প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

১০. কুঁয়ার সিং

১০.

কুঁয়ার সিং, যার কথা আমি ‘আমার ভারত’ বইয়ে লিখেছি, কালাধুঙ্গির কাছাকাছি জঙ্গলে শিকারে তার ঘোরতর আপত্তি ছিল। কারণ সেখানে এত বেশি লতাপাতা মাটি ছেয়ে থাকত যে কর্তব্যপরায়ণ বনরক্ষক বা ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্রের কবল থেকে পালাতে খুব অসুবিধে হত। এই কারণে সে তার চোরাই শিকারের সমস্ত কার্যকলাপ গারুঙুর বনেই সীমাবদ্ধ রাখত। বনের নাড়িনক্ষত্র তার জানা, অব্যর্থ লক্ষ্যভেদী, তাকে সেইজন্য আমি শ্রদ্ধাও করি, কিন্তু শিকারী হিসেবে তাকে অতটা দাম দিতে পারি না, কারণ যে সব বনে সে শিকার করত, সেখানে শিকারের প্রাণী অসংখ্য। জীবজন্তুর প্রতিটি চলার পথ, আর হরিণ চরে এমন প্রত্যেকটি ফাঁকা জায়গা তার ভালভাবে জানা থাকার ফলে সে সোজা বনে প্রবেশ করত, চুপিসারে প্রবেশ করার প্রয়োজন বোধ করত না, ভাবটা যেন এই যে, যদি বা একটা ফাঁকা জায়গায় হরিণগুলো চমকে পালিয়ে যায় তো আরেকটায় নিশ্চয় তার চেয়ে বেশি হরিণ মিলবে। কিন্তু তবুও আমার অনেক শিক্ষাই কুঁয়ার সিং-এর হাতে হয়েছে যা আমি সর্বদাই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করে এসেছি; অজানা সম্বন্ধে আমার মধ্যে যে আতঙ্ক ছিল তারও কিছুটা আমার দূর হয়েছে তারই কল্যাণে। এ-হেন একটা আতঙ্ক হল দাবানল। দাবানলের বিপদের কথা শুনে আর আমাদের জঙ্গলে তার পরিণতি লক্ষ করে এই ভয়ই আমার মনের অন্তরালে আশ্রয় করেছিল যে, কোনোদিন আমি দাবানলের কবলে পড়ে জীবন্ত পুড়ে মরব। কুঁয়ার সিংই আমার মন থেকে এই ভয় দূর করে দেয়।

কুমায়ুনের পাদদেশীয় গ্রামাঞ্চলের মানুষরা সবাই পরস্পরের ব্যাপারে কৌতূহলী, আর যে-সব মানুষ কখনো খবরের কাগজ দেখে না এবং যাদের জীবন তাদের গ্রাম বা কয়েকটি গ্রামের সমষ্টি ঘিরে যে জঙ্গল তারই মধ্যে সীমাবদ্ধ, যে-কোনো সামান্য খবরও সেখানে প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি করে ও মুখে মুখে ফিরতে থাকে, বার-বার শুনেও তা পুরনো হতে চায় না। তাই যখন সে আমার প্রথম চিতার শিকারের খবর পেল, তখনো চিতাটার শরীর ঠাণ্ডা হয়েছে কি না, সন্দেহ, এবং খেলোয়াড়ি নিয়ে এসে আমাকে অভিনন্দন জানাতেও তার দেরি হল না। সার্জেন মেজরেরদেওয়া রাইফেলটার কথা সে জানত বটে, কিন্তু চিতাটা না মরা পর্যন্ত সে বিশ্বাস করতে পারে নি যে তা ব্যবহার করার সামর্থ্য আমার কাছে। এখন এই প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে সে আমার আর আমার রাইফেলের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠল। সেদিন সে চলে যাবার আগে কথা হল, পরদিন ভোর পাঁচটার সময় গারুপ্পু রোডের চার নম্বর মাইল-স্টোনের কাছে আমার তার সঙ্গে দেখা হবে।

ম্যাগি যখন এক কাপ চা তৈরি করে আমার হাতে দিল তখনও ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। এক ঘণ্টা সময় থাকতে আমি কুঁয়ার সিং-এর সঙ্গে দেখা করতে বেরোলাম। এই নির্জন জংলা পথে আমি এইভাবে অনেকবার হেঁটেছি, তাই অন্ধকারের ভয় আমার ছিল না। চার নম্বর মাইল-স্টোনের কাছে পৌঁছতে রাস্তার ধারের একটা গাছের নিচে আগুন দেখতে পেলাম। কুঁয়ার সিং আমার আগেই এসে গেছে। আগুনে হাতদুটো গরম করব বলে তার পাশে বসতেই সে বললে, “কি কাণ্ড, তাড়াতাড়িতে ট্রাউজার্স পরতেই ভুলে গেছ!’ বৃথাই তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে আমি ভুল করিনি, এই প্রথম আমি একটা নতুন ধরনের পোশাক পরেছি যাকে বলে শর্টস্। কিন্তু তবুও সে বলে চলল যে আমি যা পরে আছি তা জাঙ্গিয়া মাত্র এবং বনে শিকারের পক্ষে একান্ত অনুপযুক্ত,-এবং তার দৃষ্টি দিয়ে এটাই সে বলতে চায় যে আমার পোশাক যে-রকম অভব্য তাতে আমার সঙ্গে তাকে দেখা গেলে তার মাথা কাটা যাবে। শুরতেই এই বাগড়া পড়ার ফলে সহজে আবহাওয়া পরিষ্কার হল না যতক্ষণ না কাছের একটা গাছে একটা মোরগ ডেকে উঠল। শুনেই কুঁয়ার সিং তক্ষুনি খাড়া হয়ে উঠল, তারপর আগুনটা নিবিয়ে দিয়ে বললে, ‘এবার বেরিয়ে পড়া দরকার, কারণ অনেকটা যেতে হবে।

সেখান থেকে বেরোতেই জঙ্গলে প্রাণের সাড়া জেগে উঠতে লাগল। যে বনমোরগটা আমাদের আগুনের সাড়ায় জেগে উঠে নতুন দিনকে স্বাগত করে ডেকে উঠেছিল, সে যেন একটা শব্দতরঙ্গের সৃষ্টি করে প্রতিটি পাখি ছোট বড় নির্বিশেষে ঘুম ভেঙে উঠে এই ক্রমবর্ধমান শব্দ-সমষ্টিতে কণ্ঠ মেলাচ্ছে। বনমোরগটা সর্বপ্রথম চোখ থেকে ঘুম তাড়ালেও সবার আগে কিন্তু সে মাটিতে নামল না। ভোরবেলার প্রথম পতঙ্গ-শিকারে অধিকার হিমালয়ের হুইসলিং গ্রাশের। যার আরেক নাম হুইসলিং স্কুলবয়। কুমায়ুনের বনে বনে দিন আর রাত্রির মধ্যে আধো-আলো-আঁধারির মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে দেখা যাবে কোনো পাখি হয়ত নিঃশব্দ পাখায় ভর করে গানের সোনালি ঝরনা বইয়ে দিল,–সে গান একবার শুনলে আর কোনোদিন ভোলবার নয়। এই গায়ক পাখির নামই হুইলিং স্কুলবয়। একটা দিনকে বিদায়ী শুভরাত্রি জানিয়ে সে আরেকটা নতুন দিনকে স্বাগত জানায়। সকাল-সন্ধ্যা সে উড়তে উড়তে গান গাইতে থাকে, আর দিনের বেলায় ঘন্টার পর ঘণ্টা কোনো পত্রবহুল গাছে বসে মিষ্টি সুরে নিচু গলায় এমন এক গান গেয়ে যায় যার না আছে শুরু না আছে সমাপ্তি। তার পরে দিনের আলোকে স্বাগত জানায় কোনো ভিমরাজ, আর তার মিনিটখানেক পরেই কোনো ময়ুর। বিরাট শিমূল গাছটার সবচেয়ে উঁচু ডাল থেকে এই তীক্ষ্ণ ডাক ওঠে, এবং তার পরে আর কোনো পাখির পক্ষেই ঘুমিয়ে থাকা সম্ভব হয় না। আর এই সময়ে, যখন রাত চলে যাচ্ছে আর ভোর হচ্ছে, শত-শত প্রাণময় কণ্ঠস্বর প্রকৃতির ঐকতানে যোগ দেয়, ধ্বনি ক্রমবর্ধমান আন্দোলনে জঙ্গল মুখর করে তোলে।

আর শুধু পাখিই নয়, জীবজন্তুরাও এখন বেরোতে শুরু করেছে। চিতল হরিণের ছোট-খাট একটা দল আমাদের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেল। তারও দুশো গজ তফাতে একটা স্ত্রী-সম্বর আর তার বাচ্চা রাস্তার ধারের ছোট ছোট ঘাস খেয়ে চলেছে। এবার পুব দিক থেকে একটা বাঘ ডেকে উঠল, ময়ুরেরা শুনে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল। কুঁয়ার সিং-এর ধারণা বাঘটার দূরত্ব বন্দুকের গুলির পাল্লার চার গুণ, –বাঘটা আছে সেই বালিভরা নালায় যেখানে সে আর হর সিং মৃত্যুর কাছাকাছি। এসে পড়েছিল। বোঝা গেল বাঘটা কোনো মড়ি থেকে ফিরছে, তাই সে পরোয়া করে না কে তাকে দেখল বা না দেখল। প্রথমে একটা কাকার হরিণ, তারপর দুটো সম্বর, আর এখন একপাল চিতল বনের বাসিন্দাদের তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন করে দিতে লাগল। আমরা যখন গারুপ্প পৌঁছলাম রোদ তখন গাছের আগায়। তারপর কাঠের সাঁকোটা পার হয়ে ঘাটের বিধ্বস্ত বাড়িটার পাশে খোলা জমিতে গোটা পঞ্চাশ ষাট বন-মোরগ চরছিল তাদের চমকে দিয়ে আমরা একটা পায়ে-চলা পথ ধরে অগ্রসর হলাম–একটা সরু ঝোপ-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। এই পথ সেই শুকনো জলপথে গিয়ে পড়েছে যেটার উপরকার সাঁকো আমরা এইমাত্র পার হয়ে এলাম। এই জলপথে প্রবল বর্ষার সময়ে ছাড়া কোনো ঋতুতেই জল থাকে না। বনের সকল প্রাণীর এটা রাজপথ; –তিন মাইল নিচে যেখানে স্বচ্ছ জলের ঝরনাটার উৎস সেখানে সকল প্রাণীই যায় এই পথে তৃষ্ণা দূর করতে। পরবর্তীকালে এই জলপথ আমার রাইফেল ও ক্যামেরার একটি প্রিয় শিকার-স্থল হয়ে উঠেছিল,–কারণ যে অঞ্চল দিয়ে এটা চলে গেছে সেখানে শিকার অজস্র; সেখানে বালির উপর মানুষের পায়ের চিহ্ন রবিনসন ক্রুসোর দ্বীপে ফ্রাইডের পায়ের ছাপের মতোই রহস্যময় হয়ে ওঠে।

আধ-মাইলটাক ঝোপ-জঙ্গল দিয়ে চলে যাবার পর এই জলপথ সিকি মাইল চওড়া আর মাইলের পর মাইল লম্বা একখানি নলবনের মধ্যে প্রবেশ করে। নলঘাস ফাপা, বাঁশের মত গাঁট গাঁট, চোদ্দ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। যেখানে এ বস্তু গ্রামের ধারে-কাছে পাওয়া যায় সে অঞ্চলে গ্রামবাসীরা কুটির নির্মাণের কাজে এর প্রচুর ব্যবহার করে। গরু-ভেড়ার চারণভূমির জন্যে যখন গ্রামবাসীরা গারুপ্পুর আশে-পাশের জঙ্গল পুড়িয়ে দেয়, এ অঞ্চলের সমস্ত প্রাণী তখন গিয়ে নল-ঘাসের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে, কারণ জায়গাটা সাত-সেঁতে বলে এখানকার নল-ঘাস সারা বছর সবুজ থাকে। কোনো-কোনো বছরে অবশ্য বর্ষা যখন অত্যন্ত কম হয় তখন এই নল-বনে আগুন ধরে, এবং তা থেকে ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়, কারণ ঘাসের সঙ্গে এখানে লতা-পাতা জড়িয়ে-মড়িয়ে থাকে। আর নল-ঘাসের প্রতিটি গাঁট যখন আগুন লেগে ফেটে পড়ে তখন আওয়াজ হয় বন্দুকের গুলির মত, এবং যখন কোনো-কোনো গাঁট একসঙ্গে ফাটতে শুরু করে তখন যে শব্দের সৃষ্টি হয় তা কানে তালা ধরিয়ে দেবার মত; সে শব্দ শোনা যায় এক মাইলেরও বেশি দূর থেকে।

সেদিন সকালে কুঁয়ার সিং-এর সঙ্গে জলপথটা ধরে এগোতে এগোতে দেখি, কালো ধোঁয়া আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দূর থেকে আগুনের শব্দ আর নল-বন থেকে গাঁট ফাটার শব্দ আমার কানে এল। জলপথটা চলে গেছে। দক্ষিণ দিকে, আর পূব বা বাঁ পাড় থেকে আগুনটা, জোর বাতাসে সেদিকে এগিয়ে আসতে লাগল। কুঁয়ার সিং আগে আগে যাচ্ছিল, সে বললে দশ বছর পরে আজ নল-বনে আগুন লাগল। সিধে, এগিয়ে চলল সে। একটা বাঁকে মোড় ফিরতে আমাদের আগুনের দেখা মিলল-জল-পথের থেকে শ-খানেক গজ দূরে। আগুনের বিরাট বিরাট শিখা কালো ধোঁয়ার মেঘের মধ্যে লাফিয়ে উঠছে; যে সব উড়ন্ত পোকা গরম হাওয়ার তাপে পাক খেতে খেতে উপরে উঠে যাচ্ছে, অসংখ্য ময়না, নীলকণ্ঠ আর ফিঙে তাদের খেয়ে চলেছে। যে-সব পোকা পাখিদের কবল থেকে রক্ষা পেল তাদের অনেকে জলপথের বালিভরা গর্ভে বসল, আর সঙ্গে সঙ্গে ময়ুর আর বনমোরগ আর কালো তিতির তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এইসব শিকারের পাখিদের মধ্যে গোটা-কুড়ি চিতলের একটা পাল বিরাট শিমূল গাছটার ঝরে-পড়া শাঁসালো ফুলগুলো খেতে লাগল।

দাবানলের অভিজ্ঞতা জীবনে এই আমার প্রথম, এবং এ থেকে যে ভয় আমি পেলাম সে ভয় অজানার ভয়, অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই তা বর্তমান। তারপর যখন মোড় ফিরে দেখলাম কত পাখি পশু এই আগুনের কাছেই চরে বেড়াচ্ছে এবং কিছুমাত্র ভয় পাচ্ছে না, তখন বুঝলাম যে একমাত্র আমিই ভয় পেয়েছি, এবং সে ভয়ের একমাত্র কারণ, অভিজ্ঞতার অভাব। কুঁয়ার সিং-এর সঙ্গে জলপথের পাশ দিয়ে এগোতে এগোতে আমার ইচ্ছে হচ্ছিল পিছু ফিরে দৌড়ে পালাই, কিন্তু পাছে সে আমায় কাপুরুষ মনে করে এই ভয়ে তা থেকে বিরত হলাম। আর এখন এই পঞ্চাশ গজ চওড়া শুকনো জলপথের বালিভরা বুকে দাঁড়িয়ে এগিয়ে আসা আগুনের ক্রমবর্ধমান গর্জন আর মাথার উপরে ধোঁয়ার কালো মেঘ লক্ষ করতে করতে, নল-ঘাসের ওদিক থেকে কোনো শিকারের প্রাণীর আসার প্রতীক্ষায় থেকে সেই যে আমার ভয় দূর হল, আর তা ফিরে আসে নি। জলপথের যেখানে আমরা আছি আগুনের তাপ সেখান পর্যন্ত আসছে। দেখলাম হরিণ, ময়ূর, বন-মোরগ আর কালো তিতির জল-পথের ডান পাড় বেয়ে উঠে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমরা ফেরার পথ ধরলাম।

পরবর্তী জীবনে দাবানল থেকে আমার প্রচুর রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা হয়। তার .একটার বর্ণনা দেবার আগে জানানো দরকার যে আমরা যারা হিমালয়ের পাদদেশে চাষবাসের কাজ করি, অসংরক্ষিত বনের ঘাসে আগুন দিয়ে তাকে চারণভূমিতে পরিণত করার অধিকার আমরা সরকার থেকে পেয়েছি। এসব বনে অনেক রকম ঘাস আছে, এবং সব রকম ঘাসই সমান শুকনো না হওয়ায় এক এক রকম ঘাস এক এক সময়ে পোড়ানো হয়। এই ঘাস পোড়ানো চলে ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত। এই পুরো সময়টা ঘাসের বনে এখানে ওখানে আগুন দেখা যায়। কোনো ঘাস জমির পাশ দিয়ে যেতে যেতে যদি কারো মনে হয়, ঘাসটা বেশ শুকনো, সহজে জ্বলে উঠতে পারে, সে স্বচ্ছন্দে দেশলাই জ্বালিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দিতে পারে।

তখন আমি উইণ্ডহ্যামের সঙ্গে তরাইয়ের বিন্দুখেরায় কালো তিতির শিকার করছি। একদিন খুব সকালে আমি আর বাহাদুর পঁচিশ মাইল হাঁটা পথ ধরে কালাধুঙ্গিতে আমাদের বাড়ির দিকে চললাম। এই বাহাদুর হচ্ছে আমাদের বহুদিনের বন্ধু–ত্রিশ বছর ধরে সে আমাদের গ্রামের মোড়ল। আমরা তখন প্রায় দশ মাইল– এসেছি। এই পথের দুধারে বেশির ভাগ ঘাসই পুড়ে গেছে, মাঝে মাঝে কেবল কোথাও কোথাও খানিকটা করে রয়ে গেছে। এইরকম একটা ঘাসের ঝোঁপ থেকে একটা প্রাণী বেরিয়ে এল, যে গরুর গাড়ির পথ দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম তারই উপর এসে দীর্ঘ এক মিনিট কাল আমাদের দিকে পাশ করে দাঁড়াল। সকালের রোদে তার গায়ের রঙ আর আকৃতি দেখে তাকে বাঘ বলেই মনে হল। কিন্তু পথটা পেরিয়ে ঘাস-জমিতে প্রবেশ করতে তার ল্যাজের দৈর্ঘ্য থেকে বোঝা গেল যে সে একটা চিতা। বাহাদুরের দুঃখ, ‘সাহেব, বড়ই আপসোসের কথা যে কমিশনার সাহেব এখন তার হাতিদের নিয়ে দশ মাইল দূরে; কারণ তরাই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় চিতা হল এটা,–শিকারের যোগ্য প্রাণী। শিকারের যে যোগ্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উইন্ডহ্যাম আর তার দলবল দশ মাইল দূরে থাকলেও আমি ঠিক করলাম আমিই, একবার চেষ্টা করে দেখব, কারণ চিতাটা এক গোশালার দিক থেকে আসছে আর এ সময়ে যখন সে এই ফাঁকা জায়গাটায় ঘুরছে ফিরছে তা থেকে প্রমাণ হয় যে গতরাত্রে সে সেখানে কোনো প্রাণী মেরেছে। ঘাস-বনে আগুন লাগিয়ে চিতাটাকে তাড়িয়ে আনবার মতলব বাহাদুরকে জানাতে সে বললে সে আমায় সাহায্য করতে প্রস্তুত। কিন্তু আমার সাফল্য সম্বন্ধে সে সন্দিহান রইল। প্রথমে দেখতে হবে ঘাস-জমিটা কত বড়; তাই রাস্তা থেকে নেমে আমরা খানিকটা ঘুরে গেলাম। দেখলাম, জমিটার দশ একরের মত আয়তন, একটা দিক শঙ্কু আকৃতির,–গরুর গাড়ির পথটা শঙ্কুর ভূমি ধরে গেছে।

বাতাস ছিল আমাদের অনুকূলে; তাই পথ থেকে প্রায় দুশো গজ দূরে ঘাস-জমিটার অপর প্রান্তে পৌঁছে আমি দু-গাছা ঘাস কেটে নিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে বাহাদুরের হাতে দিয়ে বললাম ডান দিকের ঘাস-বনের আগুন দিতে, আর আমি নিজে বাঁ দিকের হোগলা-বনে আগুন লাগালাম। এই ঘাস বার ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়, আর জ্বালানী কাঠের মত শুকনো খটখটে হয়ে থাকে। ফলে আগুন লাগাবার এক মিনিটের মধ্যেই ভয়ঙ্করভাবে জ্বলতে শুরু করল। দৌড়ে গিয়ে পথের উপর শুয়ে পড়লাম, তারপর ২৭৫ রিগবি রাইফেলটা কাঁধে নিয়ে রাস্তাটার ওপারে একটা সুবিধেমত উঁচু জায়গা বেছে নিলাম যেখান থেকে গুলি করলে রাস্তার দিকে ধেয়ে আসা চিতাটার গায়ে লাগতে পারে। ঘাস-বন থেকে আমার দূরত্ব দশ গজের মত, আর চিতাটা যেখানে ঢুকেছে সে জায়গাটা আমার থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে। রাস্তাটা দশ ফুট চওড়া। চিতাটাকে গুলি করার একমাত্র সুযোগটা আসবে যে মুহূর্তে আমি সেটাকে দেখতে পাব, কারণ আমি জানি একেবারে শেষ মুহূর্তে সে রাস্তাটা পার হবে, প্রচণ্ড বেগে। বাহাদুরের কোনো আঘাতের আশঙ্কা নেই কারণ তাকে নির্দেশ দিয়েছি ঘাসে আগুন দিয়েই রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা দূরের একটা গাছে উঠে পড়তে।

অর্ধেকটা ঘাস-বন পুড়ে গেল,–আগুনের গর্জন যেন কোনো সেতুর উপর দিয়ে ধাবমান এক্সপ্রেস ট্রেনের গর্জন। হঠাৎ দেখি আমার ডান কাঁধের কাছে মানুষের একটা খালি পা। তাকিয়ে দেখি একটা লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে–পোশাক দেখে বুঝলাম সে এক মুসলমান গাড়োয়ান, হয়তো কোনো হারানো গরুর খোঁজ করছে। আমি তাকে টেনে আমার কাছে নামিয়ে আল্লাম, তারপর তার কানে চিৎকার করে বললাম, একেবারে চুপচাপ আমার কাছে শুয়ে পড়তে, আর পাছে সে আমার কথা না শোনে তাই আমার একটা পা তুলে দিলাম তার শরীরের উপর। এগিয়ে আসছে আগুন। যখন ঘাস-বন আর মাত্র পঁচিশ গজের মত অবশিষ্ট, এমন সময় চিতাটা তীরবেগে রাস্তাটা পার হল। আমি ঘোড়া টিপতেই তার ল্যাজটা উঁচু হয়ে উঠল। পথের বাঁ দিকে ঘাস কদিন আগেই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। পোড়া আঁটির যে বনে চিতাটা অদৃশ্য হয়ে গেল, তাতে আমার গুলির পরিণাম বুঝতে সুযোগ পেলাম না। অবশ্য যেভাবে তার ল্যাজটা উপর দিকে উঠে গেল তাতে আঘাত যে মারাত্মক হয়েছে এ-বিষয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে আমি লাফিয়ে উঠলাম, শক্ত করে লোকটার হাত ধরে এক ঝটকায় তাকে দাঁড় করিয়ে দিলাম, তারপর তাকে নিয়ে সেই রাস্তা ধরে ধোঁয়ার ঘন মেঘের ভিতর দিয়ে দৌড়তে লাগলাম; ধাবমান আগুনের শিখা আমাদের মাথার উপর ভয়ঙ্কর হয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে। চিতাটা যখন আমার চোখে পড়ল তখন আমরা প্রায় তার উপর গিয়ে পড়েছি। অসহ্য উত্তাপে একটুও সময় নষ্ট না করে আমি ঝুঁকে পড়লাম, তারপর লোকটার একটা হাত চিতাটার ল্যাজের উপর দিয়ে আমার নিজের হাত দিয়ে সে হাতটা চেপে ধরলাম। তারপর আগুনের কাছ থেকে সেটাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে যেই টানতে শুরু করেছি অমনি মহা আতঙ্কের সঙ্গে শুনলাম, চিতাটা ক্রুদ্ধ গর্জন করে উঠল। ভাগ্য ভাল যে আমার গুলি তার কঁধ ভেদ করে বেরিয়ে গিয়ে তাকে অবশ করে দিয়েছিল; পঞ্চাশ গজের মত টেনে আনতে আনতে মারা পড়ল চিতাটা। হাতটা ছেড়ে দিতেই লোকটা এক লাফে এমনভাবে আমার কাছ থেকে পালাল, যেন আমি তাকে কামড়ে দিয়েছি। তারপর পাগড়িটা মাথা থেকে খুলে যে দৌড় সে দৌড়ল কোনো গাড়োয়ান কখনো তেমন দৌড়য় নি। পাগড়িটা তার পেছনে লুটোতে লুটোতে চলল।

আমার বন্ধুটি যখন ওর গন্তব্য স্থানে পৌঁছয় (জানি না সে কোথায়) তখন সেখানে উপস্থিত ছিলাম না বলে আমার আপসোস হচ্ছে। গল্প বলায় ভারতীয়েরা অত্যন্ত ওস্তাদ, সুতরাং, এক পাগল ইংরেজের কবল থেকে তার উদ্ধার পাওয়ার এই কাহিনী নিশ্চয়ই রীতিমত উপভোগ্য হয়েছিল। গাছের উপর থেকে বাহাদুর সমস্ত ঘটনাটা প্রত্যক্ষ করেছিল। আমার কাছে এসে সে বললে, বহু বছর ধরে লোকটা এখন গল্পের আসর জমিয়ে রাখবে। কিন্তু ওর গল্প কেউ বিশ্বাস করবে না।

এ-হেন ভয়ঙ্কর প্রাণীর কাছে এগিয়ে গিয়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে গুলি করার মত পরিস্থিতি না থাকলে সাধারণত হাতির, না হয় লোকজনের সাহায্যে কিংবা এই দুই উপায়ই একসঙ্গে অবলম্বন করে তাকে বন থেকে তাড়িয়ে বার করা হয়ে থাকে। এ-হেন উপায়ে শিকার তাড়িয়ে আনার তিনটি অভিজ্ঞতা আমার মনে স্পষ্ট হয়ে . আছে যা লিপিবদ্ধ করার যোগ্য। আর কিছু না হক শুধু এই কারণে যে, দুটি ক্ষেত্রে মানুষের সংখ্যা ছিল যথাসম্ভব অল্প, আর তৃতীয় অভিজ্ঞতার কথা চিন্তা করলে আজও আমার হৃদস্পন্দন আটকে আসে।

প্রথম বীট

আমাদের শিকারী কুকুর রবিনকে নিয়ে আমি একদিন সকালে দাবানল-পথ ধরে বোর নদীর পুলের পশ্চিমে আধমাইলটাক অগ্রসর হয়েছি, রবিন চলেছে আমার আগে-আগে। এই চলা-পথে খানিকটা এগোতে এক জায়গায় ঘাস ছোট-ছোট হয়ে গেছে, সেখানে পৌঁছে সে থেমে দাঁড়াল; ঘাস শুকল, তারপর মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল। তার কাছে গিয়ে কোনো থাবার ছাপ পেলাম না; তাই আমি তাকে ইঙ্গিতে বললাম গন্ধ অনুসরণ করে এগোতে। তখন সে দৃঢ়ভাবে বাঁ দিকে ফিরল, তারপর পথের ধারে যেখানে একটুকরো ঘাসজমি আছে সেখানে পৌঁছে একটা ঘাসের কাছে নাকটা একবার উপরে আর একবার নিচে করে শুঁকে নিয়ে চকিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল,–যেন বলতে চায়, সে ঠিকই ধরেছে, তার ভুল হয় নি। তারপর সেখানকার আঠার ইঞ্চি উঁচু ঘাস-বনের মধ্যে ঢুকল। গন্ধ অনুসরণ করে এক ফুট এক ফুট করে সে এগোতে লাগল। এভাবে একশো গজ মত অগ্রসর হবার পর একটা স্যাঁতসেঁতে নিচু জায়গায় পৌঁছে দেখলাম যে সে একটা বাঘের পিছু নিয়েছে। এই জায়গাটার ওপারে পৌঁছে রবিন খুব মনোযোগের সঙ্গে একটুকরো ঘাস পরীক্ষা করে দেখল। ঝুঁকে পড়ে দেখলাম খানিকটা রক্ত সে আবিষ্কার করেছে। অন্য শিকারীর গুলিতে আহত প্রাণী দেখে আমার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে কোনো বাঘের চলা-পথে রক্ত দেখলেই আমি সন্দিগ্ধ হয়ে পড়ি। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপারটা অনেকটা সহজ, কারণ এ রক্ত খুব টাটকা, এবং আজ সকালে যখন এ অঞ্চলে কোনো বন্দুকের শব্দ শোনা যায় নি তখন আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে বাঘটা নিশ্চয় তার কোনো শিকারকে বয়ে নিয়ে চলেছে–হয়তো কোনো চিতল, কিংবা কোনো বড় শুয়োর হয়তো। আর কয়েক গজ এগোতে লম্বায় চওড়ায় পঞ্চাশ গজ একটা ঘন ক্লেরোডেনড্রনের ঘন ঝোঁপ দেখা গেল; সেখানে পৌঁছে রবিন থেমে দাঁড়িয়ে এবার আমার নির্দেশের অপেক্ষায় রইল।

নরম মাটিতে থাবার ছাপ থেকে আমি বাঘটাকে চিনতে পেরেছিলাম। এই প্রকাণ্ড বাঘটি বোর নদীর ওপারের ঘন ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে বাস করছিল। তিন মাস আগে যখন আমরা পাহাড় থেকে নেমে আসি বাঘটা তখন থেকেই আমার প্রচুর দুর্ভাবনার কারণ হয়েছে। যে দুটো রাস্তা আর দাবানল পথ ধরে ম্যাগি আর আমি সকালে বিকেলে বেড়াতাম এই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সেগুলো চলে গেছে। আমার অনুপস্থিতিতে বেড়াতে বেরিয়ে ম্যাগি আর রবিন বহুবার এই বাঘের সাক্ষাৎ পেয়েছে এবং ক্রমেই যেন বাঘটা ওদের পথ ছেড়ে দিয়ে সরে যেতে নারাজ হয়ে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থা হয়েছে যে রবিন আর ম্যাগির পক্ষে এ-সব পথ নিরাপদ মনে হয় নি; তাই সে পুলের ওপারে যেতে সরাসরি আপত্তি করে। পাছে কোনোদিন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাই আমি ঠিক করেছিলাম প্রথম সুযোগেই বাঘটাকে গুলি করব, এবং এখন সে সুযোগ উপস্থিত। (যদি অবশ্য বাঘটা এখন তার মড়িকে নিয়ে ক্লেরোডেনড্রন ঝোপের মধ্যে শুয়ে থাকে)। রবিন বাঘটার পিছু নিয়েছিল যেদিক থেকে বাতাস বইছিল সেদিক থেকে অগ্রসর হয়ে; তাই অনেকটা ঘুরে আমি তার উল্টো দিক থেকে ক্লেরোডেনড্রন ঝোপটার দিকে অগ্রসর হলাম। যখন আর ত্রিশ গজ বাকি তখন রবিন থেমে দাঁড়াল। বাতাসে মুখ তুলল, মাথাটা কয়েকবার হেঁচকা দিয়ে উঁচু আর নিচু করল, তারপর ফিরল আমার দিকে। হুঁ! বাঘটা তাহলে ওখানেই আছে ঠিক। তখন আমরা আবার দাবানল-পথে ফিরে গিয়ে সেখান থেকে বাড়ির পথ ধরলাম।

প্রাতরাশের পর আমি বাহাদুরকে ডেকে পাঠালাম। তাকে বাঘটার কথা সমস্ত বলে আমি আমাদের দুই প্রজা, ধনবান ও ধর্মানন্দকে ডাকতে পাঠালাম। হুকুম তামিল করায় তারা অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য, গাছে ওঠার ব্যাপারে তারা বাহাদুরের আর আমার মতই পারদর্শী। বেলা দুপুর নাগাদ ওরা তিনজন খাওয়া-দাওয়া সেরে আমাদের কুটিরের সামনে এসে হাজির। প্রথমে পরীক্ষা করে দেখে নিশ্চিন্ত হলাম যে ওদের পকেটে এমন কিছু নেই যাতে শব্দ হতে পারে, তারপর ওদের জুতো খুলতে বললাম। একটা .৪৫০.৪০০ রাইফেল নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম ওদের সঙ্গে। কিভাবে জঙ্গল পেটা হবে সে সম্বন্ধে আমার পরিকল্পনা আমি ওদের বুঝিয়ে বললাম। এ জঙ্গল সম্বন্ধে ওদের জ্ঞান আমার চেয়ে কম নয়; তাই যখন বললাম বাঘটা কোথায় শুয়ে আছে আর আমি ওদের কি কাজের ভার দিচ্ছি, ওরা উৎসাহিত হয়ে উঠল। আমার মতলব হল ক্লেরোডেনড্রন ঝোপের তিন দিকে ওদের তিন জনকে তিনটে গাছে তুলে দেওয়া; যে যার জায়গায় থেকে তারা বাঘটাকে উত্তেজিত করবে আর আমি থাকব আর এক দিকে। বাহাদুর থাকবে মাঝের গাছটাতে, আর আমার ইঙ্গিত পেলে (ইঙ্গিতটা হবে চিতার ডাকের নকল) সে একটা গাছের ডালে শব্দ করতে থাকবে, আর বাঘটা যদি কোনো দিক দিয়ে পালাবার চেষ্টা করে তাহলে তার নিকটবর্তী গাছের লোক হাততালি দিতে থাকবে। সমস্ত ব্যাপারটার সাফল্যের জন্যে সবচেয়ে বেশি দরকার চরম নিস্তব্ধতা পালন করা কারণ প্রত্যেকের থেকেই বাঘটার দূরত্ব ত্রিশ থেকে চল্লিশ গজ পর্যন্ত; সুতরাং গাছের কাছে যাবার সময়ে, গাছে ওঠবার সময়ে বা সঙ্কেতের প্রতীক্ষায় থাকবার সময়ে, সামান্যতম শব্দেও মতলবটা পণ্ড হয়ে যাবে।

রবিন যে জায়গায় বাঘটার গন্ধ পেয়েছিল সেখানে পৌঁছে আমি ধনবান আর ধৰ্মানন্দকে সেখানে বসতে বললাম, আর বাহাদুরকে নিয়ে গিয়ে একটা গাছে উঠতে– বললাম। এ গাছটা হল ক্লেরোডেনড্রন ঝোঁপ থেকে কুড়ি গজ দূরে, আর যেখানে আমি নিজে দাঁড়াব ঠিক করেছিলাম তার উল্টোদিকে। তারপর আমি ওই দু-জনকে বাহাদুরের ডাইনে আর বাঁয়ে দুটো গাছে উঠতে বললাম। ওরা তিনজন যেমন পরস্পরের দৃষ্টিগোচর রইল তেমনি ক্লেরোডেনড্রনের ঝোপটাও ওদের প্রত্যেকেরই চোখে রইল এবং সেখানে একটা ঝোঁপ মাঝখানে থাকায় তারা তিনজনেই ছিল আমার দৃষ্টির অগোচরে। সবাই নিরাপদে এবং সম্পূর্ণ নিঃশব্দে গাছে ওঠার পর আমি দাবানল-পথে ফিরে গেলাম। সেখান থেকে একশো গজ মত এগোবার পর আর একটা দাবানল-পথ এই দাবানল-পথটাকে কেটে গেছে; এই পথটি একটা দিক দীর্ঘ অনুচ্চ পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে চলে গেছে, ক্লেরোডেনড্রন ঝোপটার পাশ দিয়ে। বাহাদুর যে গাছটায় ছিল তার পেছনে একটা সরু অগভীর দরিপথ পাহাড়টার পাশ দিয়ে চলে গেছে। এই দরিপথে শিকারী প্রাণীদের প্রচুর যাওয়া আসা ছিল এবং আমার স্থির বিশ্বাস যে বাঘটা তাড়া খেলে এই পথেই চলে যাবে। দরিপথের ডানদিকে, পাহাড়টার উপরে দশ গজ মত দুরে একটা বড় জামগাছ। বীট-এর (তাড়া করে জঙ্গলের প্রাণীকে বার করে আনা) পরিকল্পনাটা ঠিক করবার সময় আমি ভেবেছিলাম এই গাছটার উপর বসব, আর বাঘটা আমার পাশ দিয়ে দরিপথ ধরে যেতে গেলেই তাকে গুলি করব। কিন্তু এখন গাছটার কাছে এসে আমি দেখলাম যে এই ভারি রাইফেল হাতে করে আমি গাছে উঠতে পারব না। আশেপাশে তেমন আর কোনো গাছ না থাকায় আমি ঠিক করলাম মাটিতেই বসব। এই ঠিক করে আমি গাছটার গুঁড়ি থেকে শুকনো পাতাগুলো সরিয়ে সেখানে হেলান দিয়ে বসলাম।

চিতার ডাক ডাকার আমার উদ্দেশ্য ছিল দুটো। একটা হল, বাহাদুরকে যে শুকনো লাঠিটা দিয়েছি ইঙ্গিতটা পেয়ে সে সেটাকে দিয়ে গাছটার ডালে ঘা মেরে শব্দ করতে থাকবে, আর একটা উদ্দেশ্য, বাঘটার পক্ষে যে দাবানল-পথটা পেরিয়ে যাওয়া। নিরাপদ এ বিষয়ে তাকে আরও নিশ্চিন্ত করা, আর যদি বা তার মনে কোনো সন্দেহ থাকে যে তাকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে তাও দূর করা। মাটিতে আরাম করে বসবার পর আমি সেফটি ক্যাচটা ঠেলে রাইফেলটা কাঁধে তুলে নিলাম, তারপর চিতার ডাক ডেকে উঠলাম। কয়েক সেকেন্ড পর বাহাদুর শব্দ করতে লাগল। কয়েকবার মাত্র শব্দ করেছে, এমন সময় ঝোপটা ফাঁক হয়ে গেল, আর চমৎকার। একটা বাঘ সেখান থেকে বেরিয়ে দাবানল-পথের উপর এসে দাঁড়াল। দশ বছর ধরে আমি সিনেমার ক্যামেরায় একটা বাঘের ছবি তোলার চেষ্টা করে আসছি, এবং বাঘের দেখা বহুবার পেলেও মনের মত ছবি কিন্তু একবারও তুলতে পারি নি। আর এখন এই ফাঁকা জায়গায়, আমার থেকে মাত্র কুড়ি গজ তফাতে বাঘটা, মাঝখানে একটা গাছের পাতায় বা এতটুকু ঘাসে পর্যন্ত কোনো কাপন নেই। বাঘের চমৎকার শীতের চামড়া রোদে ঝলমল করছে। এ-হেন একটা বাঘের ছবি তোলার জন্যে আমি যে-কোনো জায়গায় যেতে বা আমার যা কিছু তাই দিতে প্রস্তুত। অনেকবার এমন হয়েছে যে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনো বা দিনের পর দিন কোনো জন্তুর পিছু নিয়ে চলেছি, তার পরে সুযোগ পেয়ে বন্দুক তুলেছি, ভাল করে লক্ষ্য স্থির করে বন্দুক নামিয়েছে, তারপর প্রাণীটির দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্যে হ্যাটটা তুলে ধরেছি, আর গভীর তৃপ্তির সঙ্গে লক্ষ করেছি তার লাফাতে লাফাতে পালিয়ে যাওয়া। এ বাঘটাকেও অমনি ছেড়ে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমার মনে হল তা করলে অন্যায় হবে। ম্যাগি বা শের সিং বা যে সব ছোট ছোট ছেলে জঙ্গলে গরু ভেড়া চরাত বা গ্রামের যে সব স্ত্রীলোক যে সব ছোট ছোট ছেলে জঙ্গলে গরু ভেড়া চরাত বা গ্রামের যে সব স্ত্রীলোক আর ছেলেমেয়েরা শুকনো কাঠ কুড়োতে আসত কেবলমাত্র তাদের কথা চিন্তা করেই নয়, যেরকম ভয়ঙ্করভাবে বাঘটা চলা-ফেরা করত, তাতে যদিও সে তখন পর্যন্ত কোনো মানুষ মারে নি, যে-কোনো সময়ে তেমন বিপদ ঘটে যাবার সম্ভাবনা ছিল।

দাবানল-পথের উপর এসে পৌঁছে বাঘটা দু-এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে একবার ডাইনে আর একবার বাঁয়ে তাকাল, তারপর কাঁধের উপর দিয়ে তাকাল যেদিকে বাহাদুর ছিল সেদিকটায়। তারপর সে অলসভাবে রাস্তাটা পার হয়ে দরিপথের বাঁ দিক দিয়ে উপরে উঠতে লাগল। ক্লেরোডেনড্রন ঝোপের ফাঁক দিয়ে সে যখন বেরোয় তখন থেকেই আমার চোখ তার উপর ছিল; যে মুহূর্তে সে আমার সঙ্গে এক লাইন হল, আমি ঘোড়া টিপে দিলাম। আমার মনে হয় না সে গুলির শব্দটা পর্যন্ত শুনতে পেয়েছে, –তার পাগুলো পেটের নিচে কুঁকড়ে গেল, পেছন দিকে হটে সে আমার পায়ের কাছে এসে স্তব্ধ হয়ে গেল।

দ্বিতীয় বীট

জিন্দের মহামান্য মহারাজা মারা গেলেন। তার অনেক বয়স হয়েছিল, সকলের ভালবাসা তিনি পেয়েছিলেন। তার মৃত্যুতে ভারত তার একজন শ্রেষ্ঠ শিকারীকে হারাল। তাঁর রাজত্বের বিস্তার ছিল ১,২৯৯ বর্গমাইল আর তার লোকসংখ্যা ৩২৪, ৭০০। রাজস্বও উঠত চমৎকার। মহারাজার মত অমন সাদাসিধে মানুষ আমি আর দেখি নি। তার শখ ছিল শিকারী কুকুরদের শিক্ষা দেওয়া আর বাঘ শিকার করা, এবং এই দুটি ব্যাপারেই তার সমকক্ষ কেউ ছিল কি না সন্দেহ। প্রথম যখন তার সঙ্গে আলাপ হয় তখন তার চারশো কুকুর। বাচ্চা কুকুরগুলোকে শিক্ষা দেওয়ার সময়ে কিংবা পরে মাঠে খেলাবার সময়ে তার ধৈর্য ও যত্ন দেখে শিখবার মত, আমি মুগ্ধ হয়ে তাই দেখতাম। কেবলমাত্র একবার আমি মহারাজাকে গলার স্বর তুলতে বা কোনো কুকুরকে শাস্তি দিতে চাবুকের ব্যবহার করতে দেখেছি। সেদিন রাত্রে নৈশাহারের সময় মহারানী যখন জিজ্ঞাসা করলেন কুকুরগুলো ভালভাবে চলেছিল কি না, মহারাজা উত্তরে বললেন, ‘না, স্যাণ্ডি বড় অবাধ্য হয়েছিল, তাই তাকে একটু উত্তম-মধ্যম লাগাতে হয়েছিল।

মহারাজা আর আমি সেদিন পাখি শিকারে বেরিয়েছি। একটা প্রশস্ত ঘাসজমি আর ঝোঁপ জঙ্গল বীট করে মানুষ আর হাতি একসার হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এটার পরে প্রায় পঞ্চাশ গজ চওড়া খানিকটা জমি। মহারাজা আর আমি এই জমির অপর পারে কয়েক গজ তফাতে দাঁড়িয়ে,–আমাদের পিছনে ছোট ছোট ঘাসের জঙ্গল। মহারাজার বাঁ দিকে লাইনে বসে তিনটে অল্পবয়স্ক ল্যাব্রেডর কুকুর–তাদের মধ্যে স্যাণ্ডি সোনালী রঙের, বাকি দুটো কালো। একটা কালো তিতির ওরা তাড়িয়ে আনতে মহারাজা সেটাকে গুলি করে ফাঁকা জায়গাটার উপর নামালেন আর ওই কালো কুকুর দুটোর একটাকে পাঠালেন সেটাকে আনবার জন্যে। এরপর একটা বন-মোরগ আমার মাথার নিচ দিয়ে যাচ্ছিল, আমি গুলি করতে সেটা পিছনদিকের ঘাসজমিতে পড়ে গেল। এটাকে নিয়ে এল দ্বিতীয় কালো কুকুরটা। কয়েকটা বন-মোরগ উপরে উঠতে শুরু করেছিল, কিন্তু সামনের দিক থেকে দুটো গুলির আওয়াজ শুনে বাঁ দিকে মোড় ফিরে রাইফেলের পাল্লার বাইরে চলে গেল। তারপর একটা খরগোশ ঝোঁপ থেকে বেরোল, কিন্তু মহারাজাকে দেখেই নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা ডান দিকে আমার সামনে এসে পড়ল-মহারাজা তখন পিছন ফিরে একজন ভৃত্যের সঙ্গে কথা কইছিলেন। যখন খরগোশটা একেবারে নাগালের সীমানার কাছে চলে গেল তখন গুলি করলাম, কারণ অল্পবয়স্ক কুকুরের সামনে যেটুকু নিতান্ত দরকার তার বেশি শিকার করা উচিত নয়। গুলি খেয়েই প্রথমে উল্টে পড়ল খরগোশটা, তারপর আমাদের দুজনের সামনে দিয়ে মহারাজার ডানদিকে ত্রিশ গজটাক গিয়ে পড়ে গেল। সে পড়ে যেতেই সাণ্ডি তীরবেগে ছুটল। স্যাণ্ডি, স্যা-ডি!’ চিৎকার করলেন মহারাজা। কিন্তু স্যাণ্ডি কারুর কোনো কথাই শুনতে রাজী নয়। তার দুই সঙ্গী দুটো পাখি এনেছে, সুতরাং এবার নিশ্চয় তার পালা, কোনো বাঁধাই মানতে রাজী নয় সে। ছুটতে ছুটতেই সে খরগোশটাকে ধরল আর তেমনি ছুটতে ছুটতে এসে সেটা আমার হাতে দিল। তারপর মনিবের কাছে ফিরে গিয়ে বসল নিজের জায়গায়। তখন খরগোশটা নিয়ে আসার হুকুম পেতে, যেখানে আমি খরগোশটা রেখেছিলাম সেখান থেকে সেটাকে তুলে নিয়ে উঁচু করে স্যাণ্ডি মহারাজার কাছে গেল। কিন্তু মহারাজা তাকে দূরে চলে যেতে ইঙ্গিত করলেন–আরো আরো দূরে, ডানদিকে আরো দূরে,যতক্ষণ না যেখান থেকে সে খরগোশটা নিয়ে এসেছিল সেখানে পৌঁছচ্ছে। এখানে খরগোশটা রেখে তাকে ফিরে আসতে ইঙ্গিত করা হল। আবার স্যাণ্ডি তার মনিবের কাছে ফিরে এল,–তার ল্যাজ নিচু হয়ে গেছে, দু-কান ঝুলে পড়েছে। তখন আর-একটা কুকুরকে পাঠানো হল খরগোশটা নিয়ে আসতে। খরগোশটা আনা হলে মহারাজা বন্দুকটা একজন চাকরের হাতে দিলেন, তারপর তার হাত থেকে চাবুকটা নিয়ে এক হাতে স্যাণ্ডির হাতে দিলেন, তারপর তার হাত থেকে চাবুকটা নিয়ে এক হাতে স্যাণ্ডির ঘাড়ের পিছনটা ধরে প্রচুর প্রহার করলেন। প্রহারটা প্রচুর হল সন্দেহ নেই, কিন্তু স্যাণ্ডির উপর নয়,কারণ তার উপর আঘাত পড়ল না, দু-দিকে মাটির উপর। মহারাজা যখন স্যাণ্ডির অপরাধ আর তার শাস্তির কথা মহারানীকে বলছিলেন সেই সময় আমি এক ভৃত্যের কাছ থেকে কাগজ নিয়ে তাতে লিখলাম (কারণ মহারাজা ছিলেন একেবারে বধির), ‘স্যাণ্ডি বাহাদুর আজ আপনাকে অমান্য করেছে বটে, কিন্তু তবুও ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ কুকুর সে; দেখবেন শিকারী কুকুরদের পরবর্তী প্রতিযোগিতাতেই সে শ্ৰেষ্ঠস্থান অধিকার করবে। সেই বছরেই পরবর্তীকালে আমি একটা টেলিগ্রাম পাই, তাতে লেখা–’আপনি ঠিকই বলেছিলেন। স্যাণ্ডি প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে।

ক্রমেই দিন বড় হতে থাকল, রোদের তেজও বাড়তে লাগল, তাই একদিন খুব ভোরে বেরিয়ে পড়ে আমি দশ মাইল পথ হেঁটে যখন মোহনে মহারাজার তাঁবুতে এসে পৌঁছলাম ওঁরা তখন প্রাতরাশে বসেছেন। বড় ভাল সময়ে এসেছেন আমি টেবিলে বসতে তিনি বললেন, ‘কারণ আজই আমরা সেই বুড়ো বাঘটাকে মারতে চলেছি, তিন বছর ধরে সে আমাদের ফাঁকি দিয়ে আসছে। এই বাঘের কথা আমি অনেকবার শুনেছি, তাই আমি জানতাম একে বুদ্ধির খেলায় হারিয়ে গুলি করার ব্যাপারে মহারাজার কত উৎসাহ। তাই যখন মহারাজা তিনটে মাচানের সবচেয়ে ভালটায় আমায় বসতে বললেন এবং একটা রাইফেলও ধার দিলেন, আমি রাজি হলাম না, বললাম, তার চেয়ে বরং আমি দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করব। দশটার সময় মহারাজা, মহারানী, তাদের দুই মেয়ে আর এক বান্ধবী আর আমি গাড়ি করে, যে পথে আমি হেঁটে এসেছি সেই পথে চললাম যেখানে বন বীট করার জন্যে লোকজন আমাদের প্রতীক্ষায় রয়েছে।

যে জমিটা বীট করা হবে সেটা একটা উপত্যকা–পাহাড়ের পাদদেশে অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে, আর একটা ছোট নদী তার ভিতর দিয়ে এঁকে বেঁকে গেছে, তার দুই তীরে তিনশো ফুট উঁচু পাহাড়। এর নিচের দিকের সীমানায় যেখানে রাস্তাটা এটাকে কেটে চলে গেছে উপত্যকাটা সেখানে প্রায় পঞ্চাশ গজ চওড়া, তারপর আধ মাইল দূরে গিয়ে আবার সরু হয়ে পঞ্চাশ গজে দাঁড়িয়েছে। এই দুই জায়গার মাঝামাঝি নদী চওড়ায় তিনশো থেকে চারশো গজ পর্যন্ত, আর এখানে একরের পর একর এলাকা জুড়ে যে ঘন জঙ্গল, তারই আড়ালে, আগের দিন যে মোটা মেরেছে, সেটা নিয়ে বাঘটা লুকিয়ে আছে বলে আন্দাজ করা যাচ্ছে। এই উপত্যকার অন্য প্রান্তে পর্বতমালা থেকে একটা ছোট শৃঙ্গ বেরিয়ে ডান দিকে চলে গেছে, এই শৃঙ্গের উপরের একটা গাছে যেখানে মাচান বাঁধা হয়েছে সেখান থেকে উপত্যকাটা আর পাহাড়গুলোর দু-দিকের নিচু ঢালটা দেখা যায়। এই শৃঙ্গের ওপারে আর নদীটার পরপারে (নদীটা এখানে সোজা ডানদিকে মোড় ফিরেছে) ত্রিশ গজ তফাতে আরো দুটো মাচান তৈরি হয়েছে।

রাস্তার উপর গাড়ি রেখে আমরা পায়ে হেঁটে উপত্যকা ধরে অগ্রসর হলাম। সর্দার-শিকারী, আর যে সেক্রেটারিটি যারা বন বীট করছিল তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল, এদেরই নির্দেশে বাঘটাকে যেখানে আন্দাজ করা হয়েছে সেই জায়গাটার বাঁ দিকের জঙ্গল ধরে অগ্রসর হলাম আমরা। মহারাজা আর তার বন্দুকবাহক শৃঙ্গের মাচানটায় বসলে চারজন মহিলা আর আমি নদী পার হয়ে ওদিকের দুটো মাচান আশ্রয় করলাম।

সর্দার-শিকারী আর সেক্রেটারি তখন আমাদের ছেড়ে রাস্তায় গেলেন বন ঠেঙানো শুরু করতে।

যে মাচানে আমি আর দুই রাজকন্যা ছিলাম বেশ মজবুত করে বানানো সেটা, -পুরু কার্পেট আর সিল্কের কুশন তাতে। গাছের শক্ত ডালে বসতেই আমি অভ্যস্ত; তার জায়গায় ভোরে উঠে দীর্ঘ পথ চলা আর তার পরে মাচানের এই বিলাসিতা–আমার ঘুম এসে গেল। ঘুমিয়ে পড়তাম, এমন সময় দূর থেকে বিউগলের শব্দ শুনে আমি একেবারে সজাগ হয়ে উঠলাম। বুঝলাম বীট শুরু হয়েছে। বীটের জন্যে আছে দশটা হাতি, সেক্রেটারিরা, এ.ডি.সি.-রা মহারাজার বাড়ির কর্মচারীরা, সর্দার-শিকারী আর তার সহকারীরা, আর আশপাশের গ্রাম থেকে সংগৃহীত শ-দুই লোক। উপত্যকার ঘন গাছপালায় ছাওয়া মাটি হাতিরা পায়ে দলে আসবে; তাদের পিঠে রয়েছেন সেক্রেটারিরা ও আরো অনেকে, আর ওই দুশো লোক দু-দিকের ঢাল ধরে ঠেঙাতে ঠেঙাতে এগিয়ে আসছে। দুই শৈলশিরায় লাইন করে যারা বন ঠেঙাবে এদের কয়েকজন তাদের আগে-আগে যাবে, যাতে বাঘটা বেরিয়ে পড়তে না পারে।

সমস্ত ব্যবস্থা, আর এই বন ঠেঙানোর ব্যাপারটাও আমার কাছে অত্যন্ত কৌতূহলজনক হয়ে উঠেছিল, কারণ এমন একটা ব্যাপারে আমি আজ দর্শক যেখানে : আমি এ পর্যন্ত সর্বদাই অভিনেতার ভূমিকা নিয়ে এসেছি। ব্যবস্থাপনার বা ঠেঙানোর কাজে কোথাও কোনো ত্রুটি হল, সময়-নির্বাচনও হয়েছিল চমৎকার; মাচান পর্যন্ত আমাদের যাওয়াটাও হয়েছিল পরম নিঃশব্দে, আর ঠেঙানোর কাজ যে ভালভাবেই হচ্ছিল তার প্রমাণ, অসংখ্য পাখি, কালিজ, বন-মোরগ, ময়ুর সব উড়তে শুরু করেছিল। ঠেঙানো ব্যাপারটায় সব সময়েই প্রচুর উত্তেজনার খোরাক থাকে, কারণ যখনই দূর থেকে তোকজনের ডাকাডাকি শোনা যায়, ধরে নেওয়া যায় তখনই বাঘও চলতে শুরু করেছে। মহারাজা বধির বলে খানিকটা অসুবিধে ছিল বটে, কিন্তু তার পাশে একজন ওস্তাদ রয়েছে, দেখলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই লোকটি ইঙ্গিত করে ডানদিকে কি দেখিয়ে দিচ্ছে। দু-এক মুহূর্ত সেইদিকে তাকিয়ে থেকে মহারাজা ঘাড় নাড়লেন। একটু পরেই একটা পুরুষ-সম্বর নদী পেরিয়ে এল, আর মহারাজার গন্ধ পেয়েই আমাদের পাশ দিয়ে সবেগে উপত্যকা ধরে পালিয়ে গেল।

শৈলশিরার বাঁদিকে যারা লাইন করে অগ্রসর হচ্ছিল এখন তারা দৃষ্টিগোচর হল, বাঘটার বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে এবার। এগিয়ে এল ঠেঙিয়ের দল চেঁচিয়ে, হাততালি দিয়ে সবাই যোগ দিল তাতে। এক গজ এক গজ করে যতই তারা অগ্রসর হতে লাগল, আমার মনে হল যে মহারাজার গুলি করার সম্ভাবনা ততই কমে যাচ্ছে, কারণ কোনো পাখির বা কোনো পশুর কোনো সতর্কতাসূচক আওয়াজ আমার কানে এল না। আমার মাচানের সঙ্গিনীরা নিস্পন্দ হয়ে রয়েছে, মহারাজা রাইফেল উদ্যত করে রয়েছেন কারণ বাঘটা এখন বেরিয়ে এলে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে গুলি করতে হবে। কিন্তু দেখা গেল রাইফেল আজ কোনো কাজেই লাগবে না, কারণ বাঘটাই নেই এ অঞ্চলে। মই লাগানো হল, অত্যন্ত হতাশার সঙ্গে সবাই নেমে এলেন মাচান থেকে। নেমে এসে যাদের সঙ্গে মিলিত হলেন তাদের হতাশা আরও বেশি। ঠেঙিয়েদের মধ্যে কেউ বাঘের দেখা পায় নি, তারা বুঝল না কোথায় কী গলদ হয়েছে। তবে, কোথাও যে একটা কিছু ভুল হয়েছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে, কারণ গাড়ি করে এসে পোঁছবার অল্প আগেই উপত্যকা থেকে বাঘের আওয়াজ শোনা গেছে। আমার মনে হচ্ছে আমি আন্দাজ করতে পারছি কেন আমাদের ব্যর্থ হতে হল; কিন্তু আমি আজ দর্শক মাত্র, তাই আমি কোনো কথাই বললাম না। বনভোজন সেরে তাবুতে ফিরলাম আমরা। সবাই যখন বিশ্রাম করছে আমি তখন কোশী নদীতে গিয়ে মাছ ধরলাম। সন্ধ্যাটা চমৎকার কাটল, কারণ এপ্রিলের শেষ, মাছ ধরার সেরা সময়।

নৈশভোজে বসে এবং নৈশভোজের পরেও, সেদিনকার ব্যর্থতার আর ওই বাঘের জন্যই আগের পাঁচটা বীটের ব্যর্থতার খুঁটিনাটি আলোচনা করা হল এবং তার কারণ অনুসন্ধান করা হল। প্রথমবার যখন এই বাঘটারই সন্ধানে বীটের ব্যবস্থা হয় বাঘটা তখন মহারাজার মাচানের ডান দিকে দেখা দেয় এবং মোটেও না নড়তে পারার ফলে মহারাজা যে গুলি করেন তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এর পরের বীটগুলি অনুষ্ঠিত হয় পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে। কোনোবারই দেখা যায় নি বাঘটাকে, যদিও বীট শুরু হবার সময় সে সেখানে ছিল বলে জানা গেছে। আর সকলে তখন কথাবার্তা বলছে, কাগজে লিখে মহারাজাকে দেখাচ্ছে। আমি কেবল ভাবছি। মহারাজা ভাল শিকারী, সুতরাং যদি আমি বাঘটা মারার ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে পারি তো সে চেষ্টা আমার করা উচিত। ভুল হয়েছে সেদিন, যেখানে বাঘটা আছে বলে ধরে নেওয়া হয়েছে সে-জায়গার সামনে দিয়ে মহারাজার সদলবলে যাওয়া; কিন্তু বীটের অসাফল্যের কারণ সেটা হতে পারে না, কারণ বীট যে সময়ে শুরু হয় প্রায় সেই সময়েই বাঘটা চলে যায় ওখান থেকে। মোটর গাড়ি থেকে নামবার কিছুক্ষণ পরে কাকার হরিণটার যে সাবধান-বাণী শোনা গিয়েছিল, তা থেকেই এই সন্দেহটা আমার মনে জেগে ওঠে। পরে যখন জানা গেল যে বীটের জঙ্গলে বাঘ নেই তখন আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম জঙ্গল থেকে বেরোতে হলে বাঘটার মাচানের সামনে দিয়ে ছাড়া পালাবার আর কোনো পথ ছিল কি না। মাচানগুলোর পিছন দিককার। শৈলশিরা থেকে শুরু হয়ে একটা ধস একেবারে উপত্যকার নিচে পর্যন্ত চলে গেছে। এই ধসের উপরটা থেকে ডেকে উঠেছিল কাকারটা, বাঘটা সেখানে তার মড়ি রেখেছিল এখান থেকে সেই জায়গা পর্যন্ত যদি কোনো পশু-চলার পথ থাকে তাহলে হয়তো প্রতিবারেই বীটের ব্যবস্থার সাড়া পেয়ে বাঘটা এই পথ ধরে উপত্যকা থেকে বেরিয়ে গিয়ে থাকবে।

সবাই যখন কথাবার্তায় ব্যস্ত সে সময়ে এই মতলবটা আমার মাথায় ঘুরছিল যে কাকারটা যেখানে ডেকে উঠেছিল মহারাজাকে শৈলশিরার উপর সেখানে থাকতে বলা, আর বাঘটাকে তাড়িয়ে সেখানে নিয়ে যাওয়া। ঠিক পরের দিনই আবার বাঘটার জন্যে বীটের ব্যবস্থা করার কথায় সবাই আপত্তি করে উঠল, এই যুক্তিতে যে, টাটকা টোপেই যখন বাঘটা এল না তখন বাসি টোপে তাকে পাওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই। তবে, আমার মতলব যদি ব্যর্থও হয় তাহলেও ক্ষতি নেই, কারণ সেদিনের জন্যে কোনো ব্যবস্থাই করতে হবে না। এক সেক্রেটারির কাছ থেকে কাগজ নিয়ে আমি লিখলাম, ‘কাল যদি ভোর পাঁচটার সময় আপনি প্রস্তুত থাকতে পারেন তাহলে এই বাঘটার জন্যে একটা একক বীটের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। চিঠিটা মহারাজাকে দিতে তিনি সেটা পড়ে তার সেক্রেটারিকে দিলেন, তারপর সেটা হাতে হাতে সমস্ত ঘরে ঘুরতে লাগল। আমি আপত্তির আশঙ্কা করেছিলাম, এখন উঠল সে আপত্তি। কিন্তু যখন তারা দেখলেন মহারাজা মতলব-মত কাজ করতে রাজী তখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও সমস্ত কেতার কথা ভুলে রাজী হলেন এবং মাত্র দু-জন বন্দুকবাহকের সঙ্গে মহারাজার শিকার-যাত্রায়ও আপত্তি করলেন না।

ঠিক পাঁচটার সময় মহারাজা, দু-জন বন্দুকবাহক আর আমি তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়লাম। মোটরে করে গেলাম যেখানে হাতিটা একটা ছোট মাচান নিয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। মহারাজাকে আর বন্দুকবাহকদের হাতিতে তুলে দিয়ে আমি পায়ে হেঁটে সেই সম্পূর্ণ অজানা বনপথ ধরে মাইলের পর মাইল পথ দেখিয়ে নিয়ে চললাম। সৌভাগ্যবশত আমার দিকজ্ঞানটা ছিল ভাল, তাই অন্ধকারের মধ্যে বেরোলেও আমি মোটামুটি সিধে পথ ধরেই নিয়ে গেলাম। সূর্য যখন উঠছে আমরা তখন শৈলশিরায় যথাস্থানে পৌঁছে গেছি। এখান থেকে উপত্যকা পর্যন্ত একটা প্রাণী-চলার পথ দেখে আমি অত্যন্ত খুশি হলাম,-বোঝা গেল এ-পথে বেশ পশুর যাতাযাত আছে। এই পথের কাছে একটা গাছের উপর মাচান বাঁধলাম। মহারাজা আর একজন বন্দুকবাহক মাচানে উঠলে আমি হাতিটাকে ফেরত পাঠালাম, তারপর অপর বন্দুকবাহককে নিয়ে গিয়ে শৈলশিরা বরাবর খানিক দূরের একটা গাছে তুলে দিলাম। তখন আমি গেলাম একাই বাঘটাকে বীট করতে।

উপত্যকাটা ওখান থেকে অত্যন্ত খাড়া নেমে গেছে,–যেমন খাড়া তেমনি রুক্ষ। কিন্তু সঙ্গে রাইফেলের বালাই না থাকায় নিরাপদে নেমে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হল। গতদিনের মাচানগুলো নিঃশব্দ পায়ে অতিক্রম করে, যে ঘন ঝোপটার আড়ালে বাঘটাকে আন্দাজ করা হয়েছিল সেটাও পার হয়ে আরও দুশো গজ এগিয়ে গেলাম। এবার আমি ফেরার পথ ধরলাম, আর যেতে যেতে নিচু গলায় নিজের সঙ্গে কথা কইতে লাগলাম। যে জায়গাটায় বাঘটা মোষটাকে টেনে নিয়ে আসে সেখানে একটা বড় কাটা গাছ রয়েছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে আমি এই গাছটার উপর বসলাম, –এই আশায়, যদি জঙ্গল থেকে কোনো খবর মেলে। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দই মিলল না। তখন কয়েকবার কেশে আর কয়েকবার গাছের ফাঁকা গুঁড়িতে জুতো দিয়ে শব্দ করে আমি গেলাম মড়িটার সন্ধানে, বাঘটা সেখানে ফিরে এসেছে কি না দেখতে। দেখলাম বাঘটা মড়িটাকে একটা ঘন ঝোপের মধ্যে টেনে নিয়ে গেছে আর মাত্র কয়েক মিনিট আগে তা থেকে খানিকটা খেয়ে ফেলেছে, আর যেখানে সে শুয়ে ছিল সে জায়গাটা তখনও গরম হয়ে রয়েছে। দৌড়ে গাছটার কাছে ফিরে গিয়ে আমি একটা পাথর নিয়ে সেটাকে ঠুকতে লাগলাম আর প্রাণপণে চিৎকার করতে লাগলাম, যাতে মহারাজার সঙ্গী বন্দুকবাহক বুঝতে পারে যে বাঘ আসছে। দু-এক মিনিটের মধ্যেই একটা বন্দুকের আওয়াজ আমার কানে এল। শৈলশিরায় পৌঁছে দেখলাম মহারাজা পশু-চলার পথটার উপর দাঁড়িয়ে–আর যে চমৎকার বাঘটা তিনি মেরেছেন সেটার দিকে তার দৃষ্টি নিবন্ধ।

জিন্দের প্রাসাদে, এখন সেটা মহারাজার জ্যেষ্ঠ পুত্রের দখলে, একটা চামড়া আছে, তার নিচে লেখা–’জিমের বাঘ’, আর স্বর্গত মহারাজার শিকারের বইয়ে একটা উদ্ধৃতি আছে যাতে এই বৃদ্ধ বাঘ শিকারের তারিখ, স্থান আর যেভাবে তাকে মারা হয়েছে তার বিবরণ দেওয়া আছে।

তৃতীয় বীট

এক স্মরণীয় শিকার-অভিযানের শেষ দিন সেটা। স্মরণীয় কেবল আমরা যারা এতে যুক্ত ছিলাম তাদের পক্ষেই নয়, দেশের শাসকদের পক্ষ থেকেও বটে, কারণ একজন বড়লাট ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম চিরাচরিত রীতির ব্যতিক্রম ঘটিয়ে কালাধুঙ্গির জঙ্গলে কয়েকটা দিন কাটাবার জন্যে এসেছিলেন।

ভারতের বড়লাটের সমস্ত চলাফেরাই সাবেকী প্রথার কড়া নিয়মে বাঁধা। নিয়মের এমন শক্ত আঁটুনি মেনে আর কোনো ব্যক্তিকেই চলাফেরা করতে হয় না। এই নিয়মে কোনোদিন বিচ্যুতি ঘটতে পারে, এমন কথা কেউ কোনোদিন ভাবে নি, তাই কোন বিকল্প নীতির প্রয়োজনও কখনও অনুভূত হয় নি। ফলে এদেশের বড়লাটের দায়িত্বভার গ্রহণে অব্যবহিত পরেই লর্ড লিনলিথগো যখন পূর্বসূরীদের বাঁধা পথ ছেড়ে নিজে নতুন পথ বেছে নিলেন, তখন স্বভাবতই সারা দেশে বিস্ময়ের সীমা রইল না। দিল্লীতে আইন-দপ্তর বন্ধ হয়ে সিমলায় দপ্তর খোলার মাঝে যে দশ দিন, এ সময়টা ভারতের বড়লাট দক্ষিণ ভারত পরিক্রমায় কাটাতেন। বহু বছরের এই রেওয়াজে ব্যতিক্রম ঘটায় সরকারী দপ্তরে যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় তা দীর্ঘকাল মানুষের মনে থাকবে।

আমি সাধারণ মানুষ, সরকারের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগই ছিল না; প্রশাসনের কল কেমন করে প্যাঁচে প্যাঁচে ঘঘারে, সে বিষয়ে বিপুল অজ্ঞতা নিয়ে দিব্যি ছিলাম। এহেন অবস্থায় মার্চ মাসের শেষের দিকে একদিন আমি আমাদের কালাধুঙ্গির কুটির থেকে রাত্রের রান্নার জন্যে মাছ ধরতে বেরোচ্ছি, এমন সময় পিয়ন রাম সিং একটা টেলিগ্রাম নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে হাজির। দু মাইল দূরে ডাকঘর, থেকে আমাদের দৈনিক ডাক নিয়ে আসা ছিল তার কাজ। পোস্টমাস্টার তাকে বলে দিয়েছেন এটা নাকি খুব জরুরী। নৈনিতাল ঘুরে টেলিগ্রামটা কালাধুঙ্গিতে এসেছে, পাঠিয়েছেন বড়লাটের সামরিক সচিব হিউ স্টে। সচিব লিখেছেন বড়লাটের দক্ষিণ ভারত সফর বাতিল হয়ে গেছে, তিনি জানতে চেয়েছেন এমন কোনো জায়গার আমি নাম করতে পারি কি না যেখানে বড়লাট গ্রীষ্মের জন্য সিমলা যাবার আগে এই দশ দিন কিছু শিকার পেতে পারেন। তাড়াতাড়ি উত্তর দেবার অনুরোধ জানিয়ে টেলিগ্রামটা শেষ হয়েছে–সময় যেমন কম, ব্যাপারটাও তেমনি জরুরী। রাম সিং ইংরেজি বলতে পারত না, কিন্তু ত্রিশ বছর আমাদের কাজ করে সে এখন ইংরেজি বুঝতে পারত। আমি টেলিগ্রামটা ম্যাগিকে পড়ে শোনালাম, আশেপাশে টুকিটাকি কাজ করতে করতে রাম সিং ব্যাপারটা বুঝে নিল। তারপর বললে কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে খাওয়া সেরে এসে আমার উত্তর নিয়ে হলদোয়ানি চলে যাবে। হলদোয়ানি হল আমাদের সবচেয়ে কাছের তার ও টেলিফোন দপ্তর,-কালাধুঙ্গি থেকে চোদ্দ মাইল দূরে। যে ডাক-হরকরা নিয়মিত ডাক নিয়ে যায় তাকে দিয়ে না। পাঠিয়ে আমি রাম সিংকে দিয়ে আমার উত্তর পাঠিয়ে দিলাম,এতে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা সময় বাঁচল। আমি হিউ স্টেবলকে বার্তা পাঠালাম–কাল বেলা এগারোটায় হলদোয়ানিতে আমায় টেলিফোন করুন। রাম সিং চলে যাবার পর আমি আবার ছিপটা হাতে তুলে নিলাম, মাছ ধরতে ধরতেই ভাবা যাবে, আর ভাবনাও অনেক। তা ছাড়া রাত্রের জন্যে মাছ ধরাও দরকার। হিউ স্টেলের টেলিগ্রামটা স্পষ্টই গুরুতর বিপদ-সঙ্কেতের সামিল,–আমার সামনে এখন প্রশ্ন–তাকে সাহায্য করতে আমি কী করতে পারি?

কোটা রোড ধরে মাইল-দুই অগ্রসর হয়ে আমি পৌঁছলাম আমাদের গোলাবাড়ির সীমানার কাছে যেখানে আমি নিতান্ত ছেলেবেলায় আমার প্রথম চিতা শিকার করি। সেখান থেকে বাঁক নিয়ে নদীর বুকে একটা জলাশয়ে গিয়ে উপস্থিত হলাম–এখানে একটা দেড়সেরী মহাশোল মাছ ছিল বলে জানতাম। জলাশয়ের কাছে আসতে একটা বাঘের থাবার ছাপ আমার চোখে পড়ল,-বাঘটা সেদিন সকালে নদী পার হয়ে চলে গেছে। এই জলাশয়ের মাথায় যেখানে স্রোত প্রবল আর জল গভীর, তিনটে বড়-বড় পাথর সেখানে জল থেকে এক ফুট উঁচু হয়ে রয়েছে। এই পাথরগুলি জল-কাদায় সর্বদা সিক্ত, এবং তার ফলে বরফের মত পিচ্ছিল। এই পাথরগুলোর উপর দিয়ে চিতারা নদী পার হয়। যে বাঘটার থাবার ছাপ এখন বালিতে দেখা যাচ্ছে একদিন সেই বাঘটাও সেইভাবে নদী পার হবার চেষ্টা করেছিল আমি দেখেছিলাম। সেদিন আমি। এক মাইল পথ ওই বাঘটার পিছু পিছু গিয়েছিলাম, তার অজানতেই দু-দুবার আমি তাকে রাইফেলের পাল্লার মধ্যে পেয়েছিলাম, কিন্তু দু-বারই গুলি করতে নিবৃত্ত হয়েছিলাম, কারণ তাকে যে একেবারে মেরে ফেলতে পারব এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারি নি। তারপর যখন দেখলাম সে নদীর দিকে চলেছে, আমি কেবল তাকে চোখে চোখে রেখেছিলাম, কারণ আমি জানতাম যে পার হবার সময় তাকে ঠিকভাবে গুলি করার সুযোগ পাব। কিন্তু আমি দেখলাম সে জলে না নেমে পাথর থেকে পাথরে পা দিয়ে শুকনো পায়ে নদীটা পার হতে চাইছে। এতে আমার সুবিধেই হল, কারণ নদীতে পৌঁছতে হলে কুড়ি ফুট নিচু একটা ঢাল আছে, সেখান দিয়েই ওকে নেমে যেতে হবে। তাই যখন সে নিচে নেমে যাবার জন্যে ঢালের উপরটায় পৌঁছল আমি দৌড়ে গিয়ে পাড়ের উপরে পোঁছে শুয়ে পড়লাম।

পাথর তিনটের মধ্যে যা দূরত্ব তা কোনো অলিম্পিকের প্রতিযোগী অনেকটা দৌড়ে আসার জায়গা পেলে হ-স্টেপ-জাম্প করে পার হতে পারে। চিতাদের আমি দেখেছি কমনীয় তিনটি লাফে এই দূরত্ব পেরিয়ে যেতে। পাড়ের উপর থেকে মুখ বাড়িয়ে আমি দেখলাম, প্রথম লাফটা ঠিকভাবে নিয়ে দ্বিতীয়টির বেলায় কিন্তু বাঘটা গোলমাল করে ফেলল, পিছল পাথরে পা পিছলে যেতে ডিগবাজি খেয়ে গভীর জলে গিয়ে পড়ে গেল। জলের শব্দে আমি শুনতে পেলাম না কী সে বললে, তবে আমি আন্দাজ করতে পারি তা কী; কারণ ওভাবে পার হতে গিয়ে আমি নিজেও একবার অমনি পা পিছলে পড়েছিলাম। কাছেই খানিকটা শুকনো বালির জমি, –কোনোরকমে সেখানে পৌঁছে বাঘটা গা-ঝাড়া দিল, তারপর শুয়ে পড়ে কেবলই গড়াতে লাগল যাতে গরম বালিতে তার চমৎকার চামড়াটা শুকিয়ে যেতে পারে, তারপর দাঁড়িয়ে উঠে আর একবার গা ঝাড়া দিয়ে ধীরে ধীরে তার গন্তব্য স্থানের দিকে অগ্রসর হল। আমার তরফ থেকে সে কোনো বাধাই পেল না, কারণ যে বস্তু প্রকৃতির আনন্দের খোরাক যোগায় তাকে আঘাত করা জঙ্গলের নীতিতে খেলোয়াড়-সুলভ কাজ নয়। এখন আবার বালিতে বাঘটার থাবার ছাপ দেখা যেতে লাগল কিন্তু এবার পাথরগুলোয় পা দিয়ে দিয়ে পার হয়ে যেতে তার অসুবিধে হল না, কারণ বালিটা পার হবার সময় তার পা শুকিয়ে গিয়েছিল।

এই পাথরগুলোর নিচে ওদিকের তীরের কাছে একটা বড় পাথর মাথা উঁচু করে একটা বদ্ধ জলার সৃষ্টি করেছে, আমার বন্ধু সেই দেড়সেরী মহাশোল মাছটা থাকত সেখানে। বঁড়শিতে গেঁথে একটা জক স্কট (মাছ ধরার জন্য নির্মিত নকল পোকা) এই ঢালু পাথরের উপরে ফেলে আস্তে আস্তে সরিয়ে নিতেই দু-দুবার মহাশোলটা বেগে বেরিয়ে এসেছিল। ছিপটা ফেলতে হচ্ছিল অনেকটা দূর থেকে, এবং তাও খুব কঠিন হয়ে উঠেছিল, কারণ, প্রথমত, গাছের একটা ডাল ওদিকে ঝুঁকে পড়েছিল, আর দ্বিতীয়ত, অনেকটা ঝুঁকে পড়ে ছিপটা ফেলতে হচ্ছিল, কারণ জলে স্থলে শূন্যে সর্বত্র শত্রু থাকায় মহাশোল মাছের দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, তাই আমাকে বিশেষ সাবধানে অগ্রসর হতে হত। বালিভরা তীর আর তার উপর পায়ের দাগগুলো ছেড়ে আমি নদীটার গতিপথ ধরে খানিকটা অগ্রসর হলাম। যে দশ ফুট সুতোটা আমি সেদিন সকালে অনেক যত্নে তৈরি করেছিলাম একটা পাথরের নিচে সেটাকে ভিজতে দিয়ে আমি ছিপটা রেখে ধূমপান শুরু করলাম। প্রস্তুতিপর্ব শেষ হতে আমি হুইল থেকে দরকার-মত সুতো খুলে নিলাম। তারপর খুব সাবধানে সেটা বাঁ হাতে ধরে গুঁড়ি মেরে সেই একমাত্র জায়গায় গিয়ে উপস্থিত হলাম যেখান থেকে সুতোটা কোনো রকমে পাশ করে ফেলা যায়–চিরাচরিত প্রথায় ফেলা সম্ভব নয় এখানে। আমার তিন-সেরী বন্ধুটির জন্য সেদিন বঁড়শিতে যে নতুন আট নম্বরী জক স্কট লাগিয়েছিলাম সেটি গিয়ে পড়ল ঠিক যেখানটায় চেয়েছিলাম সেখানেই। সুতোর টানে পাথর থেকে গভীর জলে যেই সেটি পড়েছে, অমনি জলে পাক দিয়ে একটা ছলাৎ শব্দ! আমার বন্ধুটি আবার বঁড়শিতে গাঁথা পড়েছে–এই নিয়ে তৃতীয়বার। পাতলা সুতোয় মহাশোল মাছের প্রথম টান সরাসরি রোধ করা অসম্ভব; তবে টানটা ঠিক হিসেব মত রাখতে পারলে, যে পাথরের আড়ালে সে লুকিয়ে পড়তে চায় সেখান থেকে তাকে ঠেকিয়ে রাখা অসম্ভব নয়, যদি অবশ্য শিকারী যেদিকে আছে পাথরটা সেদিকে না হয়। আমি ছিপ ফেলেছিলাম নদীর ডান তীর থেকে, আর মাছটাকে যেখানে গেঁথেছিলাম তার ত্রিশ গজ নিচে একটা বাঁকা শেকড় জলের মধ্যে বেরিয়ে এসেছিল। দু-দুবার মাছটা এই শেকড়ের সাহায্যে আমায় ফাঁকি দিয়েছিল। এবার আমি তাকে কোনোমতে আটকাতে পেরেছি–মাত্র দু-এক ইঞ্চি থাকতে। জলাশয়ের মধ্যে যতক্ষণ আছে ততক্ষণ সে নিরাপদ, তাই আমি ইচ্ছেমত খেলায় তাকে বাধা দিলাম না। তারপর সে ক্লান্ত হয়ে এলে তাকে বালির তীরের কাছে এনে হাতে করে তুলে নিলাম, কারণ মাছ তোলার কোনো জাল আমার সঙ্গে ছিল না। আমার দেড় সের হিসেবটায়–এক পোয়াটাক ভুল ছিল–সেটা অবশ্য বেশির দিকেই। সুতরাং আমাদের রাত্রের ভোজ তো হবেই, তা ছাড়াও গ্রামের যে অসুস্থ ছেলেটিকে ম্যাগি সেবা-শুশ্রূষা করছিল, তাকেও একটু ভাগ দেওয়া যাবে,–মাছই তার সবচেয়ে প্রিয় আহার্য।

 ছেলেবেলায় বন্দুক ছোঁড়া শিক্ষার সময়ে যে উপদেশ পেয়েছিলাম সেই অনুসারে আমি হিউ স্টেকে যে টেলিগ্রাম পাঠালাম তাতে নিশ্চয় করে কিছু জানালাম না, এবং এই সুযোগে চিন্তা করার যথেষ্ট সময় পেলাম। বাঘটার থাবার ছাপ দেখতে পাওয়ার ফলেই হ’ক বা মহাশোল শিকারে সাফল্যের ফলেই হ’ক, বাড়ি যখন ফিরলাম ততক্ষণে আমি মনস্থির করেছি হিউ স্টেকে জানিয়ে দেব যে বড়লাটের ছুটি কাটাবার পক্ষে সবচেয়ে ভাল জায়গা কালাধুঙ্গি। ম্যাগি, চা তৈরি করে বারান্দায় এনে রেখেছিল, আর এই নিয়ে আমাদের কথাবার্তা হচ্ছে, এমন সময় বাহাদুর এসে হাজির। আমি জানি যে দরকার হলে বাহাদুর পেটের কথা চেপে রাখতে পারে; তাই দিল্লী থেকে আসা টেলিগ্রামটার কথা তাকে বললাম। উত্তেজনা হলে বাহাদুরের চোখ একেবারে নাচতে শুরু করে, কিন্তু সেদিনের মত অমন নাচতে আর কখনো দেখি নি। স্বয়ং বড়লাট কালাধুঙ্গি আসবেন কে কবে ভাবতে পেরেছে! তবে তো তার জন্যে জবর বন্দোবস্তা করতে হবে। আর সময়টাও বেশ জুতসই হয়েছে–ধান কাটা শেষ, গ্রামের সকলেরই সাহায্য মিলবে। পরে যখন খবরটা ছড়িয়ে পড়ল যে বড়লাট আমাদের জঙ্গল অঞ্চলে আসছেন, তখন কেবল আমাদের প্রজারাই নয়, কালাধুঙ্গির প্রত্যেকেই বাহাদুরের মতই উৎসাহিত হয়ে উঠল। এ থেকে কোনো লাভ বা সুযোগ-সুবিধের চিন্তায় নয়,–এই আগমনকে তারা কি করে অতিথির পক্ষে সুখকর করে তুলবে, তাদের স্বল্প সাধ্য নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে, কেবল এই কথা ভেবেই।

পরদিন সকালে আমি অন্ধকার থাকতে চোদ্দ মাইল হাঁটা-পথ ধরে হলদোয়ানির পথে বেরিয়ে পড়লাম, কারণ হিউ স্টেবলের সঙ্গে কথা কইবার আগে আমি জে হপকিন্সের সঙ্গে দেখা করব ঠিক করলাম–তিনি তখন ফতেপুরে তাঁবু ফেলেছেন। এ-পথের প্রথম সাত মাইল জঙ্গলের মধ্য দিয়ে,আর এই ভোরে সে পথে বনের প্রাণী আর আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। কালাধুঙ্গির বাজার থেকে এক মাইল এগোতে অন্ধকার ফিকে হয়ে এল, রাস্তার ধুলোর উপর একটা পুরুষ-চিতার টাটকা থাবার ছাপ আমার চোখে পড়ল। মনে হল সে আমার উপস্থিতি টের পেয়েছে, কারণ মোড়টা ভাল করে ফিরতে না ফিরতেই সে মাথা ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল। যাই হ’ক তবুও সে সেইভাবেই রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল আর থেকে-থেকে পিছন ফিরে আমায় দেখতে লাগল। দূরত্বটা যখন আমি কমিয়ে পঞ্চাশ গজে এনেছি তখন সে পথ ছেড়ে একটা হালকা ঘাস-জমিতে নেমে গেল। তেমনি একভাবে সামনে তাকিয়ে এগোতে এগোতে আমি চোখ টেরিয়ে দেখলাম, রাস্তা থেকে কয়েক ফুট তফাতে সে ঘাসের উপর গুঁড়ি মেরে রয়েছে। আরও একশো গজ মত এগোবার পর আমি মুখ ফিরিয়ে তাকালাম। দেখলাম, আবার সে রাস্তার উপর উঠেছে যেন একজন সাধারণ পথচারীকে যাবার পথ করে দিয়ে আবার চলতে শুরু করেছে। কয়েকশো গজ অগ্রসর হবার পর তাকে পথ থেকে নেমে একটা গভীর দরির মধ্যে প্রবেশ করতে দেখলাম। মাইল-খানেকের মত পথে আমি একাই চলছিলাম। তারপর ডানদিকের জঙ্গল থেকে পাঁচটা লাল কুকুর লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এল। যেমন নির্ভীক, তেমনি দ্রুতগতি। তারা; প্রজাপতির মত নিঃশব্দে ও নিঃসঙ্কোচে তারা বনে দৌড়ে বেড়ায়, আর খিদে পেলে খায় যা সবচেয়ে সেরা প্রাণীদের মধ্যে ভারতীয় বনকুত্তাদের মত অত উন্নত ধরনের জীবনযাত্রা আর কারুর নয়।

আমি যখন বন-বাংলোয় পৌঁছলাম তখন জেফ আর জিলা হপকিন্স প্রাতরাশে বসেছেন,একটু সকাল-সকালই। আমি কী কাজে হলদোয়ানি যাচ্ছি তা শুনে তারা যেমন খুশি তেমনি উৎসাহিত হলেন। জেফ তখন তরাই আর ভাবর গভর্মেন্ট এস্টেটের বিশেষ বন-রক্ষক, তাই তার সাহায্যে ভিন্ন হিউ স্টেবলের কাছে কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাতলানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। জে উৎসাহের সঙ্গেই সাড়া দিলেন। শিকারের অভিযান সফল করতে হলে বনের মধ্যে দুটো শিকারের আস্তানা দরকার। যে দুটো আস্তানা আমার পছন্দ দুটোই সৌভাগ্যবশত তখন খালি ছিল, জে বললেন তিনি সে দুটো আমার জন্যে রেখে দেবেন। পার্শ্ববর্তী সংরক্ষিত অঞ্চল দাচাউরির যে আস্তানা তিনি নিজের জন্যে নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন সেটাও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ব্যবহারের জন্যে দিলেন। বাঘের থাবার ছাপ লক্ষ করা আর মহাশোল মাছ ধরা থেকে আরম্ভ করে জেফের সঙ্গে এই সুফলপ্রসু সাক্ষাৎকার–সবই বেশ চলছিল। হলদোয়ানির পথের মাইলের পর মাইল কখন যে অতিক্রম করে গেলাম তা যেন টেরই পেলাম না।

ঠিক এগারোটার সময় হিউ স্টেবলের টেলিফোন এলো। তিনশো মাইল ব্যবধান থেকে আমাদের এই কথাবার্তা অব্যাহত চলল এক ঘণ্টা ধরে। এই এক ঘণ্টায় হিউ জানলেন যে হিমালয়ের পাদদেশে কালাধুঙ্গি নামে একটা ছোট্ট গ্রাম আছে যার চারদিকে জঙ্গল আর সেই জঙ্গলে অনেক রকম শিকারের প্রাণী আছে, এবং ছুটি কাটাবার পক্ষে তার চেয়ে ভাল কোনো জায়গা আমার জানা নেই। হিউয়ের কাছে শুনলাম বড়লাটের দল বলতে মহামান্য লর্ড লিনলিথগো ও তার স্ত্রী, আর তাঁদের তিন কন্যা–লেডি অ্যান, জোন ও ডোরীন (বান্টি) হোপ। আর সেই দলে আসবেন বড়লাটের ব্যক্তিগত কর্মচারিবৃন্দ, কারণ ছুটির মধ্যেও বড়লাটকে পুরো দিনের কাজ করতে হয়। শেষে শুনলাম, শিকারের প্রস্তুতির জন্যে আমি সময় পাব পনের দিন। বড়লাটের গৃহস্থালির তত্ত্বাবধায়ক মাউজ ম্যাক্সওয়েল পরদিনই দিল্লী থেকে মোটরে এসে পৌঁছলেন। তার পরে এলেন পুলিসের প্রধান, সিআইডি-র প্রধান, নাগরিক প্রশাসনের প্রধান, বন-বিভাগের প্রধান, আরও অনেক অনেক বিভাগীয় প্রধান। আর, সবচেয়ে ভীতিপ্রদ, একজন রক্ষী–তার কাছে শুনলাম বড়লাটের দেহরক্ষক হিসেবে সে একদল সৈন্যও কালাধুঙ্গিতে নিয়ে আসছে।

বাহাদুর যে বলেছিল জবর বন্দোবস্ত করতে হবে, ঠিকই বলেছিল, কিন্তু সে বন্দোবস্ত যে কত জবর হতে পারে সে সম্বন্ধে কোনো ধারণা তার বা আমার স্বপ্নেও কখনো ছিল না। যাই হক, সকলের আপ্রাণ সহযোগিতা ও সাহায্যের ফলে কাজ সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হল, কোথাও কোনো অসুবিধা হয় নি বা বাধ্য পড়ে নি। চারটি বীট সম্পন্ন হল, চারটি বাঘ মারা পড়ল,–যারা শিকার করলেন আগে তারা কখনো জঙ্গলে বাঘ দেখেন নি–অথচ গোলা গুলির খরচও হল যতটা কম সম্ভব। বীট করে বাঘকে বার করার অভিজ্ঞতা যাদের আছে একমাত্র তারাই ঠিকমত বুঝতে পারবে এটা কত বড় সাফল্য। এই স্মরণীয় শিকার অভিযানের শেষ দিন, দলের যে কনিষ্ঠতমা কেবল তারই এখন বাঘ শিকার বাকি। সেদিনের বীটটার ব্যবস্থা হল একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি এলাকা ঘিরে, প্রাচীন যুগে যেটা ছিল বোর নদীর গর্ভ কিন্তু এখন ছোট-বড় গাছ-গাছড়ার ঝোপে-জঙ্গলে আর নল-ঘাসে আর বুনো কমলালেবু ঝোপে নিবিড়। এক কালে যেটা ছিল নদীর তীর সেখানে বড় বড় পাঁচটা গাছে পাঁচটা মাচান বাঁধা হয়েছে–নিচের জমি থেকে বাঘটাকে তাড়িয়ে এদিকে আনা হবে।

অনেকটা ঘুরিয়ে আমি সবাইকে মাচানের পেছন দিয়ে নিয়ে গেলাম কারণ অনেক বীট পণ্ড হয়ে যেতে দেখেছি বাঘ যেখানে থাকার সম্ভাবনা তার সমানে দিয়ে বন্দুক হাতে চলে যাবার ফলে। যারা বাঘের গতি রোধ করবে তারাও সঙ্গে ছিল, তারাও আমার ডাইনে বাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ে যে-সব গাছ আমি তাদের জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলাম সেইসব গাছে গিয়ে উঠল; আর পিটার বরউইক (বড়লাটের এক এ ডি সি); বাহাদুর আর আমি বন্দুকধারীদের যথাস্থানে বসিয়ে দিলাম। এক নম্বর মাচানে বসালাম অ্যানকে, আর দু-নম্বরে বড়লাটকে। তিন নম্বরটা হল বড় গাছের অভাবে একটা বেঁটেখাটো কুল-জাতীয় গাছ, আমার মতলব ছিল বাহাদুরকে সেই গাছে বসিয়ে বাঘটাকে তাড়া দেওয়া। তাড়া খেয়ে বাঘটা বাঁ দিকে মোড় ফিরবে, এই কারণে বান্টিকে বসালাম চার নম্বর মাচানে, দলের মধ্যে একমাত্র সে-ই এ পর্যন্ত কোনো বাঘ মারে নি।

যে ঝোপটার মধ্যে বাঘটা ছিল সেদিক থেকে বেরিয়ে একটা পশু চলার পথ নদীর তীর ধরে এসে সোজা তিন নম্বর মাচানের তলা দিয়ে চলে গেছে। আমি নিশ্চয় জানতাম যে বাঘটা এই পথ ধরে আসবে, এবং মাচানটা মাটি থেকে ছ-ফুট উঁচু হওয়ায় আমি ভেবে দেখলাম যে যদিও কোনো অভিজ্ঞ মানুষকে তাড়া দেবার জন্যে এখানে বসানো যেতে পারে, কোনো বন্দুকধারী শিকারীকে এখানে বসানো অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে। মেয়েদুটি, পিটার, বাহাদুর আর আমি মাচানের কাছে গিয়েছি, বাহাদুর মাচানে উঠতে যাচ্ছে, ঠিক এ-হেন মুহূর্তে আমি আমার মতলব পালটালাম। মাচানটা ছিল ঠিক আমার মাথা-বরাবর। সেখানে হাত দিয়ে আমি ফিসফিস করে বান্টিকে বললাম যে আমি চাই সে সেখানে বসুক,তার সঙ্গী হবে পিটার। বিপদের সম্ভাবনা তাকে বুঝিয়ে দেবার পর সে কিছুমাত্র ইতস্তত না করেই সেখানে বসতে রাজী হল। তখন আমি অনুরোধ করলাম যেন আমার চিহ্নিত একটা জায়গা পর্যন্ত বাঘটা না এলে কোনোমতেই গুলি না করে, আর গুলি যেন করে খুব ভাল করে তার গা লক্ষ্য করে। বান্টি আমায় কথা দিল তাই করবে। তখন পিটার আর আমি তাকে ধরে মাচানে তুলে দিলাম। তারপর পিটারকেও ওঠবার ব্যাপারে সাহায্য করবার পর আমি তাকে আমার ৪৫০ ৪০০ ডি.বি. রাইফেলটা দিলাম,বান্টির হাতেও একই রাইফেল। (পিটারের কোন অস্ত্র ছিল না, কারণ কথা ছিল তিনি আমার সঙ্গে বীটে থাকবেন।) তারপর নদীর তীর ছেড়ে আমরা এগিয়ে গেলাম পশু-চলা পথ ধরে। মাচান থেকে কুড়ি গজ মত দূরে এসে আমি একটা শুকনো কাঠি রাস্তার উপর আড়াআড়ি করে রাখলাম আর সেইসঙ্গে মুখ তুলে বান্টির দিকে তাকালাম। সেও মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল যে সে বুঝেছে।

লেডি জোন, বাহাদুর আর আমি এবার গেলাম যে গাছে চার নম্বর মাচান তৈরি হয়েছে সেখানে। মাটি থেকে মাচানটার উচ্চতা কুড়ি ফুট, কোনো আড়াল না থাকায় ত্রিশ গজ দূরের তিন নম্বর মাচানটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। রাইফেলটা তাকে দেবার জন্যে জোনের পিছু-পিছু আমি মই বেয়ে উঠে ওঁকে অনুরোধ করলাম লক্ষ রাখতে, যদি বান্টি আর পিটার বাঘটাকে থামাতে না পারে, কোনোমতেই যেন তিনি বাঘটাকে তিন নম্বর মাচান পর্যন্ত পৌঁছতে না দেন। তিনি আমায় নিশ্চিন্ত হতে বললেন, প্রতিশ্রুতি দিলেন তার সাধ্যমত চেষ্টা করবেন। নদীতীরের এদিকটায় ঝোঁপ-টোপ নেই, কেবল ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত কিছু গাছ আছে। কাজেই বাঘটা যখন ষাট গজ দূরের ঝোঁপ থেকে বেরোবে তখন দুটো মাচান থেকেই তাকে স্পষ্ট দেখা যাবে, যতক্ষণ না সে, আমার পরিকল্পনা মত বান্টির গুলিতে মারা পড়ছে। বাহাদুরকে পাঁচ নম্বর মাচানে রেখে দিলাম যাতে দরকার হলে বাঘটাকে আটকাতে পারে, তারপর আমি বীটের বাইরে দিয়ে ঘুরে বোর-নদীতে এসে পৌঁছলাম।

যে ষোলটা হাতি দিয়ে বীট করানো হবে, যেখানে আমি মহাশোলটা ধরেছিলাম তার কাছে–অর্থাৎ ওখান থেকে সিকি মাইলটাক দূরে তাদের একত্র করা হল। আমার বহুদিনের পুরনো বন্ধু বুড়ো মোহনের নেতৃত্বে তারা চলবে। মোহন ত্রিশ বছর উইণ্ডহ্যামের প্রধান শিকারী ছিল, বাঘ সম্বন্ধে তার মত জ্ঞান ভারতে আর কারো নেই। মোহন আমার খোঁজ করছিল, তাই জঙ্গলের ভিতর থেকে আমায় আসতে আর টুপি দোলাতে দেখে সে নদীর খাত ধরে হাতিগুলোকে রওনা করে দিল। নুড়ি-বিছানো পথে ষোলটা হাতির একটার পেছনে একটা করে সিকি মাইল পথ অতিক্রম করতে সময় লাগবে খানিকটা। তাই একটা পাথরের উপর বসে ধূমপান করতে করতে চিন্তার অবসর হল। যতই চিন্তা করলাম ততই অস্বস্তিবোধ হতে লাগল। জীবনে এই প্রথম আমি একজনের–কিংবা হয়তো দু-জনের জীবন বিপন্ন করে তুললাম, এবং এটা যে প্রথমবার, এ কথাতেও মনে কোনো সান্ত্বনা মিলল না। কালাধুঙ্গিতে এসে পৌঁছবার আগে লর্ড লিনলিথগো আমায় বলেছিলেন সকলের কর্তব্য নির্ধারণ করে দিতে। এই কর্তব্য সবাই খুব নিখুঁতভাবে পালন করে আসছিল; তিনশোর বেশি লোক তাঁবু করে রয়েছে, প্রতিদিন শিকার করছে, মাছ ধরছে, কারুর গায়ে একটা আঁচড় পর্যন্ত লাগে নি। কিন্তু আজ এই শেষের দিনে সবার বিশ্বাসভাজন আমি নিজেই বুঝি এমন একটা কাজ করে বসলাম যে জন্যে আমায় অত্যন্ত অনুতাপ করতে হচ্ছে। মাটি থেকে মাত্র ছ’ফুট উঁচু ওই পলকা মাচানে ভরসা করে আমার পরিচিত কাউকেই আমি বসাতে পারতাম না। অথচ সেখানেই আমি বসিয়েছি বাচ্চা একটা মেয়েকে। তাকে বলেছি, বাঘটা সোজা তার দিকে এগিয়ে এলে তাকে মারতে–বাঘ শিকারের সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রক্রিয়া। বান্টি আর পিটার দু-জনেই অবশ্য বাঘের মতই দুঃসাহসী, কারণ বিপদের সম্ভাবনাটা ভাল করে জেনে নিয়েও তারা বিনা দ্বিধায় মাচানে উঠেছে। কিন্তু বন্দুকে লক্ষ নিখুঁত না হলে কেবলমাত্র সাহসই তো আর যথেষ্ট নয়। তারা এমনকি বন্দুক সিধে করে ধরতে পারে কি না তাও আমার সঠিক জানা নেই। মোহন যখন তার হাতিদের নিয়ে এসে পৌঁছল তখনও আমি বীট চালাব না বন্ধ করে দেব সে বিষয়ে মনস্থির করতে পারি নি। সমস্ত ব্যাপারটা তাকে খুলে বলতে মোহন প্রথমে জোরে শ্বাস টানল (পশ্চিমীরা শিস দিয়ে উঠত); তারপর শক্ত করে চোখ বন্ধ করল, তারপর আবার বন্ধ চোখ খুলল। তারপর বললে, ‘ঘাবড়াবেন না সাহেব, সব ঠিক হয়ে যাবে।

সমস্ত মাহুতদের একত্র করে আমি তাদের বুঝিয়ে দিলাম যে বাঘটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে, কিন্তু ভয় পাওয়ালে চলবে না। হাতিগুলোকে নদীর তীরে লাইন করে সাজাবার পর ওরা আমার নির্দেশ গ্রহণ করবে। যখন দেখবে আমি মাথা থেকে হ্যাটটা খুলে দোলাচ্ছি তারা একবার চিৎকার করে উঠবে, তারপর হাততালি দিতে শুরু করবে এবং হাততালি দিয়ে চলবে যতক্ষণ না আমি হ্যাটটা আবার মাথায় পরছি। এই ব্যাপার চলবে কিছুক্ষণ পরে পরে। এতেও যদি বাঘটা না নড়ে তখন আমি ওদের অগ্রসর হবার সংকেত করব এবং সে অগ্রগমন হবে নিঃশব্দে ও অত্যন্ত মন্থর গতিতে। প্রথম চিৎকারটায় দুটো কাজ হবে: এক, এতে করে বাঘের ঘুম ভাঙবে, আর দুই, বন্দুকধারীরা সতর্ক হবে।

যে জঙ্গলটা বীট করতে হবে সেটার আয়তন চওড়ায় তিনশো গজ আর লম্বায় পাঁচশো গজ। হাতিগুলো আমার দু-দিকে লাইন করে দাঁড়ালে আমি হ্যাটটা খুলে নিয়ে দোলাতে লাগলাম। তখন ওরা খুব জোরে একটা চিৎকার করে হাততালি দিতে শুরু করল। তিন-চার মিনিট হাততালি দেওয়া হয়ে গেলে আমি টুপিটা আবার মাথায় পরলাম। এই অঞ্চলটায় ছিল সম্বর, চিতল, কাকার হরিণ, ময়ুর আর বন-মোরগ, তাই কোনো সংকেত-সূচক শব্দের জন্যে উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। কিন্তু কিছুই আমার কানে এল না। পাঁচ মিনিট পরে আমি আবার টুপিটা খুলে নিয়ে দোলাতে লাগলাম। এক মিনিট কি দু-মিনিট পরেই একটা রাইফেলের আওয়াজ শোনা গেল। আমি মুহূর্তগুলো গুনতে লাগলাম, কারণ বাঘের বীটের সময়ে পর-পর গুলির আওয়াজের মধ্যবর্তী বিরতির সময় হিসেব করলে অনেক কিছুই জানতে পারা যায়।–এক-দুই-তিন চার-পাঁচ পর্যন্ত গুনলাম। তারপর আবার শ্বাস নিচ্ছি, এমন সময় অল্প সময়ের ব্যবধানে বন্দুকের দুটো আওয়াজ আমার কানে এল। তারপর আবার: এক-দুই তিন-চার, চতুর্থ একটা গুলির আওয়াজ হল। প্রথম আর চতুর্থ এই দুটো গুলি নিক্ষিপ্ত হয় বন্দুকের মুখ আমাদের দিকে ফিরিয়ে, আর বাকি দুটো হয় অন্য দিকে ফিরিয়ে। এর মাত্র একটাই অর্থ হতে পারে; সেটা হল নিশ্চয় কোনো গণ্ডগোল হয়েছে, এবং জোনকে সাহায্যে আসতে হয়েছে, কারণ বড়লাট যে মাচানে ছিলেন সেখান থেকে বান্টির মাচান–দৃশ্যমান নয়।

আমার হৃদস্পন্দন তখন অত্যন্ত দ্রুত হয়ে উঠেছে, অবর্ণনীয় আতঙ্কে আমার মন ভরে উঠেছে। হাতিদের চালাবার ভার মোহনের উপর দিয়ে আমি আমার হাতির মাহুত আজমতকে বললাম যত বেগে সম্ভব গুলির আওয়াজ অনুসরণ করে যেতে। আজমতের শিক্ষা হয়েছিল উইণ্ডহ্যামের কাছে,সম্পূর্ণ অকুতোভয় সে, তার মত মাহুত আমি আর একটি দেখি নি। আর তার হাতিও শিক্ষায় সহবতে তারই উপযুক্ত। কাটা-ঝোঁপ ভেঙে, বড় বড় পাথরের উপর দিয়ে ভাঙা পথ মাড়িয়ে, মাথার উপরের ঝুলে-পড়া ডালপালার তলা দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম–আমার দুশ্চিন্তা তখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তারপর একফালি বার ফুট লম্বা নল-ঘাসের বনের মধ্যে প্রবেশ করার পর হাতিটা ইতস্তত করতে লাগল। আজমত পেছন ফিরে ফিসফিস করে আমায় বললে, “ও বাঘের গন্ধ পেয়েছে সাহেব; ভাল করে ধরে থাকুন, কারণ আপনি নিরস্ত্র।

আর মাত্র একশো গজ পথ বাকি, অথচ এখনো বন্দুকধারীর কাছ থেকে কোনো সংকেত নেই, যদিও প্রত্যেককেই একটা করে রেলের হুইল্স দেওয়া আছে দরকার হলে বাজাবার জন্যে। হুইল শোনা যায় নি এ কথা ভেবেও আমার মনে কোনো স্বস্তি এল না, কারণ অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি যে উত্তেজনার মুহূর্তে হুইলের চেয়ে অনেক বড় বস্তুও মাচান থেকে পড়ে যেতে পারে। তখনই গাছের ফাঁক দিয়ে আমি জোনকে দেখতে পেলাম। স্বস্তিতে, আনন্দে আমি চিৎকার করে উঠতে পারতাম, কারণ দেখলাম রাইফেলটা দুই হাঁটুর উপর রেখে সে নির্বিকার মাচানে বসে আছে। আমায় দেখতে পেয়ে সে দু-হাত প্রসারিত করে দেখাল, যার অর্থ-বাঘটা বেশ বড়, তারপর বান্টির মাচানের সামনে অঙ্গুলি-নির্দেশ করল।

এর পরের ঘটনা, কিন্তু পনের বছর পরেও সে কাহিনী বলতে আমার ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে। তিন তরুণ তরুণীর অসীম সাহস ও অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ না থাকলে সেদিনের ঘটনার মর্মান্তিক পরিসমাপ্তি ঘটতে পারত।

 বীট শুরুর সময় আমাদের চিৎকার বন্দুকধারীরা শুনতে পেয়েছিল স্পষ্ট, তারপর হাততালির ক্ষীণ আওয়াজ। তারপর বিরতির সময়টায় বাঘটা বেরিয়ে যেখানে আসে সে জায়গাটা হল তিন নম্বর মাচান থেকে ষাট গজেরও বেশি দূরে। তারপর বাঘটা পশু-চলা পথ ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকে। হাতির পিঠে বসে আমাদের দ্বিতীয় বারের চিৎকার যখন শুরু হল বাঘটা তখন নদীর পাড় পর্যন্ত পৌঁছেছে। চিৎকারটা কানে যেতে সে থেমে পড়ে মাথা ফিরিয়ে পেছন দিকে তাকায়, তাড়াহুড়োর প্রয়োজন নেই স্থির করে, দু-এক মিনিট কান পেতে শুনে সে নদীর তীর ধরে উঠতে শুরু করে। রাস্তার উপরে যেখানে আমি শুকনো কাঠিটা রেখেছিলাম বাঘটা সেখানে পৌঁছতে বান্টি গুলি করে। গুলি করে কিন্তু তার বুকে, কারণ মাথা নিচু করে অগ্রসর হওয়ার ফলে গলাটা লক্ষ করা তারপক্ষে সম্ভব হয় নি। গুলিটা লেগেছিল ঠিকই; সেটা খেয়ে বাঘটা, বান্টি বা পিটারের মাচান থেকে দ্বিতীয় কোনো গুলি খাওয়ার আগে সামনের দিকে লাফিয়ে পড়ে, তারপর গর্জন করতে করতে মাচানটার তলায় এসে সেখান থেকে সেটাকে আক্রমণ করে। বেঁটে গাছটার উপরে পলকা মাচানটা যখন দুলছে আর বাঘটার আক্রমণে যে-কোনো মুহূর্তে পড়ে যাবে মনে হচ্ছে আর বান্টি আর পিটার উন্মত্তের মত মাচানের ফাঁক দিয়ে নল গলিয়ে দেবার চেষ্টা করে চলেছে, ত্রিশ গজ দূরের মাচান থেকে জোন তখন একটা গুলিতে তাকে মাটিতে পেড়ে ফেললেন, তারপর দ্বিতীয় গুলিটাও ছুড়লেন। এই দ্বিতীয় গুলিটা খেয়ে বাঘটা নদীর তীর ধরে নেমে যাচ্ছিল–যে ঘন ঝোঁপ থেকে এসেছিল সেখানে যাবার উদ্দেশ্যেই মনে হয়–এমন সময় বান্টি তার মাথার পিছনে আর একটা গুলি করে।

এই আমাদের বড়লাটের প্রথম কালাধুঙ্গি সফর, কিন্তু শেষ সফর নয়। এরপরে আরও অনেকবার তার আগমনে আমাদের ছোট তরাইয়ের গ্রাম সম্মানিত হয়েছে, কিন্তু তার বা তার দলের কোনো ব্যক্তির নিরাপত্তা সম্বন্ধে আর কখনো মুহূর্তের জন্যেও আমার কিছুমাত্র দুশ্চিন্তার কারণ ঘটে নি, কারণ সেই স্মরণীয় সফরের শেষ দিনের মত ঝুঁকি ভুলেও আর কখনো আমি গ্রহণ করিনি।

.

১১.

 নভেম্বর থেকে মার্চ–হিমালয়ের তরাই অঞ্চলের এই সময়ের জলবায়ুর কোনো তুলনা নেই। আর এর মধ্যে আবার সবচেয়ে ভাল সময় হল ফেব্রুয়ারি। বাতাস তখন স্বচ্ছ ও স্বাস্থ্যকর, আর যে অসংখ্য পাখি উঁচু পাহাড়-অঞ্চল থেকে খাদ্য ও উষ্ণ আশ্রয়ের সন্ধানে নভেম্বরে নেমে এসেছিল তখনও তারা চলে যায় না। যে-সব পত্রমোচী গাছ সমস্ত শরঙ্কাল ও শীতের সময় পত্রহীন ছিল এই সময় তাদের কোনোটায় ফুল ফুটতে শুরু করে, কোনোটা বা ছেয়ে যায় সবুজ আর গোলাপি কচি-কচি পাতায়। বসন্তের ছোঁয়া তখন বাতাস ছেয়ে, প্রতিটি গাছের রসে, প্রতিটি প্রাণীর রক্তে পরিব্যাপ্ত। উত্তরের পাহাড়-অঞ্চলে হক, দক্ষিণের সমতল অঞ্চলে হক বা তরাই অঞ্চলেই হক, বসন্তের আবির্ভাব কিন্তু হয় রাতারাতি। এক শীতের রাত্রে হয়তো আপনি শুতে গেছেন, পরদিন সকালে যখন ঘুম থেকে উঠলেন, দেখলেন যে বসন্তকাল শুরু হয়ে গেছে। সারা প্রকৃতি আপনাকে ঘিরে বসন্তের আসন্ন আনন্দের কল্পনায় উদ্বেল–প্রচুর খাদ্যসামগ্রী, গরমের আরাম, প্রাণের পুনঃপ্রকাশ। যাযাবর পাখিরা ছোট-ছোট ঝকে ঘুরছে ফিরছে,–অন্যান্য দলের সঙ্গে তারা একত্র হবে কোনো নির্দিষ্ট দিনে, পায়রা বা তোতাপাখি বা দোয়েল বা আর-আর ফলহারী পাখিরা আপন-আপন সর্দারের নির্দেশে উপত্যকা থেকে উঠে এসে যে যার নির্দিষ্ট অঞ্চলে চলে যাবে, আর যারা পতঙ্গভুক তারা গাছ থেকে গাছে বেগে যেতে যেতে সেই একই উদ্দেশ্যে একই অভিমুখে অগ্রসর হয়ে দিনে মাত্র কয়েক মাইল পথ অতিক্রম করবে। যাযাবর পাখিরা বেরিয়ে পড়বার জন্যে তৈরি আছে, আর যে-সব পাখি এ অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা তারা যে যার সঙ্গী বেছে নিয়ে খোঁজ করে কোথায় বাসা বাঁধবে। এদিকে বনের সমস্ত বাসিন্দাদের মধ্যে যেন স্বরক্ষেপের প্রতিযোগিতা শুরু হল–তাদের ডাক শুরু হয় দিনের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে আর নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে যতক্ষণ না অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। এই প্রতিযোগিতায় যোগ দেয় সর্বভুক পাখিরা পর্যন্ত, আর তাদের মধ্যে গলার জোর যার সবার বেশি, সেই তিলিয়া বাজ অনেক উঁচুতে উঠে এতটুকু হয়ে গিয়েও তার তীক্ষ্ণ স্বর পাঠিয়ে দেয় মাটির পৃথিবীতে।

জঙ্গলের লড়াইয়ের শিক্ষাদানের সময় একদিন আমি মধ্যভারতের এক জঙ্গলে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল একদল পক্ষি-বিশারদ। মাথার উপরে, অনেক অনেক উঁচুতে একটা তিলিয়া বাজ ঘুরছিল আর চিৎকার করে চলছিল। আমার সঙ্গে দলটা এসেছে ব্রিটেনের নানা অঞ্চল থেকে, নতুন এসেছে বাহিনীতে, যাবে ব্রহ্মদেশ। কিন্তু ওদের মধ্যে কেউই ইতিপূর্বে তিলিয়া বাজ দেখে নি। একটা ফাঁকা জায়গায় পোঁছে আমি আকাশে একটা ছোট্ট চিহ্ন ওদের দেখালাম। দূরবীন বার করা হল, কিন্তু হতাশ হল সবাই, কারণ পাখিটা এত উঁচুতে, যে তাকে সনাক্ত করা বা স্পষ্ট করে দেখা সম্ভব হল না। সঙ্গীদের চুপ করে থাকতে বলে আমি পকেট থেকে একটা তিন ইঞ্চি ভেঁপু বার করলাম, তারপর খুব জোরে ফুঁ দিলাম তাতে। ভেঁপুটার একটা দিক খোলা আর একটা দিক বন্ধ,–অত্যন্ত নিপুনভাবে তাতে বিপন্ন হরিণ-শিশুর তীক্ষ্ণ চিৎকারের নকল করা যেত। সংকেতের শিক্ষা গ্রহণের সময়ে এটার ব্যবহার হত, কারণ দিনে বা রাত্রে এটাই ছিল বনের একমাত্র স্বাভাবিক আওয়াজ; সুতরাং কোনো শত্রুকে আকর্ষণ করবার মত নয়। শুনেই তিলিয়া বাজটা চিৎকার বন্ধ করল, কারণ সাপ প্রধান খাদ্য হলেও অন্য খাদ্যে, তার অরুচি ছিল না। ডানা বন্ধ করে সে কয়েকশো ফুট নেমে এল, তারপর আবার পাক খেতে খেতে ঘুরতে লাগল। তারপর প্রতিটি ডাকের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই নেমে আসতে লাগল। শেষ পর্যন্ত বড় বড় গাছগুলো বরাবর এসে ঘুরতে লাগল। এখন আর তাকে স্পষ্টভাবে দেখতে আমাদের অসুবিধে হল না। পঞ্চাশ জনের সেই দলের যাঁরা ব্রহ্মের যুদ্ধের পর জীবিত আছেন তাদের কি চিনদোয়ারার সেই দিনের কথা মনে আছে যখন কিছুতেই আমি বাজটাকে ফোটো তোলার উদ্দেশ্যে কাছাকাছি কোনো ডালে বসাতে পারি নি? মন খারাপ করবেন না। এই বসন্তের সকালে আসুন আমার সঙ্গে তিলিয়া বাজের মত অনেক চমকদার প্রাণীরই দেখা পাবেন।

চিনদোয়ারার সেই দিনের পরে আপনি আরো অনেক কিছু জেনেছেন। আত্মরক্ষার তাগিদে আপনি শিখেছেন যে মানুষের দৃষ্টির পরিধি ১৮০ ডিগ্রি। শব্দের উৎপত্তি সঠিক নির্ণয় করা, যা তখন আপনার কাছে এত কঠিন মনে হত, এখন তা আপনার স্বভাবের অঙ্গীভূত হয়ে পড়েছে। ছেলেবেলায় গোলাপ আর ভায়োলেট ফুলের গন্ধের পার্থক্য বুঝতে পারতেন, কিন্তু এখন যে-কোনো ফুলের গন্ধ থেকে গাছটাকে চিনতে পারবেন। গাছের মগডালেও যদি সেই ফুল ফুটে থাকে, কিংবা গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে, তবুও সেই ফুলের গন্ধ আপনি চিনতে পারবেন। এতদিনে আপনি অনেক কিছু শিখেছেন, আর তার ফলে আপনার আত্মবিশ্বাস নিরাপত্তাবোধ, সুখ, সবই অনেকটা বেড়েছে। তবুও এখন অনেক শিখবার আছে। আসুন, এই সুন্দর বসন্তের সকালে আমরা অরো খানিকটা জেনে শুনে নিই।

আমাদের এলাকার উত্তর সীমানা-স্বরূপ যে খালটিতে আমাদের মেয়েরা স্নান করত, তাতে জল নিয়ে আসা হত পূর্বোক্ত পাহাড়ী নদীটি থেকে, একটি নালা কেটে। এই নালার নাম ছিল ‘বিজলী দন্ত’ অর্থাৎ বিদ্যুৎ জলধারা। প্রথম যে নালাটি স্যার হেনরি র‍্যামজে তৈরি করিয়েছিলেন বহু বছর আগেই সেটা বাজ পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। লৌকিক কুসংস্কারে বলে যে কোনো অপদেবতার আকর্ষণেই কোনো বিশেষ জায়গায় বজ্রপাত হয়ে থাকে। এই অপদেবতা সাধারণত সাপের রূপ নিয়ে থাকে। তাই সেই পুরনো ভিত ভেঙে দিয়ে অন্য জায়গায় সেইরকমই আর একটা নালা কাটা হয় এবং আজ পঞ্চাশ বছর ধরে তা দিয়ে জল বয়ে আসছে। উত্তরের জঙ্গল থেকে যেসব বন্য জন্তু রাত্রে গ্রামে আসে এবং যারা ওই দশ ফুট চওড়া খাল সাঁতরাতে বা লাফিয়ে পার হতে চায় না তারা এই নালা ব্যবহার করে। তাই এই বসন্তের সকালে আমরা এই জায়গাটা থেকে যাত্রা শুরু করব।

নালাখিলানের নিচের বালি-ছাওয়া পথে খরগোশ, কাকার হরিণ, শুয়োর, শজারু, হায়েনা আর শেয়ালের চলা-ফেরার চিহ্ন রয়েছে। এসবের মধ্যে কেবলমাত্র শজারুর চিহ্নগুলোই আমরা ভাল করে লক্ষ করব, কারণ রাতের বাতাস নেমে যাওয়ার পর আর তার চলা-পথে উড়ো বালি এসে জমে না। পাঁচটা আঙুল আর পায়ের পাতার ছাপ দেখা যায়, প্রতিটি পদক্ষেপ স্পষ্ট; কারণ শজারুর গুঁড়ি মেরে চলবার দরকার হয় না এবং তার একটা পা আরেকটা পায়ের দাগের উপর পড়ে না। প্রত্যেকটা পায়ের দাগের সামনে বালির উপর একটা গর্ত-মত দেখা যায় (শজারুর শক্ত নখের দাগ), খাদ্য আহরণে এই নখই তার অস্ত্র। শজারুর পিছনের পায়ের পাতাগুলো হয় লম্বাটে ধরনের, এই লম্বাটে অংশটার বা গোড়ালিটার ছাপ অবশ্য ভালুকের মত অতটা স্পষ্ট হয় না, তাহলেও অন্য যে-কোনো প্রাণীর পায়ের দাগের থেকে একে আলাদা করে চিনে নেবার পক্ষে তা যথেষ্ট। আরও নিশ্চিত হতে হলে খুব ভাল করে তাকালে দেখা যাবে, এই চিহ্নের মাঝ দিয়ে বা এর সমান্তরাল হয়ে কতকগুলো সূন্ন রেখা চলে গেছে। শজারুর চলার সময়ে তার ঝুলে পড়া দীর্ঘ কাটাগুলো মাটিতে লেগে এই রেখাগুলি টেনে দিয়ে গেছে। শজারুর কাটা মসৃণ নয়, তাতে আবার ছোট-ছোট কাঁটার মত থাকে। শজারু তার কাটা ছুঁড়তে বা ফোলাতে পারে না, আত্মরক্ষা বা আক্রমণে তার একমাত্র পদ্ধতি হল কাটাগুলো খাড়া করে পিছন দিকে ছুটে যাওয়া। তার ল্যাজের শেষে থাকে কতকগুলো কঁপা কাটা, দেখতে সরু-বোঁটাওলা লম্বা মদের গেলাসের মত কতকটা। এই কাটাগুলো তারা কাজে লাগায় শব্দ করে শত্রুকে ভয় দেখাবার জন্যে আর তার ডেরায় জল বহন করবার জন্যে। ডোবালে এগুলো সহজেই জলে ভরে ওঠে, আর এই জল শজারু ব্যবহার করে তার ডেরা ঠান্ডা বা পরিষ্কার রাখবার জন্যে। শজারুরা নিরামিষাশী, ফলমুল আর শস্য হল তাদের খাদ্য। হরিণের খসে-পড়া শিং বা চিতার বা বনকুত্তার বা বাঘের কবলে মরা হরিণের শিংও তাদের খাদ্য, তাদের স্বাভাবিক খাদ্যে ক্যালসিয়াম বা অন্য কোনো খাদ্যপ্রাণের যে অভাব তা পূরণ করবার জন্যেই হয়তো। অপেক্ষাকৃত ছোট্ট প্রাণী হলেও শজারুর মনে সাহসের অভাব নেই, অনেক বড় বড় শত্রুও সে মুখোমুখি হতে প্রস্তুত।

নালাটির কয়েক শো গজ উপর পর্যন্ত জল-পথটির গর্ভ পাথরে পাথরে ছাওয়া; জায়গায় জায়গায় পশুদের পায়ে-চলা পথ জলপথের উপর দিয়ে গেছে। এগুলির কথা বাদ দিলে পাহাড়ের পাদদেশ ধুয়ে আসা সূক্ষ্ম বালিতে ছাওয়া এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে না পৌঁছনো পর্যন্ত আর কোথায়ও বন্যপ্রাণীর পায়ের ছাপ দেখা যাবে না। যত প্রাণী এখানে জল-পথ ধরে আসে তাদের সকলেরই চিহ্ন এখানে স্পষ্ট। এই বিস্তীর্ণ এলাকার দু-দিকে ঘন ল্যান্টানার ঝোপ,–এর মধ্যে হরিণ, শুয়োর, ময়ুর আর বন-মোরগ দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে আর কেবলমাত্র চিতা, বাঘ আর শজারু রাতে প্রবেশের সাহস রাখে। সেই ল্যান্টানার ঝোপে এখন বন-মোরগের শুকনো পাতায় পা আঁচড়ানোর শব্দ পাওয়া যাবে। এখান থেকে একশো গজ দূরে একটা নেড়া শিমূল গাছের মগডালে বসে রয়েছে ওদের সবচেয়ে মারামক শত্রু শা-বাজ। কেবল বন-মোরগের নয়, ময়ূরেরও মারাত্মক শত্রু সে। এরাই হল তার স্বাভাবিক শিকার। তবুও কিন্তু এই বনে বয়স্ক পাখি বা অল্পবয়সী পাখির সংখ্যা প্রায় সমান সমান। তাতেই প্রমাণ হয় যে পাখিরা নিজেরাই নিজেদের সামলাতে পারে। আমি তাই কোনোদিন শা-বাজদের পিছনে লাগি নি। কেবল একদিন একটা বিপন্ন হরিণশিশুর ডাক শুনে আমি তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে দেখি, একটা শা-বাজ একটা একমাস-বয়স্ক চিতল হরিণকে ধরে তার মাথাটা ছিঁড়ে ফেলবার চেষ্টা করছে, আর চিতল-শিশুর মা ক্ষিপ্তপ্রায় হয়ে পাখিটাকে ঘিরে ঘুরছে আর সামনের পা দিয়ে তাকে মারবার চেষ্টা করছে। বাচ্চাকে বাঁচাবার জন্যে বীর মায়ের এই প্রাণপাত চেষ্টা সত্ত্বেও (যার প্রমাণ তার মুখে আঁচড়ের আর রক্তের দাগ) সে শা-বাজের সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠছে না। তার শত্রুকে আমি ঘায়েল করলাম, কিন্তু তার বাচ্চাকে কেবল সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়া ছাড়া আরকিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব হল না। কারণ, যদি-বা তার ঘাগুলো সারাতে পারতাম, তার চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হত না। এই ঘটনার পর বহু শাবাজ আমার গুলিতে মারা পড়েছে, শট-গানে গুলি করা সম্ভব। শিমূল গাছের এই পাখিটার অবশ্য আমাদের থেকে কোনো ভয় নেই, কারণ আমরা এখন এসেছি দেখতে; হরিণ-শিশুর শত্রুদের শাস্তি দিতে নয়। যখন আমি গুলতি দিয়ে শিকার করতাম, শা-বাজের সবচেয়ে সাংঘাতিক লড়াই তখন আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম। লড়াইটা ঘটেছিল বোর পুলের একটু নিচে, নদীর গর্ভে একফালি বালির মধ্যে। খরগোশ ভ্রমে একটা মেছো বেড়ালকে লক্ষ করে ঈগলটা নেমে এসেছিল। ঈগলটা ডানা ছাড়িয়ে নিতে পারে নি বলেই হ’ক কিংবা মেজাজ বিগড়ে যাবার ফলেই হক, দুটির মধ্যে এক জীবন মরণ লড়াই শুরু হয়। দুই প্রতিদ্বন্দ্বীই সশস্ত্র; বেড়ালটার অস্ত্র হল দাঁত আর থাবা, আর শা-বাজটার ঠোঁট আর নখ। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে তখনকার দিনে ফোটোগ্রাফি ছিল কেবলমাত্র স্টুডিয়োর মধ্যেই সীমাবদ্ধ, মুভি ক্যামেরারও চল হয় নি। শোনা যায় বেড়ালের নটা প্রাণ আছে, তা যদি হয় ঈগলের তাহলে আছে দশটা প্রাণ। আর এ-হেন লড়াইয়ের মীমাংসা শেষ পর্যন্ত প্রাণের সংখ্যা দিয়েই হয়ে থাকে। একটা মাত্র প্রাণ কোনোরকমে বজায় রেখে ঈগলটা তার মৃত শত্রুকে বালিতে রেখে একটা ভাঙা ডানা টানতে টানতে একটা জলাশয়ে নেমে গেল। তারপর তৃষ্ণা নিবারণ করে তার দশ নম্বর প্রাণটাও ত্যাগ করল।

ল্যান্টানার ঝোঁপ থেকে অনেকগুলো পশু-চলা পথ ফাঁকা জায়গাটার দিকে চলে গেছে। আমরা যখন ঈগলটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম তখন, একটা বাচ্চা রুরু হরিণ ল্যান্টানার ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পঞ্চাশ গজ দূরের জল-পথের কাছে। পৌঁছেছে,–পার হবে বলেই বোধ হয়। আমরা যদি একেবারে নিশ্চল হয়ে থাকি তাহলে আমাদের লক্ষ করবে না। বনের সমস্ত জন্তুর মধ্যে রুরুই সবচেয়ে বেশি সতর্ক, এখানে এই ফঁকাতেও সে সন্তর্পণে পা টিপে টিপে চলেছে। পিছনের পা দুটো পেটের তলায় সেঁধিয়ে রয়েছে, বিপদের কোনো সংকেত চোখে পড়লেই বা ঘ্রাণে এলেই সে দ্রুতবেগে ছুটে পালাবে। কখনো কখনো তাকে নীচ ও ভীরু প্রকৃতির বলে বর্ণনা করা হয়েছে; বলা হয়েছে সে জঙ্গলের প্রহরী হিসেবে নির্ভরযোগ্য নয়। এ বর্ণনার সঙ্গে আমি একমত নই। কোনো প্রাণীকেই নীচ প্রকৃতির বলা চলে না, –নীচতা হল কেবলমাত্র মানুষেরই বৈশিষ্ট্য। এবং রুরুর মত যে-সব প্রাণী জঙ্গলের গহনে বাঘের সঙ্গে বাস করে তাদের ভীরু অপবাদ দেওয়া যায় না। আর, নির্ভরযোগ্যতার কথায় বলি, যে মানুষ মাটিতে থেকে শিকার করে, রুরুর চেয়ে বড় বন্ধু তার আর কেউ হতে পারে না। রুরু ছোট-খাট প্রাণী, আত্মরক্ষার ক্ষমতা তার অল্প; তার উপর শত্রু তার অসংখ্য। সুতরাং বীটের সময় যদি সে কেবলমাত্র বাঘ দেখে ডেকে না ওঠে কোনো ময়াল সাপ দেখেও ডেকে ওঠে তাহলে তাকে অনির্ভরযোগ্যতার অপবাদ না দিয়ে বরং করুণা করাই উচিত, কারণ তার বা তার মত অন্যান্য প্রাণীর কাছে এই দুই নির্মম শত্রুই অত্যন্ত ভয়াবহ। সুতরাং যদি তাদের সাড়া পেয়ে ডেকে উঠে তাহলে তাকে অনির্ভরযোগ্যতার অপবাদ না দিয়ে বরং করুণা করাই উচিত, কারণ তার বা তার মত অন্যান্য প্রাণীর কাছে এই দুই নির্মম শত্রুই অত্যন্ত ভয়াবহ। সুতরাং তাদের সাড়া পেয়ে ডেকে উঠে প্রহরী হিসেবে সে তার কর্তব্যই করছে-জঙ্গলকে সাবধান করে দিচ্ছে তাদের উপস্থিতির খবর দিয়ে।

রুরু হরিণের উপরের চোয়ালে দুটো লম্বা কুকুরে দাঁত থাকে। এ দুটো অত্যন্ত ধারালো,তার আত্মরক্ষার একমাত্র অস্ত্র; কারণ তার মাথার ছোট ছোট শিঙের অগ্রভাগ থাকে ভিতর দিকে বাঁকানো, ফলে আত্মরক্ষার অস্ত্র হিসেবে তা নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। কয়েক বছর আগে ভারতীয় সংবাদপত্রে এক দীর্ঘ পত্রালাপ প্রকাশিত হচ্ছিল, যদিও তার কোনো সমাধান হয় নি। রুরু হরিণ মাঝে-মাঝে যে অদ্ভুত খট-খ শব্দ করে থাকে তাই নিয়েই বিতণ্ডা। কেউ কেউ বলেন, শব্দটা যখন কেবলমাত্র রুরুর দৌড়ের সময়েই শোনা যায় তখন বুঝতে হবে যে তার কারণ, তার পায়ের দুটো করে জোড়। আবার কেউ কেউ বলেন, এর কারণ হল, কুকুরে দাঁতদুটোর কোনো অজ্ঞাত কারণে ঠোকাঠুকি। এই যে দুটি কারণ দেখানো হয়েছে তাদের কোনোটাই ঠিক নয়। শব্দটা আসে রুরুর মুখ থেকে, ঠিক যেভাবে অন্য যে-কোনো প্রাণী শব্দ করে সেভাবেই, এবং অনেক রকম পরিস্থিতিতেই এ শব্দ শোনা যায়; যেমন দৃষ্ট বস্তু সম্বন্ধে অনিশ্চয়তা থাকলে, বা কোনো শিকারী কুকুরের সাড়া পেলে, কিংবা কোনো সঙ্গীর পিছু-পিছু চলার সময়ে। রুরুর সাবধানী ডাক এক স্পষ্ট বক্তৃত শব্দ, মাঝারি আকারের কোনো কুকুরের ডাকের সঙ্গে তার সাদৃশ্য আছে।

রুরুটা যখন জল-পথটা পার হচ্ছে, তখন কীট-পতঙ্গভুক আর ফল-ভুক বিরাট একঝাঁক পাখি ডানদিক দিয়ে আমাদের কাছে এগিয়ে এল। এই ঝাঁকে আছে স্থানীয় পাখির সঙ্গে যাবাবর পাখিও। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে দেখতে পাব পাখিগুলো আমাদের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে,–ওরা যখন জলপথের দু-দিকের উপর বসবে কিংবা যখন উড়তে থাকবে তখন ওদের ভাল করে দেখবার সুযোগ হবে। পাখি যখন এমন জায়গায় বসে যেখানে পশ্চাৎপট বলে কিছু নেই বা আকাশই একমাত্র পশ্চাৎপট, তখন খুব কাছে না হলে রঙ দেখে তাদের সনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু আকার ও ডানার ঝাঁপটানি লক্ষ করে যে-কোনো প্রজাতির উড়ন্ত পাখিকে সনাক্ত করা যায়। এইবার যে পাখির ঝাঁক আমাদের দিকে উড়ে আসছে, তাতে প্রতিটি পাখিই কিচির-মিচির করছে, নয়তো শিস দিচ্ছে। এই ঝুঁকে আছে, দু-জাতের সাতসতী, এদের এক জাতের ঠোঁট ছোট, রঙ টকটকে লাল। অন্য জাত আকারে ছোট, গলায় গোলাপী ছোপ। ছোট ঠোঁট শয়ালি ও ছোট্ট বুলালচশম। এরা থাকে গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ের মগডালের সবচেয়ে উঁচু পাতায় আর গাছ বা ঝোপের কচি কচি ডালে, আর সেই জায়গা থেকে আকাশে লাফিয়ে উঠে পতঙ্গ ধরে। তাদেরই জাতের বা অন্য জাতের উড়ন্ত পাখিদের ঝুঁকের সামনে পড়ে এই পতঙ্গরা ভয়ে উড়ে বেড়ায়। সাত-সতীদের সঙ্গে থাকে চার রকম কটকটে,–সাদা-ভুরু চোখদয়াল, হলদে চোখ-দয়াল ইত্যাদি; ছ-রকম কাঠঠোকরা; হরবোলা প্রভৃতি চার রকম বুলবুল; দুর্গাটুনটুনি প্রভৃতি তিন রকম টুনটুনি; তা ছাড়াও আরও অনেক রকম পাখি।

এইসব পাখির সংখ্যা দুই থেকে তিনশো। এছাড়াও একজোড়া কালোমুড়ী সোনালী-হলদে পাখি, গাছ থেকে গাছে তারা পরস্পরকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে, আর আছে একটা ছোটখাট ভিমরাজ; বড় ভিমরাজের মত অতটা মারমুখো না হলেও সে তার প্রহরার এলাকা থেকে প্রচুর রসালো পতঙ্গ গ্রাস করেছে। এই তো সবে ধরেছে একটা মোটাসোটা শূককীট, একটা বেঁটেখাটো কাঠঠোকরা অনেক খেটে সেটাকে শুকনো গাছের ডাল থেকে বার করে এনেছিল। পাখির ঝাঁকটা এতক্ষণে আমাদের মাথার উপর দিয়ে উঠে বাঁদিকের জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে;–এখন একমাত্র শব্দ ল্যান্টানার ঝোপের থেকে বন-মোরগের আঁচড়ানোর শব্দ, আর একমাত্র পাখি যা চোখে পড়ছে সে হল শা-বাজ-শান্ত হয়ে শিমূল গাছের মগডালে বসে শিকারের প্রতীক্ষা করছে।

ডানদিকে ল্যান্টানার ঝোপের পেছনে বাগানের মত খানিকটা ফাঁকা জায়গা, অনেক বড় বড় প্লাম গাছ সেখানে। ওইদিকে থেকে শোনা গেল একটা লাল বানরের সাবধানী ধ্বনি আর তার কয়েক মুহূর্ত পরেই গোটা-পঞ্চাশ বিভিন্ন বয়সের ও বিভিন্ন আকৃতির বানরের উত্তেজিত কিচির-মিচির, গর্জন। বোঝা যাচ্ছে চিতা বেরিয়েছে, এবং যেহেতু সে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গা ধরে চলেছে তাই মনে হয় না সে শিকারের সন্ধানে বেরিয়েছে। মনে হয় সে চলেছে পাহাড়ের পাদদেশের কোনো গভীর দরিপথে, দিনের গরম সময়টা চিতারা প্রায়ই এমনি জায়গায় গিয়ে কাটায়। প্লাম গাছগুলো ঘুরে একটা পথ আছে যেটা মানুষ ও পশু উভয়েরই চলার পথ। আরও দুশো গজ এগিয়ে এই পথটা আমাদের জলপথকে কেটে চলে গেছে। চিতাটার যখন এই পথে আসা একরকম নিশ্চিতই বলা চলে, তখন চলুন আমরা তাড়াতাড়ি শ-দেড়েক গজ এগিয়ে গিয়ে বাঁ দিকের উঁচু তীরটায় হেলান দিয়ে বসি। জলপথটা এখানে চওড়ায় পঞ্চাশ ফুট,-এর বাঁ তীরের গাছগুলোয় হনুমানের একটা বিরাট পাল থাকে। লাল বানরের সতর্কধ্বনি তারা শুনেছে, শুনে দলের সব মা-ই তাদের বাচ্চাদের ধরে রেখেছে। সকলের চোখ এখন যে দিক থেকে সাবধানী ডাকটা এসেছে সেদিকে।

এ পথের দিকে আপনার তাকিয়ে থাকবার দরকার নেই, কারণ পথের সবচেয়ে কাছে যে গাছ তার শেষের ডালে যে বাচ্চা হনুমানটা বসে আছে চিতাটা এলে সে-ই আপনাকে সতর্ক করে দেবে। চিতা দেখলে বানররা একরকম আচরণ করে, হনুমানরা আরেক রকম। হয় হনুমানরা আরো সঙ্বদ্ধ বলে, নয়তো তাদের আত্মীয় লাল বানরদের মত অতটা সাহসী নয় বলে। চিতার দেখা পেলে দলের সব বানর একসঙ্গে চেঁচামেচি শুরু করে, পরপর সারি বাঁধা গাছ থাকলে গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে তাকে অনুসরণ করে চলে বেশ কিছু দূর পর্যন্ত। হনুমানরা কিন্তু তা করে না। প্রহরী হনুমান চিতার দেখা পেলেই ‘খক খক্ খ’ করে সাবধান করে দেয়, আর যখন দলের সর্দার প্রহরীর নির্দেশ অনুসরণ করে চিতার দেখা পেয়েই নিজেই ডাক শুরু করে, প্রহরী তখন থামে। তখন থেকে সাবধানী ডাক দেবে কেবল দলের সর্দার আর সবচেয়ে বুড়ী-হনুমান, স্ত্রী-হনুমানের ডাকটা কতকটা হাঁচির শব্দের মত। কিন্তু কেউই চিতাটাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করবে না। এবার প্রহরী হনুমানটা চার পায়ে দাঁড়িয়ে উঠবে। তারপর মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে দিয়ে এপাশে ওপাশে বাঁকাবে। এইবার সে নিশ্চিত, সে চিতাটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। তাই সে আবার ডেকে উঠবে। পিছন থেকে তার আরো দু’এক সন্ত্রস্ত সঙ্গীও ডেকে উঠবে। এতক্ষণে সর্দারও ভয়ঙ্কর শত্রুর দেখা পেয়েছে। সেও ডেকে উঠবে, এবং মুহূর্ত-পরেই দলের বৃদ্ধাও ডেকে উঠবে হাঁচির মত শব্দ তুলে। বাচ্চারা এখন সবাই চুপচাপ, থেকে-থেকে কেবল মাথা তুলছে আর নামাচ্ছে, আর মুখভঙ্গি করছে। পুরো দলটা কেমন যেন জেনে গেছে, আজ এই বসন্তের সকালে চিতা তাদের কোনো ক্ষতি করবে না কারণ খিদে পেয়ে থাকলে চিতা এভাবে ফাঁকায় পেরিয়ে না এসে হয় আরও উপরে নয় আরও নিচে কোথাও জল-পথটা পার হয়ে অদৃশ্য থেকে অগ্রসর হত। চিতা হনুমানের মতই ক্ষিপ্র, ওজনে হনুমানের চেয়ে একটু ভারি, তাই হনুমান ধরতে তার কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু লাল বানরদের ব্যাপারটা আলাদা, তারা সরু ডালের প্রান্তে চলে যায়, সেখানে চিতা তার ভারি শরীর নিয়ে উঠতে সাহস করে না।

চিতাটা এখন মাথা উঁচু করে পঞ্চাশ গজ ফাঁকা জায়গাটা পার হয়ে চলেছে, অপূর্ব ফুটকি দেওয়া তার শরীরে সকালের সূর্যের আলো এসে পড়েছে। যে বৃক্ষশ্রেণীর দিকে সে চলেছে সেখানকার ডালে ডালে যে সব হনুমান ভিড় করে রয়েছে তাদের দিকে তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হচ্ছে না। একবার সে থামল, তারপর জলপথের দুদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আবার তেমনি ধীরভাবে এগিয়ে গেল। তীরে পিঠ দিয়ে আমরা নিস্পন্দ বসে আছি, আমাদের সে দেখতে পায় নি। খাড়াই তীর বেয়ে উঠে সে আমাদের দৃষ্টির অগোচর হয়ে গেল। কিন্তু যতক্ষণ হনুমান-সর্দার আর বুড়ী হনুমানটা তাকে দেখতে পাবে ততক্ষণ তারা জঙ্গলের প্রাণীদের সতর্ক করতে থাকবে।

এবার চিতাটার থাবার ছাপ পরীক্ষা করে দেখা যাক। পথটা যেখানে জলপথটাকে। কেটে গেছে সেখানকার মাটি লাল, মানুষের খালি পায়ের চাপে চাপে শক্ত হয়ে গেছে। এই মাটির উপর সূক্ষ্ম সাদা ধুলোর আস্তরণ থাকায় আমাদের সুবিধে হয়েছে। ধরে নেওয়া যাক যে আমরা চিতাটাকে দেখি নি, হঠাৎ এই থাবার ছাপ আবিষ্কার করেছি। প্রথমেই যা আমাদের চোখে পড়ে তা হল, থাবার ছাপগুলো দিব্যি টাটকা বলে মনে হচ্ছে। সুতরাং বেশিক্ষণ হয় নি ওগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। এ ধারণা আমাদের হয়েছে এই থেকে যে, এই ধুলোর আস্তরণের উপর যেখানে চিতাটার থাবার ছাপ পড়েছে সেখানটা চ্যাপ্টা আর মসৃণ হয়ে বসে গেছে আর পায়ের পাতার আর আঙুলের ছাপ ঘিরে যে দেওয়াল তৈরি হয়েছে তা স্পষ্ট, আর মোটামুটি সিধে। অল্পক্ষণের মধ্যেই হাওয়া আর রোদ লেগে আবার ধুলোর স্তূপটা উঁচুহতে থাকবে, দেওয়ালগুলো ভেঙে পড়বে। পিঁপড়ে এবং অন্যান্য অনেক কীটপতঙ্গ এই পথ অতিক্রম করে যাবে, ধুলো জমতে থাকবে। ঘাস আর শুকনো পাতার টুকরো হাওয়ায় উড়ে বা অন্যভাবে এখানে এসে পড়বে; কালক্রমে দাগটা অদৃশ্য হয়ে যাবে একেবারে। কোনো দাগ দেখে সেটা কত পুরনো তা বিচার করার কোনো বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই, সেই দাগ বাঘের বা চিতারই হক কিংবা সাপের বা হরিণেরই হক। কখন প্রাণীবিশেষ এই দাগ এঁকে রেখে চলে গেছে তা মোটামুটি নির্ভুল নির্ণয় করতে গেলে খুঁটিয়ে লক্ষ করতে হয়, সঙ্গে সঙ্গে আরো কয়েকটা ব্যাপার ভেবে নিতে হয়; যেমন ধরা যাক, থাবার ছাপ পড়েছে কোথায়, ছায়ায় না ফাঁকা জমিতে; পড়েছে কখন, দিনে রাত্রে যখন অনেক পোকামাকড় চলাফেরা করে; যখন সাধারণত বাতাস বয়; কিংবা যখন শিশির ঝরে নয়তো গাছ থেকে টুপ টুপ করে পড়ে। এইসব মিলিয়ে একটা মোটামুটি ঠিক সময় আঁচ করে নেওয়া যায়। বর্তমান ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চিত যে দাগটা টাটকা, কিন্তু এইটুকু জানলেই তো চলবে না। এখন আবার দেখতে হবে চিতাটা পুরুষ না স্ত্রী, যুবক না বৃদ্ধ, বড় না ছোট। থাবার ছাপ যে-রকম গোল তাতে বোঝা যাচ্ছে, এ হল পুরুষ চিতা। পায়ের পাতায় কোনো ফাটল বা ভাজ না-থাকায়, পায়ের আঙুলগুলো গোল-গোল হওয়ায়, আর সমস্ত ছাপটার মধ্যে একটা নিটোল ভাব থাকায় বোঝা যায় যে চিতাটা অল্পবয়স্ক। অনেক দিন ধরে লক্ষ করে দেখে থাকলে পায়ের ছাপ থেকে জন্তু-জানোয়ারের আয়তন অনুমান করা যায়। এ ব্যাপারে খানিকটা অভিজ্ঞতা হলেই চিতা বা বাঘের দৈর্ঘ্য বলে দেওয়া যায়, বড় জোর ইঞ্চি দুয়েক এদিক ওদিক হতে পারে। মির্জাপুরের কোলদের বাঘের মাপের কথা জিজ্ঞাসা করলে একটা ঘাসের শিস নিয়ে তারা থাবার ছাপটা মেপে নেয়, তারপর ঘাসটা মাটিতে রেখে হাতের আঙুল দিয়ে মেপে দেখে। এই উপায়ে ওরা কতটা নির্ভুল হতে পারে জানি না; তবে থাবার ছাপের মোটামুটি আকৃতি দেখে আমি কোনো জন্তুর দৈর্ঘ্য ও আকৃতি সম্বন্ধে একটা ধারণা করে নিই; কারণ যে উপায়ই গ্রহণ করা হ’ক তা আন্দাজ বই তো আর কিছু নয়।

একটু এগিয়ে গেলেই, পথটা যেখানে জলধারা পার হয়ে এগিয়ে গেছে, সেখানে খানিকটা শক্ত বালিভরা জমি, আর এক দিকে পাথরের স্তূপ আর অপর দিকে উঁচু তীর। এই বালির উপর দিয়ে একপাল চিতল হরিণ চলে গেছে। জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে চিতল বা সম্বরের পালে কটা হরিণ আছে গুণতে সব সময়ই বেশ মজা লাগে। আর সঙ্গে সঙ্গে আলাদা করে প্রত্যেকটি হরিণকে লক্ষ করে দেখে নিলে পরবর্তীকালে দেখা পেলে পালটাকে চেনা যায়। দলের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছে কি না বোঝা যায়। তা ছাড়া দলটার সঙ্গে যেন একটা চেনাপরিচয় গড়ে ওঠে। ফাঁকায় থাকলে দলে কটা পুরুষ তা গণনা করা, তাদের শিঙের দৈর্ঘ্য বা আকৃতি লক্ষ করা, কিংবা কটা হরিণী বা বাচ্চা আছে, তা গণনা করা কঠিন নয়। কিন্তু যখন একটামাত্র হরিণ দেখা যায় আর অন্যগুলো আড়ালে থাকে, তাদের আড়াল থেকে বার করে আনার একটা পদ্ধতি দশ বারের মধ্যে ন-বারই সফল হতে দেখা গেছে। তার পিছু নিয়ে যতটা কাছাকাছি আসা সম্ভব এসে কোনো গাছ বা ঝেপের পেছনে লুকিয়ে পড়ে চিতার ডাক ডেকে উঠুন। সব জন্তুই শব্দের উৎস নিখুঁত আন্দাজ করতে পারে; তাই যেই দেখবেন হরিণটা আপনার দিকে ফিরেছে গাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে কাঁধটা একটুখানি বার করে আস্তে আস্তে দু-একবার উপরে নিচে দোলান কিংবা ঝোঁপ হলে তার কয়েকটা পাতা নাড়িয়ে দিন। নড়াচড়াটা লক্ষ করলেই হরিণটা ডাকতে শুরু করবে, তার দলের সকলে বেরিয়ে এসে তার দু-দিকে সার বেঁধে দাঁড়াবে। একবার দলের পঞ্চাশটা চিতলই সার বেঁধে আমায় দেখা দিয়েছে, আমি নিশ্চিন্তে তাদের ছবি তুলেছি। তবে একটু সাবধান করে দিচ্ছি। যতক্ষণ না একেবারে নিশ্চিত হচ্ছেন, যে বনের ওই অঞ্চলে আপনি ছাড়া আর কেউ নেই ততক্ষণ পর্যন্ত কখনো চিতার ডাক ডাকবেন; এবং সে ক্ষেত্রেও চারদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। কারণ বলছি। একদিন রাত্রে আমি শুনি, একটা চিতা ক্রমাগত ডেকে চলেছে। তার আওয়াজ শুনে ভাবলাম সে বিপন্ন। পরদিন আলো ফোঁটার আগেই আমি বেরিয়ে পড়লাম কী তার হয়েছে খোঁজ করতে। সে যেদিক থেকে ডাকছিল রাত্রের মধ্যে কখন চলে গেছে সেদিক থেকে। সকালে ডাক শুনে মনে হল, খানিকটা দূরের একটা পাহাড়ে সরে গেছে। পশুদের পায়ে-চলা পথ ধরে একটা ফাঁকা-মত জায়গায় পৌঁছলাম। এখান থেকে চিতাটাকে দেখতে পাব সে আমায় দেখতে পাবার আগে। সেখানে একটা বেড়ার থামের আড়ালে শুয়ে পড়ে আমি তার ডাকের সাড়া দিলাম। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে চলল এই ডাকা আর সাড়া। এগিয়ে আসছে চিতাটা, কিন্তু আস্তে আস্তে, এবং অত্যন্ত সন্তর্পণে। শেষ পর্যন্ত যখন সে আমার একশো গজের মধ্যে এসে গেল তখন আমি ডাক বন্ধ করলাম। যে কোনো মুহূর্তে চিতাটার প্রতীক্ষায় আমি উপুড় হয়ে শুয়ে ছিলাম হাতের উপর থুতনি রেখে, এমন সময় পেছনে পাতার খসখস শব্দ শুনে মাথা ফিরিয়ে তাকাতেই একটা বন্দুকের নল সোজা আমার চোখে পড়ল।

আগের দিন রাত্রে নৈনিতালের ডেপুটি কমিশনার ক্যাসেলস্ আর কর্নেল ওয়ার্ড বন-বাংলোয় এসেছেন এবং আমার অজাতেই তারা এক চিতার বাচ্চাকে গুলি করেছেন। রাত্রে তার মায়ের ডাক শোনা যায়। ঠিক ভোরবেলায় ওয়ার্ড একটা হাতি করে তাকে মারতে বেরিয়ে পড়েন। মাটিতে শিশির আর ওস্তাদ মাহুত। নিঃশব্দে সে হাতি নিয়ে এগিয়ে এসেছে। তার আর আমার মধ্যে তখন কেবলমাত্র একসারি গাছের ব্যবধান। ওয়ার্ড আমাকে সেখানে হয়তো দেখতে পেতেন, কিন্তু প্রথম তার বয়স হয়েছে, তার উপর আবার ভোরের আলোও খুব স্পষ্ট ছিল না; ফলে যখন তিনি তাঁর রাইফেলের সাইটটা ঠিক করে আমার কাঁধে লক্ষ স্থির করতে পারলেন না তখন ইঙ্গিতে হাতিটাকে এগিয়ে যেতে বললেন। আমাদের ভাগ্য ভাল যে গাছপালা ডিঙিয়ে হাতিটা যখন মাত্র দশ গজের মধ্যে এসে পড়েছে আর মাহুতের ইঙ্গিতে (সেও বৃদ্ধ) ওয়ার্ড দ্বিতীয়বার বন্দুকটা বাগিয়ে ধরবার চেষ্টা করছেন, এমন সময় হাতিটা একটা নোয়ানো ডালে পা দিয়ে শব্দ করতে আমি মাথা ফেরাতেই একটা ভারি বন্দুকের নল আমার একেবারে চোখের সামনে ঝলকে উঠল।

চিতল হরিণের যে পালটার পদচিহ্ন অনুসরণ করে আমরা চলেছি, আগের দিন সন্ধ্যায় তারা বালি-ভরা জমিটার উপর দিয়ে চলে গেছে। এটা বোঝা যায় রাত্রে যে-সব কীটপতঙ্গ তাদের পদরেখা অতিক্রম করে গেছে তা থেকে, আর ঝুলে পড়া একটা গাছ থেকে যে শিশির পড়েছে তা থেকে। দলটা এখন এক মাইল কি পাঁচ মাইল দূরে, হয়তো কোনো ফাঁকা জায়গায়, কিংবা কোনো ঝোপ-জঙ্গলের আড়ালে। তবুও আমরা গুণে দেখব কটা ছিল,–বলছি কিভাবে। ধরা যাক, কোনো চিতল হরিণের দাঁড়ানো অবস্থায় সামনের আর পেছনের পায়ের খুরের দূরত্ব ত্রিশ ইঞ্চি। এবার একটা কাঠ দিয়ে বালির উপর এই চিহ্নের সমকোণে একটা রেখা টানুন। এই রেখা থেকে ত্রিশ ইঞ্চি মেপে নিন,–মাপা সহজ, কারণ আপনার জুতো দশ ইঞ্চি লম্বা। এবার এই রেখা থেকে প্রথম রেখাটার সমান্তরাল আর একটা রেখা টানুন। এবার কাঠিটা নিয়ে গুণে দেখুন এই দুই রেখার মধ্যে কতগুলো খুরের চিহ্ন আছে, আর সেইসঙ্গে প্রতিটি দাগ বরাবর কাঠিটা দিয়ে একটা করে চিহ্ন করে যান। ধরুন, গুণে দেখলেন, ত্রিশ। এই সংখ্যাটাকে দুই দিয়ে ভাগ করুন, তাহলেই আপনি একরকম নিশ্চিন্ত হয়ে বলতে পারবেন যে আগের দিন সন্ধ্যায় পনেরটা চিতলের একটা দল এখান দিয়ে চলে গেছে। বন্য বা গৃহপালিত যে-কোনো জন্তুর সংখ্যা স্থির করতে এ পদ্ধতি কার্যকরী হবে, তবে, খুব বেশি সংখ্যা হলে হয়তো নিখুঁত হবে না, –ধরুন দশটা পর্যন্ত; তার বেশি হলে নিখুঁত না হলেও তার কাছাকাছি হবে–যদি অবশ্য সামনের পা আর পেছনের পায়ের দূরত্বটা জানা থাকে। ছোট ছোট প্রাণী–যথা বনকুত্তা, শুয়োর বা ভেড়ার ক্ষেত্রে এই দূরত্ব ত্রিশ ইঞ্চির কম, আর সম্বর বা গৃহপালিত গরু-মোষের ত্রিশ ইঞ্চির বেশি।

আমি যখন জঙ্গলে যুদ্ধের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলাম তখন যাঁরা আমার সঙ্গে ছিলেন না তাদের অবগতির জন্যে বলছি, জঙ্গলে মানুষের পায়ের চিহ্ন থেকেও অনেক খবরই সংগ্রহ করা সম্ভব, সে চিহ্ন রাস্তার উপরে পশু-চলা পথে বা অন্য যেখানেই হক না কেন। ধরা যাক আমরা কোনো শত্রুর এলাকায়, কোনো পশু-চলা পথের উপরে এসে পড়েছি যেখানে পায়ের চিহ্ন আছে। পদ-চিহ্নগুলো দেখে তাদের পরিমাপ, তাদের আকৃতি, কাটা আছে কি না, গোড়ালিতে লোহা আছে কি নেই, জুতোরসোল চামড়ার না রবারের ইত্যাদি জেনে নিয়ে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসি যে এই চিহ্ন আমাদের লোকদের জুতোর নয়, শত্রুপক্ষের। এ বিষয়ে নিশ্চিত হবার পর আমাদের দেখতে হবে তারা কখন এখান দিয়ে গেছে, এবং দলে ক-জন ছিল। সময়টা কিভাবে হিসেব করতে হবে তা আপনারা জানেন। এবার সংখ্যাটা নির্ণয় করত হলে আমাদের এই চিহ্ন কেটে একটা রেখা টানতে হবে, আর এই রেখার উপর এক পায়ের আঙুলগুলো রেখে ত্রিশ ইঞ্চি তুফাতে পা ফেলতে হবে। এই দুই রেখার মধ্যবর্তী গোভলির ছাপগুলো থেকে আরও অনেক তথ্য আবিষ্কার করা সম্ভব। যেমন ধরুন, কত বেগে তারা চলছি। স্বাভাবিক পদক্ষেপে চলবার সময় মানুষের শরীরের ওজন সমভাবে তার পদচিহ্নের উপর পড়ে, এবং পদক্ষেপের দূরত্বটা হয় মানুষের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী ত্রিশ থেকে বত্রিশ ইঞ্চি। গতি যত বাড়িয়ে দেওয়া হয়, গোড়ালির চাপ তত কম পড়ে আর আঙুলের চাপ তত বাড়তে থাকে, এবং পদক্ষেপের দূরত্ব তত দীর্ঘ হতে থাকে। গোড়ালি কম চাপ, আঙুলে বেশি ক্রমেই আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত পূর্ণ বেগে দৌড়ের সময়ে কেবলমাত্র গোড়ালির সামান্য ছোঁয়া, আর আঙুলের ছাপ মাটিতে ফুটে ওঠে। দলে অল্পসংখ্যক লোক থাকলে অর্থাৎ একশো কুড়ি থেকে দেড়শোর মঋে হলে হিসেব করা সম্ভব তার মধ্যে কেউ খুঁড়িয়ে চলছে কি না, এবং কেউ আহত হয়েছে কি না তাও আন্দাজ করা যায় রক্তের দাগ থেকে।

জঙ্গলে কখনো কেটে-কুটে গেলে একটা ছোট, নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর চারাগাছের খবর আপনাদের দিতে পারি যা শুধু রক্ত বন্ধ করবে না, আমার জানা যে-কোনো ওষুধের চেয়ে ভালভাবে সারিয়ে তুলবে। সব জঙ্গলেই এ গাছ পাওয়া যায়, লম্বায় বার ইঞ্চির মত, আর এর লম্বা সরু বোঁটায় যে ফুল ফোটে তা দেখতে কতকটা ডেজি ফুলের মত। এর পাতাগুলো শাঁসালো, আর ক্রিসান্থিমামের পাতা যেমন, তেমন করাতের মত.আকৃতির। কয়েকটা পাতা নিয়ে প্রথমে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে যাতে ধুলো না থাকে, তারপর আঙুলের চাপ দিলেই ক্ষতস্থানে রস পড়বে। প্রচুর রস লাগাবেন, ব্যস আর কোনো চিকিৎসার দরকার হবে না; এবং ক্ষতটা বিশেষ গভীর না হলে দু-একদিনেই সেরে যাবে। নামটাও সার্থক, ব্রহ্ম বুটি’ অর্থাৎ ঈশ্বরের ফুল।

যুদ্ধের ক-বছর আপনাদের অনেকেই ভারত ও ব্রহ্মের জঙ্গলে আমার সঙ্গে ছিলেন। যদি আমি তখন সময়ের অভাবে আপনাদের বেশি খাঁটিয়ে থাকি তো নিশ্চয় এতদিনে আপনারা আমাকে ক্ষমা করছেন। এবং তখন যা আমরা একসঙ্গে শিখেছি নিশ্চয় সে সব ভুলে যান নি। যেমন ধরুন, কোন্ কোন্ ফুল আর ফল খাওয়া নিরাপদ, খাবার যোগ্য শেকড় কোথায় মিলতে পারে, চা আর কফির অভাবে কী খাওয়া যেতে পারে,জ্বর-জারিতে, ঘায়ে বা গলার ব্যথায় কোন্ চারা গাছ বা কোন্ গাছের ছাল খেতে হবে, স্ট্রেচার হিসেবে কোন্ লতার ব্যবহার চলবে, ভারি মালপত্র বা বন্দুক কোন্ লতায় বেঁধে নদী বা দরি পার হতে হবে, কিভাবে চললে পায়ে ফোস্কা পড়বে না ঘামাচি হবে না, কিভাবে আগুন জ্বালাতে হরে, ভিজে বনে কিভাবে শুকনো কাঠ মিলবে, বন্দুক না নিয়ে কিভাবে শিকার করা সম্ভব, উপযুক্ত পাত্র না থাকলেও কিভাবে চা করা যাবে, নুনের অভাব, কিসে মিটবে, কী করে সাপের কামড়ের, স্ময়ের বা পেটের অসুখের চিকিৎসা হবে, এবং শেষ পর্যন্ত, কিভাবে জঙ্গলের মধ্যে শরীর ঠিক রাখা যাবে আর সমস্ত বন্য প্রাণীর সঙ্গে শান্তিতে বাস করা যাবে। এ সমস্ত, এবং এইরকম আরও অনেক কিছুই আপনারা আর আমি একসঙ্গে শিখেছি। আমরা জড় হয়েছিলাম কত জায়গা থেকে, ভারতের পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল্প থেকে, ব্রিটেনের নগর গ্রাম থেকে, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যাণ্ড ও অন্য দেশ থেকে। বাকি জীবনটা জঙ্গলে জঙ্গলে কাটাব এ উদ্দেশ্যে নয়, নিজেদের আর পরস্পরের মধ্যে সাহস সঞ্চারের উদ্দেশ্যে অজানার ভয়কে জয় করতে আর শত্রুকে দেখাতে যে তাদের চেয়ে মানুষ হিসেবে আমরা উচ্চস্তারের। তবে, যা কিছু শিখেছি সে সবই অত্যন্ত ভাসা-ভাসা; কারণ প্রকৃতির জ্ঞানভাণ্ডারের না আছে শুরু না আছে সমাপ্তি।

বসন্তপ্রভাতের অনেকটা সময়ই এখনো আমাদের হাতে রয়েছে। আমরা এসে পৌঁছেছি পাদশৈল অঞ্চলে, সমতল ভূমি পার হয়ে। এখানকার উদ্ভিদ আলাদা। এখানকার বহুতর বট আর প্লাম গাছে ফলের লোভে অনেক রকমের পাখির আড্ডা বসে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে চোখে পড়ে বড়-বড় ধনেশ পাখি। এদের অদ্ভুত অভ্যাস মেয়ে-পাখিদের বাসায় আটকে রাখা। এর ফলে পুরুষ-পাখিদের উপর একটা ভীষণ চাপ পড়ে, কারণ যত দিন পেটে ডিম থাকে মাদিরা ভয়ঙ্কর মোটা হতে থাকে এবং ডিম পাড়ার পর-সচরাচর তারা দুটো ডিম পাড়ে–তাদের ওড়ার ক্ষমতা থাকে না। পুরুষকে তখন সমস্ত পরিবারের খাদ্য সংস্থানের জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করতে হয়। বেপ চেহারা, শব্দযন্ত্র লাগানো প্রকাণ্ড ঠোঁট আর ভারি শরীর নিয়ে কষ্ট করে ওড়া–এসব দেখে মনে হয় যেন বিবর্তনের ইতিহাসে তাদের কথা কেউ ভাবে নি। বাসার মুখ এঁটে দিয়ে ছোট্ট একটা ফাঁক রাখা, যেখান দিয়ে মাদি ধনেশ ঠোঁটের আগাটা মাত্র গুলিয়ে দিয়ে মদ্দার নিয়ে আসা খাবার খেতে পারে-এ অভ্যাস সম্ভবত প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে চলে আসছে যখন আজকের দিনের চেয়ে তার শত্রু ছিল অনেক বেশি শক্তিশালী। কঁপা গাছের ভিতরে বা গাছে ফোকর তৈরি করে যে-সব পাখি বাসা বাঁধে তাদের সকলের শত্রু এক। এদের মধ্যে কয়েক জাতের পাখি একেবারেই অসহায় ও নিরস্ত্র; তাই প্রশ্ন ওঠে, কেন তাহলে কেবলমাত্র ধনেশ পাখি, শক্তিশালী এক জোড়া ঠোঁট থাকায় যার আত্মরক্ষার শক্তি বরং সকলের চেয়ে বেশি, এভাবে তার বাসা বন্ধ করে থাকে? ওর আর একটা অভ্যাস যা অন্য কোনো পাখির মধ্যে আমি দেখি নি, রঙ দিয়ে পালক সাজানো। রঙটা হলদে, এবং রুমাল দিয়ে মুছলেই উঠে যায়; এটা থাকে ল্যাজের উপরের একটা ছোট থলেতে। দুই ডানার প্রস্থের উপর সে এটা ঠোঁটে করে মাখিয়ে দেয়। বৃষ্টি হলেই যা ধুয়ে যায় এমন জিনিস কেন ধনেশ তার পিঠে লাগায় জানি না,-একমাত্র যুক্তি যা আমার মনে হয়, শত্রুর আক্রমণ এড়াবার জন্যে আত্মগোপনের চেষ্টা,-কোনো সুদূর অতীতে যার প্রয়োজন হয়েছিল। আজকের দিনে তার একমাত্র শত্রু হল চিতা,-এবং যে চিতা রাত্রে শিকার করে এ-হেন আত্মগোপন-প্রচেষ্টা তার বিপক্ষে কার্যকরী হয় না।

ধনেশ ছাড়া আরও অনেক ফলাহারী পাখি এইসব বট আর প্লাম গাছে বাসা বাঁধে। এদের মধ্যে আছে দু-রকম হরিয়াল, দু-রকম বসন্তবাউরি, চার রকম বুলবুল প্রভৃতি। সালামুড়ি ছোট পেঙারা তাদের সু-উচ্চ বাসা ছেড়ে যায় সব পাখির শেষে, আবার ফিরেও আসে সব পাখির আগে।

বটগাছগুলোর কাছে আছে একটা দাবানল-পথ,এটাকে কেটে গেছে সেই বহু-ব্যবহৃত পশু-চলা পথ যেটা সিধে পাহাড় বেয়ে সেই ভোল পর্যন্ত গেছে যেটার কাছে বরনার জল জমে একটা জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। ভোল আর এই জলাশয়ের মাঝামাঝি জায়গায় আছে একটা গাছের গুঁড়ি। একটা বেঁটে-খাটো কুসুম গাছ এখানে ছিল, চোরাশিকারীরা শিকারের নিয়ম মেনে চলে না; তাই যখন বার-বার মাচান ভেঙে দিয়েও কোনো কাজ হল না তখন আমি কেটেই দিলাম গাছটা। শুনেছি নাকি মাংসাশী প্রাণীরা ভোলে কিংবা জলাশয়ে প্রাণ বধ করে না। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মাংসাশী প্রাণীদের যতই বিচার-বিবেচনা থাকুক, ভারতে কিন্তু ভোলে হত্যা করায় তাদের বিবেকে বাধে না। বলতে কি, তারা এইসব জায়গাতেই হত্যা করে বেশি দেখবেন, এই ভোলের কাছে অনেক হাড় আর শিঙ ছড়িয়ে রয়েছে। শজারুরা তার কিছু কিছু খেয়ে গেছে। হরিণ আর বানররা থাকে এমন যে কোনো বনের মধ্যে ভোল থাকলেই তার ধারে এই দৃশ্য দেখবেন।

চলুন এবার ভোলের উপরকার পাহাড় বেয়ে উঠি সেইখানটায় যেখান থেকে পাদশৈল আর তার চারপাশের জঙ্গল দেখা যেতে পারে। আমাদের সামনেই সেই বিস্তীর্ণ জঙ্গল যার মধ্য দিয়ে আমরা এইমাত্র সেই জলাশয়টার কাছে এসে পড়েছি যেখানে থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এ বন প্রকৃতির হাতে গড়া,এখানকার কাঠের বাজার নেই বলে মানুষের সর্বধ্বংসী হাত এ বনকে স্পর্শ করে নি। সামনে হালকা সবুজ ঝোঁপ দেখা যাচ্ছে, শিশু গাছের চারার কোল,-এর জন্ম হয়েছে পাদশৈল থেকে বন্যার জলে ধুয়ে আসা বীজ থেকে। এই চারা পরবর্তীকালে পরিণত আকার লাভ করে গরুর গাড়ির চাকা বা আসবাবপত্র তৈরির প্রয়োজনে সেরা কাঠ হিসেবে গণ্য হয়। ঘন সবুজ যে ঝোঁপগুলির মধ্যে লাল ফলের কাঁদ দেখছেন ওগুলো হল রুনি গাছ। ওইগাছ থেকে আসে সেই মসৃণ রেণু, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে যার নাম কমলা। গরিব মানুষরা যখন পাখিদের মত খাবারের আশায় আর শীতের ভয়ে উঁচু পাহাড় থেকে পাদশৈলে নেমে আসে, তখন তারা কাজ থেকে একটি দিন ছুটি নিয়ে ছেলে-বুড়ো সবাই কমলার সন্ধানে জঙ্গলে গিয়ে ঢোকে। কমলা হল এ ধরনের লাল রেণু–এই রেণু রুনি ফলের গায়ে লেগে থাকে। কমলা সংগ্রহ করতে হলে প্রথমে গাছের ডাল কেটে নিতে হয়, তারপর ফলগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে একটা বড় সরু ঝুড়িতে রেখে বুড়ির গায়ে ফলগুলোকে ঘষে নিতে হয়। রেণুগুলো তখন ঝুড়ির ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে পড়ে কোনো চিতল হরিণের চামড়া বা একফালি কাপড়ের উপর। যখন প্রচুর ফলন হয়, সংসারের পাঁচ জন–স্বামী-স্ত্রী আর তিন ছেলেমেয়ে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত কাজ করে দু-সেরের মত কমলা সংগ্রহ করতে পারে বাজারে তার দাম এক টাকা থেকে দু-টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। ভারতে ও মধ্যপ্রাচ্যে এই রেণুর ব্যবহার হয় পশম রঙ করতে, এবং অসৎ ব্যবসায়ীরা এর সঙ্গে ইটের গুঁড়ো মেশানো শুরু করবার আগে মাখন রঙ করার জন্যে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রেও এর বহুল প্রচলন ছিল। ওষুধের কাজেও এর ব্যবহার আছে,-সরষের তেলে রুনির ফল : সেদ্ধ করে বাতের যন্ত্রণায় উপকার পাওয়া যায়।

শিশু আর রুনি গাছের মধে-মধ্যে আছে খয়ের গাছ-পালকের মত হালকা তার পাতা। শুধু লাঙলের ফলা তৈরির কাজেই নয়, উত্তরপ্রদেশের হাজার হাজার দরিদ্র মানুষ খয়েরের এক কুটিরশিল্প গড়ে তুলেছে। এই শিল্প শীতকালীন, চার মাস ধরে দিনরাত্রি মানুষ পরিশ্রম করে চলে। এ থেকে হয় পানে খাওয়ার খয়ের, আর সেইসঙ্গে ফাউ হিসেবে পাওয়া যায় খাকি রঙ-পোশাক বা মাছ-ধরা জাল রাঙানোর কাজে যার ব্যবহার। আমার বিশ্বাস মীর্জা নামে আমার এক ব্লন্ধুই প্রথম এর এই গুণ আবিষ্কার করে এবং তাও নিতান্ত, ঘটনাচক্রেই। একদিন লোহার পাত্রে খয়ের সেক্স হচ্ছিল, মীজা ঝুঁকে পড়ে দেখছিল, এমন সময় তার সাদা রুমালটা পড়ে যায় খয়েরের মধ্যে। একটা কাঠ দিয়ে রুমালটা তুলে নিয়ে মীর্জা কাঁচতে দেয় সেটা। কিন্তু কেচে, আসার পর যখন মীর্জা দেখল রুমালের দুগ একটুও ওঠে নি, তখন সে ধোপাকে ধমক দিয়ে আবার সেটা কাঁচতে দিল। কিন্তু ধোপা ফিরে এসে বললে যে দাগ ওঠাবার যত পদ্ধতি অর জানা আছে সব প্রয়োগ করেও সে এ দাগ ওঠাতে পারে নি। মীর্জা তখন বুঝল যে সে একটা পাকা রঙ আবিষ্কার করেছে। ইজ্জতনগরে তার তৈরি ফ্যাক্টরিতে এখন দিব্যি এইরঙ তৈরির কাজ চলছে।

সবুজের অনেক রকম-ফেরের সঙ্গে (কারণ প্রত্যেক গাছেরই একটা নিজস্ব রঙ আছে) দেখা যায় উজ্জ্বল কমলা, সোনালি, গোলাপি, লাল ইতাদি রঙের সমারোহ। যে গাছের কমলা রঙের ফুল তার নাম ক, এ থেকে যে পদ্মরাগ রঙের, আঠা বেরোয় তা দিয়ে সবার সেরা রেশম রঙ করা হয়। এখানে আছে তিন ফুট দীর্ঘ ডাল ভর্তি সোনালি ফুল অমলতাস, এর দু-ফুট লম্বা বেলনাকৃতি, বীজাধারের মিষ্টি রসে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়,কুমায়ুনের সর্বত্রই এর ব্যাপক ব্যবহার আছে। আর আছে রক্তকাঞ্চন, হালকা বেগুনি রঙের ফুল। গোলাপি ফুলগুলো কুসুম গাছের,-আর হালকা থেকে ঘন-গোলাপি যেগুলো স্তূপীকৃত:দেখা যাচ্ছে সেগুলো কোন ফুল নয়, কুচি কচি পাতা। লাল ফুলগুলো শিমুল গাছের,-ফুলের মধুপায়ী সব রকম, পাখির আর যত বানর আর হরিণ আর শুয়োর এই শাঁসালো ফুল খায় তাদের অত্যন্ত প্রিয়, কিছুকাল পরে ফুলগুলি খসে গিয়ে শুধু শক্ত বীজাধারটা রয়ে যায়। এপ্রিল মাসে যখন গরম বাতাস বইতে থাকে তখন এগুলো ফেটে উড়ে যায় মেঘের মত সাদা তুলো,–এর প্রত্যেকটি ভাগে থাকে একটা করে বীজ; প্রকৃতির উদ্যানকে আবার এরা উদ্ভিদে ভরে তোলে। পাখি বা পশু যে সব বীজ স্থানান্তরে নিয়ে যায় না সেগুলো আবার এমনভাবে তৈরি যাতে বাতাসে উড়ে দিগবিদিক ছড়িয়ে পড়তে পারে। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। নারকেল; যার শক্ত খোসাটাই সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে ভেসে দেশ-দেশান্তরে গিয়ে ঠেকে।

খালটার ওপারে আমাদের গ্রাম, ওখান থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। উজ্জ্বল সবুজ আর সোনালি ছোপ থেকে বোঝা যাবে কোথায় গমের অঙ্কুর বেরোচ্ছে আর কোথায় সরষে খেত, ফুলে ভরে উঠেছে। গ্রামের পাদদেশের সুদা রেখাটা হল সীমান্তের প্রাচীর, ওটা তৈরি করতে দশ বছর লেগেছিল-দেওয়ালটার ওপারে বনের বিস্তার শেষ পর্যন্ত দিগন্তরেখায় গিয়ে মিশেছে। পূর্বে আর পশ্চিমে যতদুর চোখ যায় সীমাহীন বনের পর বন, আমাদের পেছনেশৈলশিরার পর শৈলশিরা শেষ পর্যন্ত চিরতুষার রাজ্যে পৌঁছেছে।

বিরাট হিমালয়ের ছায়ায় এই শান্ত সুন্দর পরিবেশে আমরা বসে আছি, আমাদের ঘিরে বনু বসন্তের নতুন সাজে সেজেছে। বাতাসের প্রতি তরঙ্গে ভেসে আসছে ফুলের সুগন্ধ। বহুতর পাখির গানের খুশিতে বাতাস স্পন্দমান। এখানে বসলে আমরা কিছুকালের জন্যে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ক্লেদ ভুলে প্রাণিজগতের স্বাদ গ্রহণ করতে পারি। কারণ এখানে জঙ্গলের আইন বিরাজমান, সে আইন মানুষের তৈরি আইনের থেকে শধু পুরনোই নয়, অনেক ভালও। এ আইনে প্রত্যেকের নিজের মত জীবন ধারণের অধিকার, ভবিষ্যতের চিন্তায় সেখানে কোনো দুশ্চিন্তা, কোনো উদ্বেগ কোনো দুঃখের অবকাশ নেই। বিপদ সেখানে সকলেরই আছে; কিন্তু তাতে জীবন আরো প্রাণময় হয়ে ওঠে, এবং প্রতিটি প্রাণী সর্বদা সতর্ক থাকলেও জীবন উপভোগে বাধা ঘটে না। আপনার চারদিকে যে আনন্দের পরিব্যাপ্তি ‘আপনি তা এখন ধরতে পারবেন, কারণ এখন আপনি শব্দের উৎস নির্ণয় করতে শিখেছেন, ডাক শুনে প্রত্যেকটি পশু-পাখিকে আলাদা করে চিনতে শিখেছেন এবং সে ডাকের কারণ জানতে পেরেছেন। বাঁ দিকে দূরে একটা ময়ূর জোড় বাঁধবে বলে ডেকে উঠল, –ডাকটা শুনে আপনি বুঝতে পারলেন যে সে পুচ্ছ মেলে নাচছে ময়ুরীর ঝাঁকটাকে আকৃষ্ট করবার জন্যে। আরও কাছে আছে এক বন-মোরগ,আশেপাশের সব-কিছুকে অবজ্ঞা করে সে ডেকে চলেছে, আর সে ডাকের সাড়া যারা দিচ্ছে। তাদের আওয়াজেও অবজ্ঞার ভাব সমান স্পষ্ট। লড়াই কিন্তু পারতপক্ষে ঘটে না, কারণ বনের মধ্যে লড়াই করা মানেই বিপদকে ডেকে আনা। দুরে ডানদিকে একটা পুরুষ-সম্বর জঙ্গলকে সাবধান করে দিচ্ছে, সে দেখেছে একটা চিতা শুয়ে রোদ পোয়াচ্ছে। এই চিতাটাকে আমরা ঘণ্টাখানেক আগে দেখেছি। সমানে ডেকে যাবে সম্বরটা যতক্ষণ না চিতাটা সেদিনের মত ঘন ঝোপের মধ্যে চলে গিয়ে এইসব প্রহরীর দৃষ্টির অগোচর হয়ে যাচ্ছে। আমাদের নিচের একটা ঝোঁপ থেকে অনেকগুলো পাখি পত্রবহুল কুঞ্জের আড়ালে একটা ঘুমন্ত ফুটকি পেঁচাকে আবিষ্কার করে সেই আবিষ্কার বন্ধুত্বের দেখাবার জন্যে ডাকছো তাঁরা জানে যে এই জ্ঞানী জ্ঞানী দেখতে জীবটির কাছে এগোনো, এমনকি তার কানের কাছে চিৎকার করা পর্যন্ত এখন নিরাপদ, কারণ বাচ্চা কাছে থাকলেই সে ক্কচিৎ কখনো দিনের আলোয় হত্যা করে, নয়তো নয়। আর পেঁচাটাও জানে যে ওরী তাকে যতই ভয় বা ঘৃণা করুক তাদের থেকে তার কোনো ভয় নেই এবং খেলা শেষ হলেই নিজে থেকেই ক্লান্ত হয়ে ওরা চলে যাবে, পেঁচা আবার ঘুমোতে পারবে। বাতাসে কেবলই শব্দ আর শব্দ, কিন্তু প্রতিটি শব্দই অর্থপূর্ণ। ওই যে চমৎকার নরম সুরটা কানে আসছে, ওটা হল শ্যামার ভাক,লাজুক সঙ্গীকে প্রেম নিবেদন করছে। ট্যাপ-ট্যাপ-ট্যাপ শব্দটা হল একটা সোনালি-পিঠ কাঠঠোকরার,নতুন ডেরা গড়বে বলে একটা মরা গাছে গর্ত করে চলেছে। আর কর্কশ চিৎকারটা হল একটা পুরুষ-চিতলের আওয়াজ,–প্রতিদ্বন্দ্বীকে সংগ্রামে আহ্বান করছে। আকাশে অনেক উঁচুতে একটা তিলিয়া বাজ চিৎকার করে চলেছে, তারও উপরে এক ঝক শকুনি স্থির হয়ে আকাশ পরিদর্শন করে বেড়াচ্ছে। গতকাল একজোড়া কাক শকুনিদের দেখিয়ে দেয় কোথায় একটা বাঘ তার মড়ি লুকিয়ে রেখেছিল–জায়গাটা হল একটা ঝোপ, সেই ঝোপটার কাছে আজ একটা ময়ুর নেচে চলেছে। আজও এখন উড়তে উড়তে, ঘুরতে ঘুরতে তারা সেইরকম সৌভাগ্যের প্রত্যাশায় রয়েছে।

এখানে সদলে বা একা বসে আপনি পুরোমাত্রায় অনুভব করতে পারবেন জঙ্গলের অভিজ্ঞতার তাৎপর্য আপনার কাছে কতটা এবং সে অভিজ্ঞতার ফলে অন্যের আত্মবিশ্বাস ও আনন্দ কী পরিমাণে বর্ধিত হয়েছে। জঙ্গলকে আর আপনি ভয় করেন না, কারণ আপনি জেনেছেন যে জঙ্গলে ভয় করবার মত কিছু নেই। প্রয়োজন হলে না থাকতে পারেন যেখানে খুশি। দিক নির্ণয় করতেও শিখেছেন, বাতাসের গতি সম্বন্ধেও সজাগ হয়েছেন,কাজেই দিনে বা রাতের কোনো সময়েই জঙ্গলে পথ হারাবার ভয় আর আপনার রইল না। দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রিত করাটা প্রথমে খুব কঠিন হয়েছিল বটে, কিন্তু এখন আপনি জানেন যে আপনার দৃষ্টির পরিধি ১৮০ ডিগ্রি, এবং সেই পরিধির মধ্যে যে-কোনো নড়াচড়া আপনার দৃষ্টিগোচর হবে। জঙ্গলের যে-কোনো প্রাণীর জীবনযাত্রার মধ্যেই আপনি অংশগ্রহণ করতে পারেন, কারণ তাদের ভাষা আপনি শিখেছেন, এবং শব্দের উৎস নির্ণয় করার ফলে তাদের প্রতিটি চলাফেরাও এখন আপনার আয়ত্তে। নিঃশব্দে চলাফেরা বা নির্ভুল গুলি, করা এখন আপনি শিখেছেন; এবং যদি-বা কখনো কোনো প্রাণীকে গুলি করতে হয় তাহলেও কোনোরকম-হীনমন্যতা আপনার মধ্যে থাকবে না, কারণ আপনি জানেন যে যত সুনামের অধিকারীই সে হক না কেন তার চেয়ে আপনার জ্ঞান বেশি; তার কাছ থেকে কিছুই আপনার শেখবার নেই বা তাকে ভয় করবারও কিছু নেই।

এবার ফেরার পথ ধরতে হবে, কারণ অনেকটা পথ আমাদের সামনে, ম্যাগি প্রাতরাশ নিয়ে বসে থাকবে। ফিরে যে-পথে এসেছি সেই পথে, এবং যেখানে আমরা বালির উপর চিতলের পায়ের চিহ্নের হিসেব নিচ্ছিলাম সে জায়গা পার হয়ে, যে পথে চিতাটা জল-স্থল পার হয়েছিল সেটা পার হয়ে, পাদশৈল থেকে যে পলিমাটি ধুয়ে এসেছিল, তাও পার হয়ে এসে এবার আমরা একটা গাছের ডাল টানতে-টানতে নিয়ে যাব যাতে আমাদের কোনো চিহ্ন না থেকে যায়, কারণ তাহলেই, কাল বা পরশু বা যেদিনই আমরা আবার শিকারে যাব, বুঝতে পারব যে যা কিছু চিহ্ন আমাদের চোখে পড়ছে সে সমস্তই এই ক-দিনের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে।

.

১২.

জঙ্গলের জ্ঞান সঞ্চয় করতে করতে এমন একটা বোধ গড়ে উঠতে পারে যা আমাদের আদিম পুরুষ থেকে বংশানুক্রমে আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে আসছে, যাকে আমরা বলব, জঙ্গল-অনুভূতি। এই অনুভূতি, যা আসে জঙ্গলে বহুকাল বন্য জন্তুর নিবিড় সান্নিধ্যের ফলে, এ হল অবচেতন মনের বিকাশ, জঙ্গলের বিপদ সম্বন্ধে যা আমাদের সাবধান করে দেয়।

অনেকেই সাক্ষ্য দেবেন, অনির্দেশ্য এক আবেগের বশে কাজ করে অনেক ক্ষেত্রে রক্ষা পেয়ে গেছেন, কোনো আসন্ন বিপদ সম্বন্ধে তা তাদের অবচেতন মনকে সাবধান করে দিয়েছে। কোনো ক্ষেত্রে তা হয়তো কোনো পথে অগ্রসর হতে বারণ করেছে,–দেখা গেছে মুহূর্তকাল পরেই সেখানে একটা বোমা ফেটেছে,–কোনো ক্ষেত্রে আবার কোনো বাড়ির কাছাকাছি অঞ্চল থেকে সরে যেতে বলেছে পরমুহূর্তেই যেটা একটা গোলার আঘাতে ভেঙে পড়েছে, আবার কখনো কোনো গাছের তলা থেকে সরে যেতে বলেছে, পরমমুহূর্তেই যে গাছে বাজ পড়েছে। এতে করে যে বিপদ সম্বন্ধে সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে, সে বিপদ ছিল জানা, এবং আন্দাজ করা হয়েছিল। চৌগড়-মানুষ-খেকো’র কাহিনীতে আমি অবচেতন মনের এই সাবধান করে দেবার দুটো উদাহরণ দিয়েছি। মানুষ খেকোর আক্রমণ থেকে যে সময়ে আমায় বিরত করা হয় আমার সমস্ত মন তখন এই চিন্তায় একাগ্র হয়েছিল-কিভাবে মানুষখেকোটার কবল থেকে রক্ষা পেতে পারি। প্রথম বার বিরত করা হয়েছে একত্র জড় করা পাথরের ঢিবিটা থেকে, আর দ্বিতীয়বার একটা ঝুঁকে পড়া পাথরের থেকে যেটার তলা দিয়ে আমার চলে যাবার কথা ছিল। উভয়-ক্ষেত্রেই তা ছিল যেমন স্বাভাবিক তেমনি সুবোধ্য। এবার আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি যেখানে বিপদের সম্ভাবনা ছিল অজানা তবুও অবচেতন মন থেকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে,-এর একমাত্র ব্যাখ্যা যা আমার মনে আসে সে হল জঙ্গল-অনুভূতির চরম বিকাশ।

শীতের ক-মাস কালাধুঙ্গিতে থাকতে মাঝে মাঝে আমি আমাদের প্রজাদের জন্যে .একটা সম্বর বা চিতল হরিণ শিকার করতাম। একবার তাদের ক-জন এসে আমায় মনে করিয়ে দিল যে অনেকদিন আমি তাদের জন্যে কিছু শিকার করি নি। পরদিন একটা গ্রাম্য উৎসব ছিল, সেই উপলক্ষে তারা আমায় একটা চিতল মেরে দিতে অনুরোধ করল। এই সময় জঙ্গল অত্যন্ত শুকনো হওয়ায় শিকারের পিছু নেওয়া কঠিন হয়ে ওঠে, ফলে সূর্যাস্তের আগে কোনো শিকার করা, গেল না, কেবল একটা হরিণ ছাড়া। অন্ধকারে হরিণটাকে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে না ভেবে আমি চিতার ভয়ে সেটা ঢাকালুকি দিয়ে রেখে ফিরে এলাম, ঠিক করলাম পরদিন ভোরে দলবল নিয়ে ওটাকে আনব।

আমার বন্দুকের আওয়াজ গ্রাম থেকে শোনা গিয়েছিল। বাড়ি ফিরতে দেখলাম, জন দশ-বার লোক দড়ি, আর একটা মজবুত আঁশ নিয়ে আমাদের কুটিরের সিঁড়িতে আমার প্রতীক্ষায় রয়েছে। ওদের কথার উত্তরে জানালাম অমি হরিণ মেরেছি, আর বললাম পরদিন সূর্যাস্তের সময় গ্রামের গেটে আমার সঙ্গে দেখা করলে ওদের হরিণটার কাছে নিয়ে যাব। কিন্তু ওরা সেদিন রাত্রেই হরিণটা নিয়ে আসবে বলে তৈরি হয়ে এসেছিল, তাই বললে যে আমি যদি বলে দিই কোথায় সেটা রয়েছে তাহলে ওরা গিয়ে খুঁজে নিয়ে আসতে পারবে। আগে যখন আমি গ্রামবাসীদের জন্যে হরিণ মেরেছি, একটা চিহ্ন রেখে এসেছি। জঙ্গলটার সূঙ্গে তারাও, আমার মতই পরিচিত, তাদের এখন শুধু বলে দিলেই হবে কোন্ দাবানল-পথের, বা বন্য জন্তুর বা গরুর চলার পথের কাছে সে চিহ্ন। সেই চিহ্ন ধরে তারা আমার নিশানা অনুসরণ করে যাবে। শিকার-করা জীবজন্তু আবিষ্কারের এই পন্থা কখনো বিফল হয় নি। কিন্তু এক্ষেত্রে হরিণটা মেরেছি সন্ধ্যার পরে, অন্ধকার রাত্রে। ফলে কোনো চিহ্ন রেখে আসা সম্ভব হয় নি। ওরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল সে-রাত্রেই হরিণটা ভাগ করে নিয়ে পরদিনের ভোজের ব্যবস্থা করতে। তাই ওদের হতাশ করতে আমার ইচ্ছে হল না। ওদের বললাম পাওয়ালগড়ের দাবানল-পথ ধরে আড়াই মাইল পর্যন্ত গিয়ে সুপরিচিত হলুদ গাছটার নিচে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে। ওরা বেরিয়ে চলে যেতে, ম্যাগি আমার জন্যে যে চা তৈরি করে এনেছিল তা, খেতে বসলাম।

একজনের পিছনে একজন এইভাবে একদল মানুষের জঙ্গলের পথে যা সময় লাগে একা মানুষের সময় লাগে তার চেয়ে অনেক কম, তাই আমি তাড়াহুড়ো করি নি। বন্দুক নিয়ে যখন আমি বেরিয়ে পড়লাম তখন একেবারে অন্ধকার হয়ে গেছে। সেদিন আমাকে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অনেক মাইল হাঁটতে হয়েছে, কিন্তু আমার স্বাস্থ্য, খুব ভাল থাকায় তার উপর আর পাঁচ মাইল বা ছ-মাইল বিশেষ কিছু অসুবিধের ছিল না। অনেকটা আগে বেরিয়ে পড়া সত্ত্বেও যখন, আমি তাদের নাগাল ধরে ফেললাম, হলুদ গাছটা তখনও খানিকটা দুরে। হরিণটা সহজেই খুঁজে পাওয়া গেল। তারপর সেটাকে বাঁশের সঙ্গে বাঁধা হয়ে গেলে আমি একটা সংক্ষিপ্ত পথ ধরে যাত্রা করলাম,এতে করে পথ আধ-মাইল কম হল। বাড়ি যখন ফিরলাম তখন রাত্রের খাওয়ার সময় হয়েছে। শুতে যাবার আগে স্নান করব, এই বলে আমি ম্যাগিকে খাবারের ব্যবস্থা করতে বলে হাত-পা ধুতে গেলাম।

সেদিন রাত্রে হাত-পা ধোবার জন্যে জামাকাপড় খুলতে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখি, আমার হালকা রবারের জুতো লাল ধুলোয় ভরে গেছে; দু-পায়েও লেগেছে ধুলো। পায়ের ব্যাপারে আমি অত্যন্ত সাবধানী, যে কারণে পায়ের জন্যে আমায় কখনো ভুগতে হয় না। তাই বুঝলাম না এত অসাবধানী আমি কী করে হলাম। ছোটখাট এক একটা ব্যাপার মন থেকে কিছুতেই যেতে চায় না। আর মনে এলেই আমাদের মস্তিষ্কে যেখানে সংবাদ জমা হয়, সেখানকার স্নায়ুতে পৌঁছে যায়, তারপর হঠাৎ রহস্যটা প্রকাশ হয়ে পড়ে হয়তো কোনো মানুষের বা কোনো জায়গার নাম, অথবা বর্তমান ক্ষেত্রে যেমন, আমার পায়ের এই দুরবস্থার কারণ।

কাঠগুদামে রেলপথ তৈরি হবার আগে যে বড় রাস্তা দিয়ে পাহাড়ের দিকে যানবাহন চলাচল হত, সেই রাস্তা আমাদের গেট থেকে বোর পুল পর্যন্ত এক সরলরেখা। পুল ছাড়িয়ে তিনশো গজ এগিয়ে রাস্তাটা বেঁকে গেছে বাঁ দিকে। এই মোড়ের ডান দিকের রাস্তাটা, সেই সময়ে, পাওয়ালগড়ের দাবানল-পথের সঙ্গে মিশেছিল। কয়েকশো গজ পর্যন্ত সেটা পাওয়ালগড়ের বর্তমান মোটর-চলা পথের সঙ্গে সমান্তরাল হয়ে চলেছে। বোর পুল থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে কোটা রোড় ডান দিক থেকে এসে বড় রাস্তায় মিশেছে। এই দুই রাস্তার সংযোগস্থল আর মোড়টার মাঝামাঝি রাস্তাটা একটা অগভীর নিচু জায়গা দিয়ে চলে গেছে। ভারি ভারি গরুর গাড়ি চলার ফলে এই নিচু জায়গাটা লাল ধুলোয় ভরে উঠেছে, ফলে ধুলো এখানে ছ-ইঞ্চি পুরু। এই ধুলো এড়াবার জন্যে এই ধুলোমাখা পথ আর বাঁ দিকের জঙ্গলের মাঝামাঝি জায়গার উপর দিয়ে একটা সরু পায়ে-চলা পথের সৃষ্টি হয়েছে। মোড়টার কাছের দিকে ত্রিশ গজের মধ্যে রাস্তাটা, আর সরু পায়ে-চলা পথটা একটা ছাৈট পুলের উপর দিয়ে চলে গেছে ঐই পুলের দেওয়াল এক ফুট পুরু আঠার ইঞ্চি উঁচু, যাতে গেরুর গাড়ি ‘এখান থেকে নিচে পড়ে যেতে না পারে। বহু বছর হল এই পুলটা অকেজো হয়ে রয়েছে। এই পুলের নিচের দিকে, অর্থাৎ সরু পায়ে চলা পথটার দিকে রাস্তার সমান উঁচ লম্বায় চওড়ায় আট-দশ ফুট বালি ভরা জমি।

আমার পায়ে এত ধুলো লাগল কেন ভাবতে গিয়ে আমার মনে পড়ল, চা সেরে ওদের পিছন পিছন চলতে চলতে আমি পুলটার কয়েক গজ আগে পর্যন্ত এসে রাস্তাটা বাঁ দিক থেকে অতিক্রম করে ডান দিকে ছ-ইঞ্চি পুরু ধুলোর উপর দিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর রাস্তাটার ভান দিকের ধার ঘেঁষে পুলটা পার হয়ে আবার রাস্তা অতিক্রম করে পায়ে-চলা পথটা ধরে চলেছিলাম। কিন্তু কেন করেছিলাম? বাড়ি থেকে বেরোনো থেকে হলদু গাছটার কাছে আমার লোকজনের ধরে ফেলা পর্যন্ত আর্মি এমন একটা শব্দও পাই নি যাতে বিপদের আশঙ্কা হতে পারে, আর সেই অন্ধকার রাত্রে আমি চোখেও দেখি নি কিছু। কেন তবে আমি রাস্তাটা পার হলাম, আর কেনই বা আবার রাস্তাটা পেরিয়ে গেলাম ওদিকে?

এই বইয়ের গোড়ার দিকে বলেছি যে, যেদিন আমি ড্যানশির বনশীর কারণ নির্ণয় করে জানলাম যে দুটো মসৃণ গাছের ঘর্ষণে এর সৃষ্টি, সেই থেকে জঙ্গলের যে-কোনো অস্বাভাবিক শব্দ বা দৃশ্যের কারণ নির্ণয় করা আমার একটা নেশায় দাঁড়িয়েছে। এই তো আর-একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। এর রহস্য উদ্ধার করতে হবে। তাই পরদিন ভোরে কোনো গাড়ি চলার আগে আমি রহস্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম।

আগের দিন সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ি থেকে ওরা সবাই দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে এবং গ্রামের গেটের কাছে আরও তিনজন ওদের দলে যোগ দেওয়ায় সে সংখ্যা দাঁড়ায় চোদ্দয়। বোর পুল পার হবার পর ওরা পায়ে-চলা পথটা ধরে একজনের পিছনে একজন এইভাবে এগিয়ে পুলটা পার হয়। তারপর মোড়ে পৌঁছে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে গিয়ে দাবানল-পথ ধরে এগিয়ে চলে। এর কিছুক্ষণ পরে একটা বাঘ কোটা রোড ধরে এগিয়ে আসে, দুই রাস্তার সঙ্গমের সন্নিকটে একটা ঝোপের কাছে মাটিতে আঁচড় কাটে, তারপর বড় রাস্তাটা অতিক্রম করে পায়ে-চলা পথ ধরে এগিয়ে চলে। এখানে আমার নোকজনের পায়ের দাগের উপর বাঘটার থাবার ছাপ স্পষ্ট। বাঘটা এই পায়ে-চলা পথে ত্রিশ গজ পর্যন্ত অগ্রসর হবার পর আমি পুলটার উপর গিয়ে পৌঁছই।

পুলটা লোহার; স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে আমি যখন পুল পার হয়েছি, বাঘটা শব্দ পেয়েছে। কারণ আমি জোরে পা ফেলে চলেছিলাম, নিঃশব্দে চলার কোনো চেষ্টাই করি নি। শব্দ শুনেই বাঘটা বুঝতে পারে, আমি কোটার রাস্তা ধরে এগোব না, বরং তার দিকেই এগিয়ে আসছি। তাতেই সে দ্রুত পায়ে-চলা পথটা দিয়ে এগিয়ে যায়, পুলের কাছে এসে পথটা ছেড়ে দিয়ে রাস্তার দিকে মুখ করে বালি-ভরা জমিটার উপর শুয়েছিল,–পথটা থেকে তার মাথাটার দূরত্ব তখন এক গজ মাত্র। পায়ে-চলা পথটা ধরে আমি বাঘটার পিছু পিছু চলেছিলাম, আর পুলটার পাঁচ গজের মধ্যে এসে অমি ডাইনে মোড় ফিরেছিলাম; তারপর ছ-ইঞ্চি পুরু ধুলো-ভরা রাস্তাটা পার হয়ে রাস্তার ডান কিনার ধরে এগিয়ে চলে আবার রাস্তাটা পার হয়ে পায়ে-চলা পথটায় গিয়ে পড়েছিলাম। এ সমস্তই আমি করেছিলাম সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে, যাতে আমায় বাঘটার এক গজের মধ্যে দিয়ে না যেতে হয়।

আমার ধারণা, যদি আমি পায়ে-চলা পথটা ধরেই চলতাম তাহলেও সম্পূর্ণ নিরাপদে বাঘটার সামনে দিয়ে চলে যেতে পারতাম, যদি (ক) স্থির পায়ে হেঁটে চলে যেতাম, (খ) কোনোরকম কথা না বলতাম, এবং (গ) হঠাৎ খুব বেশিরকম নড়াচড়া না করতাম। বাঘটার আমাকে হত্যা করবার কোনো মতলব ছিল না বটে, কিন্তু তার সামনে দিয়ে চলে যাবার সময় যদি আমি জঙ্গলের কোনো শব্দ শোনবার জন্যে থাকতাম, কিংবা কাশতাম বা হাঁচতাম বা নাক ঝাড়তাম, হয়তো তাহলে বাঘটা ঘাবড়ে গিয়ে আমায় আক্রমণ করতে পারত। আমার অবচেতন মন এই ঝুঁকিটা নিতে প্রস্তুত ছিল না। জঙ্গল-অনুভূতি এবার আমার সহায় হয়ে এই সম্ভাব্য বিপদের সান্নিধ্য থেকে আমায় সরিয়ে নিয়ে গেল।

এই জঙ্গল-অনুভূতি যে কতবার আমায় বিপদ এড়িয়ে যেতে সাহায্য করেছে তার হিসেব নেই। কিন্তু এতদিন জঙ্গলে বাসের মধ্যে মাত্র একবার আমি এক বন্য জন্তুর একেবারে সান্নিধ্যে এসে পড়েছিলাম। এ থেকেই প্রমাণ হয় যে, এই জঙ্গল-অনুভূতিই হক বা আমার রক্ষী কোনো দেবদূতই হক, বার-বার চরম মুহূর্তে এ আমার নিরাপত্তা বিধান করে এসেছে।