প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

০৫. তদন্ত

৫. তদন্ত

রুদ্রপ্রয়াগে যে দশ সপ্তাহ আমি ছিলাম তার প্রতিদিনের কার্যবিবরণ আপনাদের দেবার চেষ্টা করব না। কারণ এতদিন পরে সে বিবরণী লেখাও কঠিন, যদি লিখি, আপনাদের তা পড়তে বিরক্ত লাগবে। সুতরাং আমি আমার সামান্য কয়েকটি অভিজ্ঞতার কথাই বলব, যে সময়টা কখনো আমি একা, কখনো বা ইবটসনের সঙ্গে কাটিয়েছি। কিন্তু তার আগে, যে এলাকায় আট বছর ধরে চিতাটা বিচরণ করেছে এবং যেখানে দশ সপ্তাহ যাবৎ আমি তার পিছনে ঘুরেছি সে এলাকাটা সম্বন্ধে আপনাদের কিঞ্চিৎ ধারণা দিতে চেষ্টা করব।

রুদ্রপ্রয়াগের পুবদিকের পাহাড়টায় উঠলে আপনি ঐ ৫০০ বর্গমাইল এলাকাটার বেশির ভাগই দেখতে পাবেন। ঐ এলাকায় রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক রাজত্ব করেছে। অলকানন্দা নদী এলাকাকে কমবেশি সমান দু-ভাগে ভাগ করেছে এবং কর্ণয়াগ পেরিয়ে দক্ষিণে রুদ্রপ্রয়াগের দিকে বয়ে গেছে। সেখানে তার সঙ্গে উত্তর-পচিম থেকে এসে মিশেছে মন্দাকিনী। দুই নদীর মাঝখানে ত্রিভুজাকৃতি অঞ্চলটা অলকানন্দার ঝ পাড়ের এলাকার চেয়ে কম খাড়াই। ফলে শেষোক্ত এক্সার চেয়ে প্রথমোক্ত এলাকায় গ্রামের সংখ্যা বেশি।

আপনি দাঁড়িয়ে আছেন উঁচুতে। সেখান থেকে দুরের আবাদী জমিগুলো দেখাচ্ছে খাড়া পাহাড়ের গায়ে আঁকা সার-সার রেখার মত। ওই রেখাগুলো হল খেতী-জমির স্তর। জমিগুলোর চওড়াইয়ে তফাত প্রচুর। এক গজ থেকে শুরু করে কোন-কোন খেতে পঞ্চাশ গজ, বা তারও বেশি।

আপনি লক্ষ করলে দেখবেন, গ্রামের বাড়িগুলো সব সময়েই আবাদী জমির উপর সীমানায়। দলছুট গরু-ছাগল ও বুনো জন্তু-জানোয়ারের ওপর নজর রেখে, খেত-আবাদ। তাদের থেকে বাঁচাবার জন্যেই এইভাবে ঘরবাড়ি তৈরি করা। অতি বিরল দু-একটা খেত ছাড়া খেতী-জমি ঘিরে কোনো ঝোঁপ বা বেড়া নেই।

এ নিসর্গ দৃশ্যছবির অধিকাংশই যে বাদামী ও সবুজ রঙের ছোপে আঁকা, তা হল, যথাক্রমে ঘেসোজমি ও বনভূমি। দেখবেন কয়েকটা গ্রাম একেবারে ঘেসোজমিতেই ঘেরা। আবার অন্যগুলো একেবারে জঙ্গলে ঘেরা। নিচে চাইলে দেখবেন, সমস্ত দেশটাই অসমান ও বন্ধুর। অসংখ্য গভীর গিরিদরি ও খাড়াই ঢালের পাহাড়ে রচিত-খচিত। এ অঞ্চলে রাস্তা বলতে মাত্র দুটি। একটি রুদ্রপ্রয়াগ থেকে বেরিয়ে চড়াই উঠে কেদারনাথ চলে গেছে। আরেকটি হল বদ্রীনাথে যাবার প্রধান তীর্থ-পথ। আমি যে সময়ের কথা লিখছি, তখন অবধি দুটো রাস্তাই ছিল সংকীর্ণ, বন্ধুর। তখন অবধি এগুলোর ওপর দিয়ে কোনোরকম চাকাই চলে নি।

এ বইয়ের শেষে যে মানচিত্র আছে, তা দেখলে পরে দেখবেন তাতে অনেকগুলো গোল-গোল চিহ্ন আছে। প্রতি গ্রামে রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদকের মরা মানুষের সংখ্যার নিশানা চিহ্নগুলি। পরের পাতায়, ১৯১৮ থেকে ১৯২৬ সাল অবধি চিহ্নিত গ্রামগুলির প্রত্যেকটিতে নিহত মানুষ দেওয়া হল।

আবাদী-জমি ঘেরা গ্রামগুলোর চেয়ে জঙ্গল-ঘেরা গ্রামগুলোতে বেশি মানুষ মারা পড়বে এরকম মনে করাই যুক্তিসংগত। নরখাদকটি বাঘ হলে, নিঃসন্দেহে তাইই ঘটত। কিন্তু নরখাদক চিতা তত শুধু রাতেই শিকার করে। আড়াল-আবডাল থাকা-না-থাকায় তার কিছু এসে যায় না। এক গ্রামে অন্য গ্রামের চেয়ে কেন বেশি মানুষ মরেছে, তার একমাত্র কারণ হল–এর ক্ষেত্রে সতর্কতার অভাব। ওর ক্ষেত্রে সতর্কতা-ব্যবস্থা মেনে চলা।

নরখাদকটি একটি অতিকায় মদ্দা চিতা, যৌবন তার বহুদিন বিগত, এ আমি বলেছি। তবে বুড়ো হলেও শরীরে তার প্রচণ্ড শক্তি। যেখানে বসে মাংসাশী প্রাণীরা নিরুপদ্রবে খেতে পারবে, সে জায়গায় শিকারকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তাদের আছে কি না, তার অনেকটা স্থিরীকৃত হয়, শিকারকে মারার জন্যে তারা যে জায়গা ঠিক করেছে তার উপর।

রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদকের কাছে সব জায়গাই সমান। কারণ, মারার পর ওর শিকারের মধ্যে যে মানুষ সবচেয়ে ভারি, আকেও ও বহুদূর বয়ে নিয়ে যাবার ক্ষমতা রাখত। যেবারকার কথা আমি জানি, সেবার ও চার মাইল বয়ে নিয়ে গিয়েছিল মড়ি। আমি যেবারের কথা বলছি, সেবার চিতাটি একটি পূর্ণবয়স্ক মানুষকে তার বাড়ির ভিতর মারে। তারপর জঙ্গল-ঢাকা এক পাহাড়ের খাড়াই-ঢাল বেয়ে দু’ মাইল উঠে যায় মড়ি বয়ে। দুরের ঘনঝোঁপ জঙ্গলে ঢাকা ঢাল ধরে নেমে যায়। কেন করেছিল তার কারণ বোঝা যায়। কেন না রাতের প্রথমদিকেই মানুষটাকে ও হত্যা করে। পরদিন দুপুরের আগে চিতাটার পেছু-পেছু যায় নি কেউ।

রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক চিতার নিহতদের তালিকা (গ্রাম অনুসারে) ১৯১৮-১৯২৬

ছয়জন নিহত
চোপরা
পাঁচজন নিহত
কোঠকি, রাতাউরা
 চারজন নিহত
 বিজরাকোট
তিনজন নিহত
নাকোট, গান্ধারী, কোখান্ডি, দাদোলি,কোয়েথি, ঝিরমোলি, গোলারাই, লামেরি
দুজন নিহত
বাজারু, রামপুর, মাইকোটি, ছাততালি, কোটি, মাদোলা, রাউতা, কান্দে (যোগি), বরান, সারি, রানাউ, পুনার, তিলানি, বাঊঠা, নাগরাসু, গোয়র, মারোয়ারা।
একজন নিহত
আসো, পিলু, ভাউসাল, মংগু, বৈঁজি, ভাটোয়ারি, খামোলি, সোয়ারি, ফালসি, কান্দা, ধারকোট, দাংগি, গুনাওন, ভাটগাঁও, বাওয়াল, বারসিল, ভৈঁগাঁও, নরি, সান্দার, তামেন্দু, খাঁটিয়ানা, সিওপুরী, সান, সাইউ, কামেরা, দারমারি, ধামক বেলা, বেলা-কুন্ড, সাউর, ভৈসাঁরি, বাজনু, কুইলি ধারকোট, ভাইগাঁও, ছিংকা, ধুং, কিউরি, বামনকান্দাই, পোস্তা, ঠাপালগাঁও, বসু, নাগ, বৈসানি, রুদ্রপ্রয়াগ, গোয়র, কালনা ভুকা, কামেরা, সৈ, পাবো, ভৈঁসোয়ারা।

