১১. মিম : নতুন অনুলিপনকারী

অধ্যায় ১১: মিম : নতুন অনুলিপনকারী

এতক্ষণ পর্যন্ত বিশেষ করে মানুষের ব্যাপারে আমি বেশী কিছু বলিনি, আলোচনা থেকে যদিও মানুষকে আমি ইচ্ছাকৃতভাবে বাদও দেইনি। ‘সারভাইভাল মেশিন’ বা টিকে থাকার যন্ত্র শব্দটি ব্যবহার করার আংশিক কারণ হচ্ছে, ‘প্রাণী’ শব্দটি ব্যবহার করলে সেটি উদ্ভিদদের এই আলোচনার বাইরে রাখতো, এবং কিছু মানুষের মনে, মানুষদেরকেও। যে যুক্তিগুলো আমি প্রস্তাব করেছি এখানে সেগুলো, প্রথম দৃষ্টিতে, যে-কোনো বিবর্তিত জীবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিৎ। যদি কোনো প্রজাতিকে তালিকা থেকে বাদ হতে হয়, সেটিকে অবশ্যই সুনির্দিষ্টভাবে উপযুক্ত কিছু কারণে হতে হবে। আমাদের নিজেদের প্রজাতি স্বতন্ত্রভাবে অনন্য– এমন কিছু মনে করার কি ভালো কোনো কারণ আছে? আমি বিশ্বাস করি এর উত্তর, হ্যাঁ।

মানুষের ক্ষেত্রে যা কিছু ব্যতিক্রম সেগুলো সব একটি মাত্র শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যেতে পারে: ‘সংস্কৃতি। আর আমি এই শব্দটি ব্যবহার করছি সংস্কৃতিহীনতার প্রতি একটি অবজ্ঞা অর্থে না, বরং একজন বিজ্ঞানী যে অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেন সেই অর্থে। সাংস্কৃতিক কোনো কিছুর বিস্তার বা হস্তান্তর প্রক্রিয়ার সাথে জিনগত বিস্তার বা হস্তান্তরণ সদৃশ এই অর্থে যে, যদিও মৌলিকভাবে রক্ষণশীল একটি অর্থে, এটিও একধরনের বিবর্তনের সূচনা করতে পারে। জিওফ্রে চসার তার সমসাময়িক ইংরেজী ভাষা ব্যবহার করে আধুনিক কোনো ইংরেজীভাষীর সাথে কথোপথন চালিয়ে যেতে পারবেন না, যদিও তাদের মধ্যে সম্পর্কের সেতুবন্ধন রচনা করে আছে অবিচ্ছিন্ন প্রায় বিশটি প্রজন্মের ইংরেজরা, যাদের প্রত্যেকেই সেই ধারাবাহিক বংশধারার শৃঙ্খলের পার্শবর্তী প্রতিবেশীর সাথে কথা বলতে পারবেন, যেমন করে কোনো পুত্র তার পিতার সাথে কথা বলে থাকে। প্রতীয়মান হয় যে ভাষা বিবর্তিত হয় জিনগত নয় এমন কোনো উপায়ে এবং এমন একটি হারে, যা জিনগত বিবর্তনের চেয়ে বেশ কয়েকগুণ দ্রুত।

সাংস্কৃতিক এই বিস্তার বা হস্তান্তরণ শুধু মানুষেরই অনন্য কোনো বৈশিষ্ট্য নয়। মানুষ নয় এমন কোনো প্রাণীদের ক্ষেত্রে আমার জানা এর সবচেয়ে সেরা উদাহরণটি সাম্প্রতিক সময়ে যা বর্ণনা করেছেন পি. এফ. জেনকিন্স ‘স্যাডলব্যাক’ পাখিদের গানে, যারা বাস করে নিউ জিল্যান্ডের কাছাকাছি একটি দ্বীপে। বিশেষ যে দ্বীপে তিনি গবেষণা করেছিলেন, সেখানে স্যাডলব্যাক পাখিদের সংগ্রহে মোট নয়টি সুস্পষ্টভাবে পৃথক গান ছিল। কোনো পুরুষ পাখি সেই গানগুলো থেকে শুধু একটি বা অল্প কয়েকটি কেবল গাইতে পারে। পুরুষদের এইভাবে ভিন্ন ভিন্ন ডায়ালেক্ট গ্রুপে শ্রেণী বিন্যস্ত করা যেতে পারে। যেমন, আটটি পুরুষ পাখির একটি গ্রুপ তাদের পাশের এলাকা থেকে ভিন্ন কারণ তার একটি বিশেষ গান গায়, যার নাম ‘সিসি সং। অন্য ডায়ালেক্ট বা উপভাষাগত গ্রুপরা ভিন্ন ভিন্ন গান গায়। কখনো কোনো একটি ডায়ালেক্ট গ্রুপের সদস্যরা একাধিক সুনির্দিষ্ট গান ব্যবহার করে। বাবা এবং ছেলের গানের তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ করে জেনকিন দেখিয়েছিলেন গানের প্যাটার্নটি জিনগতভাবে হস্তান্তরিত হচ্ছে না। প্রতিটি তরুণ পুরুষ পাখি তার এলাকার প্রতিবেশীকে অনুকরণ করে কোনো গানকে বেছে নিচ্ছে, মানুষ যেমন করে ভাষা গ্রহন করে সেভাবে। বেশীর ভাগ সময় যখন জেনকিন্স সেই দ্বীপে ছিলেন সেখানে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক গান ছিল, একধরনের গানে সম্ভার বা সং পুল, যেখান থেকে তরুণ পুরুষ পাখিরা তাদের নিজেদের সংগ্রহের গান বেছে নেয়। কিন্তু মাঝে মাঝে জেনকিনসের সৌভাগ্য হয়েছিল নতুন গানের আবিষ্কার হতে দেখতে, পুরোনো কোনো একটি গান অনুকরণের সময় সৃষ্ট ভুলের মাধ্যমে যেটি ঘটে। তিনি লেখেন: ‘নতুন গানের রুপগুলোকে দেখা গেছে নানা ভাবে উদ্ভব হতে, কোনো একটি নোটের পিচ পরিবর্তন, বা কোনো একটি নোটের পুনরাবৃত্তি, কোনো নোটে ধ্বনিলোপ, অন্যান্য কোনো গানের নানা অংশের সম্মিলন, ইত্যাদির মাধ্যমে। নতুন রুপের কোনো গানের আবির্ভাব খুবই আকস্মিক একটি ঘটনা এবং বেশ কয়েক বছরের জন্য এই ঘটনার ফলে সৃষ্ট বিষয়টি মোটামুটি স্থিতিশীল থাকে। এছাড়াও বেশ কিছু ক্ষেত্রে এই ভিন্ন রুপটি নিখুঁতভাবে ছড়িয়ে পড়ে এর নতুন রুপে তরুণদের মধ্যে, সুতরাং একটি একই ধরনের শিল্পীদের শনাক্তযোগ্য সম্মিলিত গ্রুপ গড়ে ওঠে। জেনকিন এই নতুন গানের সৃষ্টিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। ‘সাংস্কৃতিক একটি মিউটেশন’ হিসাবে।

স্যাডলব্যাক পাখিদের মধ্যে সংগীত সত্যিকারভাবে নন-জেনেটিক বা জিনগত নয় এমন উপায়ে বিবর্তিত হয়। বানর এবং পাখিদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিবর্তনের আরো উদাহরণ আছে, কিন্তু লক্ষণীয়ভাবে এগুলো বেশ ব্যতিক্রম কিছু ঘটনা। সাংস্কৃতিক বিবর্তন কি করতে পারে, সেটি আমাদের নিজেদের প্রজাতিতেই শুধুমাত্র আমরা সত্যিকারভাবে দেখতে পাই। অনেকগুলোর মধ্যে ‘ভাষা’ হচ্ছে শুধুমাত্র একটি উদাহরণ। কাপড় কিংবা খাদ্যাভাসের রীতি, নানা আচার অনুষ্ঠান এবং সামাজিক প্রথা, শিল্পকলা এবং স্থাপত্য, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, সব বিবর্তিত হয়েছিল ঐতিহাসিক সময়ে এমন একটি উপায়ে যা দেখতে অনেক দ্রুতহারে চলমান জিনগত বিবর্তনের মতই মনে হয়, কিন্তু যার আসলেই জিনগত বিবর্তনের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। জিনগত বিবর্তনের মতই যদিও পরিবর্তন হতে পারে ক্রমবর্ধিষ্ণু। অবশ্যই একটি অর্থে, যেখানে আধুনিক বিজ্ঞান প্রাচীন বিজ্ঞান অপেক্ষা আসলেই উত্তম। বহু শতাব্দী অতিক্রান্ত হয়ে এখন মহাবিশ্ব সম্বন্ধে আমাদের জানার পরিধিই শুধু বদলে যায়নিঃ এটি ক্রমোন্নয়নও ঘটেছে। স্বীকার করতে হবে যে, জ্ঞানার্জনের এই সাম্প্রতিক বিস্ফোরণটির সময়কাল অতীতে বিস্তৃত কেবল রেনেসাঁ অবধি, যা পূর্ববর্তী সময়টি ছিল হতাশাজনকভাবে নিষ্ক্রিয় এবং আবদ্ধতার একটি পর্ব, যখন ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি ছিল স্থির সেই পর্যায় অবধি, যা গ্রিকরা এর পূর্বে অর্জন করেছিল। কিন্তু যেমন, আমরা অধ্যায় ৫ এ দেখেছি, জিনগত বিবর্তনও এমন সংক্ষিপ্ত হঠাৎ ব্যস্ত সময়ের ধারাক্রম হতে পারে, যাদের অন্তবর্তীকালীন পর্বে স্থিতিশীল পরিস্থিতিগুলো আমরা লক্ষ করি।

 সাংস্কৃতিক এবং জিনগত বিবর্তনের তুলনামূলক উদাহরণ প্রায়শই উল্লেখ করা হয়েছে, কখনো সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় রহস্যময়তার আবরণে। বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে জিনগত বিবর্তন বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করেছেন স্যার কার্ল পপার। আমি সেই দিক বরাবর আরো অগ্রসর হতে চাই, যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন, যেমন, জিনতাত্ত্বিক এল, এল, কাভালি এসফোরজা, নৃতাত্ত্বিক এফ. টি. ক্লোক এবং প্রাণি-আচরণ বিশেষজ্ঞ জে. এম, কালেন।

একজন উৎসাহী ডারউইনবিদ হিসাবে, আমার অন্যান্য সহযোগী উৎসাহী ডারউইনবিদদের ব্যাখ্যাগুলোয় আমি সন্তুষ্ট না, মানুষের আচরণের ব্যাখ্যা হিসাবে যা কিছু তারা প্রস্তাব করেছিলেন। তারা মানব সভ্যতার বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোর ‘জৈববৈজ্ঞানিক সুবিধাগুলো অনুসন্ধান করতে চেষ্টা করেছিলেন। যেমন, গোত্রগত ধর্মকে গ্রুপ ‘সংহতি’ ও ‘পরিচয়’ দৃঢ় করার একটি মাধ্যম হিসাবে দেখা হয়। দল বেধে শিকার করা, প্রাণীদের মধ্যে যা বিশেষভাবে গুরুতুপূর্ণ, যখন সদস্যরা আরো বড় এবং দ্রুত প্রাণী শিকার করতে পরস্পর সহযোগিতা করে। প্রায়শই বিবর্তনীয় প্রাকধারণা, যার উপর এই তত্ত্বগুলো তাদের ভিত্তি রচনা করে, সেগুলো পরোক্ষভাবে গ্রুপ সিলেকশনবাদী, কিন্তু অর্থোডক্স বা মূলধারার ‘জিন সিলেকশন’ তত্ত্ব দ্বারা এই তত্ত্বগুলোকে নতুন করে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। মানুষ খুব সম্ভবত গত কয়েক মিলিয়ন বছর সময়কালের বড় একটি অংশ ‘কিন’ বা আত্মীয়দের ক্ষুদ্র গোষ্ঠী হিসাবে বসবাস করে এসেছে। কিন সিলেকশন এবং পারস্পরিক পরার্থবাদীতার জন্য নির্বাচন হয়তো আমাদের অনেকগুলো মৌলিক মনোজাগতিক বৈশিষ্ট্য এবং প্রবণতা সৃষ্টি করতে মানব জিনের উপর কাজ করেছে। এই ধারণাগুলো যেভাবে প্রস্তাবিত হয়েছে, সেখানে সম্ভাব্য এবং ব্যাখ্যাযোগ্য আপাতগ্রাহ্যতা আছে, যত দূর সম্ভব এটি ভাবা যেতে পারে। কিন্তু আমার মনে করি, সেগুলো সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক বিবর্তন এবং পৃথিবী মানব সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বিশাল পার্থক্যগুলো ব্যাখ্যা করার সমীহ জাগানো চ্যালেঞ্জটি মোকাবেলা করতে পারেনা, যেমন: উগান্ডার ‘ইক’দের চূড়ান্ত স্বার্থপরতা থেকে– যা ব্যাখ্যা করেছিলেন কলিন টার্নবুল– মার্গারেড মীডের বর্ণিত ‘আরাপেশ’দের বিনম্র পরার্থবাদীতা। আমি মনে করি আমাদের আবার শুরু করতে হবে এবং প্রথম মূলনীতি থেকেই আবার শুরু করতে হবে। এবং আমি যে যুক্তি প্রস্তাব করবো, বিস্ময়কর মনে হতে পারে, যখন কিনা এটি এমন কেউ প্রস্তাব করছে যিনি এই বইয়ের আগের অধ্যায়গুলো লিখেছেন। সেটি হচ্ছে, আধুনিক মানুষের বিবর্তন সম্বন্ধে একটি বোধগম্যতা অর্জন করতে আমাদের অবশ্যই শুরু করতে হবে বিবর্তন সংক্রান্ত সকল ধারণার একমাত্র ভিত্তি হিসাবে জিনের ধারণাটিকে বাদ দিয়ে। আমি একজন তীব্র উৎসাহী ডারউইনবাদী, এবং আমি মনে করি জিনের সংকীর্ণ ধারণায় সীমাবদ্ধ হয়ে থাকার জন্য ডারউইনবাদ আসলেই অনেক বড় একটি তত্ত্ব। জিন আমার এই মূল প্রস্তাবনায় অবশ্যই থাকবে, তবে শুধুমাত্র তুলনামূলক উদাহরণ হিসাবে, তার বেশী কিছু নয়।

সর্বোপরি, জিনদের সেই বিশেষ বিশেষত্বটি কি? এর উত্তর হচ্ছে। তারা হচ্ছে রেপ্লিকেটর বা অনুলিপনকারী। আমাদের অভিগম্য এই মহাবিশ্বে সর্বত্র পদার্থবিদ্যার সূত্র একই রকম হবার কথা। জীববিজ্ঞানেরও কি এমন কোনো মূলনীতি আছে, যেগুলোরও ঠিক একই রকম বিশ্বজনীন সত্যতা আছে? নভোচারীরা যখন দূরের কোনো গ্রহে অভিযানে যান এবং জীবনের অনুসন্ধান করেন, এমন জীবের অনুসন্ধান তারা পেতে পারেন বলে প্রত্যাশা করতে পারেন, যা অবশ্যই আমাদের কল্পনার চেয়েও বেশী অদ্ভুত আর অপার্থিব হবে। কিন্তু এমন কি কিছু আছে যা সব জীবনের জন্য একইভাবে সত্য হবে, যেখানেই তাদের পাওয়া যাক না কেন এবং তাদের ভিত্তিতে যে রসায়নের উপস্থিতি থাকুক না কেন? যদি জীবনের এমন কোনো রুপ থাকে, যার ভিত্তি কার্বন নয় সিলিকন অথবা পানি নয় বরং অ্যামোনিয়া, যদি এমন কোন জীব পাওয়া যায়, যারা– ১০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডেই সিদ্ধ হয়ে মারা যায়, যদি এমন কোনো জীবনের রুপ, যারা কোনো ধরনের রসায়নভিত্তিক নয় বরং কম্পমান ইলেক্ট্রনিক সার্কিটের সমষ্টি, তাহলে এমন কি কোনো সাধারণ মূলনীতি থাকবে, যা জীবনের যেকোনো রুপের জন্য সত্য হবে? অবশ্যই আমি জানি না, কিন্তু, যদি আমাকে বাজী রাখতে হয়, আমি আমার বাজী ধরবো একটি মৌলিক মূলনীতির উপর। সেটি হচ্ছে সেই সূত্র, অনুলিপনকারী সত্তাগুলোর টিকে থাকার ক্ষমতার পার্থক্যর উপর ভিত্তি করে সকল জীবন ‘বিবর্তিত হয় (১)। জিন, ডিএনএ অণু, ঘটনাচক্রে সেই অনুলিপনকারী সত্তা যা আমাদের এই গ্রহে আধিপাত্য স্থাপন করেছে। অন্য আরো এ-ধরনের সত্তা থাকতে পারে; যদি তারা থেকে থাকে, এবং যদি অন্যান্য শর্তাবলী পূর্ণ হতো, তারা প্রায় অবশ্যম্ভাবীভাবে বিবর্তন প্রক্রিয়ার ভিত্তি হতে পারতো।

 কিন্তু অন্য ধরনের অনুলিপনকারী এবং এর পরিণতিতে উদ্ভূত ভিন্ন বিবর্তন প্রক্রিয়াসমূহ খুঁজতে কি আমাদের ভিন্ন কোনো গ্রহে যেতে। হবে? আমি মনে করি একটি নতুন ধরনের অনুলিপনকারী খুব সম্প্রতি আবির্ভূত হয়েছে এই গ্রহেই, আর ঠিক আমাদের চোখের সামনেই, এখনও এটি তার শৈশবে, এখনও অদক্ষভাবে এটি ভেসে বেড়াচ্ছে আদিম জৈব মিশ্রণ বা সুপে, কিন্তু ইতিমধ্যে এটি অর্জন করেছে এমন একটি গতির বিবর্তনীয় পরিবর্তন, যা পুরোনো জিন বিবর্তনকে হাঁপানোরত অবস্থায় বহু পেছনে ফেলে রেখে অনেক দূর সামনে দৌড়ে এগিয়ে গেছে।

এই নতুন সুপটি হচ্ছে মানব সংস্কৃতির সুপ। এই নতুন অনুলিপনকারীকে চিহ্নিত করার জন্য আমাদের একটি নামের প্রয়োজন। কোনো একটি বিশেষ্য পদ যা সাংস্কৃতিক ধারণাগুলোর বিস্তার বা ছড়িয়ে পড়ার এককের ধারণাটি প্রকাশ করতে পারবে, কিংবা ‘অনুকরণ করার কোনো একক। মাইমিম’ (Mimeme) এসেছে একটি উপযুক্ত গ্রিক মূল শব্দ থেকে, কিন্তু আমি চাই এটি একটি একক স্বরধ্বণির কোনো শব্দ হোক, যা ‘জিন’ শব্দটির মতই শুনাবে, আমি আশা করছি গ্রিক বিশেষজ্ঞ বন্ধুরা আমাকে ক্ষমা করবেন, যদি আমি “মাইমিম’ শব্দটিকে সংক্ষেপিত করি, মিম (meme) শব্দে (২)। যদি কোনো সান্ত্বনার বিষয় হয়, সেকারণে আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, বিকল্পভাবে এটিকে ভাবা যেতে পারে মেমোরী বা স্মৃতি শব্দটির সাথে সংশ্লিষ্ট, অথবা ফরাসী মিম (méme) শব্দটির সাথে সম্পর্কিত। এটিকে উচ্চারণ করা উচিৎ হবে যেন এটি ‘ক্রিম’ (cream) শব্দটির সাথে ছন্দময় হয়।

 ‘মিমে’র উদাহরণ হতে পারে যেমন, কোনো সুর, ধারণা, বা কোনো বহুল ব্যবহৃত শব্দ-সমষ্টী বা ‘ক্যাচ-ফ্রেজ’, কাপড়ের ফ্যাশন, কোনো পাত্র বানানোর উপায় বা আর্চ বা খিলান তৈরী করার কৌশল। ঠিক যেভাবে জিনরা জিন পুলে শুক্রাণু বা ডিম্বাণু দ্বারা এক শরীর থেকে অন্য শরীরে প্রবেশ করার মাধ্যমে তাদের বংশ বিস্তার করে, সেভাবে একটি মস্তিষ্ক থেকে অন্য একটি মস্তিষ্কে প্রবেশ করার মাধ্যমে মিমরাও মিম পুলে বিস্তার করে এমন একটি প্রক্রিয়ায়, যেটিকে ‘বৃহত্তর’ অর্থে ‘অনুকরণের মাধ্যমে বলা যেতে পারে। যদি একজন বিজ্ঞানী কোনো একটি ভালো ধারণা সম্পর্কিত কিছু শোনেন। বা পড়েন, তিনি তার সহকর্মী ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেটি প্রচার করেন। তিনি সেটি উল্লেখ করেন তার প্রবন্ধে এবং ভাষণে। যদি সেই ধারণাটি জনপ্রিয়তা পায়, বলা যেতে পারে, একটি মস্তিষ্ক থেকে অন্য একটি মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে এটি নিজেকে বিস্তার করতে পেরেছে। আমার সহকর্মী এন.কেহামফ্রে যেমন চমৎকারভাবে এর একটি সংক্ষিপ্ত রুপ দিয়েছিলেন এই অধ্যায়ের আগের একটি খসড়া পর্যালোচনা করার সময়, .. মিমগুলোকে জীবন্ত কোনো কাঠামো হিসাবে বিবেচনা করা উচিৎ, শুধু রুপকার্থেই না বরং কারিগরী অর্থে। (৩) যখনই আপনি কোনো উর্বর মিম আমার মনের মধ্যে স্থাপন করবেন, আক্ষরিকার্থে আপনি আমার মস্তিষ্ককে পরজীবির মত অধিগ্রহন করবেন, এটিকে যা রূপান্তরিত করে সেই মিম সম্প্রচারের একটি বাহক হিসাবে, ঠিক যেমন, কোনো ভাইরাস পোষক কোষের জিনগত প্রক্রিয়াকে দখল করে নেয়। এবং এটি শুধুমাত্র বলার জন্য কোনো কিছু বলা নয় –যেমন, সেই মিমটি, ‘মৃত্যু পরবর্তী জীবনের উপরে বিশ্বাস’ আসলেই সারা পৃথিবী জুড়ে বহু মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে ভৌত একটি কাঠামো হিসাবে বহু লক্ষবার বাস্তবায়িত হয়েছে।

 ‘ঈশ্বর’ ধারণাটির কথা ভাবুন। আমাদের জানা নেই মিম সম্ভারে কিভাবে এটি আবির্ভূত হয়েছিল, হয়তো স্বতন্ত্র ‘মিউটেশন’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বহুবার এটি সৃষ্টি হয়েছে। যে-কোনো ক্ষেত্রেই, এটি সত্যিই বহু প্রাচীন। কিন্তু কিভাবে এটি নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করে? উচ্চারিত এবং লিখিত ‘শব্দের মাধ্যমে, অসাধারণ ‘সঙ্গীত’ আর ‘শিল্পকলার সহায়তায়। কিন্তু কেন এটি টিকে থাকার জন্য এত দক্ষ? কেন এর সারভাইভাল ভ্যালু এত বেশী? মনে রাখতে হবে যে ‘সারভাইভাল ভ্যালু’ এখানে জিন পুলের কোনো একটি জিনের গড় সারভাইভাল ভ্যালুকে বোঝাচ্ছে না, বরং মিম পুলে কোনো মিমের সারভাইভাল ভ্যালুকে বোঝাচ্ছে। এই প্রশ্নটির আসলে বোঝাচ্ছে: ঈশ্বর ধারণাটির কি এমন কোনো বৈশিষ্ট্য আছে, যা কোনো একটি সাংস্কৃতিক পরিবেশে এর উচ্চহারে গ্রহনযোগ্যতা ( পেট্রোন্স: জিনের ভাষায় শব্দটি বোঝায় সেই জিনটির বাহক সদস্যদের মধ্যে কি পর্যায় অবধি সেই জিন বা জিন সেটি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ফিনোটাইপ বা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশিত হয়, বাহকদের মধ্যে কত শতাংশ সেই বৈশিষ্ট্যসূচক ফিনোটাইপটি বহন করছে সেই সংখ্যাটি দ্বারা এটি পরিমাপ করা হয়) এবং স্থিতিশীলতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে? ঈশ্বর বা গড় মিমটি মিম পুলে সারভাইভাল ভ্যালুর কারণ হচ্ছে এর অসাধারণ একটি মনস্তাত্ত্বিক আবেদন। এটি উপরিভাবে ‘অস্তিত্ব সম্বন্ধে গভীর এবং জটিল দ্বন্দ্বময় প্রশ্নগুলোর সম্ভাব্য একটি উত্তর প্রদান করে। এটি প্রস্তাব করে যে এই জগতের যত অবিচার পরবর্তী জগতে সুবিচার পাবার মাধ্যমে সংশোধিত হবে। চিরস্থায়ী হাত আমাদের নিজেদের সব অক্ষমতার বিপরীততে সুরক্ষার বালিশ এগিয়ে ধরছে, যেমন, কোনো ডাক্তারের দেয়া ঔষধ-বিকল্প বা প্ল্যাসিবো, যা কাল্পনিক হওয়া সত্ত্বেও কোনো অংশেই আসল ঔষধের চেয়ে কম কার্যকরী নয়। এগুলো হচ্ছে কিছু কারণ, যা ব্যাখ্যা করে কেন ঈশ্বরের ধারণাটি অতি সহজে ধারাবাহিকভাবে একক মস্তিষ্কের প্রজন্মদের মাধ্যমে অনুলিপিকৃত হয়েছে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে, শুধুমাত্র যদিও, মানব সংস্কৃতির সৃষ্ট পরিবেশে টিকে থাকার উচ্চ ক্ষমতা (সারভাইভাল ভ্যালু) বা সংক্রমণ করার শক্তি বিশিষ্ট একটি মিম রুপে।

আমার কিছু সহকর্মী প্রস্তাব করেছিলেন, ‘গড’ মিমটির সারভাইভাল ভ্যালু সম্বন্ধে এই ব্যাখ্যা অবধারিতভাবে আরো কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। আগের বিশ্লেষণটিতে তারা সবসময়ই আশা করেন, ‘জৈববৈজ্ঞানিক সুবিধা প্রসঙ্গটিতে ফিরে যেতে। তাদের কাছে এটি যথেষ্ট না শুধুমাত্র বলা যে, ঈশ্বর ধারণাটির একটি সুবিশাল মনস্তাত্ত্বিক আবেদন আছে। তারা জানতে চান, কেন’ এর এই বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক আবেদন আছে। মনস্তাত্ত্বিক আবেদন মানে এটির আবেদন আমাদের মস্তিষ্কে, এবং জিন পুলে জিনদের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে সেই মস্তিষ্ক তার রুপ পেয়েছে। তারা কোনো একটি উপায় খুঁজে পেতে চান, যা দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চান যে, এমন কোনো মস্তিষ্ক থাকা জিনের টিকে থাকার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।

এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমি যথেষ্ট সহমর্মিতা বোধ করি এবং আমি সন্দেহ করিনা যে, আমাদের যে-ধরনের মস্তিষ্ক আছে সেই ধরনের মস্তিষ্ক আমাদের জিনগত সুবিধা দেয়। কিন্তু তাসত্ত্বেও, আমি মনে করি, এই সব সহকর্মীরা, যদি তারা খুব সতর্কতার সাথে তাদের মূল ধারণাটির মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ করেন, তারা দেখতে পারবেন, সেগুলোও বহু প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে ঠিক যেমন আমার প্রস্তাবটি দিচ্ছে বলে তারা দাবী করেছেন। মৌলিকভাবে, জিন সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো জৈববৈজ্ঞানিক প্রপঞ্চকে ব্যাখ্যা করা কেন আমাদের জন্য একটি উত্তম নীতি, তার কারণটি হচ্ছে। জিনরা অনুলিপনকারী। যখনই আদিম সুপ সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল সেখানে অণুরা তাদের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে, তখনই অনুলিপনকারীরা প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করেছিল। প্রায় তিন হাজার মিলিয়ন বছরের বেশী সময় ব্যাপী, ডিএনএ হচ্ছে একমাত্র অনুলিপনকারী, এই পৃথিবীতে যা আলোচনায় গুরুত্ব পেতে পারে। কিন্তু ডিএনএ আবশ্যিকভাবে সব সময়ের জন্য এই অধিকারের উপর একচ্ছত্রভাবে অধিকার দাবী করতে পারেনা। যখনই পরিস্থিতি অনুকুলে আসে, তখন অন্য আরেক ধরনের অনুলিপনকারীরা সেই জায়গা দখল করে, এবং তাদের নিজেদের মত করেই তারা একটি নতুন ধরনের বিবর্তন শুরু করে। একবার যখন এই নতুন বিবর্তন শুরু হয়, পুরোনো অনুলিপনকারীদের অধীনে থাকার কোনো বাধ্যবাধকতার অর্থ হয়না। পুরোনো জিন-নির্বাচিত বিবর্তন, মস্তিষ্ক সৃষ্টি করার মাধ্যমে সেই সুপের যোগান দেয়, যেখানে প্রথম মিমের উদ্ভব হয়। একবার যখন স্ব-অনুলিপি করতে সক্ষম মিমদের উদ্ভব হয়, তাদের নিজস্ব এবং অনেক দ্রুততর ধরনের বিবর্তনের সূচনা হয়। আমরা জীববিজ্ঞানীরা জিনগত বিবর্তনের ধারণাটিকে এতটাই গভীরভাবে আত্তীকরণ করেছি, আমাদের প্রবণতা আছে ভুলে যাবার যে এটি বহু সম্ভাব্য ধরনের বিবর্তনের শুধুমাত্র একটি।

অনুকরণ, আরো ব্যাপক অর্থে, হচ্ছে একটি উপায় যার মাধ্যমে মিমরা নিজেদের অনুলিপি সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু ঠিক যেমন করে সব জিনই একই রকম সফলতার সাথে নিজেদের অনুলিপি সৃষ্টি করতে পারেনা, ঠিক তেমনভাবে কিছু মিম অন্য মিমদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশী সফল হয় মিম পুলে। এটাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের একটি অ্যানালগ বা সমরুপ পরিস্থিতি। আমি সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলোর উদাহরণ উল্লেখ করেছি যা মিমদের মধ্যে অনেক উঁচু সারভাইভাল ভ্যালুর মূল কারণ। কিন্তু সাধারণভাবে তাদের অবশ্যই দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করা অনুলিপনকারীদের মতই একই রকম হতে হবে:দীর্ঘস্থায়ীত্ব, উর্বরতা, এবং বিশ্বস্ততার সাথে নিজেদের অনুলিপি করার দক্ষতা। কোনো এক কপি মিমের দীর্ঘস্থায়ী হবার ব্যাপারটা সম্ভবত আপেক্ষিকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক যেমন করে কোনো এক কপি জিনের ক্ষেত্রে এটি সত্য। যেমন, Auld Lang Syne’ বা অল্ড ল্যাঙ সাইন-এর সুরটির অনুলিপি আমার মস্তিষ্কে টিকে থাকবে শুধুমাত্র আমার বাকী জীবন অবধি (৪)। সেই একটি সুরের আরেকটি অনুলিপি যা মূদ্রিত আছে আমার সংগ্রহে থাকা ‘দ্য স্কটিশ স্টুডেন্টস সঙ বুকে’ সেটিরও সম্ভাবনা নেই আরো দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকার, তবে আমার প্রত্যাশা, এই একই সুরের বহু অনুলিপি হবে কাগজে এবং মানুষের মস্তিষ্কে আরো বহু শতাব্দী ধরে টিকে থাকবে। যেমন, জিনের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে, এর কোনো একটি নির্দিষ্ট অনুলিপির স্থায়ীত্বের তুলনায় এর উর্বরতা বা নিজেকে আরো বেশী করে অনুলিপি করতে সক্ষম হওয়ার ব্যাপারটি অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। যদি মিম একটি বৈজ্ঞানিক ধারণা হয়ে থাকে, এর প্রসার নির্ভর করবে কোনো বিজ্ঞানী জনগোষ্ঠীর কাছে এটি কতটুকু গ্রহনযোগ্য তার উপর। এর সারভাইভাল ভ্যালুর একটি স্কুল পরিমাপ। পাওয়া যেতে পারে পর পর বছর প্রতি বৈজ্ঞানিক জার্নালে এটি কত বার উল্লেখিত হয়েছে সেটি গণনা করে (৫)। যদি এটি জনপ্রিয় কোনো সুর হয়, মিম পুলে এর প্রসারের পরিমান আমরা মাপতে পারি, রাস্তায় কত সংখ্যক মানুষ সেটি শীষ দিয়ে গাইছে সেটি পরিমাপ করার মাধ্যমে। যদি এটি কোনো বিশেষ স্টাইলের রমনীদের জুতো হয়, জনসংখ্যা মিমতাত্ত্বিকরা হয়তো জুতোর দোকানে বিক্রির পরিসংখ্যান উপাত্ত ব্যবহার করতে পারেন। কিছু মিম দ্রুত প্রসারের ক্ষেত্রে কিছু জিনের মতই চমৎকার স্বল্প মেয়াদী সফলতা অর্জন করে, কিন্তু মিম পুলে দীর্ঘ মেয়াদী তেমন কোনো সফলতা অর্জন করতে পারেনা। জনপ্রিয় গানগুলো আর সুচালো স্টিলেটো হিল জুতা এর কিছু উদাহরণ। অন্য উদাহরণ, যেমন ইহুদীদের ধর্মীয় আইন, হয়তো তাদের নিজেদের প্রসার করেছে হাজার হাজার বছর ধরে, সাধারণত এর কারণ লিখিত রেকর্ডের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় স্থায়িত্ব।

 এই প্রসঙ্গটি সফল অনুলিপনকারীদের তৃতীয় বৈশিষ্ট্যটির দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে: সেটি হচ্ছে অনুলিপি করার সময় মূল কপিটির বিশ্বস্ততা রক্ষা করা বা ‘কপিইং ফিডেলিটি। এখানে আমি অবশ্যই স্বীকার করছি খানিকটা নড়বড়ে অবস্থানে আমি দাঁড়িয়ে, প্রথম দৃষ্টিতে দেখে মনে হতে পারে মিমরা আদৌ উচ্চ বিশ্বস্তপুর্ণ বা হাই ফিডেলিটি অনুলিপনকারী না। যখনই কোনো বিজ্ঞানী একটি ধারণা শোনেন এবং অন্য একজনকে সেই ধারণাটি হস্তান্তর করেন, সেটি কিছুটা পরিবর্তন করার সম্ভাবনা থাকে, যেমন, আমি গোপন করিনি যে এই বইটির ধারণার জন্য আমি আর, এ. ট্রিভার্স-এর কাছে ঋণী, কিন্তু তারপরও আমি ট্ৰিভার্সের নিজের ভাষায় বিষয়টির পুনরাবৃত্তি করিনি, আমি নিজের বক্তব্যের উদ্দেশ্যে খানিকটা রদবদল করেছি, গুরুত্ব দেবার জায়গাটি পরিবর্তিত হয়েছে, আমার নিজের ও অন্যদের ধারণার সাথে সেটি মিশিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। পরিবর্তিত রুপে মিমগুলো আপনাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এটি সেকারণেই জিনগত বিস্তারের সুনির্দিষ্ট কণাসূলভ প্রকৃতি, ‘পুরোটা-অথবা-কোনটাই না’ বৈশিষ্ট্যের সদৃশ্য নয়। দেখে মনে যেন মিমের বিস্তার ক্রমাগত মিউটেশন এবং মিশ্রণ প্রক্রিয়ার শিকার।

সম্ভাবনা আছে, সুনির্দিষ্ট কণার মত নয় আপাত এই রুপটি বিভ্রম হতে পারে, এবং জিনদের সাথে এর তুলনামূলক উদাহরণটিও ভেঙ্গে পড়ে না। মোট কথা, যদি আমরা বহু জিনগত বৈশিষ্ট্যের চরিত্র লক্ষ করি, যেমন মানুষের উচ্চতা অথবা চামড়ার রং, আমাদের মনে হয় না এসব কোনো অবিভাজ্য আর অমিশ্রণযোগ্য জিনের কাজ। যদি একজন কৃষ্ণাঙ্গ এবং শেতাঙ্গ মানুষ প্রজনন করে, তাদের সন্তান শুধু সাদা বা কালো হয়নাঃ তারা মধ্যবর্তী একটি রুপ পায়, এর অর্থ কিন্তু এই না যে এর জন্য দায়ী জিনগুলো সুনির্দিষ্টভাবে পৃথক কোনো কণার মত রুপ নয়। এর কারণ হচ্ছে চামড়ার রঙ কি হবে তার জন্য বহু সংখ্যক জিন মূলত দায়ী। প্রত্যেকটিরই এমনই অল্প প্রভাব আছে, যে তাদের দেখতে মনে হয় তারা একে অপরের সাথে মিশে গেছে। এ পর্যন্ত আমি মিমদের বিষয়ে কথা বলেছি যেন এটা খুবই স্পষ্ট একটি একক ইউনিটের মিম কি দিয়ে তৈরী, কিন্তু অবশ্যই বিষয়টি এখনও সুস্পষ্টতা থেকে বহু দূরে, আমি বলেছি যে, একটি সুর একটি মিম, কিন্তু তাহলে একটি সিম্ফনী কি: কত সংখ্যক মিম সেখানে আছে? প্রতিটি মুভমেন্ট কি একটি মিম, নাকি মেলোডির সুনির্দিষ্ট অংশগুলো একেকটি মিম, প্রতিটি বার, প্রতি কর্ড অথবা অন্য কোনো কিছু?

অধ্যায় ৩–এ আমি যে শব্দের কৌশল ব্যবহার করেছিলাম, আমি তার প্রতি আবারো আবেদন করছি। সেখানে আমি ‘জিন কমপ্লেক্সকে ভাগ করেছিলাম বড় এবং ছোট জিনগত একক হিসাবে এবং ইউনিটের মধ্যে ইউনিট হিসাবে। ‘জিন’ সংজ্ঞায়িত করেছিলাম, “সব-অথবা-কোনটাই নয় এমন কোনো কঠোর নিয়ম ছাড়াই। কিন্তু সুবিধাজনক একক হিসাবে, ক্রোমোজোমের একটি দৈর্ঘ্য, যার যথেষ্ট পরিমান অনুলিপি করার বিশ্বস্ততা আছে যে, সেটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের একটি কার্যকরী একক হিসাবে কাজ করতে পারে। যদি বিটহোভেনের সিম্ফোনীর একটি একক ফ্রেজ বা সঙ্গীতাংশকে যথেষ্ট পরিমান স্বতন্ত্র এবং মনে রাখার মত মনে হয়, যাকে পুরো সিম্ফোনী কাঠামো থেকে পৃথক করা সম্ভব এবং সেটি ব্যবহৃত হয় চূড়ান্তমাত্রায় আগ্রাসীরুপে ইউরোপীয় কোনো ব্রডকাস্টিং স্টেশনের সূচনা সঙ্গীত হিসাবে, তাহলে সেই পর্যায় অবধি এটি একটি মীম হিসাবে চিহ্নিত হবার দাবী রাখে। ঘটনাচক্রে বাস্তবিকভাবে এটি আমার মূল সিম্ফোনীটি উপভোগ করার ক্ষমতা হ্রাস করেছে।

একইভাবে, যখন আমরা বলি যে, আজকাল সব জীববিজ্ঞানীরাই ডারউইনের তত্ত্ব বিশ্বাস করেন, আমরা কিন্তু বোঝাচ্ছি না প্রতিটি জীববিজ্ঞানীদের মস্তিষ্কে স্বয়ং চার্লস ডারউইনের শব্দগুলোর অনুলিপি হুবহু খোদাই করা রয়েছে; প্রতিটি ব্যক্তি স্বতন্ত্রভাবেই ডারউইনের তত্ত্বটিকে ব্যাখ্যা করেন, তিনি হয়তো সেটি জেনেছেন ডারউইনের নিজের লেখা থেকে না, বরং সাম্প্রতিক কোনো একজন লেখকের লেখা থেকে। ডারউইন যা বলে গিয়েছিলেন, তার অনেক কিছুই, বিস্তারিতভাবে পড়লে, মনে হবে ভুল। ডারউইন নিজে যদি এই বই পড়তেন, তিনি নিজেই এখানে তার মূল তত্ত্বটি খুঁজে বের করতে বেশ সমস্যায় পড়তেন, যদিও আমি আশা করছি আমি যেভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছি সেটি তিনি পছন্দ করতেন। কিন্তু তাসত্ত্বেও, এমন কিছু আছে, ডারউইনবাদের কিছু মূল বিষয়, যা প্রতিটি ব্যাক্তির মাথায় আছে যারা এই তত্ত্বটি বুঝেছেন। যদি এরকম না হত বিষয়টি, তাহলে দুজন মানুষের একমত হবার বিষয় সংক্রান্ত যে কোনো বক্তব্য অর্থহীন হতো। একটি ধারণা-মিম’ হয়তো এমন একটি সত্ত্বা হিসাবে ব্যাখ্যা করা যাবে, যা একটি মস্তিষ্ক থেকে অন্য একটি মস্তিষ্কে সঞ্চারিত হতে সক্ষম। ডারউইনের তত্ত্বের মিম সুতরাং ধারণাটি মূল ভিত্তি যা সব মস্তিষ্কই সাধারণ হিসাবে গ্রহন করে যারা এই তত্ত্বটি বুঝেছে। ভিন্ন ভিন্ন মানুষরা তার সেই তত্ত্বটি কিভাবে উপস্থাপন করেন, সেটি তাহলে, সংজ্ঞানুযায়ী, মিমের কোনো অংশ নয়। যদি ডারউইনের তত্ত্বটিকে বেশ কিছু উপাদানে ভাগ করা যায়, যেমন কিছু মানুষ উপাদান ‘ক’ বিশ্বাস করেন কিন্তু উপাদান ‘খ’ নয়, অপরদিকে অন্যরা হয়তো ‘খ’ অংশ বিশ্বাস করেন, কিন্তু ‘ক’ অংশটি নয়, তাহলে ‘ক’ এবং ‘খ’ অংশটিকে পৃথক মিম হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। যদি প্রায় সবাই যারা ‘ক’ বিশ্বাস করেন, তারা ‘খ’ অংশও বিশ্বাস করেন– যদি মিমগুলো ঘনিষ্ঠ হয়, যদি আমরা জিনগত ভাষায় বিষয়টি ভাবি–তাহলে দুটি অংশকে একসাথে একক মিম হিসাবে চিহ্নিত করাই সুবিধাজনক।

আসুন, এবার মিম ও জিনের মধ্যকার এই সদৃশ্যতা নিয়ে আলোচনাটিকে আরো খানিকটা অগ্রসর করা যাক। পুরো এই বইটা জুড়ে, আমি বার বার গুরুত্বারোপ করেছি, অবশ্যই জিনদের কোনো সচেতন, উদ্দেশ্য ধারণ করতে সক্ষম সত্তা হিসাবে আমাদের বিবেচনা করা সঠিক না। অন্ধ প্রাকৃতিক নির্বাচন, যদিও, তাদের এমনভাবে আচরণ করায় যেন তারা উদ্দেশপূর্ণ এবং সরলভাবে ব্যাখ্যা করার লক্ষ্যে উদ্দেশ্যময় ভাষা জিনদের নিয়ে আলোচনা উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে বিষয়টি সুবিধাজনক হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। যেমন, যখন আমরা বলি, “জিনরা চেষ্টা করছে ভবিষ্যত জিন পুলে তাদের সংখ্যা বাড়াতে’, আমরা এটি বলতে আসলে যা বোঝাচ্ছি সেটি হচ্ছে, সেই জিনগুলো এমনভাবে আচরণ করে যেন ভবিষ্যত জিন পুলে তাদের সংখ্যা বাড়ে, সাধারণত তারাই সেই সব জিন হয় যাদের প্রভাবগুলো আমরা পৃথিবীতে দেখি। ঠিক যেভাবে আমরা জিনদের সক্রিয় কোনো এজেন্ট হিসাবে ভাবতে সুবিধা বোধ করি, যারা তাদের নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাজ করে, হয়তো, মিমদের নিয়ে সেভাবে ভাবাও আমাদের জন্য সুবিধাজনক হবে। কোনো ক্ষেত্রেই এই বিষয়টিকে বাড়তি কোনো রহস্যময়তা দেবার প্রয়োজনীয়তা নেই। উভয় ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্যময়তার ধারণা শুধুমাত্র একটি রুপক, কিন্তু আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি জিনদের ক্ষেত্রে এটি বেশ ফলপ্রসূ একটি রুপক। আমরা এমনকি জিনদের ক্ষেত্রে এমন শব্দও ব্যবহার করেছি, ‘স্বার্থপর’ এবং ‘নিষ্ঠুর’ জিন, যখন আমরা খুব ভালোভাবে জানি এটি শুধুমাত্র একটি কথার কথা। আমরা কি ঠিক একই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে স্বার্থপর আর নিষ্ঠুর মিমদের অনুসন্ধান করতে পারবো?

 প্রতিযোগিতার ধরণ নিয়ে এখানে একটি সমস্যা আছে। যখন যৌন প্রজনন ঘটে, প্রতিটি জিন ক্রোমোজোমে তাদের জন্য সেই নির্দিষ্ট স্লট বা জায়গাটির জন্য সুনির্দিষ্টভাবে তার অন্য প্রতিরুপ বা অ্যালিলগুলোর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। মিমদের ক্ষেত্রে ক্রোমোজোম সমরুপ কোনো কিছু নেই এবং তাদের অ্যালিল সমতুল্যও কিছু নেই। আমি মনে করি, খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় এমন একটি অর্থে বহু ধারণার ক্ষেত্রে বলা যাবে যে তাদের বিপরীত কিছু আছে। কিন্তু সাধারণভাবে মিমরা খুব আদি অনুলিপনকারী অণুদের সদৃশ্য, যারা বিশৃঙ্খল ও স্বাধীনভাবে ভেসে বেড়ায় আদিম জৈব সুপে, আধুনিক জিনরা যেমন সুন্দরভাবে জোড়ায় জোড়ায় সজ্জিত থাকে ক্রোমোজোমে তেমনি কোনো সজ্জায় নয়। কোন অর্থে তাহলে মিমরা পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করে? আমাদের কি তাদের ‘স্বার্থপর’ অথবা ‘নিষ্ঠুর হিসাবে প্রত্যাশা করা উচিৎ, যদি তাদের কোনো অ্যালিল বা বিকল্প রুপ না থাকে? এর উত্তর হচ্ছে হয়তো আমরা পারি সেটি করতে, কারণ একটি অর্থ আছে, যেখানে অবশ্যই পরস্পরের সাথে একধরনের প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ে।

ডিজিটাল কম্পিউটারের যে-কোনো ব্যবহারকারী জানেন, কম্পিউরের সময় আর মেমোরি সংরক্ষণ করার জায়গার পরিমান কত মূল্যবান। অনেক বিশাল কম্পিউটার সেন্টারে, আক্ষরিকার্থে এর। মূল্য পরিশোধ করতে অর্থের বিনিময়ে। অথবা প্রতিটা ব্যবহারকারীকে হয়তো নির্দিষ্ট পরিমান সময় রেশন করে বরাদ্দ করা দেয়া হয়, যা সেকেন্ডে আমরা পরিমাপ করি, এবং সুনির্দিষ্ট পরিমান স্পেস বা জায়গা বরাদ্দ করতে পারি, যা পরিমাপ করা হয় “শব্দে। যে কম্পিউটারে মিমরা বাস করে সেটি হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্ক (৬)। ‘সময় হয়তো সংরক্ষণ করার জায়গা বা স্টোরেজ স্পেসের’ তুলনায় আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা সৃষ্টিকারী একটি বিষয়। এবং এটি তীব্র প্রতিযোগিতারও একটি বিষয়। মানুষের মস্তিষ্ক, এবং যে শরীরকে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করে, একই সাথে একটি বা অল্প কিছু কাজ ছাড়া করতে পারেনা। যদি একটি মিমকে মানব মস্তিষ্কের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রাধান্য বিস্তার করতে হয়, এটি অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বী মিমদের সাথে প্রতিযোগিতা করেই করতে হয়। অন্যান্য সামগ্রীগুলো যার জন্য মিমরা প্রতিযোগিতা করে, সেগুলো যেমন হতে পারে, রেডিও এবং টেলিভিশন সম্প্রচার সময়, বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডের জায়গা, সংবাদপত্রের মতামত কলামের জায়গা এবং লাইব্রেরীর তাকের জায়গা ইত্যাদি।

জিনদের ক্ষেত্রে, যেমনটি আমরা অধ্যায় ৩ এ দেখেছি সহ অভিযোজিত জিন কমপ্লেক্সও জিন পুলে উদ্ভব হতে পারে। সংশ্লিষ্ট প্রজাপতিদের মিমিক্রি বা বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য অনুকরণ প্রক্রিয়ার জন্য বড় একটি সেট জিনগুচ্ছ, তারা একই ক্রোমোজোমের উপর পরস্পরের সাথে এত ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট থাকে যে তাদেরকে একটি একক জিন হিসাবে মনে করা যেতে পারে। পঞ্চম অধ্যায়ে বিবর্তনীয়ভাবে স্থিতিশীল জিনগুচ্ছ সংক্রান্ত আরো বেশী জটিল একটি ধারণা আমরা পেয়েছিলাম। পরস্পরের সাথে উপযোগী দাঁত, নোখ, অন্ত্র এবং অনুভূতির সাথে সংশ্লিষ্ট অঙ্গগুলো মাংসাশী প্রাণীদের জিন পুলে বিবর্তিত হয়েছে, যখন একটি ভিন্ন গুচ্ছ স্থিতিশীল সেট যারা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যাবলীর কারণ তারা নিরামিশাষী প্রাণীদের জিনপূলে আবির্ভূত হয়েছে। মিম পুলে কি সমরুপ কোনো ঘটনা ঘটে? ঈশ্বর মিম কি অন্য কোনো সুনির্দিষ্ট মিম বা মিমদের সাথে সংশ্লিষ্ট, এই সংশ্লিষ্টতা কি প্রতিটি অংশগ্রহনকারী মিমের টিকে থাকার ব্যাপারে সহায়তা করে? হয়তো আমরা কোনো সুসংগঠিত চার্চের কথা ভাবতে পারি, এর স্থাপত্য,আচার অনুষ্ঠান, আইন, সঙ্গীতশিল্পকলা এবং লিখিত ঐতিহ্য, সহ-অভিযোজিত স্থিতিশীল পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ মিম হিসাবে ভাবতে পারি।

একটি সুনির্দিষ্ট উদাহরণ আমরা নিতে পারি, কোনো মতবাদের বিশেষ একটি দিক, ধর্মীয় আনুগত্য নিশ্চিৎ করার জন্য যা খুবই কার্যকরী, সেটি হচ্ছে ‘নরকের আগুনের ভয় দেখানো। বহু শিশু এবং এমন কি কিছু প্রাপ্তবয়স্করা বিশ্বাস করেন যে, মৃত্যুর পরে তারা খুব ভয়াবহ নির্যাতনের স্বীকার হবেন, যদি তারা ধর্মযাজকের নির্দেশিত নিয়ম মেনে না চলেন। কোনো কিছু করানোর জন্য প্ররোচিত করার ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে খুবই নোংরা একটি কৌশল, যা মারাত্মক মানসিক যন্ত্রনার কারণ হয়েছিল মধ্যযুগে এবং এমনকি আজও। কিন্তু এটি খুবই কার্যকর। এটি হয়তো মনে হতে পারে যেন উদ্দেশ্যমূলকভাবেই কোনো একটি মাকিয়াভেলীয় যাজকগোষ্ঠী দ্বারা এটি পরিকল্পিত হয়েছে, যারা গভীরভাবে মানসিক দীক্ষা দেবার কৌশলে প্রশিক্ষিত। তবে আমি আসলেই সন্দেহ করি যে যাজকরা আসলেই এই বিষয়ে এতটা বুদ্ধি রাখতে পারেন। বরং আরো বেশী যে সম্ভাবনা, সেটি হচ্ছে অবচেতন স্তরের এই মিমগুলো তাদের নিজেদের টিকে থাকাটা নিশ্চিৎ করে, সেই একই ছদ্ম-নিষ্ঠুরতার গুণাবলী ব্যবহার করে, যা সফল জিনরাও প্রদর্শন করে। নরকের আগুনের ধারণাটি হচ্ছে খুব সাধারণভাবেই ‘নিজে নিজেই এর অস্তিত্বকে চিরন্তনভাবে টিকিয়ে রাখে’, কারণ এর নিজেরই গভীর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব। এটি যুক্ত হয়েছে ঈশ্বর মিমের সাথে, কারণ এরা একে অন্যকে শক্তিশালী করে এবং মিম পুলে পরস্পরের টিকে থাকার ব্যাপারে সহায়তা করে।

ধর্মীয় মিম কমপ্লেক্সের আরো একটি সদস্য হচ্ছে ‘ফেইথ’ বা ধর্মবিশ্বাস। এর অর্থ আসলে অন্ধ বিশ্বাস, কোনো ধরনের প্রমাণের অনুপস্থিতিতে বিদ্যমান অন্ধ বিশ্বাস, এমনকি প্রয়োজনে সব প্রমাণের সরাসরি বিরোধীতা করে। সন্দেহবাদী থমাসের সেই গল্প বলা হয়ে থাকে, এমন নয় যে আমরা থমাসকে প্রশংসা করতে পারবো, বরং আমরা যেন অন্যান্য শিষ্য বা অ্যাপস্টোলদের প্রশংসা করতে পারি তার সাথে তুলনা করে। থমাস প্রমাণ দাবী করেছিলেন, এবং কিছু বিশেষ ধরনের মিমের জন্য প্রমাণ অনুসন্ধান করার চেয়ে আর কোনো কিছুই এত বেশী ভয়ঙ্কর নয়। অন্য শিষ্যরা, যাদের ধর্মবিশ্বাস এত বেশী শক্তিশালী যে তাদের কোনো প্রমাণের প্রয়োজন নেই, তাদেরকে অনুকরণের উপযুক্ত ও আদর্শ হিসাবে আমাদের কাছে উপস্থাপন করা হয়। অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের মিম তার নিজের চিরন্তন স্থায়ীত্ব নিশ্চিৎ করে শুধুমাত্র অবচেতনে সুবিধাজনক কৌশল ব্যবহার করে, যে কৌশল সকল যৌক্তিক অনুসন্ধানকে অনুৎসাহিত করে।

অন্ধ বিশ্বাস যেকোনো কিছুকে যুক্তিযুক্ত করতে পারে (৭)। যদি কোনো মানুষ ভিন্ন একটি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন বা এমনকি যদি তিনি ভিন্ন ধর্মীয় আচার ব্যবহার করেন সেই একই ঈশ্বরকে উপাসনার জন্য, অন্ধ বিশ্বাস ডিক্রি জারী করতে পারে তার মরে যাওয়া উচিৎ– ক্রুশবিদ্ধ হয়ে, আগুনে দগ্ধ হয়ে, ক্রসেডারদের তলোয়ারে আঘাতে এফোড় ওফোড় হয়ে, বৈরুতের রাস্তায় গুলি খেয়ে,অথবা বেলফাস্টের কোনো পানশালায় বোমা বিস্ফোরণে বহু টুকরো হয়ে। অন্ধ বিশ্বাসের জন্য মিমগুলোদের নিজস্ব নিষ্ঠুর উপায় আছে নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য। এবং ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের মতই এটি দেশপ্রেম এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও সত্য।

মিম ও জিনরা প্রায়শই হয়তো প্রায়ই পরস্পরকে শক্তিশালী করে থাকে, কিন্তু কখনো তারা আবার পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানেও এসে দাঁড়ায়। যেমন, চিরকৌমার্যের অভ্যাসটি খুব সম্ভবত জিনের মাধ্যমে প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিত হয় না। চিরকুমার থাকা কোনো জিন, জিন পুলে ব্যর্থ হতে বাধ্য, শুধুমাত্র বিশেষ কিছু পরিস্থিতি ছাড়া, যেমন আমরা সামাজিক কীটপতঙ্গদের মধ্যে দেখি। কিন্তু তারপরও, চিরকুমার থাকার একটি মিম, মিমপুলে সফল হতে পারে। যেমন, ধরুন কোনো মিমের সফলতা নির্ভর করে খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে ঠিক কতটা সময় মানুষ ব্যয় করেছে সক্রিয়ভাবে এই মিমটি মানুষের মধ্যে সঞ্চারণ করার জন্য। যেকোনো পরিমান সময় যা কিনা ব্যয় করা হয়েছে এই মিমটিকে প্রচার করা ছাড়া, মিমের দৃষ্টিভঙ্গিতে সেই পরিমান সময়কে গণ্য করা যেতে পারে সময়ের অপচয় হিসাবে। চিরকুমার থাকার মিম প্রচারিত হয় যাজকদের দ্বারা অল্পবয়সী বালকদের মধ্যে, এখনও যারা সিদ্ধান্ত নেয়নি তাদের জীবন নিয়ে তারা কি করবে। এই প্রচারের মাধ্যম হচ্ছে নানা ধরনের মানবিক প্রভাব আরোপন, কথ্য এবং লিখিত শব্দমালা, ব্যক্তিগত উদাহরণ ইত্যাদি। ধরুন, তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই, ঘটনাচক্রে দেখা গেল, বিবাহ, কোনো যাজক তার অনুসারীদের উপর যে প্রভাব প্রদর্শন করে থাকেন, সেটি দুর্বল করে দেয়, কারণ এটি তার সময়ের ও মনোযোগের বিশাল একটি অংশ দখল করে রাখে। এটাই আসলে, যাজকদের মধ্যে চিরকুমার থাকার বিষয়টির সপক্ষে আনুষ্ঠানিক কারণ হিসাবে প্রস্তাব করা হয়। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে আমরা বলতে পারি চিরকুমার থাকার মিমটি বেশী পরিমান টিকে থাকার ক্ষমতা আছে বিবাহের মিমটির অপেক্ষায়। অবশ্যই, ঠিক এর উল্টোটাই সত্যি হবে চিরকুমার থাকার জিনটির ক্ষেত্রে। যদি কোনো যাজক মিমদের জন্য টিকে থাকার যন্ত্র হয়, তাহলে চিরকুমার থাকার বৈশিষ্ট্যটা একটি উপযোগী বৈশিষ্ট্য যদি সেটি তার ভিতরে থাকে। চিরকুমার থাকার ব্যপারটি পারস্পরিক সহযোগিতা করা মিমদের বড় কোনো কমপ্লেক্সে কেবল মাত্র একটি গৌন অংশীদার।

আমি ধারণা করছি যে, সহ-অভিযোজিত মিম-কমপ্লেক্সগুলো বিবর্তিত হয়েছে সহ-অভিযোজিত জিন-কমপ্লেক্সগুলোর মতই। নির্বাচন সেই সব মিমদের সহায়তা করে যারা তাদের সাংস্কৃতিক পরিবেশকে তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। এই সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরী করে অন্য মিমরাও, যারা এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়। মিম পুল, সেকারণে বিবর্তনীয়ভাবে স্থিতিশীল সেট হিসাবে বৈশিষ্ট্য অর্জন করে, যেখানে নতুন মিমদের পক্ষে আগ্রাসন করা কঠিন হয়ে পড়ে।

আমি মিমদের ব্যপারে কিছুটা নেতিবাচক অবস্থান নিয়েছি ঠিকই, কিন্তু আনন্দময় দিকও তাদের আছে। আমরা যখন মারা যাই, দুটো জিনিস আমরা ছেড়ে যাই, জিন এবং মিম। আমরা এমনভাবে নির্মিত যেন জিন মেশিন, যাদের সৃষ্টি করা হয়েছে জিনদের হস্তান্তর করার জন্য। কিন্তু আমাদের সেই দিকটি তিন প্রজন্ম পরেই বিস্মরিত হবে। আপনার শিশু, এবং দৌহিত্র, হয়তো আপনার মত কিছুটা দেখতে, হয়তো মুখের গড়নে, সঙ্গীতের প্রতিভায়, চুলের রঙে। কিন্তু একটি করে প্রজন্ম অতিক্রান্ত হলে, আপনার জিনের অংশগ্রহন সেখানে অর্ধেকে নেমে আসে। সুতরাং বেশী সময় লাগেনা প্রায় নগন্য পরিমান অংশগ্রহনের মত একটি পরিস্থিতিতে পৌঁছাতে। আমাদের জিন হতে পারে অমর, কিন্তু আমাদের যে-কোনো কারোর শরীরেরই জিনদের সমষ্টি অবশ্যই ভেঙ্গে যেতে বাধ্য। দ্বিতীয় এলিজাবেথ উইলিয়াম দ্য কঙ্কেররের সরাসরি উত্তরসূরী। তাসত্ত্বেও খুবই সম্ভাবনা আছে যে, তিনি সেই প্রাচীন রাজার একটি জিনও বহন করছেন না। প্রজননের মাধ্যমে অমরত্বের অনুসন্ধান করা আমাদের উচিৎ নয়।

কিন্তু আপনি যদি বিশ্ব সংস্কৃতিতে অবদান রাখেন, আপনার যদি ভালো কোনো ধারণা থাকে, বা কোনো সুর সৃষ্টি করেন, স্পর্কিং প্লাগ আবিষ্কার করে থাকেন, কবিতা লিখে থাকেন, সাধারণ জিনপুলে আপনার জিনগুলো হারিয়ে যাবার পরে সেটি হয়তো অপরিবর্তিত টিকে থাকবে। সক্রেটিসের একটি বা দুটি জিন হয়তো এখনও এই পৃথিবীতে জীবিত থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে, যেমনটি জি, সি, উইলিয়ামস মন্তব্য করেছিলেন, কিন্তু আসলেই কার কি এসে যায় তাতে? সক্রেটিস, লিওনার্দো, কোপার্নিকাস এবং মার্কোনীর মিম-কমপ্লেক্স এখনও শক্তিশালী।

 এবং মিমতত্ত্বটি যত বেশী ধারণাভিত্তিক হোক না কেন, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আমি আরো একবার বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। এটাই হচ্ছে সেটা, যখন আমরা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টগুলোর বিবর্তন এবং তাদের টিকে থাকার যোগ্যতা বা সারভাইভাল ভ্যালু লক্ষ করি, আমাদের সুস্পষ্ট হতে হবে, আমরা আসলে ‘কার’ টিকে থাকার কথা বলছি। জীববিজ্ঞানীরা, যেমনটি আমরা দেখেছি, জিন পর্যায়ে সুবিধাগুলো খোঁজার ক্ষেত্রে অভ্যস্ত (অথবা কোনো একক সদস্য, গ্রুপ, অথবা প্রজাতি যার যেমন রুচি); যা আমরা এর আগে বিবেচনা করিনি সেটি হচ্ছে কোনো একটি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বিবর্তিত হতে পারে এমন একটি উপায়ে,কারণ খুব সরলভাবেই এটি এর নিজের জন্যই সুবিধাজনক।

ধর্ম, সঙ্গীত, আচার অনুষ্ঠানের নৃত্য ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রচলিত প্রথাগত জৈববৈজ্ঞানিক টিকে থাকার যোগ্যতা আমাদেও অনুসন্ধান করার কোনো প্রয়োজন নেই, যদিও তাদের সেটি থাকতেও পারে। যখনই জিনরা তাদের সারভাইভাল মেশিনগুলোকে মস্তিষ্ক প্রদান করেছে যা দ্রুত অনুকরণ করতে সক্ষম, তখন মিমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এর উপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। অনুকরণের কোনো ধরনের জিনগত সুবিধার ব্যাপারে আমাদেও কোনো প্রস্তাব করার বাধ্যবাধকতা নেই, যদি তারা অবশ্যই সহায়ক এই ক্ষেত্রে। যেটা আবশ্যিক সেটি হচ্ছে মস্তিষ্কের সেই ‘ক্ষমতা থাকতে হবে অনুকরণ করার জন্য। মিমরা এরপর বিবর্তিত হবে এই ক্ষমতাকে পুরোপুরি নিজেদের স্বার্থে সদ্ব্যবহার করার জন্য।

আমি এখন নতুন রেপ্লিকটর বা অনুলিপনকারীদের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা স্থগিত রাখবো, এবং এই অধ্যায়টি শেষ করবো একটি তথ্যপুষ্ট যোগ্য আশা দিয়ে। মানুষের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য, যা মিম প্রক্রিয়ায় বিবর্তিত হতেও পারে আবার নাও হতে পারে, সেটি হচ্ছে সচেতন ভবিষ্যৎদর্শিতা। স্বার্থপর জিনগুলোর ( এবং যদি আপনি এই অধ্যায়ের ধারণাগুলোকে সম্মতি দেন, সেক্ষেত্রেও মিমগুলোর) কোনো ভবিষ্যৎদর্শিতা নেই। তারা সচেতনতাহীন, অন্ধ অনুলিপনকারী। বাস্তব সত্যটি হচ্ছে যে তারা নিজেদের অনুলিপি সৃষ্টি করে, আরো সুনির্দিষ্ট কিছু বাড়তি শর্তাবলীসহ, এর অর্থ কোনো পরিকল্পনা ছাড়া, যে তারা বিবর্তিত হয় সেই সব বৈশিষ্ট্যগুলোর দিকে যারা, এই বইয়ের বিশেষ অর্থে যাদের বলা যেতে পারে, স্বার্থপর। একটি সরল অনুলিপনকারী, জিন হোক অথবা মিম হোক, তার কাছে এমন কিছু প্রত্যাশা করা যেতে পারেনা যে তার স্বল্পমেয়াদী স্বার্থপর সুবিধা পরিত্যাগ করবে এমনকি যখন এমন কোনো কিছু তাকে দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা প্রদান করবে। আমরা এটা দেখেছি আগ্রাসন নিয়ে লেখা অধ্যায়টিতে। এমনকি যদিও ‘ডোভদের ষড়যন্ত্র প্রতিটি একক’ সদস্যের জন্য বিবর্তনীয়ভাবে স্থিতিশীল বা ‘ইএসএস’ কৌশলের চেয়ে সুবিধাজনক, তারপরও প্রাকৃতিক নির্বাচন ইএসএসকে সুবিধা দিতে বাধ্য।

এটা সম্ভব যে, মানুষের আরো একটি অনন্য বৈশিষ্ট হচ্ছে, নির্ভেজাল, নৈর্ব্যক্তিক, নিস্বার্থ সত্যিকারের পরার্থবাদীতা। আমি তাই আশা করি, আর আমি পক্ষে বিপক্ষে এই কেসটি নিয়ে কোনো তর্ক করবো না, কিংবা এর সম্ভাব্য মিম নির্ভর বিবর্তনের বিষয় নিয়ে কোনো ধারণাও করবো না। আমি যে বিষয়টি বলতে চাইছি সেটি হচ্ছে যদি আমরা অন্ধকার দিকটি দেখি এবং ধরে নেই যে প্রতিটি একক ব্যক্তি মৌলিকভাবে স্বার্থপর, আমাদের সচেতন ভবিষ্যৎদর্শিতা বা দুরদৃষ্টি– কল্পনার মাধ্যমে ভবিষ্যতকে একটি কৃত্রিম মডেল হিসাবে সৃষ্টি করার ক্ষমতা– অন্ধ অনুলিপনকারীদের সবচেয়ে খারাপ স্বার্থপর বাড়াবাড়ি থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে। অন্ততপক্ষে আমাদের সেই মানসিক দক্ষতা আছে, শুধুমাত্র আমাদের স্বল্প মেয়াদী স্বার্থপর উদ্দেশ্য পূর্ণ করার চেয়ে বরং দীর্ঘ মেয়াদী স্বার্থপর উদ্দেশ্য প্রতিপালন করা। আমরা দীর্ঘ মেয়াদী সবিধা অর্জনের লক্ষ্যে পারস্পরিক সহযোগিতাকে আমরা ‘ডোভদের ষড়যন্ত্র হিসাবে দেখতে পারি এবং কিভাবে এই ‘ষড়যন্ত্রটিকে আমাদের পক্ষে কাজ করানো যেতে পারে সেই বিষয়ে আলোচনা করতে আমরা একসাথে বসতে পারি। জন্মের সময় থেকে বহন করা স্বার্থপর জিনগুলোর ক্ষমতাকে প্রতিহত করার সেই ক্ষমতা

আমাদের আছে এবং, যদি প্রয়োজন হয়, আমাদের মতদীক্ষিত হওয়া সেই অনুশাসনের স্বার্থপর মিমগুলোর বিরুদ্ধেও আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিশুদ্ধ, নৈর্ব্যক্তিক পরার্থবাদীরা সৃষ্টি ও প্রতিপালন করার নানা উপায় নিয়ে আমরা এমনকি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে পারি। আর এমন কিছু করার অন্য কোনো নজির নেই প্রকৃতিতে, পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে যার কোনদিনও অস্তিত্বই ছিল না। জিন মেশিন হিসাবে আমরা নির্মিত হয়েছি এবং মিম মেশিন হিসাবে সাংস্কৃতিকভাবে প্রতিপালিত হয়েছি। কিন্তু আমাদের সৃষ্টিকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সেই ক্ষমতা আছে আমাদের। আমরা, এই পৃথিবীতে শুধুমাত্র একা আমরাই, স্বার্থপর অনুলিপনকারীদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারি (৮)।

নোটস (অধ্যায় ১১)

(১) আমার সেই বাজিটি, সব ধরনের জীবন, মহাবিশ্বের যে কোনো জায়গায়, দেখা যাবে ডারউইনীয় প্রক্রিয়ায় বিবর্তিত হয়েছে, এখন বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং এর সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছি ইউনিভার্সাল ডারউইনিজম’ শিরোনামে আমার একটি। প্রবন্ধে এবং আমার ‘দ্য ব্লাইন্ড ওয়াচমেকার’ বইটির শেষ অধ্যায়ে। আমি দেখিয়েছি যে, ডারউইনবাদের সব বিকল্পগুলো এযাবৎ যা প্রস্তাব করা হয়েছে, নীতিগতভাবে সেই প্রস্তাবনাগুলো জীবনের সুসংগঠিত জটিলতা ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নয়। এই যুক্তিটি খুব সাধারণ একটি যুক্তি, আমাদের পরিচিত ‘জীবনের কোনো বিশেষ বাস্তব সত্যের উপর এটি নির্ভরশীল নয়। আর এভাবেই এটির সমালোচনা করেছেন সেই বিজ্ঞানীরা, যারা যথেষ্ট পরিমান কল্পনাশক্তিহীন এমন কিছু ভাবার জন্য যে, গরম টেস্ট-টিউব (অথবা কর্দমাক্ত ঠাণ্ডা বুট) নিয়ে পরিশ্রম করাই হচ্ছে বিজ্ঞানে কোনো কিছু আবিষ্কার করার একমাত্র উপায়। একজন সমালোচক অভিযোগ করেছিলেন, আমার যুক্তিগুলোর প্রকৃতি ‘দার্শনিক’, যেন সেটি যথেষ্ট পরিমানে একটি অপবাদ। দার্শনিক হোক বা না হোক, বাস্তব সত্যটি হচ্ছে তিনি এবং অন্য কেউই আমি যা বলেছি সেখানে কোনো ভুল খুঁজে পাননি। এবং নীতিগতভাবে এইসব যুক্তিগুলো যেমন, আমার, বাস্তব পৃথিবীতে আদৌ অপ্রাসঙ্গিক তো নয়ই এবং আরো বেশী শক্তিশালী হতে পারে সত্যিকারের কোনো নির্দিষ্ট বাস্তব গবেষণা নির্ভর যুক্তি থেকে। আমার যুক্তিগুলো, যদি এটি সঠিক হয়, এই মহাবিশ্বে যেকোনো স্থানে জীবন সম্বন্ধে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধারণা দেয়। ল্যাবরেটরী এবং মাঠপর্যায়ের গবেষণা আমাদের শুধুমাত্র তথ্য দেয় এখানে জীবনের যে নমুনা আমরা সংগ্রহ করি, তার সম্বন্ধে।

(২) মিম শব্দটি আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে একটি ভালো মিমে পরিণত হয়েছে। এখন এটি বেশ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয় এবং ১৯৮৮ সালে এটি অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারীর ভবিষ্যৎ সংস্করণে যুক্ত হবার জন্য বিবেচিত শব্দতালিকায় এটি যুক্ত হয়েছিল। এবং আমাকে আরো বেশী এটি চিন্তিত করে তোলে পুনরাবৃত্তি করতে যে, মানব সংস্কৃতির উপর আমার পরিকল্পনাগুলো খুব সামান্য প্রায় শূন্যে মিলিয়ে যাবার মতই ছিল। আমার সত্যিকারের আকাঙ্খা– এবং স্বীকার করতেই হবে সেগুলো আসলেই বিশাল– সম্পূর্ণ ভিন্ন দিক বরাবর নির্দেশিত হয়েছে। মহাবিশ্বের যেকোনো জায়গায় একবার যখন তাদের উদ্ভব হয়, সেই খানিকটা কম সঠিক স্ব-অনুলিপনকারী সত্তাদের প্রায় অসীম ক্ষমতার কথা আমি দাবী করতে চেয়েছিলাম। এর কারণ তারাই ডারউইনীয় নির্বাচনের ভিত্তিতে পরিণত হয়, যা যথেষ্ট পরিমান প্রজন্মে পুঞ্জীভূত হয়ে খুব জটিলতার একটি সিস্টেম তৈরী করতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, সঠিক পরিস্থিতির উপস্থিতিতে অনুলিপিগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরস্পরের সাথে জোট বদ্ধ হবে একটি সিস্টেম বা যন্ত্র সৃষ্টি করতে, যা তাদের বহন করে বেড়াবে এবং তাদের অনুলিপিগুলোর অব্যাহত হস্তান্তর নিশ্চিৎ করার জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করবে। ‘দ্য সেলফিশ জিন’ বইটির প্রথম দশটি অধ্যায়ে আমি কেবল এক ধরনের অনুলিপনকারীদের ব্যাপারে আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখেছি, সেটি হচ্ছে জিন। শেষ অধ্যায়ে মিম আলোচনা করার মাধ্যমে আমি সব ধরনের অনুলিপনকারীদের বিষয়ে একটি সাধারণ প্রস্তাব করার চেষ্ঠা করলাম এবং দেখাতে চেয়েছি জিনরাই এই গুরুত্বপূর্ণ অনুলিপনকারী শ্রেণীর একমাত্র সদস্য নয়। মানব সংস্কৃতির পরিবেশ আসলেই সেটি আছে কিনা, এ ধরণের ডারউইনবাদকে পরিচালিত করার জন্য যার প্রয়োজন আছে, আমি নিশ্চিৎ নই, কিন্তু যেকোনো ক্ষেত্রেই এই প্রশ্নটি আমার মূল চিন্তার সামান্য একটি অংশ। অধ্যায় ১১ সফল হবে যদি পাঠক এই বইটি বন্ধ করেন এমন একটি অনুভূতি নিয়ে যে ডিএনএ অণুরাই শুধুমাত্র একমাত্র সত্তা নয় যা ডারউইনীয় বিবর্তনের ভিত্তি রচনা করেছে। আমার উদ্দেশ্য মানব সংস্কৃতির একটি সুবিশাল কোনো তত্ত্ব গড়ার বদলে বরং জিনকে তার সঠিক জায়গায় স্থাপন করা।

(৩) ডিএনএ হচ্ছে স্ব-অনুলিপনকারী এক টুকরো হার্ডওয়্যার। প্রতিটি অংশের আছে একটি সুনির্দিষ্ট গঠন, যা প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক টুকরো ডিএনএর তুলনায় ভিন্ন। যদি মস্তিষ্কে মিমরা জিনদের অনুরুপ হয় তাদের অবশ্যই স্ব-অনুলিপনকারী মস্তিষ্কের গঠন হতে হবে, সত্যিকারের নিউরনের প্যাটার্ন হতে হবে যা পরস্পরের সাথে সংযুক্ত, যারা নিজেদের পুনর্গঠন করে একটি মস্তিষ্কের পর আরেকটি মস্তিষ্কে। আমি সবসময়ই ইতস্তত বোধ করেছি বিষয়টি এত স্পষ্ট করে বলার জন্য, কারণ আমরা জিন সম্বন্ধে যতটুকু জানি, মস্তিষ্ক সম্বন্ধে তার চেয়ে অনেক কম জানি এবং সেকারণে আবশ্যিকভাবে খানিকটা অস্পষ্ট এধরনের মস্তিষ্কের গঠন আসলে কেমন হতে পারে সেই বিষয়ে। সেকারণে আমি খুবই স্বস্তিবোধ করেছি সম্প্রতি একটি প্রবন্ধ পড়ে, এই কৌতূহলোদ্দীপক গবেষণা পত্রটি লিখেছেন। জার্মানীর ইউনিভার্সিটি অফ কনস্টানজ এর হুয়ান ডেলিয়াস। আমার ব্যতিক্রম, ডেলিয়াস আদৌ কোনো ইতস্ততাবোধ করেননি এবং ক্ষমাপ্রার্থীও হননি, কারণ তিনি এখন বিখ্যাত স্নায়ুবিজ্ঞানী, যখন আমি আদৌ স্নায়ুবিজ্ঞানী নই। আমি খুব আনন্দিত হয়েছি, সেকারণে, যে তিনি যথেষ্ট সাহসের সাথে বিষয়টি ব্যাখ্যা দিয়েছেন আসলেই একটি চিত্র প্রকাশের মাধ্যমে, যেন কোনো একটি মিমের স্নায়বিক হার্ডওয়্যার কেমন দেখতে হতে পারে তার একটি রুপ আমরা দেখতে পাই। আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় তিনি করেছিলেন, তিনি অনুসন্ধান করেছিলেন আরো বেশী অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে, আমি যতটা করেছিলাম তার চেয়ে বেশী, মিমের সাথে পরজীবিদের তুলনামূলক একটি উদাহরণ টেনে, আরো বেশী সুনির্দিষ্টভাবে, সেই স্পেকট্রাম বা বিস্তারটি ব্যবহার করে যেখানে ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক পরজীবি এক চূড়ান্ত প্রান্তে, নীরিহ মিথোজীবি অন্য চূড়ান্ত প্রান্তে। আমি বিশেষভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি বেশী উৎসাহী কারণ আমার নিজের আগ্রহ ‘এক্সটেন্ডেড ফিনোটাইপিক বা সম্প্রসারিত বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত প্রভাব নিয়ে যা পরজীবির মত জিনের পোষকের আচরণের উপর ফেলতে পারে (এই বইয়ে অধ্যায় ১৩ এবং ‘দি এক্সটেন্ডেড ফিনোটাইপ’ বইটির অধ্যায় ১২ দেখুন), ডেলিয়াস, প্রসঙ্গক্রমে মিম এবং তাদের বাহ্যিক বা ফিনোটাইপিক প্রভাবের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজনের উপর জোর দিয়েছেন, এবং তিনি সহ-অভিযোজিত হওয়া মিম-কমপ্লেক্সগুলো গুরুত্ব পুনরাবৃত্তি করেছেন, যেখানে মিমরা নির্বাচিত হয় তাদের পারস্পরিক সামঞ্জস্যতার উপর।

(৪) অল্ড ল্যাঙ সাইন, ভাগ্যক্রমে নিজের অজান্তেই আমার নির্বাচন করা বেশ কার্যকরী একটি উদাহরণ ছিল। এর কারণ, প্রায় সর্বজনীনভাবে, এটি গাওয়া হয় একটি ভুল সহ, একটি ‘মিউটেশন’। সেই বিষয়টি হচ্ছে, প্রায় সবসময়ই ইদানীং, এটি গাওয়া হয় “ফর দ্য সেক অফ অল্ড ল্যাঙ সাইন’ কিন্তু বার্নস (রবার্ট বার্নস) এটি লিখেছিলেন ‘ফর অল্ড ল্যাঙ সাইন’। মিমগত বিষয়ে নজর রাখা কোনো ডারউইনবাদী তাৎক্ষণিকভাবে ভাববেন এই ভ্রান্ত বাক্য বা প্রতিস্থাপিত শব্দমালা ‘ফর দি সেক অফ র তাহলে টিকে থাকার মূল্য বা ‘সারভাইভাল ভ্যালু’ কি? মনে রাখুন যে, আমরা কিন্তু এমন কোনো উপায়ের অনুসন্ধান করছি না যেখানে মানুষরা হয়তো বেশী সফলভাবে বাঁচতে পারবে এই গানটিকে বিকল্পভাবে গাওয়ার মাধ্যমে। আমরা সেই উপায়গুলো অনুসন্ধান করছি যেখানে এই ‘পরিবর্তনটি’ নিজেই হয়তো মিম পুলে টিকে থাকার জন্য অনেক বেশী দক্ষ। প্রত্যেকেই তাদের শৈশবে গানটি শিখেছিলেন, বার্নস এর মাধ্যমে না কিন্তু প্রতিটি নববর্ষের আগের সন্ধ্যায় এটি যেভাবে গাওয়া হয়ে থাকে তার মাধ্যমে। কোনো এক সময়, ধারণা করছি, প্রত্যেকেই সঠিক শব্দেই গেয়েছেন। ফর দ্য সেক অফ’ অবশ্যই দুর্লভ একটি মিউটেশন হিসাবে ‘উদ্ভূত হয়েছে। আমাদের প্রশ্নটি হচ্ছে, কেন এই শুরুতে উদ্ভূত হওয়া দুর্লভ মিউটেশনটি ছড়িয়ে পড়েছে এত বিস্তারিতভাবে সবার অগোচরে যে, মিম পুলে এটি স্বাভাবিক রুপ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে?

এই উত্তরটির জন্য আমাদের বেশী দুর খোঁজার দরকার আছে বলে আমি মনে করিনা। শিষধ্বনিযুক্ত ‘এস’ উচ্চারণ করার প্রক্রিয়া কুখ্যাতভাবে চোখে পড়ার মত। চার্চের সঙ্গীত দলগুলো সাধারণত বেশ পরিশ্রম করেন ‘ভি’ শব্দটাকে যতটা সম্ভব ততটা হালকা ভাবে উচ্চারণ করার জন্য। অন্যথায় পুরো চার্চ জুড়েই প্রতিধ্বনির শব্দ শোনা যাবে। বিড়বিড় করে কিছু উচ্চারণ করা কোনো যাজক বিশাল ক্যাথিড্রালে প্রার্থনার বেদীতে যখন দাঁড়িয়ে থাকেন, মূল কক্ষের শেষ সীমানা থেকেও তার কথা কিন্তু শোনা যায়, শুধু মাত্র কখনো বিক্ষিপ্ত গুঞ্জনধ্বনির ‘এস’ উচ্চারণে। অন্য যে ব্যঞ্জন বর্ণ ‘সেক’ শব্দটিতে আমরা পাই সেই হচ্ছে ‘কে’, আরো বেশী সুস্পষ্টভাবে এটি প্রায় ভেদ্য। কল্পনা করুন যে, উনিশজন মানুষ সঠিকভাবে গাইছেন ‘ফর অল্ড ল্যাঙ সাইন’ এবং একজন ব্যক্তি সেই রুমের অন্য কোথাও, ভুল করে যুক্ত করেছেন “ফর দ্য সেক অল্ড ল্যাঙ সাইন’, একজন শিশু, এই গানটি যখন প্রথম বারের মত শোনে, সে খুবই আগ্রহী থাকে সবার সাথে গলা মেলাতে, কিন্তু সে শব্দগুলো সঠিকভাবে জানেনা, যদিও প্রায় সবাই “ফর অল্ড ল্যাঙ সাইন’ গাইছেন, ‘এস’ একটি শব্দ এবং ‘কে’ এর শক্তিশালী উচ্চারণ জোর করে শিশুর কানে প্রবেশ করে সুতরাং যখনই সেই অংশটি আবার গাইবার জন্য ফিরে আসে, সেও গেয়ে ওঠে ‘ফর দ্য সেক অফ অল্ড ল্যাঙ সাইন। পরিবর্তিত মিম আরো একটি বাহককে অধিগ্রহন করে। যদি অন্য কোনো শিশু সেখানে থেকে থাকে বা প্রাপ্তবয়স্ক কেউ, যিনি গানের সঠিক শব্দগুলো নিয়ে আত্মবিশ্বাসী না হন, তাদের অনেক বেশী সম্ভাবনা থাকবে পরবর্তীতে মিউট্যান্ট বা পরিবর্তিত রুপটি গাওয়ার জন্য, যখন সেই অংশটি আবার ফিরে আসবে গাইবার সময়। এমন নয় যে তারা মূল রুপটির পরিবর্তিত রুপটি বেছে নিচ্ছেন, তারা আন্তরিকভাবেই জানেন না শব্দগুলোর সঠিক রুপ কি এবং সত্যিকারভাবে তারা উৎসাহীও সেগুলো শেখার জন্য। এমনকি যারা ভালোভাবে জানেন শব্দগুলো তারা যদি ক্রোধান্বিত হয়ে উচ্চস্বরে গর্জন করেন, ‘ফর অল্ড ল্যাঙ সাইন’ (যেমন আমি করি!), সঠিক শব্দগুলোর মধ্যে কোনো সুস্পষ্ট ব্যঞ্জন বর্ণ নেই, এবং এর পরিবর্তিত রুপটি, এমনকি যদি শান্তভাবে এবং সব কিছু উপেক্ষা করেও যদি গাওয়া হয়, অপেক্ষাকৃত সহজেই শোনা যায়।

 একটি সমরুপী উদাহরণ হচ্ছে ‘রুল ব্রিটানিয়া। এর কোরাসে সঠিক দ্বিতীয় পংক্তিটি হচ্ছে “ব্রিটানিয়া, রুল দ্য ওয়েভস’। এটি প্রায়শই যদি সর্বজনীন নয়, গাওয়া হয়, “ব্রিটানিয়া রুলস দ্য ওয়েভ হিসাবে। এখানে আবার সেই অগ্রাহ্য করা অসম্ভব শিষধ্বনিযুক্ত ‘এস’ শব্দটির মিমকে সহায়তা করে বাড়তি একটি বিষয়ে। এর প্রত্যাশিত উদ্দেশ্য যা কবি (জেমস থম্পসন) বোঝাতে চেয়েছিলেন সম্ভবত একটি বাধ্যতামূলক কোনো বিষয় (ব্রিটানিয়া, গো আউট অ্যান্ড রুল দি ওয়েভস!) অথবা সম্ভবত ভাববাচক কিছু (লেট ব্রিটানিয়া রুল দ্য ওয়েভস!)। কিন্তু উপরিভাবে এটি সহজতর বাক্যটিকে কোনো নির্দেশবাচক এমন কিছু ভাবার জন্য (ব্রিটানিয়া, অ্যাস এ ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট, ডাস রুল দ্য ওয়েভস)। এই পরিবর্তিত মিমটির তাহলে দুটি ভিন্ন ভিন্ন সারভাইভাল ভ্যালু আছে এর মূল রুপটির তুলনায়, যাকে এটি প্রতিস্থাপিত করে; এটি শুনতে আরো বেশী সুস্পষ্ট এবং অপেক্ষাকৃত সহজতর বোঝার ক্ষেত্রে।

কোনো একটি হাইপোথিসিসের চূড়ান্ত নিরীক্ষাটি পরীক্ষা নির্ভর হওয়া উচিৎ। সুতরাং হিস হিস ধ্বনির সেই বৈশিষ্ট্যসূচক মিমটিকে পরিকল্পিতভাবে মিম পুলে স্বল্প হারে প্রবেশ করানো সম্ভবপর হওয়া উচিৎ এবং এরপর আমরা দেখতে পারি কিভাবে এটি ছড়িয়ে পড়ে এর নিজস্ব সারভাইভাল ভ্যালুর জন্য। কি হবে যদি আমরা অল্প কয়েকজন ‘গড সেভ আওয়ার গ্রেশাস কুইন’ গাইতে শুরু করি?

(৫) আমি অবশ্যই চাইনা এই বাক্যগুলোর অর্থ যেন এমন করা হয় যে আমি বলছি, ‘আকর্ষণীয়তা’ কোনো একটি বৈজ্ঞানিক ধারণা গ্রহনযোগ্য হবার একমাত্র মানদণ্ড হতে পারে। আর যাই হোক, কিছু বৈজ্ঞানিক ধারণা আসলেই সঠিক এবং কিছু অবশ্যই ভুল! তাদের গুরুত্বহীনতা কিংবা ভ্রান্তি পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব। তাদের যুক্তিকে ব্যবচ্ছেদ করা যেতে পারে। তারা আসলে কোনো পপ গানের সুর, কিংবা ধর্ম বা পাঙ্কদের চুলের ফ্যাশনের মত না। তবে যাই হোক না কেন বিজ্ঞানে যেমন সমাজবিজ্ঞান আছে তেমনি যুক্তিও আছে। কিছু। বাজে বৈজ্ঞানিক ধারণা অনেক ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে, অন্ততপক্ষে খানিকটা সময় ধরে। এবং কিছু ভালো ধারণা স্বীকৃতি এবং গ্রহনযোগ্যতা ও বৈজ্ঞানিক কল্পনাকে অধিগ্রহন করতে পারার আগেই বহু বছর ধরে সুপ্ত থাকতে পারে।

আমরা এই ধরনের সুপ্তাবস্থা ও পরে ব্যাপকহারে গ্রহনযোগ্যতার বিস্তারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ খুঁজে পেতে পারি এই বইয়ের একটি প্রধান ধারণায়, হ্যামিলটনের ‘কিন সিলেকশন’ তত্ত্ব। আমি ভেবেছিলাম বৈজ্ঞানিক জার্নালে রেফারেন্স খোঁজার ক্ষেত্রে এটি খুবই উপযুক্ত একটি কেস হতে পারে মিমদের ছড়িয়ে পড়া পরিমাপ করার ধারণাটিকে পরীক্ষা করে দেখার জন্য। প্রথম সংস্করণে আমি উল্লেখ করেছি (মূল বইয়ের পৃষ্ঠা ১১৬), ‘এই বিষয়ে আজ অবধি যত প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, ১৯৬৪ সালে সোস্যাল ইথথালজী বিষয়ে তার দুটি প্রবন্ধ ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এবং আমি কখনোই বুঝতে পারিনি কেন তার এই প্রবন্ধগুলোকে অবহেলা করেছে ইথোলজিস্টরা (তার নাম এমনকি উল্লেখ করা হয়নি ইথোলজীর উপর লেখা দুটি প্রধান পাঠ্যপুস্তকের ইনডেক্সেও, যেগুলো প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭০ এ)। সৌভাগ্যক্রমে তার ধারণার প্রতি কৌতূহল বৃদ্ধি পাবার একটি সাম্প্রতিক চিহ্ন দৃশ্যমান। আমি এটি লিখেছিলাম ১৯৭৬ সালে, আসুন আমরা সেই মিমের যাত্রাটি লক্ষ করি এর পরবর্তী দশকগুলোয়।

‘সায়েন্স সাইটেশন ইনডেক্স’ সূচকটি একটি অদ্ভুত প্রকাশনা, যেখানে যেকোনো প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র কেউ চাইলে খুঁজে দেখতে পারেন এবং একই সাথে টেবিল আকারে বছর প্রতি এর পরবর্তী প্রকাশনাগুলোর একটি তালিকাও দেখতে পারেন, যা এই প্রবন্ধটিকে তাদের তথ্যসূত্রে উল্লেখ করেছে। কোনো একটি বিষয়ে প্রকাশিত গবেষণা প্রবেন্ধ খোঁজার জন্য এটি নির্মিত হয়েছে। ইউনিভার্সিটির অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিটিগুলোও স্কুল (বেশী স্কুল ও খুব সহজে পাওয়া যায়) এবং দ্রুত ব্যবহারযোগ্য একটি মানদণ্ড হিসাবে এটি ব্যবহার করার অভ্যাস গুড়ে তুলেছে, যার মাধ্যমে তারা একই পদের জন্য আবেদনকৃত প্রার্থীদের তুলনা করে দেখতে পারেন। হ্যামিলটনের গবষণাপত্রটির সাইটেশনের সংখ্যা গণনা করার মাধ্যমে, ১৯৬৪ থেকে প্রতিটি বছর, আমরা মোটামুটি একটা ধারণা পেতে পারি জীববিজ্ঞানীদের সচেতনতার স্তরে তার প্রবন্ধগুলো কিভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সেই বিষয়টি অনুসরণ করার জন্য (ছবি ১)।

 প্রাথমিক সুপ্তাবস্থার পর্বটি এখানে খুব স্পষ্ট। এরপর দেখা যায় যেন ১৯৭০ এর দশকে ‘কিন সিলেকশন’ নিয়ে আগ্রহ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যদি কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়কে চিহ্নিত করতে হয় এই উর্ধমূখী প্রবণতার বৃদ্ধির জন্য, এটি মনে হয় ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ এর মধ্যে। এই উর্ধমুখী আগ্রহের শীর্ষ বিন্দুটি স্পর্শ করতে আমরা দেখি ১৯৮১ তে, এরপর থেকে এর বাৎসরিক সাইটেশনের হার স্থিতিশীল একটি পর্যায়ে থাকে, কম বেশী ওঠা নামার মধ্যে।

 একটি মিমগত পুরাণ প্রচার পেয়েছিল যে, ‘কিন সিলেকশন’ নিয়ে কৌতূহলের উর্ধমূখী বৃদ্ধির চালিকা শক্তি ছিল ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৬ এর মধ্যে প্রকাশিত বইগুলো। গ্রাফটি, যার উর্ধমুখী পরিবর্তন শুরু হয়েছিল ১৯৭৪ এ, আপাতদৃষ্টিতে এই ধারণাটিকে মিথ্যা প্রমাণ করেছিল। বরং এর বিপরীত, প্রমাণগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে ভিন্ন একটি হাইপোথিসিসকে সমর্থন করার জন্য, বিশেষ করে আমরা যখন এমন কোনো ধারণা নিয়ে কথা বলছি যা কিনা ‘বাতাসে ভাসছিল’ বা ‘যার সময় অবশেষে এসেছে। মধ্য সত্তরের দশকে প্রকাশিত বইগুলো হয়তো, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রধান কারণ হবার পরিবর্তে বরং “ব্যান্ড-ওয়াগন’ ইফেক্ট এর উপসর্গই হবে (অর্থাৎ কোনো একটি ধারণার গ্রহনযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়, যখন এটি অন্যদের কাছে ইতিমধ্যেই গ্রহনযোগ্য হয়)।

ছবি ১, হ্যামিলটনের ১৯৬৪ সালে প্রবন্ধটি বছর প্রতি সাইটেশন, সায়েন্স সাইটেশন ইনডেক্স মোতাবেক।

ছবি ১, হ্যামিলটনের ১৯৬৪ সালে প্রবন্ধটি বছর প্রতি সাইটেশন, সায়েন্স সাইটেশন ইনডেক্স মোতাবেক।

 হয়তো, আসলেই আমরা এমন কোন কিছু নিয়ে কথা বলছি যা কিনা দীর্ঘ মেয়াদী, ধীরে শুরু হওয়া, ক্রমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাওয়া ব্যান্ড-ওয়াগন যা হয়তো শুরু হয়েছিল আরো আগের কোনো এক সময়ে। আমরা চাইলে এই সাধারণ মানুপাতিক হাইপোথিসিসটি পরীক্ষা করে দেখতে পারি, পুঞ্জীভূত উপাত্তগুলো ‘লগারিদমের স্কেলে’ পরিমাপ করে। যে কোনো বৃদ্ধি প্রক্রিয়া, যেখানে বৃদ্ধি পাবার হার ইতিমধ্যে সে আকারটি তা অর্জন করেছে তার সমানুপাতিক হয়, এটাকে বলে সমানুপাতিক বা ক্রমানুপাতে বৃদ্ধি। একটি বৈশিষ্ট্যসূচক ক্রমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাবার প্রক্রিয়ার উদাহরণ হতে পারে যেমন কোনো এপিডেমিক বা মহামারী: প্রতিটি ব্যক্তি প্রশ্বাসের সাথে বেশ কয়েকজন ব্যক্তির উপর ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিচ্ছে, যাদের প্রত্যেকেই আবার সেই একই কাজটি করছে আরো একই সংখ্যক মানুষের উপর। সুতরাং আক্রান্তদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারেই বাড়তে থাকবে। কোনো একটি ক্রমানুপাতিক কার্ভের এটি শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য যে এটি যদি কোনো লগারিদমের স্কেলে গ্রাফে প্লট করা হয়, এটি সরল রেখার রুপ নেবে। এটি আবশ্যিক নয়, কিন্তু পুঞ্জীভূত উপাত্ত নিয়ে এধরনের কোন লগারিদমের গ্রাফ তৈরী করা সুবিধাজনক এবং সাধারণত করা হয়ে থাকে। যদি হ্যামিলটনের মিম আসলেই ক্রমশ বাড়তে থাকা কোনো মহামারীর রুপ নিয়ে থাকে, তাহলে পুঞ্জীভুত লগারিদমের গ্রাফ একটি একক সরল রেখায় পড়া উচিৎ, সেটা কি ঘটছে?

 ছবি–২ এ যে রেখাটি আকা হয়েছে, পরিসংখ্যানগত দৃষ্টিতে, প্রতিটি বিন্দুতে ভালোভাবে খাপ খায়। আপাতদৃষ্টিতে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভবত উপেক্ষা করা যেতে পারে, যার কারণ অনির্ভরযোগ্য ক্ষুদ্র-সংখ্যার প্রভাব যা সাধারণত বৃদ্ধি পাবার প্রবণতা আছে এ ধরণের কোনো লগারিদম স্কেল প্লট করার সময়। এরপরে, এই গ্রাফ একটি সরল রেখার সাথে বেশ মানানসই, যদি ছোটখাট এর উপর আরোপিত হওয়া প্যাটার্নও আমরা লক্ষ্য করতে পারি। যদি আমার এই ক্রমানুপাতিকহারে বাড়ার ব্যাখ্যাটি গ্রহন করা যায়, তাহলে আমরা যেটা দেখছি সেটি হচ্ছে হ্যামিলটনের মিম বিষয়ে খুব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা কৌতূহল পর্বটি ১৯৬৭ থেকে ১৯৮০র দশক অবধি অব্যাহত ছিল। এককভাবে কোনো বই বা প্রবন্ধকে বরং গণ্য করা উচিৎ হবে এই দীর্ঘ মেয়াদী প্রবণতার কারণ হিসাবে। এমন কিছু ভাববেন না যে, এই বৃদ্ধি পাবার ধরণটি কোনো না কোনভাবে তুচ্ছ একটি ব্যপার, কারণ এমন কিছুই অবশ্যই ঘটবে এই অর্থে। কোনো পুঞ্জীভূত প্রবণতা, অবশ্যই, বৃদ্ধি পায় এমনকি যদি বছর প্রতি সাইটেশনের হার স্থির থাকে। কিন্তু লগারিদম স্কেলে এটি স্থিতিশীল অপেক্ষাকৃত ধীরগতিতে বৃদ্ধি পায়, একসময় এই বৃদ্ধির হারটি স্বাভাবিকতায় ফিরে আসে। ছবি ৩ এর উপরের গাঢ় রেখাটি দেখাচ্ছে তাত্ত্বিক সেই কার্ডটি যা আমরা পেতাম যদি প্রতিটি বছরের সাইটেশনের হার যদি ধ্রুব কে নো সংখ্যা হতে (যা হ্যামিলটনের সাইটেশনেরর গড় হারের সমান, প্রতি বছরে প্রায় ৩৭ বার)। এই ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়া কার্ভটিকে তুলনা করা যেতে পারে পর্যবেক্ষিত ফিগার ২ এর সরল রেখার সাথে, যে রেখাটি নির্দেশ করছে বৃদ্ধি হবার আনুপাতিক হারটিকে। আমরা আসলেই যেটা দেখছি সেই হচ্ছে বৃদ্ধির উপর আরেকটি বৃদ্ধি, সাইটেশনের কোন স্থিতিশীল হার নয়।

ছবি দুই: লগ, কুমুলেটিভ সাইটেশন, হ্যামিলটন (১৯৬৪)
ছবি ৩: লগ, কুমুলেটিভ সাইটেশনস, হ্যামিলটনের তিনটি প্রবন্ধ, এখানে তুলনা করা হচ্ছে তাত্ত্বিক কার্ড এর সাথে (বিস্তারিত ব্যাখ্যা উপরে)

দ্বিতীয়ত, আমরা হয়তো ভাবতে প্ররোচিত হতে পারি, কিছু একটি বেশী আছে, যদিও অবশ্যম্ভাবী নয়, নিদেনপক্ষে কম গুরুত্বপূর্ণ অর্থে যেমনটি আশা করা হয় আনুপাতিক হারে কোনো কিছু বৃদ্ধি পাবার বিষয়টিকে। বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশের সার্বিক হার এবং সেই সাথে অন্য কোনো প্রবন্ধ উল্লেখ করার হারও কি বেড়ে যায়নি, এটি নিজেই বৃদ্ধি পাচ্ছে আনুপাতিক হারে? হয়তো বৈজ্ঞানিক সমাজের আকারও আনুপাতিক হারে বেড়েছে। হ্যামিলটনের মিমে কোনো বিশেষ কিছু আছে সেই বিষয়টি প্রদর্শন করার জন্য, সবচেয়ে সহজ উপায় হবে অন্যান্য কোনো প্রবন্ধের একই ধরনের গ্রাফের সাথে এটি প্লট করা। ফিগার ৩ সেই কুমুলেটিভ সাইটেশনের হারটির প্রদর্শন করছে আরো তিনটি ভিন্ন প্রবন্ধের সাথে ( যারা ঘটনাচক্রে এই বইটির প্রথম সংস্করণের জন্য অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল); সেগুলো হচ্ছে। উইলিয়ামস এর ১৯৬৬ র বই, অ্যাডাপটেশন অ্যান্ড ন্যাচারাল সিলেকশন, ট্রিভারস এর ১৯৭১ এর রেসিপ্রোকাল আলট্রইজমের উপর প্রকাশিত প্রবন্ধ এবং ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ইএসএস ধারণাটিকে উপস্থাপন করা মেনার্ড স্মিথ ও প্রাইসের প্রবন্ধটি। তাদের তিনটি কার্ভই প্রদর্শন করছে তারা পুরো সময় জুড়ে আনুপাতিকহারে বাড়েনি। এই কাজগুলোর ক্ষেত্রেও, বাৎসরিক সাইটেশন রেট মোটেও সুসম ভাবে বিস্তৃত নয়, এবং কিছুটা অংশে তারা হয়তো আনুপাতিকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, উইলিয়ামের কার্ভটি, যেমন, ১৯৭০ থেকে শুরু করে এটি মোটামুটিভাবে একটি সরলরেখার মত লগ স্কেলে আমরা যখন দেখছি, যা ইঙ্গিত করছে, এটিও প্রভাবিত করার একটি বিস্ফোরণ-পর্বে প্রবেশ করেছিল।

আমি হ্যামিলটনের মিমটির বিস্তারে বিশেষ বইগুলোর ভূমিকা খানিকটা অবমূল্যায়ন করেছি। তা সত্ত্বেও, এখানে আপাতদৃষ্টিতে মিম নিয়ে এই বিশ্লেষণের একটি বেশ ইঙ্গিতবাহী সংযোজন বা পুনশ্চ আছে। অল্ড ল্যাঙ সাইন’ এবং “রুল ব্রিটানিয়ার ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছে, আমরা একটি দৃষ্টি উন্মোচনকারী ভ্রান্তির মুখোমুখি হই। ১৯৬৪ সালে হ্যামিলটনের প্রবন্ধটির সঠিক শিরোনাম ছিল, ‘দ্য জেনেটিকাল ইভ্যোলুশন অফ সোস্যাল বিহেভিয়র। এবং ১৯৭০ এর দশকের মধ্য থেকে শেষাংশে, বেশ কিছু প্রকাশনা, যেমন ‘সোসিওবায়োলজী এবং ‘দ্য সেলফিশ জিন’ তাদের মধ্যে অন্যতম, ভুল করে এটির শিরোনাম উল্লেখ করেছিল ‘দ্য জেনেটিকাল থিওরী অফ সোস্যাল বিহেভিয়র’। জন সেগের এবং পল হার্ভি এই ভ্রান্ত মিমের সবচেয়ে পুরোনো উল্লেখটি অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছিলেন, তারা এটিকে বেশ কার্যকরী একটি মার্কার হিসাবে মনে করেছিলেন, অনেকটা রেডিওঅ্যাকটিভ লেবেল এর মত, বৈজ্ঞানিক প্রভাব বিস্তারের সেই উৎস অনুসন্ধান করার জন্য। তারা এটিকে অনুসন্ধান করতে পেরেছিলেন ই, ও, উইলসনের প্রভাবশালী সোসিওবায়োলজী বইটিতে, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৫ এ, এবং বেশ কিছু পরোক্ষ প্রমাণও মিলেছে এর প্রস্তাবিত বংশলতিকায়।

আমি উইলসনের এই অসাধারণ কাজটিকে যতই প্রশংসা করিনা কেন– আমি আসলেই কামনা করি, বইটি সমন্ধে পড়ার চেয়ে বরং বেশী মানুষরা যেন মূল বইটি পড়ে– কিন্তু আমি সবসময়ে বিরক্ত হই সম্পূর্ণ ভ্রান্ত সেই প্রস্তাবটি শুনে, যা দাবী করে আমার বইটি তার বই দ্বারা প্রভাবিত। তারপরও, যেহেতু আমার বইও সেই একই ভুল সাইটেশন ধারণ করে আছে– দ্য রেডিওঅ্যাকটিভ লেবেল– এটি শঙ্কাজনকভাবে এমন ধারণার ইঙ্গিত দেয় যে অন্তত একটি মিম উইলসন থেকে আমার কাছে এসেছে! এটি খুব বেশী বিস্ময়কর না যদি সুনির্দিষ্টভাবে আমরা দেখি। যেহেতু সোসিওবায়োলজী ব্রিটেনে যখন এসেছিল তখন আমিও দ্য সেলফিশ জিন শেষ করেছি, ঠিক সেই সময় আমি হয়তো আমার গ্রন্থতালিকার উপর কাজ করছি। উইলসনের সুবিশাল গ্রন্থতালিকা হয়তো মনে হতে পারে ঈশ্বর প্রেরিত, লাইব্রেরীতে বহু সময় অপচয় কমানোর জন্য। আমার সেই হতাশা আনন্দে রূপান্তরিত হয়েছিল, যখন আমি হঠাৎ করে একটি পুরোনো গ্রন্থতালিকা হাতে পাই, ১৯৭০ সালে যে তালিকা আমি একটি লেকচারের সময় ছাত্রদের মধ্যে বিতরণ করেছিলাম, এবং সেখানে সুস্পষ্টভাবে সেই ভুল, ‘দ্য জেনেটিক থিওরী অফ সোস্যাল বিহেভিয়র’, উইলসনের প্রকাশনার পাঁচ বছর আগের ঘটেছিল এই ঘটনাটি, আমার ১৯৭০ সালে গ্রন্থ তালিকা উইলসনের পক্ষে দেখতে পারার কথা নয়। কোনো সন্দেহ নেই এই বিষয়ে, উইলসন এবং আমি স্বতন্ত্রভাবেই একই পরিবর্তিত মীমটির সাথে পরিচিত হয়েছিলাম! এমন একটি কাকতলীয় ঘটনা কেমন করে ঘটতে পারে? আবারো, যেমনটি ঘটেছে ‘অল্ড ল্যাঙ সাইন’ এর ক্ষেত্রে, একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা খুজতে বেশী দুর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আর, এ. ফিশারের সবচেয়ে বিখ্যাত বই ‘দ্য জেনেটিকাল থিওরি অফ ন্যাচারাল সিলেকশন’। এই বইটির শিরোনাম এত বেশী পরিচিত ছিল বিবর্তন জীববিজ্ঞানীদের জগতে, আমাদের পক্ষে কঠিন ছিল তৃতীয় শব্দটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে যোগ না করে প্রথম শব্দ দুটি ব্যবহার করা। আমি সন্দেহ করছি, উইলসন এবং আমি, আমরা দুজনই, অবশ্যই সেই কাজটি করেছিলাম, এটি সংশ্লিষ্ট সবার জন্য। একটি আনন্দের উপসংহার ছিল, ফিশারের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন এমন স্বীকারোক্তিতে কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়।

 (৬) অবশ্যই ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব যে বানানো ইলেক্ট্রনিক কম্পিউটারগুলোও কোনো এক সময় স্ব-অনুলিপনকারী প্যাটার্নের তথ্য বহন করবে– মিম। ক্রমবর্ধমানহারে কম্পিউটারদের একে অপরের সাথে সংযুক্ত করা হচ্ছে তথ্য ভাগাভাগি করতে সক্ষম জটিল নেটওয়ার্কে। তাদের অনেকেই আক্ষরিকার্থেই যুক্ত ইলেক্ট্রনিক মেইল এক্সচেঞ্জের সাথে। অন্যরা এই তথ্য ভাগাভাগি করে যখন তাদের মালিকরা ফ্লপি ডিস্ক নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করেন ব্যবহার করার জন্য। এটি একটি আদর্শ পরিবেশ স্ব-অনুলিপনকারী প্রোগ্রামদের জন্য, যেখানে তারা সফলভাবে টিকে থাকে এবং ছড়িয়ে পড়তে পারে। যখন আমি এই বইটির প্রথম সংস্করণটি লিখেছিলাম, আমি যথেষ্ট অবুঝ ছিলাম বোঝার জন্য যে অনাকাঙ্খিত কম্পিউটার মিমদের জন্ম হতে পারে সত্যিকার প্রোগ্রামের অনুলিপি প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত কোনো স্বতস্ফূর্ত ভ্রান্তির মাধ্যমে। এবং আমি ভাবতাম, এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম। হায়, আসলেই নিষ্পাপ একটা সময় ছিল সেটি। দুরভিসন্ধীপূর্ণ প্রোগ্রামদের ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়িয়ে দেয়া ‘ভাইরাস’ আর ‘ওয়ার্মদের’ মহামারীগুলো, এখন সারা বিশ্বের কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের জন্য পরিচিত একটি সমস্যা। আমার নিজের হার্ড ডিস্ক আমার জানামতে দুটি ভাইরাস মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছে গত বছর এবং যারা খুব বেশী হারে কম্পিউটার ব্যবহার করেন, তাদের জন্য এটি খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। আমি যদিও সেই বিশেষ ভাইরাসগুলোর নাম উল্লেখ করবোনা কোন এক ক্ষুদ্র অশুভ প্রোগ্রামারকে কোন ধরনের অশুভ আত্মতুষ্টি দেবার জন্য। আমি বলেছি অশুভ কারণ তাদের আচরণ দেখে মনে হয় তাদেরকে নৈতিকভাবে আলাদা করা যাবে না, কোনো অনুজীববিজ্ঞান ল্যাবরেটরীর টেকনিশয়ান থেকে, যে কিনা খাওয়ার পানিতে ইচ্ছাকৃতভাবে সংক্রমণ ছড়ায় মানুষের আক্রান্ত হওয়া দেখে আনন্দ পাবার জন্য। আমি এদের ক্ষুদ্র বলেছি কারণ এই মানুষগুলো মানসিকভাবে ক্ষুদ্র। কোনো কম্পিউটার ভাইরাস বানানোর মধ্যে বুদ্ধিমত্তার কিছু নেই। যে কোনো মাঝারী দক্ষতার প্রোগামারও এটি করতে পারেন, এবং মাঝারী পর্যায়ের কম্পিউটার প্রোগ্রামারও সহজলভ্য আধুনিক এই পৃথিবীতে। আমিও নিজেও তাদের একজন। আমি সময় নষ্ট করবো না কোনো কম্পিউটার ভাইরাস কিভাবে কাজ করে সেটি ব্যাখ্যা করার জন্য। কারণ খুব সুস্পষ্ট সহজবোধ্য একটি ব্যাপার।

যেটা জানা অপেক্ষাকৃতভাবে কম সহজ সেটি হচ্ছে কিভাবে এই ভাইরাসগুলোর মোকাবেলা করা যায়। দুঃখজনকভাবে কিছু খুব দক্ষ প্রোগ্রামাররা তাদের মূল্যবান অনেক সময় অপচয় করেন ভাইরাস শনাক্তকারী ও ভাইরাস প্রতিরোধ প্রোগ্রাম লেখার জন্য (মেডিকেল ভ্যাক্সিনেশন সাথে তুলনামূলক উদাহরণ, বিস্ময়করভাবে সমরুপী, এমনকি সেই ভাইরাসের ‘দূর্বল স্ট্রেইনের ইনজেকশন দেয়া অবধি)। বিপদটি হচ্ছে একটি অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হবে। প্রতিটি ভাইরাস প্রতিরোেধ প্রোগ্রামকে পাল্লা দিতে হবে নতুন ভাইরাস প্রোগ্রামের আরো বেশী দক্ষতার সাথে। এ পর্যন্ত প্রায় সব অ্যান্টি ভাইরাস প্রোগ্রাম যা লেখা হয়েছে, তা করেছেন পরার্থবাদীরা এবং বিনামূল্যে এটি সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি একটি সম্পূর্ণ নতুন পেশার উদ্ভব– অন্য যে কোন পেশার মত তারাও লাভজনকভাবে বিশেষায়িত বিষয়ে বিভাজিত হবে– সফটওয়ার চিকিৎসক, যাদের কালো ব্যাগ ভর্তি রোগশনাক্তকারী আর চিকিৎসা দেবার নানা ধরনের ডিস্ক থাকবে। আমি ডাক্তার নামটি ব্যবহার করলাম, কিন্তু সত্যিকার ডাক্তাররা প্রাকৃতিক সমস্যার সমাধান করছে যা মানবিক অশুভ কোনো মস্তিষ্কে তৈরী হয়নি ইচ্ছাকৃতভাবে। আমার সফটওয়ার ডাক্তাররা, অন্যদিকে আবার আইনজীবিদের মত হবে, যারা মানুষের বানানো সমস্যা সমাধান করছে যা এর আগে কখনোই ছিলনা। ভাইরাস নির্মাতাদের নিয়ে আমরা যে দেখি তাদের সুস্পষ্ট কোনো উদ্দেশ্য নেই, সম্ভবত তারা খানিকটা নৈরাজ্যবাদী হিসাবে নিজেদের অনুভব করেন। আমি তাদের প্রতি আবেদন জানাবো, আপনারা কি আসলে একটি নতুন লোভনীয় পেশার জন্ম দিতে চান? যদি না হয়, এই সব চটুল মিম নিয়ে খেলা বন্ধ করুন, আপনার মাঝারী মাত্রার প্রোগামিং প্রতিভাকে ভালো কোন কাজে লাগান।

(৭) পূর্বপ্রত্যাশিতভাবেই অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের শিকার এমন বহু মানুষের কাছ থেকে আমি প্রচুর পরিমান চিঠি পেয়েছি। তারা অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে আমার সমালোচনা প্রসঙ্গে সবাই প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অন্ধ বিশ্বাস হচ্ছে খুব সফল একটি মগজ ধোলাইকারী তার নিজের স্বার্থেই, বিশেষ করে শিশুদের মগজ ধোলাইকারী, এর মানে হচ্ছে এর থেকে মুক্ত হওয়া খুব কঠিন একটি কাজ। কিন্তু, আসল কথা হচ্ছে ফেইথ বা অন্ধ বিশ্বাস মূলত কি? এটি হচ্ছে মনের একটি অবস্থা যা মানুষকে বিশ্বাস করতে শেখায় কোনো কিছু– যে কোনো কিছু– এর সপক্ষে প্রমাণের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতিতে। যদি কোনো ভালো সমর্থক প্রমাণ থাকে, তাহলে অন্ধ বিশ্বাস বাহুল্য ছাড়া কিছু নয় কারণ প্রমাণই আমাদের বাধ্য করবে সেটি বিশ্বাস করার জন্য। অন্ধ বিশ্বাস হচ্ছে সেই মানসিক অবস্থা যা প্রায়শই তোতাপাখির মত পুনরাবৃত্তি করা দাবী উচ্চারণ করে যে, বিবর্তন নিজেই অন্ধ বিশ্বাসের মত একটি বিষয়। খুবই হাস্যকর একটি যুক্তি। মানুষ বিবর্তনে বিশ্বাস করে তার কারণ তারা নিজেদের ইচ্ছামত সেটি বিশ্বাস করতে চান সেই জন্য নয় বরং অসংখ্য পরিমান, সবার জন্য উন্মুক্ত প্রমাণের অস্তিত্ব আছে এর সপক্ষে।

আমি বলেছি, কোনো কিছু যায় আসেনা’ অন্ধ বিশ্বাসীরা কি বিশ্বাস করেন, যা প্রস্তাব করে যে মানুষ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, হাস্যকর আর মনগড়া বিষয়ের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস আছে, ঠিক যেমন ডগলাস অ্যাডামস এর ইলেকট্রিক মঙ্ক, যাকে আমরা দেখি ‘ডার্ক জেন্টলি’স হলিস্টিক ডিটেকটিভ এজেন্সিতে। তিনি ছিলেন উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে নির্মিত যিনি আপনার হয়ে বিশ্বাসের কাজটি করবেন, এবং খুব সফলভাবে। যেদিন আমাদের সাথে তার পরিচয় হয়, তিনি তখন অনড় ভাবে বিশ্বাস করেন, সব প্রমাণ উপেক্ষা করে, এই পৃথিবীর সব কিছু গোলাপী রঙের। আমি এমন কোনো তর্কে যেতে চাইনা যে সেই সব বিষয়গুলো যা কোনো ব্যক্তির অন্ধ বিশ্বাসের বিষয়, সেগুলো খুবই হাস্যকরভাবে নির্বুদ্ধিতা। সেটি হতে পারে আবার নাও হতে পারে। মূল বিষয়টি যা এখানে খেয়াল রাখতে হবে সেটি হচ্ছে কোনো উপায় নেই সিদ্ধান্ত নেয়ার যে সেগুলো আসলেই নির্বুদ্ধিতা কিনা, কোনো উপায় নেই কোনোভাবে একটি বিশ্বাসের বস্তু উপর অন্য বিশ্বাসের বস্তু গুরুত্ব দেবার, কারণ, খুব সুস্পষ্টভাবে প্রমাণগুলো ছুঁড়ে ফেলা হবে। আসলেই বাস্তব সত্য যে সত্যিকারের ধর্মবিশ্বাসের কোনো প্রয়োজন নেই সদগুণ হিসাবে এটির বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে। এটাই কারণ আমার ডাউটিং থমাস-এর গল্পটি এখানে উল্লেখ করার জন্য, শুধুমাত্র সত্যিকারের প্রশংসাযোগ্য যীশুর বারো অনুসারীর একজন।

 অন্ধ বিশ্বাস কোনো পর্বতকে নাড়াতে পারেনা ( যদিও বহু প্রজন্মের শিশুদের গুরুগম্ভীরভাবে বলা হয়েছে এর বিপরীতটাই যা তারা বিশ্বাস করেছে); কিন্তু এটি খুব ভালোভাবে পারে মানুষকে ভয়ঙ্কর সব উদ্ভট কাজ করার জন্য প্ররোচিত করতে, একারণেই অন্ধ বিশ্বাসকে আমার কাছে মনে হয় একধরনের মানসিক অসুস্থতা। এটি কোনো কিছুর উপর মানুষকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে এত দৃঢ়ভাবে যে চরম কিছু ক্ষেত্রে একজন বিশ্বাসী মরতে এবং মারতে প্রস্তুত থাকে কোনো ধরনের যথার্থতা বা কাজটি নৈতিক হচ্ছে কিনা সেটির প্রয়োজনীয়তা যাচাই করা ছাড়াই। কিথ হেনসন ‘মেমেওয়েড’ শব্দটি প্রস্তাব করেছেন, সেই সব শিকারদের চিহ্নিত করার জন্য “যাদের দখল করে কোনো মিম এমন একটি পর্যায় অবধি যেখানে তাদের নিজেদের বেঁচে থাকার ব্যপারটা অর্থহীন। আপনি বহু মানুষ দেখেছেন এই ধরনের সন্ধ্যার খবরে, বেলফাস্ট থেকে বৈরুতে। ধর্ম বিশ্বাস যথেষ্ট পরিমান শক্তিশালী যা এর ধারককে সব ধরনের করুনা, দয়া, ক্ষমা এবং সব সভ্য মানবীয় অনুভূতির আবেদন ইত্যাদি সবকিছুর বিরুদ্ধে সুরক্ষিত রাখে। এটি এমনকি ভয় থেকেও এর বাহককে সুরক্ষিত করে রাখে, তারা যদি সৎভাবে বিশ্বাস করে শহীদের মৃত্যু তাদের সরাসরি স্বর্গে নিয়ে যাবে। কি ভয়ঙ্কর একটি অস্ত্র! ধর্মীয় বিশ্বাস যুদ্ধের প্রযুক্তির কোনো প্রকাশনায় লঙ বো, যুদ্ধে ঘোড়া, ট্যাঙ্ক এবং হাউড্রোজেন বোমা, ইত্যাদি যুদ্ধাস্ত্রের সাথে সমান গুরুত্ব দিয়ে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় পাওয়ার যোগ্য।

(৮) আমার উপসংহারের আশাবাদ সমালোচকদের মনে সংশয়ের জন্ম দিয়েছিল, যারা অনুভব করেন এই বাক্যটি পুরো বইয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমালোচনা এসেছে মতবাদ চাপিয়ে দিতে উৎসাহী সোসিওবায়োলজিষ্টদের কাছ থেকে যারা খুব ঈর্ষাকাতরভাবে জিনগত প্রভাবের গুরুত্বকে রক্ষা করার ব্যাপারে উৎসাহী। অন্য ক্ষেত্রে সমালোচনা এসেছে খুব অদ্ভুতভাবে বিপরীত দিক থেকে, বামের উচ্চ পর্যায়ের তাত্ত্বিক পণ্ডিতরা, যারা খুব ঈর্ষাকাতরভাবে রক্ষা করতে চেয়েছেন তাদের প্রিয় দানবীয় আইকনটিকে। রোস, কামিন এবং লিওনটিন তাদের ‘নট ইন আওয়ার জিন’-এ একটি ব্যক্তিগত ভ্রান্তি আছে, যাকে বলা যায় রিডাকশনিজম (রিডাকশনিজম, রিডাকশনিজম এর মূল প্রশ্নটি হচ্ছে কোনো একটি বৈজ্ঞানিক ডোমেইন এর বৈশিষ্ট্য, মূলভাবনা,ব্যাখ্যা বা পদ্ধতি (সাধারণ জটিল ও উচ্চ সাংগাঠনিক স্তর) থেকে আমরা অন্য একটি বৈজ্ঞানিক ডোমেইনের বৈশিষ্ট্য, মূলভাবনা,ব্যাখ্যা বা পদ্ধতি (সাধারণ সরল ও নীচু সাংগাঠনিক স্তর) সমন্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বা ব্যাখ্যা করতে পারি।) এবং সেরা সব রিডাকশনিস্টরাই আপাতদৃষ্টিতে ডিটারমিনিস্ট, বিশেষ করে জেনেটিক ডিটারমিনিস্ট ( ডিটারমিনিজম বা পরিণামবাদ হচ্ছে একটি দার্শনিক ধারণা যে প্রতিটি ঘটনা, পরিস্থিতি, যার মধ্যে আছে মানুষের প্রতিটি সিদ্ধান্ত এবং কর্ম– হচ্ছে পূর্ববর্তী কোনো ঘটনা কিংবা পরিস্থিতির অনিবার্য এবং অত্যাবশকীয় পরিণতি)।

মস্তিষ্ক হচ্ছে, কোনো রিডাকশনবাদীর ক্ষেত্রে– এর নির্ধারক জৈববৈজ্ঞানিক বস্তু যার বৈশিষ্ট্যাবলী এমন আচরণ সৃষ্টি করার জন্য দায়ী যা আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি এবং সেই আচরণের কারণ চিন্তাগুলো বা উদ্দেশ্য, আমরা আচরণ থেকে ব্যাখ্যা করতে পারি। এ ধরণের কোনো অবস্থান হচ্ছে, অথবা এটি যেটা হওয়া উচিৎ সোসিওবায়োলজীর মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যা প্রস্তাব করেছেন উইলসন এবং ডকিন্স। তবে, এটিকে পুরোপরিভাবে গ্রহন করার সাথে জড়িত আছে প্রথমত সেই উভয়সংকটটি, এ ধরনের কোনো মানবিক আচরণের সহজাত স্বভাবসিদ্ধতা বিষয়ে যুক্তি দেয়া, মুক্ত মানুষ হিসাবে যা তাদের কাছে অনেক কম আকর্ষণীয় মনে হয় (বিদ্বেষ, দীক্ষা ইত্যাদি) তারপর কোনো অপরাধের দায়বদ্ধতা নিয়ে উদারনৈতিক ও নৈতিকার্থে সংক্রান্ত আলোচনায় নিজেদের জড়িয়ে ফেলা, যদি এইসব কিছুই, অন্যান্য বাকী কাজের মতই জৈববৈজ্ঞানিকভাবে পূর্বনির্ধারিত। এই সমস্যাটি এড়াতে, উইলসন ও ডকিন্স ফ্রি উইল বা স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির ধারণাটি উত্থাপন করেন, যা আমাদের সুযোগ করে দেয় আমাদের জিনের নির্দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, যদি আমরা চাই–এটি আবশ্যিকভাবেই নির্লজ্জভাবে কার্তেশিয়ানিজমে (রেনে দেকার্ত এর দর্শন) প্রত্যাবর্তন, এটি দ্বৈত্ববাদী ‘দিউস এক্স ম্যাশিনা’ (বা মেশিনের মধ্যে ঈশ্বর)।

আমি মনে করি, রোজ এবং তার সহকর্মীরা নিজেদের কেক নিজেরা কেটে খাবার জন্য আমাদের অভিযুক্ত করেছেন। আমাদের হয় আমরা অবশ্যই ‘জিনগত পরিণামবাদী’ অথবা আমরা ‘ফ্রি উইল’ এ বিশ্বাস করি, কিছুতেই আমরা একসাথে দুটো হতে পারবো না। কিন্তু– এবং এখানে আমরা ধরে নিচ্ছি আমি অধ্যাপক উইলসনের পক্ষ হয়েও কথা বলছি, আমার জন্য তো বটেই। শুধুমাত্র রোজ এবং তার সহকর্মীদের চোখে আমরা জিনগত পরিণামবাদী। তারা যে বিষয়টি বুঝতে পারছেন না, সেটি হচ্ছে (যদিও খুব কঠিন তাদের সেই কৃতিত্ব দেয়ার জন্য) খুব ভালোভাবেই সম্ভব এমন কোনো মতামত ধারণ করা যে জিনরা একটি পরিসংখ্যানগত প্রভাব ফেলে মানুষের আচরণের উপর, এবং একই সাথে বিশ্বাস করা যে, এই প্রভাবটিকে কম বেশী পরিবর্তন, এটিকে প্রতিরোধ করা এবং প্রতিবর্তন করা সম্ভব অন্যান্য কিছুর প্রভাবের মাধ্যমে। জিন অবশ্যই একটি পরিসংখ্যানগত প্রভাব ফেলবে যে কোনো আচরণের উপর যা বিবর্তিত হয়েছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে। আশা করা যেতে পারে রোজ এবং তার সহকর্মীরা একমত হবেন যে মানুষের যৌন কামনা বিবর্তিত হয়েছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে, একই অর্থে যেমন যেকোনো কিছু কখনও বিবর্তিত হয়েছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে। সেকারণে তারা নিশ্চয়ই একমত হবেন যে অবশ্যই কিছু জিন আছে যা যৌন কামনাকে প্রভাবিত করে– ঠিক যে অর্থে জিনরা অন্য যে কোনো কিছুর উপর তাদের প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তারপরও মনে করা যেতে পারে তাদের কোনো সমস্যা হয়না এই কামনাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে যখন সামাজিকভাবে প্রয়োজন হয় সেটি করার জন্য। এর সাথে দৈত্ববাদীতার কি সম্পর্ক? অবশ্যই কোনো কিছুনা। স্বার্থপর অনুলিপনকারীদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পক্ষে আমার ওকালতি করাও আদৌ দ্বৈতবাদীতা নয়। আমরা, অর্থাৎ আমাদের মস্তিষ্কগুলো, আমাদের জিন থেকে যথেষ্ট পরিমান পৃথক এবং যথেষ্ট পরিমান স্বতন্ত্র, তাদের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণার জন্য। ইতিমধ্যেই যা বলেছি, আমরা ছোট আকারে সেই কাজটিই করি যখনই আমরা জন্মনিরোধক ব্যবহার করি। আরো বড় আকারে আমাদের বিদ্রোহ করতে পারার কোনো কারণই নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *