০৩. অমর কুণ্ডলী

অধ্যায় ৩: অমর কুণ্ডলী

আমরা হচ্ছি সারভাইভাল মেশিন বা টিকে থাকার যন্ত্র। কিন্তু ‘আমরা’ মানে এখানে শুধু মানুষকে বোঝাচ্ছে না, এই ‘আমরা’র মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সকল প্রাণী, উদ্ভিদ, ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাস। এই পৃথিবীতে সারভাইভাল মেশিনের মোট সংখ্যা কত, সেটি গণনা করা খুবই কঠিন এবং এমনকি পথিবীতে প্রজাতির মোট সংখ্যা কত সেটিও আমাদের অজানা। যদি শুধু কীটপতঙ্গদের কথাই ধরা হয়,তাদের জীবিত প্রজাতির সংখ্যা অনুমান করা হয়েছে প্রায় তিন মিলিয়নের কাছাকাছি, এবং কীটপতঙ্গদের একক সদস্যদের সংখ্যা হতে পারে এক মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন।

বিভিন্ন ধরনের সারভাইভাল মেশিনগুলো আপাতদৃষ্টিতে বাইরে থেকে কিংবা তাদের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোর ক্ষেত্রে খুবই ভিন্ন ভিন্ন রুপের মনে হতে পারে। একটি অক্টোপাস কোনোভাবেই ইঁদুরের মত নয় এবং দুটি প্রাণীই আবার একটি ওক গাছ থেকে খুব ভিন্ন। কিন্তু তাদের মৌলিক রসায়নে তারা বরং একই, এবং, বিশেষ করে, যে অনুলিপনকারীদের তারা তাদের মধ্যে ধারণ করে, জিনগুলো, সেগুলো মূলত একই ধরনের অণু, যা আমাদের সবার মধ্যে থাকে, ব্যাকটেরিয়া থেকে হাতি। আমরা সবাই একই ধরনের অনুলিপনকারী অণুর সারভাইভাল মেশিন– যে অণুর নাম ডিএনএ– কিন্তু আরো অনেক উপায় আছে এই পথিবীতে বাঁচার জন্য এবং সেই সব উপায়গুলোর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করার লক্ষ্যে অনুলিপনকারী সেই অণুটি বহু ধরনের মেশিনও তৈরী করেছে। বানর হচ্ছে একটি যন্ত্র যা গাছের উপরের মগডালে জিনগুলোকে সুরক্ষা করে, মাছ হচ্ছে তেমনই একটা যন্ত্র পানিতে জিনগুলোকে সুরক্ষা করে, এমনকি খুব ক্ষুদ্র একটি নেমাটোড প্রজাতি আছে যারা জার্মান বিয়ার ম্যাটে (বিয়ারের গ্লাসের নীচে রাখার জন্যে কার্ডবোর্ডের তলাচি) তাদের জিনগুলোকে সুরক্ষা করে (১)। বহু রহস্যময় উপায়ে ডিএনএ কাজ

করে। খুব সরলভাবে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার জন্য আমি এমনভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছি যে, আধুনিক জিনগুলো, যারা ডিএনএ দিয়ে তৈরী হয়েছে, আদিম সেই রাসায়নিক মিশ্রণে আবির্ভূত অনুলিপনকারী অণুর মত তারা ঠিক একই রকম দেখতে ছিল। আমার প্রস্তাবিত যুক্তির জন্য বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু বিষয়টি আসলেই সত্যি নাও হতে পারে। সেই আদি মূল অনুলিপনকারী অণুরা হয়তো ডিএনএ-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত এমন কোনো অণুই ছিল। অথবা হয়তো তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো প্রকারের ছিল। পরের সম্ভাবনাটির ব্যপারে আমরা হয়তো বলতে পারি যে তাদের টিকে থাকার যন্ত্রগুলো পরবর্তীতে কোনো একসময় দখল করে নেয় ডিএনএ’রা। যদি তাই হয়, তাহলে আধুনিক টিকে থাকার কোনো যন্ত্রে তাদের আর কোনো চিহ্নের অবশেষ নেই, আদিম সেই অনুলিপনকারী অণুগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ভাবনা সুত্রেই এ. জি. কেয়ার্ন-স্মিথ (২) আমাদের পূর্বসূরিদের নিয়ে দারুণ আগ্রহ উদ্দীপক প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেছিলেন, প্রথম অনুলিপনকারী অণুগুলো হয়তো আদৌ কোনো জৈব অণুই ছিল না, সেগুলো হয়তো অজৈব স্ফটিক ছিল– খনিজ, ক্লে বা কাদার ক্ষুদ্র কোনো অংশ। দখলকারী হোক বা না হোক বর্তমানে ‘ডিএনএ’ তর্কাতীতভাবে মূল নিয়ন্ত্রণে আছে, যদি না, যেমন, পরীক্ষামূলকভাবে প্রস্তাব করেছি। অধ্যায় ১১ তে, ক্ষমতা নতুন করে দখল করার একটি পক্রিয়া কেবল শুরু হয়েছে।

 কোনো ডিএনএ অণু হচ্ছে বিল্ডিং ব্লক বা গঠনগত একক অণু দিয়ে তৈরী একটি সুদীর্ঘ শৃঙ্খল, এই সব গঠনগত একক অণুগুলোকে বলে ‘নিউক্লিওটাইড’। ঠিক যেমন করে কোনো প্রোটিন অণু অ্যামাইনো এসিডদের শৃঙ্খল, তেমনি ডিএনএ হচ্ছে। নিওক্লিওটাইডদের শিকল। একটি ডিএনএ অণু খালি চোখে দেখার জন্যে অনেক বেশী ক্ষুদ্র, কিন্তু পরোক্ষ উপায়ে এর সঠিক আকারটি উদ্ভাবনী দক্ষতার সাথে আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। এটি তৈরী হয়েছে এক জোড়া নিউক্লিওটাইড দিয়ে তৈরী শঙ্খল দিয়ে, যারা পরস্পরের সাপেক্ষে কুণ্ডলী পাকিয়ে পেঁচানোর মাধ্যমে সর্পিলকার একটি আকার তৈরী করে। সেই ডাবল হেলিক্স (৩), সেই ‘অমর কুণ্ডলী’। নিউক্লিওটাইডগুলো, যারা ডিএনএ তৈরী করে তারা চার ধরনের, তাদের নামের আদ্যক্ষর ব্যবহার করে সংক্ষেপে বলা হয়, A,L,G এবং C; আর সব প্রাণী বা উদ্ভিদের নিউক্লিওটাইডরা ঠিক একই রকমের। শুধুমাত্র পার্থক্যটি হচ্ছে তারা কোন অনুক্রমে একটার পর একটি সাজানো থাকে। কোনো একটি G বিল্ডিং ব্লক মানুষের যেমন, সেটি শামুকের G বিল্ডিং ব্লকের মত হুবহু একই রকম দেখতে। কিন্তু কোনো একটি মানুষের ক্ষেত্রে এইসব নিউক্লিওটাইড বেসগুলোর সজ্জা বা অনুক্রম কোনো শামুকের বেস সজ্জা বা অণক্রম থেকে শুধু ভিন্নই না, অন্য কোনো মানুষের বেস সজ্জা থেকে আলাদা– যদিও অপেক্ষাকৃত কম ( শুধুমাত্র হুবহু জিনগত যমজদের ক্ষেত্র ছাড়া)।

আমাদের ডিএনএ বাস করে আমাদের শরীরে, শরীরের কোনো একটি অংশে তারা জড়ো হয়ে থাকে না, তারা ছড়িয়ে থাকে শরীরের কোষগুলোয়। গড় পড়তা কোনো মানব শরীরে প্রায় এক হাজার মিলিয়ন মিলিয়ন কোষ থাকে, গ্রাহ্য না করার মত অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে একটি সম্পূর্ণ সেট ডিএনএ থাকে। এই ডিএনএ-কে মনে করা যেতে পারে এক সেট নির্দেশাবলী হিসাবে, যেখানে কিভাবে একটি শরীর তৈরী করতে হয় সেই নির্দেশ থাকে, এবং সেই নির্দেশাবলী লেখা থাকে নিওক্লিওটাইড বেসদের বর্ণমালায়, A,T,G এবং C। তুলনা করা যেতে পারে কোনো একটি সুবিশাল অট্টালিকা, যার প্রতিটি রুমে বই রাখার একটি আলমারী বা ‘বুক-কেস আছে, যেখানে সেই পুরো অট্টালিকাটি কিভাবে তৈরী করতে হবে, সে ব্যপারে স্থপতির পরিকল্পনাটি রাখা আছে। প্রতিটি কোষের সেই ‘বুক-কেসটিকে বলা হয় নিউক্লিয়াস, মানুষের ক্ষেত্রে স্থপতির পরিকল্পনাটি সাজানো আছে ৪৬ টি খণ্ডে। এই সংখ্যাটি প্রজাতিভেদে ভিন্ন। আর সেই ভলিয়ুম বা খণ্ডকে বলা হয় ক্রোমোজোম। মাইক্রোস্কোপের নীচে তাদের লম্বা সুতার মত দেখা যায়, এবং জিনরা সেই সুতায় ধারাবাহিকভাবে সাজানো থাকে। বিষয়টি অবশ্য এত সহজ না, আসলেই এমনকি এটি অর্থবহও হয় না, ঠিক কোথায় কোনো একটি জিন শেষ হচ্ছে আর পরবর্তী জিনটি শুরু হচ্ছে। সৌভাগ্যক্রমে এই অধ্যায় আমাদের প্রদর্শন করবে, আমাদের আলোচনার উদ্দেশ্যের জন্য বিষয়টি তেমন কোনো সমস্যা না।

আমি স্থপতির পরিকল্পনার রুপকটি এখানে ব্যবহার করবো, স্বাধীনভাবে রুপকের ভাষার সাথে সত্যিকারের বিষয়টির ভাষা মিশ্রণ করার মাধ্যমে। খণ্ড’ শব্দটি ক্রোমোজোমের সাথে পরস্পর পরিবর্তনীয়ভাবে ব্যবহৃত হবে। “পৃষ্ঠা’ শর্ত সাপেক্ষে পরস্পর পরিবর্তনীয়ভাবে ব্যবহৃত হবে জিনের সাথে, যদিও জিনদের মধ্যে বিভাজন কোনো বইয়ের আলাদা আলাদা পাতার মত এতটা সুস্পষ্ট নয়। তবে এই রুপকটি আমাদের অনেক কিছু বুঝতে সাহায্য করবে। যখন এটি অপ্রতুল হয়ে অবশেষে ভেঙ্গে পড়বে, আমি আরো নতুন কোনো রুপক ব্যবহার করবো। ঘটনাচক্রে, অবশ্যই কোনো ‘স্থপতির’ অস্তিত্ব নেই, ডিএনএর নির্দেশাবলী একসাথে জড়ো করেছে প্রাকৃতিক নির্বাচন।

 ডিএনএ অণুগুলো দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, প্রথমত তারা অনুলিপনকারী, অর্থাৎ তারা নিজেদের অনুলিপি তৈরী করে। এবং জীবনের সূচনা থেকে এটি বিরামহীনভাবেই চলেছে এবং ডিএনএ অণুগুলো বর্তমানে আসলেই এই কাজটি করতে অত্যন্ত দক্ষ। প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে, আপনার শরীরের প্রায় এক হাজার মিলিয়ন মিলিয়ন কোষ আছে, কিন্তু যখন মাতৃগর্ভে প্রথম আপনি যাত্রা শুরু করেছিলেন, আপনি ছিলেন শুধু একটি মাত্র কোষ। আপনার সেই কোষে ‘স্থপতির’ পরিকল্পনার একটি মাত্র ‘মাস্টার’ বা মূল কপি ছিল, সেই কোষটি দ্বিবিভাজিত হয় এবং উৎপন্ন দুটি কোষ সেই মূল কপি থেকে তাদের নিজেদের কপিটি পায়। পরবর্তী আরো বিভাজনে কোষ সংখ্যা বাড়াতে থাকে ধারাবাহিক হারে, ৪, ৮, ১৬, ৩২ এবং এভাবে হাজার কোটি কোষে। প্রতিটি কোষ বিভাজনের সময় ডিএনএ পরিকল্পনাটি বিশ্বস্তভাবে অনুলিপি হয়, প্রায় কোনো ভুল ছাড়াই।

ডিএনএ’র অনুলিপি তৈরী নিয়ে কথা বলা এক বিষয়, কিন্তু ডিএনএ যদি আসলে শরীর গঠন করার জন্য এক সেট পরিকল্পনাই হয়ে থাকে, কিভাবে সেই পরিকল্পনাটিকে কাজে প্রয়োগ করা হয়? কিভাবে আমাদের শরীরের গঠনের প্রক্রিয়ায় সেটি অনূদিত হয়? আর এই বিষয়টি আমাকে ডিএনএ দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজটিতে নিয়ে আসে। একটি ভিন্ন ধরনের অণু সৃষ্টি করার প্রক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে এটি তদারকী করে– প্রোটিন। আগের অধ্যায়ে হিমোগ্লোবিনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি হচ্ছে শুধুমাত্র একটি উদাহরণ, অসংখ্য প্রোটিন অণুর একটি মাত্র উদাহরণ। ডিএনএ’র সাংকেতিক বা কোড করা বার্তা লেখা আছে চার অক্ষরের ‘নিউক্লিওটাইড’ বর্ণমালায়, এবং সাধারণ যান্ত্রিক একটি উপায়ে এটি অনুদিত হয় অন্য একটি বর্ণমালায়, সেটি হচ্ছে অ্যামাইনো এসিডদের বর্ণমালা, যা প্রোটিন অণু গঠন করে।

কিন্তু শুধু প্রোটিন বানানো পুরো একটি শরীর বানানো থেকে অনেক দূরের একটি বিষয় মনে হতে পারে। কিন্তু সেই লক্ষ্যে এটি হচ্ছে প্রথম ক্ষুদ্র পদক্ষেপ। প্রোটিন শুধুমাত্র শরীরের গঠনগত মূল উপাদান হিসাবে কাজ করে না, তারা কোষের মধ্যে সব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায়, বিশেষ সময় ও বিশেষ স্থানে তাদের বেছে বেছে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় করে তাদের সংবেদনশীল নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব খাটায়। এবং ঠিক কি ভাবে এই সব কাজ অবশেষে একটি শিশুকে তৈরী করে সে এক বিশাল কাহিনী, যার রহস্য পুরোপুরি উদ্ধার করতে ভ্রূণতত্ত্ববিদদের। কয়েক দশক কিংবা শতাব্দীকাল সময় লাগবে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে এটি তাই করে। জিন পরোক্ষভাবে শরীর তৈরী হবার প্রক্রিয়াটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু সেই প্রভাবটি খুব কঠোরভাবে একমুখী: অর্জিত কোনো বৈশিষ্ট্যই উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তরিত হয় না। জীবনে আপনি যত জ্ঞান আর প্রজ্ঞা অর্জন করুন না কেন, তার একটি বিন্দুও জিনের মাধ্যমে আপনার সন্তানদের মধ্যে হস্তান্তরিত হবেনা, প্রতিটি প্রজন্মকেই শুরু থেকে শুরু করতে হয়। অবিকৃত অবস্থায় জিনগুলোকে সংরক্ষিত করার জন্য শরীর সে-কারণে জিনেরই একটি উপায়।

আর জিনরা যে ভ্রূণসংক্রান্ত বিকাশ প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করে, সেই বাস্তব সত্যটির বিবর্তনীয় গুরুত্ব হচ্ছে এটি: এর অর্থ জিনরা অন্ততপক্ষে আংশিকভাবে ভবিষ্যতে তাদের নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য দায়ী। কারণ তাদের টিকে থাকাটা নির্ভর করবে যে শরীরে তারা বাস করবে এবং যে শরীর তৈরী করতে তারা সাহায্য করেছে, সেই শরীরের দক্ষতার উপর। কোন এক সময়, প্রাকৃতিক নির্বাচন মূলত ছিল আদিম সুপ বা মিশ্রণের মধ্যে মুক্তভাবে ভাসমান অনুলিপন করতে সক্ষম এমন অণুদের বৈষম্যমূলক একটি হারে টিকে থাকা, এখন প্রাকৃতিক নির্বাচন সেই অনুলিপনকারী অণুদের প্রতি আনুকুল্যতা প্রদর্শন করে যারা ভালো ‘সারভাইভাল মেশিন’ তৈরী করতে পারে, সেই সব জিনগুলো, যারা দক্ষতার সাথে ভ্রূণগত বিকাশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এখানে এই অনুলিপনকারী অণু, তারা যেমন কখনোই ছিল না, তেমনি কোনোভাবে আরো বেশী সচেতন বা উদ্দেশ্যমূলক ছিল না। সেই পুরানো প্রক্রিয়া, স্বয়ংক্রিয় নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বী অণুগুলোর মধ্যে তাদের দীর্ঘসময় টিকে থাকা বা দীর্ঘজীবিতা, উর্বরতা আর অনুলিপি করার সময় ভুল না করার দক্ষতা বা অনুলিপি-বিশ্বস্ততার কারণে তখনও পরিচালিত হয় অন্ধভাবেই এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে, যেমন একসময় বহু দিন আগে তারা করতো। জিনদের কোনো ভবিষ্যৎদর্শিতা নেই। আগে থেকে তারা কোনো পরিকল্পনা করে না। জিন শুধু জিন, কিছু জিন অন্য জিনদের তুলনায় কিছু বেশী এবং এখানে আর বেশী কিছু বলারও নেই। কিন্তু যে গুণগুলো কোনো জিনের দীর্ঘায়ু নির্ধারণ করে বা তাদের অনুলিপি করার দ্রুততা বা উর্বরতাকে নির্দেশ করে তারা জিনদের মত আর সরল নয় এখন, যেমন আগে ছিল, অনেক পার্থক্য সেখানে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয়– গত ছয়শ মিলিয়ন বছরের মত এই অনুলিপিকারী অণুগুলো তাদের টিকে থাকার যন্ত্র তৈরীর প্রযুক্তিতে কিছু উল্লেখযোগ্য বিজয় অর্জন করেছে, যেমন, মাংসপেশী, হৃদপিণ্ড, চোখ (স্বতন্ত্রভাবে বেশ কয়েকবার যা বিবর্তিত হয়েছে); তবে এর আগে অনুলিপনকারী অণু হিসাবে তাদের পূর্বতন জীবনাচরণের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো তারা বৈপ্লবিকভাবেই বদলে ফেলেছে, আমাদের সেটা অবশ্যই আগে বুঝতে হবে, যদি যুক্তিটি নিয়ে আমরা সামনে অগ্রসর হতে চাই।

একটি আধুনিক অনুলিপনকারী অণুর বিষয়ে প্রথমেই যে বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে সেটি হচ্ছে তারা ভীষনভাবে সঙ্গলি, দলবদ্ধ হয়ে তারা বাস করতে চায়। কোনো একটি সারভাইভাল মেশিন’ হচ্ছে সেই বাহন, যা শুধু একটি জিন ধারণ করেনা, সেখানে বাস করে ‘বহু’ হাজার জিন। একটি শরীর তৈরীর প্রক্রিয়া এতটাই সূক্ষ্ম জটিল সমবায়ী একটি উদ্যোগ, সেই উদ্যোগে কোনো একটি জিনের অবদান অন্য কোনো জিনের অবদান থেকে পৃথক করা প্রায় অসম্ভব (৪)। একটি জিনের হয়তো পৃথক অনেক প্রভাব থাকতে পারে শরীরের বিভিন্ন অংশে। শরীরের যেকোনো একটি জায়গা প্রভাবিত হয় বহু জিনের কর্মকাণ্ডে এবং কোনো একটি জিনের প্রভাব আরো অনেকগুলো জিনের সাথে তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। কিছু জিন আছে যারা কাজ করে মাষ্টার’ জিন হিসাবে, যারা অন্য একগুচ্ছ জিনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। রুপকের ভাষায় বললে, স্থপতির পরিকল্পনার কোনো একটি পাতা, অট্টালিকার বিভিন্ন অংশের পরিকল্পনার প্রতি ইঙ্গিত করে এবং প্রতিটি পাতা অর্থবহ হয় অন্য পাতায় থাকা অসংখ্য তথ্যের আলোকে।

জিনদের এই জটিল ও সূক্ষ্ম পারস্পরিক নির্ভরশীলতা আপনাকে ভাবাবে, আসলেই আমরা ‘জিন’ শব্দটি আদৌ কেন ব্যবহার করি? কেনই বা আমরা কোনো সমষ্ঠীসূচক শব্দ, যেমন, “জিন-কমপ্লেক্স’ শব্দটি ব্যবহার করিনা? উত্তর হচ্ছে, নানা উদ্দেশ্যের কারণে এটি আসলেই খুব ভালো একটি ধারণা, কিন্তু আমরা যদি বিষয়টি অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করি, কোনো জিন কমপ্লেক্সের ধারণাটিও অর্থবহ হয়, যখন জিন কমপ্লেক্সটি সুস্পষ্টভাবে পৃথক পৃথক অনুলিপনকারী অংশে বা জিনে বিভাজিত হবে এমনভাবে চিন্তা করা হয়। আর যৌন প্রজননের কারণে এই সমস্যাটি সৃষ্টি হয়। জিনগুলোকে মিশ্রণ আর সাফলিং বা এলোমেলো করে মিশিয়ে দেবার ক্ষেত্রে যৌন প্রজননের একটি বিশাল প্রভাব আছে। এর অর্থ হচ্ছে যে, একজন ব্যক্তির শরীর শুধু একটি স্বল্পায়ু জিন সন্নিবেশের ক্ষণস্থায়ী বাহন। আর জিনদের এই সন্নিবেশ হচ্ছে, যা কোনো একক সদস্যের শরীর ধারণ করে, সেই শরীরটি হয়তো বেশী দিন নাও বাঁচতে পারে, কিন্তু এর ধারণ করা জিনরা নিজেরা অনেক দীর্ঘায়ু হবার সম্ভাবনা রাখে। তাদের পথগুলো অবিরতভাবে বারবার মুখোমুখি হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। কোনো একটি জিনকে মনে করা যেতে পারে ‘একক’ হিসাবে, ধারাবাহিকভাবে আসা বহু সংখ্যক একক সদস্যদের শরীরে স্থানান্তরিত হবার মাধ্যমে যা টিকে থাকে। আর এটাই এই অধ্যায়ে মূল যুক্তি হিসাবে গড়ে তোলা হবে। এটি হচ্ছে একটি যুক্তি, আমার বেশ কিছু সম্মানিত সহকর্মীরা যে যুক্তিটির সাথে দুর্দমনীয়ভাবে একমত হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সুতরাং আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন যদি মনে হয় আমি বিষয়টি নিয়ে পরিশ্রম করছি!। প্রথমে যৌন প্রজনন নিয়ে কিছু বাস্তব বিষয় আমি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে চাই।

আমি বলেছিলাম যে মানুষের একটি শরীর তৈরী করার বিস্তারিত পরিকল্পনাটি সুরক্ষিত আছে ৪৬ টি খণ্ডে। আসলেই এটি অতিসরলীকরণ হয়ে গেছে। সত্যিটা বরং আরো অদ্ভুত, ৪৬টা ক্রোমোজোমে আছে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম। আমরা হয়তো বলতে পারি শরীর নির্মাণের পরিকল্পনাটি ২৩ খণ্ডের বিকল্প দুইটি সেট হিসাবে প্রতিটি কোষের নিউক্লিয়াসে সজ্জিত আছে। আমরা তাদের নাম দিলাম খণ্ড ১ক’ এবং ১খ, খণ্ড ‘ক’ এবং ২খ’ ইত্যাদি থেকে খণ্ড ‘২৩ক’ এবং খণ্ড ‘২৩খ’। অবশ্যই শনাক্তকারী সংখ্যাগুলো যা খণ্ডগুলো চিহ্নিত করতে এখানে এবং পরবর্তীতে পাতা নির্দেশ করতে আমি ব্যবহার করছি, সেটি অবশ্যই বিশুদ্ধভাবে কাল্পনিক।

আমরা প্রতিটি ক্রোমোজোম অবিকৃত অবস্থায় পাই আমাদের পিতা বা মাতা– এই দুজনের কারো একজনের কাছ থেকে, যাদের অণ্ডকোষ বা ডিম্বাশয়ে সেই ক্রোমোজোমটি তৈরী হয়েছিল। ধরুন খণ্ড ‘ক’, ‘২ক’, ‘ক’ .. এসেছে আপনার বাবার কাছ থেকে, খণ্ড ‘খ’, ‘২খ’, ‘খ’ এসেছে আপনার মায়ের কাছ থেকে। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কাজটি করা অত্যন্ত দুরুহ একটি ব্যাপার, তবে তাত্ত্বিকভাবে আপনি অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে আপনার যে কোনো একটি কোষের ৪৬টি ক্রোমোজোমের দিকে তাকাতে পারেন এবং যেখান থেকে যে ২৩টি আপনার মায়ের কাছ থেকে এসেছে এবং যে ২৩ টি আপনার বাবার কাছ থেকে এসেছে, সেগুলো পৃথক করতে পারেন।

জোড়া ক্রোমোজোমগুলো তাদের সারা জীবন কিন্তু একসাথে পাশাপাশি পরস্পরে সংস্পর্শে থেকে কাটায় না কিংবা এমনকি একে অপরের কাছাকাছিও থাকেও না, তাহলে কোন অর্থে তাদের জোড়া বলা হচ্ছে? সেই অর্থে যে, এর প্রতিটি জোড়ের যেটি আসছে মূলত বাবার কাছ থেকে এসেছে সেটির প্রতিটি পাতা অনুযায়ী, তার সঙ্গী ক্রোমোজোমের বিকল্প হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে যেটি মূলত আসছে মায়ের কাছ থেকে। যেমন, খণ্ড ১৩ক’ এর ‘পৃষ্ঠা ৬’ এবং খণ্ড ‘১৩খ’ এর ‘পৃষ্ঠা ৬’ দুটোই হয়তো চোখের কি রঙ হবে সেই বিষয়ের নির্দেশনা হতে পারে, হয়তো একটি বলছে ‘নীল’, অন্যটি বলছে ‘বাদামী।

কখনো কখনো দুটি বিকল্প পৃষ্ঠাই হুবহু একই রকম দেখতে, কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেমন আমাদের চোখের রঙ বিষয়ক উদাহরণে যেভাবে বর্ণনা করলাম, তারা ভিন্নতা প্রদর্শন করছে। যদি তারা বিপরীতার্থক কোনো ‘প্রস্তাব করে পরিকল্পনায়, তাহলে শরীর কি করবে? এর উত্তর ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কখনো একটি অন্যটির উপর প্রাধান্য বিস্তার করে। চোখের রঙ নিয়ে যে উদাহরণটি দেয়া হলো এই মাত্র, এই মানুষটি হয়তো আসলেই বাদামী চোখের, সেক্ষেত্রে শরীরটি বানানোর সময় নীল চোখ বানানোর নির্দেশটি উপেক্ষা করা হয়েছে; তবে এটি কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মে তাদের হস্তান্তর হবার ক্ষেত্রে কোনো বাধার কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। কোনো জিন যখন এভাবে উপেক্ষিত হয় তাকে বলে ‘রিসেসিভ’ জিন। আর ‘রিসেসিভ জিনের বিপরীতটি হচ্ছে ‘ডমিন্যান্ট’ জিন। নীল চোখের জিনটির উপর বাদামী চোখের জিনটি হচ্ছে ‘ডমিন্যান্ট’। কোন ব্যাক্তির নীল চোখ হবে তখনই যদি সংশিষ্ট পৃষ্ঠা দুটি ‘নীল রঙের চোখ তৈরী করার নির্দেশ দেবার ক্ষেত্রে একমত হয়। যখন দুটি বিকল্প জিন হুবহু একই রকম থাকে না, সচরাচর হয়ে থাকে তা হচ্ছে এক ধরনের সমঝোতা– শরীর কোনো একটি মধ্যবর্তী ডিজাইনে অথবা সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো পরিকল্পনায় তৈরী হয়।

যখন দুটি জিন, যেমন ‘বাদামী’ আর ‘নীল চোখের জিন, যারা ক্রোমোজোমে নির্দিষ্ট একটি জায়গা (লোকাস) দখল করার জন্য একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তাদেরকে পরস্পরের ‘অ্যালিল’ বলা হয়। আমাদের এখানকার আলোচনার খাতিরে, অ্যালিল শব্দটি প্রতিদ্বন্দ্বী শব্দটির সাথে সমার্থক। কল্পনা করুন স্থপতির পরিকল্পনাটি একটি আলাদা আলাদা পাতাগুলো একসাথে জড়ো করা আছে কোনো বাইন্ডারের মত, যেখান থেকে পৃষ্ঠাগুলো ইচ্ছামত খুলে সরিয়ে ফেলা যাবে এবং তাদের জায়গা অদল বদল করা যাবে। প্রতিটি ১৩ খণ্ডের (১৩ক ও ১৩খ) অবশ্যই একটি পৃষ্ঠা ৬’ থাকবে, কিন্তু ‘পৃষ্ঠা ৬ এর বেশ কয়েকটি সংস্করণ আছে, যাদের যে কোনো একটি ৫’ ও ‘পৃষ্ঠা ৭’ এর মধ্যবর্তী জায়গাটি নিতে পারে। একটি সংস্করণ হয়তো বলছে ‘নীল চোখ, আরেকটি সম্ভাব্য সংস্করণ বলছে ‘বাদামী চোখ, হয়তো আরো একটি সংস্করণ সেই জনগোষ্ঠীতে বিদ্যমান আছে যা হয়তো অন্য একটি রঙের কথা বলছে যেমন, ‘সবুজ। হয়তো প্রায় অর্ধ-ডজন বিকল্প সংস্করণ বা অ্যালিল আছে যারা ১৩ তম ক্রোমোজোমের ‘পৃষ্ঠা ৬ এর অবস্থানটিতে বসে আছে সেই পুরো জনগোষ্ঠীতে। যেকোন একক ব্যক্তির ‘খণ্ড ১৩’ ক্রোমোজোম মাত্র দুটি, সে কারণে তার পৃষ্ঠা ৬ এর জায়গায় সর্বোচ্চ দুটি অ্যালিল থাকতে পারবে, তার হয়তো, যেমন ‘নীল চোখের একজন ব্যক্তি, দুটি অ্যালিল একই সংস্করণের বা তার হয়তো যেকোনো দুটি অ্যালিল থাকতে পারে, সেই জনগোষ্ঠীর জিনপুল (জিন সম্ভারে) বিদ্যমান অর্ধ ডজন অ্যালিল থেকে বাছাইকৃত।

অবশ্যই, আক্ষরিকার্থে, পুরো জনগোষ্ঠীর জিন সম্ভার থেকে নিজের ইচ্ছামত আপনার জিন বাছাই করে আনতে আপনি পারবেন না। যেকোনো একটি সময়ে সব জিনই কোনো একক টিকে থাকা বা সারভাইভাল মেশিনের মধ্যে বন্দী। আমাদের জিনগুলো আমাদের প্রদান করা হয় ঠিক যে মুহূর্তে মাতৃগর্ভে পিতার শুক্রাণুর দ্বারা মায়ের ডিম্বাণু নিষিক্ত হবার মাধ্যমে সৃষ্ট একটি মাত্র কোষ হিসাবে আমরা যাত্রা শুরু করি। আমাদের এখানে বাছ বিচার করার কোনো উপায়ই নেই। যাইহোক, এক অর্থে, যেখানে, দীর্ঘ মেয়াদী একটা রুপে, সাধারণভাবে কোনো জনগোষ্ঠীতে বিদ্যমান জিনগুলোকে গন্য করা যেতে পারে ‘জিনপুল বা জিন সম্ভার হিসাবে। তবে জিনপুল শব্দটিতে আসলেই একটি কারিগরী’ শব্দ, যা জিনতত্ত্ববিদরা ব্যবহার করে থাকেন। জিনপুলের ধারণাটি যুক্তিযুক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা, কারণ, যৌন প্রজনন জিনগুলোর মিশ্রণ ঘটায়, যদিও খানিকটা সতর্ক পদ্ধতিগত উপায়ে। নির্দিষ্টভাবে, এমন কোনো কিছু– যেমন সেই খোলা পাতার বাইন্ডারের কোনো একটি বা একসাথে একগুচ্ছ পৃষ্ঠা আলাদা করে সরিয়ে অন্য কোনো স্থানে প্রতিস্থাপিত করার প্রক্রিয়াটা আসলেই চলতে থাকে, আমরা এখন যা দেখবো।

 আমি একটি কোষের দুটি নতুন কোষে বিভাজিত হবার সাধারণ প্রক্রিয়াটি নিয়ে আগে আলোচনা করেছিলাম, প্রত্যেকটি কোষই একটি সম্পূর্ণ সেট, ৪৬ টি ক্রোমোজোমের সবকটি ক্রোমোজোম পায় সেখানে। এই সাধারণ কোষ বিভাজন পরিচিত ‘মাইটোসিস’ হিসাবে। কিন্তু আরো একধরনের কোষ বিভাজন আছে যাকে বলা হয় ‘মাইওসিস। এটি ঘটে শুধু মাত্র জনন কোষগুলি তৈরী হবার সময়: জনন কোষ হচ্ছে: শুক্রাণু ও ডিম্বাণু। শুক্রাণু ও ডিম্বাণু আমাদের সব কোষগুলোর মধ্যে অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন, সেখানে ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকার বদলে থাকে মাত্র ২৩ টি ক্রোমোজোম। এটি অবশ্য, ঠিক ৪৬ এর অর্ধেক –এবং বেশ সুবিধাজনক, কারণ তারা একসাথে সংযুক্ত হয়, যৌন প্রজনেনর নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়ায় একটি নতুন জীব সদস্য তৈরী করার জন্য। মাইওসিস হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের কোষ বিভাজন, যা ঘটে শুধুমাত্র অণ্ডকোষ আর ডিম্বাশয়ে, যেখানে কোনো কোষ যার পুরো সেট, অর্থাৎ ২৩ জোড়া বা ৪৬টি ক্রোমোজোম আছে, বিভাজিত হয়ে ‘জনন কোষ তৈরী করে, যেখানে শুধু একটি সেট, বা ২৩টি ক্রোমোজোম থাকে (উদাহরণ হিসাবে আমি এখন সব সময়ই মানুষের ক্রোমোজোম সংখ্যাই উল্লেখ করছি)।

একটি শুক্রাণু, তার ২৩ ক্রোমোজোমসহ, তৈরী হয় অণ্ডকোষের সাধারণ ৪৬টি ক্রোমোজোমসহ কোষের মাইওটিক কোষ বিভাজনের মাধ্যমে। কিন্তু কোন ২৩টি ক্রোমোজোমকে কোনো একটি শুক্রাণুতে স্থানান্তর করা হবে? স্পষ্টতই গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার হচ্ছে, কোনো একটি শুক্রাণু যেন অবশ্যই যেকোনো পুরোনো ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম না পায়: অবশ্যই এমন ঘটনা যেন না ঘটে, যেমন, এটি খণ্ড ১৩ র দুটি কপি আর খণ্ড ১৭ র কোনো কপি পেল না। তাত্ত্বিকভাবে যদিও সম্ভব কোনো একটি ব্যক্তি তার কোনো একটি শুক্রাণুতে শুধুমাত্র সেই ক্রোমোজোমগুলো রাখতে পারে, যারা এসেছে ধরুন, পুরোপুরিভাবে তার মায়ের কাছ থেকে, যেমন খণ্ড ১, ২খ, ৩খ ..২৩খ; এবং এই অসম্ভাব্য পরিস্থিতিতে সেই বিশেষ শুক্রাণুটি দ্বারা নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে সৃষ্ট শিশু তার অর্ধেক জিন সমষ্টি পাবে তার দাদীর কাছ থেকে, কোনটাই তার দাদার কাছ থেকে না। কিন্তু আসলেই এই ধরনের মোটা দাগের পুরো ক্রোমোজোমসহ বিন্যাস সাধারণত ঘটেনা। আসল সত্যিটাই বরং আরো বেশী জটিল। মনে করে দেখুন যে খণ্ডগুলোকে (ক্রোমোজোম) আমরা ভাবছিলাম খোলা-আলাদা পাতার কোনো। বাইন্ডার হিসাবে। যা ঘটে তা হলো, শুক্রাণু তৈরী হবার সময়, একক পাতাগুলো বা বরং অনেকগুলো পাতার কিছু অংশ আলাদা হয়ে এর। বিকল্প খণ্ডটির সেই একই অংশের সাথে জায়গা রদবদল করে। সুতরাং কোন একটি নির্দিষ্ট শুক্রাণু কোষের খণ্ড ১ হয়তো তৈরী হয়েছে খণ্ড ১ক এর পৃষ্ঠা ৬৫ এবং খণ্ড ১খ এর পৃষ্ঠা ৬৬ থেকে শেষ পর্যন্ত পাতাগুলো একসাথে নিয়ে। শুক্রাণু কোষটি বাকি ২২ টি খণ্ডও পূর্ণ হয় একইভাবে। সুতরাং কোনো একক ব্যাক্তির প্রতিটি শুক্রাণু কোষ আসলেই অনন্য, যদিও তার সকল শুক্রাণু কোষ তাদের ২৩টি ক্রোমোজোম জড়ো করেছে সেই একই সেট ৪৬ টি ক্রোমোজোমের নানা অংশ নিয়ে। ডিম্বাণু এভাবেই তৈরী হয় ডিম্বাশয়ে, তারাও প্রত্যেকটি অনন্য।

 বাস্তব ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়ায় এই মিশ্রণটি ঘটে সেটি এখন আমরা খুব ভালো করে জানি। কোনো একটি শুক্রাণু (বা ডিম্বাণু) তৈরী হবার সময়, পিতার কাছ থেকে আসা প্রত্যেকটি ক্রোমোজোমের টুকরো টুকরো অংশ শারীরিকভাবেই তাদের নিজেদের ক্রোমোজোম থেকে পৃথক করে নেয়, এবং মায়ের থেকে আসা সংশ্লিষ্ট ক্রোমোজোমের সেই অংশগুলোর সাথে তাদের জায়গা রদবদল করে। (মনে রাখতে হবে আমরা ক্রোমোজোম নিয়ে কথা বলছি যা মূলত এসেছে সেই মানুষটির বাবা-মার কাছ থেকে যে শুক্রাণুটি বানাচ্ছে, যেমন, সেই শিশুটির দাদা-দাদীর কাছ থেকে, যে শিশুটি সেই শুক্রাণুটি দিয়ে তার মায়ের ডিম্বাণু নিষিক্ত হবার পর জন্ম নেবে)। ক্রোমোজোমের টুকরোগুলোর এই অদল-বদল করার প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ‘ক্রসিং ওভার’। এই বইটির মূল যুক্তিটির জন্যে এই প্রক্রিয়াটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর অর্থ হচ্ছে যে আপনি যদি আপনার মাইক্রোস্কোপ বের করেন এবং আপনার নিজের শুক্রাণুর ( বা ডিম্বাণুর– যদি আপনি নারী হন) দিকে তাকান, সেখানে কোনগুলো আপনার মায়ের কাছ থেকে এসেছে, আর কোনগুলো আপনার বাবার কাছ থেকে এসেছে সেটা পার্থক্য করা আসলেই সময়ের অপচয় হবে। (এটি খুব বড় একটি পার্থক্য, শরীরের অন্যান্য সাধারণ কোষের সাথে যদি আপনি তুলনা করেন) (মূল বইয়ের পৃষ্ঠা ৩১ দেখুন)। যেকোনো একটি ক্রোমোজোম একটি শুক্রাণুতে আসলেই একটি প্যাঁচওয়ার্ক, বা মিশ্রণ, একটি মোজাইক, মা এবং বাবার জিনের সমন্বয়ে যা তৈরী হয়েছে।

এই পর্যায়ে জিনের রুপক হিসাবে ‘পৃষ্ঠার’ বর্ণনা আসলেই ভেঙ্গে পারে। কোনো একটি আলাদা করে খোলা যায় এমন পাতার বাইন্ডারে পুরো একটি পৃষ্ঠাই হয়তো কোথাও ঢুকে যেতে পারে কিংবা অপসারিত হতে পারে বা রদবদল হতে পারে সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠার সাথে, কিন্তু আংশিক পৃষ্ঠার ক্ষেত্রে তেমন হবার কথা না নয়। কিন্তু জিন কমপ্লেক্সরা আসলেই আণবিক নিউক্লিওটাইড অক্ষরের একটি ধারাবাহিক সুতোর মত, যা আলাদা আলাদা পৃষ্ঠায় সুস্পষ্ট করে বিভাজিত নয়।

নিশ্চিতভাবে যদিও, সেই ধারাবাহিক অনুক্রমে, প্রোটিন চেইন তৈরীর সংকেতের সমাপ্তি’ ও ‘প্রোটিন অণু তৈরীর করার সংকেত শুরু; এর বিশেষ সংকেত থাকে সেই একই চারটি নিউক্লিওটাইড বেস নির্দেশিত অক্ষরে, ঠিক যেমন করে প্রোটিন বার্তা নিজেরাও সজ্জিত হয়। এই দুটি বিরাম চিহ্নের মাঝখানে কেমন করে একটি প্রোটিন অণু তৈরী করতে হবে সেই সাংকেতিক বার্তাটি থাকে। আমরা যদি চাই তাহলে একটি জিনকে আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারি নিউক্লিওটাইড বর্ণমালার অনুক্রম হিসাবে যারা ‘শুরু’ আর ‘শেষ’ সংকেতের মধ্যে অবস্থান করে এবং যা একটি প্রোটিন অণুর শৃঙ্খল তৈরী করার সংকেত-বার্তা ধারণ করে। এভাবে সংজ্ঞায়িত করা কোন একটি ইউনিট বা একককে বোঝাতে ‘সিসট্রোন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এবং অনেকেই সিসট্রোন আর জিন শব্দ দুটি পরস্পর পরিবর্তনীয় রুপেও ব্যবহার করেন। কিন্তু ‘ক্রসিং ওভার’ প্রক্রিয়াটি সিসট্রোনদের মধ্যে থাকা কোনো বিভাজক সীমানা মেনে চলে না। একটি সিসট্রোনের ঠিক মাঝখানে বা কোনো দুটি সিসট্রোনের মাঝখানেও বিভাজিত হতে পারে। যেমন, অনেকটা এমন, স্থপতির পরিকল্পনাটি কোনো আলাদা আলাদা পৃষ্ঠায় লেখা হয়নি, যেন তাদের লেখা হয়েছে ৪৬ টি ‘টিকার টেপের’ রোল এর উপর (টিকার টেপ হচ্ছে কাগজের ফিতার মত, যার উপর টেলিগ্রাফিক টেপ মেশিনে বার্তাগুলো লিপিবদ্ধ হতো)। সিসট্রোনের কোনো সুনির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য নেই। কোথায় একটি সিসট্রোন শেষ হচ্ছে আর কোথায় আরেকটি শুরু হচ্ছে সেটি বলার একটি মাত্র উপায় হতে পারে, সেই টেপের উপর সংকেতটি ভালো করে লক্ষ করা, ‘বার্তা শেষ’ বা ‘বার্তা শুরু’ সংকেত খুঁজে বের করার মাধ্যমে। ‘ক্রসিং-ওভার’ প্রক্রিয়াটি প্রতিনিধিত্ব করে— বাবা ও মায়ের ম্যাচিং বা সদৃশ টেপগুলো নিয়ে, সংশ্লিষ্ট অংশগুলো কেটে আবার সদৃশ আংশগুলো তাদের জায়গায় রদবদল করে যুক্ত করার প্রক্রিয়াটিকে, সেই টেপে কি লেখা আছে সেটি আদৌ লক্ষ না করে।

এই বইটির শিরোনামে, ‘জিন’ শব্দটির অর্থ একটি একক’ সিসট্রোন নয় বরং আরো সূক্ষ্ম কিছু। আমার সংজ্ঞা হয়তো অনেকেরই পছন্দ মত হবেনা, কিন্তু আসলে সর্বজনীনভাবে মেনে নেয়া হয়েছে জিনের এমন কোনো সংজ্ঞাও নেই। এমনকি যদিও তেমন কিছু থাকতো, মনে রাখতে হবে সংজ্ঞার বিশেষ কোনো অলঙঘনীয় পবিত্রতার স্মারক চিহ্ন নেই। আমরা যেকোনো শব্দকে আমাদের ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে সংজ্ঞায়িত করে নিয়ে পারি, শুধু আমাদের কাজটি সুস্পষ্টভাবে করতে হবে, অর্থের কোনো অস্পষ্টতা ছাড়া। আমি যে সংজ্ঞাটি ব্যবহার করছি, সেটি এসেছে জি. সি. উইলিয়ামস (৫) এর কাছ থেকে। একটি জিনকে সংজ্ঞায়িত করা হয়, ক্রোমোজোম উপাদানের যেকোনো একটি অংশ, প্রাকৃতিক নির্বাচনের একক হিসাবে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকে থাকার মত যথেষ্ট পরিমান দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকার যার সম্ভাবনা আছে। আর এর আগের অধ্যায়ের সংজ্ঞানুযায়ী, কোনো জিন হচ্ছে খুব নিখুঁতভাবে নিজের অনুলিপি তৈরী করতে পারে এমন কোনো অনুলিপনকারী’। এই বিশ্বস্তভাবে নিজের অনুলিপি করা বাক্যটি ‘অনুলিপি-হিসাবে-দীর্ঘ-সময় টিকে থাকা বাক্যটিকে অন্যভাবে বলা এবং আমি এটিকে সংক্ষিপ্তভাবে এরপর থেকে আলোচনায় ব্যবহার করবো ‘দীর্ঘায়ু’ হিসাবে। জিনের সংজ্ঞাটির জন্য আরো কিছুটা ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

যেকোনো সংজ্ঞানুযায়ী, একটি জিনকে ক্রোমোজোমের একটি অংশ হতে হবে। প্রশ্নটি হচ্ছে, কত বড় অংশ, ‘টিকার টেপের’ কতটা অংশ? টেপের উপর যেকোনো একটি সাংকেতিক অক্ষরের অনুক্রম কল্পনা করুন। সেই অনুক্রমটির নাম দিন একটি জেনেটিক ইউনিট’। মাত্র দশটি অক্ষরের কোনো একটি সিসট্রোনের মধ্যে এটি হতে পারে একটি অনুক্রম। এটি আটটি সিসট্রোনের একটি অনুক্রমও হতে পারে; এটি হতো কোনো সিসট্রোনের মাঝামাঝি শুরু কিংবা শেষও হতে পারে। এটি হয়তো বা অন্য একটি জেনেটিক ইউনিটের কিছুটা অংশ ওভারল্যাপ বা অধিক্রমণ অর্থাৎ অপর অংশটির কিছু অংশ নিয়ে তৈরী হতে পারে। এর মধ্যে থাকবে ক্ষুদ্রতর ইউনিটগুলো এবং এটি বড় ইউনিটগুলোর অংশ তৈরী করবে। ইউনিটগুলো কত ছোট বা বড়, আমাদের বর্তমান যুক্তির জন্য সেটি ব্যপার না, সেটাকেই আমরা একটি ‘জেনেটিক ইউনিট’ বলছি। এটি ক্রোমোজোমের দৈর্ঘ্য বরাবর একটি অংশ মাত্র, যা সত্যিকারভাবে ক্রোমোজোমের বাকী অংশ থেকে শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন নয়।

এবার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কোনো একটি জেনেটিক ইউনিট যত ছোট হবে, এর জেনারেশন বা প্রজন্মগুলোর অপেক্ষাকৃত বেশী দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে। আরো সুনির্দিষ্টভাবে সেই ইউনিটটি মাইওসিসের সময় ‘ক্রসিং ওভার’ প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হবার সম্ভাবনা কম। ধরুন, একটি পুরো ক্রোমোজোম, গড়ে, একবার ‘ক্রসিং ওভার’ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে, প্রতিবার মাইওটিক কোষ বিভাজনের মাধ্যমে যখন কোনো একটি শুক্রাণু বা ডিম্বাণু তৈরী হয়। এবং ক্রস ওভারটি হতে পারে এর দৈর্ঘ্য বরাবর যেকোনো স্থানেই। আমরা যদি খুব বড় কোনো একটি জেনেটিক ইউনিট বিবেচনা করি, ধরুন ক্রোমোজোর অর্ধেক দৈর্ঘ্য ব্যাপী, তাহলে প্রতিটি মাইওটিক বিভাজনে এর খণ্ডিত হবার ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা আছে। যদি জেনেটিক ইউনিটটি ক্রোমোজোমের দৈর্ঘ্যের শুধুমাত্র ১ শতাংশ হয়, আমরা ধরে নিতে পারি যে যেকোনো একটি মাইওটিক বিভাজনের সময় এর খণ্ডিত হবার মাত্র ১ শতাংশ সম্ভাবনা আছে। এর অর্থ হচ্ছে ইউনিটটি নিয়ে আশা করা যেতে পারে যে, সেই ব্যক্তিটির বংশধারার উত্তরসূরিদের মধ্যে এটি বিশাল সংখ্যক প্রজন্মান্তরে টিকে থাকবে। একটি একক সিসট্রোন সাধারণত পুরো ক্রোমোজোমের ১ শতাংশ দৈর্ঘ্যের চেয়ে অনেক কম দৈর্ঘ্যের মনে করে হয়। এবং পাশাপাশি থাকা একগুচ্ছ সিসট্রোন ‘ক্রসিং ওভার’ প্রক্রিয়ায় খণ্ডিত হবার আগে, বহু প্রজন্ম ধরে টিকে থাকার আশা করতে পারে।

 কোনো একটি জেনেটিক ইউনিটের গড় জীবনকাল ‘প্রজন্ম দিয়ে খুব সুবিধাজনকভাবে প্রকাশ করা যেতে পারে, যা আবার ‘বছরে’ অনুবাদ করা সম্ভব। আমরা যদি পুরো একটি ক্রোমোজোম নেই আমাদের আনুমানিক জেনেটিক ইউনিটটির জন্য, এর জীবনকালের স্থায়িত্ব মাত্র একটি প্রজন্ম। ধরুন এটি আপনার ক্রোমোজোম ‘৮ক’, আপনার বাবার কাছ থেকে যা আপনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। এটি তৈরী হয়েছে আপনার বাবার অণ্ডকোষে, মায়ের গর্ভে আপনার জীবন শুরু হবার অল্প কিছু সময় আগে। পৃথিবীর পুরোটা ইতিহাস জুড়ে আগে কখনোই এর অস্তিত্ব ছিলনা। এটি সৃষ্টি হয়েছে মাইওটিক কোষ বিভাজনের শাফলিং বা রদবদল প্রক্রিয়ায়, আপনার দাদা আর দাদীর ক্রোমোজোমের নানা টুকরো সমন্বয়ে গড়েপিটে সেটি তৈরী করা হয়েছে। এবং এটি একটি শুক্রাণুর মধ্যেই রাখা হয়েছিল, যেটি অনন্যভাবে স্বতন্ত্র। সেই শুক্রাণুটি কয়েক মিলিয়ন শুক্রাণুর একটি, ছোট ছোট নৌযানসহ একটি বিশাল নৌবাহিনীর মত, যারা একসাথে আপনার মায়ের জরায়ুতে সাঁতার কেটে প্রবেশ করেছিল। এবং সেই নির্দিষ্ট আর অনন্য শুক্রাণুটি (যদি না আপনি একজন আইডেন্টিকাল বা হুবহু যমজ না হয়ে থাকেন। সেই জাহাজের বিশাল নৌ-বহরে একটি মাত্র জাহাজ, যা কিনা আপনার মায়ের ডিম্বাণুতে নোঙ্গর ফেলতে পেরেছিল। আর আপনার অস্তিত্বে কারণ সেটাই। যে জিনগত ইউনিটটি আমরা বিবেচনা করছিলাম, আপনার ক্রোমোজোম নং ৮ক’, আপনার বাকী জিনগত উপাদানের সাথে সে তাকেও অনুলিপি করেছে। এখন এটি বিদ্যমান, প্রতিলিপি হিসাবে, আপনার সারা শরীরে। কিন্তু যখন আপনার সন্তান জন্ম দেবার সময় আসবে, এই ক্রোমোজোমটি ধ্বংস হবে, যখন আপনি ডিম্বাণু (বা শুক্রাণু তৈরী করবেন), এর নানা টুকরো অংশ আমরা মায়ের কাছ থেকে আসা সংশ্লিষ্ট ক্রোমাজোম ‘৮খ’ এর সংশ্লিষ্ট নানা টুকরো অংশের সাথে তাদের জায়গা রদবদল করবে। যেকোনো একটি জনন কোষে, একটি নতুন ক্রোমোজোম নং ৮’ সৃষ্টি হবে, হয়তো বা সেটি আগের চেয়ে আরো ‘উত্তম’ বা হয়তো আরো ‘খারাপ হতে পারে। কিন্তু, বরং প্রায় অসম্ভব দৈবক্রম ছাড়া, অবশ্যই সেটি আলাদা হবে, অবশ্যই এককভাবে অনন্য হবে। কোনো একটি ক্রোমোজোমের জীবনকালের ব্যাপ্তি হবে একটি প্রজন্মের সমান।

ক্ষুদ্র জেনেটিক ইউনিটদের জীবনকাল কতটুকু, ধরুন আপনার ক্রোমোজোম “৮ক’ এর দৈর্ঘ্যের ১ শতাংশ? এই ইউনিটও এসেছে আপনার বাবার কাছ থেকে, এবং খুব সম্ভবত এটি মূলত তার শরীরেও সৃষ্টি হয়নি; এর আগের যুক্তি অনুযায়ী, প্রায় ৯৯ শতাংশ সম্ভাবনা আছে যে তিনি এটি পেয়েছিলেন সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত অবস্থায় তার বাবা অথবা মা, দুজনের যেকোনো একজনের কাছ থেকে। এবং অবশেষে, যদি আমরা ক্ষুদ্র জেনেটিক ইউনিটদের বংশঐতিহ্য অনুসরণ করে দেখার চেষ্টা করি যথেষ্ট অতীত কোনো সময় অবধি, আমরা এর মূল সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছাতে পারবো। কোনো একটি পর্যায়ে এটি অবশ্যই প্রথমবারের মত সৃষ্টি হয়েছিল আপনার কোনো পূর্বসূরির অণ্ডকাষ বা ডিম্বাশয়ের মধ্যে।

আবারো পুনরাবৃত্তি করতে চাই যে, বিশেষ একটি অর্থে আমি ‘সৃষ্টি শব্দটি ব্যবহার করছি। ক্ষুদ্রতর সাব-ইউনিটগুলো যারা জেনেটিক ইউনিট তৈরী করে, যাদের কথা আমি আলোচনা করছি হয়তো বিদ্যমান ছিল আগে থেকেই। আমাদের জেনেটিক ইউনিট সৃষ্টি হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে শুধুমাত্র এই অর্থে যে কোনো নির্দিষ্ট সাব-ইউনিটদের ‘সজ্জা’ যার মাধ্যমে এটি সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, সেই মুহূর্তের আগে তার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। সৃষ্টির মুহূর্তটি হয়তো ঘটেছে সাম্প্রতিক কোনো সময়ে, ধরুন আপনার কোনো পিতামহ বা প্রপিতামহের সময়ে। কিন্তু আমরা যদি খুব ছোটো কোনো ইউনিটের কথা ভাবি, সেটি হয়তো আরো অনেক দূরের কোনো পূর্বসূরিদের শরীরে সৃষ্টি হয়েছিল। হয়তো কোনো এইপ সদৃশ প্রাক-মানব পূর্বসূরির শরীরে। উপরন্তু, একটি ক্ষুদ্র ইউনিট আপনার শরীরে অনেক দূর ভবিষ্যতের দিকেও যেতে পারে, অখণ্ড অবস্থায় এটি স্থানান্তরিত হতে পারে আপনার উত্তরসূরিদের দীর্ঘ ধারায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

এটাও মনে রাখতে হবে যে, কোনো ব্যক্তির উত্তরসূরিরা একটি একক ধারা তৈরী করে না বরং একটি শাখাপ্রশাখা বিশিষ্ট ধারার সৃষ্টি করে; আপনার পূর্বসূরিদের মধ্যে যিনি, যে কিনা আপনার ক্রোমোজোম ‘৮ক’ এর সুনির্দিষ্ট অল্প দৈর্ঘ্যের একটি অংশ ‘সৃষ্টি করেছিল আপনি ছাড়াও তার হয়তো আরো বহু উত্তরসূরি আছে। আপনার জেনেটিক ইউনিটগুলোর মধ্যে একটি হয়তো উপস্থিত থাকতে পারে আপনার দ্বিতীয় জ্ঞাতি ভাইয়ের শরীরে। এটি আমার মধ্যে থাকতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর শরীরে এবং আপনার কুকুরের শরীরেও থাকতে পারে, কারণ আমরা যদি যথেষ্ট পরিমান অতীতে যেতে পারি, আমাদের সবাই কোনো না কোনো সাধারণ পূর্বসূরি ভাগ করেছিলাম। এছাড়াও আরো এই একই ক্ষুদ্র ইউনিট হয়তো বেশ কয়েকবারই স্বতন্ত্রভাবে তৈরী হয়েছিল দৈবক্রমে যদি ইউনিটটি ছোট হয়, তাহলে দৈবক্রমে ঘটার বিষয়টি খুব বেশী অসম্ভাব্য নয়। কিন্তু এমনকি কোনো একজন নিকটাত্মীয়ের পক্ষেও আপনার সাথে একটি আস্ত ক্রোমোজোম ভাগ করে নেবার সম্ভাবনা খুবই কম। কোনো একটি জেনেটিক ইউনিট যত ছোট হবে, অন্য কেউ সেটি ভাগ করে নেবার বা ধারণ করার সম্ভাবনাও বেশী হবে– এবং সারা পৃথিবীতে বহুবার এর অনুলিপি রুপে প্রতিনিধিত্ব করার আরো বেশী সেটির সম্ভাবনা থাকবে।

আগে থেকেই বিদ্যমান সাব-ইউনিটগুলোর ‘ক্রসিং ওভারের মাধ্যমে একত্র হওয়া হচ্ছে, একটি নতুন জেনেটিক ইউনিট তৈরী হবার সাধারণ একটি উপায়। অন্য একটি উপায়– বিবর্তনীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি যদিও এটি কদাচিৎ ঘটে, সেটিকে বলা হয় ‘পয়েন্ট মিউটেশন’। একটি পয়েন্ট মিউটেশন’ হচ্ছে একটি ভুল, যার সাথে তুলনা করা যেতে পারে একটি বইয়ে ভুলভাবে মূদ্রিত হওয়া কোনো একটি অক্ষরের সাথে। সচরাচর এটি ঘটেনা কিন্তু স্পষ্টতই যতই দীর্ঘ হবে কোনো জেনেটিক ইউনিট, এর দৈর্ঘ্যের কোনো না কোনো অংশে মিউটেশনের মাধ্যমে এর পরিবর্তন হবার সম্ভাবনা ততই বাড়বে।

আরো একটি দুর্লভ ধরনের মিউটেশন, যার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আছে সেটিকে বলা হয় “ইনভারশন। ক্রোমোজোমের একটি টুকরো দুই প্রান্তে এর মূল ক্রোমোজোম থেকে বিচ্ছিন্ন হবে, এটি পুরোপুরি উল্টো হয়ে যাবে, এবং আবার নিজেকে মূল ক্রোমোজোমের যুক্ত করবে, তবে পুরোপুরি উল্টোভাবে। এর আগের তুলনার সাথে বিষয়টি ব্যাখ্যা করলে এটি হচ্ছে নতুন করে যুক্ত হওয়া পৃষ্ঠাগুলোয় পুনরায় পৃষ্ঠা সংখ্যা দিতে হবে। কখনো কখনো ক্রোমোজোমের অংশ শুধু উল্টোভাবে যুক্তই হয়না বরং ক্রোমোজোমের সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গায় গিয়ে সেটি যুক্ত হয় বা সম্পূর্ণ অন্য কোনো একটি ক্রোমোজোমের সাথে যুক্ত হয়। প্রক্রিয়াটি হচ্ছে কোন একটি খণ্ড থেকে একগুচ্ছ পাতা অন্য আরেকটি খণ্ডের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া। এই ধরনের ভুলের গুরুত্ব হচ্ছে, যদি সাধারণত বিধ্বংসী, কখনো কখনো এটি কিছু জেনেটিক ইউনিটের মধ্যে কাছাকাছি একটি সংযোগ বা ‘লিংকেজ’ তৈরী করে যারা ঘটনাচক্রে একত্রে বেশী ভালোভাবে কাজ করে। হয়তো দুটো সিসট্রোনের কোনো উপযোগিতা আছে। যখন তারা দুটোই একসাথে উপস্থিত থাকে, তারা পরস্পরের সম্পুরক বা কোনো না কোনোভাবে পরস্পরকে আরো শক্তিশালী করে। ইনভারশন প্রক্রিয়াটি এমনই কোনো সিসট্রোনদের পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে আসে। এরপর প্রাকৃতিক নির্বাচন এই নতুন করে তৈরী হওয়া ‘জেনেটিক ইউনিটের প্রতি তার আনুকুল্য প্রদর্শন করবে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের মধ্যে এটি ছড়িয়ে পড়বে। সম্ভাবনা আছে যে জিন কমপ্লেক্সগুলো, বহু সময়ের পরিক্রমায়, আরো ব্যাপকভাবে পুনবিন্যস্ত ও সজ্জিত হবে বা ‘সম্পাদিত হবে। এই উপায়ে।

এই বিষয়টি সংক্রান্ত পরিচ্ছন্ন উদাহরণের একটি হচ্ছে সেই প্রাকৃতিক প্রপঞ্চটি যা পরিচিত ‘মিমিক্রি’ নামে। কিছু প্রজাপতির স্বাদ খুবই বাজে, সাধারণত তাদের রঙ উজ্জ্বল আর খুব বৈশিষ্ট্যসূচক এবং সেই সতর্কতামূলক রঙ দেখেই পাখিরা সাধারণত তাদেরকে খাওয়া থেকে বিরত থাকে। এখন অন্য প্রজাতির প্রজাপতি যাদের স্বাদ খারাপ না তারা এই কৌশলটি নিজেদের কাজে লাগায়। তারা খারাপ স্বাদের প্রজাপতিদের ‘মিমিক’ বা অনুকরণ করে। তারা আকারে ও রঙে ঠিক খারাপ স্বাদের প্রজাপতিদের মত দেখতে হয়। কিন্তু স্বাদে নয়), এভাবে তারা প্রায়শই মানব প্রকৃতিবিদদের বোকা বানায়তো বটেই, তারা পাখিদেরও বোকা বানায়। কোনো একটি পাখি যে একবার সত্যিকারের খারাপ স্বাদের প্রজাপতি মুখে নিয়েছে, সাধারণত সেই একই রকম দেখতে আর কোনো প্রজাপতি খাওয়া থেকে এড়িয়ে চলে। এবং এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সেই অনুকরণকারী বা মিমিক প্রজাতিগুলোও। সুতরাং যে জিনগুলো এই অনুকরণ বা মিমিক করতে সাহায্য করে সেই জিনগুলো প্রাকৃতিক নির্বাচনের আনুকুল্য পায়। এভাবে মিমিক্রি বিবর্তিত হয়।

 ‘বাজে’ স্বাদের বহু প্রজাতির প্রজাপতি আছে, এবং তারা সবাই একই রকম দেখতে নয়। একটি মিমিক বা অনুকরণকারী প্রজাতি তাদের সবার মত দেখতে হতে পারেনাঃ তাকে একটি মাত্র খারাপ স্বাদের কোনো প্রজাপতিকে অনুকরণ করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হয়। সাধারণত, কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির অনুকরণকারী বা মিমিক, একটি নির্দিষ্ট বাজে স্বাদের প্রজাপতিকে অনুকরণ করতে বিশেষজ্ঞ। কিন্তু আরো কিছু প্রজাতির মিমিক বা অনুকরণকারী আছে, যারা আরো অদ্ভুত কিছু কাজ করে। তাদের কোনো কোনো সদস্য একটি বাজে স্বাদের প্রজাতিকে মিমিক করে, কিন্তু সেই প্রজাতির অন্য সদস্য হয়তো অন্য একটি প্রজাতির বাজের স্বাদের প্রজাতিকে মিমিক করে। সেই প্রজাতি জনগোষ্ঠীর কোনো সদস্য যারা দুজনকেই মিমিক বা অনুকরণ করার চেষ্টা করে বা আর কেউ যদি এর মাঝামাঝি একটি অবস্থানে থাকে, তারা বেশ তাড়াতাড়ি পাখিদের খাদ্যে পরিণত হয়, কিন্তু এমন ধরনের মধ্যবর্তী কারো জন্ম হয়না। ঠিক যেমন কোনো একক সদস্য হয় নির্দিষ্টভাবে পুরুষ বা নারী। সুতরাং কোনো একটি একক সদস্য প্রজাপতি যা কোনো কোনো একটিমাত্র বাজে স্বাদের প্রজাপতির ‘মিমিক’ হয়। একটি প্রজাপতি হয়তো প্রজাতি ‘ক’ কে অনুকরণ করে আর তার ভাই হয়তো প্রজাতি ‘খ’কে অনুকরণ করে।

দৃশ্যত মনে হয় যেন একটি একক কোনো জিন নির্ধারণ করছে কোন একক সদস্যটি প্রজাতি ‘ক’ বা প্রজাতি ‘খ’ কে অনুকরণ করবে। কিন্তু কিভাবে একটি একক জিন মিমিক্রির এই বহুমাত্রিক কাজটি করতে পারে– রঙ, আকার, স্পটের বিন্যাস, ওড়ার ভঙ্গিমায়? এর উত্তর হচ্ছে কোনো একটি জিন, একটি সিসট্রোন অর্থে সম্ভবত সেই কাজটি পারেনা। কিন্তু সচেতন নয় এমন কোনো স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জিত সম্পাদিত বা এডিটিং হওয়া জিন যা ঘটতে পারে জিন উপাদানের ইনভারশন বা অন্যান্য দূর্ঘটনাবশত পুনবিন্যাস প্রক্রিয়ায়। প্রাক্তন কোনো বিচ্ছিন্ন জিনের একটি বড় সমষ্ঠী একসাথে কাছাকাছি এসে একটি দৃঢ় সংযোগ বা লিংকেজ গ্রুপ তৈরী করে কোনো একটি ক্রোমোজোমে। পুরো গুচ্ছ বা ক্লাস্টারটি একটি একক জিন হিসাবে আচরণ করে আসলেই, আমাদের সংজ্ঞানুযায়ী সেটি এখন একটি একক জিন ও তার একটি অ্যালিল বা বিকল্প রুপ আছে, যেটি আসলেই আরেকটি জিন গোষ্ঠী বা ক্লাষ্টার। একটি ক্লাস্টার হয়তো সেই সব সিসট্রোনগুেলো ধারণ করে যারা প্রজাতি ‘ক’ কে অনুকরণ করতে সাহায্য করে এবং বিকল্প অন্যটি হয়তো প্রজাতি ‘খ’ কে অনুকরণ করতে সাহায্য করে। এবং প্রতিটি ক্লাষ্টার ক্রসিং ওভারের মাধ্যমে খণ্ডিত হবার সম্ভাবনা খুব কম, আর তাই যেকোনো মাঝামাঝি রুপের কোনো প্রজাপতিকে আমরা প্রকৃতিতে কখনো দেখতে পাবো না। কিন্তু এই সব মাঝামাঝি রুপের প্রজাপতিদের মাঝে মাঝে আমরা দেখতে পাই যদি বহু সংখ্যক প্রজাপতিদের আমরা ল্যাবরেটরীতে প্রজনন করি।

আমি জিন শব্দটি ব্যবহার করছি একটি জেনেটিক ইউনিটকে বোঝতে। এবং বহু সংখ্যক প্রজন্ম টিকে থাকার জন্য তারা যথেষ্ট পরিমানে আকারে ছোট এবং অনেক সংখ্যক প্রতিলিপি হিসাবে এটি জনগোষ্ঠীতে বিদ্যমান। এটি কিন্তু খুব আটোসাটো অলঙ্ঘনীয় কোনো সংজ্ঞা নয়, বরং এক ধরনের ধীরে ধীরে মিশে যাওয়া সংজ্ঞার মত, ঠিক ‘বড়’ আর ‘পুরাতন’ এর সংজ্ঞার মত। ক্রোমোজোমের কোনো একটি দৈর্ঘ্যের ক্রসিং ওভার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খণ্ডিত হবার বা নানা ধরনের মিউটেশনের মাধ্যমে পরিবর্তিত হবার যতই সম্ভাবনা থাকবে, ততই এটি একটি ‘জিন’ হিসাবে চিহ্নিত হবার গুণাবলী হারায় ঠিক সেই অর্থে, যে অর্থে আমি ‘জিন’ শব্দটি ব্যবহার করছি। আনুমানিক হিসাবে কোনো একটি সিসট্রোন হয়তো এই নামের যোগ্য, কিন্তু একইভাবে যোগ্য আরো বড় ইউনিটগুলোও। এক ডজন সিসট্রোন হয়তো একে অপরের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে কোনো একটি ক্রোমোজোমে, সেটি আমাদের আলোচনার উদ্দেশ্য পুরণ করে একটি একক দীর্ঘায়ু জেনেটিক ইউনিট হিসাবে। প্রজাপতির মিমিক্রি ক্লাষ্টার ভালো একটি উদাহরণ। সিসট্রোন একটি শরীর ত্যাগ করে এবং অন্য একটি শরীরে প্রবেশ করে যখন তারা শুক্রাণু বা ডিম্বাণুতে আরোহণ করে পরবর্তী প্রজন্ম বরাবর যাত্রা শুরু করে। সম্ভাবনা আছে তারা সেই ক্ষুদ্র নৌযানে তাদের আগের যাত্রায় নিকটতম প্রতিবেশী খুঁজে পাবে, পুরোনো অভিযান সঙ্গী, যাদের সাথে তারা একটি দীর্ঘ যাত্রা শুরু করেছিল দুরবর্তী কোনো পূর্বসুরির শরীর থেকে। একই ক্রোমোজোমে পাশাপাশি থাকা ক্রোমোজোমগুলো একটি খুব দৃঢ় বন্ধনযুক্ত অভিযান সঙ্গীদের গ্রুপ তৈরী করে, যখন মাইওসিস কোষ বিভাজনের সময় হয় যাদের কেউ খুব কদাচিৎ একই জাহাজে উঠতে ব্যর্থ হয়।

খুব কঠোরভাবে বললে এই বইটি নাম হওয়া উচিৎ না ‘The Selfish Cistron’ of ‘The Selfish Chromosome but The slightly selfish big bit of chromosome and the even more selfish little bit of chromosome, sports ‘ক্রোমোজোমের খানিকটা স্বার্থপর বড় টুকরা এবং ক্রোমোজোমের আরো বেশী স্বার্থপর ছোট টুকরো”। অন্ততপক্ষে বইয়ের শিরোনাম হিসাবে এটি তেমন আকর্ষণীয় নয়। সুতরাং ক্রোমোজোমের সংক্ষিপ্ত অংশ বহু প্রজন্ম টিকে থাকার মত যারা সম্ভাবনাময়, তাদের জিন হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে আমি এই বইটির নাম দিয়েছি, ‘দ্য সেলফিশ জিন।

আমরা আবার সেই প্রসঙ্গেই ফিরে এসেছি, অধ্যায় ১ এর শেষে যা আমরা ছেড়ে এসেছিলাম। সেখানে আমরা দেখেছিলাম যে, স্বার্থপরতাই প্রত্যাশা করা যাবে এমন কোনো কিছুর কাছে, যা কিনা ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের কাজ করার একক’ শিরোনামটি দাবী করতে পারে। আমরা দেখেছি কেউ কেউ প্রজাতিকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কাজ করার একক হিসাবে মনে করেন, অন্যরা ভাবেন এই দাবী করতে পারে জনগোষ্ঠী অথবা কোনো প্রজাতির মধ্যে কোন গ্রুপ বা গোষ্ঠী, আবার কেউ কেউ ভাবেন প্রজাতির একক সদস্যরা হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কাজ করার একক। আমি বলেছিলাম যে, আমি মনে করি জিনরাই হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মৌলিক একক এবং সেকারণে আত্ম-স্বার্থের মৌলিক একক। আমি এখন যা করলাম সেটি হচ্ছে জিনকে ‘সংজ্ঞায়িত করলাম এমনভাবে, যে আমি চাইনা সেখানে ন্যূনতম সংশয় আর ভুল হবার অবকাশ থাকুক!

প্রাকৃতিক নির্বাচনের সবচেয়ে সাধারণতম রুপে নানা এনটিটি বা সত্তার বৈষম্যমূলক ভাবে টিকে থাকাকেই বোঝায়। কিছু সত্তারা টিকে থাকে আর কিছুর কোনো অস্তিত্ব থাকে না। এই বাছাইকৃতভাবে মারা যাওয়ার বিষয়টির এই পৃথিবীর উপর কোনো প্রভাব রাখতে হলে, আরো একটি বাড়তি শর্ত মেনে নিতে হবে। প্রতিটি সত্তাকে অবশ্যই অস্তিত্বশীল হতে হবে বহু সংখ্যক প্রতিলিপি রুপে। এবং কমপক্ষে কিছু সত্তার অনুলিপি রুপে– যথেষ্ট পরিমান বিবর্তন সময়ের জন্যে এর টিকে থাকার অবশ্যই সম্ভাবনা থাকবে। ছোটো জেনেটিক ইউনিটগুলোর এই বৈশিষ্ট্যাবলী আছে: প্রজাতির কোনো একক সদস্য, গোষ্ঠী বা গ্রুপ বা প্রজাতির এই বৈশিষ্ট্য নেই। গ্রেগর মেন্ডেলের একটি অসাধারণ অর্জন হচ্ছে তিনি দেখিয়েছিলেন যে, হেরেডিটারি বা বংশগতির এককগুলোকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এমনভাবে গ্রহন করা যেতে পারে, যেন সেটি অবিভাজ্য এবং স্বতন্ত্র কোনো পার্টিকেল বা ক্ষুদ্রতর কোনো অংশ বা কণা। ইদানীং আমরা জানি যে এটি একটি বেশী সরলীকরণ। এমনকি একটি সিসট্রোনও মাঝে মাঝে বিভাজিত হতে পারে এবং যেকোনো দুটি জিন একই ক্রোমোজোমে আসলে পুরোপুরিভাবে স্বতন্ত্র স্বাধীন নয়। আমি যেটা করেছি সেটি হচ্ছে, কোনো একটি জিনকে একটি ইউনিট হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছি, যা কিনা একটি উচ্চ মাত্রা অবধি অবিভাজ্য ক্ষুদ্র স্বতন্ত্র কনার আদর্শ বৈশিষ্ট্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে। কোনো একটি জিন অবিভাজ্য নয় বটে, কিন্তু এটি কদাচিৎ বিভাজিত হয়। কোনো একটি একক সদস্যর শরীরে এটি হয় সুনির্দিষ্টভাবে উপস্থিত থাকবে বা সুনির্দিষ্টভাবে অনুপস্থিত থাকবে। একটি জিন অখণ্ডিত অবস্থায় পিতামহ থেকে পৌত্রের শরীরে যাত্রা করে। যা অতিক্রম করে মধ্যবর্তী প্রজন্মটি, কিন্তু সেখানে তার কোনো মিশ্রণ হয়না বা অন্য কোনো জিনের সাথে এটি মিশে যায় না। যদি জিনরা সারাক্ষণই একে অপরের সাথে মিশে যেত, ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ বলতে আমরা এখন যা বুঝি, সেটি অসম্ভব একটি ব্যাপার হতো। ঘটনাচক্রে, এটি প্রমাণ হয়েছিল ডারউইনের জীবদ্দশায় এবং এটি ডারউইনকে ভীষণ চিন্তায় ফেলেছিল কারণ সেই সময় ধারণা করা হতো বংশগতি বা হেরেডিটি হচ্ছে মিশে যাবার একটি প্রক্রিয়া। মেন্ডেলের আবিষ্কার ততদিনে প্রকাশিত হয়েছিল, এবং সেটি ডারউইনকে দুশ্চিন্তা মুক্ত করতে পারতো, কিন্তু হায় তিনি সে বিষয়ে কিছুই জানতেন না। ডারউইন ও মেন্ডেল দুজনেরই মারা যাবার বহু বছর পরে ছাড়া আসলে কেউই মনে হয় সেটি মনোযোগ দিয়ে পড়েননি। হয়তো মেন্ডেল নিজেও তার আবিষ্কারের গুরুত্বটি বুঝতে পারেননি, নয়তো তিনি হয়তো ডারউইনকে বিষয়টি জানিয়ে লিখতেন।

জিনের পার্টিকুলেটনেস বা ক্ষুদ্র কণার মত বৈশিষ্ট্যের আরো একটি দিক হচ্ছে এটি কখনোই সেনাইল বা জরাগ্রস্থ হয় না। এটি যেমন মিলিয়ন বছর বয়স হলেও মরার সম্ভাবনা যতটুকু বাড়েনা, ঠিক তেমনই সেই সম্ভাবনা বাড়ে না এর যখন বয়স মাত্র একশ। এটি এক শরীর থেকে অন্য শরীরে লাফিয়ে চলে প্রজন্মান্তরে, একটার পর একটি শরীরকে তার নিজের মত করে ব্যবহার করে, তার নিজের উদ্দেশ্যে, ধারাবাহিকভাবে মরনশীল দেহগুলো সে পরিত্যাগ করে, দেহগুলো জরাগ্রস্থ আর মৃত্যুর কাছে পরাজিত হবার আগে।

 জিনরা আসলে অমর, অথবা বরং তাদের সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে জিনগত সত্তা হিসাবে যারা এই আখ্যা পাবার জন্য সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছায়। আমরা, এই পৃথিবীতে একক সেই সারভাইভাল মেশিন, কয়েক দশক বেঁচে থাকার আশা করতে পারি। কিন্তু জিনরা এই পৃথিবীতে তাদের যে সময়ব্যাপী জীবনকাল আশা করতে পারে, সেটি দশক দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব না বরং হাজার এবং মিলিয়ন বছর দিয়ে পরিমাপ করতে হবে।

 যৌন প্রজনন করে এমন কোনো প্রজাতিতে, একটি জেনেটিক ইউনিট হিসাবে বিবেচনা করার ক্ষেত্রে কোনো একক সদস্য হচ্ছে অনেক বড় ও অনেক বেশী ক্ষণস্থায়ী বা সাময়িক, প্রাকৃতিক নির্বাচনের যে ইউনিটটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারেনা (৬); আর একটি গ্রুপ বা গোষ্ঠী তার চেয়ে আরো বড় একটি ইউনিট। জিনগত দৃষ্টিভঙ্গিতে একক সদস্য আর সদস্যদের কোনো গ্রুপ হচ্ছে আকাশে ভাসমান মেঘ বা মরুভূমির মরু-ঝড়ের মত; একটি ক্ষণস্থায়ী সহযোগিতায় তারা সাময়িকভাবে একসাথে জড়ো হয়। বিবর্তনীয় সময়ের প্রেক্ষিতে এটি যথেষ্ট পরিমান স্থিতিশীল নয়। কোনো জনগোষ্ঠী হয়তো বহুদিন টিকে থাকে, কিন্তু তারা সারাক্ষণই মিশ্রিত হচ্ছে অন্য জনগোষ্ঠীর সাথে এবং তাদের সেই পরিচিতিটাও লঘু হয়ে হারাচ্ছে। এবং তারা নিজেরাও ভিতর থেকে বিবর্তনীয় পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়। প্রাকৃতিক নির্বাচনের একক হবার জন্য একটি জনগোষ্ঠী যথেষ্ট পরিমান পৃথক সত্তা নয়, তেমনি এটি স্থিতিশীলও নয় এবং অন্য কোনো একটি জনগোষ্ঠীর তুলনায় যা কিনা নির্বাচিত হতে পারে এমন কোনো এককও নয়।

 প্রজাতির কোনো একক সদস্যের দেহকে মনে হতে পারে সুস্পষ্টভাবে যথেষ্ট পৃথক যখন এটি টিকে থাকে, কিন্তু হায়, কতটা দীর্ঘ সময় সেটা? প্রতিটি সদস্যই স্বতন্ত্রভাবে অনন্য। এমন কোন সত্তাদের মধ্যে বাছাই করে আপনি কোনো বিবর্তন পেতে পারেন না, যখন প্রতিটি সত্তার জন্য সেখানে আছে মাত্র একটি কপি। যৌন প্রজনন কিন্তু অনুলিপিকরণ নয়। ঠিক যেমন কোনো একটি জনগোষ্ঠী অন্য জনগোষ্ঠী দ্বারা দুষিত হতে পারে, কোন একটি একক সদস্যের বংশধররাও দুষিত হতে পারে তার যৌন সঙ্গীর মাধ্যমে। আপনার সন্তান হচ্ছে অর্ধেকটি আপনি, আপনার পৌত্র হচ্ছে শুধু সিকি ভাগ আপনি। এবং এভাবে কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই বড় জোর আপনি হয়তো আশা করতে পারেন বিশাল সংখ্যক উত্তরসূরিদের, যাদের প্রত্যেকেই আপনার সামান্য কিছু অংশ বহন করে– অল্প কিছু জিন এমনকি যদিও তাদের খুব অল্প কয়েকজন আপনার পদবী বহন করে।

একক সদস্যরা স্থিতিশীল নয়, তারা ক্ষণস্থায়ী, রদ বদলের মাধ্যমে ক্রোমোজোম হারিয়ে যায় বিস্মতিতে, ঠিক তাস খেলায় বেটে পাওয়া হাতের তাসের কার্ডের মত; কিন্তু কার্ডরা নিজেরা এই রদবদল আর সাজানো পর্বে টিকে থাকে। এই কার্ডগুলো হচ্ছে জিন। এবং জিনরা ধ্বংস হয়না ‘ক্রসিং ওভারের মাধ্যমে, তারা শুধু সঙ্গী বদলায় এবং প্রজন্মান্তরে বহমান থাকে। অবশ্যই তারা চলতে থাকে, সেটাই তাদের কাজ। তারা হচ্ছে অনুলিপনকারী এবং আমরা তাদের বেঁচে থাকার মেশিন। যা কাজ সেটি হয়ে গেলে পরিত্যক্ত হিসাবে আমাদেরকে একপাশে সরিয়ে রাখা হয়। কিন্তু জিনরা হচ্ছে ভূতাত্ত্বিক সময়ের নাগরিক: জিনরা হচ্ছে অবিনশ্বর।

জিনগুলো, হীরার মত, চিরকালের জন্য, কিন্তু ঠিক হীরার মত একই ভাবে নয়। হীরার একক ভাবে কোনো স্ফটিক, যা পরমাণু সজ্জার অপরিবর্তিত একটি রুপ হিসাবে টিকে থাকে। ডিএনএ অণুর সেই একই ধরনের স্থায়ীত্ব নেই। শারীরিকভাবে কোনো একটি ডিএনএ অণুর জীবনকাল সংক্ষিপ্ত– হয়তো কয়েক মাসের ব্যাপার। নিশ্চয়ই কোনো একটি জীবনকালের চেয়ে দীর্ঘ নয়। কিন্তু একটি ডিএনএ অনু তার নিজের অনুলিপি হিসেবে তাত্ত্বিকভাবেই শত মিলিয়ন বছর ধরে বেঁচে থাকতে পারে। উপরন্তু, সেই আদিম সুপে বা মিশ্রণে প্রাচীন অনুলিপনকারীদের মত, কোনো একটি নির্দিষ্ট জিনের অনুলিপি সারা বিশ্বব্যাপী বিন্যস্ত থাকে। পার্থক্যটি হলো, আধুনিক সংস্করণগুলো তাদের টিকে থাকার যন্ত্র শরীরগুলোতে সব সুন্দর করে সাজানো আছে।

আমি যা করছি, তাহলে শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য হিসাবে অনুলিপি রুপে কোনো একটি জিনের সম্ভাব্য প্রায়-অমরত্বের বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করা। কোনো একটি জিনকে একটি একক সিসট্রোন হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা কিছু কিছু ক্ষেত্রে উপযোগী, কিন্তু বিবর্তনীয় তত্ত্বের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরো সম্প্রসারিত হওয়ার দরকার। সংজ্ঞার উদ্দেশ্য অনুযায়ী সেই সম্প্রসারণের সীমানাটি নির্ধারিত হতে পারে। আমরা আসলেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের একটি ব্যবহারিক’ ইউনিট খুঁজতে চাই। আর সেটা করতে আমরা শুরু করি সেই বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করার মাধ্যমে, যা কোনো প্রাকৃতিক নির্বাচনের সফল ইউনিটের অবশ্যই থাকতে হবে। গত অধ্যায়ের ভাষায়, সেগুলো হচ্ছে দীর্ঘায়ু, উর্বরতা ও নিজের সঠিক অনুলিপি করার ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা। আমরা তারপর একটি বড় ইউনিট হিসাবে ‘জিনকে’ সংজ্ঞায়িত করতে পারি, যার অন্ততপক্ষে এই সব গুণাবলী থাকার থাকার সম্ভাবনা আছে। কোনো একটি জিন হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকা একটি অনুলিপনকারী, এবং বহু অনুলিপি রুপে সেটি বিদ্যমান। অবশ্যই অসীমভাবে দীর্ঘায়ু নয়, এমনকি একটি হীরকখণ্ডও আক্ষরিক অর্থে চিরস্থায়ী নয় এবং এমন কি একটি সিসট্রোনও ক্রসিং ওভারের মাধ্যমে দ্বিখণ্ডিত হতে পারে। জিনকে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে ক্রোমোজোমের টুকরো হিসাবে, যা যথেষ্ট পরিমানে ক্ষুদ্র এবং যথেষ্ট পরিমান দীর্ঘ সময় ধরে যার টিকে থাকার সম্ভাবনা আছে, যেন সেটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি ইউনিট হিসাবে কাজ করে।

কিন্তু কত দীর্ঘ সময় আসলে যথেষ্ট দীর্ঘ সময়’? এই প্রশ্নের কোনো ধরাবাধা উত্তর নেই। এটি নির্ভর করবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের চাপটি কত শক্তিশালী। অর্থাৎ, একটি ‘ভালো’ অ্যালিলের তুলনায় একটি ‘খারাপ’ জেনেটিক ইউনিট ধ্বংস হয়ে যাবার কতটা বেশী সম্ভাবনা আছে। এটি হচ্ছে গুণবাচক একটি বিষয়, যা উদাহরণ থেকে উদাহরণ ভিন্নতা প্রদর্শন করে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের সবচেয়ে বড় ব্যবহারিক একক– জিন– সাধারণত অবস্থান করে সিসট্রোন আর ক্রোমোজোমের মাঝামাঝি কোনো মাত্রায়।

এই সম্ভাবনাময় অমরত্বের বৈশিষ্ট্যটাই হচ্ছে কোনো একটি জিনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মৌলিক একক হিসাবে দাবী করার পক্ষে যথেষ্ট শক্তিশালী একটি কারণ। এখন এই ‘পোটেনশিয়াল’ বা সম্ভাবনাময় শব্দটির উপর জোর দেবার সময় এসেছে। কোনো একটি জিন এক মিলিয়ন বছর বছর বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু অনেক নতুন জিন তাদের প্রথম প্রজন্মই পার হতে পারেনা। অল্প কিছু নতুন জিন সেটি করতে সফল হয় তার কারণ আংশিকভাবে তাদের ভাগ্য ভালো, কিন্তু মূলত তাদের সেই সব বৈশিষ্ট্য আছে যা থাকা দরকার, এবং এর অর্থ হলো তারা সারভাইভাল মেশিন বা টিকে থাকার শরীর যন্ত্রগুলো তৈরীতে দক্ষ। প্রত্যেকটি ধারাবাহিকভাবে আসা শরীরের জণগত বিকাশে তাদের একটি প্রভাব আছে, অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী জিন বা অ্যালিলের সমরুপ প্রভাবের তুলনায় যে শরীরগুলোয় তারা বাস করে যেন সেই শরীরটি খানিকটা বেশী বেঁচে থাকে ও প্রজনন সফল হয়। যেমন একটি “ভালো’ জিন হয়তো, একে পর এক আসা যে শরীরে সে বাস করে, এর টিকে থাকা নিশ্চিৎ করে সেই শরীরে দীর্ঘ পা সৃষ্টি করতে সাহায্য করে, দৌড়াবার দক্ষতা বাড়িয়ে যে পাগুলো সেই শরীরকে শিকারী প্রাণীদের হাত থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে।

এটি একটি সুনির্দিষ্ট উদাহরণ তবে সর্বজনীন নয়। লম্বা পা, আর যাই হোক, সব সময় উপকারে নাও আসতে পারে। কোনো একটি মোল ইঁদুরের জন্য এটি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা; নানা বিস্তারিত খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা মত্র না করে বরং আমরা কি ভাবতে পারি এমন কোনো বিশ্বজনীন গুণাবলী যা আমরা আশা করবো যে কেন ভালো (যেমন দীর্ঘায়ু) জিনে? এর বীপরিতার্থে, কি সেই গুণাবলী যা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো জিনকে চিহ্নিত করে ‘বাজে’ বা ‘স্বল্পায়ু’ জিন হিসাবে? এধরনের বিশ্বজনীন বৈশিষ্ট্য বেশ কয়েক ধরনেরই হতে পারে। কিন্তু একটি আছে, যা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক এই বইটির জন্য: জিন পর্যায়ে, পরার্থবাদীতা অবশ্যই খারাপ এবং স্বার্থপরতা অবশ্যই ভালো। অনতিক্রম্য এই ধারণাটি আসে আমাদের প্রস্তাবিত পরার্থবাদীতা ও স্বার্থপরতার সংজ্ঞানুযায়ী। জিনরা টিকে থাকার জন্য তাদের বিকল্প সংস্করণ বা অ্যালিলদের সাথে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, যখন তাদের অ্যালিলগুলো জিনপুলে ভবিষ্যত প্রজন্মেগুলোয় ক্রোমোজোমের একই জায়গা বা স্পটের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। যেকোনো একটি জিন যা কিনা জিন পুলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যালিলকে হটিয়ে তার নিজের টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়াতে এভাবে আচরণ করে, সেই জিনটির, সংজ্ঞানুযায়ী, যৌক্তিকভাবেই টিকে থাকার সম্ভাবনা থাকবে। জিন হচ্ছে স্বার্থপরতার মৌলিক একক।

এই অধ্যায়ের মূল বার্তাটি এখন বলা হয়ে গেছে, কিন্তু আমি কিছু জটিলতা আর গোপন পূর্বধারণা আলোচনায় এড়িয়ে গেছি। প্রথম সমস্যাটি এর আগে সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রজন্মান্তরে তাদের যাত্রায় জিনদের যতই স্বাধীন আর মুক্ত মনে হোক না কেন, তারা ভ্রূণ বিকাশের উপর তাদের আরোপিত নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আসলে খুব বেশী ‘স্বাধীন আর মুক্ত নয়। ব্যাখ্যাতীত অত্যন্ত জটিল নানা উপায়ে তারা পারস্পরিক সহযোগিতা ও তাদের বাহ্যিক পরিবেশের সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে। লম্বা পায়ের জন্য জিন’ বা ‘পরার্থবাদী আচরণের জন্য জিন’, এমন অভিব্যক্তিগুলো আসলে ধারণাটিকে ব্যাখ্যা করার অর্থেই সুবিধাজনক, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি বুঝতে হবে সেটি হচ্ছে, এই অভিব্যক্তিগুলো আসলে কি বোঝাচ্ছে। এমন কোনো জিন নেই যা কিনা একাই একটি পা তৈরী করতে পারে, লম্বা কিংবা খাটো। পা তৈরী করার মত কোনো কাজ হচ্ছে বহু জিন নির্ভর সমবায়ী সম্মিলিত একটি উদ্যোগ। বাহ্যিক পরিবেশের প্রভাবও সেখানে অপরিহার্য। সর্বোপরি পা আসলে তৈরী হচ্ছে খাদ্য দিয়ে! কিন্তু আসলেই সেখানে এমন কোনো একক জিনও থাকতে পারে, যে জিনটি আর সব কিছু অপরিবর্তিত থাকলে, তার বিকল্প অ্যালিলের প্রভাবে পা যতটা লম্বা হতো তার চেয়ে দীর্ঘতর পা তৈরী করতে পারে। একটি তুলনামূলক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, জমিতে ব্যবহার করা সারের কথা ভাবুন, যেমন, গমের বৃদ্ধির উপর নাইট্রেটের প্রভাব। প্রত্যেকেই জানেন, অনুপস্থিতির তুলনায়, নাইট্রেটের উপস্থিতিতেই বরং গম গাছ আকারে অনেক দ্রুত বাড়ে। কিন্তু একটি গম গাছ বানাতে শুধুমাত্র নাইট্রেটেরই ক্ষমতা আছে, এমন কোনো দাবী করার মত কেউ খুব বোকা নয়। সেই কাজটি করতে বীজ, মাটি, সূর্য, পানি ও নানা ধরনের খনিজ অবশ্যই সব একান্ত প্রয়োজনীয়, কিন্তু এই সব অন্য শর্তগুলো যদি অপরিবর্তিত থাকে এবং এমনকি যদি তারা একটি সীমার মধ্যে পরিবর্তিত হবার অনুমতিও পায়, যদি গমের ক্ষেতে নাইট্রেট যোগ করা হয় তাহলে গম গাছ আকারে অনেক বড় হয়। এবং ভ্রূণবিকাশের প্রক্রিয়ায় একক জিন যেভাবে তার প্রভাব ফেলার চেষ্টা করে ঠিক একই রকম ঘটে। যে পরস্পরসংবদ্ধ সম্পর্কের বিস্তৃত জালের মত প্রক্রিয়াটি দ্বারা ভ্রূণবিকাশ নিয়ন্ত্রিত হয় সেটি এত বেশী জটিল যে, আমাদের জন্য আপাতত সেটি চিন্তা না করাই উত্তম হবে। একটি শিশুর যেকোনো একটি অংশের একক কারণ হিসাবে জিনগত বা পরিবেশ নির্ভর কোনো পূর্বশর্ত নেই যা কিনা বিবেচনা করা যেতে পারে। কোনো শিশুর সব অংশের প্রায় অসীম সংখ্যক পূর্ববর্তী কারণ আছে। কিন্তু একটি শিশু থেকে অন্য কোনো একটি শিশুর মধ্যে পার্থক্য, যেমন, পায়ের দৈর্ঘের পার্থক্য, খুব সহজেই অনুসরণ করা সম্ভব হবে একটি, কিংবা অল্প কিছু পূর্ববর্তী কারণের প্রতি, এর পরিবেশনতুবা এর জিনে। আর প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সংগ্রামে এই পার্থক্যগুলোই টিকে থাকার জন্যে জরুরী এবং জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পার্থক্যগুলোই বিবর্তনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

কোনো একটি জিনের জন্যে এর অ্যালিল হচ্ছে ভয়ঙ্কর প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু অন্য জিনরাও এর পরিবেশের একটি অংশ, তাপমাত্রা, খাদ্য, শিকারী প্রাণী অথবা সঙ্গীদের মতই। কোন জিনের প্রভাব কি হবে সেটি নির্ভর করে এর পরিবেশের উপর এবং সেখানে অন্যান্য জিনরাও অন্তর্ভুক্ত। কখনো কখনো কোনো একটি জিন প্রভাব ফেলতে পারে, নির্দিষ্ট অন্য একটি জিনের উপস্থিতিতে, এবং হয়তো এর সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো প্রভাব আছে অন্য আরেক সেট সঙ্গী জিনের উপস্থিতিতে। একটি শরীরের পুরো সেট জিন একধরনের জিনগত পরিবেশ বা প্রেক্ষাপট গঠন করে, যা কোনো একটি নির্দিষ্ট জিনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ ও পরিবর্তন করতে পারে।

কিন্তু এখন আমরা একটি ধাঁধার সম্মুখীন হয়েছি, কোনো একটি শিশু তৈরী করা যদি এত বেশী বিস্তারিত, সূক্ষ্ম আর জটিল সামগ্রিক প্রচেষ্টা হয়ে থাকে এবং প্রতিটি জিনের যদি আরো কয়েক হাজার সঙ্গী জিনের সাহায্য দরকার হয় তার কাজটি শেষ করার জন্য, তাহলে আমার বর্ণিত অবিভাজ্য জিনের ধারণার সাথে কিভাবে আমরা এই বিষয়টির সামঞ্জস্য করতে পারি, যে জিনগুলো অমর ‘শামোয়া’ হরিণের মত এক শরীর থেকে লাফিয়ে অন্য আরেকটি শরীরে যুগের পর যুগ টিকে থাকে: জীবনের সেই স্বাধীন, বন্ধনমুক্ত স্বার্থপর এজেন্টটি? এসবই কি তাহলে অর্থহীন পুরোপুরি? মোটেও না, আমি হয়তো একটু বেশী আলঙ্কারিক বর্ণনায় নিজেকে প্রসঙ্গচ্যুত করে ফেলেছিলাম, কিন্তু আমি অর্থহীন কিছু বলিনি এবং আসলেই এখানে কোনো সত্যিকারের ধাঁধা নেই। আমরা আরো একটি তুলনামূলক উদাহরণ দিয়ে এটি ব্যাখ্যা করতে পারি।

 একজন নৌকাচালকের একক প্রচেষ্টায় অক্সফোর্ড আর কেমব্রিজ নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় জেতা অসম্ভব। তার সাথে দাঁড় টানার জন্য আরো আট জন সহকর্মীর দরকার হয়। যারা প্রত্যেকেই বিশেষজ্ঞ, নৌকার একটি নির্দিষ্ট স্থানে তারা সবসময় বসেন– বোবা স্ট্রোক বা কক্স ইত্যাদি। নৌকা বাওয়া একটি সম্মিলিত উদ্যোগ, কিন্তু কিছু মানুষ তাসত্ত্বেও অন্যদের চেয়ে এই কাজটিতে বেশী দক্ষ। ধরুন একজন কোচ বেশ কিছু সম্ভাব্য প্রার্থী থেকে তার আদর্শ নৌকা বাইচ দলটি নির্বাচন করবেন, কেউ বিশেষজ্ঞ হয়তো ‘বো’ অবস্থানে, অন্য কেউ ভালো ‘কক্স’ হিসাবে ইত্যাদি। ধরুন সে তার নির্বাচনটি করছে একরমভাবে, প্রতিদিন তিনি তিনজন করে নতুন পরীক্ষামূলক সদস্য বাছাই করেন, ইচ্ছামত নানা বিন্যাসে প্রতিটি অবস্থানের জন্য প্রার্থীদের জায়গা অদল বদল করে, তিনি তিনটি দলকে একে অপরের সাথে পরীক্ষামূলক একটি প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেন। এভাবে কয়েক সপ্তাহ পর ধীরে ধীরে দেখা যাবে যে প্রতিবারই যে নৌকাটা জিতছে, সেটি চালিয়েছে একই সদস্যদের নিয়ে তৈরী একটি দল। তাদের চিহ্নিত করা হয় ভালো নৌকা চালক হিসাবে। অন্যান্য সদস্যরা দেখা যাবে প্রতিবারই তারা স্বল্পগতির টীমের সাথেই আছে, এবং অবশেষে টীম থেকে বাদ দেয়া হয় তাদের। কিন্তু এমনকি কখনো অসাধারণ কোনো নৌকা চালাতে পারে এমন কেউ ধীর গতি টীমেও থাকতে পারে, হয়তো তার অন্যান্য দলীয় সদস্যদের দুর্বলতার কারণে কিংবা শুধুমাত্র খারাপ ভাগ্যের জন্য– ধরুন, বীপারতমুখী প্রতিকুল বাতাস। শুধুমাত্র ‘গড়পড়তা’ সেরা নৌকা চালকরা বিজয়ী নৌকাটিতে থাকে।

নৌকা চালকরা হচ্ছে জিন; নৌকায় প্রতিটি সীটের জন্য প্রতিদ্বন্দিরা হচ্ছে অ্যালিল, ক্রোমোজোমের একই জায়গা দখল করার জন্যে যাদের সম্ভাবনাময় যোগ্যতা আছে। দ্রুত নৌকা চালানোর ক্ষমতার এই উদাহরণের সাথে এমন ধরনের শরীর তৈরী করার সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যারা টিকে থাকার জন্য সফল। বাতাস হচ্ছে। বাইরের পরিবেশ, এবং পানি পূর্ণ পুলটি হচ্ছে জিন পুলের বিকল্প দাবিদার। যতদুর কোনো একটি শরীরের টিকে থাকার প্রশ্ন, সব জিনই একই নৌকায় আসীন। অনেক ভালো জিন খারাপ সঙ্গী পায় এবং এমন কোনো জিনের সাথে তারা নিজেদের আবিষ্কার করে, শরীরের জন্যে যারা ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক হতে পারে, যারা শৈশবেই শরীরকে হত্যা করে, তখন ভালো জিনটিও সেই খারাপ জিনের সাথেই হারিয়ে যায়। কিন্তু এটি একটি মাত্র শরীর এবং একই ভালো জিনের অনুলিপি অন্য শরীরেও বাস করে যার সেই ক্ষতিকর প্রাণনাশী জিনটি নেই। ভালো জিনের বহু কপি হারিয়ে যায় কারণ তারা ঘটনাচক্রে ক্ষতিকর কোনো জিনের সাথে শরীরে বাস করে বা আরো নানা ধরনের দুর্ভাগ্যের কারণে তারা হারিয়ে যায়, যেমন, ধরুন হয়তো তাদের শরীর বজ্রাহত হলো। কিন্তু ভাগ্য এর সংজ্ঞানুযায়ী, খারাপ কিংবা ভালো, কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই আঘাত হানতে পারে এবং একটি জিন যেটি সারাক্ষণই পরাজিত পক্ষে থাকে, সেটি দুর্ভাগা কোনো জিন নয়, এটি একটি খারাপ জিন।

ভালো নৌকা বাইচ দলের কোনো সদস্যের একটি গুণ অবশ্যই ‘টিমওয়ার্ক’, অন্যদের সাথে একটি একক দল হিসাবে কাজের সমন্বয় করতে পারার দক্ষতা, বাকী সদস্যদের সাথে সহজেই সহযোগিতা আর খাপ খাইয়ে নেবার যোগ্যতা। এটি হয়তো শক্তিশালী মাংসপেশী থাকার মতই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। প্রজাপতির ক্ষেত্রে আমরা যেমন দেখেছি, প্রাকৃতিক নির্বাচন তার নৈর্ব্যক্তিক অচেতন প্রক্রিয়া, যা কোনো একটি জিন কমপ্লেক্সকে ‘সম্পাদিত’ করে ইনভারশন বা ক্রোমোজোমের টুকরো অংশকে ব্যাপক নাড়াচাড়া করার মাধ্যমে। যার ফলে সেই জিনগুলো কাছাকাছি চলে আসে যারা পরস্পরের সাথে ভালো সহযোগিতা করতে পারে, এবং খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত কোনো গ্রুপ হিসাবে কাজ করে। কিন্তু আরো একটি অর্থ আছে, যেখানে জিনরা, যারা কোনোভাবে পরস্পরের সাথে শারীরিকভাবে যুক্ত নয় তবে তারা নির্বাচিত হতে পারে তাদের পারস্পরিক সামঞ্জস্যপূর্ণ উপযোগিতার কারণে। একটি জিন যা অন্য সব জিনের সাথে ভালোভাবে সহযোগিতা করে, ধারাবাহিকভাবে আসা শরীরে যাদের সাথে তাদের দেখা হয়, যেমন, বাকী পুরো জিনপুলে থাকা অন্য সব জিনদের সাথে, তাদের বাড়তি সুবিধা পাবার প্রবণতা আছে।

যেমন, বেশ কিছু উপযোগী বৈশিষ্ট্য আছে যারা দক্ষ কোনো মাংসাশী প্রাণীর শরীরে কাঙ্খিত, তাদের মধ্যে যেমন আছে কোনো কিছু কাটার উপযোগী ধারালো তীক্ষ্ম দাঁত, মাংস পরিপাক করার জন্যে সঠিক ধরনের আন্ত্রিক নালী এবং আরো অনেক কিছু। একটি দক্ষ তৃণভোজী প্রাণীর অন্যদিকে প্রয়োজন চ্যাপটা, পিষ্ট করার উপযোগী দাঁত এবং অনেক লম্বা আন্ত্রিক নালী, এবং ভিন্ন ধরনের পরিপাক উপযোগী রসায়ন। কোনো একটি তৃণভোজী প্রাণীদের জিন পুলে, যদি এমন কোনো জিনের উদ্ভব হয়, যারা এর বাহককে ধারালো মাংস কাটার উপযোগী কোনো দাঁত দেয়, তারা খুব বেশী সফল হবেনা। এর কারণ কিন্তু এই না যে মাংস খাওয়া সার্বিকভাবে একটা খারাপ ধারণা, বরং যেহেতু কেউ ভালোভাবে মাংস খেতে পারবে না, যদি না তার সঠিক ধরনের আন্ত্রিক নালী না থাকে এবং মাংসাশী প্রাণী হিসাবে জীবন কাটানোর জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য গুণাবলীও থাকে। ধারালো, মাংস খাওয়ার উপযোগী দাঁত এমনিতে সহজাতভাবে খারাপ কোনো জিন নয়। তবে তারা শুধুমাত্র খারাপ জিন হয় এমন কোনো জিন পুলে, যেখানে তৃণভোজী বৈশিষ্ট্য সৃষ্টিকারী জিনরা প্রাধান্য বিস্তার করে আছে।

 এটি বেশ সূক্ষ্ম আর জটিল একটি ধারণা। এটি জটিল কারণ কোনো একটি জিনের পরিবেশ মূলত গঠিত হয় অন্য অনেক জিনদের দ্বারা, যাদের প্রত্যেকটি এর নিজস্ব পরিবেশে অন্যান্য জিনদের সাথে এর সহযোগিতা করার যোগ্যতার উপর ভিত্তি করে নিজেই নির্বাচিত হয়। এই সূক্ষ্ম বিষয়টির সাথে তুলনামূলক একটি উদাহরণ আমাদের হাতে আছে, কিন্তু এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। এই রুপক উদাহরণটি মানুষের ‘গেম থিওরী’ সংক্রান্ত, অধ্যায় ৫ এ একক প্রাণীদের মধ্যে বিদ্যমান আগ্রাসী প্রতিতিদ্বন্দ্বিতার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করার সময় যা আমি আলোচনার জন্যে উপস্থাপন করবো। সুতরাং পরে অধ্যায়ের শেষাংশ অবধি আমি এই বিষয়ে কোনো আলোচনা আপাতত স্থগিত রাখছি, এবং এই অধ্যায়ের মূল বার্তাটিতে আবার ফিরে আসি। সেটি হচ্ছে যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মৌলিক একক হিসাবে প্রজাতিকে গন্য করা ঠিক হবে না, তেমনি কোনো গ্রুপ বা জনগোষ্ঠীর কথা, এমনকি প্রজাতির একক সদস্যদেরও তেমন কিছু ভাবা সঠিক হবেনা, বরং এই একক হিসাবে কাজ করতে পারে খুব ক্ষুদ্র জিনগত উপাদান, যাকে ‘জিন’ হিসাবে সুবিধাজনকভাবে আমরা ডাকতে পারি।

 এই যুক্তির মূল বক্তব্যটি হচ্ছে– এর আগেও যা উল্লেখ করা হয়েছে।– সেই ধারণাটি, জিনের অমর হবার সম্ভাবনা আছে, যখন কিনা এদের বাহক শরীরগুলো এবং এর চেয়ে উচ্চ কোনো এককগুলো আসলেই চিরস্থায়ী হতে পারেনা। আর এই ধারণাটি দুটি বাস্তব সত্যের উপর নির্ভর করে আছে: যৌন প্রজনন আর ক্রসিং ওভার প্রক্রিয়ার বাস্তব সত্য এবং একক সদস্যদের মরণশীলতা। এই বাস্তবতাটি অনস্বীকার্যভাবেই সত্যি। কিন্তু বিষয়টি আমাদের সেই প্রশ্নগুলো উত্থাপন করতে বাধা দেয় না, যেমন, কেন তারা সত্য? কেন আমরা এবং অন্য সব টিকে থাকার বা সারভাইভাল মেশিনগুলো যৌন প্রজনন করি? কেন আমাদের ক্রোমোজোমে ‘ক্রসিং ওভার’ প্রক্রিয়াটি ঘটে? কেন আমরা চিরকাল বেঁচে থাকি না?

বৃদ্ধ বয়সে কেন আমরা মারা যাই এই প্রশ্নটি একটি জটিল প্রশ্ন এবং এর বিস্তারিত বিষয়গুলো এই বইয়ের আলোচনা করার সুযোগের বাইরে। সুনির্দিষ্ট কারণগুলো ছাড়াও, আরো কিছু সাধারণ কারণও প্রস্তাব করা হয়েছে। যেমন, একটি তত্ত্ব বলছে, জরা বা বার্ধক্য আসলে কোনো একক জীব সদস্যের জীবদ্দশায় ডিএনএ অনুলিপন প্রক্রিয়ায় ঘটা পুঞ্জীভূত হওয়া সব ক্ষতিকর ভুল ও অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্থ জিনের প্রতিনিধিত্ব করে। স্যার পিটার মেদাওয়ারের (৭) প্রস্তাবিত অপর একটি তত্ত্ব অনুযায়ী, জিন নির্বাচনের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টি দেখার ক্ষেত্রে বেশ ভালো একটি উদাহরণ (৮); মেদাওয়ারই প্রথম প্রচলিত সেই যুক্তিগুলো খণ্ডন করেছিলেন, যেমন, ‘প্রজাতির বাকী সদস্যদের প্রতি পরার্থবাদী একটি কর্ম হিসাবে বদ্ধ সদস্যরা মারা যায়, কারণ যদি তারা বেঁচে থাকে, প্রজননক্ষম হবার জন্যে তারা যথেষ্ট পরিমানে জরাগ্রস্থ হয়ে থাকে। কোনো ভালো কারণ ছাড়া তারা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খল ভীড় সৃষ্টি করবে। যেমন, মেদাওয়ার উল্লেখ করেছিলেন, এটি হচ্ছে একটি আবদ্ধ যুক্তি, ধরে নেয়া হয়েছে, এটি শুরু থেকেই প্রমাণ করতে চেয়েছে, তাদের জরাগ্রস্থতার জন্য বৃদ্ধ জীবরা প্রজননক্ষম নয়। এছাড়াও এটি সেই গ্রুপ-সিলেকশন বা প্রজাতি-সিলেকশনের সরল ধরনের একটি ব্যাখ্যা, যদি সেই অংশটি নতুন করে আরো খানিকটা সম্মানজনক উপায়ে বলা যেতে পারে। মেদাওয়ারের নিজের তত্ত্বে ছিল সুন্দর একটি যুক্তি। আমরা এভাবে সেই যুক্তিটি গড়ে তুলতে পারি:

আমরা ইতিমধ্যেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কোনো একটি ভালো জিনের সবচেয়ে সাধারণতম বৈশিষ্ট্য কি হতে পারে। এবং আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, স্বার্থপরতা সেই গুণাবলীর একটি। কিন্তু কোনো সফল জিনের আরো একটি সাধারণ গুণ থাকে, সেটি হচ্ছে। প্রজনন শেষ না হওয়া অবধি এর সারভাইভাল মেশিনের মৃত্যুকে স্থগিত করা। কোনো সন্দেহ নেই আপনার কিছু আত্মীয় এবং কিছু চাচা বা মামা শৈশবে মারা গিয়েছিল, কিন্তু আপনার কোনো পূর্বসূরি শৈশবে মারা যাননি, পূর্বসূরি অল্প বয়সে মারা যেতেই পারে না!

কোনো জিন, যে কিনা এর বাহককে মেরে ফেলে তাকে বলা হয় প্রাণঘাতী একটি জিন। একটি আংশিক-প্রাণঘাতী জিন কিছু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যেমন, এটি অন্যান্য কারণে মৃত্যু হবার সম্ভাবনা আরো বেশী বাড়িয়ে দেয়। একটি জিন শরীরের উপর তার সর্বোচ্চ প্রভাব ফেলে জীবনের নির্দিষ্ট একটি পর্যায়ে, এবং প্রাণঘাতী কিংবা আংশিক-প্রাণঘাতী জিনগুলো এর ব্যতিক্রম নয়। বেশীর ভাগ জিন তাদের প্রভাব খাটায় ভ্রূণ অবস্থায় এবং অন্যান্যরা শৈশবে, অন্যরা প্রাপ্তবয়স্কতার প্রারম্ভেই, কোনোটি মধ্যবয়সে এবং আরো কিছু অন্য জিন কাজ করে বার্ধক্যে (ভাবুন একটি শুয়োপোকা আর যে প্রজাপতিতে তারা রূপান্তরিত হয়,তাদের ঠিক একই সেট জিন থাকে); অবশ্যই প্রাণঘাতী জিনরা জিন পুল থেকে ক্রমশ অপসারিত হতে থাকে, কিন্তু একই সাথে স্পষ্টতই জীবনের শুরুর দিকে কাজ করা কোনো প্রাণঘাতী জিন অপেক্ষা, পরে কাজ করে এমন একটি প্রাণঘাতী জিন কোনো জিন পুলে বেশী স্থিতিশীল হবে। বৃদ্ধ শরীরে কোনো প্রাণঘাতী জিন হয়তো তারপরও জিনপুলে সফলভাবে টিকে থাকে, শুধুমাত্র শর্ত হচ্ছে তার সেই প্রাণঘাতী প্রভাবটি প্রদর্শিত হয়না যতক্ষণ না কোনো না কোনোভাবে প্রজনন করতে শরীরের কিছুটা সময় থাকে। যেমন, একটি জিন, যা কোনো বৃদ্ধ শরীরে ক্যান্সারের কারণ সেটি বহুসংখ্যক উত্তরসূরিদের মধ্য দিয়ে বিস্তার লাভ করতে পারে কারণ সেই জিনটির বাহক সদস্যটি তার শরীরে ক্যান্সার হবার আগেই প্রজনন করবে। অন্যদিকে, একটি জিন যা কোনো তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক শরীরে ক্যান্সারের কারণ হয়, সেটি বেশী সংখ্যক উত্তরসূরিদের মধ্যে বিস্তার লাভ করবে না এবং কোনো জিন যা কোনো শিশুর শরীরে প্রাণঘাতী ক্যান্সারের কারণ হয় সেটি কোনো উত্তরসূরিদের মধ্যেই বিস্তার লাভ করবে না। এই তত্ত্বানুযায়ী, জিনপুলে জমা হওয়া আর পরবর্তীতে সক্রিয় হতে পারে শুধুমাত্র এমন প্রাণঘাতী ও আংশিক প্রাণঘাতী জিনই জরা বা বার্ধক্যজনিত ক্ষয়ের কারণ। শুধুমাত্র তারা জীবনের শেষাংশে কাজ করে বলে যে জিনগুলোকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফাঁদ গলে বেরিয়ে যাবার অনুমতি দেয়া হয়েছে।

 যে বিষয়টির উপর মেদাওয়ার নিজেই জোর দিয়েছিলেন, সেটি হচ্ছে। যে, নির্বাচন সেই সব জিনদের সুবিধা দেয় যারা অন্যান্য প্রাণঘাতী জিনগুলোর সক্রিয় হয়ে ওঠাটিকে স্থগিত করে রাখে, এটি আরো বিশেষভাবে সুবিধা দেয় সেই জিনগুলোকে, যারা “ভালো’ জিনগুলো যেন দ্রুত তাদের প্রভাব ফেলতে পারে, সে বিষয়টিকে তরান্বিত করে। বিবর্তন অনেকটুকুই জিনের কর্মকাণ্ড শুরু হবার সময়ে জিন নিয়ন্ত্রিত পরিবর্তনগুলোর সমষ্টি হতে পারে।

গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টির দিকে লক্ষ রাখতে হবে সেটি হচ্ছে, প্রজনন ঘটছে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট বয়সে, এই তত্ত্বটির এমন কোনো পূর্বধারণার প্রয়োজন নেই। শুরুতেই যদি আমরা এমন কোনো ধারণা গ্রহন করে নেই যে, যেকোনো বয়সে সন্তানের জন্ম দেবার জন্যে প্রত্যেকেরই সমান সম্ভাবনা থাকবে। মেদাওয়ারের তত্ত্বটি খুব দ্রুত ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে যে, জিন পুলে শেষের দিকে সক্রিয় হওয়া ক্ষতিকারক জিনগুলো পুঞ্জীভূত হবে, এবং বার্ধক্যে প্রজনন কম করার বিষয়টি এরই পরোক্ষ পরিণতিতে ঘটে।

একটি পার্শ্ব বিষয় হিসাবে, এই তত্ত্বটির অন্যতম একটি ভালো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি আমাদের বরং আরো কিছু কৌতূহলোদ্দীপক ধারণার দিকে মনোযোগ নির্দেশ করে। যেমন, এখান থেকে আমরা এমন একটি ধারণা পেতে পারি, যদি আমরা মানুষরা আমাদের জীবনকাল বাড়াতে চাই, দুটি সাধারণ উপায় আছে সেটি আমরা করতে পারি। প্রথমত, আমরা একটি নির্দিষ্ট বয়সের আগে প্রজননের নিষিদ্ধ করতে পারি, ধরুন, চল্লিশ বছর বয়সের আগে। কয়েক শতাব্দী পর সর্বনিম্ন বয়সসীমা বেড়ে হবে পঞ্চাশ এবং এভাবে আরো বাড়বে। ভাবা খুবই সম্ভব যে মানুষের দীর্ঘায়ু এভাবে বেশ কয়েক শতাব্দী আরো বাড়িয়ে দেয়া সম্ভব। কোনো পরিস্থিতিতেই আমরা অবশ্য কল্পনা করতে পারিনা এমন কোনো নীতিমালা বাস্তবিকভাবে আরোপ করা সম্ভব হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, জিনদের বোকা বানাতে আমরা চেষ্টা করতে পারি, যেন তারা ভাবে যে শরীরে তারা বাস করছে সেটি আসলে যতটা বয়স হয়েছে, এটি তার চেয়ে তরুণ। ব্যবহারিক পর্যায়ে এর মানে হচ্ছে শরীরের অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক পরিবেশে সেই পরিবর্তনটি চিহ্নিত করা, যা বার্ধক্য হবার প্রক্রিয়ার সাথে ঘটে। এর যে কোনোটি শেষের দিকে কাজ করে এমন ক্ষতিকর জিনগুলোকে সক্রিয় হয়ে ওঠার জন্যে ‘ইঙ্গিত’ হতে পারে। কোনো একটি তরুণ শরীরের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের মত পরিবেশ সৃষ্টি করে শেষের দিকে কাজ করা ক্ষতিকর জিনগুলোকে সক্রিয়া হওয়া স্থগিত রাখা সম্ভব হতে পারে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়টি হচ্ছে বার্ধক্যের সেই রাসায়নিক সংকেতগুলো কিন্তু সাধারণ অর্থে নিজেরাই ক্ষতিকর হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই; যেমন, ধরুন ঘটনাচক্রে আমরা দেখতে পেলাম, বাস্তব একটি সত্য হচ্ছে ‘পদার্থ এস’ বয়স্ক সদস্যদের শরীরে যে পরিমান ঘনত্বে থাকে, তার চেয়ে অনেক কম পরিমানে থাকে তরুণদের মধ্যে। এস পদার্থটি’ নিজে ক্ষতিকর নয়, হয়তো খাদ্যের কোনো উপাদান যা আমাদের শরীরে সময়ের সাথে জমা হয়। কিন্তু স্বয়ংক্রিয়ভাবে, কোনো জিন, যা কিনা ঘটনাচক্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এই ‘পদার্থ এস’ এর উপস্থিতিতে, কিন্তু এর অনুপস্থিতিতে এটি কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না বরং ভালো প্রভাব ফেলে, এমন কোনো জিন জিন পুলে ইতিবাচকভাবে নির্বাচিত হবে এবং আসলেই এটি হবে বৃদ্ধ বয়সে মারা যাওয়ার জন্য জিন। এর চিকিৎসা হবে শুধুমাত্র ‘পদার্থ এস’কে শরীর থেকে সরিয়ে ফেলা।

 এই ধারণাটির বৈপ্লবিক দিক হচ্ছে যে ‘পদার্থ এস’ নিজে বৃদ্ধ বয়সের শুধুমাত্র একটি লেবেল’। কোনো ডাক্তার যিনি রোগীর শরীরের উচ্চামাত্রায় এর উপস্থিতি মৃত্যুর কারণ হিসাবে লক্ষ করবেন, তিনি সম্ভবত ভাববেন,’পদার্থ এস’ হয়তো একটি বিষ এবং তিনি সারাক্ষণই ভাবতে থাকবেন, কিভাবে ‘পদার্থ এস’ এর সাথে শরীরের বিকল হয়ে যাবার একটি যোগসূত্র তিনি খুঁজে বের করবেন। কিন্তু আমাদের এই হাইপোথেটিকাল উদাহরণে তিনি হয়তো তার সময় নষ্ট করবেন!

আরো একটি পদার্থ হয়তো থাকতে পারে, ‘পদার্থ ওয়াই’, যা তারুণ্যের ‘লেবেল’, এই অর্থে যে বৃদ্ধ বয়সের তুলনায় অল্প বয়সে শরীরেএটির মাত্রা বেশী থাকে। আবারো সেই সব জিনগুলো হয়তো নির্বাচিত হবে যারা ভালো প্রভাব ফেলে ‘ওয়াই’ এর উপস্থিতিতে, এবং যার অনুপস্থিতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এস’ ও ‘ওয়াই’ কি সেটি জানার কোনো উপায় ছাড়াই– আরো বহু রাসায়নিক পদার্থে উপস্থিতি থাকতে পারে। আমরা শুধুমাত্র সাধারণ একটি ভবিষ্যদ্বাণী করবো যত বেশী বদ্ধ শরীরে আমরা অনুকরণ প্রণোদনা দেবো তরুণ বয়সের শরীরের কোনো গুণাবলীকে, সেই গুণাবলী যতই উপরি বৈশিষ্ট্য মনে হোক না কেন, বৃদ্ধ শরীর ততই দীর্ঘ সময় বাঁচবে।

মেদাওয়ারের তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে আমি অবশ্যই গুরুত্বারোপ করবো যে এগুলো শুধুমাত্র আনুমানিক কিছু ধারণা। যদি একটি অর্থে যেখানে মেদাওয়ার তত্ত্ব যৌক্তিকভাবে অবশ্যই কিছু সত্য এর মধ্যে ধারণ করে, তবে এর অর্থ এই না যে, কিভাবে বার্ধক্য ও জরায় আমরা আক্রান্ত হই, কোনো একটি ব্যবহারিক উদাহরণের ক্ষেত্রে, এটাই সঠিক কোনো ব্যাখ্যা। বর্তমান আলোচনার উদ্দেশ্যে যেটা সত্যি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হচ্ছে বৃদ্ধ হলে প্রজাতিদের সদস্যদের মারা যাবার প্রবণতাটি ব্যাখ্যা করতে বিবর্তনের জিন নির্বাচন কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো সমস্যা হবেনা। কোন একক সদস্যের মরণশীলতার ধারণা, যা এই অধ্যায়ে আমাদের যুক্তির কেন্দ্রে অবস্থিত, সেটি এই তত্ত্বের ব্যাখ্যার কাঠামোতে যুক্তিযুক্ত।

 আরেকটি যে ধারণা আমি হালকাভাবে আলোচনা করেছিলাম, সেটি হচ্ছে যৌন প্রজনন আর ক্রসিং ওভারের অস্তিত্ব, আর সেটি ব্যাখ্যা দেয়া বরং আরো কঠিন। সবসময়ই ক্রসিং ওভার হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। পুরুষ ফুট ফ্লাইরা সেটি করে না। এই প্রজাতির স্ত্রী সদস্যের একটি জিন আছে যা এই ‘ক্রসিং ওভার’ যেন না হয় সেটি লক্ষ করে। আমরা যদি এমন কোনো মাছি জনগোষ্ঠীকে প্রজনন করানোর চেষ্টা করি, যাদের মধ্যে এই জিনটি সর্বজনীন, তাহলে ক্রোমোজোম পুলে একটি ক্রোমোজোম প্রাকৃতিক নির্বাচনের অবিভাজ্য একক হবে। বাস্তবিকভাবে যদি আমরা আমাদের সংজ্ঞাটির যৌক্তিক উপসংহার বরাবর অনুসরণ করতে পারি, একটি পুরো ক্রোমোজোমকে তখন একটি ‘জিন’ হিসাবে বিবেচনা করতে হবে।

কিন্তু আবার, যৌন প্রজননের বিকল্পেরও অস্তিত্ব আছে। স্ত্রী গ্রিনফ্লাইরা জীবন্ত, পিতৃহীন, স্ত্রী সন্তানদের জন্ম দিতে পারে, যাদের প্রত্যেকেই তাদের মায়ের সব জিনগুলো ধারণ করে। (ঘটনাচক্রে কোনো একটি মায়ের গর্ভে’ কোনো ভ্রূণের হয়তো আরো একটি ক্ষুদ্র ভ্রূণ থাকে তার নিজের গর্ভের ভিতর। সুতরাং একটি স্ত্রী গ্রিনফ্লাই এমন কোনো কন্যা এবং নাতনীর একসাথে জন্ম দিতে পারে, যারা দুজনই তার হুবহু জমজ)। অনেক উদ্ভিদ প্রজনন করে অঙ্গজ জননের মাধ্যমে, যেমন, সাকার বা চোষকদের ছড়িয়ে দিয়ে। এই ক্ষেত্রে আমরা হয়তো, প্রজননের বদলে ‘বৃদ্ধি পায় এমনভাবে বলতে পছন্দ করবো। কিন্তু তারপরও, যদি আপনি বিষয়টি নিয়ে ভাবেন, মূলত বৃদ্ধি আর অযৌন প্রজননের মধ্যে সেখানে খুব সামান্য পার্থক্য আছে। কারণ দুটোই ঘটছে মাইটোটিক কোষ বিভাজনের মাধ্যমে। কখনো উদ্ভিদরা অঙ্গজ জননের মাধ্যমে প্রজনন করে এবং তারপর সেই বাড়তি অংশটি তাদের পিতামাতা সদৃশ মূল বৃক্ষটি থেকে পৃথক হয়ে যায়। অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেমন, এলম গাছ, তাদের সংযুক্ত সাকার বা চোষকটি অপরিবর্তিত থাকে। আসলেই পুরো এলম জঙ্গলকে একক একটি সদস্য মনে করা যেতে পারে।

সুতরাং প্রশ্নটি হচ্ছে: যদি গ্রিনফ্লাইরা আর এলম গাছ কাজটি না করে, তাহলে বাকী সবাই আমরা কেন এতটাই পরিশ্রম করি, আমাদের সন্তান তৈরীর আগে অন্য কারো জিনের সাথে আমাদের জিনের মিশ্রণ করানোর জন্য? মনে হতে পারে একটি অদ্ভুত পথ বেছে নিতে হচ্ছে। কেন তাহলে যৌন প্রজনন, সরাসরি অনুলিপি তৈরী করার প্রক্রিয়াটির সেই অদ্ভুত বিকৃতি, কেনই বা বিবর্তিত হয়েছিল? যৌন প্রজননের উপকারিতাটি কি (৯)?

এটি বিবর্তনবাদীদের পক্ষে উত্তর দেবার জন্যে খুবই কঠিন একটি প্রশ্ন। এর উত্তর দেবার জন্য বেশীরভাগ গুরুতর প্রচেষ্টার সাথে গাণিতিক যুক্তি প্রক্রিয়ার সংশ্লিষ্টতা আছে। একটি কথা বলা ছাড়া আমি সরাসরি এই বিষয়ে আলোচনা এড়িয়ে যাবো। সেটি হচ্ছে যৌন প্রজননের বিবর্তন ব্যাখ্যা করার জন্য অন্ততপক্ষে কিছু সমস্যা যা তাত্ত্বিকরা মুখোমুখি হন সেগুলো সূচনা হয়েছিল সেই বাস্তব সত্যটি থেকে, তারা স্বভাবজাতভাবেই মনে করেন একক সদস্যরা যারা টিকে থাকে তারা তাদের জিন সংখ্যা বাড়াতে চেষ্টা করে, আর এই শর্তানুযায়ী, যৌন প্রজনন আসলেই আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী, কারণ এটি একক সদস্যের জন্যে তার জিন টিকিয়ে রাখার একটি অদক্ষ উপায়: প্রতি শিশুর মাত্র ৫০ শতাংশ জিন আসে কোনো একটি সদস্য থেকে, বাকী ৫০ শতাংশ আসে তার যৌন সঙ্গী থেকে। শুধু যদি গ্রিনফ্লাইয়ের মত, তারা সরাসরি সন্তানের জন্ম দিতে পারতো, যারা তার হুবহু অনুলিপি, সেক্ষেত্রে পুরো ১০০ শতাংশ জিনই পরবর্তী প্রজন্মের সকল সন্তানে মধ্যে থাকার নিশ্চয়তা থাকতো। আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী এই বিষয়টি বেশ কিছু তাত্ত্বিককে গ্রুপ সিলেকশনবাদকে গ্রহন করে নিতে সহায়তা করেছে, যেহেতু যৌন প্রজননের একটি গ্রুপ-স্তরের সুবিধার কথা ভাবা অপেক্ষাকৃত সহজ, যেমন ডাব, এফ, বোদমার চমৎকার সংক্ষিপ্ত ভাবে প্রকাশ করেছিলেন, যৌন প্রজনন –’কোন একটি একক ব্যক্তির শরীরে সুবিধাজনক মিউটেশনগুলো পুঞ্জীভূত করার প্রক্রিয়াটিকে সহায়তা করে, যে মিউটেশনগুলো ভিন্ন ভিন্ন একক সদস্যদের শরীরের উদ্ভব হয়েছিল।

কিন্তু এই আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী বিষয়টি অপেক্ষাকৃত কম সত্যবর্জিত মনে হয়, যদি আমরা এই বইয়ের যুক্তিটি অনুসরণ করি এবং কোনো একক সদস্যকে একটি সারভাইভাল মেশিন হিসাবে ভাবি, যে মেশিনটি দীর্ঘায়ু জিনদের স্বল্পস্থায়ী একটি সহযোগিতার মাধ্যমে তৈরী করেছে। অপ্রয়োজনীয় একটি বিষয় হিসাবে পুরো একক কোনো সদস্যের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা দক্ষতা বা এফিসিয়েন্সি ব্যাপারটি দেখতে পারি। যৌন বা অযৌন বিষয়টিকে গণ্য করা যেতে পারে একটি একক জিনের নিয়ন্ত্রণে থাকা কোনো বৈশিষ্ট্য হিসাবে, ঠিক যেমন নীল চোখ বনাম বাদামী চোখ। যৌনতার জন্য কোনো জিন অন্য সেই সব জিনদের তাদের নিজেদের স্বার্থপর উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে প্রভাবিত করবে, একই কাজ করবে মাইওসিস কোষ বিভাজনের সময় ক্রসিং ওভার প্রক্রিয়াটির জন্যে দায়ী একটি জিন। এমনকি এমনও জিন আছে, যাদের মিউটেটর বলা হয়– যারা অন্য জিনের অনুলিপি হবার সময় কি পরিমান ভুল (কপিইং এরর রেট) হবে সেটি নিয়ন্ত্রণ করে। সংজ্ঞা মোতাবেক, কপিইং এরর বা অনুলিপন প্রক্রিয়ার সময় কোনো ভুল হলে যে জিনটির ভুল অনুলিপি হচ্ছে তার জন্যে সমস্যার সৃষ্টি করে। কিন্তু স্বার্থপর মিউটেটর জিনের জন্যে যদি সেটি সুবিধাজনক হয়, তাহলে মিউটেটর জিনটি জনগোষ্ঠীর জিন পুলে বিস্তার লাভ করতে পারে। একই ভাবে ক্রসিং ওভার যদি কোনো একটি জিনকে ক্রসিং ওভার করলে কোনো সুবিধা দেয়, তাহলে সেটিই ক্রসিং ওভার জিনের অস্তিত্বের জন্যে একটি সন্তোষজক ব্যাখ্যা। এবং অযৌন প্রজননের ব্যতিক্রম, যদি যৌন প্রজনন কোনো জিনকে সুবিধা দেয় যৌন প্রজননে, যৌন প্রজননের অস্তিত্বের জন্য সেটাই যথেষ্ট একটি ব্যাখ্যা। প্রজাতির কোনো একক সদস্যের বাকী সব জিনকে এটি কোনো সুবিধা দিক বা না দিক সেটি তুলনামূলকভাবে গৌণ একটি বিষয়। স্বার্থপর জিনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, যৌন প্রজনন আসলেই অদ্ভুত কোনো বিষয় না।

খুব আশঙ্কাপূর্ণভাবে উপরের যুক্তিটি প্রায় আবদ্ধ কোনো যুক্তির কাছাকাছি পৌঁছায়, যেহেতু যৌন প্রজননের অস্তিত্বই এই ধারাবাহিক যুক্তি প্রক্রিয়াটির অগ্রসর হবার একটি পূর্বশর্ত, যা নির্বাচনের একক হিসাবে ‘জিনকে’ বিবেচনা করার বিষয়টিতে আমাদের নিয়ে যায়। আমি বিশ্বাস করি, এই আবদ্ধ যুক্তি থেকে পালাবার পথ আছে, কিন্তু এই বইটি সেই প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধান নিয়ে আলোচনা করার জায়গা নয়। যৌন প্রজননের অস্তিত্ব আছে, সেটুকু সত্যি। যৌন প্রজনন আর ক্রসিং ওভারের পরিণতি হচ্ছে, সেই ক্ষুদ্র জেনেটিক ইউনিট বা জিনদের আমরা গণ্য করতে পারি এমন কিছু যেটি তার বৈশিষ্ট্যাবলীতে বিবর্তনের মৌলিক আর স্বাধীন এজেন্টের সবচেয়ে নিকটবর্তী কিছু হতে পেরেছে।

 যৌন প্রজনন শুধুমাত্র আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী বা প্যারাডক্সই নয়, যা অনেক কম ধাঁধা মনে হয় যে মুহূর্তে আমরা স্বার্থপর জিনের ধারণায় চিন্তা করতে শিখি। যেমন, একটি জীবের শরীরে ডিএনএর পরিমান তার ঠিক যতুটুকু লাগবে অর্থাৎ সেই জীবটি তৈরী করার জন্য জন্য যতটুকু দরকার, তার চেয়েও বেশী দরকার হয়: ডিএনএ এর বিশাল অংশ প্রোটিন অনু তৈরী হবার মাধ্যমে কখনোই অনূদিত হয় না। কেবলমাত্র কোনো এটি একক জীব সদস্যর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটি ধাঁধা মনে হয়। যদি ডিএনএর উদ্দেশ্য কিংবা লক্ষ্য হয় শরীর কিভাবে তৈরী হবে সেটি তত্ত্বাবধান করা, ডিএনএ এর বিশাল একটি অংশ এধরনের কোনো কাজ করে না, সেটি যখন আমরা দেখতে পাই আসলেই অবাক হতে হয়। আপাতদৃষ্টিতে এই বাড়তি ডিএনএ আসলে কোনো উপযোগী কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট কিনা বিষয়টি বোঝার জন্যে জীববিজ্ঞানীরা সব ধরনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু স্বার্থপর জিনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি আদৌ কোনো প্যারাডক্স নয়। ডিএরএ এর সত্যিকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে টিকে থাকা, কমও না বেশী না। এই বাড়তি ডিএনএর উপস্থিতি ব্যাখ্যা করার সরলতম উপায় হচ্ছে এমন কিছু মনে করা যে, এটি পরজীবি বা বড়জোর কোনো নিরীহ, ক্ষতি করেনা, তবে কোনো উপকারেও আসেনা এমন কোন যাত্রী, যারা ডিএনএ অন্য অংশ দিয়ে তৈরী সারভাইভাল মেশিনে জায়গা করে নেয় কোনো কিছু না করার বিনিময়েই (১০)।

কেউ কেউ অবশ্য এর বিরোধীতা করেন, কারণ তাদের দৃষ্টিতে তারা। যা দেখেন, সেটি হচ্ছে বিবর্তনের অতিমাত্রায় জিন-কেন্দ্রিক একটি দৃষ্টিভঙ্গি। সর্বোপরি, তারা তর্ক করেন, পুরো একটি জীব সদস্য, তাদের সব জিন নিয়ে আসলেই বাঁচে অথবা মারা যায়। আমার মনে হয় এই অধ্যায়ে আমি যথেষ্ট বলেছি, যা প্রদর্শন করেছে যে আসলেই এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। ঠিক যেমন একটি পুরো নৌকা প্রতিযোগিতায় জিততে পারে অথবা হারতে পারে, আসলেই কোনো একক সদস্য বাঁচে অথবা মারা যায় এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের তাৎক্ষণিক প্রকাশ পায় সবসময়ই একক সদস্য পর্যায়ে। কিন্তু নন র‍্যানডোম সদস্যদের মৃত্যু এবং প্রজনন সাফল্যের দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাবটি প্রকাশ পায় জিন পুলে জিনের উপস্থিতির হারের তারতম্য ঘটিয়ে। কিছু সীমাবদ্ধতাসহ আধুনিক অনুলিপনকারী অণুদের প্রতিটি জিন পুল একই দায়িত্ব পালন করে, যেমন করে আদিম সেই সুপ মূল অনুলিপনকারীদের সাথে করেছিল। সুপটির আধুনিক সমতুল্য রুপটির তরলত্ব সংরক্ষিত করার ক্ষেত্রে যৌন প্রজনন ও ক্রোমোজোমের ক্রসিং ওভার প্রক্রিয়ার একটি প্রভাব আছে। কারণ যৌন প্রজনন ও ক্রোমোজোমের ক্রসিং ওভারের কারণে জিন পুল যথেষ্ট পরিমান মিশ্রণ প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে এবং জিনগুলো আংশিকভাবে রদবদল হয়। বিবর্তন হচ্ছে সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কিছু জিনের হার বেড়ে যায় এবং অপেক্ষাকৃতভাবে অন্যদের পরিমান কমে যায়। সুতরাং ভালো হবে যদি আমরা অভ্যাস করে নিতে পারি একটি প্রশ্ন করার, যখনই আমরা কোনো বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের বিবর্তন, যেমন পরার্থবাদী আচরণ, ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি: জিন পুলে জিনদের উপস্থিতির হারের উপর এই বৈশিষ্ট্যটির কি প্রভাব আছে? কখনো কখনো, জিনের ভাষা কিছুটা ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে এবং সংক্ষিপ্ততা আর প্রাণবন্ততা জন্য আমরা মেটাফর বা রুপকের আশ্রয় নেবো। কিন্তু আমরা সবসময়ই আমাদের সংশয়বাদী চোখ রাখবো আমাদের রুপগুলোর উপর, নিশ্চিৎ করার জন্য যে, যদি প্রয়োজন পড়ে তাদের যেন জিনের ভাষায় পুনরায় অনূদিত করা যেতে পারে।

যতক্ষণ জিন আলোচনার বিষয়, জিনপুল হচ্ছে শুধু আরেকটি নতুন ধরনের সুপ বা মিশ্রণ যেখানে তাদের বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হয়। যা বদলেছে সেটি হচ্ছে এখন এটি তার জীবন ধারণ করে ধারাবাহিকভাবে জিন পুল থেকে আসা সঙ্গী জিন গুচ্ছদের সাথে সহযোগিতা করার মাধ্যমে, যারা তাদের জন্য ধারাবাহিকভাবে মরনশীল সারভাইভাল মেশিন বা টিকে থাকার যন্ত্র তৈরী করে। আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে এই সব সারভাইভাল মেশিন, এবং সেই অর্থে, যেখানে বলা যেতে পারে জিনরা তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করছে, সেই বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের আলোচনার দিক পরিবর্তন করবো।

নোটস (অধ্যায় ৩)

(১) নেমাটোড প্রজাতিটির নাম Panagrellus redivivus, বহু আগেই চিহ্নিত হয়েছিল এই স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারা খুবই ক্ষুদ্র নেমাটোড বা রাউণ্ড ওয়ার্মটি, যা মাইক্রোওয়ার্ম নামে পরিচিত। ১৯১৪ সালে নাথান কব মন্তব্য করেছলিনে যে এটি শুধুমাত্র সার্বক্ষণিকভাবে ভেজা ফেল্ট ম্যাটের উপর পাওয়া যায়, যে ম্যাটের উপর সাধারণত জার্মানরা তাদের বিয়ারের মগ রাখে। ১৯২১ সালে আরো বেশ কিছু জায়গায় এদের সন্ধান মেলে। কিন্তু কবের বিয়ার ম্যাট সংক্রান্ত উদ্ধৃতি প্রায়শই বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা ব্যবহৃত হয়েছে, সেকারণে এটি ‘বিয়ার ম্যাট’ নেমাটোড নামে পরিচিত।

 (২) আলেক্সান্ডার গ্রাহাম কেয়ার্নস-স্মিথ (জন্ম ১৯৩১) জৈব রসায়নবিদ এবং আণবিক জীববিজ্ঞানী। বিশেষভাবে পরিচিত ১৯৮৫ সালে তার প্রকাশিত বিতর্কিত Seven Clues to the Origin of Life বইয়ের জন্য। বইটি মূলত ষাটের দশক থেকে তার গবেষণা করা একটি হাইপোথিসিসে জনপ্রিয়করণ– স্ব-অনুলিপন করতে সক্ষম ক্লে- ক্রিস্টালরা কোনো দ্রবণে হয়তো অজৈব কোনো পদার্থ থেকে জৈব জীবনের অন্তবর্তীকালীন পর্যায়ের সেই সরল ধাপটি সৃষ্টি করেছিল।

(৩) ডাবল হেলিক্স হচ্ছে যখন কোনো কিছু এমন একটি ত্রিমাত্রিক রুপ নেয়, যেন কোনো কোন (মোচাকৃতি) বা সিলিন্ডারের উপরে একটি স্তরে সুসমভাবে পেঁচানো তার, যেমন কোনো কর্ক স্ট্র অথবা সর্পিলকার সিঁড়ির ক্ষেত্রে দেখি।

 (৪) এখানে এবং (মূল বইয়ের) ১১০-১৩ পৃষ্ঠা হচ্ছে জেনেটিক ‘অ্যাটোমিজম’ সংক্রান্ত সমালোচকদের বিরুদ্ধে আমার উত্তর। খুব কঠোর একটি রুপে এটি মূলত একটি আকাঙ্খ, উত্তর না, কারণ এটি সমালোচনার আগেই লেখা হয়েছে! আমি দুঃখিত, নিজের উদ্ধৃতিগুলো এখানে পুরোপুরিভাবে উদ্ধৃত করা জরুরী হয়ে পড়বে, কিন্তু দ্য সেলফিশ জিনের প্রাসঙ্গিক অনুচ্ছেদগুলো উদ্বিগ্ন করার মত খুব সহজ চোখে না পড়ার মতই মনে হয়। যেমন, Caring Groups and Selfish Genes 9 (The Panda’s Thumb বইটিতে), স্টিফেন জে, গুল্ড বলেছিলেন,

‘এমন কোন জিন নেই যা সুস্পষ্টভাবে কোনো বাহ্যিক প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যের একাংশের জন্য দায়ী, যেমন, আপনার বা পায়ের হাটুর মালা বা প্যাটেল কিংবা আপনার নোখ। নানা খণ্ডাংশে শরীরকে এভাবে আণবিকীকরণ করা যায়না, যা কিনা তৈরী করে কোনো একটি একক জিন। শত শত জিন অবদান রাখে শরীরের বেশীর ভাগ অংশ তৈরীতে ..

গুল্ড এটি লিখেছিলেন দ্য সেলফিশ জিন এর সমালোচনায়। কিন্তু এখন আমার মূল কথাগুলো পড়ুন (মূল বইয়ের পৃষ্ঠা ৩০):

একটি শরীর তৈরীর প্রক্রিয়া এতটাই সূক্ষ্ম জটিল সমবায়ী একটি উদ্যোগ, সেই উদ্যোগে কোনো একটি জিনের অবদান অন্য কোনো জিনের অবদান থেকে পৃথক করা প্রায় অসম্ভব। একটি জিনের হয়তো অনেকগুলো পৃথক পৃথক প্রভাব থাকতে পারে শরীরের ভিন্ন ভিন্ন অংশে। শরীরের যেকোনো একটি জায়গা প্রভাবিত হয় বহু জিনের কর্মকাণ্ডে এবং কোনো একটি জিনের প্রভাব নির্ভর করে আরো অনেকগুলো জিনের সাথে তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার উপর।

এবং আবারো (পৃষ্ঠা ৪৬, মূল বইয়ের):

‘তবে জিনদের যতই স্বাধীন আর মুক্ত মনে হোক না কেন এই প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে তাদের যাত্রায়, তারা ভ্রূণ বিকাশের উপর তাদের আরোপিত নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আসলে খুব বেশী স্বাধীন আর মুক্ত ‘নয়। তারা পারস্পরিক সহযোগিতা ও তাদের বাহ্যিক পরিবেশের সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে ব্যাখ্যাতীত অত্যন্ত জটিল নানা উপায়ে। ‘লম্বা পায়ের জন্য জিন’ বা ‘পরার্থবাদী আচরণের জন্য জিন’, এমন অভিব্যক্তিগুলো আসলে সুবিধাজনকভাবে ধারণাটিকে ব্যাখ্যা করার অর্থেই বলা হয়, কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি বুঝতে হবে সেটি হচ্ছে, এই অভিব্যক্তিগুলো আসলে কি বোঝাচ্ছে। এমন কোনো জিন নেই যা কিনা একাই একটি পা তৈরী করতে পারে, লম্বা কিংবা খাটো। পা তৈরী করার মত কোনো কাজ হচ্ছে বহু জিন নির্ভর সমবায়ী সম্মিলিত একটি উদ্যোগ। বাহ্যিক পরিবেশের প্রভাবও সেখানে অপরিহার্য। সর্বোপরি পা আসলে তৈরী হচ্ছে খাদ্য দিয়ে! কিন্তু আসলেই সেখানে এমন কোনো একক জিনও থাকতে পারে, যে জিনটি আর সব কিছু অপরিবর্তিত থাকলে, তার বিকল্প অ্যালিলের প্রভাবে পা যতটা লম্বা হতো তার চেয়ে দীর্ঘতর পা তৈরী করতে পারে।

আমি বিষয়টি আরো বিস্তারিত করেছিলাম আমার পরবর্তী অনুচ্ছেদে গমের উপর সারের প্রভাব সংক্রান্ত তুলনামূলক একটি উদাহরণ ব্যবহার করে। মনে হতে পারে যেন গুল্ড অত্যন্ত নিশ্চিৎ, আগে থেকেই যে, আমি অতি সরল কোনো অ্যাটোমিষ্ট, আর সেকারণে বিস্তারিত অনুচ্ছেদটি তিনি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন যেখানে আমি ঠিক সেই পারস্পরিক ক্রিয়-প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত বিষয়টি উল্লেখ করেছি, যার উপর তিনি জোর দিয়েছেন।

গুল্ড সেখানে আরো বলেছিলেন:

‘ডকিন্সের অন্য কোনো রুপকের প্রয়োজন পড়বে: জিনদের সংঘবদ্ধ হওয়া, সহযোগিতার জন্য জোট বাধা, কোনো গ্রুপে যোগ দেবার সুযোগের প্রতি সম্মান দেখানো, সম্ভাব্য পরিবেশের নানা উপাদান পরিমাপ করা।

আমার নৌকা চালানোর সমরুপ উদাহরণটিতে (মূল বইয়ের পৃষ্ঠা ১১০-১২) ইতিমধ্যে আমি ঠিক সেই কাজটি করেছি যা গুল্ড এখানে করার পরামর্শ দিয়েছেন। এই নৌকা চালানোর অনুচ্ছেদটি ভালো করে লক্ষ করুন, কেন গুল্ড, যদিও আমরা অনেক বিষয়ে একমত পোষণ করি, এখানে ভুল এমন কোনো দাবী করার ক্ষেত্রে যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন ‘গ্রহন বা বর্জন করে পুরো জীবকে কারণ নানা অংশ, জটিল উপায়ে নিজেদের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করার মাধ্যমে উপযোগিতা বা সুবিধা প্রদান করে। জিনদের এই সহযোগিতা করার প্রবণতার সত্যিকারের ব্যাখ্যা হচ্ছে:

জিনরা নির্বাচিত হয়, এই কারণে না যে তারা এককভাবে ‘ভালো’, বরং জিনপুলে অন্যান্য জিনের উপস্থিতিতে তারা ভালোভাবে কাজ করতে পারে সেই অর্থে ভালো। একটি ভালো জিনকে অন্যান্য জিনগুলোর সাথে অবশ্যই সামঞ্জস্যপূর্ণ, সম্পূরক হতে হবে যাদের সাথে এটি ধারাবাহিকভাবে বহুশীর ভাগাভাগি করে সময়ের সুদীর্ঘ পরিক্রমায়। (পৃষ্ঠা ১১০, মূল বই)

আমি জেনেটিক অ্যাটোমিজম সংক্রান্ত সমালোচনার আরো বিস্তারিত একটি প্রত্যুত্তর লিখেছিলাম The Extended Phenotype, বইটিতে, বিশেষ করে পৃষ্ঠা ১১৬-১৭ এবং ২৩৯-৪৭ এ।

(৫) Adaptation and Natural Selection বইটিতে উইলিয়ামসের হুবহু শব্দগুলো হচ্ছে: আমি “জিন’ শব্দটি ব্যবহার করেছি বোঝাতে, যা বিচ্ছিন্ন আর পুনসংযুক্ত হয় পরিমাপযোগ্য উচ্চহারে’ .. একটি জিনকে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে, যেকোনো বংশগতির তথ্য হিসাবে যার জন্য একটি অনুকূল অথবা প্রতিকূল নির্বাচনী পক্ষপাতিত্ব আছে যা এর অন্তর্জনিষ্ণু পরিবর্তন হারের সমান থেকে বেশ কয়েক বা বহু গুণের সমান।

উইলিয়ামসের বইটি এখন বেশ সুপরিচিত এবং ব্যাপকভাবে এবং সত্যিকারভাবে একটি ধ্রুপদী রচনা হিসাবে যা বিবেচিত হয়, যা শ্রদ্ধা কুড়িয়েছে ‘সোসিওবায়োলজিস্ট’ ও ‘সোসিওবায়োলজীর’ সমালোচক উভয় পক্ষের।

আমার মনে হয় এটি স্পষ্ট, উইলিয়ামস কখনোই নিজেকে এমন ব্যক্তি ভাবেননি, যিনি নতুন কিছু বা বৈপ্লবিক কোনো কিছুর পক্ষে ওকালতী করছে তার জিন নির্বাচনবাদ বা সিলেকশনিজম ধারণা দিয়ে এবং আমিও তার চেয়ে বেশী কিছু করেছি বলে মনে করিনি, ১৯৭৬ সালে। আমরা দুজনেই ভেবেছিলাম আমরা শুধুমাত্র ফিশার, হলডেন ও রাইটের মৌলিক নীতিগুলো পুনর্ব্যক্ত করছি, যারা ১৯৩০ এর দশকে নব্য-ডারউইনবাদের প্রতিষ্ঠাতা পিতা ছিলেন। যাইহোক, হয়তো আমাদের অনমনীয় ভাষার কারণে, কিছু মানুষ, এমনকি সিওয়াল রাইট নিজেও, আপাতদৃষ্টিতে নির্বাচনের একক হচ্ছে জিন’ এই দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন। তাদের মূল কারণটি হচ্ছে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন পুরো জীবদের দেখছে, সেই জীবের মধ্যে ধারণ করা জিনদের নয়। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি, যেমন, রাইটের, আমার উত্তর আছে দি এক্সটেন্ডেড ফেনোটাইপ বইটিতে, বিশেষ করে পৃষ্ঠা ২৩৮-৪৭ এ। নির্বাচনের একক হিসাবে জিন প্রশ্নে উইলিয়ামসের সবচেয়ে সাম্প্রতিকতম ধারণা, পাওয়া যাবে তার ‘ Defense of Reductionism in Evolutionary Biology বইটিতে, সেটি তার আর সব বইয়ের মতই অত্যন্ত গভীর এবং মর্মস্পর্শী। কিছু দার্শনিক যেমন ডি, এইচ, হাল, কে, স্টেরেলনী এবং পি. কিচার এবং এম, হাম্প এবং এস, আর, মর্গানও সম্প্রতি নির্বাচনের একক বিষয়টি স্পষ্ট করে তাদের উপযোগী অবদান রেখেছেন। দুঃখজনকভাবে, আরো অনেক দার্শনিক আছেন, যারা ব্যাপারটি আরো সংশায়চ্ছন্ন করেছেন।

(৬) উইলিয়ামসকে অনুসরণ করে, আমি আমার মাইওসিস কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় খণ্ডিতকরণের প্রভাব সংক্রান্ত যুক্তিটি উপস্থাপন করেছি, যেখানে একক কোনো সদস্য প্রাকৃতিক নির্বাচনের অনুলিপনকারীর ভূমিকা পালন করতে পারেনা। আমি এখন দেখতে পাচ্ছি এটি আসলে মূল কাহিনীর অর্ধেক মাত্র। এর বাকী অংশ বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে দি এক্সটেন্ডেড টাইপ (পৃষ্ঠা ৯৭-৯৯) বইয়ে এবং আমার প্রবন্ধ Replicators and Vehicles এ। মাইওসিসের এই খণ্ডিত করার প্রভাব যদি পুরো কাহিনী হতো, তাহলে অযৌন উপায়ে প্রজনন করা কোনো প্রাণী যেমন, স্ত্রী স্টিক ইনসেক্টরা হতো সত্যিকারের অনুলিপনকারী, এক ধরনের দানবীয় জিনের মত। কিন্তু যদি কোনোভাবে একটি স্টিক ইনসেক্টের শরীরে কোনো পরিবর্তন হয়– ধরুন সে তার একটি পা হারিয়ে ফেললো সেই পরিবর্তনটি পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরিত হবে না, শুধু জিনরাই পারে একটি প্রজন্ম থেকে অন্য একটি প্রজন্মে হস্তান্তরিত হবার জন্য, প্রজনন যৌন বা অযৌন, যাই হোক না কেন। সে কারণে জিনরা আসলেই অনুলিপনকারী। অযৌন স্টিক ইনসেক্টদের ক্ষেত্রে, তাদের পুরো জীনোম (এর পুরো সেট জিন) হচ্ছে একটি অনুলিপনকারী। কিন্তু স্টিক ইনসেক্ট নিজে তা নয়। কোনো একটি স্টিক ইনসেক্টের শরীর আগের প্রজন্মের শরীরের ছাঁচে হুবহু অনুলিপি হিসাবে তৈরী হয় না। কোনো একটি প্রজন্মে শরীর গড়ে ওঠে ডিম থেকে নুতন করে, এর পুরো জিনোম বা জিনগত সংকেতের নির্দেশনায়, যে জিনোমটি এর আগের প্রজন্মের জিনোমের একটি অনুলিপি।

এই বইটি সব ছাপা সংখ্যাই একে অপরের সদৃশ হবে, তার অনুলিপি, তবে অনুলিপিকারক করা। তারা অনুলিপি কারণ তারা একে অপরের অনুলিপি নয়, বরং তারা অনুলিপি কারণ একই প্রিন্টিং প্লেট থেকে তারা সবাই এসেছে। তারা অনুলিপির কোনো বংশধারা তৈরী করে না যে কোনো বই অন্য একটি বইয়ের পূর্বসূরি। অনুলিপির বংশধারার অস্তিত্ব হতে পারে যদি আমরা বইয়ের কোনো একটি পাতার ফটোকপি করি, তারপর সেই ফটোকপির আবার ফটোকপি করি, ফটোকপির ফটোকপির ফটোকপি করে,এভাবে চলতে থাকবে। পৃষ্ঠাদের এই বংশধারায়, সেখানেই আসলেই পূর্বসূরি-উত্তরসূরি সম্পর্ক আমরা দেখবো। কোনো একটি দাগ এই ধারার কোনো একটি জায়গায় উদ্ভব হলে, সেই দাগটি সকল উত্তরসূরিরা উত্তরাধিকার সূত্রে পাবে, কোনো পূর্বসূরি সেটি পাবে না। একটি পূর্বসূরি/উত্তরসূরি ধারাবাহিক এই ধরনের সম্পর্কের বিবর্তিত হবার সকল সম্ভাবনা আছে।

 উপরিভাবে, স্টিক ইনসেক্টদের ধারাবাহিক প্রজন্মগুলোয় আপাতদৃষ্টিতে শরীর অনুলিপিদের একটি বংশধারার রুপ নেয়। কিন্তু যদি আপনি সেই বংশধারায় কোন একটি সদস্যকে পরীক্ষামূলকভাবে পরিবর্তন করেন (যেমন তার একটি পা কেটে সরিয়ে নেন), সেই পরিবর্তনটি কিন্তু সেই বংশধারায় পরবর্তী উত্তরসূরিরা উত্তরাধিকার সূত্রে পাবে না। বরং এর ব্যতিক্রম, যদি আপনি পরীক্ষামূলকভাবে সেই বংশধারায় কোন একটি সদস্যদের জিনোমকে বদলে দেন ( যেমন, এক্স-রে ব্যবহার করে, সেই পরিবর্তনটি তার বংশধারায় পরবর্তী উত্তরসূরিদের মধ্যে হস্তান্তরিত হবে; এটাই, মাইওসিসে এর খণ্ডিতকরণ প্রভাব ছাড়াই, মূল কারণ এমন কিছু বলা যে, কোনো একক জীব সদস্য নির্বাচনের একক হতে পারে না– এবং তারা সত্যিকারের অনুলিপিকারকও না। এটি সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত বাস্তব সেই সত্যটি যে “লামার্কিয় উত্তরাধিকারের তত্ত্বটি মিথ্যা’ তারই গুরুত্বপূর্ণ পরিণতির একটি।

(৭) স্যার পিটার ব্রায়ান মেদাওয়ার (১৯১৫-১৯৮৭) ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী। অঙ্গ প্রতিস্থাপন গ্রাফট রিজেকশন এবং অ্যাকোয়াড ইমিউন টলারেন্স এর বিষয়ে তার মৌলিক গবেষণা অঙ্গ প্রতিস্থাপন বিষয়টি সম্ভব করেছে।

(৮) আমাকে কঠোরভাবেই তিরস্কার করা হয়েছে (অবশ্যই উইলিয়াম নিজে নন বা তাদের জানামতেও না) এই বার্ধক্য সংক্রান্ত তত্ত্বটির কৃতিত্ব, জি সি উইলিয়ামসের বদলে পি. বি. মেডাওয়ারকে দেবার জন্য। এটি সত্যি যে অনেক জীববিজ্ঞানী, বিশেষ করে আমেরিকায়, এই তত্ত্বটি সম্বন্ধে জেনেছেন মূলত ১৯৫৭ সালে লেখা উইলিয়ামস এর Pleiotropy, Natural Selection, and the Evolution of Senescence শীর্ষক একটি প্রবন্ধ থেকে। আরো সত্যি যে, মেডাওয়ার যা বলেছিলেন, উইলিয়ামস এই তত্ত্বটি নিয়ে আরো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছিলেন। তবে যাই হোক আমার নিজের বিবেচনা বলছে যে, মেডাওয়ারই প্রথম এই ধারণাটির কেন্দ্রীয় যুক্তিটিকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, ১৯৫২ সালে তার An Unsolved Problem in Biology এবং ১৯৫৭ সালে The Uniqueness of the individual বইয়ে। আমি যুক্ত করতে চাই যে তত্ত্বটি নিয়ে উইলিয়ামসের ব্যাখ্যা আসলেই খুব বোধগম্য, কারণ এটি এই যুক্তিতে একটি আবশ্যকীয় ধাপ, যা সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছে (pleiotropy বা multiple gene effects এর গুরুত্ব) যা মেডাওয়ার যেমন সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেননি। সাম্প্রতিক সময়ে ডাবলিউ. ডি. হ্যামিলটন এই ধরনের তত্ত্বকে আরো খানিক সম্প্রসারণ করেছেন তার The Moulding of Senescence by Natural Selection শীর্ষক একটি প্রবন্ধে। ঘটনাচক্রে আমি অনেক উল্লেখযোগ্য চিঠি পেয়েছি ডাক্তারদের কাছ থেকে, কিন্তু আমার মনে হয় কেউই মন্তব্য করেননি আমার সেই অনুমান নির্ভর ‘fooling’ জিনের ধারণা নিয়ে, জিনগুলো যে শরীরে তারা বাস করে সেই শরীরের বয়স নিয়ে বোকা বানানো সংক্রান্ত ধারণা প্রসঙ্গে (মূল বইয়ের পৃষ্ঠা৫৩-৪); ধারণাটি এখনও আমার কাছে খুব স্পষ্টভাবে অর্থহীন বলে মনে হয় না। আর যদি সেটি সঠিক হয়ে থাকে, এটি নিশ্চয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ হবার কথা তাইনা?

(৯) যৌন প্রজনন কিসের জন্য ভালো সেই প্রশ্নটির সমস্যা আগের মতই এখনও আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে লোভনীয় একটি প্রস্তাবনা, যদিও বেশ কিছু ভাবনা উদ্রেক করার মত বই প্রকাশিত হয়েছে এই বিষয়ে, বিশেষ করে, এম, টি, গিশেলিন, জি, সি. উইলিয়ামস, জে, মেনার্ড স্মিথ এবং জি. বেল প্রমূর্খ লেখকদের লেখা, এছাড়া একটি খণ্ড, যা সম্পাদনা করেছেন আর. মিশেদ এবং বি. লেভিন। আমার মনে হয় সবচেয়ে আকর্ষণীয় ধারণাটি এসেছে ডাবলিউ. ডি. হ্যামিলটনের পরজীবি তত্ত্বটি থেকে, যা সাধারণ ভাষায় ব্যাখ্যা করেছে জেরেমি শেফাস ও জন গ্রিবিন তাদের The Redundant Male বইটিতে।

(১০) (মূল বইয়ের পৃষ্ঠা ২৩৭ও দেখুন); বাড়তি, অনূদিত হয় না ডিএনএ-এর এমন অংশগুলো কোনো স্বার্থপর পরজীবি হতে পারে, আমার এমন ধারণাটি আরো বিস্তারিতভাবে গবেষণার বিষয় হিসাবে গ্রহন করেছেন আণবিক জীববিজ্ঞানীরা (ওরগেল এবং ক্রিক, ডুলিটল ও সাপিয়েনজার প্রবন্ধগুলো দেখতে পারেন) পরিচিত স্লোগান ‘Selfish DNA’ শিরোনামে। স্টিফেন. জে. গুল্ড তার Hen’s Teeth and Horse’s Toes বইটিতে একটি প্ররোচনামূলক প্রস্তাব (আমার প্রতি!) করেছিলেন, স্বার্থপর ডিএনএ ধারণাটি ঐতিহাসিক উৎস জানা সত্ত্বেও তিনি দাবী করেন, “স্বার্থপর জিন ও স্বার্থপর ডিএনএর তত্ত্বগুলো খুব বেশী আলাদা কিছু হতে পারে না তাদের লালনকারী ব্যাখ্যার কাঠামো ছাড়া। আমি এই যুক্তিটি ভ্রান্ত তবে আকর্ষণীয় মনে করি। ঘটনাচক্রে, তিনি আমাকে দয়া করে জানিয়েছিলেন, আমার ধারণাগুলো সম্বন্ধে সাধারণত তার অনুভূতিও একই রকম। রিডাকশনিজম’ এবং ‘হায়ারার্কি’ সংক্রান্ত কিছু প্রারম্ভিক আলোচনার পর (যা যথারীতি আমার ভুলও কিছু মনে হয়নি তেমন আকর্ষণীয় কিছু মনে হয়নি), তিনি আরো বলেন:

‘ডকিন্সের স্বার্থপর জিনের উপস্থিতির হার বৃদ্ধি পায় কারণ শরীরগুলোর উপরতাদের প্রভাব আছে, বেঁচে থাকার সংগ্রামে যা তাদের সহায়তা করে। স্বার্থপর ডিএনএ হারে বৃদ্ধি ঠিক এর বিপরীত কারণে– কারণ শরীরের উপর এর কোনো প্রভাবই নেই।

গুল্ড এখানে যে পার্থক্যটি করেছেন সেটি আমি দেখতে পারছি, কিন্তু আমি সেটাকে মৌলিক কোনো বিষয় হিসাবে দেখছি না। এর বিপরীত, আমি এখনও স্বার্থপর ডিএনএ কে দেখি, পুরো স্বার্থপর জিন তত্ত্বের একটি বিশেষ কেস হিসাবে, এবং ঠিক এভাবেই স্বার্থপর ডিএনএ ধারণাটির উদ্ভব হয়েছিল মূলত (এই বিষয়টি, যে স্বার্থপর ডিএনএ হচ্ছে বিশেষ কোনো কেস, হয়তো আরো বেশী স্পষ্ট এই বইয়ের ২৩৭ পৃষ্ঠায় (মূল বইয়ের)। ৫৭ পৃষ্ঠায় (মূল বইয়ে) উল্লেখিত অনুচ্ছেদ যা ডুলিটল ও সাপিয়েঞ্জা এবং ওরগেল ও ক্রিক উদ্ধৃত করেছিলেন, তার চেয়েও বেশী স্পষ্ট। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা দরকার ডুলিটল ও সাপিয়েঞ্জা তাদের লেখায় বরং selfish DNA এর পরিবর্তে selfish genes শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন); গুন্ডের সমালোচনার উত্তর দেবার জন্য আমাকে এই অনুরুপ উদাহরণটি ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হোক: যে জিনগুলো ওয়াস্প বা বোলতাদের হলুদ আর কালো ডোরা কাটা দাগের সৃষ্টি করে তার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় কারণ এই ( সতর্কতামূলক) রঙের প্যাটার্নটি শক্তিশালীভাবে অন্যান্য প্রাণীদেও মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে, যে জিনগুলো বাঘদের শরীরে হলুদ কালো ডোরাকাটা দাগ সৃষ্টি করে সেটি তার সংখ্যায় বাড়ে ‘সম্পূর্ণ বিপরীত কোনো কারণে’– কারণ আদর্শভাবে এই সব (ক্রিপ্টিক বা গোপন) রঙের সজ্জা অন্য কোনো প্রাণীদের মস্তিষ্ককে আদৌ উত্তেজিত করে না। আসলেই এখানে। একটি পার্থক্য আছে, যা খুবই সমরুপী গুন্ডের পাথর্কের সাথে (একটি ভিন্ন হায়ারার্কি বা প্রাধান্য পরম্পরার স্তরে!), কিন্তু শুধুমাত্র বিস্তারিত প্রেক্ষাপটে এটি খুব সূক্ষ্ম একটি পার্থক্য। এমন কোনো কিছু দাবী করার সামান্যতম ইচ্ছা পোষণ করা আমাদের উচিৎ না যে, এই দুটি উদাহরণ, কোনোভাবে ভিন্ন হতে পারে না, সেই ব্যাখ্যার কাঠামোতে, যে ব্যাখ্যাটি এদের লালন করছে। ওরগেল ও ক্রিক সঠিক সেই জায়গাটিকে শনাক্ত করে গুরুত্ব দিয়েছিলেন যখন তারা স্বার্থপর জিনের সাথে কোকিলের ডিমের তুলনা করেছিলেন। কোকিলের ডিম, সর্বোপরি, চোখ ফাঁকি দেয় পোষক পাখির ডিমের হুবহু রুপ ধারণ করে।

ঘটনাচক্রে, Oxford English Dictionary র সাম্প্রতিক সংস্করণে selfish শব্দটির একটি নতুন অর্থ তালিকাভুক্ত করেছে এভাবে, ‘কোনো একটি জিন বা জেনেটিক উপাদানের’: ‘যার চিরস্থায়ী হবার প্রবণতা আছে অথবা সেটি বিস্তার লাভ করে ফিনোটাইপের উপর কোনো প্রভাব না ফেলেই’। স্বার্থপর ডিএনএ’ র এটি আসলে চমৎকার একটি আটসাট সংজ্ঞা এবং দ্বিতীয় সহায়ক উদ্ধৃতিটি আসলেই স্বার্থপর ডিএনএ সংক্রান্ত। আমার মতে যদিও, শেষ বাক্যটি– যদিও ফিনোটাইপের উপরে কোনো প্রভাব ফেলে না– দুর্ভাগ্যজনক। স্বার্থপর জিনদের হয়তো ফিনোটাইপের উপর কোনো প্রভাব নাও থাকতে পারে, কিন্তু তাদের অনেকেরই প্রভাব থাকে। লেক্সিকোগ্রাফারদের জন্য বিষয়টি তাই উন্মুক্ত দাবী করার জন্য যে, তারা তাদের অর্থটা ‘স্বার্থপর ডিএনএ’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছেন, যাদের আসলেই ফিনোটাইপের উপর কোনো প্রভাব থাকেনা। কিন্তু তাদের প্রথম সাক্ষ্যমূলক উদ্ধৃতি, যেটি নেয়া হয়েছে The Selfish Gene থেকে, সেটি সেই সব স্বার্থপর জিনদের অন্তর্ভুক্ত করেছে যাদের ফিনোটাইপিক প্রভাব আছে। যদিও এটি আমি যা বোঝাতে চেয়েছি তার থেকে বহু দূরে, তাসত্ত্বেও অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারীতে উদ্ধৃত হবার সম্মানের প্রতি এটি সামান্য অভিযোগ মাত্র।

স্বার্থপর ডিএনএ নিয়ে আমি পরবর্তীতে আরো আলোচনা করেছি, The Extended Phenotype (মূল বইয়ের পৃষ্ঠা ১৫৬-১৬৪)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *