প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

২০. বুনো শুয়োরের পিছনে

২০. বুনো শুয়োরের পিছনে

বুড়ো পশু পালক আগের দিন সন্ধ্যায় কাটা-বেড়া-ঘেরা আস্তানাটায় এসে পৌঁছেছিল। হরিদ্বারের বাজার থেকে লবণ আর গুড় নিয়ে সে বদ্রীনাথের ওপারের গ্রামগুলোর দিকে যাচ্ছিল, তার ভেড়া আর ছাগলগুলোর পিঠে পুরো বোঝ। লম্বা পথ হেঁটে আস্তানাটায় এসে পৌঁছতে খুব দেরি হয়ে গিয়েছিল, বেড়ার দুর্বল অংশগুলো মেরামত করে নেওয়ারও সময় আর ছিল না।

ফলে কয়েকটা ছাগল বেড়ার ফাঁক দিয়ে ইতস্তত ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তার ভিতর থেকে ভোর রাতের দিকে রাস্তার ধারেই চিতাটার হাতে মারা পড়ে। কুকুরগুলোর ডাকে বুড়োর ঘুম ভেঙে যায়, এবং দিনের আলো ফুটলে সে দেখে যে রাস্তার কাছে মরে পড়ে আছে তার সবচেয়ে সেরা ছাগলটি। প্রায় শেটল্যান্ড পনির মত বড় ইস্পাত-রঙা সেই সুন্দর প্রাণীটাকে চিতাটা অনর্থক মেরে রেখে গেছে।

নরখাদকটার আগের রাতের আচরণ লক্ষ করলেই বোঝা যায়, নরখাদক হয়ে পড়লে এবং বহু বছর যাবৎ মানুষের সান্নিধ্যে থাকলে চিতাদের স্বভাবের কতটা পরিবর্তন ঘটে।

যুক্তিসঙ্গতভাবেই এটা ধরে নেওয়া যায় যে কলে আটক পড়ে নরখাদকটা প্রচণ্ড ধাক্কা ও ভয়ঙ্কর ভয় পেয়েছে। ভারি কলটা টেনে দশ গজ দূরে নিয়ে যাওয়া ও তার ক্রুব্ধ গর্জনের ধাঁচ থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সবাই আশা করবে, কল থেকে মুক্ত হওয়ামাত্রই সে লোকালয় থেকে যতটা সম্ভব দূরে একটা নির্জন জায়গায় বিশ্রাম নেবে এবং কয়েক দিনের মধ্যে আর ক্ষুধার্ত হবে না। কিন্তু তা দূরে থাক, সে ছিল মড়ির কাছাকাছি এবং আমাদের নিরীক্ষণ করতে এসেছিল।

সৌভাগ্যবশত ইটসন সতর্কতা হিসেবে মাচানটার চারদিকটা তারের জাল দিয়ে ঘিরে নিয়েছিল, কারণ নরখাদক চিতা অপেক্ষমান শিকারীকে হত্যা করেছে এমন ঘটনা বিরল নয়। মধ্যপ্রদেশে একটা নরখাদক চিতা আছে, সেটা বিভিন্ন সময়ে চারজন ভারতীয় শিকারীকে মেরে খেয়েছে। শেষ যখন এই প্রাণীটার কথা শুনেছি ততদিনে সে নরহত্যা করেছে চল্লিশটি। তার সম্ভাব্য নিধনকারীদের খেয়ে ফেলার এই অভ্যাসের ফলে সে মানুষের সঙ্গে মাঝে-মাঝে বন্য ও গৃহপালিত জন্তু দিয়ে মুখ বদলিয়ে অব্যাহত শান্তিতে দিন কাটাচ্ছিল।

আমগাছটার কাছে আসার পর আমাদের নরখাদকটির গেঁয়ো পথের সংযোগস্থল পর্যন্ত চলে যায়। এখানেই আমরা জমাট রক্ত দেখেছিলাম। এখান থেকে ডানদিকে মোড় নিয়ে পায়ে-চলা পথ ধরে মাইলখানেক সে গিয়েছে, তারপর তীর্থপথটা ধরে আরও চার মাইল গিয়ে তার উপদ্রুত এলাকার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অংশে প্রবেশ করেছে। রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছে সে বাজারের প্রধান রাস্তা ধরে গিয়েছে আর আধমাইল পরে ইন্সপেকশন বাংলোর গেটের কাছে মাটি আঁচড়িয়েছে। আগের রাতে বৃষ্টিতে মাটি নরম হয়ে থাকায় চিতাটার থাবার ছাপ ফুটে রয়েছে স্পষ্ট। তা থেকে বোঝ গেল যে জাঁতিকলে পড়ে তার কোনো পায়ে তেমন আঘাত লাগে নি।

প্রাতরাশের পর গেটের কাছ থেকে থাবার ছাপ অনুসরণ করে আমি পশুপালকের আস্তানা পর্যন্ত গেলাম। আস্তানা থেকে একশো গজ দূরে রাস্তার একটা বাঁক থেকেই চিতাটা বেড়া থেকে বেরিয়ে-পড়া ছাগলগুলো দেখতে পায় এবং রাস্তার বাইরের কিনারা থেকে ভিতরের কিনারে সরে এসে পাহাড়ের ধার দিয়ে গুঁড়ি মেরে ছাগলগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। তারপর ইস্পাত-রঙা ছাগলটাকে মেরে তার রক্তটাও পান করেই সে রাস্তায় ফিরে যায়।

কাঁটা-বেড়ার মধ্যে শক্ত খুঁটিতে ভারি শিকল দিয়ে বাঁধা পশুপালকের দুটো পাল-প্রহরী কুকুর মরা ছাগলটা ও নিখুঁতভাবে সাজানো মালের বস্তাগুলো পাহারা দিচ্ছিল। আমাদের পাহাড়গুলোয় ব্যবহৃত এই বৃহদাকার কালো রঙের তেজীয়ান কুকুরগুলো গ্রেট ব্রিটেন বা য়ুরোপের পাল-প্রহরী কুকুর বলতে যা বোঝায়, ঠিক তেমন নথিভুক্ত কুলীন নয়। চলার সময় তারা কাছে-কাছে থাকে, কিন্তু তাদের কাজ শুরু হয় তাঁবু ফেলার পর থেকে, আর তারা তা অত্যন্ত নিপুণভাবেই সমাধা করে। রাতে তারা বন্য প্রাণীদের হাত থেকে তাবুকে রক্ষা করে। এদের দুটোয় মিলে একটা চিতা মারার ঘটনাও আমি জানি। দিনের বেলায় মনিব যখন পশু চরাতে যায়, এরা বাইরের প্রবেশকারীদের হাত থেকে তাঁবুকে বাঁচায়। এমন একটা ঘটনার উল্লেখ রয়েছে যাতে একটি লোক তাঁবু থেকে একটা বস্তা সরানোর চেষ্টা করছিল, অমনি ক-টা কুকুর মিলে তাকে মেরেই ফেলেছে।

ছাগলটাকে মেরে চিতাটা আবার যেখানে রাস্তায় ফিরে এসেছে সেখান থেকে তার থাবার ছাপ অনুসরণ করে গোলাাইয়ের ভিতর দিয়ে আরও এক মাইল পর্যন্ত গেলাম। সেখানে একটা গভীর খাদ রাস্তাটাকে চিরে চলে গিয়েছে। আমগাছ থেকে খাদ পর্যন্ত যে দূরত্ব চিতাটা অতিক্রম করেছে সেটা প্রায় আট মাইল। মড়ি থেকে দূরে, এই দীর্ঘ এবং উদ্দেশ্যহীন হেঁটে যাওয়াই এমন একটা ব্যাপার, যা সাধারণ চিতা কোনো পরিস্থিতিতেই করবে না। তা ছাড়া খিদে না পেলে ছাগলও মারবে না।

খাদটা ছাড়িয়ে সিকি মাইল দূরে রাস্তার ধারে একটা পাথরের ওপর বসে বুড়ো পশুপালক পশমের সুতো কাটছিল, আর তার পশুর পালটা চরছিল খোলা পাহাড়ের গায়ে। তকলি আর পশমগুলো আলখাল্লার পকেটে রেখে, একটা সিগারেট নিয়ে সে জিগ্যেস করল আমি তার তাবুর পাশ দিয়ে এসেছি কি না।

যখন বললাম, এসেছি, এবং দুষ্ট আত্মাটা কি করেছে তাও দেখেছি। সেইসঙ্গে যোগ করলাম, পরের বার হরিদ্বারে গিয়ে যেন সে তার কুকুরদুটো উটওয়ালাদের কাছে বেচে দেয় কারণ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে ওগুলোর সাহস নেই–তখন সে অনেকটা সম্মতিসূচকভাবে মাথাটা নাড়াল।

তারপর বলল, ‘সাহেব, আমরা বুড়োরাও অনেক সময় ভুল করি। আর আজ রাত্রে যেমন আমার সেরা ছাগলটা হারিয়ে ভুগছি তেমনি তার ফলও ভুগি। আমার কুকুরগুলোর বাঘের মত সাহস, গাড়োয়ালের সেরা কুকুর এরা। তুমি যে এদের উটওয়ালাদের কাছে বেচে দিতে বললে, এটা এদের পক্ষে অপমান। আমার তাঁবু তো দেখেছ, রাস্তার একেবারে ধারেই। রাতে হঠাৎ কোনো লোক যদি রাস্তা দিয়ে এসে পড়ে তবে কুকুরগুলো তার ক্ষতি করতে পারে ভেবেই আমি ও-দুটোকে ছাড়া না রেখে বেড়ার বাইরে বেঁধে রেখেছিলাম। তার ফল তুমি দেখেছ। কিন্তু কুকুরের দোষ দিয়ো না সাহেব, আমার ছাগল বাঁচানোর চেষ্টায় ওদের গলায় শিকল বসে গিয়েছে গম্ভীর হয়ে, তার ঘা সেরে উঠতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে।

যখন আমরা এসব কথা বলছি তখন গঙ্গার অনেক দূরে পাহাড়ের চূড়ায় একটা প্রাণীকে দেখা গেল। রং ও আকার দেখে প্রথমে আমি ওটাকে একটা হিমালয়ের ভাল্লুক বলে মনে করেছিলাম, কিন্তু যখন ওটা পাহাড় থেকে নদীর দিকে নামতে লাগল তখন বুঝতে পারলাম ওটা প্রকাণ্ড একটা বুনো শুয়োর। শুয়োরটার পিছনে তাড়া করে আসছিল একপাল গেঁয়ো কুকুর, তাদের পিছনে এক দঙ্গল ছেলে-বুড়ো। তাদের সবার হাতেই নানা আকারের লাঠিসোঁটা।

সবশেষে আসছিল বন্দুকধারী একটি মানুষ। লোকটি পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছেই বন্দুকটা তুলল। এক-ঝলক ধোঁয়া দেখতে পেলাম এবং একটু পরেই গাদা বন্দুকের একটা শব্দ। বন্দুকের পাল্লার মধ্যে জীবন্ত প্রাণী বলতে ছিল শুধু ছেলেবুড়োর দলটা, কিন্তু সেই দৌড় প্রতিযোগিতা থেকে কেউ পড়ে গেল না দেখে বোঝা গেল যে শিকারীর গুলি লক্ষভ্রষ্ট হয়েছে।

শুয়োরটার সামনে তখন লম্বা একটা ঘেসো ঢাল। ইতস্তত এক-আধটা ঝোপ-জঙ্গলের একটা বেষ্টনী একেবারে নদীর ধার পর্যন্ত নেমে গিয়েছে।

ভাঙাচোরা জমিটার ওপর কুকুরগুলো শুয়োরটাকে প্রায় ধরে ফেলল। সবগুলো প্রায় একসঙ্গেই ঢুকে পড়ল ঝোপ-জঙ্গলের ভিতরে। পরমুহূর্তেই, শুধু আগের হালকা রঙের কুকুরটা ছাড়া সব-কটা কুকুর পরিত্রাহি ছুটে ঝোপ-জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল। লোজনরা এসে পৌঁছলে মনে হল তারা কুকুরগুলোকে আবার জঙ্গলে ঢোকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু শুয়োর তার দাঁত দিয়ে কী করতে পারে সদ্য-সদ্য তার নমুনা দেখে কুকুরগুলো এখন অনিচ্ছুক। এই সময় বন্দুকধারী লোকটি এসে পৌঁছবার সঙ্গে-সঙ্গেই তাকে ঘিরে ধরল সবাই।

আমরা উঁচু পাহাড়ে বসে আছি, মাঝখান দিয়ে নদী বয়ে চলেছে। ওপারের পাহাড়ে যে দৃশ্য অভিনীত হচ্ছে তা একটি নির্বাক ছবি, কারণ জলের গর্জনে সব শব্দ মুছে গিয়েছে, শব্দের মধ্যে শুনতে পাচ্ছি শুধু গাদা বন্দুকের ভোতা আওয়াজটা।

বন্দুকধারী লোকটিও দেখা গেল জঙ্গলে প্রবেশ করতে কুকুরগুলোর মতই অনিচ্ছুক। অচিরেই সে সবার সঙ্গ ত্যাগ করে একটা পাথরের ওপর গিয়ে বসে পড়ল ভাবখানা এই, আমার যেটুকু করার করেছি, এখন তোমরা বোঝ গিয়ে।’ কুকুরগুলোর কয়েকটাকে প্রহার করা সত্ত্বেও তারা শুয়োরটার সম্মুখীন হতে কিছুতেই রাজী হল না; এই উভয়-সঙ্কটে পড়ে প্রথমে ছেলেগুলো, পরে বয়স্করাও ঝোপের মধ্যে পাথর ছুঁড়তে শুরু করল।

এইসব ব্যাপার যখন চলেছে তখন আমরা শুয়োরটাকে জঙ্গলের নিচের দিক থেকে একটুকরো বালি-জমির ওপর বেরিয়ে আসতে দেখলাম। দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে সেটা খোলা জায়গায় এসে পড়ল, নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেণ্ড, আরও কয়েক পা এগোল, থামল আবার, তারপর একটু দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীর মধ্যে। বুনো জাতের শুয়োররা দুর্দান্ত সাঁতারু, এবং সাঁতারের সময় খুরের ঘায়ে তাদের গলা আদৌ কেটে যায় না, যদিও চলতি ধারণা তাই।

নদীতে স্রোত ছিল প্রচণ্ড, কিন্তু আমাদের বুনো শুয়োরদের মত বীরের কলিজা খুব কম জানোয়ারেরই আছে। শেষবার শুয়োরটাকে যখন দেখলাম তখন স্রোতের টানে সে প্রায় সিকি মাইল দূরে চলে গিয়েছে, কিন্তু সাঁতার কাটছে, অমিতবিমে, আর এপারের দিকেই আসছে। সন্দেহ নেই যে সে নিরাপদেই পাড়ে পৌঁছেছিল।

‘শুয়োরটা যখন বালিটার উপর দাঁড়িয়েছিল তখন ওটা কি তোমার রাইফেলের পাল্লার মধ্যে ছিল সাহেব?’ পশুপালক প্রশ্ন করল।

 ‘হ্যাঁ’, আমি উত্তর দিলাম, শুয়োরটা পাল্লার মধ্যেই ছিল। কিন্তু প্রাণের দায়ে যে শুয়োর পালাচ্ছে, তাকে গুলি করার জন্যে আমি রাইফেল নিয়ে গাড়োয়ালে আসিনি। গুলি করতে এসেছি, তুমি যাকে দুষ্ট আত্মা বলে ভাব আর আসলে আমি যেটাকে চিতা বলে জানি।

 ‘তোমার যা অভিরুচি’, সে জবাব দিল, “তুমি এখন চলে যাবে, এবং আর কখনো হয়তো আমাদের মধ্যে দেখা হবে না। আমার আশীর্বাদ জানাচ্ছি তোমাকে। যথাসময়েই প্রমাণ হবে কার কথা ঠিক, তোমার না আমার।

আমার দুঃখ, যে আর কোনোদিন বুড়োর সঙ্গে দেখা হয় নি। বুড়ো লোক ছিল চমৎকার–সম্রাটের মত গর্বিত, আর রোদ ঝলমলে দিনের মত সদাই হাসিখুশি। কেবল, তার সেরা ছাগলগুলো চিতাটার হাতে মারা না পড়লে, বা তার কুকুরের সাহস নিয়ে কেউ প্রশ্ন না তুললেই হল।

.

২১. পাইন গাছে রাতের পাহারা

পরের দিন ইবটসন পাউরি ফিরে গেল এবং তার পরের দিন সকালেই রুদ্রপ্রয়াগের পূর্বদিকের গ্রামগুলোয় ঘুরতে ঘুরতে নরখাদকটার থাবার ছাপ দেখতে পেলাম। থাবার ছাপটা ছিল একটা গ্রাম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তায়। নরখাদকটা আগের রাতে গ্রামের যে বাড়ির দরজাটা ভাঙার চেষ্টা করেছে সে-বাড়িতে একটি ছেলে প্রচণ্ড কাশিতে ভুগছিল। থাবার ছাপ ধরে কয়েক মাইল চলার পর গিয়ে পৌঁছলাম একটা পাহাড়ের ঢালের উপর,এখানেই কিছুদিন আগে ডাকিয়ে ছাগলটাকে বেঁধে আমি ইবটসন বসে ছিলাম। সেটা পরে চিতার হাতে মারা পড়ে।

তখনও খুব ভোর রয়েছে। এই বিস্তৃত ভাঙাচোরা জায়গাটার কোথাও হয়তো চিতাটাকে পাথরের উপর রোদ পোহাতে দেখতে পাব এই আশায়, অনেকটা এলাকা নজরে আসে এমন একটা পাথরের ওপর শুয়ে পড়লাম। আগের সন্ধ্যায় বৃষ্টি হয়ে গেছে, ফলে চিতাটার থাবার ছাপ অনুসরণ করতে পেরেছি; আর বাতাসের ধোঁয়াটে ভাবটা কেটে গিয়ে আবহাওয়াটাও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টি অব্যাহত ছিল এবং পাথরটা থেকে যে দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল তা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দৃশ্যাবলীর অন্যতম পাহাড়গুলো ২৩০০০ ফুট উপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আমার ঠিক নিচেই অলকানন্দার রূপসী উপত্যকা, রুপোলী ফিতের মত আঁকাবাঁকা নদীটা তার বুক চিরে বয়ে চলেছে।

নদীর ওপারের পাহাড়ে ছিটেফোঁটা কয়েকটি গ্রাম। কোনোটায় শুধু একটিমাত্র খড়ে-ছাওয়া কুঁড়ে, কোনোটায় সারিবদ্ধ স্লেট পাথরের ছাদ-দেওয়া লম্বা লম্বা ঘর। এই সারিবদ্ধ ঘরগুলো আসলে কিন্তু আলাদা বাড়ি, খরচ আর জায়গা বাঁচানোর জন্যেই গায়ে-গায়ে লাগিয়ে তৈরি হয়েছে। কেননা এখানকার মানুষ গরিব এবং গাড়োয়ালে চাষের উপযোগী প্রতিটি ফুট জমিই কৃষিকাজের জন্যে দরকার।

পাহাড়গুলোর পিছনে এবড়ো-খেবড়ো শিলারাশির সমারোহ, শীতে ও প্রাক্-বসন্তে সেখান দিয়ে প্রচণ্ড গর্জনে নেমে আসে তুষার-ধস। শিলারাশির পিছনে ও ওপারে হল ঘন নীল আকাশের গায়ে দৃশ্যমান চিরন্তন তুষারের দেশ, ঠিক যেন সাদা কার্ডবোর্ড কেটে তৈরি। এর চেয়ে সুন্দর আর শান্তিপূর্ণ ছবি কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু তবুও, যখন আমার পিছনের এই সূর্য ঐ তুষার-পর্বতের অন্তরালে অস্ত যাবে তখন অসহ্য আতঙ্ক সামনের এই মেলেধরা সারাটা এলাকা গ্রাস করে নেবে। এ আতঙ্ক আজ দীর্ঘ আট বছর ধরে ছড়িয়ে আছে, আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়া এর প্রকৃত রূপ কল্পনা করাও অসম্ভব।

ঘণ্টাখানেক পাথরটার উপর শুয়ে আছি, এই সময় পাহাড় দিয়ে দুজন লোক বাজারে যাওয়ার পথে নেমে এল। আরো এক মাইল ওপরের একটি গ্রামে তারা। থাকে, সেখানে আগের দিন আমি গিয়েছিলাম। তারা বলল যে সূর্যোদয়ের খানিকটা। আগে তারা এইদিকে একটা চিতাকে ডাকতে শুনেছে। ছাগল বেঁধে চিতাটাকে গুলি করার সম্ভাবনা সম্বন্ধে আমরা খানিকটা আলোচনা করলাম। তখন আমার নিজের কোনো ছাগল না থাকায় তারা তাদের গ্রাম থেকে একটা ছাগল আমাকে এনে দেবে বলল। যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি সেইখানেই সূর্যাস্তের ঘণ্টা-দুই আগে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে বলে কথা দিল।

লোকগুলো চলে গেলে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম কোথায় বসা যায়। পাহাড়ের একদিকটায় একমাত্র গাছ হচ্ছে একটি নিঃসঙ্গ পাইন। যে-পথ দিয়ে লোকদুটো নেমে এসেছে তারই কাছাকাছি শৈলশিরাটার উপর গাছটা দাঁড়িয়ে আছে। তার নিচ দিয়ে দ্বিতীয় একটা পথ বের হয়ে পাহাড়টার গা দিয়ে, যেখানে, একটু আগে আমি চিতাটার সন্ধান করছিলাম, সেই ভাঙাচোরা জায়গাটার ওপর-কিনার ঘেঁষে চলে গিয়েছে। গাছটা থেকে দেখা যায় অনেকখানি বিস্তৃত এলাকা, কিন্তু ওটাতে চড়া খুব কঠিন হবে, আড়ালও পাব সামান্যই। যাই হক, এলাকার একমাত্র গাছ বলে ওটাতেই বসব ঠিক করলাম।

বিকেল চারটে নাগাদ যখন সেখানে ফিরে এলাম দেখি, লোকদুটো একটা ছাগল নিয়ে অপেক্ষা করছে, কোথায় বসব-তাদের এ প্রশ্নের জবাবে যখন পাইন গাছটার · দিকে আঙুল দেখলাম তখন তারা হাসতে লাগল। বললে, দড়ির একটা মই ছাড়া যদি উঠতেও পারি আর সারা রাত সেখানে কাটাই, তাহলেও নরখাদকটার হাত থেকে আত্মরক্ষার কোনো উপায়ই থাকবে না আমার, কারণ এ গাছটা চিতাটার কাছে কোনো বাধা বলেই গণ্য হবে না।

গাড়োয়ালে দুজন শ্বেতাঙ্গ মানুষ ছিল–তাদের মধ্যে একজন হল ইবটসন; এদের ছোটবেলায় পাখি সংগ্রহের বাতিক ছিল এবং দুজনেই গাছে চড়তে জানত। “পুল পার হওয়ার আগে সেটার কাছে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা”–এই প্রবাদটার কোনো যথাযথ হিন্দী নেই বলেই লোকদুটোর শেষ কথাগুলোর কোনো জবাব দিলাম না, শুধু আমার রাইফেলটা দেখিয়ে দিলাম।

পাইন গাছটায় চড়া খুব সহজসাধ্য হল না, কারণ কুড়ি ফুট পর্যন্ত গাছটায় কোনো ডালপালা নেই। কিন্তু সব থেকে নিচের ডালটা পর্যন্ত পৌঁছনোর পর বাকিটা সহজ। হল। লম্বা একটুকরো সুতো নিয়ে উঠেছিলাম, লোকদুটো তাতে আমার রাইফেলটা বেঁধে দিল। সেটা টেনে নিয়ে গাছের উপরে উঠে গেলাম–সেখানে প্রধান আড়াল হল পাইন পাতাগুলো।

ছাগলটা ভালই ডাকে বলে লোকদুটো আমায় আশ্বাস দিয়েছিল। গাছের বেরিয়ে-থাকা একটা শিকড়ে সেটাকে বেঁধে এবং পরদিন খুব সকালে সেখানে ফিরে আসবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা গ্রামের পথে ফিরে গেল। ছাগলটা লোকদুটোর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর গাছের নিচে ছোট-ছোট ঘাস ছিঁড়ে খেতে লাগল। সে-পর্যন্ত ছাগলটা একবারও না-ডাকলেও আমি চিন্তিত হই নি, কারণ আমি নিশ্চিত জানতাম যে একটু বাদেই সে নিঃসঙ্গ বোধ করতে শুরু করবে। তখনই এ সন্ধ্যায় ত র যতটুকু করণীয় তা সে করবে। আলো থাকতে-থাকতেই যদি সে তা করে তবে চিতাটা ছাগলের ধারে-কাছে আসার অনেক আগেই আমি আমার উঁচু জায়গা থেকে চিতাটাকে মারতে পারব।

গাছটার ওপর যখন উঠে বসলাম তখন তুষার-পর্বতের ছায়াগুলো এসে অলকানন্দার উপর পড়েছে। ধীরে-ধীরে ছায়াগুলো পাহাড় বেয়ে উঠে এল, ছাড়িয়ে গেল আমাকে, শেষ পর্যন্ত শুধু পাহাড়ের চূড়াটা রাঙা আভায় রঞ্জিত হয়ে রইল। এই আভা নিভে যাওয়ার পর দীর্ঘ আলোর রেখা ফুটে বেরুল তুষার-পর্বত থেকে। সেখানে পড়ন্ত সূর্যের রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে একপ্রস্থ মেঘের গায়ে ধরা পড়েছে। পাঠক জানেন যে সূর্যাস্ত দেখার চোখ খুব কম সংখ্যক লোকেরই আছে, আর তারা সবাই মনে করে যে সারা পৃথিবীর মধ্যে তাদের এলাকার সূর্যাস্তই সবচেয়ে সুন্দর।

আমিও ব্যতিক্রম নই, কারণ আমিও মনে করি যে আমাদের সূর্যাস্তের তুলনা পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। এর সঙ্গে দ্বিতীয় হিসেবে তুলনা চলে একমাত্র উত্তর টাঙ্গানাইকার সূর্যাস্তের। সেখানে বায়ুমণ্ডলের কোনো বিশেষ গুণে তুষারমণ্ডিত কিলিমানজারো আর তার উপরের মেঘগুলো পড়ন্ত সূর্যের আলোয় গলানো সোনার মত জ্বলে ওঠে। আমাদের হিমালয়ের সূর্যাস্তের রঙ বেশির ভাগই লাল, গোলাপী বা সোনালী। সেদিন পাইন গাছের ওপর থেকে যেটা দেখেছিলাম সেটার গেলাপী-লাল, সাদা আলোর বর্শাগুলো, বর্শার ফলার মত তুষার-উপত্যকা থেকে গোলাপী মেঘ ভেদ করে বিস্তৃত হয়ে উপরের আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছিল।

অনেক মানুষের মত ছাগলটারও সূর্যাস্ত দেখার কোনো আগ্রহ ছিল না। নাগালের মধ্যেকার ঘাস-কটি খাওয়া হয়ে গেলেই পা দিয়ে খানিকটা মাটি আঁচড়িয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আমার হল সংকট। যে ছাগলটার ওপর চিতাটাকে ডেকে দেবে বলে ভরসা করেছিলাম সেটা নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোচ্ছে, এবং শুধু ঘাস খাওয়ার প্রয়োজন ছাড়া একবারও মুখ খোলে নি। এখন মনে হয় বেশ নিশ্চিন্ত আরামে, বোধহয় সারা রাতই ব্যাটা ঘুমোবে।

এই মুহূর্তে গাছ থেকে নেমে বাংলোর দিকে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করার অর্থ হল নির্ঘাত আত্মহত্যা করতে যাওয়া। নরখাদকটাকে মারার জন্যে আমায় কিছু একটা করতেই হবে। মড়ির অভাবে সব জায়গাই আমার কাছে সমান, কাজেই স্থির করলাম যেখানে আছি সেখানেই থাকব, এবং নিজেই চিতাটাকে ডাকব।

আমাকে যদি কেউ জিগ্যেস করে বহু বছর ভারতবর্ষের জঙ্গলে-জঙ্গলে কাটিয়ে আমি কিসে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছি, তাহলে বিনা দ্বিধায় বলব যে সবচেয়ে আনন্দ পেয়েছি বনের বাসিন্দাদের ভাষা আর চালচলন সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করে। জঙ্গলের কোনো সার্বজনীন ভাষা নেই। প্রত্যেক প্রজাতির আলাদা-আলাদা ভাষা। যদিও শজারু, শকুন প্রভৃতির শব্দভাণ্ডার খুবই সীমাবদ্ধ–তবু প্রত্যেকে প্রত্যেকের ভাষা বুঝতে পারে, একমাত্র ঝুঁটিওয়ালা তার-ল্যাজা ড্রোন্সে ছাড়া। মানুষের শব্দনালীর ক্ষমতা জঙ্গলের অন্য যে-কোনো প্রাণীর চেয়ে অনেক বেশি। এই কারণেই মানুষের পক্ষে নানারকমের পাখি আর প্রাণীদের সঙ্গে সংকেত বিনিময় সম্ভব। জঙ্গলের প্রাণীদের ভাষা বোঝার ক্ষমতা শুধু নিজের আনন্দ-বর্ধনেই লাগে না, অনেক সময় ইচ্ছে করলে এটাকে বেশ কাজেও খাটানো যায়। একটা উদাহরণই যথেষ্ট হবে।

ইটনের এক প্রাক্তন শিক্ষক, লায়োনেল ফোর্টেস্থ এবং আমি প্রথম মহাযুদ্ধের অল্পদিন পরেই হিমালয়ে ফোটো তোলা ও মাছ ধরার সফরে বেরিয়ে ছিলাম। এক সন্ধ্যায় আমরা একটা বিরাট পাহাড়ের নিচে বনবিভাগের এক বাংলোয় গিয়ে উঠলাম–এই পাহাড়ের ওপারের কাশ্মীর উপত্যকাটাই ছিল আমাদের লক্ষ্যস্থল। কঠিন পথে বেশ কিছুদিন ধরে হেঁটে আসছি, মাল বাহকদের বিশ্রামের দরকার। কাজেই একটা দিন বাংলোটায় বিশ্রাম নেওয়া স্থির করলাম।

পরদিন ফোর্টেক্স তার নোটবই খুলে লিখতে বসল, আর আমি পাহাড়টা ঘুরে দেখতে আর একটা কাশ্মীরী হরিণ শিকারের চেষ্টায় বেরিয়ে পড়লাম। কাশ্মীরের যেসব বন্ধুর শিকারের অভিজ্ঞতা আছে তাদের কাছে আগেই শুনেছিলাম যে অভিজ্ঞ শিকারী ছাড়া আর কারো পক্ষে এ জাতের হরিণ শিকার সম্ভব নয়। এ কথা বাংলোয় চৌকিদারটিও বলল। সারাটা দিন আমার সামনে। প্রাতরাশের পর একাই বেরিয়ে পড়লাম। আমার কোনো ধারণা নেই যে এই লাল হরিণগুলো কত উঁচুতে থাকে বা কী ধরনের জায়গায় তাদের দেখা পাওয়া যেতে পারে। পাহাড়টা প্রায় ১২,০০০ ফুট উঁচু, এর উপর দিয়ে একটা গিরিপথ কাশ্মীরে প্রবেশ করেছে। আমি ৮,০০০ ফুট ওঠার পরই একটা ঝড় নেমে এল।

মেঘের রঙ দেখেই বুঝতে পারলাম ঝড়ের সঙ্গে শিল পড়বে, তাই আশ্রয় হিসেবে একটা গাছের তলা বেছে নিলাম। শিলাঘাতে এবং তার অচ্ছেদ্য সঙ্গী বজ্রপাতে আমি মানুষ ও পশু মারা যেতে দেখেছি। সুতরাং সূচলোচুড়ো বড়-বড় দেওদার গাছগুলো বাদ দিয়ে গোল-মাথা ঘন-পাতাওয়ালা ছোট একটা গাছ বেছে নিলাম। ঝরা-পাতা ও দেওদারপাতা জড় করে আগুন জ্বালোম। ঘন্টাখানেক ধরে, মাথার ওপরে যতক্ষণ বাজের গর্জন ও চারপাশে শিলাবৃষ্টি চলতে লাগল, আমি গাছতলায় আগুনের কাছে বেশ নিরাপদে বসে রইলাম।

শিলাবৃষ্টি বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সূর্য দেখা দিল এবং আমি আমার আশ্রয় ছেড়ে রূপকথার রাজ্যে পা দিলাম। মাটিতে বিছানো শিলের টুকরোগুলো থেকে লক্ষ-লক্ষ আলোর কণা বিচ্ছুরিত। তার সঙ্গে প্রতিটি ঘাস পাতাতেই উজ্জ্বল প্রতিফলন দেখা দিচ্ছিল। আরো দু-তিন হাজার ফুট উঠে কতগুলো পাথরের চাইয়ের কাছে পৌঁছলাম। তার নিচেই কতগুলো পাহাড়ী পপি। হিমালয়ের বুনো ফুলদের মধ্যে এই ফুলগুলোই সবচেয়ে সুন্দর। অনেকগুলোর উঁটি গেছে ভেঙে, কিন্তু তা সত্ত্বেও, নিষ্কলঙ্ক সাদার ওপর দাঁড়িয়ে-থাকা এই আসমানি-রঙ ফুলগুলোর দৃশ্য কোনোদিন ভোলবার নয়।

পাথরগুলো অত্যন্ত পিছল বলে এবং পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত ওঠার কোনো দরকার না থাকায়, উপরে না উঠে বাঁ-দিক পানে গেলাম। বিরাটকায় একটা দেওদার বনের ভিতর দিয়ে প্রায় আধ মাইল পর্যন্ত গিয়ে একটা ঢালু ঘেসো জমির কাছে এসে পৌঁছলাম। ঘেসো জমিটা পাহাড়ের মাথা থেকে শুরু হয়ে কয়েক হাজার ফুট নিচেকার জঙ্গল পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। গাছগুলোর ভিতর দিয়ে ঘেসো জমিটার দিকে আসতে-আসতে দেখলাম, অপর প্রান্তে একটা টিবির ওপর একটা জন্তু পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শিকারের বইয়ে বহু ওর ছবি দেখেছি, কাজেই বুঝতে পারলাম যে ওটা লাল কাশ্মীরী হরিণ, এবং মাথা তুলতেই দেখলাম হরিণটা মাদী।

ঘেসো জমিটার আমার দিকটায়, বনের কিনারা থেকে ত্রিশ গজ দূরে প্রায় চার ফুট উঁচু একটা পাথর। পাথরটা থেকে ঢিবিটার দূরত্ব আন্দাজ চল্লিশ গজ। হরিণটা যখন ঘাস খায় তখন এগিয়ে যাই, আর যখন মাথা তোলে তখন স্থির হয়ে থাকি। এই করে-করে গুঁড়ি মেরে পাথরটার আড়ালে গিয়ে পৌঁছলাম। প্রত্যেকবার মাথা তোলার সময় সে তার ডানদিকে তাকিয়ে দেখছিল, তাতে বুঝতে পারলাম তার সঙ্গীরাও কাছাকাছিই আছে এবং কোন্ দিকে আছে। ঘাসের ওপর দিয়ে তার চোখ এড়িয়ে আর কাছে এগোনো অসম্ভব।

আবার বনের ভিতর ঢুকে উপর দিক থেকে এগোনো অবশ্য কঠিন নয়, কিন্তু তাতে আমার উদ্দেশ্য সফল হবে না। কারণ বাতাস বইছিল সেইদিক থেকেই। আর একটা বিকল্প পথ হচ্ছে বনে ঢুকে ঘেসো জমির নিচের দিক ঘুরে উপরে ওঠা, কিন্তু তাতে সময় লাগবে এবং খাড়া চড়াই ভাঙতে হবে। শেষ পর্যন্ত যেখানে আছি সেখানেই থাকা স্থির করলাম।

এই হরিণগুলোকে এই বনে প্রথম দেখছি, কাজেই চিতার ডাকে এদেরও চিতল বা সম্বরের মতই প্রতিক্রিয়া হয় কি না তা দেখব ঠিক করলাম। জানতাম ঐ পাহাড়ে অন্তত একটা চিতা আছেই, সেদিনই সকালে তার আঁচড়ানোর দাগ দেখতে পেয়েছি। একটা চোখ বাইরে রেখে অপেক্ষা করতে লাগলাম, এবং যেই হরিণটা ঘাস খেতে শুরু করেছে অমনি চিতার ডাক ডেকে উঠলাম।

ডাকের সঙ্গে সঙ্গে হরিণটা ঘুরে দাঁড়ালো এবং সঙ্গীদের সতর্ক করার জন্যে সামনের পা দিয়ে মাটিতে ঠুকতে লাগল। সঙ্গীগুলোকে আমি দেখতে চাই, কিন্তু হরিণটা না ডাকা পর্যন্ত তারা স্থান-ত্যাগ করবে না, এবং চিতাকে না দেখা পর্যন্ত হরিণটাও.ডাকবে না। আমার গায়ে ছিল ব্রাউন রঙের একটা টুইড কোট। বাঁ-কাঁধের কয়েক ইঞ্চি পাথরটার বাইরে বের করে একটু উপর নিচে নাড়লাম।

সঙ্গে-সঙ্গে এই নড়াচড়াটা তার চোখে পড়ল। দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে এসে সে ডাকতে শুরু করল। মাটিতে খুর ঠুকে যে-বিপদ সম্বন্ধে সঙ্গীদের সে সতর্ক করে দিয়েছে সেই বিপদ দেখা গেছে, এখন তারা এসে তার সঙ্গে যোগ দিতে পারে। প্রথমেই একটা এক বছরের বাচ্চা শিল-বিছানো জমির ওপর দিয়ে পরিষ্কার পা ফেলে ফেলে মাদীটার গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াল। তার পিছনে এল তিনটে পুরুষ-হরিণ এবং সবশেষে একটা বেশি বয়সের মাদী। সমস্ত দলটায় সবসুদ্ধ ছ’টি প্রাণী, তাদের এবার পঁয়ত্রিশ গজ দূরে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে।

মাদীটা তখনও ডেকে চলেছিল এবং অন্যগুলো তাদের কান কখনো খাড়া করে … কখনো সামনে পিছনে হেলিয়ে শব্দ বা বাতাসের গতি বোঝার চেষ্টা করতে-করতে একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আমার পিছনের বনটার দিকে তাকাচ্ছিল। গলন্ত শিলের ভূপের ওপর ভিজে অবস্থায় বসে থাকাটা আমার কাছে মোটেই আরামদায়ক বলে মনে হচ্ছিল। ওভাবে জবুথুবু হয়ে বেশিক্ষণ বসে থাকলে হয়তো সর্দি লেগে যাবে। বহুবিখ্যাত কাশ্মীরী হরিণের প্রতিনিধিমূলক একটা দল আমি দেখলাম, একটা মাদী হরিণের ডাকও আমি শুনলাম। কিন্তু আরো একটা জিনিস আমার চাই–শুনতে চাই একটা পুরুষ হরিণের ডাক। আবার কাঁধের কয়েক ইঞ্চি পাথরের বাইরে বের করে দিলাম, এবং প্রাণভরে শুনতে পেলাম পুরুষ, মাদী ও বাচ্চা হরিণের বিভিন্ন পর্দায় গলার আওয়াজ।

শিকারের লাইসেন্স অনুযায়ী একটা পুরুষ-হরিণ শিকারের অনুমতি আমার ছিল, এবং খুব সম্ভবত একটা রেকর্ড সাইজেরই শিং আমার নাগালের মধ্যে এসে গেছে। কিন্তু যদিও সেদিন ক্যাম্পে মাংস দরকার, আর সকালে আমি হরিণের খোঁজেই। বেরিয়েছিলাম, তবু সেই মুহূর্তে আমার মনে হল, যে শিং-এর তেমন খুব জরুরী প্রয়োজন আমার নেই। যাই হক, হরিণটার মাংসও খুব শক্ত, আর ছিবড়েওয়ালা হবে। সুতরাং রাইফেল না তুলে আমি নিজেই উঠে দাঁড়ালাম এবং কাশ্মীরের সবচেয়ে দুর্লভ হরিণের দলটা নিমেষে চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। এক মুহূর্ত পরে টিবিটার পিছন দিককার ঝোপ-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে তাদের বিদ্যুৎগতিতে ছুটে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম।

ততক্ষণে আমার বাংলোর দিকে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে, ঠিক করলাম ঢালু ঘেসো জমিটা দিয়ে নেমে নিচেকার পাতলা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাব। ঢালটা খুব খাড়া নয়, লম্বা কদমে সহজেই দৌড়ে নামা যায়। শুধু নজর রাখা দরকার, প্রত্যেকটা ধাপে ঠিক জায়গায় পা পড়েছে কি না। খোলা জায়গাটার মাঝামাঝি পর্যন্ত পৌঁছেছি ছ-শো গজের মত এই সময় ঢালটার বাঁ-হাতি বনের ধারে একটা পাথরের উপর দাঁড়ানো সাদা একটা জিনিসের উপর চোখ পড়ল।

চকিত নজরে বুঝলাম যে সাদা জিনিসটা একটা ছাগল, খুব সম্ভব সেটা বনের ভিতর নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। এক পক্ষ কাল হল আমাদের ভাগ্যে মাংস জোটে নি, এবং ফোর্টেস্ককে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেরিয়েছিলাম যে আজ কিছু কিছু নিয়ে ফিরবোই। এই হচ্ছে সুযোগ। ছাগলটা আমাকে দেখেছে এবং আমি যদি তার সন্দেহ কাটাতে পারি তবে খুব সম্ভব সে আমাকে তার কাছ দিয়ে চলে যেতে দেবে এবং সেই সুযোগে খ করে তার পা চেপে ধরব।

সুতরাং দৌড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে একটু বাঁ দিক কেটে নামতে নামতে ট্যারচা চোখে জন্তুটার উপর নজর রাখতে লাগলাম। ওটা যদি ঠিক ঐ জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকে তবে ধরার জন্যে এর চেয়ে ভাল জায়গা পাহাড় এলাকায় আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে চ্যাপটা পাথরটার কিনারে প্রাণীটা দাঁড়িয়ে আছে সেটা পাঁচ ফুট উঁচু। সোজাসুজি ওটার দিকে না তাকিয়ে আর গতিবেগ সমান রেখে পাথরটার পাশ দিয়ে আমি বেরিয়ে গেলাম এবং যাওয়ার সময় বাঁ হাত চালিয়ে ছোঁ মারলাম ওটার সামনের পায়ে। ফাঁচ করে একটা শব্দ করে প্রাণীটা আমার হাত এড়িয়ে লাফিয়ে উঠল। পাথরটা সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে গিয়ে থেমে পেছন ফিরে তাকাতেই অবাক হয়ে দেখলাম যে যাকে, আমি একটা সাদা ছাগল বলে মনে করেছিলাম আসলে সেটা একটা সাদা কস্তুরী হরিণ।

আমাদের মধ্যে মাত্র দশ ফুটের ব্যবধান, ছোট্ট তেজী প্রাণীটা নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আমার দিকে দৃপ্ত ভঙ্গীতে তাকিয়ে ফেস-ফোঁস করছে। ফিরে আমি হাঁটতে লাগলাম এবং পঞ্চাশ গজ নেমে যখন পিছন ফিরে তাকালাম, তখনও সেটা সেই পথটার উপরই দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত আমাকে ভয় পাইয়ে দিতে পেরেছে বলে মেজাজটা খুব খুশি। কয়েক সপ্তাহ পরে যখন ঘটনাটা কাশ্মীরের গেম ওয়ার্ডেনকে বলি, তিনি কোন্ জায়গায় দেখতে পেয়েছি সেটা জানার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু জায়গা সম্বন্ধে আমার স্মরণশক্তিও খুব কম, আর তার বর্ণনাতেও প্রায় ভুলত্রুটি থেকে যায়। তাই আমার মনে হয় যে ঐ বিশেষ সাদা কস্তুরী হরিণটা কোনো মিউজিয়ামেরই শোভা বর্ধন করছে না।

নিজের এলাকায় অন্যের নাক গলানো পুরুষ-চিতারা আদৌ পছন্দ করে না। এ কথা সত্য যে নরখাদকটার এলাকা ৫০০ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে ছিল, কিন্তু তার মধ্যে আরো অনেকগুলো পুরুষ-চিতার থাকাটাই সম্ভব। তবু এই বিশেষ এলাকাটায় কয়েক সপ্তাহ ধরে থাকার ফলে সে যুক্তিসঙ্গতভাবেই এটাকে নিজের এলাকা বলে ধরে নিতে পারে। উপরন্তু মিলনের ঋতু সবেমাত্র শেষ হয়েছে এবং চিতাটা আমার ডাককে কোনো স্ত্রী-চিতার ডাক বলেও ভুল করতে পারে। সুতরাং বেশ অন্ধকার হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর আমি আবার ডাক দিলাম, এবং আমাকে বিস্মিত করে সঙ্গে সঙ্গেই একটা চিতা আমার ঈষৎ ডানদিকে আন্দাজ চারশো গজ নিচে থেকে তার জবাব দিল।

আমাদের মধ্যকার জমিটা বড় বড় পাথর ও বেঁটে বেঁটে কাটাগাছে ভর্তি, আর আমি জানতাম যে চিতাটা সোজা পথে আমর দিকে আসবে না। বরং খুব সম্ভবত ভাঙাচোরা জায়গাটা ঘুরে একটা ছোট শৈলশিরা ধরে আমার গাছটার কাছে আসবে। তার পরবর্তী ডাক শুনে বুঝলাম যে সেইভাবেই সে আসছে। পাঁচ মিনিট পরে আবার তার ডাক শোনা গেল ঐ পথ থেকেই, পথটা আমার গাছের কাছ থেকে সরু হয়ে দুশো গজ দূরে পাহাড়ের গা দিয়ে চলে গেছে। চিতাটাকে দিকনির্দেশ দেবার জন্যে আমি এই ডাকটার জবাব দিলাম। তিন বা চার মিনিট পরে সে আবার প্রায় একশো গজ দূর থেকে ডাক দিল। অন্ধকার রাত্রি, আমার টর্চ-লাইটটা রাইফেলের পাশে বাঁধা। তার বোতামের উপর বুড়ো আঙুল রেখে অপেক্ষা করছি। গাছের গোড়া থেকে পথটা সোজা পঞ্চাশ গজ গিয়ে একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে। পথটার কোন অংশে এবং কখন টর্চের আলো ফেলতে হবে তা জানা সম্ভব নয় বলে চিতাটা ছাগলটার ওপরে এসে না পড়া পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।

ঠিক বাঁকটার ওধারে, ষাট গজ দূর থেকে চিতাটা আবার ডেকে উঠল। জবাব এল পাহাড়ের অনেক ওপরের আর একটা চিতার কাছ থেকে। এ এক মহা ঝামেলা যেমন অপ্রত্যাশিত তেমনি দুর্ভাগ্যজনক, কারণ চিতাটা আমার এত কাছে এসে পড়েছে যে ডাক দেওয়ার অবস্থা আর নেই, এবং সে আমার শেষ ডাক শুনেছে দুশো গজ দূর থেকে। কাজেই তার ধারণা হবে যে স্ত্রীচিতাটা আরো উপরের দিকে উঠে গিয়ে সেখান থেকেই ডাকছে।

যাই হক ঐ রাস্তা ধরেই চিতাটার চলে আসার একটা সম্ভাবনা ছিল এবং এলে দরকার না থাকলেও মারতই ছাগলটাকে। কিন্তু বরাত খারাপ আমার, চিতাটা কোনাকুনিভাবে চলে গেল এবং পরের বার তার ডাক শোনা গেল আমার থেকে একশো গজ দূরে এবং দ্বিতীয় চিতাটার একশো গজ কাছ থেকে। দুটো চিতার ডাক কাছাকাছি হতে হতে থেমে গেল। অনেকক্ষণ নিস্তব্ধতার পর আবার সে-দুটোর আওয়াজ মনে হল জঙ্গলের ধার থেকে ভেসে এল; ঘেসো জমিটা সেখানে গিয়েই শেষ হয়েছে।

নানা দিক দিয়েই চিতাটার বরাত ভাল ছিল বলতে হবে, রাতটা অন্ধকার থাকাটাও তার মধ্যে অন্যতম। মিলনের সময় চিতাকে শিকার করা খুবই সহজ। এ কথা বাঘের পক্ষেও খাটে, তবে এ অবস্থায় যেসব শিকারী হেঁটে বাঘ দেখতে যাবেন তারা সত্যি-সত্যিই তা দেখতে চান কি না সে বিষয়ে স্থির-নিশ্চয় হয়ে যাওয়া ভাল, কারণ এ সময় বাঘের নয়, বাঘিনীর মেজাজ অত্যন্ত কড়া থাকে। তার কারণও বোঝা শক্ত নয়। বিড়াল-জাতীয় মদ্দা প্রাণীদের আদর সোহাগের ধরনটা কর্কশ এবং তারা জানে না যে তাদের নখ কতখানি ধারাল।

 চিতাটা মরে নি, সে-রাতে মরবেও না। কিন্তু আগামী কাল বা তার পরের দিন হয়তো সে মারা পড়তে পারে, কারণ দিন তার ফুরিয়ে এসেছে। বেশ কিছুটা সময়ের জন্যে মনে হল আমারও বুঝি দিন ফুরিয়ে এসেছে, কারণ কোনোরকম আভাস না দিয়েই আচমকা একটা দমকা বাতাস এসে গাছটার গায়ে লাগল আর গাড়োয়ালের মাটির সঙ্গে আমার পা আর মাথার পারস্পরিক অবস্থানের পরিবর্তন ঘটল।

কয়েক সেকেণ্ড যাবৎ আমার মনে হতে লাগল যে, গাছটা আর কখনো সোজা অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে না বা আমিও আর গাছের গায়ে লেগে থাকতে পারব না। পাইন গাছটা আগেও হয়তো এরকম অথবা এর চেয়েও মারাত্মক ঝড়ের প্রকোপ সয়ে এসেছে, কিন্তু তার সঙ্গে বাড়তি একটা মানুষের বোঝা নিশ্চয়ই ছিল না। রাইফেলটা একটা ডালে বেঁধে রেখে আমি একটার পর একটা ডালে উঠে যতদূর পর্যন্ত পারি পাইন-পাতা-ভরা ছোট-ছোট প্রশাখাগুলো ভেঙে ফেলতে লাগলাম। এটা আমার কল্পনাও হতে পারে, কিন্তু গাছটাকে হালকা করার পরে সত্যিই মনে হল যেন সেটা আর প্রথমবারের মত বিপজ্জনকভাবে হেলে পড়ছে না।

সৌভাগ্যক্রমে গাছটা ছিল চারা গাছ, সহজেই নমনীয় আর গোড়াটাও বেশ শক্ত। ঘন্টাখানেক ধরে ঝড়ের দাপটে সেটা এপাশ-ওপাশ করতে লাগল, তারপর যেমন আচমকা শুরু হয়েছিল তেমনি আচমকা বাতাসটা থেমে গেল। চিতাটা ফিরে আসার আর কোনো সম্ভাবনা নেই দেখে একটা সিগারেট শেষ করার পর আমিও ছাগলটার পিছু পিছু স্বপ্নের দেশে পাড়ি দিলাম।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে একটা ‘কু শুনে আমি স্বপ্নের দেশ থেকে মাটির পঞ্চাশ ফুটের মধ্যে ফিরে এলাম। গাছের নিচে আমার আগের দিনের সেই বন্ধুদুটি, সঙ্গে গ্রামের আর দু-জন যুবক। আমাকে জেগে উঠতে দেখে তারা জিগ্যেস করল, আমি রাতে চিতার ডাক শুনতে পেয়েছি কি না, আর গাছটার এ অবস্থাই বা কী করে হল।

চিতাদের সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ বাক-বিতণ্ডা হয়ে গিয়েছে এবং আর কিছুই করার না থাকায় বসে বসে গাছের ডালগুলো ভেঙেছি শুনে তারা খুবই মজা পেল। তারপর যখন তাদের জিগ্যেস করলাম রাতে যে সামান্য বাতাস উঠেছিল সেটা তারা টের পেয়েছে কি না, যুবকদের একজন উত্তর দিল, সামান্য বাতাস, সাহেব! এরকম প্রচণ্ড ঝড় আর কখনো দেখা যায় নি! আমার কুঁড়েঘরটা তো ওর দাপটে উড়েই গিয়েছে!

এ কথায় তার সঙ্গীটি যোগ দিল, ‘এতে দুঃখের কিছু নেই সাহেব। শের সিং অনেক দিন ধরেই তার ঘরটা ভেঙে নতুন করে তৈরি করবে বলে শাসাচ্ছিল, কাল ঝড়টা সেই পুরনো ঘর ভেঙে ফেলায় তার একটা খরচ বাঁচিয়ে দিয়েছে।

.

২২. আতঙ্কের রাত

পাইন গাছের অভিজ্ঞতার পর বেশ কয়েক দিনের জন্যে নরখাদকটার সঙ্গে, সংযোগ হারিয়ে ফেললাম। সে আর ভাঙা-জায়গাটায় ফিরে আসে নি এবং চষা-জমিটার উপরদিকের জঙ্গলে মাইলের পর মাইল খুঁজেও আমি তার বা তার প্রাণ-বাঁচানো সঙ্গিনীটির কোনো হদিসই পেলাম না। এই ধরনের জঙ্গল আমার খুব পরিচিত এবং চিতাদুটো এর কোনো অংশে থাকলে আমি নিশ্চয়ই খুঁজে পেতাম। জঙ্গলে যে-সব প্রাণী বা পাখি রয়েছে তারাই আমাকে সাহায্য করত।

পাইন গাছের উপর থেকে মাদীটা আমার ডাক শুনতে পেয়ে প্রচুর ছটফট করতে করতে তার নিজের এলাকা ছেড়ে বহু দূরে এসে পড়েছিল, আর আমি তাকে সঙ্গী খুঁজে দিতে সাহায্য করায় তার সঙ্গে যোগ দিয়ে নিজের এলাকাতেই ফিরে গিয়েছিল। পুরুষটা শিগগিরই একাই ফিরে আসবে এবং নদীর বাঁ-পাড়ের লোকদের সতর্কতার জন্যে তার মানুষ শিকার করা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে খুব সম্ভব নদী পার হয়ে অলকানন্দার ডান পাড়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করবে। পরের কয়েক রাত অমি রুদ্রপ্রয়াগ পুলের ওপর পাহারায় থাকলাম।

বাঁ-পাড়ের পুলের ওপর উঠে আসার তিনটে পথ ছিল। তার একটা এসেছে দক্ষিণ থেকে, চৌকিদারের ঘরের কাছ দিয়ে। চারদিনের দিন রাতে চিতাটার চৌকিদারের কুকুরটাকে মেরে ফেলবার আওয়াজ শুনলাম। বেশ পোষ মানা ছোট্ট প্রাণীটা, ও-পথ দিয়ে গেলেই সেটা আমাকে দেখে ছুটে বেরিয়ে আসত। কুকুরটা ডাকত খুবই কম, কিন্তু সে-রাতে পাঁচ মিনিট ধরে ডেকেছিল। এমন সময় হঠাৎ একটা আর্তনাদ উঠেই ডাকটা থেমে গেল এবং তারপরই ঘরের ভিতর থেকে চৌকিদারের চিৎকার শোনা গেল, তারপর সব চুপচাপ। পুলের উপরের কাটা ঝোপগুলো সরিয়ে রাখা হয়েছিল বটে, কিন্তু পুলটা ভোলা ছিল; বাকি রাতটা রাইফেলের ট্রিগারে আঙুল রেখে অপেক্ষা করলাম, কিন্তু চিতাটা আর পুল পার হওয়ার কোনো চেষ্টাই করল না।

সকালে থাবার ছাপ দেখে বুঝলাম, কুকুরটাকে রাস্তার উপর মেরে রেখে চিতাটা টাওয়ারের কাছাকাছি এসেছিল। যেদিকে সে এগোচ্ছিল সেদিকে আর পাঁচ-পা এগোলেই সে পুলটার উপর এসে পড়ত, কিন্তু পাঁচ পা আর সে এগোয় নি। তার বদলে ডানদিকে ঘুরে বাজারের দিকে কিছুটা পথ গিয়ে ফিরেছে, তারপর তীর্থপথ ধরে চলে গিয়েছে উত্তর দিকে। সে রাস্তায় মাইলখানেক যাওয়ার পর আমি তার থাবার দাগ হারিয়ে ফেললাম।

দুদিন পরে খবর পেলাম, আগের দিন সন্ধ্যায় তীর্থপথের সাত মাইল উপরে একটা গরু মারা পড়েছে। সন্দেহ করা হচ্ছিল নরখাদকটাই সেটাকে মেরেছে, কারণ তার আগের রাতেই কুকুরটা মারা পড়েছিল। পরের সন্ধ্যায় গরুটা সেখানে মারা পড়ে তার খুব কাছেই। নরখাদকটা একটা বাড়ির দরজা ভাঙার চেষ্টা করেছিল।

রাস্তায় দেখলাম কয়েকজন লোক অপেক্ষা করছে। তারা জানত যে রুদ্রপ্রয়াগ থেকে হেঁটে যাওয়াটা বিশেষ ক্লান্তিকর হবে, কাজেই বুদ্ধি করে একবাটি চায়ের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। আমরা একটা আমগাছের ছায়ায় বসে ধূমপান করছি আর আমি সেইসঙ্গে চায়ের বাটিতে চুমুক দিচ্ছি, এমন সময় লোকগুলো জানাল যে গরুটা পালের সঙ্গে আগের সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে নি, এবং পরের দিন তল্লাসীর সময় সেটাকে রাস্তা আর নদীটার কাছাকাছি জায়গায় পাওয়া গিয়েছে।

তাদের প্রত্যেকেই গত আট বছরের মধ্যে নরখাদকটার হাত থেকে কে কিভাবে অল্পের জন্যে রক্ষা পেয়ে গিয়েছে সেসব কাহিনীও অনেক শুনলাম। নরখাদকটার দরজা ভেঙে মানুষ ধরার চেম, আর বহু ক্ষেত্রে তাতে সফল হওয়ার বর্তমান অভ্যাসটা যে মাত্র বছর তিনেকের, এ কথা শুনে আমার খুবই আশা হল। তার আগে সে ঘরের বাইরে থেকে বা দরজা-খোলা বাড়ি থেকে মানুষ ধরেই সন্তুষ্ট থাকত। ‘এখন, তারা বলল, ‘শয়তানটার সাহস এতটা বেড়ে গিয়েছে যে কখনো-কখনো দরজা ভাঙতে না পেরে সে মাটির দেয়ালে গর্ত খুঁড়েও মানুষ ধরে নিয়ে যায়।

যারা আমাদের পাহাড়ী লোকদের চেনে না বা তাদের অলৌকিকে বিশ্বাস বা ভয়ের কথা জানে না তাদের কাছে এটা অবিশ্বাস্য বলেই মনে হবে। সাহসের জন্যে যাদের খ্যাতি আছে, যুদ্ধক্ষেত্রে যারা বীরত্বের সর্বোচ্চ সম্মান লাভ করেছে, তাদের ঘরে কুঠার, কুকরি এমন কি আগ্নেয়াস্ত্র থাকা সত্ত্বেও কি ভাবে তারা দরজা ভেঙে বা দেয়াল কুঁড়ে তাকে ঘরে ঢুকতে দেয়!

এই দীর্ঘ আট-বছরের মধ্যে আমি একটিমাত্র ঘটনার কথা জানি যেখানে একটি স্ত্রীলোক নরখাদকটাকে বাধা দিয়েছিল। সে তখন একটা ঘরে একা ঘুমোচ্ছিল। ঘরটার দরজায় আগল দেওয়া ছিল না। দরজাটা খুলত ভিতরের দিকে। ঘরে ঢুকে চিতাটা স্ত্রীলোকটির বাঁ-পা কামড়ে ধরে যখন বাইরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তখন মেয়েটির হাতে ঠেকে একটা “গনদেসা”, খড় কুচোবার হেঁসো। তাই দিয়ে সে চিতাটার গায়ে কোপ বসায়। চিতাটা অবশ্য তার কামড় না ছেড়ে তাকে টেনে নিয়ে দরজার দিকে পিছোতে থাকে। এটা করার সময় হয়তো স্ত্রীলোকটিই দরজাটা ঠেলে দেয় অথবা সেটা দৈবক্রমেই বন্ধ হয়ে যায়। সে যাই হক, চিতাটা থাকে দরজার বাইরে আর স্ত্রীলোকটি দরজার ভেতরে, এবং চিতাটার প্রচণ্ড টানে স্ত্রীলোকটির পা-টা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

তৎকালীন যুক্তপ্রদেশ বিধান পরিষদে গাড়োয়ালের সদস্য শ্রীমুকুন্দীলাল সে সময় নির্বাচনী সফরে বেরিয়ে পরের দিন ঐ গ্রামে উপস্থিত হন এবং ঐ ঘরে একটা রাত কাটান, কিন্তু চিতাটা আর সেখানে ফিরে আসে নি। বিধান পরিষদে এক কিপার্ট পেশের সময় মুকুন্দলাল বলেন যে সেই এক বছরের মধ্যে পঁচাত্তরটির মানুষ ঐ নরখাদকটার হাতে প্রাণ হারিয়েছে। তিনি গভর্মেন্টকে নরখাদকটার বিরুদ্ধে জোরাল অভিযান শুরু করতে বলেন।

মাধো সিংকে এবং পথ দেখানোর জন্যে গ্রামের একজনকে নিয়ে মড়িটার কাছে গেলাম। রাস্তা থেকে সিকি মাইল ও নদীর একশো গজ দূরে একটা গভীর খাদের মধ্যে গরুটা মারা পড়েছে। খাদের এক দিকে ঘন ঝোঁপ জঙ্গল ও বড়-বড় পাথর, অন্যদিকে ছোট-ছোট কয়েকটা গাছ; কোনোটাই বসার উপযুক্ত নয়। গাছগুলোর নিচে, মড়িটা থেকে গজ ত্রিশেক দূরে একটা পাথর, আর তার গোড়ায় ছোট্ট একটা গর্ত। আমি এই গর্তটায় বসব ঠিক করলাম।

মাধো সিং এবং গ্রামবাসীটি আমার মাটির ওপর বসে থাকার সিদ্ধান্তে ঘোরর। আপত্তি তুলল। কিন্তু রুদ্রপ্রয়াগে আসার পর এই প্রথম মড়ি হিসেবে একটি প্রাণীকে পেলাম, আর এমন জায়গায়, যেখানে চিতাটা বেশ বেলাবেলি, সূর্যাস্ত নাগাদ এসে পড়বে বলে আশা করা যায়। অতএব সমস্ত আপত্তি অগ্রাহ্য করে তাদের গ্রামে ফেরত পাঠালাম।

জায়গাটা বেশ শুকনো ও আরামদায়ক। একটা ছোট ঝোপের পিছনে গা লুকিয়ে, পাথরটায় ঠেস দিয়ে বসে আমি নিঃসন্দেহ হলাম যে চিতাটা আমাকে দেখতে পাবে না এবং আমার উপস্থিতি টের পাওয়ার আগেই আমি তাকে বধ করতে পারব। সঙ্গে এনেছিলাম একটা টর্চ লাইট এবং একটা ছুরি। রাইফেলটা হাঁটুর ওপর রেখে এই একান্ত প্রান্তে বসে আমার মনে হল যে চিতাটাকে মারার সম্ভাবনা এখানে আগের চেয়ে অনেক বেশি।

নড়াচড়া না করে, চোখদুটো সামনের পাথরগুলোর উপর রেখে সারা বিকেল বসে রইলাম। প্রতি মুহূর্তে নিরুদ্বেগ, নিঃসন্ধিগ্ধ, চিতাটার মড়ির উপর ফিরে আসার সময় ঘনিয়ে আসছে। যে-মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করছি তা এসে চলে যাচ্ছে। কাছের জিনিস ঝাপসা, অস্পষ্ট হতে শুরু করেছে। প্রত্যাশিত সময় পেরিয়ে দেরি করে আসছে চিতাটা, কিন্তু সেজন্যে আমি উদ্বিগ্ন হচ্ছিলাম না। সঙ্গে রয়েছে টর্চ, আর মড়িটা মাত্র ত্রিশ গজ দূরে। খুব সতর্ক হয়েই আমি গুলি করব যাতে আবার একটা আহত প্রাণীর সঙ্গে মোকাবিলা করতে না হয়।

খাদের গভীরে অখণ্ড নিস্তব্ধতা। যে-পাড়ে বসে আছি সেখানকার ঝরা পাতার রাশ গত কয়েক দিনের প্রখর রৌদ্রের তাপে মচমচে হয়ে শুকিয়ে আছে। এটা অত্যন্ত। আশ্বস্ত হওয়ার মত ঘটনা, কারণ অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে এবং আগে যেমন আমার আত্মরক্ষার জন্যে চোখদুটোর উপর নির্ভর করতে হয়েছে, এখন তেমনি নির্ভর করতে হবে আমার কানদুটোর উপর। ট্রিগারে একটা আঙুল ও টর্চের বোতামে বুড়ো আঙুল রেখে যে-কোনো সামান্য শব্দ পেলেই গুলি করবার জন্যে তৈরি হয়ে বসে রইলাম।

চিতাটা এসে না-পোঁছনোয় এবার আমি অস্বস্তিবোধ করতে শুরু করলাম। এও কি সম্ভব যে পাথরগুলোর মধ্যে কেনো লুকানো জায়গা থেকে সে এতক্ষণ আগাগোড়া আমাক লক্ষ করে আসছে, আর এখন আমার গলায় দাঁত বসানোর আশায় উদগ্রীব হয়ে ঠোঁট চাটতে শুরু করেছে? কেননা বহুদিন তো তার মানুষের মাংস জোটে নি। এখন যদি সৌভাগ্যক্রমে খাদ ছেড়ে পায়ে হেঁটে চলে যেতে পারি তবে আমার কানদুটোর সাহায্যের প্রয়োজন হবে খুবই বেশিরকম। এ-হেন দুরূহ কর্তব্য তাদের আর কখনো পালন করতে হয় নি।

উৎকর্ণ হয়ে বসে আছি, যেন কত ঘণ্টা ধরে। অন্ধকার অস্বাভাবিক গাঢ় হয়ে আসছে দেখে উপরদিকে তাকিয়ে দেখলাম, একপ্রস্থ ঘন মেঘ আকাশ ছেয়ে ফেলেছে, তারাগুলো ঢেকে যাচ্ছে একে-একে। একটু পরেই বড়-বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করল। অখণ্ড ও পূর্ণ নিস্তব্ধতার পরিবর্তে এখন চারদিকে শুধু নড়াচড়া আর শব্দ। চিতাটা যে-সুযযাগের অপেক্ষা করছিল তা বোধ করি এবার পাবে।

তড়িৎ-গতিতে কোটটা খুলে ফেলে গলায় জড়িয়ে নিলাম, হাতা দিয়ে বেঁধে নিলাম ভাল করে। রাইফেল এখন নিষ্প্রয়োজন, সুতরাং সেটাকে বাঁ হাতে বদলি করে ছোরাটা বের করে ডান হাতে বাগিয়ে ধরলাম। ছোরাটা হল, যাকে বলে আফ্রিদি ছোরা। একান্তভাবেই আশা করতে লাগলাম যে এটা আগের মালিকের প্রয়োজন যেমন সিদ্ধ করেছে আমার প্রয়োজনও ঠিক সেইমত সিদ্ধ করবে। উত্তর পশ্চিম সীমান্তের হাতে অবস্থিত সরকারী মালখানা থেকে এটা কেনার সময় কমিশনার এর সঙ্গের লেবেল এবং এর হাতলে কাটা তিনটে খাঁজের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন যে তিন-তিনটে খুনের সঙ্গে ছোরাটা জড়িত। এটা একটা বীভৎসতার স্মারক-চিহ্ন বটে, কিন্তু এটা হাতে পেয়ে আমি খুশিই হয়েছিলাম। সেই মুষলধার বৃষ্টির মধ্যেও শক্ত মুঠোয় বাগিয়ে ধরে বসেছিলাম।

জঙ্গলের সাধারণ চিতারা বৃষ্টি পছন্দ করে না এবং বৃষ্টি হলেই আশ্রয় খোঁজে। কিন্তু নরখাদক চিতা সাধারণ চিতা নয়, তার পছন্দ-অপছন্দের কিছুই আমার জানা নেই। সে কী করবে না-করবে তারও কিছু ঠিক নেই।

গ্রামে ফিরে যাওয়ার সময় মাধো সিং জিগ্যেস করেছিল আমি কতক্ষণ বসে থাকব, আর আমি উত্তর দিয়েছিলাম, যে-পর্যন্ত না চিতাটাকে গুলি করতে পারি।

তার কাছ থেকে এ-সময়ে কোনো সাহায্যই আমি প্রত্যাশা করতে পারি না, অথচ সাহায্যের তখন আমার বিশেষ দরকার। বসে থাকব, না উঠে যাব–এই দুটো প্রশ্নই আমার মনে আলোড়িত হতে লাগল। দুটোই সমান সঙ্কটের। যদি এ পর্যন্ত চিতাটা আমাকে না দেখে থাকে তবে উঠে গিয়ে ধরা দেওয়া বোকামি হবে। তীর্থপথটায় গিয়ে উঠতে যে সঙ্কীর্ণ জায়গাটি পার হতে হবে হয়তো সেখানেই তার কবলে পড়ে যাব।

অন্যদিকে, আরো ছ-ঘণ্টা সময়ের প্রতিটি মুহূর্তে একটা অনভ্যস্ত অস্ত্র হাতে জান-বাঁচানো লড়াইয়ের সম্ভাবনা নিয়ে বসে থাকলে স্নায়ুর উপর এমন চাপ পড়বে যে তা সহ্য করা সম্ভব হবে না। কাজেই উঠে দাঁড়িয়ে রাইফেল ঘাড়ে ফেলে আমি রওনা দিলাম।

খুব বেশি দূরে যেতে হবে না, মাত্র ৫০০ গজের মত পথ। তার অর্ধেকটা কাদায় ভর্তি আর অন্য অর্ধেক তেলতেলে মসৃণ পাথরের উপর দিয়ে। চিতাটার দৃষ্টি আকর্ষণের ভয়ে টর্চ জ্বালাতে পারছি না। এক হাতে রাইফেল, অপর হাতে বাগিয়ে-ধরা ছুরি, এইভাবে প্রতি পদে আছাড় খেতে খেতে চললাম। তারপর যখন রাস্তার উপর গিয়ে পৌঁছলাম তখন জোরে একটা ‘কু’ ডাক ছাড়লাম এবং মুহূর্ত-পরেই দেখতে পেলাম উপরে গ্রামের একটা ঘরের দরজা খুলে লণ্ঠন হাতে বেরিয়ে আসছে মাধো সিং ও তার সঙ্গী।

দু-জন যখন কাছে এল, মাধো সিং বলল যে বৃষ্টি নামার আগে পর্যন্ত সে আমার সম্বন্ধে বিশেষ চিন্তিত হয় নি। কিন্তু তার পর হতেই সে লণ্ঠন জ্বালিয়ে দরজায় কান লাগিয়ে অপেক্ষা করছে। দু-জনই আমাকে রুদ্রপ্রয়াগ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে প্রস্তুত, অতএব সাত মাইল হাঁটা-পথে রওনা দিলাম; আগে আগে বাঁচি সিং, মধ্যে লণ্ঠন হাতে মাধো সিং, শেষে আমি। পরদিন সকালে এসে দেখলাম মড়িটা কেউ ছোঁয়ও নি, কিন্তু রাস্তার ওপর নরখাদকটার থাবার ছাপ। আমরা চলে যাওয়ার কতক্ষণ পরে নরখাদকটা আমাদের অনুসরণ করেছে তা জানবার উপায় ছিল না।

ঐ রাতটার কথা যখনই আমার মনে পড়ে, গভীর আতঙ্কের রাত্রি বলেই ওটাকে মনে হয়। আগেও আমি ভয় পেয়েছি অসংখ্যবার, কিন্তু সে-রাত্রে অপ্রত্যাশিতভাবে বৃষ্টি এসে আমার প্রতিরোধের সব পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। আত্মরক্ষার জন্যে আমার হাতে ছিল শুধু এক খুনীর হাতের একটি মাত্র ছোরা। তখনকার মত ভয়ঙ্কর ভয় জীবনে আর কখনো পাই নি।

.

২৩. চিতা বনাম চিতা

রুদ্রপ্রয়াগ পর্যন্ত আমাদের অনুসরণ করে চিতাটা চলে গিয়েছে তীর্থপথ ধরে গোলাব্রাইয়ের ভিতর দিয়ে। কয়েকদিন আগে যে নালাটা সে পার হয়ে গিয়েছিল সেটা পার হয়ে সে একটা বন্ধুর পায়ে-চলা পথ ধরে এগিয়ে গিয়েছে। রুদ্রপ্রয়াগের পূর্বদিকের পাহাড়ের অধিবাসীরা হরিদ্বার যাতায়াতের জন্যে এটাকে সংক্ষিপ্ত পথ হিসেবে ব্যবহার করত।

কেদারনাথ ও বদ্রীনাথে তীর্থযাত্রা মৌসুমী ব্যাপার, এবং যাত্রারম্ভ ও যাত্রীদের যায়াতের সময়সীমা নির্ভর করে প্রথমত তুষার গলার উপর। দ্বিতীয়ত তীর্থদুটো যে-সব উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত সে-সব এলাকায় তুষারপাতের উপর। বদ্রীনাথের প্রধান পুরোহিত মাত্র কয়েকদিন আগে সারা ভারতের পুণ্যার্থী হিন্দুদের বহু-প্রতীক্ষিত তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন যে রাস্তা খুলে গিয়েছে। গত কয়েকদিন ধরেই ছোটখাট তীর্থযাত্রীর দুল রুদ্রপ্রয়াগের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলেছিল।

গত কয়েক বছর ধরে নরখাদকটা রাস্তার উপর অনেকগুলো তীর্থযাত্রীর প্রাণ নিয়েছে। এই তীর্থযাত্রার মৌসুমে রাস্তা ধরে তার এলাকার মোটামুটি একটা সীমানা পর্যন্ত নেমে যাওয়া, আর তারপর রুদ্রপ্রয়াগের পূর্বদিকের পাহাড়গুলোয় অবস্থিত গ্রামগুলোর ভিতর দিয়ে ঘুরে গিয়ে রুদ্রপ্রয়াগের পনের মাইল পর্যন্ত উপরের দিকে যে-কোনো জায়গায় আবার রাস্তায় গিয়ে পড়া, তার প্রায় নিয়মিত অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

এই বৃত্তাকারে ঘুরে আসার সময় লাগত বিভিন্ন রকম, কিন্তু রুদ্রপ্রয়াগ ও গোলাব্রাইয়ের মধ্যবর্তী রাস্তাটুকুর উপর গড়ে প্রতি পাঁচ দিন অন্তর চিতার থাবার ছাপ দেখতে পাওয়ায় বাংলোয় ফেরার পথে একটা জায়গা দেখে নিলাম যেখান থেকে রাস্তাটার উপর নজর রাখতে পারি। পরের দু-রাত্রি আমি আরাম করে একটা খড়ের গাদার উপর বসে পাহারা দিলাম, কিন্তু চিতাটার কোনো চিহ্নই দেখতে পেলাম না।

আশেপাশের গ্রাম থেকেও দু-দিন নরখাদকটার কোনো খবর পেলাম না এবং তৃতীয় দিন সকালে আমি তীর্থপথ ধরে ছ-মাইল নেমে সেদিককার গ্রামে কোনো হদিস পাই কি না দেখতে গেলাম। বার মাইল হেঁটে ফিরে এলাম দুপুরবেলায়। দেরি করে প্রাতরাশ খাচ্ছি, এমন সময়ে দু-জন লোক এসে খবর দিল যে রুদ্রপ্রয়াগের আঠারো মাইল দক্ষিণ-পূর্বে ভৈঁসোয়ারা গ্রামে আগের সন্ধ্যায় একটা ছেলে মারা পড়েছে।

ইবটসনের চালুকরা সংবাদ-সংগ্রহ-পদ্ধতিটা বেশ ভাল কাজ করছে। এই পদ্ধতিতে নরখাদক-উপদ্রুত এলাকার মড়ির খবরগুলোর জন্যে ক্রমবর্ধমান হারে পুরস্কার দেওয়া হয়। ছাগলের জন্যে দু-টাকা থেকে শুরু করে মানুষের জন্যে কুড়ি টাকা পর্যন্ত। এই পুরস্কারগুলোর জন্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলে। এর ফলে যথাসম্ভব কম সময়ের মধ্যেই আমরা খবরগুলো পেয়ে যাই।

লোকদুটোর হাতে দশ টাকা দেওয়ার পর একজন বলল যে সে আমাকে পথ দেখিয়ে ভৈঁসোয়ারা পর্যন্ত নিয়ে যাবে। অপর জন বলল, যে সে ঐ রাতটা রুদ্রপ্রয়াগেই কাটাবে কারণ তার জ্বর হয়েছে। আবার আঠারো মাইল পথ হাঁটা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। লোকদুটো তাদের কাহিনী শোনাতে লাগল।

আমি প্রাতরাশ শেষ করলাম এবং বেলা একটা বাজার কিছু আগেই আমার রাইফেল, কয়েকটা কার্তুজ ও টর্চ-লাইটটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ইনসপেকশন বাংলোর কাছে রাস্তাটা পার হয়ে যখন ওদিকের খাড়া পাহাড়টায় উঠছি তখন আমার সঙ্গীটি জানাল যে অনেকটা পথ যেতে হবে এবং অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর বাইরে থাকা আর নিরাপদ হবে না।

এ কথায় আমি তাকে গতিবেগ বাড়িয়ে আগে-আগে যেতে বললাম। উপায়ান্তর থাকলে আমি কক্ষনো খাওয়ার ঠিক পরেই পাহাড়ে চড়ি না। কিন্তু এখানে আর উপায় নেই। প্রথম তিন মাইল আমার পথ প্রদর্শকের সঙ্গে তাল রেখে প্রায় চার হাজারফুট উঠতে আমর রীতিমত কষ্টই হচ্ছিল। তিন মাইলের শেষে খানিকটা সমতল পথ পাওয়ায় আবার দম ফিরে পেলাম ও এবার আগে-আগে চলতে লাগলাম।

রুদ্রপ্রয়াগ আসার সময়েই লোকদুটো পথের দু-পাশের গ্রামগুলোয় ছেলেটির মৃত্যুর খবর দিয়ে গিয়েছিল।

তারা বলে গিয়েছিল যে আমাকে তাদের সঙ্গে ভৈসোয়ারায় আসতে রাজী করাবে। আমি যে রাজী হব তাতে কারুর সন্দেহ ছিল না বলেই মনে হয়, কারণ : প্রত্যেক গ্রামের সমস্ত অধিবাসীই আমার জন্যে রাস্তার ধারে অপেক্ষা করছিল। কেউ-কেউ আমাকে আশীর্বাদ জানাল, কেউ-কেউ আবেদন জানাল তাদের শত্রু নিধন না হওয়া পর্যন্ত আমি যেন সে এলাকা ছেড়ে চলে না যাই।

আমার সঙ্গীটি আমাকে বলেছিল যে আমাদের ঠিক আঠারো মাইল পথ যেতে হবে। পাহাড়ের পর পাহাড় এবং মধ্যবর্তী উপত্যকাগুলি অতিক্রম করতে করতে আমি বুঝতে পারলাম যে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাকে জীবনের দীর্ঘতম ও কঠিনতম আঠারোটি মাইল আজ পাড়ি দিতে হচ্ছে।

সূর্য প্রায় ডুবু-ডুবু, এই সময় ঐ সীমাহীন পাহাড়গুলোর একটা থেকে দেখতে পেলাম কয়েকশো গজ সামনে একটা শৈলশিরার উপর কতকগুলো লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখেই কয়েকটি লোক ওপিঠে অদৃশ্য হয়ে গেল এবং বাকি ক-জন আমাদের দিকে এগিয়ে এল। গাঁয়ের মোড়ল ছিল শেষোক্ত দলে, এবং আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর পর বেশ খুশি হওয়ার মত সংবাদই দিল সে। তার গ্রামটা এই পাহাড়ের ঠিক ও-পিঠেই, এবং তখনই সে তার ছেলেকে চা তৈরি রাখার জন্যে গ্রামে পাঠিয়ে দিল।

১৯২৬ সালের চোদ্দই এপ্রিল তারিখটা গাড়োয়াল বহুদিন মনে রাখবে। ঐ তারিখে রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক চিতাটা তার শেষ মানুষটি শিকার করে। ঐ দিন বিকেলে এক বিধবা ও তার দুটি সন্তান–একটি ন-বছরের মেয়ে এবং একটি বারো বছরের ছেলে–প্রতিবেশী আট বছরের একটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ভৈঁসোয়ারা গ্রাম থেকে কয়েক গজ দূরের এক ঝরনায় জল আনতে যায়।

ঐ বিধবা তার ছেয়েমেয়ে নিয়ে লম্বা একসার বাড়ির মাঝামাঝি একটা ঘরে থাকত। বাড়িগুলো দোতলা। নিচু একতলাটা শস্য ও জ্বালানি রাখার কাজে ব্যবহৃত হত–উপরতলাই ছিল বাসগৃহ। চার-ফুট চওড়া এবং বাড়ি বরাবর লম্বা একটা বারান্দা চলে গিয়েছে। দু-ধারে দেওয়াল-দেওয়া ছোট-ছোট পাথরের সিঁড়ি দিয়ে বারান্দাটায় ওঠা যায়, প্রত্যেকটা সিঁড়ি দুটো করে পরিবার ব্যবহার করে। বাড়িটার সামনে নিচু দেওয়ালে ঘেরা ষাট ফুট চওড়া তিনশো ফুট লম্বা একটা উঠোন।

বিধবা ও তার ছেলেমেয়ের সঙ্গে প্রতিবেশী ছেলেটিই সবার আগে সিঁড়ির কাছে আসে এবং সিঁড়িতে ওঠার সময় সিঁড়ির সংলগ্ন নিচের ঘরে একটা প্রাণীকে শুয়ে থাকতে দেখে। সেটাকে সে একটা কুকুর বলে মনে করে। সে-সময় সে প্রাণীটার কথা কাউকে বলে নি বা অন্য কেউ সেটা দেখতেও পায় নি। ছেলেটির পিছনে ছিল মেয়েটি, তারপর বিধবা, সবশেষে বিধবার ছেলে।

সিঁড়ির মাঝামাঝি পর্যন্ত উঠে মা ছেলের মাথার পিতলের কলসিটা সিঁড়ির উপর গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল। অসাবধানতার জন্য ছেলেকে বকুনি দিয়ে সে নিজের কলসিটা বারান্দার উপর নামিয়ে রেখে পিছনে ফিরে দেখে, সিঁড়ির গোড়ায় কলসিটা কাত হয়ে পড়ে আছে। নেমে সেটা তুলে নিয়ে সে ছেলের খোঁজে চারদিকে তাকাল। কোথাও তাকে দেখতে না পেয়ে সে ভয় পেয়ে পালিয়েছে ভেবে মা ছেলেকে ডাকাডাকি শুরু করল।

আশে-পাশের প্রতিবেশীরা কলসি পড়ার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল, এখন মায়ের ডাকাডাকি শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ব্যাপার কি জানতে চাইল। ঘটনা শুনে সবাই বলল, ছেলেটি নিচের তলায় কোনো ঘরে বোধহয় লুকিয়ে আছে। ঘরগুলোর ভেতরে ততক্ষণে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে দেখে একজন একটি লণ্ঠন এনে স্ত্রীলোকটির কাছে এগিয়ে এল। গিয়েই সে দেখে, সেখানে পাথরের উপর রক্তের ফোঁটা। লোকটির ভীত-চকিত কণ্ঠস্বর শুনে অন্যান্য লোকজনও নেমে এল।

তাদের মধ্যে ছিল এক বুড়ো সে আগে তার মনিবের সঙ্গে বহুবার শিকার আঁভিযানে বেরিয়েছে। লণ্ঠনটা নিয়ে বুড়ো রক্তের দাগ ধরে উঠোন পেরিয়ে দেওয়ালের কাছে গেল। দেওয়ালের ও-পিঠে আট ফুট নিচে একটা খেত। সেখানে নরম মাটির ওপর চিতার থ্যাবড়া থাবার ছাপ স্পষ্ট ফুটে রয়েছে। সেই মুহূর্ত পর্যন্ত কেউ সন্দেহ করে নি যে ছেলেটি নরখাদকের কবলে পড়েছে, কারণ নরখাদকটার ‘কথা সবাই শুনলেও সেটা কোনোদিনই তাদের গ্রামের দশ মাইলের মধ্যে আসে নি।

কী ঘটেছে, তা বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েরা চেঁচিয়ে উঠল এবং পুরুষদের কেউ-কেউ ছুটে গেল ঢাক আনতে, কেউ বা ছুটল বন্দুক আনতে। সে গ্রামে তিনটে বন্দুক ছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তুমুল শোরগোল শুরু হয়ে গেল। সারা রাত ধরে ঢাক পেটানো, বন্দুক ছোঁড়া চলতে লাগল। দিনের আলো ফুটলে ছেলেটা দেহ পাওয়া গেল এবং রুদ্রপ্রয়াগে আমাকে খবর দেওয়ার জন্যে-দুজন লোক পাঠানো হল।

মোড়লের সঙ্গে গ্রামের কাছে পৌঁছে নারীকণ্ঠের বিলাপ শুনতে পেলাম, ছেলেটির মা কাঁদছে। গ্রামে পৌঁছলে সে-ই আমাকে প্রথম অভ্যর্থনা জানাল। আমার অনভ্যস্ত চোখেও ধরা পড়ল, কিছুক্ষণ আগেই একটা বিলাপের ঝড় বয়ে গিয়েছে এবং শিগগিরই আর-একটা ঝড় শুরু হবে। এ অবস্থায় লোকের সঙ্গে বাক্যালাপের কলাকৌশলে আমি অপটু। তাই স্ত্রীলোকটির কাছ থেকে আগের সন্ধ্যার ঘটবলী বর্ণনা না-শুনতেই চাচ্ছিলাম। কিন্তু সে আমার কাছে তা বলার জন্যে খুব আগ্রহ প্রকাশ করায় শুনতেই হল।

শুনতে-শুনতে বুঝলাম যে তার বক্তব্যে গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযোগই বেশি–কেন তারা চিতাটার পিছনে ছুটে গিয়ে তার ছেলেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করল না, “ছেলের বাপ বেঁচে থাকলে তো তাই করত!”

এই অভিযোগের উত্তরে আমি বললাম যে তার বিচার ঠিক হয় নি এবং সে যে ভাবছে তার ছেলেকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা যেত তাও ঠিক নয়। কারণ যখনই চিতাটা তার ছেলের গলায় কামড় বসিয়েছে তখনই ঘাড় থেকে মাথাটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে এবং চিতাটা উঠোন পেরিয়ে যাওয়ার আগেই ছেলেটির মৃত্যু ঘটেছে। সমবেত গ্রামবাসী বা অন্য কারুর পক্ষেই তখন আর করার কিছু ছিল না।

উঠোনে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে এবং শতখানেক বা ততোধিক লোককে জড় হতে দেখে আমি বুঝতেই পারলাম না, চিতার মত অত বড় প্রাণী কী করে মির বেলায় নোকজনের চোখ এড়িয়ে উঠোন পার হয়ে এল, আর গ্রামের কুকুরগুলোর পক্ষেই বা তার উপস্থিতি টের না পাওয়া কি ভাবে সম্ভব হল।

ছেলেটাকে নিয়ে চিতাটা যে আট ফুট উঁচু দেওয়ালটা লাফিয়ে পার হয়েছে তার উপর উঠে, খেতের ভিতর দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ অনুসরণ করে বার ফুট উঁচু আরেকটা দেওয়ালের ওপারের খেতের উপর দিয়ে গেলাম।

এই দ্বিতীয় খেতটার অপর পাশে ছিল চার ফুট উঁচু ঘন লতা-গোলাপের বেড়া। এখানে চিতাটা ছেলেটার গলার কামড় ছেড়ে দিয়ে বেড়ার মধ্যে ফাঁক খুঁজেছে। ফাঁক না পেয়ে ছেলেটার পিঠ কামড়ে ধরে বেড়াটা লাফিয়ে পার হয়ে গিয়েছে। এই তৃতীয় দেওয়ালটার তলা দিয়ে ছিল একটু গরু-বাছুর চলার পথ, এ-পথ দিয়ে সামান্য যাওয়ার পরই গ্রামে শোরগোল উঠেছে। রাস্তার ওপরই ছেলেটাকে নামিয়ে রেখে চিতাটা পাহাড় দিয়ে নেমে গিয়েছে এবং সারা রাত গ্রামে বন্দুক ও ঢাকের আওয়াজ হওয়ায় আর মড়ির কাছে ফিরে আসতে পারে নি।

আমার এখানে স্বাভাবিক কর্তব্য ছিল যেখানে চিতাটা মৃতদেহটা রেখে গিয়েছিল সেখানেই তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে কাছাকাছি বসে অপেক্ষা করা। কিন্তু এ ব্যাপাবে দুটো অসুবিধে দেখা গেল-বসার মত উপযুক্ত জায়গার অভাব, এবং অনুপযুক্ত জায়গায় বসার বিপক্ষে আমার স্বভাবজ অনীহা।

সবচেয়ে কাছের গাছটা হল তিনশো গজ দূরের একটা পাতাশূন্য আখরোট গাছ। অতএব হিসেবের বাইরে সেটা। এবং সত্যি বলতে, মাটির ওপর বসতে আমার সাহসে কুলোচ্ছিল না। আমি গ্রামে এসেছি সূর্য ডোবার সময়। কিছুটা সময় গিয়েছে চা খেতে, মায়ের কাহিনী শুনতে এবং চিতাটার দাগ অনুসরণ করতে।

তখন আর আত্মরক্ষার মত কোনো আশ্ৰয় তৈরি করে নেওয়ার সময় অবশিষ্ট নেই। যদি আমাকে মাটিতে বসতেই হয় তবে কোন্ দিক দিয়ে চিতাটা আসবে তা না আন্দাজ করেই যে-কোনো জায়গাতে বসে পড়তে হবে। এবং এটাও পরিষ্কার যে, চিতাটা আমাকে আক্রমণ করলে আমার একমাত্র পরিচিত অস্ত্র রাইফেলটি ব্যবহারের কোনো সুযোগই আমি পাব না। কারণ সুস্থ চিতা অথবা বাঘের সঙ্গে প্রকৃত মোলাকাত হবার পর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা আর সম্ভবপর হয় না।

পরিদর্শনের কাজ সেরে আমি উঠোনটায় ফিরে এসে মোড়লের কাছে একটা শাবল, একটা শক্ত কাঠের গোঁজা, একটা হাতুড়ি ও একটা কুকুরের চেন চাইলাম। শাবল দিয়ে উঠোনের পাথর তুলে গোঁজটা শক্ত করে মাটিতে পুঁতে তাতে চেনটা বেঁধে দিলাম এবং মোড়লের সহায়তায় ছেলেটির মৃতদেহ সেখানে বয়ে নিয়ে গিয়ে ঐ চেনের সঙ্গে আটকে রাখলাম।

যে অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে জীবন-যাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় তা বুদ্ধির অগম্য। তাকে কেউ বলে নিয়তি, কেউ বলে কিমৎ! গত কিছুদিনের মধ্যে এই শক্তি এক উপার্জনক্ষম লোকের জীবনে ছেদ টেনে দিয়ে পরিবারটিকে পথে বসিয়েছে। এক বৃদ্ধা সারাজীবন হাড়ভাঙা খাটুনির পর শেষের কয়েকটা বছর একটু আরামে কাটাবে আশা করছিল। অতীব যন্ত্রণাদায়কভাবে তার দিনগুলোর পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে, আর আজ এই ছেলেটির জীবনকে শেষ করে দিয়েছে।

একে দেখলে বোঝা যায় যে তার বিধবা মা তাকে বহু যত্নে মানুষ করে তুলেছিল। কাজেই মর্মভেদী কান্নার মধ্যে শোকাতুরা মায়ের বার-বার এ বিলাপ আশ্চর্যের কিছুই : নয়–’হায় পরমেশ্বর, আমার ছেলে কী দোষ করেছে? তাকে সবাই ভালবাসত, তাকে জীবনের শুরুতেই এমন ভয়ঙ্করভাবে কেন মৃত্যু বরণ করতে হল?

উঠোনটায় পাথরটা ওঠানোর আগে আমি বিধবা ও তার মেয়েকে দূরে এক পাশের একটা ঘরে স্থানান্তরিত করেছিলাম। তারপর আমার অন্যান্য প্রস্তুতির কাজ সারা হওয়ার পর আমি ঝরনায় গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এসে এক আঁটি খড় চাইলাম। খড়টা রাখলাম বিধবার খালি করা ঘরটার সামনের বারান্দায়।

ততক্ষণে পুরো অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। সমবেত লোকজনকে রাত্রে যথাসম্ভব চুপচাপ থাকতে বলে তাদের নিজের নিজের ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে আমি বারান্দায় উঠে বসলাম, সেখানে সামনে কিছু খড় জড় করে পাশ ফিরে শুয়ে পরিষ্কারভাবে মড়িটার উপর নজর রাখা সম্ভব হল এবং আমাকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা আর খুব একটা থাকল না।

আগের রাতে প্রচুর হৈ-হল্লা হওয়া সত্ত্বেও আমার ধারণা হয়েছিল যে চিতাটা ফিরে আসবে, আর যথাস্থানে মৃতদেহটা না পেলে নতুন শিকারের সন্ধানে গ্রামের মধ্যেই চলে আসবে। কারণ ভৈঁসোয়ারার প্রথম শিকার সে যত সহজে পেয়ে গিয়েছিল তাতে আবার নতুন প্রচেষ্টায় উৎসাহ পাবারই কথা। বেশ আশা নিয়েই আমি পাহারা দেওয়া শুরু করলাম।

সারা সন্ধ্যা ঘন মেঘ জমে উঠেছে, আটটার সময় মায়ের বিলাপ-ধ্বনি ছাড়া গ্রামের আর সমস্ত শব্দ স্তব্ধতায় লীন হয়ে গিয়েছে। একটা বিদ্যুতের ঝলক খেলে গেল। এক ঘণ্টা ধরে ঝড়ের মাতামাতি চলল, বিদ্যুৎ-চমক এত তীব্র ও ঘন-ঘন হতে লাগল যে উঠোনে একটা ইঁদুর এসে পড়লেও আমি তা পরিষ্কার দেখতে এবং খুব সম্ভব গুলিও করতে পারতাম। অবশেষে বৃষ্টি থামল, কিন্তু আকাশ মেঘে ভারি হয়ে থাকল, এবং দৃষ্টিসীমা কয়েক ইঞ্চির ভিতরে সঙ্কুচিত হয়ে এল। এখনই ঠিক সময়। ঝড়ে চিতাটা যেখানেই আশ্রয় নিয়ে থাকুক সেখান থেকে রওনা হওয়ার সময় হয়েছে। তার এসে পৌঁছনোর সময়টা শুধু নির্ভর করবে সেই জায়গা থেকে গ্রামটার দূরত্বের ওপর।

স্ত্রীলোকটির কান্না এতক্ষণে থেমেছে, পৃথিবীর কোথাও যেন কোনো শব্দ নেই। আমিও এইটিই আশা করছিলাম, কারণ চিতাটার আসার খবরের জন্যে আমাকে কানের উপরই নির্ভর করতে হবে এবং সেইজন্যেই আমি দড়ি ব্যবহার না করে কুকুরের চেন দিয়ে মুড়িটা বেঁধে রেখেছি।

যে খড়গুলো আমাকে দেওয়া হয়েছিল সেগুলো শুকনো, মচমচে। উদগ্রীব হয়ে কালো অন্ধকারে কান পেতে শুয়ে আছি। প্রথম শব্দটা শুনতে পেলাম,আমার পায়ের কাছে আমার শোবার জন্যে বিছানো খড়ের উপর দিয়ে গুঁড়ি মেরে-মেরে কিছু একটা আসছে। হাফ-প্যান্ট পরে ছিলাম, হাঁটুর কাছটা ছিল খালি। হঠাৎ ওই খালি চামড়ার উপর একটা প্রাণীদেহের রোমশ স্পর্শ অনুভব করলাম। নির্ঘাত নরখাদকটা গুঁড়ি মেরে এগিয়ে এসেছে আমার গলা চেপে ধরার জন্যে!

বাঁ কাঁধের উপর পা রাখার একটা হালকা চাপ পড়ল এবং যে-মুহূর্তে আমি রাইফেলের ট্রিগারটা টিপতে যাব, অমনি একটা ছোট্ট প্রাণী আমার বাহু ও বুকের মাঝখানটায় লাফিয়ে পড়ল। একটা ভিজে সপে ছোট্ট বেড়ালের বাচ্চা ঝড়ের সময় বাইরে ছিল, এখন সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ দেখে একটু উষ্ণতা ও আশ্রয়ের আশায় আমার কাছে এসেছে।

বেড়ালছানাটা সবেমাত্র আমার কোটের মধ্যে আরাম করে বসেছে এবং আমিও সেই আতঙ্কের ঝাঁপটা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছি, এমন সময় ধাপে-ধাপে সাজানো খেতগুলোর উপর থেকে একটা চাপা গর্জন শোনা গেল–শব্দটা ক্রমেই বাড়তে লাগল।

তারপর সেটা এমন একটা হিংস্র লড়াইয়ে রূপান্তরিত হল যেমনটি জীবনে কখনো শুনি নি। স্পষ্ট বোঝা যাছে নরখাদকটা যথাস্থানে ফিরে এসেছিল এবং যখন সে তার রেখে-যাওয়া মড়িটার খোঁজ করেছে, তখন তার মেজাজটাও খুব ভাল ছিল না। ঠিক এই সময় আরেকটি চিতা, এ-চিতাটা হয়তো এই এলাকাটাকেই তারই নিজস্ব বিচরণ-ভূমি বলে মনে করে, আকস্মিকভাবেই তার মুখোমুখি এসে পড়েছে।

যে ধরনের লড়াইয়ের শব্দ পাচ্ছি সেটা অত্যন্ত অসাধারণ, কারণ মাংসাশী প্রাণীরা সর্বদাই তাদের নিজের নিজের গণ্ডীর ভিতর থাকে, এবং দৈবাৎ যদি কখনো দুটোর মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটে যায় তবে এক নজরেই দু-জনে দু-জনের শক্তি সামর্থের পরিমাপ করে ফেলে এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বলটি সবলের জন্যে পথ ছেড়ে দেয়।

নরখাদকটার বয়স হলেও তার প্রকাণ্ড শরীরে যথেষ্ট শক্তি ছিল এবং যে পাঁচশো বর্গমাইল এলাকা জুড়ে তার আনাগোনা তার মধ্যে তার রাজত্বের বিরোধিতা করার শক্তিও বোধহয় অন্য কোনো পুরুষ-চিতার ছিল না। কিন্তু এখানে, এই ভৈঁসোয়ারাতে সে আগন্তুক ও অনধিকার-প্রবেশকারী। আর যে গণ্ডগোলে সে নিজেকে এখন জড়িয়ে ফেলেছে তা থেকে উদ্ধার পেতে হলে তাকে প্রাণপণে লড়াই করতে হবে, এবং বলা বাহুল্য, তাতে সে পরাম্বুখও হয় নি।

এখন আমার গুলি করার সম্ভাবনা হয়েছে, কারণ নরখাদক তার আক্রমণকারীকে পরাস্ত করতে পারলেও তার নিজের ক্ষতগুলোর জন্যে আপাতত আর মড়ির উপর তার কিছুদিন টান না থাকাটাই সম্ভব। এমনকি লড়াইয়ে তার ঘায়েল হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। সেক্ষেত্রে সত্যিই এটা হবে তার জীবনের অপ্রত্যাশিত উপসংহার। আট বছর ধরে সরকার ও জনসাধারণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর আকস্মিক লড়াইয়ে স্বজাতির হাতেই তার মৃত্যু নিঃসন্দেহে অভিনব।

পাঁচ মিনিটব্যাপী প্রথম রাউণ্ড লড়াই চলল মারাত্মক হিংস্রতার সঙ্গে। ফলাফল অনির্ধারিত রইল, কারণ তখনও আমি দুটোরই গর্জন শুনতে পাচ্ছিলাম। দশ পনের মিনিট বিরতির পর লড়াই আবার শুরু হল, কিন্তু যেখানে প্রথম সূত্রপাত সেখান থেকে দু-তিনশো গজ দূরে। স্পষ্টতই লড়াইয়ে স্থানীয় যোদ্ধাটির সুবিধে হচ্ছিল এবং সে ধীরে ধীরে অনধিকার-প্রবেশকারীকে সীমানার বাইরে বের করে দিচ্ছিল।

তৃতীয় রাউণ্ডটা আগের দুটোর চেয়ে স্বল্পস্থায়ী হল, কিন্তু কম জোরদার হল না। অবশেষে অনেকটা নিস্তব্ধতার পর যখন আবার লড়াই শুরু হল তখন লড়াইয়ের ক্ষেত্র শৈলশিরাটির উপর সরে গিয়েছে। কয়েক মিনিট পরে সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

তখনও ছ-ঘণ্টা রাত ছিল, কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম যে আমার ভৈসোয়ারা আসার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। বাঁচা-মরার লড়াই শেষ হবে, নরখাদকটা খতম হবে, আমার এ ধারণাও ক্ষণস্থায়ী হয়েছে। লড়াই খতম, নরখাদকটা জখম হয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু তাতে তার মানুষের মাংসে অরুচি ঘটবে না বা তার মানুষ মারার ক্ষমতারও কমতি হবে না।

বেড়ালছানাটা সারারাত ধরে আরামে ঘুমোলো। পূব আকাশে প্রথম ঊষার আলো ফোঁটার সঙ্গে-সঙ্গে আমি উঠোনে নেমে গিয়ে, যে চালা থেকে ছেলেটাকে আনা হয়েছিল সেই চালার নিচে তাকে সরিয়ে রাখলাম। যে কম্বলে তার শরীরটা আগে ঢাকা ছিল সেটা দিয়েই ঢেকে দিলাম। মোড়ল তখনও ঘুমোচ্ছিল, তার দরজায় গিয়ে ঘা দিলাম। চা হতে কিছুটা সময় নেবে বলে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাকে আশ্বাস নিয়ে বললাম যে নরখাদকটা কোনোদিনই আর তাদের গ্রামের দিকে ফিরে আসবে না। মোড়ল তখনই ছেলেটির দেহ শ্মশানঘাটে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে তার কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি নেওয়ার পর আমি রুদ্রপ্রয়াগের দীর্ঘ পথে পা বাড়ালাম।

কোনো প্রচেষ্টায় আমরা যতবারই ব্যর্থ হই না কেন, প্রত্যেক ব্যর্থতার পর যে নৈরাশ্যবোধ, তাতে কোনোদিনই অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারি না। কয়েক মাস ধরে দিনের পর দিন আমি এই আশা নিয়ে ইন্সপেকশন বাংলো থেকে বেরিয়ে এসেছি যে এই বিশেষ দিনটিতে আমি নিশ্চয়ই সফলকাম হব, কিন্তু প্রতিদিনই আমি নিরাশ ও ম্রিয়মান অবস্থায় ফিরে এসেছি।

আমার ব্যর্থতাগুলোয় যদি শুধু আমার ব্যক্তিগত ভালমন্দ জড়িত থাকত তবে কিছু যেত-আসত না। কিন্তু যে কাজ হাতে নিয়েছি সে কাজে ব্যর্থতার সঙ্গে আমার নিজের চেয়ে অন্যান্য লোকই বেশি জড়িত। দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কোনো কিছুর উপরই আমার ব্যর্থতার দায়িত্ব চাপাতে পারি না। দুর্ভাগ্যের ক্রমবর্ধমান চাপ আমার পিছনে তাড়া করেছিল এবং এ-সবের সম্মিলিত প্রভাব আমাকে হতাশ্বাস করে তুলেছিল।

আমার মনে হচ্ছিল যে এ কাজ নিষ্পন্ন করা আমার ভাগ্যে নেই। নরখাদকটা মড়িটা এমন জায়গায় রাখল যার-কাছে একটিও গাছ নেই, এটা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী? আরো দেখুন, যে চিতাটার বিচরণক্ষেত্র অন্তত ত্রিশ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে, সেটা কী করে এমন মুহূর্তে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পড়ল–যখন সে মড়ি খুঁজে না পেয়ে গ্রামের দিকে যেখানে তার জন্যে আমি অপেক্ষা করছি সেইদিকেই চলে আসছে?

গতকাল আঠারটা মাইল দীর্ঘ পথ মনে হচ্ছিল, আজ মনে হল দীর্ঘতর, এবং পাহাড়গুলো আরো খাড়াই। যে সব গ্রামের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলাম নোকজন আগ্রহভরে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল, এবং যদিও আমার কাছে অরা শুধু দুঃসংবাদই শুনছিল তবু তাদের মুখে একবারও নৈরাশ্য দেখি নি। কোনো মানুষ বা কোনো প্রাণী তার নির্দিষ্ট সময়ের আগে মরতে পারে না–এই তত্ত্বে তাদের সীমাহীন বিশ্বাস। সে বিশ্বাস পাহাড়কেও টলিয়ে দিতে পারে। হতোদ্যম বুকে সান্ত্বনা তাদের অপার। তা কোনো ব্যাখ্যা বা যুক্তিতর্কের অপেক্ষা রাখে না। নরখাদকটার সময় এখনো আসে নি।

সারা সকাল যে ব্যর্থতা ও হতাশার বোঝায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম তার জন্যে লজ্জিত হয়ে শেষ গ্রামটা ছেড়ে বের হলাম বেশ উৎফুল্ল চিত্তে। এ গ্রামের অধিবাসীরা আমাকে থামিয়ে এক পেয়ালা চা এনে দিল। রুদ্রপ্রয়াগের শেষ চার মাইলের পথে যখন মোড় নিয়েছি তখন খেয়াল হল আমি নরখাদকটার থাবার ছাপের উপর দিয়েই যাচ্ছি।

আশ্চর্য, মানুষের মানসিক অবস্থা তার পর্যবেক্ষণ শক্তিতে কতখানি ভোতা বা ধারাল করে তুলতে পারে। নরখাদকটা খুব সম্ভব বহু মাইল আগেই এই পথটার উপর এসে পড়েছে। সরল গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এক পেয়ালা চা খাওয়ার পর সারা সকালের মধ্যে এই প্রথম আমি চিতাটার থাবার ছাপগুলো লক্ষ করলাম। পথটা এখানে লাল মাটির উপর দিয়ে গিয়েছে, বৃষ্টিতে মাটি নরম। থাবার ছাপ দেখে, বুঝলাম যে নরখাদকটা তার স্বাভাবিক চালেই এখান দিয়ে চলে গিয়েছে। আরো আধ মাইল পরে সে গতিবেগ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং এই গতিতে চলে গিয়েছে গোলাাইয়ের উপর খাদটার মাথা পর্যন্ত। তারপর সে খাদের ভেতর দিয়ে নেমে গিয়েছে।

কোনো বাঘ বা চিতা স্বাভাবিক গতিতে হাঁটলে মাটিতে শুধু তার পিছনের পায়ের ছাপগুলোই দেখা যায়, কিন্তু কোনো কারণে গতি বেড়ে গেলে পিছনের পা সামনের পায়ের আগে-আগে মাটিতে পড়ে, এবং ফলৈ মাটিতে চারটে পায়ের ছাপই দেখা যায়। পিছনের ও সামনের পায়ের ছাপগুলোর দূরত্ব থেকে বিড়ালজাতীয় প্রাণীর চলার বেগ নির্ণয় করা সম্ভব। দিনের আলো ফুটে ওঠাই এ ক্ষেত্রে নরখাদকটার গতিবেগ বাড়িয়ে দেওয়ার প্রধান কারণ।

নরখাদকটার চলার ক্ষমতা সম্বন্ধে আমার আগেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো ছিল তার খাবারের খোঁজে পথ চলা। বর্তমান ক্ষেত্রে তার দীর্ঘ পথ চলার যথেষ্ট কারণ ছিল। যে চিতাটা তাকে অনধিকার প্রবেশের জন্যে শিক্ষা দিয়ে ছেড়েছে, তার কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে সরে যেতেই সে এখন ব্যগ্র। শিক্ষাটা কতখানি কঠিন হয়েছিল তা নরখাদকটার একটা বিবরণ থেকেই বুঝতে পারা যাবে। বিবরণটা পরে দেওয়া হচ্ছে।

.

২৪ অন্ধকার : একটি গুলি

ভারতবর্ষে আহারের সময় বছরের ঋতু এবং ব্যক্তিগত রুচির উপর নির্ভর করে। বেশির ভাগ পরিবারে তিনটি প্রধান আহারের সর্বসম্মত সময় হল : প্রাতরাশ ৮ থেকে ৯, দুপুরের খাওয়া ১ থেকে ২ এবং রাতের খাওয়া ৮ থেকে ৯।

আমি যত মাস রুদ্রপ্রয়াগে ছিলাম এবং আমার খাওয়া-দাওয়া খুব অনিয়মিত হয়েছিল। এটাই স্বীকৃত বিশ্বাস যে আহারের নিয়মানুবর্তিতা এবং দ্রব্য মিশ্রণের উপর স্বাস্থ্য নির্ভর করে। কিন্তু আমার অভ্যাসবিরোধী। অনিয়মিত আহার এই বিশ্বাসের বিরোধিতা করে আমাকে খুব মজবুত রেখেছিল। রাত আটটায় পরিজ, সকাল আটটায় সুপ, দিনে একবার আহার কিংবা অনাহার আমার কোনো ক্ষতি করে নি। শুধু হাড় থেকে একটু মাংস কমে গিয়েছিল।

 গতকালের প্রাতরাশের পর আমি কিছু খাই নি। যেহেতু আমি বাইরে রাত কাটাব বলে ঠিক করেছি, আমি ভৈঁসোয়ারা ফিরে বর্ণনারহিত একটা আহার গ্রহণ করলাম। এক ঘন্টা ঘুমিয়ে উঠে স্নান করলাম, তারপর চললাম গোলাবরাই-এর দিকে। তীর্থশালার পণ্ডিতকে সাবধান করতে যে ওর এলাকায় নরখাদকটা এসেছে।

রুদ্রপ্রয়াগে প্রথম আসার পর আমি এই পণ্ডিতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিলাম, এবং ওর বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কখনো ওর সঙ্গে দু-একটা কথা না বলে যাই নি। কেননা নরখাদক এবং গোলাব্বাই দিয়ে যাতায়াত করা তীর্থযাত্রীদের নিয়ে বহু চিত্তাকর্ষক গল্প জানা ছাড়া, ও ছিল আমার দেখা গাড়োয়ালের দুজনের একজন, যে নরখাদকের আক্রমণ থেকে বেঁচে ফিরেছে। অন্যজন হল সেই মহিলা যে ছেঁড়া হাত নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছিল।

ওর একটা গল্প ছিল এক রমণীর বিষয়ে। সে এই রাস্তারই একটু দুরের এক গ্রামে থাকত। তার সঙ্গে ওর আলাপ ছিল। একদিন মহিলাটি রুদ্রপ্রয়াগের বাজার থেকে ফেরার সময় গোলাবরাইয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসে। ওর ভয় হল যে সে অন্ধকার হওয়ার আগে বাড়ি পৌঁছতে পারবে না।

সে তখন ওকে তীর্থশালায় রাত কাটাতে দেওয়ার জন্য পণ্ডিতকে অনুরোধ করল। পণ্ডিত অনুমতি দিল। ওকে বলল যে ও ফেন গুদাম-ঘর্যের দরজার সামনে শোয়। সে ঘরে তীর্থযাত্রীদের কিনবার জন্য রসদ থাকত। তাহলে ওর একদিকে থাকরে ঘর এবং অন্যদিকে পঞ্চাশজন কি, আরো বেশি তীর্থযাত্রী, যারা তীর্থশালায় রাত কাটাচ্ছে।

ঘরটা ছিল ঘাস এবং মাটি দিয়ে তৈরি। রাস্তার দিকটা খোলা, পাহাড়ের দিকটা তক্তামারা। গুদাম-ঘর এই ছাউনির মাঝামাঝি পাহাড়ের ভিতরে ঢোকানো। তাতে ছাউনির মেঝেতে কোনো অসুবিদা হত না। মহিলাটি যখন গুদাম-ঘরের দ্বাজায় শুয়ে পড়ল, তখন ওর এবং রাস্তার মাঝে এ পরি তীর্থযাত্রী ছিল।

রাত্রিবেলা এক সময়ে একজন মহিলা তীর্থযাত্রী চিৎকার করে ওঠে, বলে, যে ওকে কাকড়াবিছে কামড়েছে। কোনো আলোর ব্যবস্থা ছিল না। দেশলাই-এর আলোয় মহিলার পা দেখা গেল। দেখা গেল পা একটু কেটে গেছে। সামান্য রক্ত পড়ছে। তীর্থযাত্রীরা সবাই অসন্তোষ প্রকাশ করল যে মহিলা মিছামিছি ঝামেলা করছে। তাছাড়া কাঁকড়াবিছের কামড় থেকে রক্তপাত হয় না। এই বলে তারা আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে আমগাছের উপরের পাহাড়ের বাড়ি থেকে পণ্ডিত নামল। সে দেখল আশ্রমের সামনে রাস্তার উপর পাহাড়ী মেয়েদের একটা শাড়ি পড়ে আছে। শাড়িতে রক্ত। পণ্ডিত ভেবেছিল যে সে তার বন্ধুকে ঘরের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাটা দিয়েছে। কিন্তু যদিও মহিলাকে ঘিরে জন পঞ্চাশ তীর্থযাত্রী শুয়েছিল, চিতাটা ঘুমন্ত লোকদের উপর হেঁটে গিয়ে তাকে মারে এবং রাস্তায় ফিরবার সময় দৈবাৎ ঘুমন্ত তীর্থযাত্রীটির পা আঁচড়ে দেয়।

পণ্ডিতের ব্যাখ্যা হল যে চিতাটা বাকি জীর্থযাত্রীদের ছেড়ে ওই পাহাড়ী মহিলাটিকে নিয়ে যায় কেননা সে রঙিন পোশাক পরে ছিল। এই ব্যাখ্যা বিশ্বাসযোগ্য নয়। চিতারা ঘ্রাণশক্তি দিয়ে শিকার করে না, না, হলে বলতাম যে যাত্ৰীশালায় সব লোকদের মধ্যে ওই পাহাড়ী মহিলাটির গায়ের গন্ধটাই চিতাটার কাছে পরিচিত লেগেছিল। দুর্ভাগ্য? না অদৃষ্ট? কিংবা হয়তো ঘুমন্ত লোকদের মধ্যে ওর একার খোলা ঘরে শেয়ার বিপদের ভয়? নিহত মহিলাটির ভয়টা কি কোনো অজানা উপায়ে নরখাদকটি বুঝতে পেরেছিল? তাতেই কি ও আকৃষ্ট হয়?

এই ঘটনার কিছুদিন পরে পণ্ডিত নিজে নরখাদকের মুখোমুখি হয়। ঠিক তারিখটা বলার প্রয়োজন নেই, যদিও রুদ্রপ্রয়াগের হাসপাতালের কাগজপত্র দেখলে সেটা জানা যাবে। এই বললেই যথেষ্ট হবে, যে ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯২১ সালের গ্রীষ্মর সবচেয়ে গরম সময়ে, আমার সঙ্গে পণ্ডিতের দেখা হওয়ার চার বছর আগে।

সেই গ্রীষ্মর এক সন্ধ্যার শেষের দিকে মাদ্রাজবাসী দশজন তীর্থর্যাত্রী ক্লান্ত এবং ক্ষত-পদ অবস্থায় গোলারাইয়ে আসে এবং তীর্থশালায় রাত কাটাবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। পণ্ডিতের ভয় ছিল যে গোলাব্রাইয়ে আরো লোক মারা গেলে ওর তীর্থশালার বদনাম হয়ে যাবে। পণ্ডিত অই ওদের বলার চেষ্টা করল যে ওরা আরো দু-মাইল দূরে রুদ্রপ্রয়াগে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় পাবে।

কিন্তু ওর কোনো কথায় ক্লান্ত তীর্থযাত্রীরা রাজী হল না। শেষ পর্যন্ত ও তাদের ওর নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিতে রাজি হয়। বাড়িটা ছিল আম গাছটার পঞ্চাশ গজ উপরে, যে গাছটার কথা আমি আগেই বলেছি।

পণ্ডিতের বাড়িটা ভৈঁসোয়ারার অন্যান্য বাড়ির ছাদে গড়া। নিচে একটা ঘর যেখানে জ্বালানী কাঠ জমা থাকে। উপরতলার ঘরটা থাকার জন্য। পাথরের ছোট সিঁড়ির ধাপ চলে যায় একটা সরু বারান্দায়। থাকার ঘরের দরজাটা সিঁড়ির সবচেয়ে উঁচু ধাপের উলটো দিকে।

পণ্ডিত এবং ওর অযাচিত দশজন অতিথি সান্ধ্য-আহার শেষ করে নিজেদের ঘর বন্ধ করল। ঘরে বাস চলাচলের কোনো পথ ছিল না। ঘরের ভিতরে অসহ্য গরম, এবং রাত্রে কোনো সময়ে পণ্ডিতের মনে হল যে ওর দম আটকে যাবে।

সে তখন দরজা খুলে বাইরে এসে সিঁড়ির দুপাশের থাম ধরে দাঁড়ায়। যে থামের ওপর বারান্দার ছাদটা দাঁড়িয়ে আছে। সে বুক ভরে রাতের হাওয়া টেনে নেয়, এবং ওর গলাটা কে যেন যন্ত্রে চেপে ধরে।

ও তখন থামদুটো ধরে আততায়ীর গায়ে পায়ের পাতা লাগিয়ে এক মরিয়া লাথিতে চিটার দাঁত নিজের গলা থেকে খুলে ফেলে এবং সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দেয়। অজ্ঞান হয়ে যাবে এই ভয়ে ও একপাশে ঘুরে বারান্দার রেলিং দু-হাত দিয়ে ধরে।

সেই মুহূর্তে চিতাটা আবার নিচ থেকে লাফ দিয়ে ওর বাঁ হাতে নখ বসিয়ে দেয়। নিজের দিকে টান পড়তে ওর রেলিং-এ রাখা হাতটা বাধা দেয়।

চিতাটার দেহের ভারে নখগুলি কব্জি পর্যন্ত মাংস ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে।

চিতাটা দ্বিতীয়বার লাফাবার আগে তীর্থযাত্রীরা পণ্ডিতের ছেঁড়া গলা দিয়ে নিশ্বাস নেওয়ার ভয়াবহ আওয়াজ শুনতে পায়। ওরা, ওকে, ঘরের ভিতরে টেনে দরজায় ছিটকিনি মেরে দেয়। সেই দীর্ঘ গরম রাতের বাকিটুকু পণ্ডিত নিশ্বাসের জন্য হাঁপাতে থাকে, ক্ষত থেকে অঝোরে রক্তপাত হয়। এদিকে চিতাটা গর্জন করে ঠুনকো দরজাটা আঁচড়াতে থাকে। তীর্থযাত্রীর সন্ত্রাসে আর্তনাদ করতে থাকে।

দিন হতে তীর্থযাত্রীরা সৌভাগ্যবশত অচেতন পণ্ডিতকে বয়ে নিয়ে যায় রুদ্রপ্রয়াগের কালাকমলী হসপাতালে। সেখানে তিন মাস তাকে খাওয়ানো হয় গলায় রূপার নল ঢুকিয়ে। ছ-মাসের অনুপস্থিতির পর সে তার গোলাবুরাইয়ের বাড়িতে ফিরে আসে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে।

ওর চুলও সব পেকে গিয়েছিল। পাঁচ বছর পরে ভোলা ছবিতে পণ্ডিতের মুখের বাঁদিকে, গলায় দাঁতের দাগ এবং হাতে নখের দাগ দেখা যায় নি। যদিও সেগুলি এমনিতে স্পষ্ট দেখা যেত।

আমার সঙ্গে আলোচনার সময় পণ্ডিত নরখাদককে সব সময়ে দুষ্ট আত্মা লত। প্রথম দিনে সে বলেছিল যে ওর অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আমি কি প্রমাণ দিতে পারি যে দুষ্ট আত্মারা দৈহিক আকার ধারণ করতে পারে না? আমিও সেই জন্য, নরখাদুকটাকে দুষ্ট আত্মা বলে ডাকতাম।

সেই সন্ধ্যায় গোলারাইয়ে পৌঁছে আমি পণ্ডিতকে ভৈঁসোয়ারার নিষ্ফল যাত্রার কথা বললাম। ওকে সাবধান করে দিলাম যে ও যেন নিজের এবং ওর তীর্থশালার আশ্রয়প্রার্থী তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়। কেননা সেই দুষ্ট আত্মা দীর্ঘদিন পাহাড়ে কাটিয়ে আবার এই এলাকায় ফিরেছে।

সেই রাত্রে এবং পর-পর আরো তিন রাত আমি খড়ের গাদায় বসে রাস্তার উপর নজর রাখলাম। চতুর্থ দিনে ইবটসন পাউরি থেকে ফিরল।

ইবটসন সবসময় আমাকে নতুন করে প্রাণবন্ত করত। স্থানীয় লোকদের সঙ্গে ওরও মতবাদ একই, যে নরখাদকটা যে গতকাল মরে নি তারজন্য কারুর দোষ নেই। কেননা সেটা আজ না হয় আগামীকাল মরবে। ওকে সব খবর এবার বললাম। যদিও আমি ওকে নিয়মিতভাবে চিঠি লিখতাম, এবং চিঠিগুলির কিছু-কিছু অংশ ওর গভরমেন্টের কাছে পাঠানোর রিপোর্টের অন্তর্ভুক্ত করা হত, এবং সেখান থেকে সংবাদপত্রে ছাপানো হত। তবুও, সেগুলি শুনবার জন্য ওর আগ্রহ ছিল, ওকে সব খুঁটিনাটি বলতে পারি নি।

ইবটসনেরও আমাকে অনেক কিছু বলার ছিল। সংবাদপত্রে নরখাদকটাকে মারা নিয়ে খুব হৈ-চৈ হয়েছে, এবং তারা প্রস্তাব করেছে যে ভারতবর্ষের নানান অঞ্চল থেকে শিকারীদের গাড়োয়ালে গিয়ে চিতাটাকে মারতে সাহায্য করা উচিত। এই সংবাদপত্রের প্রচারের ফল হল যে ইবটসনের কাছে একজন মাত্র খবর নেয় এবং আরেকজন একটি প্রস্তাবই করে।

খবর নেয় একজন শিকারী। সে বলে, যদি তার আসা যাওয়া, থাকা এবং খাবারের সুবন্দোবস্ত করা হয় সে ভেবে দেখতে পারে যে গাড়োয়ালে আসাটা পোষাকে কিনা। আর, প্রস্তাব করে একজন বলে, চিতাটাকে মারার চেয়ে সহজ এবং ত্বরিত পদ্ধতি হল একটা ছাগলের গায়ে আর্ষেনিক মাখিয়ে তার মুখ সেলাই করে দিতে হবে যাতে সে নিজেকে চাটতে না পারে। তাকে এক জায়গায় বেঁধে রাখলে চিতাটা ওকে দেখে খেয়ে ফেলবে এবং বিষক্রিয়ায় মারা যাবে।

সেদিন আমরা অনেক কথা বলাবলি করলাম। আবার বহু অকৃতকার্য প্রচেষ্টা খুঁটিয়ে বিন্সর করা হল। লাঞ্চ খেতে-খেতে আমি ইটসনকে বললাম যে চিতাটা প্রতি পাঁচ দিন অন্তর একবার রুদ্রপ্রয়াগ এবং গোলাব্রাইয়ের রাস্তায় আসাযাওয়া করে। আমি ওকে বোঝালাম যে আমার চিতাটাকে মারার শেষ আশা হল রাস্তার ধারে দশ রাত বসে থাকা।

আমি বললাম যে এই সময়ের মধ্যে চিতাটা রাস্তাটা অন্তত একবার ব্যবহার করবেই। ইবটসন অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার পরিকল্পনায় রাজী হল, কেননা আমি এর মধ্যে বহু রাত জেগেছি, এবং আরো দশ রাত জাগা আমার পক্ষে খুব কষ্টকর হবে।

শেষ পর্যন্ত আমার কথাই রইল। আমি এবার ইবটসনকে বললাম যে এই সময়ের মধ্যে আমি যদি চিতাটাকে না-মারতে পারি আমি নৈনিতাল ফিরে যাব। অন্য নতুন শিকারীরা তখন ইচ্ছামত আমার জায়গা নিতে পারে।

সেই সন্ধ্যায় ইবটসন আমার সঙ্গে গোলাব্বাইয়ে এসে একটা আমগাছে মাচান খাটাবার সময়ে আমাকে সাহায্য করল। আমগাছটা তীর্থশালা থেকে একশো গজ দূরে, এবং পণ্ডিতের বাড়ি থেকে পঞ্চাশ গজ নিচে। গাছটার ঠিক নিচে, রাস্তার মাঝখানে শক্ত কাঠের খুঁটি পুঁতলাম। তার সাথে একটা ছাগল বাঁধলাম। সেটার গলায় ঘণ্টা বাঁধা ছিল।

চাঁদ প্রায় পূর্ণিমার কাছাকাছি, তবুও গোলাইয়ের পূবের উঁচু পাহাড়ের জন্য এই গভীর গঙ্গা-উপত্যকা মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য চাঁদের আলো পায়। যদি অন্ধকার হতে চিটা আসে ছাগলটাই আমাকে ওর আগমনের বিষয়ে সতর্ক করবে।

আয়োজন শেষ হওয়ার পর ইবটসন বাংলোয় ফিরে গেল। বলে গেল যে ভোর হলে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমার দু-জন লোককে পাঠাব। গাছের নিচে একটা পাথরের উপর বসে আমি ধূমপান করতে করতে সন্ধ্যা ঘনাবার জন্য অপেক্ষা করলাম। পণ্ডিত এসে আমার পাশে বসল।

সে ভক্তি-সম্প্রদায়ের লোক, ধূমপান করে না। সন্ধ্যার আগে সে আমাকে সারা রাত গাছে বসে থাকা থেকে নিরস্ত করতে চেষ্টা করল। কেননা আমি ইচ্ছা করলে আরাম করে বিছানায় ঘুমাতে পারি। আমি ওকে ভরসা দিলাম যে আমি রাতটা গাছেই কাটাব, এবং পরের আরো নয় রাতও ওইভাবেই যাবে।

আমি যদি দুষ্ট আত্মাকে মারতে না পারি, অন্ততপক্ষে আমি ওর বাড়ি পাহারা দিতে পারব এবং ওর তীর্থশালার যে-কোনো শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারব।

আমার উপরের পাহাড় থেকে রাত্রে একবার কাকার হরিণ ডাকল, তারপর রাত আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল। পর দিন সূর্যোদয়ে দুটি লোক এল। আমি ইপেশন বাংলোর দিকে যেতে-যেতে রাস্তাটায় থাবার ছাপ আছে কি না, দেখতে লাগলাম। পিছনে আমার লোকরা কম্বল এবং রাইফেল বয়ে আনল।

পরের ন-দিন আমার কর্মসূচীতে কোনো ব্যত্যয় ঘটে নি। সন্ধ্যা হতে-হতে আমি দু-জন লোক নিয়ে বাংলো থেকে বেরোতাম। মাচানে উঠে তাদের সময় থাকতে পাঠিয়ে দিতাম। যাতে ওরা সন্ধ্যা ঘনাবার আগে বাংলোয় ফিরতে পারে। ওদের উপর। কড়া হুকুম ছিল, যে ওরা যেন পুরো আলো হওয়ার আগে বাংলো থেকে না-বেরোয়। প্রতি সকালে নদীর ওপারের পাহাড়ে সূর্যোদয় হলে ওরা আসত এবং আমার সঙ্গে বাংলোয় ফিরত।

এই দশ রাতে প্রথম রাতের কাকারের ডাক ছাড়া আর কিছু শোনা যায় নি। নরখাদকটা যে এলাকাতেই আছে, তার যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েছিলাম। এই দশ রাতের মধ্যে সে দু-বার কয়েকটি বাড়িতে ঢুকেছিল। প্রথমবার সে একটা ছাগল তুলে নিয়ে যায়, দ্বিতীয়বার একটা ভেড়া।

দুটি মড়িকে খুঁজতে আমার বেগ পেতে হয়েছিল কেননা দুটোকেই অনেক দূর। টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, এবং দুটোকেই এমন নিঃশেষে খাওয়া হয়েছিল, যে ওগুলি আমার কোনো কাজে আসে নি।

এই দশ রাতের মধ্যে চিতাটা একটি বাড়ির দরজা ভেঙে ঢোকে। গৃহবাসীদের সৌভাগ্য যে বাড়িতে দুটি ঘর ছিল। এবং ভিতরের দরজাটা চিতাটার আক্রমণ রুখবার পক্ষে যথেষ্ট মজবুত ছিল।

আমগাছে দশম রাত কাটাবার পর বাংলোয় ফেরার পর আমি ও ইবটসন আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করলাম। সেই শিকারীর কাছ থেকে আর কোনো চিঠি আসে নি। কেউই গভরমেন্টের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে ইচ্ছাপ্রকাশ করে নি। এবং সংবাদপত্রের আবেদনে সাড়া দেয় নি।

আমার এবং ইবটসনের রুদ্রপ্রয়াগে আর সময় কাটানো সম্ভব ছিল না। ইবটসন দশ দিন ধরে ওর সদর শহর পাউরির বাইরে আছে। আমারও আফ্রিকায় কাজ আছে এবং আমি আমার যাওয়া তিন মাস পিছিয়েছি। আর দেরি করা সম্ভব ছিল না। গাড়োয়ালকে নরখাদকের দয়ার ওপর ফেলে যেতে আমাদের দুজনেরই অনিচ্ছা। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে আমরা কি করব ঠিক করতে পারছিলাম না।

এক উপায় ছিল যে ইবটসন ছুটির দরখাস্ত করে, এবং আমি যা খেসারত দেওয়ার দিয়ে আফ্রিকা যাওয়ার টিকেট বাতিল করে দিই। আমরা শেষে ঠিক করলাম যে রাতে কোনো সিদ্ধান্ত নেব না, বরং সকালে উঠে মনস্থির করব। এই সিদ্ধান্তে এসে আমি ইবটসনকে বললাম যে গাড়োয়ালে আমার শেষ রাতটা আমগাছে কাটাব।

ইবটসন এই একাদশ এবং শেষ সন্ধ্যায় আমাকে সঙ্গ দিল। গোলাব্রাইয়ের কাছে এসে দেখলাম একদল লোক রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আমগাছের পিছনের মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকগুলি আমাদের দেখতে পায় নি এবং আমরা ওদের কাছে পৌঁছবার আগে তীর্থশালার দিকে যেতে লাগল। ওদের মধ্যে একজন ফিরে তাকিয়ে দেখল আমি হাতছানি দিয়ে ডাকছি। সেই দেখে ও ফিরে এল। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে ও বলল যে ও এবং ওর সঙ্গীরা এক ঘণ্টা ধরে মাঠের মধ্যে দুটি বড় সাপের লড়াই দেখছিল।

দেখে মনে হল যে গত এক বছর কি তার বেশি দিন ওখানে কোনো ফসল ফলে নি। মাঠের মাঝখানে একটা বড় পাথরের গাছে সাপটিকে দেখা গিয়েছিল। পাথরের উপর রক্তের দাগ ছিল। লোকটা বলল ওগুলি সাপগুলির রক্ত। ওরা পরস্পরকে কামড়েছে এবং ওদের দেহের বহু জায়গা থেকে রক্তপাত হচ্ছে। আমি পাশের একটা ঝোঁপ থেকে একটা ডাল ভেঙে নিয়ে মাঠে নেমে দেখতে গেলাম পাথরটার কাছে, কোনো গর্ত আছে কি-না, এবং সেই সময় রাস্তার ঠিক নিচের একটা ঝোপের ভিতরে সাপদুটিকে দেখতে পেলাম।

ইবটসনও একটা শক্ত লাঠি যোগাড় করে ফেলেছিল, যেমনি একটা সাপ রাস্তায় উঠবার চেষ্টা করল ইবটসন সেটাকে মেরে ফেলল। অন্যটা একটা উঁচু মাটির স্তূপের মধ্যে একটা গর্তে ঢুকে গেল। সেখান থেকে আমরা সেটাকে বার করতে পারলাম না। ইবটসন যে সাপটাকে মেরেছে সেটা সাত ফুট লম্বা, এবং গায়ের রং হালকা খড়ের মত। সেটার ঘাড়ে অনেকগুলি কামড় লেগেছিল। ওটা দাঁড়াস সাপ নয়। ওটার বেশ বড় বিষদাঁত ছিল।

তাই মনে হল যে ওটা এক ধরনের ফণাহীন গোখরো সাপ। শীতলরক্ত জীবরা সাপের বিষ থেকে অনন্যক্রম্য নয়। আমি দেখেছি যে একটা ব্যাঙকে গোখরোর কামড়ে কয়েক মিনিটের ভিতরে মারা যেতে। তবে আমি জানি না এক শ্রেণীর সাপরা পরস্পরকে বিষ দিয়ে ঘায়েল করতে পারে কিনা। যে সাপটা গর্তে ঢুকেছে সেটা হয়তো কয়েক মিনিটের ভিতরে মরে যায় কিংবা হয়তো বেঁচে গিয়ে পরে জরাগ্রস্ত হয়ে মারা যায়।

ইবটসন চলে যাওয়ার পরে পণ্ডিত আমার গাছের নিচে দিয়ে একবালতি দুধ নিয়ে তীর্থশালার দিকে গেল। ও বলল যে সেই দিন দেড়শো তীর্থযাত্রী এসেছে এবং তারা ওর আশ্রয়ে রাত কাটাতে বদ্ধপরিকর। ও ওদের সেই সংকল্পের বিরুদ্ধে ক্ষমতাহীন। আমার পক্ষে কিছু করার আর সময় ছিল না। আমি ওকে বললাম তীর্থযাত্রীদের সতর্ক করে দিতে যে ওরা যেন দলবদ্ধ হয়ে থাকে এবং অন্ধকার হয়ে গেলে যেন চলাফেরা না করে। ও কয়েক মিনিট পর তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফিরবার সময় বলে গেল যে ও তাদের সতর্ক করে দিয়েছে।

আমার গাছ থেকে প্রায় একশো গজ দূরে রাস্তার পাশে এক মাঠে একটা কাটা ঝোপের ঘেরা জায়গা ছিল। সেখানে একজন মালবাহক–আমার সেই পুরনো বন্ধু নয়-সন্ধ্যার আগে ওর ছাগল এবং ভেড়ার পাল ঢুকিয়েছিল। মালবাহকটির সঙ্গে দুটি কুকুর ছিল। আমরা যখন রাস্তা ধরে আসি ওদুটি আমাদের দেখে প্রচণ্ডভাবে ঘেউ-ঘেউ করেছিল, এবং ইবটসনকে দেখে আমাকে ছেড়ে বাংলোয় ফিরে যায়।

পূর্ণিমা কয়েক দিন আগে হয়ে গেছে। উপত্যকা অন্ধকারে ঢাকা। রাত নটার একটু পরে আমি দেখলাম একজন লোক লণ্ঠন হাতে তীর্থশালার বাইরে এসে রাস্তা পার হল। দু-এক মিনিট পরে সে আবার রাস্তা পার হয়ে আশ্রয়ে ঢুকবার সময় লণ্ঠটা নেভাল। ঠিক এই সময়ে মালবাহকের কুকুর দুটি অভ্রান্তভাবে চিতাটার দিকে মুখ করে ডাকছিল। চিতাটা সম্ভবত লণ্ঠন হাতে লোকটাকে দেখেছে এবং এখন রাস্তা ধরে যাত্রীশালার দিকে আসছে।

প্রথমে কুকুর দুটি রাস্তার দিকে তাকিয়ে ডাকছিল। একটু পরে ওরা ঘুরে এবং আমার দিকে তাকিয়ে ডাকতে লাগল। তার মানে চিতাটা নিশ্চয় ঘুমন্ত ছাগলটাকে দেখেছে এবং কুকুর দুটির দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে।

কুকুর দুটি ডাক থামিয়েছে। চিতাটা নিশ্চয় এবার কি চাল চালবে, ভাবছে। আমি জানতাম যে চিতাটা এসেছে, আর এটাও জানতাম যে আমার গাছের আড়াল থেকে ছাগলটাকে অকস্মাৎ আক্রমণ করবে।

দীর্ঘ মিনিটগুলি কেটে যাচ্ছিল। যে প্রশ্নটা আমাকে উত্যক্ত করছিল, সেটা হল যে চিতাটা কি ছাগলটাকে ছেড়ে তীর্থযাত্রীদের একজনকে মারবে না ও ছাগলটাকে মেরে আমাকে গুলি করার সুযোগ দেবে।

এতগুলি রাত গাছে কাটিয়ে আমি একটা কায়দা শিখেছিলাম, যার ফলে ন্যূনতম নড়াচড়া এবং সময়ের মধ্যে রাইফেল চালাতে পারতাম। আমার মাচান এবং ছাগলটার মধ্যে ব্যবধান প্রায় কুড়ি ফুট, কিন্তু গাছের ঘন ডালপালার নিচে রাত এত অন্ধকার লাগছিল আমি অনেক চেষ্টা করেও এত অল্প দূরত্বেও ঠিক দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি চোখ বন্ধ করে কানদুটি সজাগ করলাম।

আমার রাইফেলে একটা ছোট ইলেকট্রিক টর্চ লাগানো ছিল। রাইফেলের নিশানা ছাগলটার দিকে। আমি ভাবতে শুরু করলাম যে চিতাটা–যদি অনুমান করা যায় ওটাই নরখাদকটাযাত্রীশালায় ঢুকে মানুষ শিকার করা স্থির করছে। ঠিক এই সময়ে গাছের নিচে থেকে কে যেন ছুট মারল। ছাগলের ঘণ্টা তীক্ষ্ণ সুরে বেজে উঠল। টর্চের বোতাম টিপে দেখলাম যে রাইফেলের মাছি চিতাটার কাঁধের ওপর নিবন্ধ, এবং আমি রাইফেল এক ইঞ্চিও না সরিয়ে ঘোড়া টিপলাম। টর্চ নিভে গেল।

আজকালের মতন সেকালে টর্চের এত প্রচলন ছিল না। এই টর্চটা আমার প্রথম কেনা। ওটা বহু মাস ধরে বয়ে বেড়িয়েছি। ব্যবহার করার কোনো সুযোগ হয় নি। ব্যাটারির তয় জানা ছিল না, এবং সেটা পরীক্ষা করার প্রয়োজন আছে কিনা জানতাম না। এবার যখন বোম টিপলাম, টর্চটা একটু ক্ষীণ আলো জ্বালিয়ে নিভে গেল। আমি আবার অন্ধকারে। জানতেও পারলাম না আমার গুলির কোনো ফলাফল হল কিনা।

আমার গুলির আওয়াজের প্রতিধ্বনি উপত্যকায় মিলিয়ে গেল। পণ্ডিত দরজা খুলে হেঁকে প্রশ্ন করল আমার কোনো সাহায্য দরকার আছে কিনা। আমি কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করছিলাম চিতাটা কোনো আওয়াজ করছে কি না। সেই জন্য আমি কোনো জবাব দিলাম না। ও তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিল।

আমি যখন গুলি করি তখন চিতাটা রাস্তার উপর। মাথা অন্য দিকে ঘুরিয়ে রেখেছিল। আমার অস্পষ্টভাবে মনে হল যে ও ছাগলটার উপর দিয়ে লাফিয়ে পাহাড় বেয়ে নিচের দিকে গেছে। পণ্ডিত ডাকার ঠিক আগে আমার মনে হল যে আমি একটা গলার ঘড়ঘড় আওয়াজ শুনেছিলাম। তবে আমি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না।

আমার গুলির আওয়াজে তীর্থযাত্রীরা জেগে উঠেছিল। কয়েক মিনিট নিচু গলায় কথা বলে ওরা আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ছাগলটা মনে হল আহত হয় নি, কেননা ওর ঘন্টার আওয়াজ শুনে মনে হল যে ওটা চলাফেরা করে ঘাস খাচ্ছে। ওকে প্রত্যেক রাত্রে প্রচুর পরিমাণে ঘাস দেওয়া হয়।

আমি রাত দশটায় গুলি চালিয়েছি। চাঁদ উঠতে এখনো কয়েক ঘণ্টা বাকি। ইতিমধ্যে কিছু করার নেই বলে আমি আরাম করে বসে কান পেতে ধূমপান করলাম।

কয়েক ঘন্টা পরে চাঁদ উঠল। গঙ্গার পারের পর্বতশিখণ্ডলি আলোকিত করল! উপত্যকা গড়িয়ে চলে এল, একটু পরে আমার পিছনের পাহাড়ের চূড়ার উপর দেখা দিল।

চাঁদ মাথার উপর উঠতে আম গাছের মগডালে উঠলাম, কিন্ত ছড়ানো ডালপালার জন্য ঠিক দেখতে পেলাম না।

আবার মাচানে নামলাম, রাস্তার উপরে ছড়ানো ডালে উঠলাম, কিন্তু এখন থেকেও পাহাড়ের যে দিকে চিতাটা গেছে বলে মনে হল সেদিকটা দেখা যাচ্ছিল না। তখন বাজে রাত তিনটা। দু-ঘণ্টা পরে চাঁদ অস্ত যেতে লাগল। পুব আকাশে উষা জন্ম নিল। কাছের জিনিসগুলি দেখা গেল। আমি গাছ থেকে নামলাম। ছাগলটা বন্ধুসুলভ গলায় ডেকে আমাকে অভ্যর্থনা করল।

ছাগলটার পিছনে, রাস্তার ধারে, একটা নিচু লম্বা পাথর। পাথরের উপর একইঞ্চি চওড়া রক্তের দাগ। যে চিতাটার গা থেকে এই রক্ত পড়েছে, সে নিশ্চয় দু-এক মিনিট মাত্র বেঁচেছে।

যে সতর্কতা সাধারণত মাংসাশী পশুর রক্তের দাগ অনুসরণ করতে গেলে অবলম্বন করতে হয়, আমি তা উড়িয়ে দিলাম।

রাস্তা থেকে নামলাম, পাথরের অন্য পাশে রক্তের দাগ দেখলাম, পঞ্চাশ গজ পর্যন্ত অনুসরণ করলাম। দেখলাম চিতাটা মরে পড়ে আছে। ও জমির একটা গর্তে লেজের দিক দিয়ে পিছলে পড়ে গেছে। তার মধ্যে গুটিসুটি মেরে আছে। গর্তের ধারে থুতনিটা।

মৃত জন্তুটাকে শনাক্ত করার মত কোনো দাগ দেখা যাচ্ছিল না। তবুও আমার এক মুহূর্তের জন্যে সন্দেহ হয় নি যে গর্তে পড়ে থাকা চিতাটাই নরখাদকটা। এ কোনো পিশাচ নয় যে দীর্ঘ রাতের প্রহর ধরে আমাকে লক্ষ করেছে। ওকে কাবু করবার আমার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় নিঃশব্দ পৈশাচিক হাসিতে গড়াগড়ি দিয়েছে। সেই সুযোগের আশায় ঠোঁট চেটেছে, যখন আমাকে অসতর্ক অবস্থায় পেয়ে আমার গলায় দাঁত বসাবে।

এখানে পড়ে আছে একটি বুড়ো চিতা, অন্য চিতাদের সঙ্গে ওর এইমাত্র তফাত, যে ওর মুখটা ধূসর, ঠোঁটের উপর গোঁফ নেই। ভারতবর্ষে সবার চেয়ে ঘৃণ্য এবং সন্ত্রাসকারী জন্তু, যার একমাত্র অপরাধ–প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে নয়, কিন্তু মানুষের নিয়মের বিরুদ্ধে–সে মানুষের রক্তপাত করেছে। মানুষকে আতঙ্কিত করার জন্য নয়, শুধু নিজের প্রাণ রক্ষার জন্য।

সে এখন গর্তের ধারে থুতনি রেখে শুয়ে আছে, চোখদুটি আধবোজা, তার শেষ ঘুমে শান্তি মগ্ন।

আমি দাঁড়িয়ে আমার রাইফেল গুলিশূন্য করলাম। যে রাইফেলের একটি গুলিতে ঘুমন্ত জীবটির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত হিসাব চুকে গেছে। একটা কাশির শব্দ শুনলাম। উপর দিয়ে চেয়ে দেখলাম পণ্ডিত রাস্তার ধার থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি হাতছানি দিতে সে সন্তর্পণে পাহাড় বেয়ে নামল। চিতাটার মাথা দেখে সে থামল, ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল যে সে মৃত কি না। এবং সেটা কি!

আমি যখন বললাম যে সেটা মৃত, এবং সেটা হল সেই দুষ্ট আত্মা যে পাঁচ বছর আগে ওর গলা ছিঁড়ে দিয়েছিল, যার ভয়ে সে গত রাত্রে দরজা বন্ধ করে ছিল। ও হাতজোড় করে আমার পায়ে মাথা ঠেকাতে গেল। পরের মিনিটেই রাস্তা থেকে ডাক। এল “সাহেব, তুমি কোথায়?”

আমার একজন লোক উদ্বিগ্ন হয়ে আমাকে ডাকছে। আমার উত্তর, গঙ্গার উপর প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। চারটি মাথা দেখা গেল। আমাদের দেখে চারজন লোক হুড়মুড় করে পাহাড় বেয়ে নামল। একজনের হাতে লণ্ঠন জ্বলছে। লণ্ঠনটা সে নেভাতে ভুলে গেছে।

চিতাটা গর্তের মধ্যে শক্ত হয়ে জমে গিয়েছিল। ওকে বার করতে বেশ কষ্ট হয়েছিল। ওকে লোকদের আনা শক্ত বাঁশের লম্বা ডাণ্ডায় বাঁধা হল। ওরা বলল যে ওরা রাত্রে ঘুমোতে পারে নি। ইবটসনের জমাদারের ঘড়িতে সাড়ে চারটা বাজতে দেখেই ওরা লণ্ঠন জ্বালিয়ে, হাতে লম্বা ডাণ্ডা এবং একগাছা দড়ি নিয়ে আমাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে।

কেননা, ওদের ধারণা হয়েছিল যে আমার ওদেরকে দরকার। আমাকে মাচানে না দেখে, ছাগলটাকে অনাহত দেখে, এবং পাথরে রক্তের দাগ দেখে ওরা ধরে নিল যে নরখাদকটা আমাকে মেরে ফেলেছে। ওরা তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মরিয়া হয়ে আমাকে ডাকল।

পণ্ডিতকে রেখে এলাম মাচান থেকে আমার কম্বলটা উদ্ধার করতে এবং ভিড়-করা- তীর্থযাত্রীদের রাত্রের ঘটনা বিষয়ে ওর কাহিনী শোনাতে। চারজন লোক এবং আমি–পাশে ছাগল-ইন্সপেকশন বাংলোর দিকে চললাম। যে মুহূর্তে চিতাটা ছাগলটাকে ধরেছিল, সেই মুহূর্তেই আমি গুলি করার জন্য ছাগলটা বেশী আহত হয় নি। সে জানত না যে ওর রাতের অ্যাডভেঞ্চারের জন্য সে সারা জীবনের মত বিখ্যাত হয়ে থাকবে। ওর গলায় থাকবে পিতলের আংটা, এবং যার কাছ থেকে ওকে আমি কিনেছিলাম সেই লোকটির আয়ের একটি উৎস হয়ে দাঁড়াবে ও। কেননা আমি ছাগলটা ফেরত দিয়েছিলাম।

আমি যখন ঘষা কাঁচের দরজায় টোকা মারলাম ইবটসন ঘুমাচ্ছিল। আমাকে দেখে ও খাট থেকে লাফিয়ে উঠে দরজার কাছে দৌড়ে এল। দড়াম করে দরজা খুলে আমাকে জড়িয়ে ধরল। পরের মিনিটে ও লোকদের বারান্দায় রাখা চিতাটার চারপাশে নাচতে লাগল।

চিৎকার করে চা বানাতে বলল, আমার জন্য গরম জল করতে বলল, স্টেনোগ্রাফারকে ডেকে গভর্নমেন্ট, সংবাদপত্র, আমার বোন এবং জীনকে তার পাঠাল।

ও একটাও প্রশ্ন করল না, কেননা ও জানত যে, এই সকালে যে চিতাটাকে আমি এনেছি সেটা নরখাদকটা–কোনো প্রশ্নের প্রয়োজন নেই। আগের বার, বহুপ্রমাণ সত্ত্বেও, আমি বলেছিলাম যে আঁতিকলে পড়া চিতাটা নরখাদক নয়। এবার আমি কিছু বললাম না।

গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে ইবটসন খুব গুরুর দায়িত্ব বয়ে বেড়াচ্ছিল, কেননা নির্বাচকদের সন্তোষপ্রয়াসী কাউন্সিলার, ক্রমবর্ধমান মৃত সংখ্যাতে উদ্বিগ্ন সরকারী কর্মচারী, সাফল্য প্রয়াসী সংবাদপত্র এদের সবার প্রশ্নের জবাব ওকেই দিতে হয়েছিল।

বহুদিন ধরে ওর অবস্থা পুলিসের বড়কর্তার মত হয়েছিল, যে, কোনো দাগী অপরাধীর পরিচয় জানা সত্ত্বেও, তার দ্বারা কৃত অপরাধগুলি বন্ধ করতে পারছিল না। আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ নেই যে ১৯২৬ সালের মে মাসের দু’তারিখে ইবটসনের মত সুখী লোক আমি আর দেখিনি, কেননা সে কর্তৃপক্ষ ছাড়া, বাজারের লোক আশেপাশের গ্রামবাসী, তীর্থযাত্রী, এবং ইনসপেকশন বাংলোর মাঠে ভিড় করা সব লোকদের বলতে পেরেছিল যে, যে দুষ্ট্র আত্মা ওদের দীর্ঘ আট বছর ধরে উৎপীড়ন করেছে আজ সে মৃত।

এক পট চা খেয়ে, গরম জলে স্নান করে আমি একটু ঘুমোতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু পা অসাড় হয়ে খিঁচ ধরার ভয়ে আমি উঠে পড়লাম–যে খিচুনি থেকে একমাত্র ইবটসনের জোর মালিশ আমাকে বাঁচায়। ইবটসন এবং আমি চিতাটাকে মাপলাম, ভাল করে নিরীক্ষণ করলাম। আমাদের মাপ এবং নিরীক্ষণের ফলাফল এবার লিখছিঃ

মাপ

খুঁটির মধ্যে মাপ  – সাত ফুট ছয় ইঞ্চি।
দেহের বক্রতা সুদ্ধ মাপ  – সাত ফুট দশ ইঞ্চি।

(দ্রষ্টব্য: চিতাটার মৃত্যুর বার ঘণ্টা পরে মাপ নেওয়া হয়েছিল)।

বর্ণনা

রঙ – হালকা খড়ের মত
লোম – ছোট, শক্ত
গোঁফ – ছিল না।
দাঁত -ক্ষয়প্রাপ্ত, বিবর্ণ, একটা বড় দাঁত ভাঙা
জিভ এবং মুখের ভিতর – কাল
 ক্ষত – ডান কাঁধে তাজা গুলির আঘাত।

 পিছনে বাঁ পায়ের থাবায় পুরনো গুলির আঘাত, একই থাবা থেকে একটি আঙুলের কিছুটা অংশ এবং নখ ছিল না।

মাথায় অনেক গভীর এবং অল্প শুকানো কাটা দাগ।

 পিছনের ডান পায়ে একটা গভীর এবং অল্প শুকানো কাটা দাগ।

লেজে অনেক অল্প শুকানো কাটা দাগ।

পিছনের বাঁ পায়ের হাঁটুর উপরে অল্প শুকানো কাটা দাগ।

চিতাটার জিভে এবং মুখের ভিতরটা কেন কাল ছিল বলতে পারব না। বলা হয়েছিল যে এটা সায়ানাইডের প্রতিক্রিয়ায় হয়েছিল। তবে সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। অল্প শুকানো ক্ষতগুলির মধ্যে মাথা, পিছনের ডান পা এবং লেজের ক্ষতগুলি ভৈঁসোয়ারার লড়াইয়ের ফল।

পিছনের বাঁ পায়ের হাঁটুটা জাতিকলে পড়ে, কেননা আমরা যে একগোছ লোম এবং চামড়ার অংশ পেয়েছিলাম সেগুলি এই ক্ষতে ঠিক মাপসই হয়ে বসে গেল। পিছনের বাঁ পায়ে থাবার ক্ষতটা হয়েছিল, যখন ১৯২১ সালে পুলের উপর যুবক আর্মি-অফিসার ওকে গুলি করে। চিতাটার চামড়া ছাড়াতে গিয়ে দেখলাম বুকের চামড়ার নিচে অনেকগুলি ছররাগুলি বিধে আছে। একজন দেশীয় খ্রীষ্টধর্মী বহু বছর পরে বলে যে, যে-বছর চিতাটা নরখাদক হয় তার আগের বছর ও চিতাটাকে গুলি করেছিল।

ইবটসন এবং আমি চিতাটাকে মাপ এবং পরীক্ষা করে গাছের ছায়ায় শুইয়ে দিলাম। সারাদিন ধরে হাজার-হাজার পুরুষ স্ত্রীলোক এবং শিশুরা ওকে দেখতে এল।

আমাদের পাহাড়ী লোকরা যখন কোনো লোকের কাছে কোনো বিশেষ কারণে আসে, যেমন তাদের কৃতজ্ঞতা দেখাতে, কিংবা ধন্যবাদ জানাতে, ওদের প্রথা হল খালি হাতে না আসা। একটি গোলাপ, একটি গাঁদা, কিংবা এই ফুলদুটির যে কোনো একটির কয়েকটি পাপড়িতে কাজ হয়ে যায়, এবং শ্রদ্ধার্ঘ্যটি দুহাতে অঞ্জলি করে দিতে হয়। গ্রহীতা শ্রদ্ধার্ঘ্যটিকে ডান হাতের আঙুলের ডগা দিয়ে ছোঁয়ার পর সে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিয়ে আসে, সে যেন সেটি গ্রহীতার পায়েদুহাতে অঞ্জলি করে জল ঢালার মত করে ঢেলে দেয়।

আমি এর আগেও কৃতজ্ঞতা স্বীকার দেখেছি, কিন্তু সেইদিন রুদ্রপ্রয়াগের ইন্সপেকশন . বাংলো এবং পরে বাজারে যেমন দেখেছিলাম, সে-রকম কখনো দেখি নি।

“আমাদের একমাত্র ছেলেকে মেরেছে, সাহেব, আমরা বুড়ো হয়েছি আমাদের ঘর খাঁ-খাঁ করছে।

“আমার পাঁচ সন্তানের মা-কে খেয়েছে। ছোটটার মাত্র কয়েক মাস বয়স। বাচ্চাদের দেখবার জন্য ঘরে কেউ নেই–রান্না করবার কেউ নেই।”

“আমার ছেলের রাতে অসুখ করে। ভয়ে কেউ হাসপাতালে ওষুধ আনতে যেতে পারে নি। ও মারা যায়।”

একটির পর একটি করুণ কাহিনী আমি শুনতে থাকলাম। আমার পায়ের নিচের মাটি ফুলে ভরে উঠল।

.

২৫. শেষ কথা

যে ঘটনাগুলোর বর্ণনা করলাম সেগুলো ঘটেছিল ১৯২৫-২৬ সালে। ষোল বছর পরে, অর্থাৎ ১৯৪২ সালে, যুদ্ধের কাজে মীরাটে আছি, এক উদ্যানপার্টিতে, আহত সৈনিকদের আপ্যায়নে সাহায্য করতে কর্নেল ফ্লাই আমাকে ও আমার বোনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সমাগত পঞ্চাশ ষাট জন সৈনিক একটা টেনিস কোর্টের চারদিকে বসে ছিল। আমরা যখন গিয়ে পৌঁছিলাম তখন সবে চা জলখাবার শেষ হয়ে ধূমপানের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। কোর্টের দুই বিপরীত প্রান্ত থেকে আমি ও আমার বোন অভ্যাগতদের মধ্যে ঘুরতে লাগলাম।

সৈনিকদের সকলেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছিল, কিছুদিন বিশ্রামের পর তাদের কাউকে ছুটি দিয়ে, কাউকে বা কাজ থেকে অবসর দিয়ে নিজের নিজের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

মিসেস ফ্লাই গ্রামোফোন রেকর্ডে ভারতীয় সংগীত পরিবেশনের ব্যবস্থা করেছিলেন। পার্টি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে ও আমার বোনকে থেকে যেতে অনুরোধ করা হয়েছিল।

কাজেই ঘুরে-ঘুরে আহত সৈনিকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার মত ঘণ্টা দুই সময় আমরা পেয়েছিলাম।

অর্ধেকটা ঘোরার পর একটি তরুণের মনে এসে পৌঁছলাম। সে একটু নিচু চেয়ারে বসে আছে। চেয়ারের কাছে যাতে পড়ে আছে একজোড়া ক্রাচ। বুঝলাম মারাত্মকভাবেই আহত হয়েছিল। আমি এগিয়ে যেতে সে বহু কষ্টে চেয়ার থেকে নেমে আমার পয়ের উপর তার মাথাটা রাখতে চেষ্টা করল। অত্যন্ত হালকা তার দেহ ক-মাস হাসপাতালে কাটিয়ে এসেছে।

তাকে তুলে নিয়ে চেয়ারের উপর বসিয়ে দিতে সে বলল, আমি আপনার ভগ্নীর সঙ্গে কথা বলছিলাম; যখন আমি বললাম আমি গাড়োয়ালের লোক তখন তিনি জানালেন, আপনি কে। আপনি যখন নরখাদকটাকে মারেন তখন আমি খুব ছোট। আমাদের বাড়ি রুদ্রপ্রয়াগ থেকে অনেক দূরে হওয়ায় আমি সেখানে হেঁটে যেতে পারি নি, আর আমার বাবার গায়েও তেমন জোর না থাকায় আমকে কাঁধে করে নিয়ে যেতে পারে নি। সুতরাং আমাকে বারিতে থাকতে হয়েছিল।  বাবা আমাকে ফিরে এসে বলেছিল যে সে নরখাদকটাকে দেখেছে, আর নিজের চোখে দেখে এসেছে তাকে, যে সাহেবকে মেরেছে।

আরো বলেছিল যে সেখানে বহু লোক জড়ো হয়েচজিল, মিষ্টিও বিলানো হয়েছিল, আর তার নিজের ভাগটা সে আমার জন্যে বাড়িতে বয়ে নিয়ে এসেছিল। আর এখন, সাহেব, আমি বহুত খুশি মনে বাড়ি ফিরে যাব, কারণ আমি বাবাকে বলতে পারব যে আমিও আমার নিজের চোখে আপনাকে দেখেছি এবং নরখাদকটার মৃত্য-স্মরণে প্রতি বছর রুদ্রপ্রয়াগে যে মেলাটা হয় সেখানে কেউ যদি আমাকে নিয়ে যায় তবে মেলায় যাদের সঙ্গে দেখা হবে তাদের সবাইকে ডেকে বলতে পারব যে আপনাকে আমি দেখেছি, আপনার সঙ্গে কথা বলেছি।

জীবনের প্রারম্ভেই পঙ্গু, যুদ্ধ থেকে ফিরে আসছে ভগ্ন দেহ নিয়ে–বীরত্বের কোনো কাহিনী শোনানোর চিন্তা তার নেই, শুধু বাবাকে একটা কথা বলার জন্যেই সে এত ব্যর্থ যে, বহু বছর আগে যাকে তার দেখার সুযোগ হয় নি তাকে সে নিজের চোখে দেখে এসেছে–এমন একটি লোক, যাকে মনে রাখার একমাত্র দাবি যে, সে একটা নিখুঁত গুলি ছুঁড়তে পেরেছিল।

এ সেই সরল ও পরিশ্রমী পাহাড়ী মানুষদের সন্তান, আদত গাড়োয়ালের ছেলে; অল্প সংখ্যক যারা তাদের মধ্যে বসবাস করছে, এই বৃহত্তর ভারতবর্ষের সন্তানদের শুধু তারাই ঠিক চিনেছে, এরাই সেই উদার হৃদয় মাটির মানুষ, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে একদিন যারা সমস্ত যুযুধান শক্তিগুলোকে সম্পূর্ণ সংহত করে ভারতবর্ষকে একটি মহান জাতিতে পরিণত করবে।