প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

২. মুক্তেশ্বরের মানুষখেকো

২. মুক্তেশ্বরের মানুষখেকো

নৈনিতালের উত্তর, উত্তর-পূবের আঠার মাইল দূরে একটি পাহাড় আছে। তা আট হাজার ফুট উঁচু এবং পূবে-পশ্চিমে বারো থেকে পনের মাইল লম্বা। পাহাড়টির পশ্চিম প্রান্ত উঠে গেছে খাড়া, আর এই প্রান্তের কাছেই আছে মুক্তেশ্বর ভেটেরিনারী রিসার্চ ইনস্টিক্ট। সেখানে ভারতের গৃহপালিত পশুদের রোগের সঙ্গে লড়বার জন্য জীবাণু ও টিকা তৈরি হয়। ল্যাবরেটরি ও কর্মী আবাস- গৃহগুলি পাহাড়ের উত্তর দিকে এবং এই জায়গাটির মুখোমুখি যে নিসর্গ দৃশ্য দেখা যায়, তা তুষারাবৃত হিমালয় গিরিমালার যে-কোনো জায়গা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এই পর্বতমালা এবং ভারতের সমভূমির মধ্যবর্তী জায়গায় যত পাহাড় আছে, সবগুলিই পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত এবং যে-কোনো পাহাড়ের বেশ উঁচু থেকে যতদূর চোখ চলে ততদূর শুধু উত্তরের তুষারপাতই নয়, পুব ও পশ্চিমের সব পাহাড় উপত্যকার অবাধ দৃশ্য চোখে পড়ে। যারা মুক্তেশ্বরে থেকেছে তারা দাবি করে এটি কুমায়ুনের সুন্দর-শ্রেষ্ঠ স্থান আর এ জায়গায় জলহাওয়ার কোনো জুড়ি নেই।

মুক্তেশ্বরের সুখসুবিধের কথা মানুষ যে রকম উঁচুদরের বলে ভাবে, সেই রকমই মনে হয়েছিল এক বাঘিনীরও। সে ওই ক্ষুদ্র বসতির সংলগ্ন বিস্তৃত অরণ্যে বসবাস শুরু করে। যতদিন না এক শজারুর সঙ্গে সংঘর্ষের দুর্ভাগ্য হয়, ততদিন সে এখানে মহানন্দে সম্বর, কাকার ও বনবরা খেয়ে দিন কাটাচ্ছিল। এই সংঘর্ষে সে একটি চোখ হারায় আর এক থেকে ন ইঞ্চি বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের প্রায় পঞ্চাশটি শজারু-কাঁটা ওর ওপর-পা এবং সামনের ডান পা-র থাবার নিচে গেঁথে যায়। হাড়ে বিধে যাবার পর এই কাটার অনেকগুলো ইংরিজী ‘U’ অক্ষরের ছাঁদে বেঁকে যায়, কাটার দু-মুখ কাছাকাছি চেপে বসে। সেখান থেকে সে দাঁত দিয়ে কাঁটা বের করার চেষ্টা করে। ফলে সেখানে পুঁজ-ঘা হয়ে যায় এবং উপোসে ঘা চাটতে চাটতে সে যে ঘন ঘাসঝোপে শুয়েছিল, একটি রমণী সেই বিশেষ ঘাসঝোঁপটিকে তার গৃহপালিত পশুর খাদ্যের জন্যে বেছে নেয়। প্রথমটা বাঘিনীটি ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দেয় না কিন্তু ও যেখানে শুয়ে আছে, মেয়েটি যখন একেবারে সেই পর্যন্ত ঘাস কেটে ফেলে, বাঘিনী একবার থাবা মারে, ফলে মেয়েটির খুলি ভেঙে যায়। মৃত্যু ঘটে তৎক্ষণাৎ, কেননা পরদিন যখন মেয়েটিকে পাওয়া যায় মেয়েটি এক হাতে কাস্তে চেপে ধরে ছিল, তখনি কাটবে বলে আরেক হাতে চেপে ধরে ছিল এক গোছা ঘাস, যখন চোটটা খায়। মেয়েটি যেখানে পড়ে যায় সেখানেই তাকে ফেলে রেখে বাঘিনী খুঁড়িয়ে চলে যায় এক মাইলেরও বেশি দূরে এবং একটি পতিত গাছের নিচে একটি ছোট গর্তে আশ্রয় নেয়। দু-দিন বাদে এই পতিত গাছটি থেকে জ্বালানী কাঠের টুকরো কেটে নিতে একটি লোক আসে এবং বাঘিনীটি তাকেও মারে। বাঘিনী শুয়েছিল গাছটির অপর প্রান্তে। লোকটি গাছের ওপর পড়ে এবং যেহেতু সে তার শার্ট ও কোট খুলে ফেলেছিল আর ওকে মারার সময়ে যেহেতু বাঘিনী ওর পিঠে আঁচড়েছিল, লোকটি যখন গাছের গুঁড়ির ওপর পড়ে ঝুলছিল, ওর শরীর থেকে বেয়ে নামা রক্তের দৃশ্য দেখে বাঘিনীর প্রথম মনে হয় সে তার ক্ষুগ্নিবৃত্তি করতে পারে এটা এমন কিছু। সে যাই হক না কেন, লোকটিকে ফেলে চলে যাবার আগে ও পিঠ থেকে অল্প একটু খায়। একদিন বাদে রীতিমত মন ঠিক করে ও তৃতীয় মানুষটি মারে। কোন উস্কানি ছাড়াই। এরপর থেকে ও পাকাপাকি মানুষখেকো হয়ে দাঁড়ায়।

ও মানুষ মারতে শুরু করার স্বল্প পরেই আমি বাঘিনীটির কথা শুনি। যেহেতু মুক্তেশ্বরে বেশ কিছু শিকারী ছিলেন, তাঁহাদের সকলেই বাঘিনীটিকে মারতে আগ্রহীও, বাঘিনীটি তাদেরই দোরগোড়ায় কার্যকলাপ চালাচ্ছিল, সেহেতু সে ব্যাপারে এক বাইরের মানুষের মাথাগলানো ঠিক হবে বলে আমার মনে হয় নি। তবে যখন বাঘিনীর নিহত মানুষের সংখ্যা চব্বিশে পৌঁছল, যখন বসতিতে বসবাসকারী সকল মানুষ ও প্রতিবেশী গ্রামগুলির মানুষদের জীবন বিপন্ন হল, যখন ইনস্টিটুটের কাজে মন্দা পড়ল, ইনস্টিট্যুটের ভারপ্রাপ্ত ভেটেরিনারী আধিকারিক তখন আমার সাহায্য চাইবার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানালেন।

আমার যা মনে হয়েছিল, আমার কাজটি খুব সহজ হবে না। কেননা নরখাদক বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত সীমিত, এ ছাড়াও, যে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে বাঘিনী তার কার্যকলাপ চালাচ্ছিল সেটি আমার চেনাজানা নয় এবং কোথায় ওকে খুঁজব সে বিষয়ে আমার কোন ধারণাই ছিল না।

একটি ভৃত্য এবং এক বাণ্ডিল বিছানা ও একটি সুটকেস বহনকারী দুটি লোককে সঙ্গে নিয়ে আমি দুপুরে নৈনিতাল থেকে রওনা হলাম এবং দশ মাইল হেঁটে রামগড় ডাকবাংলোতে পৌঁছলাম, সেখানে রাতটা কাটালাম। ডাকবাংলোর খানসামা, (রাঁধুনী, বোতল ধোয়া এবং হাজার কাজের কাজী) আমার এক বন্ধু এবং যখন শুনল মানুষখেকোটি মারবার প্রচেষ্টায় আমি মুক্তেশ্বরের পথে চলেছি, মুক্তেশ্বরে পৌঁছবার শেষ দু-মাইল বিষয়ে খুব সাবধান হতে হুঁশিয়ার করে দিল ও আমায়। কেননা, ও বলল, পথের ওই অংশটিতে বহু লোক ইদানীং নিহত হয়েছে।

জিনিসপত্র গুছিয়ে আমার পেছনে পেছনে আসতে বলে আমার লোকজনকে রেখে এলাম। উন্নত ধরনের বারুদ ব্যবহার করতে হয় এমন একটি দোনলা ৫০০ এক্সপ্রেস রাইফেলে সশস্ত্র হলাম ও পরদিন খুব ভোরে রওনা হয়ে যখন ঠিক ভোরের আলো ফুটছে তখন এসে পৌঁছলাম নৈনিতাল-আলমোড়া রোড ও মুক্তেশ্বর রোডের সন্ধিস্থলে। এই জায়গাটি থেকে খুব সতর্ক হয়ে হাঁটতে থাকা উচিত কেননা আমি এখন মানুষখেকোর রাজ্যে। এঁকে বেঁকে মুচড়ে একটি অত্যন্ত খাড়াই পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠার আগে কিছুদূর পথটি যায় সমভূমি ধরে। সে জমিতে ফোটে কমলা রঙা লিলি ফুল। সে ফুলের শক্ত গোল বিচি গাদা বন্দুকের গুলি হিসেবে ব্যবহার করা চলে। এই প্রথম আমি এ পাহাড়ে চড়ছি। পথের ওপর ঝুলন্ত বেলেপাথরের পাহাড়ী কার্নিসের গায়ে বাতাসে কুরে কুরে, যে গুহাগুলো সৃষ্টি হয়েছে তা দেখে আমার ভারি মজা লেগেছিল। আমার মনে হয় ঝড়ের সময়ে গুহাগুলো অত্যন্ত অতি প্রাকৃত শব্দ ছড়ায়। কেন না গুহাগুলি বিভিন্ন মাপের। কতকগুলি অগভীর, দেখে মনে হয় অন্যগুলি বেলেপাথরের গহীনে ঢুকে গেছে ভেদ করে।

যেখানে রাস্তাটা পাহাড়ের পিঠে উঠেছে, সেখানে খানিকটা খোলা জায়গা আছে। সেই ভোলা জায়গাটার এক মাথায় একটি ডাকঘর ও একটি ছোট বাজার রয়েছে। এত ভোরে ডাকঘর খোলা নেই। তবে একটি দোকান খোলা ছিল এবং ডাকবাংলোর কেমন করে খোঁজ মিলবে, দোকানীটি দয়া করে আমাকে সে হদিশ দিল। ও বলল, পাহাড়ের উত্তর দিকের গায়ে আধমাইল দূরে বাংলোটি। মুক্তেশ্বরে ডাকবাংলো দুটি। একটি সরকারী কর্মচারিদের জন্যে সংরক্ষিত, অন্যটি সাধারণের জন্য। আমি তা জানতাম না। বোধ হয় আমার টুপির মাপ দেখে বন্ধু দোকানীটি আমাকে সরকারী কর্মচারী ভেবে ভুল করে ভুল বাংলোটি এবং সে বাংলোর ভারপ্রাপ্ত খানসামার কাছে পাঠাল। খানসামাটি আমাকে প্রাতরাশ দেওয়াতে আমি তা খাওয়ার ফলে আমি লাল-ফিতে-ফৌজের বিরাগভাজন হয়েছিলাম। যাই হোক তবে সে ব্যাপারটা আমার অজ্ঞাতে হয়েছিল। পরে খেয়াল রেখেছিলাম আমার ভুলের জন্যে যেন খানসামাটি বিন্দুমাত্র না ভোগে।

আমি যখন তুষার শৃঙ্গমালার অপরূপ শোভার তারিফ করছিলাম, অপেক্ষা করছিলাম প্রাতরাশের জন্যে, সেনাবিভাগের রাইফেল নিয়ে বারজন ইউরোপীয়ানের একটি দল আমার সামনে দিয়ে গেল। কয়েক মিনিট বাদে তাদের পেছু পেছু গেলেন একজন সার্জেন্ট ও নিশানা এবং পতাকা নিয়ে দুজন লোক। সার্জেন্টটি বেশ বন্ধুভাবাপন্ন। তিনি আমায় জানলেন, সদ্য যে দলটি গেল, ওটি যাচ্ছে রাইফেল রেঞ্জে আর মানুষখেকোটার জন্যে দলটি অমন জোট বেঁধে আছে। সার্জেন্টের কাছে শুনলাম ইনস্টিটুটের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক গতকাল সরকারের কাছ থেকে এক টেলিগ্রাম পেয়েছেন। তাতে জানানো হয়েছে আমি মুক্তেশ্বরের পথে রওনা হয়েছি। সার্জেন্ট আশা প্রকাশ করলেন মানুষখেকোটিকে নিধনে আমি সফল হব। তিনি বললেন বসতিটিতে অবস্থা খুব সঙিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন কি দিবালোকেও কেউ একা ঘুরতে ফিরেত চায় না আর সন্ধ্যার পর সকলকে দোর বন্ধ করে থাকতে হয়। মানুষখেকোটিকে মারার বহু প্রচেষ্টা হয়েছে। কিন্তু যে সব মড়ির সামনে বসে থাকা হয়েছে তার একটিরও কাছেও বাঘিনীটি একবারও ফিরে আসে নি।

অতি চমৎকার প্রাতরাশের পর, আমার লোকজন যখন পৌঁছবে, মানুষখেকোটির খবর পাবার চেষ্টা করতে বেরোচ্ছি আমি, আর কখন ফিরব তা জানি না এ কথা তাদের বলতে নির্দেশ দিলাম খানসামাকে। তারপর, রাইফেল তুলে নিয়ে, আমি নিরাপদে পৌঁছেছি তা মাকে জানাতে তাকে একটি টেলিগ্রাম পাঠাতে আমি ডাকঘরে গেলাম।

ডাকঘর ও বাজারের সামনের সমতল জমি থেকে মুক্তেশ্বরের পাহাড়ের ডানদিকটি খাড়া ঢালে নেমে গেছে। ঘনগুল্মে আচ্ছাদিত শৈলশিরা ও খাতে সে দিকটি ক্ষতবিক্ষত। নিচের উপত্যকা ও তার ওপারের অরণ্যনিবিড় রামগড় পর্বতমালার দিকে চেয়ে আমি পাহাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে আছি, পোস্টমাস্টার ও বহু দোকানী এসে জুটলেন। পোস্টমাস্টার গতকালের সরকারী টেলিগ্রামটি দেখেছেন। এখনি আমি তার হাতে যে টেলিগ্রাম ফর্ম দিয়েছি তাতে আমার সই দেখে তিনি ধরে নিয়েছেন টেলিগ্রামে উল্লেখিত ব্যক্তি আমিই। এবং তিনি ও তাঁর বন্ধুরা তাদের সাহায্যেচ্ছা জানাতে এসেছেন আমাকে। এ প্রস্তাবে আমি খুবই খুশি হলাম কেননা মুক্তেশ্বরে যাঁরাই আসছেন, প্রত্যেককে দেখার তাদের সঙ্গে কথা বলার সর্বাধিক সুযোগ এঁদেরই। যেহেতু দুই বা ততোধিক লোক একত্র জঙ্গলে সুনিশ্চিত যে মানুষখেকোটিই কথোপকথনের মুখ্য প্রসঙ্গ হয়, এঁরা খবর যোগাড় করতে পারেন, সে খবর আমার কাছে খুবই মূল্যবান। অন্যদেশের মানুষের কাছে শুড়িখানা বা ক্লাব যা, গ্রামীণ ভারতে গ্রামবাসীর কাছে ডাকঘর ও বেনের দোকানও তাই। যদি কোনো বিশেষ প্রসঙ্গের খবর নিতে হয়, তাহলে খবরের হদিস পেতে ডাকঘর ও বেনের দোকানই শ্রেষ্ঠ জায়গা।

আমাদের সামনে বাঁদিকে পাহাড়ের একটি ভাজে, আমাদের থেকে হাজার ফুট নিচে, আন্দাজ দু-মাইল দূরে একখণ্ড–কর্ষিত জমি। আমাকে জানানো হল ওটি বদ্রী সিংয়ের আপেল বাগিচা। আমার এক পুরনো দোস্তের ছেলে বদ্রী কয়েকমাস আগে নৈনিতালে ‘আমার সঙ্গে দেখা করেছিল, আমাকে ওর গেস্ট হাউসে রাখার এবং মানুষখেকোটি নিধনে ও যতভাবে পারে আমাকে সাহায্য করার প্রস্তাব জানিয়েছিল। সে প্রস্তাব আমি গ্রহণ করি নি কেন, তা এর মধ্যে বলা হয়েছে। এখন যেহেতু সরকারের অনুরোধে আমি মুক্তেশ্বরে এসেছি, ঠিক করলাম, বদ্রীর সঙ্গে দেখা করব, ওর সাহায্য-প্রস্তাব গ্রহণ করব। বিশেষ, যখন এখনি সঙ্গীরা আমাকে জানিয়েছে, বদ্রীর আপেল বাগিচার নিচের উপত্যকায় শেষ মানুষটি মারা পড়েছে।

আমাকে ঘিরে যারা দাঁড়িয়েছিল, তাদের প্রত্যেককে ধন্যবাদ জানিয়ে, আরো তথ্যের জন্য ওদের ওপরই ভরসা রাখব ও কথা বলে আমি ধারি রোড ধরে রওনা হলাম। তখনো সকাল, বদ্রীর সঙ্গে দেখা করার আগে পাহাড় ধরে পুবে এগিয়ে কয়েকটি গ্রামে যাবার সময় আছে। পথে কোনো মাইল স্টোন ছিল না, আর আমার ধারণামত আমি যখন ছ মাইল পথ হেঁটেছি এবং দুটি গ্রামে গিয়েছি, ফিরতি পথে ঘুরলাম। ঘুরতি মুখে মাইল তিনেক এসেছি, একটি ছোট্ট মেয়ে একটা বলদকে নিয়ে ঝামেলায় পড়েছে, তাকে আমি ধরে ফেললাম। মেয়েটির বয়স বছর আষ্টেক হবে, তার ইচ্ছে বলদটি মুক্তেশ্বরের দিকে যায়। আর বলদটি যেতে চায় উল্টোদিকে। আমি যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছলাম তখন সেই পর্যায়ে পৌঁছনো গেছে যখন এ যা চায় অপরে তা করবে না। বলদটি শান্ত ও বৃদ্ধ এক প্রাণী ওর গলায় বাঁধা দড়িটি ধরে মেয়েটি হাঁটতে থাকল সামনে আর আমি পেছনে রইলাম ওকে চলতি রাখার জন্যে, ও আর কোনো ঝামেলা করল না। অল্প পথ এগোবার পর আমি বললাম।

‘আমরা কালোয়াকে চুরি করছি না, করছি কি?

মেয়েটিকে কালো বলদটিকে ওই নামেই ডাকতে শুনেছিলাম।

 ‘না–আ, মেয়েটি সতেজ উত্তর দিল, ওর বড় বড় বাদামী চোখদুটি আমার পানে তুলে।

‘ও কার বলদ?’ এর পরে আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 ‘আমার বাবার’, মেয়েটি বলল।

‘আমরা ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি?

 ‘আমার কাকার কাছে।

 ‘কাকা কালোয়াকে চান কেন?

 ‘তার খেতে লাঙল দিতে।

 ‘কিন্তু কালোয়া তো একা একা কাকার খেতে লাঙল দিতে পারবে না?

মেয়েটি বলল, “নিশ্চয়ই পারবে না। আমি বোকার মতই কথাটা বলেছি বটে, তবে সাহেব বলদ আর লাঙল চষা বিষয়ে কিছু জানবে এত কেউ আশা করতে পারে না?

এর পরে জিজ্ঞেস করলাম, কাকার কি একটাই বলদ?

মেয়েটি বলল, ‘হ্যাঁ, এখন কাকার একটাই বলদ, তবে দুটো ছিল।

 ‘অন্যটি এখন কোথায়? আমি প্রশ্ন করলাম, ভাবলাম বোধ হয় ধার শুধতে সেটি বেচে দেওয়া হয়েছে।

আমাকে বলা হল, গতকাল বাঘটা মেরে ফেলেছে সেটা। এ খবরের মত খবর বটে। খবরটা হজম করতে থাকলাম। আমরা চলছি কথা-না কয়ে। মেয়েটি থেকে থেকেই ফিরে চাইছে আমার দিকে, অবশেষে সাহস করে ও জিজ্ঞেস করল,

‘আপনি বাঘটা মারতে এসেছেন?

আমি বললাম, হ্যাঁ, বাঘটা মারবার চেষ্টা করতে এসেছি।

 তবে মড়িটার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছেন কেন?

 ‘কেননা আমার কালোয়াকে নিয়ে যাচ্ছি কাকার কাছে?’ মনে হল আমার জবাবে মেয়েটি সন্তুষ্ট হল, আমরা চলতে থাকলাম টিকিয়ে টিকিয়ে। অত্যন্ত দরকারী কিছু খবর পেলাম বটে কিন্তু আরো খবর চাই, আর একটু বাদে আমি জিজ্ঞেস করলাম,

‘তুমি জানো বাঘটা মানুষখেকো?

মেয়েটি বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি। ও কুন্তীর বাবাকে খেয়েছে আর. বংশী সিংয়ের মাকে, আরো অনেক লোককে।

‘তবে তোমার বাবা কালোয়র সঙ্গে তোমাকে পাঠাল কেন? নিজে এল না কেন?

‘তার যে ভাবারী বুখার (ম্যালেরিয়া হয়েছে।

 ‘তোমার কোন ভাই নেই?

 ‘না। একটি ভাই ছিল, সে অনেকদিন আগে মারা গেছে।

 ‘মা?’

‘হ্যাঁ মা আছে। রান্না করছে মা।

‘বোন?

‘না, আমার কোন বোন নেই। অতএব যে রাস্তায় চার ঘণ্টায় আমি আর দ্বিতীয় মানুষ দেখি নি, যে পথ ধরে বড় দল বেঁধে ছাড়া পুরুষরা হাঁটতে ভয় পায়, সেই পথ দিয়ে ওর বাবার বলদটি কাকাকে পৌঁছবার বিপজ্জনক দায়িত্ব এই ছোট্ট মেয়েটির ওপর পড়েছে।

আমরা একটি পথে পৌঁছেছি, মেয়েটি পথটি ধরে এগোল, বলদটি ওর পেছনে, সবচেয়ে পেছনে আমি। অচিরে আমরা একটি খেতে এসে গেলাম, তার অপর প্রান্তে একটি ছোট বাড়ি। আমরা যেমন বাড়িটির কাছে পৌঁছলাম মেয়েটি ডাকল, ওর কাকাকে, জানাল ও কালোয়াকে এনেছে।

বাড়ির ভেতর থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠে জবাব এল, “ঠিক আছে। ওটাকে খুঁটোয় বাঁধূ পুলী, বাড়ি যা। আমি খেতে বসেছি। অতএব আমরা কালোয়াকে খুঁটিতে– বাঁধলাম আর ফিরে গেলাম রাস্তায়। আমাদের মধ্যে কালোয়ার সংযোগবন্ধন না থাকায় পুলী এখন লজ্জা পাচ্ছে। যেহেতু ও আমার পাশে হাঁটবে না, ওর চালে চাল মিলিয়ে আমি এগিয়ে হাঁটতে থাকলাম। কিছুক্ষণ হাঁটলাম নিশ্ৰুপে তারপর আমি বললাম,

‘কাকার বলদটাকে যে বাঘ মেরেছে আমি তাকে মারতে চাই, কিন্তু আমি জানি না মড়িটা কোথায়। আমাকে দেখিয়ে দেবে?

ও সাগ্রহে বলল, হ্যাঁ নিশ্চয়। আমি আপনাকে দেখাব।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি মড়িটা দেখেছ?’

না, তবে সেটা কোথায় ছিল কাকা যখন বাবাকে বলছিল তখন আমি শুনেছি’, সে বলল।

‘সেটা কি রাস্তার কাছে?

‘আমি জানি না।

‘যখন মারা পড়ে তখন বলদটা কি একা ছিল?

 ‘না। গাঁয়ের গরুবাছুরের সঙ্গে ছিল।

 ‘সকালে মারা পড়ে না সন্ধ্যায়?

সকালে গরুগুলির সঙ্গে যখন চরতে যাচ্ছিল তখনই মারা পড়েছে।

মেয়েটির সঙ্গে কথা কইছিলাম যখন, তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলাম চারদিকে, কেননা রাস্তাটা সরু আর বাঁদিকে তার ঘন জঙ্গল, ডানদিকে ঘন ঝোপঝাড়। আমরা। মাইলখানেক এগোলাম, তারপর পৌঁছলাম বহু ব্যবহৃত একটা গরুছাগলের চলার পথে। পথটি বাঁয়ে জঙ্গলপানে চলে গেছে। এখানে মেয়েটি থামল, বলল, কাকা ওর বাবাকে বলেছিল এই পথটায় বলদটা মারা পড়েছে। মড়ি খুঁজে পেতে আমার যত খুঁটিনাটি জানা দরকার ছিল সব পেয়ে গেছি এখন। মেয়েটিকে নিরাপদে ওর ঘরে পৌঁছে দিয়ে আমি গো-রাস্তায় ফিরে এলাম। পথটা চলে গেছে একটা উপত্যকা পেরিয়ে এবং এই পথ ধরেই প্রায় সিকি মাইল এগিয়ে একটি জায়গায় পৌঁছলাম, যেখানে গরুবলদগুলো প্রাণভয়ে ছিটকে পালিয়েছে। গো-রাস্তা ছেড়ে, রাস্তাটি থেকে পঞ্চাশ গজখানেক নিচে, ওরই সমান্তরাল জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চললাম আমি এখন। সবে অল্প পথই গিয়েছি, দেখলাম হেঁচড়ে টানার দাগ। দাগটি সিধে ঢুকে গেল উপত্যাকাটিতে আর ওটিকে কয়েকশো গজ অনুসরণ করতেই আমি পেয়ে গেলাম বলদটিকে। তার শরীরের পেছন ভাগ থেকে সামান্য খানিকটা খাওয়া হয়েছে শুধু। একটি গভীর খাতের মুখ থেকে প্রায় চল্লিশ ফুট দূরে আন্দাজ বিশ ফুট উঁচু একটা পাড়ের পায়ের কাছে পড়েছিল ওটা। খাত ও মড়ির মাঝে একটি বাড়-থেমে যাওয়া গাছ, একটি বুনো গোলাপ গাছে সেটি চাপা পড়েছে। মড়ির কাছাকাছি বাঁধা জায়গা-সীমার মধ্যে এটিই একমাত্র গাছ, বাঘটিকে মারার কিছু আশা নিয়ে যার ওপর বসতে পারি আমি, কেন না আকাশে চাঁদ নেই। আর বাঘটা যদি অন্ধকারের পর আসে, নিশ্চিত জানছিলাম যা ও আসবেই, মড়ির যত কাছে থাকব, বাঘকে মারার সুযোগ পাব তত বেশি।

এখন বেলা দুটো। বদ্রীর সঙ্গে দেখা করার, ওর কাছে এক পেয়ালা চা চাইবার সময়টুকুই আছে আমার, আর চায়ের দরকার আমার খুব কেন না সকাল চারটেয় রামগড় ছেড়ে বেরোবার পর থেকে আমি প্রচুর হাঁটা হেঁটেছি। গো-রাস্তাটি যেখানে পথের সঙ্গে মেশে, বদ্রীর ফলবাগিচার পথ তার কাছাকাছি শুরু হয়ে ঘন গুল্মঝোপের ভেতর দিয়ে একটি খাড়াই পাহাড় ধরে এক মাইল নামে। আমি যখন পৌঁছলাম, বদ্রী ওর গেস্টহাউসের কাছে ছিল, একটি চোট-খাওয়া আপেল গাছের তদারকি করছিল। আমার আগমনের কারণ শুনে, ফলবাগিচার মুখোমুখি একটি ছোট টিলার ওপর অবস্থিত গেস্টহাউসে নিয়ে গেল ও আমাকে। বদ্রী ওর চাকরকে আমার জন্যে চা আর কিছু খাবার তৈরি করতে বলল, বারান্দায় বসে আমরা যখন তারই অপেক্ষা করছি, কেন মুক্তেশ্বরে এসেছি, তা এবং ছোট মেয়েটি আমাকে যে মড়িটি খুঁজে পেতে সহায়তা করেছে তার কথা–সবই আমি ওকে বললাম। বদ্রীকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, মুক্তেশ্বরে শিকারীদের কাছে এ মড়িটার খবর বলা হয় নি কেন, ও বলল, বাঘটি মারায় শিকারীদের বারবার ব্যর্থতার কারণে গ্রামের লোকরা ওদের ওপর ভরসা হারিয়েছে, আর এই জন্যেই হত্যার খবরগুলো শিকারীদের আর দেওয়া হয় না। মড়ির কাছে পাহারা বসার জন্য যে লম্বাচওড়া তোড়জোড় চলে, তাকেই ব্যর্থতার কারণ বলে বদ্রী জানাল। এই তোড়জোড়ের মধ্যে আছে–ঝোঁপ ও ছোট ছোট গাছের সকল বাধা সরিয়ে মড়ির কাছের জমি সাফ করা; বড় বড় মাচান তৈরি; আর বহুজন মিলে মাচান দখল করা। কখনো মড়ির কাছে ফিরে না-আসার যে খ্যাতি অর্জন করেছে বাঘটি, এ তার যথেষ্ট কারণ। বদ্রী স্ববিশ্বাসে স্থির যে মুক্তেশ্বর জেলায় কেবল একটি বাঘই আছে; সেটির সামনের ডানপা সামান্য খোঁড়া; তবে কিসে সে খোঁড়া হয়েছে তা সে জানে না; এও জানে না জানোয়ারটি মদ্দা না মাদী।

একটি বড় এয়ারডেল টেরিয়ার কুকুর আমাদের সঙ্গে বারান্দায় বসেছিল। অচিরে কুকুরটি গরগর করতে শুরু করল, আর ও যেদিকপানে মুখ করে আছে, সেদিকে চেয়ে দেখি একটি বড় হনুমান জমিতে বসে একটি আপেলগাছের ডাল নুইয়ে ধরে কঁচা ফল খাচ্ছে। বারান্দার রেলিঙে ঠেস দেওয়া ছিল একটি শটগান। সেটি তুলে নিয়ে বদ্রী তাতে ৪ নং ছররা পুরে গুলি করল। হনুমানটিকে কোনো চোট দিতে হলে ছররাগুলোর পক্ষে পাল্লাটা বড় বেশি লম্বা হয়ে গেল, যদি একটাও লক্ষে গিয়ে বিধত, তবুও তাই বলতে হত। তবে গুলি ছোঁড়ায় এই সুফল হল, হনুমানটি ছুটে পালাল পাহাড় ধরে ওপর পানে। কুকুরটি জোর তাড়া করল ওকে। কুকুরটার সর্বনাশ হবে বলে ভয় পেয়ে বদ্রীকে বললাম ওটাকে ডেকে ফেরাতে। কিন্তু ও বলল, ও ঠিক আছে। কুকুরটা এই বিশেষ হনুমানটাকে সদাই তাড়া করে। ও বললে, ওর চারা গাছগুলির যথেষ্ট ক্ষতি করেছে ওটা। কুকুরটা হনুমানটাকে প্রায় ধরে ফেলছিল। কয়েক গজের মধ্যে ও পৌঁছেছে যখন, হনুমানটা হঠাৎ ফিরে দাঁড়াল। কান টেনে ধরল কুকুরটার, ওর মাথার পাশ থেকে এক খাবলা মাংস কামড়ে ছিঁড়ে নিল। খুব জোর জখম হয়েছিল। আমরা ক্ষতের শুশ্রূষা শেষ করেছি, সে সময়ে আমার চা আর এক থালা গরম পুরি তৈরি হয়ে গেল।

যে গাছটায় বসতে চাই তার কথা বদ্রীকে বলেছিলাম, আর আমি যখন মড়ির কাছে ফিরে যাচ্ছি, একটি ছোট মাচান তৈরির সাজসরঞ্জাম-বাহী দু-জন লোক সহ আমার সঙ্গে যাবে বলে বদ্রী জোরাজোরি করল। এক বছরেরও ওপর বদ্রী এবং লোক দুটি মানুষখেকোটির আতঙ্কের ছায়ায় বসবাস করছে, বাঘটির বিষয়ে ওদের ধারণার কমতি ছিল না কিছু। আর যখন ওরা দেখল আমি যেটি বেছেছি সেটি ছাড়া মড়ির কাছে এমন একটি গাছও নেই যার ওপর মাচা বাঁধা চলে, ওরা আমাকে সে-রাতে মাচায় না-বসার জন্যে তাগিদ দিল। এই ধারণায় যে, বাঘটি মড়িটাকে সরিয়ে নেবে আর পরের রাতে মাচায় বসার জন্যে আমাকে যোগ্যতর কোনো জায়গা জুটিয়ে দেবে। বাঘটি মানুষখেকো না হলে আমি তাই করতাম, কিন্তু যেহেতু বাঘটি মানুষখেকো, এ-কাজে খানিকটা ঝুঁকি থাকলেও আমি এ সুযোগ হারাতে রাজী ছিলাম না। সুযোগটির পুনরাবৃত্তি পরের রাতে না ঘটতেও পারে। এ জঙ্গলে ভাল্লুক আছে, এবং যদি একটা ভাল্লুকও মড়ির গন্ধ পায়, বাঘকে মারার সব আশাই নষ্ট হবে আমার। কেননা হিমালয়ের ভাল্লুকরা বাঘকে সমীহ করে না মোটে আর বাঘের মড়ি অপহরণে ইতস্তত করে না। গাছটি যেহেতু গোলাপ ঝোপে চাপা, তাতে চড়া বেশ কষ্টসাধ্য এক কাজ। কাটা সত্ত্বেও যতদূর পারলাম ততদূর নিজের আরামে বসার ব্যবস্থা করে নেবার পর, আমাকে রাইফেলটি তুলে দিয়ে এবং পরদিন ভোরে আসবে বলে কথা দিয়ে বদ্রী ও তার লোকেরা চলে গেল।

খাত আমার পেছনে। আমি পাহাড়ের দিকে মুখ করে আছি। ওপর থেকে যে জন্তুই নামুক আমি পরিষ্কার দেখতে পাব। কিন্তু আমি যেমন ভাবছি, বাঘ যদি সে-মত নিচ থেকে আসে মড়ির কাছে না পৌঁছানো অব্দি ও ‘আমায় দেখতে পাবে না। বলদটি সাদা। পনের ফুট দূরে আমার দিকে পা মেলে ডানকাতে পড়ে আছে ওটি। বিকেল চারটেয় আমি জায়গায় বসি আর একঘণ্টা বাদে আমার দুশো গজ নিচে খাতের দিক থেকে একটি কাকার ডাকতে শুরু করল। বাঘ এখন চলতে শুরু করেছে আর তা দেখে কাকার নিশ্চল দাঁড়িয়ে পড়ে ডাকছে। বহুক্ষণ ও ডাকল তারপর চলে যেতে শুরু করল। ডাকটি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকল যতক্ষণ না পাহাড়ের ঢালের ওপারে মিলিয়ে যায়। মড়ির দৃশ্যসীমার মধ্যে আসার পর বাঘটা গুঁড়ি মেরে বসেছে। এ হল তারই নিশানা। ঘড়ি রেখে বাঘটিকে গুলি করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণগুলো বদ্রী আমাকে বলার পর এমনটি ঘটবে বলেই আমি ভেবেছিলাম। চোখ-কান খোলা রেখে ও মড়ির কাছে আসার আগে নিশ্চিত হয়ে নেবে মড়ির কাছে কোন মানুষ নেই, সে জন্যে কাছেই কোথাও গুঁড়ি মেরে বসে থাকবে এ আমি জানতাম। একটি মিনিটের পর আরেকটি দীর্ঘ মিনিট এল আর গেল। সন্ধ্যা নামল। আমার সামনের পাহাড়ে এটাসেটা অস্পষ্ট হয়ে এল, মিলিয়ে গেল। মড়িটিকে তখনো ঝাপসা সাদা দাগের মত দেখতে পাচ্ছি, খাতের মুখে একটা ডাল মট করে ভাঙল; সন্তর্পণ পদক্ষেপ আমার দিকে এগোল, থামল আমার ঠিক নিচে। এক বা দুই মিনিট নিচ্ছিদ্র নীরবতা তারপর গাছের পায়ের তলের শুকনো পাতার ওপর শুল বাঘটি।

সূর্যাস্তের কাছাকাছি ঘন মেঘ জমে উঠেছিল, এখন মাথার ওপর এক কালো চন্দ্রাতপ তারাগুলি মুছে দিয়েছে। অবশেষে বাঘ যখন উঠে মড়ির কাছে গেল, তখন রাতকে কাজলকালো বললে সবচেয়ে ভাল বলা হয়। যত তীক্ষ্ণ নজরই চালাই না কেন, সাদা বলদটার কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না, বাঘকে তো আরোই কম। মড়ির কাছে পৌঁছে বাঘটি মড়ির ওপর ফুঁ দিতে থাকল। হিমালয়ে, বিশেষ গরমকালে মড়ির টানে ভিমরুল আসে। দিনের আলো মিলিয়ে গেলে অধিকাংশ ভিমরুলই চলে যায়। যেগুলো ওড়ার পক্ষে বড় বেশি ঝুঁদ হয়ে থাকে সেগুলো থেকে যায়। সম্ভবত তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই, খেতে শুরু করার আগে বাঘ মাংসের ছিন্ন উন্মুক্ত অংশে সেঁটে থাকা ভিমরুলগুলোকে ফুঁ দিয়ে তাড়ায়। তাহাহুড়ো করে গুলি করার কোনোই দরকার নেই আমার। কেননা যদিও কাছেই আছে তবু কোনো নড়াচড়া বা আওয়াজ দ্বারা ওর দৃষ্টি আকর্ষণ না-করা অব্দি বাঘটি আমায় দেখবে না। অন্ধকার রাতে তারার আলোয় আমি মোটামুটি ভালই দেখতে পাই কিন্তু সে রাতে একটি তারাও দৃশ্যমান নয়। ঘন মেঘে এক ঝলক বিদ্যুৎও চমকায় নি। খেতে শুরু করার আগে বাঘ মড়িটা সরায় নি তাই জানছিলাম মড়ির ডান ধারে আমার দিকে পাশ ফিরে আছে বাঘটা।

বাঘটিকে মারার যে সব প্রচেষ্টা হয়েছে তার কারণে আমার সন্দেহ ছিল অন্ধকার হবার আগে ও আসবে না। তারার আলোয় যেমনটি তাক করতে পারি তাই করা এবং তারপর যাতে মড়ির এক বা দু ফুট ডাইনে আমার বুলেট পৌঁছয় সেইমত রাইফেলের নল সরিয়ে তাক করা, এই ছিল আমার অভিপ্রেত। কিন্তু এখন যখন মেঘ আমার চোখ দুটি অকেজো করে দিয়েছে আমাকে নির্ভর করতে হবে কানের ওপর (তখন আমার শ্রবণশক্তি ছিল অটুট)। কনুই দুটো হাঁটুতে রেখে রাইফেল তুলে ধরে, বাঘটা যে আওয়াজ করছিল সেদিক পানে সযত্নে তাক করলাম। রাইফেলটি দৃঢ় অনড় ধরে রেখে আমার ডান কান ফেরালাম আওয়াজের দিকে। আবার সোজা হয়ে বসলাম। আমার তাক একটু উঁচু হয়ে গিয়েছিল তাই নলটি এক ইঞ্চিরও অত্যন্ত কম নামিয়ে ধরে আমি আবার মাথা ফেরালাম, কান পাতলাম। এরকমটি কয়েকবার করে যখন সন্তুষ্ট হলাম যে শব্দের দিকেই নিশানা করেছি আমি, নলটি ডানদিকে একটু সরিয়ে ট্রিগার টিপলাম। দুই লাফে বাঘটা সেই বিশ-ফুট উঁচু পাড়ে উঠে গেল। তার মাথায় ছোট একটু করে সমতল ভূমি তার ওপারে পাহাড় উঠে গেছে সিধে খাড়াইয়ে। সেই সমতল ভূমি অব্দি বাঘের শব্দ পেলাম শুকনো পাতার ওপর তারপর সব হয়ে গেল নৈঃশব্দ্য। হয় সেই সমতলে পৌঁছে বাঘটা মারা গেছে নয় ও বে-জখম, নৈঃশব্দ্যের ব্যাখ্যা এই দু-রকম হতে পারে। রাইফেল কাঁধে ধরে রেখে অত্যন্ত অভিনিবেশে তিন বা চার মিনিট শুনলাম। যেহেতু আর কোনো আওয়াজ হল না, রাইফেল নামালাম। আমার এই আচরণের জবাবে পাহাড়ের মাথা থেকে নেমে এল গম্ভীর গর্জন। তবে বাঘটা বে-জখম, এবং আমায় দেখেছে ও। গাছের ওপর আমার বসার জায়গাটি গোড়ায় দশ ফুট উঁচুতে ছিল, কিন্তু যেহেতু আমার বসার মত শক্ত কিছু জিনিস ছিল না, আমার ভারে গোলাপ ঝাড়টি দেবে যায়। এখন সম্ভবত জমি থেকে আট ফুটের বেশি উঁচুতে নই। আর আমার ঝুলন্ত ঠ্যাং দুটি তো আরোই নিচে। আর খানিকটা ওপরে, প্রায় বিশ ফুট দূরে একটি বাঘ গলার গভীরে গরগর করছে। ওই মানুষখেকো, একথা মনে করবার সম্পূর্ণ কারণ আছে আমার।

যখন বাঘ আমাকে দেখছে না তখনও, দিবালোকেও বাঘের নিকট সান্নিধ্য রক্ত। চলাচলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। যখন সে সাধারণ বাঘ নয়, মানুষখেকো; সময় যখন অন্ধকার রাতের দশটা;, আপনি যখন জানছেন মানুষখেকোটি আপনাকে নজর করছে; রক্তপ্রবাহের বিশৃঙ্খলা পরিণত হয় তুফানে। আমি একথা বলেই যাব বিনা উসকানিতে বাঘ স্ব-প্রয়োজনের বাইরে হত্যা করে না। যে বাঘটা আমার উদ্দেশ্যে গজরাচ্ছে তার দু-তিন দিন চলে যাবে এমন একটা মড়ি ওর আছে। ওর আমাকে মারবার দরকার নেই কোন। তবুও আমার এক অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে যে এবারটা এই বিশেষ বাঘটা হয়তো এ হিসেবের বাইরের জানোয়ার বলে প্রমাণিত হবে। তার উদ্দেশ্যে গুলি ছোঁড়ার পরও বাঘ সময়ে-সময়ে মড়ির কাছে ফেরে কিন্তু আমি জানতাম এ তা করবে না। আমি এও জানতাম যে আমার অস্বস্তির অনুভূতি সত্ত্বেও যতক্ষণ না ভারসাম্য হারাই, ধরার কিছুই ছিল না আমার–অথবা ঘুমিয়ে পড়ি এবং পড়ে যাই গাছ থেকে, আমি সম্পূর্ণই নিরাপদ। এখন আর ধূপান থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখবার কোনো কারণ নেই আমার। তাই সিগারেট কেস বের করলাম আর যেমন দেশলাই কাঠি জ্বেলেছি পাড়টির কিনারা থেকে বাঘটিকে সরে যেতে শুনলাম। অচিরে ও ফিরে এল, গজরাল আবার। আমি তিনটে সিগারেট খেলাম, বাঘ তখনো আমার সঙ্গে লেগে আছে, তখন বৃষ্টি এল। প্রথমে কয়েকটি বড়-বড় ফোঁটা, তারপর ঝমঝম ধারাপাত। সে-সকালে রামগড় থেকে বেরোই যখন, পাতলা পোশাক পরেছিলাম। কয়েক মিনিটেই চামড়া অব্দি ভিজে গেলাম, কেননা বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে ঠেকিয়ে গুঁড়ো করে দেয় এমন একটি পাতাও ছিল না আমার মাথার ওপরে। আমি জানতাম, যে মুহূর্তে বৃষ্টি শুরু হল, বাঘটা চলে যাবে দ্রুত কোনো গাছের নিচে অথবা পাহাড়ের আড়াল-জায়গার আশ্রয়ে। রাত এগারটায় বৃষ্টি নেমেছিল, ভোর চারটেয় থামল, আকাশ পরিষ্কার হল, আমার অসুবিধা বাড়িয়ে তুলতে এখন বাতাস বইতে শুরু করল। এর আগে যদি শুধুই শীতার্ত ছিলাম, এখন বরফ জমা হয়ে গেছি। যখনি বাত কামড় দেয়, আমি সে রাত, এবং অনুরূপ অন্যান্য নিশীথের কথা স্মরণ করি আর কৃতজ্ঞ হই, বাতের প্রকোপটি সামান্য বলে।

বদ্রীও বন্ধু হিসেবে ভাল। সূর্য যখন উঠছে তখনি ও পৌঁছে গেল এক কেটলি গরম চা-বাহী একটি লোককে নিয়ে। রাইফেলের ভার থেকে আমায় মুক্তি দিয়ে, আমি যেমন গাছ থেকে পিছলে নেমে এলাম, ওরা দুজনে ধরল আমাকে কেননা আমার পা এত আড়ষ্ট, যে চলছিল না। আমি যেমন মাটিতে শুয়ে চা খেতে থাকলাম, ওরা আমরা পা ডলাইমলাই করে রক্ত চলাচল ফিরিয়ে আনল। যখন দাঁড়াতে সক্ষম হলাম, গেস্ট হাউসে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালবার জন্যে বদ্রী ওর লোক পাঠিয়ে দিল। বুলেটের গতি নির্দেশ করবার জন্য এর আগে শ্রবণশক্তিকে কাজে লাগাই নি কখনো, তাই দেখে খুশি হলাম মাত্র কয়েক ইঞ্চির জন্য বাঘের মাথা ফসকে ফেলেছি। রাইফেল উঁচনোটা ঠিকই হয়েছিল তবে রাইফেলের নলটি যথেষ্ট বাঁয়ে ঘোরাই নি। ফল দাঁড়ায়, বাঘ বলদটির যেখান থেকে খাচ্ছিল, তার দু-ইঞ্চি দূরে আমার বুলেটটি বলদটিকে বেঁধে।

সেই চা আর পথ ধরে আধমাইল হাঁটা আমার শরীর থেকে সকল খিল-ধরা ভাব দূর করে দিল আর বদ্রীর ফলবাগিচার দিকের এক মাইল লম্বা পথটি যখন ধরেছি, ভিজে কাপড় আর খালি পেটের কারণেই আমার যা কিছু কষ্ট তখন। লাল মাটির ওপর দিয়ে গেছে সে পথ, বৃষ্টিতে সে মাটি বেজায় পিছল। এই মাটিতে তিনটি পদচিহ্ন; বদ্রী এবং ওর লোকটির পদচিহ্ন উঠতি পথে; লোকটির পদচিহ্ন ফিরতি পথে। ভিজে মাটিতে শুধু এই তিন জোড়া পদচিহ্ন পঞ্চাশ গজ; তারপর পথ যেখানে মোড় ঘুরছে, ডান পাড় থেকে একটি বাঘিনী বঁপিয়ে নেমেছে এবং বদ্রীর লোকটির পেছু পেছু গেছে ওই পথেই। লোকটির পদচিহ্ন আর বাগিনীটির থাবার ছাপ বুঝিয়ে দিচ্ছে, দুজনেই গেছে খুব জোরকদমে। তখন আমার বা বদ্রীর করবার কিছুই নেই কেন না লোকটি আমাদের বিশ মিনিট আগে রওনা হয়ে গেছে; এবং সে যদি বাগিচার নিরাপত্তায় পৌঁছতে না পেরে থাকে, তবে এর অনেক আগেই আমরা ওকে যে সাহায্যই করতে পারতাম, তার নাগালের বাইরে চলে গেছে ও। অস্বস্তিকর চিন্তায় পীড়িত হতে হতে, সে পিছল মাটিতে যদ্র পারি তত তাড়াতাড়ি হাঁটলাম অমরা; আর সেখান থেকে বাগিচা এবং বাগিচায় কর্মরত একদল লোককে চোখে পড়ে, তেমন একটি পায়েচলা-পথে পৌঁছে ভারি নিশ্চিন্ত হলাম দেখে বাঘিনীটি সে পথে চলে গেছে, লোকটি গেছে বাগিচা পানে। পরে জিজ্ঞেস করতে লোকটি বলে ও জানতই না বাঘিনীটি ওর পেছু নিয়েছে।

গেস্টহাউসে গনগনে কাঠের আগুনের সুমুখে আমার জামাকাপড় শুকোতে শুকোতে যে জঙ্গলে বাঘিনীটি গেছে তার কথা জিজ্ঞেস করলাম বদ্রীকে। বদ্রী বলল, বাঘিনী যে পথ ধরেছে সেটি নেমে গেছে এক গভীর, ঘন বনে নিবিড় গিরিখাতের দিকে। একমাইল বা তারও বেশি জায়গায় খাতটি একটি অত্যন্ত খাড়াই পাহাড়ের গা দিয়ে এগিয়েছে, তারপর ডান দিক থেকে আরেকটি খাত এসে মিলেছে তার সঙ্গে। দুটি খাতের সঙ্গমে আছে একটি নদী, আর, বদ্রী বলল, এক টুকরো খোলা জমি আছে। সে জমিটি দুটি গিরিখাত থেকে বেরুবার পথের মুখোমুখি অবস্থিত। সে গিরিখাতে বাঘিনীটি ঢুকেছে বলে মনে করার সম্পূর্ণ কারণ আছে আমাদের। বদ্রীর মতে সেই খাতেই দিনটা ঘাপটি মেরে থাকবে বাঘিনী। জায়গাটি যেহেতু জঙ্গল-হাঁকাবার পক্ষে আদর্শ স্থান, আমরা ঠিক করলাম, যদি জঙ্গল-হাঁকাবার মত যথেষ্ট লোক যোগাড় করতে পারি তবে বাঘিনীটাকে মারবার জন্য এই উপায়টি পরখ করব। বদ্রীর প্রধান মালী গোবিন্দ সিংকে তলব করা হল, তাকে আমাদের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করা হল। গোবিন্দ সিং বলল, দুপুর অব্দি সময় দিলে ও জঙ্গল-হাঁকাবার জন্যে তিরিশ জন লোক, এবং তার ওপরে ওর মনিবের হুকুম মত পাঁচ মন মটরশুটি যোগাড় করতে পারে। আপেল-বাগিচার ওপর বদ্রীর আছে এক বিস্তীর্ণ তরকারি-বাগিচা আর সন্ধ্যায় ও টেলিগ্রাম পেয়েছে নৈনিতাল বাজারে মোটাদানার মটরশুটির দাম ঝপ করে পাউন্ড প্রতি চার আনায় উঠেছে। এ চড়া দরের সুযোগ নিতে বদ্রী আগ্রহী আর ওর লোকরা মটরশুটি তুলছিল। সেই রাতেই মালবাহী টাটুঘোড়া সে মাল নিয়ে যাবে, পরদিন নৈনিতালে পৌঁছবে ভোরের বাজার ধরার জন্য।

রাইফেল পরিষ্কার করে আর বাগিচার চারপাশে ঘুরে বেরিয়ে বদ্রীর সঙ্গে ওর দিনের খাওয়াতে যোগ দিলাম; আমার সুবিধের জন্য খাওয়ার সময় একঘণ্টা এগিয়ে আনা হয়েছিল, আর মধ্যাহ্নে গোবিন্দ ওর তিরিশ জনের দলকে হাজির করল। কারো মটর-তুলিয়েদের তদারকি করা দরকার তাই বদ্রী থেকে যাওয়া স্থির করল আর খেদান চালাবার জন্যে পাঠাল গোবিন্দ সিংকে। গোবিন্দ এবং সেই তিরিশ জন লোক স্থানীয় বাসিন্দা এবং মানুষখেকোটির হাতে কেমন বিপদ ঘটতে পারে তা জানে। বাঘিনীটির জন্যে সেই খাতে তল্লাসী করতে, যদি আমি গুলি ছুঁড়তে ব্যর্থ হই তবে নদীটির কাছে খোলা জায়গাটিতে স্ব-স্থানে বসতে, আমাকে একঘণ্টা সময় দিল বদ্রী। গোবিন্দ ওর লোকদের দু দলে ভাগ করবে; একটি দলের দায়িত্বে নিজে থাকবে; অন্যটির ভার দেবে একটি নির্ভরযোগ্য লোকের ওপর। সেই একঘণ্টা কাটলে বদ্রী একটি গুলি ছুঁড়বে আর দল দুটি তখন বেরিয়ে পড়বে; খাতের দুদিকে দুটি দল যাবে; পাথর গড়াবে, চেঁচাবে আর হাততালি দেবে। শুনতে এমনি সহজ সরলই বটে তবে আমার সংশয় ছিল কেননা আমি বহু হাঁকাই বিগড়ে যেতে দেখেছি।

যে-পথ ধরে সেই সকালে নেমেছি সেই পথের চড়াইয়ে গিয়ে আমি বাঘিনী যে-পথে গেছে সেটি ধরলাম। তাতে এই শুধু দেখলাম অল্প দূর গিয়ে, সে পথটি একটি নিবিড় ও বহুবিস্তৃত গুল্মবনে হারিয়ে গেছে। বহুশত গজ পথ ভেদ করে গিয়ে আমি দেখলাম পাহাড়ের গায় এক সার গভীর খাত ও শৈলশিরায় কাটা কাটা। যে গিরিখাতে হাঁকানো হবে তার ডান সীমানা বলে যে শৈলশিরাটিকে ঠাউরেছিলাম, তা ধরে উত্রাই নেমে আমি একটা উঁচু খাড়াইয়ের মুখে পৌঁছলাম। এর তলে আমার বাঁ দিকের গিরিখাতটি ডানদিকে থেকে আসা আরেকটি খাতের সঙ্গে মিশেছে, আর দুটি খাতের সন্ধিতে একটি নদী। যখন নিচের দিকে চেয়ে দেখছি আর ভেবে অবাক হচ্ছি যে ফাঁকা জমিতে আমি দাঁড়াব সেটি গেল কোথায়, কাছেই শুনলাম মাছির ভনভনানি; আর সে শব্দের অনুসরণে গিয়ে দেখলাম এক হপ্তা আগে নিহত একটি গরুর ভুক্তাবশেষ। প্রাণীটির গলার দাগ বুঝিয়ে দিল ওটি একটি বাঘের হাতে মারা পড়েছে। কাঁধের একাংশ, ঘাড় ও মাথা ছাড়া গরুটির সবটাই খেয়েছে বাঘটি। এ-কাজ করার বিশেষ কোনো যুক্তি না থাকলেও আমি গরুর শবটাকে কিনারা অব্দি টেনে নিয়ে খাড়া পাহাড়ের নিচে ফেলে দিলাম ঠুড়ে। শতখানেক গজ গড়িয়ে ওটা থামল গিয়ে নদী থেকে অল্প দূরে একটা ছোট গহ্বরে। বাঁ দিকে ঘুরে গিয়ে যে গহ্বরে গরুটির দেহাবশেষ গড়িয়ে ফেললাম তা থেকে আন্দাজ তিনশো গজ দূরে একটি শৈলশিরার ওপর একটা ফাঁকা জমির টুকরো পেয়ে গেলাম। এ জায়গাটি যেমনটি হবে বলে আমি ভেবেছিলাম, এটি তা থেকে একেবারেই অন্য রকম। পাহাড়ের যে পাশটা হাঁকানো হবে, দাঁড়িয়ে সেটার ওপর নজর রাখি এমন একটি জায়গাও নেই; আর আমি ওকে না দেখতেই বাঘিনীটি যে কোনো জায়গা দিয়ে বেরোতে পারে। তবে তখন সে বিষয়ে কিছু করার পক্ষে খুবই দেরি হয়ে গেছে কেননা যে গুলি আমাকে জানাবে যে হাঁকাই শুরু হয়ে গেছে, বদ্রী সেটি ছুঁড়েছে। অচিরে মানুষদের চেঁচাতে শুনলাম দূরে। কিছুক্ষণের জন্যে মনে হল হাঁকাই আমার দিকে আসছে, তারপর চেঁচামেচি ক্ষীণ হতে ক্ষীণ হতে থাকল, ক্রমে মিলিয়ে গেল। আবার এক ঘণ্টা বাদে হাঁকাই করছে যারা তাদের গলা শুনলাম। তারা পাহাড়ের উত্রাইয়ে আমার ডান দিকে নেমে আসছে আর তারা যখন আমার সঙ্গে সমোচ্চতায়, আমি ওদের চেঁচিয়ে বললাম হাঁকাই বন্ধ করে শৈলশিরায় আমার কাছে চলে আসতে। হাঁকাই যে বিফল হয়েছে সে কারো দোষ নয় কেননা জায়গাটি না জেনে পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই একদল আনাড়ী লোক দিয়ে আমরা হাঁকাতে চেষ্টা করেছিলাম ঘন গুল্মবনের এক বিশাল এলাকা, শত-শত তৈরি লোকও এ কাজ পেরে ওঠা কঠিনই মনে করত।

গুল্মবন ঠেলে পথ করে ঢুকতে হাঁকাইদারদের খুব কষ্টকর সময় কেটেছে; আর ওরা যখন দল বেঁধে বসে হাত-পা থেকে কাটা বের করছিল আর আমার সিগারেট খাচ্ছিল; আমি আর গোবিন্দ দাঁড়িয়েছিলাম মুখোমুখি; পরদিন সকালে মুক্তেশ্বরে আর আশপাশের গ্রামে যত লোক পাওয়া যায় সবাইকে নিয়ে একটি হাঁকাইএর বিষয়ে ওর প্রস্তাবটি আলোচনা করছিলাম। হঠাৎ একটা কথার মাঝখানে গোবিন্দ কথা-কওয়া থামাল। আমি দেখলাম আমার পেছনে অপ্রত্যাশিত কিছু ওর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে কেননা ওর চোখ সরু হয়ে গেল আর বিশ্বাস করতে পারছে না এমন অসম্ভব ব্যাপার ঘটছে বলে, এই ভাবটি ফুটে উঠল ওর মুখে। ও যেদিকে মুখ করে ছিল সেদিক পানে চাইলাম আমি, ঝট করে ঘুরে গিয়ে আর সেখানে, একটি বরবাদ আবাদী খেত ধরে ধীরে আসছিল বাঘিনীটি। নদীটির ও- প্রান্তে পাহাড়ের ওপর চারশোখানেক গজ দূরে বাঘিনীটি, ও আসছে আমাদেরই দিকে।

জঙ্গলে যখন বাঘ আপনার কাছে এগোতে থাকে, যখন আপনি জনবসতি থেকে দূরে আছেন তখনো, যে-ছবি আপনি তুলতে চান অথবা যে গুলি ছুঁড়তে চান, তার সুযোগ নষ্ট করে দেবার মত যে সব ব্যাপার ঘটতে পারে সেগুলোর চিন্তা আপনার মাথায় আসতে থাকে। একবার, জানোয়ার চলার পথের মুখোমুখি একটি পাহাড়ের গায়ে বসে ছিলাম আমি একটি বাঘের প্রতীক্ষায়। বরম কা থান’ নামে এক অতি পবিত্র অরণ্য পীঠে গিয়েছে পথটি। বরম’ এক অরণ্যদেবতা। তিনি মানুষদের রক্ষা করেন। এবং তিনি যে এলাকায় পাহারা দেন সেখানে জানোয়র হত্যা করতে দেন না। যে জঙ্গলের গভীরে এই পীঠ আছে সেটি জানোয়ারে বোঝাই; আশেপাশের বহু মাইল জায়গার চোরাশিকারীদের এবং ভারতের সর্বত্রের শিকারীদের প্রিয় মৃগয়া ভূমি। তবু সে জঙ্গলের সঙ্গে এক জীবন কালের পরিচয়েও আমি একটি বারের জন্যেও জানি নি ওই পীঠস্থানের সমীপে একটি জানোয়ারও গুলি খেয়েছে বলে। তাই আমাদের গ্রামের মোষ মারছিল যে বাঘটি, তাকে মারার জন্যে সেদিন আমি যখন বেরোই, বরমের থানের এক মাইল দূরের একটি জায়গা নির্বাচন করি আমি। বিকেল চারটেয় আমি একটি ঝোপের পেছনের জায়গায় বসে যাই আর যেদিক থেকে বাঘটিকে আশা করছি সেদিকে একটি সম্বর ডাকল এক ঘণ্টা বাদে। কিছুক্ষণ বাদে আমার অপেক্ষাকৃত কাছে একটি কাকার ডাকতে শুরু করল; যে পথের কাছে আমি বসেছিলাম, তাই ধরে বাঘ আসছে। জঙ্গলটি মোটামুটি খোলামেলা। তাতে আছে বেশির ভাগ তরুণ জাম গাছ, দুই থেকে তিন ফুট মোটা। যখন ও দুশো গজ দূরে তখন আমি বাঘটিকে দেখলাম–এক বিশাল মদ্দা বাঘ। ও আসছিল ধীর চালে আর আমাদের মধ্যের দূরত্ব কমিয়ে এনেছিল একশো গজে, তখন আমি পাতার খসখস শব্দ শুনলাম; আর মুখ তুলে দেখলাম একটি জামগাছ, তার ডালপালা আরেকটির সঙ্গে জড়ানো, কাত হতে শুরু করেছে। অতি মন্দ গতিতে গাছটি টলতে থাকলে যতক্ষণ না একই জাতের ও মাপের আরেকটি গাছকে ছোঁয়। কয়েক মুহূর্ত দ্বিতীয় গাছটি প্রথমটির ভার সইল, তারপর সেটিও টলে পড়তে শুরু করল। গাছদুটি যখন সোজা অবস্থা থেকে আন্দাজ তিরিশ ডিগ্রী কোণে পৌঁছেছে, ওরা একটি তৃতীয়, একটু ছোট গাছে বেঁধে গেল। এক কি দুই মুহূর্তের বিরতি, তারপর তিনটি গাছই হুড়মুড়িয়ে মাটিতে পড়ল। আমার থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে গাছগুলি দেখছিলাম যখন, বাঘটির ওপরও একটা চোখ রেখেছিলাম। পাতাগুলির প্রথম শব্দেই ও দাঁড়িয়ে পড়েছিল আর গাছগুলি যখন মাটিতে ভেঙে পড়ল ও ঘুরে দাঁড়াল, এবং ঘাবড়াবার কোনো লক্ষণ না দেখিয়েই যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে প্রস্থান করল। আমি যে ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম তাকে স্বাভাবিকতার বাইরে বলে ব্যাখ্যা করতে হবে এই কারণের জন্যে গাছগুলি তরুণ সতেজ; ওদের শিকড় শিথিল করে দেবার মত কোনো বৃষ্টিপাত সম্প্রতি ঘটে নি; জঙ্গলে এক ঝলক বাতাসও বইছিল না; আর পীঠস্থানে যাবার পথের ওপরই পড়ল গাছগুলি যখন বাঘটি আর সত্তর গজ এলেই আমি যে গুলিটি মারব বলে অপেক্ষা করছি তা খুঁড়তে পারি।

গুলি মারার সুযোগ নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা খুবই বেড়ে যায়, যখন যে জনবসতি এলাকায় মানুষজন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে বা বাজারে যাওয়া আসা করতে পারে; অথবা আপেল-বাগিচা থেকে হনুমানদের ভয় দেখিয়ে তাড়াবার জন্যে গুলি ছোঁড়া হতে পারে; তেমন জায়গায় থাকে অভিপ্রেত শিকারটি। নদীতে পৌঁছতে বাঘিনীটির এখনো তিনশো গজ যেতে হবে, আর তার মধ্যে দুশো গজই হল ফাঁকা জমি, যার ওপর একটি গাছ বা ঝোঁপ নেই। সামান্য কান্নি মেরে বাঘিনী আমাদের দিকে আসছে, আমরা যে নড়াচড়াই করি তা দেখতে পাবে ও; অতএব ওকে দেখে চলা ছাড়া কিছুই করতে পারি না আমি। আর কোনো বাঘিনী কোনোদিন এত আস্তে চলে নি। মুক্তেশ্বরে লোকজনের কাছে ও ‘খোঁড়া বাঘ’ নামে পরিচিত কিন্তু ওর খোঁড়াত্বের কোনো লক্ষণই দেখতে পাচ্ছি না আমি। ওকে যখন লক্ষ করছি, তখন মাথায় এই পরিকল্পনা দানা বাঁধতে লাগল যে ও আগাছার জঙ্গলে ঢোকা অব্দি সবুর করব, তারপর সামনে ছুটে যাব, আর ও নদীটা পেরোবার আগে অথবা পরে একটা গুলি মারতে চেষ্টা করব। ও যে জায়গাটা তাক করে যাচ্ছে সেটার এবং আমার মধ্যে যথেষ্ট আড়াল থাকলে ওকে দেখার সঙ্গেসঙ্গেই আমি সামনে চলে যেতাম; আর হয় ফাঁকা জমির ওপরই ওকে মারতে চেষ্টা করতাম, নয়তো তাতে বিফল হলে ওই নদীতে ওকে আটকাতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমার নড়াচড়া গোপনে সারবার মত যথেষ্ট আড়াল ছিল না; তাই ফাঁকা জমি ও নদীর মধ্যবর্তী ঝোপে বাঘিনী না-ঢোকা অব্দি আমাকে অপেক্ষা করতেই হল। আমি না ফেরা অব্দি লোকজনকে নড়তে বা কোনো আওয়াজ না-করতে বলে, বাঘিনী যেই চোখের আড়ালে গেল অমনি আমি দৌড়ে রওনা হলাম। পাহাড়টি খুব খাড়াই, আর যেমন বাঁক ঘিরে ছুটেছি, পৌঁছলাম একটি বন-গোলাপের ঝোপে, সেটি পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে বহু গজ বিস্তৃত। ঝোপের মধ্য দিয়ে একটি নিচু সুড়ঙ্গ ছিল আর সেটি দিয়ে ছুটব বলে যেমন সামনে ঝুঁকেছি, আমার টুপি খুলে পড়ল আর সুড়ঙ্গের শেষে তড়বড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার ফলে মাথায় যে কাঁটা ফুটল তার টানে আমি শূন্যে উঠে যাচ্ছিলাম প্রায়। এই বনগোগালাপের কাটা বাঁকানো খুবই শক্ত আর যেহেতু আমি থামতে পারলামনা সে-হেতু কিছু কাটা আমার মাথায় ভেঙে গিয়ে গেঁথে থাকল– যখন আমি বাড়ি যাই আমার দিদি ম্যাগি সেগুলো বের করতে কষ্ট পেয়েছিলেন খুব–অন্য কাঁটাগুলো চামড়া ছিঁড়ে দিল। মুখ বেয়ে সরু সরু ধারে রক্ত ঝরছে, আমি ছুটতেই থাকলাম যতক্ষণ না ওপরের পাহাড় থেকে আংশিক ভুক্ত মড়িটি যে গহবরে গড়িয়ে ফেলেছিলাম সেটির কাছে পৌঁছই। এ গর্তটি আন্দাজ চল্লিশ গজ লম্বা আর তিরিশ গজ চওড়া। যেখানে মড়িটি পড়েছিল সেই ওপর কিনার; মড়ির ওপরকার পাহাড় এবং আরো দূরের পাড়, সব ঘন গুল্ম বনে আকীর্ণ। গর্তটির নাবালের আধখানায় আর আমার দিকের পাড়টিতে ঝোঁপ নেই। গহ্বরটির কিনারে গিয়ে যেমন উঁকি মেরেছি, একটা হাড় ভাঙতে শুনলাম। আমার আগেই বাঘিনী গর্তে পৌঁছে গেছে আর পুরনো মড়িটা পেয়ে গত রাত্রে যে আহার থেকে ও বঞ্চিত হয়েছে, সেটা পুরিয়ে নিতে চেষ্টা করছে।

মড়িটিতে খুব কম মাংসই আছে। ওটি ছেড়ে বাঘিনী যদি ফাঁকা জায়গাটিতে বেরিয়ে আসে তবে আমি ওকে একটা গুলি মারতে পাই, কিন্তু ও যদি পাহাড় অথবা দূরের পাড়টির চড়াই ধরে উঠে যায়, আমি ওকে দেখতে পাব না। যে নিবিড় গুল্মঝোঁপ থেকে আমি বাঘিনীটার আওয়াজ পাচ্ছি, তা থেকে একটি সংকীর্ণ পথ আমার দিকের পাড়ে উঠে এসেছে এবং আমার বাঁয়ে এক গজের ভেতর দিয়ে গেছে, আর পথটির এক গজ ওপারে গেলে সিধে পড়তে হবে পঞ্চাশ ফুট নিচে নদীটিতে। ওর ওপরকার পাহাড়ে একটা পাথর ছুঁড়ে বাঘিনীটিকে গুল্মবন থেকে তাড়িয়ে খোলা জায়গাটায় বের করে আনার সম্ভাবনা বিবেচনা করছি, এমন সময়ে আমার পেছনে একটা শব্দ শুনলাম। পেছনে চেয়ে দেখি আমার টুপি হাতে দাঁড়িয়ে গোবিন্দ। সে সময়ে ভারতে কোনো ইউরোপীয়ান টুপি ছাড়া চলাফেরা করত না; আর গোলাপ-ঝাড়ের পাশে আমার টুপিটা পড়ে থাকতে দেখে গোবিন্দ সেটি কুড়িয়ে নিয়ে আমার কাছে এনেছে। আমাদের কাছেই পাহাড়ে একটা গর্ত ছিল। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে আমি গোবিন্দর বাহু ধরলাম, ওই গর্তে চেপে ঢোকালাম ওকে। মোড়ানো হাঁটুর ওপর চিবুক রেখে, আমার টুপি জাপটে উবু হয়ে বসে ও সে গর্তে মাপে-মাপে এঁটে গেল;  এবং খুবই হতভাগ্য কোনো জন্তুর মত দেখাচ্ছিল ওকে, কেন না ও কয়েক গজ দূরে বাঘিনীটার হাড়-চিবানো শুনতে পাচ্ছিল। আমি যেমন সিধে হয়ে পাড়ের কিনারে আগেকার জায়গায় ফিরে দাঁড়িয়েছি, বাঘিনী খাওয়া বন্ধ করল। হয় ও আমায় দেখেছে; নয়, যা বেশি সম্ভব, পুরনো মড়িটা ওর পছন্দ হয় নি। এই দীর্ঘ মিনিট কোনো নড়াচড়া বা শব্দ রইল না, তারপর আমি ওর দেখা পেলাম। ও উলটো পাড়টা বেয়ে উঠেছে, এখন ওর ওপর দিয়ে চলেছে পাহাড়ের দিকে। ওখানে কয়েকটা ছ ইঞ্চি মোটা পপলার চারা গাছ, আর ওগুলোর ভেতর দিয়ে যখন বাঘিনী চলছিল, আমি ওর শরীরের বহিরেখা দেখতে পাচ্ছিলাম শুধু। আমার বুলেট চারাগাছগুলো এড়াবে, বাঘিনীকে বিধবে এই ক্ষীণতম আশায় আমি রাইফেল উঁচোলাম আর দুম করে গুলি ছুঁড়লাম একটা। আমার গুলিতে বাঘিনী সাঁ করে ঘুরে দাঁড়াল, পাড় ধরে নামল, গহ্বরটি পেরোল এবং যত দ্রুত পারে আমার দিকের পথে চলে এল। আমি তখন জানি না যে আমার বুলেট বিঁধেছে ওর মাথার কাছে এক চারাগাছে। জানি না ওর এক চোখ কানা। তাই যা দেখে মনে হল এ এক অতি দৃঢ়সংকল্প আক্রমণ; তা শুধু এক ভয় পাওয়া জন্তুর বিপদ থেকে পলায়নও হতে পারে কেন না সেই আবদ্ধ জায়গায়, কোন দিক থেকে আমার রাইফেলের আওয়াজ এল, তা ও বুঝতে নাও পারে। সে যাই হক, আমি যাকে আহত ও অতি ক্রুদ্ধ এক বাঘিনী ভাবছি, সে আমার দিকেই আসছে সোজা; তাই ও যতক্ষণে দু গজের দূরত্বে আসে ততক্ষণ সবুর করে আমি সামনে ঝুঁকলাম আর অশেষ সৌভাগ্যবশে রাইফেলের বাকি গুলিটি বেঁধাতে পারলাম যেখানে ওর ঘাড় ও কাঁধ মিশেছে সেই নাবালে। আমার বাঁ কাধ ওর থেকে ফসকে যাবার জন্যে যেটুকু বাধা প্রয়োজন সেই ভারি ৫০০ বুলেট সেটুকু বাধাই দিতে পারল ওকে, আর ওর শরীর-বেগ ওকে ফেলে দিল পঞ্চাশ ফুট নিচে, তলার নদীতে, সেখানে ও পড়ল জোর ঝপাং শব্দে। এক পা এগিয়ে আমি কিনার থেকে চাইলাম আর দেখলাম শূন্যে পা তুলে বাঘিনীটা পড়ে আছে এক আবদ্ধ জলে ডুবে, আর সে জল লাল হয়ে উঠছে ওর রক্তে।

গোবিন্দ তখন গর্তেই বসে আছে, ইশারা করতে ও আমার কাছে এল। বাঘিনীকে দেখে ও ফিরে শৈলশিরার ওপরের মানুষদের চেঁচিয়ে বলল, “বাঘটা মরেছে। বাঘটা মরেছে। শৈলশিরার ওপরে তিরিশটি লোক এখন চেঁচাতে শুরু করল আর ওদের হল্লা শুনে বদ্রী তার শটগান নিয়ে দশটা গুলি ছুঁড়ল। সে শব্দ মুক্তেশ্বর এবং আশেপাশের গ্রামে শোনা গেল এবং অচিরে চারদিক থেকে মানুষ এসে ভিড় জমাল নদীটিতে। সাগ্রহ বহু হাত বাঘিনীটিকে জল থেকে টেনে তুলল, তাকে একটি চারাগাছে বাঁধল এবং বিজয়গর্বে নিয়ে গেল বদ্রীর বাগিচায়। সকলে দেখার জন্যে এখানে তাকে রাখা হল খড়ের বিছানায়, তখন এক পেয়ালা চায়ের জন্যে আমি গেলাম গেস্টহাউসে। এক ঘণ্টা বাদে হাত লণ্ঠনের আলোয় আমি বাঘিনীটার চামড়া ছাড়ালাম; চারদিক ঘিরে অনেক লোকের এক জমায়েত দাঁড়িয়ে, তার ভেতর মুক্তেশ্বরের বহু শিকারীও ছিল। তখনই আমি দেখলাম বাঘিনীর এক চোখ কানা আর ওপর-পায়ে এবং সামনের ডান পা’র থাবার তলে গেঁথে আছে এক থেকে ন ইঞ্চি বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের প্রায় পঞ্চাশটি শজারুর কাঁটা। রাত দশটার মধ্যে আমার কাজ শেষ হল; তার সঙ্গে রাত কাটাবার জন্য বদ্রীর অতীব সদয় আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে আমি পাহাড় বাইলাম যারা মুক্তেশ্বর থেকে এসেছে তাদের সঙ্গে; তাদের মধ্যে ছিল চামড়াবাহী আমার দুটি লোক। ডাকঘরের সামনে ফাঁকা জায়গায় পোস্টমাস্টার ও তার বন্ধুদের দেখার জন্যে চামড়াটি মেলে রাখা হল। মাঝরাতে কয়েক ঘণ্টা ঘুমের জন্যে আমি সাধারণের জন্যে সংরক্ষিত ডাকবাংলোেয় গিয়ে শুলাম। চারঘণ্টা বাদে আবার চলতে শুরু করলাম আর বাহাত্তর ঘণ্টা অনুপস্থিতির পর দুপুরে নৈনিতালে ফিরলাম স্বগৃহে।

 মানুষখেকো নিধন মানুষকে এক তৃপ্তির অনুভূতি দেয়। যে কাজ করা খুব দরকার হয়ে পড়েছিল, সে কাজ করার তৃপ্তি। এক অতি সুযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে তার স্বস্থানে পরাজিত করার তৃপ্তি। আর, একটি সাহসী ছোট্ট মেয়ের হাঁটবার জন্যে পৃথিবীর এক ফালি ছোট্ট জায়গাকে বিপদমুক্ত করে দেবার তৃপ্তি হল সবার চেয়ে বড়।