০৯. স্যাবোটিউর

০৯. স্যাবোটিউর

দুপুর ১২টা ৩২ মিনিট।
হিমালয়।

সিগন্যাল আসছে কোত্থেকে? প্রশ্ন করলেন অ্যানা।

 গানধারের কল পাওয়ার পর মেইনটেন্যান্স রুমে ছুটে এসেছেন তিনি। লিসাকে সাথে আনেননি, সে লাইব্রেরিতে রয়ে গেছে। পেইন্টার ভাবল, অ্যানা এখনও ওদের দুজনকে একটু আলাদা করে রাখতে চান।

অবশ্য এর ভাল দিকও আছে। লিসার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে।

তার ওপর স্যাবোটেজকারীকে খুঁজে বের করার জন্য এটাই যদি সঠিক পথ হয় তাহলে তো কথাই নেই।

 ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে ঝুঁকে আঙুলের ডগা ডলল পেইন্টার। ওর নখের ওখানটায় কেমন যেন টনটন করছে, চুলকাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ক্যাসলের থ্রিডি নকশায় পয়েন্ট করার জন্য আঙুল ডলা বন্ধ করল।

 মোটামুটি এই হলো জায়গা, বলল পেইন্টার, স্ক্রিনে হাত দিয়ে দেখাল ও। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ক্যাসলের বিস্তৃতি দেখে বিস্মিত না হয়ে পারল না। পাহাড়ের চুড়োর দিকে গর্ত করে ক্যাসল এগিয়ে গেছে। সিগন্যাল আসছে দূরবর্তী প্রান্ত থেকে। তবে এটা নিখুঁত নয়। স্যাবোটাজকারী তার স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহার করলে ভোলা জায়গায় যেতে হবে।

সোজা হলেন অ্যানা। ওখানে একটা হেলিপ্যাড আছে।

ঘোত শব্দ করে সায় দিল গানথার।

স্ক্রিনে থাকা সিগন্যাল পালসগুলো হঠাৎ করে ধসে পড়ল। সে কথা শেষ করেছে, বলল পেইন্টার। আমাদেরকে দ্রুত এগোতে হবে।

 গানথারের দিকে ফিরল অ্যানা। ক্লাউসের সাথে কথা বলে ওর লোকজনকে হেলিপ্যাডের কাছে থাকতে বলল। এখুনি!

দেয়ালে থাকা ফোন রিসিভারের কাছে গিয়ে লকডাউন করল গানথার। প্ল্যান হলো : সিগন্যাল পাঠিয়ে চেক করা হবে কার কাছে স্যাট-ফোন আছে।

অ্যানা পেইন্টারের দিকে ফিরলেন। আপনার সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ। আমরা এখান থেকে সার্চ শুরু করব।

আমি হয়তো আরও একটু সাহায্য করতে পারব। ল্যাপটপে ব্যস্ত হাতে টাইপ করছে পেইন্টার। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নাম্বারটির ও মাথা রাখল। আপনাদের কাছ থেকে একটা পোর্টেবল স্যাটেলাইট ফোন নিতে হবে।

হাতে ফোন দিয়ে আপনাকে আমি এখানে বসিয়ে রেখে যেতে পারি না, বলতে বলতে নিজের কপালের দুপাশ আঙুল দিয়ে চেপে ধরলেন তিনি। মাথাব্যথা হচ্ছে।

আমাকে এখানে রেখে যেতে হবে না। আমিও আপনাদের সাথে হেলিপ্যাডে যাচ্ছি।

কাজ সেরে এগিয়ে এলো গানথার। বরাবরের মতো মুখ হাঁড়ি করে রেখেছে।

ওকে হাতের ইশারায় সরে যেতে বললেন অ্যানা। তর্ক করার মতো সময় নেই আমাদের। তবে দুই ভাই-বোনের ভেতরে নীরবে কথা হয়ে গেল। পেইন্টারের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন অ্যানা।

আঙুল ডলতে ডলতে পেইন্টার তার পিছু নিল। ওর নখগুলো এখন জ্বলে যাচ্ছে। প্রথমবারের মত নখের দিকে নজর দিল ও। ভেবেছিল নখগুলো লাল হয়ে গেছে কিন্তু অবাক হয়ে খেয়াল করল ওগুলোর রং ফ্যাকাসে, রক্তশূন্য।

ফ্রস্টবাইট?

ক্যাসলের একটি ফোন ওর হাতে দিল গানথার। পেইন্টারের মনোযোগ দেখে মাথা নাড়ল সে। নিজের একহাত সামনে বাড়িয়ে দিল। প্রথমে পেইন্টার কিছু বুঝতে না পারলেও পরে খেয়াল করে দেখল গানখারের শেষ তিন আঙুলে কোনো নখ নেই।

 হাত নামিয়ে আনার পিছু পিছু এগোল গানথার।

নিজের আঙুলগুলো আর একটু ডলে ডলাডলি বন্ধ করল গ্রে। আচ্ছা, তাহলে এগুলো ফ্রস্টবাইট নয়। কোয়ান্টাম রোগের প্রভাব। বেল থেকে যেসব বিকৃতি হয়েছিল সেগুলো মনে করল ও : হাতের আঙুল, কান, পায়ের আঙুল নেই।

হাতে আর কত সময় আছে?

পাহাড়ের দূর প্রান্তে এগোতে এগোতে গানথারকে পর্যবেক্ষণ করল পেইন্টার। এই লোক সারা জীবন মাথার ওপর মৃত্যুঘণ্টা নিয়ে কাটিয়ে দিলো। দীর্ঘস্থায়ী রোগ তার শরীরে বাসা বেঁধে বসে আছে, যার চূড়ান্ত পরিণতি পাগল হয়ে যাওয়া। পেইন্টারও সেদিকেই এগোচ্ছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, বিষয়টা পেইন্টারকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে… তবে ভয়টা যতটা না শারীরিক তারচেয়ে বেশি মানসিক।

আর কতক্ষণ ঠিকভাবে বাঁচবে ও?

গানথার ওর মনের কথা বুঝতে পেরে বলল, অ্যানার কিছু হতে দেব না আমি। এই রোগ থামানোর জন্য যা দরকার হয় করব। গর্জনের মতো শোনাল ওর কণ্ঠ।

পেইন্টারের মনে পড়ল, এরা তো দুই ভাই-বোন। এদের ঠোঁটের বাক, থুতনি আর ড্র-তে মিল আছে। অবশ্য এরা ভাই-বোন এটা জানার আগপর্যন্ত এই মিলগুলো পেইন্টারের চোখে পড়েনি। তবে মিল বলতে এটুকুই। অ্যানার চুল কালো কুচকুচে, চোখগুলো তীক্ষ্ণ। তার সাথে গানথারের মিল নেই। অবশ্য গানখারের জন্ম হয়েছে বেল-এর অধীনে। Sonnekonige এর শেষ বংশধর।

হলওয়ে পার হয়ে সিঁড়িতে পা রাখতে রাখতে পেইন্টার পোর্টেবল ফোনের পেছনের অংশ খুলে ফেলে পকেটে ভরল। ব্যাটারি খুলে নিয়ে ওটার সাথে অ্যামপ্লিফায়ারের আন্টেনার তার পৌঁছিয়ে নিল ও। আচমকা সিগন্যাল পাঠানো হবে, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য, তবে ওতেই কাজ হয়ে যাবে।

কী এটা? গানথার জানতে চাইল।

জিপিএস স্নিফার। কল করার সময় অ্যামপ্লিফায়ারে স্যাবোটেজকারীর ফোনের চিপ সম্পর্কিত তথ্য রেকর্ড করা হয়েছে। যদি তাকে কাছে পাই তাহলে এই রেকর্ড ব্যবহার করে ধরে ফেলা সম্ভব।

ঘোঁত ঘোত করল গানথার।

দেখা যাক সামনে কী হয়।

চওড়া প্যাসেজে গিয়ে সিঁড়ি শেষ হয়েছে। এতটাই চওড়া যে এখানে চাইলে ট্যাঙ্ক নামিয়ে দেয়া যাবে। স্টিলের পুরোনো রাস্তা সোজা এগিয়ে গেছে পাহাড়ের ভেতরে। এই রাস্তার শেষ প্রান্তে হেলিপ্যাড় অবস্থিত। মূল ক্যাসল থেকে বেশ দূরে সেটা। একটি ফ্ল্যাটবেড কারে চড়ল ওরা। হ্যান্ডব্রেক ছেড়ে ইলেকট্রিক মোটর চালু করল গানথার, ফ্লোর প্যাডেলে চাপ দিল। এই বাহনে কোনো সিট নেই। স্রেফ ঘের দেয়া। প্যাসেজের দিকে এগোচ্ছে ওরা। পেইন্টার রেইল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আলো জ্বলছে ওদের মাথার ওপর।

এটা তাহলে আপনাদের সাবওয়ে সিস্টেম… বলল পেইন্টার।

এটাকে জিনিসপত্র আনা-নেয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়, ব্যথার চোটে অ্যানা কুঁচকে রেখেছেন। এখানে আসার সময় পিল নিয়েছেন দুটো। ব্যথা কমানোর জন্য?

সারি সারি স্টোর রুম পার হলো ওরা। ওগুলোর ভেতরে ব্যারেল, বাক্স, সিন্দুক দিয়ে বোঝাই হয়ে আছে। মিনিটখানেকের মধ্যে ওরা প্যাসেজের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল। এখানকার বাতাস বেশ গরম, গন্ধকের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। বাহন থেকে নামতেই পেইন্টারের পায়ে হালকা কাপুনি অনুভূত হলো।

ওরা আসলে নিচে নয় উপরে যাচ্ছে।

এখান থেকে খাড়া ঢাল উঠে গেছে উপরে। বেশ চওড়া র‍্যাম্প। উপরে উঠে বিশাল ভোলা জায়গায় এসে পড়ল ওরা। কমার্শিয়াল এয়ারফিল্ডের মতো লাগছে জায়গাটিকে। ক্রেন, ফোর্কলিফট, ভারি যন্ত্রপাতি সবই আছে। মাঝখানে চুপ করে বসে আছে দুটো এ-স্টার ইকুইরিল হেলিকপ্টার। একটা সাদা, অন্যটি কালো। খেপে যাওয়া ভীমরুলের মতো দেখতে ওগুলো। অত্যধিক উচ্চতায় উড্ডয়নের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে।

ওদেরকে এগোতে দেখে বিশালদেহি ক্লাউস সামনে এগিয়ে এলো। অ্যানাকে ছাড়া অন্য কাউকে পাত্তাই দিল না। সব ঠিক আছে। খাস জার্মান ভাষায় জানাল সে।

একপাশে সারি সারি লোকজন দাঁড় করানো আছে। নারী-পুরুষ সবাই। এদেরকে পাহারা দিচ্ছে সশস্ত্র গার্ড।

কেউ ফসকে যায়নি তো? অ্যানা প্রশ্ন করলেন।

না, আমরা প্রস্তুত ছিলাম।

চারজন Sonnekonige-কে ক্যাসলের প্রত্যেক এক চতুর্থাংশে বসিয়ে দিয়েছিলেন অ্যানা, যাতে ক্যাসলের যে অংশে যারা আছে সেখান থেকে স্থান পরিবর্তন করতে না পারে। পেইন্টার স্যাবোটাজকারীকে ক্যাসলের যে অংশেই খুঁজে পাক না কেন তাকে ধরতে যেন কোনো অসুবিধা না হয়। এরকম অনুসন্ধান চলার ফলে স্যাবোটাজকারী সাবধান হয়ে যাবে, কোনো সন্দেহ নেই। তাই যা করার একবারেই করতে হবে। দ্বিতীয় কোনো সুযোগ পাওয়া যাবে না।

বিষয়টি সম্পর্কে অ্যানাও জানেন। সামনে এগোলেন তিনি। পেয়েছ…?

পা ফেলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে টলে উঠলেন। গানথার তাকে ধরে সোজা করে দাঁড় করাল, চেহারায় উদ্বিগ্নতার ছাপ স্পষ্ট।

আমি ঠিক আছি, বিড়বিড় করে ভাইকে আশ্বস্ত করলেন অ্যানা।

আমরা সবাইকে সার্চ করেছি, বলল ক্লাউস। অ্যানা হোঁচট খাওয়ার ব্যাপারটা যতটুকু সম্ভব এড়িয়ে গেল সে। এখানে কারও কাছে ফোন কিংবা অন্য কোনো ডিভাইস পাওয়া যায়নি। এবার হেলিপ্যাডে সার্চ শুরু করতে যাচ্ছিলাম আমরা।

 ভ্রু কুঁচকালেন অ্যানা। ঠিক এই ভয়-ই পাচ্ছিলেন তিনি। স্যাবোটোজকারী তার কাজ শেষ করে ফোন বয়ে বেড়াবে না। বরং সেটাকে কোথাও ছুঁড়ে ফেলে দেবে, এটাই স্বাভাবিক।

কিংবা এমনও হতে পারে, পেইন্টার হয়তো হিসেবে ভুল করেছে।

সেক্ষেত্রে, পেইন্টারকেই নিজের ভুল শুধরে নিতে হবে।

অ্যানার পাশে এসে দাঁড়াল পেইন্টার। নিজের ডিভাইস বের করে বলল, আমি বরং ফোন খোঁজার কাজ শুরু করি।

সন্দেহের দৃষ্টিতে অ্যানা ওর দিকে তাকালেন। কিন্তু হাতে কোনো বিকল্পও নেই।সম্মতি দিয়ে মাথা নাড়লেন তিনি।

গানথারও লেগে রইল।

স্যাটেলাইট ফোন বের করে চালু করল পেইন্টার। মুখস্থ করে রাখা ৯ ডিজিটের নাম্বার চাপল। কিন্তু না, কিছুই হলো না। উপস্থিত সবার দৃষ্টি এখন ওর দিকে।

মনোঃসংযোগ করে আবার নাম্বারগুলো চাপল ও।

 হচ্ছে না।

 নাম্বার ভুল হয়েছে? ও কি নাম্বার গুলিয়ে ফেলেছে?

কী সমস্যা? প্রশ্ন করলেন অ্যানা।

ফোনের ছোট্ট ক্রিনের দিকে তাকাল পেইন্টার। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নাম্বারগুলো আবার পড়ল। ধরা পড়েছে। আমি শেষের দুই ডিজিট এদিক-ওদিক করে ফেলেছিলাম। ঠিক করছি।

 মাথা ঝাঁকিয়ে নাম্বারগুলোকে আবার টাইপ করতে শুরু করল ও। মনোযোগ দিয়ে ধীরে ধীরে। অবশেষে ঠিকভাবে নাম্বার ভোলা হলো। বাটন চাপা শেষে চোখ তুলতেই অ্যানার সাথে চোখাচোখি হলো ওর। দক্ষতার অভাবে এই ভুল হয়নি, এই ভুল হয়েছে পরিস্থিতির চাপে কারণে। অ্যানা বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন। সঠিকভাবে বাটন চাপতে পারাকে মানসিক তীক্ষ্ণতার পরিচায়ক হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।

যদিও এটা একটা সাধারণ টেলিফোন নাম্বার।

 তবে সাধারণ হলেও গুরুত্বপূর্ণ।

নাম্বার নিশ্চিত হয়ে ট্রান্সমিট বাটনে চাপ দিল পেইন্টার।

মিলিসেকেন্ড পর চেম্বারে একটি ফোন বেশ উচ্চ আওয়াজে বেজে উঠল।

 সবকটি চোখ ঘুরল ওদিকে।

 ক্লাউস।

 সে এক পা পেছালো।

আপনাদের স্যাবোটাজকারী…ঘোষণা করল পেইন্টার।

 অভিযোগ অস্বীকার করার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল ক্লাউস… কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে হ্যান্ডগান বের করল। ওর চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আছে।

সেকেন্ডের মধ্যে গানথার তার এমকে-২৩ পিস্তল দিয়ে ক্লাউসকে উপযুক্ত জবাব দিল।

ছুটল বুলেট।

অস্ত্রটি ছিটকে পড়ে গেল ক্লাউসের হাত থেকে।

সামনে এগিয়ে এসে গানথার নিজের ধোঁয়া ওঠা পিস্তলের ব্যারেল নিয়ে ক্লাউসের গালে ঠেসে ধরল। গরম মাজলের ছোঁয়া লাগতেই চরচর করে উঠল ঠাণ্ডা মাংস, দাগ বসে গেছে। কিন্তু ক্লাউস নির্বিকার। মুখ কুঁচকালো না পর্যন্ত! স্যাবোটোজকারীকে প্রাণে মারা যাবে না। প্রয়োজনীয় প্রশ্ন-উত্তরগুলো জানতে হবে। গর্জন করে প্রথম প্রশ্ন করল গানথার।

কেন? কীসের জন্য?

ভাল চোখ দিয়ে ওর দিকে তাকাল ক্লাউস। অন্য চোখ আগের জায়গায় চুপ করে রইল, প্যারালাইসিস। ওর ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি, খুব ভয়ানক দেখাচ্ছে সেটা। মেঝেতে চাটি মেরে বলল, Leprakonige দের অপমানকাল শেষ করার জন্য করেছি।

অনেকদিন চাপা থাকা ঘৃণা প্রকাশ পেল ওর চেহারায়। পেইন্টার ভেবে দেখল, এই লোকের শিরায় শিরায় রাগ-ঘৃণা জমানো ছিল। বছরের পর বছর ধরে অপমান সহ্য করেছে, এদিকে শারীরিকভাবেও বিকলাঙ্গ। সুস্থ হয়ে জন্ম নিয়ে রাজপুত্রের মতো ছিল অথচ এখন ব্যঙ্গ শুনতে হয়। পেইন্টার আন্দাজ করল, এর পেছনে শুধু রাগ, ক্ষোভ নয় আরও কিছু আছে। ক্লাউসকে ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে কেউ।

কিন্তু কে সে?

ভাই, গানথারকে বলল ক্লাউস, এভাবে অর্ধ-মৃতের মতো বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। আমাদের চিকিৎসা আছে। ওর কণ্ঠস্বরে আশার রেশ পাওয়া গেল। মানুষদের মধ্যে আমরা আবার রাজার আসন পেতে পারি।

আচ্ছা, বিশ্বাসঘাতকতা করার পেছনে তাহলে এই কাহিনি।

 রোগমুক্তির আশ্বাস।

তবে গানথার এসবে টলল না। আমি তোমার ভাই নই, একদম মন থেকেই বলল সে। আমি কখনও রাজা ছিলাম না।

এই দুই ব্যক্তির মধ্যেকার ফারাকটা টের পেল পেইন্টার। গানখারের চেয়ে ক্লাউস বয়সে প্রায় এক যুগ বড়। সে একসময় এখানে রাজপুত্রের আদরে বড় হয়েছে,কিন্তু সেটা এখন শুধুই ইতিহাস। অন্যদিকে গানথারের জন্ম টেস্টের শেষে দিকে। অঙ্গহানি আর পাগলামোর ব্যাপারটা তখন মোটামুটি সবাই জানে। তাই গানথার জনের পর থেকে কখনই রাজপুত্রের সমাদর পায়নি। সে তার বর্তমান জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে আসছে একদম ছোটবেলা থেকে।

এছাড়াও ওদের দুজনের মধ্যে জটিল একটা পার্থক্য আছে।

বিশ্বাসঘাতকতা করে তুমি অ্যানাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছ, বলল গানথার। তোমাকে এবং তোমাকে যে বা যারা সাহায্য করছে তাদের কাউকে আমি ছাড়ব না।

ক্লাউস দমল না। বলল, অ্যানাকেও সুস্থ করা সম্ভব। আয়োজন করা যাবে, সমস্যা নেই।

 গানপারের চোখ সরু হয়ে গেল। ক্লাউস বুঝতে পারল গানথার দ্বিধায় পড়ে গেছে। গানথার নিজের কথা নয়, বোনের কথা চিন্তা করছে। ওকে মরতে দেব না।

 গানথার আগে কী বলেছিল মনে করল পেইন্টার। অ্যানার কিছু হতে দেব না আমি। এই রোগ থামানোর জন্য যা দরকার হয় করব। তার মানে সে কী সবার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতেও প্রস্তুত? এমনকী বোনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও?

চিকিৎসা হবে, এই নিশ্চয়তা তোমাকে কে দিয়েছে? অ্যানা কঠিন গলায় প্রশ্ন করলেন।

হাসল ক্লাউস। তোমাদের চেয়ে অনেক ভাল মানুষ আমাকে এই কথা দিয়েছেন। এখান থেকে সরিয়ে নিতে হবে তোমাদের। অনেক কাজ করেছ এখানে। আর দরকার নেই।

উচ্চশব্দে কিছু একটা বিস্ফোরিত হলো পেইন্টারের হাতে। অ্যামপ্লিফায়ার শর্ট সার্কিট হয়ে ব্যাটারি ফেটে গেছে। জ্বলছে আঙুলগুলো। ধোঁয়া ওঠা স্যাট-ফোন হাত থেকে ফেলে দিল পেইন্টার। হেলিপ্যাডের দরজার দিকে তাকাল ও। মনে মনে বলল, যথেষ্ট সময় টিকেছিল অ্যামপ্লিফায়ারটি।

তবে এই বিস্ফোরণের ফলে শুধু পেইন্টারের-ই মনোযোগ সরে যায়নি, অন্য সবারও দৃষ্টি সরে গেছে। সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে। এমনকি গানথারও বাদ যায়নি।

এই সুযোগে ক্লাউস একটি হান্টিং নাইফ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। গুলি ছুড়ল গানথার। কিন্তু ততক্ষণে ছুড়ি এসে গানপারের কাঁধের মাংসে জায়গা করে নিয়েছে। ক্লাউস ঝাঁপিয়ে এসে পড়েছে গানথারের ওপর।

খাবি খেয়ে ক্লাউসকে মেঝের উপর ছুঁড়ে ফেলল গানথার।

মেঝেতে আছড়ে পড়লেও ক্লাউস নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। পেট চেপে ধরল সচল হাত দিয়ে। পেটের জখম থেকে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কাশল ক্লাউস। আরও রক্ত বেরোল এবার। টকটকে লাল রক্ত। গানথারের ছোঁড়া গুলি ওকে বেশ মারাত্মকভাবে জখম করেছে।

অ্যানা তাড়াতাড়ি তার ভাই গানথারের কাছে গেলেন। ছুড়ির আঘাত পরীক্ষা করে দেখতে চান। কিন্তু গানথার তাকে সরিয়ে দিল। এখনও ক্লাউসের দিকে পিস্তল তাক করে রেখেছে সে। গানথারের হাতা চুঁইয়ে রক্ত পাথুরে মেঝেতে গিয়ে পড়ছে।

হাসল ক্লাউস, বলল, মরবে তোমরা সবাই মরবে! রশির বিষ গেড়ো চেপে ধরলেই মরবে সবকটি!

আবার কাশল ও। রক্তের বন্যা বয়ে গেছে ওর আশেপাশে। শেষবারের মতো কেপে উঠে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ল ক্লাউস। গানথার নিজের পিস্তল নিচু করল। ক্লাউসের দিকে পিস্তল তাক করে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। শেষ নিঃশ্বাস ফেলে বড়সড় দেহটা স্থবির হয়ে গেল।

মৃত।

এবার বোনকে জখমের পরিচর্চা করতে দিল গানথার। আপাতত এক টুকরো কাপড় দিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত স্থান বেঁধে দেয়া হলো, মূল পরিচর্চা পরে করা হবে।

ক্লাউসের লাশের পাশে গেল পেইন্টার। কিছু একটা ওর মনে খুঁতখুঁত করছে। রুমের বাকি সবাই চারিদিকে এসে দাঁড়াল। ভয় আর আশা মেশানো কণ্ঠে কথা বলছে তারা। ওরা শুনতে পেয়েছে চিকিৎসার ব্যাপারে শুনতে পেয়েছে।

পেইন্টারের সাথে অ্যানাও যোগ দিল। আমাদের টেকনিশিয়ান দিয়ে ওর স্যাটেলাইট পরীক্ষা করিয়ে নেব। হয়তো এখান থেকে সামনে এগোনোর সূত্র পাওয়া যেতে পারে স্যাবোটাজের পেছনে কার হাত আছে।

যথেষ্ট সময় নেই, বিড়বিড় করল পেইন্টার। অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু ভাবতে চেষ্টা করল। কিন্তু আসল ব্যাপারটাকে ধরি ধরি করেও কেন যেন ধরতে পারছে না।

লাশের পাশে হাঁটতে হাঁটতে ক্লাউসের কথাগুলো ভাবল ও।

 …মানুষদের মধ্যে আমরা আবার রাজার আসন পেতে পারি।

 …অনেক কাজ করেছ এখানে। আর দরকার নেই।

চিন্তা করতে গিয়ে আবার মাথাব্যথা শুরু করল পেইন্টারের।

ইন্ডাসট্রিয়াল এসপিয়োনাজের এই খেলায় ক্লাউসকে নিশ্চয়ই ডাবল এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। কেউ একজন এখানকার সমান্তরালে রিসার্চ করে যাচ্ছে। এখন যেহেতু এই ক্যাসলের কাজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত এগিয়ে যাচ্ছে তাই প্রতিযোগীকে ধ্বংস করে রাস্তা পরিষ্কার করতে যাচ্ছে কেউ।

আচ্ছা, ও কি সত্য কথা বলেছে? প্রশ্ন করল গানথার।

একটু আগে এই বিশালদেহির ভেতরে যে দ্বিধা তৈরি হতে দেখেছিল সেটা ভাবল পেইন্টার। নিজের আর বোনের চিকিৎসার আশ্বাস তাকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু সে-সব ক্লাউসের সাথে মারা গেছে।

তবে ওরা হাল ছাড়েনি।

হাঁটু গেড়ে বসল অ্যানা। ক্লাউসের পকেট থেকে একটি ছোট ফোন বের করল। আমাদেরকে দ্রুত কাজ করতে হবে।

আপনি সাহায্য করতে পারবেন? ফোন দেখিয়ে পেইন্টারকে জিজ্ঞেস করল গানথার। ফোনের অপর পাশে কে কথা বলেছে সেটা জানতে পারলে ওদের আশা এখনও বাঁচবে।

যদি কল ট্রেস করা যায়… উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন অ্যানা।

মাথা নাড়ল পেইন্টার। না, অক্ষমতার জন্য নয়। আসলে ওর চোখ ব্যথা করছে। মাইগ্রেনের যন্ত্রণায় দপদপ করছে মাথা। তবে ওর মাথা নাড়ার কারণ এগুলোও নয়।

কিছু একটা… ধরবে ধরবে করছে কিন্তু ধরতে পারছে না…

ওর কাছে এগিয়ে এলেন অ্যানা, ওর কনুই ছুঁয়ে বললেন, এতে আমাদের দুপক্ষেরই…

জানি আমি, ঝামটা দিল পেইন্টার। এখন মুখ বন্ধ রাখুন! আমাকে ভাবতে দিন।

ওর কনুই ছেড়ে দিলেন অ্যানা।

পেইন্টারের হঠাৎ গর্জনে পুরো রুম একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। ওর মনে কিছু একটা খচখচ করে যাচ্ছে… ও সেটাকে বের করতে চাইছে কিন্তু হচ্ছে না। একধরনের মানসিক যুদ্ধ করছে ও।

 স্যাট-ফোন… এই স্যাট-ফোনে কিছু একটা আছে… কিন্তু… মাথাব্যথার মধ্যে বিড়বিড় করল পেইন্টার। কিন্তু কী সেটা?

অ্যানা নরম স্বরে বললেন, কী বলতে চাচ্ছেন?

এবার মাথায় ধরেছে! ও এত বেখেয়ালি হলে কী করে?

ক্লাউস জানতে এই ক্যাসল ইলেকট্রনিক তদারকির অধীনে আছে। তারপরও ফোন করল কেন? নিজেকে কেন প্রকাশ করল? এই ঝুঁকি নেয়ার অর্থ কী?

 ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল ওর শরীর দিয়ে। অ্যানার দিকে ঘুরল ও। গুজব। আমরা গুজব ছড়িয়ে ছিলাম কিছু জেরাম-৫২৫ এখনও অক্ষত আছে। এটা যে আসলে ভুয়া গুজব ছিল সেটা তো শুধু আমরাই জানতাম, তাই না?

রুমে উপস্থিত অন্যান্যে হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রেগেও গেল কয়েকজন। গুজব শুনে তাদের ভেতরে আশার সঞ্চার হয়েছিল। ভেবেছিল বেল হয়তো নতুন করে কার্যকর করা যাবে। অথচ এখন শোনা যাচ্ছে সেই গুজব-ই ভুয়া!

তবে এরা ছাড়া অন্য একজনও গুজবটিকে সত্য বলে ধরে নিয়েছিল।

 গানথারও জানতো, জঘন্য একটা ভীতি নিয়ে বললেন অ্যানা।

 হেলিপ্যাডের ওদিকে হেঁটে গেল পেইন্টার। ক্যাসলের নকশা কল্পনা করল ও। এখন ও বুঝতে পারছে ক্লাউস কেন এখান থেকে ফোন করেছিল। বেজন্মটা ভেবেছিল সে ধরা পড়বে না। এতটাই আত্মবিশ্বাস ছিল যে, ফোনটাকে দূরে সরিয়ে রাখারও প্রয়োজনবোধ করেনি। তবে হ্যাঁ, বেশ হিসেব কষে এই জায়গাটা ঠিক করেছে।

 অ্যানা, আপনি যখন গুজব ছড়াচ্ছিলেন তখন কী এটাও বলে ফেলেছেন, জেরাম ৫২৫ কোথায় রাখা আছে। বিস্ফোরণের হাত থেকে ওটা কীভাবে রক্ষা পেল, বলে দিয়েছেন?

হুম, আমি বলেছিলাম জেরাম-৫২৫ একটা ভল্টে রাখা আছে।

ভল্ট? কীসের ভল্ট?

 বিস্ফোরণস্থল থেকে দূরে। আমার স্টাডিতে। কেন?

স্টাডি হলো ক্যাসলের আরেক মাথায়।

আমাদের সাথে খুঁটিবাজি করা হয়েছে, বলল পেইন্টার। ক্যাসল মনিটর করা হচ্ছে জেনেও ক্লাউস এখান থেকে ফোন করেছিল। আপনার স্টাডি থেকে দৃষ্টি সরানোর জন্য আমাদেরকে ইচ্ছে করে এখানে নিয়ে এসেছে সে। কারণ, আপনার ছড়ানো গুজব অনুযায়ী, স্টাডির কোনো একটা গোপন ভল্টে জেরাম-৫২৫ রাখা আছে।

 এখনও বুঝে উঠতে পারেননি অ্যানা, মাথা নাড়লেন।

ক্লাউসের ফোন করাটা ভুয়া ছিল। ওদের আসল উদ্দেশ্য হলো, সর্বশেষ বেঁচে যাওয়া জেরাম-৫২৫-এর ক্ষতি করা।

চোখ বড় বড় হয়ে গেল অ্যানার।

গানথারও বিষয়টা বুঝতে পেরেছে। দ্বিতীয় একজন স্যাবোটোজকারী আছে তাহলে।

হ্যাঁ, আমরা এখানে ছুটে এসেছি, এই সুযোগে সে জেরাম-৫২৫-এর দফারফা করবে।

আমার স্টাডি, পেইন্টারের দিকে ফিরে বললেন অ্যানা।

পেইন্টার কথাটির গভীরতা টের পেল। অ্যানার স্টাডিতে স্যাবোটোজকারীর তাপের মুখে কেউ একজন পড়তে যাচ্ছে।

.

লোহার মইয়ে চড়ে লাইব্রেরির উপরের অংশে এসেছে লিসা। এক হাত বেলকুনির রেলিঙে রেখে ঘুরে ঘুরে দেখছে।

গত এক ঘণ্টা যাবত কোয়ান্টাম মেকানিক্স সংক্রান্ত বিভিন্ন বই ও পেপার সংগ্রহ করেছে ও। খুঁজতে খুঁজতে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের মূল গবেষণাগ্রন্থও পেয়ে গেল। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক হলেন কোয়ান্টাম থিওরির জনক। এই থিওরিতে কণিকা সংক্রান্ত এক জগতের কথা বলা আছে, যেখানে এনার্জীকে ছোট ছোট প্যাকেটে টুকরো করা যায়। ওগুলোর নাম কোয়ান্টা, আর সেগুলো কণিকা ও তরঙ্গ দুইরকম আচরণ-ই করতে পারে।

এসব পড়ে মাথাব্যথা হয়ে গেল সিসার।

 এসবের সাথে বিবর্তনের সম্পর্ক কোথায়?

হয়তো সেই উত্তরের ভেতরেই রোগের চিকিৎসা লুকিয়ে আছে।

এসব বাদ দিয়ে, শেলফ থেকে একটি বই নিল ও। কভার পড়ে দেখল। অক্ষরগুলো অস্পষ্ট।

ভলিউম ঠিক আছে তো?

 দরজার ওদিকে আওয়াজ ভেসে আসছে, শুনতে পেল লিসা। ও জানে দরজায় গার্ড পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু আওয়াজ কীসের? অ্যানা ফিরছেন নাকি? স্যাবোটোজকারীকে পাওয়া গেছে? মইয়ের দিকে এগোল লিসা। ও মনে মনে আশা করল, পেইন্টারও যেন লিসার সাথে থাকে। পেইন্টারকে ছেড়ে একা থাকতে ওর ভাল লাগছে না। সে হয়তো এই অদ্ভুত থিওরির মাথামুণ্ড বের করতে পারবে।

মইয়ের কাছে পৌঁছে নিচে নামতে শুরু করল লিসা। প্রথম ধাপে পা রেখেছে মাত্র।

এমনসময় তীক্ষ্ণ চিৎকারে ও নিজের জায়গায় থমকে দাঁড়াল। চিৎকারটা শুরু হতে গিয়েই থেমে গেছে।

দরজার ঠিক বাইরে হয়েছে সেটা।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ফলস্বরূপ লিসা নিজেকে উপরে তুলে বেলকুনিতে চলে গেল। ছায়ায় আশ্রয় নিল ও।

লিসা চুপ করে ছায়ায় ঘাপটি মেরে আছে। এমতাবস্থায় রুমের দরজা একবার খুলে বন্ধ হলো। রুমে ঢুকল একজন। নারী। তার পরনে সাদা পরিকা। কিন্তু এই নারী তো অ্যানা নন। পারকার হুড নামিয়ে একটি স্কার্ফ খুলল সে। সাদা চুল আর ভূতের মতো ফ্যাকাসে চেহারা তার।

এই নারী বন্ধু নাকি শত্রু?

সেটা না জানা পর্যন্ত লুকিয়ে থাকবে লিসা।

এই মহিলাকে বেশ আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে। চোখ বুলিয়ে রুমে কী যেন খুঁজছে সে। আধ পাক ঘুরতেই তার জ্যাকেটে লেগে থাকা রক্ত চোখে পড়ল। তার হাতে একটি বাঁকানো কাটানা দেখা যাচ্ছে। এটা জাপানিজ ফলাযুক্ত জাপানিজ অস্ত্র। ওটার ফলা থেকে রক্ত চোয়াচ্ছে।

রুমের ভেতরে ধীরে ধীরে ঘুরছে সে।

অনুসন্ধান চালাচ্ছে।

নিঃশ্বাস খুব সাবধানে ফেলছে লিসা। মনে মনে প্রার্থনা করল ছায়া যেন ওকে পুরোপুরি ঢেকে রাখে। লাইব্রেরির কয়েকটি বাতি নিচ তলা আলোকিত করে রেখেছে, এছাড়াও ফায়ারপ্লেসের আগুন যোগ করছে বাড়তি আলো। কাঠের আগুন পুড়ে পুড়ে হঠাৎ হঠাৎ আলোর পরিমাণ বেড়ে গেলেও উপরের তলা ততটা আলোকিত হলো না।

এই আলোক সল্পতা কী ওর লুকিয়ে থাকার জন্য যথেষ্ট? লিসা দেখল আগন্তক মহিলাটি আরেকবার চক্কর দিয়ে রুমের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। রক্তাক্ত কাটানা হাতে ধরা আছে, একদম প্রস্তুত।

সন্তুষ্টচিত্তে মহিলাটি অ্যানার ডেস্কের দিকে এগোল। ডেস্কের ওপরে থাকা এলোমেলো কাগজপত্র এড়িয়ে চওড়া টেবিলের পেছনে চলে গেল সে। দেয়ালের গায়ে ঝুলতে থাকা কাপরের তৈলচিত্রের কাছে গিয়ে সেটাকে সরিয়ে ফেলল। ওটা সরাতেই দেখা গেল দেয়ালে একটি লোহার সিন্দুক সেট-আপ করা আছে।

চিত্রটিকে একপাশে ধরে রেখে কম্বিনেশন লক, হ্যাঁন্ডেল আর দরজার প্রান্ত পর্যবেক্ষণ করল মহিলা।

তাকে ওরকম মনোযোগী হতে দেখে একটু স্বস্তিতে শ্বাস ফেলল লিসা। চুরি যখন করতে এসেছে করুক। যা নিতে চায় নিয়ে চলে যাক। এই মহিলা যদি বাইরের গার্ডকে খতম করে ভেতরে ঢুকে থাকে তাহলে এটাকে নিজের সুবিধা হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যদি কোনো ফোন যোগাড় করা যায়… কাজে লাগতো।

হঠাৎ জোরে আওয়াজ হওয়ায় চমকে গেল লিসা।

কয়েক ফুট দূরে শেলফ থেকে একটি ভারি বই আছড়ে পড়েছে বেলকুনির ওপর। ধাক্কার ঠেলায় পৃষ্ঠাগুলো এখনও উল্টাচ্ছে একা একা। লিসার মনে পড়ল, একটু আগে এই বইটা শেলফ থেকে বের করেছিল কিন্তু ঠিকভাবে জায়গামতো রাখেনি। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সেটার শাস্তি দিয়েছে। আস্তে আস্তে বইটাকে বাইরের দিকে টেনে নিয়ে আছড়ে ফেলেছে মেঝেতে।

নিচ তলায়, রুমের মাঝখানে এসে দাঁড়াল মহিলা।

তার আরেক হাতে এবার একটি পিস্তল শোভা পাচ্ছে, ওটা উপরের দিকে তাক করা।

লিসার লুকোচুরি খেলা শেষ।

.

সকাল ৯ টা ১৮ মিনিট।
 বারেন, জার্মানি।

বিএমডব্লিউ-এর দরজা খুলল গ্রে। ভেতরে ঢুকবে এমন সময় ওর পেছনে হাঁক শুনতে পেল। হোস্টেলের দিকে ফিরল ও। ছাতা মুড়ি দিয়ে রায়ান হিরজফিল্ড ওদের দিকে ছুটে আসছে। বিজলির চমক আর বৃষ্টির জোয়ারে পার্কিং লটে ভিজে একাকার।

ভেতরে ঢোকো, মনক আর ফিওনাকে নির্দেশ দিল গ্রে।

রায়ান কাছে এসে গ্রের পাশে দাঁড়াল।

আপনারা ক্যাসলে যাচ্ছেন? ওদের দুজনের মাথার ওপর ছাতা ধরে বলল সে।

হ্যাঁ, কেন?

আপনাদের সাথে আমিও আসি?

আমার মনে হয় সেটার দরকার হবে না…।

গ্রেকে থামিয়ে দিল রায়ান। আমার প্রপিতামহ… হিউগো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন আপনারা। সেক্ষেত্রে আমি আপনাদেরকে আরও কিছু তথ্য দিতে পারি। তারজন্য আপনাদেরকে একটু কষ্ট করে ওই পাহাড়ে যেতে হবে।

দ্বিধা করল গ্রে। এই ছেলে নিশ্চয়ই ওর বাবার সাথে গ্রের কথাবার্তায় আড়িপেতে ছিল। নইলে এসব জানল কী করে? আর রায়ান কী এমন জানে যেটা ওর বাবা জানে না? সম্মতির অপেক্ষার আগ্রহ নিয়ে গ্রের দিকে তাকিয়ে আছে রায়ান।

যে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দিল।

ধন্যবাদ। ছাতা বন্ধ করে গাড়িতে চড়ে বসল রায়ান। ফিওনার পাশে নিজের জায়গা করে নিল।

ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি ছাড়ল গ্রে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ওরা এস্টেটের ড্রাইভওয়েতে চলে এলো।

হোস্টেলে থাকাটাই বোধহয় আপনার জন্য ভাল হতো, তাই না? সামনের সিট থেকে পেছন দিকে ফিরে বলল মনক।

এলিসা ফ্রন্ট ডেস্ক সামলে নেবে, রায়ান জবাব দিল। তাছাড়া ঝড়ো আবহাওয়ার ফলে সবাই ফায়ারপ্লেসের কাছে বসে থাকবে। তদারকি করতে খুব একটা কষ্ট হবে না।

 রিয়ারভিউ আয়নায় রায়ানকে পর্যবেক্ষণ করল গ্রে। মনক আর ফিওনার উপস্থিতিতে বেচারাকে একটু নার্ভাস মনে হচ্ছে।

 আপনি আমাদেরকে কী যেন জানাবেন? গ্রে প্রশ্ন করল।

রায়ানের দৃষ্টি আয়নায় পড়ায় গ্রের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল ওর। ঢোক গিলে মাথা নাড়ল। আমার বাবা মনে করে, আমি হিউগো সম্পর্কে কিছুই জানি না। তার ধারণা, অতীতকে মাটিচাপা দিয়ে রাখাই ভাল। কিন্তু শাক দিয়ে কি আর মাছ ঢাকা যায়? ঘটনা কখনও চাপা থাকে না। গুঞ্জন ঠিকই শোনা যায়। ফুফি টোলার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

বিষয়টা গ্রে বুঝতে পারল। পরিবারের গোপন জিনিসগুলো আপনা আপনি উপরে উঠে আসে। যতই গভীরে সেগুলোকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হোক না কেন, লাভ হয় না। যুদ্ধের সময় পূর্বপুরুষদের কার্যবিধি সম্পর্কে জানার কৌতূহল থেকেই হয়তো রায়ান এসব জানতে পেরেছে। ছেলেটার চোখ-মুখে সেটার ছাপ স্পষ্ট।

আপনি নিজে পরিবারের অতীত নিয়ে তদন্ত করেছেন? বলল গ্রে।

হ্যাঁ, তিন বছর ধরে। কিন্তু এসবের শিকড় আরও পেছনে। বার্লিন ওয়ালের ধ্বংস হওয়া কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়ন লুপ্ত হওয়া পর্যন্ত এর বিস্তার।

বুঝলাম না।

 সোভিয়েতের ফাইলগুলো উন্মুক্ত করে দিয়েছিল রাশিয়া, মনে আছে আপনার?

আছে। কিন্তু ওগুলোর সাথে কী সম্পর্ক।

বেশ, উইউইলসবার্গ যখন আবার নির্মাণ করা…

দাঁড়ান! ফিওনা বাগড়া দিল। দুই হাত আড়াআড়ি রেখে রায়ানের পাশে বসে আছে ও। রায়ানের উপস্থিতিতে বোধহয় ও খুব একটা সন্তুষ্ট নয়। গ্রে কয়েকবার রিয়ারভিউ আয়নায় ওকে রায়ানের দিকে তাকাতে দেখেছে। রায়ানের ওয়ালেট এখনও বহাল তবিয়তে আছে কি-না ভাবছে গ্রে। আবার নির্মাণ? মানে ওই জঘন্য জিনিসটাকে তারা পুনরায় বানিয়েছিল? ফিওনা প্রশ্ন করল।

মাথা নাড়ল রায়ান। ক্যাসলটিকে এখন দেখা যাচ্ছে। সিগন্যাল দিয়ে গাড়িকে বার্গস্রাসের দিকে নিল গ্রে। এই রাস্তা ধরে এগোলে ক্যাসলে পৌঁছুনো যাবে। যুদ্ধের শেষ দিকে হিমল্যার এটাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। শুধু উত্তর দিকের টাওয়ারটা অক্ষত ছিল। যুদ্ধের পর এটাকে পুনরায় নির্মাণ করা হয়। ১৯৭৯ সালে কাজ শেষ হয় এটার। বিগত সরকারের সাথে অনেক পিটিশন মোকাবেলা করার পর মিউজিয়ামের পরিচালকরা ক্যাসলের সাথে সম্পর্কযুক্ত প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।

রাশিয়াসহ, বলল মনক।

 Natirlich, একটি রেকর্ডে ভেজাল ছিল। পরিচালক তখন দলিল তত্ত্বাবধায়ককে রাশিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন। তিন বছর আগে, এই অঞ্চলে রাশিয়ানদের কর্মযজ্ঞ সংক্রান্ত দলিল-পত্র ট্রাকভর্তি করে নিয়ে ফিরে আসেন তারা। রাশিয়ানদের সেই ফাইলগুলোর ভেতরে খোঁজ চালানোর জন্য একটা লম্বা তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। আমার প্র পিতামহ হিউগো হিরজফিল্ডের নামও ছিল সেখানে।

কেন?

ঠুলি সোসাইটির সাথে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ওরা ক্যাসলে আড্ডা দিত। প্রাচীন অক্ষর আর বর্ণমালা সম্পর্কে হিউগোর জ্ঞান ছিল সেটা সবাই জানতো তখন। হিমল্যারের ব্যক্তিগত জ্যোতিষী কার্ল উইলিগাটের সাথে তার পত্র যোগযোগ ছিল।

বাইবেলে থাকা সেই ত্রিশূল আকৃতির চিহ্নের কথা মনে করল গ্রে। তবে সে ব্যাপারে কিছু বলল না।

কয়েকটা বাক্সে আমার প্রপিতামহের তথ্য নিয়ে ফিরেছিলেন দলিল তত্ত্বাবধায়ক। আমার বাবাকে খবর দেয়া হয়েছিল কিন্তু তিনি যাননি।

কিন্তু আপনি গিয়েছিলেন? প্রশ্ন ছুড়ল মনক।

আমি তার সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে চাচ্ছিলাম, রায়ান জবাব দিল। কীভাবে… কেন… এসবের উত্তর… মাথা নাড়ল সে।

অতীতের শক্ত হাত আছে, যেটা কখনও বর্তমানকে ছাড়ে না।

তারপর কী জানতে পারলেন? এবার গ্রে প্রশ্ন করল।

বেশি কিছু নয়। একটা বাক্সে ছিল নাৎসি রিসার্চ ল্যাবের তথ্য, যেখানে আমার প্র-পিতামহ কাজ করতেন। তাঁর পদ ছিল : Oberarbeitsleiter। অর্থাৎ প্রজেক্টের প্রধান। শেষের শব্দগুলো একটু লজ্জা ও অবজ্ঞা মিশিয়ে উচ্চারণ করল রায়ান। তবে তারা যা নিয়েই কাজ করে থাকুক না কেন ওগুলো প্রকাশ করার মতো কিছু ছিল না। অধিকাংশ কাগজে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে লেখা ছিল। পরিবার, বন্ধু-বান্ধব; এসব।

আপনি ওগুলো সব পড়ে দেখেছেন?

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রায়ান। আমার প্রপিতামহ তাঁর কাজ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন কিন্তু প্রজেক্টও ছাড়তে পারছিলেন না, এটুকু জানতে পেরেছি।

তাহলে হয়তো তাকে গুলি করা হয়েছিল? বলল ফিওনা।

রায়ান মাথা নাড়ল। না, তা নয়। আসলে বিষয়টা এরকম, তিনি প্রজেক্টটা চালিয়ে যেতে পারছিলেন না আবার ছেড়েও দিতে পারছিলেন না।

গ্রে টের পেল রায়ানও ওদের মতো অতীত নিয়ে ঘেঁটে দেখেছে।

মটমট শব্দে নিজের ঘাড় মটকালো মনক। এগুলোর সাথে ডারউইন বাইবেলের কোনো সম্পর্ক আছে? আলোচনাকে মূল প্রসঙ্গে ফিরিয়ে আনল।

 আমি একটা নোট খুঁজে পেয়েছিলাম, জবাব দিল রায়ান। প্রপিতামহ তাঁর মেয়ে টোলাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন ওটা। তাতে লেখা ছিল এক বাক্স বই তিনি এস্টেটের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। বিষয়টা আমার পরিষ্কার মনে আছে কারণ, নোটটা একটু অদ্ভুত ছিল।

কী লিখেছিলেন তিনি?

 এখানকার জাদুঘরে চিঠিটা রাখা আছে। চাইলে দেখতে পারবেন, কপি করেও নিতে পারবেন যদি প্রয়োজন হয়।

 নোটে কী লেখা ছিল সেটা আপনার মনে নেই?

 ভ্রু কুঁচকাল রায়ান। দুই-তিনটা লাইন মনে আছে। মা টোলা, আমার বইগুলোতে নিখুঁততা লুকোনো আছে। সত্যটা এত সুন্দর যে ওটাকে গলা টিপে মারতে পারছি না আবার সেটা এতটাই দানবীয় যে মুক্তও করতে পারছি না।

গাড়িতে নীরবতা নেমে এলো।

এর দুই মাস পর তিনি মারা যান।

কয়েকটি শব্দ খেয়াল করল গ্রে। বইগুলোতে লুকোনো আছে। মারা যাওয়ার পূর্বে হিউগো সাহেব ৫টি বই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কোনো গোপন কিছুকে চাপা দেয়ার জন্য এই কাজ করেছিলেন তিনি। একই সুন্দর ও দানবীয় জিনিসকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন?

রিয়ারভিউ আয়না দিয়ে রায়ানের দিকে তাকাল গ্রে। আপনি যা জেনেছেন এগুলো অন্য কাউকে বলে দিয়েছেন নাকি?

না, বলিনি। কিন্তু এক বদ্ধ আর তার ভাতিজা, ভাতিজি এসেছিল বছরখানেক আগে। বইগুলো সম্পর্কে আমার বাবার সাথে কথা বলেছিল ওরা। এখানে এসেছিল, প্র-পিতামহের কাগজপত্র, দলিল সব ঘেঁটে দেখে গেছে। আমার মনেহয়, এই নোট সম্পর্কে তারাও জানে। কারণ পরবর্তীতে তারা আরও তথ্যের জন্য বাবার সাথে দেখা করেছিল।

আচ্ছা… তো এই ভাতিজা-ভাতিজি দেখতে কেমন ছিল?

সাদা চুল। লম্বা, সুঠাম দেহ। আমার দাদা বেঁচে থাকলে তাদেরকে দেখে বলতেন একদম কঠিন চিজ!।

মনকের দিকে তাকাল গ্রে।

গলা খাকাড়ি দিয়ে ফিওনা নিজের হাতের উল্টো পিঠ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, তাদের হাতের এখানে কি কোনো ট্যাটু ছিল?

আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল রায়ান। ছিল বোধহয়। ওরা আসার একটু পরেই বাবা আমাকে ওই রুম থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। আজকের মতো আরকি। সন্তানদের সামনে তিনি ওসব নিয়ে কথা বলতে রাজি নন। রায়ান জোর করে হাসার চেষ্টা করলেও গাড়ির ভেতরে একধরনের টেনশন বিরাজ করছে সেটা দূর হলো না। গাড়িতে থাকা সবার দিকে তাকাল ও। আপনারা তাদের চেনেন নাকি?

আমাদের প্রতিযোগী, বলল গ্রে। আমাদের মতো তারাও সংগ্রহ করে। কালেক্টর।

রায়ান কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করল না। তবে ও গ্রের কথা বিশ্বাস করেনি। কিন্তু সেটা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন তুলল না ও।

বাইবেলে হাতে আঁকা প্রাচীন বর্ণমালাগুলোর কথা মনে করল গ্রে। বাকি ৪টা বইতেও কী এরকম বর্ণমালা আঁকা আছে? এগুলোর সাথে কী হিউগোর নাস আমলের রিসার্চ জড়িত? এসবের মানে কী? বিভিন্ন রেকর্ড যারা ঘটছে তারা নিশ্চয়ই এমনি এমনি এখানে ওখানে দৌড়াদৌড়ি করছে না। নির্দিষ্ট কিছু একটা খুঁজছে তারা।

কিন্তু কী সেটা?

মনক এতক্ষণ পেছন দিকে তাকিয়ে ছিল। এইমাত্র সামনের দিকে ফিরে নিজের সিটে ভালমতো বসল ও গলা নিচু করে বলল, তুমি জানো তো, আমাদেরকে ফলো করা হচ্ছে?

গ্রে কিছু না বলে শুধু মাথা নেড়ে সায় দিল।

ওদের গাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বৃষ্টির ভেতর দিয়ে আরেকটি গাড়ি এগিয়ে আসছে। এই গাড়িটিকে ওরা হোস্টেলে দেখেছিল। বরফ সাদা মার্সেডিজ রোডস্টার। হয়তো গাড়ির আরোহীরা সাধারণ টুরিস্ট, ক্যাসল দেখতে যাচ্ছে।

এরকম হতেই পারে।

.

ইসাক, হয়তো বেশি কাছে যাওয়া ঠিক হবে না।

 শোনো, ইসকি, ওরা ইতোমধ্যে আমাদেরকে দেখে ফেলেছে। মাথা নেড়ে বলল ইসাক। খেয়াল করে দেখো, ওই গাড়ির ড্রাইভার কীরকম তীক্ষ্ণভাবে মোড় ঘুরছে। টের পেয়েছে সে।

তো আমরা কী ওদেরকে সতর্কতা করতে এসেছি নাকি? এটা ঠিক হলো?

মাথা ঘুরিয়ে বোনের দিকে তাকাল ইসাক। শিকার যদি ভড়কে পালাতে যায় তখনই শিকার করার আসল জোশ আসে।

হ্যানস এটার সাথে একমত হবেন বলে মনে হয় না। মুখ হাঁড়ি করে বলল ইসকি।

সে বোনের মাথার পেছনে হাত দিল। আশ্বাস আর সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে। সে খুব ভাল করেই জানে, তার বোন খুবই স্পর্শকাতর নারী।

 তাছাড়া এই রাস্তা ছাড়া বিকল্প কোনো রাস্তাও নেই। বুঝনোর চেষ্টা করল ইসাক। ক্যাসলে যেতে হলে এই রাস্তা ধরেই এগোতে হবে। এখন আমাদের কাজ হলো ওদেরকে হঠাৎ করে ফাঁদে ফেলা। ওদের দৃষ্টি হলো পেছনে। এই পেছনে নজর রাখতে রাখতে ওরা টেরই পাবে না কখন সামনে থেকে বিপদ হাজির হয়ে গেছে।

একমত হয়ে মাথা নাড়ল ইসকি। বুঝতে পেরেছে।

এখানকার এই হালকা কাজগুলো সারা শেষ হলেই আমরা বাড়ি ফিরে যেতে পারব।

… বাড়ি। ইসাকি পুনরাবৃত্তি করল।

আমাদের কাজ প্রায় শেষের দিকে। লক্ষ্যে প্রায় পৌঁছে গিয়েছি। হ্যানস-এর আত্মত্যাগ বিফলে যাবে না, দেখে নিয়ো। রক্তপাতের মধ্যে দিয়েই নতুন দিনের জন্ম হবে। একটা সুন্দর পৃথিবী পাব আমরা।

দাদুও তাই বলেন।

এবং তিনি ঠিকই বলেন।

আবার বোনের দিকে তাকাল ইসাক। বোনের পাতলা ঠোঁটে ক্লান্ত হাসির রেখা দেখা যাচ্ছে।

বোন আমার, রক্ত থেকে সাবধান থেকো।

হাতে থাকা ছোঁড়ার দিকে তাকাল ইসকি। কথা বলতে বলতে আনমনে ছোঁড়ার স্টিলের ফলাকে সাদা কাপড় দিয়ে মুছছিল সে। আর একটু হলেই এক ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে ওর সাদা প্যান্টে পড়তো। হালকা কাজের মধ্যে একটির দফারফা করা হয়েছে। আরও কয়েকটা করতে হবে।

ধন্যবাদ, ইসাক।

.

দুপুর ১টা ২২ মিনিট।
হিমালয়।

তাক করা পিস্তলের দিকে তাকাল লিসা।

Wer 1st dort? Zeigen Sie sichf জার্মান ভাষায় ওকে বলল মহিলা।

জার্মান বলতে না পারলে লিসা মহিলার কথার সারমর্ম বুঝতে পেরেছে। একটু সামনে এগিয়ে এসে হাত উঁচু করল ও। আমি জার্মান বুঝি না।

মহিলা ওর দিকে এমনভাবে তাকাল যেন লেজার রশ্মি দিয়ে পুরো শরীর স্ক্যান করে ফেলছে!

 দুই আমেরিকানের মধ্যে তুমি একটা, খাস ইংরেজিতে বলল মহিলা। ধীরে ধীরে নিচে নেমে এসো।

পিস্তল তাক করা রইল।

বেলকুনিতে কোনো আড়াল নেই। তাই বাধ্য হয়ে মই বেয়ে নামতে শুরু করল লিসা। মইয়ের এক ধাপ করে নামছে আর ভাবছে এই বুঝি গুলি হলো! উত্তেজনায় কাঁধ টনটন করলেও নিরাপদে নিচে নামতে পারল ও।

মই থেকে নেমে এদিকে ঘুরল লিসা। হাত এখনও উঁচু করে রেখেছে।

মহিলা ওর দিকে এগোতেই পিছু হটল লিসা। ও টের পেয়েছে এই মহিলা ওকে গুলি করে মারবে না। কারণ এতে অনেক শব্দ হবে। অন্যান্য গার্ডরা চলে আসতে পারে। বাইরে থাকা গার্ডটিকে এই মহিলা প্রায় কোনো আওয়াজ ছাড়াই কাটানা দিয়ে খুন করে ফেলেছে। তাই এখানে গুলি ছুড়বে বলে মনে হয় না।

খুনে মহিলার এক হাতে পিস্তল, আরেক হাতে কাটানা।

লিসার হয়তো উপরে থাকাই ভাল ছিল। তখন হয়তো এই মহিলা গুলি ছুঁড়তে বাধ্য হতো। আর সেই গুলির শব্দ শুনে অন্যরা এখানে হাজির হতে পারতো। কিন্তু এখন এই মহিলার ভয়ঙ্কর কাটানার কাছে এসে লিসার নিজেকে বোকা মনে হচ্ছে। কিন্তু আতঙ্কে সব গুলিয়ে গিয়েছিল। আসলে কেউ যদি পিস্তল তাক করে কিছু করতে বলে তখন সেটার অবাধ্য হওয়া খুব কঠিন কাজ।

জেরাম-২৫২, বলল মহিলা। ওটা কী এই ভল্টে আছে?

কী উত্তর দেবে, ভাবল লিসা। সত্য বলবে? নাকি মিথ্যা বলবে? কঠিন পরিস্থিতি। অ্যানা নিয়ে গেছেন। জবাব দিল ও। ইশারা করে দরজা দেখাল।

কোথায়?

পেইন্টারের কথাগুলো মনে পড়ল ওর। এখানে ধরা পড়ার পর পেইন্টার বলেছিল, নিজেদেরকে কাজের মানুষ, প্রয়োজনীয় মানুষ হিসেবে তুলে ধরতে হবে। আসলে ক্যাসল তো আমি ভাল করে চিনি না, তাই বলে বুঝাতে পারছি না। তবে আমি… আপনাকে তার কাছে নিয়ে যেতে পারি। লিসার কণ্ঠে দুর্বলতা প্রকাশ পেল। আরও আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলা উচিত ছিল ওর। মিথ্যা কথা বলতে হলে মনের জোর নিয়েই বলা উচিত। যদি মিথ্যায় জোরই না থাকে তাহলে আর সেটার কী দাম রইল? আমি আপনাকে ওখানে নিয়ে যাব যদি আপনি আমাকে কথা দেন, আমাকে এখান থেকে বের হতে সাহায্য করবেন।

শত্রুর শত্রু তো বন্ধু হয়!

এই মহিলা কী এই কথায় পটবে? মহিলা দেখতে তো দারুণ, সুতী, পরিষ্কার তুক, সুন্দর ঠোঁট, তবে নীল চোখগুলোতে হিসেব-নিকেশ আর বুদ্ধিতে বোঝাই।

এই মহিলাকে কেমন যেন অন্যরকম লাগে। মনে হয় ভিনগ্রহের মানুষ।

তাহলে দেখাও, চলো, পিস্তল দিয়ে লিসাকে তাগাদা দিল সে। অন্য হাতে ভয়ঙ্কর কাটানা।

সামনে আছে লিসা। সে দরজার ওখানে একটু দূরত্ব বাড়িয়ে নিল। হয়তো হলের ওখানে গিয়ে এই দূরত্ব থেকে কোনো সুযোগ নিতে পারবে। এটাই ওর শেষ ভরসা। উপযুক্ত সময়, কোনো দ্বিধা কিংবা অন্যমনষ্ক হওয়ার মুহূর্তে ঝেড়ে দৌড় দিতে হবে ওকে।

সুযোগ একবারই পাওয়া যাবে।

 ঘুরল লিসা… মহিলা ওর কাছে হাজির হয়ে গেছে, মাত্র এক কদম দূরে। চুপিসারে চলে এসেছে এই ভয়ঙ্কর নারী। চলার গতি নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। চোখাচোখি হলো ওদের। লিসা মনে মনে বুঝতে পেরেছিল এই মহিলা ওর কথাগুলো বিশ্বাস করেনি।

আসলে ওকে বাইরে এনে মহিলা বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। লিসাকে কোনো রক্ষণাত্মক সুযোগ দিতে চায় না।

তবে এটা তার ভুলও হতে পারে।

পুরো পৃথিবী হঠাৎ যেন থমকে গেল… জাপানিজ কাটানার ফলা এখন লিসার হৃদপিণ্ড বরাবর ধেয়ে আসছে।

.

সকাল ৯টা ৩০ মিনিট।
উইউইলসবার্গ, জার্মানি।

নীল রঙের ওলটার টুরিস্ট বাসের পাশে বিএমডব্লিউটিকে পার্ক করল গ্রে। জার্মান বাসটির পাশে পার্ক করার ফলে রাস্তা থেকে সরাসরি ওদের বিএমডব্লিউকে এখন আর দেখা সম্ভব নয়। এখান থেকে ক্যাসলে যাওয়ার প্রবেশপথ একদম নাক বরাবর সামনে।

গাড়িতে থাকো তোমরা, বাকিদের নির্দেশ দিল গ্রে। পেছন ফিরে বলল, তুমিও থাকো, মেয়ে।

অশ্লীল একটা অঙ্গভঙ্গি করল ফিওনা, তবে গাড়ি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করল না।

মনক, ড্রাইভিং সিটে বসে ইঞ্জিন চালু রাখো।

ঠিক আছে।

চোখ বড় বড় করে গ্রের দিকে তাকাল রায়ান। Was 1st los?

Nothings losমক জবাব দিল। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে মাথা নামিয়ে রাখুন।

গ্রে দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই বৃষ্টির ঝাপটা এসে ওর গালে চড় মেরে দিল। পাশের বাসের ওপর বৃষ্টি পড়ায় মেশিনগানের গুলির মতো শব্দ হচ্ছে। বাজ পড়ল দূরে কোথাও।

রায়ান, আপনার ছাতাটা ধার দেবেন?

মাথা নেড়ে ছাতা দিয়ে দিল রায়ান।

ঝাঁকি দিয়ে ছাতা ফুটিয়ে গ্রে বৃষ্টির ভেতরে নেমে পড়ল। বাসের পাশ দিয়ে গিয়ে বাসের পেছনের দরজার ওখানে গিয়ে দাঁড়াল ও। টুরিস্টদের মতো আচরণ করার চেষ্টা করল গ্রে। ছাতা দিয়ে নিজেকে ঢেকে রেখে রাস্তার ওপর নজর রাখল।

হেডলাইটের আলো দেখা গেল একটু পর।

দুই আসন বিশিষ্ট রোডস্টার হাজির হলো। গতি না কমিয়ে পার্কিং লটের পাশ দিয়ে চলে গেল ওটা। এগিয়ে চলেছে ক্যাসলের অন্যদিকে থাকা উইউইলসবার্গের কোনো এক গ্রামের দিকে। সামনে একটি মোড় পড়ায় রোডস্টারটি মোড়ের ওদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

পুরো ৫ মিনিট অপেক্ষা করল গ্রে। তারপর বাসের পাশ ঘুরে এসে মনককে সিগন্যাল দিল অল ক্লিয়ার। মনক ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। যাক, মার্সেডিজটি ফিরে আসেনি নিশ্চিত হয়ে গ্রে ওদের সবাইকে গাড়ি থেকে নেমে পড়তে বলল।

বেশি ভ্রম হচ্ছে তোমার? ওর পাশ দিয়ে ক্যাসলের রাস্তায় এগোনোর সময় বলল ফিওনা।

 না, এটা প্রম নয়। তারা সত্যি সত্যি তোমার পেছনে লেগেছে। মনক জবাব দিল। তারপর গ্রেকে বলল আচ্ছা, সত্যি কী আমাদের পেছনে লেগেছে ওরা?

ঝড়ের দিকে তাকিয়ে রইল গ্রে। কাকতালীয় ঘটনা ও পছন্দ করে না তবে সেটা ঘটেছে বলে তো আর এগিয়ে চলা বন্ধ করা সম্ভব নয়। ফিওনা আর রায়ানের সাথে থাকো। এখানকার পরিচালকের সাথে কথা বলে দেখি হিউগো সাহেব তার মেয়েকে যে চিঠিটা লিখেছিলেন সেটার একটা কপি যোগাড় করতে পারি কি-না। কাজটা হয়ে গেলেই এই ছাতার এলাকা থেকে বিদেয় হব।

সামনে দাঁড়ানো ক্যাসলের বিশাল অবয়ব আর টাওয়ারে চোখ বুলাল মনক। বৃষ্টি ওটার ধূসর পাথরগুলোকে ধুয়ে দিচ্ছে। বাইরে থেকে দেখলে পুরো ক্যাসলকে নিষ্প্রাণ বলে মনে হলেও নিচ তলার কয়েকটি জানালা দেখে মনে হলো যাক, ওখানে কেউ আছে।

 আমাদের পেছনে কেউ নেই বলে যাচ্ছি, মনক বিড়বিড় করল, কিন্তু ওখানে গিয়ে যদি একটা কালো চামবাদুড়কেও উড়তে দেখি তাহলে কিন্তু আমি নেই!

.

দুপুর ১টা ৩২ মিনিট।
হিমালয়।

নিজের বুকের দিকে ফলাকে এগোতে দেখল লিসা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এসব হচ্ছে। সময়ের গতি যেন এখন কমে গেছে, থমকে গেছে। তাহলে এভাবেই মরবে ও।

হঠাৎ গ্লাস ভাঙ্গার ঝনঝন আওয়াজ আর… গুলির আওয়াজে সব স্বাভাবিক গতি ফিরে পেল। গুলির আওয়াজটা অসম্ভব দূর থেকে এসেছে। কাছে থাকা মহিলাটির গলা ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হয়ে রক্ত আর হাড়ের প্রদর্শনী করছে, পেছন দিকে চলে গেছে মাথা।

 কিন্তু তারপরও মহিলা তার আক্রমণ সম্পন্ন করল। অর্থাৎ ফলা এসে আঘাত করল লিসাকে।

ফলা লিসার ত্বক কেটে এসে বুকের হাড়ের সাথে থাক্কা খেল। তবে ওই পর্যন্তই। হাত দিয়ে কাটানাকে সরিয়ে দিল লিসা। এটা না করলে আঘাতের পরিমাণ হয়তো আরও বাড়তো।

হোঁচট খেয়ে পিছু হটল ও। ছোড়র আঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছে বলা চলে।

ওর হাত থেকে জাপানিজ স্টিল কাটানা মেঝেতে পড়ে ঘণ্টার মতো ঢং ঢং করে উঠল। এরপরে ধপাস করে আছড়ে পড়ল আততায়ী মহিলার দেহ।

পিছু হটল লিসা, ওর কাছে এই ঘটনা বিশ্বাস হচ্ছে না, অসার আর জ্ঞানশূন্য লাগছে ওর।

আরও কিছু কাঁচ ভাঙ্গার ঝনঝনঝন শব্দ হলো।

কিছু শব্দ শুনতে পেল লিসা, যেন পানির নিচ থেকে শুনছে।

 তুমি ঠিক আছ, লিসা?…

চোখ তুলে তাকাল ও। লাইব্রেরির জানালায় আগে বরফ জমে ছিল এখন সেটার কাঁচ রাইফেলের বাটের আঘাতে ভেঙ্গে গেছে। ভাঙ্গা কাঁচের ফ্রেমের ভেতর দিয়ে একটি মানুষের চেহারা দেখা গেল।

পেইন্টার।

ওর পেছনে কী যেন একটা আছে। বেশ বড় কিছু। আকাশে ভাসছে ওটা। হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টার থেকে রশি আর হার্নেস নিয়ে ঝুলছে পেইন্টার।

কেঁপে উঠে নিজের হাঁটুর ওপর মুষড়ে পড়ল লিসা।

আমরা আসছি, পেইন্টার কথা দিল।

৫ মিনিট পর।

আততায়ী মহিলার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আছে পেইন্টার। এ হলো ২য় স্যাবোটাজকারী। অ্যানা মহিলার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে শরীর তল্লাশি করছেন। ওদিকে ফায়ারপ্লেসের কাছে একটা চেয়ার পেতে বসেছে লিসা। সোয়েটার ছেড়ে শার্টের বোতাম খুলে রেখেছে। শার্ট খোলা থাকায় ওর ব্রা দেখা যাচ্ছে এখন… তবে ব্রার ঠিক নিচেই একটা আঘাতের চিহ্ন। কাটানার আঘাত। ইতোমধ্যে গানথারের সহায়তায় লিসা ওর জখমের স্থান পরিষ্কার করে বাটারফ্লাই ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। কাটানার আঘাতে প্রায় ইঞ্চিখানেক কেটে গেছে ওর। তবে ওর কপাল ভাল বলতে হবে। ব্রার শক্ত আবরণ থাকায় ওর জখম তুলনামূলক কম হয়েছে, নইলে জীবন নিয়ে টানাটানি হওয়ার মতো পরিস্থিতি হতে পারতো।

 কোনো কাগজ কিংবা আইডি নেই, বলতে বলতে পেইন্টারের দিকে ফিরলেন অ্যানা। একে জীবিত দরকার ছিল।

অজুহাত দেয়ার কোনো রাস্তা নেই। আমি ওর কাঁধ বরাবর তাক করেছিলাম।

হতাশায় মাথা নাড়ল পেইন্টার। হেলিকপ্টারের রশি থেকে নামার পর থেকে ভার্টিগো (উচ্চতাজনিত শারীরিক সমস্যা, মাথাঘোরা) ওকে ভোগাচ্ছে। তবে হেলিকপ্টারে আসা ছাড়া ওদের কোনো উপায় ছিল না। ক্যাসলের ওই প্রান্ত থেকে অল্প সময়ে পায়ে হেঁটে আসা রীতিমতো অসম্ভব, এদিকে সময়ও হাতে নেই। তাই হেলিকপ্টারে আসা। দুইভান কপ্টারে থাকবে আর একজন রশি দিয়ে নিচে ঝুলবে, এটাই প্ল্যান ছিল।

অস্ত্র হাতে আনা খুব একটা দক্ষ নন, গানথার হেলিকপ্টার চালাচ্ছে। তাহলে শুধু বাকি রইল পেইন্টার।

তাই ভার্টিগো আর চোখে এক জিনিসকে দুটো করে দেখা সত্ত্বেও হেলিকপ্টার থেকে স্কুলে ক্যাসলের জানালা দিয়ে গুলি ছুঁড়েছিল ও। ওর হাতে খুব একটা সময় ছিল না। ও দেখছিল লিসার দিকে মহিলা ছোঁড়া বাগিয়ে আসছে… ব্যস কোনো দেরি নেই। ফায়ার!

তবে আততায়ী মহিলা মারা যাওয়ায় ওদের বেশ ক্ষতি হলো। এই স্যাবোটাজকারীদের পেছনে কার হাত ছিল সেটা জানা হলো না। তবে পেইন্টারের এ নিয়ে কোনো আফসোস নেই। লিসার চেহারায় ও যে আতঙ্ক দেখেছিল, তারপর আর অত ভাবার প্রয়োজনবোধ করেনি। ভার্টিগো ওর অস্ত্র তাক করার দক্ষতায় অনেক নাক গলিয়েছে। গুলি ছুঁড়েছে, ভেজাল শেষ। তবে ওর মাথাব্যথা এখনও থামেনি। নতুন একটা আতঙ্ক ঘিরে ধরল ওকে।

গুলিটা যদি লিসার গায়ে লাগতো…? আর কতক্ষণ ও এদের কাজে আসতে পারবে? চিন্তাগুলোকে একপাশে সরিয়ে দিল পেইন্টার।

আকাশ-কুসুম কল্পনা না করে কাজে নামা যাক।

 কোনো চিহ্ন আছে? পেইন্টার প্রশ্ন করল। অযথা দুশ্চিন্তা করার মানে হয় না।

এই যে, শুধু এটা। মহিলার কবজি ধরে সেটার উল্টো পিঠ দেখালেন অ্যানা। এই চিহ্ন চেনেন?

ধবধবে সাদা ত্বকের ওপর কালো ট্যাটু আঁকা রয়েছে। পাকানো চারটা বৃত্ত।

 কেলটেক-এর মতো দেখাচ্ছে। কিন্তু এতে কোনো অর্থ হয় কি-না জানা নেই।

 আমিও বুঝতে পারছি না। লাশের হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন অ্যানা।

পেইন্টারের চোখে কিছু একটা ধরা পড়ল। হাঁটু গেড়ে বসে হাতটা আবার তুলে নিল ও। লাশের শরীর এখনও গরম আছে। আততায়ীর আঙুলে নখ নেই, ওখানে জখমের মতো দেখা যাচ্ছে। এটা একটা ক্রটি হলেও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

পেইন্টারের কাছ থেকে হাতটাকে নিজের হাতে নিলেন অ্যানা। শুকনো… তার চোখের ভ্রু কুঁচকে গেল। পেইন্টারের দিকে তাকালেন তিনি।

আমি যা ভাবছি বিষয়টা কী তা-ই? বলল পেইন্টার।

 আততায়ীর দিকে ফিরলেন অ্যানা। কিন্তু আমি আগে ওর চোখের স্ক্যান করাব। অপটিক নার্ভের পাশে petechia আছে কি-না দেখব।

তবে পেইন্টারের আর কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন নেই। সে নিজের চোখে প্রমাণ দেখেছে। রুম থেকে বের হওয়ার সময় মহিলার যে অবিশ্বাস্য গতি ছিল সেটাই পেইন্টারের জন্য যথেষ্ট।

এই মহিলা একজন Sonnekonige. 

ওদের কাছে এলো লিসা ও গানথার।

তবে আমাদের নয়, জানালেন অ্যানা। এর বয়স অনেক কম। প্রায় নিখুঁত বলা যায়। যারা ওকে তৈরি করে থাকুক না কেন, আমাদের সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করেছে। বিগত দশক ধরে আমরা প্রযুক্তির যে উন্নতি করেছি সেটাই ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। আমরা যা গবেষণা করে কাগজে রেখেছিলাম… সেটাকে মানুষের ওপর ফলিয়ে দেখিয়েছে তারা।

সেটা কী আপনার এখানে সম্ভব নয়? কাজের সময়ের পর যে সময় থাকে সেই সময়ে যদি কেউ তৈরি করে থাকে…?

মাথা নাড়লেন অ্যানা। বেল-কে চালু করে এই কাজ করতে হলে অনেক এনার্জী প্রয়োজন হয়। লুকোনো সম্ভব নয়, ঠিকই জানা যেত।

তাহলে আর একটা উপায়-ই বাকি রইল।

 ওকে অন্য কোথাও তৈরি করা হয়েছে। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন অ্যানা।

অন্য কারও কাছে সচল বেল আছে।

পেইন্টার নখ আর ট্যাটু আবার পরীক্ষা করল। এবং সেই তারা আপনাদের প্রজেক্ট বন্ধ করে দিতে চায়। বিড়বিড় করে বলল ও।

পুরো রুম চুপচাপ হয়ে গেল।

এই পিনপতন নীরবতার মধ্যে পেইন্টার একটা হালকা আওয়াজ শুনতে পেল। খুব ভাল করে খেয়াল না করলে হয়তো টেরই পাওয়া যেত না। শব্দটা লাশ থেকে আসছে। ওর মনে হলো, এই শব্দ ও এর আগেও শুনেছে কিন্তু অন্যান্য চিন্তার কারণে পাত্তা দেয়নি।

লাশের পারকার হাতা সরাল ও।

চামড়ার ব্যান্ডে একটি ডিজিটাল ঘড়ি দেখা গেল। চওড়ায় দুই ইঞ্চি হবে। ঘড়ির লাল চেহারা পর্যবেক্ষণ করল পেইন্টার ক্রো। লাল আলো জ্বলে জ্বলে সেকেন্ড প্রদর্শন করছে।

.

০১:৩২ সেকেন্ড

এবং প্রতি সেকেন্ডে কমছে সেটা।

সবমিলিয়ে দেড় মিনিট বাকি আছে।

 হাত থেকে ঘড়ি খুলে ওটার ভেতরটা পরীক্ষা করল ক্রো। দুটো সিলভার কন্টাক একসাথে তার দিয়ে জোড়া লাগানো রয়েছে। হার্টবিট মনিটর। সেই হিসেবে এই ঘড়ির ভেতরে নিশ্চয়ই কোথাও মাইক্রোট্রান্সমিটারও আছে।

কী করছেন? অ্যানা প্রশ্ন করল।

এই মহিলার শরীরে কোনো বিস্ফোরক আছে কি-না সার্চ করে দেখেছেন?

না, কিছু নেই। কেন?

উঠে দাঁড়াল পেইন্টার। দ্রুত বলতে শুরু করল, এর হৃদপিণ্ডের সাথে মনিটর সংযুক্ত করা আছে। হৃদপিণ্ড বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে নিশ্চয়ই কোনো সিগন্যাল চলে গেছে। হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকাল ও। এটা কোনো ঘড়ি নয়। স্রেফ টাইমার।

.

০১:০৫ সেকেন্ড

ক্লাউস আর এই মহিলা আপনার ফ্যাসালিটিতে ইচ্ছেমত প্রবেশাধিকার পেয়েছিল, সেটা কতক্ষণের জন্য কে জানে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এই ঘড়ির টাইমার জিরো-তে যাওয়ার সময় আমাদের এখানে না থাকাই ভাল।

সেকেন্ড চলে যাচ্ছে। টাইমারের সময় এক মিনিটের নিচে নামতেই আরেকটা সূক্ষ্ম আওয়াজ হলো।

.

০০:৫৯

সেকেন্ড আমাদেরকে এখান থেকে সরতে হবে। এক্ষুনি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *