প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

১০. ম্যাজিক

১০. ম্যাজিক

প্রত্যেকদিন বিকেলে আমার সঙ্গে দুজন লোক মই নিয়ে পুল পর্যন্ত যেত। মই বেয়ে আমি উঠে পড়লে পরে রাইফেলটা আমার হাতে দিয়ে মইটা সরিয়ে নিয়ে যেত।, দ্বিতীয় দিন পুলের কাছে যখন পৌঁছলাম, সাদা আলখাল্লা-পরা একটি লোককে দেখলাম, তার বুকে আর কপালে কি দুটো জিনিস চকচক করছিল। ছ-ফুট রূপোর ক্রুশ নিয়ে কেদারনাথের দিক থেকে সে পুলটার দিকে আসছিল। পুলে পৌঁছে লোকটা হাঁটু গেড়ে বসল, তারপর কুশটা সামনে তুলে ধরে মাথা নোয়াল। কিছুক্ষণ সেইভাবে থেকে সে কুশটা তুলে ধরল। তারপর উঠে কয়েক পা এগিয়ে আবার হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নামিয়ে কুশ তুলে ধরল। সারাটা সেতু সে এই করতে-করতে পার হল।

আমাকে পেরিয়ে যাবার সময়ে সে নমস্কারের ভঙ্গীতে হাত তুলল, কিন্তু তাকে গভীরভাবে প্রার্থনারত মনে হওয়ায় আমি কোনো কথা বললাম না। মাথায় আর বুকে যে দুটো জিনিস চকচক করতে দেখেছিলাম সে দুটো দেখলাম রূপোর ক্রুশ।

এই অদ্ভুত মানুষটিকে দেখে আমার মত আমার লোকরাও কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। লোকটি রুদ্রপ্রয়াগ বাজারে যাবার চড়াই হাঁটাপথে উঠে গেল। ওকে দেখতে-দেখতে ওরা জিগ্যেস করল লোকটি কি রকম? কোন্ দেশ থেকে এসেছে ও? ও যে ক্রীশ্চান, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দেখা হেতু আমি ওকে কথা বলতে শুনি নি, ওর লম্বা চুল, কুচকুচে ঘন দাড়ি, আর ওর চোখ মুখ দেখে যা বুঝলাম, লোকটি উত্তর ভারতীয়।

পরদিন সকালে মই বেয়ে টাওয়ার থেকে নেমে আমি ইন্সপেশন বাংলোর দিকে যাচ্ছিলাম। দিনের যে সময়টুকু আমি নরখাদকটার খবরের খোঁজে কাছের ও দূরে গ্রামে গ্রামে ঘুরতাম না, সে সময়টা ওই বাংলোতেই থাকতাম। যাচ্ছি, তখন দেখি পথের কাছে মস্ত পাথরের চাঁইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে সেই আলখাল্লা পরা লোকটা নদী দেখছে।

আমি কাছে আসতে ও পাথর থেকে নেমে এসে আমায় সম্ভাষণ জানাল। আমি যখন জিগ্যেস করলাম, এখানে আসার উদ্দেশ্য কি, ও বলল, যে দুষ্ট আত্মা গাড়োয়ালের মানুষদের নির্যাতন করছে, তার হাত থেকে ওদের উদ্ধার করবার জন্য বহু দূরের এক দেশ থেকে ও এসেছে।

যখন বললাম, এ কাজ কিভাবে করবে? ওর প্রস্তাবটা কি? ও বলল, ও একটা বাঘের কুশপুত্তলি তৈরি করবে। তৈরি করার পর, প্রার্থনার সহায়তায় দুষ্ট আত্মাকে তার মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলবে। তারপর কুশপুত্তলটিও গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে। নদী ওটাকে ভাসিয়ে সমুদ্রে নিয়ে যাবে। সেখান থেকে দুষ্ট আত্মাটা ফিরতে পারবে না। সমুদ্রে থেকে, মানুষের আর কোন ক্ষতিও করতে পারবে না।

লোকটা যে-কাজ সেধে ঘাড়ে নিয়েছে, ওর তা সম্পন্ন করার ক্ষমতাকে আমি যত সন্দেহই করি না কেন, ওর বিশ্বাস আর পরিশ্রম করার ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। আমি টাওয়ার থেকে নামার আগেই রোজ সকালে ও পোঁছে যেত। সন্ধ্যায় যখন ফিরে আসতাম, তখনো দেখতাম কঞ্চি, দড়ি, কাগজ, সস্তার রঙিন কাপড় দিয়ে ও ওর সেই ‘বাঘ’ বানাচ্ছে খেটেখুটে। সে ‘বাঘ’ তৈরির কাজ যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এক রাতের প্রবল বর্ষণে সব ভেঙেচুরে খুলে ফেলে দিল। এতটুকু নিরস্ত না হয়ে পরদিন সকাল থেকে গান গাইতে গাইতে মহানন্দে আবার ও কাজ শুরু করল।

অবশেষে সেই মহান দিবস হাজির হল। ওর মনের মত করে জিনিটা তৈরির কাজ শেষ হল। সে ‘বাঘ’ প্রায় ঘোড়ার মত বড়। তার সঙ্গে কোনো জ্যান্ত প্রাণীর মিল নেই।

তামাশায় যোগ দিতে মনে-প্রাণে ভালবাসে না, এমন লোক আমাদের পাহাড়ীদের মধ্যে কে আছে? লম্বা খুঁটিতে বেঁধে সেই কুশপুত্তলি যখন খাড়া উত্রাই-পথে একটা ছোট বালুচরে নামানো হল তার সঙ্গে তখন একশোর বেশি লোক। তাদের অনেকে কসর পেটাচ্ছে, লম্বা শিঙায় ফুঁ দিচ্ছে।

নদীর কিনারে এনে খুঁটি থেকে কুশপুত্তলটি ভোলা হল। মাথার টুপিতে, বুকে রূপোর ক্রুশ, হাতে ছ-ফুট ক্রুশ, সাদা আলখাল্লা-পরা লোকটি বালিতে হাঁটু গেড়ে বসল। অতি আন্তরিক প্রার্থনায় দুষ্ট আত্মাটাকে ওর তৈরি মূর্তিতে ঢোকাল। তারপর কাসরের ঢংঢং, শিঙার কানফাটানো শব্দের মধ্যে সেটিকে গঙ্গায় ভাসান দেওয়া হল। বহু মিষ্টান্ন ও ফুলের অর্ঘ্যের সঙ্গে মূর্তিটি দ্রুত সমুদ্রের পথে ভেসে চলে গেল।

পরদিন সকালে পাথরের ওপর আর চেনা চেহারাটি দেখা গেল না। যারা ভোরে নদীতে স্নান করতে যাচ্ছিল, তাদের কয়েকজনকে জিগ্যেস করলাম, আমার সেই আলখাল্লা-শোভিত বন্ধুটি কোথা থেকে এসেছিল, গেলই বা কোথায়? তারা জবাব দিল, “পুণ্যাত্মা পুরুষ কোথা থেকে এলেন, কে বলতে পারে? তিনি কোথায় গেলেন, তা জিগ্যেস করার সাহস আছে কার?

কপালে চন্দনের বিলী আঁকা এই যে লোকগুলো ওই মানুষটিকে “পুণ্যাত্মা” বলে উল্লেখ করল-মূর্তি-ভাসানের অনুষ্ঠানে যারা অংশ গ্রহণ করেছিল,এরা সবাই

ভারতে কোনো পাসপোর্ট, পরিচয়-জ্ঞাপক গোল চাকতির চল নেই। সামান্য ক’জন যারা “কালাপানি” পার হয়েছে, তারা ছাড়া অন্যদের কাছে ধর্মের স্থান অতি উচ্চে।

আমার মনে হয়, গেরুয়া আলখাল্লা পরে, অথবা ভিক্ষাপাত্র হাতে, অথবা মাথার টুপিতে ও বুকে রূপোর ক্রুশ লাগিয়ে, এখানে যে-কোনো লোক খাইবার পাস থেকে কুমারিকা অন্তরীপ অবধি হেঁটে চলে যেতে পারে। কেউ তাকে একবারও তার গন্তব্য কোথায়, তা জিগ্যেস করবে না, জানতে চাইবে না তার যাত্রার উদ্দেশ্য কি।

.

১১. অল্পের জন্য রেহাই

তখনও পুলটা পাহারা দিচ্ছি, এর মধ্যে পাউরি থেকে ইবটসন আর তার স্ত্রী জীন এসে হাজির। ইন্সপেকশসন বাংলোয় জায়গার খুবই অভাব, সুতরাং তাদের জন্যে ঘরটা ছেড়ে দিয়ে তীর্থপথের অনেক দূরের পাহাড়টায় গিয়ে আমার চল্লিশ-পাউণ্ড ওজনের তাবু গাড়লাম।

বহু মাইল জুড়ে প্রত্যেকটি বাড়ির দরজায় আর জানলায় যে প্রাণীটা নখের আঁচড় রেখে গিয়েছে তার হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্যে তাঁবু মোটেই যথেষ্ট নয় বলে তামি ও আমার লোকজন মিলে তাবুর জায়গাটার চারদিকে একটা কাঁটাঝোপের বেড়া তৈরি করলাম। এই জায়গাটার উপর এসে ঝুঁকে পড়েছে একটা বড় ময়না গাছ। সেটার ডালপালার জন্যে আমার তাবু খাটাতে অসুবিধে হচ্ছে দেখে গাছটা কেটে ফেলতে বললাম। খানিকটা কাটা হয়ে যাওয়ার পর আমি মত বদলালাম, কারণ তাহলে দিনের বেলা রোদের তাত আটকানোর জন্যে ছায়া পাব না। কাজেই গাছটা সম্পূর্ণ কেটে না ফেলে শুধু ডালগুলো ছেটে দিতে বললাম। তাঁবুর উপর গাছটা প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ করে হেলে ছিল।

আমরা ছিলাম আটজন। রাতের খাওয়ার পর আমি বেড়ার প্রবেশপথটা একটা কাঁটাঝোপ দিয়ে বন্ধ করে দিলাম, এবং সেই সময় আমার খেয়াল হল যে নরখাদকটার পক্ষে গাছটায় উঠে বেড়ার ভিতর লাফিয়ে পড়া খুবই সহজ হবে। যা হক, বেজায় দেরি হয়ে গেছে, তখন আর কিছু করার ছিল না। চিতাটা যদি সে-রাতের মত আমাদের রেহাই দেয় তবে পরদিন সকালেই গাছটা কেটে সরিয়ে ফেলা যাবে।

আমার লোকদের জন্যে কোনো তাঁবু ছিল না; ভেবেছিলাম তারা ইন্সপেকশন বাংলোর সংলগ্ন কুঠরিতে ইবটসনের লোকজনদের সঙ্গেই শোবে। কিন্তু তারা তাতে রাজী হল না, বলল খোলা তাঁবুতে তাদের বিপদ আমার চেয়ে বেশি হবে না। আমার রাঁধুনি প্রচণ্ড নাক ডাকায়, আমার পাশেই গজখানেক দূরে সে শুয়ে ছিল, এবং তার ওপাশে ছোট জায়গাটার মধ্যে সার্ডিন মাছের মত গাদাগাদি হয়ে শুয়ে ছিল নৈনিতাল থেকে আনা ছ-জন গাড়োয়ালী।

আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দূর্বল জায়গা হচ্ছে গাছটা, সেটার কথাই ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।..

খুব উজ্জ্বল চাঁদনি রাত সেটা। মাঝরাত্রি নাগাদ হঠাৎ চিতাটার গাছে চড়ার শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। চার পাশে বিছানো কাঁটা থেকে পা বাঁচাবার জন্যে বিছানা থেকে রাইফেলটা তুলে নিয়ে পা দুটো নামিয়ে সরে চপ্পলের মধ্যে ভরেছি এমন সময় গাছটা থেকে একটা কটাৎ শব্দ আর সঙ্গে সঙ্গে রাঁধুনির চিৎকার : “সাহেব, বাঘ, বাঘ!”

এক লাফে তাঁবুর বাইরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে রাইফেল তাক করার আগেই চিতাটা ওধারের বাঁধ থেকে লাফিয়ে একটা ধাপ-জমির ওপর লাফিয়ে পড়ল। প্রবেশপথের কাঁটাঝোপটা টেনে সরিয়ে ছুটলাম জমিটার দিকে। শস্যশূন্য চল্লিশ গজ চওড়া জমিটার উপর দাঁড়িয়ে কাঁটাঝোপের আর বড়-বড় কয়েকটা পাথর-ছড়ানো পাহাড়ের গা-টা ভাল করে নজর করে দেখছি, এমন সময় পাহাড়টার উপর থেকে একটা শেয়ালের ডাক জানিয়ে দিল যে চিতাটা আমার নাগালের বাইরে চলে গেছে।

পরে রাঁধুনি জানিয়েছিল যে সে চিত হয়ে ছিল। আমি তা অনেক আগেই বুঝেছিলাম। গাছে চিড় খাবার শব্দ শুনে চোখ খুলতেই সোজা:তার নজর গিয়ে পড়ে চিতাটার উপর–ঠিক যে সময় জন্তুটা লাফিয়ে পড়তে যাচ্ছিল।

পরদিন গাছটা কেটে ফেলা হল, বেড়াটা শক্ত করা হল এবং যদিও ওই তাবুতে আমরা কয়েক সপ্তাহ ছিলাম, আমাদের ঘুমের আর কোনো ব্যাঘাত হয় নি।

.

১২. জাঁতি-কল

কাছাকাছি গ্রামগুলো থেকে খবর পেয়েছি নরখাদকটা ঘরে ঢোকার চেষ্টা করেছে, ব্যর্থ হয়েছে। রাস্তায় তার থাবার ছাপও দেখেছি। এসব থেকে জানতে পেরেছি সেটা তখনও এ অঞ্চলেই আছে। ইবটসনরা আসার কয়েকদিন পরেই খবর এল, এক গ্রামে গরু মারা পড়েছে। গ্রামটা রুদ্রপ্রয়াগ থেকে দু-মাইল এবং যে গ্রামে আখরোট গাছের উপর খড়ের মাচার উপর বসেছিলাম সেখানে থেকে আধ মাইল দূরে।

গ্রামটায় গিয়ে দেখলাম, একটা এক-কামরা বাড়ির দরজা ভেঙে চিতাটা ঘরের বহু গরুর মধ্যে একটা গরু মেরে সেটাকে দরজা পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছে; তারপর আর দরজার বাইরে বের করতে না পারায় বেশ খানিকটা খাওয়ার পর সেটাকে দোরগোড়ায় ফেলে রেখে গেছে।

ঘরটা গ্রামের একেবারে মাঝখানে। ঘুরে-ফিরে দেখা গেল যে কয়েক গজ দূরের একটা বাড়ির দেওয়ালে গর্ত করলে মড়িটার উপর বেশ নজর রাখা যায়।

মৃত গরুটার মালিকই ওই বাড়ির মালিক। সে আমাদের পরিকল্পনায় সানন্দে সম্মত হল। সন্ধ্যা হলে ঘরটা ভাল করে আটকে, সঙ্গে আনা স্যাণ্ডউইচ আর চা খেয়ে আমরা পালা করে দেওয়ালের গর্ত দিয়ে তাকিয়ে দীর্ঘ রাত জেগে পাহারা দিলাম, কিন্তু চিতাটার কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না।

সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার পর গ্রামবাসীরা গ্রামটা ঘুরিয়ে নিয়ে দেখাল। বেশ বড় গ্রাম। মানুষ ধরার জন্যে বাড়িগুলোর দরজা জানলায় নরখাদকটা বহু বছর ধরে যেসব নখের দাগ রেখে গেছে সেগুলো দেখলাম। বিশেষ করে একটা দরজায় নখের দাগ অন্যান্যগুলোর চেয়ে গভীর। এই দরজা ঠেলেই ঢুকেছিল চিতাটা। এই ঘরের মধ্যেই চল্লিশটা ছাগল ও রাখাল ছেলেটা বন্ধ ছিল।

একদিন কি দু-দিন পরে আরেকটা গরু মারা পড়ার খবর পাওয়া গেল, এই বাংলো থেকে কয়েকশো গজ দূরে পাহাড়ের উপর একটা ছোট গ্রামে। এখানেও দেখলাম গরুটা মারা পড়েছে ঘরের ভিতর। তাকে দরজা পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছে ও তার কিছুটা অংশ খেয়ে ফেলেছে। দরজাটার মুখোমুখি দশ গজ দূরে একটা নতুন খড়ের গাদা বানানো হয়েছিল, গাদাটা ষোল ফুট উঁচুতে, একটা দু-ফুট উঁচু কাঠের মাচার উপর।

খবরটা এসেছিল খুব সকালে, সুতরাং সারাটা দিন সময় পেলাম এবং বিকেল নাগাদ যে মাচানটা আমরা তৈরি করলাম, নিশ্চিত বলতে পারি, সেটা যে শুধু অত্যন্ত কার্যকরী হল তাই নয়, উপরন্তু এই ধরনের কাজের জন্যে এ পর্যন্ত যত মাচান বানানো হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে শিল্পসুন্দর।

প্রথমে খড়ের গাদা ভেঙে ফেলা হয়, তারপর কাঠের মাচানটার চারদিকে খুঁটি লাগিয়ে ওটার চার ফুট উপরে একটু ছোট করে দ্বিতীয় একটা মাচান তৈরি করা হল। গোটা জিনিসটাকে ঘেরা হল দু-ইঞ্চি ফাঁক তারের জাল দিয়ে। প্রথম মাচান ও মাটির মধ্যে ফাঁক থাকল। জালের ফাঁকে ঠুসে দেওয়া হল খড়ের আঁটি। আগের মত কিছু নিচে, চারদিকে ছড়িয়েও দেওয়া হল। খড়ের গাদাটা এজমালি। তার এক অংশীদার দু-একদিন আগে থেকে গ্রামে ছিল না। আমাদের কাজ শেষ হওয়ার পরই সে এসে পৌঁছয়। প্রথমটা সে বিশ্বাস করে নি যে কিছু নাড়াচাড়া করা হয়েছে, হাত দিয়ে চারদিকে দেখে, সংলগ্ন এক খেতে বাড়তি খড় দিয়ে আমরা যে দ্বিতীয় মাচানটা বানাই, সেটা দেখে তবে সে বিশ্বাস করে।

সূর্য অস্ত যাওয়ার সময়ে জালের গর্তের ভিতর দিয়ে গুঁড়ি মেরে আমরা মাচানটার মধ্যে ঢুকলাম ও ঢোকার জায়গাটা ভাল করে আটকে দিলাম। ইবটসন আমার চেয়ে মাথায় খানিকটা খাটো, কাজেই সে বসল উপরের মাচানটায়। আরাম করে বসে আমরা দুজনেই খড় সরিয়ে গুলি করার মত দুটো ছোট ফুটো তৈরি করলাম। যেহেতু চিতাটা আসার পর আর আমাদের মধ্যে কথা বলা চলবে না সেহেতু ঠিক হল, প্রথমে যার চোখে পড়বে সে-ই গুলি করবে। উজ্জ্বল জ্যোৎস্না রাত ছিল, কাজেই আমাদের টর্চলাইট ব্যবহারের প্রয়োজনও রইল না।

রাতের খাওয়ার পর সারা গ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে গেল। প্রায় দশটার সময় শুনতে পেলাম চিতাটা আমাদের পিছনের পাহাড় দিয়ে নেমে আসছে। গাদাটার কাছে এসে সে কয়েক মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর গুঁড়ি মেরে ঢুকতে লাগল আমার মাচানটার নিচে। সে যখন ঠিক আমার নিচে এবং তার মাথা ও আমার মধ্যে মাত্র একটা তক্তার ব্যবধান, দীর্ঘ এক মিনিট কাল সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আবার গুঁড়ি মেরে এগোতে লাগল।

যে-মুহূর্তে আশা করছি যে চিতাটা মাচানের তলা থেকে বেরিয়ে মাত্র তিনচার ফুটের ব্যবধানে আমাকে গুলি করার খুব সহজ একটা সুযোগ দেবে, ঠিক সেই সময় কাঁচ করে একটা বিরাট শব্দ হল উপরের মাচানটায়। চিতাটা ছুটে ডানদিকে বেরিয়ে গেল, সেদিকটা আমি আর দেখতে পেলাম না। চরম মুহূর্তে তার আওয়াজটা হওয়ার কারণ–দু-পায়ে যন্ত্রণাদায়ক খিল ধরায় একটু আরাম পাওয়ার জন্য ইবটসন সরে বসেছিল একটু। এইরকম চমক খাওয়ার পর চিতাটা আর পরের দিন বা তারও পরের দিন মড়ির কাছে ফিরে এল না।

দুরাত্রি পরে আবার একটা গরু মারা পড়ল রুদ্রপ্রয়াগ বাজারের কয়েকশো গজ উপরে।

গরুর মালিক একটা একটেরে বাড়িতে একাই থাকত। একটাই ঘর, মাঝখানে নানারকম তক্তার টুকরো বেঁধে একটা দেওয়াল করে একদিকে থাকার ও একদিকে রান্নার ব্যবস্থা। রাতে একসময় রান্নাঘরে শব্দ শুনে লোটা জেগে ওঠে। সে ঘরের দরজা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল। একটু পরে, খোলা দরজার ভিতর দিয়ে যেটুকু চাঁদের আলো আসছিল তাতে তক্তার ফাঁক দিয়ে লোকটা দেখে যে চিতাটা একটা তক্তা টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করছে।

দীর্ঘ সময় লোকটা শুয়ে-শুয়ে ঘামতে লাগল, আর চিতাটাও একটার পর একটা তক্তার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগল। অবশেষে একটাও আলগা তক্তা না-পেয়ে ব্যর্থ হয়ে চিতাটা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ঘরের সংলগ্ন ঘাসের চালার নিচে বাঁধা গরুটাকে মারল। মারার পর দড়ি ছিঁড়ে সেটাকে চালা থেকে সামান্য দুরে টেনে নিয়ে গিয়ে বেশ ভাল-মত একটা ভোজ সেরে বাকিটা সেখানেই ফেলে রেখে গেল।

যেখানে মরা গরুটা পড়েছিল, সেখান থেকে কুড়ি গজ দূরে পাহাড়ের একেবারে কিনারায় ছিল একটা মাঝারি সাইজের গাছ। তার উপর দিকের ডালের উপর একটা খড়ের গাদা! এই স্বাভাবিক মাচানটার উপর থেকে পড়লে পড়ব একেবারে কয়েকশো ফুট নিচের উপত্যকায়, তবুও আমি আর ইবটসন সেখানেই বসব ঠিক করলাম।

নরখাদকটাকে মারার সহায়তা করতে গভর্নমেন্ট কয়েকদিন আগে একটা জাতিকলের কাঁদ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পাঁচ ফুট লম্বা আর আশি পাউণ্ড ওজনের সেই জাঁতিকলটার মত একটা ভয়াবহ বস্তু আমি আরেকটি দেখিনি। তার তিন ইঞ্চি লম্বা ধারালো দাঁত-লাগানো জাঁতিদুটো চব্বিশ ইঞ্চি করে চওড়া এবং দুটো শক্তিশালী ম্প্রিঙের সহায়তায় ওটা কাজ করে। স্প্রিং চেপে ধরতে দু-জন লোক দরকার।

মড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময়ে, প্রায় চল্লিশফুট চওড়া একটা খেতের বুক-চেরা পায়ে চলা পথ ধরে গিয়ে চিতাটা একটা তিন ফুট উঁচু আল পেরিয়ে আরেকটা খেতের উপর দিয়ে গেছে। এই খেতটার চারদিকে ঘনঝোপে ঢাকা পাহাড়। উপরের ও নিচের খেতের মাঝামাঝি আমরা জাঁতিকলটা পাতলাম।

চিতাটা যাতে অবশ্যই জাঁতিকলে পা দেয়, সেজন্যে পথের দু-পাশে কয়েকটা কাটাডাল পুঁতলাম। জাতিলের একদিকে আধ ইঞ্চি মোটা ছোট শেকল আঁটা। সে-শেকলের মুখে তিন ইঞ্চি ব্যাসের একটা কড়া। এই কড়ার ভিতর দিয়ে একটা মোটা গোঁজ ঢুকিয়ে মাটিতে শক্ত করে পুঁতে জাঁতিকলটাকে মাটির উপর বসালাম।

এসব ব্যবস্থা শেষ হলে পর জীন ইবটসন লোজনদের নিয়ে বাংলোয় ফিরে গেল এবং আমি ও ইবটসন গাদাটার উপর গিয়ে উঠলাম। আমাদের সামনে একটা লাঠি বেঁধে তার উপর দিয়ে কিছু খড় ঝুলিয়ে দিয়ে আড়াল তৈরি করা হল। তারপর আমরা আরাম করে বসে চিতাটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমরা নিশ্চিত হয়েছিলাম যে এবার চিটা আমাদের হাত থেকে পালাতে পারবে না।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আকাশ ঘন মেঘে ছেয়ে এল। রাত্রি ন-টার আগে যেহেতু চাঁদ উঠবে না সেহেতু নির্ভুলভাবে গুলি করার জন্যে আমাদের বাধ্য হয়েই টর্চলাইটের উপর নির্ভর করতে হবে। এই লাইটটা বেশ ভারি ও ঝামেলার ব্যাপার। ইবটসন আমাকেই গুলি করার জন্য পীড়াপীড়ি করায় আমি খানিকটা চেষ্টার পর সেটা আমার রাইফেলে আটকে নিলাম।

অন্ধকার ঘনাবার এক ঘণ্টা বাদে উপর্যপরি ক্রুব্ধ গর্জনে বোঝা গেল চিতাটা জাঁতিকলে পড়েছে। সুইচ টিপে টর্চ জ্বেলে দেখি, চিতাটা পেছন ফিরছে। সামনের দু-পা থেকে জাঁতিকলটা ঝুলছে। দুম করে গুলি করলাম। আমার .৪৫০ বুলেট লাগল শেকলের একটা জোড়-আংটায়, শেকল ছিঁড়ে গেল।

গোঁজ থেকে ছাড়া পেতেই লম্বা-লম্বা লাফ মেরে চিতাটা খেত পেরিয়ে ছুটল। জাঁতিকলটা ওর সামনের দিকে। আমার বন্দুকের বাঁ-নলের গুলি, ইবটসনের শটগানের দুটো মরণাস্তিক গুলি ওর দিকে ছুটে গেল। প্রত্যেকটি গুলিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। রাইফেলে আবার গুলি ভরার চেষ্টা করতে গিয়ে আমি টর্চটার কোথাও গড়বড় করে ফেলি। তারপর টর্চটা আর জ্বললই না।

 চিতাটার গর্জন আর আমাদের চারটে গুলির আওয়াজ শুনে–রুদ্রপ্রয়াগ বাজার থেকে, কাছাকাছি গ্রাম থেকে লণ্ঠন ও পাইন কাঠের মশাল নিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পিল-পিল করে লোক বেরিয়ে এল। সবাই এসে জুটল একটেরে বাড়িটার চারদিকে।

চেঁচিয়ে ওদের দুরে সরে থাকতে বলে কোনো লাভ হল না। কেননা ওরা নিজেরা এত হল্লা করছিল যে আমাদের গলা শুনতে পাচ্ছিল না। আমি রাইফেল নিয়ে গাছ থেকে নামলাম। অন্ধকারে সে এক বেপরোয়া ঝুঁকি নেওয়া হল মাচানে যে পেট্রোম্যাক্স নিয়ে উঠেছিলাম, আমি নামতে-নামতে ইবটসন সেটা জ্বালল, পাম্প দিল।

দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে পেট্রোম্যাক্সটা আমার হাতে দিয়ে ইবটসন মাটিতে নেমে এল। যে-দিকে চিতাটা গেছে, দুজনেই চললাম সেদিকে। খেতের মাঝামাঝি জায়গায় নিচের পাহাড় মাটি খুঁড়ে বেরুবার ফলে একটা টিপি-পাহাড়। ভারি বাতিটা উঁচু করে ধরেছে ইবটসন, আমার কাঁধে রাইফেল। আমরা পাশাপাশি ওদিকে এগোচ্ছি। ঢিবি- পাহাড়টার পরেই মাটিতে গর্ত মত। সেখানে বসে আমাদের দিকে চেয়ে গর্জাচ্ছে চিতাটা। ওর মাথায় আমার গুলিটা ঢোকবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই এক উত্তেজিত জনতা আমাদের ঘিরে ফেলল। এতকালের ভয়ংকর শত্রুকে ঘিরে ওরা সত্যিই নাচতে শুরু করে দিল।

আমার সামনে যে জন্তুটা পড়ে আছে, এটা একটা অতিকায় মদ্দা চিতা। আগের রাতে এ কাঠের তক্তার পার্টিশন ভেঙে একটা মানুষকে ধরার চেষ্টা করেছে। যে-অঞ্চলে ডজন-ডজন মানুষ নিহত হয়েছে, সেখানেই ও গুলি খেয়ে মরল। এই যে সেই নরখাদক, তা ধরে নেবার পক্ষে এ যুক্তিগুলো ভাল, পর্যাপ্তও বটে। তবু আমি নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছি না, মেয়েটির মড়ি রেখে যখন বসেছিলাম, সে-রাতে যে জানোয়ারটাকে দেখি, এই সে। হ্যাঁ, সেও ছিল অন্ধকার রাত। হ্যাঁ, আমি চিতাটার শরীরের একটা আবছা ঝলক মাত্র দেখি। তবু, সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে যে জানোয়ারটাকে বাঁশে বাঁধা হচ্ছে, সেটা যে নরখাদক নয়, এ আমার দৃঢ়বিশ্বাস হল।

সামনে ইবটসনরা, তারপর চিতাটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ক-জন, তারপর বহু শত লোকের এক জনতা চলেছে। আমরা বাজারের পথে বাংলোর দিকে চললাম।

মিছিলের পছনে পাহাড় থেকে হোঁচট খেতে-খেতে নামছি। এই জমায়েতের মধ্যে আমিই একমাত্র বিশ্বাস করতে পারছি না রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক চিতা মরেছে। আমার চিন্তা-ভাবনা সহসা ফিরে গেল অতীতে। তখন আমি ছোট ছেলে। ঘটনাটা শীতকালীন আবাসের কাছাকাছি ঘটে। অনেক বছর বাদে, “ব্রেভ ডীডস”, কিংবা হয়তো “ব্রেভেস্ট ভীড়স” নামে একটা বইয়ে ঘটনাটার কথা দেখেছিলাম।

বন-বিভাগের ব্রেডইউড, এবং ভারতীয় সিভিল-সার্ভিসের স্মীটন, এই দুজন সে-ঘটনায় ছিল। সে রেলগাড়ির আগেকার যুগের কথা। এক অন্ধকার ঝড়ের রাতে এরা দু-জন “ডাকগাড়ি চেপে মোরাদাবাদ কালাধুংগি যাচ্ছিল। একটা পথে মোড় ঘুরতে ওরা একটা খ্যাপা হাতির সামনে পড়ে। কোচোয়ান আর ঘোড়া দুটোকে মেরে ফেলে হতিটা, গাড়িটা উলটে দেয়।

ব্রেইডউডের কাছে একটা রাইফেল ছিল। রাইফেলটা কেস থেকে বের করে জোড়া লাগিয়ে ও যখন গুলি ভরছে; স্মীটন গাড়িতে বসে একমাত্র আভাঙা বাতিটি বাতিদান থেকে খুলে নেয়। মাথার উপর উঁচু করে ধরে। সে বাতিতে সামান্য আলোর আভা ছড়াচ্ছিল মাত্র। সেই ভাবেই সেটাকে ধরে স্মীটন হাতিটার কাছে এগিয়ে হাতির কপালের উপর আলো ফেলে, যাতে ব্রেইডউড হাতিটাকে ঠিক জায়গায় গুলি মেরে মেরে-ফেলতে পারে।

চিতা আর খ্যাপা হাতিতে অবশ্যই প্রচুর পার্থক্য আছে। তবু, সঙ্গীর বুলেট তাকে বাঁচাবে মাত্র এই ভরসায়, মাথার উপর বাতি ধরে। যন্ত্রণায় উন্মত্ত একা চিতার কাছে এগোতে ভরসা পাবে, এমন লোকও কমই আছে। পরে দেখেছিলাম, চিতাটা ওর থাবাটা ছিঁড়ে, প্রায় খুলে ফেলেছিল জাঁতিকল থেকে, চামড়ার একটা পাতলা টুকরোয় বেঁধে আটকেছিল মাত্র।

বহু বছরের মধ্যে এই প্রথম, রাতে বাজারের সব বাড়ির দরজা খুলে গেল। দোরগোড়ায় মেয়েরা, ছেলেপিলেরা দাঁড়িয়ে। খুব ধীরে এগোনো যাচ্ছিল। কেননা কয়েক গজ বাদে-বাদেই, ছেলেপিলেরা চারপাশে ভিড় করে ভাল করে দেখবে বলে চিতাকে নামাতে হচ্ছিল। লম্বা পথটার অনেক দূর গিয়ে দলটা আমাদের ছেড়ে চলে গেল। বিজয়গর্বে চিতাটাকে বাংলোয় নিয়ে এল আমাদের লোকজন।

তাবুতে গিয়ে স্নান সেরে বাংলোয় ফিরে এলাম। ডিনার খেতে খেতে, তার অনেক বাদেও, ইবটসনরা এবং আমি, মৃত চিতাটাই যে নরখাদক, তার সপক্ষে ও বিপক্ষে স্ব-স্ব যুক্তি পেশ করলাম। এ-পক্ষ ও-পক্ষকে বোঝাতে, বিশ্বাস করাতে সক্ষম হল না। অবশেষে আমরা ঠিক করলাম, ইবটসনকে নিজের কাজে পাউরি ফিরতে হবে। রুদ্রপ্রয়াগে এতদিন থাকার ফলে আমিও ক্লান্ত-শ্রান্ত। তাই পরের দিনটা আমরা চিতাটার ছাল ছাড়িয়ে শুকোব। তার পর দিন, তবু উঠিয়ে পাউরি রওনা দেব।

ভোর থেকে শুরু করে, সন্ধে গড়িয়ে যাওয়া অবধি, কাছে ও দুরের গ্রাম থেকে দলের পর দল নোক আসতেই থাকল চিতাটাকে দেখতে। যেহেতু এদের মধ্যে অধিকাংশ জনই বলতে থাকল, এই জানোয়ারটাই যে নরখাদক, তা ওরা দেখেই চিনেছে–ইবটসনের বিশ্বাস বদ্ধমূল হতেই থাকল, যে ওদের ধারণা ঠিক, আর আমার বিশ্বাস বদ্ধমূল হতেই থাকল ওরা ভুল করছে। আমার অনুরোধে ইবটসন দুটো কাজ করল। ও, জনসাধারণকে হুশিয়ারী জানাল, নরখাদকটির বিষয়ে সাবধান ও সতর্ক থাকার কথা যেন মনে রাখে সবাই, সে-ব্যবস্থায় গা-ঢিলা না দেয়। আর, আমরা নরখাদকটিকেই মেরেছি সরকারকে টেলিগ্রাম করে সে-খবর জানানো থেকে বিরত হল।

সে-রাতে আমরা তাড়াতাড়ি ঘুমোত গেলাম। পরদিন ভোর না হতেই রওনা হতে হবে। আমি যখন উঠেছি, তখনো অন্ধকার। ছোটো হাজরি’ (প্রাতরাশ) খাচ্ছি। পথে কথাবার্তার আওয়াজ পেলাম। যেহেতু এটা অত্যন্ত আশ্চর্য, আমি হেঁকে জিগ্যেস করলাম, এমন সময়ে ওরা করছেটা কি?

আমাকে দেখে চারটি মানুষ চড়াই-পথ বেয়ে আমার বুতে উঠে এল। খবর দিল, চাতোয়াপিপল ঝোলা-পুল থেকে মাইল খানেক দূরে, নদীর তীরে, বেশ দূরে নরখাদকটি একটি মেয়েকে মেরেছে। আমাকে এই খবরটা দিতে পাটোয়ারী ওদের পাঠিয়েছে।

.

১৩. শিকারীরাই যখন শিকার

ভোরের চা নিয়ে ঢুকরে বলে ইবটসন সবে তার লোককে দরজা খুলে দিচ্ছে, এই সময় আমি গিয়ে উপস্থিত হলাম। পাউরি যাত্রা বাতিল করে দিয়ে জীনের বিছানার উপর বসে একটা বড় মাপ বিছিয়ে ম খেতে খেতে আমরা পরিকল্পনা আঁটতে লাগলাম।

ইবটসনের হেডকোয়ার্টার পাউরিতে তার জরুরী কাজ রয়েছে। বড়জোড় আর দুটো দিন ও দুটো রাত সে অপেক্ষা করতে পারে। আগের দিন নৈনিতালে তার করে দিয়েছিলাম যে পাউরি ও কোটদোয়ারা হয়ে ফিরছি। ওই তার বাতিল করে দেব, এবং রেলপথে না গিয়ে যে-পথ দিয়ে এসেছিলাম সেই হাঁটা-পথেই ফিরে যাব।

এই ব্যবস্থা পাকা করে, আর যে গ্রামে মেয়েটি মারা পড়েছে ম্যাপে সেটা দেখে নিয়ে আমি আমার তাবুতে ফিরে গিয়ে পরিকল্পনা বদলের কথা আমার লোকদের জানালাম, ও জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে যে চারজন লোক খবর এনেছে তাদের সঙ্গে আসতে বললাম।

জীন রুদ্রপ্রয়াগেই থাকবে। প্রাতরাশের পর ইবটসনের ঘোড়াদুটোয় চেপে আমি আর ইবটসন রওনা হয়ে পড়লাম। একটা গালফ অ্যারব, অন্যটি বিলিতী ঘোড়া। আমার যত ঘোড়ার চাপার সৌভাগ্য হয়েছে, তার মধ্যে সব চেয়ে স্থির-কদম দুটি ঘোড়।

আমরা সঙ্গে নিয়েছিলাম আমাদের রাইফেল, একটা স্টোভ, একটা পেট্রোম্যাক্স বাতি এবং কিছু খাবার-দাবার। একটা ধার-করা ঘোড়ার উপর ঘোড়াগুলোর খাবার চাপিয়ে নিয়ে সঙ্গে আসছিল ইবটসনের সহিস।

চাতোয়াপিপল পুলের কাছে গিয়ে ঘোড়া দুটো ছেড়ে দিলাম। চিতাটাকে গুলি করার রাতে পুলটা বন্ধ করা হয় নি। ফলে নরখাদকটা নদী পার হয়ে গিয়ে প্রথম গ্রামটাতেই একটা শিকার পেয়েছে।

একজন পথপ্রদর্শক পুলের উপর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। সে আমাদের নিয়ে একটি অত্যন্ত খাড়াই শৈলশিরা বেয়ে উঠে, ঘাসে-ঢাকা এক পাহাড়ের ঢাল ধরে নামল উত্রাই-পথে। ঘন জঙ্গলে ঢাকা এক গভীর খাদে। খাদ দিয়ে একটি ছোট নদী বয়ে যাচ্ছে। সেখানে পাটোয়ারী, আর জনা বিশেক লোক মড়িটা পাহাড়া দিচ্ছে।

অতি স্বাস্থ্যবতী, ফর্সা একটি মেয়ের মড়ি। বয়স প্রায় আঠার-কুড়ি হবে। উপুড় হয়ে দু-পাশে হাত দুটো ছড়িয়ে মেয়েটি পড়েছিল। শরীর থেকে সুতোটি অবধি খুলে ফেলা হয়েছে। পায়ের তলা থেকে ঘাড় অবধি চেটে সাফ করে ফেলেছে চিতাটা। ঘাড়ে বড়-বৃড় চারটে দাঁতের দাগ। শরীরের ওপর ও নিচ থেকে যথাক্রমে কয়েক পাউণ্ড করে মাংস খেয়ে ফেলা হয়েছে।

পাহাড়ের চড়াই ভাঙার সময়ে আমরা ঢোল পেটাবার শব্দ পাচ্ছিলাম। মড়িটা পাহারা দিচ্ছিল যারা, তারাই ওগুলো বাজাচ্ছিল। তখন বেলা প্রায় দুটো। ধারে কাছেও চিতাটা থাকবার কোনো সম্ভাবনা নেই। পাটোয়ারী আর পথপ্রদর্শককে সঙ্গে নিয়ে আমরা চড়াই-পথে গ্রামে গেলাম একটু চায়ের যোগাড়ে।

চা খেয়ে, যে-বাড়িতে মেয়েটিকে মারা হয়েছে, সে-বাড়িটা একবার দেখে নিতে গেলাম। পাথরে তৈরি এক-কামরা বাড়ি। ছ থেকে ন বিঘা খাঁজকাটা খেতের ঠিক মধ্যিখানে। বাড়িতে থাকত মেয়েটি, ওর স্বামী, আর ওদের ছ-মাসের একটি বাচ্চা।

দুর্ঘটনার দুদিন আগে স্বামীটি এক জমির মামলায় সাক্ষ্য দিতে পাউরি চলে যায় এবং বাড়ির তত্ত্বাবধানে রেখে যায় তার বাবাকে। মারা যাবার রাতে মেয়েটি ও তার শশুর রাতের খাওয়া শেষ করে। শুতে যাওয়ার আগে মেয়েটি শিশুটিকে দুধ খাইয়ে তাঁকে শশুরের কোলে দিয়ে দরজা খুলে সিঁড়ির ধারে গিয়ে বসে আগেই বলেছি আমাদের পাহাড়ী মানুষদের বাড়িতে শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই।

মায়ের কোল থেকে ঠাকুর্দার কোলে গিয়ে শিশুটা কাঁদতে শুরু করে, সুতরাং বাইরে কোনো শব্দ হলে অ শোনার সম্ভাবনা কম, এবং আমি নিশ্চিত, যে কোনো শব্দ হয় নি। রাতটা ছিল অন্ধকার। নোকটা কয়েক মিনিট অপেক্ষার পর মেয়েটিকে ডাক দিল, উত্তর না পেয়ে আবার ডাকল এবং এরপর উঠে গিয়ে তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে খিল এঁটে দিল।

সেদিন সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি হয়েছিল, কাজেই পুরো ঘটনাটা কি ঘটে, তা মনে-মনে সাজিয়ে বুঝে নেওয়া সহজ হল। বৃষ্টি থামার কিছু পরে চিতাটা গ্রামের দিক থেকে এসে দরজাটার বাঁয়ে ত্রিশ গজ দূরে জমির মধ্যে একটা পাথরের আড়ালে গুঁড়ি মেরে বসে ছিল।

এখানে চিতাটা কিছুক্ষণ যাবৎ শুয়ে ছিল–বোধহয় লোকটিকে আর মেয়েটিকে কথাবার্তা বলতে শুনেছিল। দরজা খুলে মেয়েটি দরজার ডানদিকে ফিরে এবং অংশত চিতাটার দিকে পিছন ফিরে বসে। পাথরটা ঘুরে ঘরের কোণ পর্যন্ত কুড়ি গজ জমি চিতাটা গুঁড়ি মেরে চলে আসে, এবং ঘরের দেয়াল ঘেঁষে এসে পিছন থেকে মেয়েটিকে ধরে পাথরটা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়।

মেয়েটি মারা যাবার পর, অথবা সম্ভবত যখন ওর শ্বশুর উদ্বেগে ডাকাডাকি করে, তখন চিতাটা অকে মুখে করে উঁচু করে তুলে নেয়, যার জন্যে চষা নরম জমিটার ওপর মেয়েটির হাতের বা পায়ের কোনো দাগ পড়ে নি। ওই অবস্থায় তাকে বয়ে নিয়ে একটা জমির পর তিন ফুট উঁচু আল পার হয়ে আরেকটা জমির শেষে গিয়ে পৌঁছয়। এই জমিটার শেষে খাড়া বার ফুট নিচে একটা পায়ে-চলা পথে প্রায় ১৫০ পাউণ্ড ওজনের মেয়েটিকে মুখে করে চিতাটা এখানে লাফ দিয়ে নামে। এই থেকে তার শক্তির কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যাবে যে, যখন সে পায়ে-চলা পথটার উপর লাফিয়ে নামে, তখনও মেয়েটির শরীরের কোনো অংশই মাটিতে লাগে নি।

পথটা পার হয়ে সে পাহাড় বেয়ে সোজা নিচে আধ মাইলখানেক নেমে যায়। জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলে এখানেই মেয়েটির কিছু অংশ খাওয়ার পর তাকে একটা ঘন লতার ছাউনি দেওয়া গাছের ছায়াতে, একটুকরো পান্না-সবুজ ঘাসে-ঢাকা জমির ওপর রেখে যায়।

বিকাল চারটে নাগাদ মড়ির ওপর বসার জন্যে আমরা নেমে গেলাম, সঙ্গে নিয়ে গেলাম পেট্রোম্যাক্স বাতিটা আর-রাতে শিকারের জন্যে টর্চলাইট।

এটা ধরে নেওয়া যুক্তিযুক্ত যে মেয়েটিকে খোঁজার সময় ও পরে পাহারা দেওয়ার সময় গ্রামবাসীরা যে হৈচৈ করেছিল চিতাটা তা শুনতে পেয়েছে এবং সে যদি মড়ির কাছে ফিরে আসে তবে অতি সন্তর্পণে আসবে। সুতরাং আমরা ঠিক করলাম মড়ির কাছাকাছি বসব না, তাই ষাট গজ দূরে পাহাড়ের গায়ে একটা গাছ বেছে নিলাম। গাছটি ওই ঘাসী-জমির মুখোমুখি।

এই বেঁটে ওক গাছটা পাহাড় থেকে বেরিয়েছে প্রায় এক সমকোণ রচনা করে। পেট্রোম্যাক্সটা খোঁদলে লুকিয়ে রেখে পাইন পাতা চাপা দেওয়া হল। দুটো ডালের মাঝখানে বসল ইবটসন। সেখান থেকে মড়িটা স্পষ্ট দেখা যায়। আর আমি বসলাম গাছের গুঁড়িতে তার দিকে পিছন ফিরে ও পাহাড়ের দিকে মুখ করে। ইবটসন গুলি করবে, আমি আমাদের নিরাপত্তার দিকে নজর রাখব।

সম্ভবত ব্যাটারি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ফলেই টর্চলাইটটা কাজ করছিল না, অতএব পরিকল্পনা ছিল যে, যতক্ষণ ইবটসন গুলি করার মত দেখতে পাবে ততক্ষণই আমরা বসে থাকব, তারপর পেট্রোম্যাক্সটা জ্বালিয়ে গ্রামে ফিরে যাব,–সেখানে রুদ্রপ্রয়াগ থেকে আমাদের লোকদের এসে পৌঁছনোর কথা আছে।

এলাকাটি ঘুরে দেখবার সময় আমাদের ছিল না, কিন্তু গ্রামবাসীরা জানাল যে মড়িটার পূর্বদিকে একটা ঘন জঙ্গল আছে এবং তারা নিশ্চিত যে তাদের তাড়া খেয়ে চিতাটা সেখানেই গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

যদি চিতাটা সেইদিক থেকে আসে তবে ঘাসী জমিতে আসার বহু আগেই ইবটসন তাকে দেখতে পাবে এবং খুব সহজেই গুলি করতে পারবে, কারণ তার রাইফেলে টেলিকোপিক-সাইট লাগানো আছে। এতে যে শুধু নিশানাই নিখুঁত হয় তা নয়, উপরন্তু, পরীক্ষা করে দেখা গেছে, আলোর ব্যাপারেও আধ ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় হাতে পাওয়া যায়–এই ধরনের পরিস্থিতিতে যা অত্যন্ত জরুরী, কেননা দিনের আলোর একটি মিনিটের কম-বেশির উপরই সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ভর করে।

উঁচু পাহাড়ের পিছনে পশ্চিমে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, কিছুক্ষণ হল, আমাদের এদিকে ছায়া পড়েছে; এমন সময় যেদিকে ঘন জঙ্গল আছে শুনেছিলাম, সেদিক থেকে হঠাৎ একটা কাকার হরিণ ডাকতে-ডাকতে পাহাড় বেয়ে ছুটে নেমে এল। পাহাড়ের গায়ে  গিয়ে সেটা থামল, কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ডাকল, তারপর চলে গেল পাহাড়ের অন্যদিকে। শব্দটা ক্রমে দূরে মিলিয়ে গেল।

কাকারটা নিঃসন্দেহে চিতাটাকে দেখেই ভয় পেয়েছে, এবং যদিও ও অঞ্চলে অন্য অনেক চিতা থাকাও সম্ভব, তবু আমার আশা বেড়ে উঠল। ইবটসনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সে-ও উৎকর্ণ হয়ে উঠেছে, দুটো হাতই রয়েছে রাইফেলে।

আলো কমে আসছিল, কিন্তু তখনও টেলিসকোপিক-সাইট ছাড়াই গুলি করা চলে। সেই সময় আমাদের ঠিক ত্রিশ গজ উপরে নিচু ঝোপগুলোর পিছন থেকে স্থানচ্যুত একটা পাইন-ফল গড়াতে গড়াতে আমার পায়ের কাছে গাছের গোড়ায় এসে ঠেকল।

চিতাটা এসে গিয়েছে এবং সম্ভবত বিপদ আঁচ করে পাহাড়ের এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখান থেকে নিরাপদে মড়ির চারদিকের জমিটা খুঁটিয়ে দেখা যায়। আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে, এই করতে গিয়ে সে আমাদের গাছটাকে একেবারে মড়ির সঙ্গে একই সঙ্গে দেখতে পেল। যদিও, আমার দেহরেখা কোথাও বেরিয়ে নেই বলে আমি হয়তো তার দৃষ্টি এড়িয়ে যাব, কিন্তু দুই ডালের মাঝখানে বসে থাকা ইবটসনকে সে নির্ঘাত দেখে ফেলবে।

আমার গুলি করার মতো আলো যখন একেবারে মিলিয়ে গেছে, এবং ইবটসনের টেলিসকোপিক-সাইট যখন আর কোনো কাজেই আসবে না, তখন টের পেলাম যে চিতাটা চুপি-চুপি গাছটার দিকে নেমে আসছে। কিছু একটা করার এই হচ্ছে সময়, সুতরাং ইবটসনকে আমার জায়গায় বসতে বলে আমি বাতিটা বের করে আনলাম। বাতিটা জার্মানির তৈরি, এর আলোটা খুব উজ্জ্বল। কিন্তু এর লম্বা গড়ন ও আরো লম্বা হাতলের জন্যে একটা জঙ্গলে ব্যবহারের উপযোগী মোটেই নয়।

আমি ইবটসনের চেয়ে একটু লম্বা বলে প্রস্তাব করলাম বাতিটা আমিই নিয়ে যাব, কিন্তু ইবটসন জানাল, বাতির দায়িত্ব সে ঠিকমতই নিতে পারবে। অধিকন্তু, নিজের রাইফেলের চেয়ে আমার রাইফেলের উপরই ওর ভরসা বেশি। সুতরাং আমরা রওনা.. দিলাম–আগে ইবটসন, পিছনে আমি–আমার দুটো হাত রাইফেলের উপর।

গাছটা থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে একটা পাথরে চড়তে গিয়ে ইবটসন পিছলে পড়ল। বাতির তলাটা জোরে ধাক্কা খেল পাথরের সঙ্গে এবং ম্যান্টলটা ভেঙে.গুঁড়ো হয়ে পড়ল বাতির তলায়। পেট্রলের চুঙি দিয়ে যে নীল শিখাটা বেরোচ্ছিল তাতে কোথায় পা ফেলব, তা দেখার মত আলো পাওয়া যাচ্ছিল বটে, কিন্তু কথা হচ্ছে, কতক্ষণ এই সুবিধে পাওয়া যাবে। ইবটসন বলল বাতিটা ফাটার আগে মিনিট-তিনেক সময় পাব আমরা। তিন মিনিটে আধ মাইল চড়াই ভাঙা অসম্ভব ভয়াবহ প্রস্তাব; বিশেষত যেখানে প্রতি পদে পদে পাথর আর কাটা ঝোঁপ এড়িয়ে চলতে হচ্ছে, এবং সম্ভবত পিছু নিয়েছে, এবং পরে দেখেছি প্রকৃতই পিছু নিয়েছিল–একটা নরখাদক।

জীবনে এক-একটা ঘটনা ঘটে যা যত দিনই যাক, কখনো স্মৃতি থেকে মুছে যায় না। আমার কাছে ওই অন্ধকারে পাহাড়ে ওঠাটা এমনি এক ঘটনা। অবশেষে যখন হাঁটা-পথটার উপর গিয়ে পড়লাম তখনও আমাদের কষ্টের শেষ হল না। কেননা,; সে-পথে সার-সার মোষ গড়াগড়ি খাবার অগভীর ডোবা! ফলে পথের চিহ্ন-টিহ্ন হারিয়ে গিয়েছিল। উপরন্তু আমাদের লোকজনরা কোথায় আছে তা জানতাম না।

কখনো ভিজে মাটির উপর আছাড় খেয়ে, কখনো অদেখা পাথরের উপর হোঁচট খেয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা কয়েকটা পাথরের সিঁড়ির গায়ে গিয়ে পৌঁছলাম। সিঁড়িগুলো পথ থেকে তফাতে, ডানদিকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে গিয়ে দেখি একটা ছোট উঠোন, তার ওদিকে একটা দরজা। দরজায় ধাক্কা দিয়ে ভিতরের লোকজনদের চেঁচিয়ে ডেকে দরজা খুলতে বললাম। উঠে আসতে আসতে হুঁকো টানার শব্দ শুনেছিলাম। দরজায় লাথি মেরে খুলতে বললাম। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পকেট থেকে দেশলাই বের করে সেটা নাড়িয়ে বললাম, ‘যদি এক মিনিটের মধ্যে দরজা না খোল তাহলে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেব। এতে ঘরের ভিতর থেকে উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে অনুনয় শোনা গেল যে দরজা খুলে দেওয়া হচ্ছে, যেন আগুন না লাগানো হয়। এক মিনিট বাদে প্রথমে ভিতরের, তারপর বাইরের দরজা খুলে গেল। দুই লাফে আমি আর ইবটসন ঘরে ঢুকলাম।

নানা বয়সের বার-চোদ্দ জন স্ত্রী-পুরুষ ও শিশু ঘরটার মধ্যে ছিল। আমাদের এ-রকম অদ্ভুত আবির্ভাবের পর লোকগুলো সংবিৎ ফিরে পেয়ে দরজা খোলায় দেরির জন্যে ক্ষমা চাইল। বলল যে পরিবারসুদ্ধ সবাই এতদিন নরখাদকের আতঙ্কে বাস করতে-করতে সাহস তাদের একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নরখাদকটা যে কখন কী বেশ ধারণ করবে তা জানা না থাকায় তারা রাতের বেলায় যে-কোনো শব্দকেই সন্দেহের চোখে দেখে। তাদের ভীতিতে আমাদের পূর্ণ সহানুভূতি ছিল, কারণ ম্যান্টলটা ভেঙে যাওয়ার কয়েক মিনিট পরে তেতে-লাল-হওয়া বাতিটা যখন ফেটে যাওয়ার আশঙ্কায় নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখন থেকেই আমি ধরে নিয়েছিলাম যে, আজ আর আমাদের সশরীরে গ্রামে পৌঁছনো সম্ভব হবে না।

আমরা জানতে পারলাম আমাদের লোকজন সূর্যাস্তের সময় এসে পৌঁছেছে। পাহাড় বেয়ে আরো দূরে গিয়ে কয়েকটা বাড়ির একটাতে তারা আছে। দু-চারজন শক্ত-সমর্থ লোক আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু আমরা জানতাম যে তাদের একলা ফিরে আসতে দেওয়াটা, খুন করারই শামিল হবে। অতএব আমি তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম। তারা এই বিপদের ঝুঁকিটা পুরো বুঝেই প্রস্তাবটা করেছিল।

আমরা জিগ্যেস করলাম তারা যে-কোনো রকমের একটা লণ্ঠন আমাদের দিতে পারে কি না। ঘরের কোণ থেকে খুঁজে পেতে তারা একটা পুরোনো, অব্যবহার্য ও চিমনি-ফাটা লণ্ঠন এনে হাজির করল এবং খুব ঝাঁকিয়ে যখন দেখা গেল কয়েক ফোঁটা তেল ওটার ভিতরে আছে, তখন সেটা জ্বালল। ঘরের সবায়ের শুভেচ্ছা নিয়ে আমরা বের হলাম ও সঙ্গে সঙ্গেই দরজা দুটো বন্ধ হল।

আরো মোষের গর্ত, আরো ডোবা পাথর। কিন্তু টিমটিমে আলোটার সাহায্যে আমরা ভালভাবেই হাঁটলাম, এবং দ্বিতীয় যে সিঁড়িটা দিয়ে আমাদের উঠে যেতে হবে বলেছিল সেটার কাছে পৌঁছলাম। সিঁড়ির উপরে উঠে দেখি ডাইনে-বাঁয়ে টানা লম্বা একসার দোতলা বাড়ির সামনেকার উঠোনের উপর আমরা এসে পড়েছি। বাড়ির প্রত্যেকটি দরজা জানলা বন্ধ, কোথাও কোনো আলোর চিহ্ন নেই।

ডাকাডাকির পর একটা দরজা খুলে গেল। একটা ছোট পাথরের সিঁড়ি বেয়ে আমরা উপরতলার বারান্দায় গিয়ে উঠলাম। এখানে পাশাপাশি দুটো ঘর আমাদের ও আমাদের লোকজনের জন্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের লোকেরা যখন লণ্ঠন ও রাইফেলগুলো নামিয়ে নিচ্ছিল তখন কোথা থেকে একটা কুকুর এসে উপস্থিত। সেটা একটা গ্রাম্য নেড়ী কুকুর, বেশ বন্ধুভাবাপন্ন। লেজ নাড়তে-নাড়তে আমাদের পায়ের চারদিকে শুঁকে যে-সিঁড়ি দিয়ে আমরা এই মাত্র উঠে এসেছি সেইদিকে এগিয়ে গেল। পরমুহূর্তেই একটা ভয়ার্ত আর্তনাদ করে ভীষণ ঘেউ-ঘেউ করতে করতে সেটা আমাদের দিকে পিছিয়ে এল। সমস্ত নোম তার খাড়া হয়ে উঠেছে।

যে লণ্ঠনটা আমরা নিয়ে এসেছিলাম, সেটা উঠোনে পৌঁছতেই নিভে গিয়েছিল, কিন্তু আমাদের লোকেরা এর জোড়াটাকে যোগাড় করে রেখেছিল। আমি খুব তাড়াতাড়ি রাইফেলে গুলি ভরে নেবার পর ইবটসন লণ্ঠনটাকে নানাভাবে কাত করে, ঘুরিয়ে ধরেও আট ফুট নিচের মাটি পর্যন্ত আলো ফেলতে পারল না।

কুকুরটাকে লক্ষ্য করেই চিতাটার গতিবিধি আন্দাজ করা যাচ্ছিল। চিতাটা যখন উঠোন পার হয়ে সিঁড়ি দিয়ে পথের দিকে নেমে গেল তখন কুকুরটা আস্তে-আস্তে ঘেউ ঘেউ থামিয়ে শুয়ে পড়ল এবং একাগ্র দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থেকে মাঝে-মাঝে গরগর করতে লাগল।

আমাদের জন্যে যে ঘরটা খালি করে দেওয়া হয়েছিল সেটায় কোনো জানলা নেই। নিরাপদে সেটার মধ্যে থাকতে হলে নিরেট দরজাটা বন্ধ করে দিতে হয়, কিন্তু তাহলে আর আলো বাতাস আসবে না। কাজেই রাতটা বারান্দার উপর কাটাব স্থির করলাম। ঘরটায় যে থাকত, কুকুরটা মনে হল তারই। দেখলাম বারান্দায় শুতে সে অভ্যস্ত। কারণ নিশ্চিন্তভাবে সে আমাদের পায়ের কাছে শুয়ে থাকল। ফলে আমাদের মনেও একটা নিরাপত্তার অনুভূতি হল। তারপর দীর্ঘ রাতের প্রহরগুলো পালা করে পাহারা দিয়ে কাটালাম।

.

১৪. পশ্চাদপসরণ

পরদিন ভোরে খুব সন্তর্পণে মড়িটার কাছে গিয়ে দেখে হতাশ হলাম যে চিতাটা আর সেখানে ফিরে আসে নি। আমাদের কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে আগের সন্ধ্যায় আমাদের একজনকেও বাগে না পাওয়ায় সে নিশ্চয়ই সেখানে ফিরে আসবে।

ওকে কিছু আপিসের কাজকর্ম পাঠানো হয়েছিল। দিনের বেলায় ইবটসন তাই নিয়ে বসল। আর আমি রাইফেল নিয়ে চিতাটাকে গুলি করতে পারি কিনা, সেই খোঁজে বেরুলাম। পাইন-কাটাভরা শক্ত মাটিতে তাকে অনুসরণ করা সম্ভব নয়, সুতরাং আমি পাহাড়ের ও-পিঠে, যেখানে ঘন জঙ্গল আছে বলে গ্রামবাসীরা বলেছিল, সেদিক পানে এগোতে লাগলাম। এদিকটায় এগোনোও ভারি শক্ত কাজ, কারণ ঘন ঝোপ-জঙ্গল ছাড়াও এদিকে এমন একসার পাহাড়ের চুড়ো পেলাম যার ওপর পা রেখে চলা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

অবাক হলাম এ এলাকাটায় নানা রকমের জীবজন্তু দেখে। সেখানকার প্রাণী-চলা পথগুলোর উপর আমি কাকার, ঘুরাল, শুয়োর এবং একটা সেরো-র পায়ের চিহ্ন দেখতে পেলাম। কয়েকটা পুরোনো আঁচড়ের দাগ ছাড়া চিতাটার আর কোনো চিহ্নই দেখতে পেলাম না।

জাঁতিকলটা আগের দিন রুদ্রপ্রয়াগ থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের দুপুরের খাওয়ার সময় সেটা এসে পৌঁছল। বেলা পড়ে আসতেই সেটা নিয়ে ঐ ঘেসো জমির উপর আমরা পাতলাম আর মড়িটাকে সায়ানাইড দিয়ে বিষাক্ত করে রাখলাম। বিষ সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা আমার ছিল না, ইবটসনেরও না। কিন্তু নৈনিতাল ছাড়ার আগে এক ডাক্তার বন্ধুকে কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলুম যে গভর্মেন্ট চাচ্ছেন আমি চিতাটাকে মারতে যে-কোনো উপায় প্রয়োগ করি। কিন্তু বিষ দিয়ে চেষ্টা করে কোনো লাভ হবে না, কারণ দেখা গিয়েছে চিতাটা বিষ খেলে বেশ বহাল তবিয়তেই থাকে।

এ পর্যন্ত কি কি বিষ ব্যবহার করা হয়েছে তা শুনে সে আমাকে সায়ানাইড ব্যবহারের কথা বলল। জানাল, মার্জার জাতীয় প্রাণীদের পক্ষে ওটাই সবচেয়ে কার্যকরী। এ খবরটা ইবটসনকে দিয়েছিলাম এবং কয়েকদিন আগেই কিছু সায়ানাইড এবং যে ক্যাপসুলে তা ভরে প্রয়োগ করতে হবে, তার কতকগুলো এসে পৌঁছেছিল। মড়িটার যে-সব জায়গা খেয়েছিল সে-সব জায়গায় কয়েকটা ক্যাপসুল ভরে দিলাম।

খুবই আশা ছিল এই দ্বিতীয় রাতে চিতাটা মড়ির কাছে ফিরে আসবে। আগের সন্ধ্যায় সে গাছের উপরে আমাদের দেখে ফেলেছে, কাজেই আর তার জন্যে বসে না থেকে জাঁতিকল আর বিষের ওপরই ভরসা রেখে চলে এলাম।

পায়ে-চলা পথটার কাছে একটা বড় পাইন গাছে আমরা মাচান বাঁধলাম। তার ওপর খড় পেতে, ইবটসনের স্টোভে রাধা রাতের খাওয়া শেষ করে আমরা তাতে চড়ে বসলাম। এই আরামদায়ক মাচানটার ওপর সটান লম্বা হয়ে শুয়ে সিগারেট টানা ও কথাবার্তা বলাও বেশ সম্ভব হল। কেননা সেখানে আমাদের থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য, মড়ির দিকে কোনো শব্দ হয় কি না তা শোনা।

আমরা পালা করে পাহারা দিলাম আর ঘুমোলাম, আশা করতে লাগলাম যদি দৈবাৎ চিতাটা গিয়ে ফাঁদে পা দেয়, তাহলে তার ক্রুদ্ধ গর্জন শুনতে পাব। কারণ সেখানে এমন কোনো পথের রেখা ছিলনা দিয়ে চিতাটাকে ফাঁদের উপর এনে ফেলা যায়। সারা রাতে একবার মাত্র একটা কাকারের ডাক কানে এল, তাও যেদিক দিয়ে চিতাটা আসবে বলে আশা করেছিলাম তার উল্টো দিক থেকে।

ভোরের আলো ফুটে উঠলে আমরা গাছ থেকে নামলাম, এবং এক কাপ করে চা তৈরি করে খেয়ে মড়িটার কাছে গিয়ে দেখলাম–যেমনটি রেখে গিয়েছিলাম সেটা তেমনই পড়ে আছে।

সকাল-সকাল প্রাতরাশ সেরে ইবটসন রুদ্রপ্রয়াগের দিকে চলে গেল। আমি জিনিসপত্র গুছোতে-গুছোতে পনের দিনের পথ নৈনিতাল’ যাত্রার আগে গ্রামবাসীদের সঙ্গে শেষ দু-চারটে কথা বলছি, এমন সময় একদল লোক এসে খবর দিল যে চার মাইল দূরের একটা গ্রামে চিতা একটা গরু মেরেছে।

তাদের সন্দেহ যে গরুটা মেরেছে নরখাদকটাই, কারণ রাতেই চিতাটা আমাকে ও ইবটসনকে গাছ থেকে বারান্দা পর্যন্ত অনুসরণ করেছিল এবং শেষ রাতের দিকে মোড়লের বাড়ির দরজা ভাঙার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। পরের দিন সন্ধ্যার পরে বাড়িটার তিনশো গজ দূরে জঙ্গলের মধ্যে গরুটা মারা পড়েছে। লোকগুলোর সনির্বন্ধ অনুরোধে আমি নৈনিতাল যাত্রা স্থগিত রাখলাম এবং জাতিক আর বিষ নিয়ে তাদের সঙ্গে সে গ্রামে গেলাম।

মোড়লের বাড়িটা আবাদী-জমি-ঘেরা ছোট একটা টিলার উপর, একটা পায়ে-চলা পথ ধরে যেতে হয়। আবার খানিকটা পথ গিয়েছে নরম প্যাঁচপেচে জমির উপর দিয়ে। এখানে নরখাদকটার থাবার ছাপ দেখা গেল।

মোড়ল আমাকে উপত্যকা দিয়ে আসতে দেখে টাটকা দুধে ফোঁটানো গুড়-দেওয়া ধোঁয়া-ওঠা একবাটি গরম চা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। উঠোনে, ঘুরালের চামড়া-ছাওয়া একটা মোড়ার উপর বসে আমি সেই সুমিষ্ট ঘন, পানীয়টায় চুমুক দিচ্ছিলাম আর সে তার দরজাটার অবস্থা দেখাচ্ছিল। দু-রাত্রি আগে চিতাটা ওটা ভাঙতে চেষ্টা করেছিল। ঘরের ছাদ সারানোর জন্যে ভাগ্যক্রমে কিছু চেরাই-তক্তা মজুত ছিল। তা দিয়ে দরজায় ঠেকে দেওয়া না থাকলে চিতাটার চেষ্টা নিশ্চয় সফল হত।

বুড়ো মোড়ল বাতে পঙ্গু, কাজেই সে মভিটা দেখানোর জন্যে তার ছেলেকে আমার সঙ্গে দিল আর নিজে তার বাড়িতে আমার ও আমার লোকজনের থাকার বন্দোবস্ত করতে লাগল।

 মড়িটা দেখলাম। অল্প বয়সের একটা চমৎকার গরু-গরু বাছুরের চলাপথের ঠিক উপরেই একটুকরো সমান জমির উপর পড়ে আছে। ফঁদটা পাতবার পক্ষে আদর্শ জায়গা। গরুটার পিঠটা ছিল একটা বুনো গোলাপ ঝাড়ের গায়ে, আর পায়ের খুরগুলো ছিল একফুট উঁচু একটা আলের গায়ে। খাওয়ার সময় চিতাটা বসেছিল আলটার উপর আর তার সামনের থাবা দুটো ছিল গরুর পাগুলোর মাঝখানে।

গরুর পায়ের মধ্যকার জমি খুঁড়ে মাটিটা দূরে সরিয়ে ফেললাম। চিতাটা যেখানে থাবা রেখেছিল সেখানে জাঁতিকলটা পেতে তার ওপর বড়-বড় সবুজ পাতা চাপা দিলাম। তারপর একপ্রস্থ মাটি ছড়িয়ে দিয়ে গরুর পায়ের মাঝখানে শুকনোপাতা, কুঠো কাঠি ও হাড়ের টুকরো ঠিক যেমনটি দেখেছিলাম তেমনি করে সাজিয়ে রাখলাম। মড়িটার কাছে গিয়ে কেউই বুঝতে পারত না যে জমিটাতে কোনোরকম নাড়াচাড়া করা হয়েছে বা সেখানে একটা মারাত্মক ফঁদ পাতা হয়েছে।

মনোমত ব্যবস্থা করে আমি ফিরে এসে মোড়লের বাড়ি ও মড়িটার মাঝামাঝি জায়গায় একটা গাছে উঠে বসলাম। দরকার হলে ওখান থেকে চট করে জাঁতিকলটার কাছে যেতে পারব।

সূর্যাস্তের সময় একজোড়া কালীজ ফেজেন্ট ও তাদের পাঁচটা ছানাকে আমি কিছুক্ষণ যাবৎ লক্ষ্য করছিলাম, হঠাৎ তারা ভয় পেয়ে পাহাড়ের নিচের দিকে উড়ে পালাল। কয়েক সেকেণ্ড পরেই একটা কাকার ছুটে এল আমার দিকে। আমার গাছটার নিচে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে সেটা পাহাড়ের উপর উঠে গেল। তারপর আর কিছুই ঘটল না। গাছের ছায়ার অন্ধকারে যখন আমার বন্দুকের নিশানা দেখা কঠিন হয়ে এসেছে তখন গাছ থেকে নেমে রবার-সোলের জুতো পরা পা টিপে টিপে গ্রামের দিকে রওনা দিলাম।

মোড়লের বাড়ি থেকে একশো গজ দূরে পথটা ত্রিশ গজ লম্বা কুড়ি গজ চওড়া একটা খোলা জমির উপর দিয়ে গেছে। জমিটার উপরে পাহাড়ের দিকে একটা বড় পাথর। জমিটার উপর পৌঁছেই আমার মনে হল চিতাটা আমার পিছু নিয়েছে। পরিস্থিতির পুরো সুযোগ নেওয়ার জন্যে আমি পথ ছেড়ে নরম জমির উপর গোটা-দুই লম্বা লম্বা পা ফেলে পাথরটার পিছনে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কেবল একটা চোখ থাকল মড়িটার দিকে।

পুরো দশ মিনিট ভিজে মাটির উপর শুয়ে থাকলাম, তারপর দিনের আলো একেবারে নিভে গেলে, রাস্তা ধরে, সবরকম সতর্কতা অবলম্বন করে, বাকি পথটা পার হয়ে মোড়লের বাড়িতে এসে পৌঁছলাম।

রাতে একবার মোড়ল আমাকে জাগিয়ে বলল, যে সে চিতাটাকে দরজা আঁচড়াতে শুনেছে। পরদিন সকালে দরজার সামনে ধুলোর উপর নরখাদকটার থাবার ছাপ দেখতে পেলাম। থাবার ছাপ ধরে আমি ফিরে গেলাম সেই ভোলা জমিটার উপর। দেখতে পেলাম, আগের সন্ধ্যায় আমি যা-যা করেছি চিতাটাও ঠিক তাই-তাই করেছে। আমি যেখানটায় পথটা ছেড়েছি, সে-ও ছেড়েছে। নরম জায়গাটা পেরিয়ে গেছে। পাথরটার কাছে, তারপর আবার পথের উপর ফিরে গিয়ে বাড়ি পর্যন্ত আমাকে অনুসরণ করে এসেছে এবং বাড়িটার চারপাশে কয়েকবার ঘুরেছে।

বাড়িটা ছেড়ে চিতাটা পথ ধরে ফিরে গেছে। থাবার ছাপ ধরে মড়িটার দিকে এগোতে এগোতে আমার আশা বেড়ে উঠল। তখনও পর্যন্ত আমি পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারি নি, আট বছর ধরে মানুষের কাছাকাছি থাকতে-থাকতে একটা নরখাদক চিতা কতটা পরিমাণ ধূর্ত হয়ে উঠতে পারে।

পথটা ছেড়ে আমি উঁচু জমির দিক থেকে এগোতে লাগলাম। খানিকটা দূর থেকে দেখতে পেলাম মড়িটা নেই, আর যে-মাটিতে জাঁতিকলটা বসানো আছে, সেখানে। দুটো থাবার দাগ ছাড়া জমিটার উপর একটুও নাড়াচাড়ার চিহ্ন দেখা গেল না।

প্রথম রাতের মতই চিতাটা এক ফুট উঁচু আলের উপর বসে সামনের দুটো পা গরুর পায়ের মাঝখানে রাখে। কিন্তু এবারে পা দুটো ছড়িয়ে রেখেছিল দুদিকে। বেশ ফঁক করে, লুকোনো ফাঁদের ডাণ্ডাদুটোর উপর। যে দুটো খুলে গেলেই মস্ত জাতিদুটো বন্ধ হয়ে যেত। এখানে নিশ্চিন্তে বসে সে খাওয়া শেষ করেছে। তারপর ঘুরে গিয়ে গরুর মাথাটা ধরে গোলাপ-কাটার মধ্য দিয়ে পাহাড় থেকে গড়িয়ে ফেলেছে নিচে, সেখানে পঞ্চাশ গজ নিচে একটা ওক চারায় গিয়ে সেটা ঠেকেছে। রাতের মত এ কাজ সমাধান করে চিতাটা গেছে গরু-বাছুর চলা পথটা ধরে। মাইলখানেক তাকে অনুসরণ করার পর শক্ত জমিতে তার থাবার চিহ্ন হারিয়ে গেল।

চিতাটার মড়ির কাছে ফেরার আর কোনো আশা ছিল না। যাই হক, আগের রাতে বিষ দিই নি বলে নিজের বিবেককে সান্ত্বনা দিতেই বেশ খানিকটা সায়ানাইড গরুটার দেহাবশেষে ঢুকিয়ে দিলাম। সত্যি বলতে, বিষ ব্যবহারের চিন্তাটাই আমার কাছে তখন ঘৃণ্য বলে মনে হয়েছিল এবং এখনও হয়।

পরদিন সকালে গিয়ে দেখলাম, যে-অংশটায় বিষ দিয়ে রেখেছিলাম সে-অংশটা কোনো চিতা খেয়ে ফেলেছে। অন্য একটা চিতাই যে দৈবাৎ সেখানে এসে পড়ে বিষটা খেয়ে ফেলেছে, নরখাদকটা নয়,–এ বিষয়ে আমি এতটা নিশ্চিত হয়েছিলাম যে গ্রামে ফিরে গিয়ে মোড়লকে বললাম যে চিতাটাকে খুঁজে পাবার জন্যে আমি আর অপেক্ষা করব না। তবে, যে ওটা খুঁজে পাবে সে যদি চামড়াটা পাটোয়ারীর কাছে নিয়ে যায় তবে তাকে একশো টাকা পুরস্কার দেব আমি। এক মাস পরে পুরস্কারটা দাবি করা হল। বহুদিন আগে-মরে যাওয়া একটা চিতার চামড়া সেটা, পাটোয়ারী সেটা মাটিতে পুঁতে রাখল।

জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে আমার লোকজনের বেশি সময় লাগে নি এবং দুপুরের অল্প পরেই আমরা নৈনিতালের দীর্ঘ পথে যাত্রা করলাম। একটা সরু পথ দিয়ে চাতোয়াপিপল পুলের দিকে নামছি, এমন সময় একটা বড় দাঁড়াস সাপ ধীরে-সুস্থে পথটা পার হয়ে গেল। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ওটাকে চলে যেতে দেখছি, আমার পিছন থেকে মাধো সিং বলল, আপনার ব্যর্থতার জন্যে দায়ী যে দুষ্ট আত্মা, ওই সে যাচ্ছে!

নরখাদকটার দয়ার উপর গাড়োয়ালকে ছেড়ে দিয়ে আমার চলে যাওয়াটা আপনাদের কাছে হৃদয়হীনতা বলে মনে হতে পারে। আমারও মনে হয়েছিল। কাগজেও বিরূপ সমালোচনা বেরিয়েছিল। কেননা সে-সময় প্রতিদিনই ভারতবর্ষের কাগজগুলোয় চিতাটার উল্লেখ থাকত।

কিছুটা দোষ স্থালনের জন্যে আমি বলতে পারি, যাতে স্নায়ুর উপর অসম্ভব চাপ পড়ে এমন কোনো প্রচেষ্টাই অনির্দিষ্টকাল যাবৎ চালিয়ে যাওয়া যায় না। বহু সপ্তাহ যাবৎ আমি গাড়োয়ালে ছিলাম। তার প্রত্যেকটা দিনে ছিল চব্বিশ ঘণ্টা করে সময়, এবং বারংবার সারা রাত ধরে জেগে বসে থাকার পর আবার পরদিন মাইলের পর মাইল আমাকে হাঁটতে হয়েছে। নরখাদকটার ব্যর্থ শিকার-প্রচেষ্টার খবর পেয়ে যেতে হয়েছে দূর দূরান্তরের গ্রামে। বহু চন্দ্রালোকিত রাত্রি নানা অসুবিধের মধ্যে বসে থেকে-থেকে আমি আমার দৈহিক শেষ শক্তির প্রান্তসীমায় এসে পৌঁছেছিলাম। যে জায়গা থেকে চিতাটা সহজেই আমাকে ধরে ফেলতে পারে, তেমন জায়গার উপর বসেও শেষ পর্যন্ত আমি আমার চোখের পাতা আর খুলে রাখতে পারছিলাম না।

ঘণ্টার পর ঘন্টা আমি সেইসব পথে ঘুরে বেরিয়েছি যে পথ রাতে ভোলা থাকত শুধু আমার আর চিতাটার জন্যে। সবরকম কৌশল খাঁটিয়ে চেষ্টা করেছি। আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত করতে, আর নরখাদকটা তার ধারণাতীত ভাগ্যের জোরে অথবা তার শয়তান-সুলভ ধূর্ততার জন্যে আমার বুলেট বারংবার এড়িয়ে গিয়েছে। এই নৈশ অভিযানগুলোর পর সকালবেলায় এইসব পথে ফিরে গিয়ে পথের উপর তার থাবার ছাপ দেখে বুঝেছি যে আমি ঠিকই অনুমান করেছিলাম, সত্যিই সে আমাকে খুব কাছে থেকে অনুসরণ করছিল। শিকার ধরতে ব্যর্থ, উন্মুখ এক নরখাদক উজ্জ্বল চাঁদনী রাতে আমায় অনুসরণ করে চলেছে–একথা মনে হলেই যে হীনমন্যতা এসে দেখা দেয় তা স্নায়ুকে প্রচণ্ড আঘাতে বিবশ করে ফেলে, এবং এর বারংবার পুনরাবৃত্তি ঘটলে তার কিছুমাত্র উপশম হয় না।

দেহে-মনে নিদারুণ ক্লান্তি নিয়ে আমি আরো অনেকদিন রুদ্রপ্রয়াগে থাকলে তা গাড়োয়ালের লোকদের পক্ষে কিছু লাভের হত না। হয়তো আমার নিজের জীবন-সংশয় হত। আমি জানতাম যে আমার এই স্বেচ্ছাহূত কাজ ছেড়ে সাময়িকভাবে চলে যাওয়াটা কাগজে দারুণ সমালোচনার বিষয় হবে। কিন্তু এখন আমি যা করেছি, তা ঠিক। যত শিগগির সম্ভব তাদের সাহায্য করতে আবার আমি ফিরে আসব–গাড়োয়ালের লোকদের এই আশ্বাস দিয়ে আমি আমার বহুদূরবর্তী বাড়ির দিকে ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে চললাম।