০৪. গোস্ট লাইটস্

০৪. গোস্ট লাইটস্

সকাল ১১টা ১৮ মিনিট।
 হিমালয়।

‘তুমি নিশ্চিত আং গেলুকে খুন করা হয়েছে? উনি মারা গেছেন?’ পেছনে তাকিয়ে প্রশ্ন করল পেইন্টার।

ইতিবাচক মাথা নেড়ে জবাব দিল একজন।

 লিসা কামিংস পুরো ঘটনা বলে শেষ করেছে। এভারেস্টে চড়ার একটি দল থেকে কী করে এই মঠের অসুস্থতা তদন্ত করতে এলো সব জানিয়েছে ও। কয়েকটি ভয়ঙ্কর বিষয়ের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে পেল লিসা। পাগলামো, বিস্ফোরণ, স্নাইপার।

মঠের ভূগর্ভস্থ সেলারে গোটা দুই গুতো খাওয়া মাথায় লিসার পুরো গল্প চিন্তা করে দেখল পেইন্টার। তবে এখানকার এই পাথুরে সরু গোলকধাঁধার মতো জায়গাটুকু ওর মতো উচ্চতাসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য নয়। ওকে মাথা নিচু করে থাকতে হচ্ছে। তারপরও ওর মাথা ছুঁয়ে দিচ্ছে জুনিপারের ডালপালা। এই সুগন্ধময় ডালগুলোকে উপরের মন্দিরে বিভিন্ন বিশেষ দিনে পোড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে সেই মন্দির নিজেই এখন পুড়ছে, জ্বলে-পুড়ে আকাশের বুকে ধোয়া পাঠাচ্ছে।

নিরস্ত্র অবস্থায় আগুনের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসে এই সেলারে আশ্রয় নিয়েছে ওরা। মাঝে একবার প্রথমে পোশাকের রুম থেকে গায়ে পরার জন্য একটি পনচো আর পায়ের জন্য একজোড়া লোমশ বুট নিয়েছে পেইন্টার। ওই পোশাকে ওকে পেকুয়োট ইন্ডিয়ানদের মতো দেখাচ্ছে। যদিও ওর শরীরে ভিন্ন দুটি জাতির রক্ত বইছে। যা-ই হোক, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো–ওর নিজের কাপড়-চোপড় কিংবা ব্যাকপ্যাক কোথায় আছে সেটা মনে করতে পারছে না।

 তিন তিনটে দিন ওর জীবন থেকে গায়েব হয়ে গেছে।

সেই সাথে ওর শরীর থেকে খোয়া গেছে দশ কেজি ওজন।

একটু আগে গায়ে পনচো (আলখাল্লা) পরার সময় নিজের পাজরের অবনতি লক্ষ করেছে ও। এমনকী ওর কাধও চিকন হয়ে গেছে। এখানকার অসুখ থেকে ও রক্ষা পায়নি ঠিকই তবে ধীরে ধীরে শক্তি ফিরে পাচ্ছে, উন্নতির লক্ষণ।

এটার প্রয়োজন ছিল।

বিশেষ করে বাইরে যখন আততায়ী ঘুরে বেড়ায় তখন তো শক্তির প্রয়োজন পড়তেই পারে।

নিচে পালিয়ে আসার সময় থেমে থেমে বন্দুকের আওয়াজ হতে শুনেছে পেইন্টার। আগুন লাগা মঠ থেকে যে-ই বের হচ্ছিল না কেন তাকে মেরে ফেলেছে স্নাইপার। আক্রমণকারী সম্পর্কে বর্ণনা দিল ড. কামিংস। আক্রমণকারী একজনই। তবে তার সাথে নিশ্চয়ই আরও লোক আছে। ওরা কি মাওবাদী বিদ্রোহী? কিন্তু তাতে তো কিছুই মিলছে না। তারা এই হত্যাযজ্ঞ করে কী ফায়দা পাবে?

হাতে পেলাইট নিয়ে পথ দেখাল পেইন্টার।

ওর কাছাকাছি থেকে ড. কামিংসও পিছু পিছু এগোলো।

পেইন্টার জেনেছে লিসা আমেরিকান ডাক্তার এবং একটি পর্বতারোহণ দলের সদস্য। লিসার দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে বুঝে নেয়ার চেষ্টা করছে ক্রো, মেপে নিচ্ছে। লম্বা লম্বা পা, অ্যাথলেটিক শরীর, পেছনে ঝুঁটি করে রাখা চুল, বাতাসের তোপে গোলাপি হয়ে যাওয়া গাল ইত্যাদি। তবে লিসা বেশ ভয় পেয়েছে। ক্রো’র কাছে কাছে থাকছে। উপর থেকে হঠাৎ হঠাৎ মটমট আওয়াজ আর আগুনের চিড়বিড় শব্দে লাফিয়ে উঠছে। তবে হ্যাঁ, যত যা-ই হোক এখনও একবারের জন্যও থামেনি বেচারি। কাঁদেনি, অভিযোগ করেনি। মনের জোর কাজে লাগিয়ে আতঙ্কের কাছে হার স্বীকার করছে না সে।

কিন্তু এভাবে কতক্ষণ?

মুখের ওপর থেকে ঘাস সরাতে গিয়ে দেখা গেল ওর আঙুলগুলো কাঁপছে। সামনে এগোচ্ছে ওরা দুজন। সেলারের গভীরে যেতেই ভেতরের বাতাস বিভিন্ন সুগন্ধী ভাল পালার গন্ধে ভারি হয়ে উঠল। রোজমেরি, আর্টেমিসিয়া, পাহাড়ি পুষ্প, খেনপা ইত্যাদি। এগুলোর সবকটা ধূপ কাঠি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য একদম প্রস্তুত।

মঠের প্রধান, লামা খেসমার পেইন্টারকে ১০০ টি ঔষধি বিদ্যা শিখিয়েছিলেন। পরিশুদ্ধিকরণ থেকে শুরু করে স্বর্গীয় শক্তি লাভ, মনোযোগ ধরে রাখা, হাঁপানি ও সাধারণ সর্দি-ঠাণ্ডাজনিত সমস্যার সমাধান ছিল সেই বিদ্যায়। কিন্তু এখন ওই বিদ্যার কোনো দরকার নেই। পেইন্টার এই মুহূর্তে সেলারের পেছনের দরজায় যাওয়া সম্ভব সেটা মনে করার চেষ্টা করছে। সবকটা মঠের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে এই সেলার। শীতকালে যখন ভারি তুষারপাত হয় তখন সন্ন্যাসিগণ এই সেলার ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যাতায়াত করতেন।

এছাড়াও এই সেলার ব্যবহার করে গোলাবাড়ি ও মাঠের প্রান্তদেশে পৌঁছুনো যায়। আগুনের আক্রমণ কিংবা কারও সরাসরি দেখে ফেলার ভয় নেই এদিকে।

যদি ওরা পৌঁছে যেতে পারে… তারপর ওখান থেকে নিচের গ্রামে গেলেই…

ক্রো’র সিগমা কমান্ডে যোগাযোগ করা দরকার।

 সম্ভাবনায় ওর মন দুলে উঠল। সেইসাথে সেলারের রাস্তাও দুলে উঠল।

সেলারের দেয়ালে এক হাত ঠেস দিয়ে দাঁড়াল পেইন্টার, নিজেকে সামলে নিচ্ছে।

 মাথা ঘোরাচ্ছে ওর।

‘তুমি ঠিক আছে তো?’ পেইন্টারের কাঁধের কাছে এগিয়ে গিয়ে লিসা জানতে চাইল। মাথা নাড়ার আগে কয়েকবার শ্বাস নিল ক্রো। জেগে ওঠার পর থেকেই আশেপাশের পরিস্থিতি ওকে শান্তি দেয়নি। যদিও খারাপ ঘটনাগুলো একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে ঘটেছে… নাকি ভুল হলো?

‘আচ্ছা, উপরে আসলে কী হয়েছে? জানতে চাইল লিসা। ক্রো’র কাছ থেকে ও পেনলাইট নিয়ে নিল। আসলে এই পেনলাইটটি লিসার। ওর মেডিক্যাল কিটে ছিল। লাইট নিয়ে ক্রো’র চোখে ধরল লিসা।

 ‘আমি জানি… নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারব না… তবে আমাদের এগোতে হবে। থামলে চলবে না।

দেয়ালে ভর দিয়ে সরে আসার চেষ্টা করল ক্রো কিন্তু লিসা ওর বুকে একটি হাত রেখে থামিয়ে দিল। ক্রো’র চোখ পরীক্ষা করছে। prominent nystasmus দেখা যাচ্ছে।

 ‘কী?’

 ঠাণ্ডার পানির বোতল ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে ইশারায় নিচে থাকা খড়ের ওপর বসতে বলল লিসা। ক্রো কোনো আপত্তি করল না। খড় একদম সিমেন্টের মতো শক্ত হয়ে রয়েছে।

‘তোমার চোখে অনুভূমিক nystagmus এর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কেমন যেন টান পড়েছে চোখের মণিতে। মাথায় আঘাত পেয়েছিলে নাকি?”

“না মনে হয়। সিরিয়াস কিছু হয়েছে?

‘বলা কঠিন। তবে এটা তোমার চোখ কিংবা মস্তিষ্কের কোনো ক্ষতির ফলও হতে পারে। মাথায় একটা বাড়ি লাগা, কিংবা একাধিক শক্ত আঘাত থেকে এরকমটা হতে পারে। তোমাকে দেখে মনে হলো তোমার মাথা ঘোরাচ্ছিল, সে হিসেবে বলতে হয়, তোমার শরীরের ওপর দিয়ে বেশ ধকল গিয়েছে হয়তো। ক্ষতি হয়েছে কোথাও। হতে পারে কানের ভেতরের অংশে কিংবা নার্ভাস সিস্টেমে। তবে যা-ই হোক, খুব সম্ভবত সেটা স্থায়ী হবে না।’ শেষের শব্দগুলো কেমন যেন বিড়বিড় করে উচ্চারিত হলো।

‘খুব সম্ভব বলে তুমি কী বুঝাতে চাইছ, ডক্টর কামিংস?

 ‘আমাকে লিসা বলে ডাকো।’ বলল ও। ‘প্রসঙ্গ পরির্বতনের চেষ্টা।

 ‘ঠিক আছে। লিসা। তাহলে ওগুলো কী স্থায়ী হতে পারে?

অন্যদিকে তাকাল লিসা। ‘আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। আগের ইতিহাস জানতে হবে। বলল ও। তোমার এসব কী করে হলো, বলো। এগুলো দিয়েই শুরু করা যাক।

বোতল থেকে পানি খেল ক্রো। সবকিছু মনে করতে গিয়ে ওর চোখের পেছনে কেমন একটা ব্যথা অনুভূত হলো। শেষ দিনগুলো ঝাপসা লাগছে।

‘এক প্রত্যন্ত গ্রামে ছিলাম আমি। মাঝ রাতে পাহাড়ের উপরে অদ্ভুত আলোর উদয় হয়েছিল। তবে আমি ওগুলো দেখিনি। ঘুম থেকে জেগে দেখি ওগুলো নেই। কিন্তু সকালে উঠে গ্রামের সবাই বলল, ওদের নাকি মাথাব্যথা হচ্ছে, বিতৃষ্ণা লাগছে। আমারও একই রকম লাগছিল। একজন বয়স্ক মানুষকে সেই আলোর কথা জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল, এই আলো নাকি মাঝে মধ্যেই দেখা যায়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ওরা এটা দেখে আসছে। গোস্ট লাইট, ভূতুড়ে আলো। ওই আলো নাকি পাহাড়ের গভীরে থাকা খারাপ আত্মাদের প্রতীক।

খারাপ আত্মা?”

‘আলোগুলো যেখানে দেখা যায় ওদিকে নির্দেশ করে দেখিয়েছিল সে। পাহাড়ের এক দূবর্তী অঞ্চল ছিল ওটা। গভীর গিরি সঙ্কট, বরফ ঝরণা বিস্তৃত হয়ে চলে গেছে চীনের সীমান্ত পর্যন্ত। দুর্গম পথ। এই মঠের অবস্থান সেই জনমানব শূন্য অঞ্চলের কাছেই।

 ‘তার মানে এই মঠ সেই আলোগুলোর বেশ কাছে ছিল?

মাথা নাড়ল পেইন্টার। ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব ভেড়া মারা গেছে। কতগুলো যেখানে দাঁড়িয়েছিল ঠিক ওখানেই দুম করে মরে গেছে। আর বাকিরা ওদের মাথা ইকেছে পাথরের সাথে। নিজের ইচ্ছায় বারবার মাথা ঠুকেছে। পরদিন আমি এখানে আসি। লামা খেমসার আমাকে চা খেতে দিয়েছিলেন। আমার এই পর্যন্তই মনে আছে। আর কিছু মনে নেই।’

‘তোমার কপাল ভাল, বোতল ফিরিয়ে নিতে নিতে বলল লিসা।

‘কীভাবে?

দুহাত শক্ত করে আড়াআড়িভাবে রাখল লিসা। মঠ থেকে দূরে ছিলে সেজন্য। আলোর কাছে থাকার ফলে বিভিন্ন প্রাণীদের এখানে এরকম হাল হয়েছিল। উপরের দিকে চোখ মেলল ও, যেন দেয়াল ভেদ করে উপরের দৃশ্য দেখতে চাইছে। এটা হয়তো কোনো ধরনের রেডিয়েশন। তুমি বলেছিলে না, চীনের সীমান্ত বেশ কাছেই? হয়তো এটা কোনো নিউক্লিয়ার পরীক্ষণ।

পেইন্টারও ক’দিন ঠিক একই জিনিস ভেবেছিল।

তুমি মাথা ঝাঁকাচ্ছ কেন? প্রশ্ন করল লিসা।

 পেইন্টার নিজেও জানে ওর মাথা ঝাঁকাচ্ছে। নিজের কপালে হাত রাখল ও।

লিসা ক্রু কুঁচকিয়ে বলল, মিস্টার ক্রো, তুমি এখানে ঠিক কী করছিলে সেটা কিন্তু এখনও বলেনি।

পেইন্টার বলে ডাকলেই হবে। লিসাকে বাকা হাসি উপহার দিয়ে বলল ও।

অবশ্য লিসা ওতে মুগ্ধ হয়নি কিংবা পটেও যায়নি।

কতখানি বলবে, কী বলবে সেটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগল পেইন্টার। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সতোর পথ অবলম্বন করাই ভাল। অন্তত যতটুকু সৎ ও হতে পারে আরকি।

সরকারি চাকরি করি। DARPA নামের বিভাগে…।

আঙুল নাড়িয়ে ওকে থামিয়ে দিল লিসা। DARPA সম্পর্কে আমার ধারণা আছে। আমেরিকার মিলিটারি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট ডিভিশন। একবার তাদের সাথে রিসার্চে অংশ নিয়েছিলাম। তো এখানে তাদের কী কাজ?

 বেশ। আং গেলু শুধু তোমাকেই ডেকে আনেননি, এক সপ্তাহ আগে তিনি আমাদের প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেছিলেন। এখানকার অদ্ভুত অসুখের ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য। আমি মাত্রই পরিকল্পনা করছিলাম, এখানে কোন কোন বিশেষজ্ঞদের লাগতে পারে… ডাক্তার, ভূতাত্ত্বিক, মিলিটারি… কিন্তু ঝড় চলে এলো। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে এতদিন থাকতে হবে, এটা আমার ধারণা ছিল না।

কিছু বুঝে উঠতে পেরেছ?

প্রাথমিকভাবে যা বুঝলাম, মাওবাদী বিদ্রোহীরা হয়তো কোনো নিউক্লিয়ার বর্জ্যের নাগাল পেয়েছে। হয়তো কোনো বোমা বানানোর চেষ্টা করছে ওরা। চীনের সীমান্ত কাছে থাকলে এরকম ধারণা তো করাই যায়। তাই ঝড়ের সময়টুকুতে আমি বিভিন্ন রেডিয়েশন পরীক্ষা করে দেখেছি। অস্বাভাবিক কিছু পাইনি।

পেইন্টারের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাল লিসা। যেন ও একটা গুবরে পোকা।

 তোমাকে যদি ল্যাবে নিয়ে যাওয়া যায়, স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল ও, তাহলে হয়তো কিছু উত্তর পাওয়া যাবে।

গুবরে পোকা নয়, লিসা ওকে গিনি পিগ হিসেবে দেখছিল!

 যাক, বিবর্তন প্রক্রিয়ার একটু উপরের স্তরের প্রাণী হিসেবে ভাবছে।

আগে আমাদেরকে বাঁচতে হবে। লিসাকে বাস্তবতা মনে করিয়ে দিয়ে বলল ক্রো।

লিসা সেলারের সিলিঙের দিকে তাকাল। সর্বশেষ গুলির আওয়াজ হয়েছে অনেকক্ষণ হয়ে গেল। হয়তো ওরা ভাবছে, সবাই মরে গেছে। যদি আমরা এখানে থাকি…

পেইন্টার উঠে দাঁড়াল। তোমার কথা শুনে যা বুঝেছি, হামলা করা হয়েছে বেশ হিসেব করে। সবকিছু পূর্বপরিকল্পিত। ওরা এই টানেলের কথাও জানে হয়তো। একসময় এখানে সার্চও করতে আসবে। তবে আগুন নেভা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে, এতটুকু আশা আমরা রাখতে পারি।

 সিসা মাথা নাড়ল। তাহলে আমরা এগোই।

হ্যাঁ। আমরা এই জায়গা থেকে বেরিয়ে যাব। পারব আমরা। লিসাকে আশ্বস্ত করল ক্রো। দেয়ালে এক হাত রেখে নিজেকে সামলে নিল ও। আমরা পারব। লিসাকে নয় যেন নিজেকে শুনিয়ে বলল এবার।

রওনা হলো ওরা। কয়েক পা এগোতেই পেইন্টার কিছুটা শক্তি ফিরে পেল।

ভাল খবর।

 এখান থেকে বেরোবার রাস্তা খুব একটা দূরে নয়।

করিডর দিয়ে হাওয়া বয়ে এসে ভেতরের শুকনো তৃণলতাকে দুলিয়ে দিয়ে সেটারই প্রমাণ দিল। মুখে ঠাণ্ডা লাগল ক্রোর। হঠাৎ করে জমে গেল ও। শিকারির সহজাত প্রবৃত্তি ওকে থামিয়ে দিয়েছে… এছাড়াও ওর ভেতরে স্পেশাল অপারেশন ট্রেইনিং তো আছেই। পেছনে লিসার কনুইতে হাত দিল ক্রো। চুপ করিয়ে দিল।

অফ করল পেনলাইট।

 সামনে ভারি কিছু একটা মেঝেতে আঘাত করছে। ওটার প্রতিধ্বনি আসছে প্যাসেজে। বুট। একটি দরজা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। হাওয়াও গায়েব।

ওরা এখানে আর একা নয়।

.

গুটিসুটি মেরে ভূগর্ভস্থ সেলারে ঢুকল আততায়ী। সে জানে, এখানে ওরা আছে। কত জন? কাঁধ থেকে হেকলার অ্যান্ড কচ MK23 নামাল ও। আঙুলের অংশ কাটা পশমি গ্লোভস তার হাতে। নিজের পজিশনে, শুনছে।

হালকা দুপদাপ, ঘষটে যাওয়ার শব্দ।

পালাচ্ছে।

কমপক্ষে দুজন… তিনজনও হতে পারে।

উপরের গোলাঘরে যাওয়ার ট্রাপচোর বন্ধ করে দিল আততায়ী। ঠাণ্ডা বাতাস আসা বন্ধ হয়ে গেল, অন্ধকার নেমে এলো ওর ওপর। নাইট ভিশন গগলস চোখে পরল ও। কাঁধে থাকা আট্রা ভায়োলেট ল্যাম্প অন করে দিল। সামনে থাকা প্যাসেজটি জ্বলে উঠল ছায়াময় রুপোলি সবুজ আলোয়।

খুন করতে হবে, সবকটাকে।

 এ-কাজে সে সিদ্ধহস্ত।

দ্য বেল খুব জোরে বেজে গিয়েছিল।

দুর্ঘটনা ছিল ওটা। পুরোনো বিভিন্ন দুর্ঘটনার মধ্যে একটি।

গত মাস থেকে সে দেখে আসছে Granitschloft আর অন্যদের মধ্যে বেশ জোর আলোচনা হচ্ছে। এমনকী দুর্ঘটনাটি ঘটার আগে থেকে চলছে এই আলোচনা। প্রাসাদে কিছু একটা হয়েছে। এখান থেকে বহু দূরে নিজের বাড়িতে বসেও সেটার আঁচ পাচ্ছিল সে। তবে বিষয়টিকে ও এড়িয়ে গিয়েছিল। ও এসব ভেবে কী করবে?

তারপর হলো সেই দুর্ঘটনা… ওটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াল ওর। এবার ওকে তাদের সেই ভুলের দাগ পরিষ্কার করতে হবে।

টিকে থাকা শেষ Sonnekonige হিসেবে এটা তার দায়িত্ব।

ওর আজকের এখানকার দায়িত্ব প্রায় শেষের দিকে। সেলার অভিযান শেষ করে নিজেদের কুটিরে ফিরে যাবে ও। মঠে ঘটে যাওয়া সবকিছুর দোষ পড়বে মাওবাদীদের ওপর। ঈশ্বরহীন মাওবাদীরা ছাড়া মঠে আর কেইবা আক্রমণ করতে যাবে?

ঠিকভাবে ভাওতা দেয়ার জন্য, বিদ্রোহীদের সাথে মিলিয়ে গুলি এনেছে ও। এমনকী অস্ত্রও মিল রেখেছে।

অস্ত্র রেডি রেখে ওক গাছের খোলা পিপার পাশ দিয়ে এগোল সে। খাদ্যশস্য, রাই, আটা এবং শুকনো আপেল পর্যন্ত মজুদ করা আছে এখানে। সাবধানে এগোচ্ছে ও। যেকোন ধরনের আক্রমণের জন্য প্রস্তুত। সন্ন্যাসীরা সাধু হতে পারে, মনোবল ভেঙে যেতে পারে কিন্তু বিপদে পড়লে বিড়ালও বাঘের মতো আচরণ করে, সাবধান থাকা ভাল।

সামনে প্যাসেজ বাম দিকে মোড় নিয়েছে। ডান দিকের দেয়াল ধরে থামল। কান পাতল ও। পায়ের শব্দ শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। কপালে তুলে নাইট-ভিশন গগলস।

আলকাতরার মতো কুচকুচে অন্ধকার।

চশমা আবার চোখে দিল সে। সামনের প্যাসেজ সবুজ আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কেউ ওঁত পেতে থাকলে সেই ব্যক্তি দেখার আগেই তাকে দেখে ফেলবে ও। লকোনোর কোনো উপায় নেই। কেউ যদি পালাতে চায় তো ওকে পার হয়ে তবেই পালাতে পারবে।

একটু কোণা ঘেঁষে এগোল ও।

প্যাসেজে খড় ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে তাড়াহুড়োর ফলে পায়ের ধাক্কায় ছড়িয়ে গেছে ওগুলো। সেলারের ভেতরে সন্ধানী দৃষ্টি বুলাল আততায়ী। এখানে আরও ব্যারেল আছে। শুকনো ডালপালা ঝুলছে ছাদ থেকে।

কোনো নড়াচড়া নেই, শব্দ নেই।

 খড়ের গায়ের ওপর দিয়ে সামনে এগোল ও।

 মটমট শব্দে জুনিপারের ডাল ভাঙ্গল ওর বুটের নিচে।

চট করে নিচ দিকে তাকাল ও। পুরো মেঝে জুড়ে খড়ের পাশাপাশি ডালপালাও বিছানো রয়েছে।

ফাঁদ।

এখন?

উপরের দিকে চোখ তুলতেই ওর সামনের দুনিয়া যেন উজ্জ্বলতায় ঝলসে উঠল। গগলসের বর্ধিত সিস্টেমের কারণে আলোর মাত্রা অনেক বেড়ে ওর মস্তিষ্কে আঘাত করল, অন্ধ হয়ে গেল ও।

ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইট।

 সে মুহূর্তের মধ্যে গুলি ছুড়ল।

সরু সেলারে গুলির আওয়াজ যেন তালা লাগিয়ে দিল কানে। ওরা নিশ্চয়ই অন্ধকারে ঘাপটি মেরে শুয়ে ছিল। ডালে পা পড়ে মটমট শব্দ শোনার আগপর্যন্ত অপেক্ষা করেছে, একদম ওদের কাছে আসতে দিয়েছে ওকে, তারপর আক্রমণ চালিয়েছে। এক কদম পিছে হটল সে। খড়ের সাথে পা আটকে প্রায় হোঁচট খাচ্ছিল।

পিছু হটতে হটতে আরেকটি গুলি ছুড়ল ও।

 ভুল করল।

সুযোগ পেয়ে কেউ একজন ওকে ব্যারেল দিয়ে নিচে আঘাত করল। পায়ে আঘাত হেনে খড়ের ওপর আছড়ে ফেলল ওকে। পাথুরে মেঝেতে পিঠ দিয়ে পড়ল ও। কিছু একটা ওর উরুর মাংসের ভেতরে ঢুকে পড়ল। হাঁটু ছুড়ল সে, ওকে যে আক্রমণ করেছে সে ঘোঘোত শব্দ করল।

যাও! ওর পিস্তল হাতে নিয়ে আক্রমণকারী চিৎকার করল। চলে যাও!

 আক্রমণকারী ইংরেজিতে কথা বলছে। সন্ন্যাসী নয়।

দ্বিতীয় একজন উদয় হলো। ওদের দুজনের শরীরের ওপর দিয়ে লাফ দিল সে। ওর দৃষ্টিশক্তি এখন ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। ও শুনল গোলাবাড়ি যাওয়ার সেই ট্রাপড়োরের দিকে এগোচ্ছে দ্বিতীয় ব্যক্তি।

scheifie বলল ও।

নিজের শরীর মুচড়িয়ে উপরে থেকে আক্রমণকারীকে কাপড়ের পুতুলের মতো ছুঁড়ে ফেলল ও। Sonnekonige রা অন্য সাধারণ মানুষদের মতো নয়। ওর ওপর যে আক্রমণ করেছিল সে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেল। একটু আগে যে পালিয়েছে তার মতো করে পালানোর চেষ্টা করল সে। কিন্তু ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলোয় হারানো দৃষ্টি শক্তি খুব দ্রুত ফিরে এসেছে। রেগে গিয়ে আক্রমণকারীর পায়ের গোড়ালি ধরে পেছনে টান দিল ও।

কিন্তু আক্রমণকারী তার আরেক পা দিয়ে লাথি কষাল ওকে।

গর্জে উঠে লোকটির পায়ের স্পর্শকাতর জায়গায় নিজের বুড়ো আঙুল চালাল ও। চিৎকার করে উঠল আক্রমণকারী। ও জানে লোকটি কতখানি ব্যথা অনুভব করছে। লোকটির মনে হচ্ছে, ওর গোড়ালি ভেঙে গেছে। পায়ের উপর উঠে দাঁড়িয়ে লোকটির মুখোমুখো হওয়ার চেষ্টা করল ও।

যেই উঠতে যাবে তখুনি ওর মাথা ঘুরে গেল। পুরো পৃথিবী যেন ঘুরছে। ওর সব শক্তি যেন ফাটা বেলুনের মতো বেরিয়ে গেছে। জ্বালা করছে উরুর উপরের অংশ। কী যেন ঢুকেছে ওখানে। নিচ দিকে তাকাল। না, ঢোকেনি। ফুটেছে। একটি সিরিঞ্জ এখনও ওর উরুর মাংস থেকে ঝুলে আছে। ওটার উঁচ ফুটেছে ওর উরুতে।

ড্রাগ দেয়া হয়েছে ওকে।

আক্রমণকারী ওর দুর্বল বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে পালাতে শুরু করল।

লোকটিকে পালাতে দেয়া যাবে না।

পিস্তল উঁচু করল ও… পাথরের মতো ভারী লাগছে ওটাকে। গুলি ছুড়ল। গুলি গিয়ে মেঝেতে বিধল। খুব দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ছে ও। আবার গুলি ছুড়ল… কিন্তু লোকটি ওর চোখের আড়ালে চলে গেছে।

ও শুনতে পেল আক্রমণকারী পালিয়ে যাচ্ছে।

শরীর ভারি হয়ে আসছে ওর। হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে বুকের ভেতর। ওর হৃদপিণ্ড স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে আকারে প্রায় দ্বিগুণ তবে Sonnekonig হিসেবে ঠিকই আছে।

নিজেকে সামলে নিতে কয়েকবার বড় করে দম নিল ও।

 Sonnekonig রা অন্য আট-দশটা সাধারণ মানুষের মতো নয়।

নিজের পা টান করল আস্তে করে।

ওর একটি কাজ শেষ করা বাকি আছে।

ওর জন্মই হয়েছে এর জন্য।

 সেবা করার জন্য। কাজ করার জন্য।

দড়াম করে ট্রাপোর বন্ধ করল পেইন্টার।

 আমাকে একটু সাহায্য করো তো, এক পা টেনে টেনে বলল ও। ওর পায়ে ব্যথা হচ্ছে। কয়েকটা বাক্স দেখিয়ে বলল, এগুলোকে ট্রাপড়োরের ওপর রাখতে হবে।

সবার ওপরে থাকা বাক্সটি টেনে নিল ক্রো। উঁচু করে নিতে গিয়ে দেখে বাক্স খুবই ভারি। তাই মেঝের সাথে ঘষটে ঘষটে দরজার কাছে টেনে নিল ও। ক্রো জানে না এই বাক্সগুলোর ভেতরে কী আছে, শুধু জানে এগুলো ভারী, অনেক ভারী।

ট্রাপড়োরের ওপরে নিয়ে বসালো বাক্সটি।

দ্বিতীয় বাক্স নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল লিসা। তৃতীয় বাক্স টানতে টানতে ক্রো ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল। দুজনে মিলে ভারী বাক্সগুলো দরজার ওপর রাখল।

আর একটা, বলল পেইন্টার।

দরজার ওপরে রাখা বাক্সগুলোর দিকে তাকাল লিসা। এগুলো ঠেলে কেউ বেরোতে পারবে না তো।

বললাম তো, আর একটা। জোর দিয়ে বলল ক্রো, হাঁপাচ্ছে। আমার ওপর আস্থা রাখো।

 দুজন মিলে শেষ বাক্সটিকে জায়গামতো বসালো ওরা। এই বাক্সটিকে ওরা দুজনে মিলে উঁচু করে নিয়েছে। কারণ, তিনটি বাক্স রাখাতে ভরে গিয়েছে ট্রাপড়োরের নিচের অংশ।

যে ওষুধ দিয়েছি, ওতে সে এক ঘন্টার জন্য চুপ মেরে পড়ে থাকবে। বলল লিসা।

লিসার কথাকে ভুল প্রমাণিত করল একটি গুলির আওয়াজ। একটি রাইফেলের গুলি বোঝা চাপিয়ে দেয়া ট্রাপচোরকে ছিদ্র করে গোলাঘরের ছাদে থাকা কাঠের তক্তায় গিয়ে বিধল।

তোমার কথা মানতে পারলাম না, বলল ক্রো। লিসাকে দূরে টেনে নিয়ে গেল।

সিডেটিভে থাকা পদার্থের পুরোটা পুশ করেছিলে তো?

হ্যাঁ, করেছিলাম।

তাহলে কীভাবে…

 আমি জানি, আর এখন ওটা জেনে কোনো লাভও হবে না।

গোলাঘরের খোলা দরজার দিয়ে ওকে নিয়ে এগোল ক্রো। বাইরে অস্ত্রধারী আর কেউ আছে কি-না সেটা দেখে নিয়ে ওখান থেকে বাইরে বেরোল ওরা। বাম দিকে আগুন আর ধোয়ার খেলা চলছে। আগুনের শিখা থেকে উৎপন্ন হওয়া ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে আকাশে।

ধূসর মেঘরাজি পাহাড়ের ওপরের অংশকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে।

তাসকি ঠিক বলেছিলেন, পারকার হুড তুলতে তুলতে বিড়বিড় করল লিসা।

কে?

শেরপা গাইড। তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন আজকে আরেকটা ঝড় আঘাত হানতে পারে।

 ধোয়ার গমন পথের দিকে তাকিয়ে দেখল ওরা প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে মেঘের দিকে এগোচ্ছে। ভারি তুষার কণা নামছে আকাশ থেকে। ছাইয়ের কালো বৃষ্টির সাথে মিশে যাচ্ছে ওগুলো। আগুন ও বরফ। এই মঠে ডজনখানেক সন্ন্যাসী বাস করতেন যারা এখন শুধুই অতীত। এখানে তাদের জন্য স্মৃতিসৌধ হয়ে গেল।

এখানে যারা নিজেদের বাসস্থান গড়ে তুলেছিল তাদের ভুদ্র মুখগুলো মনে পড়ল পেইন্টারের। ওর বুকের ভেতর ক্রোধ টগবগ করে উঠল। কে বা কারা এই সন্ন্যাসীদেরকে নৃশংস, নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল?

কে করেছে সেটার উত্তর ক্রোর জানা নেই, তবে ও জানে কেন করেছে।

এখানকার অসুখ।

 কিছু একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে… আর এখন সেটাকে ধামাচাপা দিতে চাচ্ছে কেউ।

একটি বিস্ফোরণ ওর চিন্তার জাল ছিঁড়ে দিল। আগুন আর ধোঁয়া বেরিয়ে এল গোলাঘরের দরজা দিয়ে। উঠোনে একটি বাক্সের ঢাকনা ছিটকে এসে পড়ল।

লিসার হাত ধরল পেইন্টার।

নিজেকে উড়িয়ে দিল নাকি? লিসা প্রশ্ন করল, বিস্ময়ে গোলাঘরের দিকে তাকিয়ে আছে।

 ওকে নিয়ে বরফ ঢাকা মাঠ দিয়ে এগোল ক্রো। ছাগল-ভেড়ার জমে যাওয়া লাশগুলোকে এড়িয়ে গেল ইচ্ছে করেই। বাইরের দরজার দিকে এগোচ্ছে ওরা।

 তুষারপাত বাড়ছে। এর ফল ভাল এবং মন্দ, দুটোই। পেইন্টারের পরনে আছে একটি মোটা পশমি আলখাল্লা, পায়ে মোটা লোমঅলা বুট। মন্দ দিক, ভয়ঙ্কর তুষারঝড়কে মোকাবেলা করার মতো এগুলো তেমন কিছুই নয়। ভাল দিক, তুষারপাতের কারণে ওদের পদচিহ্ন ঢাকা পড়ে যাবে এবং দূর থেকে ওদেরকে কেউ দেখতেও পাবে না।

নিচের গ্রামের দিকে নেমে যাওয়া একটি পাহাড়ি রাস্তা ধরে এগোল ক্রো। কয়েকদিন আগে ও ওই গ্রাম থেকে এখানে এসেছিল।

দেখ!

নিচে ধোয়ার একটি কলাম আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। মঠের ধোঁয়ার চেয়ে এই ধোয়া তুলনামূলক ছোট সাইজের।

গ্রামটা… হাতের মুঠো শক্ত করল পেইন্টার।

শুধু মঠই নয়, নিচের গ্রামে থাকা ছোট ছোট কুঁড়ে ঘরেও বোমা মারা হয়েছে। হামলাকারীরা কোনো সাক্ষী রাখছে না।

পাহাড়ি রাস্তা থেকে সরে গেল পেইন্টার। এই রাস্তা একদম উদোম, নগ্ন। রাস্তার ওপরে নিশ্চয়ই নজর রাখা হচ্ছে, হয়তো নিচে আছে হামলাকারীরা।

ক্রো ধূমায়িত মঠের দিকে পিছু হটতে শুরু করল।

আমরা কোথায় যাচ্ছি? জানতে চাইল লিসা।

আগুনের পেছনে থাকা জায়গা নির্দেশ করে পেইন্টার জবাব দিল, জনমানব শূন্য জায়গায়।

কিন্তু ওখানে তো…?

হ্যাঁ, ওখানে আলো দেখা যায়, বলল ক্রো। কিন্তু লুকোনোর জন্য ওই জায়গাটাই আমাদের ঠিক হবে। আশ্রয় খোঁজা যাবে ওখানে। ঝড় পার না হওয়া পর্যন্ত আমরা হয়তো ওখানে থাকতে পারব। এখানকার আগুন আর ধোঁয়ার ব্যাপারে কেউ তদন্ত করতে আসার আগপর্যন্ত অপেক্ষা করব আমরা।

পুরো মোটা ধোয়ার কলামের দিকে তাকাল পেইন্টার। যেন কালো রঙের ধোয়ার পিলার। কয়েক মাইল দূর থেকেও এটা চোখে পড়বে। ধোয়ার সংকেত, আমেরিকার পূর্বপুরুষেরা একসময় এরকম ধোয়া ব্যবহার করে সংকেত দিত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কী কারও চোখে পড়বে? আরও উপরে তাকাল ও, মেঘের দিকে দৃষ্টি দিল। মেঘ পেরিয়ে নিজের দৃষ্টিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল ও। এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে এমন একজনের কাছে প্রার্থনা করল ক্রো।

ততক্ষণ পর্যন্ত,..

ওর হাতে একটি রাস্তা খোলা আছে।

চলে, যাওয়া যাক।

.

রাত ১টা ২৫ মিনিট।
ওয়াশিংটন, ডি.সি.।

ক্যাটকে সাথে নিয়ে অন্ধকার ক্যাপিটল প্লাজা পেরোল মনক। ওরা দুজন একটু লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোচ্ছে। তবে এত রাতে ডাকা হয়েছে বলে মোটেও বিরক্ত নয়।

 আমি মনে করি আমাদের অপেক্ষা করা উচিত, বলল ক্যাট। একটু তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে। যে-কোনো কিছুই হতে পারে।

ক্যাটের শরীর থেকে ভেসে আসা জেসমিনের সৌরভ পেল মনক। লোগান গ্রেগরির কাছ থেকে ফোন পেয়ে দুজন একসাথে চট করে গোসল সেরে রওনা হয়েছে ওরা। গরম পানিতে গোসল করার সময় একে অন্যকে আদর-সোহাগ করে ছুঁয়েছে, চুমো খেয়েছে। কিন্তু তারপর বাথরুম থেকে তোয়ালে প্যাচিয়ে আলাদা আলাদাভাবে বেরিয়েছে ওরা। পোশাক পরে নিজেদের ভালবাসার জগৎ থেকে বাস্তব জগতে ফিরে এসেছে। রাতের হিম শীতল ঠাণ্ডা বাড়ার সাথে নিজেদের কামনার আগুনকে নিভিয়ে ঠাণ্ডা করে ফেলেছে ওরা।

ক্যাটের দিকে তাকাল মনক।

 নেভি ব্লু রঙের ট্রাউজার, সাদা ব্লাউজ আর আমেরিকান নৌ-বাহিনীর প্রতীক খচিত একটি উইন্ডব্রেকার রয়েছে ওর পরনে। বরাবরের মতোই এবার ক্যাটের পোশাক পরিচ্ছদে পেশাদারিত্বের ছাপ স্পষ্ট। অন্যদিকে মনকের পরনে আছে রিবকের কালো জিন্স, যবের গুঁড়ো রঙের একটি উঁচু গলাঅলা সোয়েটার। মাথায় পরেছে শিকাগো কাবস বেসবল দলের ক্যাপ।

 আমি যতক্ষণ না নিশ্চিত হচ্ছি, বলল ক্যাট, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের এই প্রেগনেন্সির ব্যাপারে চুপচাপ থাকাই ভাল।

আমি যতক্ষণ না নিশ্চিত হচ্ছি বলে তুমি কী বোঝাতে চাইছ? বাচ্চাটাকে রাখবে কি-না সেটার কথা বলছ? আমাদের ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত কি-না সেটা?

 ক্যাটের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে লোগানের অফিসের চত্বরে পৌঁছা পর্যন্ত তর্ক করল ওরা। রাতের বেলা হাঁটতে বেরিয়ে এই অল্প রাস্তাকে কেমন অন্তহীন বলে মনে হচ্ছে।

মনক…

মনক থামল। এক হাত বাড়িয়ে ক্যাটকে ধরল ও, তারপর ছেড়ে দিল। ক্যাটও দাঁড়িয়ে পড়ল।

ক্যাটের চোখে চোখ রেখে বলল, বলল, ক্যাট।

আমি এই প্রেগনেন্সির ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়ে নিতে চাই… স্টিকগুলো… আমি জানি না। অন্য কাউকে জানানোর আগে আমি নিশ্চিত হতে চাচ্ছি। চাঁদের আলোতে ওর চোখ চিকচিক করে উঠল। কান্না করবে করবে ভাব।

বেবি, এজন্যই তো আমাদের উচিত সবাইকে বিষয়টা জানিয়ে দেয়া। ক্যাটের কাছে এসে এক হাত ওর পেটের ওপর রেখে বলল মনক। এখানে যেটা বড় হচ্ছে ওটার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সবাইকে ব্যাপারটা জানিয়ে দেয়া উচিত।

অন্যদিকে ঘুরল ক্যাট। মনকের হাত ক্যাটের পিঠের অল্প একটু অংশে ছুঁয়ে আছে।

 হয়তো তুমিই ঠিক বলেছিলে। আমার ক্যারিয়ার… হয়তো এটা সঠিক সময় নয়।

 মনক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সব বাচ্চা সঠিক সময়ে জন্ম নিলে পৃথিবীটাই অনেক ফাঁকা থেকে যেত।

মনক, তুমি অন্যায় করছ কিন্তু। এটা তোমার ক্যারিয়ার নয়।

কচু! আচ্ছা, তোমার কী মনে হয় না, একটা বাচ্চা আমার জীবন বদলে দিতে পারে। আমার সবকিছু বদলে যাবে তখন।

ঠিক। আর এই কারণেই আমি ভয় পাচ্ছি। মনকের দিকে পিঠ দিয়ে হেলান দিল ক্যাট। মনক ওকে দুহাতে জড়িয়ে নিল।

আমরা দুজনে মিলে বিষয়টা সামাল দেব, ফিসফিস করে বলল মনক। কথা দিলাম।

তারপরও আমার আরও কয়েকটা দিন চুপ থাকা উচিত। এখনও কোনো ডাক্তারের কাছে যাইনি। হয়তো প্রেগনেন্সি টেস্টে ভুল ছিল।

কয়বার টেস্ট করেছ?

 মনকের মুখোমুখি হল ও।

বলো বলছি।

পাঁচবার। নিচুস্বরে বলল ক্যাট।

 পাঁচবার! মনক ওর কণ্ঠ থেকে হাসির রেশটুকু লুকোতে ব্যর্থ হলো।

ওর বুকে ঘুষি মারল ক্যাট। ব্যথাও লাগল। অ্যাই! আমাকে নিয়ে মজা করবে না। ক্যাটের বলার ভঙ্গির আড়ালে থাকা হাসিটুকু মনকও টের পেল।

ক্যাটকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ও। ঠিক আছে। আপাতত আমরা এটাকে গোপন রাখব।

 মনককে জড়িয়ে ধরে চুমো খেল ক্যাট। আবেগে ভরা গভীর চুমো নয়, স্রেফ ধন্যবাদস্বরূপ। জড়িয়ে রাখা বাধন খুলল ওরা। তবে একে অন্যের আঙুল ধরে রইল। এগিয়ে চলল সামনে।

 উজ্জ্বল আলোয় এসে পড়ল ওরা। স্মিথসোনিয়ান ক্যাসল, এখানেই ওদের আসার কথা। পাথুরে লাল ছাদ, টাওয়ার, টাওয়ারের চুড়ো এগুলো অন্ধকারের মধ্যে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে রয়েছে। শহরের সেকেলে চেহারার পরিচয় বহন করছে এই ভবন। মূল ভবনটিকে স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউশন-এর ইনফরমেশন সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হলেও ওটার ঠিক নিচেই সিগমা ফোর্সের সেন্ট্রাল কমান্ডের ঘটি। এর আগে নিচের এই অংশটিকে বোমা হামলার সময় মানুষজনের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। DARPAর গোপন মিলিটারি ফোর্সকে আড়াল করছে ভবনের এই অংশ। স্মিথসোনিয়ান-এর এই প্রাণকেন্দ্রে মিলিটারি বৈজ্ঞানিকরা ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে।

ভবনের নিচতলায় পৌঁছুতেই মনকের হাত থেকে নিজের আঙুল ছাড়িয়ে নিল ক্যাট।

ওকে লক্ষ করল মনক, দুশ্চিন্তা এখনও ওর মনে খুঁতখুঁত করছে।

সবকিছু মিটমাট হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এখনও ক্যাটের আচরণে একধরনের নিরাপত্তাহীনতাবোধ লক্ষ করছে ও। বাচ্চার চেয়েও বড় কোনো বিষয় আছে কী?

 আমি যতক্ষণ না নিশ্চিত হচ্ছি।

কীসের নিশ্চিত?

বিষয়টি সিগমা কমান্ডের ভূগর্ভস্থ অফিসে যাওয়ার পথ জুড়ে মনকের মনে খচখচ করতে লাগল। তবে দুশ্চিন্তার নতুন বহর যোগ হলো লোগান গ্রেগরির বক্তব্য শোনার পর।

ওই এলাকা এখনও ঝড়ের কবলে ডুবে আছে। বজ্রসহ ঝড়ের তাণ্ডব চলছে পুরো বঙ্গোপসাগরে। একটি ডেস্কের পেছনে বসে লোগান ব্যাখ্যা করলেন। দেয়ালে একসারি এলসিডি কম্পিউটার স্ক্রিন শোভা পাচ্ছে। ওগুলোর মধ্যে দুটোতে তথ্য দেখাচ্ছে। এশিয়ার উপরে থাকা স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি সরাসরি দেখাচ্ছে এটা।

স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত একটি ফটো ক্যাটের কাছে দিল মনক।

আশা করা যায়, সূর্য উদয়ের আগেই আমরা আরও কিছু জানতে পারব। বললেন লোগান। ভোরের দিকে আং গেলু একজন মেডিক্যাল স্টাফকে নিয়ে মঠের দিকে রওনা করেছিলেন। ঝড় শুরু হওয়ার আগেই গিয়েছিল তারা। এখনও অনেক বেলা বাকি। ওখানে মাত্র দুপুর। তাই আশা করা যায়, শীঘ্রি আমরা আরও কিছু জানতে পারব।

 ক্যাটের দিকে এক পলক তাকাল মনক। ডিরেক্টরের তদন্ত সম্পর্কে ব্রিফ করা হলো ওদের। বিগত তিন দিন যাবত পেইন্টার ক্রোর সাথে কমান্ডের কোনো যোগাযোগ নেই। লোগান সাহেবের চোখ-মুখের হাল দেখে বোঝা যাচ্ছে এই ব্যক্তি পুরোটা সময় জেগে কাটিয়ে দিয়েছে। বরাবরের মতো তার পরনে নীল স্যুট আছে, তবে কনুই আর হাঁটুর অংশটুকু একটু দুমড়ে গেছে ওটার। সিগমার সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে ব্যাপারটিকে একটু দৃষ্টিকটু বলা চলে। শুকনো সোনালি চুল আর পেটা শরীরে সবসময় তাঁকে তরুণ মনে হলেও আজ রাতে বোঝা যাচ্ছে তার বয়স চল্লিশেরও বেশি। ঘোলা চোখ, ফ্যাকাসে মুখ আর কুঁচকে থাকা চামড়ার কারণে তার বয়স ফুটে উঠেছে আজ।

গ্রের কী খবর? ক্যাট প্রশ্ন করল।

দৃঢ় টেপে মোড়া একটি ফাইলকে ডেস্কের ওপর রাখলেন লোগান। ভঙ্গিটা এমন, আগের প্রসঙ্গ নিয়ে তার আর কিছুই বলার নেই। দক্ষতার সাথে দ্বিতীয় আরেকটি ফাইল নিয়ে সেটা খুললেন লোগান। এক ঘণ্টা আগে কমান্ডার পিয়ার্সের জীবনের ওপর হামলা হয়েছিল।

 কী? সামনে ঝুঁকল মনক, অনেকটা হঠাৎ করেই। তাহলে এসব আবহাওয়ার রিপোর্ট কীসের জন্য?

শান্ত হও। পিয়ার্স নিরাপদে আছে, ব্যাকআপের জন্য অপেক্ষা করছে। লোগান বললেন। কোপেনহ্যাগেনে ঘটে যাওয়া ঘটনার উল্লেখযোগ্য অংশগুলো শোনালেন তিনি। গ্রে কীভাবে বেঁচেছে সেটাও জানিয়ে দিলেন। মনক, আমি ঠিক করেছি, তুমি কমান্ডার পিয়ার্সের সাথে যোগ দেবে। ডালস-এ একটি জেট প্লেন তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ৯২ মিনিট পর ফ্লাইট।

মনককে মানতেই হবে, লোগান সাহেব একজন দক্ষ লোক। মিনিট বলে দিলেন অথচ ঘড়ির দিকে একবার তাকানোরও প্রয়োজনবোধ করলেন না।

ক্যাপ্টেন ব্রায়ান্ট, ক্যাটের দিকে ফিরে বললেন লোগান। আর এই সময়টুকু তোমাকে এখানে চাই। আমরা এখান থেকে নেপালের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করব। কাঠমাণ্ডুতে আমাদের অ্যাম্বাসিতে ফোন করতে হবে। সেক্ষেত্রে তোমার আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা প্রয়োজন পড়বে।

অবশ্যই, স্যার।

দুশ্চিন্তা করার স্মিথসোনিয়ান ফয়ত্ব পালন

ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে ক্যাটের পদবী উন্নতি হওয়ার কারণে মনক হঠাৎ তৃপ্তিবোধ করল। ক্যাট এরকম সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তে লোগানের ডান হাত হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে। বাইরে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার চেয়ে স্মিথসোনিয়ান ক্যাসলের এই ভূগর্ভস্থ অফিসে নিরাপদে থাকবে ক্যাট। দুশ্চিন্তা করার একটি জায়গা কমল।

 মনক দেখল ক্যাট ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর তাকানোর ভঙ্গিতে রাগের ছটা, মনে হচ্ছে ও মন্‌কের মন পড়তে পারছে। মনক নিজের চেহারা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল।

 লোগান উঠে দাঁড়ালেন। তাহলে তোমরা দুজনে নিজেদের কাজ বুঝে নাও। অফিসের দরজা খুলে বিদেয় করলেন ওদের।

 ওদের পেছনে দরজা বন্ধ হওয়া মাত্র ক্যাট মনকের হাত শক্ত করে প্যাচিয়ে ধরল। তুমি ডেনমার্কে যাচ্ছ?

হ্যাঁ, তো?

তাহলে ওটার…? ক্যাট ওকে মেয়েদের ওয়াশরুমে ওকে টেনে নিল। এত রাতে এখানে কেউ নেই। একদম ফাঁকা। বাচ্চার কী হবে?

আমি বুঝতে পারছি না। কীজন্য…?

 যদি তোমার কিছু হয়ে যায়?

চোখ পিটপিট করে ক্যাটের দিকে তাকাল ও। কিছুই হবে না।

মনকের আরেক হাতের হাত সরিয়ে যান্ত্রিক হাত বের করে দেখাল ক্যাট। তুমি তো সুপারম্যান নও।

 মনক নিজের হাত টেনে নিয়ে পেছনে আড়াল করল। ওর মুখ গরম হয়ে উঠেছে। মাছি মারার মতো সহজ অপারেশন এটা। গ্রে ওর কাজ করবে আমি ওকে সাহায্য করব। ওদিকে র‍্যাচেলও আসছে। ওদের দুজনের মাঝে আমাকে হয়তো কাবাব মে হাড়ি হতে হবে। আর তারপর দি। প্রথম ফ্লাইট ধরে আমরা ফিরে আসব, ব্যস।

অপারেশন যদি এত সহজই হয় তাহলে অন্য কেউ যাক। আমি লোগানকে বলব, এখানে তোমার সাহায্য লাগবে।

হ্যাঁ, তুমি বললেই তিনি শুনবে!

 মনক…

আমি যাচ্ছি, ক্যাট। প্রেগনেন্সির ব্যাপারটা তুমিই গোপন রাখতে চাচ্ছ। আমি তো পুরো দুনিয়াকে জানিয়ে দিতে চাই। যা-ই হোক, আমাদের দুজনেরই ডিউটি আছে। তুমি তোমারটা করো, আমি আমারটা। বিশ্বাস রাখো, আমি বেপরোয়া কিছু করব না। ক্যাটের পেটের ওপর হাত রাখল মনক। আমাদের তিনজনের জন্য নিজেকে সাবধানে রাখব।

ক্যাট ওর হাতের ওপর হাত রেখে শ্বাস ফেলল। হুঁ।

হাসল মনক। ক্যাটও হাসল। কিন্তু ক্যাটের চোখে দুশ্চিন্তার ছায়া ঠিকই দেখতে পেল মনক। দুশ্চিন্তার বিপরীতে ওর কাছে মাত্র একটি জবাব আছে।

কাছে এগিয়ে এল ও। দুজোড়া ঠোঁট পরস্পরকে চুমো খেল। ফিসফিস করল ওরা। কথা দিলাম।

কীসের কথা দিলে? ক্যাট জানতে চাইল।

সবকিছু। জবাব দিল মনক। আরও গভীরভাবে চুমো খেল।

একদম মন থেকে কথা দিয়েছে ও।

তুমি এটা গ্রেকে জানাতে পারো, চুমো শেষ করে বলল ক্যাট। তবে হ্যাঁ, ওকে বলো আর কাউকে যেন না বলে।

 সত্যি? মন্‌কের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু পরমুহূর্তেই সন্দেহে সরু হয়ে গেল ও দুটো। কেন?

ওর পেছনে গিয়ে আয়নামুখী হলো ক্যাট। মনকের পাছায় চাপড় মেরে বলল, যাতে সে-ও তোমার খেয়াল রাখে।

ঠিক আছে।

আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিল ক্যাট। আচ্ছা, এখন আমি তোমার সাথে কী

করব?

ওর কোমর জড়িয়ে ধরে মনক বলল, মিস্টার গ্রেগরি সাহেবের মতে আমার হাতে এখনও ৯২ মিনিট সময় আছে।

.

দুপুর ১২টা ১৫ মিনিট।
হিমালয়।

পেইন্টারের পর হামাগুড়ি দিল লিসা।

 পাহাড়ি ছাগলের মতো দক্ষতা প্রদর্শন করে ঢাল ও বরফ শিলার ভেতর দিয়ে লিসাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল ক্রো। ভারি তুষারপাত হচ্ছে ওদের ওপর। মাথার ওপরে মেঘের স্কুপ থাকার কারণে আলো কমে গেছে, কয়েক ফুট পরে কী আছে দেখা যাচ্ছে না। দিনের বেলাতেই কীরকম অদ্ভুত ধূসর জ্যোৎস্নার মতো আলো। তবে ওরা অন্তত বরফঅলা দমকা বাতাসের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। ওরা যে গিরিপথ ধরে নিচে নামছে বাতাস বইছে ঠিক তার উল্টো দিকে।

বাতাসের কবল থেকে বাঁচতে পারলেও এই হিমশীতল ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। পারকা আর গ্লোভস থাকা সত্ত্বেও লিসা কাঁপছে। ওরা রওনা হয়েছে এক ঘন্টাও হয়নি। মঠে আগুন লাগায় ওখানকার তাপমাত্রা একটু গরম ছিল, তবে সেটা এখন অতীত। ওর মুখের কয়েক ইঞ্চি চামড়া বেরিয়ে আছে, ঠাণ্ডা বাতাস যেন ওইটুকু জায়গাতেই ঝামা ঘষে দিচ্ছে।

পেইন্টারের অবস্থা আরও খারাপ। এক জোড়া মোটা প্যান্ট, পশমি দস্তানা পরেছে ও। এক মৃত সন্ন্যাসীর শরীর থেকে খুলে নিয়েছে এগুলো। ওর মাথায় কোনো হুডও নেই। মুখের নিচের অংশে একটি স্কার্ফ বেঁধে রেখেছে, ব্যস। ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে ওর শ্বাস সাদা ধোয়া হয়ে বেরোচ্ছে।

আশ্রয় খুঁজতে হবে ওদের।

দ্রুত।

লিসা ঢালে একটু পিছলে যেতেই ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল ক্রো। ওরা গিরিপথের নিচে পৌঁছে গেছে। ঢালু দেয়াল দিয়ে ফ্রেমবন্দীর মতো হয়ে আছে জায়গাটি।

 টাটকা তুষার জমেছে এখানে। ওগুলোব গভীরে পা ডুবে যাচ্ছে। স্নো-শু ছাড়া এই বরফ মাড়িয়ে যাওয়া অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

লিসার উদ্বেগ আঁচ করতে পেরে একদিকের সরু অংশ দেখাল পেইন্টার। ঢালের একটি অংশ সামনে বেরিয়ে ঝুলে আছে। ওখানে গেলে এই বৈরি আবহাওয়ার প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। পা টেনে টেনে ওটার দিকে এগোল ওরা।

ঝুলন্ত অংশের নিচে যাওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা সহজ হয়ে গেল।

 পেছনে তাকাল লিসা। ইতোমধ্যে তুষার এসে ওদের পায়ের ছাপ ঢেকে দিতে শুরু করেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে কোনো পায়ের ছাপ আর দেখা যাবে না। কেউ ওদের খুঁজতে এলে, এই বিষয়টি ওদের সাহায্যই করবে। তারপরও লিসার কেমন যেন অস্বস্তি লাগল। মনে হলো, ওদের অস্তিত্বই যেন মুছে যাচ্ছে।

সামনে ঘুরল ও। আমরা কোথায় যাচ্ছি সে-সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে? লিসা দেখল ওর গলার আওয়াজ ফিসফিসিয়ে বেরোচ্ছে। অবশ্য নিজেরা কোন অজানার উদ্দেশে যাচ্ছে সেই ভয়ে নয়, ঝড়ের ভয়ে আপনা আপনি ফিসফিস করে বলেছে ও।

খুব বেশি কিছু জানি না, বলল পেইন্টার। সীমান্তের এই অংশটুকু ম্যাপে ওভাবে চিহ্নিত করা নেই। এর অধিকাংশ জায়গায় এখনও মানুষের পা পড়েনি। হাত নেড়ে বলল ও। এখানে যখন প্রথম এসেছিলাম তখন স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত কিছু ছবিতে চোখ বুলিয়েছি। কিন্তু ওগুলো বাস্তব পরিস্থিতিতে তেমন কাজে আসবে না। এখানকার ভূমি খুব বেশি অসমতল। পর্যবেক্ষণ করা কঠিন।

ওরা চুপচাপ কয়েক পা সামনে এগোল।

ঘুরে লিসার দিকে তাকাল পেইন্টার। তুমি কী জানো ১৯৯৯ সালে এখানে ওরা সাংরি-লা আবিষ্কার করেছিল?

ক্রোকে খেয়াল করল ও। স্কার্ফে ঢাকা মুখের আড়ালে ক্রো হাসছে কি-না সেটা ও বুঝতে পারছে না। হয়তো লিসার ভয় দূর করার চেষ্টা করছে। সাংরি-লা… মানে হারানো দিগন্ত, লস্ট হরাইজন? একটি সিনেমা ও বইয়ের কথা মনে পড়ল ওর। হিমালয়ে অবস্থিত বরফে মোড়া উটোপিয়ান স্বর্গ, যেটা হারিয়ে গিয়েছিল।

 লিসাকে বুঝাতে শুরু করল ক্রো। এখান থেকে কয়েকশ মাইল দক্ষিণে দুজন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক অভিযাত্রী বিরাটাকার, গভীর গিরিসঙ্কট আবিষ্কার করেছিলেন। পাহাড়ের পার্শ্বদেশের নিচে ছিল ওটা। তাই স্যাটেলাইট ম্যাপে দেখা যেত না। ওটার তলায় একটা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় স্বর্গ বিছানো ছিল। ঝরনা, দেবদারু ও পাইন গাছ, তৃণভূমি জুড়ে রডোডেনড্রন ফুলের ছড়াছড়ি, জলপ্রবাহের পাশে সারি সারি ফার ও চিরহরিৎ গাছপালা। সবমিলিয়ে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা একটা বুনো বাগান ছিল ওটা। প্রাণসম্পদে ভরপুর জায়গাটির চারদিকে ছিল তুষার আর বরফ।

সাংরি-লা?

শ্রাগ করল পেইন্টার। প্রকৃতি যেটাকে লুকোতে চায় সেটাকে স্যাটেলাইট দিয়ে বের করা সম্ভব না, সাংরিলা সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে।

 দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি লাগছে ওর। কথা বলার কারণে অযথা শ্বাস-প্রশ্বাস ও তাপের অপচয় হয়েছে। ওদের নিজেদের জন্য একটি সাংরি-লা খুঁজে বের করতে হবে।

চুপচাপ এগোল ওরা। তুষার পড়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে।

আরও দশ মিনিট পর ওরা দেখল গিরিপথ একদিকে একেবেঁকে সরে গেছে। কোণায় পৌঁছুতেই ওদের মাথার ওপরে থাকা ঢালের ঝুলন্ত অংশ শেষ হয়ে আসছে।

থেমে আলাদা হয়ে তাকাল ওরা।

এখান থেকে ঢাল খুব খাড়াভাবে নিচে নেমে গেছে। প্রসারতাও বেড়েছে। এদের সামনে পর্দার মতো তুষার পড়ছে, যেন তুষারে ভরে যাচ্ছে পৃথিবী। দমকা বাতাস আর গভীর উপত্যকা দেখে যা মনে হলো এটা সাংরি-লা নয়।

 বরফে ঢেকে যাওয়া খাঁজ কাটা পাহাড়ের সারি সামনে বিস্তৃত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রশি ছাড়া ওখানে পা দেয়া খুব কঠিন হবে, খুব ঢালু ওগুলো। এক সারি ঝরনা দেখা গেল–তবে ওগুলো বরফে জমে স্থবির হয়ে আছে।

 তুষার আর বরফের ধোঁয়াশা যুক্ত একটি গভীর গিরিসঙ্কট চোখে পড়ল। মনে হচ্ছে ওটার কোনো তল নেই। ওটা দিয়ে পৃথিবীর শেষ মাথা পর্যন্ত যাওয়া যাবে।

 আমরা নিচে গিয়ে কোনো একটা রাস্তা খুঁজে বের করব। বলল ক্রো। তুষার পাতের ভেতরে পা বাড়ল ও। তুষার জমতে জমতে এখন পায়ের গোড়ালি ছাড়িয়ে আরও উপরে উঠে এসেছে। লিসার জন্য পথ দেখাল ক্রো।

 দাঁড়াও, বলল লিসা। ও জানে এখানে ক্রো আর বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারবে না। ওকে নিয়ে এতদূর এসেছে ঠিকই কিন্তু সামনে যাওয়ার মতো ওদের অবস্থা নেই, প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই।

 এখানে…।

ক্রোকে একটি উপত্যকার দেয়ালের দিকে নিয়ে চলল ও। বাতাসের প্রকোপ থেকে জায়গাটি মুক্ত।

কোথায়…? ক্রো প্রশ্ন করতে চাইল কিন্তু ঠাণ্ডায় দাতে দাঁত বাড়ি লাগায় করতে পারল না।

উপর থেকে নেমে জমাট বাঁধা ঝরনাধারা দেখাল লিসা। তাসকি শেরপা ওদেরকে বেঁচে থাকার জন্য কিন্তু টেকনিক শিখিয়েছিলেন। আশ্রয় খোঁজার এই টেকনিকগুলো শেখা ছিল কঠোরভাবে বাধ্যতামূলক।

লিসা খুব ভাল করেই জানে কীভাবে সেরা জায়গাটিকে খুঁজে বের করতে হবে।

 জমাট বাঁধা ঝরনাধারা ওদের যেখানে এসে পৌঁছেছে সেটা পেরিয়ে গেল লিসা। তাসকির শিখিয়ে দেয়া জ্ঞান অনুযায়ী, কালো পাথর কোথায় গিয়ে নীল-সাদা বরফের সাথে মিশেছে সেটা খুঁজতে লাগল ও। টেকনিক বলে, গ্রীষ্মকালে হিমালয়ে থাকা বরফ গলার ফলে এই ঝরনায় পানির প্রবাহ শুরু হয়। পাহাড়ের বিভিন্ন গভীর অংশের বরফও গলে পানিতে পরিণত হয় তখন। অন্যদিকে যখন ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করে তখন চলমান ঝরনাধারা আস্তে আস্তে বরফ হয়ে জমাট বেধে যায়। আর মজার ব্যাপার হলো এই জমাট বাধা জলধারার পেছনে সবসময় ফাঁকা জায়গা থাকে।

লিসা স্বস্তির সাথে খেয়াল করল, এই ঝরনাও সেটার ব্যতিক্রম নয়। তাসকি আর তাঁর পূর্বপুরুষদেরকে মনে মনে ধন্যবাদ দিল ও। কনুই ব্যবহার করে বরফ আর পেছনের দেয়ালের মধ্যকার কালো ফাঁকা অংশ চওড়া করল ও। পেছনে একটি ছোট গুহার দেখা মিলল।

লিসার সাথে যোগ দিল ক্রো। দাঁড়াও দেখে আসি ভেতরটা নিরাপদ কি-না।

ফাঁকা জায়গা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ পর ছোট্ট একটি আলো জ্বলে উঠল, আলোকিত হলো জমাট বাঁধা ঝরনাধারা।

লিসা ফাঁকা অংশ দিয়ে উঁকি দিল।

কয়েক পা দূরে পেইন্টার দাঁড়িয়ে আছে, হাতে পেলাইট। আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছোট কোটর পরীক্ষা করছে ও। দেখে নিরাপদ মনে হচ্ছে। ঝড়ো আবহাওয়ার সময়টুকু আমরা এখানে কাটিয়ে দিতে পারব।

গুহায় ঢুকল লিসা। বাইরের বাতাস আর তুষারপাত এখানে নেই। এখনই বেশ উষ্ণবোধ হচ্ছে।

ক্রো পেনলাইট বন্ধ করে দিল। এখানে আলো জ্বালানোর কোনো প্রয়োজন নেই। বাইরে যে দিনের আলো আছে সেটাকে পুরোপুরি চুষে নিয়ে বর্ধিত করে জমাটবাধা ঝরনাধারা ভেতরের গুহাকে আলোকিত করে রেখেছে। আলোর বিকিরণ হচ্ছে বরফ থেকে।

 লিসার দিকে তাকাল পেইন্টার। ওর চোখগুলো একদম নীল রঙের, জ্বলজ্বলে বরফের সাথে মিলে গেছে। ওর চেহারায় ফ্রস্টবাইট (বরফপচন)-এর লক্ষণ আছে কি না দেখল লিসা। বাতাসের তোপে ওর চামড়া একদম নীল হয়ে গেছে। ক্রোর চেহারার হাল দেখে বুঝল এই ব্যক্তি সত্যিই আমেরিকার আদিবাসী। খাঁটি আমেরিকান।

ধন্যবাদ, বলল পেইন্টার। এইমাত্র তুমি হয়তো আমাদের জীবন বাঁচালে।

 শ্রাগ করল লিসা, অন্যদিকে তাকাল। তোমার কাছে আমি ঋণী ছিলাম।

মুখে যতই গম্ভীরভাবে জবাব দিক না কেন ক্রোর কথাগুলো ওর কাছে কেমন যেন উষ্ণ মনে হলো… ও যতখানি আশা করেনি তার চেয়েও বেশি ছুঁয়ে গেল কথাগুলো।

 তুমি কীভাবে জানলে এভাবে খুঁজলে… বাক্য শেষ করতে পারল না সজোরে হাঁচি দিল ক্রো। ওউ।

 লিসা নিজের প্যাক নামাল। প্রশ্ন পরে হবে। আমাদের দুজনের উষ্ণতা বাড়ানো দরকার।

মেডিক্যাল প্যাক খুলে একটি এমপিআই ইনস্যুলেটিং কম্বল বের করল ও। জিনিসটা পাতলা হলেও এর অ্যাসট্রলার কাপড় শরীর থেকে নির্গত তাপের নব্বই শতাংশ তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারে। তবে লিসা অবশ্য শুধু নিজেদের শরীরের তাপমাত্রার ওপরেই নির্ভর করছে না।

ছোট একটি হিটার বের করল ও, পর্বতারোহণের জন্য এই জিনিস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বোসো, পেইন্টারকে নির্দেশ করল লিসা। ঠাণ্ডা পাথরের ওপর কম্বলটিকে বিছিয়ে দিল।

ঠাণ্ডায় পেইন্টারের অবস্থা শোচনীয়, কোনো আপত্তি করল না।

লিসাও ওর সাথে যোগ দিয়ে ওদের দুজনের ওপরে কম্বল টেনে নিল। কম্বলের ভেতরে বসেই কোলম্যান স্পোর্ট-ক্যাট হিটারের ইলেকট্রনিক সুইচ অন করল ও। বুটেন গ্যাসের ছোট্ট সিলিন্ডার দিয়ে চলবে এই হিটার। ১৪ ঘণ্টার মতো টিকবে। পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার করলে এই সিলিন্ডার দিয়ে সামনের দুই/তিন দিন থাকতে পারবে ওরা।

হিটার গরম হচ্ছে। লিসার পাশে থাকা পেইন্টার কেঁপে উঠল।

জুতো আর গ্লোভস খোলো, ক্রোকে খুলতে বলে নিজেও খুলল। হিটারের গরমে হাতগুলোকে সেঁকে নাও, হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল, নাক, কান ম্যাসাজ করো।

ফ্র… ফ্রস্টবাইট থেকে বাঁচার জন্য…

মাথা নাড়ল লিসা।

নিজের শরীর আর পাথরের মাঝে যতটা সম্ভব কাপড় রাখো, যাতে শরীরের তাপমাত্রা পাথরে চলে না যায়।

আস্তে আস্তে গুহার তাপমাত্রা সুন্দর উষ্ণ হতে লাগল।

আমার কাছে কয়েকটা পাওয়ারবার আছে, বলল লিসা। তুষার গলিয়ে পানি পেতে পারি আমরা।

একদম পাক্কা খেলোয়ার! বলল পেইন্টার। শরীর উষ্ণ হতেই কথায় জোর ফিরে পাচ্ছে।

কিন্তু এসবের কিছুই কিন্তু বুলেট ঠেকাতে পারবে না। লিসা বলল। পেইন্টারের দিকে তাকাল ও কম্বলের নিচে নাকের সাথে নাক ছুঁই ছুঁই অবস্থা।

শ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল ক্রো। ওরা ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে রক্ষা পেলেও বিপদ থেকে এখনও উদ্ধার পায়নি। কিন্তু কীভাবে কী করবে? যোগাযোগ করার কোনো রাস্ত ইি নেই ওদের। হাতে কোনো অস্ত্রও নেই।

আমরা লুকিয়ে থাকব, বলল পেইন্টার। মঠে যারা বোমা মেরে আগুন ধরিয়েছে ওরা আমাদেরকে এতদূর পর্যন্ত খুঁজে বের করতে পারবে না। ঝড় কেটে গেলে উদ্ধারকারীরা আসবে। আশা করা যায় হেলিকপ্টার থাকবে তাদের সাথে। রোড ফ্লেয়ার দিয়ে আমরা তাদেরকে সংকেত দিতে পারব। তোমার ইমার্জেন্সি প্যাকে রোড ফ্লেয়ার আছে, আমি দেখেছি।

কামনা করি, অন্যরা আসার আগেই যেন উদ্ধারকারীরা এখানে পৌঁছায়।

লিসার হাঁটুতে হাত রাখল ক্রো। লিসা ওর এই আচরণে খুশি। ক্রো ওকে অন্তত কোনো মিথ্যে আশ্বাস দেয়ার চেষ্টা করেনি। ওরা ফুলশয্যায় নেই, ঘোর বিপদে আছে। ক্রোর হাত ধরল লিসা, শক্ত করে। আশ্বাস দেয়ার চেষ্টা।

চুপচাপ রইল ওরা, যে যার নিজস্ব চিন্তায় ডুবে গেছে।

তোমার কী মনে হেয়, ওরা কারা? নরম স্বরে জানতে চাইল লিসা।

জানি না। তবে ওই লোকটিকে শুইয়ে ফেলার সময় শুনলাম সে জার্মান ভাষায় কী যেন শপথ করল।

জার্মান? তুমি নিশ্চিত?

আমি কোনো কিছুতেই নিশ্চিত নই। তবে লোকটা হয়তো ভাড়া করা সৈনিক। অবশ্যই ওর কিছু মিলিটারি ট্রেইনিং নেয়া ছিল।

দাঁড়াও, লিসা বলল। নিজের প্যাক নাড়াচাড়া করল ও। আমার ক্যামেরা।

ক্রো সোজা হয়ে বসে রইল। কম্বলের এক অংশ সরে যাওয়ায় কাঁপছে। কম্বল টেনে নিয়ে লিসার আরেকটু কাছ ঘেঁষে বসল। যাতে কম্বল দিয়ে দুজনেই নিশ্চিন্তভাবে ঢেকে থাকা যায়। তোমার কী মনে হয়, তুমি ওর কোনো ছবি তুলেছ?

ঘন ঘন ফ্ল্যাশ করার জন্য আমি ক্যামেরাকে একের পর এক ছবি ভোলার অপশনে সেট করেছিলাম। ওই মোডে ডিজিটাল এসএলআর ক্যামেরা প্রতি সেকেন্ডে ৫টা করে ফ্রেম তোলে। জানি না, কী উঠেছে। ক্যামেরা ঠিকঠাক করতে করতে বলল ও।

 ওদের দুজনের কাঁধের সাথে কাঁধ ঠেকে আছে। ক্যামেরা এলসিডি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে ওরা। লিসা শেষ ছবিগুলো ওপেন করল, অধিকাংশই অস্পষ্ট। ছবিগুলো একের পর এক দেখে যাওয়ার ফলে মনে হলো ওরা ওদের পালানোর স্লো-মোশন ভিডিও দেখছে। বিস্মিত আক্রমণকারী ফ্ল্যাশের আলো থেকে নিজের চোখ বাঁচানোর জন্য নিজের হাত তুলল, ব্যারেলের আড়ালে লিসা লুকিয়ে পড়তেই গুলি ছুড়ল সে, পেইন্টার ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর।

কয়েকটি ছবিতে লোকটির চেহারার অংশ বিশেষ উঠেছে। ওগুলোকে জোড়া দিয়ে মোটামুটি যে চেহারা পাওয়া গেল: সোনালি-সাদা চুল, কপালটা দেখতে পাশবিক, চোয়াল উন্নত। আক্রমণকারী আর পেইন্টার যখন শুয়ে ধস্তাধস্তি করছিল শেষ কয়েকটি ছবি সম্ভবত তখন উঠে যায়। লোকটির চোখের ক্লোজ-আপ ছবি পেল লিসা। নাইট ভিশন চশমা কানের উপরে সরে গেছে। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে লাল চোখ তাকিয়ে আছে ক্যামেরা ফ্ল্যাশের দিকে।

আং গেলুকে বড় কাস্তে নিয়ে আক্রমণ করা রেলু নাআর কথা মনে পড়ল লিসার। সেই পাগল সন্ন্যাসীর চোখেও এই একই অবস্থা দেখেছিল ও। ঠাণ্ডা শিরশিরে স্রোত বয়ে গেল ওর অনাবৃত চামড়া দিয়ে।

লোকটির অন্য চোখ লক্ষ করল লিসা। দুটো চোখ দুরকম।

একটির মণি নীল।

 অন্যটি ধবধবে সাদা।

 হয়তো ক্যামেরার ফ্ল্যাশের জন্য এটা কেমন দেখাচ্ছে।

শুরুর দিকে ভোলা ছবিগুলোর দিকে এগোল লিসা।

ভূগর্ভস্থ সেলারের ছবিগুলোর আগে তোলা সর্বশেষ ছবি এটা। রক্ত দিয়ে লেখা একটি দেয়ালের ছবি। ও এই ছবিটির কথা ভুলেই গিয়েছিল।

কী এটা? জানতে চাইল ক্রো।

লামা খেমসারের দুঃখজনক ঘটনা ইতোমধ্যে ওকে জানিয়েছে লিসা। বৃদ্ধ সন্ন্যাসী এগুলো দেয়ালে লিখেছিলেন। কয়েকটি চিহ্নকে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

পেইন্টার একটু সামনে ঝুঁকল। জুম করো তো।

লিসা জুম করল।

ভ্রু কুঁচকালো পেইন্টার। এটা তিব্বতিয়ান কিংবা নেপালি অক্ষর নয়। চিহ্নগুলো কেমন যেন আড়ষ্ট। দেখে মনে হচ্ছে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান প্রাচীন বর্ণ কিংবা ওরকম কিছু একটা হতে পারে।

তোমার তা-ই মনে হয়?

বললাম তো, হতে পারে। ক্লান্ত হয়ে পিঠ টান দিল ক্রো। তাছাড়া, হয়তো লামা খেমসার যা জানতে চেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি জানতেন।

পেইন্টারকে একটি ব্যাপার জানাতে ভুলে গিয়েছিল ও। বৃদ্ধ সন্ন্যাসী নিজের গলা কেটে ফেলার পর আমরা তার বুকে একটি অঙ্কিত চিহ্ন দেখেছিলাম। পাগলামী কিংবা কাকতালীয় ভেবে আমি ওটাকে গুরুত্ব দেইনি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে…

ওটা দেখতে কেমন ছিল? এঁকে দেখাতে পারবে?

 অত কিছুর দরকার হবে না। স্বস্তিকা চিহ্ন ছিল।

 ভ্রু উঁচু করল পেইন্টার। স্বস্তিকা?

তাই তো দেখলাম। এমনও তো হতে পারে তিনি অতীত রোমন্থন করছিলেন। যে জিনিসটা ভয় পাইয়ে দিয়েছিল সেটা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিলেন, হতে পারে না?

 আং গেলুর আত্মীয় রেলু নাআর কাহিনি শুনাল লিসা। মাওবাদী বিদ্রোহীদের কাছ থেকে কীভাবে পালিয়েছিল, নিরপরাধ চাষীদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নিয়েছিল তারা, রেল তাদের বর্বরতা মেনে নিতে পারেনি। অথচ পরবর্তী রে নাআ সেই কাজই করেছিল। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অপ্রকৃতিস্থের মতো আচরণ করেছিল সে।

লিসার বলা শেষ হলে ভ্রু কুঁচকে রইল পেইন্টার। লামা খেমসারের বয়স আনুমানিক ৭৫ বছর হবে। সে হিসেবে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি কিশোর ছিলেন। ওদিক দিয়ে বিচার করলে স্বস্তিকার ব্যাপারটা ঠিকই আছে। নাৎসিরা হিমালয়ে রিসার্চ অভিযান চালিয়েছিল।

এখানে? কেন?

শ্রাগ করল পেইন্টার। হেনরিক হিমল্যারকে দিয়ে কাহিনি শুরু করতে হবে। এসএস এর প্রধান, গুপ্ত কিছুর ব্যাপারে বদ্ধপরিকর ছিল সে। হাজার বছরের পুরোনো লিপি ঘেটে জেনেছিল এটা আর্যদের জন্মস্থান। সেই বিশ্বাস নিয়ে হারামজাদা নাসি এখানে অভিযান পাঠালো, প্রমাণ সংগ্রহ করবে। ঘোড়ার ডিম ছাড়া আর কিছু পায়নি সেটা বলাই বাহুল্য।

 হাসল লিসা। হয়তো বৃদ্ধ লামা তখন সেই অভিযানের সাথে কোনোভাবে জড়িত। ছিলেন। হয়তো গাইড হিসেবে কাজ করেছিলেন কিংবা অন্যকিছু।

হতে পারে। কিন্তু আমরা আর সেটা জানতে পারব না। গোপন যা-ই কিছু হয়ে থাক, তিনি মারা যাওয়ার সাথে সাথে সেগুলোও হারিয়ে গেছে।

হয়তো না। হয়তো তিনি তার রুমে কিছু একটা করার চেষ্টা করছিলেন। তার কিছু। হতে পারে তার অজ্ঞাতেই তার মন তাকে দিয়ে গোপন কিছু প্রকাশ করতে চাচ্ছিল।

 অনেক হয়তো রয়ে যাচ্ছে, কপালে হাত বুলাল ক্রো। আমি আরও একটা হয়তো যোগ করি। হয়তো এগুলোর সবই স্রেফ পাগলামী।

এর বিপরীতে আপত্তি তোলার মতো কিছু পেল না লিসা। শ্বাস ফেলে প্রসঙ্গ : পরিবর্তন করার চেষ্টা করল। যথেষ্ট গরম হয়েছ তো?

হ্যাঁ, ধন্যবাদ।

 হিটার বন্ধ করল ও। বুটেন গ্যাস অপচয় করা যাবে না।

মাথা নাড়ল ক্রো, হাই উঠছিল ওর, ঠেকানো চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো।

 আমরা বরং একটু ঘুমিয়ে নিই, বলল লিসা। পালা করে ঘুমাব।

.

কয়েক ঘণ্টা পর উঠল পেইন্টার। কেউ একজন ওর কাধ ধরে ঝাঁকাচ্ছে। দেয়ালের। সাথে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়েছিল, সোজা হয়ে বসল এখন। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সামনে থাকা বরফের দেয়ালে যেন আলকাতরা মেখে দেয়া হয়েছে।

তবে ঝড় মনে হয় থেমে গেছে।

কী সমস্যা? ক্রো প্রশ্ন করল।

কম্বলের এক অংশ ফেলে দিল লিসা।

 এক হাত দিয়ে ইশারা করে ফিসফিস করে বলল, দাঁড়াও।

ঘুম তাড়িয়ে লিসার আরও কাছে ঘেঁষল ও। আধা মিনিট অপেক্ষা করল। ঝড় থেমে গেছে, নিশ্চিত। বাতাসের গর্জনও নেই। গুহার বাইরে পর্বত আর উপত্যকা জুড়ে সুনসান নীরবতা। সন্দেহজনক কোনো কিছু শোনার জন্য কান খাড়া করল ও।

নিশ্চয়ই কিছু একটা লিসাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে।

ক্রো ওর মনের ভয় অনুভব করতে পারল। কারণ লিসা ভয়ে রীতিমতো কাঁপছে।

 লিসা, কী হয়েছে…

হঠাৎ করে বরফের দেয়াল উজ্জ্বল আলোয় জ্বলে উঠল। মনে হলো বাইরের আকাশে আতশবাজির খেলা হচ্ছে। তবে কোনো আওয়াজ নেই। আমোর ঝালর কিছুক্ষণ থেকে তারপর বিলীন হয়ে গেল। সব আবার অন্ধকার।

 ভূতুড়ে আলো… ফিসফিস করল লিসা। তাকাল ক্রোর দিকে।

তিন রাত আগের কথা ভাবল ক্রো। তখন থেকেই তো শুরু। গ্রামের অসুস্থতা, মঠে পাগলামী। লিসার অনুমানের কথা মনে পড়ল ওর। এই আলোর সাথে অসুস্থতার লক্ষণের সরাসরি সম্পর্ক আছে।

আর এখন ওরা সেই অভিশপ্ত ভূমিতেই অবস্থান করছে।

একদম কাছে।

পেইন্টার দেখল চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বলতায় বরফ জমা ঝরনাধারা আবার প্রজ্জ্বলিত হলো। ভূতুড়ে আলো ফিরে এসেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *