০২. অনুলিপনকারীরা

 অধ্যায় ২: অনুলিপনকারীরা

একেবারে শুরুতে ছিল শুধু সরলতা। কিভাবে একটি খুব সরল সাধারণ মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল সেটি ব্যাখ্যা করাও যথেষ্ট কঠিন একটি কাজ। আর আমি ধরে নিচ্ছি সবাই একমত হবেন যে, আরো বেশী কঠিন হবে ব্যাখা করা, যে কিভাবে পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত, আর জটিলভাবে বিন্যস্ত, জীবন বা এমন কোনো সত্তা যা কিনা জীবন সৃষ্টি করতে পারে, হঠাৎ করে আবির্ভূত হতে পারে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত হচ্ছে একটি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা, কারণ এটি আমাদের একটি উপায় দেখাতে সক্ষম যেখানে সরলতা জটিলতায় রূপান্তরিত হতে পারে, কিভাবে অবিন্যস্ত এলোমেলো অণুরা একসাথে গুচ্ছাকারে জড়ো হয়ে ক্রমান্বয়ে আরো অনেক বেশী জটিল কোনো রুপের সৃষ্টি করে চলতে যতক্ষণ না অবধি তারা মানুষ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। ডারউইন একটি সমাধান আমাদের দিয়ে গেছেন, আর আমাদের অস্তিত্বের গভীরতম সমস্যাটির সমাধানে আপাতত প্রস্তাব করা হয়েছে এমন সমাধানগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে সম্ভাব্য সমাধান। আমি এই মহান তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো সাধারণত যেভাবে করা হয় তার চেয়ে আরো খানিকটা সাধারণীকরণ করে, বিবর্তন প্রক্রিয়াটি নিজেই শুরু হবার আগের সেই সময় থেকে।

ডারউইনের ‘সবচেয়ে যোগ্যতমদের টিকে থাকা’ প্রস্তাবনাটি আসলেই আরো বেশী সাধারণ ‘স্থিতিশীলদের টিকে থাকা’ সূত্রটিরই বিশেষ একটি কেস। মহাবিশ্ব পুর্ণ নানা স্থিতিশীল জিনিসে। স্থিতিশীল কিছু বোঝাতে আমরা বুঝি, অণুদের একটি গুচ্ছ যার যথেষ্ট স্থায়িত্ব আছে বা যথেষ্ট সাধারণ এর উপস্থিতিতে যে তারা একটি নাম পাবার যোগ্যতা রাখে। হতে পারে এরা আসলেই অনন্য অণুদের স্বতন্ত্র একটি সম্ভার, যেমন, ম্যাটারহর্ন (সুইজারল্যান্ড এবং ইতালীর মাঝখানে আল্পসের একটি পর্বত, একটি নাম পাওয়ার জন্য যা যথেষ্ট পরিমান দীর্ঘসময় টিকে থাকে। বা হতে পারে এটি কোনো এক শ্রেণীর কিছু, যেমন, বৃষ্টির ফোঁটা, যারা বেশ উচ্চ হারেই অস্তিত্বশীল হয় বলে তারা সামগ্রিকভাবে একটি নামের দাবী রাখে, যদিও তাদের মধ্যে কেউ কেউ যথেষ্ট পরিমান স্বল্পস্থায়ী। যা কিছু আমরা আমাদের চারপাশে দেখি এবং যা কিছু আমরা মনে করি ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে– পাথর, ছায়াপথ, সাগরের ঢেউ– এসব কিছুই কম বেশী মাত্রায় অণুদের নানা স্থিতিশীল রুপ– সাবানের ফেনায় সৃষ্টি বুদবুদ সাধারণত গোলাকার হয় কারণ এই ধরণের গ্যাস পূর্ণ পাতলা স্তরের কোনো কিছুর জন্যে এটাই সবচেয়ে স্থিতিশীল একটি রুপ। কোনো মহাশূন্যযানেও পানি স্থিতিশীল গোলাকার গ্লোবিউল হিসাবে, কিন্তু পৃথিবীতে যেখানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আছে, পানির স্থিতিশীল উপরি পিঠটা চ্যাপটা আর আনুভূমিক। লবনের স্ফটিকগুলো সাধারণ ঘণ কিউবাকৃতির হয় কারণ, সোডিয়াম আর ক্লোরাইড আয়নকে বেধে রাখার জন্য এটাই সবচেয়ে স্থিতিশীল রুপ। সূর্যের সবচেয়ে সাধারণতম অণুগুলো হচ্ছে। হাইড্রোজেন পরমাণু, যারা পরস্পরের সাথে মিশে তৈরী করে হিলিয়াম পরমাণু, কারণ যেখানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করে যেখানে হিলিয়াম পরমানুর গঠনটি আরো বেশী স্থিতিশীল। অন্যান্য আরো জটিল অণুরা নক্ষত্রে তৈরী হচ্ছে সারা মহাবিশ্ব জুড়ে, সেই ‘বিগ ব্যাঙ্গ’ এর অল্প কিছু সময় পর থেকেই, বিদ্যমান তত্ত্ব অনুযায়ী যে মুহূর্তে মহাবিশ্বের সূচনা করেছিল। এবং আমাদের পৃথিবীর সব মৌলগুলো মূলত এখান থেকেই এসেছিল।

কখনো কখনো যখন পরমাণুরা পরস্পরের সাথে মিলিত হয়, তারা একে অপরের সাথে যুক্ত হয় রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অণু সৃষ্টি করার জন্য। তারা কম বেশী স্থিতিশীল হতে পারে। কোনো কোনো অণু হতে পারে অনেক বেশী বড়। কোনো স্ফটিক, যেমন, হিরার একটি টুকরোকে মনে করা যেতে পারে একটি অণু, এবং প্রবাদ বাক্যের মতই এটি স্থিতিশীল এই ক্ষেত্রে; কিন্তু আবার এটি খুব বেশী সরলও তার গঠনে কারণ এর আভ্যন্তরীণ পরমাণুগুলোর গঠন অসীম সংখ্যকবার পুনরাবৃত্তি ঘটে। কোনো জীবিত আধুনিক প্রাণীদের মধ্যে আরো অনেক বড় আকারের অণুদের আমরা খুঁজে পারে, যারা খুবই জটিল এবং তাদের জটিলতা আমরা দেখি বেশ কয়েকটি স্তরে। আমাদের রক্তে হিমোগ্লোবিন হচ্ছে খুব বৈশিষ্ট্যসূচক একটি প্রোটিন অণু। এটি তৈরী হয়েছে অপেক্ষাকৃত ছোট অণুদের দ্বারা, যারা অ্যামাইনো অ্যাসিড, যাদের প্রত্যেকটির মধ্যেই আছে কয়েক ডজন পরমাণু, যারা সজ্জিত থাকে সুনির্দিষ্ট একটি প্যাটার্নে। হিমোগ্লোবিন অণুতে মোট ৫৭৪ টি অ্যামাইনো এসিড আছে। এরা সজ্জিত থাকে চারটি চেইন বা শঙ্খল হিসাবে, যারা একে অপরের সাথে কুণ্ডলী পাকিয়ে গোলাকৃতির বা গ্লোবিউলার হতভম্ভ করে দেবার মত জটিল একটি ত্রিমাত্রিক কাঠামো তৈরী করে। হিমোগ্লোবিন অণুর মডেল দেখতে বরং কোনো ঘন থর্নবুশ বা কাটা গাছের ঝোঁপের মত, সত্যিকারের কোনো কাটা ঝোঁপের ব্যতিক্রম এটি এলোমেলো খামখেয়ালী কোনো প্যাটার্ণ না বরং একটি সুনির্দিষ্ট ও অভিন্ন কাঠামো, যার হুবহু পুনরাবৃত্তি হয়েছে, যার একটিও শাখা-প্রশাখা কিংবা কুণ্ডলী ভুল জায়গায় নেই, আর এই একই প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে গড়পড়তা কোনো মানুষের শরীরের প্রায় ছয় হাজার মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন বারেরও বেশী। প্রোটিন অণু যেমন, হিমোগ্লোবিন সেই নিখুঁত কাটা-ঝোঁপের আকারে স্থিতিশীল এই অর্থে যে দুটি অ্যামাইনো এসিডের চেইন বা শৃঙ্খলদের প্রবণতা আছে, দুটি স্প্রিং-এর মত, ঠিক একই ত্রিমাত্রিক কুণ্ডলী আকারের কাঠামো তৈরী করেই স্থিতিশীল হয়। হিমোগ্লোবিনের কাটা-ঝোঁপরা আমাদের শরীরে তাদের পছন্দসই আকার নিচ্ছে প্রতিটি সেকেন্ডে চার শত মিলিয়ন মিলিয়ন বার এবং একই ভাবে বহু অণু একই হারে ধ্বংস হচ্ছে।

হিমোগ্লোবিনের একটি আধুনিক অণু, পরমাণুদের স্থিতিশীল একটি প্যাটার্ন গঠন করার প্রবণতা আছে, এই মূলনীতিটি বোঝানোর জন্য যা একটি উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এখানে যে বিষয়টি প্রাসঙ্গিক সেটি হচ্ছে পৃথিবীতে জীবনের আবির্ভাব হবার আগে,। পদার্থবিদ্যা আর রসায়নের সাধারণ প্রক্রিয়াগুলোর মাধ্যমে অণুদের কিছুটা প্রারম্ভিক বিবর্তন হতে পারে। কোনো ডিজাইন বা পূর্বপরিকল্পনা বা উদ্দেশ্য বা কোনো দিক নির্দেশনার কথা ভাবার প্রয়োজন নেই। প্রাকৃতিক নির্বাচনের আদিমতম রুপটি ছিল শুধুমাত্র একটি স্থিতিশীল রুপের নির্বাচন এবং অস্থিতিশীল কোনো রুপের বর্জন। কোনো রহস্য নেই এই বিষয়ে, সংজ্ঞানুযায়ী এটি অবশ্যই হতে হবে।

এখান থেকে, অবশ্যই, শুধুমাত্র এই একই মূলনীতি ব্যবহার করে কিন্তু আপনি সেই সব সত্তার অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করতে পারবেন না, যেমন, মানুষের মত জটিল কোনো কিছু। কোনোই লাভ হবে না, যতই আপনি সঠিক সংখ্যক পরমাণু এক সাথে নিয়ে যতক্ষণ না তারা সঠিক প্যাটার্নটি তৈরী করছে ততক্ষণ তাদের ভালো করে ঝাঁকিয়ে বাইরে থেকে কিছু শক্তি সরবরাহ করেন না কেন, সেখান থেকে আস্ত আদমও বেরিয়ে আসবে না! অল্প কয়েক ডজন পরমাণু দিয়ে আপনি সেখানে হয়তো একটি অণু তৈরী করতে পারবেন, কিন্তু একটি মানুষের শরীরে এক হাজার মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন পরমাণু আছে। কোনো একটি মানুষ তৈরীর চেষ্টা করতে, আপনি আপনার সেই জৈবরাসায়নিক ককটেল শেকার নিয়ে এতটা দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে হবে যে, মহাবিশ্বের পুরো বয়সকে চোখের পলকের মত সংক্ষিপ্ত অনুভূত হবে এবং এমনকি তারপরও আপনি সফল হবেন না। আর এখানেই ডারউইনের তত্ত্ব, এর সবচেয়ে সাধারণতম রুপে আমাদের উদ্ধার করে। ডারউইনের তত্ত্ব। সেখান থেকে এর দ্বায়িত্ব নেয় যেখানে অণুদের ধীরে ধীরে তৈরী হবার গল্পটি শেষ হয়।

জীবনের উৎপত্তির কাহিনী যা আমি এখানে বর্ণনা করবো আবশ্যিকভাবে সেটি ধারণা নির্ভর; সংজ্ঞানুযায়ী, আসলে কি ঘটেছিল সেটি দেখার জন্য কেউই সেখানে ছিলনা। বেশ কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্ব আছে কিন্তু তাদের সবার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। যে সরলীকৃত ব্যাখ্যা আমি আপনাদের দেবো সেটি সম্ভবত সত্য থেকে খুব বেশী দূরে নয় (১)।

আমাদের জানা নেই জীবনের উৎপত্তি হবার আগে পৃথিবীতে কোন রাসায়নিক কাঁচামালগুলোর প্রাচুর্য ছিল। কিন্তু আপাতগ্রাহ্য সম্ভাবনাগুলোর মধ্যে সেখানে ছিল পানি, কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং অ্যামোনিয়া: সরল সব যৌগ, আমাদের সৌরজগতের অন্ততপক্ষে কয়েকটি গ্রহে তাদের উপস্থিতি আছে বলে আমরা জানি। রসায়নবিদরা চেষ্টা করেছে সেই নবীন পৃথিবীর রাসায়নিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য। তারা এইসব রাসায়নিক উপাদানগুলো কাঁচের ফ্লাস্কে রেখে সেখানে কোনো উৎস থেকে শক্তি সরবরাহ করেছিলেন, যেমন, অতিবেগুনী রশ্মি কিংবা বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ, কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট আদিম সেই বিদ্যুত চমকের রুপ। এভাবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, সাধারণত কিছু অদ্ভুত জিনিস খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল এই সব কাঁচের পাত্রের মধ্যে একটি হালকা বাদামী সুপ, যেখানে ছিল বহু সংখ্যক অণুর শুরুতে যে অণুগুলো সেখানে রাখা হয়েছিল সেগুলোর চেয়ে যারা অনেক বেশী জটিল। বিশেষ করে অ্যামাইনো অ্যাসিড খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল– প্রোটিন তৈরীর একক, বিখ্যাত দুটি জৈববৈজ্ঞানিক অণু শ্রেণীর একটি। এই পরীক্ষাগুলো হবার আগে, প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া অ্যামাইনো অ্যাসিডকে জীবনের উপস্থিতির শনাক্তকারী চিহ্ন হিসাবে ভাবা হতো। যদি তাদের খুঁজে পাওয়া যেত, যেমন ধরুন মঙ্গল গ্রহে, সেই গ্রহে জীবনের উপস্থিতিকে মনে করে হতে প্রায় নিশ্চিৎ। এখন অবশ্য কোথাও জীবনের অস্তিত্ব ইঙ্গিত করার জন্য প্রয়োজন বায়ুমণ্ডলে কিছু সাধারণ গ্যাসের উপস্থিতি, কিছু আগ্নেয়গিরি, সূর্যের আলো অথবা বিদ্যুত চমকাচ্ছে এমন আবহাওয়া ইত্যাদি। আরো সাম্প্রতিক সময়ে, পৃথিবীতে জীবনের আবির্ভাবের আগে রাসায়নিক পরিস্থিতি গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করার মাধ্যমে সেই জৈব যৌগগুলো পাওয়া গেছে, যেমন, পিউরিন আর পাইরিমিডিন; তারা জেনেটিক অণু, ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবোজ নিউক্লিক এসিড) এর গঠনগত একক।

 এ ধরনের কোনো সমতুল্য প্রক্রিয়া অবশ্যই হয়তো সৃষ্টি করেছিল ‘প্রাইমিভাল সুপ’ বা আদিম মিশ্রণ, জীববিজ্ঞানী এবং রসায়নবিদরা বিশ্বাস করেন তিন থেকে চার হাজার মিলিয়ন বছর আগে মোটামুটিভাবে যা সাগরগুলোর গঠনগত উপাদান ছিল। এই জৈব যোগগুলো স্থানীয়ভাবে উচ্চ ঘনত্ব সম্পন্ন হয়েছিল, হয়তো শুষ্ক হতে থাকা ঘন ফেনার মধ্যে সাগরের তীরের আশে পাশে বা ভেসে থাকা ক্ষুদ্র তরলের বিন্দুতে। এছাড়া সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনী রশ্মির মত শক্তির প্রভাবে তারা সংযুক্ত হয়ে অপেক্ষাকৃত বড় অণুতে তৈরী করেছিল। বর্তমানে এমন বড় জৈব অণুগুলো যথেষ্ট দীর্ঘ সময় অবধি টিকে থাকতে পারেনা যা কিনা নজরে পড়তে পারে: তারা দ্রুত শোষিত হয় অথবা তাদের ভেঙ্গে ফেলে ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য জীবন্ত প্রাণীরা। কিন্তু ব্যাকটেরিয়া আর আমরা বাকী সব জীবই এই দৃশ্যে আরো অনেক সময় পরে এসেছিলাম এবং সেই দিনগুলোয় বড় জৈব যৌগগুলো ভেসে থাকতে পারতো ক্রমশ ঘন হয়ে ওঠা সেই তরল মিশ্রণে ধ্বংস হয়ে যাবার আগে।

 কোনো এক পর্যায়ে দুর্ঘটনাক্রমে একটি বিশেষভাবে ভিন্ন অসাধারণ অণু গঠিত হয়েছিল। আমরা এটিকে নাম দিবো ‘রেপ্লিকেটর’ বা ‘অনুলিপনকারী। আবশ্যিকভাবে এটিকে সবচেয়ে বড় আর জটিলতম অণু হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু তার একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল, এটি নিজের অনুলিপি তৈরী করতে পারতো। ঘটবার মত খুবই অসম্ভাব্য ধরনের একটি দুর্ঘটনা মনে হতে পারে। কোনো কিছু যা এরকম অসম্ভাব্য, তাদের ব্যবহারিক ও বাস্তবিক কারণেই মনে করা যেতে পারে অসম্ভব। সে-কারণেই আপনি কখনো ফুটবল-পুলস লটারীগুলোয় বড় কোনো ধরনের পুরষ্কার পাবেন না। কিন্তু কি সম্ভব আর কি সম্ভব না মানব জীবনের সেই পরিমাপে শত শত মিলিয়ন বছরের সময় নিয়ে ভাবতে আমরা অভ্যস্ত নই। আপনি যদি প্রতি সপ্তাহে পুলস কুপন হাতে নেন শত মিলিয়ন বছর ধরে, খুবই সম্ভাবনা আছে আপনার বেশ কয়েকটি জ্যাকপট জেতার।

আসলেই একটি অণু, যা কিনা তার নিজের অনুলিপি করতে পারে, সেটা কিন্তু কল্পনা করা কঠিন না, প্রথমে যেমন মনে হয়, এবং শুধুমাত্র একবারই এর উদ্ভব হতে হবে। অনুলিপনকারী এই অণুটিকে কল্পনা করুন একটি ছাঁচ বা টেমপ্লেট হিসাবে। এটিকে কল্পনা করুন একটি বড় অণু হিসাবে, নানা ধরনের বিল্ডিং ব্লক বা গঠনগত একক অণুরা যা তৈরী করেছে। অনুলিপনকারী অণুটির চারপাশে পরিবেষ্টিত হয়ে থাকা আদিম সুপ সদৃশ তরলে এইসব ছোট গঠনগত একক বা বিল্ডিং ব্লক অণুগুলো পর্যাপ্ত পরিমানে বিদ্যমান। এখন ভাবুন প্রতিটি একক অণুগুলো তাদের সমগোত্রীয় অণুগুলোর প্রতি বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করে। তারপর যখনই একটি বিল্ডিং ব্লক সেই মিশ্রণ থেকে অনুলিপনকারী অণুর সেই অংশটির কাছে আসে যাদের প্রতি তাদের বিশেষ আকর্ষণ আছে, সেখানে সেটির যুক্ত হবারও প্রবণতা আছে। যে গঠনগত অনুগুলো যারা এভাবে তাদের নিজেকে সংযুক্ত করবে তারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে এমন একটি অনুক্রমে সজ্জিত হবে যে অনুলিপনকারী অণুটিকে সেটি মিমিক বা প্রায় হুবহু নকল করে। খুব সহজ তারপর এমনটি ভাবা যে তারা সব একসাথে যুক্ত হয়ে একটি স্থিতিশীল অণুর শিকল তৈরী করবে ঠিক যেমন করে মূল অনুলিপনকারী অণুটি গঠন হবার সময় ঘটেছিল। এই প্রক্রিয়াটি ধারাবাহিকভাবে চলবে একের পর একটা স্তর সজ্জিত হয়ে। এভাবেই তৈরী হয় স্ফটিক। আবার অন্যদিকে, দুটো অণুর শিকল হয়তো পরস্পর থেকে আলাদাও হতে পারে, সেই ক্ষেত্রে আমরা পাবো দুটি অনুলিপনকারী, যাদের প্রত্যেকটি নিজেদের আরো অনেকগুলো অনুলিপি করতে পারে।

আরো জটিল একটি সম্ভাবনা হচ্ছে যে, প্রতিটি গঠনগত একক তাদের মত একই ধরনের অণুদের প্রতি আকর্ষণ নয় বরং অন্য কোনো বিশেষ ধরনের অণুর সাথেও পারস্পরিক আকর্ষণ আছে। তাহলে কোনো অনুলিপিকারক টেমপ্লেট বা ছাঁচ হিসাবে কাজ করবে হবে হুবহু অণু তৈরী করার জন্য নয়, বরং একধরনের ‘নেগেটিভ এর মত, যারা আবার হুবহু মূল ‘পজিটিভ’ অণুটিকে পুনসৃষ্টি করতে পারবে। আমাদের ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে কোনো কিছু যায় আসে না যে মূল অনুলিপন প্রক্রিয়াটি পজিটিভ-নেগেটিভ নাকি নেগেটিভ পজিটিভ, যদিও এখানে মন্তব্য করা যেতে পারে সঙ্গতকারণে, প্রথম অণুলিপনকারী অণুটির আধুনিক সমতুল্য অণুটি, ডিএনএ অণু, পজিটিভ-নেগেটিভ অনুলিপন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। যেটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেটি হচ্ছে হঠাৎ করেই একটি নতুন ধরনের স্থিতিশীলতার আগমন ঘটে পৃথিবীতে। অতীতে সম্ভবত কোনো বিশেষ ধরনের জটিল অণুর প্রাধান্য ছিল না মিশ্রণে, কারণ প্রত্যেকটি অণু এর গঠনগত একক অণু বা বিল্ডিং ব্লকের ভাগ্যক্রমে একটি বিশেষ স্থিতিশীল কাঠামো গঠন করার উপর নির্ভর করে। এবং যখনই অনুলিপনকারী অণুর জন্ম হয়, অবশ্যই তার অনুলিপি অণুগুলো দ্রুত সাগরে ছড়িয়ে পড়ে, যতক্ষণ না অবধি ছোট ছোট বিল্ডিং ব্লক অণুগুলো ধীরে ধীরে আরো দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে এবং অন্য বড় অণুগুলো তৈরী হওয়া ক্রমবর্ধমান হারে আরো দুরুহ হয়ে ওঠে।

 সুতরাং আমরা হুবহু প্রতিলিপিদের বিশাল একটি জনসংখ্যার মখোমখি হই। কিন্তু আমাদের অবশ্যই এখন যেকোন অণুলিপিকরণ প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে হবে যে : এটি নিখুঁত নয়। অনুলিপন প্রক্রিয়ায় অবশ্যম্ভাবীভাবে কিছু ভুল হবে। আমি আশা করি এই বইটিতে ছাপা হয়েছে এমন কোনো ভুল শব্দ নেই, কিন্তু আপনি যদি খুব সতর্কতার সাথে লক্ষ করেন, আপনি হয়তো একটি বা দুটি ভুল খুঁজে পাবেন। তারা সম্ভবত বাক্যগুলোর অর্থ খুব বেশী বদলে দেয় না, কারণ এগুলো সবই ‘প্রথম প্রজন্মের ভুল। কিন্তু মুদ্রণ প্রক্রিয়া আসার আগের সেই দিনগুলোর কথা কল্পনা করুন, যখন সব বই, যেমন, গসপেল প্রতিলিপি করা হতো হাতে লিখে। সব স্ক্রাইব বা অনুলিপনকারী লেখকরা যতই সতর্ক থাকুন না কেন, তারা কম বেশী ভুল করতে বাধ্য। কিছু কিছু ভুল ‘ইচ্ছাকৃত সম্পাদনা ছাড়া বেশী কিছু না। যদি কোনো একটি একক মাষ্টার মূল কপি থেকে সেগুলো অনুলিপি করা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে অর্থের বিশাল কোনো রদবদল ঘটে না। কিন্তু অন্য অনুলিপি থেকে আরো অনুলিপি বানানো হোক, যারা নিজেরাও একইভাবে অন্য কোনো অনলিপির অনলিপি এবং এভাবেই ভুলগুলো জমতে থাকে ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আমরা এই ভুল অনুলিপি করার প্রক্রিয়াকে খারাপ ভেবে থাকি, কিন্তু মানুষের কাগজপত্রে, চিন্তা করা খুব কঠিন যে, কোনো ভুল সেখানে সেই লেখাটির উন্নতির কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হবে। আমার মনে হয় অন্তত বলা যেতে পারে সেপটুয়াজিন্টের (২) স্কলাররা একটা বিশাল বড় ব্যাপার শুরু করেছিলেন, যখন তারা হিব্রু ভাষায় ‘তরুণ রমনী’ বোঝাতে ব্যবহৃত শব্দটি একটি ভুল গ্রিক শব্দ, যার অর্থ ‘কুমারী নারী’ দিয়ে অনুবাদ করে একটি ভবিষ্যদ্বাণী বানিয়ে ফেলেছিলেন এভাবে.. দেখুন একজন কুমারী নারী গর্ভধারণ করবে এবং একটি পুত্র সন্তান প্রসব করবে ‘ (৩); যাই হোক, আমরা পরে দেখবো ভুল অনুলিপি করা জীববিজ্ঞানের অণুলিপনকারী অণুদের সত্যিকার অর্থেই উন্নতির কারণ হতে পারে এবং জীবনের ক্রমবিবর্তনের জন্য এটি একান্ত অপরিহার্য যে এই পক্রিয়ায় কিছু ভ্রান্তি অবশ্যই যেন ঘটে। আমাদের জানা নেই ঠিক কতটা নিখুঁতভাবে মূল অনুলিপনকারী অণুগুলো তাদের অনুলিপি তৈরী করে। তাদের আধুনিক উত্তরসুরি –মানুষের বানানো সবচেয়ে আধুনিক অনুলিপি সৃষ্টি করার প্রক্রিয়ার তুলনায় ডিএনএ অণুরা বিস্ময়করভাবে নিখুঁতভাবে অনুলিপি করতে পারে। কিন্তু এমনকি তারপরও মাঝে মাঝে তারা ভুল করে, এবং অবশেষে এই সব ভুলগুলোই বিবর্তনকে সম্ভব করে তোলে। সম্ভবত মূল। অনুলিপিকারক অনেক বেশী ভ্রান্তিপ্রবণ ছিল কিন্তু যাই হোক না কেন আমরা নিশ্চিৎ হতে পারি যে ভুলগুলো হয়েছে এবং এই ভুলগুলো ক্রমশ জমতে থাকে।

যেহেতু ভুল-অনুলিপি করা হয় এবং সেগুলো বিস্তার লাভ করে, হুবহু একই রকম অনুলিপিদের জনগোষ্ঠী দিয়ে সেই আদিম সুপ বা মিশ্রণ পূর্ণ হয়না, বরং বেশ কয়েকটি ধরনের বা প্রকরণের অনুলিপনকারী দ্বারা মিশ্রণটি পুর্ণ হয়, যাদের সবাই একটি পূর্বসূরি অণু থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। কোনো বিশেষ ধরনের অনুলিপি কি অন্য ধরনের চেয়ে সেখানে প্রাধান্য বিস্তার করে? প্রায় নিশ্চিৎভাবে বলা যায়, হ্যাঁ। সেই অণুগুলো কোনো কোনো প্রকার তাদের বৈশিষ্ট্যগত কারণে অন্য প্রকারের চেয়ে বেশী স্থিতিশীল হবে। কিছু অণু একবার তৈরী হলে অন্য অণুদের তুলনায় আবার সেটির ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনা কম থাকে। সেই মিশ্রণের মধ্যে এই প্রকারের অণুগুলো সংখ্যায় অপেক্ষাকৃতভাবে বেড়ে যাবে, সরাসরি তাদের দীর্ঘায়ুর’ যৌক্তিক পরিনামের জন্যে নয় বরং আরো একটি কারণ হচ্ছ, তাদের নিজেদের অনুলিপি তৈরী করার জন্য এইসব দীর্ঘায়ু অনুলিপনকারী অণুগুলো অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় পায়, সুতরাং মিশ্রণে ক্রমশ সংখ্যাগরিষ্ঠ অণু হয়ে উঠতে তাদের প্রবণতা থাকে। আর বাকী সব কিছুই অপরিবর্তিত থাকার কারণে এই অণু জনগোষ্ঠীর আরো দীর্ঘায়ু হবার দিকে একটি বিবর্তনীয় প্রবণতা থাকে।

কিন্তু অন্য সব বিষয়গুলো সম্ভবত এক ছিল না এবং একটি অনুলিপিকারক প্রকরণের আরো একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, পুরো জনগোষ্ঠীতে সেটি বিস্তার হবার চেয়ে যা অবশ্যই আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হচ্ছে অনুলিপি সৃষ্টি করার দ্রুততা বা ‘উর্বরতা’। যখন ‘ক’ টাইপের অনুলিপক অণুরা তাদের প্রতিলিপি তৈরী করে সপ্তাহে একবার, তখন টাইপ ‘খ’ তাদের অনুলিপি তৈরী করে প্রতি ঘন্টায় একবার, ব্যপারটা অনুধাবন করতে খুব কঠিন হবেনা যে, খুব দ্রুত টাইপ ‘ক’ অণুকে ছাড়িয়ে যাবে ‘খ’ টাইপের অণুগুলো, এমনকি যদিও তারা ‘খ’ টাইপ অণুর চেয়ে দীর্ঘদিন বাঁচে। সুতরাং সে কারণে আরো উচ্চতর ‘উর্বরতা সম্পন্ন অণুর সংখ্যা সেই মিশ্রণে বৃদ্ধি পাবার সম্ভবত একটি “বিবর্তনীয় প্রবণতা থাকে। এই অনুলিপিকারক অণুর তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যা পজিটিভ বা ইতিবাচকভাবে নির্বাচিত হবে সেটি হচ্ছে অনুলিপন প্রক্রিয়ার ক্রটিহীনতা। যদি টাইপ ‘ক’ এবং টাইপ ‘খ’ অণুরা একই সময় ধরে টিকে থাকে এবং একই হারে অনুলিপি সৃষ্টি করে, কিন্তু ‘ক’ প্রতিটি দশম অনুলিপন প্রক্রিয়ায় গড়পড়তা একটি ভুল করে, অন্যদিকে ‘খ’ ভুল করে প্রতি একশত অনুলিপন প্রক্রিয়ায় একবার, অবশ্যই ‘খ’ অণুর সংখ্যা অনেক হারে বেড়ে যাবে। জনগোষ্ঠীর ‘ক’ অংশ শুধু ‘ভুল উত্তরসূরিদেরই হারাবে না, তাদের উত্তরসুরিদের উত্তরসুরিদের হারাবে, সত্যিকারের কিংবা সম্ভাব্য।

আপনি যদি বিবর্তন সম্বন্ধে ইতিমধ্যে কিছু জেনে থাকেন, আপনার হয়তো বিষয়টি শুনে সামান্য কিছুটা খটকা লাগবে, বিশেষ করে শেষ অংশটি। আমরা কি এই দুটি ধারণার মধ্যে সমঝোতা করতে পারবো, অনুলিপি করার সময় ভুল হওয়াটা বিবর্তন ঘটার জন্য একটি অপরিহার্য পূর্বশর্ত আর প্রাকৃতিক নির্বাচন নিখুঁত-অনুলিপি করার বৈশিষ্ট্যটিকে বিশেষভাবে সুবিধা দেয়? এর উত্তরটি হচ্ছে যদিও বিবর্তনকে মনে হতে পারে, কোনো একটি অস্পষ্ট অর্থে, ভালো কোনো কিছু, বিশেষ করে যখন আমরা এর ফসল। কিন্তু কোনো কিছুই আসলে বিবর্তিত হতে চায় না। বিবর্তন হচ্ছে এমনকিছু যা না চাইলেও ঘটবে, কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই, অনুলিপনকারীদের বিবর্তন যেন না ঘটে সেই প্রতিরোধ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও (এখন যাদের আমরা জিন বলি)। জ্যাক মননা বিষয়টি চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করেছিলেন তার হার্বার্ট স্পেন্সর বক্তৃতায় খানিকটা হতাশা সহ : “বিবর্তন তত্ত্বের আরো একটি মজার বিষয় হচ্ছে, সবাই ভাবেন তারা এটি বুঝতে পেরেছেন।

আদিম সেই সুপ বা মিশ্রণের আলোচনায় ফিরে আসি, অবশ্যই সেটি ‘স্থিতিশীল’ প্রকৃতির অণু দ্বারা পুর্ণ হয়ে পড়েছিল। স্থিতিশীল দুই অর্থে, হয় প্রতিটি অণু দীর্ঘস্থায়ী বা তারা দ্রুত অনুলিপি তৈরী করে বা তারা খুব নিখুঁতভাবে তাদের অনুলিপি তৈরী করে। এই তিন ধরনের স্থিতিশীলতার প্রতি বিবর্তনীয় প্রবণতাটি ঘটে এভাবে: আপনি যদি সেই মিশ্রণ থেকে দুটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নমুনা সংগ্রহ করেন, পরের নমুনাটিতে সেই সমস্ত প্রকারের অণুদের পরিমানের শতাংশ বেশী হবে যারা দীর্ঘ সময় ধরে বাঁচে উর্বর বা দ্রুত অনুলিপি তৈরী করে/ নিখুঁতভাবে তারা তাদের অনুলিপি তৈরী করতে পারে; আর মূলত এটাই কোনো জীববিজ্ঞানী বিবর্তন বলতে বোঝাতে চান যখন তিনি জীবিত জীব নিয়ে কথা বলেন এবং প্রক্রিয়াটি সেই একই প্রাকৃতিক নির্বাচন।

তাহলে কি আমাদের মূল অনুলিপনকারী অণুটিকে বলা উচিৎ তারা ‘জীবিত’ বা তাদের জীবন আছে? কার কি এসে যায় তাতে? আমি হয়তো আপনাকে বলতে পারি, পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন এমন মানুষগুলোর মধ্যে ডারউইনই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং আপনি হয়তো বলতে পারেন, ‘না, অবশ্যই না, ‘নিউটন ছিলেন সেই শ্রেষ্ঠতম মানব’, কিন্তু আমি আশাকরি আমরা সেই তর্ক দীর্ঘায়িত করবো না, মূল বিষয়টি হচ্ছে কোনো সত্যিকারের উপসংহারে আমরা পৌঁছাতে পারবো না, যেদিকেই আমাদের এই বিতর্ক অগ্রসর হোক না কেন। বাস্তব সত্য হচ্ছে নিউটন আর ডারউইনের জীবন ও অর্জন সম্পূর্ণভাবে অপরিবর্তিত থাকবে, আমরা তাদের ‘মহান’ হিসাবে চিহ্নিত করি কিংবা না করি। একইভাবে, অনুলিপি অণুগুলোর গল্প সম্ভব ঘটেছিল যেভাবে আমি বলছি, আমরা তাদের জীবিত বলবো নাকি বলবো না, তাতে কিছু আসে যায় না। মানুষের বহু যন্ত্রণার কারণ, আমরা অনেকেই বুঝতে পারিনা শব্দ হচ্ছে শুধুমাত্র একটি উপাদান বা টুল যা আমরা ব্যবহার করি মাত্র, কোনো অভিধানে ‘জীবিত (লিভিং)’ শব্দটির উপস্থিতি থাকা মানে এই না যে বাস্তব পৃথিবীতে এটি আবশ্যিকভাবে কোনো নির্দিষ্ট কিছু বোঝাবে। আমরা আদি অনুলিপনকারীদের জীবিত কিংবা জীবিত না, যেভাবেই ডাকি না কেন, তারাই জীবনের পূর্বসূরি, তারাই ছিল আমাদের প্রতিষ্ঠাতা পূর্বসূরি।

এই যুক্তির পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ সংযোগটি হচ্ছে সেটি, যা ডারউইন নিজেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন, সেটি হচ্ছে (যদিও তিনি কথা বলছিলেন প্রাণী ও উদ্ভিদ নিয়ে, অণুদের নিয়ে নয়) প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা কম্পিটিশন’। আদিম মিশ্রণের অসীম সংখ্যক অনুলিপনকারী অণুকে টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা ছিলনা। একটি কারণ তো অবশ্যই পৃথিবীর আকার সীমিত, কিন্তু সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করার আরো কারণ ছিল যেগুলো হয়তো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমাদের দৃশ্যকল্পে অনুলিপনকারী অণু ছাচ বা টেমপ্লেট হিসাবে কাজ করে, আমরা ধারণা করে নিয়েছিলাম যে, এটি ক্ষুদ্র গঠনগত একক অণুদের সমৃদ্ধ সুপ বা মিশ্রণে ভাসছে, যারা এর অনুলিপি তৈরী করার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু যখন অনুলিপনকারী অণুদের সংখ্যা বেড়ে যায়, তাদের তৈরী করার জন্য ছোট অণুগুলো এমন একটি হারে ব্যবহৃত হয়ে যায় যে তারা দ্রুত দুর্লভ আর মূল্যবান উপাদানে পরিণত হয়। সেই সময় বিভিন্ন ধরনের আর রুপের অনুলিপি অণুরা অবশ্যই তাদের পাওয়ার জন্যে নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দিতা করেছে। আমরা সেই সব শর্তগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি, যেখানে অনুলিপনকারী অণুদের মধ্যে যে অণুটি বিশেষ আনুকুল্য পায়, তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে। আমরা এখন দেখতে পাবো, অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাপ্রাপ্ত প্রকারগুলোর সংখ্যা আসলেই ‘কমে গিয়েছিল প্রতিযোগিতার কারণে। অবশেষ তাদের অনেক বংশধারাই বিলুপ্ত হয়ে যায়। সেখানে নানা প্রকারের অনুলিপনকারী অণুগুলোর মধ্যে অস্তিত্ব বাঁচানোর সংগ্রাম বিদ্যমান ছিল। তারা কিন্তু জানতো না যে তারা টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে বা বিষয়টি নিয়ে কোন ভাবনাই ছিলনা। কোনো তিক্ত সম্পর্ক সৃষ্টি করা ছাড়াই এই সংগ্রাম চলমান, আসলে কোনো ধরনের কোনো অনুভুতি এখানে সংশ্লিষ্ট নয়। কিন্তু তারা সংগ্রাম করছিল এই অর্থে যে, কোনো ধরনের ভুল অনুলিপি নতুন কোনো উচ্চতর পর্যায়ে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে বা কোনো নুতন উপায়ে প্রতিদ্বন্দ্বী অণুর স্থিতিশীলতা কমিয়ে দিতে পারে। আর সেই সব পরিবর্তনগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সুরক্ষিত হবে এবং সংখ্যায় বৃদ্ধি পাবে। এই উন্নতির প্রক্রিয়াটি ক্রমশ পুঞ্জীভূত হয়। অণুগুলোর স্থিতিশীলতা বাড়ানোর উপায় এবং প্রতিদ্বন্দ্বী অণুদের স্থিতিশীলতা কমানোর উপায় আরো বেশ জটিলতর, বিস্তারিত আরো দক্ষতর একটি প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়। তাদের কেউ কেউ এমনকি আবিষ্কার করে কিভাবে রাসায়নিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রকারের অণুগুলো ভাঙ্গতে হয় এবং তাদের ভেঙ্গে যাওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গঠনগত মূল একক অণুগুলোকে নিজেদের অনুলিপি বানানোর কাজে ব্যবহার করতে শেখে। এই প্রোটো-কার্নিভোর, আদি-মাংসাশীরা যুগপতভাবে তাদের খাদ্য সংগ্রহ করে এবং দ্বন্দ্বরত প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দেয়। অন্য অনুলিপনকারী অণুগুলো কিভাবে এই ধরনের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হয় সেটি হয়তো আবিষ্কার করেছিল, রাসায়নিকভাবে অথবা তাদের চারপাশে প্রোটিনের তৈরী কোনো দেয়াল সৃষ্টি করে নেবার মাধ্যমে। এভাবেই হয়তো প্রথম জীবিত কোষের আবির্ভাব ঘটেছিল। অনুলিপনকারী অণুগুলো শুধুমাত্র তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে শুরু করেনি, এছাড়াও তারা তাদের অস্তিত্বের ধারা রক্ষা করার জন্যে নিজেদের জন্য খোলস, বাহনও তৈরী করতে শুরু করেছিল। যে অনুলিপনকারীরা টিকে গিয়েছিল তারা হচ্ছে সেই অনুলিপি যারা তাদের নিজেদের বাঁচানো আর বসবাস করার লক্ষ্যে সারভাইভাল মেশিন বা বেচে থাকার যন্ত্র তৈরী করে নিতে পেরেছিল। প্রথম সেই সারভাইভাল মেশিন বা টিকে থাকার যন্ত্রগুলো সম্ভবত তাদের চারপাশে ঘিরে থাকা প্রতিরক্ষামূলক একটি পর্দা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কিন্তু টিকে থাকার সেই সংগ্রামটিও ধীরে ধীরে আরো কঠিন হয়ে ওঠে যখন নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীদের আবির্ভাব ঘটেছিল, যাদের টিকে থাকার যন্ত্রটি অপেক্ষাকৃত বেশী কার্যকর। পুঞ্জীভূত এই পরিবর্তনগুলো ধারণ করার মাধ্যমে ক্রমশ অগ্রসর হতে থাকা একটি প্রক্রিয়ায় টিকে থাকার যন্ত্রটি ক্রমশ আকারে আরো বড়, বিস্তারিত আর জটিলতর হয়ে উঠেছিল।

কোনো কি শেষ আছে নানা কৌশল আর যন্ত্র উদ্ভাবনের এই ক্রমোন্নয়নের ধারাবাহিকতার, পৃথিবীতে নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য যা অনুলিপনকারীরা ব্যবহার করে আসছে? বহু সময় আছে আরো উন্নতি করার। এই নিজেকে রক্ষা করার প্রক্রিয়ার কি অদ্ভুত যন্ত্রই না জানি সৃষ্টি করেছিল ধীরে ধীরে বহু হাজার বছরের পরিক্রমায়? চার হাজার মিলিয়ন বছর পরে, আদিম অনুলিপনকারী এই অণুটির নিয়তি কি হবে? না, তারা নিঃশেষ হয়ে যায়নি, কারণ তারা হচ্ছে এই টিকে থাকার কৌশল আর ক্ষমতার আদি বিশেষজ্ঞ। কিন্তু উন্মুক্ত অবস্থায় এখনও সমুদ্রের পানিতে ভেসে আছে এমন ভাবনায় তাদের খোঁজার চেষ্টা করবেন না। তারা তাদের সেই বিরোচিত স্বাধীনতা পরিত্যাগ করেছে বহুদিন আগেই। এখন তারা দলবদ্ধ হয়ে বাস করে, বিশাল কলোনি রুপে, নিরাপদে দানবাকৃতির এলোমেলো হাটা রোবোটদের (৪) অভ্যন্তরে, বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, যার সাথে তাদের যোগাযোগ এখন বহু ঘুরপথে, দুর থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মত যাদের তারা নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের বাস এখন আমার আর আপনার মধ্যে, তারা আমাদের সৃষ্টি করেছে, আমাদের শরীর ও মন, এবং তাদের সংরক্ষণ করা আমাদের অস্তিত্বের চূড়ান্ত যৌক্তিকতা। এইসব অনুলিপনকারীরা বহু দূর অতিক্রম করে এসেছে। এখন তারা পরিচিত ‘জিন’ নামে আর আমরা হচ্ছি তাদের ‘সারভাইভাল’ মেশিন বা টিকে থাকার যন্ত্র।

নোটস (অধ্যায় ২)

(১) জীবনের উৎপত্তি সম্বন্ধে বহু তত্ত্ব আছে। সেই সব তত্ত্বগুলো সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার পরিশ্রমসাধ্য প্রচেষ্টার পরিবর্তে The Selfish Gene বইটিতে মূল ধারণাটিকে বোধগম্য করে তোলার জন্য আমি শুধুমাত্র একটি ব্যাখ্যা উদাহরণ হিসাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি আসলেই চাইনি এমন কোনো ধারণা দিতে যে- এটাই একমাত্র গুরুত্ব পেতে পারে বা এটাই সবচেয়ে ভালো তত্ত্ব। আসলেই, একই উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে The Blind Watchmaker বইটিতে আমি ইচ্ছা করেই ভিন্ন একটি উদাহরণ বেছে নিয়েছিলাম: এ. জি, কেয়ার্ন-স্মিথের clay theory। কোনো বইতেই আমি এমন ইঙ্গিত দেইনি যে উদাহরণ হিসাবে যে হাইপোথিসিসটাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে সেটি আমারও মতামত। আমি যদি অন্য কোনো বই লিখি আমি সম্ভবত সেই সুযোগটা নেবো আরো একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করার জন্য, যেমন, জার্মান গাণিতিক রসায়নবিদ ম্যানফ্রেড আইগেন এবং তার সহকর্মীদের প্রস্তাবটি। আমি সবসময়ই কোনো একটি গ্রহে জীবনের উৎপত্তি সংক্রান্ত তত্ত্বের কেন্দ্রে থাকতে বাধ্য মূল বিষয়টির মৌলিক বৈশিষ্ট্যে নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করে থাকি, বিশেষ করে স্ব-অনুলিপন সক্ষম জিনগত সত্তার ধারণাটি নিয়ে।

(২) সেপটুয়াজিন্ট ( ল্যাটিন সেপটুজিন্টা মানে সত্তর থেকে) হচ্ছে। হিব্রু বাইবেল ও কিছু সংশ্লিষ্ট লেখার গ্রীক অনুবাদ। ওল্ড টেষ্টামেন্টের প্রথম গ্রিক অনুবাদ হিসাবে এটি পরিচিত গ্রিক ওল্ড টেষ্টামেন্ট নামে। এই অনুবাদটি বহু ব্যবহৃত হয়েছে নিউ টেস্টামেন্টে।

(৩) বেশ কিছু মর্মাহত পত্রলেখক বাইবেল বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণীর মূল তরুণী নারী বা young woman শব্দটির virgin বা কুমারী নারী হিসাবে ভ্রান্ত অনুবাদের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করেছেন এবং তারা আমার কাছে এর উত্তরও দাবী করেছেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া এখন বেশ বিপদজ্জনক একটি ব্যাপার, সুতরাং আমি তাদের দাবী মেনে নিলাম। আসলেই এ জন্যে আমি আনন্দিতও বটে, কারণ সত্যিকারের অ্যাকাডেমিক কোনো পাদটীকার সত্য অনুসন্ধান করতে বিজ্ঞানীরা প্রায়শই লাইব্রেরীর বইয়ের ধুলো প্রাণ ভরে ঝাড়তে পারার সুযোগ পান না। তবে এই বিষয়টি বাইবেল বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অজানা কোনো বিষয় নয় এবং তারা বিষয়টি নিয়ে কোনো বিতর্কও করেননি। ইসাইয়াহ’তে (Isaiah) উল্লেখিত হিব্রু ‘আলমাহ’ (almah) শব্দটির অর্থ তর্কাতীতভাবে তরুণী নারী, যেখানে তার কুমারিত্ব বিষয়ে সম্বন্ধে কোনো ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। যদি বইটিতে কুমারী নারী উল্লেখ করাই প্রয়োজন বোধ করা হতো তাহলে, এর পরিবর্তে বেথুলাহ (bethulah) শব্দটি তারা ব্যবহার করতে পারতেন (অস্পষ্ট অর্থের ইংলিশ শব্দ মেইডেনই (maiden) দেখাচ্ছে কত সহজে দুটো অর্থের একটি থেকে অন্যটিতে সরে আসা যায়)। মিউটেশন বা পরিবর্তনটি ঘটেছিল যখন প্রাক-খ্রিস্ট গ্রিক অনুবাদ যা সেপ্টয়াজিন্ট (Septuagint) নামে পরিচিত; সেখানে almah শব্দটিকে গ্রিক parthenos শব্দে অনুবাদ করা হয়েছিল, যার আসলেই অর্থ হচ্ছে কুমারী। ম্যাথিউ (না, অবশ্যই যীশুর সমসায়য়িক আর শিষ্য সেই ম্যাথিউ নন বরং সেই গসপেল নির্মাতা, যিনি বহু বছর পরে লিখেছিলেন) Isaiah থেকে উদ্ধৃতি দেন সেখানে, যেটা আপাতদৃষ্টিতে Septuagint সংস্করণ থেকে উদ্ভব হয়েছিল ( সবগুলো শব্দ মানে ১৫ টি শব্দ মাত্র দুটি গ্রিক শব্দ ছাড়া এখানে হুবহু একই) যখন তিনি বলেছিলেন, এখন এই সব শেষ হলো, যেন এটি পরিপর্ণ হতে পারে সেই সব শব্দ দিয়ে, ঈশ্বরের যে শব্দগুলো তার দূত যা উচ্চারণ করেছেন, তিনি বলেন, দেখো, একটি কুমারী নারী গর্ভধারণ করবে এবং একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেবে, তারা তার নাম দেবে ইমানুয়েল’ ( স্বীকৃত ইংরেজী অনুবাদ)। খ্রিস্টীয় বিদ্বানদের অনেকে মেনে নিয়েছেন, কুমারী মাতার গর্ভে যীশুর জন্ম পরবর্তীতে সংযুক্ত হয়েছিল, খুব সম্ভবত কাজটি করেছিলেন গ্রিকভাষী শিষ্যরা এই (ভুল ভাবে অনুদিত) ভবিষ্যদ্বাণীটি যে পূর্ণ হয়েছে এমনভাবে এটি উপস্থাপন করার মাধ্যমে। আধুনিক সংস্করণ যেমন New English Bible সঠিকভাবে Isaiah সেই শব্দটি অনুবাদ করেছে তরুণ রমনী হিসাবে; এবং সঠিক ভাবেই ম্যাথিউতে শব্দটি virgin হিসাবে রেখে দিয়েছেন, কারণ তারা সেখানে গ্রিক থেকে অনুবাদ করেছিলেন।

 (৪) এই ভাবালুতাপুর্ণ অনুচ্ছেদ বা ‘পারপল’ প্যাসেজটি (একটি দুর্লভ, ঠিক আছে, বেশ দুর্লভ একটি অসংযমী প্রশ্রয়) উদ্ধৃতি হিসাবে ব্যবহার আর পুনব্যবহার হয়ে আসছে আমার উন্মত্ত আনন্দের সাথে জিনগত ডিটারমিনিজমকে সমর্থন করার সপক্ষে প্রমাণ হিসাবে। আংশিকভাবে এই সমস্যাটির কারণ জনপ্রিয় তবে ভ্রান্ত ধারণা যা আমরা রোবট শব্দটির সাথে যুক্ত করেছি। আমরা এখন ইলেকট্রনিক্সের স্বর্ণযুগে বসবাস করছি এবং রোবোট আর সেই অনমনীয় নির্বোধ কোনো যন্ত্র নয় বরং তারা কোন কিছু শিখতে পারদর্শী, এছাড়া তাদের বুদ্ধিমত্তা আর সৃজনশীলতাও আছে। নিয়তির পরিহাস, যে সেই দুর অতীতে, ১৯২০ সালে ক্যারেল ক্যাপেক যখন প্রথম রোবাট শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, যে রোবোটও ছিল যান্ত্রিক সত্তা, যে কিনা মানবিক অনুভূতি, যেমন প্রেমে পড়া অনুভব করতে পেরেছিল অবশেষে। মানুষরা যারা মনে করেন রোবোটরা আসলে আবশ্যিকভাবে সংজ্ঞানুযায়ী পূর্বনির্ধারিত বা ডিটারমিনিস্টিক, মানুষদের তুলনায় তারা বিষয়টি গুলিয়ে ফেলেছেন (যদি না তারা ধর্মবাদী হয়ে থাকেন, সেই ক্ষেত্রে সারাক্ষণই সেই ধারণাটি নিয়ে বড়াই করবেন যে, মানুষদের স্বর্গীয় সেই উপহার স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি আছে যা সাধারণ যন্ত্রকে দেয়া হয়নি)। যদি আমার এই লাম্বারিং রোবট অনুচ্ছেদের বেশীরভাগ সমালোচকদের মত আপনি যদি ধর্মবাদী না হয়ে থাকেন, তাহলে, এই প্রশ্নটির মুখোমুখি করুন নিজেকে। আপনি নিজেকে আসলে কি মনে করেন, যদি না খানিকটা রবোটের মত কোনো কিছু ছাড়া? আমি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি The Extended Phenotype (পৃষ্ঠা ১৫-১৭) বইয়ে। কিন্তু ভুল আরো জটিল হয়ে যায় আরো একটি জোরালো মিউটেশন বা পরিব্যক্তির কারণে। ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকে ঠিক যেমন এটি প্রয়োজনীয় মনে করা হয় যে, যীশুকে অবশ্যই কুমারী কোনো নারীর গর্ভেই জন্ম নিতে হবে, ঠিক তেমনি মনে করা যেতে পারে অশুভতম উদ্দেশ্যেই বাধ্যবাধকতা আছে কোন ধরনের জেনেটিক ডিটারমিনিজমের (জিনগত পরিণামবাদী) সত্যিকারের সমর্থক অবশ্যই বিশ্বাস করবেন যে, জিন আমাদের আচরণেরর সবকটি ক্ষেত্ৰই নিয়ন্ত্রণ করে। আমি জিনগত অনুলিপনকারী অণুদের কথা বলেছিঃ তারা আমাদের সৃষ্টি করেছে, শরীর এবং মনে; এবং এটি যথারীতি ভুলভাবে উদ্ধৃতি হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে ( যেমন: Not in Our Genes– Rose, Kamin, and Lewontin, পৃষ্ঠা ২৮৭) এবং এর আগে প্রকাশিত লেওনটিনের একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে, যার শিরোনাম ছিল, ‘এভাবে .. (তারা) আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে, শরীর ও মনে’ (আমি গুরুত্বপূর্ণ শব্দটিকে আন্ডারলাইন করে দিয়েছি)। এই অধ্যায়ের প্রাসঙ্গিকতায়, আমি মনে করি খুব স্পষ্ট আমি আসলে সৃষ্টি করা হয়েছে শব্দটি দিয়ে কি বোঝাতে চেয়েছি এবং এটি নিয়ন্ত্রণ করে এমন কোনো শব্দ থেকে খুবই ভিন্ন; যে কেউই বিষয়টি দেখতে পাবেন, আর আসল কথাটিও হচ্ছে, জিন তাদের সৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করেনা সেই শক্তিশালী অর্থে যাকে সমালোচনা করা হয়েছে ‘ডিটারমিনিজম’ হিসাবে উল্লেখ করে। আমরা খুব সহজেই (বেশ যথেষ্ট কম কষ্ট সাপেক্ষে) তাদের অবজ্ঞা করি প্রতিটি সময় যখনই আমরা গর্ভনিরোধক ব্যবহার করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *