১৫. হর্নস্ অফ দ্য বুল

১৫. হর্নস্ অফ দ্য বুল

বিকাল ৩টা ১০ মিনিট।
সাউথ আফ্রিকা।

তেরপল দিয়ে ঢাকা একটা পয়োনালীর ভেতরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে খামিশি।

তিন মিনিট, বললেন পলা কেইন, তিনিও পেটে ভর দিয়ে শুয়ে আছেন।

ওরা দুজন বাইনোকুলার দিয়ে কালো বেড়ার ওপর নজর রাখছে।

পার্কের সীমানা দিয়ে খামিশি ওর জনবল ছড়িয়ে দিয়েছে। বিক্ষিপ্তভাবে গরু চড়াচ্ছে কিছু জুলু পোক। বংশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে রয়েছেন একঝাক বয়স্ক জুলু। গ্রামে উচ্চশব্দে ঢোল বাজিয়ে গান-বাজনা শুরু হয়ে গেছে। স্টেশনের দিকে এগোচ্ছে তারা। শত্রুপক্ষের চোখে ধুলো দেয়ার জন্য পুরো আয়োজনটাকে বিয়ের অনুষ্ঠানের মতো করে সাজানো হয়েছে।

 মোটরসাইকেল, এটিভি বাইক এবং ট্র্যাক জড়ো করা হয়েছে এলাকার আশেপাশে। অল্পবয়স্ক জুলু যোদ্ধা ও নারীরা পর্যন্ত উঠছে সেগুলোতে। কয়েকজন জুলু দম্পতি যুদ্ধের আগে একে অপরকে শেষবারের তত দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করছে। যুদ্ধে কী হবে সেটা তো কেউ জানে না। একঝাক জুলু খালি গায়ে রং-চং মেখে বিয়ের অনুষ্ঠানের ভেক ধরেছে, হাতে গদা নিয়ে ঐতিহ্যবাহী নাচও করছে তারা। বাকি লোকজনরা যে যার মতো করে তৈরি হচ্ছে। কয়েকজনের গায়ে ভারি কম্বল, এটাও বিয়ের ঐহিত্যবাহী পোশাকের অন্তর্ভুক্ত।

এই গদাগুলো ছাড়া আর কোনো অস্ত্র চোখে পড়ছে না।

খামিশি বাইনোকুলারের ফোকাস ঠিক করে নিলো। কাঁটাতারের বেড়া দেয়া অংশে নজর দিলো ও। বেড়ার ওপাশে জঙ্গলের সামিয়ানার ওপরে ঝুলন্ত রাস্তায় লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। ওয়ালেনবার্গ এস্টেটের গার্ডরা সেই রাস্তার ওপর এসে জড়ো হয়ে বেড়ার দিকে নজর রাখছে। পাহারা দিচ্ছে সীমানার ওপর।

এক মিনিট, তেরপলের নিচে একটা স্নাইপার নিয়ে শুয়ে আছেন পলা। তবে স্নাইপারটাকে বসানোর যে ট্রাইপড স্ট্যান্ড ব্যবহার করেছেন সেটা তেরপলে ঢাকা নেই। গাছের ছায়ার আড়ালে রয়েছে সেটা। পলা কেইন অলিম্পিকে সোনা জেতা শুটার, বিষয়টা জানতে পেরে খামিশি অবাক না হয়ে পারেনি।

বাইনোকুলার নামাল খামিশি। জুলুদের ঐতিহ্যবাহী আক্রমণকে ড় বলা হয়। আক্রমণের বড় অংশের নাম বুক, এই অংশ একদম মুখোমুখি হামলায় অংশ নেবে। অন্যদিকে ষাড়ের শিং নামের অংশটি আক্রমণ করবে দুপাশ থেকে। শত্রুপক্ষের কেউ যাতে পালিয়ে ফিরতে না পারে সেটা নিশ্চিত করবে। দুপাশ দিয়ে গিয়ে ঘিরে ফেলবে শত্রুদের। তবে আধুনিক অস্ত্রের সাহায্যে খামিশি এই যুদ্ধকৌশলে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। সেই পরিবর্তন আনতে গিয়ে সারারাত ঘুমায়নি বেচারা। শত্রুপক্ষের জন্য চমক রেখেছে ও।

দশ সেকেন্ড, ঘোষণা করলেন পলা। তারপর চুপচাপ উল্টোদিকে শুনতে শুরু করলেন। স্নাইপারে গাল ঠেকালেন তিনি। সময় হলে ফায়ার করবেন।

 ট্রান্সমিটার তুলে নিলো খামিশি, চাবি ঘুরিয়ে এক সারি বাটনের ওপর নিজের বুড়ো আঙুল রাখল।

জিরো, পলা গোনা শেষ করলেন।

 প্রথম বাটনে চাপ দিলে খামিশি।

সারারাত জেগে বেড়ার ওপাশে খামিশি যেসব চার্জ সেট করে এসেছিল সেগুলোর একটা বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো। ঝুলন্ত ব্রিজের কাঠের তক্তা উঠে গেল শূন্যে, বিস্ফোরণের আওয়াজে আতঙ্কিত হয়ে জঙ্গলের সব পাখি আকাশে ডানা মেলল। বিভিন্ন রঙের পাখিকে একসাথে উড়তে দেখে মনে হলো রংধনু ছড়াচ্ছে।

ব্রিটিশদের কাছ থেকে পাওয়া সি-৪ প্যাকেট সেট করেছিল খামিশি। ঝুলন্ত ব্রিজের বিভিন্ন সংযোগস্থল আর পোলের গায়ে বসিয়েছিল ওগুলো। একে একে সব বিস্ফোরক ফাটতেই পুরো ব্রিজ ধসে পড়ল। ওয়ালেনবার্গ গার্ডদের মধ্যে একই সাথে ভয়, আতঙ্ক ও দ্বিধা জেগে উঠেছে। দিশেহারা হয়ে পড়ছে তারা।

এবার বিয়ের অনুষ্ঠানের সাজে থাকা জুলুরা তাদের আসল চেহারা প্রকাশ করতে শুরু করল। গায়ে থাকা কম্বল ফেলে রাইফেল বের করল তারা। যার আছে যা অস্ত্র লুকোনো ছিল সব একযোগে যার যার হাতে চলে এলো। হামলা করার জন্য ষাড়ের বুক-এ রূপান্তরিত হয়ে গেল তারা। তাদের দুপাশ থেকে গর্জে উঠল ইঞ্জিন। জুলু যোদ্ধারা মোটরবাইক আর ট্রাক নিয়ে হামলার জন্য তেড়ে যাচ্ছে। এরা হলো ড়ের শিং।

এবার, বললেন পলা।

খামিশি ওর হাতে থাকা ট্রান্সমিটারের অন্য বাটনগুলোতে চাপ দিলো।

বিস্ফোরিত হয়ে কাঁটাতার দেয়া বেড়া ধুলোয় মিশে গেল, পুরো আধা মাইল। বেড়া সরে যেতেই যেন শত্রুপক্ষের পেট উন্মুক্ত হয়ে গেল।

তেরপল সরিয়ে উঠে দাঁড়াল খামিশি। ওর পেছনে থাকা একটা মোটর সাইকেল চালু হয়ে এগিয়ে এলো। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে এসে থামল ওর পাশে। নজঙ্গো ওকে বাইকে উঠতে বলল কিন্তু তার আগে খামিশিকে একটা কাজ সারতে হবে। একটা সাইরেন হর্ন মাথার ওপর তুলে ওটার ট্রিগার টিপল ও। বিকট আওয়াজ বেরোল হর্ন থেকে। সাইরেন হর্নের আওয়াজ পুরো এলাকা কাঁপিয়ে দিলো। জানিয়ে দিলো জুলুদের ষাঁড় শিং উঁচিয়ে ধেয়ে আসছে।

.

বিকাল ৩ টা ১৩ মিনিট।

বিস্ফোরণের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়ে নেমে এলো ওপর থেকে। বেল চেম্বারে থাকা লাইটগুলোর আলো দপদপ করে কেঁপে উঠল। একদম স্থির হয়ে গেল সবাই। নাতি ইসাককে নিয়ে ব্যালড়িক কন্ট্রোল বোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। একটু দূরে ইসকি গ্রেকে পাহার দিচ্ছে, ওর হাতে একটা পিস্তল, একদম গ্রের বুকের দিকে তাক করা। উপর দিকে তাকাল ইসকি। কীসের শব্দ বোঝার চেষ্টা করছে।

তবে গ্রে তাকায়নি।

গ্রের দৃষ্টি আটকে রয়েছে কনসোলে থাকা পাওয়ার মিটারের ওপর। ওটার ইনডিকেটর আস্তে আস্তে উপর দিকে উঠে যাচ্ছে। গ্রের আকুতি ব্যালড্রিক কানে নেননি। বেল চালু করেছেন তিনি। বেল-এর চারপাশ থেকে গুঞ্জন ভেসে আসছে। ভিডিও মনিটরে দেখা যাচ্ছে নীল হয়ে গেছে বেল-এর বাইরের শেল।

পাওয়ার মিটার তার সর্বোচ্চে পৌঁছে গেলে এই বেল থেকে যে আউটপুট বেরোবে সেটা ছড়িয়ে যাবে ৫ মাইল। মনক, ফিওনা, রায়ান… যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেন মারা পড়বে ওরা। শুধু গ্রে নিরাপদ।

কী হচ্ছে গিয়ে দেখো তো, নাতিকে নির্দেশ দিলেন ব্যালড্রিক। বিস্ফোরণের শব্দ এখন মিলিয়ে গেছে।

ইতোমধ্যে লাল ফোনের দিকে হাত বাড়িয়েছে ইসাক।

হঠাৎ পিস্তলের শব্দে সবাই চমকে উঠল। বিস্ফোরণের শব্দ থেমে যাওয়ার পর সবকিছু মাত্র সুনসান হচ্ছিল ঠিক এমন সময় এরকম বিকট আওয়াজে সবাই বিস্মিত।

অন্যদিকে ঘুরল গ্রে, টাইলসের মেঝেতে রক্ত ছিটকে পড়েছে।

তাজা রক্তে লাল টকটকে হয়ে গেছে ইসকির বা কাঁধ। গুলির ধাক্কায় সে-ও ঘুরে উঠেছে। পেছন থেকে গুলি করা হয়েছে ওকে। দুর্ভাগ্যবশত ইসকির ডান হাতে পিস্তলটা ধরা ছিল। গুলির ধাক্কা খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে আততায়ীর দিকে নিজের পিস্তল তাক করল ইসকি।

 হাঁটু গেড়ে বসে আছেন ড. মারশিয়া ফেয়ারফিল্ড। ডান হাতে ব্যান্ডেজ থাকায় বাধ্য হয়ে বা হাত দিয়ে গুলি ছুঁড়েছেন। তাই এক গুলিতে ইসকিকে পরপারে পাঠাতে পারেননি।

তবে ইসকি কঠিন চিজ। আচমকা গুলিতে আহত হয়েও তেজ কমেনি কিংবা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার দক্ষতা হারায়নি। গ্রে শেষমুহূর্তে বাধা না দিলে নিখুঁতভাবে সে আঘাত করতে পারতো।

ইসকির গুলিতে মারশিয়ার হাত থেকে পিস্তল ছুটে গেল। এদিকে গ্রের ধাক্কার ফলে ইসকির হাতেও পিস্তল নেই।

ইসকি ও মারশিয়া দুজনই তাদের টার্গেট মিস করেছে।

ইসকিকে ভালুকের মতো পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে গ্রে। মারশিয়ার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে। কিন্তু ইসকি অত্যন্ত তেজি, সে বুনো বেড়ালের মতো লড়ছে। গ্রে কোনোমতে ইসকির ডানহাতটাকে বাগে আনতে পারল।

হাতে জার্মান স্টিলের ছোরা নিয়ে সামনে এগোলো ইসাক। হাতের ছোরাটা নিচু করে ধরে রেখেছে।

মারশিয়া ইতোমধ্যে নিজের পিস্তল কুড়িয়ে নিয়েছেন কিন্তু গ্রে আর ইসকির ধস্তাধস্তির জন্য ইসাককে গুলি করার মতো ক্লিন শট পাচ্ছেন না।

ইসকির কাঁধের আহত অংশে নিজের থুতনি শক্ত করে গ্রে ঠেসে ধরল। গুঙিয়ে উঠল ইসকি, একটু দুর্বল হয়েছে। পড়ে থাকা পিস্তলটা হাতে তুলে নিতেই গ্রে ওর হাত তুলে নিয়ে আঙুলগুলো মুচড়ে দিলো। গুলি বেরিয়ে গেল পিস্তল থেকে। কিন্তু নিচ দিকে তাক করা থাকায় বুলেট কারও গায়ে লাগলো না। ইসাকের পায়ের কাছে মেঝেতে গিয়ে মুখ খুঁজল সেটা। তবে গুলির আঘাতে মেঝে থেকে কয়েক টুকরো টাইলস ছিটকে গিয়ে ইসাকের কয়েক জায়গার চামড়া তুলে নিয়েছে। সামনে এগোতে গিয়ে ইসাক একটু দুলে উঠল।

ভাইকে আঘাত পেতে দেখে আরও মারমুখী হয়ে উঠল ইসকি। ক্ষীপ্রতার সাথে এক হাত ঘুরিয়ে কনুই দিয়ে আঘাত করল গ্রের পাজরে। হুক করে গ্রের ফুসফুস থেকে সব বাতাস বেরিয়ে গেল, চোখে লাল-নীল ফুটকি দেখতে লাগল ও। ইসকি এখন মুক্ত।

ওদিকে ইসাক নিজেকে সামলে নিয়েছে। চোখে ধুনের নেশা আর হাতে ছোরা নিয়ে এগিয়ে আসছে সে।

গ্রে-ও নিজেকে সামলে নিলো। পেছন থেকে ইসকিকে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা মারল ও। গ্রের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে আহত ইসকি তখনও পুরোপুরি টাল সামলে উঠতে পারেনি উপরন্ত এখন গ্রের ধাক্কা খেয়ে রীতিমতো উড়ে যেতে লাগল ইসাকের দিকে।

একদম ইসাকের ছোরার দিকে।

 মুহূর্তের মধ্যে জার্মান স্টিল ব্লেড এসে ইসকির বুকে বিধল।

ব্যথায় গগণ বিদারি চিৎকার করল ইসকি। ইসাকও চিৎকার করে উঠল। অবিশ্বাস নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল বোন, হাত থেকে পড়ে গেল পিস্তলটা।

ইসকির হাত থেকে পিস্তলটা ভূমিতে আছড়ে পড়ার আগেই ঝাঁপ দিয়ে ওটাকে তালুবন্দি করল গ্রে। মেঝেতে শুয়ে থেকেই ইসাককে টার্গেট করল।

 ইসাক সরে যেতে পারতো, ওর সরে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু বোনকে আঁকড়ে ধরে সে বেদনায় কাতর।

ফায়ার করল গ্রে। একদম ক্লিন হেডশট। ইসাকের মগজে গুলি পৌঁছে গিয়ে ওকে বোনের মৃত্যুশোক থেকে রেহাই দিলো।

মেঝেতে আছড়ে পড়ল যমজ ভাই-বোন। একে অন্যের রক্তে মাখামাখি।

 উঠে দাঁড়াল গ্রে।

 রুমে ঢুকলেন মারশিয়া, ব্যালড্রিকের দিকে পিস্তল তাক করেছেন তিনি।

বৃদ্ধ তার মৃত নাতি-নাতনির দিকে চেয়ে রয়েছেন। কিন্তু তার চোখে কোনো শোক নেই।

পুরো লড়াইটা হতে এক মিনিটেরও কম সময় লেগেছে।

গ্রে লক্ষ করল রেড জোনে প্রবেশ করেছে বেল-এর পাওয়ার মিটার। ওর হাতে হয়তো আর বড়জোর দুই মিনিট আছে। পিস্তলের গরম মাজল বৃদ্ধ ব্যালড্রিকের গালে ঠেসে ধরল ও। বন্ধ করতে বলেছি।

ওর চোখে চোখ রাখলেন বৃদ্ধ। করব না।

.

বিকাল ৩ টা ১৩ মিনিট।

বিস্ফোরণের আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই ওয়ালেনবার্গ ভবনের উপরের হলওয়েতে থাকা স্থবিরতা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করল। বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনে কতগুলো দানবাকার হায়েনা শুয়ে পড়েছিল মেঝেতে, কয়েকটা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেলেও বাকিগুলো ঠিকই শিকার ধরার আশায় রয়ে গেছে। এক এক করে উঠে দাঁড়াতে শুরু করল হায়েনাগুলো।

কেউ গুলি করবেন না! জরুরি ভিত্তিতে ফিসফিস করল মনক। সবাই ওই রুমে ঢুকুন! পাশের একটা দরজা দেখাল, ওখানে যেতে পারলে একটু সুবিধে করতে পারবে। আড়াল পাওয়া যাবে খানিকটা। অ্যানাকে নিয়ে এলো গানথার। বর্শা দিয়ে একটা দানবকে খতম করে জুলু সর্দার মশি সরে এলেন। মেজর ব্রুকসকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন তিনি। মেজরের উরু থেকে রক্ত ঝরছে। দানবটা গভীরভাবে কামড়ে দিয়েছে ওখানে।

ওরা সবাই রুমের দিকে এগোতে যাবে এমন সময় মনকের অপরপাশ থেকে হিংস্র গর্জন ভেসে এলো।

ওর নাম উচ্চারণ করল কেউ। মনক…

পেইন্টারের অজ্ঞান দেহের পাশে ঝুঁকে রয়েছে লিসা। ওদের দুজনের পেছনে একটা বিশালদেহি দানব উদয় হলো।

কাঁধ উঁচু করে দাঁড়াল ওটা, শিকার দুটোকে দেখছে। ঠোঁট দুটো পেছন দিকে সরে যাওয়া ধারাল দাঁতের চোয়াল প্রায় উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে ওটার। গরগর আওয়াজ করছে, রক্ত ও লাল ঝরছে ঠোঁট থেকে। চোখ দুটো টকটকে লাল।

মন বুঝতে পারল এখন ও যদি অস্ত্র ব্যবহার করতে যায় দানবটা সাথে সাথে পেইন্টার আর লিসাকে ছিঁড়ে ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলবে। কিন্তু তারপরও ওকে একটা চেষ্টা করতে হবে, কিন্তু মনক আর কিছু ভাবার আগেই হলের পেছন দিক থেকে একটা নির্দেশ ভেসে এলো।

স্কাল্ড! না!

ঘুরল মনক। নির্দেশটা ফিওনা দিয়েছে। উদয় হলো সে। দুটো দানবের পাশ দিয়ে অবলীলায় হেঁটে চলে এলো ফিওনা, দানবগুলো অনেকটা বিড়ালের মতো মিউ মিউ করে ওকে জায়গা করে দিলো। ফিওনার হাতে একটা টেজার দেখা যাচ্ছে, নীল ফুলকি দেখা যাচ্ছে ওতে। ওর অন্য হাতে আরেকটি জিনিস আছে, অ্যান্টিনাঅলা। অ্যান্টিনাটা লিসা ও পেইন্টারের পাশে থাকা দানবটার দিকে তাক করা।

ব্যাড ডগ! বলল ফিওনা।

 মনক অবাক হয়ে লক্ষ করল, পিছিয়ে গেল দানবটা। গর্জন কমে গেল, এতক্ষণ দাঁত খিচাচ্ছিল এখন আর সেটা করছে না। দরজার দিকে সরে গেল ওটা। ওটার লাল টকটকে চোখে এখন আর আগের হিংস্রতা নেই। মেঝেতে শুয়ে পড়ল দানব। আনন্দের গোঙানি ছাড়ল।

ফিওনা এসে গেছে।

হলের দিকে তাকাল মনক। সবকটা হায়েনা একদম কুপোকাত।

ওয়ালেনবার্গরা এই হারামিগুলোর ভেতরে চিপ বসিয়ে রেখেছে, ব্যাখ্যা করল ফিওনা, হাতে ধরা ডিভাইসটা দেখিয়ে বলল, এটা দিয়ে দুটো অপশন সিলেক্ট করা যায়। হিংস্র আর ভদ্র।

দরজার কাছে থাকা একটা দানব মিউ মিউ করে বশ্যতা প্রকাশ করছে।

ভ্রু কুঁচকে ফিওনার হাতে থাকা ট্রান্সমিটারের দিকে তাকাল মনক। এটা কোথায় পেয়েছ?

ফিওনা মনকের দিকে চোখ তুলে তাকাল, ডিভাইস ধরা হাতে তুলে ওর পিছু পিছু আসতে ইশারা করল ওদের।

চুরি করেছ, বলল মনক।

ফিওনা কাঁধ ঝাঁকিয়ে হলের দিকে পা বাড়াল। এক বুড়ির সাথে ধাক্কা খেয়েছিলাম, পরে দেখি এই ডিভাইসটা আমার পকেটে চলে এসেছে। বুড়ি এটা ব্যবহার করছিল না।

মন ভাবল, বুড়ি বলতে ফিওনা ইসকিকে বোঝাচ্ছে। সবাইকে ডেকে নিলো ও। লিসা আর পেইন্টারকে সাহায্য করল মনক। ওদিকে গানথার বোনের এক হাত ধরে সামনে এগোতে শুরু করেছে। একে অন্যের সাহায্য নিয়ে এগোচ্ছে মশি আর ব্রুকস। প্রাথমিকভাবে তাদের আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছে।

সমস্যা নেই, ব্যাকআপ আছে।

এক ডজন দানব এগিয়ে আসছে ওদের পিছু পিছু। আসলে ওরা এখন ফিওনাকে প্রভু মানছে।

এদেরকে পিছু ছাড়ানোর চেষ্টা করেছি, পারিনি বলল ফিওনা। মনক খেয়াল করল বেচারির হাত কাঁপছে। দানবগুলোকে যতই পোষ মানাক ভয় ঠিকই পাচ্ছে ফিওনা।

বাটন চাপ দেয়ার পর থেকে আমার পিছু নিয়েছিল ওরা। আমি ওদেরকেসহ একটা জায়গায় গিয়ে লুকিয়েছিলাম, গ্রে আমাকে সেখানে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে বলেছিল… কিন্তু তারপরও হলে আর বিভিন্ন রুমে কয়েকটা দানব ছিল।

খুব ভাল কথা! ভাবল মনক। একদম সেই কয়েকটা দানবের খপ্পরে এসে পড়লাম আমরা!

তারপর আমি আপনাদের চিৎকার আর বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পাই। তারপর…

বেশ। মনক ফিওনাকে থামিয়ে দিলো। গ্রের কী খবর? সে কোথায়?

নিচ দিকে যাওয়ার জন্য লিফটে চড়েছিল। সেটাও এক ঘণ্টা আগের কথা। সামনের দিকে দেখাল ও। ওখানে করিডোর শেষ হয়ে বেলকুনিতে রূপ নিয়েছে। বড় একটা হল দেখা যাবে ওখান থেকে। চলুন দেখাচ্ছি।

দ্রুত এগোল ফিওনা। পেছন পেছন বাকি সবাই এগোচ্ছে, বারবার পেছনে ফিরে দেখছে দানবগুলোকে। ফিওনা এক সারি সিঁড়ি বেয়ে নিচের মূল হলে নিয়ে এলো ওদের। লিফটের দরজাগুলো বন্ধ, ওটার ঠিক বিপরীত দিকে ওয়ালেনবার্গ ভবনের বিশাল সদর দরজা অবস্থান করছে।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ইলেকট্রনিক লকের দিকে এগোল মেজর ব্রুকস। একগাদা কি কার্ড পাঞ্চ করল… কিন্তু কাজ হচ্ছে না। অবশেষে একটা কার্ড কাজ করল। লাল বাতি সরে গিয়ে সবুজ হলো। মোটরের আওয়াজ ভেসে এলো কোথা থেকে। নিচের কোথাও থেকে কিছু একটা সরে যাচ্ছে।

 অপেক্ষা করছে ওরা। তখন দেখা গেল হায়েনাগুলোও সিঁড়িতে এসে হাজির হয়ে গেছে। ফিওনার হাতে থাকা ডিভাইসে বুঁদ হয়ে আছে ওগুলো। হলের মেঝেতে চলে এলো কয়েকটা। দানবগুলোর ভেতরে সেই স্কাল্ড নামের হায়েনাটাও আছে।

কেউ কিছু বলল না, চুপচাপ দেখছে দানবগুলোকে।

মূল ভবনের দরজার ওপাশ থেকে চিৎকার আর গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসছে। লড়াইয়ে নেমে পড়েছে খামিশি। এখানে পৌঁছুতে ওর কতক্ষণ লাগতে পারে?

মনকের মনের কথা বুঝতে পেরেই হয়তো সামনের দরজা দড়াম করে খুলে গেল। গোলাগুলির আওয়াজ আগে দূরে ছিল এখন প্রতিনিয়ত কাছে আসছে। আরও প্রকট হচ্ছে চিৎকার, আর্তনাদ। দরজা দিয়ে লোজন ভেতরে ঢুকতে শুরু করল। ওয়ালেনবার্গের গার্ডরা লড়াই ছেড়ে দিয়ে পিছু হটছে। গার্ডদের পাশাপাশি ওয়ালেনবার্গদের তৈরি প্রায় এক ডজন যমজ ভাই-বোনকে দেখল মনক।

বাইরে যুদ্ধ চলছে। কিন্তু দুই পক্ষ একদম মুখোমুখি পড়ে গেছে হলের ভেতর।

এটা কোনো ভাল খবর নয়।

 নিজের টিমকে নিয়ে মনক একদম কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।

 ওদের তুলনায় শত্রুরা সংখ্যায় অনেক বেশি।

.

বিকাল ৩টা ১৫ মিনিট।

ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গের কাছ থেকে সরে এলো গ্রে।

এর ওপর নজর রাখুন, মারশিয়াকে নির্দেশ দিলো ও।

গ্রে ইসাকের ওয়ার্কস্টেশনের দিকে গেল, বেল-এর পাওয়ার মিটারের ওপরেও নজর রেখেছে ও। একটা টগল সুইচের দিকে হাত বাড়াল ও, এর আগে ইসাককে এই সুইচ ব্যবহার করতে দেখেছে। ব্লাস্ট শিল্ড নিয়ন্ত্রণ করে এটা।

কী করছেন? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইলেন ব্যালড্রিক।

যাক এই বুড়োকে ভয় পাইয়ে দেয়ার মতো কিছু একটা অন্তত পাওয়া গেল। বুলেট দেখে ভয় পায়নি কিন্তু এখন ঠিকই ভয় পাচ্ছে। ভাল খবর। টগল পেছনে টানল গ্রে। মোটরের গুঞ্জন বেড়ে গেল, নিচে নেমে গেল শিল্ড। শিল্ড নেমে যেতেই তীক্ষ্ণ নীল আলো দেখা গেল।

না! আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবেন আপনি! থামুন!

 বুড়োর দিকে তাকাল গ্রে। তাহলে এই জিনিস বন্ধ করুন।

কনসোল আর নিচে নেমে যাওয়া শিন্ডের দিকে তাকালেন ব্যালড্রিক। আমি এটা বন্ধ করতে পারব না। বেল চালু হয়ে গেছে। এটা ডিসচার্জ করবেই!

গ্রে কাঁধ ঝাঁকাল। তাহলে আমরা এখন চেয়ে চেয়ে দেখব।

নীল আলোর বৃত্ত আরও গভীর, পুরু হলো।

ব্যালড্রিক কনসোলের দিকে ঘুরলেন। তবে আমি মানুষ মারার বিষয়টাকে মুছে দিতে পারি। তাহলে আপনার বন্ধুদের কেউ মারা পড়বে না।

করুন।

দ্রুত টাইপ করতে শুরু করলেন ব্যালড্রিক। আপনি শিল্ড তুলুন!

আগে আপনি আপনার কাজ শেষ করবেন, তারপর। বৃদ্ধের কাঁধের ওপর দিয়ে নজর রাখছে গ্রে। ও দেখল স্ক্রিনে ওদের সবার নাম ভেসে উঠেছে, আলফানিউমেরিক কোডে জেনেটিক্স প্রোফাইল দেখাচ্ছে নামের পাশে। ব্যালড্রিক চারবার ডিলিট বাটন চাপলেন… চারজনের নামের পাশ থেকে জেনেটিক্স প্রোফাইল মুছে গেল।

করেছি! গ্রের দিকে ফিরে জানালেন ব্যালড্রিক। এবার ব্লাস্ট শিল্ড তুলুন!

 টগল সুইচ ঠেলে দিয়ে গ্রে ব্লাস্ট শিল্ড আগের মতো তুলে দিলো।

আবার মোটরের গুঞ্জন বেড়ে গেল… কিন্তু এবার গোলমাল হয়েছে। শিন্ড উঠতে গিয়েও উঠছে না।

ওদিকে নীল আলোর বৃত্ত গাছ থেকে গাঢ়তর হচ্ছে তো হচ্ছেই। বাতাস তৈরি হচ্ছে বেল-এর চারপাশে। বেল-এর বাইরের শেল ঘুরছে একদিকে, ভেতরের শেল ঘুরছে অন্যদিকে।

কিছু একটা করুন! আকুতি জানালেন ব্যালড্রিক।

 হাইড্রোলিকগুলো জ্যাম হয়ে গেছে। গ্ৰে বিড়বিড় করে জবাব দিলো।

পিছু হটলেন ব্যালড্রিক, প্রতিবার পা ফেলতে গিয়ে তার চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে। আপনি আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে দিলেন। বেল যখন ডিসচার্জ করবে তখন এরকম শিল্ড নামানো অবস্থায় এখান থেকে ৫ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা সবাই মারা যাবে… কিংবা আরও খারাপ কিছুও হতে পারে।

 শিল্ড তোলা থাকলে যাবতীয় চার্জ ব্রডকাস্ট রড হয়ে চারপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়তো কিন্তু শিল্ড নামতে থাকায় চার্জের পুরোটা এই চেম্বার থেকে ছড়াতে শুরু করবে।

আরও খারাপ কী হতে পারে সেটা জিজ্ঞেস করার মতো সাহস পেল না গ্রে।

.

বিকাল ৩ টা ১৬ মিনিট।

মনক দেখল ওদের দিকে রাইফেল তাক করা হয়েছে।

সংখ্যায় অগণিত।

লিফট এখনও এই তলায় এসে পৌঁছেনি। আর পৌঁছুলেও ওটাতে চড়ে দরজা বন্ধ হতে হতে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যাবে।

গোলাগুলি থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই।

তবে…

 ফিওনার দিকে ঝুঁকল মনক। অনেকক্ষণ তো দ্র হলে এখন একটু হিংস্র হলে কেমন হয়…

হায়েনাগুলো সিঁড়ির যেদিকে চলে গেছে সেদিকে ইশারা করল ও।

মনক কী বলতে চাচ্ছে সেটা ফিওনা বুঝতে পারল, চাপ দিলো ডিভাইসে। ড্র থেকে হিংস্র করার সুইচ।

ফলাফল পাওয়া গেল হাতেনাতে। হায়েনাগুলো এমনভাবে গর্জন ও চিৎকার করে উঠল যেন কেউ ওদের লেজে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। উপরের বেলকুনি থেকে দানবগুলো লাফিয়ে এসে মেঝেতে নামল। বাকিগুলো উঠে এলো সিঁড়ি দিয়ে। ওদের ধারে কাছে যে-ই নড়ে উঠছে তাকেই দাঁত দিয়ে খুবলে দিচ্ছে। আর্তচিৎকার ছাড়ল ওয়ালেনবার্গের লোকজন। বুলেট বেরোতে শুরু করল রাইফেল থেকে।

মনকের পেছনে অবশেষে লিফটের দরজা খুলল।

ওতে ঢুকল মনক, সাথে ফিওনাকেও টেনে নিলো। ওর পিছু পিছু ঢুকল লিসা ও পেইন্টার।

কিছু বুলেট ওদের দিকে ছুটে এলেও অধিকাংশ ওয়ালেনবার্গদের টার্গেট হলো হায়েনাদের দিকে। পাল্টা বুলেট ছুঁড়ে জবাব দিলেন মশি আর মেজর, ফায়ার করতে করতে লিফটে ঢুকলেন দুজন।

আপাতত বেঁচে গেলেও এখন কী হবে? ওয়ালেনবার্গরা তো ওদের সম্পর্কে জেনে গেছে, পুরোপুরি সতর্ক এবার। নিঃসন্দেহে ওদের পিছু নেবে।

মনক অন্ধের মতো ভূগর্ভে যাওয়ার বাটনগুলোতে চাপ দিলো।

 এসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে।

তবে এখানকার খেলা এখনও শেষ হয়নি। অ্যানাকে মনকের হাতে তুলে দিলো গানথার। ওকে ধরুন! আমি হারামিগুলোকে ঠেকিয়ে রাখব।

কে থামানোর জন্য এগিয়ে এলেন অ্যানা। গানথার আস্তে করে বোনের হাত নিচে নামিয়ে দিলো। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে লিফটের দরজা। ঘুরে দাঁড়াল গানথার। এক হাতে পিস্তল, আরেক হাতে রাইফেল। শেষবারের জন্য মনকের দিকে তাকাল গানথার। ওর চোখ চুপচাপ একটা কথাই বলছে…

অ্যানাকে দেখে রাখবেন।

 লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

.

বিকাল ৩টা ১৬ মিনিট।

মোটরসাইকেলে বসে মাথা নিচু করে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটছে খামিশি। ওর পিছনে পলা কেইন বসে আছেন। তার কাঁধে রাইফেল শোভা যাচ্ছে। একজন জুলু যোদ্ধা আরেকজন ব্রিটিশ এজেন্ট, অদ্ভুত জুটি। কারণ উনিশ শতকে ইংরেজ আর জুলুদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল।

তবে সেটা অতীত।

এখন এরা দুজন এক টিমের হয়ে কাজ করছে। বোঝাপড়াও ভাল।

বায়ে! চিৎকার করলেন পলা।

খামিশি বাইক সরালো। কাঁধের এক পাশ থেকে অন্য পাশে রাইফেল সরালেন পলা। রাইফেল হাতে পৌঁছুতেই ফায়ার করলেন। এক ওয়ালেনবার্গ সেন্ট্রি চিৎকার করে পরপারে চলে গেল।

জঙ্গলের দুপাশে গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

এস্টেটের গার্ডরা সব কোণঠাসা হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে।

হঠাৎ ওদের বাইকটা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে দশ একর বাগানের ভেতরে এসে পড়ল। ব্রেক চাপল খামিশি। নরম গুল্ম গাছের ভেতর দিয়ে বাইকটা স্কিড করে চলে যাচ্ছে।

সামনেই ওয়ালেনবার্গ ভবন।

গলায় ঝুলানো বাইনোকুলার চোখে লাগাল খামিশি। ছাদের হেলিপ্যাডে হেলিকপ্টার পার্ক করে রাখা আছে। কিন্তু ছাদের কিনারায় নড়াচড়া করছে কী যেন। পরিচিত একজনকে দেখতে পেল ও। তাউ। খামিশির জুলু বন্ধুটি ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে নিচের লড়াই পর্যবেক্ষণ করছে।

 বাম পাশ থেকে একটা নতুন অবয়ব প্রবেশ করল। তাউ-এর ঠিক পেছনেই। নতুন আগম্ভকের হাতে একটা পাইপ ধরা। তাউ-এর মাথায় আঘাত হানতে যাচ্ছে সে। আগম্ভকের নাম: জেরাল্ড কেলজ।

নড়বেন না। বললেন পলা।

খামিশির মাথার ঠিক উপরে রাইফেলের নল রেখে স্নাইপার স্কোপের দিকে তাকালেন তিনি।

দেখতে পাচ্ছি, পলা জানালেন।

খামিশি একটু নিচু হলো তবে কাপলো না। এখনও বাইনোকুলার ধরে উপরে তাকিয়ে রয়েছে।

ট্রিগার চাপলেন পলা। রাইফেলের আওয়াজে খামিশির কানে তালা লাগার দশা। মাথায় ঝাঁকি খেয়ে কেলজ পেছনে আছড়ে বলল। গুলির আওয়াজে তাউ শুয়ে পড়েছে… আর একটু হলে ছাদ থেকে পড়েই যেত বেচারা। ও জানেও না এইমাত্র ওর জীবন বাঁচানো হয়েছে।

 তাউর এরকম অবস্থা দেখে ভয় পেল খামিশি। তাউ নাহয় অল্পের জন্য বেঁচে গেল কিন্তু বাকিদের কী অবস্থা?

.

বিকাল ৩টা ১৭ মিনিট।

আপনি আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে দিলেন! একই কথা আবার বললেন ব্যালড্রিক।

কিন্তু যে হাল ছাড়তে নারাজ। ডিসচার্জ করা থেকে বেলকে আরও কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব? তাহলে আমি বাড়তি কিছু সময় পেয়ে নিচে গিয়ে দেখতে পারতাম হাইড্রোলিক্সের কোথায় জ্যাম হয়েছে। শিল্ডের সমস্যাটা দূর করা যেত।

স্থির হয়ে থাকা ব্লাস্ট শিন্ডের দিকে তাকিয়ে আছেন বৃদ্ধ ব্যালড্রিক। ওটার ওপর দিয়ে নীল আলো দেখা যাচ্ছে। বৃদ্ধের চেহারায় আতঙ্ক। একটা উপায় আছে, কিন্তু… কিন্তু…

কিন্তু কী?

কাউকে ভেতরে ঢুকতে হবে। হাতে থাকা লাঠিটাকে কাঁপতে কাঁপতে ব্লাস্ট চেম্বার দেখালেন বৃদ্ধ। সেইসাথে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলেন তিনি নিজে ভেতরে ঢুকতে নারাজ।

দরজা খোলার পর একটা কণ্ঠ ভেসে এলো। আমি যাব।

পিস্তল হাতে নিয়ে পাই করে ঘুরল গ্রে ও মারশিয়া।

রুমে সুন্দর এক দৃশ্যের অবতারণা হলো। প্রথমে মনককে দেখা গেল। কালো চুলের অধিকারিণী এক নারীকে সাহায্য করছে সে। কণ্ঠটা এই নারীর। ওদের দুজনের সাথে আরও কয়েকজনকে দেখা গেল, অধিকাংশই অপরিচিত। একজন বয়স্ক ব্যক্তি ক্লিন সেইভ করা এক মিলিটারি ধাচের ব্যক্তির কাঁধে ভর দিয়ে ঢুকলেন। তাদের পেছন পেছন ফিওনা ও একজন লম্বা দেহের অধিকারিণী নারী মূর্তির উদয় হলো। নারীকে দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র ম্যারাথন দৌড় শেষ করে এসেছেন। ওরা দুজন একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোককে সাহায্য করছে। এতক্ষণ লোকটি ওদের কাঁধের ওপর ভর দিয়ে মাথা নিচু করে থাকলেও কিন্তু এখন ধীরে ধীরে মাথা তুলে গ্রের সেই চিরচেনা নীল চোখ দেখতে পেল।

গ্রে… বিড়বিড় করে বলল সে।

 গ্রে রীতিমতো ধাক্কা খেয়েছে। ডিরেক্টর ক্রো? দ্রুত এগোলো ডিরেক্টরের দিকে।

হাতে সময় নেই, বললেন কালো চুল। মনকের সহায়তায় তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তবে তাঁর অবস্থা পেইন্টারের চেয়ে ভাল। পরিচিত দৃষ্টিতে শিল্ড আর বেল দেখলেন তিনি। ভেতরে ঢোকার জন্য আমাকে সাহায্য করুন। আর উনাকেও আমার সাথে যেতে হবে। একটা কাঁপা হাত তুলে ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গকে দেখালেন তিনি।

 গুঙিয়ে উঠলেন বৃদ্ধ। না…

ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন নারী। আপনি খুব ভাল করেই জানেন ভেতরে কাজ করার জন্য দুই জোড়া হাত প্রয়োজন।

কালো ব্যক্তির দিকে ফিরল মনক। মশি, আপনি অ্যানাকে নিয়ে ভেতরে যান। তারপর গ্রের দিকে ফিরল ও, আন্তরিকতার সাথে শক্ত করে হাত মিলাল। আরও ঘনিষ্ঠ হলো একে অপরের সাথে বুক মিলিয়ে।

 আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই, মনকের কানে কানে বলল গ্রে। মনককে দেখে ও নতুন করে আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছে।

যা করতে হবে জানিয়ো। একটা রেডিও বের করে গ্রের হাতে দিলো ও। যন্ত্রটা চলতে থাকুক। বাকিটা আমি দেখছি।

রেডিওটা হাতে নিয়ে সামনে এগোল গ্রে। ওর মনে হাজারটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু উত্তরগুলো পেতে হলে অপেক্ষা করতে হবে। রেডিও চ্যানেল খোলা রাখল ও। বিভিন্ন শব্দ, কণ্ঠ, তর্কাতর্কি আর চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পেল। পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে ওর দিকে। পেছন ঘুরল ও। ফিওনা।

আমিও তোমার সাথে যাব! দ্রুত এগোতে এগোতে চিৎকার করল বেচারি।

সিঁড়ি ধরে গ্রে নামতে শুরু করেছে।

একটা ট্রান্সমিটার বের করে ওটার অ্যান্টিনা বড় করল ফিওনা। যদি ওই = দানবগুলোর ভেতর দিয়ে তোমাকে এগোতে হয়…

নিজের কাছেই রাখো ওটা।

চুপ করো, তুমি!

বাকি পথটুকু ওরা দুজন একসাথে দৌড়াল। নিচের লেভেলের হলওয়েতে পৌঁছে ইউটিলিটি রুমের সামনে গেল ওরা।

মনক রেডিওতে কথা বলছে। অ্যানা আর বুড়ো শয়তানটা চেম্বারের ভেতরে ঢুকেছে। বুড়োটা বেজায় খোশ।

মনক… রসিকতা বাদ দিয়ে সহকর্মীকে কাজের কথা বলার জন্য তাগাদা দিলো গ্রে।

 আমি অ্যানাকে রেডিওটা দিয়ে দিচ্ছি। তিনি তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবেন। আর হ্যাঁ, তোমার হাতে সবমিলিয়ে আছে মাত্র ১ মিনিট।

মাথা নেড়ে গ্রে ইউটিলিটি রুমে দরজা ধাক্কা দিলো।

লকড।

ওকে আবার চেষ্টা করতে দেখে ফিওনা বলল, কি-কার্ড নেই?

ভ্রু কুঁচকানো গ্রে। ওয়েস্টব্যান্ড থেকে পিস্তল বের করে তালা বরাবর ফায়ার করল। পুরো হল কেঁপে উঠল গুলির শব্দে। যেখানে এতক্ষণ তালাটা ছিল ওখানে এখন একটা গর্ত দেখা যাচ্ছে। ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল গ্রে।

ওর পিছু পিছু ফিওনাও ঢুকল। আমিও তাই ভাবছিলাম, কি-কার্ড না থাকলে পিস্তল দিয়েও কাজ চালানো যায়।

সামনে এগোতেই মোটর আর উপরে-নিচে ওঠানামা করার পিস্টন দেখতে পেল গ্রে। এই পিস্টনগুলোর সাহায্যেই ব্লাস্ট শিল্ড ওঠানো কিংবা নামানো হয়।

রেডিওতে একধরনের অদ্ভুত গুঞ্জন ভেসে এলো। গ্রে বুঝতে পারল বেল-এর কারণে হচ্ছে সেটা। মনক নিশ্চয়ই আমার কাছে রেডিও দিয়ে ফেলেছে।

ওর ধারণাকে সত্য প্রমাণ করতেই যেন গুঞ্জনের ভেতরে একটা নারী কণ্ঠ ভেসে এলো। জার্মান আর ডাচ ভাষায় কারিগরি বিভিন্ন দিক দিয়ে তর্ক হচ্ছে। রেডিওর ভলিউম বাড়িয়ে টিউন করল গ্রে। মোটরগুলোর কাছে চলে এসেছে ও। এমন সময় পরিষ্কার ইংরেজিতে নারী কণ্ঠ ভেসে এলো রেডিওতে।

কমান্ডার পিয়ার্স?

 গলা পরিষ্কার করল গ্রে। বলুন…

তার গলায় ক্লান্তি। আপাতত হাত ব্যবহার করে আমরা কোনোমতে কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু এটা তো বেশিক্ষণ টিকবে না।

শক্ত করে ধরে থাকুন।

ইতোমধ্যে সমস্যাটা কোথায় হয়েছে সেটা খুঁজে পেয়েছে গ্রে। একটা পিস্টনের ফিউজ থেকে ধোয়া বেরোচ্ছে। গ্রে শার্টের এক অংশ দিয়ে ধরে ফিউজটাকে বের করল। ফিওনাকে বলল, আরেকটা ফিউজ লাগবে। এখানে কোথাও অতিরিক্ত ফিউজ থাকার কথা।

কমান্ডার, তাড়াতাড়ি করুন।

রেডিওর গুঞ্জন আরও বাড়তে শুরু করলেও ব্যালড্রিকের কণ্ঠ ঠিকই শোনা গেল এপাশ থেকে জরুরি ভিত্তিতে অ্যানার সাথে কথা বলছেন তিনি। … আমাদের সাথে যোগ দাও। আমরা দক্ষ লোকবল ব্যবহার করে আরেকটা বেল তৈরি করতে পারব।

ভয়ে সিঁটিয়ে থাকার পরও বুড়ো ভাম কূটচাল দিয়েই চলেছে।

ভাল করে কান পাতল গ্রে। অ্যানা কী ওদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে? ফিওনার দিকে ফিরল ও, ট্রান্সমিটারটা দাও তো।

ফিওনা ট্রান্সমিটার দিলো। ট্রান্সমিটার থেকে অ্যান্টিনা খুলে ফেলল গ্রে। বাড়তি ফিউজ খুঁজে বের করার মতো যথেষ্ট সময় নেই। যা করার দ্রুত করতে হবে। অ্যান্টিনা দিয়ে সংযোগ ঘটিয়ে দিলো। ফিউজ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল, অ্যান্টিনা দিয়ে আপাতত সমস্যার সমাধান হলো। বিদ্যুৎ সংযোগ পুনরায় জুড়তেই উপরে-নিচে উঠতে শুরু করল পিস্টন।

রকেট সাইন্স নয়, স্রেফ উপস্থিত বুদ্ধি খাঁটিয়ে সমস্যার সমাধান করল গ্রে।

অ্যানা, আপনি ও ব্যালড্রিক ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। গ্রে রেডিওতে বলল।

সম্ভব না, কমান্ডার। আমাদের যে-কোন একজনকে আঙুল রাখতে হবে নালায়। নালা থেকে আঙুল সরানো মাত্র বেল বিস্ফোরিত হবে।

চোখ বন্ধ করল গ্রে। কোনভাবেই ব্যালড্রিকের ওপর ভরসা করা যাবে না।

গুঞ্জন বেড়েই চলছে। কানের সহ্য ক্ষমতা ছাড়িয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

কমান্ডার, আপনি জানেন আপনাকে এখন কী করতে হবে।

 অ্যানার কথা মতো কাজ করল গ্রে।

আবছাভাবে অ্যানার শেষ কয়েকটি কথা ভেসে এলো। আমার ভাইটাকে বলবেন… তাকে আমি ভালবাসি।

রেডিও নামাতে নামাতে আরও একটা কথা বললেন অ্যানা। কথাটা ব্যালড্রিকের প্রস্তাবের জবাব হতে পারে কিংবা পৃথিবীর উদ্দেশে কোনো বার্তা বা স্রেফ নিজের সষ্টির জন্য।

আমি নাৎসি নই।

.

বিকাল ৩টা ১৯ মিনিট।

পেইন্টারকে নিয়ে মেঝেতে বসে আছে লিসা। হঠাৎ ও মেঝেতে ভারি মেশিনের কম্পন টের পেল। সেইসাথে ওর সামনে থাকা শিন্ড উঠতে শুরু করল ওপর দিকে। নীল আলো ধীরে ধীরে শিল্ডের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।

 বসা থেকে উঠতে যাচ্ছিল লিসা। অ্যানা এখনও ভেতরে রয়েছেন। এমনকি মনকও পা বাড়িয়েছে শিল্ডের দিকে।

 শিন্ডের ভেতর থেকে তীব্র আর্তনাদ ভেসে এলো।

বুড়ো ব্যালড্রিক। লিসা দেখল বুড়োর কয়েকটা আঙুল উন্মাদের মতো শিল্ডের দেয়াল আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। এখন আর তার পক্ষে শিল্ডের দেয়াল টপকে এপাশে আসা সম্ভব নয়। শিল্ডের দেয়াল উঠতে উঠতে সিলিঙে থাকা বৃত্তাকার অংশে মসৃণভাবে লেগে গেল।

ব্যালড্রিকের চিৎকার এখনও শোনা যাচ্ছে। উন্মাদের মতো চিৎকার করছেন তিনি।

হঠাৎ লিসা একটা শক্তির প্রভাব অনুভব করল। অনুভূতিটা কীরকম সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। একটা ঝাঁকুনি… তারপর সব চুপ। নিশুতি সুনসান হয়ে গেল সব।

গুঙিয়ে উঠল পেইন্টার। ওর মাথা লিসার কোলে রাখা। ওকে পরীক্ষা করল লিসা। পেইন্টার চোখ দুটো উল্টে ভেতরে ঢুকে গেছে। শ্বাস-প্রশ্বাস একদম অস্বাভাবিক। লিসা ওকে ঝাঁকুনি দিলো। কিন্তু কোনো সাড়া নেই। হারিয়ে যাচ্ছে পেইন্টার।

মনক…!

.

বিকাল ৩টা ২৩ মিনিট।

গ্রে, তাড়াতাড়ি! রেডিওতে বলল মনক।

ফিওনার পিছু পিছু গ্রে পা চালালো। নিচে ফিউজের বিকল্প খুঁজতে গিয়ে ওর বেশ দেরি হয়ে গেছে। মনক কেন এত তাগাদা দিচ্ছে তার কারণ পুরোটা না জানলেও আন্দাজ করতে পারছে গ্রে। পেইন্টার ক্রো রেডিয়েশনে আক্রান্ত আর তাকে সারিয়ে তোলার একমাত্র উপায় এই বেল।

ছয় তলার ল্যান্ডিঙের কাছাকাছি আসতেই পা ফেলার ভারি আওয়াজ ভেসে এলো। কিছুটা টলতে টলতে এগিয়ে আসছে কেউ। পিস্তল বের করল গ্রে। এবার?

বিশালদেহি এক ব্যক্তি হাজির হলো। তার শার্ট রক্তে ভিজে গেছে। সিঁড়ির ওপর প্রায় বসে পড়ল আগন্তক। মুখের এক পাশ থেকে গলা পর্যন্ত চিড়ে গেছে তার। একটা ভাঙ্গা কব্জি পেটের কাছে ধরে রেখেছে।

পিস্তল উঁচু করল গ্রে।

ফিওনা ওর পাশ কাটিয়ে সামনে এলো। না। ইনি তো আমাদের পক্ষে। নিচুস্বরে গ্রেকে বলল, অ্যানার ভাই।

 বিশালদেহি চোখ তুলে তাকাল। ফিওনাকে চিনতে পেরেছে। ক্লান্ত থাকার পরও চোখ সরু করে সন্দেহ নিয়ে গ্রের দিকে তাকাল বেচারা। কিন্তু রাইফেল উঁচিয়ে সিঁড়ির পেছনের অংশ দেখাল সে। ঘোতঘোত করে বলল, Blockiert.

তার মানে এই বিশালদেহি ব্যক্তি নিজের রক্তের বিনিময়ে ওদের জন্য বাড়তি সময়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

ওরা তিনজন বেল চেম্বারের দিকে এগোলো। গ্রে জানে গানথারকে ওর বোন সম্পর্কে জানিয়ে রাখা ভাল। নইলে বেচারা খুব ধাক্কা খাবে। অ্যানা ওদের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন তার শেষ কথাগুলো গানথারকে জানিয়ে দেয়া গ্রের দায়িত্ব। গানপারের কনুই স্পর্শ করল গ্রে।

অ্যানা…

গানথার ওর দিকে ঘুরল। ওর চোখে-মুখে বেদনার ছাপ স্পষ্ট। আন্দাজ করে নিয়েছে খারাপ কিছু হয়েছে হয়তো।

কঠিন কথাটা কীভাবে সহজভাবে জানাবে ভেবে পেল না গ্রে। অবশেষে সরাসরি জানিয়ে দিলো, তার চেষ্টার কারণে বাকি সবাই বেঁচে গেছে।

কথাটুকু শুনতে শুনতে গানধারের চলার গতি কমে গেল। রক্তক্ষরণ আর ক্লান্তি ওকে ধীর করতে পারেনি যতটা বোনের মৃত্যু সংবাদ করতে পেরেছে। ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ও।

গ্রেও থামল। তার শেষ কথাগুলো আপনার উদ্দেশে বলা। তিনি আপনাকে ভালবাসেন।

গানথার নিজের মুখ ঢেকে মেঝেতে শুয়ে পড়ল।

আমি দুঃখিত…সমবেদনা জানাল গ্রে।

দরজার সামনে মনক হাজির। গ্রে, এত সময় ধরে কী করছ? কোথায় ছিলে?… কিন্তু শোকে কাতর গানথারকে দেখে থামল ও। আর কিছু বলল না।

গ্রে মনকের দিকে পা বাড়াল।

ওদের কাজ এখনও শেষ হয়নি।

.

বিকাল ৩ টা ২২ মিনিট।

শিল্ড নিচে নামান!

 লিসা দেখল কমান্ডার পিয়ার্স ও মনক একসাথে চেম্বারে প্রবেশ করছে। মাথা নিচু করে রেখেছে দুজন। লিসা এখন বেল-এর কন্ট্রোল প্যানেলের ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিগত কয়েক মিনিট ধরে এখানে দাঁড়িয়ে বেল কীভাবে পরিচালনা করতে হবে সেটা জানার চেষ্টা করেছে ও। ওদের পক্ষে থাকা লোকদের মধ্যে একমাত্র অ্যানা বেল সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখতেন। আপদকালীন সময়ে কাজে লাগতে পেরে ভেবে লিসাকে কিছু টিপস দিয়ে গেছেন তিনি। তবে লিসার ভয় ছিল ও হয়তো তালগোল পাকিয়ে ফেলবে। যা-ই হোক, অ্যানার কাছ থেকে শেখা বিদ্যা লিসা এখন কাজে লাগাচ্ছে।

শিল্ড! মনকের পাশ থেকে আবার হাক ছাড়ল গ্রে।

মাথা নেড়ে লিসা সুইচ চাপল।

গুঞ্জন হলো মোটরে। কন্ট্রোল প্যানেল থেকে ঘুরে তাকাল লিসা। ব্লাস্ট শিল্ড নামছে। বেল এখন শান্ত, তাই কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। সিসার পাশেই একটা তেরপলের ওপর শুয়ে আছে পেইন্টার। ওর পাশে রয়েছেন ড. মারশিয়া। মশি আর মেজর রয়েছেন ডান দিকে। যমজ ভাইবোনের মৃতদেহ দুটোকে তেরপল দিয়ে ঢেকে দিচ্ছেন।

ওদের দাদুর কী খবর? ব্যালড্রিক?

শিল্ড আরও নিচে নামছে। কোমড় সমান হয়েছে এখন। চেম্বারের ঠিক মাঝখানে বেল চুপচাপ বসে আছে, আবার চালু হওয়ার অপেক্ষায় আছে ওটা। অ্যানার মুখে বেল সম্পর্কে যা শুনেছিল সেটা মনে পড়ে গেল লিসার। পরম কোয়ান্টাম পরিমাপক যন্ত্র। ভয়াবহ জিনিস। লিসা এই যন্ত্রটাকে খুব ভয় পায়।

বাঁ পাশে রয়েছে মনক। খামিশির কাছ থেকে রেডিও মেসেজ নিচ্ছে সে। জুলু যোদ্ধারা এস্টেটের দখল নিয়ে নিয়েছে। এর বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ওয়ালেনবার্গ গার্ডদেরকে তাড়িয়ে এনে ভবনে জড়ো করছে ওরা। সামনে আরেকটা বন্দুকযুদ্ধ হবে, নিশ্চিত।

জরুরি সিঁড়ির অংশটুকু গানথার নিজে আটকে দিয়ে এসেছে, বলল গ্রে। আর খোলা রেখে জ্যাম করে দেয়া হয়েছে লিফটের দরজাগুলো। এর ফলে আমাদের হাতে বেশকিছু সময় থাকবে। মশি ও মেজরের দিকে ফিরল ও। এখন শুধু বাইরের হলের দিকে নজর রাখুন। তাতেই হবে।

মশি আর মেজর অস্ত্র নিয়ে সেদিকে এগোলো।

ওরা দুজন বেরিয়ে যাওয়ার পর গানথার ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করল। ওর চেহারা দেখেই লিসা বুঝতে পারল বোনের খবরটা বেচারা ইতোমধ্যে জানতে পেরেছে। নিজের শরীরে থাকা অস্ত্রগুলো এক এক করে খুলে মেঝেতে ফেলল গানথার। নিচু হতে থাকা শিল্ডের দিকে এগোচ্ছে। বোনের কী অবস্থা দেখতে চায়।

নামতে নামতে শিল্ড থেমে গেল। মোটরের গুঞ্জনও নেই। ভেতরে কী অবস্থা হয়েছে সেটা দেখার কথা ভাবতে গিয়ে ভয় হলো লিসার। কিন্তু ওকে তো দেখতেই হবে। কারণ বিষয়টা ওর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

বেল-এর দিকে এগোলো ও।

 ডিভাইসের ছায়ার আড়ালে একপাশে আনার দেহ পড়ে রয়েছে। ছোট বাচ্চার মতো কুঁকড়ে রয়েছেন তিনি। তার চামড়া ছাইয়ের মতো সাদাটে আর কালো চুলগুলো বরফ-সাদা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে তিনি যেন এক মার্বেলের মূর্তি। শিল্ড পেরিয়ে বোনের কাছে গেল গানথার। হাটু গেড়ে বসল। কোনো কথা না বলে চুপচাপ মৃত বোনকে কোলে তুলে নিলো বেচারা।

বোনকে কোলে নিয়ে বেল-এর দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল গানথার, রওনা হয়ে গেল বাইরের দিকে।

কেউ ওকে থামানোর চেষ্টা করল না।

দরজার বাইরে গানথার অদৃশ্য হয়ে গেল।

ব্লাস্ট চেম্বারের ভেতরে থাকা আরেকটা লাশের দিকে তাকাল লিসা। ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গ। অ্যানার মতো এর চামড়ারও অস্বাভাবিক রকম সাদা হয়ে গেছে। রেডিয়েশনের প্রভাবে তার মাথায় কোনো চুল নেই। এমনকি চোখের ভ্রু, চোখের পাতা সেগুলোও গায়েব। শরীরের মাংসগুলো লেপ্টে গেছে হাঁড়ের সাথে। অনেকটা মমির মতো লাগছে। তার অস্থিগত গঠনে কিছু একটা হয়েছে…

ভয়ে লিসা আর সামনে এগোতে পারছে না।

মাথায় কোনো চুল না থাকায় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে খুলির আকৃতি আর স্বাভাবিক নেই। ওটার কিছু অংশ গলে গিয়ে আবার জমাট বেধে গেছে। হাত মুচড়ে গেছে ব্যালড্রিকের। আঙুলগুলো অদ্ভুত দেখাচ্ছে, অনেকটা গরিলাদের মতো। বিকেন্দ্রীকরণের কথা মনে পড়ল লিসার।

 ওকে বের করতে হবে, বিরক্তি নিয়ে বলল গ্রে। তারপর লিসার দিক তাকাল। পেইন্টারকে ভেতরে নিতে আমি আপনাকে সাহায্য করব।

ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে লিসা পিছু হটল। আমরা পারব না… ওয়ালেনবার্গের মরহুম সর্বেসর্বা ব্যালড্রিক সাহেবের ভয়াবহ পরিণতির ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না লিসা। ও চায় না পেইন্টারেরও এইরকম ভয়াবহ অবস্থা হোক।

লিসার কাছে এলো গ্রে। আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?

 লিসা ঢোঁক গিলল। দেখল মনক ব্যালড্রিকের মৃত দেহ সরাচ্ছে কিন্তু দেহের গায়ে স্পর্শ করছে না। শার্টের হাত ধরে টানছে সে। ব্যালড্রিকের শরীরের সাথে সরাসরি স্পর্শ করতেও ভয় পাচ্ছে মনক। পেইন্টার অনেক দূরে চলে গেছে। বেল-এর মাধ্যমে আমরা স্রেফ এই বিকেন্দ্রীকরণকে ঠেকিয়ে রাখা কিংবা গতি কমিয়ে রাখতে পারতাম। কিন্তু পুরোপুরি উল্টো ফলাফল তো আনা সম্ভব নয়। আপনি কী চান আপনাদের ডিরেক্টর এখনই মারা যাকঃ

 যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। আমরা হাল ছাড়তে রাজি নই। নরম সুরে বলল গ্রে।

এরকম মিথ্যা আশার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে গেল লিসা।

 কিন্তু ব্যালড্রিকের ওপর ওর চোখ পড়ল। ধপ করে দুচোখ খুলল বুড়ো ওয়ালেনবার্গ। তার দুটো চোখ এখন দুধের মতো সাদা। ওগুলোকে পাথরের মতো স্থবির দেখাচ্ছে। মুখ হাঁ করে চিৎকার করতে চাইলেন ব্যালড্রিক কিন্তু তার কণ্ঠস্বর নষ্ট হয়ে গেছে। জিহ্বাও নেই। ভয় আর যন্ত্রণা ছাড়া তার ভেতরে আর কিছুই নেই এখন।

বুড়োর এই দশা দেখে চিৎকার করে উঠল লিসা। পেছাতে পেছাতে একেবারে কন্ট্রোল প্যানেলের সাথে গিয়ে ধাক্কা খেল। এতক্ষণে মনকের চোখেও পড়েছে বিষয়টা। ব্যালড্রিককে ব্লাস্ট চেম্বারের বাইরে ফেলে দূরত্ব বাড়াল সে।

পড়ে রইল বুড়ো ওয়ালেনবার্গ। তার পুরো শরীর নিশ্চল হলেও মুখটা বারবার খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। ভাঙায় ভোলা মাছ যেরকম পানির জন্য খাবি খায় অনেকটা সেরকম অবস্থা। দুটো অন্ধ চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছেন ব্যালড্রিক।

 ব্যালড্রিক আর লিসার মাঝে এসে গ্রে দাঁড়াল। লিসার কাধ ধরল গ্রে। ড. কামিংস, ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকাল লিসা। ডিরেক্টর ক্রোর আপনার সাহায্য প্রয়োজন।

আমার করার মতো কিছুই… নেই।

আছে, অবশ্যই আছে। আমরা বেলকে ব্যবহার করতে পারি।

না, আমি পারব না। লিসার গলা চড়ে গেল। পেইন্টারকে আমি ওটা করতে পারব না।

 আপনি যেমনটা ভাবছেন ওরকম হবে না। মনক বলল অ্যানা নাকি আপনাকে বেল পরিচালনা করা শিখিয়ে গেছেন। আপনি বেলকে একদম সর্বনিম্ন আউটপুটে সেট করবেন। যাতে ওখান থেকে প্রশমনকারী রেডিয়েশন বের হয়। একটু আগে এখানে যেটা হলো সেটা ভিন্ন বিষয়। কারণ ব্যালড্রিক বেলকে সর্বোচ্চতে সেট করেছিল যাতে সবাইকে খুন করতে পারে। তারপর তার অবস্থা কী হলো… যেমন কর্ম তেমন ফল।

দুহাতে মুখ ঢাকল লিসা। কিন্তু আমরা কী ফল পেতে চাচ্ছি? গুঙিয়ে উঠল বেচারি। পেইন্টার ওর জীবনের একদম শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওকে কেন আরও বেশি কষ্ট দেব?

গ্রে ওর হাত দুটো টেনে নিচে নামাল। লিসার চোখে চোখ রেখে বলল, আমি ডিরেক্টর ক্রোকে চিনি আর আপনিও তো চেনেন। শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার মতো ক্ষমতা ওনার আছে।

 মেডিক্যাল ডাক্তার হওয়ার সুবাদে এরকম তর্ক লিসার কাছে নতুন নয়। কিন্তু ও নিজে একজন বাস্তববাদী মানুষ। তাই যেখানে আশা নেই সেখানে একজন ডাক্তার যেটা করতে পারে সেটা হলো রোগীর জন্য শান্তির ব্যবস্থা করা।

যদি ওকে সারিয়ে তোলার কোনো সুযোগ থাকতো, মাথা নাড়তে নাড়তে বলল লিসা। যদি একটা ছোট্ট সুযোগও থাকতত আমি সেটা নিতাম। হিউগো সাহেব তার মেয়েকে ওই কোডগুলো দিয়ে কী বলতে চেয়েছিলেন সেটা যদি জানতে পারতাম। কোডটা যদি ভাঙা সম্ভব হতো… আবার মাথা নাড়ল ও।

আঙুল দিয়ে লিসার চিবুক স্পর্শ করল গ্রে। সরে যেতে চাইল লিসা, অস্বস্তিবোধ করছে। কিন্তু গ্রে শক্ত করে ধরে রইল।

আমি জানি, হিউগো ওই কোডের মধ্যে কী লুকিয়ে রেখেছেন।

ভ্রু কুঁচকে গ্রের দিকে তাকাল লিসা। কিন্তু গ্রের চোখে সততা দেখতে পেল ও।

আমি উত্তরটা জানি। বলল গ্রে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *