স্যাংচুয়ারি

ফাইনাল কেসেস (মিস মার্পল)

স্যাংচুয়ারি

০১.

দুহাতে ফুটন্ত ক্রিসেনথেমাম নিয়ে ভাইকারের বউ প্রবেশ করলেন ভিকারেজের ঘরের মধ্যে। তার জুতোর ডগায় লেগে আছে শিশিরস্নাত মৃত্তিকার কণা, শুধু তাই নয়, তাঁর নাকের অগ্রে সাত সকালের নিষ্পাপ ভালোবাসার স্পন্দন, কিন্তু এ দুটি বিষয় সম্পর্কে তিনি মোটেই অবহিত নন।

দরজা খুলতে সামান্য পরিশ্রম করতে হল তাকে। অবাধ্য দরজা কিছুতেই খুলবে না বুঝি, দুষ্টু বাতাস উড়িয়ে দিতে চাইল তাঁর মাথার ওপর তেরছাভাবে বসানো ফেল্টের হ্যাট। অতি কষ্টে হ্যাটকে সামলালেন তিনি। বসে ডাকলেন-বথার।

উৎসাহী জননী ডিয়ানা মিসেস হারমনের নামটা পালটে বাঞ্চ করেছেন তার কিশোরী বেলায়। কিন্তু কেন, সে খবর আমরা জানি না। এখন তার নামের সাথে এই শব্দটি জুড়ে গেছে। দুহাতে ধরা ক্রিসেনথেমাম, এগিয়ে গেছে পথ চার্চ প্রাঙ্গনের দিকে, তিনি এগিয়ে গেলেন চার্চের দরজার পাশে।

নভেম্বরের বাতাস এখন মৃদুমন্দ বইছে। আর্দ্রতার চিহ্ন মাখা। আকাশের সেখানে এখানে দুষ্ট কালো মেঘের দল ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে, চোখের পরতে নীলাভ রেখা। চার্চের ভেতর বাতাবরণ এখন অন্ধকারপথে শীতার্ত আর্তনাদ, সার্ভিস মুহূর্ত ছাড়া কখনো তাকে কাঙ্ক্ষিত উত্তাপ দেওয়া হয় না।

বাঞ্চ বলে উঠলেন–ধ্যুৎ, মনে হচ্ছে এই শীতে বোধহয় আমি আর বাঁচব না।

অভ্যাস মতো সংগ্রহ করেছেন ফুল সাজানোর জিনিসপত্র–ফুলদানি, জল, ঢাকা দেবার টুকরো, তারপর বাঞ্চ মনে মনে বললেন, লিলিফুল থাকলে ভালো হত, এই ক্রিসেনথেমাম দেখে আর ভালো লাগছে না আমার। তবুও অভ্যাসমতো আঙুল চালিয়ে ফুলকে সুসজ্জিত করার চেষ্টায় মেতে উঠলেন তিনি।

আজ এই সন্ধ্যার মধ্যে কোনো কিছুকেই আমরা মৌলিক অথবা কৃত্রিম বলতে পারি না। বাঞ্চ হারমেন হয়তো নিজের জীবনেও মৌলিকত্বকে সেভাবে আঁকড়ে ধরতে ভালোবাসেন না। তার কাজ কর্মের মধ্যে শৈল্পিক অনুভূতির ছাপ নেই কিন্তু তার মধ্যে এমন একটা আবেশ আছে যাকে আমরা গৃহস্থালি বলতে পারি। আর আছে অনুপম উপস্থাপনা। সাবধানে ফুলদানিটিকে ধরলেন তিনি। তারপর এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে, এবার তাকে বেদী পর্যন্ত পৌঁছতেই হবে। বেদীতে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের সূর্যের ঝলকানি চোখে পড়ল।

পূর্বদিকের জানলা পথে হাওয়া ঢুকে পড়েছে, তবে তার প্রবেশ পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে ঘষা কাঁচের দল। নীল এবং লালের সমাহার, কোনো এক ভিক্টোরিও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির দান, এর ফলে সেখানে একটা অদ্ভুত আবছা আলোর সৃষ্টি হয়েছে। বাঞ্চ ভাবলেন, অনেকটা দামী মণিমুক্তোর মতো, ভাবনারা হারিয়ে গেল। তিনি ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। এবার তাঁকে সিঁড়িতে পা রাখতে হবে।

নীচু হয়ে সাবধানে ফুলগুলো সাজিয়ে দিলেন, ঘাড় নীচু করে কিছু যেন বলার চেষ্টা করলেন–একী? কালো মতো বস্তুটা কী? এখানে মানুষের দেহ? তিনি অবাক হলেন। হাঁটু মুড়ে বসলেন ওই পুরুষ মানুষটির পাশে। তারপর ধীরে ধীরে মানুষটিকে উল্টে দিলেন। এবার মনে হল তিনি যেন কিছু একটা অনুমান করতে পারছেন। কোনো বিপদ ঘটে গেছে কি? হাত দিলেন তার নাড়ির ওপর, অতি মৃদু স্পন্দনে, এত মৃদু যে সহসা তা উপলব্ধি করা যায় না। তার মানে? এখনও কি লোকটা বেঁচে আছে? তার সমস্ত মুখে ভয়ার্ত সবুজের আবরণ। নাঃ এই মানুষটি মৃতার্ত, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

 লোকটিকে দেখে মনে হয় তার বয়স পঁয়তাল্লিশের এপাশ ওপাশ, ঘন অথচ মলিন পোশাক তার পরিধানে। ভদ্রমহিলা কী আর করবেন? আবার নাড়ির ধ্বনি অনুভব করার চেষ্টা করলেন। মনে হল, এখন বোধ হয় তাকে কিছুটা শুশ্রূষা করা দরকার। তিনি এই মৃতপ্রায় লোকটির বুকে ঘুষি মারার চেষ্টা করলেন, যাতে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হতে পারে। আবার ভালো ভাবে তার মুখের দিকে তাকালেন। কী আশ্চর্য, তার বুকের ওপর এমন শক্ত করে কাপড় বাঁধা কেন? মনে হচ্ছে, কেউ কি তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে? মস্ত বড়ো এক টুকরো কাপড়। কিছুই বুঝতে পারছেন না শ্রীমতী তবু রহস্যটা বোঝার চেষ্টা করছেন। তার মানে? ওই কালচে রঙা বস্তুটি কী? রক্ত শুকিয়ে এমন কালচে হয়ে গেছে? এবার বাঞ্চ আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। কোনো রকমে বসে পড়লেন, ভয়ের ছবি আঁকা হল তার সমস্ত তনু বাহারে।

এবার লোকটির চোখের দিকে তাকালেন। বন্ধ চোখ, বেশ বোঝা যাচ্ছে, উনি বোধহয় প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন। একটু বাদে ভদ্রলোক চোখ দুটি খুললেন, তাকালেন বাঞ্চের মুখের দিকে, সেই চোখের তারায় কোথাও কোনো অনুভূতির চিহ্ন নেই, না, ভয় অথবা উত্তেজনা বা সাহস অথবা অবদমন, কিছুই চোখে পড়ল না কিন্তু চোখ দুটি এখনও জীবন্ত এবং সেখানে বুদ্ধিমত্তার ছাপ আছে। ভদ্রলোক ঠোঁট খুলে কিছু বলার চেষ্টা করলেন। বাঞ্চ নীচু হয়ে তার কথা শুনতে চাইছেন। কী আশ্চর্য, একটি মাত্র শব্দ বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে, ফিসফিসানি শব্দ–স্যাংচুয়ারি, অর্থাৎ অরণ্য আবাস।

এই শব্দ কী দারুণ এক অর্থ বহন করছে। বাঞ্চ ভাবলেন, কিন্তু এই অর্থের মধ্যে কী লুকিয়ে থাকতে পারে? একটু বাদে ওই ভদ্রলোক আবার কাঁপা কাঁপা শব্দে বললেন স্যাংচুয়ারি, মানে অরণ্য আবাস।

তারপর? কী এক তন্দ্রাচ্ছন্নতা এসে গ্রাস করল ওই মানুষটিকে, তিনি আবার কেমন যেন হয়ে গেলেন। শ্বাসের শব্দ শোনা গেল। চোখ দুটি আবার বন্ধ হয়ে গেল, আরও একবার বাঞ্চ ওই মানুষটিকে বাঁচাবার চেষ্টা করলেন, তার কবজিতে হাত রাখলেন, কত নাড়ির স্পন্দন বোঝার চেষ্টা করলেন, কী আশ্চর্য! নাড়ির গতি এখন আরও কমে গেছে, মাঝে মধ্যে থেকে থেকে নাড়ির স্পন্দন শোনা যাচ্ছে। এবার তাকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।

তিনি বললেন–নড়বার চেষ্টা করবেন তো তাহলে ফল মারাত্মক হবে। আমি দেখছি। কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি।

এই কটি কথা বোধহয় ওই মৃতার্ত মানুষের কানে পৌঁছে গিয়েছিল। তিনি অতি কষ্টে চোখ খোলার চেষ্টা করলেন। না, এবার বোধহয় আর দেখতেই পাবেন না, তবু দেখবার চেষ্টা করলেন। পূর্ব জানলা দিয়ে ছিটকে ছুটে আসা আলোর উৎসই তাকে এখন বাঁচিয়ে দিতে পারে। তিনি বিড়িবিড় করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন, শব্দগুলো এত অস্পষ্ট যে বাঞ্চ তার অর্থ বুঝতেই পারলেন না। বাঞ্চ ভাবলেন এই মানুষটির মধ্যে বোধহয় একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু? এটা কি তার স্বামীর নাম উচ্চারিত হচ্ছে?

উনি বললেন–জুলিয়ান? আপনি কি এখানে এসেছেন জুলিয়ানকে খুঁজে পাবার জন্য?

এই প্রশ্নের কোনো উত্তর ভেসে এল না মৃতপ্রায় ওই মানুষটির মুখ থেকে। ভদ্রলোক শুয়ে আছেন, নিশ্চল, নিশ্চপ, চোখ দুটি বোজান, এখনও অতি মৃদু ভাবে নাড়ি স্পন্দিত হচ্ছে। তার মানে এখনও প্রাণ আছে। অতএব বাঞ্চকে এবার সচল এবং সজাগ হতেই হবে।

বাঞ্চ উঠে দাঁড়ালেন, অতি দ্রুত চার্চ থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তিনি তাকালেন তার ঘড়ির দিকে, সময়টা দেখে ঘাড় নাড়লেন উৎসাহের আতিশয্যে। তার মানে? ডাঃ গ্রিফিথস তখনও হয়তো তার সার্জারিতে বসে আছেন, কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি সেখানে পৌঁছে যেতে পারবেন। অতি দ্রুত হাঁটতে শুরু করলেন শ্রীমতী বাঞ্চ। এখন আর নষ্ট করার মতো সময় নেই, এখানে অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না, সোজা পৌঁছে গেলেন ডাক্তারের সার্জারি রুমে।

বাঞ্চ হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন–স্যার আপনাকে এখনই আসতে হবে, ওদিক একটি মানুষ মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। একটু পরীক্ষা করি দেখুন ওই মৃতার্ত মানুষটিকে। পরীক্ষায় কী জানা গেল বোঝা যাচ্ছে না।

ডাক্তার বললেন–এই মানুষটিকে এখনই এখান থেকে ভিকারেজে নিয়ে যেতে হবে, সেখানে গেলে আমি আরও ভালোভাবে ওনার চিকিৎসা করতে পারব।

–কিন্তু কীভাবে সেটা সম্ভব?

বাঞ্চ বললেন–ঠিক আছে। আমিও আপনার পাশাপাশি থাকব। আমি আপনার হাতের কাছে সব কিছু গুছিয়ে দেব। আমি হাবার্ট এবং জোনসকেও সঙ্গে পাব। আমার মনে হয় ওদের এখনই ডাকা উচিত। না হলে মানুষটিকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।

-তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আমি ভিকারেজকে এখনই ফোন করছি, একটা অ্যাম্বুলেন্স আনতে হবে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যদি বেশি সময় নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে হয়তো….

ডাঃ গ্রিফিথস তার কথা শেষ করলেন না। তিনি অতি দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার অভিব্যক্তির মধ্যে এখন একটা ভয়চকিত ভাব বিরাজ করছে, বাঞ্চের বুঝতে অসুবিধা হল না যে, আহত লোকটির আয়ু আর বেশিক্ষণ নেই।

বাঞ্চ বললেন–রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেছে?

ডাঃ গ্রিফিথস মাথা নাড়লেন। তিনি বললেন-হা, কতক্ষণ ধরে উনি এখানে পড়ে আছেন?

বাঞ্চ বললেন–আমার মনে হয়, সারারাত ধরেই উনি এইভাবে পড়ে আছেন। আসলে সকাল বেলা হাবার্ট চার্চের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ে, কাজ শুরু করে, কিন্তু আজ এখনও তো সে আসেনি।

পাঁচ মিনিট পরে ডাঃ গ্রিফিথসের কার্য ধারা শুরু হয়ে গেল। তিনি ইতিমধ্যে সব কিছু শেষ করে এসেছেন। তিনি ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লেন। আহত লোকটি তখনও মাটিতেই শুয়ে আছেন। তাঁকে সোফার ওপর শুইয়ে দেওয়া হল। গায়ের ওপর কম্বল চাপিয়ে দেওয়া হল। বাঞ্চ তখনই কাজ করতে শুরু করেছেন, তিনি জল পূর্ণ একটি পাত্র নিয়ে এলেন, ডাক্তারের নির্দেশমতো লোকটির ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে লাগলেন।

গ্রিফিথস বললেন–ঠিক আছে, আমি এখনই একটা অ্যাম্বুলেন্স পাঠাবার চেষ্টা করছি। তবে পুলিশকে একটা খবর তো দিতেই হবে।

ডাঃ গ্রিফিথস উঠে দাঁড়ালেন। রোগীর দিকে তাকালেন, চোখ দুটি তখনও বন্ধ। তিনি আবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন, বেশ বোঝা যাচ্ছে কোনো কারণে স্নায়বিক বিকার ঘটে গেছে ওই মানুষটির। কারণটা কী? তা জানার চেষ্টা করতে হবে কি?

গ্রিফিথস বললেন–না, এই লোকটিকে গুলি করা হয়েছে, কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে এই গুলি করার ঘটনা বেশিক্ষণ আগে ঘটেনি। তিনি রুমাল দিয়ে ক্ষতস্থানটি ঢাকবার চেষ্টা করেছেন, আর যাতে রক্ত না বের হয় তাই ওই জায়গাটাকে ব্যান্ডেজ বাঁধার ব্যর্থ প্রয়াস করেছেন।

বাঞ্চ জানতে চাইলেন–এই ঘটনাটা কখন ঘটেছে বলে মনে হয়? আর কী ভাবে আপনি এত কথা বলতে পারছেন?

আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আমাকে এই সিদ্ধান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে। আমরা জানি যদি কোনো মানুষ আহত হয় তাহলে সে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করে, শুধু তাই নয়, সেই মরিয়া ভাবটা চোখে মুখে ফুটিয়ে রাখারও চেষ্টা করে। কিন্তু এইক্ষেত্রেও দেখে মনে হয় সে বোধহয় আহত হয়নি, যেন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তার শরীরটা একেবারে এলিয়ে যায়। আমার মনে হচ্ছে এই ভদ্রলোকের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটে গেছে। কিন্তু আমার অনুমান ওনাকে চার্চের ভেতর গুলি করা হয়নি। ওনাকে বোধহয় অন্য কোথাও গুলি করা হয়েছে। অথবা উনি আত্মহত্যার চেষ্টাও করে থাকতে পারেন, তার পর রিভলভারটা ফেলে দিয়েছেন। চার্চের দিকে এগিয়ে গেছেন আহত পায়ে, বেশিক্ষণ আগে এই ঘটনা ঘটেনি, আমার মনে হয়, এটা বোধ হয় খুব টাটকা ঘটনা।

হঠাৎ বাঞ্চ বলে উঠলেন–উনি অস্ফুটভাবে একটি শব্দ বলেছেন, স্যাংচুয়ারি!

ডাক্তার ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন-স্যাংচুয়ারি?

বাঞ্চ বললেন–এখানেই জুলিয়ান এসে গেছে। তিনি এগিয়ে গেলেন, তারপরে বললেন তার স্বামীকে–জুলিয়ান, তাড়াতাড়ি এখানে এসো।

রেভারেন্ড জুলিয়ান হারমন ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন। তার চেহারার মধ্যে বৌদ্ধিক ছায়া আছে। মনে হয় তিনি বোধ হয় যথেষ্ট প্রাজ্ঞ এবং বিচক্ষণ ব্যক্তি। আর এই প্রাজ্ঞতা তার মধ্যে এমন একটা পরিমিত বোধের জন্ম দিয়েছে, যা তার বয়সটাকে অকারণে বাড়িয়ে তুলেছে।

জুলিয়ান হারমন বললেন–কী হয়েছে? তাঁর হাবভাবের মধ্যে অদ্ভুত এক চঞ্চলতা প্রকাশ পাচ্ছে। যদিও তিনি সেটাকে ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তিনি ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে এলেন।

বাঞ্চ অতি অল্প শব্দ খরচ করে পুরো ঘটনাটা স্বামীর কাছে ব্যক্ত করলেন।

বাঞ্চ বললেন–চার্চের ভেতর ওই মৃতার্ত মানুষটি পড়েছিলেন, ডাক্তার মনে করছেন তাকে গুলি করা হয়েছে। জুলিয়ান, আমার মনে হয় উনি ঘোরে তোমার নামই বলছিলেন।

সোফার কাছাকাছি জুলিয়ান এসে দাঁড়ালেন। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আহত ব্যক্তিটিকে লক্ষ্য করলেন। আহা, হতভাগ্য মানুষটি, জুলিয়ান নিজের মনে বললেন। মাথা নেড়ে বললেন–না, আমি এই জীবনে কখনো এই মানুষটিকে দেখিনি। নাহ, কোনো জায়গাতে এনার সাথে আমার যোগযোগ হয়েছিল বলে মনে পড়ছে না।

এই সময় ওই মৃতপ্রায় মানুষটির চোখ দুটি খুলে গেল। তিনি একবার ডাক্তারের মুখের দিকে তাকালেন, তারপর জুলিয়ান হারমনকে দেখলেন। এবার বোধহয় বাঞ্চের পালা। চোখের তারায় কী যেন একটা উত্তেজনা ফুটে উঠেছে, তিনি বাঞ্চের মুখের দিকে তাকালেন। ডাক্তার গ্রিফিথস সামনের দিকে এগিয়ে এলেন।

উনি বললেন–আসল ঘটনাটা কিন্তু আমিই জানি।

তার চোখ দুটি বাঞ্চের চোখের ওপর নিবদ্ধ। ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর একেবারে ভেঙে গেছে। তিনি বললেন–প্লীজ…..প্লীজ…..

তারপর? সমস্ত শরীরে একটা অদ্ভুত কম্পন দেখা দিল। এক মুহূর্তের মধ্যে তাঁর প্রাণপাখি খাঁচা ছেড়ে কোথায় যেন উড়ে গেল।

সার্জেন্ট হায়াত পেনসিলটাকে নিয়ে কী যেন চিন্তা করছেন। নোটবুকের ওপর তাকিয়ে আছেন।

শ্রীমতী হারমন, তাহলে এইটুকুই আপনারা জানেন, তাইতো? এর থেকে আর কোনো কিছু বেশি খবর কি আমি আশা করতে পারি না?

বাঞ্চ বললেন –এটাই হল গল্প, তার কোটের পকেট থেকে এইসব জিনিস পাওয়া গেছে।

সার্জেন্ট হায়াত তাকালেন টেবিলের দিকে, তার মনে এখন নানা প্রশ্নের ভিড়। টেবিলে সাজানো আছে একটা ওয়ালেট, একটা পুরোনো দিনের ঘড়ি, এখানে ডবলিউ এফ এই দুটি অক্ষর খোদাই করা আছে। লন্ডনে যাবার রিটার্ন টিকিট, এছাড়া আর কিছুই নয়। সুতরাং এই দ্রব্যগুলি দেখে ওই ভদ্রলোকের মৃত্যু রহস্য সম্পর্কে কোনো কথাই জানা যাবে না।

বাঞ্চ জিজ্ঞাসা করলেন–আপনারা কি বুঝতে পারছেন, এই ভদ্রলোক আসলে কে?

জনৈক মিস্টার এবং মিসেস একলেস স্টেশনে ফোন করেছিলেন। আমার মনে হয় এই ভদ্রলোক বোধহয় মিসেস একলেসের ভাই, এনার নাম বোধহয় স্যান্ডবর্ন, ইনি প্রথম থেকেই খুব দুর্বল চিত্তের মানুষ ছিলেন। বেশ কিছু দিনের জন্য তার মধ্যে এক অদ্ভুত উন্মাদনা দেখা দিয়েছিল। তিনি ক্রমশ খারাপের দিকে এগিয়ে যান। একদিন আগে উনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। আর ফিরে যাননি। মনে হয় ওনার সঙ্গেই বোধহয় রিভলভারটা ছিল।

-নাহ, আমার মনে হয় এটা হয়েছে আত্মঅবদমন থেকে। যে কোনো কারণে উনি বোধহয় খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তাই এই জীবনের ভার আর বহন করতে চাননি। অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটে যায়। হতাশা থেকে তো মানুষ জীবন সম্পর্কে নিস্পৃহ হয়ে ওঠে।

বাঞ্চ ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–না, আমি জানতে চাইছি উনি এখানে এলেন কেন? রহস্যটা আমার কাছে বড়ো অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছে।

সার্জেন্ট হায়াত এই ব্যাপারে কী জবাব দেবেন? তিনি পুরোনো দিনের পদ্ধতি অনুসারে বললেন–তিনি এখানে এসেছেন, আমার জানা আছে।

আবার অধৈর্য হয়ে উঠলেন বাঞ্চ। জানতে চাইলেন, সেটা তো আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু পৃথিবীতে এত জায়গা থাকতে বেছে বেছে এই চার্চেই এলেন কেন? এই রহস্যটা আমার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না।

হায়াত বললেন–সত্যি কথা বলতে কী মিসেস হারমন, ব্যাপারটা আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না। এর অন্তরালে কোন কারণ লুকিয়ে আছে সেটা জানার চেষ্টা করতে হবে। তবে যদি মনের ভারসাম্য হারিয়ে যায়….

বাঞ্চ তার কথা শেষ করতে দিলেন না। বোঝা গেল তিনি বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। তিনি বললেন–সে যা হোক, আপনি কিন্তু কিছুতেই আমার মনকে শান্তি করতে পারছেন না। কোনো ব্যক্তি কেন বাস ধরে এমন একটি ছোট্ট শহরতলিতে এসে পৌঁছবেন, তিনি যেখানকার কিছুই জানেন না, ঠিক তো?

বাঞ্চের কথার মধ্যে বুদ্ধিমত্তার ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সার্জেন্ট হায়াত বললেন–না, মনে হচ্ছে এই জায়গাটা সম্পর্কে তিনি খুব একটা ওয়াকিবহাল ছিলেন না। এবার তার কণ্ঠস্বরের মধ্যে কিছুটা ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিমা জেগে উঠেছে। অকারণে খুক খুক করে কাশলেন তিনি। নিজের দুটি পায়ের ওপর ভর দিয়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই মিস্টার এবং মিসেস একলেস এখানে এসে পৌঁছবেন। ম্যাডাম, আপনি আর একটুখানি সময় অপেক্ষা করুন, আমার মনে হচ্ছে আসল তথ্যটা ওই দম্পতির কাছ থেকেই জানা যাবে। আশাকরি একটুখানি সময় অপেক্ষা করতে আপনার কোনো আপত্তি থাকবে না।

বাঞ্চ তির্যক কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন–না, না, সে ব্যাপারে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমাকে তো এখন অপেক্ষা করতেই হবে। আসলে ওনাদের মধ্যে আমি কিছু গোপন শব্দ লুকিয়ে রেখেছি। সেসব বলে দেব। এই কথায় সার্জেন্ট হায়াতের চোখে মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। তিনি বললেন–ঠিক আছে, আপনি না হয় একটুখানি সময় অপেক্ষা করুন।

বাঞ্চ বললেন–আমি ভাবছি, এটা বোধহয় একটা হত্যার ঘটনা নয়, এর অন্তরালে অন্য কোনো রহস্য ঘনীভূত হয়ে আছে।

ভিকারেজ গেটের মধ্যে দিয়ে একটা গাড়ি প্রবেশ করল। সার্জেন্ট হায়াত উদাসীন ভাবে গাড়িটির দিকে তাকলেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য করলেন–মনে হয় শ্রী এবং শ্রীমতী একলেস এখানে এসে গেছেন, ম্যাডাম, ওঁরা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন নিশ্চয়ই।

এই কথা শুনে ক্ষণকালের জন্য বাঞ্চ কী যেন চিন্তা করলেন। বেশ বোঝা যাচ্ছে তিনি মনে মনে সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করছেন। আসলে তাঁকে এখন একটা শোকাবহ বাতাবরণের সামনে এসে দাঁড়াতে হবে। এই অস্বস্তিকর মুহূর্তটিকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু তিনি জানেন তা সম্ভব নয়। বাঞ্চ অনুচ্চ কণ্ঠস্বরে বললেন, –আমার মনে হয়, জুলিয়ানকে ডেকে পাঠানো দরকার। জুলিয়ান আমাকে সাহায্য করতে পারবে। যখন মানুষের মনের আকাশে শোকের মেঘ উড়ে যায়, তখন একজন পাদরির সাহায্য দরকার হয়।

শ্রী এবং শ্রীমতী একলেস-কে দেখে মনে হল বাঞ্চ যেমনটি অনুমান করেছিলেন তারা ঠিক তেমনটি। বাঞ্চ তাদের দিকে ভালো করে তাকালেন। কেমন একটা অনুভূতির সঞ্চারণ ঘটে গেল তার মনের মধ্যে। শান্তভাবে তিনি ওই দম্পতিকে অভ্যর্থনা জানালেন। কিন্তু তার মনের ভেতর বিস্ময়ের উদ্রেক হল। মিস্টার একলেসকে আমরা একজন সুদেহের অধিকারী পুরুষ বলে মনে করতে পারি। পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আছে, যাদের দেখলে মনে হয় তারা সবসময় সুখের সাগরে অবগাহন করতে ভালোবাসে। এই বসুন্ধরাতে কোনো দুঃখ আছে, সেটা তারা ভুলে থাকতে ভালোবাসেন। তাকে দেখে সেকথাই মনে হল বাঞ্চের, এবার শ্রীমতী একলেসের কথা বলি, একলেসকে দেখলে কেমন অগোছালো স্বভাবের মহিলা বলে মনে হয়। তাঁর মুখটা গোলাকৃতি, আকারে ছোটো, তার কণ্ঠস্বরের মধ্যে একটা তীক্ষ্ণতা আছে, কিন্তু সেটা খুবই মিনমিনে এবং তার মধ্যে ভেসে উঠছে অনিশ্চয়তা।

তিনি বললেন–মিসেস হারমন, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এটা আমাদের কাছে কত বড়ো একটা শোকের ঘটনা।

বাঞ্চ বলে উঠলেন–হ্যাঁ, আমি তা অনুমান করতে পারছি। কিন্তু যেটা ঘটে গেছে সেটাকে তো আটকাবার কোনো উপায় নেই। এখন আসুন, আমরা ঠাণ্ডা মাথায় পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ আলোচনা করি। অনুগ্রহ করে আপনি একটু বসবেন কি? এই সময় আপনি কি কিছু একটা খাবেন? এখন কি চা খাওয়ার সময় হয়ে গেছে?

বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে অসংলগ্ন কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে বাঞ্চ তার হারানো ব্যক্তিত্ব পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় মেতে উঠেছেন। শ্রীযুক্ত একলেস হাত নেড়ে বললেন-না, না, এখন আমরা কিছুই খাব না। আমাদের যে আপনি খেতে বলেছেন এ জন্য আপনাকে আমি অজস্র ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এখন কিছু কথা বলতে হবে। বেচারি উইলিয়াম কী বলেছে সেটা আমাদের জানা দরকার। তার সম্পর্কে আপনি কোনো খবর জানতে পেরেছেন কি?

শ্রীযুক্ত একলেসের কণ্ঠস্বরের ভেতর কৌতূহল ঝরে পড়ছে। এবার শ্রীমতী একলেসের পালা। তিনি বললেন–আহা, বেচারি ভাইটি দীর্ঘদিন বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছে। আমার মনে হয় ওর বোধহয় এমন কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল যেগুলোকে আমরা ঠিক মতো ব্যাখ্যা করতে পারব না। জীবনে চলার পথে অনেক সময় আমাদের নানা অনভিপ্রেত ঘটনার সামনে এসে দাঁড়াতে হয়। এমন কিছু মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয় যাদের অতীতটা খুব একটা উজ্জ্বল নয়। কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে আমার ভাইটি খুব শান্ত স্বভাবের হয়ে যায়। সবসময় নিজের তৈরি করা জগতের মধ্যে বাস করতে ভালোবাসত। আসলে যখন সে বাড়িতে ফিরে আসে এখন তার চরিত্রের মধ্যে লক্ষণীয় পরিবর্তনটা আমার নজরে পড়েছিল। বারবার সে বলত, এই পৃথিবীটা তার পক্ষে বাসযোগ্য গ্রহ নয়। এখানে সে কিছুই করতে পারবে না। হতভাগ্য! এছাড়া আর আমি কী বলতে পারি তাকে ছোটোবেলা থেকেই আমার ভাইটি ছিল এমন আবেগপ্রবণ আর পালটানো মনোভাবের। সত্য, এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে প্রতি মুহূর্তে আমাদের কত রক্তাক্ত সংগ্রামের সামনে দাঁড়াতে হয়। কত প্রতিবন্ধকতার সামনে এসে বসতে হয়, তার সঙ্গে লড়াই করার মতো সাহস থাকা দরকার। তা বলে সে নিজেকে এইভাবে বিসর্জন দেবে, আমি তো ভাবতেই পারছি না।

বাঞ্চ দুজনের দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল, তখন সেখানে বিরাজ করছে সীমাহীন নৈঃশব্দ্য। আসলে মাঝে মাঝে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যখন ভাষারা সব হারিয়ে যায়।

শ্ৰীমতী একলেস বললেন-আমার স্বামীর রিভলভারটা ঘিরেই এই ঘটনাটা ঘটে গেছে। কিন্তু রিভলভারটা সে যে নিয়েছে সেটা কি আমরা জানতাম না। সে বাসে চেপে এখানে এসেছে। এখানে একা কেন, সেটাও আমি বুঝতে পারছি না। সে তো এই ঘটনাটা আমাদের বাড়িতেও ঘটাতে পারত।

মিস্টার একলেস বিড় বিড় করে বলে উঠলেন–হতভাগ্য, তার জন্য আমার অনুতাপ হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন-এই কাণ্ডটা করা তার পক্ষে উচিত। নি।

আবার কিছুক্ষণ সীমাবদ্ধ নীরবতা। শ্রীযুক্ত একলেস বলে উঠলেন–সে কি কোনো খবর দিয়েছে? তার মুখ থেকে উচ্চারিত শেষ শব্দগুলি কী ছিল? তার মধ্যে কোনো লুকোনো সংকেত ছিল কি?

তার চোখ দুটো হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সেই উজ্জ্বল চোখ মেলে তিনি বাঞ্চকে পর্যবেক্ষণ করলেন। শ্রীমতী একলেসকেও দেখা গেল বাঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকতে। এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য তিনি যে মনে মনে কতটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন সেটা তাঁর আচরণে পরিস্ফুটিত হল। যদিও তিনি প্রাণপণ চেষ্টায় তার মনের মধ্যে হঠাৎ উথলে ওঠা এই উত্তেজনাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর অভিব্যক্তির এই হঠাৎ পরিবর্তনে বাঞ্চ অবাক হলেন।

বাঞ্চ শান্তভাবে বললেন না, তিনি একেবারে মৃতার্ত অবস্থায় এইভাবে এসে পৌঁছেছিলেন। আর তার মুখ থেকে একটি শব্দ বেরিয়েছে–স্যাংচুয়ারি অর্থাৎ অরণ্য আবাস। এই শব্দের অভ্যন্তরে কোন্ গূঢ় অর্থ লুকিয়ে আছে তা আমি বুঝতেই পারছি না।

শ্ৰীমতী একলেস অবাক হওয়া কণ্ঠস্বরে বললেন–স্যাংচুয়ারি? এই শব্দটা ও বলল কেন?

শ্রী একলেস বাধা দিয়ে বলার চেষ্টা করলেন-আমার মনে হয়, এটা বোধহয় খুব পবিত্র একটা জায়গা হয়তো কোনো এক পাপ থেকে সে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছিল। তার মনের ভেতর অনুশোচনার আগুন জ্বলে উঠেছিল।

বাঞ্চ বললেন-মৃত্যুর আগে ওই ভদ্রলোক আরও কিছু বলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেই চেষ্টা তার সফল হয়নি। তিনি প্লীজ এই শব্দটা বলেছিলেন। তারপর তাঁর মুখ থেকে আর একটি শব্দও বেরিয়ে আসেনি।

শ্রীমতী একলেস রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন। তারপর একটু হেঁকে বললেন–ওই আমার প্রিয় ভাইটি, আমি ব্যাপারটা কী করে সহ্য করব বুঝতেই পারছি না।

বেশ বোঝা গেছে এই ঘটনাতে তিনি বিহ্বল হয়ে উঠেছেন।

এবার তার স্বামীর পালা, তিনি বললেন-পান, এই ব্যাপারটাকে শান্তভাবে মানতেই হবে। সব জিনিস তো আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি না। বেচারি উইলি, এখন সে তো শান্তির শয্যায় শুয়ে আছে। এসো, আমরা ব্যাপারটা এইভাবে ভাববার চেষ্টা করি। শ্রীমতী হারমন, আশা করি আমাদের আগমনে আপনার দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কোন পরিবর্তন ঘটেনি। আমি জানি একজন ভাইকারের স্ত্রীকে কত কর্মব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটাতে হয়, ব্যাপারটা আমাদের স্পষ্ট জানা আছে।

এবার করমর্দনের পালা। তারপর একলেসরা যাবার জন্য এগিয়ে গেলেন। তাদের আচরণের ভেতর দ্রুততার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেতে যেতে শ্রীমতী বলে উঠলেন–আর কিছু কি বলার বাকি থেকে গেল? আচ্ছা, আপনি কি তার গায়ে কোটটা দেখেছেন?

বাঞ্চ অবাক হওয়া কণ্ঠস্বরে শুধোলেন–কোট? কী বলতে চাইছেন আপনি?

শ্রীমতী একলেস বললেন–না, অনেক সময় মানুষ তার পছন্দের পোশাক পরেই আত্মহত্যা করে। বুঝতে পারছেন তো–এখানে আবেগ কাজ করে।

-তার কাছ থেকে একটা ঘড়ি পাওয়া গেছে, আর একটা ওয়ালেট, সেখানে রেলের টিকিট ছিল, এছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। আমি সব কিছু সার্জেন্ট-এর হাতে তুলে দিয়েছি।

থেমে থেমে কথা বললেন বাঞ্চ।

শ্ৰীযুক্ত একলেস বললেন–ঠিক আছে, তাহলে এবার আমাদের যেতে হবে। আমার মনে হয় ওই ওয়ালেটের মধ্যে বোধ হয় ওর ব্যক্তিগত কাগজগুলো ছিল।

বাঞ্চ বললেন-না, সেখানে একটা এক পাউন্ডের নোট ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আর কিছু না।

–কোনো চিঠি ছিল না? চিঠি, অথবা চিরকূট?

এই প্রশ্ন শুনে বাঞ্চ মাথা নাড়লেন।

–ঠিক আছে, আপনাকে আবার ধন্যবাদ জানাচ্ছি শ্রীমতী হারমন। যে কোটটা সে পরে বেরিয়েছিল সেটা কোথায় গেল? সার্জেন্টের হাতে গেল কি?

বাঞ্চ সব কিছু মনে করার চেষ্টা করছিলেন।

তিনি বললেন–না, আমার তো মনে পড়ছে না, আমি আরও একবার পুরো ব্যাপারটা ভেবে দেখার চেষ্টা করি। ডাক্তার আর আমি তার কোট খুলে দিয়েছিলাম। যাতে ওই ক্ষতচিহ্নটা পরিষ্কার ভাবে দেখা যায়।

এবার তিনি ঘরের চার পাশে শূন্য দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন–কোটের ওপর রক্তের দাগ কালচে হয়ে লেগে ছিল। আমি সেটা ওপরে নিয়ে গিয়েছিলাম, পরিষ্কার করার জন্য। এখন আমার বেশ স্পষ্ট মনে পড়ছে।

–আপনি যদি কিছু মনে না করেন, শ্রীমতী হারমন, তাহলে কষ্ট করে আপনাকে একবার সেখানে যেতে হবে। ওই কোটটাই হল মৃত ব্যক্তিটির শেষ স্মৃতিচিহ্ন, বুঝতেই তো পারছেন এই ব্যাপারটা আমার স্ত্রীর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ওই কোটটা ছাড়া আর কোনো স্মৃতি আমরা ধরে রাখব বলুন তো?

বাঞ্চ বললেন–ঠিক আছে, আগে কোটটা পরিষ্কার করতে হবে। তার গায়ে রক্তের কলঙ্ক রেখা লেগে রয়েছে। এই কথা শুনে ভদ্রলোক হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললেন–আমি খুবই দুঃখিত, যে মেয়েটি আমার সংসার দেখাশোনা করে সে ওই কোটটাকে নিয়ে চাদরে বেঁধে রেখেছিল। আর একটু হলেই কোটটাকে সে বেঠকখানায় পাঠিয়ে দিত। আমার সৌভাগ্য তেমন ঘটনা ঘটেনি। অনেকক্ষণ সময় লাগল ওটাকে খুঁজে বার করতে। এই দেখুন, আমি এই কোটটা নিয়ে এসেছি। এটাকে একটা বাদামি কাগজে মুড়িয়ে আপনাদের হাতে তুলে দিই কেমন?

বাঞ্চের এই প্রয়াসে ভদ্রমহিলা অথবা ভদ্রলোকের চোখে মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। এবার বিদায় নেবার পালা। একলেস দম্পতি জীপে উঠে চার্চ প্রাঙ্গন থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

বাঞ্চ এবার ঠাণ্ডা মাথায় পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করার চেষ্টা করলেন। তিনি ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন, তারপর ধীর পায়ে হেঁটে গেলেন তার একান্ত স্টাডিতে। যখনই তার মাথায় নানা চিন্তার মেঘ জমে, তিনি তখন স্টাডিতে বসে সেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। ওখানে রেভারেন্ড জুলিয়ান হারমন বসেছিলেন। তিনি বোধহয় শান্তভাবে কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছিলেন। আসলে তিনি একটি নীতিবাক্য রচনা করছিলেন। সময় ও সুযোগ পেলে এমন ভাবেই তিনি ছন্দের তালে তালে নীতিবাক্য লিখতে ভালোবাসেন। তাঁর মনে হল এবার বোধহয় তার ভাবনায় ছেদ পড়ে যাবে। কারণ তিনি যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছিলেন, সেটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জুডিকা এবং পথদর্শনের মধ্যে রাজনৈতিক টানা পোড়েন, যেটা ঘটে গিয়েছিল মাইনাসের রাজত্বকালে হঠাৎ ছন্দপতন ঘটে গেল।

তিনি বললেন–প্রিয়তমা?

 বাঞ্চ বললেন–জুলিয়ান স্যাংচুয়ারি শব্দটির আসল অর্থ কী, তুমি কি তা জানো?

জুলিয়ান অবাক চোখে স্ত্রীর দিলে তাকালেন। বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে, অভাবিত এই ঘটনাটা তাকে কতটা মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে। আসলে তিনি শান্ত জীবনযাপন করতেই ভালোবাসেন।

ভদ্রলোক বললেন–ঠিক আছে, আমি তোমাকে ওই শব্দটার আসল মানে বুঝিয়ে দিচ্ছি। রোমান এবং গ্রিক মন্দিরগুলোতে একটা ছোটো কুঠুরি থাকে, যেখানে কোনো এক দেবতার মূর্তি বসানো থাকে, তুমি বলতে পারো এটা হল দেবী এই শব্দটির ল্যাটিন পরিশব্দ, আজ এর মধ্যে আরেকটা ব্যাপার লুকিয়ে আছে যাকে আমরা নিরাপত্তা বলতে পারি।

যে কোনো বিষয়ে ভদ্রলোকের অসীম জ্ঞান। আসলে একেবারে ছোট বয়স থেকে তিনি গভীর ভাবে পড়াশোনা করেছেন বলেই বোধ হয় এই জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছেন। তিনি গড়গড়িয়ে বলে চললেন–৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে এই শব্দটার একটা আলাদা গুরুত্ব ছিল। তখনকার দিনের খ্রিস্টিয় চার্চে এই শব্দটি একটি অতিরিক্ত মর্যাদা পেত। এখান থেকেই জনগণের প্রতি নানা নির্দেশ উচ্চারিত হত। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সব থেকে পুরোনো যে স্যাংচুয়ারিটির অস্তিত্ব আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটি ৬০০ খ্রিস্টাব্দের এথেলবাট থেকে। তখন কিছু নির্দেশ জারি হয়েছিল, জনগণ এই নির্দেশনামা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে বাধ্য থাকত।

উনি হয়তো আরও কিছু কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এতটা শোনার মতো ধৈর্য শ্ৰীমতীর নেই। মাঝে মধ্যেই এমন ঘটনা ঘটে থাকে। এবার এই কথোপকথনে ইতি টানতে হবে। শ্রীমতী বলে উঠলেন–প্রিয়তম, সত্যি তুমি কত জানো সব কিছু। তোমার জন্য আমার বেশ অহঙ্কার হয়।

উনি ঝুঁকে পড়ে স্বামীর নাকের ডগায় চুমুর চিহ্ন এঁকে দিলেন। হঠাৎ এই পট পরিবর্তনে জুলিয়ান কেমন যেন হয়ে গেলেন। মনে হল তিনি বোধহয় একটা কুকুরছানা, দারুন একটা খেলা দেখিয়ে মনিব পত্নীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।

 বাঞ্চ বলে উঠলেন–একলেস দম্পতি এখানে এসেছিলেন।

এবার ভাইকারের অবাক হওয়ার পালা। আসলে তিনি গভীর জ্ঞান সাগরে সাঁতার কাটতে ভালোবাসেন। তাঁর স্র ভঙ্গিতে জেগে উঠল ঔৎসুক্য। তিনি বললেন একলেস? আমার তো ঠিক মনে পড়ছে না……

–সেকি তুমি এর মধ্যেই তাদের ভুলে গেলে? চার্চে যে মানুষটি মারা গিয়েছিলেন, তাঁর বোন এবং বোনের স্বামী।

প্রিয়তমা তোমার উচিত ছিল আমাকে ডেকে পাঠানো।

বাঞ্চ কঠিন কণ্ঠস্বরে বললেন–আমি তার কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছি না, তারা তো শোক সংবরণের জন্য এখানে আসেননি, তারা এসেছিলেন সম্পূর্ণ অন্য কাজে। আমি যদি কালকের খাবারটা ক্যাসারোলে তুলে রাখি তাহলে তুমি কি সেটা খেয়ে নিতে পারবে, জুলিয়ান?

আমার মনে হচ্ছে, আমাকে লন্ডনে যেতে হবে, সেখানে সেল শুরু হয়ে যাবে।

রেভারেন্ড আবার অবাক হয়ে গেলেন। তিনি শূন্য চোখে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন–সেলস মানে জাহাজ? সেটা কি ইয়ট, নাকি একটা নৌকা, অথবা এমন কিছু?

এবার বোধহয় বাঞ্চের রেগে যাবার পালা। তার পরিবর্তে তিনি খিল খিলিয়ে হেসে উঠে বললেন–না, ডার্লিং বাঘোস অ্যান্ড কোটম্যানের সাদা জিনিস পত্রের সেল শুরু হয়ে গিয়েছে। তুমি তো জান, এখন আমার বেডশিটের কত দরকার। টেবিল কভারটা নোংরা হয়ে গেছে। তোয়ালেগুলোও পালটাতে হবে। আরও কত কিছু টুকিটাকি জিনিস করতে হবে। আমি জানি না গ্লাসক্লথগুলো কী অবস্থা। কেচে কেচে সেগুলো তো প্রায় ছিঁড়েই গেছে। এছাড়া গভীর ভাবে চিন্তা করে তিনি বললেন-আমার মনে হয় একবার আন্টগ্র্যানের সঙ্গে দেখা করাটা খুবই জরুরী।

.

০২.

এবার আমরা ওই সুন্দর স্বভাবের বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা মিস মার্পল সম্পর্কে দুচার কথা শুনে নিই। এই মুহূর্তে তিনি তার মেট্রোপলিসে বসে ছুটির দিনগুলি উপভোগ করছিলেন। দেখতে দেখতে পনেরোটি দিন কেটে গেছে আহা, ভাইপোর কেনা এই স্টুডিও টাইপের ব্যালকনিতে থাকতে বেশ ভালোই লাগে। এখানে জীবনের সমস্ত উন্মাদনা জমা হয়েছে, জীবনটা এখানে বেশ অলসভাবেই কেটে যায়।

উনি বললেন–প্রিয়তম রেমন্ড, আমার ভাইপো আর জোয়ান আমেরিকাতে গেছে। দিন পনেরোর জন্য। তারা বলেছে আমি যেন এখানে এসে ফ্ল্যাটে দিন কাটাই। ডিয়ার বাঞ্চ, দেখি, তোমার চোখে মুখে এমন অস্বস্তিকর ছাপ পড়েছে কেন? তুমি কি কোনো ব্যাপার নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করছ?

বাঞ্চকে আমরা কী বলব? বাঞ্চ মিস মার্কলের অতি প্রিয়, দুজনের মধ্যে দীর্ঘকালীন সম্পর্ক। ওই বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা দুচোখের তারায় স্নেহের চাউনি এনে বাঞ্চকে ভালোভাবে দেখলেন। বেশ বোঝা যাচ্ছে, বাঞ্চের চোখে মুখে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তার মাথায় বসানো ফেল্ট হ্যাটটা বোধ হয় সেকথাই বলছে। এবার বাঞ্চ কি তার গল্পকথা শোনাবেন?

বাঞ্চের কণ্ঠস্বর পরিষ্কার। তিনি শান্তভাবে বললেন–কিছু কথা, মিস। মিস মার্পল সেই কথা শুনে মাথা নাড়লেন। বাঞ্চের গল্প বলা শেষ হয়ে গেল কি? মিস মার্পল বারবার বলার চেষ্টা করলেন–ঠিক আছে, আমি দেখছি, তুমি এত চিন্তা করো না।

বাঞ্চ বললেন-এই জন্যই তো আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলাম। তুমি কি সব ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ? তুমি তো খুব চালাক তাই না?

-তুমি কি আমার থেকে কম চালাক? এবার বোধ হয় ঠাট্টা তামাশার পালা শুরু হয়ে গেল।

-না, না, আমি না, আমি বোধহয় জুলিয়ানকেও চালাকিতে হারাতে পারব না।

-হ্যাঁ, জুলিয়ান সম্পর্কে আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে, তার মধ্যে এমন একটা সুন্দর বৌদ্ধিক ছাপ আছে তাকে আমি প্রশংসা না করে পারি না।

মিস মার্পলের এই সহজ সরল স্বীকারোক্তিতে মন ভরে গেল বাঞ্চের। স্বামীর প্রশংসা শুনলে কোন স্ত্রী না খুশি হয়?

তাহলে? বাঞ্চ বলে উঠলেন, জুলিয়ানের মধ্যে যে বুদ্ধির ছাপ আছে সেখান দিয়ে বিচার করলে আমি তো একেবারে নির্বোধ, তাই নয় কি?

বাঞ্চ, তোমার মধ্যে একটা সাধারণ বোধবুদ্ধি আছে, তোমার বুদ্ধির চাতুর্য মাঝে মধ্যে আমাকেও মোহিত করে দেয়।

একথা বলে আমাকে রাগিয়ে দেবার চেষ্টা করো না। এতে ভালো হবে না বলছি। আমি জুলিয়ানকে সব কথা জিজ্ঞাসা করতে পারতাম, কিন্তু সে তার ওপর চাপানো কাজের দায়িত্ব নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে, আমার কথা মন দিয়ে শুনত না। তাই শেষ পর্যন্ত আমি বাধ্য হয়ে তোমার কাছে এসেছি।…….

এই কথাগুলির মধ্যে এমন একটা স্থির প্রজ্ঞা নির্গত হচ্ছে যে, মিস মার্পল অবাক না হয়ে পারলেন না। তিনি বললেন –একটু শান্ত হয়ে বসো, আমরা মেয়েরা অল্পতেই কেমন অধৈর্য হয়ে যাই। তুমি তো পুরো ঘটনাটা আমার কাছে বলেছ, বাঞ্চ, আমি বুঝতে পারছি না এর সঙ্গে তোমার যোগসূত্রতা কতখানি? এটাকে তুমি কেন একটা দুর্ঘটনা বা অঘটন বলে মনে করছ না?

বাঞ্চ বলে উঠলেন–না, না, একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, এত জায়গা থাকতে ওই ভদ্রলোক এখানে কেন এলেন? তিনি কি ওই স্যাংচুয়ারি বা গোপন কুঠুরির সম্পর্কে সব কথা জানতেন? জুলিয়ান যেভাবে ব্যাখ্যা করেছে, সেটা শুনে আমি তো একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছি। তার মানে ওই ভদ্রলোক পড়াশোনা করা মানুষ। যথেষ্ট শিক্ষাদীক্ষার অহঙ্কার আছে তার, অথচ তিনি জীবন সম্পর্কে এতখানি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলেন কেমন করে? যদি উনি সত্যি সত্যি নিজেকে নিজেই গুলি করে থাকেন, তাহলে তিনি তো এখানে বেশিক্ষণ আগে আসেন নি। মৃত্যুর আগে উনি স্যাংচুয়ারি শব্দটা উচ্চারণ করেছেন, সেটা আমার কানে ঢুকে গেছে। স্যাংচুয়ারি বলতে কী বোঝায়? স্যাংচুয়ারি বলতে বোঝায় চার্চের এমন এক গোপন প্রকোষ্ট যেখানে বেরিয়ে গেলে তুমি বাইরের আক্রমণ থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখতে পারবে। কোনো কিছুই তোমাকে আর স্পর্শ করতে পারবে না। এমন কি এক সময় আইনের লম্বা হাতও স্যাংচুয়ারিতে গিয়ে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে পারত না। তা হলে ভেবে দেখ, এই চার্চের গঠন সম্পর্কে ওই ভদ্রলোকের কী নিখুঁত ধারণা ছিল। না হলে উনি কী করে বুঝতে পারবেন যে যেখানে একটি গোপন কুঠুরি আছে।

এই কথাগুলি শেষ করে মিস মার্পলের দিকে সম্ভ্রম দৃষ্টিতে তাকালেন বাঞ্চ। মাথা নাড়লেন। বাঞ্চ বলে চললেন–একলেসদের দেখে মনে হল এই ব্যাপারটা সম্পর্কে তারা খুব একটা আগ্রহী নন। হয়তো কোনো কারণে একটা অদ্ভুত উদাসীনতা ওঁদের ব্যক্তিসত্ত্বাকে গ্রাস করেছে তারা ওই ব্যাপার নিয়ে খুব বেশি কথা বলতে চাইলেন না। এবার আমি ঘড়িটার কথা বলি। মৃত মানুষটির ঘড়ি, সেখানে ডবলিউ আর এস এই শব্দ দুটি বসানো ছিল। পেছনে দিকে কিন্তু ঘড়িটি খোলার পর আমি দেখেছি খুব ছোট ছোট কয়েকটি অক্ষর লেখা আছে, ওয়ালটারকে দেওয়া হয়েছে, বাবার উপহার, একটি তারিখ চোখে পড়েছে। কিন্তু একলেস তো কখনো ওই মানুষটিকে ওয়ালটার নামে ডাকেনি। তারা বারবার উইলিয়াম অথবা বিল–এই নামেই ডাকছিলেন। তাহলে ওয়ালটার কে? এই ব্যাপারটার মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

মিস মার্পলকে মনে হল তিনি বাঞ্চের কথা শুনতে বেশি মাত্রায় আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আসলে যাঁরা মিস মার্পলকে চেনেন, তারা জানেন, তিনি এখন গভীর চিন্তার জগতে পৌঁছে গিয়েছেন।

বাঞ্চ গড়গড়িয়ে বলতে থাকেন–আমরা একসময় একজন মানুষকে তার ধর্মদত্ত নামে ডেকে থাকি না। আশা করি তুমি আমার কথার আসল অর্থ বুঝতে পেরেছ। হয়তো ওই ভদ্রলোককে উইলিয়াম নামেই ডাকা হত, অথবা ওকে বগরি কিংবা ক্যারটস নামেও ডাকা হতে পারে। কিন্তু তুমি যদি কারোর বোন হও, তাহলে তুমি কি তার আসল ডাক নাম কটা জানবে না? উইলিয়াম অথবা বিলকে ওয়ালটার নামে ডাকা যেতে পারে কি? আমার কেবলই মনে হচ্ছে……..

মিস মার্পলের মাথার আকাশে বিদ্যুৎ চমক। তিনি চকিতে বলে ওঠেন–তার মানে তুমি অনুমান করছ ওই ভদ্রমহিলা সত্যি সত্যি ওই মৃত মানুষটির বোন নন, তাই তো?

এই ব্যাপারে আমি ঠিক স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না। কিন্তু ওনার হাবভাব দেখে আমার কেবলই মনে হয়েছে, উনি ওনার ব্যক্তিত্বের মধ্যে একটা আরোপিত সত্তা আনতে চেষ্টা করছিলেন। শুধু ওনাকে বলব কেন, ওনার স্বামীকেও আমি একইভাবে দোষী সাব্যস্ত করতে পারি। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, ওঁরা ভিকারিজে এসেছিলেন কোনো জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে এবং জানতে মৃত্যুর আগেই ভদ্রলোকের মুখ থেকে কোনো শব্দ উচ্চারিত হয়েছে কিনা। তারা এ ব্যাপারে বারবার প্রশ্ন করেছিলেন। আমি যখন শেষ পর্যন্ত বললাম যে, উনি মৃত্যুর আগে কোনো কথা বলতে পারেননি, তখন ওনাদের মুখমণ্ডলে একটা অদ্ভুত প্রশান্তির ভাব ফুটে উঠল। প্রশান্তি বললে ভুল হবে, মনে হল উদ্বিগ্ন অবস্থা থেকে ওনারা মুক্তি পেয়েছেন। ব্যাপারটা আমার চোখ এড়ায়নি।

বাঞ্চ তার বক্তব্য শেষ করলেন–আমার স্থির সিদ্ধান্ত, একলেসই ওই ভদ্রলোককে গুলি করে হত্যা করেছেন।

মিস মার্পল বলে উঠলেন–সেকী? তুমি বলছ, এটা আত্মহত্যার ঘটনা নয়, এটা হল ঠাণ্ডা মাথায় খুন?

বাঞ্চ বললেন–হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তাই তো ডার্লিং, আমি তোমার কাছে এসেছি, তোমার বুদ্ধিমত্তার প্রতি আমার অগাধ আস্থা। তুমি এর আগে একটা জায়গায় বসে কত রহস্যের যবনিকা উত্তোলন করেছ। প্লীজ, তুমি এই ব্যাপারটার তদন্ত ভার গ্রহণ করো। না হলে আমার আর অনুশোচনার অন্ত থাকবে না।

বাঞ্চের এইসব কথাবার্তা মিস মার্পলের মনের ভেতর কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছে। সেটা জানার কোনো উপায় আমাদের নেই। মাঝে মধ্যে মিস মার্পলকে এমন প্রশংসার বাক্য শুনতে হয়। তিনি নিস্পৃহচিত্তে এসব শুনতে বাধ্য হন। আসলে খুনের ঘটনার তদন্ত করে ইতিমধ্যে বেশ নাম করেছেন মিস মার্পল। বলা যেতে পারে, তার অনেক স্তাবক জুটে গেছে।

বাঞ্চ আবার বলতে থাকলেন–ওই ভদ্রলোক মৃত্যুর আগে প্লীজ-এই শব্দটা বলতে পেরেছিলেন। আমার বেশ মনে হচ্ছে উনি বোধহয় আরও কিছু কথা বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভগবান ওনার এই শেষ আশা পূর্ণ করেননি। সেই কথাগুলো জানতে পারলে আজ আমাকে তোমার কাছে ছুটে আসতে হত না। তাই সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন গোলমেলে বলে মনে হচ্ছে। তুমি না থাকলে এই সমস্যার সমাধান আর কেউ করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। পুলিশের ওপর আমার খুব একটা আস্থা নেই। ওরা সাধারণত মাথা মোটা স্বভাবের হয়ে থাকে। অবশ্য এর জন্য আমি ওদের খুব একটা দোষ দিতে পারছি না। ওদেরকে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থেকে তদন্ত চালাতে হয়। বলতে পারো, ওদের হাত পা একেবারে বাঁধা।

মিস মার্পল এতক্ষণ মনোযোগ সহকারে বাঞ্চের মুখ থেকে ঠিকরে ছুটে আসা এই শব্দগুলো শুনছিলেন। যদিও তার অভিব্যক্তিতে সেই মনোযোগী আচরণের কোনো পরিচয় নেই। এটাই হল মিস মার্পলের চরিত্রের সবথেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য। ইতিমধ্যে একাধিক খুনের ঘটনাকে ইতিবাচক তদন্ত করে যথেষ্ট নাম এবং প্রশংসা অর্জন করেছেন তিনি।

বাঞ্চ বলতে থাকেন–ওই ভদ্রলোক মৃত্যুর ঠিক আগে প্লীজ শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন কিন্তু এর পর তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন, সেটা আমার পক্ষে আর জানা সম্ভব হল না। যদি ঈশ্বর ওনাকে আর কয়েক মুহূর্ত বেঁচে থাকার ছাড়পত্র দিতেন, আমি সুনিশ্চিত, তাহলে খুনির নামটাও উনি উচ্চারণ করতেন। এই ব্যাপারটা আমাকে খুবই অনুশোচনার মধ্যে রেখেছে।

মিস মার্পল চুপ করে ভাবনার জগতে পৌঁছে গেলেন। তারপর তিনি বাঞ্চের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন–আচ্ছা, ওই ভদ্রলোক শেষ অব্দি তোমাদের চার্চে এলেন কেন, সেই ব্যাপারটা তো আমার কাছে এখনও পর্যন্ত পরিষ্কার হচ্ছে না।

বাঞ্চ বললেন–এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে একমত পোষণ করছি। তুমি যদি স্যাংচুয়ারি শব্দটার ওপর বেশি জোর দাও, তাহলে উনি তো যে কোনো একটা চার্চের মধ্যেই ঢুকতে পারতেন। মোটামুটি সব চার্চেই এমন একটি গোপন প্রকোষ্ঠ থাকে। তিনি কেন বাসে করে অত দূরের একটা জায়গাতে যাবেন, যে বাসটা সারা দিনের মধ্যে মাত্র চারবার আমাদের এই শহরতলীতে আসে, তারপর তুমি কেন এমন একটা নির্জন জায়গা বেছে নেবে? না, রহস্যের জট ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে আমার কাছে।

মিস মার্পল মন্তব্য করলেন–তিনি নিশ্চয়ই কোনো একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে ওই চার্চে এসেছিলেন। আমার মনে হচ্ছে, উনি বোধহয় কারো সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। আসলে চিপিং লেক হর্নটা তো খুব একটা বড়ো জায়গা নয়, বাঞ্চ। সকলে সেখানে সকলের সাথে পরিচিত দেখতো, তিনি কার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন বলে তোমার মনে হয়?

ওই ব্যাপারটা নিয়ে এতক্ষণ এইভাবে ভাবতে পারেন নি বাঞ্চ। মনে মনে আরও একবার মিস মার্পলের অগাধ বুদ্ধির তারিফ করলেন তিনি। তিনি ওই ছোট্ট শহরতলির বাসিন্দাদের মুখচ্ছবিগুলি ভাববার চেষ্টা করলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন–না আমি তো কাউকেই সম্ভাব্য মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করতে পারছি না। আমাদের ওই ছোট্ট পল্লীতে এমন কে-ইবা আছেন, যাঁর সাথে ওই ভদ্রলোকের জরুরী দরকার ছিল?

–উনি কি কোনো নাম বলেছেন?

-হ্যাঁ, মনে পড়েছে। উনি জুলিয়ান শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন। তবে আমার ঠিক মনে নেই উনি জুলিয়ান, নাকি জুলিয়া বলেছিলেন। কিন্তু আমি যতদূর পর্যন্ত জানি, আমাদের চিপিং লেক হর্নে জুলিয়া নামে কোনো মেয়ে বসবাস করে না। আমি তো মোটামুটি সকলের সাথেই পরিচিত। বুঝতেই তো পারছ, আমাদের ছোট্ট জনপদ, মুখ পরিচিতি সকলের সাথেই আছে আমার।

আবার কথাটা থেমে গেল। বোঝা গেল এখন দুজনেই চিন্তার জগতে ডুব দিয়েছেন। অনেক কিছু ভাববার চেষ্টা করতে থাকেন বাঞ্চ। জুলিয়ান, নাকি জুলিয়া ঠিক মতো মনে পড়ছে না তাঁর। চোখ বন্ধ করলেন তিনি। ওই তো, সিঁড়ির ধারে শোয়ানো আছে রক্তাক্ত শরীরটা, জানলা দিয়ে যেটুকু আলো এসে পড়েছে তাতে কী এক অদ্ভুত অপছায়ার সৃষ্টি হয়েছে। মনে হচ্ছে সেখানে যেন হীরক-দতি জ্বলে উঠেছে।

মিস মার্পল শান্তভাবে উচ্চারণ করলেন–কোনো হীরে মণিমুক্তো?

বাঞ্চ বললেন–হ্যাঁ, এবার বোধহয় আমরা আমাদের গল্পের সব থেকে উল্লেখযোগ্য অংশে পৌঁছে গিয়েছি। শুধু এই ব্যাপারটার জন্য আজ আমি বৃত্তান্ত হয়ে তোমার কাছে ছুটে এসেছি। একলেসরা। একটা ব্যাপার নিয়ে খুবই জোরাজুরি করছিলেন। সেটা হল ওই মৃত মানুষটির কোট। যখন ডাক্তার ওনাকে পর্যবেক্ষণ করতে আসেন, তখন আমরা কোটটা ওনার দেহ থেকে খুলে নিয়েছিলাম। কোটটা পুরোনো দিনের। দেখলেই বোঝা যায় অনেকবার পরিধান করা হয়েছে। একেবারে শেষ অবস্থায় পৌঁছে গেছে। আমি বুঝতে পারছি না, কেন ওনারা ওই কোটটির জন্য এত ঘোরাঘুরি করছিলেন। শেষ পর্যন্ত কোটটি ফিরে পাবার পর ওনাদের মুখে স্বস্তির অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল। ওঁরা বলছিলেন এর সঙ্গে মৃত মানুষটির স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কিন্তু আমার মনে হয়, এই ব্যাপারটা অত সহজ নয়। আমার মনে হয় ওই কোটটির মধ্যেই বোধহয় আসল রহস্য লুকিয়ে আছে।

………আমি ওপরে উঠে গিয়ে কোটটি খুঁজছিলাম। যখন অনেক কষ্টে সেটি খুঁজে পেয়েছিলাম, তখন সেটাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, এই কোটটি পাবার পর ওই ভদ্রলোকের সমস্ত চেহারাতে একটা স্বস্তির ছাপ ফুটে উঠেছিল। আমি কোটটি দেবার পর ওনার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আর একটা কথা তোমাকে না জানিয়ে পারছি না, এই কোটের লাইনিংএর ভেতর একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমি লক্ষ্য করে ছিলাম। আমি দেখেছিলাম লাইনিংএর কিছুটা অংশে অন্য সুতো দিয়ে সেলাই করা হয়েছে। আর আমি সেখানে হাত দিয়ে দিয়ে দেখলাম, একটা করে কাগজ রয়ে গেছে। আমি সাবধানে কাগজটা বাইরে বার করেছিলাম, তারপর আবার সুন্দরভাবে ওটা সেলাই করে দিই, এমন সুতো ব্যবহার করেছিলাম যাতে ওপর থেকে দেখলে কিছুই বুঝতে পারা না যায়। আমি ব্যাপারটা সম্পর্কে খুবই ওয়াকিবহাল ছিলাম, আমার মনে হয়, একলেস হয়তো আমি কী করেছি সেটা ধরে ফেলতে পারে, অথবা তাদের নজর এড়িয়ে যেতে পারে এটা। আমি তারপর কোটটা নীচে এনে ওঁদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম যে, আমার কাজের মেয়েটা কোটটা বৈঠকখানায় নিয়ে যাবার জন্য তৈরি হয়েছিল তাই আমার কিছুটা দেরি হয়ে গেছে।

এবার মিস মার্পলের চোখের তারায় ফুটে উঠল ঔৎসুক্যের চিহ্ন। তিনি বললেন দেখি কাগজের টুকরোটা।

বাঞ্চ তার হ্যান্ডব্যাগটি খুললেন–আমি এটা কিন্তু জুলিয়ানকে দেখাতে পারিনি, আসলে আমার এই কাণ্ডটা হয়তো সে খুব একটা সমর্থন করবে না। আমার উচিত ছিল এই কাগজের টুকরোটা একলেসের হাতে সমর্পণ করা। কিন্তু আমি এটা তোমার কাছে নিয়ে এসেছি।

মিস মার্পল তাকালেন ওই কাগজের টুকরোটার দিকে, এটা হল বুকের একটা টিকিট, বেডিংটন স্টেশন লেখা আছে।

-তার মানে উনি বেডিংটন স্টেশনের রিটার্ন টিকিট আর একটা পকেটে রেখে দিয়েছিলেন তাই তো?

বাঞ্চ মন্তব্য করলেন।

এবার চার চোখের মিলন ঘটে গেল।

মিস মার্পল সাবধানে বললেন–তাহলে? কোনো একটা কার্যকারণ পাওয়া গেল কি? বাঞ্চ, তুমি কি লন্ডনে আসার পথে তোমার কোনো অনুসরণকারীকে দেখেছিলে? আমার মনে হচ্ছে তোমাকে কেউ নিঃশব্দে অনুসরণ করছে।

এই কথা শুনে বাঞ্চ খুবই অবাক হয়ে গেলেন, তিনি বললেন–কী বলছ? আমি কী করেছি যে, আমার প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর কড়া নজর দিতে হবে?

মিস মার্পল বললেন আমার মনে হচ্ছে, আমার অনুমান বলতে পারো, আমার স্থির সিদ্ধান্ত, এই পৃথিবীতে যখন তখন যে কোনো ঘটনা ঘটতে পারে, তাই আগে থেকে আমাদের সাবধান হওয়া উচিত।

উনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন তারপর বললেন-তুমি এখানে এসেছ এই খবরটা কি কেউ জানে? আমার মনে হয়, তোমার এখন একলেস-এর ওখানেই চলে যাওয়া উচিত। যেখানে গিয়ে তুমি কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকো। আমিও তোমার সঙ্গে যেতে চাই। যেতে যেতে আমরা না হয় কথা বলব, না, আমার এখন যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

মিস মার্পল বলে চললেন–হ্যাঁ, তোমার সাথে আমাকে যেতেই হবে, এই রহস্যটা আমার মনকেও ভাবিয়ে তুলেছে।

 দুই ভদ্রমহিলা প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ালেন। তারা নানা ধরনের জিনিসপত্র কিনে ফেললেন। যেগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগে, এবার হারল্ড বাগ নামে একটি অঞ্চলে পৌঁছে গেলেন। সেখানে গিয়ে মনের আনন্দে মেতে উঠলেন খাদ্য অন্বেষণে, আহা, এত সুন্দর খাবার কি না চেখে থাকা যায়? হরিণের সাথে অ্যাপেলটাও, এবং টোস্টার–দুজনেরই অত্যন্ত প্রিয় পদ।

মিস মার্পল বলার চেষ্টা করলেন-দেখ, এত সুন্দর পেন্টাবল আমি কখনো দেখিনি। এর ওপর ছোটো করে জে বর্ণটা লেখা আছে। দেখ, রেডান্সের বউয়ের নাম তো জোয়ান, আমার মনে হয় এটা জোয়ানের জন্যই রাখতে হবে। তাহলেই বোধহয় আমাদের আশা পরিপূর্ণ হবে।

বাঞ্চ কিশোরীর আনন্দে মেতে উঠে বললেন–ওই গ্লাসক্লথগুলো আমার খুবই দরকার ছিল। এত সহজে যে পাব সেটা আমি কখনো ভাবতেই পারিনি। আমার মনে হয় যে কোনো ভদ্রমহিলার উচিত এখানে এসে ওগুলো কিনে ফেলা।

তাদের কথাবার্তায় ছেদ পড়ে গেল। আসলে তখনই অ্যাপেলবার্গে প্রবেশ করেছে। এক তরুণী। যথেষ্ট আকর্ষণীয় চেহারা ওর। ঠোঁটে রঞ্জনির ছোঁয়া। সে এখানে সেখানে তাকাল অর্থহীন দৃষ্টিতে। তারপর ছুটে এল তাদের টেবিলের দিকে। মিস মার্পলের উপস্থিতিতে খুশি হল সে।

মিস মার্পলের কোলের ওপর একখানি খাম ছুঁড়ে দিল।

তারপর অত্যন্ত দ্রুতভাবে বলল–মিস, তুমি এখানে?

মিস মার্পল বললেন-তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, গ্ল্যাডি। তোমাকে আমি সব সময় ধন্যবাদ জানাতে চাই, তুমি এত তৎপরতার সঙ্গে কাজগুলো করে ফেলো।

এই কথা শুনে গ্ল্যাডির লাল গাল আর একটু বেশি লালিমায় রাঙা হল। গ্ল্যাডি বলল–তোমার কথা মানতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করি, হেনরি আমাকে সব সময় বলে থাকে। মিস মার্পলের কাছ থেকে জীবনের সব সৎগুণগুলো নিয়ে নেবার চেষ্টা করবে। মিস মার্পলকে সেবা করার মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ আছে–সে কথাই মেনে চলার চেষ্টা করি আমি। তাতে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই।

মিস মার্পল গ্ল্যাডির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন-তুমি সত্যি খুব উপকারী মেয়ে, তোমার মতো এত ভালো মেয়ে আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি।

যেমন ঝড়ের মতো এসেছিল গ্ল্যাডি, তেমনই চলে গেল সে। তখনও ক্যাফেটেরিয়াতে রয়ে গেল তার উজ্জ্বল উপস্থিতির দিকচিহ্নগুলি।

এবার মিস মার্পল এনভেলাপটা খুলে কিছু দেখার চেষ্টা করলেন। তারপর সেটা বাঞ্চের দিকে তুলে দিয়ে বললেন-তুমি কিন্তু এখন থেকে সাবধানে পথ চলবে। আচ্ছা, এখনও কি সেই সুদক্ষ ইন্সপেক্টার মেলচেষ্টরে কর্মরত অবস্থায় আছেন? আমার ঠিক মনে পড়ছে না।

বাঞ্চ বললেন–আমিও জানি না, মনে হয় উনি এখনও সেখানে কাজ করছেন।

মিস মার্পল চিন্তামগ্ন কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন–আচ্ছা, আমি দেখছি, আমার মনে হয় চীফ কনস্টেবলকে এখনই একটা ফোন করা দরকার। তিনি বোধহয় এখনও আমাকে মনে রেখেছেন।

বাঞ্চ বলে উঠলেন–হ্যাঁ, যিনি একবার তোমার সংস্পর্শে এসেছেন, তিনি কি তোমাকে ভুলে যেতে পারেন? তুমি তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি নিয়ে সব সময় বিরাজ করছ।

এবার বাঞ্চকে উঠে দাঁড়াতে হল। বেডিংস্টোন আসার পর বাঞ্চ লাগেজ অফিসে গেলেন, ক্লোকরুম টিকিটটা আধিকরিকের হাতে তুলে দিলেন। কিছুক্ষণ পরে একটা পুরোনো স্যুটকেস সেখানে এসে গেল। স্যুটকেস নিয়ে তিনি শান্তভাবে প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটতে শুরু করলেন। .

বাড়ি আসা পর্যন্ত কোনো ঘটনা ঘটল না। ট্রেন চিপিং লেক হর্নের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। বাঞ্চের হাতে ধরা আছে ওই পুরোনো সুটকেসটা। তিনি শান্তভাবে স্যুটকেস ধরে হেঁটে চলেছেন। হঠাৎ একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল, বাঞ্চ লক্ষ্যই করেননি যে আর এক ভদ্রলোক তাকে এইভাবে অনুসরণ করে আসছে। হঠাৎ সেই ভদ্রলোক তার হাত থেকে স্যুটকেসটা ছিনিয়ে নিল, ভিড়ের মধ্যে পালাবার চেষ্টা করল।

বাঞ্চ চিৎকার করে উঠল-থামোথামো! ওই লোকটিকে থামান, ও আমার স্যুটকেস চুরি করেছে।

গ্রাম্য স্টেশনের টিকিট কালেক্টাররা যেমনটি হয়ে থাকেন, অত্যন্ত মন্দাক্রান্তা ছন্দে তাঁদের জীবনচক্র বাঁধা। তিনি বললেন-দেখছি, এমনটি কখনো করা উচিত নয়…..

কিন্তু তার চোয়ালের ওপর নিখুঁত একটা ঘুষির পাঞ্চ। তিনি আর এগোতেই পারলেন না। স্যুটকেস নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেল ওই দুবৃত্ত। অপেক্ষামান একটি গাড়িতে চড়ে বসল। পুলিশ কনস্টেবল আবেলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল–তাহলে? কী ঘটনা ঘটেছে বলুন তো?

বাঞ্চ স্টেশন থেকে ইতিমধ্যে সেখানে পৌঁছে গেছে। লোকটি আমার স্যুটকেস তুলে নিয়েছে। আমি ট্রেন থেকে সেটা নিয়ে নামছিলাম।

লোকটি বলল –ননসেন্স, আমি জানি না, এই ভদ্রমহিলা কী বলার চেষ্টা করছেন। এটা আমার স্যুটকেস। আমি ট্রেন থেকে এটা নিয়ে নেমে এসেছি।

ওই লোকটা বাঞ্চের দিকে তাকাল। রাগী চোখের তারায়। পুলিশ কনস্টেবল অ্যাবেল কিছুই বুঝতে পারছেন না। মিসেস হারমন তাঁর বিশেষ পরিচিত। এর আগে মিসেস হারমনের সঙ্গে পুলিশ কনস্টেবল অ্যাবেলের বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছে। বিশেষ করে কীভাবে ভালো সার দিলে গোলাপটা ফুটবে সেই সম্পর্কে অ্যাবেলের অসীম কৌতূহল।

পুলিশ কনস্টেবল অ্যাবেল বিব্রত সুরে বললেন–ম্যাডাম, এটি কি আপনার স্যুটকেস?

বাঞ্চ বললেন–অবশ্যই।

এবার আপনার কথা শুনি, স্যার।

–এটা আমার স্যুটকেস, আমি জোরের সঙ্গে বলছি।

লোকটা দীর্ঘদেহী, গায়ের রং ঈষৎ কালো। ভালো পোশাক পরিহিত। এমনভাবে কথা বলছেন যেন কর্তৃত্বের ছাপ আছে। গাড়ির ভেতর বসে ছিলেন এক ভদ্রমহিলা, তার এবার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল।–এডুইন এখানে আর দেরি করে লাভ কী, তুমি এখনই স্যুটকেস নিয়ে এখানে চলে এসো। আমি জানি না এই ভদ্রমহিলা এসব কথা বলছেন কেন?

এবার পুলিশ কনস্টেবল অ্যাবেলের জয় হবার পালা। তিনি বললেন–ঠিক আছে, আমি ব্যাপারটার এখনই মীমাংসা করে দিচ্ছি।

-ম্যাডাম, যদি এটা আপনার স্যুটকেস হয়ে থাকে, তাহলে আপনি বলুন তো এর মধ্যে কী আছে?

বাঞ্চ একটুও ইতস্তত না করে বলে উঠলেন–জামাকাপড় আছে, একটা কোটও আছে, যার কলারের রঙটা ঈষৎ ময়লা হয়ে গেছে। দুটো উলের জাম্পার আছে, একজোড়া জুতো আছে।

পুলিশ কনস্টেবল অ্যাবেল বললেন–ঠিক আছে। বেশ ভালোভাবেই আপনি বলছেন দেখছি। এবার তিনি অন্যদিকে ঘুরে বললেন–এবার আপনি বলুন তো?

ওই দীর্ঘদেহী পুরুষটি বলে উঠলেন–এর মধ্যে থিয়েটারের কসটিউম আছে। থিয়েটারের জিনিসপত্র এখানে আছে। আমি এখানে এসেছি একটা অ্যামেচার থিয়েটারে অংশ নেব বলে।

পুলিশ কনস্টেবল অ্যাবেল বললেন–ঠিক আছে, স্যার, আমরা সুটকেসটা খুলে ফেলি কেমন? দেখি ভেতরে কী আছে। আমরা এখনই পুলিশ স্টেশনে যেতে পারি, তবে আপনার যদি খুব তাড়া থাকে, তাহলে আমরা স্যুটকেসটা স্টেশনে নিয়ে যেতে পারি। সেখানে গিয়ে না হয় এটা খুলে ফেলব।

এবার ওই ভদ্রলোকের অধৈর্য হবার পালা, তিনি বললেন–এই স্যুটকেসটা আমার, আমার নাম মস, এডুইন মস।

পুলিশ কনস্টেবল হাতে ধরা স্যুটকে নিয়ে স্টেশনে ফিরে গেলেন। তারপর বললেন–আমরা এখনই পার্সেল অফিসে যাব।

টিকিট কালেক্টারকে তিনি বললেন–চার্জ, এই স্যুটকেসটা এখনই পার্শেল অফিসে নিয়ে চলো তো।

পুলিশ কনস্টেবল অ্যাবেল ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন, পার্শেল অফিসে স্যুটকেসটা পৌঁছে দেওয়া হল। স্যুটকেসটার তালা বন্ধ করা হয়নি। বাঞ্চ এবং মিস্টার এডুইন মস দু পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন অন্যজনের দিকে অর্থহীন ভাবে তাকিয়ে আছেন।

পুলিশ কনস্টেবল বললেন–ঠিক আছে, এবার স্যুটকেসটা খুলে ফেলা যাক।

খুলে ফেলা হল, আহা, সেখানে সুন্দরভাবে পাট করা একটা পুরোনো দিনের টুইড কোট রয়েছে। দুটো মাফলারও চোখে পড়ল। সাধারণত আমরা যে চটি পায়ে দিয়ে বাড়িতে চলাফেরা করে থাকি তেমন একজোড়া চটি।

এবার পুলিশ কনস্টেবল অ্যাবেলের মুখে বুঝি বিস্ময়ের হাসি। তিনি বললেন–ম্যাডাম, আপনার বর্ণনা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে।

এবার মিস্টার এডুইন মস কী করবেন? তার কণ্ঠস্বরে একটা আশ্চর্য পরিবর্তন চোখে পড়ল।

তিনি বললেন-আমি অত্যন্ত ক্ষমাপ্রার্থী। বিশ্বাস করুন, আমি এই ব্যাপারটা কখনোই ঘটাতে চাইনি। কোথায় গেল আমার স্যুটকেসটা? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন-মনে হচ্ছে আমাকে এক্ষুনি ছুটে যেতে হবে। আমার স্যুটকেসটা বোধহয় ট্রেনেই রয়ে গেছে।

উনি ওনার হ্যাট ঠিক করতে করতে বাঞ্চের দিকে তাকিয়ে বললেন–আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন তো? অতি দ্রুত ভদ্রলোক পার্শেল অফিস থেকে চলে গেলেন।

বাঞ্চ পুলিশ কনস্টেবল অ্যাবেলের কানে কানে বললেন–আপনি ওকে ছেড়ে দিলেন কেন? ওনাকে আটকে রাখা উচিত ছিল।

অ্যাবেল কোনো কথা বললেন না। একটু বাদে তিনি বললেন-উনি বেশি দুর যেতে পারবেন না। এই ব্যাপারে আপনি আমার ওপর অগাধ আস্থা রাখতে পারেন। ওর গতিবিধির ওপর আমার লোকেরা কড়া নজর রেখেছে। আশা করি আপনি আমার কথার আসল অর্থ বুঝতে পারছেন।

বাঞ্চ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন–তাহলে ঠিক আছে।

পুলিশ কনস্টেবল অ্যাবেল বললেন–ওই বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা ফোন করে আমাকে সব কথা বলে দিয়েছেন। ওনার সাথে আমার অনেক দিনের পরিচয়। আমি সব কথা ঠিক বলছি তো? দেখা যাক, এবার ঘটনা কোন দিকে ঘুরে যায়। তবে মনে রাখবেন, আপনাকে কোনো ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে না। আপনি আমার বুদ্ধিমত্তা এবং কার্যক্ষমতার ওপর আস্থা রাখতে পারেন। আশা করি কাল সকালে আপনার সাথে ইন্সপেক্টরদের দেখা হয়ে যাবে। ইন্সপেক্টর অথবা সার্জেন্ট। আজ রাতের ঘুমটা নষ্ট করবেন না।

.

০৩.

 মিস মার্পলের পরিচিত ইন্সপেক্টার ক্রাডফও বাঞ্চকে অভিযানে জানালেন, তাঁর ঠোঁটের কোণে পুরোনো বন্ধুত্বের উষ্ণ হাসির পরশ।

তিনি বললেন–চিপিং লেক হর্নে আবার একটা অপরাধের ঘটনা ঘটে গেল। মিসেস হারমন, এখানে কি ব্যাপারটা নিয়ে তেমন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে?

ভদ্রলোকের এই কথা শুনে একটু রেগে গেলেন শ্রীমতী হারমন। আসলে কদিন ধরে তাঁর স্নায়ুর ওপর যে চাপ পড়েছে, রাগ দেখানোটাই স্বাভাবিক। তবুও নিজেকে শান্ত সংযত রেখে তিনি বললেন–আমি আপনার উদ্দেশ্যটা ঠিক মতো বুঝতে পারছি না। আপনি কি আমাকে প্রশ্ন করতে এসেছেন, নাকি আপনি এই ব্যাপারটা সম্পর্কে সত্যি তদন্ত করতে চান?

ইন্সপেক্টর বললেন–আমি প্রথমেই কয়েকটা কথা আপনাকে পরিষ্কারভাবে জানাতে চাইছি। আমি মিস্টার এবং মিসেস একলেসের গল্প দিয়ে এই কাহিনিটা শুরু করব। আমরা কিছু দিনের জন্য তাদের ওপর কড়া নজর রাখতে বাধ্য হয়েছি। তারা বিভিন্ন ধরনের ডাকাতি কাজের সঙ্গে যুক্ত। এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আর একটি বিষয়ের কথা আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, শ্রীমতী একলেসের একজন ভাই আছে। তার নাম স্যান্ড বর্ন। সে বিদেশ থেকে সম্প্রতি ফিরে এসেছে। কিন্তু যে মানুষটিকে আপনারা চার্চ প্রাঙ্গনে শুয়ে থাকতে দেখেছেন তিনি কিন্তু স্যান্ড বর্ণ নন। এ ব্যাপারে আমি একশো ভাগ নিঃসন্দেহ।

বাঞ্চ বললেন–আমি এ ব্যাপারটা আগেই অনুমান করেছিলাম। ওই ভদ্রলোকের নাম ওয়াল্টার, উইলিয়াম নয়–এটাও আমি জোরের সঙ্গে বলছি।

ইন্সপেকটর ঘাড় নেড়ে বললেন–ঠিকই অনুমান করেছেন আপনি। ওনার নাম ওয়াল্টার সেন্ট জন, ইনি ক্যারিংটন জেলখানা থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে পালিয়ে এসেছেন।

এই তথ্যটা শুনে শ্রীমতী বাঞ্চ একটু অবাক হলেন বৈকি। তিনি মনে মনে কিছু ভাবার চেষ্টা করলেন। তারপর বলে উঠলেন–তার মানে ওনাকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আর সেজন্য উনি এমন একটা নিরাপদ স্থানের সন্ধান করছিলেন যেখানে একবার ঢুকে পড়তে পারলে কেউ ওনার টিকিটটিও ছুঁতে পারবে না। তাই তো?

একটু বাদে শ্রীমতী বাঞ্চ প্রশ্ন করলেন–উনি কি কাজ করেছিলেন যার জন্য এই শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছিল?

–এটা একটা মস্ত বড়ো গল্প। গল্পের মধ্যে নানা জটিল অধ্যায় আছে। কয়েক বছর আগে একজন ড্যান্সার একটি মিউজিক হলে নৃত্য প্রদর্শন করছিল। আপনি কি কখনো তার নাম শুনেছেন? এক সময় সে আরবিয়ান নাইট ড্যান্সে খুব নাম করেছিল। তার একটা বিখ্যাত উপস্থাপনা ছিল রত্নগুহায় আলাদীন, সে এইভাবে যথেষ্ট অর্থবান হয়ে ওঠে।

………তবে নাচের ব্যাপারটা সে খুব একটা ভালো জানতো বলে, আমার মনে হয় না। অবশ্য সবই আমার ব্যক্তিগত অনুমান, কিন্তু তার চেহারার মধ্যে এমন একটা যৌন মাদকতা ছিল যে, পুরুষ দর্শকেরা তার শরীরের মধ্যে প্রাচ্য দেশীয় সৌন্দর্যের সাথে পাশ্চাত্যের আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটে গিয়েছিল। এইভাবে সে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এক এশীয় রাজপুরুষ তার প্রেমে পড়ে যায়। সে ওই প্রেমিকাকে অসংখ্য জিনিস দিয়েছিল। তার মধ্যে প্রথমে একটা হীরের নেকলেসের কথা উল্লেখ করতে হয়।

এবার বাঞ্চ নিজের মনেই বলতে থাকলেন–তার মানে একজন রাজা সেই বিখ্যাত হীরে মাণিক তো?

ইন্সপেক্টর ক্রাডফ একটুখানি কেশে বললেন–না, মিসেস হারমন, এ ব্যাপারটাকে আরও ভালোভাবে বুঝিয়ে বলা উচিত। এই প্রেমের ঘটনাটা বেশি দিন ঘটতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত কেন যে এটা ভেঙে গেল আমি জানি না। আর তাই বোধহয় দেখা দিল কিছু বিশৃঙ্খলা।

………ওই নাচিয়ে মেয়েটির নাম জোরেইদা। অবশ্য এটা তার বানানো নাম হতে পারে। মাঝে মধ্যে সে নেকলেসটা পরে চারদিকে ঘুরে বেড়াতো। আসলে সে এই উপহারটাকে তার যৌবনের প্রশংসা হিসাবেই ধরে নিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ওই ভেঙে যাওয়া প্রেম কাহিনির অন্তরালে এক খলনায়কের আবির্ভাব হয়, ভদ্রলোক সিনেমাতে চুটিয়ে অভিনয় করত, সে ওই মেয়েটির ওপর তার শারীরিক এবং মানসিক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেল। নেকলেসটা হারিয়ে গেল নর্তকীর ড্রেসিংরুম থেকে। তখন সে থিয়েটারেই ছিল। কেউ বলে থাকে, এটি নাকি তারই এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র। সে ইচ্ছে করে নেকলেসটাকে চোখের সামনে থেকে তুলে নিয়ে গেল যাতে সেটার ওপর চোর ডাকাতের নজর না পড়ে। আবার অনেকে বলল, এভাবেই সে খবরের কাগজের পাতায়, নিজের নাম ছাপাতে চাইছে। অথবা এর অন্তরালে আরও কোনো কুরুচিকর উদ্দেশ্য থাকতে পারে।

নেকলেসটা আর কখনো পাওয়া যায়নি, কিন্তু তদন্ত করে দেখা গেল, একজনের নাম বেরিয়ে এসেছে, পুলিশের খাতায় সে ওয়াল্টার সেন্ট জন নামে পরিচিত। এই লোকটার মোটামুটি পড়াশোনা আছে। সে যে কেন এই নীচ কাজ করতে গেল তা কে জানে। সে জুয়েলারির দোকানে কাজ করত। এর পাশাপাশি আরও এমন কিছু কাজ করত, যা হয়তো আমরা ঠিকমতো জানতে পারিনি। এর আগে কয়েকটা ছোটো খাটো অপরাধে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

……..এটাও প্রমাণিত হল যে, ওই নেকলেসটা তার হাত দিয়েই পাচার করা হয়েছে। আর এই জন্য তাকে শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাতে ধরা দিতে হয়। তার বিচার শুরু হয়। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়াতে তাকে জেলখানায় পাঠানো হয় কিন্তু সেখানে সে বেশিদিন থাকতে পারেনি। কীভাবে যে সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেল সেটা এখনও আমার কাছে একটা অমীমাংসিত প্রশ্ন হিসাবেই রয়ে গেছে।

এই গল্পটার পরতে পরতে এত উত্তেজনা যে বাঞ্চ বোধহয় নিশ্বাস বন্ধ করে শুনছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি প্রশ্ন করতে বাধ্য হলেন–লোকটা এখানে একা কেন?

এই ব্যাপারটা সম্পর্কে আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগে আছে। মিসেস হারমন আমি ঠিক কথাই বলছি। জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসার পর সে কোথায় যাবে হয়তো ভেবে ঠিক করতে পারছিল না। কিন্তু তার গতিবিধি লন্ডন শহরে সীমাবদ্ধ ছিল। সে তার পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে চায়নি, তবে এক বৃদ্ধা রমণীর কাছে গিয়েছিল। ওনার নাম শ্রীমতী জ্যাকাস উনি একসময় থিয়েটারে পোশাক সরবরাহ করতেন। ওই রমণী কিন্তু ভদ্রলোকের ব্যাপারে খুব বেশি কথা বলতে পারেন নি। স্থানীয় বাসিন্দারা দেখেছিল ওই লোকটির হাতে একটি স্যুটকেস ছিল।

বাঞ্চ বললেন–হ্যাঁ, মনে হচ্ছে এই স্যুটকেসটিই বোধহয় ওই লোকটি বেডিংটনে ক্লোকরুমে ফেলে আসে। তারপর সোজা এখানে চলে আসে।

ইন্সপেক্টার ক্রাডফ বলতে থাকেন–ওই সময় একলেস এবং যে লোকটি নিজেকে এডুইন মস বলে ঘোষণা করেছিল, তাদের সন্ধান পাওয়া গেল। তারা ওই স্যুটকেসটার ওপর তাদের অধিকার প্রমাণ করতে চাইল। ওই লোকটির সঙ্গে তাদের দেখা হয়ে যায় বাসের মধ্যে। তারা বোধহয় গাড়িতে করে বাসটিকে অনুসরণ করতে থাকে। কিন্তু এই অনুসরণের ফল খুব একটা ভালো হয়নি। বাস থেকে শয়তান লোকটি নেমে আসে।

বাঞ্চ প্রশ্ন করলেন-তখনই তাকে হত্যা করা হয়েছে, তাই তো?

ক্রাডফ বললেন–আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন, ম্যাডাম। আপনার বুদ্ধির তারিফ না  করে আমি পারছি না। খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছিল। একলেসের রিভলভার থেকে। কিন্তু মস কি এই কাজে অংশ নিয়েছিল? এ ব্যাপারে আমি খুব একটা সুনিশ্চিত নই। মিসেস হারমন, আমরা একটা ব্যাপার আপনার কাছ থেকে জানতে চাইছ। ওয়াল্টার সেন্ট জন যে স্যুটকেসটা বেডিংটন স্টেশনে জমা দিয়েছিল সেটা এখন কোথায় আছে?

বাঞ্চ বলতে চেষ্টা করলেন–আমার মনে হয় আন্ট জেনের কাছেই সেটা রয়ে গেছে। অর্থাৎ এই মিস মার্পলের একটা পরিকল্পনা। মিস মার্পল তার এক কাজের মেয়েকে বেটিংটন স্টেশনের ক্লোকরুমে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেখানেই সে স্যুটকেসটা দিয়ে দেয়। আমরা টিকিট বিনিময় করে নিই। মিস মার্পল অনুমান করেছিলেন, আমার হাত থেকে স্যুটকেসটা ছিনতাই হতে পারে। এখন বুঝতে পারছি কত বিচক্ষণ তিনি। যদি এইভাবে আগে থেকে পরিকল্পনা না করা হত তা হলে আসল স্যুটকেসটা আমি কখনোই পেতাম না।

এই কথা শুনে ইন্সপেক্টর ক্যাডফও খুব অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বললেন–তা হলে? আমায় এখনই লন্ডনে যেতে হবে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য। আপনি কি আমার সঙ্গে যাবেন, মিসেস হারমন?

বাঞ্চ বললেন–ঠিক আছে, আমি এখনই তৈরি হচ্ছি। ব্যাপারটা আমার ভাবতে বড্ড ভালো লাগছে। গতকাল আমার দাঁতে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। ভেবেছিলাম লন্ডন শহরে গিয়ে এক ভালো ডেন্টিস্টের শরণাপন্ন হব।

ইন্সপেক্টর ক্যাডও বললেন–আমার পরম সৌভাগ্য।

***

মিস মার্পল প্রথমে ইন্সপেক্টার ক্রাডফের মুখের দিকে তাকালেন। তারপর বাঞ্চ হারমনের উদ্বিগ্ন মুখমণ্ডলের ছবি তার চোখের পর্দায় ফুটে উঠল। টেবিলের ওপর স্টকসেটা পড়েছিল। ওই ভদ্রমহিলা বললেন আমি কিন্তু এখনও ওটা খুলিনি, খোলাটা আমার পক্ষে উচিত হবে না। তবে আমি অপেক্ষা করছিলাম আপনার আসার জন্য। তারপর তিনি বলে উঠলেন–এই স্যুটকেসটা কিন্তু বন্ধ করা আছে, তার ঠোঁটে ফুটে উঠেছে ভিকটোরিও যুগের দুষ্টুমি ভরা হাসির টুকরো।

ইন্সপেক্টার জানতে চাইলেন-এর ভেতর কী থাকতে পারে বলে আপনার অনুমান মিস মার্পল?

মিস মার্পল বললেন–আপনি তো জানেন আমি খুব ভালো অনুমান করতে পারি। আসলে অনেক সময় আমার অনুমান আর বাস্তব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এর ভেতর আছে জেবেইদার থিয়েটারের পোশাক। আপনি কি নেবেন ইন্সপেক্টার? কিছু একটা খেতে তো হবে? আমরা সরবত খেতে পারি কি?

সকলে মিলে খেতে শুরু করলেন। জানলা দিয়ে সূর্যের আলো ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। মনে হচ্ছে সেখানে যেন হাজার রথের উজ্জ্বল উদ্ধার। কখনো সেটা লালাভ কামনায় ভরিয়ে তুলেছে পরিবেশ, কখনো সপ্তমীদের আলিঙ্গনে, কখনো সবুজের সীমাহীন তারুণ্য, আবার কখনো কমলার গৈরিক আবেদন।

মিস মার্পল বললেন–আলাদীনের গুহা, এইসব রত্নরাজিতে নিজেকে সাজিয়ে নিয়ে মেয়েটি নেচে উঠল। পুরুষ দর্শকদের মনে তৈরি হত এমন এক বিভ্রম, যার থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারত না।

ইন্সপেক্টার ক্রাডফ বললেন–আপনি সত্যি বলেছেন, কিন্তু শুধুমাত্র ওই কারণে কি একজন লোককে হত্যা করা উচিত?

মিস মার্পল চিন্তামগ্ন মুখে বললেন–আমার মনে হয় ওই মহিলা খুবই বুদ্ধিমতী কিন্তু সে কি মরে গেছে? ইন্সপেক্টার, আপনি কী বলছেন?

-হ্যাঁ, তিন বছর আগে তার মৃত্যু হয়েছে।

মিস মার্পল বললেন–এই অত্যন্ত মূল্যবান নেকলেসটি তো তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি? যদি তার থেকে পাথরগুলোকে খুলে নেওয়া যায়, আর মেয়েটির কসটিউমে তার লাগিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে কী হবে? তাহলে কি এক মায়াবী বিভ্রমের সৃষ্টি হবে? আর যদি কেউ আর একটা নকল নেকলেস তৈরি করে? সেই নেকলেসটা কি কখনো হারিয়ে যাবে? না, এই নেকলেসটা হয়তো কখনো হাতবদল হয়ে বাজারে আসবে না। কারণ চোরটা বুঝতেই পারবে যে, তার ওপর বানানো পাথর অথবা হীরের টুকরোগুলো একেবারে নকল।

বাঞ্চ বললেন–এখানে এনভেলাপটা আছে, এনভেলাপ-এর মধ্যে থেকে উজ্জ্বল বিচ্ছুরিত আলোর ঝর্ণাধারায় নির্গত রত্নরাজির টুকরোগুলো বেরিয়ে এল।

ইন্সপেক্টার ক্রাডফ এটি বাঞ্চের কাছ থেকে গ্রহণ করলেন। তারপর দুটো কাগজ সেখান থেকে বের করে আনলেন। সেখানে লেখা আছে–ওয়াল্টার এডমন্ড সেন্ট জোয়ান এবং ম্যারিমসেকের মধ্যে বিয়ের ঘোষণাপত্র। তার মানে? এটাই হল জোবেইদার আসল নাম।

মিস মার্পল বললেন–তার মানে ওরা বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী তাই তো?

বাঞ্চ জিজ্ঞাসা করলেন–তাহলে ব্যাপারটা আমার কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। ওই কাগজটায় কী আছে?

-একটি কন্যা সন্তানের জন্ম শংসাপত্র। যার নাম জুয়েল।

বাঞ্চ চিৎকার করে উঠল-জুয়েল, চিপিং লেক হর্নে আমি এই নামটি প্রথম শুনেছিলাম। তার মানে ওই মৃতার্ত ভদ্রলোক এই শব্দটি উচ্চারণ করার চেষ্টা করেছিল–জুয়েল, র‍্যাভারনাম কটেজে আমি জুয়েলের দেখা পেয়েছি সেখানে জুয়েল সকলের মধ্যে দিন কাটিয়েছিল। হ্যাঁ, মনে পড়েছে, তবে ওখানে তাকে জিল নামে ডাকা হত। মিসেস মান্ডির কথাও মনে পড়ছে। এক সপ্তাহ আগে তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। তারা ইনফরমারিতে এসেছিল। জিলের একটা ভালো নামের সন্ধান করতে হবে।

…..আমার মনে হয় জেলখানায় বসে হয়তো বাবার কানে এই সংবাদ পৌঁছে গিয়ে ছিল। তাই বোধহয় সে জেলখানার দুয়ার ভেঙে বাইরে আসার চেষ্টা করছিল। আর পুরোনো ড্রেসারের কাছ থেকে এই সুটকেসটা নিয়ে আসে অথবা এই সুটকেসটা হয়তো তার স্ত্রী ফেলে গিয়েছিল। আমার মনে হয় যদি সত্যি সত্যি ওই বহু মূল্যবান রত্নরাজি তার মায়ের হয়ে থাকে তাহলে সেগুলি বিক্রি করে দেওয়া উচিত, আর সেই টাকায় মেয়েটির ভালোভাবে বেড়ে ওঠায় সাহায্য করা উচিত।

–আমার অনেক কথাই মনে পড়ছে মিসেস হারমন। কিন্তু সেগুলো সত্যি সত্যি এখানে আছে কি?

–মিস মার্পল হাসি মুখে বলে উঠলেন–হ্যাঁ, এখানে সব কিছু নিরাপদে গচ্ছিত আছে।

.

০৪.

–রেভারেন্ড জুলিয়ান হারমনকে এখন আবার তাঁর আগের অবস্থানে দেখা গেল। তিনি তার স্ত্রীকে স্নেহ এবং সন্তুষ্টি ভরা আচরণের মাধ্যমে অভিনন্দিত করলেন। তারপর বললেন–তুমি যে ফিরে এসেছ, এতে যে আমি কত খুশি হয়েছি তোমাকে কী করে বোঝাব? শ্রীমতী বার্ড চেষ্টা করে সবকিছু ভালো ভাবে করতে। সে আমায় মাছের কেক করে খাইয়েছে। লাঞ্চের খাওয়াটা খুব একটা খারাপ হয় নি। কিন্তু তোমার মতো রান্না সে কি করতে পারে?

…….বাধ্য হয়ে আমি খাবারের টুকরোগুলো টিগালাথকে দিয়ে দিয়েছি।

–টিগলাথ? বাঞ্চ চিৎকার করে উঠলেন, তার মানে ওই মোটা সোটা বেড়ালটি, যেটা এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়, খাবারের জন্য। তিনি বলে উঠলেন, টিগলাথের ভাগ্য ভালো বলতে হবে। মনে হয় সে বোধহয় খেয়ে খেয়ে আরও একটু মুটিয়ে যাবে।

দাঁতের ব্যথাটা কেমন আছে, প্রিয়তমা? তুমি কি ডেন্টিস্টের শরণাপন্ন হবার সুযোগ পেয়েছিলে?

বাঞ্চ বলে, উঠলেন–এখন আর দাঁতের যন্ত্রণা তেমন ভাবে আমাকে আঘাত করছে না। আমি আরও একবার আন্ট জেনের সঙ্গে দেখা করতে যাব।

জুলিয়ান বললেন–তিনি এখনও ভালো আছেন, আমি আশা করি।

বাঞ্চ বলে উঠলেন–হ্যাঁ, তিনি কখনো খারাপ থাকেন না।

পরদিন সকালে ক্রিসেনথেমাম হাতে চার্চের দিকে এগিয়ে চলেছেন। সূর্যকে আবার পূর্ব দিগন্তে দেখা গেল। বাঞ্চের মনে হল, চারপাশে এখন হাজার হীরকের বর্ণচ্ছটা ছড়িয়ে পড়েছে। নিশ্বাস নিতে বড্ড ভালো লাগছে তার। তিনি ভাবলেন এখন আকশের দিকে দুহাত তুলে ওই নবজাতিকা মেয়েটির জন্য প্রার্থনা করা উচিত। তিনি মনে মনে বললেন-হে ঈশ্বর, এই মেয়েটি যেন ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে। আমাকে অনেকটা পথ এখনও হাঁটতে হবে ওকে সাহায্য করার জন্য।

তিনি ধীরে ধীরে চার্চে পৌঁছে গেলেন, বেশ কিছুটা সময় কাটালেন ঈশ্বরের সামনে নতজানু অবস্থায়। মনে হল গত দুটি দিনের স্মৃতি বুঝি তার মনের আকাশ থেকে চিরতরে বিলুপ্তি হয়ে গেছে। এখন তাকে নতুন উদ্যমে আবার জেগে উঠতে হবে। জেগে উঠতে হবে শুধুমাত্র ওই নবজাতিকা মেয়েটিকে মানুষ করার জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *