রমেই ছোট করে এনে তীব্র গতিতে উঠছিল ওপর দিকে। আমরা সবাই তখন দম বন্ধ করে একই কথা ভাবছি পাচাটা কি মেঘের আড়ালে পালাতে পারবে না ভয়ে দিশেহারা হয়ে গোঁত্তা মেরে নিচে নেমে গর্ততে লুকোবার চেষ্টা করবে? ভাল করে দেখার জন্যে তখন অনেকেরই পকেট থেকে দূরবীন বেরিয়ে এসেছে, চারিদিকে ভরে উঠেছে হিন্দী ইংরিজী এই দুই ভাষাতেই উত্তেজিত স্বগতোক্তিতে।

না! আর বোধহয় পারল না।

নিশ্চয়ই পারবে! আলবৎ পারবে।

আর একটুখানি গেলেই হয়ে যাবে।

কিন্তু দেখ, দেখ। বাজটা কত কাছে এগিয়ে এসেছে।’

হঠাৎ দেখা গেল আকাশে দুটো পাখির জায়গায় শুধু একটা মাত্র পাখি ঘুরপাক খাচ্ছে। আর একটা পাখি সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়েছে। বাহবা! বাইবা! শাবাশ! শাবাশ! প্যাচাটা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে বেঁচে গেছে! সবাই একসঙ্গে হাততালি দিয়ে উঠল, কেউবা আকাশের দিকে সাদা টুপি নেড়ে অভিনন্দন জানাল প্যাচাটিকে। বাজটা কোনো কিছু গ্রাহ্য না করে শো করে ডানায় ভর দিয়ে নেমে এল তারপর বসল যে শিমূল গাছ থেকে প্যাচাটিকে তাড়া করেছিল তারই একটি ডালে।

মানুষের কোন ঘটনায় যে কি প্রতিক্রিয়া হয় বলা বড় কঠিন। সেদিন সকাল থেকে আমরা চুয়ান্নটি পাখি আর চারটি জানোয়ার মেরেছিলাম–অনেকগুলি আমাদের তাক ফস্কে পালিয়েও গিয়েছে। তা নিয়ে বড় একটা হইচই হয় নি। আর এখন দর্শক, শিকারী, মাহুত সবাই যেন বাজের কবল থেকে পাচাটা বেঁচে যাওয়ায় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেঁচেছে। আনন্দিত হয়ে উঠেছে।

সমতলভূমির উত্তর প্রান্তে এসে আমি আবার হাতির দলটিকে দক্ষিণ মুখে ফেরালাম। যে পার্বত্য নদীটির জলে তিনটি গ্রামের চাষের জমি সেচ হয় তারই ডানদিকের পাড় দিয়ে এগোতে থাকলাম আমরা। এখানকার জমি ভিজে স্যাঁতসেঁতে আর ঘাসও খুব ঘন। আমরা সবাই রাইফেল তুলে তৈরি হলাম। এ জায়গাটায় অনেক হরিণ আর বারশিঙা পাওয়া যায়। তাছাড়া একটা চিতাও এখানে পাব আমরা আশা করেছিলাম।

আমরা নদীর পাড় দিয়ে প্রায় মাইলখানেক এগিয়ে গেলাম। পথে আমরা মারলাম পাঁচটা ময়ূর, চারটে কাঠ ময়ূর, তিনটে কাদাখোঁচা আর একটা বেশ ভাল শিংঅলা বরা হরিণ। এগিয়ে চলেছি ধীরে ধীরে। হঠাৎ আমার কানের কাছে যেন বাজ ফাটল। আমার বাঁ কানের ভেতরের চামড়া যেন জ্বলে গেল, ভেতরের পর্দা গেল ফেটে। আমারই হাতির হাওদার পেছনে একজন দর্শক খুব জোরাল একটা রাইফেল হাতে করে বসেছিলেন। তার হাত থেকে আচমকা রাইফেল ছুটে যাওয়াতেই এই বিপত্তি। এরপরে সারাটা দিন আমার কাটল অবর্ণনীয় কষ্টে। কোনোরকমে বিনিদ্র একটা রাত কাটিয়ে পরদিন খুব ভোরে কালাধূঙ্গির পথে পা বাড়ালাম। কালাধূঙ্গিতে আমার বাড়ি। দূরত্ব আমাদের ক্যাম্প থেকে প্রায় পঁচিশ মাইল। আমি যখন রওনা হলাম ক্যাম্পে তখনও কেউ জেগে ওঠে নি।

কালাধুঙ্গিতে নতুন পাস করা তরুণ ডাক্তারটিও পরীক্ষা করে বললেন আমার কানের পর্দাই ফেটেছে। মাসখানেক পর আমরা নৈনিতালে আমাদের গ্রীষ্মকালীন বাড়িতে গেলাম। সেখানেও র‍্যামসে হাসপাতালে নৈনিতালের সিভিল সার্জেন কর্নেল বারবার একই কথা বললেন। এরপরে বেশ কিছুদিন চলে গেল। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যে আমার মাথার মধ্যে একটা ফোঁড়া হচ্ছে। আমার এই অসুস্থতায় আমি তো কষ্ট পাচ্ছিলামই, আমার দুই বোনের অশান্তি যেন ছিল আরও বেশি। হাসপাতালের চিকিৎসায় যখন কোনো ফলই পেলাম না তখন আমার বোনেদের ও ডক্টর বারবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমি চলে যাওয়া স্থির করলাম।

আমি কিন্তু কারো সহানুভূতি আকর্ষণের জন্যে এ দুর্ঘটনার কথা বলি নি। এটি বললাম তার কারণ এরপরে যে তল্লাদেশ মানুষখেকো বাঘের গল্প আপনাদের শোনাব তার সঙ্গে এই দুর্ঘটনার যোগ খুব গভীর।

.

০২.

১৯২৯ সালে বিল বেনেস ও হ্যাম ভিভিয়ান ছিলেন যথাক্রমে আলমোড়া ও নৈনিতালের ডেপুটি কমিশনার। দুজনকেই দারুণ ভোগাচ্ছিল দুটো মানুষখেকো বাঘ। প্রথমজনকে তল্লাদেশের মানুষখেকো বাঘ আর দ্বিতীয়জনকে চৌগড় মানুষখেকো বাঘ।

আমি ভিভিয়ানকে কথা দিয়েছিলাম তার বাঘটিই প্রথমে মারার চেষ্টা করব। কিন্তু সে শীতে বাঘটা বিশেষ উপদ্রব করে নি। তাই ভিভিয়ানের অনুমতি নিয়ে আমি বেনেসের অঞ্চলের বাঘটাই আগে মারার সংকল্প করলাম। আমার এই সংকল্পের পেছনে আর এটা ধারণাও কাজ করছিল। আমি ভেবেছিলাম বাঘের খোঁজে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরলে দুর্ঘটনাজনিত মানসিক অবসাদ আমি অনেকখানি কাটিয়ে উঠতে পারব আর শারীরিক অক্ষমতাও আস্তে আস্তে সয়ে যাবে। যাই হক শেষ পর্যন্ত চলে গেলাম তল্লাদেশে।

আমার এই গল্পটি তল্লাদেশের বাঘকে নিয়ে এবং আমি “জাঙ্গল লোর” বইটি না লেখা পর্যন্ত এ গল্প কাউকে বলি নি। কারণ “জাঙ্গল লোর” বইটি না পড়ে নিলে আমি ছোটবেলার এবং পরেও কিভাবে জঙ্গলে হাঁটতে শিখেছি, রাইফেল চালাতে শিখেছি তা না জানলে পর, যাঁরা সে সময়ে কুমায়ুনে ছিলেন না তাদের কাছে গল্পটি অবিশ্বাস্য মনে হবে।

অচিরেই আমার যাওয়ার প্রস্তুতি পর্ব শেষ হল এবং ৪ঠা এপ্রিল আমি নৈনিতাল থেকে রওনা হলাম। সঙ্গে নিলাম ছ’জন গাড়োয়ালী। তাদের মধ্যে ছিল মাধো সিং, রাম সিং, এলাহাই নামে এক রাঁধুনী আর এক ব্রাহ্মণ, নাম গঙ্গারাম। গঙ্গারামের আমার সঙ্গে যাওয়ার উৎসাহ ছিল খুব। ওর কাজ ছিল টুকিটাকি ফাইফরমাশ খাটা। চোদ্দ মাইল হেঁটে কাঠগুদামে নেমে আমরা ট্রেনে উঠলাম সন্ধেবেলা। বেরিলি, পিলিভিট হয়ে টনকপুর গিয়ে পৌঁছলাম পরদিন দুপুর বেলায়। এখানে বেনেস তার পেশকারকে পাঠিয়েছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। তার কাছেই শুনলাম যে তার আগের দিনই তল্লাদেশের মানুষখেকো একটি ছোট ছেলেকে মেরেছে। সে আরো জানাল যে বেনেসের নির্দেশ অনুযায়ী, আমার শিকারের টোপ হিসেবে দুটি বাচ্চা মোষ চম্পাবত দিয়ে তল্লাদেশে পাঠানো হয়েছে। আমার লোকজনেরা রান্নাবান্না করে তাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে নিল। আমি খেয়ে নিলাম ডাকবাংলোয়। সেই রাতেই আমরা পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়লাম চব্বিশ মাইল দূরে কালাধূঙ্গার (কালাধুঙ্গি কিন্তু আলাদা) পথে।

রাস্তার প্রথম বার মাইল–বরমদেও হয়ে পবিত্র পূর্ণগিরি পাহাড়ের নিচ পর্যন্ত অধিকাংশই গভীর বনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ওই পাহাড়ের নিচেই রাস্তাটা শেষ হয়ে গেছে। এখান থেকে কালাধূঙ্গায় যাওয়ার দুটো পায়ে চলা পথের মধ্যে একটা বেছে নিতে হবে। একটি যেটি একটু দীর্ঘ সেই পথটি বাঁ দিক দিয়ে খাড়া উঠে গিয়ে পূর্ণগিরি মন্দিরে পৌঁছেছে, সেখান থেকে উত্রাইয়ের রাস্তা নেমে গিয়েছে কালাধূঙ্গা গ্রামে। আরেকটি পথ গিয়েছে কোলিয়ারের দশ লক্ষ ঘন ফুট শালকাঠ কাটার সময় তৈরি ট্রামওয়ে লাইনের সমান্তরাল হয়ে (আসলে এটি রেলপথ। তখন কাঠ চালানের জন্য তৈরি রেলপথকে ট্রামওয়ে লাইনই বলা হত।-সম্পাদিকা)। সারদা নদীর খাদ ধরে চার মাইল লম্বা কোলিয়ারের ট্রামওয়ে লাইনটি বহুদিন হল জলে ভেসে গেছে। কিন্তু যেখানে পাহাড়ের পাথুরে অংশের ওপর দিয়ে পাথর কেটে লাইন বসানো হয়েছিল, সেখানে তার কিছু অংশ এখনও রয়েছে। আমার সঙ্গে ভারি বোঝা নিয়ে যে গাড়োয়ালীরা চলছিল তাদের পক্ষে এই রাস্তাটা পার হওয়া ক্রমেই দুঃসাধ্য হয়ে উঠছিল। তার ওপরে নদীর খাদ ধরে আমরা আধাআধি পথ আসতে না আসতেই রাতের অন্ধকার নেমে এল। রাতে তাবু ফেলার মত একটা জায়গা খুঁজে বার করা খুব সহজ হল না। কয়েকটা জায়গা মিলল বটে তবে ওপর থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ে বিপদ ঘটবার আশঙ্কা আছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর শেষ পর্যন্ত একটা চাতালের মত পাথর পাওয়া গেল। মাথার ওপর ছাদের মত আরেকটি পাথর থাকার জায়গাটা মোটামুটি নিরাপদ মনে হল। এখানেই আমরা রাত কাটানো স্থির করলাম। আমি খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম। আমার লোকজন নদীর ভেসে আসা কাঠকুটো কুড়িয়ে রান্নাবান্না সেরে নিচ্ছিল। আমি জামাকাপড় ছেড়ে ক্যাম্প খাটে গা এলিয়ে দিলাম। আমার ক্যাম্পিং-এর সাজসরঞ্জাম বলতে এই ক্যাম্প খাটটি ছাড়া ছিল একটা হাতমুখ ধোওয়ার পাত্র আর একটা চল্লিশ পাউন্ডের তাবু।

সারা দিনটা খুব গরম ছিল আর টনকপুরে ট্রেন থেকে নেমে আমরা এ পর্যন্ত প্রায় ষোল মাইল হেঁটেছি। আমার সারা শরীর জুড়ে একটা ক্লান্তির আমেজ–বেশ আরাম করে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানছিলাম। হঠাৎ আমার চোখে পড়ল নদীর ওপারে তিনটে আলো। নেপাল অঞ্চলে প্রত্যেক বছরই বনে আগুন লাগানো হয় এই এপ্রিল মাস নাগাদ। এই আলোগুলো দেখে আমার মনে হল নদীর খাদের হাওয়ায় ধিকিধিকি জ্বলা কোনো মরা গাছের কাঠ হয়তো জ্বলে উঠেছে। আমি শুয়ে আলোগুলো দেখতে দেখতেই আর একটু ওপরে আরো দুটো আলো জ্বলে উঠল। একটু পরেই নতুন দুটি আলোর বাঁ দিকেরটি ঢালু জমির পাড় দিয়ে আস্তে আস্তে নেমে এসে প্রথম তিনটি আলোর মাঝেরটির সঙ্গে মিশে গেল। এবার আমি নিঃসন্দেহ হলাম যে ওগুলো আলোই, কোনো আগুন নয়। আলোগুলো সব একই আকারের, ব্যাসের দৈর্ঘ্য হবে দু ফুট মত। আলোগুলো জ্বলছিলও স্থির, অচঞ্চল শিখায়, কোনো ধোঁয়ার চিহ্নমাত্র ছিল না। তারপরেই আরো কিছু আলো দেখা গেল–কিছু বাঁ দিকে, কিছু পাহাড়ের আরো ওপরে। তখন আমার মনে হল কোনো বড় জমিদার হয়তো শিকার করতে বেরিয়ে দামী কিছু হারিয়ে ফেলেছেন আর লোকজনকে লণ্ঠন হাতে পাঠিয়েছেন তারই সন্ধানে। একথা আমার হঠাৎ কেন মনে হল জানি না কিন্তু ওই বরফগলা নদীর ওপারেও নানারকম অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে।

আমার লোকজন তখন আমারই মত আলোগুলো সম্বন্ধে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। নিচে নিস্তরঙ্গ নদী, চারিদিকে জঙ্গলের সীমাহীন স্তব্ধতা। আলোগুলোর দূরত্ব আমাদের আস্তানা থেকে প্রায় দেড়শো গজ। আমি জিজ্ঞাসা করলাম তারা কোনো গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে কি না। তারা উত্তর দিল কিছুই শোনা যাচ্ছে না। ওপারের পাহাড়ে কি হচ্ছে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করা এখন বৃথা। সারাদিনের পরিশ্রমের পর আমরাও ছিলাম ক্লান্ত। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাম্পের সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। রাত্রে শুধু একটা ঘুরাল আমাদের ওপরের পাহাড় থেকে বিপদ সংকেত জানিয়েছিল তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা একটা চিতার ডাক শুনেছিলাম।

এখনও আমাদের পার হতে হবে অনেকখানি পথ আর চড়াইয়ের রাস্তাটাও বেশ দুর্গম। আমি আমার লোকজনদের জানিয়েই রেখেছিলাম যে আমাদের ভোর থাকতেই রওনা হতে হবে। পুবে প্রথম ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গেসঙ্গেই এক কাপ গরম চা আমার হাতে এসে গেল। আমাদের ক্যাম্প ভাঙা মানে তো টুকটাক কিছু বাসনপত্র আর আমার ক্যাম্প খাটটি গুছিয়ে নেওয়া। তাই সময় বিশেষ লাগল না। নদীর খাদের মধ্যে দিয়ে একটা ছাগল চলার পথ দিয়ে আমার রাঁধুনী আর গাড়োয়ালীরা লাইন করে নামছিল। কোলিয়ারের আমলে এই গর্তটার ওপরে একটা লোহার সাঁকো ছিল। আমি কাল রাতে যে পাহাড়টায় আলো দেখেছিলাম, সেইদিকে তাকালাম। সূর্য উঠতে তখন আর বিশেষ দেরি নেই–দূরের জিনিসও এখন বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। আমি নদীর পাড় থেকে পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত তারপর পাহাড়ের চূড়া থেকে নদীর পাড় পর্যন্ত প্রতিটি ইঞ্চি জমি তন্ন-তন্ন করে খুঁজে দেখলাম–প্রথমে শুধু চোখে, পরে দূরবীন দিয়ে কিন্তু কোনো জন-মানবের চিহ্ন আমার চোখে পড়ল না। আমার প্রথম ধারণাও যে অমূলক তার প্রমাণও পেয়ে গেলাম। ধিকিধিকি জ্বলা কোনো আগুন আমার চোখে পড়ল না। আর এক ঝলক তাকালেই বোঝা যায় যে এ-অঞ্চলের গাছপালা অন্তত গত এক বছরের মধ্যে পোড়ানোনা হয় নি। পাহাড়টা আগাগোড়াই শক্ত পাথর। গাছপালা নেই বললেই চলে। পাথরের মধ্যে শেকড় চালানোর মত ফাটল যেখানে আছে সেসব জায়গায় কিছু ঝোপঝাড়, কিছু অপুষ্ট গাছ গজিয়েছে। যেখানে আলো দেখা গিয়েছিল সেটা একটা পাথরের দেয়ালের মত সোজা খাড়াই। মানুষকে ওপর থেকে ঝুলিয়ে না নামিয়ে দিলে কোনো মানুষের পক্ষে সেখানে যাওয়া অসম্ভব।

ন’দিন বাদে, পাহাড়ীদের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে আমি একরাতের জন্যে। কালাধূঙ্গায় তাঁবু ফেলেছিলাম। যাঁরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভালবাসেন বা মাছ ধরার নেশা আছে তাঁদের কাছে কালাধূঙ্গা কুমায়ুন অঞ্চলের একটি স্বর্গ-বিশেষ। নেপাল ভারতকে যে কাঠ দিয়েছিল তা কেটে আনবার সময়ে কোলিয়ার এখানে একটা বাংলো বানিয়েছিলেন। সেই বাংলো থেকে গড়ানো জমি থাকে থাকে নেমে গেছে সারদা নদী। পর্যন্ত। এই থাকগুলির ওপর কোনো এক সময়ে শস্য ফলানো হত। এখন এইগুলি ভরে আছে ঘন, সবুজ ঘাসে। এখানে সকালে সন্ধ্যায় ঘাস খেতে আসে সম্বর আর চিতল হরিণ। বাংলোর পেছন দিকে ঢেউ খেলানো নিবিড় বন। সেখানে আছে চিতা আর বাঘ–আরো আছে ময়ূর, বনমোরগ আর কালিজ পাখির ঝাক। বাংলোর নিচেই সারদা নদীর জল থেকে তৈরি হয়েছে বড় বড় পুকুর আর মাছের ভেড়ি। সারা অঞ্চলে মাছ ধরার এমন জায়গাটি মেলা ভার। আপনি বড় হুইল ছিপেই ধরুন বা বোলতার টোপ দিয়ে হালকা ছিপেই ধরুন।

পরদিন খুব ভোরে আমরা কালাধূঙ্গা থেকে রওনা হলাম। গঙ্গারাম পাহাড়ী রাস্তা চলে গেল পূর্ণগিরির দিকে। আমরা সারদা নদীর গভীর উপত্যকা দিয়ে সোজা পথ। ধরলাম। গঙ্গারামকে দশ মাইল ঘুরপথে পাঠানোর উদ্দেশ্য হল পবিত্র পূর্ণগিরি মন্দিরের বিগ্রহের সামনে আমাদের জন্যে পুজো দেওয়া। যাওয়ার আগে তাকে বলে দিয়েছিলাম সে যেন বিগ্রহের পূজারীদের কাছ থেকে আমরা তল্লাদেশে আসার পথে যে অদ্ভুত আলো দেখেছিলাম তার রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করে। পরদিন সন্ধেবেলা যখন সে টনকপুরে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল তখন তার কাছেই শুনলাম সেই কাহিনী। এর কিছুটা সে নিজে লক্ষ করেছে আর বাকিটাও শুনেছে মন্দিরের পুরোহিতদের কাছে।

পূর্ণগিরি মন্দিরে ভগবতীর পুজো হয়। হাজার হাজার তীর্থযাত্রী প্রতি বছর এখানে আসে। এখানে আসার দুটি মাত্র পথ আছে। একটা আসে বরমদেও থেকে, আরেকটা কালাঙ্গা থেকে। এই দুটো পথই চূড়ার কিছু নিচে পাহাড়ের উত্তর পারে এসে মিশেছে। এইখানেই পূর্ণগিরির দুটি মন্দিরের মধ্যে একটি–যেটি সম্বন্ধে কম লোকই আগ্রহী। বিখ্যাত পূর্ণগিরির মন্দিরটি আরো ওপরে, বাঁদিকে। এই পবিত্র মন্দিরটিতে আসার রাস্তা একটিই–সেটা হল খাড়া এক পাথুরে পাহাড়ের মধ্যের এক ফাটল দিয়ে। শিশু, বৃদ্ধ বা যাদের মনের জোর কম তারা এই মন্দিরে যায় পাহাড়ীদের পিঠে একরকম ঝুড়িতে। ওপরের মন্দিরে পৌঁছতে পারে একমাত্র তারাই যাদের ওপর ভগবতী প্রসন্না। অন্যেরা অন্ধ হয়ে যায় এবং তাদের পুজো দিতে হয় নিচের মন্দিরে।

ওপরে মন্দিরে পুজো আরম্ভ হয় সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে–চলে দুপুর পর্যন্ত। এর পরে নিচের মন্দির পার হয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ। ওপরের পবিত্র মন্দিরের কাছেই একটা প্রায় একশো ফুট উঁচু পাথরের চাই আছে। এই পাথরটির ওপরে ওঠা দেবী নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। বহুকাল আগে এক. অহংকারী সাধু নিজেকে দেবীর সমান প্রতিপন্ন করার জন্যে ওই পাথরটার ওপর উঠেছিলেন। দেবী সাধুর স্পর্ধায় কুপিত হয়ে পাথরটির ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন তাঁকে বরফগলা নদীর ওপারের পাহাড়টির ওপর। এই সাধুই পূর্ণগিরি থেকে চিরকালের মত নির্বাসিত হয়ে, দুহাজার ফুট নিচে আলো জ্বালিয়ে দেবী ভগবতীর পুজো করেন। এই পুজোর আলো কোনো কোনো বিশেষ সময়ে দেখা যায় (আমরা দেখেছিলাম ৫ই এপ্রিল) আর এ আলো দেখতে পায় একমাত্র তারাই যারা দেবীর অনুগ্রহ লাভ করেছে। দেবী আমাকে ও আমার লোকজনদের কৃপা করেছেন কারণ আমরা যাচ্ছিলাম পাহাড়ীদের উপকার করতে, যারা দেবীর আশ্রিত।

এই পুরো কাহিনীটাই গঙ্গারাম আমাকে শুনিয়েছিল যখন আমরা টনকপুরে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সপ্তাহ কয়েক পরে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন পূর্ণগিরির রাওয়াল (প্রধান পুরোহিত)। পূর্ণগিরির আলো সম্পর্কে আমি একটি স্থানীয় কাগজে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। তিনি প্রবন্ধটি নিয়ে আলোচনা করতে এবং আমাকে অভিনন্দন জানাতে এসেছিলেন, কারণ আমি একমাত্র ইউরোপীয়ান যার এই আলো দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আমার প্রবন্ধে সেই আলো সম্বন্ধে আমি নিজের যুক্তি দিয়ে একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম যেমন এখানেও দিয়েছি। সেই প্রবন্ধে আমি উল্লেখ করেছিলাম যে পাঠকেরা যদি আমার ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য মনে না করেন এবং নিজেদের যুক্তিগ্রাহ্য কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে বার করতে চান তাহলে এই বিষয়গুলি মনে রাখলে ভাল করবেন :

এই আলোগুলো একসঙ্গে জ্বলে ওঠে নি।

 সব আলো একই আকারের (প্রায় দু ফুট ব্যাস বিশিষ্ট)।

বাতাসেও আলোগুলো ছিল স্থির।

আলোগুলো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নড়াচড়া করে বেড়াতে পারে।

প্রধান পুরোহিত জোরের সঙ্গে বললেন আলোর ব্যাপারটা এক প্রতিষ্ঠিত সত্য সে বিষয়ে কোনো বিরোধ থাকতেই পারে না। আমি তার সঙ্গে একমত হলাম কারণ আলোগুলি আমি নিজের চোখে দেখেছি। এ বিশ্বাসও আমার ছিল যে আলোগুলির কারণ সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা আমি দিয়েছি তার বাইরে কোনো ব্যাখ্যা হতে পারে না।

পরের বছর আমি এবং স্যার ম্যালকম (এখন লর্ড) হেইলি; যিনি তখন ইউ পি’র গভর্নর ছিলেন, তার সঙ্গে সারদা নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। স্যার ম্যালকম আমার প্রবন্ধটি দেখেছিলেন। আমরা যখন সারদা নদীর সেই খাতের দিকে এগোচ্ছিলাম তিনি আমায় বললেন কোথায় আলো দেখতে পেয়েছি সেই জায়গাটা দেখিয়ে দিতে। আমাদের সঙ্গে চারজন ধীমা (জেলে) ছিল। তারাই সারনি (চামড়া ফোলানো নৌকো) করে আমাদের এক মাছ ধরার জায়গা থেকে আর এক মাছ ধরার জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিল। কুমায়ুন ও নেপাল পাহাড়ের ওপরের দিকে পাইনের জঙ্গল কেটে নদী দিয়ে কাঠ ভাসিয়ে বরমদেও ঘাটে পৌঁছনোর কাজে এক ঠিকাদার যে কুড়ি জন লোককে কাজে লাগিয়েছিল, এই ধীমারা তাদেরই দলের। এই কাজটা খুবই সময়সাপেক্ষ, কঠিন-ও অত্যন্ত বিপজ্জনক; এ কাজে যেমন সাহস চাই, তেমনই চাই এই বিপজ্জনক ভয়ঙ্কর নদী ও তার খালখন্দ সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান।

কোলিয়ার পাথর কাটিয়ে যে ধাপটা বের করেছিল এবং তল্লাদেশে যাওয়ার পথে আমি ও আমার লোকেরা যেখানে রাত কাটিয়েছিলাম তার নিচেই ছিল এক সরু আমি যখন যে জায়গায় আলোগুলো দেখা গিয়েছিল সেই জায়গাটা দেখিয়ে দিলাম তখন স্যার ম্যালকম বললেন ধীমারা হয়তো এ ব্যাপারে কিছু জানতে পারে। তিনি ধীমাদের দিকে ফিরে চাইলেন। কোন ভারতীয়ের কাছ থেকে খবর বার করতে গেলে কিভাবে কথাবার্তা বলতে হয় তা তিনি ভাল মতনই জানেন। আর ওদের ভাষাও উনি অনর্গল বলতে পারেন। তিনি ওদের কাছ থেকে এই তথ্যগুলো সংগ্রহ করলেন। ওদের বাড়ি হল কাংড়া উপত্যকায়। ওদের চাষবাস কিছু আছে কিন্তু চাষের রোজগারে সংসার চলে না। তাই ওরা কাজ করে ঠাকুর দান সিং বিস্ত এর জন্যে। ওদের কাজ হল বড় বড় কাঠ সারদা নদীতে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া। বরমদেও পর্যন্ত নদীর প্রতিটি খালখন্দ ওদের নখদর্পণে কারণ এই নদীপথে ওরা অগুনতিবার যাতায়াত করেছে। এই খাতটি ওরা খুব ভাল করেই জানে কারণ এর জমা জলে কাঠগুলি আটকিয়ে গিয়ে মাঝে মাঝে মহা ঝামেলার সৃষ্টি করে। তারা নদীর এই অংশটিতে কখনো আলো বা অন্য অস্বাভাবিক কিছু দেখে নি।

উনি যখন ধীমাদের কাছ থেকে চলে আসছিলেন তখন তাকে আমি আরেকটি মাত্র প্রশ্ন করতে বললাম। এই যে বছরের পর বছর নদীপথে আসা-যাওয়া করছে, ওই খাতটির মুখে কখনও কি তারা রাত কাটিয়েছে? তার সমস্বরে বেশ জোরের সঙ্গেই উত্তর দিল না, কখনও না। আরও প্রশ্ন করতে তারা জানাল যে তারা নিজেরা যে শুধু রাত কাটায় নি তাই না কেউ এখানে কখনো রাত কাটিয়েছে বলে তারা শোনেও নি। কারণ এ জায়গাটায় নাকি ভূতের উপদ্রব আছে।

এখান থেকে দু হাজার ফুট ওপরে একটা সরু ফাটল দীর্ঘকাল ধরে তীর্থযাত্রীদের পায়ের ঘষায় ঘষায় মসৃণ হয়ে গেছে। লম্বা ফাটলটা প্রায় পঞ্চাশ গজ নেমে এসেছে কিন্তু সেখানে হাত দিয়ে ধরার মত কোনো অবলম্বন নেই। তীর্থযাত্রীদের জীবন রক্ষার জন্যে মন্দিরের পুরুতরা যতই সচেষ্ট থাকুন কিছুদিন আগে পর্যন্ত এখানে বহু দুর্ঘটনা ঘটত। শেষ পর্যন্ত বছর কয়েক আগে মহীশূরের মহারাজা এই পাহাড় বরাবর নিচের মন্দির থেকে ওপরের মন্দির পর্যন্ত একটা তার ঝুলিয়ে দেওয়ার জন্যে কিছু টাকা বরাদ্দ করেছেন।

কাজেই পাহাড়ের নিচে কোনো আত্মা থাকলেও আমি আশ্চর্য হব না–তবে আমার মনে হয় এ আত্মারা মানুষের অনিষ্ট করে না।

.

০৩.

এবার গল্পে ফিরে আসা যাক।

গঙ্গারাম কুমায়ুনের যে কোনো লোকের মতই খুব ক্ষিপ্রগতিতে চলাফেরা করতে পারে। সে আমার সঙ্গে থেকে গেল আমার ক্যামেরা বইবার জন্যে। আমরা যেখানে রাত কাটিয়েছিলাম সেখান থেকে মাইল দুয়েক যাওয়ার পর আমরা সেই রাঁধুনী ও ছ’জন গাড়োয়ালীকে পেলাম। এর পর ছ’ ঘণ্টা ধরে আমরা ক্রমাগত হেঁটে চললাম–কখনও সারদা নদীর কিনারে কিনারে, কখনও গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। যেতে যেতে আমরা কালাধূঙ্গা পার হলাম, চুকা পার হলাম– তারপরে পৌঁছলাম সেই পাহাড়টির পাদদেশে যার ওপারই হল আমাদের গন্তব্যস্থল। যেখানে তল্লাদেশের মানুষখেকোর দৌরাত্ম চলেছে। পাহাড়টির চার হাজার ফুট চড়াইয়ে ওঠার আগে আমরা সেখানে ঘণ্টা দুই অপেক্ষা করে আমাদের দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম।

তারপর শুরু হল আমাদের চড়াইভাঙা। এত খাড়া আর ক্লান্তিকর চড়াই আমাদের অভিজ্ঞতায় বড় একটা পড়ে নি। এপ্রিলের জ্বলন্ত রোদ সর্বাঙ্গ যেন পুড়িয়ে দিচ্ছে, কোথাও একটা গাছও নেই যে ছায়ায় দু দণ্ড জিরোব। এবড়োখেবড়ো পায়ে চলার সরু পথটা সোজা উঠে গেছে পাহাড়ের গা বেয়ে। এক আধটা বাঁক থাকলেও হয়তো ওঠার কিছুটা সুবিধে হত। থেমে থেমে, বহু কষ্টে আমরা সন্ধে নাগাদ একটা কুঁড়েঘরের কাছাকাছি এসে থামলাম। ঘরটি পাহাড়ের চূড়া থেকে প্রায় হাজার ফুট নিচে। চুকাতেই আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিল এই কুঁড়েঘরটি এড়িয়ে যেতে কারণ, পাহাড়ের দক্ষিণদিকে এইটাই একমাত্র জনবসতি হওয়ার দরুণ মানুষখেকোটি এখানে নিয়মিত হানা দিয়ে থাকে। এখন মানুষখেকো হ’ক আর যাই হক, আমাদের আর এগোবার শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। তাই পথের কয়েক শো গজ দূরে এই কুঁড়েঘরটির দিকেই এগিয়ে গেলাম আমরা। এই কুঁড়েঘরে বাস করে দুটি পরিবার। তারা এত মানুষজন আসায় খুব খুশি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে রাত্রের খাওয়াদাওয়া সেরে নেওয়ার পর আমার লোকজন আশ্রয় পেল খিল দেওয়া ঘরের মধ্যে। আমি কুঁড়েঘরটির পাশেই একটা গাছের নিচে ক্যাম্প খাটটা পেতে শুয়ে পড়লাম। আমার পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে ছোট্ট একটা ঝরনা। এই ঝরনার জলেই পরিবার দুটির রান্না খাওয়া চলে। সে রাতে আমার সঙ্গী ছিল আমার রাইফেলটি আর একটা টিমটিমে লণ্ঠন।

সে রাত্রে শুয়ে শুয়ে আমি সম্পূর্ণ পরিস্থিতিটা মনে মনে ভাবার চেষ্টা করলাম। প্রত্যেক গ্রাম-প্রধানকে বিল বেনেস জানিয়ে দিয়েছিলেন যে আমি না যাওয়া পর্যন্ত মানুষ বা অন্য কোনো জন্তু বাঘের হাতে মারা পড়লে তা যেন সরিয়ে না নেওয়া হয়। টনকপুরে পেশকার যে ছেলেটির কথা আমায় বলেছিল সে মারা পড়েছিল চার তারিখে আর আজ হল ছ তারিখের রাত। টনকপুরে গাড়ি ছাড়ার পর আমরা একটা মিনিটও নষ্ট না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর আপ্রাণ চেষ্টা করছি। আমি জানতাম আমরা পৌঁছনোর আগেই বাঘটা তার শিকারের সবটাই খেয়ে ফেলবে–তবে তাকে যদি ঘাঁটানো না হয় তাহলে হয়তো ধারে কাছেই সে আরো দু এক দিন থাকবে। সেদিন সকালে ক্যাম্প ছাড়ার আগে আমি ভেবেছিলাম যে সময় মত গন্তব্যস্থলে পৌঁছে সেই বাচ্চা মোষগুলোর একটিকে বেঁধে হয়তো টোপ করতে পারব। কিন্তু সারদা নদী থেকে এই দুর্গম চড়াইয়ের রাস্তাটাই আমার সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিল। এরকম অবস্থায় একটা দিন হাত থেকে ফসকে যাওয়া খুবই আপসোসের ব্যাপার। কিন্তু কি আর করা যাবে। আমি একমাত্র আশা করতে পারি যে বাঘটা তার শিকার থেকে খুব একটা দূরে সরে যায় নি। আমার একটা বড় রকম অসুবিধে হল আমি কুমায়ুনের এই অঞ্চলটা ভাল চিনি না। বাঘটা এই অঞ্চলে প্রায় আটবছর ধরে দৌরাত্ম চালাচ্ছে। মানুষ মেরেছে শ দেড়েক। সেই জন্যে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে একটা বিরাট জায়গা জুড়ে বাঘটার অবাধ গতিবিধি। আমার নাগালে এসেও বাঘটা যদি একবার হারিয়ে যায় তাহলে আবার তার হদিস মিলতে বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে যাবে। যাই হক, বাঘটা কি করেছে আর কি করবে এ নিয়ে অকারণে কল্পনার জাল বুনে কোনো লাভ নেই কাজেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

আমাদের বেরনোর কথা ছিল খুব ভোরে। রাত থাকতেই আমার বিছানার পাশে নিভে যাওয়া লণ্ঠনটা জ্বালিয়ে গঙ্গারাম আমায় তুলে দিল। সকালের খাবার যখন তৈরি হচ্ছে তখন আমি ঝরনার জলে স্নান সেরে নিলাম। তখন নেপাল পাহাড়ের ওপর দিয়ে সূর্য উঠছে। তারপরে আমার .২৭৫ রিগবি মসার রাইফেলটা তেলটেল, দিয়ে পরিষ্কার করে, পাঁচ রাউন্ড–গুলি ভরে নিয়ে যাত্রার জন্যে তৈরি হলাম, মানুষখেকোর ভয়ে বিভিন্ন গ্রামের মধ্যে যোগযোগ প্রায় ছিল না বললেই হয়। কাজেই সেই কুঁড়েঘরের বাসিন্দা নোক দুটি বাঘটির শেষ শিকার সম্বন্ধে কিছু শোনেও নি। আমাদের কোনদিকে, কতদূর যেতে হবে সে সম্বন্ধেও তারা কিছুই বলতে পারল না। এরপরে কখন কোথায় খাওয়া-দাওয়া জুটবে তার কোনো ঠিক নেই। তাই আমি আমার লোকজনদের বলে দিলাম ভাল করে খেয়ে নিয়ে আমার সঙ্গে আসতে। তাদের আরও বলে দিলাম তারা যেন পরস্পরের খুব কাছাকাছি থেকে হাঁটে আর বিশ্রামের প্রয়োজন হলে সব সময় যেন ভোলা জায়গায় বসে।

আগের দিন যে পথে চড়াই ভেঙেছি সেই পথে এসে, চারিদিকের অপূর্ব দৃশ্য দেখার জন্যে আমি একটু দাঁড়ালাম। নিচে সারদা নদীর উপত্যকা ছায়ায় ঢাকা-নদীটা পাহাড়ের নিচ দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে টনকপুরে। নদীর বাঁকগুলি হালকা কুয়াশার আস্তরণে ঢাটনকপুরের পর নদীটি ঝকঝকে রূপোলী ফিতের মত সোজা গিয়ে মিশেছে. দিগন্তে। চুকা তখনও ছায়া আর কুয়াশার আড়ালে ঢাকা। কিন্তু যে পথটা এঁকে বেঁকে থাক পর্যন্ত উঠে গিয়েছে তা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দশ বছর ধরে থাকের মানুষখেকো বাঘ মারার সময় এই পথটির সঙ্গে আমার গভীর পরিচয় হয়। একশো বছর আগে কুমায়ুনের চাঁদ রাজারা পূর্ণগিরির পুরোহিতদের এই থাক গ্রামটি দান করেছিলেন। সেই গ্রামটি এবং পূর্ণগিরির চূড়া তখন সকালের সোনাগলা সূর্যের আলোয় স্নান করছে।

সেই দিনটির পরে আজ প্রায় পঁচিশ বছর কেটে গেছে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বহু কিছুই ঘটেছে। কিন্তু যা মানুষের মনে দাগ কেটে রেখে যায়, সময় তা নষ্ট করতে পারে না। আমার স্মৃতির মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করছে তল্লাদেশ মানুষখেকো মারার ওই পাঁচটা দিন। এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও ওই দিনটির স্মৃতি আমার মনে আজকের দিনটির মতই স্পষ্ট উজ্জ্বল।

পাহাড়ের ওপরে দেখি যে আমি যে পথ দিয়ে এসেছি সে পথটি বেশ ভাল একটা জঙ্গলের রাস্তার সঙ্গে মিশেছে। প্রায় ছ ফুট চওড়া রাস্তাটি চলে গেছে পুব থেকে পশ্চিমে। এখানে আমি একটা সমস্যায় পড়লাম। আশেপাশে কোনো গ্রাম নেই অথচ কোনদিকে যে যেতে হবে সে সম্বন্ধে আমার বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা নেই। শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবেচিন্তে আমি প্রথমে পুব দিকের রাস্তাটি ধরাই ঠিক করলাম। কারণ এটা ভুল রাস্তা হলেও আমি গিয়ে পৌঁছব বড়জোর সারদা নদী পর্যন্ত।

আমাকে যদি বলা হয় পৃথিবীর যে কোনো অঞ্চলে বেড়াবার সময় ও জায়গা খুঁজে নাও তাহলে আমি নির্দ্বিধায় কোনো এক এপ্রিলের সকালে হিমালয় পাহাড়ে উত্তরমুখী কোনো বনাকীর্ণ পথই বেছে নেব। এপ্রিলে সারা প্রকৃতি সাজেন নয়নাভিরাম সাজে। পত্রমোচী গাছ ভরে ওঠে নতুন পাতায়–হাল্কা সবুজ থেকে গাঢ় সবুজ কত রঙের বাহার তার। ভায়োলেট, বাটারকাপ, রডোডেনড্রন, প্রাইমুলাস, লার্কসপার, অর্কিড কত রকমারি ফুল। আর কত অজস্র রকমের পাখি দামা, ছাতারে, সাতসয়ালী, গাংরা, আরও সব নানান জাতের পাখি যারা শীতের সময়ে নিচে নেমে গিয়েছিল তারা সব আবার ফিরে এসেছে তাদের শিসে, গানে, কিচিমিচিতে নিস্তব্ধ, বনভূমি যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। যে বনে কোনো বিপদ নেই, যেখানে পাখির কলকাকলিতে মুখর বনভূমি নানা ধরনের ফুল, নতুন পাতার সাজে সেজে আবাহন করে পথিককে, সেখানে সব দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ মিলে মিশে একটা সামগ্রিক আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি করে। কিন্তু যে বনে মানুষখেকোর ভয় থাকে সে বনে দৃশ্য যতই সুন্দর হক না, স্নায়ু সবসময় সজাগ হয়ে থাকে কোন অদৃশ্য বিপদের আশঙ্কায়।

বিপদের আশঙ্কা শুধু শিকারের উত্তেজনাই বাড়ায় না জঙ্গলের প্রতিটি দৃশ্য ও শব্দকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। যে বিপদ জানা, যার মুখোমুখি হওয়ার জন্যে আপনি তৈরি সে ধরনের বিপদ আপনার আনন্দ উপভোগে বাধার সৃষ্টি করে না। পাথরের পেছনে কোনো ক্ষুধার্ত, হিংস্র বাঘ লুকিয়ে থাকতে পারে বলে সামনের ভায়োলেট ফুলের ঝাড়ের সৌন্দর্য বিন্দুমাত্র মলিন হয় না। ছাতারে পাখি যখন গাছের নিচ থেকে চিৎকার করে জঙ্গলে পথচারীদের কোনো বিপদ সংকেত পাঠায় তখনও ওর গাছের ওপরে কালো মাথাওয়ালা সিবিয়া পাখির গান কম মধুর লাগে না।

 অনেক সৌভাগ্যবান লোক আছেন যাদের কোনো ভয় ডর নেই। আমি কিন্তু তাঁদের দলে পড়ি না। বন্যজীবনের সঙ্গে সারা জীবনের পরিচয় সত্ত্বেও বাঘের নখ দাঁতকে সেই প্রথম দিনটির মতনই ভয় পাই যেদিন একটি বাঘ ঘুমোবার জায়গা করার জন্যে আমাকে আর ম্যাগিকে জঙ্গল থেকে বার করে দিয়েছিল। কিন্তু সেই ভয়কে দমন করার জন্যে, কাটিয়ে ওঠার জন্যে, এখন আমার আছে অভিজ্ঞতা যা আমার প্রথম জীবনে ছিল না। আগে মনে হত সবদিকেই বিপদ ঘিরে আছে, যে কোনো শব্দ শুনলেই ভয় পেয়ে যেতাম। এখন ঠিক বুঝতে পারি কোথায় বিপদ লুকিয়ে আছে, কোন শব্দটির দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। তাছাড়া, আগে বন্দুক ছুঁড়লে মনে মনে একটা অনিশ্চয়তা থাকত কোথায় গিয়ে লাগবে বুলেটটা। এখন কিন্তু একটা আত্মবিশ্বাস এসে গিয়েছে। জানি যে আমি যে দিক লক্ষ করেই বন্দুক হুঁড়ি গুলিটা মোটামুটি সেই দিকই যাবে। অভিজ্ঞতা থেকেই মানুষ নিজের শক্তির ওপর বিশ্বাস ফিরে পায়। আমি যে দুটি গুণের কথা বললাম, এ দুটি না থাকলে একা পায়ে হেঁটে মানুষখেকো বাঘ মারার চেষ্টা একটা বিশ্রি রকমের আত্মহত্যারই সামিল।

সেদিন এপ্রিলের সকালবেলা আমি যে জঙ্গুলে পথ দিয়ে হাঁটছিলাম সেট এমন একটা অঞ্চল দিয়ে গিয়েছে যেখানে একটা মানুষখেকো বাঘ উৎপাত করে বেড়াচ্ছে। এ পথটা যে বাঘটা প্রায়ই ব্যবহার করে তার প্রমাণ ছিল এখানে সেখানে তার আঁচড়ের দাগ। এ দাগগুলো পুরোনো হয়ে এসেছে আর এর, মধ্যে বাঘটার থাবার কোনো ছাপ আমি খুঁজে পেলাম না। এ দাগগুলোর সঙ্গে মিশেছে নানাধরনের চিতা, সম্বর, ভাল্লুক, কাকার আর শুয়োরের পায়ের দাগ। এ জঙ্গলে নানা ধরনের পাখি আর ফুলের বৈচিত্র্যের তা অন্তই নেই। ফুলের মধ্যে আমার সব চেয়ে ভাল লেগেছিল সাদা প্রজাপতি অর্কিড; এই ফুলগুলি গাছের গা বেয়ে ঝরনার মত নেমে এসেছে। যে গাছের গায়ে এদের শেকড় জড়ানো সে গাছের গুঁড়ি ডালপালা ফুলে লতায় পাতায় ঢাকা প্রায় দেখাই যায় না। এই রকমই একটা গাছে আমি দেখেছিলাম একটা হিমালয়ের কালো ভাল্লুকের বাসা। সত্যিই ভাল্লুকটির শিল্পজ্ঞানের তারিফ না করে থাকা যায় না। কি সুন্দর বাসাটি। জমির থেকে প্রায় চল্লিশ ফুট ওপরে একটা বিশাল ওক গাছ হয় তুষারের চাপে অথবা ঝড়ে ভেঙে গেছে। যেখানে গাছটা ভেঙেছে সেখানে মানুষের কবজির সমান চওড়া কিছু ডালপালা গাছের গোড়া থেকে কোনাকুনিভাবে বেরিয়েছে। এই জায়গাটা পাহাড়ী শ্যাওলায় ভরা আর সেই শ্যাওলায় শেকড় চালিয়ে দিয়ে উঠেছে সাদা প্রজাপতি অর্কিড। এই অর্কিডগুলোর মধ্যেই একটা ভাল্লুক ডালপালাগুলো বেঁকিয়ে গাছের গুঁড়িটার কাছে টেনে একটা বাসা বানিয়েছে। ভাল্লুকেরা সাধারণত বাসা তৈরির জন্যে এমন সব ডালপালা বেছে নেয় যা বেঁকে যায় কিন্তু ভাঙে না। এ ধরনের বাসার সঙ্গে ভালুকদের পারিবারিক জীবনের কোনো সম্পর্ক সাধারণত থাকে না এবং বাসাগুলি আমি দেখেছি দুই থেকে আট হাজার ফুট উঁচুতে। শীতকালে যখন ভালুকেরা বুনো খেজুর আর মধুর খোঁজে আরো ওপর থেকে নিচে নেমে আসে তখন পিঁপড়ে, মাছির হাত থেকে এই বাসাগুলি তাদের বাঁচায়। বেশি উচ্চতায় এই বাসাগুলিতে ভাল্লুকেরা বেশ আরামে রোদ পোয়াতে পারে।

একটা রাস্তা দিয়ে চলতে ভাল লাগলে তার দূরত্ব সম্বন্ধে সব সময় চৈতন্য থাকে না। আমি প্রায় ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর জঙ্গল শেষ হল। সামনেই একখণ্ড ঘাসে ঢাকা জমি। সেখানে থেকে নজরে পড়ল দূরে একটা গ্রাম। খোলা জায়গা দিয়ে হাঁটার সময়ে গ্রামের লোক নিশ্চয়ই আমাকে দেখতে পেয়েছিল। আমি গ্রামে পৌঁছতে দেখি গ্রামসুদ্ধ লোক জড় হয়েছে আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে। আমার অবাক লাগে যে কুমায়ুনের যে কোনো সুদূর গ্রামে যদি কোনো আগন্তুক হঠাৎ এসে পড়ে, তার আসার উদ্দেশ্য কি জানা না থাকলেও সে যা সমাদর পায় তা পৃথিবীর অন্য কোথাও লোকে ভাবতে পারবে না। আমিই সম্ভবত প্রথম সাহেব যে একা পায়ে হেঁটে তাদের গ্রামে হাজির হয়েছি। আমি সেই ভিড়ের কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতেই একটা শতরঞ্জি পাতা হয়ে গিয়েছে তার ওপর বসানো হয়েছে একটা মোড়া। আমি বসতে না বসতেই আমার হাতে পেতলের পাত্রে একপাত্র দুধ ধরিয়ে দেওয়া হল। আমার জীবনটাই প্রায় কেটেছে পাহাড়ীদের সঙ্গে। তাই ওদের ভাষা, নানা অঞ্চলের কথাবার্তার টান সবই আমার জানা এমনকি ওরা কি ভাবছে না ভাবছে তাও আমি বলে দিতে পারি। আমি রাইফেল হাতে পৌঁছনো মাত্রই ওরা ধরে নিয়েছে যে আমি এসেছি দুর্ধর্ষ মানুষখেকোটার হাত থেকে ওদের উদ্ধার করতে; কিন্তু ওদের অবাক লাগছে যে এত সকাল সকাল আমি পায়ে হেঁটে এলাম কোত্থেকে? সব থেকে কাছে যে ডাকবাংলোটি সেটাই তো এখান থেকে ত্রিশ মাইল দূরে।

দুধ খেতে খেতেই আমি তাদের কয়েকটা সিগারেট বিলি করলাম। তারপর নানাধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আমিও কয়েকটা প্রশ্ন করলাম ওদের। জানলাম গ্রামটির নাম তামালি। বহু বছর ধরে গ্রামটি মানুষখেকোর উপদ্রবে ভুগছে। কেউ কেউ বলল আট বছর আবার কেউ বলল দশ বছর। তবে একটা বিষয়ে সবাই একমত যে, যে বছর বাঁচি সিং কুড়োল দিয়ে কাঠ কাটতে গিয়ে তার পায়ের বুড়ো আঙুল কেটে ফেলে আর দানি সিং ত্রিশ টাকা দিয়ে যে কালো ষাঁড়টা কিনেছিল সেটা যেবার পাহাড় থেকে পড়ে মরে যায়, ঠিক সেই বছরটিতেই মানুষখেকোটা প্রথম হানা দেয় এই অঞ্চলে। তামালিতে মানুষখেকোর হাতে শেষ মারা গেছে কুন্দনের মা। সে মারা গেছে গত মাসের (মার্চ) বিশ দিনের দিন। যখন মারা যায় তখন সে গ্রামের আর সব মেয়েদের সঙ্গে নিচের একটা মাঠে কাজ করছিল। বাঘটা মাদী না মদ্দা কেউ জানে না তবে সেটা যে বিরাট সে বিষয়ে সবাই নিঃসন্দেহ। বাঘটার জন্যে সারা গ্রামে এমন একটা ত্রাসের সঞ্চার হয়েছে যে গ্রামের আশপাশের জমিগুলো কেউ আর চাষ করে না। প্রয়োজনীয় খাবার-দাবার আনার জন্যেও আর টনকপুরে যেতে চায় না কেউ। বাঘটা তামালি ছেড়ে কখনও একনাগাড়ে বেশিদিন দূরে থাকে না, প্রায়ই ফিরে ফিরে আসে। আমাকে ওরা খুব পীড়াপীড়ি করতে লাগল এখানে থেকে যাওয়ার জন্যে কারণ তল্লাদেশের অন্য যে কোনো জায়গার থেকে এখানেই বাঘটা মারবার সুযোগ অনেক বেশি।

যারা দ্বিধাহীনভাবে আমাকে বিশ্বাস করেছে, আমার ওপর নির্ভর করছে, তাদের একটা মানুষখেকোর খেয়ালখুশির ওপর ছেড়ে দিয়ে যাওয়া খুব সহজ নয়। যাই হক আমি কেন যাচ্ছি ওদের বুঝিয়ে বলতে ওরা বুঝল। আমায় ঘিরে ভিড় করে আসা জনা পঞ্চাশেক গ্রামবাসীকে আমি কথা দিলাম যে প্রথম সুযোগেই আবার আমি তামালিতে ফিরে আসব। তারপর ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি রওনা দিলাম সেই গ্রামটির দিকে যেখানে মানুষখেকোটা তার শেষ শিকারটিকে মেরেছে।

সেই কুঁড়েঘর থেকে পথটা যেখানে এসে জঙ্গলের রাস্তায় মিলেছে সেখানে আমি একটা চিহ্ন রেখে এসেছিলাম যাতে আমার লোকজনেরা বোঝে যে আমি পূবদিকে গিয়েছি। সে চিহ্নটা তুলে পশ্চিম দিকের রাস্তায় বসিয়ে দিলাম। তা সত্ত্বেও ওরা যাতে ভুল না করে সেইজন্যে পুব দিকের রাস্তায় একটা রাস্তা বন্ধ’ চিহ্ন লাগিয়ে দিলাম। যে চিহ্ন দুটির কথা আমি বললাম তা পাহাড়ী অঞ্চলের সর্বত্র পরিচিত। এ চিহ্নগুলি যে আমি ব্যবহার করব তা আমার লোকজন জানত না কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম ওরা ঠিকই বুঝবে যে চিহ্নগুলি আমারই রাখা। আমার সংকেতও ওরা ঠিকই বুঝবে। প্রথম চিহ্নটি হল রাস্তার ওপর এক টুকরো পাথর বা একটা কাঠের সাহায্যে একটি ডালকে এমনভাবে রাখা যাতে অনুসরণকারী বুঝতে পারে ডালটির পাতাগুলি যেদিকে মুখ করে আছে সেদিকেই তাকে যেতে হবে। দ্বিতীয় চিহ্নটি হল দুটো ডালকে কাটাকুটির (x এর) চিহ্নের মত ভাবে রাস্তার ওপর ফেলে রাখা।

পশ্চিম দিকের রাস্তাটার অধিকাংশই সমতল। রাস্তাটা গিয়েছে বিরাট বিরাট ওক গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, নিচে হাঁটু পর্যন্ত নানাধরনের ফার্নের ঝোঁপ। জঙ্গলের যেখানেই একটু ফাঁকা সেখান থেকে দেখা যায় দিগন্ত জোড়া উঠে গেছে পাহাড়ের পর পাহাড়, মিশেছে আকাশ ছোঁয়া বরফে ঢাকা চূড়ায়। এমন অপূর্ব দৃশ্য বড় একটা দেখা যায় না।

.

০৪.

মাইল চারেক পশ্চিমে যাওয়ার পর রাস্তাটা ঘুরে গেছে, উত্তর দিকে, তারপর একটা উপত্যকার ওপর দিয়ে চলে গেছে রাস্তাটা। উপত্যকার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে এক স্ফটিক স্বচ্ছ পার্বত্য নদী। আমার বাঁ দিকের পাহাড়ে ঘন ওক গাছের জঙ্গলের মধ্যে থেকেই এসেছে নদীটা। পাথরের টুকরোর ওপর পা রেখে রেখে আমি নদীটা পেরোলাম।.একটু চড়াইয়ে একটা খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখি একটু পুবেই একটা গ্রাম। গ্রাম থেকে কয়েকটি মেয়ে আসছিল নদীটির দিকে। তারা খোলা জায়গাটায় আমাকে দেখতে পেয়েই ‘সাহেব এসেছে! সাহেব এসেছে!’ বলে মহা উৎসাহে চিৎকার করতে লাগল। আমি গ্রামে পৌঁছবার আগেই গ্রামবাসীরা তাদের চিৎকার শুনেছে। পৌঁছানো মাত্রই আমার চারিদিকে ভিড় করে দাঁড়াল পুরুষ নারী শিশুর এক উত্তেজিত জনতা।

গ্রামের মোড়লের কাছে জানলাম গ্রামটির নাম তাল্লাকোট। আরও শুনলাম যে চম্পাবত থেকে দুদিন আগে (৫ই এপ্রিল) এক পাটোয়ারী এসেছে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। সে সবাইকে বলেছে যে নৈনিতাল থেকে এক সাহেব আসছে মানুষখেকো বাঘটাকে মারতে। পাটোয়ারী এখানে পৌঁছবার কিছুক্ষণের মধ্যে গাঁয়ের একটি মেয়ে মানুষখেকোর হাতে মরেছে। আলমোড়ার ডেপুটি কমিশনারের নির্দেশমত মড়ি কোথাও সরানো হয় নি। শেষ পর্যন্ত আমি আসছি ধরে নিয়ে সেদিন সকালেই একদল লোককে পাঠানো হয়েছে মড়ির খোঁজ করতে; আর যদি তার কিছু অবশিষ্ট থাকে তাহলে সেখানে আমার জন্যে একটা মাচান তৈরি করতে। গাঁয়ের মোড়ল যখন আমাকে এইসব খবরাখবর দিচ্ছিল তখনই ফিরে এল জনা তিরিশেকের সেই দলটি, এই লোকজনেরা আমায় জানাল যে বাঘটা মড়িকে যেখানে রেখেছে। সেখানে খুঁজেপেতে তারা মেয়েটির দাঁতগুলি শুধু পেয়েছে। এমনকি তার জামাকাপড় পর্যন্ত সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় নি। আমি যখন জানতে চাইলাম বাঘ কোথায় মেয়েটিকে মেরেছে তখন দলের মধ্যে থেকে একটি বছর সতেরোর ছেলে বলল গাঁয়ের ওপাশে গেলে সে দেখিয়ে দিতে পারে কোথায় মানুষখেকোটা তার মাকে মেরেছে। ছেলেটি আমাদের রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চলল, তার পেছনে আমি আর আমার পেছনে গ্রামের ছেলেমেয়ে বুড়োর এক উৎসুক জনতা। আমরা গ্রামের মধ্যে দিয়ে গিয়ে পৌঁছলাম একটা জায়গায় সেখানে গজ পঞ্চাশের লম্বা ঘোড়ার পিঠের জিনের মত সরু একফালি জমি দুটো ছোট পাহাড়কে যোগ করেছে। দুটো বিরাট উপত্যকা এসে মিশেছে ওই জমিটার সঙ্গে। বাঁ দিকের অর্থাৎ পশ্চিম দিকেরটি নেমে গেচে লাধিয়া নদীর দিকে। ডানদিকেরটি খাড়াইবে দশ কি পনের মাইল দূরে নেমে গেছে কালি নদীতে। সেই ঘোড়ার পিঠের জিনের মতো জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছেলেটি ডানদিকের উপত্যকার দিকে তাকাল। এই উপত্যকাটির বাঁদিক অর্থাৎ উত্তর দিকটি ছোট ছোট ঘাসে ভরা, এখানে ওখানে কয়েকটা ঝোপঝাড়–ডানদিকটায় আগাছা আর গাছের জঙ্গল। ঘাসে ঢাকা উপত্যকায় আটশো থেকে হাজার গজ দূরে আর আমাদের থেকে হাজার থেকে দেড়হাজার গজ নিচে একটা ঝোপের দিকে আঙুল দেখিয়ে ছেলেটি বলল, আরো কিছু মেয়ের সঙ্গে তার মা যখন ঘাস কাটছিল তখন ঠিক ওই জায়গাটাতেই সে মারা পড়ে। তারপর নালায় একটা ওক গাছ দেখিয়ে বলল ওই গাছের নিচেই তারা মায়ের বাঘে খাওয়া শরীরটা দেখতে পেয়েছে। হনুমানে ওই ওক গাছটির ডালপালা ভেঙেছে। সে আরও বলল সে বা তার দলের লোকেরা বাঘটাকে দেখেনি, বাঘের কোনো আওয়াজও শোনে নি। শুধু তারা যখন পাহাড় বেয়ে নামছিল তখন তারা প্রথমে একটা ঘুরালের ডাক শোনে আর তার কিছুক্ষণ পরেই একটা হনুমান ডেকে ওঠে।

তাহলে একটা ঘুরাল আর একটা হনুমান ডেকেছিল। ঘুরাল অনেক সময় মানুষ দেখলেও চিৎকার করে ওঠে কিন্তু হনুমান! হনুমান তো তা করে না। অবশ্য বাঘ, দেখলে দুজনেই ডেকে উঠবে। এটা কি সম্ভব যে বাঘটা মড়ির কাছেই কোথাও ঘাপটি মেরে ছিল, লোকজনের দলবল হাজির হতেই সে সরে গেছে? হয়তো ঘুরালটাই তাকে প্রথম দেখে, তারপরে দেখে হনুমানটা। আমি যখন ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তা করছিলাম আর মনে মনে আমার সামনে ছড়িয়ে থাকা এই পুরো অঞ্চলটার একটা মানচিত্র এঁকে নিচ্ছিলাম তখন পাটোয়ারী খাওয়া-দাওয়া সেরে এসে আমার সঙ্গে যোগ দিল। আমি বেনেসের কাছে যে দুটো বাচ্চা মোষ চেয়েছিলাম সে বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করতে সে আমায় জানাল যে সে চম্পাবত থেকে মোব দুটো নিয়েই রওনা হয়েছিল। গত ৪টা এপ্রিল তল্লাকোট থেকে মাইল দশেক দূরে য়ে গ্রামটায় মানুষজনের চোখের সামনেই মানুষখেকো বাঘটা একটা ছেলেকে মেরেছে, সেই গ্রামেই মোযদুটো সে রেখে এসেছে। মানুষখেকোটাকে মারতে পারে এমন কেউ সে গ্রামে নেই। তাই মৃত দেহটা তুলে আনা হয়েছে। ঘটনা সম্পর্কে একটা রিপোর্ট চম্পাবতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে আমাকে খবর দেওয়ার জন্যে টনকপুরে তার করা হয়েছে। ছেলেটিকে দাহ করার নির্দেশও সে দিয়ে এসেছে।

যে গ্রামে আমরা রাত কাটিয়েছিলাম, সেখান থেকে আমার লোকজন তখনো আসে নি। গাঁয়ের মোড়লকে ছোট নদীটির ধারে আমার তাঁবু ফেলার ব্যবস্থা করতে বলে আমি ঠিক করলাম বাঘটা যেখানে মড়িটা খেয়েছে একবার সেই জায়গাটা দেখে আসব। দেখব বাঘটা মাদী না মদ্দা। মাদী হলে বাঘটার কোনো বাচ্চাকাচ্চা আছে কিনা। আমি আগেই বলেছি কুমায়ুনের এই অঞ্চলটা আমার সম্পূর্ণ অজানা। আমি গ্রামের মোড়লকে জিজ্ঞাসা করলাম কোন পথে সবচেয়ে সহজে ওই উপত্যকায় নেমে যাওয়া যাবে। তখন যে ছেলেটির মাকে বাঘে খেয়েছিল আর যে আঙুল দিয়ে আমায় দেখিয়েছিল কোথায় বাঘটা তার মাকে খেয়েছে সে এগিয়ে এসে খুব আগ্রহের সঙ্গে বলল-”আমি তোমার সঙ্গে আসব সাহেব, পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।

সব সময় মানুষখেকো বাঘের আতঙ্কে যারা বাস করে তাদের সাহস, সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকের ওপর বিশ্বাস রাখার ক্ষমতা দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি। ছেলেটির নাম দুঙ্গার সিং। তার মধ্যেও আমি দেখেছি সেই একই সাহস আর বিশ্বাস। বছরের পর বছর দুঙ্গার সিং বাস করেছে মানুষখেকোর দৌরাত্ম্যের মধ্যে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই সে দেখে এসেছে তার মায়ের ছিন্নভিন্ন দেহাবশেষ। ঘুরাল আর হনুমানের ডাক শুনে সেও বুঝতে পেরেছে যে তার মায়ের হত্যাকারী হয়তো আশেপাশেই কোথাও ওত পেতে আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও একা এবং সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকের সঙ্গে সেই বিপদসঙ্কুল জায়গায় যেতে তার মনে কোনো দ্বিধা নেই। একথা সত্যি যে সে সদ্য সদ্য জায়গাটা একবার ঘুরে এসেছে। কিন্তু তখন তার সঙ্গে ছিল আরো জনা তিরিশেক বন্ধুবান্ধব। আর এ কথা কে না জানে যে সমষ্টি মানুষকে একটা নিরাপত্তা বোধ দেয়।

সেই ঘোড়ার পিঠের জিনের মত উঁচু জায়গাটা থেকে পাহাড় বেয়ে নামবার কোনো পথ ছিল না। দুঙ্গার সিং আমাকে গ্রামের মধ্যে দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল একটা ছাগল চরা রাস্তায়। আমরা যখন ছড়ানো ছেটানো ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছি তখন আমি দুঙ্গার সিংকে বললাম আমি কানে ভাল শুনতে পাই না; যদি সে কোনো বিশেষ কিছু আমায় দেখাতে চায় তাহলে সে যেন থেমে পড়ে আর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আর যদি সে কিছু বলতে চায় তাহলে যেন আমার ডান কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে। আমরা যখন প্রায় চারশো গজ এগিয়েছি তখন দুঙ্গার সিং হঠাৎ থেমে পড়ল এবং পেছনের দিকে তাকাল। আমি ফিরে সেদিকে তাকাতেই দেখি পাটোয়ারী নেমে আসছে। তার পেছনে পেছনে বন্দুক হাতে একটা লোক। কোন খবর আছে মনে করে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। একটু হতাশই হলাম শুনে যে পাটোয়ারী তার বন্দুকবাহককে নিয়ে আমাদের সঙ্গে যেতে চায়। আমি খুব অনিচ্ছার সঙ্গে রাজী হলাম কারণ তাদের পায়ে ছিল ভারি ভারি জুতো–তাছাড়া বুঝলাম জঙ্গলের মধ্যে বেশ শব্দ না করে ওরা চলাফেরা করতে পারবে না।

আমরা ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আরও চারশো গজ মত এগিয়ে একটা খোলা জায়গার ওপর এসে দাঁড়ালাম। এখানে ছাগল চরার রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে, একটা বাঁ দিক দিয়ে নেমে গভীর নালার দিকে চলে গেছে আরেকটা পাহাড়ে পাক দিয়ে ডান দিকে চলে গেছে। দুঙ্গার সিং এখানে দাঁড়িয়ে গভীর নালাটার দিকে আঙুল দেখিয়ে ফিসফিস করে বলল এই দিকেই বাঘটা তার মাকে খেয়েছে। যেখানে বাঘের থাবার ছাপ খুঁজতে যাব সে জমির ওপর ভারি জুতো পরা তোক আমি সঙ্গে নিতে চাই নি–কারণ তাতে ছাপগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। তাই দুঙ্গার সিংকে লোক দুটির সঙ্গে খোলা জায়গাটায় রেখে আমি একাই গভীর নালাটার মধ্যে নামা ঠিক করলাম। সেইসব দুঙ্গার সিংকে বোঝাচ্ছি এমন সময় সে ঘুরে দাঁড়াল আর ওপরে পাহাড়ের দিকে তাকাল। সেদিকে চেয়ে দেখি সেই ঘোড়ার পিঠের জিনের মত জায়গাটায় এক দঙ্গল লোক দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই আমি ছিলাম ওই জায়গাটায়; এক হাতের ইশারায় আমাদের চুপ করতে বলে আরেক হাত কানের কাছে দিয়ে দুঙ্গার সিং খুব মনোযোগ দিয়ে কি যেন শুনছিল আর মাঝে মাঝে মাথা নাড়াচ্ছিল। শেষবারের মত মাথাটা ঝাঁকিয়ে সে আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল–আমার ভাই আপনাকে জানাতে বলছে- নিচে পোড়ো জমিটার ওপর রোদে পিঠ দিয়ে লাল মত কি একটা শুয়ে আছে।

ওই পোড়া জমিটা বন্ধ্যা, ওখানে আর চাষবাস হয় না। ওখানে সতিই লালমত, কিছু একটা শুয়ে আছে নিশ্চয়ই। যাই হক, এরকম একটা সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার আমায় করতেই হবে। আমি দুঙ্গার সিংকে আমার রাইফেলটা দিয়ে পাটোয়ারী আর তার তল্পিদারকে দুহাত ধরে টেনে নিয়ে গেলাম একটা গাছের কাছে। পাটোয়ারীর বন্দুক থেকে গুলি বার করে সেটা ঢুকিয়ে দিলাম একটা ঝোপের নিচে। তারপরে তাদের বললাম গাছটার ওপর চড়ে বসে থাকতে। আমি না বললে তারা যেন গাছ থেকে না নামে, নামলে প্রাণের ভয় আছে। পৃথিবীর অন্য কোনো দুজন মানুষ এত উৎসাহের সঙ্গে গাছে উঠেছে বলে আমার জানা নেই। যতদূর সম্ভব উঁচুতে উঠে তারা যেভাবে ডালপালা আঁকড়ে ধরে বসে রইল’ তাতে মন হ’ল গ্রাম থেকে, আমার পেছনে পেছনে আসা থেকে এ পর্যন্ত মানুষখেকো মারা সম্বন্ধে তাদের ধারণার আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে।

ছাগল চরা রাস্তাটা ডানদিকে ঘুরে গিয়ে পড়েছে একটা থাক-কাটা ফসলের জমিতে। এই জমিটিতে বহুদিন চাষবাস বন্ধ–এখন ভরে আছে ওট ঘাসে। জমিটা : প্রায় একশ গজ লম্বা-আমার দিকে চওড়া প্রায় দশ ফুট আর যেদিকটা পাহাড়ের গায়ে মিশেছে সেদিকটা ফুট তিরিশেক চওড়া। প্রায় পঞ্চাশ গজ পর্যন্ত জমিটা চলে গেছে সোজা তারপরেই বাঁক নিয়েছে বাঁ দিকে, দুঙ্গার সিং সেই জমিটার দিকে আমাকে তাকাতে দেখে বলল তার ভাই যে লাল জিনিসটা দেখেছে, সেটা জমির ওধার থেকে ভাল দেখা যাবে মাথা নিচু করে, জমির আলের ভেতরের দিকটা দিয়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছলাম জমির ওধারে। এখানে মাটির ওপর প্রায় শুয়ে পড়ে হাতে পায়ে শরীরটাকে টেনে মাঠের ধারে এসে ঘাস ফাঁক করে নিচের দিকে তাকালাম।

আমাদের নিচে একটা ছোট উপত্যকা। তারই ওধারে ঘাসের জমি খাদ্যাভারে নেমে গেছে। তারপরেই ওক গাছের চারার ঘন বন। বনের পরেই গভীর নালাটি যেখানে বাথটা মেরেছে দুঙ্গার সিং-এর মাকে। ঘাসের ঢালু জমিটা প্রায় তিরিশ গজ। চওড়া। তারপরেই একটা বিরাট পাথর। কাছাকাছির গাছপালা দেখে মনে হল পাথরটা আশি থেকে একশো ফুট উঁচু হবে। ঢালু জমিটার কাছেই রয়েছে প্রায় একশো গজ। লম্বা, দশ গজ চওড়া এক খণ্ড থাক কাটা জমি।জমিটা আমাদের সোজাসুজি। জমিটার। এ-দিক মরকত মণির মত-উজ্জ্বল সবুজ ঘাসে ঢাকা। বাকিটায় এক ধরনের সুগন্ধি আগাছা জন্মেছে। এই আগাছাগুলো চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা হয়। পাতাগুলো অনেক চন্দ্রমল্লিকার মত, নিচের দিকটা সাদা। একখণ্ড ঘেসো জমির ওপর উজ্জ্বল সূর্যালোকে প্রায় দশ ফুট দূরত্বে শুয়ে আছে দুটো বাঘ।

কাছের বাঘটা শুয়ে আছে আমাদের দিকে পিঠ দিয়ে, পাহাড়ের দিকে মুখ করে। অন্যটার পেটটা ছিল আমাদের দিকে আর লেজটা পাহাড়ের দিকে। কাছেরটাকে গুলি করা খুবই সহজ কিন্তু আমার ভয় হল দূরেরটা গুলির আওয়াজ শুনে তার মাথাটা যেদিকে আছে সেদিকে সোজা গভীর বনের মধ্যে লুকিয়ে পড়বে। অথচ আমি যদি দূরেরটাকে প্রথমে গুলি করি তাহলে রাইফেলের শব্দে প্রথম বাঘটি হয় পাহাড়ে উঠে যাবে যেখানে লুকোবার জায়গা কম, না হয় আমার দিকে এগিয়ে আসবে। অনেক ভেবেচিন্তে আমি প্রথমে দূরেরটিকে গুলি করাই স্থির করলাম। আমার থেকে বাঘটার দূরত্ব ছিল প্রায় একশ কুড়ি গজ (আমার লক্ষ্য চড়াই-এর দিকে না সেইজন্যে গুলি করার সময় গুলি যাতে বেঁকে না যায় তার জন্যে কোনো বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন : হবে না। হিমালয়ে যাঁরা ওপর দিকে গুলি ছুঁড়বেন আঁদের সব সময় মনে রাখতে হবে যে গুলি কিছুটা বেঁকে যায়)। খেতের কিনারে হাতের পেছন দিকটা দিয়ে একটা কুশন মত করে নিয়ে অর ওপর রাইফেলটা স্থিরভাবে রেখে জানোয়ারটার হৃৎপিণ্ড আন্দাজ করে নিশ্বা করে আস্তে আস্তে ঘোড়া টিপলাম। বাঘটা একটা পেশীও নাড়াল না কিন্তু অন্য বাঘটা বিদ্যুতের মত ছুটে জমিটা আর বৃষ্টির জলের নালার মধ্যে যে পাঁচফুট চওড়া জায়গাটা আছে সেখানে একলাফে গিয়ে পড়ল। এখানে দাঁড়িয়ে বাঘটা তার ভান কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনের সঙ্গীর দিকে তাকাল। আমার গুলি খেয়ে ছিটকে পিছিয়ে গিয়ে সে গিয়ে পড়ল বৃষ্টির জলের নালাটার মধ্যে। তারপর আর তাকে দেখা গেল না।

আমার দ্বিতীয় গুলিটার পরেই আমি সেই সুগন্ধ আগাছার ঝোপে একটা নড়াচড়া লক্ষ করলাম-মরা বাঘটার কাছেই। একটা বিরাট জানোয়ার তীব্র বেগে ছুটে চলে যাচ্ছে জমিটার ওপর দিয়ে। বাঘদুটোর এত কাছ দিয়ে যখন যাচ্ছে তখন তৃতীয়টিও বাঘ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি জানোয়ারটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না কিন্তু তার গতিপথ অনুসরণ করতে পারছিলাম কেননা সে আগাছা ভেদ করে যাচ্ছিল, আর আগাছার পাতাগুলির নিচের দিকটা সাদাটে। প্রায় দুশো গজ দূরে পাতার আড়াল থেকে জানোয়ারটির বেরিয়ে আসার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু পরেই ঘাসের ঢালু জমিটার ওপর একটা বাঘ বেরিয়ে এল। লক্ষ করে দেখলাম বাঘটা যেখান দিয়ে যাচ্ছে সে ঢালটা নেমেছে ডানদিকে আর আমি যেখানে আছি সে ঢালটা বাঁ দিকে। বাঘটা পাহাড় বরাবর এগোচ্ছিল বলে এই ঢালটার দরুণ আমার পাশ দিক থেকে অক করাও সহজ হয়ে গেল। রাইফেল ছুঁড়লাম।

গুলি খেয়ে বাঘের পড়ে যাওয়া, শরীর কুঁকড়ে যাওয়া আমি আগেও দেখেছি কিন্তু। একটা গুলিতে এত নিশ্চিতভাবে কোনো বাঘের মৃত্যু আমি দেখি নি। বাঘটা কয়েক মুহূর্ত নিশ্চলভাবে পড়েছিল তারপরেই পা সামনের দিকে রেখে সে গলুর ওপর দিয়ে হড়কে পড়তে লাগল। যত নিচে নামছে ততই তার গতি বাড়ছে। বাঘটার ঠিক নিচেই, বড় পাথরটার কয়েক ফুটের মধ্যে একটা আট দশ ইঞ্চি চওড়া ওক গাছের চারা ছিল। ঘের গেটটা সেই চারা গাছে আটকে গেল- মাথাটা আর সামনের পা দুটো একদিকে এবং লেজ ও পেছনের পা দুটো ঝুলে রইল আরেক দিকে। রাইফেল কাঁধে রেখে ঘোড়ায় আঙুল দিয়ে আমি আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম কিন্তু বাঘটার শরীরে কোথাও কোনো জীবনের স্পন্দন দেখলাম না। আমি দাঁড়িয়ে উঠে পাটোয়ারীকে ডাকলাম। সে এতক্ষণ গাছের মগডাল থেকে বাজার হালে পুরো জিনিসটা দেখছিল। দুঙ্গার সিং ছিল আমারই কাছে জমিতে বুক দিয়ে শুয়ে, আর খুব ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। এখন সে উঠে দাঁড়িয়ে আনন্দের আতিশয্যে নাচতে আরম্ভ করেছে। সে এভাবে একবার বাঘদুটোর দিকে আর একবার সেই ঘোড়ার পিঠের জিনের মত উঁচু জায়গাটায় সমবেত গ্রামবাসীদের দিকে তাকাচ্ছিল তাতে মনে হল, সে সেই রাতে এবং তার পরেরও অনেক অনেক রাতে কিভাবে এ.গল্প শোনারে সেই কথাই ভাবছে।

আমি প্রথমে যখন বাঘ দুটোকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখি তখন ভেবেছিলাম মানুষখেকো বাঘটার একটা বাঘিনী জুটেছে কিন্তু তামার তৃতীয় গুলিতে যখন আরেকটা বাঘ বেরিয়ে এল তখন বুঝল্লাম যে ওরা বাঘিনী আর তার দুই বাচ্চা। এদের মধ্যে কোনটি মা, কোন দুটি বাচ্চা বলা বড় কঠিন কারণ আমি রাইফেলের সাইট’-এর মধ্যে দিয়ে যখন দেখি তখন তিনটে বাঘ একই আকারের মনে হয়েছিল। এ তিনটের মধ্যে একটিই যে তল্লাদেশের মানুষখেকো সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই কারণ পাহাড় অঞ্চলে বাঘ বিরল। আর তিনটে বাঘকেই মারা হয়েছে লোকালয়ে কাছাকাছি যেখানে সদ্য-সদ্য একজন মানুষকে মেরে তারা খেয়েছে। তাদের মায়ের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে হল বাচ্চা দুটোকে। মায়ের দুধ ছাড়ার পর থেকেই তারা যে মায়ের আনা নরমাংসে ভাগ বসিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তার মানেই এ নয় যে মায়ের আশ্রয় থেকে বেরিয়েই তারা মানুষখেকো হত। কুমায়ুনের মানুষখেকো’ প্রকাশিত হওয়ার পর যত আলোচনাই হয়ে থাক আমি এখনও বিশ্বাস করি আমি যে অঞ্চলের কাহিনী বলছি সে অঞ্চলে বাচ্চারা ছোটবেলায় নরমাংস খেয়েছে বলেই বড় হয়ে মানুষখেকো হয়ে ওঠে না।

জমিটার কোনায় পা ঝুলিয়ে বসে রাইফেলটা হাঁটুর ওপর রেখে আমি আমার, সঙ্গীদের সিগারেট দিলাম আর বললাম সিগারেটটা খাওয়া হলেই আমি যাব নালার মধ্যে যে বাঘটা পড়েছে সেটার খোঁজে। বাঘটাকে যে মৃত অবস্থায় দেখব সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। কয়েক মিনিটের এদিক সেদিকে কিছু এসে যাবে না। তাছাড়া ভাগ্যদেবী যে আমার ওপর এতটা প্রসন্ন হয়েছেন তার জন্যে নিজের মনেই একটু আনন্দ করতে ইচ্ছে হচ্ছিল। তল্লাদেশে পৌঁছনোর ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ঘটনাচক্রে দেখা পেয়ে গেলাম মানুষখেকোটার যে আট বছর ধরে বহু শত বর্গ.. মাইল জায়গা জুড়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছিল। আর মানুষখেকো বাঘটা আর তার বাচ্চা দুটোকে মারতে আমার লাগল মাত্র কয়েক মুহূর্ত সময়। শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু যখন উত্তেজনায় দপদপ করছে তখন স্থিরভাবে রাইফেল চালাতে পারলে সব শিকারীই আনন্দিত হয়। আমার এই আনন্দের সঙ্গে মিলেছিল আর একটা সান্ত্বনা যে কোনো আহত জানোয়ারকে অনুসরণ করে খুঁজে বেড়াতে হবে না। যারা পায়ে হেঁটে শিকার করে তাদের এই ঝুঁকিটি প্রায়ই নিতে হয়।

আমার সঙ্গীরা অবশ্য আমার সৌভাগ্যকে ভাগ্যদেবীর ওপর ছাড়তে নারাজ। তারা নৈনিতালের বৃদ্ধ পুরোহিতের কাছে পরামর্শ নিয়েছে যাতে আমাদের অভিযান ব্যর্থ না হয়। তল্লাদেশে যাত্রা করার একটা শুভদিনও তারা দেখে নিয়েছিল। আমরা যাত্রা করার সময় কোনো অশুভ সংকেতও তাদের চোখে পড়ে নি। সেইজন্যেই তাদের : মতে আমার সাফল্যের সঙ্গে ভাগ্যের কোনো যোগ নেই আমি যদি বাঘগুলোকে না মারতে পারতাম তাহলে ওরা কখনই বলত না সেটা আমার দুর্ভাগ্য। কারণ বাঘের মৃত্যুর সময় যতক্ষণ না ঘনিয়ে আসে, যতু নিশানা করেই গুলি ছোঁড়া হক না কেন। বাঘ কখনই তাতে মরবে না। আমি যাদের সঙ্গে শিকারে গিয়েছি তাদেরূ নানা ধরনের সংস্কারগুলি সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট কৌতূহল ছিল। আমি নিজেই শুক্রবারে কোথাও যেতে চাই না। তাই কোনো পাহাড়ী যদি মঙ্গল বা বুধবার উত্তর দিকে, বৃহস্পতিবার দক্ষিণ দিকে, অথবা রবিবার কি শুক্রবার পশ্চিমদিকে যাত্রা করতে না চায় তাহলে আমি ঠাট্টা করি না। কোনো বিপজ্জনক অভিযানে বেরোনোর দিনক্ষণ ঠিক করতে দেওয়াটা একটা সামান্য ব্যাপার, কিন্তু এর ফলে সঙ্গীরা বিপদের ভয়ে মুষড়ে না। থেকে অনেক ফুর্তি নিয়ে চলে। হাসিখুশি লোক সঙ্গে থাকলে ভাল লাগে বইকি?

আমরা, চারজন জমিটার ধারে বসে সবে আমাদের সিগারেট শেষ করেছি হঠাৎ. আমার নজরে পড়ল, বাঘটা যে ওক গাছের চারাতে আটকে ছিল সেটা নড়তে আরম্ভ করেছে। শরীরের রক্তটা নিশ্চয়ই মাথার দিকে গড়িয়েছে তাই সেই দিকটা লেজের দিকের থেকে ভারি। তাই বাঘটা মাথা সামনে দিকে সরে ক্রমেই হড়কে নিচের দিকে। নেমে যাচ্ছিল। ওক গাছের চারাটা পেরিয়ে বাঘটা ঢালু জমিটার ওপর গিয়ে পিছলে নেমে সেই পাথরটার ধারে গিয়ে পৌঁছল। বাঘটা গড়িয়ে পড়তে পড়তেই আমি রাইফেল তুলে গুলি করলাম। আমি তল্লাদেশে আমার সাফল্যের আনন্দে অভিভূত, হয়ে ঝোঁকের মাথায় গুলি চালিয়েছিলাম। আর এখন বলতে লজ্জা করে যে সেদিন আমি সবাইকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে এমন দিনে আমার পক্ষে কিছুই মারা অসম্ভব নয়–এমনকি একটা গড়িয়ে পড়া বাঘও নয়। বাঘটা গাছের আগা ভেঙে গড়িয়ে পড়ার পর একটা ডালপালা ভাঙার শব্দ পেলাম, তার পরেই একটা ভারি কিছু পড়ার শব্দ। আমার গুলি, পড়ন্ত বাঘটার গায়ে লেগেছে কি না লেগেছে তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু ঢালু জমিটার ওপর থাকলে বাঘটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ হত, এখন তাকে নিয়ে রাস্তা ভাঙতে হবে অনেক বেশি।

সিগারেট খাওয়া শেষ করে আমি আমার সম্বীদের চুপচাপ বসে থাকতে বললাম তারপর গেলাম বৃষ্টির জলের নালার বাঘটার খোঁজ করতে। পাহাড়টার খাড়াই ছিল খুব বেশি। আমি প্রায় পঞ্চাশ ফুট নেমেছি এমন সময় কানে এল দুঙ্গার সিং-এর উত্তেজিত চিৎকার দেখুন, সাহেব দেখুন। ওই বাঘটা যাচ্ছে! তখন আমার মাথায় নিচের বাঘাটার চিন্তা, তাই ওপর থেকে কোনো বাঘ তাড়া করে আসছে মনে করে চট করে বসে রাইফেল তুললাম। আমার তোড়জোড় দেখে ছেলেটি আবার চিৎকার করে উঠল, “এদিকে নয় সাহেব, ওদিকে, ওদিকে!” সামনের দিকে কোনো বিপদের। আশঙ্কা নেই সে সম্বন্ধে, নিশ্চিন্ত হয়ে আমি দুঙ্গার, সিং-এর দিকে ফিরে তাকালাম। দেখলাম সে আঙুল দিয়ে উপত্যকার ওধারে পাহাড়ের নিচের ঢালুর দিকে যেদিকে তার মা মারা পড়েছে সেইদিকে দেখাচ্ছে। প্রথমে আমি কিছুই দেখতে পেলাম না। তারপর দেখলাম একাট বাঘ কোনাকুনিভাবে উঠে যাচ্ছে পাহাড়ে। বাঘটা বেশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। একেবারে তিনচার পা করে গিয়েই একটু করে দাঁড়াচ্ছে। তার ডান কাঁধে রক্ত চাপ বেঁধে আছে। দেখেই বুঝলাম এটি সেই বাঘটি যে গাছপালা ভেঙে জঙ্গলে মধ্যে পড়েছিল কারণ যেটা নালার পড়েছিল, গুলি লেগেছিল তার বাঁ কাঁধে।

আমি যেখানে বসেছিলাম তার কাছেই পাহাড়ের গায়ে একটা সতেজ ঋজু পাইন গাছের চারা। রাইফেলে তিনশো গজের নিশানা ঠিক করার ব্যবস্থা করে নিলাম। তারপর বাঁ হাতে চারা গাছটা ধরে, রাইফেলটা কবজির ওপর রেখে ধীরে সুস্থে তাক করলাম। আমাদের মধ্যে দূরত্ব ছিল চারশো গজের মত আর বাঘটা ছিল আমার থেকে একটু বেশি উচ্চতায়। তাই বাঘটা একটু না দাঁড়ানো পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম তারপর আস্তে ট্রিগার টিপলাম। বুলেটটা যেতে অবিশ্বাস্যরকম বেশি সময় নিল মনে হল। তারপরে একটু ধুলো উড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বাঘটা সামনের দিকে একটু ঝোঁক খেয়ে আবার ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল। বুঝলাম আমার নিশানা ঠিক হয় নি তাই বুলেটটা লক্ষ্যস্থলের এক চুল ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এখন আমার আর বাঘটার মধ্যে দূরত্বও কমে এসেছে। ওটাকে মারা আমার এখন শুধু একটা বুলেটের অপেক্ষা। কিন্তু সেই বুলেটটাই আমার নেই। যখন বাঘটা গুলি খেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল তখন বোকার মত অন্য বুলেটটা আমি খরচ করেছি। শূন্য রাইফেল হাতে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম বাঘটা আস্তে আস্তে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পাহাড়ের ওপর উঠল তারপর মুছে গেল আমার দৃষ্টির সামনে থেকে।

যে শিকারীদের হিমালয় অঞ্চলে শিকারের অভিজ্ঞতা নেই তারা হয়তো আমাকে বোকা ভাববেন কারণ আমি সঙ্গে নিয়েছিলাম কেবলমাত্র একটা হাল্কা ২৭৫ রাইফেল আর সেই সঙ্গে পাঁচ পাউন্ড গুলি। কেন নিয়েছিলাম তার কারণ আমি বলছি :

(ক) এই রাইফেলটি আমি বিশ বছর ধরে ব্যবহার করছি এবং এটির সঙ্গে আমার পরিচয় খুব গভীর।

(খ) এটা বয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে বেশ হাল্কা, এতে নিশানা হয় নিখুঁত আর তিনশ গজ দূরত্ব পর্যন্ত লক্ষ্যভেদের ব্যবস্থা এতে আছে।

(গ) কর্নেল বারবার আমাকে বলেছিলেন ভারি রাইফেল ব্যবহার না করতে আর হাল্কা রাইফেলেও প্রয়োজনের বেশি গুলি না করতে।

গুলি সম্বন্ধে আমি একথাই বলতে পারি যে সেদিন সকালে আমি’বাঘ মারব বলে বেরোই নি। আমি বেরিয়েছিলাম বাঘটা যে গ্রামে শেষ মানুষ মেরেছে সেই গ্রামটা দেখব বলে আর হাতে যদি সময় বেশি থাকে তাহলে একটা বাচ্চা মোষ টোপ হিসাবে বাঁধব বলে। এ পর্যন্ত যা ঘটল তা থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে আমি এই মোক্ষম গুলিটা বোকামি করে খরচ না করলে পাঁচ রাউন্ড গুলিই ছিল আমার পক্ষে যথেষ্ট।

আমার লোকেরা ঠিক সময়মত এসে সেই উঁচু জায়গাটায় দাঁড়িয়ে অন্যান্যদের সঙ্গে আমাদের সব গতিবিধি লক্ষ করছিল। তারা জানত আমার রাইফেলের ম্যাগাজিনে পাঁচটা গুলিই আছে। আমার পঞ্চম গুলির পরে আহত বাঘটা যখন পাহাড়ের ওপর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল তখন মাধো সিং আরো গুলি নিয়ে পাহাড়ের ওপর থেকে দৌড়ে নেমে এল।

সবুজ ঘাসের ওপরে আর নালার মধ্যে যে বাঘদুটি মরে পড়েছিল সে দুটোই প্রায় পূর্ণবয়স্ক। যে বাঘটি আহত হয়ে চলে গেল সেটি যে ওদের মা সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই–সেইটিই তল্লাদেশের মানুষখেকো। মাধো সিং আর দুঙ্গার সিংকে বাঘের বাচ্চা দুটো গ্রামে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলে আমি একাই রওনা হলাম সেই আহত বাঘিনীর সঙ্গে মোলাকাতের চেষ্টা করতে। যে ভাঙা ডালপালার ওপর বাটা পড়েছিল সেখানে রক্তের ছিটে লেগে রয়েছে। সেই হাল্কা রক্তের দাগ অনুসরণ করে আমি পৌঁছলাম সেই জায়গাটায় যেখানে বাঘিনীটাকে আমি শেষ গুলি করেছিলাম। আমার বুলেটটা তার পিঠ ঘেঁষে কিছুটা লোম উড়িয়ে নিয়েছে মাত্র। দেখলাম কিছুটা লোম এদিক সেদিক ছড়িয়ে আছে-তার সঙ্গে লেগে আছে একটু রক্ত। আমার বলেটটা ওর পিঠ ঘেঁষে পাথরে লেগে আওয়াজ করা মাত্রই ও সামনের দিকে একটা বোঁক নিয়েছিল। তখনই নিশ্চয় ওর ক্ষত থেকে কিছুটা রক্ত ছড়িয়ে পড়ে। এখন থেকে পাহাড় পর্যন্ত: রক্তের ফোঁটা ক্রমেই কমে এসেছে। ওপরের ঘাসের বনে রক্তের দাগ সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেছে। কাছাকাছিই একটা প্রায় একশো গজ চওড়া আগাছার জঙ্গল ছিল–আমার সন্দেহ হল বাঘিনীটা সেই জঙ্গলেই আশ্রয় নিয়েছে। জঙ্গলটা পাহাড়ের ওপর খাড়া উঠে গেছে প্রায় তিনশো গজ! কি তখন সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। নিশানা করে গুলি চালানো কঠিন তাই আমি স্থির করলাম আজ গ্রামে ফিরে যাওয়াই ভাল। কাল সকালেই জঙ্গলটা ভাল করে খোঁজা যাবে।

.

০৫.

পরদিন সকালটা কেটে গেল বাঘের বাচ্চা দুটোর ছাল ছাড়িয়ে টান-টান করে শুকোতে দিতে। সেজন্যে নৈনিতাল থেকে আমি সঙ্গে করে এনেছিলাম ছয় ইঞ্চি লম্বা পেরেক। আমি যখন এই কাজে ব্যস্ত তখন কম করেও শ খানেক শকুন আমার তাঁবুর আশপাশের গাছগুলোর মাথায় নেমে এসেছে। মানুষখেকোর শিকারদের কাপড়চোপড় কোথায় গিয়েছে তার হদিশ এতক্ষণে মিলল। বাঘের বাচ্চাদুটো সেই রক্ত মাখা কাপড়গুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে গিলে ফেলেছিল।

আমি যখন বাচ্চাগুলোর ছাল ছাড়াচ্ছিলাম তখন গ্রামের লোকজন আমায় ঘিরে বসেছিল। আমি তাদের বললাম যে আগাছার জঙ্গলে বাঘিনীটা আশ্রয় নিয়েছে মনে হয়, সে জায়গাটা খেদানোর ব্যাপারে আমার গাড়োয়ালীদের সাহায্য করার জন্যে কিছু নোকজন দরকার। তারা খুব উৎসাহের সঙ্গেই এই কাজ করতে রাজী হল। আমরা যখন রওনা হলাম তখন বেলা প্রায় দুপুর। লোকজনেরা গ্রামের মধ্যে দিয়ে, সেই ঘোড়ার পিঠের জিনের মত উঁচু জায়গাটা ধরে পাহাড়ের ওপর দিকে গেল–অর্থাৎ বাঘিনীটা যেখানে আশ্রয় নিতে পারে ভেবেছিলাম তার থেকে কিছুটা উঁচুতে। আমি সেই ছাগল-চলা রাস্তাটা দিয়ে নিচে উপত্যকার দিকে গেলাম-এই রাস্তাতেই গতকাল বিকেলে আমি বাঘিনীটাকে অনুসরণ করেছিলাম। আগাছার জঙ্গলটার শেষ প্রান্তে একটা বিরাট পাথর ছিল–প্রায় একটা ছোটখাট বাড়ির মত বড়। আমি সেটার ওপর দাঁড়াতে পাহাড়ের ওপরের লোকজন আমায় দেখতে পেল। আমি টুপি নাড়িয়ে। ওদের খেদা শুরু করার নির্দেশ দিলাম। বাঘিনীটার হাতে যাতে কেউ না জখম হয় সেইজন্যে আমি ওদের বলে দিয়েছিলাম হাততালি, চিৎকারের পর ওরা যেন সেই আগাছার জঙ্গলে বড় বড় পাথর ফেলে। ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে থেকে একটা কাকার আর একটা কালিজ বেরিয়ে এল, কিন্তু আর কিছুই না। যখন পাথর ফেলে ফেলে জঙ্গলের প্রায় প্রতিটি ফুট তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়ে গেল তখন আমি আবার টুপি নেড়ে লোকজনদের খেদা শেষ করে গ্রামে ফিরে যেতে বললাম।

লোকজনরা চলে যেতে আমি আবার জঙ্গলটা খুঁজলাম কিন্তু বাঘিনীটাকে পাওয়ার কোনো আশাই আর ছিল না। আগের দিন তাকে যখন পাহাড়ে উঠতে দেখি তখন সে ক্ষতের যন্ত্রণায় খুব কাতর ছিল। গুলি খাওয়ার পর যেখানে সে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল সেখানকার রক্ত পরীক্ষা করে বুঝলাম যে ক্ষতটা ওপর ওপরই হয়েছে, খুব গভীর নয়। তবে বাঘিনীটা কুড়ুলের কোপ খাওয়ার মত অমন হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলই বা কেন আর মরার মত ওক চারাটা থেকে ঝুলে পড়েই বা ছিল কেন? এই প্রশ্নগুলির কোনো সদুত্তর আমি তখন খুঁজে পাই নি–এখনও পাই না। পরে আমি আমার নিকেলে মোড়া নরম মাথাওয়ালা গুলিটা বাঘিনীর ডান কাঁধের হাড়ের জোড়ের মধ্যে আটকানো দেখতে পাই। একটা বিদ্যুৎগতি বুলেট যখন হাড়ে আটকে থেমে যায় তখন যে কোনো জানোয়ারই প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাঘ যে কোনো সাধারণ জানোয়ারের থেকে ভারি আর তার জীবনশক্তিও প্রচণ্ড, তবে কেন যে একটা হাল্কা ২৭৫ রাইফেলের বুলেট তাকে একেবারে ধরাশায়ী করে দশ পনের মিনিট অজ্ঞান করে রেখেছিল তা আজও আমার কাছে স্পষ্ট নয়।

পাহাড়ের ওপর উঠে এসে আমি একটু দাঁড়ালাম আর চারপাশের এলাকাটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। পাহাড়টা ঢেউ খেলিয়ে চলে গেছে মাইলের পর মাইল–তার দুপাশে দুটো উপত্যকার মধ্যে দেয়াল যেন ওটা। বাঁ দিকের উপত্যকাটা, যেখানে আগাছার জঙ্গল সেটা ঘাসে ঢাকা, ডানদিকের উপত্যকায় ঘন গাছ ও আগাছার জঙ্গল আর ঢালু পাথুরে জমি নেমে একটা পাথরের গোড়ায় গিয়ে শেষ হয়েছে।

পাহাড়ের ওপর একটা পাথরে বসে সিগারেট ধরিয়ে গতকাল সন্ধের ঘটনাগুলো মনে মনে সাজিয়ে নিতে চেষ্টা করলাম : (ক) বাঘিনীটা আমার গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়ার পর থেকে গাছপালা ভেঙে জঙ্গলে পড়ে যাওয়া পর্যন্ত অজ্ঞান ছিল। (খ) গাছ আগাছার নরম গদীর ওপর পড়ে তার জ্ঞান ফিরে এসেছিল বটে কিন্তু বাগিনীটা তখনও হতবুদ্ধি ছিল। (গ) এই অবস্থায় সে নাক-বরাবর এগিয়ে গিয়ে পাহাড়টা সামনে পেয়ে তাতেই উঠেছিল কিন্তু কোথায় যাচ্ছে সে বিষয়ে তার কোনো হুঁশ ছিল না।

এখন আমার সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে বাঘিনীটা কোনদিকে আর কত দূরে গিয়েছে, খোঁড়া পায়ে পাহাড়ের নিচে নামা ওপরে ওঠার থেকে অনেক কঠিন। বাঘটা এই হতবুদ্ধি অবস্থাটা কাটিয়ে উঠলেই পাহাড়ের ঢালু বেয়ে নিচে নামা বন্ধ করে চোটটা সামলে নেওয়ার জন্যে একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজবে। কোন আশ্রয় খুঁজে পেতে গেলে বাঘিনীটাকে পাহাড় পার হতেই হবে। সেইজন্যে এখন সর্বপ্রথম দেখা দরকার সে তাই করেছে কিনা। এই পাহাড়ের মাথাটা ক্ষুরের মত ধারাল না হলে একটা নরম থাবাওয়ালা জানোয়ার তার মাইলের পর মাইল বিস্তারের মধ্যে দিয়ে কোথায় গিয়েছে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব হত। পাহাড়ের মাথার কাছাকাছি একটা জন্তু জানোয়ারের পায়ে চলার পথ রয়েছে। কতরকম জন্তু জানোয়ার এখান দিয়ে চলাফেরা করে বোঝার পক্ষে আদর্শ জায়গা। পথটার বাঁ দিকে ঢালু ঘাসের জমি আর ডানদিকে চাতালের মত একটা পাথর। তারপরেই গভীর খাদ।

সিগারেটটা শেষ করে আমি সেই জানোয়ারদের পায়ে চলা পথটা ধরে এগোলাম। পথে দেখলাম ঘুরাল, বনছাগল, সম্বর, হনুমান আর শজারুর পায়ের দাগ। একটা মদ্দা চিতার থাবার ছাপও চোখে পড়ল। যতই দূরে এগোচ্ছি ততই আমি হতাশ হয়ে পড়ছি কারণ আমি জানি যে এই পথে বাঘিনীটার পায়ের থাবার ছাপ না পেলে তাকে আর খুঁজে পাওয়ার আশা কম। আমি পাহাড়ের ওপর দিয়ে তখন মাইল খানেক এগিয়েছি। পথে দুটো ঘুরাল আমাকে দেখে ভয় পেয়ে বাঁ দিকের চালু ঘেসো জমিটার ওপর দিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিল। হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম সেই বাঘিমীটার থাবার ছাপ আর কিছুটা রক্ত শুকিয়ে চাপ বেঁধে রয়েছে। থাবার ছাপটা দেখে মনে হয় গতকাল বিকেলে পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর বাঘিনীটা সোজা ঘাসের ঢালু জমি বেয়ে নেমে যায়। তারপর হতবুদ্ধি ভাবটা কাটলে সে পাহাড় ঘুরে এই জন্তু জানোয়ারদের পায়ে চলার পথটার কাছে এসেছে। আমি থাবার ছাপ ধরে ধরে এগোলাম প্রায় আধমাইল। শেষে এমন একটা জায়গায় এলাম যেখানে ডানদিকের পাথরের চাতালটা সরু হয়ে প্রায় পনের গজে দাঁড়িয়েছে। বাঘিনীটা সেখানে নিশ্চয় চাতালটা বেয়ে নামার চেষ্টা করেছে–বোধহয় ওর মতলব ছিল খাদের ওপারের ঘন জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া। আহত পায়ে হয়তো সে বিশেষ জোর পায় নি; মাথাও হয় তো তার ঝিমঝিম করছিল–যে কারণেই হোক মাথা সামনের দিকে দিয়ে হড়কে কিছুটা নামার পরই সে ওই গভীর খাদে পড়ার ভয়ে ফিরে আসবার চেষ্টা করে। মাথা ঘুরিয়ে, পা দুটো ছাড়িয়ে নখ মাটি আঁকড়ে ধরে সে ওপরে উঠে আসার বৃথা চেষ্টা করে। আমি নিজে পাহাড়ী ছাগলের মত স্বচ্ছন্দগতিতে হাঁটতে পারি কিন্তু আমার পক্ষেও ওই খাদের ঢাল বেয়ে নামা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কাজেই আমি ওই পথ দিয়ে আরো কয়েকশো গজ এগিয়ে পাহাড়ের একটা ফাটলের কাছাকাছি এলাম। এ ফাটলটা বেয়ে আমি খাদের রাস্তা ধরলাম।

ত্রিশ ফুট চওড়া নালাটা ধরে আমি যখন ওপরের দিকে উঠলাম তখন দেখতে পেলাম, সেই পাথরের চাতালটা নালা থেকে ষাট থেকে আশি ফুট ওপরে। ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অতখানি উঁচু থেকে পাথরের ওপর পড়লে কোনো জানোয়ারই বাঁচতে পারে না। বাঘিনীটা যেখানে পড়েছে সেই জায়গাটার কাছে এগিয়ে যেতে আমার মন আনন্দে নেচে উঠল–একটা বেশ বড়সড় জানোয়ারের পেটের সাদা দিকটা দেখা যাচ্ছে। আমার আনন্দ কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হ’ল না, কারণ জানোয়ারটা ‘সারাও’ নামের একটা বন্য ছাগল, বাঘিনী নয়। সারাটা সম্ভবত পাহাড়টার ওপর সেই সরু চাতালটাতে শুয়ে ছিল। ওপরে বাঘিনীর পায়ের শব্দে আর বোঁটকা গন্ধে হয়তো ওর ঘুম ভেঙে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘাবড়ে গিয়ে ও নিচে লাফ মারে। ফলে, একটা পাথরের ওপর পড়ে ওর ঘাড়টা ভেঙে গেছে। সারাটা যেখানে লাফ মারে তার কাছেই একটা জায়গায় কিছুটা আলগা বালি ছিল। বাঘিনীটা লাফ মেরে পড়ে সেই বালির ওপর। তাতে ওর বিশেষ ক্ষতি হয় নি শুধু কাঁধের ক্ষতটা দিয়ে রক্তপড়া আবার শুরু হয়। প্রায় গজখানেক দূরে সারাওয়ের মৃত দেহটার দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বাঘিনীটা খাদ পেরিয়ে চলে যায়। এখান থেকে বাঘিনীটা পরিষ্কার রক্তের নিশানা রেখে গেছে। নালাটার ডান দিকের পাড়টা মাত্র কয়েক ফুট উঁচু। কিন্তু বাঘিনীটা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও তার ওপরে উঠতে পারে নি। আমি বুঝতে পারলাম এখানে থেকে প্রথমে যে জায়গায় আশ্রয় নিতে পারে সেইরকম জায়গাতেই বাঘিনীটা আছে। কিন্তু আমার ভাগ্য নেহাতই খারাপ। কিছুক্ষণ আগে থেকেই আকাশ জুড়ে কালো মেঘেরা তোড়জোড় শুরু করেছিল, এখন বাঘিনীটা কোথায় নালায় পাড় বেয়ে উঠেছে দেখার আগেই মুষলধারে একপশলা বৃষ্টি এল। ফলে রক্তের দাগ ধুয়ে মুছে গেল। কিন্তু একদিক থেকে ভাগ্য আমার ওপর সুপ্রসন্ন। আমার ভয় ছিল বাঘিনীটা ঘেসো ঢালু জমির ওপর দিয়ে নেমে চলে যাবে–তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না কিন্তু এখন আমি জানি ঠিক কোথায় তাকে পাওয়া যাবে। তার সঙ্গে মোলাকাত আমার হবেই।

.

০৬.

পরদিন আমি আমার ছয়জন গাড়োয়ালীকে সঙ্গে নিয়ে নালাটার কাছে ফিরে এলাম। সারা কুমায়ুনে সারাওয়ের মাংসের খুব আদর। ঘাড়ভাঙা সারাওয়ের মাংসও খুব টাটকা ছিল। আমার সঙ্গের লোকজনও খুব খুশি। ওরা যখন সারাওটার ছাল ছাড়াতে ব্যস্ত, আমি গতকাল যেখান থেকে ফিরেছিলাম সেই জায়গাটাতে গেলাম। এখানে দেখলাম ডান দিকে দুটি গভীর সরু নালা পাহাড়ের দিকে চলে গেছে। এর একটার মধ্যে দিয়ে বাঘিনীটা গিয়ে থাকতে পারে ভেবে আমি কাছের নালাটা দিয়ে কয়েকশো গজ এগিয়ে গেলাম–কিন্তু দেখলাম পাড়গুলোর খাড়াই এত বেশি যে এখান দিয়ে বাঘিনীর ওঠা অসম্ভব। তাছাড়া নালাটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে বর্ষার বৃষ্টিতে নিশ্চয় ফুট তিরিশেক উঁচু একটা জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়েছিল। আমি যেখান থেকে রওনা হয়েছিলাম সেখানে এসে লোকজনদের ডেকে নিলাম। তারা মূল নালী থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে আমার চায়ের জন্যে এক কেটলি গরম জ্বল করতে ব্যস্ত ছিল। তারপর আমি দ্বিতীয় নালাটা পরীক্ষা করার জন্যে এগোলাম। কিছুটা এগিয়ে দেখি বাঁ দিক দিয়ে একটা জন্তু-জানোয়ারের পায়ে চলার পথ নেমে এসেছে পাহাড় বেয়ে। পথটা বেশ ব্যবহার হয় মনে হল। সেই পথে আমি দেখতে পেলাম বাঘিনীটার থাবার ছাপ–গত সন্ধের কৃষ্টিতে অবশ্য কিছুটা ধুয়ে গেছে। আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম তার কাছেই একটা বিরাট পাথর। পাথরটার কাছে গিয়ে দেখি ওদিকটায় একটা খাঁজ মত রয়েছে। সেই খাঁজটার ওপর শুকনো পাতাগুলো যেন কোনো একটা চাপে মসৃণ হয়ে গেছে আর তার ওপর চাপ চাপ রক্ত। বাঘিনীটা নালার মধ্যে পড়েছিল এখন থেকে প্রায় ঘণ্টা চল্লিশেক আগে। তারপরে বাঘিনীটা নিশ্চয়ই এখানেই ছিল। আমি যখন লোকজনদের চায়ের জল গরম করার জন্যে হাঁক দিয়েছিলাম বাঘিনীটা নিশ্চয়ই আমার গলার আওয়াজ শুনে সরে যায়।

 সব বাঘের মেজাজ একরকম হয় না তাই একথা বলা কঠিন যে কোনো আহত বাঘের কাছে কেউ পায়ে হেঁটে গেলে বাঘটা কি করবে। আহত বাঘ কদ্দিন বিপজ্জনক থাকে অর্থাৎ বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটালে আক্রমণ করতে পারে সেকথা বলা মুশকিল। আমি একটা বাঘকে দেখেছিলাম, পালাতে গিয়ে তার পেছনের পায়ে প্রায় ইঞ্চিখানেক কেটে যায়। এই আঘাত পাওয়ার পাঁচ মিনিট পরে সে প্রায় একশো গজ দূরে থেকে প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ করে। আমি আরও একটা বাঘ দেখেছিলাম যে বহু ঘণ্টা ধরে প্রচণ্ড চোয়ালের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও তার কয়েক ফুটের মধ্যে লোক গেলেও সে আক্রমণের চেষ্টা করে নি। কিন্তু আহত মানুষখেকো বাঘদের কথা সম্পূর্ণ আলাদা। বলা মুশকিল যে কেউ কাছাকাছি এলে আহত বাঘটি তাকে আক্রমণ করবে কিনা। তাছাড়া, জখমটা, যখন আন্তর্শরীর নয়, তখন খাদ্য সংগ্রহের জন্যেও বাঘ আক্রমণ করতে পারে। বাঘেরা সাধারণত আহত না হলে বা মানুষখেকো না হলে বেশ ঠান্ডা মেজাজের হয়। তা যদি না হত তাহলে যেসব বনে বাঘ আছে সেখানে হাজার হাজার লোকের কাজকর্ম করা সম্ভব হত না। আর আমার মতন লোকের পক্ষেও কোনো অনিষ্ট ঘটেই বছরের পর বছর জঙ্গলে জঙ্গলে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানো সম্ভব হত না। মাঝে মাঝে কোনো বাঘ তার বাচ্চার খুব কাছাকাছি আসা বা যে মড়িটা সে আগলে রেখেছে তার আশপাশে যাওয়া পছন্দ করে না। একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ করে প্রথমে সে তার বিরক্তি প্রকাশ করে। তাতে যদি কাজ না হয়, তখন সে একটু একটু ছুটে গিয়ে প্রচণ্ড গর্জন করে। এ গর্জনেও যদি কিছু না হয় তাহলে যে ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে তার দায়িত্ব সম্পূর্ণ আগন্তুকের। কয়েক বছর আগে আমার যে অভিজ্ঞতার কথা এখন বলছি তাতেই প্রমাণিত হয় বাঘেরা কত ভাল মেজাজের জীব। আমাদের কালাধুঙ্গির বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে বোর নদীতে একদিন আমি আর আমার বোন ম্যাগি মাছ ধরছিলাম। আমি দুটো ছোট ছোট মহাশোল মাছ ধরে একটা পাথরের ওপরে বসে সিগারেট খাচ্ছিলাম, এমন সময় জিওফ হকিন্স সেখানে এক হাতির পিঠে চড়ে এসে উপস্থিত। জিওফ হকিন্স পরে উত্তর প্রদেশের কনসারভেটর অফ ফরেস্ট পদে উন্নীত হন। তিনি কয়েকজন বন্ধুকে আশা করছেন কিন্তু বাড়িতে মাংস কম পড়ে যাওয়ায় ২৪০ রুক রাইফেলটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন কিছু কাকার বা বনময়ূরীর সন্ধানে, আমার মাছ ধরা হয়ে গিয়েছিল তাই উনি বলতেই ওর সঙ্গে শিকারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে রাজী হয়ে গেলাম। হাতিতে চড়ে আমরা নদীটা পেরিয়ে গেলাম এবং মাহুতকে কাকার ময়ূর পাওয়া যায় এমন একটা জঙ্গলের দিকে যেতে বললাম। আমরা যাচ্ছিলাম ছোট ছোট ঘাস আর বুনো ফুলের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। এমন সময়ে আমি দেখলাম একটা চিতল মরে পড়ে আছে একটা গাছের নিচে। হাতিটাকে থামিয়ে আমি নেমে গেলাম চিতলটা কিভাবে মরেছে দেখার জন্যে। মাদী চিতলটা বয়স্ক আর মারাও গেছে প্রায় চল্লিশ ঘন্টা আগে। তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন না দেখে আমি ভাবলাম বোধহয় সাপের কামড়েই মারা গেছে চিতলটা। আমি যখন হাতিতে ওঠার জন্যে পেছনে ফিরেছি তখন দেখি একটা পাতার ওপর এক ফোঁটা তাজা রক্ত। রক্তের দাগের আকার দেখেই মনে হল যে জানোয়ার থেকে রক্তটা ছিটকে পড়েছে সে মরা চিতলটার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। রক্তের ছিটে থেকে জানোয়ারটা যেদিকে গেছে সেদিকে লক্ষ করে দেখি সেদিকেও খানিকটা রক্তের দাগ। এই নতুন রক্তের দাগটা দেখে আমার অবাক লাগল। তখন হাতিটাকে আমায় অনুসরণ করতে বলে আমি রক্তের নিশানা মত এগিয়ে গেলাম। ঘাসের ওপর দিয়ে ষাট-সত্তর গজ যাবার পর পাঁচ ফুট উঁচু এক ঘন ঝোপের সামনে এসে পড়লাম। রক্তের দাগ যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে এসে আমি দুহাত দিয়ে ঝোপটা ফাঁক করলাম। কারণ মাছ ধরার ছিপটা আমি হাতির পিঠে ফেলে এসেছিলাম। আমার হাতের ঠিক নিচেই একটা চিতল হরিণ পড়ে আছে। তার শিং দুটো যেন মখমলে মোড়া। হরিণটাকে একটা বাঘ খাচ্ছিল। আমি যেই ঝোপটা সরালম বাঘটা আমার দিকে মুখ তুলে এমনভাবে তাকাল যার অর্থ হচ্ছে–”এতো আচ্ছা জ্বালাতনে পড়া গেল!” আমিও নিজের মনে ওই একই কথা বলছিলাম। ভাগ্যক্রমে আমি এত হতচকিয়ে গিয়েছিলাম যে আমার নড়ার শক্তি পর্যন্ত ছিল না আর খুব সম্ভব তখন আমার হৃৎপিণ্ডও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাই আমি দাঁড়িয়েছিলাম নিশ্চল পাথরের মত। আমি বাঘটার এত কাছে ছিলাম যে সে ইচ্ছে করলেই ওর থাবা বাড়িয়ে আমার মাথায় বুলিয়ে দিতে পারত। কিন্তু তা না করে বাঘটা কয়েক মুহূর্ত সোজা আমার মুখের দিকে চেয়ে উঠে দাঁড়াল, ঘুরে গেল এবং অপূর্ব সাবলীল ভঙ্গীতে লাফ দিয়ে তার পেছনের ঝোপে চলে গেল। আমার আসার একটু আগে বাঘটা সেই কুলগাছের জঙ্গলে হরিণটাকে মেরেছে আর মরা চিতলটার পাশ দিয়ে নিচে হরিণটাকে এই ঝোপের মধ্যে টেনে আনার সময় রক্তের দাগ রেখে এসেছে। সেই দাগই আমি অনুসরণ করেছিলাম। হাতির পিঠে যে তিনজন ছিল তারা বাঘটা লাফ দেওয়ার পরে তাকে দেখতে পেল! মাহুত ভয়ে চিৎকার করে উঠল–”খবর্দার সাহিব। শের হায়!” ও আমাকে সাবধান হতে বলছিল।

আমার লোকজনদের কাছে ফিরে এসে আমি এক কাপ চা খেলাম। ততক্ষণে ওরা সারাটা কেটেকুটে বয়ে নিয়ে যাওয়ার মত করে তৈরি করল। তারপর আমরা গেলাম পাথরের সেই খাঁজটার কাছে যেখানে রক্ত জমে ছিল। এই ছয়জনই আমার সঙ্গে বহুবার শিকারে গিয়েছে। রক্তের পরিমাণ দেখে ওরা বলল বাঘটার শরীরে এমন কোনো একটা গভীর ক্ষত হয়েছে যার ফলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওটা মারা যাবে। এ বিষয়ে আমি ওদের সঙ্গে একমত হতে পারলাম না কারণ আমি জানি যে বাঘটা আঘাত পেয়েছে শরীরের ওপর-ওপর। সময় পেলেই বাঘটা সেরে উঠবে এবং যত বেশি দিন সে বাঁচবে ততই তাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।

একটা সরু নালা একটা খাড়া পাহাড় বরাবর চলে গেছে, তার ডান দিকের জমিটা নালার দিকে ঢালু এবং সেই জমির ওপর ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের নিচেটায় তেমন আগাছা নেই। নালার বাঁ দিকের জমিটা ওপরের দিকে উঠে গেছে আর তাতে রয়েছে খাটো বাঁশ এবং অন্যান্য আগাছার ঘন জঙ্গল। এই ছবিটা মনে মনে ভেবে নিলেই বুঝতে পারবেন কিরকম জায়গায় আমি আমার লোকজনদের নিয়ে সেদিন সারাদিন কাটিয়েছিলাম।

আমার পরিকল্পনা ছিল নালার ডান দিকটায় আমার লোকজনকে পাঠিয়ে সবচেয়ে উঁচু গাছ খুঁজে উঠে বসতে বলব যাতে তারা আমায় নজরে রাখতে পারে, আর যদি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার দরকার থাকে তাহলে শিস দিতে পারে। পাহাড়ীরা, কোনো কোনো ছোকরার মত দাঁতের ফাঁকে শিস দিতে ওস্তাদ। বাঘিনীর থেকে ওদের বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই কারণ ওদের দিকে বাঘটা লুকনোর মত কোনো ঝোপঝাড় নেই। তাছাড়া ওরা সবাই খুব ভাল গাছে উঠতে পারে। পাথরের খাঁজটা ছাড়ার পর বাঘিনীটার থাবার ছাপ দেখে বুঝলাম যে সেটা নালার বাঁ পাশ দিয়ে পাহাড়ের ওপর উঠে গেছে। এই পাহাড়ের পর্থেই আমি তার পিছু নিলাম।

আমি অন্য কোথাও জোর দিয়ে বলেছি যে অরণ্যগাথা, বিজ্ঞান নয় যে পাঠ্যপুস্তক পড়ে তা শেখা যাবে। এ শেখা যায় অল্প অল্প করে–অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে। এ অভিজ্ঞতা অর্জন চিরকাল ধরে চলতে পারে এর কোনো সময়সীমা নেই। অনুসরণ করার বিদ্যাও একইভাবে অর্জন করতে হয়। অনুসরণের কাজে এত ধরনের রকমফের আছে যে শিকারে গেলে এই কাজটিই আমার সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হয় আর এ কাজে উত্তেজনাও প্রচুর। অনুসরণের ব্যাপারে দুটি পদ্ধতি মোটামুটি স্বীকৃত। একটি হল রক্তের নিশানা অনুসরণ করা- আর একটি হল এমন একটি পথ অনুসরণ করা যেখানে রক্তের মিশানা নেই। এ দুটি পদ্ধতি ছাড়াও আমি অনেক সময় ঘায়ের মাছি বা মাংসভুক পাখি অনুসরণ করেও আহত জানোয়ারের সন্ধান পেয়েছি। কিন্তু যেহেতু জখমে সবসময় রক্ত পড়ে না, থাবার ছাপ দেখে, অথবা গমনকালে ওরা গাছপালার জগতে যে আলোড়ন সৃষ্টি করে, তাই দেখে জখম জানোয়ারকে অনুসরণ করতে হয়। অনুসরণের কাজ সহজ বা কঠিন হওয়া নির্ভর করে যে জমির ওপর এবং যে জানোয়ারকে অনুসরণ করা হচ্ছে তার পায়ে শক্ত খুর না নরম থাবা তার ওপর। আমার চিৎকার শুনে বাঘিনীটা যখন পাথরের খাঁজ ছেড়ে যায় তখন তার ক্ষত দিয়ে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার বিষিয়ে ওঠা ক্ষত থেকে যে সামান্য পুঁজ গড়িয়ে পড়েছিল তা দেখে তাকে অনুসরণ করা সম্ভব নয়। সেইজন্যে তার থাবার ছাপ আর পথের আশপাশের গাছপালার অবস্থা দেখেই আমাকে অনুসরণের কাজ চালাতে হচ্ছিল। যে মাটির ওপর দিয়ে আমি যাচ্ছিলাম তাতে ওইভাবে অনুসরণ করা কঠিন নয়, কিন্তু এতে সময় লাগবে অনেক– আর তাতে বাঘিনীটারই লাভ হবে।

কারণ তাকে অনুসরণ করে খুঁজে পেতে আমার যতই সময় বেশি লাগে ততই তার ঘাটা শুকিয়ে আসবে। শেষ পর্যন্ত তাকে হয়তো আর খুঁজেই পাব না কারণ গত কয়েক দিনের পরিশ্রমে আমিও ক্রমে কাহিল হয়ে পড়েছিলাম।

প্রথম একশো গজ আমায় চলতে হল হাঁটু সমান উঁচু চেঁকিশাকের মধ্যে দিয়ে। এইটুকু পথ তার চলার রাস্তা অনুসরণ করা কঠিন হল না কারণ সে এগিয়েছে মোটামুটি সরল রেখা ধরে। এরপরেই শুরু হয়েছে রিঙ্গলের ঘন ঝোঁপ। আমার নিশ্চিত ধারণা হল বাঘিনীটা এই ঝোপের মধ্যেই লুকিয়ে আছে কিন্তু সে আমাকে আক্রমণ না করলে তাকে গুলি করার কোনো আশা আমার নেই–কারণ রিঙ্গল ঝোপের জড়াজড়ি করা গাছের মধ্যে দিয়ে গেলে আওয়াজ হবেই। ঝোপটা যখন প্রায় আধাআধি পেরিয়েছি তখন হঠাৎ একটা কাকার ডেকে উঠল। বাঘিনীটা তাহলে চলতে শুরু করেছে, তবে পাহাড় বেয়ে সোজা না উঠে সে নিশ্চয় বাঁ দিকে খোলা জায়গাটার দিকেই গেছে কারণ কাকারটা তখনও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ডেকে চলেছে। আমি ফিরে এসে বাঁ দিকে গেলাম কিন্তু সেদিকে কোনো খোলা জায়গা পেলাম না কিংবা যে কাকার হরিণটা ডাকছিল তাকেও দেখতে পেলাম না। একটু পরেই কাকারটা নেমে গেল এবং কতকগুলি কালিজ পাখি কিচিরমিচির শুরু করে দিল। বাঘিনীটা তাহলে এখনও এগিয়ে চলেছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু কোনো শব্দ শুনতে পেলাম না।

 একটা শব্দ শুনে অর দিক এবং দুরত্ব ঠিক করা যে কোনো শিকারীর পক্ষেই একটা বিশেষ গুণ। আমি এ ব্যাপারটা প্রায় নিখুঁত করে এনেছি বলে আমার মনে মনে একটা গর্ববোধ ছিল। কিন্তু হঠাৎ আমি উপলব্ধি করলাম যে আমার সেই দুর্ঘটনায় এই ক্ষমতাটি থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি। আমি আমার নিরাপত্তার জন্যে আর আমার শ্রবণশক্তির ওপর নির্ভর করতে পারব না। জঙ্গলের বাসিন্দাদের যে ভাষা শেখার জন্যে আমার এত বছর লেগেছে সেই ভাষা শুনে আনন্দ পাওয়ার ক্ষমতা, আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমার কানের ওপর আর আমি কোনোদিনই নির্ভর করতে পারব না। আমার অন্য কানটা ঠিক থাকলেও হয়তো কাজ চালানো যেত কিন্তু সেটার পর্দাও বহুদিন আগে এক বন্দুক-দুর্ঘটনায় আঘাত পেয়েছিল। যাই হক এ সম্বন্ধে সাত পাঁচ ভেবে এখন কোনো লাভ নেই। আমার যে অক্ষমতাই থাক না কেন, এখন আমি মেনে নিতে রাজী নই যে কোনো বাঘ সে মানুষখেকোই হক আর যাই। হক আমার ওপর টেক্কা দিয়ে যাবে। বিশেষ করে যখন আমরা দুজনেই দুজনের। জীবনের ওপর তাক করে আছি আর পারিপার্শ্বিক অবস্থা কাউকেই বিশেষভাবে সাহায্য করছে না।

আমি আবার সেই ঝোপে ফিরে গেলাম। এবার বাঘিনীটাকে খোঁজার চেষ্টা করলাম সম্পূর্ণ দৃষ্টিশক্তির ওপর নির্ভর করে। বারবার সম্বর, কাকার হরিণ আর হনুমানের ডাক থেকেই বুঝলাম এ বনে শিকার আছে প্রচুর। কালিজ, জে. রসিক-দামা, ডাক শুনে বুঝলাম এখন পাখিরাও ভিড় করেছে বাঘিনীটার চারিদিকে। সাধারণত এই শব্দগুলোই আমায় পথ চিনিয়ে নিয়ে চলে কিন্তু এখন সেদিকে কোন নজর না দিয়ে আমি বাঘিনীটাকে ধীরে ধীরে অনুসরণ করে চললাম। এখন সে পাহাড়ের ওপর উঠছে–কখনও চলছে সোজা, কখনও এঁকেবেঁকে এ-ঝোঁপ ও-ঝোপের মধ্যে দিয়ে। পাহাড়ের প্রায় মাথায় একটা মাঠের মত জায়গা ছোট্ট শক্ত শক্ত ঘাসে ভরা–জায়গাটার আয়তন হবে প্রায় একশো গজ। এই খোলা জায়গাটার ওধারে ঘন আগাছার দুটো বড় ঝোঁপ রয়েছে। এ দুটো ঝোপের মধ্যে দিয়ে একটা সরু রাস্তা গিয়ে উঠেছে একেবারে পাহাড়টির মাথায়। এই ঘাসের ওপর আমি বাঘিনীটার থাবার ছাপ হারিয়ে ফেললাম। বাঘিনীটা টের পেয়েছিল তাকে খুব কাছ থেকে অনুসরণ করা হচ্ছে তাই সে যতটা সম্ভব আড়াল নিয়েই চলার চেষ্টা করছিল। আমার ডান পাশের ঝোঁপটি অন্য ঝোঁপটির থেকে গজ তিরিশেক কাছে। তাই আমি ডান দিকটাই প্রথমে দেখা ঠিক করলাম। আমি যখন জঙ্গলটার দু-এক গজের মধ্যে এসে পড়েছি তখন হঠাৎ একটা শুকনো ডাল ভেঙে যাওয়ার শব্দ শুনলাম। ডালটা ভাঙল যেন কোনো ভারি জানোয়ারের চাপে। আমার নিশ্চিত ধারণা হল যে শব্দটা, বাঁ দিকের ঝোঁপ থেকেই আসছে। আমি ঘুরে শব্দটা লক্ষ্য করে বাঁ দিকের ঝোপের দিকে এগোলাম। এইটাই হল ওই দিন আমার দ্বিতীয় মারাত্মক ভুল। প্রথমটা হল চিৎকার করে আমার লোকজনকে চা করতে বলা। এখন, আমার লোকজন পুরে আমাকে বলেছিল, আমি নাকি প্রায় বাঘিনীটার পায়ে পায়েই খোলা জায়গাটা পেরিয়েছিলাম। আমি যখন বাঁ দিকে ফিরলায় তখন সে ঝোপের কয়েক গজ ভেতরেই একটা ছোট্ট খোলা জায়গায় শুয়েছিল আর নিশ্চয়ই সে আমার অপেক্ষায় ছিল।

বাঁ দিকের ঝোপে বাষিনীটার কোনো চিহ্ন না দেখে আমি আবার খোলা জায়গাটায় ফিরে এলাম। হঠাৎ শুনলাম আমার লোকজনদের শি! ওরা আমার ডানদিকের কয়েকশো গজ দূরে একটা গাছের ওপর উঠেছিল। আমি ওদের দিকে ফিরে হাত নেড়ে জানালাম যে ওদের আমি দেখতে পেয়েছি। তখন তারা হাত পা নেড়ে সংকেত করে আমায় একবার ওপর একবার নিচে দেখাতে লাগল। ওরা আমায় বোঝাবার চেষ্টা করছিল যে বাঘটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে অন্য দিক দিয়ে নেমে গেছে। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরু পথটা ধরে পাহাড়ের মাথায় উঠে ওপারে খানিকটা খোলা জায়গা দেখতে পেলাম। ওই জায়গাটায় সদ্য সদ্য ঘাস পোড়ানো হয়েছে আর আগের দিন বিকেলে বৃষ্টি হওয়ার দরুণ সেই জমির ছাইমাখা মাটি ভিজে রয়েছে। ভিজে মাটির ওপর আমি বাঘিনীর থাবার ছাপ পেলাম। পাহাড়টা ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে একটা ছোট্ট ঝরনার দিকে নেমে গেছে। আমি যেদিন তল্লাকোটে এসে পৌঁছই সেদিন এই নদীটাই পার হয়েছি কয়েক মাইল ওপর দিকে। শুয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে, জল খেয়ে বাঘিনীটা ঝরণা পার হয়ে ওপারের গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে। তখন সন্ধে হয়ে আসছে তাই আমি পাহাড়ের ওপর ফিরে এলাম এবং আমার লোকজনদের ডেকে নিলাম।

যে বড় পাথরটার কাছ থেকে আমি বাঘিনীটার খাবার ছাপ অনুসরণ করতে শুরু করি সেখান থেকে ঝরণাটা পর্যন্ত দূরত্ব হচ্ছে মাইল চারেক কিন্তু এই পথটা অতিক্রম করতে আমার সময় লেগেছে প্রায় সাত ঘণ্টা। দিনটা যদিও ব্যর্থ হয়েছে কিন্তু সময়টা কেটেছে বেশ উৎসাহ উত্তেজনার মধ্য দিয়েই। এ শুধু আমার কথা নয়। আমাকে তো এগোবার সময় প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হয়ছে যাতে মানুষখেকোর খপ্পরে না পড়ি। গাছের ওপর থেকে আমার ও বাঘিনীটার প্রতিটি গতিবিধি লক্ষ করা আমার গাড়োয়ালী লোকজনদের পক্ষেও কম উত্তেজনার হয় নি। দিনটাও ছিল আমাদের পক্ষে দীর্ঘ। বেরিয়েছি সেই ভোরবেলায় আর যখন ক্যাম্পে ফিরলাম তখন রাত প্রায় আটটা।

.

০৭.

পরদিন সকালে আমার লোকজনেরা যখন, খাওয়া-দাওয়া সারছিল, আমি বাঘের চামড়াগুলো আবার নতুন করে মাটিতে গেঁথে গেঁথে শুকোতে দিলাম আর কাঁচা জায়গাগুলোতে ছাই আর ফিটকিরি ঘষে ঘষে লাগিয়ে দিলাম। বাঘের চামড়ার জন্যে অনেক যত্ন করতে হয় কারণ চর্বি পুরো ছাড়িয়ে না নিলে বা কান ঠোঁট থাবা এগুলো খুব ভালভাবে পরিষ্কার না করলে, চামড়ার লোমগুলো খসে পড়তে থাকে। ফলে চামড়াটা নষ্ট হয়ে যায়। দুপুরের কিছু আগেই আমি বেরোবার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। দুজন লোককে ক্যাম্পে রেখে গেলাম, সারাও-এর চামড়াটার ব্যবস্থা করার জন্যে। বাকি চারজনকে সঙ্গে নিয়ে আগের দিন বিকেলে বাঘিনীকে যে পর্যন্ত অনুসরণ করেছি সেই জায়গার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। যে উপত্যকার ওপর দিয়ে ঝরণা বয়ে গেছে সেটা বেশ চওড়া মোটামুটি সমতল আর তার বিস্তার হচ্ছে। পশ্চিম থেকে পুব দিকে উপত্যকার বাঁ দিকে সেই পাহাড়টা যার ওধারে কাল আমি বাঘিনীটাকে অনুসরণ করেছি। ডানদিকের পাহাড়টার ওপর দিয়ে চলে গেছে টনকপুরে যাওয়ার রাস্তাটা। মানুষখেকোর দৌরাত্ম্য শুরু হওয়ার আগে তল্লাটের যত গরু মোষ চরানোর জন্যে নিয়ে আসা হত এই উপত্যকাটায়। এর ফলে উপত্যকাটা জুড়ে জালের মত ছড়িয়ে আছে সরু সরু গরু মোষ চলার পথ আর মধ্যে মঞ্চে বুজে আসা নালা। উপত্যকাটার চারিদিকে নানা আকারের ঘাস, ঘন আগাছার ঝোঁপ আর জঙ্গল। এই পথগুলোর ওপর সম্বর, কাকার, ভাল্লুকের থাবার ছাপও দেখলাম। এগুলো মারার পক্ষে জায়গাটা প্রশস্ত সন্দেহ নেই কিন্তু একটা মানুষখেকো বাঘকে খুঁজে বের করা এ ধরনের জমির ওপর বেশ দুঃসাধ্য ব্যাপার। বাঁদিকের পাহাড়টা থেকে উপত্যকার অনেকটা দেখা যায়। অই আমি আমার লোকজনদের পাহাড়ের মাথায় গাছের ওপর চড়িয়ে দিলাম–একটা গাছ থেকে আরেকটা গাছের দূরত্ব দুশো গজ মতন। এতে তারা চারিদিকে নজর রাখতে পারবে আর প্রয়োজন হলে এগিয়ে আসতে পারবে। সব ব্যবস্থা করে আমি গেলাম আগের দিন বাঘিনীটার থাবার ছাপ অনুসরণ করে যে জায়গাটা পর্যন্ত গিয়েছি সেই জায়গায়।

বাঘিনীটা আমার গুলিতে আহত হয় এই এপ্রিল আর আজ ১০ই। সাধারণভাবে আঘাত পাওয়ার চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেলে বাঘ আর বিপজ্জনক থাকে না অর্থাৎ মানুষ দেখলেই আক্রমণ করে না। কিন্তু এ নিয়মের ব্যতিক্রমও দেখা যায় আর তা নির্ভর করে ক্ষতের গভীরতা এবং আহত বাঘের মেজাজের ওপর। আঘাত সামান্য। হলে চব্বিশ ঘণ্টা পরে লোকজনের সাড়া পেলে বাঘ সাধারণত সরে যায় কিন্তু শরীরের ক্ষত যদি খুব যন্ত্রণাদায়ক হয় তাহলে বাঘ বেশ কিছু দিন ধরে ভয়ের কারণ। হয়ে থাকে। এ বাঘিনীটার ক্ষত ঠিক কি ধরনের সে সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা ছিল না। গতকাল সারাদিন যখন সে আমায় আক্রমণের কোন চেষ্টা করেনি তখন তাকে আহত বাঘ বলে মনকে স্তোকবাক না দিয়ে সোজাসুজি মানুষখেকো ভাবাই ভাল, এতক্ষণে বার্থিনীটা নিশ্চয় খুব ক্ষুধার্ত কারণ মেয়েটিকে মেরে বাচ্চাদের সঙ্গে ভাগ করে খাওয়ার পর আর পেটে আর কিছুই পড়ে নি।

 বাঘিনীটা যেখানে ঝরাটা পার হয়েছে সেখানে তিন ফুট চওড়া ও দু ফুট গভীর একটা বৃষ্টির জলের নালা ছিল। এই নালাটার দুদিকেই ঘন আগাছার ঝোপঝাড়। বাঘিনীটা গিয়েছে এই নালার পথ ধরেই। ওর থাবার ছাপ অনুসরণ করে এসে পড়লাম একটা গরু মোষ চরার পথে। এখানে নালাটা ছেড়ে ও ডানদিকের রাস্তায় গিয়েছে। এই রাস্তা ধরেই তিনশো গজ মত এগিয়ে একটা ঘুন পাতাওয়ালা গাছ। এর নিচেই শুয়ে বাছিটা রাত কাটিয়েছে। ক্ষতের যন্ত্রণায় সে সারারাত ছটফট করেছে, এপাশ ওপাশ করেছে কিন্তু পাতার ওপর কোনো রক্ত বা পুঁজের দাগ চোখে পড়ল না। এখান থেকেই তার থাবার টাটক ছাপ দেখে আমি এগোতে লাগলাম। আমাকে এগোতে হচ্ছিল খুব সাবধানে কারণ অসতর্কতার যে কোনো মুহূর্তে বাঘিনীটা আমার ওপর লাফিয়ে পড়তে পারে। সন্ধের মধ্যে তার থাবার ছাপে বহু পথ আমার হাঁটা হল। বহু নালী, জন্তু জানোয়ার গরু মোষের পায়ে চলার পথ আমি পেরিয়ে এলাম কিন্তু এখন পর্যন্ত বাঘিনীটার ল্যাজের ডগাটুকু পর্যন্ত আমার নজরে পড়েনি। সূর্যাস্তের পর আমি আমার লোকজনদের ডেকে জড় করে ক্যাম্পে ফিরে গেলাম। রাস্তায় ও আমাকে বলল যে জন্তু জানোয়ার আর পাখির ডাকে ওরা বাঘিনীটা জঙ্গলের কোনখান দিয়ে যাচ্ছে বুঝত্বে পেরেছে ঠিকই কিন্তু ওরাও বাঘিনীটাকে দেখে নি।

যে মানুষখেকো বাঘ চোট খায় নি তাকে শিকার করতে যখন হাওয়ার উলটো মুখে হাঁটতে হয় তখন সবচেয়ে বড় ভয় থাকে পেছন থেকে আক্রান্ত হওয়ার। অবশ্য দুপাশ থেকেও বাঘ লাফিয়ে পড়তে পারে, তবে সে বিপদ তুলনামূলকভাবে কম। হাওয়াটা যখন থাকে পেছন দিকে তখন ভয় থাকে শুধু দুদিক থেকে আক্রান্ত হওয়ার। ঠিক তেমনই হাওয়াটা যদি বইতে থাকে ডানদিক থেকে তাহলে বাঁ দিকে আর পেছনে বিপদের আশঙ্কা থাকে আর বাঁ দিক থেকে যখন হাওয়া বয় তখন ডানদিকে আর পেছনে নজর রাখা উচিত। এর কোনো ক্ষেত্রেই বাঘ মানুষখেকো হ’ক বা নাই হক সামনের দিক থেকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ একেবারে মুখোমুখি– কোনো জিনিসকে আক্রমণ করা বাঘের স্বভাব বিরুদ্ধ। সাধারণভাবে মানুষখেকোরা এমন একটা দূরত্ব থেকে আক্রমণ করে যেখান থেকে ওরা শিকারের ওপর লাফ দিয়ে পড়তে পারে। সেই জন্যই আহত বাঘের চেয়ে মানুষখেকোরা অনেক ঝেশি। বিপজ্জনক। কারণ আহত বাঘ আক্রমণের সময় সবসময় একটা দূরত্ব মেনে চলে, সে দশ-বিশ গজই হোক বা একশো পজ হক। তার মানে মানুষখেকো আক্রমণ করলে প্রস্তুতির কোনো সময় পাওয়া যায় না কিছু করার তা করতে হয় বিদ্যুৎগতিতে।, কিন্তু আহত বাঘের ক্ষেত্রে অন্তত রাইফেলটা ভোলা, কোনোরকমে নিশানা করার সময়টা পাওয়া যায়। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই গুলি চালাতে হবে চট করে আর আকুল প্রার্থনা জানাতে হবে, যে দুএক আউন্সের একটা সীসের টুকরো যেন কয়েকশো পাউন্ড মাংসপেশী আর হাড়ের চলার গতি রুদ্ধ করে।

এ বাঘিনীটার বেলায় আমি জানতাম যে ক্ষতের জন্যে ওটা আমার ওপর লাফিয়ে। পড়তে পারবে না–আর আমি যদি কোনোরকমে ওর আওতার বাইরে থাকতে মি। তবেই আমি নিরাপদ। কিন্তু আমি ওকে দেখার পর গত চারদিনে ওর জখমটা হয়তো সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে। সে সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেই জন্যে আমি .. যেদিন ১১ই এপ্রিল সকালে ওর পায়ের ছাপের ফেলে-আসা জায়গাটা খুঁজতে বেরোলাম, আমি মনে মনে ঠিক করে নিলাম যে-কোনো পাথর, ঝোপঝাড়, গাছ বা অন্য যা কিছুর পেছনে বাঘিনীটা লুকিয়ে থাকতে পারে এমন জায়গা থেকে দূরে দূরে। থাকব।

বাঘিনীটা গতকাল সন্ধে বেলা টনকপুরের রাস্তার দিকে এগোচ্ছিল। যেখানে ও শুকনো ঘাসের ওপর রাত কাটিয়েছিল সে জায়গাটা আবার আমি খুঁজে বার করলাম। তারপর ওর টাটকা থাবার ছাপ ধরে এগোলাম। ঘন ঝোঁপ ঝাড় সে এড়িয়ে গেছে সম্ভবত তার মধ্যে দিয়ে নিঃশব্দে চলতে পারবে না বলেই। যেভাবে সে নালা, জন্তু জানোয়ারের চলার পথ ধরে এগিয়েছে তা দেখে মনে হয় ওর চলাটা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যহীন নয়। হয় তোত কিছু মেরে খাওয়ার মতলব আছে ওর। কিছু দূর এগিয়েই একটা নালার মধ্যে, দেখলাম বাঘিনীটা একটা বাচ্চা কাকার হরিণ খেয়েছে বাচ্চাটার বয়েস কয়েক সপ্তাহ হবে কিনা সন্দেহ। বাচ্চাটা যখন বালির ওপর শুয়ে রোদ্দুরে ঘুমোচ্ছিল তখন বাঘিনীটা ওকে ধরে। এমনভাবে ওটাকে খেয়েছে যে ওর ছোট ছোট খুরগুলো ছাড়া আর দেহের কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমার থেকে তখন বাঘিনীটার দূরত্ব মিনিট খানিক কি মিনিট দুয়েকের। বুঝলাম বাচ্চা হরিণটা খেয়ে বাঘিনীটার কিছুই হয় নি শুধু খিদে বেড়ে গেছে। তাই আরো সতর্ক হয়ে গেলাম। যে নালা, জন্তু জানোয়ারের পায়ে চলার পথ ধরে বাঘিনীটা এগোচ্ছিল সেগুলো মাঝে মাঝে এঁকেবেঁকে ঝোপঝাড় পাথরের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। আমার শরীরের অবস্থা ভাল থাকলে পিছু নিয়েই বাঘিনীটার নাগাল হয়তো আমি পেয়ে যেতাম কিন্তু ভাগ্যের মার ছাড়া কি বলব; সেদিন আমার শরীর একেবারেই ভাল ছিল না। আমার মাথা মুখ গলা সব এত ফুলে গিয়েছিল যে ওপর নিচ বা পাশে ঘাড় ফেরানই আমার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার ওপর বাঁ চোখটা ফুলে প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। যাই হক। সৌভাগ্যক্রমে আমার ডান চোখটা ভালই ছিল আর তখন পর্যন্ত আমার শ্রবণশক্তি সম্পূর্ণ চলে যায় নি।

সেদিন সারাটা দিন আমি বাঘিনীটার পেছনে পেছনে ঘুরলাম। আমি ওকে দেখি নি আর আশা করি সে-ও আমাকে দেখতে পায় নি। যেখানেই সে কোনো জলের নালা ধরে, জন্তু জানোয়ার বা গরু বাছুর চলার পথ ধরে গভীর ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে, দিয়ে গেছে, সেখানেই আমি সেই ঝোপঝাড়গুলো এড়িয়ে ঘুরে গিয়ে উলটোদিকে আবার বাঘিনীর থাবার ছাপ খুঁজে গিয়েছি। এ অঞ্চলটা ভাল করে জানা না থাকায় আমার অসুবিধে আরও বেড়ে গিয়েছিল। এর জন্যে যে শুধু প্রয়োজনের থেকে বেশি মাইল আমাকে হাঁটতে হল তাই নয়, বাঘিনীটার গতিবিধি অনুমান করা বা তার মোকাবিলা করাও আমার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াল। সেদিনকার মত আমার অনুসরণ যখন শেষ হ’ল বাঘিনীটা তখন গ্রামের পথে পা বাড়িয়েছে।

ক্যাম্পে ফিরে এসে বুঝতে পারলাম যে দুঃসময়ের ভয় আমি করেছিলাম তা এসে গিয়েছে। একটা ফোঁড়া থেকে দুঃসহ যন্ত্রণা বিদ্যুতের মত ছড়িয়ে পড়ছিল শিরায় শিরায়, মাথায় যেন হাতুড়ির ঘা মারছিল। একটার পর একটা বিনিদ্র রাত কাটানো আর শুধু চা খেয়ে থাকা আমার সব সাহস যেন শুষে নিচ্ছিল। আরও একটা রাত বিছানায় বসে বসে যন্ত্রণায় ছটফট করা, কি একটা যেন ঘটবে তারই অপেক্ষায় থাকা–এ চিন্তাটাই আমার কাছে কেমন অসহ্য বোধ হল। আমি তন্নাদেশে এসেছি ওখানকার পাহাড়ী লোকজনদের সন্ত্রাসমুক্ত করব বলে আর নিজের খারাপ সময়টাও কিছুটা কাটিয়ে উঠব বলে। কিন্তু এ পর্যন্ত যা করেছি তাতে ওখানকার লোকজনের বিপদ কাটা দূরে থাক, বরং বেড়েই গেছে। বাঘিনীটা গত আট বছরে প্রায় দেড়শো মানুষ মেরেছে। এখন ওর স্বাভাবিক শিকারের ক্ষমতা না থাকলে আর জখমটা সেরে না উঠলে সবচেয়ে সহজে যা মারা যায়, অর্থাৎ মানুষ, তাই ও মারবে। কারণ ওকে খেতে তো হবেই কিছু। বাঘিনীটার সঙ্গে একটা শেষ বোঝাঁপড়া আমায় করতেই হবে। আর সেটা আজ রাতেই বা হবে না কেন!

চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহাড়ী কায়দায় তৈরি প্রচুর দুধ দেওয়া এক কাপ চা খেয়ে আমি রাতের খাওয়া সারলাম। তারপর আমার আটজন লোককে ডেকে ভাল করে বুঝিয়ে দিলাম যে তারা যেন কাল বিকেল পর্যন্ত আমার জন্যে এই গ্রামেই অপেক্ষা করে। তার মধ্যে যদি আমি না ফিরি তাহলে তারা যেন আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে সকালবেলা নৈনিতালে রওনা হয়ে যায়। বলা শেষ হলে আমি বিছানার ওপর থেকে রাইফেলটা তুলে নিয়ে উপত্যকার দিকে নেমে গেলাম। আমার লোকেরা আমার সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে আছে। ওরা আমাকে ভাল করেই জানে। তাই কোথায় যাচ্ছি কেউ জিজ্ঞাসা করল না বা আমায় থামাবারও চেষ্টা কেউ করল না। তারা সব চুপচাপ দাঁড়িয়ে আমায় চলে যেতে দেখল। তাদের গাল বেয়ে রুপোলী রেখার মত যদি কিছু দেখে থাকি সে নিশ্চয়ই আমার মনের ভুল–কি জানি চাঁদের আলোয়ও তো অনেকরকম বিভ্রম হয়। আমি যখন চলে গেলাম তখন ওরা সার বেঁধে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

.

০৮.

আমার ছেলেবেলার সবেচেয়ে আনন্দের স্মৃতির মধ্যে একটি হচ্ছে শীতকালে যখন আমরা দলবেঁধে চাঁদের আলোয় জঙ্গলে বেড়াতে যেতাম আর ফিরে এসে প্রচুর চা খাবার খেতাম। এই ভাবে হাঁটা অভ্যেস করলে রাতের জঙ্গল সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের মনে যে অহেতুক ভয় আছে তার অনেকখানি কেটে যায় আর তাছাড়া জঙ্গলে রাতে যে নানাধরনের শব্দ হয় তার সঙ্গেও পরিচিত হবার সুযোগ মেলে। এর পরে আমার বহু বছরের অভিজ্ঞতা, জঙ্গল সম্বন্ধে আমার জ্ঞান আত্মবিশ্বাস আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই ১১ই এপ্রিল রাতে কাকডাকা জ্যোৎস্নায় যখন আমি তল্লাদেশের মানুষখেকোর সঙ্গে আমার শেষ বাজি ধরার জন্যে বেরোলাম তখন আমার আত্মবিশ্বাসের কোন অভাব ছিল না–যদিও অনেকের কাছেই মনে হবে এভাবে বেরনো আত্মহত্যারই সামিল।

বাঘ সম্বন্ধে আমার আগ্রহ দীর্ঘদিনের–প্রায় যতদূর আমার স্মৃতি যায় ততদিনের। আর এমন একটা অঞ্চলে আমার জীবন কেটেছে যেখানে বাঘও ছিল প্রচুর আর তাদের লক্ষ করার সুযোগও আমার যথেষ্ট ছিল। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন আমার একমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল একটা বাঘ দেখব। ব্যাস্ আর কিছুর দরকার নেই। পরে আমার বাঘ মারার ইচ্ছে হল। পায়ে হেঁটে বাঘ মারলাম পঞ্চাশ টাকায় কেনা একটা সৈনাদলের রাইফেল দিয়ে। এটা কিনেছিলাম এক জাহাজীর কাছ থেকে। মনে হয় চোরাই মাল, পরে ও ওটাকে শিকারের রাইফেল বানিয়ে নিয়েছিল। যাই হক তারও পরে আমার ইচ্ছে হল বাঘের ছবি তোলার। কালক্রমে আমার এই তিনটে ইচ্ছেই পূরণ হয়েছিল। এই ছবি তোলার সময়েই বাঘ সম্বন্ধে যেটুকু আমি জানি সেট, জানার সুযোগ আমার হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে ‘জঙ্গলের স্বাধীনতা পাওয়ার পর, যা আমি ছাড়া অন্য একজন মাত্র শিকারীই ভারতবর্ষে পেয়েছেন, আমি স্বাধীনভাবে অবাধে ব্যাঘ্ৰ অধ্যুষিত সব জঙ্গলে ঘোরার প্রচুর সুযোগ পেয়েছি। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, একবার একনাগাড়ে সাড়ে চার মাস ধরে লক্ষ্য করে তাদের স্বভাব ও শিকারের কাছে তাদের এগিয়ে আসা, শিকারকে মারা ইত্যাদি সম্বন্ধে কিছু জানতে পেরেছিলাম। বাঘ কখনো তার শিকারের পেছনে ধাওয়া করে না, হয় সে শিকারের জন্যে ওঁত পেতে থাকে, না হয় তাকে গোপনে অনুসরণ করে। উভয় ক্ষেত্রেই সে হয় লাফ দিয়ে শিকারের ঘাড়ে পড়ে, না হয় কয়েক গজ দৌড়ে তারপর লাফ দেয়। কোনো জানোয়ার যদি বাঘের লাফ দেওয়ার দূরত্বটা এড়িয়ে চলতে পারে, বাঘকে যদি ঠিকমত অনুসরণ করতে না দেয় আর দৃশ্য, গন্ধ, শব্দ থেকে বিপদের আভাস বুঝে নিতে পারে তাহলে তার আর পরিণত বয়স পর্যন্ত বাঁচার কোনো বাধা নেই, জানোয়ারদের যে তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তি, মানুষের তা নেই কারণ সভ্যতা অনেক কিছুর মত মানুষের এই ক্ষমতাটিও কেড়ে নিয়েছে। তাই মানুষ যখন কোনো মানুষখেকোর কবল থেকে বাঁচার চেষ্টা করে তখন নিরাপত্তার জন্যে তাকে সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হয় তার দৃষ্টিশক্তির ওপর। আমার মানসিক চাঞ্চল্য আর শারীরিক যন্ত্রণার জনে সে রাতে যখন বেরিয়ে পড়লাম তখন আমার বিরাট একটা সুবিধা ছিল এই যে সে রাতে শুধু একটা চোখেই আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। অসুবিধেটা যাতে মনে শেকড় গেড়ে না বসে সেইজন্যে আমি মনকে প্রবোধ দিচ্ছিলাম এই ভেবে যে আমি যদি বাঘিনীটার খুব কাছাকাছি না যাই তাহলে সে আমার কিছুই করতে পারবে। অথচ আমি তাকে অনেক দূর থেকেই মারতে পারব। আমি যে আমার লোকজনকে নির্দেশ দিয়েছিলাম পরদিন সন্ধেবেলার মধ্যে আমি না ফিরলে নৈনিতালে চলে যেতে তা বাঘিনীটার সঙ্গে পেরে উঠব না বলে নয়, আমার মনে একটা আশঙ্কা ছিল হয়তো আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলব, হয়তো নিজেকে রক্ষা করার মত শক্তি আমার থাকবে না।

কোনো জায়গা দিয়ে এগোবার সময় মনে মনে একটা মানচিত্র এঁকে নেওয়ার সুবিধে হল, ফেরার সময়ে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছতে অসুবিধে হয় না। যেখানে বাঘিনীটার থাবার ছাপ ছেড়ে আমি চলে এসেছিলাম সেখান থেকেই আবার অনুসরণ শুরু করলাম। আমার ভাগ্য ভাল কারণ বাঘিনীটা এগোচ্ছিল বুনো জন্তু জানোয়ার ও গরু মোষের পায়ে চলার পথ ধরেই। অন্য কোনো পথ ধরে গেলে আমার পক্ষে হয়তো অনুসরণ চালানো সম্ভব হত না। সম্বর আর কাকারগুলো এখন মাঝে মাঝেই ভোলা জায়গায় বেরিয়ে আসছে–কেউ ঘাস খেতে, কেউ আত্মরক্ষার জন্যে। আমি তাদের বিপদ সংকেত ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কিন্তু ওদের গতিবিধি দেখেই আন্দাজ করতে পারছিলাম বাঘিনীটা কখন চলতে শুরু করেছে বা কোনদিকে যাচ্ছে। একটা সরু আঁকাবাঁকা গরু মোষের পায়ে চলার পথ ধরে বাঘিনীটার থাবার ছাপ ঢুকেছে একটা ঘন আগাছাপূর্ণ ঝোপের মধ্যে। আমি কেপটা ঘুরে অন্যদিকে গিয়ে আবার থাবার ছাপটা ধরার চেষ্টা করলাম। ঝোপটা পেরতে আমি যা ভেবেছিলাম তার থেকেও বেশি সময় আমার লাগল। ঝোপটা পেরিয়েই একটা খোলা জায়গা ছোট ছোট ঘাসে ভরা আর মাঝে মাঝে বড় বড় ওক গাছ। এখানে একটা বেশ বড়সড় গাছের ছায়ায় দাঁড়ালাম। হঠাৎ ছায়াটার নড়াচড়া থেকে অনুমান করলাম যে গাছটার ওপর নিশ্চয়ই হনুমানের বাস। রওনা হওয়ার পর প্রায় আঠার ঘন্টা ধরে একনাগাড়ে আমি বহু পথ হেঁটেছি। এ-জায়গাটা মোটামুটি নিরাপদ কারণ বিপদের আভাস পেলেই হনুমানগুলো আমায় সতর্ক করে দেবে। সেইজন্য ভাবলাম এখানেই কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেওয়া যাক। গাছটার গুঁড়িতে হেলান দিয়ে, ঝোপটার দিকে মুখ করে আধঘণ্টাটাক বিশ্রাম করেছি কি না করেছি এমন সময় একটা বড়ো হনুমান বিপদ সংকেত জানিয়ে ডেকে উঠল। বাঘিনীটা ঝোঁপ ছেড়ে ভোলা জায়গাটায় বেরিয়ে এসেছে তাই হনুমানটা দেখতে পেয়েছে ওকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমিও দেখতে পেলাম বাঘিনীটাকে–আস্তে আস্তে মাটিতে শুয়ে পড়ছে। ও ছিল আমার ডানদিকে প্রায় একশো গজ দূরে-ঝোপটার থেকে ওর দূরত্ব তখন প্রায় দশ গজ। আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে শুয়ে ও ডেকে ওঠা হনুমানটার দিকে তাকিয়ে দেখল।

রাত্তিরে গুলি চালানোর অভ্যাস আমার আছে কারণ শীতকালে কালাধুঙ্গিতে আমাদের প্রজাদের ক্ষেতখামার শুয়োর, হরিণের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে প্রায়ই আমার তলব পড়ত। পরিষ্কার চাঁদের আলোয় প্রায় একশো গজ দূরত্ব পর্যন্ত কোনো জানোয়ারকে আমি মোটামুটি নিশ্চিতভাবে মারতে পারি। অধিকাংশ শিকারীর মত গুলি চালানোর সময় আমি দু চোখই খোলা রাখি। কারণ এক চোখ দিয়ে জানোয়ারটিকে লক্ষ্য করা যায়, আর অন্য চোখ দিয়ে রাইফেলের নিশানা ঠিক করা যায়। অন্য যে কোনো সময় হলে আমি বাঘিনীটা উঠে দাঁড়ানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম, তারপরে গুলি করতাম। কিন্তু ভাগ্যক্রমে আমার বাঁ চোখটা বন্ধ আর একচোখে গুলি চালানোর পক্ষে একশো গজ দূরত্বটা অনেক বেশি। আগেই দুই রাত বাঘিনীটা একটা জায়গাতে শুয়েই রাত কাটিয়েছে–হয়তো বেশির ভাগ সময়টা ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। আজও ও তাই করতে পারে। এখন ও শুয়ে আছে পেটের ওপর ভর দিয়ে, মাথাটা ওপর দিকে করে। কিন্তু রাত্রে ও যদি পাশ ফিরে শোয়, আর ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে আমি সেই গরু মোষ চলার পথটায় ফিরে গিয়ে ওর থাবার ছাপ দেখে দেখে ঝোপটার পাশ দিয়ে ওর গজ দশেকের মধ্যে পৌঁছতে পারি। কিংবা আমি খোলা জায়গাটার ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ওর কাছাকাছি যেতে পারি–সেখান থেকে আমার গুলি নিশ্চিত লক্ষভেদ করবে। যাই হক, এখন আমার নিশ্চল হয়ে বসে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই। এখন সবই নির্ভর করছে বাঘিনীটার মর্জির ওপর।

বাঘিনীটা একভাবেই শুয়ে রইল প্রায় আধঘণ্টা কি তারও বেশি–মাঝে মাঝে মাথাটা সে নাড়াচ্ছিল এদিক ওদিক। বুড়ো হনুমানটা ঘুমজড়ানো গলায় বিপদ সংকেত দিয়েই চলল। শেষে বাঘিনীটা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে আমার ডানদিক বরাবর চলতে শুরু করল। দেখেই বুঝলাম হাঁটতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। ও যেদিকটায় যাচ্ছে সেদিকে ওর ঠিক সোজাসুজি একটা দশ পনের ফুট গভীর খোলা নালা। নালাটা প্রায় বিশ পঁচিশ ফুট চওড়া। এখানে আমার পথে নিচের দিকে নালাটা আমায় পেরোতে হয়েছিল। বাঘিনীটা এখন আমার থেকে প্রায় দেড়শো গজ দূরে চলে গেছে–ওর আমাকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। তাই আবার অনুসরণ শুরু করলাম।.এ গাছ ও গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে, ওর থেকে আরো একটু তাড়াতাড়ি হেঁটে ও নালা পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই আমি আমাদের দুরত্বটা কমিয়ে আনলাম পঞ্চাশ গজে। বাঘিনীটা এখন আমার লক্ষ্যের সীমার মধ্যে। কিন্তু ও দাঁড়িয়ে আছে ঘন ছায়ার আড়ালে। ওর ল্যাজের যেটুকু আমি দেখতে পাচ্ছিলাম তা দেখে গুলি করা সম্ভব নয়। ও একইভাবে দাঁড়িয়ে রইল মিনিটখানেক–সে এক দীর্ঘ উদ্বিগ্ন মিনিট। তারপর নালাটা পেরোনোই ঠিক করল ও-খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল নালাটার পাড়ে।

বাঘিনীটা চোখের সামনে থেকে সরে যাওয়া মাত্রই আমি ঝুঁকে পড়ে কোনো শব্দ না করে সামনে দৌড়তে শুরু করলাম। মাথা নিচু করে দৌড়ানো আমার পক্ষে নেহাতই বোকামি হয়েছে কারণ কয়েক গজ দৌড়ানোর পরই আমার মাথা ঘুরতে লাগল। আমার কাছেই মাত্র কয়েক ফুটের ব্যবধানে ছিল দুটি ওকের চারা-পরস্পরের গায়ে ঘেঁষে ছড়িয়েছে তাদের ডালপালা। আমি মাটিতে রাইফেল রেখে একটা গাছে প্রায় দশ বার ফুট উঠে গেলাম। এখানে বসার, পা মেলার আর হেলান দেওয়ার মত কয়েকটি ডাল ছিল। আমি সামনের ডালপালা আঁকড়ে ধরে মাথাটা ডালের ওপর হেলিয়েছি এমন সময় সেই মারাত্মক ফোঁড়াটা ফাটল। আমার ভয় ছিল ফেঁড়াটা আমার মস্তিষ্কের মধ্যে, কিন্তু তা না হয়ে আমার বাঁ কান আর নাকের মধ্যে দিয়েই গলগল করে বেরিয়ে এল পুঁজরক্ত।

‘হঠাৎ কোনো তীব্র যন্ত্রণা থেমে যাওয়ার আনন্দের তুলনা নেই’–একথা যিনি বলেছিলেন তিনি যন্ত্রণায় যেমন কষ্ট পেয়েছিলেন তেমনি হঠাৎ কষ্ট উপশমের আনন্দ পেয়েছিলেনও তিনিই। প্রায় মাঝরাত নাগাদ আমার যন্ত্রণা সম্পূর্ণ দূর হল। যখন পুবের আকাশ আসন্ন ভোরের ছোঁয়ায় ক্রমেই স্বচ্ছ হয়ে আসছে, আমি কনুই থেকে মাথা তুললাম। এক নাগাড়ে চার ঘণ্টা একটা সরু ডালে বসে থাকার ফলে আমার পায়ে খিচ ধরেছিল–সেই ব্যথাতেই আমার ঘুম ভেঙে যায়; কিছুক্ষণ আমি ধন্দ ধরার মত বসে রইলাম–আমি কোথায় আছি, আমার কি হয়েছে কিছুই আমার মুখ, ঘাড় ফোলা চলে গেছে। আমি এখন যেদিকে খুশি মাথা ঘোরাতে পারি। আমার বাঁ চোখটা ফোলা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই খুলে গেছে আর এখন ঢোক গিলতেও কোনো কষ্ট হচ্ছে না। আমি বাঘিনীটাকে গুলি করার একটা সুবর্ণ সুযোগ হারিয়েছি সত্যিই কিন্তু তাতে কি এসে যায়? আমার ‘দুঃসময় কেটে গেছে-বাঘিনীটা যেখানে যত দূরেই থাক আমি ওকে খুঁজে বার করবই। সময় যাই লাগুক না কেন আমি নিশ্চয় আরেকটা সুযোগ পাব।

আমি শেষ যখন বাঘিনীটাকে দেখি তখন ও এগোচ্ছিল গ্রামের দিকে। যে গাছে উঠতে আমার এত কষ্ট হয়েছিল সেই গাছের একটা ডাল ধরে ঝুলে লাফিয়ে মাটিতে নেমে এলাম তারপর রাইফেলটা তুলে নিয়ে একই দিকে রওনা দিলাম। ঝরনাটার ধারে এসে আমি নিজেকে এবং আমার জামাকাপড় যতদূর সম্ভব পরিষ্কার করে নিলাম। আমার লোকেরা কিন্তু আমার নির্দেশ মত গ্রামে রাত কাটায় নি; আমার তাঁবুর কাছে একটা আগুন জ্বালিয়ে গোল হয়ে ঘিরে সবাই বসে ছিল। আগুনের ওপর ফুটছিল এক কেটলি জল। যখন ভিজে সপসপে অবস্থায় ওরা আমায় দেখতে পেল তখন ওরা আনন্দে উত্তেজনায় লাফ দিয়ে উঠল–”সাহেব! সাহেব! আপনি ফিরে এসেছেন! আর আপনি ভাল আছেন?” “হ্যা”,আমি উত্তর দিলাম “আমি ফিরে এসেছি–আর বহাল তবিয়তে!” কোনো ভারতীয় যখন আনুগত্য প্রকাশ করে তখন সে হিসেব করে না আর তার মধ্যে কোনো খাদ থাকে না। আমরা যখন তল্লাকোটে পৌঁছলাম তখন গ্রামের সর্দার আমার লোকজনকে দুটো ঘর ছেড়ে দিল কারণ ওখানে খিল দেওয়া দরজার বাইরে শোওয়া বিপজ্জনক। আমার সেই দুঃসময়ের’ রাতে, বাইরে বিপদ আছে জেনেও আমার লোকজন বাইরে বসেছিল যদি আমার কোন সাহায্যের প্রয়োজন হয় ভেবে–আর এক কেটলি জল ওরা ফুটন্ত অবস্থায় রাখছিল আমি যদি ফিরি আমায় চা দেবে বলে। চা খেয়েছিলাম কিনা আমার ঠিক খেয়াল নেই কিন্তু মনে আছে সে রাতে আমি শুয়ে পড়ার পর একজোড়া খুব ইচ্ছুক হাত আমার পা থেকে জুতো জোড়া খুলে নিয়েছিল, আর আমার গায়ে একটা কম্বল ঢাকা দিয়ে দিয়েছিল। ঘন্টার পর ঘণ্টা একটা নিশ্চিন্ত ঘুম তারপরে একটা স্বপ্ন। কেউ আমাকে খুব উত্তেজিত গলায় ডাকছে আর অন্য একজন কেউ সমান উত্তেজিতভাবে তাকে আমায় ডাকতে বারণ করছে। এই স্বপ্নটাই একটু রকমফের হয়ে বারবার আমার সামনে আসতে লাগল–অবশেষে আমার ঘুমের জাল ছিঁড়ে এই কথাগুলো পরিষ্কার আমার কানে এল–”ওকে ঘুম থেকে না ওঠালে উনি খুব রেগে যাবেন।” কেউ একজন উত্তর দিল-”ওকে তুলো না, উনি খুব ক্লান্ত। শেষের বক্তা গঙ্গারাম। আমি ওকে ডেকে লোকটিকে আমার কাছে নিয়ে আসতে বললাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমার তাঁবুটা ছেলে বুড়োর এক উত্তেজিত জনতায় ভরে গেল-সবাই সমস্বরে আমায় বলতে লাগল যে মানুষখেকোটা গ্রামের অন্য প্রান্তে সদ্য সদ্য ছটি ছাগল মেরেছে। আমি জুতো পরতে পরতে জনতার দিকে তাকিয়ে দুঙ্গার সিংকে দেখতে পেলাম। যখন বাঘিনীর বাচ্চা দুটোকে মারি তখন এই ছেলেটিই আমার সঙ্গে ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম ছাগলগুলো কোথায় মারা পড়েছে ও তা জানে কিনা আর আমায় সেখানে নিয়ে যেতে পারবে কিনা। “হ্য, হ্যাঁ,” সে খুব উৎসাহ ভরে। উত্তর দিল “আমি জানি কোথায় তারা মারা পড়েছে। আমি আপনাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারি।” গাঁয়ের সর্দারকে বললাম জনতাকে সামলাতে তারপর আমার ২৭৫ রাইফেলটি নিয়ে দুঙ্গার সিং-এর সঙ্গে গ্রামের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

ঘুমিয়ে বেশ তাজা হয়ে উঠেছিলাম আর এখন ঝাঁকির দরুন মাথায় যন্ত্রণার ভয়ে আস্তে আস্তে পা ফেলারও কোনো প্রয়োজন নেই-তাই বহুদিন পরে বেশ স্বচ্ছন্দে সহজভাবে হাঁটতে পারছিলাম।

.

০৯[3PP1] .

আমি যেদিন প্রথম তল্লাকোটে পৌঁছই সেদিন এই দুঙ্গার সিংই আমাকে নিয়ে যায় দুটো উপত্যকার মধ্যে সেই ঘোড়ার পিঠের জিনের মত জায়গাটিতে। ডান দিকের উপত্যকাটি খাড়াভাবে নেমে গেছে কালি নদীর দিকে। এই উপত্যকারই ওপর দিকে আমি বাচ্চা দুটোকে মেরেছিলাম আর বাঘিনীটাকে জখম করেছিলাম। বাঁ দিকের উপত্যকাটির খাড়াই অত বেশি নয়- ওপরের পাড় থেকে একটা ছাগল চলা রাস্তা নেমে গেছে নিচে। এই উপত্যকাটার মধ্যেই ছাগলগুলো মারা পড়ে। ওই সরু রাস্তাটি দিয়ে ছেলেটি দৌড়তে শুরু করল। আমিও তার পিছু নিলাম। পাথুরে এবড়ো খেবড়ো জমির ওপর দিয়ে পাঁচ-ছশো গজ গিরে পথটা এসে ঠেকেছে একটা ছোট্ট ঝরনার ধারে। ওপার দিয়ে পথটি আবার এঁকেবেঁকে উপত্যকার দিকে চলে গেছে। পথটা যেখানে এসে ঝরনাটার সঙ্গে মিশেছে সেখানে একখণ্ড অপেক্ষাকৃত সমতল ভূমি। এই ভোলা জায়গাটার ওপর দিয়ে ডানদিক থেকে বাঁদিক পর্যন্ত একটা পাথরের ঢিবি। তার ওদিকে একটা গর্ত মতন রয়েছে। সেই গর্তের মধ্যেই পড়ে আছে তিনটে ছাগল।

পাহাড় থেকে দৌড়ে নামার সময়েই ছেলেটি আমায় বলেছিল যে বেলা দুপুর নাগাদ দশ পনেরটা ছেলের হেফাজতে বেশ বড় একপাল ছাগল এই গর্তটায় ঘাস। খাচ্ছিল। হঠাৎ একটা বাঘ, ওদের মনে হল সেটা মানুষখেকোটাই হবে, কোত্থেকে যেন লাফিয়ে পড়ে আর ছটা ছাগলকে মেরে ফেলে। বাঘ দেখে ছেলেগুলো সমস্বরে চিৎকার আরম্ভ করে–তখন আর কিছু লোকজন যারা আশেপাশে জ্বালানী কাঠ কুড়োচ্ছিল, তার চিৎকার শুনে দৌড়ে আসে। এই হট্টগোল, চিৎকার, ছাগলের দৌড়াদৌড়ির মধ্যে বাঘটা সরে পড়ে। কোনদিকে যে গিয়েছে তা ওরা কেউই লক্ষ করে নি। তিনটে মরা ছাগল নিয়ে লোকজন ছেলেরা গ্রামের দিকে দৌড়ে আসে আমাকে খবর দেওয়ার জন্যে আর তিনটে ছাগল ওই গর্তের মধ্যেই পড়ে থাকে পিঠ ভাঙা অবস্থায়।

সেই আহত মানুষখেকোই যে ছাগল মেরেছে তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই কারণ আমি যখন তাকে গত রাতে শেষ দেখি তখন সে সোজা গ্রামের দিকেই যাচ্ছিল। তাছাড়া আমার নোকজনও আমাকে বলেছিল আমি ক্যাম্পে ফেরার ঘণ্টাখানেক আগে ঝরনার ধারে একটা কাকার ডেকে উঠেছিল–ওরা যেখানে বসেছিল তার থেকে প্রায় একশো গজ দূরে। আমায় দেখেই কাকারটি ডাকছে মনে করে ওরা আগুনটা জ্বালিয়েছিল। আগুনটা জ্বালিয়ে ওরা ভালই করেছিল কারণ পরে আমি দেখেছিলাম বাঘিনীটার থাবার ছাপ আগুনের চারিদিক ঘুরে গ্রামের দিকে চলে গেছে। নিশ্চয়ই কোন মানুষ শিকারের খোঁজে গিয়েছিল ও। শিকার জোটাতে না পেরে ও নিশ্চয়ই গ্রামের আশেপাশেই কোথাও ঘাপটি মেরে বসেছিল। খাদ্য সংগ্রহের প্রথম সুযোগেই ও ছাগলগুলো মারে। এ কাজগুলো ও সারে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আর তখন জখমের যন্ত্রণায় ও নিশ্চয়ই খুব খোঁড়াচ্ছিল।

আমি জায়গাটার সঙ্গে বিশেষ পরিচিত ছিলাম না তাই দুঙ্গার সিংকে জিজ্ঞাসা করলাম ওর কি মনে হয়? কোনদিকে গেছে বাঘটা? উপত্যকার নিচের দিকটা দেখিয়ে সে বলল তার মনে হয় নিচের ঘন জঙ্গলের মধ্যেই ঢুকেছে বাঘটা। আমি বাঘটাকে খুঁজতে যাব মনস্থ করে ওর কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করে জঙ্গলটা সম্বন্ধে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম হঠাৎ একটা কালিজ কিচিরমিচির করে উঠল। কালিজের ডাক শুনেই ছেলেটি ঘুরে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের ওপর দিকটায় তাকাল–আমাকেও ইশারায় জানিয়ে দিল কোন দিকে থেকে পাখিটা ডাকছে। আমাদের বাঁ দিক দিয়ে পাহাড়টা খাড়া উঠে গেছে। পাহাড়ের গায়ে কিছু কিছু ঝোপঝাড় আর ছড়ানো ছেটানো খাটো খাটো গাছ। আমি জানতাম বাঘটা ওই পাহাড় বেয়ে ওঠে নি। আমি খুঁজছি দেখে দুঙ্গার সিং আমায় বলল কালিজটা পাহাড়ের ওপর থেকে ডাকছে না, পাহাড় ঘুরে একটা নালা আছে, ডাকটা আসছে সেই দিক থেকেই। পাখিটা যখন আমাদের দেখতে পায় নি তখন তার ভয় পেয়ে ডাকার একমাত্র কারণ হতে পারে বাঘিনীটা। আমি দুঙ্গার সিংকে বললাম এখন আমাকে ছেড়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দৌড়ে ও যেন গ্রামে ফিরে যায়। ও দৌড়ে বিপদ সীমানা পেরনো পর্যন্ত আমি রাইফেল নিয়ে ওর ফেরার পথ পাহারা দিলাম তারপর একটা সুবিধেমত বসার জায়গা খোঁজার জন্যে ফিরলাম।

এ অঞ্চলের একমাত্র গাছ হল বিশাল বিশাল পাইন। এ গাছগুলোয় ত্রিশ চল্লিশ ফুট পর্যন্ত কোনো ডালপালা না থাকায় গাছে ওঠা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। সেই জন্যে আমাকে বাধ্য হয়ে মাটিতেই বসতে হবে। দিনের বেলা হলে কোন চিন্তা ছিল না, কিন্তু বাঘিনীটা ফিরতে ফিরতে যদি রাত হয়ে যায়, আর ওর যদি ছাগল ভেড়া ছেড়ে মানুষের মাংস খাওয়ার ইচ্ছে প্রবল হয়ে থাকে তাহলে চাঁদের আলো ওঠার আগে ঘন্টা দুয়েক অন্ধকারে কাটানোর জন্যে আমার অনেক বরাতজোর দরকার হবে।

গর্তটার এদিকে বাঁ দিক থেকে ডানদিক পর্যন্ত যে ঢিবিটা চলে গেছে তার এপাশে ছিল একটা বড় চ্যাটালো পাথর। তার কাছেই অন্য আরেকটা, একটু ছোট। আমি দেখলাম ওই ছোট পাথরটার ওপর বসলে আমি বড় পাথরটার আড়াল পাব। এতে বাঘিনীটা যেদিক থেকে আসতে পারে সেদিকে শুধু আমার মাথাটাই বেরিয়ে থাকবে। সেই জন্যে এখানে বসাই আমি স্থির করলাম। আমার ঠিক সামনেই একটা বিরাট গর্ত–প্রায় চল্লিশ গজ চওড়া; তার ওপারের চড়াটা প্রায় কুড়ি ফুট মত উঁচু। ঐ পাড়ের ওপর রয়েছে দশ থেকে কুড়ি ফুট চওড়া একটা সমতল জায়গা–জায়গাটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে ডানদিকে। এর ওপারেই খাড়া উঠে গেছে পাহাড়। লোকজন আর রাখাল ছেলেরা যখন দৌড়ে পালায় গর্তের মধ্যে ছাগল তিনটে তখনও জ্যান্ত ছিল–এখন তারা মৃত। থাবা মারার সময় বাঘিনীটা একটা ছাগলের পিঠের ছাল চামড়া তুলে নিয়েছিল।

কালিজটা এখন আর চিৎকার করছে না। আমি ভাবতে লাগলাম পাখিটা ডেকেছিল কখন? আমি ছেলেটার সঙ্গে এখানে পৌঁছবার পর যখন বাঘিনীটা নালা বেয়ে ওপর দিকে যাচ্ছিল তখন, না বাঘিনীটা ফিরে আসবার সময়? একটা হচ্ছে দীর্ঘ প্রতিক্ষার ব্যাপার কিন্তু অন্যটি হলে যা ঘটার তা অচিরেই ঘটবে। আমি বেলা দুটোর সময় আমার ঘাঁটি আগলে বসেছিলাম। আধঘণ্টাখানেক পরে একজোড়া নীল হিমালয় অঞ্চলের ‘ম্যাগপাই’ পাখি উপত্যকার ওপর দিয়ে উড়ে এল। এই সুন্দর পাখিগুলো বাসা বাঁধার মরসুমে ছোট ছোট পাখির বাসা ভেঙে দেয় বটে কিন্তু জঙ্গলে কোথাও কিছু মরলে ওদের খুঁজে বার করার ক্ষমতা অসাধারণ। আমি ‘ম্যাগপাই’ পাখিগুলোকে দেখার আগেই ওদের ডাক শুনেছিলাম–ওদের গলার খুব জোর। মরা ছাগলগুলো দেখে ওরা ডাক থামিয়ে খুব সাবধানে এগিয়ে গেল। তারপর কয়েকবার হুশিয়ারির : ডাক ডেকে তারা ছাল ছাড়ানো ছাগলটার পিঠে উঠে খেতে লাগল। কিছুক্ষণ ধরে একটা রাজ শকুন আকাশে চক্কর দিচ্ছিল। ম্যাগপাইগুলোকে ছাগলটার পিঠে দেখে সেটা যেন হাওয়ায় ভেসে নেমে এল আর পালকের মত হাল্কা চালে বসল একটা পাইন গাছের মরা ডালে। এই সাদা বুক, কালো পিঠ ও লাল মাথা পা-ওয়ালা বাজ শকুনগুলোই সর্বপ্রথম্ মড়ির সন্ধান পায়। অন্য জাতের শকুনের তুলনায় এগুলো আকারে ছোট বলে ভোজসভায় এদের আগেই হাজির হতে হয়। কারণ অন্যেরা এলে ওদের পিছিয়ে যেতে হয়।

শকুনটির আসাকে আমি মনে মনে স্বাগত জানালাম কারণ ওর গতিবিধি থেকে না-জানা অনেক কিছুই আমি জানতে পারব। পাইন গাছের ওপর থেকে ও বহুদুর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে; ও যদি নেমে আসে ম্যাগপাই পাখিগুলোর সঙ্গে যোগ দেয় তাহলে বুঝতে হবে বাঘিনীটা চলে গেছে কিন্তু ও যদি গাছেই বসে থাকে তার মানে হবে বাঘিনীটা আশেপাশেই কোথাও আছে। পরের আধঘণ্টা দৃশ্যটা এইরকম থাকল–ম্যাকপাই দুটো ছাগলের মাংস ঠুকরে ঠুকরে খেতে থাকল, শকুনটা সেই মরা ডালের ওপর বসেই রইল–তারপর ঘন বৃষ্টির মেঘের আড়ালে সূর্য ঢাকা পড়ল। কিছুক্ষণ পরেই আবার কালিজটা কিচিরমিচির আরম্ভ করল আর ম্যাগপাইগুলো খুব জোরে ডাকতে ডাকতে উপত্যকার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। বাঘিনীটা আসছে। গতরাতে হঠাৎ মাথা ঘুরে যাওয়ার দরুণ যে সুযোগ হাতে এসেও ফস্কে গেল সেই সুযোগই আবার আসছে। বাঘিনীটাকে আমি গুলি করতে পারব-যখন ভেবেছিলাম তার অনেক আগেই।

পাহাড়ের ওপর কয়েকটা ছোটখাট আগাছার ঝোঁপ থাকার দরুন নালাটা আমার নজরে পড়ছিল না। একটু পরে এই ঝোপের মধ্যে দিয়েই আমি বাঘিনীটাকে দেখতে পেলাম। সে খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে কুড়ি ফুট উঁচু পাড়ের ওপর সেই সমতল জমিটার ওপর দিয়ে তার চোখ আমারই ওপর। আমার মাথাটা শুধু দেখা যাচ্ছে, তাও নরম টুপিটা চোখের ওপর পর্যন্ত টানা; আমি যদি নড়াচড়া না করি তাহলে ও আমায় দেখতে পাবে না জানতাম। তাই রাইফেলটা চ্যাটালো পাথরটার ওপর রেখে আমি নিশ্চল মূর্তির মত বসে রইলাম। আমার ঠিক উল্টো দিকে এসে বাঘিনীটা বসল–আমাদের দুজনের মাঝে শুধু একটা পাইন গাছে গুঁড়ি। আমি গাছটার একপাশ দিয়ে ওর মাথা আর অন্য পাশ দিয়ে ওর পেছনের কিছুটা অংশ আর ল্যাজ দেখতে পাচ্ছিলাম। এখানে সে কয়েক মিনিট বসে রইল–শুধু ঘায়ের ওপর যে মাছিগুলো ভনভন করে বিরক্ত করছিল সেগুলোকে মাঝে মাঝে তাড়াবার চেষ্টা করছিল সে।

.

১০.

আট বছর আগে, বাঘিনীটি যখন এখনকার চেয়ে তরুণী, একটি শজারুর সঙ্গে মোলাকাতে ও ভীষণভাবে জখম হয়। যখন এই চোটটা খায়, তখন হয়তো ওর বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চাদের স্তন্যপান করাবার জন্য নিজের খাওয়া দরকার আর সে সময়টা নিজের স্বাভাবিক শিকার যোগাড় করতে না পেরে ও মানুষ মারতে শুরু করে। এ কাজ করে ও প্রকৃতির আইনের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করে নি। ও মাংসাশী প্রাণী। মানুষের হক, বা অন্য কোনো জন্তু জানোয়ারের হক, মাংসটাই একমাত্র খাদ্য যা ও হজম করতে পারে। অবস্থা বিপাকে পড়লে জানোয়ার তো বটেই, এমন কি মানুষও এমন সব খাবার খায়, যা স্বাভাবিক অবস্থায় তারা কখনই খেতে চাইবে না। সম্পূর্ণ নরখাদক জীবনে বাঘিনীটি মাত্র দেড়শো মানুষ মেরেছে, বছরে তা কুড়িটিরও কম, এই ঘটনা থেকে আমার ধারণা এই সহজলভ্য শিকারের দিকে ও তখনি ঝুঁকেছিল যখন ওর বাচ্চা হয়, এবং যখন এই জখমের কারণে ও নিজের ও স্ব-পরিবারের বাঁচার মত প্রয়োজনীয় পরিমাণ স্বাভাবিক খাদ্য আহরণে অক্ষম হয়।

বাঘিনীটার জন্যে তল্লাদেশের মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে–যে ক্ষতি ও করেছে তার দাম আজ দিতে হচ্ছে ওকে। ওর দুঃখ-দুর্দশার থেকে ওকে চিরকালের মত মুক্তি দেওয়ার জন্যে আমি অনেকবার রাইফেলের নিশানা জুড়েছিলাম ওর মাথা লক্ষ্য করে কিন্তু আকাশ ভরা মেঘ থাকার ফলে আমার পক্ষে প্রায় ষাট গজ দূরে একটা তুলনামূলকভাবে ছোট্ট জিনিস তাক করে মারার মত যথেষ্ট আলো ছিল না।

অবশেষে বাঘিনীটা উঠে দাঁড়িয়ে তিন পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল তারপরে আমার দিকে পাশ ফিরে নিচে ছাগলগুলোর দিকে তাকাল। চ্যাটালো পাথরটার ওপর কনুই রেখে আমি তার হৃৎপিণ্ড যেখানে হতে পারে সেরকম একটা বিন্দু সহজে লক্ষ্য করে রাইফেলের ঘোড়া টিপলাম, দেখলাম তার পেছনের পাহাড়ে একটু ধুলো উড়ে গেল। ধুলো দেখেই আমার মনে একটা চিন্তা বিদ্যুতের মত ঝলসে গেল–আমি যে শুধু হৃৎপিণ্ডে গুলি লাগাতে পারি নি তাই নয়, পুরো জানোয়ারটাতে আমার তাক ফসকে গেছে। কিন্তু তবুও আমি যে রকম সযত্নে নিশানা করেছি তাতে তো লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার কথা নয়। যা সন্দেহাতীতভাবে হয়েছে তা হচ্ছে গুলিটা ওর শরীর সম্পূর্ণ ভেদ করে বেরিয়ে গেছে, কোথাও বাধা পায় নি। আমার গুলি খেয়ে বাঘিনীটা সামনের দিকে লাফ দিল, তারপর খুব ভয় পাওয়া একটা জানোয়ারের মত সমতল জমিটার ওপর দিয়ে ছুটতে লাগল, ওর ছোটাটা কিন্তু আহত জানোয়ারের মত নয়। আমি আরেকটা গুলি করার আগেই ও আমার দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।

বাঘিনীটা আমাকে এমন চমৎকার সুযোগ দিল আর আমি ওকে মারতে পারলাম না এতে খেপে গেলাম আমি, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলাম যে ও আমাকে এড়িয়ে পালাতে পারবে না। পাথরটার ওপর থেকে লাফিয়ে নেমে আমি দৌড়ে গর্তটা পার হয়ে কুড়ি ফুট উঁচু পাড় বেয়ে উঠে সমতল জায়গাটার ওপর দিয়ে যেখানে বাঘিনীটা অদৃশ্য হয়েছে সেখানে এসে পড়লাম। সেখানে দেখি আলগা কতকগুলো পাথরের পর একটা চল্লিশ ফুটটাক খাড়াই নেমে গেছে। বাঘিনীটা এই দিক দিয়েই বিরাট লাফ মেরে চলে গেছে। এখানে লাফ দিলে পা মচকে যাওয়ার ভয় আছে তাই হাঁটু গেড়ে বসে হেঁচড়ে হেঁচড়ে নামলাম নিচ পর্যন্ত। এই খাড়াইএর নিচেই রয়েছে একটা বহু ব্যবহৃত পায়ে চলার পথ-বাঘিনীটা নিশ্চয়ই ওই পথ ধরেই এগিয়েছে কিন্তু জমি খুব শক্ত হওয়ার দরুণ ও পথে ওর থাবার ছাপ খুঁজে পাওয়া কঠিন। পথটার ডানদিকে একটা নুড়ি ভর্তি ঝরনা–এই ধরনাটাই আসার পথে আমি আর দুঙ্গার সিং পার হয়েছি কিছুটা ওদিক থেকে। ঝরনাটার পাশ থেকে উঠে গেছে একটা ঘাসে ঢাকা খাড়া পাহাড়। ঝরনাটার বাঁ দিকে আরেকটা পাহাড়–তার ওপরে রয়েছে শুধুমাত্র কয়েকটা পাইন গাছ। পথটা কিছুদূর পর্যন্ত সোজা চলে গেছে। এই পথ ধরে পঞ্চাশ কি ষাট গজ এগিয়েছি এমন সময় শুনি একটা ‘ঘুরাল’ হুশিয়ারি জানাচ্ছে। ঘুরালটা থাকতে পারে একমাত্র আমার ডান দিকে, ঘাসে ঢাকা পাহাড়টিতে। বাঘিনীটা সম্ভবত ঝরনাটা পেরিয়ে ওই পাহাড়ে উঠে গেছে, এই মনে করে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম বাঘিনীটাকে দেখা যায় কিনা দেখার জন্যে। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে গ্রামের দিকে তাকাতেই দেখি একদল লোক সেই ঘোড়ার পিঠের মত উঁচু জায়গাটার ওপর এসে দাঁড়িয়েছে। আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখে ওরা চিৎকার করে, হাতের ইশারায় আমাকে এগিয়ে যেতে বলল পথটা ধরে একদম নাক বরাবর সোজা। সঙ্গে সঙ্গে আমি আবার দৌড়তে লাগলাম এবং একটা মোড় ঘুরতেই পথের ওপর দেখতে পেলাম তাজা রক্তের দাগ।

জানোয়ারের চামড়া সাধারণত ঢিলে থাকে। যদি কোনো জানোয়ার স্থিরভাবে দাঁড়ানো অবস্থায় গুলি খায় এবং তারপরেই যদি সে বেগে ছুটতে থাকে তাহলে তার চামড়ার ফুটো আর শরীরের মাংসের ফুটো এক লাইনে থাকে না। এর ফলে যতক্ষণ জানোয়ারটা জোরে দৌড়ায় ততক্ষণ তার ক্ষত থেকে রক্ত পড়ে না বললেই চলে–পড়লেও তা অতি সামান্য। তবে জানোয়ারটার দৌড়ের বেগ যখন কমে আসে তখন দুটো ফুটো কাছাকাছি হয়ে যায় আর রক্ত ঝরতে থাকে। যতই সে আস্তে চলে রক্ত ঝরা ততই বাড়তে থাকে। কোনো জানোয়ারের গায়ে গুলি ঠিকমত লেগেছে কিনা সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা থাকলে গুলি করার সময়ে যেখানে জানোয়ারটি ছিল সেখানে লোমের কুঁচির খোঁজ করা উচিত। লোমের কুচি থাকলে বুঝতে হবে গুলি জানোয়ারটার গায়ে লেগেছে আর না থাকলে ধরে নিতে হবে গুলি জানোয়ারটাকে একেবারেই ফসকে গেছে।

মোড়টা ঘুরে বাঘিনীটার গতি মন্থর হয়ে এসেছে কিন্তু রক্তের ছিটে থেকে বোঝা গেল তখনও সে দৌড়াচ্ছে। ওকে ধরার জন্যে আমি জোরে দৌড়াতে শুরু করলাম। কিছুটা যাওয়ার পরই দেখি আমার বাঁদিকে পাহাড় থেকে একটা পাথর বেরিয়ে আছে। এখানে পথের বাঁকটা এমন কোণ কেটে হঠাৎ মোড় নিয়েছে যে গতির মুখে আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না, পাহাড়ের গা ছাড়া আমার ধরারও কিছু ছিলনা, পথটার ধার দিয়ে খাড়াভাবে নিচে পড়লাম। দশ পনের ফুট নিচে ছিল একটা রডোডেনড্রনের চারা এবং চারা গাছটার পরেই একটা বিরাট খাদ। খাদটার নিচে একটা অন্ধকার ভয়াবহ চেহারার নালা। নালার জল পাহাড়ের গোড়ায় একটা সমকোণ সৃষ্টি করে ঘুরে গেছে; আমি চারাগাছটা পেরোবার সময়ে নরম মাটিতে আমার পা বসে যাচ্ছিল তাই ডান হাতে চারাগাছটা চেপে ধরলাম। আমার ভাগ্য ভাল যে চারা গাছটা শেকড় সুষ্ঠু উপড়ে এল না–যদিও বেঁকে গিয়েছিল তবু গাছটা ভাঙে নি। খুব আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে নিয়ে আমি প্রাণোচ্ছল মেডেন হেয়ার ফার্নে ঢাকা পিছল ও নরম পাহাড়ের গায়ে পা ঠুকে ঠুকে পা রাখার মত জায়গা করে নিলাম।

বাঘিনীটাকে ধরার সুযোগ চলে গেল বটে কিন্তু এখন বেশ রক্তের স্পষ্ট দাগের নিশানা ধরে ধরে এগোনো যাবে। আর তাড়াহুড়োর কিছু নেই। যে চলার পথটা এতক্ষণে উত্তর দিকে চলছিল সেটা এখন একটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা খাড়া পাহাড়ের উত্তর দিক ঘেঁষে পশ্চিম মুখে চলেছে। এই পথ ধরে আরো দুশো গজ মত এগোবার পর আমি এসে পড়লাম পাহাড়ের মাঝ বরাবর একটা সমতল জায়গায়। শরীরে রাইফেলের গুলির চোট লাগার পর একটা বাঘের এর থেকে বেশি দূর যাওয়া সম্ভব নয় তাই চেঁকিশাক আর বিক্ষিপ্ত ঝোঁপঝাপে ঢাকা সমতল জায়গাটির দিকে আমি খুব সতর্কভাবে এগোতে লাগলাম।

যে বাঘ তার আঘাতের প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর তার মত ভয়াবহ জীব ভারতের জঙ্গলে আর কিছু নেই। বাঘিনীটা বদলা নেওয়ার মত একটা চোট খেয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। ছটা ছাগল মেরে আর আমার গুলি খাওয়ার পর জোরে ছুটে বাঘিনীটা বুঝিয়ে দিয়েছে যে পাঁচদিন আগে ওর পায়ে যে গুলির ক্ষত হয়েছিল ওর জোরে ছোটার পক্ষে তা কোনো বাধাই নয়। আমি মনে মনে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে যে মুহূর্তে ও বুঝতে পারবে আমি ওর পিছু নিয়েছি আর আমি ওর আওতায় মধ্যে এসে পড়েছি, ও আমাকে একটা মরণ কামড় দেবেই দেবে। সে আক্রমণের মোকাবিলা আমায় সম্ভব করতে হবে শুধু মাত্র একটি বুলেট দিয়ে। রাইফেলের বোল্টটা খুলে ফেলে আমি কার্টিজটা খুব ভাল করে পরখ করে নিলাম। আশ্বস্ত হলাম যে সম্প্রতি আমি কোলকাতার ম্যান্টন কোম্পানীর কাছ থেকে যে নূতন কার্টিজগুলি আনিয়েছি এটি তারই একটা। আমি আবার ওটা বন্দুকে ভরে বোল্টটা লাগিয়ে সেফটি ক্যাচ খুলে ফেললাম।

চেঁকিশাকের পথটা গেছে প্রায় কোমর পর্যন্ত উঁচু ঝোপের মধ্য দিয়ে। গাছগুলো পথের দুপাশ থেকে এসে গায়ে গায়ে লেগে রয়েছে। রক্তের দাগ সেই পথ ধরে এগিয়ে ঢেঁকিশাকের ঝোপের দিকে গেছে। বাঘিনীটা এই পথের ওপরেই কি ডাইনে বা বাঁয়ে কোথাও ঘাপটি মেরে থাকতে পারে। সুতরাং প্রতিটি ফুট সতর্কতার সঙ্গে দেখতে দেখতে আমি চেঁকিশাকের ঝোপের দিকে এগোলাম- আমার দৃষ্টি সামনের দিকে কারণ এরকম অবস্থায় ঘাড় ঘুরিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করা বোকামি। আমি যখন ঝোপের তিন গজের মধ্যে এসে পড়েছি, তখন পথের ডান দিকে গজ খানেকের মধ্যে হঠাৎ একটা নড়াচড়া লক্ষ করলাম; বাঘিনীটা ঝাঁপ দেওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে। আহত এবং দীর্ঘ সময়ের উপবাসী হলে কি হয়, একটা শেষ লড়াই না করে ও ছাড়বে না। তবে শেষ লাফটা আর সে দিতে পারে নি। ও উঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই আমার প্রথম গুলিটা ওকে এফেঁড় ওফেঁড় করে বেরিয়ে গেল, দ্বিতীয় গুলিতে ওর ঘাড়টা গেল ভেঙে।

খালি পেটে দিনের পর দিন ব্যথায় কষ্ট আর অমানুষিক শারীরিক পরিশ্রমের ধকল সইবার ফলে আমার সর্বাঙ্গ তখন কাঁপতে শুরু করেছে। বহু কষ্টে আমি সেই বাঁকটার কাছে এসে পৌঁছলাম যেখানে ভাগ্যক্রমে রডোডেনড্রনের চারাটা না থাকলে নিচের পাথরে পড়ে আমার হয়তো প্রাণটাই যেত।

গ্রামের সমস্ত মানুষ, তার সঙ্গে আমার লোকজনেরাও তখন দুই পাহাড়ের মাঝে সেই ঘোড়ার পিঠের মত উঁচু জায়গাটায় এসে জড় হয়েছে। তাদের দিকে টুপি তুলে নাড়তে না নাড়তেই, প্রাণপণে চিৎকার করতে করতে ছেলে বুড়ো সব দলে দলে নেমে আসতে লাগল; আমার ছ’জন গাড়োয়ালীই পৌঁছল সব থেকে আগে। অভিনন্দনের হিড়িক কমতে কুমায়ুনের সব থেকে বেশি গর্বিত ছয়জন গাড়োয়ালী একটা বাঁশের সঙ্গে তল্লাদেশের মানুষখেকোকে বেঁধে বিজয় গর্বে বয়ে নিয়ে চলল তল্লাকোট গ্রাম অভিমুখে। গাঁয়ে মেয়েদের ও শিশুদের দেখাবার জন্যে একটা খড়ের গদীর ওপর বাঘিনীটাকে শুইয়ে রাখা হল। আমিও ফিরে গেলাম ক্যাম্পে বহু সপ্তাহ পর আজ পেটভরে কিছু খাওয়ার জন্যে। ঘণ্টাখানেক পরে একদঙ্গল মানুষের ভিড়ের মধ্যে আমি বাঘিনীটার ছাল ছাড়ালাম।

আমার প্রথম বুলেটটা, অর্থাৎ ২৭৫ নিকেলের খোলে ভরা নরম ডগার বুলেটটা যেটা গত ৭ই এপ্রিল ছুঁড়েছিলাম, সেটা দেখি বাঘিনীটার ডান কাঁধের জোরের মধ্যে শক্তভাবে আটকে আছে। যখন সে লাফ দিয়ে পড়ে ওপারের পাহাড় দিয়ে চলে যায় তখন দ্বিতীয় আর তৃতীয় যে দুইটি গুলি আমি ছুঁড়েছিলাম তার একটিও তার গায়ে লাগে নি। চতুর্থ গুলিটা, যেটা ১২ই এপ্রিল ছোঁড়া হয়েছিল সেটা ওর শরীর ভেদ করে চলে গেছে কিন্তু কোথাও হাড়ে আটকায় নি। শেষ পর্যন্ত ও মারা গেছে আমার পঞ্চম ও ষষ্ঠ গুলিতে। ওর ডান পা ও কাঁধ থেকে আমি প্রায় বিশটা শজারুর কাটা বার করলাম। কাঁটাগুলো দুই থেকে ছয় ইঞ্চি লম্বা। এই কাটাগুলো ওর মাংসপেশীর মধ্যে ঢুকেছিল আর নিঃসন্দেহে বলা যায় এগুলিই ওর মানুষখেকো হওয়ার কারণ।

পরের দিন আমি চামড়াটা মোটামুটি শুকিয়ে নিলাম আর তিনদিন পরে আমি আমার ‘দুঃসময়’ পেছনে ফেলে বাড়ি ফিরে এলাম। বেনেস, দুঙ্গার সিং আর তার ভাইকে ডেকে পাঠালেন এবং আলমোড়ায় একটি অনুষ্ঠানে আমাকে সাহায্য করার জন্যে তাদের ধন্যবাদ জানানো হল। আমার কৃতজ্ঞতা নিদর্শন স্বরূপ তাদের দেওয়া হল কিছু উপহার। নৈনিতালে ফিরে আসার এক সপ্তাহ পরে স্যার ম্যালকম হেইলি আমাকে পাঠালেন কর্নেল ডিক নামে এক কর্ণ বিশেষজ্ঞের কাছে। তিনি লাহোরে, তার হাসপাতালে তিন মাস ধরে আমার চিকিৎসা করলেন। তারই চিকিৎসায় আমার শোনার ক্ষমতা আস্তে আস্তে ফিরে এল। এখন আমার আর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড়ষ্টভাবে মিশতে হয় না–সঙ্গীত এবং পাখির গান উপভোগ করার আনন্দ আমি আবার ফিরে পেয়েছি।

.

উপসংহার

অরণ্যগাথা (“জাঙ্গল লোর”) লেখার আগে যে গল্প আপনাদের শোনাতে চাই নি সেই তল্লাদেশের মানুষখেকো বাঘের কাহিনী বলা শেষ হল। আমি জানি বহু লোকের কাছেই বিশেষ করে যাঁদের বাঘ শিকারের অভিজ্ঞতা আছে তাদের কাছে আমার গল্পটি অবিশ্বাস্য মনে হবে। মাটির ওপর দাঁড়িয়ে বাঘ শিকার করা, বিশেষ করে মানুষখেকো মারা খুব জনপ্রিয় স্পোর্ট নয়– একথা আমার থেকে ভাল আর কেউ জানে না। আমি এও জানি যে পায়ে হেঁটে আহত বাঘকে অনুসরণ করা এমন একটা কাজ যা কেউ করতে চায় না, আর সকলেই ভয় করে। কিন্তু এসব জানা সত্ত্বেও আমি পায়ে হেঁটে এক মানুষখেকো মারার গল্পই শোনালাম-যার পেছনে শুধু দিনে নয়,– রাত্রিতেও আমাকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে–শোনালাম এক আহত বাঘকে অনুসরণ করার কাহিনী। সেইজন্যে, এ গল্প যদি কারুর কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকে তাহলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

দিন পনেরর ছুটি কাটানোর পক্ষে সারা কুমায়ুনে, আলমোড়া জেলার পূর্ব প্রান্তের মত এত মনোরম জায়গা খুবই কম আছে। অবসর বিনোদনের উপায় হিসেবে হিমালয় পায়ে হেঁটে বেড়ানো এখন ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যে কোনো খেলোয়াড়, তরুণ সৈনিক দল বা ছাত্ররা আমার নিম্নলিখিত নির্দেশ মত ঘুরে এসে আমার কথার সত্যতা যাচাই করে নিতে পারেন।

টনকপুর থেকে যাত্রা শুরু করুন। কিন্তু তার আগে পেশকারকে বলুন আপনার সঙ্গে একজন তহশিল পিওন দিতে। সে আপনাদের সেই জায়গাটি দেখিয়ে দেবে যেখানে একটি হাতির সঙ্গে দুটি বাঘের এক স্মরণীয় লড়াই হয়েছিল। টনকপুর থেকে বরমদেও হয়ে পূর্ণগিরিতে যান। এখানে মন্দির দর্শন সেরে সারদা নদীর ওপরে যে আলো দেখা যায় সে সম্বন্ধে এবং এই রকম আরো বহু ঘটনা সম্বন্ধে যেমন পিন্ডারী হিমবাহের পাদদেশে এক বৃদ্ধকে দেখা যায় আলোর কাছে বসে মালা জপছে–এই সব বিষয়ে প্রধান পুরোহিত ও মন্দিরের পূজারীর কাছ থেকে জেনে নিন। পূর্ণগিরি থেকে পুরোহিতরা যে পথে যাতায়াত করেন সেই পথটি আপনাদের নিয়ে যাবে এক গাঁয়ে। গ্রামটি খুব সুন্দর জায়গায়। এখানে বিশ্রাম করতে করতে এবং চারিদিকের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে গাঁয়ের মোড়লকে বা যারা আপনাদের ঘিরে বসে থাকবে তাদের যে কোনো একজনকে থাক এবং চুকার মানুষখেকো বাঘ মারার গল্প বলতে বলুন। মোড়লের আত্মীয়, সুদর্শন পাহাড়ী ব্রাহ্মণ তেওয়ারী আপনাদের দেখাবে কোথায় তার ভাই মারা পড়েছে যার মৃতদেহ সে আমায় দেখিয়েছিল। চুকা যাওয়ার পথে সে সেই পাথরটা আপনাদের দেখাবে যেখানে থাকের মানুষখেকোটা আমি মেরেছিলাম। যদি আপনার সময় থাকে তাহলে যেখান থেকে আমি চুকার মানুষখেকোটাকে গুলি করেছিলাম সেই বট গোষ্ঠীর ফিকাস গাছটাও সে আপনাদের দেখাতে পারে। চুকার কুনওয়ার সিং-এর খোঁজ করবেন তার কাছেও শুনবেন দুটো বাঘ মারার গল্প।

চুকা থেকে তল্লাকোট অনেকখানি রাস্তা তাই ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই বেরনো ভাল। লাচিয়া যেখানে সারদা নদীতে মিশেছে সেই জায়গাটা পেরোলে, পৌঁছবেন সেম-এ। সে গ্রামের সর্দারকে যখন আমি জানতাম তখন সে নেহাতই ছোট। সে আপনাকে দেখাবে বাড়ির কাছে কোন জায়গাটায় ঘাস কাটার সময় মানুষখেকো তার মাকে মেরেছিল। সে গ্রামটি পেছনে ফেলে একটা কঠিন চড়াই পেরিয়ে আপনি ছোট্ট একটা গায়ে এসে পৌঁছবেন যেখানে একটা আমগাছ তলায় আমি একটা রাত কাটিয়েছিলাম। পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়ে পার হয়ে জঙ্গল বরাবর এগিয়ে গেলে আপনি ছোট্ট একটা ঝরনা পাবেন। ঝরনাটা পার হয়েই এক টুকরো খোলা জায়গা–এইখানেই আমার ৪০ পাউন্ড তাবুটা ফেলা হয়েছিল। অর্থাৎ আপনি তল্লাকোটে পৌঁছে গেলেন।

তল্লাকোটের মালওজার (জোতদার) দুঙ্গার সিংয়ের বয়স এখন প্রায় বছর চল্লিশেক হবে। তাকে আমার সেলাম জানাবেন আর তাকে বলবেন আপনাকে সেই ঘোড়ার পিঠের জিনের মত উঁচু জায়গাটাতে নিয়ে যেতে যার দুই দিকে দুই উপত্যকার বিস্তার। প্রথমে তাকাবেন পূবদিকের উপত্যকাটার দিকে–দুঙ্গার সিংকে সেই ঝোঁপটি দেখিয়ে দিতে বলবেন যেখানে তার মা মারা পড়েছিল, সেই ওক গাছটা যার নিচে বাঘ তার মড়ি খেয়েছিল, সেই বাঁজা-ফসলী জমিটা, যেখানে মারা হয়েছিল বাঘিনীর বাচ্চা দুটোকে আর সেই ঘাসে ঢাকা পাহাড়টা যার ওপর দিয়ে আহত বাঘিনীটা চলে গিয়েছিল। তারপর ফিরে এসে কয়েক পা হেঁটে পশ্চিম দিকের উপত্যকাটার মুখোমুখি দাঁড়ান। দুঙ্গার সিং আরো আপনাকে দেখিয়ে দেবে কোথায় ছটা ছাগল মারা পড়েছিল, আমার গুলি যখন বাঘিনীটাকে ভেদ করে যায় তখন কোথায় সে দাঁড়িয়েছিল, সেই গাঁয়ে চলার পথটা যার ওপর দিয়ে দৌড়েছিল আর আমি তার পিছু নিয়েছিলাম।

তল্লাদেশের মানুষখেকো শিকারের সময়, মূল শিকারের সঙ্গে যোগ নেই এমন দর্শকদের ভিড় যা হয়েছিল তা অন্য কোনো বাঘ মারার সময়ে কোথাও হয়েছে কিনা সন্দেহ। তাদের কেউ কেউ হয়তো মারা গেছে কিন্তু অনেকেই আজো আছে যারা আমার তল্লাদেশে যাওয়ার কথা, সেই ঘটনাবহুল এক সপ্তাহের কথা কোনোদিন ভুলবে না।