বার্ষিক যোগফল

১৯১৮… … ১
১৯১৯ … … ৩
১৯২০ … … ৬
১৯২১ … … ২৩
১৯২২. … …২৬
১৯২৩ … … ২৪
১৯২৪ … … ২০
১৯২৫ … … ৮
১৯২৬ … … ১৪
—————-
মোট… … ১২৫

আমাদের সকল অরণ্যপ্রাণীর মধ্যে, নরখাদক চিতা ছাড়া অন্য চিত্রদের মারা সবচেয়ে সহজ। কেন না তাদের গন্ধ বিষয়ে কোনো অনুভূতিই নেই।

অন্য কোনো প্রাণী মারার সময়ে যেসব পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার চেয়ে অনেক। বেশি সংখ্যক পন্থায় চিতা মারা হয়। চিতাটিকে নিছক শিকারের আনন্দে মারা হচ্ছে, না লাভের জন্য, সেই বুঝে পন্থাতেও তফাত করা হয়।

শিকারের আনন্দে চিল মারবার সবচেয়ে রোমাঞ্চকর, চমৎকার পন্থা হল, জঙ্গলে ওদের খোঁজে যাওয়া। যখন খোঁজ মিলল, তখন চুপে-চুপে গিয়ে ওদের গুলি করে মারা।

লাভের জন্য চিতা মারার সবচেয়ে সহজ, সবচেয়ে নিষ্ঠুর পন্থা হল, চিতার মারা কোনো জন্তুর মাংসের ভিতর একটি ছোট, ভীষণ বিস্ফোরক বোমা ঢুকিয়ে দেওয়া।

অনেক গ্রামবাসীই এই বোমাগুলো বানাতে শিখেছে। যখন একটা বোমার সঙ্গে চিতার দাঁতের ছোঁয়া লাগে, তখন বোমাটা ফাটে, চিতাটার চোয়াল উড়িয়ে দেয়। কোনো-কোনো সময়ে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু ঘটে। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই হতভাগ্য জীবটি গুঁড়ি টেনে চলে যায়, মরে। সে মৃত্যু বড় সময়সাপেক্ষ, বড় যন্ত্রণার। কেন না যারা বোমাগুলো ব্যবহার করে, তাদের এ সাহস নেই যে,রক্তের নিশানা অনুসরণ করে গিয়ে চিতাটাকে মেরে ফেলে।

থাবার ছাপ দেখে চিতাকে খুঁজে বের করা, নিশ্চুপে কাছে যাওয়া, রোমাঞ্চকর ও চিত্তাকর্ষক তো বটেই, তুলনায় তা সহজও। কেন না চিতার থাবা নরম। তারা যতদূর সম্ভব মানুষ ও জীবজন্তুর চলার পথ ধরে চলে। ওদের খুঁজে বের করা খুব কঠিন নয়। কেন না বলতে গেলে জঙ্গলের প্রতিটি পশু-পাখি শিকারীকে সহায়তা করে। নিশূপে ওদের কাছে যাওয়াও সোজা। কেন না ভাগ্যবশে ওদের চোখ ও কানের শক্তি অতি তীক্ষ্ণ। তবে গন্ধ বিষয়ে কোনো অনুভূতি না থাকায় ওখানে ওরা মার খেয়ে গেছে। সেই জন্যেই, বাতাস যেদিক থেকেই বইতে থাকুক, যেভাবে এগোলে পরে তার সবচেয়ে সুবিধে, শিকারী তা বেছে নিতে পারে।

খুঁজে বের করে, নিশ্চুপে চিতার কাছে যাওয়ার পর, রাইফেলের ট্রিগার টেপার চেয়ে ক্যামেরার বোতাম টিপলে অনেক, অনেক বেশি আনন্দ পাওয়া যায়। এর ক্ষেত্রে, চিতাটাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে দেখা যায়। বসে দেখতে হলে, চিতার চেয়ে সলীল-লাবণ্য, মনোগ্রাহী জন্তু জঙ্গলে দুটি নেই। ইচ্ছে মত ক্যামেরার বোতাম টিপে এমন এক স্থায়ী দলিল রাখা যায়, যাতে আগ্রহ কখনো ফুরোয় না।

অন্য ক্ষেত্রে–এক পলকের দেখা, ট্রিগারে একটি চাপ, লক্ষ্য যদি সঠিক হয় তবে। একটি ট্রফি লাভ। সে ট্রফির সৌন্দর্য, তাতে আগ্রহ, দ্রুত চলে যায়।

.

৬. প্রথম মড়ি

আমি রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছনোর অল্প আগেই ইবটসন একটা ঝপানের (জঙ্গল বা অন্য জায়গা ঘেরাও করে জন্তু খোঁজার জন্য বন্দোবস্ত করা হল ঝাপান।) ব্যবস্থা করেছিল। সেটি সার্থক হলে পনেরটা মানুষের প্রাণ বাঁচত। সে ঝাঁপান, যে কার্যকারণে তা করতে হয়, সে বিবরণী লিখে রাখার মত।

কুড়িজন তীর্থযাত্রী বদ্রীনাথের চড়াই-পথ ভাঙতে-ভাঙতে সন্ধ্যার দিকে পথের পাশের একটি ছোট দোকানে হাজির হয়। ওদের যা দরকার, সব দেবার পর দোকানীটি ওদের রওনা হতে তাড়া দেয়। বলে চার মাইল পথ এগোলে পরে ওরা যাত্ৰীশালায় পৌঁছবে। সেখানে ওরা আহার ও নিরাপদ আশ্রয় পাবে। তা ওদের ওখানে পৌঁছবার পক্ষে যতটুকু আলো দরকার, ততটুকুই দিনের আলো আছে।

তীর্থযাত্রীরা এ পরামর্শ নিতে নারাজ। ওরা বলল, সেদিন ওরা দীর্ঘ পথ হেঁটেছে। আরো চার মাইল হাঁটার পক্ষে বড়ই হতক্লান্ত। রাতের আহারের ব্যবস্থা ও রান্না করার এবং দোকানের লাগাও কাঠের মাচায় শোবার অনুমতি, এই সুবিধেটুকু মাত্র চায় ওরা। এ প্রস্তাবে দোকানী ঘোর আপত্তি জানায়। তীর্থযাত্রীদের বলে, নরখাদকটি প্রায়ই ওর বাড়িতে হানা দেয়। খোলা জায়গায় শোয়া মানে মৃত্যু ডেকে আনা।

বাদানুবাদ যখন চূড়ান্তে পৌঁছেছে। তখন মথুরা থেকে বদ্রীনাথ যাত্রী সাধু ঘটনাস্থলে হাজির হল। সে তীর্থযাত্রীদের জোর সমর্থন জানাল। বলল, দোকানী যদি দলের মেয়েদের আশ্রয় দেয়, তবে ও মাচাটায় পুরুষদের সঙ্গে শোবে। নরখাদক বা অন্য কোনো চিতা যদি পুরুষদের জখম করতে চেষ্ট করে, সাধু সেটাকে মুখে ধরে দু’ টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও এ প্রস্তাবে দোকানীকে রাজী হতে হল। এক-কামরার দোকান-ঘরে, বন্ধ দরজার পিছনে দলের দশটি মেয়েছেলে আশ্রয় নিল। দশটি পুরুষ সারি বেঁধে মাচাটিতে শুল। সাধুটি রইল মধ্যিখানে।

মাচার ওপর যারা শুয়েছিল, সে তীর্থযাত্রীরা সকালে উঠে দেখে সাধুটি নিখোঁজ। যে কম্বলে সে শুয়েছিল, তা দলামোচড়া। গায়ে যে চাদর ঢাকা দিয়েছিল, তার খানিকটা মাচার বাইরে, তাতে রক্তের দাগ। লোকগুলির উত্তেজিত কথাবার্তার আওয়াজে দোকানীটি দরজা খোলে। এক পলকেই দেখে কি হয়েছে। সূর্য উঠলে পরের দোকানীটি, লোকগুলির সঙ্গে রক্তের চিহ্ন অনুসরণ করে পাহাড়ের নিচে নামে। তিনটি খাঁজ-টা খেত পেরোয়, একটা নিচু পাঁচিলের কাছে পৌঁছায়। পাঁচিলের ওপারে সাধুটিকে খুঁজে পায় ওরা। শরীরের নীচের অংশটি চিতাটি খেয়ে গেছে।

সে-সময় ইটসন ছিল রুদ্রপ্রয়াগে। নরখাদকটির হদিস পেতে চেষ্টা করছিল। ও থাকার সময়ে কেউ মারা পড়ে নি। অলকানন্দার পাশে দূরে একটা জায়গা, খুব মনে হয় ওটা চিতাটার লুকোবার জায়গা। স্থানীয় লোকদের সন্দেহ, যতক্ষণ দিনের আলো থাকে, ওখানেই লুকিয়ে থাকে ও। তাই ইটসন আন্দাজেই ঝাঁপান চালাবে ঠিক করল।

তাই, এদিকে যখন ওই বিশজন তীর্থযাত্রী ছোট দোকানটির পথে চড়াই ভাঙছে, পাটোয়ারী এবং ইবটসনের কর্মচারীদের অন্যরা কাছাকাছি গ্রামগুলো ঘুরছে। সকালে যে ঝাঁপান হবে, সেজন্যে তৈরি থাকতে বলে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে পুরুষদের।

পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি প্রাতরাশ সেরে ইবটসন ঝোলা-পুল দিয়ে অলকানন্দা পেরোল। পাহাড়ের চড়াই বেয়ে মাইলখানে দূরে ওপাশে গেল, কঁপানের জন্যে যে-যার জায়গায় দাঁড়াল। সঙ্গে ছিল ওর স্ত্রী, এক বন্ধু-তার নাম আমি ভুলে গেছি, ওর কর্মচারীদের কয়েকজন, আর দুশো ঝাপানদার।

ঝাঁপান যখন চলছে, তখন রানার এসে সাধুকে মারার খবর দিল।

ঝাঁপান শেষ হল, তবে কাজ হল না কিছুই। তাড়াতাড়ি সবাই পরামর্শ করে নিল। ফলে ব্যাপারটা দাঁড়াল এই, ইবটসন ওর সঙ্গীরা, দুশো ঝাপানদার, নদীর উজান মুখে চার মাইল উজিয়ে গিয়ে, একটা ঝোলা-পুলে নদী পেরিয়ে বাঁ-পাড় দিয়ে ফিরতি পথে হত্যার ঘটনাস্থলে পৌঁছবার জন্য নদীর ডান পাড়ের চড়াই ভেঙে রওনা হল। ওর কর্মচারীরা যতজন পুরুষকে পারে, যোগাড় করে দোকানে জমায়েত করার জন্যে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল।

দুপুর গড়িয়ে যেতে দু-হাজার ঝাপানদার, অনেকগুলো বাড়তি বন্দুক জমায়েত হল। দোকানের ওপরের উঁচু, এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়টার ওপর থেকে নিচ অবধি ঝাঁপান চালানো হল। ইবটসনকে যদি চিনে থাকেন, তাহলে ঝাঁপানের বন্দোবস্ত হয়েছিল পরম দক্ষতায়, সমান দক্ষতায় তা চালানো হয়েছিল, আপনাদের এ কথা আমাকে বলে দিতে হবে না। ঝপানের উদ্দেশ্য কেন ব্যর্থ হল, তার একমাত্র কারণ হল, চিতাটা ও অঞ্চলেই ছিল না।

যখন কোনো চিতা বা বাঘ নিজে থেকেই ভোলা, উন্মুক্ত জায়গায় মড়ি ফেলে রেখে চলে যায়, তার যে ও মড়িতে আর আকর্ষণ নেই, এ তারই একটা লক্ষণ। খাওয়া সেরে এরা সব সময়ে মড়ি দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। কখনো দু-তিন মাইল দুরে, কিংবা নরখাদকের ক্ষেত্রে হয়তো দশ বা আরো বেশি মাইল দূরে। তাই, যখন পাহাড়ে ঝাঁপান চলছিল, নরখাদকটা দশ মাইল দূরে আরামে ঘুম দিচ্ছিল, এ খুবই সম্ভব।

.

৭. চিতার সন্ধান

নরখাদক চিতা খুবই দুর্লভ ঘটনা। সেইজন্যে তাদের সম্বন্ধে খুব কমই জানা যায়।

এই প্রাণীগুলো সম্বন্ধে আমার নিজের অভিজ্ঞতা খুব সীমাবদ্ধ। শুধু বহু বছর আগে মাত্র একটার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত মোলাকাত হয়েছিল। যদিও আমার ধারণা হয়েছিল যে শুধু পশু আহার থেকে খাদ্যাভ্যাস বদলিয়ে মানুষ-আর-পশু আহারে অভ্যস্ত হলে স্বভাবের পরিবর্তন বাঘ আর চিতার একই রকম হয়। তবু আমি জানতাম না চিতার অভ্যাস কতদূর অবধি বদলাবে। এর মধ্যে আমি ঠিক করলাম, নরখাদকটাকে মারতে চিতা মারার সাধারণ পদ্ধতিগুলোই প্রয়োগ করব।

চিতা শিকারের সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে, হয় মড়ির ওপর, না হয় ছাগল বা ভেড়ার জ্যান্ত টোপ বেঁধে ওদের জন্যে বসে থাকা। এ দুটো পদ্ধতির যে-কোনোটা কাজে লাগাতে গেলে, একটায় দরকার মড়ি খুঁজে বের করা, অপরটায় দরকার চিতাটার অবস্থিতির খোঁজ পাওয়া।

আমার রুদ্রপ্রয়াগে যাবার উদ্দেশ্য ছিল যাতে আরো মানুষ প্রাণ না হারায় তার চেষ্টা করা। আরেকটা মানুষ মড়ি হয়ে আমাকে তার ওপর বসার সুযোগ করে দেবে, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করার আমার আদৌ ইচ্ছে ছিল না। কাজেই স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল আমার কাজ হল চিতাটা খুঁজে বের করে জ্যান্ত টোপের সহায়তায় তাকে গুলি করা।

এখানে একটা ভয়াবহ প্রতিবন্ধ দেখা দিল। আশা করলাম, সময়ে তা অন্তত অংশত দূর করতে পারব। আমাকে যে মানচিত্রগুলি দেওয়া হয়, তাতে দেখি নরখাদকটা প্রায় পাঁচশো বর্গমাইলের এক এলাকা জুড়ে হানা দিয়ে বেড়াচ্ছে। যে কোনো জায়গাতেই একটি জানোয়ারকে খুঁজে বের করে গুলি করার পক্ষে পাঁচশো বর্গমাইল এক বিরাট এলাকা। অলকানন্দা নদী যে এলাকাটিকে কম বেশি দু-ভাগে ভাগ করেছে, এ-কথা যতক্ষণ ভেবে দেখি নি, ততক্ষণ অবধি প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়েছিল, যে-জানোয়ার শুধু রাতে হানা দিয়ে ফেরে, গাড়োয়ালের এই পার্বত্য, বন্ধুর অঞ্চলে তাকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব কাজ।

সাধারণ্যে এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, অলকানন্দা নরখাদকটির কাছে কোনো প্রতিবন্ধই নয়। যখন নদীর এক পারে শিকারের মানুষ খুঁজে পেতে ওর মুশকিল হয়, ও নদী সাঁতরে ও-পারে চলে যায়।

এ বিশ্বাস আমি বাতিল করে দিই। আমার মতে, কোনো চিতা কোনো পরিস্থিতিতেই নিজে থেকে অলকানন্দার খরস্রোত তুষার-শীতল জলে নামবে না। আমার বদ্ধমূল বিশ্বাস হয়, নরখাদকটি যখন এক-পার থেকে অপর পারে যায়, ও একটা ঝোলা-পুলের ওপর দিয়ে পেরোয়।

ও এলাকায় দুটি ঝোলা-পুল। একটি রুদ্রপ্রয়াগে, অন্যটি নদীর প্রায় বার মাইল উজানে, চাতোয়াপিপলে। এই দুটো পুলের মাঝে একটা দড়ির পুল আছে। ঝাঁপানের দিন ওটার ওপর দিয়েই ইবটসন, ওর দল, আর দুটো লোক নদী পেরিয়েছিল।

আমি এ-জাতের যত পুল দেখেছি, তার মধ্যে এই দড়ির পুলটার মত ভয়-জাগানো বস্তু কখনো দেখি নি। ইঁদুর ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী সম্ভবত ওটা পেরোতে পারে না। দুটো হাতে পাকানো ঘাসের দড়ি, পুরনো হয়ে কাল হয়ে গেছে-নদী থেকে যে কুয়াশা ওঠে, তার দরুন দড়ি দুটো পিছল। প্রায় দুশো ফুট ফেনিল সাদা জলের ওপর দিয়ে চলে গেছে দড়ি দুটো। একশো গজ নিচে নেমে দুটো পাথুরে দেওয়ালের ভিতর দিয়ে বজ্রগর্জনে ফুলে-ফেঁপে ছুটেছে সে জল। শোনা যায়, বুনো কুকুরের তাড়া খেয়ে একটা কাকার এই জায়গায় লাফ মেরে অলকানন্দা পেরিয়ে গিয়েছিল।

পা রেখে চলবার জন্য দড়ি দুটোর মাঝে-মাঝে প্রায় দু-ফুট অন্তর অন্তর এক ইঞ্চি বা দেড় ইঞ্চি চওড়া যেমন-তেমন কতকগুলো কাঠের টুকরো ঘাসের গোছা দিয়ে দড়ি দুটোর সঙ্গে আলগা বাঁধা আছে। মাকড়সার জালের মতো এই পলকা বস্তুটি পার হবার বিপদ আরো বেড়ে গেছে। কেননা, একটা দড়ি ঝুলে পড়েছে। ফলে যে কাঠগুলোতে পা রাখতে হবে, সেগুলো পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোণ রচনা করে বেঁকে আছে।

যে লোকটা মাশুল নেয়, সে এক পয়সা মাশুলের জন্যে আমাকে ওটায় উঠিয়ে জীবন বিপন্ন করে দিয়েছিল আমার। প্রথম যখন এই ভয়ংকর ঝুলাটি দেখি, আমি এমন বোকা, যে ওকেই জিগ্যেস করেছিলাম, ঝুলাটি কখনো পরখ, অথবা মেরামত করা হয়েছে কি না। আমার আগাগোড়া সাহেবি বেশ এক নজরে দেখে নিয়ে ও জবাব দিল, ‘ঝুলাটা কখনো পরখ, অথবা মেরামত করা হয় নি। তবে কে একজন ওটা পেরোচ্ছিল। তার ভার সইতে না পেরে ওটা ছিঁড়ে যায়। তখন সে-জায়গায় আরেকটা ঝুলা লাগানো হয়েছে। ওর জবাব শুনে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা একটা কনকনানি নেমে যায়। নিরাপদে ও-পারে পৌঁছবার পরেও অনেকক্ষণ অবধি সে অনুভূতিটা রয়ে গিয়েছিল আমার ভিতরে।

এ ঝুলা পেরনো নরখাদকটার সাধ্যের বাইরে। তা হলে বাকি রইল দুটো ঝোলা-পুল। আমি নিশ্চিত ভাবলাম, ওগুলো বন্ধ করে যদি নরখাদকটাকে রুখে দিই, তবে ওকে অলকানন্দার এক-পারে আটকে ফেলতে সমর্থ হব। ফলে ওকে খোঁজার এলাকাও আয়তনে অর্ধেক কমে যাবে।

তাই, নদীর কোন্ পাড়ে চিতাটা আছে, তা খুঁজে বের করতে চেষ্টা করাই দাঁড়াল প্রথম কর্তব্য। চাতোয়াপিপল ঝোলা-পুলের কয়েক মাইল দূরে, নদীর বাঁ-পারে, চিটির শেষ শিকার, সাধুর হত্যা ঘটেছিল। আমি নিশ্চিত জানতাম, চিতা মড়ি ছেড়ে যাবার সময়ে এই পুল দিয়েই পেরিয়েছে। কেননা, একজনকে ঘায়েল করবার আগে স্থানীয় বাসিন্দা আর তীর্থযাত্রীরা যত সাবধানতামূলক ব্যবস্থাই গ্রহণ করুক না কেন, একজন ঘায়েল হবার ঠিক পরেই সে ব্যবস্থা দ্বিগুণ জোরদার হবে। ফলে, সেই একই অঞ্চলে পর-পর শিকার যোগাড় করা চিতাটার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠবে।

মানচিত্র দেখে আপনি জিগ্যেস করবেন, তাই যদি হবে, তাহলে একটা গ্রামের নামের পাশে ছয়টা মৃত্যুর সংখ্যা দেখানো হল কেন। অনির্দিষ্টকাল ধরে কোনো প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া যায় না, আমি শুধু এই উত্তরই দিতে পারি। বাড়িগুলো ছোট। শৌচের সুবিধে ৰা ব্যবস্থা যেখানে নেই। তাই নরখাদকটা দশ, পনের বা বিশ মাইল দূরের কোনো গ্রামে হানা দিয়ে ফিরছে শুনে, প্রয়োজনীয় শারীরিক তাগিদে কোনো পুরুষ, রমণী বা শিশু মুহূর্তোকের জন্যে দরজা খুলবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। যে জন্যে চিতাটা হয়তো বহু রাত ধরে অপেক্ষা করছিল, ওই মুহূর্তেকেই সে-সুযোগ তার হাতে তুলে দেওয়া হল।

.

৮. দ্বিতীয় মড়ি

থাবার ছাপ দেখে নরখাদকটাকে চিনি, তেমন কোনো ফোটো বা অন্য কোনো উপায় ছিল না। তাই, নিজের জন্য এ তথ্যটি যতক্ষণ না যোগাড় করার সুযোগ পাচ্ছি, ততক্ষণ অবধি রুদ্রপ্রয়াগের আশপাশের সব চিতাকেই আমি আসামী বলে সন্দেহ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঠিক করলাম, যে চিতা সুযোগ দেবে, তাকেই গুলি করব।

যেদিন রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছই, সেদিনই দুটো ছাগল কিনি। পরদিন সন্ধ্যায় তীর্থ-পথের এক মাইল গিয়ে একটিকে বেঁধে এলাম। অন্যটিকে অলকানন্দার ওপারে নিয়ে একটা পথের ওপর বাঁধলাম। পথটা চলে গেছে ঘন ঝোঁপঝাড়ের জঙ্গল দিয়ে। ও-পথে আমি একটা বড় মা চিতার থাবার পুরনো ছাপ দেখেছিলাম।

পরদিন সকালে ছাগল দুটোকে দেখতে গিয়ে দেখি, নদীর ওপারের ছাগলটাকে মারা হয়েছে, সামান্য মাংসও খাওয়া হয়েছে। একটা চিতাই যে ছাগলটাকে মেরেছে, তা নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না, তবে ওটিকে খেয়েছে কোনো ছোট প্রাণী, সম্ভবত পাহাড়ে কেজি।

দিনের বেলায় নরখাদকটার কোনো খবর পেলাম না। সুতরাং মরা ছাগলটার উপর বসা সাব্যস্ত করলাম, এবং বেলা তিনটের সময় মড়ি থেকে গজ-পঞ্চাশেক দুরে একটা ছোট গাছের উপর গিয়ে বসলাম। যে তিন ঘণ্টা গাছের উপর ছিলাম সে সময় চিতাটা যে কাছাকাছি কোথাও আছে, কোনো জীবজন্তু বা পাখির ব্যবহার থেকে এমন কোনো লক্ষণই বুঝতে পরলাম না। যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে তখন গাছ থেকে নেমে ছাগলের দড়িটা কেটে নিলাম। চিতাটা আগের রাতে সেটা ছেঁড়ার কোনো চোই করে নি। তারপর বাংলোর দিকে পা চালিয়ে দিলাম।

আগেই বলেছি যে নরখাদক চিতা সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা খুবই কম, কিন্তু কয়েকটা নরখাদক বাঘ আমি দেখেছি। গাছ থেকে নামার পর থেকে বাংলোয় পৌঁছনো পর্যন্ত অতর্কিত আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্যে সবরকম ভাবে সতর্ক রইলাম। ভাগ্যিস তা করেছিলাম!

পরদিন বেশ সকালে বেরিয়ে পড়ে বাংলোর গেটের কাছেই একটি বড় মদ্দা চিতার থাবার ছাপ দেখতে পেলাম। ছাপ অনুসরণ করে গিয়ে দেখি সেগুলো এসেছে একটা ঘন জঙ্গলে ভরা খাদ থেকে।

যে-পথটার কাছে ছাগলটা পড়েছিল, খাদটা সে-পথ পার হয়ে চলে গেছে। রাতে ছাগলটাকে কেউ ছোঁয়ও নি।

যে চিতাটা আমাকে অনুসরণ করেছিল, সেটা নিশ্চয়ই নরখাদকটাই হবে। নরখাদকটা এখন নদীর এ-ধারে, আমাদের দিকে–এই কথা জানিয়ে দিয়ে হুঁশিয়ার হতে বললাম গ্রামে-গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের, পথে যার সঙ্গে দেখা হল, তাদের সকলকে। দু-পায়ে যতদূর বয়, তত মাইল হেঁটে-হেঁটে এ-কথাই বললাম বাকি দিনটা ধরে।

সেদিনটা কিছু ঘটল না, কিন্তু পরদিন সকালে গোলারাইয়ের পিছনের জঙ্গলগুলোয় অনেকক্ষণ ধরে সন্ধান চালিয়ে এসে সবে প্রাতরাশ শেষ করেছি এমন সময় একটি নোক উত্তেজিতভাবে ছুটে এসে খবর দিল যে আগের রাতে নরখাদকটি বাংলোর উপরের একটি পাহাড়ী গ্রামে এক স্ত্রীলোককে মেরেছে। যেখান থেকে একনজরে আপনি নরখাদকটার ৫০০ বর্গমাইল বিচরণভূমির সবটা দেখেছিলেন, সেই পাহাড়টায়, এবং প্রায় সেই জায়গাতেই।

কয়েক মিনিটের মধ্যে আমি প্রয়োজনীয় সব জিনিস গুছিয়ে নিলাম–একটা বাড়তি রাইফেল আর শটগান, গুলি, দড়ি আর খানিকটা মাছ-ধরা ছিপের সুতো। খাড়াই পাহাড় ভেঙে রওনা দিলাম, সঙ্গে রইল গ্রামবাসীটি, আমার নিজের লোক দু-জন। দিনটা বেজায় গুমোট, ভ্যাপসা গরম। দূরত্ব যদিও বেশি নয়, বড়জোড় তিন মাইল, তবু ঐ রোদের ভিতর ৪০০ ফুট চড়াই-ভাঙা বেশ কষ্টকর হয়েছিল। ঘামে প্রায় নেয়ে উঠে গ্রামে গিয়ে পৌঁছলাম।

মৃত স্ত্রীলোকটির স্বামীর কাছে কাহিনীটা শুনলাম। উনুনের আলোয় রাতের খাওয়া শেষ হলে স্ত্রীলোকটি এঁটো বাসনগুলো ধোয়ার জন্য দরজার কাছে নিয়ে যায়। পুরুষটি তখন তামাক খেতে বসে। দরজার কাছে গিয়ে স্ত্রীলোকটি চৌকাঠের উপর বসে এবং বসার সঙ্গে-সঙ্গেই বাসনগুলো সশব্দে মাটিতে পড়ে যায়।

কি ঘটল দেখার মত যথেষ্ট আলো ছিল না। উৎকণ্ঠায় ডাকাডাকি করেও যখন সাড়া পায় নি, তখন পুরুষটি ছুটে গিয়ে খিল তুলে দরজা এঁটে দেয়।

ও বলল, “একটা মৃতদেহ উদ্ধার করতে চেষ্টা করতে গিয়ে নিজের জীবনটা বিপন্ন করে লাভ কি হত?” যুক্তিটা হৃদয়হীন, তবে অকাট্য। আমি বুঝলাম ও যে শোকপ্রকাশ করছে, তা ওর স্ত্রীর মৃত্যুর জন্যে ততটা নয়। কয়েকদিনের মধ্যে যে ছেলে, উত্তরাধিকারী জন্মাবে বলে ও আশায় ছিল, তার মৃত্যুতেই ওর বেশি শোক।

যে দরজা থেকে স্ত্রীলোকটিকে ধরে নিয়ে গেছে সেটা একটা চার ফুট চওড়া গলির উপর; পঞ্চাশ ফুট লম্বা এই গলিটার দু-ধারে দু-সারি বাড়ি। বাসনগুলো ছড়িয়ে পড়ার শব্দ আর তারপরেই লোকটির উৎকণ্ঠিত ডাক শুনে গলির সমস্ত দরজা এনিমেষে বন্ধ হয়ে গেল। মাটির উপর দাগ দেখে বোঝা গেল যে চিতাটা হতভাগ্য স্ত্রীলোকটিকে সারাটা গলি টেনে নিয়ে গিয়েছে, তারপর তাকে মেরে পাহাড়ের নিচের দিকে খানিকটা দূরে কয়েকটা ধাপ-জমির সংলগ্ন একটা ছোট খাদের ভিতর বয়ে নিয়ে গিয়েছে। এখানে বসেই সে খেয়েছে এবং এখানেই ফেলে রেখে গিয়েছে শোচনীয় ভুক্তাবশিষ্ট।

একটা সরু ধাপ-জমির এক সীমান্তে খাদের মধ্যে দেহটা পড়ে ছিল। অন্য মাথায়, চল্লিশ গজ দূরে একটা পাতাবিহীন বেঁটে আখরোট গাছ। তার উপর একটা খড়ের মাচা। খড়ের এই মাচাটা হল মাটি থেকে চার ফুট উপরে, ছ-ফুট উঁচু। এই খুড়ের মাচার উপরই বসব স্থির করলাম।

দেহটার কাছ থেকে শুরু হয়ে একটা সরু পথ নালার মধ্যে নেমে গিয়েছে। এই পথের উপর, যে চিতাটা মেয়েটিকে মেরেছে, তার থাবার ছাপ দেখতে পেলাম। দু-রাত আগে ছাগলের মড়ির কাছ থেকে রুদ্রপ্রয়াগের বাংলো পর্যন্ত যে ছাপগুলো আমাকে অনুসরণ করেছিল অবিকল সেইরকম। থাবার ছাপগুলো বিগত যৌবন অতিকায় এক মদ্দা চিতার, সামান্য একটু খুঁত-যুক্ত,–কেননা আর পিছনের বাঁ থাবার কোনায় চার বছর আগে একটা গুলি লেগে থাবাটা কুঁচকে দেয়।

গ্রাম থেকে দুটো শক্ত আট-ফুট লম্বা বাঁশ যোগাড় করলাম। নিচের খেত, আর যে খেতে মড়িটা পড়ে আছে, দুটো খেতের মাঝে একটা খাড়া বাঁধ। সেই বাঁধের কাছের মাটিতে শক্ত করে গেড়ে দিলাম বাঁশ দুটো। বাঁশ দুটোতে আমার বাড়তি রাইফেল ও শটগান শক্ত করে তুলাম। রেশমী মাছ-ধরা সুতো বন্দুকগুলোর ঘোড়ার সঙ্গে বাঁধলাম। সুহোর ফাঁস ট্রিগার-গার্ডের উপরে গলিয়ে পেছনে টেনে নিয়ে পথের দূরে একটু উপরে পাহাড়ের গায়ে পোঁতা দুটো কাঠের গোঁজের সঙ্গে বেঁধে দিলাম।

গত রাতে যে-পথে এসেছে, সে-পথে চিতাটা এলে, সুতোয় টান লাগলে ও আপনা থেকেই গুলি খাবে, সে-সম্ভাবনা ভালমতই রইল। অপরপক্ষে, চিত্রটা যদি সুতোগুলো এড়াতে পারে, অথবা অন্য কোনো পথে আসে-ও যখন মড়ি খাচ্ছে, তখন যদি আমি ওকে গুলি করি–তবে যে-পথে পিছু হটে পালানো সবচেয়ে স্বাভাবিক, সে-পথে পালালেও ও সুতোর ফাঁদে গিয়ে পড়বে এ প্রায় নিশ্চিত। ফঁদটা ওর পালাবার পথের উপর।

 চিতাটার গায়ের রং এমন যে, তাই ওকে আত্মগোপনে সহায়তা করে। মড়ির গা থেকেও সব জামাকাপড় খুলে ফেলা হয়েছে। অন্ধকারে দুজনকেই দেখা যাবে না। তাই, কোন্ দিকে গুলি করব, তার আন্দাজ পাবার জন্য আমি খাদ থেকে এক চাঙড় সাদা পাথর আনলাম। মড়িটার কাছাকাছি ফুট-খানেক দূরে, খেতের কিনারায় সেটা রাখলাম।

নিচের বন্দোবস্ত আমার মনোমত করেই সারা হল। এবার খড়ের মাচার উপর আরামে বসার বন্দোবস্ত করলাম। খানিক খড় টেনে ফেলে দিলাম। খানিক পেছনে, খানিক সামনে আমার কোমর ঢেকে পাঁজা করলাম। মড়ি আমার সামনে। গাছে পিঠ ঠেস দিয়ে বসেছি। যে-সময়েই আসুক না কেন, চিতাটা আমায় দেখতে পাবে, সে সম্ভাবনা অত্যত কম। এক মড়ির কাছে কখনো ফিরে আসে না বলে ওর খ্যাতি আছে বটে, তবু রাতে ও যে আসবেই, তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

খাড়া-চড়াই ভাঙার ফলে আমার জামাকাপড় তখনো ঘামে ভেজা। তবু একটা মোটামুটি শুকনো জ্যাকেট হিমেল হাওয়া আটকাল। আমি আমার নরম, আরামপ্রদ আসনে বসলাম, রাতভোর প্রহরার জন্যে প্রস্তুত করলাম নিজেকে। আমার লোকদের ফেরত পাঠলাম। বলে দিলাম, যতক্ষণ আমি ওদের খোঁজে না-আসি, অথবা পরদিন সালে সূর্য ভাল মত না-ওঠে, ওরা যেন গ্রাম-প্রধানের বাড়িতেই থাকে। (আমি সোজা বাঁধ থেকে মাচানে উঠেছি। নরখাদকটাও তাই করলে, তাকে আটকানো যাবে না)।

সূর্য অস্ত যায়-যায়। অস্ত্যমান সূর্যের সিধে রশ্মিতে পশ্চাৎপটে তুষার-মৌলী হিমালয়কে নীলচে গেলাপী দেখাচ্ছে। সে দৃশ্য, গঙ্গা-উপত্যকার দৃশ্য চোখ ভরে দেখার মত। আমি টের পাবার প্রায় আগেই আকাশ থেকে দিবালোক মিলিয়ে গেল। নেমে এল রাত।

‘অন্ধকার’ শব্দটা যখন রাত্রি সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়, তখন সেটা একটা আপেক্ষিক শব্দ। তার কোনো নির্দিষ্ট মান নেই। একজনের কাছে যা সূচিভেদ্য অন্ধকার, আরেকজনের কাছে তা শুধু অন্ধকার এবং তৃতীয়জনের কাছে তা মোটামুটি অন্ধকার। আমার জীবনের বহু দিন আমি ভোলা জায়গায় কাটিয়েছি। তাই, যদি না আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা থাকে, রাত্রি আমার কাছে কখনই তেমন অন্ধকার নয়।

আমি এ কথা বলতে চাই না যে আমি রাতেও দিনের মতই দেখি। কিন্তু আমি যে-কোনো জঙ্গলে বা যে-কোনো জায়গায় পথ দেখে যথেষ্ট চলতে পারি। মড়ির কাছে সাদা পাথরটা রেখেছিলাম শুধু সতর্কতা হিসেবে। আশা করেছিলাম যে তারার আলো তুষারমণ্ডিত পর্বতশ্রেণীর ওপর প্রতিফলিত হয়ে গুলি করার মত যথেষ্ট আলো যোগাবে।

কিন্তু আমার ভাগ্য বিরূপ। কারণ রাত হতে না হতেই দেখা গেল একটা বিদ্যুতের চমক, তারপর দুরে বজ্রনির্ঘোষ, এবং কয়েক মিনির্টের মধ্যেই আকাশ ঘন মেঘে ছেয়ে গেল। বড়-বড় বৃষ্টির ফোঁটা সবে দু-চারটে পড়েছে, এই সময় নালার মধ্যে একটা পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ পেলাম। কয়েক মিনিট পরে আমার নিচে মাটিতে ছড়ানো– বিচালির ওপর খসখসানি শোনা গেল।

চিতাটা এসেছে। যতখন আমি মুষলধারে বৃষ্টিতে বসে রইলাম, তুষারশীতল বাতাস শোঁ-শোঁ করে আমার ভিজে পোশাক ভেদ করে বইতে লাগল, সে ততক্ষণে আরামে নিচে শুকনো জায়গায় শুয়ে থাকল। আমার অভিজ্ঞতার মধ্যে যৎপরোনাস্তি খারাপ এই ঝড়টা। ঝড় যখন তুঙ্গে, তখন দেখতে পেলাম গ্রামের দিক থেকে একটা লণ্ঠন নিয়ে কে যেন যাচ্ছে।

যে লণ্ঠন নিয়ে যাচ্ছে, তার সাহস দেখে আমি তাজ্জব। কয়েক ঘন্টা বাদে তবে আমি জানতে পারি, যে-লোকটি অমন সাহসে ঝড় ও চিতাকে পরোয়া না করে যাচ্ছিল, সে সেদিন বাধ্য হয়ে ত্রিশ মাইল হেঁটে পাউরি থেকে এল। রাতে গুলি করার জন্য, সরকার আমাকে যে ইলেকট্রিক টর্চ দেবেন বলে কথা দেন, সেটি আনল ও।

মাত্র তিন ঘন্টা আগে এ টর্চটা এসে পৌঁছত যদি…তবে বৃথা এ অনুশোচনা। চিতাটা যদি ওদের গলায় দাঁত না-বসাত, তাহলেই পরে যে চোদ্দজন লোক মারা পড়ে, তার আরো কিছুকাল বাঁচত, এ কথা কে বলতে পারে? তা ছাড়া, সময়ে টর্চটা এসে যদি পৌঁছতও, সে-রাতে আমি চিটাকে মারতামই, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

আমার হাড় অবধি কাঁপিয়ে দিয়ে বৃষ্টি হঠাৎ থামল। মেঘ কাটছে, এমন সময়ে হঠাৎ সাদা পাথরটা ঢাকা পড়ল। একটু বাদেই শুনলাম চিতাটা খাচ্ছে। গত রাতে খাদে শুয়ে খাদের দিক থেকে মড়ি খেয়েছে। আজ রাতেও ও তাই করবে আশা করে আমি মড়ির কাছে সাদা পাথরটা রেখেছিলাম।

বোঝাই যাচ্ছে বৃষ্টির ফলে খাদের ভিতর ছোট-ছোট ডোবায় জল জমেছে। সেগুলো এড়াতে চিতাটা নতুন একটা জায়গা বেছে নিয়ে কমছে। ফলে আমার নিশানাটা আড়াল করে দিয়েছে। এ এমন ঘটনা, যে আগে আমি ভেবে দেখি নি এমন হতে পারে। যাই হ’ক, চিতাদের স্বভাব-অভ্যাস জানি বলে জানতাম, পাথরটা আবার দেখা যাবে। বেশি সবুর করতে হবে না আমায়।

দশ মিনিট পরে পাথরটাকে দেখা গেল, এবং সঙ্গে সঙ্গেই আমার নিচে একটা শব্দ শুনতে পেলাম ও একটা হালকা হলদে জিনিসের মত চিটাকে গাদায় নিচে মিলিয়ে যেতে দেখলাম। তার হালকা রঙের কারণ তার বেশি বয়স, কিন্তু চলার সময়ে সে যে শব্দ করেছিল, তার কারণ আমি তখনো বুঝি নি, এখনো বুঝে উঠতে পারি নি। সেটা ছিল মেয়েদের রেশমী পোশাকের শব্দের মত। খেতে ‘না’ (শস্য কেটে নেবার পর যে গোড়া থাকে) ছিল বললে হবে না, নাড়া ছিল না। আশপাশে যে-খড় পড়ে ছিল, তাও সে শব্দের কারণ নয়।

প্রয়োজনীয় সময়কাল সবুর করে রাইফেল তুলে পাথরটা নিশানা করলাম। যেই ওটা আবার ঢাকা পড়বে, সেই মুহূর্তে গুলি ছুঁড়ব, এই মনের ইচ্ছে। কিন্তু ভারি রাইফেল কাঁধে তুলে ধরে রাখার সময়ের একটা সীমা আছে তো! সে সীমায় পৌঁছে যেতে ব্যথায় টনটনে মাংসপেশীগুলোকে একটু আরাম দিতে আমি রাইফেলটা নামাম।

নামাতে-না নামাতেই পাথরটা দ্বিতীয় বার আড়ালে ঢাকা পড়ল। পরের দু-ঘন্টায় তিন-তিন বার এই একই কাণ্ড ঘটল। তারপর চিতাটা যখন চতুর্থবার মাচার দিকে আসছে বলে শুনলাম, মরিয়া হয়ে ঝুঁকে পড়ে আমার তলের ওই অস্পষ্ট জিনিসটার দিকে গুলি ছুঁড়লাম।

সরু ধাপ-জমিটা, যেটাকে আমি প্রচলিত ‘খেত’ নাম দিয়েছি, সেটা এখানে মাত্রই দু-ফুট চওড়া। পরদিন সকালে যখন জমি নিরীক্ষণ করে দেখছি, তখন দেখি ওই দু-ফুট পরিসরের ঠিক মধ্যিখানে আমার গুলির ফুলে। চিতাটার ঘাড়ের কয়েকটা লোম, ফুটোর চারপাশে ছড়িয়ে আছে।

সে-রাতে চিতাটার আর দেখা পাই নি। ভোরে সূর্য উঠতে আমার লোকদের ডেকে নিয়ে খাড়াই-পাহাড়ের উত্রাই পথে রুদ্রপ্রয়াগ রওনা হলাম। ওদিকে মেয়েটির দেহের যেটুকু পড়েছিল, সৎকারের জন্যে তাই বয়ে নিয়ে গেল ওর স্বামী, স্বামীর বন্ধু-বান্ধব।

.

৯. আয়োজন

রাতের ব্যর্থতার পর ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে যখন রুদ্রপ্রয়াগের দিকে ফিরে যাচ্ছিলাম তখন আমার মন তিক্ততায় ভরে গেছে, কারণ যেদিক থেকেই দেখা হক, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে গাড়োয়ালের সঙ্গে এবং আমার সঙ্গে অদৃষ্ট একটা বিশ্রী চাল চেলেছে যা আমাদের প্রাপ্য নয়। •

আমার যোগ্যতা যাই হক না কেন, আমাদের পাহাড়ের মানুষগুলোর নরখাদকের ব্যাপারে আমাকে অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন বলে মনে করে। আমি আসার আগেই খবর পৌঁছে গিয়েছিল মে মাড়োয়ালকে নরখাদক-মুক্ত করতে আমি রওনা হয়ে পড়েছি। রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছতে তখনও অনেক দিনের পথ বাকি, এর মধ্যেই রাস্তায় যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে অথবা মাঠ থেকে বা গ্রাম থেকে যারা আমায় পথ চলতে দেখেছে তারা আমার অভীষ্ট সিদ্ধিতে অটল বিশ্বাস রেখে যেভাগে আমায় অভিনন্দন জানিয়েছে তা যেমন মর্মস্পর্শী তেমনি বিব্রতকর। যতই রুদ্রপ্রয়াগের কাছে আসছিলাম ততই এগুলোর মাত্রা বাড়ছিল। রুদ্রপ্রয়াগে আমি ঢোকার সময় কেউ যদি সেখানে থাকত তবে তার পক্ষে বিশ্বাস করাই কঠিন হত যে জনতা যাকে ঘিরে ধরেছে সে কোনো যুদ্ধফেরত বীরপুরুষ নয়, সে নিজের ক্ষমতার সীমা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন একটি মানুষ। অত্যন্ত ভীত হয়ে সে ভাবছে, যে-কাজ সে হাতে নিয়েছে তা সম্পন্ন করা হয়তো তার সাধ্যের অতীত।

যেখানে হয়তো প্রায় পঞ্চাশটা চিতা আছে, সেখানে বিশেষ একটি চিতাকে খুঁজে বের করে মারার পক্ষে পাঁচশো বর্গমাইল জায়গা একটা বিরাট এলাকা। বিশেষত যার সবটাই ঘন ঝোপ-জঙ্গলে ভরা, এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়ী এলাকা। যতই এই বিরাট সুন্দর এলাকাটা দেখছিলাম ততই, যে-কাজ হাতে নিয়েছি সে-কথা ভেবে জায়গাটা অপছন্দ করছিলাম।

এখানকার জনসাধারণের মনে স্বভাবতই তেমন কোনো সংশয় ছিল না। তাদের কাছে আমি অনন্যসাধারণ, কেননা আমি অন্যান্য এলাকা নরখাদকের হাত থেকে বাঁচিয়েছি। এখন তাদের মধ্যে এসেছি তাদের দীর্ঘ আট বছরের উৎপাতটাকে উৎখাত করতে। তারপর, অবিশ্বাস্যরকম বরাতজোরে আমি আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যাকে মারতে এসেছি সেই জন্তুটা আমার একটা ছাগল মেরেছে, উপরন্তু অন্ধকারের পর খানিকটা সময় বাইরে থেকেই আমি জন্তুটাকে আবার অনুসরণ করে অলকানন্দার যে পারে আসতে বাধ্য করেছি সেখানে তাকে মারা অপর পারের চেয়ে কম কঠিন। এই প্রাথমিক সাফল্যের পর হতভাগ্য স্ত্রীলোকটি নিহত হয়েছে। যাতে আরো মানুষের প্রাণনাশ না হয় সে চেষ্টা করেছিলাম। তাতে ব্যর্থ হয়েছি। আমার ব্যর্থতাই আমায় চিতাটাকে গুলি করার সুযোগ করে দিয়েছে। অন্যথায় সে সুযোগ আমি কয়েক মাসের মধ্যেও হয়তো পেতাম না।

আগের দিন আমার পথপ্রদর্শকের পিছনে চড়াই ভেঙে পাহাড়ে ওঠার সময় হিসেব করে দেখেছিলাম, চিতাটাকে মারার সম্ভাবনা দুই বনাম এক। যদিও ইদানীং চিতাটা এক মড়ির কাছে কখনো ফিরে আসে না বলে নাম কিনেছে। রাতটা ছিল অন্ধকার, এবং আমার কাছে রাতে শিকারের উপযুক্ত কোনো সরঞ্জাম ছিল না। যেদিন আমি মাইকেল কীনের সঙ্গে দেখা করে জানিয়েছিলাম যে আমি গাড়োয়ালে যাব, তিনি জিগ্যেস করেছিলেন, প্রয়োজনীয় সবকিছু আছে কি না। যখন বললাম আমার শুধু একটা রাতে শিকার করার টর্চলাইট দরকার এবং সেজন্যে কলকাতায় তার করব, তখন তিনি বললেন যে আমার জন্যে সরকার এইটুকু করতে পারবেন এবং সবচেয়ে ভাল টর্চ যা পাওয়া যায় তা রুদ্রপ্রয়াগে গিয়ে আমি দেখতে পাব।

টর্চটা এসে পৌঁছয় নি দেখে আমি অত্যন্ত নিরাশ হওয়া সত্ত্বেও খানিকটা আশা ছিল এইজন্যে যে, অন্ধকারেও আমার মোটামুটি নজর চলত, এবং সেজন্যই চিতাটাকে মারার সম্ভাবনা দুই বনাম এক বলে ধরেছিলাম। সে রাতের অভিযানের উপর এত নির্ভর করছিল, যে আমি বাড়তি একটা রাইফেল আর বন্দুক সঙ্গে নিয়েছিলাম। এবং খড়ের গাদার উপরে আমার লুকনো জায়গাটা থেকে সামনের দিকে তাকিয়ে যখন দেখলাম যে খুব অল্প দূরের পাল্লা থেকে আমি গুলি করতে পারব এবং লক্ষ ব্যর্থ হলে অথবা প্রাণীটা শুধু আহত হলেও নিখুঁতভাবে লুকনো বন্দুক আর রাইফেলের ফাঁদের মধ্যে তাকে এসে পড়তেই হবে–আমার আশা বেড়ে গেল এবং সাফল্যের সম্ভাবনাটা ধরে নিলাম দশ বনাম এক।

তারপর এল ঝড়, দৃষ্টির পরিধি সংকুচিত হয়ে শূন্যে এসে ঠেকল, এবং টর্চের অভাবে আমি ব্যর্থ হলাম! বুঝলাম আমার ব্যর্থতার খবর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সারা উপদ্রুত এলাকাটায় ছড়িয়ে পড়বে।

মনের তিক্ততা কমাবার আশ্চর্য সান্ত্বনাদায়ী ক্ষমতা আছে ব্যায়াম, গরম জল আর খাবারের। খাড়া উত্রাই বেয়ে নেমে পথ ধরে এসে গরম জলে স্নান করে প্রাতরাশ খাওয়ার পর অদৃষ্টকে ধিক্কার দেওয়া বন্ধ করলাম। রাতের ব্যর্থতাটাকে আরো যুক্তি দিয়ে বুঝতে পারলাম। মাটিতে একটি গুলি লেগেছে বলে আফসোস করাটা বালির ওপর দুধ পড়েছে বলে আফসোস করার মতই নিরর্থক। চিতাটা যদি অলকানন্দা পার হয়ে গিয়ে না থাকে তবে আমার তাকে মারার সম্ভাবনা বেড়েছে। কারণ এখন আমার কাছে আছে টর্চলাইটটা, যেটা আমাকে এনে দেবার জন্যে রানারটি এই ঝড়-জল, আর চিন্তা দুই বিপদই তুচ্ছ করেছিল।

এখন প্রথম কর্তব্য হচ্ছে চিতাটা অলকানন্দা পার হয়ে গিয়েছে কি না সেটা বের করা, আর যেহেতু আমার দৃঢ় বিশ্বাষ, একমাত্র কোনো একটি ঝোলাপুল দিয়েই তাকে যেতে হবে, আমি প্রাতরাশের পরই সেই খবরটা আনতে বেরোলাম।

চাতোয়াপিপল পুল দিয়ে চিতাটার নদী পার হওয়ার সম্ভাবনাটা বাতিল করে দিলাম, কারণ আমার ভারি রাইফেলটার গুলি তার মাথা থেকে ক-ফুট দূরে লাগাতে সে যত কমই ঘাবক না কেন, এটা সম্ভব নয় যে গুলি খাওয়ার পর দিনের আলো ফুটতে যতটা সময় বাকি ছিল তারই মধ্যে সে মড়ি ছেড়ে চোদ্দ মাইল পথ অতিক্রম করে ঐ পুলটা পর্যন্ত পৌঁছবে। সুতরাং আমি শুধু রুদ্রপ্রয়াগের ঝোলা পুলেই আমার অনুসন্ধান সীমিত রাখা স্থির করলাম।

পুলে পৌঁছনোর তিনটে পথ : একটা উত্তর থেকে, একটা দক্ষিণ থেকে, আর একটা বহুব্যবহৃত পায়ে-চলা পথ থেকে, যেটা এসেছে রুদ্রপ্রয়াগ বাজার থেকে। এই পথগুলো ভাল করে পরীক্ষা করার পর পুলটা পার হয়ে কেদারনাথের পথে আধ মাইল পর্যন্ত পরীক্ষা করে দেখলাম। তারপর দেখলাম সেই পায়ে-চলা পথটা, যার ওপর তিন রাত আগে আমার ছাগলটা মারা পড়েছিল।

চিতাটা নদী পার হয় নি এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে আমি পুলদুটো বন্ধ করে দিয়ে সেটাকে নদীর এই পারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার পরিকল্পনাট কাজে লাগাতে মনস্থ করলাম। পুলের চৌকিদারদের সহযোগিতা পেলে পরিকল্পনাটা সহজ। ওরা দুজন নদীর বাঁ-পারে, পুলের থামের কাছেই থাকে। তাদের সহযোগি পেলে সাফল্য সুনিশ্চিত।

নদীর দুই পারের ত্রিশ মাইলের মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র উপায়কে বন্ধ করে রাখাটা একটু বাড়াবাড়ি বলেই মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে তা নয়। কারণ সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত, চিতাটার জারী-করা সান্ধ্য আইনের ভয়ে পুলদুটো ব্যবহার করার কারো সাহস ছিল না।

পুলের দু-মুখে টাওয়ার দুটোর ওপর ইস্পাতের দড়ির ভার, ইস্পাতের দড়ি থেকে আবার কাঠের তক্তায় তৈরি পায়ে হাঁটা পাটাতনের সার ঝুলছে। সেই টাওয়ার দুটোর নিচের চার ফুট চওড়া খিলানের মুখ কাঁটাঝোপ ফুঁসে বন্ধ করে দেওয়া হল। যত কাল পুলের মুখ ওইভাবে বন্ধ থাকে, অথবা আমি পাহারা দিই, কোনো মানুষই ও-পথে পেরোবার দাবি জানায় নি।

রুদ্রপ্রয়াগের বাঁ-তীরে পুলের টাওয়ারের উপরে সসুদ্ধ আমি প্রায় কুড়ি রাত কাটিয়েছি। সে রাতগুলো ভোলার নয়।

ঠেলে বেরিয়ে আসা একটা পাহাড়ের উপর টাওয়ারটা তৈরি হয়। ওটা কুড়ি ফুট উঁচু, ওপরের ছাতটা প্রায় চার ফুট চওড়া, আট ফুট লম্বা। ওখানে ওঠার উপায় দুটো। টাওয়ারের ওপরের দিকে ফুটো দিয়ে ইস্পাতের দড়িগুলো ঢুকেছে, পিছনে বেরোবার পর, টাওয়ার থেকে প্রায় পঞ্চাশ ফুট দূরে পাহাড়ের গায়ে দড়িগুলো নোঙর-বাঁধা। এক উপায় হল, সেই দড়ি বেয়ে ওঠা। আরেকটি হল অত্যন্ত নড়বড়ে একটা বাঁশের মই বেয়ে ওঠা। আমি দ্বিতীয়টাই বেছে নিই। কেননা ইস্পাতের পাকানো তারের দড়ির ওপর একটা কাল, দুর্গন্ধ জিনিসের স্তর জমেছে। জিনিসটা হাতে লেগে থাকে, জামাকাপড়ে সে দাগ ধরায় তা আর ওঠে না।

মইটা হল, দুটো অসমান মাপের বাঁশের মাঝে দড়ি দিয়ে বাঁধা পাতলা-পাতলা কাঠে তৈরি। ওটা টাওয়ারের ছাতের চারফুট নিচে অবধি পৌঁছায়। মইয়ের শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে মসৃণ ছাতটা ধরার জন্যে আমার হাতের চেটোর ওপর নির্ভর করতে হয়। ও-ভাবে ওপরে ওঠা শারীরিক কৌশলের মহাকীর্তি বিশেষ। যত বেশিবার চেষ্টা করা। গেছে, ততই জিনিসটা কম পছন্দ হয়েছে।

হিমালয়ের এ-অঞ্চলে সব নদীই উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়। যে অধিত্যকার ভিতর দিয়ে বয়, সেখানে একরকম বাতাস বয়। সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সঙ্গে সে বাতাসের গতি বদলায়। স্থানীয় ভাষায় ও-বাতাসের নাম ‘দাদু। বাতাসটা দিনের বেলা দক্ষিণ থেকে বয়। রাতে বয় উত্তর থেকে।

যে-সময়ে আমি ছাতে উঠতাম, তখন সাধারণত বাতাস মন্দা থাকত। কিন্তু একটু পরেই, স্বয়ং পবনদেবের মত তার জোর বাড়ত, বাতাস বইত, মাঝরাত নাগাদ রীতিমত ঝড় বইত। হাত দিয়ে ধরার মত ছাতে কিছু ছিল না। বাতাসের চাপ ঠেকাতে শরীরের চাপ বাড়াতে আমি উপুড় হয়ে পড়ে থাকতাম পেট চেপে। তবু বাতাসে উড়িয়ে আমাকে ষাট ফুট নিচের পাথরে ফেলে দেবে, এ ঝুঁকি থেকে যেত। সেখান থেকে ছিটকে গিয়ে তুষার-শীতল অলকানন্দায় পড়ার কথা। অবশ্য ধারালো, খোঁচা-খোঁচা পাথরের ওপর ষাট ফুট উঁচু থেকে আছড়ে পড়ার পর জলের তাপমাত্রা নিয়ে চিন্তা করার কোনো মানে থাকার কথা নয়। আশ্চর্য, যখনই পড়ে যাব বলে ভয় হত, সব সময়ে জলের কথাই মনে হত, পাথরগুলোর কথা মনে হত না।

বাতাসের দরুন অস্বস্তির ওপর, অসংখ্য ছোট পিঁপড়ে আমায় যন্ত্রণা দিত। ওরা আমার জামাকাপড়ে ঢুকে পড়ে চামড়ার টুকরো খেয়ে নিত। যে কুড়ি রাত আমি পুল পাহারা দিই, কাটাবোপ পুলের মুখে ছিল না। সেই দীর্ঘ সময়-কালের মধ্যে একটি মাত্র জ্যান্ত জানোয়ার পুলটা পেরোয়। একটা শেয়াল।