০. যুদ্ধজয়ের ধারাবাহিকতা

টেম্পল – মূল : ম্যাথিউ রীলি / অনুবাদ : হাসান খুরশীদ রুমী

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

এবার বিশেষ করে অনেককেই কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে।

নাটালি ফ্রিয়ার : আমার পাতাগুলো সবার আগে পড়ে আর চল্লিশ পাতার স্তূপ করে। তাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ তার অসাধারণ ধৈর্য, সহৃদয় এবং সমর্থনের জন্য। আমার ভাই স্টিফেন রীলিকে ম্যানুস্ক্রিপ্ট নিয়ে তার তীক্ষ্ণ মন্তব্যের জন্য। (কখনো কি বলেছি, আমার পড়া সবচে সেরা স্ক্রিনপ্লেটা তার লেখা?)

বাবা মায়ের প্রতি, তাদের ভালোবাসা, সমর্থন আর উৎসাহের জন্য। তৃতীয়বারের মতো গিনিপিগ হয়েছিল জন টেন। ধন্যবাদ তাকেও। (এখনো মনে আছে, সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে বসে ক্রিকেট দেখতে দেখতে ও আমার আইস স্টেশন পড়ছিল।) নিক কোজলিনা আর সিমন এই বইয়ের হিরোর চরিত্র চিনতে সহায়তা করেছে।

শেষে প্যান ম্যাকমিলানের সবার কাছে কৃতজ্ঞ আমি। আমার প্রকাশক কেট পিটারসনের জন্য ধন্যবাদ, সবকিছু তিনিই গুছিয়ে এনেছেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার এই দেশে এই থ্রিলার ফিকশনটি ছাপা হল। এডিটর অ্যানা ম্যাকফারলেন আমার ভেতর থেকে সেরাটুকু বের করে এনেছেন। প্যানের প্রত্যেক সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভকেও। সর্বক্ষণ কাজে মত্ত তারা ফন্টলাইনে। প্রতিদিন তারা বেরিয়ে পড়ে এবং সর্বক্ষণ কাজ করে দেশের সামনের সারি বই-এর দোকানগুলোতে এবং সবশেষে প্যানে আমার পাবলিশিস্ট জেন নোভাক। মায়ের মতো স্নেহ করেছেন এবং কঠিন হতে দেখেছি যখন আমি এবং রিচার্ড স্টার ন্যাশনাল রেডিওতে তাকে নিয়ে কথা বলেছি।

আর এখন। পথে নেমেছি আমরা…

.

সূচনা

হতে: হলস্টেন মার্ক জে.
সিভিলাইজেশন লস্ট দ্য কনকোয়েস্ট অফ ইনকাস
(অ্যাডভান্টেজ প্রেস, নিউইয়র্ক, ১৯৯৬)

অধ্যায় ১: যুদ্ধজয়ের ধারাবাহিকতা

মানবজাতির ইতিহাসে ইনকাদের উপর স্প্যানিশদের হামলে পড়া একক সভ্যতার যুদ্ধে সবচেয়ে বড়।

 সমুদ্রে সবচেয়ে দুর্জয় এক বাহিনী নিয়ে, ইউরোপের ধাতব অগ্রগতির সবটুকু নিয়ে আমেরিকার বুকে সবচেয়ে বড় একক সাম্রাজ্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কাহিনি এটি।

ফ্রান্সিসকো পিজারো আর তার স্বর্ণখেকো সেনাদলকে ধন্যবাদ, তাদের কল্যাণে। আমরাই আমেরিকার সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের ব্যাপারে প্রায় কিছুই জানতাম না।

লিখিত ইতিহাসে ১৫৩২ সালে পিজারোর সেনাদল যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে সেটা সবচে বড়গুলোর মধ্যেই পড়ে। গানপাউডার আর কলোনিয়াল উইপন নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে একের পর এক ইনকা নগরে।

ইনকা নারীরা, নিজ ঘরে ধর্ষণ হওয়ার পর বেশ্যালয়ে পাঠান হয়েছে বল প্রয়োগ করে। পুরুষদের নিয়মিতভাবে টর্চার করা হয়েছে, চোখ কয়লা দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, তারপর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একে একে কেটে ফেলা হয়েছে। টিকে যাওয়া শত শত শিশুদের গ্যালিয়নে বোঝাই করে চালান করে দেয়া হয়েছে ইউরোপে, দাস হিসাবে।

শহরগুলোতে, পড়ে ছিল মন্দিরের দেয়ালগুলো, সোনার পাত, আইডল গলিয়ে ফেলার পর সোনার বার তৈরি করার আগে সংস্কৃতি নিয়ে কেউ দাবি করতে পারবে না।

পাকহাকামাক শহরের পথে বেরিয়ে গিয়েছিল ফ্রান্সিসকোর ভাই হার্নান্দো পিজারো। তার এই অতুলনীয় যাত্রার কথা কেউ ভুলতে পারবে না, জানার পর। যাত্রাটা হয় মাত্র একটা আইডলের পেছনে। ফ্রান্সিসকো ডি জেরেজ তার বিখ্যাত লেখা ভারডাডেরা রিলাসিয়ন ডে লা কনকোয়েস্টা ডে লা পেরু-তে ব্যাখ্যা করেছিলেন সেটা। পাকহাকামাক শহরের (লিমা থেকে বেশি দূরে নয়) টেম্পল লুট করে হার্নান্দো ধনী হয়েছিল তা এখন এক মিথ্যের গল্প।

ইনকা রাজার ছোট্ট এই পড়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ থেকে স্প্যানিয়ার্ড দালানগুলো ধ্বংস করেনি, স্বর্ণের পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন খুব সামান্যই তুলে আনতে পারছে আজকের ইতিহাসবেত্তার দল।

তৈরি হচ্ছে দোটানার রাজ্য।

ইনকাদের চাকা প্রযুক্তি ছিল না, তারপরও আমেরিকার বুকে সবচেয়ে বিখ্যাত পথগুলো তাদের তৈরি। লোহা গলাতে জানে না যারা, তারা কী করে এত সোনা আর রূপা নিয়ে কাজ করল সেটাও বিস্ময়। তারা অক্ষর চিনত না, কিন্তু সংখ্যা আর রঙ দিয়ে যেভাবে ভাব প্রকাশ করত তা ছিল পূর্ণ, কুইপাস। কুইপোকামায়করা ছিল সাম্রাজ্যের কর কর্মকর্তা। তাদের চোখ গলে একটা চন্দনের টুকরা হারাবার পথ ছিল না।

স্বভাবতই ইনকার সমস্ত রেকর্ড আসে স্প্যানিশদের কাছ থেকে। তারা চাইলে যেভাবে খুশি বিকৃত করতে পারে সেসব তথ্য। তবে, বিশ বছর আগে মেক্সিকোতে কোর্টেজ করেছিল ঠিক সেভাবেই তারা সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল ধর্মযাজকদের। ঈশ্বরের কথা প্রচারের জন্য। এসব যাজক ফিরে গেছে স্পেনে। তাই সেখানকার মনাস্টারিতে এখনো পাওয়া যাওয়ার কথা অজানা সব লেখনী। [পৃ. ১২]

হতে: ডি জেরেজ, ফ্রান্সিসকো
ভারডেরা রিলাসিয়ন ডে লা কনকোয়েস্ট ডে লা পেরু (সেভিল, ১৫৩৪)

ক্যাপ্টেন (হার্নান্দো পিজারো) গিয়েছিল বিশাল চেম্বারে অনুসারীদের নিয়ে। তার কথা, সে গভর্ণরের ফ্রান্সিসকো পিজারো পক্ষ থেকে এসেছে এসব টেম্পলের স্বর্ণ তুলে নিয়ে যেতে।

শহরের সকল প্রধান পুরুষেরা রাজি হল, আইডল তুলে দিবে, কিন্তু শুরু করে দিল গড়িমসি। নিয়ে এল অনেক পরে, সামান্য কিছু, বলল, এর বেশি নেই।

ক্যাপ্টেন বলল, তাদের আইডলটা দেখার ইচ্ছা আছে তার। গেল সে। দালানটা ছিল ভালো, সুন্দর করে রঙ করা, ইন্ডিয়ান আইডল দিয়ে সাজান ছিল: প্রবেশ মুখে পাহারা দিচ্ছে পাথরের জাগুয়ার মূর্তি, বেড়ালের মতো দেখতে প্রাণীদের আইডল দেয়াল জুড়ে খোদাই করা ছিল। ভেতরে ঢুকে ক্যাপ্টেন অন্য রকম একটা গন্ধ পেল, আরো ছিল খালি একটা বেদি। আমাদের পুরো যাত্রায় বলা হয়েছিল পাকহাকামাকের টেম্পলের ভেতরে রাখা আছে একটা আইডল। ইন্ডিয়ানরা বলে যে, ওটা তাদের ঈশ্বর যে ওদের সৃষ্টি করেছে, তাদের সম্পদ দিয়েছে, দিয়েছে শক্তি।

কিন্তু আমরা পাকহাকামাকে কোনো আইডল খুঁজে পাইনি। বিশ্রি গন্ধ আর একটা খালি মঞ্চ ছাড়া।

তারপর ক্যাপ্টেন শাস্তিস্বরূপ মেরে ফেলল নগরপতিকে। মেরে ফেলল আইডলের সমস্ত সেবক-কর্মচারিকে। অবশেষে সে শেখাল তাদের পবিত্র ক্যাথলিক শিক্ষা, শেখাল ক্রসের পবিত্র সব চিহ্ন।

হতে: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস
ডিসেম্বর, ৩১, ১৯৯৮, পৃ. ১২

দুর্লভ ম্যানুস্ক্রিপ্টের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিদগ্ধরা

তুলুস, ফ্রান্স: স্যান সেবাস্টিয়ান অ্যাবের সাধুরা তাদের গোপন লাইব্রেরি খুলে দিয়েছে তিনশ বছরের মধ্যে এই প্রথম। খুলে দিয়েছে অধার্মিক বিশেষজ্ঞদের সামনে, পাইরিনিস পর্বতমালায়।

এই অ্যাকাডেমিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন হাতে লেখা অতি প্রাচীন সব ম্যানুস্ক্রিপ্টের উপর। সেখানে সোসাইটি অফ জিসাসের প্রতিষ্ঠাতা সেইন্ট ইগনাটিয়াস লয়োলার লেখাও ছিল।

অ্যাবের গোলকধাঁধার মতো লাইব্রেরিতে প্রথমবারের মতো প্রবেশ করে বিশেষজ্ঞরা অবাক হয়ে দেখে, অনেক পাণ্ডুলিপি পাওয়া যাচ্ছে সেখানে, যেগুলোর কোনটাই পৃথিবীতে টিকে আছে এমন সম্ভাবনা ছিল না।

লেখার মধ্যে সেইন্ট অ্যালয়সিয়াস গনজাগা, সেইন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার, এমনকি সান্তিয়াগোর ম্যানুস্ক্রিপ্টের অবিকৃত অংশও ছিল সেখানে।

১৫৬৫ সালে এই ম্যানুস্ক্রিপ্টটা লিখেছিলেন স্প্যানিশ সাধু আলবার্তো লুই সান্তিয়াগো, এটায় সাড়া পড়ে যায় ব্যাপকভাবে। ধরা হত, ফরাসি বিপ্লবের সময় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল লেখাটা।

১৫৩০-এর দিকে স্প্যানিশদের পেরু অভিযানের প্রায় অবিশ্বাস্য কাহিনি বর্ণিত আছে ম্যানুস্ক্রিপ্টে। একমাত্র এখানেই উঠে এসেছে স্প্যানিশ এক ক্যাপ্টেনের কাজ, সে পেরুর বন জঙ্গল আর শহর ঘেঁটে বের করতে চেয়েছিল মাত্র একটা আইডল।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এক্সিবিশনটা ছিল, স্পর্শ-করা যাবে-না-দেখা যাবে ধরনের। শেষ স্কলারকে লাইব্রেরি থেকে বের করে আনার পর আবার বন্ধ হয়ে যায় বিশাল ওকের দরজা।

আশা করা যায়, সে দরজা খুলতে আরো শ তিনেক বছর লাগবে না।

.

.

টেম্পল

প্রস্তাবনা

স্যান সেবাস্তিয়ান অ্যাবে
ফ্রেঞ্চ পিরানিজ পার্বত্য এলাকা
শুক্রবার, ১ জানুয়ারি, ১৯৯৯, ৩:২৩ এ এম

বন্দুকের ঠাণ্ডা ব্যারেল কপালে শক্তভাবে চেপে বসায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁদছে তরুণ সন্ন্যাসী।

কাঁপছে তার কাঁধ। চোখ থেকে পানি গড়াচ্ছে।

ঈশ্বরের দোহাই, ফিলিপ্পি, বলল সে। জানা থাকলে ওদেরকে বলে দাও কোথায় আছে।

ব্রাদার ফিলিপ্পি ডি ভিলিয়ার্স অ্যাবের ডাইনিং হলের মেঝেতে দুই হাঁটু গেড়ে বসে আছে, হাত দুটো মাথার পেছনে পরস্পরের সঙ্গে শক্তভাবে আটকান। তার বাম দিকে হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে তরুণ সন্ন্যাসী ব্রাদার মরাইস ডুপন্ট, মাথার ওপর বন্দুক ঠেকে আছে, ডান দিকে রয়েছে আরো ষোলোজন জেসুইট সন্ন্যাসী, সবাই স্যান সেবাস্তিয়ান অ্যাবিতে বসবাস করে। আঠারোজন হাঁটু গেড়ে বসে আছে, এক সারিতে।

 ডি ভিলিয়ার্সের সামনে, একটু বাদিকে, যে লোকটা দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পরনে কালো কমব্যাট ফেটিগ, হাতে গ্লক-১৮ অটোমেটিক পিস্তল এবং একটা হেকলার অ্যান্ড কচ জি-১১ অ্যাসল্ট রাইফেল, অত্যন্ত অ্যাডভান্স রাইফেল এর আগে তৈরি হয়নি। এই মুহূর্তে কালো পোশাক পরিহিত মানুষটার হাতের গ্লক মরাইস ডুপন্টের মাথায় ঠেকে আছে।

আরো বারোজন একই পোশাক পরা, একই অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে চওড়া ডাইনিং হলের চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মুখে কালো স্কি মাস্ক, ফিলিপ্পি ডি ভিলিয়ার্সের কাছ থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে তারা।

ওটা কোথায় জানি জানি না, চেপে বসা দুসারি দাঁতের ফাঁক দিয়ে বলল ডি ভিলিয়ার্স।

ফিলিপ্পি…মরাইস ডুপন্ট বলল।

কোনো সতর্কতা ছাড়াই ডুপন্টের কপালে ধরা পিস্তল গর্জে উঠল, প্রায় ফাঁকা অ্যাবের নীরবতা ভঙ্গ করে কাঁপতে লাগল আওয়াজটা। তরমুজের মতো বিস্ফোরিত হল ডুপন্টের মাথা, রক্তের ছিটা লেগে ডি ভিলিয়ার্সের সারা মুখ ভিজে গেল।

অ্যাবের বাইরে এমন কেউ নেই যার কানে গুলির শব্দ যায় নি।

স্যান সেবাস্তিয়ান অ্যাবে সমুদ্রের পিঠ থেকে ৬০০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের উপরে। দাঁড়িয়ে আছে, ওটার আশপাশে তুষার মোড়া ফ্রেঞ্চ পিরানিজের চূড়া ছাড়া আর কিছু নেই। বুড়ো সন্ন্যাসীরা বলে থাকে ঈশ্বরের কাছাকাছি অবস্থান করা, স্যান সেবাস্তিয়ানের কাছেই হল পিক ডু মিডি অবজারভ্যাটরির টেলিস্কোপ প্লাটফর্ম, তাও আবার বিশ কিলোমিটার দূরে।

গ্লক হাতে লোকটা ডি ভিলিয়ার্স ডান দিকে চলে এল, হাতের অস্ত্রের নলটা তার মাথায় ঠেকাল।

 মানুস্ক্রিপ্টটা কোথায়? বন্দুক হাতের লোকটা দ্বিতীয়বারের মতো ডি ভিলিয়ার্সকে জিজ্ঞেস করল। তার কথার সুরে ব্যাভারিয়ান টান স্পষ্ট।

বললাম তো, আমি জানি না, জবাব দিল ডি ভিলিয়ার্স।

 ব্লাম।

পেছন দিকে ছিটকে পড়ল দ্বিতীয় সন্ন্যাসী, মেঝেতে আছড়ে পড়ল, গর্তটা থেকে তরল লাল রক্ত বেরিয়ে আসছে। কয়েক সেকেন্ড থরথর করে কাঁপল, কোঁচকাল, যেন পানির পাত্র থেকে ছিটকে পড়া একটা মাছের মতো।

চোখ বুজল ডি ভিলিয়ার্স, প্রার্থনা করছে সে।

 ম্যানুস্ক্রিপ্টটা কোথায়? জিজ্ঞেস করল জার্মান লোকটা।

 আমি জানি না—

ব্লাম!

আরেকজন সন্ন্যাসী পড়ল।

 কোথায় সেটা?

আমি জানি না!

 ব্লাম!

হঠাৎ ঘুরে গেল গ্লক, এবার সরাসরি ডি ভিলিয়ার্সের মুখের দিকে তাক করা।

এটা আমার শেষ প্রশ্ন, ব্রাদার ডি ভিলিয়ার্স ম্যানুস্ক্রিপ্টটা কোথায়?

ডি ভিলিয়ার্স চোখ বুজেই থাকল। স্বর্গীয় পিতা, ওকে তুমি শান্ত করে দাও—

ট্রিগারে চাপ বাড়াচ্ছে জার্মান।

দাঁড়াও! সারির অন্য মাথা থেকে কেউ একজন বলে উঠল।

জার্মান আততায়ী ঘুরে তাকিয়ে দেখল হাঁটু গেড়ে থাকা জেসাইট সন্ন্যাসীদের লাইন ভেঙে একটু সামনে এগোল বয়স্ক এক সন্ন্যাসী।

প্লিজ, প্লিজ! আর নয়, আর নয়! আমি বলছি ম্যানুস্কিপ্টটা কোথায় আছে, যদি তুমি কথা দাও আর কাউকে খুন করবে না।

কোথায় সেটা? জানতে চাইল আততায়ী।

এই দিকে, বুড়ো সন্ন্যাসী বলল, পা বাড়াল লাইব্রেরির দিকে। তার পিছু নিয়ে পাশের কামরাটায় ঢুকল আততায়ী।

কয়েক মিনিট পর দুজনেই ফিরে এল, আততায়ীর বাঁ হাতে চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা বড় আকারের একটা বই।

ডি ভিলিয়ার্স তার চেহারা দেখতে না পেলেও, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কালো কি মাস্ক পরা জার্মান আততায়ী উল্লাসে হাসছে।

 এবার, যাও, আমাদেরকে শান্তিতে থাকতে দাও, বুড়ো সন্ন্যাসী বলল। চলে যাও আর লাশগুলোকে কবর দিতে দাও।

মনে হল প্রসঙ্গটা নিয়ে চিন্তা করছে জার্মান আততায়ী। তারপর ঘুরল সে, নিজের লোকদের উদ্দেশে নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল।

ইঙ্গিতে সাড়া দিয়ে সশস্ত্র আততায়ীরা জি-১১ তুলে হাঁটু গেড়ে থাকা সন্ন্যাসীদের সারি লক্ষ্য করে গুলি চালাল।

সুপার মেশিন গানের গুলিতে অবশিষ্ট সন্ন্যাসীদের ফালি ফালি করে ফেলছে। মাথাগুলো বিস্ফোরিত হল, শরীর থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল মাংস। এমন শক্তিশালী গুলি ছোঁড়া এর আগে দেখেনি ওরা।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সন্ন্যাসীরা সবাই মারা গেল, শুধু একজন বাদে, বয়স্ক সেই সন্ন্যাসী, জার্মান আততায়ীর হাতে যে ম্যানুস্ক্রিপ্টটা তুলে দিয়েছে। কমরেডদের রক্তের উপর একা দাঁড়িয়ে আছে সে, তাকিয়ে আছে তার অত্যাচারীর দিকে।

আততায়ীর লিডার সামনে এগোল, গ্লুক তাক করল মাথা দিকে।

 কে তুমি? জিজ্ঞেস করল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।

আমরা সুৎজটাফেল ডার টকেনকপভারবান্ড, জবাব দিল আততায়ী।

সন্ন্যাসীর চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠল। হায় ঈশ্বর… নিঃশ্বাসের সঙ্গে বলল সে।

আততায়ী হাসল। এমন কী সে-ও এখন আর তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না।

 ব্লাম!

শেষবারের মতো গ্নকটা কেশে উঠল, এর পরেই অ্যাবে থেকে বেরিয়ে বাইরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল আততায়ীরা।

এক মিনিট পার হল, তারপর আরো।

 নিঃশব্দে পড়ে আছে অ্যাবে।

আঠারোজন জেসাইট ব্রাদারের লাশ হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকল, রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে।

 আততায়ীরা দেখতে পায়নি তাকে।

মাথার অনেক উপরে লুকিয়ে আছে সে, বিরাট ডাইনিং রুমের সিলিঙে। কাঠের সিলিংটা অনেক পুরানো, ডাইনিং রুমের মাঝখানে একটা কাঠের দেয়াল দিয়ে আলাদা করেছে। তক্তার জোড়গুলো ফাঁক হয়ে গেছে।

আততায়ীরা যদি ভালো করে তাকাত তাহলে দেখতে পেত ওরকম একটা ফাঁকে একটা চোখ তাদেরকে দেখছে।

একটা মানুষের চোখ তাকিয়ে আছে।

.

৩৭০১ নর্থ ফেয়ারফ্যাক্স ড্রাইভ, আর্লিংটন, ভার্জিনিয়া
 ইউএস ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ
 প্রজেক্ট এজেন্সি
সোমবার, ৪ জানুয়ারি, ১৯৯৯, ৫.৫০ এ এম।

চোরের দল ঝড়ো গতিতে এগোল। সবাই পরিষ্কার জানে কোথায় যাচ্ছে।

আঘাত হানার জন্য একটা সময় বেছে নিয়েছে তারা। ছয়টা বাজতে দশ মিনিট আগে। নাইট গার্ডদের ডিউটি শেষ হতে যখন মাত্র দশ মিনিট বাকি। এই সময় পরিশ্রান্ত থাকবে নাইট গার্ডেরা, বারবার ঘড়ির দিকে তাকাবে, বাড়ি ফেরার জন্য পাগল হয়ে যাবে। এই সময়টাতেই সবচেয়ে অরক্ষিত তারা।

৩৭০১ নর্থ ফেয়ারফ্যাক্স ড্রাইভ একটা লাল ইটের আটতলা ভবন, ভার্জিনিয়ার আলিংটনের ভার্জিনিয়া স্কোয়ারে মেট্রো স্টেশনের ঠিক উল্টোদিকে। ডিফেন্স অ্যাডভান্স রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি, ডি এ আর পি এ অর্থা ডারপা অফিস রয়েছে এই ভবনে। যুক্তরাষ্টের ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টর একটি অস্ত্র রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্ট শাখা।

ভেতরে ঢুকে সাদা আলোয় উদ্ভাসিত করিডর ধরে এগোল চোরের দল, সাইলেন্সার লাগান এমপি-ফাইভ এস ডি সাব-মেশিন গান বাগিয়ে ধরে আছে। প্রত্যেকে, সিল স্টাইলে ফোল্ডিং স্টক দৃঢ়ভাবে কাঁধে আটকান, ব্যারেল বরাবর সোজা দৃষ্টি, টার্গেট খুঁজছে।

থট-থট-থট-থট!

প্রায় নিঃশব্দে বুলেটগুলো আরো একজন নেভি গার্ড ছিন্নভিন্ন করল, এটাকে নিয়ে মোট সতেরজন। এতটুকু ইতস্তত না করে লাফ দিয়ে লাশটা টপকাল চোরের দল, ভল্ট রুমের দিকে এগুলো। তাদের একজন কার্ড-কি ঢোকাল, আরেকজন ঠেলে খুলে ফেলল ভারী হাইড্রলিক দরজা।

ভবনের চারতলায় রয়েছে তারা, এরইমধ্যে সাতটা গ্রেড-ফাইভ সিকিউরিটি চেকপয়েন্ট পার হয়ে এসেছে। চেকপয়েন্টগুলো খুলতে চারটে আলাদা কার্ড-কি আর ছয়টা আলফা নিউমেরিক কোড দরকার হয়েছে। আন্ডারগ্রাউন্ড লোডিং ডক হয়ে দালানটার ভেতরে ঢুকছে ওরা, একটা ভ্যানে করে তারা আসে, এই ভ্যানটার আসার কথা জানত গার্ডেরা। আন্ডারগ্রাউন্ড গেটে যারা গার্ডে ছিল তারাই প্রথমে খুন হয়েছে। ওদের পরপরই ভ্যান ড্রাইভারও সেই পথে গেল।

ভল্ট রুমে ঢুকল তারা প্রথম সুযোগেই। বিরাট একটা ল্যাব চেম্বার, চারদিকে ছয় ইঞ্চি পুরু পরসেলিনের দেয়াল। এই পসেলিনের চেম্বারের বাইরে রয়েছে আরো একটা দেয়াল। সেটার কিনার সীসা দিয়ে মোড়া, আর কম করে হলেও বারো ইঞ্চি পুরু। ডারপা-র কর্মচারীরা সঙ্গত কারণে এটাকে ভল্ট বলে। রেডিও ওয়েভ এই বাধা ভেদ করতে পারে না। ডিরেকশনাল লিসনিং ডিভাইস স্পর্শ করতে পারে না। গোটা দালানে এটাই হলো সবচেয়ে সিকিউর জায়গা।

দালানের সবচেয়ে সিকিউর ফেসিলিটি ছিল, এখন নেই।

 ল্যাব চেম্বারে ঢুকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল চোরের দল।

নীরবতা।

গর্ভের মতো।

তারপর, হঠাৎ স্থির হয়ে গেল তারা।

জিনিসটা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, দখল করে রেখেছে ল্যাবের মাঝখানটা।

সম্ভবত ছয় ফুট লম্বা ওটা, একটা বিশাল বালুঘড়ির মতো দেখতে দুটো শঙ্কুর মতো আকৃতি উপরেরটা নিচের দিকে তাক করা, নিচেরটা উপরদিকে দুটো অংশকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে–ছোট একটা টাইটেনিয়ামের চেম্বার, যেটাতে এই মারণাস্ত্রের আসল জিনিসটা থাকে।

টাইটেনিয়াম চেম্বারের মাঝখান থেকে বেশ কিছু রঙিন তার বেরিয়ে এসেছে, সেগুলোর কয়েকটা ঢুকেছে একটা ল্যাপটপ কম্পিউটারের কিবোর্ডে, ডিভাইসটার সামনের দিকে আটকে রাখা হয়েছে ল্যাপটপটা।

এ মুহূর্তে ছোট, টাইটেনিয়াম চেম্বার খালি।

এক মুহূর্তে।

চোরের দল সময় নষ্ট করছে না। পুরো ডিভাইসটাই পাওয়ার জেনারেটার থেকে খুলে ফেলল তারা, আটকাল হাতে তৈরি একটি স্লিং-এ।

তারপর আবার ছুটতে শুরু করল তারা। দরজা দিয়ে বেরুল। করিডর পার হল। প্রথমে বাঁয়ে তারপর ডানে বাঁয়ে তারপর ডানে। ছুটল আলোকিত সরকারি বাধার ভেতর দিয়ে, লাশগুলো টপকাল যেগুলো তারা ঢোকার সময় মেরে ফেলে গিয়ে ছিল। নব্বই সেকেন্ডের মধ্যে আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজে ফিরে এল তারা। দ্রুত সবাই উঠে পড়ল ভ্যানে, সঙ্গে সে-ই জিনিসটা সহ। শেষ জনের পা ভ্যানের ভেতর ঢুকতে না ঢুকতেই কংক্রিটের পথ ধরে স্কিড করতে করতে লোডিং ডক থেকে রওনা হয়ে গেল ভ্যান এবং গতি বাড়িয়ে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

টিম লিডার তার হাতঘড়ি দেখল।

৫.৫৯ এ এম।

গোটা অপারেশনে সময় লেগেছে মাত্র নয় মিনিট।

বেশিও না। কমও না।

.

প্রথম ষড়যন্ত্র
সোমবার, জানুয়ারি ৪, ০৯০১ ঘণ্টা

উইলিয়াম রেস কাজে যেতে দেরি করে ফেলল। আবারো।

মাত্রা অতিরিক্ত ঘুম তারপরে সাবওয়েতে দেরি আর এখন দশটা বেজে নয় এবং সকালের লেকচারে যেতে দেরি করে ফেলেছে। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির দেলাওয়ার বিল্ডিং-এর তৃতীয় তলায় রেসের অফিস। দালানটিতে একটা প্রাচীন যুগের রট আয়রনের এলিভেটর আছে যা শামুকের গতিতে চলে। সিঁড়ি বেয়ে ওঠা ওটার চেয়ে দ্রুত হয়।

একত্রিশ বছর বয়সী রেস হল এন ওয়াই ইউ-র অ্যানশিয়েন্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ডিপার্টমেন্টের একজন তরুণ সদস্য। সাধারণ উচ্চতার মানুষ সে, প্রায় পাঁচ ফুট নয়, সুদর্শন এবং অপ্রকাশ্য গুণের অধিকারী। মাথায় চুল বাদামী এবং হালকা পাতলা গড়নের। নীল চোখে ওয়ের রিম ফ্রেমের চশমা এবং চেহারায় একটা লক্ষ্যণীয় চিহ্ন আছে, তিনকোনা বাদামী জন্মদাগ, ঠিক বা চোখের নিচে।

 রেস দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠে যাচ্ছে, হাজারো চিন্তা মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে : তার সকালের লেকচারের বিষয় হল ওয়ার্কস অব দ্য রোমান হিস্টোরিয়ান লেডি, গত মাসের পার্কিং ফাইন এখনো পর্যন্ত দেওয়া হয় নি এবং নিউইয়র্ক টাইম পত্রিকায় ওইদিন সকালে একটা আর্টিক্যালে ও পড়েছিল ৮৫ ভাগ মানুষ তাদের এ টি এম কার্ডের নাম্বার হিসেবে ব্যবহার করে বিশেষ দিনের তারিখ, যেমন জন্মদিনের তারিখ। চোর যখন মানুষের ওয়ালেট পকেটমার করে তাতে শুধু এ টি এম কার্ড থাকে না, পাওয়া যায় ড্রাইভিং লাইসেন্স, তাতে আবার কার্ডের মালিকের নিজের জন্ম তারিখটাও থাকে, তাই খুব সহজেই ব্যাংক একাউন্টে ঢুকে পড়া যায়। ড্যাম ইট, রেস ডাবল, সে তার পিন নাম্বার পরিবর্তন করে ফেলবে।

একেবারে ওপরের তলায় এসে থামল এবং দ্রুত করিডরে পা দিল ও।

আর তারপর সে থেমে গেল।

 দুজন তার সামনে করিডরের মুখে দাঁড়িয়ে।

সোলজার।

দুজনেই পুরোদস্তুর ব্যাটল ড্রেস পরা–হেলমেট, বডি আর্মার, এম-১৬, অন্য সব কিছু সাথে আছে। একজন দাঁড়িয়ে আছে লম্বা করিডরের মাঝামাঝি জায়গায়, রেসের কাছাকাছি। আরেকজন দাঁড়িয়েছে আরো দূরে, সে দাঁড়িয়ে আছে অনড় অবস্থায় রেসের অফিসের বাইরে। এদেরকে তেমন বাইরে দেখা যায় না। ইউনিভার্সিটিতে সোলজার।

 এলিভেটর থেকে রেসের ঝড়ের গতিতে বেরুবার আওয়াজ পেয়েই ঝট করে ঘুরে গেছে দুজনেই। কিছু কারণে, ওদের উপস্থিতিতে, রেশ হঠাৎ করে নিজেকে নিচুতর মনে করল, কোনো ভাবে নিজেকে অযোগ্য, এবং উশৃঙ্খল মনে হল। মেসি স্পোর্টস কোট জিনস এবং টাই-এ নিজেকে বোকা বোকা মনে হল। লাঞ্চ টাইম বেসবল খেলার কাপড় নিয়ে এসেছে নাইক স্পোর্টস ব্যাগে করে।

প্রথম সৈনিকের কাছাকাছি পৌঁছে রেস তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলাল, হাতের কালো অ্যাসল্ট রাইফেলটা দেখল, খেয়াল করল ভ্যালভেটিন সবুজ বেরেট একটু বাঁকা হয়ে আছে মাথায়, দেখল কাঁধে সেলাই করা কাস্তে আকৃতির প্যাঁচে লেখা: স্পেশাল ফোর্সেস।

উহ্, হাই। আমি উইলিয়াম রেস। আমি–।

সব ঠিক আছে, প্রফেসর রেস। প্লিজ, ভেতরে যান। আপনার অপেক্ষায় আছেন সবাই।

করিডর ধরে হেঁটে যাচ্ছে, দ্বিতীয় সোলজার কাছে চলে আসছে সে। লোকটা একটু বেশি লম্বা প্রথম সোলজারের তুলনায়, আসলে সে বিশালাকৃতির ছোটখাট পাহাড় বললেই হয়। অন্তত ছয় ফুট চার, সাধারণ চেহারা, গায় চুল, সরু বাদামী চোখে বোধহয় কোনো চাতুরি এড়ায় না। বুক পকেটের প্যাঁচে লেখা: ভ্যান লিওয়েন। কাঁধের তিনটে স্ট্রাইপ বলে দিচ্ছে সে একজন সার্জেন্ট।

রেসের চোখ পড়ল লোকটার এম-১৬-এর দিকে। ব্যারেলে প্যাক ১৬-এর দিকে লেজার সাইটিং ডিভাইস ফিট করা রয়েছে, যার তলার দিকে আটকান হয়েছে এম-২০৩ গ্রেনেড লঞ্চার। কঠিন জিনিস।

দ্রুত, সসম্ভ্রমে, একপাশে সরে দাঁড়াল সোলজারটি, রেস যাতে নিজের অফিসে ঢুকতে পারে।

ড. জন বার্নস্টাইন উঁচু পিঠওয়ালা চামড়ায় মোড়া চেয়ারে বসে ছিলেন, রেস ডেস্কে, বিব্রত দৃষ্টি। বার্নস্টাইন একজন সাদা চুলের মানুষ, বয়স উনষাট এবং নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির প্রাচীন ভাষা ডিপার্টমেন্টের রেসের বস।

অন্য আরো তিনজন মানুষ রয়েছে ঘরের ভেতর : দুজন সোলজার, একজন সিভিলিয়ান।

দুজন সোলজার বাইরে দাঁড়ান গার্ডের মতো একই সাজসজ্জা পরিহিত ফেটিগ, হেলমেট, লেজার-সাইটেড এম-১৬, এবং দুজনই অসম্ভব যোগ্য। একজনের বয়স অন্যজনের তুলনায় একটু বড় হবে হয়তো। নিজের হেলমেটটা কনুই আর পাঁজরের মাঝখানে আটকে রেখেছে আর খুলি কামড়ান কালো চুল কোনোরকমে পৌঁছেছে কপালে। রেসের বাদামী বালু রঙের চুল সব সময়ের জন্য চোখের ওপর এসে পড়ছে।

তৃতীয় ব্যক্তিটি হল একজন সিভিলিয়ান, বার্নস্টাইনের সামনে এক চেয়ারে বসে আছেন তিনি। দেখতে বিশাল, ড্রামের মতো বুক, পরনে শার্ট এবং ট্রাউজার। নাকটা ছোট, চেহারায় বয়স এবং দায়িত্ববোধের ছাপ। আর তিনি চেয়ারে এমন ভঙ্গিতে বসে আছেন যেন শান্ত নিশ্চয়তা প্রকাশ পাচ্ছে, যেন সবার আনুগত্য পেতে অভ্যন্ত।

তার জন্য অপেক্ষা।

উইল, জন বানস্টাইন বললেন, ডেস্ক ঘুরে এগিয়ে এলেন করমর্দন করলেন। সুপ্রভাত। আসুন। একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। প্রফেসর উইলিয়াম রেস, ইনি কর্ণেল ফ্রাঙ্ক ন্যাশ।

রিটায়ার্ড, গুড টু মিট ইউ। এরপর দুই সৈনিকের দিকে ইঙ্গিত করলেন। আর ওরা হলেন ক্যাপটেন স্কুট আর করপোরাল কোচরেন ইউএস আর্মি স্পেশাল ফোর্সেস।

গ্রিন বেরেট, রেসের কানে ফিসফিস করলেন বার্নস্টাইন।

গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে শুরু করল বার্নস্টাইন। কর্ণেল, আমি বলতে চাইছি, ডক্টর ডিফেন্স অ্যাডভান্স রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সির টেকটিক্যাল টেকনলজি অফিস থেকে এসেছেন ন্যাশ। তিনি আমাদের সাহায্যের আশায় এসেছেন।

ফ্রাঙ্ক ন্যাশ রেসের হাতে তার ফটো-আইডি কার্ড বাড়িয়ে দিলেন। কার্ডটা নিয়ে ফটোর উপর চোখ বুলাল রেস, মাথার দিকে লাল ডারপা লোগোটা দেখল, সেটার নিচে একগাদা সংখ্যা আর কোড ছাপা রয়েছে। কার্ডের একপাশে একটা ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ রয়েছে। ফটোর নিচে লেখা ফ্রন্সিস কে, ন্যাশ, ইউএস আর্মি, কর্ণেল (অব.)। দেখতে খুব সুন্দর কার্ডটা। কার্ডের গুরুত্ব আছে বেশ।

উহ্ রেস ভাবছে।

ডারপা সম্পর্কে আগেও শুনেছে সে। মার্কিন ডিপার্টমেন্ট প্রাথমিক রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান এটি, এই এজেন্সি আপানেট আবিষ্কার করেছে যা একমাত্র আর্মি ইন্টারন্যাট। ১৯৭০-এ ডারপা বিখ্যাত ব্র প্রজেক্টে অংশগ্রহণ করেছিল, টপ সিক্রেট এয়ার ফোর্স প্রজেক্টের এফ-১১৭ স্টিলথ ফাইটার প্লেন।

 ডারপা সম্পর্কে একটু বেশি জানে রেস, কারণটা হল ওর ভাই, মার্টিন ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করে ওখানে।

আসলে ডারপা-য় লোকজন একযোগে কাজ করে ইউএস আর্মির তিন সশস্ত্র বাহিনী অর্থাৎ আর্মি, নেভি এবং এয়ার ফোর্স নিজ নিজ ফোর্সের জন্য হাই টেকনোলজি মিলিটারি জিনিসপত্র উন্নত করে: স্টিলথ টেকনোলজি এয়ার ফোর্সের জন্য, আল্টা হাই টেনসিল বডি আর্মার আর্মির জন্য। তাছাড়া ডারপা-র কাজকর্ম লিজেন্ড পর্যায় রয়েছে। শোনা যায়, জে-সেভেন, অর্থাৎ এ-ফ্রেম রকেট প্যাক তৈরি করেছে তারা, এরপর আর প্যারাশূট ব্যবহার করার দরকার হবে না, তবে ব্যাপারটা এখনো প্রমাণসাপেক্ষ।

 টেকটিক্যাল টেকনোলজি অফিস, যাহোক, ডারপা-র আরসানালের অগ্রভাগ, এই শাখার কাজ হল বিশালাকৃতির হাইরিস্ক হাই-রিটার্ন স্ট্রাটেজিক অস্ত্র উন্নত করা।

রেস ভাবল, ডারপা-র টেকটিক্যাল টেকনোলজি অফিস নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি প্রাচীন ভাষার ডিপার্টমেন্টের সাহায্য চাইছে।

কার্ডটা থেকে চোখ ফিরিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, আমাদের সাহায্য দরকার আপনার?

আসলে আমরা আপনার সাহায্যের জন্য এসেছি।

আমার সাহায্য, রেস ভাবল, সে লেকচার দেয় প্রাচীন ভাষার ওপর, বিশেষ করে ক্লাসিক্যাল এবং মিডিয়েভ্যাল ল্যাটিন, পাশাপাশি হালকা পাতলা ফ্রেঞ্চ, স্পেনিশ এবং জার্মান ভাষা জানে। ভাবতেই পারছে ডারপর কি কাজে লাগবে সে।

কী ধরনের সাহায্য? জিজ্ঞেস করল সে।

 অনুবাদ। একটা ম্যানুস্ক্রিপ্ট অনুবাদ। চারশো বছরের পুরানো একটা ল্যাটিন ম্যানুস্ক্রিপ্ট।

 একটা ম্যানুস্ক্রিপ্ট… বলল রেস। এ-ধরনের একটা অনুরোধ অস্বাভাবিক নয়। মাঝে মধ্যে তাকে মিডিয়েভ্যাল ম্যানুস্ক্রিপ্ট অনুবাদ করতে অনুরোধ করা হয়ে থাকে। এটা অস্বাভাবিক যখন, অনুরোধটা সশস্ত্র কমান্ডোর উপস্থিতিতে আসে।

প্রফেসর রেস, ন্যাশ বলল, যে ডকুমেন্ট অনুবাদের কথা বলা হচ্ছে সেটা অত্যন্ত জরুরি একটা বিষয়। ডকুমেন্টটা এখনো যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছায়নি। এই মুহূর্তে রাস্তায় রয়েছে। আমরা চাইছি ওটা যখন নিউ ইয়ার্কে আপনি পৌঁছাবে, তখন আমরা আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হবার পর প্লেনে বসে ওটা অনুবাদ করবেন।

যাওয়ার পথে? ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল রেস। কোথায়?

আমার মনে হয় এ মুহূর্তে প্রশ্নটার উত্তর আমি দিতে পারছি না।

ব্যাপারটা নিয়ে তর্ক করতে যাবে রেস এই সময় হঠাৎ দরজা খুলে অফিসে ঢুকল আরো একজন গ্রিন বেরেট। তার পিঠে রেডিও প্যাক দেখা যাচ্ছে এবং দ্রুত পায়ে ন্যাশের দিকে হেঁটে এল সে, তার কানের কাছে নিচু গলায় ফিসফিস করল। কয়েকটা শব্দ শুনতে পেল রেস …. প্রস্তুত হও যাত্রার জন্য।

কখন? জানতে চাইল ন্যাশ।

 দশ মিনিট আগে, স্যার, ফিসফিস করে বলল সৈন্যটি।

 দ্রুত হাতঘড়ির দিকে তাকাল ন্যাশ। ড্যাম ইট।

 ঝট করে রেসের দিকে ফিরল।

প্রফেসর রেস, আমাদের হাতে সময় খুব কম, কাজেই কথাগুলো সোজা-সাপ্টা জানাচ্ছি আপনাকে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মিশন, যে মিশন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তায় বিরাট অবদান রাখবে। কিন্তু এ মিশনে সফল হবার সুযোগ খুবই কম। আমাদের এখন তৎপর হতে হবে। সেই মতো করতে হলে আমার একজন অনুবাদক দরকার। একজন মিডিয়েভ্যাল ল্যাটিন অনুবাদ। সেটা হলেন আপনি।

কত তাড়াতাড়ি দরকার?

 আমার গাড়ি অপেক্ষা করছে।

ঢোক গিলল রেস। আমি জানি না…

বুঝতে পারছে সবগুলো চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই সে ভয় পেয়ে গেল, অজানা গন্তব্যে ভ্রমণ করতে হবে ফ্রাঙ্ক ন্যাশ এবং একদল গ্রিন বেরেটের সাথে, এই কথা ভেবে। ওর মনে হল রেল লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে।

হার্ভার্ড-এর এড ডিরেক্সকে ডাকছেন না কেন? জানতে চাইল সে। ল্যাটিন ভাষায় আমার চেয়ে অনেক ভালো তিনি। অনেক দ্রুত।

ন্যাশ বললেন, ভালো কাউকে আমার দরকার নেই, আর বোস্টনে যাবার সময়ও আমি পাব না। আপনার ভাই আপনার নাম আমাদেরকে বলেছেন। তিনি বলেছেন আপনিই হলেন ভালো এবং নিউইয়র্কে আছেন এটুকুই জানা দরকার ছিল, ব্যস। আমি চাই আমাদের খুব কাছের লোক কাজটা করে দিক।

রেস নিজের ঠোঁট কামড়াল।

ন্যাশ বলল, পুরো মিশনটায় আমরা আপনার জন্য একজন বডিগার্ড দিচ্ছি। আধঘণ্টার মধ্যে নিউআর্ক থেকে ম্যানুস্ক্রিপ্টটা পিক করব আমরা, তার কয়েক মিনিট পর প্লেনে চড়ব। সব যদি ঠিক থাকে, প্লেন ল্যান্ড করার সময় দেখা যাবে ডকুমেন্টটা আপনি অনুবাদ করে ফেলেছেন। সেক্ষেত্রে প্লেন থেকে আপনাকে নামতেই হবে না। আর যদি নামতে হয়, গ্রিন বেরেট-এর একটা টিম আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

ভ্রু কুঁচকাল রেস।

প্রফেসর রেস, মিশনটায় আপনিই একমাত্র অ্যাকাডেমিক নন। স্ট্যানফোর্ড থেকে ওয়াল্টার চেম্বারস থাকছেন ওখানে থাকছেন প্রিন্সটন আরো রয়েছেন লরেন ও’ কোনার—

লরেন ও’ কোনার, চিন্তা করছে রেস।

বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল এই নামটা শোনেনি ও।

উই এসসি-তে পড়ার সময় থেকে লরেনকে রেস চেনে। যখন সে ভাষা নিয়ে পড়াশুনা করত তখন লরেন থিওরিটেক্যাল ফিজিক্স নিয়ে পড়ত। ডেট করেছে, কিন্তু খুব খারাপভাবে সমাপ্তি ঘটেছে। শেষ খবর জানত লিভারমুরে ল্যাবের নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে কাজ করছে সে।

রেস ফিরে তাকাল ন্যাশের দিকে। অবাক হয়ে ভাবছে লরেন এবং তার সম্পর্কে ফ্রাঙ্ক ন্যাশ কতটা জানে, ভাবছে তার নামটা বাদ দিতে বলবে নাকি।

যদি করে, তাহলে কাজ হবে।

লরেন যদি কিছু হয়ে থাকে, সে একজন স্ট্রিট-স্মার্ট। ভালো কারণ ছাড়া এ ধরনের মিশনে সে যাবে না। আসল কারণ হল ন্যাশের এই অ্যাডভেঞ্চারে একটা ক্র্যাডিবিলিটি আছে।

প্রফেসর, আপনি ক্ষতিপূরণের জন্য প্রচুর সময় পাবেন।

 তা নয়–

আপনার ভাইও আমাদের টিমের একজন সদস্য, ন্যাশ বলল, রেস অবাক হল শুনে। আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন না তিনি, তবে টেকনিকাল টিমের সঙ্গে ভার্জিনিয়া অফিসে থাকছেন।

মার্টি, ভাবল রেস। অনেকদিন তার সাথে দেখা নেই, নয় বছর আগে বাবা মার ডিভোর্সের পর থেকে। তবে মার্টি যদি এই মিশনে থেকে থাকে, তাহলে…

 প্রফেসর রেস, দুঃখিত, আমাদের যেতে হবে। আমাদের এখনি যেতে হবে। উত্তর চাই আপনার কাছ থেকে।

উইল, জ বার্নস্টেইন বললেন, ইউনিভার্সিটির জন্য বিশাল সুযোগ

ভ্রু কুঁচকে তাকাল রেস বার্নস্টেইনের দিকে : বলছিলে এটা জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নঃ

ঠিক তাই।

আর আপনি আমাকে জানাচ্ছেন না কোথায় যাব আমরা।

প্লেনে না ওঠা পর্যন্ত। তারপর আপনার প্রশ্নের উত্তর দেব আমি।

রেস ভাবল, আমার একজন বডিগার্ড থাকবে। আপনি তখনই একজন বডিগার্ড নিয়োগ করবেন যখন আপনার ওপর হত্যার হুমকি আসবে।

কামরার ভেতর নীরবতা নেমে এল।

রেস অনুভব করছে, ও কী বলে শোনবার জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। ন্যাশ, বার্নস্টেইন ডিন, গ্রিন বেরেট।

দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। কি বলবে বুঝতে পারছে না।

 ঠিক আছে, বলল সে। আমি যাব।

.

করিডর ধরে ন্যাশের পিছু নিয়ে দ্রুত হাঁটছে রেস। পরনে সেই জ্যাকেট এবং টাই। নিউইয়র্কে বেশ শীত, দিনটাও ভেজা ভেজা। ওরা করিডরের গোলকধাঁধা পেরিয়ে ইউনিভার্সিটির গেটের দিকে এগিয়ে গেল, রেস দেখতে পেল বাইরে বেশ ভারী বর্ষণ হচ্ছে।

দুজন গ্রিন বেরেট যারা অফিসে ছিল তারা রয়েছে সামনে, বাকি দুজন সবার পেছনে। সকলেই দ্রুত যেন হাঁটছে, প্রচণ্ড ঢেউয়ের ধাক্কায় এগিয়ে যাচ্ছে। আমি কি একটা সুযোগ পাব কাপড় পরিবর্তনের? ন্যাশকে জিজ্ঞেস করল সে। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে একটা স্পোর্ট ব্যাগ। ওটার ভেতরে পরিবর্তনের কাপড় আছে।

প্লেনে পাল্টাতে পারবেন, ন্যাশ বলল হাঁটতে। এবার মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আপনার পেছনের লোকটাকে একবার দেখে রাখুন। ওর নাম সার্জেন্ট লিওভ্যান লিওয়েন এখন থেকে ও-ই আপনার বডিগার্ড।

 রেস একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিল লোকটাকে, বিশালাকৃতি গ্রিন বেরেটকে আগেও দেখেছে ও। ভ্যান লিওয়েন করিডরের চারদিকে দ্রুত চোখ বুলাবার সময় ওর উদ্দেশে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল।

ন্যাশ বলল, এখন থেকে আপনার গুরুত্ব অনেক বেড় গেছে, ফলে এখন আপনি একটা সম্ভাব্য টার্গেট। যেখানেই আপনি যাবেন, সে থাকবে আপনার সাথে নিন। এটা রাখুন।

রেসের হাতে একটা এয়ারপিস আর গলায় জড়াবার জন্য থ্রোট মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিল ন্যাশ। সোয়াট-এর টিভি ফুটেজ ছাড়া এই প্রথম ওটা দেখল। থ্রোট মাইকটা গলায় পেঁচিয়ে নিল, এই মাইক্রোফোন তার গলার কম্পনে কথা তুলে নিবে।

 গাড়িতে চড়েই পরে ফেলবেন এটা, বলল ন্যাশ। জিনিসটা ভয়েস অ্যাকটিভেটেড, তাই আপনি কথা বললেই শুনতে পাব আমরা। কোনো সমস্যা বা বিপদে পড়লে শুধু উচ্চারণ করবেন, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আপনার পাশে চলে আসবে ভ্যান লিওয়েন। বুঝতে পারছেন?

পারছি।

ওরা পৌঁছে গেল ইউনিভার্সিটির পশ্চিমের গেটের কাছে, সেখানে দুজন গ্রিন বেরেট দোর গোড়ায় পাহারা দিচ্ছে। ন্যাশ এবং রেস তাদের পাশ কাটিয়ে গেল, একেবারে বৃষ্টির মধ্যে নেমে পড়ল। সামনের চত্বরে রেস দেখতে পেল ন্যাশ যা বলেছিল সেই একটা কার দাঁড়িয়ে রয়েছে।

চারদিক থেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু পুলিশ।

চার পুলিশ মোটর সাইকেল আউটরাইডার; গাড়ির সামনে দুজন, পেছনে দুজন। ছয়টা অলিভ রঙের সিডন। ঠিক মাঝখানে গাড়ি বহরটা, ঘিরে রয়েছে আউটরাইডার ভেহিকল, হামভি। দুটো পিচ কালো আর জানালাগুলো গাঢ় রঙ-এর কাঁচ।

মোট পনেরোজন গ্রিন বেরেট দাঁড়িয়ে আছে এম-সিক্সটিন হাতে গাড়ি বহরটাকে ঘিরে। বৃষ্টির ফোঁটা আছড়ে পড়ছে তাদের মাথার হেলমেটে। ওসব দেখার সময় নেই।

দ্রুত পায়ে দ্বিতীয় হামভির পাশে গিয়ে দাঁড়াল ন্যাশ, রেসের জন্য দরজাটা খুলে দিল। তারপর তার হাতে মোটা একটা ম্যানিলা এনভেলপ ধরিয়ে দিয়ে নিজেও উঠে বসল।

ওটার ওপর একবার চোখ বুলান, ন্যাশ বলল। প্লেনে ওঠার পর আরো তথ্য দেব।

.

নিউইয়র্কের রাস্তা ধরে মোটর শোভাযাত্রা এগিয়ে চলেছে।

শোভাযাত্রা ঠিক ছুটে চলেছে ভেজা রাস্তার ওপর দিয়ে, একের পর এক ক্রসিং পেরিয়ে যাচ্ছে, শহর থেকে বেরিয়ে যাবার পথে সবগুলো সবুজ বাতিই যেন পেয়ে যাচ্ছে তারা।

রেসের মনে হল ওরা ট্রাফিক লাইটগুলো এমনভাবে সেট করে রেখেছে যেমনটা প্রেসিডেন্ট নিউইয়র্কে ভিজিটের সময় করে থাকে।

কিন্তু এটা তো প্রেসিডেনশিয়াল শোভাযাত্রা নয়। ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া। মানুষগুলোর চেহারাই বলছে এসব কথা।

এটা একেবারে ভিন্ন ধরনের মোটর শোভাযাত্রা।

নেই লিমুজিন। নেই কোনো পতপত করে উড়তে থাকা ফ্ল্যাগ। শুধু দুটো কালো হেভিলি আর্মড হামভি ঠিক রাস্তার মাঝখানের লাইন বরাবর সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে হালকা অলিভ রঙের একটা গাড়িকে, ছুটে চলেছে বৃষ্টির ভেতর।

তার পাশে বসা বডিগার্ডের এয়ার পিস এবং থ্রোট মাইক যথাস্থানে, ছুটে যাওয়া হামভির জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রেস।

তার মনে হল, বেশি কারো নয়, এই মধ্য সকালে নিউইয়র্কের খালি রাস্তা যাওয়া অভিজ্ঞতা নেই। এটা একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা; অন্যভাবে ভাবলে। ভেবে অবাক হচ্ছে কতটা জরুরি এই মিশন।

তাকে দেওয়া ফোল্ডারটা খুলল। প্রথমে নামের একটা তালিকা দেখল ও।

কুজকো ইনভেস্টিগেশন টিম
সাধারণ সদস্য। ১. ন্যাশ, ফ্রান্সিস কে-ডারপা, প্রজেক্ট লিডার, নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট ২. কোপল্যান্ড ট্রয় বি-ডারপা, নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট ৩. ওকনার, লরেন এম-ডারপা, থিওরিটিক্যাল ফিজিসিসট ৪. চ্যাম্বারস, ওয়ার্টার জে-স্ট্যানফোর্ড, অ্যানথ্রপলজিস্ট ৫. লোপেজ, গ্যাবরিয়েল এস- প্রিন্সটন, আর্কিডলজিস্ট ৬, রেস, উইলিয়াম-এইচ এন ওয়াই ইউ, লিঙ্গুইস্ট

সশস্ত্র বাহিনী সদস্য
১. ডিওয়েন টি ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি (জিবি) ক্যাপটেন ২. ভ্যান লিওয়েন লিউনার্ড এম- ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি (জিবি), সার্জেন্ট ৩. কোচরেন, জেকব আর ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি (জিবি), করপোরাল ৪. রাইকার্ট, জজ পি-ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি (জিবি), করপোরাল ৫. উইলসন, চার্লস টি আর্মি ইউনাইটেড স্টেটস (জিবি), করপোরাল ৬. কেনেডি, ডগলাস কে-ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি (জিবি), করপোরাল

পাতা ওল্টাতে নিউজ পেপার কাটিং-এর একটা ফটোকপি দেখতে পেল রেস। ফ্রেঞ্চ ভাষায় ছাপাঃ মইনেস ম্যাসাকারস ডানস আন মনাস্টারি আ লা হাউটে ম টাগনে।

 রেস অনুবাদ করলেন ওটা। পাহাড়চূড়ায় মনাস্ট্রিতে পাইকারী হারে সন্ন্যাসী হত্যা।

আর্টিক্যালটা পড়ল সে। গতকালের তারিখ–৩ জানুয়ারি ১৯৯৯-ফ্রেঞ্চ পিরানিজের মঠে জেসাইট সন্ন্যাসীদের একটা দলকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।

ফ্রেঞ্চ সরকারের বিশ্বাস, আলজিরিয়া তাদের নাক গলান নীতির বিরোধিতাকারী একটা ইসলামী জঙ্গি গ্রুপ এর জন্য দায়ী। সব মিলিয়ে আঠারোজন সন্ন্যাসীকে হত্যা করা হয়েছে। একইভাবে আগের জঙ্গী গ্রুপের মতো খুব কাছ থেকে হত্যা করা হয়েছে।

ফোল্ডারের পরের আইটেমটা ওল্টাল।

এটা একটা নিউজপেপার ক্লিপিং, লস অ্যাঞ্জেলিস টাইম থেকে নেওয়া। তারিখটা গত বছরের আর হেডিংটা যেন চিৎকার করছে; নিহত ফেডারেল অফিসারদের লাশ পাওয়া গেছে।

খবরটায় বলা হয়েছে, ইউএস ফিশ অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ সার্ভিসের দুজন সদস্যের খুন করা লাশ পাওয়া গেছে হেলেনায়, মনটানায়। দুই অফিসারেরই চামড়া তুলে নেওয়া হয়েছে। এফবিআই-কে ডাকা হয়েছে। তাদের সন্দেহ এটা স্থানীয় একটি মিলিশিয়া গ্রুপের কাজ, যাদের আচরণ দেখে মনে হয় যে কোনো ফেডারেল এজেন্সির প্রতি তাদের ঘৃণা আর শত্রুতা আছে। ধারণা করা হচ্ছে, চামড়ার লোভে মিলিশিয়ারা যখন বেআইনীভাবে শিকার করছিল তখন দুজন ওয়াইল্ড লাইফ অফিসার বাধা দিয়েছিল। জন্তু জানোয়ারের বদলে জঙ্গিরা রেঞ্জারদের চামড়া তুলে নেয়।

রেস পাতা ওল্টান।

ফোল্ডারের পরবর্তী সিটটা একটা ফটোকপি, যা কোনো ইউনিভার্সিটি জার্নাল থেকে নেওয়া হয়েছে। আর্টিকেলটা জার্মান ভাষায়, আলবার্ট এল, মূলার নামে একজন বিজ্ঞানী লিখেছেন। তারিখ ১৯৯৮ নভেম্বর।

লেখাটা দ্রুত অনুবাদ করে পড়ল রেস। পেরুর জঙ্গলে উল্কা পতনের ফলে তৈরি একটা গর্ত খুঁজে পাওয়া নিয়ে লেখা।

আর্টিকেলের নিচে পুলিশ প্যাথোলজিস্ট-এর রিপোর্ট রয়েছে, সেটাও জার্মান ভাষায়। বাক্সের ওপর লেখা মৃত ব্যাক্তির নাম আলবার্ট লডউইগ মুলার।

প্যালোথজিস্ট-এর রিপোর্টের নিচে আরো অনেক সিট পেপার রয়েছে, নানা ধরনের লাল স্ট্যাম্পে ঢাকা-টপ সিক্রেট; আইজ ওনলি; ইউএস আমি পারসোনেল আইজ ওনলি। নেড়েচেড়ে দেখল রেস। বেশিরভাগই গাণিতিক সমীকরণে ভরা যার কোনো তাৎপর্য নেই তার কাছে।

এরপর রয়েছে একগাদা মেমো, ওরা চেনে না এমন সব লোকের নামে লেখা। একটা মেমোতে নিজের নামটা দেখতে পেল পড়ল :

জানুয়ারি ৩১৯৯৯ ২২:০১ ইউএস আর্মি ইন্টারনাল নেট ৭১৬ ৫৫৪৪ ৮৮২১১-০৫
 নাম্বার ১৩৯
প্রেরক : ন্যাশ, ফ্রাঙ্ক
প্রাপক : কুজকো সকল টিম
মেম্বার বিষয় : সুপারনোভা মিশন।
 রেস এর এস এ পি-র সঙ্গে যোগাযোগ করাটা বিশেষ জরুরি মিশন সফল করতে হলে তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
আশা করা হচ্ছে প্যাকেজটা কাল, ৪ জানুয়ারি ০৯৪৫ সময় নিউইয়র্কে পৌঁছাবে।
সব সদস্যকে ট্রান্সপোর্ট-এ জড়ো করা ইকুইপমেন্ট বুঝে নিতে হবে ০৯০০ সময়ে।

 মোটরকেড নিউইয়র্ক এয়ারপোর্টে পৌঁছাল। গাড়ির লম্বা লাইন সাইক্লোন ফেন্স-এর বসান গেট পার হয়ে একটা প্রাইভেট এয়ারস্ট্রিপের দিকে ছুটছে।

ওদের জন্য টারমাকে অপেক্ষা করছে বিশালাকৃতির একটা ক্যামোফ্লাজড কার্গো প্লেন।

 প্লেনটার পেছনে একটা কার্গো র‍্যাম্প নিচু করা হয়েছে, টারমাক ছুঁয়ে আছে। গাড়ির বহরটা বিশালাকৃতি প্লেনটার পাশে গিয়ে থামার সময় রেস দেখল র‍্যাম্প বেয়ে বিরাট একটা আর্মি ট্রাক উঠে যাচ্ছে প্লেনের পেটের ভেতরে।

সার্জেন্ট ভ্যান লিওয়েনের পেছনে পেছনে বৃষ্টির মধ্যে হামভি থেকে নেমে দাঁড়াল সে। বিরাট কালো গাড়িটা থেকে নামার সাথে সাথে সে শুনতে পেল। দৈত্যের গর্জন, আকাশ থেকে নেমে আসছে।

পুরানো একটা এফ-ফিফটিন-সি ঈগল, ক্যামোফ্লাজ কালার সবুজ আর খয়েরি রঙ করা, লেজে লেখা আর্মি। মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে ফিরে এল আবার, ল্যান্ড করল ওদের সামনের ভেজা টারমাকে।

ফাইটার প্লেনটা রানওয়ের উপর ঘুরে যাচ্ছে, ফিরে আসছে ওদের দিকে, ঠিক সেই সময় ফ্রাঙ্ক ন্যাশ ওর কনুই স্পর্শ করল।

 আসুন। প্রকাণ্ড কার্গো প্লেনটার দিকে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। বাকি সবাই এরইমধ্যে প্লেনে উঠে পড়েছে।

এগিয়ে যাবার সময়ে রেস লক্ষ্য করে দেখল, কার্গো প্লেনের খোলা দরজায় উদয় হল একটি মেয়ে। তাকে দেখামাত্র চিনতে পারল।

হেই, উইল, লরেন ওকোনার বলল।

 হ্যালো, লরেন।

বয়সটা তিরিশের কোটায়, যেন আগের সেই পঁচিশে স্থির হয়ে আছে। রেস লক্ষ্য করে দেখল, লরেন চুল কেটেছে। ইউ এস সি-তে তার মাথায় ছিল চকলেট রঙের ঢেউ ঢেউ চুল। তার বদলে এখন তার চুল ছোট, সরল আর পিঙ্গল। নব্বইয়ের শেষ দিকের মতো।

তার বাদামী চোখ আগের মতোই আছে, গায়ের চামড়াও আগের মতো সজীব। বড়সড় কার্গো প্লেনের দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়েছে, হাত দুটো বুকে ভাঁজ করা আর পরনে ভারী খাকি হাইকিং পোশাক, যেভাবে সে সবসময় তাকায় সেভাবেই তাকিয়ে আছে। লম্বা, সেক্সি, নমনীয় অ্যাথলেটিক।

অনেকদিন পর, মুখে হাসি এনে বলল সে।

 হ্যাঁ, অনেকদিন পর। বলল রেস।

তো। উইলিয়াম রেস। অভিজ্ঞ ভাষাবিদ। ডিফেন্স অ্যাডভান্স রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সির পরামর্শক। তুমি এখনো বল খেল, উইল?

মাঝে মধ্যে, রেস বলল। কলেজে ফুটবল খেলায় বেশ পারদর্শী ছিল। দলে সে ছিল ছোটখাটো সদস্য, তবে দৌড়ে সবার চেয়ে দ্রুততম। ট্র্যাকেও পারদর্শী ছিল।

 তোমার খবর বল? রেস বলল এবং প্রথমবারের মতো মেয়েটার বাম হাতের আঙ্গুলে আংটিটা দেখতে পেল। ভাবছে কাকে সে বিয়ে করেছে।

একটা কথা, বলল সে, দৃষ্টি যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল, মিশনটা নিয়ে আমি খুব উত্তেজিত হয়ে আছি। রোজ তো আর মানুষ ট্রেজার হান্টে বেরোয় না!

 এটা তাই বুঝি?

লরেনের উত্তরের আগেই জোরাল একটা যান্ত্রিক শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ওরা।

কার্গো প্লেনের কাছ থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে থামল ফাইটার এফ-ফিফটিন এবং পরমুহূর্তে ওটার ক্যাপি খুলে গেল, লাফ দিয়ে ভেজা টারমাকে নামল পাইলট, ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে ওদের দিকে ছুটে আসছে সে। হাতে একটা ব্রিফকেস রয়েছে তার।

সোজা ন্যাশের সামনে এসে দাঁড়াল পাইলট, বাড়িয়ে ধরল ব্রিফকেসটা। ডক্টর ন্যাশ, বলল সে। ম্যানুস্ক্রিপ্ট।

ন্যাশ হাত বাড়িয়ে ব্রিফকেসটা নিল তারপর ঘুরল যেখানে লরেন এবং রেস দাঁড়িয়ে আছে।

ঠিক আছে, বলল সে, কার্গো প্লেনের ভেতরে ঢোকার জন্য ইশারা করল।

 যাওয়ার পথে দেখা যাবে।

.

বিশালকৃতির কার্গো প্লেনটার গর্জনে রানওয়ে ধরে ছুটছে। তারপর উড়াল দিল মেঘলা আকাশে।

এটা লকহিড সি-হানড্রেড থারটি ই হারকিউলিস এবং ভেতরটা দুভাগে ভাগ করা : নিচে কার্গো হোল্ড, উপরে প্যাসেঞ্জার কম্পার্টমেন্ট। অভিযানে অংশ নিচ্ছে এমন পাঁচজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে রেস বসেছে। ওদের সঙ্গী হিসাবে ছয়জন গ্রিন বেরেট রয়েছে, তাদের সঙ্গে কার্গো হোল্ডে বসেছে আর অস্ত্রশস্ত্র চেক করেছে।

পাঁচ সিভিলিয়ানের মধ্যে দুজনকে চেনে রেস : ফ্রাঙ্ক ন্যাশ আর লরেন ও কোনোর।

 পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় পরেও পাওয়া যাবে, বলল ন্যাশ, রেসের পাশে বসে ব্রিফকেসটা নিজের কোলের উপর রাখল। জরুরি ব্যাপারটা হল এই যে আপনাদের কাজটা শুরু করা।

ব্রিফকেসটা খুলতে শুরু করল।

বলবেন কি, কোথায় যাচ্ছি আমরা? জানতে চাইল রেস।

ও, হ্যাঁ, অবশ্যই, জবাব দিল ন্যাশ। আগে বলতে পারিনি বলে দুঃখিত, তবে আপনার অফিস সুরক্ষিত ছিল না। জানালাগুলো হয়তো লেসড় ছিল।

লেসড?

লেজার-গাইডেড লিসেনিং ডিভাইস। আমরা যখন আপনার অফিসের মতো কোথাও বসে কথা বলি, আমাদের কণ্ঠস্বর জানালাগুলোকে কাঁপিয়ে দেয়। বেশিরভাগ নতুন অফিস টাওয়ারে ডিরেকশনাল লিসনিং ডিভাইস যাতে কাজ করতে না পারে তার ব্যবস্থা রাখা হয়; জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে ইলেকট্রনিক জ্যামিং সিগনাল পাঠান যায়। কিন্তু আপনারটার মতো পুরান দালানে সুবিধেটা নেই, খুব সহজেই যে কারো কথা শুনতে পারা যায়।

তো কোথায় যাচ্ছি আমরা?

কুজকো, পেরু, ১৫৩২ সালে স্প্যানিশ অভিযাত্রীরা পৌঁছাবার আগে কুজকো ছিল ইনকা সাম্রাজ্যের রাজধানী, বলল ন্যাশ। এখন সেটা বড় একটা মফঃস্বল শহর, অল্প কিছু ইনকান রয়েছে। এটা আমাদের নন-স্টপ ফ্লাইট, মাঝ আকাশে বার দুয়েক রিফুয়েলিং দরকার হবে।

ব্রিফকেস খুলে তিনি একগাদা কাগজ বের করলেন।

এ-থ্রি আকারের চল্লিশটার মতো হবে। প্রথম পাতাটায় চোখ বুলাল রেস। রঙিন একটা প্রচ্ছদের জেরক্স কপি।

কাগজের বান্ডিলটা রেসের হাতে ধরিয়ে দিল লয়েড এবং হাসল। এটার কারণেই আপনারা এখানে।

মধ্যযুগের ল্যাটিন ম্যানুস্ক্রিপ্ট আগেও অনেক দেখেছে রেস, ছাপাখানা আবিষ্কার না হওয়ায় মধ্যযুগে নিবেদিতপ্রাণ সন্ন্যাসীরা হাতে লিখে কষ্ট করে কপি করত। এ ধরনের ম্যানুস্ক্রিপ্টের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল অক্ষরগুলোর ডিজাইন সচেতনভাবে জটিল করে তোলা। নির্ভুল ক্যালিওগ্রাফি, সাথে সুন্দর বিশদভাবে শুরুর চিহ্ন (একক অক্ষর থেকে নতুন ব্যাপারটার শুরু হত), এবং মার্জিনে বিশদ পিক্টোগ্রাফ দেখে বোঝা যায় কাজের ধরন। আলোকিত এবং উচ্ছল হল মলিন গল্প; অন্ধকার এবং ভীতি বিষণ্ণ গল্পের জন্য। এইভাবে বিশদ করা হয়েছে, শোনা যায় একজন সন্ন্যাসী মাত্র একটা ম্যানুস্ক্রিপ্ট নকল করতে নিজের পুরো জীবনটাই পার করে দিত।

 তবে রেস যে ম্যানুস্ক্রিপ্টটা এখন দেখছে, সাদাকালো ফটোকপি করার পরও তেমন কিছু নয়।

চমৎকার।

পাতা উল্টে গেল সে।

হাতের লেখাটা সুন্দর, পরিষ্কার, জটিল এবং পার্শ্ব মার্জিনে সাপের মতো ড্রইং আঁকা। অদ্ভুত পাথরের স্ট্রাকচার, অন্ধকার এবং শ্যাওলাতে ঢাকা, নিচের কোনায় দেওয়া আছে সেই দৃশ্য প্রতিটি পাতায়। কোনো জাতির অমঙ্গলকারী অন্ধকার আর পূর্বাভাসের চিহ্ন।

রেস কভার পেজটা উল্টাল। পড়ল :

নারোশিও ভার সিটো ইন করিস ইনকারিজ : ওপেরিজ আলবার্তো লুইস সান্তিয়াগো আনো ডোমিনিল এমডিএলএসজি।

ইনকাদের মার্টিতে একজন সন্ন্যাসীর সত্যিকার ভূমিকা: আলবার্তো লুইস সান্টিয়াগোর লেখা একটি ম্যানুস্ক্রিপ্ট। তারিখ ১৫৬৫।

ন্যাশের দিকে ফিরল রেস। বেশ। এবার সময় হয়েছে আপনার বলার, এই মিশনটা কী নিয়ে?

ব্যাখ্যা করলেন ন্যাশ।

 ১৫৩২ সালে স্প্যানিশ অভিযাত্রীদের পাশাপাশি কাজ করার জন্য ব্রাদার আলবার্তো সান্টিয়াগোকে পেরুতে পাঠান হয় ফ্রান্সিকান মিশনারী হিসেবে। অভিযাত্রীরা যখন গোটা দেশ জুড়ে মেয়েদের ধর্ষণ করছে আর শহরগুলোয় লুঠতরাজ চালাচ্ছে, আশা করা হচ্ছিল আলবার্তো সান্টিয়াগোর মতো সন্ন্যাসীরা তখন স্থানীয় রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রতিনিধি হিসাবে ধর্মান্তরিত করার মাধ্যমে ইনকাদের খ্রিস্টান বানাবে।

সান্টিয়াগো ইউরোপে ফিরে আসার পর, ১৫৬৫ সালে লেখাটা লিখলেও ন্যাশ বলল, বলা হয় তার ম্যানুস্ক্রিপ্টে ১৫৩৫ সালের একটা ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়েছে, ঠিক যে সময় ফ্রান্সিসকো পিজারো আর তার সহ অভিযাত্রীরা পেরু দখল করে নেয়। মধ্যযুগীয় সন্ন্যাসীদের ভাষ্য অনুসারে, ম্যানুস্ক্রিপ্টটা যারা পড়েছিল, সুন্দর একটা গল্প লেখা ছিল : রাজধানী কুজকো বেদখল হয়ে যাওয়ার সময় পাচিল ঘেরা শহর থেকে ইনকাদের সবচেয়ে পবিত্র আইডল নিয়ে পেরুর পুবদিকের জঙ্গলে পালিয়ে যায় ইনকা রাজপুত্র। কিন্তু হার্নান্দো পিজারো তাকে ধাওয়া করে।

 ওয়াল্টার, ঘুরে বসল ন্যাশ, আইল-এর ওদিকে বসা চশমা পরা টাক মাথার এক লোককে বলল সে, আমাকে একটু সাহায্য করুন। প্রফেসর রেসকে আইডলের গল্পটা শোনাতে চাইছি।

নিজের সিট থেকে উঠে এসে রেসের সামনের একটা সিটে বসল ওয়াল্টার চেম্বার। ছোটখাটো দেখতে, টাকটা মাথার তিন-চতুর্থাংশ জুড়ে, বইয়ের পোকা, এবং কাজের সময় বো-টাই পরে।

 উইলিয়াম রেস। ওয়াল্টার চেম্বারস, পরিচয় করিয়ে দিল ন্যাশ ওয়াল্টার স্টানফোর্ডের একজন অ্যানথ্রপলজিস্ট। মধ্য আর দক্ষিণ আমেরিকান কালচার সম্পর্কে এক্সপার্ট-মায়ান, অ্যাজটেক, ওলমেকস আর বিশেষ করে ইনকা সংস্কৃতি।

 হাসল চেম্বারস। আপনি তা হলে আইডলটা সম্পর্কে জানতে চান?

তাই, তো, রেস বলল।

ইনকারা ওটাকে দ্য স্পিরিট অব দি পিপল বলত, চেম্বারস বলল। পাথরের তৈরি, তবে সে আশ্চর্য এক পাথর, চকচকে কালো রক্তবেগুনী রঙের অতি সূক্ষ্ম শিরা চলে গেছে ভেতর দিয়ে।

 ইনকাদের সবচেয়ে মূল্যবান আইডল ছিল ওটা। নিজেদের আত্মা আর হৃৎপিণ্ড বলে মনে করত ওটাকে তারা। আক্ষরিক অর্থে তাই মনে করত। তারা জনগণের আত্মার শক্তি হিসেবে দেখত তাদের নিজেদের শক্তির তুলনায়। মনে করত নিজেদের সমস্ত শক্তি উৎস। আসলে ওটার যাদুকরী শক্তি সম্পর্কে নানান গল্প প্রচলিত ছিল। কীভাবে হিংস্র জন্তুকে পোষ মানায় পানিতে ডোবালে কীভাবে গান গায়।

গান? জিজ্ঞেস করল রেস।

 ঠিক তাই, বললেন চেম্বারস। গান গায়।

 বেশ। তা আইডলটা দেখতে কেমন?

পেরু দখলের ইতিহাস যারা লিখেছেন তাদের অনেকের লেখাতেই আইডলটার বিবরণ আছে, কেউ লিখেছেন এক ফুট অন্যজন লিখেছেন ছয় ইঞ্চি; কারো বর্ণনায় অত্যন্ত নিখুঁত শিল্পকর্ম, স্পর্শ করলে মসৃণ লাগে, অন্যজন বলেছেন কিনারাগুলো তীক্ষ্ণ আর কর্কশ। তবে প্রত্যেকের বর্ণনা একটি বিষয়ে মিলে যায়। স্পিরিট অব দ্য পিপল হিংস্র জাওয়ারের মাথার আদলে তৈরি।

 চেম্বারস একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বসল। আইডলটার কথা শোনার পর থেকে হার্নান্দো পিজারো ওটা নিজের কাছে পেতে চাইল।

 অস্থিরতা জেদে পরিণত হয় পাচাকামাক-এর মন্দিরের পুরোহিতরা তার নাকের সামনে থেকে মূর্তিটা নিয়ে ভেগে যাওয়ায়। পেরুতে আসা পিজারে ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুর ছিল এই হার্নান্দো পিজারো। আজ বোধহয় আমি তাকে সাইকোপ্যাথ বলতে পারি। কিছু রিপোর্ট থেকে জানা যায় একটা গ্রামের সমস্ত লোকের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে সে শুধু মজা পাওয়ার জন্যে। আর আইডলটাকে খুঁজে বের করাতে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। একের পর এক গ্রাম আর শহরে হন্যে হয়ে ফিরেছে সে, সবাইকে জিজ্ঞেস করেছে আইডলটা কোথায়। কিন্তু যত মানুষকেই অত্যাচার করুক, যত গ্রামই জ্বালিয়ে দিক, ইনকারা তাকে বলবে না কোথায় আছে তাদের পবিত্র আইডল।

কিন্তু ১৫৩৫ সালে কীভাবে যেন জেনে ফেলে হার্নান্দো কোথায় রাখা হয়েছে সেটা। বেদখল হয়ে যাওয়া কুজকো শহরের মাঝখানে অবস্থিত কোরিকানিচা, বিখ্যাত সূর্যমন্দিরে, পাথরের তৈরি বিরাট একটা ভল্টের ভেতরে।

হার্নান্দোর দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, কুজকোয় পা দিয়েই সে দেখল রেনকো কানেক নামে এক তরুণ ইনকা রাজপুত্র আইডলটা নিয়ে স্প্যানিশ আর ইনকান ফ্রন্টলাইনের ভেতর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে পালাচ্ছে। মধ্যযুগের সন্ন্যাসীদের ভাষ্য অনুসারে, কুজকো থেকে রেনকোর পালান আর তাকে এই ধাওয়া করার রোমাঞ্চকর কাহিনিই সান্টিয়াগোর ম্যানুস্ক্রিপ্টে বর্ণনা করা হয়েছে। এই ধাওয়া আন্দেজ পর্বতমালা পার হয়ে আমাজন রেইন ফরেস্টে শেষ হয়।

ম্যানুস্ক্রিপ্টে বিস্তারিত বলা হয়েছে, বলল ন্যাশ। স্পিরিট অব দ্য পিপল কোথায় আছে, তাও নাকি বলা হয়েছে।

 তারমানে সে-ই আইডলটা উদ্ধার করতে চাইছে ওরা, রেস বলল।

কিছুই বলল না সে, কারণ এতে কিছুই দাঁড়ায় না এই মুহূর্তে। আর্মি নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্টদের একটা টিমকে নিখোঁজ ইনকার আইডল উদ্ধার করে আনতে দক্ষিণ আমেরিকায় পাঠাবে কেন? তাও আবার সাড়ে চারশো বছরের পুরান একটা ল্যাটিন ম্যানুস্ক্রিপ্টের উপর ভিত্তি করে? এ তো জলদস্যুদের ট্রেজার ম্যাপ অনুসরণ করার মতো একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

 জানি কী ভাবছেন, বললেন ন্যাশ। এক সপ্তাহ আগে আমাকে কেউ এই গল্প শোনালে আমিও তাই ভাবতাম। কিন্তু দুই সপ্তাহ আগে কেউ জানতই না সান্টিয়াগোর ম্যানুস্ক্রিপ্ট কোথায় আছে।

কিন্তু এখন তো জিনিসটা পেয়েছেন, বলল রেস।

না, তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল ন্যাশ। আমরা ওটার একটা কপি পেয়েছি। মূল ম্যানুস্ক্রিপ্ট কারো কাছে আছে।

কার কাছে?

 ইঙ্গিতে রেসের কোলের উপর পড়ে থাকা ফোল্ডারটা দেখাল ন্যাশ। আমার দেয়া নিউজ পেপার আর্টিক্যালটা পড়েছিলেন? পিরানিজের মনাস্ট্রিতে জেসাইট সন্ন্যাসীরা খুন হয়ে গেছে?

হ্যা…

 আঠারো জন সন্ন্যাসী খুন হয়েছে। অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্র দিয়ে ক্লোজ র‍্যাঞ্জ থেকে গুলি করা হয়েছে। প্রাথমিক দৃষ্টিতে মনে হয়েছিল আলজিরিয়ান সন্ত্রাসীদের কাজ। তারা জানে আইসোলেটেড একটা মনাস্ট্রিতে আক্রমণ করেছে এবং তাদের প্রিয় এম.ও. ক্লোজ রেঞ্জ গুলিতে মারা যায় নি। ফ্রেঞ্চ প্রেস তেমনটাই প্রকাশ করেছে।

কিন্তু, একটা আঙ্গুল তুলে বলল ন্যাশ, প্রেস কেন জানতে পারেনি যে একজন সন্ন্যাসী পালাতে পেরেছে। অল্পবয়েসি এক আমেরিকান, ওই মনাস্ট্রিতে শুভেচ্ছা সফরে ছিল। ওখান থেকে পালিয়ে প্যারিসে আমাদের দূতাবাসে আশ্রয় নেয়, দূতাবাসের সি আই এ চিফ উপস্থিত ছিলেন

 তারপর?

ন্যাশ চিকন দৃষ্টিতে রেসের দিকে তাকাল।

যারা মনাস্ট্রিতে আক্রমণ করেছিল তারা আলজিরিয়ান টেররিস্ট ছিল না, প্রফেসর রেস। ওরা কমান্ডো। সৈন্য। সাদা সৈন্য। প্রত্যেকের মুখে ছিল কালো স্কি মাস্ক এবং তারা দুর্দান্ত বেশ কিছু অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। আর ওরা নিজেদের মধ্যে জার্মান ভাষায় কথা বলছিল।

আরো কৌতূহল উদ্দীপক ছিল, ন্যাশ বলে যেতে লাগল, যে, কমান্ডোরা সকল সন্ন্যাসীদের অ্যাবের ডাইনিং হলে জড়ো করে এবং মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখে। তারপর তারা একজন সন্ন্যাসীকে ধরে জানতে চায় কোথায় রাখা হয়েছে সান্টিয়াগোর ম্যানুস্ক্রিপ্ট। সন্ন্যাসী যখন জানাল যে সে জানে না কোথায় আছে, ওরা দুজন সন্ন্যাসীকে গুলি করে হত্যা করল। তারপর আবার জিজ্ঞেস করল। আবার যখন বলল সে জানে না, ওরা পাশের দুজনকে হত্যা করল। এইভাবে বলতে থাকলে ওরা সকলেই মারা যাবে কিন্তু একজন সামনের দিকে এগিয়ে এল, বলল ম্যানুস্ক্রিপ্ট কোথায় আছে সে জানে।

জেসাস… রেস বলল।

ব্রিফকেস থেকে ফটোগ্রাফ বের করল ন্যাশ। লোকগুলো নিষ্ঠুরতা আমাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে, এই লোকটা সব কিছুর জন্য দায়ী, হেনরিক অ্যানিসটাজ, ইস্ট জার্মান সিক্রেট পুলিশ অর্থাৎ টাসির অবসরপ্রাপ্ত মেজর।

ফটোটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখল রেস। এইট-বাই-টেন সাইজ গ্লোসি কাগজে ছাপা ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক ব্যক্তি একটি গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। ছোট করে ছাঁটা কালো চুল সামনের দিকে আঁচড়ান। চোখ দুটো ছোট ছোট। চোখের দৃষ্টি কঠিন এবং ঠাণ্ডা। চিরস্থায়ী তীর্যক দৃষ্টি চোখে। মধ্য চল্লিশ হবে তার বয়স।

বাম হাতটা দেখুন, বলল ন্যাশ।

রেস ছবিটা ভালো করে দেখল। লোকটার বাম হাতটা গাড়ির দরজার ওপর রাখা। দেখল রেস।

হেনরিক অ্যানিস্টাজের কোনো মধ্যমা আঙুল নেই।

কোল্ড ওয়ারের সময় অ্যানিসটাজ ইস্ট জার্মান ক্রাইম সিন্ডিকেটের হাতে ধরা পড়ে টাসি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ওরা তার আঙুলটা কেটে উপরওয়ালার কাছে মেইল করে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু অ্যানিসটাজ পালাতে সক্ষম হয় এবং ফিরে আসে–ফিরে আসে টাসির পূর্ণ সমর্থন নিয়ে। বলার অপেক্ষা রাখে না সংগঠিত অপরাধ কমিউনিস্ট জার্মানীর কোনো সমস্যা ছিল না।

আমাদের কাছে আরো বেশি জরুরি হল, তার পদ্ধতিটা নিয়ে। লক্ষ্য করে দেখুন, অ্যানিসটাজ অদ্ভুতভাবে মানুষদের সাথে কথা বলছে : সে মানুষকে সহজেই হত্যা করতে পারে যে মানুষটা তথ্য দিতে না পারলে।

অল্পক্ষণ সকলেই নীরব রইল।

আমাদের সাম্প্রতিক তথ্য হল, ন্যাশ বলল, কোল্ড ওয়ারের শেষের দিকে ইউনিফাইড জার্মান সরকারের হয়ে নন-অফিসিয়াল গুপ্তঘাতক ছিলেন তিনি।

তার মানে জার্মানদের কাছে আসল ম্যানুস্ক্রিপ্টটা আছে, রেস বলল। আপনি কিভাবে আপনার কপিটা জোগাড় করবেন?

বিজ্ঞের টং-এ মাখা নাড়ল ন্যাশ।

সন্ন্যাসীরা জার্মানদের আসল ম্যানুস্ক্রিপ্টটা দিয়েছে। আসল, অলঙ্কিত নয়, আলাবাটো সান্টিয়াগোর হাতে লেখা ম্যানুস্ক্রিপ্ট।

 সন্ন্যাসীরা জার্মানদের বলে নি, ১৫৯৯ সালে, সান্টিয়াগোর মৃত্যুর পর অন্য আরেকজন ফ্রান্সিসকাস সন্ন্যাসী সান্টিয়াগোর হাতে লেখা ম্যানুস্ক্রিপ্টটা আরো বিশদভাবে এবং অলঙ্কিতভাবে নকল করতে শুরু করেছিল যাতে রাজার কাছে পেশ করা যায়। দুর্ভাগ্যবশত, দ্বিতীয় সন্ন্যাসী নকল করার কাজটা শেষ করার আগেই মারা যান, কিন্তু সান্টিয়াপোর দ্বিতীয় ম্যানুস্ক্রিটটার কপিতে কি ছিল, এটার কিছু অংশ ছিল স্যান স্যাবাস্তিয়ান অ্যাবেতে। ওই ম্যানুস্ক্রিপ্টের জেরোক্স কপি আমরা পেয়েছি।

রেস তার হাত তুলল।

ওকে, ওকে, বলল সে। এক মিনিট। ইনকান আইডলটার জন্য এই হত্যাকাণ্ড এবং ষড়যন্ত্র? ইউএস এবং জার্মান সরকার যেন চারশো বছরের পুরান একটা পাথরের পেছনে দৌড়াচ্ছ কেন?

ন্যাশ, রেসের দিকে তাকিয়ে হাসল।

প্রফেসর, আমরা এই আইডলটার পেছনে দৌড়চ্ছি না, বলল সে যে পদার্থ দিয়ে ওটা তৈরি তার পেছনে দৌড়চ্ছি।

কি বলতে চাইছেন?

প্রফেসর, আমি যা বলতে চাইছি তা হল : আমরা বিশ্বাস করি স্পিরিট অব পিপল উল্কাপিণ্ড থেকে তৈরি।

জার্নাল আর্টিকেল, রেস বলল।

 ঠিক, বলল ন্যাশ। বন বিশ্ববিদ্যালয়ের আলবার্ট মুলারের লেখা। অকালে মারা যাবার আগে কুজকো থেকে পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণ-পুবে, পেরুর গভীর জঙ্গলে এক মাইল চওড়া একটা গর্ত স্টাডি করছিলেন মুলার। গর্তটার আকার আর সেটার ওপর জঙ্গল বেড়ে ওটার গতি মেপে সিদ্ধান্তে পৌঁছান, ১৪৬০ থেকে ১৪৭০ সালের মধ্যে কোনো এক সময় দুই ফুট ডায়ামিটারের একটা হাই-ডেনসিটি উল্কা পড়েছিল ওখানে।

 যা, ওয়াল্টার চেম্বারস যোগ করল, কাকতালীয়ভাবে দক্ষিণ আমেরিকায় ইনকাদের উত্থানের সঙ্গে সময়টা মিলে যায়।

 আমাদের জন্যে আরো গুরুত্বপূর্ণ হল, বলল ন্যাশ, মুলার গর্তের গায়ে আবিষ্কার করেছিলেন, নমুনাটা তিনি দেয়ালে পান যা থাইরিয়াম-২৬১ নামে পরিচিত।

থাইরিয়াম-২৬১? রেস জিজ্ঞেস করল।

কমন এলিমেন্ট থাইরিয়ামেরই একটা আইসোটোপ, বলল ন্যাশ। পৃথিবীতে পাওয়া যায় না। ইন ফ্যাক্ট থাইরিয়াম এখানে শুধু শিলিভূত অবস্থায় পাওয়া গেছে, দূরবর্তী বছরগুলোতে উল্কাপাতের ফলে। এসেছে আমাদের খুব কাছের প্লিয়াডেস জগত এবং বাইনারী স্টার সিস্টেম থেকে। কিন্তু বাইনারী স্টার সিস্টেম থেকে আসায় দুনিয়ার যে-কোনো ভারী পদার্থের চেয়ে থাইরিয়ামের ঘনতু অনেক বেশি।

ধীরে ধীরে ব্যাপারটা অল্প বিস্তর পরিষ্কার হচ্ছে রেসের কাছে। বিশেষ করে আর্মি একটি ফিজিস্টিস্ট টিম জঙ্গলে পাঠিয়েছিল তা বুঝেছে।

 থাইরিয়াম দিয়ে ঠিক কী করা যায়? জানতে চাইল ও।

কর্নেল! হঠাৎ কে যেন ডাকল।

ন্যাশ এবং রেস ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল, দেখল আরেক বিজ্ঞানী, ককপিট থেকে বেরিয়ে আইল ধরে ওদের দিকে হেঁটে আসছেন। কোপল্যান্ড যথেষ্ট লম্বা, একহারা, ঈগলের মতো মুখ, সরু চোখ। সে অন্যতম ডারপা-র সদস্য, নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট, প্রথমবার দেখেই রেসের মনে হয়েছিল লোকটার মধ্যে বোধহয় রসকষ বলে কিছু নেই।

কর্নেল, আমাদের একটা সমস্যা হয়েছে, বলল সে।

কী সমস্যা? জানতে চাইল ন্যাশ।

এইমাত্র ফেয়ারফ্যাক্স ড্রাইভ থেকে প্রচার করা একটা প্রায়োরিটি অ্যালার্ট ধরেছি আমরা, কোপল্যান্ড বলল।

রেস আগেই ফেয়ারফ্যাক্স ড্রাইভের কথা শুনেছিল। এটা হল ৩৭০১ নর্থ ফেয়ার ফ্যাক্স ড্রাইভ আর্লিংটন, ভার্জিনিয়া। ডারপা হেডকোয়ার্টারের সংরক্ষিতকরণ।

কী বিষয়ে জানতে চাইল ন্যাশ।

বড় করে শ্বাস নিল কোপল্যান্ড। আজ ভোরের দিকে তোক ঢুকেছিল ওখানে। সতেরজন সিকিউরিটি স্টাফ খুন হয়েছে। নাইট ক্রুদের সকলেই।

ন্যাশের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তারা নিশ্চয়ই-

গম্ভীর মুখে মাথা ঝাঁকাল কাপল্যান্ড। সুপারনোভা নিয়ে গেছে।

 এক মুহূর্ত ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল লয়েড।

শুধু ওটাই নিয়ে গেছে, বলল কোপল্যান্ড। তারা জানত জিনিসটা কোথায় রাখা আছে। ভল্ট রুমে ঢোকার কোড জানত, ওরা কার্ড-কি নিয়ে এসেছিল তালা খোলার জন্য। আমাদেরকে ধরে নিতে হবে ডিভাইসটায় যে টাইটানিয়াম এয়ার লক আছে, তার কোডও তারা জানে, হয়তো কিভাবে ডিটোনেট করতে হবে তা-ও তাদের জানা আছে।

বোঝা যাচ্ছে কি, কাদের কাজ হতে পারে?

এনসিআইএস এখন ওখানে তদন্ত করে দেখছে। প্রাথমিক লক্ষণ দেখে সন্দেহ করা হচ্ছে প্যারা মিলিটারি গ্রুপের মতো ফ্রিডম ফাইটাররা এ কাজ করেছে।

শিট! বলল ন্যাশ। শিট! তার মানে আইডলটার কথা তারা জানে।

তাই মনে হয়।

তাহলে তো আমাদেরকেই ওখানে প্রথমে পৌঁছাতে হবে।

আমি একমত, বলল কাপল্যান্ড।

রেস টেনিস খেলার দর্শকদের মতো কথোপকথন লক্ষ্য করে গেল মাত্র। তা হলে ডারপা হেডকোয়ার্টারে চোর ঢুকিছিল, কিন্তু কি চুরি করছে সেটা তখন তার কাছে রহস্য। সুপার নোভা নামে কিছু একটা। আর এই ফ্রিডম ফাইটাররা কারা?

উঠে দাঁড়াল ন্যাশ। আমরা কতটা এগিয়ে আছি? জানতে চাইল সে।

 হয়তো তিন ঘণ্টা, যদি এগিয়ে থাকি কোপল্যান্ড বলল।

তাহলে তো আমাদের দ্রুত মুভ করতে হবে। ঘুরে রেসের দিকে তাকাল ন্যাশ। প্রফেসর রেস, দুঃখিত, খেলাটার গুরুত্ব আর ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে। নষ্ট করার মতো সময় নেই আমাদের। কুজকোয় পৌঁছাবার আগেই ম্যানুস্ক্রিপ্টটা অনুবাদ শেষ হওয়া চাই। কারণ মার্টিতে নামার সাথে সাথেই, বিশ্বাস করুণ, আমাদের দৌড়তে হবে।

ন্যাশ, কোপল্যান্ড এবং চেম্বারস প্লেনের আরেক অংশে চলে গেল, রেসকে ম্যানুস্ক্রিপ্টসহ একলা রেখে।

ম্যানুস্ক্রিটের প্রথম পাতাটার ওপর চোখ বুলিয়ে উল্টাল রেস, চোখ বুলাল ফটোকপির ওপর। দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে পরের পাতাটা উল্টাল।

দেখল মধ্যযুগীয় ক্যালিওগ্রাফিতে সুন্দর করে লেখা : মিডম নোমিনাস এস্ট আলবার্তো লুইস সান্টিয়াগো এট ইল্লে এস্ট মিডম রেস…

অনুবাদ করল সে। আমার নাম আলবার্তো লুইস সান্টিয়াগো আর এই হল আমার গল্প…!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *