১১. ডিমন ইন দ্য মেশিন

তৃতীয় খণ্ড

১১. ডিমন ইন দ্য মেশিন

রাত ১২ টা ৩৩ মিনিট।
 উড়োজাহাজে, ভারত মহাসাগরের উপরে।

ওয়াশিংটনে বসে আমি আর ক্যাপ্টেন ব্রায়ান্ট ওয়ালেনবার্গদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ অনুসন্ধান করে দেখব, ফোনে জানালেন লোগান গ্রেগরি।

মাইক্রোফোন সংযুক্ত ইয়ারপিস রয়েছে পেইন্টারের কানে। হাত দুটো ব্যস্ত থাকায় ইয়ারপিসের সাহায্য নিতে হচ্ছে ওকে। একগাদা কাগজ ফ্যাক্স করে পাঠিয়েছে লোগান। ওয়ালেনবার্গদের পারিবারিক ইতিহাস, অর্থ সংক্রান্ত রিপোর্ট, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এমনকি গুজবও বাদ যায়নি।

কাগজের স্তূপের একদম ওপরে একটা ছবি আছে। ওতে দেখা যাচ্ছে একজন পুরুষ ও আরেকজন নারী লিমুজিন থেকে বেরোচ্ছে। হোটলের স্যুট থেকে এই ছবি তুলেছে গ্লে পিয়ার্স। নিলাম অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগের ছবি এটা। ওখানে স্থাপিত অন্যান্য ক্যামেরা থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে চিহ্নট্যাটুটি ওয়ালেনবার্গ পরিবারের সাথে জড়িত। ছবিতে যে দুজনকে দেখা যাচ্ছে এরা সম্পর্কে ভাই-বোন, যমজ। ইসাক ওয়ালেনবার্গ ও ইসকি ওয়ালেনবার্গ। ওয়ালেনবার্গ বংশের সবকনিষ্ঠ বংশধর। এই পরিবারের সম্পদের পরিমাণ এতই বেশি যে অনেক দেশের সারা বছরের আয়ের সাথে টক্কর দেয়ার মতো ক্ষমতা রাখে।

তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পেইন্টার সাদা চুলের বিষয়টা খেয়াল করেছে। এরা সাধারণ যমজ ভাই-বোন নয়। এরা গানথারের মতো sonnekonige, ক্যাসলে আক্রমণকারী সেই মহিলাও এই দলের অন্তর্গত।

সামনে থাকা কেবিনের দিকে তাকাল পেইন্টার।

গানথার সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। সোফার এপাশ দিয়ে পা বের হয়ে আছে। ওর বোন অ্যানা কাছেই একটা চেয়ারে বসে পেইন্টারের মতো একগাদা কাগজে চোখ বুলাচ্ছেন। এদের দুজনের পাহারায় রয়েছে মেজর ব্রুকস ও একজোড়া অস্ত্রধারী ইউ.এস রেঞ্জার। দাবার ছক উল্টে গেছে এখন। বন্দীকর্তারা এখন বন্দী। তবে পরস্পরের এই অবস্থান বদল ছাড়া আর কিছুই তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। যোগাযোগ দক্ষতা আর সামরিক সহযোগিতার জন্য পেইন্টারকে প্রয়োজন অ্যানার। অন্যদিকে বেল সম্পর্কিত তথ্য ও বিজ্ঞানের জন্য অ্যানাকে প্রয়োজন পেইন্টারের। এব্যাপারে অ্যানা অগেই বলে রেখেছেন, এসব ঝামেলা চুকে গেলে আমরা বৈধতা ও দায়িত্বগুলো নিয়ে আলোচনায় বসব।

পেইন্টারের ভাবনায় লোগান ছেদ ঘটালেন। সাউথ আফ্রিকার অ্যাম্বাসিতে আমার আর ক্যাটের জন্য সকালের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট রেখেছি। দেখি তারা আমাদেরকে নিঃসঙ্গ ওয়ালেনবার্গ পরিবারের ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে কি-না।

 ওয়ালেনবার্গ পরিবার সত্যি নিঃসঙ্গ ধাচের। সাউথ আফ্রিকার রাজা বলা যায় এদের। প্রচুর সম্পত্তির মালিক, নির্মম, বিশাল এস্টেট…এরা নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখে। মেইন এস্টেট ছেড়ে খুব একটা বাইরে বেরই হয় না।

ডিজিটাল ফটোটা হাতে নিল পেইন্টার ক্রো।

একটা Sonnekonige পরিবার।

হাতে খুব একটা সময় নেই। সে-হিসেবে বলা যায় দ্বিতীয় বেল এদের কাছেই। আছে। এস্টেটের কোথাও আছে সেটা।

 আপনারা জোহানসবার্গ নামার পরপরই একজন ব্রিটিশ অপারেটিভ আপনাদের সাথে দেখা করতে আসবে। M5 গত এক বছর ধরে ওয়ালেনবার্গদের ওপর নজর রেখে আসছে। অর্থ লেনদেনের ওপর চোখ রেখেছে ওরা… কিন্তু পরিবারটা এতই গোপনীয়তা রক্ষা করে চলে… ওরা খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি।

অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই দেশে ওয়ালেনবার্গদের ক্ষমতা অনেক। বলা যায় ওয়ালেনবার্গদেরই দেশ এটা, ভাবল ক্রো।

MIS আমাদেরকে গ্রাউন্ড সাপোর্ট আর স্থানীয় লোকবল দিয়ে সাহায্য করবে বলে প্রস্তাব দিয়েছে, বললেন লোগান। তিন ঘণ্টার মধ্যে আপনারা ল্যান্ড করবেন। এরমধ্যে আমি বিস্তারিত তথ্য যোগাড় করছি।

ঠিক আছে। ছবির দিকে তাকিয়ে বলল ক্রো। গ্রে আর মনকের কী খবর?

ওদের কোনো খবর নেই। এয়ারপোর্টের ফ্রাঙ্কফার্টে ওদের গাড়ি পার্ক অবস্থায় পাওয়া গেছে কিন্তু ওদের কোনো হদিস নেই।

ফ্রাঙ্কফার্ট? এটা কোনো কথা হলো। ওখানে আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনগুলো বেশ সহজলভ্য কিন্তু গ্রেকে তো সরকারি জেটে ওঠার লাইসেন্স দেয়া আছে। যেকোন কর্মাশিয়াল এয়ারলাইন্সের চেয়ে জেটে দ্রুত ভ্রমণ করা যায়। ওদের কাছ থেকে কোনো খবর পাওনি?

না, স্যার। আমরা সব চ্যানেলে কান রেখেছি।

এটা কোনো ভাল খবর হতে পারে না।

মাথাব্যথা আবার চেপে ধরল ক্রোকে। অন্ধকার আকাশে ড্রোন উড়ানোর অবস্থা হয়েছে ওর। গ্নের কী হয়েছে? অপশন মাত্র কয়েকটা :

(১) লুকিয়ে আছে,

(২) কারও হাতে ধরা পড়েছে,

(৩) খুন হয়ে গেছে।

কিন্তু কোনটা ঘটেছে গ্রের সাথে?

সব জায়গায় খুঁজে দেখ, লোগান।

কাজ চলছে, স্যার। আপনারা জোহানসবার্গ নামতে নামতে হয়তো এই ব্যাপারেও তথ্য হাতে চলে আসতে পারে।

আচ্ছা, লোগান, তুমি কী কখনও ঘুমাও?

ঘুমাই, স্যার। এক কোণায় গিয়ে। যখন ঘুম ধরে হাতের কাছে যে কোণা পাই সেখানেই ঘুমাই। লোগানের কণ্ঠে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। আপনার কী খবর, স্যার?

নেপালের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ঝামেলা চুকিয়ে সবকিছু গুছিয়ে প্লেনে ওঠার আগে কাঠমাণ্ডুতে অনেকক্ষণ দেরি করতে হয়েছিল। তখন জব্বর একচোট ঘুমিয়ে নিয়েছে ক্রো।

আমি বেশ ভাল আছি, লোগান। চিন্তার কিছু নেই।

কথা সত্য।

লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর ক্রো মনের অজান্তেই ওর চতুর্থ আঙুলের নখ সরে গিয়ে বের হয়ে আসা মাংসের ওপর হাত বুলালো। ওর হাতের আঙুলগুলো শির শির করছিল… এখন আবার পায়ের আঙুলেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। লোগান একবার ওকে বুঝিয়ে ওয়াশিংটন চলে আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন। জন হপকিন্সে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো যেত। কিন্তু পেইন্টার ক্রোর ভরসা অ্যানার ওপর। এই বিশেষ অসুখের বিশেষ চিকিৎসা বেল-এর মাধ্যমে করাতে হবে। অসুখের গতি কমানোর জন্য সচল বেল দরকার ওদের। অ্যানার ভাষ্যমতে, বেল-এর অধীনে যথাযথ রেডিয়েশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করালে কয়েক বছর সময় পাওয়া যেতে পারে। আর এভাবে চিকিৎসার কোর্স কমপ্লিট করালে এই অসুখ থেকে সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। এব্যাপারে অ্যানা বেশ আশাবাদী।

কিন্তু সবার আগে ওদের আরেকটা বেল প্রয়োজন।

.. সেইসাথে আরও অনেক তথ্য লাগবে।

ওর কাঁধের পেছন থেকে একজনের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। আমার মনে হয়, অ্যানার সাথে কথা বলা উচিত। পেইন্টারের মনের অবস্থা পড়ার চেষ্টা করতে করতে বলল লিসা।

ওর দিকে ঘুরল ক্রো, ভেবেছিল লিসা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু লিসা ঘুমায়নি। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে এসেছে। ক্রোর সিটের পাশে এসে বসল ও। পরনে খাকি সেলোয়ার আর ক্রিম রঙের ব্লাউজ।

ক্রোর চেহারার ওপর চোখ বুলাল লিসা। তোমাকে দেখতে বিধ্বস্ত লাগছে।

বেশি ঘুমালে চেহারার হাল এরকমই হয়, উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল ক্রো।

দুলে উঠল প্লেন, অন্ধকার হয়ে গেল। ওর হাত ধরে ফেলল লিসা। পুরো পৃথিবী আবার উজ্জ্বল হয়ে স্বাভাবিক হয়ে গেল। আসলে প্লেন নয়, সব হয়েছে ওর মাথায়।

কথা দাও, ল্যান্ড করার আগে তুমি আরও খানিক সময় ঘুমাবে, পেইন্টারের কনুইয়ে চাপ দিয়ে বলল লিসা।

যদি সময় পাই… আউউউ… উফ!

এবার লিসা অনেক শক্ত করে চাপ দিয়েছে।

ঠিক আছে, ঘুমাবো। কথা দিলাম।

লিসা হাতের জোর কমিয়ে দিলো। অ্যানার দিকে মাথা নেড়ে দেখাল ও। ওয়ালেনবার্গদের একগাদা চালান আর বিল দেখছেন তিনি। বেল চালাতে প্রয়োজন হয় এরকম কিছু ওয়ালেনবার্গরা কিনেছে কি-না সেটা দেখছেন না।

বেল কীভাবে কাজ করে সে-ব্যাপারে আমি আরও বিস্তারিত জানতে চাই, লিসা বলল। এই থিওরির পেছনের মূল তত্ত্বটা কী? অসুখের ফলে যদি কোয়ান্টাম ক্ষয়-ক্ষতি হয় তাহলে কীভাবে এবং কেন হয় সেটা আমাদের জানা উচিত। Granitschlo৪ থেকে একমাত্র সে আর গানথার-ই বেঁচে আছে। আর গানথার বেলের থিওরি সম্পর্কে কতখানি জানে সে-ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার।

 মাথা নাড়ল পেইন্টার। গানথার হলো পাহারাদার কুকুরের মতো। ও বিজ্ঞানের কী বোঝে!

ওর কথাটার সত্যতা প্রমাণ করতে গানথারের ওখান থেকে নাক ডাকার ভারি আওয়াজ ভেসে এলো। বেল সম্পর্কিত তথ্যগুলো অ্যানার মাথায় রয়েছে। যদি তার মন বিগড়ে…।

তার মন বিগড়ে গেলে ওরা সব হারিয়ে ফেলবে।

 সেটা হওয়ার আগেই আমাদেরকে সব কিছু জেনে নিতে হবে।

একমত হলো ক্রো।

লিসার চোখে চোখ পড়ল ওর। লিসা নিজের অভিব্যক্তি লুকোনোর চেষ্টা করল না। ওর চেহারা দেখলেই সব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। কাঠমাণ্ডু থেকে প্লেনে চড়ার সময় ওর চেহারা পেইন্টার খেয়াল করেছিল। ওর চেহারায় কোনোরকম দ্বিধা ছিল না। পেইন্টারের সাথে রওনা হওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ সম্মতি ছিল। বুঝে-শুনেই এসেছে সে। লিসা এখনকার বিষয়টাও ভাল করেই বুঝতে পারছে।

 শুধু অ্যানার মন ও স্মৃতিশক্তি-ই হুমকির মুখে আছে তা নয়, পেইন্টারও ঝুঁকিতে আছে।

পেইন্টারই একমাত্র ব্যক্তি যে এই ঘটনার শুরুর সূত্র থেকে এখন পর্যন্ত টিকে আছে। মেডিক্যাল ও সাইন্টিফিক জ্ঞানও রাখে সে। কিন্তু সেই মনন ও মেধা এখন পাগল হওয়ার হুমকিতে রয়েছে। ক্যাসলে লিসা ও অ্যানা পরস্পরের মধ্যে অনেক কথাবার্তা বলেছে। অ্যানার রিসার্চ লাইব্রেরি ঘেঁটে ঘেঁটে দেখেছে লিসা। কে জানে হয়তো ছোই কোনো জিনিস বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ধরা দেবে। ছোট্ট একটা জিনিসই হয়তো ব্যর্থতা আর সফলতার পার্থক্য করে দিতে পারবে। কাঠমাণ্ডু বিষয়টা লিসা বুঝতে পেরেছিল।

কাঠমাণ্ডুতে ও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

সোজা এসে প্লেনে চেপে বসেছে। ভাবার কিছু নেই।

ক্রোর হাতের কনুই ছেড়ে আঙুল ধরল লিসা। অ্যানাকে দেখিয়ে বলল। চলো তার মাথায় কী আছে সেগুলো বের করি।

.

বেল কীভাবে কাজ করে সেটা বুঝতে হলে আপনাদেরকে প্রথমে কোয়ান্টাম থিওরি বুঝে নিতে হবে। ব্যাখ্যা করলেন অ্যানা।

এই জার্মান মহিলাকে লিসা বেশ করে পর্যবেক্ষণ করল। তার চোখের মণি বড় বড় হয়ে গেছে। ওষুধ একটু বেশিই খাচ্ছেন বোধহয়। আঙুলগুলো কাঁপছে। যক্ষের ধনের মতো দুই হাত দিয়ে চশমা ধরে আছেন তিনি। জেটের পেছনের অংশে চলে এসেছে ওরা। সামনের অংশে পাহারাদারের তত্ত্বাবধানে গানথার ঘুমাচ্ছে।

আমার মনে হয় আমাদের হাতে পিএইচডি করার মতো যথেষ্ট সময় নেই। বলল পেইন্টার।

 তা ঠিক। তবে মাত্র তিনটা মূল বিষয়বস্তু বুঝতে হবে। অবশেষে হাত থেকে চশমা রাখলেন তিনি। প্রথমে আমাদেরকে বুঝতে হবে কোনো পদার্থকে যখন সাবঅ্যাটমিক লেভেলে অর্থাৎ পরমাণুর চেয়ে ক্ষুদ্র অংশে ভাঙ্গা হয় তখন ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন পাওয়া যায়। তারপর থেকে সাধারণত আমরা যেটা জানি সেটা থেকে ভিন্ন কিছু ঘটবে। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক আবিষ্কার করলেন ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন… এরা কণিকা ও তরঙ্গ দুইভাবেই কাজ করে থাকে। বিষয়টা অদ্ভুত এবং পরস্পর বিরুদ্ধ। কণিকা বা কণাদের চলার জন্য নির্দিষ্ট চক্র আছে, পথ আছে। অন্যদিকে তরঙ্গ জিনিসটা চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। সেভাবে নির্দিষ্ট কোনো বাধাধরা নিয়মে চলে না।

আর এই সাবঅ্যাটমিক কণিকাগুলো দুরকম আচরণই করে? লিসা প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ, তাদের দুরকম আচরণ করার ক্ষমতা থাকে। কণিকা কিংবা তরঙ্গ। বললেন অ্যানা। এরপর আমরা পরবর্তী পয়েন্টে যাব। হেইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্র।

 লিসা এই সূত্র সম্পর্কে ইতোমধ্যে জ্ঞানলাভ করেছে। অ্যানার ল্যাবরেটরিতে বসে এটা নিয়ে পড়েছিল ও। হেইজেনবার্গের মতে পর্যবেক্ষণ করে না দেখা পর্যন্ত কোনোকিছুই নিশ্চিত নয়। বলল লিসা। কিন্তু এর সাথে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের কী সম্পর্ক সেটা আমার মাথায় ঢোকেনি।

 হেইজেনবার্গের সূত্র বোঝার জন্য বিড়াল পরীক্ষা সবচেয়ে কার্যকরী, অ্যানা বললেন। একটা বাক্সে বিড়াল রেখে তাতে এমন এক ডিভাইস ঢোকানো হলো যেটা বিড়ালকে যে-কোনো সময় বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত করতে পারে আবার নাও পারে। সম্পূর্ণ ভাগ্যের ওপর নির্ভর করছে বিষয়টা। এরপর বাক্সটাকে বন্ধ করে দেয়া হলে বিড়ালের অবস্থা কী দাঁড়াল? হয় জীবিত কিংবা মৃত। হেইজেনবার্গের মতে, বাক্স বন্ধ করার পর থেকে বিড়ালটা এক হিসেবে মৃত এবং অন্যভাবে জীবিত। অর্থাৎ, জীবিত-মৃত দুটোই। যতক্ষণ না কেউ বাক্স খুলে বিড়ালকে পর্যবেক্ষণ না করছে ততক্ষণ পর্যন্ত এই অবস্থা বলবৎ থাকবে।

 এই সূত্রে বৈজ্ঞানিক বিষয়ের চেয়ে দার্শনিকতার ছাপ বেশি, বলল লিসা।

বিড়ালের ক্ষেত্রে হয়তো এরকম মনে হতে পারে। তবে সাবঅ্যাটমিক লেভেলে কিন্তু এটা প্রমাণিত সত্য।

 প্রমাণিত? কীভাবে? ক্রো প্রশ্ন করল। এতক্ষণ লিসাকে প্রশ্ন করতে দিয়ে চুপচাপ বসেছিল ও। ওদিকে অ্যানাও জানেন, পেইন্টার এসব বিষয়ে মোটামুটি জ্ঞান রাখে, তাই লিসার প্রশ্নের জবাবগুলো সুন্দর করে দিচ্ছেন তিনি। যাতে লিসা বিষয়টা ভালভাবে বুঝতে পারে।

ঐতিহাসিক দুটো-ফাটল পরীক্ষার মাধ্যমে, বললেন অনা। এটা নিয়ে এবার আমরা তিন নম্বর বিষয়ে আলোচনা করব। দুটো কাগজ নিয়ে একটা কাগজে দুটো দেয়াল আঁকলেন তিনি। দেয়াল দুটোর অবস্থান হলো : একটার পেছনে আরেকটা। এরপর একটা দেয়ালে দুটো জানালার মতো ফাটল আঁকলেন।

এবার আমি আপনাদেরকে যা বলতে যাচ্ছি সেটাকে হয়তো সাধারণ বিচারবুদ্ধির সাথে সাংঘর্ষিক মনে হতে পারে। ধরুন, এই কাগজে আঁকা বাক্স দুটো হলো কনক্রিটের দেয়াল। আর যে দুটো ফাটল দেখতে পাচ্ছেন, ওগুলো হলো জানালা। এখন আপনি যদি বন্দুক দ্বারা এই জানালাগুলোর ভেতর দিয়ে গুলিবর্ষণ করেন তাহলে পেছনে থাকা। দেয়ালে কিছু দাগ দেখতে পাবেন। সেগুলো দেখতে অনেকটা এরকম হবে…

দ্বিতীয় কাগজটি নিয়ে তাতে অনেক ফুটকি আঁকলেন তিনি।

এটাকে ক প্যাটার্ন হিসেবে ধরে রাখুন। ফাটল কিংবা জানালা যা-ই বলুন না কেন কণিকা হিসেবে ব্যবহৃত গুলিগুলো এভাবেই দেয়ালে আঘাত করবে।

মাথা নাড়ল লিসা। বুঝলাম।

এবার গুলির বদলে আমরা যদি ফাটল দুটোর ভেতর দিয়ে বড় স্পটলাইট তাক করি তাহলে? গুলিকে কণিকা হিসেবে ধরেছি। এবার আলোকে তরঙ্গ হিসেবে ধরব। কারণ আমরা সবাই জানি, আলো তরঙ্গ আকারে ভ্রমণ করে। এক্ষেত্রে আমরা কিন্তু দেয়ালে ভিন্ন চিত্র দেখতে পাব।

নতুন একটা কাগজ নিয়ে তাতে হালকা আর গাঢ় কালো ছায়া আঁকলেন অ্যানা।

এরকম প্যাটার্ন হওয়ার কারণ : ডান ও বাম দুই ফাটল/জানালা দিয়ে প্রবেশ করা আলো একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল। এই প্যাটার্নকে খ হিসেবে ধরুন। তরঙ্গের ফলে এই প্যাটার্নের সৃষ্টি হয়েছে।

আচ্ছা, ধরলাম। বলল লিসা। কিন্তু আসলে কী হচ্ছে সেটার কিছুই বুঝতে পারছে না।

দুটো প্যাটার্নের কাগজ হাতে নিয়ে অ্যানা বললেন, এবার যদি আপনি একটা ইলেকট্রন গান হাতে নিয়ে ফাটল দুটোর ভেতর দিয়ে এক রেখায় ইলেকট্রন ছুঁড়তে থাকেন তাহলে কোন ধরনের প্যাটার্ন পাবেন?

ইলেকট্রনগুলোকে যদি বুলেটের মতো করে ছোঁড়া হয় তাহলে প্যাটার্ন ক–এর মতো পাব বলে মনে হচ্ছে। প্রথম ছবি দেখিয়ে লিসা বলল।

কিন্তু মজার বিষয় হলো, ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার সময় আপনি খ প্যাটার্ন পাবেন।

 লিসাও বিষয়টা ভেবে দেখেছিল। আচ্ছা, তাহলে ইলেকট্রনকে যখন গান থেকে ছোঁড়া হয় তখন সেটা বুলেটের মতো হয়ে বেরোয় না, তরঙ্গ আগে বেরোয়। তরঙ্গ আকারে যাওয়ার ফলে সেটা খ প্যাটার্ন সৃষ্টি করে?

একদম ঠিক ধরেছেন।

 তার মানে দাঁড়াচ্ছে… ইলেকট্রন তরঙ্গ আকারে ভ্রমণ করে।

হ্যাঁ। কিন্তু ফাটলের ভেতর দিয়েই যে ইলেকট্রনগুলো গেছে এটার ভো কোনো সাক্ষী নেই।

বুঝলাম না।

 বোঝাচ্ছি। অন্য এক পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা একটা ফাটলের গায়ে ছোট্ট ক্লিকার বসিয়ে ছিলেন। ফাটলের ভেতর দিয়ে যখনই একটা ইলেকট্রন পার হলেই ক্লিকার সাথে সাথে বিপ করে উঠবে। ক্লিকারের মাধ্যমে ফাটলের ভেতর দিয়ে কতগুলো ইলেকট্রন পার হয়ে যাচ্ছে সেটার পরিমাপ করা সম্ভব। এবার বলুন, ওপাশের দেয়ালে কোন প্যাটার্ন পাওয়া গিয়েছিল?

প্যাটার্নের তো কোনো পরিবর্তন হওয়ার কথা নয়, তাই না?

বাস্তব পৃথিবীতে আপনার কথা সত্য। কিন্তু এই সাবঅ্যাটমিক দুনিয়ায় নয়। ডিভাইস হিসেবে ব্যবহৃত ক্লিকারের সুইচ অন করার পর খ প্যাটার্ন বদলে ক হয়ে গিয়েছিল।

তাহলে পরিমাপ করতে যাওয়ার ফলে প্যাটার্নের এই পরিবর্তন হলো?

হেইজেনবার্গ যেমনটা বলেছিলেন। বিষয়টা অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই সত্য। বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। ইলেকট্রন কণিকা ও তরঙ্গ দুভাবে থাকতে পারে যতক্ষণ না ইলেকট্রনগুলোকে পরিমাপ করা হচ্ছে। ইলেকট্রনকে পরিমাপ করতে গেলে সেটা যে-কোনো এক অবস্থায় চলে যেতে বাধ্য হয়।

লিসা একটি সাবঅ্যাটমিক দুনিয়া কল্পনা করার চেষ্টা করল যেখানে সবকিছুই এরকম দ্বিমুখী সম্ভাবনাময়। উদ্ভট। কোনো মানেই হয় না।

আমরা জানি, পরমাণু দিয়ে অণুর জন্ম, বলল লিসা, তেমনি অণুর সমষ্টিতে গড়ে উঠেছে পুরো পৃথিবী। এখানে আমরা সবকিছু দেখি, জানি, অনুভব করি। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্সে যেরকম দুনিয়ার কথা বলা হচ্ছে সেটার সাথে আমাদের সত্যিকার পৃথিবীর মূল সীমারেখাটা কোথায়?

তার আগে আবারও বলি, দ্বিমুখী সম্ভাবনা বন্ধ করার একমাত্র উপায় হলো ইলেকট্রনকে পরিমাপ করতে হবে। ওরকম পরিমাপক যন্ত্র আমাদের বাস্তব দুনিয়াতে পাওয়া সম্ভব। পরিমাপক যন্ত্রটা হয়তো আলোর ফোটন হয়ে কিছু একটায় আঘাত করে কিংবা কোনো কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে পরিমাপ জানায়। এভাবে বাস্তব দুনিয়ার পরিমাপক যন্ত্র যখন সাবঅ্যাটমিক পৃথিবীর কোনোকিছু পরিমাপ করতে শুরু করে তখন সেটা জোরপূর্বক বাস্তব দুনিয়ার অংশ হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে নিজের হাত দেখতে পারেন। কোয়ান্টাম লেভেলে স্যাবঅ্যাটমিক কণিকাগুলো গঠিত হয়ে আপনার হাত তৈরি হয়েছে। কোয়ান্টামের কোষ তত্ত্ব মেনেই হয়েছে জিনিসটা। কিন্তু হাতের বাইরের অংশে এই বাস্তব দুনিয়ার বিলিয়ন বিলিয়ন পরমাণুর প্রভাবে আপনার নখের জন্ম। এই পরমাণুগুলো লাফাচ্ছে, ধাক্কাচ্ছে একে অপরকে। একে অপরকে পরিমাপ করে জোরপূর্বক স্থির বাস্তবে ধরে রেখেছে।

বুঝলাম…

লিসার কণ্ঠে দ্বিধার সুরটুকু নিশ্চয়ই অ্যানা শুনতে পেয়েছেন।

আমি জানি, বিষয়টা অদ্ভুত লাগছে। কিন্তু আমি কিন্তু কোয়ান্টাম থিওরির পুরোটা ব্যক্ত করিনি। স্রেফ ভাসা ভাসা কিছু তথ্য জানিয়েছি। ননলোকালিটি, টাইম টানেলিং মাল্টিপল ইউনিভার্সের মতো বিষয়গুলো কিন্তু সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছি।

ক্রো মাথা নাড়ল। ওগুলো আরও উদ্ভট লাগবে।

আপনাদেরকে ওই তিনটা মূল বিষয়বস্তু বুঝতে হবে, আঙুল দেখিয়ে দেখিয়ে বললেন অ্যানা। কোয়ান্টামের দ্বিমুখী সম্ভাব্যতার অবস্থায় সাবঅ্যাটমিক কণিকার অস্তিত্ব থাকে। কোনো পরিমাপক যন্ত্রের সাহায্যে সেই দ্বিমুখী সম্ভাব্যতাকে একমুখী অবস্থায় আনা সম্ভব। আর সেই পরিমাপক যন্ত্র আমাদের বাস্তব দুনিয়াতে আছে।

এক হাত উঁচু করে লিসা বলল, কিন্তু বেল-এর সাথে এসবের সম্পর্ক কী? লাইব্রেরিতে আপনি কোয়ান্টাম বিবর্তনের কথা উল্লেখ করেছিলেন।

হ্যাঁ, বলেছিলাম। আচ্ছা, বলুন দেখি… ডিএনএ কী? ওটা একটা প্রোটিন মেশিন ছাড়া কিছুই নয়, তাই না? শরীরের বিভিন্ন ব্লকের কোষ প্রাথমিকভাবে তৈরি করে থাকে, এই তত?

 হ্যাঁ, সোজাসাপ্টা জিনিস।

তাহলে আরও সহজ করে দিই। ডিএনএ জিনিসটা রসায়নের বন্ধনে ব্লক করা, তাই তো? তাহলে কোন জিনিস এই বন্ধন ভাঙ্গে? জিনগুলোকে সচল কিংবা অচল করে কীভাবে?

রসায়নের প্রাথমিক জ্ঞানগুলো মনে করল লিসা। ইলেকট্রন ও প্রোটনের চলাচল।

হুম! আর এই সাবঅ্যাটমিক কণিকাগুলো কোন নিয়ম অনুসরণ করে চলে? ক্লাসিক নিয়ম নাকি কোয়ান্টাম নিয়ম?

কোয়ান্টাম।

আচ্ছা, তাহলে একটা প্রোটন যদি ক ও খ দুটো স্থানে থাকার সম্ভাবনা থাকে… একটা জিনকে সচল কিংবা অচল করার ক্ষমতা রাখে… তাহলে কোনটা হবে?

যদি দুটো জায়গায় থাকার মতো সম্ভাবনা থাকে তাহলে সেটা দুই জায়গাতেই থাকবে। জিন সচল ও অচল দুটোই হবে। কিন্তু যদি কোনোকিছু এটাকে পরিমাপ করে তাহলে ভিন্ন কথা।

এর পরিমাপ করবে কে?

পরিবেশ-পরিস্থিতি।

আর জিনের পরিবেশ-পরিস্থিতি হলো…?

আস্তে আস্তে লিসার চোখ বড় হয়ে গেল। ডিএনএ অণু নিজেই।

হেসে মাথা নাড়লেন অ্যানা। একদম প্রাথমিক পর্যায়ে, কোষগুলো নিজেই কোয়ান্টাম পরিমাপক যন্ত্র হিসেবে কাজ করে। আর এটাই হলো বিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি। এ ঘটনার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় মিউটেশন বা রূপান্তরগুলো বিক্ষিপ্তভাবে হয়নি। এলোমেলো কিংবা বিক্ষিপ্তভাবে হওয়ার চেয়ে এভাবেই বিবর্তনের গতি বৃদ্ধি পেয়েছিল।

দাঁড়ান, লিসা বলল। আরও একটু বুঝিয়ে বলুন, প্লিজ।

ঠিক আছে, উদাহরণ দিচ্ছি। সেই ব্যাকটেরিয়ার কথা মনে আছে? যেটা ল্যাকটোজ হজম করতে পারতো না। অথচ তাদেরকে খাবার হিসেবে শুধু ল্যাকটোজ দেয়ার পরেও কীভাবে বেঁচে গিয়েছিল? উত্তর হচ্ছে : তারা তখন দ্রুত এমন একটা এনজাইম তৈরি করেছিল যেটা ল্যাকটোজ হজম করতে সক্ষম। এক ভ্রু উঁচু করে অ্যানা বললেন, এবার আপনি কোয়ান্টামের সেই তিন মূল বিষয়বস্তুর সাহায্যে এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারবেন? নির্দিষ্টভাবে বলে দিচ্ছি, সুবিধাজনক মিউটেশন ঘটানোর জন্য একটা প্রোটনকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিতে হয়। এবার ব্যাখ্যা করুন দেখি।

লিসা চেষ্টা করল। ঠিক আছে। যদি প্রোটন দুটো জায়গাতে থাকতে পারে তাহলে কোয়ান্টাম থিওরি বলছে, পোটন দুটো জায়গাতেই আছে। সেক্ষেত্রে জিন রূপান্তরিত এবং অরূপান্তরিত দুটোই হয়ে আছে। দ্বিমুখী সম্ভাবনা থাকছে সেক্ষেত্রে।

তারপর… মাথা নেড়ে সায় দিলেন অ্যানা।

তারপর কোষ নিজে কোয়ান্টাম পরিমাপক যন্ত্র হিসেবে আচরণ করার ফলে ডিএনএ-কে যে-কোনো একপাশে সরে আসতে বাধ্য করবে। হয় রূপান্তরিত হবে কিংবা হবে না। আর যেহেতু কোষটি তার পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বাস করছে তাই সেই পরিবেশের প্রভাবে সে বিক্ষিপ্ত আচরণ পরিহার করে সুবিধাজনক রূপান্তর বা মিউটেশন ঘটাবে।

এটাকে এখনকার বিজ্ঞানীরা খাপ খাইয়ে নেয়া মিউটেশন বলে থাকেন। পরিবেশ কোষের ওপর প্রভাব ফেলে, কোষ প্রভাব ফেলে ডিএনএন-এর ওপর। যার ফলে সুবিধাজনক মিউটেশনের জন্ম হয়। আর এসবই কোয়ান্টাম দুনিয়ার কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে হয়ে থাকে।

লিসা এখন এই আলোচনার গন্তব্য অনুধাবন করতে পারছে। অ্যানা এর আগে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন নিয়ে কথা বলেছিলেন। লিসা জানতে চেয়েছিল সেই ডিজাইনের স্রষ্টা কে… সেটার জবাবও দিয়েছিলেন এই মহিলা।

আমরা।

এবার লিসা বুঝতে পারছে। আমাদের নিজেদের কোষই বিবর্তন পরিচালনা করে আসছে। পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে ডিএনএ-এর দ্বিমুখী সম্ভাব্যতাকে একমুখী করে চলে যাচ্ছে সুবিধাজনক অবস্থানে। তাহলে ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশন থিওরি বাতিল।

 তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বললেন অ্যানা, তার কণ্ঠ একটু খসখসে ককৰ্শ শোনাল, জীবনের প্রথম শুরুর বিষয়টা কোয়ান্টাম মেকানিক ব্যাখ্যা করতে পারে। আদিকালের রসায়নের স্যুপ থেকে প্রাণের প্রথম কোষে পরিণত হওয়ার অসম্ভাব্যতার বিষয়টা মনে আছে? কোয়ান্টাম দুনিয়ায় এলোমেলো কিংবা বিক্ষিপ্তভাবে কিছুই হয় না। তাই ওই চ্যাপ্টার বাদ। কোষের পরিমাপ ক্ষমতা ও কোয়ান্টাম সম্ভাব্যতা থাকায় সেটা বিক্ষিপ্তভাবে ধাক্কাধাক্কি করে আদিকালে স্যুপ হয়ে থাকার বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে পেরেছিল। তাতে প্রাণের সঞ্চার এজন্যই হয়েছিল কারণ সেটা কোয়ান্টাম পরিমাপক যন্ত্র হিসেবে আরও উন্নত।

আর এসবে ঈশ্বরের কোনো হাত নেই, তাই তো? প্রশ্ন করল লিসা। এই প্রশ্নটা অ্যানা ওকে ২-১ দিন আগে করেছিলেন। যদিও এখন মনে হচ্ছে ইতোমধ্যে কয়েক দশক পেরিয়ে গেছে।

অ্যানা তার কপালে হাতের তালু ছোঁয়ালেন। আঙুল কাঁপছে। চোখ কচলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন তিনি। চেহারার অভিব্যক্তি মোটেও হাসি-খুশি নয়। তার কণ্ঠ এখন এতই নরম হয়ে গেছে যে প্রায় শোনাই যাচ্ছে না। আমি তো সেটা বলিনি। আপনি ভুল দিকে ভুলভাবে দৃষ্টি দিচ্ছেন।

 লিসা এ নিয়ে আর কিছু বলল না। ও বুঝতে পারল অ্যানার পক্ষে আরও কথা চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর হবে। ওদের সবাইকে আরও ঘুম দেয়া উচিত। কিন্তু আর একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেই হচ্ছে।

বেল, এটার কাজ কী? বলল লিসা।

অ্যানা প্রথমে পেইন্টার ও পরে লিসার দিকে তাকালেন। বেল হচ্ছে সেই কোয়ান্টাম পরিমাপক যন্ত্র।

অ্যানা যা বললেন সেটা হজম করতে গিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলল লিসা।

অ্যানার এরকম বিধ্বস্ত চেহারাতেও কী যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বোঝা কঠিন। গর্ব, বিশ্বাস, সাথে একটু ভয়।

 বেল-এর ফিল্ড শুধু ডিএনএ-কে নিখুঁতই করে না তার সাথে মানবজাতিরও উন্নতি ঘটায়।

তাহলে আমাদের কী অবস্থা? বলল ক্রো। আপনি, আমি? আমাদেরকে কী এবং কীভাবে নিখুঁত করা হচ্ছে এখন?

 এরকম আক্রমণাত্মক খোঁচা দেয়া প্রশ্ন শুনে অ্যানার চেহারা থেকে উজ্জ্বলতা চলে গেল। অন্য বিষয়গুলোর মতো এটাতে দ্বিমুখী সম্ভাব্যতা ছিল। একটা সামনের দিকে অন্যটা বিপরীত দিকে।

বিপরীত দিকে?

আমাদের কোষে যে রোগ আক্রমণ করেছে, বলতে বলতে অ্যানা অন্যদিকে তাকালেন। এটা শুধু অবনতিই নয়… এটা বিকেন্দ্রীকরণ। অর্থাৎ, বিবর্তনের বিপরীত।

হাঁ করে অ্যানার দিকে তাকিয়ে রইল পেইন্টার। অবাক হয়ে গেছে।

এরপর আনা যা বললেন তাতে সবার মাঝে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। আমাদের শরীর আবার সেই আদিকালের তরল অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে যেখান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল।

.

ভোর ৫টা ০৫ মিনিট।
 সাউথ আফ্রিকা।

বানরের শব্দ ওকে জাগিয়ে দিল।

বানর?

বানর এলো কোত্থেকে? বিস্ময়ের ধাক্কায় ঘুম ঘুম ভাব ছুটে গেল ওর। উঠে বসল গ্রে। ওর আশেপাশের পরিবেশ উপলব্ধি করে বুঝে উঠতে গিয়ে স্মৃতি জড়িয়ে গেল।

ও বেঁচে আছে।

একটি সেলের ভেতর।

বিষাক্ত গ্যাস, উইউইলসবার্গ মিউজিয়াম, মিথ্যে কথা… সব মনে পড়ে গেল ওর। ডারউইনের বাইবেল পুড়িয়ে দিয়েছিল, দাবি করেছিল ওটার ভেতরে থাকা গোপন তথ্য শুধু ওরাই জানে। ওর আশা ছিল ওতে কাজ হবে। দেখা যাচ্ছে, আসলেই কাজ হয়েছে। বেঁচে আছে ও। কিন্তু বাকিরা কোথায়? মনক, ফিওনা, রায়ান?

 নিজের সেলে চোখ বুলালো গ্রে। ছিমছাম সেল। একটা খাট, টয়লেট আর গোসলখানা আছে এখানে। প্রায় ইঞ্চিখানেক পুরু লোহার বার আছে দরজায়। তবে কোনো জানালা নেই। সামনের হলওয়েতে ফ্লোরোসেন্ট লাইট জ্বলছে। এবার নিজের দিকে খেয়াল করল গ্রে। কে বা কারা যেন ওকে নগ্ন করে রেখেছে। তবে ভাঁজ করা এক সেট কাপড় রাখা আছে বিছানার কাছে থাকা একটি চেয়ারের ওপর।

কম্বল সরিয়ে উঠে দাঁড়াল গ্রে। পুরো দুনিয়া দুলে উঠল, তবে কয়েকবার শ্বাস নেয়ার পর থামল দুলুনি। বিতৃষ্ণা লাগছে। ভারি লাগছে ফুসফুসকে। বিষাক্ত গ্যাস এসবের জন্য দায়ী।

গ্রে খেয়াল করে দেখল ওর উরুতে খুব ব্যথা হচ্ছে। আঙুল বুলিয়ে বুঝল ওখানে সঁচ ফোঁটানো হয়েছে। বাঁ হাতে ব্যান্ড-এইড দেখতে পেল ও। বোঝা গেল, ওকে চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে তোলা হয়েছে।

দূর থেকে আবার গর্জন ও চিৎকার ভেসে এলো।

বন্য বানর।

 খাঁচার বানরের আওয়াজ এরকম নয়।

প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকলেই এরকম আওয়াজ করা সম্ভব।

কিন্তু কোথায় আছে গ্রে? বাতাস বেশ শুকনো, উষ্ণ, কস্তুরির সুগন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। গরম অঞ্চলে এসেছে ও। আফ্রিকার কোথাও হবে হয়তো। জ্ঞান হারানোর পর কত সময় পেরিয়েছে? ওর হাতে ওরা কোনো হাতঘড়ি রেখে যায়নি। তাহলে দিন-তারিখ বুঝতে পারতো। তবে গ্রে আন্দাজ করল, একদিনের বেশি পার হয়নি। দীর্ঘ সময় ঘুমালে ওর গালে দাগ বসে যেত। হাত বুলিয়ে দেখল এখন সেরকম কোনো দাগ নেই।

কাপড়গুলো নিলো গ্রে।

ওকে নড়তে দেখে কারও টনক নড়ল।

হলের ঠিক ওপাশে থাকা সেলের বার দেয়া দরজার কাছে এলে মনক। সঙ্গীকে জীবিত দেখে গ্রে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ… বিড়বিড় করল গ্রে।

তুমি ঠিক আছ?

 আছি আরকি… তবে পরনে কিছু নেই।

মনক অবশ্য ইতোমধ্যে পোশাক পরে নিয়েছে। গ্রের জন্য রাখা পোশাক আর মনকের পোশাক একই। সাদা জাম্পস্যুট। গ্রে নিজের পোশাক পরতে শুরু করল।

 নিজের বাম হাত উঁচু করে দেখাল মনক। বেজন্মগুলো আমার হাতটা পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। ওর বাম হাতে থাকা যান্ত্রিক অংশটুকু এখন নেই। মনকের হাত না থাকাটা খুব একটা দুশ্চিন্তার বিষয় নয়। হয়তো এটা ওদের জন্য সুবিধা হয়ে ধরা দিতে পারে। তবে আগের কাজ আগে…

ফিওনা আর রায়ান কোথায়?

বলতে পারছি না। হয়তো এখানেই কোনো সেলে আছে… কিংবা অন্য কোথাও নিয়ে গেছে।

কিংবা মারা গেছে, মনে মনে বলল গ্রে।

এবার কী হবে, বস? মনক জানতে চাইল।

কিছু করার নেই। যারা আমাদেরকে বন্দী করেছে তাদের পদক্ষেপ না নেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের কাছে যে তথ্য আছে সেটা ওদের দরকার। দেখি তথ্য বিক্রি করে আমরা কী লাভ করতে পারি।

 মাথা নাড়ল মনক। ও খুব ভাল করেই জানে, ক্যাসলে গ্রে ধাপ্পা মেরেছে। কিন্তু মিথ্যা কথা বললে সেটা ঠিক-ঠাক চালিয়ে যাওয়া চাই। আর স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, এই সেলগুলোর ওপর নজর রাখা হচ্ছে।

কথাটির সত্যতা নিশ্চিত করতে হলের শেষ প্রান্তের দরজা দড়াম করে খুলে গেল।

তাদের দেখা যাচ্ছে না তবে পায়ের শব্দ শুনে বোঝা যাচ্ছে অনেকজন আসছে। দৃষ্টি সীমার ভেতরে আসার পর দেখা গেল; কালো-সবুজ ইউনিফর্ম পরিহিত একদল গার্ড এগিয়ে আসছে। একজন ফ্যাকাসে সাদা চামড়ার ব্যক্তি তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। নিলাম অনুষ্ঠানের সেই ক্রেতা। বরাবরের মতো আজও তার পোশাক পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি। কালো টুইল প্যান্ট আর লিলেন শার্টের সাথে কলারবিহীন আস্তি নঅলা স্যুট রয়েছে পরনে। দেখে মনে হচ্ছে সে কোনো গার্ডেন পার্টিতে যোগ দিতে যাচ্ছে।

 দশ জন গার্ড আছে তার সাথে। দুই দলে বিভক্ত হয়ে দুটো সেলের দিকে এগোল তারা। নগ্ন পায়ে গ্রে ও মনককে সেল থেকে বের করে আনা হলো। দুজনের হাত প্লাস্টিক স্ট্র্যাপ দিয়ে পেছন মুড়ে বাধা হয়েছে।

নেতা ওদের সামনে এসে দাঁড়াল।

 নীল চোখ দিয়ে বরফ শীতল দৃষ্টি ফেলল গ্রের ওপর।

গুড মর্নিং, কৃত্রিম ভদ্রতা দেখিয়ে বলল সে। এই হলে ক্যামেরা লাগানো আছে বলে হয়তো নিজের আচরণ সংযত রাখল। আমার দাদু আপনাদের সাথে দেখা করতে চেয়েছেন।

 যতই ভদ্রতা দেখাক তার প্রত্যেক শব্দের পেছনে চাপা রাগ লুকিয়ে আছে। ছাই চাপা আগুনের মতো ঢেকে আছে সেটা। এই লোক তো ওদেরকে খুনই করে ফেলেছিল ক্যাসলে… কিন্তু বাধ্য হয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। আবার এখন বাড়তি সময়ও দিতে হচ্ছে। কিন্তু এর এত রাগের কারণ কী? তার ভাইয়ের মৃত্যু… নাকি ক্যাসলে গ্রের চালাকিটা সহ্য করতে পারছে না? তবে যা-ই হোক, এই ব্যক্তির সভ্য-ভব্য পোশাকের নিচে একটা পাশবিক, হিংস্র চরিত্র লুকিয়ে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এদিকে আসুন, বলে গটগট করে সামনে এগোল সে।

তার পেছন পেছন এগোচ্ছে মনক ও গ্রে। সাথে গার্ডরা তো আছেই। সামনে এগোতে এগোতে দুপাশে থাকা সেলের দিকে তাকাল গ্রে। সব ফাঁকা। ফিওনা ও রায়ানের কোনো চিহ্ন নেই। ওরা কী এখনও বেঁচে আছে?

তিন ধাপ বিশিষ্ট সিঁড়ির কাছে গিয়ে হল শেষ হয়েছে। সামনে পুরু স্টিলের একটা বিশাল দরজা।

খোলা আছে, তবে গার্ডের পাহারায়।

বদ্ধ সেলব্লকের হল থেকে এবার কিছুটা অন্ধকার শ্যামল ভূমিতে পা রাখল ঘে। চারিদিকে জঙ্গলের সামিয়ানা টাঙ্গানো। চারিদিকে লতা-পাতা আর অর্কিড ফুলের সমাহার। গাছপালার পাতা এত ঘন যে আকাশ ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। তবে গ্রে আন্দাজ করল দিনের কেবল শুরু। হয়তো সূর্যও এখনও ওঠেনি। ভিক্টোরিয়া আমলের লোহার ল্যাম্পপোস্ট দেখা গেল সামনে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ দেখিয়ে চলেছে। পাখির কিচির-মিচির আর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে পোকাদের। উপরে গাছের ডালে লুকিয়ে থাকা এক বানর ওদেরকে দেখে চিৎকার করে ডাক ছাড়ল। তার চিৎকারে উজ্জ্বল রঙের এক ঝাঁক পাখি উড়ে গেল নিচু ডালপালার ভেতর দিয়ে।

 আফ্রিকা, বিড়বিড় করে বলল মনক। অন্তত সাব-সাহারান তো হবে। বিষুব রেখা সংলগ্ন অঞ্চলও হতে পারে।

 গ্রে একমত হলো। এটা হয়তো পরের দিন সকাল হবে। মাঝখান থেকে ১৮ কিংবা ২০ ঘণ্টা গায়েব হয়ে গেছে। এসময়ের মধ্যে তাদেরকে আফ্রিকার যে-কোনো অঞ্চলে নিয়ে আসা সম্ভব।

কিন্তু জায়গাটা আসলে কোথায়?

নুড়ি বিছানো পথ দিয়ে গার্ড ওদেরকে এগিয়ে নিয়ে চলল। গ্রে শুনতে পেল ওদের পথ থেকে কয়েক ফুট দূরে বড় গাছপালার নিচে থাকা ঝোঁপঝাড়ের ভেতর বড় কিছু একটা মেপে মেপে ঘোট পা ফেলে এগোচ্ছে। কিন্তু এত কাছে থাকা সত্তেও সেটার আকৃতি আন্দাজ করা সম্ভব হলো না। সেরকম কিছু হলে জঙ্গলের ভেতরে দৌড় দিতে হবে। জঙ্গলে অনেক আড়াল নেয়ার জায়গা আছে।

কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না। ১৫০ ফুট এগোনোর পর জঙ্গলের রাস্তা শেষ হলো। আরও সামনে এগোতে জঙ্গল পেছনে পড়ে গেল ওদের।

জঙ্গল ছাড়িয়ে ওরা যেখানে এসে পড়ল সেটা একটা সাজানো গোছানো সবুজ অঞ্চল। বুনো জঙ্গল নয়। এখানে পানি খেলা করছে। পুকুর ও খাড়ি আছে। ঝরণাও আছে। ওদেরকে দেখে একটা হরিণ মাথা তুলে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্য থেমে দৌড়ে বনের ভেতরে পালাল ওটা।

এখন ওপরের আকাশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তাঁরা চমকাচ্ছে আকাশে। তবে পূর্ব দিকে তারাদের দেখা যাচ্ছে না। ওখানে নতুন দিনের নতুন সূর্য উদয় হওয়ার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। ভোর হতে আর প্রায় ১ ঘন্টা বাকি।

পাশে আরেকটা জিনিস দেখে গ্রের চোখ আটকে গেল।

বাগানের ওপাশে ছয় তলা বিশিষ্ট অট্টালিকা দেখা যাচ্ছে। বনের পাশে পাথুরে অট্টালিকা। ওটা দেখে ওর পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল। ইয়োসমিটে আহওহানি লজ ভেসে উঠল ওর মানসপটে। তবে এই অট্টালিকা ওটার চেয়েও বিশাল। দশ একর জায়গা নিয়ে এই অট্টালিকা দাঁড়িয়ে আছে। ঝুল-বারান্দা, বেলকুনি সবই আছে এতে। বাম পাশে কাঁচে ঘেরা একটা কনজারভেটরি দেখা যাচ্ছে। ওটার ভেতরে আলোর ব্যবস্থা থাকায় কাঁচ ভেদ করে বাইরে আলো আসছে এখন। আলো দেখে মনে হচ্ছে ওর ভেতরে ভোরের সূর্য ঢুকে আছে যেন।

অঢেল অর্থ-সম্পত্তি এখানে। পাথুরে পথের ওপর দিয়ে হেঁটে ম্যানর ভবনের দিকে এগোচ্ছে ওরা। পাথুরে পথটা ওয়াটার গার্ডেন আর কয়েকটি পুকুর ও খাড়িকে আলাদা করেছে। পাথুরে ব্রিজের ওপর দুই মিটার লম্বা একটা সাপকে দেখা গেল। এটা কী সেটা বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু যখন মাথা উঁচু করে ফণা তুলল তখনই বোঝা গেল সব।

কিং কোবরা।

একজন সাদা চামড়াধারী একটা নলখাগড়া ভেঙ্গে এনে ওটাকে বিড়ালের মতো তাড়িয়ে দিল। ফণা তুলে হিসহিস করে প্রতিবাদ জানালেও ব্রিজ থেকে নেমে কালো পানিতে ডুব দিল কিং কোবরা।

এখানকার নির্মাণশৈলির আরেকটা ব্যতিক্রমী দিক ওর চোখে পড়েছে। ভবনের ওপর তলা থেকে জঙ্গলের ওপর দিয়ে পথ চলে গেছে। কাঠের তৈরি পথ ওটা, ওখানেও আলোর ব্যবস্থা আছে। ভবনে আগত অতিথিগণ যাতে ওপর থেকে জঙ্গলের দৃশ্য উপভোগ করতে পারে তাই এই ব্যবস্থা।

 মাথা বাড়লো, মাথা দিয়ে বাম দিক দেখিয়ে বিড়বিড় করল মনক। কাঁধে রাইফেল নিয়ে হেলে দুলে একজন গার্ড জঙ্গলের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। যেহেতু একজন আসছে, তার মানে জঙ্গলের ভেতরে এরকম আরও গার্ড আছে। পালিয়ে পার পাবার সম্ভাবনা কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় চলে আসছে এখন।

অবশেষে ওরা যখন ম্যানর ভবনের কাছে গিয়ে যখন পৌঁছুল তখন দেখল সামনে একজন নারী দাঁড়িয়ে আছে। নিলাম অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া সেই ক্রেতার যমজ বোন। লোকটি এগিয়ে গিয়ে বোনের দুই গালে চুমো খেল।

ডাচ ভাষায় বোনের সাথে কথা শুরু করল সে। ভাষাটা সে এখনও অত ভালভাবে রপ্ত করতে পারেনি। তার আমতা আমতা করার ধরন দেখে গ্রে বিষয়টা বুঝে ফেলল।

ইসকি, বাকিরা তৈরি তো? জিজ্ঞেস করল সে।

হ্যাঁ, আমরা grootvader-এর জন্য অপেক্ষা করছি। মাথা নেড়ে সেই আলো বিচ্ছুরিত হওয়া কাঁচের কনজারভেটরি দেখাল বোন। তারপর শিকার শুরু হবে।

এই কথার মানে উদ্ধার করার চেষ্টা করল গ্রে। কিন্তু পারল না।

বড় করে শ্বাস নিয়ে লোকটি ওদের দিকে ফিরল। আঙুল চালিয়ে মাথার চুলগুলো ঠিক করে বলল, সোলারিয়ামে আমার দাদু আপনাদের সাথে দেখা করবেন। আপনারা তার সাথে ভদ্রভাবে সম্মান দিয়ে কথা বলবেন। আর যদি সেটা না করবেন প্রত্যেকটা বেয়াদবিমূলক শব্দের শাস্তি আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাদেরকে পরিশোধ করব।

ইসাক…ভাইকে ডাকল ইসকি।

ঘুরল সে। বলো…

আবার ডাচ ভাষা ব্যবহার করল ইসকি। De jongen en net meisje? ওদেরকে কী এখন বের করব?

মাথা নেড়ে সায় দিল ইসাক। ডাচ ভাষায় কী যেন বলল।

কথা শেষে ভবনের ভেতরে চলে গেল ইসকি।

 ইসকির বলা বাক্যটি অনুবাদ করল গ্রে।

 De jongen en net meisje.

অর্থাৎ, ছেলেটা আর মেয়েটা।

রায়ান ও ফিওনার কথা বলেছে।

ওরা দুজন এখনও বেঁচে আছে তাহলে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাচ্ছিল গ্রে। কিন্তু ইসাকের বলা শেষ বাক্যটি ওর স্বস্তি কেড়ে নিয়ে ভয় ধরিয়ে দিলো।

ওদেরকেই আগে রক্তে রঞ্জিত করা হোক।

.

ভোর ৫টা ১৮ মিনিট।
উড়োজাহাজে, আফ্রিকার ওপর।

হাতে একটি কলম নিয়ে বসে আছে পেইন্টার ক্রো। প্লেনের ভেতর একমাত্র গানরের নাক একটু পর পর ডেকে যাচ্ছে। ওরা যে জায়গার উদ্দেশ্যে উড়াল দিয়েছে সেখানে এই ব্যক্তি একটি হুমকিস্বরূপ। তবে অ্যানা ও পেইন্টারের মতো গানরের আয়ু অত দ্রুত ফুরাচ্ছে না। যদিও ওদের তিনজনের শেষ পরিণতি একই… তবে অসুখটা… বিকেন্দ্রীকরণ… গানথারকে তুলনামূলক ধীরে ধীরে কাবু করছে। ভুক্তভোগী হিসেবে সামনের কাতারে আছে অ্যানা ও পেইন্টারের নাম।

ঘুমোতে না পেরে পেইন্টার এই সময়টুকু ওয়ালেনবার্গ পরিবার রিভিউ করে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলো। এই পরিবার সম্পর্কে যত জেনে নেয়া যায় তত ভাল।

শত্রু সম্পর্কে জ্ঞান থাকা উচিত।

সময়টা ১৬১৭ সাল, আলজিয়ারস-এর পথ হয়ে ওয়ালেনবার্গরা প্রথমবারের মতো আফ্রিকা এসেছিল। তাদের বংশের শেকড় রয়েছে কুখ্যাত বারবেরি দলদস্যুদের ভেতর এবং এটা নিয়ে তারা গর্বও করে। ওয়ালেনবার্গ বংশের প্রথম পুরুষের নাম তিনি একটি পুরো ডাচ ফ্লিট (এক দল জাহাজ)-এর ভারপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বলাই বাহুল্য সেই ফ্লিটটা জলদস্যুদের ফ্লিট ছিল।

ধীরে ধীরে পয়সার মালিক হওয়ার পর তারা দক্ষিণের কেইপ প্রদেশে চলে এলো। তবে এখানে এসেও তাদের লুটপাট থামলো না, চেহারা পরিবর্তন করল মাত্র। ডাচ অভিবাসীদেরকে নিয়ে শক্ত দল তৈরি করেছিল তারা। খনি থেকে তোলা সোনার মূল দায়িত্বে ছিল ওয়ালেনবার্গরা। আর ডাচরা খনিতে কাজ করতো। খনি থেকে ভোলা সোনার পরিমাণ নেহাত কম ছিল না। সেসব দিয়ে ওয়ালেনবার্গরা ফুলে ফেঁপে উঠল। জোহানবার্গের উইটওয়াটারসর্যান্ড রিফ নামের পাহাড়ি এলাকা থেকে পৃথিবীর প্রায় ৪০ শতাংশ সোনা উত্তোলন করা হয়েছিল। তবে De Beerses-এর মতো বিখ্যাত হীরার খনি না হলেও এখনও পর্যন্ত রিফ পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান এলাকা হিসেবে পরিচিত।

 প্রচুর সম্পত্তির ওপর ভর করে ওয়ালেনবার্গরা প্রথম ও দ্বিতীয় বোয়ার যুদ্ধকে ছাপিয়ে একটি রাজবংশ চালু করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র করে তারাই দক্ষিণ আফ্রিকার জন্ম দিয়েছিল। এখানকার ইতিহাসের সবচেয়ে বিশাল ধনী ছিল এই ওয়ালেনবার্গরা। তারপর থেকে এরা নানান পৃষ্ঠপোষকতায় নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করতে শুরু করল। এদের সেই জীবনের হাতেখড়ি হয়েছিল স্যার ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গের মাধ্যমে। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন গুজব ছড়াতে লাগল তাদের নামে। নৃশংসতা, অন্যায়, মাদকাসক্ত, আন্তর্জনন ইত্যাদি। তবে গুজব তাদের আর্থিক ক্ষতি করতে পারল না। হীরা, দেল, পেট্রোকেমিক্যাল, ফার্মাসিউটিক্যাল… বিভিন্ন দিক থেকে উপার্জিত অর্থ ওয়ালেনবার্গদেরকে আরও বিত্তশালী করে তুলল। বহুজাতিক ব্যবসাকে বহুগুণ বড় করেছিল এরা।

GranitschloB-এর ঘটনার জন্য কী এই পরিবার দায়ী?

পর্যাপ্ত কাঁচামাল ও তথ্য পাওয়ার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা ও অর্থ-প্রাচুর্য তাদের আছে। আর সেই মহিলা আততায়ীর হাতে যে ট্যাটু পেইন্টার পেয়েছিল সেটা অবশ্য এই ওয়ালেনবার্গ পরিবারের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আরও একটা প্রশ্ন, ওয়ালেনবার্গ পরিবারের যমজ ভাই-বোন; ইসাক ও ইসকি ইউরোপে গিয়েছিল কেন?

অনেক প্রশ্ন, যেগুলোর কোনো উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি।

একটি কাগজ উল্টিয়ে কলম দিয়ে ওয়ালেনবার্গ পরিবারের প্রতীকের ওপর টোকা দিতে লাগল ক্রো।

 এই প্রতীকে কিছু একটা আছে…

ওয়ালেনবার্গদের পারিবারিক ইতিহাসের সাথে এই প্রতীকের ব্যাপারেও তথ্য পাঠিয়েছেন লোগান। এই প্রতীকের শেকড় রয়েছে কেলট সম্প্রদায়ের ভেতরে, স্ক্যাভেভিয়ান উপজাতিতে। এটাকে নিরাপত্তামূলক চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। রশি দিয়ে গেড়ো দেয়ার মতো অংশকে নিরাপত্তার মূল অংশ হিসেবে ধরা হতো।

থামল ক্রো।

নিরাপত্তা গেড়ো।

ক্লাউস মারা যাওয়ার সময় ওদেরকে কী একটা অভিশাপ দিয়েছিল, সেটা মনে করল ও।

মরবে তোমরা! সবাই মরবে! রশির বিষ গেড়ে চেপে ধরলেই মরবে সবকটি! পেইন্টার ভেবেছিল ক্লাউস হয়তো ফাঁসির দড়ির কথা বলছে। কিন্তু ওর কথাগুলো কী এই প্রতীককে উদ্দেশ্য করে ছিল?

রশির বিষ গেড়ো চেপে ধরলেই…।

একটা ফ্যাক্স শিট উল্টাল ক্রো। ওয়ালেনবার্গ পরিবারের প্রতীক দেখে একটা ছবি আঁকল ও। আঁকার সময় প্রতীকে থাকা রশির গেড়োগুলোকে এমনভাবে আঁকল যেন গেড়োগুলোকে কেউ শক্ত করে টাইট দিয়েছে কিংবা চেপে ধরেছে। আঁকার পর অনেকটা জুতার ফিতার মতো হলো জিনিসটা।

কী করছ তুমি? ক্রোর কাঁধের কাছে এসে বলল লিসা।

চমকে উঠল ক্রো। আর একটু হলেই কলমের আঁচড়ে কাগজটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল।

ওহ ঈশ্বর! মেয়েদের মাথায় কবে বুদ্ধি দেবে তুমি?! লিসা, দয়া করে এভাবে হুটহাট কথা বলা বন্ধ করবে?

হাই তুলে ক্রোর চেয়ারের হাতলের ওপর বসল লিসা। এক হাত দিয়ে ক্রোর কাঁধ চাপড়ে দিল। ইস, কচি খোকা! চমকে ওঠে! কাঁধে হাত রেখে আরও কাছে এলো ও। সত্যি করে বললো তো, কী আঁকছ?

হঠাৎ পেইন্টার খুব সচেতন হয়ে খেয়াল করল লিসার ডান স্তন ওর গালের সাথে লেপ্টে রয়েছে।

গলা খাকাড়ি দিয়ে ছবি আঁকায় মন দিল ও। তেমন কিছু না। সেই মহিলার হাত থেকে পাওয়া প্রতীক নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করছিলাম। আমার এজেন্টরা ইউরোপে দুই Sonnekonige এর হাতেও এই প্রতীক দেখেছে। সেই দুইজন স্যার ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গের বংশধর। হয়তো কোনো সূত্র আছে যেটা আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে।

কিংবা এমনও হতে পারে সেই বুড়ো ভাম হয়তো এই প্রতীক দিয়ে গরুতে চিহ্ন দেয়ার মতো করে তার উৎপাদিত মানুষের গায়ে ছাপ মেরে দিয়েছে।

মাথা নাড়ল পেইন্টার। ক্লাউস কিছু একটা বলেছিল। রশির গেড়ো চেপে ধরবে…। গোপন কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছিল বোধহয়। যেটা মুখে বলতে পারেনি।

ছবি আঁকার শেষ পর্যায়ে এসে সাবধানে কয়েকটা রেখা টানল ক্রো। তারপর পাশাপাশি রাখল দুটোকে। একটা মূল প্রতীক অন্যটা টাইট দেয়ার পর।

দুটো ছবির দিকে তাকিয়ে ছবির ভেতরে থাকা নিহিত অর্থ খুঁজল ও।

আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে কাছে এলো লিসা। কী হয়েছে?

ক্রো কলম দিয়ে দ্বিতীয় ছবি দেখাল। কোনো সন্দেহ নেই ক্লাউস এদের পক্ষে চলে গিয়েছিল। আর এজন্যই হয়তো বিগত কয়েক প্রজন্ম ধরে ওয়ালেনবার্গরা গা ঢাকা দিয়ে বসবাস করছে।

বুঝলাম না।

আমরা নতুন কোনো শত্রুর মুখোমুখি হইনি। সেই পুরোনো শত্রুর সাথেই লড়ছি এখনও। শক্ত করে টাইট দেয়া গেড়োর কেন্দ্রস্থল কলম দিয়ে আরও গাঢ় করল পেইন্টার। থলের বিড়াল বেরোল এতক্ষণে।

প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে লিসা বলল, এটা তো স্বস্তিকা!

 বিশালদেহি গানথার আর তার বোনের দিকে তাকাল ক্রো।

 শ্বাস ফেলে বলল, নাসি। আরও নাৎসির মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা।

.

সকাল ৬টা ০৫ মিনিট।
সাউথ আফ্রিকা।

মূল ভবনের মতো কাঁচের কনজারভেটরিটাও বেশ পুরোনো। এর জানালার শার্সিগুলো একটু বাঁকা আকৃতির, মোচড়ানো ডিজাইনের। দেখলে মনে হয় আফ্রিকার সূর্যের তাপে গলে ওগুলো ওরকম বেঁকে গেছে। জানালার ওরকম অবস্থা দেখে গ্রের মাকড়সার জালের কথা মনে পড়ে গেল। কনজারভেটিতে ঘোলা কাঁচ ব্যবহার করা হয়েছে। ভেতর থেকে বাইরের গভীর জঙ্গল দেখা যায় না।

কনজারভেটরির ভেতরে ঢুকতেই পেইন্টার যেটাতে ধাক্কা খেল সেটা হলো আর্দ্রতা। চেম্বারের ভেতরে আর্দ্রতার পরিমাণ প্রায় ১০০%, ওর পাতলা জাম্পস্যুট আর শরীরের সাথে থাকতে চাইছে না।

তবে সোলারিয়ামের আর্দ্রতা ওদের সুবিধার জন্য বাড়ানো হয়নি। এখানে বিভিন্ন তাকে, সারিতে, পাত্রে, টবে ও কালো চেইন দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় অনেক ফুলের গাছ আছে। শত শত ফুলের সুবাসে মো-মো করছে ভেতরের বাতাস। রুমের মাঝখানে বাঁশ ও পাথরের তৈরি ছোট্ট একটা ভাস্কর্য আছে। সবমিলিয়ে বাগানটা খুবই রুচিশীল। কিন্তু একটা কথা ভেবে গ্রে অবাক হলো… আফ্রিকা এমনিতেই গরম জায়গা। এখানে যথেষ্ট আর্দ্রতা থাকার পরও কেন কনজারভেটরি তৈরি করতে হবে?

উত্তর সামনে উদয় হলো।

সাদা চুলের এক ভদ্রলোক হাতে দুটো কাঁচি নিয়ে দ্বিতীয় তাকের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। সার্জনের মতো দক্ষ হাতে একটা ছোট্ট বনসাই গাছ থেকে একটা ফুল ও শাখা কেটে নিলেন তিনি। কাজটা তিনি সামনে ঝুঁকে করছিলেন। ফুল আর ডাল কেটে সন্তুষ্ট হয়ে সোজা হলেন ভদ্রলোক।

গাছটিকে দেখে মনে হলো এর বয়স অনেক বেশি, মুচড়ে গেছে, তামার তার গাছের শরীরে জড়ানো। তবে ফুলের কোনো কমতি নেই। প্রত্যেকটি ডালে, শাখা প্রশাখায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ফুল ফুটে আছে। একদম সাজানো গোছানো ঠিকঠাকভাবে ফুটেছে ওগুলো।

গাছের বয়স ২২০ বছর, বললেন ভদ্রলোক। শুধু ভদ্রলোক বললে ভুল বলা হবে। বলা উচিত বয়স্ক ভদ্রলোক। সম্রাট হিরোহিতো নিজ হাতে ১৯৪১ সালে গাছটা আমাকে দিয়ে ছিলেন। আমার হাতে যখন আসে তখনই গাছটার বয়স অনেক ছিল।

হাতের যন্ত্রপাতি রেখে এদিকে ঘুরলেন তিনি। তার পরনে সাদা অ্যাপ্রোন আছে। অ্যাপোনের নিচে আছে নেভি স্যুট আর লাল টাই। নাতির দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। ইসাক, tevreden…।

দ্রুত এগিয়ে এসে দাদার হাত ধরে দ্বিতীয় তাক থেকে নামল সে। খুশি হয়ে তিনি নাতির কাঁধ চাপড়ে দিলেন। অ্যাপ্রোন খুলে কালো রঙের একটি ছড়ি নিয়ে তাতে বেশ ভাল করে চাপ দিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। গ্রে খেয়াল করে দেখল সেই সিলমোহর ছড়ির রুপোলি ক্রাউনের ওপরে শোভা পাচ্ছে। এই একই প্রতীক যমজ ভাই-বোন ইসাক ও ইসকির হাতেও আছে।

 আমি স্যার ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গ, গ্রে ও মনকের দিকে তাকিয়ে নরমস্বরে বললেন তিনি। আপনারা যদি ভেতরের রুমে আসেন তাহলে আরও অনেক কথা বলতে পারব।

 সোলারিয়ামের পেছনের দিকে এগোলেন তিনি।

এই বয়স্ক বৃদ্ধ লোকটির বয়স প্রায় নব্বই ছুঁই ছুঁই করছে। তবে তাঁর হাতে ছড়ি থাকলে শক্ত-পোক্ত মানুষ বলেই মনে হতো। তার মাথায় এখনও রুপোলি-সাদা রঙের ঘন চুল আছে। চুলগুলোর মাঝখানে সিঁথি করেছেন। চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত পৌঁছেছে। গলার রুপোলি চেইন থেকে একটি চশমা ঝুলছে। চশমার একটি লেন্স দেখতে অন্যরকম। জহুরিদের চোখে যেরকম ম্যাগনিফাইং (ছোট বস্তুকে বড় করে দেখা) গ্লাস থাকে, ওটা দেখতে অনেকটা ওরকম।

স্লেট পাথরের মেঝের ওপর দিয়ে এগোতে এগোতে গ্রে লক্ষ্য করল, কনজারভেটরিকে বিভিন্ন সেকশনে সাজানো হয়েছে। বনসাই গাছ, ঝোঁপ, ফার্ন বাগান এবং সর্বশেষ সেকশন যেখানে অর্কিডে ভরপুর।

 ভদ্রলোক গ্রের আগ্রহ দেখে বললেন, আমি বিগত ৬০ বছর ধরে ফুলের চাষ করছি। লম্বা একটি ফুল গাছের সামনে একটু থামলেন তিনি। ওতে রক্তবর্ণের ফুল ফুটেছে। একদম টকটকে রংটা।

খুউব সুন্দর! বলল মনক। আদতে প্রশংসা মনে হলেও তাতে স্পষ্ট খোঁচা আছে।

ইসাক তাকাল মনকের দিকে।

 বৃদ্ধ লোকটির অবশ্য এদিকে খেয়াল নেই। তবে আমি এখনও ব্ল্যাক অর্কিড চাষ করতে পারিনি। দ্য হলি গ্রেইল অফ অর্কিড ব্রিডিং। প্রায় সফল হয়েই যাচ্ছিলাম কিন্তু এখানে বিবর্তন প্রক্রিয়ার ফলে হয় অর্কিডগুলো বাঁকা হয়ে যাচ্ছিল নাহয় রংটা কালোর বদলে কেমন যেন রক্তবর্ণের হচ্ছিল।

আনমনে চশমার চেইনে হাত বুলোচ্ছিল ভদ্রলোক।

জঙ্গলের উন্মুক্ত পরিবেশ আর এই কাঁচঘেরা হটহাউজের মধ্যেকার পার্থক্যটা এবার গ্রে বুঝতে পারল। এখানে বাইরের প্রাকৃতিক জিনিসকে আপন করে উপভোগ করা হয় না। প্রাকৃতিক সম্পদকে আরও উন্নতি করা হয় এখানে। মানুষ এখানে প্রকৃতির ওপর মাতব্বরি করে নিজ হাতে রংচং করে।

সোলারিয়ামের পেছন দিকে এসেছে ওরা। রং দেয়া একটি কাঁচের দরজা পার হয়ে রত্তন ও মেহগনি গাছের কাঠ দিয়ে নির্মিত বসার জায়গায় এসে পৌঁছুল। এ অংশে একটি স্যালুন আছে। অপরপ্রান্তে রয়েছে দুটো সুইং ডোর। দরজা দুটো দিয়ে ভবনের ভেতরে যাওয়া যাবে।

একটি উইংব্যাক চেয়ারে বসলেন ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গ। একটা ডেস্কের ওপর এইচপি কম্পিউটার ও এলসিডি মনিটর লাগানো আছে। ডেস্ক পার হলো ইসাক। মনিটরের পাশেই আছে ব্ল্যাকবোর্ড। বোর্ডে কয়েকটা প্রতীক আঁকা আছে। গ্রে দেখল শেষ প্রতীকটি ডারউইন বাইবেলের সেই Mensch বর্ণ।

প্রতীকগুলো শুনে নিয়ে মুখস্থ করল গ্রে। ৫টা প্রতীক, তার মানে ৫টা বই।

হিউগো হিরজফিল্ডের বইয়ের সেট থেকে বর্ণগুলো তাহলে পাওয়া গেল। কিন্তু অর্থ কী এগুলোর কী সেই গোপন বিষয় যেটা একই সাথে সুন্দর আবার দানবীয়?

বৃদ্ধ লোকটি নিজের কোলের ওপর হাত রেখে ইসাকের দিকে মাথা নেড়ে ইশারা। করলেন।

ইসাক একটা বাটন চাপতেই এলসিডি মনিটরে একটি এইচডি ছবি ভেসে উঠল।

লম্বা একটা খাঁচা জঙ্গলের ভেতরে ঝুলছে। খাঁচাটি দুই অংশে বিভক্ত। একটি করে ছোট অবয়ব দেখা যাচ্ছে দুটো অংশে।

 সামনে এগোতে গেল গ্রে কিন্তু গার্ড রাইফেল তাক করে ওকে থামিয়ে দিলো। মনিটরে দেখা যাচ্ছে, একটা অবয়ব ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখ চকচক করছে স্পটলাইটের আলোতে।

ফিওনা।

খাঁচার অন্য অংশে আছে রায়ান। ফিওনার বাম হাতে ব্যান্ডেজ করা, হাত প্যাচিয়ে রেখেছে শার্ট দিয়ে। শার্ট কালচে হয়ে গেছে। অন্যদিকে ডান হাত নিচের বগলের নিচে চাপ দিয়ে রেখেছে রায়ান। ওদেরকেই আগে রক্তে রঞ্জিত করা হোক। হারামজাদাগুলো নিশ্চয়ই ওদের দুজনের হাত কেটে দিয়েছে। গ্রে মনে মনে প্রার্থনা করল, এতটুকুই যেন হয়। এরচেয়ে জঘন্য যেন না হয়। বুকের ভেতরে প্রচণ্ড ক্রোধ অনুভব করল গ্রে। ওর হৃদয় কেঁপে উঠলেও দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে গেল।

 দাঁত বের করে হাসল বৃদ্ধ। এবার আমরা কথা বলব, ঠিক আছে? একদম ভদ্রলোকের মতো।

 বৃদ্ধের দিকে ঘুরল গ্রে কিন্তু মনিটরের দিকেও নজর রাখল। তা বেশি হয়ে যাচ্ছে। কী জানতে চান? ঠাণ্ডা স্বরে বলল ও।

বাইবেল। ওটার ভেতরে কী পেয়েছেন আপনারা?

 যদি জানাই তাহলে আপনি ওদেরকে ছেড়ে দেবেন?

আর হ্যাঁ, আমি আমার হাত ফেরত চাই! চেঁচিয়ে বলল মনক।

 একবার মনকের ওপর চোখ বুলিয়ে গ্রে বৃদ্ধের দিকে তাকাল।

ইসাককে মাথা নেড়ে ইশারা করলেন ব্যালড্রিক। সে এক গার্ডকে ডাচ ভাষায় কী যেন নির্দেশ দিলো। নির্দেশ পেয়ে জোড়া সুইং ডোরের দিকে এগোল গার্ড। মূল। ভবনের ভেতরে চলে গেল।

যদি আপনি সহায়তা করেন তাহলে আর কোনো ভেজাল হবে না, কথা দিলাম। আর হ্যাঁ, ভদ্রলোকের এক কথা।

 গ্রে অবশ্য এতে কোনো আশার আলো দেখতে পেল না, কারণ মিথ্যে বলা ছাড়া ওর ঝুড়িতে আর কিছুই নেই। একটু পাশে সরে নিজের বাঁধা হাত দেখিয়ে বলল, আমরা যেটা পেয়েছি সেটা মুখে বলে বোঝানো যাবে না। তবে বোর্ডে আঁকা। প্রতীকগুলোর মতোই ওটাও একটা প্রতীক।

 ব্যালড্রিক আবার মাথা নাড়লেন। মুহূর্তের মধ্যে গ্রের হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হলো। দুহাতের কব্জি ডলতে ডলতে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে এগোল গ্রে। একাধিক রাইফেল ওর প্রাণ কেড়ে নেয়ার জন্য সদা প্রস্তুত।

ওকে এমন কিছু আঁকতে হবে যেটা দেখে ব্যালড্রিক সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রাচীন বর্ণমালা সম্পর্কে ওর সেরকম কোনো জ্ঞান নেই। মিউজিয়ামে হিমল্যারের চায়ের পটের কথা মনে পড়ল ওর। পটের গায়ে একটা প্রাচীন বর্ণমালার মত প্রতীক আঁকা ছিল। হয়তো ওটা দিয়ে কাজ হতে পারে। আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে হয়তো এদেরকে সেই প্রতীকের অর্থ উদঘাটনের কাজে ব্যস্তও রাখা সম্ভব হবে।

গ্রে এক টুকরো চক তুলে নিয়ে পটের সেই প্রতীক বোর্ডে আঁকতে শুরু করল

 সামনে ঝুঁকে চোখ ছোট করলেন ব্যালড্রিক। একটা সূর্য চক্র। ইন্টারেস্টিং।

চক হাতে নিয়ে গ্রে বোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। ওকে দেখে মনে হচ্ছে শিক্ষক ছাত্রকে বোর্ডে গিয়ে একটা অংক কষতে বলেছেন… অংক কষা শেষ করে এখন শিক্ষকের রায়ের অপেক্ষায় ছাত্র দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আচ্ছা, তাহলে ডারউইন বাইবেল থেকে আপনি এটা পেয়েছেন? ব্যালড্রিক প্রশ্ন

চোখের কোণা দিয়ে গ্রে খেয়াল করল, ইসাকের ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছে।

ভুল হয়ে গেছে কোথাও।

ব্যালড্রিক গ্রের জবাবের জন্য অপেক্ষা করছেন।

 আগে ওদেরকে ছেড়ে দিন। মনিটর দেখিয়ে দাবি করল গ্রে।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক স্থির দৃষ্টিতে গ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন। গ্রে টের পেল এই ব্যক্তির ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে একটা নৃশংস, ধুরন্ধর, নিষ্ঠুর চেহারা লুকিয়ে আছে। গ্রের মিথ্যে বলা তিনি উপভোগ করছেন মাত্র।

অবশেষে ব্যালড্রিক স্থবিরতা ভাঙলেন। নাতিকে মাথা নেড়ে ইশারা করলেন তিনি।

Wie eerst? ইসাক প্রশ্ন করল। অর্থাৎ, কাকে আগে?

 গ্রের দুশ্চিন্তা হলো। কিছু একটা গড়বড় হয়েছে। অবশ্যই হয়েছে।

নাতির প্রশ্নের জবাব ইংরেজি দিলেন ব্যালড্রিক। গ্রের চোখে চোখ রেখে বললেন,। ছেলেটাকেই আগে ধরো। মেয়েটার ব্যবস্থা পরে করা যাবে।

কি-বোর্ড চেপে ইসাক কমান্ড দিলো।

মনিটরের পর্দায় দেখা যাচ্ছে, রায়ানের নিচে থাকা একটা চোরাদরজা আচমকা খুলে গেল। খাঁচা থেকে চিৎকার করতে করতে নিচে থাকা লম্বা ঘাসের ওপর সজোরে আছড়ে পড়ল বেচারা। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চারিদিকে চোখ বুলাল, পুরোপুরি আতঙ্কিত। গ্রে জানে না, কিন্তু রায়ান জানে সামনে কী বিপদ আসতে যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ আগে ইসাকের বলা কথাগুলো গ্রের মাথায় আবার বেজে উঠল।

আমরা grootvader-এর জন্য অপেক্ষা করছি… তারপর শিকার শুরু হবে।

 কী শিকার?

 নাতিকে নব ঘুরাতে ইশারা করলেন ব্যালজিক।

ইসাক তার দাদার নির্দেশ পালন করতেই রুমে থাকা স্পিকার থেকে আওয়াজ ভেসে আসতে শুরু করল। চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে স্পিকার থেকে।

দৌড়াও, রায়ান! গাছে উঠে বসো। ফিওনার গলার চিৎকার, পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে।

এক পাক ঘুরেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড় শুরু করল রায়ান। পর্দার বাইরে চলে গেল। কিন্তু জঘন্য ব্যাপার হলো, হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছে গ্রে। ক্যামেরার দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকা গার্ডরা হাসছে।

এবার স্পিকার থেকে নতুন চিৎকার শোনা গেল। এটাকে চিৎকার না বলে গর্জন বলা ভাল।

পাশবিক, রক্তহিম করা গর্জন।

গর্জনের প্রভাবে গ্রের শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেল।

ব্যালড্রিক ঘাড় নেড়ে ইশারা করতেই বন্ধ হয়ে গেল স্পিকার।

আমরা এখানে শুধু অর্কিড-ই চাষ করি না। বুঝেছেন, কমান্ডার পিয়ার্স? ভদ্রতার মুখোশ খুলে বললেন ব্যালড্রিক।

আপনি কথা দিয়ে ছিলেন। বলেছিলেন… আপনি এক কথার মানুষ। গ্রে বলল।

বলেছিলাম, যদি আপনি সহায়তা করেন! ব্যালড্রিক ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। বোর্ডের দিকে হাত তুলে বললেন, আপনার কী মনে হয়, আমরা গাধা? ঘাস খাই? ডারউইন বাইবেল থেকে নতুন করে আর কিছু জানার নেই, সেটা আমরা খুব ভাল করেই জানতাম। আমাদের যা জানার দরকার ছিল সেটা আমরা আগেই জেনে গেছি। এটা স্রেফ একটা টেস্ট ছিল। অবশ্য আপনাদেরকে এখানে আনার অন্য একটা কারণ আছে। প্রশ্নের জবাব দরকার।

নিজের কানে এইমাত্র যা শুনলো সেগুলো হজম করতে গ্রের কষ্ট হচ্ছে। তাহলে গ্যাস…

 ওটা দিয়ে আপনাদেরকে অক্ষম করার চেষ্টা করা হয়েছিল। মেরে ফেলার জন্য নয়। তবে আপনার নাটকটা বেশ ভালই লেগেছে। বাহবা পাওয়ার মতো নাটক করতে জানেন আপনি। তবে এখন আর ওসবে কাজ হবে না। মনিটরের দিকে এগিয়ে গেলেন ব্যালড্রিক। আপনি এই পিচ্চি মেয়েটাকে বাঁচাতে চান, তাই তো? মেয়েটা খুব ঝাল ঝাল ধাঁচের। সে যা-ই হোক। আপনাকে দেখাচ্ছি জঙ্গলে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে।

তিনি মাথা নাড়তেই ইসাক একটা বাটনে চাপ দিলো। নতুন একটা ছবি চলে এলো মনিটরের একপাশে।

ভয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল গ্রের।

 ব্যালড্রিক বললেন, আমরা আপনার এক সাথীর কথা জানতে চাই। তার আগে বলে রাখি, কোনোপ্রকার ছল-চাতুরি আর কাজ করবে না। আশা করি ইতোমধ্যে সেটা বুঝতে পেরেছেন। নাকি আরেকটা নমুনা দেখাব?

মনিটরের দিকে চোখ রেখেই গ্রে প্রশ্ন করল, কে? কার কথা জানতে চান আপনি?

আপনার বস। পেইন্টার ক্রো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *