৪. গম্ভীর স্বর ভেসে এল

সবসময় কেউই নির্ভুল হতে পারে না। বিরক্তিভরে বলে ওঠেন মিসস লরিমার।

আমি পারি। পোয়ারোর গম্ভীর স্বর ভেসে এল এবং এটা সবসময়ই এতই অনিবার্য যে মাঝে মাঝে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই। তবুও এক্ষেত্রে একটা বিষয়ে আমার নিশ্চয় বড় রকমের ভুল হয়েছে। আপনি বলছেন যে খুনটা আপনি করেছেন। কিন্তু তা তো হতে পারে না। তাই যদি হত তাহলে কিভাবে আপনি এই খুনটা করেছেন এরকুল পোয়ারো তা আপনার থেকে ভালভাবেই জানত।

কি সব আবোল-তাবোল বকছেন। মিসেস লরিমার বলে ওঠেন।

আপনার মনে হতে পারে আমি পাগল। কিন্তু আমি তা নই। আমি নির্ভুল এবং অভ্রান্ত। মিঃ শেটানকে আপনি খুন করেছেন এ কথা আমি মেনে নিতে রাজি আছি, কিন্তু যেভাবে বলেছেন সেইভাবে খুনটা আপনি করতে পারেন না। নিজের চরিত্র বিরোধী কাজ কেউ করতে পারে না। হয় খুনটা আগে থেকে প্ল্যান করা, নয় আপনি এ খুন করেন নি। পোয়ারো মিসেস লরিমারের দিকে তাকালেন।

আপনি সত্যিই বদ্ধ পাগল। তীক্ষ্ণণ কণ্ঠে বলে ওঠেন মিসেস লরিমার। যখন আমি স্বেচ্ছায় বলছি যে খুনটা আমিই করেছি তখন কিভাবে খুনটা করেছি তাই নিয়ে মিথ্যে বলতে যাব কেন? আমার কি স্বার্থ?

এরকুল পোয়ারো আবার ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করলেন। একটু পরে নিজের জায়গায় ফিরে এলেন। তাঁর উত্তেজনার ভাবটা কেটে গেছে।

এখন আমি গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। খুনটা আপনি করেন নি। পোয়ায়োর শান্ত স্বর ভেসে এল, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি-কালেস্ট্রীটে অ্যানা মেরিডিথের বিষণ্ণ মূর্তির পাশাপাশি আরও একটি মেয়ের ছবি ফুটে উঠছে, যে মেয়েটি চিরটাকাল একাকী নিঃসঙ্গভাবে সময়ের সাঁকো পেরিয়ে আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। সবটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আমার কাছে। কিন্তু ম্যাডাম, আপনি নিশ্চিন্ত হলেন কি করে যে মিস মেরিডিথই খুন করেছে শেটানকে?

কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো–

মিথ্যে বলে কোন লাভ নেই ম্যাডাম। যেদিন কার্লেস্ট্রীটে আপনার মানসিক অবস্থা আমি বুঝতে পেরেছি। ডাক্তার রবার্টস বা মেজর ডেসপার্ডের জন্য এরকম কাজ আপনি করবেন না। কিন্তু মিস মেরিডিথ?–তার প্রতি আপনার সমবেদনা আছে। কারণ সে যা করেছে অতীতে আপনি তাই করেছিলেন। আপনি হয়ত জানতেন না কি উদ্দেশ্যে মিস মেরিডিথ খুন করেছে শেটানকে, কিন্তু সে-ই যে খুন করেছে আপনি নিশ্চিতভাবে তা জানতেন। এমনকি ব্যাটেল যখন আপনাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন তখনও জানতেন আপনি এ-কথা। বুঝতেই পারছেন গোটা ব্যাপারটাই আমার জানা। অপরের অপরাধের বোঝা নিজের ঘাড়ে নিয়ে আপনি যেভাবে একটি অল্পবয়সী মেয়েকে বাঁচাতে চেষ্টা করছেন–সত্যি মহৎ আপনি।

আপনি ভুলে যাচ্ছেন মঁসিয়ে পোয়ারো–শুকনো গলায় বলে ওঠেন মিসেস লরিমার, আমিও নিরপরাধ নই–অনেক বছর আগে আমি নিজের হাতে আমার স্বামীকে খুন করেছিলাম।

কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলেন দুজনেই। তারপর পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, এই হল বিধাতার অমোঘ বিচার। আপনার বিবেক বুদ্ধি রয়েছে নিজের অপরাধের জন্য শাস্তি পেতে আপনি প্রস্তুত। খুনটা খুনই। নিহত ব্যক্তিই একমাত্র লক্ষ্য নয়। আপনার সাহস আছে ম্যাডাম। আপনার দৃষ্টিশক্তিও খুব স্বচ্ছ। কিন্তু মিসেস লরিমার–আপনি এত নিশ্চিন্ত হলেন কি করে যে মিস মেরিডিথই খুন করেছেন শেটানকে?

একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন মিসেস লরিমার।

আমি যে তাকে খুন করতে দেখেছি মঁসিয়ে পোয়ারো।

 পোয়ারো আচমকা হেসে উঠলেন। তার প্রাণখোলা হাসিতে সারা ঘর গম-গম করতে লাগল। একটু বাদে হাসি থামিয়ে বললেন, কি আশ্চর্য! ঘটনাটা নিয়ে এত তর্ক করলাম, যুক্তি দেখালাম, কত প্রশ্ন এল, অথচ এই ব্যাপারটার একজন প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছে। খুনটা তার চোখের সামনেই ঘটেছে। ম্যাডাম ঘটনাটা আমাকে খুলে বলুন।

তখন বেশ রাত। অ্যানা মেরিডিথ ডামি ছিল। ও উঠে দাঁড়িয়ে অন্য সকলের তাসগুলো উঁকি মেরে দেখে নিল। তারপর পায়চারি করতে লাগল ঘরের মধ্যে। এদিকে আমাদের তাসটাও সেরকম ঘোর প্যাঁচের ছিল না তাই খুব একটা মনোযোগ দিইনি। খেলাটা শেষ হবার মুখে আমার হঠাৎ নজর গেল মিঃ শেটানের দিকে। অ্যানা মেরিডিথ যেন সেখানে ঝুঁকে পড়ে কি করছে। তারপর আস্তে আস্তে সে উঠে দাঁড়ালো কিন্তু তার হাতটা ভদ্রলোকের বুকের ওপর। মেরিডিথের চোখে মুখে আতঙ্ক আর ভয়ের ছাপ। সে চট করে আমাদের দিকে তাকালো, তখনই লক্ষ্য করলাম তার চোখে অপরাধের ছায়া। তখনও আমি ব্যাপারটা বুঝিনি, পরে অবশ্য সবই পরিস্কার হয়ে গেল। আহারে বেচারা কি ভয় বুকে নিয়েই না দিন কাটাচ্ছে। অথচ আমি যে ওকে লক্ষ্য করেছি তাও হয়ত জানে না। মঁসিয়ে পোয়ারো, আগে আমি এতটা সহানুভূতিশীল ছিলাম না। দয়া জিনিসটা কোন দিনই আমাকে এতটা বিচলিত করেনি, কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথেই তো এ-সবের জন্ম।

কথাগুলো শুনতে ভালোই। পোয়ারোর মন্তব্য শোনা গেল। কিন্তু ম্যাডাম এর সবগুলোই সকলের প্রতি প্রযোজ্য নয়। অ্যানা মেরিডিথ অল্পবয়সী মুখে চোখে একটা ভীরু ভাব। মনে হয় একটু কড়া কথা বললেই কেঁদে ফেলবে–তাই না? হ্যাঁ ঠিকই, সকলের সমবেদনা জাগতে পারে। কিন্তু আমি সকলের সঙ্গে একমত নই। অ্যানা মেরিডিথ কেন শেটানকে খুন করেছে জানেন? কারণ মেরিডিথ এক কাজের বাড়িতে চুরি করে ধরা পড়ে, চিরকালের মত মুখ বন্ধ করার জন্য সেই বাড়ির গৃহকর্ত্রীকে খুন করেছিলেন, এ-কথা শেটান জানতেন।

অবাক হয়ে তাকালেন তার দিকে মিসেস লরিমার। এসব কি সত্যি মঁসিয়ে পোয়ারো?

প্রতিটি কথাই নিদারুণ সত্যি। লোকে ভাবে মিস মেরিডিথ শান্ত, ভদ্র মেয়ে। কিন্তু আসলে, ঐ ছোট, শান্তশিষ্ট মেয়েটি খুবই সাংঘাতিক, বিপজ্জনক। যেখানেই তার সুখ বা নিরাপত্তা জড়িত থাকবে সেখানেই সে হিংস্র বন্য হয়ে উঠবে। এবং ছোবল মারতেও দ্বিধা করবে না। কাউকে বিশ্বাস করে না সে। অপর এভাবেই খুন করতে করতে সে পাকাপোক্ত হয়ে যাবে। যাক আমি এখন বিদায় নেব ম্যাডাম, যা বললাম ভেবে দেখবেন।

যদি সেরকম মনে হয়, তবে আমি কিন্তু আজকের সমস্ত কথাবার্তা অস্বীকার করতে পারি। কোন সাক্ষীও নেই। সেদিন সন্ধ্যায় আমি যা দেখেছি তা শুধু আপনার আমার মধ্যেই থাকবে।

কোন ভয় নেই ম্যাডাম। আপনার অনুমতি ছাড়া কেউই কোন কথা জানবে না। তাছাড়া আমি নিজের সঠিক পথেই এগোচ্ছি।

মিসেস লরিমারকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন পোয়ারো। রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে যাবার পর কি মনে হতে মিসেস লরিমারের বাড়ির দিকে ফিরে তাকালেন তিনি। অন্ধকারে স্পষ্ট না দেখা গেলেও মনে হল মিস মেরিডিথ গেট পেরিয়ে ঐ বাড়িতে ঢুকল। পোয়ারো ফিরে যাবেন কি না ভাবলেন একবার, কিন্তু মনস্থির করে নিজের পথেই পা বাড়ালেন তিনি।

বাড়ি ফিরেই ব্যাটেল কে ফোন করলেন পোয়ারো।

 হ্যালো! ব্যাটেলের ভরাট কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

আমি যা বলছি শুনুন। মিস মেরিডিথের সঙ্গে একবার দেখা করাটা খুব জরুরী। পোয়ারো উত্তেজিত ভাবে বলে উঠলেন।

হ্যাঁ। সেটা আমিও জানি। কিন্তু এখনই ব্যাপারটা এত জরুরী হয়ে উঠল কেন?

মঁসিয়ে ব্যাটেল। যত সময় যাবে সে আরও সাংঘাতিকভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে এটা ভুলে যাবেন না।

মিনিটখানেক চুপ করে থেকে ব্যাটেল বললেন, হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু সেরকম তো কেউ নেই–যাকগে, আমি অবশ্য তাকে সরকারীভাবে চিঠি লিখে জানাচ্ছি যে আমি আগামীকাল তার সঙ্গে উইলিংফোর্ডে দেখা করব। মনে হয়, এতে কিছুটা নার্ভাস হয়ে পড়বে সে। তখনই তাকে কায়দা করা সহজ হবে।

হ্যাঁ। এটা খারাপ না। আপত্তি না থাকলে আমি আপনার সঙ্গী হতে পারি।

আপত্তি? কি যে বলেন। আপনাকে সঙ্গী পেলে খুব খুশী হব।

রিসিভার নামিয়ে রেখে কিছুক্ষণ বসে রইলেন পোয়ারো। তার মনটা কিছুতেই স্থির থাকতে চাইছে না। কিসের একটা আশঙ্কায় অস্বস্তি হচ্ছে তার।

কাল সকালেই দেখা যাবে। বিড় বিড় করতে করতে ঘুম চোখে বিছানার দিকে এগোলেন পোয়ারো।

আমার কর্ত্রী কিন্তু এসব ব্যাপার খুব অপছন্দ করতেন, স্যার। যাই ঘটুক না কেন গেরস্থ বাড়ি পুলিশ ঢুকবে কেন? তিনি যদি ভুল করে দু একটা বেশি ট্যাবলেট খেয়ে মারাই যান, সেটাতে দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। পুলিশের এতে মাথা গলাবার কি আছে?

মিসেস লরিমারের বাড়ির বৃদ্ধা দাসী পোয়ারোর কথার উত্তর দিচ্ছিলেন। একটু আগেই মিসেস লরিমার-এর মৃত্যুর খবর পেয়েছেন পোয়ারো। সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল তাকে ফোন করে খবরটা জানান। পুলিশের মতে–মিসেস লরিমার আত্মহত্যা করেছেন। পোয়ারোর সঙ্গে ডাঃ রবার্টসের দেখা হয়েছে এ বাড়িতে ঢোকার মুখে। তারও মত ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন মিসেস লরিমার। সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেলের কাছ থেকে পোয়ারো মোটামুটি ঘটনাটা জানতে পেরেছেন।

মৃত্যুর আগে মিসেস লরিমার বাকী তিনজন ডাক্তার রবার্টস, মেজর ডেপার্ড আর মিস মেরিডিথের নামে চিঠি লিখে গেছেন। পরিস্কার চিঠি, কোনরকম জটিলতা নেই। সব ঝামেলা, ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্ত হবার একটা পথই তার সামনে খোলা আছে আত্মহত্যা। শেটানের খুনী তিনি নিজেই। এই ঘটনায় অন্য তিনজনকে যে কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। তার জন্য তিনি ক্ষমাপ্রার্থী। এই হল চিঠির মূল বক্তব্য।

সকাল আটটার ডাকে সর্বপ্রথম ডাঃ রবার্টস এই চিঠি পান। তারপর তিনি তার পরিচারিকাকে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে নির্দেশ দিয়ে তড়িঘড়ি উপস্থিত হন মিসেস লরিমার-এর বাড়িতে। যেখানে গিয়ে শোনেন যে মিসেস লরিমার তখনও ঘুম থেকে ওঠেননি। দ্রুত পায় তার শোবার ঘরে গিয়ে হাজির হন ডাঃ রবার্টস। কিন্তু তখন আর করার কিছু ছিল না, সব শেষ। ভদ্রমহিলার মাথার কাছে টেবিলে একটা ভেরোনাইলের ফাইল পাওয়া গেছে। এক ধরণের ঘুমের ওষুধ। ফাইলের অর্ধেকটাই খালি। ডাঃ রবার্টসের পরিচারিকার ফোন পেয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে ডিভিশনাল সার্জেনও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মিসেস লরিমারের বাড়িতে উপস্থিত হন। তারও একই মত, ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন মিসেস লরিমার।

মেজর ডেসপার্ড শহরের বাইরে গেছেন, সুতরাং সেদিন সকালের ডাকে চিঠি পাননি তিনি। মিস মেরিডিথ চিঠি পেয়েছেন।

পোয়ারো বাস্তবে ফিরে এলেন। তখনও সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে বদ্ধা দাসী-ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

কি ভয়ঙ্কর, বীভৎস ব্যাপার স্যার। কাল সন্ধ্যাবেলায় তো আপনি তার সঙ্গে চা খেলেন, কি সুন্দর ভদ্র ব্যবহার করলেন তিনি। আর আজ সকালেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। ঐ যে ডাক্তার রবার্টস না কি যেন ভদ্র লোক। তা সেই ভদ্রলোক ভোরে এসে উত্তেজিতভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, মিসেস লরিমার কোথায়? আমি তো অবাক, বললাম যে তিনি ঘুম থেকে উঠে ঘন্টি না বাজালে কেউ তাকে বিরক্ত করে না, এটাই তার আদেশ। ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তার শোবার ঘর কোথায়, বলতে বলতে তিনি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন। আমিও দাঁড়ালাম তার পেছন পেছন। দূর থেকে শোবার ঘরটা দেখতেই তিনি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে উঠলেন।–হ্যায়-হায়, বড় দেরী হয়ে গেছে। গিয়ে দেখি আমাদের কী খাটের ওপর পড়ে আছেন, স্থির দেহ। ডাক্তার ভদ্রলোক তবু তার হৃৎস্পন্দন চালু করার কত চেষ্টা করলেন। আমাকে বললেন গরম জল আর ব্রাণ্ডি নিয়ে আসতে। কিন্তু সব ব্যর্থ হল। ইতিমধ্যে আবার পুলিশের গাড়িও এসে গেছে–তারপর এই ঝামেলা, এটা কিন্তু ঠিক হল না স্যার। এখানে পুলিশ আসবে কেন?

পোয়ারো এ-কথার জবাব দিলেন না, প্রণাম করলেন, গতকাল রাত্রে মিসেস লরিমারকে কি কোন কারণে উদ্বিগ্ন বা চিন্তিত মনে হচ্ছিল?

না তো স্যার। স্বাভাবিকই ছিল। তবে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, মনে হয় খুব যন্ত্রণা পাচ্ছিলেন তিনি। ইদানিং শরীরও বিশেষ ভালো যাচ্ছিল না। গতকাল আপনি চলে যাবার পর আর একটি অল্পবয়সী মেয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। মনে হয় সেই কারণেও তিনি খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তে পারেন।

পোয়ারো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে থমকে দাঁড়ালেন।

তরুণী মহিলা?

 হ্যাঁ স্যার। নাম বললেন–মিস মেরিডিথ।

 কতক্ষণ ছিলেন তিনি?

প্রায় ঘণ্টাখানেক। তারপর আমার কর্ত্রী শুতে গেলেন। সন্ধ্যোর ডিনারটা শোবার ঘরেই দিতে বললেন, খুব ক্লান্ত বোধ করছিলেন তিনি।

পোয়ারো কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। গতকাল সন্ধ্যায় কি কোন চিঠিপত্র লিখেছিলেন তোমার কর্ত্রী?

শুতে যাবার আগে কিছু লিখেছিলেন কিনা ঠিক জানি না তবে বসবার ঘরের টেবিলের ওপর ডাকে পাঠাবার জন্যে কয়েকটা চিঠি পড়েছিল। রাত্রে গেট বন্ধ করবার আগে সেগুলো তাকে দিয়ে আসি আমি। কিন্তু সে চিঠিগুলোতে অনেক আগে থেকেই টেবিলে রাখা ছিল।

মোট কটা চিঠি ছিল?

 ঠিক সংখ্যাটা মনে নেই। দুটো কি তিনটে। তিনটেই বোধহয়।

ডাকে দেবার আগে চিঠির ওপরের ঠিকানাগুলো লক্ষ্য করেছিলে? ভালো করে ভেবে বল, ব্যাপারটা খুব জরুরী।

চিঠিগুলো ডাকবাক্সে ফেলার সময় ওপরের চিঠির ঠিকানাটা নজরে পড়েছিল–সেটা হচ্ছে ফোঁটাম অ্যাণ্ড ম্যাসন। তবে অন্যগুলোর কথা তো ঠিক বলতে পারব না।

চিঠি যে ঠিক তিনটের বেশি ছিল না তুমি নিশ্চিত?

হ্যাঁ স্যার।

পোয়ারো গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন কয়েকবার। শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সিঁড়ির দিকে। তোমার কী যে ঘুমের ওষুধ ব্যবহার করতেন তুমি জানতে?

হ্যাঁ স্যার, ডাঃ লঙই তাকে ঘুমের ওষুধ খেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

সেই ওষুধের শিশিটা কোথায় থাকত?

 তার শোবার ঘরের ছোট জালের আলমারিটার মধ্যে।

আর কোন প্রশ্ন না করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন পোয়ারো। গম্ভীর থমথমে মুখ।

দোতলায় সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল এবং ডিভশনাল সার্জনের সঙ্গে দেখা হলো তার। তাদের সব পরীক্ষা তখন শেষ। ব্যাটেলের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মিসেস লরিমার-এর শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন পোয়ারো। মৃত দেহটা একবার নিজে পরীক্ষা করবেন তিনি।

ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন পোয়ারো। প্রাণহীন দেহটা বিছানার ওপর স্থির হয়ে পড়ে আছে। ঝুঁকে মিসেস লরিমারের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।

পোয়ারোর বুকের ভেতর একটা জমাট অশান্তি ক্রমেই দানা বাঁধছে। সত্যিই কি মিসেস রিমার একটি তরুণীকে অপমান এবং মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য শেষ পর্যন্ত এই আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন? না কোন অন্য রহস্যময় কারণ আছে?

অন্তত কয়েকটা তথ্য যদি জানা যেত–

হঠাৎ খাটের ওপর আর একটু ঝুঁকে পড়লেন পোয়ারো। মৃতদেহের বাঁ হাতের মাঝখানে একফেঁটা শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ।

সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো, তার দুচোখের মধ্যে চকচক করছে অদ্ভুত একধরণের সবুজ আলো। পোয়ারোকে যারা গভীরভাবে চেনেন, তারা এ দৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত।

ঘর ছেড়ে নিচে নেমে এলেন পোয়ারো। দেখলেন, ফোনের পাশে ব্যাটেল তার এক অধীনস্থ কর্মচারীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন। একটু বাদে ফোন নামিয়ে রাখলেন কর্মচারীটি। না, স্যার, তিনি এখনো তার ফ্ল্যাটে ফিরে আসেন নি।

পোয়ারোর দিকে তাকালেন ব্যাটেল। মেজর ডেসপার্ডকে অনেকক্ষণ থেকে ফোনে ধরবার চেষ্টা করছে। তার নামে চেলসী ডাকঘরের ছাপ মারা একটা চিঠি আছে।

ডাক্তার রবার্টস কি এখানে আসার আগে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছিলেন? পোয়ারো হঠাৎ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন।

অবাক হয়ে তার দিকে ফিরে তাকালেন ব্যাটেল। না, ভদ্রলোক একবার বলেছিলেন, ব্রেকফাস্ট না করেই বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি।

তাহলে, নিশ্চয়ই বাড়িতে আছেন এখন।

 কিন্তু কেন?

পোয়ারো ততক্ষণে রিসিভার তুলে ডায়াল ঘোরাতে শুরু করেছেন।

ডাঃ রবার্টস? সুপ্রভাত। আমি এরকুল পোয়ারো। একটা প্রশ্ন আছে। আপনি কি লরিমারের হাতের লেখার সঙ্গে পরিচিত? পরিচিত নন? আগে কখনো দেখেননি বলছেন। আচ্ছা আচ্ছা, ধন্যবাদ, অশেষ ধন্যবাদ। রিসিভার নামিয়ে রাখলেন পোয়ারো।

আপনার মতলবটা কি মঁসিয়ে পোয়ারো। ব্যাটেল অবাক হয়ে বলে উঠলেন।

ব্যাটেলের দিকে ফিরে তাকালেন পোয়ারো। গতকাল সন্ধ্যায় এখান থেকে আমি বিদায় নেবার পর, মিস মেরিডিথ এ-বাড়িতে এসেছিলেন। তিনি চলে যাবার পর মিসেস লরিমার শুতে যান। সেই সময় এ বাড়ির ঝি তাকে কোন চিঠিপত্র লিখতে দেখেনি। আর গতকাল সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার আগেই যে তিনি এ চিঠিগুলো লিখে রেখেছিলেন সেটাও ঠিক বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। কারণ, তাহলে তার কথাবার্তাতেও কিছু একটা আঁচ করা যেত। তবে চিঠি তিনটে কখন লিখলেন?

কেন? কাজের লোকেরা শুতে যাবার পর, হয়ত নিজেই বাইরে গিয়ে এগুলো ডাকে দিয়ে এসেছিলেন।

হ্যাঁ হতে পারে। মাথা নাড়লেন পোয়ারো। আবার এমনও তো হতে পারে যে চিঠিগুলো তিনি আদৌ লেখেন নি।

কি বলছেন মঁসিয়ে পোয়ারো-ব্যাটেলের কথা শেষ হবার আগেই ঝনঝন শব্দে টেলিফোনটা বেজে উঠল। ফোন ধরে একটু পরেই রিসিভার নামিয়ে রাখল পুলিশ কর্মচারীটি।

স্যার মেজর ডেসপার্ডের ফ্ল্যাট থেকে সার্জেন্ট ওকোনার জানাচ্ছে যে ডেসপার্ড আজ সকালে উইলিংফোর্ড-এ যেতে পারেন।

পোয়ারো রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠলেন–ব্যাটেলের হাত ধরে টানলেন তিনি। এক্ষুণি উইলিংফোর্ডে যাবার ব্যবস্থা করুন, এক মুহূর্তও সময় নেই। একটা ভয়ানক কিছু ঘটতে যাচ্ছে, হয়ত এই শেষ নয়। আপনাকে আগেই বলেছি সুন্দরী মেরিডিথ অল্প বয়সী হলেও খুবই সাংঘাতিক আর বিপজ্জনক–এটা ভুললে চলবে না।

অ্যানা, রোডা বলে উঠল, কি হল তোর, তখন থেকে ডাকছি। ওসব পাজল-টাজল রাখ। যা বলছি মন দিয়ে শোন।

অ্যানা টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে একটা দৈনিক পত্রিকার ক্রশ-ওয়ার্ড পাজলের সমাধান খুঁজছিল। রোডার কথায় কাগজটা মুড়ে রাখল। কি বলছিস বল?

হ্যাঁ, শোন্–ইতস্তত করল রোডা। ভদ্রলোক তো আবার আসছেন।

 কার কথা বলছিস? সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল?

হ্যাঁ। আমার কি মনে হয় জানিস, মিসেস বেনসনের ব্যাপারটা তাকে বলে দেওয়াই ভালো।

তুই কি পাগল নাকি? অ্যানার ঠাণ্ডা জবাব ভেসে এল, এখন এ কথা বলতে যাবো কেন?

কারণ–কারণ তিনি ভাবতে পারেন তুই হয়ত ঘটনাটা লুকোতে চাইছিস। অত ঝামেলার কি দরকার? তার থেকে আসল ব্যাপারটা ভদ্রলোককে জানিয়ে দে।

এখন আর তা বলা যায় না।

 প্রথমে বললেই ভালো করতিস।

 হ্যাঁ। কিন্তু এতদিন বাদে আর এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।

তা অবশ্য ঠিক।

আমি তোর কথার মাথা মুণ্ডু বুঝতে পারছি না রোডা। বিরক্ত হয়ে ওঠে অ্যানা।

সেই ঘটনার সঙ্গে তখনকার ঘটনার কি সম্পর্ক? তা ছাড়া সুপারিনটেন্টে ব্যাটেল চাইছেন আমার স্বভাব-চরিত্রের সম্বন্ধে খোঁজখবর। আমি তো সেখানে ছিলাম মাত্র দু মাস। ঐ দুমাসে তারা আমার কতটুকু পরিচয়ই বা পাবে?

ঠিকই বলেছিস। অমি হয়ত বোকার মতো কথা বলছি। তবুও জানিস কেমন একটা অস্বস্তি রয়েছে। সবকিছু খুলে বলাটাই ভাল। ধর, ব্যাটেল ব্যাপারটা কোনভাবে জানতে পারলেন, তখন তো ভাববেন যে তুই ইচ্ছে করে ব্যাপারটা চেপে গেছিস। অযথা সন্দেহ বাড়বে।

একটা জিনিস কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, বাইরের কেউ এ কথা জানবে কি করে? একমাত্র তুই আর আমিই ব্যাপারটা জানি, আর কেউই জানে না।

না, তা যদিও জানে না– তোতলাতে শুরু করল রোডা।

অ্যানা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রোলার দিকে ফিরে তাকাল, রোডার ইতস্তত ভাব আর নজর এড়ায় নি। কেন আর কে জানে বলে তোর মনে হয়?

একটু চুপ করে থেকে রোডা উত্তর দিল, অনেকেই। কোম্বীকারের বাসিন্দারা নিশ্চয়ই অত সহজে ঘটনাটা ভুলবে না।

ওঃ এই কথা! হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অ্যানা। সেখানকার কারো সাথে সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেলের দেখা হবে কি না সন্দেহ। একেবারেই অসম্ভব।

কিন্তু অসম্ভব অনেক কিছুই এ পৃথিবীতে ঘটে থাকে।

রোডা! সামান্য ব্যাপারটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করছিস তুই।

 খুব দুঃখিত, অ্যানা, তবে কথাটা পুলিশের কানে গেলে তারা ভাববে তুই কিছু লুকিয়েছিস।

তারা জানবে কি ভাবে? কে বলবে এ কথা? তুই আর আমি ছাড়া তো কেউই জানে না। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার কথাটা উচ্চারণ করল অ্যানা, কিন্তু তার গলার স্বর পাল্টে গেছে, উচ্চারণের ভঙ্গীটাও অদ্ভুত, কেমন একটা শিরশিরে শিহরণ জাগায়।

রোডা ব্যাজার মুখে বলল, তাহলেও কিন্তু তোর বলা উচিত। অ্যানার দিকে ফিরে তাকাল রোডা। কিন্তু অ্যানা তখন চুপ করে কি যেন ভাবছে। তার দীর্ঘ –জোড়া কুঁচকে মনে মনে যেন কোন কিছু হিসাব কষছে সে।

রোডা হঠাৎ প্রশ্ন করল, গোয়েন্দাপ্রবর ব্যাটেল কখন এখানে পায়ের ধুলো দেবে?

বেলা বারোটায়। অ্যানা জবাব দিল–এখন তো সাড়ে দশটা। চল রোডা নদী থেকে স্নান করে আসি।

কিন্তু মেজর ডেসপার্ড তো এগারোটা নাগাদ এসে পড়বেন, সেই রকমই তো চিঠিতে জানিয়ে দেন তিনি।

তাতে কি? মিসেস অষ্টওয়েলের কাছে একটা চিরকুট লিখে রেখে গেলেই চলবে। সেরকম জরুরী দরকার থাকলে তিনি নদীর ধারেই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন।

তা অবশ্য ঠিক, চল্ নদী থেকেই ঘুরে আসি

 বাগানের পায়ে চলা সরু পথ ধরে নদীর দিকে পা বাড়াল রোডা আর অ্যানা।

দশ মিনিট বাদে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই হাজির হলেন মেজর ডেসপার্ড। দু-জনেই বেরিয়ে গেছে শুনে অবাক হয়ে গেলেন, মেঠো পথ ধরে নদীর দিকে রওনা হলেন তিনি।

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার কলিংবেলটা বেজে ওঠে ওয়েডেন কুটিরে। পরিচারিকা মিসেস অস্টওয়েল আপনমনে গজগজ করতে করতে দরজা খুলে দিল।

এখানে ছোটখাট চেহারার বিদেশী ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন, তার সঙ্গে একজন বলিষ্ঠ চেহারার ইংরেজ। মিস মেরিডিথ কি বাড়িতে আছেন? লম্বা ভদ্রলোকটি এগিয়ে এলেন।

না, নদীতে স্নান করতে গেছেন।

 বিদেশী ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, আর মিসেস দোবাস?

 দুজনেই এক সাথে গেছেন।

ধন্যবাদ। ব্যাটেল বললেন, নদীর দিকে যাবার রাস্তাটা কোনদিকে? মিসেস অস্টওয়েলের কাছ থেকে রাস্তাটা জেনে সেদিকে পা বাড়ালেন ব্যাটেল এবং পোয়ারো।

পোয়ারোকে উত্তেজিতভাবে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে দেখে ব্যাটেল কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। কি ব্যাপার মঁসিয়ে পোয়ারো? হঠাৎ এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে?

কেন জানি না, খুব অস্বস্তি বোধ করছি।

কোন কিছু আশঙ্কা করছেন নিশ্চয়ই। সকালবেলাই এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে এখানে চলে এলেন। আবার আপনার কথাতেই আমি কনস্টেবল টার্পারকে এ অঞ্চলের গ্যাস সরবরাহ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করার নির্দেশ পাঠালাম। মেয়েটা কি সাংঘাতিক কোন কিছু করে বসতে পারে বলে আপনি আশঙ্কা করছেন?

এই পরিস্থিতিতে আর কি আশঙ্কা করব বলুন?

ব্যাটেল মাথা নাড়লেন। তা ঠিক। তবে আমি একটা কথা ভাছি–মেরিডিথ কি জানে যে তার বন্ধু মিসেস অলিভারের কাছে গোপন কথা ফাঁস করে দিয়েছে?

মাথা দোলালেন পোয়ারো। ঠিক তাই। সেই জন্যই তো বলছি তাড়াতাড়ি চলুন।

দুজনেই তাড়াতাড়ি হেঁটে চললেন। নদীতে নৌকা বা স্টীমার নেই। বাঁদিকে বাঁক নিয়ে রাস্তার পাশে স্থির হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন পোয়ারো।

তাদের থেকে শ-দুয়েক গজ দূরে মেজর ডেসপার্ড নদীর দিকে এগোচ্ছেন।

এখান থেকে নদীটা দেখা যাচ্ছে। নদীর মাঝ-বরাবর একটা ডিঙিতে বসে আছে। অ্যানা আর রোডা। দাঁড় টানছে রোডা, তার সামনে বসে গল্প করছে অ্যানা। দুজনেই কেউই তীরের এই লোকগুলোকে লক্ষ্য করেনি।

ঠিক সেই সময় অ্যানা দু হাত বাড়িয়ে ধাক্কা মারল রোডাকে। পড়ে যেতে যেতে অ্যানার জামা ধরে টাল সালাবার চেষ্টা করল রোডা। কঁকানিতে উল্টে গেল ডিঙিটা, দুজনে জড়াজড়ি করে জলের মধ্যে গিয়ে পড়ল।

ব্যাটেল ও পোয়ারো দুজনেই দৌড়তে শুরু করলেন। চেঁচিয়ে উঠলেন ব্যাটেল দেখুন দেখুন, অ্যানা মেরিডিথ ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরে তার বন্ধুকে জলে ফেলে দিল।

কিন্তু তাদের অনেক আগেই ছিলেন মেজর ডেসপার্ড। মেয়ে দুজনের কেউই যে সাঁতার জানে না তাদের হাবেভাবেই বোঝা যাছিল। ইতিমধ্যে ডেসপার্ড নদীর তীরে পৌঁছে গেছেন। নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। সাঁতার কেটে তাদের দিকে এগোলেন ডেসপার্ড।

ব্যাটেলও জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ততক্ষণে রোডাকে জল থেকে তুলে নদীর তীরে একটা পরিষ্কার জায়গায় শুইয়ে দিলেন ডেসপার্ড। আবার ঝাঁপ দিয়ে জলে পড়লেন তিনি। এবার তিনি এগিয়ে চললেন সেই দিকে, যেখানে অল্প আগেও অ্যানাকে হাঁকডাক করতে দেখা গেছে।

সাবধান! চেঁচিয়ে উঠলেন ব্যাটেল। এখানে অনেক বুনো আগাছা আছে। পায়ে জড়িয়ে বিপদ হতে পারে।

তারা দুজনেই প্রায় একই সঙ্গে সেই জায়গাটায় গিয়ে পৌঁছলেন, কিন্তু ততক্ষণে অ্যানা জলের তলায় তলিয়ে গেছে।

শেষ অবধি অনেক চেষ্টা করে অ্যানাকে খুঁজে পাওয়া গেল। ব্যাটেল আর ডেসপার্ড তুলে আনলেন অ্যানাকে। রোডার থেকে হাত তিনেক দূরে শোয়ানো হল তাকে।

পোয়ারোর সেবা শুশ্রূষায় ইতিমধ্যে রোডার জ্ঞান ফিরে এসেছে। শ্বাস প্রশ্বাসও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরিয়ে আনা ছাড়া উপায় নেই। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন ব্যাটেল। তবে মনে হয় না কোন কাজ দেবে। সম্ভবতঃ অ্যানা মেরিডিথ মারা গেছে।

ব্যাটেল তৎক্ষণাৎ শ্বাস প্রশ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে লেগে গেলেন, তাঁকে সাহায্য করার জন্য পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন পোয়ারো।

আপনি কি বলছেন মঁসিয়ে পোয়ারো– নোডার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে–অ্যানা আমাকে ধাক্কা মেরে জলে ফেলে দিয়েছিল? আমারও অবশ্য সেইরকমই মনে হল, কেননা ও তো জানত আমি সাঁতার জানি না। কিন্তু ও কি এটা ইচ্ছাকৃত করল?

হ্যাঁ, ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত এবং আগে থেকে পরিকল্পনা করা– পোয়ারো গম্ভীরভাবে জবাব দিলেন। গাড়ি তখন ছুটে চলেছে লণ্ডনের সীমান্ত দিয়ে।

কিন্তু কেন?

সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল ফিরে তাকালেন রোডার দিকে। কেন জানতে হলে আপনার মনকে প্রস্তুত করুন মিস দোবাস। আমি এবার যা বলব তাতে আপনি প্রচণ্ড আঘাত পাবেন। আপনার বন্ধু যে মিসেস বেনসনের বাড়িতে কাজ করতেন তিনি দুর্ঘটনায় মারা যাননি। তাকে সুপরিকল্পিতভাবে খুন করে আনা মেরিডিথ।

এসব কি বলছেন আপনি?

আমাদের বিশ্বাস, পোয়ারোর জবাব ভেসে এল। অ্যানাই বোতল দুটো বদলে রেখেছিল।

না-না–এ হতে পারে না। এমন সাংঘাতিক কাজ অ্যানা করতেই পারে না। কেনই বা সে খুন করবে?

তার পেছনেও কারণ আছে। সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল বললেন। সে যাই হোক, অ্যানার ধারণা ছিল একমাত্র আপনিই আমাদের কাছে এ ঘটনার হদিশ দিতে পারেন। আচ্ছা, মিস দোবাস, আপনি কি মিসেস অলিভারের কাছে এই ঘটনাটা নিয়ে গল্প করেছেন এ-কথা নিশ্চয়ই আপনার বন্ধুকে জানাননি?

না। মৃদু জবাব দেয় রোড, ভেবেছিলাম ও তাতে আমার ওপর অসন্তুষ্ট হবে।

তা হতো, খুবই বিরক্ত হত। ব্যাটেল মন্তব্য করলেন, তবে মিস মেরিডিথ জানত ঘটনাটা একমাত্র আপনিই জানেন। তাই আপনার দিক থেকেই বিপদ আসবার সম্ভাবনা সেইজন্য পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিতে চেয়েছিল আপনাকে।

আমাকে সরিয়ে দিতে? কি সাংঘাতিক কাণ্ড। আমার কিন্তু এখনও ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।

যাক, যখন সে মারাই গেছে, তখন আর এ নিয়ে আলোচনার দরকার নেই। তবে বন্ধু হিসাবে মিস মেরিডিথ যে মোটেই ভাল ছিল না, এতে কোন সন্দেহ নেই।

গাড়িটা একটা বাড়ির সামনে এসে থামল।

এটা হচ্ছে মঁসিয়ে পোয়ারোর বাড়ি। চলুন, আমরা সকলে এখানে বসেই সমস্ত বিষয়টা সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করবো।

 পোয়ারোর ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছিলেন মিসেস অলিভার আর ডাক্তার রবার্টস।

আসুন আসুন। মিসেস অলিভার সকলকে স্বাগত জানালেন, আপনার টেলিফোন পাওয়া মাত্রই আমি ডাক্তার রবার্টসের সঙ্গে যোগাযোগ করে, দুজনে এখানে এসে হাজির হয়েছি। রবার্টসের পেশেন্টরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সে যাই হোক, আমরা কিন্তু এই ঘটনার আগা-গোড়া সমস্তটা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছি।

হ্যাঁ। পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল–শেষ পর্যন্ত আমরা মিঃ শেটানের খুনীকে আবিষ্কার করতে পেরেছি।

আমার কাছে কিন্তু গোটা ব্যাপারটাই অস্পষ্ট ধোঁয়াটে হয়ে যাচ্ছে। সুন্দরী মেরিডিথই যে খুনী, এ তো কোনদিন ভাবতেই পারিনি। রবার্টস বললেন।

সে যে একজন খুনী, কোন সন্দেহ নেই। ব্যাটেলের মন্তব্য শোনা গেল, এর আগেও তিন-তিনটে খুন করে শেষবারে অর্থাৎ চার নম্বর খুনটাতে সফল হতে পারেনি।

অবিশ্বাস্য! বিড় বিড় করলেন রবার্টস।

মোটেই না। মিসেস অলিভার বলে উঠলেন গোয়েন্দা গল্পে যে রকম ঘটে, যার ওপর কম সন্দেহ হয়, দেখা যায় সে-ই আসল খুনী। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

আচ্ছা মিসেস লরিমারের চিঠিটা নিশ্চয়ই জাল?রবার্টস ফিরে তাকলেন পোয়ায়োর দিকে।

নিঃসন্দেহে, তিনটে চিঠিই জাল।

 তাহলে মিস মেরিডিথও নিজের নামে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন?

সেটাই স্বাভাবিক। নকলটাও খুব দক্ষতা নিয়ে করা হয়েছিল। অবশ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে ঠিকই ধরা পড়ল। কিন্তু এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতামতের দরকার হত না, মিসেস লরিমার যে আত্মহত্যা করেছেন, পারিপার্শ্বিক ঘটনাগুলো তাই বলে।

মসিয়ে পোয়ারো, মিসেস লরিমারের মৃত্যুটা যে আদৌ আত্মহত্যা নয়, একেবারে পরিকল্পনা করা খুন এটা আপনি সন্দেহ করলেন কিভাবে?

চেইন লেনে। তার বাড়িতে বৃদ্ধা কাজের লোকের সঙ্গে কথা বলে।

তাঁর কাছ থেকেই বোধহয় খবর পেয়েছিলেন, যে অ্যানা মেরিডিথ আগের দিন সন্ধ্যায় দেখা করতে আসেন মিসেস লরিমারের সঙ্গে?

হ্যাঁ, অন্যান্য খবরের সঙ্গে এটাও সে বলেছিল। তাছাড়া আসল খুনী কে, সে সম্বন্ধেও মনে মনে আমি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম, মানে মিঃ শেটানের খুনী কে আমি জানতাম এবং তিনি মিসেস লরিমার নন, এও জানতাম।

মিস মেরিডিথকে আপনি সন্দেহ করলেন কেন? ডাঃ রবার্টস বললেন।

 ধৈর্য্য ধরুন। ডাক্তার রবার্টসকে বাধা দিলেন পোয়ারো।

সবটাই বলব আমি। তবে আমার একটা বিশেষ পদ্ধতি আছে। এক এক করে বাছাই করে বলা। সেভাবেই বলব। মিসেস লরিমার খুন করেননি, মিঃ শেটানকে। মোরে ডেসপার্ডও তাকে খুন করেননি। শুনলে আরও অবাক হবেন এই খুনের পেছনে মিস মেরিডিথের কোন হাত ছিল না–

সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়লেন পোয়ারো, তার মৃদু কোমল কণ্ঠস্বর বাতাস ছুঁয়ে গেল। তাহলে বুঝতে পারছেন ডাক্তার রবার্টস, বাকি থাকেন আপনি। আপনিই মিঃ শেটানকে খুন করেছেন এবং মিসেস লরিমারকেও।

মিনিট তিনেক কারোর মুখেই কথা ফুটল না।

একটা চাপা অস্বস্তিকর নীরবতায় থমথম করছে সারা ঘর। হঠাৎ রবার্টস বীভৎস ভঙ্গিতে হো হো করে হেসে উঠলেন। আপনি কি পাগল মঁসিয়ে পোয়ারো? মিঃ শেটানকে আমি খুন করিনি আর মিসেস লরিমারকে খুন করাও আমার পক্ষে অসম্ভব। মিঃ ব্যাটেল এসব আজগুবি কথা শুনবার জন্যই আমাকে ডেকে এনেছেন?

মঁসিয়ে পোয়ারোর বক্তব্যটা শুনলেই আপনি ভাল করবেন ডাঃ রবার্টস। ব্যাটেলের শান্তস্বর ভেসে এল।

যদিও কিছুদিন আগেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে একমাত্র আপনার পক্ষেই মিঃ শেটানকে খুন করা সম্ভব, কিন্তু আমার হাতে কোন সঠিক প্রমাণ ছিল না। কিন্তু পোয়ারো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন রবার্টসের দিকে। কিন্তু মিসেস লরিমারের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে আপনি প্রত্যক্ষদর্শী থেকে জানা গেছে যে আদালতে দাঁড়িয়ে আপনার অপকীর্তির সাক্ষ্য দিতে পারবে।

রবার্টসের হাবভাব ক্রমশ শান্ত হয়ে এলো, চোখের দৃষ্টিতে একটা উজ্জ্বল চকচকে আভা। আপনি আবোল তাবোল বলছেন মঁসিয়ে পোয়ারো।

একটুও ভুল নয়। আজ ভোরে আপনি ঝিয়ের কাছে বাজে ভাওতা দিয়ে মিসেস লরিমারের শোবার ঘরে ঢুকলেন–গত রাত্রে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফলে মিসেস লরিমার তখন গভীর ঘুমে অচেতন। আপনি আবার বৃদ্ধা ঝিকে ভাওতার দিয়ে বললেন, মিসেস লরিমার খুব সম্ভবত মারা গেছেন তবুও একবার শেষ চেষ্টা করবেন আপনি। এজন্য তাকে ব্রাণ্ডি আর গরম জল আনতে পাঠান, ঘরে কেউ ছিল না। ঝি একবার মাত্র উঁকি দিয়ে তার কর্ত্রীর দিকে তাকিয়েছিল, তাই তিনি মৃত কি জীবিত এটা বোঝা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

আপনি হয়ত জানেন না ডাক্তার রবার্টস সেই ভোরে জানালায় জমে থাকা বরফ পরিস্কার করতে একজন উইণ্ডো-ক্লীনার্স মিসেস লরিমারের জানালার কাঁচ পরিস্কার করতে এসেছিল। ব্যাপারটা সেই দেখে, তার মুখ থেকেই শোনা যাক।

পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে ডাকলেন-ভেতরে এসো স্টিফেন্স।

একটু পরেই শ্রমিক শ্রেণীর দশাসই চেহারার একজন লোক ঘরে ঢুকলো, ডান হাতে ধরা একটা ক্যাম্বিসের টুপি। তাতে গোল করে লেখা-চেলসী উইণ্ডো ক্লীনার্স অ্যাসোসিয়েশান।

পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, ঘরের মধ্যে কাউকে কি তুমি চিনতে পেরেছ?

লোকটা চারিদিকে তাকিয়ে দেখল তারপর ডাক্তারকে দেখিয়ে বলে উঠল, এই ভদ্রলোককে চিনতে পারছি।

শেষ যখন তুমি এঁকে দেখ, কি করছিলেন তখন এই ভদ্রলোক?

আজ ভোরবেলা, তখন বোধহয় আটটাও বাজেনি, চেইন লেনে এক ভদ্রমহিলার ঘরের জানলায় জমে থাকা বরফ সাফ করছিলাম। এই ভদ্রলোক তখন ভদ্রমহিলার বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। হাতে সিরিঞ্জ দেখে ভেবেছিলাম বোধহয় ডাক্তার। ভদ্রমহিলা বিছানায় শুয়ে ছিলেন, খুবই অসুস্থ দেখাচ্ছিল তাকে। ঘুমের ঘোরে একবার চোখ মেলে তাকালেন। এই ভদ্রলোক তখন ইনজেকশনের সিরিঞ্জটা খুব দ্রুত ভদ্রমহিলার হাতে ফুঁড়ে দিলেন, ভদ্রমহিলা আবার ঘুমিয়ে পড়লেন চোখ বুজে। আমি সেখানে আর অপেক্ষা না করে অন্য দিকে এগোলাম।

বাঃ অপূর্ব, অপূর্ব! পোয়ারো বলে উঠলেন, তাহলে ডাক্তার রবার্টস?

একটা সাধারণ-সাধারণ শক্তিবর্ধক ওষুধ তোতলাতে শুরু করলেন রবার্টস, তার জ্ঞান ফেরাবার জন্য

সাধারণ শক্তিবর্ধক? পোয়ারো তীব্র দৃষ্টিতে ডাক্তার রবার্টসের দিকে। এন-মিথাইল-সাইক্লো হেক্সানিল-ম্যালাথিন ইউরিয়া। যাকে বলে এভিপ্যান। ছোটখাটো অপারেশান-এর সময়ে সেই জায়গাটা অসাড় করতে লাগে। শিরার মধ্যে বেশি পরিমাণ এভিপ্যান ইনজেক্ট করলে সঙ্গে সঙ্গে যে কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়তে বাধ্য। ভোয়রাম্যাল বা ঐ জাতীয় ঘুমের ওষুধ ব্যবহারের পর এভিপ্যান প্রয়োগ প্রচণ্ড বিপজ্জনক। মিসেস লরিমারের হাতের ওপর আমি তো একটা ইনজেকশানের চিহ্ন দেখেছিলাম। পুলিশ সার্জেনকে ব্যাপারটা জানানোর পর তারা পরীক্ষা করে আমাকে এই তথ্য জানান।

এতেই আমাদের চলে যাবে। ব্যাটেল মন্তব্য করলেন শেটানের মৃত্যুর ব্যাপারে মাথা ঘামানোর দরকার হবে না। অবশ্য প্রয়োজন হলে মিঃ ক্র্যাক আর মিসেস ক্র্যাডককে খুন করার দায়ে আপনাকে অভিযুক্ত করা যায়।

ক্র্যাডকদের নাম শুনেই ডাঃ রবার্টস হতাশভাবে মুষড়ে পড়লেন। কোন প্রতিবাদ করতে পারলেন না তিনি। হতাশাভাবে এলিয়ে পড়লেন চেয়ারের ওপর।

বেশ, আমি আমার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি। ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন ডাঃ রবার্ট, আর বাধা দেব না, মনে হয় শয়তান শেটানই এ বিষয়ে আপনাদের কোন আভাস দিয়েছিলেন। ভেবেছিলাম খুব ভালোভাবেই শেটানের মুখটা বন্ধ করতে পেরে

না, শেটান নয়। ব্যাটেল বললেন, সমস্ত কৃতিত্বটাই মঁসিয়ে পোয়ারোর।

ডাক্তার রবার্টসকে সঙ্গে করে দুজন পুলিশ কর্মচারী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

তখনই বলেছিলাম, রবার্টস-এর কীর্তি– মিসেস অলিভার বলে উঠলেন।

পোয়ারো গম্ভীরভাবে সোফার ওপর বসে রয়েছেন, ঘরের সকলের উদগ্রীব দৃষ্টি তার দিকে। বলতে শুরু করলেন পোয়ারো।

আমি জীবনভর যতগুলো রহস্যময় মামলার মুখোমুখি হয়েছি বলতে বাধা নেই তার মধ্যে সবথেকে জটিল আর চমকপ্রদ মামলা হল এটা। এগিয়ে যাবার মত কোন সূত্র হাতে নেই, চারজন মাত্র লোক এবং তাদের মধ্যে একজন এই অপকীর্তির নায়ক। কিন্তু কে সে? কোন প্রমাণ-কাগজপত্র এমনকি কোন হাতের ছাপও নেই। শুধু সন্দেহভাজন চারজনই আমাদের সামনে হাজির।

আর একটা মাত্র সূত্র পাওয়া গেছে ব্রীজ খেলার চারটে স্কোরশীট, শুধু হাতে এল এইটা।

আপনাদের হয়ত মনে আছে, আমি প্রথমদিকে এই স্কোরশীটগুলোর উপর বিশেষভাবে নজর দিয়েছিলাম। কারণ এর মধ্যেই ঐ চারজনের মনের গতিবিধির কিছুটা আঁচ পাওয়া যেতে পারে। সত্যিই এর মধ্যে একটা মূল্যবান তথ্য পাওয়া গেল। দেখলাম রাবারের স্কোরশীটে একদিকে লেখা রয়েছে১৫০০ সংখ্যাটা। বুঝলাম এটা বেশ বড় খেলা মানে গ্রাণ্ডস্ল্যামের খেলা। সেদিন সন্ধ্যের পরিবেশটা কল্পনা করুন, সেই অস্বাভাবিক পরিবেশের মধ্যে শেটানকে যখন খুন করার কথা ভাবছে কোন একজন তাকে অন্তত দুটো মারাত্মক ঝুঁকি নিতে হবে, প্রথমটা মারা যাবার আগে শেটান চীৎকার করে উঠতে পারেন, দ্বিতীয়ত সেই মুহূর্তে কেউ খুনীকে দেখে ফেলতে পারে।

ভেবে দেখুন, প্রথম ঝুঁকিটায় করার কিছু নেই, ভাগ্যের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে, কিন্তু দ্বিতীয়টা? সেটা তা নয়, চেষ্টা করলে কিছু করা যেতে পারে। সাধারণ তাস পড়লে ব্রিজ খেলোয়াড়রা খুব একটা মনোযোগ দেন না, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখেন, গল্প করেন নিজেদের মধ্যে। কিন্তু কোন জটিল তাসের খেলা হলে, বিশেষতঃ তা যদি গ্র্যাণ্ডস্ল্যামের খেলা হয় সকলেই খুব উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। গ্র্যাণ্ডস্ল্যামের খেলা। তিনজন খেলোয়াড়ই মন দিয়ে তাস খেলছে। একজনের চিন্তা কিভাবে তেরোটা পিটই তোলা যায়। আবার অন্য পক্ষ চেষ্টা করছে কোন সুযোগে একটা পিটও অন্তত ছিনিয়ে নেওয়া যায়। পার্টনার কোন রঙটায় উৎসাহ দেখাচ্ছে, কোনটায় দেখাচ্ছে না, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর রাখতে হয় সবকিছুর ওপর। ভেবে দেখলাম, একমাত্র ডামিই পারে এরকম পরিবেশে খুন করতে। খোঁজ করে জানলাম ডাঃ রবার্টসই ছিলেন এই ডিলটার ডামি। যে কোন দুজন পার্টনারের মধ্যে একজন অন্যজনের তাস নিয়ে খেলতে পারে। অন্যজন হল ডামি। সে ইচ্ছেমত ঘোরাফেরা করতে পারে।

আপনার মনে আছে মামলাটার অপরাধীদের মনস্তাত্ত্বিক দিকটায় আমি বেশি জোর দিয়েছিলাম। সন্দেহভাজনদের মানসিক গঠন বিচার করে আমার ধারণা হয়েছিল যে একমাত্র মিসেস লরিমারই পারেন কোন প্ল্যানকে সার্থক রূপ দিতে। কিন্তু মুহূর্তের উত্তেজনায় খুন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব। তার সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছিল হয় তিনি শেটানকে খুন করেছেন নয়ত শেটানের খুনী কে তা জানেন। আর বাকি তিনজনের যে কেউই খুন করতে পারেন কিন্তু খুন করতে গেলে এদের প্রত্যেক-এর মনে ভিন্ন মনোভাব কাজ করবে।

এরপর আমি সকলকেই একটাই প্রশ্ন করলাম যে সেদিন ঘরের মধ্যে কি কি জিনিস তাদের চোখে পড়েছে। ডাক্তার রবার্টসের ছুরিটা চোখে পড়ার কথা। কেন না তিনি সবকিছু খুঁটিনাটি নজর দিয়ে দেখেন–ডাক্তারদের এই গুণটা সহজাত। কিন্তু সেদিন ব্রীজ খেলার তাসের সম্বন্ধে কোন কথাই তিনি বলতে পারলেন না। আমি অবশ্য আশাও করিনি, কিন্তু এতটা ভুলে যাবার কি কারণ হতে পারে? তবে কি তিনি তখন অন্য চিন্তায় ব্যস্ত ছিলেন? এদিক থেকেও সন্দেহটা ডাক্তার রবার্টসের ওপরেই পড়েছে।

মিসেস লরিমারের কাছ থেকে একটা মূল্যবান তথ্য পেলাম। ডাক্তার রবার্টস গ্র্যাণ্ডস্ল্যামের ডাক দিয়েছিলেন, খুবই অযৌক্তিকভাবে। এবং তিনি তার পার্টনার মিসেস লরিমারের রঙেই ডাক দেন। ফলে ভদ্রমহিলাকে তাসটা খেলতে হয়। এও একটা পয়েন্ট।

এরপর সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল আর মিসেস অলিভারের চেষ্টায়, সন্দেহভাজন চারজনেরই অতীত সম্পর্কে খোঁজখবর চালান হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল, অতীতে কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে তারা খুন করেছেন অথবা আদৌ খুন করেননি। বর্তমান ক্ষেত্রেও তারা পুরোনো পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন কি না। কিন্তু সব খোঁজ খবর করেও সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল হতাশ হলেন। কেন না তার ধারণা আগের খুনগুলোর সঙ্গে, অর্থাৎ অতীতে এদের চারজন যেভাবে খুনগুলো করেছে, তার সঙ্গে বর্তমান খুনের কোন মিল নেই। কিন্তু তা নয়। ডাক্তার রবার্টস আগে যে দুটো খুন করেছেন, তার সঙ্গে বর্তমান খুনের কোন মিল হয়ত নেই। কিন্তু এদের চারিত্রিক মিল নিশ্চয়ই আছে। ক্র্যাডকদের খুন করাটার কথা ভেবে দেখা যাক। যেন সকলের সামনে হাসতে হাসতে বুক ফুলিয়ে খুনটা হয়ে গেল। রোগীকে পরীক্ষা করার পর বাথরুমে গিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ডাক্তারদের রীতি, সেই সুযোগে বাথরুমে একজনের শেভিংব্রাসে অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণু মাখিয়ে রেখে আসা, কত সহজ ব্যাপার। মিসেস ক্র্যাডককে খুন করা হল টাইফয়েডের প্রতিষেধক ইনজেকসন দেবার সুযোগে। কোন লুকোচুরি নেই, সকলের সামনে দিয়ে হাসতে হাসতে খুনটা হয়ে গেল।

এবার মিঃ শেটানের কথাটা চিন্তা করুন। ডাঃ রবার্টস হঠাৎ বুঝতে পারলেন যে খুব তাড়াতাড়ি শেটানের মুখ চিরকালের জন্য বন্ধ করতে না পারলে, তার সমস্ত কুকীর্তির কথা জানাজানি হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকি নিলেন। আমরা ব্রীজ টেবিলের ডাঃ রবার্টসকে জানি তিনি ঝুঁকি নিয়েও দক্ষভাবে খেলেন। এক্ষেত্রেও তিনি সম্পূর্ণ কাজটা হাসিল করলেন।

আমি মনে মনে প্রায় নিশ্চিত হয়ে উঠেছি ডাঃ রবার্টসই খুনি, ঠিক তখনই মিসেস লরিমার আমাকে জানালেন খুনটা তিনিই করেছেন। প্রথমে আমি প্রায় তার কথা বিশ্বাসই করে বসেছিলাম, কিন্তু একটু পরেই আমার মনে হল–না, তিনি এ-কাজ কিছুতেই করতে পারেন না।

কিন্তু ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে দাঁড়ায় যখন মিসেস লরিমার বললেন, যে অ্যানা মেরিডিথকে তিনি এই খুনটা করতে দেখেছেন। পরের দিন মিসেস লরিমারের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারলাম, তিনি যা বলেছেন তাও সত্যি, আবার আমার ধারণাও সত্যি।

আসলে ব্যাপারটা ছিল এই–অ্যানা মেরিডিথ জমি থাকাকালীন ঘুরতে ঘুরতে শেটানের কাছে চলে যায়। শেটান যে মারা গেছেন এটা সে সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে। কিন্তু মেরিডিথের নজরে পড়ে শেটানের বুক পকেটের দিকে, কিছু একটা চকচক করতে দেখে সে হাত বাড়ায়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চকচকে জিনিসটা কি সে বুঝে যায়।

ঘাবড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় সে। ডিনার টেবিলে শেটানের মন্তব্য মনে ছিল তার। হয়ত শেটান কোন কাগজপত্রে এই ঘটনা সম্বন্ধে লিখে রেখে যেতে পারেন। তাতে, প্রমাণ হবে সেই শেটানকে খুন করেছে এবং সকলেই ভাববে এতে মেরিডিথের কোন উদ্দেশ্য ছিল। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ব্রীজ টেবিলে ফিরে এল সে।

তাহলে মিসেস লরিমার যা দেখেছেন তাও ঠিক। আবার আমার ধারণাও ঠিক তিনি খুনীকে দেখেননি।

ডাক্তার রবার্টস যদি এই খুনের পর চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকতেন তবে হয়ত তাকে কোনভাবেই ধরা যেত না। অবশ্য এতো সহজে হাল ছাড়তাম না আমি।

যাই হোক শেটানকে খুন করে বেশ অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন রবার্টস। তিনি জানতেন যে ব্যাটেল যত দিন না এই খুনের কিনারা হয় ততদিন তার পেছনে লেগে থাকবেন। আর এইভাবে পুলিশের খোঁজখবর করার ফলে তার আগেকার অপরাধের কথা হয়ত প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে। এর থেকে বাঁচতে তিনি একটা চমৎকার উপায় বের করলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মিসেস লরিমার আর বেশিদিন বাঁচবেন না। রোগের জ্বালাযন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পেতে তাঁর পক্ষে আত্মহত্যা করা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আর আত্মহত্যার আগে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে নিজের অপরাধের স্বীকারোক্তি দিয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়।

সেই কারণেই ডাক্তার রবার্টস কোনভাবে মিসেস লরিমারের হাতের লেখা যোগাড় করে সেই লেখার নকলে তিনটে চিঠি লিখলেন, তারপর কাক পক্ষী জাগার আগে সেই চিঠির ছুতো করে ছুটলেন মিসেস লরিমারের বাড়িতে। তার আগে নিজের বাড়ির পরিচারিকাকে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে যান। পুলিশের সার্জন এসে পৌঁছনোর আগে নিজের কাজ হাসিল করবার সময় তিনি পেয়েছিলেন এবং সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন। ছককাটা প্ল্যান। একেবারে নিখুঁত।

রবার্টসের তখন একমাত্র লক্ষ্য নিজের নিরাপত্তা আর মিসেস লরিমারের মৃত্যু। তাই আমি যখন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে মিসেস লরিমারের হাতের লেখা তার পরিচিত কিনা–তখন তিনি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন, সত্যিই যদি কোন সময় এই নকলের ব্যাপারটা ধরা পড়ে। তিনি মিসেস লরিমারের হাতের লেখার সঙ্গে পরিচিত নন এই অজুহাতই তাকে রক্ষা করল। সেইজন্য আমার প্রশ্নের জবাব তিনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দিলেও খুব একটা তৎপরতার সঙ্গে দিতে পারেন নি।

উইলিংফোর্ড থেকে আমার ফোন পেয়ে মিসেস অলিভার আমার বাড়িতে রবার্টসকে নিয়ে এলেন। ডাক্তার রবার্টস সব ঝামেলা মিটে গেছে ভেবে যখন মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়াচ্ছেন, ঠিক তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাত। এরকুল পোয়ারো বিদ্যুৎ গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শিকারের ওপর। ডাক্তার রবার্টসও আর কোন নতুন খেলা দেখানোর আগেই অসহায়ভাবে ধরা দিলেন।

কিছুক্ষণ কারোর মুখে কোন কথা নেই। সকলেই যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। একসময় রোডার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ভাগ্যিস জানালা দিয়ে ঐ উইণ্ডোক্লীনার্স লোকটা ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছিল। তা না হলে ডাক্তার রবার্টসের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই খাড়া করা যেত না।

না, না ম্যাডাম। এতে ভাগ্যের কোন হাত নেই। পোয়ারো হেসে উঠলেন, লোকটা আদৌ কোন উইণ্ডো-ক্লীনার্স নয়। এখানে উদীয়মান অভিনেতা মিঃ জেরাল্ড হেমিংওয়ে। এসো এসো এদিকে চলে এসো বন্ধু। পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে উইণ্ডো ক্লীনার্সকে নিয়ে এলেন। তখন সেই ভদ্রলোককে এখানে অন্যরকম মনে হচ্ছে।

বন্ধু তুমি তোমার ভূমিকা চমৎকার অভিনয় করেছ, সত্যিই চমৎকার। তারিফ করলেন পোয়ারো।

তাহলে! রোডা চেঁচিয়ে উঠল, রবাটর্সকে কেউই দেখেনি, গোটা ব্যাপারটা দারুণ ভাঁওতা।

আমি দেখেছিলাম ম্যাডাম। পোয়ারোর রহস্যময় গম্ভীর কণ্ঠস্বর বাতাসে ভেসে বেড়ালো, আমি দেখেছিলাম। কিভাবে জানেন? মৃদু হাসলেন পোয়ারো মনের চোখ দিয়ে।